পাঁচ
সকালের নাশতার পর লেভিন আগের সারিতে নয়, পড়লেন রসিক বুড়ো আর এক ছোকরা চাষীর মাঝখানের সারিতে বুড়ো তাঁকে ডেকেছিল পড়শী হতে। ছোকরা চাষী সবেমাত্র বিয়ে করেছে শরতে, এই প্রথমবার গ্রীষ্মে ঘাস কাটতে আসছে।
আগে আগে যাচ্ছিল বুড়ো, পা মুচড়িয়ে লম্বা সমতাল পদক্ষেপে, ভঙ্গি তার নিখুঁত, সমান, যেন হাঁটার সময় হাত দোলানোর বেশি মেহনত লাগছে না তার, এমনি খেলাচ্ছলে একই রকম উঁচু কাটা ঘাসের সারি বেঁধে যাচ্ছিল সে। যেন ও কিছু করছে না, ধারালো কাস্তেটা আপনা-আপনিই রসালো ঘাসে কেটে বসছে।
লেভিনের পেছনে আসছিল ছোকরা মিকা। মুখখানা তার মিষ্টি, এক গোছা তাজা ঘাস দিয়ে চুল বাঁধা, পরিশ্রম সে মুখ ক্রমাগত খিঁচড়ে যাচ্ছে; কিন্তু তার দিকে চাইলেই সে হাসে। বোঝা যায় যে, তার কষ্ট হচ্ছে সেটা স্বীকার করার চেয়ে বরং মরতে রাজী।
লেভিন যাচ্ছিলেন তাদের মাঝখানে দিয়ে। ঘাস কাটার ধূম যখন তুঙ্গে উঠল, লেভিনের তখন কষ্ট হয়নি তেমন দরদর ঘাম শীতল করে তুলছিল তাঁকে, পিঠ, মাথা, আস্তিন গুটানো হাত পুড়িয়ে রোদ তাঁকে দিচ্ছিল জোর আর কাজের গোঁ। ঘনঘন আসছিল সেই সব অচেতন মুহূর্তে যখন কি করছেন সে নিয়ে চিন্তা না করে থাকা যায়। কাস্তে ঘাস কেটে চলছে আপনা থেকেই। সুখের মুহূর্ত এগুলো। আরো আনন্দ হল যখন সারি যে নদীতে গিয়ে পড়েছে সেখানে এসে বুড়ো ভেজা ঘন ঘাস দিয়ে কাস্তে মুছে, নদীর টাটকা পানি দিয়ে ধুয়ে বেরি সিজানো পাত্র থেকে খানিকটা পানীয় দিলে লেভিনকে
‘নাও, আমার শরবত। কেমন, ভালো?’ বলল সে চোখ মটকে।
আর সত্যিই পাতার কুচি ভাসা, টিনের কৌটার মরচে ধরা স্বাদ মাখা এমন পানীয় লেভিন কখনো খাননি। এর পরেই শুরু হল কাস্তেতে হাত রেখে সুখাবিষ্ট মন্থার পাদচারণ যখন কপালের ঘাম মোছা, বুক ভয়ে নিঃশ্বাস নেওয়া, ঘেসুড়েদের গোটা সারিটা আর চারপাশে, মাঠে, বনে কি হচ্ছে তা দেখে নেওয়া সম্ভব।
যত বেশি লেভিন ঘাস কাটতে লাগলেন ততই ঘনঘন আসছিল সেই আত্মভোলা মুহূর্ত যখন তাঁর হাত কাস্তে হাঁকায় না, যখন কাস্তেই তার পেছনে টানে সজ্ঞান, জীবনে ভরপুর দেহকে, আর যেন যাদুবলে, কাজ নিয়ে কোন ভাবনা ছাড়াই সঠিক, চমৎকার কাজ হয়ে চলে আপনা-আপনি। সবচেয়ে সুখের মুহূর্ত এগুলো।
কঠিন লাগত যখন এই অচেতন গতি থামিয়ে ভাবতে হত, যখন ছাঁটতে হত ঢিবি অথবা না-নিড়ানোর সরেল- জমি। বুড়ো এটা করত অনায়াসে। চাঙড় এলে বুড়োর কাজের ভঙ্গি বদলে যেত, কখনো গোড়ালি দিয়ে, কখনো কাস্তের ডগা দিয়ে দু’দিক থেকে ছোট ছোট যা দিয়ে পরিষ্কার করত চাঙড়। আর তা করতে করতেই নজর করে দেখত আগে কি পড়ছে। কখনো সে কোন-একটা বেরি ছিঁড়ে খেত বা দিত লেভিনকে, কখনো কাস্তের ডগা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলত ডাল, কখনো তাকিয়ে দেখত তিতির পাখির বাসা, একেবারে কাস্তের মুখে পক্ষিণী উড়ে গেল যেখান থেকে। একবার পথে পড়া একটা সাপ ধরল, কাঁটার তোলার মত করে সেটা তার কাস্তেয় তুলে ধরে লেভিনকে দেখিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল।
কিন্তু লেভিন এবং তাঁর পেছনকার ছোকরাটির পক্ষে কাজের ভঙ্গি বদলানো কঠিন হচ্ছিল। দুজনেই তাঁরা শ্রমসাধ্য কোন একটা ভঙ্গি আয়ত্ত করে কাজে মেতে উঠছিলেন যে তা বদলানো আর সেই সাথে সামনে কি পড়ছে দেখা সম্ভব হচ্ছিল না।
লেভিন লক্ষ্য করেননি কিভাবে সময় কাটছে। কতক্ষণ তিনি ঘাস কাটছেন জিজ্ঞেস করলে তিনি হয়ত বলতেন, আধঘণ্টা, অথচ দিবাহারের সময় কাছিয়ে এসেছিল। সারি দিয়ে ফেরার সময় বুড়ো লেভিনকে দেখাল কতকগুলো ছেলেমেয়ে। সামান্য দেখা যাচ্ছিল তাদের, লম্বা লম্বা ঘাস আর রাস্তা উজিয়ে নানা দিক থেকে তারা আসছিল ঘেসুড়েদের কাছে, রুটির পোঁটলা আর তাদের হাত টেনে ধরা ন্যাকড়া গোঁজা ভাসের ভাঁড় নিয়ে।
‘দেখছ তো, গুটি গুটি পোকা-মাকড়েরা আসছে’, ওদের দেখিয়ে বুড়ো বলল, হাত আড়াল করে সূর্যের দিকে তাকাল।
আরো দুটো সারি শেষ হতে বুড়ো থামল।
চূড়ান্ত স্বরে সে বলল, ‘খেতে হবে গো, মনিব!’ নদী পর্যন্ত গিয়ে ঘেসুড়েরা সারি পেরিয়ে গেল কাফতানগুলোর কাছে। খাবার নিয়ে এসে ছেলেমেয়েরা সেখানে বসে ছিল তাদের অপেক্ষায়। দূরের লোকেরা জুটল গাড়ির নিচে, কাছের লোকেরা উইলো ঝোপের তলে, তার ওপর ঘাস চাপিয়ে।
লেভিন গেলেন তাদের কাছে, বাড়ি যাবার ইচ্ছে হচ্ছিল না তাঁর।
মনিবের সামনে যত কিছু সংকোচ সব অনেক আগেই কেটে গিয়েছিল। খাবার তোড়জোড় করছিল চাষীরা। একদল হাত-মুখ ধুল, ছোকরারা গোসল করল নদীতে। অন্যেরা বিশ্রামের জায়গা ঠিকঠাক করল, রুটির পোঁটলা খুলল, বের করল ভাসের ভাঁড়। বুড়ো একটা পেয়ালায় রুটি ভেঙে ভেঙে ফেলল, তা থেঁতো করল চামচের বাঁট দিয়ে, বেরি সিজানো পাত্র থেকে পানি ঢালল, তার ওপর আরো খানিক পাঁউরুটি কেটে লবণ ছিটিয়ে পুব দিকে মুখ করে প্রার্থনা করতে শুরু করল।
পেয়ালার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে সে বলল, ‘খেয়ে দ্যাখো মনিব, আমার পান্তা।’
পান্তাটা এমনই সুস্বাদু যে বাড়ি গিয়ে খাবার সংকল্প ত্যাগ করলেন লেভিন। বুড়ার সাথেই তিনি খেলেন, আলাপ করলেন তার ঘর-সংসারের কথা নিয়ে, জীবন্ত আগ্রহ দেখালেন তাতে, তাঁর নিজের যে সমস্ত ব্যাপার-স্যাপারে বুড়োর আগ্রহ হতে পারে, সেগুলো বললেন। বড় ভাইয়ের চেয়ে বুড়োকেই তাঁর বেশি আপন মনে হল, তার প্রতি একটা কোমলতায় অজ্ঞাতসারে হাসলেন তিনি। বুড়ো যখন আবার উঠে প্রার্থনা সেরে মাথার তলে এক তাল ঘাস দিয়ে ওখানেই ঝোপের নিচে শুয়ে পড়ল, লেভিনও তাই করলেন, যদিও রোদ্দুরে নাছোড়বান্দা এঁটেল মাছি আর পোকাগুলো সুড়সুড়ি দিচ্ছিল তাঁর ঘর্মাক্ত মুখ আর দেহে। সাথে সাথেই ঘুমিয়েই পড়লেন তিনি। জাগলেন কেবল সূর্য যখন ঝোপের অন্য পাশে সরে তাঁর মুখে রোদ ফেলছিল। বুড়ো অনেক আগেই উঠে শান দিচ্ছিল ছোকরাদের কাস্তেতে।
চারপাশে তাকিয়ে দেখে লেভিন চিনতে পারলেন না জায়গাটা : এতই তা বদলে গিয়েছিল। মাঠটার বিরাট এলাকায় ঘাস কাটা হয়ে গেছে, বৈকালিক সূর্যের তির্যক কিরণে ইতিমধ্যেই গন্ধে ভুরভুরে সারিগুলো নিয়ে তা ঝকঝক করছে বিশেষ একটা নতুন ঝলকানিতে। নদীর কাছে কাটা ঝোপ, খোদ নদীটাই যা আগে দেখা যেত না আর এখন তার দাঁড়াচ্ছে, চলাফেরা করছে তারা, না-কাটা জায়গাগুলোয় ঘাসের খাড়া দেয়াল, খোলা মাঠের ওপরে পাক দেওয়া বাজপাখিগুলো—এ সবই একেবারে নতুন। সজাগ হয়ে উঠে লেভিন হিসাব করতে লাগলেন কতটা জায়গায় ঘাস কাটা হয়েছে, কতটায় এখনো কাটা যেতে পারে আজকেই।
বিয়াল্লিশ জন লোকের পক্ষে কাজ হয়েছে অসাধারণ। বেশি বেগার খাটুনির আমলে তিরিশ জনে যা কাটত দু’দিন ধরে তেমন একটা বড় মাঠের গোটাটাই কাটা হয়ে গেছে। হয়নি শুধু ছোট ছোট সারির কোণগুলো। কিন্তু লেভিনের ইচ্ছে হচ্ছিল সেদিন যত পারা যায় বেশি কাটা, রাগ হচ্ছিল সূর্যের ওপর যা এত দ্রুত ঢলে পড়ছে। কোনরকম ক্লান্তি বোধ হচ্ছিল না তাঁর; শুধু চাইছিলেন আরো, আরো তাড়াতাড়ি যত পারা যায় বেশি খাটতে।
বুড়োকে তিনি বললেন, ‘কি, মাষ্কার উঁচু জমিটাও সেরে ফেলব নাকি?’
‘সৃষ্টিকর্তার যা ইচ্ছে। সূর্য তো আর উঁচুতে নেই। তা ছোকরাগুলোর জন্যে ভোল্কা হবে তো?’
দুপুরে গড়িয়ে নেবার পর লোকগুলো যখন আবার উঠে বসল, ধূমপান শুরু করল ধূমপায়ীরা, বুড়ো ঘোষণা করল, মাষ্কার উঁচু জমির ঘাস কাটতে পারলে ভোদ্কা মিলবে।
‘এহ্, কাটব না আবার! চল তিত্! এমন হাঁকান হাঁকাব-না? রাতে খাবি পেট পুরে। চল যাই!’ শোনা গেল কলরব, রুটিগুলো শেষ করে চলল ঘেসুড়েরা, ‘তাহলে, রুখে থাকো হে সবাই!’ প্রায় ঘোড়ার মত দৌড়ে তিত্ চলল সামনে।
‘চল, চল!’ পেছনে পেছন এসে অনায়াসে তার পাল্লা ধরে বুড়ো বলল, ‘সামলে! কাটা পড়বি!’
জোয়ান, বুড়ো সবাই যেন পাল্লা দিয়ে ঘাস কাটতে লাগল। কিন্তু যতই ওরা তাড়াহুড়া করুক, ঘাস পয়মাল করছিল না তারা, একই রকম পরিচ্ছন্ন আর সুস্পষ্ট সারি পড়ছিল। কোণে কোণে যে জায়গাগুলো ছিল, পাঁচ মিনিটে তা কাটা শেষ। শেষের ঘেসুড়েরা সারি শেষ করতে-না-করতেই সামনের লোকরা রাস্তা পেরিয়ে চলে গেল মাষ্কার উঁচু জমিতে।
তখন সূর্য নেমে এসেছে গাছগুলোর মাথায়, আর পাত্র ঝমঝমিয়ে তারা ঢুকল উঁচু জমির বনের খাদে। সারা জায়গাটার মাঝখানে ঘাস কোমর সমান উঁচু, সরস, নরম, কোথাও কোথাও কাও-হুইট ফুলে চিত্রবিচিত্র।
লম্বালম্বি যাওয়া হবে নাকি আড়াআড়ি—এই নিয়ে সংক্ষিপ্ত একটু আলোচনার পর প্রখর এরমিলিন, বিশালকায় কালচে রঙের এক চাষী, সেও নামকরা ঘেসুড়ে, আগে গিয়ে সারিটা পাড়ি দিয়ে ফিরল। সবাই অনুসরণ করল তাকে, পাড়ের নিচে লম্বালম্বি গিয়ে আবার পাড় বেয়ে বনের কিনারা পর্যন্ত। সূর্য নামল বনের পেছনে। শিশির পড়তে শুরু করেছিল, পাড়ের ওপরকার ঘেসুড়েরাই শুধু রোদ্দুর পাচ্ছিল, কিন্তু নিচে ভাপ উঠছিল, উল্টো দিকটায় পড়েছে তাজা শিশিরসিক্ত ছায়া। জোর কাজ চলল।
কাটা ঘাস সরস শব্দে ঝাঁঝালো গন্ধ ছেড়ে ঢিপ হতে লাগল উঁচু সারিতে। ছোট ছোট সারিতে চারদিক থেকে ঘেঁষাঘেঁষি করে পাত্র ঝমঝমিয়ে কখনো কাস্তে কাস্তে ঠোকাঠুকি, কখনো কাস্তেতে শান দেওয়ার শব্দ তুলে ঘেসুড়েরা পরস্পরের সাথে পাল্লা দিচ্ছিল।
লেভিন যাচ্ছিলেন আগের মতই ছোকরা আর বুড়োর মাঝখান দিয়ে। মেষচর্মের কোট পরা বুড়ো আগের মতই হাসি-খুশি, রগুড়ে, অনায়াস তার ভঙ্গি। বনে অনবরত পাওয়া যাচ্ছিল রসালো ঘাসের মধ্যে ফুলে ওঠা ব্যাঙের ছাতা, কাস্তেয় কাটা পড়ছিল তা। কিন্তু সে ছাতা দেখলেই বুড়ো প্রতিবার নিচু হয়ে তা তুলে ঢোকাচ্ছিল জামার ভেতর। বলছিল, ‘বুড়ি ভালোমন্দ খাবে কিছু। :
ভেজা নরম ঘাষ কাটা যত সহজই হোক, খাদের খাড়া পাড় বেয়ে ওঠা-নামা ছিল শক্ত। কিন্তু বুড়ার তাতে অসুবিধে হচ্ছিল না। গাছের ছালের বড় বড় জুতো পরা পায়ের ছোট ছোট দৃঢ় পদক্ষেপে সে ধীরে ধীরে উঠছিল পাড় বেয়ে এবং সমস্ত শরীর আর কামিজ থেকে ঝুলে পড়া পায়জামা কাঁপলেও পথের একটা ঘাস, একটা ব্যাঙের ছাতাও ছাড়ছিল না সে, সমানে রসিকতা করছিল লেভিন আর চাষীদের সাথে। লেভিন যাচ্ছিলেন তার পেছনে আর প্রায়ই তাঁর মনে হচ্ছিল, কাস্তে ছাড়াই যাতে ওঠা কঠিন, কাস্তে নিয়ে তেমন খাড়া ঢিবিতে উঠতে গিয়ে নিশ্চয় তিনি পড়ে যাবেন; তাহলেও তিনি উঠলেন এবং যা করণীয় তা করলেন, টের পাচ্ছিলেন কি-একটা বহিঃশক্তি যেন তাঁকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
ছয়
শেষ হল মাষ্কার উঁচু জমির ঘাস কাটা। সারা হল শেষ সারিটা। কাফতান পরে ফুর্তি করে বাড়ি চলল সবাই। সখেদে চাষীদের কাছে থেকে বিদায় নিয়ে ঘোড়ায় চেপে লেভিনও রওনা দিলেন। ঢিবির ওপর থেকে তাকিয়ে দেখলেন তিনি : নিচু থেকে ওঠা কুয়াশায় তাদের আর দেখা যাচ্ছিল না; শোনা যাচ্ছিল শুধু তাদের ফুর্তিবাজ কর্কশ কণ্ঠস্বর, হাসির হুল্লোড়, আর কাস্তে ঠোকাঠুকির আওয়াজ।
অনেকক্ষণ আগে ডিনার সেরে সদ্য ডাকে আসা পত্র-পত্রিকায় চোখ বুলাতে বুলাতে কজ্নিশেভ যখন তাঁর ঘরে লেবু-বরফ দেওয়া পানি খাচ্ছিলেন, কপালের ওপর ঘামে লেপটে যাওয়া চুল আর কালচে হয়ে যাওয়া ভেজা বুক-পিঠ নিয়ে সোল্লাসে লেভিন হুড়মুড় করে তাঁর ঘরে ঢুকলেন।
লেভিন গতকালে অপ্রীতিকর কথাবার্তা একেবারে ভুলে গিয়ে বললেন, ‘আমরা ওদিকে গোটা মাঠটার ঘাস কেটে ফেলেছি! আহ্, কি চমৎকার, আশ্চর্য ব্যাপার! আর তোমার কাটল কেমন?
‘মাগো! কি চেহারা হয়েছে তোর!’ কজ্নিশেভ প্রথম মুহূর্তটায় ভাইয়ের দিকে অসন্তুষ্ট দৃষ্টি হেনে বললেন, ‘আরে দরজাটা, দরজাটা বন্ধ কর!’ চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি, ‘নিশ্চয় গোটা দশেক ঢুকিয়ে ফেলেছিস।’
কজ্নিশেভে মাছি সহ্য করতে পারতেন না, নিজের ঘরে জানালা খুলতেন কেবল রাতে, সযত্নে বন্ধ রাখতেন দরজা।
‘সৃষ্টিকর্তার দিব্যি, একটাও না। যদি ঢুকিয়ে থাকি, আমি নিজেই ধরব। কি পরিতৃপ্তি তুমি ভাবতে পারবে না! তুমি দিনটা কাটালে কেমন?
‘ভালোই। কিন্তু সত্যি, সারা দিন তুই কাটলি নাকি? নিশ্চয় তোর খিদে পেয়েছে রাক্ষুসে। সব তৈরি করে রেখেছে কুজ্মা।
‘না, খেতে ইচ্ছে করছে না, খেয়ে নিয়েছি ওখানে। এবার গিয়ে গা-হাত-পা ধোব।’
‘তা যা, ধুগে যা। আমি এখনই যাব তোর কাছে। কজ্নিশেভ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লেন, ‘তাড়াতাড়ি কর’, হেসে যোগ করলেন তিনি, বই-পত্তর নিয়ে তৈরি হলেন যাবার জন্য। হঠাৎ তাঁর নিজেরই ফুর্তি লাগল, ইচ্ছে হচ্ছিল না ভাইকে ভেড়ে থাকতে। ‘বৃষ্টির সময় কোথায় ছিলি?’
‘বৃষ্টি আবার কোথায়! সে তো শুধু কয়েক ফোঁটা। আমি এখনই আসছি। তাহলে দিনটা কাটিয়েছ ভালোই। তা বেশ।’ লেভিন চলে গেলেন সাজগোজ করতে।
মিনিট পাঁচেক পরে ভাইয়ের মিললেন ভাবার ঘরে। লেভিনের যদিও মনে হয়েছিল তিনি খেতে চান না, খাবার টেবিলে বসলেন শুধু কুমাকে ক্ষুণ্ণ না করার জন্য, তাহলেও খেতে শুরু করে তাঁর মনে হল খাবারগুলো অসাধারণ সুস্বাদু। কজ্নিশেভ তাঁকে দেখে হাসলেন। বললেন : ‘ও হ্যাঁ, তোর একটা চিঠি এসেছে। কুজ্মা নিয়ে এসো-না নিচে থেকে। তবে দেখে, দরজা বন্ধ করে রেখো কিন্তু।’
চিঠি লিখেছেন অব্লোন্স্কি লেভিন সেটা শুনিয়ে শুনিয়ে পড়লেন। পিটার্সবুর্গ থেকে অব্লোন্স্কি লিখেছেন : ‘ডল্লির কাছ থেকে আমি চিঠি পেয়েছি। সে আছে এগুশোভোতে; বিশেষ ভালো যাচ্ছে না ওর। যাও-না একটু ওর কাছে, পরামর্শ দিয়ে সাহায্য কর, তুমি তো সবই জান। তোমাকে দেখে খুব খুশি হবে। বেচারি একেবারে একলা। শাশুড়ী তাঁর স্বামী-কন্যা নিয়ে এখনো বিদেশে।’
‘বাঃ, অবশ্য অবশ্যই যাব!’ লেভিন বললেন, ‘চল যাই এক সাথেই, চমৎকার মেয়ে। তাই না?’
‘এখান থেকে বেশি দূর নয়?
‘ভার্স্ট তিরিশেক। বড়জোর চল্লিশ হতে পারে। তবে রাস্তাটা খুব ভালো। চমৎকার গাড়ি চলবে।’
‘তা বেশ’, তখনো হাসিমুখেই বললেন কজ্নিশেভ।
ছোট ভাইয়ের চেহারা দেখে স্রেফ শরিফ হয়ে উঠল তাঁর মেজাজ।
‘আচ্ছা খিদে বাপু তোর!’ প্লেটের ওপর ঝুঁকে পড়া লেভিনের বাদামি-লালচে রোদপোড়া মুখ আর ঘাড়ের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন।
‘খিদে চমৎকার! যত রাজ্যের রোগ-ভোগের পক্ষে এই যে কি উপকারী তোমার বিশ্বাস হবে না। চিকিৎসাবিদ্যাকে আমি সমৃদ্ধ করতে চাই নতুন একটা পরিভাষা দিয়ে : ArbeItscur ( জার্মান ভাষায় শ্রম দ্বারা আরোগ্য লাভ’ )।
‘কিন্তু তোর তো এটার প্রয়োজন নেই মনে হয়।’
‘হ্যাঁ, কিন্তু নানা ধরনের স্নায়বিক রুগীর পক্ষে দরকার।
‘হ্যাঁ, পরীক্ষা করে দেখতে হয় এটা। ভেবেছিলাম ঘাস কাটার এখানে গিয়ে তোকে দেখব। কিন্তু এমন অসহ্য গরম যে বনটা ছাড়িয়ে আর যাওয়া হল না। সেখানে খানিক বসলাম, তারপর বন দিয়ে গেলাম গ্রামটায়। দেখা হল তোর ধাই-মা’র সাথে। চাষীরা তোকে কি চোখে দেখে তা নিয়ে কিছু বাজিয়ে দেখলাম ওকে। বোঝা গেল, ওরা এ সব ভালো মনে করে না। ধাই-মা আমাকে বলল, ‘ওটা মনিবী কাজ নয়।’ মোটের ওপর আমার মনে হয়, চাষীদের ধারণায়, ‘মনিবী কাজকর্ম’ সম্পর্কে খুবই সুনির্দিষ্ট একটা দাবি আছে। তারা চায় না যে তাদের ধারণায় দানা-বাঁধা গণ্ডিটা থেকে মনিব বেরিয়ে আসুক।’
‘হতে পারে; কিন্তু এটায় এত তৃপ্তি যা আমি জীবনে কখনো পাইনি। এতে খারাপ তো কিছু নেই। তাই না?’ জবাব দিলেন লেভিন, ‘ওদের ভালো না লাগলে কি আর করা যাবে। তবে আমার মনে হয়, ওটা কিছু না। তুমি কি বল?’
‘মোটের ওপর’, কজ্নিশেভ বলে গেলেন, ‘আমি যা দেখছি, দিনটা তুই যেভাবে কাটালি তাতে তুই খুশি।’
‘খুবই খুশি। গোটা মাঠের ঘাস কেটেছি আমরা। আর যে বুড়োর সাথে সেখানে ভাব হল, সে কি বলব! ভাবতে পারবে না—কি চমৎকার!’
‘তাহলে দিনটা ভালোই কাটিয়েছিল বলে তুই খুশি। আমিও, প্রথমত, দাবার দুটো চাল আমি ঠিক করেছি, একটা খুবই খাশা, সেটা শুরু হবে বোড়ে দিয়ে। তোকে দেখাব তারপর ভাবলাম কালকের কথাবার্তা নিয়ে। ‘
‘কি? কালকের কথাবার্তা?’ লেভিন বললেন তৃপ্তিতে চোখ কুঁচকে, খাওয়া শেষের ঢেঁকুর ছেড়ে। একেবারেই মনে করতে পারলেন না কি কথাবার্তা হয়েছিল কালকে।
‘আমি ভেবে দেখলাম তুই অংশত সঠিক। আমাদের মতভেদটা এখানে যে, তুই চালিকা বলে ধরিস ব্যক্তিগত স্বার্থকে আর আমি মনে করি কিছুটা শিক্ষাপ্রাপ্ত প্রতিটি লোকের কাছে সেটা হওয়া উচিত সাধারণত কল্যাণের স্বার্থ। হয়ত তোর এ কথাও ঠিক যে বৈষয়িক স্বার্থপ্রণোদিত ক্রিয়াকলাপ বেশি বাঞ্ছনীয়। মোটের ওপর তোর স্বভাবটাই হল, ফরাসিরা যাকে বলে, বড় বেশি ‘প্রথম ঝোঁকেই চালিত হবার প্রবণতাসম্পন্ন’; তুই চাস সাবেগ, উদ্যমী ক্রিয়াকলাপ অথবা কিছুই না।’
লেভিন ভাইয়ের কথা শুনলেন বটে কিন্তু একেবারেই কিছু বুঝলেন না, বুঝতে চাইলেনও না। তাঁর শুধু ভয় হচ্ছিল যে, বড় ভাই আবার তাঁকে এমন প্রশ্ন করে না বসেন যাতে বোঝা যাবে যে কিছুই শোনেননি তিনি
‘এই হল গিয়ে ব্যাপার’, কজ্নিশেভ বললেন লেভিনের কাঁধ চাপড়ে।
‘হ্যাঁ, সে তো বটেই। তা, আমি নিজের গোঁ ধরে থাকছি না’, লেভিন বললেন শিশুসুলভ দোষী-দোষী হাসি নিয়ে। মনে মনে ভাবলেন, ‘কি আমি তর্ক করেছিলাম? বলাই বাহুল্য আমিও ঠিক, উনিও ঠিক এবং সবই হয়ে গেল চমৎকার। শুধু সেরেস্তায় একেবার যেতে হয়, হুকুম-টুকুম দিয়ে আসি।’ সিধে হয়ে হেসে উঠে দাঁড়ালেন তিনি।
কজ্নিশেভও হাসলেন।
ভাইকে ছাড়তে চাইছিলেন না তিনি, ভারি একটা তাজা আমেজ আর সজীবতা বিকিরিত হচ্ছিল তাঁর কাছ থেকে। বললেন, ‘যদি বেড়াতে চাস, চল যাই একসাথে। তোর দরকার থাকলে সেরেস্তাতেও যাওয়া যাবে।’
‘যাঃ!’ লেভিন এত জোরে চেঁচিয়ে উঠলেন যে, ভয় পেয়ে গেলেন সের্গেই ইভানোভিচ কজ্নিশেভ।
‘কি রে, হল কি?’
‘আগাফিয়া মিখাইলোভনার কজি?’ মাথায় করাঘাত করে লেভিন বললেন, ‘ওঁর কথা ভুলেই গিয়েছিলাম একেবারে।’
‘অনেক ভালো।’
‘তাহলেও ওঁকে দেখে আসি। তুমি টুপি পরে উঠতে-না-উঠতেই আমি ফিরব।’
চৌকিদারের খটখটিয়ার মত সিঁড়িতে হিলের শব্দ তুলে ছুটলেন তিনি।
সাত
অব্লোন্স্কি যখন পিটার্সবুর্গে যান অরাজপুরুষদের কাছে অবোধ্য হলেও সমস্ত রাজপুরুষদের কাছে স্বাভাবিক, বোধগম্য ও প্রয়োজনীয় সেই কর্তব্যটি পালন করতে যা ছাড়া চাকরি করা অসম্ভব, যথা মন্ত্রি-দপ্তরে দর্শন দিয়ে নিজের কথা মনে করিয়ে দেওয়া, এবং এই কর্তব্য পালন করতে গিয়ে বাড়ির সব টাকাকড়ি সাথে নিয়ে ঘোড়দৌড় আর পল্লীভবনগুলোয় গিয়ে সময় কাটাচ্ছিলেন হেসে-খেলে, ফুর্তি করে, ডল্লি তখন যথাসম্ভব পয়সা বাঁচাবার জন্য ছেলেমেয়েদের নিয়ে চলে যান গ্রামে। যান যৌতুক হিসেবে পাওয়া এগুশোভো গ্রামে, বসন্তে যেখানে গাছ বেচে দেওয়া হয়, লেভিনের পক্রোভস্কয়ে থেকে যা পঞ্চাশ ভার্স্ট দূরে।
অনেকদিন আগে এগুশোভোর পুরানো বড় বাড়িটা ভেঙে পড়েছিল। প্রিন্স তার সংস্কার করে একটা বারবাড়ি জুড়ে তাকে বাড়িয়ে তোলেন। বিশ বছর আগে, ডল্লি যখন শিশু, বারবাড়িটা তখন ছিল প্রশস্ত, সুবিধাজনক, যদিও সমস্ত বারবাড়ির মত সেটা ছিল বাইরে বেরোবার বীথি আর দক্ষিণের দিকে পাশকে হয়ে। কিন্তু এখন বারবাড়িটা পুরানো আর জীর্ণ। বসন্তে অবলোন্স্কি যখন গাছ বেচতে এসেছিলেন, তখনই ডল্লি তাঁকে বলেছিলেন বাড়িটা দেখতে আর যা যা দরকার সারাবার আদেশ দিয়ে আসতে। সমস্ত দোষী স্বামীর মত স্ত্রীর সুবিধার্থে যা যা দরকার তা করার হুকুম দিয়ে যান। তাঁর ধারণা, সমস্ত আসবাবে ক্রেটন মারতে হবে, পর্দা টাঙানো দরকার, বাগানটা সাফ করতে হবে, পুকুরের কাছে একটা মাচা করা উচিত, এবং ফুলগাছ পোঁতা চাই, কিন্তু অনেক দরকারী জিনিস যা না থাকায় পরে বেশ কষ্ট হয়েছিল ডল্লির, তিনি ভুলে গেলেন।
যত্নশীল পিতা ও স্বামী হবার জন্য অব্লোন্স্কি যত চেষ্টাই করুন, তাঁর মোটেই মনে থাকত না যে তাঁর স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে আছে। তাঁর রুচি ছিল অবিবাহিতের মত আর তিনি বুঝতেন শুধু সেগুলোই। মস্কোয় ফিরে তিনি স্ত্রীর কাছে সবর্গে ঘোষণা করলেন যে, বাড়িটা হবে ছবির মত। সেখানে যেতে তাঁকে খুবই পরামর্শ দিচ্ছেন তিনি। স্ত্রীর গ্রামে যাওয়াটা অব্লোন্স্কির মনোরম ঠেকেছিল সব দিক থেকেই : স্বাস্থ্য ফিরবে ছেলেমেয়েদের, খরচাও হবে কম, তিনি মুক্তি পাবেন। গ্রীষ্মকালটা গ্রামে থাকাটা ছেলেমেয়েদের পক্ষে, বিশেষ করে স্কার্লেট রোগে ভোগা যে খুকিটি সেরে উঠতে যাচ্ছিল তার পক্ষে প্রয়োজনীয় মনে করেছিলেন ডল্লি, তা ছাড়া ছোটখাট যেসব হীনতা, ছোটখাট যেসব ধার তাঁর ছিল কাঠওয়ালা, মাছওয়ালা, জুতা-বানিয়ের কাছে, যা তাঁকে পীড়া দিচ্ছিল তা থেকে রেহাইও মিলত। তদুপরি যাত্রাটা তাঁর কাছে ভালো লাগছিল আরো এই জন্য যে লোভ দেখিয়ে গাঁয়ে নিজের কাছে বোন কিটিকে নিয়ে আসার বাসনা ছিল তাঁর। বিদেশ থেকে কিটির ফেরার কথা গ্রীষ্মের মাঝামাঝি, অবগাহন গোসলের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে তাকে। বিদেশ থেকে কিটি লিখেছে যে, উত্তরের কাছেই ছেলেবেলাকার স্মৃতিতে ভরা এগুশোভোতে ডল্লির সাথে গ্রীষ্মটা কাটাতে পারার মত আনন্দের ব্যাপার তার কাছে আর কিছুই নেই।
প্রথম দিকটা গ্রাম্য জীবন কষ্টকর হয়েছিল ডল্লির পক্ষে। গ্রামে তিনি ছিলেন ছেলেবেলায়। এমন একটা ধারণা তাঁর মনে রয়ে দিয়েছিল যে গ্রাম হল সমস্ত শহুরে বিড়ম্বনা থেকে নিষ্কৃতি, জীবন সেখানে সুন্দর না হলেও (এটার সাথে তিনি নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলেন সহজেই) সস্তা আর সুবিধাজনক : সবই আছে সেখানে, সবই সস্তা, সবই পাওয়া যেতে পারে, ছেলেমেয়েদের পক্ষেও ভালো। কিন্তু এখন কর্ত্রী হিসেবে গ্রামে এসে তিনি দেখলেন যে তিনি যা ভেবেছিলেন, কিছুই তেমন নয়।
ওঁদের আসার পরের দিন অঝোরে বৃষ্টি নামল, রাতে পানি চুঁইয়ে পড়তে লাগল করিডরে আর শিশুদের ঘরে। তাই খাটগুলো সরিয়ে আনতে হল ড্রয়িং-রুমে। রাঁধুনি ছিল না। নয়টা গরুর মধ্যে, পাল দেখা-শোনা করে যে মেয়েটা—সে বলল, কোনটা গাভিন, কোনটা বাছুর দিয়েছে, কোনটা বুড়ো, কোনটার বাঁট শক্ত; মাখন নেই, এমন কি শিশুদের জন্যও দুধের টানাটানি। ডিম নেই। মুরগি পাওয়া যাচ্ছে না; ভাজা আর সেদ্ধ করা হচ্ছিল বুড়ো বুড়ো, বেগুনি রঙের, ছিবড়ে মাংসের মোরগ। মেঝে ধোওয়ার জন্য লোক মিলছিল না, সবাই আলু চাষে ব্যস্ত। গাড়ি চড়ে বেড়াবার উপায় ছিল না, কেননা একটা ঘোড়া ছিল অস্থির, লাফিয়ে উঠত দণ্ডের মধ্যে। গোসল করার জো নেই, কেননা নদীর গোটা তীর গরুর খুরে চটকানো, আর রাস্তা থেকে চোখে পড়ে জায়গাটা; এমন কি বেড়িয়ে বেড়ানোও অসম্ভব, কেননা গরুর পাল ভাঙা বেড়ার ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়ত বাগানে আর একটা ছিল ভয়াবহ ষাঁড় গর্জন করত সেটা, সুতরাং সে টিস মারতে আসবে। পোশাক রাখার আলমারি ছিল না। যেগুলো ছিল বন্ধ হত না, নয়ত কাছ দিয়ে কেউ গেলে খুলে যেত আপনা থেকেই। চুলার জন্য লোহার হাঁড়ি বা শিক ছিল না, কাপড় সিদ্ধ করার বড় পাত্র ছিল না, এমন কি ইস্ত্রি করার তক্তাও ছিল না ঝিদের ঘরে।
ডল্লির মতে যা ভয়াবহ বিপর্যয়, তাতে নিক্ষিপ্ত হয়ে প্রথমটায় শান্তি ও বিশ্রাম পাবার বদলে ডব্লি হতাশ হয়ে পড়লেন : চালাবার চেষ্টা করছিলেন প্রাণপণে, নিরুপায় অবস্থাটা টের পাচ্ছিলেন, প্রতি মুহূর্তে চোখে উথলে ওঠা অশ্রু রোধ করতে হত। বাড়ির গোমস্তা, ভূতপূর্ব যে কোয়ার্টার-মাস্টারকে তার সুন্দর সসম্ভ্রম চেহারার জন্য অব্লোন্স্কির ভালো লেগেছিল এবং চাপরাশীদের মধ্যে থেকে তাকেই বেছে নেন, ডল্লির বিপদে কোন অংশ নিত না, সম্মান দেখিয়ে বলত : ‘কিছুই করা যাবে না, লোকগুলো ভারি নচ্ছার’ এবং কোন সাহায্যেই করেনি।
মনে হল অবস্থাটা থেকে উদ্ধারের উপায় নেই। কিন্তু সমস্ত বড় সংসারের মত অবলোন্স্কিদের বাড়িতেও ছিলেন অলক্ষ্য, তবে গুরুত্বপূর্ণ উপকারী মানুষ—মাত্রেনা ফিলিমনোভনা। কর্ত্রীকে তিনি শাস্ত করলেন, আশ্বাস দিলেন যে সব ঠিক হয়ে যাবে (মাতভেই কথাটা তাঁর কাছ থেকেই ধার নিয়েছিল) আর নিজে তাড়াহুড়া না করে, অস্থির না হয়ে কাজে লেগে গেলেন।
তখনই তাঁর ভাব হয়ে যায় গোমস্তা-বৌয়ের সাথে এবং প্রথম দিনেই গোমস্তা-বৌ আর গোমস্তার বাড়িতে চা খেলেন অ্যাকেসিয়া গাছের তলে, আলোচনা হল সমস্ত ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে। অচিরেই অ্যাকেসিয়া তলে গড়ে উঠল মাত্রেনা ফিলিমনোভনার ক্লাব গোমস্তা-বৌ, গাঁয়ের মণ্ডল আর মহুরিকে নিয়ে, এবং একটু একটু করে আসান হতে লাগল মুশকিলগুলোর, আর এক সপ্তাহ পরে সত্যিই ঠিক হয়ে গেল সব কিছু। মেরামত হল ছাদ, রাঁধুনি পাওয়া গেল – গ্রাম-মণ্ডলের ছেলের ধর্ম-মা, কেনা হল মুরগি, দুধ দিতে লাগল গরুগুলো, বাগান ঘেরা হল খোঁটা পুঁতে ছুতোর কাপড়-চোপড় ইস্ত্রির বেলন করে দিলে, হুক বসাল আলমারিগুলোয়, তা আর ইচ্ছেমত খুলে যেত যা, আর সৈনিকের উর্দি বানাতে ব্যবহৃত মোটা কাপড়- মোড়া একটা ইস্ত্রির পাটাতন রইল কেদারা আর দেরাজে ভর দিয়ে, ইস্ত্রির গন্ধ উঠল ঝিদের ঘরে।
‘এই তো, সবই দিব্যি হয়েছে, পাটাতনটা দেখিয়ে বললেন মাত্রেনা ফিলিমনোভনা।
খড়ের দেয়াল দিয়ে একটা গোসলের ঘর পর্যন্ত বানানো হল, গোসল করতে লাগল লিলি, অংশত হলেও পূরণ হল ডল্লির আশা, গ্রাম্য জীবনের প্রশান্তি না হলেও আরাম মিলল। ছ’টা শিশু সন্তান নিয়ে শান্তিতে থাকা ডল্লির পক্ষে সম্ভব ছিল না। কারো অসুখ করে, কেউ অসুখে পড়তে পারে, কেউ কিছু একটা পাচ্ছে না, কারো মধ্যে আবার মন্দ স্বভাবের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, লেগেই আছে এসব। খুব কম, খুব কমই দেখা দিত শান্তিতে থাকার সংক্ষিপ্ত সময়টুকু। কিন্তু এসব উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তা ছিল ডল্লির কাছে সম্ভবপর একমাত্র সুখ। এটা না থাকলে যে স্বামী তাঁকে ভালোবাসেন না, তাঁর কথা ভেবে তিনি পড়ে থাকতেন একলা। কিন্তু ছেলেমেয়েদের অসুখের কথা ভেবে মাযের ভয়টা যতই কষ্টকর হোক, ছেলেমেযেদের রোগ, ছেলেমেয়েদের মধ্যে বদ স্বভাবের দুর্লক্ষণ তাঁকে যতই দুঃখ দিক, তারাই এখন ছোট ছোট আনন্দ দিয়ে সে দুঃখের ক্ষতিপূরণ করতে লাগল। সে আনন্দ এতই ক্ষুদ্র যে তা ছিল বালুর মধ্যে স্বর্ণকণার মত অলক্ষ্য, মন খারাপের সময় তাঁর চোখে পড়ত কেবল দুঃখ, কেবল বালি, কিন্তু সুমুহূর্তও আসত যখন তিনি দেখতেন কেবল আনন্দ, কেবল সোনা।
এখন, গ্রামের নিঃসঙ্গতায় এই আনন্দগুলো সম্পর্কে তিনি সজ্ঞান হতেন ঘন ঘন। ওদের দিকে তাকিয়ে প্রায়ই তিনি নিজেকে প্রাণপণে বোঝাতে চাইতেন যে বিভ্রান্ত মা হিসেবে তিনি ছেলেমেয়েদের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট; তাহলেও মনে মনে তিনি এ কথা না বলে পারতেন না যে, তাঁর ছেলেমেয়েরা সব ক’টাই চমৎকার, ছয়টার সব ক’টারই স্বভাব ভিন্ন ভিন্ন, কিন্তু এমন ছেলেমেয়ে হয় খুবই কম, তাদের তাঁর জন্য সুখ আর গর্ববোধ হত।
আট
মে মাসের শেষে যখন সবই ন্যূনাধিক ঠিকঠাক হয়ে গেছে, তখন গ্রামের অসুবিধাগুলো নিয়ে তাঁর নালিশের জবাব এল স্বামীর কাছ থেকে। সব কিছু ভেবে দেখেননি বলে তাঁর কাছে ক্ষমা চেয়েছেন তিনি, প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যেই সম্ভব হবে অমনি সেখানে যাবেন। তবে সে সম্ভাবনাটা দেখা গেল না, জুনের গোড়া পর্যন্ত ডল্লি গ্রামে রইলেন একা।
পিটার পরবের সপ্তাহে রবিবারের ডল্লি তাঁর সমস্ত ছেলেমেয়েদের নিয়ে গির্জায় গেলেন তাদের ব্রতানুষ্ঠানের জন্য। বোন, মা, বন্ধুদের সাথে অন্তরঙ্গ, দার্শনিক আলোচনায় তিনি প্রায়ই তাঁদের অবাক করেছেন ধর্মের ব্যাপারে তাঁর স্বাধীনচিত্ততায়। ওঁর ছিল মেতেমসাইকোসিসের এক বিচিত্র ধর্ম, গোঁড়া গির্জার তোয়াক্কা না করে তাতে তাঁর প্রগাঢ় বিশ্বাস। কিন্তু ঘরে তিনি শুধু লোক দেখানির জন্য নয়, মনে প্রাণে গির্জার সমস্ত দাবি মেনে চলতেন আর ছেলেমেয়েরা যে প্রায় এক বছর ব্রত গ্রহণে যায়নি, এটা তাঁকে খুবই উদ্বিগ্ন করছিল। মাত্রেনা লিপমনোভনার পুরো অনুমোদন আর সহানুভূতি পেয়ে তিনি ঠিক করলেন সেটা করা যাক এখন, গ্রীষ্মে 1
দিনকয়েক আগে থেকেই ডল্লি ভাবছিলেন ছেলেমেয়েদের কি সাজে সাজাবেন। ফ্রকগুলো বানানো হল, ঢেলে সাজা হল, ধোলাই করা হল, নামিয়ে দেওয়া হল হেম, সেলাই করা হল বোতাম, তৈরি রইল রিবন। তানিয়ার জন্য যে ফ্রকটি বানাবার ভার নিয়েছিলেন ইংরেজ মহিলাটি, তাতে ডল্লির অনেক আশা পানিতে গেল। নতুন করে সেলাই করতে গিয়ে তিনি ভাঁজগুলো ফেলেননি জায়গামত, আস্তিন দুটো কেটেছিলেন এমন যে পোশাকটাই মাটি হয়ে গেছে একেবারে। তানিয়ার গায়ে তা যেভাবে বসল, তাকিয়ে দেখা যায় না। তবে মাত্রেনা ফিলমনোভনা একটা পটি গুঁজে কেপ দিয়ে তা ঢাকার কথা বললেন। ব্যাপারটা সামলানো গেল, কিন্তু প্রায় আর ন’টার সময়, যাজককে যখন মাস উপাসনার জন্য অপেক্ষা করতে বলা হয়েছিল, আনন্দে জ্বলজ্বলে হয়ে বেশভূষা করে ছেলেমেয়েরা গাড়ি-বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল মায়ের অপেক্ষায়
বেয়াড়া ‘দাঁড়কাকে’র বদলে মাত্রেনা ফিলিমনোভনার হস্তক্ষেপে গাড়িতে জোতা হয়েছে গোমস্তার ‘পাটকিলে’কে। ডল্লির দেরি হচ্ছিল প্রসাধনের ঝামেলায়, শেষ পর্যন্ত সাদা মসলিন গাউন পরে তিনি বেরিয়ে এলেন গাড়িতে উঠতে।
ডল্লি তাঁর কবরী রচনা ও সাজগোজ করেছেন সযত্নে, উতলা হয়ে। আগে তিনি সাজ করতেন নিজের জন্যই যাতে নিজেকে সুন্দর দেখায়, লোকের ভালো লাগে; পরে যত বয়স হতে লাগল ততই তাঁর বিরক্তি ধরত সাজ করতে; টের পেতেন কত কুশ্রী হয়ে পড়েছেন তিনি। কিন্তু এখন তিনি আবার সাজগোজ করলেন পরিতোষ আর উত্তেজনা নিয়ে। এখন তিনি সাজসজ্জা করলেন নিজের জন্য নয়, নিজের রূপের জন্য নয়, এজন্য যাতে এই সোনার কণাগুলোর মা হিসেবে তিনি সাধারণ ছাপটা মাটি করে না দেন। এবং শেষবারের মত আয়নায় মুখ দেখে তিনি খুশিই হলেন। সুন্দর দেখাচ্ছে তাঁকে। ঠিক অতটা সুন্দর নয় যা হবার তাঁর ইচ্ছে হত বলনাচগুলোতে যাবার সময়। কিন্তু যে লক্ষ্যটা এখন তিনি সামনে রেখেছেন, তার পক্ষে সুন্দর।
গির্জায় কৃষক, জমাদার আর তাদের বৌয়ের ছাড়া আর কেউ ছিল না। কিন্তু তাঁর ছেলেমেয়েদের এবং তাঁকে দেখে ওদের মুখে-চোখে একটা তারিফ আর চাঞ্চল্য তিনি দেখতে পেলেন, অথবা তাঁর মনে হয়েছিল যে দেখতে পাচ্ছেন। ছেলেমেয়েদের এমনিতেই, বাহারে পোশাক-আশাকেই শুধু যে ভালো দেখাচ্ছিল তা নয়, যেভাবে তারা চলছিল, তাতেও মিষ্টি লাগছিল তাদের। আলিওশা অবশ্য দাঁড়িয়ে ছিল তেমন শোভন ঢঙে নয় : কেবলই সে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে চাইছিল নিজের কোটের পেছন দিকটা; তাহলেও অসাধারণ মিষ্টি লাগছিল তাকে। তানিয়া বড়দের মত ভাব করে তাকিয়ে দেখছিল ছোটদের। তবে সবচেয়ে যা কিছু ঘটছে তাতে তার সরল বিস্ময়ে ছোটটি, লিলি ছিল অপরূপ, আর স্যাক্রামেন্ট নেবার পর সে যখন ইংরেজিতে বলে ওঠে ‘আরেকটু দিন দয়া করে’, তখন কঠিন হয়েছিল না হেসে থাকা।
বাড়ি ফিরে ছেলেমেয়েরা টের পাচ্ছিল গুরুগম্ভীর কিছু-একটা ঘটে গেল; ভারি নম্র হয়ে রইল তারা।
বাড়িতেও ভালোই চলল সব; কিন্তু প্রাতরাশে বসে শিস দিতে লাগল গ্রিশা, আর সবচেয়ে যেটা খারাপ, কথা সে শুনছিল না ইংরেজ মহিলাটির, তাই মিষ্টি পিঠে দেওয়া হয়নি তাকে। সেখানে থাকলে এমন একটা দিনে শাস্তিদান অনুমোদন করতেন না ডল্লি, কিন্তু ইংরেজ মহিলার নির্দেশ মান্য করতে হল, মিষ্টি পিঠে গ্রিশা পাবে না—এ সিদ্ধান্ত সমর্থন করলেন তিনি। সাধারণ আনন্দ খানিকটা মাটি হল এতে।
গ্রিশা এই বলে কাঁদতে লাগল যে, নিকোলিকাও শিস দিয়েছে কিন্তু তাকে শাস্তি দেওয়া হয়নি, কাঁদছে সে পিঠের জন্য নয়, কিছু এসে যায় না তার, কাঁদছে তার ওপর অবিচার করা হয়েছে বলে। এতে মন খারাপ হল বড় বেশি, ডল্লি ঠিক করলেন, ইংরেজ মহিলাটির সাথে কথা করে গ্রিশাকে মাপ করতে অনুরোধ করবেন এবং চললেন তাঁর কাছে। কিন্তু হলের ভেতর দিয়ে যাবার সময় যে দৃশ্যটা তিনি দেখলেন তাতে এতই আনন্দে তাঁর বুক ভরে উঠল যে পানি এসে পড়ল চোখে, নিজেই তিনি ক্ষমা করে দিলেন অপরাধীকে।
দণ্ডিতটি হলে বসে ছিল কোণের জানালার কাছে; তার কাছে তানিয়া প্লেট হাতে দাঁড়িয়ে। পুতুলগুলোকে খাওয়াবার ছল করে তানিয়া তার নিজের কাছ থেকে কিন্তু তার বদলে বদলে সেটা নিয়ে আসে ভাইয়ের কাছে। তার ওপর অবিচার নিয়ে কান্না চালিয়ে যেতে যেতে গ্রিশা খাচ্ছিল নিয়ে আসা পিঠেটা আর ফোঁপানির ভেতর দিয়ে বলে যাচ্ছিল : ‘নিজেই তুমি খাও, দুজনে মিলে খাব… দুজনে মিলে।’
গ্রিশার জন্য প্রথমে কষ্ট হয়েছিল তানিযার, তারপর নিজের মহানুভবতার চেতনা ক্রিয়া করছিল তার মনে, ওর ও চোখে পানি এসে পড়েছিল; তবে আপত্তি না করে সে খেতে লাগল তার ভাগটা।
মাকে দেখে আঁতকে উঠেছিল ওরা, কিন্তু তাঁর মুখের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখে, তারা ঠিক কাজই করছে বুঝতে পেরে হেসে উঠল, মুখ ভর্তি পিঠে নিয়ে হাস্যময় ঠোঁট মুছতে লাগল হাত দিয়ে, জ্বলজ্বলে মুখগুলো মাখামাখি হয়ে গেল চোখের পানিতে আর জ্যামে।
‘মাগো! নতুন সাদা পোশাক! তানিয়া, গ্রিশা!’ পোশাক বাঁচাবার চেষ্টা করে মা বলছিলেন, তবে চোখে পানি নিয়ে, পরমানন্দের দীপ্ত হাসি হেসে।
পোশাক খুলে রেখে মেয়েদের ব্লাউজ আর ছেলেদের পুরানো জ্যাকেট পরতে বলা হল, ব্যাঙের ছাতা তোলা আর গোসলে যাবার জন্য জুততে বলা হল গাড়ি, গোমস্তার মনঃক্ষুণ্ণ করে জোতা হল ‘পাটকলে’ ঘোড়া। শিশুকক্ষে উঠল উল্লাসের চিল্লানি, গোসলের জন্য রওনা দেবার আগে পর্যন্ত তা থামল না।
ব্যাঙের ছাতা মিলল পুরো এক ঝুড়ি, লিলি পর্যন্ত পেয়ে গেল একটা। আগে মিস গুল নিজে ব্যাঙের ছাতা দেখতে পেলে লিলিকে দেখিয়ে দিতেন আর লিলি তা তুলত, কিন্তু এখন লিলি নিজেই পেয়েছে বড় একটা ব্যাঙের ছাতা, উল্লাসের সমবেত চিৎকার উঠল : ‘লিলি ব্যাঙের ছাতা পেয়েছে।’
তারপর গোসল করতে যাওয়া হল নদীতে, ঘোড়াগুলোকে রেখে দেওয়া হল বার্চ গাছের তলে। ডাঁশ তাড়াচ্ছিল সেগুলো। কোচোয়ান তেরেতি তাদের গাছের সাথে বেঁধে ঘাসগুলো দলে শুয়ে পড়ল বার্চের ছায়ায়। ঘাট থেকে ভেসে আসতে লাগল শিশুদের অবিরাম ফুর্তির চিল্লানি।
সমস্ত ছেলেমেয়েগুলোর ওপর নজর রাখা আর তাদের দুষ্টুমি ঠেকানো ঝামেলার ব্যাপার হলেও, এসব মোজা, প্যান্টালুন, জুতার কোনটা কোন পায়ের তা মনে রাখা, গোলমাল করে না ফেলা, অসংখ্য ফিতে, লেস, বোতাম খোলা, আঁটা, বাঁধাছাদা করা কঠিন হলেও ডল্লি নিজেই সব সময় ছিলেন গোসলের ভক্ত, ছেয়েমেয়েদের পক্ষেও তা উপকারী জ্ঞান করতেন, তাদের সবাইকে নিয়ে এসব পাগুলোর হাত বুলাতে বুলাতে তাতে মোজা পরানো কোলে তুলে নিয়ে ন্যাংটা দেহগুলোকে পানিতে ঢুবানো, কখনো ফুর্তির কখনো আতংকের চিল্লানি শোনা, ভীত আর উল্লসিত চোখ মেলা, দম ফুরিয়ে আসা পানিসিঞ্চিত এসব মুখ, তাঁর এসব নিষ্পাপশিশুদের দেখা তাঁর কাছে তৃপ্তির পরাকাষ্ঠা।
ছেলেমেয়েদের অর্ধেকের যখন পোশাক পরা হয়ে গেছে, ওষধি গাছগাছড়া জোগাড় করতে বেরোনো পরবের পোশাক পরা কয়েকজন চাষী মেয়ে ঘাটের কাছে এসে সসংকোচে দাঁড়িয়ে পড়ল। বিছানার একটা চাদর আর কামিজ পানিতে পড়ে গিয়েছিল, মাত্রেনা ফিলিমনোভনা মেয়েদের একজনকে ডেকে বললেন সেগুলো তাঁকে শুকাবার জন্য দিতে। ডল্লি চাষী মেয়েদের সাথে কথাবার্তা বলতে লাগলেন। প্রথমে তারা হাতে মুখ ঢেকে মুচকি হাসছিল, ডল্লির প্রশ্ন ধরতে পারছিল না। তবে শিগগিরই তাদের সাহস বাড়ল, কথা বলতে শুরু করল, এবং ছেলেমেয়েদের যে অকৃত্রিম তারিফ তারা করল তাতে তৎক্ষণাৎ ডল্লিকে কিনে নিল তারা
তানিয়াকে দেখে মুগ্ধ হয়ে মাথা নেড়ে নেড়ে একজন বলল, ‘ইস, সুন্দরী বটে, চিনির মত তবে রোগা… ‘
‘হ্যাঁ, অসুখ করেছিল।’
কোলের বাচ্চাটাকে দেখে বলল আরেকজন, ‘আরে, তুইও গোসল করলি নাকি!’
‘না, ও শুধু তিন মাসের’, গর্বের সুরে বললেন ডল্লি।
‘বটে!’
‘তোমার ছেলেমেয়ে আছে?’
‘ছিল চারটি। আছে দুটো : বেটা আর বেটী। গত লেন্ট পরবের পর মেয়েটা বুকের দুধ ছেড়েছে।’
‘সেটা ক’বছরের?’
‘দুই বছর চলছে।’
‘এত দিন ধরে বুকের দুধ দিলে যে?’
‘আমাদের ওই চলে : তিনটা লেন্ট…’
কথাবার্তাটা হল ডল্লি পক্ষে সবচেয়ে আকর্ষণীয় : প্রসব হয়েছিল কেমন? কি অসুখ? স্বামী কোথায়? প্রায়ই আসে?
ওদের সাথে আলাপটা এতই আকর্ষণীয়, এতই একই রকম ছিল তাদের আগ্রহ যে মেয়েদের ছাড়তে চাইছিলেন না ডল্লি। সবচেয়ে তাঁর ভালো লাগছিল এটা পরিষ্কার দেখতে পেয়ে যে ওঁর কতগুলো ছেলেমেয়ে আর সবাই কি সুন্দর দেখে ওরা মুগ্ধ হয়েছে। ডল্লিকে হাসাল ওরা আর ক্ষুব্ধ করল ইংরেজ মহিলাটিকে এই জন্য যে তাঁর কাছে দুর্বোধ্য এই হাসির কারণ তিনিই। একটা তরুণী মেয়ে ইংরেজ মহিলাটিকে লক্ষ্য করছিল, তিনি পোশাক পরছিলেন সবার শেষে। আর যখন তিনি তৃতীয় স্কার্টটাও পরলেন, মেয়েটা তখন মন্তব্য না করে পারল না : ‘এহ্, স্কার্ট পরছে তো পরছেই, পরা আর শেষ হয় না!’ বলতেই সবাই খিলখিলিয়ে হেসে উঠল।
নয়
গোসল শেষে ভেজা চুলে সমস্ত ছেলেমেয়েদের নিয়ে আর নিজে মাথায় রুমাল বেঁধে ডল্লি যখন প্রায় বাড়ির কাছে এসে পড়েছেন কোচোয়ান বলল : ‘কে-একজন সাহেব আসছেন, মনে হয় পক্রোভস্কয়ে থেকে।’
ডল্লি সামনে তাকিয়ে তাঁদের দিতে এগিয়ে আসা ধূসর টুপি আর ধূসর ওভারকোট পরিহিত লেভিনের মূর্তি দেখে খুশি হয়ে উঠলেন। তাঁকে দেখলে তিনি খুশি হতেন সব সময়ই, কিন্তু এখন তিনি আরো খুশি হলেন এজন্য যে লেভিন তাঁকে দেখবেন তাঁর সমগ্র মহিমায়। লেভিনের মত আর কেউ তাঁর এ মহিমা বোঝে না।
ডল্লিকে দেখে নিজের কল্পিত ভবিষ্যৎ সংসারের একটা ছবি খুলে গেল লেভিনের সামনে।
‘আপনি একেবারের যে ছানাপুনোর মুরগি-মা দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা।’
‘আহ্, কি যে খুশি হলাম!’ হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন ডল্লি।
‘খুশি হলেন, তবে আমাকে তো জানাননি। বড় ভাই আছেন আমার এখানে। স্তিভার কাছ থেকে চিরকুট পেলাম যে আপনি এখানে এসেছেন।’
‘স্তিভার কাছ থেকে?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন ডল্লি।
‘হ্যাঁ, লিখেছ যে আপনি এসেছেন, এই মনে করে যে কোনকিছুতে সাহায্য করতে আপনি দেবেন আমাকে’, লেভিন বললেন আর বলেই হঠাৎ বিব্রত হয়ে কথা বন্ধ করে নীরবে গাড়ির কাছে ঘুরতে লাগলেন, লাইম গাছের ডাল ছিঁড়ে তা চিবাতে চিবাতে। তাঁর বিব্রত লাগল এই জন্য যে স্বামীর যা করা উচিত সে ব্যাপারে লোকের সাহায্য ডল্লির কাছে খারাপ লাগবে। অব্লোন্স্কির পক্ষ থেকে নিজের পারিবারিক ব্যাপার অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেবার এই যে ধরন, সেটা সত্যিই ভালো লাগেনি ডল্লির। লেভিনও যে সেটা বুঝেছেন, তা বুঝতে পারলেন তিনি তৎক্ষণাৎ। বোধের এই সূক্ষ্মতার জন্য, এই মাত্রাবোধের জন্যই তিনি পছন্দ করতেন লেভিনকে।
লেভিন বললেন, ‘আমি অবশ্য তাতে শুধু এই বুঝেছি যে আপনি আমায দেখতে চান আর সে জন্যে আমি খুবই খুশি। বলাই বাহুল্য যে আমি কল্পনা করতে পারি যে শহুরে গৃহকর্ত্রী হিসেবে এখানে আপনার খুবই অসুবিধে হবে, কিছু দরকার পড়লে আমি সব সময়ই আছি আপনার সেবায়।’
‘আরে না’, ডল্লি বললেন; ‘প্রথমে অসুবিধে হয়েছিল। তবে এখন সব চমৎকার ঠিকঠাক হয়ে গেছে আমার ওই ধাই-মা’র কল্যাণে’, বললেন তিনি মাত্রেনা লিফিমনোভনাকে দেখিয়ে। তিনিও বুঝেছিলেন কথা হচ্ছে তাঁকে নিয়ে। লেভিনের দিকে তাকিয়ে তিনি হাসলেন ভালো মনে, হাসি-খুশিতে। লেভিনকে চিনতেন তিনি, জানতেন ইনি আপামণির পাণিপ্রার্থী, চাইতেন যেন সেটা হয়। বললেন, ‘বসুন না, আমরা খানিক ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকব।’
‘না, আমি হেঁটে যাব। এই ছেলেমেয়েরা, কে আমার সাথে ঘোড়দৌড় দেবে?’
ছেলেমেয়েরা লেভিনকে চিনতে কম, কবে তাঁকে দেখেছে তা মনে নেই তাদের, তবে বয়স্ক লোকেরা প্রায়ই ভান করে বলে ছেলেমেয়েরা যে বিচিত্র বিরাগ আর সংকোচ বোধ করে এবং সে জন্য বেশ শায়েস্তা হতে হয়, সেটা তাদের মধ্যে দেখা গেল না। যে কোন ব্যাপারেই ভান অতি বুদ্ধিমান, অন্তর্ভেদী মানুষকে প্রতারিত করতে পারে বটে, কিন্তু ভান যত সযত্নেই ঢাকা দেওয়া হোক, সবচেয়ে ক্ষীণমতি শিশুও তা ধরতে পারে, বিরাগ বোধ করে। লেভিনের আর যে ত্রুটিই থাক, ভানের কোন লক্ষণ্যই তাঁর মধ্যে নেই, তাই ছেলেমেয়েরা তাঁর সাথে তেমনি ভালোমানুষি করল যা তারা দেখে তাদের মায়ের মুখে। লেভিনের আমন্ত্রণে বড় দুজন তখনই লাফিয়ে এল তাঁর কাছে আর তেমনি সহজে দৌড়াতে লাগল তাঁর সাথে যেমন তারা দৌড়াতে পারত ধাই-মা, মিস গুল বা মাকে নিয়ে। লিলিও তাঁর কাছে আসতে চাইছিল, মা তাকে লেভিনের হাতে দিতেই লেভিন তাকে কাঁধে চাপিয়ে ছুট মারলেন।
মায়ের দিকে তাকিয়ে ফুর্তিতে হেসে বললেন, ‘ভয় পারেন না, ভয় পাবেন না দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা! চোট লাগবে কি পড়ে যাবে, সে অসম্ভব।’
তাঁর ক্ষিপ্র, বলিষ্ঠ, সযত্ন-সতর্ক এবং বড় বেশি টান-টান গতিভঙ্গি দেখে মা শান্ত হয়ে ফুর্তিতে অনুমোদনের হাসি হাসলেন তাঁর দিতে তাকিয়ে।
এখানে এই গ্রামে, ছেলেমেয়ে এবং তাঁর অনুরাগী দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনাকে পেয়ে বেশ একটা ছেলেমানুষি দিলদরিয়া মেজাজ পেয়ে বসল তাঁকে, যা তাঁর প্রায়ই হয় আর যেটা বিশেষ করে ভালো লাগত ডল্লি। ছেলেমেয়েদের সাথে দৌড়াদৌড়ি করে তিনি তাদের ব্যায়াম শেখালেন নিজের অকথা ইংরেজি ভাষায় হাসালেন মিস গুলকে, ডল্লিকে বললেন গাঁয়ে তাঁর কাজকর্মের কথা।
খাওয়া-দাওয়ার পর ডল্লি তাঁর সাথে একা ঝুল-বারান্দারায় বসে বললেন কিটির কথা।
‘জানেন? কিটি এখানে আসবে, গ্রীষ্মকালটা থাকবে আমার সাথে।’
‘সত্যি?’ লাল হয়ে বললেন তিনি এবং তখনই কথাটা ঘুরিয়ে দেবার জন্য যোগ করলেন, ‘তাহলে দুটো গরু পাঠাব আপনাকে? যদি হিসাব মেটাতে চান, মাসে পাঁচ রুব্ল করে দেবেন, অবশ্য যদি আপনার সংকোচ না হয়।’
‘না-না, ধন্যবাদ। আমাদের সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে।’
‘তাহলেও আপনাদের গরুগুলোকে আমি দেখব, যদি অনুমতি দেন, হুকুম দিয়ে যাব কি করে খাওয়াতে হবে। খাওয়ানোটাই আসল কথা।’
এবং শুধু কথাবার্তার মোড় ঘুরিয়ে দেবার জন্যই লেভিন ডল্লিকে বোঝাতে লাগলেন তাঁর ডেয়ারি তত্ত্ব, যার মোদ্দা কথা, গরু হল খাদ্যকে দুধে পরিণত করার যন্ত্র ইত্যাদি।
এটা তিনি বলছিলেন যদিও ভয়ানক চাইছিলেন কিটি সম্পর্কে খুঁটিনাটি সমস্ত কথা শুনতে, আবার ভয়ও হচ্ছিল তাতে। ভয় হচ্ছিল যে এত কষ্টে যে প্রশান্তি তিনি লাভ করেছেন সেটা চুরমার হয়ে যাবে।
‘হ্যাঁ, তবে এ সবের ওপর তো নজর রাখতে হয়, কিন্তু কে করবে সেটা?’ অনিচ্ছায় জবাব দিলেন ডল্লি। মাত্রেনা ফিলিমনোভনার মাধ্যমে তিনি তাঁর কাজকারবার এমন গুছিয়ে তুলেছেন যে তাতে অদল-বদল করার ইচ্ছে ছিল না তাঁর; তাছাড়া কৃষির ব্যাপারে লেভিনের জ্ঞানেও তাঁর ভরসা ছিল না। গরু হল দুধ বানাবার যন্ত্র এ যুক্তি তাঁর কাছ সন্দেহজনক ঠেকেছিল। তিনি ভাবলেন এ ধরনের চিন্তায় কেবল ক্ষতিই হতে পারে গৃহস্থালির। তাঁর মনে হয়েছিল ব্যাপারটা অনেক সহজ : দরকার শুধু মাত্রেনা ফিলিমনোভনা যা তাঁকে বুঝিয়েছেন, ছোপে ছোপে আর পাশ- ধবলীকে বেশি করে খাদ্য পানীয় দেওয়া দরকার, আর বাবুর্চি যেন রান্নাঘরের ফেলানি পানি ধোপানীর গরুর জন্য না নিয়ে যায়। এটা বেশ স্পষ্ট। ওদিকে আটা আর ঘাস খাওয়াবার যুক্তিটা অনিশ্চিত এবং অস্পষ্ট। তবে প্রধান কথা, ওঁর ইচ্ছে হচ্ছিল কিটির কথা বলেন।