আন্না কারেনিনা - প্রথম পর্ব
আন্না কারেনিনা - দ্বিতীয় পর্ব
আন্না কারেনিনা - তৃতীয় পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - চতুর্থ পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - পঞ্চম পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - ষষ্ঠ পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - সপ্তম পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - অষ্টম পৰ্ব
1 of 2

আন্না কারেনিনা – ৪.১০

দশ

পেস্তসোভ শেষ পর্যন্ত তর্ক করতে ভালোবাসতেন, সের্গেই ইভানোভিচ কজ্‌নিশেভের কথায় তিনি তুষ্ট হননি, সেটা আরো এই কারণে যে নিজের মতামতের অন্যায্যতা তিনি নিজেই টের পাচ্ছিলেন।

তিনি স্যুপ খেতে খেতে কারেনিনকে রললেন, ‘আমি শুধু জনবহুলতার কথাই বলতে চাইনি, সেই সাথে ভিত্তিটাও, তবে নীতি নয়।’

তাড়াহুড়া না করে আলস্যভরে জবাব দিলেন কারেনিন, ‘আমার মনে হয় ওটা একই ব্যাপার। আমার মতে, অন্য জাতিকে প্রভাবিত করতে পারে শুধু সেই জাতি যার বিকাশ উচ্চতর, যে…

‘সেই তো কথা’, জলদকণ্ঠে বাধা দিলেন পেস্তসোভ, যিনি ব্যস্ত হয়ে উঠতেন কথা বলতে এবং যে বিষয়ে কথা বলছেন সব সময় তাতে মন-প্রাণ ঢেলে দিতেন বলেই মনে হবে, ‘উচ্চতর বিকাশ বলতে কি বোঝায়? ইংরেজ, ফরাসি, জার্মান-কে বিকাশের উন্নত পর্যায়ে? কে একে অপরকে জাতীভূত করবে? আমরা দেখছি যে রাইন অঞ্চল সরকারিভাবে ফরাসিভুক্ত হয়েছে অথচ জার্মানদের মান নিচু নয়’, চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি, ‘এক্ষেত্রে আছে আরেকটা নিয়ম!’

‘আমার মনে হয়, প্রভাটা সব সময় আসে সত্যিকারের সুশিক্ষা থেকে’, ভুরু সামান্য কপালে তুলে বললেন কারেনিন।

‘কিন্তু সত্যিকার সুশিক্ষার লক্ষণগুলো কি বলে আমরা ধরব?’ জিজ্ঞেস করলেন পেস্তসোভ।

কারেনিন বললেন, ‘আমি মনে করি, তার লক্ষণগুলো সবারই জানা।’

‘পুরো জানা কি?’ মিহি হেসে আলাপে নাক গলালেন কজ্‌নিশেভ, ‘এখন স্বীকৃত হয়েছে যে, সত্যকার শিক্ষা হতে পারে কেবল বিশুদ্ধ চিরায়ত শিক্ষা; কিন্তু দু’পক্ষে ঘোর বিতর্ক দেখতে পাচ্ছি আমরা এবং অস্বীকার করা যায় না যে বিপক্ষ শিবিরেও স্বীয় অনুকূলে যুক্তি আছে জোরদার।

‘আপনি তো চিরায়তপন্থী, কজ্‌নিশেভ। লাল মদ চলবে?’ বললেন অব্‌লোন্‌স্কি।

‘কোন শিক্ষা সম্পর্কেই আমি নিজের অভিমত দিচ্ছি না’, পানপত্র বাড়িয়ে দিয়ে শিশুর প্রতি প্রশ্রয়ের হাসি হেসে কজ্‌নিশেভ বললেন, ‘আমি শুধু বলছি যে, দু’পক্ষেরই জোরালো যুক্তি আছে,’ কারেনিনের দিকে চেয়ে তিনি চালিয়ে গেলেন। ‘নিজে আমি চিরায়ত শিক্ষা পেয়েছি, কিন্তু এ বিতর্কে আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে এখনো আমার স্বস্থান খুঁজে পাচ্ছি না। বাস্তব বিদ্যার চেয়ে চিরায়ত বিদ্যাকে কেন প্রাধান্য দেওয়া হবে তার পরিষ্কার যুক্তি চোখে পড়ছে না আমার।’

‘শিক্ষাদানে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের প্রভাবও তো একই’, খেই ধরলেন পেস্তসোভ, ‘ধরুন না শুধু জ্যোতির্বিদ্যা, ধরুন উদ্ভিদবিদ্যা, পশুবিদ্যা এবং তাদের সাধারণ নিয়মগুলো!’

কারেনিন জবাব দিলেন, ‘আমি এর সাথে পুরোপুরি একমত হতে পারছি না। আমার মনে হয় এটা অস্বীকার করা যায় না যে, ভাষায় গঠনপ্রণালীর অধ্যয়নই আত্মিক বিকাশে অতি অনুকূল প্রভাব ফেলে। তাছাড়া চিরায়ত সাহিত্যিকদের প্রভাব অতিমাত্রায় নৈতিক, এটাও অস্বীকার করা যায় না। যেক্ষেত্রে দুর্ভাগ্যবশত প্রাকৃতিক বিদ্যাশিক্ষার সাথে মিলেছে অনিষ্টকর, অসত্য কতকগুলো মতবাদ যা আমাদের কালের দুষ্টক্ষত।’

কজ্‌নিশেভ কিছু-একটা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু পেস্তসোভ তাঁর জলদগম্ভীর কণ্ঠে তাঁকে থামিয়ে দিলেন। সোৎসাহে তিনি প্রমাণিত করতে লাগলেন এ অভিমতের অসারতা। কজনিশেভ শান্তভাবে তাঁর কথা আসার পালার অপেক্ষায় রইলেন, স্পষ্টতই একটা বিজয়সূচক জবাব তৈরি ছিল তাঁর।

‘তবে’, মুচকি হেসে, কারেনিনকে উদ্দেশ্য করে কজ্‌নিশেভ বললেন, ‘দুই বিদ্যার লাভালাভ ওজন করে কোন- একটাকে পছন্দ করা যে কঠিন তা না মেনে উপায় নেই। আর আপনি এখনই যা বললেন, চিরায়ত বিদ্যায় নৈতিকতা—সোজাসুজি বলব—কালাপাহাড়-বিরোধী মনোবৃত্তির প্রভাব না থাকলে কোন্‌টা বাছব—এ প্রশ্নের এত সত্বর ও চূড়ান্ত মীমাংসা সম্ভব হত না।’

‘চিরায়ত বিদ্যার পক্ষে যদি এই কালাপাহাড়-বিরোধী মনোবৃত্তির শ্রেষ্ঠতা না থাকত, তাহলে আমরা একটু বেশি ভাবনা-চিন্তা করতাম, বাজিয়ে দেখতাম দু’পক্ষের যুক্তিকে’, মুচকি হেসে বললেন কজ্‌নিশেভ, ‘দুই ধারার জন্যেই রাস্তা খুলে দিতাম আমরা। কিন্তু এখন আমরা জানি যে, চিরায়ত বিদ্যার এই বটিকাগুলোর মধ্যে আছে কালাপাহাড়-বিরোধী মনোবৃত্তির ভেষজশক্তি। তখন আমরা নির্ভয়ে তা সুপারিশ করব আমাদের রোগীদের জন্যে…কিন্তু যদি তা না থাকে?’ কথা তিনি সম্পূর্ণ করলেন সূক্ষ্ম লবণ ছিটিয়ে।

সের্গেই ইভানোভিচের বটিকার কথায় সবাই হেসে উঠলেন। সবচেয়ে সশব্দে ও স্ফূর্তিতে তুরোভ্‌ৎসিন, আলাপটা শুনতে শুনতে তিনি কেবল প্রতীক্ষা করছিলেন কখন পরিহাসে এর শেষ হবে।

অব্‌লোন্‌স্কি পেস্তসোভকে নিমন্ত্রণ করে ভুল করেননি। পেসোভের কাছে বিদগ্ধ আলোচনা ক্ষান্ত হতে পারে না এক মিনিটের জন্যও। কজ্‌নিশেভ তাঁর রসিকতা দিয়ে আলোচনাটা বন্ধ করা মাত্রই তিনি টেনে আনলেন অন্য প্রসঙ্গ। বললেন, ‘সরকারের এই-ই উদ্দেশ্য ছিল, এটা মানা যায় না। সরকার স্পষ্টতই চালিত হয়েছে সাধারণ বিবেচনায় গৃহীত ব্যবস্থাগুলো কি প্রতিক্রিয়া হবে সেদিকে উদাসীন থেকেছে। যেমন নারীশিক্ষার কথাটাই ধরা যাক। এটাকে গণ্য করা উচিত অতি ক্ষতিকর, কিন্তু সরকার মেয়েদের জন্যে কোর্স আর বিশ্ববিদ্যালয় খুলছে।’

আর সাথে সাথেই কথোপকথন চলে গেল নারীশিক্ষার নতুন খাতে।

কারেনিন বললেন যে, নারীশিক্ষাকে সাধারণত নারীমুক্তির সাথে গুলিয়ে ফেলা হয় এবং সেই কারণে এটা ক্ষতিকর মনে হতে পারে।

পেস্তসোভ বললেন, ‘উল্টো আমি মনে করি, দুটো প্রশ্নই অঙ্গাঙ্গি জড়িত। এটা এক পাপচক্র। যথেষ্ট শিক্ষা নেই বলে মেয়েদের অধিকারও নেই। আবার শিক্ষার অপ্রতুলতা আসছে অধিকারের প্রভাব থেকে। মনে রাখা উচিত যে, মেয়েদের দাসত্ব এত প্রবল আর পুরানো যে—ওদের কাছ থেকে আমাদের যা তফাৎ করে রাখছে সেই গহ্বরটা আমরা দেখতে চাই না?’

‘আপনি বলছেন অধিকার’, পেস্তসোভ কখন থামবেন তার অপেক্ষায় থাকার পর কজ্‌নিশেভ বললেন, ‘জুরি, নির্বাচক, অধিকর্তা, কর্মচারী, আইনসভার সদস্য হবার অধিকার…’

‘নিঃসন্দেহে।’

‘কিন্তু বিরল ব্যতিক্রম হিসেবে মেয়েরা যদি এসব পদে যায়ও, তাহলেও আমার মনে হয় আপনার অধিকার কথাটার ব্যবহার হয়েছে বেঠিক। দায়িত্ব কথাটা বলা বেশি সঠিক হত। জুরি, নির্বাচক, টেলিগ্রাফ-কর্মীর কাজ করতে গিয়ে আমরা অনুভব করি—একটা দায়িত্ব পালন করছি। তাই সঠিকভাবে বলা উচিত যে, মেয়েরা দায়িত্ব চাইছে এবং সেটা খুবই আইনসঙ্গত। এবং সাধারণ পুরুষালী শ্রমে তাদের সাহায্য করার এই বাসনাটায় সহানুভূতি জানানোই সম্ভব।’

‘একেবারে ঠিক কথা’, সায় দিলেন কারেনিন, ‘আমি মনে করি, প্রশ্নটা শুধু এই যে—এ দায়িত্ব পালনে তারা সক্ষম কিনা।’

‘খুব সম্ভব যে সক্ষম মধ্যে। আমরা দেখছি, যে…’

‘আর সেই প্রবাদটা?’ আলাপটা অনেকক্ষণ ধরে শুনতে শুনতে তাঁর ছোট ছোট চোখে উপহাস ঝিকমিকিয়ে বললেন প্রিন্স, ‘নিজের মেয়েদের সামনেও বলা চলবে : লম্বা চুলে খাটো বুদ্ধি।’

‘নিগ্রোর মুক্ত হবার আগে পর্যন্ত ঠিক এরকমটাই ভাবা হত!’ রাগতভাবে বললেন পেস্তসোভ।

‘আমার কাছে শুধু অদ্ভুত ঠেকে যে, মেয়েরা নতুন দায়িত্ব নিতে চাইছে’, বললেন কজ্‌নিশেভ, ‘যেক্ষেত্রে দুঃখের বিষয় আমরা দেখছি যে পুরুষেরা সাধারণত তা এড়িয়ে চলে।

‘দায়িত্বের সাথে সাথেই থাকে অধিকার; ক্ষমতা, টাকা, সম্মান—এই চায় মেয়েরা’, বললেন পেস্তসোভ।

‘এরও সমান কথা যে, আমি ধাই মা হবার অধিকার চাইছি অথচ তার জন্যে আমাকে নয়, টাকা দেওয়া হচ্ছে মেয়েদের’, বললেন বৃদ্ধ প্রিন্স

তুরোভ্‌ৎসিন হেসে উঠলেন হো-হো করে, আর কর্নিশেভের আফসোস হল যে, এমন একটা কথা তিনি বলেননি। এমন কি কারেনিনও হাসলেন।

‘হ্যাঁ, কিন্তু পুরুষেরা সন্তানদের নিজের স্তন পান করাতে পারে না, তবে মেয়েরা…’

‘আরে না, জাহাজে সেই যে ইংরেজটা নিজের ছেলেকে দুধ খাইয়েছিল’, নিজের মেয়েদের সামনে কথোপকথনের এই স্বাধীনতাটুকু নিজের জন্য মঞ্জুর করে বললেন বৃদ্ধ প্রিন্স।

‘এমন ইংরেজ যতগুলো আছে, চাকুরে মেয়েও হবে ততগুলো’, কজ্‌নিশেভ বললেন শেষ পর্যন্ত।

‘কিন্তু যে মেয়ের সংসার নেই, কি সে করবে?’ চিবিসোভার কথা মনে করে বললেন অব্‌লোন্‌স্কি, তার কথাই তাঁর মনে হচ্ছিল সারাক্ষণ, সেই ভেবেই তিনি সহানুভূতি দেখালেন পে সোভকে, সমর্থন করলেন তাঁকে।

‘যদি সে মেয়ের ঘটনাটা ভালো করে বিচার করা যায়, তাহলে দেখা যাবে যে–নিজের সংসার অথবা ভালো করে নারীর মত থাকতে পারত বোনের সে সংসারও ত্যাগ করে গেছে’, হঠাৎ পিত্তি জ্বলে ওঠায় কথোপকথনে যোগ দিলেন দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনা, কোন মেয়ের কথা অব্‌লোন্‌স্কি বলতে চাইছিলেন, সেটা সম্ভবত অনুমান করেছিলেন তিনি।

‘কিন্তু আমরা দাঁড়াচ্ছি নীতি নিয়ে, আদর্শ নিয়!’ সোচ্চার জলদকণ্ঠে বললেন পোেভ, ‘নারীরা চায় স্বাধীনতার, শিক্ষিত হবার অধিকার। তার অসম্ভাবিতার চেতনায় তারা সংকুচিত, দমিত।’

‘আর আমি সংকুচিত আর দমিত এজন্যে যে; অনাথাশ্রমে ধাই মা হিসেবে আমাকে নেওয়া হচ্ছে না’, আবার বললেন বৃদ্ধ প্রিন্স আর তাতে তুরোৎসিনের এত আনন্দ হল যে তাঁর অ্যাসপারাগাসের মোটা বোঁটাটা তিনি গুঁজে দিলেন সসের মধ্যেই।

এগারো

শুধু কিটি আর লেভিন ছাড়া সবাই এই সাধারণ আলোচনায় যোগ দিয়েছিল। প্রথমে যখন এক জাতির ওপর অন্য জাতির প্রভাবপাতের কথা ওঠে, তখন লেভিনের আপনা থেকেই মনে হয়েছিল যে—এ বিষয়ে তাঁর কিছু বলার আছে। কিন্তু এই নিয়ে যে ভাবনাটা আগে তাঁর কাছে ছিল অতি গুরুত্বপূর্ণ, এখন সেটা ঝলক দিয়েছিল শুধু যেন স্বপ্নে, কোন আগ্রহই তাতে আর বোধ করছিলেন না তিনি। তাঁর এমন কি অদ্ভুত লাগল কেন ওরা এমন বিষয় নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করছে যা সবার কাছেই নিষ্প্রয়োজন। তেমনি কিটির কাছেও মনে হয়েছিল নারীর অধিকার আর শিক্ষা নিয়ে তারা যা বলছে সেটা আগ্রহোদ্দীপক হবার কথা। কতবার সে এ নিয়ে ভেবেছে, স্মরণ করেছে প্রবাসে তার বান্ধবী ভারেঙ্কা, তার দুঃসহ অধীনতার কথা, কতবার সে ভেবেছে যে তারও কি দশা হবে যাদ তার বিয়ে না হয়, কতবার সে বোনের সাথে তর্ক করেছে এ নিয়ে! কিন্তু এখন এতে তার আগ্রহ নেই মোটেই। এখন ওর কথাবার্তা চলছে লেভিনের সাথে, কথাবার্তা নয়, কি-এক রহস্যময় মিলন যা প্রতি মুহূর্তে তাঁদের নিবিড় করে বাঁধছে, যে অজানায় তাঁরা পদার্পণ করছেন তার সামনে একটা আনন্দঘন ত্রাসে দুজনেই আবিষ্ট হচ্ছিলেন।

লেভিন গত বছর কেমন করে তাকে দেখতে পেয়েছিলেন, কিটির এ প্রশ্নের জবাবে লেভিন প্রথমে বললেন যে ঘাস-কাটা থেকে ফেরার সময় বড় সড়কে তাকে দেখতে পেয়েছিলেন।

লেভিন হেসে বললেন, ‘তখন খুব সকাল। আপনি সম্ভবত সবেমাত্র ঘুম থেকে জেগেছিলেন। আপনার মা তখনো নিজের কোণটিতে ঘুমিয়ে। সকালটা চমৎকার। যেতে যেতে ভাবছিলাম, কারা যাচ্ছে ওই চার ঘোড়ার গাড়িতে? চমৎকার চার ঘোড়ার গাড়ি, গলায় ঘণ্টি। মুহূর্তের জন্যে দেখা গেল আপনাকে, জানালার দিকে তাকিয়ে দেখি আপনি এভাবে বসে আছেন, দু’হাতে টুপির ফিতে ধরে আছেন আর কিছু-একটা নিয়ে চিন্তায় ভয়ংকর মগ্ন। কি ভাবছিলেন তা জানার জন্যে আমার কি যে ভয়ানক ইচ্ছে করছিল! গুরুতর কিছু?’

কিটি ভাবল, ‘চুল কি এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল?’ কিন্তু এই খুঁটিনাটিগুলোর স্মরণে তাঁর মুখে যে উল্লাসের হাসি ফুটেছিল তা দেখে কিটি বুঝল যে ভালোই একটা ছাপ ফেলেতে পেরেছিল সে। লাল হয়ে উঠে সে হেসে ফেলল।

‘সত্যি, মনে নেই।’

লেভিন তাঁর আর্দ্র চোখ আর কম্পমান দেহের দিকে তদ্‌গত হয়ে তাকিয়ে বললেন, ‘কি সুন্দর হাসে তুরোভৎসিন।’

কিটি জিজ্ঞেস করল, ‘ওঁকে আপনি চেনেন অনেকদিন থেকে?’

‘কে ওকে না চেনে!’

‘দেখতে পাচ্ছি, আপনি ওঁকে খারাপ লোক বলে ভাবেন।’

কিটি বলল, ‘ওটা ঠিক নয়! ওরকম কথা আর ভাববেন না। আমারও ওঁর সম্পর্কে খুব নিচু একটা ধারণা ছিল। কিন্তু উনি, উনি আশ্চর্য সহৃদয় মানুষ। মনটা ওঁর সোনার।’

‘ওর মনের খবর আপনি জানলেন কোত্থেকে?’

‘আমাদের সাথে ওঁর খুবই বন্ধুত্ব। ওঁকে আমি খুব ভালো জানি। গত শীতে, আপনি…আমাদের ওখানে যখন গিয়েছিলেন, তারপরে’, কিটি বলল একটু দোষী-দোষী, সেই সাথে ভরসার হাসি হেসে, ‘ডল্লির ছেলেমেয়েরা সবাই ভুগছিল স্কার্লেট জ্বরে। উনি একবার এলেন ডল্লির কাছে, আর থেকে গেলেন, ছেলেমেয়েদের শুশ্রূষায় সাহায্য করতে লাগলেন। ভাবতে পারেন’, ফিসফিসিয়ে বলল কিটি, ‘ওঁর এত মায়া হল যে উনি হ্যাঁ, তিন সপ্তাহ ছিলেন সেখানে, আয়ার মত দেখাশোনা করেন বাচ্চাদের।’

কিটি বোনের দিকে ঝুঁকে বলল, ‘তুরোৎসিনের কথা বলছি কনস্তান্তিন দ্‌দ্‌মিত্রিচকে।’

তুরোসিনের দিকে দৃষ্টিপাত করে ডল্লি বললেন, হ্যাঁ, আশ্চর্য, সুন্দর মানুষ!’ তিনিও টের পাচ্ছিলেন তাঁকে নিয়ে কথা হচ্ছে, সলজ্জভাবে ডল্লি হাসলেন তাঁর উদ্দেশে। লেভিন তুরোৎসিনের দিকে তাকিয়ে অবাক হলেন কেমন করে তিনি এ মানুষটির সমস্ত মাধুর্য আগে লক্ষ করেননি।

তাঁর যা এখন অনুভূতি, অকপটেই স্ফূর্তিতে সেটা প্রকাশ করে বললেন, ‘ঘাট, ঘাট মানছি! আর কখনো লোকদের সম্পর্কে খারাপ কিছু ভাবব না!’

বারো

যে আলাপটা জমেছিল তাতে নারীর অধিকার নিয়ে মেয়েদের সামনে দাম্পত্য জীবনে অধিকারের অসাম্যের প্রশ্নটা সুড়সুড়ি দেওয়ার মত। ডিনারের সময় পেস্তসোভ বারকয়েক প্রশ্নটা তুলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সের্গেই ইভানোভিচ কজ্‌নিশেভ ও অব্‌লোন্‌স্কি তাঁকে সাবধানে নিরস্ত করেন।

টেবিল ছেড়ে উঠলেন সবাই যখন আর মহিলারা বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে পেস্তসোভ তাঁদের অনুসরণ না করে অসাম্যের প্রধান কারণ কি তা বোঝাতে লাগলেন কারেনিনকে। তাঁর মতে, আইনে এবং জনমতের পক্ষ থেকে স্ত্রীর বিশ্বাসঘাতকতা ও স্বামীর বিশ্বাসঘাতকতায় শাস্তি বিধানের মধ্যে বৈষম্য থাকে।

অব্‌লোন্‌স্কি তাড়াতাড়ি করে কারেনিনের কাছে এসে তাঁকে ধূমপানের আমন্ত্রণ জানালেন।

‘না, আমি ধূমপান করি না’, শান্তভাবে উত্তর দিলেন কারেনিন এবং এ প্রসঙ্গটায় যে ভয় পান না সেটা যেন ইচ্ছে করেই দেখাবার জন্য তিনি নিষ্প্রাণ হেসে ফিরলেন পেসোভের দিকে।

‘আমি মনে করি যে, ব্যাপারটাই এমন যে এরূপ দৃষ্টিভঙ্গির যুক্তি থাকে’, এই বলে উনি ড্রয়ি-রুমে চলে যেতে চাইছিলেন; কিন্তু এই সময় তাঁকে উদ্দেশ করে হঠাৎ কথা বলে উঠলেন তুরোভ্‌ৎসিন।

‘আচ্ছা, আপনি প্রিয়ানিকভের খবরটা শুনেছেন?’ শ্যাম্পেন সেবনে মদির হয়ে বহুক্ষণ নিজের কষ্টকর নীরবতাটা ভাঙার অপেক্ষায় থাকার পর তুরোভ্‌ৎসিন বললেন, ‘ভাসিয়া প্রিয়ানিকভ—সেদিন শুনলাম যে’, আর্দ্র ও রক্তিম ঠোঁটে তাঁর হৃদয়বান হাসি নিয়ে বিশেষ করে প্রধান অতিথি আলেকসেই আলেক্‌সান্দ্রভিচকে লক্ষ্য করে তিনি বললেন, ‘ভের শহরে ভিৎস্কির সাথে ডুয়েল লড়ে তিনি তাকে খুন করেছেন।’

সব সময়ই যেমন মনে হয় ইচ্ছে করেই যেন চোট লাগছে ঠিক ব্যথার জায়গাটাতেই, এখন তেমনি অব্‌লোন্‌স্কিরও মনে হচ্ছিল যে প্রতি মুহূর্তে কথাবার্তাটা গিয়ে পড়ছে কারেনিনের ব্যথার জায়গায়। জামাতাকে আবার সরিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করলেন তিনি, কিন্তু কারেনিন নিজেই উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘প্রিয়ানিকভ লড়ল কেন?’

‘বৌয়ের জন্যে। বাহাদুরের মত কাজ করেছেন। চ্যালেঞ্জ করে দিলেন খতম করে!’

কারেনিন নিরাসক্ত গলায় বললেন, ‘অ’, ভুরু কপালে তুলে চলে গেলেন ড্রয়িং-রুমে।

ড্রয়িং-রুমে ওঁর সাথে দেখা হতে ভীত হাসি নিয়ে ডল্লি বললেন তাঁকে, ‘ভারি আনন্দ হচ্ছে যে আপনি এসেছেন। আপনার সাথে কথা আছে। বসুন এখানে।’

উত্তোলিত ভুরুতে যে নিরাসক্তির ভাব ফুটেছিল মুখে, সেটা নিয়ে কারেনিন বসলেন দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনার পাশে, কৃত্রিম হাসি হাসলেন। বললেন, ‘সে ভালোই। কেননা আমিও আপনার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে তখনই বিদায় নেব বলে ভাবছিলাম। কাল চলে যেতে হবে আমাকে।’

দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনার দৃঢ়বিশ্বাস ছিল যে আন্না নির্দোষ, তিনি টের পাচ্ছিলেন যে বিবর্ণ হয়ে উঠছেন; নিরুত্তাপ, অনুভূতিহীন এই যে লোকটা অমন শান্তভাবে মনস্থ করেছে যে তাঁর নির্দোষ বান্ধবীর সর্বনাশ করে ছাড়বে, তার প্রতি রাগে তাঁর ঠোঁট কাঁপছে।

একটা মরিয়া প্রতিজ্ঞায় তাঁর চোখে চোখে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘কারেনিন, আলেক্‌সান্দ্রভিচ, আপনাকে আমি আন্নার খবর জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি জবাব দেননি। কেমন আছেন সে?

কারেনিন তাঁর চোখের দিকে না তাকিয়ে উত্তর দিলেন, ‘সুস্থ আছে বলেই তো মনে হয়, দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনা।’

‘কারেনিন, মাপ করবেন আমাকে, এ কথা জিজ্ঞেস করার অধিকার আমার নেই…কিন্তু বোন হিসেবে আমি আন্নাকে ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি; আমি অনুরোধ করছি, মিনতি করছি। বলুন আমাকে, কি হল আপনাদের মধ্যে? কি অপরাধ পেলেন ওঁর ‘

কারেনিন মুখ কুঁচকে, চোখ প্রায় খুঁজে মাথা নোয়ালেন।

তিনি ওঁর চোখের দিকে না তাকিয়ে ড্রয়িং-রুম পেরিয়ে চলে যাওয়া শ্যেরবাৎস্কির দিকে অপ্রসন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি ধরে নিতে পারি, কেন আন্না আর্কাদিয়েভনার সাথে আমার পুরানো সম্পর্ক বদলানোর প্রয়োজন বলে মনে করছি সে কারণ স্বামী আপনাকে বলেছেন।’

নিজের সামনে তাঁর হাড্ডিসার হাতটা মুঠো করে সতেজ ভঙ্গিতে ডল্লি বলে উঠলেন, ‘এটা আমি বিশ্বাস করি না, বিশ্বাস করি না! বিশ্বাস করতে পারি না!’ ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে হাত দিলেন কারেনিনের আস্তিনে। ‘এখানে আমাদের অসুবিধা হচ্ছে, চলুন ওখানে যাই।’

কারেনিনকে প্রভাবিত করল ডল্লির উত্তেজনা। উঠে দাঁড়িয়ে তিনি বাধ্যের মত ডল্লির পিছু পিছু গেলেন পড়ার ঘরে। কলম-কাটা ছুরিতে আঁচড় পড়া অয়েল-ক্লথ মোড়া একটা টেবিলের সামনে বসলেন তাঁরা।

তাঁকে এড়িয়ে যাওয়া ওঁর দৃষ্টিটা ধরার চেষ্টা করে ডল্লি বললেন, ‘আমি বিশ্বাস করি না এটা!

‘সত্য ঘটনাকে বিশ্বাস না করা চলে না, দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনা’, উনি বললেন ‘সত্য ঘটনা’ কথাটায় জোর দিয়ে।

‘কিন্তু কি সে করেছে?’ বললেন দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনা, ‘ঠিক কি করেছে সে?’

‘সে তার কর্তব্য চুলোয় পাঠিয়েছে, বিশ্বাসঘাতকতা করেছে স্বামীর প্রতি। এই সে করেছে’, উনি বললেন।

‘না-না, হতে পারে না! না, আপনি করেছেন!’ ডল্লি বললেন চোখ খুঁজে, রগে হাত দিয়ে।

কারেনিন ঠাণ্ডা হাসলেন শুধু তাঁর ঠোঁট দিয়ে, ডল্লিকে আর নিজেকেও দেখাতে চাইলেন তাঁর প্রত্যয়ের দৃঢ়তা’ কিন্তু ডল্লির এই সতেজ সমর্থন তাঁকে দোলাতে না পারলেও তাতে লবণের ছিটে পড়ল তাঁর ক্ষতে। উনি বেশ উত্তেজিত হয়ে কথা বলতে লাগলেন।

‘ভুল করা খুবই কঠিন যখন স্ত্রী নিজেই সে কথা বলে স্বামীকে। বলে যে জীবনের আট বছর আর ছেলে- সবই ভুল। সে আবার গোড়া থেকে জীবন শুরু করতে চায়’, উনি বললেন রেগে, নাক ফোঁস ফোঁস করে।

‘আন্না আর দুশ্চরিত্রা—এ দুটো জিনিস মেলাতে পারছি না আমি, বিশ্বাস করি না ও কথা’

‘দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনা’, এবার উনি বললেন সোজাসুজি ডল্লির সদাশয় উত্তেজিত মুখের দিকে চেয়ে, টের পাচ্ছিলেন যে অনিচ্ছা সত্ত্বেও মুখ ওঁর আলগা হয়ে আসছে, ‘অনিশ্চয়তা এখানে সম্ভব হতে পারলে আমি সব দিতাম। যখন মাত্র সন্দেহ ছিল তখন সেটা কষ্টকর হলেও এখনকার চেয়ে তা ছিল লঘু। যখন মাত্র সন্দেহ ছিল, তখন আশাও ছিল; কিন্তু এখন আর আশা নেই; তাহলেও আমি সব কিছুতেই সন্দেহ করি। সব কিছুতেই এমন আমার সন্দেহ যে ঘৃণা করি নিজের ছেলেকে, মাঝে মাঝে বিশ্বাস হয় না যে ও আমার ছেলে। বড় দুর্ভাগা আমি।’

এ কথা তাঁর বলার দরকার হত না। দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনার মুখের দিকে উনি তাকাতে ডল্লি সেটা বুঝতে পেরেছিলেন, ওঁর জন্য কষ্ট হল তাঁর, তাঁর বান্ধবী নির্দোষ এ বিশ্বাস তাঁর টলে উঠল।

উঁহু, এ যে ভয়ংকর, ভয়ংকর! কিন্তু এ কি সত্যি যে আপনি বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন?’

‘শেষ ব্যবস্থার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আর কিছু করার নেই আমার।’

‘করার নেই, করার নেই…’, চোখে পানি নিয়ে পুনরাবৃত্তি করলেন ডল্লি। ‘না, করার নেই হতে পারে না!’ উনি বললেন।

‘এ ধরনের বিপদে সবচেয়ে ভয়ংকর হল অন্য বিপদ, লোকসান, মৃত্যুর মত তা নীরবে সয়ে যাওয়া যায় না, কিছু-একটা করতে হয়’, উনি বললেন যেন ডল্লির চিন্তাটা অনুমান করে, ‘যে হীনতার অবস্থায় পড়েছি তা থকে বেরিয়ে আসা দরকার। তিনজনে তো আর ঘর করা যায় না।’

‘বুঝতে পারছি, খুব ভালো করে বুঝতে পারছি সেটা’, বলে মাথা নিচু করলেন ডল্লি। চুপ করে রইলেন তিনি, ভাবছিলেন নিজের কথা, আপন পারিবারিক দুঃখের কথা। হঠাৎ সবেগে মাথা তুলে অনুনয়ের ভঙ্গিতে হাত জড়ো করলেন, ‘কিন্তু দাঁড়ান, আপনি তো খ্রিস্টান। ওর কথাটা ভাবুন! আপনি যদি ওকে ত্যাগ করেন তাহলে কি হবে ওর?’

‘আমি ভেবেছি দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনা, অনেক ভেবেছি’, বললেন কারেনিন। মুখ ওঁর ভরে উঠল লাল লাল ছোপে, ঘোলাটে চোখ দুটো তাকিয়ে ছিল সোজা ডল্লির দিকে। এখন ওঁর জন্য কষ্টে সত্যিই বুক ভরে উঠল দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনার। ‘ও নিজেই যখন আমার মুখে চুন-কালি লাগাবার কথাটা আমাকে বলে, তারপর আমি ঠিক ওটাই করেছিলাম : সব আগের মত চলতে দিলাম। সংশোধনের সুযোগ দিয়েছিলাম তাকে, চেষ্টা করেছিলাম তাকে বাঁচাতে কিন্তু কি হল? শোভনতা বজায় রেখে চলা—এই অতি সহজ দাবিটাও সে মেনে চললে না’, উত্তপ্ত হয়ে তিনি বললেন, ‘যে লোক ধ্বংস পেতে চায় না তাকে বাঁচানো যায়; কিন্তু স্বভাব যদি এতই নষ্ট হয়ে, বিকৃত হয়ে গিয়ে থাকে যা ধ্বংসটাই তার কাছে উদ্ধার বলে মনে হচ্ছে, তাহলে কি করা যাবে?’

‘সব করা যায়, শুধু বিবাহবিচ্ছেদ নয়!’ জবাব দিলেন দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনা।

‘কিন্তু সেই সবটা কি?’

‘না, এ যে ভয়ংকর কথা! কারো বউ হবে না সে, মারা পড়বে!’

‘কি আমি করতে পারি?’ কাঁধ আর ভুরু উঁচিয়ে বললেন কারেনিন। স্ত্রীর শেষ অপরাধের স্মৃতিটা তাঁকে এতই উত্ত্যক্ত করছিল যে, কথা শুরুর সময়ের মত আবার নিরুত্তাপ হয়ে গেলেন তিনি। ‘আপনার সহানুভূতির জন্যে আমি আপনার কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ, কিন্তু সময় হয়ে গেছে আমার’, উঠে দাঁড়িয়ে বললেন তিনি 1

‘না-না, একটু দাঁড়ান! ওকে ধ্বংস করা আপনার উচিত নয়। দাঁড়ান, আমি নিজের সম্পর্কে আপনাকে বলি। বিয়ে করলাম, কিন্তু স্বামী আমাকে ছলনা করে; রাগে দুঃখ আমি সব কিছু বিসর্জন দিতে চেয়েছিলাম, নিজেই আমি চেয়েছিলাম তা…কিন্তু চৈতন্যোদয় হল। কে করালে? আন্না বাঁচালে আমাকে। তারপর এই তো বেশ চলে যাচ্ছে। বেড়ে উঠছে ছেলেমেয়েরা, স্বামী পরিবারের কাছে ফিরে আসছে, বুঝতে পারছে নিজের অন্যায়, হয়ে উঠছে অনেক শুদ্ধ, ভালো, আমিও বেঁচে আছি…আমি ক্ষমা করেছিলাম, আপনাকেও ক্ষমা করতে হবে!’

কারেনিন শুনে গেলেন, কিন্তু ডল্লির কথা আর প্রভাবিত করছিল না তাঁকে। মনের মধ্যে তাঁর আবার ফুঁসে উঠল সেদিনের সমস্ত বিদ্বেষ যখন বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন তিনি। গা ঝাড়া দিয়ে তিনি উচ্চ খনখনে গলায় কথা বলতে লাগলেন : ‘ক্ষমা আমি করতে পারি না এবং চাই না, সেটাকে আমি অন্যায় বলে মনে করি। এই নারীটির জন্যে আমি করেছি সব কিছু, সেটা সে তার স্বভাবসিদ্ধ কাদায় চটকেছে। আমি আক্রোশপরায়ণ লোক নই, কখনো ঘৃণা করিনি কাউকে, কিন্তু ওকে আমি প্রাণপণে ঘৃণা করি, এমন কি তাকে ক্ষমা করতেও পারি না। কেননা আমার যে অপকার সে করেছে, তার জন্যে তাকে ঘৃণা করি বড় বেশি!’ বিদ্বেষে রুদ্ধকণ্ঠ হয়ে বললেন তিনি।

দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনা সসংকোচে ফিসফিস করে বললেন, ‘যারা তোমাকে ঘৃণা করে তাদের ভালোবেসে…’, ঘৃণাভরে মুচকি হাসলেন কারেনিন। কথাটা তাঁর অনেকদিন থেকেই জানা, কিন্তু এটা তাঁর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে না।

‘তোমাকে যারা ঘৃণা করে তাদের ভালোবেসে তা ঠিক, কিন্তু তুমি যাদের ঘৃণা কর তাদের ভালোবাসা যায় না। আপনার মনে যে ব্যথা দিলাম সে জন্যে মাপ করবেন। প্রত্যেকেরই নিজ নিজ কষ্ট আছে যথেষ্ট!’ আত্মসংবরণ করে শান্তভাবে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন কারেনিন।

তেরো

টেবিল ছেড়ে সবাই যখন উঠলেন, লেভিনের ইচ্ছে হয়েছিল কিটির সাথে ড্রয়িং-রুমে যাবেন; কিন্তু ভয় হল, তার প্রতি বড় বেশি সুস্পষ্ট মনোযোগ প্রদর্শনে কিটি আবার রাগ না করে। পুরুষদের দলটার সাথেই তিনি থেকে গেলেন, যোগ দিলেন সাধারণ আলাপটায়, এবং কিটির দিকে না তাকিয়েও অনুভব করছিলেন তার গতিভঙ্গি, তার দৃষ্টি, ড্রয়িং- রুমের সেই জায়গাটা যেখানে সে ছিল।

তিনি তার নিজের ওপর এতটুকু জোর না খাটিয়ে তখনই পালন করতে লাগলেন যে প্রতিশ্রুতি কিটিকে তিনি দিয়েছিলেন—সবার সম্পর্কে সব সময় তাদের ভালো দিকটার কথা ভাবতে হবে, সব সময় ভালোবাসতে হবে সবাইকে। আলাপ চলছিল রুশী পল্লীসমাজ নিয়ে। পেস্তসোভ তার ভেতর কি একটা বিশেষ সূচনা দেখতে পাচ্ছিলেন, তার নাম তিনি দিয়েছেন ঐকতানীয় সূচনা। লেভিনের অমত ছিল পেসোভের সাথেও, বড় ভাইয়ের সাথেও, যিনি নিজের ধরনে রুশী পল্লীসমাজের গুরুত্ব মেনেও নিচ্ছিলেন, আবার মানছিলেনও না। তবে লেভিন ওঁদের সাথে কথা বললেন তাঁদের মধ্যে আপোস করিয়ে দিয়ে মতভেদ নরম করিয়ে আনার চেষ্টা করে। তিনি নিজে কি বললেন তাতে তাঁর বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না আর ওঁর যা বলছেন তাতে তাঁর আগ্রহ ছিল আরো কম, তিনি চাইছিলেন শুধু একটা জিনিস—তাঁরও এবং ওঁদেরও যেন ভালো হয়। এখন তিনি জেনেছেন শুধু কোন্ জিনিসটা গুরুত্বপূর্ণ। আর সেই জিনিসটা প্রথমে ছিল ওখানে, ড্রয়িং-রুমে, তারপর চলতে চলতে এসে দাঁড়িয়েছে দরজায়। ফিরে না চেয়েও তিনি টের পাচ্ছিলেন তাঁর প্রতি নিবদ্ধ দৃষ্টি আর হাসি, তাই না চেয়ে পারলেন না। শ্যেরবাৎস্কির সাথে কিটি দাঁড়িয়ে ছিল দোরগোড়ায়, চাইছিল তাঁর দিকে।

তার কাছে গিয়ে লেভিন বললেন, ‘আমি ভেবেছিলাম আপনি পিয়ানো বাজাতে যাচ্ছেন। গাঁয়ে এই জিনিসটা আমি পাই না—সঙ্গীত।’

কিটি হাসির উপহারে তাঁকে ভূষিত করে বলল, ‘না, আমরা এসেছি আপনাকে ডেকে নিয়ে যেতে আর এসেছেন বলে ধন্যবাদ জানাতে। তর্কের কি যে এত শখ? একজন অন্যজনকে স্বমতে আনতে তো পারবে না কখনো।’

লেভিন বললেন, ‘তা ঠিক, অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই হয় যে উত্তপ্ত তর্কটা চলে কারণ প্রতিপক্ষ কি বলতে চাইছ সেটা কোনক্রমেই বোঝা হয় না।’

বেশি বুদ্ধিমান লোকদের মধ্যে তর্কে লেভিন প্রায়ই লক্ষ্য করেছেন যে প্রচুর প্রয়াস এবং ভুরিভুরি সূক্ষ্ম যুক্তি ও বাক্যের পর তার্কিকেরা শেষ পর্যন্ত এই চেতনায় পৌঁছায় যে পরস্পরের কাছে যে তারা প্রমাণ করার চেষ্টা করছে বহুক্ষণ ধরে, আগেই, তর্ক শুরুর প্রথম থেকেই তা তাদের জানা ছিল কিন্তু ভালো-লাগাটা তাদের বিভিন্ন, এবং কি সেই ভালোলাগাটা তা বলতে চায় না পাছে আপত্তি ওঠে এই ভয়ে। বহুবার তাঁর এই অভিজ্ঞতা হয়েছে যে তর্কের সময় মাঝে মাঝে ধরা যায় কি ভালোবাসে প্রতিপক্ষ এবং হঠাৎ নিজেরই ভালো লেগে যায় সেটা, মতে মতে মিল হয়ে যায় সাথে সাথেই। সমস্ত যুক্তি ঝরে পড়ে নিষ্প্রয়োজন হয়ে; কখনো কখনো অভিজ্ঞতাটা হয়েছে বিপরীত : নিজে ডেটা পছন্দ করি, যার জন্য যুক্তি বানাচ্ছি, সেটা শেষ পর্যন্ত বলে ফেলে আর ভালোভাবে, অকপটে, তা বলা হলে প্রতিপক্ষ হঠাৎ সায় দিয়ে বসে, তর্ক থামায়। এই কথাটাই বলতে চেয়েছিলেন তিনি।

কিটি কপাল কুঁচকে বোঝার চেষ্টা করছিল। কিন্তু লেভিন বোঝতে শুরু করা মাত্রই বুঝে ফেলেছিল কিটি।

 ‘বুঝতে পারছি, জানতে হবে কি জন্যে তর্ক করছে, কি তার পছন্দ, তাহলে…’

লেভিন যে ভাবনাটা ভালো করে প্রকাশ করতে পারেননি সেটা পুরোপুরি অনুমান করে প্রকাশ করলে কিটি। আনন্দে হাসলেন লেভিন : পেস্তসোভ আর বড় ভাইয়ের সাথে শব্দবহুল গোলমেলে তর্কটা থেকে অমি জটিল ভাবনার অতি সংক্ষিপ্ত ও পরিষ্কার, যাতে প্রায় শব্দ নেই বললেই চলে, এমন একটা বিবৃতিতে পৌঁছে যাওয়ায় অভিভূত হয়েছিলেন তিনি।

শ্যেরবাৎস্কি সরে গেল ওঁদের কাছ থেকে আর তাস খেলার জন্য যে টেচিল পাতা হয়েছিল কিটি গিয়ে বসল সেখানে, একটা চকখড়ি নিয়ে নতুন সবুজ টেবিল-ঢাকা জাজিমের ওপর একটার পর একটা বৃত্ত আঁকতে লাগল। ডিনারের সময় যে আলাপটা শুরু হয়েছিল সেটার পুনরারম্ভ করল তারা, যথা মেয়েদের স্বাধীনতা আর কাজ। যে মেয়ে বিয়ে করেনি সে কোন পরিবারের নারীসুলভ কাজ জুটিয়ে নিতে পারে, দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনার এ মতটায় সায় ছিল লেভিনের। জোর দিয়ে তিনি বললেন যে সাহায্যকারিণী ছাড়া কোন সংসারেরই চলে না, ধনী, গরিব সমস্ত সংসারেই আছে, থাকা উচিত মাইনে করা অথবা আত্মীয় কোন আয়া।

‘না’, লাল হয়ে এবং তাতে করে আরো অসংকোচে লেভিনের দিকে তার ন্যায়পরায়ণ চোখ মেলে কিটি বললেন, ‘মেয়ে এমন অবস্থায় পড়তে পারে যে হীনতা স্বীকার না করে সে কোন পরিবারের কাজ নিতে পারে না আর নিজে সে… ‘

লেভিন বুঝলেন তার ইঙ্গিত। বললেন, ‘ও, হ্যাঁ-হ্যাঁ-হ্যাঁ। আপনি ঠিক বলেছেন, ঠিকই বলেছেন!’

ডিনার টেবিলে নারী স্বাধীনতা নিয়ে পেস্তসোভ যা প্রমাণ করতে চাইছিলেন সেটা সবই লেভিনের বোধগম্য হয়ে গেল শুধু এই কারণে যে কিটির মধ্যে দেখতে পেলেন কুমারীত্ব ও হীনতাস্বীকারের ভয়, আর তাকে ভালোবাসায় নিজেই সে ভয় আর হীনতাটা অনুভব করে তৎক্ষণাৎ বাতিল করে দিলেন নিজের যুক্তি।

নীরবতা নামল। খড়ি দিয়ে কিটি কেবলই দাগ দিয়ে যাচ্ছিল টেবিলে। চোখ তার জ্বলজ্বল করছিল একটা শান্ত দীপ্তিতে। তার মেজাজে নিজেকে সঁপে দিয়ে লেভিন তাঁর সমগ্র সত্তায় অনুভব করছিলেন সুখের একটা ক্রমবর্ধমান চাপ।

‘যাঃ, গোটা টেবিলটায আঁকিবুকি কেটে ফেলেছি!’ এই বলে খড়ি রেখে সে যেন উঠবার উপক্রম করল। ‘ওকে ছাড়া আমি একটা থাকব কি করে?’ সভয়ে মনে হল লেভিনের। খড়িটা নিয়ে টেবিলের কাছে বসে বললেন, ‘একটু দাঁড়ান, অনেকদিন থেকে আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব ভাবছিলাম।’

সোজাসুজি তিনি চাইলেন কিটির সস্নেহ, তবু ত্রস্ত চোখের দিকে।

‘বেশ তো, জিজ্ঞেস করুন।

’এটা’, বলে তিনি লিখলেন শব্দের আদ্যক্ষরগুলো : আ. য. ব. য. হ. পা. না. সে. কি. ব. ম. না. ত. জ? অক্ষরগুলোর অর্থ : ‘আপনি যখন বলেছিলেন যে হতে পারে না, সেটা কি বরাবরের মত, নাকি তখনকার জন্যে?’ জটিল এই বাক্যটা কিটি বুঝতে পারবে এমন কোন নিশ্চয়তা ছিল না; তার দিকে লেভিন তাকিয়ে রইলেন এমন ভাব করে যেন কথাগুলো সে বুঝবে কিনা, তার ওপর নির্ভর করছে তাঁর জীবন।

গম্ভীরভাবে কিটি চাইল তাঁর দিকে, তারপর হাতের ওপর কুঞ্চিত কপাল ভর দিয়ে পড়তে লাগল অক্ষরগুলো। মাঝে মাঝে সে লেভিনের দিকে তাকিয়ে যেন বলচ্ছিল : ‘আমি যা ভাবছি সেটা ঠিক?’

লাল হয়ে উঠে সে বলল, ‘বুঝতে পেরেছি।’

যে কথাটায় বলা হয়েছে ‘বরাবরের মত’ সে অক্ষরটা দেখিয়ে লেভিন জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটা কি শব্দ?’

‘বরাবরের মত’, কিটি বলল, ‘কিন্তু ওটা ঠিক নয়!’

তাড়াতাড়ি অক্ষরগুলো মুছে লেভিন উঠে দাঁড়িয়ে কিটিকে খড়িটা দিলেন। সে লিখল : ত. আ. আ. জ. দি. পা, না.।

কারেনিনের সাথে কথাবার্তা থেকে ডল্লি যে কষ্ট পেয়েছিলেন তার ভার একেবারে নেমে গেল যখন দেখলেন এই যুগল মূর্তিকে : খড়ি হাতে, ভীরু-ভীরু, সুখের হাসি নিয়ে কিটি চোখ তুলে আছে লেভিনের দিকে, আর তাঁর সুকুমার দেহ নুয়ে আছে টেবিলের ওপর, দীপ্ত চোখ কখনো নিবদ্ধ টেবিলে, কখনো কিটির দিকে। হঠাৎ জ্বলজ্বল করে উঠলেন তিনি : বুঝতে পেরেছেন। অক্ষরগুলোর অর্থ : ‘তখন আমি অন্য জবাব দিতে পারতাম না!’

কিটির দিকে তিনি চাইলেন সপ্রশ্ন ভীরু, দৃষ্টিতে।

‘শুধু তখন?’

‘হ্যাঁ’, জবাব দিলে কিটির হাসি।

‘বেশ, পড়ে দেখুন। যা চেয়েছি, খুবই যা চেয়েছি, সেটা বলব!’ কিটি লিখল : যা. ঘ. তা. যে. আ. ভু. যা. ক্ষ. ক। অক্ষরগুলোর অর্থ : ‘যা ঘটেছিল তা যেন আপনি ভুলে যান ক্ষমা করেন।’

উত্তেজিত হাতে লেভিন খড়ি নিয়ে সেটাকে ভেঙে কাঁপা কাঁপা আঙুলে লিখলেন এই বাক্যটার আদ্যক্ষরঃ ‘ভুলে যাবার, ক্ষমা করার কিছু নেই আমার, আপনাকে ভালোবাসতে কখনো ক্ষান্ত হইনি আমি।’

তাঁর দিকে নিবদ্ধ হাসি নিয়ে কিটি চাইল।

ফিসফিসিয়ে বলল, ‘বুঝতে পেরেছি।’

লেভিন বসে লিখলেন লম্বা একটা বাক্য। কিটি বুঝল এবং ‘তাই না?’ জিজ্ঞেস না করেই তখনই জবাব লিখল তার।

কি সে লিখেছে তা বহুক্ষণ বুঝে উঠতে পারেননি লেভিন, ঘন ঘন চাইছিলেন তার চোখের দিকে। সুখে আঁধার হয়ে আসছিল তাঁর চিন্তা। কিটি যা বোঝাতে চেয়েছে সে শব্দগুলো তিনি কিছুতেই ধরতে পারছিলেন না; কিন্তু তাঁর যা জানা দরকার ছিল তা সবই বুঝলেন কিটি সুখোজ্জ্বল মধুর চোখ থেকে। তাঁর তিনটা অক্ষর লেখা শেষ না হতেই কিটি তা পড়ে ফেলে বাক্যটা শেষ করে উত্তর দিল : ‘হ্যাঁ।’

‘কি, ধাঁধা—ধাঁধা খেলা হচ্ছে?’ কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন বৃদ্ধ প্রিন্স, ‘তবে সময় মত থিয়েটারে যেতে হলে এখন রওনা দিতে হয়।’

লেভিন উঠে দাঁড়িয়ে কিটিকে দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিলেন।

তাঁদের কথাগুলোয় সবই বলা হয়ে গিয়েছিল; বলা যে কিটি ভালোবাসে লেভিনকে, বাপ-মাকে সে কথা সে জানাবে; লেভিন তাঁদের বাড়িতে আসবে পরদিন সকালে।

চৌদ্দ

কিটি চলে যাওয়ার পর তাকে ছাড়া এক লেভিনের এতই অস্থিরতা, আবার যখন তাঁদের দেখা এবং চিরকালের জন্য মিলন হবে, আগামী কালের সেই সকালটার জন্য এতই অসহিষ্ণুতা বোধ হচ্ছিল যে কিটিকে ছাড়া এই যে চোদ্দটা ঘণ্টা তাঁকে কাটাতে হবে তাতে আতংক হচ্ছিল তাঁর, যেন সাক্ষাৎ যম এসে দাঁড়িয়েছে সামনে। একা যাতে না থাকতে হয়, সময়কে যাতে ছলনা করা যায় তার জন্য তাঁর প্রয়োজন ছিল কারো সাথে থাকা, কথা বলা। তাঁর কাছে সবচেয়ে মনোহর সহালাপী ছিলেন অব্‌লোন্‌স্কি, কিন্তু তিনি চলে গেলেন, ওঁর কথায়, কোন একটা সান্ধ্যবাসরে, কিন্তু আসরে ব্যালেতে। লেভিন শুধু এটুকু বলবার ফুসরত পেলেন যে তিনি সুখী, তাঁকে তিনি ভালোবাসেন এবং কখনো কখনো ভুলবেন না তাঁর জন্য যা তিনি করেছেন। অব্‌লোন্‌স্কির দৃষ্টি ও হাসি থেকে লেভিন টের পেলেন যে বন্ধু তাঁর এ অনুভূতিটাকে বেশ বুঝতে পারছেন।

‘কি মরার সময় হয়নি তাহলে?’ লেভিনের মর্মস্পর্শী করমর্দন করে বললেন অব্‌লোন্‌স্কি।

লেভিন বললেন, ‘মোটেই না!’

দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনাও তাঁকে বিদায় দিতে গিয়ে অভিনন্দনের সুরে বললেন : ‘কিটির সাথে আপনার আবার দেখা হওয়ায় ভারি আনন্দ হল আমার, অনেকদিনকার ভাব, তার কদর করা উচিত।’

কিন্তু দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনার এ কথাগুলো লেভিনের ভালো লাগল না। এটা যে তাঁর অয়নাত্ত কত এর ব্যাপার সেটা বুঝতে পারেন না তিনি, ও কথা উল্লেখের স্পর্ধা করা উচিত হয়নি তাঁর।

ওঁদের কাছ থেকে বিদায় নিলেন লেভিন, কিন্তু একা যাতে না থাকতে হয়, তার জন্য বড় ভাইয়ের সঙ্গ ধরলেন। ‘কোথায় যাচ্ছ তুমি?’

‘আমি—বৈঠকে।’

‘আমিও যাব তোমার সাথে। আপনি নেই?’

‘আপত্তি কিসের? চল যাই’, হেসে বললেন কজ্‌নিশেভ, ‘আজ তোর হয়েছে কি বল তো?’

‘আমার? সৌভাগ্যের উদয় হয়েছে আমার?’ যে গাড়িতে তাঁরা যাচ্ছিলেন তার জানালার কপাট নামিয়ে দিয়ে লেভিন বললেন, ‘তোমার অসুবিধা হবে না তো? নইলে বড় গুমোট। আমার সৌভাগ্যোদয় হয়েছে! তুমি কখনো বিয়ে করলে না কেন বল তো?’

সের্গেই ইভানোভিচ কজ্‌নিশেভ হাসলেন। ‘ভারি খুশি হলাম মেয়েটা মনে হয় চমৎ…’ শুরু করতে যাচ্ছিলেন কজ্‌নিশেভ।

‘ও কথা নয়, ও কথা নয়, ও কথা নয়!’ দুই হাতে তাঁর ফার কোটের কলার চেপে ধরে ওঁর মুখ বন্ধ করে চেঁচিয়ে উঠলেন লেভিন। ‘চমৎকার মেয়ে’ কথাটা বড়ই মামুলি, তুচ্ছ। তাঁর হৃয়দাবেগের অনুপযোগী।

ফুর্তিতে হাসলেন কজ্‌নিশেভ, যা তাঁর ক্ষেত্রে ঘটে কদাচিৎ।

‘তাহলেও এটুকু তো বলতে পারি যে আমি এতে খুবই খুশি।’

‘সেটা হতে পারে কাল, কালকে; এখন আর কিছু নয়! কিছু নয়, কিছু নয়, চুপ!’ ফার কলার দিয়ে আরেকবার তাঁর মুখ বন্ধ করে লেভিন বললেন, ‘তোমাকে আমি ভারি ভালোবাসি! কি, তোমাদের বৈঠকে যেতে পারি?’

‘বলাই বাহুল্য, নিশ্চয় প্যারিস।’

‘আজ, তোমাদের আলোচনা হবে কি নিয়ে?’ হাসি না থামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন লেভিন।

এলেন তাঁরা অধিবেশনে। তোতলাতে তোতলাতে কর্মসচিব আলোচ্যসূচি পড়ে শোনালেন, যেটা স্পষ্টতই তাঁর নিজের কাছেই বোধগম্য ছিল না; কিন্তু সচিবের মুখ থেকেই লেভিন বুঝতে পারলেন কি মিষ্টি, সহৃদয়, চমৎকার মানুষ তিনি। আলোচ্যসূচি পড়তে গিয়ে যেভাবে তিনি থতমত খাচ্ছিলেন, গুলিয়ে ফেলছিলেন তা থেকে ই সেটা বোঝা যাচ্ছিল। তারপর শুরু হল বক্তৃতা। কি একটা টাকা বরান্দ আর কি-সব পাইপ বসানো নিয়ে তর্ক হচ্ছিল। দুজন সদস্যকে বিষ-কামড় দিয়ে বিজয়ের ভাব নিয়ে কজ্‌নিশেভ কি যেন বললেন অনেকক্ষণ ধরে; অন্য একজন সদস্য কাগজে কি-সব জুকে নিয়ে প্রথমে শুরু করলেন সসংকোচে কিন্তু পরে মোক্ষম জবাব দিলেন বেশ পিত্তি জ্বলিয়ে তারপর য়িাজইস্কও (তিনিও ছিলেন সেখানে) কি-কি বললেন ভারি সুন্দর করে, উদার স্বরে। লেভিন এসব শুনে পরিষ্কার দেখতে পেলেন যে এসব টাকা বরাদ্দ আর পাইন কিছুই নয়, সদস্যরা মোটেই রাগারাগি করছেন না, সবাই তাঁরা ভারি ভালো, চমৎকার লোক, তাঁদের মধ্যে সবই চলছে বেশ ভালোভাবেই। কেউ কাউকে বাধা দিচ্ছেন না, সবাই সুপ্রসন্ন। লেভিনের পক্ষে বিশেষ আকর্ষক হয়েছিল এই যে তিনি আজ সবার ভেতরটা পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছিলেন, আগে যা তাঁর লক্ষ্যে পড়ে নি এমন সব ছোট ছোট লক্ষণ থেকে তিনি প্রত্যেকের অন্তরটা জানতে পারছিলেন এবং পরিষ্কার দেখলেন যে তাঁরা সবাই সহৃদয় লোক। বিশেষ করে তাঁকে, লেভিনকে, ওঁরা আজ সবাই খুব ভালোবাসছেন। যেভাবে তাঁর কথা কইছিলেন তাঁর সাথে, কি সাদরে, সৌজন্যসহকারে তাঁর দিকে চাইছিলেন এমন কি অপরিচিতরাও, তা থেকে সেটা বোঝা যাচ্ছিল।

কজ্‌নিশেভ জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি খুশি হয়েছিস?’

‘খুবই। আমি কখনো ভাবিনি যে এত ভালো লাগবে! চমৎকার!’

সি্‌ভ্‌য়াজ্‌স্কি লেভিনের কাছে এসে তাঁকে চা-পানে ডাকলেন। সি্‌ভ্‌য়াজ্‌স্কি ওপর লেভিন অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন কেন, কি তাঁর মধ্যে তিনি চেয়েছিলেন, সেটা বুঝতে বা স্মরণ করতে লেভিন পারলেন না কিছুতেই। এ যে ভারি বুদ্ধিমান, আশ্চর্য সদাশয় মানুষ

‘সানন্দে’, বলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন তাঁর স্ত্রী ও শ্যালিকার খবর। আর তাঁর কাছে সি্‌ভ্‌য়াজ্‌স্কি শ্যালিকার কথাটা বিবাহের সাথে মিলে থাকায় একটা বিচিত্র ভাবানুষঙ্গে তাঁর মনে হল যে নিজের সুখের কথাটা শুনবার পক্ষে সি্‌ভ্‌য়াজ্‌স্কির স্ত্রী ও শ্যালিকার মত লোক আর হয় না। ওঁদের কাছে যেতে পারায় খুবই খুশি হলেন তিনি।

গ্রামে তাঁর বিষয়-আশয়ের খবর জিজ্ঞেস করলেন সি্‌ভ্‌য়াজ্‌স্কি, ইউরোপে যা যাওয়া যায়নি তেমন কোন উপায় পাবার সম্ভাবনায় বরাবরের মতই কোন আমল না দিয়ে, কিন্তু তাতেও এখন লেভিনের এতটুকু খারাপ লাগল না। বরং তাঁর মনে হল সি্‌ভ্‌য়াজ্‌স্কি সঠিক, তাঁর সমস্ত ব্যাপারটাই তুচ্ছ, নিজের সঠিকতার প্রতিপাদন যে আশ্চর্য নম্রতা ও কোমলতায় সি্‌ভ্‌য়াজ্‌স্কি এড়িয়ে যাচ্ছেন সেটা দেখতে পেলেন তিনি। লেভিনের মনে হল তাঁরা তাঁর সব কথা জানেন ও টের পাচ্ছেন কিন্তু বলল না শুধু ভদ্রতাবেশে। ওঁদের ওখানে তিনি রইলেন ঘণ্টা দু’তিন, কথা হল নানা বিষয় নিয়ে, কিন্তু একটা জিনিসেই তাঁর মন ছিল ভরা, খেয়ালই করেননি যে উনি ওঁদের ভয়ানক অতিষ্ঠ করে তুলছেন, বহুক্ষণ ঘুমাবার সময় হয়ে গেছে ওঁদের। হাই তুলতে তুলতে এবং বন্ধুর বিচিত্র মেজাজে অবাক হয়ে সি্‌ভ্‌য়াজ্‌স্কি তাঁকে এগিয়ে দিলেন প্রবেশ-কক্ষে পর্যন্ত। তখন একটা বেঘে গেছে। হোটেলের ফিরে অবশিষ্ট আরো দশ ঘণ্টা তাঁকে একা কাটাতে হবে ভেবে ভয় হল লেভিনের। বাতি জ্বালিয়ে দিয়ে অনিদ্রিত চাপরাশি চলে যেতে চাইছিল, কিন্তু লেভিন তাকে থামালেন। এটি এই ইয়েগরটি, লেভিন যাকে, খেয়ালই করেননি আগে, দেখা গেল খুবই বুদ্ধিমান, ভালো এবং বড় কথা, সহৃদয় লোক।

‘কি হল ইয়েগর, সারা রাত জেড়ে থাকা কঠিন, তাই না?’

‘কি করা যাবে! ওই আমাদের চাকরি। ভদ্রলোকের বাড়ি চাকরিতে ঝামেলা নেই, তবে এখানে পয়সা আছে।’

জানা গেল ইয়েগরের ঘর-সংসার আছে, তিনটা ছেলে আর, একটা মেয়ে, সেলাই করে, জিন বিক্রির দোকানে যে ছেলেটা কাজ করে তার সাথে মেয়েটার বিয়ে দিতে চায় সে।

এই উপলক্ষে লেভিন তাকে জানিয়ে দিলেন কি তিনি ভাবেন, বললেন যে বিয়ের ব্যাপারে প্রধান কথা হল ভালোবাসা, সেটা থাকলে সব সময়ই সুখী হওয়া যায়, কেননা সুখ থাকে কেবল নিজের মধ্যেই।

ইয়েগর মন দিয়ে শুনলে তাঁর কথা, বাহ্যত মনে হল লেভিনের কথাটা সে পুরোপুরি বুঝতে পেরেছে, কিন্তু তার সমর্থনে সে লেভিনের কাছে একেবারে অপ্রত্যাশিত যে কথাটা বলল সেটা হল এই যে : যখন সে থেকেছে ভালো মনিবদের সাথে, মনিবদের ব্যাপারে সব সময় সন্তুষ্ট থেকেছে সে, এখনো সে পুরোপুরি সন্তুষ্ট তার মনিবকে নিয়ে যদিও সে ফরাসি।

‘আশ্চর্য ভালোমানুষ’, মনে হল লেভিনের।

‘কিন্তু তুমি যখন বিয়ে করেছিলে ইয়েগর, ভালোবাসাতে বৌকে?’

‘ভালো না বাসরে চলে!’ জবাব দিলে ইয়েগর।

লেভিন দেখতে পেলেন যে ইয়েগরও একই রকম উচ্ছ্বসিত অবস্থায় আছে, বলতে চাইছে তার প্রাণের সব কিছু কথা।

‘আমার জীবনওটা আশ্চর্য বটে। ছেলেবেলা থেকে আমি…’ চোখ জ্বলজ্বল করে শুরু করল ইয়েগর, স্পষ্টতই লেভিনের উচ্ছ্বাসে সংক্রামিত হয়েছিল সে-ও, যেভাবে একজন হাই তুললে অন্যজনেরও হাই পায়।

কিন্তু এ সময় ঘণ্টি বাজল; ইয়েগর চলে গেল, লেভিন রইলেন একা। ডিনার তিনি প্রায় কিছুই খাননি, সি্‌ভ্‌য়াজ্‌স্কিদের ওখানে চা আর নৈশাহারও বাদ দিয়েছিলেন, কিন্তু খাবার কথা ভাবতে পারছিলেন না তিনি। আগের রাতে ঘুম হয়নি তাঁর, কিন্তু গুমোট লাগিছল। জানালার ওপরকার ছোট কপাট—দুটোই খুলে দিয়ে তিনি বসলেন তার সামনাসামনি। তুষারাবৃত চালগুলোর মধ্যে দেখা যাচ্ছিল শেকল ঝোলানো নশি ক্রশ আর তার ওপরে উদীয়মান ত্রিকোণ অরিগা নক্ষত্রমণ্ডলী আর জ্বলজ্বলে-হলুদ কাপেলা তারাটা। কখনো ক্রশ, কখনো তারাটাকে দেখছিলেন তিনি, তাজা, হিমেল হাওয়া টানছিলেন বুক ভরে, যা ঘরে ঢুকছিল তালে তালে এবং স্বপ্নের মত কল্পনায় ভেসে উঠতে লাগল স্মৃতি আর মূর্তি। রাত তিনটার পর পদশব্দ শোনা গেল করিডরে, উনি তাকিয়ে দেখলেন দরজা দিয়ে। তাঁর পরিচিত জুয়াড়ি মিয়াস্কিন ফিরছে ক্লাব থেকে। ফিরছিল সে মনমরার মত, কাশতে কাশতে। ‘বেচারি, হতভাগ্য!’ লেভিন ভাবলেন, লোকটার জন্য ভালোবাসা আর অনুকম্পায় চোখে পানি এসে গেল তাঁর। ভেবেছিলেন ওর সাথে কথা বলবেন, সান্ত্বনা দেবেন; কিন্তু মনে পড়ে গেল যে তিনি শুধু শার্ট পরে আছেন, তাই সে চিন্তা ছেড়ে আবার গিয়ে বসলেন জানালার কাছে শীতল বাতাসে অবগাহনের জন্য আর তাঁক কাছে ভারি তাৎপর্যময় ওই ক্রশটার অদ্ভুত আকার আর উদীয়মান জ্বলজ্বলে-হলুদ তারাটাকে দেখতে। ছ’টার পর শোনা গেল মেঝে-পালিশ করা লোকদের শব্দ, কি-একটা আরাধনার জন্য গির্জার ঘণ্টা, শীত-শীত করতে লাগল লেভিনের। ওপর-জানালা বন্ধ করে, হাত-মুখ ধুয়ে পোশাক পরে বাইরে বেরিয়ে এলেন তিনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *