এক
কারেনিন দম্পতি একই বাড়িতে বাস করেন। প্রতিদিনই তাঁদের দেখা হয়, কিন্তু একেবারেই বাইরের লোকের মত। কারেনিন নিয়ম করে নিয়েছিলেন যে, রোজ দেখা দেবেন স্ত্রীর সামনে—যাতে চাকর-বাকররা কিছু-একটা অনুমান করে নেবার সুযোগ না পায়, তবে বাড়িতে আহার এড়িয়ে যেতেন। এ বাড়িতে ভ্রন্স্কি কখনো আসতেন না কিন্তু বাইরে আন্না তাঁর সাথে দেখা করতেন আর স্বামীও তা জানতেন। তিনজনের পক্ষেই অবস্থাটা কষ্টকর ছিল এবং সেটা একদিনের জন্যও তাঁদের কেউ সইতে পারতেন না যদি তাঁদের এই আশা না থাকত যে এটা বদলাবে, এটা কেবল একটা সাময়িক শোকাবহ অসুবিধা যা কেটে যাবে। কারেনিন আশা করছিলেন যে, এই হৃদয়াবেগ কেটে যাবে যেমন কেটে যায় সব কিছু, সবাই ব্যাপারটা ভুলে যাবে, তাঁর নাম থাকবে অকলঙ্কিত। আন্না, এ অবস্থার জন্য যিনি দায়ী, যাঁর কাছে অবস্থাটা সবার চেয়ে কষ্টকর, তিনি শুধু আশা নয়, সুদৃঢ় বিশ্বাস রেখেছিলেন যে শিগগিরই জট খুলবে, পরিষ্কার হয়ে যাবে। অবস্থাটার জট কিসে খুলবে সেটা তিনি একেবারেই জানতেন না, কিন্তু খুবই নিশ্চিত ছিলেন যে এবার কিছু-একটা ঘটবে শিগগিরই ভ্রন্স্কিও অজ্ঞাতসারে তাঁকে মেনে নিয়ে ভাবছিলেন তাঁর অপেক্ষা রাখে না এমন কিছু-একটা ঘটতে বাধ্য যা সমস্ত মুশকিলের আসান করে দেবে।
ভ্রন্স্কির শীতের মাঝামাঝি সময় একটা সপ্তাহ খুবই বিছ্ছিরিভাবে কাটে। পিটার্সবুর্গে আগত এক বিদেশী প্রিন্সের ভার পড়েছিল তাঁর ওপর, রাজধানীর দ্রষ্টব্যাদি দেখাতে হবে তাঁকে। ভ্রন্স্কি নিজেই একজন দর্শনধারী ব্যক্তি, তদুপরি নিজের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ না করে এই ধরনের লোকদের সাথে চলাফেরায় তিনি অভ্যস্ত, তাই তাঁকে দেওয়া হয় প্রিন্সটির দায়িত্ব। কিন্তু দায়টা তাঁর কাছে খুবই গুরুভার মনে হল। রাশিয়ায় এটা কি তিনি দেখেছেন, স্বদেশে এমন প্রশ্নের জবাব দেবার মত কোন কিছুই বাদ দিতে প্রিন্স রাজী নন; তাছাড়া নিজেও তিনি যথাসম্ভব রুশী উপভোগাদিতে ইচ্ছুক। দুটো ব্যাপারেই তাঁকে পথ দেখাবার ভার ভ্রন্স্কির। রোজ সকালে তাঁরা যেতেন দর্শনীয় স্থান দেখতে, সন্ধ্যায় যোগ দিতেন জাতীয় প্রমোদে। প্রিন্সদের ক্ষেত্রেও যা অসাধারণ, তেমন একটা স্বাস্থ্য ছিল এই প্রিন্সটির; ব্যায়াম করে আর শরীরের ভালো যত্ন নিয়ে তিনি এমন মাত্রায় উঠেছিলেন যে উপভোগের আধিক্য সত্ত্বেও তিনি ছিলেন সবুজ, চেকনাই, ওলন্দাজ শসার মত তাজা। অনেক ঘুরেছেন তিনি এবং আবিষ্কার করেছেন যে বর্তমান কালের অনায়াস যোগাযোগ পথের একটা প্রধান লাভ হল বিদেশের প্রমোদ সম্ভোগ। তিনি স্পেনে গেছেন, সেখানে সেরিনাদ গেয়েছেন, দহরম- মহরম করেছেন ম্যান্ডোলিন-বাদিকা এক স্পেনীয়ার সাথে। সুইজারল্যান্ডে গিয়ে তিনি শ্যাময় মেরেছেন। ইংল্যান্ডে লাল ফ্রক-কোট পরে তিনি বেড়া ডিঙিয়েছেন এবং দু’শ উড়ন্ত ফিজ্যান্ট শিকার করেছেন। তুরস্কে রাত কাটিয়েছেন হারেমে, ভারতবর্ষে হাতির পিঠে চেপেছেন, এখন বিশেষ করে যা রুশী তেমন সমস্ত উপভোগের স্বাদ নিতে চান।
এরূপ ব্যক্তি পরিবেশন-কর্তা হয়ে নানান লোকের প্রস্তাবিত সমস্ত রুশী প্রমোদের মধ্যে থেকে বাছাই করতে খুবই মুশকিলে পড়েছিলেন ভ্রন্স্কি। হল অশ্বারোহণ, সরুচাকলি ভোজন, ভালুক শিকার, তিন ঘোড়ায় টানা স্লেজে চাপা, জিপসি দর্শন, রুশী কায়দায় পাত্র ভেঙেচুরে পানোৎসব। অসাধারণ অনায়াসে রুশ মেজাজ রপ্ত করে নিলেন প্রিন্স, পাত্র ভর্তি ট্রে ভাঙলেন, বেদেনীকে কোলে বসালেন এবং মনে হল যেন জিজ্ঞেস করছেন : সে কি, মাত্র এটুকুনেই রুশী মেজাজ শেষ?
আসলে সমস্ত রুশী উপভোগের মধ্যে প্রিন্সের সবচেয়ে ভালো লেগেছিল ফরাসি অভিনেত্রী, ব্যালে নর্তকী আর সাদা ছাপ দেওয়া শ্যাম্পেন। প্রিন্স নামক জাতটার সাথে মেলামেশার অভ্যাস ছিল ভ্রন্স্কির, কিন্তু হয়ত নিজেই তিনি ইদানীং বদলে গেছেন বলে, কিংবা প্রিন্সটিকে তিনি দেখলেন বড় বেশি কাছ থেকে, এ সপ্তাহটা তাঁর মনে হয়েছিল সাঙ্ঘাতিক কষ্টকর। গোটা এই সপ্তাহটা তিনি অবিরাম নিজেকে অনুভব করেছেন সেই লোকের মত, যে বিপজ্জনক এক উন্মাদের ভার পেয়েছে, যাকে সে ভয় পায়, আবার এ ভয়ও হয় যে তার সাহচর্যে নিজেরই মাথা খারাপ না হয়ে যায়। নিজে অপমানিত না হবার জন্য কঠোর আনুষ্ঠানিকতার সুরে মুহূর্তের জন্যও ঢিলা না দেবার প্রয়োজনীয়তা অনুক্ষণ অনুভব করতেন ভ্রন্স্কি। ভ্রন্স্কিকে স্তম্ভিত করে প্রিন্সের জন্য রুশী উপভোগের ব্যবস্থা করতে যারা সোৎসাহ এত খাটত যে কহতব্য নয়, ঠিক তাদের সাথেই প্রিন্সের আচরণ ছিল অবজ্ঞাসূচক। যে রুশ নারীদের অনুধাবন করার বাসনা ছিল প্রিন্সের, তাদের সম্পর্কে তাঁর মতামতে একাধিকবার রাগে লাল হতে হয়েছে ভ্রন্স্কিকে। প্রিন্সকে যে ভ্রন্স্কির বিশেষ রকম দুর্বিসহ লেগেছিল তার প্রধান কারণটা কিন্তু এই যে তাঁর মধ্যে ভ্রন্স্কি দেখতে পাচ্ছিলেন নিজেকেই। আর সে আয়নায় যা তিনি দেখলেন সেটা তাঁর আত্মপ্রীতির তোয়াজ করেনি। প্রিন্স ছিলেন অতি নিবোধ, অতি আত্মবিশ্বাসী, অতি সুস্থ-সবল, এবং অতি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন একটা লোক, তার বেশি কিছু নয়। তিনি ছিলেন জেন্টলম্যান তা ঠিক, ভ্রন্স্কি সেটা অস্বীকার করতে পারেন না। তিনি ছিলেন ওপরওয়ালাদের কাছে সুস্থির, অপদলেহী, সমান-সমানদের সাথে আচরণ নিঃসঙ্কোচ ও সহজ আর নিম্নতনদের ক্ষেত্রে অবজ্ঞাভরে উদার। ভ্রন্স্কি নিজেও এরকম এবং মনে করতেন সেটা একটা বড় গুণ, কিন্তু প্রিন্সের তুলনায় তিনি নিম্নতর, ফলে তাঁর প্রতি এই অবজ্ঞাসূচক উদারকা ক্ষেপিয়ে তুলতে তাঁকে।
‘নির্বোধ গোমাংস! আমিও কি অমনি নাকি?’ ভাবতেন ভ্রন্স্কি।
সে যা হোক, সপ্তম দিনে প্রিন্সের মস্কো যাত্রার আগে বিদায় নিয়ে ও ধন্যবাদ পেয়ে ভ্রন্স্কি সুখীই হলেন যে অস্বস্তিকর অবস্থা আর অপ্রীতিকর আয়নাটা থেকে রেহাই পেয়েছেন। ভালুক শিকার, যেখানে সারা রাত তাঁরা রুশী হিম্মতের নমুনা দেখেছেন, সেখান থেকে ফিরে রেল-স্টেশনে তিনি বিদায় নেন প্রিন্সের কাছ থেকে।
দুই
একদিন ভ্রন্স্কি বাড়িতে ফিরে এসে আন্নার চিঠি পেলেন। তিনি লিখেছেন : ‘আমার শরীর ভালো নেই এবং মন ভালো নেই। আমি বাড়ি থেকে বেরোতে পারছি না কিন্তু আপনাকে না দেখেও আর থাকতে পারছি না। সন্ধ্যায় আসুন আমার কাছে। সাতটায় কারেনিন যাবেন পরিষদে, সেখানে থাকবেন দশটা পর্যন্ত।’ স্বামী তাঁকে বাড়িতে আসতে মানা করেছেন, অথচ সে দাবি আগ্রহ্য করে আন্না সোজাসুজি তাঁকে ডাকছেন নিজের কাছে, এই অদ্ভুত ব্যাপারটা নিয়ে মিনিটখানেক ভেবে ভ্রন্স্কি সেখানে যাবেন বলে ঠিক করলেন।
ভ্রন্স্কির সে শীতে পদোন্নতি হয়েছিল কর্নেল, রেজিমেন্ট ছেড়ে দিয়ে তিনি থাকছিলেন একা। জলযোগ সেরে তিনি তখনই শুয়ে পড়লেন সোফায় এবং গত কয়েকদিন যে বিছ্ছিরি দৃশ্যগুলো তিনি দেখেছেন, সেগুলো মিনিট পাঁচেক মনে করতে গিয়ে তা গোলমাল হয়ে জুড়ে গেল আন্না আর সেই চাষীটার ছবির সাথে, যে শিকারে ভালুক খোঁজায় একটা বড় ভূমিকা নিয়েছিল। ঘুমিয়ে পড়লেন ভ্রন্স্কি। তারপর ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে জেগে উঠলেন অন্ধকারে, তাড়াতাড়ি করে মোমবাতি জ্বালালেন। ‘কি ব্যাপার? কি হল? কি অমন ভয়ংকর দেখলাম স্বপ্নে? ও হ্যাঁ, ওই চাষীটা, ছোটখাট নোংরা একটা লোক, এলোমেলো দাড়ি, নুয়ে পড়ে কি-একটা যেন করছিল, হঠাৎ কি সব অদ্ভুত কথা বলে উঠল ফরাসি ভাষায়, তাছাড়া তো স্বপ্নে আর কিছু দেখিনি’, মনে মনে ভাবলেন তিনি, ‘কিন্তু সেটা অত ভয়াবহ হয়ে উঠল কেমন করে?’ চাষীটা আর তার দুর্বোধ্য ফরাসি কথাগুলো জলজ্যান্ত মনে পড়ল তাঁর, আতকের একটা হিমপ্রবাহ নামল পিঠ বেয়ে।
‘যতসব বাজে ব্যাপার!’ ভ্রন্স্কি এই ভেবে ঘড়ি দেখলেন। ততক্ষণে সাড়ে আটটা বেজে গেছে। চাকরকে ডেকে তিনি তাড়াতাড়ি পোশাক পরলেন, স্বপ্নের কথা একদম ভুলে, শুধু দেরি হয়ে গেছে এই অনুশোচনায় পীড়িত হয়ে তিনি বেরিয়ে এলেন অলিন্দে। কারেনিনদের গাড়ি বারান্দার কাছে গিয়ে তিনি ঘড়ি দেখলেন : ন’টা বাজতে দশ মিনিট। ঢোকার মুখে ছাইরঙের জুড়ি ঘোড়া জোতা উঁচু সংকীর্ণ একটা গাড়ি। আন্নার গাড়িটা তিনি চিনতে পারলেন। ভাবলেন, ‘আন্না আমার কাছে যেতে চাইছিল, সেই ভালো হত। এ বাড়িতে ঢুকতে আমার বিছছিরি লাগে। যাক, লুকিয়ে তো আর থাকতে পারি না। এই ভেবে, কিছুতে যার লজ্জা পাবার নেই, তেমন লোকের যে চালটা তিনি ছোট থেকে আয়ত্ত করেছেন, সেই চালে তিনি স্লেজ থেকে নেমে গেলেন দরজার দিকে। হাতে একটা কম্বল নিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এল চাপরাশি, গাড়িটাকে ডাকল। খুঁটিনাটি লক্ষ্য করতে অভ্যস্ত না হলেও ভ্রন্স্কির নজরে পড়ল যে চাপরাশি তাঁর দিকে চাইছে অবাক হয়ে। একেবারে দরজার সামনে প্রায় তাঁর ধাক্কা লাগতে যাচ্ছিল কারেনিনের সাথে। ওভারকোটের বীবর ফার কলারের তলে ঝকঝক করা সাদা গলবন্ধী আর কালো টুপি পরা তাঁর চোপসানো রক্তহীন মুখখানার ওপর সোজা এসে পড়ল গ্যাসের আলো। কারেনিনের নিশ্চল নিষ্প্রভ চোখ নিবদ্ধ হল ভ্রন্স্কির মুখের ওপর। ভ্রন্স্কি মাথা নুইয়ে অভিবাদন করলেন, কারেনিন গাল কুঁচকে হাত তুলে টুপি ছুঁয়ে বেরিয়ে গেলেন। ভ্রন্স্কি দেখলেন উনি ফিরে না তাকিয়ে উঠলেন গাড়িতে, জানালা দিয়ে কম্বল আর দূরবীন নিয়ে আড়ালে গেলেন। ভ্রন্স্কি ঢুকলেন প্রবেশ-কক্ষে। ভুরু ওঁর কোঁকানো, চোখ ঝিকঝিক করছে আক্রোশ আর গর্বের ছটায়। ভাবলেন, ‘আচ্ছা এক অবস্থায় পড়েছি! ও যদি লড়, নিজের মান বাঁচাত, তাহলে আমি কিছু একটা করতে পারতাম, প্রকাশ করতাম নিজের চিত্তাবেগ; কিন্তু এ যে দুর্বলতা, নাকি পাষণ্ডতা… ও আমাকে ফেলছে প্রবঞ্চকের অবস্থায় যেক্ষেত্রে আমি চাইনি এবং চাচ্ছি না প্রবঞ্চক হতে।’
ভেদে’র বাগানে আন্নার কাছে নিজের মনোভাব ব্যক্ত করার পর অনেক পরিবর্তন হয়েছে ভ্রন্স্কির চিন্তাধারায়। যে আন্না তাঁকে দিয়েছে সব কিছু, ভবিষ্যতের সব কিছু মেনে নিয়ে কেবল তাঁর কাছ থেকে আশা করেছেন তাঁর ভাগ্যলিপি, অজ্ঞাসারে সেই আন্নার দুর্বলতার বশীভূত হয়ে তিনি বহুদিন এ ভাবনা ছেড়ে দিয়েছেন যে তাঁদের সম্পর্কে অবসান হওয়া সম্ভব, যা তিনি ভেবেছিলেন তখন। তাঁর উচ্চাভিলাষী সব পরিকল্পনা আবার গেছে গৌণ স্থানে। যে ক্রিয়াকলাপগুলোয় সবই ছিল সুনির্দিষ্ট, তা ছেড়ে যাচ্ছেন বুঝেও তিনি আত্মসমর্পণ করলেন নিজের হৃদয়াবেগের কাছে আর সে আবেগ তাঁকে ক্রমেই বেশি করে বাঁধতে লাগল আন্নার সাথে।
প্রবেশ-কক্ষ থেকেই তাঁর কানে এল আন্নার অপসৃয়মাণ পদশব্দ। এস্কি বুঝলেন যে আন্না তাঁর প্রতীক্ষা করছিলেন, কান পেতে ছিলেন, এখন ফিরে যাচ্ছেন ড্রয়িং-রুমে।
‘না!’ চেঁচিয়ে উঠলেন আন্না, প্রথম শব্দটাতেই চোখ তাঁর ভরে উঠল পানিতে, ‘না, এভাবে চলতে থাকলে এটা ঘটবে আরো, আরো অনেক আগে!’
‘কি হল?’
‘কি? আমি অপেক্ষা করে থাকছি, কষ্ট সইছি, এক ঘণ্টা, দু’ঘণ্টা…না, করব না!… তোমার সাথে ঝগড়া করতে আমি পারব না। নিশ্চয় আসা তোমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। না, ঝগড়া করব না!’
দু’হাত তাঁর কাঁধে রেখে আন্না বহুক্ষণ প্রগাঢ় উল্লসিত, সেইসাথে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে দেখতে লাগলেন ভ্রন্স্কিকে। যে কয়দিন তিনি তাঁকে দেখেন নি তাঁর মধ্যে কি দাঁড়িয়েছে সেটা নিরীক্ষণ করতে লাগলেন তাঁর মুখ দেখে। প্রতিবার সাক্ষাতের সময় যা হয়, ভ্রন্স্কি সম্পর্কে তাঁর কল্পিত ধারণাকে (যা অতুলনীয় রকমের ভালো, আর বাস্তবে অসম্ভব) ভ্রন্স্কি আসলে যা, তার সাথে মেলাতে লাগলেন।
তিন
ওঁরা বাতির নিচে টেবিলের কাছে বসার পর আন্না জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওর সাথে দেখা হল তোমার? তোমার দেরি করে আসার এই প্রতিফল।
‘হ্যাঁ, কিন্তু কি ব্যাপার? ওঁর তো পরিষদে থাকার কথা?
‘পরিষদে গিয়েছিল; ফিরে এসে আবার কোথায় যেন গেল। ওটা কিছু নয়। ও কথা আর তুলো না। তুমি ছিলে কোথায়? সারাক্ষণ প্রিন্সের সাথে?’
ভ্রন্স্কির জীবনের সমস্ত খুঁটিনাটি আন্না জানতেন। ভ্রন্স্কি বলবেন ভাবছিলেন গতকাল সারা রাত তিনি ঘুমাননি ফলে আজ দিনে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, কিন্তু আন্নার সুখাবিষ্ট আকুল মুখখানার দিকে তাকিয়ে সে-কথা বলতে তাঁর লজ্জা হল। বললেন যে, প্রিন্সের চলে যাবার রিপোর্ট দেবার জন্য তাঁর দপ্তরে যেতে হয়েছিল।
‘তাহলে এখন চুকল? উনি চলে গেছেন?’
‘হ্যাঁ, চুকেছে। ভাবতে পারবে না—কি অসহ্য লেগেছিল আমার।’
‘কেন? এ তো তোমাদের, যুবকদের সবারই দৈনন্দিন জীবন’, আন্না বললেন দুই ভুরু জুড়ে; টেবিলে পড়ে থাকা বোনার কাজটা নিয়ে, ভ্রন্স্কির দিকে না তাকিয়ে তা থেকে ক্রুশকাঠি খুলতে লাগলেন।
‘সে জীবন আমি অনেকদিন ফেলে এসেছি’, আন্নার মুখভাবের পরিবর্তনে অবাক হয়ে এবং তার অর্থ বোঝার চেষ্টা করে ভ্রন্স্কি বললেন, ‘স্বীকার করতেই হবে’, ঘনবদ্ধ সাদা তাঁর দাঁত উদ্ঘাটিত হল হাসিতে, ‘এ সপ্তাহে সে জীবনটাকে যেন দেখেছি আয়নায়, আর দেখে ভালো লাগেনি।’
বোনার কাজটা আন্না হাতে ধরে রেখেছিলেন কিন্তু বুনছিলেন না, ভ্রন্স্কির দিকে তাকালেন একটা বিচিত্র, ঝকঝকে, সৌহাদহীন দৃষ্টিতে।
‘আজ সকালে লিজা এসেছিল আমার কাছে, কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনা সত্ত্বেও এখনো আমার কাছে আসতে ভয় পায় না ওরা’, টিপ্পনী কাটলেন আন্না, ‘তোমাদের এথেন্স সন্ধ্যার গল্প করল। কি জঘন্য!’
‘আমি শুধু বলতে চাইছিলাম যে…’
আন্না তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘তেরেজাও ছিল, যাকে তুমি জানতে আগে?’
‘আমি বলতে চাইছিলাম…’
‘কি জঘন্য তোমরা, পুরুষেরা! কেন তোমরা কল্পনা করতে পারো না যে মেয়েরা এটা ভুলতে পারে না।’ ক্রমেই উত্তেজিত হয়ে বলতে শুরু করলেন তিনি এবং তাতে করে ফাঁস করে ফেললেন তাঁর উষ্মার কারণ, ‘বিশেষ করে যে মেয়ে তোমার জীবনের কিছুই জানে না। কি আমি জানি? কি আমি জানতে পেরেছি?’ বললেন আন্না, ‘যা আমাকে তুমি বল। কিন্তু কোত্থেকে জানব যে আমাকে তুমি সত্যি চলেছ…’
‘আন্না, তুমি আমাকে অপমানিত করছ। আমাকে কি বিশ্বাস কর না তুমি? তোমাকে কি আমি বলিনি যে আমার মনে এমন কোন চিন্তা নেই যা তোমার কাছে মেলে ধরি না?’
‘হ্যাঁ, তা ঠিক’, স্পষ্টই ঈর্ষা ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করে আন্না বললেন, ‘শুধু তুমি যদি জানতে আমার পক্ষে কি কষ্টকর। বিশ্বাস করি বৈকি, বিশ্বাস করি তোমাকে…তা কি তুমি বলতে যাচ্ছিলেন?’
কিন্তু কি তিনি বলতে চাইছিলেন, ভ্রন্স্কির তা চট করে মনে এল না। ঈর্ষার এই যে প্রকোপ ইদানীং আন্নার মধ্যে দেখা যাচ্ছে ঘন ঘন, সেটাতে ভয় পেতেন তিনি যতই তা চাপা দেবার চেষ্টা করুন, তাঁর প্রতি ভালোবাসাই সে ঈর্ষাটার কারণ, তা জানা থাকা সত্ত্বেও এতে আন্নার প্রতি তাঁর উষ্ণতা শীতল হয়ে আসত। কতবার তিনি নিজেকে বলেছেন যেভাবে ভালোবাসতে পারেন তেমন এক নারী, ভালোবাসাই যাঁর কাছে জীবনের অন্য সমস্ত সৌভাগ্যের চেয়ে বড়, কিন্তু আন্নাকে অনুসরণ করে ভ্রন্স্কি যখন এসেছিলেন মস্কো থেকে তখনকার চেয়ে সে সুখ এখন তাঁর কাছে অনেক সুদূর। তখন উনি নিজেকে ভাবছিলেন অসুখী কিন্তু সুখ ছিল তাঁর সামনে; এখন কিন্তু তিনি অনুভব করছেন সেরা সুখটা ইতিমধ্যেই পেছনে পড়ে গেছে। প্রথম দিকে তিনি আন্নাকে যেরকম দেখেছিলেন, মোটেই তিনি তেমন নন। নৈতিক এবং দৈহিক, উভয় ক্ষেত্রেই তাঁর পরিবর্তন ঘটেছে অবনতির দিকে। বেশ স্থূলকায়া হয়ে গেছেন তিনি আর অভিনেত্রী তেরেজার কথা যখন বলছিলেন তখন মুখে তাঁর একটা আক্রোশ ফুটে উঠেছিল যাতে বিকৃত হয়ে গিয়েছিল মুখ। একটা ফুল ছেঁড়ার পর তা শুকিয়ে নষ্ট করেছে তা আর বিশেষ খুঁজে পাচ্ছে না, সেভাবে আন্নাকে দেখছিলেন ভ্রন্স্কি। কিন্তু তা সত্ত্বেও উনি টের পাচ্ছিলেন যে তাঁর প্রেম যখন প্রবলতর ছিল তখন প্রচণ্ড ইচ্ছা করলে সে প্রেম উৎপাটিত করতে পারতেন হৃদয় থেকে, কিন্তু এখন, এই মুহূর্তে যা তাঁর মনে হচ্ছে, আন্নার প্রতি তিনি আর প্রেম অনুভব করছেন না, তা সত্ত্বেও তাঁর জানা ছিল যে আন্নার সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিন্ন হবার নয়।
‘তা বল বল, প্রিন্স সম্পর্কে কি বলতে চাইছিলে? আমি তাড়িয়ে দিয়েছি, হ্যাঁ, তাড়িয়ে দিয়েছি পিশাচটাকে’, যোগ দিলেন। পিশাচ বলতে ওঁরা বোঝাতেন ঈর্ষা, ‘তা প্রিন্স সম্পর্কে কি বলতে শুরু করেছিলে? কেন অত কষ্টকর লেগেছিল তোমার কাছে?’
‘এহ্, অসহ্য!’ চিন্তার হারানো সূত্রটা ধরার চেষ্টা করতে করতে ভ্রন্স্কি বললেন, ‘ঘনিষ্ঠ পরিচয় থেকে ওঁর খারাপটাই বেশি চোখে পড়ে। যদি ওঁর কোন সংজ্ঞা দিতে হয়, তাহলে বলব উন চমৎকার হৃষ্টপুষ্ট একটা পশু প্রদর্শনীতে যারা প্রথম পুরস্কারে পদকটা পেয়ে থাকে, তার বেশি কিছু নয়।’ ভ্রন্স্কি বললেন বিরক্তিতে আর তাতে আগ্রহী হয়ে উঠলেন আন্না।
‘বাঃ, তা বলছ কেন?’ আপত্তি করলেন আন্না, ‘যতই হোক অনেক কিছু তো দেখেছেন উনি, শিক্ষিত লোক?’
‘ওটা একেবারে অন্য ধরনের শিক্ষা-ওদের শিক্ষা। বোঝা যায়, উনি শিক্ষিত শুধু এজন্য যাতে শিক্ষাকেই ঘৃণা করার সুযোগ পান, পাশবিক পরিতৃপ্তিটা ছাড়া যে ঘৃণা ওঁরা করেন সব কিছুকেই।
‘তোমরা সবাই তো ওই পাশবিক পরিতৃপ্তিটা ভালোবাসো’, আন্না বললেন আর ভ্রন্স্কি আবার লক্ষ্য করলেন তাঁকে এড়িয়ে যাওয়া একটা অন্ধকার দৃষ্টি।
হেসে ভ্রন্স্কি বললেন, ‘তুমি ওঁকে এতে সমর্থন করছ কেন বল তো?’
‘সমর্থন করছি না, আমার বয়েই গেল; কিন্তু আমার ধারণা, তুমি নিজে যদি এসব আনন্দ ভালো না বাসতে তাহলে না করে দিলেই পারতে। কিন্তু ইভের সাজে তেরেজাকে দেখে তো তোমার আনন্দই হল…’
‘আবার, আবার সেই দানোটা!’ টেবিলে আন্না যে হাতটা রেখেছিলেন সেটা নিয়ে চুমু খেয়ে বললেন ভ্রন্স্কি। ‘হ্যাঁ, কিন্তু আমি পারি না! তুমি জানো না তোমার পথ চেয়ে থেকে কি কষ্ট পেয়েছি আমি! আমার মনে হয় ঈর্ষাপরায়ণ নই। না, ঈর্ষা নেই আমার, বিশ্বাস করি তোমাকে, যখন তুমি থাকে আমার কাছে; কিন্তু যখন তুমি একা কে জানে কোথায় আমার কাছে অবোধ্য একটা জীবন যাপন কর… ‘
ভ্রন্স্কির কাছ থেকে সরে এলেন আন্না, বোনার কাজ থেকে শেষ ক্রশকাঠিটা খুলে দ্রুত তর্জনীর সাহায্যে বাতির আলোয় ঝলমলে সাদা উল দিয়ে ঘর তুলতে লাগলেন একটার পর একটা, দ্রুত এম্ব্রয়ডারি করা আস্তিনের মধ্যে স্নায়বিক চঞ্চলতায় ঘোরাতে লাগলেন তাঁর তনু মণিবন্ধ।
‘কিন্তু কি ব্যাপার? কারেনিনের সাথে কোথায় দেখা হল তোমার?’ হঠাৎ একটা অস্বাভাবিক ধ্বনি লাগল তাঁর কণ্ঠস্বরে। ‘দরজায় ঢোকার মুখে।’
‘তোমাকে সে অভিবাদন করেছে এমনি করে তো?
মুখ লম্বা করে আধবোজা চোখে আন্না দ্রুত তাঁর মুখের ভাব বদল করতে করতে হাত গুটিয়ে নিলেন আর তাঁর সুন্দর মুখে ভ্রন্স্কি হঠাৎ দেখতে পেলেন সে মুখভাবে কারেনিন তাঁকে অভিবাদন করেছিলেন, ঠিক সেটা। ভ্রন্স্কি হাসলেন আর খিলখিলিয়ে উঠলেন আন্না, যেটা তাঁর প্রধান একটা মাধুর্য।
ভ্রন্স্কি বললেন, ‘আমি একেবারেই ওকে বুঝি না। পল্লীভবনে তোমার কথাগুলো শোনার পর ও যদি তোমাকে ত্যাগ করত, অথবা ডাকত আমাকে, সে এক কথা…কিন্তু এটা আমি বুঝি না; এ অবস্থাটা সে সইতে পারে কমেন করে? কষ্ট যে পাচ্ছে সে তো দেখাই যায়।’
‘ও কষ্ট পাচ্ছে?’ আন্না বললেন বিদ্রূপের সুরে, ‘পুরোপুরি সন্তুষ্ট হয়ে সে আছে।’
‘কেন আমরা সবাই কষ্ট পাচ্ছি যখন সব কিছু হতে পারত দিব্যি খাশা?’
‘শুধু ও কষ্ট পাচ্ছে না। ওকে কি আমার চিনতে বাকি আছে, জানি না কি মিথ্যায় ও আকণ্ঠ ডুবে আছে?… কিছু একটা অনুভূতি থাকলে আমার সাথে ও যেভাবে আছে সেখানে থাকা সম্ভব কি? ওর কোন বোধ নেই, কোন অনুভূতি নেই। কিছু-একটা অনুভূতি থাকলে কি লোকে নিজের পাতকিনী স্ত্রীর সাথে দিন কাটাতে পারে একই বাড়িতে? কথা বলা যায় কি তার সাথে? ‘তুমি’ বলে ডাকা যায়?’
আবার আন্না অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাঁকে নকল না করে পারলেন না। ‘তুমি ma chere, আন্না প্রিয়তমা!’
‘ও পুরুষ নয়, মানুষ নয়, ও একটা পুতুল! কেউ তা জানে না। কিন্তু আমি জানি। আমি হলে আমার মত এক স্ত্রীকে অনেক আগেই খুন করতাম, টুকরো টুকরো করে ফেলতাম, বলতাম না ma chere, আন্না। ও মানুষ নয়, মন্ত্রিদপ্তরের একটা যন্ত্র। ও বোঝে না যে আমি তোমার স্ত্রী, ও আমার কাছে পর, ও ফালতু…যাক গে, ও কথা থাক!…’
‘তোমার ভুল হচ্ছে, ভুল হচ্ছে গো’, ওঁকে শান্ত করার চেষ্টায় ভ্রন্স্কি বললেন, ‘তবে সে যাই হোক, ওর সম্পর্কে কথা আর তুলব না। তার চেয়ে বরং বল কি তুমি এ কয়দিন করেছ, কি হয়েছে তোমার? অসুখটা কি, ডাক্তারে কি বলছে?’
আন্না ভ্রন্স্কির দিকে তাকালেন একটা উপহাসের আনন্দ নিয়ে। স্পষ্টতই স্বামীর হাস্যকর কদর্য আরো কিছু দিক তিনি খুঁজে পেয়েছেন, সময়ের অপেক্ষা করছেন সেটা বলার জন্য।
কিন্তু ভ্রন্স্কি বলে চললেন : ‘আমার অনুমান ওটা অসুখে নয়, এটা তোমার ওই অবস্থাটার দরুন। কবে হবে?’ উপহাসের ছটাটা মিলিয়ে গেল আন্নার চোখে, আগের মুখভাবের বদলে দেখা দিল অন্য একটা হাসি, ভ্রন্স্কির কাছে যা অজানা তেনম কিছু-একটার চেতনা আর শান্ত একটা বিষাদ।
‘শিগগিরই, শিগগিরই। তুমি বলছিলে যে আমাদের অবস্থাটা কষ্টকর, তার গিঁট খোলা দরকার। আমার অবস্থাটা কি দুঃসহ তা যদি জানতে, অবাধে, কিছুর পরোয়া না করে তোমাকে ভালোবাসতে পারলে কি না করতে পারতাম আমি! আমিও কষ্ট পেতাম না, তোমাকেও জ্বালাতাম না আমার ঈর্ষা দিয়ে…সেটা ঘটবে শিগগিরই, কিন্তু আমরা যা ভাবছি সেভাবে নয়।’
কিভাবে তা ঘটবে তা ভেবে আন্নার নিজের জন্যই এত মায়া হল যে চোখ তাঁর ভরে উঠল পানিতে। সবটা আর বলতে পারলেন না। বাতির তলে আংটি আর গাত্রবর্ণের ধ্বলিমায় ঝকঝকে হাতটা তিনি রাখলেন ভ্রন্স্কির আস্তিনে। ‘আমরা যা ভাবছি সেভাবে ঘটবে না, চাইছিলাম না কথাটা তোমাকে বলতে, কিন্তু তুমি বলিয়ে ছাড়লে। শিগগিরই সব জট খুলে যাবে আর আমরা সবাই, সবাই স্বস্তি পাব, কষ্ট ভুগতে হবে না আর।’
‘তোমার কথা বুঝতে পারছি না’, ভ্রন্স্কি বললেন এবং বললেন বুঝতে পেরেই।
‘তুমি জিজ্ঞেস করছিলে কখন? শিগগিরই। আমি সেটা পর্যন্ত বেঁচে থাকব না। বাধা দিও না তো!’ তাড়াতাড়ি করে তিনি কথাটা বলে ফেলতে চাইলেন, ‘আমি জানি এটা, একেবারে অভ্রান্ত জানি। আমি মরতে চরেছি আর মরে নিজেকে আর তোমাদের নিষ্কৃতি দিতে পারব বলে খুব খুশি।’
পানি গড়িয়ে এল চোখ বেয়ে; ভ্রন্স্কি তাঁর হাতে ওপর নুয়ে চুমু খেতে লাগলেন। চেষ্টা করলেন তাঁর ব্যাকুলতা চাপা দেবার, যার কোন ভিত্তি নেই বলে তাঁর জানা থাকলেও পারলেন না তা দমন করতে।
‘এই হল ব্যাপার, এটাই ভালো’, ভ্রন্স্কির হাতে প্রচণ্ড চাপ দিয়ে তিনি বলছিলেন, ‘এই একটা। একটা জিনিসই আমাদের বাকি আছে।’
সম্বিত ফিরে পেয়ে ভ্রন্স্কি মাথা তুলে বললেন, ‘কি বাজে কথা! কি অর্থহীন ছাইভস্ম বলছ তুমি!’
‘না, এটা সত্যি।’
‘কি, কি সত্যি?’
‘আমি মরব। স্বপ্নে তা দেখেছি আমি।’
‘স্বপ্ন?’ পুনরাবৃত্তি করলেন ভ্রন্স্কি আর মুহূর্তের জন্য স্বপ্নে দেখা চাষীটার কথা মনে পড়ল তাঁর।
‘হ্যাঁ, স্বপ্ন’, আন্না বললেন, ‘অনেকদিন আগেই স্বপ্নটা দেখেছি। দেখেছি যে আমি ছুটে ঢুকছি আমার শোবার ঘরে, কি যেন আমাকে নিতে হবে সেখান থেকে, জানতে হবে কি যেন; জানো তো, স্বপ্নে জিনিসটা কেমন হয়’, আতংকে চোখ বড় বড় করে আন্না বলছিলেন, ‘আর শোবার ঘরে, কোণে কি একটা যেন দাঁড়িয়ে।
‘আহ্, কি আজেবাজে কথা! কি করে বিশ্বাস করা যায় যে…’
কিন্তু বাধা মানলেন না আন্না। যা তিনি বলছেন সেটা তাঁর কাছে বড় বেশি জরুরি।
‘সেই কি একটা ঘুরে দাঁড়াল। দেখলাম সে আলুথালু দাড়িওয়ালা এক চাষী, ছোটখাট, ভয়ংকর দেখতে। আমি পালাতে যাইছিলাম, কিন্তু সে একটা বস্তার ওপর ঝুঁকে তার ভেতর কি যেন হাতড়াতে লাগল… ‘
কিভাবে বস্তার ভেতর ও হাতড়াচ্ছিল, সেটা দেখালেন আন্না, মুখে তাঁর আতংক। আর নিজের স্বপ্নটার কথা মনে করে একই রকম আতংক তাঁরও বুক ভরে উঠছে বলে ভ্রন্স্কি টের পেয়ে বললেন, ‘বস্তা হাতড়াতে হাতড়াতে সে হড়বড় করে ফরাসি ভাষায় কথা বলছে, জান, গড়গড়িয়ে বলছে : লোহাটা পিটাতে হবে, ঠুকতে হবে, পিষতে হবে,
আতংকে আমি জেগে উঠতে চাইছিলাম, জেগেও উঠলাম,…কিন্তু সেটা স্বপ্নেই। নিজেকে জিজ্ঞেস করতে লাগলাম কি এর মানে। কর্নেই আমাকে বলল : ‘প্রসবে, প্রসবে মারা যাবে মা, প্রসবে…’ তখন ঘুম ভেঙে গেল…’
‘কি বাজে কথা, কি বাজে কথা!’ ভ্রন্স্কি বলছিলেন কিন্তু নিজেই টের পাচ্ছিলেন যে তাঁর গলার স্বরে কোন প্রত্যয় নেই।
‘যাক গে, কথা আর তুলব না। ঘণ্টি দাও তো, আমি চা আনতে বলি। আরে দাঁড়াও, এখন আর বেশি দিন নয়…’
কিন্তু হঠাৎ থেমে গেলেন আন্না। মুহূর্তের মধ্যে বদলে গেল তাঁর মুখভাব। আতংক আর উদ্ভ্রান্তির স্থলে দেখা গেল একটা মৃদু, গুরুতর, সুখাবিষ্ট মনোযোগ। ভ্রন্স্কি এই পরিবর্তনটার কারণ বুঝতে পারলেন না। নিজের ভেতর আন্না নতুন একটা জীবনের স্পন্দন শুনতে পেয়েছিলেন।
চার
ভ্রন্স্কির সাথে অতর্কিত বাড়ির অলিন্দে সাক্ষাৎটার পর কারেনিন যা স্থির করে রেখেছিলেন সেই অনুসারে গেলেন ইতালীয় অপেরায়। সেখানে তিনি রইলেন দুটো অংক পর্যন্ত, যাদের সাথে দরকার ছিল দেখা করলেন তাদের সবার সাথে। বাড়ি ফিরে খুঁটিয়ে হল-স্ট্যান্ডটা লক্ষ করলেন, কোন সামরিক ওভারকোট ঝুলছে কিনা দেখে তিনি বরাবরের মত চলে গেলেন নিজের ঘরে। কিন্তু বরাবরের বিপরীতে বিছানায় না শুয়ে তিনি স্টাডিতে সামনে-পেছনে পায়চারি করে গেলেন রাত তিনটা পর্যন্ত। শালীনতা মান্য করতে চাননি স্ত্রী। বাড়িতে প্রণয়ীকে ডাকবেন না-তাঁর দেওয়া এই একটা শর্তও পালন করেননি, তার জন্য স্ত্রীর ওপর ক্রোধে তিনি শান্তি পাচ্ছিলেন না। তাঁর দাবি উনি অগ্রাহ্য করেছেন, সেজন্য ওঁকে শাস্তি দিতে তিনি বাধ্য, যে হুমকি তিনি দিয়েছিলেন, সেটাকে কার্যে পরিণত করবেন, বিবাহবিচ্ছেদ দাবি করে কেড়ে নেবেন ছেলেকে। তিনি জানতেন এই ব্যাপারটার সাথে সংশ্লিষ্ট সমস্ত মুশকিলের কথা, কিন্তু এটা তিনি করবেন বলেছিলেন, এবার হুমকিটা কার্যকৃত করবেন তিনি। কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনা তাঁকে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে তাঁর অবস্থায় এটাই শ্রেষ্ঠ পন্থা, সম্প্রতি বিবাহবিচ্ছেদের ব্যাপারটা এত উন্নত হয়েছে যে আনুষ্ঠানিক ঝামেলাগুলো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব বলে মনে হল কারেনিনের। তাছাড়া বিপদ তো একা আসে না, দেশের অরুশ জাতিগুলোর সুব্যবস্থা করা এবং জারাইস্কায়া গুবের্নিয়ার জমিতে সেচের ব্যাপারটা তাঁর কর্মক্ষেত্রে এত অপ্রীতির কারণ ঘটিয়েছে যে, ইদানীংকার এই গোটা সময়টা একটা চূড়ান্ত রকমের তিরিক্ষি মেজাজে ছিলেন কারেনিন।
তাঁর সারা রাত ঘুম হল না, ক্রোধ তাঁর বেড়ে উঠতে থাকল, সকাল নাগাদ তা পৌঁছলে চূড়ান্ত সীমায়। তাড়াতাড়ি করে পোশাক পরলেন তিনি এবং স্ত্রী ঘুম থেকে উঠেছেন জানা মাত্র ক্রোধের ভরা পেয়ালাটা বয়ে নিয়ে যেতে গিয়ে আবার ছিলকে না পড়ে এই ভয়ে ভয়ে, আর স্ত্রীর সাথে বোঝাপড়ার জন্য যে শক্তিটা প্রয়োজন সেটা যেন ক্রোধের সাথে সাথে খরচা না হয়ে যায় সে ভয় নিয়েও ঢুকলেন তাঁর ঘরে।
আন্না ভাবতেন যে স্বামীকে তিনি খুব ভালো চেনেন, কিন্তু স্বামী ঘরে ঢুকতে তাঁর চেহারা দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন আন্না। ললাটে ভ্রূকুটি, আন্নার দৃষ্টি এড়িয়ে অন্ধকার চোখ নিজের সামনে নিবদ্ধ; দুই ঠোঁট ঘৃণাভরে দৃঢ়সংলগ্ন। তাঁর চলনে, প্রতিভঙ্গিতে, কণ্ঠের ধ্বনিতে এমন একটা সংকল্প ও দৃঢ়তা ছিল যা স্ত্রী আগে তাঁর মধ্যে কখনো দেখেননি। ঘরে ঢুকে, স্ত্রীর সাথে সম্ভাষণ বিনিময় না করে সোজা গেলেন লেখার টেবিলে, চাবি দিয়ে দেরাজ খুলে বললেন, ‘কি চাই আপনার?’ চেঁচিয়ে উঠলেন আন্না।
‘আপনার প্রেমিকের চিঠি’, উনি বললেন।
‘এখানে তা নেই’, বলে দেরাজ বন্ধ করে দিলেন আন্না; কিন্তু বন্ধ করার ভঙ্গিটা দেখে উনি বুঝলেন যে ঠিকই ধরেছেন, রূঢ়ভাবে তাঁর হাতে ধাক্কা মেরে তিনি ক্ষিপ্র টেনে নিলেন পোর্টফোলিওটা যাতে সবচেয়ে দরকারী কাগজপত্র আন্না রাখতে বলে তিনি জানতেন। পোর্টফোলিওটা কেড়ে নিতে যাচ্ছিলেন আন্না, ক্লিতু উনি তাঁকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিলেন।
‘বসুন! আপনার সাথে কথা আছে আমার’, তিনি বললেন। পোর্টফোলিওটা বগলদাবা করে কনুই দিয়ে এমন সজোরে তাতে চাপ দিচ্ছিলেন যে কাঁধ তাঁর উঁচু হয়ে উঠল
আন্না অবাক হয়ে ভীরু-ভীরু দৃষ্টিতে নীরবে তাকিয়ে রইলেন তাঁর দিকে।
‘আপনাকে আমি বলেছিলাম যে আপনার প্রেমিককে এখানে গ্রহণ করতে আমি আপনাকে দেব না।’
‘ওর সাথে দেখা করার দরকার চিল আমার যাতে…. ‘
কোন একটা ওজর খুঁজে না পেয়ে আন্না থেমে গেলেন।
‘প্রেমিকের সাথে দেখা করা কেন নারীর কাছে প্রয়োজন তার বিস্তারিত দাখিলায় আমি যাচ্ছি না।’
‘আমি চেয়েছিলাম, আমি শুধু…’ ফুঁসে উঠে বলে উঠলেন আন্না। তাঁর এই রূঢ়তায় পিত্তি জ্বলে উঠল তাঁর, সাহস জোগাল। ‘সত্যিই কি আপনি টের পান না যে, আমাকে অপমান করা আপনার পক্ষে কত সহজ?’ আন্না বললেন।
‘অপমান করা সম্ভব কোন সৎ লোক বা সৎ নারীকে, কিন্তু চোরকে চোর বললে সেটা হয় শুধু সত্য ঘটনা প্রতিষ্ঠা।’
‘আপনার মধ্যে নিষ্ঠুরতার এই নতুন দিকটা আমার জানা ছিল না।’
স্ত্রী শালীনতা মেনে চলবে, এই শর্তে সুনামের একটা সাধু আচ্ছাদন জুগিয়ে স্বামী তাকে স্বাধীনতা দিচ্ছে, এটাকে আপনি নিষ্ঠুরতা বলছেন। এটা নিষ্ঠুরতা?’
‘এটা নিষ্ঠুরতার চেয়েও খারাপ, এটা পাষণ্ডতা’, আক্রোশে ফেটে পড়ে চিৎকার করে উঠলেন আন্না, যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালেন।
‘না!’ স্বামী চেঁচিয়ে, উঠলেন তাঁর কিঁচকিঁচে গলায় যা এখন উঠল আরো এক পর্দা উঁচুতে। এত জোরে নিজের বড় বড় আঙুলে তাঁর হাত চেপে ধরলেন যে চাপ যেখানে পড়ছিল সেই ব্রেসলেটটা থেকে লাল লাল দাগ রয়ে গেল বাহুতে, জোর করে তিনি আন্নাকে বসিয়ে দিলেন তাঁর স্বস্থানে। ‘পাষণ্ডতা?’ কথাটা যদি ব্যবহার করতে চান, তাহলে পাষণ্ডতা হল প্রেমিকের জন্যে স্বামী-পুত্রকে ত্যাগ করা আর স্বামীর অন্ন খেয়ে যাওয়া।
আন্না মাথা নিচু করলেন। গতকাল প্রেমিককে এই যে কথাটা তিনি বলেছিলেন যে ভ্রন্স্কিই তাঁর স্বামী আর এ স্বামীটা ফালতু, সেটা তিনি বললেন না শুধু নয়, বলার কথা মনেও এল না। কারনিনের কথার সমস্ত ন্যায্যতা তিনি অনুভব করছিলেন, শুধু আস্তে করে বললেন : ‘আমার অবস্থাটা আমি নিজে যতটা বুঝি, তার চেয়েও খারাপ করে সেটা দেখানো আপনার পক্ষে সম্ভব নয়, কিন্তু কেন বললেন এসব?’
‘কেন বলছি? কেন?’ একই রকম ক্রোধে বলে চললেন তিনি, ‘আপনি যাতে জানেন যে, শালীনতা মেনে চলার ব্যাপারে আপনি যেহেতু আমার ইচ্ছা পালন করেননি, তাই অবস্থাটা যাতে চুকে যায় তার ব্যবস্থা আমি করব।’
‘শিগরিই, শিগরিই সেটা ওইভাবেই চুকবে’, আন্না বললেন এবং আসন্ন আর এখন কাম্য মৃত্যুর কথা ভেবে আবার চোখে পানি এল তাঁর।
‘আপনি আর আপনার প্রেমাস্পদ, দুজনে মিলে যা ভাবছেন, চুকবে তার আগেই! পাশবিক কাম আপনারা পরিতৃপ্ত করতে চান…’
‘কারেনিন! ভূপতিতকে প্রহার করাকে আমি অনুদার বলব না, এটা অমর্যাদাকর।’
‘আপনি শুধু নিজের কথা ভাবেন, কিন্তু যে লোকটা ছিল আপনার স্বামী, তার কষ্টে আপনার কোন আগ্রহ নেই। এতে আপনার কিছু এসে যায় না যে তার গোটা জীবন চূর্ণ হয়েছে। সয়েছে সে যর…যর… যরন্ত্রণা।’
এত হুড়মুড় করে কারেনিন কথা বলছিলেন যে গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল তাঁর, শব্দটা তিনি উচ্চারণ করে উঠতে পারছিলেন না। শেষ পর্যন্ত বলে বসলেন ‘যন্ত্রণা’। আন্নার মজা লাগল আর সাথে সাথেই এই জন্য লজ্জা হল যে এরূপ একটা মুহূর্তেও কোন কিছুর জন্য তাঁর মজা লাগা সম্ভব হচ্ছে। আর এই প্রথম কেটা সহানুভূতি বোধ করলেন তিনি, নিজেকে ওঁর জায়গায় বসিয়ে কষ্ট হল ওঁর জন্য। কিন্তু কিই-বা তিনি বলতে বা করতে পারেন? মাথা নুইয়ে তিনি চুপ করে রইলেন। স্বামীও চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ, তারপর কথা বললেন কম কিঁচকিঁচে, ঠাণ্ডা গলায়, জোর দিতে লাগলেন এলোমেলো বেছে নেওয়া শব্দগুলোয় যা বিশেষ কোন গুরুত্ব ধরে না।
বললেন, ‘আমি আপনাকে বলতে এসেছি….
আন্না তাকালেন তাঁর দিকে। ‘যন্ত্রণা’ কথাটা নিয়ে যখন গোলমাল পড়েছিলেন তখন তাঁর মুখের ভাবটা স্মরণ করে মনে মনে ভাবলেন আন্না, ‘না, ওটা নেহাৎ আমার কল্পনা। এই যে মানুষটার এমন নিষ্প্রভ চোখ, এমন আত্মতুষ্ট প্রশান্তি, তার কি কোন অনুভূতি থাকতে পারে?’
‘কিছুই আমি বদলাতে পারি না’, ফিসফিসিয়ে বললেন আন্না।
‘আমি আপনাকে বলতে এসেছি যে, কাল আমি মস্কো যাচ্ছি। এ বাড়িতে আর ফিরব না। আমার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে আপনি খবর পাবেন অ্যাডভোকেটের কাছ থেকে। বিবাহবিচ্ছেদের ভারটা আমি তাঁর ওপর দিয়ে যাব।’ ছেলের সম্পর্কে কি বলতে চাইছিলেন সেটা বহু প্রয়াসে স্মরণ করে কারেনিন বললেন, ‘আর আমার ছেলে যাবে আমার বোনের কাছে।’
‘সেরিওজাকে আপনার দরকার আমাকে আরো কষ্ট দেবার জন্যে’, আড়চোখে ওঁর দিকে তাকিয়ে বললেন আন্না, ‘আপনি তো ওকে ভালোবাসেন না…ওকে রেখে যান আমার কাছে!’
হ্যাঁ, ছেলের প্রতি ভালোবাসাও আমার ঘুচে গেছে। কেননা আপনার প্রতি আমার বিতৃষ্ণার সাথে ও সম্পর্কিত। তাহলেও নেব ওকে। বিদায়!’
উনি চলে যাবার উপক্রম করলেন। কিন্তু এবারে আন্না থামালেন ওঁকে।
‘কারেনিন সেরিওজাকে রেখে যান!’ আরো একবার ফিসফিস করলেন আন্না, ‘আমি এর বেশি কিছু আর বলতে পারছি না। সেরিওজাকে রেখে যান যদ্দিন আমার…শিগগিরই আমার সন্তান হবে, রেখে যান ওকে!
কারেনিন লাল হয়ে উঠলেন, আন্নার কাছ থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ঘর থেকে নীরবে বেরিয়ে গেলেন।