প্রতিহিংসা আমার; আমিই তাহা শুধিব, বলিলেন সৃষ্টিকর্তা।
এক
সকল সুখী পরিবারের সুখের অনুভূতিগুলো একে অন্যের মত; প্রতিটা অ-সুখী পরিবারের অ-সুখের কারণগুলো নিজের নিজের ধরনে।
অবলোনস্কির পরিবারের সব কিছুই কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। তাঁর স্ত্রী জানতে পারলেন যে, বাড়ির পুরানো ফরাসি গৃহশিক্ষিকার সাথে স্বামীর অবৈধ সম্পর্ক ছিল। স্বামীকে তিনি জানিয়ে দিলেন যে, তার সাথে এক বাড়িতে বাস করতে আর পারবেন না। গত তিন দিন ধরে এরকম অবস্থা চলছে। খোদ দম্পতি এবং পরিবারের অন্যান্য লোক আর চাকর-বাকরদের কাছেও তা যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠেছে। পরিবারের সকল সদস্য এবং চাকর-বাকররা বুঝতে পারছিল যে, আর একসাথে থাকার কোন অর্থ হয় না। সরাইখানায় অকস্মাৎ মিলিত লোকদের মধ্যেও তাদের চেয়ে, অবলোনস্কি পরিবারের লোক আর চাকর-বাকরদের চেয়ে পারস্পরিক সম্পর্ক অনেক বেশি থাকে। স্ত্রী নিজের ঘর থেকে আর বেরোচ্ছেন না। স্বামী আজ তিন দিন বাড়িতে নেই। ছেলেমেয়েরা আশ্রয়হীনের মত সারা বাড়ি ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে; ইংরেজ মহিলাটি ঝগড়া বাঁধালেন ভাণ্ডারিনীর সাথে এবং অন্য কোন জায়গায় কাজ খুঁজে দেবার জন্য অনুরোধ জানিয়ে চিরকুট পাঠালেন বান্ধবীর কাছে। বাবুর্চি গতকালই দিবাহারের সময় বাড়ি ছেড়ে গেছে। রান্নাঘরের– পরিচারিকা আর কোচোয়ানও কাজ ছেড়ে দেবে বলে হুমকি দিয়েছে।
প্রিন্স স্তেপান আর্কাদিচ অবলোনস্কি সমাজে যাঁকে বন্ধু-বান্ধবরা ‘স্তিভা’ বলে ডাকে–ঝগড়া-বিবাদের পর তৃতীয় দিনে–যথাসময়ে অর্থাৎ সকাল আটটায় তার ঘুম ভাঙল স্ত্রীর শয়নকক্ষে নয়, নিজের কাজের ঘরে, মরক্কো চামড়ায় মোড়া একটা সোফায়। সোফার গদিতে পুরুষ্টু অসার দেহটা ঘুরিয়ে অন্য দিক থেকে সজোরে বালিশ আলিঙ্গন করে গাল ঠেকালেন তাতে; তারপর হঠাৎ লাফিয়ে উঠলেন, সোফায় বসে চোখ মেলে তাকালেন।
স্বপ্নের কথাটা মনে পড়ায় ভাবলেন, তাই তো, তাই তো, কি যেন হয়েছিল? হা, কি হয়েছিল? হ্যাঁ, আলাবিন একটা ভোজের আয়োজন করেছিল ডার্মস্টাটে, কিংবা হয়ত আমেরিকান কিছু। হ্যাঁ, ওই ডার্মস্টাক্ট ছিল আমেরিকায়। হু, আলাবিন ভোজ দিচ্ছিল কাঁচের টেবিলে। আর টেবিলগুলো ইতালীয় ভাষায় গান গাইছিল : আমার গুপ্তধন, আরে না, আমার গুপ্তধন নয়, তার চেয়েও ভালো, আর ছোট ছোট কেমন সব পানপাত্র, আর তারা সব নারী, তার মনে পড়ল।
অবলোনস্কির চোখ খুশিতে চকচক করে উঠল এবং হাসিমুখে তিনি বিভোর হয়ে রইলেন। ‘হ্যাঁ, ভীষণ জমেছিল। বেশ ভালো। আরো কত কি যে ছিল চমৎকার, কথায় তা বলা যায় না, জাগা অবস্থায় চিন্তাতেও তা ফোঁটানো যায় না।’ তারপর শাটিনের পর্দার পাশ দিয়ে এসে পড়া এক ফালি আলো দেখে সোফা থেকে পা বাড়িয়ে খুঁজলেন স্ত্রীর বানানো সোনালি মরক্কোর এম্ব্রয়ডারি করা জুতা (গত বছর জন্মদিনে তার জন্য উপহার) এবং না উঠে ন’বছরের অভ্যাসমত হাত বাড়ালেন যেখানে শয়নকক্ষে টাঙানো থাকত তার ড্রেসিং গাউন। আর তখন হঠাৎ তার মনে পড়ল– কেন তিনি তাঁর স্ত্রীর শয়নকক্ষে নয়, ঘুমাচ্ছেন নিজের কাজের ঘরে; এবার তার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। তিনি কপাল কুঁচকালেন এবং কি হয়েছিল তা মনে করে ককিয়ে উঠলেন, ‘উহ্, উহ্, উহ্! আহ!’ তার কল্পনায় আবার ভেসে উঠল : স্ত্রীর সাথে ঝগড়ার সমস্ত খুঁটিনাটি, তাঁর অবস্থার সমস্ত নিরুপায়তা আর সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক তাঁর নিজ অপরাধের কথা।
তিনি ভাবলেন, ‘না, ও ক্ষমা করবে না। ক্ষমা করতে পারে না। আর সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার, সব কিছুর জন্য আমার দোষ, আমার দোষ, কিন্তু আমি তো দোষী নই। আর সেটাই তো ট্রাজেডি। তাঁর পক্ষে এই ঝগড়ার সবচেয়ে কষ্টকর দিকগুলোর কথা ভেবে তিনি বলে উঠলেন, উহ্, উহ্, উহ্!’
সবচেয়ে বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার ঘটেছিল সেই প্রথম মুহূর্তটা, যখন তিনি হাসি-খুশি হয়ে স্ত্রীর জন্য প্রকাণ্ড একটা নাশপাতি হাতে থিয়েটার থেকে ফিরে স্ত্রীকে দেখতে পেলেন না ড্রয়িংরুমে। আশ্চর্য ব্যাপার, কাজের ঘরেও তার দেখা পাওয়া গেল না। শেষে তাকে শোবার ঘরে পেলেন। সব কিছু ফাঁস হয়ে-যাওয়া হতভাগা সেই চিরকুটটা তার হাতে।
সব সময়ই শশব্যস্ত, উদ্বিগ্ন এবং স্বামী যা ভাবতেন, বোকা-সোকা তার ডল্লি চিরকুট হাতে নিস্পন্দ হয়ে বসে। আছেন, এবং আতঙ্ক, হতাশা আর ক্রোধের দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালেন। চিরকুটটা দেখিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কি এটা? এটা?
আর অবলোনস্কিকে কষ্ট দিচ্ছিল এই স্মৃতিচারণায়। যা প্রায়ই হয়ে থাকে, আসল ঘটনাটা নয়, স্ত্রীর এই প্রশ্নে যেভাবে তিনি জবাব দিয়েছিলেন সেটা।
হঠাৎ করে যদি বড় বেশি লজ্জাকর কিছু-একটায় ধরা পড়ে যাওয়া লোকের ক্ষেত্রে যা ঘটে থাকে সে মুহূর্তে তার তাই ঘটেছিল। অপরাধ ফাঁস হয়ে যাবার পর স্ত্রীর সামনে যে অবস্থায় তিনি পড়েছিলেন, তার জন্য নিজেকে তৈরি করে তুলতে তিনি পারলেন না। অপমানিত বোধ করা, অস্বীকার করা, কৈফিয়ত দেওয়া, মার্জনা চাওয়া, এমন কি নির্বিকার থাকার বদলে তিনি যা করলেন তার তুলনায় এ সবই হত ভালো!–তাঁর মুখে একেবারে অনিচ্ছাকৃতভাবে (‘মস্তিষ্কের প্রতিবর্তী ক্রিয়া’, ভাবলেন অবলোনস্কি, যিনি শারীরবৃত্ত ভালোবাসতেন)–একেবারে অনিচ্ছায় হঠাৎ ফুটল তাঁর অভ্যস্ত, সদাশয় এবং সেই কারণেই বোকাটে হাসি।
এই বোকাটে হাসিটার জন্য তিনি নিজেকে ক্ষমা করতে পারেন না; সেই হাসি দেখে ডল্লি যেন শারীরিক যন্ত্রণায় কেঁপে উঠলেন। তারপর তার স্বাভাবিক উত্তপ্ততায় চোখা চোখা কথার বন্যা তুলে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে যান। তিনি সেই থেকে আর স্বামীকে দেখতে চাননি।
অবলোনস্কি ভাবলেন, ‘ওই বোকাটে হাসিটারই সকল দোষ।’ তিনি হতাশ হয়ে নিজেকেই বললেন, ‘কিন্তু কি করা যায়? কি করি?’ তবে এ কথার কোন উত্তর পেলেন না।
দুই
অবলোনস্কি নিজের প্রতি খুবই সত্যনিষ্ঠ মানুষ। তিনি তাঁর আচার-আচরণের জন্য অনুতপ্ত–এ কথা বলে তিনি নিজেকে ভোলাতে পারেন না। এখন তিনি অনুশোচনা করতে পারেন না যে তিনি, চৌত্রিশ বছরের সুদর্শন, প্রেমাকুল পুরুষ পাঁচটা জীবিত ও দুটো মৃত সন্তানের জননী, তার চেয়ে মাত্র এক বছরের ছোট তাঁর স্ত্রীকে ভালোবাসতেন না। তাঁর অনুশোচনা শুধু এজন্য যে, স্ত্রীর কাছ থেকে আরো ভালো করে তিনি লুকিয়ে থাকতে পারেননি। তবে তিনি নিজের অবস্থার গুরুত্ব সবই টের পাচ্ছিলেন। স্ত্রী, ছেলেমেয়ে এবং নিজের জন্য মায়া হচ্ছিল তার। খবরটা স্ত্রীর ওপর কেমন রেখাপাত করবে তা জানা থাকলে হয়ত তিনি তার অপরাধ আরো ভালো করে চাপা দিতে পারতেন। প্রশ্নটা নিয়ে তিনি কখনো পরিষ্কার করে ভাবেননি, কিন্তু ঝাপসাভাবে তার মনে হত যে, অনেকদিন থেকেই স্ত্রী আন্দাজ করেছেন যে তিনি তার প্রতি বিশ্বস্ত নন এবং সেটায় গুরুত্ব দেন না। তার এমন কি এও মনে হত যে শীর্ণা, বুড়িয়ে-আসা, ইতিমধ্যেই অসুন্দরী নারী, কোন দিক থেকেই যে উল্লেখযোগ্য নয়, সাধারণ, নিতান্ত সংসারের সহৃদয়া জননী; ন্যায়বোধে তার উচিত প্রশ্রয় দেওয়া। কিন্তু ঘটল তার উল্টোটা।
অবলোনস্কি বারবার নিজেকেই বললেন, ‘আহ্, ভয়ানক ব্যাপার! ইস্, ইস্, ইস্! ভয়ানক!’ কিন্তু কিছুই ভেবে উঠতে পারলেন না : ‘অথচ এর আগে পর্যন্ত সব কিছু কি ভালোই না ছিল! কি সুন্দর দিন কাটছিল আমাদের! উনি ছিলেন ছেলেমেয়েদের নিয়ে সুখী, সন্তুষ্ট, কোন কিছুতে ওঁর অসুবিধা ঘটাইনি আমি। উনি যা চাইতেন, ছেলেমেয়েদের নিয়ে, সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকার সুযোগ ওঁকে দিয়েছি। তবে ঐ মেয়েটা যে আমাদের গৃহশিক্ষকা ছিল, সেটা ভালো হয়নি। ভালো নয়! গৃহশিক্ষিকার প্রতি প্রেম নিবেদনে কেমন একটা তুচ্ছতা, মামুলিপনা আছে। কিন্তু কেমন গৃহশিক্ষিকা! (জীবন্ত হয়ে ওঁর মনে ভেসে উঠল মাদমোয়াজেল রোলার কালো চোখ আর মিষ্টি হাসি)। কিন্তু যতদিন সে আমাদের বাড়িতে ছিল ততদিন আমি নিজেকে কিছু করতে দিইনি। সবচেয়ে খারাপ এই যে, ও এখন…এসব যেন ইচ্ছে করেই! উহ্, উহ্, উহ্! কিন্তু কি করা যায় এখন?’
সকল জটিল অমীমাংসেয় প্রশ্নের যে সাধারণ উত্তর দেয় জীবন, তাছাড়া অন্য কোন উত্তর ছিল না। সেটা এই: দিনের চাহিদা মত বাঁচতে হবে, অর্থাৎ বিভোর হয়ে থাকতে হবে। স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকা চলে না, অন্তত রাত পর্যন্ত পানপাত্র নারীরা যে গান গেয়েছিল ফেরা যায় না তাতে; তাহলে জীবনের স্বপ্নেই বিভোর হয়ে থাকা উচিত।
অবলোনস্কি মনে মনে বললেন, তখন দেখা যাবে। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে, নীল রেশমি আস্তর দেওয়া ধূসর ড্রেসিং গাউন চাপিয়ে, থুপিতে বাঁধন দিয়ে, প্রশস্ত বুক ভরে নিঃশ্বাস টেনে খুশি হয়ে, তার পুরুষ্টু দেহ অত অনায়াসে বহন করে যে পদদ্বয়, তাতে তার অভ্যস্ত, উফুল্ল, পাক দেওয়া কদম বাড়িয়ে গেলেন জানালার কাছে। পর্দাটা সরিয়ে ঘণ্টি দিলেন। ঘণ্টি শুনেই তৎক্ষণাৎ ঘরে ঢুকল পুরানো বন্ধু, খাস চাকর মাতভেই, গাউন জুতা আর টেলিগ্রাম নিয়ে। মাতভেইয়ের পিছু পিছু ক্ষৌরকমের সাজসরঞ্জাম নিয়ে নাপিত এল।
অবলোনস্কি টেলিগ্রামটা নিয়ে আয়নার সামনে বসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘অফিস থেকে কাগজ আছে।’
মাতভেই জবাব দিল, ‘টেবিলে আছে।’ তারপর সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে সহমর্মিতায় মনিবের দিকে তাকিয়ে ধূর্ত হেসে যোগ করল, ‘ঘোড়া গাড়ির মালিকের কাছ থেকে লোক এসেছিল।’
অবলোনস্কি কোন জবাব না দিয়ে আয়নায় তাকালেন মাতভেইয়ের দিকে; আয়নায় যে দৃষ্টি বিনিময় হল, তাতে বোঝা যায় পরস্পরকে তারা কতটা বোঝে। অবলোনস্কির দৃষ্টি যেন বলছিল, এ কথা কেন বলছিস? তুই কি জানিস না?
মাতভেই তার জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে পা ফাঁক করে নীরবে, ভালো মনে, একটু-বা হেসে তাকিয়ে ছিল তার মনিবের দিকে।
সে বলল, ‘আমি বলেছিলাম ওই রবিবারে আসতে। এর মাঝখানে যেন আপনাকে আর নিজেকে মিছেমিছি বিরক্ত না করে।’ বোঝা যায় কথাটা আগে থেকেই তৈরি করা ছিল।
অবলোনস্কি বুঝলেন যে মাতভেই রসিকতা করতে, নিজের দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাইছে। টেলিগ্রামটা ছিঁড়ে বরাবরের মত ছিন্ন শব্দগুলো অনুমান করে সেটা তিনি পড়লেন, তাঁর মুখটা উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।
‘মাতভেই, বোন আন্না আর্কাদিয়েভনা কাল আসছে’, তিনি মিনিটখানেক নাপিতের চেকনাই মোটা হাতের দিকে না তাকিয়ে বললেন। কোঁকড়া দুই গালপাট্টার মাঝখানে সে হাত গোলাপি সেতু রচনা করছিল।
মাতভেই বলল, হায় আল্লাহ্! জবাবটায় সে বোঝাতে চাইল যে মনিবের মত সেও বোঝে এই আগমনের গুরুত্ব। অর্থাৎ অবলোনস্কির স্নেহের বোন আন্না আর্কাদিয়েভনা স্বামী-স্ত্রীর মিল করিয়ে দিতে সাহায্য করতে পারেন।
মাতভেই জিজ্ঞেস করল, ‘একা, নাকি স্বামীর সাথে?
অবলোনস্কি কোন কথা বলতে পারলেন না। কেননা নাপিত তখন তার ওপরের ঠোঁট নিয়ে ব্যস্ত। উনি একটা আঙুল তুললেন। আয়নায় মাথা নাড়ল মাতভেই।
‘বেশ। ওপর তলায় ব্যবস্থা করব?
দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনাকে বল, যেখানে বলবে সেখানে।
কেমন যেন সন্দিহান হয়ে পুনরুক্তি করল মাতভেই, দারিয়া আলেকসান্দ্রভনাকে?’
হ্যাঁ, ওঁকে বল। আর এই টেলিগ্রামটা নে, কি উনি বললেন–জানাস।
যাচাই করে দেখতে চাইছেন?’ মাতভেই বুঝল ব্যাপারটা। কিন্তু শুধু বলল, ‘জ্বি আচ্ছা।
মাতভেই যখন টেলিগ্রাম হাতে বুট জুতার কাঁচকেঁচে শব্দ তুলে ধীরে ধীরে পা ফেলে ঘরে ঢুকল, অবলোনস্কি ততক্ষণে বোয়া-পাকলা হয়ে চুল আঁচড়ে পোশাক পরার উপক্রম করছেন। নাপিত চলে গেছে।
দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা জানাতে বলেছেন যে, উনি চলে যাচ্ছেন। ওঁর, তার মানে আপনার যা খুশি তাই করুন, সে বলল শুধু চোখ দিয়ে হেসে, পকেটে হাত ঢুকিয়ে, ঘাড় কাত করে মনিবের দিকে তাকিয়ে।
অবলোনস্কি চুপ করে রইলেন। পরে সহৃদয় কিন্তু খানিকটা করুণ হাসি ফুটে উঠল তাঁর সুন্দর মুখে।
তিনি মাথা নেড়ে বললেন, ‘এ্যাঁ? মাতভেই?
মাতভেই বলল, ‘ও কিছু না, ঠিক হয়ে যাবে।’
‘ঠিক হয়ে যাবে?
‘জ্বি হ্যাঁ।
দরজার ওপাশে মেয়েলী পোশাকের খসখস শব্দ শুনে অবলোনস্কি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোর তাই মনে হচ্ছে? কে ওখানে?’
‘জ্বি, এটা আমি’, সাড়া এল দৃঢ় মোলায়েম নারীকণ্ঠে, দরজার বাইরে থেকে বসন্তের দাগ ধরা কঠোর মুখখানা বাড়ালেন আয়া মাত্রেনা ফিলিমনোভনা।
অবলোনস্কি দরজার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি হল, মাত্রেনা?’
অবলোনস্কি স্ত্রীর কাছে পুরোপুরি দোষী হলেও এবং নিজেও সেটা অনুভব করলেও বাড়ির সবাই, এমন কি দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনার প্রধান বান্ধবী আয়া পর্যন্ত তাঁর পক্ষে।
তিনি ক্লান্তভাবে জিজ্ঞেস করলেন, তা কি হল?
‘মিটিয়ে নিন, নয় দোষ স্বীকার করুন। সৃষ্টিকর্তা দেখবেন। খুবই যাতনা পাচ্ছেন, দেখতে কষ্ট লাগে। বাড়ির সব কিছুই একেবারে এলোমেলো। ছেলেমেয়েগুলোর জন্য একটু মায়া হওয়া উচিত। দোষ মেনে নিন। কি করা যাবে। ভালোবাসার দায় অনেক।
‘আমাকে তো নেবে না…’
‘আপনার যা যা করার করুন না। সৃষ্টিকর্তা অসীম দয়ালু, সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করুন! ক্ষমা চান!
অবলোনস্কি হঠাৎ লাল হয়ে উঠে বললেন, ‘ঠিক আছে, যাও এখন। মাতভেইয়ের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, যাক গে, পোশাক পরা যাক’, এবং দৃঢ় ভঙ্গিতে ছাড়লেন ড্রেসিং গাউনটা।
অদৃশ্য কি-একটা জিনিসকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিতে দিতে মাতভেই আগে থেকেই শার্টটা ধরে ছিল, সুস্পষ্ট তৃপ্তির সাথে মনিবের সযত্নমার্জিত শরীরে তা পরিয়ে দিল।
তিন
অবলোন্স্কি পোশাকটা পরার পর সেন্ট মেখে তার শার্টের হাতা ঠিক করে নিলেন এবং অভ্যস্ত ভঙ্গিতে সিগারেট, মানিব্যাগ, দেশলাই, দুটো চেন আর পেন্ডেন্ট লাগানো ঘড়ি পকেটে ঢোকালেন, তারপর রুমাল ঝাড়া দিয়ে নিজেকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, সুরভিত, সুস্থ আর নিজের দুর্ভাগ্যটা সত্ত্বেও শারীরিকভাবে উৎফুল্ল অনুভব করে দু’পা সামান্য নাচিয়ে নাচিয়ে ডাইনিং-রুমে ঢুকলেন। সেখানে তার জন্য ইতিমধ্যেই কফি প্রস্তুত আর কফির পাশে রয়েছে কয়েকটা চিঠি আর কর্মচারীদের দাখিলা। তিনি সেখান থেকে তুলে নিয়ে চিঠিগুলো পড়লেন। একটা চিঠি বড়ই অপ্রীতিকর, তার স্ত্রীর সম্পত্তির অন্তর্গত বন কিনছে যে বেনিয়া, সে লিখেছে। বনটা বিক্রি করা অত্যাবশ্যক ছিল; কিন্তু এখন, স্ত্রীর সাথে মিটমাট না-হওয়া পর্যন্ত সে কথাই ওঠে না। সবচেয়ে অপ্রীতিকর এই যে, এতে স্ত্রীর সাথে মিটমাটের ব্যাপারে আর্থিক স্বার্থ জড়িয়ে যাচ্ছে। এই স্বার্থে তিনি চালিত হতে পারেন, এই বিক্রির জন্য তিনি স্ত্রীর সাথে মিটমাট চাইবেন, এ ভাবনাটাই তার কাছে অপমানকর বলে মনে হল।
অবলোনস্কি চিঠি পড়া শেষ করে কর্মচারীদের দাখিলাগুলো টেনে নিলেন। দ্রুত পাতা উটিয়ে গেলেন দুটো মামলার, বড় একটা পেনৃসিলে কয়েকটা মন্তব্য টুকলেন, তারপর কাগজপত্রগুলো সরিয়ে শুরু করলেন কফি খেতে; কফির পর তিনি তখনো সোঁদা সোঁদা প্রভাতী কাগজ খুলে পড়তে লাগলেন।
যে সাহিত্যিক উদারনৈতিক সংবাদপত্রটি চরমপন্থী নয়, কিন্তু অধিকাংশই ছিল যার মতামতের পেছনে, অবলোনস্কি তা পেতেন এবং পড়তেন। বিজ্ঞান বা শিল্প বা রাজনীতি, কিছুতেই আসলে তার আগ্রহ না থাকলেও এসব ব্যাপারে অধিকাংশ লোকের এবং তার পত্রিকার যা মতামত তিনিও তাই পোষণ করতেন এবং সেটা পালটাতেন শুধু যখন অধিকাংশ লোক সেটা পালটাত, অথবা বলা ভালো, পালটাত না, নিজেরাই তাতে অলক্ষ্যে বদলে যেত।
অবলোনস্কি মতবাদ বা দৃষ্টিভঙ্গি বাছবিচার করে গ্রহণ করতেন না। এগুলো তার কাছে আসত আপনা থেকেই। ঠিক যেমন টুপির আকৃতি বা ফ্রক-কোট তিনি তাই বেছে নিতেন লোকে যা পরে। আর উঁচু সমাজে যিনি বাস করছেন, যেখানে কিছুটা মস্তিষ্কচালনা যা পরিপক্বতার কালে সাধারণত বিকশিত হয়ে ওঠে, সেখানে তার একটা দৃষ্টিভঙ্গি থাকা একটা টুপি থাকার মতই সমান প্রয়োজন। তাঁর মহলের অনেকেও রক্ষণশীল মতবাদ পোষণ করত, তার বদলে তিনি কেন উদারনৈতিক ধারা পছন্দ করলেন তার যদি কোন কারণ থেকে থাকে, তাহলে সেটা এই নয় যে উদারনৈতিক মতবাদ তাঁর কাছে বেশি যুক্তিযুক্ত বলে ঠেকেছিল, উদারনৈতিক ধারাটার মিল ছিল তাঁরই জীবনযাত্রার সাথে । উদারনৈতিক পার্টি বলত যে রাশিয়ায় সবই খারাপ এবং সত্যিই অবলোনস্কির ঋণ ছিল প্রচুর আর টাকায় একেবারে কুলাচ্ছিল না। উদারনৈতিক পার্টি বলত যে বিবাহ একটা অচল প্রথা, ওটাকে ঢেলে সাজা দরকার আর সত্যিই পারিবারিক জীবন অবলোনস্কিকে তৃপ্তি দিয়েছে কম, তাকে মিথ্যা কথা বলতে, ভান করতে বাধ্য করেছে যা তাঁর প্রকৃতিবিরুদ্ধ। উদারনৈতিক পার্টি বলত, অথবা বলা ভালো ধরে নিত যে ধর্ম হল কেবল অধিবাসীদের বর্বর অংশকে বলগায় টেনে রাখার ব্যাপার, এবং সত্যিই ছোট একটা প্রার্থনাতে অবলোনস্কির পা ব্যথা করে উঠত এবং তিনি বুঝতে পারতেন না কেন পরলোক নিয়ে ঐ সব ভয়াবহ, বড় বড় কথা, যখন ইহলোকেই দিন কাটানো এত আনন্দের। সেই সাথে হাসি-খুশি রসিকতার ভক্ত অবলোনস্কি নিরীহ কোন লোককে এই বলে ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়াতে আনন্দ পেতেন যে বংশ নিয়ে গর্ব যদি করতেই হয়, তাহলে রিউরিকেই থেকে গিয়ে প্রথম বংশপিতা বানরকে অস্বীকার করা অনুচিত। এভাবে উদারনৈতিক মতবাদ একটা অভ্যাস হয়ে ওঠে অবলোনস্কির কাছে এবং নিজের কাগজটিকে তিনি। ভালোবাসতেন আহারের পর একটা চুরুটের মত, মাথায় যে একটা হালকা কুয়াশা তাতে দেখা দিত, তার জন্য। সম্পাদকীয় প্রবন্ধটি পড়লেন, তাতে বলা হয়েছে যে আমাদের কালো খামোকাই এই বলে চিৎকার তোলা হচ্ছে যে র্যাডিকেলিজম বুঝি সমস্ত রক্ষণশীল উপাদানকে গ্রাস করে ফেলার বিপদস্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে, সরকারের নাকি উচিত বৈপ্লবিক সর্পদানবকে দমন করার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া, উলটে বরং আমাদের মতে বিপদটা সর্পদানবে নয়, সমস্ত প্রগতি রুদ্ধ করা সনাতনতার একগুয়েমিতে’, ইত্যাদি। অর্থ বিষয়ে আরেকটা প্রবন্ধ তিনি পড়লেন, যাতে বেন্থাম ও মিল-এর উল্লেখ করে খেচা দেওয়া হয়েছে মন্ত্রিদপ্তরকে। নিজের প্রকৃতিগত দ্রুত কল্পনাশক্তিতে প্রতিটি খেচার অর্থ তিনি বুঝতেন : কার কাছ থেকে, কার উদ্দেশে, কি উপলক্ষে এসব খোঁচা শাণিত আর বরাবরের মত এতে তিনি। খানিকটা তৃপ্তি পেতেন। কিন্তু আজ এ তৃপ্তি বিষিয়ে গেল মাত্রেনা ফিলিমনোভনার উপদেশে আর বাড়িটা যে কি অশান্তিকর হয়ে উঠেছে সে কথা মনে পড়ে গিয়ে। তিনি আরো পড়লেন যে শোনা যাচ্ছে কাউন্ট বেইস্ট ভিসবাডেনে গেছেন, সাদা চুল আর নেই, হালকা ঘোড়াগাড়ি বিক্রি হচ্ছে, তরুণ জনৈক ব্যক্তি কি প্রস্তাব দিয়েছে; কিন্তু এসব খবরে আগের মত মৃদু অন্তর্ভেদী আনন্দ আর পেলেন না।
পত্রিকা পড়া, দ্বিতীয় পাত্র কফি আর মাখন-লাগানো মিহি কুটি শেষ করে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। ওয়েস্ট-কোট থেকে ঝেড়ে ফেললেন রুটির গুড়ো। ঝেড়ে ফেলে চওড়া বুক টান করে আনন্দে হাসলেন। সেটা এজন্য নয় যে, অন্তর তাঁর বিশেষ প্রীতিকর কোন কিছুতে ভরে উঠেছিল; সানন্দ হাসিটা এসেছিল খাদ্যের উত্তম পরিপাক থেকে।
এই সানন্দ হাসিটা তাকে তৎক্ষণাৎ সব কিছু মনে পড়িয়ে দিয়েছিল এবং চিন্তায় ডুবে গেলেন তিনি।
দরজার ওপাশে শোনা গেল দুটো শিশু কণ্ঠ (অবলোনস্কি চিনতে পারলেন ছোট ছেলে গ্রিশা আর বড় মেয়ে তানিয়ার গলা)। কি-একটা তারা নিয়ে যাচ্ছিল, সেটা পড়ে গেল।
‘আমি যে তোকে বলেছিলাম ছাদে প্যাসেঞ্জার বসাতে নেই’, মেয়েটা ইংরেজিতে চেঁচিয়ে উঠল, ‘নে, এখন কুড়োয়
সব তালগোল পাকিয়েছে। শিশুরা ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে একা একা, ভাবলেন অবলোনস্কি। দরজার কাছে গিয়ে তিনি তাদের ডাকলেন। যে কাসকেটটা ট্রেন হয়েছিল, সেটাকে ফেলে দিয়ে তারা বাবার কাছে এল।
মেয়েটা বাবার প্রিয়পাত্রী। সোৎসাহে ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল। আর বরাবরের মতই খুশি হয়ে উঠল সেন্টের পরিচিত গন্ধে, যা ছড়িয়ে পড়ছিল তাঁর জুলপি থেকে। নুয়ে থাকার ফলে আরক্ত আর কমনীয়তায় জ্বলজ্বলে মুখে বাবাকে চুমু খেয়ে মেয়েটা আবার ছুটে যেতে চাইল; কিন্তু বাবা তাকে ধরে রাখলেন।
মায়ের কি হল?’ মেয়ের মসৃণ নরম গালে হাত বুলিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন। ছেলেটার দিকে তাকিয়ে হেসে তিনি তাকে স্বাগত জানালেন।
অবলোনস্কি জানতেন যে, ছেলেটাকে তিনি কম ভালবাসেন, সব সময় চেষ্টা করতেন সমান চোখে দেখতে; কিন্তু ছেলেটা তা টের পেত, বাবার নিষ্প্রাণ হাসির জবাব সে দিল না হাসি দিয়ে।
মেয়েটা জবাব দিল, মা? বিছানা ছেড়ে উঠেছেন।
অবলোনস্কি নিঃশ্বাস ছাড়লেন। ভাবলেন, তার মানে আবার ঘুমায়নি সারা রাত!
মেজাজ ভালো?
মেয়েটা জানত যে বাবা-মায়ের মধ্যে ঝগড়া হয়েছে। মা খুশি থাকতে পারছেন না, বাবার সেটা জানার কথা, কিন্তু বাবা ভান করে সে কথা জিজ্ঞেস করছেন অমন অনায়াসে। বাবার জন্য লজ্জায় সে লাল হয়ে উঠল। অবলোনস্কি
তখনই সেটা বুঝে নিজেও লাল হয়ে উঠলেন।
মেয়েটা বলল, কি জানি, মা পড়ায় বসতে বললেন না। বললেন আজ মিস হল-এর সাথে বেড়াতে যা নানীর কাছে।
‘তা যা-না, তানচুরোচকা (বিশেষ সাদরে বলা ‘তানিয়া’ নাম) আমার। ও হ্যাঁ, দাঁড়া’, মেয়েটাকে তখনো ধরে রেখে তার নরম হাতে হাত বুলোত বুলোতে তিনি বললেন।
তিনি গতকাল সন্ধ্যায় ফায়ার প্লেসের ওপর এক কৌটা মিষ্টি রেখেছিলেন। সেটা নিয়ে তা থেকে তার প্রিয় দুটো বনবন দিলেন মেয়েকে। একটায় চকোলেটের অন্যটায় পমেদকার প্রলেপ।
চকোলেটটা দেখিয়ে মেয়েটা জিজ্ঞেস করল, গ্রিশাকে।
হ্যাঁ। তারপর আরেকবার তার কাঁধে হাত বুলিয়ে চুলের গোড়ায় আর গালে চুমু খেয়ে ছেড়ে দিলেন তাকে।
মাতভেই বলল, গাড়ি তৈরি, তারপর যোগ করল, তাছাড়া উমেদারনিও।
অবলোনস্কি জিজ্ঞেস করলেন, ‘অনেকক্ষণ?
‘আধঘণ্টা থেকে।
কতবার না তোকে বলা হয়েছে যে তখনই খবর দিবি!
আপনাকে অন্তত কফি খেতেও তো দিতে হয়, মাতভেই বলল এমন একটা ভালোমানুষি রূঢ় গলায় যাতে রাগ করা চলে না।
‘নে, তাড়াতাড়ি ডেকে আন’, বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে বললেন অবলোনস্কি।
উমেদারনি স্টাফ-ক্যাপ্টেন কালিনিনের স্ত্রী। তিনি যা চাইলেন সেটা অসম্ভব ও অর্থহীন; কিন্তু তাঁর যা স্বভাব অবলোনস্কি বাধা না দিয়ে মন দিয়ে তার কথা শুনলেন এবং বিস্তারিত পরামর্শ দিলেন কার কাছে কিভাবে আবেদন করতে হবে, এমন কি নিজের বড় বড় দীর্ঘায়ত, সুন্দর এবং নিখুঁত হস্তাক্ষরে একটা চিরকুট লিখে দিলেন জনৈক ব্যক্তির কাছে যিনি তাকে সাহায্য করতে পারেন। স্টাফ-ক্যাপ্টেনের স্ত্রীকে বিদায় দিয়ে অবলোনস্কি টুপি তুলে নিলেন, তারপর থেমে গিয়ে মনে করার চেষ্টা করলেন কিছু ভুলে যাননি তো। দেখা গেল যেটা তিনি ভুলতে চাইছিলেন– স্ত্রীকে–সেটা ছাড়া কিছুই তিনি ভোলেননি।
‘হুঁ। মাথা নিচু করলেন তিনি, তাঁর সুন্দর মুখে ফুটে উঠল কষ্টের ছাপ। মনে মনে তিনি বললেন, যাব কি যাব না? আর ভেতরের একটা কণ্ঠস্বর তাঁকে বলছিল, যাবার দরকার নেই। মিথ্যাচার ছাড়া এক্ষেত্রে আর কিছুই হবার নয়। তাদের সম্পর্ক শোধরানো, ঠিকঠাক করে নেওয়া সম্ভব নয়। কেননা অসম্ভব আবার ওকে আকর্ষক উন্মাদক প্রেম দেওয়া অথবা নিজেকে ভালোবাসতে অক্ষম বৃদ্ধ করে তোলা। এখন অসত্য আর মিথ্যা ছাড়া কিছুই দাঁড়াবে না; কিন্তু অসত্য আর মিথ্যা তাঁর প্রকৃতিবিরুদ্ধ ছিল।
কিন্তু এক সময় তো ওটা দরকার; এটা যে এভাবেই থেকে যাবে সেটা তো হতে পারে না, নিজেকে সাহস দেবার চেষ্টা করে তিনি বললেন। বুক টান করলেন তিনি। সিগারেট ধরিয়ে দু’বার টান দিয়ে ছুঁড়ে ফেললেন ঝিনুকের ছাইদানিতে, দ্রুত পায়ে বিষণ্ণ ড্রয়িংরুম পেরিয়ে অন্য দরজাটা খুললেন–স্ত্রীর শয়নকক্ষে।
চার
দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা রাউজ পরে আছেন। এককালের ঘন সুন্দর চুল এখন পাতলা হয়ে এসেছে। মাথার পেছনে তার বিনুনি কাঁটা দিয়ে গোঁজা। ভয়ানক শুকিয়ে যাওয়া রোগা মুখে আর মুখের শীর্ণতার ফলে সুপ্রকট হয়ে ওঠা ভীত চোখে দাঁড়িয়ে ছিলেন ঘরময় ছড়ানো-ছিটানো জিনিসপত্রের মধ্যে খোলা শিফোনিয়েরকার সামনে, যা থেকে তিনি কি সব বাঁচাই করছিলেন। স্বামীর পদশব্দ শুনে তিনি থেমে গেলেন, দরজার দিকে তাকিয়ে তিনি বৃথাই চেষ্টা করলেন মুখে একটা কঠোর, ঘৃণাব্যঞ্জক ভাব ফুটিয়ে তুলতে। তিনি টের পাচ্ছিলেন যে, স্বামীকে তিনি ভয় পাচ্ছেন এবং ভয় পাচ্ছেন আসন্ন সাক্ষাৎ। এইমাত্র তিনি যার চেষ্টা করছিলেন, এই তিন দিনে সেটা তিনি করেছেন দশবার; ছেলেমেয়েদের এবং নিজের জিনিসপত্র বেছে তা নিয়ে চলে যাবেন মায়ের কাছে–এবং আবার মনস্থির করতে পারলেন না; কিন্তু আগের মত এখনো তিনি মনে মনে বলছিলেন, এটা এভাবেই থাকতে পারে না, কিছু-একটা তাকে করতে হবে, শাস্তি দিতে, কলঙ্কিত করতে হবে ওঁকে। স্বামী তাকে যে যাতনা দিয়েছে তার খানিকটার জন্যও অন্তত প্রতিহিংসা নিতে হবে। তিনি তখন বলছিলেন যে স্বামীকে ছেড়ে যাবেন, কিন্তু টের পাচ্ছিলেন যে সেটা অসম্ভব; ওঁকে স্বামী বলে ভাবায় এবং ভালোবাসায় অনভ্যস্ত হয়ে তিনি অক্ষম। তাছাড়া তিনি টের পাচ্ছিলেন, এখানে, নিজের বাড়িতেই যদি তাঁর পাঁচটি ছেলেমেয়ের দেখাশোনা করে ওঠা সহজ না হয়, তাহলে ওদের সবাইকে নিয়ে তিনি যেখানে যাবেন সেখানে তো আরো খারাপই দাঁড়াবে। আর এই তিন দিন ছোটটার জন্য তার কষ্ট হচ্ছিল কারণ ছোটটাকে খাওয়ানো হয়েছে বিছিরি বুলিয়ন আর বাকিগুলো তো কাল সন্ধ্যায় না খেয়েই ছিল। তিনি টের পাচ্ছিলেন যে চলে যাওয়া অসম্ভব; কিন্তু তাহলেও আত্মপ্রতারণা করে তিনি জিনিসপত্র বাছছিলেন, ভান করছিলেন যে চলে যাবেন।
স্বামীকে দেখে তিনি শিফোনিয়েরকার ড্রয়ারে হাত ঢোকালেন যেন কি খুঁজছেন আর তার দিকে তাকালেন শুধু যখন স্বামী এসে পড়লেন একেবারে কাছে। কিন্তু যে মুখখানায় তিনি একটা কঠোর, অনমনীয় ভাব ফোঁটাতে চেয়েছিলেন, তাতে ফুটল বিহ্বলতা আর যাতনা।
‘ডল্লি! স্বামী বললেন মৃদু, ভীরু ভীরু গলায়। মাথাটা তিনি কাঁধের দিকে খুঁজলেন, চেয়েছিলেন একটা করুণ বশংবদ চেহারা দাঁড় করাবেন, তাহলেও জ্বলজ্বল করছিলেন তাজা আমেজ আর স্বাস্থ্যে। ক্ষিপ্ৰ দৃষ্টিপাতে তার জ্বলজ্বলে সতেজ স্বাস্থ্যবান মূর্তিটা ডল্লি আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করলেন। হ্যাঁ, ও সুখী, সন্তুষ্ট! ভাবলেন তিনি, আর আমি…আর ওর এই সদয়তাটাও বিছিরি যার জন্য সবাই ভালোবাসে তাকে, প্রশংসা করে, দেখতে পারি না ওর এই সদয়তা, ভাবলেন তিনি। বিবর্ণ, স্নায়বিক মুখের ডান দিককার পেশী কেঁপে উঠে ওর ঠোঁট চেপে বসল।
কি চাই আপনার?’ বললেন তিনি নিজের স্বাভাবিক নয়, দ্রুত, জোরালো গলায়।
‘ডল্লি! কাঁপা কাঁপা গলায় পুনরুক্তি করলেন স্বামী, আন্না আজ আসছে।
‘তাতে আমার কি? আমি ওকে বরণ করতে পারব না!’ চেঁচিয়ে উঠলেন উনি।
‘কিন্তু করতে হয় যে, ডল্লি…’
‘চলে যান, চলে যান, চলে যান! চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি, যেন চিৎকারটা এল দৈহিক কোন যন্ত্রণা থেকে।
স্ত্রীর কথা মনে পড়ে শান্ত থাকতে পারতেন অবলোনস্কি, আশা করতে পারতেন যে মাততেইয়ের কথামত সব ঠিক হয়ে যাবে, এবং নিশ্চিন্তে কাগজ পড়তে আর কফি খেতে পারতেন; কিন্তু যখন তিনি দেখলেন স্ত্রীর যন্ত্রণাক্লিষ্ট, আর্ত মুখ, শুনলেন ভাগ্য ও হতাশার কাছে আত্মসমর্পিত এই কণ্ঠধ্বনি তখন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল তার, গলায় কি যেন দলা পাকিয়ে উঠল, অশ্রুতে চোখ চিকচিক করে উঠল।
‘হায় সৃষ্টিকর্তা! এ আমি কি করলাম! ডল্লি! সৃষ্টিকর্তার দোহাই!…এ যে…’ কথাটা তিনি শেষ করতে পারলেন না, গলায় দেখা দিল একটা ফোঁপানি।
স্ত্রী শিফোনিয়েরকার ড্রয়ার বন্ধ করে তাকালেন তার দিকে।
‘ডল্লি, কি আর বলব? শুধু একটা কথা; ক্ষমা কর আমাকে ক্ষমা কর…ভেবে দেখো, নয় বছরের জীবনে কি এক মিনিট, এক মিনিটের খণ্ডন হয় না…’
চোখ নিচু করে স্ত্রী শুনে গেলেন, যেন অনুনয় করছিলেন স্বামী কোনরকমে তার সন্দেহ নিরসন করুক।
স্বামী বললেন, ‘এক মিনিটের মোহ…’ এবং আরো বলে যেতে চাইছিলেন, কিন্তু এই কথাটাতেই যেন শারীরিক যন্ত্রণায় আবার চেপে বসল স্ত্রীর ঠোঁট, আবার মুখের ডান দিকে কেঁপে উঠল গালের পেশী।
‘চলে যান, চলে যান এখান থেকে!’ আরো তীক্ষ্ণ স্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি, আপনার মোহ আর জঘন্যতার কথা আমাকে বলতে আসবেন না!
চলে যেতে চাইছিলেন তিনি, কিন্তু শরীর দুলে উঠল, ভর দেবার জন্য চেয়ারের পিঠটা ধরলেন। স্বামীর মুখ স্ফীত হয়ে উঠল, ফুলে উঠল ঠোঁট, অশ্রুতে সজল হয়ে উঠল চোখ।
‘ডল্লি!’ ফুঁপিয়ে বললেন তিনি, সৃষ্টিকর্তার দোহাই, ছেলেমেয়েদের কথা ভাবো। ওদের তো দোষ নেই, দোষী আমি, আমাকে শাস্তি দাও, সে দোষ স্থালন করতে বলে। আমি যতটা পারি, সব কিছুর জন্য আমি তৈরি! আমি দোষী, কতটা যে দোষী বলার নয়। কিন্তু ডল্লি, ক্ষমা কর।
স্ত্রী বসলেন। ওঁর গুরুভার, সজোর নিঃশ্বাসের শব্দ কানে আসছিল স্বামীর, স্ত্রীর জন্য অবর্ণনীয় মায়া হল তার। স্ত্রী কয়েকবার কথা বলার চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেন না। স্বামী অপেক্ষা করে রইলেন।
‘ছেলেমেয়েদের কথা তুমি ভাবছ ওদের সাথে খেলা করার জন্য, আর আমি ভাবছি আর জানি যে ওরা এবার মারা পড়ল’, বললেন স্ত্রী, বোঝা যায় এ তিন দিন একাধিক বার যেসব কথা তিনি মনে মনে বলেছেন, এটা তার একটা।
উনি বললেন, ‘তুমি’, এতে স্বামী কৃতার্থে মত চাইলেন ওঁর দিকে, এগিয়ে গেলেন ওঁর হাতটা ধরতে, কিন্তু উনি ঘৃণাভরে সরে গেলেন।
‘ছেলেমেয়েদের কথা আমার মনে হচ্ছে, তাই ওদের বাঁচাবার জন্য দুনিয়ায় সব কিছু করতে পারতাম; কিন্তু আমি নিজেই জানি না কি করে বাঁচাই; বাবার কাছ থেকে ওদের নিয়ে গিয়ে কি, নাকি ব্যভিচারী বাপের কাছে রেখে যেয়ে হ্যাঁ, ব্যভিচারী বাপ…বলুন তো, যা… ঘটেছে তার পরে কি আমাদের একসাথে থাকা সম্ভব? সে কি সম্ভব? বলুন-না, সে কি সম্ভব? গলা চড়িয়ে আবার বললেন তিনি, আমার স্বামী, আমার ছেলেমেয়েদের বাবা নিজের ছেলেমেয়েদের গভর্নেসের সাথে প্রেম সম্পর্কে যানার পর…’
‘কিন্তু কি করা যায়? কি করা যায়? স্বামী বললেন করুণ স্বরে, নিজেই জানতেন না কি বলছেন, ক্রমেই নুয়ে এল তার মাথা।
‘আমার কাছে আপনি একটা নচ্ছার লোক, ন্যক্কারজনক!’ ক্রমেই উত্তেজিত হয়ে চেঁচালেন স্ত্রী, আপনার কান্না নেহাৎ পানি! কখনো আমাকে ভালোবাসেননি আপনি; আপনার হৃদয়ও নেই, উদারতাও নেই! আমার কাছে আপনি একটা নচ্ছার, নীচ, বাইরের লোক, হ্যাঁ, একেবারে বাইরের লোক! এই ভয়ঙ্কর বাইরের লোক’ কথাটা উনি উচ্চারণ করলেন যন্ত্রণায় আর আক্রোশে।
অবলোনস্কি স্ত্রীর দিকে তাকালেন আর তাঁর মুখে ফুঠে ওঠা আক্রোশ তাঁকে ভীত ও বিস্মিত করল। উনি বোঝেননি যে ওঁর মায়াটার স্ত্রীর পিত্তি জ্বলে গেছে। এতে তিনি দেখছেন অনুকম্পা, প্রেম নয়। আমাকে ও ঘৃণা করে। ক্ষমা করবে না, ভাবলেন স্বামী।
তিনি বললেন, কি ভয়ঙ্কর! ভয়ঙ্কর!
এই সময় অন্য ঘরে, সম্ভবত পড়ে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠল শিশু; দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা কান পেতে শুনলেন, মুখখানা তার হঠাৎ নরম হয়ে এল। বোঝা যায় কয়েক সেকেন্ড লাগল তার চেতনা ফিরতে, যেন বুঝতে পারছিলেন না কোথায় তিনি আছেন, কি তাকে করতে হবে, তারপর দ্রুত উঠে গেলেন দরজার দিকে।
‘আমার ছেলেটাকে ও যে ভালোবাসে, শিশুর চিৎকারে ওঁর মুখের ভাব পরিবর্তন লক্ষ্য করে স্বামী ভাবলেন, : ‘আমার ছেলে; কি করে সে ঘৃণা করতে পারে আমাকে?
তিনি স্ত্রীর পিছু পিছু গিয়ে বললেন, ‘ডল্লি, আরো একটা কথা।’
‘আপনি যদি আমার পেছন পেছন আসেন, তাহলে আমি লোকদের, ছেলেমেয়েদের ডাকব! সবাই জানুক যে আপনি একটা বদমায়েস। আজ আমি চলে যাব আর আপনি এখানে থাকবেন আপনার প্রণয়িনীর সাথে!
দড়াম করে দরজা বন্ধ করে উনি বেরিয়ে গেলেন।
অবলোনস্কি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, মুখ মুছলেন, মৃদু পায়ে গেলেন ঘর বরাবর। মাতভেই বলছে ঠিক হয়ে যাবে; কিন্তু কেমন করে? এমন কি তার লক্ষণও আমি দেখছি না। উহ্, কি ভয়ংকর! আর কি হেঁদোভাবেই না চেঁচাল, চিৎকার আর বদমায়েশ ও প্রণয়িনী কথা দুটো স্মরণ করে মনে মনে ভাবলেন তিনি, হয়ত-বা মেয়েগুলোর কানে গেছে! সাংঘাতিক, ছেঁদো, সাংঘাতিক!’ কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে রইলেন অবলোনস্কি, চোখ মুছলেন, তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে, বুক টান করে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।
দিনটা শুক্রবার, ডাইনিংরুমে জার্মান ঘড়ি-বরদার দম দিচ্ছিল ঘড়িতে। এই টেকো জার্মান ঘড়ি-বরদার সম্পর্কে নিজের রসিকতাটা মনে পড়ল তাঁর : ঘড়িতে দম দেওয়ার জন্য জার্মানটিকেই দম দেওয়া হয়েছে সারা জীবনের জন্য, মুখে হাসি ফুটল। ভালো ভালো রসিকতা অবলোনস্কি ভালোবাসতেন। আর হয়ত ঠিক হয়েই যাবে! ঠিক হয়ে যাবে–বেশ কথাটি’, ভাবলেন তিনি, তা বলতেই হবে।’
মাতভেই! হাঁক দিলেন তিনি। মাতভেই আসতে বললেন, তাহলে আন্না আর্কাদিয়েভনার জন্য সোফার ঘরে সব গোছগাছ করে রাখ।
‘জ্বি আচ্ছা।’
অবলোনস্কি তার কোট চাপিয়ে গাড়ি বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন।
মাতভেই তাকে এগিয়ে দিতে এসে জিজ্ঞেস করল, বাড়িতে যাবেন না?’
‘যেমন দাঁড়াবে। হ্যাঁ, এই নে খরচার জন্য, মানিব্যাগ থেকে বের করে দশ রুল ওকে দিয়ে বললেন তিনি। ‘এতে হবে তো?
‘হোক না-হোক, দেখা যাবে, চালিয়ে নিতে হবে, এই বলে গাড়ির দরজা বন্ধ করে মাতভেই গাড়ি বারান্দায় উঠে এল।
ইতিমধ্যে ছেলেটাকে শান্ত করে গাড়ির শব্দে দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা বুঝলেন যে উনি চলে গেলেন। আবার নিজের শোবার ঘরে ফিরলেন তিনি। বেরোতেই যেসব সাংসারিক ঝামেলা হাজির হত, তা থেকে এটাই ছিল তাঁর একমাত্র আশ্রয়। এমন কি এখনো, অল্প সময়ের জন্য যখন তিনি শিশুদের ঘরে গিয়েছিলেন, ইংরেজ মহিলাটি আর মাত্রেনা ফিলিমনোভনা তার ভেতর এমন কিছু ব্যাপার তাঁকে জিজ্ঞেস করে ওঠার ফুরসত করে নিলেন যা মুলতবি রাখা যায় না এবং একমাত্র তিনি যার উত্তর দিতে পারেন : বেড়াতে নিয়ে যাবার জন্য বাচ্চাদের কি পোশাক পরানো হবে? দুধ খেতে দেব কি? অন্য একটা বাবুর্চি ডাকলে হয় না?
‘আহ, আমাকে রেহাই দাও, রেহাই দাও!’ এই বলে তিনি ফিরলেন শোবার ঘরে। স্বামীর সাথে যেখানে বসে কথা কয়েছিলেন আবার বসলেন সেই চেয়ারেই, অস্থিল আঙুল থেকে খসে পড়ো-পড়া কয়েকটা আংটি সমেত হাত জড়ো করে মনে করতে লাগলেন ভূতপূর্ব কথাবার্তাটা। চলে গেল! কিন্তু তার সাথে দেখা করবে? কেন জিজ্ঞেস করলাম না ওকে? না-না, মিলন চলে না। আমরা যদি এক বাড়িতেও থাকি, তাহলেও আমরা হব বাইরের লোক। বরাবরের মত বাইরের লোক!’ তার কাছে ভয়ংকর এই কথাটায় বিশেষ অর্থ দিয়ে তিনি আবার পুনরাবৃত্তি করলেন, ‘আর কি ভালোই না তাকে বেসেছিলাম, ভালোবেসেছিলাম…সৃষ্টিকর্তা, কি ভালোই না বেসেছিলাম। আর এখন কি ওকে ভালোবাসি না? আগের চেয়ে বেশি ভালোবাসি না কি? কিন্তু সবচেয়ে যেটা ভয়ংকর…’ নিজের চিন্তা শুরু করলেও সেটা শেষ হল না, কেননা মাত্রেনা ফিলিমনোভনা ঢুকল দরজা দিয়ে।
বলল, আমার ভাইকে ডেকে আনার হুকুম দিন। সে খাবার রান্না করে দেবে। না হলে গতকালের মত ছেলেমেয়েরা না খেয়ে থাকবে।’
‘ঠিক আছে, আমি এখনই বেরিয়ে সব দেখছি। হ্যাঁ, টাটকা দুধের জন্য লোক পাঠানো হয়েছে?
এবং ডলি সংসারের নানা কাজে ডুবে গিয়ে তাতে নিজের দুঃখ সাময়িকভাবে ভুলে গেলেন।