এক
সের্গেই ইভানোভিচ কজ্নিশেভ মানসিক শ্রম থেকে বিশ্রাম নিতে চাইলেন, সচরাচরের মত তিনি বিদেশে না গিয়ে মে মাসে গ্রামে এলেন ভাইয়ের কাছে। তাঁর ধারণা, গ্রামীণ জীবনই সবচেয়ে ভালো। তিনি এখন ভাইয়ের কাছে এলেন সে জীবন উপভোগ করার জন্য। খুব খুশি হলেন কনস্তান্তিন লেভিন, সেটা আরও এই কারণে যে সে গ্রীষ্মে তিনি আর নিকোলাই ভাইয়ের আশা করছিলেন না। কিন্তু কজনিশেভের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা সত্ত্বেও ভাইকে নিয়ে ভেতরে ভেতরে অস্বস্তি বোধ করছিলেন কনস্তান্তিন লেভিন। গ্রামের প্রতি ভাইয়ের মনোভাব তাঁর কাছে অস্বস্তিকর, এমন কি অপ্রীতিকরই ঠেকেছিল। কনস্তান্তিন লেভিনের কাছে গ্রাম হল জীবনধারণের জায়গা, অর্থাৎ আনন্দ, দুঃখ, শ্রমের ভূমি; কজ্নিশেভের কাছে গ্রাম একদিকে হল খাটুনি থেকে বিশ্রাম, অন্যদিকে বিকৃতির হিতকর বিষনাশক ওষুধ যা তিনি সানন্দে এবং তার উপকারিতার চেতনা নিয়ে সেবন করতে লাগলেন। কনস্তান্তিন লেভিনের কাছে গ্রাম এই জন্য ভালো যে তা হল সন্দেহাতীত উপকারী শ্রমের আশ্রয; কজ্নিশেভের কাছে তা খুবই ভালো কারণ সেখানে কিছুই না করে থাকা যায় ও থাকা উচিত। তাছাড়া জনগণের প্রতি কজ্নিশেভের মনোভাব খানিকটা মোচড় দিচ্ছিল কনস্তান্তিনকে। কজ্নিশেভ বলতেন যে তিনি চাষীদের ভালোবাসেন। এবং তাদের চেনেন, প্রায়ই আলাপ করতেন তাদের সাথে আর ভান বা ঢং না করে সেটা তিনি করতে পরতেন ভালোই এবং এই রকম প্রতিটি আলাপ থেকে তিনি চাষীদের প্রশংসা করা এবং তিনি যে তাদের ভালো চেনেন তা প্রমাণের মত সাধারণ ইত্যাদি আহরণ করতেন। চাষীদের সম্পর্কে এই মনোভাব কনস্তান্তিন লেভিনের ভালো লাগেনি। কনস্তান্তিনের কাছে চাষীরা হল শুধু সাধারণ মেহনতে প্রধান শরিক। চাষীদের প্রতি সমস্ত শ্রদ্ধা এবং একটা রক্তের টান, যা নিশ্চয় তিনি তাঁর ধাই-মার দুধ খাওয়ার সাথে সাথে পেয়েছেন বলে তিনি নিজেই বললেন, যে সত্ত্বেও, সাধারণ কর্মকাণ্ডের শরিক হিসেবে এসব লোকেদের শক্তি, নম্রতা, ন্যায়বোধ দেখে মাঝে মাঝে উচ্ছ্বসিত হলেও সাধারণ কাজটায় যথন অন্য গুণের প্রয়োজন পড়ত, তখন চাষীদের ওপর তিনি চটে উঠতেন তাদের ঔদাসীনা, আলসেমি, মাতলামি, মিথ্যাবাদিতার জন্য। কনস্তান্তিন লেভিনকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করত চাষীদের তিনি ভালোবাসেন কিনা, তাহলে নিশ্চয় তিনি ভেবে পেতেন না কি উত্তর দেবেন। চাষীদের, যেমন সাধারণভাবে সমস্ত লোকদের তিনি ভালোবাসতেনও বটে; আবার বাসতেনও না। বলাই বাহুল্য, সহৃদয় মানুষ হিসেবে লোকদের তিনি ভালো না বাসার চেয়ে ভালোই বাসতেন বেশি, চাষীদের বেলাতেও তাই। কিন্তু বিশেষ একটা ব্যাপার হিসেবে চাষীদের ভালোবাসা বা না বাসা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। কারণ চাষীদের সাথে তিনি শুধু দিনই কাটাতেন না, তাঁর সমস্ত আগ্রহ চাষীদের সাথে জড়িত ছিল শুধু তাই নয়, নিজেকে তিনি চাষীদেরই একাংশ বলে মনে করতেন। নিজের এবং চাষীদের মধ্যে বিশেষ কোন গুণ বা ত্রুটি তাঁর চোখে পড়ত না, নিজেকে দাঁড় করাতে পারতেন না চাষীদের বিপরীতে। তাছাড়া মনিব, মধ্যস্থ, আর সবচেয়ে বড় কথা, পরামর্শদাতা হিসেবে (চাষীরা তাঁকে বিশ্বাস করত, তাঁর পরামর্শ নেবার জন্য তাঁর কাছে আসত ভার্স্ট চল্লিশেক পথ ভেঙে) তিনি চাষীদের সাথে অতি নিকট সম্পর্কে দীর্ঘ দিন কাটালেও তাদের সম্পর্কে তাঁর কোন সুনির্দিষ্ট মতামত ছিল না এবং চাষীদের তিনি জানেন কিনা এ প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে চাষীদের তিনি ভালোবাসেন কিনা প্রশ্নটার মতই সমান মুশকিলে পড়তেন। চাষীদের তিনি চেনেন বলা আর লোকদের তিনি চেনেন বলা তাঁর কাছে একই কথা। সব ধরনের লোকদেরই তিনি অনবরত পর্যবেক্ষণ করতেন, আবিষ্কার করতেন, চাষাভুষা লোকেরাও তার অন্তর্গত, এদের তিনি মনে করতেন ভালো লোক, মনোগ্রাহী লোক, অবিরাম তাদের মধ্যে নতুন নতুন দিক লক্ষ্য করতেন, তাদের সম্পর্কে নিজের পুরানো মত বদলে পৌছাতেন নতুন মতে। কজ্নিশেভ ছিলেন উলটো। যে জীবনটা তিনি ভালোবাসতেন না তার বিপরীতে যেমন তিনি ভালোবাসতেন ও তারিফ করতেন গ্রাম্য জীবনের ঠিক তেমনি যে শ্রেণীর লোককে তিনি ভালোবাসতেন না, তাদের বিপরীতেই তিনি ভালোবাসতেন চাষীদের এবং ঠিক তেমনি চাষীদের তিনি জানতেন লোকসাধারণের বিপরীত হিসেবে। তাঁর প্রণালীবদ্ধ মানসে পরিষ্কার দানা বেঁধেছিল কৃষকজীবনের সুনির্দিষ্ট কতকগুলো রূপ যা অংশত খাস কৃষকজীবন থেকেই নেওয়া, কিন্তু প্রধানত তার বিপরীতটা থেকে। তিনি কখনো চাষীদের সম্পর্কে নিজের মতামত এবং তাদের প্রতি তাঁর সহানুভূতিশীল মনোভাব বদলাননি।
দুই ভাইয়ের চাষীদের ব্যাপারে মতভেদ ঘটলে কজ্নিশেভ সব সময়ই ভাইকে পরাজিত করতেন ঠিক এই জন্য যে চাষীদের, তাদের চরিত্র, বৈশিষ্ট্য, রুচি সম্পর্কে তাঁর ছিল সুনির্দিষ্ট সব ধারণা; কনস্তান্তিন লেভিনের কিন্তু সুনির্দিষ্ট ও অপরিবর্তিত কোন ধারণা ছিল না, ফলে তর্কগুলোয় সব সময়ই তিনি তাঁর স্ববিরোধে ধরা পড়তেন।
সের্গেই ইভানোভিচ কজ্নিশেভের কাছে তাঁর ছোট ভাই খুবই ভালো ছেলে। হৃদয়টা বসানো আছে ভালোই (কথাটা বলতেন তিনি ফরাসিতে), কিন্তু বুদ্ধিটা বেশ ক্ষিপ্র হলেও তাৎক্ষণিক ধারণার বশবর্তী, সুতরাং স্ববিরোধে ভরা। বড় ভাই মাঝে মাঝে কৃপা করে লেভিনকে ব্যাপার-স্যাপারের তাৎপর্য বুঝিয়ে দিয়ে, কিন্তু তাঁর সাথে তর্ক করে তৃপ্তি পেতেন না, কেননা লেভিন হেরে যেতেন বড় বেশি সহজেই।
তাঁর বড় ভাইকে কনস্তান্তিন লেভিন মনে করতেন অতি-মেধাবী ও শিক্ষিত একজন লোক, সর্বাধিক মাত্রায় উচ্চমনা, সাধারণের কল্যাণে ক্রিয়াকলাপ চালাতে পারায় কৃতিত্ব আছে। কিন্তু যতই তাঁর বয়স হচ্ছে আর বড় ভাইকে ঘনিষ্টভাবে আনছেন ততই মনের গভীরে কেবলই তাঁর ধারণা হতে লাগল যে সাধারণের কল্যাণে ক্রিয়াকলাপ চালাতে পারার এই যে কৃতিত্বটা লেভিনের মোটেই নেই বলে তিনি টের পান, সেটা হয়ত-বা গুণ নয়, বরং উল্টো, শুভ, সাধু উন্নত বাসনার ঘাটতি সেটা নয়, জীবনশক্তির ঘাটতি, সেটার ঘাটতি যাকে বলা হয় হৃদয়, সেই আকাঙ্ক্ষার ঘাটতি যা জীবনের অসংখ্য পথের মধ্যে থেকে কেবল একটাকে বেছে নিতে, সেই একটাকেই চাইতে বাধ্য করে। ভাইকে লেভিন যত বেশি করে জানলেন, ততই লক্ষ্য করলেন যে কজ্নিশেভ এবং সাধারণ কল্যাণের অন্যান্য বহু কর্মী সাধারণ কল্যাণের জন্য এই ভালোবাসায় উপনীত হয়েছেন প্রাণের তাগিদে নয়, বুদ্ধি দিয়ে ভেবে দেখেছেন যে এ কাজে লিপ্ত হওয়া ভালো, তাই লিপ্ত হয়েছেন। লেভিনের এই অনুমান আরও দৃঢ় হল এই দেখে যে এক দফা দাবা খেলা কিংবা নতুন একটা যন্ত্রের বুদ্ধিমান কারিগরির চেয়ে সাধারণ কল্যাণ আর আত্মার অমরতার প্রশ্নটা তাঁর হৃয়দকে এতটুকু বেশি নাড়া দেয় না। তাছাড়া গাঁয়ে ভাইয়ের সাথে থাকতে কনস্তান্তিন লেভিনের অস্বস্তি হচ্ছিল আরও এজন্য যে গাঁয়ে, বিশেষ করে গ্রীষ্মে, লেভিনকে অনবরত চাষবাস নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হত আর যেমনটা দরকার সব কিছু সেভাবে ঢেলে সাজার পক্ষে গ্রীষ্মের লম্বা দিনগুলোতেও কুলাচ্ছিল না, অথচ কজ্নিশেভ বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। কিন্তু এখন তিনি বিশ্রাম নিলেও, অর্থাৎ নিজের রচনা নিয়ে না খাটালেও মানসিক কর্মে তিনি এত অভ্যস্ত যে মাথায় যে চিন্তাটা এসেছে সেটাকে একটা সুন্দর সংক্ষিপ্ত রূপ দিয়ে প্রকাশ করতে তিনি ভালোবাসতেন এবং ভালোবাসতেন কেউ তাঁর কথা শুনুক। আর সবচেয়ে সাধারণ স্বাভাবিক শ্রোতা তো হবে তাঁর ভাই। এবং তাই তাঁদের সম্পর্কের সৌহার্দপূর্ণ সহজতা সত্ত্বেও বড় ভাইকে একলা রেখে যেতে কনস্তান্তিনের অস্বস্তি হত। ঘাসের ওপর শুয়ে থাকতে, শুধুই শুয়ে থেকে রোদ পোয়াতে-পোয়াতে অলস বকবকানি চালিয়ে যেতে কজ্নিশেভ খুব ভালোবাসতেন। ভাইকে বলতেন, ‘তুই ভাবতে পারবি না এই নবাবী আলসেমিতে আমার কি আরাম। মাথার একটা চিন্তাও সেই। একেবারে ফাঁকা বেলুন।’ কিন্তু কনস্তান্তিন লেভিনের বসে বসে তাঁর কথা শুনতে খারাপ লাগত, বিশেষ করে এজন্য যে তিনি না থাকলে লোকগুলো গোবর-সার নিয়ে যাবে তৈরি না হয়ে ওঠা ক্ষেতে আর নজর না রাখলে যেমন-তেমন করে কোথায় যে ফেলবে, খোদাই জানেন। কালটিভেটারের ব্লেডগুলো স্ক্রু-আঁটা করে আঁটবে না, খুলে ফেলবে, বলবে এগুলো সব বাজে খেয়াল, এ কি আর আমাদের সেই সাবেকি লাঙল?
কজ্নিশেভ তাঁকে বলতেন, ‘খুব হয়েছে তোর রোদে রোদে ঘোরা।’
‘না, আমাকে শুধু এক মিনিটের জন্যে সেরেস্তায় যেতে হবে’, বলে লেভিন ছুটে যেতেন জমিতে।
দুই
জুন মাসের প্রথমদিকে লেভিনের ধাই-মা এবং হিসাবরক্ষক আগাফিয়া মিখাইলোভনা এক বয়াম ব্যাঙের ছাতা সদ্য লবণে জারিয়ে মাটির নিচের কুঠুরিতে নিয়ে যেতে গিয়ে পিছলে পড়ে কব্জি ভাঙলেন। এলেন জেমভোর ডাক্তার, সবেমাত্র কোর্স শেষ করা বকবকুনে একটা ছাত্র। হাত দেখে বললেন যে ভাঙেনি, কমপ্রেস দিলেন, রয়ে গেলেন দ্বিপ্রাহরিক আহারের জন্য, বোঝা যায় নামকরা কজ্নিশেভের সাথে আলাপে তিনি জমে গিয়েছিলেন, এবং নানা ব্যাপারে নিজের আলোকপ্রাপ্ত মতামত তাঁকে জানাবার জন্য সমস্ত স্থানীয় লোকনিন্দাগুলো আওড়ালেন, আর অভিযোগ করলেন যে জেমভোর ব্যাপার-স্যাপার খুবই খারাপ। কজ্নিশেভ মন দিয়ে শুনলেন, জিজ্ঞাসাবাদ করলেন, নতুন শ্রোতা পেয়ে চাঙ্গা হয়ে কথা বলে গেলেন। অব্যর্থ এবং ওজনদার মন্তব্য করলেন কয়েকটা, যার সসম্ভ্রম মূল্য দিলেন তরুণ ডাক্তার, মেজাজ তাঁর হয়ে উঠল তেমনি শরিফ যা লেভিনের পরিচিত, চমৎকার উৎসাহিত কথোপকথনের পর সাধারণত তাঁর এ রকম হয়। ডাক্তার চলে যাবার পর কজ্নিশেভ ছিপ নিয়ে নদীতে যাবার বাসনা প্রকাশ করলেন। মাছ ধরতে ভালোবাতেন তিনি আর এমন একটা নির্বোধ কাজ যে তিনি ভালোবাসতেন পারেন, তাতে যেন গর্বই হত তাঁর।
কনস্তান্তিন লেভিনের জমিতে এবং ঘেসো মাঠে যাবার দরকার ছিল। তিনি তাঁর ছোট গাড়িটায় করে পৌঁছে দেবার জন্য ডাকলেন ভাইকে।
তখন সেরকম একটা সময়, গ্রীষ্ম-শরতের সন্ধিকাল, যখন বর্তমান বছরের ফসলের ভাগ্য স্থিরীকৃত হয়ে গেছে। যখন শুরু হচ্ছে সামনের বছরের বপনের জন্য যত্ন, এগিয়ে এসেছে ঘাস কাটার সময়, যখন মঞ্জরি ধরেছে রাই গাছে, তখনও হালকা, ধূসর-সবুজ সে মঞ্জরি আন্দোলিত হয় বাতাসে, যখন মাঝে মাঝে হলদেটে ঘাসের ঝোপ নিয়ে দেরিতে চষা মাঠে অসমান হয়ে ছড়িয়ে পড়ে সবুজ ওট, যখন মাটি ঢেকে ফেলে আগে আগে ফলা বাক-হুইটের কোরকোদ্গম হয়ে গেছে, যখন লাঙলের ফাল না-বসা পথগুলো ছেড়ে দিয়ে গরু চরে চরে শক্ত হয়ে ওঠে পতিত জমিগুলোর অর্ধেকে হাল পড়েছে; যখন প্রতিদিন ঊষার মাঠে জড়ো করে রাখা শুকিয়ে ওঠা গোবর সারের গন্ধ মেশে মধুগন্ধী ঘাসের সৌরভের সাথে আর নাবালে কাস্তের অপেক্ষায় অটুট সমুদ্রের মত পড়ে থাকে ঘেসো মাঠ যার এখানে-ওখানে কালো হয়ে ওঠে আগাছা নিড়ানো সরেল শাকের স্তূপ।
এটা সেই সময় যখন প্রতি বছরে পুনরাবৃত্ত এবং প্রতি বছরে চাষীদের সমস্ত শক্তি দাবি করা ফসল তোলার আগে গাঁয়ের কাজে সামান্য বিরতি দেখা দেয়। ফসল হয়েছিল চমৎকার, ঝকঝকে গরম গ্রীষ্মের দিন, শিশির ঝরা ছোট রাত।
ঘেসো জমিটায় পৌঁছার জন্য দু’ভাইকে যেতে হয় বনের মধ্যে দিয়ে। পল্লবে ছাওয়া বনটার সৌন্দর্যে সর্বক্ষণ মুগ্ধ হয়ে থাকছিলেন কজ্নিশেভ, ভাইকে কখনো দেখাচ্ছিলেন ফুল ফোটার জন্য তৈরি হয়ে ওঠা, হলুদ উপপত্রে চিত্রবিচিত্র, ছায়ার দিকটায় কালো রঙের কোন-একটা বুড়ো লাইম, কখনো গাছের এই বছরে গজানো পান্নার ঝলমলে কচি ডাল। প্রকৃতির সৌন্দর্যের কথা বলতে বা শুনতে কনস্তান্তিন লেভিন ভালোবাসতেন না। যা তিনি দেখলেন তার সৌন্দর্য তাঁর কাছে লোপ পায় কথায়। বড় ভাইয়ের বক্তব্যে তিনি সায় দিচ্ছিলেন বটে, কিন্তু আপনা থেকে তাঁর মন চলে গিয়েছিল অন্য দিকে। বন পেরিয়ে আসার পর তাঁর সমস্ত মনোযোগ গ্রাস করে নিল ঢিবির ওপর ফেলে রাখা একটা মাঠের দৃশ্য, তার কোন জায়গা ঘাসে হলুদ, কোন জায়গা দলিত, চৌখুপি-মারা, কোথাও সারের ডাঁই, কোথাও হাল দেওয়া। সারি দিয়ে গাড়ি যাচ্ছিল মাঠে গাড়িগুলো গুনলেন লেভিন, যতটা সার দরকার তা সবই নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলে খুশি হলেন। ঘেসো মাঠ দেখে মন তাঁর চলে গেল বিচালি কাটার প্রশ্নে। বিচালি তোলায় তিনি একটা বিশেষ উত্তেজনা বোধ করতেন সব সময়ই। ঘেসো মাঠটার কাছে গিয়ে লেভিন ঘোড়া থামালেন।
তখনো ঘন ঘাসের তলে তলে প্রভাতী শিশির থেকে গিয়েছিল। পা যাতে না ভেজে তার জন্য কজ্নিশেভ ভাইকে বললেন তাঁর গাড়ি করে মাঠ দিয়ে তাঁকে সেই উইলো ঝোপটায় পৌঁছে দিতে, যেখানে পার্চ মাছ আদার খায় ভালো। নিজের ঘাসগুলো ধামসাতে কনস্তান্তিন লেভিনের খুবই কষ্ট হলেও তিনি মাঠে গাড়ি হাঁকালেন। চাকা আর ঘোড়ার পায়ের কাছে জড়িয়ে যেতে লাগল লম্বা লম্বা ঘাস, ভেজা স্পোক আর ধুরায় লেগে তাদের বিচি থাকছিল।
বড় ভাই ঝোপের নিচে বসে ছিপ ঠিকঠাক করতে লাগলেন আর লেভিন ঘোড়াকে খুলে নিয়ে গিয়ে বেঁধে রাখলেন গাছের সাথে। তারপর নামলেন বাতাসে নিশ্চল ঘাসের বিশাল ধূসর-সবুজ সমুদ্রে। জলো জায়গাগুলোয় পাকন্ত বিচি ভরা ঘাস প্রায় কোমর সমান।
মাঠটা আড়াআড়ি পার হয়ে লেভিন রাস্তায় উঠলেন, দেখা হল চোখ-ফুলো একটা লোকের সাথে, মৌমাছির চাক নিয়ে যাচ্ছিল সে।
লেভিন জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি ফোমিচ? ধরলে নাকি?’
‘কোথায় আর ধরি কনস্তান্তিন দ্মিত্রিচ! নিজেরগুলো সামলে রাখতে পারলেই বাঁচি… এই দ্বিতীয়বার পালিয়েছিল। ছোঁড়াগুলোকে বলিহারি, ঘোড়া ছুটিয়ে যায়। ঐ যে আপনার এখানে লাঙল দেয় যারা। ঘোড়া খুলে গিয়ে পাল্লা ধরে
‘তা কি বলছ ফোমিচ। ঘাস কাটতে লাগব নাকি সবুর করব?’
‘কি আর বলি! আমরা তো সেন্ট পিটার উৎসব পর্যন্ত সবুর করি। আপনি কিন্তু বরাবর আগে শুরু করেন। তা দেখুন, সৃষ্টিকর্তা দেবেন, ঘাস তো খুবই ভালো। গরু-ঘোড়া খেয়ে বাঁচবে।’
‘কিন্তু আবহাওয়া কেমন হবে বলে ভাবছ?’
‘সেটা সৃষ্টিকর্তার হাত। আবহাওয়াও হয়ত ভালো থাকবে।
লেভিন ভাইয়ের কাছে এলেন। মাছ মেলেনি, কিন্তু তাতে কিছু এসে যায়নি। কজ্নিশেভের, বেশ ফুর্তির মেজাজেই আছে বলে মনে হল। লেভিন দেখতে পাচ্ছিলেন যে, ডাক্তারের সাথে আলাপটা তাঁকে চাগিয়ে তুলেছে। কথা বলার ঝোঁক এসেছে তাঁর। লেভিন কিন্তু চাইছিলেন তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে, যাতে পরের দিন ঘেসুড়েদের ডাকার হুকুম দিয়ে ঘাস কাটা নিয়ে যে সন্দেহটা তাঁকে খুবই ভাবাচ্ছিল সেটা চুকিয়ে দেন। বললেন, ‘যাওয়া যাক তাহলে।’
‘এত তাড়া কিসের? খানিক বসে থাকি না কেন? তবে জবর ভিজেছিস বটে! মাছ না মিললেও বেশ লাগছে। সমস্ত রকমের শিকারই ভালো, কেননা ব্যাপারটা প্রকৃতি নিয়ে। দ্যাখ কি সুন্দর এই ইস্পাতের মত পানিটা!’ উনি বললেন, ‘আর ঘাসে ভরা এই তীর’, বলে চললেন উনি, ‘সব সময়ই আমাকে মনে করিয়ে দেয় ওই ধাঁধাটার কথা। জানিস তো? ঘাস বলছে পানিকে : আর আমরা টলছি, কেবলই টলছি…’
লেভিন মনমরার মত জবাব দিলেন, ‘ওই ধাঁধা আমি জানি না।’
তিন
সের্গেই ইভানোভিচ কজ্নিশেভ বললেন, ‘শোন, তোর কথাই আমি ভাবছিলাম। ডাক্তারটি আমাকে যা বলল, তাতে তোদের উয়েদে যা ঘটছে সে যে সৃষ্টিছাড়া ব্যাপার; ছোকরার বেশ বুদ্ধিশুদ্ধি আছে। আমি তোকে আগেও বলেছি, এখনও বলছি : তুই যে সভায় যাস না এবং সাধারণভাবেই জেমস্ভোর ব্যাপার-স্যাপার থেকে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছিস, এটা খারাপ। সৎ লোকেরা যদি সরে যায়, তাহলে তো বলাই বাহুল্য, সৃষ্টিকর্তাই জানেন কি দাঁড়াবে। আমরা টাকা দিচ্ছি, তা যাচ্ছে মাইনেতে, অথচ স্কুল নেই, সহকারী ডাক্তার নেই, ধাই নেই, ওষুধের দোকান নেই, কিচ্ছুই নেই।’
‘চেষ্টা তো আমি করেছিলাম’, মৃদুস্বরে অনিচ্ছাভরে লেভিন বললেন, ‘পারি না! কি করা যাবে!
‘পারিস না কেন? সত্যি বলছি আমি বুঝি না। উদাসীনতা, অকর্মণ্যতার কথা আমি মানি না; সত্যিই কি তবে নেহাৎ আলস্য?’
‘ওর কোনটাই নয়। আমি চেষ্টা করেছিলাম, দেখলাম কিছুই করতে পারি না’, লেভিন বললেন।
বড় ভাই যা বলছিলেন তাতে বিশেষ মন যাচ্ছিল না লেভিনের। নদীর ওপারে খেতের দিকে ভালো করে তাকিয়ে তিনি কালোমত কি-একটা লক্ষ্য করলেন, কিন্তু ধরতে পারছিলেন না সেটা ঘোড়া, নাকি ঘোড়ার পিঠে গোমস্তা।
‘কেন, তুই কিছু করতে পারিস না? চেষ্টা করে দেখলি, তোর মতে হল না, আর তুইও অমনি হাল ছেড়ে দিলি। তোর আত্মসম্মান নেই?’
‘আত্মসম্মান’, লেভিন বড় ভাইয়ের কথার মর্মাহত বললেন, ‘আমি বুঝতে পারছি না। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাকে যদি কখনো বলা হত যে, সমাকলন অংক অন্যরা বোঝে আমি বুঝি না, সেটা হত আত্মসম্মানের ব্যাপার। কিন্তু এক্ষেত্রে এ সব কাজের খানিকটা সামর্থ্য আছে এবং বড় কথা, কাজগুলো অতি-জরুরি, প্রথমেই এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ হওয়া দরকার।’
‘কি বলছিস! ওটা কি জরুরি নয়?’ তিনি যা নিয়ে ভাবিত সেটা যে ভাইয়ের কাছে গুরুত্বহীন মনে হচ্ছে এবং বিশেষ করে ভাই যে স্পষ্টতই তাঁর কথা প্রায় শুনতেও না, এতে আহত হয়ে বললেন কজ্নিশেভ।
‘আমার কাছে জরুরি বলে মনে হয় না। আমাকে স্পর্শ করে না, কি করা যাবে?…’ লেভিন বললেন এবং ধরতে পারলেন যে তিনি যাকে দেখেছিলেন সে তাঁর গোমস্তা এবং নিশ্চয় হাল দেওয়া থেকে চাষীদের সে ছেড়ে দিচ্ছে। লাঙল উলটে ধরছে তারা। হাল দেওয়া শেষ হয়ে গেল নাকি?’ মনে মনে ভাবলেন তিনি।
‘কিন্তু শোন’, সুকুমার বুদ্ধিমান মুখখানায় ভ্রূকুটি ফুটিয়ে বড় ভাই বললেন, ‘সব কিছুরই একটা সীমা আছে। খাপছাড়া, অকপট লোক হওয়া, মিথ্যে ভালো না-বাসা খুবই ভালো—এসবই আমি জানি; কিন্তু তুই যা বলছিল তার হয় কোন অর্থ নেই নয় অর্থটা খুবই খারাপ। এটাকে তুই কি করে গুরুত্বহীন বলে ভাবতে পারিস যখন যে চাষীদের তুই ভালোবাসিস বলছিস…’
‘আমি তা কখনো বলিনি’, মনে মনে ভাবলেন কনস্তান্তিন লেভিন।
‘…তারা মরছে কোন সাহায্য না পেয়ে। বিটকেলে মহিলাদের হাতে মারা যাচ্ছে শিশুরা, চাষীরা অজ্ঞতার মধ্যে পড়ে থাকছে, তাদের ওপর মাতব্বরি করছে যত রাজ্যের কলমবাজ, অথচ তোর হাতে রয়েছে সাহায্য করার উপায়, কিন্তু করছিস না। কারণ তোর মতে, ওটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।
কনস্তান্তিন লেভিন টের পেলেন যে, এখন তাঁর পক্ষে খোলা আছে শুধু দুটো পথ : হল বড় ভাইয়ের কথায় সায় দেওয়া, নয় মেনে নেওয়া যে সাধারণ কল্যাণের জন্য তার ভালোবাসা কম। এটা তাঁকে অপমানিত ও দুঃখিত করল।
দৃঢ়ভাবে বললেন, ‘একটাও বটে, ওটাও বটে। আমি দেখতে পাচ্ছি না কি করে সম্ভব হত…’
‘সে কি? টাকার ভালো বিলি-ব্যবস্থা করে চিকিৎসায় সাহায্য দেওয়া যেত না?
‘আমার মনে হয়, যেত না…বসন্তের বান, শীতের বরফ-ঝড়, চাষের মৌসুম নিয়ে আমাদের উয়েদের চার হাজার বর্গ ভার্স্ট এলাকায় সবখানে চিকিৎসা-সাহায্যের সম্ভাবনা আমি দেখছি না। তা ছাড়া ওষুধপত্রে আমার বিশ্বাসও নেই।
‘নে, খুব হয়েছে, এটা অন্যায়… আমি তোকে হাজারটা দৃষ্টান্ত দিতে পারি… কিন্তু স্কুল?’
‘স্কুল কি হবে?’
‘কি বলছিস তুই? শিক্ষার উপকারিতা নিয়ে কোন সন্দেহ থাকতে পারি কি? শিক্ষা যদি তোর পক্ষে ভালো হয়, তাহলে সবার পক্ষেই ভালো।’
কনস্তান্তিন লেভিন টের পাচ্ছিলেন যে, নৈতিক দিক থেকে তিনি কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। তাই উত্তেজিত হয়ে সামাজিক কল্যাণের জন্য তাঁর উদাসীনতার প্রধান কারণটা বলে ফেললেন।
‘সম্ভবত এসবই বেশ ভালো, কিন্তু কেন আমি ব্যস্ত চিকিৎসা-কেন্দ্র খোলা নিয়ে যখন কখনো আমি তা ব্যবহার করব না, স্কুল-নিজের ছেলেমেয়েদের আমি পাঠাব না যেখানে, চাষীরাও যেখানে পাঠাতে চায় না তাদের ছেলেমেয়েদের আর পাঠানো যে দরকার তেমন একটা দৃঢ়বিশ্বাস আমার এখনো নেই’, লেভিন বললেন।
এই অপ্রত্যাশিত আপত্তি মুহূর্তের জন্য বিস্মিত করল কজ্নিশেভকে। তবে তখনই তিনি আক্রমণের নতুন পরিকল্পনা ফাঁদলেন।
চুপ করে রইলেন তিনি, একটা ছিপ তুলে আবার সেটা ফেললেন, হেসে ভাইকে বললেন : ‘নে, তবে বলি…. প্রথমত চিকিৎসা-কেন্দ্রের দরকার ছিল। এই তো আমরা আগাফিয়া মিখাইলোভনার জন্যে জেমভোর ডাক্তারকে ডাকলাম।’
‘তবে আমার ধারণা, হাত বাঁকাই থেকে যাবে।’
‘সেটা এখানে সুনিশ্চিত নয়…তাপর সাক্ষর চাষী, মুনিষ যে তোর বেশি দরকার, বেশি কাজের।’
উঁহু, যাকে খুশি জিজ্ঞেস কর’, দৃঢ়ভাবে বললেন, ‘কনস্তান্তিন লেভিন, মুনিষ হিসেবে সাক্ষরেরা অনেক খারাপ। রাস্তা মেরামত করবে না তারা; সাঁকো বানানো মাত্র তার কাঠ চুরি যাবে।’
‘তবে’, মুখ হাঁড়ি করে বললেন কজ্নিশেভ। বিরোধিতা সইতে পারতেন না তিনি, বিশেষ করে এমন বিরোধিতা যা ক্রমাগত সরে যাচ্ছে একটা থেকে আরেকটায়, কোন সম্পর্ক না রেখে হাজির করছে নতুন যুক্তি, ফলে বোঝাই যায় না কোনটার জবাব দিতে হবে, ‘তবে ওটা কোন কথা নয়। শোন বলি। শিক্ষা যে জনগণের পক্ষে কল্যাণকর সেটা তুই স্বীকার করিস কি?’
1
‘করি’, ঝট করে বলে বসলেন লেভিন এবং তখনই বুঝলেন যে তিনি যা ভাবেন সেটা বলা হল না। তিনি টের পেলেন যে, এটা স্বীকার করল তাঁকে দেখিয়ে দেওয়া হবে যে তিনি বাজে কথা বলছেন যার কোন অর্থ হয় না। কি করে দেখিয়ে দেওয়া হবে সেটা তিনি জানতেন না, কিন্তু এটা জানতেন যে নিঃসন্দেহে যুক্তিযুক্তরূপেই তা দেখানো হবে এবং তার অপেক্ষায় রইলেন তিনি।
যা তিনি আশা করেছিলেন যুক্তিটা এল তার চেয়ে অনেক সহজভাবে।
কজ্নিশেভ বললেন, ‘এটাকে তুই কল্যাণ বলে যদি মানিস, তাহলে সৎ লোক হিসেবে তুই ও-কাজটাকে ভালো না বেসে, তার প্রতি সহানুভূতি পোষণ না করে। সুতরাং তার জন্যে খাটতে ইচ্ছুক না হয়ে পারিস না।’
‘কিন্তু আমি এখনও মানছি না যে কাজটা ভালো’, লাল হয়ে বললেন কনস্তান্তিন লেভিন।
‘সে কি? তুই যে এখনই বললি … ‘
‘মানে, আমি ওটাকে ভালো বলেও মানি না, সম্ভবও মনে করি না।’
‘তা ধরে নিচ্ছি’, লেভিন বললেন। যদিও মোটেই তা ধরে নিচ্ছিলেন না, ‘ধরে নিচ্ছি নয়, তাই। তাহলেও আমি দেখতে পাচ্ছি না কেন ও নিয়ে আমি মাথা ঘামাব।’
‘না, এ নিয়ে যখনই কথাই উঠল, তাহলে আমাকে দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে বুঝিয়ে দাও’, লেভিন বললেন। ‘এখানে দর্শন আসে কোথা থেকে, আমি বুঝি না’, কজ্নিশেভ বললেন এমন সুরে যাতে লেভিনের মনে হল যেন দর্শন নিয়ে কথা বলার অধিকার তিনি ভাইকে দিতে চান না। সেটা চটিয়ে দিল লেভিনকে।
তিনি উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘এই জান! আমি মনে করি যে যতই বল আমাদের সমস্ত ক্রিয়াকলাপের চালিকা হল ব্যক্তিগত সুখ। এখন জেমভো প্রতিষ্ঠানটা অভিজাত হিসেবে আমার কোন কল্যাণ লাগছে, তা আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। রাস্তাগুলো ভালো হয়নি এবং হতেও পারে না; খারাপ রাস্তায়ও আমার ঘোড়াগুলো বয়ে নিয়ে যাবে আমাকে। ডাক্তার, চিকিৎসা-কেন্দ্রে আমার দরকার নেই। সালিশ আদালত আমার চাই না—কখনো আমি তার দ্বারস্থ হইনি, হবও না। স্কুল আমার কাছে নিষ্প্রয়োজন শুধু নয়, ক্ষতিকরই—সে তো তোমাকে বলেছি। জেমস্তভো প্রতিষ্ঠান আমার কাছে শুধু দেসিয়াতিনা পিছু আঠারো কোপেক দেওয়া, শহরে যাওয়া, ছারপোকার সাথে রাত কাটানো আর যত রাজ্যের আজেবাজে কথা শুনে যাওয়ার বাধ্যতা, আমার ব্যক্তিগত কোন স্বার্থ তা মেটায় না।’
‘দাঁড়া’, হেসে বাধা দিলেন কজ্নিশেভ, ‘চাষীদের মুক্তির জন্যে খাটতে ব্যক্তিগত কোন স্বার্থ আমাদের প্রলুব্ধ করেনি, অথচ খেটেছি আমরা।’
‘তা নয়!’ আরো উত্তেজিত হয়ে বাধা দিলেন লেভিন, ‘চাষীদের মুক্তিটা অন্য ব্যাপার। ব্যক্তিগত স্বার্থ তাতে ছিল। যে জোয়ালটা আমাদের, সমস্ত ভালো লোকদের পিষ্ট করেছিল সেটা আমরা ছুঁড়ে ফেলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পৌরসভার সদস্য হওয়া, কত জন মেথর দরকার, যে শহরে আমি থাকি না সেখানে কিভাবে পাইপ বসাতে হবে— তা নিয়ে আলোচনা চালানো; জুরি হয়ে বসে হ্যাম চুরি-করা কোন চাষীর বিচার করা, আসামীর উকিল আর অভিশংসক যেসব আজেবাজে কথা ফাঁদছেন ছ’ঘণ্টা ধরে তা এবং বিচারপতি কিভাবে আমার বুড়ো বোকাটা আলিওশাকে জিজ্ঞেস করবেন, ‘অভিযুক্ত সাহেব, আপনি কি হ্যাম চুরির ঘটনাটা স্বীকার করছেন?’
‘অ্যাঁ? এসব শোনা…’
মেতে উঠে কনস্তান্তিন নকল করতে লাগলেন বিচারপতি আর বোকা আলিওশাকে; তাঁর মনে হয়েছিল এতে কাজ দেবে।
কিন্তু কাঁধ নাড়ালেন কজ্নিশেভ।
‘তা তুই কি বলতে চাস?’
‘আমি শুধু বলতে চাই যে আমাকে, আমার স্বার্থকে স্পর্শ করছে যেসব অধিকার তা আমি রক্ষা করব প্রাণপণে; যখন আমাদের, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের খানাতল্লাশি করা হয়, সশস্ত্র পুলিশেরা আমাদের চিঠিপত্র পড়ে, তখন সর্বশক্তিতে এসব অধিকার রক্ষা করতে, আমার শিক্ষার, স্বাধীনতার অধিকার রক্ষা করতে প্রস্তুত ছিলাম। বাধ্যতামূলক সৈন্যভুক্তির ব্যাপারটা আমি বুঝি যা আমার সন্তানদের, ভাইদের ভাগ্যকে, খোদ আমাকেই স্পর্শ করছে; যা আমাকে নিয়ে তা আলোচনা করতে আমি প্রস্তুত; কিন্তু জেমভোর চল্লিশ হাজার টাকাটার কি ব্যবস্থা হবে তা স্থির করা অথবা বোকা আলিওশার বিচার করা—এটা আমি বুঝিও না, পারিও না।’
কনস্তান্তিন এমনভাবে বললেন যেন তাঁর কথা বাঁধ ভেঙে লাগবে সাবেকি কজ্নিশেভ হাসলেন।
‘আর কাল যদি তোর বিচার হয়, তোর কি ভালো লাগবে সাবেকি ফৌজদারি আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে?’
‘বিচার আমার হবে না। কারও গলা আমি কাটব না কখনো, ওসবের প্রয়োজন নেই আমার, তাহলে বলি!’ আবার একেবারে অপ্রাসঙ্গিক কথায় লাফিয়ে গিয়ে বলে চললেন লেভিন, ‘জেমভো প্রতিষ্ঠানগুলো এবং এসব কিছুই সেই কাটা বার্চ গাছগুলোর মত যা আমরা ট্রিনিটি দিনে পুঁতি যাতে ইউরোপে আপনা-আপনি গজানো বনের মত দেখায়। মনে-প্রাণে এসব বার্চে পানি দিতে বা বিশ্বাস করতে আমি পারি না।’
শুধু কাঁধ কোঁচাকালেন কজ্নিশেভ, বিতর্কের মধ্যে হঠাৎ এখন কোথা থেকে এসব বার্চ এসে পড়ায় তাঁর বিস্ময় প্রকাশ করতে চাইলেন ভঙ্গিটায়, যদিও তখনই বুঝলেন এতে করে কি বলতে চাইছেন তাঁর ভাই।
মন্তব্য করলেন, ‘দাঁড়া, এ যে কোন যুক্তি হল না।’
কিন্তু নিজের যে ত্রুটির কথা কনস্তান্তিন লেভিন জানতেন, সাধারণ কল্যাণের প্রতি উদাসীনতা, সেটাকে সমর্থন করতে চাইছিলেন তিনি, তাই বলে চললেন : ‘আমি মনে করি কোন কাজই পাকাপোক্ত হতে পারে না যদি ব্যক্তিগত স্বার্থে তার ভিত্তি না থাকে। এটা হল একটা সাধারণ সত্য, দার্শনিক সত্য’, দার্শনিক শব্দটার দৃঢ় পুনরাবৃত্তি করে বললেন তিনি, যেন দেখাতে চাইলেন যে সকলের মত তাঁরও অধিকার আছে দর্শন নিয়ে কথা বলার।
আরেকবার হাসলেন কজ্নিশেভ। ভাবলেন, ‘নিজের ঝোঁকগুলোকে সমর্থনের জন্যে ওরও কি একটা দর্শন আছে দেখছি।’
‘নে, দর্শনের কথা রাখ তো। সমস্ত যুগের দর্শনের প্রধান কাজটাই হল ব্যক্তিগত ও সাধারণ স্বার্থের মধ্যে যে আবশ্যকীয় যোগাযোগ বর্তমান তা খুঁজে পাওয়া। কিন্তু সেটা প্রশ্ন নয, প্রশ্নটা এই যে তোর তুলনাটা আমার শুধু শুধরে দিতে হবে। যে মার্চ গাছ মাটিতে গোঁজা হয়নি, রোপণ করা হয়েছে, বপন করা হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। কেবল সেই জাতিরই ভবিষ্যৎ থাকে, তাদেরই ঐতিহাসিক বলা যায় যারা নিজেদের প্রথা- প্রতিষ্ঠানের যা গুরুত্বপূর্ণ আর তাৎপর্যময়, তার সম্পর্কে সজাগ এবং মূল্য দেয় তাতে।’
এবং প্রশ্নটাকে কজ্নিশেভ নিয়ে গেলেন কনস্তান্তিন লেভিনের অনায়ত্ত দার্শনিক-ঐতিহাসিক ক্ষেত্রে এবং দেখিয়ে দিলেন লেভিনের দৃষ্টিভঙ্গির সমস্ত নীতিবিরুদ্ধতা।
‘ও কাজগুলো যে তোর ভালো লাগছে না, মাপ করিস আমাকে, তার কারণ আমাদের রুশী আলসা আর নবাবী। আমার দৃঢ় ধারণা এটা তোর একটা সাময়িক বিভ্রান্তি এবং তা কেটে যাবে।’
কনস্তান্তিন চুপ করে রইলেন। তিনি টের পাচ্ছিলেন যে তিনি সব দিক থেকে পরাস্ত, তবে সেই তিনি এও অনুভব করছিলেন যে তিনি যা বলতে চেয়েছিলেন সেটা বড় ভাইয়ের বোধগম্য নয়। শুধু জানতেন না বোধগম্য নয় কেন : সেটা কি এজন্য যে বলতে যা চেয়েছিলেন সেটা তিনি পরিষ্কার করে বলতে পারেননি, নাকি বড় ভাই বুঝতে চাননি অথবা বোঝা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয় বলে? কিন্তু এ নিয়ে তিনি তলিয়ে দেখতে গেলেন না, অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন একেবারে অন্য ভাবনায়, নিজের ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে।
কজ্নিশেভ চুপচাপ শেষ ছিপটা গুটালেন। ঘোড়াটা খুলে আনলেন, দুজনে রওনা দিলেন।
চার
বড় ভাইয়ের সাথে কথাবার্তার সময় যে ব্যক্তিগত ব্যাপারটা নিয়ে লেভিন ভাবছিলেন, সেটা এই : গত বছর একবার ঘাস কাটা দেখতে এসে লেভিন চটে ওঠেন গোমস্তার ওপর এবং শান্ত হবার জন্য ব্যবহার করেন তাঁর নিজস্ব পদ্ধতি-একজন চাষীর হাত থেকে কাস্তে টেনে নিয়ে লেগে যান ঘাস কাটতে।
তাঁর কাজটা এত ভালো লেগেছিল যে বারকয়েক নিজে ঘাস কাটায় নামেন; পুরো সাফ করেন বাড়ির সামনেকার ঘেসো মাঠটা আর এ বছর বসন্ত থেকেই পরিকল্পনা ঠিক করে রেখেছিলেন—দিনের পর দিন চাষীদের সাথে ঘাস কাটবেন। বড় ভাই আসার পর ভাবনায় পড়েন তিনি : কাটবেন কি কাটবেন না। গোটাগুটি দিনগুলো বড় ভাইকে একা রেখে যেতে সংকোচ হচ্ছিল তাঁর ভয়ও হচ্ছিল এর জন্য বড় ভাই আবার তাঁকে নিয়ে হাসাহাসি না করেন। কিন্তু মাঠ দিয়ে যাবার সময় ঘাস কাটার অভিজ্ঞতাটা মনে পড়ে তাঁর এবং প্রায় ঠিক করে ফেলেন কাটাবেন। আর বড় ভাইয়ের সাথে বিরক্তিকর আলাপটার পর আবার তাঁর মনে হল সংকল্পটার কথা। ভাবলেন, ‘শারীরিক, পরিশ্রম দরকার নইলে আমার স্বভাব একেবারেই বদখৎ হয়ে যাবে’ এবং স্থির করলেন এতে বড় ভাই বা চাষীদের সামনে নিজেকে যতই ব্ৰিত লাগুক, কাটবেনই।
সন্ধ্যায় কনস্তান্তিন লেভিন সেরেস্তায় গিয়ে কাজের হুকুম দিলেন। কাল সবচেয়ে সেরা আর বড় কালিনোভ মাঠের ঘাস কাটার জন্য ঘেসুড়েদের ডাকতে লোক পাঠালেন গাঁয়ে গাঁয়ে।
‘দয়া করে আমার কাস্তেটা তিতের কাছে পাঠিয়ে দেবেন, ও যেন শান দিয়ে কাল নিয়ে আসে; হয়ত নিজেই আমি নামব ঘাস কাটতে’, বিব্রত না হবার চেষ্টা করে বললেন তিনি।
‘জ্বি আচ্ছা।’
সন্ধ্যায় চায়ের সময় বড় ভাইকেও সে কথা বললেন লেভিন। বললেন, ‘মনে হচ্ছে আবহাওয়াটা টিকেই গেল। কাল ঘাস কাটা শুরু করব।’
‘এ কাজটা আমি খুবই ভালোবাসি’, বললেন কজ্নিশেভ।
‘ভয়ানক ভালো লাগে আমার। আমি নিজে মাঝে মাঝে ঘাস কেটেছি চাষীদের সাথে, কাল গোটা দিনটা কাটব ভাবছি।’
কজ্নিশেভ মাথা তুলে কৌতূহল ভরে তাকালেন ভাইয়ের দিকে।
‘তার মানে? চাষীদের সাথে সমানে সমানে, সারা দিন?’
লেভিন বললেন, ‘হ্যাঁ, কাটতে বেশ লাগে।’
শারীরিক ব্যায়াম হিসেবে জিনিসটা চমৎকার, তবে সবটা পেরে উঠবি কিনা সন্দেহ’, কোনরকম ঠাট্টা না করে বললেন কজ্নিশেভ।
‘আমি কেটে দেখেছি। প্রথমটা কষ্ট হয় বটে, পরে মেতে ওঠা যায়। পিছিয়ে পড়ব না মনে হয়…’
‘আচ্চা, চাষীরা এটাকে কেমনভাবে নেয় বল তো। মনিবের কাণ্ড দেখে হাসাহাসি করে নিশ্চয়।
‘না, আমি তা ভাবি না’ তবে কাজটা এত ফুর্তির আবার সেই সাথে কঠিন যে সময়ই থাকে না ভাবার।’
‘কিন্তু ওদের সাথে তুই খাবি কি করে? তোর জন্যে লাফিতের বোতল আর ভাজা টার্কি পাঠানো তো আর ভালো দেখায় না।’
‘না, আমি শুধু ওদের বিশ্রামের সময়টায় বাড়ি চলে আসব।’
পরের দিন সচরাচরের চেয়ে আগে উঠলেন কনস্তান্তিন লেভিন, কিন্তু কাজের বিলি-বন্দোবস্ত করতে গিয়ে আটকে গেলেন, ঘাস কাটার জায়গায় যখন পৌঁছলেন, ঘেসুড়েরা ততক্ষণে দ্বিতীয় সারি কাটতে শুরু করে দিয়েছে।
ঢিবির ওপর থেকেই তাঁর চোখে পড়ল মাঠের ঘাস কাটা অংশটা, তাতে ধূসর হয়ে ওঠা সারি, আর যেখান থেকে প্রথম সারি শুরু হয়েছিল, সেখানে ঘেসুড়েরা যে কাফতান খুলে রেখেছিল, তার কালো কালো স্তূপ।
যতই তিনি এগিয়ে যেতে লাগলেন, ততই তিনি বেশ দেখতে পাচ্ছিলেন কেউ কাফতান, কেউ-বা শুধুই কামিজ পরা, পরের পর এগিয়ে যাওয়া, নানান ঢঙে কাস্তে হাঁকানো সারিবন্দী চাষীদের। গুণে দেখলেন, বিয়াল্লিশ জন।
মাঠের অসমান নাবালে পুরানো বাঁধটা যেখানে ছিল সেখানে দিয়ে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে ওরা। নিজের লোকদের কয়েকজনকে চিনতে পারলেন লেভিন। ছিল সেখানে কাস্তে হাঁকাবার জন্য নুয়ে পড়া, অতি লম্বা একটা সাদা শার্ট গায়ে বুড়ো এরমিল; ছিল সেখানে লেভিনের ভূতপূর্ব কোচোয়ান ছোকরা-বয়সী ভাস্কা, প্রতিটি সারিতে ফলাও করে কাস্তে হাঁকাচ্ছিল সে; তিতও ছিল, ঘাস কাটার তারই কাছে লেভিনের হাতেখড়ি। ছোটখাট রোগা এই চাষীটি সামনে না ঝুঁকে, যেন কাস্তে নিয়ে খেলা করতে করতে কেটে ফেলছিল তার চওড়া সারিটা।
ঘোড়া থেকে নেমে লেভিন তাকে বেঁধে রাখলেন রাস্তার কাছে। তিতের কাছে যেতে সে ঝোপ থেকে দ্বিতীয় একটা কাস্তে বের করে এগিয়ে দিল।
হেসে টুপি খুলে কাস্তেটা দিয়ে সে বলল, ‘তৈরি মনিব, দাড়ি কামানো চলবে, ঘাস কাটবে নিজে নিজেই।’ লেভিন কাস্তেটা নিয়ে পরখ করে দেখলেন। নিজের নিজের সারি শেষ করে হাসি-খুশি ঘর্মাক্ত জানাচ্ছিল লেভিনকে। তারা সবাই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল লেভিনকে, কিন্তু মেষচর্মের কোট পরা, শ্মশ্রুহীন অকুঞ্চিত-মুখ দীর্ঘদেহী বৃদ্ধ রাস্তায় না-আসা পর্যন্ত কেউ কিছু তাঁকে বলল না।
সে বলল, ‘দেখো মনিব, ধরেছ যখন–ছেড়ো না!’ ঘেসুড়েদের চাপা হাসির শব্দ কানে এল লেভিনের।
‘চেষ্টা করব না ছাড়তে’, তিতের পেছনে গিয়ে শুরু করার অপেক্ষা করতে করতে লেভিন বললেন।
‘দেখো’, বুড়ো পুনরাবৃত্তি করল।
তিত জায়গা খালি করে দিল, লেভিন চললেন তার পিছু পিছু। ঘাস এখানে ছোট, রাস্তার কাছে যেমন হয়। অনেকদিন ঘাস কাটেননি লেভিন, লোকদের দৃষ্টিপাতে অস্বস্তি লাগছিল, প্রথমদিকটা ঘাস কাটলেন খারাপ, যদিও কাস্তে চালাচ্ছিলেন সজোরেই। তাঁর পেছনে কাদের গলা শোনা গেল : ‘ঠিকমত বসানো হয়নি, হাতলটা লম্বা, দেখেছ, ওকে নুইতে হচ্ছে কেমন করে’, একজন বলল।
‘গোড়ালি লাগাও’, বলল দ্বিতীয় জন।
বুড়ো বলে চলল, ‘ও কিছু না, ঠিক হয়ে যাবে। ওই দ্যাখো, চলতে লেগেছে… চওড়া সারি নিচ্ছ গো, জেরবার হয়ে পড়বে, অমন কাটতে নেই মনিব, নিজের জন্যেই তো খাটছ! অথচ দ্যাখো, কত ঘাস বাদ যাচ্ছে! আমরা অমন করলে মজা টের পেতাম যে।’
এবার পাওয়া গেল নরম ঘাস, লেভিন শুনছিলেন, কিন্তু উত্তর দিচ্ছিলেন না, চেষ্টা করছিলেন যথাসম্ভব ভালো করে কাটতে, যাচ্ছিলেন তিতের পেছনে। একশ’ পা গেল তাঁরা। না থেমে এতটুকু ক্লান্ত না দেখিয়ে তিত এগোচ্ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পেরে উঠবেন না ভেবে ভয় করতে লাগল লেভিনের : ভারি ক্লান্ত তিনি।
লেভিন টের পাচ্ছিলেন যে শক্তি ফুরিয়ে আসছে, ঠিক করলেন যে তিতকে থামতে বললেন। কিন্তু ঠিক এই সময়েই তিত নিজেই থেমে গেল, নিচু হয়ে কিছু ঘাস ছিঁড়ে কাস্তেটা মুছে শান দিতে লাগল, লেভিন সিধে হয়ে নিঃশ্বাস ছাড়লেন, তাকিয়ে দেখলেন আশপাশ। তাঁর পেছনে যে চাষীটা আসছিল স্পষ্টতই সে হয়রান হয়ে গেছে, কেননা লেভিন পর্যন্ত না পৌঁছিয়েই থেমে গিয়ে কাস্তেতে শান দিতে শুরু করেছে সে। তিত তার নিজের এবং লেভিনের কাস্তেতে শান দিয়ে আরো এগোতে থাকল।
দ্বিতীয়বারেও একই ব্যাপার। না থেমে, ক্লান্ত না হয়ে তিত চলল কাস্তের পর কাস্তে হাঁকিয়ে। লেভিন যাচ্ছিলেন তার পেছন পেছন, চেস্টা করছিলেন পিছিয়ে না পড়ার, কিন্তু ক্রমে কঠিন আর কষ্টকর হয়ে পড়ছিল তাঁর পক্ষে। একটা সময় এল যখন তিনি টের পেলেন যে তাঁর শক্তি আর নেই, কিন্তু ঠিক সেই সময়েই তিত থেমে শান দিতে লাগল।
এভাবেই তাঁরা শেষ করলেন প্রথম সারিটা। লম্বা এই সারিটা লেভিনের বিশেষ কষ্টকর লেগেছিল; তবে প্রথম সারিটা পাড়ি দেবার পর তিত কাঁধে কাস্তে লাগিয়ে ঘাস-কাটা জায়গায় তার জুতার হিলে যে ছাপ পড়েছিল তা ধরে ধরে দীর পদক্ষেপে আসতে থাকল এবং লেভিনও ঠিক সেভাবে চললেন নিজের ছাঁটা জায়গাটা দিয়ে। তখন মুখ থেকে দরদর করে নাক থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় ঘাম ঝরতে থাকলেও, আর গোটা পিঠটা এমন পানিতে চুবানোর মত করে ভিজে উঠলেও লেভিনের খুব ভালো লাগছিল। খুবই তাঁর খুশি লাগছিল এজন্য যে তিনি এখন জানেন যে পারবেন।
তৃপ্তিটা মাটি হচ্ছিল কেবল এই দেখে যে, সারিটা তাঁর ভালো হয়নি। নিজের এবড়োখেবড়ো ঝটকা-মারা সারিটার সাথে তিতের সুতার মত কাটা সারিটার তুলনা করে তিনি ভাবলেন, ‘কাস্তেটা কম করে দেহকাণ্ডটা বেশি করে চালাতে হবে।’
লেভিন লক্ষ্য করেছিলেন, প্রথম সারিটা কাটার সময় তিত এগোচ্ছিল খুবই দ্রুত, খুব সম্ভব মনিবকে যাচাই করে নেবার জন্য, সারিটাও দাঁড়াল লম্বা। পরের সারিগুলোর কষ্ট হল না অতটা, তাহলেও চাষীদের কাছ থেকে পিছিয়ে না পড়ার জন্য সমস্ত শক্তি খাটাতে হল লেভিনকে।
চাষীদের কাছ থেকে পিছিয়ে না পড়া আর যথাসম্ভব ভালোভাবে খাটা ছাড়া অন্য কোন ভাবনা, কোন বাসনা ছিল না লেভিনের। তিনি শুনছিলেন কেবল কাস্তের আওয়াজ, দেখছিলেন সামনে সরে যাচ্ছে তিতের খাড়া মূর্তি, ঘাস-কাটা জায়গাটার বাঁকা বৃত্ত, ধীরে ধীরে ঢেউয়ের মত লুটিয়ে পড়া ঘাস, তাঁর কাস্তের ধারালো দিকটার কাছে ফুলের চুড়ো আর আগে সারির শেষ, যেখানে শুরু হবে বিশ্ৰাম।
কাজের মাঝখানে তিনি হঠাৎ টের পেলেন তপ্ত ঘর্মাক্ত কাঁধে ঠাণ্ডার একটা প্রীতিকর অনুভূতি, ভেবে পাচ্ছিলেন না, কি এটা, আসছে কোথা থেকে। কাস্তেটার শান দেবার সময় চাইলেন আকাশের দিকে। ভেসে যাচ্ছে একটা নিচু ভারী মেঘ, বৃষ্টি পড়ছে বড় বড় ফোঁটার। একদল চাষী কাফতানগুলোর কাছে গিয়ে তা গায়ে চড়াল, অন্যেরা ঠিক লেভিনের মতই সুখপ্রদ তাজা শীতলতায় কাঁধ কোঁচকাল সানন্দে।
চলল সারির পর সারি। লম্বা সারি, ছোট সারি, কোনটার ভালো ঘাস, কোনটার খারাপ। সময়ে সব চেতনা লোপ পেল লেভিনের, মোটেই খেয়াল ছিল না বেলা গড়িয়ে গেছে নাকি গড়ায়নি। তাঁর কাজে এবার একটা বদল ঘটছিল যাতে অসীম সুখানুভব হচ্ছিল তাঁর। এক-এক সময় তিনি ভুলে যাচ্ছিলেন যাতে অসীম সুখানুভব হচ্ছিল তাঁর। এক- এক সময় তিনি ভুলে যাচ্ছিলেন কি করছেন, বেশ সহজ বোধ করছিলেন নিজেকে, তাঁর সারি তখন হয়ে দাঁড়াচ্ছিল প্রায় তিতের মতই সমান আর সুন্দর। কিন্তু যেই মনে পড়ত কি করছেন, চেষ্টা করতেন আরো ভালো করে করার, অমনি খাটুনির সমস্ত কষ্টটার বোধ হত তাঁর, সারি হয়ে দাঁড়াত খারাপ।
আরো একটা সারি শেষ করে তিনি আবার আরেকটা ধরতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তিত থেমে গেল, বুড়োর কাছে গিয়ে মৃদুস্বরে কি বলল। দুজনেই তারা তাকাল সূর্যের দিকে। ‘কি বলাবলি করছে ওরা, সারি ও ধরছে না কেন?’ ভাবলেন লেভিন, আন্দাজ করতে পারেননি যে না থেমে চাষীরা ঘাস কেটেছে চার ঘণ্টার কম নয়, সময় হয়েছে প্রাতরাশের।
বুড়ো বলল, ‘ছোট হাজারি, মনিব।’
‘সময় হয়ে গেছে নাকি? তা বেশ, ছোট হাজারিই হোক।’
তিতকে কাস্তে দিয়ে যে চাষীরা রুটির জন্য কাফতানগুলোর কাছে যাচ্ছিল তাদের সাথে লেভিন লম্বা-ঘাস-কাটা জায়গাটার সামান্য পানির ছিটে লাগা সারিগুলো দিয়ে গেলেন তাঁর ঘোড়ার কাছে। কেবল এখনই তিনি টের পেলেন যে আবহাওয়ার মেজাজ তিনি আন্দাজ করতে পারেননি, ভিজে গেছে তাঁর বিচালি। বললেন, ‘বিচালি নষ্ট হয়ে যাবে।’
‘ও কিছু না, মনিব। বাদলায় কাস্তে ধর, রোদে বিচালি জড়ো!’ বুড়ো বলল।
ঘোড়ার বাঁধন খুলে লেভিন বাড়ি গেলেন কফি খেতে।
কজ্নিশেভ সবেমাত্র উঠেছিলেন ঘুম থেকে। পোশাক-আশাক পরে তিনি খাবার ঘরে আসতে-না-আসতেই লেভিন তাঁর কফি শেষ করে ঘাস কাটার জায়গায় আবার গেলেন।