আন্না কারেনিনা - প্রথম পর্ব
আন্না কারেনিনা - দ্বিতীয় পর্ব
আন্না কারেনিনা - তৃতীয় পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - চতুর্থ পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - পঞ্চম পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - ষষ্ঠ পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - সপ্তম পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - অষ্টম পৰ্ব
1 of 2

আন্না কারেনিনা – ২.১

এক

শীতের শেষে শ্যেরবাৎস্কিদের বাড়িতে ডাক্তারদের একটা পরামর্শ সভা হল—কিটির স্বাস্থ্যের অবস্থা কেমন এবং তার শক্তি পুনরুদ্ধারের জন্য কি ব্যবস্থা নেওয়া দরকার তা স্থির করার জন্য। অসুখ হয় কিটির, বসন্ত কাছিয়ে আসার সাথে সাথে স্বাস্থ্যে আরো খারাপ হতে থাকে। গৃহচিকিৎসক তাকে দিলেন কডলিভার অয়েল, তারপর লোহা, তারপর লাপিস, কিন্তু তার কোনটাতেই যেহেতু কোন ফল দিল না এবং যেহেতু তিনি বসন্তে কিটিকে বিদেশে নিয়ে যাবার পরামর্শ দিলেন, তাই নামকরা ডাক্তারকে ডাকা হল। নামকরা ডাক্তার তখনো বৃদ্ধ নন, দেখতে খুবই সুপুরুষ, রোগীকে পরীক্ষা করে দেখার দাবি করলেন তিনি। এই জেদ ধরে মনে হল তিনি বিশেষ তুষ্টি লাভ করছেন যে কুমারীর লজ্জাটা মাত্র বর্বরতার জের এবং যে পুরুষ এখনো বৃদ্ধ নয়, সে যে একজন নগ্ন তরুণীকে টিপেটুপে দেখবে, এর চেয়ে স্বাভাবিক আর কিছু হয় না। এটা তাঁর কাছে স্বাভাবিক লেগেছে, কারণ এই কাজই তিনি করছেন প্রতি দিন এবং তাতে তাঁর কিছুই মনে হত না, জিনিসটা খারাপ বলে তিনি ভাবতেন না, তাই বালিকার লজ্জাকে তিনি শুধু বর্বরতার জের নয়, নিজের প্রতি অপমানকর বলেও গণ্য করতেন।

মেনে নিতে হল, কেননা সমস্ত ডাক্তার একই স্কুলে একই বই পড়লেও এবং একই বিদ্যা জানলেও, আর এই নামকরা ডাক্তারটি পাজি ডাক্তার এমন কথা কেউ কেউ বললেও প্রিন্স-মহিষীর বাড়িতে এবং তাঁর মহলে কেন জানি ধরে নেওয়া হয়েছিল যে একমাত্র এই নামকরা ডাক্তারটিই বিশেষ কি একটা জিনিস জানেন এবং একমাত্র তিনিই বাঁচাতে পারেন কিটিকে। হতবুদ্ধি এবং লজ্জায় আড়ষ্ট রোগীকে মন দিয়ে গা ঠুকে ঠুকে দেখে নামকরা ডাক্তার সযত্নে হাত ধুয়ে গিয়ে দাঁড়ালেন ড্রয়িং-রুমে, কথা বলতে লাগলেন প্রিন্সের সাথে। প্রিন্স ভুরু কুঁচকে কাশতে কাশতে তাঁর কথা শুনছিলেন। প্রিন্স জীবনাভিজ্ঞ লোক, বোকাও নন, রুগ্নও নন, ওষুধপত্রে তাঁর বিশ্বাস ছিল না, গোটা এই প্রহসনটায় তিনি মনে মনে খেপছিলেন, এবং সেটা আরও এই জন্য যে একমাত্র তিনিই বোধহয় কিটির রোগের কারণ পুরো বুঝতে পারছিলেন। ‘ঘেউঘেউয়ে কুকুর’, শিকারীদের ঝুলি থেকে নেওয়া এই শব্দটা মনে মনে নামকরা ডাক্তারের উদ্দেশে প্রয়োগ করে তিনি শুনে যাচ্ছিলেন কন্যার রোগলক্ষণ নিয়ে তাঁর বকবকানি। ডাক্তারও ওদিকে বৃদ্ধ এই নবাবপুত্রের প্রতি তাঁর বিতৃষ্ণা কষ্টে চেপে রেখে তাঁর বোধগম্যতার মানে নেমে আসছিলেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন যে বৃদ্ধের সাথে কথা বলে লাভ নেই, এ বাড়ির প্রধান হলেন গিন্নি। তাঁর কাছেই তিনি তাঁর মুক্তা ছড়াবেন বলে ঠিক করলেন। এই সময় প্রিন্স মহিষী ড্রয়িং-রুমে এলেন গৃহচিকিৎসককে নিয়ে। গোটা এই প্রহসনটা তাঁর কাছে কত হাস্যকর সেটা কারো চোখে পড়তে না দেবার জন্য প্রিন্স করে গেলেন। প্রিন্স-মহিষী হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিলেন, বুঝতে পারছিলেন না কি করবেন। কিটির কাছে নিজেকে দোষী মনে হচ্ছিল তাঁর। বললেন, ‘আমাদের ভাগ্য গুণে দিন ডাক্তার। সব কিছু আমার বলুন।’ বলতে চাইছিলেন, ‘আশা আছে কি?’ কিন্তু ঠোঁট তাঁর কেঁপে উঠল, প্রশ্নটা আর করতে পারলেন না, তাহলে ডাক্তার?…’

‘এখন প্রিন্সেস, আমার সহকর্মীর সাথে একটু কথা কয়ে নিই তারপর আপনাকে আমার মত জানাবার সম্মান পেতে পারব।’

‘তাহলে আপনাদের এখানে একলা রেখে যাব?’

‘আপনার যা অভিরুচি।’

দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রিন্স-মহিষী বেরিয়ে গেলেন।

ওঁরা একলা হতে গৃহচিকিৎসক ভয়ে ভয়ে তাঁর এই অভিমত দিয়ে শুরু করলেন যে ক্ষয়রোগ প্রক্রিয়ার শুরুটা দেখা যাচ্ছে, তবে… ইত্যাদি, ইত্যাদি। নামকরা ডাক্তার তাঁর কথা শুনতে শুনতে কথার মাঝখানেই তাকিয়ে দেখলেন তাঁর প্রকাণ্ড সোনার ঘড়িটায়।

বললেন, ‘হুঁ, তবে…’

কথার মাঝখানে সসম্ভ্রমে চুপ করে গেলেন গৃহচিকিৎসক।

‘আপনি তো জানেন, গহ্বর দেখা না দেওয়া পর্যন্ত ক্ষয়রোগ প্রক্রিয়ার শুরুটা আমরা স্থির করে বলতে পারি না। তবে সন্দেহ করতে পারি। তার লক্ষণও আছে : খাওয়ায় বেনিয়ম, স্নায়বিক উত্তেজনা, ইত্যাদি। প্রশ্নটা দাঁড়াচ্ছে এইঃ ক্ষয়রোগের সন্দেহ হলে পুষ্টি বজায় রাখার জন্য কি করা যায়?’

‘কিন্তু এসব ক্ষেত্রে সব সময়ই একটা নৈতিক, মানসিক কারণ লুকিয়ে থাকে, আপনি তো জানেন’, মৃদু হেসে গৃহচিকিৎসক কথাটা পাড়লেন।

আবার ঘড়িতে দৃষ্টিপাত করে নামকরা ডাক্তার জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, সে তো বলাই বাহুল্য।’ জিজ্ঞেস করলেন, ‘মাপ করবেন, ইয়াউজা সেতু কি বসানো হয়েছে, নাকি আবার ঘুরে যেতে হবে? বটে, বসানো হয়েছে? তবে তো আমি বিশ মিনিটে পৌঁছে যেতে পরি। তাহলে যা বলছিলাম, প্রশ্নটা এই : পুষ্টি বজায় রাখা আর স্নায়ু সুস্থ করা। একটা আরেকটার সাথে সম্পর্কিত। এগোতে হরে দুদিক থেকেই।’

গৃহচিকিৎসক জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিন্তু বিদেশে যাওয়া?’

‘আমি বিদেশযাত্রার বিরোধী। দেখুন-না, ক্ষয়রোগ প্রক্রিয়া যদি শুরু হয়ে গিয়ে থাকে, যা জানা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়, তাহলে বিদেশে গিয়েও লাভ হবে না। আমাদের এমন কিছু করতে হবে যাতে পুষ্টি বজায় থাকে আর ক্ষতি না হয়।’

এবং নামকরা ডাক্তার সোডেন পানি দিয়ে তাঁর চিকিৎসার পরিকল্পনা পেশ করলেন, এটা বরাদ্দ করার প্রধান উদ্দেশ্য, বোঝাই গেল, ওতে ক্ষতি হতে পারে না।

গৃহচিকিৎসক মন দিয়ে সসম্ভ্রমে সবটা শুনলেন।

বললেন, ‘কিন্তু আমি বলব, অভ্যাসের বদল, স্মৃতি জাগিয়ে তোলার মত পরিবেশ থেকে সরে যাওয়া হল বিদেশে যাবার উপকার। তা ছাড়া মাও তাই চাইছেন।

‘ও! তা সেক্ষেত্রে কি করা যাবে, যাক বিদেশে, শুধু এই জার্মান হাতুড়েগুলো ক্ষতিই করবে… আমাদের কথা ওঁদের শোনা উচিত… তা যাক।’

আবার ঘড়ি দেখলেন তিনি।

‘আহ্, সময় হয়ে গেছে’, বলে গেলেন দরজার দিকে।

নামকরা ডাক্তার প্রিন্স-মহিষীকে জানালেন যে (সৌজন্যবশে) রোগীকে তাঁকে আবার দেখতে হবে।

‘সে কি! আবার পরীক্ষা!’ আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠলেন মা।

‘জ্বি না, শুধু কতকগুলো খুঁটিনাটি প্রিন্সেস।’

‘চলুন তাহলে।’

ডাক্তারকে সাথে করে মা গেলেন কিটির কাছে। কিটি দাঁড়িয়ে ছিল ঘরের মাঝখানে, রোগা, মুখ রাঙা, যে লজ্জা তাকে সইতে হয়েছে তার জন্য জ্বলজ্বল করছে চোখ। ডাক্তার ঢুকতেই আবার আরক্ত হয়ে উঠল সে, চোখ ভরে উঠল পানিতে। তার সমস্ত পীড়া তার কাছে মনে হচ্ছিল নির্বোধ, এমন কি হাস্যকর একটা ব্যাপার। চিকিৎসাটা তার কাছে মনে হচ্ছিল ভাঙা ফলদানির টুকরো জোড়া দেবার মতই নিরর্থক। বুক তার ভেঙে গেছে। পিল আর পাউডার দিয়ে কি সারাতে চায় ওরা? কিন্তু মায়ের মনে ঘা দেওয়া চলে না, সেটা আরো এই জন্য যে মা নিজেকে দোষী মনে করছেন।

নামকরা ডাক্তার বললেন, ‘বসুন, বসুন প্রিন্সেস।’

হাসিমুখে তার সামনে বসে তিনি নাড়ি দেখলেন, আবার সেই একঘেয়ে প্রশ্নগুলো করে যেতে থাকলেন। জবাব দিচ্ছিল কিটি, হঠাৎ রেগে উঠে দাঁড়াল।

‘মাপ করবেন ডাক্তার, কিন্তু সত্যি, এতে কোন ফল হবে না। তিনবার আপনি একই কথা জিজ্ঞেস করছেন আমাকে।’

নামকরা ডাক্তার রাগ করলেন না।

কিটি চলে যাবার পর তিনি প্রিন্স-মহিষীকে বললেন, ‘অসুস্থ বিরক্তিপ্রবণতা। তবে আমার কাজ হয়ে গেছে…’

তারপর যেন একজন অসাধারণ বুদ্ধিমতী নারীর সাথে কথা বলছেন এমনভাবে প্রিন্স-মহিষীকে তিনি তাঁর কন্যার অবস্থা সম্পর্কে একটা বৈজ্ঞানিক সংজ্ঞা দিলেন এবং শেষ করলেন যে পানি খাবার প্রয়োজন নেই তা কি করে খেতে হবে তার উপদেশ দিয়ে। বিদেশে যাওয়া চলবে কিনা এ প্রশ্নে ডাক্তার গভীর চিন্তায় ডুবে গিয়ে কঠিন একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে লাগলেন। অবশেষে উত্তর পাওয়া গেল : যান, তবে হাতুড়েদের যেন বিশ্বাস না করেন আর সব ব্যাপারে তাঁর উপদেশ নেবেন।

ডাক্তার চলে যাবার পর যেন খুব একটা আনন্দের ব্যাপার ঘটেছে বলে মনে হল। মা আনন্দ করে এলেন কিটির কাছে, কিটিও ভান করল যেন তারও আনন্দ হয়েছে। ওকে ঘন ঘন, প্রায় সব সময়ই ভান করতে হচ্ছে এখন।

‘সত্যি মা, আমি সুস্থ। কিন্তু আপনি যদি যেতে চান, চলুন যাওয়া যাক!’ এবং আসন্ন যাত্রায় তার আগ্রহ দেখাবার জন্য তোড়জোড়ের ব্যাপার নিয়ে কথা বলতে শুরু করল।

দুই

ডল্লি এলেন ডাক্তার চলে যাবার পরই। তিনি জানতেন যে সেদিন একটা ডাক্তারি পরামর্শ হবার কথা, তাই অতি সম্প্রতি প্রসব থেকে উঠলেও (শীতের শেষে মেয়ে হয়েছে তাঁর) এবং নিজেরই তাঁর নানান দুর্ভাবনা আর ঝামেলা থাকলেও কোলের শিশুটি আর রুগ্ন একটা মেয়েকে বাড়িতে রেখে চলে এসেছেন কিটির ভাগ্য আজ কি দাঁড়াল জানতে।

তিনি ড্রয়িং-রুমে ঢুকে টুপি না খুলেই বললেন, ‘কি, তোমরা সবাই যে বড় হাসিখুশি। তাহলে ভালো?’ ডাক্তার কি বলেছেন সেটা তাঁকে বোঝাবার চেষ্টা হল, কিন্তু ডাক্তার বেশ গুছিয়ে অনেকক্ষণ ধরে ব্যাপারটা বললেও ঠিক কি যে বলেছেন সেটা বোঝানো গেল না। শুধু এটুকুই আকর্ষণীয় যে বিদেশে যাওয়া স্থির হয়েছে।

অজ্ঞাতসারে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ডল্লি। তাঁর সেরা বন্ধু, তাঁর বোন চলে যাচ্ছে। অথচ তাঁর নিজের জীবন আনন্দের নয়। মিটমাটের পর অব্‌লোন্‌স্কির সাথে সম্পর্কটা হয়ে দাঁড়িয়েছে হীনতাসূচক। আন্না যে রাং ঝালাই দিয়েছিলেন, দেখা গেল সেটা মজবুত নয়। পারিবারিক বনিবনার জোড় খুলে গেল আবার সেই একই জায়গায়। সুনির্দিষ্ট কিছু ঘটেনি বটে, কিন্তু অব্‌লোন্‌স্কি প্রায় কখনোই বাড়িতে থাকতেন না, টাকাও প্রায় কিছু থাকত না, তাঁর অবিশ্বস্ততার সন্দেহ ডল্লিকে অবিরাম পীড়া দিত, সেটা তিনি মন থেকে ঝেড়েও ফেলেছেন ঈর্ষার যে কষ্ট ভুগেছেন তার ভয়ে। ঈর্ষার প্রথম বিস্ফোরণ একবার কেটে গেলে তা আবার ফেরে না, এমন কি অবিশ্বস্ততা প্রকাশ পেলেও তার প্রতিক্রিয়া হয় না সেই প্রথমবারের মত। তা প্রকাশ পেলে এখন শুধু তাঁর সাংসারিক অভ্যাসগুলোই ঘুচে যেত, তাই তিনি আত্মপ্রতারণা করতেন আর এই দুর্বলতার জন্য ঘৃণা করতেন স্বামীকে এবং তার চেয়েও বেশি নিজেকে। তাঁর ওপর একটা বড় সংসারের ঝামেলা অবিরাম তাঁকে জ্বালাত : কখনো কোলেরটাকে খাওয়ানো হয় না, কখনো চলে যায় আয়া, আবার কখনো, যেমন এখন, ছেলেমেয়েদের কেউ না কেউ রোগে পড়ে।

‘আর তোমাদের খবর কি?’ মা জিজ্ঞেস করলেন।

‘আহ্ মা, আপনাদের নিজেদের দুঃখ-কষ্টই তো অনেক। লিলি অসুখে পড়েছে, আমার ভয় হচ্ছে স্কার্লেট জ্বর, আমি এলাম শুধু খবরটা জানতে, আর সৃষ্টিকর্তা না-করুন, যদি স্কার্লেট হয় তাহলে ঘরেই বসে থাকব, বেরোনো হবে না।’

ডাক্তার চলে যাবার পর বৃদ্ধ প্রিন্সও বেরিয়ে এলেন তাঁর কেবিনেট থেকে, ডল্লির দিকে গাল বাড়িয়ে দিয়ে কথা বললেন তাঁর সাথে। স্ত্রীকে বললেন : ‘কি ঠিক করলে তাহলে, যাচ্ছ? আর আমার কি করবে ভাবছ?’

স্ত্রী বললেন, ‘আমার মনে হয় তোমার থাকাই ভালো হবে আলেকজান্ডার।’

‘যা বলবে।’

কিটি বলল, ‘মা, কেনই-বা বাবা যাবেন না আমাদের সাথে? ওঁর ভালো লাগবে, আমাদেরও।

বৃদ্ধ প্রিন্স উঠে দাঁড়িয়ে হাত বোলালেন কিটির চুলে। কিটি মুখ তুলল, জোর করে হেসে চাইল তাঁর দিকে। কিটির সব সময় মনে হত পরিবারের সবার চেয়ে উনিই তাকে ভালো বোঝেন, যদিও তার সাথে কথা বলতেন কম। সবার ছোট বলে সে ছিল বাপের প্রিয়পাত্রী এবং তার মনে হত যে তার প্রতি ভালোবাসাই ওঁকে অন্তর্দর্শী করে তুলেছে। প্রিন্স একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলেন তার দিকে। তাঁর সহৃদয় নীল চোখে চোখ পড়তেই কিটির মনে হল উনি তার ভেতরটা দেখতে পাচ্ছেন, সব কিছু বুঝতে পারছেন যা খারাপ, কি হচ্ছে তার ভেতরটায়। লাল হয়ে কিটি চুমু পাবার আশায় মুখ বাড়িয়ে দিল, উনি কিন্তু শুধু তার চুল ঘেঁটে বললেন, ‘যতসব নির্বোধ পরচুলা! আসল মেয়েটা পর্যন্ত পৌঁছানোই মুশকিল, আদর করতে হচ্ছে স্থবিরা মহিলার চুলে। তা ডল্লিন্‌কা’, বড় মেয়ের দিকে ফিরলেন তিনি, ‘তোমার তুরুপের তাসটি কি করছে?’

‘কিছুই করছে না বাবা’, কথাটা যে তাঁর স্বামীকে নিয়ে সেটা বুঝে জবাব দিলেন ডল্লি। ‘কেবিল কোথায় বেরিয়ে যায়, দেখা পাওয়াই ভার’, একটু উপহাসের হাসি না হেসে জবাব দেওয়া অসম্ভব হয়েছিল তাঁর পক্ষে।

‘সে কি, বন বেচবার জন্য এখনো গাঁয়ে যায়নি সে?’

না, কেবল তোড়জোড়ই চলছে।’

‘বটে!’ প্রিন্স বললেন, ‘তাহলে আমিই যাব, নাকি?’ আসন নিয়ে তিনি স্ত্রীকে বললেন, ‘আজ্ঞা হোক। আর তুই কাতিয়া শোন’, ছোট মেয়ের দিকে ফিরলেন তিনি, ‘সুন্দর এক দিনে তুই একবার জেগে উঠে নিজেকে বলবি : আরে আমি যে একেবারে সুস্থ, হাসি-খুশি, তুহিন ঠাণ্ডায় ভোরে আবার বেড়াতে যাওয়া যাক বাপের সাথে, এ্যাঁ, কি বলিস?’

বাবা যা বললেন সেটা খুবই সহজ বলে মনে হওয়া উচিত, কিন্তু কথাগুলো কিটিকে বিব্রত আর অপ্রস্তুত করে তুলল, যেন চোর ধরা পড়েছে। ‘হ্যাঁ, উনি সব জানেন, সব বোঝেন, এই কথাগুলোতে উনি আমাকে বলতে চাইছেন লজ্জার কথা বটে, কিন্তু লজ্জা কাটিয়ে ওঠা দরকার।’ জবাব দেবার সাহস হল না তার। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎ কেঁদে ফেলে ছুটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

‘হল তো তোমার রসিকতা!’ প্রিন্সের ওপর মুখিয়ে উঠলেন প্রিন্স-মহিষী, ‘সব সময় তুমি…’ শুরু করলেন তাঁর ভর্ৎসনা-ভাষণ।

বেশ অনেকক্ষণ ধরেই প্রিন্স-মহিষীর বকুনি শুনলেন প্রিন্স, চুপ করেই ছিলেন, কিন্তু ক্রমেই ভ্রুকুটি ফুটে উঠছিল মুখে।

‘এমনিতেই বেচারা মরমে মরে আছে, আর তুমি বোঝো না যে তার কারণ নিয়ে যে কোন ইঙ্গিতেই কি কষ্ট হয় ওর। আহ্! মানুষ সম্পর্কে এমন ভুল কেউ করে!’ প্রিন্স-মহিষী বললেন এবং তাঁর গলার স্বর পরিবর্তনে ডল্লি ও প্রিন্স বুঝলেন যে উনি ভ্রন্‌স্কির কথা বলছেন, ‘এই ধরনের জঘন্য ইতর লোকদের বিরুদ্ধে আইন নেই কেন বুঝি না।’

‘আহ্, শুনতে না হলে বাঁচি!’ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে প্রিন্স যাওয়ায় উপক্রম করলেন, কিন্তু থেমে গেলেন দরজার কাছে, ‘আইন আছে গো, আর আমাকে যখন বলিয়ে ছাড়লে তখন বলি সমস্ত ব্যাপারটায় দোষ কার : তোমার, তোমার, একলা তোমার। এসব ছোকরাদের বিরুদ্ধে সব সময়ই ছিল আর আছে আইন! হ্যাঁ, যা হওয়া উচিত নয় তা যদি না হত, তাহলেও, বুড়ো হলেও আমি ওকে, ওই ভদ্রলোককে ডুয়েলে ডাকতাম। আর এখন যাও, সারিয়ে তোলো, ডেকে আনো যত হাতুড়েদের।’

মনে হল প্রিন্সের আরো অনেক কিছু বলার আছে কিন্তু তাঁর কথায় সুর ধরতে পারা মাত্র প্রিন্স-মহিষী তখনই নরম হয়ে অনুতাপ করতে লাগলেন, গুরুতর প্রশ্নে সব সময়ই যা হয়ে থাকে।

কাছে সরে এসে, কেঁদে ফেলে, ফিসফিস করে তিনি বললেন, ‘আলেকজান্ডার, আলেকজান্ডার।‘

উনি কাঁদতেই প্রিন্সও চুপ করে গেলেন। গৃহিণীর কাছে গেলেন তিনি।

‘নাও, হয়েছে, হয়েছে! তুমিও কষ্ট পাচ্ছ আমি জানি। কিন্তু কি করা যাবে? মহাবিপদ কিছু নয়। সৃষ্টিকর্তা করুণাময়… ধন্যবাদ জানাও…’ উনি বললেন কিন্তু নিজেই জানতেন না কি বলছেন। হাতে গৃহিণীর সিক্ত চুম্বন অনুভব করে তার প্রতিদান দিলেন তিনি। এবং বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে

সাশ্রনয়নে কিটি ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই ডল্লি তাঁর মাতৃসুলভ পারিবারিক অভ্যাসবশে টের পেয়েছিলেন, এখানে নারীর হস্তক্ষেপ দরকার এবং তার জন্য তৈরি হলেন। টুপি খুলে রেখে নৈতিক দিক থেকে আস্তিন গুটিয়ে তিনি কাজে নামলেন। মা যখন বাবাকে আক্রমণ করছিলেন, তখন কন্যার পক্ষ থেকে সম্মানের মধ্যে যতটা সম্ভব, মাকে ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন তিনি। বাপ যখন ফেটে পড়েন তখন তিনি চুপ করে ছিলেন। মায়ের জন্য তাঁর লজ্জা হচ্ছিল, আর তখনই সদয় হয়ে ওঠা বাপের জন্য একটা কোমলতা বোধ করেছিলেন ডল্লি। কিন্তু বাবা চলে যাবার পর প্রধান যে জিনিসটা করা উচিত তার জন্য তিনি তৈরি হলেন, অর্থাৎ কিটির কাছে গিয়ে তাকে শান্ত করা।

‘আমি আপনাকে অনেকদিন থেকে বলব ভাবছিলাম মা; গতবার লেভিন যখন এখানে এসেছিল, সে কিটির পাণিপ্রার্থনা করতে চেয়েছিল, জানেন? স্তিভাকে সে বলেছে।’

‘তাতে কি হল? আমি বুঝতে পারছি না…’

‘মানে কিটি হয়ত তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে?… আপনাকে কিছু বলেনি সে

না, ওর সম্পর্কে বা অন্যজন সম্পর্কেও কিছু সে বলেনি; বড় বেশি ওর গর্ব কিন্তু আমি জানি এ সবই ওই থেকে….

‘হ্যাঁ, ভেবে দেখুন, ও যদি লেভিনকে প্রত্যাখ্যান করে থাকে, আর প্রত্যাখ্যান করত না যদি এটা না থাকত, আমি জানি… অথচ পরে এটি ভয়ংকরভাবে ঠকাল ওকে।’

মেয়ের কাছে প্রিন্স-মহিষী কত দোষী সেটা ভাবতে আতংক হচ্ছিল তাঁর, তিনি রেগে উঠলেন।

‘আহ্ কিছুই আমি বুঝতে পারছি না! সবাই আজকাল চলতে চায় নিজের বুদ্ধিতে, মাকে কিছু বলে না, তারপর এই তো…’

‘মা, আমি ওর কাছে চললাম।’

‘যাও-না। আমি কি বারণ করেছি?’

তিন

কিটির ছোট্ট সুন্দর পুরানো স্যাক্সন চিনেমাটি পুতুলে সাজানো, দু’মাস আগেও কিটি যেমন ছিল তেমনি তারুণ্যে ভরা, গোলাপি, হাসিখুশি ঘরখানায় ঢুকে ডল্লির মনে পড়ল গত বছর দুজনে মিলে ওরা ঘরখানা কিভাবে গুছিয়েছিল কি আনন্দ করে, ভালোবেসে। গালিচার এক কোণে নিশ্চল দৃষ্টি মেলে দরজার কাছে নিচু একটা চেয়ারে কিটিকে বসে থাকতে দেখে বুক তাঁর হিম হয়ে এল। বোনের দিকে চাইল কিটি, মুখের নিরুত্তাপ, ঈষৎ রুক্ষ ভাবটা কাটল না।

তার কাছে বসে দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনা বললেন, ‘আমি এখন চলে যাচ্ছি, ঘরে বসে থাকতে হবে, তোরও আমার কাছে আসা চলে না। কিছু কথা আছে তোর সাথে।’

‘কি নিয়ে?’ ভীতভাবে মাথা তুলে ক্ষিপ্র প্রশ্ন করল কিটি।

‘তোর কষ্টের ব্যাপারটা ছাড়া আর কি নিয়ে?’

‘আমার কোন কষ্ট নেই।’

‘খুব হয়েছে কিটি। তুই কি ভাবিস আমি জানতে পারি না? সব জানি। বিশ্বাস কর আমাকে, ওটা কিছু না… সবাই আমরা এ জিনিসের মধ্যে দিয়ে গেছি।

কিটি চুপ করে রইল, কঠোরতা ফুটে উঠল মুখে।

‘তুই ওর জন্য কষ্ট পাবি, ও তার যোগ্য নয়’, সোজাসুজি আসল কথাটা তুললেন দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনা।

‘কারণ ও আমাকে অবহেলা করেছে’, কাঁপা কাঁপা গলায় কিটি বলল, ‘বলো না ও কথা! দয়া করে বলো না!’

‘কে তোকে বলতে যাচ্ছে? কেই বলেনি। আমার কোন সন্দেহ নেই যে তোকে ও ভালোবেসেছিল এবং বাসছে, তবে…’

‘উঃ, এসব দরদ আমার কাছে ভয়ংকর লাগে!…’ হঠাৎ রেগে মেগে চেঁচিয়ে উঠল কিটি। চেয়ারে ঘুরে বসল সে, লাল হয়ে উঠল, কোমরবন্ধের বকলসটা কখনো এ-হাতে কখনো ও-হাতে চেপে ধরে দ্রুত আঙুল নাড়াতে লাগল। রেগে উঠলে কিছু একটা চেপে ধরার এই যে এক অভ্যাস আছে কিটির, ডল্লির জানা ছিল। এও তিনি জানতেন যে উত্তেজনার মুহূর্তে কিটি অনাবশ্যক ও অপ্রীতিকর অনেক কিছুই বলে ফেলতে পারে। তাকে শান্ত করতে চেয়েছিলেন ডল্লি কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গিয়েছিল।

‘কি, কি আমাকে বোঝাতে চাস তুই, কি?’ দ্রুত বলে গেল কিটি, ‘এই তো যে আমি একজনের প্রেমে পড়েছিলাম, সে আমাকে পাত্তাই দিল না, আর তার ভালোবাসার জন্য আমি হেদিয়ে মরছি? আর সে কথা বলছে কিনা বোন, যে ভাবছে যে… যে…যে আমাকে দরদ দেখাচ্ছে!… এসব করুণা আর ভানে আমার দরকার নেই!

‘কিটি, ওটা ঠিক নয়।’

‘কেন যন্ত্রণা দিচ্ছ আমাকে?’

‘আরে না, বরং উল্টো… আমি দেখছি তুই কষ্ট পাচ্ছিস…’

কিন্তু উত্তেজনায় কিটি শুনল না ওঁর কথা।

‘দুঃখ করার, সান্ত্বনা পাবার কিছু নেই। আমাকে যে ভালোবাসে না তাকে যে আমি ভালোবাসতে যাব না, এ গর্ববোধ আমার আছে।’

‘আরে না, আমি তা বলছি না… কিন্তু একটা কথা, সত্যি করে বল তো’, কিটির হাত ধরে দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনা বললেন, ‘আচ্ছা, লেভিন তোকে কিছু বলেছিল?…’

লেভিনের উল্লেখে কিটি তার শেষ আত্মসংযমটুকুও হারাল বলে মনে হল; চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে বকলসটা মেঝেয় আছড়ে ফেলে ঘন ঘন হাত নেড়ে কিটি বলল, ‘এখানে লেভিনের কথা আবার আসে কেন? বুঝি না, আমাকে যন্ত্রণা দেবার কি দরকার পড়ল তোমার? আমি বলেছি এবং আবার বলছি, আমার গর্ববোধ আছে, তুমি যা করছ তা আমি কখনো করব না, কখনো না—যে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, অন্য মেয়েকে ভালোবেসেছে, ফিরব না তার কাছে। এ জিনিস আমি বুঝি না, বুঝি না। তুমি পারো, কিন্তু আমি পারি না :’

এই বলে কিটি তাকাল বোনের দিকে আর ডল্লি বিষণ্ণভাবে মাথা নুইয়ে চুপ করে আছে দেখে যা ভেবেছিল তার বদলে ঘর থেকে বেরিয়ে না গিয়ে দরজার কাছে বসে রুমালে মুখ ঢেকে মাথা নিচু করল।

দু’মিনিট কাটল নীরবতায়। ডল্লি ভাবছিলেন নিজের কথা। যে হীনতা তিনি অনুক্ষণ টের পাচ্ছেন, বোন সেটা মনে করিয়ে দেওয়াতে খুবই ব্যথা লাগল তাঁর। বোনের কাছ থেকে এতটা নিষ্ঠুরতা তিনি আশা করেননি, রাগ হল তাঁর। বোনের কাছ থেকে এতটা নিষ্ঠুরতা তিনি আশা করেননি, রাগ হল তাঁর। কিন্তু হঠাৎ পোশাকের খসখস আর চাপা কান্নার শব্দ তাঁর কানে এল, নিচু থেকে কার হাত জড়িয়ে ধরল তাঁর গলা। সামনে তাঁর হাঁটু গেড়ে বসে আছে কিটি।

‘ডল্লিন্‌কা, আমি বড়বড় অসুখী!’ দোষীর মত সে বলল ফিসফিসিয়ে।

চোখের পানিতে ভেজা তার মিষ্টি মুখখানা সে গুঁজল ডল্লির স্কার্টে।

অশ্রু যেন সেই তৈলপ্রলেপ যা ছাড়া দু’বোনের মধ্যে আদান-প্রদানের শকট ভালোরকম চলতে পারে না। কান্নার পর নিজেদের মনের কথা বলাবলি করল না বোনেরা, কিন্তু অন্য ব্যাপার নিয়ে কথা বললেও পরস্পরকে বুঝতে তাদের অসুবিধা হল না। কিটি বুঝল যে রাগের মাথায় স্বামীর বিশ্বাসঘাতকতা এবং তাঁর হীনতা সম্পর্কে সে যে কথা বলেছে তা বেচারা বোনকে মর্মাহত করেছে, তবে তিনি ক্ষমা করেছেন তাকে। অন্যদিকে ডল্লি যা জানতে চাইছিলেন তা সবই বুঝতে পারলেন; তিনি নিশ্চিত হয়ে উঠলেন যে তাঁর অনুমানটা সঠিক। কষ্ট, কিটির অচিকিৎস্য কষ্টটা হল এই যে লেভিন পাণিপ্রার্থনা করেছিলেন কিন্তু কিটি তা প্রত্যাখ্যান করেছে, ওদিকে ভ্রন্‌স্কি প্রতারণা করেছেন তার সাথে, লেভিনকে ভালোবাসতে আর ভ্রন্‌স্কিকে ঘৃণা করতে কিটি রাজি; এ সম্পর্কে একটা কথাও কিটি বলল না, সে বলল, শুধু তার মনের অবস্থার কথা।

‘আমার কোন দুঃখ নেই’, শান্ত হয়ে কিটি বলল, ‘কিন্তু তুমি বুঝতে পারবে কি, সব কিছু আমার কাছে হয়ে দাঁড়িয়েছে জঘন্য, বিছ্‌ছিরি, কর্কশ, সবার আগে আমি নিজে। তুমি ভাবতে পারবে না সবার সম্পর্কে কি জঘন্য চিন্তা আমার মনে আসে।’

‘তোর আবার কি জঘন্য চিন্তা মনে আসবে?’ হেসে জিজ্ঞেস করলেন ডল্লি।

‘অতি অতি জঘন্য আর কদর্য। তোমাকে বলতে পারব না। সেটা একঘেয়েমি বা মন-পোড়ানি নয়, তার চেয়ে অনেক খারাপ। আমার মধ্যে ভালো যা কিছু ছিল সব যেন চাপা পড়েছে, রয়ে গেছে শুধু জঘন্যটা। মানে কি তোমাকে বলি? বোনের চোখে বিহ্বলতা লক্ষ্য করে কিটি বলে চলল, ‘বাবা আজ আমাকে বলতে শুরু করেছিলেন—আমার মনে হয় যে উনি কেবল ভাবেন যে আমার বিয়ে হওয়া উচিত। মা আমাকে নিয়ে যান বলনাচের আসরে, আমার মনে হয় উনি নিয়ে যান কেবল তাড়াতাড়ি আমার বিয়ে দিয়ে রেহাই পাবার জন্য। আমি জানি যে কথাটা ঠিক নয়, কিন্তু এই ভাবনাগুলো তাড়াতে পারি না। তথাকথিত পাত্রদের আমি দেখতে পারি না দু’চক্ষে। মনে হয় ওরা যেন আমার মাপ নিয়ে দেখেছে। বলনাচের পোশাক পরে কোথাও যাওয়া আগে আমার কাছে ছিল স্রেফ একটা আনন্দের ব্যাপার, নিজেকে নিয়ে মুগ্ধ হয়ে থাকতাম আমি; এখন লজ্জা হয়, অস্বস্তি লাগে, মানে কি আর বলব! ডাক্তারটি…’

একটু থতমত খেল কিটি; এর পরে সে বলতে চেয়েছিল যে তার ভেতর এসব বদল ঘটার পর থেকে অব্‌লোন্‌স্কিকে তার অসহ্য রকমের বিরক্তিকর লাগছে, তাঁকে দেখলেই যত রূঢ় আর বিতিকিছিরি ভাবনা মনে আসে। সে বলে চলল, ‘হ্যাঁ, সব কিছু আমার চোখে দেখা দিচ্ছে অতি কদর্য, জঘন্য চেহারায়। এই আমার রোগ, হয়ত কেটে যাবে…’

‘তুই বরং ও সব নিয়ে ভাবিস না…’

‘পারি না যে। শুধু ছেলেমেয়েদের সাথে, তোমাদের ওখানে ভালো বোধ করি।

‘দুঃখের কথা যে আমাদের ওখানে তোর আসা চলছে না।’

‘না, যাব। আমার স্কার্লেট জ্বর হয়েছিল তো, মায়ের অনুমতি চেয়ে নেব।

কিটি তার জেদ ধরে রইল আর স্কার্লেট জ্বরের যে হিড়িকটা সত্যিই এসেছিল, তার গোটা সময়টা সেবাযত্ন করল ছেয়েমেয়েদের। দু’বোনে মিলে সারিয়ে বুলল ছয়টি শিশুকে কিন্তু কিটির স্বাস্থ্য ভালো হল না, লেন্ট পরবের সময় শ্যেরবাৎস্কিরা গেলেন বিদেশে।

চার

আসলে পিটার্সবুর্গের উঁচু মহল একটাই; সেখানকার সবাই সবাইকে চেনে, সবারই সবার বাড়িতে যাতায়াত। কিন্তু এই বড় মহলটার আবার নিজ নিজ উপবিভাগ আছে। আন্না আর্কাদিয়েভনা কারেনিনার বন্ধু-বান্ধব ও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল তিনটি বিভিন্ন মহলে। একটা ছিল রাজপুরুষদের সরকারি মহল, তাঁর স্বামীর সহকর্মী ও অধস্তনদের নিয়ে, যাঁরা অতি বৈচিত্র্যে ও খামখেয়ালে সামাজিক প্রতিষ্ঠায় পরস্পর যুক্ত বা বিযুক্ত। প্রথম দিকে এসব লোকেদের প্রতি প্রায় ভক্তির মত যে শ্রদ্ধা আন্না পোষণ করতেন, তা এখন তিনি মনে করতে পারেন বহু কষ্টে। এখন এঁদের সকলকেই তিনি চেনেন, যেমন মফস্বল শহরের লোকে চেনে পরস্পরকে। জানেন কার কি অভ্যাস আর দুর্বলতা, কার কোথায় কাঁটা বিঁধছে, পরস্পরের সাথে আর নাটের গুরুর সাথে কার কেমন সম্পর্ক। জানেন কে কার পক্ষে, কিভাবে কেমন করে টিকে থাকছে, কার সাথে কার এবং কিসে মিল বা অমিল, কিন্তু কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনার চেষ্টা-চরিত্র সত্ত্বেও সরকারি পুরুষালি আগ্রহের এই মহলটা তাঁকে আকৃষ্ট করতে পারেনি এবং এটাকে তিনি এড়িয়ে চলতেন।

দ্বিতীয় আরেকটা যে মহল আন্নার ঘনিষ্ঠ, কারেনিন তার সাহায্যেই প্রতিষ্ঠাপন্ন হয়েছেন। এ মহলের কেন্দ্র হলেন কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনা। এটা হল বৃদ্ধ, অসুন্দর, সদাচারী, ধর্মপ্রাণ নারী আর বুদ্ধিমান, বিদগ্ধ, উচ্চাকাঙ্ক্ষী পুরুষদের চক্র। এ মহলের একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তি তার নাম দিয়েছিলেন ‘পিটার্সবুর্গ সমাজের বিবেক’। কারেনিন এই মহলটা খুবই কদর করতেন এবং সবার সাথে মিশতে পটু আন্নাও তাঁর পিটার্সবুর্গ জীবনের প্রথম দিকটায় এই মহলেই তাঁর বন্ধুদের পেয়েছিলেন। এখন কিন্তু মস্কো থেকে ফেরার পর মহলটা অসহনীয় লাগল তাঁর কাছে। মনে হল তিনি নিজে এবং ওঁরা সবাই ভান করে চলেছেন এবং মহল তাঁর কাছে এত একঘেয়ে আর অস্বস্তিকর হয়ে উঠল যে কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনার ওখানে তিনি যেতে লাগলেন যথাসম্ভব কম।

তৃতীয় যে মহলের সাথে তাঁর যোগাযোগ ছিল, সেটাই হল আসল সমাজ—বলনাচ, ভোজ, চোখ-ঝলসানো বেশভূষার সমাজ, যা রাজদরবার আঁকড়ে ধরে থাকা যাতে অর্ধসমাজে নেমে যেতে না হয়। এই মহলের লোকেরা অর্ধসমাজকে ঘৃণা করেন বলে ভাবতেন যদিও তাঁদের রুচি ছিল শুধু সদৃশ নয়, একই। এই সমাজের সাথে আন্নার যোগাযোগ ছিল তাঁর ফুফাতো ভাইয়ের স্ত্রী প্রিন্সস বেত্‌সি ভেস্কায়া মারফত, যাঁর আয় ছিল এক লাভ বিশ হাজার, সমাজে আন্নার আবির্ভাব মাত্র তিনি তাঁর বিশেষ অনুরাগী হয়ে ওঠেন, তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা করতেন এবং কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনার মহল নিয়ে হাসাহাসি করে তাঁকে টেনে নিতেন নিজের মহলে।

বেত্‌সি বললেন, ‘আমি যখন বুড়ি আর বিছ্‌ছিরি হয়ে উঠব, তখন আমিও হয়ে যাব ঐরকম! কিন্তু আপনার পক্ষে, সুন্দরী যুবতী নারীর পক্ষে ঐ দাতব্যালয়ে যাবার সময় এখনো আসেনি।’

প্রথমটায় আন্না যতটা পেরেছেন কাউন্টেস ভেস্কায়ার এই সমাজটাকে এড়িয়ে যেতেন, কেননা এ সমাজে ব্যয় করতে হত তাঁর সাধ্যের বাইরে, তা ছাড়া মনে মনেও প্রথম মহলটিই ছিল তাঁর পছন্দ। কিন্তু মস্কো সফরের পর ব্যাপারটা দাঁড়াল উল্টো। তিনি তাঁর সদাচারী বন্ধুদের এড়িয়ে সেরা সমাজে যাতায়াত শুরু করলেন। সেখানে ভ্রন্‌স্কির সাথে তাঁর দেখা হত আর প্রতিটি সাক্ষাতেই আনন্দের দোলা অনুভব করতেন তিনি। ভ্রন্‌স্কিকে তিনি ঘন ঘনই দেখতেন বেত্‌সির ওখানে, বিয়ের আগে উনিও ছিলেন ভস্কায়া, ভ্রন্‌স্কির চাচাতো বোন। যেখানে আন্নার দেখা পাওয়া যেতে পারে, তেমন সবখানেই হাজির থাকতেন ভ্রন্‌স্কি আর সুযোগ পেলেই বলতেন তাঁর ভালোবাসার কথা। কোন সুযোগ দিতেন না আন্না, কিন্তু দেখা হলেই তাঁর ভেতর সেই প্রাণচাঞ্চল্য জেগে উঠত যা তিনি অনুভব করেছিলেন রেল কামরায় তাঁকে প্রথম দেখে। নিজেই তিনি টের পেতেন যে ওঁকে দেখলেই ওঁর চোখ জ্বলজ্বল করে উঠছে আনন্দে, ঠোঁট কুঞ্চিত হচ্ছে হাসিতে, কিন্তু এই আনন্দের প্রকাশটা তিনি চাপা দিতে পারতেন না।

প্রথম প্রথম আন্না সত্যিই বিশ্বাস করতেন যে ভ্রন্‌স্কি ওঁর পিছু নিয়েছেন বলে উনি ওঁর ওপর অসন্তুষ্ট। কিন্তু মস্কো থেকে ফেরার কিছু পরে এক সান্ধ্য বাসরে যেখানে ভ্রন্‌স্কির দেখা পাবেন বলে ভেবেছিলেন অথচ তিনি ছিলেন না, সেখানে যে নৈরাশ্য তাঁকে আচ্ছন্ন করেছিল, তা থেকে তিনি পরিষ্কার বুঝলেন যে আত্মপ্রতারণা করছেন, ভ্রন্‌স্কির এই অনুসরণ তাঁর কাছে শুধু অপ্রীতিকর নয়, তাই নয়, এইটের তাঁর জীবনের একমাত্র আকর্ষণ।

.

দ্বিতীয়বার নামকরা গায়িকার অনুষ্ঠান হচ্ছিল, গোটা উচ্চ সমাজ গিয়েছিল থিয়েটারে। প্রথম সারির আসন থেকে ফুফাতো বোনকে দেখে ভ্রন্‌স্কি বিরতি পর্যন্ত অপেক্ষা না করেই গেলেন তাঁর কাছে বক্সে।

বেত্‌সি বললেন, ‘খেতে এলেন না যে? প্রেমিকযুগলের আলোকদর্শনক্ষমতায় অবাক মানতে হয়।’ তারপর হেসে এমনভাবে যোগ দিলেন যাতে আর কারও কানে না যায় : ‘সেও আসেনি। কিন্তু আসুন অপেরার পরে।’

ভ্রন্‌স্কি সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চাইলেন তাঁর দিকে। উনি মুখ নিচু করলেন। হাসি দিয়ে তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে ভ্রন্‌স্কি বসলেন তাঁর কাছে।

‘আপনার উপহাসগুলো আমার কি যে মনে পড়ে!’ এই প্রেমাবেগের সাফল্য দর্শনে বিশেষ একটা পরিতৃপ্তি লাভ করে কাউন্টেস বেত্‌সি বলে চললেন, ‘সে সব গেল কোথায়? আপনি ধরা পড়ে গেছেন বাপু।’

‘ধরা পড়তেই শুধু আমি চাই’, নিজের প্রশান্ত সদাশয় হাসিতে ভ্রন্‌স্কি জবাব দিলেন, ‘নালিশ করবার কিছু থাকলে সেটা শুধু এই যে সত্যি বলতে আমি ধরা পড়েছি বড়ই কম। আমি নিরাশ হয়ে উঠছি।’

‘কিন্তু কি আশা থাকতে পারে আপনার?’ বন্ধুর জন্য ক্ষুব্ধ বোধ করে বেত্‌সি ফরাসি ভাষায় বললেন, ‘দুজন দুজনকে বুঝব।’ কিন্তু তাঁর চোখে যে ঝিলিক দিচ্ছিল তাতে বোঝা যাচ্ছিল উনি ঠিক ভ্রন্‌স্কির মতই বোঝেন কি আশা তাঁর আছে।

‘কোন আশাই নেই’, হেসে তাঁর নিটোল দাঁতের সারি উদ্ঘাটিত করে ভ্রন্‌স্কি বললেন। তারপর যোগ করলেন, ‘মাপ করবেন’, ওঁর হাত থেকে দূরবীনটা নিয়ে তাঁর অনাবৃত কাঁধের ওপর দিয়ে দেখতে লাগলেন সামনের সারির বক্সগুলোকে। ‘ভয় হচ্ছে, নিজেকে হাস্যকর করে তুলছি।’

ভ্রন্‌স্কি ভালোই জানতেন যে বেত্সি বা গোটা সমাজের চোখে হাস্যকর হবার ভয় তাঁর কিছু ছিল না। তাঁর খুব ভালোই জানা ছিল যে এ সব লোকেদের কাছে কোন কুমারী বা সাধারণভাবেই কোন বন্ধনহীন মহিলার হতভাগ্য প্রণয়ীর ভূমিকাটা হাস্যকর লাগতে পারে, কিন্তু যে একজন বিবাহিতা নারীর পিছু নিয়েছে এবং যে করেই হোক তাকে আত্মদানে টেনে আনাতেই জীবন পণ করেছে, তার ভূমিকায় সুন্দর, অপরূপ কিছু-একটা আছে, কখনোই তা হাস্যকর ঠেকতে পারে না, আর তাই সগর্বে, খুশি হয়ে, মোচের তলে লীলাময় হাসি নিয়ে দূরবীন নামিয়ে চাইলেন চাচাতো বোনের দিকে মুগ্ধ হয়ে বোন বললেন, ‘কিন্তু খেতে এলেন না যে?’

‘সেটা আপনাকে বলা দরকার। আমি ব্যস্ত ছিলাম। স্ত্রীকে অপমান করেছে এমন একটা লোকের সাথে মিটমাট করিয়ে দিচ্ছিলাম স্বামীর। সত্যি বলছি!’

‘মিটমাট হল?’

‘প্ৰায়।’

‘আপনার কাছ থেকে ব্যাপারটা শোনা দরকার’, উঠে দাঁড়িয়ে উনি বললেন, ‘পরের বিরতিটার সময় আসুন।’

‘উপায় নেই; আমি যাচ্ছি ফরাসি থিয়েটারে।’

‘নিলসনকে ছেড়ে?’ আতঙ্কে জিজ্ঞেস করলেন বেত্‌সি, যিনি কোন কোরাস-কন্যা থেকে নিলসনকে কিছুতেই আলাদা সনাক্ত করতে পারতেন না।

‘কি করা যাবে? দেখা করার কথা আছে। সবই এই মিটমাটের ব্যাপারটা নিয়ে।’

‘ধন্য শান্তিঘটকেরা, তারা ত্রাণ পাবে’, কারো কাছ থেকে এই ধরনের কিছু-একটা শুনেছিলেন বলে স্মরণ হওয়ায় বেত্‌সি বললেন, ‘তাহলে বসুন-না, বলুন ব্যাপারটা কি?’

এবং তিনি আবার বসলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *