আন্না কারেনিনা - প্রথম পর্ব
আন্না কারেনিনা - দ্বিতীয় পর্ব
আন্না কারেনিনা - তৃতীয় পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - চতুর্থ পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - পঞ্চম পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - ষষ্ঠ পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - সপ্তম পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - অষ্টম পৰ্ব
1 of 2

আন্না কারেনিনা – ৫.২০

বিশ

মৃত্যু

পরের দিন রোগীর অনু-সুরা পান ও গাত্রলেপন হল। অনুষ্ঠানের সময় নিকোলাই লেভিন প্রার্থনা করলেন আবেগভরে। ফুলকাটা তোয়ালেতে ঢাকা ছোট একটা টেবিলের ওপর স্থাপিত দেবপটের দিকে নিবদ্ধ তাঁর বড় বড় চোখে ফুটে উঠছিল যে আকুল আশা আর প্রার্থনা, তাতে লেভিনের ভয়ংকর লাগছিল সেদিকে চাইতে। লেভিন জানতেন, যে জীবনকে উনি ভালোবাসতেন, তার কাছ থেকে বিচ্ছেদ আরো দুঃসহই হবে এই আকুল প্রার্থনা আর আশায়। ভাইকে লেভিন চিনতেন, জানতেন তাঁর চিন্তাধারা। জানতেন যে ধর্মে তাঁর অবিশ্বাস এই জন্য আসেনি যে ধর্মবিশ্বাস ছাড়াই জীবনযাপন তাঁর কাছে সহজ, এসেছে এই থেকে যে বিশ্বের ঘটনাপ্রপঞ্চের আধুনিক বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা এক-পা এক-পা করে সংকুচিত করেছে তাঁর ধর্মবিশ্বাস, তাই তিনি জানতেন যে ধর্মে এই প্রত্যাবর্তনটা চিন্তার সেই পথটা ধরে ঘটেনি, এটা ন্যায়সঙ্গত নয়, এটা শুধু সাময়িক, স্বার্থপর একটা ব্যাপার, এসেছে আরোগ্যলাভের উন্মাদ আশা থেকে। লেভিন এও জানতেন যে তার শোনা অসাধারণ সব আরোগ্যলাভের ঘটনা বলে কিটি বাড়িয়ে তুলেছে আশাটা। এ সবই লেভিন জানতেন আর আশায় আকুল প্রার্থী এই দৃষ্টি, টান-টান কপালে ক্রুশচিহ্ন আঁকার জন্য অতিকষ্টে উত্তোলিত শীর্ণ ওই হাতের থোপা, হাড়-খোঁচা এই কাঁধ, ঘড়ঘড়ে ফাঁপা এই বুক, রোগী যে জীবনের প্রার্থনা করছিলেন তা যেখানে আর ধরবে না, এ সব দেখতে কষ্ট হচ্ছিল, যন্ত্রণা বোধ করছিলেন লেভিন। গুহ্য এসব ক্রিয়াকাণ্ডের সময় লেভিনও প্রার্থনা করছিলেন এবং নাস্তিক হয়েও হাজার বার যা তিনি করেছেন তাই করলেন। সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে তিনি বলছিলেন, ‘তোমার অস্তিত্ব যদি থেকে থাকে, তাহলে এই লোকটাকে ভালো করে দাও (এ তো বহুবার ঘটেছে), এতে করে তুমি ওকে আর আমাকেও বাঁচাবে।’

গাত্রলেপনের পর রোগীর হঠাৎ অনেক ভালো বোধ হল। এক ঘণ্টার মধ্যে একবারও তিনি কাশেননি, হেসেছেন, সাশ্রনয়নে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে চুমু খেয়েছেন কিটির হাতে এবং বললেন যে ভালো লাগছে তাঁর, কোথাও ব্যথা করছে না, ক্ষিদে আর শক্তি টের পাচ্ছেন। তাঁর কাছে স্যুপ আনতে তিনি এমন কি নিজে নিজেই উঠে বসলেন, চাইলেন কাটলেট। অবস্থা তাঁর যত নৈরাশ্যজনকই হোক, তাঁর দিকে চাইলেই তিনি যে আর সেরে উঠবেন না সেটা যত সুস্পষ্টরূপেই বোঝা যাক না কেন, এই এক ঘণ্টা লেভিন আর কিটি একই রকম সুখ, আর পাছে বা ভুল হয়—এমন একটা ভীতির দোলায় দুলছিলেন।

‘ভালো বোধ হচ্ছে—হ্যাঁ, অনেক—আশ্চর্য—আশ্চর্যের কিছু নেই—যতই হোক ভালো তো’, হেসে ফিসফিসিয়ে বলাবলি করছিলেন ওঁরা।

বিভ্রমটা বেশিক্ষণ টেকেনি। রোগী শান্তভাবে ঘুমিয়ে পড়েন, কিন্তু আধ ঘণ্টা বাদেই জেগে ওঠেন কাশির দমকে আর হঠাৎ তাঁর চারপাশের লোকদের মধ্যে, তাঁর নিজের মধ্যেও নিবে গেল আশা। যন্ত্রণার বাস্তবতা নিঃসন্দেহে, এমন কি আগেকার আশার স্মৃতিটুকু পর্যন্ত মুছে দিয়ে লেভিন, কিটি, স্বয়ং রোগীরও সব ভরসা গেল।

আধ ঘন্টা আগে কি বিশ্বাস হয়েছিল সেটা স্মরণ করাটাও যেন লজ্জার কথা। রোগী সেটা ভুলে ছেঁদা করা কাগজে মোড়া আইওডিনের শিশি চাইলেন শুঁকবার জন্য। লেভিন বয়ামটা দিলেন, আর গাত্রলেপনের সময় যেমন, তেমনি আকুল আশার একটা দৃষ্টি নিবদ্ধ হল ভাইয়ের ওপর, আইওডিন শোঁকায় যে অলৌকিক কাণ্ড হতে পারে ডাক্তারের এই কথাটার সমর্থন চাইছিলেন ভাইয়ের কাছ থেকে।

‘কি কাতিয়া নেই?’ অনিচ্ছায় লেভিন ডাক্তারের কথাটায় সায় দেবার পর উনি এদিক-ওদিক চেয়ে ঘড়ঘড়ে গলায় বললেন, ‘নেই, তাহলে বলা যায়… ওর জন্যই এই প্রহসনটা করলাম আমি। ভারি মিষ্টি মেয়ে, কিন্তু তুই আর আমি তো আত্মপ্রতারণা করতে পারি না। হ্যাঁ, এইটাকে আমি বিশ্বাস করি’, হাড্ডিসার হাতে বয়ামটা চেপে ধরে শুঁকতে শুঁকতে বললেন তিনি

সন্ধ্যা সাতটার পর নিজেদের কামরায় স্ত্রীর সাথে চা খাচ্ছিলেন লেভিন, এমন সময় হাঁপাতে হাঁপাতে তাঁদের কাছে ছুটে এল মারিয়া নিকোলায়েভনা। বিবর্ণ সে, থরথর করছে ঠোঁট।

ফিসফিস করল, ‘মারা যাচ্ছে! আমার ভয় হচ্ছে, মারা যাবে এখুনি।’

দুজনেই ছুটে গেলেন ওঁর কাছে। কনুইয়ে ভর দিয়ে দীর্ঘ পিঠ বাঁকিয়ে মাথা নুইয়ে তিনি বসে ছিলেন খাটে।

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর ফিসফিসিয়ে লেভিন জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন বোধ করছ?’

‘বোধ করছি যে চললাম’, অতি কষ্টে, কিন্তু অসাধারণ স্পষ্টতায় প্রতিটি শব্দ ধীরে ধীরে নিষ্কাশিত করে বললেন নিকোলাই। মাথা তুললেন না তিনি, শুধু ওপরে চোখ তুললেন, কিন্তু ভাইয়ের মুখ দেখতে পেলেন না, ‘কাতিয়া, চলে যাও!’ যোগ করলেন তিনি 1

লেভিন লাফিয়ে উঠে আদেশব্যঞ্জক স্বরে ফিসফিসিয়ে বললেন চলে যেতে।

‘চললাম’, নিকোলাই বললেন আবার।

‘কেন তা ভাবছ?’ কিছু-একটা বলতে হয় বলে লেভিন বললেন।

‘কারণ চললাম’, পুনরুক্তি করলেন যেন কথাটা মনে ধরে গেছে তাঁর, ‘শেষ।’

মারিয়া নিকোলায়েভনা এল তাঁর কাছে।

বলল, ‘আপনি শুতে পারেন, কিছু আরাম হত।’

‘শিগগিরই শান্ত হয়ে শুয়ে থাকব। মরা’, বললেন উনি ব্যঙ্গভরে, রাগ করে, ‘বেশ, যদি চান, শুইয়ে দিন।’ লেভিন ভাইকে চিত করে শুইয়ে দিয়ে তাঁর পাশে বসে রুদ্ধনিঃশ্বাসে চেয়ে রইলেন তাঁর মুখের দিকে। চোখ বুজে শুয়ে রইলেন মুমূর্ষু, কিন্তু মাঝে মাঝে কপালের পেশী তাঁর নড়ে উঠছিল, একাগ্র প্রগাঢ় চিন্তামগ্ন লোকের যেমন হয়। ওঁর ভেতরে এখন যা ঘটছে সে বিষয়ে তাঁর সাথেই ভাবার চেষ্টা করলেন লেভিন, কিন্তু তাঁর সঙ্গ ধরার জন্য চিন্তার সমস্ত প্রয়াস সত্ত্বেও শান্ত, কঠোর এই মুখখানায় যে ভাব ফুটে উঠেছিল তা দেখে, ভুরুর ওপর পেশীর যে কাঁপন ফুটছিল তা দেখে লেভিন বুঝলেন যে মুমূর্ষুর কাছে কিছু-একটা পরিষ্কার হয়ে উঠছে এবং যা পরিষ্কার হয়ে উঠছে তা অন্ধকারই থেকে যাচ্ছে লেভিনের কাছে।

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাই’, থেমে থেমে, ধীরে ধীরে বললেন মুমূর্ষু। ‘দাঁড়ান’, আবার চুপ করে গেলেন। ‘তাই!’ হঠাৎ শান্ত হয়ে টেনে টেনে বললেন যেন সব কিছুর মীমংসা হয়ে গেছে তাঁর কাছে; ‘ওহ্ সৃষ্টিকর্তা’, বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি।

মারিয়া নিকোলায়েভনা তাঁর পা টিপে দেখল।

ফিসফিস করে বলল, ‘ঠাণ্ডা হয়ে আসছে।’

অনেকক্ষণ, লেভিনের যা মনে হল, অনেকক্ষণ রোগী শুয়ে রইলেন নিশ্চল হয়ে। কিন্তু তখনও বেঁচে ছিলেন তিনি, মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছিলেন। চিন্তার চাপে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন লেভিন। টের পাচ্ছিলেন যে ভাবনার সমস্ত তাড়না সত্ত্বেও ওই ‘তাই’-টা কি তা তিনি বুঝতে পারবেন না। টের পাচ্ছিলেন যে মুমূর্ষুর কাছ থেকে তিনি পেছিয়ে পড়েছেন অনেক আগে। মৃত্যুর প্রশ্ন নিয়ে তিনি আর ভাবতে পারছিলেন না, তবে থেকে থেকেই তাঁর মনে আসছিল এবার, এখনই কি করতে হবে তাঁকে, চোখ বুজিয়ে দিতে হবে, পোশাক পরাতে হবে, ফরমায়েশ দিতে হবে কফিনের। এবং আশ্চর্য, নিজেকে একেবারে নিরুত্তাপ লাগছিল তাঁর, ভাইয়ের জন্য তাঁর দুঃখ, শোক, এমন কি করুণাও হচ্ছিল না। ভাই সম্পর্কে তাঁর কোন মনোভাব এখন যদি থেকে থাকে, তবে সেটা মুমূর্ষু যা জেনেছেন আর তিনি যা জানেন না সেই জানাটার জন্য ঈর্ষা।

আরো অনেকক্ষণ তিনি অমনিভাবে পাশে বসে রইলেন শেষের প্রতীক্ষায়। কিন্তু শেষ এল না। দরজা খুলে দেখা দিল কিটি। ওকে ফেরাবার জন্য লেভিন উঠে দাঁড়াতেই শোনা গেল মৃতের নড়াচড়া।

‘যাস নে’, নিকোলাই বললেন হাত বাড়িয়ে দিয়ে। লেভিন সে হাতখানা নিজের হাতে নিয়ে স্ত্রীর উদ্দেশে ক্রদ্ধ ইশারা করলেন চলে যেতে।

মৃতের হাতখানা নিজের হাতে নিয়ে লেভিন বসে রইলেন—আধ ঘণ্টা, এক ঘণ্টা, আরো এক ঘণ্টা। এখন তিনি মৃত্যুর কথা আর আদৌ ভাবছিলেন না। ভাবছিলেন কিটি এখন কি করছে, কে থাকে পাশের কামরায়, ডাক্তারের বাড়িটা কি নিজের। খিদে পাচ্ছিল তাঁর, ঘুম পাচ্ছিল। সন্তর্পণে তিনি হাতটা ছাড়িয়ে নিলেন, পা টিপে দেখলেন রোগীর। পা ঠাণ্ডা, কিন্তু তখনো নিঃশ্বাস পড়ছে। লেভিন আবার পা টিপে টিপে চলে যেতে চাইছিলেন কিন্তু রোগী পুনরায় নড়েচড়ে উঠে বললেন, ‘যাস নে।’

.

ভোর হল। রোগীর অবস্থা একইরকম। লেভিন ধীরে ধীরে হাত ছাড়িয়ে মৃত্যুপথযাত্রীর দিকে না তাকিয়ে নিজের কামরায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। যখন ঘুম ভাঙল, ভাইয়ের যে মৃত্যুসংবাদের অপেক্ষা করছিলেন তার বদলে শুনলেন যে ভাই আগের অবস্থায় ফিরেছেন। আবার তিনি উঠে বসছেন, কাশছেন, খাচ্ছেন, কথা বলছেন, মৃত্যুর কথা আর বলছেন না, আবার আরোগ্যলাভের আশা করছেন, কিন্তু হয়েছেন আরও খিটখিটে আর মনমরা। ভাই বা কিটি কেউ শান্ত করতে পারলেন না তাঁকে। তিনি রেগে রইলেন সবার ওপর, সবাইকেই অপ্রীতিকর কথা বললেন, নিজের পীড়ার জন্য ভর্ৎসনা করলেন সবাইকে এবং দাবি করলেন তাঁর জন্য মস্কোর খ্যাতনামা ডাক্তার ডাকা হোক। কেমন তিনি বোধ করছেন, এ নিয়ে যত প্রশ্ন তাঁকে করা হল, জবাব দিলেন সেই একই আক্রোশ আর তিরস্কারের সুরে : ‘কষ্ট হচ্ছে ভয়ানক, অসহ্য!’

ক্রমেই কষ্ট বাড়তে লাগল রোগীর, বিশেষ করে শয্যাক্ষতগুলোর জন্য যা আর সারবার নয়। চারপাশের লোকজনদের ওপর ক্রমেই রাগ চড়তে থাকল তাঁর, সব কিছুর জন্যই তিরস্কার করলেন তাঁদের, বিশেষ করে মস্কোর ডাক্তার ডাকা হয়নি বলে। সর্বোপায়ে কিটি চেষ্টা করলে তাঁকে সাহায্য করার, শান্ত করার; কিন্তু সবই বৃথা হল, লেভিন দেখতে পেলেন যে কিটি নিজেই দৈহিক ও মানসিক দিক থেকে কাহিল হয়ে পড়েছে যদিও সেটা সে স্বীকার করতে চাইছে না। যে রাতে নিকোলাই ভাইকে ডেকেছিলেন, তখন জীবনের কাছ থেকে তাঁর বিদায় নেবার দরুণ সবার মনে যে মৃত্যুচিন্তা জেগেছিল এখন তা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। সবাই জানতেন যে উনি অবশ্য-অবশ্যই এবং শিগগিরই মারা যাবেন, এখনই তিনি অর্ধমৃত। সবাই একটা জিনিসই চাইছিলেন—উনি যেন মারা যান তাড়াতাড়ি, আর সবাই সেটা গোপন রেখে ওষুধ ঢালছিল শিশি থেকে, অন্য ওষুধ আর ডাক্তারের খোঁজ করে তাঁকে, নিজেকে, পরস্পরকে ভুল বুঝ দিচ্ছিল। এ সবই ছিল জঘন্য, অপমানকর, অসৎ কপটতা। আর লেভিনের যা চরিত্র তাতে, তা ছাড়া মুমূর্ষুকে তিনি সবার চাইতে ভালোবাসতেন বলে এই কপটতা তাঁর কাছে মর্মান্তিক লেগেছিল।

সৎ ভাইদের মধ্যে অন্তত মরণের আগে মিটমাট করিয়ে দেবার কথা নিয়ে লেভিন ভাবছিলেন অনেক দিন থেকে। বড় ভাই কজ্‌নিশেভকে চিঠি লিখেছিলেন তিনি। জবাব পেয়ে লেভিন সেটা পড়ে শোনান রোগীকে। কজ্‌নিশেভ লিখেছেন যে তিনি নিজে আসতে পারতেন না, তবে মর্মস্পর্শী ভাষায় ক্ষমা চেয়েছেন ভাইয়ের কাছ থেকে।

রোগী কিছু বললেন না।

লেভিন জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি লিখব ওকে? আশা করি তুমি রাগ করছ না ওর ওপর?

‘উঁহু, একটুও না’, বিষণ্ণভাবে উত্তর দিলেন নিকোলাই, ‘লিখে দে, আমার জন্য যেন ডাক্তার পাঠায়।

কাটল যন্ত্রণার আরো তিন দিন; রোগীর অবস্থা একইরকম। যারাই তাঁকে দেখছিল, সবাই তারা এখন তাঁর মরণ চাইছিল : হোটেলের চাপরাশি, মালিক, হোটেলবাসী, ডাক্তার, মারিয়া নিকোলায়েভনা, লেভিন, কিটি—সবাই। শুধু রোগী এ বাসনা ব্যক্ত করেননি, বরং রাগ করতেন ডাক্তার আনা হয়নি বলে, ওষুধ খেয়ে চললেন, বলতেন বাঁচার কথা। শুধু অবিরাম যন্ত্রণা থেকে আরাম দেবার জন্য আফিং দিলে বিস্মরণের মুহূর্তটার আধো ঘুমে মাঝে মাঝে বলতেন প্রাণের মধ্যে কি তাঁর সবচেয়ে প্রবল : ‘আহ্, একটা শেষ হলেই বাঁচি!’ কিংবা, ‘কবে শেষ হবে!’

যন্ত্রণা ক্রমাগত বেড়ে উঠে তাঁকে প্রস্তুত করল মৃত্যুর জন্য। কষ্ট হবে না এমন একটা অবস্থায় পড়ে থাকা, এমন একটা মুহূর্ত যখন ভুলে থাকা যায়, দেহের এমন একটা প্রত্যঙ্গ যা ব্যথা দিচ্ছে না, যন্ত্রণাকর ঠেকছে না, কিছুই ছিল না। এমন কি এই দেহের স্মৃতি অভিজ্ঞতা ভাবনা, তা নিয়ে চিন্তা এখন ওই দেহটার মতই বিতৃষ্ণা জাগাচ্ছিল। অন্য লোককে দেখা, তাদের কথাবার্তা, নিজের স্মৃতিচারণ—সবই কষ্ট দিচ্ছিল তাঁকে। আশেপাশের লোকে সেটা টের পেত এবং তাঁর সামনে খোলাখুলি ঘোরা, কথা বলা, ইচ্ছাপ্রকাশ থেকে অজ্ঞাতসারে বিরত থাকত। তাঁর সমস্ত জীবন মিলে গিয়েছিল যন্ত্রণার একটা অনুভূতি আর তা থেকে পরিত্রাণের কামনায়।

স্পষ্টতই তাঁর মধ্যে একটা পরিবর্তন ঘটছিল যা তাঁকে শেখাবে তাঁরই ইচ্ছার পরিপূরণ হিসেবে, সুখ হিসেবে মৃত্যুকে দেখতে। আগে যন্ত্রণা থেকে, অথবা ক্ষুধা, ক্লান্তি, তৃষ্ণার মত অভাববোধ থেকে উদ্ভূত তাঁর এক-একটা ইচ্ছা মিটতো দেহ দিয়ে, যাতে তৃপ্তি পাওয়া যেত; কিন্তু এখন অভাববোধ ও যন্ত্রনার উপশম হচ্ছিল না, তা মেটাবার চেষ্টা করতে গেলে দেখা দিতো নতুন যন্ত্রণা। তাই সমস্ত ইচ্ছা মিলে গেল একটায় : সমস্ত যন্ত্রণা এবং তার উৎস দেহটা থেকে অব্যাহতি পাবার ইচ্ছেয়। কিন্তু অব্যাহতি পাবার এ ইচ্ছেটা প্রকাশ করার মত ভাষা ছিল না তাঁর, তাই সে ইচ্ছাটার কথা তিনি বলেননি, শুধু অভ্যাসবশে তাঁর সেই ইচ্ছাগুলো মেটাবার দাবি করতেন যা আর মিটবার নয়। বলতেন : ‘আমাকে ওপাশে কাত করে শোয়াও’, আর তক্ষুনি আবার দাবি করতেন আগে যেমন ছিলেন সেভাবে রাখতে। ‘বুলিয়ন খেতে দাও। নিয়ে যাও বুলিয়ন। কথা বলো, কেন চুপ করে আছ সবাই।’ আর কথা বলতে শুরু করলেই তিনি চোখ বুজে ক্লান্তি, উদাসীনতা আর বিতৃষ্ণার ভাব ফুটিয়ে তুলতেন।

শহরে আসার দশম দিনে অসুস্থ হয়ে পড়ল কিটি। মাথা ধরেছিল, বমি করল, সারা সকাল উঠতে পারল না বিছানা ছেড়ে।

ডাক্তার বলল, অসুখের কারণ ক্লান্তি, অস্থিরতা, মনের শান্তি বজায় রাখার পরামর্শ দিলেন তিনি।

তবে ডিনারের পর কিটি উঠে দাঁড়াল এবং বরাবরের মত সেলাইটা নিয়ে গেল রোগীর কাছে। ঘরে ঢুকতে রোগী কঠোর দৃষ্টিতে চাইলেন তার দিকে, সে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল বলায় হাসলেন ঘৃণাভরে। সারাটা দিন তিনি নাক ঝাড়লেন আর কাতরাতে লাগলেন করুণ সুরে।

‘কেমন বোধ করছেন?’ কিটি জিজ্ঞেস করল।

‘খারাপ’, বহু কষ্টে বলতে পারলেন উনি, ‘ব্যথা! ‘কোথায় ব্যথা?’

‘সবখানে।’

‘আজ শেষ হয়ে যাবে দেখবেন’, মারিয়া নিকোলায়েভনা বলল যদিও ফিসফিসিয়ে, কিন্তু এমনভাবে যে অতি সজাগ রোগীর (লেভিনের সেটা চোখে পড়েছিল) তা কানে যাবার কথা। মারিয়া নিকোলায়েভনাকে চুপ করার ইঙ্গিত দিয়ে লেভিন চাইলেন রোগীর দিকে। নিকোলাই কথাটা শুনতে পেয়েছিলেন; কিন্তু তাতে কোন প্রতিক্রিয়া হল না তাঁর। দৃষ্টি তাঁর একইরকম ধিক্কারহানা ও তীব্র।

লেভিনের পিছু পিছু মারিয়া নিকোলায়েভনা করিডোরে বেরিয়ে আসতে লেভিন জিজ্ঞেস করলেন তাকে, কেন তা ভাবছেন?’

‘উনি নিজেকে খামচাতে শুরু করেছেন’, বলল মারিয়া নিকোলায়েভনা।

‘খামচানো মানে?’

‘এই রকম’, নিজের উলের পোশাকটার ভাঁজ টেনে ধরে সে বলল। সত্যিই লেভিন লক্ষ করেছিলেন যে সারাটা দিন রোগী নিজেকে খামচেছেন যেন কিছু-একটা টেনে ছিঁড়ে ফেলতে চান।

সঠিকই হয়েছিল মারিয়া নিকোলায়েভনার ভবিষ্যদ্বাণী। রাতের দিকে হাতখানা তোলারও শক্তি রইল না রোগীর। দৃষ্টিতে একটা অপরিবর্তিত মনোযোগী কেন্দ্রীভূত ভাব নিয়ে তিনি তাকিয়ে রইলেন সামনের দিকে। উনি যাতে তাঁদের দেখতে পান সে জন্য লেভিন আর কিটি তাঁর ওপর ঝুঁকে এলেন, তখনো তিনি তাকিয়ে রইলেন একইভাবে। অন্তিম প্রার্থনা পাঠের জন্য যাজক ডেকে পাঠাল কিটি।

যাজক যখন প্রার্থনা পড়ছিলেন, মুমূর্ষুর মধ্যে জীবনের কোন লক্ষণ দেখা গেল না; চোখ ছিল বন্ধ। শয্যাপার্শ্বে দাঁড়িয়ে ছিলেন লেভিন, কিটি আর মারিয়া নিকোলায়েভনা। পাঠ তখনো শেষ হয়নি, মুমূর্ষু টান-টান হয়ে নিঃশ্বাস ফেলে চোখ মেললেন। পাঠ শেষ করে যাজক তাঁর শীতল কপালে ক্রস ঠেকালেন, তারপর ধীরে ধীরে তা জড়িয়ে রাখলেন স্টোলে এবং নীরবে মিনিট দুয়েক দাঁড়িয়ে থেকে ঠাণ্ডা হয়ে আসা রক্তহীন বিশাল হাতখানা ছুঁলেন।

‘মারা গেছে’, বলে যাজক চলে যাবার উপক্রম করলেন। হঠাৎ দেখা গেল মৃতের লেপটে যাওয়া গোঁফ নড়ছে, এবং নীরবতার মধ্যে পরিষ্কার শোনা গেল বুকের গভীর থেকে বেরিয়ে সুনির্দিষ্ট একটা তীক্ষ্ণ ধ্বনি : ‘পুরো নয়… শিগগিরই।’

এক মিনিট বাদেই মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল গোঁফের নিচে ফোটা হাসিতে এবং যে নারীরা জুটেছিল তারা সযত্নে সাজাতে লাগল তাঁকে।

ভাইয়ের চেহারা আর মৃত্যুর সান্নিধ্য ও অনিবার্যতায় একটা আতংক জাগিয়ে তুলল, শরতের সেই সন্ধ্যায় ভাই তাঁর কাছে এলে যা হয়েছিল। এই অনুভূতিটা এখন আগের চেয়েও বেশি তীব্র; মৃত্যুর অর্থ ধরতে পারা তার কাছে আগের চেয়ে কম সম্ভব বলে বোধ হল; তার অনিবার্যতা আরো ভয়ংকর ঠেকল তাঁর কাছে; কিন্তু এখন স্ত্রী কাছে থাকায় সেটা তাঁকে হতাশায় ঠেলে দেয়নি; মৃত্যু সত্ত্বেও তিনি বেঁচে থাকা ও ভালোবাসার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছিলেন। টের পাচ্ছিলেন যে হতাশা থেকে তাঁকে বাঁচিয়েছে ভালোবাসা আর হতাশায় পড়ার ভয় থেকে সে ভালোবাসা হয়ে দাঁড়িয়েছে আরো প্রবল ও পূত।

মৃত্যুর যে রহস্যটা অজ্ঞেয় থেকে গেছে, সেটা তাঁর চোখের সামনে ঘটতে না ঘটতেই দেখা দিল সমান অজ্ঞেয় আরেকটা রহস্য যা প্রেম আর জীবনের চ্যালেঞ্জ জানায়।

কিটি সম্পর্কে নিজের অনুমান সমর্থন করলেন ডাক্তার। কিটির অসুস্থতা তার গর্ভবতী হওয়ার লক্ষণ।

একুশ

বেত্‌সি আর অবলোন্‌স্কির সাথে কথাবার্তার পর কারেনিন যখন বুঝেছিলেন যে, তাঁর কাছে শুধু এটুকু চাওয়া হচ্ছে যে নিজের উপস্থিতি দিয়ে স্ত্রীকে কষ্টে না ফেলে তাঁকে শান্তিতে রাখা হোক, স্ত্রী নিজেই যেটা চাইছেন, সেই মুহূর্ত থেকে তিনি এত উদ্ভ্রান্ত বোধ করছিলেন যে নিজে কিছু স্থির করতে পারছিলেন না, নিজেই জানতেন না এখন কি তিনি চাইছেন এবং যাঁরা এত আনন্দের সাথে তাঁর ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছেন তাঁদের হাতে নিজেকে সঁপে দিয়ে নিজের সম্মতি জানাতে লাগলেন সব কিছুতে। শুধু আন্না যখন বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে এবং ইংরেজ গৃহশিক্ষিকা লোক পাঠালে জানতে সে তাঁর সাথে খাবে, নাকি আলাদা, কেবল তখনই প্রথম তিনি তাঁর অবস্থাটা পুরোপুরি বুঝলেন এবং আতংক হল তাঁর।

তাঁর অবস্থার সবচেয়ে মুশকিল ব্যাপারটা ছিল এই যে নিজের অতীতকে বর্তমানের সাথে মেলাতে, মেনে নিতে তিনি পারছিলেন না। সে অতীতটা তাঁকে বিব্রত করছিল না যখন তিনি সুখে দিন কাটিয়েছেন স্ত্রীর সাথে। সে অতীত থেকে স্ত্রীর বিশ্বাসঘাতকতার ব্যাপারটা জানতে পারার উৎক্রমণটা তিনি কাটিয়ে উঠেছেন শহীদের মত; সে অবস্থাটা ছিল কষ্টকর কিন্তু তাঁর কাছে বোধগম্য। স্ত্রী যদি তখন তাঁর বিশ্বাসঘাতকতার কথা জানাবার পর তাঁকে ত্যাগ করে যেতেন, তাহলে কষ্ট হত তাঁর, নিজেকে দুর্ভাগা মনে হত, কিন্তু এখন তিনি যে অতি নিরুপায়, নিজের কাছেই দুর্বোধ্য একটা অবস্থায় পড়েছেন, সেটা হত না। এখন তিনি নিজের সাম্প্রতিক ক্ষমা, নিজের মমতা, স্ত্রী আর অপরের ঔরসজাত সন্তানটির জন্য তাঁর ভালোবাসাকে মেলাতে পারছিলেন না এখন যা দাঁড়িয়েছে তার সাথে, অর্থাৎ এটার সাথে যে এ সবের পুরস্কার হিসেবেই যেন তিনি এখন হয়ে পড়েছেন একা, কলংকিত, উপহাসাস্পদ, সবার কাছেই নিষ্প্রয়োজন এবং সবার কাছেই ঘৃণিত।

স্ত্রী চলে যাবার পর প্রথম দু’দিন কারেনিন উমেদারদের ও কর্মাধ্যক্ষের সাথে কথা বলেছেন, কমিটিতে যেতেন, এবং সচরাচরের মতই বেরোতেন ক্যান্টিনে খাবার জন্য। কেন এটা করছেন সে সম্পর্কে সচেতন না থেকেই এই দুই দিন তিনি তাঁর সমস্ত শক্তি নিয়োগ করেছেন একটা শান্ত, এমন কি নির্বিকার ভাবই বজায় রাখার জন্য। আন্না আর্কাদিয়েভনার ঘর আর জিনিসপত্রের কি ব্যবস্থা হবে এই প্রশ্নের জবাবে তিনি এমন একটা লোকের ভাব নেবার জন্য প্রাণপণ করেছেন যার কাছে যা ঘটল সেটা অপ্রত্যাশিত কিছু নয়, একসার সাধারণ ঘটনার কাঠামো তা ছাড়ায় না, এবং এটা তিনি করতে পেরেছিলেন, কেউ তাঁর মধ্যে হতাশার কোন লক্ষণ দেখতে পায়নি। কিন্তু আন্না চলে যাবার দ্বিতীয় দিন যখন কর্নেই ফ্যাশনেবল দোকানের বিল, আন্না যা শোধ করতে ভুলে গিয়েছিলেন, তাঁকে দিয়ে জানাল যে দোকানের লোকটি এখানে আছে, কারেনিন বললেন লোকটাকে ডাকতে।

‘মাপ করবেন হুজুর, যে আপনাকে বিরক্ত করার অপরাধ করেছি, কিন্তু যদি বলেন, হুজুরানির কাছে পাঠাতে, তাহলে কৃপা করে ওঁর ঠিকানাটা যদি দেন…

লোকটির মনে হয়েছিল কারেনিন কি যেন ভাবছেন, কিন্তু হঠাৎ তিনি ঘুরে গিয়ে টেবিলে বসলেন। হাসের ওপর মাথা ভর দিয়ে অনেকক্ষণ তিনি ওই অবস্থায় বসে রইলেন, কি যেন বলবার চেষ্টা করলেন কয়েকবার, কিন্তু থেমে গেলেন।

কর্তার ভাবাবেগ বুঝতে পেরে কর্নেই দোকানের লোকটিকে বললেন অন্য দিন আসতে। আবার একা হয়ে কারেনিন টের পেলেন যে দৃঢ়তা ও প্রশান্তির ভূমিকা চালিয়ে যাবার শক্তি তাঁর আর নেই। অপেক্ষমাণ গাড়িটিকে চলে যাবার হুকুম দিয়ে তিনি বললেন কারো সাথে তিনি আজ সাক্ষাৎ করবেন না, খেতেও গেলেন না তিনি।

তিনি অনুভব করলেন দোকানের এই লোকটি, কর্নেই, এবং এই দুই দিনে যাদের সাথেই তাঁর দেখা হয়েছে বিনা ব্যতিক্রমে তাদের সবার মুখে যে ঘৃণা ও নিষ্ঠুরতা তিনি পরিষ্কার দেখেছেন তার সর্বাত্মক চাপ সহ্য করার সাধ্য নেই তাঁর। তিনি অনুভব করছিলেন লোকদের এই আক্রোশ থেকে আত্মরক্ষা করতে তিনি অক্ষম, কেননা আক্রোশটা আসছে এই জন্য নয় যে তিনি খারাপ লোক (তাহলে ভালো হবার চেষ্টা করতে পারতেন তিনি), আসছে এই থেকে যে উনি লজ্জাকররূপে জঘন্যরকমে অসুখী। তিনি জানতেন যে এই জন্যই, বুক তাঁর শরবিদ্ধ বলেই ওরা তাঁর প্রতি নির্মম। তিনি টের পাচ্ছিলেন যে, যন্ত্রণায় আর্তনাদ করছে যে আহত কুকুরটাকে অন্য কুকুরেরা যেমন করে মেরে ফেলে, তেমনি করেই তাঁকে মেরে ফেলবে ওরা। তিনি জানতেন যে লোকদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় নিজের ক্ষতটা ঢেকে রাখা, এ দু’দিন তিনি অচেতনভাবে সে চেষ্টা করেছেন, কিন্তু এখন অনুভব করলেন যে এই অসমান সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার শক্তি তাঁর আর নেই।

হতাশা তাঁর আরো বেড়ে উঠল এই চেতনায় যে নিজের দুঃখে তিনি একেবারে একা। যাকে তিনি বলতে পারেন কি সহ্য করতে তাঁকে হয়েছে, উচ্চ রাজপুরুষ হিসেবে, উঁচু সমাজের লোক হিসেবে নয়, আর্ত মানুষ বলে তাঁর জন্য যে কষ্ট বোধ করবে এমন লোক শুধু পিটার্সবুর্গেই ছিল না তাই নয়; এমন লোক তাঁর কোথাওই ছিল না।

কারেনিন বেড়ে উঠেছিলেন অনাথ অবস্থায়। দুই ভাই ওঁরা। পিতাকে তাঁদের মনেই পড়ে না। মা মারা যান যখন কারেনিনের দশ বছর বয়স। বিষয়-আশয় তেমন ছিল না, তাঁদের মানুষ করেন কারেনিনের চাচা, বড় রকমের রাজপুরুষ, একদা প্রয়াত সম্রাটের প্রিয়পাত্র।

স্বর্ণপদক পেয়ে জিমনাসিয়াম আর বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্স শেষ করে কারেনিন চাচার সাহায্যে তখনি বড় চাকরির পদ ধরেন এবং সেই থেকে পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করেন চাকরি ক্ষেত্রের উচ্চাভিলাষে। জিমনাসিয়াম, বিশ্ববিদ্যালয় এবং পরে কর্মক্ষেত্রে, কোথাও কারেনিন কারো সাথে বন্ধুত্ব করেননি। বড় ভাই ছিল তাঁর কাছে সবচেয়ে আপন জন, কিন্তু তিনি কাজ করতেন বৈদেশিক মন্ত্রিদপ্তরে, প্রায় সব সময় থাকতেন বিদেশে এবং সেখানেই মারা যান কারেনিনের বিবাহের কিছু পরেই।

যখন তিনি একটি গুবের্নিয়ায় রাজ্যপাল হিসেবে কাজ করছেন, তখন আন্নার ফুফু, মফস্বলের এক ধনী অভিজাত তাঁর ভাইঝির সাথে তখন আর যুবক না হলেও নবীন রাজ্যপালটির বিয়ে দেবার চেষ্টা করেন এবং তাঁকে এমন অবস্থায় এনে ফেলেন যে ওঁকে হয় পাণিপ্রার্থনা করতে হয়, নয় চলে যেতে হয় শহর ছেড়ে। বহু দ্বিধা করেছিলেন আলেকসেই আলেক্‌সান্দ্রভিচ কারেনিন। এ পদক্ষেপ নেওয়ার পক্ষে যত যুক্তি ছিল, বিপক্ষেও ততটাই, এবং এমন চূড়ান্ত যুক্তি কিছু ছিল না যাতে তিনি বাধ্য হন তাঁর এই নীতি পালটাতে : সন্দেহ থাকলে ক্ষান্ত থেকো; কিন্তু আন্নার ফুফু জনৈক পরিচিত মারফত তাঁর মনে এই বিশ্বাস জাগান যে উনি বালিকাটিকে অপদস্থ করেছেন, নিজের সম্মান রাখতে হলে তাঁর উচিত পাণিপ্রার্থনা করা। পাণিপ্রার্থনাই তিনি করলেন এবং যে ভাবাকুলতা তাঁর পক্ষে সম্ভব তা সবই ঢাললেন পাত্রী এবং স্ত্রীর ওপর।

আন্নার জন্য তাঁর যে টান হয়েছিল তাতে তাঁর প্রাণের মধ্যে অন্য লোকের সাথে হৃদ্যতার শেষ চাহিদাটুকুও নাকচ হয়ে যায়। আর এখন তাঁর পরিচিতদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ বলতে নেই কেউ। যাকে বলা হয় যোগাযোগ তেমন ছিল অনেকই; কিন্তু বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল না। এমন লোক কারেনিনের অনেকেই ছিলেন যাঁদের তিনি খেতে ডাকতে, তাঁর দরকারি কোন ব্যাপারে অংশ নেবার অনুরোধ করতে পারতেন, পৃষ্ঠপোষকতা করতে চাইতেন কোন উমেদারের, অন্যান্য ব্যক্তি এবং উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের ব্যবহার নিয়ে খোলাখুলি আলাপ করতে পারতেন অনেকের সাথে; কিন্তু এসব লোকদের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল রীতিনীতি আর অভ্যাসাদি দ্বারা অতি সুনির্দিষ্ট একটি ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ, তা থেকে বেরিয়ে আসা ছিল অসম্ভব। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সতীর্থ ছিল, যাঁর সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল, নিজের ব্যক্তিগত দুঃখের কথা তাঁকে তিনি বলতে পারতেন; কিন্তু বন্ধুটি সুদূরের এক মফস্বলে বিদ্যালয় পরিদর্শক। পিটার্সবুর্গে যারা আছে, তাদের মধ্যে সবার চেয়ে নিকট ও সম্ভবপর হতে পারে তাঁর কর্মাধ্যক্ষ এবং ডাক্তার।

তাঁর কর্মাধ্যক্ষ মিখাইল বাসিলিয়েভিচ স্লিউদিন একজন সহজ, বুদ্ধিমান, সহৃদয় ও নীতিনিষ্ঠ লোক, তাঁর জন্য লোকটির কিছু দুর্বলতা আছে বলে কারেনিন টের পেতেন; কিন্তু চাকরির পাঁচ বছর কাজকর্মের ফলে তাঁদের মধ্যে প্রাণ খোলা আলাপের পথে বাধার সৃষ্টি হয়।

কাগজগুলো সই করে কারেনিন মিখাইল ভাসিলিয়েভিচের দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইলেন অনেকক্ষণ, কথা বলার চেষ্টা করলেন কয়েকবার, কিন্তু পারলেন না। বাক্যটা তিনি তৈরি করেও রেখেছিলেন : ‘আমার দুর্ভাগ্যের কথা শুনেছেন আপনি?’ কিন্তু শেষ করলেন বরাবরের মত এই বলে যে : ‘তাহলে এটা আমার জন্য তৈরি করে রাখবেন’, এবং ছেড়ে দিলেন তাঁকে।

দ্বিতীয় ব্যক্তি হলেন ডাক্তার। তিনিও তাঁর প্রতি সুপ্রসন্ন; কিন্তু বহুদিন হল দুজনের মধ্যে একটা নীরব স্বীকৃতি দেখা দিয়েছে যে দুজনেই কাজে ভারি ব্যস্ত, দুজনেরই তাড়া আছে।

নিজের নারী বন্ধুদের কথা, তাদের মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনার কথা কারেনিন ভাবেননি। সমস্ত নারীই স্রেফ নারী বলেই তাঁর কাছে ভয়াবহ আর বিরক্তিকর লাগত।

বাইশ

কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনার কথা ভুলে গিয়েছিলেন আলেক্সেই আলেক্‌সান্দ্রভিচ কারেনিন, কিন্তু তিনি ভোলেননি তাঁকে। নিঃসঙ্গ হতাশার অতি দুঃসহ এই মুহূর্তেই তিনি এলেন তাঁর কাছে এবং কোনরকম জানানি না দিয়ে ঢুকলেন তাঁর স্টাডিতে। দুই হাতে মাথা রেখে যে অবস্থায় তিনি বসেছিলেন, সেই অবস্থাতেই তাঁকে দেখলেন কাউন্টেস।

‘নিষেধ অমান্য করলাম’, দ্রুত পদক্ষেপে এবং বিচলিত হৃদয় ও দ্রুততার জন্য হাঁপাতে হাঁপাতে ফরাসি ভাষায় বললেন তিনি, ‘আমি সব শুনেছি, কারেনিন, বন্ধু আমার!’ দুই হাতে শক্ত করে ওঁর হাতে চাপ দিয়ে নিজের সুন্দর ভাবালু দৃষ্টি ওঁর চোখে নিবদ্ধ রেখে বলে চললেন তিনি।

ভুরু কুঁচকে উঠে দাঁড়ালেন কারেনিন, নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে চেয়ার এগিয়ে দিলেন তাঁর দিকে।

‘বসবেন না কাউন্টেস? আমি কারো সাথে দেখা করছি না কারণ আমি অসুস্থ, কাউন্টেস’, উনি বললেন, ঠোঁট ওঁর কাঁপছিল।

‘বন্ধু আমার।’ তাঁর ওপর থেকে দৃষ্টি না সরিয়ে পুনরুক্তি করলেন কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনা। হঠাৎ ভুরু তাঁর জোড়ের জায়গায় উঁচু হয়ে উঠে একটা ত্রিভুজ গড়ে তুলল কপালে; কাউন্টেসের অসুন্দর হলদেটে মুখখানা হয়ে উঠল আরো অসুন্দর; কিন্তু কারেনিন টের পাচ্ছিলেন যে তাঁর জন্য কষ্ট হচ্ছে তাঁর, কেঁদেও ফেলবেন বুঝি। মন ভিজে উঠল তাঁর; কাউন্টেসের মুটকো হাতখানা নিয়ে চুমু খেতে লাগলেন তিনি।

‘বন্ধু আমার!’ ব্যাকুলতায় ভাঙা ভাঙা কণ্ঠস্বরে বললেন কাউন্টেস, ‘দুঃখে ভেঙে পড়া আপনার উচিত নয়। আপনার দুঃখটা খুবই বেশি, কিন্তু সান্ত্বনা পেতে হবে আপনাকে।’

‘আমি ভেঙে পড়েছি, মারা গেছি, আমি আর মানুষ নই’, ওঁর হাত ছেড়ে দিয়ে বললেন কারেনিন, তাকিয়েই রইলেন ওঁর সজল চোখের দিকে। ‘আমার অবস্থাটা সাংঘাতিক, কারণ কোথাও, এমন কি নিজের মধ্যেও আমি কোন নির্ভরস্থল দেখতে পাচ্ছি না।’

‘নির্ভরস্থল আপনি পাবেন, তার খোঁজ করুন, তবে আমার মধ্যে খুঁজবেন না, যদিও আমার বন্ধুত্বে বিশ্বাস রাখতে আপনাকে’, দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন উনি। ‘আমাদের নির্ভরস্থল হল প্রেম, সেই প্রেম যার উত্তরাধিকার তিনি দিয়ে গেছেন আমাদের; তাঁর বোঝা হালকা’, তিনি বললেন সেই তুরীয় দৃষ্টি মেলে যা কারেনিনের খুবই পরিচিত, ‘উনি রক্ষা করবেন আপনাকে, সাহায্য করবেন।’

কথাগুলোর মধ্যে নিজের মহত্ত্বের জন্য একটা মমতা আর কারেনিনের কাছে যা বাড়াবাড়ি বলে মনে হয় এবং পিটার্সবুর্গে সম্প্রতি যে নতুন তুরীয় অতীন্দ্রিয় মনোভাবের চল হয়েছে তা থাকলেও কথাগুলো শুনতে এখন ভালো লাগল কারেনিনের।

‘আমি দুর্বল। আমি ধ্বংসপ্রাপ্ত। কিছুই আমি আগে থেকে দেখতে পাইনি আর এখন বুঝতে পারছি না কিছুই।’

‘বন্ধু আমার—’ পুনরুক্তি করলেন লিদিয়া ইভানোভনা।

‘এখন যেটা নেই সেটা আমি হারাচ্ছি না, ও কথা নয়’, বলে গেলেন কারেনিন, ‘ও নিয়ে আমার কোন খেদ নেই। কিন্তু আমি যে অবস্থায় পড়েছি তাতে লোকের কাছে মুখ দেখানো ভার। এটা খারাপ, কিন্তু আমি পারছি না, পারছি না।’

‘ক্ষমা করার মহৎ যে কাজটা নিয়ে আমি এবং সবাই উচ্ছ্বসিত সেটা আপনি করেছেন তা নয়, আপনার বুকের মধ্যে যিনি আশ্রয় নিয়েছেন তিনি সেটা করেছেন’, তুরীয় উল্লাসে চোখ তুলে বললেন কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনা, ‘তাই নিজের আচরণের জন্য আপনার লজ্জার কিছু নেই।’

ভুরু কুঁচকে হাত ঘুটিয়ে আঙুল মটকাতে লাগলেন আলেক্‌সেই আলেক্‌সান্দ্রভিচ কারেনিন।

সরু গলায় তিনি বললেন, ‘সমস্ত খুঁটিনাটি আপনার জানা দরকার। মানুষের শক্তির একটা সীমা আছে কাউন্টেস, আমি সেই সীমায় পৌঁছেছি। সারা দিন আজ আমাকে হুকুম দিতে হয়েছে, আমার নতুন একাকী অবস্থা থেকে যা আসছে’ (‘যা আসছে’ কথাটার ওপর তিনি জোর দিলেন) ‘সেই হুকুম দিতে হয়েছে সংসার নিয়ে। চাকর, গৃহশিক্ষিকা, বিল… ছোট এই আগুনটা আমাকে দগ্ধে মারছে। টিকে থাকার শক্তি আমার আর নেই। ডিনারে… কাল সন্ধ্যায় ডিনার ছেড়ে প্রায় চলে যাচ্ছিলাম আর কি। ছেলে আমার দিকে যেভাবে তাকাচ্ছিল, তা সইতে পারছিলাম না আমি। এসবের মানে কি সেটা সে জিজ্ঞেস করেনি আমাকে, তবে জিজ্ঞেস করতে চাইছিল, আর সে দৃষ্টি আমি সইতে পারছিলাম না। আমার দিকে তাকাতে সে ভয় পাচ্ছিল, তবে এটুকুই সব নয়…’

বিলটার কথা বলবেন ভাবছিলাম কারেনিন, কিন্তু গলা তাঁর কেঁপে গেল, থেমে গেলেন তিনি। নীল কাগজে টুপি আর ফিতের জন্য এই বিলটার কতা তিনি ভাবতে পারছিলেন না আত্মরুণা বোধ না করে।

‘আমি বুঝতে পারছি, বন্ধু আমার’, কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনা বললেন, ‘সবই আমি বুঝতে পারছি। আমার কাছে থেকে সাহায্য আর সান্ত্বনা আপনি পাবেন না। তাহলেও এলাম শুধু পারলে আপনাকে সাহায্য করার জন্য। হীন করে তোলা ছোট ছোট এসব ঝামেলা থেকে যদি রেহাই দিতে পারতাম আপনাকে… আমি বুঝতে পারছি যে নারীর মুখের কথা, নারীর হুকুম দরকার। আপনি সে ভার দেবেন আমাকে?

নীরবে, কৃতজ্ঞচিত্তে কারেনিন ওঁর হাতে চাপ দিলেন।

‘আপনি আমি দুজনে সেরিওজার দেখাশোনা করব। সাংসারিক ব্যাপারে আমি দুরস্ত নই। তাহলেও ভার নিচ্ছি, আমি হব আপনার ভাণ্ডারিণী। ধন্যবাদ দিতে হবে না। এটা তো করছি আমি নিজে নয়…’

‘ধন্যবাদ না দিয়ে যে পারি না।’

‘কিন্তু বন্ধু আমার, ওই যে মনোভাবটার কথা বললেন ওতে গা ভাসাবেন না। খ্রিস্ট ধর্মের দিক থেকে যে জিনিসটা সবচেয়ে মহনীয় তার জন্য আবার লজ্জা কি। যে নিজেকে নিচু করে, সে ওপরে ওঠে। আর আমাকে ধন্যবাদও দিতে পারেন না আপনি। ধন্যবাদ দিতে হয় ওঁকে, সাহায্য চান ওঁর কাছে। শুধু ওঁর কাছ থেকেই আমরা পাব শান্তি, সান্ত্বনা, ত্রাণ এবং প্রেম’, এই বলে তিনি আকাশের দিকে চোখ তুললেন এবং প্রার্থনা করতে লাগলেন, কারেনিন সেটা অনুমান করলেন তাঁর নীরবতা থেকে।

কারেনিন শুনছিলেন তাঁর কথা। তাঁর যে উক্তিগুলো আগে বিশ্রী না হলেও অন্তত অনাবশ্যক মনে হত, সেগুলো এখন মনে হল স্বাভাবিক, সান্ত্বনাদায়ক। নতুন এই তুরীয় প্রেরণাটা ভালোবাসতেন না কারেনিন। তিনি ছিলেন ধর্মবিশ্বাসী লোক, কিন্তু ধর্মে তাঁর আগ্রহ ছিল প্রধানত রাজনৈতিক অর্থে, আর নতুন যে মতবাদটা কিছু কিছু ভিন্ন ব্যাখার সুযোগ দিচ্ছে, তা তর্ক ও বিশ্লেষণের পথ করে দিচ্ছে বলেই নীতির দিক থেকে তাঁর বিরাগ উদ্রেক করত। নতুন এই মতবাদটা সম্পর্কে আগে তিনি ছিলেন নিরুত্তাপ, এমন কি শত্রুভাবাপন্নই। কিন্তু কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনা এই নিয়ে মেতে উঠলে তিনি কখনো তর্ক করেননি তাঁর সাথে, প্রাণপণে চেষ্টা করতে নীরবতায় তাঁর চ্যালেঞ্জগুলো এড়িয়ে যেতে। এখন কিন্তু এই প্রথম তাঁর কথা শুনেছিলেন তৃপ্তির সাথে, মনের মধ্যে কোন প্ৰতিবাদ উঠছিল না তাঁর।

‘আপনার কাজ আর কথা দুইয়ের জন্যই আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ’, ওঁর প্রার্থনা শেষ হতে বললেন কারেনিন।

কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনা আরো একবার বন্ধুর দুই হাতে চাপ দিলেন।

‘এবার আমি কাজে নামছি’, কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অবশিষ্ট অশ্রুটুকু মুখ থেকে মুছে তিনি বললেন হেসে, ‘আমি যাচ্ছি সেরিওজার কাছে। শুধু চূড়ান্ত ক্ষেত্রেই আপনার দ্বারস্থ হব’, এই বলে তিনি উঠে চলে গেলেন।

কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনা সেরিওজার কামরায় গিয়ে চোখের পানিতে ভীত ছেলেটির গাল ভিজিয়ে দিয়ে বললেন যে তার বাবা সাধু পুরুষ আর তার মা মারা গেছেন।

নিজের প্রতিশ্রুতি পালন করলেন কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনা। সত্যিই তিনি কারেনিনের সংসারের সুব্যবস্থা করা ও তা চালানোর ভার নিলেন। তবে তিনি যে বলেছিলেন, সাংসারিক ব্যাপারে তিনি দুরস্ত নন, সেটা কিন্তু অত্যুক্তি ছিল না। তাঁর সমস্ত হুকুম পালটাতে হচ্ছিল, কেননা সেগুলো অপালনীয়, আর পালটাচ্ছিল কারেনিনের পোশাক – বরদার কর্নেই। সকলের অলক্ষ্যে সে এখন কারেনিন সংসার চালাতে লাগল এবং পোশাক পরাবার সময় শান্তভাবে সাবধানে তাঁকে জানাতো কি দরকার। তাহলেও লিদিয়া ইভানোভনার সাহায্য কার্যকরী হয়েছিল খুবই : কারেনিনের প্রতি তাঁর ভালোবাসা আর শ্রদ্ধায় তাঁকে একটা নৈতিক অবলম্বন যোগালেন তিনি এবং বিশেষ করে যা ভাবতে তাঁর ভালো লাগত, তাঁকে প্রায় খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত করে ফেললেন, অর্থাৎ উদাসীন ও অলস এক ধর্মবিশ্বাসীতে তিনি প্রায় পরিণত করলেন নতুন ব্যাখ্যার সেই মতবাদটার দৃঢ় ও প্রচণ্ড এক ভক্ততে যার হাওয়া তখন এসেছিল পিটার্সবুর্গে। কারেনিনের প্রত্যয় জাগানো ছিল সহজ। লিদিয়া ইভানোভনা এবং এই দৃষ্টিভঙ্গি যারা গ্রহণ করেছে তেমন অন্যান্য সব লোকের মত কারেনিনের কল্পনার কোন গভীরতা, মননের যে শক্তিতে কল্পনা থেকে উদ্ভূত ধ্যান-ধারণাগুলি হয়ে দাঁড়ায় এমন বাস্তব যে অন্যান্য ধারণা ও বাস্তবতার সাথে তা সমন্বয় দাবি করে, সেটা তাঁর আদৌ ছিল না। মৃত্যু যে আছে শুধু অবিশ্বাসীদের জন্য, তাঁর জন্য নয়, এবং তিনি যেহেতু ধর্মে পরিপূর্ণ বিশ্বাসী, আর বিশ্বাস কতটা তার বিচারকর্তা তিনি নিজে, সেহেতু তাঁর প্রাণে কোন পাপ নেই এবং এখানে, এই ইহলোকেই তিনি যে ত্রাণ পেয়ে গেছেন, এ ভাবনায় তিনি অসম্ভব বা অকল্পনীয় কিছু দেখলেন না।

নিজের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে তাঁর এই ধারণাটা যে আসছে অতি অনায়াসে এবং তা ভ্রান্ত, সেটা ঝাপসাভাবে কারেনিন যে অনুভব করতেন তা ঠিক; তিনি জানতেন যে তাঁর ক্ষমাটা কোন উচ্চ শক্তির ক্রিয়া কিনা তা না ভেবেই তিনি যখন ঐ অকপট অনুভূতিটায় আত্মসমর্পণ করেছিলেন তখন তিনি সুখ পেয়েছিলেন এখনকার চেয়ে বেশি, যখন প্রতি মুহূর্তে তিনি ভাবছেন যে প্রাণে বাস করছে খ্রিস্ট, কাগজপত্রগুলো সই করে তিনি তাঁর ইচ্ছাই পালন করছেন, তবে কারেনিনের পক্ষে এই রকমটা ভাবা ছিল খুবই আবশ্যক, নিজের হীনতায় তাঁর পক্ষে প্রয়োজন ছিল কল্পিত হলেও এমন একটা উচ্চতা লাভ করা যেখান থেকে সকলের কাছে ঘৃণিত তিনি অন্যদের ঘৃণা করতে পারবেন, ত্রাণ হিসেবে তিনি আঁকড়ে রইলেন নিজের কল্পিত ত্রাণটাকে।

তেইশ

অধ্যাত্মানন্দে আকুল এক বালিকা কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনার বিয়ে দেওয়া হয় খুব অল্প বয়সে, ধনী উচ্চবংশীয়, ভালোমানুষ এবং লম্পট এক ফুর্তিবাজের সাথে। দ্বিতীয মাসেই স্বামী তাঁকে ত্যাগ করেন এবং তাঁর হৃদয়াবেগের উচ্ছ্বসিত বিবরণের জবাব দেন উপহাসে এমন কি বিদ্বেষভরেই। যাঁরা জানতেন যে কাউন্ট ভালোমানুষ এবং লিদিয়ার আধ্যাত্মিক আকুলতায় খারাপ কিছু দেখতেন না, তাঁদের কাছে এটা দুর্বোধ্য ঠেকেছিল। বিবাহবিচ্ছেদ না হলেও সেই থেকে ওঁরা বাস করছেন পৃথক হয়ে এবং স্ত্রীর সাথে দেখা হলে স্বামী অবধারিতরূপেই বিষাক্ত বিদ্রূপ করতেন, যার কারণ বোঝা যেত না।

স্বামীর প্রণয়িনী হওয়ায় কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনা ক্ষান্তি দিয়েছিলেন অনেকদিন, কিন্তু সেই থেকে কারো একজনের প্রণয়িনী হয়ে থাকতে তাঁর ককনো আটকায়নি। হঠাৎ তিনি ভালোবেসে ফেলতেন একসাথে একাধিক লোককে, নারী পুরুষ উভয়কেই। যাঁর কিছু-একটা বৈশিষ্ট্য আছে এমন প্রায় সকলেরই প্রেমে পড়েছেন তিনি। জার বংশের সাথে আত্মীয়তা আছে এমন প্রতিটি প্রিন্সেস ও প্রিন্সকে তিনি ভালোবেসেছেন, রুশ গির্জার একজন মেট্রোপলিটান, একজন ভিকার এবং একজন পুরোহিতের প্রেমে পড়েছেন; একজন সাংবাদিক, তিনজন মন্ত্রী, একজন ডাক্তার, একজন ইংরেজ মিশনারি আর কারেনিনকে। কখনো ক্ষীণ, কখনো প্রবল এসব ভালোবাসায় অতি সুবিস্তৃত ও জটিল দরবারী ও সামাজিক সম্পর্কে পাততে তাঁর বাধা হয়নি। কিন্তু কারেনিনের দুর্ভাগ্যের পর, যখন থেকে তিনি তাঁকে তাঁর নিজের বিশেষ রক্ষণাধীনে নেন, যখন থেকে তিনি তাঁর মঙ্গলার্থে তাঁর সংসারে খাটতে থাকেন, তখন থেকে তাঁর মনে হতে লাগল যে অন্য সমস্ত ভালোবাসা সাঁচ্চা নয়, সত্যি করে তিনি ভালোবাসেন এক কারেনিনকে। তাঁর প্রতি তাঁর এখনকার যে হৃদয়াবেগ, সেটা মনে হল আগেকার সমস্ত হৃদয়াবেগের চেয়ে প্রবল। নিজের হৃদয়াবেগের বিশ্লেষণ এবং পূর্বেকারগুলির সাথে তুলনা থেকে তিনি পরিষ্কার বুঝতে পারলেন যে জারের জীবন রক্ষা না করলে কমিসারভের প্রেমে তিনি পড়তেন না, নিখিল স্লাভ প্রশ্ন না উঠলে তিনি প্রেমে পড়তেন না রিস্তিচ-কুজিৎস্কির সাথে, কিন্তু কারেনিনকে তিনি ভালোবেসেছেন তাঁর নিজের জন্যই, তাঁর সমুন্নত দুর্বোধ্য প্রাণ, তাঁর কাছে মধুর তাঁর সরু কণ্ঠস্বর, প্রলম্বিত বাগভঙ্গি, তাঁর ক্লান্ত দৃষ্টি, তাঁর চরিত্র, তাঁর ফুলো ফুলো শিরায় ভরা নরম সাদা হাতের জন্যই। তাঁর সাথে দেখা হলে শুধু আনন্দই হত না তাঁর, কি প্রভাব তিনি ফেলছেন তার লক্ষণ তিনি খুঁজতেন কারেনিনের মুখভাবে। তাঁকে কারেনিনের মনে ধরুক, এটা তিনি চাইতেন শুধু কথা কয়ে নয়, সর্ব সত্তা দিয়ে। ওঁর জন্য তিনি এখন নিজের প্রসাধন নিয়ে যত ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, তা আগে আর কখনো হননি। ওঁর যদি স্বামী না থাকত আর কারেনিন ঘরে ঢুকলে উদ্বেল হৃদয়ে তিনি লাল হয়ে উঠতেন, কারেনিন তাঁকে মনোরম কিছু বললে উল্লাসের হাসি তিনি দমন করতে পারতেন না।

কয়েক দিন ধরে কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনা আছেন প্রবল উত্তেজনার মধ্যে। তিনি জানতে পেরেছেন যে আন্না আর ভ্রন্‌স্কি রয়েছেন পিটার্সবুর্গে। আন্নার সাথে সাক্ষাৎ থেকে বাঁচাতে হবে কারেনিনকে, কষ্টকর এই জ্ঞানটা থেকেও তাঁকে বাঁচাতে হবে যে ভয়াবহ ওই নারীটা রয়েছে তাঁর সাথে একই শহরে আর যে কোন মুহূর্তে ওঁর সাথে দেখা হয়ে যেতে পারে তাঁর।

নিচের পরিচিতদের মারফত লিদিয়া ইভানোভনা খবর নিলেন কি মতলব এই জঘন্য লোকগুলোয় (আন্না আর ভ্রন্‌স্কিকে তিনি এই বলেই অভিহিত করতেন), এবং ওঁদের সাথে যাতে দেখা না হয় তার জন্য এই দিনগুলোয় নিজের বন্ধুর সমস্ত গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলেন। ভ্রন্‌স্কির বন্ধু তরুণ অ্যাডজুট্যান্ট, যার মারফত তিনি খবর জোগাড় করেছিলেন এবং কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনার কৃপায় যে একটা পারমিট পাবার আশা করছিল সে জানাল যে ওঁদের কাজকর্ম মিটে গেছে, চলে যাবেন পরের দিন। লিদিয়া ইভানোভনা শান্ত হয়ে আসছিলেন, এমন সময় পরের দিন সকালে তাঁকে একটা চিঠি দেওয়া হল সভয়ে যার হস্তাক্ষর চিনতে পারলেন তিনি। এটা আন্না কারেনিনার হস্তাক্ষর। প্রিন্টের মত পুরু মোটা কাগজে খামটা বানানো, লম্বাটে হলুদ কাগজে বিশাল এক মনোগ্রাম, চিঠি থেকে মিষ্টি গন্ধ ছাছিল।

‘কে আনলে এটা?’

‘হোটেলের একজন লোক।’

চিঠিটা পড়ার জন্য কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনা সুস্থির হয়ে বসতে পারলেন না অনেকক্ষণ। উত্তেজনায় হাঁপের টান ধরল তাঁর, এ রোগটায় তিনি ভোগেন। যখন শান্ত হলেন, ফরাসি ভাষায় লেখা নিচের এই চিঠিটা পড়লেন তিনি

মান্যবরা কাউন্টেস,

খ্রিস্টীয় যে অনুভূতিতে আপনার হৃদয় পূর্ণ, তাতে আপনার কাছে চিঠি লেখার, আমার বিশ্বাস, অমার্জনীয় দুঃসাহস পাচ্ছি আমি। ছেলের সাথে বিচ্ছেদে আমি কষ্ট পাচ্ছি। আমি চলে যাবার আগে ওকে অন্তত একবার দেখার অনুমতি ভিক্ষা করছি। আমার কথা আপনার মনে পড়িয়ে দিলাম বলে মাপ করবেন। আমি কারেনিনের কাছে নয়, আপনার কাছেই লিখছি শুধু এই জন্য যে নিজের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে মহানুভব ওই মানুষটাকে কষ্ট দিতে চাই না আমি। ওঁর প্রতি আপনার বন্ধুত্বের কথা আমি জানি, তাই আমাকে আপনি বুঝবেন। সেরিওজাকে কি আমার কাছে পাঠাবেন, নাকি-একটা নির্দিষ্ট সময়ে আমিই বাড়ি যাব, অথবা আপনি জানাবেন বাড়ির বাইরে কোথায় এবং কখন ওর সাথে দেখা করতে পারি? যাঁর ওপর এটা নির্ভর করছে তাঁর মহানুভবতা জানা থাকায় আমি আশা করছি না যে এতে আপত্তি হবে। আপনি কল্পনা করতে পারবেন না কি আকুলতা বোধ করছি ওকে দেখার জন্য, তাই আপনার সাহায্য আমার মধ্যে কি কৃতজ্ঞতা জাগাবে সেটাও কল্পনা করতে পারবেন না আপনি।

আন্না’

চিঠির সব কিছুতে, তার বক্তব্য, মহানুভবতার ইঙ্গিত, বিশেষ করে তার সুর, যেটা তাঁর মনে হল বেহায়া গোছের—সব কিছুতেই পিত্তি জ্বলে গেল কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনার

‘বলে দাও জবাব মিলবে না’, এই বলে কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনা তৎক্ষণাৎ তাঁর লেখার কেস খুলে কারেনিনকে লিখে পাঠালেন যে প্রাসাদে অভিনন্দন অনুষ্ঠানে দ্বিপ্রহরে তাঁর দেখা পাবার আশা করছেন।

‘গুরুত্বপূর্ণ ও দুঃখজনক একটা ব্যাপার নিয়ে আপনার সাথে আমার কথা বলা প্রয়োজন। ওখানে আমরা ঠিক করব কোথায়। ভালো হয় আমার বাড়িতে, সেখানে আমি আপনার যা রুচি, তেমন চা করতে বলব। জরুরি প্রয়োজন। উনি ক্রস দেন, তা বহনের শক্তিও দেন তিনি’, ওঁকে খানিকটা অন্তত তৈরি করে রাখার জন্য যোগ করলেন তিনি।

দিনে সাধারণত দু’তিনটা চিরকুট ওঁকে লিখে পাঠাতেন কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনা। ওঁর সাথে যোগাযোগের এই পদ্ধতিটা কাউন্টেসের ভালো লাগত, তাতে একটা চারুতা ও গোপন রহস্যময়তার ভাব থাকত যা পাওয়া যেত না তাঁর ব্যক্তিগত আলাপে।

চব্বিশ

শেষ হল অভিনন্দন অনুষ্ঠান। লোকে চলে যেতে গিয়ে পরস্পর দেখা হওয়ায় টাটকা খবরাখবর, সদ্যপ্রাপ্ত পারতোষিক আর বড় কর্তাদের অদল-বদল নিয়ে গল্প করতে লাগল।

অদল-বদল নিয়ে জিজ্ঞেস করায় সোনালি জরির কাজ করা উর্দি পরিহিত এক পক্ককেশ বৃদ্ধ বললেন জনৈক দীর্ঘাঙ্গী রাজ্ঞী-সহচরীকে : ‘কাউন্টেস মারিয়া বরিসভনা সমর মন্ত্রী আর প্রিন্সেস ভাৎকোভস্কায়া স্টাফ-প্রধান হলে বেশ হত।’

‘আর আমি অ্যাডজুট্যান্ট’, হেসে জবাব দিলে রাজ্ঞী-সহচরী।

‘আপনার পদ তো স্থির হয়ে আছে। আপনি যাবেন আধ্যাত্মিক বিভাগে আর কারেনিন হেবন আপনার সহকারী। ‘নমস্কার প্রিন্স’, যে লোকটি এগিয়ে এসেছিলেন তাঁর করমর্দন করে বৃদ্ধ বললেন।

‘কারেনিন সম্পর্কে কি যেন?’ জিজ্ঞেস করলেন প্রিন্স।

‘বলছিলাম যে উনি আর পুতিয়াতোভ ‘আলেক্‌সান্দর নেভস্কি’ অর্ডার পেয়েছেন।

‘আমার দারণা ছিল সেটা তিনি পেয়েছেন আগেই।’

উঁহু। দেখুন ওঁর দিকে চেয়ে’, কাঁধের ওপর দিয়ে নতুন লাল ফিতে ঝোলালো দরবারী উর্দিপরা কারেনিনের দিকে নকশী টুপি দিয়ে দেখিয়ে বৃদ্ধ বললেন। হলের দরজার কাছে কারেনিন দাঁড়িয়ে ছিলেন রাষ্ট্রীয় পরিষদের এক প্রভাবশালী সদস্যের সাথে। ‘তামার পয়সার মত সুখী আর তুষ্ট’, ব্যায়ামবীরের মত দেখতে এক সুপুরুষ কামেরহেরের সাথে করমর্দনের জন্য থেমে তিনি বললেন।

‘না, উনি বুড়িয়ে যাচ্ছেন’, বললেন কামেরহের।

‘দুর্ভাবনার দরুন। প্রকল্প ছকা ছাড়া এখন তাঁর আর কি আছে? সমস্ত পয়েন্ট বুঝিয়ে না বলা পর্যন্ত উনি ছাড়বেন না বেচারিকে।’

বুড়িয়ে গেছে মানে? সাফল্য লাভ তো করছেন! আমার মনে হয় কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনা এখন ঈর্ষা করছেন ওঁর স্ত্রীকে।’

‘কি বলছেন! কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনা সম্পর্কে খারাপ কিছু বলবেন না দয়া করে।’

‘উনি যে কারেনিনের প্রেমে পড়েছেন, সেটা কি খারাপ হল?’

‘আচ্ছা, কারেনিনা এখানে, সত্যি নাকি?’

’মানে এখানে, প্রাসাদে নয়, তবে পিটার্সবুর্গে। কাল আলেক্সেই ভ্রন্‌স্কি আর ওঁর সাথে দেখা হয়েছিল আমার- বাহুলগ্না, বাহুলগ্না মস্কায়া রাস্তায়।’

‘এ লোকটার নেই…’ ফরাসি ভাষায় বলতে শুরু করেছিলেন কামেরহের, কিন্তু জার বংশের একজনকে পথ ছেড়ে দিয়ে অভিবাদন জানাবার জন্য থেমে গেলেন।

এভাবে ওঁরা কারেনিনকে অবিরাম ধিক্কার আর টিটকারি দিয়ে কথা বলে চললেন আর উনি ওদিকে রাষ্ট্রীয় পরিষদের সদস্যকে পাকড়াও করে তাঁর জন্য পথ না ছেড়ে দিয়ে এক মিনিটও না থেমে, উনি যাতে ফসকে না যান তার জন্য আর্থিক প্রকল্পটির প্রতি পয়েন্ট বোঝাতে থাকলেন তাঁকে।

স্ত্রী যখন কারেনিনকে ছেড়ে যান, ঠিক সেই সময়েই ঘটে চাকুরে লোকের কাছে সবচেয়ে যা দুঃখজনক সেই ঘটনাটি—উদীয়মান ভাগ্যের অবসান। অবসানটা ঘটল এবং সবাই পরিষ্কার তা দেখতে পাচ্ছিল, কিন্তু কারেনিন নিচে সজ্ঞান ছিলেন না যে তাঁর উন্নতি থেমে গেছে। স্ত্রেমভের সাথে সংঘাত, নাকি স্ত্রীর ব্যাপারে তাঁর দুর্ভাগ্য অথবা তাঁর যা নির্বন্ধ ছিল সে সীমায় তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন কিনা, যে কারণেই হোক, এ বছর সবার কাছেই সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে তাঁর চাকরি জীবনে ইতি পড়েছে। তখনও তিনি গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী, বহু কমিশন ও কমিটির সদস্য, কিন্তু তিনি তখন ফুরিয়ে যাওয়া মানুষ, কেউ তাঁর কাছ থেকে কোন প্রত্যাশা রাখে না। যাই তিনি বলুন, যে প্রস্তাবই তিনি দিন, লোকে তাঁর কথা শুনতো এমনভাবে যেন তিনি যা বলছেন তা অনেকদিন থেকেই সবার জানা এবং সেটি ঠিক তাই যা নিষ্প্রয়োজন।

কিন্তু কারেনিন এটা অনুভব করতেন না, বরং উল্টো : সরকারি ক্রিয়াকলাপে সরাসরি অংশগ্রহণ থেকে অপসারিত হবার পর অন্যের কাজকর্মে ভুলচুক তাঁর চোখে পড়তে লাগল আগের চেয়েও বেশি স্পষ্ট করে, এবং তা সংশোধনের উপায় নির্দেশ করা তাঁর কর্তব্য বলে গণ্য করলেন। স্ত্রীর সাথে তাঁর বিচ্ছেদের কিছু পরেই তিনি লিখতে শুরু করেন নতুন আদালত সম্পর্কে রিপোর্ট, প্রশাসনের সমস্ত শাখা নিয়ে অসংখ্য যেসব নিষ্প্রয়োজন রিপোর্ট লেখা তাঁর কপালে ছিল, এটি তার প্রথম।

চাকুরির জগতে তাঁর নৈরাশ্যজনক পরিস্থিতিটা কারেনিন শুধু যে খেয়াল করলেন না তাই নয়, তার জন্য তাঁর কোন বেদনা হল না তাই নয়, নিজের কাজকর্মে এত তুষ্ট তিনি আর কখনো বোধ করেননি।

‘বিবাহিতরা জাগতিক ব্যাপার লইয়া ভাবিত, কিভাবে সন্তোষ বিধান করা যায় স্ত্রীর, ব্রহ্মচারীরা সৃষ্টিকর্তা লইয়া ভাবিতো, কি করিয়া সন্তোষ বিধান করা যায় সৃষ্টিকর্তার’, বলেছেন খ্রিস্টদূত পল আর এখন সর্বব্যাপারে পবিত্র গ্রন্থ অনুসারে চালিত হয়ে তিনি প্রায়ই স্মরণ করতে এই উক্তিটি। তাঁর মনে হত, স্ত্রীর সাথে ছাড়াছাড়ি হবার পর থেকে এসব প্রকল্প দিয়ে তিনি প্রভুর সেবা করেছেন আগের থেকে বেশি করে।

তাঁর কাছ থেকে চলে যাবার জন্য পরিষদ সদস্যের সুস্পষ্ট অধৈর্যে বিব্রত বোধ করছিলেন না কারেনিন; তিনি তাঁর বক্তব্য থামালেন শুধু তখন, যখন কাছ দিয়ে এক রাজবংশীয়কে যেতে দেকার সুযোগ নিয়ে পরিষদ সদস্য তাঁর হাত ছাড়ান।

একলা হয়ে পড়ে কারেনিন তাঁর ভাবনাগুলো ভেবে দেখলেন মাথা নুইয়ে, তারপর অন্যমনস্কের মত এদিক-ওদিক চেয়ে গেলেন দরজার দিকে, যেখানে কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনার দেখা পাবেন বলে আশা করছিলেন।

কামেরহেরের জুলপি আঁপড়ানো, সুরভিত, তাঁর দিকে এবং প্রিন্সের উর্দিতে আঁটো লাল গর্দানের দিকে তাকিয়ে (এঁদের কাছ দিয়ে যেতে হচ্ছিল তাঁকে) কারেনিন ভাবলেন, ‘কি-সব তাগড়াই দশাসই মানুষ। লোকে ঠিকই বলে যে দুনিয়ায় সবই বিদ্বেষে ভরা’, কামেরহেরের পায়ের ডিমের দিকে আরও একবার তীর্যক দৃষ্টিপাত করে ভাবলেন তিনি।

এই যে লোকগুলো তাঁকে নিয়েই আলোচনা করছিল, অলস পদক্ষেপে ক্লান্তি ও মর্যাদার অভ্যস্ত ভঙ্গিতে কারেনিন তাদের উদ্দেশে মাথা নুইয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে খুঁজতে লাগলেন কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনাকে।

‘আরে, কারেনিন!’ কারেনিন যখন ওঁর কাছাকাছি এসে নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে মাথা নোয়ালেন, বৃদ্ধ তখন বলে উঠলেন বিদ্বেষে চোখ চকচক করে, ‘আপনাকে আমার অভিনন্দন জানানো হয়নি যে’, সদ্যপ্রাপ্ত ফিতেটা দেখিয়ে বললেন তিনি।

‘ধন্যবাদ আপনাকে’, জবাব দিলেন কারেনিন, ‘কি সুন্দর আজকের দিনটা’, ‘সুন্দর’ কথাটার ওপর তাঁর অভ্যস্ত ঢঙে ঝোঁক দিয়ে বললেন তিনি।

ওরা যে তাঁকে নিয়ে হাসাহাসি করেছে, সেটা তিনি জানতেন, কিন্তু ওদের কাছ থেকে বিরূপতা ছাড়া আর কিছু আশা করতেন না তিনি এবং এতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন।

দরজার কাছে আসা কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনার কর্সেট থেকে বেরিয়ে আসা হলুদ কাঁধ আর ডাক পাঠানো অপরূপ ভাবালু চোখ জোড়া দেখতে পেয়ে কারেনিন তাঁর অক্ষয় দাঁতের পাটি উদ্ঘাটিত করে গেলেন তাঁর কাছে।

লিদিয়া ইভানোভনার প্রসাধনে মেহনত লেগেছে অনেক, যেমন লাগছিল সাম্প্রতিক এই দিনগুলোয়। তিরিশ বছর আগে তাঁর যা লক্ষ্য ছিল, তাঁর এখনকার প্রসাধনের লক্ষ্য তার একেবারে বিপরীত। তখন তিনি নিজেকে সাজাতে চাইতেন যা-কিছু দিয়ে হোক, এবং সেটা যত বেশি হয় ততই ভালো। কিন্তু এখন তাঁর বয়স আর দেহরেখার সাথে বেমানান প্রসাধন অবশ্য-অবশ্যই এত বেশি চোখে পড়ে যে তাঁকে দেখতে হচ্ছে শুধু এই যাতে তাঁর চেহারার সাথে এসব প্রসাধনের বৈকট্য বড় বীভৎস না হয়ে পড়ে। কারেনিনের ক্ষেত্রে এটা তিনি করতে পেরেছিলেন, আর নিজেকে চিত্তাকর্ষকই মনে হত তাঁর কাছে। কাউন্টেস ছিলেন তাঁর কাছে শুধু তাঁর প্রতি প্রসন্নতার নয়, তাঁকে ঘিরে শত্রুতা ও উপহাসের যে সমুদ্র বিরাজ করছে সেখানে ভালোবাসার একটি দ্বীপ।

উপহাসের দৃষ্টির মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে তিনি স্বভাবতই কাউন্টেসের প্রেমাবিষ্ট দৃষ্টিতে আকৃষ্ট হলেন যেভাবে উদ্ভিদ আকৃষ্ট হয় আলোয়।

‘অভিনন্দন’, চোখ দিয়ে রিবনের প্রতি ইঙ্গিত করে বললেন কাউন্টেস।

পরিতৃপ্তির হাসিটা দমন করে উনি চোখ বুজে কাঁধ কোঁচকালেন, যেন তাতে করে বলতে চান যে আমাকে এটা খুশি করতে পারে না। কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনা ভালোই জানতেন যে ওঁর প্রধান একটা আনন্দই হল এটা, যদিও তা তিনি স্বীকার করবেন না কখনো।

‘আমাদের পুরো সন্তুষ্ট এমন কথা বলতে পারব না’, চোখ মেলে ভুরু তুলে বললেন কারেনিন, ‘সিনিকভও খুশি নন।’ (সিৎনিকভ শিক্ষক, সেরিওজার ইহলৌকিক শিক্ষার ভার পেয়েছিলেন তিনি।) ‘আমি তো আগেও আপনাকে বলেছিলাম, প্রধান প্রধান যেসব প্রশ্নে প্রতিটি মানুষ ও প্রতিটি শিশুর মন দোলায়িত হবার কথা, তাতে ওর কেমন একটা অনীহা আছে’, এই বলে চাকুরি আর যে একটা প্রশ্নে তিনি আগ্রহী—ছেলের শিক্ষাদীক্ষা, তা নিয়ে নিজের মতামত পেশ করতে লাগলেন কারেনিন।

লিদিয়া ইভানোভনার সাহায্যে তিনি যখন জীবন ও কাজকর্মে ফেরেন, তখন তাঁর হাতে রেখে যাওয়া ছেলের শিক্ষাদীক্ষার ব্যাপারটা দেখা তাঁর কর্তব্য বলে মনে হয়েছিল। শিক্ষার প্রশ্ন নিয়ে কারেনিন আগে কখনো মাথা ঘামাননি, এখন ব্যাপারটার তাত্ত্বিক অধ্যয়নে সময় দিতে লাগলেন কিছুটা। এবং নরবিজ্ঞান, শিক্ষণবিদ্যা ও নীতিশাস্ত্রের খানকত বই পড়ে তিনি শিক্ষাদানের একটা পরিকল্পনা ছকলেন নিজের জন্য আর উপদেশের জন্য পিটার্সবুর্গের সেরা শিক্ষককে আমন্ত্রণ করে তিনি কাজে নামলেন। আর এই কাজেই ব্যস্ত রইলেন সব সময়।

‘কিন্তু মনটা? আমি দেখছি ও বাবার মনটা পেয়েছে আর এরকম মন থাকলে শিশু খারাপ হতে পারে কখনো’, সোচ্ছ্বাসে বললেন কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনা।

‘হতে পারে… আমার কথা যদি ধরেন, তাহলে আমি আমার কর্তব্য করে যাচ্ছি। এটুকুই করতে পারি আমি।’ একটু চুপ করে থেকে কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনা বললেন, ‘আপনি আসুন আমার ওখানে। আপনার পক্ষে কষ্টকর একটা ব্যাপার নিয়ে কথা বলা দরকার। কতকগুলি স্মৃতি থেকে আমি আপনাকে নিষ্কৃতি দিতে চাই, সবাই তা ভাবে না। ওর কাছ থেকে চিঠি পেয়েছি আমি। ও এখানে, পিটার্সবুর্গে।’

স্ত্রীর উল্লেখে কেঁপে উঠলেন কারেনিন কিন্তু সাথে সাথেই তাঁর মুখ ফুটে উঠল মড়ার মত আড়ষ্টতা যাতে এ ব্যাপারে প্রকাশ পাচ্ছিল তাঁর সম্পূর্ণ অসহায়ত্ব।

বললেন, আমি তাই আশা করেছিলাম।’

কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনা তাঁর দিকে চাইলেন তুরীয় দৃষ্টিতে, তাঁর প্রাণের মহিমা দেখে উচ্ছ্বাসে তাঁর চোখ ভরে উঠল পানিতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *