এক
প্রিন্স-মহিষী শ্যেরবাৎস্কায়া স্থির করলেন লেন্ট উৎসবের আগেই বিবাহ অনুষ্ঠান অসম্ভব, তার বাকি ছিল মাত্র পাঁচ সপ্তাহ। আর এই সময়ের মধ্যে যৌতুকের অর্ধেকটাই তৈরি হয়ে উঠতে পারবে না; কিন্তু লেভিনের এই কথায় সায় না দিয়ে তিনি পারলেন না যে, লেন্ট উৎসবের পরে হলে বড়ই দেরি হয়ে যাবে। কেননা প্রিন্স শ্যেরবাৎস্কির আপন বৃদ্ধ ফুফু অতি রুগ্ণা এবং মারা যেতে পারেন শিগগিরই, তখন শোক-পালনের জন্য আরো আটকে যেতে পারে বিয়েটা। সেই কারণে যৌতুককে দুই ভাগ—ছোট আর বড় অংশ ভাগ করবেন স্থির করে প্রিন্স-মহিষী লেন্টের আগেই বিবাহ অনুষ্ঠানে রাজি হলেন। তিনি ঠিক করলেন যে যৌতুকের ছোট অংশটা তিনি এখনই প্রস্তুত করে ফেলবেন, বড়টা পাঠানো যাবে পরে আর লেভিনের ওপর তাঁর ভারি রাগ হল কারণ এই ব্যবস্থায় তিনি রাজি কিনা, গুরুত্বসহকারে সে কথার জবাব দিচ্ছিলেন না লেভিন। এই ব্যবস্থাটা আরো বেশি সুবিধাজনক লাগল কেননা বিয়ের পরই তরুণযুগল চলে যাবে গ্রামে, আর সেখানে বড় যৌতুকের জিনিসপত্রের প্রয়োজন হবে না।
লেভিন থেকে গেলেন বিভোর তার সেই একই ঘোরে, যাতে তাঁর মনে হচ্ছিল যে বিদ্যমান সব কিছুর প্রধান ও একমাত্র লক্ষ্য হল তিনি আর তাঁর সুখ, এখন তাঁর আর কিছু নিয়ে ভাববার, ব্যতিব্যস্ত হবার কিছু নেই, অন্যেরাই সব করে দিচ্ছে এবং করে দিচ্ছে তাঁর জন্যই। এমন কি ভবিষ্যৎ জীবন সম্পর্কে কোন পরিকল্পনা বা লক্ষ্যও তাঁর ছিল না; সে সিদ্ধান্তের ভার তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন অন্যদের ওপর, তাঁর জানাই ছিল যে সবই চমৎকার হবে। কি তাঁর করা উচিত সে ব্যাপারে তাঁকে চালাচ্ছিলেন তাঁর বড় ভাই কজ্নিশেভ, অব্লোন্স্কি আর প্রিন্স-মহিষী। তাঁকে যা বলা হচ্ছিল, তিনি শুধু তার সব কিছুতেই পুরো সম্মতি দিয়ে যাচ্ছিলেন। বড় ভাই তাঁর জন্য টাকা ধার করছিলেন, প্রিন্স-মহিষী পরামর্শ দিলেন বিয়ের পর মস্কো ছাড়তে, অব্লোন্স্কি বললেন বিদেশে যেতে। উনি সবেতেই রাজি। তিনি ভাবতেনঃ ‘যা ইচ্ছে হয় করুন যদি তাতে আনন্দ পান আপনারা। আমি সুখী আর আপনারা যাই করুন-না কেন, সুখ আমার বাড়বেও না, কমবেও না।’ অব্লোন্স্কি ওঁদের বিদেশে যাবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, সে কথা কিটিকে বলায় কিটি তাতে রাজি হল না দেখে ভারি অবাক লেগেছিল লেভিনের। ভবিষ্যত জীবন সম্পর্কে কিটির নিজস্ব সুনির্দিষ্ট কি-একটা যেন চাহিদা ছিল। কিটি জানতো যে গ্রামে লেভিনের কি-সব কাজকর্ম আছে যা তিনি ভালোবাসেন। লেভিন দেখতে পেলেন যে সে কাজকর্মগুলো কিটি শুধু বোঝে না তাই নয়, বুঝতে চাও না। তবে সেগুলো অতি গুরুত্বপূর্ণ বলে গণ্য করতে এতে তার বাধা হয়নি। তাই সে জানতো যে গ্রামে হবে তাঁদের বাড়ি, তাই বিদেশে যেতে চায়নি, যেখানে সে বাস করবে না, চাইছিল সেখানেই যেতে যেখানে তাঁদের বাড়ি। সুস্পষ্টরূপে ব্যক্ত এই সংকল্পটা বিস্মিত করেছিল লেভিনকে। কিন্তু এতে তাঁর যেহেতু কিছু এসে যায় না, তাই তৎক্ষণাৎ তিনি অব্লোন্স্কিকে অনুরোধ করেন গ্রামে গিয়ে তাঁর জ্ঞানবুদ্ধি মত এবং যে সুরুচি তাঁর প্রচুর সেই অনুসারে ব্যবস্থা করে রাখেন, যেন এটা ওঁরই দায়িত্ব।
গ্রামে তরুণযুগলের জন্য সব ব্যবস্থাদি করে ফিরে এসে অলোনস্কি বললেন, ‘কিন্তু শোন, তুমি পাপ স্বীকার করেছ উপাসনায়, এমন সাক্ষ্য আছে তোমার?’
‘নেই। কিন্তু কেন?’
‘তা ছাড়া বিয়ে দেওয়া যাবে না।’
‘ধুত্তোরি ছাই!’ চেঁচিয়ে উঠলেন লেভিন, ‘আমি বোধহয় বছর নয়েক উপবাস আর দীক্ষায় যোগ দিইনি।‘
‘বেশ!’ হেসে বললেন অব্লোন্স্কি, ‘আর আমাকে বলো কিনা নিহিলিস্ট! তবে এটা ছাড়া চলবে না। তোমাকে যথারীতি উপবাস দিয়ে দীক্ষাশীর্বাদ নিতে হবে।’
‘কবে? বাকি আছে যে চারদিন।’
অব্লোন্স্কি এটারও ব্যবস্থা করলেন। উপোস দিতে লাগলেন লেভিন। নিজে নাস্তিক অথচ অন্যদের ধর্মবিশ্বাসের প্রতি সশ্রদ্ধ লোকদের মত লেভিনের পক্ষেও গির্জায় উপস্থিত থেকে তার বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদিতে যোগ দেওয়াটা ছিল বড়ই কষ্টকর। এখন তাঁর প্রাণের যা অবস্থা, যাতে সব কিছুর প্রতি তিনি সংবেদনশীল ও নম্রীভূত, তাতে ভান করা লেভিনের পক্ষে শুধু কঠিন নয়, একেবারে অসম্ভব ঠেকল। এখন তাঁর যশ, তাঁর শ্রীবৃদ্ধি যে-রকম দাঁড়িয়েছে, তাতে তাঁকে হয় মিথ্যে বলতে হয়, নয় সৃষ্টিকর্তার নিন্দা করতে হয়। তিনি টের পাচ্ছিলেন যে, এর কোনটাই করার মত অবস্থায় তিনি নেই। অব্লোন্স্কিকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, উপবাস-দীক্ষাদি ছাড়াই সাক্ষ্য পাওয়া যায় কি না। অব্লোন্স্কি বললেন, সেটা অসম্ভব।
‘কি আর এমন হল—দুটো তো দিন? ওটি বেশ অমায়িক বুদ্ধিমান বৃদ্ধ। তোমার এই দাঁতটা এমনভাবে সে তুলে ফেলবে যে তুমিই টেরও পাবে না।’
ষোল-সতের বছর বয়সে তাঁর মনে যে প্রবল ধর্মভাব জেগেছিল, প্রথম দ্বিপ্রাহরিক উপাসনার সেই কৈশোর স্মৃতি সতেজ করে তোলার চেষ্টা করলেন লেভিন। কিন্তু সাথে সাথেই নিঃসন্দেহ হয়ে উঠলেন যে সেটা তাঁর পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। তিনি চেষ্টা করলেন এসব কিছুকে একটা তাৎপর্যহীন ফাঁকা রেওয়াজ হিসেবে দেখবার চেষ্টা করতে, যেরকম রেওয়াজ হল আনুষ্ঠানিক দেখা করার ব্যাপারটা; কিন্তু টের পেলেন যে এটাও তিনি করতে পারছেন না কিছুতেই। ধর্মের ব্যাপারে লেভিন তাঁর অধিকাংশ সমসাময়িকদের মতই ছিলেন অতি অনির্দিষ্ট এক অবস্থায়। সৃষ্টিকর্তার বিশ্বাস তাঁর ছিল না, কিন্তু সেইসাথে এ সবই অন্যায়—এমন একটা দৃঢ় বিশ্বাসও ছিল না তাঁর। তাই তিনি যা করছেন তার অর্থমাহাত্ম্যে বিশ্বাস রাখা অথবা ফাঁকা একটা আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে এটাকে নির্বিকারভাবে দেখা, এর কোনটাই করার মত অবস্থায় না থাকায় উপবাস-দীক্ষার এই গোটা সময়টা তাঁর অস্বস্তি ও লজ্জা বোধ হচ্ছিল, যা করছিলেন তা তাঁর নিজের কাছেই বোধগম্য ছিল না, তাই তাঁর অন্তর যা বলছিল, করছিলেন তা তাঁর নিজের কাছেই বোধগম্য ছিল না, তাই তাঁর অন্তর যা বলছিল, করছিলেন কিছু-একটা মিথ্যাচার ও অন্যায়।
উপাসনার সময় তিনি প্রার্থনা কখনো শুনছিলেন এবং তাতে এমন অর্থ আরোপ করার চেষ্টা করছিলেন যা তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে নয়, আবার ওসব তিনি বুঝবেন না কিন্তু তার নিন্দাও করতে হয় এটা অনুভব করে চেষ্টা করছিলেন প্রার্থনা না শুনতে, নিজের ভাবনা, পর্যবেক্ষণ আর স্মৃতিচারণে নিমগ্ন থাকতে চাইছিলেন, যা গির্জায় এই পরবে দাঁড়িয়ে থাকার সময় অসাধারণ জীবন্ত হয়ে তাঁর মাথায় ঘুরঘুর করছিল।
প্রভাতী দ্বিপ্রাহরিক ও সান্ধ্য উপাসনা তিনি সয়ে গেলেন আর পরের দিন উঠলেন সচরাচরের চেয়ে আগে, চা না খেয়ে সকাল আটটায় প্রভাতী উপাসনা ও বচনামৃত শোনার জন্য।
একজন কাঙাল সৈনিক, দুজন বৃদ্ধা আর গির্জার সেবকরা ছাড়া সেখানে কেউ ছিল না।
পাতলা আলখাল্লার নিচে তরুণ ডিকনের লম্বা পিঠের দুই অর্ধাংশ প্রকট হয়ে ফুটে উঠেছে। লেভিনকে স্বাগত করে তিনি তৎক্ষণাৎ দেয়ালের কাছে ছোট একটা টেবিলের সামনে গিয়ে নীতিমালা পাঠ করতে শুরু করলেন। পাঠ যত এগোতে লাগল ততই, বিশেষ করে ‘প্রভু কৃপা করো’ কথাটার ঘনঘন ও দ্রুত পুনরুক্তিতে যা শোনাচ্ছিল ‘কৃপক, কৃপক’-এর মতই, লেভিন টের পাচ্ছিলেন যে তাঁর চিন্তা অবরুদ্ধ ও সীলমোহরাঙ্কিত হয়ে পড়ছে, এখন তাতে ছোঁয়া বা নাড়া দেওয়া অনুচিত, নইলে গোলমাল বেঁধে যাবে, তাই ডিকনের পেছনে দাঁড়িয়ে তিনি পাঠ না শুনে, তার ভেতরে প্রবেশ না করে নিজের ভাবনা ভেবে চললেন। কাল সন্ধ্যায় কোণের টেবিলটায় বসে থাকার কথা মনে করে তিনি ভাবছিলেন, ‘আশ্চর্য ভাবব্যঞ্জক কিটির হাত।’ বরাবরের মত প্রায় এই সময়টায় তাঁদের বলার কিছু ছিল না, আর কিটি টেবিলে হাত রেখে তা মুঠো করছিল আর খুলছিল আর তার নড়ন-চড়ন দেখে হেসে উঠছিল নিজেই। তাঁর মনে পড়ল যে সে হাতে তিনি চুমু খেয়েছিলেন, তারপর লক্ষ্য করছিলেন গোলাপি তালুতে মিলে যাওয়া রেখাগুলো। ‘আবার কৃপক…’ শরীর নুইয়ে এবং ডিকনের স্থিতিস্থাপক অবনত পিঠটা লক্ষ্য করতে করতে ভাবলেন লেভিন, ‘কিটি তারপর আমার হাতটা টেনে নিয়ে কররেখা দেখতে থাকে। বলেছিল, ‘তোমার চমৎকার হাত।’ নিজের হাতটা আর ডিকনের বেঁটে হাতটা লক্ষ করেন তিনি। ‘এবার বোধহয় শিগগিরই শেষ হচ্ছে’, ভাবলেন তিনি। ‘উঁহু, আবার মনে হচ্ছে গোড়া থেকে শুরু হল’, প্রার্থনা শুনতে শুনতে তিনি ভাবলেন, ‘না, শেষই হচ্ছে। ঐ তো উনি আভূমি নত হচ্ছেন। শেষ হবার আগে সব সময়ই এই করা হয়।’
ভেলভেটের কফে চুপিচুপি তিন রুবলের নোট পেয়ে ডিকন বললেন যে উনি ওঁর নাম লিখে নেবেন এবং শূন্য গির্জার পাটাতনে নতুন বুট জুতার তৎপর শব্দ তুলে গেলেন বেদীতে। মিনিট খানেক বাদে সেখান থেকে মুখ বাড়িয়ে দেখলেন এবং লেভিনকে ইশারা করলেন আসতে। এতক্ষণ পর্যন্ত অবরুদ্ধ চিন্তা নড়েচড়ে উঠল লেভিনের মাথায়, কিন্তু তাড়াতাড়ি করে তাকে তাড়ালেন তিনি। ‘কোন রকমে ঠিকঠাক হয়ে যাবে’, ভেবে গেলেন পৈঠার কাছে। সিঁড়ি দিয়ে উঠে ডান দিকে ফিরে তিনি দেখতে পেলেন যাজককে। আধপাকা পাতলা দাড়ি তাঁর, ক্লান্ত সহৃদয় চোখ, লেকটার্নের কাছে দাঁড়িয়ে প্রার্থনাগ্রন্থের পাতা ওলটাচ্ছিলেন বৃদ্ধ যাজক। লেভিনের উদ্দেশে সামান্য মাথা নুইয়ে উনি তখনই অভ্যস্ত গলায় প্রার্থনাপাঠ শুরু করলেন। সেটা শেষ হলে আভূমি নত হলেন তিনি, মুখ ফেরালেন লেভিনের দিকে।
ক্রসটা দেখিয়ে বললেন, ‘আপনার পাপস্বীকারোক্তি নেবার জন্য খ্রিস্ট এখানে অদৃশ্য থেকে উপস্থিত আছেন। আমাদের পবিত্র অ্যাপোস্ল গির্জা যা শিক্ষা দেয়, তা সবই আপনি বিশ্বাস করেন?’ লেভিনের মুখ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে স্টোলের তলে হাত রেখে তিনি বলে গেলেন।
‘সব কিছুতে আমার সন্দেহ আছে এবং সন্দেহ করি’, নিজের কাছেই অপ্রীতিকর একটা কণ্ঠস্বরে লেভিন বললেন এবং চুপ করে রইলেন।
আরো কিছু যদি বলে, এই আশায় কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করলেন যাজক তারপর চোখ বুজে ‘ও’ স্বরের ওপর দ্রুত জোর দিয়ে ভ্লাদিমির অঞ্চলের টানে বলে গেলেন : ‘সন্দেহ মানুষের দুর্বলতার লক্ষণ, কিন্তু করুণাময় প্রভু যাতে আমাদের শক্তি দেন তার জন্য প্রার্থনা করতে হবে আমাদের। বিশেষ পাপ কি করেছেন আপনি?’ এতটুকু ফাঁক না দিয়ে যোগ করলেন যেন সময় নষ্ট হতে পারে বলে ভয় হচ্ছিল তাঁর।
‘আমার প্রধান পাপ সন্দেহ। সব সময়ই সন্দেহ হয় আমার, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে থাকি সন্দেহের মধ্যে।’
‘সন্দেহ মানুষের দুর্বলতার লক্ষণ’, একই কথার পুনরাবৃত্তি করলেন যাজক, ‘প্রধানত কিসে আপনার সন্দেহ?’
‘সব কিছুতেই। মাঝে মাঝে এমন কি সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বেই সন্দেহ হয় আমার’, অজ্ঞাতসারেই বলে ফেললেন লেভিন আর যা বলেছেন তার অনৌচিতো আতংক হল তাঁর। কিন্তু লেভিনের কথায় মনে হল যেন কোন প্রতিক্রিয়া ঘটল না যাজকের।
সামান্য লক্ষগোচর একটু হাসি নিয়ে তিনি তাড়াতাড়ি বললেন, ‘সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বে সন্দেহ আবার কি হতে পারে?’
লেভিন চুপ করে রইলেন।
‘সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বে সন্দেহ আবার কি হতে পারে, যখন তাঁর সৃষ্টি আপনি দেখছেন?’ দ্রুত অভ্যস্ত টানে বলে গেলেন যাজক। ‘গগনমণ্ডলকে জ্যোতিষ্ক দিয়ে সাজাল কে? পৃথিবীকে কে সৌন্দর্যে মণ্ডিত করেছে? স্রষ্টা ছাড়া চলে কি?’ লেভিনের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে তিনি বললেন।
লেভিন টের পাচ্ছিলেন যে যাজকের সাথে দার্শনিক বিতর্কে প্রবৃত্ত হওয়া অশোভন, তাই জবাবে শুধু সেটা বললেন যা প্রশ্নটার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত।
লেভিন বললেন, ‘আমি জানি না।’
‘জানেন না? তাহলে সৃষ্টিকর্তার যে এ সব সৃষ্টি করেছেন, তাতেও সন্দেহ করেন আপনি?’ আমুদে একটা বিহ্বলতায় বললেন যাজক।
‘আমি কিছুই বুঝি না’, লাল হয়ে উঠে লেভিন বললেন, অনুভব করছিলেন যে তাঁর কথা হবে বোকার মত, এ অবস্থায় বোকার মত না হয়ে পারে না।
‘সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করে তাঁর কাছে অনুরোধ জানান। এমন কি দেবোপম পাদ্রীদেরও সন্দেহ থাকত, তাঁদের বিশ্বাস দৃঢ় করার জন্য তাঁরা প্রার্থনা করেছিলেন সৃষ্টিকর্তার কাছে। শয়তানের শক্তি অনেক, কিন্তু তার কাছে আত্মসমর্পণ করা আমাদের উচিত নয়। সৃষ্টিকর্তার উপাসনা করুন, প্রার্থনা করুন তাঁর কাছে। উপাসনা করুন’, তাড়াতাড়ি পুনরুক্তি করলেন তিনি।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে যাজক যেন কিছু-একটা ভাবছিলেন।
‘আমি শুনেছি আপনি আমার প্যারিশভুক্ত ও আধ্যাত্মিক পুত্র প্রিন্স শ্যেরবাৎস্কির কন্যাকে বিয়ে করতে যাচ্ছেন?’ হেসে যোগ করলেন তিনি, ‘চমৎকার মেয়ে।’
‘হ্যাঁ’, যাজকের বদলে লজ্জায় লাল হয়ে জবাব দিলেন লেভিন। ভাবলেন, ‘স্বীকারোক্তির ব্যাপারে ওটা তাঁর কি দরকার।’
এবং যেন তাঁর ভাবনার জবাব দিয়ে যাজক বললেন, ‘আপনি বিয়ে করতে যাচ্ছেন আর সৃষ্টিকর্তা হয়ত বংশধর দিয়ে পুরস্কৃত করবেন আপনাকে, তাই না? কিন্তু শয়তানের প্রলোভন যা আপনাকে অবিশ্বাসের দিকে আকর্ষণ করছে তা জয় করতে না পারলে কি শিক্ষা দেবেন আপনার শিশুদের?’ নিরীহ ভর্ৎসনায় উনি বললেন। ‘আপনার আত্মজনদের যদি আপনি ভালোবাসেন, তাহলে সন্তানদের জন্য আপনি শুধু ধন-সম্পদ, বিলাস, মানসম্মানই চাইবেন না; আপনি চাইবেন ওদের ত্রাণ, সত্যের আলোয় তাদের আত্মিক উদ্ভাসন। তাই না? কি আপনি জবাব দেবেন যখন আপনার নিষ্পাপ শিশুসন্তান আপনাকে জিজ্ঞেস করবে, ‘বাবা, এ দুনিয়ায় আমার যা-যা ভালো লাগে—পৃথিবী, পানি, সূর্য, ফুল, ঘাস—এ সব কে গড়ে দিল? তাকে কি আপনি বলবেন, ‘আমি জানি না?’ না জেনে আপনি পারেন না যখন প্রভু তাঁর পরম করুণায় আপনার জন্য এসব উন্মোচিত করে দিয়েছেন। কিংবা আপনার ছেলেমেয়েরা জিজ্ঞেস করবে, ‘পরলোকে কি হবে আমার?’ কি তাকে বলবেন যখন কিছুই আপনি জানেন না? কি করে জবাব দেবেন তাকে? তাকে দেবেন বিশ্ব আর শয়তানের মাধুর্য? এটা ভালো নয়!’ এই বলে মাথা একপাশে হেলিয়ে লেভিনের দিকে তাঁর সহৃদয় নিরীহ দৃষ্টি নিবন্ধ করে থামলেন তিনি।
লেভিন এবার কিছুই বললেন না—সেটা এজন্য নয় যে যাজকের সাথে তর্কে নামতে চাইছিলেন না তিনি, এজন্য যে এমন প্রশ্ন তাঁকে কেউ আগে করেনি; আর তাঁর শিশু এসব প্রশ্ন করার আগে কি জবাব দেবেন ভাববার মত সময় থাকবে বেশ।
‘আপনি জীবনের এমন একটা পর্বে প্রবেশ করছেন’, যাজক বলে চললেন, ‘যখন পথ স্থির করে নিয়ে সেটা অনুসরণ করে যেতে হয়। সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করুন যেন তিনি তাঁর দয়ায় আপনাকে সাহায্য করেন, ক্ষমা করেন’, উপসংহার টানলেন তিনি, ‘প্রভু এবং আমাদের সৃষ্টিকর্তার যিশু খ্রিস্ট লকের মানবপ্রেমের উদারতায় শিশুকে ক্ষমা করেন…’, অনুমতির প্রার্থনা শেষ করে যাজক লেভিনকে আশীর্বাদ করে তাঁকে ছেড়ে দিলেন।
বাড়ি ফিরে লেভিনের এজন্য আনন্দ হল যে অস্বস্তিকর অবস্থাটার অবসান এবং এমনভাবে অবসান হল যে তাঁকে মিথ্যে বলতে হয়নি। তাছাড়া তাঁর এই একটা ঝাপসা স্মৃতি রয়ে গেল যে সহৃদয় মিষ্টস্বভাব বৃদ্ধটি যা বলছিলেন সেটা প্রথমে তাঁর যা মনে হয়েছিল, মোটেই তেমন নির্বোধ কিছু নয়, তাঁর কথায় এমন কিছু-একটা ছিল যেটা পরিষ্কার করে নেওয়া উচিত।
লেভিন ভাবলেন, ‘এখনই অবশ্য নয়, তবে পরে কোন-এক সময়।’ আগের চেয়ে বেশি করে লেভিনের এখন মনে হতে লাগল যে তাঁর প্রাণের মধ্যে অস্পষ্ট ও দূষিত কিছু-একটা আছে এবং ধর্মের ব্যাপারে তিনি ঠিক সেই অবস্থায়ই রয়েছেন যা তিনি অন্যের ক্ষেত্রে পরিষ্কার দেখতেন এবং পছন্দ করতেন না, যার জন্য তিরস্কারও করেছেন বন্ধু সি্ভ্য়াজ্স্কিকে।
ভাবী বধূর সাথে লেভিন এ সন্ধ্যাটা কাটান ডল্লির ওখানে, খুবই ফুর্তি লাগছিল তাঁর, অব্লোন্স্কির কাছে তাঁর এই চাঙ্গা অবস্থাটার কারণ বোঝাতে গিয়ে তিনি বললেন যে হুপের মধ্যে দিয়ে লাফিয়ে যেতে শেখানো হচ্ছে যে কুকুরটাকে, তার কাছে কি চাওয়া হচ্ছে সেটা বুঝে যখন সে তা করে ফ্যালে আর ডাক ছেড়ে, লেজ নেড়ে উল্লাসে লাফিয়ে ওঠে টেবিলে আর জানালায়, তাঁরও ফুর্তি লাগছে ওই কুকুরটার মতই।
দুই
বিয়ের দিন রীতি অনুযায়ী (আর সমস্ত রীতি পালনের জন্য কঠোরভাবে জিদ করছিলেন প্রিন্স-মহিষী আর দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা) নিজের কনেকে লেভিন দেখতে পেলেন না। খাওয়া-দাওয়া সারলেন নিজের হোটেলে। হঠাৎ এসে জোটা তিনজন অবিবাহিতের সাথে : সের্গেই ইভানোভিচ কজ্নিশেভ, কাতাভাসোভ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সতীর্থ, এখন প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের প্রফেসর, রাস্তায় তাঁকে দেখতে পেয়ে লেভিন ধরে নিয়ে আসেন নিজের ওখানে এবং চিরিক, নিত্বর, মস্কোর সালিশী আদালতের জজ, ভালুক শিকারে লেভিনের সহচর। খাওয়া-দাওয়া চলল খুবই আনন্দ করে। কজ্নিশেভ ছিলেন খুবই শরিফ মেজাজে, কাতাভাসোভের মৌলিকতায় বেশ মজা লাগল তাঁর। তাঁর মৌলিকতার কদর হচ্ছে, লোকে তা ধরতে পাচ্ছে এটা অনুভব করে কাতাভাসোভ তা নিয়ে চাল মারতে লাগলেন। ফুর্তি করে ভালো মনে সব রকম আলাপেই মেতে উঠছিলেন চিরিকভ।
এক-একটা শব্দ আলাদা আলাদা করে বলার যে অভ্যাস তাঁর হয়েছিল ক্যাথেড্রায়, সেই ভঙ্গিতে কাতাভাসোভ বলছিলেন, ‘এই যে আমাদের বন্ধু কনস্তান্তিন দ্দ্মিত্রিচ, গুণী ছেলে ছিল। আমি অবর্তমানদের কথা বলছি, কেননা সে আর নেই। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরোবার সময় তখন বিজ্ঞানও ভালোবাসতো, মানবিক আগ্রহ-কৌতূহলও ছিল; এখন তার আধখানা গুণ যাচ্ছে আত্মপ্রতারণায়, বাকি আধখানা সে প্রতারণাকে ন্যায়সঙ্গত প্রতিপন্ন করতে।’
‘আপনার মত বিবাহের এত ঘোর শত্রু আমি আর দেখিনি’, বললেন কজ্নিশেভ।
‘না, শত্রু নই। আমি শ্রমবিভাগের বান্ধব। যারা কিছুই করতে পারে না, তারা লোক উৎপাদন করুক, বাকিরা তাদের আলোকপ্রাপ্তি আর সুখে সহায়তা করবে। আমি তো এই বুঝি। এই দুই বৃত্তিকে মিশিয়ে ফেলতে বহু লোকের ভালো লাগে। আমি ওদের দলে নই।’
‘আপনি প্রেমে পড়েছেন জানতে পারলে আমি কি সুখীই যে হব!’ লেভিন বললেন, ‘বিয়েতে আমাকে ডাকতে ভুলবেন না যেন।’
‘ইতিমধ্যেই প্রেমে পড়ে গেছি।’
‘হ্যাঁ, কাল্ মাছের সাথে’, লেভিন বড় ভাইয়ের দিকে ফিরলেন, ‘জান, মিখাইল সেমেনিচ নিবন্ধ লিখছেন পুষ্টি আর…’
‘থাক, গোলমাল করে ফেলতে হবে না! কি নিয়ে লিখছি তাতে এসে যায় না কিছু। আসল কথাটা হল, আমি সত্যিই কাতল মাছ ভালোবাসি।’
‘কিন্তু সে তো স্ত্রীকে ভালোবাসায় ব্যাঘাত ঘটায় না।’
‘সে তো ব্যাঘাত ঘটায় না, কিন্তু ব্যাঘাত ঘটায় স্ত্রী।
‘কেমন করে?’
‘নিজেই দেখবেন। এই তো, আপনি ভালোবাসেন বিষয়-আশয়, শিকার, দেখবেন পরে!’
‘আজ আর্খিপ এসেছিল, বলল প্রুদনোয়ের কাছে হরিণ আছে অনেক আর দুটো ভালুক’, বললেন চিরিকভ।
‘তা ওগুলোকে আপনি ধরাশায়ী করুন আমাকে বাদ দিয়েই।’
‘ঠিক কথা’, বললেন কজ্নিশেভ, ‘এর পর থেকে ভালুক শিকারে সেলাম, বৌ যেতে দেবে না!’
লেভিন হাসলেন। বৌ তাঁকে যেতে দেবে না, এ কল্পনাটা তাঁর কাছে এতই মনোরম ঠেকল যে ভালুক দর্শনের আনন্দ তিনি তখন চিরকালের জন্য ত্যাগ করতে রাজি।
‘কিন্তু এ দুটো ভালুককে অপরে ঘায়েল করবে, এ যে আফসোসের কথা। আর মনে আছে, শেষ বার সেই খাপিলভোতে? চমৎকার হত শিকারটা’, বললেন চিরিকভ
কিটিকে ছাড়া কোথাও কিছু চমৎকার হতে পারে, এ কথা বলে ওঁকে হতাশ করতে না চেয়ে লেভিন চুপ করে রইলেন।
‘অবিবাহিত জীবন থেকে বিদায় নেবার এই রীতিটা গড়ে উঠেছে খামোকা নয়’, বললেন কজ্নিশেভ, যতই সুখী হও, স্বাধীনতা বিসর্জন দুঃখের কথা।’
‘স্বীকার করুন, এরকম একটা জিনিস আছে যে গোগলের বইয়ের বরের মত ইচ্ছে হয় না কি জানালা দিয়ে লাফিয়ে পালাই?’
‘নিশ্চয় আছে, কিন্তু স্বীকার করছে না!’ বলে কাতাভাসোভ হেসে উঠলেন হো-হো করে।
‘তা জানালা তো খোলাই রয়েছে… এখনই যাওয়া যাক ভেতরে! একটা ভল্লুকী, গুহাতেই পাওয়া যাবে। সত্যি, যাওয়া যাক পাঁচটার ট্রেনে! আর এঁরা থাকুন যেমন খুশি’, হেসে বললেন চিরিকভ।
লেভিন হেসে বললেন, ‘কিন্তু হেই সৃষ্টিকর্তা, নিজের স্বাধীনতা নিয়ে প্রাণের ভেতর এরকম দুঃখ যে খুঁজে পাচ্ছি না!’
‘হ্যাঁ, আপনার প্রাণের ভেতর এখন এমনই বিশৃঙ্খলা যে কিছুই খুঁজে পাবেন না’, কাতাভাসোভ বললেন, ‘অপেক্ষা করুন, খানিকটা গুছিয়ে উঠতে পারলে তখন পাবেন!
‘না, আমার এই হৃদয়াবেগ (ভালোবাসা—কথাটা ওঁদের সামনে তিনি বলতে চাইলেন না) আর সুখ ছাড়াও স্বাধীনতা হারানোর জন্য অন্তত খানিকটা দুঃখও যদি বোধ করতে পারতাম… উল্টে, এই স্বাধীনতা হারানোতেই আমার আনন্দ।’
‘খুব খারাপ! কোন আশা নেই’, বললেন কাতাভাসোভ, ‘যাক গে, পান করা যাক ওঁর আরোগ্য লাভের জন্য অথবা শুধু কামনা করা যাক যেন ওঁর স্বপ্নের অন্তত একশতাংশও সফল হয়। সেটুকুই হবে এমন সুখ যা পৃথিবীতে হয় না।’
আহারের পর অতিথিরা তাড়াতাড়ি চলে গেলেন বিবাহোৎসব উপলক্ষে বেশভূষা করে নেবার জন্য।
একলা হয়ে, এই অবিবাহিতদের কথাবার্তা স্মরণ করে লেভিন পুনর্বার জিজ্ঞাসা করলেন নিজেকে : যে স্বাধীনতার কথা ওঁরা বলছিলেন তার জন্য তাঁর প্রাণের ভেতর কোন দুঃখবোধ আছে কি? এ প্রশ্নে হাসলেন তিনি। ‘স্বাধীনতা? কিসের জন্য স্বাধীনতা? সুখ শুধু ভালোবাসায়, তার যা কামনা তাই কামনা করায়, তার যা ভাবনা তাই ভাবায়, অর্থাৎ কোন স্বাধীনতা নয়—এই হল সুখ!’
‘কিন্তু ওর ভাবনা, কামনা, ভাবাবেগ আমি জানি কি?’ হঠাৎ কার যেন কণ্ঠস্বর তাঁকে বলল ফিসফিস করে। মুখের হাসি মিলিয়ে গেল, চিন্তাচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন তিনি। সহসা অদ্ভুত একটা অনুভূতি পেয়ে বসল তাঁকে। ভয় আর সন্দেহ হল তাঁর, সব কিছুতে সন্দেহ।
‘আমাকে যদি সে ভালো না বেসে থাকে? আমাকে যদি সে বিয়ে করতে যাচ্ছে শুধু বিয়ে করতে হয় বলে? কি করছে সেটা যদি তার নিজেরই জানা না থাকে?’ নিজেকে প্রশ্ন করলেন তিনি, ‘ওর চৈতন্য হতে পারে কেবল বিয়ে করার পর। বুঝবে যে আমাকে সে ভালোবাসে না, ভালোবাসতে পারে না।’ মনে আসতে লাগল অদ্ভুত, অতি বিশ্ৰী সব চিন্তা। এক বছর আগের মত ভ্রন্স্কির প্রতি কিটির মনোভাবে ঈর্ষা হল, ভ্রন্স্কির সাথে কিটিকে তিনি যে সন্ধ্যায় দেখেছিলেন, সেটা যেন গতকালের ঘটনা। তাঁর সন্দেহ হল কিটি তাঁকে সব কিছু বলেনি।
দ্রুত লাফিয়ে উঠলেন তিনি। হতাশায় মনে মনে বললেন, ‘না, এ চলতে পারে না! যাব ওর কাছে, জিজ্ঞেস করব, শেষবারের মত বলব : আমরা বন্ধনহীন, ক্ষান্ত হওয়াই ভালো হবে নাকি? চিরকাল অসুখী হয়ে থাকা, কলংক, বিশ্বাসহানির চেয়ে সেটাই ভালো!’ বুকের মধ্যে হতাশা আর সমস্ত লোকের ওপর, নিজের ওপর, কিটির ওপর আক্রাশ নিয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে তিনি গেলেন তার কাছে।
বাড়ির পেছনদিককার ঘরে কিটির সাথে তাঁর দেখা হল। সিন্দুকের ওপর বসে চেয়ারের পিঠে আর মেঝেয় রাখা একরাশ নানা রঙের পোশাক বাছাবাছি করে দাসীকে কি যেন হুকুম দিচ্ছিল সে।
‘আরে!’ ওঁকে দেখে আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে চেঁচিয়ে উঠল কিটি, ‘কেমন করে তুমি, কেমন করে আপনি?’ (এই শেষ দিনটা পর্যন্ত কিটি তাঁকে বলতো কখনো ‘তুমি’, কখনো ‘আপনি’।) ‘আশা করিনি! আর আমি আমার কুমারী দিনগুলোর পোশাক বেছে ঠিক করছি কোটা কাকে দেব…’
‘ও! তা ভালো কথা!’ দাসীর দিকে নিরানন্দ দৃষ্টিতে চেয়ে তিনি বললেন।
কিটি বলল, ‘এখন যাও দুনিয়াশা। আমি ডেকে পাঠাব পরে। কি হল তোমার?’ দাসী চলে যেতেই স্থির সংকল্পে ‘তুমি’ সম্ভোধন করে জিজ্ঞেস করল কিটি। লেভিনের বিচলিত, বিমর্ষ, অদ্ভুত মুখ লক্ষ্য করে ভয় হল তার।
‘কিটি! কষ্ট হচ্ছে আমার। একলা আমি কষ্ট সইতে চাই না’, কিটির সামনাসামনি দাঁড়িয়ে সানুনয় দৃষ্টিতে তার চোখের দিকে হতাশাদীর্ণ কণ্ঠে বলে উঠলেন তিনি। কিটির প্রেমে ঢলঢল সরল মুখখানা দেখে তিনি ইতিমধ্যেই বুঝেছিলেন যে তাকে যা বলবেন ঠিক করেছিলেন তা থেকে কোন ফল হবে না, তাহলেও তাঁর দরকার ছিল যে কিটি নিজেই তাঁকে আশ্বস্ত করুক। ‘আমি বলতে এলাম যে সময় এখনো পেরিয়ে যায়নি। এ সবই ঘুচিয়ে দিয়ে ঠিকঠাক করে নেওয়া যায়।’
‘কি? কিছুই আমি বুঝতে পারছি না। কি হল তোমার?’
‘তোমাকে আমি হাজার বার যা বলেছি এবং না ভেবে পারছি না… যে আমি তোমার যোগ্য নই। আমাকে বিয়ে করতে রাজি হওয়া সম্ভব নয় দেখো। আমাকে ভালোবাসতে তুমি পারো না… যদি তাই… বরং সেটা বলো’, কিটির দিকে না তাকিয়ে বললেন তিনি। ‘আমি অসুখী হব। বলুক সবাই যা খুশি; অসুখী হওয়ার চেয়ে সেটাই ভালো…. এখনো যখন সময় আছে, সেটাই ভালো…’
‘আমি কিছুই বুঝতে পারছি না’, সভয়ে বলল কিটি, ‘মানে তুমি চাইছ ভেঙে দিতে… দরকার নেই?
‘হ্যাঁ, যদি তুমি আমাকে না ভালোবাসো।’
‘মাথা খারাপ হয়েছে তোমার!’ সরোষে লাল হয়ে চেঁচিয়ে উঠল কিটি।
কিন্তু লেভিনের মুখখানা এত করুণ যে রোষ সংবরণ করলে সে, একটা চেয়ার থেকে ফ্রক ছুড়ে বসল ওঁর কাছাকাছি।
‘কি তুমি ভাবছ? বলো তো সব।’
‘ভাবছি যে আমাকে তুমি ভালোবাসতে পারো না। কিসের জন্য ভালোবাসবে আমাকে?’
‘উহ্ সৃষ্টিকর্তা! কি আমি করতে পারি?’ এই বলে কেঁদে ফেলল সে।
‘এহ্, কি আমি করলাম!’ চেঁচিয়ে উঠলেন লেভিন, কিটির সামনে নতজানু হয়ে চুমু খেতে লাগলেন তার হাতে।
পাঁচ মিনিট বাদে প্রিন্স-মহিষী যখন ঘরে ঢুকলেন, ওঁদের তখন মিটমাট হয়ে গেছে একেবারে। কিটি লেভিনকে নিঃসন্দেহ করে তোলে যে তাঁকে সে ভালোবাসে, এমন কি কেন সে ভালোবাসে তাঁর এ প্রশ্নেরও জবাব দেয়। কিটি তাঁকে বলে যে ভালোবাসে, কারণ তাঁর সবখানি সে বোঝে, কারণ সে জানে কি কি লেভিন ভালোবাসেন, কারণ উনি যা ভালোবাসেন তা সবই ভালো। এটা লেভিনের কাছে পানির মত পরিষ্কার লাগল। প্রিন্স-মহিষী যখন ঘরে ঢুকলেন, ওঁরা সিন্দুকের ওপর পাশাপাশি বসে পোশাক বাছছিলেন আর তর্ক করছিলেন : লেভিন যখন পাণিপ্রার্থনা করেন, তখন কিটির পরনে যে বাদামি গাউনটা ছিল, কিটি সেটা দিতে চাইছিল দুনিয়াশাকে আর লেভিন জেদ ধরেছিলেন যে ওটা কাউকে দেওয়া চলবে না, দুনিয়াশাকে দেওয়া হোক নীল রঙেরটা।
‘কেন তুমি বোঝো না? ওর চুল যে গাঢ় রঙের। এটা ওকে মানাবে না… সব ভেবে ঠিক করা আছে আমার! লেভিন কেন এসেছিলেন সেটা জানতে পেরে প্রিন্স-মহিষী আধা ঠাট্টায়, আধা গুরুত্ব দিয়ে রেগে তাঁকে বেশভূষা করার জন্য ফেরত পাঠালেন হোটেলে, কিটির কবরী বন্ধনে তিনি যেন ব্যাঘাত না ঘটান, কারণ শার্ল এই এসে পড়ল বলে।
‘এমনিতেই ও কয়েক দিন ধরে ভালো করে খাচ্ছে না, চেহারা খারাপ হয়ে গেছে, আর তুমি এসেছ কিনা তোমার যত পাগলামিতে ওর মন খারাপ করে দিতে’, লেভিনকে বললেন তিনি, ‘ভাগো তো, ভাগো তো বাছা।’
দোষ আর লজ্জার একটা বোধ থাকলেও স্বস্তি নিয়ে লেভিন তাঁর হোটেলে ফিরলেন। তাঁর বড় ভাই কজ্নিশেভ, দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা আর অব্লোন্স্কি, সবাই পরিপাটী সাজসজ্জা করে তাঁর অপেক্ষা করছিলেন দেবপট নিয়ে তাঁকে আশীর্বাদ করবেন বলে। হচ্ছে হবে করার সময় ছিল না। দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনাকে আবার বাড়ি যেতে হবে পমেড-চর্চিত চিকুরকুঞ্চিত ছেলেটিকে আনতে, কনের সাথে দেবপট নিয়ে যাবে সে। তারপর একটি গাড়ি পাঠাতে হবে শাফেরের ( শাফের গির্জায় বিবাহানুষ্ঠানে বর-কনের পেছনে যে মুকুট ধরে থাকে) জন্য, তারপর আরেকটি কজ্নিশেভকে যা নিয়ে যাবে, সেটিকে ফেরত আনতে হবে। মোটের ওপর, খুবই জটিল সব ভাবনা-চিন্তা ছিল অনেক। শুধু একটা ব্যাপার সন্দেহাতীত যে ঢিমে-তেতালা করা চলবে না, কেননা সাড়ে ছ’টা বেজে গেছে।
দেবপট নিয়ে আশীর্বাদটা থেকে দাঁড়াল না কিছুই। অব্লোন্স্কি স্ত্রীর পাশে একটা হাস্যকর-গুরুগম্ভীর ভাব করে দাঁড়ালেন, দেবপট হাতে নিয়ে লেভিনকে বললেন আভূমি নত হতে, তারপর একটা সহৃদয় ও সকৌতুক হাসি নিয়ে আশীর্বাদ করে লেভিনকে চুম্বন করলেন তিনবার; দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনাও তাই করলেন এবং তখনই ব্যস্ত হলেন যাবার জন্য আর পুনরায় গাড়িগুলোর গতিবিধির হিসাবে তালগোল পাকালেন।
‘তাহলে আমরা এই করব : আমাদের গাড়িটায় করে তুমি চলে যাও ওর জন্য, আর কজ্নিশেভও যদি দয়া করে আমাদের নিয়ে যেতে পারতেন, তারপর গাড়ি ফেরত পাঠিও।’
‘সে কি, সানন্দে যাব।’
অব্লোন্স্কি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি এখনই ওকে নিয়ে আসছি, জিনিসপত্র পাঠানো হয়েছে?’
‘পাঠানো হয়েছে’, বলে লেভিন পোশাক দিতে হুকুম করলেন কুজ্মাকে।
তিন
বিয়ের জন্য গির্জা ঘিরে জুটেছিল একদল লোক, বেশির ভাগই নারী। যারা ভেতরে ঢোকার সুযোগ পায়নি, তারা ভিড় করেছিল জানালার কাছে, ঠেলাঠেলি করছিল, ঝগড়া বাঁধাচ্ছিল, উঁকি দিচ্ছিল জানালার গরাদে দিয়ে।
ইতিমধ্যে বিশটির বেশি গাড়িকে সেপাইরা রাস্তা বরাবর সারি বাঁধিয়ে রেখেছে। হিমেল আবহাওয়া উপেক্ষা করে প্রবেশমুখে দাঁড়িয়ে নিজের উর্দিতে ঝলমল করছিল জনৈক পুলিশ অফিসার। অবিরাম আসছিল আরও গাড়ি, ফুলে শোভিত মহিলারা কখনো তাঁদের বসনের কলাপ তুলে ধরে, কখনো পুরুষেরা তাঁদের খাটো টুপি অথবা লম্বা কালো হ্যাট খুলে ঢুকছিলেন গির্জার ভেতর। গির্জার ভেতরে ইতিমধ্যেই জ্বালানো হয়েছে দুটো ঝাড়লণ্ঠন আর দেবপটগুলোর সামনেকার সমস্ত বাতি। পটপ্রাচীরের রক্তিম গাত্রে স্বর্ণাভা, দেবপটগুলির গিল্টি-করা খোদাই-কাজ, কান্ডেলাব্রাস আর মোমবাতিদানগুলির রুপো, মেঝের টালি আর গালিচাগুলি, কয়ের-লটের ওপরে পবিত্র নিশানগুলি, বেদীর সোপান, কালো হয়ে আসা প্রাচীন নিত্যকর্মপদ্ধতির পুস্তকগুলি, আলখাল্লা আর জমকালো কৌশিক—সবই আলোয় প্লাবিত। উষ্ণ গির্জার ডান দিকে, ফ্ৰক-কোট আর সাদা টাই, উর্দি আর জামদানি, মখমল, চিকন রেশম, কেশ, কুসুম, অনাবৃত স্কন্ধ ও বাহু, লম্বা দস্তানার ভিড়টা থেকে উঠছিল সংযত ও সজীব আলাপের কূজন যা একটা বিচিত্র প্রতিধ্বনি তুলছিল উঁচু গম্বুজে। দরজা খোলার ক্যাঁচ শব্দ হতেই প্রতিবার আলাপ থেমে আসছিল, বর-কনেকে আসতে দেখবার আশায় সবাই তাকাচ্ছিল সেদিকে। কিন্তু দরজা ইতিমধ্যে খুলেছে দশ বারেরও বেশি, কিন্তু প্রতিবার ঢুকেছে বিলম্বিত অতিথি যারা যোগ দিয়েছে ডানের আমন্ত্রিতদের কিংবা পুলিশ অফিসারকে ফাঁকি দিয়ে অথবা মিনতি করে কোন দর্শনার্থিনী, যে যোগ দিয়েছে বাঁ দিকের অনাহূতদের দলে। আত্মীয়-স্বজন আর বাইরের লোক, সবারই প্রত্যাশার সব ক’টা পর্যায় কেটে গেল।
বিলম্বটায় কোন গুরুত্ব না দিয়ে প্রথমে ভাবা হয়েছিল বর-কনে এই এল বলে। পরে শুরু হল ঘন ঘন দরজার দিকে চাওয়া, বলাবলি করলে কোন অঘটন ঘটল না তো। পরে বিলম্বটা হয়ে উঠল অস্বস্তিকর, আত্মীয়-স্বজন আর আমন্ত্রিতরা ভাব করার চেষ্টা করলে যেন তারা বরের কথা ভাবছে না, নিজেদের কথাবার্তাতেই তারা মশগুল।
প্রধান ডিকন তাঁর সময়ের মূল্য স্মরণ করিয়ে দেবার জন্যই যেন এমন অধৈর্যে কাশলেন যে জানালার শার্সি কেঁপে উঠল। কয়ের-লফ্ট থেকে শোনা যাচ্ছিল কখনো বেজার গায়কদের গলা সাধা, কখনো নাক ঝাড়া। যাজক অনবরত কখনো ডিকন, কখনো কোন স্তোত্রপাঠককে পাঠাচ্ছিলেন দেখতে বর এল কি না। আর নিজে নকশি বেল্টে আঁটা বেগুনি আলখাল্লায় ঘন ঘন যাচ্ছিলেন পাশের দরজায়, দেখছিলেন বর এল কি না। শেষ পর্যন্ত আমন্ত্রিত জনৈক মহিলা ঘড়ি দেখে বলে উঠলেন, ‘সত্যি, ভারি অদ্ভুত!’ এবং সমস্ত অতিথিরই তখন ভারি অস্বস্তি বোধ হতে লাগল, সরবে প্রকাশ করতে থাকলেন তাঁদের বিস্ময় অথবা বিরক্তি। কি ঘটেছে জানার জন্য বেরিয়ে গেলেন একজন শাফের। কিটি এ সময় তার সাদা গাউন, ফুল-তোলা দীর্ঘ অবগুণ্ঠনে তৈরি হয়ে মায়ের বদলি আর বড়দি লজ্জার সাথে বসেছিল শ্যেরবাৎস্কি ভবনের হলঘরে, আধঘণ্টা ধরে জানালা দিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল, বর গির্জায় পৌঁছেছে এ খবর আশা করছিল তার শাফেরের কাছ থেকে।
লেভিন ওদিকে ওয়েস্ট-কোট আর ফ্রক-কোট ছাড়া শুধু প্যান্টালুন পরে নিজের কামরায় ছটফট করে বেড়াচ্ছিলেন, অবিরাম দরজা খুলে দেখছিলেন করিডরে। কিন্তু যে ব্যক্তির তিনি আশা করছিলেন করিডরে তাকে দেখা যাচ্ছিল না। হতাশায় ফিরে এসে, হাত ঝাঁকিয়ে নিশ্চিন্তে ধূমপানরত অব্লোন্স্কিকে তিনি বলছিলেন : ‘এমন ভয়ংকর আহাম্মকি অবস্থায় কেউ পড়েছে কখনো?’
‘হ্যাঁ, বিদঘুটে’, নরম করে আনার হাসি হেসে বললেন অব্লোন্স্কি, ‘তবে শান্ত হও, এখুনি আনবে।’
‘কিন্তু শান্ত হব কি করে!’ সংযত তিতিবিরক্তিতে বললেন লেভিন। ‘এই জাহান্নামী ওয়েস্ট-কোট! সামনেটা খোলা, পরা অসম্ভব!’ বললেন তিনি তাঁর দলামোচড়া কামিজের দিকে তাকিয়ে। ‘আমার জিনিসপত্র যদি এর মধ্যেই স্টেশনে পাঠিয়ে দিয়ে থাকে, তাহলে!’ হতাশায় চিৎকার করে উঠলেন তিনি।
‘তাহলে আমার শার্টটা পরবে।’
‘অনেক আগেই তা পরা উচিত ছিল।’
‘হাস্যাস্পদ হয়ে লাভ নেই… দাঁড়াও, দাঁড়াও, সব ঠিক হয়ে যাবে।’
ব্যাপারটা হয়েছিল এই যে লেভিন যখন পোশাক দিতে বলেন, পুরাতন ভৃত্য কুজ্মা তখন ফ্রক-কোট, ওয়েস্ট- কোট এবং প্রয়োজনীয় সব কিছুই এনেছিল।
‘কিন্তু কামিজ?’ চেঁচিয়ে উঠেছিলেন লেভিন। ‘কামিজ তো আপনার পরনেই’, শান্ত হেসে বলেছিল কুজ্মা। পরিষ্কার একটা কামিজ রাখার খেয়াল হয়নি কুমার। সব জিনিসপত্র বাঁধাছাদা করে শ্যেরবাৎস্কিদের পৌঁছে দিতে হবে, যেখানে থেকে সেই সন্ধ্যাতেই নবদম্পতি রওনা দেবে—এই আদেশ পেয়ে কুজ্মা ঠিক তাই করেছে। সে লেভিনের ড্রেস-স্যুটটা ছাড়া সবই বাক্সবন্দী করে নিয়ে গেছে। সকাল থেকে লেভিন যে শার্টটা পরে ছিলেন, সেটা দলামোচড়া হয়ে গিয়েছিল, ফ্যাশনদুরস্ত খোলা ওয়েস্ট-কোটের সাথে তা একেবারেই মানায় না। শ্যেরবাৎস্কিদের বাড়ি বহু দূরে, লোক পাঠিয়ে ফল হবে না। নতুন একটা শার্ট কেনার জন্য পাঠানো হল খানসামাকে। সে ফিরে এসে বলল সব দোকান বন্ধ, রবিবার। লোক পাঠানো হল অব্লোন্স্কির ওখানে শার্ট আনার জন্য : দেখা গেল সেটা অসম্ভব চওড়া আর খাটো। শেষ পর্যন্ত শ্যেরবাৎস্কিদের ওখানে লোক পাঠিয়ে মাল খুলতে বলা হল। গির্জায় বরের অপেক্ষা করছে লোকে আর লেভিন এদিকে খাঁচায় বন্ধ পশুর মত ছটফট করছেন ঘরটায়, তাকাচ্ছেন করিডরে, আতংকে আর হতাশায় তাঁর মনে পড়ছিল কি কথা আছে তিনি বলেছেন কিটিকে, এরপর কি ভাববে সে।
অবশেষ অপরাধী কুজ্মা প্রচণ্ড হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরে ঢুকল শার্ট নিয়ে।
‘কোনরকমে ধরলাম। গাড়িতে মাল চাপানো শুরু হয়ে গিয়েছিল’, কুজ্মা বলল।
তিন মিনিট বাদে পোড়া ঘায়ে লবণের ছিটে এড়াবার জন্য ঘড়ির দিকে দৃপাত না করেই লেভিন ছুটলেন করিডোর দিয়ে।
লেভিনের পিছু পিছু বিনা ব্যস্ততায় তাঁর সঙ্গ ধরে অব্লোন্স্কি হেসে বললেন, ‘ওতে কোন লাভ হবে না। সব ঠিক হয়ে যাবে… বলছি তোমাকে, সব ঠিক হয়ে যাবে।’
চার
‘এসে গেছে!…’ ‘ওই যে!…’ ‘কোন লোকটি?…’ ‘অল্পবয়সীটি কি?…’ ‘আর কনে, মা গো, একেবারে জীবনমৃত!’ দেউড়িতে কনেকে সাথে নিয়ে লেভিন যখন গির্জায় ঢুকলেন, ভিড়ের মধ্যে তখন এসব কথা।
স্ত্রীকে বিলম্বের কারণ জানালেন অব্লোন্স্কি। অতিথিরা হেসে ফিসফাস করতে লাগলেন নিজেদের মধ্যে। কিছুই এবং কাউকেও দেখছিলেন না লেভিন; তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল তাঁর কনের উপর।
সবাই বলেছিল যে এই কয়েক দিনে কিটির চেহারা খারাপ হয়ে গেছে, আগে তাকে যেমন সুন্দর দেখাতো, বিবাহানুষ্ঠানে তেমনটি আর নেই, কিন্তু লেভিনের তা মনে হচ্ছিল না। তার উঁচু কবরী, আলুলায়িত সাদা অবগুণ্ঠন, সাদা ফুল, কুঁচি দেওয়া খাড়া কলার যা তার দীর্ঘ গ্রীবাকে ঘিরে বিশেষ একটা শূচিতায় ঢেকে রেখেছে দু’দিক থেকে, খোলা শুধু সামনের দিকটা, আশ্চর্য সুতনু তার কটির দিকে চেয়ে দেখলেন লেভিন আর তাঁর মনে হল এত সুন্দর কিটিকে তিনি আর কখনো দেখেননি। সেটা এই জন্য নয় যে ঐ ফুলগুলো, ঐ অবগুণ্ঠন; প্যারিস থেকে আনানো এই গাউনটা তার রূপ বুঝি বাড়িয়ে তুলেছে কিছু, না, সেটা এই জন্য যে সাজের এই ঘটা সত্ত্বেও তার সুমধুর মুখভাব, তার দৃষ্টি, তার অধরে ছিল অপাপবিদ্ধ সততার সেই একই লাবণ্য।
‘আমার ভাবনাই হয়েছিল তুমি বুঝি পালাতে চাইছিলে’, লেভিনের দিকে চেয়ে কিটি বলল হেসে।
‘এমন হাঁদার মত কাণ্ড ঘটল যে বলতেও লজ্জা হয়’, লেভিন বললেন লাল হয়ে এবং তাঁর দিকে এগিয়ে আসা কজ্নিশেভের দিকে ফিরতে হল তাঁকে।
তিনি মাথা নেড়ে হেসে বললেন, ‘মন্দ নয় শার্ট নিয়ে তোর ঝামেলাটা!’
‘হ্যাঁ, সত্যি’, লেভিন বললেন কি কথা তাঁকে বলা হচ্ছে সেটা না বুঝেই।
‘তা কস্তিয়া, এবার একটা সিদ্ধান্ত নিতে হয়’, কপট ত্রাসের ভাব করে বললেন অব্লোন্স্কি, ‘গুরুতর প্রশ্ন। ঠিক এখনই এর সমস্ত গুরুত্বটা বোঝার মত অবস্থায় আছ তুমি। আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে, জ্বালানো মোমবাতি জ্বালানো হবে, নাকি না-জ্বালানো? দশ রুবলের পার্থক্য’, ঠোঁট দু’খানা হাসিতে আকুঞ্চিত করে যোগ দিলেন তিনি, ‘আমি স্থির করে ফেলেছি, তবে ভয় আছে হয় তো তোমার মত পাওয়া যাবে না।’
লেভিন বুঝলেন ওটা ঠাট্টা, কিন্তু হাসতে পারলেন না।
‘তাহলে কি? জ্বালানো, নাকি না-জ্বালানো।’
‘না-জ্বালানো, না-জ্বালানো।’
‘ভারি আনন্দ হল। কথা পাকা হয়ে গেল তাহলে!’ হেসে বললেন অব্লোন্স্কি, ‘কিন্তু এ অবস্থায় কি রকম বোকা মেয়ে যায় লোকে’, লেভিন যখন বিহ্বল দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে সরে গেলেন কনের কাছে, তখন বিহ্বল দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে সরে গেলেন কনের কাছে, তখন চিরিকভকে বললেন অব্লোন্স্কি।
‘দেখিস কিটি, গালিচায় দাঁড়াবি প্রথম’, কাছে এসে বললেন কাউন্টেস নডর্স্টন, তারপর লেভিনের উদ্দেশে, ‘আরে, অবশেষে!’
‘কি ভয় করছে না?’ জিজ্ঞেস করলেন বৃদ্ধা ফুফু মারিয়া দমিত্রিয়েভনা।
‘তোর শীত করছে কি? ফ্যাকাশে লাগছে তোকে। দাঁড়াবে, মাথা নোওয়া’, বললেন কিটির বড় বোন লভা, নিজের গোলালো হাত বেড়ে দিয়ে হেসে কিটির মাথার ফুলগুলো ঠিক করে দিলেন তিনি।
ডল্লি এলেন, কি-একটা বলতে চাইছিলেন যেন, কিন্তু মুখ ফুটে তা আর বলতে পারলেন না, কেঁদে ফেললেন, তারপর হাসলেন অস্বাভাবিক একটা হাসি।
কিটি সবার দিকে চাইছিল লেভিনের মতই একটা আত্মবিস্মৃত দৃষ্টিতে। তাকে যা কিছু বলা হচ্ছিল, উত্তর দিতে পারছিল কেবল সুখের একটা অকৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে
ওদিকে গির্জার সেবকেরা তাঁদের আলখাল্লা পরে নিলেন, যাজক আর ডিকন গেলেন গির্জার পেছন দিকে অবস্থিত গ্রন্থপীঠের দিকে। লেভিনকে কি যেন বললেন যাজক, কিন্তু সেটা লেভিনের কানে গেল না।
শাফের বুঝিয়ে দিলেন, ‘কনের হাত ধরে নিয়ে যান।’
অনেকক্ষণ লেভিন ধরতে পারছিলেন না কি চাওয়া হচ্ছে তাঁর কাছে। অনেকক্ষণ ধরে লোকে ঠিক করে দিচ্ছিল তাঁকে। সব আশা তারা প্রায় ছেড়েই দিতে বসেছিল, কেননা যা উচিত সে হাতটা তিনি বাড়িয়ে দিচ্ছিলেন না, যা উচিত ধরছিলেন না সে হাতটাও। অবশেষে তিনি বুঝলেন যে জায়গা বদল না করে তাঁর ডান হাত দিয়ে ধরতে হবে কনের ডান বাহু। অবশেষে যেমনটা উচিত সেভাবে যখন বাহুলগ্না করলেন কনেকে, যাজক কয়েক পা সামনে এসে থামলেন গ্রন্থপীঠের কাছে। আত্মীয় ও পরিচিতদের ভিড়টা গুঞ্জন করে পোশাকের কলাপ খসখসিয়ে এগিয়ে গেল তাঁদের দিকে। কে একজন নুয়ে ঠিক করে দিলে কনের কলাপ। গির্জা এত চুপচাপ হয়ে গেল যে মোম গলে পড়ার শব্দটা পর্যন্ত শোনা যাচ্ছিল।
বৃদ্ধ যাজকের মাথায় উঁচু শিরোভূষণ, ঝক্ঝকে সাদা চুল দু’পাশে কানের পেছনে গোটানো। পিঠে এম্ব্রয়ডারি করা সোনালি ক্রস দেওয়া ভারি রূপালি জরির আলখাল্লাটা থেকে তিনি ছোট ছোট বুড়োটে হাত বার করে গ্রন্থপীঠে কি যেন ঠিকঠাক করে নিলেন।
অব্লোন্স্কি সন্তর্পণে তাঁর কাছে কি যেন বললেন ফিসফিস করে তারপর লেভিনের দিকে চোখ মটকে আবার ফিরে এলেন তাঁর জায়গায়।
যাজক পুষ্পালংকৃত দুটো বাতি জ্বালিয়ে বাঁ হাতে তা ধরে রাখলেন কাত করে যাতে তা থেকে মোমের ফোঁটা গড়ায় ধীরে ধীরে, তারপর মুখ ফেরালেন বর-কনের দিকে। ইনি সেই যাজকই যাঁর কাছে পাপস্বীকার করেছিলেন লেভিন। ক্লান্ত বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তিনি বর-কনের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, আলখাল্লার তল থেকে ডান হাত বার করে আশীর্বাদ করলেন বরকে, তারপর একইভাবে, কিন্তু কিছুটা সাবধানী একটা কোমলতা নিয়ে তাঁর গিঁটগিট আঙুল রাখলেন কিটির অবনত মাথার ওপরে। ওঁদের বাতি দুটো দিয়ে ধূপ নিয়ে ধীরে ধীরে চলে গেলেন তিনি।
‘এ সব কি সত্যি?’ লেভিন ভাবলেন, তাকালেন কনের দিকে। খানিকটা উঁচু থেকে তিনি দেখছিলেন কিটির মুখাবয়ব, তার ঠোঁট আর আখিপল্লবের চাঞ্চল্য থেকে বুঝতে পারছিলেন যে তাঁর দৃষ্টিপাত সে অনুভব করছে। কিটি মুখ তুলে চাইল না, কিন্তু তার কুঁচি দেওয়া খাড়া কলার কেঁপে কেঁপে উঁচু হয়ে ঠেকল তার ছোট্ট গোলাপি কানে। লেভিন দেখলেন যে একটা নিঃশ্বাস অবরুদ্ধ হয়ে পড়ল তার বুকে, মোমবাতি ধরা লম্বা দস্তানা পরা ছোট্ট হাতখানা কাঁপছে।
শার্ট নিয়ে গোটা ঝামেলাটা, বিলম্ব, পরিচিতদের, আত্মীয়দের সাথে কথাবার্তা, তাঁদের অসন্তোষ, নিজের হাস্যকর অবস্থা—সব হঠাৎ মিলিয়ে গেল, একাধারে ভয় আর আনন্দ হল তাঁর।
দু’পাশে চাঁচর চিকুর নিয়ে রুপালি আলখাল্লা পরা সুকুমার দীর্ঘাঙ্গ প্রধান ডিকন অভ্যস্ত ভঙ্গিতে দুই আঙুলে উত্তরীয় সামান্য তুলে ক্ষিপ্রবেগে গিয়ে থামলেন পুরোহিতের সামনে।
‘আ-শী-র্বাদ করো হে প্র-ভু!’ একের পর এক বায়ুতরঙ্গ তুলে ধীরে ধীরে উঠতে লাগল সুগম্ভীর ধ্বনি। ‘আমাদের প্রভু চিরকাল, এক্ষণে এবং আগামীতে, চিরযুগ ধরিয়া পুণ্যময়’, নম্র সুরেলা গলায় জবাব দিয়ে যাজক গ্রন্থপীঠে কি যেন ঠিকঠাক করা চালিয়ে যেতে থাকলেন। তারপর জানালা থেকে গম্বুজ পর্যন্ত গোটা গির্জা গমগম করে কখনো উদাত্তে, কখনো মুহূর্তের জন্য থেমে, আস্তে আস্তে স্তব্ধ হয়ে গিয়ে উঠতে লাগল অদৃশ্য ঐকতান দলের পরিপূর্ণ, উদার, সুরম্য সুরসঙ্গতি।
বরাবরের মত প্রার্থনা করা হল স্বর্গীয় শান্তি আর ত্রাণ, সিনোদ আর জারের জন্য; আজ যারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার দাস সেই কনস্তান্তিন ও ইয়েকাতেরিনার জন্যও প্রার্থনা করা হল।
‘ওদের ওপর পরম প্রেম, শান্তি, সাহায্য বর্ষণের জন্য প্রার্থনা করি প্রভুর কাছে’, সারা গির্জা যেন শ্বসিত হয়ে উঠল প্রধান ডিকনের কণ্ঠস্বরে।
লেভিন কথাগুলো শুনলেন এবং তাতে অভিভূত হলেন। তিনি নিজের সাম্প্রতিক সমস্ত আতংক ও সন্দেহের কথা স্মরণ করে ভাবলেন, ‘সাহায্য, ঠিক সাহায্যই যে দরকার সেটা ওঁরা অনুমান করলেন কেমন করে? কি আমি জানি? এই ভয়ংকর ব্যাপারটায়’, মনে হল তাঁর, ‘কি আমি করতে পারি সাহায্য ছাড়া? ঠিক সাহায্যই আমার এখন দরকার।’
ডিকন যখন তাঁর প্রার্থনা শেষ করলেন, যাজক তখন বিবাহকৃত্যের গ্রন্থটি নিলেন : বিনীত সুরেলা বাক্যে তিনি পড়তে লাগলেন, ‘অনন্ত ঈশ্বর, যাহারা পৃথক রহিয়াছিল, তাহাদিগে প্রেমের অটুট মিলনে মিলিত ও আবদ্ধকারী : আইজাক ও রেবেকা, তাহাদিগের বংশধরদিগের বরাভয়দাতা এক্ষণে তোমার দাস এই কনস্তান্তিন ও ইয়েকাতেরিনাকে আশীর্বাদ করহ, উহাদিগে সমুদয় কল্যাণের পথে চালিত করহ। করুণাময় তুমি, মানবদরদী সৃষ্টিকর্তা, তোমার পিতা ও পুত্রের জয়গান করিতেছি, এবং পবিত্র প্রেতের, এক্ষণে এবং আগামীতে, চিরযুগ ধরিয়া।’—’তথাস্তু!’ আবার বাতাসে ঝরে পড়ল অদৃশ্য ঐকতান।
‘যাহারা পৃথক রহিয়াছিল, তাহাদিগে প্রেমের অটুট মিলনে মিলিত ও আবদ্ধকারী –কি গভীর এই কথাগুলি এবং মনের এখন যা অনুভূতি, তার সাথে কি-রকম মিলে যায়’, ভাবলেন লেভিন, ‘ও-ও কি ভাবছে আমার মতই?’
ওর দিকে চাইতেই দৃষ্টিবিনিময় হল ওঁদের।
আর সে দৃষ্টির ব্যঞ্জনা থেকে তিনি স্থির করলেন সেও তাঁরই মত ভাবছে। কিন্তু সেটা ঠিক নয়; বিবাহানুষ্ঠানের সময় যেসব গুরুগম্ভীর বাক্য উচ্চারিত হয়েছিল সেগুলি হৃদয়ঙ্গম হয়নি কিটির, এমন কি কানেও যায়নি। কথাগুলো শোনা আর তার অর্থ উপলব্ধি করা সম্ভব ছিল না তার পক্ষে : যে একটা অনুভূতি তার বুক ভরে তুলে ক্রমাগত বেড়ে উঠছিল, সেটা ছিল খুবই প্রবল। দেড় মাস আগে তার প্রাণের মধ্যে যা ঘটে গেছে আর এই ছয় সপ্তাহ ধরে তাকে পুলকিত করেছেন, কষ্ট দিয়েছে, অনুভূতিটা হল তার পূর্ণতাপ্রাপ্তির আনন্দ। তাদের আরবাৎ রাস্তার বাড়িতে কিটি যেদিন তার বাদামি পোশাকে লেভিনের কাছে গিয়ে আত্মনিবেদন করেছিল, সেই দিন ও সেই সময়টা থেকে আগেকার গোটা জীবনের সাথে একটা পরিপূর্ণ বিচ্ছেদ ঘটে গিয়েছিল তার প্রাণের মধ্যে, শুরু হয় একেবারেই নতুন, তার কাছে একেবারেই অপরিজ্ঞাত অন্য একটা জীবন, যদিও আসলে পুরানো জীৱনই চলছিল। এই ছয় সপ্তাহ তার কাছে ছিল অতি সুখাবেশ, অতি যন্ত্রণার এক কাল। তার সমস্ত জীবন, সমস্ত কামনা, আশা কেন্দ্রীভূত হয়েছিল তার কাছে তখনো দুয়ে এই মানুষটাকে ঘিরে যার সাথে সে জড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে, কখনো ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছে, ওদিকে দিন কেটে যেতে লাগল পুরানো জীবনের পরিস্থিতিতেই। পুরানো জীবন কাটাতে কাটাতে তার সমস্ত অতীত—বস্তু, অভ্যাস, যারা তাকে ভালোবাসতো আর ভালোবাসে, এমন সমস্ত লোক, এই উদাসীনতায় মায়ের দুঃখ, তার স্নেহশীল সুকোমল পিতা, আগে যাকে সে ভালোবাসতো দুনিয়ায় সবার চেয়ে বেশি—এই গোটা অতীতের প্রতি তার পরিপূর্ণ অপরাজেয় একটা ঔদাসীন্যে ভয় হত তার। কখনো তার ভয় হত এই ঔদাসীন্যে নিয়ে এসেছে। এই মানুষটার সাথে জীবন বাদ নিয়ে কিছু ভাবা, কিছু চাওয়া সম্ভব ছিল না তার পক্ষে; কিন্তু সে জীবন তখনো শুরু হয়নি, সেটা এমন কি পরিষ্কার করে কল্পনা করতেও পারছিল না কিটি। ছিল শুধু একটাই প্রত্যাশা : যা নতুন ও অজানা তার ভীতি ও আনন্দ। এখন সেই প্রত্যাশা, সেই অজানাটা, আগের জীবন পরিত্যাগের জন্য খেদ—সব কিছুর অবসান হয়ে নতুনের শুরু হল বলে। অজ্ঞেয়তার জন্য এই নতুনটা ভয়াবহ না হয়ে পারে না; তবে ভয়াবহ হোক বা না হোক, সেটা তার অন্তরের মধ্যে ঘটে গেছে ছয় সপ্তাহ আগে; বহু আগে যা ঘটেছে তার প্রাণের মধ্যে, এখন কেবল মন্ত্রপূত করা হচ্ছে তাকে।
আবার গ্রন্থপীঠের দিকে ফিরে অতি কষ্টে যাজক কিটির ছোট্ট আংটিখানা তুলে নিলেন এবং লেভিনের হাত চেয়ে নিয়ে তা পরালেন আঙুলের প্রথম গিঁটে। ‘সৃষ্টিকর্তার দাস কনস্তান্তিন সৃষ্টিকর্তার দাসী ইয়েকাতেরিনার দারপরিগ্রহ করছেন।’ আর বড় আংটিটা নিয়ে কিটির ছোট, গোলাপি, দুর্বলতায় করুণ আঙুলে পরিয়ে দিয়ে বললেন একই কথা। কি করতে হবে, বর-কনে সেটা অনুমান করার চেষ্টা করলে, আর প্রতিবারই ভুল হল তাদের, যাজক ফিসফিসিয়ে তাদের শুধরে দিলেন। অবশেষে যা করার ছিল করে আংটি দিয়ে তাদের ক্রস করে যাজক আবার কিটিকে দিলেন বড় আংটিটা, লেভিনকে ছোট; আবার গোলমাল হয়ে গেল ওদের, দু’বার হাতবদল হল আংটি দুটোর; তাহলেও যা দরকার ছিল, সেটা হল না।
ডল্লি, চিরিকভ আর অব্লোন্স্কি এগিয়ে গেলেন সাহায্যে। শুরু হল চাঞ্চল্য, ফিসফিসানি, হাসাহাসি, কিন্তু বর- কনের গুরুত্বপূর্ণ মর্মস্পর্শী মুখভাব বদলাল না; বরং আংটির ব্যাপারে গোলমাল করে ফেলার পর তাদের মুখভাব হয়ে দাঁড়াল আগের চেয়েও গুরুগম্ভীর আর যে হাসি নিয়ে অব্লোন্স্কি ফিসফিস করে বলছিলেন যে এবার প্রত্যেকেই নিজ নিজ আংটি পরুক, সেটা আপনা থেকে মিলিয়ে গেল তাঁর ঠোঁটে। তাঁর মনে হল, যে কোন হাসিতেই আহত বোধ করবে ওরা।
‘আদি হইতে তুমি নারী ও পুরুষ সৃষ্টি করিলেক’, অঙ্গুরী বিনিময়ের পর পড়তে লাগলেন যাজক, ‘সাহায্যের লাগি এবং মানবজাতির বংশরক্ষার লাগি তুমি স্বামীকে দাও স্ত্রী। তোমার উত্তরাধিকারের মধ্যে এবং তোমার প্রতিশ্রুতিতে সত্যকে যিনি প্রেরণ করেন, তোমার দাস, বংশে বংশে নির্বাচিত আমাদের পিতৃপুরুষদের নিকট, হে প্রভু পরমেশ্বর, তোমার দাস কনস্তান্তিন আর দাসী ইয়েকাতেরিনাকে অবলোকন করো এবং বিশ্বাসে, সমভাবনায়, সত্যে ও প্রেমে উহাদিগের পরিণয় সংগত করো…’
লেভিনের ক্রমেই মনে হতে লাগল যে বিবাহ সম্পর্কে তাঁর যা ধারণা ছিল, কিভাবে নিজের জীবন গড়ে তুলবেন তা নিয়ে তাঁর যা স্বপ্ন, সে সবই নেহাৎ ছেলেমানুষি, এটা এমন একটা জিনিস যা তিনি এতদিন পর্যন্ত বোঝেননি, এখন তো আরো কম বুঝছেন, যদিও ব্যাপারটা ঘটছে তাঁকে নিয়েই; বুকে তাঁর ক্রমেই বেশি করে একটা খামচি বোধ হতে থাকল, চোখ ফেটে বেরোল অবাধ্য অশ্রু।