পাঁচ
কারেনিন যখন ঢুকলেন, পিটার্সবুর্গের লব্ধপ্রতিষ্ঠ অ্যাডভোকেটের অভ্যর্থনাকক্ষটি ছিল লোকে গিজগিজ 1 তিনজন মহিলা : বৃদ্ধা, যুবতী আর বেনে-বৌ, তিনজন ভদ্রলোক : অঙ্গুরী পরিহিত একজন জার্মান ব্যাংকার, একজন দেড়েল বেনে, তৃতীয় জন গলায় ক্রস ঝোলানো, উর্দি পরা জনৈক আমলা স্পষ্টতই অনেকক্ষণ থেকে অপেক্ষা করছিল। দুজন সহকারী টেবিলের পেছনে বসে খাগের কলম দিয়ে খসখস করে লিখে যাচ্ছিল। লেখার যেসব উপকরণে কারেনিনের বিশেষ আগ্রহ, তা এখানে খুবই ভালো। তিনি সেটা লক্ষ্য না করে পারলেন না। একজন সহকারী উঠে না দাঁড়িয়ে চোখ কুঁচকে কারেনিনকে জিজ্ঞেস করলেন : ‘কি চাই আপনার?’
‘অ্যাডভোকেটের সাথে কাজ আছে।’
‘উনি ব্যস্ত’, কঠোরভাবে জবাব দিয়ে সহকারী কলম দিয়ে অপেক্ষমাণদের দিকে দেখিয়ে লিখে যেতে লাগল। ‘একটু সময় ওঁর হবে না কি?’ বললেন কারেনিন
‘ফাঁকা সময় ওঁর নেই। সব সময় উনি ব্যস্ত, অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ‘
‘তাহলে একটু কষ্ট করে আমার কার্ডটা ওঁকে দেবেন’, অজ্ঞাত থাকা চলবে না দেখে কারেনিন বললেন মর্যাদাভরে।
সহকারী কার্ডটা নিল, স্পষ্টতই বোঝা গেল যে তাতে যা লেখা আছে সেটা তার মনঃপূত নয়। তাহলেও দরজার দিকে গেল সে।
নীতিগতভাবে প্রকাশ্য বিচারের দিকে সহানুভূতি ছিল কারেনিনের কিন্তু আমাদের দেশে তার প্রয়োগের কিছু কিছু খুঁটিনাটিতে উচ্চ পদাধিকারের দিক থেকে তাঁর পুরো সায় ছিল না, তাই তার সমালোচনা করতেন, সর্বোচ্চ কোন সিদ্ধান্তের যতটা সমালোচনা করা তার পক্ষে সম্ভব। তাঁরন সারা জীবন কেটেছে প্রশাসনিক ক্রিয়াকলাপে, তাই কোন কিছুতে তাঁর অনুরাগ না থাকলেও সে বিরাগটা নরম হয়ে আসত তাঁর এই স্বীকৃতিতে যে ভুল করা অনিবার্য এবং যে কোন ব্যাপারেই তা সংশোধন করা সম্ভব। আদালতের নতুন প্রথায় যেসব শর্ত দেওয়া হয়েছে ওকালতির ব্যাপারে, তা তিনি অনুমোদন করতেন না। এ যাবত তাঁকে কখনো ওকালতি ব্যবস্থার দারস্থ অ্যাডভোকেটের অভ্যর্থনাকক্ষ তাঁর ওপর যে বিশ্রী ছাপ ফেলল, তাতে সে অননুমোদন গেল আরো বেড়ে
‘এখনই বেরিয়ে আসবেন’, সহকারী বলল; আর সত্যিই দু’মিনিট বাদে দরজায় দেখা দিল আইনজ্ঞের দীর্ঘ মূর্তি যিনি আলাপ করছিলেন অ্যাডভোকেটের সাথে, তারপর স্বয়ং অ্যাডভোকেট।
অ্যাডভোকেট লোকটা বেঁটে গাঁট্টাগোট্টা, টেকো, মুখে কালচে-পাটকিলে দাড়ি, হালকা রঙের লম্বা ভুরু, টিট কপাল। গলাবন্ধ আর ঘড়ির দুটো চেন থেকে শুরু করে পেটেন্টে-লেদার জুতো পর্যন্ত তাঁর গোটা সাজটা বরের মত। মুখখানা বুদ্ধিমান, চাষী-চাষী কিন্তু পোশাক, সাহেব-সাহেব, রুচিহীন 1
‘আসুন’, বলে, হাঁড়িমুখে কারেনিনকে তাঁর পাশ দিয়ে ঢুকতে দিয়ে অ্যাডভোকেট দরজা বন্ধ করলেন।
কাগজ ছড়ানো ‘লেখার টেবিলের কাছে একটা ইজিচেয়ার দেখিয়ে তিনি বললেন, ‘বসুন না!’ আর নিজে বসলেন কর্তার আসনটায়, ছোট ছোট সাদা লোহ গজানো আঙুল সমেত খাটো হাত দু’খানা ঘষতে ঘষতে, পাশের দিকে মাথা হেলিয়ে। কিন্তু নিজের ভঙ্গিতে সুস্থির হতে না হতেই টেবিলের ওপর দিয়ে উড়ে এল একটা কাপড়-খেকো পোকা। তাঁর পক্ষে যা আশা করা যায় না, এমন একটা ক্ষিপ্রতায় তিনি হাত দিয়ে পোকাটাকে ধরে আবার আগের ভঙ্গিতে ফিরে গেলেন।
‘আমার ব্যাপারটা বলার আগে’, চোখ দিয়ে অ্যাডভোকেটের ক্ষিপ্রতাটা লক্ষ্য করে অবাক হয়ে কারেনিন বললেন, আমার জানিয়ে রাখা দরকার যে, আপনার সাথে যে ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলব, সেটাকে গোপন রাখতে হবে।’
সামান্য লক্ষ্যে পড়ে এমন একটা হাসিতে অ্যাডভোকেটের পাটকিলে গোঁফ ফুলে উঠল।
‘বিশ্বাস করে আমাকে যা বলা হয় তার গোপনীয়তা রক্ষা করতে না পারলে আমি অ্যাডভোকেটই নই। আপনার যদি তার প্রমাণ দরকার হয়…’
তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে কারেনিন লক্ষ্য করলেন যে তাঁর বুদ্ধিমান ধূসর চোখ জোড়া হাসছে যেন সবই তারা জানে।
‘আমার নাম আপনি জানেন কি? বলে চললেন কারেনিন।
‘আপনাকে জানি, সমস্ত রুশীর মত আপনার মূল্যবান ক্রিয়াকলাপের কথাও জানি’, কাপড়-থেকো পোকা ধরে অ্যাডভোকেট বললেন নিচু হয়ে।
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বুক বাঁধতে লাগলেন কারেনিন কিন্তু একবার মনস্থির করার পর না তোতলিয়ে, কয়েকটা শব্দের ওপর বিশেষ জোর দিয়ে, নির্ভয়ে তিনি বলে চললেন তাঁর কিচকিঁচে গলায়। শুরু করলেন, ‘প্রতারিত স্বামী হবার দুর্ভাগ্য হয়েছে আমার এবং আইনত স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে চাই। অর্থাৎ বিবাহবিচ্ছেদ, কিন্তু এমনভাবে যাতে ছেলে মেয়ের কাছে না থাকে।’
অ্যাডভোকেটের ধূসর চোখ চেষ্টা করল না হাসতে কিন্তু অদম্য আনন্দে তা নাচছিল এবং কারেনিনের মনে হল ব্যাপারটা শুধুই মোটা একটা ফি পাবার আনন্দই নয়, আছে তাতে জয়চেতনা, উল্লাস, স্ত্রীর চোখে যে বিদ্বেষপূর্ণ ঝিলিক তিনি দেখেছেন, আছে তেমন একটা ঝিলিক 1
‘বিবাহবিচ্ছেদের জন্যে আমার সহযোগিতা আপনি চান?’
‘হ্যাঁ, ঠিক তাই, কিন্তু আপনাকে বলে রাখা উচিত যে এতে আপনার মনোযোগের অব্যবহার করার ভয় থাকছে আমার। আমি এসেছি শুধু আপনার সাথে প্রাথমিক একটা পরামর্শের জন্যে। বিবাহবিচ্ছেদ আমি চাই, কিন্তু কি কি উপায়ে সেটা সম্ভব তা আমার গুরুত্বপূর্ণ। উপায়গুলো যদি আমার প্রয়োজনের সাথে না মেলে, তাহলে খুব সম্ভব আমি আইনের আশ্রয় নিতে অস্বীকৃত হব।’
‘ও, সে তো সব সময়ই তাই’, অ্যাডভোকেট বললেন, ‘সব সময়ই সেটা আপনার ইচ্ছাধীন।’
অ্যাডভোকেট চোখ নামালেন কারেনিনের পায়ের দিকে, টের পাচ্ছিলেন যে নিজের অসংযত আনন্দ দেখিয়ে তিনি আহত করতে পারেন মক্কেলকে। নাকের সামনে উড়ে-আসা আরেকটা পোকার দিকে চাইলেন তিনি, হাত তাঁর ঝটকা দিয়ে উঠল, কিন্তু কারেনিনের অবস্থাটার প্রতি সম্মানবশত ধরলেন না সেটাকে।
‘এ ব্যাপারে আমাদের আইনে বিধি আমার মোটামুটি জানা থাকলেও’, কারেনিন বলে চললেন, ‘আমি সাধারণভাবে জানতে চাই, কার্যক্ষেত্রে এ ধরনের ব্যাপার চলে কিভাবে?’
‘আপনি চাইছেন যে’, চোখ না তুলে, কিছুটা তুষ্টি নিয়েই মক্কেলের কথার সুরে সুর মিলিয়ে অ্যাডভোকেট জবাব দিলেন, ‘কি কি উপায়ে আপনার ইচ্ছা পূরণ হতে পারে তা আপনাকে আমি বলি?’
কারেনিনের সম্মতিসূচক মাথা-নাড়া পেয়ে শুধু মাঝে মাঝে তাঁর লাল ছোপে ভরে ওঠা মুখের দিকে চকিত দৃষ্টিপাত করে অ্যাডভোকেট কথা চালিয়ে গেলেন।
আমাদের আইনের প্রতি তাঁর অনুমোদনের সামান্য আভাস দিয়ে তিনি বললেন, ‘আমাদের আইনে বিবাহবিচ্ছেদ সম্ভব, যা আপনি জানেন, নিম্নোক্ত ক্ষেত্রে…অপেক্ষা করুন!’ দরজায় উঁকি দেওয়া সহকারীকে বললেন তিনি, তাহলেও উঠে দাঁড়িয়ে কয়েকটা কথা বলে আবার বসলেন, ‘সম্ভব এই-এই ক্ষেত্রেঃ দম্পতিদের দৈহিক অক্ষমতা, সংবাদ না দিয়ে পাঁচ বছরের বিচ্ছেদ’, বলছিলেন তিনি লোমে ভরা নিজের খাটো আঙুল মুড়ে, ‘তারপর ব্যভিচার’ (কথাটা তিনি উচ্চারণ করলেন সুস্পষ্ট তৃপ্তির সাথে)। ‘উপবিভাগগুলো এই রকম’ (মোটা মোটা আঙুলগুলো মুড়ে চললেন তিনি, যদিও ঘটনা এবং উপবিভাগগুলোকে স্পষ্টতই একসাথে শ্রেণীবদ্ধ করা যায় না) : ‘স্বামী বা স্ত্রীর দৈহিক অক্ষমতা, তারপর স্বামী বা স্ত্রীর দিক থেকে ব্যভিচার।’ সমস্ত আঙুলগুলো মোড়া শেষ হয়ে যাওয়ায় উনি আবার সেগুলো সোজা করে নিলেন এবং বলে চললেন : ‘এগুলো হল তাত্ত্বিক দিক থেকে। কিন্তু আমি অনুমান করি, আপনি আমার কাছে এসে আমাকে সম্মান দেখিয়েছেন ব্যবহারিক ব্যাপারটা জানাবার জন্যে। তাই আগেকার নজিরগুলো থেকে আপনাকে আমার জানানো উচিত যে বিবাহবিচ্ছেদের সমস্ত ঘটনাই দাঁড়ায় এই : দৈহিক অক্ষমতা নেই, যা আমি বুঝছি? খবর না দিয়ে অনুপস্থিতিও?…’
সায় দিয়ে মাথা নাড়লেন কারেনিন।
‘তাহলে আসছে এটা : দম্পতিদের একজনের ব্যভিচার এবং পরস্পরের সম্মতিক্রমে তা প্রকাশ, আর সে রকম সম্মতি না থাকলে জোর করে তা প্রকাশ। বলা উচিত যে, শেষোক্ত ব্যাপারটা বাস্তবে দেখা যায় কম’, বলে অ্যাডভোকেট চকিতে দৃষ্টিপাত করলেন কারেনিনের দিকে, তারপর চুপ করে রইলেন, যেভাবে পিস্তল-বিক্রেতা দুটো অস্ত্রের গুণ বর্ণনা করে খরিদ্দারের পছন্দের প্রতীক্ষায় থাকে। কিন্তু কারেনিন কিছু বললেন না, তাই অ্যাডভোকেট আবার শুরু করলেন, ‘সবচেয়ে সাধারণ, সহজ এবং আমি মনে করি বিচক্ষণ হল পরস্পরের সম্মতিক্রমে ব্যভিচার। কোন অপরিণত লোক হলে আমি কথাটা এভাবে বলতাম না’, অ্যাডভোকেট বললেন, ‘কিন্তু আশা করি, আমাদের কাছে এটা বোধগম্য।‘
কারেনিন কিন্তু এতই হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন যে পরস্পরের সম্মতিক্রম ব্যভিচারের বিচক্ষণতা তখনই বুঝে উঠতে পারলেন না, সে না-বোঝাটা প্রকাশ পেল তাঁর দৃষ্টিতে; তবে অ্যাডভোকেট সাথে সাথেই সাহায্য করলেন তাঁকে : ‘দুজনে আর একসাথে থাকতে পারছে না-এই হল গে ঘটনা। আর দুজনেই যদি সেটা মেনে নেয়, তাহলে খুঁটিনাটি ও আনুষ্ঠানিকভাবে দিকগুলো হয়ে দাঁড়ায় অচিঞ্চিৎকার। সেই সাথে এটা হল সবচেয়ে সহজ আর সঠিক উপায়।
কারেনিন এবার পুরোপুরি বুঝলেন। কিন্তু এ ব্যবস্থা গ্রহণে বাধা দিচ্ছিল তাঁর ধর্মীয় সংস্কার। বললেন, ‘বর্তমান ক্ষেত্রে এ প্রশ্ন আসে না। এক্ষেত্রে শুধু একটা ব্যাপারেই সম্ভব : ইচ্ছার বিরুদ্ধেই প্রকাশ করে দেওয়া, আমার কাছে যে চিঠি আছে তাতে তা প্রমাণিত হবে।’
চিঠির উল্লেখ অ্যাডভোকেট ঠোঁট চেপে অস্ফুট শব্দ করলেন যাতে প্রকাশ পেল একই সাথে সমবেদনা আর অবজ্ঞা।
শুরু করলেন, ‘দেখুন, এ ধরনের ব্যাপারের নিষ্পত্তি করে ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ, যা আপনি জানেন। আর পাদ্রীরা, স্বামীরা এ সব ব্যাপারের তুচ্ছ খুঁটিনাটিও ঘাঁটাঘাঁটি করতে খুব ভালোবাসেন’, হেসে বললেন উনি, তাতে ফুটে উঠল পাদ্রীদের রুচির সাথে তাঁর সহমর্মিতা, ‘চিঠি অংশত প্রমাণ করতে পারে তাতে সন্দেহ নেই; কিন্তু ব্যাপারটা ফাঁস করতে হবে সরাসরি উপায়ে, অর্থাৎ সাক্ষী মারফত। আপনি যদি আমার ওপর আস্থা রাখার সম্মান আমাকে দেন, তাহলে কি কি ব্যবস্থা নেওয়া উচিত তা নির্বাচনের ভার আমাকে দিন। যে ফল পেতে চায় তাকে উপায়টাও মেনে নিতে হবে।’
‘যদি তাই হয়…’, হঠাৎ বিবর্ণ হয়ে শুরু করলেন কারেনিন, কিন্তু এই সময় অ্যাডভোকেট উঠে পড়লেন, গেলেন আবার দুয়ারে দেখা দেওয়া সহকারীর কাছে।
‘ভদ্রমহিলাকে বলে দিন যে আমরা খেলো মালের ব্যাপারী নই’, এই বলে তিনি ফিরে এলেন কারেনিনের কাছে। স্বস্থানে এসে তিনি চুপিসারে আরেকটা পোকা ধরলেন, ভুরু কুঁচকে ভাবলেন, ‘গ্রীষ্ম নাগাদ আমার রেপ্স কাপড়ে বাঁধানো আসবাবগুলোর দশা ভালোই দাঁড়াবে।’
বললেন, ‘তাহলে বলুন কি বলছিলেন…’
‘আমার সিদ্ধান্ত আমি আপনাকে লিখে জানাব’, উঠে দাঁড়িয়ে কারেনিন টেবিলে ভয় দিলেন; কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে বললেন, ‘আপনার কথা থেকে তাহলে আমি ধরে নিতে পারি যে বিবাহবিচ্ছেদ পাওয়া সম্ভব। সেইসাথে অনুরোধ, আপনার ফি কত সেটা জানাবেন। ‘
‘সবই সম্ভব যদি আমার বুদ্ধিমত আমি যে ব্যবস্থাই নিই তার স্বাধীনতা দেন আমাকে’, প্রশ্নের জবাব না দিয়ে অ্যাডভোকেট বললেন, ‘কবে আপনার চিঠি পাওয়ার আশা করতে পারি?’ চোখ আর পেটেন্ট-লেদার বুট ঝকঝকিয়ে দরজার দিকে এগুতে এগুতে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
‘এক সপ্তাহের মধ্যে। আর এ ব্যাপারটায় তদবির করার ভার আপনি নিচ্ছেন কিনা এবং এ উপকারের জন্যে কত ফি লাগবে সেটা আমাকে জানাবেন।’
‘তা বেশ।’
অ্যাডভোকেট সসম্ভ্রমে মাথা নোয়ালেন, মক্কেলের জন্য দরজা খুলে দিলেন। তারপর একা হতে আনন্দে গা ভাসালেন। এত খুশি হয়েছিলেন যে তাঁর নিয়মের বিরুদ্ধেই দরাদরি-করা মহিলাটিকে ছাড় দিলেন এবং থামালেন পোকা ধরা, একেবারে স্থির করে ফেললেন যে সামনের শীত নাগাদ সিগোনিনের মত আসবাবগুলো মখমলে বাঁধাই করে ফেলবেন।
ছয়
আগস্ট মাসের ১৭ তারিখে কমিশনের অধিবেশনে চমকপ্রদ বিজয় হয়েছিল কারেনিন কারেনিনের। কিন্তু সে বিজয়ের পরিণাম তাঁকে ল্যাঙ মারে। অরুশ জাতিদের জীবনযাত্রা সব দিক থেকে পর্যালোচনার জন্য নতুন কমিশন গঠন করে অসাধারণ দ্রুত ও উদ্যোগসহকারে তা যথাস্থানে পাঠিয়েছিলেন কারেনিন। রিপোর্ট পেশ করা হল তিন মাসের মধ্যে। অরুশদের জীবনযাত্রা বিচার করা হয়েছে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, নরকৌলিক, বৈষয়িক ও ধর্মীয় দিক থেকে। সমস্ত প্রশ্নেই উত্তর উপস্থাপিত হয়েছে চমৎকার, আর সে উত্তরে সন্দেহের অবকাশ নেই। কেননা রিপোর্ট রচিত হয়েছে সব সময় প্রমাদপ্রবণ মনুষ্যমস্তিষ্ক দ্বারা নয়, তা রচিত হয়েছে সরকারী ক্রিয়াকলাপ থেকে। সমস্ত রিপোর্টই হল সরকারী এবং রাজ্যপাল ও বিশপের রিপোর্টের ফল। যার ভিত্তি হল উয়েজ্দ শাসক ও রাজপুরুষদের রিপোর্ট, তারও আবার ভিত্তি ভলোত্ শাসন দপ্তর আর স্থানীয় পাদ্রীর রিপোর্ট; সুতরাং এ সবই উত্তর সন্দেহাতীত। দৃষ্টান্তস্বরূপ সরকারী যন্ত্রের সুবিধা ছাড়া কেন মাঝে মাঝে ফলন কমে, কেন অধিবাসীরা নিজেদের ধর্মবিশ্বাস আঁকড়ে থাকে ইত্যাদি যেসব প্রশ্নের যুগ যুগ ধরে সমাধান হয় না, হতে পারে না, তার পরিষ্কার, সন্দেহাতীত সমাধান পাওয়া গেছে। আর সে সিদ্ধান্ত হয়েছে কারেনিনের মতামতের অনুকূলে। কিন্তু স্ত্রেমভ, গত অধিবেশনে যিনি ভয়ানক মার খেয়েছেন বলে, অনুভব করছিলেন, তিনি হঠাৎ এমন একটা কৌশল অবলম্বন করলেন যা কারেনিনের কাছে অপ্রত্যাশিত। অন্য কতকগুলো সদস্যকে পেছনে টেনে স্ত্রেমভ হঠাৎ চলে এলেন কারেনিনের পক্ষে এবং কার্যকরী করার জন্য কারেননি যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন তার প্রচণ্ড সমর্থন করলেন শুধু তাই নয়, একই প্রেরণায় অন্যান্য সব চরমপন্থী প্রস্তাবও পেশ করলেন। কারেনিনের যা মূল ভাবনা ছিল তার বিপরীতে আরো জোরদার করা এসব ব্যবস্থা গৃহীত হয় এবং তখন প্রকাশ পেল স্ত্রেমভের কারসাজি। একেবারে চূড়ান্ত টেনে নিয়ে যাওয়া এসব ব্যবস্থা হঠাৎ দেখা গেল এমনই গবেট যে একই কালে রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা, সমাজসেবক, বুদ্ধিমতী মহিলা তার সংবাদপত্র-সবাই একসাথে আক্রমণ করল ব্যবস্থাগুলোকে এবং তার স্বীকৃত জনক কারেনিনের বিরুদ্ধে প্রকাশ করল তাদের ক্রোধ। প্ৰেমভ কিন্তু সরে রইলেন, ভাব দেখালেন যেন কারেনিনের পরিকল্পনা তিনি অনুসরণ করেছেন অন্ধের মত, যা করা হয়েছে তাতে নিজেই এখন তিনি বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ। ল্যাঙ খেলেন কারেনিন। কিন্তু ক্ষীয়মাণ স্বাস্থ্য ও পারিবারিক অশান্তি সত্ত্বেও কারেনিন হার মানলেন না। দ্বিধাবিভক্ত হল কমিশন। প্রেমভের নেতৃত্বে একদল সদস্য নিজেদের ভুলের এই কৈফিয়ত দিল যে কারেনিন পরিচালিত রিভিজরী কমিশনের রিপোর্ট তারা বিশ্বাস করেছিল এবং বলল যে রিপোর্টটা একেবারে বাজে, শুধু একটা চোতা কাগজ। কারেনিন এবং আরেক দল লোক কাগজের প্রতি এইরূপ বৈপ্লবিক মনোভাবের বিপজ্জনকতা লক্ষ্য করে রিভিজরী কমিশন রচিত তথ্যগুলো সমর্থন করে চললেন। এর ফলে রাষ্ট্রের উঁচু মহলে এমন কি সমাজেও সবাই গোলমালে পড়লেন এবং ব্যাপারটায় সকলের খুবই আগ্রহ থাকলেও কেউ বুঝতে পারলেন না অরুশ লোকেরা সত্যি কি দারিদ্র্যে ভুগছে আর ধ্বংস পাচ্ছে নাকি শ্রীবৃদ্ধি হচ্ছে তাদের। এর পরিণামে এবং অংশত স্ত্রীর বিশ্বাসঘাতকতার জন্য তাঁর প্রতি একটা অবজ্ঞার ফলে কারেনিনের অবস্থা হয়ে দাঁড়াল খুবই টলমলে। এই অবস্থায় একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। কমিশনকে অবাক করে তিনি ঘোষণা করলেন যে সমীক্ষার জন্য তিনি নিজে অত্যন্ত অঞ্চরে যাবার অনুমতি চাইবেন। এবং অনুমতি পেয়ে তিনি যাত্রা করলেন দূরের গুবেনির্য়াগুলোয়।
কারেনিনের যাত্রাটা খুবই সোরগোল তুলল আরো এই জন্য যে নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে যাবার জন্য বারোটা ঘোড়া ভাড়ার যে টাকা তাঁকে দেওয়া হয়েছিল যাত্রার ঠিক আগে, সরকারীভাবে সে টাকা তিনি ফেরত দেন।
এই প্রসঙ্গে প্রিন্সেস মিয়াগ্কায়াকে বেত্সি বললেন, ‘আমি এটাকে খুবই মহৎ কাজ বলে মনে করি। কেন ডাক- ঘোড়ার জন্যে ভাতা দেওয়া যখন সবাই জানে যে লোকে আজকাল সর্বত্র যাচ্ছে রেলে।’
প্রিন্সেস মিয়াকায়া মানলেন না, বেত্সির মতে তিনি বিরক্তই হলেন। বললেন, ‘ও কথা বলা আপনার পক্ষে সোজা—যখন লাখ লাখ টাকা আছে আপনার, জানি না কত? তবে আমার স্বামী যখন গ্রীষ্মকালে পরিদর্শনে যায় তখন আমার খুবই ভালো লাগে। ওর কাছেও সফরটা স্বাস্থ্যকর এবং উপাদেয় আর ওই টাকায় আমিও গাড়ি আর কোচোয়ান রাখতে পারি।’
দূরের গুবের্নিাগুলোয় যাবার পথে কারেনিন তিন দিন রইলেন মস্কোয়।
আসার পরের দিন তিনি দেখা করতে গেলেন বড়লাটের সাথে। ফেরার পথে জাগেনি গলির মোড়ে সব সময় যেখানে গাড়ি আর গাড়োয়ানের ভিড় জমে যায, সেখানে হঠাৎ এত সোল্লাসে উচ্চৈস্বরে তাঁর নাম ধরে ডাক শুনলেন যে ফিরে না তাকিয়ে পারলেন না। ফুটপাতের কোণে ফ্যাশনদুরস্ত ছোট কোটে আর ফ্যাশনদুরস্ত ছোট টুপি বাঁকা করে পরে অব্লোন্স্কি দাঁড়িয়ে ছিলেন হাসিমুখে, লাল ঠোঁটের ফাঁকে ঝলমল করছে সাদা দাঁত, আনন্দ তাঁর ধরছে না, যৌবনে দীপ্তিমান, দৃঢ়ভাবে নাছোড়বান্দার মত চেঁচিয়ে তাঁকে বলছেন থামতে। মোড়ে থেমে থাকা একটা গাড়ি জানালা এক হাতে ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। যার ভেতর থেকে মুখ বাড়িয়ে ছিল মখমলে টুপি পরা একটা মহিলা আর দুটো শিশুর মাথা, অন্য হাতে তিনি জামাতাকে হাতছানি দিচ্ছিলেন হেসে। মহিলাটিও দরাজ হাসিমুখে হাত নাড়লেন কারেনিনের উদ্দেশে। উনি হলেন সন্তান ডল্লি।
মস্কোয় কারো সাথে দেখা করার ইচ্ছে ছিল না কারেনিনের, স্ত্রীর ভাইয়ের সাথে তো একেবারেই নয়। টুপি তুলে সৌজন্যটুকু দেখিযে তিনি এগিয়ে যেতে চাইছিলেন কিন্তু অব্লোন্স্কি তাঁর কোচোয়ানকে থামতে বলে বরফের ওপর দিয়ে ছুটে গেলেন তাঁর কাছে।
‘খবর না দেওয়াটুকুও মহা অপরাধ হত বুঝি! কবে এলে? কাল আমি গিয়েছিলাম দ্যুসো হোটেলে, আবাসীদের নামের বোর্ডে দেখি লেখা ‘কারেনিন’। একেবারে খেয়ালই হয়নি যে ওটা তুমি!’ গাড়ির জানালায় মাথা গলিয়ে বললেন অব্লোন্স্কি, ‘নইলে তখনই যেতাম। তোমাকে দেখে কি যে আনন্দ হচ্ছে!’ তুষারকণা ঝেড়ে ফেলার জন্য পায়ে পা ঠুকে বললেন তিনি, পুনরুক্তি করলেন, ‘কি মহাপাপ, খবরটুকুও না দেওয়া!’
‘সময় ছিল না, বড় ব্যস্ত’, শুকনো গলায় বললেন কারেনিন।
‘চল, আমার স্ত্রীর কাছে, তোমাকে সে খুবই দেখতে চায়।’
যে কম্বলটায় কারেনিনের শীতার্ত পা জড়ানো ছিল সেটা খুলে গাড়ি থেকে নেমে তুষারপাতের মধ্যে দিয়ে তিনি গেলেন দারিয়ার আলেক্সান্দ্রভনার কাছে।
‘কি ব্যাপার কারেনিন। আমাদের এড়িয়ে এড়িয়ে যাচ্ছেন কেন?’ হেসে ডল্লি বললেন।
‘বড় ব্যস্ত ছিলাম। খুব খুশি হলাম আপনাকে দেখে’, বললেন এমন সুরে যাতে পরিষ্কার বোঝা গেল এতে তিনি অখুশি, ‘কেমন আছেন?
‘আমাদের আন্না বোনটির খবর কি?’
কারেনিন কি একটা গুঁইগুঁই করে বলে চলে যেতে চাইছিলেন, কিন্তু অব্লোন্স্কি থামালেন তাঁকে।
‘শোনো কাল আমরা কি করব। ডল্লি, কাল খেতে ডাকো ওকে! কজ্নিশেভ আর পেস্তসোভকেও ডাকব, যাতে মস্কো বুদ্ধিজীবীদের কিছু স্বাদ ও পায়।’
‘আসুন দয়া করে’, ডল্লি বললেন, ‘আমরা আপনার অপেক্ষায় থাকব পাঁচটায়, যদি চান ছ’টাতে। তা, আন্না বোনটি কেমন আছে? কতদিন যে…’
‘ভালো আছে’, মুখ কুঁচকে গুঁইগুঁই করলেন কারেনিন, ‘খুব খুশি হলাম!’ নিজের গাড়ির দিকে গেলেন তিনি।
‘আসবেন তো? চেঁচিয়ে ডল্লি জিজ্ঞেস করলেন।
কি একটা বললেন কারেনিন, চলন্ত গাড়ি ঘোড়ার শব্দে সেটা ডল্লি ভালো শুনতে পেলেন না।
‘আমি কাল যাব তোমার কাছে!’ তাঁর উদ্দেশে চেঁচিয়ে বললেন অব্লোনস্কি।
গাড়িতে উঠে কারেনিন এমন সেঁধিয়ে বসলেন যাতে তিনি ওঁদের না দেখেন, তাঁকেও ওঁরা দেখতে না পায়।
‘একেবারে বিদঘুটে!’ স্ত্রীকে বললেন অব্লোন্স্কি, তারপর ঘড়ি দেখে মুখের কাছে হাত দিয়ে স্ত্রী এবং সন্তানদের প্রতি স্নেহজ্ঞাপক ভঙ্গি ছুঁড়ে চটপটিয়ে চলে গেলেন ফুটপাত দিয়ে।
‘স্তিভা! স্তিভা!’ লাল হয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন ডল্লি।
তিনি ঘুরে দাঁড়ালেন।
‘আমাকে যে গ্রিশা আর তানিয়ার জন্যে ওভারকোট কিনতে হবে। টাকা দাও তার জন্যে!’
‘ও কিছু না, বলে দিয়ো যে আমি পরে দামটা দিয়ে দেব’, পরিচিত একজনের উদ্দেশে ফুর্তিতে মাথা নেড়ে উধাও হয়ে গেলেন তিনি।
সাত
পরের দিন রবিবার। ব্যালের মহলায় অব্লোন্স্কি গেলেন বলশয় থিয়েটারে এবং তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় সদ্য অবতীর্ণ সুন্দরী নর্তকি মাশা চিবিসোেভাকে দিলেন গতকালকার প্রতিশ্রুতি প্রবাল নেকলেস এবং যবনিকার অন্তরালে দিনের অন্ধকারে উপহার পেয়ে জ্বলজ্বল করে ওঠা মধুর মুখখানায় একটা চুমু এঁকে দেবারও সুযোগ করে নিলেন তিনি প্রবাল নেকলেস দেওয়া ছাড়াও ব্যালের পর দেখা করা নিয়ে কথা বলে নেবারও প্রয়োজন ছিল। ব্যালের শুরুতে উপস্থিত থাকা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়, এই, কথা জানিয়ে তিনি প্রতিশ্রুতি দিলেন যে শেষ অংকে আসবেন এবং ওকে নিয়ে যাবেন নৈশাহারে। থিয়েটার থেকে অব্লোন্স্কি গেলেন অখোৎনি রিয়াদ-এ, ডিনারের জন্য মাছ আর অ্যাসপারাগাস বাছলেন নিজেই এবং বারোটার সময় পৌঁছলেন দ্যুসো হোটেলে, সেখানে তিনজনের সাথে তাঁর দেখা করার দরকার ছিল, সৌভাগ্যবশত তিনজনেই উঠেছেন একই হোটেলে : তাঁদের একজন হলেন লেভিন, সম্প্রতি তিনি ফিরছেন বিদেশ থেকে, অন্যজন তাঁর নতুন অধিকর্তা, এই উচ্চ পদে তিনি সবে অধিষ্ঠিত হয়েছেন, মস্কোয় এসেছেন পরিবর্তন, আর রয়েছেন জামাতা কারেনিন, অবশ্য-অবশ্যই তাঁকে বাড়িতে নিয়ে যেহেত হবে ডিনারের।
অব্লোন্স্কি নিজে খেতে ভালোবাসেন, তবে আরো বেশি ভালোবাসেন অন্যকে খাওয়াতে, পার্টি হবে ছোট, কিন্তু আহার্য, পানীয় ও আমন্ত্রিত নির্বাচনে উপাদেয়। সেদিনকার ডিনারের কর্মসূচিটা তাঁর খুব মনে ধরেছে : থাকবে টাটকা পার্চ মাছ আর অ্যাসপারাগাস এবং প্রধান খাদ্য হবে অপূর্ব কিন্তু সাধারণ রোস্ট বীফ এবং যথাযোগ্য মদ : এই গেল খাদ্য আর পানীয়ের ব্যাপার। অতিথিদের মধ্যে থাকবে কিটি আর লেভিন এবং জিনিসটা যাতে দৃষ্টিকটু না লাগে সে জন্য ডাকা হয়েছে এক খালাতো বোন আর তরুণ শ্যেরবাৎস্কিকে, অতিথিদের মধ্যে প্রধান খাদ্য হবে কজ্নিশেভ সের্গেই এবং কারেনিন। কজ্নিশেভ-মস্কোওয়ালা, দার্শনিক, কারেনিন-পিটার্সবুর্গী, জাগতিক। হ্যাঁ, আরও ডাকবেন বিখ্যাত বাতিকগ্রস্ত উৎসাহী পেস্তসোভকে যিনি একাধারে উদারনীতিক, বাপ্রিয়, সুরকার, ঐতিহাসিক ও সুমিষ্ট পঞ্চাশ-বছুরে এক কিশোর, যিনি কজ্নিশেভ ও কারেনিনের চাটনি বা সসের কাজ করবেন। তিনি ওঁদের চটাবেন আর লেলিয়ে দেবেন পরস্পরের বিরুদ্ধে
বন বিক্রির টাকার দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়া গেছে, এখনো তা খরচ হয়ে যায়নি। ডল্লি ইদানীং খুব ভালো, মিষ্টি ব্যবহার করছেন, ডিনার পার্টির আইডিয়াটায় সব দিক থেকেই খুশি লাগছিল অব্লোন্স্কির। খুবই শরীফ তাঁর মেজাজ। শুধু দুটো ব্যাপার কিছুটা অপ্রীতিকর, কিন্তু অব্লোন্স্কির চিত্তভরপুর-করা উদার ফুর্তির সাগরে দুটো ব্যাপারই তলিয়ে গেছে। ব্যাপার দুটো হল : প্রথম, গতকাল রাস্তায় কারেনিনের সাথে সাক্ষাৎ হয়ে যাবার সময় উনি লক্ষ্য করেছিলেন যে ভদ্রলোক তাঁর প্রতি শুষ্ক ও কঠোর, তাঁর এই মুখভাব এবং মস্কোয় এসে তিনি যে তাঁর কাছে যাননি, আত্মগোপন করে থেকেছেন, তার সাথে আন্না আর ভ্রন্স্কিকে নিয়ে যেসব কথা তাঁর কানে এসেছে তা মিলিয়ে অব্লোন্স্কি অনুমান করলেন যে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কিছু একটা নটখট বেঁধেছে।
এই হল একটা অপ্রীতিকর ব্যাপার। খানিকটা অপ্রীতিকর দ্বিতীয় ব্যাপারটা হল এই যে, সমস্ত নতুন অধিকর্তার মত এই নতুন অধিকর্তাটিরও ভয়ংকর লোক বলে নামডাক আছে যিনি শয্যা ত্যাগ করেন সকাল ছ’টায়, ঘোড়ার মত খাটেন এবং একই রকম খাটুনি দাবি করেন অধীনস্থদের কাছ থেকে। তাছাড়া লোকজনের সাথে আচার-ব্যবহার ভল্লুক বলে নতুন অধিকর্তাটির খ্যাতি আছে। আগের কর্তা যে ধারা অনুসরণ করতেন এবং আজ পর্যন্ত অব্লোন্স্কি যে ধারা অনুসরণ করে আসছেন, শোন যার এঁর ধারাটি ঠিক তার বিপরীত। আগের দিন অব্লোন্স্কি অফিসে এসেছিলেন উর্দি পরে এবং নতুন অধিকর্তা তাঁর প্রতি খুবই সৌজন্য প্রকাশ করেন, কথা বলেন পরিচিতের মত; সেই জন্য ফ্রককোট পরে তাঁকে দেখতে যাওয়া কর্তব্য বলে গণ্য করেছিলেন অব্লোন্স্কি। নতুন অধিকর্তা তাঁকে ভালোবাসা গ্রহণ নাও করতে পারেন—এই ভাবনাটা হল আরেকটা বিছছিরি ব্যাপার, কিন্তু স্বতঃপ্রবৃত্তিতে অব্লোন্স্কি অনুভব করছিলেন গিয়ে পাপী। কেন চটাচটি-ঝগড়াঝাঁটি করা?’ হোটেলে ঢুকতে ঢুকতে ভাবছিলেন তিনি।
‘এই যে ভাসিলি’, বাঁকা করে টুপি পরে করিডর দিয়ে যেতে যেতে পরিচিত এক চারপাশিকে বললেন তিনি। ‘গালপাট্টা রাখতে শুরু করেছ দেখছি। লেভিন—সাত নম্বর কামরায়, তাই না? আমাকে নিয়ে চল না। আর হ্যাঁ, জেনে এসো তো, কাউন্ট আনিচ্কিনের’ (ইনিই নতুন অধিকর্তা) ‘সাথে দেখা করা চলবে কিনা।’
‘জ্বি আচ্ছা’, হেসে জবাব দিলে ভাসিলি, ‘অনেকদিন আমাদের এখানে আসেননি।’
‘কাল এসেছিলাম, তবে অন্য প্রবেশপথ দিয়ে। এটা সাত নম্বর?’
অব্লোন্স্কি যখন ভেতরে ঢুকলেন, লেভিন তখন ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ভের গুবের্নিয়ার এক চাষীর সাথে মাপকাঠি দিয়ে টাটকা মারা একটা ভালুকের চামড়া মাপছিলেন।
‘ওহো মেরেছ?’ চেঁচিয়ে উঠলেন অব্লোন্স্কি, ‘খাসা চীজ! মাদী ভালুক?…
চাষীর করমর্দন করে ওভারকোট টুপি না খুলে চেয়ারে বসলেন তিনি।
‘আরে ওগুলো ছাড়ো-না, বসো’, ওঁর মাথা থেকে টুপি খুলতে খুলতে লেভিন বললেন।
‘না, সময় নেই আমার। এসেছি এক সেকেন্ডের জন্যে’, জবাব দিলেন অব্লোন্স্কি। ওভারকোটের বোতাম খুললেন তিনি, তারপর কোটটাই খুলে ফেললেন এবং শিকার নিয়ে আর অতি অঙ্গরঙ্গ সব বিষয় নিয়ে গল্প করে কাটালেন ঝাড়া এক ঘণ্টা।
‘তা বল তো, কি তুমি করলে বিদেশে? কোথায় গিয়েছিলে?’ চাষী বেরিয়ে যেতে বললেন অব্লোন্স্কি। ‘গিয়েছিলাম জার্মানিতে, প্রাশিয়ায়, ফ্রান্সে, ইংলন্ডে, তবে রাজধানীগুলোয় নয়, ফ্যাক্টরি-শহরগুলোতে, নতুন অনেক কিছু দেখা গেল। গিয়ে আনন্দই হচ্ছে।’
‘হ্যাঁ, শ্রমিকদের সংগঠন নিয়ে তোমার ধারণাটা জানা আছে আমার।’
‘মোটেই না : রাশিয়ায় শ্রমিকের প্রশ্ন উঠতেই পারে না। রাশিয়ায় প্রশ্নটা হল জমির সাথে শ্রমজীবী মানুষের সম্পর্ক নিয়ে। ও প্রশ্নটা ওখানেও আছে, তবে ওটা হল যা নষ্ট হয়েছে তার মেরামতি নিয়ে কিন্তু আমাদের এখানে…’
অব্লোন্স্কি মন দিয়ে লেভিনের কথা শুনছিলেন। বললেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, খুব সম্ভব তোমার কথাই ঠিক।’ যোগ করলেন, ‘কিন্তু তুমি বেশ খোশ মেজাজে আছ দেখে আনন্দ হচ্ছে; ভালুক শিকারেও যাচ্ছ, আবার কাজও করছ, মেতে থাকছ। অথচ শ্যেরবাৎস্কি আমাকে বলেছিল, তোমার সাথে দেখা হয়েছিল ওর—তুমি নাকি মনমরা হয়ে আছে, মৃত্যুর কথা বলছ…’
‘তা মরণের ভাবনা করা আমার বন্ধ হবে না’, লেভিন বললেন, সত্যি, মরার সময় হয়েছে। আর বাকি সব একেবারে বাজে। আমি তোমাকে সত্যি কথাই বলছি : আমার ভাবনাগুলোকে, আমার কাজকে মূল্য দিই আমি; কিন্তু আসলে—তুমি ভেবে দ্যাখো : আমাদের এই গোটা দুনিয়াটা হল ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র গ্রহের ওপর গজিয়ে ওঠা ছত্রাক। অথচ আমরা ভাবছি : মহতী কিছু-একটা থাকতে পারে আমাদের এখানে, চিন্তা, কর্ম! এসবই বালুকণা মাত্র।’
‘এ কথাটা—আমাদের দুনিয়াটার মতই পুরানো।’
‘পুরানো, কিন্তু জানো, কথাটা যখন পরিষ্কার বুঝবে, সব তখন কেমন যেন হয়ে ওঠে অকিঞ্চিৎকর। যখন বুঝবে যে আজ বা কাল মারা যাবে, কিছুই তোমার টিকে থাকবে না তখন সবই তুচ্ছ! নিজের ভাবনাটাকে আমি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি কিন্তু সেটা যদি কাজে পরিণত করাও যায়, তাহলেও দেখা যাবে সেটা ঐ ভালুকটা মারার মতই তুচ্ছ। এভাবেই জীবন কাটে, মেতে থাকি শিকার নিয়ে, কাজ নিয়ে, শুধু মরণের চিন্তাটা যাতে না আসে।’
লেভিনের কথা শুনে সূক্ষ্ম সস্নেহে একটা হাসি ফুটল অব্লোন্স্কির মুখে।
‘সে তো বটেই! এই তো তুমি এসেছিলে আমার কাছে। মনে আছে, আমি জীবন উপভোগ করতে চাই বলে তুমি আমাকে আক্রমণ করেছিলে?’
‘অত কঠোর হয়ো না নীতিবাদী!… ‘
‘তাহলেও জীবনে ভালোটা হল এই…’ লেভিন গোলমালে পড়ে গেলেন, ‘না, আমি ঠিক জানি না। শুধু জানি যে মরব শিগগিরই।
‘কেন শিগগির ‘
‘আর জানো মৃত্যুর কথা ভাবলে জীবনের অনেক মাধুর্য খোয়া যায়, তবে শান্তি মেলে।
উল্টো, শেষের দিকে বরং খুশি লাগে বেশি। তবে আমার সময় হয়ে গেছে’, দশ বারের বার উঠে দাঁড়িয়ে অব্লোন্স্কি বললেন।
‘না-না, খানিক বসো’, তাঁকে আটকালেন লেভিন, ‘কবে আবার দেখা হবে? আমি তো কালই চলে যাচ্ছি।’
‘বাঃ বেশ লোক বটে আমি!’ কেন এসেছিলাম এখানে… অবশ্য-অবশ্য আজ আসবে আমার ওখানে খেতে। তোমার ভাই থাকবে, আমার ভগিনীপতি কারেনিনও থাকবে।’
‘সে কি এখানে?’ লেভিন বললেন, কিটির কথা জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে হয়েছিল। শুনেছিলেন শীতের গোড়ায় কিটি ছিল পিটার্সবুর্গে কূটনীতিকের স্ত্রী, বোনের কাছে। জানতেন না ফিরেছে কিনা। তবে জিজ্ঞেস করলেন না। ‘থাকে থাকবে, না থাকে নেই—এসে যায় না কিছুতে।
‘আসছ তো?’
‘নিশ্চয়ই।’
‘তাহলে পাঁচটার সময়, ফ্রক-কোট চাপিয়ে।’
অব্লোন্স্কি উঠে পড়লেন, গেলেন নিচে নতুন অধিকর্তার কাছে। স্বতঃবোধ প্রতারণা করেনি তাঁকে। ভয়ংকর নতুন অধিকর্তা দেখা গেল বেশ অমায়িক লোক। অব্লোন্স্কি তাঁর সাথে জলযোগ সারলেন এবং এতটা সময় কাটালেন যে, কারেনিনের কাছে পৌঁছতে পারলেন কেবল তিনটার পর।
আট
কারেনিন প্রভাতী উপাসনা থেকে ফিরে সারাটা সকাল নিজের ঘরেই কাটালেন। সেদিন সকালে তাঁর করার কাজ ছিল দুটো : প্রথমত, অরুশ জাতিদের যে প্রতিনিধিদল পিটার্সবুর্গ যাবার পথে এখন মস্কোয় আছে তাদের গ্রহণ করে সেখানে পাঠানো : দ্বিতীয়ত, অ্যাডভোকেটের কাছে প্রতিশ্রুত চিঠিটা লেখা। কারেনিনের উদ্যোগেই আহূত হলেও প্রতিনিধিদল তাঁর অনেক অসুবিধা, এমন কি তাঁর পক্ষে বিপদেরও কারণ হয়েছিল, মস্কোয় তাদের ধরতে পেরে খুশি হয়েছিলেন তিনি। নিজেদের কারণ হয়েছিল, মস্কোয় তাদের ধরতে পেরে খুশি হয়েছিলেন তিনি। নিজেদের ভূমিকা ও দায়িত্ব সম্পর্কে এ দলের সদস্যদের সামান্যতম জ্ঞানও ছিল না। সরলতাবেশে তাদের স্থির ধারণা হয়েছিল যে তাদের কাজ হল নিজেদের প্রয়োজনের কথা বলা এবং বর্তমান অবস্থাটা জানানো, সরকারের কাছ থেকে সাহায্য চাওয়া, তাদের আদৌ কোন জ্ঞান ছিল না যে তাদের কোন কোন দাবি ও আরজি শত্রুপক্ষকে সাহায্য করছে এবং পশু করে দিচ্ছে গোটা ব্যাপারটা। কারেনিন অনেকক্ষণ ধরে ব্যস্ত রইলেন তাদের নিয়ে, তাদের জন্য লিখে দিলেন একটা কর্মসূচি, যার বাইরে যাওয়া তাদের চলবে না, তারপর তাদের ছেড়ে দিয়ে পিটার্সবুর্গে চিঠি লিখলেন প্রতিনিধিদের তদারকির জন্য। এ ব্যাপারে প্রধান সাহায্যকারিণী হওয়ার কথা কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনার। প্রতিনিধিদের ব্যাপার-স্যাপারে উনি বিশেষজ্ঞ, তাঁর প্রতিনিধিদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে সত্যিকার সলাপরামর্শ দিতে পারত না আর কেউ। এটা সেরে কারেনিন চিঠি লিখলেন অ্যাডভোকেটকে। এতটুকু দ্বিধা না করে তাঁর বিচার-বিবেচনা মত কাজ করার অনুমতি তাঁকে তিনি দিলেন। ছিনিয়ে নেওয়া পোর্টফোলিওতে তিনি আন্নার কাছে ভ্রন্স্কির যে তিনটা চিঠি পেয়েছিলেন, তাও পুরে দিলেন খামের মধ্যে।
কারেনিন যেদিন ঘরে আর না ফেরার সংকল্প নিয়ে বেরিয়ে যান, এবং যেদিন তিনি অ্যাডভোকেটের কাছে গিয়ে অন্তত একটা মানুষের কাছে নিজের সংকল্পের কথা বলেছিলেন এবং বিশেষ করে যেদিন তিনি জীবনের এই ব্যাপারটাকে কাগজের ব্যাপার করে তোলেন, সেদিন থেকে তিনি ক্রমে অভ্যস্ত হয়ে উঠছিলেন নিজের সংকল্প এবং এখন পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলেন তা কার্যে পরিণত করার সম্ভাবনা।
অ্যাডভোকেটের কাছে লেখা খামটায় যখন তিনি সীল মারছিলেন, কানে এর অবলোন্স্কির উচ্চ কণ্ঠস্বর। চাকরের সাথে বচসা হচ্ছিল অব্লোন্স্কির, তিনি দাবি করছিলেন যে তাঁর আগমন কর্তাকে জানানো হোক।
কারেনিন ভাবলেন, ‘বয়ে গেল, এ বরং ভালোই : ওর বোন সম্পর্কে আমার অবস্থাটা এখুনি ওকে জানিয়ে দিয়ে বলব কেন ওর ওখানে খেতে যেতে আমি পারি না।’
‘আসতে দাও!’ কাগজপত্র গুটিয়ে রাইটিং কেসে রাখতে রাখতে চেঁচিয়ে বললেন তিনি।
‘দেখলে তো মিথ্যে কথা বলছিলে, উনি তো ঘরেই আছেন!’ যে চাপরাশিটা তাঁকে ঢুকতে দিচ্ছিল না তাকে বললেন অব্লোন্স্কি এবং আসতে আসতেই ওভারকোট খুলে ঘরে ঢুকলেন। ‘ভারি আনন্দ হচ্ছে যে, তোমাকে ধরতে পেরেছি! তাহলে আশা করছি…’ ফুর্তিতে শুরু করলেন অব্লোন্স্কি।
‘আমি যেতে পারব না।’ উঠে দাঁড়িয়ে, অতিথিকে বসতে না বলে নিরুত্তাপ গলায় বললেন কারেনিন।
যে স্ত্রীর বিরুদ্ধে তিনি বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা আনছেন তার ভাইয়ের সাথে যে শীতল মনোভাব নেওয়া তাঁর উচিত সেটা তখনই নেবেন বলে তিনি ভেবেছিলেন; কিন্তু ভালোমানুষির যে সাগর অব্লোন্স্কির হৃদয়ের কূল ছাপিয়ে উঠছিল, সেটা তিনি হিসেবে ধরেননি।
নিজের পরিষ্কার ঝকঝকে দু’চোখ বড় বড় করে মেলে ধরলেন অব্লোন্স্কি।
‘যেতে পারবে না কেন? কি বলতে চাইছ তুমি?’ ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে বললেন ফরাসি ভাষায়, ‘ও চলবে না, তুমি যে কথা দিয়েছ। আমরা সবাই তোমার ভরসা করে আছি।’
আমি বলতে চাইছি যে, আপনাদের ওখানে আমি যেতে পারি না। কেননা আমাদের মধ্যে যে আত্মীয়তার সম্পর্কে ছিল তা ছিন্ন করতে হবে আমাকে। ‘
‘সে কি? মানে, কি ব্যাপার? কেন?’ হেসে অব্লোন্স্কি বললেন।
‘কারণ আপনার ভগিনী, আমার স্ত্রীর সাথে বিবাহবিচ্ছেদের মামলা শুরু করছি আমি। আমার উচিত…’
কিন্তু তিনি কথা শেষ করতে-না-করতেই অব্লোন্স্কি যা করলেন সেটা তিনি কল্পনাও করতে পারেন না। ‘আহ্’ শব্দ করে তিনি ধপ করে বসে পড়লেন চেয়ারে।
‘না, কারেনিন, কি বলছ তুমি!’ অব্লোন্স্কি চেঁচিয়ে উঠলেন, মুখে তাঁর ফুটে উঠল যন্ত্রণার ছাপ।
‘ব্যাপারটা তাই-ই।’
‘মাপ করো আমাকে, আমি এটা বিশ্বাস করতে পারি না…’
কারেনিন বসলেন, টের পেলেন যে তিনি যা আশা করেছিলেন তাঁর কথায় সে প্রতিক্রিয়া হয়নি, তাঁকে এখন সবটা বুঝিয়ে বলতে হবে এবং যাই তিনি বোঝেন, শ্যালকের সাথে তাঁর সম্পর্ক তাই থাকবে, যা ছিল। বললেন, ‘হ্যাঁ, বিবাহবিচ্ছেদ দাবি করার দুঃসহ আবশ্যিকতা দেখা দিয়েছে আমার সামনে।’
‘শুধু একটা কথা বলি, কারেনিন। আমি তোমাকে চমৎকার ন্যায়পর একজন মানুষ বলে জানি। আন্নাকেও জানি, মাপ করো আমাকে, ওর সম্পর্কে নিজের মতামত বদলাতে আমি অক্ষম, ওকে আমি জানি সুন্দর, চমৎকার এক নারী বলে, তাই মাপ করো আমাকে, এটা আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। এখানে কিছু-একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে।
‘আহ্, যদি মাত্র ভুল বোঝাবুঝির ব্যাপার হত…’
‘দাঁড়াও, আমি বুঝতে পারছি’, ওঁর কথায় বাধা দিলেন অব্লোন্স্কি, ‘তা সে তো বটেই… শুধু একটা কথা : তাড়াহুড়া করো না। না-না, তাড়াহুড়া করবে না!’
‘আমি তাড়াহুড়া করিনি’, নিরুত্তাপ গলায় বললেন কারেনিন, ‘আর এ ধরনের ব্যাপারে কারোর পরামর্শ নেওয়াও চলে না। আমি মন স্থির করে ফেলেছি।’
‘এ যে ভয়ংকর ব্যাপার!’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন অব্লোন্স্কি। আমি হলে এক কাজ করতাম কারেনিন। মিনতি করছি, তুমি এটা কর, উনি বললেন, ‘আমি যা বুঝছি, মামলা এখনো শুরু হয়নি। মামলা শুরু করার আগে আমার স্ত্রীর সাথে দেখা করো, কথা বল তার সাথে। বোনের মত সে আন্নাকে ভালোবাসে, তোমাকেও ভালোবাসে, আশ্চর্য মানুষ সে। দোহাই তোমার, কথা বল ওর সাথে! এই উপকারটুকু আমার জন্যে কর, মিনতি করছি!’
চিন্তামগ্ন হলেন কারেনিন, দরদভরে অবলোন্স্কি তাকিয়ে রইলেন তাঁর দিকে, তাঁর নীরবতা ভঙ্গ করলেন না।
‘তুমি যাবে তো ওর কাছে?’
‘জানি না। এ কারণেই আপনাদের ওখানে যাইনি। আমি মনে করি, আমাদের সম্পর্ক বদলানো উচিত।‘
‘কিসের জন্যে! আমি তো তার কোন কারণ দেখছি না। আমাকে অন্তত এটা ভাবতে দাও যে আমাদের মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছাড়াও তোমার প্রতি সব সময় যে সৌহার্দ্য পোষণ করে এসেছি তার অন্তত খানিকটা তোমারও আছে আমার প্রতি…এবং সত্যকার শ্রদ্ধা’, ওঁর হাতে চাপ দিয়ে বললেন অব্লোন্স্কি, ‘তোমার সবচেয়ে খারাপ অনুমানটাই যদি ন্যায্যা হয়, তাহলেও আমি কোন পক্ষকেই বিচার করার দায়িত্ব নিচ্ছি না, কখনো নেবও না এবং কেন আমাদের সম্পর্ক বদলানো উচিত তার কোন কারণ দেখছি না আমি। এবার এটা করো, চল আমার স্ত্রীর কাছে।’
‘আমরা ব্যাপারটা দেখছি ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিতে’, নিরুত্তাপ কণ্ঠে বললেন কারেনিন, ‘তবে ও-নিয়ে আলোচনা থাকে।’
‘না-না, কেন আসবে না তুমি? অন্তত আজ ডিনারে। স্ত্রী আশা করছে তোমাকে। এসো দয়া করে। আর প্রধান ব্যাপার, কথা বল ওর সাথে। আশ্চর্য মানুষ সে। দোহাই তোমার, নতজানু হয়ে মিনতি করছি!’
‘এতই যখন আপনার ইচ্ছে, বেশ যাব’, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন কারেনিন।
এবং প্রসঙ্গ পালটাবার বাসনায় তিনি জিজ্ঞেস করলেন অব্লোন্স্কির নতুন অধিকর্তার কথা, যাতে দুজনেরই আগ্রহ। ভদ্রলোক এখনো বৃদ্ধ হননি আর হঠাৎ কিনা পেয়ে গেলেন এত উঁচু একটা পদ।
কাউন্ট আনিচুকিনকে কারেনিন আগেও পছন্দ করতেন না, সব সময়ই পার্থক্য ঘটত তাঁদের মতামতে, কিন্তু এখন কর্মক্ষেত্রে যে ব্যক্তির পদোন্নতি হল তার প্রতি পরাজিতের যে বিদ্বেষ চাকুরেদের কাছে বোধগম্য তা থেকে বিরত
থাকতে পারলেন না।
‘তা কি, ওর সাথে দেখা হয়েছে তোমার?’ কারেনিন জিজ্ঞেস করলেন বাঁকা হেসে।
‘হবে না, কেন, কাল এসেছিলেন আমাদের আপিসে। মনে হয় নিজের কাজটা উনি চমৎকার বোঝেন, খুব কর্মপটু লোক।’
‘হ্যাঁ, কিন্তু কোন দিকে চালিত ওর পটুতা?’ কারেনিন বললেন, ‘কোন-একটা কাজ করার দিকে, নাকি যা করা হয়েছে তার কেঁচেগণ্ডুষ করতে? আমাদের রাষ্ট্রের দুর্ভাগ্য যে এটা কাগুজে প্রশাসন, যার যোগ্য প্রতিনিধি উনি।’
‘সত্যি আমি জানি না ওঁর মধ্যে কোন জিনিসটার সমালোচনা করা যায়। ওঁর কি ধারা আমার জানা নেই। তবে একটা কথা-লোক উনি খাশা। আমি এইমাত্র ওঁর কাছে গিয়েছিলাম, সত্যি, খাশা লোক। জলযোগ করলাম আমরা, ওঁকে আমি শিখিয়ে দিলাম, ওই-যে জানো তো, কি করে সুরা আর নারাঙ্গার রস মিশিয়ে শরবত করতে হয়। গা জুড়িয়ে দেয় তা। অথচ আশ্চর্য, এটা উনি জানতেন না। খুব ভালো লেগেছে তাঁর। না, সত্যি, খাশা লোক।’
ঘড়ি দেখলেন অব্লোন্স্কি। ‘বাপ্ রে, চারটা বেজে গেছে দেখছি, অথচ দলগোভুশিনের কাছে যাওয়া আমার এখনো বাকি! তাহলে খেতে এসো কিন্তু। তুমি ভাবতে পারবে না তুমি কি দুঃখ দিচ্ছ আমাকে আর আমার স্ত্রীকে।’
শ্যালককে কারেনিন যেভাবে অভ্যর্থনা করেছিলেন, বিদায় দিলেন মোটেই সেভাবে নয়।
বিষণ্নভাবে বললেন, ‘কথা যখন দিয়েছি, যাব।’
‘বিশ্বাস কর, কদর করছি তোমাকে। আশা করি তোমাকে খেদ করতে হবে না’, হেসে বললেন অব্লোন্স্কি।
যেতে যেতেই ওভারকোট পরে নিলেন তিনি, হাতের ধাক্কা লাগল চাপরাশির মাথায়, হেসে উঠে বেরিয়ে গেলেন।
‘পাঁচটায়, ফ্রক-কোটে!’ দরজার দিকে ফিরে আরো একবার চেঁচিয়ে বলে চলে গেলেন।
নয়
যখন গৃহস্বামী নিজে এসে পৌঁছলেন, ততক্ষণে পাঁচটা বেজে গেছে, কিন্তু অতিথি এসে পড়লেন ইতিমধ্যেই। তিনি ঢুকলেন সের্গেই ইভানোভিচ কজ্নিশেভ আর পেস্তসোভকে নিয়ে একত্রে, ঢোকার মুখে দেখা হয়েছিল তাঁদের সাথে অব্লোন্স্কি যা বলতেন, এ দুজন হলেন মস্কো বুদ্ধিজীবীদের প্রধান প্রতিনিধি। চরিত্র ও চাতুর্য, উভয় দিক থেকেই তাঁর শ্রদ্ধেয়। তাঁরাও সম্মান করতেন পরস্পরকে, কিন্তু প্রায় সব ব্যাপারেই তাঁদের মধ্যে মতভেদ হত প্রচণ্ড এবং আপোসহীন, সেটা এই জন্য নয় যে তাঁরা ছিলেন দুই বিরোধী ধারার লোক, বরং এই জন্য যে তাঁরা একই শিবিরভুক্ত (শত্রুরা তাঁদের এক করেই, দেখতেন), কিন্তু সে শিবিরের অভ্যন্তরে প্রত্যেকের ছিল নিজ নিজ তারতম্য। আর অর্ধবিমূর্তনের ক্ষেত্রে ভিন্ন চিন্তার মত মতের মিল ঘটাতে এতটা অক্ষম যেহেতু আর কিছুই নেই, তাই তাঁদের মতে মতে কখনো মেলেনি শুধু তাই নয়, উষ্মা প্রকাশ না করে, কেবল এক অপরের অসংশোধনীয় বিভ্রান্তিতে হাসাহাসি করে তাঁরা পরস্পর অভ্যস্ত হয়ে গেছেন বহুদিন।
তাঁরা দরজায় ঢুকে আবহাওয়া নিয়ে আলাপ করছিলেন, এমন সময় অব্লোন্স্কি তাঁদের সাথে ধরলেন। ড্রয়িং- রুমে বসে ছিলেন অব্লোন্স্কির শ্বশুর প্রিন্স কারেনিন, তরুণ শ্যেরবাৎস্কি, তুরোভ্ৎসিন, কিটি আর কারেনিন।
অব্লোন্স্কির তৎক্ষণাৎ নজরে পড়ল যে তাঁকে বিনা আসরটা ভালো জমছে না। দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা তাঁর ধূসর রেশমী পোশাকি গাউনে স্পষ্টতই ভাবনা করছিলেন ছেলেমেয়েদের নিয়ে যাদের একলা খাবার কথা শিশু-কক্ষে, এবং এই জন্যও যে স্বামী এখনো ফিরছেন না, স্বামীকে ছাড়া দলটাকে সামলাতে পারছিলেন না তিনি। সবাই তাঁরা বসেছিলেন পাদ্রীকন্যাদের মত (বৃদ্ধ প্রিন্সের ভাষায়), ভেবে পাচ্ছিলেন না কেন তাঁরা এখানে, চুপ করে যাতে না থাকতে হয় তার জন্য উচ্চারণ করছিলেন কষ্টকল্পিত এক-একটা শব্দ। দিলদরাজ তুরোভ্ৎসিন স্পষ্টতই নিজেকে স্বস্থানচ্যুত বলে অনুভব করছিলেন, মোটা ঠোঁটের যে হাসিতে তিনি অব্লোন্স্কিকে স্বাগত করলেন তা যেন স্পষ্ট ভাষায় বলছিল, ‘বেশ ভাই, বুদ্ধিমন্তদের মধ্যে আমাকে দিব্যি বসিয়ে রেখে গেছিস। কিছু টেনে Chateau des fluers-এ গেলেই পারতাম, ওটাই আমার যথাস্থান।’ বৃদ্ধ প্রিন্স চুপচাপ বসে ছিলেন, চকচকে আড়চোখে দেখছিলেন কারেনিনকে অব্লোন্স্কি টের পেলেন, এই যে রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাটিকে অতি উপাদেয় ভোজ্যরূপে পরিবেশন করা হয় নিমন্ত্রিতদের কাছে তাঁকে দেগে দেবার মত কোন-একটা টিপ্পনী তাঁর ভাবা হয়ে গেছে। কিটি তাকিয়ে ছিল দরজার দিকে যাতে কনস্তান্তিন লেভিনের আগমনে লাল না হয়ে ওঠার মত শক্তি সে পায়। তরুণ শ্যেরবাৎস্কি যার সাথে কারেনিনের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়নি, দেখাবার চেষ্টা করছিল যে তাতে তার কিছু এসে যায় না। স্বয়ং করেনিন, মহিলাদের সাথে ডিনারে বসলে পিটার্সবুর্গের যা চাল, ফক-কোট আর সাদা টাই পরে বসেছিলেন আর অব্লোন্স্কি তাঁর মুখ দেখে বুঝলেন যে তিনি এসেছেন শুধু কথা দিয়েছেন বলে, আর এই সমাবেশটায় উপস্থিত থেকে তিনি একটা গুরুভার কর্তব্য পালন করছেন। অব্লোন্স্কির আসার আগে পর্যন্ত যে হিম সমস্ত অতিথিকে জমিয়ে রেখেছিল তার প্রধান অপরাধ তাঁরই।
অব্লোন্স্কি ড্রয়িং-রুমে ঢুকে মাপ চাইলেন। কৈফিয়ত দিলেন যে, কোন এক প্রিন্সের কাছে তিনি আকটা পড়েছিলেন। যিনি সব সময় তাঁর সমস্ত বিলম্ব ও অনুপস্থিতির ওজর, মিনিটখানেকের মধ্যে সবার সাথে সবার পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং পোল্যান্ডের রুশীকরণ নিয়ে কারেনিনকে লাগিয়ে দিলেন সের্গেই কজ্নিশেভের সাথে, সে প্রসঙ্গটা তাঁরা তৎক্ষণাৎ লুফে নিলেন পেসোভের সাথে। তুরোৎসিনের কাঁধ চাপড়ে তিনি মজার কিছু-একটা বললেন তাঁর কানে কানে, এবং তাঁকে বসালেন প্রিন্স আর স্ত্রীর মাঝখানে। তারপর কিটিকে বললেন যে তাকে আজ ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে, কারেনিনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন শ্যেরবাৎস্কির। এক মিনিটের মধ্যে তিনি এই সামাজিক ময়দার তালটা এমন বদলে দিলেন যে ড্রয়িং-রুম যা হয়ে দাঁড়াল বলার নয়, চাঙ্গা হয়ে উঠল কণ্ঠস্বর। ছিলেন না শুধু কনস্তান্তিন লেভিন। তবে সে বরং ভালোই, কেননা ভোজনকক্ষে গিয়ে অব্লোন্স্কি সভয়ে দেখলেন যে পোর্ট, ওয়াইন আর শেরি আনা হয়েছে লেভে থেকে নয়, দেভ্রে থেকে। যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি লেভে’র কাছে কোচোয়ানকে পাঠাবার ব্যবস্থা করে তিনি আবার ফিরলেন ড্রয়িং-রুমে।
ভোজনকক্ষে তাঁর সাথে দেখা হল কনস্তান্তিন লেভিনের।
‘দেরি না করে তুমি পারো কখনো?’ তাঁকে বাহুবন্ধনে নিয়ে বললেন অব্লোন্স্কি।
‘তোমার এখানে অনেক লোক? কে, কে?’ অজ্ঞাতসারে লাল হয়ে আর দস্তানা দিয়ে টুপির তুষারকণা ঝড়তে ঝড়তে বললেন লেভিন।
‘সবাই আপনার লোক। কিটিও আছে। চল, কারেনিনের সাথে তোমার পরিচয় করিয়ে দিই।’
উদারনৈতিক মতাবলম্বী হলেও অব্লোন্স্কি জানতেন যে কারেনিনের সাথে পরিচয় থাকাটা কারো কাছে চরিতার্থতার একটা ব্যাপার না হয়ে পারে না, তাই সেরা বন্ধুর কাছে তারই প্রস্তাব দিলেন তিনি। কিন্তু সেই মুহূর্তে এ পরিচয়ের সমগ্র পরিতোষ গ্রহণের অবস্থায় ছিলেন না কনস্তান্তিন লেভিন। সড়কে কিটিকে ক্ষণিক দেখতে পাওয়ার কথাটা ছেড়ে দিরে সেই যে স্মরণীয় সন্ধ্যায় তিনি ভ্রন্স্কিকে দেখেছিলেন, তার পর থেকে তিনি কিটিকে আর দেখেননি অন্তরে অন্তরে তিনি জানতেন যে আজ এখানে তিনি দেখতে পারেন কিটিকে। কিন্তু নিজের চিন্তার স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রেখে তিনি নিজেকে বোঝাতে চাইছিলেন যে সেটা তাঁর জানা নেই। কিন্তু এখন, যখন শুনলেন যে সে এখানে, তখন এমন আনন্দ আর সেই সাথে এমন ভয় হল তাঁর যে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল, যা বলতে চাইছিলেন, বলতে পারলেন না।
‘কেমন, কেমন সে এখন? যেমন ছিল আগে, অথবা যেমন তাকে দেখেছিলেন ঘোড়ার গাড়িটায়? আর দারিয়া অলেক্সান্দ্রভনা যদি সত্যি কথাই বলে থাকেন, তাহলে? কেনই-বা সত্যি বলবেন না?’ মনে মনে ভাবছিলেন তিনি।
‘ও, হ্যাঁ, আলাপ করিয়ে দাও কারেনিনের সাথে’, বহু কষ্টে শেষ পর্যন্ত বলতে পারলেন কথাটা, দৃঢ়, মরিয়া পদক্ষেপে ড্রয়িং-রুমে ঢুকে দেখতে পেলেন কিটিকে।
কিটি আগের মতও নয়, গাড়িতে যা দেখা গিয়েছিল, তার মতও নয়; একেবারে অন্যরকম।
কিটিকে দেখাচ্ছিল সন্ত্রস্ত, ভীরু, লজ্জিত আর তাতে করে আরো মধুর মনে হল তাকে। ঘরে ঢুকতেই তাঁকে দেখল কিটি। তাঁর অপেক্ষায় সে ছিল। খুশি হয়ে উঠল সে আর নিজের খুশিতে এমনই বিব্রত বোধ করল যে, লেভিন যখন গৃহকর্ত্রীর কাছে যেতে যেতে আবার তার দিকে তাকান, সে মুহূর্তে তার, লেভিনের ডল্লি ওরও যিনি সবই দেখছিলেন, মনে হল সে আর সামলাতে পারবে না, কেঁদে পেলবে। লাল হয়ে উঠল কিটি, বিবর্ণ হয়ে গেল, আবার লাল হয়ে উঠে আড়ষ্ট হয়ে গেল, সামান্য কাঁপা-কাঁপা ঠোঁটে অপেক্ষা করতে লাগল লেভিনের। লেভিন ওর কাছে এসে মাথা নুইয়ে হাত বাড়িয়ে দিলেন নীরবে। ঠোঁটের সামান্য কাঁপন আর যে আর্দ্রতা চোখকে আরো জ্বলজ্বলে করে তুলেছে তা না থাকলে হাসিটা তার প্রায় প্রশান্ত মনে হতে পারত যখন সে বলল : ‘কতদিন দেখা হয়নি আমাদের!’ মরিয়া দৃঢ়তায় নিজের ঠাণ্ডা হাতে লেভিনের করমর্দন করল সে।
‘আপনি আমাকে দেখতে পাননি কিন্তু আমি আপনাকে দেখেছি’, সুখের হাসিতে দীপ্তি ছড়িয়ে লেভিন বললেন, ‘আমি আপনাকে দেখেছি যখন রেলস্টেশন থেকে আপনি যাচ্ছিলেন এওঁশোভোতে।’
‘কবে?’ অবাক হয়ে কিটি জিজ্ঞেস করল।
‘আপনি গাড়ি করে যাচ্ছিলেন এওঁশোভোতে’, লেভিন বললেন এবং অনুভব করলেন যে হৃদয় ভরে উঠছে যে সুখে তাতে হাবুডুবু খাচ্ছেন তিনি। ‘মর্মস্পর্শী এই যে প্রাণীটি, তার কিছু-একটা দোষ ধরার স্পর্ধা আমি পেয়েছিলাম কোত্থেকে! হ্যাঁ, দারিয়া আলক্সান্দভনা যা বলেছিলেন, মনে হচ্ছে তা ঠিকই’, ভাবলেন লেভিন।
অব্লোন্স্কি তাঁর হাত ধরে নিয়ে গেলেন কারিনিনের কাছে।
‘আসুন, আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিই’, দুজনের নাম বললেন তিনি।
‘আবার দেখা হয়ে খুবই আনন্দ হল’, লেভিনের করমর্দন করে কারেনিন বললেন শীতল কণ্ঠে।
‘আপনাদের আগেই পরিচয় ছিল নাকি?’ অবাক হয়ে অব্লোন্স্কি জিজ্ঞেস করলেন।
‘রেলগাড়িতে তিন ঘণ্টা আমরা ছিলাম একসাথে’, হেসে বললেন লেভিন, ‘কিন্তু বেরিয়ে আসি যেন ছদ্মবেশী নৃত্য থেকে, কুহেলিকা নিয়ে, অন্তত আমি।’
‘বটে! আচ্ছা এবার আসুন’, ভোজনকক্ষের দিকে হাত দেখিয়ে বললেন অব্লোন্স্কি।
ভোজনকক্ষে ঢুকে পুরুষেরা গেলেন মুখরোচক টেবিলটার কাছে, যাতে ছিল ছয় ধরনের ভোদ্কা, রুপার খুন্তি দেওয়া বা না-দেওয়া সমান সংখ্যক পনীর, মাছের ডিমের আচার, নোনা হেরিং মাছ, নানা ধরনের জমিয়ে রাখা খাবার, ফরাসি পাঁউরুটির চাকা ভরা ডিশ।
ভোদ্কা আর মুখরোচক খাবারগুলো গন্ধে ভুরভুর টেবিলটার কাছে পুরুষেরা দাঁড়িয়ে রইলেন মূল আহারের অপেক্ষায়। পোল্যান্ডের রুশীকরণ নিয়ে সের্গেই ইভানোভিচ কজ্নিশেভ, কারেনিন আর পেসোভের মধ্যেকার আলাপটা থিতিয়ে এল।
অতি বিমূর্ত ও গুরুতর বিতর্কের অবসান ঘটাবার জন্য সূক্ষ্ম লবণ প্রয়োগে বিতর্কিদের মেজাজ ফেরাতে আর কেউ পারতেন না কর্নিশেভের মত, এবারেও সেটা তিনি দেখালেন।
কারেনিন প্রমাণ করছিলেন যে পোল্যান্ডের রুশীকরণ সম্ভব হতে পারে কেবল সর্বোচ্চ নীতি প্রবর্তনের ফলে, যা রচনা করার কথা রুশী প্রশাসনের
পেস্তসোভ জিদ করছিলেন যে একটা জাতির অন্য জাতিতে আত্তীকরণ ঘটে কেবল শেষোক্ত জাতির জনবহুলতায়।
কজ্নিশেভ উভয়ের বক্তব্যেই সায় দিচ্ছিলেন কিছু ‘কিন্তু’ রেখা। ড্রয়িং-রুম থেকে তাঁরা বেরোন, তর্কটা থামাবার জন্য কজ্নিশেভ হেসে বললেন : ‘তাহলে অরুশদের রুশীকরণের জন্যে একটাই উপায় আছে— যথাসম্ভব বেশি সন্তানোৎপাদন। এ ব্যাপারে আমি আর আমার ভাই সবার চেয়ে খারাপ। কিন্তু আপনারা, বিবাহিত সাহেবরা আর বিশেষ করে আপনি, অবলোন্স্কি, পুরোপুরি দেশপ্রেমিকের কাজ করছেন; ক’টা হল আপনার?’ হেসে, ছোট্ট একটা পানপাত্র তাঁর কাঁছে ধরে তিনি বললেন গৃহস্থামীকে।
সবাই হেসে উঠল, সবচেয়ে ফুর্তি করে হাসলেন অব্লোন্স্কি।
‘হ্যাঁ, এটাই সবচেয়ে সেরা পদ্ধতি!’ পনীর চিবাতে চিবাতে এগিয়ে দেওয়া পানপাত্রটায় কি-এক বিশেষ ধরনের ভোদ্কা ঢালতে ঢালতে বললেন তিনি। এই রহস্যেই অবসান হল বিতর্কের।
‘পনীরটা মন্দ নয়। কে নেবেন?’ গৃহস্বামী বললেন, ‘আবার তুমি ব্যায়াম শুরু করেছ নাকি?’ বাঁ হাতে লেভিনের পেশী টিপে বললেন তিনি। হেসে লেভিন তাঁর পেশী ফোলালেন, অব্লোন্স্কির আঙুলের নিচে পাতলা ফ্রক-কোটের তল থেকে ইস্পাতের মত উঁচু হয়ে উটল গোলাকার পনীর-সদৃশ পেশীর ডিম
‘আহ্, বাইসেপখান কি! একেবারে সামসন!’
‘আমার মনে হয় ভালুক শিকারের জন্যে বেশ শক্তি দরকার’, বললেন কারেনিন, শিকার সম্পর্কে যাঁর ধারণা ছিল খুবই ঝাপসা। পনীর মাখাতে গিয়ে ফিনফিনে এক টুকরো রুটি ভেঙে ফেললেন তিনি।
লেভিন হাসলেন।
‘শক্তির কোন দরকার নেই। একটা বাচ্চাও ভালুক মারতে পারে’, মুখরোচক টেবিলেটা কাছে গৃহকর্ত্রীর সাথে যে মহিলারা আসছিলেন তাঁদের উদ্দেশে মাথা নুইয়ে সরে গিয়ে লেভিন বললেন।
‘শুনেছি আপনি ভালুক মেরেছেন, সত্যি?’ কিটি জিজ্ঞেস করল বারবার পিছলে যাওয়া একটা ব্যাঙের ছাতাকে কাঁটার বিধাবার চেষ্টা করে, সাদা বাহুর ওপরকার লেসটা ঝাঁকিয়ে, ‘আপনাদের ওখানে ভালুক আছে নাকি?’ তাঁর দিকে মাথা আধখানা ফিরিয়ে সে যোগ করল হেসে।
সে যা বলল, সেটা মনে হবে অসাধারণ কিছু নয়, কিন্তু যখন এটা সে বলছিল তখন তার প্রতিটি ধ্বনি, ঠোঁট, হাতের প্রতিটি ভঙ্গি কি অবর্ণনীয় তাৎপর্যই না ধরেছিল লেভিনের কাছে। ছিল তাতে লেভিনের কাছে ক্ষমাভিক্ষা, তাঁর ওপর আস্থা, সোহাগ, কমনীয়, ভীরু-ভীরু লেভিনের আর প্রতিশ্রুতি আর আশা আর ভালোবাসা যাতে তিনি বিশ্বাস না করে পারেন না, সুখে যাতে তাঁর শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছিল।
‘না, আমরা গিয়েছিলাম ভের গুবের্নিয়ায়। ফেরার পথে ট্রেনের কামরায় দেখা জয় আপনার দেওয়া অথবা দেওরের জামাইয়ের সাথে’, হেসে বললেন তিনি, ‘সে এক মজার সাক্ষাৎ।’
ফুর্তি করে, মজা করে তিনি বলতে লাগলেন কিভাবে সারারাত না ঘুমিয়ে তিনি মেষচর্মের কোট গায়ে হুড়মুড়িয়ে ঢুকেছিলেন কারেনিনের কামরায়।
‘প্রবাদে যা বলে তার উল্টোটা করলে কন্ডাক্টর, আমার ওই মেষচর্মের জন্যে আমাকে সে ভাগাতে চাইছিল; আমি যত লম্বা-চওড়া বুলি ঝড়তে লাগলাম, আর আপনিও…’ কারেনিনের নাম, পিতৃনাম মনে করতে না পেরে তিনি বললেন তাঁর উদ্দেশে, ‘আমার মেষচর্মের জন্যে আমি খুবই কৃতজ্ঞ।’
‘আসন নির্বাচনে যাত্রীদের অধিকার এমনিভাবে খুব বিশৃঙ্খলা’, রুমাল দিয়ে আঙুলের ডগা মুছে বললেন কারেনিন।
‘দেখলাম, আমার সম্পর্কে আপনি মনঃস্থির করে উঠতে পারছেন না’, ভালোমানুষি হাসি হেসে বললেন লেভিন, ‘কিন্তু আমার ঐ মেষচর্মটা মার্জনা করিয়ে নেবার জন্যে আমি তাড়াতাড়ি করে শুরু করলাম সুধীসুলভ আলাপ।’
সের্গেই ইভানোভিচ আলাপ চালিয়ে যাচ্ছিলেন গৃহকর্ত্রীর সাথে আর এক কান দিয়ে শুনছিলেন ভাইয়ের কথা, আড়চোখে তাকিয়েছিলেন তাঁর দিকে। ভাবছিলেন, ‘আর ওর হল কি?’ এমন জয়জয়কার ভাব।’ তিনি জানতেন না যে লেভিন অনুভব করছেন যে তাঁর পাখা গজিয়েছে। লেভিন জানতেন যে কিটি তাঁর কথা শুনছে আর তার ভালো লাগছে শুনতে। শুধু সেটাতেই তিনি নিমগ্ন। শুধু এই ঘরখানায় নয়, সারা দুনিয়ায় আছেন শুধু তিনি, যিনি পেয়ে গেছেন বিপুল তাৎপর্য আর গুরুত্ব, এবং আছে কিটি। তিনি অনুভব করছিলেন যে তিনি আছেন এত উঁচুতে যে মাথা ঘোরে, আর নিচুতে কোথায় যেন অনেক দূরে রয়েছে এসব সজ্জন, সুন্দর কারেনিনরা, অব্লোন্স্কিরা, সারা পৃথিবী।
একেবারে অলক্ষিতে, ওঁদের দিকে না তাকিয়ে যেন আর কোথাও বসার জায়গা নেই এমন ভাব করে অব্লোন্স্কি খাবার টেবিলে লেভিন আর কিটিকে বসিয়ে দিলেন পাশাপাশি। লেভিনকে তিনি বললেন, ‘তুমি তো এখানে বসতে পারো।’
যার জন্য অব্লোন্স্কির দূর্বলতা ছিল সেই বাসনগুলোর মতই খাবারও হয়েছিল চমৎকার। খুব উৎরেছিল মারি- লুইজ স্যুপ; মুখে গলে যাওয়া ছোট ছোট পিঠেগুলো একেবারে অনবদ্য। সাদা টাই-ঝোলানো দুজন চাপরাশি আর মাতভেই আহার্য ও মদ্য পরিবেশন করছিল দৃষ্টিকটু না হয়ে শান্তভাবে, তৎপরতার সাথে। বৈষয়িক দিক থেকে সার্থক হয়েছিল ডিনার; অবৈষয়িক দিক থেকেও কম সার্থক হয়নি। কখনো সবার মিলিত, কখনো ব্যক্তিগত কথোপকথন থেমে গেল না, আর ডিনারের শেষে তা এতই সজীব হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে, পুরুষেরা টেবিল ছেড়ে উঠেছিলেন আলাপ না থামিয়ে, এমন কি কারেনিনেরও নিরাসক্তি কেটে গিয়েছিল।