দশ
যে নীরবতা নেমে এসেছিল সেটা কাটলে ডল্লি বললেন, ‘কিটি আমাকে লিখেছে যে শান্তি আর নিঃসঙ্গতা ছাড়া আর কিছু সে চায় না।’
লেভিন দুরুদুরু বুকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আর স্বাস্থ্যটা, ভালো হয়েছে কি?’
‘সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ, একেবারে সেরে উঠেছে। আমার কখনো বিশ্বাসই হয়নি যে বুকের দোষ আছে তার।’
‘আহ্, শুনে বড় আনন্দ হল!’ লেভিন বললেন আর বলে নীরবে ডল্লির দিকে তাকিয়ে থাকায় ডল্লি তাঁর মুখে মর্মস্পর্শী অসহায় কি একটা ভাব দেখতে পেলেন যেন।
‘শুনুন কনস্তান্তিন দ্দ্মিত্রিচ’, ডল্লি বললেন তাঁর সহৃদয়, খানিকটা উপহাসের হাসি হেসে, ‘কিটির ওপর আপনার রাগ কেন?’
‘আমি? আমি তো রাগিনি।’
‘না, রেগেছেন। যখন মস্কোয় গিয়েছিলেন, আমাদের কাছে বা ওদের কাছে কোথাও এলেন না যে?’
‘দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা’, চুলের গোড়া পর্যন্ত আরক্ত হয়ে লেভিন বললেন, ‘আমার অবাক লাগছে যে আপনি এত সহৃদয় হয়ে বুঝছে না এটা। আমার ওপর নেহাৎ করুণাও আপনার কেন হচ্ছে না যখন জানেন যে…’
‘কি আমি জানি?’
‘জানেন যে আমি প্রস্তাব দিয়েছিলেন এবং প্রত্যাখাত হয়েছি’, লেভিন বললেন আর এক মুহূর্ত আগে কিটির প্রতি যে কোমলতা বোধ করেছিলেন, বুকের মধ্যে তার স্থান নিল অপমানের জ্বালা।
‘কেন ভাবছেন যে আমি জানি?’
‘কেননা সবাই জানে ব্যাপারটা।’
‘এখানেই ভুল হচ্ছে আপনার; আমি এটা জানতাম না যদিও অনুমান করেছিলাম।’
‘বটে! তা এখন তো জানলেন।’
‘আমি জানতাম কেবল কিছু একটা হয়েছে বোধ হয়, ভয়ানক কষ্ট পাচ্ছিল সে, আমাকে সে বলে ও নিয়ে আর কখনো যেন কথা না তুলি। আর আমাকে যখন বলে নি তখন আর কাউকেও সে বলবে না। কিন্তু হয়েছিলটা কি? বলুন আমাকে।’
‘কি হয়েছিল সে তো বললাম আপনাকে।’
‘কখন ওটা ঘটেছিল?’
‘যখন শেষবার আপনাদের ওখানে যাই আমি।’
‘তবে শুনুন, আপনাকে একটা কথা বলি’, ডল্লি বললেন, ‘ওর জন্যে আমার ভয়ানক, ভয়ানক কষ্ট হয়। আপনি কষ্ট পাচ্ছেন কেবল আহত গর্ব থেকে…’
লেভিন বললেন, ‘হতে পারে, কিন্তু…’
ডল্লি বাধা দিলেন তাঁর কথায় : ‘বেচারির জন্যে আমার ভয়ানক, ভয়ানক কষ্ট হয়। এখন সব বুঝতে পারছি আমি।’
‘কিন্তু মাপ করবেন দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা’, লেভিন বললেন উঠে দাঁড়িয়ে, ‘আসি দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা। আবার দেখা হবে।’
‘আরে না-না, বসুন-বসুন’, তাঁর আস্তিন ধরে ডল্লি বললেন।
‘ও নিয়ে কিন্তু আর কথা নয়’, বসে লেভিন বললেন আর সেই সাথে টের পেলেন যে সমাধিস্থ বলে যা মনে হয়েছিল সে আশাটা নড়েচড়ে মাথা তুলছে তাঁর বুকের মধ্যে।
‘আপনাকে যদি আমি ভালো না বাসতাম’, বললেন ডল্লি, চোখে তাঁর পানি এসে গিয়েছিল, ‘আপনাকে বলে মনে হয়েছিল তা ক্রমেই জীবন্ত হয়ে অধিকার করতে লাগল লেভিনের অন্তর।’
ডল্লি বলে চললেন, ‘হ্যাঁ, এখন আমি বুঝলাম। আপনি এটা বুঝতে পারবেন না, আপনার পুরুষেরা স্বাধীন বাছবিচার করতে পারেন, আপনাদের কাছে সব সময় পরিষ্কার কাকে ভালোবাসেন। কিন্তু নারীসুলভ, কুমারীসুলভ লজ্জা নিয়ে অপেক্ষমাণা এক বালিকা, যে বালিকা আপনাদের পুরুষদের দেখছে দূর থেকে, সবাইকে গ্রহণ করে তার কথা দিয়ে, এরকম বালিকার এমন অনুভূতি হতে পারে যে সে বুঝতে পারছে না কি বলবে।’
‘হ্যাঁ, হৃদয় যদি না বলে…’
‘হৃদয় বলে বৈকি, কিন্তু আপনি ভেবে দেখুন : আপনাদের পুরুষদের নজর পড়ল কোন-একটা মেয়ের ওপর, তার বাড়ি যেতে লাগলেন, ঘনিষ্ঠ হলেন, খুঁটিয়ে দেখলেন সব, অপেক্ষা করে রইলেন আপনি যা ভালোবাসেন তা পাচ্ছেন কিন, তারপর নিশ্চিত হলেন যে ভালোবাসছেন, তখন প্রস্তাব দিলেন…’
‘ঠিক তাই-ই এমন নয়। ‘
‘তা না হোক, আপনি প্রস্তাব দিলেন যখন আপনার ভালোবাসা পরিপক্ক হয়ে উঠেছে অথবা নির্বাচনীয় দুজনের মধ্যে পাল্লা ভারী হল একজনের। অথচ মেয়েটাকে তো জিজ্ঞেস করা হয় না। লোকে চায় নিজেই সে বেছে নিক, কিন্তু বেছে নিতে সে যে অপারগ, সে কেবল জবাব নিতে পারে হ্যাঁ কিংবা না।’
‘হ্যাঁ, আমার আর ভ্রন্স্কির মধ্যে বাছাবাছি’, লেভিন ভাবলেন আর প্রাণ পেয়ে ওঠা শব আবার মারা গেল তাঁর অন্তরে, শুধু তা যন্ত্রণা দিয়ে দলিত করত থাকল তাঁর হৃদয়।
বললেন, ‘দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা, ওভাবে বাছা হয় একটা গাউন কি অন্য কিছু জানি না, ভালোবাসা নয়। বাছা হয়ে গেছে, আর সেটাই ভালো…পুনরাবৃত্তি হতে পারে না।’
‘আহ্ গর্ব আর গর্ব!’ ডল্লি বললেন যেন অন্যান্য যেসব অনুভূতি শুধু মেয়েরাই জানে, তার সাথে তুলনায় এ অনুভূতিটার নীচতার জন্য তাঁকে ঘৃণা করে।’যে সময় আপনি কিটির পাণিপ্রার্থনা করেছিলেন তখন সে ঠিক সেই অবস্থাতেই ছিল যখন জবাব দিতে সে পারে না। দোদুল্যমানতা ছিল তার। আপনি নাকি ভ্রন্স্কি-এই দোদুল্যমানতা। ভ্রন্স্কিকে কিটি দেখছিল রোজই অথচ আপনাকে দেখেনি অনেকদিন। ধরা যাক, ওর যদি আরেকটু বয়স হত—যেমন ওর জায়গায় আমি হলে আমার পক্ষে কোন দোলায়মানতা থাকা সম্ভব হত না। ভ্রন্স্কিকে আমার বরাবরই খারাপ লেগেছে, শেষও হল তাই।’
লেভিনের মনে পড়ল কিটির জবাব। সে বলেছিল : না, এটা হতে পারে না…
নীরস কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা, আমার ওপর আপনার আস্থায় মূল্য দিই আমি; কিন্তু আমার মনে হয়, আপনি ভুল করছেন। তবে আমি ঠিক বলছি কি বলছি না, জানি না, এই যে বর্গটাকে আপনি এত ঘৃণা করেন, তাতে কিটি সম্পর্কে কোন চিন্তা আমার পক্ষে একেবারে অসম্ভব হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বুঝতে পারছেন, একেবারে অসম্ভব।’
‘আমি শুধু আরেকটা কথা বলব। আপনি বুঝতে পারছেন তো, আমি বলছি আমার বোন সম্পর্কে, যাকে আমি ভালোবাসি নিজের সন্তানের মত। আপনাকে সে ভালোবেসেছিল এমন কথা আমি বলছি না, আমি শুধু বলতে চাইছিলাম যে ওই মুহূর্তটার প্রত্যাখ্যান প্রমাণ হয় না বিছুই।’
‘জানি না!’ লাফিয়ে উঠে লেভিন বললেন, ‘বুঝতে পারছেন না কি কষ্ট দিচ্ছেন আমাকে। এ যেন আপনার ছেলে মারা গেছে আর সবাই আপনাকে বলছে : আহা ছেলেটা অমন ছিল, তেমন ছিল, বেঁচে থাকলে কত সুখ হত আপনার। অথচ সে তো মারা গেছে, মারা গেছে, মারা গেছে…’
‘কি হাস্যকার লোক আপনি’, লেভিনের উত্তেজনা কেয়ার না পরে ডল্লি বললেন বিষণ্ণ উপহাসে; ‘হ্যাঁ, এখন আমি আরো বেশি করে বুঝতে পারছি’, চিন্তিতভাবে তিনি বলে চললেন, ‘তাহলে কিটি এলে আপনি আমাদের এখানে আসবেন না?
‘না, আসব না। বলাই বাহুল্য, আমি পালিয়ে বেড়াব না তার কাছ থেকে, তবে যেখানে সম্ভব চেষ্টা করব আমার উপস্থিতির অপ্রীতিকরতা থেকে তাকে রেহাই দিতে।’
‘ভারি, ভারি হাস্যকর লোক আপনি’, লেভিনের মুখের দিতে কোমল দৃষ্টিতে তাকিয়ে পুনরাবৃত্তি করলেন ডল্লি, ‘তা বেশ, তবে এ নিয়ে আমরা যেন কোন কথা বলিনি। কেন এলি রে তানিয়া?’ মেয়েটা ঘরে ঢুকতে তাকে ফরাসি ভাষায় জিজ্ঞেস করলেন ডল্লি।
‘আমার কোদালটা’, জিজ্ঞেস করলেন ডল্লি।
মেয়েটাও তাই বলবে ভেবেছিল, কিন্তু কোদালের ফরাসি প্রতিশব্দ কি ভুলে গিয়েছিল সেটা; মা খেই ধরিয়ে দিলেন এবং ফরাসিতেই বললেন, কোথায় খুঁজতে হবে কোদালটা। এটা লেভিনের কাছে খারাপ লাগল।
দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনার বাড়ি আর তাঁর ছেলেমেয়ের কিছুই এখন আর তেমন মিষ্টি মনে হল না।
ভাবলেন, ‘ছেলেমেয়েদের সাথে ফরাসি ভাষায় কেন কথা বলছেন উনি : কি অস্বভাবিক আর কৃত্রিম! ছেলেমেয়েরোও টের পায় সেটা। ফরাসি শেখা আর স্বাভাবিকতা ভোলা’, মনে মনে ভাবলেন তিনি। জানতেন না যে ডল্লি নিজেও এ নিয়ে ভেবেছেন বিশ বার, তাহলেও স্বাভাবিকতায় ক্ষতি হলেও এই উপায়েই ছেলেমেয়েদের শিক্ষাদান প্রয়োজনীয় জ্ঞান করেছেন।
‘কিন্তু যাবেন আবার কোথায়? বসুন না।’
চা-পান পর্যন্ত রয়ে গেলেন লেভিন। কিন্তু তাঁর ফুর্তি উবে গিয়েছিল এবং অস্বস্তি লাগছিল।
লেভিন চায়ের পর প্রবেশকক্ষে গেলেন ঘোড়া দেবার জন্য বলতে। যখন ফিরলেন, ডল্লিকে দেখলেন অতি বিচলিত অবস্থায়, উদ্ভ্রান্ত মুখ, চোখে পানি। লেভিন যখন বেরিয়ে যান, তখন যে ঘটনাটা ঘটে তাতে ডল্লির আজকের সমস্ত সুখ আর ছেলেমেয়েদের জন্য গর্ব সব মাটি হয়ে যায়। গ্রিশা আর তানিয়া মারামারি করেছে একটা বল নিয়ে। শিশুকক্ষে চেঁচামেচি শুনে ডল্লি যান সেখানে, দেখেন ভয়াবহ এক দৃশ্য। তানিয়া গ্রিশার ঝুঁকি টেনে ধরেছে আর রাগে বিকৃত মুখে যেখানে পারছে সে ঘুসি চালাচ্ছে তানিয়ার ওপর। এটা দেখে ডল্লির বুকের মধ্যে কি-একটা যেন ছিঁড়ে গেল। যেন অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে তাঁর জীবনে, তিনি টের পেলেন যে নিজের যে ছেলেমেয়েদের নিয়ে তাঁর অত গর্ব হত, তারা নেহাৎ সাধারণ ছেলেমেয়েই শুধু নয়, রূঢ় পাশবিক প্রবৃত্তির বদ, দুঃশীল ছেলেমেয়ে, দুরাত্মা।
আর কোন বিষয়ে কথা তিনি বলতে বা ভাবতে পারছিলেন না, নিজের দুঃখের কথা লেভিনকে না বলে পারলেন না তিনি।
লেভিন দেখতে পাচ্ছিলেন যে ডল্লি মুষড়ে পড়েছেন, এতে মন্দ কিছু প্রমাণিত হয় না, সব ছেলেমেয়েই মারামারি করে, এই কথা বলে তাঁকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলেন তিনি; কিন্তু সে কথা বললেও লেভিন মনে মনে ভাবছিলেন, ‘না, আমি ন্যাকামি করব না, নিজের ছেলেমেয়েদের সাথে কথা বলবই না ফরাসিতে। তবে ওই ধরনের ছেলেমেয়ে আমার হবে না; দরকার শুধু ছেলেমেয়েদের মাথা না খাওয়া, বিকৃত করে না তোলা, তাহলেই তারা হবে খাশা। উঁহু, অমন হবে না আমার ছেলেমেয়ে।’
বিদায় নিয়ে চলে গেলেন লেভিন। ডল্লি তাঁকে আর আটকালেন না।
এগারো
জুলাই মাসের মাঝামাঝি পক্রোভ্স্কায়ে থেকে বিশ ভার্স্ট দূরে তাঁর বোনের মহাল থেকে মণ্ডল এল ঘাস-কাটার হিসাবপত্র দাখিল করতে। বোনের সম্পত্তির প্রধান আয় ছিল সেচ জমির ঘাস। আগেকার কালে দেসিয়াতিনা পিছু বিশ রুব্ল দিলে চাষীরা ঘাস কাটত। লেভিন যখন সম্পত্তিটা দেখাশোনার ভার নেন, ঘাস-কাটা পর্যবেক্ষণ করে তিনি দেখলেন যে ওর দাম বেশি, দর ধার্য করলেন দেসিয়াতিনা পিছু পঁচিশ রুল। চাষীরা এ দর দিতে চায়নি এবং লেভিনের যা সন্দেহ ছিল, অন্যান্য খরিদ্দারদেরও তারা ভাগিয়ে দেয়। লেভিন তখন নিজে সেখানে গিয়ে ঘাস-কাটার ব্যবস্থা করেন একাংশে মজুর লাগিয়ে, একাংশে আধিয়ারি মারফত। নিজের চাষীরা সর্বোপায়ে এই নয়া ব্যবস্থা প্রতিবন্ধকতা করে, কিন্তু ব্যাপারটা চালু হয়ে যায় আর প্রথম বছরে ঘেসো মাঠ থেকে আয় হয় প্রায় দ্বিগুণ। তৃতীয় এবং গত বছরে চাষীদের প্রতিবন্ধকতা চলতেই থাকে আর ফসল তোলাও চলে একই ধারায়। এ বছর চাষীরা তেভাগায় সমস্ত ঘাস কাটার ভার নিয়েছে, মণ্ডল এসেছে এই কথা জানাতে যে ঘাস কেটে তোলা হয়েছে, গাছে বৃষ্টি নামে এই ভয়ে সে সেরেস্তার মহুরাকে ডেকে তার উপস্থিতিতে সব ভাগাভাগি করেছে, মালিককে দেওয়া হয়েছে এগারো গাদি। প্রধান মাঠটায় কত ঘাস তাড়াহুড়ো কেন, এসব প্রশ্নে উত্তরের অনির্দিষ্টতা এবং চাষীটার কথার সমস্ত সুর দেখে লেভিন বুঝলেন যে বিচালির এই ভাগাভাগিতে কিছু-একটা কারচুপি আছে, ঠিক করলেন নিজেই গিয়ে ব্যাপারটা যাচাই করে দেখবেন।
দিবাহারের সময় গ্রামে এসে ছাইয়ের স্তন্যদাত্রীর স্বামী, পরিচিত এক বৃদ্ধের কাছে ঘোড়াটা রেখে তিনি গেলেন তার মৌমাছি খামার দেখতে, ভেবেছিলেন ঘাস কাটার বিশদ খবর তার কাছ থেকে জেনে নেবেন। সুপুরুষ বৃদ্ধ পারমেনিচ কথা বলতে ভালোবাসে, লেভিনকে সে আনন্দ করেই আপ্যায়ন করল, দেখাল তার সমস্ত জোতজমা, বলল নিজের মৌমাছিগুলোর সমস্ত খুঁটিনাটি, এ বছরের নতুন ঝাঁকের কথা, কিন্তু ঘাস-কাটার ব্যাপারে লেভিনের প্রশ্নের উত্তর সে দিলে অনিচ্ছাসহকারে, সুনির্দিষ্ট কিছু না বলে। এতে লেভিন আরো নিশ্চিত হলেন তাঁর অনুমানে। ঘাস-কাটার জায়গায় গিয়ে তিনি গাদিগুলো দেখলেন। গাদিগুলোয় পশ্চাম গাড়ি করে ঘাস হতে পারে না। চাষীদে মুখোশ খোলার জন্য তিনি তখনই বিচালি বওয়ার গাড়ি ডেকে একটা গাদিকে গোলাঘরে নিয়ে যেতে বললেন। দেখা গেল গাদিটায় ছিল বত্রিশ গাড়ি বিচালি। ঘাসগুলো ছিল ফুলো-ফুলো, গাদিতে থেকে নেতিয়ে পড়েছে; সব কিছু করা হয়েছে ধর্মমতে, মণ্ডলের এসব আশ্বাস আর শপথ সত্ত্বেও লেভিন তাঁর এই অভিমতে অটল রইলেন যে বিচালি ভাগাভাগি হয়েছে তাঁর হুকুম ছাড়াই, তাই পঞ্চাশ গাড়ি করে এই গাদি তিনি নিতে পারেন না। দীর্ঘ তর্কবিতর্কের পর স্থির হল যে, চাষীরা এই এগারো গাদির প্রত্যেকটাকে পঞ্চাশ গাড়ি হিসেবে নিজেরা নেবে, মালিকের ভাগ বাঁটা হবে নতুন করে। এসব কথাবার্তা আর বাঁটোয়ারা গড়াল বিকেল পর্যন্ত। শেষ বিচালিটুকু ভাগাভাগি হয়ে গেলে লেভিন মহুরির ওপর বাকিটা দেখবার ভার দিয়ে ঝোপ আলাদা করা একটা বিচালি গাদার ওপর বসে মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগলেন লোকে গিজগিজ ঘেসো জমি 1
সামনে তাঁর, জলাটার পর নদীর বাঁকে উচ্চকণ্ঠের ঝংকার তুলে ফুর্তিতে এগিয়ে চলেছে মেয়েদের একটা রঙচঙে সারি, ছড়ানো-ছিটানো ঘাসগুলো দিয়ে তারা চিকন-সবুজ ডাঁটার পটে বানাচ্ছিল কুণ্ডলী পাকানো ধূসর স্তূপ। তাদের পেছনে আঁকশি নিয়ে যাচ্ছে পুরুষেরা, ঘাসগুলো হয়ে উঠছে লম্বা লম্বা উঁচু উঁচু ফুলো ফুলো, গাদি ছেঁটে ফেলা মাঠের বাঁ দিকে ঘর্ঘর করছে গাড়ি। বিপুল সাপটে তুলে দেওয়া গাদিগুলো অদৃশ্য হচ্ছে একে একে, তাদের জায়গায় ঘোড়ার পাছার দিকে ডাঁউ হয়ে উঠছে গন্ধ-ছড়ানো ঘাস।
‘আবহাওয়া ভালো থাকতে থাকতে তুলে ফেলতে পারলে হয়? বিচারি হবে কেমন!’ লেভিনের পাশে বসে বৃদ্ধ বলল, ‘ঘাস তো নয়! যেন হাঁসদের সামনে দানা। টপাটপ গিলছে!’ তুলে ফেলা গাদিগুলোকে দেখিয়ে সে যোগ করল, বড় হাজরির পর অর্ধেকটাই সাফ।’
‘এই শেষ খেপ নাকি?’ গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে লাগাম হাঁকিয়ে যে যুবকটা মেয়ের দিকে হেসে চিৎকার করে বলল ছেলেটা। গাড়ি চালিয়ে দিল আবার।
লেভিন জিজ্ঞেস করলেন, ‘ও কে? তোমার ছেলে?’
‘আমার ছোটটা’, বুড়ো বলল স্নেহের হাসি হেসে।
‘দিব্যি ছেলে!’
‘তা মন্দ নয়।’
‘বিয়ে হয়েছে?’
‘খ্রিস্ট আবির্ভাবের তিথি থেকে আজ তিন বছর চলছে।’
‘তা বেশ, ছেলেপুলে আছে তো?’
কোথায় ছেলেপুলে! এক বছর তো কোন জ্ঞানগম্যিই ছিল না, লজ্জা পেত’, বুড়ো বলল, ‘তা বিচালি বটে বাপু! ধর একেবারে ভুরভুরে!’ বুড়ো প্রসঙ্গটা বদলাবার ইচ্ছার পুনরাবৃত্তি করল।
লেভিন মন দিয়ে লক্ষ্য করছিলেন ভাল্কা পারমেনভ আর তার বৌকে তাঁর কাছ থেকে সামান্য দূরে তোরা ঘাস বোঝাই করছিল গাড়িতে। ভান্কা পারমেনভ দাঁড়িয়ে ছিল গাড়িতে। তার তরুণী সুন্দরী গিন্নি দুই হাত দিয়ে ঘাস জড়ো করে ফর্ক দিয়ে তার বড় বড় যে ডাঁইগুলো নিপুণ ভঙ্গিতে তুলে দিচ্ছিল সেগুলো সে নিয়ে সমান করে বিছিয়ে পা দিয়ে মাড়াচ্ছিল। মেয়েটা কাজ করছিল অনায়াসে, ফুর্তি করে, ক্ষিপ্র ভঙ্গিতে। মাটিতে পড়ে থাকা ঘাস চট করে ফর্কে উঠছিল না। প্রথমে সে হাত দিয়ে গাদিটা ঝাঁকাচ্ছিল, তারপর ফর্ক ঢুকিয়ে দ্রুত, নমনীয় ভঙ্গিতে তার ওপর দেহের সমস্ত ভার দিয়ে তখনই লাল কোমরবন্ধে ঘেরা পিঠ টান করে সাদা ঝালবের তলেকার ভরা বুক এগয়ে দিয়ে ক্ষিপ্ৰ মুঠোয় ফর্ক চেপে ধরে ঘাস বৌকে রেহাই দেবার জন্য তাড়াতাড়ি করে দু’হাতে বাড়িয়ে তা ধরে ফেলে বিছিয়ে দিচ্ছিল গাড়িতে। আঁকশি দিয়ে শেষ ঘাসগুলো তুলে দিয়ে ঘাড়ে লেগে থাকা কুচিগুলো ঝেড়ে ফেলে সাদা যে কপালখানা রোদপোড়া নয়, তার ওপর কসে পড়া মাথার লাল রুমালটা ঠিক করে নিয়ে গাড়ির তলে ঢুকে পড়ল সে বোঝাটা বাঁধার জন্য। ভাকা ওকে বোঝাচ্ছিল কিভাবে বাঁধতে হবে আর ওর কি একটা মন্তব্যে হেসে উঠল হো-হো করে। উভয়েরই মুখভাবে দেখা যাচ্ছিল প্রবল, তরুণ, ইদানিং জেগে ওঠা প্রেম।
বারো
বোঝা বাঁধা হল। ভান্কা লাফিয়ে নেমে খাদ্যপরিতৃপ্ত তাগড়াই ঘোড়াটাকে চালাতে লাগল লাগাম ধরে। বৌ তার আঁকশি ছুঁড়ে দিল বোঝার ওপর, তারপর ফুর্তিতে পা ফেলে হাত দোলাতে দোলাতে চলে গেল মেয়েদের জলসায়। ভাকা রাস্তা পর্যন্ত গিয়ে যোগ দিলে অন্যান্য গাড়ির সারিতে। কাঁধে আঁকশি নিয়ে জ্বলজ্বলে রঙিন পোশাকে ফুর্তিতে কলরব করে মেয়েরা চলল গাড়িগুলোর পেছন পেছন। গান ধরল কর্কশ-উদ্দাম একটা নারীকণ্ঠ এবং ধুয়ায় পৌঁছানো পর্যন্ত তা গেয়ে গেল, তখন গোড়া থেকে তা আবার শুরু করল গোটা পঞ্চাশেক মিহি-মোটা, সুস্থ নানা গলা।
গান গাইতে গাইতে মেয়েরা এগিয়ে আসছিল লেভিনের দিকে আর তাঁর মনে হল ফুর্তির একটা বজ্রগর্ভ কালো মেঘ আছড়ে পড়ছে তাঁর ওপর। মেঘটা এগিয়ে এসে তাঁকে, ঘাসের যে গাদিটার ওপর তিনি শুয়ে ছিলেন সেটাকে, অন্যান্য গাদি আর গাড়িগুলোকে আর দূরের জমিটা সমেত গোটা মাঠখানাকে জাপটে ধরল আর চিৎকার করা, সিটি মারা উদ্দাম গানটার তালে তালে সব কিছু দুলতে লাগল, টিপটিপ করতে লাগল। বলিষ্ঠ এই ফুর্তিটায় ঈর্ষা হল লেভিনের। ইচ্ছে হল জীবনের আনন্দের এই উৎসারে যোগ দেন। কিন্তু কিছুই করতে পারেন না তিনি, তাঁকে শুয়ে থেকে, দেখে আর শুনে যেতে হবে। গীতমুখরিত লোকগুলো যখন দর্শন আর শ্রবণের বাইরে চলে গেল, তখন নিজের একাকিত্ব, নিজের দৈহিক আলস্য, এই জগৎটার প্রতি নিজের বিরূপতার জন্য একটা গুরুতের মনঃকষ্ট আচ্ছন্ন করল লেভিনকে।
বিচালি নিয়ে যে চাষীরা তাঁর সাথে তর্ক করেছিল সবচেয়ে বেশি তাদেরই কেউ কেউ, যাদের লেভিন নিজেই অপমান করেছিলেন তারা, যারা তাঁকে ঠকাতে চাইছিল সেই চাষীরাই এখন আনন্দ করে মাথা নোয়াচ্ছিল তাঁর উদ্দেশে, স্পষ্টতই তাঁর ওপর ওদের কোন রাগ ছিল না, থাকতেও পারে না, কোনরকম অনুতাপ তাদের মদ্যে দেখা গেল না শুধু নয়, লেভিনকে তারা যে ঠকাতে চেয়েছিল, সে কথাটা পর্যন্ত ভুল গিয়েছিল তারা। হাসি-খুশি সাধারণ শ্রমের সাগরে তলিয়ে গিয়েছিল সব কিছুটা। ভালো দিনটা দিয়েছেন আল্লাহ্, আল্লাহ্ দিয়েছেন শক্তি। দিন আর শক্তি উৎসর্গিত শ্রমে আর শ্রমটাই তার পুরস্কার। শ্রমটা কার জন্য? কি হবে তার ফল? এ ভাবনা অপ্রাসঙ্গিক এবং তুচ্ছ।
লেভিন প্রায়ই এই জীবনটাকে লক্ষ্য করতেন মুগ্ধ হয়ে আর সে জীবন যারা যাপন করছে তাদের প্রতি একটা ঈর্ষা বোধ করতেন তিনি, কিন্তু আজই প্রথম বার, বিশেষ করে তরুণী বৌয়ের প্রতি ভাল্কা পারমেনভের মনোভাবের ভেতর তিনি যা দেখলেন তার প্রভাবে এই প্রথম বার লেভিনের পরিষ্কার ধারণা হল যে কষ্টকর কর্মহীন কৃত্রিম, ব্যক্তিগত যে জীবনটা তিনি যাপন করছেন তাকে এই শ্রমশীল নির্মল, সার্বিক এক অপরূপ জীবনের পরিণত করা নির্ভর করছে তাঁরই ওপর।
যে বুড়ো লেভিনের পাশে বসেছিল, বহু আগেই বাড়ি চলে গেছে সে, চাষীরা ছড়িয়ে পড়ছে। যারা কাছে থাকে, তারা বাড়ি চলে গেল, দূরের লোকেরা নৈশাহার সেরে ওখানেই রাত কাটাবে বলে জড়ো হল মাঠের লোকগুলোর অলক্ষিতে লেভিন গাদিতে শুয়ে শুয়ে ওদের দেখা, কথা শোনা আর নিজের ভাবনা চালিয়ে যেতে লাগলেন। রাত কাটাবার জন্য যে লোকেরা মাঠে থেকে গিয়েছিল গ্রীষ্মের ছোট রাতে প্রায় ঘুমালই না তারা। প্রথমে কানে এল খেতে বসে ফুর্তির সাধারণ কথাবার্তা আর হাসি তারপর আবার গান আর হাসি।
ফুর্তি ছাড়া খাটুনির গোটা লম্বা দিনটা তাদের মধ্যে আর কোন চিহ্ন রেখে যায়নি। ভোরের আগে সব চুপচাপ হয়ে গেল। শোনা যাচ্ছিল শুধু জলায় ভেককুলোর ফোঁৎ-ফোঁৎ। টনক নড়তে লেভিন গাদি থেকে উঠে দাঁড়ালেন, তারার দিকে তাকিয়ে বুঝলেন রাত আর নেই।
‘কিন্তু কি করব আমি? কিভাবে সেটা করব?’ গ্রীষ্মের এই ছোট রাতে যা কিছু তিনি ভেবেছেন, অনুভব করেছেন, চেষ্টা করলেন সেটা নিজের কাছেই প্রকাশ করার। যা কিছু তিনি ভেবেছেন, অনুভব করেছেন তা ভাগ হয়ে গেল পৃথক তিনটা ধারায়। একটা হল নিজের পুরানো জীবনকে, নিজের অকেজো জ্ঞানকে, সবার কাছে নিষ্প্রয়োজন তাঁর শিক্ষাকে বিসর্জন। এই ত্যাগটা থেকে তিনি তৃপ্তি পাচ্ছিলেন। তাঁর কাছে এটা সহজ, অনায়াস। অন্য ধারণা ও চিন্তাগুলো হল যে জীবন তিনি এখন কাটাতে চান তাই নিয়ে। সে জীবনের সহজাত, বিশুদ্ধতা আর ঔচিত্য তিনি পরিষ্কার টের পাচ্ছিলেন এবং নিঃসন্দেহ ছিলেন, যে তুষ্টি, প্রশান্তি আর মর্যাদার যে অভাবে তিনি অমন রুগ্নের মত ভুগছিলেন সেগুলো তিনি ওই জীবনে পাবেন। কিন্তু তাঁর তৃতীয় ধারার চিন্তাগুলো ঘুরে মরছিল এই প্রশ্নে : পুরানো জীবন থেকে নতুনে উত্তরণটা করা যায় কিভাবে। আর এ ব্যাপারে পরিষ্কার কিছুই তাঁর চোখে পড়ছিল না। ‘বিয়ে করব? কাজ এবং কাজের প্রয়োজনীয়তা রাখতে হবে? পক্রোভ্স্কয়ে ছেড়ে দেব? জমি কিনব? গ্রামসমাজে নাম লেখাব? বিয়ে করব কৃষাণীকে? কি করে এটা করা যায়?’ আবার নিজেকে প্রশ্ন করলেন তিনি এবং জবাব পেলেন না। ‘তবে সারা রাত তো আমি ঘুমাইনি, পরিষ্কার করে কিছু স্থির করা সম্ভব নয় এখন। পরে পরিষ্কার করে নেওয়া যাবে। শুধু একটা জিনিসে সন্দেহ নেই যে এই রাতটা স্থির করে দিল আমার ভাগ্য। পারিবারিক জীবন নিয়ে আমার সমস্ত কল্পনাগুলো বাজে, আসল জিনিস নয়’, নিজেকে বললেন তিনি, ‘এটা অনেক সহজসরল, অনেক ভালো…’
‘কি সুন্দর!’ আকাশের মাঝখানে ঠিক তাঁর মাথার ওপর অদ্ভূত, ঠিক যেন পেঁজা তুলো দিয়ে গাড়া ঝিনুকের একটা একটা দেখে মনে মনে ভাবলেন তিনি, ‘অপরূপ এই রাতটায় সবই কি অপরূপ! ওই ঝিনুকটা গড়ে উঠতে পারল কখন? এই কিছু আগেই আমি আকাশের দিকে তাকিয়েছিলাম, কিছুই তখন ছিলনা সেখানে, শুধু দুটো সাদা পাড় ঠিক এভাবেই জীবন সম্পর্কে আমারও দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেছে অলক্ষ্যে!’
মাঠ থেকে বেরিয়ে এসে তিনি চলতে লাগলেন গাঁয়ের দিকের বড় রাস্তাটা ধরে। জোর হাওয়া দিল, সব কিছু, হয়ে উঠল ধূসর বিষণ্ন।দেখা দিয়েছে সেই নিষ্প্রভ মুহূর্তটা যা উষার, তমসার ওপর জ্যোতির পূর্ণ বিজয়ের পূর্বাভাস দেয়।
শীতে কুঁকড়ে মাটির দিকে তাকাতে তাকাতে লেভিন যাচ্ছিলেন ক্ষিপ্র গতিতে। ঘণ্টির ঝুনঝুন শুনে লেভিন মাথা তুললেন, ভাবলেন, ‘কি ব্যাপার? কে যেন আসছে।’ যে বড় রাস্তা দিয়ে তিনি যাচ্ছিলেন, সেখানে তাঁর কাছ থেকে চল্লিশ পা দূরে চার ঘোড়ার এক গাড়ি আসছে তাঁর দিকে। শ্যাফটের ঘোড়াগুলো গাড্ডায় ঠেলা মারছিল শ্যাফটে কিন্তু নিপুণ কোচোয়ান বক্সে পাশকে ভাবে বসে শ্যাফট ধরে রাখছিল গাড্ডাতেই যাতে চাকাগুলো যেতে পারে দু’পাশের মসৃণ জায়গা দিয়ে।
শুধু এটুকু লক্ষ্য করে কে আসতে পারে সে কথা না ভেবে অন্যমনস্কের মত লেভিন তাকালেন গাড়িটার দিকে গাড়ির কোণে ঢুলছিলেন এক বৃদ্ধা আর জানালার কোণে, বোঝা যায় সদ্য নিদ্রোখিত একটা তরুণী বসে ছিল দু’হাতে সাদা টুপির রিবন ধরে। লেভিনের কাছে যা এখন বিজাতীয় সেই সুচারু ও জটিল অন্তর্জীবনের প্রতিমূর্তি, ভাস্বর চিন্তামগ্ন একটা মেয়ে লেভিনকে লক্ষ্য না করে দেখছিল সূর্যোদয়।
দৃশ্যটা যখন অন্তর্হিত হচ্ছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে মেয়েটার সত্যসন্ধ দৃষ্টি পড়ল লেভিনের ওপর। আর তাঁকে চিনতে পেরে মুখ তার উদ্ভাসিত হয়ে উঠল বিস্মিত আনন্দে।
লেভিনের ভুল হতে পারে না। এরকম চোখ দুনিয়ায় শুধু এই একজোড়া। দুনিয়ায় শুধু এই একটা মানুষই আছে যে জীবনের সমস্ত আলো আর অর্থ কেন্দ্রীভূত করে তুলতে পারে লেভিনের কাছে। হ্যাঁ, সেই। মেয়েটা কিটি। লেভিন বুঝলেন যে রেলস্টেশন থেকে কিটি যাচ্ছে এগুশোভোতে। আর বিনিদ্র এই রাতটায় লেভিনকে যা আলোড়িত করেছিল, যেসব সিদ্ধান্ত তিনি নিয়েছিলেন, তা সবই হঠাৎ অন্তর্ধান করল। কৃষাণীকে বিয়ে করার যে কল্পনা তাঁর মনে এসেছিল, সেটা স্মরণ করে তাঁর বিতৃষ্ণা হল। শুধু ওখানে, দ্রুত অপসৃয়মান ওই যে গাড়িটা রাস্তার অন্য দিকে চলে গেছে, শুধু ওখানেই সম্ভব যে প্রহেলিকাগুলো ইদানীং তাঁকে পীড়িত ও পিষ্ট করছিল তার নিরসন।
কিটি আর ফিরে তাকায়নি। গাড়ির স্প্রিঙের আওয়াজ আর শোনা গেল না, সামান্য কানে আসছিল ঘোড়ার ঘণ্টি। কুকুরের ডাক থেকে বোঝা গেল গাড়ি গাঁয়ের মধ্যে—চারদিকে পড়ে রইল শুধু ফাঁকা মাঠগুলো, সামনের গ্রামটা আর তিনি নিজে, একাকী, সবার কাছে পর, পরিত্যক্ত বড় রাস্তাটা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন একাকী
যে ঝিনুকটা তাঁকে মুগ্ধ করেছিল, তাঁর আজকের রাতের ভাবনাধারাকে যা মূর্ত করে তুলেছিল, সেটা দেখার আশায় তিনি আকাশের দিকে তাকালেন। ঝিনুকের মত দেখতে কোন কিছুই তখন আর ছিল না। আকাশে। অনধিমগ্য ঐ উঁচুতে একটা রহস্যময় পরিবর্তন ঘটে গেছে। ঝিনুক নেই, তার বদলে আকাশের পুরো অর্ধেকটায় বিছিয়ে গেছে ক্রমেই ছোট ছোট হয়ে আসা কোদালে মেঘের টানা গালিচা। আকাশ নীল হয়ে ঝকঝক করছে, লেভিনের সপ্রশ্ন দৃষ্টির উত্তর সে দিল সেই একই কোমলতায়, কিন্তু সেই একই অনধিগম্যতায়।
লেভিন মনে মনে বললেন, ‘না, সহজসরল শ্রমজীবী এই জীবন যত সুন্দরই হোক, তাতে ফেরা আমার পক্ষে অসম্ভব। আমি ভালোবাসি কিটিকে।’
তেরো
কারেনিনের নিতান্ত ঘনিষ্ঠ লোকেরা ছাড়া আর কেউ জানত না যে, বাইরে থেকে দেখলে এই যে মানুষটিকে অতি নিরুত্তাপ, যুক্তিনির্ভর ব্যক্তি বলে মনে হয় তাঁর একটা দুর্বলতা আছে যা তাঁর চরিত্রের সাধারণ আদলের বিরোধী অবিচলিত চিত্তে কারেনিন শিশু বা নারীর কান্না শুনতে ও চোখের পানি দেখতে পারতেন না। চোখের পানি দেখলে তিনি অস্থির হয়ে পড়তেন, চিন্তা করার ক্ষমতা তাঁর একেবারে লোপ পেত। তাঁর দপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক ও সচিব এটা জানতেন, প্রার্থিনীদের তাঁরা সাবধান করে দিতেন যে নিজেদের কাজ পণ্ড করতে না চাইলে কিছুতেই যেন তারা না কাঁদে। বলতেন, ‘উনি রেগে উঠবেন, আপনার কথা শুনবেন না।’ আর সত্যিই, চোখের পানি দেখে এসব ক্ষেত্রে তাঁর যে চিত্তবিকার হত তা প্রকাশ পেত দমকা একটা রাগে। ‘আমি পারব না, কিছুই করতে পারব না। দয়া করে ভাগুন তো!’ সাধারণত এসব ক্ষেত্রে চেঁচিয়ে উঠতেন তিনি।
ঘোড়দৌড় থেকে ফেরার সময় আন্না যখন ভ্রন্স্কির সাথে তাঁর সম্পর্কের কথা তাঁকে জানান আর তার পরেই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলেন, কারেনিন তখন তাঁর প্রতি বিদ্বেষ বোধ করলেও চোখের পানি সব সময়ই তাঁর ভেতর যে চিত্তবিকার জাগায় সেটা তিনি টের পাচ্ছিলেন। এটা জানা থাকায় এবং এই মুহূর্তে তাঁর মনোভাব প্রকাশ করাটা পরিস্থিতির সাথে খাপ খাবে না, তাও জানা থাকার তিনি চেষ্টা করলেন নিজের মধ্যে জীবনের সব প্রকাশ রুদ্ধ করে রাখতে, তাই নড়লেন না, তাকালেন না আন্নার দিকে। এই থেকেই দেখা দেয তাঁর সেই বিচিত্র, মৃত মুখভাব যা আন্নাকে অত স্তম্ভিত করেছিল।
বাড়িতে আসতে উনি গাড়ি থেকে নামতে সাহায্য করলেন আন্নাকে, কষ্ট করে অভ্যস্ত ভদ্রতা বজায় রেখে বিদায় নিলেন এবং যে কথাগুলো বললেন তা বলার কোন বাধ্যতা ছিল না; বললেন যে কাল তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত জানাবেন। তাঁর সবচেয়ে নিকৃষ্ট সন্দেহ সমর্থিত হল স্ত্রীর যে কথায় তাতে নিষ্ঠুর যন্ত্রণা হল কারেনিনের। সে যন্ত্রণা আরো বেড়েছিল তাঁর চোখের পানিতে যে প্রত্যক্ষ অনুকল্পা বোধ করছিলেন তাতে। কিন্তু গাড়িতে একলা হবার পর কারেনিন অবাক হয়ে সানন্দে অনুভব করলেন যে, এই অনুকরণ আর ইদানীংকার সন্দেহ আর ঈর্ষা জ্বালা থেকে তিনি মুক্ত।
অনেক দিন থেকে যে দাঁতটা কষ্ট দিচ্ছে তা তুলে ফেললে লোকের যেমন লাগে তেমনি লাগল তাঁর। প্রচণ্ড যন্ত্রণা আর প্রকাণ্ড, নিজের মাথার চেয়েও বড় কি নিজের সৌভাগ্যে বিশ্বাসও করতে পারে না, হঠাৎ টের পায় যা একদিন তার জীবনকে বিষিয়ে দিচ্ছিল, সমস্ত মনোযোগ টেনে রাখছিল নিজের দিকে তা আর নেই, এখন সে আবার দিন কাটাতে, ভাবতে, আগ্রহী হতে পারবে শুধু তার দাঁতটা নিয়েয়ই নয়। এরকমেরই বোধ হল কারেনিনের। যন্ত্রণাটা হয়েছিল বিচিত্র আর ভয়ংকর, এখন আর নেই; তিনি অনুভব করলেন আবার তিনি দিন কাটাতেও ভাবতে পারবেন শুধু স্ত্রীর কথাই নয়।
নিজেকে তিনি বললেন, ‘সম্মান, নেই, হৃদয় নেই, ধর্ম নেই—নষ্ট মেয়ে! সব সময়ই তা জানতাম, সব সময় দেখতে পাচ্ছিলাম, যদিও তার ওপর করুণাবশে চেষ্টা করছিলাম আত্মপ্রতারণার।’ এবং সত্যিই তাঁর মনেহল যে তিনি সব সময়ই সেটা দেখতে পাচ্ছিলেন; এবং সত্যিই তাঁর মনে হল যে তিনি সব সময়ই সেটা দেখতে পাচ্ছিলেন; নিজেদের বিগত জীবনটার খুঁটিনাটি তিনি স্মরণ করতে লাগলেন, এ জীবন আগে তাঁর কাছে খারাপ মনে হয়নি, কিন্তু এসব খুঁটিনাটিতে পরিষ্কার প্রমাণ হল যে আন্না চিরকালই ছিলেন নষ্টা। ‘ওর সাথে নিজের জীবন জড়িয়ে ভূল করেছি আমি; কিন্তু এ ভুলে খারাপ কিছু নেই, তাই অসুখী আমি হতে পারি না। দোষ আমার নয়, ওর’, নিজেকে বললেন তিনি, ‘ওকে নিয়ে আমার দায় নেই কোন। ওর অস্তিত্বই নেই আমার কাছে…’
যেমন আন্নার প্রতি তেমনি তাঁদের ছেলের প্রতিও তাঁর মনোভাব বদলে গেছে, ওঁদের কি হবে তা নিয়ে তিনি আর ভাবছিলেন না। শুধু একটা প্রশ্ন নিয়েই তিনি ভাবিত, নিজের অধঃপতনের মধ্য দিয়ে আন্না যে নোংরা ছিটিয়েছেন তাঁর ওপর, সেটা সবচেয়ে ভালো, শোভন, নিজের পক্ষে সুবিধাজনক এবং সুতরাং সবচেয়ে ন্যায়সঙ্গত উপায়ে সাফ করতে আর নিজের সক্রিয়, সৎ, প্রয়োজনীয় জীবনের পথ ধরে চলতে থাকা যায় কিভাবে।
‘ঘৃণ্য এক নারী অপরাধ করছে বলে আমি অসুখী হতে পারি না; আমাকে যে কঠিন অবস্থায় সে ফেলেছে তা থেকে বেরিয়ে আসার সর্বোত্তম উপায় শুধু আমাকে পেতে হবে। আর সেটা আমি পাব’, ক্রমেই মুখ কোঁচকাতে কোঁচকাতে নিজেকে বলছিলেন তিনি, ‘আমিই প্রথমে নই, আমি শেষও নই।’
‘সুন্দরী হেলেন’ অপেরার ফলে যে মেনেলসের স্মৃতি সবার মনে তাজা হয়ে উঠেছিল তা থেকে শুরু করে অন্য সমস্ত ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত বাদ দিলেও কারেনিনের কল্পনায় ভেসে উঠতে লাগল উচ্চ সমাজে স্বামীর প্রতি স্ত্রীর বিশ্বাসঘাতকতার একসারি সাম্প্রতিক ঘটনা। ‘দারিয়ালাভ, পলতাভস্কি, প্রিন্স কারিবানোভ, কাউন্ট পাঙ্কুদিন, ড্রাম ….হ্যাঁ, ড্রামও, এমন সঃ কর্মিষ্ঠ মানুষ… সেমিওনভ, চাগিন, সিগোনিন’, স্মরণ করতে লাগলেন কারেনিন। ‘মেনে নিচ্ছি এসব লোকের কেমন একটা অবিবেচনাপ্রসূত টিটকারি জোটে, কিন্তু আমি এর ভেতর দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কিছু দেখিনি। সব সময় সহানূভূতি বোধ করেছি ওদের জন্যে’, নিজেকে বোঝালেন কারেনিন, যদিও কথাটা ঠিক নয়, এই ধরনের দুর্ভাগ্যে তিনি সহানুভূতি বোধ করেননি কদাচ, আর স্বামীর প্রতি স্ত্রীর বিশ্বাসঘাতকতার দৃষ্টান্ত যত ঘন ঘন ঘটেছে ততই নিজেকে উঁচু মনে করেছেন তিনি। ‘এ দুর্ভাগ্য সকলেরই ঘটতে পারে। আমারও ঘটেছে। ব্যাপারটা হল সবচেয়ে উত্তম উপায়ে এটা সয়ে যাওয়া।’ আর ওঁর মত অবস্থায় পতিত লোকেরা কি করেছে তা তিনি বিশদভাবে খতিয়ে দেখতে লাগলেন।
‘দারিয়ালভ ডুয়েল লড়েছিল…’
তারুণ্যে কারেনিন ডুয়েলের ভাবনায় বিভোর হতেন ঠিক এই কারণেই যে, দৈহিক দিক থেকে তিনি ছিলেন ভীরু, এবং নিজেও সেটা ভালো জানতেন। নিজের দিকে উদ্যত একটা পিস্তলের কথা তিনি ভাবতে পারতেন না বিনা ত্রাসে, কোন হাতিয়ারই তিনি ব্যবহার করেননি জীবনে। এই ত্রাসই তরুণকেই ডুয়েলের কথা ভাবিয়ে নিজের জীবনকে বিপন্ন করতে হবে এমন একটা পরিস্থিতে নিজের শক্তি পরীক্ষার স্বপ্ন দেখিয়েছে। জীবনে সাফল্য ও পাকা চাকরি পেয়ে তিনি বহুকাল ওই অনুভূতিটা ভুলে গিয়েছিলেন; কিন্তু অভ্যস্ত অনুভূতিটারই জয় হল, দেখা গেল নিজের কাপুরুষতার জন্য আতংক এখনো এতই প্রবল যে কারেনিন অনেকখন ধরে ও সব দিক দিয়ে ডুয়েল লড়ার কথা ভাবলেন ও তাতে আচ্ছন্ন হলেন যদিও আগে থেকেই তাঁর জানা ছিল যে কোনক্রমেই তিনি লড়বেন না।
‘কোন সন্দেহ নেই, আমাদের সমাজ এখনও এত বুনো (ইংরেজরা যা নয়) যে অনেকেই’, আর এই অনেকের মধ্যে তাঁরাও পড়েন যাঁদের মতামতে কারেনিন বিশেষ মূল্য দিতেন, ‘ডুয়েলকে ভালো চোখে দেখেন। কিন্তু কি ফল হবে? ধরা যাক আমি ডুয়েলকে ডাকলাম’, মনে মনে তিনি ভেবে চললেন, আর ডুয়েলে ডাকার পর যে রাতটা তাঁর কাটবে, যে পিস্তলটা উদ্যত হবে তাঁর দিকে সে কথা কল্পনা করে কেঁপে উঠলেন তিনি, এবং টের পেলেন, এ কাজ কখনো তিনি করবেন, না ‘ধরা যাক, আমি ওকে ডুয়েলে ডাকলাম। ধরা যাক, আমাকে সব শিখিয়ে-পড়িয়ে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল’, ভেবে চললেন তিনি, ‘আমি ট্রিগার টিপলাম’,–এই ভেবে তিনি চোখ বুজলেন, ‘দেখা গেল, আমি ওকে খুন করেছি’, মনে মনে ভেবে কারেনিন মাথা ঝাঁকালেন নির্বোধ ভাবনাটা অগিয়ে দেবার জন্য। ‘পাতকী স্ত্রী আর পুত্রের সাথে সম্পর্ক স্থির করে নেবার জন্যে নরহত্যার কি অর্থ হয়? স্ত্রীর ব্যাপারে কি করা হবে সেটাও আমাকে স্থির করতে হবে ঠিক ওভাবেই। কিন্তু যেটা আরো বিশ্বাস্য এবং যা অবশ্যই ঘটবে, সেটা হল—আমিই মারা যাব কিংবা আহত হব। আমি নির্দোষ একটা লোক, হব শিকার—নিহত বা আহত। এটা আরো অর্থহীন। তা ছাড়া আমার পক্ষ থেকে ডুয়েলে ডাকা হবে একটা কপট আচরণ। একি আমি আগেই জানি না যে আমার বন্ধুরা ডুয়েল লড়তে দেবে না—এটা হতে দেবে না যে রাশিয়ার জন্যে প্রয়োজনীয় এক রাজপুরুষের জীবন বিপন্ন হোক। কি দাঁড়াবে তাহলে? দাঁড়াবে এই যে ব্যাপারটা বিপদ পর্যন্ত গড়াবে না জেনে রেখেই আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে কিছু মিথ্যে বাহাদুরি দেখাতে চেয়েছিলাম। এটা অসাধু, এটা কপট, অন্যদেরকে এবং নিজেকে প্রতারণা। ডুয়েল অকল্পনীয়, আমার কাছ থেকে সেটা কেউ আশা করে না। আমার লক্ষ্য হল, বিনা বাধায় নিজের ক্রিয়াকলাপ চালিয়ে যাবার মত মান-সম্মান সুনিশ্চিত করা।’ রাজসেবার যে ক্রিয়াকলাপ কারেনিনের কাছে আগেও বেশ গুরুত্ব ধরত, সেটা তাঁর কাছে এখন অতি গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রতীয়মান হল।
ভেবে-টেবে ডুয়েলের সংকল্প বাদ দিয়ে কারেনিন বিবাহবিচ্ছেদের কথা চিন্তা করল—যেসব পুরুষের কথা তাঁর মনে পড়ছিল তাঁদের কয়েকজন বেছে নেন এই দ্বিতীয় পদ্ধতিটি। বিবাহবিচ্ছেদের যত ঘটনা জানা আছে (তাঁর সুপরিচিত উচ্চ সমাজে এর সংখ্যা খুবই বেশি) তা সব বিচার করে কারেনিন এমন একটা ঘটনাও পেলেন না যার লক্ষ্য তিনি যা ভাবছিলেন সেরকম। এগুলোর প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বামী বিশ্বাসঘাতিনী স্ত্রীকে স্রেফ ছেড়ে বা বেচে দিয়েছে আর অপরাধের কারণে যে পক্ষের বিয়ের কোন অধিকার ছিল না, সে একটা বানিয়ে নেওয়া, আপাত-বৈধ সম্পর্ক পেতেছে নতুন স্বামীর সাথে। নিজের ক্ষেত্রে কারেনিন দেখতে পেলেন যে একটা বৈধ বিচ্ছেদ, অর্থাৎ যাতে দোষী স্ত্রীই শুধু প্রত্যাখ্যাত হবে, সেটা অসম্ভব। তিনি দেখতে পেলেন যে জটিল যে পরিস্থিতিতে তিনি আছেন তাতে স্ত্রীকে দোষী সাব্যস্ত করার জন্য আইন যেসব স্থূল প্রমাণ দাবি করে তা জোগাড় করা সম্ভব নয়; দেখতে পাচ্ছিলেন যে এ সব প্রমাণ থাকলেও তাঁর জীবনের মার্জিত রুচি তা ব্যবহার করতে দেবে না, ব্যবহার করলে সমাজের কাছে স্ত্রীর চেয়ে তাঁরই ক্ষতি হবে বেশি।
বিবাহবিচ্ছেদ করতে গেলে দাঁড়াবে শুধু একটা কেলেঙ্কারি মামলা যা শুধু কুৎসা রটনা আর সমাজে তাঁর উচ্চ প্রতিষ্ঠার হানি ঘটানোর জন্য কাজে লাগবে তাঁর শত্রুদের। সবচেয়ে কম ভাঙচুরে নিজের অবস্থাটা স্থির করে নেওয়া— এই প্রধান লক্ষ্যটা বিবাহবিচ্ছেদেও সিদ্ধ হবে না। তা ছাড়া স্পষ্টই বোঝা যায় বিবাহবিচ্ছেদের, এমন কি তার চেষ্টা করলেও স্ত্রী স্বামীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে যোগ দেবে তার প্রণয়ীর সাথে। এবং স্ত্রীর প্রতি তিনি এখন একটা সুঘৃণ ঐদাসীন্য বোধ করছেন বলে তাঁর মনে হলেও অন্তরে অন্তরে কারেনিন অনুভব করছিলেন শুধু একটা প্রবণতা—স্ত্রী অবাধে ভ্রন্স্কির সাথে মিলিত হতে পারবে, তার অপরাধই হবে তার কাছে লাভজনক, এতে অনিচ্ছা। এই একটা ভাবনাই তাঁকে এত উত্ত্যক্ত করছিল যে ব্যাপারটা কল্পনা করে বেদনায় ককিয়ে উঠলেন তিনি, দাঁড়িয়ে উঠে জায়গা বদল করলেন গাড়িতে, তারপর মুখ কুঁচকে অনেকক্ষণ ধরে কম্বলে তাঁর ঠাণ্ডা হাড্ডিসার পা ঢাকা দিতে লাগলেন।
‘আনুষ্ঠানিক বিবাহবিচ্ছেদ ছাড়াও কারিবানোভ, পাঙ্কুদিন আর ঐ ভালোমানুষ ড্রাম যা করেছে তা করা যায়, অর্থাৎ স্ত্রীর কাছ থেকে আলাদা হওয়া’, একটু শান্ত হয়ে ভাবতে লাগলেন তিনি; কিন্তু এ ব্যবস্থাটাও বিবাহবিচ্ছেদের মতই কলঙ্কের সমান অসুবিধা ঘটাবে, আর সবচেয়ে বড় কথা, ঠিক বিবাহবিচ্ছেদের মতই এটা স্ত্রীকে তুলে দেবে ভ্রন্স্কির আলিঙ্গেনে। ‘না, সে অসম্ভব, অসম্ভব!’ আবার কম্বল জড়াতে জড়াতে তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘অসুখী আমি হতে পারি না, কিন্তু সুখী হওয়া চলে না ওদের দুজনেরও।’
যে ঈর্ষা তাঁকে পীড়িত করছিল অনিশ্চিত থাকার সময়, স্ত্রীর কথায় সযন্ত্রণায় তাঁর দাঁত তুলে ফেলার সাথে সাথে তা চলে যায়। কিন্তু তার স্থান নেয় অন্য একটা জিনিস : স্ত্রী শুধু জয়বোধ করবে না তাই নয়, অপরাধের প্রতিফলও পাক, এই বাসনা। এই অনুভূতি সম্পর্কে তিনি সজ্ঞান ছিলেন না, কিন্তু মনের গভীরে তিনি চাইছিলেন যে তাঁর প্রশান্তি ও সম্মান নষ্ট করার জন্য স্ত্রী কষ্ট ভুগুক। এবং ডুয়েল, বিবাহবিচ্ছেদ আর পৃথক বসবাসের শর্তগুলো আবার পুনর্বিবেচনা ও বর্জন করে কারেনিন নিশ্চিত হয়ে উঠলেন যে উপায়ান্তর আছে কেবল একটা—যা ঘটেছে তা সমাজের কাছ থেকে লুকিয়ে আন্নাকে নিজের কাছে রাখা এবং তাঁর সাধ্যায়ত্ত সমস্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করে ওঁদের যোগাযোগ বন্ধ করা আর প্রধান কথা—যার সম্পর্কে তিনি নিজেই সজ্ঞান ছিলেন না-আন্নাকে শাস্তি দেওয়া। ‘নিজের এই সিদ্ধান্ত আমাকে ঘোষণা করতে হবে যে পরিবারকে যে গুরুতর অবস্থায় সে ফেলেছে তাতে বাহ্যিক স্থিতাবস্থা ছাড়া অন্য সমস্ত ব্যবস্থাই হবে দু’পক্ষের ক্ষেত্রেই খারাপ, স্থিতাবস্থা আমি মেনে চলতে রাজি কিন্তু সে আমার ইচ্ছা, অর্থাৎ প্রণয়ীর সাথে সম্পর্ক বন্ধ করবে এই শর্তের কঠোর পালনে।’ এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্তরূপে নিয়ে নেওয়ার পর তিনি আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি পেলেন তার সমর্থনে। নিজেকে তিনি বললেন, ‘ধর্মমতে আমি চলতে পারব কেবল, এই সিদ্ধান্তেই, কেবল এই সিদ্ধান্তেই আমি পাতকী স্ত্রীকে ত্যাগ না করে তাকে সংশোধনের সুযোগ দেব আর এমন কি আমার পক্ষে যত কঠিনই হোক, নিজের শক্তির একাংশ ব্যয় করব তাকে সংশোধন করতে, বাঁচাতে। কারেনিন যদিও জানতেন যে, স্ত্রীর ওপর নৈতিক প্রভাবপাতে তিনি অক্ষন এবং সংশোধনের এসব চেষ্টা থেকে মিথ্যা ছাড়া আর কোন ফল হবে না; দুঃসহ এই মুহূর্তগুলোর কষ্ট ভোগের সময় যদিও তিনি একবারও ধর্মের শরণ নেননি, তাহলেও এখন তাঁর যা মনে হল, তাঁর সিদ্ধান্ত ধর্মীয় দাবির সাথে মিলে যাচ্ছে আর ধর্মের এই মঞ্জুরি তাঁকে দিল পরিপূর্ণ সন্তুষ্টি এবং আংশিক শান্তি। এ ভেবে তাঁর আনন্দ হল যে কেউ বলতে পারবে না যে জীবনের এমন একটা গুরুতর অবস্থাতে তিনি সে ধর্মের অনুজ্ঞা মেনে চলেননি, সাধারণ শীতলতা ও ঐদাসীন্যের মধ্যে যার পতাকা তিনি চিরকাল উচ্চে তুলে ধরেছেন। আরো খুঁটিনাটি বিচার করে কারেনিন দেখতেই পেলেন না কেন স্ত্রীর সাথে তাঁর সম্পর্ক আগের মতই থাকতে পারবে না। তার প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা তিনি যে কখনো ফিরিয়ে আনতে পারবেন না তাতে সন্দেহ নেই; কিন্তু স্ত্রী নষ্ট আর অবিশ্বস্তা বলে তিনি তাঁর জীবন পয়মাল করবেন, কষ্ট ভুগবেন, এর কোন কারণ নেই, থাকতেও পারে না। ‘হ্যা, সময় যাবে, সর্বদুঃখহর সময়, সম্পর্ক হয়ে উঠবে আগের মত, নিজেকে বোঝালেন কারেনিন, ‘মানে, তা এমন মাত্ৰায় যাবে যে আমার জীবনের ধারায় কোন বিশৃঙ্খলা বোধ করব না। ওর অসুখী হওয়ার কথা, কিন্তু আমার তো দোষ নেই, তাই আমি অসুখী হতে পারি না।’
চৌদ্দ
আলেক্সেই আলেক্সান্দ্রভিচ কারেনিন পিটার্সবুর্গ যেতে যেতে শুধু যে এ সিদ্ধান্তে অটল রইলেন তাই নয়, স্ত্রীকে যে চিঠি লিখবেন তার বয়ানও তিনি করতে লাগলেন মনে মনে। হলে ঢুকে মন্ত্রিদপ্তর থেকে আসা চিঠিপত্রগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করে তিনি হুকুম দিলেন সেগুলো তাঁর কেবিনেটে নিয়ে যাবার।
‘ঘোড়া সরিয়ে নাও, আর কারও আসা এখন বারণ’, খানসামার জিজ্ঞাসার জবাবে তিনি বললেন খোশমেজাজের লক্ষণস্বরূপ খানিকটা তৃপ্তির সাথে, ‘আসা বারণ’ কথাটায় জোর দিয়ে।
কেবিনেটে কারেনিন দু’বার এ-মোড় ও-মোড় হেঁটে লেখার বিরাট টেবিলটার কাছ থামলেন। তাঁর আগে আগে এসে সাজবরদার তাতে ছয়টা মোমবাতি জ্বালিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। আঙুল মটকে কারেনিন চেয়ারে বসলেন, ঠিকঠাক করতে লাগলেন টেবিলের জিনিসপত্র। কনুইয়ে ভর দিয়ে তিনি এক মিনিট ভাবলেন তারপর এক মুহূর্ত না থেমে লিখতে শুরু করলেন। লিখলেন তিনি সম্বোধন না করে, ফরাসি ভাষায় আর ব্যবহার করলেন ‘আপনি’ সর্বনাম যা ফরাসিতে রুশ ভাষার মত অতটা নিরুত্তাপ নয়।
আমাদের শেষ কথাবার্তায় আমি কথাবার্তার বিষয় প্রসঙ্গে আমার সিদ্ধান্ত জানাবার সংকল্প জ্ঞাপন করেছিলাম। সব কিছু মনোযোগসহকারে ভেবে দেখে আমি এখন আমার প্রতিশ্রুতি পালনের জন্য লিখছি। আমার সিদ্ধান্ত এই : আপনার আচরণ যা হোক, ওপরওয়ালা যে বাঁধনে আমাদের বেঁধেছেন তা ছিন্ন করার অধিকার আমার নেই বলে আমি মনে করি। দম্পতিদের একজনের খামখেয়াল, স্বেচ্ছাচার এমন কি পাতকেও পরিবার ধ্বংস করা চলে না, এবং আমাদের জীবন আগে যেমন চলেছে তেমনি চলা উচিত। এটা আবশ্যক আমার জন্য, আপনার জন্য, আমাদের ছেলের জন্য। আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত যে এই চিঠির যা উপলক্ষ তার জন্য আপনি অনুতাপ করেছেন ও করছেন, এবং আমাদের মনান্তরের কারণ আমূল উৎপাটিত করে অতীতকে ভুলে যেতে আপনি আমাকে সহায়তা করবেন। বিপরীত ক্ষেত্রে আপনি নিজেই কল্পনা করতে পারেন আপনার এবং আপনার পুত্রের ভাগ্যে কি আছে। আশা করি, এসব নিয়ে সাক্ষাতে আরো বিশদ কথা হবে বলে। পল্লীবাসের মৌসুম যেহেতু শেষ হতে চলেছে, তাই আপনাকে অনুরোধ করি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, মঙ্গলবারের মধ্যেই পিটার্সবুর্গে চলে আসতে। আপনার আগমনের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত ব্যবস্থা করা থাকবে আপনাকে মনে রাখতে মিনতি করি যে আমার এ অনুরোধ পালনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব অর্পণ করছি আমি।
আ. কারেনিন
পুনশ্চ : চিঠির সাথে টাকা রইল, আপনার খরচার জন্য তা দরকার হতে পারে।’
চিঠিটা পড়ে দেখে তিনি সন্তুষ্ট হলেন, বিশেষ করে এই জন্য যে টাকাটা দেবার খেয়াল হয়েছিল তাঁর; কোন কড়া কথা বা তিরস্কার নেই, তাতে আবার প্রশ্রয়ও নেই। বড় কথা-প্রত্যাবর্তনের স্বর্ণসেতু পাতা গেল। চিঠি ভাঁজ করে হাতির দাঁতের মস্ত ইয়া বড় ছুরিতে তা পালিশ করে টাকাসহ তা খামে পুরলেন এবং নিজের টেবিলের চমৎকার সুব্যবস্থিত জিনিসপত্রগুলো ব্যবহার করতে তিনি সব সময় যে তৃপ্তি লাভ করতেন সেই তৃপ্তিতে ঘণ্টি বাজালেন।
‘পত্রবাহককে দিয়ে বলো যে, পল্লীনিবাসে আন্না আর্কাদিয়েভনাকে যেন পৌঁছে দেয় কালই’, বলে উঠে দাঁড়ালেন তিনি।
‘জ্বি আচ্ছা। কেবিনেটে চা আনব?’
কেবিনেটেই চা দিতে বললেন কারেনিন, ইয়া বড় ছুরিটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে গেলেন ইজি-চেয়ারটার কাছে, সেখানে বাতি তৈরি ছিল আর ছিল মিশরীয় লিপি সম্পর্কে পড়তে শুরু করা একটা ফরাসি বই। কেদারার ওপরে টাঙানো ছিল ডিম্বাকৃতি সোনালি ফ্রেমে বাঁধানো, নামকরা চিত্রকরের আঁকা আন্নার চমৎকার প্রতিকৃতি। কারেনিন তার দিকে তাকালেন। আন্নার দুর্ভেদ্য চোখ তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে বেহায়ার মত উপহাসভরে, তাঁদের গত সন্ধ্যার আলাপের সময়কার মত। মাথার কালো লেস, কালো চুল, অপরূপ সাদা হাতের অনামিকায় আংটি, শিল্পী যা এঁকেছে অতি সুন্দর করে তা কারেনিন কাছে লাগল অসহ্য বেহায়া আর আস্ফালনের মত। ছবিটার দিকে এক মিনিট চাইতেই তিনি এমন চমকে উঠলেন যে ঠোঁট কেঁপে গিয়ে একটা ‘ব্রর’ শব্দ বেরুল। মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে তাড়াতাড়ি করে কেদারায় বসে বই খুললেন। পড়ার চেষ্টা করলেন, কিন্তু মিশরীয় লিপি সম্পর্কে আগে তাঁর যে সজীব আগ্রহ ছিল সেটা কিছুতেই ফিরিয়ে আনতে পারলেন না। বইটার দিকে তাকিয়ে থেকে তিনি ভাবতে লাগলেন অন্য কথা। স্ত্রীর কথা নয়, সম্প্রতি তাঁর রাষ্ট্রীয় ক্রিয়াকলাপে যে একটা জটিলতা দেখা দিয়েছে, চাকরিতে এখন যেটায় তাঁর প্রধান আগ্রহ, ভাবছিলেন তার কথা। তিনি অনুভব করছিলেন যে এই জটিল ব্যাপারটা তিনি আগে কখনো এতটা তলিয়ে দেখেননি, এবং মাথায় তাঁর—বড়াই না করে এ কথা তিনি বলতে পারেন—এসেছে একটা খাশা ভাবনা, তাতে ব্যাপারটার জট খুলবে, তাঁর উন্নতি হবে চাকরিতে, শত্রুদের ক্ষতি হবে, সুতরাং উপকার হবে রাষ্ট্রের। চা দিয়ে লোকটা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই কারেনিন গেলে লেখার টেবিলের কাছে। চলতি ব্যাপারগুলোর পোর্টফোলিওটা টেনে নিয়ে আত্মতৃপ্তির সামান্য লক্ষণীয় হাসিমুখে একটা পেনসিল বার করে সামনের আরেকটা জটিল ব্যাপারের আগে যে জটিল ব্যাপারটা কাগজগুলো তিনি চেয়ে পাঠিয়েছিলেন তা পড়ায় মগ্ন হয়ে গেলেন। জটিলতা হল এই। রাজপুরুষ হিসেবে কারেনিনের বৈশিষ্ট্য, যা পুরোগামী প্রতিটি ব্যক্তির থাকে, এবং যা শুধু তাঁর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, একগুঁয়ে আত্মাভিমান, সংযম, সততা ও আত্মবিশ্বাসের সাথে মিলে যা তাঁর চাকরিভাগ্য গড়ে দিয়েছে সেটা হল কাগুজে আনুষ্ঠানিকতার প্রতি তাঁর তাচ্ছিল্য, লেখালেখি কমিয়ে আনা, যতদূর সম্ভব জীবন্ত ব্যাপারটার সাথে সরাসরি যোগাযোগ, এবং মিতব্যয়িতা। হয়েছিল এই যে ২ জুনের কমিশনে জারাইস্ক গুবের্নিয়ায় সেচকর্মের ব্যাপারটা ওঠে যা কারেনিন যে মন্ত্রিদপ্তরে আছেন তার অন্তর্ভুক্ত, এবং অপব্যয়ের নিষ্ফলতা ও কাজটার প্রতি কাগুজে মনোভাবের প্রখর দৃষ্টান্ত এটি। কারেনিন জানতেন যে ব্যাপারটা সত্যিই তাই। জারাইস্ক গুবের্নিয়ায় সেচের ব্যাপার শুরু করেছিলেন তাঁর পূর্ববর্তী পদাধিকারীর পূর্ববর্তী ব্যক্তি। এবং সত্যিই এই ব্যাপারে অনেক টাকা খরচ হয়েছে ও হচ্ছিল একেবারেই কোন কাজ না দিয়ে এবং স্পষ্টতই গোটা ব্যাপারটায় কোন ফল হতে পারে না। চাকরিতে গিয়ে কারেনিন তখনই সেটা বুঝেছিলেন এবং ভেবেছিলেন হস্তক্ষেপ করবেন; কিন্তু প্রথমটায় যখন তিনি পায়ের তলে তখনও বিশেষ শক্ত মাটি পাননি, তিনি জানতেন যে তাতে বড় বেশি লোকের স্বার্থে ঘা পড়বে, এবং কাজটা বিচক্ষণ হবে না; পরে তিনি অন্য কাজে ব্যস্ত থাকায় এ ব্যাপারটা স্রেফ ভুলেই যান। অন্য সমস্ত ব্যাপারের মত এটাও চলতে থাকে আপনা-আপনি, জাডোর শক্তিতে। (এতে অনেক লোকের খাওয়া জুটছিল, বিশেষ করে অতি নীতিপরায়ণ সঙ্গীতভক্ত একটা পরিবারের : ও বাড়ির সব মেয়েই তারযন্ত্র বাজাত। কারেনিন পরিবারটিকে জানতেন এবং বড় মেয়েদের একটার ধর্মবাপও হয়েছিলেন।) শত্রুভাবাপন্ন অন্য একটা মন্ত্রিদপ্তর যে ব্যাপারটা খুঁচিয়ে তুলেছে সেটা কারেনিনের মতে অসাধু। কেননা প্রতি দপ্তরেই এরকম ব্যাপার আছে যা চাকরির নির্দিষ্ট কতকগুলো কারণবশত কেউ খুঁচিয়ে তোলে না। এখন কিন্তু ওঁর দিকে যখন দ্বন্দ্ব্বাহ্বানের দস্তানা ছুঁড়েই ফেলা হল, তখন সেটা তিনি নির্ভয়ে লুফে নিলেন, এবং জারাইস্ক গুবের্নিয়ার সেচ-বিষয়ক কমিশনের কাজ দেখা ও যাচাই করার জ্য বিশেষ কমিশন নিয়োগের দাবি করলেন; এই ভদ্রলোকদের কোন ছাড়টাড় দেবেন না তিনি। আরো একটা বিশেষ কমিশন তিনি দাবি করলেন অরুশদের উন্নতির জন্য। ২ জুনের কমিটিতে অরুশ জাতির প্রশ্নটা এসেছিল নেহাৎ অকস্মাৎ, কিন্তু অরুশদের শোচনীয় অবস্থা আর বিলম্ব সইতে পারে না বলে কারেনিন সতেজে তা সমর্থন করেন। কমিটিতে প্রশ্নটা হয়ে দাঁড়ায় কয়েকটি মন্ত্রিদপ্তরের মধ্যে বচসার উপলক্ষ। কারেনিনের প্রতি যে দপ্তরটা শত্রুভাবাপন্ন ছিল, তারা প্রমাণ করে দিল যে অরুশদের অবস্থায় খুবই শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে, উন্নয়নের যে প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে তাতে সেটা ধ্বংসই পাবে আর খারাপ যদি কিছু থেকে থাকে তবে সেটা আসছে কারেনিনের মন্ত্রিদপ্তর কর্তৃক আইনসঙ্গত ব্যবস্থা চালু না করা থেকে। এবার কারেনিন স্থির করলেন যে দাবি করবেন : প্রথমত, নতুন একটা কমিশন গঠন যার ওপর ভার দেওয়া হবে অকুস্থলে গিয়ে অরুশদের অবস্থা তদন্ত করার; দ্বিতীয়ত, কমিটির হাতে যেসব সরকারী তথ্যাদি আছে তা থেকে অরুশদের অবস্থা যা দাঁড়ায় তাই যদি সত্যি হয়, তাহলে নতুন আরেকটা কমিশন গড়া হোক অরুশদের এই নিরানন্দ অবস্থাটা পর্যালোচনার জন্য : (ক) রাজনৈতিক, (খ) প্রশাসনিক, (গ) অর্থনৈতিক, (ঘ) নরকৌলিক, (ঙ) বৈষয়িক এবং (চ) ধর্মীয় দিক থেকে; তৃতীয়ত, অরুশরা বর্তমানে যে অসুবিধাজনক পরিস্থিতিতে আছে তা নিবারণের জন্য শত্রুভাবাপন্ন মন্ত্রিদপ্তরটি গত দশ বছরে কি ব্যবস্থা অবলম্বন করেছে তার বিবরণ দাবি করা হোক উক্ত মন্ত্রিদপ্তরের কাছে; অবশেষে চতুর্থত, ১৮৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর ও ১৮৬৪ সালের ৭ জুন তারিখের ১৭০১৫ ও ১৮৩০৮ নং যে দলিল কমিটিতে পেশ করা হয়েছে তা থেকে যা দেখা যাচ্ছে খণ্ড… ধারা ১৮ ও ৩৬ ধারার টীকার মৌলিক ও আঙ্গিক আইনের সরাসরি বিরোধিতা করে মন্ত্রিদপ্তর কেন কাজ করেছে তার কৈফিয়ত দাবি করা হোক। দ্রুত এই ভাবনার সংক্ষিপ্তসার টুকে রাখার সময় কারেনিনের মুখে ফুটে উঠল সঞ্জীবনের আভা। এক টুকরো কাগজে তিনি প্রয়োজনীয় তথ্য চেয়ে পাঠিয়ে উঠে দাঁড়ালেন এবং ঘণ্টি দিয়ে চিরকুটটা তাঁর দপ্তরের তত্ত্বাবধায়ককে দিতে বললেন। উঠে দাঁড়িয়ে ঘরে পায়চারি করতে করতে তিনি আবার তাকালেন আন্নার প্রকৃতির দিকে, ভুরু কুঁচকে হাসলেন ঘৃণাভরে। তারপরে মিশরীয় লিপির বইখানা পড়ে এবং তাতে আগ্রহ ফিরে আসার পর উনি ঘুমাতে গেলেন এগারোটার সময় আর বিছানায় শুয়ে শুয়ে স্ত্রীর ঘটনাটা স্মরণ করে—ব্যাপারটা মোটেই অতটা বিষাদের নয় বলে তাঁর মনে হল।