বিশ
পার্টিশান দিয়ে আধাআধি ভাগ করা প্রশস্ত পরিচ্ছন্ন একটা কৃষক কুটিরে থাকতেন ভ্রন্স্কি। ক্যাম্পেও পেত্রিৎস্কি থাকতেন তাঁর সাথে। ভ্রন্স্কি আর ইয়াভিন যখন এলেন, তখন পেত্রিৎস্কি ঘুমাচ্ছিলেন।
‘ওঠ, খুব ঘুমিয়েছিস’, পার্টিশানের ওপাশে গিয়ে বালিশে নাক গুঁজে থাকা পেত্রিৎস্কির কাঁধে ধাক্কা দিয়ে বললেন ইয়াভিন।
পেত্রিৎস্কি হঠাৎ হাঁটুতে ভর দিয়ে লাফিয়ে উঠে দুজনকে তাকিয়ে দেখলেন।
ভ্রন্স্কিকে বললেন, ‘তোর বড় ভাই এসেছিল, আমাকে জাগিয়ে দিল হতচ্ছাড়াটা, বলল আবার আসবে। আবার কম্বল টেনে নিয়ে মাথা রাখলেন বালিশে। ‘জ্বালাস নে বাপু ইয়াভিন’, ওঁর কম্বলটা টানছিলেন ইয়াভিন, তাতে চটে উঠে পেত্রিৎস্কি বললেন, ‘ছাড় তো!’ পাশ ফিরে চোখ মেললেন তিনি, ‘তার চেয়ে বরং বল কি পান করা যায়; এমন বিস্বাদ হয়ে আছে মুখটা যে…’
‘সবচেয়ে ভালো হবে ভোদ্কা’, গাকগাঁক করে উঠলেন ইয়াভিন, ‘তেরেশ্যেঙ্কো! সাহেবের জন্য ভোদ্কা আর শশা!’ চেঁচিয়ে বললেন তিনি, বোঝা যায় নিজের গলা শুনতে তাঁর ভালো লাগছিল।
‘বলছিস ভোদ্কা? এ্যা?’ মুখ কুঁচকে চোখ রগড়াতে রগড়াতে বললেন পেত্রিৎস্কি, ‘আর তুই খাবি? তাহলে একসাথেই খাওয়া যাক! খাবি ভ্রন্স্কি?’ উঠে দাঁড়িয়ে বাঘছালের কম্বলটা হাতের নিচে জড়াতে জড়াতে পেত্রিৎস্কি বললেন।
পার্টিশানের দরজায় এসে হাত তুলে ফরাসি ভাষায় গেয়ে উঠলেন, ‘এক যে রাজা ছিল গো তু-উ-লায়’। ‘অস্কি, টানবি?’
‘ভাগ তো’, চাকর যে ফ্রক-কোটটা এনে দিয়েছিল সেটা পরতে পরতে বললেন ভ্রন্স্কি।
‘কোথায় রে?’ ইয়াভিন জিজ্ঞেস করলেন। একটা ত্রয়কা গাড়ি আসতে দেখে যোগ করলেন, ‘ত্রয়কাও এসে গেছে দেখছি।
‘আস্তাবলে, তাছাড়া ঘোড়ার ব্যাপারে ব্রিয়াস্কির কাছেও যেতে হবে’, ভ্রন্স্কি বললেন।
ভ্রন্স্কি সত্যিই ব্রিয়ান্স্কিকে কথা দিয়েছিলেন যে পিটার্সহফ থেকে দশ ডার্স্ট দূরে তার কাছে গিয়ে টাকা দিয়ে আসবেন ঘোড়ার জন্য; চেয়েছিলেন এখানেও ঢুঁ মেরে আসতে পারবেন। কিন্তু বন্ধুরা সাথে সাথে ধরে ফেললেন যে শুধু ব্রিয়াস্কির কাছেই তিনি যাচ্ছেন না। গান চালিয়ে যেতে যেতেই চোখ মটকালেন পেত্রিৎস্কি, ঠোঁট ফোলালেন যেন বলতে চান : জানি রে তোর ব্রিয়াস্কিকে।
‘দেখিস, দেরি করিস না যেন!’ শুধু এটুকু বলে ইয়াভিন প্রসঙ্গ পালটাবার জন্য যে ঘোড়াটাকে বিক্রি করেছেন জানালা দিয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, তা আমার ফুট-ফুটকি কাজ দিচ্ছে কেমন, ভালো?’
ভ্রন্স্কি ততক্ষণে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, পেত্রিৎস্কি তাঁর উদ্দেশে চেঁচালেন, ‘আরে দাঁড়া, দাঁড়া! তোর বড় ভাই তোর জন্যে একটা চিঠি আর চিরকুট রেখে গেছে। দাঁড়া, দাঁড়া, কোথায় সেগুলো?’
ভ্রন্স্কি দাঁড়ালেন।
‘কিন্তু কোথায় সেগুলো?’
‘কোথায়? আরে সে-ই তো প্রশ্ন!’ নাক থেকে ওপরের দিকে তর্জনী তুলে সগাম্ভীর্যে বললেন পেত্রিৎস্কি।
ভ্রন্স্কি হেসে বললেন, ‘আরে বাবা বল, ফক্কড়ি করিস না।’
‘ওটা দিয়ে তো আর ফায়ার-প্লেস ধরাইনি, এখানেই থাকবে কোথাও।’
‘নে, বাজে কথা রাখ! কোথায় চিঠি?’
উঁহু, সত্যি মনে নেই। নাকি স্বপ্নে দেখলাম? দাঁড়া, দাঁড়া, রাগ করিস না। গতকাল যদি আমার মত চার বোতল শেষ করতিস, তাহলে তুইও ভুলে যেতিস কোথায় আছিস। দাঁড়া ভেবে দেখি।’
পেত্রিৎস্কি পার্টিশানের ওপাশে গিয়ে শুলেন নিজের বিছানায়।
‘দাঁড়া, এভাবে শুয়ে ছিলাম আমি আর ও দাঁড়িয়ে ছিল ওখানে। হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ… এই যে!’ তোষকের তলে যেখানে লুকিয়ে রেখেছিলেন, সেখান থেকে পেত্রিৎস্কি টেনে বের করলেন চিঠিটা।
চিঠি নিয়ে বড় ভাইয়ের চিরকুট পড়ে দেখলেন ভ্রন্স্কি। যা ভেবেছিলেন, তাই-ই। যাননি বলে মা অনুযোগ করেছেন চিঠিতে, বড় ভাইয়ের চিরকুটে লেখা আছে কথা বলা দরকার। ভ্রন্স্কি জানতেন সবই ওই ব্যাপারটা নিয়েই। ‘ওঁদের এ নিয়ে মাথা ঘামাবার কি আছে?’ এই ভেবে ভ্রন্স্কি চিঠিটা দলা-মোচড়া করে গুঁজলেন ফ্রক-কোটের বোতামের ফাঁকে, পথে যেতে যেতে মন দিয়ে পড়বেন বলে। বেরোবার বারান্দায় দেখা হল দুজন অফিসারের সাথে, একজন তাঁদের, দ্বিতীয়জন অন্য রেজিমেন্টের লোক।
ভ্রন্স্কির বাসা সব সময়ই সমস্ত অফিসারদের আড্ডাস্থল।
‘কোথায়?’
‘পিটার্সহফে, কাজ আছে।’
‘জারস্কোয়ে থেকে ঘোড়া এসেছে?’
‘এসেছে, তবে আমি এখনো দেখিনি।
‘শুনছি নাকি মাখোতিনের গ্লাদিয়াতর খোঁড়া হয়েছে।’
‘বাজে কথা। কিন্তু এই কাদায় আপনারা দৌড়াবেন কেমন করে?’ বলল অন্যজন।
‘এতেই আমার উদ্ধার!’ আগতদের দেখে চেঁচিয়ে উঠলেন পেত্রিৎস্কি। সামনে তাঁর ভোদ্কা আর ট্রে-তে নোনা শশা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল অর্দালি। ‘তরতাজা হয়ে ওঠার জন্যে খেতে হুকুম করছে ইয়াভিন।’
‘কাল আমাদের বেশ দেখালেন বটে’, বলল নবাগতদের একজন। ‘সারা রাত ঘুমাতে দেননি।’
‘কিন্তু শেষটা হল কেমন?’ পেত্রিৎস্কি বলতে লাগলেন, ‘ভলকোভ ছাদে উঠে বলে ওর নাকি মন খারাপ লাগছে। আমি বললাম, লাগাও গান, অন্ত্যেষ্টি মার্চ! ওই অন্ত্যেষ্টি মার্চ সঙ্গীত শুনতে শুনতেই সে ঘুমিয়ে পড়ল ছাদের ওপর।’
‘খেয়ে নে, ভোদ্কাটা খেয়ে নিতেই হবে, তারপর সেসার পানি আর প্রচুর লেবু’, পেত্রিৎস্কির ওপর ঝুঁকে ইয়াভিন বলছিলেন মায়ের মত, যেন জোর করে ওষুধ গেলাচ্ছেন। ‘তারপর কিছুটা শ্যাম্পেন, এই বোতলখানেক।’
‘হ্যাঁ, এটা বুদ্ধিমানের মত কথা। দাঁড়া ভ্রন্স্কি, মদ খাওয়া যাক।’
‘উঁহু, আসি সাহেবরা। আজ আমি মদ খাব না।’
‘কি, চর্বি জমবে ভাবছিস? তাহলে আমরা নিজেরাই চালাই। দে সেলৎসার পানি আর লেবু।’
ভ্রন্স্কি যখন প্রায় বেরিয়ে এসেছেন, কে যেন চেঁচিয়ে উঠল, ‘ভ্ৰন্স্কি!’
‘কি হল?’
‘তুই চুল ছাঁটলে পারিস, নইলে বড্ড ভারি হয়ে উঠছে, বিশেষ করে টাকের জায়গাটায়।’
সত্যিই ভ্রন্স্কির চুল পাতলা হয়ে আসছিল অকালে। খুশি হয়ে হেসে নিজের সমান ছাঁদের দাঁত দেখিয়ে টুপিটা টাকের ওপর টেনে এনে গাড়িতে এসে উঠলেন অনস্কি।
‘আস্তাবল’, এই বলে পড়ার জন্য চিঠিটা নিতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু নিলেন না, যাতে ঘোড়া দেখার আগে মনেটা বিগড়ে না যায়। ‘পরে! …’
একুশ
তক্তা দিয়ে বানানো একটা চালাই হল অস্থায়ী আস্তাবল। ঘোড়দৌড়ের মাঠের কাছেই। গতকালই সেখানে তাঁর ঘোড়ার এসে পড়ার কথা। এখনো তাকে তিনি দেখেননি। ইদানীং নিজে তিনি তাতে চাপছিলেন না, ভার দিয়েছিলেন টেনারের ওপর, তখন একেবারেই তিনি জানতেন না ঘোড়াটা কি অবস্থায় এসেছে এবং আছে। গাড়ি থেকে নামতে- না-নামতেই তাঁর সহিস, যাকে খোকা বলে ডাকা হয়, দূর থেকে গাড়িটা চিনতে পেরে ট্রেনারকে ডেকে আনে। লম্বা হাইবুট আর খাটো জ্যাকেট পরা শুকনোটে চেহারার ইংরেজ, শুধু থুতনির কাছে ছেড়ে রাখা হয়েছে কিছুটা দাড়ি, জকিদের আনাড়ী চলনে দুই কনুই প্রসারিত করে দুলতে দুলতে এগিয়ে এল তাঁর দিকে।
‘তা কেমন আছে ফ্র-ফু?’ ভ্রন্স্কি জিজ্ঞেস করলেন ইংরেজিতে।
‘Allright, sir—সব ঠিক আছে, স্যার, গলার কোন ভেতর বাগ থেকে ইংরেজটি বলল। ‘তবে কাছে না যাওয়াই ভালো’, টুপি তুলে যোগ করল সে; ‘আমি ওকে মুখসাজ পরিয়েছি, কিছুটা চটে আছে। না যাওয়াই ভালো, তাতে ঘোড়া খেপে উঠবে।’
‘না, আমি যাব। দেখতে চাই।’
‘তাহলে চলুন,’ ইংরেজটি বলল ভ্রূকুটি করে আর সেই একইভাবে মুখ না খুলে, এবং কনুই নাড়াতে নাড়াতে নড়বড়ে চলনে চলল আগে আগে।
ওঁরা ঢুকলেন ব্যারাকের সামনে আঙিনাটায়। হাতে ঝাড় নিয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কোর্তা পরা বাহারে সাজে যে তুখোড় ছেলেটা ডিউটিতে ছিল, সে এগিয়ে চলল ওঁদের পেছনে পেছনে। ব্যারাকের স্টলে স্টলে ছিল পাঁচটা ঘোড়া, ভ্রন্স্কি জানতেন যে, আজ নিয়ে আসা হয়েছে এবং এখানেই আছে তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী, মাখোতিনের লালচে আভার উজ্জ্বল-বাদামি দীর্ঘকায় গ্লাদিয়াতর। নিজের ঘোড়াটার চেয়েও ভ্রন্স্কির বেশি ইচ্ছে হচ্ছিল গ্লাদিয়াতরকে দেখার, যাকে তিনি দেখেননি। কিন্তু ভ্রন্স্কি জানতেন যে ঘোড়দৌড়ে শোভনতার নিয়ম অনুসারে তাকে দেখা তো দূরের কথা, তার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করাও অনুচিত। যখন তিনি করিডোর দিয়ে যাচ্ছিলেন, ছেলেটা বাঁ দিকের দ্বিতীয় স্টলের দরজা খুলল, সাদা পায়ে বড় একটা বাদামি ঘোড়া দেখতে পেলেন ভ্রন্স্কি। উনি জানতেন যে, এটাই গ্লাদিয়াতর, কিন্তু অপরের খোলা একটা চিঠি থেকে চোখ ফিরিয়ে নেওয়া লোকের মত তিনি মাথা ঘুরিয়ে চলে গেলেন ফ্র-ফ্রুর স্টলের দিকে।
‘এটা ম্যাক…ম্যাক…’, কাঁধের পেছন দিকে নোংরা নখওয়ালা আঙুল দিয়ে গ্লাদিয়াতরের স্টলটা দেখিয়ে বলল ইংরেজটি। এ নামটা সে কখনোই উচ্চারণ করতে পারত না।
‘মাখোতিনের? হ্যাঁ, এ আমার এক গুরুতর প্রতিদ্বন্দ্বী’, ভ্রন্স্কি বললেন।
ইংরেজটি মন্তব্য করল, ‘ওকে যদি আপনি চালাতেন, তাহলে আমি বাজি ধরতাম আপনার ওপর।
ফ্রু-ফ্রু স্নায়বিক, কিন্তু এটা তাগড়াই’, নিজের অশ্বচালনার তারিফে হেসে বললেন ভ্রন্স্কি।
‘হার্ডল ঘোড়দৌড়ে সবটাই হল pluck-এর ব্যাপার’, ইংরেজটি জানাল।
নিজের মধ্যে যথেষ্ট plcuk, অর্থাৎ উদ্যম ও সাহস ভ্রন্স্কি শুধু যে অনুভব করতেন তাই নয়, তার চেয়েও যেটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ, তিনি একেবারে সুনিশ্চিত ছিলেন যে, এই pluck জিনিসটা তাঁর চেয়ে বেশি দুনিয়ায় আর কারো নেই।
‘আর বেশি ঘামানোর দরকার নেই বলে আপনি মনে করেন?’
‘দরকার নেই’, জবাব দিল ইংরেজটা; তারপর যে বন্ধ স্টলটার পাশে ওঁরা দাঁড়িয়ে ছিলেন, খড়ের ওপর খুর ফেলার শব্দ আসছিল যেখান থেকে, মাথা হেলিয়ে তার দিকে ইঙ্গিত করে সে যোগ করল, ‘জোরে কথা বলবেন না দয়া করে। ঘোড়াটা চেগে আছে।’
দরজা খুলল সে, ছোট একটা গবাক্ষের আলোয় স্বপ্নালোকিত স্টলের ভেতরে ঢুকলেন ভ্রন্স্কি। টাটকা খড়ের ওপর এ-পা ও-পা করে দাঁড়িয়ে ছিল মুখসাজ পরানো গাঢ় পিংলা রঙের ঘোড়া। আধা-অন্ধকারে চোখ মেলে নিজের অজ্ঞাতসারে এক দৃষ্টিতেই ভ্রন্স্কি আবার তাঁর পেয়ারের ঘোড়াটার সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দেখে নিলেন। ফ্রু-ফ্রু ছিল মাঝারি আকারের ঘোড়া, সর্বাঙ্গে নিখুঁতও নয়। হাড়ের দিক থেকে সে সরু গোছের। বুক সামনের দিকে প্রচণ্ড এগিয়ে থাকলেও সে বুক প্রশস্ত নয়। পাছা সামান্য ঝুলে-পড়া, সামনের, বিশেষ করে পেছনের পা তেরছা। সামনের পেছনের কোন পায়ের পেশীই তেমন জাঁকালো নয়; কিন্তু কাঁধ অসাধারণ চওড়া। যা তার ঠাট আর রোগা পেটের দরুন বিশেষ চমৎকৃত করে। সামনে থেকে দেখলে হাঁটুর নিচে তার পায়ের হাড় আঙুলের চেয়ে বেশি মোটা বলে মনে হবে না, কিন্তু পাশ থেকে দেখলে তা অসাধারণ চওড়া। বুকের পাঁজর ছাড়া তার গোটা শরীর যেন পাশ থেকে চাপা আর দৈর্ঘ্যে প্রলম্বিত। কিন্তু উচ্চমাত্রার এমন একটা গুণ তার ছিল যাতে এসব ত্রুটি ভুলে যেতে হয়; এই গুণটা হল উঁচু জাত, এমন জাত, যা ইংরেজরা বলে, জানানি দেয়। সাটিনের মত সমৃণ, মিহি, চঞ্চল চামড়ার তলে বিছানো শিরার জালি থেকে প্রকট হয়ে ওঠা পেশী মনে হয় হাড়ের মত শক্ত। শুকনোটে মুখে ফুলো ফুলো, জ্বলজ্বলে, হাসিখুশি চোখ, সে মুখ থোবনায় এসে বিস্তৃত হয়ে গেছে প্রকাণ্ড নাসারন্ধ্রে যার ভেতর চোখে পড়ে রক্তোচ্ছ্বসিত কোমলাস্থি। তার সমস্ত অবয়বে, বিশেষ করে মাথায় ছিল সুনির্দিষ্ট, তেজস্বী, সেই সাথে কমনীয় একটা ভাব। এটা তেমনি একটা পশু যা কথা বলছে না মনে হবে শুধু এজন্য যে তার মুখের গঠন তার অনুকূল নয়।
অন্তত ভ্রন্স্কির মনে হত তার দিকে তাকিয়ে কি তিনি ভাবছেন তা সব বুঝতে পারছে ঘোড়াটা।
ভ্রন্স্কি তার কাছে যেতেই সে গভীর শ্বাস নিল, এমনভাবে ফুলো-ফুলো চোখ ঘোরাল যে তার সাদা অংশটায় দেখা দিল রক্তের স্ফীতি, মুখসাজ ঝাঁকিয়ে, স্থিতিস্থাপকতায় এ-পায়ে ও-পায়ে ভর দিয়ে বিপরীত দিক থেকে সে তাকাল আগন্তুকদের দিকে।
‘দেখছেন তা কেমন চেগে আছে’, ইংরেজটি বলল।
‘ও-ও, সোনা আমার, লক্ষ্মী আমার’, ঘোড়ার কাছে যেতে যেতে তাকে বুঝ মানাতে লাগলেন ভ্রন্স্কি।
কিন্তু যতই তিনি এগোতে লাগলেন, ততই উত্তেজিত হয়ে উঠতে লাগল ঘোড়া। শুধু যখন তিনি ওর মাথার কাছে পৌঁছলেন, হঠাৎ শান্ত হয়ে গেল সে, মিহি নরম লোমের তলে তিরতির করতে লাগল পেশী। তার শক্ত গ্রীবায় হাত বুলালেন ভ্রন্স্কি, তীক্ষ্ণ ঘাড় থেকে অন্যদিকে ছিটকে পড়া একগোছা কেশর ঠিক করে দিলেন, মুখ বাড়ালেন তার প্রসারিত, বাদুড়ের মুখের মত চিকন নাসারন্ধ্রের দিকে। উত্তেজিত নাসারন্ধ্র দিয়ে ঘোড়াটা সশব্দে নিঃশ্বাস নিচ্ছিল আর ছাড়ছিল, খোঁচা-খোঁচা কান চেপে কেঁপে উঠল সে, শক্ত কালো ঠোঁট সে বাড়িয়ে দিল ভ্রন্স্কির দিকে, যেন তাঁর আস্তিন ধরতে চায়। কিন্তু মুখসাজের কথা মনে পড়ায় আবার শুরু করল তার সরু সরু এ-পায়ে ও-পায়ে ভর দিতে।
‘শান্ত হ’ লক্ষ্মীটি, শান্ত হ’, আরেকবার ওর পাছা চাপড়ে ভ্রন্স্কি বললেন এবং ঘোড়ার হাল যে চমৎকার সেটা জেনে সানন্দে বেরিয়ে গেলেন স্টল থেকে।
ঘোড়ার উত্তেজনা সঞ্চারিত হয়েছিল ভ্রন্স্কির মধ্যেও; তিনি টের পাচ্ছিলেন যে, হৃৎপিণ্ডে রক্ত উঠে আসছে। ঘোড়াটার মতই তিনি চাইছেন ছুটতে, কামড়াতে; যেমন ভয় হচ্ছিল তাঁর, তেমনি আনন্দ।
ইংরেজটিকে তিনি বললেন, ‘তাহলে আপনার ওপর ভরসা করে থাকছি। যথাস্থানে সাড়ে ছ’টায়।’
‘সব ঠিক আছে’, বলল ইংরেজ, তারপর প্রায় কখনো সে যা বলে না সেই My Lord কথাটা ব্যবহার করে সে বলল, ‘কিন্তু কোথায় যাচ্ছেন, হুজুর?’
অবাক হয়ে ভ্রন্স্কি মাথা তুললেন এবং প্রশ্নের এই স্পর্ধায় বিস্মিত হয়ে তিনি চাইলেন ইংরেজটির চোখে নয়, কপালের দিকে, যা কেবল তিনিই পারেন। কিন্তু প্রশ্নটা যে করা হয়েছে মনিবকে নয়, যে হতে চলেছে জকি তাকে, এটা বুঝে তিনি জবাব দিলেন, ‘ব্রিয়াস্কির কাছে যেতে হবে আমাকে, এক ঘণ্টার মধ্যেই বাড়ি ফিরব।’
‘কতবার আজ আমাকে এই প্রশ্নটা শুনতে হচ্ছে’, মনে মনে ভাবলেন তিনি এবং লাল হয়ে উঠলেন, যা তিনি হন কদাচিৎ। ইংরেজটা মন দিয়ে তাঁকে দেখল। এবং ভ্রন্স্কি কোথায় যাচ্ছেন, তা যেন সে জানে এমন ভঙ্গিতে যোগ করল, ‘দৌড়ের আগে সুস্থির থাকাটাই প্রথম কথা’, এবং বলল, ‘মেজাজ ভালো রাখবেন, কিছুতেই মনমরা হবেন না যেন।’
‘অল রাইট’, হেসে জবাব দিলেন ভ্রন্স্কি এবং গাড়িতে উঠে হুকুম করলেন পিটার্সহফে যেতে।
কিছু দূর যেতে-না-যেতেই যে কালো মেঘ সকাল থেকেই বৃষ্টির ভয় দেখাচ্ছিল তা এগিয়ে এসে অঝোরে ঝরে পড়ল বৃষ্টিধারায়।
‘গতিক খারাপ’, হুড তুলে দিয়ে মনে মনে ভাবলেন ভ্রন্স্কি। ‘এমনিতেই ছিল কাদা, এখন হয়ে দাঁড়াবে একেবারে জলা।’ ঢাকা গাড়িতে একলা বসে উনি মায়ের চিঠি আর ভাইয়ের চিরকুট বের করে পড়তে লাগলেন।
হ্যাঁ, সেই একই ব্যাপার। সবাই, তাঁর মা, ভাই, সবাই তাঁর হৃয়দঘটিত ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা প্রয়োজন জ্ঞান করেছে। এই হস্তক্ষেপ তাঁর মধ্যে জাগিয়ে তুলল বিদ্বেষ, যে অনুভূতিটা তিনি বোধ করতেন কদাচিৎ। ‘ওঁদের কি মাথাব্যথা? কেন সবাই মনে করে যে আমার তদারকি করা তাদের কর্তব্য? কিন্তু কি জন্যে ওর পিছু লেগেছে আমার? কারণ ওরা দেখতে পাচ্ছে যে এটা এমন জিনিস বা তাদের বোধের বাইরে। এটা যদি হত একটা মামুলি ইতর সামাজিক কেচ্ছা, তাহলে ওরা আমাকে শান্তিতে থাকতে দিত। ওরা টের পাচ্ছে এটা অন্য কিছু, এটা খেলা নয়, এ নারী আমার কাছে আমার জীবনাধিক প্রিয়। আর ঠিক এইটাই ওদের কাছে দুর্বোধ্য, সেহেতু বিরক্তিকর। আমাদের ভাগ্যে যা ঘটেছে বা ঘটবে, সেটা আমরাই ঘটিয়েছি, তার জন্যে কোন আফসোস নেই আমাদের’, বললেন তিনি, আর ‘আমরা’ কথাটায় নিজেকে যুক্ত করলেন আন্নার সাথে। ‘না, কি করে জীবন কাটাতে হবে, সেটা ওদের শেখানোই চাই আমাদের। সুখ কি জিনিস—তার ধারণাই নেই ওদের, ওরা জানে না যে এই ভালোবাসা ছাড়া আমাদের কাছে সুখও নেই, অসুখও নেই,—জীবনই নেই’, ভাবলেন ভ্রন্স্কি।
এই হস্তক্ষেপের জন্য সবার ওপরে তিনি রেগে উঠলেন ঠিক এই কারণে যে মনে মনে টের পাচ্ছিলেন, ওরা, এই সবাইরাই সঠিক। তিনি অনুভব করছিলেন যে আন্নার সাথে তিনি যে প্রেমে বাঁধা পড়েছেন সেটা ক্ষণিকের মাতন নয় যা কেটে যাবে, প্রীতিকর বা অপ্রতীতিকর কিছু স্মৃতি ছাড়া জীবনে আর কোন চিহ্ন না রেখে যেমন কেটে যায় উঁচু সমাজের প্রণয়ঘটিত ব্যাপার। তিনি বুঝতে পারছিলেন তাঁর ও আন্নার অবস্থার সমস্ত যন্ত্রণা, সমাজের দৃষ্টিপথে থাকায় নিজেদের প্রেম লুকিয়ে রাখা, মিথ্যা বলা, প্রতারণা করা দুরূহতা; এবং মিথ্যা বলা, প্রতারণা করা, চালাকি খাটানো আর অনবরত অন্যদের কথা ভাবা কিনা তখন, যখন যে আবেগ তাঁদের বেঁধেছে তা এতই প্রবল যে নিজেদের ভালোবাসা ছাড়া আর সব কিছুই ভুলে গেছেন তাঁরা দুজনেই।
যা তাঁর সাতিশয় প্রকৃতিবিরুদ্ধ সেই মিথ্যা ও প্রতারণার ঘন ঘন প্রয়োজনীয়তা ঘটনাগুলো স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠল তাঁর মনে; অতি স্পষ্ট করে তাঁর মনে পড়ল মিথ্যা ও প্রতারণার এই প্রয়োজনীয়তার জন্য আন্নার মধ্যে একাধিকবার যে লজ্জবোধ তিনি লক্ষ্য করেছেন তার কথা। আন্নার সাথে তাঁর সম্পর্কের সময় থেকে যে বিচিত্র একটা অনুভূতি তাঁকে মাঝে মাঝে পেয়ে বসত, সেটা বোধ করলেন তিনি। এটা হল কিসের প্রতি যেন বিতৃষ্ণার একটা অনুভূতি; কারেনিনের প্রতি, নিজের প্রতি, নাকি গোটা সমাজের প্রতি—সেটা ঠিক ভালো করে তিনি জানতেন না। কিন্তু সব সময়ই এই বিচিত্র অনুভূতিটা তিনি দূর করে দিতেন। এবারও তা ঝেড়ে ফেলে চালিয়ে গেলেন তাঁর চিন্তাধারা।
তিনি মনে মনে ঠিক করলেন, ‘হ্যাঁ, আন্না আগে ছিল অসুখী, কিন্তু গর্বিত আর সুস্থির; কিন্তু এখন সে আর শান্তি ও মর্যাদা নিয়ে থাকতে পারছে না, যদিও দেখায় না সেটা। না, এটার অবসান ঘটাতে হবে। এবং এই মিথ্যা যে বন্ধ করা প্রয়োজন আর যত তাড়াতাড়ি তা হয় ততই ভালো, এই পরিষ্কার চিন্তাটা তাঁর মাথায় এল এই প্রথম। তিনি নিজেকে বললেন, ‘এসব ছেড়েছুঁড়ে শুধু নিজেদের ভালোবাসা নিয়ে ওকে আর আমাকে কোথাও গিয়ে লুকিয়ে থাকতে হবে।
বাইশ
খুব বেশিক্ষণ চলল না বৃষ্টিটা। ঢিলা লাগামে কদমে ছোটা দু’পাশের ঘোড়া দুটোকে কাদার মধ্যে দিয়ে টেনে মূল ঘোড়াটা যখন দ্রুতগতিতে ভ্রন্স্কির গাড়িটাকে গন্তব্যের কাছে নিয়ে এল, তখন আবার সূর্য দেখা দিল, প্রধান রাস্তার দু’পাশে পল্লীভবনগুলির চালা আর বাগানের বুড়ো লাইম গাছ সিক্ত ছটায় ঝকঝক করছে ডাল, থেকে সহর্ষে ঝরছে ফোঁটা ফোঁটা পানি, চালে স্রোত। বৃষ্টিটায় ঘোড়দৌড়ের মাঠ কতটুকু নষ্ট হবে, সে কথা আর ভাবছিলেন না অন্স্কি। এখন তাঁর এই জন্য আনন্দ হল যে বৃষ্টির দৌলতে আন্নাকে তিনি বাড়িতে পাবেন একা কেননা তিনি জানতেন যে সম্প্রতি হাওয়া বদল করে ফেরার পর কারেনিন পিটার্সবুর্গ থেকে পল্লীতে এখনো আসেননি
ছোট সাঁকোটা না পেরিয়েই ভ্রন্স্কি গাড়ি থেকে নামলেন আন্নাকে একা পাবার আশায়। লোকের দৃষ্টি যথাসম্ভব কম আকর্ষণের জন্য যা তিনি করে থাকেন সব সময়ই, এবং চললেন পায়ে হেঁটে। রাস্তা থেকে তিনি অলিন্দে উঠলেন না; আঙিনায় গেলেন।
মালীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কর্তা এসেছেন?’
‘জ্বি না। তবে গিন্নিমা আছেন। আপনি অলিন্দে যান-না, লোক আছে সেখানে, দরজা খুলে দেবে’, মালী বলল।
‘না, আমি বাগান দিয়ে যাব।’
আন্না যে একা সে সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে, এবং যেহেতু আজ তিনি আসবেন বলে দেননি আর আন্নাও নিশ্চয় ভাবেননি যে ঘোড়দৌড়ের আগে তিনি আসতে পারেন, তাই তাঁকে চমকে দেওয়া যাবে ভেবে, তরোয়াল ঠিক করে নিয়ে ফুলগাছ ঘেরা হাঁটাপথটার বালির ওপর দিয়ে সন্তর্পণে এগোলেন বারান্দা লক্ষ্য করে, যা বাগানের দিকে মুখ করে আছে। গাড়িতে আসতে আসতে নিজের অবস্থার দুঃসহতা ও কাঠিন্যের যে কথা ভ্রন্স্কি ভাবছিলেন, তা এখন ভুলে গেলেন তিনি। শুধু এটাই তিনি ভাবছিলেন যে, এবার ওঁকে দেখতে পাবেন শুধু মানসনেত্রে নয়, জীবন্ত বাস্তবে আন্না যার তার সবটাই। শব্দ না করার জন্য বারান্দার নিচু সিঁড়িতে পা চেপে চেপে তিনি উঠছিলেন। হঠাৎ মনে পড়ে গেল, যা তিনি সব সময়ই ভুলে যান এবং আন্নার সাথে তাঁর সম্পর্কের যেটা সবচেয়ে কষ্টকর দিক—আন্নার ছেলে আর তার সপ্রশ্ন এবং তাঁর যা মনে হত বিরূপ, দৃষ্টির কথাটা।
তাঁদের সম্পর্কের পথে এই ছেলেটাই ছিল সবার চেয়ে বড় বাধা। সে উপস্থিত থাকলে ভ্রন্স্কি বা আন্না কেউই এমন কিছু বলতেন না যা অপরের সমক্ষে বলা যায় না তাই নয়, এমন কি আভাসে ইঙ্গিতেও এমন কিছু বলতেন না যা ছেলেটা বুঝবে না। এ নিয়ে তাঁরা কোন বোঝাপাড়া করেননি। এটা স্থির হয়ে গিয়েছিল আপনা থেকেই। ছেলেটাকে প্রতারণা করা ছিল তাঁদের নিজেদের কাছেই অবমাননাকর। তার সামনে ওঁরা আলাপ করতেন নেহাৎ পরিচিতের মত। কিন্তু এই সাবধানতা সত্ত্বেও ভ্রন্স্কি প্রায়ই দেখেছেন ছেলেটার মনোযোগী বিমূঢ় তাঁর প্রতি নিবদ্ধ তাঁর প্রতি মনোভাবে ছেলেটার অদ্ভুত একটা সংকোচ, অস্থিরতা, কখনো প্রীতি, কখনো শীতলতা আর লজ্জা। ছেলেটা যেন অনুভব করত যে এই লোকটা আর তার মায়ের মধ্যে কিছু-একটা গুরুতর সম্পর্ক আছে যার অর্থ সে বোঝে না।
সত্যিই ছেলেটা অনুভব করত যে এই সম্পর্কটা সে বুঝতে পারছে না, এই লোকটার প্রতি তার কি মনোভাব হওয়া উচিত, মথ চেষ্টা করেও সেটা পরিষ্কার হত না তার কাছে। মনোভাব সম্পর্কে শিশুর সংবেদনশীলতায় সে পরিষ্কার বুঝতে পারত যে বাবা, গৃহশিক্ষিকা, ধাই-মা—সবাই শুধু যে ভ্রন্স্কিকে পছন্দ করত না তাই নয়, তাঁর সম্পর্কে একটা বিতৃষ্ণা আর ভয়ই বোধ করত, যদিও কিছুই বলত না সে সম্পর্কে, অথচ মা তাঁকে দেখতে সেরা বন্ধুর মত
‘এর কি মানে? কেমন লোক সে? কিভাবে ভালেবাসা যায় ওকে? যদি তা না বুঝি তাহলে দোষ, আমার অথবা আমি বোকা, কিংবা পাজি’, ভাবত ছেলেটা; এই থেকেই আসত তার পরীক্ষকসুলভ, জিজ্ঞাসু, অংশত বিরূপ মুখভাব, আবার সংকোচ আর অস্থিরতাও যা অমন বিড়ম্বিত করত ভ্রন্স্কিকে। এই ছেলেটা থাকলে ভ্রন্স্কির মধ্যে সব সময়ই সেই অদ্ভুত অকারণ বিদ্বেষ জেগে উঠত যা ইদানীং তিনি বোধ করছেন। ছেলেটার উপস্থিতিতে ভ্রন্স্কি এবং আন্না উভয়েরই যে অনুভূতি হত, সেটা সেই ক্যাপ্টেনের মত যে কম্পাসে দেখতে পাচ্ছে যে, তার জাহাজ যেদিকে দ্রুত ভেসে চলেছে সেটা মোটেই নির্ধারিত দিক নয়, অথচ এ গতি থাতামে সে অক্ষম, প্রতি মিনিটেই সে কেবলি দূরে সরে যাচ্ছে নির্দিষ্ট পথ থেকে আর নিজের কাছে এ বিচ্যুতি স্বীকার করার অর্থ ধ্বংস মেনে নেওয়া।
যা তাঁরা জানেন অথচ জানতে চাইছেন না তা থেকে কতটা বিচ্যুতি ঘটল তা জানাবার কম্পাস হল জীবন সম্পর্কে সরল দৃষ্টির এই ছেলেটা।
এবার সেরিওজা বাড়িতে ছিল না। বেড়াতে গিয়ে বৃষ্টিতে আটকা-পড়া ছেলের আগমন প্রতীক্ষায় আন্না বারান্দায় বসে ছিলেন একেবারে একা। ছেলেকে খোঁজার জন্য একটা চাকর আর চাকরানি পাঠিয়ে তার অপেক্ষা করছিলেন। : চওড়া এম্ব্রয়ডারির সাদা গাউন পরে তিনি বারান্দার এক কোণে বসে ছিলেন ফুলগাছগুলোর পেছনে ভ্রন্স্কির আসা শুনতে পাননি। কোঁকড়া কালো চুলে ভরা মাথা নুইয়ে রেলিং বসানো ঠাণ্ডা ঝারিতে কপাল চেপে ঝারি ধরে ছিলেন তাঁর সুন্দর দুটো হাতে, যাতে পরা ছিল ভ্রন্স্কির অতি পরিচিত আংটিগুলি। তাঁর দেহের গোটা গড়ন মাথা, গ্রীবা, হাতের সৌন্দর্য প্রতিবারই ভ্রন্স্কিকে অভিভূত করত তার অভাবনীয়তায়। থেমে গিয়ে ভ্রন্স্কি মুগ্ধ হয়ে তাঁকে দেখলেন। কিন্তু সেই তাঁর কাছে যাবার জন্য পা বাড়াতে গেলেন অমনি আন্না যেন তাঁর উপস্থিতি টের পেয়ে ঝারিটা ঠেলে দিয়ে তাঁর দিকে নিজের আতপ্ত মুখ ফেরালেন।
‘আপনার কি হয়েছে? শরীর ভালো নেই?’ তাঁর দিকে এগোতে এগোতে তিনি বললেন ফরাসিতে। ইচ্ছে হচ্ছিল ছুটে যাবেন; কিন্তু বাইরের লোক থাকতে পারে ভেবে বারান্দার দরজার দিকে চকিতে তাকিয়ে লাল হয়ে উঠলেন, তাঁকে ভয় পেয়ে চলতে হবে। চারদিকে তাকিয়ে দেখতে হবে ভেবে যেমন তিনি লাল হয়ে উঠতেন প্রতিবারই।
উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর প্রসারিত হাতে সজোের চাপ দিয়ে আন্না বললেন, ‘না, শরীর ভালোই আছে। তবে… তোমাকে আশা করিনি।’
ভ্রন্স্কি বললেন, ‘ইস্, কি ঠাণ্ডা হাড়!’
আন্না বললেন, ‘তুমি যে আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছ। আমি একলা, সেরিওজার পথ চেয়ে আছি, গেছে বেড়াতে। ফিরবে এখান দিয়েই। ‘
কিন্তু শান্ত থাকার চেষ্টা সত্ত্বেও আন্নার ঠোঁট কাঁপছিল।
‘মাপ করবেন যে এলাম, কিন্তু আপনাকে না দেখে দিনটা কাটানো আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না’, তিনি বলে গেলেন ফরাসি ভাষাতেই, তাঁদের মধ্যে অসম্ভব প্রাণহীন ‘আপনি’ আর রুশ ভাষায় বিপজ্জনক ‘তুমি’ এড়িয়ে যা তিনি সব সময়ই বলতেন।
‘রাগ করার কি আছে? আমার তো ভারি আনন্দই হচ্ছে।’
‘কিন্তু দেখছি আপনার শরীর কিংবা মন ভালো নেই।’ আন্নার হাত না ছেড়ে তাঁর দিকে ঝুঁকে ভ্রন্স্কি বললেন, ‘কি নিয়ে ভাবছিলেন?’
হেসে আন্না বললেন, ‘সেই একই জিনিস।’
সত্যি কথাই তিনি বললেন। যখনই, যে কোন মুহূর্তেই তাঁকে জিজ্ঞেস করা হোক না কি তিনি ভাবছেন, নির্ভুল জবাব তাঁর হতে পারত : সেই একই নিজের সুখ আর দুর্ভাগ্যের কথা। ভ্রন্স্কির আসার সময় তিনি ভাবছিলেন এই : ‘আচ্ছা, অন্যদের কাছে যেমন বেত্সির কাছে’ (তুশকেভিচের সাথে তাঁর গোপন প্রণয়সম্পর্ক আন্নার জানা ছিল) এ সবই খুব সোজা, আর আমার কাছে কেন এত যন্ত্রনাদায়ক?’ কতকগুলি দিক থেকে এ চিন্তাটা এখন যন্ত্রণাকর হয়ে উঠেছে আরো বেশি। ঘোড়দৌড়ের কথা উনি জিজ্ঞাসা করলেন ভ্রন্স্কিকে। ভ্রন্স্কিও জবাব দিলেন এবং ওঁকে বিচলিত দেখে চেষ্টা করলেন অতি মামুলি ঢঙে দৌড়ের উদ্যোগপর্বের খুঁটিনাটি জানিয়ে ওঁর মন ফেরাতে।
আন্না ভ্রন্স্কির সৌম্য সপ্রেম চোখের দিকে তাকিয়ে ভাবলেন, ‘বলব, নাকি বলব না? ও যে এত সুখী, নিজের দৌড়ে নিয়ে এত ব্যস্ত যে উচিতমত ব্যাপারটা বুঝবে না, বুঝতে পারবে না আমাদের কাছে ঘটনাটার সমস্ত গুরুত্ব।’
‘আমি যখন এলাম তখন কি আপনি ভাবছিরেন তা কিন্তু বললেন না, নিজের বিবরণ থামিয়ে ভ্রন্স্কি জিজ্ঞেস করলেন, ‘বলুন-না দয়া করে।’
কোন জবাব দিলেন না আন্না, মাথা কিছুটা নুইয়ে তাঁর দীর্ঘ আঁখিপল্লবের তল থেকে জ্বলজ্বলে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চুপিসাড়ে চাইছিলেন তাঁর দিকে। ছেঁড়া একটা পাতা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে হাত তাঁর কাঁপছিল। এটা ভ্রন্স্কির চোখে পড়ল মুখে তাঁর ফুঠে উঠল বশ্যতা আর দাসোচিত আনুগত্যের সেই ভাব যা আন্নাকে জয় করেছিল।
‘বুঝতে পারছি কিছু-একটা ঘটেছে। আপনার এমন কিছু-একটা দুঃখ আছে যাতে আমিও ভাগ নিতে পারি, এমন এক মুহূর্তের স্বস্তি কি আমি পেতে পারি না? দোহাই আপনার, দয়া করে বলুন!’ আবার মিনতি করে বললেন ভ্রন্স্কি। ‘না, ব্যাপারটার সমস্ত গুরুত্ব যদি সে না বোঝে তাহলে ক্ষমা করব না। না বলাই ভালো। কি হবে যাচাই করে?’ একইভাবে তাঁর দিকে তাকিয়ে পাতাধরা হাতটা ক্রমেই বেশি করে কাঁপছে টের পেয়ে ভাবলেন আন্না।
‘দোহাই সৃষ্টিকর্তার!’ আন্নার হাত ধরে পুনরুক্তি করলেন ভ্রন্স্কি।
‘বলব?’
‘হ্যাঁ, নিশ্চয়, নিশ্চয়…’
আন্না ধীরে ধীরে মৃদুস্বরে বললেন, ‘আমি অন্তঃসত্ত্বা।’
আরো জোরে কাঁপতে থাকল তাঁর হাতের পাতাটা কিন্তু কিভাবে ভ্রন্স্কি জিনিসটা নিচ্ছেন তা দেখার জন্য ওঁর ওপর থেকে চোখ নামালেন না তিনি। ফ্যাকাশে হয়ে গেলেন ভ্রন্স্কি। কি-একটা বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু থেমে গেলেন, হাত ছেড়ে দিয়ে মাথা নিচু করলেন। ‘হ্যাঁ, ঘটনাটার সমস্ত তাৎপর্য ও বুঝেছে’, আন্না ভাবলেন, কৃতার্থের মত হাতে চাপ দিলেন ওঁর।
কিন্তু তিনি, নারী, যেভাবে এর তাৎপর্য বুঝছেন, ভ্রন্স্কিও সেভাবে এটা নিচ্ছেন ভেবে ভুল করলেন আন্না। কার প্রতি যেন বিচিত্র যে বিতৃষ্ণাটা তাঁকে পেয়ে বসত, খবরটা শুনে তার দশগুণ প্রবল প্রকোপ অনুভব করলেন ভ্রন্স্কি, কিন্তু সেই সাথে তিনি বুঝলেন, যে-সংকটটা তিনি চাইছিলেন সেটা এসে গেছে, স্বামীর কাছ থেকে আর লুকিয়ে রাখা চলবে না, যে-করেই হোক এই অস্বাভাবিক অবস্থাটার অবসান ঘটাতে হবে। তাছাড়া আন্নার বিচলন দৈহিকভাবে সঞ্চারিত হল তাঁর মধ্যে। আন্না দিকে মর্মস্পষ্ট অনুগত দৃষ্টিপাত করলেন তিনি, উঠে দাঁড়িয়ে নীরবে পায়চারি করতে লাগলেন বারান্দায়।
দৃঢ়চিত্তে আন্নার কাছে গিয়ে তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, আপনি, আমি, কেউই আমরা আমাদের সম্পর্কটাকে খেলা বলে নিইনি, আর এখন স্থির হয়ে গেল আমাদের ভাগ্য। যে মিথ্যার মধ্যে আমরা আছি’, আশেপাশে তাকিয়ে দেখে তিনি বললেন, ‘তার ইতি হয়ে যাক।’
‘ইতি? কি করে ইতি হবে আলেক্সেই?’ আন্না বললেন মৃদুস্বরে। এখন শান্ত হয়ে এসেছেন তিনি, মুখে তাঁর উদ্ভাসিত হয়ে উঠল কোমল হাসিতে।
‘স্বামীকে ছেড়ে দিয়ে আমাদের জীবন মেলাতে হবে।’
‘সে তো এমনিতেই মিলে আছে’, অস্ফুট স্বরে আন্না বললেন।
‘কিন্তু পুরোপুরি, পুরোপুরি।’
‘কিন্তু কিভাবে আলেকসেই, শিখিয়ে দাও আমায়, কিভাবে?’ আন্না বললেন তাঁর অবস্থার নিরুপায়তায় বিষণ্ণ উপহাস নিয়ে, ‘এই অবস্থা থেকে বেরোবার উপায় আছে কি? আমি কি আমার স্বামীর স্ত্রী নই?’
‘বেরোবার উপায় থাকে সব অবস্থাতেই। দরকার, মন স্থির করে নেওয়া’, ভ্রন্স্কি বললেন, ‘তুমি, যে অবস্থায় আছ তার চেয়ে যে-কোন অবস্থাই ভালো। আমি তো দেখতে পাচ্ছি কিভাবে তুমি কষ্ট পাচ্ছ সমাজ, ছেলে, স্বামী – সব কিছু থেকে।’
‘আহ্, শুধু স্বামী নয়’, স্রেফ ব্যঙ্গভরেই বললেন আন্না, ‘আমি, ওকে চিনি না, ভাবি না, ওর কথা। নেই।’
‘তুমি সত্যি কথা বলছ না। তোমাকে আমি চিনি। ওর জন্যেও তুমি কষ্ট পাচ্ছ।’
আন্না বললেন, ‘ও তো জানেই না’, এবং হঠাৎ তাঁর মুখে ফুটে উঠল জ্বলজ্বলে রঙ; কপোল ললাট গ্রীবা রাঙা
হয়ে উঠল, চোখে দেখা ছিল গ্লানিবোধের অশ্রু। ‘যাক গে, থাক ওর কথা।
তেইশ
ভ্রন্স্কি এর আগেও কয়েকবার আন্নাকে তাঁর অবস্থার আলোচনায় টেনে আনার চেষ্টা করেছেন, যদিও এবারের মত এত দৃঢ়চিত্তে নয়। আর আজ যেভাবে তাঁর চ্যালেঞ্জার জবাব দিলেন আন্না প্রতিবারই তিনি যুক্তির সেই অগভীরতা ও লঘুতার সম্মুখীন হয়েছেন। য়েন এর মধ্যে এমন একটা কিছু আছে যা আন্না নিজের কাছে পরিষ্কার করে তুলতে পারছেন না বা চাইছেন না, যেন এ বিষয়ে কথা বলতে শুরু করলেই তিনি, আসল আন্না নিজের মধ্যে, কোথায় যেন ডুবে যান আর দেখা দেয় অদ্ভূত, ভ্রনস্কির কাছে অনাত্মীয় এক নারী, যাকে তিনি ভালোবাসেন, না ভয় করেন, যে প্রতিহত করছে তাঁকে। কিন্তু আজ সব কিছু বলবেন বলে স্থির করলেন তিনি।
ভ্রন্স্কি বললেন তাঁর অভ্যস্ত দৃঢ় ও প্রশান্ত কণ্ঠে, ‘উনি জানেন কি জানেন না, তাতে আমাদের কিছু এসে যায় না। আমরা আর এভাবে থাকতে পারি না… আপনি পারেন না, বিশেষ করে এখন।’
‘আপনার মতে তাহলে কি করা উচিত?’ সেই একই লঘু বিদ্রূপে আন্না জিজ্ঞেস করলেন। তাঁর গর্ভধারণকে ভ্রুনস্কি পাছে হালকাভাবে নেন বলে যাঁর ভয় হয়েছিল, তাঁর এখন বিরক্ত লাগল যে ভ্রন্স্কি এ থেকে কি একটা ব্যবস্থা নেবার প্রয়োজনীয়তা দেখাচ্ছেন।
‘সব কিছু বলে দিয়ে ওঁকে ত্যাগ করেন। ‘
‘বেশ, ধরা যাক আমি তাই করলাম’, আন্না বললেন। ‘এ থেকে কি দাঁড়াবে জানেন? আমি আগেই বলে দিচ্ছি, তাঁর মুহূর্তপূর্বের কোমল চোখে ঝিকিয়ে উঠল হিংস্র ছটা, ‘বটে, আপনি অন্যকে ভালোবাসেন আর তার সাথে একটা পাতকী সম্পর্ক পাতিয়েছেন?’ (স্বামীকে নকল করে আন্না ঠিক একইভাবে ‘পাতকী’ কথাটার ওপর জোর দিলেন, যেমন দিয়েছেন কারেনিন।) ‘ধর্মীয় নাগরিক, পারিবারিক দিক থেকে এর পরিণাম সম্পর্কে আপনাকে আমি সাবধান করে দিয়েছিলাম। আপনি আমার কথা শোনেননি। এখন আমি নিজের নাম কলংকিত হতে দিতে পারি না।…’ এবং ছেলের নাম, বলতে চেয়েছিলেন আন্না, কিন্তু ছেলেকে নিয়ে তিনি ঠাট্টা করতে পারেন না, ‘নিজের নামের কলংক এবং এই গোছের আরো কিছু, যোগ দিলেন আমার, ‘মোটের ওপর তার তার সরকারী কেতায়, স্পষ্টতায়, যথাযথতায় ও বলবে যে সে আমাকে ছাড়তে পারে না, কেলেঙ্কারি ঠেকাবার জন্য সে যথাসাধ্য ব্যবস্থা নেবে। আর যা বলবে সেটা সে করবে স্থির মাথায়, পরিপাটী করে। এই হবে ব্যাপার। এ যে মানুষ নয়, যন্ত্র, হিংস্র যন্ত্র যখন চটে ওঠে’, কারেনিনের চেহারার সমস্ত খুঁটিনাটি, তাঁর ভেতরের খারাপ যত কিছু খুঁজে পেয়েছেন তাঁর জন্য অপরাধী সাব্যস্ত করলেন তাঁকে, আর যে মহা অপরাধে তিনি নিজে তাঁর কাছে অপরাধী, তার জন্য ক্ষমা করতে পারলেন না তাঁকে।
‘কিন্তু আন্না’, বোঝাবার মত করে নরম গলায় বললেন ভ্রন্স্কি, চেষ্টা করলেন তাঁকে শান্ত করতে, ‘তাহলেও ওঁকে বলা প্রয়োজন, তারপর কি ব্যবস্থা উনি নেন তাই দেখে বলা যাবে।’
‘তার মানে, পালাবে?’
‘কেনই বা নয়? এভাবে চালিয়ে যাওয়ার কোন সম্ভাবনা আমি দেখছি না। সেটা নিজের জন্যে নয়। আমি দেখতে পাচ্ছি যে, আপনি কষ্ট পাচ্ছেন।
হ্যাঁ, পালিয়ে গিয়ে হব আপনার রক্ষিতা?’ ক্ষেপে বললেন আন্না।
‘আন্না!’ ভ্রন্স্কি বললেন কোমল ভর্ৎসনায়।
আন্না আবার বললেন, ‘হ্যাঁ, পালিয়ে গিয়ে আপনার রক্ষিতা হব। আর ডোবাব সবাইকে…’
এবারও বলতে চেয়েছিলেন : ‘ছেলেকে’, কিন্তু কথাটা মুখে এল না।
ভ্রন্স্কি বুঝতে পারছিলেন না নিজের সুদৃঢ়, সৎ প্রকৃতি সত্ত্বেও কি করে আন্না প্রবঞ্চনার এই অবস্থাটা সয়ে যেতে পারেন, তা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছেন না কেন; তিনি বুঝতে পারেননি যে এর প্রধান কারণ হল ‘ছেলে’ নামক শব্দটা, যা আন্না উচ্চারণ করতে পারছিলেন না। যখন তিনি ছেলে আর বাপকে ছেড়ে যাওয়া মায়ের সাথে তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কের কথা ভাবতেন, তখন কৃতকর্মের জন্য তাঁর এমন ভয় হত যে বিচার করে দেখতে পারতেন না, নারী হিসেবে মিথ্যা যুক্তি ও কথায় নিজেকে প্রবোধ দিতেন যাতে সব কিছু আগের মতই থাকে, ছেলের কি হবে এই ভয়াবহ প্রশ্নটা যাতে ভুলে যাওয়া যায়।
‘আমি তোমাকে অনুরোধ করছি, মিনতি করছি’, হঠাৎ ভ্রন্স্কির হাত টেনে নিয়ে অন্য সুরে, অকপট নরম গলায় আন্না বললেন, ‘এ নিয়ে আর কখনো কিছু আমাকে বলো না।’
‘কিন্তু আন্না…’
‘কখনো না। সব কিছু ছেড়ে দাও আমার ওপর। নিজের অবস্থার সমস্ত হীনতা, সমস্ত ভয়াবহতা আমি জানি; কিন্তু তুমি যা ভাবছ অমন সহজ তাতে তার মীমাংসা হয় না। আমার ওপর ছেড়ে দাও এবং আমার কথা শোন। কখনো কিছু আর বলো না—এ নিয়ে। কথা দিচ্ছ তো?…না-না, কথা দাও!…’
‘সব কিছু কথা আমি দিচ্ছি, কিন্তু শাস্তি আমি পাব না, বিশেষ করে তুমি যা বললে তার পর। শান্তি আমি পাব না যখন তুমি শান্তিতে থাকতে পারছ না।…
‘আমি!’ পুনরুক্তি করলেন আন্না, ‘হ্যাঁ, মাঝে মাঝে কষ্ট হয় আমার; কিন্তু ওটা কেটে যাবে যদি এই কথাটা কখনো না তোলো। ওটা যখন আমাকে বল, যন্ত্রণা হয় কেবল তখনই।’
‘আমি বুঝতে পারছি না’, অন্ল্কি বললেন।
ওঁকে থামিয়ে দিয়ে আন্না বললেন, ‘তোমার সৎ প্রকৃতির পক্ষে মিথ্যাচার কত কষ্টকর তা আমি জানি, সে জন্যে মায়া হয় তোমার ওপর। প্রায়ই আমি ভাবি আমার জন্যে কিভাবে নষ্ট করছ তোমার জীবন।’
‘আমি তো এখনই তাই ভাবছিলাম’, ভ্রন্ল্কি বললেন, ‘আমার জন্যে কি করে তুমি বিসর্জন দিতে পারলে সব কিছু?’ তুমি যে দুর্ভাগিনী এর জন্যে নিজেকে আমি ক্ষমা করতে পারব না।’
‘আমি দুর্ভাগিনী?’ ভ্রন্স্কির কাছ ঘেঁষে এসে ভালোবাসার হ্লাদিত হাসি নিয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন আন্না, ‘আমি সেই উপোসী যে খাবার পেয়ে গেছে। হয়ত সে শীতে কাঁপছে, পোশাক তার ছেঁড়া-খোঁড়া। লজ্জা হচ্ছে তার কিন্তু হতভাগ্য সে নয়। আমি দুর্ভাগিনী? না, এই যে আমার সুখ…’
ফিরে আসা ছেলের গলা শুনতে পেয়ে তিনি বারান্দায় ত্বরিত দৃষ্টিক্ষেপ করে ঝটকা মেরে উঠে দাঁড়ালেন। ভ্রন্স্কির পরিচিত ঝলক তাঁর চোখে, দ্রুতভঙ্গিতে তিনি তাঁর অঙ্গুরীশোভিত সুন্দর হাতে ভ্রন্স্কির মাথা ধরে দীর্ঘদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন তাঁর দিকে, স্থিত স্ফূরিত অধরে তাঁর দিকে মুখ নামিয়ে দ্রুত তাঁর ঠোঁটে আর দুই চোখে চুমু খেয়ে তাঁর ঠেলে দিলেন। চলে যেতে চাইছিলেন তিনি, কিন্তু অনুল্কি তাঁকে ধরে রাখরেন।
আন্নার দিকে উচ্ছ্বসিত চোখে তাকিয়ে তিনি ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কখন?’
‘আজ রাত একটায়’, দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে ফিসফিসিয়ে বললেন আন্না, তারপর দ্রুত লঘু পায়ে গেলেন ছেলের দিকে।
সেরিওজা যখন বড় বাগিচায়, তখন বৃষ্টি নেমেছিল, ধাই মা’র সাথে সে বসে ছিল কুঞ্জকুটিরে।
‘তাহলে অপেক্ষায় রইলাম,’ আন্না বললেন অঙ্কিকে, ‘এখন শিগগিরই ঘোড়দৌড়ে, বেত্সি কথা দিয়েছেন— আমাকে নিয়ে যাবার জন্যে আসবেন বলে।’
ঘড়ি দেখে তাড়াতাড়ি করে চলে গেলেন ভ্রন্স্কি।
চব্বিশ
ভ্রন্স্কি যখন কারেনিনদের বারান্দায় ঘড়ি দেখেছিলেন, তখন তিনি নিজের চিন্তায় এতই উদ্বিগ্ন আর নিমগ্ন ছিলেন যে ঘড়ির কাঁটাই শুধু তাঁর চোখে পড়েছিল, বুঝতে পারেননি ক’টা বেজেছে। সড়কে এসে সাবধানে কাদায় পা ফেলে ফেলে তিনি গেলেন তাঁর গাড়ির কাছে। মনে তাঁর শুধু আন্নার ভাবনা, ক’টা বেজেছে, ব্রিয়াঙ্কির কাছে যাবার সময় আছে কি না সে খেয়াল তাঁর ছিল না। প্রায়ই যা ঘটে থাকে, শুধু একটা ভালবাসা স্মৃতি রয়ে গিয়েছিল কিসের পর কি করতে হবে। ইতিমধ্যেই ঝাঁকড়া লাইম গাছের হেলে পড়া ছায়ায় বক্সে ঘুমন্ত কোচোয়ানের কাছে এসে ঘর্মাক্ত ঘোড়াগুলোর ওপর ঘূর্ণায়মান ডাঁশামাছির ঝিলমিলে কুণ্ডলীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কোচোয়ানকে জাগালেন, গাড়িতে উঠে হুকুম করলেন ব্রিয়াঙ্কির কাছে যেতে। ভার্স্ট সাতেক যাবার পরই কেবল ঘড়ি দেখার মত সজ্ঞান হতে পারলেন ভ্রন্স্কি এবং বুঝলেন যে সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে, দেরি হয়ে গেছে তাঁর।
ঘোড়দৌড় ছিল সেদিন একাধিক : অশ্বারোহী গার্ড রেস, তারপর অফিসারদের দুই ভার্স্ট আর চার ভাৰ্ট দৌড়, তারপর হার্ডল রেস, যাতে অনুস্কি নিজে নামছেন। নিজের দৌড়ের নামের সময় কখনো আছে, কিন্তু যদি ব্রিয়ানস্কর, কাছে যান, তাহলে পৌঁছাবেন কোনক্রমে, যখন সমস্ত দরবার জমায়েত হয়ে গিয়েছে। এটা ভালো দেখায় না। কিন্তু ব্রিয়ান্স্কিকে কথা দিয়েছেন যে যাবেন, তাই ঠিক করলেন যাবেনই, কোচোয়ানকে বললেন ঘোড়ার মায়া না করতে।
ব্রিয়াস্কির কাছে গিয়ে মিনিট পাঁচেক সেখানে থেকে আবার ফিরে এলেন। এই দ্রুত সফরটায় শাস্তি বোধ করলেন তিনি। আন্নার সাথে তাঁর সম্পর্ক যা-কিছু ছিল দুঃসহ, কথোপকথনের পর যা-কিছু অনির্দিষ্টতা, সব দূর হয়ে গেল তাঁর মন থেকে; এখন পরিতোষের সাথে উত্তেজনায় ভাবছিলেন শুধু দৌড়ের কথা, ভাবছিলেন যে যতই হোক, দেরি হয়নি। আজ রাতে আন্নার সাথে অভিসারের ব্যাপারটা ব্যাপারটা থেকে থেকে ঝলক দিচ্ছিল তাঁর কল্পনায়।
যতই তিনি পল্লীভবন আর পিটার্সবুর্গ থেকে আগত গাড়িগুলোকে অতিক্রম করে ঘোড়দৌড়ের মেজাজে পৌছাচ্ছিলেন, ততই আসন্ন দৌড় তাঁকে ক্রমেই পেয়ে বসছিল।
সবাই গেছে ঘোড়দৌড়ে, তাঁর বাসায় তখন কেউ ছিল না। খানসামা তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল গেটের কাছে। উনি যখন পোশাক বদলাচ্ছিলেন, খানসামা বলল যে দ্বিতীয় দৌড় শুরু হয়ে গেছে। অনেক সাহেব এসেছিলেন তাঁর খবরাখবর করতে, আস্তাবল থেকে ছোকরা এসেছিল দু’বার।
ধীরে-সুস্থে পোশাক বদলিয়ে (কখনো তিনি তাড়াহুড়া করতেন না, আত্মসংযম হারাতেন না কখনো), ভ্রন্স্কি হুকুম কররেন ব্যারাকে যেতে। ব্যারাক থেকে তাঁর চোখে পড়ল ঘোড়দৌড়ের মাঠ ঘিরে গাড়ি-ঘোড়া, পদচারী, সৈনিকদের ভিড়, মঞ্চে গিজগিজ করছে লোক। নিশ্চয় দ্বিতীয় দৌড়ে চলছে, কেননা যখন তিনি ব্যারাকে ঢোকেন, তখন হুইসিল শোনা গিয়েছিল। আস্তাবলে যেতে গিয়ে তিনি দেখলেন মাখোতিনের সাদা-মোজা পাটকিলে গ্লাদিয়াতরকে কমলা-নীল আস্তরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ঘোড়দৌড়ের মাঠে, আস্তরের জন্য প্রকাণ্ড দেখাচ্ছিল তার নলীরঙা খাড়া কান।
তিনি সহিসকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কর্ড কোথায়?’
‘আস্তাবলে। জিন চাপাচ্ছে।’
স্টলে খোলা, ফ্রু-ফ্রু’র ওপর নিজ বাঁধা হয়ে গেছে, উপক্রম হচ্ছে তাকে নিয়ে যাবার।
‘দেরি হয়নি?’
‘অল রাইট, অল রাইট, সব ঠিক আছে, ঠিক আছে’, বলল ইংরেজটি, ‘শুধু উত্তেজিত হবেন না।’
ভ্রন্স্কি আরেকবার তাঁর প্রিয়পাত্র, সর্বাঙ্গে কম্পমান অপরূপ ঘোড়াটার দিকে তাকালেন। বহু কষ্টে দৃশ্যটা থেকে চোখ ফিরিয়ে বেরিয়ে এলেন ব্যারাক থেকে। নিজের প্রতি কারো দৃষ্টি আকর্ষণ না করার মত সবচেয়ে অনুকূল মুহূর্তটিতেই তিনি পৌঁছিলেন মঞ্চের কাছে। সবে শেষ হচ্ছে দুই ভার্স্ট দৌড়, সবার দৃষ্টি সামনের হর্স গার্ড আর পেছনের হুসারের দিকে নিবদ্ধ, প্রাণপণে তারা ঘোড়া ছুটিয়ে আসছে সমাপ্তি পোস্টের দিকে। বৃত্তের মাঝখানে আর বাইরেকার সমস্ত লোক ভিড় করেছে পোস্টের কাছে, একদল হর্স গার্ড সৈন্য ও অফিসার নিজেদের সাথী ও অফিসারের প্রত্যাশিত বিজয়ে উল্লাস প্রকাশ করছে উচ্চকণ্ঠে চিৎকার করে। ভ্রন্স্কি অলক্ষ্যে ভিড়টার মাঝখানে ঢুকলেন ঠিক যখন দৌড়ে শেষ হবার ঘণ্টা পড়ল। আর অগ্রবর্তী কাদা-মাখা দীর্ঘাঙ্গ হর্স গার্ড জিনে গা ছেড়ে দিয়ে বসে ঢিল দিল তার ধূসর, ঘামে কালচে হয়ে ওঠা প্রচণ্ড হাঁসফাঁস করা ঘোড়াটার লাগামে।
কষ্টে ঠ্যাং চেপে ঘোড়াটা তার বিশাল দেহটার দ্রুতগতি কমিয়ে আনল আর হর্স গার্ড অফিসার গভীর ঘুম থেকে জেগে ওঠা মানুষের মত চারদিকে তাকিয়ে দেখে জোর করে হাসল। নিজেদের দলের এবং বাইরের জনতা ছেঁকে ধরল তাকে।
উচ্চ সমাজের যে নির্বাচিত দলটা মঞ্চের সামনে সংযতভাবে এবং অবাধে ঘোরাফেরা করছিল আর আলাপ চালাচ্ছিল নিজেদের মধ্যে, তাদের ইচ্ছে করে এড়িয়ে গেলেন ভ্রন্স্কি। তিনি জানতে পেলেন যে কারেনিনা, বেত্সি এবং তাঁর ভাবী আছে সেখানে, তবে চিত্ত বিক্ষিপ্ত হতে না দেবার জন্য মতলব করেই সেদিকে গেলেন না। কিন্তু অনবরত তাঁর দেখা হচ্ছে পরিচিতদের সাথে আর যে দৌড়গুলো হয়ে গেল তার বিশদ বিবরণ দিচ্ছিল তারা, জিজ্ঞেস করছিল কেন তাঁর দেরি হল।
পুরস্কার নেবার জন্য যখন অশ্বারোহীদের ডাক পড়ল মঞ্চে এবং সবাই তাকাল সেদিকে, ভ্রন্স্কির ভাই আলেক্সান্দর এলেন তাঁর কাছে। ইনি কর্নেল, কাঁধপট্টিতে গিঁট, মাথায় উঁচু নন, আলেক্সেইয়ের মতই গাঁটাগোট্টা, তবে আরো সুপুরুষ লালচে গাল, রাঙা নাক, খোলামেলা নেশাতুর মুখমণ্ডল।
‘আমার চিরকুট পেয়েছিস? তোকে যে ধরাই যায় না কখনো।
আলেক্সান্দর ভ্রন্স্কি লম্পট, বিশেষ করে মদ্যপ জীবনযাত্রার জন্য নামকরা, তাহলে খুবই দরবারী চালের লোক এখন ভাইয়ের সাথে তাঁর পক্ষে খুবই অপ্রীতিকর একটা বিষয় নিয়ে কথা বলার সময় অনেকের দৃষ্টি তাঁদের দিকে নিবদ্ধ থাকতে পারে জানা থাকায় তিনি হাসি-হাসি মুখ করলেন, যেন তুচ্ছ কোন ব্যাপার নিয়ে ঠাট্টা-তামাসা করছেন ভাইয়ের সাথে।
আলেকসেই বললেন, ‘পেয়েছি, কিন্তু সত্যি বুঝতে পারছি না কি নিয়ে তোমার মাথা ব্যথা।
‘এজন্যে যে আমি জানতে পেরেছি যে তুই এখানে নেই, সোমবার তোকে দেখা গেছে পিটার্সহফে ‘
‘এমন কিছু ব্যাপার আছে যা শুধু তাদের মধ্যেই আলোচ্য যারা তার সাথে সোজাসুজি জড়িত। আর তুমি যা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছ সেটা এই ধরনেরই ব্যাপার।’
‘তাহলে ফৌজে কাজ করা তোর চলে না এবং… ‘
‘আমি তোমাকে মিনতি করছি, মাথা গলাতে এসো না, ব্যস।’
আলেক্সেই ভ্রন্স্কির ভ্রূকুঞ্চিত মুখ বিবর্ণ হয়ে উঠল, কেঁপে উঠল নিচের প্রকটিত চিবুক যা তাঁর ঘটে কদাচিত। খুবই ভালো মনের লোক হওয়ায় তিনি কমই চটে উঠতেন, কিন্তু একবার যদি চটেন আর থুতনি যদি কেঁপে ওঠে তাহলে তখন খুবই বিপজ্জনক লোক তিনি। আলেক্সান্দর ভ্রন্স্কি সেটা জানতেন, তাই তিনি ফুর্তির ভাব করে হেসে উঠলেন।
‘আমি শুধু মায়ের চিঠি দিতে এসেছিলাম তোকে। জবাব দিস, দৌড়ের আগে মেজাজ বিগড়াস না আবার। সাফল্য কামনা করি’, কথাটা যোগ করে হেসে ভাইয়ের কাছ থেকে তিনি চলে গেলেন।
কিন্তু তাঁর পরে আবার প্রিয় সম্ভাষণ ভ্রন্স্কির থামাল।
‘বন্ধুকে চিনতে চাচ্ছিস না যে। সুপ্রভাত, mon cher!’ বললেন অব্লোন্স্কি। এখানে, এই পিটার্সবুর্গী দীপ্তির মধ্যেও তিনি তাঁর রাঙা মুখ আর পরিপাটী করে আঁচড়ানো চেকনাই গালপাট্টায় ঝিলিক দিচ্ছিলেন মস্কোর চেয়ে কম নয়। ‘এসেছি কাল, তোমার জয় দেখা যাবে বলে আনন্দ হচ্ছে। কবে দেখা হবে?’
‘কাল মেসে এসো’, বল ভ্রন্স্কি তাঁর ওভারকোটের আস্তিন চাপ দিয়ে মাপ চেয়ে চলে গেলেন মাঠের মাঝখানে, বড় রেসটার জন্য ইতিমধ্যেই সেখানে ঘোড়া আনা হচ্ছিল।
ঘর্মাক্ত, দৌড়ের পর ক্লান্ত ঘোড়াগুলোকে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল সহিসেরা। আসন্ন দৌড়ের জন্য দেখা দিতে থাকল একের পর এক নতুন নতুন তাজা ঘোড়া। বেশির ভাগই বিলাতি, সাজ পরানো, এঁটে বাঁধা পেট, দেখাচ্ছিল বিরাট বিরাট অদ্ভূত কি-সব পাখির মত। ডান দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল টানটান সুঠাম শরীরের সুন্দর ফ্র-ফ্লু’কে, রীতিমত লম্বা স্থিতিস্থাপক টেংরিতে ভর দিয়ে সে পা ফেলছিল স্প্রিঙের মত। তার অদূরে দীর্ঘকর্ণ গ্লাদিয়াতরের চাদর খোলা হচ্ছিল। অজ্ঞাসতারেই ভ্রন্স্কি তাকিয়ে রইলেন সুন্দর সুগঠিত ঘোড়াটার দিকে, চমৎকার তার পাছা, খাটো টেংরি একেবারে খুরের ওপর বসানো। ভ্রন্স্কি নিজের ঘোড়ার কাছে যাবেন ভাবছিলেন, কিন্তু আবার তাঁকে আটকালেন একজন পরিচিত।
আলাপ জমিয়ে পরিচিতটি বলল, ‘ওই যে কারেনিন! বৌকে খুঁজছে, সে ওদিকে মঞ্চের মাঝখানে। আপনি দেখেননি ওকে?’
‘না, দেখিনি’, ভ্রন্স্কি বললেন এবং পরিচিতটি মঞ্চের যেখানে কারেনিনাকে দেখাচ্ছিলেন সেদিকে দৃকপাতও না করে গেলেন নিজের ঘোড়ার কাছে।
ঘোড়ার জিন নিয়ে কিছু নির্দেশ তাঁর দেবার ছিল, কিন্তু সেটা ভালো করে দেখতে-না-দেখতেই মঞ্চে সওয়ারীদের ডাক পড়ল নম্বর টেনে নিজের নিজের জায়গায় যেতে। সতেরো জন অফিসার গুরুত্বপূর্ণ, কঠোর অনেক বিবৰ্ণ মুখে মঞ্চে গিয়ে নম্বর টানলেন। ভ্রন্স্কির ভাগে পড়ল সাত। হুকুম শোনা গেল : ‘ওঠো ঘোড়ায়!’
সবার চোখ যেদিকে নিবদ্ধ, তিনি এবং অন্যান্য সওয়ারীরা যে তার কেন্দ্র সে সম্পর্কে সচেতন হয়ে ধীরে, শান্ত পদক্ষেপে তিনি গেলেন তাঁর ঘোড়ার কাছে, উত্তেজিত হলে সাধারণত তিনি একরকমই করেন। ঘোড়দৌড়ের সম্মানে তার পোশাকী কস্টিউম পরেছে কর্ড : বোতাম-আঁটা কালো ফ্রক-কোট, গালে ঠেলে ওঠা কড়া মাড় দেওয়া কলার, গোল কালো টুপি আর জ্যাক বুট। বরাবরের মতই সে ধীর, গুরুগম্ভীর, ঘোড়ার সামনে দাঁড়িয়ে সে নিজের ধরে ছিল তার দুটো লাগামই। ফ্লু-ফ্লু তখনো কেঁপে যাচ্ছিল যেন জ্বর উঠেছে। দীপ্ত চোখে সে কটাক্ষে চাইলে সমাগত ভ্রন্স্কির দিকে। জিনের তলে আঙুল ঢোকালেন ভ্রন্স্কি, ঘোড়াটা আরো চোখ পাকাল, দাঁত বার করল, কান এঁটে রইল তার নিজ বাঁধা পরখ করা হল দেখে হাসি ফোটাবার জন্য ঠোঁটা কুঞ্চিত করল ইংরেজটি।
‘উঠে বসুন, অস্থিরতা বোধ করবেন কম।’
শেষবারের মত ভ্রন্স্কি তাকালেন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীদের দিকে। উনি জানতেন যে দৌড়ের সময় তিনি ওদের আর দেখবেন না। যেখান থেকে দৌড় শুরু হবার কথা, দু’জন এর মধ্যেই আগে আগে চলতে শুরু করেছে সেদিকে। ভ্রন্স্কির একজন বিপজ্জনক প্রতিযোগী ও বন্ধু গাৎসিন ঘুরঘুর করছিরেন তাঁর বাদামি ঘোড়াটার কাছে, জিনে তাঁকে উঠতে দিচ্ছিল না সে। আঁটো ব্রিচেস পরা ছোটখাট একজন হুসার জিনের পেছনে ভর দিয়ে ইংরেজ জকিদের কায়দায় বেড়ালের মত ঝুঁকে পড়ে ঘোড়া ছুটিয়ে গেল। প্রিন্স কুজোভলেভ তাঁর গ্রাবভ প্রজনন কেন্দ্রের জাত ঘুড়ির পিঠে বসে ছিলেন বিবর্ণ হয়ে, একজন ইংরেজ তাঁর লাগাম ধরে নিয়ে যাচ্ছিলে। ভ্রন্স্কি এবং তাঁর সমস্ত সাথীরা কুজোলেভকে এবং তাঁর ‘দুর্বল’ স্নায়ু আর সাঙ্ঘাতিক আত্মাভিমানের কথা জানতেন। তাঁরা জানতেন যে সব কিছুতেই উনি ভীত, ভয় পেতেন এমন কি লড় য়ে ঘোড়াতে চাপতে; এখন ব্যাপারটা ভয়াবহ বলে, লোকের হাড়গোড় ভাঙছে আর প্রতিটি হার্ডলের সামনেই ডাক্তার, নার্স সমেত ক্রস টাঙানো হাসপাতাল মার্কা গাড়ি বরাদ্দ আছে বলেই তিনি দৌড়ে যোগ দেবেন ঠিক করলেন। চোখাচোখি হল ওঁদের, সাদরে, সানুমোদনে চোখ মটকালেন ভ্রন্স্কি। শুধু একজনকে তিনি দেখতে পেলেন না, তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী, গ্লাদিয়াতরের সওয়ার মাখোতিনকে।
ভ্রন্স্কিকে কর্ড বলল, ‘তাড়াহুড়া করবেন না। শুধু একটা কথা মনে রাখবেন : হার্ডলের সামনে থমকাবেন না, তাড়া দেবেন না, ঘোড়াটা যেমন চায় করতে দিন।’
‘ঠিক আছে, ঠিক আছে’, লাগাম নিয়ে ভ্রন্স্কি বললেন।
‘সম্ভব হলে দৌড়ের আগে আগেই ছুটবেন, কিন্তু পেছনে পড়ে গেলেও শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত হতাশ হবেন না।’ ঘোড়াটা এগোতে-না-এগোতেই ভ্রন্স্কি লঘু বলিষ্ঠ ভঙ্গিতে ইস্পাতের দাঁড়ালো রেকাবে পা দিয়ে অনায়াসে তাঁর পেটাই করা দেহ স্থাপন করলেন চামড়ার ক্যাঁচকেঁচে জিনে। ডানের রেকাবে পা ঢুকিয়ে তিনি তাঁর অভ্যস্ত চালে আঙুলগুলোর মধ্যে সমান করে নিলেন লাগাম দুটো, কর্ডও হাত নামিয়ে নিল। কোন পা-টা আগে ফেলবে তা যেন স্থির করতে না পেরে ফ্লু-ফ্লু তার ঘাড় লম্বা করে টান দিল লাগামে, তারপর তার স্থিতিস্থাপক পিঠের ওপর আরোহীকে দোলাতে দোলাতে এগিয়ে গেল যেন স্প্রিঙের ওপর দিয়ে। তাড়াতাড়ি পা ফেলে কর্ড চলতে লাগল তাঁর পেছনে পেছনে। উত্তেজিত ঘোড়াটা কখনো এপাশ কখনো ওপাশ থেকে লাগামে টান দিয়ে আরোহীকে ঠকাবার চেষ্টা করছিল আর ভ্রনৃস্কি মুখে আওয়াজ করে হাত থাবড়ে তাকে বৃথাই শান্ত করার চেষ্টা করলেন।
বাঁধ দেওয়া নদীটার কাছে গিয়ে যেখান থেকে দৌড় শুরু হবে সেদিকে যাচ্ছিলেন তাঁরা। সওয়ারদের অনেকে আগে, অনেকে পিছনে, হঠাৎ ভ্রনৃস্কি শুনতে পেলেন রাস্তার কাদায় কদমে ছোটা ঘোড়ার শব্দ, মাখোতিন তার সাদা ঠেঙে দীর্ঘকর্ণ গ্লাদিয়াতরে পেরিয়ে গেল তাঁকে। লম্বা লম্বা দাঁত বের করে মাখোতিন হাসল, কিন্তু ভ্রন্স্কি তার দিকে চাইলেন ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে। এমনিতেই মাখোতিনকে তিনি দেখতে পারতেন না, আর এখন তো তাকে নিজের সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রতিদ্বন্দ্বী বলেই গণ্য করছেন। ঘোড়া ছুটিয়ে চলে গিয়ে তাঁর ঘোড়াটাকে উত্তেজিত করল বলে রাগ তাঁর। কদমে ছোটার জন্য বাঁ পা বাড়িয়ে দিয়েছিল ফু-ফু, দু’বার লাফও দিল, কিন্তু লাগামের টানে চটে উঠে ছুটল দুলকি চালে সওয়ারকে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে কর্ডও ভুরু কুঁচকে প্রায় ভ্রন্স্কির পেছন পেছন ছুটতে লাগল।