ত্রিশ
প্রচণ্ড ঝড় ওয়াগনের চাকা আর স্টেশনের কোণে ল্যাম্পপোস্টগুলোর মধ্যে শনশনিয়ে উঠছিল আর ফুঁসছিল। ওয়াগন, পোস্টগুলো, লোকজন, যা কিছু দৃশ্যগোচর সবারই একটা পাশ তুষারকণায় ছেয়ে গেছে, ক্রমেই বেশি বেশি আসছে তুষারের ঝাপটা। মুহূর্তের জন্য একটু নরম হচ্ছিল ঝড়, কিন্তু তারপরেই আবার এমন দমকায় ধেয়ে আসছিল যে মনে হচ্ছিল যে ঠেকানো অসম্ভব। অথচ এর ভেতর ছুটাছুটি করছিল কিসব লোক, ফুর্তিতে কথা বলাবলি করে ক্যাচক্যাচ শব্দ তুলছিল প্ল্যাটফর্মের পাটাতনে, আর অবিরাম খুলছিল আর বন্ধ করছিল বড় বড় দরজা। মানুষের একটা গুঁড়ি-মারা ছায়া ভেসে গেল তাঁর পায়ের মাঝখান দিয়ে আর শোনা গেল লোহার ওপর হাতুড়ি ঠেকার শব্দ। ঝড়ের আঁধিয়ারায় অন্যদিক থেকে ভেসে এল কুপিত কণ্ঠস্বর : ‘ডিসপ্যাচটা দাও!’
‘২৮ নম্বর—এখানে এসো!’ চেঁচাচ্ছিল আরো নানারকম গলা, ছুটে যাচ্ছিল তুষারাচ্ছন্ন কর্মচারীরা। জ্বলন্ত সিগারেট মুখে তাঁর পাশ দিয়ে চলে গেলেন দুজন ভদ্রলোক। বেশ ভালো করে হাওয়া খাওয়ার জন্য আরেকবার নিঃশ্বাস নিলেন তিনি, তারপর রড ধরে ওয়াগনে ওঠার জন্য মাফ থেকে হাত বের করেছেন এমন সময় ফৌজী গ্রেটকোট পরা একজন লোক একেবারে তাঁর কাছে এসে বাতির দোলায়মান আলোটা আড়াল করে দিল তাঁর কাছ থেকে। আন্না তাকিয়ে তখনই চিনতে পারলেন ভ্রন্স্কির মুখ। টুপিতে হাত ঠেকিয়ে মাথা নত করে ভ্রন্স্কি জিজ্ঞেস করলেন তাঁর কিছু দরকার আছে কিনা, তাঁর কোন কাজে লাগতে তিনি পারেন কি? কোন জবাব না দিয়ে আন্না অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন তাঁর দিকে আর ভ্রন্স্কি ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও আন্না দেখতে পেলেন, অথবা তাঁর মনে হল যে দেখতে পাচ্ছেন ভ্রন্স্কির মুখ-চোখের ভাব। সেটা আবার সেই সশ্রদ্ধ পুলক যা আগের দিন সন্ধ্যায় তাঁকে অত অভিভূত করেছিল। এ দু’দিন তিনি একাধিকবার নিজেকে বলেছেন যে সব সময় একই রকম শত শত যে নবযুবক সর্বত্র দেখা যায়, ভ্রন্স্কি তাঁর কাছে মাত্র তাদেরই একজন, ওঁকে নিয়ে ভাববেন এ তিনি হতে দিতে পারেন না। কিন্তু এখন তাঁর সাথে সাক্ষাতের প্রথম মুহূর্তেই তিনি আচ্ছন্ন হলেন একটা সানন্দ গর্ববোধে। এখানে তিনি কেন, এ কথা জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন ছিল না তাঁর। ওটা তিনি এত অভ্রান্তরূপে জানেন যেন ভ্রন্স্কি বলেছেন যে আন্না যেখানে সেখানটিতেই থাকার জন্য উনি এখানে।
‘আমি জানতাম না যে, আপনি যাচ্ছেন। কেন যাচ্ছেন?’ যে হাতটা রড ধরতে যাচ্ছিল তা নামিয়ে এনে জিজ্ঞেস করলেন আন্না। তাঁর মুখটা দুর্নিবার একটা আনন্দ আর সজীবতায় জ্বলজ্বল করে উঠল।
‘কেন যাচ্ছি?’ সরাসরি আন্নার চোখের দিকে তাকিয়ে ভ্রন্স্কি বললেন, ‘আপনি জানেন, যেখানে আপনি সেখানে থাকার জন্যে আমি চলেছি। এ ছাড়া আমি পারি না।’
ঠিক এ সময়েই যেন একটা বাধা জয় করে ওয়াগনের ছাদ থেকে তুষারকণা ঝরিয়ে দিল হাওয়া। খড়খড়িয়ে উঠল একটা খসে পড়া লোহার পাতে। সামনের দিকে খাদে কান্নার মত বিমর্ষ হুইসিল দিল ইঞ্জিন। তুষারঝঞ্ঝার সমস্ত ত্রাস এখন আন্নার কাছে মনে হল আরো অপরূপ। ভ্রন্স্কি সে কথাই বলেছেন—যা চাইছিল তাঁর মন। কিন্তু ভয় পাচ্ছিলেন তাঁর বিচারবোধে। কোন জবাব দিলেন না আন্না, তাঁর মুখে ভ্রন্স্কি দেখতে পেলেন সংগ্রামের ছাপ।
‘যা বললাম সেটা আপনার ভালো না লেগে থাকলে মাপ করবেন’, ভ্রন্স্কি বললেন বিনীতভাবে।
কথাটা উনি বললেন সৌজন্য সহকারে, সম্মান করে, কিন্তু এত দৃঢ় আর একাগ্র স্বরে যে আন্না অনেকক্ষণ কোন জবাব দিতে পারলেন না।
শেষ পর্যন্ত বললেন, ‘ও কথা বলা আপনার উচিত নয়, আর আপনি যদি ভালো লোক হন, তাহলে যা বলেছেন সেটা ভুলে যান, আমিও তা ভুলে যাব।
‘আপনার একটা কথা, একটা ভঙ্গিও আমি ভুলব না কখনো, ভুলতে পারি না…’
‘থাক, থাক, খুব হয়েছে!’ চেঁচিয়ে উঠলেন আন্না, বৃথাই একটা কঠোর ভাব ফুটিয়ে তুলতে চাইলেন মুখে যেদিকে সতৃষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়েছিলেন প্রস্কি। ঠাণ্ডা রডটা ধরে উনি উঠে পড়লেন পৈঠায়, দ্রুত ঢুকে পড়লেন ওয়াগনের প্যাসেজে। কিন্তু এই ছোট্ট প্যাসেজে থেমে গিয়ে তিনি মনে মনে ভেবে দেখতে লাগলেন কি ঘটল। তাঁর নিজের অথবা ভ্রন্স্কির কোন কথা স্মরণে না এনেও তিনি অনুভবে বুঝলেন যে এই ক্ষণিকের বাক্যালাপ তাঁদের সাঙ্ঘাতিক কাছাকাছি এনে ফেলেছে, তাতে তিনি বোধ করলেন একাধারে আতঙ্ক আর সুখ। কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকে তিনি ভেতর ঢুকলেন, বসলেন নিজের জায়গায়। যে উত্তেজিত অবস্থাটা তাঁকে প্রথম দিকে পীড়া দিচ্ছিল, সেটা শুধু ফিরে এল তাই নয়, বেড়ে উঠল এমন মাত্রায় যে তাঁর ভয় হল, ভেতরে টান-টান কিছু একটা বুঝি ছিঁড়ে যাবে যে কোন মুহূর্তে। সারা রাত ঘুম হল না তাঁর। কিন্তু যে উত্তেজনা আর দিবাস্বপ্ন তাঁর কল্পনাকে ছেয়ে ফেলছিল তাতে অপ্রীতিকর বা বিষণ্ন কিছু ছিল না, বরং সেগুলো ছিল আনন্দময়, চনমনে, উদ্দীপক। সকালের দিকে আন্না তাঁর আসনে বসে বসেই ঢুকলেন আর যখন জেগে উঠলেন তখন ফরসা হয়ে গেছে, সব সাদা, ট্রেন পৌঁছাচ্ছে পিটার্সবুর্গ স্টেশনে। সাথে সাথেই বাড়ি, স্বামী, ছেলের চিন্তা, আসন্ন’ও পরবর্তী দিনগুলোর ভাবনায় ডুবে গেলেন তিনি।
পিটার্সবুর্গে সবেমাত্র ট্রেন থেমেছে, বেরিয়ে এসে আন্নার দৃষ্টি প্রথম যে মুখখানায় আকৃষ্ট হল সেটি ‘তাঁর স্বামীর। তাঁর নিরুত্তাপ দর্শনধারী মূর্তি, বিশেষ করে এখন তাঁকে যা অবাক করল তাঁর সেই কান যার ডগায় ভর দিয়েছে তাঁর গোল টুপির কানা তা দেখে তাঁর মনে হল, ‘মাগো, অমন কান ওর হল কেমন করে?’ আন্নাকে দেখে তিনি তাঁর অভ্যস্ত উপহাসের ভঙ্গিতে ঠোঁট মুচকে, বড় বড় ক্লান্ত চোখে সোজাসুজি তাঁর দিকে তাকিয়ে এগিয়ে গেলেন। তাঁর ক্লান্ত স্থির দৃষ্টি দেখে কেমন বিশ্রী অনুভূতিতে এগিয়ে গেলেন। তাঁর ক্লান্ত স্থির দৃষ্টি দেখে কেমন বিশ্রী অনুভূতিতে বুক মুচড়ে উঠল আন্নার, যেন ওঁকে অন্যরকম দেখার আশা করেছিলেন তিনি। তবে ওঁর সাথে দেখা হওয়ায় বিশেষ করে নিজের ওপর একটা অসন্তোষ আচ্ছন্ন করল আন্নাকে। এটা অনেকদিনকার পরিচিত একটা অনুভূতি, স্বামীর সাথে সম্পর্কে ভান করে চলার যে অনুভূতিটা হত, তার মত; কিন্তু আগে তিনি এটা খেয়াল করেননি, এখন সুস্পষ্ট করে যন্ত্রণায় বিদ্ধ হয়ে সচেতন হলেন সে বিষয়ে।
‘দেখছ তো, তোমার মমতাময় স্বামী, বিয়ের দ্বিতীয় বছরের মত মমতাময়, তোমাকে দেখার জন্য কিরকম অধীর হয়ে উঠেছিল’, উনি বললেন তাঁর ধীরে মিহি গলায়, এবং সেই সুরে স্ত্রীর সাথে ব্যবহারে যা তিনি সব সময়ই গ্রহণ করতেন—সত্যিই যারা এভাবে কথা বলে থাকে তাদের প্রতি একটা উপহাসের সুর।
আন্না জিজ্ঞেস করলেন, ‘সেরিওজা ভালো আছে তো?’
উনি বললেন, ‘আমার সমস্ত হৃদয়াবেগের এটুকু মাত্র পুরস্কার? হ্যাঁ-হ্যাঁ, ভালো আছে, খুব ভালো আছে…’
একত্রিশ
ভ্রন্স্কি সে রাতে ঘুমাবার কোন চেষ্টাই করলেন না। নিজের চেয়ারে বসে তিনি কখনো তাকিয়ে থাকছিলেন সোজা সামনের দিকে, কখনো তাকিয়ে দেখছিলেন কারা আসছে, যাচ্ছে। তাঁর অপরিচিতদের তিনি আগে যেখানে বিস্মিত ও বিচলিত করতেন তাঁর অটুট অচঞ্চলতায়, এখন সেখানে তাঁকে মনে হল আরো বেশি অহংকারী আর আত্মতৃপ্ত। লোকেদের তিনি দেখছিলেন এমনভাবে যেন তারা এক-একটা জিনিস। তাঁর সামনে উপবিষ্ট একজন স্নায়বিক যুবক, স্থানীয় আদালতের কর্মচারী, তাঁর এই চেহারার জন্য দেখতে পারছিল না তাকে। যুবকটি সিগারেট ধরাবার জন্য আগুন চাইল তাঁর কাছে, কথা চালাবার চেষ্টা করল, এমন কি তাঁকে টের পাওয়াতে চাইল যে জিনিস নয় সে, মানুষ, কিন্তু ভ্রন্স্কি তা সত্ত্বেও তার দিকে তাকিয়ে রইলেন যে একটা লণ্ঠন দেখছেন এবং যুবকটি তার মানবসত্তার এই অস্বীকৃতির চাপে নিজের আত্মসংযম হারাচ্ছে অনুভব করে মুখবিকৃতি করল।
প্রস্কি কিছুই দেখছিলেন না, কাউকেও দেখছিলেন না। নিজেকে তাঁর লাগছিল যেন রাজার মত, সেটা এ জন্য নয় যে আন্নার ওপর ছাপ ফেলেছেন বলে তাঁর বিশ্বাস হয়েছিল, না, সে বিশ্বাস তাঁর তখনো ছিল না, কিন্তু আন্না তাঁর ওপর যে ছাপ ফেলেছেন তাতে সুখ, গর্ববোধ হচ্ছিল তাঁর।
এসবের পরিণাম কি দাঁড়াবে সেটা তিনি জানতেন না, সে নিয়ে ভাবানও করছিলেন না তিনি। টের পাচ্ছিলেন যে এ যাবত স্খলিত বিক্ষিপ্ত তাঁর সমস্ত শক্তি একটা জায়গায় এসে মিলেছে এবং সাঙ্ঘাতিক উদ্যোগে ধাবিত হয়েছে একটা পরমানন্দময় লক্ষ্যের দিকে। এতেই তিনি সুখী। তিনি জানতেন যে তিনি সত্যি কথাটাই বলেছেন যে আন্না যেখানে, সেখানেই তিনি যাচ্ছেন, তাঁকে দেখতে পাওয়া, তাঁর কথা শোনার মধ্যেই তিনি এখন খুঁজে পাচ্ছেন জীবনের সমস্ত সুখ, তার একমাত্র অর্থ। সেলজার পানি খাবার জন্য বলোগোভো স্টেশনে নেমে যখন তিনি আন্নাকে দেখতে পেলেন, তখন তিনি মনে মনে যা ভাবছিলেন সেই কথাটাই নিজে অজ্ঞাতসারে প্রথম বললেন তাঁকে। সেটা যে তাঁকে বলেছেন, আন্না যে এখন তা জানলেন, তা নিয়ে ভাববেন, এতে আনন্দ হচ্ছিল তাঁর। সারা রাত তিনি ঘুমোলেন না। ওয়াগনে ফিরে এসে কি কি অবস্থায় তিনি আন্নাকে দেখেছেন, কি তিনি বলেছেন তা নিয়ে অবিরাম নাড়াচাড়া করতে লাগলেন মনে মনে, তাঁর বুক আড়ষ্ট করে কল্পনায় ভেসে উঠতে লাগল সম্ভাব্য ভবিষ্যতের যত ছবি।
পিটার্সবুর্গে যখন গাড়ি থেকে নামলেন, বিনিদ্র রাতের পর নিজেকে মনে হচ্ছিল চাঙ্গা, তরতাজা যেন ঠাণ্ডা পানিতে গোসল সেরে এলেন। আন্না বেরিয়ে আসার প্রতীক্ষায় নিজের ওয়াগনের সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। মনে মনে তিনি বলছিলেন, আপনা থেকে মুখ ফুটে উিেছল হাসি, ‘আরো একবার তাকে দেখব, দেখব তার গতিভঙ্গিমা, তার মুখ, কিছু একটা বলবে, মাথা ফেরাবে, তাকাবে, হাসবে হয়ত-বা।’ কিন্তু আন্নাকে দেখবার আগেই তিনি দেখতে পেলেন তাঁর স্বামীকে, ভিড়ের মধ্যে স্টেশন মাস্টার সসম্মানে তাঁর পথ করে দিচ্ছিল। ‘ও হ্যাঁ, স্বামী!’ শুধু এখনই ভ্রন্স্কি পরিষ্কার বুঝলেন যে আন্নার সাথে বাঁধা রয়েছে তাঁর স্বামী। তিনি জানতেন যে আন্নার স্বামী আছেন, কিন্তু তাঁর অস্তিত্বে বিশ্বাস ছিল না, সে অস্তিত্বে তাঁর পূর্ণ প্রত্যয় জন্মাল শুধু যখন দেখলেন তাঁর মাথা, কাঁধ, কালো পেন্টালুন পরা পা : বিশেষ করে যখন দেখলেন সে স্বামী মালিকানার ভাব নিয়ে বাহুলগ্না করছেন তাঁকে।
কারেনিনের তাজা পিটার্সবুর্গী মুখ, সামান্য নুয়ে পড়া পিঠ, গোল টুপি পরা কঠোর আত্মবিশ্বাসী মূর্তি যখন তিনি দেখলেন, একটা অপ্রীতিকর অনুভূতি হল তাঁর, যেমন হয় তৃষ্ণার্ত মানুষ উৎসের কাছে পৌঁছে যখন দেখে যে কুকুর, ভেড়া বা শুয়োর সেখানে পানি খেয়ে তা ঘোলা করে রেখেছে। গোটা কোমর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ভোঁতা ভোঁতা পায়ে কারেনিনের চলন ভঙ্গিটাই বিশেষ অপমানকর ঠেকল ভ্রন্স্কির কাছে। আন্নাকে ভালোবাসার সন্দেহাতীত অধিকার একমাত্র তাঁরই আছে বলে ভ্রন্স্কির ধারণা ছিল। কিন্তু আন্না ঠিক সেই একইরকম; তাঁর দর্শন তাঁকে প্রভাবিত করল, দৈহিকভাবে তাঁকে সেই একই রকম চাঙ্গা আর আন্দোলিত করে তুলে, বুক আনন্দে ভরে দিয়ে। দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে যেতে বলে এগিয়ে গেলেন আন্নার দিকে। স্ত্রীর সাথে স্বামীর প্রথম সাক্ষাৎটা তিনি দেখলেন, স্বামীর সাথে আন্নার কথায় সামান্য সংকোচের লক্ষণ তাঁর চোখে পড়ল প্রেমিকের অন্তর্দৃষ্টিতে। নিজেই তিনি স্থির করে নিলেন, ‘না, ওকে সে ভালোবাসে না, ভালোবাসতে পারে না।’
যখন তিনি পেছন থেকে আন্না আর্কাদিয়েভনার দিকে আসছিলেন তখন এটা লক্ষ্য করে তাঁর আনন্দ হয়েছিল যে আন্না তাঁর কাছিয়ে আসা টের পাচ্ছেন। তাঁর দিকে তাঁকিয়ে তাঁকে চিনতে পেরে আন্না আবার স্বামীর দিকে ফিরলেন।
একসাথে আন্না এবং স্বামীর উদ্দেশ্য মাথা নুইয়ে এবং অভিনন্দনটা স্বামীরই উদ্দেশে, সেটা গ্রহণ করা বা না করা তাঁর খুশি, এটা তাঁকে বুঝতে দিয়ে ভ্রন্স্কি বললেন, ‘রাতটা ভালো কেটেছে তো?’
‘ধন্যবাদ, চমৎকার কেটেছে’, আন্না বললেন।
মুখখানা তাঁর মনে হল ক্লান্ত, কখনো হাসিতে, কখনো চোখে প্রাণোচ্ছ্বাসের যে খেলা দেখা যেত সেটা নেই। কিন্তু ভ্রন্স্কির প্রতি দৃষ্টিপাতে এক মুহূর্তের জন্য কি যেন ঝলক দিল তাঁর চোখে আর তখনই শিখাটা নিবে গেলেও ভ্রন্স্কি এই মুহূর্তটুকুর জন্যই খুশি হয়ে উঠলেন। ভ্রন্স্কিকে স্বামী চেনে কিনা জানবার জন্য আন্না তাকালেন তাঁর দিকে। কারেনিন ভ্রন্স্কির দিকে তাকালেন অসন্তোষের সাথে, ভুলো মনে ভাবতে চেষ্টা করলেন কে এটি। যোগ্যের সাথে যোগ্যের মত এক্ষেত্রে ঠোকাঠুকি হল ভ্রন্স্কির অচঞ্চলতা ও আত্মবিশ্বাস এবং কারেনিনের নিরুত্তাপ আত্মবিশ্বাসের মধ্যে।
আন্না বললেন, ‘ইনি কাউন্ট ভ্ৰন্স্কি।’
‘ও! মনে হচ্ছে আমরা পরিচিত’, হাতে বাড়িয়ে দিয়ে উদাসীনভাবে বললেন কারেনিন। ‘গেলে মাকে সাথে করে, ফিরলে ছেলেকে নিয়ে’, বললেন তিনি সুস্পষ্ট উচ্চারণে, যেন প্রতিটি শব্দে এক-একটা রুল দান করছেন। ‘আপনি বোধহয় ছুটিতে?’ কিন্তু উত্তরের অপেক্ষা না করে তাঁর রহস্যের সুরে স্ত্রীর দিকে ফিরে বললেন, ‘তা বিচ্ছেদের সময় কত চোখের পানি পড়েছিল মস্কোয়?’
স্ত্রীর দিকে ফিরে এই কথা বলে তিনি ভ্রন্স্কিকে বুঝতে দিলেন যে তাঁরা একা থাকতে চান, এবং ভ্রন্স্কির দিকে ফিরে টুপিতে হাতও ঠেকালেন। ভ্রন্স্কি কিন্তু আন্না আর্কাদিয়েভনাকে উদ্দেশ করে বললেন : ‘আশা করি আপনাদের ওখানে যাবার সম্মান পাব?’
ক্লান্ত চোখে কারেনিন তাকালেন ভ্রন্স্কির দিকে। বললেন : ‘খুব খুশি হব। প্রতি সোমবার আমাদের বাড়ির দরজা খোলা।’ তারপর তাঁকে একেবারে উপেক্ষা করে স্ত্রীকে জানালেন, ‘কি ভালোই না হল, তোমাকে নিতে আসার, তোমার প্রতি আমার অনুরাগ দেখাবার জন্য আধ ঘণ্টা সময় পেয়ে গেছি’, বলে চললেন সেই একই রহস্যের সুরে।
‘তোমার অনুরাগের কথা তুমি এতই তুলে ধরো যে তার কদর করা আমার পক্ষে মুশকিল’, পেছন পেছন আসা ভ্রন্স্কির পদশব্দে অজান্তেই কান পেতে আন্না বললেন সেই একই রহস্যের সুরে। তারপর ভাবলেন, ‘ওতে আমার কি এসে যায়?’ এবং বলতে লাগলেন ওঁর না থাকায় সেরিওজা সময় কাটিয়েছে কেমন।
‘ওহ্ চমৎকার! মারিয়েট বলছে ভারি লক্ষ্মীর মত ছিল, আর তোমাকে একটু নিরাশ করতে হচ্ছে… তোমার স্বামীর মত ওর তেমন মন কেমন করেনি তোমার জন্য। তবে এ দিনটা যে আমাকে দিলে তার জন্য আরো একবার mersI গো। আমাদের আদরণীয়া সামোভার একেবারে আনন্দে নেচে উঠবেন।’ (খ্যাতনামী কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনাকে তিনি সামোভার বলতেন, কেননা সব সময় এবং সব কিছু নিয়েই তিনি উদ্বিগ্ন ও উত্তেজিত হয়ে উঠতেন)। ‘তোমার কথা জিজ্ঞেস করছিলেন তিনি; সাহস করে একটা উপদেশ দিই, আজই ওঁর কাছে গেলে পারো। সব কিছুর জন্যই তো ওঁর মন টাটায়। এখন তাঁর অন্য সমস্ত দুর্ভাবনা ছাড়াও অলোনস্কিদের পুনর্মিলন নিয়ে তিনি ভাবিত।’
কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনা আন্নার স্বামী কারেনিনের বন্ধু এবং পিটার্সবুর্গ সমাজের একটা চক্রের কেন্দ্র, স্বামী মারফত আন্না তাঁর সাথে বিশেষ ঘনিষ্ঠ ছিলেন।
‘আমি তো ওঁকে চিঠি দিয়েছি।’
‘কিন্তু সমস্ত খুঁটিনাটি যে ওঁর জানা দরকার। ক্লান্ত না হয়ে থাকলে যাও-না গো। তোমাকে গাড়ি করে নিয়ে যাবে কন্দ্রাতি, আমি চললাম কমিটিতে। আবার আর একা-একা খাওয়া সারতে হবে না’, আলেকসেই আলেক্সান্দ্রিভিচ বলে চললেন, কিন্তু তাতে রহস্যের সুর আর ছিল না, ‘কি যে অভ্যেস হয়ে গেছে বিশ্বাস করবে না…’
অনেক সময় ধরে হাতে চাপ দিয়ে তিনি বিশেষ রকমের একটু হাসি হেসে গাড়িতে তুলে দিলেন আন্নাকে।
বত্রিশ
তাঁর ছেলের সাথেই বাড়িতে ফেরার পর প্রথম দেখা হল। গৃহশিক্ষিকার চেঁচামেচি সত্ত্বেও সে সোল্লাসে ‘মা, মা! বলে চিৎকার করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে ধেয়ে নেমে তাঁর গলা জড়িয়ে ধরল।
গৃহশিক্ষিকার উদ্দেশে চ্যাচাল, ‘আমি যে আপনাকে বললাম যে মা! আমি আগেই জানতাম!’
আর স্বামীর মত ছেলেকে দেখেও আন্নার যে অনুভূতি হল সেটা মোহভঙ্গের মত। আসলে সে যা, তার চেয়ে ছেলেকে ভালো বলে কল্পনা করেছিলেন তিনি। ছেলেটি যা, সেইভাবেই তাকে নিয়ে তৃপ্তি পেতে হলে তাঁকে বাস্তবতায় নেমে আসতে হয়। কিন্তু ছেলেটি যা, তাতে, তার হালকা রঙের কোঁকড়া চুল, নীল চোখ আর আঁটো মোজায় পুরুষ্টু সুঠাম পায়ে তাকে সত্যিই মিষ্টি লাগছিল। তার নৈকট্য ও আদর অনুভব করে আন্না প্রায় দৈহিক একটা পরিতৃপ্তিই বোধ করছিলেন। তার সরল, বিশ্বাসভরা স্নেহময় দৃষ্টি দেখে, তার সহজ সব প্রশ্ন শুনে একটা নৈতিক প্রশান্তি লাভ করলেন তিনি। ডল্লির ছেলেমেয়েরা যে সব উপহার পাঠিয়েছিল সেগুলো তিনি বার করলেন, ছেলেকে বললেন মস্কোয় তানিয়া নামে কেমন একটা মেয়ে আছে, সে পড়তে পারে, এমন কি অন্যদেরও শেখায়।
‘আমি কি তাহলে খারাপ ওর চেয়ে?’ সেরিওজা বলল।
‘আমার চোখে তুই দুনিয়ায় সবার সেরা।
‘আমি তা জানি’, হেসে সেরিওজা বললে।
আন্না কফি খাওয়া শেষ করে উঠতে না উঠতেই কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনার আগমনবার্তা এল। কাউন্টেস দীর্ঘ স্থূলাঙ্গী মহিলা, মুখের রঙ কেমন অসুস্থ, হলদেটে, চিন্তামগ্ন অপূর্ব কালো চোখ। আন্না তাঁকে ভালোবাসতেন, এখন তাঁকে যেন এই প্রথম দেখলেন তাঁর সমস্ত খুঁত সমেত।
‘তা কি ভাই, অলিভ শাখা দিলে?’ ঘরে ঢুকেই কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনা জিজ্ঞেস করলেন।
‘হ্যাঁ, সব চুকে গেছে, তবে আমরা যা ভেবেছিলাম তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়’, আন্না ফরাসি ভাষায় জবাব দিলেন, ‘আমার ভাবী বড় বেশি গোঁয়ার টাইপের।
কিন্তু যার সাথে তাঁর সংস্পর্শ নেই এমন সব কিছুতে আগ্রহী হলেও যাতে তাঁর আগ্রহ তা না শোনার একটা অভ্যাস ছিল কাউন্টেসের। আন্নাকে বাধা দিয়ে তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ দুনিয়ায় দুঃখ-কষ্ট অনেক, আজ আমি একেবারে জেরবার হয়ে গেছি।
‘কেন, কি হল?’ হাসি চাপার চেষ্টা করে জিজ্ঞেস করলেন আন্না।
‘সত্যের জন্য খামোকা লড়তে গিয়ে আমি হাঁপিয়ে উঠি, একেবারেই জেরবার হয়ে পড়ি মাঝে মাঝে ‘ভগিনীগণের’ ব্যাপারটা (এটা হল লোকহিতৈষী ধর্মীয়-দেশপ্রেমিক একটা প্রতিষ্ঠান) বেশ চমৎকার শুরু হয়েছিল, কিন্তু এই ভদ্রলোকদের দিয়ে কিছুই করা সম্ভব নয়’, ভাগ্যের কাছে ব্যঙ্গাত্মক আত্মসমর্পণের সুরে কাউন্টেস যোগ দিলেন, ‘ভাবনাটা ওঁরা লুফে নিলেন, তাকে বিকৃত করলেন, এখন তুচ্ছ অকিঞ্চিৎকর সব যুক্তি দিচ্ছেন। দু’তিনজন লোক, আপনার স্বামী তাঁদের একজন—ব্যাপারটার গুরুত্ব বোঝেন, অন্যেরা জানেন কেবল পণ্ড করতেই। কাল প্রাভদিনের চিঠি পেয়েছি।’
প্রাভদিন হলেন বিদেশের একজন নামকরা নিখিল-স্লাভপন্থী, কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনা বলতে লাগলেন চিঠিতে কি আছে।
তারপর গির্জাগুলোকে সম্মিলিত করার বিরুদ্ধে কি সব বিচ্ছিরি ব্যাপার আর ঘোঁট চলছে তার কথা বললেন এবং তাড়াহুড়া করে চলে গেলেন, কেননা সেই দিনই তাঁকে একটা সমিতির অধিবেশনে যোগ দিতে এবং স্লাভ কমিটিতে যেতে হবে।
আন্না মনে মনে ভাবলেন, ‘এ সবই তো আগেও হয়েছে অথচ তখন লক্ষ্য করিনি কেন? নাকি আজ বড় চটে আছেন? আসলে কিন্তু হাস্যকর : ওঁর লক্ষ্য লোকহিত, খ্রিস্টান উনি, অথচ সব সময় উনি রেগে আছেন, সবাই ওঁর শত্রু, আর শত্রু কিনা খ্রিস্টধর্ম আর পরহিতের ব্যাপারেই।’
কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনার পর এলেন আন্নার বান্ধবী, ডিরেক্টরের স্ত্রী, শহরের সমস্ত খবর দিলেন। তিনটের সময় তিনিও চলে গেলেন, কথা দিলেন ডিনারের সময় আসবেন। কারেনিন ছিলেন মন্ত্রী দপ্তরে। একা থেকে আন্না ডিনার পর্যন্ত সময়টুকু কাটালেন ছেলের খাওয়ার সময় উপস্থিত থাকার জন্য (ছেলে সব সময়ই খায় একা), তা ছাড়া নিজের জিনিসপত্র গোছানো, যেসব চিঠিপত্র টেবিলে জমেছে তা পড়ে জবাব দিতেও সময় গেল।
ট্রেনে আসার সময় যে অকারণ লজ্জাবোধ আর অস্থিরতা তাঁকে পেয়ে বসেছিল তা একেবারে অন্তর্ধান করল। জীবনের অভ্যস্ত পরিস্থিতিতে আবার নিজেকে সুদৃঢ় ও ভর্ৎসনাতীত বলে মনে হল তাঁর।
তাঁর গতকালের ঘটনাগুলো মনে করে অবাক লাগল। ‘হয়েছিলটা কি! কিছুই না। বোকার মত কথা বলেছিল ব্রঙ্কি, সহজেই তা চুকিয়ে দেওয়া যায়, আমিও যা উচিতও নয়। বলা মানে যার গুরুত্ব নেই তাতে গুরুত্ব দেওয়া।’ তাঁর মনে পড়ল যে একবার পিটার্সবুর্গে তাঁর স্বামীর অধীনস্থ একটা যুবক যে তাঁর কাছে প্রেমের স্বীকৃতি জানিয়েছিল, সে কথা তিনি স্বামীকে বলেছিলেন। কারেনিন জবাব দিয়েছিলেন যে সমাজে থাকলে যে কোন নারীর ক্ষেত্রেই এমনটা ঘটতে পারে, তবে আন্নার মাত্রাজ্ঞানে তাঁর পূর্ণ বিশ্বাস আছে, ঈর্ষিত হয়ে আন্নাকে এবং নিজেকে হীন হতে তিনি কখনো দেবেন না। ‘তার মানে বলার কারণ নেই কোন? সত্যি, যাক সৃষ্টিকর্তা, কিই-বা বলার আছেই’, আন্না মনে মনে ভাবলেন।
তেত্রিশ
আলেক্সেই আলেক্সান্দ্রভিচ কারেনিন মন্ত্রী দপ্তর থেকে চারটার সময় ফিরলেন, কিন্তু প্রায়ই যা ঘটে থাকে, আন্নার কাছে যাবার সময় পেলেন না। তিনি তাঁর কেবিনেটে ঢুকলেন অপেক্ষমাণ উমেদারদের সাথে কথা বলতে এবং কার্যাধ্যক্ষের পাঠানো কতকগুলো কাগজ সই করতে। ডিনারের জন্য এসেছিলেন (কারেনিনদের বাড়িতে সব সময়ই ডিনারে হাজির থাকে জনা তিনেক করে লোক) : কারেনিনের বৃদ্ধা চাচাতো বোন, ডিপার্টমেন্টের ডিরেক্টর সস্ত্রীক এবং একটা যুবক, চাকরির জন্য তাকে সুপারিশ করা হয়েছে কারেনিনের কাছে। আন্না ড্রয়িং-রুমে এলেন এঁদের নিয়ে ব্যস্ত থাকতে। ঠিক পাঁচটায় প্রথম পিটারের ব্রোঞ্জ ঘড়িতে পঞ্চম ঘণ্টা বাজতে না বাজতেই কারেনিন সাদা টাই বেঁধে দুটো তারা লাগানো ফ্রক-কোটে ভেতরে ঢুকলেন, কেননা খাওয়ার পরেই তাঁকে বেরোতে হবে। কারেনিন জীবনের প্রতিটি মুহূর্তেই কর্মব্যস্ত, সব গোনাগাঁথা। আর প্রতি দিন তাঁর যা করার কথা সেটা করে উঠতে পারার জন্য তিনি কড়া নিয়মানুবর্তিতা মেনে চলতেন। তাঁর মূলমন্ত্র ছিল, ‘তাড়াহুড়াও নয়, বিশ্রামও নয়।’ হলে ঢুকে সবার উদ্দেশে মাথা নোয়ালেন তিনি, বৌয়ের দিকে তাকিয়ে হেসে তাড়াতাড়ি খেতে বসলেন।
‘হ্যাঁ, আমার একাকিত্ব শেষ হল। তুমি ভাবতে পারবে না, একা-একা খাওয়া কি অস্বস্তিকর’ (‘অস্বস্তিকর’ কথাটায় জোর দিলেন তিনি)।
খাওয়ার সময় তিনি মস্কোর ব্যাপার নিয়ে কথা বললেন স্ত্রীর সাথে। একটু ঠাট্টার হাসি ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করলেন অব্লোন্স্কির খবর; তবে কথাবার্তা হল প্রধানত সাধারণ প্রসঙ্গ, পিটার্সবুর্গের চাকরি-বাকরি আর সামাজিক ব্যাপার নিয়ে। খাবারের পর তিনি অতিথিদের সাথে কাটালেন আধ ঘণ্টা, তারপর হাসিমুখে বৌয়ের হাতে চাপ দিয়ে বেরিয়ে গেলেন পরিষদ সভায় যাবার জন্য। আন্না এবার প্রিন্সেস বেত্সি ভেস্কায়ার কাছেও গেলেন না, আন্না ফিরেছেন শুনে তিনি সন্ধ্যায় ডেকেছিলেন তাঁকে, গেলেন না থিয়েটারেও, আজ সেখানে তাঁর জন্য একটা বক্স রাখা হয়েছিল। গেলেন না প্রধানত এজন্য যে পরবেন বলে যা ভেবেছিলেন সে গাউনটা তখনো তৈরি হয়নি। অতিথিরা চলে যাবার পর নিজের বেশভূষা দেখতে গিয়ে খুবই বিরক্তি ধরেছিল আন্নার। খুব দামী সাজপোশাক না করায় আন্না পারদর্শিনী। মস্কো যাবার আগে তিনি তিনটে গাউন দর্জি মেয়েকে দিয়েছিলেন ঢেলে সাজাবার জন্য। এমনভাবে তাদের খোল-নলচে পালটাবার কথা যাতে পুরানো বলে চেনা না যায়, আর তা তৈরি হয়ে যাওয়া উচিত ছিল তিন দিন আগেই। দেখা গেল দুটো গাউন একেবারেই তৈরি হয়নি, আর যেটা তৈরি হয়েছে সেটাও আন্না যা চেয়েছিলেন তেমনভাবে নয়। দর্জি মেয়ে এসেছিল কৈফিয়ত দিতে, বোঝালে যে এটাই বেশি ভালো হবে, আন্না এমন ক্ষেপে উঠলেন যে পরে সে কথা মনে করতেও লজ্জা হচ্ছিল তাঁর। একেবারে শান্ত হবার জন্য তিনি গেলেন শিশুকক্ষে, সারা সন্ধে কাটালেন ছেলের সাথে, নিজেই তাকে শোয়ালেন, ক্রুশ করে ঢেকে দিলেন লেপ দিয়ে। কোথাও যাননি বলে আনন্দ হল তাঁর, সন্ধ্যাটা তাঁর কাটল চমৎকার। নিজের ভারি হালকা আর নিশ্চিন্ত মনে হচ্ছিল তাঁর, পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলেন যে রেলগাড়িতে তাঁর কাছে যা খুবই তাৎপর্যময় মনে হয়েছিল তা কেবল সমাজ-জীবনের এটা মামুলি অকিঞ্চিৎকর ঘটনা মাত্র, কারো কাছে, নিজের কাছেও লজ্জায় মাথা হেঁট করার মত কিছু নেই। একটা ইংরেজি উপন্যাস নিয়ে ফায়ারপ্লেসের কাছে বসে তিনি স্বামীর অপেক্ষা করতে লাগলেন। ঠিক সাড়ে নটায় তাঁর ঘণ্টি শোনা গেল। ঘরে ঢুকলেন তিনি।
আন্না তাঁর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘অবশেষে এলে যা হোক।
হাতে চুমু দিয়ে উনি বসলেন তাঁর কাছে। বললেন, ‘দেখতে পাচ্ছি তোমার যাত্রাটা বেশ ভালোই উৎরেছে।’
‘খুবই ভালো’, জবাব দিয়ে আন্না সব কিছু বলতে লাগলেন গোড়া থেকে : মিসেস এস্কায়ার সাথে তাঁর যাওয়া, পৌঁছানো, রেললাইনে দুর্ঘটনা। পরে বললেন প্রথমে ভাইয়ের জন্য, পরে ডল্লির জন্য তাঁর যে কষ্ট হয়েছিল সে কথা।
‘তোমার ভাই হলেও অমন লোককে ক্ষমা করা চলে বলে আমি মনে করি না’, কড়া করে বললেন কারেনিন।
আন্না হাসলেন। তিনি বুঝেছিলেন যে কথাটা তিনি বললেন এটা দেখাবার জন্য যে আত্মীয়তার কথা ভেবে নিজের অকপট অভিমত জানানো থেকে তিনি বিরত থাকতে পারেন না। স্বামীর চরিত্রের এই দিকটা আন্না জানতেন এবং সেটা তাঁর ভালো লাগতো।
উনি বলে চললেন, ‘যাক, সব ভালোয় ভালোয় ঢুকল। তুমিও এসে গেলে। এতে আমি খুশি। তা পরিষদে আমি যে ব্যবস্থাটা পাশ করিয়ে নিয়েছি, সে সম্পর্কে ওখানে কি বলছে লোকে
ওই ব্যবস্থাটার কথা আন্না কিছুই শোনেননি। ওঁর কাছে যা অত গুরুত্বপূর্ণ সেটা তিনি অমন অনায়াসে ভুলে যেতে পেরেছিলেন ভেবে তাঁর লজ্জা হল।
‘এখানে কিন্তু ওটা প্রচুর সোরগোল তুলেছে’, স্বামী বললেন আত্মতৃপ্ত হাসিমুখে।
আন্না বুঝতে পারছিলেন যে কারেনিন এই ব্যাপার নিয়ে তাঁর নিজের কাছে প্রীতিকর কিছু একটা জানাতে চান, আন্নাও প্রশ্ন করে করে তাঁকে সেই প্রসঙ্গে টেনে আনলেন। উনিও সেই একই আত্মতৃপ্ত হাসি নিয়ে বললেন ব্যবস্থাটা পাশ হবার পরে কি জয়ধ্বনি লাভ করেছিলেন তিনি।
‘অত্যন্ত, অত্যন্ত আনন্দ হয়েছিল আমার। এতে প্রমাণ হয় যে ব্যাপারটা নিয়ে আমাদের একটা বুদ্ধিমন্ত দৃঢ় দৃষ্টিভঙ্গি দানা বাঁধছে।’
ক্রিম আর রুটি সহযোগে দ্বিতীয় কাপ চা শেষ করে তিনি কেবিনেটে গেলেন। বললেন : ‘কিন্তু, তুমি কোথাও গেলে না যে; নিশ্চয় একম্বেয়ে লেগেছে।’
‘না, না!’ উঠে দাঁড়িয়ে হল দিয়ে ওঁকে কেবিনেটে এগিয়ে দিতে দিতে আন্না জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি এখন কি পড়ছ?
‘এখন পড়ছি ডিউক দ্য লিল, নরকের কবিতা, চমৎকার বই।‘
আন্না হাসলেন যেভাবে লোকে হাসে প্রিয়জনের দুর্বলতায়। বাহুলগ্ন করে তিনি ওঁকে পৌঁছে দিলেন কেবিনেটের দরজা পর্যন্ত। আন্না জানতেন ওঁর অভ্যাস সন্ধ্যায় পড়া, যা একটা আবশ্যিকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জানতেন যে চাকরির কাজে তাঁর প্রায় সমস্তটা সময় খেয়ে গেলেও মনীষার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সমস্ত ঘটনা অনুসরণ করা তাঁর কর্তব্য বলে তিনি গণ্য করতেন। আন্না এও জানতেন যে তাঁর সত্যকার আকর্ষণ ছিল রাজনৈতিক, দার্শনিক, ধর্মতাত্ত্বিক বইয়ে, কান্তিকলা একেবারেই তাঁর প্রকৃতিবিরুদ্ধ, কিন্তু তা সত্ত্বেও, কিংবা বলা ভালো সেই কারণেই এক্ষেত্রে যা কোলাহল তুলেছে তার কিছুই কারেনিন বাদ দিতেন না, সব কিছু পড়া তাঁর কর্তব্য বলে তিনি ভাবতেন। আন্না জানতেন যে রাজনীতি, দর্শন, ধর্মতত্ত্বের ক্ষেত্রে তাঁর মনে প্রশ্ন উঠত অথবা কিছু-একটার সন্ধান করতেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও, কিংবা বলা ভালো সেই কারণেই এক্ষেত্রে যা কোলাহল তুলেছে তর কিছুই ‘কারেনিন বাদ দিতেন না, সব কিছু পড়া তাঁর কর্তব্য বলে তিনি ভাবতেন। আন্না জানতেন যে রাজনীতি, দর্শন, ধর্মতত্ত্বের ক্ষেত্রে তাঁর মনে প্রশ্ন উঠত অথবা কিছু- একটার সন্ধান করতেন, কিন্তু শিল্প বা কবিতা, বিশেষ করে সঙ্গীতের বোধ কারেনিনের কিছুই ছিল না, এগুলো সম্পর্কে খুবই সুনির্দিষ্ট ও দৃঢ় মতামত পোষণ করতেন তিনি। শেপীয়র, রাফায়েল, বেঠোফেনকে নিয়ে, কবিতা ও সঙ্গীতের নতুন ধারা নিয়ে কথা বলতে ভালোবাসতেন তিনি এবং খুব সুস্পষ্ট সঙ্গতিতে এগুলো তিনি ভাগ করে রাখতেন।
তাঁর জন্য কেবিনেটে ইতিমধ্যে বাতির ওপর শেড আর চেয়ারের কাছে একপাত্র পানি রাখা হয়েছিল। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আন্না বললেন, ‘তা যাও, পড়ো গে। আমি চিঠি লিখব মস্কোয়।’
আন্নার হাতে চাপ দিয়ে উনি আবার চুমু খেলেন।
নিজের ঘরে এসে আন্না মনে মনে ভাবলেন, ‘যতই বল, উনি ভালো মানুষ, সত্যনিষ্ঠ, সহৃদয়, নিজের ক্ষেত্রে বিশিষ্ট’, যেন কেউ ওঁর দোষ ধরে বলেছে যে ওঁকে ভালোবাসা চলে না, তার বিরুদ্ধে আন্না সমর্থন করছেন ওঁকে 1 ‘কিন্তু কানটা অমন অদ্ভুতভাবে বেরিয়ে আছে কেন? নাকি চুল কেটেছেন বলে?’
ঠিক বারোটার সময় আন্না যখন তখনো লেখার টেবিলে ডল্লির কাছে চিঠি শেষ করছেন, শোনা গেল ঘরোয়া পাদুকার মাপা তালে শব্দ, কারেনিন এসে দাঁড়ালেন তাঁর কাছে—হাত-মুখ ধোয়া, চুল আঁচড়ানো, বগলে একটা বই।
‘শেষ কর তো, রাত হল’, বিশেষ ধরনের একটা হাসি হেসে এই কথা বলে তিনি শোবার ঘরে গেলেন।
‘কিন্তু ওঁর দিকে অমন করে চাইবার কি অধিকার আছে ওর?’ কারেনিনের দিকে ভ্রন্স্কির চাহনিটা মনে পড়ায় আন্না ভাবলেন।
আন্না পোশাক ছেড়ে ঢুকলেন শোবার ঘরে, কিন্তু মস্কো থাকার সময় যে সজীবতা তাঁর চোখে আর হাসিতে ছলকে উঠছিল তা আর ছিল না শুধু তাই নয়; বরং মনে হল আগুন তাঁর মধ্যে এখন নিবে গেছে অথবা দূরে কোথায় যেন লুকিয়ে পড়েছে।
চৌত্রিশ
ভ্রন্স্কি পিটার্সবুর্গ থেকে চলে যাবার সময় তাঁর মস্কায়া রাস্তার বড় ফ্ল্যাটখানা তাঁর বন্ধু ও প্রিয়পাত্র পেত্রিৎস্কির হেফাজতে রেখে গিয়েছিলেন।
একজন নবীন লেফটেন্যান্ট হলেন পেত্রিৎস্কি। কোন বংশমর্যাদা বিশেষ নেই, ধনী তো ননই। দেনায় আকণ্ঠ ডোবা। সন্ধ্যায় সব সময় মাতাল, প্রায়ই নানা হাস্যকর এবং নোংরা ঘটনাদির জন্য হাজতে যেতে হয়। তবে বন্ধু- বান্ধব আর ওপরওয়ালার প্রিয়পাত্র। রেল স্টেশন থেকে বারোটার সময় নিজের ফ্ল্যাটের কাছে এসে ভ্রন্স্কি দেখলেন গেটের কাছে তাঁর পরিচিত একটা ভাড়াটে গাড়ি। ঘণ্টি দিতে তিনি শুনলেন ভেতর থেকে পুরুষের হো-হো হাসি, মেয়েলী গলায় বকবকানি, আর পেত্রিৎস্কির চিৎকার, ‘বদমায়েশদের কেউ হলে ঢুকতে দিয়ো না!’ চাপরাশিকে তাঁর আসার কথা জানাতে না বলে ভ্রন্স্কি ঢুকলেন প্রথম ঘরখানায়। পেত্রিৎস্কির বান্ধবী ব্যারনেস শিলতন তাঁর বেগুনি রেশমি গাউন আর কোঁকড়া চুলের লালচে মুখখানা ঝলমলিয়ে তাঁর প্যারিসী বুলিতে ক্যানারি পাখির মত গোটা ঘরখানা মুখরিত করে গোল টেবিলের সামনে বসে কফি বানাচ্ছিলেন। ওভারকোট পরা পেত্রিৎস্কি আর পুরো উর্দি পরা ক্যাপ্টেন কামেরোভস্কি, নিশ্চয় সোজা ডিউটি-ফেরত, বসে আছেন ব্যারনেসকে ঘিরে।
‘ব্রেভো! ভ্রন্স্কি!’ সশব্দে চেয়ার ঠেলে লাফিয়ে উঠে চেঁচালেন পেত্রিৎস্কি, ‘খোদ গৃহকর্তা! ব্যারনেস, ওর জন্য নতুন কফিপট থেকে কফি। আশাই করিনি! আশা করি তোর কেবিনেটের নতুন শোভাটিতে তুই খুশি’, ব্যারনেসকে দেখিয়ে তিনি বললেন, ‘তোমাদের পরিচয় আছে?’
‘থাকবে না মানে!’ ফুর্তিতে হেসে ব্যারনেসের ছোট্ট হাতখানায় চাপ দিয়ে ভ্রন্স্কি বললেন, ‘আমরা যে পুরনো বন্ধু!’
ব্যারনেস বললেন, ‘আপনি পথ পাড়ি দিয়ে বাড়ি এলেন, তাহলে আমি উঠি। যদি ব্যাঘাত হয় তবে এখনই আমি যাচ্ছি।’
‘আপনি যেখানে ব্যারনেস, সেখানেই আপনি বাড়ির লোকের মত’, ভ্রনস্কি বললেন। এরপর নিরুত্তাপভাবে কামেরোভস্কির সাথে করমর্দন করে শুভেচ্ছা বিনিময় করলেন।
ব্যারনেস পেত্রিৎস্কির উদ্দেশে বললেন, ‘আপনি কিন্তু কখনো অমন চমৎকার করে কথা বলতে পারেন না।
কে বললে? ডিনারের পর আমিও কথা বলব তেমন খারাপ নয়।’
‘ডিনারের পর হলে সেটা গুণপনা নয়! নিন, আমি আপনাকে কফি দিচ্ছি, হাত-মুখ ধুয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে নিন।’ এই বলে আবার বসে পড়ে সযত্নে কফিপটের স্ক্রু ঘোরাতে লাগলেন ব্যারনেস। পেত্রিৎস্কিকে বললেন, ‘পিয়ের, আরেকটু কফি দিন তো।’ পেত্রিৎস্কিকে তাঁর উপাধি অনুসরণে তিনি ডাকতেন পিয়ের বলে, ওঁর সাথে নিজের সম্পর্ক তিনি লুকাতেন না। ‘আরেকটু কফি মেশাই।’
‘নষ্ট করে ফেলবেন।‘
‘না, নষ্ট হবে না। কিন্তু আপনার বউ কোথায়?’ বন্ধুর সাথে ভ্রন্স্কির কথাবার্তায় বাধা দিয়ে হঠাৎ বলে উঠলেন ব্যারনেস, ‘আমরা তো এদিকে আপনার বিয়ে দিয়ে রেখেছি। বউকে এনেছেন?
‘না ব্যারনেস, আমি বেদে হয়েই জন্মেছি, বেদে হয়েই মরব।’
‘সে তো আরও ভালো। আপনার হাতখানা দিন।’
এবং ভ্রন্স্কিকে না ছেড়ে দিয়ে রগড়ের ফোড়ন মিশিয়ে তিনি বলতে লাগলেন তাঁর জীবনযাত্রার সর্বশেষ পরিকল্পনার কথা, ভ্রন্স্কির পরামর্শ চাইলেন।
বিবাহবিচ্ছেদে সে রাজি নয়! কিন্তু কি যে আমি করি?’ (সে মানে তাঁর স্বামী) ‘এখন আমি মামলা আনতে চাইছি। আপনি কি বলেন? কামেরোভস্কি, কফিটা দেখবেন—উথলে উঠল। আপনি দেখছেন যে আমি ব্যস্ত! আমি ভাবছি মামলা আনব, কেননা আমার সম্পত্তি আমি পেতে চাই। জানেন কি বোকার মত কথা, আমি নাকি বিশ্বাসঘাতিনী’, বললেন শ্লেষভরে, ‘আর সেই কারণে সে আমার সম্পত্তি ভোগ করতে চায়।
ভ্রন্স্কি সন্তোষের সাথে সুন্দরী নারীর এই আমুদে বকবকানি শুনে যাচ্ছিলেন, সায় দিচ্ছিলেন তাঁর কথায়, আধারহস্যে উপদেশও বিতরণ করছিলেন এবং মোটের ওপর এই ধরনের নারীর সাথে তিনি যেভাবে কথা বলেন, সেই অভ্যস্ত সুরটায় তখনই ফিরে গেলেন। তাঁর পিটার্সবুর্গী দুনিয়ায় সমস্ত লোক ছিল একেবারে দুই বিপরীত ভাগে বিভক্ত। একদল নিচু জাতের লোক, মামুলি, হাঁদা এবং সবচেয়ে বড় কথা, হাস্যকর; এরা বিশ্বাস করে যে একজন স্বামীকে সেই একজন স্ত্রীর সাথেই থাকতে হবে, যার সাথে তার বিয়ে হয়েছে। কুমারীকে হতে হবে অপাপবিদ্ধ, নারীকে ব্রীড়াময়ী, পুরুষকে পুরুষোচিত, সংযত, দৃঢ়, ছেলেমেয়েদের মানুষ করে তুলতে, রুজি রোজগার করতে, দেনা শুধুতে এবং এই ধরনের লোক। কিন্তু আরেক ধরনের লোক আছে, আসল লোক, তাঁরা যে দলে পড়েন। এদের সর্বোপরি হওয়া চাই সুমার্জিত, রূপবান, মহানুভব, সাহসী, ফুর্তিবাজ, লজ্জায় এতটুকু লাল না হয়ে যারা যত রকম ব্যসনে আসক্ত হয় আর বাকি সব কিছু ওড়ায় হেসে।
মস্কোর একেবারে ভিন্ন জগতের অভিজ্ঞতার পর ভ্রন্স্কি বিমূঢ় হয়েছিলেন শুধু প্রথম মুহূর্তটাতেই। কিন্তু তখনই যেন পুরনো জুতায় পা ঢোকালেন, চলে গেলেন নিজের পূর্বতন, আমুদে, প্রীতিকর জগতে।
কফি কিন্তু আর তৈরি হল না। উথলে উঠে তা ছিটকে পড়ল সবার গায়ে এবং তাই ঘটাল যার প্রয়োজন ছিল, যথা হাসি ও হুল্লোড়ের উপলক্ষ, দামী গালিচা ও ব্যারনেসের গাউন ভিজিয়ে দিল তা।
‘তাহলে এবার বিদায়, নইলে কখনোই আপনি গা ধোবেন না আর আমার বিবেকে বিঁধে থাকবে সজ্জন লোকের যা প্রধান অপরাধ—অপরিচ্ছন্নতা। তাহলে আপনি বলছেন গলার কাছে ছোরা ধরে রাখতে?’
‘অবশ্যই এবং এমনভাবে যাতে আপনার হাতখানা থাকে তার ঠোঁটের কাছে। ও আপনার হাতে চুমু খাবে এবং সব ভালোয় ভালোয় মিটে যাবে’, জবাব দিলেন ভস্কি।
‘তাহলে আজ ফরাসি থিয়েটারে!’ গাউন খসখস করে ব্যারনেস উধাও হলেন।
কামেরোভস্কিও উঠে দাঁড়ালেন। ভ্রন্স্কি তাঁর হাতে চাপ দিয়ে তাঁর চলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা না করেই গোসলখানা ঢুকলেন। তিনি যখন হাতমুখ ধুচ্ছিলেন, পেত্রিৎস্কি সংক্ষেপে তাঁকে বললেন তাঁর অবস্থার কথা, ভ্রন্স্কি চলে যাওয়ার পর কতটা তা বদলেছে। টাকা একেবারে নেই। বাপ বলে দিয়েছে টাকা দেবে না, তাঁর ধারও শুধবে না। দর্জি তাঁর নামে মামলা করতে চায়, অন্যেরাও সোজাসুজি ভয় দেখাচ্ছে মামলার। রেজিমেন্ট কমান্ডার জানিয়ে দিয়েছেন, কেলেঙ্কারিগুলো না থামালে ইস্তফা দিতে হবে কাজে। ব্যারনেস তাঁকে তিতিবিরক্ত করে তুলেছে, বিশেষ করে এই জন্য যে অনবরত তাঁকে টাকা দিতে চান। আরেকটি আছে, ভ্রন্স্কিকে দেখাবেন, অপরূপ, অনিন্দ্য, নিখুঁত পুরবিয়া ছাঁদ, ‘ক্রীতদাসী রেবেকার জাত, বুঝেছিস।’ বেরকশেভের সাথেও কাল একচোট গালাগালি হয়ে গেছে। ও ডুয়েলের জন্য দোসর পাঠাতে চেয়েছিল, তবে বুঝতেই পারছিস, কিছুই ও সব হবে না। মোটের ওপর সবই চমৎকার, ফুর্তিতে চলছে। এবং বন্ধুকে নিজের অবস্থার খুঁটিনাটিতে ঢুকতে না দিয়ে পেত্রিৎস্কি তাঁকে জানাতে লাগলেন আকর্ষণীয় সমস্ত খবর। নিজের তিন বছরের পুরনো অতি পরিচিত ফ্ল্যাটে পেত্রিৎস্কির অতি পরিচিত কাহিনীগুলো শুনতে শুনতে অভ্যস্ত ও নিশ্চিন্ত পিটার্সবুর্গী জীবনে ফিরে আসার একটা মনোরম অনুভূতি হল ভ্রন্স্কির।
‘বলিস কি!’ যে ওয়াশ-বেসিনে তিনি তাঁর লালচে সবল ঘাড়ে পানি ঢালছিলেন, তার পাদানি ছেড়ে দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘বলিস কি!’ চেঁচিয়ে উঠলেন এই খবর শুনে যে লোরা ফেটিসফকে ছেড়ে দিয়ে মিলেয়েভের সাথে জুটেছে। ‘ও সেই তেমনি বোকা আর খুশি হয়েই আছে? আর বুজুলুকভের খবর কি?’
‘আর বুজুলুকভের যা কাণ্ড, তোফা!’ চিৎকার করলেন পেত্রিৎস্কি, ‘ওর নেশা তো বলনাচ, দরবারের একটা আসরও সে বাদ দেয় না। এলাহি এক বলনাচে সে যায় নতুন হেলমেট পরে। নতুন হেলমেটগুলো দেখেছিস? অতি চমৎকার, হালকা। ও তো দাঁড়িয়েই আছে… আর শোন, শোন!
‘শুনছিই তো’, ফুঁয়ো-ফুঁয়ো তোয়ালেতে গা মুছতে মুছতে ভ্রন্স্কি বললেন।
‘কোন এক রাষ্ট্রদূতের সাথে গ্র্যান্ড ডাচেস এলেন, বেচারার কপাল খারাপ, ওঁদের কথাবার্তা চলছিল নতুন হেলমেট নিয়ে। গ্র্যান্ড ডাচেস ওঁকে নতুন হেলমেট দেখাতে চাইলেন… দেখেন, আমাদের শ্রীমানটি দাঁড়িয়ে আছে’ (পেত্রিৎস্কি দেখালেন কেমনভাবে সে দাঁড়িয়ে ছিল), ‘গ্র্যান্ড ডাচেস ওকে বললেন হেলমেটটা দিতে, ও কিন্তু দেয় না। ব্যাপার কি? সবাই ওর দিকে চোখ টেপে, মাথা নাড়ে, ভুরু কোঁচকায়। দাও হে! দেয় না। একেবারে নট নড়নচড়ন। ব্যাপার বোঝ। শুধু ঐ লোকটা রে…কি যেন নাম হেলমেটটা নিতে চায়। দেয় না!… তখন হেলমেট ছিনিয়ে নিয়ে সে দিল গ্র্যান্ড ডাচেসকে। উনি বললেন, ‘এই যে, এই হল গে নতুন।’ হেলমেট উলটিয়ে ধরলেন, আর ভাবতে পারিস, সেখান থেকে ঝুপ! পড়ল একটা নাশপাতি, বনবন, দু’পাউন্ড বনবন! শ্ৰীমান এগুলো মেরে দিয়েছিলেন!’
ভ্রন্স্কি হেসে একেবারে গড়াগড়ি। এবং তার অনেক পরেও বন্ধুর সাথে কথা বলার সময় হেলমেটের ঘটনাটা মনে পড়ে যেতে তিনি তাঁর শক্ত শ্রেণীবদ্ধ দাঁত বার করে হেসে উঠেছিলেন হো-হো করে।
সমস্ত খবর শোনার পর চাকরের সাহায্যে উর্দি পরে গেলেন দপ্তরে রিপোর্ট করতে। রিপোর্ট করে উনি ঠিক করলেন যাবেন ভাইয়ের কাছে, বেত্সির কাছে, এবং আরো কয়েকটা জায়গায় যাতে সেই সমাজে যাতায়াত শুরু করতে পারেন যেখানে কারেনিনার দেখা পাওয়া সম্ভব। পিটার্সবুর্গে থাকাকালীন সময়ে অন্যান্য বারের মতই বেশ রাত না হওয়া পর্যন্ত ফিরবেন না বলে তিনি বের হলেন।