পাঁচ
অবলোনস্কি ভালো মেধা থাকার দরুন স্কুলে পড়াশুনা করেছিলেন ভালোই। কিন্তু আলসে আর দুরন্ত হওয়ায় পাশ করে বেরোন শেষ সারিতে; কিন্তু সব সময় আড্ডা মেরে বেড়ানো জীবন, অনুচ্চ র্যাঙ্ক আর অপ্রবীণ বয়স সত্ত্বেও মস্কোর একটা সরকারি অফিসে চাকরি পেয়েছিলেন ভালো বেতনের। চাকরিটা পেয়েছিলেন তাঁর বোন আন্নার স্বামী আলেকসেই আলেক্সান্দ্রভিচ কারেনিন-এর সাহায্যে। তিনি মন্ত্রীদপ্তরে একজন পদস্থ ব্যক্তি, অফিসটি এই দপ্তরেরই অধীনে। কারেনিন তার শ্যালককে এই চাকরিটা না দিলেও শত শত অন্য লোক, ভাই-বোন, নিকট-আত্মীয় মারফত এই চাকরিটাই অথবা হাজার ছয়েক বেতনের অমনি একটা চাকরিই তিনি পেতেন, যা তার দরকার ছিল। কেননা স্ত্রীর যথেষ্ট সম্পত্তি থাকা সত্ত্বেও তাঁর হাল দাঁড়িয়েছিল খারাপ।
মস্কো আর পিটার্সবুর্গের অর্ধেকই ছিল অবলোনস্কির আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব। যেসব লোকের পরিবেশে তাঁর জন্ম, তাঁরা ছিলেন এবং হয়ে ওঠেন ইহজগতে প্রতিপত্তিশালী। সরকারি লোকদের এক-তৃতীয়াংশ যারা বৃদ্ধ, তাঁর ছিলেন তাঁর পিতার সুহৃদ, ওঁরা তাঁকে জানতেন তার বাল্যাবস্থা থেকে দুই-তৃতীয়াংশের সাথে তার তুমি বলে ডাকার সম্পর্ক, আর তৃতীয়দের সাথে তার পরিচয় ছিল ভালো; সুতরাং চাকরি, পারমিট ইত্যাদির বিতরণকারীরা স্বজনকে এড়িয়ে যেতে পারত না; একটা মোটা চাকরি পাবার জন্য অবলোনস্কিরও চেষ্টা করার প্রয়োজন ছিল না; তেমন প্রয়োজন ছিল শুধু আপত্তি না করা, ঈর্ষা না করা, ঝগড়া না বাধানো, আহত বোধ না করা, তাঁর প্রকৃতিগত সদয়তায় এটা তিনি কখনোই করেননি। কেউ যদি ওঁকে বলত যে ওঁর দরকারমত বেতনের কোন চাকরি তিনি পাবেন না, আরো এই জন্য যে বেশি বহরের দাবি তিনি করেননি, তাহলে সেটা তাঁর কাছে হাস্যকরই মনে হত; তার সমবয়সীরা যা পায় তিনি শুধু তাই পেতে চাইতেন, আর একই ধরনের কাজ তিনি করতেন অন্য কারো চেয়ে খারাপ নয়।
পরিচিতরা স্তিভা অবলোনস্কিকে ভালোবাসততা কেবল তার সদাশয়, হাসি-খুশি স্বভাব আর সন্দেহাতীত সততার জন্যই নয়, তার ভেতরে, তার সুদর্শন, সমুজ্জ্বল চেহারা, জ্বলজ্বলে চোখ, কালো ভুরু, চুল, মুখের শ্বেতাভা আর রক্তিমাভায় এমন কিছু ছিল যা লোকের ওপর আনন্দ প্রীতির একটা শারীরিক প্রভাব ফেলত। ওঁর সাথে দেখা হলে লোকে প্রায় সব সময়ই খুশির হাসিতে বলে উঠত, ‘আরে স্তিভা যে! অবলোনস্কি! সেই লোক! কখনো কখনো তার সাথে আলাপের পর দেখা গেল তেমন আনন্দের কিছু ঘটত না। তাহলেও তার পরের দিন, তৃতীয় দিনে তার সাথে দেখা হওয়ায় একই রকম খুশি হয়ে উঠত সবাই।
তিন বছর মস্কোর একটা অফিসে অধিকর্তার পদে থেকে অবলোনস্কি তাঁর সহকর্মী, অধীনস্থ, বড় সাহেব এবং তার সাথে যাদের সম্পর্ক ছিল তাদের সবার কাছ থেকে শুধু ভালোবাসাই নয়, শ্রদ্ধাও অর্জন করেছিলেন। চাকরির ক্ষেত্রে এই সর্বজনীন শ্রদ্ধা অবলোনস্কি পেয়েছিলেন যে প্রধান গুণাবলির সুবাদে, তা হল প্রথমত, নিজের ত্রুটি সম্পর্কে সচেতন থাকায় অন্য লোকদের প্রতি প্রশ্রয়দান; দ্বিতীয়ত, একান্ত উদারনৈতিকতা, যা তিনি খবরের কাগজে পড়েছেন তা নয়, যা মিশে আছে তার রক্তে, যার দরুন অবস্থা ও পদ নির্বিশেষে সমস্ত লোকের সাথে তার ব্যবহার একেবারে একইরকম, আর তৃতীয়ত, যেটা প্রধান কথা, যে কাজ তিনি করছেন তার প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীনতা, ফলে কখনো তিনি তাকে মেতে ওঠেননি এবং ভুল করেননি।
অবলোনস্কি চাকরিস্থলে এলে সম্ভ্রান্ত চাপরাশি তাঁকে এগিয়ে দিল, পোর্টফোলিও নিয়ে তিনি গেলেন তার ছোট কেবিনেটে, উর্দি চাপিয়ে এলেন অফিসে। কেরানি কর্মচারীরা সবাই উঠে দাঁড়াল, মাথা নোয়াল সানন্দে, সসম্মানে। অবলোনস্কি বরাবরের মত তাড়াতাড়ি করে গেলেন তার জায়গায়, সদস্যদের সাথে করমর্দন করে আসন নিলেন। কিছু রসিকতা করলেন, কথা বললেন ঠিক যতটা ভদ্রতাসম্মত হয় ততটা, তারপর কাজে মন দিলেন। স্বাধীনতা, সহজতা আর সানন্দে কাজ চালাবার জন্য যে আনুষ্ঠানিকতার প্রয়োজন তাদের ভেতরকার সীমারেখাটা অবলোনস্কির চেয়ে সঠিকভাবে আর কেউ খুঁজে পেত না। অবলোনস্কির অফিসের সবার মতই স্মিত সসম্মানে কাগজপত্র নিয়ে এগিয়ে এল সেক্রেটারি এবং কথা বলল সেই অন্তরঙ্গ-উদারনৈতিক সুরে যার প্রবর্তন করেছিলেন অবলোনস্কি :
‘শেষ পর্যন্ত আমরা পেনজা গুবেনিয়ার কর্তাদের কাছ থেকে খবর পেয়েছি। এই যে, চলবে…’
‘পেয়েছেন তাহলে?’ কাগজটায় আঙুল দিয়ে বললেন অবলোনস্কি, তাহলে সাহেবরা…’ শুরু হল অফিসের কাজ।
রিপোর্ট শোনার সময় অর্থময় ভঙ্গিতে মাথা নুইয়ে তিনি ভাবলেন, যদি ওদের জানা থাকত আধ ঘন্টা আগে কি দোষী বালকই না হতে হয়েছিল সভাপতিকে!’ চোখ ওঁর হাসছিল। না থেমে কাজ চলার কথা বেলা দুটো পর্যন্ত। বেলা দুটোয় বিরতি আর আহার।
দুটো তখনো হয়নি, এমন সময় অফিস-কক্ষের কাঁচের বড় দরজাটা হঠাৎ খুলে গেল এবং কে যেন ভেতরে ঢুকল। মনোযোগ বিক্ষেপে খুশি হয়ে পোর্ট্রেটের নিচে থেকে, আয়নার পেছন থেকে সমস্ত সভ্য চাইল দরজার দিকে; কিন্তু দরজার কাছে দণ্ডায়মান দারোয়ান তখনই আগন্তুককে বার করে দিল এবং কাঁচের দরজাটা বন্ধ করে দিল।
মামলাটা পড়া শেষ হলে অবলোনস্কি টানটান হয়ে উঠে দাঁড়ালেন এবং একালের উদারনৈতিকতার আদর্শে অঞ্জলি দিয়ে সিগারেট বের করে চললেন তার কেবিনেটে। তার দুজন বন্ধু পুরানো কর্মচারী নিকিতিন আর দরবারে পদস্থ গ্রিনেভিচও বেরোলেন তার সাথে।
অবলোনস্কি বললেন, ‘খাবারের পর শেষ করে ওঠা যাবে।
খুব পারা যাবে!’ বললেন নিকিতিন।
‘আর এই ফোমিনটি একটা তোফা হারামজাদা নিশ্চয়’, যে মামলাটা ওরা দেখছেন তাতে জড়িত জনৈক ব্যক্তি সম্পর্কে মন্তব্য করলেন গ্রিনেভিচ।
গ্রিনেভিচের কথায় অলোঙ্কি মুখ কোঁচকালেন, তাতে করে বুঝিয়ে দিলেন যে, আগেভাগেই রায় দিয়ে দেওয়া অশোন, তবে ওঁকে কিছু বললেন না।
তিনি দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলেন, কে ঢুকেছিল?
‘কে-একজন লোক হুজুর জিজ্ঞাসাবাদ না করেই ঢুকে পড়ছিল, শুধু আমি ঘুরে দাঁড়াই। আপনাকে চাইছিল। বললাম : সদস্যরা যখন বেরোবেন তখন…’
‘কোথায় সে?
হয়ত বারান্দায় বেরিয়েছে। না হলে এখানেই তো কেবলি ঘোরাঘুরি করছিল। এই যে ওই লোকটা, কোঁকড়া দাড়িওয়ালা বলিষ্ঠগঠন বৃষ একজনকে দেখিয়ে বলল দারোয়ান। লোকটা তার ভেড়ার লোমের টুপি না খুলেই ক্ষিপ্র এবং লঘু পায়ে পাথুরে সিঁড়ির ক্ষয়ে যাওয়া ধাপগুলো বেয়ে ছুটে উঠল ওপরে। একজন রোগাটে রাজপুরুষ পোর্টফোলিও হাতে নিচে নামছিলেন, অননুমোদনের ভাব করে তিনি ছুটন্ত লোকটার পায়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন তারপর সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালেন অবলোনস্কির দিকে।
অবলোনস্কি সিঁড়ির ওপরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ধেয়ে-আসা লোকটাকে চিনতে পেরে নক্শা-তোলা কলারের ওপর তাঁর ভালোমানুষি জ্বলজ্বলে মুখখানা আরো জ্বলজ্বল করে উঠল।
তার দিকে এগিয়ে আসা লেভিনের দিকে তাকিয়ে বন্ধুসুলভ ঠাট্টামিশ্রিত হাসি হেসে তিনি বলে উঠলেন, তাই তো বটে! শেষ পর্যন্ত দেখা দিল লেভিন!’ বন্ধুর সাথে করমর্দন বিনিময়ে যেন আশ মিটছিল না তার, লেখিনকে চুম্বন করে বললেন, ‘এই চোরের আড্ডায় আমাকে খুঁজতে আসতে তোমার গা ঘিনঘিন করল না যে বুড়ো?
‘আমি এইমাত্র এসেছি। তোমার সাথে দেখা করার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল, লেভিন বললেন সসংকোচে, সেইসাথে রাগত আর অস্বস্তিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলেন চারদিক।
বন্ধুর আত্মাভিমানী রুষ্ট সংকোচের কথা জানা থাকায় অবলোনস্কি নাও, চলো যাই কেবিনেটে’ বলে তাকে নিয়ে গেলেন যেন বিপদ-আপদের মাঝখান দিয়ে।
পরিচিত প্রায় সকলের সাথেই অবলোনস্কির ‘তুমি’ সম্পর্ক ও ষাট বছরের বুড়ো, বিশ বছরের ছোকরা, অভিনেতা, মন্ত্রী, বেনিয়া-কারবারী, জেনারেল-অ্যাডজুট্যান্ট–সকলের সাথেই, তাঁর ‘তুমি’ সম্পর্কিত অনেকেই ছিল সামাজিক সোপানের দুই চরম প্রান্তে এবং অবলোনস্কির সাথে তাদের সাধারণ কিছু একটা আছে জেনে খুবই অবাক হত। যার সাথেই তিনি শ্যাম্পেন খেতেন তার সাথেই তার ‘তুমি’ সম্পর্ক, আর শ্যাম্পেন তিনি খেতেন সকলের সাথেই, তাই অফিসে নিজের অধীনস্থদের সামনে সংকুচিত ‘তুমি’র ঠাট্টা করে তিনি তাঁর অনেক বন্ধুদের যা বলতেন–সাথে সাক্ষাতের সময় তাঁর প্রকৃতিগত উপস্থিত বুদ্ধিতে অধীনস্থদের এই প্রসঙ্গে অপ্রীতিকর অনুভূতিটা হ্রাস করে আনতে পারতেন। লেভিন সংকুচিত ‘তুমি’র দলে ছিলেন না, কিন্তু অবলোনস্কি তাঁর সহজাত লোকচরিত্রবোধে অনুভব করছিলেন যে তার অধীনস্থদের সমক্ষে তাঁর ঘনিষ্ঠতা প্রকাশ করতে না চাইতেও পারেন বলে লেভিন ভাবছেন, তাই তাড়াতাড়ি করে তাকে নিয়ে গেলেন কেবিনেটে।
লেভিন অবলোনস্কির প্রায় সমবয়সী, তাই তার সাথে ‘তুমি’ সম্পর্কটা শুধু শ্যাম্পেনের সুবাদে নয়। প্রথম যৌবন। থেকেই লেভিন তাঁর সাথী ও বন্ধু। চরিত্র ও রুচিতে পার্থক্য সত্ত্বেও তারা ভালোবাসতেন পরস্পরকে, যেমন প্রথম যৌবনে মিলিত বন্ধুরা পরস্পরকে ভালোবাসে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভিন্ন ভিন্ন ক্রিয়াকলাপের পথ নেওয়া লোকদের ক্ষেত্রে প্রায়ই যা হয়ে থাকে, অপরের কাজ বিচার করে তাকে সঙ্গত প্রতিপন্ন করলেও মনে মনে সেটাকে তারা ঘৃণা করে। প্রত্যেকেরই মনে হত যে জীবন, সে নিজে অতিবাহিত করছে সেটাই আসল জীবন, আর বন্ধুর জীবনটা কেবল ছায়ামূর্তি। লেভিনকে দেখে অবলোনস্কি ঈষৎ ঠাট্টা-মেশা হাসি চাপতে পারলেন না। গ্রাম থেকে মস্কোয় এলে কতবার তার সাথে দেখা হয়েছে, গ্রামে লেভিন কি একটা করছিলেন, কিন্তু ঠিক কি সেটা অবলোনস্কি কখনো ভালো করে বুঝে উঠতে পারেননি, তাছাড়া তাতে তার আগ্রহও ছিল না। লেভিন মস্কো আসতেন সব সময়ই উত্তেজিত, ব্যস্তসমস্ত হয়ে, কিছুটা সংকোচবোধ নিয়ে আর সে সংকোচবোধে বিরক্ত হয়ে ওঠে এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সব কিছু দেখতেন একটা নতুন অপ্রত্যাশিত দৃষ্টিতে। এসবে হাসতেন অবলোনস্কি এবং ভালোবাসতেন এসব। ঠিক তেমনি লেভিনও মনে মনে বন্ধুর নাগরিক জীবনযাত্রা আর তাঁর কাজ–দুইই ঘৃণা করতেন, ও কাজটাকে তিনি মনে করতেন বাজে, হাসতেন তা নিয়ে। কিন্তু তফাৎটা এই যে লোকে যা করে তা সব কিছু করে অবলোনস্কি হাসতেন আত্মবিশ্বাস নিয়ে এবং ভালো মনে আর লেভিনের আত্মবিশ্বাস ছিল না, মাঝে মাঝে রেগেও উঠতেন।
কেবিনেটে ঢুকে লেভিনের হাত ছেড়ে দিয়ে এবং তাতে করে এখানে আর বিপদ নেই এটা যেন বুঝিয়ে অবলোনস্কি বললেন, ‘আমরা অনেকদিন তোমার অপেক্ষায় আছি। ভারি, ভারি আনন্দ হল তোমাকে দেখে। কিন্তু কি ব্যাপার? কেমন আছো? এলে কবে?
লেভিন চুপ করে তাকিয়ে রইলেন তাঁর কাছে অপরিচিত অবলোনস্কির দু’বন্ধুর মুখের দিকে, বিশেষ করে ভারি লম্বা লম্বা সাদা আঙুল, ডগার দিকে বেঁকে যাওয়া হলদে হলদে নখ আর কামিজের বিরাট ঝকঝকে কফ-
বোম সমেত মার্জিত গ্রিনেভিচের হাতের দিকে, যে হাত দুখানা তাঁর সমস্ত মনোযোগ গ্রাস করেছে, চিন্তার ফুরসৎ দিচ্ছে না। অবলোস্কি তৎক্ষণাৎ সেটা লক্ষ্য করে হাসলেন। বললেনঃ
‘ও হ্যাঁ, পরিচয় করিয়ে দিই। আমার সাথি ও ফিলিপ ইনিচ নিকিতিন, মিখাইল স্তানিস্লাভিচ গ্রিনেভিচ,–আর লেভিনের দিকে ফিরে–জেমস্থভো’র কর্তকর্তা, জেমস্তুভো’র নতুন আমলের লোক, ব্যায়ামবীর–এক হাতে পাঁচ পুদ ওজন তোলেন, পশুপালক, শিকারী এবং আমার বন্ধু কনস্তান্তিন দৃমিত্রি লেভিন, সের্গেই ইনিচ কনিশেভের ভাই।
‘ভারি আনন্দ হল, বললেন বৃদ্ধ।
আপনার ভাই, সের্গেই ইভানিচকে জানার সৌভাগ্য হয়েছে আমার’, লম্বা লম্বা নখ সমেত সরু হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন গ্রিনেভিচ।
লেভিন ভুরু কোঁচকালেন, নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে করমর্দন করেই তৎক্ষণাৎ ফিরলেন অবলোনস্কির দিকে। সারা রাশিয়ায় নামকরা সাহিত্যিক তাঁর সৎভাইয়ের প্রতি তাঁর প্রচুর শ্রদ্ধা থাকলেও তাঁকে কনস্তান্তিন লেভিন না বলে বিখ্যাত কজনিশেভের ভাই বলা হলে তিনি সইতে পারতেন না।
না, আমি আর জেমস্তভো’র কর্মকর্তা নই। সবার সাথে ঝগড়াঝাটি করেছি, সভায় আর যাই না’, অবলোনস্কির দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন।
‘এত তাড়াতাড়ি! হেসে বললেন অবলোনস্কি, কিন্তু কি করে? কেন?
‘সে এক লম্বা ইতিহাস। বলব পরে এক সময়’, লেভিন এ কথা বললেও সাথে সাথেই ইতিহাসটা জানাতে শুরু করলেন : মানে সংক্ষেপে বললে, জেমস্তভো’র কর্মকর্তা বলে কেউ নেই, থাকতেও পারে না। এমনভাবে উনি বললেন যেন এই মাত্র কেউ তাঁকে আঘাত দিয়েছে, একদিক থেকে ওটা খেলনা, পার্লামেন্ট-পার্লামেন্ট খেলা হচ্ছে, আর আমি তেমন তরুণও নই, তেমন বুড়োও নই যে খেলনা নিয়ে মাতব; অন্য (একটু তোতলালেন তিনি) দিকে এটা উয়েদের দুবৃত্ত দলের পক্ষে টাকা করার একটা উপায়। আগে ছিল তত্ত্বাবধান, বিচারালয়, আর এখন জেমস্তভো, উৎকোচের চেহারায় নয়, বিনা মোগ্যতায় বেতন হিসেবে’, বললেন উনি এত উত্তেজিত হয় যেন উপস্থিতদের কেউ আপত্তি করেছে তার মতামতে।
বটে! তুমি দেখছি আবার নতুন পর্যায়ে, রক্ষণশীল পর্যায়ে’, বললেন অবলোনস্কি, তবে সে কথা হবে পরে।
‘হ্যাঁ, পরে। কিন্তু তোমার সাথে দেখা করা আমার দরকার ছিল, বিদ্বেষের দৃষ্টিতে গ্রিনেভিচের হাতের দিকে তাকিয়ে লেভিন বললেন।
অবলোনস্কি প্রায় অলক্ষ্যে হাসলেন একটু।
‘তুমি যে বড় বলেছিলে আর কখনো ইউরোপীয় পোশাক পরবে না? তাঁর নতুন, স্পষ্টতই ফরাসি কাটের পোশাকের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, বটে! দেখছি নতুন পর্যায়!
হঠাৎ লাল হয়ে উঠলেন লেভিন, বয়স্ক লোকেরা যেভাবে লাল হয়ে হয়ে ওঠে নিজেরাই তা লক্ষ না করে, তেমন নয়, যেভাবে লাল হয়ে ওঠে বালকেরা, যখন তারা টের পায় যে তাদের সংকোচপরায়ণতায় তারা হাস্যকর, তার ফলে লজ্জা পেয়ে লাল হয়ে ওঠে আরো বেশি, প্রায় কান্না এসে যায়। আর এই বুদ্ধিমান পুরুষালী মুখখানাকে শিশুদের দশায় দেখতে পাওয়া এত বিচিত্র যে তার দিকে অবলোনস্কি আর তাকালেন না।
লেভিন বললেন, ‘তা কোথায় দেখা হবে? তোমার সাথে কথা বলা আমার কাছে খুবই জরুরি।’
অবলোনস্কি যেন চিন্তায় ডুবে গেলেন।
‘শোন, চল গুরিনের ওখানে প্রাতরাশ সারতে, সেখানে কথা হবে। তিনটা পর্যন্ত আমি ফাঁকা।
একটু ভেবে লেভিন বললেন, না, আমাকে তো আবার যেতে হবে।’
‘তা বেশ, তাহলে একসাথে লাঞ্চ করা যাক।
লাঞ্চ আমার যে দরকার শুধু দুটো কথা বলা, আর আলোচনা করা যাবে পরে।
‘তাহলে এখনই কথা দুটো বলে ফ্যালো, লাঞ্চে আবার আলাপ কি।
কথা দুটো এই’, বললেন লেভিন, তবে বিশেষ কিছু নয়।
মুখখানায় ওঁর হঠাৎ আক্রোশ ফুটে উঠল, যেটা দেখা দিয়েছে নিজের সংকোচশীলতা দমনের প্রয়াসে।
উনি বললেন, ‘শ্যেরবাৎস্কিরা কি করছে? সব আগের মতই?’
বহুদিন থেকে লেভিন তার শ্যালিকা কিটির প্রেমাসক্ত, সেটা জানা থাকায় অবলোনস্কি সামান্য হাসলেন, চোখ তার আমোদে চকচক করে উঠল।
‘তুমি বললে দুটো কথা, কিন্তু দুটো কথায় আমি জবাব দিতে পারব না, কেননা…মাপ কর, এক মিনিট…’.
অন্তরঙ্গতা মেশা সম্মান দেখিয়ে ঘরে ঢুকল সেক্রেটারি, সমস্ত সেক্রেটারির পক্ষেই যা সাধারণ, কর্তার চেয়ে সে, যে কাজটা ভালো বোঝে তেমন একটা বিনীত চেতনাসহ, কাগজপত্র নিয়ে সে গেল অবলোনস্কির কাছে এবং প্রশ্নের আড়ালে কি একটা মুশকিলের কথা বোঝাতে শুরু করল। অবলোনস্কি সেটা পুরো না শুনে সস্নেহে তাঁর হাত রাখলেন সেক্রেটারির আস্তিনে।
না, আমি যা বলেছিলাম তাই করুন’, হাসিতে তার মন্তব্যটাকে নরম করে তিনি বললেন, এবং ব্যাপারটা তিনি কিভাবে বুঝছেন সেটা ব্যাখ্যা করে কাগজগুলো সরিয়ে দিয়ে বললেন, এই করুন অনুগ্রহ করে, এই ধারায়, জাখার নিকিতিচ।
অপ্রস্তুত হয়ে সেক্রেটারি চলে গেল। তার সাথে যখন কথাবার্তা হচ্ছিল, লেভিন তার মধ্যে তাঁর সংকোচ সম্পূর্ণ কাটিয়ে উঠে চেয়ারে দু’হাতের কনুই ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন, মুখে তার দেখা দিয়েছিল বিদ্রুপাত্মক মনোযোগ। বললেন, বুঝি না, একেবারে বুঝি না।
‘কি বুঝতে পারছ না?’ তেমনি আমুদে হাসি হেসে, সিগারেট বের করে বললেন অবলোনস্কি। লেভিনের কাছ থেকে তিনি কোন একটা বিদঘুঁটে কাণ্ড আশা করছিলেন।
‘কি যে তোমরা করে যাচ্ছ কিছুই বুঝি না, লেভিন কাঁধ কুঁচকে বললেন। গুরুত্বসহকারে এটা তুমি করতে পারো কি করে?
কি জন্য?’
‘এজন্য যে, করার কিছু নেই।
‘তুমি তাই ভাবছ, কিন্তু আমরা কাজে আকণ্ঠ ডুবে আছি।
‘কাগজে ডুবে আছ। তা এ ব্যাপারে তোমার গুণ আছে বৈকি, যোগ করলেন লেভিন।
তার মানে তুমি ভাবছ আমার কোন একটা ঘাটতি আছে?’
হয়ত সত্যিই আছে’, লেভিন বললেন। ‘তাহলেও তোমার উদারতায় আমি মুগ্ধ হই এবং গর্ববোধ করি যে এমন উদার মানুষ আমার বন্ধু। কিন্তু তুমি আমার প্রশ্নের জবাব দিলে না’, অবলোনস্কির চোখে চোখে তাকাবার মরিয়া চেষ্টা করে তিনি যোগ দিলেন।
নাও, হয়েছে-হয়েছে। দাঁড়াও না, তুমিও এই পথেই আসবে। তোমার যে কারাজিনস্কি উয়েজুদে তিন হাজার দেসিয়াতিনা (এক দেসিয়াতিনা–১০,০০০ বর্গ মিটারের মত)। জমি আছে, এমন পেশী, বারো বছরের কুমারীর মত এমন তাজা আমেজ, তাহলেও আসবে তুমি আমাদের কাছেই। তা তুমি যা জিজ্ঞেস করেছিলে অদলবদল কিছু হয়নি, তুমি বহুদিন যাওনি সেখানে–এটাই শুধু আফসোসের কথা।
লেভিন ভীতভাবে বললেন, ‘কেন, কি হল?
‘ও কিছু না, জবাব দিলেন অবলোনস্কি। কথা হবে। কিন্তু সত্যি, কেন তুমি এলে বলো তোর ‘আহ্, এ নিয়েও কথা হবে পরে, আবার আকর্ণ রক্তিম হয়ে বললেন লেভিন।
তা বেশ। বোঝা গেল’, অবলোনস্কি বললেন। কি জানো, আমি তোমাকে নিজের বাড়িতেই ডাকতাম, কিন্তু স্ত্রী মোটেই সুস্থ নয়। আর শোনো, ওদের সাথে যদি দেখা করতে চাও, তাহলে ওরা নিশ্চয় এখন জু-পার্কে, চারটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত থাকবে। কিটি স্কেট করে। তুমি চলে যাও সেখানে, আমিও যাব, তারপর একসাথে খেয়ে নেব কোথাও।
চমৎকার, আবার দেখা হওয়া পর্যন্ত।
‘দেখো, আমি তো তোমাকে জানি, ভুলে যাবে কিংবা হঠাৎ চলে যাবে গায়ে!’ হেসে চিৎকার করে বললেন অবলোনস্কি।
না, সত্যি বলছি।
এবং অবলোনস্কির বন্ধুদের অভিনন্দন জানাতে যে ভুলে গেছেন কেবিনেট থেকে।
লেভিন চলে গেলে গ্রিনেভিচ বললেন, ‘নিশ্চয় খুব উদ্যোগী পুরুষ।
‘হ্যাঁ গো, মাথা দুলিয়ে বললেন অবলোনস্কি, সুখী লোক! কারাজিনস্কি উয়েজদে তিন হাজার দেসিয়াতিনা জমি, সবই পড়ে আছে ওর সামনে, আর কি তাজা! আমাদের মত নয় ভায়া।
‘অবলোনস্কি, আপনার নালিশ করার কি আছে?
অবলোনস্কি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আরে যাচ্ছেতাই, বিছছিরি।
ছয়
লেভিনকে অবলোনস্কি যখন জিজ্ঞেস করেছিলেন ঠিক কেন সে এসেছে, তখন লেভিন লাল হয়ে ওঠেন, এবং লাল হয়ে উঠেছেন বলে রেগে ওঠেন নিজের ওপরেই, কেননা এ জবাব তিনি দিতে পারতেন না : ‘এসেছি তোমার শ্যালিকার পাণিপ্রার্থনা করতে, যদিও শুধু এজন্যই তিনি এসেছিলেন।
লেভিন আর শ্যেরবাৎস্কিদের বংশ মস্কোর বনেদি অভিজাত বংশ, সব সময়ই তাদের মধ্যে ছিল ঘনিষ্ঠতা ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক। এ সম্পর্ক আরো দৃঢ় হয় লেভিনের উচ্চশিক্ষার্থী জীবনে। ডল্লি আর কিটির ভাই তরুণ প্রিন্স শ্যেরবাৎস্কির সাথে একই সাথে তিনি প্রস্তুত হন এবং একসাথেই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেন। এই সময় লেভিন প্রায়ই শ্যেরবাৎস্কিদের বাড়িতে আসতেন, বাড়িটাকে তিনি ভালোবেসে ফেলেন। যতই এটা আশ্চর্য ঠেকুক, লেভিন ভালোবেসেছিলেন ঠিক বাড়িটাই, পরিবারটাকে, বিশেষ করে তার অন্দরমহলকে। নিজের মাকে লেভিনের মনে পড়ে না, আর বোন ছিল তাঁর চেয়ে বয়সে বড়, তাই শ্যেরবাৎস্কিদের বাড়িতেই তিনি প্রথম দেখেন সেই বনেদি, অভিজাত, সুশিক্ষিত ও সততাশীল সংসার, যা তিনি হারিয়েছিলেন পিতা-মাতার মৃত্যুতে। এ পরিবারের সমস্ত সভ্য, বিশেষ করে মেয়েরা ছিল কেমন একটা রহস্যময় কাব্যধর্মী অবগুণ্ঠনে ঢাকা, আর তিনি তাদের ভেতর কোন ত্রুটি দেখেননি তাই নয়, এই অবগুণ্ঠনের তলে সবচেয়ে সমুন্নত অনুভূতি, সবরকমের পূর্ণতা আছে বলে ধরে নিতেন। একদিন পর পর কেন এই তিন দ্ৰ কন্যার প্রয়োজন হত ফরাসি আর ইংরেজিতে কথা বলার; কেন একটা নির্দিষ্ট সময়ে তারা পালা করে বাজাতো পিয়ানো যার ধ্বনি পৌঁছতো ওপরতলায় ভাইয়ের ঘরে যেখানে পড়াশুনা করত ছাত্ররা; কেন আসততা ফরাসি সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা, নৃত্যের এই শিক্ষকেরা; কেন একটা নির্দিষ্ট সময়ে এই তিন কন্যাই মাদমোয়াজেল লিনোর সাথে গাড়ি করে তভেঞ্চয় বুলভারে যেত তাদের বিলিতি কোট পরে–ডল্লিরটা লম্বা, নাটালির আধা-লম্বা, আর কিটিরটা একেবারেই খাটো, ফলে টানটান লাল মোজা পরা তার সুঠাম পা-দু’খানা চোখে পড়ত; সোনালি তকমা লাগানো টুপি পরা চাপরাশি সমভিব্যাহারে কেন তাদের রহস্যময় জগতে আরো যা যা ঘটত তার অনেককিছুই তিনি বুঝতেন না, কিন্তু জানতেন যে এখানে যা কিছু ঘটছে তা সবই অপরূপ আর প্রেমে পড়ে যান ঠিক এই রহস্যময়তার সাথে।
ছাত্রজীবনে উনি প্রায় বড় বোন ডল্লির প্রেমে পড়তে যাচ্ছিলেন। কিন্তু শিগগিরই তার বিয়ে হয়ে গেল অবলোনস্কির সাথে। পরে তিনি মেজো বোনের প্রণয়াসক্ত হতে থাকেন। উনি কেমন যেন অনুভব করতেন যে, বোনদের একজনের প্রেমে তার পড়া দরকার, শুধু ঠিক কার প্রেমে সেটা স্থির করে উঠতে পারতেন না। কিন্তু নাটালিও সমাজে দেখা দিতে না দিতেই কূটনীতিক ভভের সাথে বিয়ে হয়ে গেল তার। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেভিন যখন পাশ করে বেরোলেন, কিটি তখনো হোট। তরুণ শ্যেরবাৎস্কি যোগ দিলেন নৌবহরে এবং বালটিক সাগরে সলিলসমাধি নেন। অবলোনস্কির সাথে বন্ধুত্ব সত্ত্বেও শ্যেরবাৎস্কি পরিবারের সাথে সম্পর্ক ক্ষীণ হয়ে এল। কিন্তু এক বছর গ্রামে গ্রামে কাটিয়ে এ বছর শীতের প্রারম্ভে লেভিন যখন মস্কো আসেন এবং দেখা হয় শ্যেরবাৎস্কিদের সাথে, তিনি বুঝলেন, এই তিনজনের মধ্যে সত্যি-সত্যিই কাকে ভালোবাসা ছিল তাঁর নিবন্ধ।
ভালো বংশের লোক, গরিবের চেয়ে বরং বড়লোক বলাই উচিত, বত্রিশ বছর বয়স, তার মত এমন একজনের পক্ষে প্রিন্সেস শ্যেরবাৎস্কায়ার পাণিপ্রার্থনা করার চেয়ে সহজ আর কিছু হতে পারে না বলেই মনে হতে পারত; একান্ত সম্ভব ছিল যে তাকে তৎক্ষণাৎ গ্রহণ করা হত উত্তম পাত্র হিসেবে। কিন্তু লেভিন প্রেমে পড়েছিলেন এবং তাঁর মনে হত যে কিটি সব দিক দিয়ে এতই সুসম্পূর্ণ, পার্থিব সব কিছুর উর্ধ্বে এমন এক জীব আর তিনি এতই পার্থিব ও হীন যে অন্যেরা এবং কিটি স্বয়ং তাকে তার যোগ্য বলে স্বীকার করবে এমন কথা ভাবাই যায় না।
মস্কোয় যেন ঘোরের মধ্যে দুমাস কাটিয়ে, প্রতি দিন সমাজে কিটিতে দেখে, তার সাথে দেখা করার জন্যই সেখানে তিনি যেতেন, লেভিন হঠাৎ ঠিক করলেন, এ হতে পারে না এবং চলে গেলেন গ্রামে।
এ হতে পারে না, লেভিনের এমন প্রত্যয়ের ভিত্তি ছিল এই যে আত্মীয়-স্বজনদের চোখে তিনি ছিলেন মাধুরীময়ী কিটির পক্ষে অলাভজনক অযোগ্য পাত্র আর কিটি নিজে তাঁকে তো ভালোবাসতেই পারে না। আত্মীয়-স্বজনদের চোখে তিনি প্রচলিত সুনির্দিষ্ট কোন কাজে নিযুক্ত নন, সমাজেও কোন প্রতিষ্ঠা নেই, যে ক্ষেত্রে ওঁর বত্রিশ বছর বয়সে বন্ধুরা ইতিমধ্যেই কেউ কর্নেল, কেউ এইডডেকং, কেউ প্রফেসর, কেউ ব্যাঙ্ক আর রেলপথের ডিরেক্টর, কেউ-বা অবলোনস্কির মত সরকারি অফিসের অধিকর্তা; আর উনি ওদিকে (অন্য লোকের কাছ তাকে কেমন লাগার কথা সেটা তিনি ভালোই জানতেন) জমিদারি চালাচ্ছেন, গো-পালন করছেন, পাখির কোটরে গুলি মারছেন, আর এটা-ওটা ঘর তুলছেন। অর্থাৎ গুণহীন ছোকরা যার কিছুই হল না, এবং সমাজের মতে, যারা কোন কাজের নয়, তারা যা করে উনি ঠিক তাই করছেন।
তিনি নিজেকে যা ভাবতেন তেমন একটা অসুন্দর লোক, প্রধান কথা, কোন দিক থেকেই উল্লেখযোগ্য নয় এমন একটা মামুলী লোককে রহস্যময়ী মনোরমা কিটি নিজেই ভালোবাসতে পারে না। তা ছাড়া কিটির সাথে তার পূর্বতন সম্পর্ক, ভাইয়ের সাথে বন্ধুত্বের ফলে যেটা ছিল শিশুর প্রতি বয়স্কের সম্পর্কের মত, সেটা তাঁর কাছে মনে হয়েছিল ভালোবাসার পথে আরো একটা নতুন অন্তরায়। তিনি নিজেকে যা ভাবতেন তেমন একটা অসুন্দর সদয় লোককে বন্ধুর মত ভালোবাসা সম্ভব বলে তিনি মনে করতেন, কিন্তু তিনি নিজে কিটিকে যেরকম ভালোবাসতেন, তেমন ভালোবাসা পেতে হলে হওয়া উচিত সুদর্শন, বিশেষ করে অসাধারণ একজন লোক।
তিনি শুনেছেন যে মেয়েরা প্রায়ই অসুন্দর, সাধারণ লোককে ভালোবেসে থাকে, কিন্তু সেটা তিনি বিশ্বাস করতেন না। কেননা নিজেকে দিয়ে বিচার করে দেখলে, উনি নিজে ভালোবাসতে পারেন কেবল সুন্দরী, রহস্যময়ী, অনন্যসাধারণ নারীকে।
কিন্তু গ্রামে একা একা দুমাস কাটিয়ে উনি নিঃসন্দেহ হয়ে উঠলেন যে প্রথম যৌবন যে সব ভালোবাসা তিনি অনুভব করেছিলেন, এটা তারই একটা নয়; এই আবেগ তাকে মুহূর্তের জন্য স্বস্তি দিচ্ছিল না; এই প্রশ্নের মীমাংসা না। করে বাঁচতে পারেন না তিনি; ও আমার বৌ হবে কি হবে না; তাঁর হতাশাটা আসছে শুধু তাঁর এই কল্পনা থেকে যে তাঁকে প্রত্যাখ্যান করাই হবে এমন কোন প্রমাণ তাঁর কাছে নেই। এবং পাণিপ্রার্থনা করবেন আর গৃহীত হলে বিবাহও করবেন এই দৃঢ় সংকল্প নিয়ে তিনি এবার চলে এলেন মস্কোয়। অথবা…প্রত্যাখ্যাত হলে তার কি হবে সে কথা ভাবতেও পারছিলেন না তিনি।
সাত
লেভিন সকালের ট্রেনে মস্কো এসে ওঠেন তার মায়ের প্রথম স্বামীর ঔরসজাত পুত্র, তার সৎ বড় ভাই সের্গেই ইভানোভিচ কজনিশেভ-এর বাড়িতে; কেন তিনি এসেছেন তখনই তা বলে তার পরামর্শ নেবেন বলে স্থির করে পোশাক বদলে তিনি ঢুকলেন তার স্টাডিতে; কিন্তু বড় ভাই কজনিশেভ একা ছিলেন না। তাঁর কাছে বসে ছিলেন দর্শনের নামকরা এক প্রফেসর। খারক থেকে তিনি এসেছেন বিশেষ করে অতি গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক প্রশ্নে তাঁদের মধ্যে মতভেদের মীমাংসা করার উদ্দেশ্যেই। বস্তুবাদের বিরুদ্ধে উত্তপ্ত বিতর্ক চালাচ্ছিলেন প্রফেসর আর সের্গেই ইভানোভিচ কজনিশেভ আগ্রহভরে তা অনুসরণ করে গেছেন; তারপর বিতর্কের শেষ প্রবন্ধটা পড়ে তিনি আপত্তি জানিয়ে প্রফেসরকে চিঠি লেখেন। বস্তুবাদীদের কাছে বড় বেশি ছাড় দেওয়া হয়েছে বলে তিনি প্রফেসরকে ভর্ৎসনা করেন। সাথে সাথেই প্রফেসর চলে আসেন আলোচনার জন্য। প্রসঙ্গটা ছিল একটা চলতি প্রশ্ন নিয়ে মানুষের। ক্রিয়াকলাপে মনস্তাত্তিক আর শারীরবৃত্তীয় ঘটনার মধ্যে সীমারেখা আছে কি, থাকলে সেটা কোথায়?
সকলকেই যে নিরুত্তাপ স্নেহের হাসিতে স্বাগত করতেন কজনিশেভ, ভাইকেও সেভাবে গ্রহণ করে পরিচয় করিয়ে দিলেন প্রফেসরের সাথে, তারপর চালিয়ে গেলেন কথোপকথন।
সরু-কপালে ক্ষুদ্রকায় হলুদ-রঙা চশমা-পরা মানুষটা সম্ভাষণ বিনিময়ের জন্য এক মুহূর্ত আলাপ থামিয়ে আবার। কথাবার্তা চালিয়ে গেলেন, লেভিনের দিকে মন দিলেন না। প্রফেসর কখন চলে যাবেন তার অপেক্ষায় বসে রইলেন লেভিন, কিন্তু অচিরেই আলোচনার প্রসঙ্গে কৌতূহলী হয়ে উঠলেন।
যে সব প্রবন্ধ নিয়ে কথা হচ্ছিল, পত্র-পত্রিকায় লেভিনের তা চোখে পড়েছে, এবং সেগুলো তিনি পড়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকৃতিবিদ্যার ছাত্র হিসেবে প্রকৃতিবিদ্যার যে মূলকথাগুলো তার জানা ছিল তার পরিবিকাশ সম্পর্কে আগ্রহ নিয়ে, কিন্তু জীব হিসেবে মানুষের উদ্ভব, প্রতিবর্ত ক্রিয়া নিয়ে জীববিদ্যা ও সমাজবিদ্যার যুক্তিকে তিনি কখনো জীবন ও মৃত্যুর যা তাৎপর্য সে প্রশ্নের সাথে যুক্ত করেননি যা ইদানীং ঘন ঘন তার মনে উঠছে।
প্রফেসরের সাথে বড় ভাইয়ের কথাবার্তা শুনতে শুনতে লেভিন লক্ষ্য করলেন যে তাঁরা বৈজ্ঞানিক প্রশ্নকে যুক্ত করছেন প্রাণের প্রশ্নের সাথে, বারকয়েক তারা প্রায় এসব প্রশ্নেরই কাছে এসে গিয়েছিলেন, কিন্তু যা তার মনে হচ্ছিল, প্রতিবার যেই তাঁরা সবচেয়ে প্রধান ব্যাপারটার কাছে আসছেন অমনি তারা তাড়াতাড়ি সরে যাচ্ছেন এবং সূক্ষ্ম ভেদাভেদ, কুণ্ঠা জ্ঞাপন, উদ্ধৃতি, ইঙ্গিত, প্রামাণ্যর নজিরের জগতে ডুব দিচ্ছেন, তাদের কথাবার্তা বোঝা তাঁর পক্ষে কঠিন হচ্ছিল।
‘আমি এটা মানতে পারি না, কজনিশেভ বললেন তার অভ্যস্ত প্রাঞ্জলতা আর প্রকাশের সুনির্দিষ্টতা আর মার্জিত বাচনভঙ্গিতে, কোনক্রমেই আমি কেইসের সাথে এ বিষয়ে একমত হতে পারি না যে, বহির্জগৎ থেকে আমার সমস্ত ধারণা আসছে সংবেদন মারফত। মূল যে বোধ সত্তা, সেটা আমি পেয়েছি সংবেদন মারফত নয়, কেননা এই বোধটা দেবার মত কোন বিশেষ প্রত্যক্ষ নেই।’
হ্যাঁ, কিন্তু ওঁরা–ভুর্স্ট, কনাউস্ট, প্রিপাসভ জবাবে আপনাকে বলবেন যে আপনার সত্তাচেতনা আসছে সমস্ত অনুভূতির যোগফল থেকে, সত্তার এ চেতনা হল অনুভূতির পরিণাম। ভু তো আরো এগিয়ে সোজাসুজি দাবি করেন যে অনুভূতি না থাকলে সত্তার চেতনাও থাকে না।
কজনিশেভ শুরু করলেন, আমি বলব বিপরীত কথা…’
কিন্তু এবারেও লেভিনের মনে হল ওঁরা প্রধান জিনিসটার কাছাকাছি এসে আবার সরে যাচ্ছেন এবং প্রফেসরকে একটা প্রশ্ন করবেন বলে তিনি ঠিক করলেন।
জিজ্ঞেস করলেন, তাহলে দাঁড়াচ্ছে, আমার অনুভূতি যদি ধ্বংস পায়, দেহ মরে যায়, তাহলে কোনক্রমেই আর অস্তিত্ব সম্ভব নয়?
প্রফেসর বিরক্তিতে এবং বাধা পাওয়ায় যেন একটা মানসিক যন্ত্রণায় তাকালেন প্রশ্নকর্তার দিকে, দেখতে যে দার্শনিকের বদলে বরং গুণটানা খালাসির মত, তারপর কজনিশেভের দিকে চোখ ফেরালেন, যেন জিজ্ঞেস করছেন? কি আর বলার আছে এখানে। কিন্তু কজনিশেভ যিনি কথা বলছিলেন প্রফেসরের মত উদগ্রতায় আর একদেশদর্শিতায় নয়, প্রফেসরের জবাব দেওয়ার সাথে সাথে যে সহজ স্বাভাবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে প্রশ্নটা করা হয়েছে তা বোঝার মত মানসিক প্রসারতা যার ছিল, তিনি হেসে বললেন : ‘এ প্রশ্ন সমাধানের অধিকার আমাদের এখনো নেই…’
তথ্য নেই’, সমর্থন করলেন প্রফেসর এবং নিজের যুক্তিবিস্তার চালিয়ে গেলেন। বললেন, ‘আমি উল্লেখ করতে চাই, প্রিপাসভ যা সোজাসুজি বলেন, অনুভবের ভিত্তি যদি হয় সংবেদন, তাহলে এ দুয়ের মধ্যে কঠোরভাবে পার্থক্য করতে হবে।’
লেভিন আর শুনছিলেন না, প্রফেসর কখন চলে যান তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
আট
প্রফেসর চলে যাবার পর সের্গেই ইভানোভিচ কজনিশেভ তার ভাইকে বললেন, ‘তুই এসেছিস বলে ভারি খুশি হলাম। কতদিনের জন্য? চাষবাস কেমন চলছে?
লেভিন জানতেন যে চাষবাসে বড় ভাইয়ের বিশেষ কৌতূহল নেই। প্রশ্নটা করলেন শুধু তাঁকে একটু প্রশ্রয় দিয়ে, তাই লেভিনও উত্তরে কেবল গম বিক্রি আর টাকার কথাটা বললেন।
লেভিন ভেবেছিলেন যে তার বিবাহের সংকল্পের কথা বড় ভাইকে জানাবেন, তার উপদেশ চাইবেন, এমন কি এ বিষয়ে একেবারে মনস্থির করে ফেলেছিলেন; কিন্তু যখন তিনি ভাইকে দেখলেন, প্রফেসরের সাথে তার কথাবার্তা কানে গেল এবং পরে যে পৃষ্ঠপোষকতার সুরে তিনি জিজ্ঞেস করলেন চাষবাসের কথা (ওঁদের মায়ের সম্পত্তি ভাগাভাগি হয়নি, লেভিন দুই অংশই দেখতেন) সেটা শুনলেন, তখন টের পেলেন কেন জানি বড় ভাইয়ের কাছে বিয়ের কথাটা পাড়তে তিনি অক্ষম। লেভিন টের পাচ্ছিলেন, উনি যা চান, বড় ভাই সেভাবে জিনিসটা দেখবেন না।
‘তা জেমস্তভোর খবর কি? কেমন চলছে?’ জিজ্ঞেস করলেন কজনিশেভ, জেমস্তভোর ব্যাপারে তার আগ্রহ ছিল প্রচুর এবং তাতে বড় একটা তাৎপর্য আরোপ করতেন।
‘সত্যিই আমি জানি না…’।
‘সেকি? তুই যে বোর্ডের সদস্য?
না, এখন আর নই, বেরিয়ে এসেছি’, জবাব দিলেন কনস্তান্তিন লেভিন, সভায় আর যাই না।
‘আফসোসের কথা!’ ভুরু কুঁচকে কজনিশেভ বললেন।
কৈফিয়ৎ দেবার জন্য লেভিন বলতে শুরু করেছিলেন তাঁর উয়েজদে সভায় কি-সব হচ্ছে।
কজনিশেভ তাঁকে বাধা দিলেন, সৰু সময়ই ওই ব্যাপারে। আমরা রুশীরা সব সময়ই ওই রকম। হয়ত এটা আমাদের একটা ভালো গুণ–নিজের ত্রুটি দেখতে পাওয়ার ক্ষমতা, কিন্তু আমরা নুন-পোড়া করে ছাড়ি, আমরা বিদ্রূপ করে তুষ্টি লাভ করি আর সেটা সব সময়ই আসে আমাদের জিবের ডগায়। আমি তোকে শুধু বলব, আমাদের জেমস্তভো প্রতিষ্ঠানগুলোর যে অধিকার আছে, তা যদি অন্য ইউরোপীয় জাতি পায়,জার্মানরা বা ইংরেজরা তা ব্যবহার করে নিজেদের মুক্তির ব্যবস্থা করে নিত, আর আমরা কেবল হাসাহাসি করি।
কিন্তু কি করা যায়? দোষীর মত বললেন লেভিন, এটা আমার শেষ অভিজ্ঞতা। মনেপ্রাণে চেষ্টা করেছি। পারি । আমার সে সামর্থ্য নেই।’
সামর্থ্য নেই’, বললেন নিশেভ, ব্যাপারটা তুই ঠিকভাবে দেখছিস না। হতে পারে, মনমরা জবাব দিলেন লেভিন।
‘আরে জানিস, নিকোলাই ভাই আবার এখানে।
নিকোলাই ভাই কনস্তান্তিন লেভিনের আপন সহোদর বড় ভাই আর কজনিশেভের সহোদর সভাই। ভুষ্টিনাশা ‘লোক, সম্পত্তির বেশির ভাগটা উড়িয়ে দিয়েছে, বিচিত্র আর বদ লোকেদের সমাজে ঘোরাঘুরি করে ঝগড়া করেছে ভাইদের সাথে।
বলছ কি? সভয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন লেভিন, ‘কোত্থেকে তুমি জানলে?
‘প্রকোফিই ওকে রাস্তায় দেখেছে।
‘এখানে, মস্কোয়? কোথায় সে? জানো তুমি?’ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন লেভিন, যেন তখনই যেতে চান তিনি।
‘তোকে কথাটা বললাম বলে অনুতাপ হচ্ছে, ছোট ভাইয়ের উত্তেজনায় মাথা নেড়ে বললেন কজুনিশেভ, ‘কোথায় আছে জানার জন্য লোক পাঠিয়েছিলাম, ক্রবিনের কাছে দেওয়া যে হুভিটার টাকা আমি শোধ করেছি, সেটাও পাঠিয়েছিলাম। এই তার উত্তর।
কাগজ-চাপার তল থেকে একটা কাগজ কজনিশেড দিলেন তার ভাইকে।
বিচিত্র, কিন্তু চেনা হস্তাক্ষরে লেখা চিরকুটটা লেভিন পড়লেন : বিনীত প্রার্থনা যে আমাকে শান্তিতে থাকতে দেওয়া হোক। আমার অমায়িক ভাইয়েদের কাছে আমার একটা মাত্র দাবি। নিকোলাই লেভিন।’
লেভিন এটা পড়লেন এবং হাতের চিরকুটটা থেকে মাথা না তুলে দাঁড়িয়ে রইলেন কজনিশেভের সামনে। হতভাগ্য ভাইয়ের ভুলে যাবার ইচ্ছা আর সেটা যে খারাপ এই চেতনার মধ্যে লড়াই চলছিল তার অন্তরে।
‘বোঝা যাচ্ছে, ও আমাকে অপমান করতে চায়’, বলে গেলেন কজনিশেভ, তবে আমাকে সে অপমান করতে পারে না আর আমি সর্বান্তঃকরণে ওকে সাহায্য করতে চাই, কিন্তু জানি যে সেটা হবার নয়।’
হ্যাঁ, হা’, পুনরুক্তি করলেন লেভিন, ‘আমি বুঝি, ওর প্রতি তোমার মনোভাবের কদর করি আমি; কিন্তু আমি যাব।’
‘তোর যদি ইচ্ছে হয়, যা, কিন্তু আমি সে পরামর্শ দেব না, কজনিশেভ বললেন, ‘মানে আমার দিক থেকে এতে আমার ভয় নেই, আমার সাথে তোর একটা ঝগড়া বাধিয়ে দিতে ও পারবে না, কিন্তু তোর জন্য বলছি, না যাওয়াই বরং ভালো। সাহায্য করা যাবে না। তবে কর তোর যা ইচ্ছে।’
‘সাহায্য হয়ত করা যাবে না, কিন্তু আমি অনুভব করছি, বিশেষ করে এই মুহূর্তে, তবে সেটা অন্য ব্যাপার আমি অনুভব করছি যে না হলে আমি শান্তি পাব না।
কজনিশেভ বললেন, এটা আমি বুঝি না। তারপর যোগ করলেন, ‘আমি শুধু এটা বুঝি যে এটা হীনতাবোধের একটা পাঠ। অন্য দিকে নিকোলাই এখন যা হয়ে দাঁড়িয়েছে তারপর যাকে বলা হয় নীচতা সেটাকে আমি প্রশ্রয়ের দৃষ্টিতেই দেখতে শুরু করেছি। জানিস কি সে করেছে…’
‘ওহ্ কি ভয়ানক, ভয়ানক!’ দু’বার কথাটা উচ্চারণ করলেন লেভিন।
কজনিশেতের চাপরাশির কাছ থেকে ভাইয়ের ঠিকানা পেয়ে লেভিন তখনই তার কাছে যাবার উপক্রম করছিলেন, কিন্তু খানিক ভেবে ঠিক করলেন ওটা সন্ধে পর্যন্ত মুলতবি রাখবেন। সেটা সর্বাগ্রে মনের প্রশান্তি পাবার জন্য, মস্কোয় যে কারণে এসেছেন সে ব্যাপারটার একটা ফয়সালা করা দরকার। ভাইয়ের কাছ থেকে লেভিন আসেন অবলোনস্কির অফিস এবং শ্যেরবাৎস্কিদের খবর পেয়ে যেখানে কিটিকে ধরা যাবে বলে অবলোনস্কি বললেন, রওনা দিলেন সেখানেই।
নয়
লেভিন বেলা চারটায় দুরুদুরু বুকে জু-পার্কের কাছে ভাড়া গাড়ি থেকে নামলেন এবং হাঁটা পথ দিয়ে চললেন টিবি আর স্কেটিং রিঙ্কের দিকে। নিশ্চিত ছিলেন যে, সেখানে কিটিকে পাওয়া যাবে। কেননা গেটের কাছে। শ্যেরবাৎস্কিদের গাড়ি দেখতে পেয়েছিলেন তিনি।
দিনটা পরিষ্কার। গেটের কাছে সারি বেঁধে গাড়ি, জে, কোচোয়ান, সিপাহী জ্বলজ্বলে রোদে টুপি ঝলকিয়ে গেটের কাছে আর খোদাই কাঠের ছোট ছোট রুশী কুটিরের মাঝখান দিয়ে পরিস্কৃত পথে গিজগিজ করছে পরিপাটী সব লোক। বাগানের আঁকড়া বুড়ো বাচগাছগুলো সমস্ত ডালপালায় বরফ ঝুলিয়ে যেন সমারোহের নববেশ ধারণ করেছেন।
হাঁটা পথ দিয়ে স্কেটিং রিঙ্কের দিকে যেতে যেতে নিজেকে তিনি বলছিলেন, ব্যাকুল হওয়া উচিত নয়, শান্ত থাকা দরকার। কি রে তুই? কি হল তোর? চুপ করে থাক, বোকাটা’, নিজের হৃদয়কে বললেন তিনি। আর যত তিনি শান্ত থাকার চেষ্টা করছিলেন, ততই নিঃশ্বাস তার আরো বন্ধ হয়ে আসছিল। দেখা হল একজন পরিচিতের সাথে, তাকে সে ডাকলে, কিন্তু লেভিন চিনতেই পারলেন না লোকটাকে। ঢিবির কাছে এলেন তিনি, সেখানে গড়িয়ে নামা আর টেনে তোলা ছোট ছোট খেলার স্নেজগুলোর শেকল ঝনঝন করছে, শব্দ তুলছে ছুটন্ত স্লেজ, শোনা যাচ্ছে খুশির কলরোল। আরো কয়েক পা এগোতে সামনে দেখা দিল স্কেটিং রিঙ্ক, যারা কেট করছে তাদের মধ্যে তখনই তিনি চিনতে পারলেন কিটিকে।
যে আনন্দ আর ভয় তার হৃদয়কে চেপে ধরেছিল, তা দিয়েই তিনি জেনে গেলেন যে সে এখানেই। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে কথা বলছিল রিঙ্কের বিপরীত প্রান্তে একটা মহিলার সাথে। তার পোশাকে আর ভঙ্গিমায় বিশেষত্ব কিছু ছিল না বলেই মনে হবে; কিন্তু এই ভিড়ের মধ্যে লেভিনের পক্ষে ওকে সনাক্ত করা বিছুটি গাছের ঝোঁপ থেকে একটা গোলাপ ঠাহর করার মতই সহজ। সব কিছুই উজ্জ্বল করে তুলেছে সে। ও যেন এক হাসি যার কিরণ পড়ছে পরিপার্শ্বের ওপর। লেভিনের মনে হল, বরফের ওপর দিয়ে, ওখানে ওর কাছে আমি সত্যিই যেতে পারি কি? যেখানে সে দাঁড়িয়েছিল সে জায়গাটা লেভিনের কাছে মনে হল অনধিগম্য পবিত্র, এক সময় তিনি প্রায় ফিরেই যাচ্ছিলেন : এতই ভয় করছিল তার। নিজের ওপর জোর করে তাঁকে ভাবতে হল যে ওর আশেপাশে আসা-যাওয়া করছে নানান ধরনের লোক, এবং তিনি নিজেও সেখানে যেতে পারেন স্কেটিং করতে। নিচে নামলেন তিনি, সূর্যকে না দেখার মত করে তার দিকে দৃষ্টিপাত এড়িয়ে, কিন্তু না তাকিয়েও তিনি তাকে দেখতে পাচ্ছিলেন সূর্যের মত।
সপ্তাহের এই দিনটায়, এই সময়টায় জুটেছিল একই চক্রের লোকেরা, পরস্পর যারা পরিচিত। ছিল স্কেটিংয়ে যারা ওস্তাদ, নিজেদের ফলিয়ে বেড়াচ্ছিল, ছিল চেয়ার ধরে ভীরু ভীরু আনাড়ি ভঙ্গিতে স্কেটিং শিক্ষার্থী, ছিল শিশু আর স্বাস্থ্য রক্ষার উদ্দেশ্যে স্কেটিং-করা বৃদ্ধ; লেভিনের মনে হল সবাই তারা ভাগ্যের বরপুত্র, কেননা ওরা রয়েছে কিটির কাছাকাছি। যারা ফেট করছিল, সবাই যেন একেবারে নির্বিকার চিত্তে তার পাল্লা ধরছিল, তাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছিল, এমন কি কথাও বলছিল তার সাথে আর একেবারেই তার অপেক্ষা না রেখেই খুশি হয়ে উঠছিল চমৎকার বরফ আর চমৎকার আবহাওয়ায়।
খাটো জ্যাকেট আর সরু প্যান্টলুন পরা কিটির চাচাতো ভাই নিকোলাই শ্যেরবাৎস্কি স্কেট পরা পায়ে বসে ছিলেন বেঞ্চিতে, লেভিনকে দেখে চেঁচিয়ে উঠলেন : ‘আরে পয়লা নম্বরের রুশ স্কেটার যে! কতদিন এসেছেন? চমৎকার বরফ, নিন, কেট পরে নিন।
‘স্কেট আমার নেই’, বললেন লেভিন। কিটির উপস্থিতিতে তার এই অসংকোচ অকুণ্ঠতায় অবাক লাগল লেভিনের। কিটির দিকে না তাকালেও তাকে দৃষ্টিপথচ্যুত করতে এক সেকেন্ডও তিনি অপব্যয় করছিলেন না। তিনি টের পাচ্ছিলেন যে সূর্য কাছিয়ে এসেছে। কিটি ছিল কোণে, উঁচু বুট পরা সরু পায়ে ভর দিয়ে স্পষ্টতই একটু ভয়ে ভয়ে সে এগিয়ে এল তাঁর দিকে। জোরে হাত দুলিয়ে রুশী কোর্তা পরা একটা ছেলে প্রায় মাটি পর্যন্ত নুয়ে ছাড়িয়ে গেল তাকে। কিটি কেট করছিল খুব নিশ্চিত ভঙ্গিতে নয়; রশিতে ঝোলানো হোট মাফ থেকে হাত বার করে সে তৈরি হয়ে রইল, তারপর লেভিনের দিকে তাকিয়ে তাকে চিনতে পেরে হাসল তার উদ্দেশে আর হেসে ওড়াল নিজের ভয়ও। বাঁক নেওয়াটা শেষ হলে সে তার স্থিতিস্থাপক পায়ে ঠেলা দিয়ে ফেট করে এল সোজা শ্যেরবাৎস্কির কাছে। আর তার হাত আঁকড়ে ধরে হেসে মাথা নোয়ালে লেভিনের দিকে। লেভিন যা কল্পনা করেছিলেন, তার চেয়েও সে অপরূপা।
তার কথা লেভিন যখন ভাবতেন, তখন সব কিছু জীবন্ত হয়ে কিটি ভেসে উঠত তার কল্পনায়, বিশেষ করে এই মাধুরী, শিশুর স্বচ্ছ শুভময়তার ব্যঞ্জনা, সুকুমার কুমারী কাঁধের ওপর ফরসা চুলের অনায়াস মাথাটি। তার মুখের শিশুসুলভ অভিব্যক্তি দেহের সূক্ষ্ম সৌন্দর্যের সাথে মিলে গড়ে তুলেছিল তার বিশেষ একটা লাবণ্য, যেটা তার বেশ মনে আছে? কিন্তু তার ভেতর অপ্রত্যাশিত যে জিনিসটা তাকে সব সময়ই বিস্মিত করেছে সেটা তার নম্র, শান্ত, সত্যনিষ্ঠ চোখের দৃষ্টি, বিশেষ করে তার হাসি, লেভিনকে তা সব সময়ই নিয়ে যেত ইন্দ্রজালের জগতে, সেখানে তিনি নিজেকে অনুভব করতেন কোমল, মরমী, যেমনটি তিনি স্মরণ করতে পারেন তার একান্ত শৈশবের বিরল কয়েকটি দিনের ক্ষেত্রে।
‘অনেকদিন এসেছেন? হাত বাড়িয়ে দিয়ে কিটি বলল। আর লেভিন তার মাফ থেকে খসে পড়া রুমাল কুড়িয়ে দিলে যোগ করল, ধন্যবাদ।
‘আমি? আমি এসেছি সম্প্রতি, গতকাল… মানে আজকেই এসেছি’, উত্তেজনাবশে চট করে তার প্রশ্নটা ধরতে না পেরে জবাব দিলেন লেভিন। ভাবছিলাম আপনাদের ওখানে যাব’, বললেন লেভিন এবং তখনই কি সংকল্প নিয়ে তিনি ওকে খুঁজছিলেন সেটা মনে পড়ায় থতমত খেয়ে লাল হয়ে উঠলেন, ‘আমি জানতাম না যে, আপনি স্কেট করেন। এবং সুন্দর করেন।
কিটি মন দিয়ে তাকিয়ে দেখল তার দিকে, যেন অস্বস্তির কারণটা বুঝতে চায়।
‘আপনার প্রশংসার কদর করতে হবে বৈকি। এখানে লোকমুখে এখনো চলে আসছে যে, আপনি সেরা স্কেটার, কালো দস্তানা পরা হোট হাত দিয়ে মাফের ওপর জমা হিমের কাঁটাগুলোকে ঝেড়ে ফেলতে ফেলতে বলল কিটি।
হ্যাঁ, এক সময় আমি ফেট করতাম পাগল হয়ে; ইচ্ছে হত সুসম্পূর্ণতায় পৌঁছাই।’
মনে হয় আপনি সব কিছুই করেন পাগল হয়ে’, একটু হেসে সে বলল, আমার ভারি ইচে হচ্ছে আপনি কি রকম ক্ষেট করেন দেখব। কেট পরে নিন, চলুন আমরা একসাথে কেটিং করব।’
‘এক সাথে স্কেটিং! সে কি সম্ভব?’ লেভিন ভাবলেন কিটির দিকে তাকিয়ে। বললেন : ‘এখনই পরে আসছি।
স্কেটিঙের জুতা পরতে চলে গেলেন তিনি।
‘অনেকদিন আমাদের এখানে আসেননি’, পা ধরে হিলে স্কু পেঁচাতে পেঁচাতে বলল স্কেটিং পরিচারক, আপনার পর ওদের মধ্যে ওস্তাদ আর কেউ নেই। এটা চলবে’ বেল্ট টানতে টানতে সে বলল।
‘চলবে, চলবে, তাড়াতাড়ি কর, সুখের যে হাসিটা আপনা থেকে তার মুখে এসে গিয়েছিল সেটাকে বহু কষ্টে সংযত করে তিনি বললেন। ভাবলেন, হ্যাঁ, এই হল জীবন, এই হল সুখ। ও বলল এক সাথে, আসুন এক সাথে স্কেট করি। এবার ওকে বলব? কিন্তু আমি যে এখন সুখী, অন্তত সুখ পাচ্ছি আশা থেকে, সেই জন্যই যে বলতে ভয় হচ্ছে..আর যদি বলি?…কিন্তু বলা যে দরকার, দরকার! দূর হোক ছাই এই দুর্বলতা!
লেভিন উঠে দাঁড়ালেন, তারপর কুটিরের সামনের খড়খড়ে বরফের ওপর দিয়ে ছুটে গেলেন মসৃণ বরফে, তারপর অনায়াসে, যেন তার ইচ্ছাশক্তিতেই গতিবেগ বাড়িয়ে পথ সংক্ষিপ্ত করে ছুটলেন। কিটির কাছে তিনি এলেন সসংকোচে, কিন্তু আবার তার হাসি আশ্বস্ত করল তাঁকে।
কিটি তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলে, গতিবেগ বাড়তে থাকল আর যতই তা হল দ্রুত, ততই সজোরে কিটি হাত চেপে ধরল তার।
‘আপনার কাছে হলে আমি তাড়াতাড়ি শিখে ফেলতে পারতাম, কেননা আপনার ওপর বিশ্বাস আছে আমার।’
আর আপনি যখন আমার ওপর ভর দেন তখন আমিও বিশ্বাস রাখি নিজের ওপর, আর যা বলে ফেলেছেন তাতে তখনই ঘাবড়ে গিয়ে লাল হয়ে উঠলেন তিনি। এবং সত্যিই, এ কথাগুলো বলা মাত্র সূর্য যেন মেঘে ঢাকা পড়ল, মুছে গেল মুখের মৃদুলতা, লেভিন লক্ষ্য করলেন মুখের সেই ভাব পরিবর্তন যাতে বোঝায় চিন্তায় নিমগ্নতা ও তার মসৃণ কপালে দেখা দিয়েছে কুঞ্চন।
তাড়াতাড়ি করে তিনি বললেন, আপনার অপ্রীতিকর কিছু ঘটেনি তো? অবশ্য এ কথা জিজ্ঞেস করার অধিকার আমার নেই।’
‘কি কারণে?…না, অপ্রীতিকর কিছু আমার ঘটেনি’, নিরুত্তাপ গলায় জবাব দিল সে, তারপর সাথে সাথেই যোগ করল, মাদমোয়াজেল লিনোর সাথে দেখা হয়েছে আপনার?
না এখনো নয়।
ওর কাছে যান। ভারি উনি ভালোবাসেন আপনাকে।
‘কি ব্যাপার? আমি আঘাত দিয়েছি ওকে। সৃষ্টিকর্তা, আমাকে সাহায্য করো!’ এই ভাবতে ভাবতে লেভিন ছুটে গেলেন বেঞ্চে বসা পাকা চুলের কুণ্ডলী দোলানো বৃদ্ধা ফরাসিনীর কাছে। বাঁধানো দাঁত বার করে হেসে তিনি তাঁকে। গ্রহণ করলেন পুরনো বন্ধুর মত।
‘হ্যাঁ, এই তো আমরা বেড়ে উঠছি’, চোখ দিয়ে কিটিকে দেখিয়ে তিনি বললেন, ‘আর বুড়োচ্ছি। ছোট্ট ভালুক এখন বড় হয়ে উঠেছে!’ হেসে বলে চললেন ফরাসিনী, তিন বোনকে ইংরেজি কাহিনী থেকে তিন ভালুক বলে লেভিন যে রসিকতা করতেন, সে কথা মনে করিয়ে দিলেন তিনি। মনে আছে, আপনি তাই বলতেন?
লেভিনের সেটা আদৌ মনে ছিল না, কিন্তু এই দশ বছর উনি এই রসিকতাটায় হেসে আসছেন আর ভালোবাসতেন সেটা।
‘নিন যান, স্কেটিং করুন গে। আমাদের কিটি ভালোই স্কেটিং করতে শিখেছে, তাই না?
লেভিন যখন আবার কিটির কাছে এলেন, মুখ তার তখন আর কঠোর নয়, চোখে চোখে সততাশীল স্নেহময় দৃষ্টি। কিন্তু লেভিনের মনে হল এই স্নেহময়তার ভেতর আছে একটা বিশেষ রকমের, ইচ্ছাকৃত শান্তভাব। মন খারাপ হয়ে গেল তার। নিজের বৃদ্ধা গাভর্নেস আর তার বিদঘুঁটেমির গল্প করে কিটি তাকে তার জীবনের কথা জিজ্ঞেস করল।
বলল, সত্যিই কি শীতকালে গাঁয়ে আপনার একঘেয়ে লাগে না?’
না, একঘেয়ে লাগে না, কাজ আমার অনেক’, লেভিন বললেন, তিনি টের পাচ্ছিলেন যে কিটি তাকে তার শান্ত সুরের কবলে ফেলছে, তা থেকে বেরোনো তার পক্ষে অসাধ্য, যেমন হয়েছিল এই শীতের গোড়ায়।
কিটি জিজ্ঞেস করল, ‘অনেক দিনের জন্য এসেছেন?
‘জানি না, কি বলছেন সে কথা না ভেবেই বললেন লেভিন। যদি কিটির এই শান্ত বন্ধুত্বে তিনি ধরা দেন, তাহলে কিছুরই ফয়সালা না করে আবার তিনি ফিরে যাবেন, এই ভাবনাটা মনে এল তাঁর, ঠিক করলেন ক্ষেপে উদ্দাম হয়ে উঠবেন।
জানেন না মানে?
‘জানি না। সব নির্ভর করছে আপনার ওপর’, এই বলেই তখনই তাঁর আতঙ্ক হল নিজের কথাগুলোয়।
কিটি তার কথাগুলো হয়ত-বা শুনেছিল, হয়ত শুনতে চায়নি, সে যাই হোক, যেন হোঁচট খেল সে, দু’বার পা ঠুকে তাঁর কাছ থেকে সে দূরে চলে গেল। মাদমোয়াজেল লিনোর কাছে গিয়ে কি যেন বললে, তারপর মহিলারা যেখানে স্কেট খোলে, সেই ঘরটায় গেল।
সৃষ্টিকর্তা, কি আমি করলাম! সৃষ্টিকর্তা! সাহায্য কর আমাকে, জ্ঞান দাও’, এই বলে প্রার্থনা করার সাথে সাথে সবেগ গতির একটা তাগিদ অনুভব করে ছুটে গেলেন একটা বাইরের, আরেকটা ভেতরের বৃত্ত এঁকে।
ঠিক এই সময় পায়ে স্কেট, মুখে সিগারেট নিয়ে কফি ঘর থেকে বেরিয়ে এল তরুণ স্কেটারদের সেরা একজন, সশব্দে স্কেট পায়েই লাফাতে লাফাতে সে নামল সিঁড়ি বেয়ে। ধেয়ে সে নামল নিচে, হাতের অবাধ ভঙ্গি না বদলিয়েই সে ফেট করতে লাগল বরফের ওপর।
‘আরে, এ যে দেখি নতুন খেল, এই বলে লেভিন তখনই ওপরে উঠলেন এই নতুন খেলটা খেলবার জন্য।
মারা পড়তে যাবেন না। এর জন্য অভ্যেস দরকার!’ নিকোলাই শ্যেরবাৎস্কি তাঁকে বললেন চেঁচিয়ে।
ওপরে উঠে লেভিন যতটা সম্ভব দৌড়ে এসে ঝাঁপ দিলেন নিচে, অনভ্যস্ত এই গতিতে ভারসাম্য বজায় রাখলেন হাত বাড়িয়ে, শেষ ধাপে তার পা আটকে গিয়েছিল, কিন্তু হাত দিয়ে বরফ সামান্য স্পর্শ করে সজোর একটা দেহভঙ্গিতে সামলে নিয়ে হেসে এগিয়ে গেলেন।
স্কেট খোলার ঘর থেকে এই সময় মাদমোয়াজেল লিনোর সাথে বেরিয়ে এসেছিল কিটি। হেসে, যেন তার আদরের বড় ভাই এমনি একটা মৃদু স্নেহে লেভিনের দিকে তাকিয়ে কিটি ভাবলে, কি ভালো, কি মিষ্টি! সত্যিই কি আমি দোষী, সত্যিই কি খারাপ কিছু করেছি? লোকে বলে? ছিনালি। আমি জানি যে আমি ভালোবাসি ওকে নয়; তাহলেও ওর সাহচর্যে আমার বেশ লাগে, ভারি সুন্দর লোক। কিন্তু ওই কথাটা ও বলল কেন?
সিঁড়িতে মেয়ের কাছে আসা মা আর কিটিকে চলে যেতে দেখে দ্রুতবেগে ধাবনের জন্য লাল হয়ে ওঠা লেভিন থেমে গিয়ে ভাবনায় ডুবে গেলেন। তারপর স্কেট খুলে ফটকের কাছে সঙ্গ ধরলেন মা আর মেয়ের।
প্রিন্স-মহিষী বললেন, ‘ভারি আনন্দ হল আপনাকে দেখে। বরাবরের মতই আমরা লোককে অভ্যর্থনা করি। বৃহস্পতিবার।
তার মানে আজকে?’
‘আপনার দেখা পেলে খুবই খুশি হব’, শুকনো গলায় বললেন প্রিন্স-মহিষী।
মায়ের এই নিরুত্তাপ ভাবটাকে শুধরে নেবার ইচ্ছা থেকে নিবৃত্ত হতে পারল না কিটি।
লেভিনের দিকে ফিরে হেসে সে বলল : তাহলে দেখা হবে।
এ সময় পাশকে করে টুপি মাথায়, চোখ-মুখ জ্বলজ্বল করে, বিজয়ীর আনন্দে পার্কে এলেন অবলোনস্কি। কিন্তু শাশুড়ির কাছে গিয়ে মনমরা আর দোষী মুখ করে তিনি ডল্লির স্বাস্থ্য সম্পর্কে তাঁর জিজ্ঞাসার জবাব দিয়ে বুক টান করে লেভিনের হাত ধরলেন। জিজ্ঞেস করলেন? তাহলে কোথায় যাব? লেভিনের চোখের দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘আমি কেবলই তোমার কথা ভেবেছি, এসেছ বলে ভারি খুশি।’
যাব, যাব’, উত্তর দিলেন সুখী লেভিন, তাহলে দেখা হবে’ এই কণ্ঠস্বর আর যে হাসির সাথে তা উচ্চারিত হয়েছিল তা তখনো তার কানে আর চোখে ভাসছিল।
ইংরেজি হোটেল, নাকি ‘এর্মিতাজ??
‘আমার কাছে সবই সমান।’
‘তাহলে ইংরেজি হোটেলই’, বললেন অবলোনস্কি, ইংরেজি হোটেল তিনি বাছলেন কারণ সেখানে, ইংরেজি হোটেলে তার দেনা ‘এর্মিতাজের চেয়ে বেশি। তাই এ হোটেলটা এড়িয়ে যাওয়া ভালো নয় বলে তার মনে হয়েছিল।
‘তোমার ভাড়া গাড়ি আছে? চমৎকার। আমি নিজের গাড়িটা ছেড়ে দিয়েছি।’
সারাটা রাস্তা দু’বন্ধু চুপ করে রইলেন। কিটির মুখের এই ভাবপরিবর্তনের অর্থ কি, সেই কথা ভাবছিলেন লেভিন, কখনো নিজেকে আশ্বস্ত করছিলেন এই বলে যে আশা আছে, কখনো হতাশ হয়ে উঠছিলেন এবং পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলেন যে আশা করাটা পাগলামি, তাহলেও কিটির হাসি আর তাহলে দেখা হবে’ কথাটায় আগে তিনি যা ছিলেন তার চেয়ে নিজেকে ভিন্ন একটা লোক বলে অনুভব করছিলেন তিনি।
পথে যেতে যেতে অবলোনস্কি খাবারের মেনু ঠিক করছিলেন।
লেভিনকে বললেন, তুমি তো তুর্বো ভালোবাসো?
লেভিন জিজ্ঞেস করলেন, ‘এ্যাঁ? ত্যুর্বো? হ্যাঁ, আমি দারুণ ভালোবাসি ত্যুর্বো।