পঁচিশ
সুরোভস্কি উয়েদে রেলপথ বা ডাকপথ কিছুই ছিল না, লেভিন গেলেন নিজের ঘোড়ায় টানা তারান্তাসে। মাঝপথে ঘোড়াগুলোকে খাওয়াবার জন্য লেভিন থামলেন এক ধনী কৃষকের বাড়ির কাছে। গালের কাছে পেকে যাওয়া পাটকিলে চাপ-দাড়িওয়ালা এক টেকো চাঙ্গা বুড়ো ফটক খুলে থামের সাথে সেঁটে তিন ঘোড়ার গাড়িটায় যাবার পথ করে দিলে। রোদে পোড়া কাঠের লাঙল রাখা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন প্রশস্ত একটা নতুন আঙিনায় চালার তলে ঘোড়াগুলোকে রাখবার জায়গাটা কোচোয়ানকে দেখিয়ে দিয়ে বুড়ো লেভিনকে ডাকল বড় ঘরে। বিনা মোজার গালোশ পরা পরিচ্ছন্ন পোশাকের একটা যুবতী ঘাড় গুঁজে নতুন বারান্দার মেঝে ঘষছিল। লেভিনের পিছু পিছু ছুটে আসা কুকুরটা দেখে ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠল সে, কিন্তু কামড়াবে না শুনে তখনই নিজের ভয় পাওয়াতেই হেসে ফেললে। সুন্দর মুখখানা লুকিয়ে আবার পরিষ্কার করতে লাগল মেঝে।
মেয়েটা জিজ্ঞেস করলে, ‘সামোভার আনব?’
‘তা আনুন-না।’
ঘরখানা বেশ বড়, পার্টিশান দেওয়া, একটা ওলন্দাজ চুল্লি আছে। দেবপটগুলোর নিচে রঙিন নকশা আঁকা টেবিল, বেঞ্চি, দুটো চেয়ার। ঢোকার মুখে বাসনপত্রে ভরা আলমারি। জানালার খড়খড়ি বন্ধ, তাই মাছি কম, আর সবই এমন ঝকঝকে-তকতকে যে লেভিনের ভয়ই হল, রাস্তায় ছুটতে ছুটতে তাঁর কুকুর লাস্কা পানিতে ডুব দিয়ে এসেছে, সে না আবার মেঝে মাড়ায়, দরজার কাছে এক কোণে তাকে বসে থাকার হুকুম দিলেন তিনি। ঘরখানা দেখে লেভিন পেছনকার আঙিনায় বেরোলেন। গালোশ পরা সুশ্রী মেয়েটা বাঁকে দুটো খালি বালতি দোলাতে দোলাতে লেভিনের সামনে দিয়ে ছুটে গেল কুয়ো থেকে পানি আনতে।
‘চটপট!’ তার উদ্দেশে ফুর্তিতে চেঁচিয়ে বুড়ো এল লেভিনের কাছে। ‘সাহেবের কি নিকোলাই ইভানোভিচ সি্ভ্য়াজ্স্কির ওখানে যাওয়া হচ্ছে? আমাদের এখানেও উনি এসে থাকেন’, অলিন্দের রেলিঙে কনুই ভর দিয়ে বুড়ো শুরু করল আলাপের আগ্রহ নিয়ে।
সি্ভ্য়াজ্স্কির সাথে তার পরিচয়-বৃত্তান্তের মাঝখানে আবার ক্যাচক্যাচ করে উঠল ফটক, কাঠের লাঙল আর মই নিয়ে খেত থেকে আঙিনায় ফিরল মুনিষেরা। লাঙল আর মইয়ের সাথে জোতা ঘোড়াগুলো হৃষ্টপুষ্ট, বড় বড়। মুনিষেরা স্পষ্টতই ঘরের লোক, দুজন জোয়ান, পরনে ক্যালিকো কামিজ, মাথায় টুপি, বাকি দুজন ঘরে বোনা জামা পরা ভাড়া করা মুনিষ—একজন বুড়ো, অন্যজন ছোকরা। অলিন্দ থেকে নেমে বুড়ো গেল ঘোড়া খুলতে।
‘কি চষলে?’ লেভিন জিজ্ঞেস করলেন।
‘আলু। আমাদেরও জমি আছে। ফেদত, খাসি ঘোড়াটাকে তুই ছাড়িস না, পাতনার সাথে বেঁধে রাখ, অন্যটাকে জুত।’
‘কি বাবা, আমি যে ফাল আনতে বলেছিলাম, এনেছ?’ জিজ্ঞেস করল দীর্ঘাঙ্গী স্বাস্থ্যবান এক ছোকরা, স্পষ্টতই বুড়োর ছেলে।
‘ওই যে…স্লেজে’, লাগামগুলো খুলে গুটিয়ে মাটিতে ফেলে দিয়ে বুড়ো বলল, ‘ওরা খেতে খেতে জুড়ে ফ্যাল।’
ভরা বালতিতে টানটান কাঁধে সুশ্রী মেয়েটা ঢুকল বারান্দায়। কোত্থেকে দেখা দিল আরো মেয়ে — অল্পবয়সীরা সুন্দরী, মধ্যবয়সী ও বৃদ্ধারা অসুন্দর, কারো সাথে শিশু, কারো নেই।
সামোভারের নল গোঁ-গোঁ করে উঠল। ঘোড়াগুলোর ব্যবস্থা করে মজুর আর ঘরের লোক সবাই গেল খেতে। লেভিন গাড়ি থেকে নিজের খাবার-দাবার এনে বুড়োকে আমন্ত্রণ করলেন তাঁর সাথে চা খেতে।
‘আজ চা তো খাওয়া হয়ে গেছে’, বুড়ো বলল, স্পষ্টতই আনন্দের সাথে প্রস্তাবটা গ্রহণ করে, ‘তবে সঙ্গদান করা আর-কি।’
লেভিন চা খেতে খেতে বুড়োর বিষয়-আশয়ের সমস্ত খবরাখবর শুনলেন। দশ বছর আগে জমিদারনীর কাছ থেকে একশ’ বিশ দেসিয়াতিনা জমি সে ইজারা নেয়। গত বছর জমিটা সে কিনে নিয়েছে। আরো তিনশ’ দেসিয়াতিনা সে পত্তনি নিয়েছে পাশের জমিদারের কাছ থেকে। জমিটার অল্পাংশ, সবচেয়ে খারাপ যেটা, নিজেই সে পত্তনি দিয়েছে অন্যকে। সে নিজে পরিবারের লোকজন আর দুটো মুনিষ ভাড়া করে চষেছে মাঠের চল্লিশ দেসিয়াতিনা। বুড়ো খেদ করলে যে অবস্থা ভালো যাচ্ছে না। তবে লেভিন বুঝলেন যে খেদটা নেহাৎ সৌজন্যবশত, বিষয়-আশয় ভালোই চলছে। খারাপ হলে একশ’ পাঁব রুব্ল দরে জমি কিনত না, বিয়ে দিত না তিন ছেলে আর ভাইপোর, আগুন লাগার পর দু’বার নতুন করে বাড়ি বানাত না, আর প্রতিবারই তা আগের চেয়ে ভালো। বুড়োর খেদ সত্ত্বেও বেশ বোজা যাচ্ছিল সে সঙ্গত কারণেই নিজের শ্রীবৃদ্ধিতে গর্বিত, নিজের ছেলেদের নিয়ে, ভাইপোকে নিয়ে, বৌমাদের নিয়ে, ঘোড়া, গরু এবং বিশেষ করে সে যে এই সম্পত্তিটা চালাচ্ছে গর্বিত তার জন্য। বুড়োর সাথে কথাবার্তা থেকে লেভিন জানতে পারলেন নতুনত্ব প্রবর্তনে সে মোটেই গররাজী নয়। আলু বুনেছে সে, আর আসার সময় লেভিন যা দেখেছেন, আলুগাছগুলোর ফুল এর মধ্যেই, ঝরে ফল দিতে শুরু করেছে যেক্ষেত্রে লেভিনের নিজের আলুগাছগুলোর ফুল ফুটতে শুরু করেছে সবে। জমিদারের কাছ থেকে নেওয়া লাঙল, যাকে সে বলছিল লাওল, তা দিয়ে আলুগাছগুলোর চারপাশের মাটি সে আলগা করে দেয়। গম বুনেছে সে। ছোট্ট একটা ঘটনা বিশেষ রকম অবাক করল লেভিনকে : রাই খেত নিড়ানির সময় সে ওই নিড়ানির রাই খাওয়াত ঘোড়াকে। চমৎকার এই খাদ্যটা নষ্ট হচ্ছে দেখে লেভিন কতবার ওগুলো সংগ্রহ করতে চেয়েছেন কিন্তু প্রতিবারই দেখা গেছে তা অসম্ভব। এ কৃষকটি কিন্তু তা করেছে, এ খাদ্যের প্রশংসায় যে পঞ্চমুখ।
‘মহিলাগুলো আছে কি করতে? রাস্তায় স্তূপ দিয়ে রাখুক, গাড়ি এসে নিয়ে যাবে।’
‘আর আমাদের জমিদারদের মহা ঝামেলা মজুর নিয়ে’, এক গ্লাস চা এগিয়ে দিয়ে লেভিন বললেন।
‘ধন্যবাদ’, বুড়ো বলল। চা নিলে, কিন্তু চিনি নিতে চাইল না, কামড়ে খাওয়া একদলা মিছরি পড়ে ছিল, সেটা সে দেখাল। বলল, ‘মুনিষ দিয়ে কাজ চলে কখনো? শুধুই লোকসান। এই সি্ভ্য়াজ্স্কির কথাই ধরুন-না কেন। কি জমি সে তো আমরা জানি, সরেস, কিন্তু ফসলটি তেমন হয় কি? সবই হেলা ফেলা!’
‘কিন্তু তুমিও তো মুনিষ খাটিয়ে চালাও?
‘আমরা যে কৃষক। নিজেরাই সব দেখি। কাজ যদি খারাপ করে দূর হও; নিজেরাই চালিয়ে নেব।’
‘বাবা, ফিনোগেন আলকাতরা চাইছে’, ঘরে ঢুকে বলল গালোশ পরা মেয়েটা।
‘এই হল গিয়ে ব্যাপার সাহেব!’ উঠে দাঁড়িয়ে বুড়ো বলল, ক্রুশ করল সে অনেকক্ষণ ধরে, তারপর লেভিনকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে গেল।
কোচোয়ানকে ডাকার জন্য লেভিন যখন কুটিরের ভেতরে ঢুকলেন, দেখলেন—সব পুরুষেরা টেবিল ঘিরে বসেছে। মেয়েরা পরিবেশন করছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। হৃষ্টপুষ্ট ছোকরা একটা ছেলে এক গ্রাস চরু মুখে পুরে হাস্যকর কি-একটা ব্যাপার বলছিল আর সবাই ফেটে পড়ছিল হাসিতে, বিশেষ করে গালোশ পরা মেয়েটা, পেয়ালায় বাঁধাকপির স্যুপ ঢালছিল সে।
লেভিনের মনে এই কৃষক গৃহটি সমৃদ্ধির যে ছাপ ফেলেছিল, গালোশ পরা মেয়েটার সুশ্রী মুখখানা তাতে বহু দিক থেকে সাহায্য করে থাকতে পারে, কিন্তু ছাপটা এতই প্রবল যে লেভিন তা থেকে ছাড়ান পাচ্ছিলেন না। বুড়োর ওখান থেকে সি্ভ্য়াজ্স্কির কাছে যাওয়ার গোটা পথটায় থেকে থেকেই তিনি স্মরণ করছিলেন এই সংসারটার কথা, যেন তাঁর বিশেষ মনোযোগ দাবি করছে সেটা।
ছাব্বিশ
সি্ভ্য়াজ্স্কি ছিলেন তাঁর উয়েদের অভিজাত-প্রমুখ। লেভিনের চেয়ে তিনি পাঁচ বছরের বড়, বিয়ে হয়েছে অনেকদিন। তাঁদের সাথে বাড়িতে থাকত সি্ভ্য়াজ্স্কির তরুণী শালী, যাকে খুবই সুন্দরী বলে মনে হত লেভিনের। লেভিন এও জানতেন যে, সি্ভ্য়াজ্স্কি এবং তাঁর স্ত্রী খুবই চান যে লেভিনের সাথে মেয়েটার বিয়ে হোক। সেটা তিনি নিঃসন্দেহে জানতেন যেমন তা সব সময়ই জানা থাকে বর নামক যুবাপুরুষদের, যদিও কাউকে কখনো সে কথা বলার সাহস পাননি এবং এও তিনি জানতেন যে যদিও তিনি বিবাহিত হতে ইচ্ছুকই, যদিও অতি মনোহারিণী মেয়েটার উত্তম স্ত্রী হওয়ারই কথা, তাহলেও কিটির প্রেমের না পড়লেও এ মেয়েটাকে তিনি বিয়ে করতে পারেন না, যেমন পারেন না আকাশে উড়ে যেতে। সি্ভ্য়াজ্স্কির কাছে আসা থেকে যে তৃপ্তি তিনি পাবেন বলে আশা করছিলেন, এই জ্ঞানটা তা মাটি করে দিচ্ছিল।
শিকারে আমন্ত্রণ জানিয়ে সি্ভ্য়াজ্স্কি যে চিঠি দেন, সেটা পাওয়া মাত্র কথাটা তিনি ভেবেছিলেন, তাহলেও স্থির করলেন তাঁকে নিয়ে সি্ভ্য়াজ্স্কির এমন কিছু একটা চিন্তা আছে, এ অনুমানের মোটেই কোন ভিত্তি নেই, সুতরাং যাবেন। তাছাড়া অন্তরে অন্তরে চাইছিলেন নিজেকে পরীক্ষা করবেন, আবার মেয়েটার জন্য নিজের হৃদয়াবেগ বুঝে দেখবেন। সি্ভ্য়াজ্স্কির গার্হস্থ্য জীবন ভারি চমৎকার, আর লেভিন যাদের জানেন, তাদের মধ্যে জেমভের সেরা কর্মকর্তাদের অন্যতম হলেন সি্ভ্য়াজ্স্কি, লেভিনের তাঁকে সব সময়ই অতি চিত্তাকর্ষক লেগেছে।
সি্ভ্য়াজ্স্কি সেই ধরনের একজন লোক যারা সব সময়ই অবাক করে লেভিনকে, মতামত যাদের অতি সঙ্গতিপূর্ণ যদিও কখনোই স্বাধীন নয়, সেটা এসে যায় আপনা-আপনি, অথচ জীবনের ধারা অসাধারণ সুনির্দিষ্ট ও দৃঢ়, চলে আপনা থেকে, একেবারে স্বাধীনভাবে এবং প্রায় সব সময়ই যুক্তিকে নাকচ করে। সি্ভ্য়াজ্স্কি ছিলেন অসাধারণ উদার মতাবলম্বী ব্যক্তি। অভিজাত সম্প্রদায়কে ঘৃণা করতেন তিনি, মনে করতেন অধিকাংশ অভিজাতই গোপনে ভূমিদাস মালিক যদিও ভীরুতাবশে সেটা প্রকাশ করে না। মনে করতেন, রাশিয়া তুরস্কের মত একটা ধ্বংসপ্রাপ্ত দেশ আর রুশ সরকার এতই নচ্ছার যে, গুরুত্বসহকারে তার ক্রিয়াকলাপের সমালোচনা করতে দেয় না কখনো; সেই সাথে নিজে কিন্তু সরকারী কাজ চালাতেন, ছিলেন আদর্শ অভিজাত-প্রমুখ, আর বাইরে বেরোবার সময় সব সময়ই পরতেন লাল কর্ড দেওয়া পদপরিচায়ক টুপি। তিনি মনে করতেন যে মনুষ্যোচিত জীবনযাপন সম্ভব কেবল বিদেশে এবং সুযোগ পেলেই সেখানে যেতেন অথচ সেই সাথে রাশিয়ায় অতি জটিল ও আধুনিক একটা জোত চালাতেন, আর রাশিয়ার যা ঘটেছে, অসাধারণ আগ্রহে তার সব কিছু অনুধাবন করতেন, জানতেন সব কিছু। তিনি মনে করতেন বিকাশের দিক দিয়ে রুশ কৃষক রয়েছে বানর ও মানুষের মাঝামাঝি, অথচ জেমভো সভার নির্বাচনে সবার চেয়ে বেশি আগ্রহে করমর্দন করতেন কৃষকদের, শুনতেন তাদের মতামত। তন্ত্রেমন্ত্রে বিশ্বাস ছিল না তাঁর, কিন্তু যাজকদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন ও প্যারিসের সংখ্যা হ্রাসের প্রশ্ন নিয়ে খুবই ভাবিত থাকতেন, যদিও তাঁর গ্রামের উপাসনালয়টি যাতে থাকে তার জন্য তিনি চেষ্টার ত্রুটি করেননি।
নারীদের প্রশ্নে তিনি ছিলেন তাদের পূর্ণ স্বাধীনতার, বিশেষ করে শ্রমের অধিকারের চরমপন্থী পক্ষপাতীদের দলে, কিন্তু স্ত্রীর সাথে এমনভাবে দিন কাটাতেন যে লোকে তাঁদের নিঃসন্তান, মিলমিশ সংসার দেখে মুগ্ধ হত, স্ত্রীর জীবন তিনি এমনভাবে বেঁধে দিয়েছিলেন যে স্ত্রী কিছু করতেন না, কি করে আরো ভালোভাবে ফুর্তিতে দিন কাটানো যায়, স্বামীর সাথে এই সাধারণ উদ্বেগে ভাগ নেওয়া ছাড়া কিছু করতেও পারতেন না তিনি।
লোককে তার ভালো দিকটা দিয়ে বিচার করার গুণ লেভিনের না থাকলে সি্ভ্য়াজ্স্কির চরিত্র নিয়ে তাঁর মনে কোন জটিলতা বা প্রশ্ন দেখা দিত না; মনে মনে বলতেন লোকটা হাঁদা কিংবা ওঁছা, সব কিছুই পরিষ্কার হয়ে যেত। হাঁদা তিনি বলতে পারেন না, কেননা সি্ভ্য়াজ্স্কি নিঃসন্দেহেই শুধু অতি বুদ্ধিমানই নন, অতিশয় শিক্ষিতও আর সে শিক্ষা নিয়ে তাঁর কোন জাঁক নেই। এমন বিষয় নেই যা তিনি জানতেন না; কিন্তু নিজের জ্ঞান তিনি জাহির করতেন কেবল যখন তা করতে বাধ্য হতেন। তাঁকে ওঁছা বলতে লেভিন পারেন আরো কম, কেননা নিঃসন্দেহেই য়িাঙ্কি ছিলেন সৎ, দয়ালু, বিচক্ষণ লোক, সজীব ফূর্তিতে তিনি নিরন্তর যে কাজ করে যেতেন, চারপাশের লোকেরা তাতে খুবই মূল্য দিত এবং নিশ্চয় সজ্ঞানে কোন খারাপ কাজ তিনি কখনো করেননি, তাঁর পক্ষে করা সম্ভবই নয়।
লেভিন চেষ্টা করেছেন তাঁকে বুঝতে কিন্তু বুঝতে পারেননি, তিনি এবং তাঁর জীবনে লেভিনের কাছে সব সময় মনে হয়েছে একটা জীবন্ত প্রহেলিকা।
লেভিনের সাথে তাঁর বন্ধুত্ব ছিল, তাই সি্ভ্য়াজ্স্কিকে জেরা করে ভাঁর জীবনদৃষ্টির মূলে পৌঁছানোর চেষ্টা করা সম্ভব বলে লেভিন মনে করেছিলেন; কিন্তু সর্বদা বৃথা হয়েছে সে চেষ্টা। যতবার সি্ভ্য়াজ্স্কির মানসের যে অভ্যর্থনা কক্ষ সবার কাছে উন্মুক্ত তার আরো ভেতরে যেতে গেছেন, ততবার সি্ভ্য়াজ্স্কি যে সামান্য বিব্রত বোধ করছেন, সেটা নজরে পড়েছে তাঁর; প্রায় অলক্ষ্য একটা শংকা ফুটেছে তাঁর, দৃষ্টিতে, যেন ভয় পাচ্ছেন লেভিন তাঁকে বুঝে ফেলবেন, হৃদয় হাসি-খুশিতে তিনি নিরস্ত করেছেন লেভিনকে।
এখন, বিষয়-আশয়ে মোহভঙ্গ হবার পর সি্ভ্য়াজ্স্কির ওখানে যাওয়াটা খুবই মনোরম লেগেছিল লেভিনের কাছে। নিজেদের এবং অন্য সবাইকে নিয়ে খুশি এই সৌভাগ্যবান কপোতেরা, তাঁদের সুন্দর বাসাটি তাঁর ওপর যে সুখাবেশ ফেলছিল সে কথা ছেড়ে দিলেও নিজের জীবনে অতি অসন্তুষ্ট বোধ করে লিভেনের ইচ্ছে হচ্ছিল সি্ভ্য়াজ্স্কির মধ্যে তিনি সেই গোপন রহস্যটা ধরতে পারবেন, যা তাঁর জীবনে এনে দিচ্ছে এতটা স্পষ্টতা, সুনির্দিষ্টতা আর আনন্দ। তাছাড়া লেভিন জানতেন যে সি্ভ্য়াজ্স্কির প্রতিবেশীর জোতদার, আর জোতজমা নিয়ে, ফসল, ভাড়া করা মুনিষ ইত্যাদি নিয়ে যে কথাবার্তাগুলো সবচেয়ে নিচু স্তরের গণ্য করা হয় বলে লেভিন জানতেন কিন্তু যা তাঁর কাছে এখন একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ, তা শোনা এবং তা নিয়ে কথার আদান-প্রদান তাঁর কাছে এখন অতি আগ্রহজনক। ‘এটা হয়ত ভূমিদাসপ্রথার আমলে কিংবা ইংলন্ডের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ নয়, উভয় ক্ষেত্রেই পরিস্থিতিটা সুনির্দিষ্ট। কিন্তু আমাদের এখানে এখন যখন সব কিছু ওলটপালট হয়ে গেছে এবং মাত্র সুস্থির হচ্ছে, পরিস্থিতিটা কি রকম হওয়া উচিত, এ প্রশ্ন যখন সবে দানা বাঁধছে, তখন রাশিয়ায় শুধু এটাই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন’, ভাবলেন লেভিন 1
লেভিন যা আশা করেছিলেন, শিকারটা তেমন ভালো হয় না। জলা শুকিয়ে গিয়েছিল; স্নাইপ ছিল না একটাও। সারা দিন তিনি ঘুরলেন, আনলেন শুধু তিনটা পাখি, তবে শিকার থেকে ফিরলে সব সময় তাঁর যা হয়, এলেন চমৎকার খিদে, চমৎকার মেজাজ আর প্রচণ্ড শারীরিক শ্রমের পর তাঁর মানসিকতায় বরাবর যে উত্তেজনা দেখা দেয় তাই নিয়ে এবং শিকারকালে, যখন মনে হচ্ছিল তিনি কিছুই ভাবছেন না, তখনো থেকেই থেকেই তাঁর মনে পড়ছিল বৃদ্ধ আর তার সংসারের কথা আর সেটা যেন শুধু মনোযোগ নয়, তার সাথে জড়িত কি একটার সমাধানও দাবি করছিল।
সন্ধ্যায় চায়ের টেবিলে একটা অছির ব্যাপার নিয়ে আগত দুই জোতদারের উপস্থিতিতে শুরু হল লেভিনের প্রত্যাশিত সেই চিত্তাকর্ষক আলাপটা।
চায়ের টেবিলে লেভিন বসেছিলেন গৃহকর্ত্রীর কাছে, তাই তাঁর এবং লেভিনের সামনে উপবিষ্ট বোনটির সাথে তাঁর কথাবার্তা চালাতে হয়। গোলগাল মুখ গৃহস্বামিনীর। পাতলা রঙের চুল, মাথায় খাটো, কেবলি জ্বলজ্বলে করছেন গালের টোলে আর হাসিতে। তাঁর স্বামী লেভিনের কাছে যে গুরুত্বপূর্ণ প্রহেলিকা হাজির করেছেন লেভিন চেষ্টা করলেন ওঁর মারফত সেটার সমাধান পেতে; কিন্তু অবাধ চিন্তার সুযোগ তাঁর হচ্ছিল না, কেনন কষ্টকর অস্বস্তি হচ্ছিল তাঁর। কষ্টকর অস্বস্তি তাঁর হচ্ছিল এই জন্য যে তাঁর সামনে বসেছিল গৃহস্বামীর শালী, লেভিনের মনে হল সে যে পোশাকটা পরেছে সেটা বিশেষ করে তাঁর জন্যই, তাতে সাদা বুকের ওপর বিশেষ রকমের একটা উন্মুক্ত ট্রাপেজইডাল কাট; বুক ধবধবে সাদা হওয়া সত্ত্বেও, কিংবা বিশেষ করে বুক ধবধবে সাদা বলেই ওই চতুষ্কোণ কাটটা লেভিনের চিন্তার স্বাধীনতা হরণ করছিল। তিনি কল্পনা করলেন, খুব সম্ভবত ভুল করে, যে কাটটা তাঁর কথা ভেবেই করা হয়েছে। ভাবলেন ওটার দিকে তাকাবার অধিকার নেই তাঁর এবং চেষ্টা করলেন না তাকাতে; কিন্তু অনুভব করলেন, কাটটা যে করা হয়েছে, শুধু সে জন্যই তিনি দোষ। লেভিনের মনে হল তিনি দোষী। লেভিনের মনে হল তিনি কাউকে প্রতারণা করছেন, তাঁর উচিত কিছু-একটা বুঝিয়ে বলা, কিন্তু সেটা বোঝানো কিছুতেই চলে না, তাই তিনি অনবরত লাল হয়ে উঠতে লাগলেন, বোধ করলেন অস্থিরতা আর অস্বস্তি। তাঁর অস্থিরতা সঞ্চারিত হল সুন্দরী শালীটির মধ্যেও। কিন্তু গৃহকর্ত্রী মনে হল সেটা লক্ষ্য করছেন না এবং ইচ্ছে করেই তাঁকে টানলেন কথাবার্তায়।
‘আপনি বলছেন যে’, শুরু করা আলোচনাটা চালিয়ে গেলেন গৃহকর্ত্রী, ‘রুশী সব কিছুতে আমার স্বামীর আগ্রহ থাকতে পারে না। বরং উল্টো, বিদেশে থাকলে তিনি খুশি হন, কিন্তু কখনোই এখানকার মত নয়। এখানে নিজেকে তিনি অনুভব করেন স্বীয় পরিবেশে। কত কাজ ওঁর, সব কিছুতে আগ্রহী হবার গুণ আছে তাঁর। ওহো, আমাদের স্কুলে গেছেন আপনি?’
‘দেখেছি … আইভিতে ছাওয়া বাড়িটা তো?’
‘হ্যাঁ, ওটি নাস্তিয়ার কীর্তি’, বোনকে দেখিয়ে বললেন তিনি।
‘আপনি নিজেই পড়ান?’ লেভিন জিজ্ঞেস করলেন কাটটা এড়িয়ে তাকাবার চেষ্টা করে যদিও টের পাচ্ছিলেন, যেদিকেই তিনি তাকান না কেন, কাটটা তাঁর চোখে পড়বেনই।
‘হ্যাঁ, আমি নিজেই পড়াতাম এবং পড়াই, তবে আমাদের শিক্ষয়িত্রীটি চমৎকার। আমরা শরীরচর্চাও চালু করেছি।’
‘না, ধন্যবাদ। আর চা খাব না’, লেভিন বললেন, এবং অনুভব করছিলেন যে অসৌজন্য হচ্ছে, কিন্তু এ কথোপকথন আর চালাতে পারছেন না তিনি, লাল হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। ‘খুব আগ্রহোদ্দীপক কথাবার্তা কানে আসছে’, যোগ দিলেন তিনি এবং গেলেন টেবিলের অন্য প্রান্তে যেখানে বসেছিলেন গৃহস্বামী ও জোদতার দুজন। য়িাঙ্কি বসেছিলেন টেবিলের দিকে পাশকে হয়ে, কনুই ভর দিয়ে কাপ ঘোরাচ্ছিলেন, অন্য হাত মুঠো করে দাড়ি ধরে থেকে থেকে তা নাকের কাছে নিয়ে যাচ্ছিলেন আবার নামিয়ে আনছিলেন, যেন শুঁকছেন। জ্বলজ্বলে কালো চোখে তিনি সোজা তাকিয়ে আনছিলেন, পাকা-মোট জোতদারের দিকে, স্পষ্টতই ভদ্রলোক যা বলছিলেন তাতে মজা পাচ্ছিলেন তিনি। কৃষকদের তিনি নিন্দা করছিলেন। লেভিন বেশ বুঝতে পারছিলেন, এর এমন জবাব সি্ভ্য়াজ্স্কির জানা আছে যে সাথে সাথেই ওঁর সমস্ত বক্তব্য ধূলিসাৎ হয়ে যাবে, কিন্তু যে পদে তিনি অধিষ্ঠিত তাতে সে জবাব দেওয়া য়ায় না, তাই জোতদারের মজাদার বক্তব্য তিনি শুনে যাচ্ছেন তৃপ্তির সাথেই।
পাকা-মোট জোতদারটি স্পষ্টতই ভূমিদাসপ্রথার ঝানু ভক্ত। গ্রামের পুরানো বাসিন্দা, বিষয়-কড়া মালিক। লেভিন তার লক্ষণ দেখলেন পোশাকে-সাবেককালের জীর্ণ সাটুকে, যাতে জোতদার অনভ্যস্ত, তাঁর বুদ্ধিমান ভ্রূকটিত চোখে, তাঁর রুশ ভাষার বাঁধুনিতে, স্পষ্টতই দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় রপ্ত করা প্রভুত্বব্যঞ্জক সুরে, অনামিকায় একটা পুরানো বিয়ের আংটি পরা বড় বড় লাল রোদে পোড়া হাতের দৃঢ় ভঙ্গিতে।
সাতাশ
‘যা গড়ে তুলেছি, যত মেহনত ঢালা হয়েছে, তা সব ভাসিয়ে দিতে মায়া না হলে…দূর ছাই বলে নিকোলাই ইভানিচের মত চলে যেতাম…সুন্দরী হেলেন শুনতে’, বুদ্ধিমান বৃদ্ধ মুখখানা প্রসন্ন হাসিতে উদ্ভাসিত করে জোতদার বললেন।
‘ভাসিয়ে তো দিচ্ছেন না’, বললেন নিকোলাই ইভানোভিচ সি্ভ্য়াজ্স্কি, ‘তার মানে খতিয়ে দেখেছেন। ‘
‘খতিয়ে দেখা সে শুধু একটাই, নিজের বাড়িতে থাকি, কেনা নয়, ভাড়া করা নয়। তাছাড়া আরো আশা রাখি যে কৃষকদের চৈতন্য হবে, নইলে বিশ্বাস করুন, এ শুধু মাতলামি, লাম্পট্য! জমি কেবল ভাগ্যের পর ভাগ, ঘোড়া নেই, গরু নেই। না খেয়ে মরবে, তাকে মজুর খাটাও, আপনার সর্বনাশ করার বুদ্ধিতে ঘাটতি পড়বে না, তার ওপর আবার সালিশী আদালতে টেনে নিয়ে যাবে।’
‘সালিশী আদালতের কাছে আপনিও নালিশ করুন’, বললেন সি্ভ্য়াজ্স্কি।
‘আমি নালিশ করব? জান গেলেও নয়! এমন গুজব রটবে যে নালিশে আনন্দ পাব না! এই কারখানার কথাই ধরুন-না-অগ্রিম দাদন নিয়ে পালাল। কি করল সালিশী আদালত? বেকসুর মাপ। সব টিকে থাকছে কেবল ভলো স্ত্ আর গ্রামপ্রধানের জন্যে। আগের কালের মত ছাল ছাড়িয়ে নেয় তারা। তা না হলে সব চুলোয় দাও! পালাও দুনিয়ার শেষ কিনারায়!’
স্পষ্টতই জোতদার খেপাচ্ছিলেন সি্ভ্য়াজ্স্কিকে, কিন্তু তিনি শুধু চটছিলেন না তাই নয়, বোঝা যার মজাই পাচ্ছিলেন।
‘ও সব ব্যবস্থা ছাড়াই তো আমরা জোতজমা চালাচ্ছি’, হেসে বললেন তিনি, ‘আমি, লেভিন, উনি।’ অন্য জোতদারকে দেখালেন তিনি।
‘হ্যাঁ, মিখাইল পেত্রভিচ চালাচ্ছেন, কিন্তু জিজ্ঞেস করুন-না, কিভাবে? এটা কি-একটা যুক্তিযুক্ত ব্যবস্থা?’ বললেন জোতদার, স্পষ্টতই নিজের ‘যুক্তিযুক্ত’ শব্দটায় প্রীতি লাভ করে।
‘আমার জোতজমা চালানো সহজ’, বললেন মিখাইল পেত্রভিচ, ‘সৃষ্টিকর্তার দয়ায়; হৈমন্তী ট্যাক্সের টাকাটা তৈরি রাখলেই হল। কৃষকরা আসে; মালিক, উদ্ধার কর! তা সবাই আপনার লোক, পাড়া-প্রতিবেশী, মায়া হয়। তিন ভাগের প্রথম ভাগটা দিয়ে শুধু বলি; মনে রেখো, তোমাদের সাহায্য করলাম, আমার যখন দরকার পড়বে-ওট বুনতে, বিচালি বানাতে, ফসল তুলতে, তখন তোমারও সাহায্য করো। তারার কথা বলে নাও কার ভাগে কি। তবে তাদের মধ্যেও ধড়িবাজ আছে তা সত্যি।’
এই পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা বহুদিন থেকে লেভিনের জানা, য়িাঙ্কির সাথে দৃষ্টি বিনিময় করে, মিখাইল পেত্রভিচের কথায় বাধা দিয়ে তিনি আবার ফিরলেন পাকা-মোচ জোতদারের দিকে
জিজ্ঞেস করলেন, ‘তাহলে কি আপনি বলতে চাইছেন? কিভাবে এখন জোতজমা চালাতে হবে?’
‘চালান মিখাইল পেত্রভিচের মত করে : হয় কৃষকদের আধভাগ দিন, নয় জমি পত্তনি দিন তাদের কাছে; এটা করা যায়, তবে এতে করে ধ্বংস পাচ্ছে রাষ্ট্রের সাধারণ সম্পদ। ভূমিদাসপ্রথায় আর ভালো ব্যবস্থাপনায় যেখানে আমি পেতাম নয় ভাগ, আধি প্রথায় পাচ্ছি তিন ভাগ। কৃষকমুক্তি রাশিয়ার সর্বনাশ করল।’
স্মিত দৃষ্টিতে সি্ভ্য়াজ্স্কি তাকালেন, লেভিনের দিকে, এমন কি প্রায় অলক্ষ্য একটা উপহাসেরও ইঙ্গিত দিলেন; কিন্তু জোতদারের কথাটা হাস্যকর ঠেকল না লেভিনের কাছে; সি্ভ্য়াজ্স্কিকে যতটা তিনি বোঝেন, তার চেয়ে জোতদারের কথাগুলো তাঁর কাছে বেশি বোধগম্য। কৃষকমুক্তিতে রাশিয়ার সর্বনাশ হয়েছে, এটা প্রমাণ করার পরে জোতদার আরো যা যা বলেছিলেন তার অনেক কিছুই লেভিনের কাছে মনে হয়েছিল সঠিক, তাঁর পক্ষে নতুন এবং অকাট্য। স্পষ্টতই জোতদার বলছিলেন তাঁর নিজস্ব মতামত যেটা ঘটে কদাচিৎ, আর সে মতামতে তিনি পৌঁছেছেন অলস মস্তিষ্ককে ব্যস্ত রাখার বাসনা থেকে নয়, গ্রামের নিঃসঙ্গতায় যে জীবন তিনি কাটিয়েছেন আর সব দিক দিয়ে ভেবে দেখেছেন, এ মতামত দেখা দিয়েছে তাঁর সেই পরিস্থিতি থেকেই।
‘দেখুন না, ব্যাপারটা হল এই যে সব কিছু প্রগতি ঘটে কেবল ক্ষমতার জোরে’, বলছিলেন তিনি, স্পষ্টতই দেখাতে চাইছিলেন যে শিক্ষা-দীক্ষার তিনি নেহাৎ অপাক্তেয় নন, পিচার, ইয়েকাতেরিনা, আলেকজান্ডারের সংস্কারগুলো ধরুন। ইউরোপের ইতিহাস নিন। কৃষির প্রগতির তো আরো বেশি। এমন কি আলু, তাও আমাদের এখানে চালু হয়েছে জোরজবরদস্তিতে। লোকে লাঙ্গল দিয়ে সব সময় জমি চষেছে এমন তো নয়। তাও চালু হয়েছে সম্ভবত ছোট ছোট রাজ্য গড়ে ওঠার সময়, কিন্তু নিশ্চয় চালু হয়েছে জোরজবরদস্তিতে। এখন, আমাদের কালে, আমরা জমিদাররা ভূমিদাসপ্রথার আমলে চাষ-আবাদ চালিয়েছি উন্নত পদ্ধতিতে; শুকাবার যন্ত্র, ঝাড়াইয়ের যন্ত্র, গোবর-সার দেওয়া, যত কিছু যন্ত্র—সব আমরা চালু করেছি নিজেদের ক্ষমতার জোরে, কৃষকরা প্রথমে বিরোধিতা করেছিল, পরে আমাদের অনুসরণ করতে থাকে। এখন, ভূমিদাসপ্রথা উঠে যাওয়ায় আমাদের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হল, আর আমাদের চাষ-আবাদ যেখানে উঁচু মানে উঠেছিল তাকে একটা অতি আদিম, বর্বর স্তরে নেমে যেতে হবে। এই আমি বুঝি।’
‘কেন? পদ্ধতিটা যদি যুক্তিযুক্ত হয়, তাহলে মজুর খাটিয়ে তা চালাতে পারেন’, সি্ভ্য়াজ্স্কি বললেন।
‘ক্ষমতা নেই যে। জিজ্ঞেস করি কাকে দিয়ে তা চালাব?’
‘হ্যাঁ, শ্রমিক শক্তি—এই হল চাষ-আবাদের প্রধান উপাদান’, লেভিন ভাবলেন।
‘মজুর দিয়ে।
‘ভালো করে খাটতে আর ভলো হাতিয়ারপত্র নিয়ে খাটতে চায় না মজুরেরা। আমাদের মজুরেরা জানে শুধু একটা জিনিস—শুয়োরের মত মদ গিলতে, যে যন্ত্র ওদের দেওয়া হবে মাতাল হয়ে সবই নষ্ট করে ফেলবে। ঘোড়াকে পানি খাইয়ে খাইয়ে মারবে, ভালো সাজ কেটে ফেলবে, টায়ার পরানো চাকা বদলিয়ে মদ খাবে, মাড়াই কলে বোল্ট ঢুকিয়ে দেবে তা ভাঙাবার জন্যে। যা নিজের মতনটি নয়, তা দেখলে বমি আসে ওদের। চাষ-আবাদের সমস্ত মান নেমে গেছে এই জন্যে। জমি পড়ে থাকছে, ভরে উঠছে আগাছায় অথবা পত্তনি দেওয়া হচ্ছে কৃষকদের, আগে যেখানে ফলত দশ লাখ, এখন সেখানে ফলে কয়েক লাখ, চার ভাগের এক ভাগ; দেশের মোট সম্পদ কমে গেছে। যদি একই জিনিস করা হত হিসেব করে…’
এবং কৃষকমুক্তি নিয়ে তিনি তাঁর নিজস্ব পরিকল্পনা পেশ করতে লাগলেন যাতে নাকি এই অসুবিধা দূর হতে পারত।
তাতে লেভিনের আগ্রহ ছিল না, জোতদার যখন তাঁর বক্তব্য শেষ করলেন, লেভিন ফিরলেন তাঁর প্রথমাংশ এবং সি্ভ্য়াজ্স্কি যাতে গুরুত্বসহকারে নিজের অভিমত দেন, সেজন্য তাঁকে উদ্দেশ করে বললেন : ‘চাষ-আবাদের মান যে নেমে যাচ্ছে এবং শ্রমিকদের সাথে আমাদের যা সম্পর্ক তাতে যে লাভজনক যুক্তিযুক্ত চাষ সম্ভব নয়, তা খুবই সত্যি।’
‘আমি তা মনে করি না’, এবার গুরুত্ব দিয়েই আপত্তি জানালেন সি্ভ্য়াজ্স্কি, ‘আমি শুধু এই দেখতে পাচ্ছি যে, আমরা চাষ-আবাদ চালাতে পারি না এবং ভূমিদাসপ্রথার আমলে যা চালিয়েছি তার মান বড় বেশি উঁচুর বদলে, উলটো বরং ছিল বড় বেশি নিচু। আমাদের যন্ত্রপাতি নেই, ভালোরকম ভারবাহী পশু নেই, সত্যিকারের পরিচালনা নেই, হিসেব করতে পারি না আমরা। জিজ্ঞেস করুন কোন মালিককে, সে বলতে পারবে না কোনটা তার পক্ষে লাভজনক, কোনটা নয়।’
‘ইতালিয়ান গণিতক’, জোতদার বললেন ব্যঙ্গভরে, ‘যেভাবেই হিসেব করুন, সব ছয়লাব করবে, লাভ আর হবে না।’
‘কেন ছয়লাব করবে? বাজে একটা মাড়াই কল, আপনার আহামরি রুশ যন্ত্রটাকে নষ্ট করবে, বাষ্পচালিত আমার যন্ত্রটাকে করবে না। গেঁয়ো, কি বরে তাকে? গেঁতো একটা ঘোড়া লেজ ধরে যাকে ঠেলতে হয়, তাকে নষ্ট করবে, কিন্তু পের্শেরন, অন্তত বিত্যুগ জাতের ঘোড়া রাখুন, তাকে নষ্ট করবে না। সব ব্যাপারেই তাই আমাদের চাষ-আবাদকে তুলতে হবে উঁচুতে।
‘কেনার মত আওকাত থাকলেও না হয় হত, নিকোলাই ইভানিচ! আপনার আর কি, এদিকে আমাকে ছেলের খরচাপাতি বইতে হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যে, ছোটগুলোকে পড়াতে হচ্ছে জিমনাসিয়ামে, তাই পের্শেরন কেনা আমার দ্বারা হবে না।’
‘তার জন্যে ব্যাংক আছে।’
‘যাতে শেষ সম্পত্তিটুকুও নিলামে ওঠে? না বাবা, রক্ষা করুন!
‘চাষ-আবাদের মান আরো উঁচুতে তোলা দরকার এবং সম্ভব, এ কথায় আমার সায় নেই’, লেভিন বললেন, ‘আমি চাষ-আবাদ নিয়েই আছি, তার জন্যে টাকাও আছে আমার, কিন্তু কিছুই করতে পারছি না। ব্যাংকে কার উপকার হচ্ছে জানি না। আমি অন্তত চাষবাসে যতই না টাকা ঢালি, সবই লোকসান : গরু-বাছুরে লোকসান, যন্ত্রপাতিতে লোকসান।’
‘এই হল খাঁটি কথা’, সন্তুষ্টিতে এমন কি হাসিমুখেই সমর্থন করলেন পাকা-মোচ জোতদার।
‘আর আমিই একা নই’, লেভিন বলে চললেন, ‘যুক্তিযুক্তভাবে চাষ-আবাদ চালায় এমন সমস্ত মালিকেরই উল্লেখ করব আমি; বিরল ব্যতিক্রম বাদে সবাই তারা চালাচ্ছে লোকসান দিয়ে। আপনিই বলুন, বিষয়-আশয় থেকে আপনার লাভ হচ্ছে কি?’ লেভিন বললেন এবং তৎক্ষণাৎ য়িাঙ্কি দৃষ্টিতে লক্ষ্য করলেন ক্ষণিক সেই ভয়টা, সি্ভ্য়াজ্স্কির মানসের অভর্থনা কক্ষের চেয়ে বেশি দূর অগ্রসর হতে গেলে যা তাঁর চোখে পড়েছে।
তাছাড়া লেভিনের দিক থেকে প্রশ্নটা করা সঙ্গত হয়নি। চায়ের টেবিলে গৃহকর্ত্রী এইমাত্র তাঁকে বলেছেন যে, এ বছর গ্রীষ্মে তাঁরা মস্কো থেকে হিসাব-নিকাশে পারদর্শী জনৈক জার্মানকে আমন্ত্রণ করে আনেন, পাঁচশ রুব্ল পারিতোষিকে তিনি তাঁদের বিষয়-আশয়ের হিসাব কষে দেখেন যে তাতে লোকসান যাচ্ছে তিন হাজার রুবলের কিছু বেশি করে। তাঁর মনে নেই ঠিক, তবে জার্মানটা মনে হয় শেষ কপর্দকটি হিসেব করে দেখেছেন।
সি্ভ্য়াজ্স্কির বিষয়-আশয় থেকে লাভের উল্লেখে জোতদার ভদ্রলোকটি হাসলেন, স্পষ্টতই তাঁর জানা ছিল প্রতিবেশী অভিজাত-প্রমুখের কতটা মুনাফা হওয়া সম্ভব।
সি্ভ্য়াজ্স্কি বললেন, ‘হতে পারে যে লাভজনক নয়। তাতে শুধু প্রমাণ হয় যে আমি হয় খারাপ মালিক, নয় পুঁজি ঢালছি খাজনা বাড়বার জন্যে।’
‘খাজনা, বটে!’ সভয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন লেভিন, ‘হয়ত খাজনা আছে ইউরোপে, জমিতে শ্রম নিয়োগ করায় তা উন্নত হয়েছে, কিন্তু আমাদের এখানে শ্রম নিয়োগ করে জমি খারাপই হচ্ছে, মানে, তাকে বেদম চষা হচ্ছে, সুতরাং খাজনা আসতে পারে না।’
‘খাজনা আসবে না মানে? ওটা যে আইন।’
‘তাহলে আমরা আইন-বহির্ভূত : খাজনা আমাদের কিছুই ব্যাখ্যা করে না, বরং গুলিয়ে দেয়। না, বলুন তো, খাজনার তত্ত্ব কি করে…’
‘দই খাবেন? মাশা, আমাদের এখানে কিছু দই বা রাস্পবেরি পাঠাও’, স্ত্রীকে বললেন তিনি, এ বছর র্যাম্পবেরি ধরে আছে অনেক বেশি দিন।’
অতি খোশমেজাজে সি্ভ্য়াজ্স্কি উঠে চলে গেলেন, স্পষ্টতই তিনি ধরে নিয়েছিলেন যে কথাবার্তাটা সেখানেই শেষ হয়ে গেছে যেখানে সবে শুরু হচ্ছে বলে মনে হয়েছিল লেভিনের।
সহালাপীকে না পেয়ে লেভিন কথা চালিয়ে গেলেন জোতদারটির সাথে, তাঁর কাছে প্রমাণ করার চেষ্টা করলেন যে সমস্ত মুশকিলটা এই থেকে আসছে যে আমরা আমাদের শ্রমিকদের গুণাগুণ ও অভ্যাস জানতে চাই না; কিন্তু স্বাধীনভাবে একা একা চিন্তা করতে অভ্যস্ত সমস্ত লোকের মতই অপরের চিন্তা ভোজা জোতদারটির পক্ষে কঠিন হচ্ছিল, নিজের চিন্তাতেই তাঁর বিশেষ পক্ষপাত। এই কথায় তিনি জোর দিচ্ছিলেন যে রুশ কৃষক শূকুর শূকরত্বই সে ভালোবাসে, শূকরত্ব থেকে বের করে আনতে হলে দরকার ক্ষমতা, সেটা নেই, দরকার ডাণ্ডা, কিন্তু আমরা এতই উদারনীতিক হয়ে পড়েছি যে হাজার বছরের পুরানো ডাণ্ডার স্থলাভিষিক্ত করেছি উকিলদের আর কারাদণ্ডকে, যেখানে অপদার্থ দুর্গন্ধময় কৃষকদের খাওয়ানো হয় ভালো স্যুপ, তাদের জন্য বরাদ্দ হয় অত ঘন ফুট বাতাস।
নিজের প্রশ্নে ফিরে আসার চেষ্টা করে লেভিন বললেন, ‘কেন ভাবছেন যে শ্রম-শক্তির সাথে এমন সম্পর্ক স্থাপন করা যায় না যাতে কাজটা ফলপ্রসূ হবে?’
‘রুশ কৃষককে দিয়ে সেটা কখনো হবার নয়, ক্ষমতা নেই’, জবাব দিলেন জোতদার।
‘নতুন শর্ত পাওয়া যাবে কেমন করে?’ দই খেয়ে, ধূমপান করে পুনরায় বিতর্কীদের কাছে এসে বললেন সি্ভ্য়াজ্স্কি, ‘শ্রমিক শক্তির সাথে সম্ভবপর সমস্ত সম্পর্কই সুনির্দিষ্ট ও বিচারিত হয়েছে। বর্বরতার অবশেষ — সমষ্টিগত দায়িত্বসহ গ্রামসমাজ আপনা থেকেই ভেঙে পড়ছে, ভূমিদাসপ্রথা বিলুপ্ত, থাকছে শুধু স্বাধীন শ্রম, তার রূপ সুনির্দিষ্ট ও সুপ্রস্তুত হয়ে উঠেছে, যেগুলো নিতে হবে। ক্ষেতমজুর, দিনমজুর, খামারী-এ থেকে বেরোতে পারবেন না।’
‘কিন্তু এসব নতুন রূপের সন্ধান করছে। তা পেয়েও যাবে সম্ভবত।’
‘আমি তো শুধু সেই কথাই বলছি’, জবাব দিলেন লেভিন, ‘আমাদের তরফ থেকে আমরাই বা সন্ধান করব না কেন?’
‘কারণ, সেটা হবে নতুন করে রেলপথ নির্মাণের প্রণালী নিয়ে ভাবতে বসার সমান। সে প্রণালী তো তৈরিই আছে, উদ্ভাবিত হয়ে গেছে।’
‘কিন্তু সেটা যদি আমাদের উপযোগী না হয়, যদি তা হয় নির্বোধ?’ লেভিন বললেন।
এবং আবার লক্ষ্য করলেন সি্ভ্য়াজ্স্কির চোখে ভয়ের ভাব।
‘হ্যাঁ, যা বলেছেন : আমরা তুড়ি মেরে ওড়াই ইউরোপ যা খুঁজছে, সেটা আমরা পেয়ে গেছি! এ সবই আমি জানি, কিন্তু মাপ করবেন, শ্রমিকদের সুব্যবস্থার প্রশ্নে ইউরোপে যা করা হয়েছে, তা সব আপনি জানেন কি?’
‘না, বিশেষ কিছু জানি না।’
‘ইউরোপের সেরা সেরা মাথা এই সমস্যা নিয়ে খাটছে, শুট্সে-ডেলিচ…তারপর শ্রমিক প্রশ্ন নিয়ে অতি উদারনৈতিক লাসাল ধারার বিপুল সাহিত্য…মিলগাউজেন প্রথা—এগুলো এখন বাস্তব ঘটনা, আপনি নিশ্চয় এ সব কথা জানেন।’
‘কিছুটা ধারণা আছে, তবে খুবই ঝাপসা।’
‘না, ওটা আপনি শুধু বলছেন; সম্ভবত এসব আপনি জানেন আমার চেয়ে কম নয়। আমি অবশ্য সমাজবিদ্যার অধ্যাপক নই, কিন্তু এসব আমার আগ্রহ জাগায়, আর আগ্রহ যদি জাগে, তাহলে সত্যিই তো তা নিয়ে লোকে খাটবে।’
‘কিন্তু কি সিদ্ধান্তে তাঁরা পৌঁছেছেন?’
‘ক্ষমা করবেন…’
উঠে দাঁড়ালেন জোতদাররা আর সি্ভ্য়াজ্স্কির মনের অভ্যর্থনা কক্ষের পেছনে উঁকি দেবার অপ্রীতিকর অভ্যাসটায় লেভিনকে ফেলে রেখে অতিথিদের এগিয়ে দিতে সি্ভ্য়াজ্স্কি চলে গেলে।
আটাশ
লেভিনের কাছে মহিলাদের সাথে সে সন্ধ্যাটা অসহ্য একঘেয়ে লেগেছিল; বিষয়-আশয় নিয়ে যে অসন্তুষ্টি তিনি এখন বোধ করছেন, সেটা যে তাঁর একার নয়। রাশিয়ার ব্যাপার-স্যাপার যা তারই সাধারণ পরিস্থিতি এই ভাবনাটায় তাঁকে আগে কখনো এমন বিচলিত করেনি। তাঁর মনে হল, মাঝপথের ওই কৃষকটার মজুররা যেভাবে খাটছে, সেভাবেই তারা যেন খাটে, মজুরদের এমন সম্পর্ক স্থাপন করা স্বপ্ন নয়, অবশ্যই সাধনীয় একটা কর্তব্য। তাঁর মনে হল এ কর্তব্য সাধন করা যায় এবং সে চেষ্টা করা উচিত।
মহিলাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এবং পরের গোটা দিনটাও এখানে থেকে গিয়ে ওঁদের সাথে ঘোড়ায় চেপে দেখতে যাবেন সরকারী বনের মধ্যে অতি চিত্তাকর্ষক একটা খাদ এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে শ্রমিক সমস্যা নিয়ে যে বইটা সি্ভ্য়াজ্স্কি দেবেন বলেছিলেন, সেটা নেবার জন্য ঘুমের আগে লেভিন গেলেন তাঁর স্টাডিতে। ঘরটা প্রকাণ্ড, তাতে সারি সারি বইয়ের আলমারি আর দুটো টেবিল—ঘরের মাঝখানে একটা জগদ্দল লেখার টেবিলে, অন্যটা গোল, তার ওপর বাতিদান ঘিরে নক্ষত্রাকারে নানান ভাষায় পত্র-পত্রিকা বিছানো। লেখার টেবিলের কাছে বইয়ের শেল্ফ্ তার দেরাজগুলোয় সোনালি অক্ষরে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়বস্তুর নাম।
সি্ভ্য়াজ্স্কি বইটা এনে দিয়ে একটা দোলন চেয়ারে বসলেন।
লেভিন গোল টেবিলটার কাছে থেমে পত্র-পত্রিকায় চোখ বোলাচ্ছিলেন, সি্ভ্য়াজ্স্কি তাঁকে বললেন, ‘কি ওটা দেখছেন?’
লেভিনের হাতে যে পত্রিকাটা ছিল সেটা দেখে বললেন, ‘ওঃ এটা, খুবই চিত্তাকর্ষক একটা প্রবন্ধ আছে ওতে। দেখা যাচ্ছে’, খুশিতে চাঙ্গা হয়ে তিনি যোগ দিলেন, ‘পোল্যান্ড বিভাগের জন্যে প্রধান অপরাধী মোটেই ফ্রিডরিখ নন। দেখা যাচ্ছে…’
এবং তাঁর স্বভাবসুলভ প্রাঞ্জলতায় বললেন এই নতুন, অতি গুরুত্বপূর্ণ ও আগ্রহোদ্দীপক উদ্ঘাটনগুলোর কথা। লেভিনের মন এখন বিষয়কর্মের ভাবনায় ব্যস্ত থাকলেও গৃহকর্তার কথা তিনি শুনতে লাগলেন আর নিজেকে প্রশ্ন করলেন : ‘কি আছে ওর ভেতরটায়? আর কেন, কেনই-বা পোল্যান্ড বিভাগ নিয়ে ওর অত আগ্রহ?’ সি্ভ্য়াজ্স্কির কথা যখন শেষ হল, অজ্ঞাতসারেই লেভিন বলে ফেললেন, ‘কিন্তু তাতে কি হল?’ কিছুই হয়নি। যা ‘দেখা যাচ্ছে’ সেটাই কেবল আগ্রহোদ্দীপক। কিন্তু কেন ওটা তাঁর কাছে আগ্রহোদ্দীপক, সেটা সি্ভ্য়াজ্স্কি বুঝিয়ে বললেন না, প্ৰয়োজনও বোধ করলেন না বলার।
‘আমাকে কিন্তু ভারি আগ্রহী করে তুলেছিল ওই রাগী জোতদারটি’, দীর্ঘশ্বাস ফেলে লেভিন বললেন, ‘লোকটার মাথা আছে, সত্যি কথাই বলেছে অনেক।’
‘আহ্ ছাড়ুন! আর সবার মতই গোপনে গোপনে ঝানু একটা ভূমিদাস মালিক!’ য়িাঙ্কি বললেন।
‘আপনি যাদের অভিজাত-প্ৰমুখ…’
হ্যাঁ, শুধু ওদের প্রমুখত্ব করি ভিন্ন দিকে…’ হেসে বললেন সি্ভ্য়াজ্স্কি।
লেভিন বললেন, ‘আমাকে এটা খুব ভাবাচ্ছে। ও ঠিকই বলেছে যে আমাদের কাজটা, মানে যুক্তিযুক্ত ভিত্তিতে কৃষি চলছে না, চলছে কেবল ওই চুপচাপ লোকটার মত মহাজনী চাষ বা যেটা একান্ত মামুলী। সেটা কার দোষ?
‘বলা বাহুল্য আমাদেরই, তবে চলছে না, এ কথাটা ঠিক নয়। ভাসিলচিকভের তো চলছে।’
‘কারখানা যে…’
‘তাহলেও কিন্তু বুঝতে পারছি না, আপনি অবাক হচ্ছেন কিসে। বৈষয়িক আর নৈতিক দুইয়েরই বিকাশের এত নিম্নস্তরে কৃষকরা রয়েছে যে স্পষ্টতই যা তার জানা নেই তেমন সব কিছুরই তার বিরোধিতা করার কথা। ইউরোপে যুক্তিযুক্ত কৃষি চলে কেননা কৃষকরা সেখানে শিক্ষিত। সুতরাং কৃষকদের শিক্ষিত করতে হবে—এই হল কথা। ‘
‘কিন্তু সেটা করা যায় কিভাবে?’
‘কৃষকদের শিক্ষিত করে তোলার জন্যে দরকার তিনটা জিনিস—স্কুল, স্কুল এবং স্কুল।’
‘কিন্তু আপনি নিজেই তো বললেন যে, কৃষকরা রয়েছে বৈষয়িক বিকাশের নিম্নস্তরে। তাহলে স্কুলে তাদের কি সাহায্য হবে?’
‘জানেন, আপনার কথায় রোগীকে পরামর্শ দানের একটা চুটকি মনে পড়ছে : ‘আপনি জোলাপ নিন।’ নিয়েছি, খারাপ দাঁড়াল।’ ‘তাহলে কেজি লাগিয়ে দেখুন।’ ‘দেখেছি, আরো খারাপ হল।’ ‘তাহলে আর কি, সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করুন।’ ‘তাও করেছি হল আরো খারাপ।’ আপনারও তাই। আমি অর্থশাস্ত্রের কথা বলছি, আপনি বলছেন— আরো খারাপ, আমি সমাজতন্ত্রের কথা বলছি—আরো খারাপ। শিক্ষা-আরো খারাপ।’
‘কিন্তু স্কুল সাহায্য করবে কি করে?’
‘নতুন চাহিদা এনে দেবে।’
‘ঠিক এই জিনিসটাই আমি বুঝে উঠতে পারিনি কখনো’, উত্তেজিত হয়ে আপত্তি জানালেন লেভিন, ‘নিজেদের বৈষয়িক অবস্থা উন্নত করতে কৃষকদের কিভাবে সাহায্য করবে স্কুল? আপনি বলছেন স্কুল থেকে, শিক্ষা থেকে চাষীর নতুন চাহিদা জাগবে। সেটা আরো খারাপ, কেননা তা মেটাবার সাধ্য তার থাকবে না। আর যোগ-বিয়োগের জ্ঞান বা তিহোপদেশ কি করে তার বৈষয়িক অবস্থা উন্নত করতে পারে, এটা কখনো আমি বুঝে উঠতে পারিনি। পরশু সন্ধ্যায় ছেলে-কোলে একটা নারীর সাথে দেখা হয় আমার, জিজ্ঞেস করলাম কোথায় সে যাচ্ছে। বলল : ‘গিয়েছিলাম বুড়ির কাছে। ছেলেটার চিল্লানি রোগ ধরেছে, তাই সারাতে নিয়ে যাই।’ জিজ্ঞেস করলাম, বুড়ি এ রোগ সারায় কি করে। ‘বুড়ি ছেলেটাকে বসায় মুরগীর সাথে আর কি-সব মন্ত্র পড়ে।’
‘এই তো আপনি নিজেই বলছেন! চিল্লানি সারাবার জন্যে সে যাতে মুরগীর কাছে ছেলেটাকে নিয়ে না যায়, তার জন্যে দরকার…’ সানন্দে হেসে বললেন সি্ভ্য়াজ্স্কি।
‘আরে না’, সক্ষোভে লেভিন বললেন, ‘এ চিকিৎসা আমার কাছে শুধু স্কুল দিয়ে চাষীদের চিকিৎসা করার মত। কৃষকরা গরিব, অশিক্ষিত, এটা আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি যেমন বুড়িটা দেখছে চিল্লানি রোগ। কিন্তু চিল্লানি থেকে মুরগি তাকে কি সাহায্য করবে এটা যেমন দুর্বোধ্য, তেমনি দারিদ্র্য থেকে কৃষককে কি সাহায্য করবে স্কুল, সেটাও তেমনি দুর্বোধ্য। কেন সে দরিদ্র, সাহায্য করা উচিত সেখানটায়।’
‘এক্ষেত্রে তাহলে আপনি অন্তত স্পেনসারকে সমর্থন করছেন যাকে আপনার ভারি অপছন্দ; উনিও বলেন যে শিক্ষা আসতে পারে প্রচুর সচ্ছলতা, জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য, ঘনঘন গাত্র প্রক্ষালন থেকে, উনি যা বলেন, অংক কষার নৈপুণ্য থেকে নয়…’
‘তা আমি খুব খুশি অথবা উল্টো, বড় অখুশি যে স্পেনসারের সাথে আমার মত মিলছে; তবে এ কথাটা আমি অনেকদিন থেকে জানি যে স্কুলে কোন উপকার করে না, সাহায্য হয় তেমন ব্যবস্থায় যাতে জনগণ হবে সমৃদ্ধ, অবকাশ মিলবে বেশি, তখন স্কুলও হবে।’
‘তাহলেও সারা ইউরোপে স্কুল এখন বাধ্যতামূলক।
‘কিন্তু আপনি নিজে, আপনি এ ব্যাপারে স্পেনসারের সাথে একমত?’ জিজ্ঞেস করলেন লেভিন।
কিন্তু সি্ভ্য়াজ্স্কি চোখে ঝিলিক দিল ভয়, আর হেসে তিনি বললেন : ‘তা ঐ চিল্লানি রোগটা খাশা? আপনি শুনেছেন নাকি?’
লেভিন টের পেলেন যে লোকটার জীবন আর চিন্তার মধ্যে সম্পর্ক কি সেটা তিনি ধরতে পারবেন না কিছুতেই। স্পষ্টতই তাঁর যুক্তিবিস্তারে কি সিদ্ধান্ত দাঁড়ায় তাতে তাঁর কিছু এসে যায় না। ওঁর আগ্রহ শুধু যুক্তিবিস্তারের প্রক্রিয়াটায়। আর সেটা তাঁকে কানাগলিতে ঠেলে দিলে তাঁর খুবই বিছ্ছিরি বোধ হয়। তাঁর ভালো লাগে না শুধু এটাই, প্রীতিকর মজাদার কোন কিছুতে আলাপের মোড় ঘুরিয়ে দিয়ে তিনি পালান।
মাঝপথের কৃষকটি তাঁর মনে যে ছাপ ফেলেছিল, যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল যেন এখনকার সমস্ত অনুভব আর চিন্তার ভিত্তিস্বরূপ তা থেকে শুরু করে এদিনকার সমস্ত অনুভূতি ভয়ানক আলোড়িত করছিল লেভিনকে। অমায়িক এই যে সি্ভ্য়াজ্স্কি, নিজের চিন্তাগুলো যিনি জমিয়ে রাখেন কেবল জনসমাজে ব্যবহারের জন্য, স্পষ্টতই যাঁর আছে জীবনের অন্য কোন কোন ভিত্তি যা লেভিনের কাছে গোপন, অথচ সেই সাথে যিনি চলেন অগণিত জনতার সাথে, জনমত চালিত করেন তাঁর কাছে বিজাতীয় ধ্যান-ধারণা দিয়ে; কোপন এই যে জোতদার, প্রপীড়িত জীবনের যুক্তিগুলো যাঁর খুবই সঠিক, কিন্তু গোটা একটা শ্রেণী, তদুপরি রাশিয়ার সেরা শ্রেণীটির প্রতি বিদ্বেষ পোষণে যা বেঠিক; নিজেরই কার্যকলাপে তাঁর অসন্তোষ আর তা সংশোধন করতে পারার একটা ঝাপসা আশা—এ সবই মিলে গেল ভেতরকার একটা উদ্বেগ আর অচিরেই তার সমাধানের প্রত্যাশায়।
তাঁকে যে ঘরখানা দেওয়া হয়েছিল তাতে লেভিন শুয়ে রইলেন একটা স্প্রিঙের খাটে, লেভিনের হাত-পায়ের নড়নচড়নের তার স্প্রিঙগুলো হঠাৎ হঠাৎ মাথাচাড়া দিচ্ছিল, ঘুম হল না অনেকক্ষণ। বিজ্ঞ অনেক উক্তি থাকলেও সি্ভ্য়াজ্স্কির একটা আলাপেও আগ্রহ ছিল না লেভিনের; কিন্তু জোতদারের যুক্তিগুলো বিবেচনার দাবি রাখে। আপনা থেকেই তাঁর সমস্ত কথা স্মরণ করলেন লেভিন আর তিনি যে জবাব দিয়েছিলেন, কল্পনায় সেটা শুধরে নিলেন।
‘হ্যাঁ, ওঁকে আমার বলা উচিত ছিল : ‘আপনি বলছেন আমাদের চাষ-আবাদ চলছে না। কারণ কৃষকরা কোন উন্নত ব্যবস্থা দু’চক্ষে দেখতে পারে না, সেটা জোর করে চালানো দরকার; কিন্তু এসব উন্নত ব্যবস্থা ছাড়া চাষ-আবাদ যদি আদৌ না চলত, তাহলে আপনার কথা ঠিক হত; কিন্তু তা তো চলছে এবং চলছে সেখানে লোক যেখানে খাটে নিজেদের অভ্যাস অনুসারে, যেমন মাঝপথের ওই বুড়োটার ওখানে। চাষ-আবাদ নিয়ে আপনাদের আর আমাদের অসন্তুষ্টিতে প্রমাণ হয় যে দোষটা হয় আমাদের নয় কৃষি-শ্রমিকদের। শ্রমশক্তির বৈশিষ্ট্যের কথা না ভেবে আমরা অনেকদিন থেকে আমাদের পদ্ধতি, ইউরোপীয় পদ্ধতি চালু, করার জন্যে মাথা ঠুকছি। শ্রমশক্তি যে আদর্শ শক্তি নয়, নিজেদের সহজবোধে চালিত রুশ কৃষক—সেটা মেনে, সেই ভেবে চাষ-আবাদের ব্যবস্থা করা যাক। ধরে নিন’, আমার বলা উচিত ছিল, ‘আপনার চাষ-আবাদ চলছে ওই বুড়োটার মত, কাজের সাফল্যে মুনিষদের আগ্রহী করার উপায় এবং যে উন্নয়নগুলো তারা মেনে নেবে তার একটা মধ্যপন্থা আপনি পেয়ে গেলেন,—তাহলে আপনি মৃত্তিকাকে জীর্ণ না করে আগের তুলনায় ফসল পাবেন দ্বিগুণ, তিনগুণ। ভাগাভাগি করুন, অর্ধেকটা দিন শ্রমশক্তিকে, তাহলেও যে বাদবাকিটা আপনার থেকে যাচ্ছে, সেটা হবে বেশি, শ্রমশক্তিও পাবে বেশি। আর সেটা করতে হলে দরকার চাষ- আবাদের মান মানানো এবং চাষের সাফল্যে মুনিষদের আগ্রহী করে তোলা। কিভাবে তা করতে হবে, সেটা খুঁটিনাটির প্রশ্ন কিন্তু কোন সন্দেহ নেই যে তা করা সম্ভব।’
এই ভাবনায় ভয়ানক উত্তেজিত হয়ে উঠলেন লেভিন, অর্ধেকটা রাত তিনি ঘুমালেন না, ভাবনটা কাজে পরিণত করার খুঁটিনাটি নিয়ে চিন্তা করতে লাগলেন। পরের দিনই চলে যাবার কোন তোড়জোড় তিনি করছিলেন না, কিন্তু এখন ঠিক করলেন ভোর সকালেই বাড়ি ফিরবেন। তাছাড়া শ্যালিকার গাউনে ওই উন্মুক্ত কাটটা তাঁর মনে কুকার্য করার জন্য লজ্জা আর অনুতাপের মত একটা অনুভূতি খোঁচাচ্ছিল। তাঁর কাছে এখন প্রধান কথা গড়িমসি না করে চলে যাওয়া : দরকার কৃষকদের শীতের বপনের আগেই নতুন পরিকল্পনার প্রস্তাব দিতে পারা যাতে বপনটা চলবে নতুন ভিত্তিতে। আগেকার ব্যবস্থা সব ঢেলে সাজবেন বলে স্থির করলেন তিনি।
ঊনত্রিশ
পরিকল্পনা হাসিল করায় লেভিনের অনেক মুশকিল ছিল; কিন্তু যত শক্তি ছিল লড়লেন এবং যা তিনি চাইছিলেন না হলেও, তাঁর যা সাধ্য সেটা তিনি হাসিল করলেন এবং আত্মপ্রতারণা না করে তাঁর বিশ্বাস হল যে এর জন্য খাটার সার্থকতা আছে। প্রধান একটা মুশকিল ছিল এই যে চাষ-আবাদ চালু হয়ে গিয়েছিল, সব কিছু থামিয়ে দিয়ে গোড়া থেকে শুরু করা সম্ভব ছিল না, দরকার চালু অবস্থাতেই যন্ত্রটাকে নতুন করে নেওয়া।
লেভিন যখন বাড়ি ফিরে সেই সন্ধ্যায়ই গোমস্তাকে তাঁর পরিকল্পনার কথা জানালেন, সুস্পষ্ট আনন্দের সাথে সে সায় দিলে সেই অংশটায় যেখানে মানা হয়েছে যে এতদিন পর্যন্ত যা করা হয়েছে সেটা অর্থহীন এবং অলাভজনক। গোমস্তা বলল, সে তো অনেক দিন থেকেই তা বলে আসছে, কিন্তু ওর কথায় কান দেওয়া হয়নি। তবে চাষবাসের সমস্ত উদ্যোগে কৃষকদের মত সে শেয়ার-হোল্ডার হিসেবে অংশ নেবে, লেভিনের এই প্রস্তাবে মুখ তার খুবই ম্লান হয়ে গেল, সুনির্দিষ্ট কোন মত প্রকাশ করলে না সে, শুধু তৎক্ষণাৎ জানাল যে কালই রাইয়ের বাকি গাদিগুলোকে জড়ো করতে হবে আর লোক পাঠাতে হবে, লেভিন টের পেলেন যে সে বলতে চায় এখন ও সব আলোচনার সময় নেই।
একই কথা কৃষকদের কাছেও বলায় এবং নতুন শর্তে জমি বিলির প্রস্তাব দেওয়ায় লেভিন সেই একই প্ৰধান এই মুশকিলের সম্মুখীন হলেন যে দিনের চলতি কাজে তারা এত ব্যস্ত যে নতুন ব্যবস্থার লাভ-লোকসান নিয়ে তাদের ভাবার সময় নেই।
ইভান সাদাসিধে কৃষক, গোয়ালে যে খাটে, সপরিবারে সে গোয়াল থেকে পাওয়া লাভে অংশ নিক, লেভিনের এই প্রস্তাব সে পুরো বুঝল বলে মনে হল এবং পুরোপুরি সায় দিল। কিন্তু লেভিন যখন ভবিষ্যৎ লাভের কথা তাকে বোজাতে গেলেন, ইভানের মুখে ফুটে উঠল শংকা আর এই আফসোস যে সব কথা শেষ পর্যন্ত শুনতে সে পারছে না এবং তাড়াতাড়ি করে কোন একটা কাজ ভেবে নিল যাতে দেরি করা চলে না : আঁকশি নিয়ে বিচালি টেনে স্টল থেকে বের করতে অথবা পানি চালতে, কিংবা সে গোবর পরিষ্কার করতে লেগে গেল।
আরেকটা মুশকিল হল, যতটা পারা যায় শুষে নেওয়ার বাসনা ছাড়া জমিদারের যে অন্য কোন উদ্দেশ্য থাকতে পারে সে সম্পর্কে কৃষকদের ঘোরতর অবিশ্বাস। ওদের দৃঢ় বিশ্বাস যে জমিদার যাই বলুক, তার যা সত্যিকারের উদ্দেশ্য সেটা কখনো বলবে না তাদের। নিজেরাও তারা মতামত দিতে গিয়ে অনেক কিছু বলল, কিন্তু কদাচ বলল না তাদেরই-বা সত্যকার উদ্দেশ্য কি। তা ছাড়া (লেভিন টের পেলেন যে তিরিক্ষি জোতদারটি ঠিকই বলেছিলেন), চুক্তি যাই হোক তার প্রথম এবং অপরিবর্তনীয় শর্ত তারা এই রাখল যে চাষ-আবাদের কোন একটা নতুন পদ্ধতি ও নতুন হাতিয়ার ব্যহারে তাদের বাধ্য করা চলবে না। তারা মানল যে কলের লাঙল ভালো চষে, স্ক্যরিফায়ার কাজ দেয় মন্দ নয়, কিন্তু হাজারটা কারণ তারা দেখাল কেন ও-দুটোর কোনটাই ব্যবহার করা চলে না আর জমির মান নামানো দরকার বলে লেভিন নিঃসন্দেহ থাকলেও উন্নত ব্যবস্থা যার উপকারিতা সুস্পষ্ট তা ছেড়ে দিতে কষ্ট হল তাঁর। কিন্তু এ সব মুশকিল সত্ত্বেও তিনি তাঁর নিজের কথাটাই বহাল করলেন এবং শরৎ নাগাদ ব্যাপারটা এগোতে থাকল কিংবা তাঁর তাই অন্তত মনে হয়েছিল।
লেভিন প্রথমে ভেবেছিলেন গোটা খামার যেমন আছে তেমনি রেখে নতুন বারোয়ারি, শর্তে তা তুলে দেবেন কৃষকদের, কৃষি-শ্রমিকদের আর গোমস্তার হাতে, কিন্তু অতি সত্বর নিঃসন্দেহ হলেন যে সেটা সম্ভব নয়, তাই ঠিক করলেন ওটাকে ভাগ ভাগ করতে হবে। গোশালা, বাগান, সবজি ভুঁই, বিচালি মাঠ, কয়েকটা উপরিভাগে বিভক্ত খেত হবে পৃথক পৃথক জোত। সাদাসিধে যে ইভান ব্যাপারটা সবার চেয়ে ভালো বুঝেছে বলে লেভিনের মনে হয়েছিল, সে প্রধানত নিজের পরিবার থেকে লোক জুটিয়ে গোশালার ভার নিলে। দূরের যে খেতটা আট বছর পতিত পড়ে ছিল, চালাক-চতুর ছুতোর ফিওদোর রেজুনভের সাহায্যে নতুন সামাজিক ভিত্তিতে সেটা নিলে ছয়টি কৃষক পরিবার আর একই শর্তে গোটা সবজি জমিটা পত্তনি নিল কৃষক গুরায়েভ। বাকিটা আগের মতই রইল, কিন্তু এই তিনটা ইউনিট হল নতুন ব্যবস্থার সূত্রপাত এবং পুরোপুরি তা ব্যস্ত রাখল লেভিনকে।
গোশালার ব্যাপারটা এখনো পর্যন্ত আগের চেয়ে ভালো চলছে না—একথা সত্যি এবং গরম গোয়াল আর ক্রীম থেকে মাখন বানানোয় ইভান তীব্র আপত্তি জানায় এই বলে যে, ঠাণ্ডায় গরুদের খাবার লাগে কম আর টক ক্রীমে মাখন ওঠে তাড়াতাড়ি। আগের মত বেতন দাবি করল সে এবং যে টাকাটা সে পেল সেটা যে বেতন নয়, লাভে তার ভাগের আগাম, তাতে বিন্দুমাত্র গা করল না।
এ কথা সত্যি যে, শতমত ফিওদোর রেজুনভের দল চাষের জমি কলের লাঙল দিয়ে দু’বার চষেনি এবং কৈফিয়ত দিলে হাতে সময় কম। এ কথা সত্যি যে এই দলের কৃষকরা নতুন ভিত্তিতে চাষ চালাবার শর্ত নিলেও জমিটাকে বারোয়ারি নয়, বলত পত্তনি এবং শুধু কৃষকরা নয় নিজে রেজুনভও একাধিকার লেভিনকে বলেছে, ‘জমির জন্যে খাজনা নিলে পারেন, তাতে আপনিও নিশ্চিন্ত, আমরাও ছাড়া পাই।’ তাছাড়া শর্ত ছিল, এ জমিতে ওরা গোয়াল আর মাড়াই জমি বানাবে, সেটা ওরা পিছিয়ে দিচ্ছিল, টেনে নিয়ে গেল শীত পর্যন্ত 1
একথা সত্যি যে, শুরায়েভ যে সবজি জমি পত্তনি নিয়েছিল সেটা সে ছোট ছোট খণ্ডে কৃষকদের বিলি করতে চাইছিল। স্পষ্টতই যে শর্তে ওকে জমি দেওয়া হয়েছিল সেটা সে ভুল বুঝেছে এবং মনে হল ভুল বুঝছে ইচ্ছে করেই।
একথা সত্যি যে, চাষীদের সাথে কথা বলার সময় এবং উদ্যোগটায় কি লাভ সেটা তাদের বোঝাতে গিয়ে লেভিন প্রায়ই অনুভব করেছেন তারা শুনছে কেবল তাঁর গলার স্বর আর দৃঢ়ভাবে তারা জেনে রেখেছে যাই উনি বলুন, নিজেদের প্রতারিত হতে তারা দেবে না। বিশেষ তীব্রভাবে এটা তিনি অনুভব করেছেন কৃষকদের মধ্যে সবচেয়ে চতুর রেজুনভের সাথে কথা বলার সময় আর লক্ষ্য করেছেন চোখে তার এমন একটা নাচন যাতে পরিষ্কার প্রকাশ পায় লেভিনের প্রতি উপহাস আর এই দৃঢ় নিশ্চয়তা যে কেউ যদি প্রতারিত হতে চায় হোক, সে, কখনোই রেজুনভ নয়। কিন্তু এসব সত্ত্বেও লেভিন মনে করলেন যে ব্যাপারটা চালু হয়েছে, কড়া হিসেবে রেখে এবং নিজের মতে জিদ ধরে থেকে তিনি ভবিষ্যতে ওদের কাছে প্রমাণ করে দেবেন, এ ব্যবস্থাটায় কি লাভ আর তখন আপনা থেকেই চলতে থাকবে ব্যবস্থাটা।
এসব ব্যাপার, সেই সাথে তাঁর হাতে থেকে যাওয়া খামার আর ঘরে বসে বইটা লেখার কাজে সারা গ্রীষ্ম লেভিন এতে ব্যস্ত রইলেন যে শিকারও প্রায় যেতেনই না। জিনটা ফেরত দিতে এসেছিল যে লোকটা তার কাছ থেকে তিনি জানতে পেলেন যে, অলোনস্কিরা মস্কো চলে গেছেন। তিনি টের পেলেন যে দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনার চিঠির জবাব না দিয়ে, নিজের যে মূর্খতার কথা ভাবতে গিয়ে লজ্জায় রাঙা না হয়ে উঠে তিনি পারতেন না, তাতে তিনি নিজের জাহাজটাই পুড়িয়েছেন, কখনো আর ওঁদের কাছে যাবেন না। বিদায় না নিয়েই চলে এসে তিনি একই ব্যবহার করেছেন সি্ভ্য়াজ্স্কির সাথে। ওঁদের কাছেও তিনি আর যাবেন না কখনো। এখন এতে তাঁর এমন কিছু এসে যায় না। তাঁর বিষয়-আশয়ের নতুন ব্যবস্থার ব্যাপারটায় তিনি এত ব্যস্ত রইলেন যা আর কখনো হয়নি। সি্ভ্য়াজ্স্কি তাঁকেযে বইগুলো দিয়েছিলেন তা তিনি আবার পড়লেন, যেসব বই তাঁর ছিল না তার বায়না দিলেন, এই বিষয়টা নিয়ে অর্থনৈতিক ও সমাজতান্ত্রিক পুস্তক যা ছিল আবার পড়লেন এবং যা আশা করেছিলেন, তিনি যে কাজটা শুরু করেছেন তার সাথে সম্পর্ক আছে এমন কিছুই পেলেন না। অর্থনৈতিক পুস্তকগুলোতে, দৃষ্টান্তস্বরূপ, মিল্’তে, যা তিনি প্রথম পড়লেন অতি উত্তেজনায় এই আশা করে যে, যে-কোন মুহূর্তে তিনি তাঁর সমস্যাগুলোর সমাধান পেয়ে যাবেন, পেলেন তিনি ইউরোপীয় অর্থনীতির পরিস্থিতি থেকে আহৃত নিয়ম; কিন্তু তিনি কিছুতেই বুঝতে পারলেন না কেন রাশিয়ার অপ্রযোজ্য এই নিয়মগুলোকে হতে হবে সাধারণ নিয়ম। একই জিনিস তিনি দেখলেন সমাজতান্ত্রিক পুস্তকগুলোতে : হয় এগুলো অপরূপ কিন্তু অপ্রয়োজ্য উৎকল্পনা যা নিয়ে তিনি মেতেছিলেন ছাত্রজীবনেই, অথবা ইউরোপে যে অবস্থা বিদ্যমান, রাশিয়ার কৃষিকর্মের সাথে যার মিল নেই তার সংশোধন, মেরামতি। অর্থশাস্ত্র বলছে, ইউরোপের সম্পদ বৃদ্ধি পেয়েছে ও পাচ্ছে যেসব নিয়ম অনুসারে তা সার্বজনীন ও সন্দেহাতীত। সমাজতন্ত্র বলছে এসব নিয়মে বিকাশ পরিণত হচ্ছে ধ্বংসে। এর কোনটাই শুধু জবাবই নয়, সামান্য ইঙ্গিত দিল না কোটি কোটি হাত আর দেসিয়াতিনা জমি নিয়ে কি করতে হবে তাঁকে, লেভিনকে এবং সমস্ত রুশী চাষী আর ভূস্বামীদের যাতে সাধারণ কল্যাণের জন্য তা হয় সর্বাধিক উৎপাদনশীল।
ব্যাপারটা একবার হাতেই নেওয়া হয়েছে বলে তার বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক সব কিছু লেভিন পড়লেন পুঙ্খানুপুঙ্খ করে এবং স্থির করলেন শরৎকালে বিদেশে যারে অকুস্থলে ব্যাপারটা অনুধাবন করতে যাতে বিভিন্ন প্রশ্নে তাঁর যা প্রায়ই ঘটোছ এই প্রশ্নটায় তা যেন আর না হয়। সহালাপীর কথাটা সবে বুঝতে শুরু করেছেন আর নিজেরটা বলবেন, হঠাৎ শুনলেন কিনা : ‘আর কাউফমান, জোন্স, দ্যুয়া, আর মিচেলি? আপনি ওঁদের পড়েননি। পড় ন; এই প্রশ্নটারই বিচার করেছেন ওঁরা।’
এখন উনি পরিষ্কার দেখতে পেলেন যে, তাঁকে কিছু বলার নেই কাউফমান আর মিচেলির দেখতে জানেন কি তিনি চান। রাশিয়ার আছে চমৎকার জমি, চমৎকার কৃষি-শ্রমিক, কোন কোন ক্ষেত্রে মাঝপথের ওই চাষীটির মত কৃষি – শ্রমিক আর জমি উৎপাদন করে প্রচুর, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যখন পুঁজি লগ্নি করা হয় ইউরোপীয় ধরনে, তখন ফলন হয় কম আর এটা ঘটছে শুধু এই কারণে যে কৃষি-শ্রমিকেরা খাটতে চায় এবং ভালো খাটে কেবল, তাদের স্বকীয় ধরনে, তাদের বিরোধিতাটা আপতিক নয়, নিত্যকার, জনগণের ধাতটাই তার ভিত্তি। তিনি ভাবছিলেন, বিশাল অকর্ষিত ভূমিতে বাস পাতা ও তা হাসিল করা যে রুশ জনগণের নির্বন্ধ তারা যতদিন না তা হাসিল হচ্ছে ততদিন সে জন্য প্রয়োজনীয় এসব পদ্ধতি আঁকড়ে আছে আর সে পদ্ধতিগুলো সাধারণত যা ভাবা হয় তেমন খারাপ কিছু নয়। তিনি চাইছিলেন তত্ত্বগতভাবে বইয়ে আর ব্যবহারিকভাবে তাঁর খামারে সেটা প্রমাণ করবেন তিনি।