পনেরো
সবেমাত্র তাঁরা মস্কো থেকে ফিরে একা হতে পেরে খুশি হলেন। লেভিন তাঁর স্টাডিতে টেবিলের সামনে বসে লিখতেন। আর বিয়ের পর প্রথম কদিন গাঢ় বেগুনি রঙের যে পোশাকটা সে পরতো, লেভিনের কাছে যা ছিল বিশেষ আদৃত ও মনে রাখার মত, সেটা কিটি আবার পরলে এবং স্টাডিও লেভিনের বাবা ও দাদার আমলে সব সময় যেটা থাকত, চামড়া-বাঁধাই সেই পুরানো সোফাটায় বসে বিলেতি এম্ব্রয়ডারি বুনে যেত। লেভিন ভাবতেন আর লিখতেন এবং সব সময় কিটির উপস্থিতি অনুভব করে আনন্দ হত তাঁর। বিষয়-আশয় দেখা এবং যে বইটাতে কৃষিকর্মের মূল নীতিগুলি বিবৃত করার কথা, তা নিয়ে খাটুনি তিনি ছেড়ে দেননি; কিন্তু যে অন্ধকারে তাঁর জীবন সমাচ্ছন্ন ছিল, তার তুলনায় আগে যেমন এই খাটুনি আর চিন্তাপ্রয়াস ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ মনে হত, এখন তেমনি সুখের উজ্জ্বল কিরণে উদ্ভাসিত ভবিষ্যৎ জীবনের তুলনায় সমান গুরুত্বহীন ও ক্ষুদ্র মনে হচ্ছিল। কাজ তিনি চালিয়ে যাচ্ছিলেন কিন্তু টের পাচ্ছিলেন যে এখন তাঁর মনোযোগের ভারকেন্দ্র সরে গেছে অন্য জিনিসে আর তার ফলে এখন ব্যাপারটা তিনি দেখছেন সম্পূর্ণ অন্যভাবে এবং আরও পরিষ্কার করে। আগে কাজগুলো তাঁর কাছে ছিল জীবন থেকে পরিত্রাণ। আগে তিনি অনুভব করতেন যে এই কাজটা ছাড়া জীবন হবে বড় বেশি তিমিরাচ্ছন্ন। এখন জীবন যাতে বড় বেশি একটানা রকমের উজ্জ্বল না হয়ে পড়ে তার জন্য কাজটা তাঁর কাছে প্রয়োজনীয়। আবার নিজের কাগজগুলো নিয়ে যা লিখেছেন পড়ে দেখে তিনি খুশি হলেন যে কাজটা নিয়ে খাটার সার্থকতা আছে। কাজটা নতুন এবং তা উপকার দেবে। তাঁর আগেকার চিন্তার বহুকিছু তাঁর কাছে মনে হল অবান্তর এবং তা চরমে গেছে, কিন্তু গোটা বিষয়টা মনে মনে নতুন করে নাড়াচাড়া করে নেওয়ায় অনেক সমস্যাই পরিষ্কার হয়ে উঠল তাঁর কাছে। রাশিয়ার কৃষির দুরবস্থার কারণ নিয়ে নতুন একটা অধ্যায় তিনি লিখলেন এবার। তিনি দেখাচ্ছিলেন যে রাশিয়ায় দারিদ্র্য দেখা দিচ্ছে শুধু ভূসম্পত্তির বেঠিক বণ্টন আর ভুল পরিচালনার জন্য নয়। ইদানীং এতে সহায়তা করছে রাশিয়ায় অস্বাভাবিকভাবে আমদানি করা বাইরের সভ্যতা, বিশেষ করে যোগাযোগ ব্যবস্থা, রেলপথ, যা থেকে ঘটছে শহরগুলির কেন্দ্রীভবন, বিলাস বৃদ্ধি এবং তার পরিণামে কৃষির ক্ষতি করে ফ্যাক্টরি-ভিত্তিক শিল্প, ক্রেডিট আর তার সহচর শেয়ার-বাজারি ফাটকার বিকাশ। তাঁর মনে হচ্ছিল যে দেশে সম্পদের স্বাভাবিক বিকাশ হলে এই ব্যাপারগুলিই আসবে, তবে শুধু তখন, যখন কৃষিতে যথেষ্ট শ্রম ঢালা হয়েছে, যখন কৃষি চলছে সঠিক পথে, অন্তত নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে; দেশের সম্পদ বাড়া চাই সমভাবে, বিশেষ করে এমনভাবে যাতে সম্পদের অন্যান্য শাখা কৃষিকে ছাড়িয়ে না যায়; কৃষি যে নির্দিষ্ট মানটায় রয়েছে তারই উপযোগী রূপে বাড়া উচিত যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং আমাদের ভূমির অপব্যবহারের ক্ষেত্রে যে রেলপথ প্রবর্তিত হয়েছে অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিক প্রয়োজন থেকে, সেটা হয়েছে অকালে এবং রেলপথ দ্বারা কৃষির যে সাহায্য হবে আশা করা হয়েছিল তার বদলে রেলপথ কৃষিকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছে, আর শিল্প ও ক্রেডিটের বিকাশ ঘটিয়ে কৃষিকে থামিয়ে রেখেছে, জীবদেহে কোন একটা অঙ্গের অকালে ও একপেশে বৃদ্ধিতে যেমন দেহের সাধারণ বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়, তেমনি রাশিয়ায় সম্পদের সাধারণ বিকাশের ক্ষেত্রে ক্রেডিট, যোগাযোগ ব্যবস্থা, এবং ইউরোপে ফ্যাক্টরিগুলি কালোপযোগী এবং নিঃসন্দেহে প্রয়োজনীয় হলেও ফ্যাক্টরিগুলির কর্মচাঞ্চল্য বৃদ্ধি আমাদের এখানে কৃষির সুব্যবস্থা করার উপস্থিত প্রশ্ন নাকচ করে দিয়ে ক্ষতিই করেছে।
আর ওদিকে লেভিন যতক্ষণ লিখছেন, কিটি তখন ভাবছে তরুণ প্রিন্স চার্স্কির প্রতি কি অস্বাভাবিক মনোযোগ দেখিয়েছে তার স্বামী। চলে আসার আগে কিটির প্রতি প্রিন্স হয়ে উঠেছিলেন অতি অশিষ্ট ধরনে গদগদ। কিটি ভাবছিল, ‘ও যে হিংসে করে! ওহ্ সৃষ্টিকর্তা, অথচ কি মিষ্টি আর বোকা ও। আমার জন্য ঈর্ষা হয় ওর! যদি ও জানতো যে আমার কাছে ওদের সবার দাম পিওতর বাবুর্চির চেয়ে বেশি নয়’, নিজের কাছেই অদ্ভুত মালিকানা অনুভূতি নিয়ে লেভিনের মাথার পেছনটা আর লাল ঘাড়ের দিকে চেয়ে কিটি ভাবলে, ‘কাজ থেকে ওকে টেনে আনতে কষ্ট হচ্ছে অবশ্য (তবে ও পরে লিখে ফেলতে পারবে!), কিন্তু ওর মুখ আমাকে দেখতে হবে। ও কি টের পাচ্ছে যে আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি? চাই ও যেন ফিরে তাকায়!… চাই, কিন্তু!’ ওঁর ওপর তার দৃষ্টির এভাব বাড়িয়ে তোলার জন্য সে চোখ মেললে আরো বড় বড় করে।
‘হ্যাঁ, ওগুলো রসটুকু শুষে নিয়ে একটা মিথ্যে রোশনাই ছাড়ে’, বিড়বিড় করে লেখা থামালেন লেভিন আর কিটি তাঁর দিকে হেসে তাকিয়ে আছে টের পেয়ে মুখ ফেরালেন।
‘কি হল?’ হেসে উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
‘ফিরে তাকাল তাহলে’, ভাবল কিটি। এবং ওঁর দিকে তাকিয়ে কাজ থেকে সরানো হয়েছে বলে রাগ করেছেন কিনা তা আনন্দ করার চেষ্টা করে বলল, ‘আমার ইচ্ছে হচ্ছিল তুমি যেন আমার দিকে চাও।’
‘তা, শুধু দুজনে মিলে থাকতে ভালোই তো লাগে! আমার লাগে’, সুখের হাসিতে জ্বলজ্বলে হয়ে কিটির কাছে এসে লেভিন বললেন।
‘এত ভালো লাগছে আমার! কোথাও আমি যাব না, বিশেষ করে মস্কোয়।’
‘কি ভাবছিলে?’
‘আমি? আমি ভাবছিলাম… না, না, যাও লেখো গে, অন্য দিকে মন দিয়ো না’, কিটি বলল ওষ্ঠ সংকুচিত করে, ‘আমাকে এখন এইগুলো কাটতে হবে, দেখছ, এই ছেঁদাগুলো।’
কাঁচি নিয়ে কাটতে শুরু করল সে।
‘না, বলো কি?’ কিটির পাশে বসে ছোট্ট কাঁচিটার বৃত্তাকার গতি লক্ষ করতে করতে লেভিন বললেন। ‘ও, কি আমি ভাবছিলাম? ভাবছিলাম মস্কোর কথা, তোমার মাথার পেছনটার কথা।’
‘ঠিক কেন যে আমার এত সুখ বলো তো? স্বাভাবিক নয়। বড় বেশি ভালো’, লেভিন বললেন ওর হাতে চুমু খেয়ে।
‘আমার কাছে উল্টো, যত ভালো ততই স্বাভাবিক।’
‘তোমার কিন্তু একগোছা চুল খসে এসেছে’, সন্তর্পণে কিটির মাথাটা ঘুরিয়ে লেভিন বললেন, ‘চুল। দেখেছ, এখানে। না, থাক, কাজে ফিরতে হবে আমাদের।’
কাজ আর চলল না, আর কুজ্মা এসে যখন বলল যে চা দেওয়া হয়েছে, দোষীর মত পরস্পর থেকে ছিটকে গেলেন ওঁরা।
‘শহর থেকে ওরা এসেছে?’ কুমাকে জিজ্ঞেস করলেন লেভিন।
‘এইমাত্র ফিরল। ডাক বাছছে।’
‘তাড়াতাড়ি ফিরো’, স্টাডি থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে কিটি বলল লেভিনকে, ‘নইলে তোমাকে ছাড়াই চিঠি পড়ে ফেলব। আর শোন, ডুয়েটে পিয়ানো বাজানো যাক।’
একা হয়ে নিজের খাতাপত্র কিটির কেনা নতুন পোর্টফোলিওটায় গুছিয়ে কিটির সাথে সাথে মনোরম সব সাজ- সজ্জা সমেত নতুন যে ওয়াশস্ট্যান্ডটার উদয় হয়েছে এখানে তাতে হাত ধোবার জন্য উঠে দাঁড়ালেন লেভিন। নিজের ভাবনাটায় হাসি পেল লেভিনের এবং অননুমোদনের ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন সে ভাবনায়; অনুশোচনার মত একটা মনোভাব বিঁধছিল তাঁকে। তাঁর বর্তমান জীবনে কি-একটা যেন আছে লজ্জাকর, থলথলে, তাঁর ভাষায় ঘ্যাটের মত; তাঁর মনে হল, ‘এভাবে দিন কাটানো ভালো নয়। তিন মাস হতে চলল অথচ প্রায় কিছুই করিনি আমি। আজ প্রথম গুরুত্ব নিয়ে কাজে লেগেছিলাম, কিন্তু কি দাঁড়াল? শুরু করেই ছেড়ে দিলাম। এমন কি আমার সাধারণ যে কাজ, তাও প্রায় ফেলে রেখেছি। বিষয়কর্ম—তা দেখতেও আমি প্রায় যাই না। কখনো ওকে একলা রেখে যেতে কষ্ট হয়, কখনো দেখতে পাই যে ওর একঘেয়ে লাগছে। অথচ আমি কিনা ভেবেছিলাম যে বিয়ের আগের জীবনটা সে হলেই হল, চলে যাচ্ছে, ওটা ধর্তব্যের মধ্যেই নয়, সত্যিকারের জীবন শুরু হবে বিয়ের পরে। অথচ তিন মাস তো হতে চলল, এমন অলস আর অসার্থক দিন আমি কাটাইনি কখনো। না, এটা অনুচিত, শুরু করা দরকার। বলা বাহুল্য ওর দোষ নেই। কোন কিছুর জন্যই ভর্ৎসনা করা চলে না ওকে। নিজেরই আমার শক্ত হওয়া উচিত ছিল, রক্ষা করতে হত নিজের পুরুষালী স্বাধীনতা। নইলে এভাবে আমি নিজেই অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারি, ওকেও তাই করে তুলব… বলাই বাহুল্য ওর দোষ নেই’, মনে মনে ভাবলেন তিনি।
কিন্তু অসন্তুষ্ট ব্যক্তির পক্ষে অন্যকে এবং যে তার কাছে সবচেয়ে প্রিন্স তাকে নিজের অসন্তোষের জন্য ভর্ৎসনা না করা কঠিন। এবং লেভিনের ঝাপসাভাবে মনে হল দোষ ওর নয় (কোন কিছুতেই দোষী হওয়া সম্ভব নয় ওর পক্ষে), দোষ ওর লালনপালনের যা অগভীর, চপল (যেমন ঐ বাঁদর চাঙ্কিটা; আমি জানি যে কিটি ওকে থামিয়ে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি’)। ‘হ্যাঁ, সংসার নিয়ে আগ্রহ ছাড়া (এটা ওর আছে), নিজের প্রসাধন আর বিলেতি এম্ব্রয়ডারি ছাড়া ওর গুরুত্বপূর্ণ কোন আগ্রহ নেই। আমার কাজে, বিষয়কর্মে, চাষীদের নিয়ে, সঙ্গীতে, যাতে তার বেশ দখল আছে, বই পড়ায় কোন আগ্রহ নেই ওর। কিছুই সে করে না আর তাতে খুব তুষ্ট থাকে সে।’ মনে মনে লেভিন এটার সমালোচনা করতেন, কিন্তু তখনো বোঝেননি যে কিটি ক্রিয়াকলাপের সেই পর্বের জন্য তৈরি হচ্ছে যা আসার কথা, যখন সে হবে একই সময়ে স্বামীর স্ত্রী, গৃহের কর্ত্রী, গর্ভধারিণী, স্তন্যদাত্রী, শিশুদের পালিকা। লেভিন ভাবেননি যে কিটি এটা তার সহজবোধে জেনে ফেলেছে এবং তৈরি হচ্ছে এই সাংঘাতিক খাটুনির জন্য, নির্ভাবনা আর প্রেমসুখের যে মুহূর্তগুলিকে সে এখন কাজে লাগিয়ে সানন্দে তার ভবিষ্যৎ নীড় রচনা করে চলেছে তার জন্য আত্মগ্লানি নেই তার।
ষোলো
লেভিন যখন ওপরে গেলেন, স্ত্রী তখন রূপার নতুন সামনোভার আর চায়ের নতুন সরঞ্জামগুলোর সামনে বসে ছোট একটা টেবিলের কাছে আর এক পেয়ালা চা ঢেরে বৃদ্ধা আগাফিয়া মিখাইলোভনাকে বসিয়ে ডল্লির চিঠি পড়ছিল। তাঁর সাথে কিটির অবিরাম পত্র-বিনিময় হত ঘন ঘন।
‘দেখছেন তো, আমাকে এখানে বসিয়ে তাঁর কাছে থাকতে বলেছেন’, কিটির দিকে চেয়ে অমায়িক হেসে বললেন আগাফিয়া মিখাইলোভনা।
আগাফিয়া মিখাইলোভনার কথাগুলো থেকে লেভিন অনুমান করলেন যে আগাফিয়া মিখাইলোভনা আর কিটির মধ্যে ইদানীং যে ঝগড়া চলছিল, তার অবসান হয়েছে। তিনি বুঝতে পারলেন, শাসন-ভার কেড়ে নিয়ে নতুন কর্ত্রী যত দুঃখই তাঁকে দিক, তা সত্ত্বেও কিটি জয় করে নিয়েছে আগাফিয়া মিখাইলোভনাকে, বাধ্য করেছে ভালোবাসতে কিটিকে।
‘তোমার চিঠিও আমি পড়ে নিয়েছি’, অশিক্ষিত একটা চিঠি এগিয়ে দিয়ে কিটি বলল, ‘এটা মনে হয় তোমার ভাইয়ের ওই মেয়েলোকটার কাছ থেকে… তবে’, কিটি বলল, ‘আমি পড়িনি। আর এগুলো আমাদের লোকজন আর ডল্লির। কি কাণ্ড! সারমাৎস্কিদের ওখানে শিশুদের বলনাচে গ্রিশা আর তানিয়াকে নিয়ে গিয়েছিল ডল্লি। তানিয়া যায় মার্কুইসের বেশে।
কিন্তু লেভিন তার কথা শুনছিলেন না; লাল হয়ে তিনি নিকোলাই ভাইয়ের ভূতপূর্ব প্রণয়িনী মারিয়া নিকোলায়েভনার চিঠিটা নিয়ে পড়তে লাগলেন। এটা তার দ্বিতীয় চিঠি। প্রথম চিঠিতে সে লিখেছিল যে বিনা দোষে ভাই তাড়িয়ে দিয়েছেন তাকে এবং মর্মস্পর্শী সরলতায় যোগ করেছিল যে আবার দারিদ্র্যের মধ্যে পড়লেও কিছুই সে চায় না, আশা করে না, কিন্তু তাকে ছাড়া ক্ষীণ স্বাস্থ্যের জন্য নিকোলাই দমিত্রিয়েভিচ টেসে যাবেন এই চিন্তাটা তাকে বড় কষ্ট দিচ্ছে; তার দিকে দৃষ্টি রাখতে সে অনুরোধ করেছিল ভাইকে। এখন সে অন্য কথা লিখেছে। নিকোলাই দমিত্রিয়েভিচের দেখা পেয়েছে সে, মস্কোয় ওঁর সাথে সে থাকে, তারপর তাঁরা চলে যান মফস্বল শহরে, সেখানে নিকোলাই দমিত্রিয়েভিচ চাকরি পান। কিন্তু ওপরওয়ালার সাথে ঝগড়া করে আবার মস্কো ফেরেন তিনি, কিন্তু পথে এতই অসুস্থ হয়ে পড়েন যে শয্যা ছাড়তে পারবেন কিনা সন্দেহ। লিখেছে ‘কেবলি আপনার কথা বলেন। টাকাকড়িও আর নেই।’
পড়ে দেখো, ডল্লি তোমার সম্পর্কে লিখেছে…’ হেসে বলতে যাচ্ছিল কিটি, কিন্তু স্বামীর পরিবর্তিত মুখভাব লক্ষ করে থেমে গেল হঠাৎ।
‘কি হল? কি ব্যাপার?’
‘ও লিখেছে নিকোলাই ভাই মরণাপন্ন। আমি যাব।’
হঠাৎ বদলে গেল কিটির মুখচ্ছবি। মার্কুইস-বেশে তানিয়ার কথা, ডল্লির কথা, সব উধাও হল মন থেকে।
জিজ্ঞেস করল, ‘কবে যাবে?’
‘কাল।’
‘আমিও তোমার সাথে যাব, কেমন?’ কিটি বলল।
‘কিটি! এটা কি হচ্ছে?’ ভর্ৎসনার সুরে লেভিন বললেন।
‘কি হচ্ছে মানে?’ লেভিন যে তার প্রস্তাবটাকে যেন নিচ্ছেন অনিচ্ছায় এবং বিরক্তি সহকারে এতে আহত বোধ করল সে। ‘আমার যাওয়া চলবে না কেন? আমি তোমার ব্যাপারে বাধা দেব না। আমি… ‘
আমি যাচ্ছি কারণ আমার ভাই মারা যাচ্ছে। কিন্তু তুমি কি জন্য…’
কি জন্য? তুমি যে জন্য সেই জন্যই…’
‘আমার পক্ষে এমন গুরুতর একটা মুহূর্তেও ও ভাবছে কেবল এই কথা যে একলা থাকলে ওর বিছছিরি লাগবে’, লেভিন ভাবলেন এবং এরূপ গুরুতর ব্যাপারে এই কৈফিয়ৎটা রাগিয়ে দিল তাঁকে।
কঠোরভাবে তিনি বললেন, ‘এটা অসম্ভব।’
ব্যাপারটা কলহের দিকে গড়াচ্ছে দেখে আগাফিয়া মিখাইলোভনা আস্তে করে পেয়ালাটা নামিয়ে রেখে বেরিয়ে গেলেন। কিটির সেটা নজরেই পড়ল না। যে সুরে স্বামী ওই শেষ কথাটা বলেছেন সেটা তাকে আঘাত দিল বিশেষ করে এই জন্য যে কিটি যা বলেছে স্পষ্টতই সেটা তিনি বিশ্বাস করছেন না।
‘আর আমি তোমাকে বলছি যে তুমি যদি যাও, তাহলে আমিও তোমার সাথে যাব, অবশ্য-অবশ্যই যাব’, কিটি বলল তাড়াতাড়ি কর এবং সরোষে। ‘কেন অসম্ভব? কেন বলছ যে অসম্ভব?’
‘কারণ সৃষ্টিকর্তা জানেন কোথায় যাচ্ছি, কোন রাস্তায়, কোন হোটেলে। তুমি থাকলে মুশকিলে পড়ব’, লেভিন বললেন শান্ত থাকার চেষ্টা কর।
‘একটুও না। আমার কিছুই লাগবে না। তুমি যেখানে পারবে, সেখানে আমিও…’
‘অন্তত শুধু এই একটা কারণে যে—ওই মেয়েটা থাকবে সেখানে, তার সাথে তোমার অন্তরঙ্গতা হতে পারে না।’
‘আমি কিছু জানি না, জানতে চাই না কে থাকবে সেখানে, কি থাকবে। শুধু জানি যে স্বামীর ভাই মারা যাচ্ছে, স্বামী যাচ্ছে তার কাছে, আমিও স্বামীর সাথে চলেছি যাতে…’
‘কিটি! রাগ করো না। কিন্তু ভেবে দেখো যে ব্যাপারটা গুরুতর, ভাবতে কষ্ট হচ্ছে যে তুমি এখানে নিজের দুর্বলতাটা, একলা থাকতে অনিচ্ছাটা মিশিয়ে ফেলছ। একলা থাকতে বিছছিরি লাগবে, বেশ মস্কো যাও।’
‘সবসময় তুমি আমার মধ্যে এটা খারাপ একটা নিচ মতলব দেখতে পাও’, কিটি বলল অপমান ও ক্রোধের অশ্রু নিয়ে, ‘আমি কিছু না, দুর্বলতা কিছু নেই আমার… আমি শুধু এই বুঝি যে স্বামী যখন দুঃখে পড়েছে; তখন তার সাথে থাকা আমার কর্তব্য। কিন্তু তুমি ইচ্ছে করেই কষ্ট দিতে চাও আমাকে, ইচ্ছে করেই বুঝতে চাইছে না…’
‘না, ভয়ংকর ব্যাপার! কেমন একটা গোলাম হয়ে থাকা!’ নিজের বিরক্তি আর চেপে রাখতে না পেরে চেঁচিয়ে উঠলেন লেভিন। কিন্তু তক্ষুনি টের পেলেন যে তিনি আঘাত করছেন নিজেকেই।
‘তাহলে কেন বিয়ে করলে তুমি? বেশ তো স্বাধীন ছিলে। কেন, এখন যখন অনুতাপ হচ্ছে তোমার?’ এই বলে লাফিয়ে উঠে কিটি ছুটে গেল ড্রয়িং-রুমে।
লেভিন যখন তার কাছে গেলেন, সে ফোঁপাচ্ছিল।
তিনি বলতে শুরু করলেন, খুঁজলেন এমন কথা যা তাকে বুঝ মানাতে না পারলেও অন্তত শান্ত করবে। কিটি কিন্তু শুনছিল না তাঁর কথা, কোন কিছুতেই সে রাজি হল না। নিচু হয়ে লেভিন তার হাতটা নিলেন যা প্রতিরোধ করছিল। চুমু খেলেন হাতে, চুমু খেলেন চুলে, তারপর আবার হাতে—কিটি চুপ করে রইল। কিন্তু যখন তিনি দুই হাতে কিটির মুখখানা ধরে বলে উঠলেন : ‘কিটি!’ তখন হঠাৎ সম্বিত ফিরল তার, কেঁদে ফেলে মিটমাট করে নিল।
ঠিক হল পরের দিন তাঁরা একসাথে রওনা দেবেন। স্ত্রীকে লেভিন বললেন যে সে যেতে চাইছে কেবল তাঁকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে সেটা তিনি বিশ্বাস করেন, সায় দিলেন যে ভাইয়ের কাছে মারিয়া নিকোলায়েভনা থাকলে অশালীন কিছু হবে না; কিন্তু মনে মনে তিনি অসন্তুষ্ট হলেন কিটি আর নিজের ওপর। কিটির ওপর অসন্তুষ্ট হলেন, কারণ যখন প্রয়োজন তখন তাঁকে ছেড়ে দেবার মত মনের জোর তার হয়নি (ভেবে তাঁর অদ্ভূত লাগল যে কিটি তাঁকে ভালোবাসতে পারে এ সৌভাগ্য সেদিনও পর্যন্ত বিশ্বাস করতে না পারলেও এখন নিজেকে অসুখী মনে হচ্ছে এই জন্য যে কিটি তাঁকে ভালবাসছে বড় বেশি!) আর নিজের ওপর অসন্তুষ্ট হলেন, কারণ তিনি তাঁর মত বজায় রাখতে পারেননি। মনের গভীরে তাঁর আরো বেশি অমত ছিল এই কথায় যে ভাইয়ের সাথে যে মেয়েটা আছে তাতে কিটির কিছু এসে যায় না, সম্ভাব্য নানা সংঘাতের কথা তিনি ভাবলেন সভয়ে। তাঁর স্ত্রী, তাঁর কিটি ওই মেয়েটার সাথে থাকবে একই ঘরে, শুধু এই কথা ভেবেই তিনি চমকে উঠছিলেন বিতৃষ্ণা আর আতংকে।
সতেরো
মফস্বলী যে হোটেলটায় নিকোলাই লেভিন ছিলেন, তা তেমনি একটা মফস্বলী হোটেল যা গড়া হয় আধুনিক সব সুব্যবস্থা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, আরাম, এমন কি রমণীয়তার অতি শুভ সংকল্প নিয়ে, কিন্তু তাতে যেসব লোক ওঠে তাদের দৌলতেই অতি অচিরেই যা পরিণত হয় আধুনিক সুব্যবস্থার জাঁক করা নোংরা একটা সরাইখানায় আর ঐ জাঁকটার দরুনই তা হয়ে দাঁড়ায় সেকেলে নোংরা হোটেলগুলোর চেয়েও খারাপ। এ হোটেলটাও সেই দশায় পৌঁছেছে; প্রবেশদ্বারে ধূমপানরত নোংরা উর্দি পরা যে সৈনিকটির চাপরাশি সাজার কথা, পেটাই লোহার বিমর্ষ, ছ্যাদা ভরা বিশ্রী সিঁড়িটা, নোংরা ফ্রক-কোট পরা চালিয়াত ওয়েটার, লাউঞ্জে টেবিলের ওপর মোম দিয়ে বানানো ফুলের ধূলিধূসর তোড়ার শোভা এবং জঞ্জাল, ধুলো, সর্বত্র বিশৃঙ্খা আর সেই সাথে হোটেলটার কেমন একটা আধুনিক ‘রেলওয়ে- সুলভ’ আত্মতৃপ্ত উদ্বেগ—লেভিনদের নবজীবন কাটানোর পর খুবই দুর্বিষহ ঠেকল এগুলো, বিশেষ করে তাঁরা যা প্রত্যাশা করছিলেন তার সাথে হোটেলটার একটা মিথ্যে ছাপ কিছুতেই মিলছিল না।
ভালো একটা কামরা কি ভাড়ায় পাওয়া যাবে এ প্রশ্নের পর বরাবরের মতই দেখা গেল ভালো কামরা একটাও নেই; একটা ভালো কামরা দখল করেছেন রেলওয়ে পরিদর্শক, আরেকটা মস্কোর জনৈক উকিল, তৃতীয়টা গ্রাম থেকে আগত প্রিন্সেস আস্তাফিয়েভা। বাকি আছে কেবল একটা নোংরা কামরা, তার পাশেই আরেকটা ঘর সন্দ্যা নাগাদ খালি হতে পারে। যা আশংকা করেছিলেন তাই যে সত্যি হল, আসার প্রথম মুহূর্তেই ভাইয়ের কি হয়েছে ভেবে তিনি যখন অস্থির, তখনই তাঁর কাছে ছুটে যাবার বদলে তাঁকে যে স্ত্রীর কথা ভাবতে হচ্ছে, এতে স্ত্রীর ওপর বিরক্ত হয়ে তিনি তাকে নিয়ে গেলেন প্রদত্ত ঘরটায়।
তাঁর দিকে ভীরু-ভীরু দোষী-দোষী দৃষ্টিতে চেয়ে কিটি বলল, ‘যাও, যাও ওর কাছে!
নীরবে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন লেভিন আর তখনই দেখা পেলেন মারিয়া নিকোলায়েভনার, তাঁর আসার খবর পেয়েছে সে কিন্তু ভেতরে ঢোকার সাহস পাচ্ছিল না। মস্কোয় লেভিন তাকে যেমন দেখেছিলেন, এখনো ঠিক তেমনি; সেই একই হাত-কাটা গলা-খোলা পশমী গাউন, একটু ভারী হয়ে ওঠা বসন্তের দাগ ধরা সেই একইরকম সহৃদয় ভোঁতা মুখ।
‘কি? কেমন আছে? কি হয়েছে?’
‘খুব খারাপ। বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেন না। উনি আপনার অপেক্ষা করছেন… উনি… আপনি… স্ত্রীর সাথে।’
লেভিন প্রথমটা বুঝতে পারেননি কেন সে বিব্রত বোধ করছে, কিন্তু তখনই সে বুঝিয়ে বলল নিজেই।
‘আমি এখন যাচ্ছি। আমি থাকব রান্নাঘরে’, সে বলল, ‘উনি খুশি হবেন। উনি শুনেছেন, ওঁকে চেনেন, বিদেশে থাকতেই চেনেন।’
লেভিন বুঝলেন যে তাঁর স্ত্রীর কথা হচ্ছে, কিন্তু কি জবাব দেবেন ভেবে পেলেন না।
বললেন, ‘চলুন যাই!’
কিন্তু তিনি পা বাড়াতেই তাঁর কামরার দরজা খুলে গেল, মুখ বাড়াল কিটি। লজ্জায় এবং এই দুঃসহ অবস্থায় নিজেকে ও তাঁকে ফেলেছে বলে স্ত্রীর ওপর বিরক্তিতে লাল হয়ে উঠলেন লেভিন; কিন্তু মারিয়া নিকোলায়েভনা লাল হয়ে উঠল আরও বেশি। একেবারে কুঁকড়ে গিয়ে সে লাল হয়ে উঠল কাঁদো-কাঁদো মুখ করে, কি বলবে, কি করবে ভেবে না পেয়ে সে দুই হাতে মাথার রুমালের প্রান্ত ধরে জড়াতে লাগল রাঙা রাঙা আঙুলে।
তার কাছে দুর্বোধ্য ভয়াবহ এই নারীটিকে কিটি প্রথম যে দৃষ্টিতে দেখেছিল, তাতে লেভিন একটা অদম্য কৌতূহলই লক্ষ করেছিলেন; কিন্তু সেটা শুধু এক মুহূর্তের জন্য।
‘কি? কেমন আছে?’ কিটি জিজ্ঞেস করল প্রথমে স্বামীকে, পরে ওকে।
‘না, করিডোর কথাবার্তা বলার জায়গা নয়’, লেভিন বললেন বিরক্তিতে এক ভদ্রলোকের দিকে চেয়ে, যিনি তখন করিডোর দিয়ে পা নাচাতে নাচাতে যাচ্ছিলেন যেন নিজেরই কাজে।
‘তাহলে ভেতরে আসুন-না’, কিটি বলল সামলে ওঠা মারিয়া নিকোলায়েভনার উদ্দেশে, তবে স্বামীর উদ্বিগ্ন মুখভাবও চোখে পড়ল তার, ‘তাহলে যান, যান, পরে ডেকে পাঠাবেন আমাকে’, এই বলে সে ঢুকল কামরায়। লেভিন গেলেন ভাইয়ের কাছে।
ভাইয়ের ওখানে তিনি যা দেখলেন, যে অনুভূতি তাঁর হল সেটা মোটেই আশা করেননি লেভিন। তিনি আশা করেছিলেন যে দেখবেন সেই একই আত্মপ্রতারণা, ক্ষয়রোগীদের ক্ষেত্রে যা প্রায়ই ঘটে থাকে বলে তিনি শুনেছেন এবং গত হেমন্তে ভাই তাঁর ওখানে গেলে যা তাঁকে খুবই বিহ্বল করেছিল; তিনি আশা করেছিলেন যে দেখবেন মৃত্যুর সান্নিধ্যের আরও সুপ্রকট দৈহিক লক্ষণ, বেশি দুর্বলতা, বেশি শীর্ণতা, তাহলেও একইরকম অবস্থা। আশা করেছিলেন যে প্রিয়তম ভ্রাতাকে হারাবার জন্য সেই করুণা আর মৃত্যুর সামনে সেই আতংক তাঁর হবে যা তখন তিনি বোধ করেছিলেন, শুধু আরও অধিক পরিমাণে। এর জন্য তিনি তৈরি হয়ে ছিলেন; কিন্তু দেখলেন একেবারে ভিন্ন জিনিস।
ছোট্ট নোংরা একটা কামরা, দেয়ালের রঙিন প্যানেলে থুতু ছিটানো, পার্টিশনের ওপাশ থেকে কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে, পেটের নাড়ি উলটে আসা দুর্গন্ধে বাতাস ভরপুর, দেয়ালের কাছ থেকে সরিয়ে আনা একটা খাটে কম্বল-ঢাকা একটি দেহ। সে দেহের একটা হাত দুর্বোধ্য কি কারণে যেন পাতলা, মসৃণ একটা তক্তার সাথে কনুই পর্যন্ত বাঁধা। মাতাটা কাত হয়ে আছে বালিশের ওপর। লেভিনের চোখে পড়ল রঙের কাছে ঘর্মাক্ত বিরল চুল আর টান টান, প্রায় স্বচ্ছ কপাল।
লেভিনের মনে হল, ‘ভয়াবহ এই দেহটা নিকোলাই ভাই হতে পারে না।’ কিন্তু কাছে গিয়ে মুখখানা দেখতেই সন্দেহ আর সম্ভব হল না। মুখের সাঙ্ঘাতিক পরিবর্তন সত্ত্বেও আগতের দিকে তোলা জীবন্ত ওই চোখজোড়া, লেপটে- যাওয়া মোচের তলে ঠোঁটের সামান্য নাড়াচড়া দেখা মাত্রই লেভিনের কাছে এই ভয়ংকর সত্যটা অস্পষ্ট রইল না যে মৃত এই দেহটাই তাঁর জীবন্ত ভাই।
আগত ভাইয়ের দিকে তিরস্কারের কঠোর এক দৃষ্টি হানল ধকধকে চোখ দুটো। আর তখনই সে দৃষ্টিতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল জীবিতদের মধ্যে সম্পর্ক। তাঁর দিকে নিবদ্ধ দৃষ্টিতে তিরস্কার টের পেলেন লেভিন, নিজের সুখের জন্য অনুশোচনা হল।
কনস্তান্তিন যখন তাঁর করমর্দন করলেন, হাসি ফুটল নিকোলাইয়ের মুখে। হাসিটা ক্ষীণ, সামান্য চোখে পড়ে মাত্র আর হাসি সত্ত্বেও চোখের কঠোর ভাবটা বদলাল না।
‘আমাকে এই অবস্থায় দেখবি আশা করিসনি তো’, অতি কষ্টে বলতে পারলেন নিকোলাই।
‘হ্যাঁ… মানে, না’, কথাগুলো গোলমাল করে বললেন লেভিন, ‘আগে, মানে আমার বিয়ের সময় খবর দিলে না কেন? আমি সবখানে খোঁজ নিয়েছিলাম।’
চুপ করে থাকতে না হলে কথা বলা দরকার কিন্তু লেভিন জানতেন না কি বলা যায়, তার ওপর ভাই কোন জবাব দিচ্ছিলেন না, চোখ না সরিয়ে শুধু একদৃষ্টে দেখছিলেন, স্পষ্টতই প্রতিটি শব্দের অর্থ ধরতে চাইছিলেন। লেভিন তাঁকে জানালেন যে তাঁর স্ত্রীও এসেছেন সাথে। সন্তুষ্টির একটা ভাব দেখা গেল নিকোলাইয়ের মধ্যে, কিন্তু বললেন, তাঁর যা অবস্থা তাতে ওকে ভয় পাইয়ে দেবেন বলে আশংকা হচ্ছে তাঁর। নামল নীরবতা। হঠাৎ নড়েচড়ে উঠে নিকোলাই কি- একটা যেন বলতে গেলেন। তাঁর মুখভাব দেখে লেভিন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যময় কিছু-একটার আশা করেছিলেন, কিন্তু তনি বললেন শুধু নিজের স্বাস্থ্যের কথা। ডাক্তার সম্পর্কে নালিশ করলেন তিনি, আক্ষেপ করলেন যে মস্কোর নামকরা ডাক্তার ডাকা হয়নি, এবং লেভিন বুঝলেন যে এখনো আশা রাখছেন উনি।
তিনি একটু চুপ করতেই যন্ত্রণাকর অনুভূতিটা থেকে অন্তত এক মিনিটের জন্য মুক্তি পাবার আশায় লেভিন উঠে দাঁড়ালেন, বললেন স্ত্রীকে নিয়ে আসতে যাচ্ছেন।
‘তা বেশ, আমি জায়গাটা পরিষ্কার করতে বলি। জায়গাটা নোংরা, দুর্গন্ধও আছে বলে মনে হয়। মাশা! ঘর পরিষ্কার করো তো’, কষ্ট করে রোগী বললেন। ‘আর হ্যাঁ, পরিষ্কার করা হয়ে গেলেই চলে যেয়ো, এ্যাঃ’, জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে যোগ করলেন তিনি 1
কোন কথা বললেন না লেভিন। বেরিয়ে করিডোরে তিনি থাকলেন। তিনি বলেছেন স্ত্রীকে নিয়ে আসবেন, কিন্তু এখন, যে কষ্ট তাঁর হয়েছিল সেটা স্মরণ করে স্থির করলেন উল্টো, চেষ্টা করবেন কিটিকে বোঝাতে যাতে রোগীর কাছে সে না যায়। ভাবলেন, ‘আমার মত ওকে কষ্ট পাইয়ে কি হবে মিছেমিছি?
‘কি? কেমন আছেন?’ আতংকিত মুখে বলল কিটি।
‘ওহ্, ভয়ংকর, ভয়ংকর! কিন্তু তুমি চলে এলে কেন?’ লেভিন বললেন।
ভীত করুণ মুখে স্বামীর দিকে চেয়ে কয়েক সেকেন্ড কিটি চুপ করে রইল; তারপর দুই হাতে কনুই আঁকড়ে ধরল লেভিনের।
‘কস্তিয়া! ওঁর কাছে নিয়ে চল আমাকে। দুজন থাকলে হালকা লাগবে। তুমি শুধু আমাকে নিয়ে চল লক্ষ্মীটি; আমাকে পৌঁছে দিয়ে তুমি চলে যেয়ো’, কিটি বলল, ‘তোমাকে দেখব আর ওঁকে দেখব না, সে যে আমার কাছে অনেক বেশি কষ্টকর। ওখানে হয়ত আমি তোমারও, ওঁরও উপকারে লাগল। সত্যি, নিয়ে চল!’ স্বামীকে এমনভাবে সে মিনতি করতে লাগল যেন তার জীবনের সব সুখ নির্ভর করছে এরই ওপর।
রাজি না হয়ে লেভিনের উপায় ছিল না; খানিকটা সামলে উঠে আর মারিয়া নিকোলায়েভনার কথা একেবারে ভুলে গিয়ে তিনি আবার কিটির সাথে গেলেন ভাইয়ের কাছে।
লঘু পদক্ষেপে, কেবলি স্বামীর দিকে তাকাতে তাকাতে এবং নির্ভীক ও দরদী মুখখানা তাঁকে দেখিয়ে রোগীর ঘরে ঢুকল কিটি এবং বিনা ব্যস্ততায় ঘুরে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর নিঃশব্দ পায়ে দ্রুত গেল রোগীর পালংকের কাছে এমনভাবে যাতে তাঁকে মাথা ফেরাতে না হয় আর তাঁর বিরাট হাতখানা নিজের তাজা, তরুণ হাতে নিয়ে চাপ দিল এবং শুধু মেয়েদেরই যা প্রকৃতিগত তেমন একটা মৃদু উৎসাহে কথা বলতে লাগল তাঁর সাথে যা আত্মাভিমানে ঘা দেয় না, অথচ সহানুভূতি জানায়।
কিটি বলল, ‘আমাদের দেখা হয়েছিল সোডেনে কিন্তু পরিচয় হয়নি, আপনি তখন ভাবতে পারেননি যে আমি হব আপনার ভ্রাতৃবধূ।’
‘আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না তো?’ কিটি আসায় হাসিতে মুখ উদ্ভাসিত করে তিনি বললেন।
‘না, পারছি। খবর দিয়ে খুব ভালো করেছেন! আপনার কথা কন্তিয়া মনে করেনি, দুশ্চিন্তা করেনি আপনার জন্য, এমন একটা দিনও যায়নি।’
কিন্তু রোগীর চাঙা ভাবটা টিকল না বেশিক্ষণ।
কিটির কথা না ফুরতেই মুখে তাঁর আবার দেখা দিল জীবিতের প্রতি মুমূর্ষুর ঈর্ষার সেই কঠোর, তিরস্কারের ছাপ।
আমার ভয় হচ্ছে এ ঘরখানা আপনার পক্ষে ভালো নয়’, কিটি বলল তাঁর স্থির দৃষ্টি থেকে মুখ ফিরিয়ে ঘরটায় চোখ বুলিয়ে। ‘অন্য একটা ঘরের জন্য মালিককে বলা দরকার’, কিটি বলল স্বামীকে, ‘যা হবে আমাদের কাছাকাছি।’
আঠারো
লেভিন শান্তভাবে ভাইয়ের দিকে তাকাতে পারছিলেন না, নিজে স্বাভাবিক ও সুস্থির হতে পারছিলেন না তাঁর উপস্থিতিতে। রোগীর কাছে গেলে তাঁর দৃষ্টি ও মনোযোগ আপনা থেকে ঝাপসা হয়ে যেত, ভাইয়ের অবস্থার খুঁটিনাটি তাঁর চোখে পড়ত না, পার্থক্য করে দেখতে পারতেন না। শুধু ভয়াবহ একটা দুর্গন্ধ পেতেন, দেখতেন ময়লা, বিশৃঙ্খলা, যন্ত্রণাকর অবস্থা, কানে আসত কাতরানির শব্দ, আর টের পেতেন যে ওঁকে সাহায্য করা আর সম্ভব নয়। তাঁর খেয়ালই হল না যে রোগীর অবস্থাটা বোঝার জন্য ভাবনা-চিন্তা করা দরকার, ভাবা দরকার কিভাবে তাঁর দেহটা রয়েছে কম্বলের তলে, বেঁকে যাওয়া শীর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কোমর পিঠ রয়েছে কি অবস্থায়, তাদের ভালো করে কি রাখা যায় না, কিছু-একটা কি করা যায় না, যাতে ভালো না হলেও হবে কম খারাপ। এসব জিনিস ভাবতে গেলেই হিম নামত তাঁর শিরদাঁড়া বেয়ে। সন্দেহাতীত এই বিশ্বাস তাঁর জন্মাল যে ভাইয়ের আয়ু বৃদ্ধি অথবা যন্ত্রণা হ্রাসের জন্য কিছুই করবার নেই। কিন্তু কোনরকম সাহায্য যে সম্ভব নয় এই চেতনাটা রোগীকে পীড়া দিত, মেজাজ হয়ে উঠত খিটখিটে। সেই কারণে বেশি কষ্ট হত লেভিনের। রোগীর কামরায় থাকা তাঁর পক্ষে যন্ত্রণাদায়ক হত, না থাকাটা হত আরো বেশি খারাপ। তাই নানা অজুহাতে অবিরাম ঘরে ঢুকতেন আর বেরিয়ে যেতেন, একলা থাকার শক্তি ছিল না তাঁর।
কিন্তু কিটির ভাবনা, অনুভূতি ও আচরণ তেমন ছিল না মোটেই। রোগীকে দেখলে তার করুণা হত। আর করুণা তার নারী হৃদয়ে মোটেই তার স্বামীর মত ভীতি ও বিতৃষ্ণার উদ্রেক করত না, জাগাত কিছু করার, তাঁর অবস্থার সমস্ত খুঁটিনাটি জানার, তাঁকে সাহায্য করার তাগিদ। আর তার যে সাহায্য করা উচিত এ বিষয়ে যেহেতু তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না, এ বিষয়েও সন্দেহ ছিল না যে সেটা সম্ভব, তাই তৎক্ষণাৎ কাজে নেমে পড়ল সে। যে খুঁটিনাটির কথা ভাবতে গেলেই আতংক হত তার স্বামীর, ঠিক সেইগুলিই মনোযোগ আকর্ষণ করল তার। ডাক্তার ঢাকতে পাঠালে সে, ওষুধ কিনতে পাঠাল, তার যে দাসীটি তাঁদের সাথে এসেছিল, তাকে আর মারিয়া নিকোলায়েভনাকে লাগাল ঘরদোর পরিষ্কার করা, ধুলো ঝাড়া, কাপড় কাচায়, নিজেও সে কিছু কাচলে, কিছু বিছিয়ে দিলে কম্বলের তলে। তার হুকুমে রোগীর ঘর থেকে কিছু কিছু জিনিস সরিয়ে দেওয়া হল, কিছু-বা আনা হল সেখানে। সামনে যে ভদ্রলোকেরা পড়তেন তাঁদের দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে নিজে সে তার ঘরে গিয়ে বিছানার চাদর, ওয়াড, কামিজ বার করে আনত।
সাধারণ কক্ষে ইঞ্জিনিয়ারদের একটা দলকে খাবার পরিবেশন করছিল যে চাপরাশিটি কিটির ডাকে বার কয়েক করে সে এসেছে রাগত মুখে, কিন্তু তার আদেশ পালন না করে পারেনি, কেননা সে আদেশ কিটি দিত এমন একটা সস্নেহ ঝোঁক ধরে যে এড়ানো যেত না। এসব পছন্দ হত না লেভিনের; তিনি বিশ্বাস করতেন না যে এ সব থেকে রোগীর কোন উপকার হতে পারে। এতে রোগী আবার চটে না যায়, এই ভয় তাঁর হত সবচেয়ে বেশি। কিন্তু এতে রোগীকে নির্বিকার মনে হলেও তিনি চটলেন না, শুধু লজ্জা পেলেন, তাঁর জন্য কিটি কি করছে তাতে যেন আগ্রহই দেখা গেল তাঁর। লেভিনকে কিটি পাঠিয়েছিল ডাক্তারের কাছে; সেখানে থেকে ফিরে দরজা খুলে রোগীকে তিনি সেই অবস্থায় দেখতে পেলেন যখন কিটির হুকুমে তাঁর অন্তর্বাস বদলানো হচ্ছে। পিঠের লম্বা সাদা কংকাল তাতে সুপ্রকট হয়ে ওঠা কাঁধের বিশাল হাড়, খোঁচা খোঁচা পাঁজর, আর মেরুদণ্ড, সব নগ্ন। মারিয়া নিকোলায়েভনা আর একজন চাপরাশি কামিজের আস্তিনে আটকে যাওয়া তাঁর দীর্ঘ লম্বমান হাত তাতে গলাতে পারছিল না। লেভিনের পেছনে তাড়াতাড়ি করে দরজা বন্ধ করে কিটি, তবে চাইছিল না ওদিকটায়; কিন্তু রোগী ককিয়ে উঠতে সে দ্রুত গেল তাঁর কাছে। বলল, ‘আহ্ তাড়াতাড়ি কর।’
‘আসবেন না’, রোগী বলে উঠলেন রেগে, ‘নিজেই আমি…’
‘কি বললেন?’ বলল মারিয়া নিকোলায়েভনা।
কিন্তু কিটির কানে গিয়েছিল কথাটা, সে বুঝল যে তার সামনে নগ্ন দেহে থাকতে ওঁর সংকোচ হচ্ছে, বিছছিরি লাগছে। ‘আমি দেখছি না, দেখছি না’, হাত ঠিক করতে করতে কিটি বলল। ‘মারিয়া নিকোলায়েভনা, আপনি ওপাশে গিয়ে ঠিক করে দিন’, যোগ দিল সে।
স্বামীকে সে বললে, ‘যাও লক্ষ্মীটি, আমার ছোটো ব্যাগটায় একটা শিশি আছে, পাশের পকেটে। নিয়ে এসো না গো, ততক্ষণে এরা সব পরিষ্কার করে ফেলবে।’
শিশি নিয়ে ফিরে লেভিন দেখলেন রোগীকে শোয়ানো হয়েছে, একেবারে বদলে গেছে তাঁর চারপাশের চেহারা। গুমোটার জায়গায় পাওয়া যাচ্ছে ভিনিগার আর সেন্টের গন্ধ, নলে ঠোঁট দিয়ে লালচে গাল ফুলিয়ে সেটা স্প্রে করেছে কিটি। ধুলোর চিহ্ন নেই, খাটের নিচে গালিচা। টেবিলে পরিপাটী করে সাজানো, শিশি-বোতল, পানির পাত্র, ভাঁজ করে রাখা হয়েছে বিছানার দরকারী চাদর আর কিটির বিলেতি এমব্রডারি। রোগীর খাটের কাছে অন্য একটা টেবিলে পানীয়, মোমবাতি আর বড়ি। রোগীকে ধুইয়ে চুল আঁচড়ে দেওয়া হয়েছে। শুয়ে আছেন তিনি পরিষ্কার বিছানায়, উঁচু করে রাখা বালিশগুলোয় মাথা, গায়ে পরিচ্ছন্ন কামিজ, তাতে অস্বাভাবিক রোগা গলার কাছে মাদা কলার, মুখে তাঁর নতুন একটা আশা, চোখ না ফিরিয়ে তাকিয়ে আছেন কিটির দিকে।
যে ঢাক্তার নিকোলাইয়ের চিকিৎসা করত এবং নিকোলাই যার ওপর ছিলেন অসন্তুষ্ট, ক্লাবে যে ডাক্তারকে পেয়ে লেভিন নিয়ে এসেছেন তিনি সে নন। নতুন ডাক্তার স্টেথোস্কোপ বার করে বুক দেখলেন, মাথা নাড়লেন, ওষুধ লিখে দিলেন এবং বিশেষ সবিস্তারে বোঝালেন প্রথম ওষুধ খেতে হবে কিভাবে, দ্বিতীয়ত—পথ্য কি হবে। পরামর্শ দিলেন ডিম, কাঁচা বা সামান্য সেদ্ধ, নির্দিষ্ট একটা তাপমাত্রায় টাটকা দোয়া দুধের সাথে সেলৎজার পানি। ডাক্তার চলে যেতে রোগী কি যেন বললেন ভাইকে, কিন্তু লেভিন শুনতে পেলেন শুধু শেষ শব্দটা : তোর কাতিয়া’, তবে যে দৃষ্টিতে তিনি কিটিকে দেখছিলেন তাতে লেভিন বুঝলেন কিটির প্রশংসা করছেন। কিটি বা তিনি তাকে যা বলে উল্লেখ করেছেন সেই কাতিয়াকেও ডাকলেন তিনি।
বললেন, ‘অনেক ভালো বোধ করছি। আপনি থাকলে সেরে উঠতাম অনেক আগেই। আহ, কি যে ভালো লাগছে! কিটির হাত ধরে তিনি তা টেনে আনলেন ঠেটের কাছে, কিন্তু এটা কিটির ভালো লাগবে না ভেবে শুধু হাত বলাতে লাগলেন। নিজের দুই হাতে হাতখানা নিয়ে কিটি চাপ দিল তাতে।
‘এবার আমাকে বাঁ পাশ ফিরিয়ে শুইয়ে আপনি ঘুমাতে যান’, উনি বললেন।
কি উনি বললেন তা ধরতে পারেনি কেউ, কিন্তু কিটি বুঝেছিল। বুঝেছিল, কেননা কি তাঁর প্রয়োজন সেটা মনে মনে অবিরাম অনুধাবন করে যেত সে।
স্বামীকে সে বলল, ‘ওপাশে, উনি ঘুমোন ওপাশ ফিরে। ওঁকে পাশ ফিরিয়ে দাও, চাকর ঢাকা ভালো দেখাবে না। আমি তো পারব না। আপনি পারবেন?’ মারিয়া নিকোলায়েভনাকে জিজ্ঞেস করল কিটি।
‘ভয় পাচ্ছি আমি’, জবাবে বলল মারিয়া নিকোলায়েভনা।
ভয়াবহ এই দেহটাকে জড়িয়ে ধরা, কম্বলের তলে যে অঙ্গগুলোর কথা ভাবতেই চাইতেন না, তাতে হাত দেওয়া লেভিনের কাছে যত ভয়ংকরই লাগুক, স্ত্রীর প্রভাবে আত্মসমর্পণ করে একটা দৃঢ়তাব্যঞ্জক মুখভাব ফুটিয়ে তুললেন যা স্ত্রীর ভালোই জানা, হাত নামিয়ে কাজে লাগলেন তিনি। নিজের যথেষ্ট শক্তি সত্ত্বেও এই শীর্ণ অঙ্গগুলি এত আশ্চর্য রকমের ভারি দেখে অবাক লাগল তাঁর। বিশাল এক শীর্ণ হাত তাঁর গলা জড়িয়ে ধরেছে এই অনুভূতি নিয়ে তিনি যখন ওঁকে ঘোরাচ্ছিলেন, কিটি ততক্ষণে দ্রুত নিঃশব্দে বালিশ ঠিক করে এগিয়ে দেয় মাথার তলে, আবার রগের সাথে লেপটে যাওয়া তাঁর বিরল চুলগুলোও বিন্যস্ত করে দেয়।
রোগী ভাইয়ের হাত ধরে রেখেছিলেন নিজের হাতে। লেভিন টের পেলেন যে উনি তাঁর হাত নিয়ে কিছু-একটা করতে চান, কোথায় যেন সেটা টানছেন। আড়ষ্ট হাতে ঢিল দিলেন। হ্যাঁ, হাতটা উনি নিজের মুখের কাছে টেনে এনে চুমু খেলেন। ফোঁপানিতে কাঁপতে কাঁপতে, কথা বলার শক্তি হারিয়ে লেভিন বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।
ঊনিশ
‘প্রাজ্ঞদের কাছ থেকে লুকিয়ে রেখে উদ্ঘাটিত করেছে শিশু আর সরলদের কাছে’, সে সন্ধ্যায় স্ত্রীর সাথে কথা বলার সময় কিটি সম্পর্কে এই কথা মনে হচ্ছিল লেভিনের।
বাইবেলের এই উক্তিটা লেভিনের মনে পড়ছিল এই জন্য নয় যে নিজেকে ভিনি প্রাজ্ঞ বলে ভাবতেন। নিজেকে তিনি প্রাজ্ঞ বলে ভাবতেন না, কিন্তু এও তাঁর না জানা থাকার নয় যে তিনি নিজের স্ত্রী আর আগাফিয়া মিখাইলোভনা যা জানেন তার এক শতাংশও তাঁরা জানতেন না। এই দুই নারীর মধ্যে পার্থক্য যতই থাক, আগাফিয়া মিখাইলোভনা আর কাতিয়া-নিকোলাই ভাই তাকে যে নামে ডেকেছিলেন, যে নামে তাকে ডাকতে লেভিনের এখন খুবই ভালো লাগছে, এ ব্যাপারে তাঁরা একেবারে একরকম। দুজনেই নিঃসন্দেহেই জানেন জীবন কি জিনিস, মৃত্যু কি জিনিস। এবং লেভিনের মনে যে সব প্রশ্নের উদয় হয়েছিল, তার কোন উত্তর দিতে না পারলেও, এমন কি প্রশ্নগুলিকেই না বুঝলেও ঘটনাটার তাৎপর্যে দুজনের কোন সন্দেহ নেই এবং তাঁরা শুধু নিজেদের মধ্যে নয়, লক্ষ লক্ষ অন্যান্য লোকের সাথেও তাঁরা জিনিসটা দেখেন একইভাবে। মৃত্যু কি সেটা যে তাঁরা নিঃসন্দেহে বোঝেন এবং ভয় পান না তাতে। লেভিন এবং অন্যান্য অনেকে কিন্তু মৃত্যু সম্পর্কে অনেক কথা বলতে পারলেও স্পষ্টতই সেটা জানেন না, কেননা মৃত্যুকে তাঁরা ভয় পান আর লোকে যখন মরছে তখন কি করা দরকার সেটা বোঝেন না একেবারেই। লেভিন যদি এখন ভাইয়ের কাছে একা থাকতেন, ভাইয়ের দিকে তিনি তাহলে চাইতেন আতংকে এবং আরো বেশি আতংকে প্রতীক্ষা করতেন মৃত্যুর, তা ছাড়া কিছুই করতে পারতেন না।
শুধু তাই নয়, কি বলবেন, কেমন করে তাকাবেন, কিবাবে হাঁটবেন তাও জানা নেই তাঁর। অন্য বিষাদ নিয়ে কথা বলা, তাও চলে না। চুপ করে থাকা—চলে না। ‘চেয়ে দেখব—ও ভাববে আমি ওকে খুঁটিয়ে লক্ষ করছি, ভয় পাচ্ছি; চাইব না–ও ভাববে আমি অন্য চিন্তায় মগ্ন। পা টিপে টিপে হাঁটবও চটে যাবে। পা ফেলে হাঁটব–বিবেকে বাঁধে।’ কিটি কিন্তু স্পষ্টতই নিজের কথা ভাবছিল না, ভাবার সময়ই ছিল না তার; ভাবছিল ওঁর কথা; কিছু সে জানতো বলে সবই উৎরে যেত ভালোই। ওঁর কাছে সে গল্প করে বলতো নিজের কথা, বিয়ের কথা, হাসতো, কষ্ট হত ওঁর জন্য, দরদ দেখাতো, আরোগ্যলাভের ঘটনা শোনাতো, আর সবই উৎরে যেত ভালোই; তাহলে দাঁড়াচ্ছে যে ও জানে। কিটি আর আগাফিয়া মিখাইলোভনার কাজগুলো যে স্বতঃপ্রবৃত্তিবশে নয়, জীবধর্মী নয়, অবিবেচনাপ্রসূত নয়, তার প্রমাণ দৈহিক শুশ্রূষা, যন্ত্রণার লাঘব ছাড়াও আগাফিয়া মিখাইলোভনা আর কিটি, মুমূর্ষুর জন্য দুজনেরই দাবি ছিল দৈহিক পরিস্থিতির সাথে যার কোন মিল নেই। পরলোকগত বুড়োটা প্রসঙ্গে আগাফিয়া মিখাইলোভনা বলেছিলেন : ‘তা সৃষ্টিকর্তার কৃপা, গির্জায় পবিত্র অন্ন-সুরা নিলে, গাত্রলেপন দেওয়া হল, সৃষ্টিকর্তা করুন আমরা সবাই যেন অমনি করে চলে যেত পারি।’ কাতিয়াও ঠিক একইভাবে বিছানাপত্র, শয্যাক্ষত, পানীয় সম্পর্কে সমস্ত যত্ন ছাড়া প্রথম দিনই রোগীকে বোঝাতে পেরেছিল যে অন্ন-সুরা আর গাত্রলেপন দরকার।
রাতে রোগীর কাছ থেকে নিজেদের নেওয়া দুই কামরায় ফিরে লেভিন মাথা নিচু করে বসে রইলেন, ভেবে পাচ্ছিলেন না কি করবেন। রাতের খাবার, রাত যাপনের ব্যবস্থা, কি তাঁরা করবেন সে নিয়ে ভাবার কথা ছেড়ে দিলেও স্ত্রীর সাথেও কথা বলতে পারছিলেন না তিনি; লজ্জা হচ্ছিল তাঁর। পক্ষান্তরে কিটি ছিল সচরাচরের চেয়েও বেশি কর্মচঞ্চল। এমন কি সচরাচরের চেয়েও সজীবই। রাতের খাবার আনতে বলল সে, নিজেই জিনিসপত্র বাছাবাছি করল, নিজেই সাহায্য করল বিছানা পাততে আর তাতে পারস্যীয় পাউডার ছিটাতে ভুলল না। তার মধ্যে ছিল এমন একটা উদ্যম আর চিন্তায় ক্ষিপ্রতা যা পুরুষদের ভেতর জেগে ওঠে লড়াই, সংগ্রামে নামার আগে, জীবনের বিপজ্জনক ও নির্ধারক মুহূর্তগুলোয়, পুরুষ যখন বরাবরের মত দেখিয়ে দেয় তার মূল্য, দেখিয়ে দেয় যে তার গোটা অতীতটা বৃথায় কাটেনি, এই মুহূর্তগুলিরই প্রস্তুতি চলেছিল তখন
কিটির সমস্ত কাজ চলছিল ফুর্তিতে, বারোটা না-বাজতেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, পরিপাটী করে গোছগাছ হয়ে গেল সব জিনিসের, এমন একটা বিশেষ ধরনে যে হোটেলের কামরা হয়ে দাঁড়াল নিজের বাড়ি, কিটির নিজের ঘরখানার মত : বিছানা তৈরি, বুরুশ চিরুনি আয়না সাজানো, ন্যাপকিন পাতা।
লেভিনের মনে হচ্ছিল, খাওয়া, ঘুমানো, এমন কি কথা বলাও এখন অমার্জনীয়, অনুভব করছিলেন যে তাঁর প্রতিটি হাবভাব হবে অশোভন। কিটি কিন্তু তার বুরুশগুলো বাছলে এবং বাছলে এমনভাবে যে মনে আঘাত পাবার মত কিছু রইল না তাতে।
তবে খেতে ওঁরা পারলেন না, অনেকক্ষণ ঘুম আসেনি, এমন কি শুতেও যাননি অনেকক্ষণ।
‘কাল গাত্রলেপনে ওঁকে রাজি করাতে পেরেছি বলে ভারি আনন্দ হচ্ছে আমার’, একটা ব্লাউজ পরে নিজের ভাঁজ করা আয়নাটার কাছে বসে সুরভিত নরম চুলে ঘন ঘন চিরুনি চালাতে চালাতে কিটি বলল, ‘এরকম ক্রিয়াকর্ম আমি কখনো দেখিনি, তবে জানি, মা বলেছেন ওতে আরোগ্যলাভের প্রার্থনা হয়।
‘সত্যিই কি তুমি ভাবছ যে ও সেরে উঠতে পারে’, যতবার কিটি চিরুনি চালাচ্ছিল ততবার তার গোল মাথার পেছন দিকে সরু যে সারিটা অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিল, তার দিকে চেয়ে লেভিন বললেন।
‘আমি ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম : উনি বললেন তিন দিনের বেশি বাঁচা সম্ভব নয়। তবে ওঁরা কি আর সব জেনে ফেলতে পারেন? যাই বলো, ওঁকে বুঝিয়ে রাজি করাতে পেরেছি বলে আমি খুব খুশি’, চুলের তল থেকে কটাক্ষে স্বামীর দিকে চেয়ে বলল কিটি, ‘সবই হতে পারে’, কিটি বলল সেই বিশেষ রকমের, খানিকটা দূর্ত একটা ভাব নিয়ে যা ধর্মের বিষয়ে কথা বলতে গেলে সচরাচর ফুটে উঠত তার মুখে।
যখনও তাঁদের বিয়ে হয়নি তখন ধর্ম নিয়ে একটা আলাপের পর লেভিন বা কিটি কেউ আর ও প্রসঙ্গ কখনো তোলেননি, কিন্তু কিটি গির্জায় যাওয়া, প্রার্থনা করার অনুষ্ঠানগুলো পালন করে এসেছে সব সময় একইরকম এক শান্ত চেতনায় যে ওটা দরকার। লেভিনের বিশ্বাস বিপরীত হলেও কিটির স্থির বিশ্বাস ছিল যে লেভিন তারই মত, বলতে কি তারও চেয়ে ভালো খ্রিস্টান এবং এ নিয়ে যা তিনি বলেছিলেন সেটা তাঁর এক হাস্যকর পুরুষালী চাল, যেমন বিলেতি এম্ব্রয়ডারি সম্পর্কে বলেছিলেন যে সজ্জন লোকের ফুটো রিফু করে থাকে আর কিটি ফুটো করছে ইচ্ছে করে, এই আর কি।
‘এই তো, ওই মেয়েটা, মারিয়া নিকোলায়েভনা এ সব করতে পারেনি’, লেভিন বললেন, ‘আর… স্বীকার করতেই হবে, তুমি যে এসেছ তার জন্য আমার খুব, খুবই আনন্দ হচ্ছে। এত তুমি নির্মল যে…’ কিটির হাতখানা তিনি নিলেন, কিন্তু চুম্বন করলেন না (মৃত্যুর এই সান্নিধ্যে তার হস্তচুম্বন অসভ্যতা বলে মনে হল তাঁর কাছে), শুধু তার জ্বলজ্বলে চোখের দিকে দোষীর মত চেয়ে চাপ দিলেন।
‘একলা তোমার বড় যন্ত্রণা হত’, এই বলে কিটি তৃপ্তিতে রাঙা হয়ে ওঠা গাল ঢেকে হাত উঁচু করে চাঁদির ওপর বেণী ছড়িয়ে খোঁপা বেঁধে কাঁটা গুজতে লাগল তাতে। ‘না—’ বলে চলল কিটি, ‘ও যে জানতো না… সৌভাগ্যের কথা যে আমি অনেককিছু শিখেছি সোডেনে।’
‘সেখানে এমন রোগী ছিল নাকি?’
‘ছিল আরো খারাপ।’
‘তরুণ বয়সে ও যা ছিল সে মূর্তি ভেসে উঠছে আমার চোখের সামনে। বিশ্বাস করবে না কি চমৎকার ছেলে ছিল সে, কিন্তু তখন আমি ওকে বুঝতে পারিনি।’
‘খুবই, খুবই বিশ্বাস করি। আমি বেশ বুঝতে পারছি ওঁর সাথে, কি ভাব হয়ে যেত আমাদের’, কিটি বলল আর যা বলেছে তার জন্য ভয় পেয়ে গেল, স্বামীর দিকে তাকিয়ে চোখ তার পানিতে ভরে উঠল।
‘হ্যাঁ, হতে পারত’, লেভিন বললেন বিষণ্ণ সুরে, ‘এ ঠিক সেই মানুষ যাদের সম্পর্কে লোকে বলে ওনারা এ জগতের জন্য নয়।
‘যাক গে, সামনের দিনগুলোয় অনেক কাজ আছে। শুতে হয়’, নিজের ক্ষুদে ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে কিটি বলল।