পনেরো
তখনো রাস্তাটা ফাঁকা, শ্যেরবাৎস্কিদের বাড়িতে গেলেন লেভিন। সদর দরজা বন্ধ, সবাই ঘুমাচ্ছে। ফিরে এলেন তিনি হোটেলে, ঘরে গিয়ে কফি চাইলেন। ইয়েগর নয়, দিনের বেলাকার চাপরাশি তা নিয়ে এল। তার সাথে কথা বলার ইচ্ছে হয়েছিল লেভিনের, কিন্তু ঘণ্টি বেজে উঠল, চলে গেল সে। লেভিন চেষ্টা করলেন কফিটা খেতে, এক টুকরো বান রুটি মুখে দিলেন, কিন্তু সেটা নিয়ে কি করা যাবে, মুখ কিছুতেই তা বুঝতে পারছিল না। রুটিটা উগরে ফেলে ওভারকোট পরে আবার বেরোলেন লেভিন। শ্যেরবাৎস্কিদের বাড়ির গাড়িবারান্দার দ্বিতীয়বার যখন তিনি পৌঁছলেন, তখন ন’টা বেজে গেছে। বাড়ির লোকে সবে ঘুম থেকে উঠছে, বাবুর্চি গেল দোকানে। দরকার ছিল আরো দু’ঘণ্টা কাটানোর।
সেদিনের সারা রাত আর সকালটা লেভিনের কেটেছে একেবারে অচেতন অবস্থায়, নিজেকে অনুভব করছিলেন পার্থিব জীবন থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন। সারা দিন কিছু তিনি খাননি, ঘুমাননি দু’রাত, হালকা জামায় কয়েক ঘণ্টা ঘুরেছেন হিমের মধ্যে, অথচ নিজেকে এত তাজা ও সুস্থ আর কখনো বোধ করেননি তাই নয়, দেহ থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন মনে হচ্ছিল তাঁর; চলছিলেন তিনি পেশীর প্রয়াস বিনাই, মনে হচ্ছিল তিনি সব কিছু করতে পারেন তিনি নিঃসন্দেহে ছিলেন যে প্রয়োজন হলে তিনি আকাশে উড়তে পারবেন, ঠেলে সরিয়ে দেবেন বাড়ির ভিত। বাকি সময়টা তিনি কাটালেন রাস্তায়, ক্ষণে ক্ষণে ঘড়ি দেখছিলেন আর চাইছিলেন আশেপাশে।
তিনি এ সময় যা দেখেছিলেন তা পরে দেখেননি আর কখনো। বিশেষ করে স্কুলে যাচ্ছে যে ছেলেরা, ঘুঘুরঙা যে পায়রাগুলো চাল থেকে নেমে এল ফুটপাথে, ময়দা ছিটানো যে বান রুটি অদৃশ্য একটা হাত রেখে দিল জানালায়, তা অভিভূত করল তাঁকে। এই রুটি, পায়রা, ছেলে দুটোকে মনে হল অপার্থিব বস্তু। সবই ঘটল একই সময়ে’ঃ ছেলে ছুটে গেল পায়রার দিকে আর হেসে চেয়ে দেখল লেভিনকে; বাতাসে কম্পমান তুষারধূলির মধ্যে রোদে ঝকমক করে ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে গেল পায়রা, আর জানালা থেকে ভেসে এল সেঁকা রুটির গন্ধ, রেখে দেওয়া হল বান রুটি। এসব কিছু একসাথে এত সন্দুর লাগল যে আনন্দে লেভিন হেসে উঠলেন, কেঁদে ফেললেন। গাজেনি গলি আর কিসলোঙ্কায় একটা বড় চক্কর দিয়ে তিনি আবার ফিরলেন হোটেলে, ঘড়ি সামনে রেখে অপেক্ষা করতে লাগলেন কখন বাজবে বারোটা। পাশের কামরায় কথা হচ্ছিল যন্ত্রপাতি আর ঠকবাজি নিয়ে, সকালবেলার কাশি শোনা যাচ্ছিল। তারা বুঝতেই পারছে না যে ঘড়ির কাঁটা সরে আসছে বারোটার ঘরে। সরেও এল। লেভিন বেরিয়ে এলেন গাড়িবারান্দায়। বোঝাই যায় যে গাড়োয়ানরা সবই যেন জানত। সহর্ষ আনন্দে তারা লেভিনকে ঘিরে বচসা করতে লাগল নিজেদের মধ্যে, সবাই তারই গাড়িতে যাবার অনুরোধ করল লেভিনকে। কারো মনে আঘাত না দেবার চেষ্টা করে তাদের গাড়িতেও যাবে এই প্রতশ্রুতি দিয়ে লেভিন একটা গাড়ি নিয়ে বললেন শ্যেরবাৎস্কিদের ওখানে যেতে। গাড়োয়ানটি চমৎকার, কাফতানের তল থেকে বেরিয়ে আসা কামিজের সাদা কলারে ঘেরা রক্তোজ্জ্বল, তেজী গর্দান স্লেজটা তার উঁচু, আয়েসী, এমন স্লেজে পরে আর কখনো লেভিন ওঠেননি, ঘোড়াও সুন্দর, চেষ্টা করছিল স্লেজ টানার, কিন্তু নড়ছিল না জায়গা থেকে। গাড়োয়ান শ্যেরবাৎস্কিদের বাড়ি চিনত, আরোহীর প্রতি বিশেষ সম্মান জানিয়ে হাত ঘের করে, ‘পুরু’ বলে গাড়ি থামাল গাড়িবারান্দার কাছে। শ্যেরবাৎস্কিদের চাপরাশি নিশ্চয় সব জানত। সেটা বোঝা গেল তার চোখের হাসি আর কথা থেকে : ‘অনেকদিন আসা হয়নি, কনস্তান্তিন দৃদ্মিত্রিচ!’
সবই সে জানত শুধু তাই নয়, স্পষ্টতই বেশ উল্লসিত বোধ করছিল সে, চেষ্টা করছিল নিজের আনন্দ লুকিয়ে রাখার। তার বৃদ্ধ সহৃদয় চোখের দিকে চেয়ে লেভিন সুখে আরো নতুন কিছু-একটার স্বাদ পেলেন।
‘সবাই উঠেছেন?’
‘জ্বি, যান ভেতরে। আর এটা এখানেই রেখে যান’, লেভিন যখন তাঁর টুপি সাথে নেবার জন্য ফিরতে আসছিলেন, সে বলল। এটারও অর্থ আছে কিছু।
‘কাকে খবর দেব?’ জিজ্ঞেস করল চাকর।
চাকরটা ছোকরা আর নতুন চাকরদের মত কিছু সাহেব গোছের হলেও বেশ সজ্জন, ভালামানুষ, সেও সব বুঝতে পারছিল।
লেভিন বললেন, ‘প্রিন্স-মহিষী… প্রিন্স… প্রিন্স কন্যাকে … ‘
প্রথম যে ব্যক্তিটিকে তিনি দেখলেন, তিনি মাদমোয়াজেল লিনোঁ। মুখ আর কোঁকড়া চুল জ্বলজ্বলিয়ে তিনি আসছিলেন হল পেরিয়ে। তাঁর সাথে কথা বলতে না বলতেই হঠাৎ দরজার বাইরে শোনা গেল পোশাকের খসখস শব্দ, মাদমোয়াজেল লিনোঁও পলকে আদৃশ্য হলেন লেভিনের দৃষ্টিপথ থেকে, সুখের সান্নিধ্যের একটা সানন্দ আতংক অভিভূত করল তাঁকে। মাদমোয়াজেল লিনোঁ তাঁকে ছেড়ে রেখে তাড়াতাড়ি করে গেলেন অন্য দরজায়। আর তিনি যেতেই দ্রুত লগু পদক্ষেপ শোনা গেল মেজের পার্কেটে এবং তাঁর যা সুখ, তাঁর জীবন, তিনি নিজে, নিজের চেয়েও যা বেশি, এতদিন যার অপেক্ষা করেছেন তিনি, খুঁজছেন, দ্রুত তা কাছিয়ে এল তাঁর দিকে, এল না, অদৃশ্য কোন এক শক্তি ভাসিয়ে আনল তাকে।
তিনি দেখলেন শুধু তার চোখ—স্বচ্ছ, ন্যায়পর, তাঁর নিজের বুক যে আনন্দঘন ভালোবাসায় ভরা,
সেই ভালোবাসায় সে চোখ ত্রস্ত, জ্বলজ্বল করে সে চোখ ক্রমেই কাছিয়ে আসতে লাগল, ভালোবাসার দীপ্তিতে চোখ ধাঁধিয়ে দিলে লেভিনের। কিটি থামলে একেবারে লেভিনের কাছে,ত তাঁর গা ছুঁয়ে। হাত তার উঠে গিয়ে নামল লেভিনের কাঁধে।
যা সম্ভব সবই করল সে—ছুটে এল লেভিনের সানন্দে আত্মসমর্পণ করল। লেভিন আলিঙ্গন করলেন তাকে, যে মুখ চুম্বন ভিক্ষা করছিল, লেভিন তাঁর ঠোঁট চেপে ধরলেন সে মুখে।
কিটিও সারা রাত ঘুমায়নি। সেদিন সারা সকাল অপেক্ষা করেছে তাঁর জন্য। মা আর বাবা সম্মত ও তার সুখে সুখী হয়েছিলেন বিনা দ্বন্দ্বে। লেভিনের অপেক্ষা করছিল যে, চেয়েছিল নিজের ও তাঁর সুখের কথা সে তাঁকে জানাবে সর্বপ্রথম। একা তাঁর সাথে দেখা করার জন্য সে তৈরি হয়েছিল, সে কথাটা ভেবে তার আনন্দ হচ্ছিল, আবার সংকোচ হচ্ছিল, লজ্জা পাচ্ছিল, নিজেই জানত না কি সে করছে। লেভিনের পদশব্দ আর কণ্ঠস্বর তার কানে গিয়েছিল, দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে সে অপেক্ষা করছিল কখন মাদমোয়াজেল লিনোঁ চলে যাবেন। চলে গেলেন তিনি। কোন কিছু না ভেবে, কি-কেন নিজেকে জিজ্ঞাসামাত্র না করে কিটি চলে গিয়েছিল তাঁর কাছে এবং যা করেছে সেটা করে ফেলল।
‘চলুন, মায়ের কাছে যাই’, ওঁর হাত টেনে নিয়ে কিটি বলল। বহুক্ষণ লেভিন কিছু বলতে পারলেন না, সেটা এই জন্য ততটা নয় যে কথায় তাঁর হৃদয়াবেগের ইচ্ছায় নষ্ট হয়ে যাবে বলে ভয় হচ্ছিল তাঁর, যতটা এই কারণে যে প্রতিবার কিছু-একটা বলতে গেলেই তিনি অনুভব করছিলেন যে কথার বদলে সুখের অশ্রুজল ছাপিয়ে উঠবে তাঁর চোখে। কিটির হাত টেনে নিয়ে চুমু খেলেনে তিনি
‘সত্যিই কি এটা সত্যি?’ অবশেষে রুদ্ধকণ্ঠে বললেন তিনি, ‘আমি বিশ্বাস করতে পারছি না যে তুমি ভালোবাসো আমাকে!’
এই ‘তুমি’ কথাটা শুনে আর যে ভীরুতায় তিনি তাকালেন তার দিকে, তাতে হাসল কিটি।
‘হ্যাঁ, ধীরে ধীরে’, কথাটাকে অর্থে ভরে তুলে সে বলল, ‘ভারি সুখী আমি!’
লেভিনের হাত না ছেড়ে কিটি ঢুকল ড্রয়িং-রুমে। তাঁদের দেখে প্রিন্স মহিষীর নিঃশ্বাস পড়তে লাগল ঘন ঘন, তখনই কেঁদে ফেললেন তিনি, আবার তখনই হাসলেন আর লেভিনের পক্ষে আশাতীত সতেজ পদক্ষেপে এলেন তাঁদের কাছে; লেভিনের মাথা জড়িয়ে ধরে তাঁকে চুমু খেয়ে চোখের পানিতে ভিজিয়ে দিলেন তাঁর গাল।
‘তাহলে সব চুকল! আনন্দ হচ্ছে আমার। ওকে তুমি ভালোবাসো। আনন্দ হচ্ছে আমার…ও কিটি!’
‘তাহলে সব ঠিক করে নিলে চটপট’, বৃদ্ধ প্রিন্স বললেন উদাসীন থাকার চেষ্টা করে, কিন্তু লেভিনের সাথে যখন কথা বললেন লেভিনের নজরে পড়ল চোখ ওঁর ভেজা।
‘অনেক দিন থেকেই আমি এটাই চাইছিলাম’, লেভিনের হাত ধরে নিজের দিকে টেনে এনে বললেন, ‘এমন কি তখনই যখন এই ছেবলাটার মাথায় ঢুকেছিল…’
‘বাবা!’ চেঁচিয়ে উঠে কিটি তাঁর মুখ বন্ধ করে দিলে হাত দিয়ে। 1
‘নে হয়েছে, হয়েছে, বলব না’, বললেন উনি, ‘আমি খুবই, খুবই আন…আহ্ কি হাঁদা আমি…’
কিটিকে আলিঙ্গন করে তিনি তার মুখ, হাত এবং আবার মুখ চুম্বন করে ক্রুশ-চিহ্ন আঁকলেন তার ওপর।
আর এই যে বৃদ্ধ প্রিন্স আগে তাঁর কাছে ছিল বাইরের লোক, তাঁর প্রতি নতুন একটা প্রীতি জেগে উঠল লেভিনের মনে যখন তিনি দেখলেন কিভাবে তাঁর মাংসল হাতে অনেকখন ধরে সস্নেহে চুমু, খাচ্ছে কিটি।
ষোলো
ইজি-চেয়ারে বসে চুপচাপ হাসছিলেন প্রিন্স-মহিষী; প্রিন্স বসলেন তাঁর পাশে। কিটি বাবার হাত না ছেড়ে দাঁড়িয়ে রইল তাঁর চেয়ারের কাছে। চুপ করে রইলেন সবাই।
প্রিন্স-মহিষীই প্রথম সব কিছু কথায় ব্যক্ত করলেন, সমস্ত ভাবনা ও অনুভবগুলোকে টেনে আনলেন বাস্তব প্রশ্নে। প্রথম মুহূর্তে সেটা সকলের কাছেই সমান অদ্ভুত, এমন কি বেদনাদায়ক মনে হল।
‘তাহলে কবে? আশীর্বাদ চাই, লোকদের জানাতে হবে। কবে হবে বিয়ে? কি তুমি ভাবছ আলেকজান্ডার?’
‘ওই’, লেভিনকে দেখিয়ে বললেন বৃদ্ধ প্রিন্স, ‘ওই এ ব্যাপারে মুখ্য ব্যক্তি।’
‘কবে?’ লেভিন বললেন লাল হয়ে, ‘কালই। আমার মত যদি চান, তাহলে আমার মনে হয় আজ আশীর্বাদ কাল বিয়ে।’
‘রাখো তো যত বাজে কথা, mon cher!‘
‘তাহলে এক সপ্তাহ বাদে।’
‘একেবারে পাগলা।’
‘কেন আমার!’ ওঁর এই ব্যস্ততায় সানন্দে হেসে বললেন মা, ‘আর যৌতুক?
‘যৌতুক-টৌতুকও চাই নাকি?’ সভয়ে ভাবলেন লেভিন, ‘তবে যৌতুক আর আশীর্বাদ-টাশীৰ্বাদ—এসব কিছু সুখ মাটি করে দিতে পারে? কোন কিছুতেই এটা মাটি হবার নয়!’ উনি তাকালেন কিটির দিকে, লক্ষ্য করলেন যে যৌতুকের কথায় মোটেই, মোটেই অপমানিত বোধ করছে না সে। ভাবলেন, ‘তাহলে এটার দরকার আছে।’
‘আমার তো কিছু জানা নেই। শুধু নিজের ইচ্ছের কথাটা বললাম’, লেভিন বললেন কাঁচুমাচু হয়ে।
‘তাহলে ঠিক করা যাক। এখন আশীর্বাদ আর লোককে খবর দেওয়া যেতে পারে। এই ঠিক।’
প্রিন্স-মহিষী স্বামীর কাছে গিয়ে তাঁকে চুমু খেয়ে চলে যেতে চাইছিলেন, কিন্তু প্রিন্স তাঁকে ধরে রাখলেন, আলিঙ্গন করলেন তাঁকে, নবীন প্রণয়ীর মত কোমল হেসে চুমু, খেলেন কয়েকবার। বৃদ্ধেরা স্পষ্টতই মুহূর্তের জন্য আত্মহারা হয়ে ঠিক বুঝতে পারছিলেন না তাঁরাই আবার প্রেমে পড়েছেন নাকি তাঁদের মেয়ে। প্রিন্স আর প্রিন্স-মহিষী চলে গেলে লেভিন কিটির কাছে গিয়ে তার হাত ধরলেন। এখন তিনি নিজের ওপর কর্তৃত্ব ফিরে পেয়েছেন, কথা বলতে পারেন আর বলার কথা তাঁর অনেক। কিন্তু যা বলার কথা মোটেই সেটা বললেন না তিনি।
‘ওহ্, আমি জানতামই যে এই হবে! তবে আশা করিনি কিছু; কিন্তু মনে মনে সব সময় নিশ্চিত ছিলাম’, বললেন তিনি, ‘আমার বিশ্বাস এটা আমার নির্বন্ধ।’
‘আর আমি?’ কিটি বলল, ‘এমন কি তখনো…’ থেমে গিয়ে সে আবার তার ন্যায়পরায়ণ চোখে তাঁর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে যেতে লাগল, ‘এমন কি তখনও, যখন নিজের সুখকে আমি ঠেলে সরিয়ে দিয়েছিলাম। সব সময় আমি শুধু আপনাকেই ভালোবেসেছি। তবে মোহে পড়েছিলাম। সেটা আপনাকে বলতেই হবে… আপনি কি তা ভুলে যেতে পারবেন?’
বোধ হয় সেটা ভালোই। আমার অনেক কিছু ক্ষমা করতে হবে আপনাকে। আমার বলা উচিত।…’
কিটিকে লেভিন যা যা বলতে চেয়েছিলেন এটা তার একটা। উনি ঠিক করেছিলেন যে কিটিকে বলবেন দুটো বিষয়—উনি তার মত পূতপবিত্র নন, আর দ্বিতীয়ত, উনি নাস্তিক। বলাটা কষ্টকর কিন্তু উনি মনে করেছিলেন, দুটো কথাই বলা উচিত
‘না, এখন নয়, পরে হবে!’ বললেন তিনি।
‘বেশ, পরেই হবে। কিন্তু অবশ্য-অবশ্য বলবেন। কিছুতেই ভয় নেই আমার। সব কিছু জানা আমার দরকার। এখন তো সব ঠিক হয়ে গেছে।’
কিটির কথাটা লেভিন সম্পূর্ণ করলেন : ‘ঠিক হয়ে গেছে যে আমি যাই হই, যাই ছিলাম না কেন, আপনি আমাকে নেবেন, ত্যাগ করবেন না? তাই কি?’
‘তাই, তাই।’
তাঁদের কথোপকথন বাধা দিলেন মাদমোয়াজেল লিনোঁ। অকপট না হলেও কোমল হাসি হেসে তিনি অভিনন্দন জানালেন আদরের শিক্ষার্থিনীকে। তিনি যেতে না যেতেই অভিনন্দন জানাতে এল চাকর-বাকরেরা, তারপর এলন আত্মীয়-স্বজনেরা, শুরু হল স্বর্গসুখের এমন একটা ডামাডোল যা থেকে লেভিন মুক্তি পেয়েছিলেন কেবল বিয়ের পরের দিন। লেভিনের সব সময় অস্বস্তি আর বিরক্তিকর ঠেকছিল কিন্তু সুখ তাঁর ক্রমাগত উঠতে লাগল পঞ্চমে। কেবলি তিনি টের পাচ্ছিলেন যে তিনি যা জানেন না এমন অনেক কিছুই তাঁর কাছে থেকে আশা করছে লোকে, এবং তাঁকে যা বলা হল সেগুলো করে তিনি আনন্দই পেলেন। তিনি ভেবেছিলেন যে তাঁর বিয়েটা অন্য বিয়ের মত হবে না, বিয়ের সাধারণ ব্যাপার-স্যাপারগুলো তাঁর অসাধারণ সুখকে পণ্ড করবে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল তিনি তাই করছেন যা করে অন্য লোকেরা আর এ থেকে সুখ তাঁর বেড়েই চলল, হয়ে উঠল তা মোটেই অন্য লোকের মত নয়, নিজের অসাধারণ একটা সুখ।
‘এখন আমরা মিষ্টি খাব’, বললেন মাদমোয়াজেল লনোঁ আর লেভিনও ছুটলেন মিষ্টি কিনতে ‘ভারি আনন্দ হচ্ছে’, বললেন সি্ভ্য়াজ্স্কি, ‘আমি তোমাকে বলব, ফুলের তোড়া কোন ফোমিনের দোকান থেকে।’
‘কেন, দরকার বুঝি?’ ছুটলেন তিনি ফোমিনের দোকানে।
বড় ভাই বললেন, ‘টাকা ধার করা দরকার। কেননা অনেক খরচ আছে, উপহার আছে…’
‘উপহারও চাই?’ ছুটলেন তিনি ফুলদে’র কাছে।
আর মিষ্টিওয়ালা, ফোমিন, ফুলদে—সর্বত্রই তিনি দেখলেন যে সবাই তাঁর প্রত্যাশায় ছিল, সবাই তাঁর সুখে আনন্দিত, উল্লসিত যেমন আর সবাই যাদের সাথে এ দিনগুলোয় তাঁর কাজকর্ম ছিল। আশ্চর্য এই যে সবাই তাঁকে ভালোবাসছে শুধু নয়, আগে যারা তাঁর প্রতি ছিল নিরুত্তাপ, অদরদী, উদাসীন, তারা সবাই আন্দ করছে তাঁর সাথে, মেনে নিচ্ছে তাঁর মত, সৌজন্য সহকারে সম্মান করছে তাঁর ভাবাবেগ, সায় দিচ্ছে তাঁর এই অভিমতে যে দুনিয়ায় তিনি সবচেয়ে সুখী লোক, কারণ তাঁর বধূ পূর্ণতার পরাকাষ্ঠা। কিটিরও মনোভাব ছিল সেইরকম। কানউন্টের নক্স্টন যখন এই ইঙ্গিত করার সদিচ্ছা করেন যে আরো ভালো কিছু তিনি চাইতে পারতেন, কিটি তখন এত ক্ষেপে ওঠে আর এমন নিশ্চিত যুক্তি দিয়ে দেখায় যে দুনিয়ায় লেভিনের চেয়ে ভালো আর কেউ হতে পারে না, যে কাউন্টেস নস্টনকেসেটা স্বীকার করতে হয়, এবং কিটি উপস্থিত থাকলে সপ্রশংস হাসি না হেসে তিনি অর্থনা করতেন না লেভিনকে।
শুধু খোলাখুলি স্বীকৃতির যে প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছিলেন, সেটাই ছিল এ সময়টার সবচেয়ে দুঃসহ ব্যাপার। বৃদ্ধ প্রিন্সের সাথে পরামর্শ করে তাঁর অনুমতি পেয়ে লেভিন কিটিকে দেন তাঁর দিনলিপি যাতে লেখা ছিল কি তাঁর যন্ত্রণা। এটা তিনি লিখেছিলেন ভবিষ্যৎ বধূর কথা মনে রেখে। দুটো জিনিস যন্ত্রণা দিয়েছিল তাঁকে—তাঁর অপাপবিদ্ধতার লঙ্ঘন আর ধর্মে অবিশ্বাস। অবিশ্বাসের স্বীকৃতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি। কিটি নিজে ধর্মবিশ্বাসী, ধর্মে, মূল সত্যগুলোয় কখনো সন্দেহ হয়নি তার, কিন্তু লেভিনের বাহ্যিক অবিশ্বাসে একটুও বিচলিত বোধ করেনি সে। ভালোবাসা দিয়ে লেভিনের সমস্ত অন্তরটা সে জানে আর সে অন্তরে সে দেখছে যা সে চাইছিল, আর এ অন্তরকে যদি বলা হয় অধর্মীয় তাতে কিছু এসে যায় না। অন্য স্বীকৃতিটা কিন্তু হাহাকারে কাঁদিয়েছে তাকে।
অভ্যন্তরীণ একটা সংগ্রাম বিনাই লেভিন তাকে তাঁর দিনলিপি দিয়েছিলেন এমন নয়। তিনি জানতেন যে তাঁর আর কিটির মধ্যে কোন গোপনতা থাকতে পারে না, থাকা উচিত নয়, তাই ঠিক করেছিলেন এটাই সঠিক কাজ; কিন্তু তার প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে সেটা তিনি ভেবে দেখেননি, তার স্থানে তিনি বসাননি নিজেকে। শুধু সেদিন সন্ধ্যায় যখন তিনি থিয়েটারে যাবার আগে ওঁদের ওখানে যান, কিটির ঘরে ঢোকেন আর তাকে তিনি যে অপূরণীয় কষ্ট দিয়েছেন তাতে করে অশ্রুপ্লাবিত, দুঃখার্ত, করুণ আর মধুর মুখখানা দেখেন, তখন তিনি বোঝেন কি অতল ব্যবধান তাঁর কলঙ্কজনক অতীত আর কিটির কপোতসূলভ শুচিতার মধ্যে, যা করেছেন তার জন্য ভয় হল তাঁর।
‘নিয়ে যান, নিয়ে যান এই ভয়ংকর খাতাগুলো!’ সামনে টেবিলের ওপর পড়ে থাকা খাতাগুলো ঠেলে সরিয়ে দিয়ে কিটি বলল, ‘কেন ওগুলো দিয়েছেন আমাকে!…না, এ বরং ভালো; লেভিনের করুণ মুখ দেখে সে যোগ করল, ‘তাহলেও এটা সাংঘাতিক, সাংঘাতিক!’
মাথা নিচু করে নীরবে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। কিছুই বলতে পারলেন না।
পরে ফিসফিস করলেন, ‘আপনি ক্ষমা করবেন না আমাকে।’
‘না ক্ষমা, আমি করেছি, কিন্তু এটা সাংঘাতিক!’
তবে লেভিনের সুখ এত বিপুল যে এই স্বীকৃতিতে তা ধূলিসাৎ তো হলই না,বরং নতুন একটা অর্থে তা পুলকিত করল তাঁকে। কিটি ক্ষমা করেছে তাঁকে; কিন্তু সেই থেকে তিনি কিটির কাছে নিজেকে আরো বেশি অযোগ্য বলে গণ্য করতে লাগলেন, তার নৈতিক উচ্চতার কাছে আরো বেশি মাথা নত করলেন, আরো বেশি মূল্য দিলেন নিজের অন্যায্য সুখে।
সতেরো
যে কথাবার্তাগুলো হয়েছিল ডিনারের সময় এবং পরে, অজ্ঞাতসারে সেগুলো মনে মনে নাড়াচাড়া করতে করতে কারেনিন ফিরলেন তাঁর একলা কামরাটায়। ক্ষমা করা নিয়ে দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা যা বলেছিলেন, শুধু সেটাই তাঁকে পীড়া দিচ্ছিল। নিজের ক্ষেত্রে খ্রিস্টীয় নীতি প্রয়োগ করা বা না করা বড় বেশি কঠিন একটা প্রশ্ন যা নিয়ে লঘুচিত্তে কিছু বলা অনুচিত, আর বহু আগেই কারেনিন এ প্রশ্নটার নৈতিকবাচক উত্তর দিয়ে রেখেছেন। যত কিছু শোনা গিয়েছিল তার ভেতর তাঁর মনে গেঁথে দিয়েছিল নির্বোধ, সহৃদয় তুরোৎসিনের কথাটা : বাহাদুরের মত কাজ করেছেন, ডুয়েলে ডেকে দিলেন খতম করে। সবাই স্পষ্টতই এই মতই পোষণ করে যদিও সৌজন্যবশত সেটা মুখ খুলে বলেনি।
কারেনিন নিজেকে বোঝালেন, ‘তবে ব্যাপারটা স্থির হয়ে গেছে, ও নিয়ে ভাবার কিছু নেই।’ এবং শুধু নিজের আসন্ন যাত্রা আর নিয়ন্ত্রণ কমিশনের কথা ভাবতে ভাবতে তিনি ঢুকলেন নিজের কামরায় আর হোটেলের যে চাপরাশি তাঁকে এগিয়ে দিচ্ছিলেন, তাকে বললেন তাঁর চাকরটা কোথায়; সে বলল যে চাকর এইমাত্র বেরিয়ে গেছে। কারেনিন তাঁকে চা দিতে বলে বসলেন এবং গাইডবাই নিয়ে দেখতে লাগলেন তাঁর পর্যটন-পথ।
চাকর ফিরে এসে ঘরে ঢুকে বলল, ‘দুটো টেলিগ্রাম আছে। মাপ করবেন, হুজুর। আমি এইমাত্র বেরিয়েছিলাম।’
কারেনিন টেলিগ্রাম নিয়ে তার সীল ভাঙলেন। প্রথম টেলিগ্রামটায় এই খবর দেওয়া হয়েছে যে কারেনিন যে পদটার প্রার্থী ছিলেন সেটা পেয়েছেন গ্রেমভ। টেলিগ্রাম ছুঁড়ে ফেলে লাল হয়ে তিনি পায়চারি করতে লাগলেন। ‘সৃষ্টিকর্তা যাদের মারতে চান তাদের বুদ্ধিভ্রংশ করেন’, এ পদ নির্বাচনের যারা সহযোগিতা করেছে কথাটায় তাদের মনে করে লাতিন ভাষায় বললেন তিনি। এ পদটা যে তিনি পেলেন না, তাঁকে যে স্পষ্টতই এড়িয়ে যাওয়া হল, এত তিনি তেমন ক্ষুব্ধ হননি; কিন্তু তাঁর কাছে দুর্বোধ্য, বিস্ময়কর ঠেকল কি করে ওদের চোখে পড়ল না যে বাচাল, বুলিবাগীশ গ্রেমভ অন্য সবার চেয়ে ও পদের অযোগ্য। কি করে ওদের চোখে পড়ল না যে এই নির্বাচনে ওরা সর্বনাশ করছে নিজেদের, ক্ষুণ্ন করছে নিজেদের মর্যাদা।
‘এই ধরনেরই আরো একটা কিছু হবে’, দ্বিতীয় টেলিগ্রামটা খুলতে খুলতে পিত্তি জ্বলিয়ে তিনি বললেন মনে মনে টেলিগ্রামটা স্ত্রীর কাছ থেকে নীল নেপসিলে লেখা ‘আন্না’ স্বাক্ষরটা প্রথম চোখে পড়ল তাঁর ‘মরছি, আসবার জন্যে মিনতি করছি, ক্ষমা পেয়ে মরে যাব নিশ্চিন্তে’, পড়লেন তিনি। ঘৃণাভরে তিনি হাসলেন, ছুঁড়ে ফেলে দিলেন টেলিগ্ৰাম। এটা যে একটা ছলনা, ধূর্ততা, এ বিষয়ে প্রথম মুহূর্তে তাঁর কোন সন্দেহই ছিল না।
‘কোন ছলনাতেই সে দ্বিধা করবে না। তবে প্রসব হবার কথা। হয়ত এটা তার প্রসবকালীন পীড়া। কিন্তু কি উদ্দেশ্যে? সন্তানকে বৈধ করার জন্যে, আমাকে হতমান করে বিবাহবিচ্ছেদের বাধা দেবার জন্যে?’ ভাবলেন তিনি, ‘কিন্তু লিখেছে যে : মরছি …’ টেলিগ্রামটা আবার পড়লেন তিনি; আর তাতে যা লেখা ছিল তার সাক্ষাৎ অর্থটা হঠাৎ অভিভূত করল তাঁকে। ‘যদি এটা সত্যি হয়?’ মনে মনে ভাবলেন তিনি, ‘যদি যন্ত্রণার মুহূর্তে, মৃত্যু সান্নিধ্যে তার সত্যিই অনুতাপ হয়ে থাকে, আর আমি যদি এটাকে ছলনা ভেবে যেতে আপত্তি করি? এটা শুধু নিষ্ঠুরতা হবে, সবাই ধিক্কার দেবে আমাকে, তাই না, আমার পক্ষ থেকে এটা হবে মূর্খামি।’
তিনি চাকরকে বললেন, ‘পিওত্র, একটা গাড়ি ডাক, আমি পিটার্সবুর্গ যাচ্ছি।’
কারেনিন স্থির করলেন পিটার্সবুর্গ গিয়ে স্ত্রীকে দেখবেন। যদি তার পীড়াটা ছলনা হয়, তাহলে তিনি কিছুই না বলে চলে যাবেনর। আর যদি সত্যিই সে হয় অসুস্থ, মরণাপন্ন, মৃত্যুর আগে দেখতে চাইছে তাঁকে, তাহলে ও জীবিত থাকরে তাকে তিনি ক্ষমা করবেন আর বড় বেশি দেরি হয়ে গেলে শেষকৃত্য করে যাবেন।
কি তাঁকে করতে হবে, সারা রাস্তায় সে কথাটা আর ভাবলেন না তিনি।
রেল কামরায় কাটানো রাতটার ফলে একটা অপরিচ্ছন্নতার বোধ আর ক্লান্তি নিয়ে পিটার্সবুর্গের প্রভাতী কুয়াশায় তিনি ফাঁকা নেভস্কি সড়ক দিয়ে চললেন সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে, কি তাঁর কপালে আছে সে কথা মোটেই ভাবছিলেন না। সে কথা ভাবতে তিনি পারছিলেন না কারণ কি হবে সেটা কল্পনা করতে গেলেই যত মুশকিলে তিনি পড়েছেন, আন্নার মৃত্যুতে তৎক্ষণাৎ তার আসান হয়ে যাবে এই ধারণাটা তাড়ানো যাচ্ছিল না। রুটিওয়ালা ছোঁড়া, দরজা-বন্ধ দোকান, রাতের ছ্যাকরা গাড়ির গাড়োয়ান, ফুটপাত সাফ করার ঝাড় দার ভেসে যেতে লাগল তাঁর চোখের সমুখ দিয়ে। আর এসবই তিনি নিরীক্ষণ করতে লাগলেন কি তাঁর কপালে আছে যার যা চাইবার সাহস তাঁর নেই অথচ চাইছেন, সে ভাবনাটা চাপা দেবার চেষ্টা করে। গেলেন গাড়ি-বারান্দার দিকে। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল একটা ছ্যাকরা গাড়ি কোচোয়ান আর তাতে ঘুমন্ত সহিস। অলিন্দে যেতে যেতে কারেনিন মস্তিষ্কের কোন এক সুদূর প্রান্ত থেকে যেন টেনে আনলেন নিজের সিদ্ধান্ত এবং সেটা গুছিয়ে নিলেন। তার অর্থ দাঁড়াল : যদি ছলনা হয়, তাহলে ঘৃণাভরে স্থিরতা বজায় রেখে চলে যাওয়া। যদি সত্যি হয় তাহলে সৌজন্য পালন।’
কারেনিন ঘণ্টি দেবার আগেই দরজা খুলল চাপরাশি। টাই ছাড়া পুরানো একটা ফ্রক-কোট আর ঘরোয়া জুতো পরা চাপরাশি পেত্রভ বা কাপিতোনিচকে দেখাচ্ছিল অদ্ভুত।
‘গিন্নির খবর কি?’
কাল ভালোয় ভালোয় প্রসব হয়েছে।’
বিবর্ণ হয়ে থমকে দাঁড়ালেন কারেনিন। এখন তিনি পরিষ্কার বুঝতে পারলেন কি ভয়ানক আন্নার মৃত্যুকামনা করছিলেন তিনি।
‘আর স্বাস্থ্য?’
সকাল বেলাকার অ্যাপ্রন পরা কর্নেই নেমে এল সিঁড়ি দিয়ে। বলল, ‘খুব খারাপ। কাল ডাক্তারদের পরামর্শ- বৈঠক হয়েছে। এখন ডাক্তার এখানেই।’
‘জিনিসগুলো তোল’, কারেনিন বললেন এবং এখনো তাহলে মৃত্যুর আশা আছে এই সংবাদে খানিকটা হালকা হয়ে তিনি ঢুকলেন প্রবেশ কক্ষে।
র্যাকে একটা ফৌজী ওভারকোট ঝুলতে দেখে তিনি বললেন : ‘কে আছে ওখানে?’
‘ডাক্তার, ধাই আর কাউন্ট ভ্ৰন্স্কি।’
অন্তঃপুরে ঢুকলেন কারেনিন। ড্রয়িং-রুমে কেউ ছিল না; তাঁর পদশব্দ শুনে বেগুনি ফিতে লাগানো টুপি পরা ধাই বেরিয়ে এল আন্নার স্টাডি থেকে।
কারেনিনের কাছে এসে সে মৃত্যুর সন্নিকটতা হেতু অন্তরঙ্গতায় তাঁর হাত ধরে নিয়ে গেল শোবার ঘরে। বলল, ‘যাক, আপনি এসে গেছেন! কেবলই আপনার কথা, শুধু আপনার কথা।’
‘বরফ দিন শিগগির!’ শোবার ঘর থেকে শোনা গেল ডাক্তারের হুকুমদার গলা।
কারেনিন গেলেন আন্নার স্টাডিতে। সেখানে নিচু একটা টুলে পাশকে ভাবে বসে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কাঁদছিলেন ভ্রন্স্কি। ডাক্তারের গলা শুনে লাফিয়ে উঠলেন তিনি, মুখ থেকে হাত সরাতেই দেখতে পেলেন কারেনিন। স্বামীকে দেখে তিনি এত বিব্রত হয়ে গেলেন যে বসে পড়লেন আবার, ঘাড়ের মধ্যে মাথা এমনভাবে গুটিয়ে আনলেন যেন কোথাও হোক অন্তর্ধান করতে চান; তবে নিজের ওপর জোর খাটিয়ে বললেন : ‘ও মারা যাচ্ছে। ডাক্তাররা বলেছে কোন আশা নেই। এটা অবশ্য আপনার ইচ্ছাধীন, কিন্তু এখানে থাকতে দিন আমাকে…তবে এটা আপনার যা ইচ্ছে, আমি…’
ভ্রন্স্কির চোখে পানি দেখে কারেনিন বিচলিত বোধ করলেন যেমনটা তাঁর হত অন্য লোকের কষ্ট দেখলে, মুখ ফিরিয়ে ভ্রন্স্কির কথা সবটা না শুনে চলে গেলেন দরজার দিকে। শোবার ঘর তেকে শোনা যাচ্ছিল আন্নার গলা, কি যেন বলছেন। গলার স্বর ওঁর সজীব, প্রফুল্ল, সুনির্দিষ্ট জোর পড়ছে এক-একটা শব্দে। শোবার ঘরে ঢুকে কারেনিন গেলেন পালঙ্কের কাছে। আন্না শুয়েছিলেন ওঁর দিকে মুখ করে। গাল রক্তিম, ঝকঝকে চোখ, ছোট ছোট সাদা হাত ব্লাউজের আস্তিন থেকে বেরিয়ে এসে খেলা করছে কম্বলের কিনারা নিয়ে। তাঁকে শুধু সুস্থ ও সবল দেখাচ্ছিল তাই নয়, মেজাজও চমৎকার। কথা বলছিলেন দ্রুত, ঝঙ্কৃত, অসাধারণ সঠিক আর সাবেগ টানে।
কেননা আলেক্সেই, আমি বলছি কারেনিনের কথা (কি বিচিত্র, ভয়ংকর নির্বন্ধ যে দুজনেই আলেক্সেই, তাই না?) আলেক্সেই আমাকে ত্যাগ করল না। আমিও ভুলে যেতাম, সেও ক্ষমা করত…কিন্তু কেন আসছে না সে? ভারি সে ভালো লোক, নিজেই জানে না কত ভালো। আহ্, হে আল্লাহ্, কি যে বিছ্ছিরি লাগছে! তাড়াতাড়ি একটু পানি খেতে দিন আমাকে! আহ্, এতে যে আমার মেয়েটার ক্ষতি হবে! বেশ, ঠিক আছে, ওকে দিন ধারা-মা’র কাছে! সেই বরং ভালো। ও আসবে, খুকিকে দেখলে কষ্ট হবে ওর। ওকে দিয়ে দিন ধাই মা’র কাছে।’
আন্না আর্কাদিয়েভনা, উনি এসেছেন। এই-যে উনি!’ ধাই বলল কারেনিনের দিকে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে।
‘আহ্, কি ছাইভস্ম!’ আন্না বলে চললেন স্বামীকে লক্ষ্য না করে। ‘দাও ওকে, খুকিকে দাও আমাকে! এখনো ও এল না। ক্ষমা করবে না তোমরা বলছ কারণ ওকে চেনো না তোমরা। কেউ চিনতে না, চিনতাম শুধু একা আমি, তাও কি কষ্টই না হয়েছে। দেখা উচিত ওর চোখ দু’খানা, সেরিওজারও অমনি চোখ, তাই সে দিকে তাকাতে পারি না। সেরিওজাকে খেতে দেওয়া হয়েছে? আমি যে জানি, সবাই ওকে ভুলে থাকবে। ও হলে ভুলত না। সেরিওজাকে নিয়ে আসা দরকার কোণের ধরটায়, মারিয়েটকে বলা হোক ওর সাথে শুতে।’
হঠাৎ উনি কুঁকড়ে এলেন, চুপ করে গেলেন, যেন কোন একটা আঘাতের ভয়ে আত্মরক্ষায় হাত তুললেন মুখের কাছে। স্বামীকে দেখতে পেয়েছেন।
‘না-না’, আন্না বলে চললেন, ‘ওকে আমি ভয় পাই না, ভয় পাই মরণকে। আলেক্সেই এসো এখানে। বড় তাড়া আমার, কেননা সময় নেই, বেঁচে থাকব মাত্র কিছুক্ষণ, এখনই জ্বর উঠবে, তখন কিছুই আর বুঝতে পারব না। এখন পারছি, সব বুঝতে পারছি, দেখতে পাচ্ছি সবই।’
কারেনিনের কুঞ্চিত মুখে ফুটে উঠল যন্ত্রণা। আন্নার হাত ধরলেন তিনি, কি একটা বলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু কিছুতেই পারলেন না; নিচের ঠোঁট কাঁপছিল, কিন্তু তখনও তিনি লড়ছিলেন নিজের ব্যাকুলতার সাথে, আন্নার দিকে তাকাচ্ছিলেন শুধু মাঝে-মধ্যে। আর যতবার তাকাচ্ছিলেন, নজরে পড়ছিল আন্নার চোখ যা তাঁর প্রতি নিবদ্ধ ছিল এমন একটা মিনতি আর উচ্ছ্বসিত কোমলতা নিয়ে যা আগে তিনি দেখেননি কখনো।
‘দাঁড়াও তুমি জানো না…দাঁড়াও, দাঁড়াও…’ থেমে গেলেন আন্না, যেন নিজের ভাবনটা গুছিয়ে নিতে চান ‘হ্যাঁ’, শুরু করলেন তিনি, ‘হ্যাঁ-হ্যাঁ, তোমাকে যা বলতে চাইছিলাম। আমার ব্যাপারে অবাক হয়ো না। আমি সেই একই আছি…আমার মধ্যে আছে আরেকজন, আমি ভয় করি তাকে, সে ভালোবাসে ঐ লোকটাকে, চেয়েছিলাম তোমাকে ঘৃণা, করতে, কিন্তু আগে আমি যা ছিলাম সে সত্তাটাকে ভুলতে পারিনি। ও মেয়েটা আমি নই। এখন আমি আসল, গোটাটাই। আমি এবার মরছি, জানি যে মরছি, জিজ্ঞেস করো ওকে। এখনই আমি টের পাচ্ছি এই তো হাতে, পায়ে আঙুলে মন খানেক করে ভার। আঙুলগুলো দেখো-না, কি বিরাট। তবে এ সব শিগগিরই ঢুকে যাবে…শুধু একটা জিনিস আমার দরকার : আমাকে ক্ষমা করো তুমি, করে দাও পুরোপুরি। আমি যাচ্ছেতাই, কিন্তু আমার ধাই-মা যা বলত : সন্ন্যাসিনী কৃচ্ছ্রসাধিকা-কি যেন তার নাম? সে তো আমার চেয়েও খারাপ। রোমে চলে যাব আমি, মরুভূমি আছে সেখানে, তখন কারো ব্যাঘাত ঘটাব না, শুধু সেরিওজাকে সাথে নেব, আর খুকিটিকে …না, তুমি ক্ষমা করতে পারো না! আমি জানি, এটা যে ক্ষমা করা চলেনা! না, না, চলো যাও, বড় বেশি ভালো তুমি!’ উত্তপ্ত এক হাতে তিনি ধরে রইলেন তাঁর হাত, অন্য হাতে ঠেলতে লাগলেন তাঁকে।
কারেনিনের প্রাণের বেদনা ক্রমেই বেড়ে উঠে এমন পর্যায়ে পৌঁছল যে সেটা দমন করার চেষ্টা তিনি ছেড়ে দিলেন; হঠাৎ তিনি অনুভব করলেন যে প্রাণের বেদনা বলে যেটাকে ভাবছিলেন সেটা উল্টো বরং প্রাণের একটা পরামানন্দের অবস্থা, যা হঠাৎ তাঁকে দিচ্ছে নতুন একটা সুখ, যা আগে তিনি পাননি কখনো। তিনি ভাবেননি যে সারা জীবন যা তিনি অনুসরণ করতে চেয়েছেন সেই খ্রিস্টীয় অনুশাসনটাই তাঁকে তাঁর শত্রুদের ক্ষমা করতে ও ভালোবাসতে বলছে; কিন্তু শত্রুকে ভালোবাসা ও ক্ষমার একটা সুখানুভূতিতে বুক তাঁর ভরে উঠল। নতজানু হয়ে বসলেন তিনি, মাথা রাখলেন আন্নার হাতের ভাঁজে, ব্লাউজের তল থেকে তা পুড়িয়ে দিচ্ছিল তাঁর কপাল, কাঁদতে লাগলেন শিশুর মত। আন্না তাঁর কেশ বিরল মাথা জড়িয়ে ধরলেন, তাঁর দিকে সরে এসে দৃপ্ত গর্বে চোখ তুললেন ওপরে।
‘দ্যাখো কেমন লোক, আমি তো জানতামই! এবার বিদায় সকলের কাছ থেকে বিদায়!…আবার এসেছে ওরা, কেন ওরা চলে যাচ্ছে না?…আহ্, খুলে নাও না আমার ওভারকোট!’
ডাক্তার তাঁর হাতে খসিয়ে সন্তর্পণে তা রাখলেন বালিশের ওপর, কাঁধ পর্যন্ত ঢেকে দিলেন। বাধ্যের মত শুয়ে রইলেন আন্না, জ্বলজ্বলে চোখে চেয়ে থাকলেন সামনের দিকে।
‘শুধু একটা কথা মনে রেখো, আমার চাই ক্ষমা, আর কিছুই আদার দরকার নেই…ও আসছে না কেন?’ দরজায় ভ্রন্স্কিকে লক্ষ্য করে আন্না বললেন, ‘এসো, করমর্দন কর ওর।’
খাটের কিনারার কাছে এসে ভ্রন্স্কি আবার তাঁকে দেখে আবার মুখ ঢাকলেন হাত দিয়ে।
‘মুখ খোলো, ওর দিকে চাও। সাধু ও’, আন্না বললেন, খোলো, মুখ খোলো তো!’ রাগত স্বরে বলে উঠলেন তিনি, ‘কারেনিন, ওর হাত সরিয়ে নাও! আমি ওর মুখ দেখতে চাই।’
কারেনিন হাত সরিয়ে দিলেন ভ্রন্স্কির মুখ থেকে যা যন্ত্রণা আর লজ্জায় ভয়াবহ হয়ে উঠেছিল।
‘ওকে হাত দাও। ক্ষমা করো ওকে।
চোখ থেকে যে পানি ঝরছিল তা সম্বরণের চেষ্টা না করে তিনি হাত বাড়িয়ে দিলেন।
‘সৃষ্টিকর্তা মহান, সৃষ্টিকর্তা মহান’, আন্না বললেন, ‘এবার সব তৈরি। কেবল পা দুটো একটু লম্বা করে দিলে ভালো হয়। হ্যাঁ, ওইরকম, আহ্ চমৎকার! কি রুচিহীন এই ফুলগুলো, একেবারেই ভায়োলেটের মত নয়’, ওয়ালপেপার দেখিয়ে বললেন তিনি, ‘মাগো, মাগো। কখন এসব চুকবে? মর্ফিয়া দিন আমাকে। ডাক্তার! মর্ফিয়া দিন। মাগো, মাগো!’
বিছানায় ছটফট করতে লাগলেন তিনি।
এই ডাক্তার এবং অন্য ডাক্তাররাও বলেছিলেন যে এটা প্রসবের জ্বর, শতকরা নিরানব্বই ক্ষেত্রেই যার পরিণাম মৃত্যু। সারা দিন চলল জ্বর, ভুল বকা, সংজ্ঞাহীনতা। মাঝ রাতের দিকে রোগিণী পড়ে রইলেন অসাড় হয়ে, নাড়ী প্রায় ছিল না।
প্রতি মুহূর্তে লোকে প্রতীক্ষা করছিল অন্তিমটার জন্য।
ভ্রন্স্কি বাড়ি চলে গেলেন কিন্তু সকালে ফিরে এলেন খবর নিতে। প্রবেশ-কক্ষে তাঁকে দেখে কারেনিন বললেনঃ ‘থেকে যান, হয়ত চাইবে আপনাকে’, এবং নিজেই তাঁকে নিয়ে গেলেন স্ত্রীর স্টাডি ঘরে।
সকালে আবার শুরু হল ব্যাকুলতা, উত্তেজনা, চিন্তা ও উক্তির ক্ষিপ্রতা, এবং আবার শেষ হল সংজ্ঞানতায়। তৃতীয় দিনেও তাই চলল, ডাক্তাররা বললেন আশা নাকি আছে। সেদিন স্টাডিতে গেলেন কারেনিন, যেখানে বসে ছিলেন ভ্রন্স্কি, দরজা বন্ধ করে বসলেন তাঁর মুখোমুখি।
‘কারেনিন’, কৈফিয়তের পালা কাছিয়ে আসছে অনুভব করে ভ্রন্স্কি বললেন, ‘আমি কথা বলতে পারছি না, কিছু বুঝতেও পারছি না। কৃপা করুন আমাকে। আপনার যত কষ্টই হোক, আমার অবস্থা তার চেয়েও খারাপ।’
উঠতে যাচ্ছিলেন তিনি কিন্তু কারেনিন তাঁর হাত ধরে বললেন : ‘অনুরোধ করি, আমার কথাগুলো শুনুন, এর প্রয়োজন আছে। আমার মনোভাবগুলো আপনাকে বুঝিয়ে বলা উচিত, যার দ্বারা আমি চালিত হয়েছি এবং হব যাতে আমার সম্পর্কে আপনার মনে কোন বিভ্রান্ত না থাকে। আপনি জানেন যে আমি বিবাহবিচ্ছেদ করব বলে স্থির করেছিলাম এবং ব্যাপারটা শুরুও করে দিয়েছিলাম। আপনার কাছে লুকাব না যে শুরু করে দ্বিধায় পড়েছিলাম, কষ্ট পাচ্ছিলাম আমি; স্বীকার করছি যে ওর এবং আপনার ওপর প্রতিশোধ নেবার বাসনা আমাকে পেয়ে বসেছিল। যখন আমি টেলিগ্রাম পাই, তখন আমি এখানে এসেছিলাম একই মনোভাব নিয়ে, বলা উচিত তারও বেশি, মৃত্যু কামনা করেছিলাম ওর। কিন্তু…’ চিন্তায় খানিক চুপ করে রইলেন, নিজের মনোভাব ওঁর কাছে প্রকাশ করবেন কি করবেন না, ‘কিন্তু ওকে দেখার পর আমি ক্ষমা করি। ক্ষমার সুখ আমাকে বলে দেয় কি আমার কর্তব্য। ক্ষমা করেছি পুরোপুরি। অন্য গালটাও পেতে দিতে চাই আমি। কেউ আমার কোট কেড়ে নিলে কামিজটাও দিতে চাই তাকে। সৃষ্টিকর্তার কাছে আমার শুধু একটাই প্রার্থনা, ক্ষমার সুখ যেন আমার কাছ থেকে নিয়ে না নেন!’ চোখে তাঁর পানি আর সে চোখের প্রশান্ত দৃষ্টি বিস্মিত করল ভ্রন্স্কিকে। ‘এই আমার অবস্থা। আপনি আমাকে কাদায় ধামসাতে পারেন, সমাজের কাছে একটা হাসির পাত্র করে তুলতে পারেন আমাকে, কিন্তু ওকে আমি ত্যাগ করব না, আপনাকেও ভর্ৎসনা কবর না কখনো’, বলে চললেন উনি, ‘আমার কর্তব্য আমার সামনে সুস্পষ্ট : ওর সাথে আমাকে থাকতে হবে এবং থাকব। ও যদি আপনাকে দেখতে চায়, আমি জানাব, কিন্তু এখন, আমি মনে করি আপনার বিদায় নেওয়া ভালো।’
উঠে দাঁড়ালেন তিনি, ফোঁপানিতে বন্ধ হয়ে গেল কথা। ভ্রন্স্কিও উঠে দাঁড়ালেন এবং নুয়ে, খাড়া না হয়ে কপালের তল থেকে চাইছিলেন তাঁর দিকে। কারেনিনের অনুভূতিটা তিনি বুঝতে পারছিলেন না। তবে টের পাচ্ছিলেন যে সেটা একটা উঁচুদরের হৃদয়াবেগ, তাঁর যা দৃষ্টিভঙ্গি তাতে করে সেটা তাঁর পক্ষে এমন কি অনধিগম্যই
আঠারো
কারেনিনের সাথে কথাবার্তার পর ভ্রন্স্কি বেরিয়ে এসে কারেনিনদের বাড়ির দেউড়িতে থেমে চেষ্টা করে স্মরণ করতে চাইলেন—কোথায় তিনি, কোথায় যেতে হবে তাঁকে। নিজেকে লজ্জিত, অপমানিত, দোষী আর নিজের অবমাননা মুছে ফেলার সুযোগ থেকে বঞ্চিত বলে বোধ করছিলেন তিনি। যে বাঁধা-রাস্তা দিয়ে তিনি এযাবৎ অমন সগর্বে আর অনায়াসে এগিয়ে এসেছেন, তা থেকে নিজেকে নিক্ষিপ্ত বলে বোধ হচ্ছিল তাঁর। জীবনের যেসমস্ত অভ্যাস আর নিয়ম তাঁর ভারি দৃঢ় বলে মনে হত, হঠাৎ দেখা গেল সেগুলো মিথ্যা আর অপ্রয়োজ্য। প্রতারিত যে স্বামীকে তাঁর এতদিন মনে হয়েছিল করুণ একটি জীব, তাঁর সুখের পথে একটা আপতিক এবং খানিকটা হাস্যকর অন্তরায়, হঠাৎ আন্না নিজেই তাকে ডেকে পাঠালেন, তুলে দিলেন হীনতাবোধ জাগাবার মত একটা উচ্চতায়, আর সে উচ্চতায় এ স্বামী মোটেই আক্রোশপরায়ণ নয়, মিথ্যাচারী নয়, হাস্যকর নয়, সহৃদয়, সহজ, মহিমান্বিত। এটা অনুভব না করে ভ্রন্স্কি পারলেন না। হঠাৎ বদলে গেল ভূমিকা দুটো। ভ্রন্স্কি অনুভব করলেন স্বামীর উচ্চতা, নিজের হীনতা, তার ন্যায্যতা, নিজের অন্যায়। অনুভব করলেন যে নিজের দুঃখেও স্বামী মহানুভব আর নিজের প্রতারণায় তিনি নীচ আর তুচ্ছ। কিন্তু যে ব্যক্তিকে তিনি অন্যায়ভাবে অবজ্ঞা করেছেন তার কাছে এই হীনতাবোধ তাঁর শোচনার অল্পাংশ মাত্র। নিজেকে তাঁর অবর্ণনীয় অসুখী মনে হল এই জন্য যে এখন যখন তিনি বুঝলেন যে চিরকালের জন্য আন্নাকে হারিয়েছেন, তখন আন্নার জন্য যে হৃদয়াবেগ নিভে আসছে বরে তাঁর ইদানীং মনে হয়েছিল, সেটা এত প্রবল হয়ে উঠ যা আর কখনো হয়নি। অসুখের সময় তিনি আন্নার সমস্তটা দেখতে পেয়েছেন, দেখেছেন তাঁর অন্তঃস্থল, আর তাঁর মনে হয়েছে এতদিন পর্যন্ত তিনি ভালোবাসেননি তাঁকে। এখন, তিনি যখন তাঁকে জানলেন, তখন তাঁর বুকে এমন একটা ভালোবাসা উথলে উঠল যেভাবে তাঁকে ভালোবাসা উচিত; তাঁর কাছে তিনি হীন হয়েছেন, চিরকালের জন্য হারালেন তাঁকে শুধু নিজের লজ্জাকর স্মৃতি রেখে গেলেন তাঁর মনে। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার তাঁর সেই হাস্যকর, কলংকজনক দশা যখন কারেনিন তাঁর হাত সরিয়ে দেন তাঁর লজ্জিত মুখ থেকে। কারেনিনদের বাড়ির দেউড়িতে হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি, ভেবে পাচ্ছিলেন না কি করবেন।
‘গাড়ি ডাকব কি?’ জিজ্ঞেস করল চাপরাশি।
‘হ্যাঁ, গাড়ি!’
তিনটি বিনিদ্র রাতের পর ঘরে ফিরে ভ্রন্স্কি পোশাক না ছেড়ে, হাত গুটিয়ে মাথার তলে রেখে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লেন সোফায়। মাথা তাঁর ভারি। অতি বিচিত্র সব ছবি, স্মৃতি, চিন্তা অসাধারণ দ্রুততা আর স্পষ্টতায় আদল-বদল হতে থাকল : এই তিনি রোগিণীর জন্য চামচে ওষুধ ঢালতে গিয়ে উপছে ফেললেন, কখনো দেখা গেল ধাত্রীর সাদা হাত, কখনো-বা খাটের কাছে মেঝেতে কারেনিনের বিচিত্র অবস্থান।
‘ঘুম! বিস্মরণ!’ মনে মনে বললেন তিনি সুস্থ লোকের এই আত্মবিশ্বাস নিয়ে যে ক্লান্ত হয়েসে যদি ঘুমাতে চায়, তাহলে তখনই ঘুমিয়ে পড়বে। আর সত্যিই সেই মুহূর্তেই তাঁর মাথার মধ্যে সব গোলমাল হয়ে যেতে লাগল, বিস্মরণের অতল গহ্বরে পড়তে থাকলেন তিনি। অচেতন জীবনের সাগরতরঙ্গ বইত লাগল তাঁর মাথার ওপর দিয়ে, হঠাৎ যেন বিদ্যুৎপ্রবাহের একটা প্রবল আঘাত ছুঁয়ে গেল তাঁকে, এমনভাবে তিনি চমকে উঠলেন যে সোফার স্প্রিঙের ওপর সারা দেহ তাঁর লাফিয়ে উঠল, দু’হাতে ভর দিয়ে সভয়ে হাঁটু গেড়ে বসলেন তিনি। চোখ তাঁর বিস্ফারিত, যেন কখনো তিনি ঘুমাননি। মাথার ভার, অঙ্গপ্রতঙ্গের শিথিলতা যা তিনি এক মিনিট আগেও অনুভব করেছেন, হঠাৎ অন্তর্ধান করল তা।
‘আপনি আমাকে কাদায় ধামসাতে পারেন’, শুনলেন তিনি কারেনিনের গলা দেখলেন তাঁকে নিজের সামনে, দেখলেন আতপ্ত রক্তিমোচ্ছ্বাস আর জ্বলজ্বলে চোখ নিয়ে আন্নার মুখ কোমলতা আর ভালোবাসায় তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে নয়, কারেনিনের দিকে; তাঁর মুখ থেকে তিনি যখন হাত সরিয়ে দেন, নিজের তখনকার উজবুক আর হাস্যজনক মূর্তিটা, যা তাঁর মনে হচ্ছিল, চোখে পড়ল তাঁর। আবার তিনি পা টান করে আগের ভঙ্গিতে শুলেন সোফায়, চোখ বন্ধ করলেন।
‘ঘুম! ঘুম!’ পুনরাবৃত্তি করতে লাগলেন মনে মনে। কিন্তু চোখ বন্ধ করেও তিনি পরিষ্কার দেখতে পেলেন আন্নার মুখ, যেমন তাঁকে দেখেছিলেন ঘোড়দৌড়ের আগের দিনটার সন্ধ্যায়।
‘সেটা আর নেই, সে আর হবে না, আন্না এটা মুছে ফেলতে চায় স্মৃতি থেকে। অথচ এ ছাড়া আমি বাঁচতে পারি না। কিভাবে মেলা যায় আমাদের, কিভাবে মেলা যায়?’ উনি বললেন সরবেই আর অজান্তে তার পুনরাবৃত্তি করতে থাকলেন। শব্দের এই পুনরাবৃত্তিতে যে নতুন নতুন ছবি ও স্মৃতিগুলো তাঁর মাথায় ভিড় করে আসছে বলে তিনি টের পাচ্ছিলেন তা সংযত হচ্ছিল। কিন্তু সংযত হচ্ছিল অল্পক্ষণের জন্য। অসাধারণ দ্রুততায় একের পর এক দেখা দিতে থাকল সুখের সেরা মুহূর্তগুলো আর সেইসাথে সাম্প্রতিক হীনতা। আন্নার স্বর বলছে, ‘হাত সরিয়ে নাও’। হাত তিনি সরিযে নিচ্ছেন আর টের পাচ্ছেন কি বোকা-বোকা লজ্জিত দেখাচ্ছে তাঁ মুখ।
শুয়েই রইলেন তিনি, চেষ্টা করলেন ঘুমাতে যদিও বুঝতে পারছিলেন তার সামান্যতম আশাও নেই, আর নতুন ছবির উদয় ঠেকাবার জন্য মনে যে কোন একটা চিন্তার আকস্মিক দু’একটা শব্দ ফিসফিস করতে লাগলেন। কান পেতে থেকে তিনি শুনলেন অদ্ভুত, উন্মাদ একটা ফিসফিসানিতে একই কথার পুনরাবৃত্তি : ‘কদর করতে পারেনি, কাজে লাগাতে পারি না; কদর করতে পারেনি, কাজে লাগাতে পারিনি।’
তিনি মনে মনে ভাবলেন, ‘কি ব্যাপার? নাকি পাগল হয়ে যাচ্ছি আমি? সম্ভবত। কেন লোকে পাগল হয়, কেন গুলি করে নিজেকে?’ নিজেই নিজেকে জবাব দিয়ে চোখ মেলতেই অবাক হয়ে দেখলেন মাথার কাছে ভ্রাতৃবধূ ভারিয়ার এম্ব্রয়ডারি করা নকশি বালিশ। বালিশের ঝালরটা নেড়ে তিনি ভাবতে চেষ্টা করলেন ভারিয়ার কথা, কবে তাঁকে তিনি দেখেছেন শেষ বার। কিন্তু দূরের কোন ব্যাপার নিয়ে ভাবতে যাওয়া কষ্টকর। ‘না, ঘুমাতে হবে!’ বালিশটা তিনি টেনে এনে মাথায় গুঁজলেন, কিন্তু চোখ বন্ধ রাখার জন্য জোর করতে হচ্ছি। ধড়মড়িয়ে উঠে বসলেন তিনি। ভাবলেন, ‘আমার পক্ষে ওটা চুকে গেছে। ভাবতে হবে কি করা যায়। কি বাকি রইল?’ আন্নার প্রতি তাঁর ভালোবাসা বাদ দিয়ে তাঁর যে জীবন, দ্রুত তার ওপর চোখ বুলিয়ে নিলেন তিনি।
‘উচ্চাকাঙ্ক্ষা? সেপুখোভস্কয়? উচ্চ সমাজ? রাজদরবার?’ কোনটাতেই চিন্তা তাঁর স্থির হতে পারছিল না। এ সবেরই কিছু অর্থ ছিল আগে, কিন্তু এখন নেই। সোফা থেকে উঠলেন তিনি, ফ্রক-কোট খুলে ফেলে বেল্ট খসিয়ে, ভালো করে নিঃশ্বাস নেবার জন্য রোমশ বুক উন্মুক্ত করে তিনি পায়চারি করতে লাগলেন কামরায়। এভাবেই পাগল হয়ে যায় লোকে’,. পুনরাবৃত্তি করলেন তিনি, ‘এভাবেই নিজেকে গুলি করে…যাতে লজ্জা বোধ করতে না হয়’, ধীরে ধীরে যোগ দিলেন।
দরজার কাছে গিয়ে তিনি তা বন্ধ করে দিলেন; তারপর স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে দাঁত চেপে তিনি গেলেন টেবিলের কাছে, রিভলবার বের করে সেটাকে চেয়ে দেখলেন, গুলিভরা রিভলবারটা ফেরালেন নিজের দিকে এবং ভাবতে লাগলেন। বিভলবার হাতে নিশ্চল হয়ে তিনি মাথা নিচু করে একটা তীব্র মুখভাব নিয়ে চিন্তা করলেন মিনিট দুয়েক ‘বটেই তো’, নিজেকে বললেন তিনি যেন যুক্তি-পরস্পরাগত, দীর্ঘায়ত ও পরিষ্কার একটা চিন্তাধারা তাঁকে নিয়ে এসেছে সন্দেহাতীত সিদ্ধান্তে। তাঁর কাছে প্রত্যয়জনক এই ‘বটেই তো’, টা আসলে এই সময়টায় সেই একই যেসব স্মৃতি ও ছবি বারবার ভেসে উঠেছে তাঁর মনে, তার পুনরাবৃত্তির ফল। চিরকালের জন্য হারানো সেই একই সুখস্মৃতি, ভবিষ্যৎ জীবনের অর্থহীনতার সেই একই ধারণা, নিজের হীনতার সেই একই চেতনা। এসব ধারণা ও অনুভূতির পারম্পর্য ও সেই একই।
স্মৃতি ও ভাবনার সেই একই দুষ্ট চক্রে আবার যখন তাঁর মন ঘুরছে তৃতীয় বার তখন আবার পূনরাবৃত্তি করলেন তিনি, ‘বটেই তো’, এবং বুকের বাঁ দিকে রিভলবার ঠেকিয়ে প্রচণ্ড কম্পমান হাত হঠাৎ যেন মুঠো করে ঘোড়া টিপলেন। গুলির শব্দ তিনি শুনতে পাননি, কিন্তু বুকে ভয়ানক একটা ঘা খেয়ে পড়ে গেলেন তিনি। টেবিলের কিনারাটা তিনি ধরতে গিয়েছিলেন, রিভলবারটা খসে পড়ল আর তিনি টলে উঠে বসে পড়লেন মেঝেয়, অবাক হয়ে দেখতে লাগলেন চারদিক। নিচু থেকে টেবিলের বাঁকা পায়া, বাজে কাগজের ঝুড়ি, বাঘের চামড়া দেখে নিজের ঘরখানাকে তিনি চিনতে পারছিলেন না। ড্রয়িং-রুম দিয়ে ছুটে আসা চাকরের ক্যাককেঁচে দ্রুত পদশব্দে সম্বিৎ ফিরল তাঁর। জোর করে ভেবে ভেবে তিনি বুঝলেন যে তিনি মেঝেয় পড়ে আছেন এবং বাঘের চামড়ায় আর হাতে রক্ত দেখে টের পেলেন যে তিনি গুলি করেছেন নিজেকে 1
‘যাঃ! ফসকে গেছে!’ বিভলবারটার জন্য মেজে হাতড়াতে হাতড়াতে তিনি বললেন। রিভলবার ছিল তাঁর কাছেই, কিন্তু তিনি খুঁজছিলেন আরো দূরে। খুঁজতে খুঁজতে তিনি অন্য দিকে ঝুঁকলেন আর ভারসাম্য রাখতে না পেরে পড়ে গেলেন রক্ত ঝরাতে ঝরাতে।
জুলপিওয়ালা সভ্যভব্য যে চাকরটা একাধিকবার তার স্নায়ুদৌর্বল্যের অনুযোগ করেছে পরিচিতদের কাছে, মনিবকে মেঝেয় পড়ে থাকতে দেখে সে এতই ভয় পেয়ে গেল যে রক্ত নিঃসরণের জন্য তাঁকে ফেলে রেখে ছুটল লোক ডাকতে। এক ঘণ্টা পরে ভ্রাতৃবধূ ভারিয়া এলেন তিনজন ডাক্তার নিয়ে। এঁদের জন্য চতুর্দিকে লোক পাঠিয়েছিল সে আর এলেন তাঁরা একই সময়ে। আহতকে বিছানায় শুইয়ে ভারিয়া তাঁর সেবায় রইলেন।
উনিশ
কারেনিন স্ত্রীর সাথে সাক্ষাতের জন্য প্রস্তুত হবার সময় একটা ভুল করেছিলেন : এমন সম্ভাবনা তিনি ভেবে দেখেননি যে স্ত্রীর অনুতাপ হবে আন্তরিক; তিনি তাঁকে ক্ষমা করবেন এবং সে মারা যাবে না। মস্কো থেকে ফেরার দু’মাস পরে এই ভুলটা তার সমস্ত প্রবলতায় প্রকট হয়ে উঠল তাঁর কাছে। কিন্তু ভুলটা তিনি করেছিলেন শুধু এই থেকে নয় যে সম্ভাবনাটা তিনি ভেবে দেখেননি, এজন্যও যে মুমূর্ষু স্ত্রী সাথে সাক্ষাতের এই দিনটার আগে পর্যন্ত নিজের হৃদয়কে তিনি জানতেন না। রুগ্না স্ত্রীর শয্যাপার্শ্বে তিনি জীবনে প্রথম একটা মর্মস্পর্শী সমবেদনার কাছে আত্মসমর্পণ করেন। পরের কষ্ট দেখলে এই অনুভূতিটা তাঁর হত আর এটাকে একটা ক্ষতিকর দুর্বলতা জ্ঞান করে আগে লজ্জা হত তাঁর; স্ত্রীর প্রতি অনুকম্পা, তাঁর মৃত্যুকামনা করেছিলেন বলে নিজের অনুশোচনা আর বড় কথা, ক্ষমার আনন্দটা থেকেই তিনি হঠাৎ অনুভব করেছিলেন যে তাঁর মর্মযন্ত্রণা জুড়িয়ে যাবে শুধু নয়, এমন একটা শান্তিও পেলেন যা আগে কখনো পাননি। হঠাৎ তিনি অনুভব করলেন, যা ছিল তাঁর যন্ত্রণার উৎস সেটাই হয়ে দাঁড়াল তাঁর প্রাণানন্দের উৎস, যখন তিনি ধিক্কার দিয়েছেন, ভর্ৎসনা করেছেন, ঘৃণা করেছেন তখন যেটা মনে হয়েছিল সমাধানহীন, ক্ষমা করা আর ভালোবাসার সাথে সাথে তা হয়ে উঠল সহজ আর পরিষ্কার।
স্ত্রীকে ক্ষমা করলেন তিনি, তাঁর কষ্ট আর অনুতাপের জন্য মায়া হচ্ছিল তাঁর। ভ্রন্স্কিকে তিনি ক্ষমা করলেন, তাঁর জন্যও কষ্ট হচ্ছিল, বিশেষ করে যখন তাঁর মরিয়া কাণ্ডটার খবর তাঁ কানে আসে, তার পর থেকে। আগের চেয়েও ছেলের জন্য তাঁর কষ্ট হচ্ছিল বেশি, তার দিকে বড় বেশি কম দৃষ্টি দিয়েছেন বলে এখন নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু নবজাত খুকিটির জন্য শুধু মায়া নয়, স্নেহেরও একটা বিশেষ অনুভূতি হত তাঁর। যে অবলা নবজাত খুকিটি তাঁ মেয়ে নয়, মায়ের অসুখের সময় যে পরিত্যক্ত হয়, তিনি যত্ন না নিলে যে সম্ভবত মারাই পড়ত, তার প্রতি কেবল একটা সমবেদনাবশেই প্রথমটা চালিত হয়েছিলেন, তারপর নিজেই খেয়াল করেননি কেমন তাকে ভালোবেসে ফেলেছেন তিনি। দিনে বারকয়েক করে তিনি যেতেন শিশুকক্ষে, অনেকক্ষণ ধরে বসে থাকতেন, তাঁর সামনে স্তন্যদাত্রী ও আয়া প্রথমদিকটা সংকোচ বোধ করলেও পরে অভ্যস্ত হয়ে যায়। কখনো কখনো তিনি আধঘণ্টা ধরে খুকিটির জাফরানী-রাঙা, ফুলোফুলো, কোঁকড়ানো ঘুমন্ত মুখখানা দেখতেন চেয়ে চেয়ে, লক্ষ্য করতেন কিভাবে সে কোঁচকাচ্ছে কপাল, আঙুল-গুটানো ফুলোফুলো হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে রগড়াচ্ছে চোখ আর নাক। বিশেষ করে এসব মুহূর্তে তিনি বড় একটা প্রশান্তি পেতেন, তুষ্ট বোধ করতেন নিজেকে নিয়ে, নিজের অবস্থায় অসাধারণ কিছু, যা বদলানো দরকার এমন কিছুই তিনি দেখতে পেতেন না।
কিন্তু যত দিন যেতে লাগল, ততই পরিষ্কার করে তিনি দেখতে পেলেন তাঁর কাছে তাঁর অবস্থাটা এখন যতই স্বাভাবিত লাগুক, তাতে টিকে যাওয়া তাঁর সম্ভব হবেনা। তিনি অনুভব করলেন যে তাঁর প্রাণকে চালাচ্ছে যে কল্যাণী আত্মিক শক্তি তা চাড়াও আছে আরো একটা রূঢ়, সমান অথবা বেশি আধিপত্যকারী শক্তি, যা চালাচ্ছে তাঁর জীবন আর যে নিরুপদ্রব প্রশান্তি তিনি, চান, এ শক্তিটা তা তাঁকে দেবে না। তিনি অনুভব করতেন যে সবাই তাঁর দিকে তাকাচ্ছে একটা সপ্রশ্ন বিস্ময় নিয়ে, তারা তাঁকে বুঝতে পারছে না, কি যেন আশা করছে তাঁর কাছ থেকে। বিশেষ করে স্ত্রীর সাথে তাঁর সম্পর্কের অস্থিতিশীলতা ও অস্বাভাবিকতা অনুভব করছিলেন তিনি।
মৃত্যুর সান্নিধ্যে আন্নার মধ্যে যে কোমলতা জেগেছিল, সেটা কেটে যেতে কারেনিনের নজরে পড়তে লাগল যে আন্না ভয় পায় তাঁকে, ক্লিষ্ট বোধ করে, সোজাসুজি তাকাতে পারেনা তাঁর দিকে। আন্না কি যেন একটা তাঁকে বলতে চাইছেন কিন্তু সাহস পাচ্ছেন না, তাঁদের সম্পর্ক যে এভাবে চলতে পারে না, তিনিও যেন সেটা অনুভব করে কি যেন আশা করছেন কারেনিনের কাছ থেকে।
আন্নার নবজাত কন্যারও নাম দেওয়া হয়েছিল আন্না। ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে সে অসুখে পড়ে। সকালে শিশুকক্ষে গিয়ে ডাক্তার ডাকার জন্য লোক পাঠাবার হুকুম দিয়ে কারেনিন চলে যান মন্ত্রীদপ্তরে। নিজের কাজকর্ম সেরে তিনি বাড়ি ফেরেন বেলা তিনটার পর। প্রবেশ-কক্ষে ঢুকে তিনি জুড়িদার পোশাক আর ভালুকের চামড়ার ক্যাপ পরিহিত একটি সুপুরুষ ভৃত্যকে দেখতে পেলেন, আমেরিকান কুকুরের সাদা ফারকোট হাতে সে দাঁড়িয়ে আছে
জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে এখানে?’
‘প্রিন্সেস এলিজাভেতা ফিওদরোভনা ভেস্কায়া’, কারেনিনের মনে হল, জবাবটা সে দিল হেসে।
কারেনিন লক্ষ্য করেছিলেন যে, দুঃসময়ের এই গোটা কালটা উচ্চ সমাজে তাঁর পরিচিতরা, বিশেষ করে মহিলারা তাঁর ও তাঁর স্ত্রীর প্রতি একটা বিশেষ রকমের সহানুভূতি পোষণ করে এসেছেন। এই পরিচিতদের সবার মধ্যে তিনি দেখেছেন প্রায় অগোপন কি-একটা আনন্দ, ঠিক সেইরকম একটা আনন্দ যা তিনি দেখেছিলেন অ্যাডভোকেটের চোখে আর এখন দেখলেন ভৃত্যটির চোখেও। সবাই যেন উল্লসিত, যেন বিয়ে দেওয়া হচ্ছে কারো। দেখা হলে তারা তাঁর স্ত্রীর কুশল সংবাদ জিজ্ঞেস করত এমন একটা পুলকে যা বড় একটা চাপা থাকত না।
প্রিন্সেস সেস্কয়ার সাথে যে স্মৃতি জড়িত এবং সাধারণভাবেই তিনি যে তাঁকে পছন্দ করতেন না, এই উভয় কারণেই তাঁর উপস্থিতিতে অসন্তুষ্ট বোধ করে কারেনিন সোজা চলে গেলেন শিশুকক্ষে প্রথম কক্ষটায় সেরিওজা টেবিলে বুক পেতে চেয়ারে পা তুলে দিয়ে কি-একটা আঁকছিল আর ফুর্তিতে বকবক করছিল। আন্নার অসুখের সময় ফরাসিনীর বদলে যে ইংরেজ গৃহশিক্ষিকাকে নেওয়া হয়েছিল, সে উল বুনছিল ছেলেটির কাছে বসে। কারেনিনকে দেখে সে উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন করে সেরিওজার আস্তিনে টান দিল।
ছেলের চুলে হাত বুলিয়ে দিলেন কারেনিন, স্ত্রী কেমন আছেন, গৃহশিক্ষিকার এই প্রশ্নের জবাব দিয়ে নিজে জিজ্ঞেস করলেন খুকিটি সম্পর্কে কি বললেন ডাক্তার।
‘ডাক্তার বলেছেন, ভয়ের কিছু নেই স্যার, গোসলের ব্যবস্থাপত্র দিয়েছেন ‘
‘কিন্তু এখনো তো কষ্ট পাচ্ছে’, পাশের ঘরে বাচ্চাটার কান্না শুনে কারেনিন বললেন।
‘আমার মনে হয় স্তন্যদ্যত্রীটিকে দিয়ে চলবে না স্যার’, দৃঢ়ভাবে বলল ইংরেজ গৃহশিক্ষিকা
‘তা কেন ভাবছেন?’ থেমে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন উনি।
‘কাউন্টেস পলের ওখানেও এরকম হয়েছিল স্যার। শিশুটির চিকিৎসা চলল অথচ দেখা গেল সে নেহাৎ উপোস; স্তন্যদাত্রীর দুধ ছিল না স্যার।’
ভাবনায় পড়লেন কারেনিন, দুয়েক সেকেণ্ড দাঁড়িয়ে গেলেন অন্য দরজাটার দিকে। খুকিটি মাথার উল্টো দিকে ভর দিয়ে শুয়ে ছিল, আঁকুপাঁকু করছিল স্তন্যদাত্রীর কোলে যে, পুরুষ্টু স্তন তাকে দেওয়া হচ্ছিল তা নিতে চাইছিল না, তার ওপর নুয়ে স্তন্যদাত্রী আর আয়া উভয়েই শি-শি শব্দ করে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করা সত্ত্বেও চিল্লানি থামাচ্ছিল না কিছুতেই।
‘এখনো ভালো বোধ করছে না?’ জিজ্ঞেস করলেন কারেনিন।
‘বড্ড অস্থির’, ফিসফিসিয়ে আয়া বলল।
‘মিস এডওয়ার্ড বলছেন যে স্তন্যদাত্রীর বুকে হয়ত দুধ নেই’, উনি বললেন।
‘আমার নিজেরও তাই মনে হয় কারেনিন।
‘তাহলে সেটা বলছেন না কেন?’
‘কাকে বলব? আন্না আর্কাদিয়েভনা এখনো অসুস্থ’, অসন্তোষের সাথে আয়া বলল।
আয়া বাড়ির পুরানো দাসী। তার এই সাদাসিধে কথায় কারেনিনের মনে হল তাঁর অবস্থার প্রতি একটা ইঙ্গিত রয়েছে যেন।
মেয়েটা চেঁচাতে লাগল আরো জোরে এবং ভাঙা গলায়। আয়া বিরক্তির ভঙ্গি করে এগিয়ে গেল এবং স্তন্যদাত্রীর কাছ থেকে তাকে নিয়ে দোলাতে দোলাতে পায়চারি করতে লাগল।
‘স্তন্যদাত্রীকে পরীক্ষা করে দেখার জন্যে ডাক্তারকে বলতে হয়’, কারেনিন বললেন দেখতে হৃষ্টপুষ্ট এবং সাজগোজ করা স্তন্যদাত্রী ভয় পেয়ে গেল যে তাকে ছাড়িয়ে দেওয়া হবে, আপনমনে বিড়বিড় করে তার বিপুল স্তন ভেতরে ঢুকিয়ে নিয়ে যারা তার দুগ্ধ প্রাচুর্যে সন্দেহ করতে পারে তাদের উদ্দেশ্যে হাসল অবজ্ঞাভরে। সে হাসিতেও কারেনিন দেখলেন তাঁর অবস্থার প্রতি ইঙ্গিত।
‘বেচারা খুকি!’ কারেনিন, বিষণ্ণ যন্ত্রণার্ত মুখে তাকিয়ে রইলেন সামনে-পিছে পায়চারি করা আয়ার দিকে। শেষ পর্যন্ত শান্ত হয়ে আসা শিশুটিকে যখন তার গভীর শয্যায় শুইয়ে দিয়ে বালিশ ঠিকঠাক করে আয়া সরে গেল, কারেনিন উঠলেন এবং কষ্টে পা টিপে টিপে গেলেন তার কাছে। একই রকম বিষণ্ন মুখে তিনি মিনিটখানে চেয়ে দেখলেন শিশুটিকে, কিন্তু হঠাৎ তাঁর চুল আর কপালের চামড়া নড়িয়ে দিয়ে একটা হাসি ফুটে উঠল তাঁর মুখে। একই রকম চুপচাপ তিনি বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।
ডাইনিং-রুমে গিয়ে তিনি ঘণ্টি দিলেন, চাকর ভেতরে আসতে আবার তাসে যেতে বললেন ডাক্তারের কাছে। সুন্দর এই শিশুটির জন্য স্ত্রীর কোন উদ্বেগ নেই বলে তিনি বিরক্তি বোধ করছিলেন স্ত্রীর উপর আর এই বিরক্তির মেজাজে তাঁর কাছে যাবার ইচ্ছে হচ্ছিল না, প্রিন্সেস বেত্সিকে দেখারও ইচ্ছে ছিল না তাঁর; কিন্তু সচরাচরের মেত যে তাঁর কাছে গেলেন না, এতে স্ত্রী অবাক হতে পারেন, তাই নিজের ওপর জোর খাটিয়ে তিনি গেলেন শোবার ঘরে। নরম গালিচার ওপর দিয়ে দরজার কাছে গিয়ে তিনি অজ্ঞাতসারে যে কথাবার্তাটা শুনলেন তা শোনার ইচ্ছে ছিল না তাঁর।
বেত্সি বললেন, ‘ও যদি না চলে যেত, আমি আপনার এবং ওরও আপত্তিটা বুঝতে পারতাম। কিন্তু আপনার স্বামীর থাকা উচিত এর ঊর্ধ্বে।
‘স্বামীর জন্যে নয়, নিজের জন্যে আমি এটা চাই না। ও কথা থাক!’ শোনা গেল আন্নার উত্তেজিত গলা। ‘কিন্তু যে লোকটা আপনার জন্যে নিজেকে গুলি করল তার কাছ থেকে বিদায় নিতে আপত্তি করতে তো আপনি পারেন না…’
‘এই জন্যেই আমি চাই না।
ভীত ও দোষী দোষী ভাব নিয়ে আলেকসেই অলেক্সান্দ্রভিচের ইচ্ছে হয়েছিল অলক্ষ্যে চলে যাবেন। কিন্তু ভেবে দেখলেন সেটা অমর্যাদাকার হবে, তাই আবার ঘুরে এবং কেশে শোবার ঘরের কাছে এলেন। কণ্ঠস্বরগুলো থেমে যেতে তিনি ঢুকলেন ভেতরে
আন্নার পরনে ধূসর ড্রেসিং গাউন, গোল মাথা জুড়ে ঘন বুরুশের মত কালো ছাঁটা চুল, বসেছিলেন সোফায়। বরাবরের মত স্বামীকে দেখা মাত্র তাঁর সঞ্জীবিত মুখভাব হঠাৎ মিলিয়ে গেল; মাথা নিচু করে অস্বস্তিভরে তিনি চাইলেন বেত্সির দিকে। চূড়ান্তা রকমের হাল ফ্যাশনের সাজ বেত্সির, বাতির ওপর ঢাকনার মত মাথার ওপরে কোথায় যেন ভেসে আছে টুপিটা, ঘূঘূরঙা গাউনের ওপর তীক্ষ্ণ তীর্যক ডোরাগুলো এক প্রান্তে উঠে গেছে ব্লাউজে, অন্য প্রান্তে নেমেছে স্কার্টে, চ্যাপ্টা উঁচু দেহকাণ্ড খাড়া রেখে তিনি বসে ছিলেন আন্নার পাশে। মাথা হেলিয়ে তিনি কারেনিনকে স্বাগত করলেন ঈষৎ ঠাট্টার হাসি হেসে।
‘আরে!’ যেন অবাক হয়ে তিনি বললেন, ‘বড়ই খুশি হলাম আপনাকে বাড়িতে পেয়ে। কোথাও দর্শন দেন না আপনি, আন্নার অসুখের সময় থেকে আপনাকে আমি দেখি নি। সব শুনেছি আমি-আপনার যত্নের কথা। সত্যি, আপনি আশ্চর্য স্বামী!’ উনি বললেন একটা অর্থপূর্ণ স্নেহময় ভাব করে যেন স্ত্রীর সাথে তাঁর আচরণের জন্য মহানুভবতার অর্ডার অর্পণ করছেন।
কারেনিন নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে মাথা নুইয়ে অভিবাদন করল, স্ত্রীর হাত চুম্বন করে জিজ্ঞেস করলেন কেমন আছেন তিনি। ‘মনে হয় ভালোর দিকে’, স্বামীর দৃষ্টি এড়িয়ে আন্না বললেন।
‘কিন্তু তোমার মুখের রঙটা জ্বরতপ্তের মত’, উনি বললেন ‘জ্বরতপ্ত’ শব্দটায় জোর দিয়ে।
‘ওঁর সাথে আমি কথা বলেছি বড় বেশি’, বেত্সি বললেন ‘বুঝতে পারছি এটা আমার পক্ষে একটা স্বার্থপরতা, তাই আমি চলি।’
উনি উঠে দাঁড়ালেন, কিন্তু আন্না লাল হয়ে তাঁর হাত টেনে ধরলেন।
‘না-না, দয়া করে থাকুন। আপনাকে আমার বলা দরকার …না, আপনাকে’, কারেনিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, গাল আর কপাল তাঁর লালিমায় ঢেকে গেল; ‘আপনার কাছ থেকে আমি কিছুই লুকিয়ে রাখতে চাই না, পারি না’, বললেন তিনি।
কারেনিন মাথা নিচু করে আঙুল মটকালেন।
‘বেত্সি বলছিলেন যে তাশখন্দে যাবার আগে বিদায় নেবার জন্যে কাউন্ট ভ্রন্স্কি আমাদের এখানে আসতে চান’, স্বামীর দিকে না তাকিয়ে তাঁর যা বলবার সেটা যত কষ্টকরই হোক তাড়াতাড়ি বলে ফেলতে চাইছিলেন তিনি, ‘আমি বলেছি যে তাঁকে আমি অভ্যর্থনা করতে পারব না।’
‘তুমি যে বললে, এটা নির্ভর করছে কারেনিনের ওপর’, সংশোধন করে দিলেন বেত্সি।
‘না, আমি তাঁর সাক্ষাৎ চাই না আর এটা…’ সহসা থেমে গিয়ে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তিনি তাকালেন স্বামীর দিকে (আন্নার দিকে তিনি চাইছিলেন না)। ‘মোট কথা, আমি চাই না…’
কারেনিন এগিয়ে এসে স্ত্রীর হাত ধরতে চাইছিলেন।
মোটা মোটা শিরায় ফোলা আর্দ্র যে হাতখানা যেখানে তাঁর হাত খুঁজতে চাইছিল প্রথমে সেখান থেকে আন্না হাত সরিয়ে নিয়েছিলেন; কিন্তু বোঝা গেল, নিজেরে ওপর জোর খাটিয়ে আন্না করমর্দন করলেন।
‘আমার ওপর আপনার আস্থার জন্যে আমি খুবই কৃতজ্ঞ, তবে…’ কারেনিন বললেন ব্রিত হয়ে, সখেদে এটা অনুভব করে যে তিনি নিজে যা একলা সহজে ও পরিষ্কার রূপে স্থির করতে পারেন, সেটা আলোচনা করতে পারেন না প্রিন্সেস ভেস্কায়ার সামনে, তাঁর কাছে তিনি সেই রূঢ় শক্তির প্রতিমূর্তি যা সমাজের সামনে তাঁর জীবনকে পরিচারিত করতে চায়, ব্যাঘাত ঘটায় ভালোবাসা ও ক্ষমায় তাঁর আত্মসমর্পণে। প্রিন্সেস ভেস্কয়ার দিকে তাকিয়ে তিনি থেমে গেলেন।
‘তাহলে চলি, আমার লক্ষ্ণীটি,-উঠে দাঁড়িয়ে বেত্সি বললেন আন্নাকে চুম, খেয়ে তিনি বেরিয়ে গেলেন, কারেনিন এগিয়ে দিলেন তাঁকে।
ছোট ড্রয়িং-রুমটায় থেমে আরো একবার সজোরে তাঁর করমর্দন করে বেত্সি বললেন, ‘কারেনিন! সত্যিকারের মহানুভব লোক বলে আমি আপনাকে জানি। আমি বাইরের লোক, কিন্তু আন্নাকে আমি ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি আপনাকে, তাই পরামর্শ দেবার স্পর্ধা করছি। ওকে গ্রহণ করুন। আলেক্সেই ভ্রন্স্কি সম্মান বোধের প্রতভূত্, তাশখন্দে চলে যাচ্ছে সে।’
‘আপনার সহানুভূতি আর পরামর্শের জন্যে ধন্যবাদ প্রিন্সেস। কিন্তু কাউকে গ্রহণ করা হবে কি হবে না, সেটা স্থির করবে স্ত্রী নিজে।’
এটা তিনি বললেন তাঁর অভ্যস্ত মর্যাদার ভাব নিয়ে, ভুরু ওপরে তুলে, কিন্তু তৎক্ষণাৎ মনে হল যে কথাই তিনি বলুন, তাঁর অবস্থার মর্যাদার কথাই উঠতে পারে না। এটা তিনি বুঝলেন তাঁর কথার পরে বেত্সির মুখে যে সংযত, ক্রুর, উপহাসের হাসি ফুটেছিল তা দেখা।