বিশ
ভ্রন্স্কি জীবনে বিশেষ সৌভাগ্যবান এই দিক থেকে যে কি তিনি করবেন, কি করবেন না, তা সুনিশ্চিতরূপে স্থির করে দেবার মত একগোছা নিয়ম ছিল তাঁর। নিয়মগুলো খুবই ছোট্ট একটা এলাকা নিয়ে, তবে সেগুলো সুনিশ্চিত, আর এই এলাকার বাইরে কখনো না গিয়ে, যা উচিত তা পালনে মুহূর্তের জন্য ভ্রন্স্কি দ্বিধা করতেন না। এই নিয়মগুলো নিশ্চিতরূপে স্থির করে দিয়েছিল যে-জুয়ার ঠগের টাকাটা মিটিয়ে দেওয়া দরকার, কিন্তু দর্জির নয়; পুরুষদেরকে মিথ্যা কথা বলা চলবে না, কিন্তু নারীদের চলবে, কাউকে প্রতারণা করা উচিত নয়, কিন্তু স্বামীকে করা যাবে, অপমান ক্ষমা করা অনুচিত, কিন্তু অন্যকে অপমান করা যাবে ইত্যাদি। হতে পারে এ সব নিয়ম অবিবেচনাপ্রসূত, অন্যায়, কিন্তু সুবিশ্চিত, আর নিয়মগুলো পালন করে ভ্রন্স্কি অনুভব করতেন যে তিনি স্বস্তিতে আছেন, মাথা উঁচু করে চলতে পারেন। কিন্তু ইদানীং আন্নার সাথে তাঁর সম্পর্কে উপলক্ষে ভ্রন্স্কি টের পেতে শুরু করেছেন যে তাঁর নিয়মগুচ্ছ সমস্ত পরিস্থিতি পুরোপুরি স্থির করে দেয় নি এবং ভবিষ্যতে তা মুশকিল ও সন্দেহ ঘটাবে, আর তখন কিভাবে চলতে হবে তার সূত্র তিনি পাচ্ছিলেন না।
আন্না এবং তাঁর স্বামীর সাথে তাঁর বর্তমান সম্পর্ক তাঁর কাছে ছিল সুস্পষ্ট এবং সোজা। যে নিয়মগুলোতে তিনি পরিচালিত তার সাথে তা কাঁটায় কাঁটায় মেলে।
আন্না সুচরিতা নারী, তাঁকে দিয়েছেন তাঁর ভালোবাসা, তিনিও তাঁকে ভালোবাসেন, তাই তাঁর কাছে আন্না এমন এক নারী যিনি বৈধ স্ত্রীর চেয়েও সম্মানীয়। বাক্যের বা ইঙ্গিতে তাঁকে শুধু অপমানিত করা নয়, নারীর কাম্য যে মর্যাদা তা না দেওয়ার চেয়ে তিনি বরং তাঁর হাতখানা কেটে ফেলতেই রাজী।
সমাজের সাথে তাঁর সম্পর্কটাও ছিল স্পষ্ট। সবাই জানতে পারে, সন্দেহ করতে পারে, কিন্তু সে কথা কারো বলা চলবে না। অন্যথায় যে বলবে তাকে তিনি চুপ করিয়ে দিতে এবং যে নারীকে ভালোবাসেন তাঁর অবিদ্যমান মর্যাদাকে মান্য করাতে তিনি প্রস্তুত।
আন্নার স্বামীর প্রতি মনোভাবটা ছিল সর্বাধিক পরিষ্কার। ভ্রন্স্কিকে আন্না যখন ভালোবেসেছেন, তখন থেকেই তিনি ধরে নিয়েছেন তাঁর ওপর নিজের একাধিকার। স্বামী শুধু অবাস্তর একটা বিঘ্ন। সন্দেহ নেই যে তাঁর অবস্থাটা করুণ, কিন্তু কি করা যাবে? স্বামীর আছে শুধু একটা অধিকার, অস্ত্র হাতে শোধ-বোধ দাবি করা, ভ্রন্স্কি তার জন্য প্রথম থেকেই প্রস্তুত।
কিন্তু ইদানীং একটা নতুন আভ্যন্তরীণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে আন্না এবং তাঁর মধ্যে, যা তার অনিশ্চয়তার ত্রস্ত করছে ভ্রন্স্কিকে। কাল আন্না জানিয়েছেন যে তিনি গর্ভবতী। তিনি অনুভব করেছিলেন যে এই সংবাদটা এবং তাঁর কাছ থেকে আন্না যা আশা করছেন তার দাবি তিনি যে নিয়মগুলোর দ্বারা চালিত তার সাথে পুরো খাপ খাচ্ছে না। এবং সত্যিই আন্না যখন নিজের অবস্থার কথা বলেন তখন প্রথম মুহূর্তে তিনি হতচকিত হয়ে পড়েছিলেন, তাঁর হৃদয় যা চেয়েছিল, তাই তিনি দাবি করেছিলেন—স্বামীকে ত্যাগ করা উচিত। সে কথা তিনি বলেওছিলেন। কিন্তু এখন ব্যাপারটা ভেবে দেখে তিনি পরিষ্কার বুঝলেন যে ওটা এড়িয়ে যাওয়াই ভালো, কিন্তু নিজেকে সেটা বুঝিয়ে ও তাঁর আশংকা হল, এটা কি খারাপ হবে না?
‘স্বামীকে ত্যাগ করার কথা যদি বলে থাকি, তার মানে আমার সাথে থাকে। তার জানো আমি কি কি তৈরি? এখন আমার যখন টাকা নেই তখন কি করে নিয়ে আসি ওকে? ধরা যাক, সে ব্যবস্থা করা গেল… কিন্তু কি করে ওকে নিয়ে যখন আমি আছি চাকরিতে? যখন বলেছি, তখন তৈরি হতে হবে এর জন্যে, অর্থাৎ টাকা জোগাড় করে ইস্তফা দিতে হবে কাজে।’
চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেলেন তিনি। কাজে ইস্তফা দেওয়া কি না দেওয়ার প্রশ্নের তাঁর মনে উদিত হল অন্য একটা গোপন কথা যা শুধু তাঁরই জানা, যেটা তাঁর গোটা জীবনের প্রায় প্রধান স্বার্থ।
আত্মশ্লাঘা তাঁর শৈশব ও তারুণ্যের পুরানো স্বপ্ন। এ বিষয়ে তিনি সজ্ঞান না থাকলেও সেটা ছিল এতই প্রবল যে এই কামনার সাথে এখন বিবাদ বাঁধল ভালোবাসার। সমাজে এবং চাকরিতে প্রথমদিকটায় তাঁর ভালোই চলেছিল, কিন্তু দু’বছর আগে একট বেমক্কা ভুল করেন তিনি। তাঁর যে পদোন্নতির প্রস্তাব এসেছিল, সেটা তিনি নিজের স্বাধীনচিত্ততা হাজির করার বাসনায় প্রত্যাখ্যান করেন, ভেবেছিলেন এতে তাঁর মূল্য বাড়বে; কিন্তু দেখা ওটা বড়ই স্পর্ধিত একটা আশা, তাঁকে ফেলে রাখা হল। আর চান বা না চান নিজেকে স্বাধীনতা মানুষের পর্যায়ে ফেলে তিনি এটা সহ্য করে নেন এবং বেশ সূক্ষ্ম বুদ্ধিমানের মত ব্যবহার করে যান, যেন কারো ওপর তাঁর রাগ নেই, নিজেকে ক্ষুব্ধ বোধ করছেন না, তিনি, শুধু চান শান্তিতে থাকতে, কারণ বেশ ফুর্তিতেই তিনি আছেন। আসলে গত বছর যখন তিনি মস্কোর আসেন, ফুর্তি তাঁর মাটি হয়ে গিয়েছিল। তিনি অনুভব করছিলেন যে লোকটা সবাই করতে পারে কিছু কিছুই করতে চায় না, এমন একটা অভিমত লোকের মনে দানা বাঁধতে শুরু করেছে এবং অনেকেই ভাবছে যে সং আর সহৃদয় ছোকরা হওয়া ছাড়া কিছুই তিনি করতে পারেননি। কারেনিনার সাথে প্রেমঘটিত ব্যাপারে যে কোলাহল উঠেছিল, মনোযোগ আকৃষ্ট হয়েছিল তাঁর দিকে, তাতে একটা নতুন চমক দিতে পেরেছিলেন তিনি, তাঁর ক্ষীয়মাণ আত্মভিমান তাতে আপাতত শান্ত হয়েছিল, কিন্তু সপ্তাহ কানেক আগে তার কামড় নবশক্তিতে জানান দেয়। তাঁর ব্যাল্যকালের সাথে, একই মহল, একই সমাজের লোক, কোর-এ সহকর্মী একই সময়ে উত্তীর্ণ সেপুকোভস্কয়, যাঁর সাথে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল ক্লাসে, ব্যায়াম-ক্রীড়ায়, দুষ্টুমিতে, বড় হবার স্বপ্নে, তিনি ফিরেছেন মধ্য এশিয়া থেকে, দু’ধাপ উঁচিয়ে তাঁকে যে পদ দেওয়া হয়েছে সেটা অত অল্পবয়স্ক জেনারেলের পক্ষে বিরল।
পিটার্সবুর্গে আসতেই তাঁর সম্পর্কে লোকে বলতে লাগল যে এবার প্রথম শ্রেণীর একটা তারকার উদয় হয়েছে। ভ্রন্স্কির সমবয়সী ও সতীর্থ ইতিমধ্যেই জেনারেল, এমন একটা পদ তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে যাতে রাষ্ট্রের ভাগ্যচক্র নির্ধারিত হতে পারে আর ভ্রন্স্কি স্বাধীনচেতা, উজ্জ্বল, রমণীয় মরণীর দয়িত হলেও মাত্র একজন ঘোড়সওয়ার ক্যাপটেন, যে স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে যতখুশি। ‘বলাই বাহুল্য আমি সেপুখোভস্কয়কে ঈর্ষা না, করতে পারিও না, কিন্তু তার পদোন্নতিতে আমি দেখতে পাচ্ছি যে আমার মত লোকের পক্ষে কিছু সবুর করা দরকার, উন্নতি হবে শিগগিরই। তিন বছর আগে সে-ও তো ছিল আমারই অবস্থায়। ইস্তফা দিলে আমি নিজের পথেই কাঁটা দেব। চাকরিতে থাকলে আমার লোকসান নেই কিছুই। আন্না তো নিজেই বলেছে সে তার অবস্থার কোন অদলবদল চায় না। তার ভালোবাসা যখন আছে, সেপুখোভস্কয়কে তখন আমার হিংসে হতে পারে না।’ ধীরে ধীরে মোচে পাক দিয়ে তিনি উঠে পায়চারি করতে লাগলেন ঘরে। চোখ তাঁর খুবই জ্বলজ্বল করছিল, নিজের অবস্থাটা পরিষ্কার করে নেবার পর বরাবরের মত প্রাণ তাঁর শান্ত, নিশ্চিত, সানন্দ হল। হিসাব-নিকাশ করে সব কিছুই হয়ে উঠল পরিষ্কার, সুস্পষ্ট। দাড়ি কামিয়ে, ঠাণ্ডা পানিতে গোসল সেরে বেরিয়ে গেলেন তিনি।
একুশ
‘আমি তোর কাছেই আসছিলাম। তোর ধোয়া-ধুয়ি আজ চলেছে অনেকক্ষণ’, বললেন পেত্রিৎস্কি, ‘শেষ হয়েছে তো?’
‘হয়েছে’, শুধু চোখের হাসি হেসে বললেন ভ্রন্স্কি, মোচের ডগায় পাক দিলেন এমন সন্তপর্ণে যেন নিজের অবস্থাটায় যে শৃঙ্খলা তিনি নিয়ে এসেছেন যে কোন দ্রুত বা বড় বেশি দুঃসাহসী গতিবেগে তা ধ্বসে পড়তে পারে।
‘তোকে সব সময়ই দেখায় যেন এইমাত্র গোসল সেরে এলি’, পেত্রিৎস্কি বললেন, ‘আমি আসছি গ্রিস্কোর কাছ থেকে’ (রেজিমেন্ট কমান্ডারকে তাঁরা ঐ নামে ডাকতেন), ‘তোর অপেক্ষায় আছে সবাই।
কোন জবাব না দিয়ে ভ্রন্স্কি বন্ধুর দিকে তাকালেন এবং ভাবতে লাগলেন অন্য কথা।
পোল্কা আর ওয়াল্জ নাচের পরিচিত ব্রাশ ব্যান্ডের ধ্বনিতে কান পেতে ভ্রন্স্কি বললেন, ‘ওর ওখানে বাজনা? উৎসবটা কিসের?’
‘সের্পুখোভস্কয় এসেছে।’
‘ও’, ভ্রন্স্কি বললেন, ‘আমি জানতাম না।’
চোখের হাসিটা তাঁর আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
তিনি যে তাঁর প্রেমে সুখী, নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষা বিসর্জন দিয়েছেন তাঁর জন্য, নিদেনপক্ষে সেই ভূমিকাটা নিয়েছেন, নিজের কাছে এটা একবার স্থির করে নেবার পর ভ্রন্স্কি সেপুখোভস্কয়-এর প্রতি ঈর্ষা অথবা রেজেমেন্টে তাঁর সাথে প্রথম দেখা করলেন না বলে দুঃখ-কিছুই বোধ করলেন না। সের্পূখোভস্কর তাঁর ভালো বন্ধু, এসেছেন বলে খুশি।
‘খুব আনন্দ হল।’
রেজিমেন্ট কমান্ডার দেমিন একটা বড় জমিদার বাড়িতে উঠেছিলেন। গোটা দলটা জুটেছে নিচের প্রশস্ত ব্যালকনিতে। আঙিনায় প্রথম যেটা ভ্রন্স্কির নজরে পড়ল সেটা এক ব্যারেল ভোদ্কার কাছে দণ্ডায়মান উর্দি-পরিহিত গায়কবৃন্দ আর অফিসার পরিবেষ্টিত রেজিমেন্ট কমান্ডারের হৃষ্টপুষ্ট হাসি-খুশি মূর্তি। ব্যালকনির প্রথম ধাপে এসে তিনি অফেনবাখ কাড্রিলের সঙ্গীত ছাপিয়ে চিৎকার করে কি যেন হুকুম করলেন আর দূরে দাঁড়ানো সৈনিকদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়লেন। ভ্রন্স্কির সাথে একদল সৈন্য, কোয়ার্টার-মাস্টার আর কিছু সাব-অলটার্ন এল ব্যালকনির কাছে। টেবিলের কাছে গিয়ে রেজিমেন্ট আর কিছু সাব-অলটার্ন এল ব্যালকনির কাছে। টেবিলের কাছে গিয়ে রেজিমেন্ট কমান্ডার হাতে পানপাত্র নিয়ে আবার বেরিয়ে এলেন অলিন্দে এবং টোস্ট প্রস্তাব করলেন : ‘আমাদের ভূতপূর্ব সঙ্গী এবং নির্ভীক জেনারেল প্রিন্স সেপুখোভস্কয়-এর স্বাস্থ্যের জন্যে। হুররে!’
রেজিমেন্ট কমান্ডারের পেছনে পেছনে পানপাত্র হাতে হাসিমুখে বেরিয়ে এলেন সেপুখোভস্কয়ও।
‘বয়স তোর কেবলি যে কমছে বন্দারেঙ্কো’, ঠিক তাঁর সামনে দাঁড়ানো, ফৌজে দ্বিতীয় টার্মে ওঠা, রক্তিমগণ্ড ছোকরাগোছের কোয়ার্টার-মাস্টারকে বললেন তিনি।
তিন বছর সেপুখোভস্কয়কে দেখেননি ভ্রন্স্কি। গাঁট্টাগোট্টা হয়েছেন তিনি, গালপাট্টা রেখেছেন, কিন্তু আছেন একইরকম মুঠাম, সেটা বিস্মিত করে রূপে ততটা নয়, যতটা মুখখানার কোমলতা আর মহিমায় এবং দেহের গঠনে শুধু একটা যে পরিবর্তন ভ্রন্স্কির চোখে পড়ল সেটা তাঁর অবিরাম মৃদু একটা জ্বলজ্বলে ভাব যা ফুটে ওঠে তেমন লোকদের মুখে যারা সাফল্য লাভ করেছে এবং সকলের কাছ থেকে সে সাফল্যের স্বীকৃতিতে নিশ্চিত। এ দীপ্তি ভ্রন্স্কির জানা এবং তৎক্ষণাৎ সেটা তিনি লক্ষ্য করলেন সেপুখোভস্কয়-এর মধ্যে।
সিঁড়ি থেকে নামতেই তিনি দেখতে পেলেন ভ্রন্স্কিকে। আনন্দের হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল সেপুখোভস্কয়-এর মুখ। ভ্রন্স্কিকে অভিনন্দন জানবার ভঙ্গিতে তিনি পানপাত্র তুলে পেছন দিকে মাথা হেলালেন এবং এই ভঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলেন যে আগে কোয়ার্টার-মাস্টারের কাছে না গিয়ে পারেন না। ইতিমধ্যেই চুম্বনের জন্য ঠোঁট তৈরি রেখে সে দাঁড়িয়ে ছিল টানটান হয়ে।
‘এই যে উনি!’ চেঁচিয়ে উঠলেন রেজিমেন্ট কমান্ডার, ‘অথচ ইয়াভিন আমাকে বলেছিল যে তোর মন ভালো নেই।
সেপুখোভস্কয় কোয়ার্টার-মাস্টারের সিক্ত তাজা ঠোঁটে চুম্বন করে রুমালে মুখে মুছে এলেন ভ্রন্স্কির কাছে। করদমন করে তাঁকে পাশে সরিয়ে এনে বললেন, ‘কি যে আনন্দ হচ্ছে!’
ভ্রন্স্কিকে দেখিয়ে রেজিমেন্ট কমান্ডার চেঁচিয়ে বললেন ইয়াভিনকে, ওঁর দেখাশোনা করুন!’ নিজে নেমে গেলেন সৈনিকদের কাছে।
‘কাল ঘোড়দৌড়ে এলি না যে? ভেবেছিলাম সেখানে তোর দেখা পাব’, সেপুখোভস্কয়-এর দিকে তাকিয়ে ভ্রন্স্কি বললেন।
‘এসেছিলাম, তবে পরে। ঘাট মানছি’, এই বলে উনি ফিরলেন অ্যাডজুট্যান্টের দিকে, ‘মাথা-পিছু যা দাঁড়া, অনুগ্রহ করে আমার হয়ে তা সবার মধ্যে বিলি করতে বলুন কাউকে।’
তাড়াতাড়ি করে মানিব্যাগ থেকে একশ’ রুলের তিনটা নোট বের করে তিনি লাল হয়ে উঠলেন
‘ভ্রন্স্কি কিছু খাবি নাকি পান করবি?’ ইয়াভিন জিজ্ঞেস করলেন। ‘এই, কাউন্টকে খাবার দাও! আর ধর, এটা পান কর।’
রেজিমেন্ট কমান্ডারের ওখানে ফুর্তি চলল অনেক সময়।
মদ্যপান হল প্রচুর। সেপুখোভস্কয়কে নিয়ে ছোঁড়াছুঁড়ি করল লোকে। তারপর রেজিমেন্ট কমান্ডারকে। অতঃপর পেত্রিৎস্কির সাথে স্বয়ং রেজিমেন্ট কমান্ডারের ধেই-ধেই নৃত্য। অবশেষে খানিকটা ক্লান্ত হয়ে রেজিমেন্ট কমান্ডার আঙিনার বেঞ্চিতে বসে ইয়াভিনকে বোঝাতে লাগলেন প্রাশিয়ার চেয়ে রাশিয়ার শ্রেষ্ঠর কতটা, বিশেষ করে ঘোড়সওয়ার আক্রমণে, ফুর্তিও কিছুক্ষণের জন্য থিতিয়ে এল। সেপুখোভস্কয় গেলেন বাড়ির ভেতরে প্রক্ষালণকক্ষে হাত ধোবার জন্য। সেখানে পেলেন ভ্রন্স্কিকে : ভ্রন্স্কি হাত-মুখ ধুচ্ছিলেন। উর্দি খুলে রেখে তিনি তাঁর লোমে ভরা লাল ঘাড় পেতে রেখেছেন পানির ধারার নিচে এবং হাত দিয়ে ঘাড় আর মাথা রগড়াচ্ছেন। প্রক্ষালণ শেষ করে ভ্রন্স্কি বসলেন সেপুখোভস্কয়-এর কাছে। দুজনেই তাঁরা ওখানেই সোফায় বসে যে কথাবার্তা শুরু করলেন তাতে উভয়েরই আগ্রহ ছিল।
সেপুখোভস্কয় বললেন,’বৌয়ের কাছ থেকে তোর কথা সবই শুনেছি। তুই ওর সাথে প্রায়ই দেখা করিস বলে আমি খুশি।’
‘ওঁর সাথে ভারিয়ার বন্ধুত্ব আছে। পিটার্সবুর্গে ওঁরা দুজন একমাত্র নারী যাঁদের দেখে আমার আনন্দ হয়’ হেসে জবাব দিলেন ভ্রন্স্কি। হাসলেন কারণ কথাবার্তাটা কোন প্রসঙ্গে যাবে সেটা তিনি আন্দাজ করেছিলেন এবং সেটা তাঁর ভালোই লাগল।
‘একমাত্র?’ হেসে জিজ্ঞেস করলেন সেপুখোভস্কয়।
‘হ্যাঁ, আর তোর কথাও আমি শুনেছি তবে শুধু তোর বৌয়ের কাছ থেকে নয়; মুখের কড়া একটা ভাবে ইঙ্গিতটা বন্ধ করে দিয়ে বললেন ভ্রন্স্কি, ‘তোর সাফল্যে আমি খুবই খুশি, কিন্তু মোটেই অবাক হইনি। আশা করেছিলাম আরো বেশি।’
সের্পুখোভস্কয় হাসলেন। তাঁর সম্পর্কে এই মতটা যে তাঁর ভালো লেগেছিল, সেটা স্পষ্টই বোঝা যায়, লুকোবার প্রয়োজন তিনি বোধ করলেন না।
এটা
‘খোলাখুলি স্বীকার করছি, আমি কিন্তু এর চেয়ে কমই আশা করেছিলাম। তবে খুশি। আমি উচ্চাভিলাষী, স্বীকার করছি সেটা আমার দুর্বলতা।’
‘সাফল্যলাভ না করলে সম্ভবত তুই এটা স্বীকার করতিস না’, ভ্রন্স্কি বললেন।
‘তাহলেও করতাম বলে আমার ধারণা’, আবার হেসে বললেন সের্পুখোভস্কয়, ‘এ কথা বলব না যে এ ছাড়া জীবনধারণের মানে হয় না, তবে একঘেয়ে লাগত। হয়ত আমার ভুল হচ্ছে, কিন্তু যে কর্মক্ষেত্রটা আমি বেছে নিয়েছি তার উপযোগী কিছু গুণ, আমার আছে বলে আমার ধারণা, এবং আমার হাতে যদি আসে, তবে যে কর্তৃত্বই আসুক, সেটা পালিত হবে আমার পরিচিত অনেকের চেয়ে ভালোভাবে’, সাফল্যে জ্বলজ্বলে হয়ে বললেন সের্পূখোভস্কয়। ‘তাই সাফল্যের মত কাছাকাছি আসি, ততই আনন্দ হয় আমার।’
‘হয়ত ব্যাপারটা তোর ক্ষেত্রে তাই-ই, তবে সকলের ক্ষেত্রে নয়। আমিও তাই ভাবতাম, কিন্তু এখন দিন কাটাচ্ছি আর দেখতে পাচ্ছি যে শুধু এর জন্যেই বেঁচে থাকার মানে হয় না’, ক্রস্কি বললেন।
এই কথাটাই শুনতে চাইছিলাম রে, এই কথাটাই!’ হেসে বললেন সের্পূখোভস্কয়, ‘আমি তো এই বলেই শুরু করেছিলাম, যে আমি যে তোর সম্পর্কে শুনেছি, তুই যে পদোন্নতি প্রত্যাখ্যান করেছিস, সে কথাটাও…বলাই বাহুল্য আমার অনুমোদন ছিল তাতে। তবে সব কিছুরই একটা ধরন আছে। আমি মনে করি কাজটা ঠিকই হয়েছে, তবে যেভাবে করা উচিত ছিল সেভাবে করিসনি।’
‘যা করেছি, করেছি। তুই তো জানিস, যা করলাম তা থেকে আমি পালাই না। পরে কসম লাগে আমার।’
‘কসম লাগাটা শুধু সাময়িক। তাতে করে তুই পরিতৃপ্ত হবি না। তোর বড় ভাইকে এ কথা বলতে যাব না আমি। উনি মিষ্টি মানুষ, আমাদের এই গৃহস্বামীটির মত। ঐ যে তিনি!’
‘হুররে’ চিৎকার শুনে যোগ করলেন তিনি, ‘উনি খুশিই, কিন্তু তুই তো এতে পরিতৃপ্ত হবি না।’
‘আমি তো বলছি না যে পরিবৃত্তি পেয়েছি।
‘এই গেল এক কথা। তাছাড়া তোর মত লোকের দরকার আছে।’
‘কার দরকার?’
‘কার? সমাজের। লোকের দরকার আছে রাশিয়ার, দরকার আছে পার্টির। না হলে সব চুলোয় যাবে।’
‘তার মানে? রুশী কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে বের্তেনেভের পার্টি।’
‘না’, তাঁর মধ্যে ও-ধরনের একটা মূর্খতা সন্দেহ করা হচ্ছে বলে রাগে মুখবিকৃত করে সেপুখোভস্কয় ফরাসি ভাষায় বললেন, ‘এ সবই মূর্খতা।’ ওটা সব সময়ই ঘটেছে এবং ঘটবে। কমিউনিস্ট-টমিউনিস্ট কিছু নয়। কিন্তু কুচক্রী লোকদের সব সময়ই কোন-একটা অনিষ্টকর বিপজ্জনক পার্টি গড়ে তোলা দরকার। ওটা একটা পুরানো খেল। ওর নয়, প্রয়োজন তোর-আমার মত স্বাধীন লোকদের ক্ষমতাশীল পার্টি।
‘কেন?’ ক্ষমতাধর কয়েকজন লোকের নাম করলেন ভ্রন্স্কি, ‘কেন, এরা কি স্বাধীন লোক নয়?’
‘শুধু এজন্যে যে, জন্মগত সম্পত্তির স্বাধীনতা তাদের ছিল না, কর্তৃত্ব ছিল না, সূর্যের যে নৈকট্যে আমরা জন্মেছি—সেটা ছিল না। ওদের কিনে নেওয়া হয় টাকায়, নয় নেকনজরে। টিকে থাকার জন্যে ওদের কোন-একটা নবধারা ভেবে বের করা দরকার। যে আইডিয়া, ধারা তারা চালু করে তাতে তাদের নিজেদেরই বিশ্বাস নেই, তাতে অনিশ্চেষ্টই হয়; এসব ধারা হল শুধু সরকারী বাংলা আর অতটা বেতন পাবার উপায়। এসবে তেমন চতুরতার কিছু নেই, যখন দেখা যায় তাদের হাতের তাস। হয়ত আমি ওদের চেয়ে খারাপ, নির্বোধ, যদিও ওদের চেয়ে কোন আমার খারাপ হওয়ার কথা সেটা আমার চোখে পড়ছে না। কিন্তু কঠিন। আর সে রকম লোকের প্রয়োজনীয়তা আজ যত বেশি তা আগে কখনো দেখা যায় না।’
ভ্রন্স্কি শুনছিলেন মন দিয়ে। তিনি আকৃষ্ট হচ্ছিলেন কথাগুলোর বিষয়বস্তু ততটা নয়, যতটা রাষ্ট্রীয় ব্যাপার সম্পর্কে সেপুখোভস্কয়-এর মনোভাবে যিনি ক্ষমতাধরদের সাথে লড়ার কথা ভাবছেন, এ ব্যাপারে যাঁর নির্দিষ্ট অনুরাগ ও বিরাগ বর্তমান, যেক্ষেত্রে কাজে ভ্রন্স্কির আগ্রহ কেবল তাঁর ফ্লোয়াড্রনে সীমাবদ্ধ। যে মহলে ওঁর চলাফেরা সেখানে বুদ্ধি দিয়ে, বাক্যে শক্তি নিয়ে ব্যাপারটা ভেবে দেখা ও বোঝার যে সামর্থ্য অত বিরল, তাতে সেপুখোভস্কয় কত শক্তিশালী তাও টের পেলেন ভ্রন্স্কি। তাঁর পক্ষে লজ্জাকর হলেও ঈর্ষা হচ্ছিল তাঁর। বললেন, ‘তাহলেও এর জন্যে একটা প্রধান জিনিসের অভাব আছে আমার—ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা। সেটা ছিল, কিন্তু চলে গেছে।’
‘মাপ করিস, কথাটা সত্যি নয়’, হেসে বললেন সেপুখোভস্কয়।
‘না, সত্যি!…সত্যি বর্তমানে’, অকপট হবার জন্য যোগ দিলেন ভ্রন্স্কি।
‘হ্যাঁ, বর্তমানে সত্যি। সেটা অন্য ব্যাপার। কিন্তু এই বর্তমানটা তো আর চিরকাল নয়।’
‘হতে পারে’, জবাব দিলেন ভ্রন্স্কি।
‘তুই বলছিস—হতে পারে’, যেন তাঁর চিন্তাধারা অনুমান করে বলে চললেন সেপুখোভস্কয়, ‘আর আমি তোকে বলছি, নিশ্চয়ই হবে। এর জন্যেই তোর সাথে দেখা করতে চাইলাম। যা করা উচিত ছিল সেটা করেছিস তুই। এটা আমি বুঝি, কিন্তু বড় বেশি মেতে উঠিস না। আমি শুধু তোর কাছে কর্মের স্বাধীনতার অনুরোধ জানাবো। আমি তোর পৃষ্ঠপোষকতা করব না…যদিও করব না-ই বা কেন? কতবারই তো তুই পৃষ্ঠপোষকতা করেছিস আমার! আশা করি, আমাদের বন্ধুত্ব এর ঊর্ধ্বে। হ্যাঁ’, হেসে উনি বললেন নারীর মত কোমলতায়, ‘আমাকে কর্মের স্বাধীনতা দে, চলে যা রেজিমেন্ট থেকে। আমি তোকে টেনে তুলব অলক্ষ্যে।’
‘কিন্তু তুই কেন বুঝছিস না যে, আমার কিছুরই দরকার নেই’, ভ্রন্স্কি বললেন, ‘শুধু সব কিছু যেমন ছিল তেমনি থাক।’ সেপুখোভস্কয় উঠে ভ্রন্স্কির সামনে দাঁড়ালেন। ‘তুই বললি, সব কিছু যেমন ছিল তেমনি থাক। আমি বুঝি, কি তার অর্থ। কিন্তু শোন’—সেপুখোভস্কয়-এর হাসি আর ভঙ্গি যেন বলছিল যে, ভ্রন্স্কির ভয় পাবার কিছু নেই। ক্ষতস্থানটা তিনি স্পর্শ করছেন আলগোছে, সন্তপর্ণে, ‘তবে আমি বিবাহিত, আর আমাকে বিশ্বাস কর, নিজের হাজারো নারীকে জানলে যতটা পারতিস তার চেয়েও ভালো করে জানবি সমস্ত নারীকে।’
‘এখনই আসছি!’ যে অফিসারটি ঘরে উঁকি দিয়ে ওঁদের ডাকতে এসেছিল রেজিমেন্ট কমান্ডারের কাছে তার উদ্দেশে চেঁচিয়ে বললেন ভ্রন্স্কি।
ভ্রন্স্কির এখন ইচ্ছে হচ্ছিল ওঁর কথা সবটা শুনে জেনে নেবেন কি উনি বলতে চান।
‘শোন, আমার মত। মানুষের ক্রিয়াকলাপে প্রধান হোঁচট হল নারী। নারীকে ভালোবাসলে আর কিছু করা কঠিন। আরাম করে নির্বিঘ্নে ভালোবাসার একটা পন্থা আছে—সেটা বিয়ে। কি আমি ভাবছি সেটা কি করে যে তোকে বোঝাই’, উপমার ভক্ত সেপুখোভস্কয় বললেন, ‘দাঁড়া, দাঁড়া! বোঝা বইতে বইতে হাত দিয়ে কিছু করা সম্ভব শুধু সেই ক্ষেত্রে যখন বোঝাটা বাঁধা থাকে পিঠে—আর সেটা হল বিয়ে। বিয়ে করে—এটা আমি টের পেয়েছি। হঠাৎ হাত আমার খোলা পেলাম। কিন্তু বিয়ে না করে যদি এই বোঝাটা বইতে থাকিস, তাহলে হাত এমনই জোড়া থাকবে যে কিছু করতে পারবি না। মাজানকোভ, ক্রুপভকে দ্যাখ। নারীর জন্য তারা নষ্ট করল নিজেদের ভবিষ্যৎ।’
‘আহা, কি আবার নারী!’ উল্লিখিত ব্যক্তিদ্বয়ের সাথে যে ফরাসিনী আর অভিনেত্রীটির সম্পর্ক ছিল তাদের কথা স্মরণ করে বললেন অনস্কি।
‘সমাজে নারী সম্পর্কে যত পাকা, ব্যাপারটা দাঁড়ায় ততই খারাপ। সেটা হয় হাত দিয়ে আর বোঝা বওয়া নয়, অন্যের কাছ থেকে তা ছিনিয়ে নেবার মত।’
‘তুই কখনো ভালোবাসিসনি’, সামনের দিকে তাকিয়ে আন্নার কথা ভাবতে ভাবতে মৃদুস্বরে বললেন ভ্রন্স্কি
‘হতে পারে। কিন্তু আমি তোকে যা বললাম, সেটা মনে রাখিস। আরো একটা কথা : মেয়েরা সবাই পুরুষদের চেয়ে বেশি সাংসারিক। আমরা ভালোবাসা নিয়ে বড় একটা কিছু খাড়া করি আর ওরা সব সময়ই নিত্যনৈমিত্তিক।’
‘এখনই, এখনই আসছি!’ ঘরে যে চাপরাশি ঢুকেছিল তাকে তিনি বললেন। কিন্তু চাপরাশি ওঁদের আবার ডাকতে আসেনি—যা তিনি ভেবেছিলেন। সে এসেছিল ভ্রনস্কির জন্য একটা চিঠি নিয়ে।
‘প্রিন্সেস ভেস্কায়ার কাছ থেকে একটা লোক এটা নিয়ে এসেছে।’ চিঠি খুলে লাল হয়ে উঠলেন ভ্রন্স্কি। সেপুখোভস্কয়কে তিনি বললেন, ‘আমার মাথা ধরে উঠেছে, বাড়ি যাব।’
‘তাহলে বিদায়। কর্মের স্বাধীনতা দিবি তো?’
‘পরে কথা হবে। তোকে পিটার্সবুর্গে ধরব।’
বাইশ
পাঁচটা বেজে গেছে তখন, তাই সময়মত পৌঁছানো আর সেই সাথে নিজের যে ঘোড়াগুলোকে সবাই চেনে তাতে করে না যাবার জন্য ভ্রন্স্কি ইয়াভিনের ভাড়া করা গাড়িটায় উঠে তাড়াতাড়ি চালাবার হুকুম দিলেন। চার আসনের পুরানো ছ্যাকরা গাড়িটা বেশ প্রশস্ত। এক কোণে বসে উনি পা তুলে দিলেন সামনের সিটে, ডুবে গেলেন চিন্তায়।
নিজের ব্যাপারগুলোকে তিনি যে স্পষ্টতায় নিয়ে এসেছেন তার ঘোলাটে চেতনা, সেপুখোভস্কয় যে তাঁর প্রয়োজনীয় লোক বলে মনে করেন, তাঁর এই প্রশংসা আর বন্ধুত্ব, প্রধান কথা সাক্ষাৎকারের আশা, সব মিলে গেল জীবনের একটা সাধারণ সানন্দ অনুভূতিতে। সে অনুভূতি এতই প্রবল যে, অজান্তে হাসি ফুটল তাঁর মুখে। পা নামিয়ে তিনি এক হাঁটুর ওপর অন্য পা-টা তুলে দিলেন এবং আগের দিন পড়ে যাবার সময় চোট খাওয়া পায়ের স্থিতিস্থাপক ডিমটা হাতড়ে দেখলেন এবং পেছনে হেলান দিয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলেন কয়েকবার।
‘বেশ ভালো, দিব্যি ভালো!’ মনে মনে বললেন তিনি। আগেও তিনি প্রায়ই নিজের দেহের একটা পুলকিত চেতনা অনুভব করেছেন। কিন্তু এখন নিজেকে, নিজের দেহকে তিনি এতটা ভালোবাসেননি কখনো। বলিষ্ঠ পায়ে মৃদু এই ব্যথাটা অনুভব করতে তাঁর ভালো লাগিছল, ভালো লাগিছল শ্বাস-প্রশ্বাসে বক্ষপেশীর নাড়াচাড়া অনুভন করতে। আগস্টের যে পরিষ্কার দিনটা অমন হতাশ করেছিল আন্নাকে, সেটাই তাঁর কাছে মনে হচ্ছিল সঞ্জীবনীর মত উত্তেজক, প্রক্ষালনে, চিনচিন করা মুখ আর ঘাড়কে তা তাজা করে তুলছিল। মোট থেকে ব্রিলিয়ান্টিনের গন্ধটা এই তাজা হাওয়ায় বিশেষ মনোরম ঠেকছিল তাঁর কাছে। জানালা দিয়ে তিনি যা দেখতে পাচ্ছিলেন, ঠাণ্ডা নির্মল তাঁর কাছে। জানালা দিয়ে তিনি যা দেখতে পাচ্ছিলেন, ঠাণ্ডা নির্মল এই বাতাসে, সূর্যোস্তের দিকে আলোয় সব কিছুই তাঁর নিজের মতই তবতাজা, প্রফুল্ল, বলিষ্ঠ : ঢলে পড়া সূর্যের কিরণে বাড়ির ঝকঝকে চাল, বেড়া আর বাড়ি কোণগুলোর তীক্ষ্ণ রেখা, মাঝে-মধ্যে চোখে পড়া পথচারী বা গাড়ির মূর্তি, গাছ আর ঘাসের অচঞ্চল শ্যামলিমা, সঠিক ফারের সারিতে চিত্রিত আলুর খেত, ঘর-বাড়ি, গাছপালা আর খোদ আলু খেতটারই তির্যক ছায়া—সব কিছুই। বার্নিশ করা সদ্য সমাপ্ত ভালো একটা ছবির মত সবই সুন্দর।
‘চালাও, চালাও!’ পকেট থেকে তিন রুবলের একটা নোট নিয়ে জানালা দিয়ে মুখ বের করে তিনি বললেন কোচোয়ানকে। সে পেছনে মুখ ফেরাতে ভ্রন্স্কি নোটটা দিলেন তাকে। লণ্ঠনের আলোয় কোচোয়ানের হাত কি যেন খুঁজছিল, শোনা গেল চাবুকের শিস, গাড়ি সমতল সড়ক দিয়ে দ্রুত ছুটল।
দুই জানালার মাঝখানে হাড়ের ঘণ্টি-হাতলের দিকে তাকিয়ে এবং শেষবার আন্নাকে যা দেখেছিলেন সেই মূর্তিতে তাঁকে কল্পনা করে তিনি ভাবলেন, ‘এই সুখটুকু ছাড়া আর কিছুই, কিছুই আমি চাই না। যত দিন যাচ্ছে ততই বেশি করে ভালোবাসছি ওকে। আরে, এই তো ভ্রেদে’র সরকারী পল্লীভবনের বাগান। কোথায় সে এখানে? কোথায়? কেমন করে? কেন সে এখানে দেখা করতে চেয়েছে আর লিখেছে বেত্সির চিঠিটায়? ভাবলেন মাত্র যেতেই তিনি কোচোয়ানকে থামালেন এবং দরজা খুলে চলন্ত গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে চললেন তরুবীথি এবং দরজা খুলে বাড়ি পর্যন্ত। বীথিতে কেউ ছিল না; কিন্তু ডান দিকে তাকাতেই তিনি দেখতে পেলেন আন্নাকে। মুখ তাঁর ঝালরে ঢাকা, কিন্তু উৎফুল্ল দৃষ্টিতে তিনি ধরতে পারলেন আন্নার চলন, যেটা একান্ত তাঁরই নিজস্ব, কাঁধের ডৌল, মাথার ভঙ্গি আর অমনি যেন একটা বৈদ্যুতিক তরঙ্গ খেলে গেল তাঁর দেহে। নবশক্তিতে তিনি টের পেলেন নিজেকে, পায়ের স্থিতিস্থাপক গতি থেকে শ্বাস-প্রশ্বাসে ফুসফুসের সঞ্চালন পর্যন্ত, তাঁর ঠোঁটে কি যেন সুড়সুড়ি দিয়ে উঠল
আন্না কাছে এসে সজোরে তাঁর করদন করলেন।
‘তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছি বলে রাগ করোনি তো? তোমার সাথে দেখা করা আমার বড় দরকার’, আন্না বললেন; আর ঝালরের তল থেকে ভ্রন্স্কি তাঁর ঠোঁটের যে গম্ভীর ভাঁজ দেখলেন তাতে তৎক্ষণাৎ তাঁর হৃদয়াবেগ বদলে গেল।
‘আমি রাগ করব! কিন্তু তুমি এখানে এলে কেমন করে?’
‘ওতে কিছু এসে যায় না’, নিজের বাহু ওঁর বাহুতে রেখে আন্না বললেন, ‘চল যাই, তোমার সাথে কথা আছে।’ ভ্রন্স্কি বুঝলেন কিছু-একটা ঘটেছে, এ মিলনটা আনন্দের হবে না। আন্নার উপস্থিতিতে নিজের ইচ্ছাশক্তি থাকত না ভ্রন্স্কির : তাঁর উদ্বেগের কারণ না জানলেও ভ্রন্স্কি টের পাচ্ছিলেন যে অজান্তে সে উদ্বেগ সঞ্চারিত হয়েছে তাঁর মধ্যেও।
কনুই দিয়ে আন্নার বাহু চেপে মুখ দেখে তাঁর মনোভাবনা বোঝার চেষ্টা করতে করতে ভ্রন্স্কি বললেন, ‘কি ব্যাপার? কি হয়েছে?’
মন বাঁধার জন্য আন্না নীরবে হেঁটে গেলেন কয়েক পা, তারপর হঠাৎ থেমে গেলেন।
‘কাল তোমাকে বলিনি’, ঘনঘন হাঁপাতে হাঁপাতে আন্না বললেন, ‘কারেনিনের সাথে বাড়ি ফেরার সময় আমি তাঁকে সব কিছু জানিয়েছি…বলেছি যে আমি তাঁর স্ত্রী থাকতে পারি না, বলেছি যে…সবই বলেছি।’
ভ্রন্স্কি তাঁর কথা শুনছিলেন অজ্ঞাতসারে সারা দেহ নুইয়ে, যেন এতে করে তাঁর অবস্থার দুঃসহতা তিনি নরম করে আনতে চাইছিলেন। কিন্তু আন্না এ কথা বলামাত্র তিনি খাড়া হয়ে উঠলেন, গর্বিত কঠোর একটা ভাব ফুটে উঠল মুখে। বললেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, এই ভালো হাজার গুণ ভালো! তোমার পক্ষে এটা কত কষ্টকর হয়েছিল তা আমি বুঝতে পারছি।’
কিন্তু আন্না তাঁর কথা শুনছিলেন না, মুখভাব দেখে ধরতে চাইছিলেন তাঁর মনোভাব। তাঁর জানার কথা নয় যে ভ্রন্স্কির মুখভাব যার পরিচায়ক সেটা তাঁর মনে আসা প্রথম চিন্তাটা—এখন অনিবার্য ডুয়েলের কথাটা নিয়ে। ডুয়েলের কথা কখনো আন্নার মাথায়ই আসেনি তাই কঠোরতার এই ক্ষণিক মুখভাবকে তিনি নিলেন অন্যভাবে।
স্বামীর চিঠি পেয়ে আন্না অন্তরে অন্তরে বুঝেছিলেন যে—সবই থাকবে আগের মতই, নিজের প্রতিষ্ঠা তুচ্ছ করে, ছেলেকে ফেলে দিয়ে প্রণয়াস্পদের সাথে মিলনের ক্ষমতা তাঁর নেই। প্রিন্সেস ভেস্কায়ার ওখানে যে সকালটা কাটিয়েছেন তাতে তিনি আরো নিঃসন্দেহ হন এ বিষয়ে। তাহালেও ভ্রন্স্কির সাথে এই সাক্ষাৎটা ছিল তাঁর কাছে অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আশা করেছিলেন যে এতে তাঁর অবস্থা বদলে যাবে, বেঁচে যাবেন তিনি। খবরটা শুনে ভ্রন্স্কি যদি দৃঢ়ভাবে, সবেগে, এক মুহূর্ত দ্বিধা না করে তাঁকে বলতেন, ‘সব ফেলে রেখে এসো আমার সাথে!’ তাহলে তিনি ছেলেকে রেখে তাঁর সাথেই চলে যেতেন। কিন্তু তিনি যা আশা করেছিলেন, সংবাদটায় তেমন প্রতিক্রিয়া হল না ভ্রন্স্কির : তিনি শুধু কিসে যেন অপমানিত বোধ করলেন।
‘আমার এতটুকু কষ্ট হয়নি। এটা ঘটে গেছে আপনা থেকেই’, আন্না বললেন উত্যক্ত স্বরে, ‘আর এই যে…’, দস্তানা থেকে স্বামীর চিঠিটা বের করলেন তিনি।
‘আমি বুঝতে পারছি, বুঝতে পারছি’, চিঠিটা নিয়ে আন্নাকে বাধা দিলেন ভ্রন্স্কি, তবে চিঠিটা পড়লেন না, চেষ্টা করলেন তাঁকে সান্ত্বনা দিতে, ‘আমার শুধু একটা কামনা একটা মিনতি—এই অবস্থাটা চুরমার করে দাও, তোমার সুখের জন্যে যাতে আমার জীবন নিবেদন করতে পারি।’
‘ও কথা কেন বলছ আমাকে?’ আন্না বললেন, ‘ওতে কি আমি সন্দেহ করতে পারি? সন্দেহ যদি করতাম…’
‘কে আসছে?’ যে দুজন মহিলা তাঁদের দিকে আসছিলেন, তাঁদের দেখিয়ে হঠাৎ বলে উঠলেন অন্স্কি, ‘হয়ত আমাদের চিনতে পারবে’, এবং তাড়াতাড়ি করে আন্নাকে সাথে নিয়ে তিনি চলে গেলেন পার্শ্ববর্তী পথটায়।
‘আমার বয়ে গেল!’ আন্না বললেন। ঠোঁট তাঁর কাঁপছিল। ভ্রন্স্কির মনে গল ঝলরের তল থেকে চোখ দুটো তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে অদ্ভুত একটা বিরাগে। ‘তাই যা বলছিলাম, ব্যাপারটা ও নিয়ে নয়। ওতে আমার সন্দেহ হতে পারে না; দ্যাখো আমাকে ও কি লিখেছে, পড়’, আবার থেমে গেলেন আন্না।
স্বামীর সাথে ছাড়াছাড়ির খবর শুনে প্রথম মুহূর্তে যা হয়েছিল, অপমানিত স্বামীর সাথে তাঁর সম্পর্কের ব্যাপারে যে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া ঘটেছিল, চিঠি পড়ার পর ভ্রন্স্কি অজান্তে আবার তাতে আত্মসমর্পণ করলেন। এখন ওঁর চিঠিহাতে ভ্রন্স্কি অজ্ঞাতসারে কল্পনা করতে লাগলেন আজই অথবা কাল নিশ্চিতই যে চ্যালেঞ্জ আসবে তাঁর এবং খোদ ডুয়েলটার কথা। এখন তাঁর যে নিরুত্তাপ অহংকৃত মুখভাব। সেই ভাব নিয়ে তিনি সে ডুয়েলে শূন্যে গুলি ছুঁড়ে অপমানিত স্বামীর গুলির মুখে দাঁড়াবেন। আর তখনই মাথায় ঝলক দিয়ে গেল একটা চিন্তা যা কিছু আগে সেপুখোভস্কয় বলছিলেন এবং নিজেই তিনি সকালে যা চিন্তার কথাটা তিনি আন্নাকে বলতে অক্ষম।
চিঠি পড়ে তিনি চোখ তুললেন আন্নার দিকে, দৃষ্টিতে তাঁর কোন দৃঢ়তা ছিল না। আন্না তখনই বুঝলেন যে,এ ব্যাপারটা তিনি ভেবে রেখেছিলেন আগেই। আন্না জানতেন যে, ভ্রন্স্কি যাই বলুন, তিনি কি ভাবছেন তা পুরো বলবেন না। বুঝলেন যে তাঁর শেষ আশাটা গেল। তিনি যার অপেক্ষায় ছিলেন এটা তা নয়।
‘দেখছ তো কেমন লোক’, কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন আন্না, ‘উনি…’
‘মাপ কর, কিন্তু এতে আমি খুশি’, আন্নাকে বাধা দিলেন ভ্রন্স্কি, ‘সৃষ্টিকর্তার দোহাই, আমার কথাটা শেষ করতে দাও’, নিজের বক্তব্যটা বুঝিয়ে বলার জন্য সময় চেয়ে মিনতি করলেন দৃষ্টি দিয়ে, ‘আমি খুশি কারণ উনি যা প্রস্তাব করছেন। ব্যাপারটা সেভাবে থেকে যেতে পারে না।’
‘কেন পারে না?’ অশ্রু বোধ করে আন্না বললেন, ভ্রন্স্কি যা বললেন, স্পষ্টতই তাতে তিনি আর কোন গুরুত্ব দিচ্ছিলেন না। তিনি টের পাচ্ছিলেন যে নির্ধারিত হয়ে গেছে তাঁর ভাগ্য।
ভ্রন্স্কি বলতে চেয়েছিলেন যে তাঁর মতে, যে ডুয়েল অনিবার্য, তারপর এটা চলতে পারে না, কিন্তু বললেন অন্য কথা।
‘এটা চলতে থাকবে, এ হতে পারে না। আমি আশা করি এবার তুমি ছেড়ে দেবে ওকে। আমি আশা করি’, একটু থতমত খেয়ে লাল হয়ে উঠলেন ভ্রন্স্কি, ‘আশা করি যে আমাদের জীবন গড়ে তুলতে এবং ভেবে কিছু-একটা ঠিক করতে তুমি আমাকে দেবে। কাল…’ উনি কিছু-একটা বলতে যাচ্ছিলেন।
‘কিন্তু আন্না তাঁকে শেষ করতে দিলেন না।’
‘কিন্তু ছেলে?’ চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি, ‘দেখেছ তো কি লিখেছে। ওকে ছেড়ে দেওয়াই উচিত কিন্তু সে ক্ষমতা আমার নেই, চাই-ও না।’
‘সৃষ্টিকর্তার দোহাই, কোনটা ভালো? ছেলেকে ছেড়ে আসা, নাকি এই অপমানকর অবস্থাটা চালিয়ে যাওয়া?’
‘কার সাথে অপমানকর
‘সবার পক্ষে, সবচেয়ে বেশি করে তোমার পক্ষে
‘বলছ অপমানকর…এ কথা বলো না আমার কাছে কথাটার কোন অর্থ নেই।’ কাঁপা কাঁপা গলায় আন্না বললেন। এখন তিনি আর চাইছিলেন না যে ভ্রনস্কি অসত্য কিছু বলুক। এখন তাঁর অবশিষ্ট আছে কেবল তাঁর প্রেম, ভ্রন্স্কিকে ভালোবাসতে চাইছিলেন তিনি, ‘তুমি বুঝে দ্যাখো, যেদিন তোমাকে ভালোবেসেছি, সেদিন থেকে সব কিছু বদলে গেছে আমার। আমার আছে শুধু একটা জিনিস, শুধু একটা-সেটা তোমার ভালোবাসা। সে ভালোবাসা যদি আমি তাহলে নিজেকে এই উঁচু, এত দৃঢ় বলে অনুভব করব যে আমার পক্ষে কিছুই অপমানকর হতে পারে না। নিজের অবস্থায় আমি গর্বিত…গর্বিত কারণ…গর্বিত…’ কেন গর্বিত সে কথাটা তিনি শেষ করতে পারলেন না। লজ্জা আর হতাশার অশ্রুতে রুদ্ধ হয়ে গেল তাঁর কণ্ঠ। থেমে গিয়ে ফুঁপিয়ে উঠলেন তিনি।
ভ্রন্স্কিও টের পাচ্ছিলেন গলায় কি যেন আটকে যাচ্ছে, চিমটি কাটছে নাকে, জীবনে কি তাঁর প্রথম তিনি অনুভব করলেন যে কেঁদে ফেলতে পারেন। ঠিক কি তাঁর কাছে এত মর্মস্পর্শী সেটা তিনি বলতে পারতেন না। করুণা হচ্ছিল আন্নার জন্য অথচ অনুভব করছিলেন যে তাঁকে সাহায্য করতে তিনি অক্ষম। আর সেই সাথে এটাও জানতেন যে, আন্নার দুঃখের জন্য তিনিই দায়ী, কিছু-একটা করেছেন তিনি।
‘বিবাহবিচ্ছেদ কি অসম্ভব?’ ক্ষীণকণ্ঠে তিনি বললেন। জবাব না দিয়ে মাথা নাড়লেন আন্না। ‘ছেলেকে নিয়ে ওকে ছেড়ে যাওয়া চলে না?’
‘চলে, কিন্তু সব নির্ভর করছে ওর ওপর। এবার আমার যেতে হবে ওর কাছে’, শুকনো গলায় আন্না বললেন। সব কিছু আগের মতই থেকে যাবে-তাঁর এই প্রাগ্বোধটা প্রবঞ্চিত করেনি তাঁকে।
‘মঙ্গলবার আমি পিটার্সবুর্গে থাকব, সব কিছু তখন স্থির করা যাবে।’ আন্না বললেন, ‘হ্যাঁ, কিন্তু ও-নিয়ে আর কোন কথা নয়।’
আন্নার যে গাড়িটা তিনি ফেরত পাঠিয়ে আবার ভ্রেদে’র ফটকের কাছে আসতে বলেছিলেন, এল সেটা। ভ্রন্স্কির কাছে বিদায় নিয়ে বাড়ি চলে গেলেন আন্না।
তেইশ
জুন মাসের ২ তারিখের কমিশনের সাধারণ বৈঠক বসল সোমবার। অধিবেশনকক্ষে ঢুকে বরাবরের মত সদস্যদের এবং সভাপতির সাথে সম্ভাষণ বিনিময় করলেন কারেনিন। নিজের আসন গ্রহণ করে সামনে তাঁর জন্য তৈরি করে রাখা কাগজপত্রগুলোর ওপর হাত রাখলেন। কাগজপত্রগুলোর মধ্যে তথ্যাদি এবং যে বিবৃতি তিনি দেবেন বলে স্থির করেছিলেন তার খসড়া সংক্ষিপ্তসারও ছিল। তবে তথ্যাদির প্রয়োজন ছিল না তাঁর। সব কিছু তাঁর মনে ছিল, আর যা বললেন, মনে মনে তা আওড়ে নেবারও দরকার বোধ করলেন না তিনি। তাঁর জানা ছিল যে সময় যখন আসবে, সামনে যখন দেখবেন প্রতিপক্ষের মুখ যে বৃথাই চেষ্টা করছে একটা নির্বিকার ভাব ফোটাতে এখন তৈরি হবার চেষ্টা করার চেয়ে ভালোভাবে তখন তাঁর বক্তৃতাটা আপনাআপনি নিঃসৃত হতে থাকবে। তিনি টের পাচ্ছিলেন যে তাঁর ভাষণের বিষয়বস্তু এতই বৃহৎ যে তার প্রতিটা শব্দই হবে তাৎপর্যপূর্ণ। অথচ সাধারণ একটা প্রতিবেদন তিনি শুনছিলেন অতি নিরীহ, গোবেচারা ভাব করে। শিরা ফুলে ওঠা তাঁর সাদা হাত, লম্বা লম্বা আঙুলে যা সামনে একখানা সাদা কাগজের দুই প্রান্ত সন্দেহে নাড়াচাড়া করছে, ক্লান্তির ভাব নিয়ে পাশে হেলানো মাথা—এসব দেখে কেউ ভাববে না যে, এখনই তাঁর মুখ থেকে এমন বক্তৃতা নির্গত হবে যা ভয়াবহ ঝড় তুলবে, পরস্পরকে বাধা দিয়ে চেঁচামেচি করতে বাধ্য করবে সভ্যদের, শৃঙ্খলা মেনে চলার দাবি করতে হবে সভাপতিকে। প্রতিবেদন শেষ হলে কারেনিন তাঁর শান্ত মিহি গলায় ঘোষণা করলেন যে অরুশ লোকদের সুব্যবস্থা নিয়ে তিনি নিজের কিছু বক্তব্য রাখতে চান। মনোযোগ আকৃষ্ট হল তাঁর দিকে। কেশে নিলেন কারেনিন, প্রতিপক্ষের দিকে দৃষ্টিপাত না করে বরাবর যা করে থাকেন, বক্তৃতা দেবার সময় তাঁর সামনে উপবিষ্ট প্রথম ব্যক্তিটিকে বেছে নিলেন, (এক্ষেত্রে লোকটা ক্ষুদ্রকায় শান্তশিষ্ট এক বৃদ্ধ, কমিশনে যিনি কদাচ কোন মত প্রকাশ করেননি) এবং শুরু করলেন তাঁর বক্তব্য। মৌল ও আঙ্গিক আইনের কথা যখন উঠল। প্রতিপক্ষ লাফিয়ে উঠে আপত্তি জানাতে লাগলেন। স্ত্রেমভ, ইনিও কমিশনের সদস্য, এক হাত নেওয়া হয়েছিল এঁকে, ইনি কৈফিয়ত দিতে শুরু করলেন এবং মোটের ওপর বৈঠকটা হল ঝড়-তোলা; কিন্তু জিতলেন কারেনিন। গৃহীত হল তাঁর প্রস্তাব; নিযুক্ত হল তিনটা নতুন কমিশন; পরের দিন পিটার্সবুর্গের নির্দিষ্ট একটা মহলে চলল শুধু এই বৈঠকেরই আলোচনা। কারেনিনের সাফল্য ছাড়িয়ে গিয়েছিল তাঁর নিজের আশাকেও।
পরের দিন মঙ্গলবার কারেনিন সন্তুষ্টির সাথে গতকালের বিজয়ের কথা স্মরণ করে না হেসে পারলেন না। যদিও কার্যালয়ের তত্ত্ববধায়ক যখন তাঁকে তোষামোদ করার জন্য জানালেন যে, কমিশনের ঘটনাবলীর খবর তাঁর কানেও গেছে তখন তিনি নির্বিকার ভাব দেখাতে চাইছিলেন।
তত্ত্বাবধায়কের সাথে ব্যস্ত থাকায় কারেনিন একেবারে ভুলে গিয়েছিলেন যে সেদিন মঙ্গলবার। আন্না আর্কাদিয়েভনার আসার তারিখ তিনি ধার্য করেছেন সেই দিন, তাই যখন লোক এসে খবর দিল যে তিনি এসেছেন তখন তিনি বিস্মিত, এমন কি অভিভূত হলেন বিশ্রী রকমে।
আন্না পিটার্সবুর্গে আসেন বেশ সকালে; তাঁর টেলিগ্রাম অনুসারে গাড়ি পাঠানো হয় তাঁ জন্য, তাই তাঁর আসার ব্যাপারটা কারেনিনের পক্ষে জানা অসম্ভব। কিন্তু আন্না যখন পৌঁছলেন, উনি দেখা করতে এলেন না। তাঁকে বলা হয় যে উনি এখনো বেরোননি তত্ত্বাবধায়কের সাথে কাজ করছেন। তাঁর আসার খবর স্বামীকে জানাতে বলে তিনি এলেন তাঁর কেবিনেটে, স্বামী তাঁর কাছে আসবে এই প্রতীক্ষায় নিজের জিনিসপত্র গোছগাছ করতে লাগলেন। কিন্তু এক ঘণ্টা কেটে গেল, উনি এলেন না। কিছু হুকুম-টুকুম দেবার অছিলায় তিনি গেলেন ডাইনিং-রুমে, ইচ্ছে করে কথা বলতে লাগলেন জোরে জোরে, আশা করছিলেন উনি ওখানে আসবেন; কিন্তু উনি বেরোলেন না। যদিও আন্না শুনতে পেয়েছিলেন যে, তত্ত্বাবধায়ককে বিদায় দেবার জন্য তিনি স্টাডির দরজা পর্যন্ত এসেছিলেন। আন্না জানতেন যে, বরাবরের মত শিগগিরই উনি কাজে চলে যাবেন। তার আগেই নিজেদের সম্পর্কটা স্থির করে নেবার জন্য ওঁর সাথে দেখা করতে চাইছিলেন তিনি।
আন্না হল পেরিয়ে দৃঢ় পদক্ষেপে এগোলেন তাঁর উদ্দেশে। যখন ঘরে ঢুকলেন উনি তখন উর্দি পরে আছেন, স্পষ্টতই বেরোবার জন্য তৈরি, বসে আছেন ছোট টেবিলটায় কনুইয়ে ভর দিয়ে, বিষণ্নভাবে তাকিয়ে আছেন সামনে উনি আন্নাকে দেখতে পাওয়ার আগে আন্নাই ওঁকে দেখেন প্রথম এবং বুঝলেন যে তাঁর কথাই উনি ভাবছেন।
আন্নাকে দেখে উনি উঠতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু মত পালটালেন, তারপর হঠাৎ মুখ তাঁর লাল হয়ে উঠল যা আগে কখনো আন্না দেখেননি। তাড়াতাড়ি করে উঠে তিনি এলেন আন্নার কাছে, আন্নার চোখের দিকে না চেয়ে তাকালেন ওপরে, তাঁর কপাল আর কবরীর দিকে। তাঁর হাতটা নিয়ে বসতে বললেন তাঁকে।
‘আমি খুশি হয়েছি যে আপনি এসেছেন’, আন্নার কাছে বসে তিনি বললেন, বোঝা যায় কিছু-একটা জানাতে চাইছিলেন তিনি, কিন্তু থতমত খেলেন। বারকয়েক তিনি কথা শুরু করতে চেয়েছিলেন কিন্তু থেমে যাচ্ছিলেন … এই সাক্ষাটার জন্য তৈরি হতে গিয়ে ওঁকে ঘৃণা করা এবং ওঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা উচিত বলে নিজেকে বোঝালেও আন্না ভেবে পেলেন না কি ওঁকে বলবেন, করুণা হচ্ছিল ওঁর ওপর। এভাবেই নীরবতা চলল বেশ কিছুক্ষণ ধরে। ‘সেরিওজা ভালো আছে?’ এবং জবাবের জন্য অপেক্ষা না করে কারেনিন যোগ দিলেন, ‘আজ আমি বাড়িতে খাব না আর এখুনি বেরোতে হবে আমাকে।’
আন্না বললেন, ‘আমি মস্কো যেতে চাইছিলাম।’
‘না, আপনি এসে খুবই—খুবই ভালো করেছেন’, এই বলে আবার চুপ করে গেলেন উনি
কথা বলতে শুরু করার সাধ্য ওঁর নেই দেখে আন্না নিজেই শুরু করলেন : ‘কারেনিন’, আন্না বললেন তাঁর দিকে তাকিয়ে, তাঁর কবরীতে নিবদ্ধ স্বামীর দৃষ্টি থেকে চোখ না নামিয়ে, ‘আমি পাতকিনী নারী, আমি বদ মেয়ে, কিন্তু আমি যা ছিলাম, আপনাকে তখন যা বলেছিলাম আমি তাই, আপনাকে বলতে এসেছি যে কিছুই বদলাতে পারব না আমি।’
‘আমি আপনাকে ও-কথা বলিইনি’, উনি বললেন হঠাৎ দৃঢ়ভাবে, আক্রোশ সোজা আন্নার চোখের দিকে তাকিয়ে, ‘আমিও তাই অনুমান করেছিলাম।’ বোঝা যায় ক্রোধের প্রভাবে উনি আবার তাঁর সমস্ত সামর্থ্যের ওপর দখল পেয়ে গেছেন, কিন্তু আপনাকে আমি তখন যা বলেছিলাম এবং লিখেছি’, তীক্ষ্ণ সরু গলায় বলে উঠলেন তিনি, ‘আর এখন পুনরুক্তি করছি যে আমি ওটা জানতে বাধ্য নই। ওটা আমি উপেক্ষা করছি। সব নারী আপনার মত অমন সহৃদয় নয় যে তাড়াতাড়ি করে এত উপভোগ্য একটা সংবাদ স্বামীকে জানাতে যাবে’, ‘উপভোগ্য’ কথাটার ওপর বিশেষ জোর দিলেন তিনি। ‘যতদিন সমাজ এটা জানছে না, আমার সুনাম কলংকিত হচ্ছে না, ততদিন ওটা আমি উপেক্ষা করব। সেই কারণে আমি আপনাকে শুধু সাবধান করে দিয়েছে যে, আমাদের সম্পর্ক বরাবর যেমন ছিল তেমনি থাকা চাই। আর আপনি যদি নিজের মান খোয়ান, কেবল সেক্ষেত্রেই আমার মর্যাদা বাঁচাবার জন্যে ব্যবস্থা নিতে হবে আমাকে।’
‘কিন্তু আমাদের সম্পর্ক বরাবর যা ছিল তা থাকতে পারে না’, সভয়ে ওঁর দিকে তাকিয়ে ভীরু ভীরু গলায় বললেন আন্না।
আন্না যখন আবার তাঁর এই অবিচলিত ভঙ্গিটা দেখলেন, শুনলেন তাঁর এই তীক্ষ্ণ, ছেলেমানুষি, হাস্যকর কণ্ঠস্বর, বিতৃষ্ণায় তাঁর ভেতরকার করুণা উবে গেল, এখন মাত্র ভয় পাচ্ছিলেন তাঁকে, কিন্তু যে করেই হোক নিজের অবস্থাটা পরিষ্কার করে নিতে চাইছিলেন তিনি।
‘আমি আপনার স্ত্রী থাকতে পারি না যখন আমি…’ বলার উপক্রম করলেন আন্না।
আক্রোশ-ভরা নিরুত্তাপ হাসি হেসে উঠলেন উনি। ‘যে ধরনের জীবন আপনি বেছে নিয়েছেন সেটা নিশ্চয় আপনার বোধগুলোয় ছায়া ফেলেছে। আমি এতই শ্রদ্ধা বা ঘৃণা এবং দুই-ই…আপনার অতীতের প্রতি শ্রদ্ধা, বর্তমানের প্রতি ঘৃণা পোষণ করি…যে আমার কথার যে ব্যাখ্যা আপনি করছেন তা থেকে আমি বহু দূরে।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে আন্না মাথা নিচু করে বললেন, ‘তবে আমি বুঝতে পারছি না। আপনার মত এতটা স্বাধীনতা পেয়ে’, উত্তেজিত হয়ে বলে চললেন তিনি, ‘সরাসরি নিজের বিশ্বাসঘাতকতার কথা স্বামীকে বলার মধ্যে দোষের কিছু দেখতে না পেলেও, যা মনে হচ্ছে, স্বামীর কাছে স্ত্রীর দায়-দায়িত্ব পালনটা কেন দোষের বলে ধরছেন।’
‘কারেনিন, আমার কাছ থেকে কি আপনার চাই?’
আমি চাই যে লোকটাকে আমি যেন এখানে না দেখি আর আপনি এমনভাবে চলবেন যাতে সমাজ বা চাকর- বাকররা আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনতে না পারে…এবং আপনি ওর সাথে দেখা না করেন। মনে হয় এটা তেমন বেশি কিছু নয়। এর জন্যে আপনি স্ত্রীর দায়িত্ব পালন না করেও সাধ্বী স্ত্রীর অধিকার ভোগ করবেন। আপনাকে এ কথাটাই বলতে চাইছিলাম। এবার আমার যাবার সময় হয়ে গেছে। বাড়িতে খাব না।’
দরজার দিকে উনি উঠে গেলেন। আন্নাও উঠলেন। আন্নার যাবার জন্য নীরবে উনি মাথা নুইয়ে পথ করে দিলেন।
চব্বিশ
যে রাতটা লেভিন বিচালির স্তূপের ওপর কাটান সেটা তাঁর ওপর ছাপ না ফেলে যায়নি; যে চাষ-আবাদ তিনি দেখছিলেন তাতে তাঁর বিরাগ ধরল, কোন আগ্রহ আর রইল না তাতে। চমৎকার ফসল হলেও এ বছরের মত এত অসাফল্য এবং তাঁর ও কারেনিনদের মধ্যে এত শত্রুতা আর কখনো দেখা যায়নি। অন্ততপক্ষে তাঁর মনে হল যে, দেখা যায়নি। এই অসাফল্য আর শত্রুতার কারণ এখন তাঁর কাছে একেবারে পরিষ্কার। খোদ কাজ করার মধ্যেই যে অপূর্বতা তিনি অনুভব করেছিলেন, তার ফলে কৃষকদের সাথে ঘনিষ্ঠতা, তাদের প্রতি, তাদের জীবনের প্রতি তাঁর ঈর্ষা, যে জীবনে চলে যাবার জন্য তাঁর বাসনা, সে রাতে যেটা আর স্বপ্ন নয়, সুচিন্তিত সমস্ত খুঁটিনাটি নিয়ে তাঁর একটা সংকল্প, চাষ-আবাদ দেখাশোনা নিয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি এসবে এত বদলে গেল যে তিনি ও কাজে পূর্বের আগ্রহ আর বোধ করতে পারলেন না, কর্মীদের সাথে যে নিজের বিরূপ সম্পর্কটা গোটা ব্যবস্থাটার ভিত্তি, না দেখে পারলেন না সেটা। পাভার মত উন্নত জাতের গরু, সার ফেলা হাল দেওয়া মাটি, ঝোপে ঘেরা নয়টি সমতল খেত, গভীর করে গোবর দেওয়া নব্বই দেসিয়াতিনা জমি, হলরেখা বরাবর বপনযন্ত্র ইত্যাদি— এসবই চমৎকার যদি এগুলো তিনি করতেন নিজে অথবা তাঁর প্রতি সহানুভূতিশীল বন্ধুদের সাথে একত্রে। কিন্তু এখন তিনি পরিষ্কার দেখতে পেলেন (কৃষি নিয়ে যে লেখাটায় তিনি বলেছেন যে জোতের প্রধান উপাদান হওয়া উচিত শ্রমিক, তা নিয়ে খাটতে গিয়ে এ ব্যাপারে বহু দিক থেকে সাহায্য হয়েছে তাঁর), পরিষ্কার দেখতে পেলেন, যে চাষ-আবাদ তিনি দেখাশোনা করছিলেন সেটা কেবল তাঁর আর তাঁর কর্মীদের মধ্যে একরোখা নির্মম একটা সংগ্রাম যাতে এক দিকে, তাঁর পক্ষে ছিল সেরা নিদর্শন বলে তিনি যা গণ্য করছেন সেই অনুসারে সব কিছু ঢেলে সাজার জন্য নিরন্তর প্রাণপণ প্রয়াস, অন্যদিকে স্বভাবসিদ্ধ একটা গতানুগতিকতা। এই সংগ্রামে তিনি দেখলেন যে, তাঁর দিক থেকে প্রচণ্ড শক্তি নিয়োগ এবং অপর দিকে কোনরূপ প্রয়াস। এমন কি ইচ্ছারও অভাবে ফল হয়েছে কেবল এই যে চাষবাসে দাঁড়ায়নি কিছু, একেবারে খামোকা নষ্ট হয়েছে চমৎকার হাতিয়ারপত্র, চমৎকার গবাদি পশু আর মাটি। প্রধান কথা, এই দিকে নিযুক্ত কর্মোদ্যোগ শুধু যে একেবারে বৃথা গেছে তাই নয়, এখন-তাঁর চাষ-আবাদের অর্থ যখন তাঁর কাছে উদ্ঘাটিত হয়ে পড়েছে তখ তিনি এটা অনুভব না করে পারেন না যে কর্মোদ্যোগের লক্ষ্যটাই ছিল অমর্যাদাকর। আসলে সংগ্রামটা কি নিয়ে? তাঁর দিকে থেকে প্রতিটা পয়সা নিয়ে (আর তা না হয়ে পারে না, কেননা উদ্যমে ঢিল দিলে শ্রমিকদের বেতন দেবার মত টাকাও জুটবে না তাঁর), আর ওরা শুধু শান্তিতে আর আনন্দে অর্থাৎ যেভাবে তারা অভ্যস্ত শুধু সেভাবে খাটার পক্ষপাতী। তাঁর স্বার্থ হল প্রতিটা মুনিষ যেন যথাসম্ভব বেশি খাটে, না ঝিমায়, যেন চেষ্টা করে চাষের যন্ত্রপাতি ভেঙে না ফেলতে, যে কাজটা সে করছে তা নিয়ে যেন মাথা ঘামায়; মুনিষের কিন্তু ইচ্ছে যথাসম্ভব আনন্দে, বিশ্রাম নিয়ে খাটায়, সবচেয়ে বড় কথা, খাটতে চায় বিনা চিন্তা-ভাবনায় ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে। এবারকার গ্রীষ্মে লোভিন এটা লক্ষ্য করেছেন প্রতি পদে। যেসব খারাপ দেসিয়াতিনা আগাছা আর ঝোপঝাড়ে ভরে উঠেছে। ক্লোভার থেকে বীজ ভালো হবে না, সেখানে বিচালির জন্য ক্লোভার কাটতে পাঠান তিনি, ওরা একের পর এক বীজের উপযোগী সেরা দেসিয়াতিনাগুলো কেটে সাফ করল আর কৈফিয়ত দিলে যে গোমস্তা তাই বলেছিল এবং এই বলে সান্ত্বনা দিলে যে বিচালি হবে চমৎকার; কিন্তু উনি জানতেন যে ব্যাপারটা ঘটেছে কারণ এই দেসিয়াতিনাগুলোয় ঘাস কাটা সহজ। বিচালি ঝাঁকাবার জন্য যন্ত্র পাঠালেন তিনি, প্রথম সারিতেই ভেঙে ফেলা হল সেটা, কারণ মাথার ওপরে আন্দোলিত পাখনার তলে বসে থাকতে কৃষকের বেজার লাগছিল। তাঁকে বলা হল, ‘ভাবনা করবেন না, মেয়েরা ঝটাঝট ঝাঁকিয়ে দেবে।’ লাঙ্গল অকেজো হয়ে পড়ল কেননা মুনিষটার খেয়ালই হল না যে উঠে আসা ফালটা নামিয়ে দেওয়া দরকার, তার বদলে জবরদস্তি করে হাল দিয়ে সে ঘোড়াকে কষ্ট দিলে, নষ্ট করলে জমি; আর তাঁকে বলা হল শান্ত থাকতে। ঘোড়া ছেড়ে দেওয়া হল গম খেতে, কেননা কোন মুনিষই রাত-পাহারার কাজে থাকতে চায়নি এবং বারণ করা সত্ত্বেও তারা রাত পাহারায় রইল পালা করে, আর সারা দিন খাটার পর ঘুমিয়ে পড়ল ভানকা এবং নিজের দোষের জন্য এই বলে অনুতাপ করলে, ‘সে আপনার যা মর্জি, মালিক।’ তিনটা সেরা বাছুর মারা পড়ল কারণ পানি না খাইয়ে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল দ্বিতীয় বার গজানো ক্লোভারের জমিতে; আর কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইল না যে ওরা ফেঁপে উঠেছে ক্লোভার খেয়ে আর সান্ত্বনা দিলে যে প্রতিবেশীর একশ’ বারোটা গরু মারা পড়েছে তিন দিনে। এ সব ঘটছিল এজন্য যে কেউ লেভিন বা তাঁর জোতজমির ক্ষতি চাইছিল; উল্টে বরং লেভিনের জানা ছিল যে ওরা তাঁকে ভালোবাসে, তাঁকে মনে করে সরল ভদ্রলোক (যার অর্থ সর্বোচ্চ প্রশংসা); এ সব ঘটত কারণ ওরা খাটতে চাইত আনন্দে-ফুর্তিতে, বিনা চিন্তা-ভাবনায় আর লেভিনের স্বার্থ ওদের কাছে শুধু পরকীয়া ও দূর্বোধ্যই নয়, তাদের নিজেদের স্বার্থের মারাত্মক বিরোধী। বহু দিন থেকেই লেভিন চাষ-আবাদের সাথে নিজের সম্পর্কে অসন্তোষ বোধ করে আসছিলেন। তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন যে তাঁর নৌকায় পানি উঠছে, সম্ভবত ইচ্ছে করেই আত্মপ্রতারণায় ফুটোটা তিনি খোঁজেননি পাননি। কিন্তু এখন নিজেকে আর প্রতারণা করা চলে না। যে চাষ-আবাদ তিনি চালাচ্ছিলেন সেটা তাঁর কাছে শুধু আকর্ষণহীন নয়, বিরক্তিকর হয়ে উঠল, ও নিয়ে আর তিনি ব্যাপৃত থাকতে পারেন না।
এর সাথে আবার যোগ দিয়েছে তাঁর কাছ থেকে তিরিশ ভার্স্ট দূরে কিটি শ্যেরবাৎস্কায়ার উপস্থিতি, যাকে তিনি দেখতে চাইছেন অথচ পারছেন না। যখন উনি দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা অলোস্কায়ার ওখানে গিয়েছিলেন উনি তখন আসতে বলেছিলেন লেভিনকে : আসতে বলেছিলেন যাতে বোনের কাছে উনি পুনরায় বিবাহপ্রস্তাব দেন। ইঙ্গিত করেছিলেন যে সেটা এখন সে গ্রহণ করবে। কিটি শ্যেরবাৎস্কায়াকে দেখে লেভিন নিজেও বুঝেছিলেন যে কিটিকে তিনি ভালোবাসেন এখনো; কিন্তু কিটি অব্লোন্স্কিদের ওখানে আছে এটা জানা থাকায় তিনি সেখানে যেতে পারেন না। তিনি প্রস্তাব দিয়েছিলেন আর সে যে তা প্রত্যাখ্যান করেছে, এতে সৃষ্টি হয়েছে ওঁদের মধ্যে এক অনতিক্রম্য বাধা। ‘কিটি যাকে চেয়েছিল তার স্ত্রী হতে সে পারল না। শুধু এ কারণেই আমি তাকে অনুরোধ করতে পারি না আমার স্ত্রী হতে’, মনে মনে ভাবলেন লেভিন। এই ভানটা তাঁকে করে তুলল কিটির প্রতি নিরুত্তাপ ও বিরূপ। ‘ভর্ৎসনার একটা বোধ না নিয়ে ওর সাথে কথা বলা, বিদ্বেষ বোধ না করে ওকে তাকিয়ে দেখার সাধ্য আমার হবে না, এতে সে শুধু আমাকে আরো ঘৃণা করবে এবং তাই উচিত। তাছাড়া এখন দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা আমাকে যা বলেছেন তারপর কি করে ওঁদের যেতে পারি? ওঁর বলা থেকে আমি যা জেনে গেছি সেটা কি না-দেখাতে পারি আমি? আর মহত্ত্ব নিয়ে আমি কিনা যাব তাকে ক্ষমা করতে, কৃপা করতে। তার সামনে কিনা নেব ক্ষমাশীল প্রেমদাতার ভূমিকা!… কেন যে দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা আমাকে ওটা বললেন? দৈবাৎ আমি যদি ওকে দেখতে পেতাম, তাহলে সব কিছু হতে পারত আপনা থেকে কিন্তু তা অসম্ভব, অসম্ভব!’
কিটির জন্য মেয়েদের একটা জিন চেয়ে পাঠিয়েছিলেন দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা। লিখেছিলেন, ‘শুনেছি, আপনার জিন আছে। আশা করি, নিজেই সেটা নিয়ে আসবেন।
এটা তাঁর সহ্যাতীত। বুদ্ধিমতী সুচরিতা নারী বোনকে এমন হীনতায় ফেলতে পারেন কি করে! গোটা দশেক চিঠি লিখলেন তিনি, কিন্তু সব ছিঁড়ে ফেলে জিনটা পাঠালেন কোন জবাব না দিয়ে। তিনি যাবেন এ কথা লেখা অসম্ভব কারণ তিনি যেতে পারেন না। আবার উনি যেতে পারছেন না কারণ কিছু-একটা বাধা আছে অথবা অন্য কোথাও চলে যাচ্ছেন, এ কথা লেখা আরো খারাপ। জবাব না দিয়ে জিনটা পাঠালেন এই চেতনা নিয়েই যে একটা লজ্জার কাজ করলেন, পরের দিন বিরক্তিকর চাষাবাসের সমস্ত বার গোমস্তার হাতে তুলে দিয়ে তিনি বন্ধু সি্ভ্য়াজ্স্কির কাছে চলে গেলেন দূরের উয়েদে যার কাছাকাছি আছে একটা চমৎকার স্নাইপ জলা। ওঁর ওখানে যাবার সংকল্প তাঁর বহুদিনের, সেটা পূরণ করার অনুরোধ জানিয়ে সম্প্রতি চিঠিও লিখেছেন বন্ধুটি। সুরোভস্কি উয়েদের স্লাইপ জলা বহুদিন প্রলুব্ধ করেছে লেভিনকে, কিন্তু বিষয়কর্মের দরুন যাত্রাটা তিনি কেবলি পিছিয়েছেন। এবার কিন্তু শ্যেরবাৎস্কিদের নৈকট্য, বড় কথা বিষয়-আশয় ছেড়ে ঠিক শিকারে যেতেই আনন্দ হল তাঁর। সমস্ত দুঃখ-কষ্টে শিকারেই তিনি সেরা সান্ত্বনা পেয়েছেন।