আনোয়ারা – প্রথম পর্ব

আনোয়ারা – প্রথম পর্ব

প্রথম পরিচ্ছেদ

ভাদ্রমাসের ভোরবেলা। স্বর্গের ঊষা মর্ত্যে নামিয়া ঘরে ঘরে শান্তি বিলাইতেছে; তাহার অমিয় কিরণে মেদিনী-গগন হেমাভ বর্ণে রঞ্জিত হইয়াছে। উত্তর বঙ্গের নিম্ন সমতল গ্রামগুলি সোনার জলে ভাসিতেছে; কর্মজগতে জাগরণের সাড়া পড়িয়াছে; ছোট বড় মহাজনী নৌকাগুলি ধবল-পাখা বিস্তার করিয়া গন্তব্য পথে ঊষা যাত্রা করিয়াছে; পাখিকুল সুমধুর স্বরলহরী তুলিয়া জগৎপতির মঙ্গল গানে তান ধরিয়াছে; ধর্মশীল মুসলমানগণ প্রাভাতিক নামাজ অন্তে মসজিদ হইতে গৃহে ফিরিতেছেন, হিন্দু-পল্লীর শঙ্খ-ঘণ্টার রোল থামিয়া গিয়াছে।

এই সময় মধুপুর গ্রামের একটি চতুর্দশবর্ষীয়া বালিকা তাহাদের খিড়কী-দ্বারে বসিয়া বন্যার জলে ওজু করিতেছিল। তাহার মুখ, হস্তদ্বয়ের অর্ধ ও পদদ্বয়ের গুল্ফমাত্র অনাবৃত এবং সমস্ত দেহ কাল ইঞ্চিপেড়ে ধুতি কাপড়ে আবৃত। গায়ে লালফুলের কাল ডোরাছিটের কোর্তা। দুই হাতে ছয় গাছি চুড়ি। অযত্ন বিন্যস্ত সুদীর্ঘ কেশরাশি আল্ল্গাভাবে খোপা বাঁধা; বালিকার মুখমণ্ডল বিষাদে ভরা!

বালিকা যে স্থানে বসিয়া ওজু করিতেছিল, তাহার সম্মুখ দিয়া উত্তর-দক্ষিণে লম্বা অনতিবিস্তৃত খাল, দক্ষিণমুখে ঢালু বারিরাশি দুকূল প্লাবিত করিয়া স্রোত-বেগে প্রবাহিত হইতেছে। পূর্বপারে একখানি পাসী নৌকা পাট ক্রয়ের নিমিত্ত উত্তর-দক্ষিণ মুখে লাগান রহিয়াছে। একজন যুবক সেই নৌকার ছৈ-মধ্যে বসিয়া স্বাভাবিক মধুর কণ্ঠে কোরান শরীফ পাঠ করিতেছেন। নৌকায় তিনজন মাঝি, একজন যাচনদার, একটি পাচক ও যুবক স্বয়ং ছিলেন। যুবকের আদেশে যাচনদার মাঝিগণ সহ পাটের সন্ধানে ভোরেই পাড়ার উপর নামিয়া পড়িয়াছে।

যুবক নৌকায় বসিয়া কোরান পাঠ করিতেছেন। যুবকের দেহের বর্ণ ও গঠন সুন্দর; নবোদ্ভিন্ন ঘনকৃষ্ণ-গুম্ফ-শ্মশ্রু তাঁহার স্বাভাবিক সৌন্দর্য আরও বাড়াইয়া তুলিয়াছে। যুবকের বয়স ত্রয়োবিংশ বৎসর। মাথায় রুমীটুপী, গায়ে সাদাশার্ট ও পরিধানে রেঙ্গুনের লুঙ্গী। এই সাধারণ পরিচ্ছদেও তাহাকে কোন আমিরের বংশধর বলিয়া মনে হইতেছে।

বালিকা ওজু করিতেছে; কিন্তু সদ্য-ঘটনা-পরম্পরার যুগপৎ ঘাত-প্রতিঘাতে তরঙ্গায়িত হৃদয়ের ভাব যেন তাহার মুখে ক্রীড়া করিতেছে। আবার এই অবস্থায়ও গাঢ় অন্ধকারময় রজনীতে নিবিড় জলদ-জাল-মধ্যবর্তী ক্ষণপ্রভা বিকাশবৎ আশার একটি ক্ষীণোজ্জ্বলরেখা বালিকাকে যেন কোন্ এক সুধাময় শান্তি-রাজ্যের পথ দেখাইয়া দিতেছে।

বালিকা নৌকার উপর কোরান শরীফ পাঠ শুনিয়া মস্তকোত্তোলন করিল। সে মায়ের মুখে শুনিয়াছিল কোরানের মত উত্তম জিনিস আর কিছুই নাই, উহা যে পড়ে বা শুনে তাহার জন্য বেহেস্তের দ্বার উন্মুক্ত। বালিকার দাদিমাও সদা সর্বদা বলেন, কোরান শরীফ-রূপ শরাবন তহুরা পাঠে ও শ্রবণে মানুষের অন্তর্নিহিত অশান্তি-আগুন নিভিয়া যায়। বালিকা জননী ও দাদিমার উপদেশ হৃদয়ে গাঁথিয়া রাখিয়াছে। সে প্রতিদিন প্রাতে কোরান শরীফ পাঠ করে; আজও তজ্জন্য ওজু করিতে বসিয়াছে। কিন্তু নৌকার মধুবর্ষী স্বরে কোরান পাঠ বালিকাকে আত্মহারা করিয়া তুলিল। সে ওজু ভুলিয়া গিয়া অনন্যচিত্তে কোরান শরীফ পাঠ শুনিতে লাগিল।

যুবক কোরান পাঠ শেষ করিয়া দুইহাত তুলিয়া নির্মীলিত-নেত্রে মোনাজাত করিতে লাগিলেন——

“দয়াময়! তোমার পবিত্র নামে আরম্ভ করিতেছি। সমস্ত প্রশংসা তোমার। তুমি অনাদি, অনন্ত, সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান। তুমি ধৈর্য্য ও ক্ষমার আধার, তুমি অসীম করুণার উৎস। তুমি কোটি বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা ও ত্রাতা। সন্তান জন্মিবার পূর্বেই তোমার দয়ায় মায়ের বুকে তাহার আহারের বন্দোবস্ত হইতেছে। করুণাময়! অগাধ সাগরের তলে, কঠিন পাথরের মধ্যে থাকিয়াও অতি ক্ষুদ্রকীটসকল তোমার কৃপায় আহার পাইয়া সানন্দে বিহার করিতেছে। তাই বলিতেছি, হে প্রভো! তোমা অপেক্ষা আর বড় কে? তোমার চেয়ে আর দয়ালু কে? বিভো! তুমি যে কি তাহা তুমিই জান, তোমাকে জানে বা বুঝে, তোমার অনন্ত বিশ্বে এমন কে আছে? তা নাথ! তুমি যত বড়—যেমনটি হও না কেন, আমাকে তুমি অবহেলা করিতে পার না, আমি তোমার আঠার হাজার আলমের শ্রেষ্ঠতম জীবমধ্যে একজন। আমার গ্রাসাচ্ছাদন তোমাকে যোগাইতে হইবে। আমার আকাঙ্খার বিষয়ও তোমাকে শুনিতে হইবে।

‘দীননাথ। দীনের প্রার্থনা, আমাদের ভব-সমুদ্রের কাণ্ডারী হযরত মোহাম্মদ (দঃ) যিনি তোমারই একত্বের পূর্ণপ্রচারক এবং তাঁহার বংশধর মহাপুরুষেরা সমস্ত মানবজাতির জ্ঞানবর্তিকা। অতএব, সর্বাগ্রে তাহাদের পবিত্র আত্মার উপরে তোমার শুভাশীর্বাদ বর্ষিত হউক। সমস্ত মুসলমান নর-নারীর সুখ-শান্তির নিমিত্ত তোমার বরকতের দ্বার উন্মুক্ত করিয়া দাও। তোমার দাসগণ ঈমান-ধন হারাইয়া দ্রুতবেগে ধ্বংসের পথে যাইতেছে, তুমি দয়া করিয়া তাহাদিগকে রক্ষা কর। নিজ গুণে ক্ষমা করিয়া তাহাদিগকে গুণবাণ কর। ভ্রাতৃভাবে প্রীতির পবিত্র সূত্রে সমস্ত মানব জাতিকে ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ হইতে মতি দাও, স্বর্গীয় শোভায় মর্ত্য উদ্ভাসিত হউক।

অনাথনাথ! কৈশোরে মাতৃস্নেহে বঞ্চিত হইয়াছি, এই যৌবনে পিতৃশোকে সংসার অন্ধকার দেখিতেছি। প্রভো! তুমি সকলই জান, দাস অকৃতদার, যদি গোলামকে সংসারী কর, তবে যেন প্রেমের পথে তোমাকে লাভ করিতে পারি। আমিন।”

যুবক বহির্জগৎ ভুলিয়া একাগ্রমনে মোনাজাত করিতেছিলেন। তন্ময়চিত্ততায় তাহার পবিত্র হৃদয়োদ্ভূত ভক্তিবারি নয়নপ্রান্তে বহিয়া গণ্ডস্থল প্লাবিত করিতেছিল।

বালিকা কোরান শরীফ, মোহুলজান্নাত, রাহেনাজাত, পান্দেনামা, গোলেস্তাঁ প্রভৃতি আরবী, পারসিও উর্দু কেতাব তাহার দাদিমার নিকট শিক্ষা করিতেছিল। মোনাজাত আরবি মিশ্রিত উর্দুতে উচ্চারিত হইতেছিল, সুতরাং সে তাহার অর্থ অনেকাংশে বুঝিতে পারিতেছিল। বুঝিয়া শুনিয়া বালিকার চক্ষুও অশ্রুপূর্ণ হইয়া উঠিল। সে অসহ্য মনোবেদনা ভুলিয়া চিন্তা করিতে লাগিল, “আহা আজ কি শুনিলাম। এমন খোএল্হানে কোরান শরীফ পাঠ ত’ কখনও শুনি নাই, এমন মধুর উচ্চারণও ত’ কখনও শ্রুতিগোচর হয় নাই। কি মধুমাখা মোনাজাত। এমন মধুমাখা সুন্দর মোনাজাত ত’ কখনও শুনি নাই। বুঝি বা কোন ফেরেস্তা মানবমূর্তি পরিগ্রহ করিয়া মধুপুরে আসিয়াছেন, নচেৎ এমন বিশ্বপ্রেমভরা মোনাজাত কি মানবমুখে উচ্চারিত হইতে পারে? মোনাজাতে যেন হৃদয়ের ভাব ফুটিয়া বাহির হইয়াছে।” এইরূপ ভাবিতে ভাবিতে যখন, “দাস অকৃতদার, যদি গোলামকে সংসারী কর, তবে যেন প্রেমের পথে তোমাকে লাভ করিতে পারি।”— যুবকের মোনাজাতের এই শেষ কথা কয়টি বালিকার কর্ণে প্রবেশ করিল, তখন সহসা অলক্ষিতে তাহার গোলাপ-গ রক্তিমাভ হইয়া উঠিল, স্বেদ-বারিবিন্দু মুখমণ্ডলে ফুটিয়া বাহির হইতে লাগিল। পাঠক, সোনার গাছে মুক্তাফল বুঝি এইরূপেই ফলে। বালিকা এক্ষণি সেই দূর ভবিষ্যৎ আশার আলোকে আপনাকে ডুবাইয়া দিয়া অস্ফুটস্বরে বলিয়া উঠিল, “তবে ইনিই কি—তিনি?”

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

যুবক মোনাজাত অন্তে পশ্চাৎ ফিরিয়া সযত্নে যুজদানে কোরান শরীফ বন্ধ করিয়া যথাস্থানে রাখিতে নৌকার ভিতরের দিকে আরো সরিয়া গেলেন। বালিকার প্রতি তাহার দৃষ্টি পড়িল না। আত্মহারা বালিকাও তাহাকে দেখিতে পাইল না। এই সময় বালিকার পশ্চাদ্দিক হইতে—”সই তুমি এখানে?” বলিয়া আর একটি বালিকা প্রথমা বালিকার দক্ষিণ পার্শ্বে আসিয়া বসিল। আগন্তুক বালিকার বয়স প্রথমা বালিকা অপেক্ষা দুই বৎসরের বেশি হইবে। পরিধানে সাদা সেমিজের উপর নীলাম্বরী শাড়ী, হাতে সোনার বালা, করাঙ্গুলিতে প্রেমের নিদর্শন স্বর্ণাঙ্গুরী। সুতরাং অলঙ্কার পরিচ্ছদের তুলনায় প্রথমাটিকে দ্বিতীয়াটির সহিত তুলনা সম্ভবেনা কিন্তু দেহের বর্ণ ও গঠন বদল করিলে কাহারও ক্ষতি হইবে বলিয়া বোধ হয় না।

সখিত্ব-সম্বন্ধে উভয়ের মনের বিনিময় পূর্বেই হইয়া গিয়াছে। ‘সই’ শব্দ শুনিয়া যুবক নৌকার ভিতর থাকিয়া একটি ক্ষুদ্র জানালার ছিদ্রপথ দিয়া একটু তাকাইলেন। দেখিলেন, দুইটি জীবন্ত-কুসুম পশ্চিম পাড়ে খিড়কীর দ্বারা আলো করিয়া বসিয়া আছে। প্রথমটি বিকাশোন্মুখ গোলাপ, দ্বিতীয়টি পূর্ণবিকশিত শতদলস্বরূপ। ‘সই’ শব্দে প্রথমা বালিকার সুখের ধ্যান ভাঙ্গিয়া গেল। সঙ্গে সঙ্গে পূর্বকথিত যাতনার চিহ্ন তাহার মুখে ফুটিয়া উঠিল সে দ্বিতীয়া বালিকার দিকে মুখ ফিরাইয়া বসিল। দ্বিতীয়া বালিকা তাহার মুখের দিকে চাহিয়া সবিস্ময় দুঃখে কহিল, “সই, তোমার মুখের চেহারা এরূপ হইয়াছে কেন? এমন ত’ কখনও দেখি নাই? রাত্রে কি ঘুমাও নাই?” প্রথম বালিকা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া কহিল, “গত রাত্রে মা আবার অকথ্য ভাষায় গালি দিয়াছে, তাই জীবনের প্রতি ঘৃণা জন্মিয়াছে; সই, আর বরদাস্ত হয় না।” বলিতে বলিতে কথিকার চক্ষু অশ্রুপূর্ণ হইয়া উঠিল।

দ্বি-বা। কেন গালি দিয়াছিল?

প্র-বা। মগরেবের বাদ হজরতের জীবনচরিত পড়িতেছিলাম, তাই রান্নাঘরে যাইয়া ভাত খাইতে বিলম্ব হইয়াছিল।

দ্বিতীয় বালিকা বুদ্ধিমতী ও চতুরা। শিক্ষিত স্বামীসহবাসে, সংসারের অনেক বিষয়ে জ্ঞানলাভ করিয়াছে। সে একটু চিন্তা করিয়া কহিল, ‘সই, তোমার মা ত’ দিনরাতই তোমাকে তিরস্কার করে, তাহাতে তোমাকে কেবল কাঁদিতে দেখি, কিন্তু তোমার চোখ-মুখের এমন অবস্থা ত’ কখনও দেখি নাই। অবশ্যই তোমার মনের কোন বিশেষ ভাবান্তর ঘটিয়াছে? প্রথম বালিকার বিষাদপূর্ণ মুখে একটু বিজলীর আভা স্কুরিল, কিন্তু মুখ ফুটিল না। দ্বিতীয় বালিকা নৌকার দিকে চাহিয়া কহিল, “ওপারে একখানি সুন্দর ছৈ ঘেরা পাসী নৌকা দেখিতেছি, কোথা হইতে আসিয়াছে?” প্রথমা বালিকা সরল মনে কহিল, “জানি না, কিন্তু ঐ, নৌকার ভিতরে কে যেন কোরান শরীফ পড়িতেছিলেন, এমন সুমধুর রবে কোরান শরীফ পড়া আর কখনও শুনি নাই। এতক্ষণ তাই শুনিতেছিলাম।” দ্বিতীয় বালিকা পুনরায় নৌকার দিকে চাহিয়া কহিল, “কই সই, নৌকায় ত কাহারও সাড়া শব্দ নাই।” প্রথমা বালিকাও নৌকার দিকে চাহিল—নৌকা নীরব। যুবক এই সময় পাটের জমাখরচ মিলাইতেছিলেন, তিনি বালিকাদ্বয়ের কথোপকথন শুনিতে পাইলেন।

দ্বিতীয় বালিকা কহিল, “যাক, কাল বিকালে তোমরা যখন স্কুল হইতে চলিয়া আস, তারপর ডাকপিয়ন বাবজানকে একখানি মনিঅর্ডার দিয়া যায়। সেই সঙ্গে আমিও কলকাতার আর একখানি চিঠি পাই। চিঠি লইয়া আমি আমার পড়ার ঘরে বসিয়া চুপ করিয়া পড়িতেছিলাম। একটু পরে বাবজান বাড়ির মধ্যে আসিয়া মাকে বলিলেন, “এই ধর, ১৮টি টাকা, আলাদা করিয়া রাখিয়া দাও। ইহা আনোয়ারার বৃত্তির টাকা। এই টাকা আর তাহার পিতার হাতে দিব না। সে কাপড়ে-চোপড়ে, পুঁথি পুস্তকে মেয়েটিকে যে কষ্ট দেয়, আমি মনে করিয়াছি এই টাকা দিয়া তাহার সে কষ্ট দূর করিব। মা কহিলেন, “ও সব কষ্ট ত’ কিছুই না। মেয়েটাকে তার মায়ে দিনরাত যেভাবে খাটায় আর তিরস্কার করে, তা দেখিলে বুক ফাটিয়া যায়। সৎ-মা অনেক দেখিয়াছি কিন্তু এমন অসৎ সৎ-মা বুঝি ত্রিভুবনে আর নাই। আবার মেয়েটির মত ভাল মেয়েও দেখা যায় না।’

প্র-বা। সই, ওসব কথা থাক্, চল বাড়ির ভিতরে যাই, বড় মাথা ধরিয়াছে।

দ্বি-বা। সই তোমার এক ভয়ানক খবর আছে; তা এখানেই নির্জনে বলি। বাবাজান আর মা, কাল বিকালে তোমার সম্বন্ধে যত কথা বলিয়াছেন—সবই বলিতেছি।

প্র-বা। (উদ্বিগ্নচিত্তে) কি খবর সই?

দ্বি-বা। “মা বলিলেন, অত বড় সেয়ানা মেয়ে, তথাপি সে তার সত্মার অত্যাচার নীরবে সহিয়া তারই আদেশ উপদেশ মত চলে, চুঁটু শব্দটি পৰ্য্যস্ত করে না, ভুলিয়াও সমার নিন্দা করে না; বরং কেহ নিন্দাবাদ করিলে সেখানে হইতে উঠিয়া যায়। ধন্নি মেয়ে।”

প্র-বা। সই, আসল কথা কি তাই বল?

দ্বি-বা। আমি দুই কানে যা শুনিয়াছি তাহাই বলিতেছি।

এই বলিয়া দ্বিতীয়া বালিকা আবার বলিতে লাগিল, “বাবজান কহিলেন, মেয়েটি দেখিতে যেমন সুন্দর, তার স্বভাবটিও তেমনিই মনোহর, আবার পড়াশুনায় আরোও উত্তম। আনোয়ারার স্মরণশক্তি অসাধারণ; স্বাস্থ্যবিজ্ঞান, ভূগোলপাঠ, ভারতের ইতিহাস আদ্যন্ত মুখস্থ করিয়া ফেলিয়াছে। চারুপাঠ, সীতার বনবাস, মেঘনাদবধ কাব্য, পদ্যপাঠ প্রভৃতি সাহিত্য পুস্তক সুন্দররূপে বুঝাইয়া লিখিতে পারে, হাতের লেখা চমৎকার। জামা-সেলাই— নীলাম্বরী কাপড়ে ফুলতোলা দেখিয়া সেদিন ইনস্পেক্টর সাহেব তাহাকে যে ১০ টাকা পুরস্কার দিয়া গিয়াছেন তাহা ত’ বোধ হয় জান? মেয়ে পড়ার বই ছাড়া, ২০/২৫ খানি স্ত্রী পাঠ্য পুস্তক—আমি যাহা নির্দেশ করিয়া দিয়াছি, তাহা সুন্দররূপে আয়ত্ত করিয়াছে। মেয়ের জ্ঞান- পিপাসা দেখিয়া আমি বাস্তবিকই বিস্মিত হইয়াছি। ইহার মধ্যে আবার আমাকে হযরত ওমরের জীবন চরিত আনিতে টাকা দিয়াছে। আনোয়ারার কোরান পাঠ শুনিলে আমি অশ্রুসংবরণ করিতে পারি না।’

মা কহিলেন, “তা যেন হইল, মেয়ে যে বড় হইয়া গেল তাহার কি হইবে? তাহার বাপ ত’ এ বিষয়ে লক্ষ্যই করিতেছে না।’ শেষে মা বাবাজানকে, তোমার সয়ার মত নিৰ্গুণ কদাকার একটা বরের হাতে তোমাকে সমর্পণ করিতে অনুরোধ করিলেন। এই বলিয়া সে একটু মুচকিয়া হাসিল, তারপর কহিল, ‘বিশেষ করিয়া বলিলেন, ‘যেমন মেয়ে তেমন উপযুক্ত পাত্র না হইলে সবই বিফল হইবে। বাবাজান শুনিয়া বিশেষ দুঃখের সহিত বলিলেন, ‘বিফল হইবে বলিয়াই বোধ হইতেছে।’ তখন মা চমকিয়া উঠিয়া বলিলেন, “ সেকি বাবাজান কহিলেন, “তিন হাজার টাকার কাবিন, পনর শত টাকার গহনা এবং পনর শত টাকা নগদ লইয়া জাফর বিশ্বাসের নাতির সহিত ভূঞা সাহেব মেয়ে বিবাহ দিবেন বলিয়া স্বীকার করিয়াছেন—শুনিলাম। মা উত্তেজিত হইয়া কহিলেন, ‘তুমি বল কি? জাফর বিশ্বাস ডাকাত ছিল, শেষবার ধরা পড়িয়া জেল খাটিয়া মরিয়া গিয়াছে। ভূঞা সাহেব হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হইয়া রূপে মজিয়া জাফর চোরের মেয়েকে বিবাহ করিয়াছেন বলিয়াই কি আনোয়ারার মত বেহেস্তের হুরকে তাহাদেরই ঘরে বিবাহ দিবেন? আমার হামিদা আনোয়ারার সহিত ‘সই’ বন্ধন করিয়াছে, উভয়ের মধ্যে যেরূপ ভাব, তাহাতে এ সম্বন্ধ যাবজ্জীবন অচ্ছেদ্য। আনোয়ারার বিবাহ চোরের ঘরে হইলে, হামিদা যে সরমে মরিয়া যাইবে, আমরা যে কোথাও মুখ পাইব না? বিশেষত আনোয়ারা সেয়ানা মেয়ে, শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে সব বুঝিয়া উঠিয়াছে, সে শুনিলে যে কি ভাবিবে বলিতেই পারি না।

বাবজান কহিলেন, “যার মেয়ে সে যদি বিবাহ দেয়, আমরা কি করিব?” মা কহিলেন, “এ বিবাহ যাহাতে না হয়, সেজন্য তোমরা দশজনে মিলিয়া শক্ত করিয়া বাধা দাও।” বাবজান কহিলেন, “আজিমুল্লা (জাফর বিশ্বাসের পুত্র) এই বিবাহের জন্য আবুল কাশেম তালুকদার, নুরউদ্দিন মুন্সি, মীর ওয়াজেদ আলী প্রভৃতি প্রধানদিগকে একশত টাকা করিয়া ঘুষ দিয়াছে, সুতরাং এ বিবাহ আর নিবারণ করা চলিবে না। এখন খোদাতায়ালার ইচ্ছা, আর মেয়ের কপাল।’ এই বলিয়া বাবজান বাহির বাড়িতে চলিয়া গেলেন; মা আমাকে ডাকিয়া বলিলেন, “হামি, তোর সইয়ের বিবাহের কথা শুনিয়াছিস?” আমি ত’ গোপনে তাহাদের কথাবার্তা সবই শুনিয়াছি, তবু মার মুখের দিকে তাকাইলাম। আমি কাল বিকালেই তোমাকে বলিতে আসিতাম, কিন্তু কলিকাতার পত্রের উত্তর লিখিতে বিলম্ব হইল, আর ভাবিলাম, এ সংবাদ শুনিলে রাত্রে তোমার ঘুম হইবে না, তাই আসি নাই; কিন্তু তোমার মুখের চেহারায় বুঝিতেছি যে, এ সংবাদ তোমার কানে আগেই গিয়াছে। “

আনোয়ারা কহিল, “না সই, তোমার মুখে এই প্রথম শুনিলাম।” হামিদা আনোয়ারার মুখের দিকে চাহিল, দেখিল—তাহার রুক্ষ মুখ অধিকতর রুক্ষ হইয়াছে। ডাগর চক্ষু দুইটি নীহার-সিক্ত ফুটন্ত জবার ন্যায় লাল হইয়া উঠিয়াছে। সে হামিদার কথার আর কোন উত্তর করিল না, কেবল মৃদুস্বরে কহিল, “সই বড় মাথা ধরিয়াছে, চল–বাড়ির ভিতরে যাই।” এই বলিয়া আনোয়ারা উঠিয়া দাঁড়াইল, হামিদাও তাহার সঙ্গে অন্দরমুখী হইল।

এই সময়ে নৌকা হইতে প্রয়োজনবশত অবতরণকালে যুবক পেটকাটা ছৈ মধ্যে দাঁড়াইয়া কাশিয়া উঠিল। হামিদা ফিরিয়া তাকাইয়া চমকিয়া উঠিল এবং ব্যাকুলভাবে ঘোটা টানিয়া বাড়ির মধ্যে ঢুকিয়া পড়িল। আনোয়ারাও ফিরিয়া চাহিল, চারি চক্ষের মিলন হইল। কিন্তু কল্পিত স্বপ্নদৃষ্ট হৃদয়ের সামগ্রী প্রত্যক্ষ করিলে লোকে যেমন আশ্চর্যবোধে চম্‌কিয়া উঠে, যুবকের প্রতি দৃষ্টিপাত মাত্র বালিকা সেইরূপ শিহরিয়া উঠিল। যুবকও কি যেন ভাবিয়া হর্ষ-বিষাদ পরিমিশ্রিত প্রশান্ত-সৌম্য-বিস্ময়-বিস্ফারিত নেত্রে করুণ দৃষ্টিতে তাঁহার মুখের দিকে চাহিলেন। বালিকার আয়ত আঁখি লজ্জায় মুকুলিত হইল। পরন্ত সে ভাবিল ইনিই বুঝি নৌকার ভিতর মধুকন্ঠে কোরান শরীফ পাঠ ও মোনাজাত করিয়াছেন। ঝঞ্ঝাবাত সমুখানে তটিনীর বক্ষ যেরূপ প্রবল উচ্ছ্বাসে তরঙ্গায়িত হইতে থাকে, সুখ দুঃখের সংমিশ্রিত ভাবাবেগে তাহার সুকোমল ক্ষুদ্র হৃদয়খানি তখন সেইরূপ আন্দোলিত হইতে লাগিল এবং তৎসঙ্গে তাহার মাথার বেদনা আরও বাড়িয়া উঠিল। সে ধীরপদে অন্দরে প্রবেশ করিল। কেবল অস্ফুটস্বরে কহিল, “তবে ইনিই কি তিনি? মা তোমার কথা যেন সত্য হয়, আমি একমাস নফল রোজা রাখিব।”

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

এদিকে হামিদা বরাবর তাহাদের বাড়িতে আসিয়া ভোলার মার খোঁজ করিত। ভোলার মা প্রৌঢ়া বিধবা; ভোলা তাহার যুবক পুত্র। মা নিজে পুঁজিপাটা সর্বস্ব বেচিয়া বাছিয়া বাছিয়া ভোলাকে এক সুন্দরী বউ আনিয়া দিয়াছে। বউ ২/৩ বছরে যুবতী হইয়া উঠিলে, ভোলা সেই মনোমোহিনীর অসৎ-পরামর্শে গৃহস্থালীর ব্যয় লাঘবের জন্য মাতাকে গৃহতাড়িত করিয়া দিয়াছে। ভোলার মা এক্ষণে হামিদাদিগের বাড়িতে কাজকর্ম করিয়া খায়। ভোলার মা একান্ত সরলা, বুদ্ধিশুদ্ধি মন্দ নয়, দোষের মধ্যে কানে একটু কম শুনে। সে হামিদাকে খুব ভালবাসে এবং দশ কাজ ফেলিয়া তাহার হুকুম তামিল করে। হামিদা খুঁজিয়া ভোলার মাকে তাহাদের কূপের নিকট পাইল এবং অপরে না শুনে এমন ভাবে কহিল, “ভোলার মা, আমার সইদিগের খিড়কীর ঘাটে সোজা পূর্বপারে একখানি পাসী নৌকা লাগান আছে, সেই নৌকায় ঠিক তোমাদের দুলামিঞার মত কে যেন দাঁড়াইয়া আছেন—দেখিয়া আসিলাম; তুমি গোপনে যাইয়া তত্ত্ব জানিয়া আইস, তিনিই কিনা?”

ভোলার মা আদেশ পালনে রওয়ানা হইল।

এদিকে হামিদা তাহার পাঠাগারে বসিয়া চিন্তা করিতে লাগিল,—কলিকাতা হইতে দু’বেলা তাহার দু’খানি চিঠি পাইলাম, আজ তিনি এখানে তাহাও কি হয়? বোধহয় তাঁহার মত অন্য কোন লোককে দেখিয়াছি। আবার ভাবিল, তিনি এবার কলিকাতা যাইবার সময় বলিয়াছেন, যে সকল বিবাহিতা যুবতী আদরে সোহাগে অধিকাংশ সময় পিত্রালয়ে থাকে, তাহারা স্বাধীন-প্রকৃতি হইয়া বে-পর্দায় চলাফেরা করে। দেখিও, তুমি যেন সেরূপ না হও; কারণ আমি কলিকাতা গেলেই তুমি মধুপুরে পার হইবে।’ আমি তখন চোখ রাঙ্গাইয়া গর্বভরে বলিয়াছিলাম, ‘তুমি আমাকে কি মনে কর? আমি আর মধুপুরে যাইব না, এখানেও থাকিব না, কলিকাতায় যাইব।’ তিনি দমিয়া গিয়া আমাকে আদর করিয়া বলিয়াছিলেন, ‘না, না; তুমি মধুপুরে যাইও, না যাইলে আম্মাজান ভাত-পানি ছাড়িবেন। আমি আর তোমাকে এমন কথা বলিব না।’ আমার প্রেমগর্ব তখনি পানি হইল। বোধহয় তিনি আমার প্রেমাভিমানের সত্যতা পরীক্ষার নিমিত্ত চালাকি করিয়া কলিকাতা হইতে চিঠি লিখিয়া তৎপূর্বে এইখানে আসিয়াছেন। পরীক্ষা তো এইরূপ পাইলেন, আমি অনাবৃত মস্তকে লোকচক্ষুর দর্শনীয় স্থানে বসিয়া সইয়ের সহিত গল্প করিতেছি, তিনি নৌকার ভিতর চুপ করিয়া থাকিয়া আমার বেপর্দাভাব স্বচক্ষে দেখিলেন। এখন উপায়? তাঁহার কাছে মুখ দেখাইব কিরূপে? যদি এই দোষে তিনি আমাকে ঘৃণার সহিত উপেক্ষা করেন, তবে কি করিব?

হামিদা আবার ভাবিল, তিনি আমাকে যেরূপ ভালবাসেন ও বিশ্বাস করেন, এই বলিয়া ট্রাঙ্ক হইতে বৈকালের প্রাপ্ত চিঠিখানা বাহির করিয়া পড়িতে লাগিল, “সুখ শান্তির আধার প্রাণের হামি”, এইটুকু পড়িতেই তাহার চোখের জল টস্ টস্ করিয়া চিঠিতে পড়িতে লাগিল। সে অতি কষ্টে অঞ্চলে চোখ মুছিয়া আবার পড়িতে লাগিল, “আমাদের ল-ক্লাস বন্ধ হইতে আর তিন সপ্তাহ বাকি, কিন্তু এই তিন সপ্তাহ তিন বৎসর বলিয়া মনে হইতেছে। ছুটির দিন যতই নিকটবর্তী হইতেছে, তোমাকে দেখিবার আকাঙ্ক্ষা ততই বাড়িয়া উঠিতেছে।” এ পর্যন্ত পড়িয়া আর পড়িতে পারিল না। প্রেমাশ্রু অনিবার্য-বেগে তাহার বক্ষবসন সিক্ত করিতে লাগিল। হামিদা পত্রহস্তে বালিশে মুখ রাখিয়া কাঁদিতে লাগিল।

বৃষ্টির পর আকাশ যেমন লঘু ও পরিষ্কার হয়, ক্রন্দনেও সেইরূপ দুঃখ লাঘব হয়। তাহা না হইলে সংসার চলিত না। হামিদার দুঃখের তাপ কমিয়া আসিলে সে পুনরায় গালে হাত দিয়া ভাবিতে লাগিল,—যিনি তাঁহার দাসীকে এত ভালবাসেন, তাহার মনে কি দাসীর প্রতি সন্দেহ হইতে পারে? কখনই নয়। চেহারার মত চেহারা কি নাই? আমি তাহার মূর্তিতে নিশ্চয়ই অন্য লোককে দেখিয়াছি। এইরূপ বিতর্ক করিয়া হামিদা কথঞ্চিত আস্বস্ত হইল এবং আগ্রহের সহিত ভোলার মার প্রতীক্ষা করিতে লাগিল।

ভোলার মা একখানি ডিঙ্গি নৌকায় খাল পার হইয়া দুলা-মিয়াকে দেখিবার জন্য পাস নৌকার নিকট উপস্থিত হইল। দেখিল, নৌকার সম্মুখভাগে একহারা আধাবয়সী লোক চা’র পানি গরম করিবার নিমিত্ত উনুন ধরাইতেছে। এইটি যুবকের পাচক। বাঘ-মহিষের যুদ্ধের ন্যায় উনুন মধ্যে ভাদুরে খড়ি ও আগুন পরস্পর যুদ্ধ বাঁধাইয়া তীব্র ধূম্রপুঞ্জে পাচকবরকে ত্যক্ত-বিরক্ত ও অন্ধীভূত করিয়া তুলিতেছিল। এই সময় ভোলার মা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “বাবা তোমরা কোথা হইতে আসিয়াছ?” পাচক ক্রোধভরে কহিল, “ কেন? আমরা বেলগাঁও হইতে আসিয়াছি।” ভোলার মা শুনিল, ‘আমরা বেতা হইতে আসিয়াছি।’ বেতা হামিদার শ্বশুর-বাড়ি। পাচকের ক্রোধের প্রতি ভোলার মার ভ্রূক্ষেপও নাই। সে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিল, “নায়ে চড়নদার কে?” পাচক বিরক্ত হইয়া উঠিল। কিন্তু ভোলার মা নাছোড়বান্দা হওয়ায় সে ষোল আনা ক্রোধ জাগাইয়া এবার কহিল, “তোমাদের দুলা মিঞা আছে।” পাচক ভাবিল–মাগীকে শক্ত গালি দিয়াছি। মাগী ভাবিল—চড়নদার দুলা মিঞা বটে!

এই সময় দুলা-মিঞা নৌকার ভিতর দুগ্ধ-ফেননিভ শয্যায় শায়িতভাবে ‘রোমিও জুলিয়টে’ হাতে করিয়া বালিকাদ্বয়ের কথোপকথনের বিষয় চিন্তা করিতেছিলেন। তিনি ভাবিতে লাগিলেন বিবাহিতার মুখে অবিবাহিতার গুণের পরিচয় পাইলাম, পরন্তু স্বচক্ষে যাহা দেখিলাম তাহাতে এতকাল ধরিয়া যেমনটির জন্য প্রাণ লালায়িত হইয়া আছে, এই সর্বাংশে তদুপযুক্তই বটে, কিন্তু হায়! তাহার বিবাহের যে প্রস্তাব শুনিলাম তাহাতে বাসনা-সিদ্ধির আশা কোথায়? হায়, হায়, এমন রত্নও নরকে নিক্ষিপ্ত হইবে?

এদিকে ভোলার মা ফিরিয়া গিয়া হাসিতে হাসিতে হামিদাকে কহিল, “নৌকায় চড়নদার বেলতার দুলা-মিঞা। তাহাকে বাড়ির উপর আনিতে মা-জানকে খবর দেইগে।” ভোলার মা হামিদার মাকে মা-জান বলিয়া ডাকিত। হামিদা কহিল, “তাঁহার আসার সংবাদ কাহাকেও বলিও না, নিজ কাজে যাও।” ভোলার মা মলিন মুখে কূপের ধারে চলিয়া গেল। হামিদা ঘরের দরজা ঠেলিয়া দিয়া, আকাশ পাতাল ভাবিতে ভাবিতে অবসন্ন হইয়া পড়িল।

এক প্রহর বেলা অতীত হইল। হামিদার মা হামিদাকে উঠানে চলাফেরা করিতে না দেখিয়া এবং এত বেলায়ও বালিকা স্নানাহার করিতেছে না বলিয়া, তিনি তাহার পড়ার ঘরে খোঁজ করিলেন। দেখিলেন, বালিকা নিতান্ত মলিন মুখে চৌকিতে শুইয়া আছে। তিনি চমকিয়া উঠিয়া বলিলেন, “মা, অসুখ করিয়াছে কি?” হামিদা আন্তরিক ভাব গোপন করিয়া সলজ্জে কহিল, “না”। মা কহিলেন, “তবে অসময় শুইয়া আছ কেন? বেলা হইয়া গেল, গোসল করিয়া খাইতে আইস।” হামিদা কহিল, “যাও আসি।” মা চলিয়া গেলে, হামিদা পাশ ফিরিয়া শয়ন করিল। অনেকক্ষণ অতীত হইল, তথাপি হামিদা ঘর হইতে বাহির হইল না; মা মেয়েকে না দেখিয়া পুনরায় ডাকিতে আসিলেন, এবার বালিকা বলিল, “আমার ক্ষিদে পায় নাই। এখন খাইব না, তুমি খাওগে।” মার মুখ ভার হইল। তিনি চিন্তা করিতে লাগিলেন, ‘মেয়ে কাল উপর্যুপরি কলিকাতার দুইখানি চিঠি পাইয়াছে, বুঝি বা জামাতার কোন অমঙ্গল-সংবাদ আসিয়াছে। আমি জিজ্ঞাসা করিলেও মেয়ে কিছু বলিবে না। যত কথা তার সই-এর নিকট ব্যক্ত করে আজ প্রাতেও সেখানে অনেকক্ষণ ছিল, আচ্ছা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া আসি।’ এই ভাবিয়া তিনি আনোয়ারাদিগের আঙ্গিনায় গেলেন।

এদিকে আনোয়ারা শিরঃপিড়ায় কাতর হইয়া শয্যায় আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছে। তথাপি সে শয়ন করিয়া চিন্তা করিতেছে—ইনিই কি তিনি? চেহারা ঠিক সেইরূপ; কিন্তু তাঁহার পরিচ্ছদ এরূপ ছিল না। তাঁহাকে মূল্যবান আচ্‌কান পায়জামা পরিহিত দেখিয়াছি মনে হইতেছে, সুতরাং ইনি তিনি নন।’ আবার ভাবিল, ইঁহাকে যেন সই-এর স্বামী বলিয়া মনে হইল, তাঁহার চেহারা ঠিক এইরূপ।’ পর মুহূর্তে মনে হইল, ‘তিনি ত’ এমন সুন্দর কোরান শরীফ পড়িতেন না! বিশেষত সই কাল কলিকাতা হইতে তাহার চিঠি পাইয়াছে, আজ তিনি এখানে আসিবেন কিরূপে? সুতরাং ইনি সই-এর স্বামীও হইতে পারেন না। তবে ইনি কে?’—এইরূপ নানা চিন্তার ঘাত-প্রতিঘাতে বালিকার কোমল হৃদয় নিষ্পেষিত হইতে লাগিল; ধমনীর রক্ত ঊর্ধ্বগামী হইয়া মস্তিষ্ক আক্রমণ করিল, চক্ষু লাল হইয়া উঠিল, সঙ্গে সঙ্গে শরীর গরম হইয়া জ্বর আসিল। জ্বরোত্তাপে বালিকা ছটফট করিতে আরম্ভ করিল। এই সময় হামিদার মা তথায় আসিলেন। তিনি আনোয়ারার গায়ে হাত দিয়া কহিলেন, “ইস্! গা যে আগুনের মত গরম হইয়াছে, হঠাৎ এরূপ জ্বর হওয়ার কারণ কি?” মুখের দিকে চাহিয়া কহিলেন, “মেয়ের চোখ যে জবাফুলের মত লাল হইয়াছে, সমস্ত রক্ত যেন একযোগে মাথায় উঠিয়া গিয়াছে।”

আনোয়ারার দাদিমা কাছে বসিয়াছিলেন, তিনি কহিলেন, “কি জানি মা, কিসে যে কি হইল কে বলিবে? বৌয়ের দিনরাত কথার খোঁচায় বাছার আমার কলেজা ছিদ্র হইয়া গিয়াছে। গত রাত্রিতে ভাত খাইতে দেরী হওয়ায়, বৌ মেয়েকে অকারণে যেরূপ ঘেন্না দিয়া কথা বলিয়াছে, তাহা শুনিলে বুক ফাটিয়া যায়। গালাগালির ঘেন্নায় বাছা আমার উপোসে রাত কাটাইয়াছে, মনের কষ্টে শেষ রাতে বাছা ‘মা, মা’ বলিয়া কাঁদিয়া উঠিয়াছিল। মা, দুঃখের কথা কত বলিব, রূপসী বৌ ঘরে আনিয়া খোরশেদ আমার সব খোয়াইতে বসিয়াছে।”

আনোয়ারার পিতার নাম খোরশেদ আলী ভূঞা। ইনি দ্বিতীয়বার জামতাড়া গ্রামের জাফর বিশ্বাসের কন্যাকে বিবাহ করিয়াছেন।

আনোয়ারার দাদিমা হামিদার মাকে কহিলেন, “মা! পাট, ধান, কলাই যে খন্দের যা বাড়িতে আসে তাহার আধাআধি জামতাড়া যায়। তাহাছাড়া বৌ কত জিনিস চুরি করিয়া বিক্রি করে, তাহার সীমা নাই। ভাল কাপড়-চোপড় ঘটি-বাটি পর্যন্ত বৌ চুপে চুপে বাপের বাড়ি পার করিয়াছে। সেদিন খোরশেদ বেরামপুর হইতে বৌ-এর ফরমাইস মত বাদশার জন্য ছাতি, জুতা, কোট আনিয়াছে। (বাদশা বৌ-এর পূর্ব স্বামীর ঔরসজাত পুত্ৰ) সেই সঙ্গে এই ছুঁড়িটার জন্যও একটা কোর্তা আনিয়াছিল। বৌ কোর্তা দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘এটা কার জন্য?’ প্রশ্ন শুনিয়াই খোরশেদের মুখ শুকাইয়া গেল। শেষে বাধ্য হইয়া কহিল, মেয়েটাকে কিছু দেওয়া হয় না, এটা তাহারই জন্য আনিয়াছি।’ মা, লজ্জার কথা, বৌ খোরশেদকে যে কতরকম খারাপভাবে ঠাট্টা বিদ্রূপ করিল, তা বলা যায় না। মেয়েটা শুনিয়া তখনই কোর্তা বৌ-এর ঘরে ফিরাইয়া দিয়া আসিল। ইহাতে খোরশেদ টু শব্দটি করিল না। কয়েকদিন পরে জানা গেল কোর্তা জামতাড়ায় আজিমুল্লার মেয়ে তছিরনের গায়ে উঠিয়াছে। মা, আমি দু’কথা বুঝাইয়া বলিলে, খোরশেদ শুনিয়াও শুনে না। বৌ যা বলে অপরাধী লোকের ন্যায় সে তাহাই করে। আমার সোনার চাঁদ খোরশেদ নেকাহ করিয়া যে এমন বৌ- বশ হইবে তা আমি মনেও করি নাই। আমার মালুম হয় বৌ ছেলেকে যাদু করিয়াছে।” এই সময় আনোয়ারা চীৎকার করিয়া উঠিল—”দাদি, মাথা গেল—পানি—ইনিই কি তিনি?” হামিদার মা পানি দিলেন।

হামিদার মা কহিলেন, “আমিও আনোয়ারার বাপের মতিগতি দেখিয়া বাড়িতে বলিয়াছিলাম, ‘বাদশার মা ভূঞা সাহেবকে যাদু করিয়াছে।’ হামিদার বাপ এ কথা শুনিয়া কহিলেন, “ওসব কিছু না; রূপজমোহে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হইলে মানুষের মতিগতি এইরূপই হয়।’ এখন বাদশার মা ভূঞা সাহেবকে দুপোর রাত্রে পচা পুকুরে ডুব দিতে বলিলেও সে আপত্তি করিবে না। কিন্তু এর শেষ ফল বড়ই ভয়ানক; তখন চৈতন্য হইলেও নিস্তার নাই। এই সময় আনোয়ারা পুনরায় চীৎকার করিয়া পাশ ফিরিয়া শয়ন করিল এবং অস্ফুটে কহিল, ‘আমার ওস্তাদের কথা।” দাদিমা মেয়েকে জড়াইয়া ধরিয়া কহিলেন, “বুবুরে কি বকিতেছিস্? আনোয়ারা পুনরায়—”দাদি—মাথা—তিনি—উঃ—ফাটিয়া গেল” একটু পরে আবার—”মোনাজাত—কোরান—কি সুন্দর—ইনিই—কি তিনি।” হামিদার মা কহিলেন, “মেয়ে জ্বরের প্রকোপে পুস্তকের কথা আওড়াইতেছে; আপনারা সত্ত্বর ডাক্তার দেখান।” এই বলিয়া তিনি উঠিয়া বাড়িতে আসিলেন। যাহা জানিতে বা বলিতে গিয়াছিলেন, আনোয়ারার অবস্থা দেখিয়া তাহার কিছুই বলিতে পারিলেন না।

এদিকে হামিদা তাহার পাঠাগারের দ্বারে উদ্বিগ্নচিত্তে ভাবিতেছিল, তাঁর আসার সংবাদ মার নিকট বলিতে ভোলার মাকে নিষেধ করিয়া ভাল করি নাই। তিনি আসিলে পায়ে পড়িয়া ক্ষমা চাহিতাম।’ আবার ভাবিল, আর কিছুক্ষণ দেখি যদি তিনি স্বেচ্ছায় না আসেন, তবে তখন বিবেচনা করিয়া যাহা হয় করিব। এই সময় তাহার মা আসিয়া তথায় দাঁড়াইলেন; আনোয়ারার জ্বর বিকারের কথা মেয়েকে জানাইলেন না। স্নানাহারের জন্য তাহাকে রান্নাঘরের আঙ্গিনার দিকে লইয়া গেলেন।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

মধুপুর প্রাচীন গ্রাম। বাঁশ, আম, তেঁতুল, গাব, বট, দেবদারু প্রভৃতি সমুচ্চ বৃক্ষরাজিতে পূর্ণ। গ্রামখানি নিম্ন সমতল। আষাঢ়ে পানি আসে—আশ্বিনে শুকায়। গ্রামের চতুষ্পার্শ্বস্থ ক্ষেত্রে প্রচুর পাট জন্মে। গ্রামের অধিবাসী সকলেই মুসলমান। মধুপুর হইতে তিন গ্রাম উত্তরে জামতাড়া; এ-গ্রামের অধিবাসী বার আনা হিন্দু। বেলতা গ্রাম মধুপুর হইতে ১ মাইল পূর্বে একটি অনতি প্রশস্ত স্রোতস্বিনীর তীরে অবস্থিত। এই গ্রামের ৩/৪ টি ভদ্রবংশীয় উচ্চশিক্ষিত মুসলমান গভর্নমেন্টের চাকুরি করেন। বেলগাঁও প্রসিদ্ধ বন্দর; মধুপুর হইতে ৩ মাইল দক্ষিণ-পূর্ব কোণে স্রোতস্বতী নদীর পশ্চিম তটে অবস্থিত। পাট ও অন্যান্য বাণিজ্য দ্রব্যের জন্য বিখ্যাত। বড় বড় ২/৩ টি জুট কোম্পানি এখানে ব্যবসায়ের অনুরোধে বড় বড় গুদাম কলকারখানা স্থাপন করিয়াছে।

পূর্বকথিত খোরশেদ আলী ভূঞা সাহেব মধুপুর গ্রামের সম্ভ্রান্ত ও প্রধান ব্যক্তি। পৈত্রিক অবস্থা খুব সচ্ছল ছিল, ভূ-সম্পত্তিও মন্দ ছিল না, এখনও মধ্যবিত্ত অবস্থা। দেড়শত বিঘা জমি, সাতখানা হাল, নয়জন চাকর, এক পাল গরু। কেবল পাট বিক্রয় করিয়া বৎসরে ৭/৮ শত টাকা পান। বাড়ির ঘর করগেটেড টিনের। ভূঞা সাহেবের বয়স প্রায় সত্তরের কাছাকাছি। বর্ণ গৌর, আকৃতি দোহারা, মুখের চেহারা নিতান্ত মন্দ নয়। কৃপণ স্বভাব ও অর্থগৃন্ধু। পিতা-মাতার প্রথম ও আদরের ছেলে ছিলেন বলিয়া অর্ধ শিক্ষিত। তাঁহার বর্তমান অবস্থায় তিনি সন্তুষ্ট নহেন, আর্থিক উন্নতি বিধানে সর্বদা চিন্তিত ও চেষ্টান্বিত। ভূঞা সাহেব নিজ গ্রাম হইতে ৭ ক্রোশ দূরে রসুলপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত বংশে বিবাহ করেন। বহু পুণ্যফলে তিনি ফাতেমা জোহরার ন্যায় ধৈর্য্যশীলা রূপবতী পত্নী লাভ করেন! ইঁহার গর্ভে ভূঞা সাহেবের দুইটি পুত্র ও একটি কন্যা জন্মগ্রহণ করে। পুত্রদ্বয় অকালে কাল-কবলে পতিত হয়; কন্যা জীবিত আছে। কন্যার ১২ বৎসর বয়সের সময় তাহার মাতা পরলোকগমন করেন; কিন্তু ভূঞা সাহেবের ধর্মশীলা বুদ্ধিমতি জননী এই ১২ বৎসরের কন্যাকে যেভাবে গড়িয়া রাখিয়া গিয়াছেন সচরাচর সেরূপ দেখা যায় না।

কথিত আছে জাফর বিশ্বাস ডাকাতের সর্দার ছিল। শেষ জীবনে পুলিশের চেষ্টায় ধরা পড়িয়া কঠিন পরিশ্রমের সহিত ৮ বৎসরের জন্য কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয় এবং সেইখানেই তাহার মৃত্যু ঘটে। তাহার স্ত্রী, এক পুত্র ও এক কন্যা জীবিত থাকে। পুত্রের নাম আজিমুল্লা। সুখের বিষয় যে, পিতার শোচনীয় পরিণাম চিন্তা করিয়া অনেকাংশে সে আত্মসংযমপূর্বক সংসার করিতেছে। কন্যার নাম গোলাপজান। গোলাপজান ভুবনমোহিনী সুন্দরী; ছোটলোকের ঘরে ঈদৃশী সুন্দরী মেয়ের জন্মলাভ খুব কম দেখা যায়।

জামতাড়া হইতে ৫ মাইল পূর্বে বসন্তবিশুষ্ক বর্ষ প্লাবিত একটি নদীর পশ্চিম তটে আদমদীঘি গ্রামে কাসেম শেখের পুত্র মেহের আলীর সহিত ১০/১১ বৎসর বয়সের সময় এহেন রূপসী গোলাপজানের বিবাহ হয়। কিন্তু জানি না কেন বিবাহের পর হইতে সে স্বামীর বাড়ি ত্যাগ করিয়া পলাইতে আরম্ভ করে। তাহার শ্বশুর ও স্বামী এজন্য তাহাকে বিধিমত শাসনাদি করিতে থাকে, কিন্তু কিছুতেই তাহার পলায়ন-অভ্যাস দূর হয় না। একবার শ্রাবণের নিশিতে ভরা নদী সাঁতরাইয়া সে বাপের বাড়ি পলাইয়া আসে। সকলে মেয়ের সাহস দেখিয়া অবাক! মেহের আলী অনন্যোপায়ে তালাক দিল। গোলাপজান প্রসিদ্ধ সুন্দরী; সুতরাং এদ্দতকাল অতীতের পূর্বেই নিজ গ্রামের নবীবক্সের সহিত তাহার বিবাহের বন্দোবস্ত হইল। নির্দিষ্ট দিনের শেষে নবীবক্স গোলাপজানের পাণিগ্রহণ করিল। নবীবক্সের সাংসারিক অবস্থা ভাল ছিল। আজিমুল্লা ও তাহার মায়ের শাসনে গোলাপজান এবার শ্বশুরালয় হইতে আর পলাইল না, কিন্তু এ সংসারে আসিয়া তাহার একটি গুণের বিকাশ পাইতে লাগিল।

নবীবক্স গোলাপজানের রূপের মোহে তাহাকে প্রাণাধিক ভালবাসিতে লাগিল। সংসারে বৃদ্ধা শাশুড়ী মাত্র বর্তমান, সুতরাং আদর-সোহাগে গোলাপজান সংসারে সর্বময় কর্ত্রী হইয়া উঠিল। সে এক্ষণে এক একটি করিয়া গোপনে গোপনে নবীবক্সের শ্রমার্জিত ঘটী-বাটী কাপড়-চোপড় ধান চা’ল তেল-তামাক পর্যন্ত অনেক দ্রব্যই ভ্রাতা আজিমুল্লার বাটীতে প্রেরণ করিতে লাগিল। আজিমুল্লা তাহাতে আন্তরিক খুশি ছিল। কিছুদিন পর গোলাপজান এক পুত্র-সন্তান প্রসব করিল। প্রিয়তমা প্রেয়সীর গর্ভে পুত্র-সন্তান লাভ করিয়া নবীব গোলাপজানকে মাথায় তুলিল, এবং বাছিয়া বাছিয়া পুত্রের নাম রাখিল—বাদশা। সুখে- সন্তোসে এইরূপে চারি-পাঁচ বৎসর কাটিল; কিন্তু দিন কাহারও একভাবে যায় না, নবীব কার্তিক মাসের কলেরায় হঠাৎ প্রাণত্যাগ করিল। তিন দিন পর তাহার বৃদ্ধা মাতাও পুত্রের পথানুসরণ করিল। গোলাপজান এখন সংসারে একাকিনী। শিশু পুত্র লইয়া কেমন করিয়া সংসারে থাকিবে? সুতরাং ভ্রাতা আজিমউল্লা তাহাকে নিজ বাড়িতে লইয়া গেল এবং দুই এক করিয়া নবীবক্সের স্থাবরাস্থাবর সম্পত্তি নিজ সম্পত্তির সহিত মিশাইয়া নিজ গৃহস্থালী বড় করিয়া তুলিল। শিশু বাদশা মাতৃসহ মাতুলালয়ে মহাদরে প্রতিপালিত হইতে লাগিল।

এদিকে আনোয়ারার বার বৎসর বয়সের সময় তাহার মাতা পরলোকগমন করেন। খোরশেদ আলী ভূঞা সাহেব বিপত্নীক হইয়া দারান্তর গ্রহণের অভিলাষী হন। জামতাড়া গ্রামের আজিমুল্লা সম্প্রতি অবস্থাপন্ন লোক। গুরু মহাশয়ের পাঠশালায় লেখাপড়া শিখিয়া কিছু শিক্ষিতও হইয়াছিল। অবস্থা ভাল হইলে এবং তৎসঙ্গে কিছু শিক্ষা-দীক্ষা পাইলে নানা দিক দিয়া লোকের খেয়াল উচ্চ হয়। আজিমুল্লা নিচ বংশের সন্তান হইলেও কৌলিক মর্যাদা লাভের আশা এক্ষণে তাহার হৃদয়ে বলবতী হইয়াছে। সে ভূঞা সাহেবকে বিপত্নীক দেখিয়া, স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া তাহার সহিত বিধবা ভগ্নী গোলাপজানের পুনরায় বিবাহ দেওয়ার প্রস্তাব করিল। ভূঞা সাহেব ডাকের সুন্দরী গোলাপজানকে পূর্বেই দেখিয়াছিলেন। এক্ষণে সাধা বিবাহের প্রস্তাবে উল্লসিত হইলেন; কিন্তু কুলের দোহাই দিয়া কহিলেন, “নজরানা না পাইয়া কি করিয়া কার্য হয়? আজিমুল্লা তিনশত টাকা সেলামী দিতে স্বীকার করিল।

এই বিবাহে ভূঞা সাহেবের মাতা ‘নাম যাইবে, জাতি যাইবে, কুলে কলঙ্ক রটিবে’ বলিয়া অনেক আপত্তি করিয়াছিলেন। ভূঞা সাহেব গোলাপজানের রূপের মোহে মাতার কথায় কর্ণপাত করিলেন না। গ্রামের পাঁচজনকে দিয়া মাতাকে বুঝাইলেন, অবশেষে বিবাহ হইয়া গেল। নির্দিষ্ট দিনে প্রাণাধিক পুত্র বাদশাকে সঙ্গে করিয়া গোলাপজান তৃতীয় স্বামী ভূঞা সাহেবের ভবনে পদার্পণ করিল। বাদশা এখানে আসিয়া রামনগর মাইনর স্কুলে পড়িতে লাগিল। বাদশাকে বাদশাজাদার মতই সুন্দর দেখাইত! ভূঞা সাহেব আনন্দে তাহার সমস্ত ব্যয়ভার বহন করিতে লাগিলেন।

গোলাপজানের রূপে কি যেন এক মাদকতাশক্তি ছিল। ভূঞা সাহেব কিছুদিন মধ্যেই সেই রূপে কায়মনপ্রাণ উৎসর্গ করিলেন। আনোয়ারার মা বাঁচিয়া থাকিতে ভূঞা সাহেবের মা সংসারের সর্বময়ী কর্ত্রী ছিলেন। তাহার আদেশ উপদেশানুসারে আনোয়ারার মা সংসারের সমুদয় কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন করিতেন; শাশুড়ীকে মায়ের অধিক ভক্তি করিতেন; উপযুক্ত সময়ে তাঁহার স্নানাহারের তত্ত্ব লইতেন। আনোয়ারা তখন হামিদাদিগের আঙ্গিনায় তাহার সহিত বালিকা-স্কুলে পড়িত। ৪টি চাকরাণী বাহিরের কাজ-কর্ম নিরুত্তরে সম্পন্ন করিত। স্বামী-সোহাগ-গর্বিনী গোলাপজান অল্প দিনেই এ বন্দোবস্ত উল্টাইয়া নিজ হস্তে সংসারের ভার লইল। এরূপ করিবার তাহার দুইটি প্রধান উদ্দেশ্যে ছিল; প্রথম উদ্দেশ্য সংসারের ভার নিজ হাতে থাকিল ইচ্ছামত জিনিসপত্র মা-ভাইয়ের বাড়ি পাঠান যাইবে। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য আরও মারাত্মক!

বিধবা হইবার পর ভ্রাতার বাড়ি অবস্থানকালে গোলাপজান যখন সীমন্তিনীসোহাগ তৈলে সুগন্ধীকৃত তাহার দীর্ঘ কেশপাশ বিচিত্ররূপে খোঁপা বাঁধিয়া কুন্দদন্ত মঞ্জন রচিত করিয়া আয়ত আঁখি শোভিত করিয়া প্রতিবাসিগণের বাটীতে ভ্রমণে বহির্গত হইত তখন অন্যান্য স্ত্রীলোকেরা তাহার ভুবন-ভুলান রূপ দেখিয়া অনিমেষ-লোচনে তাকাইয়া থাকিত। কোন কোন মুখরা সরলা মুখ ফুটিয়া বলিত—”বাদশার মায়ের যেমন রূপ এমন আর কোথাও দেখি না।” বাদশার মা তখন মনে করিত তার মত সুন্দরী আর বুঝি নাই। কিন্তু যখন সে তৃতীয় স্বামী ভূঞা সাহেবের বাটীতে পদার্পণ করিয়া বার বৎসরের মেয়ে আনোয়ারাকে দর্শন করিল তখন তাহার রূপের গর্ব একেবারে চূর্ণ হইয়া গেল। বাস্তবিক বালারুণ-রাগরঞ্জিত বিকাশোন্মুখ পদ্মিনীর সহিত যেমন কীটগর্ভ শ্লথদল-দলিত জবার তুলনা সম্ভবে না, সেইরূপ সৌন্দর্য-প্রতিমা সরলা বালা আনোয়ারার সহিত যৌবনোত্তীর্ণা বিকৃতসুন্দরী গোলাপজানের উপমাই হয় না। কিন্তু না হইলেও গোলাপজান নিজ রূপের সহিত সতীন-কন্যার রূপের তুলনা করিয়া হিংসায় জ্বলিয়া উঠিল। স্বামী সোহাগে সে এক্ষণে গৃহের কর্ত্রী; সুতরাং সে নানা প্রকারে তাহার এই বিজাতীয় বিদ্বেষবিষে আনোয়ারাকে দগ্ধ করিতে আরম্ভ করিল।

সে প্রথমে আনোয়ারার পড়াশুনা বন্ধ করিয়া দিল এবং নানা ছলনায় অশ্রাব্য অকথ্য কটুক্তির সহিত তাহাকে দাসীগণের কার্যে সহায়তা করিতে বাধ্য করিল। বালিকা ভয়ে ভয়ে বিমাতার আদেশ পালনে প্রবৃত্ত হইল, ইহাতে তাহার নিয়মিত রূপে স্কুলে পড়া আর চলিল না। আনোয়ারার দাদীমা বিদূষী রমণী ছিলেন। নাতিনীর পড়া বন্ধ হওয়ায় তিনি যারপরনাই দুঃখিত হইলেন। পরন্তু তিনি মেয়েকে দাসীর কার্যে প্রবৃত্ত দেখিয়া আর সহ্য করিতে পারিলেন না।

একদিন তিনি গোলাপজানকে কহিলেন, “ বৌ, তুমি সংসারের কর্ত্রী হইয়াছ, তাহাতে আমি খুশি হইয়াছি; কিন্তু তোমার একি ব্যবহার? মেয়ে আজন্ম নিজ হাতে যাহা কখনও করে নাই, আমরা দাসীর দ্বারা যে সকল কাজ করাইয়া থাকি তুমি কোন্ আক্কেলে সেই সব কাজ আমার সোহাগের নাতনী দ্বারা করাইতেছ! তোমার জুলুমে নাতনীর আমার পড়াশুনা বন্ধ হইয়াছে। যাহা হউক ইহার পর তুমি আমার নাতনীকে যে-সে সাংসারিক কাজে কখনও ফরমাইশ করিতে পারিবে না। আমি কাল হইতে তাহাকে পড়িতে পাঠাইব।” বৃদ্ধার কথায় গোলাপজানের হৃদয়ে হিংসানল অনিবার্য বেগে জ্বলিয়া উঠিল; সে বাড়িময় তোলপাড় করিয়া উচ্চকন্ঠে নানাবিধ অকথ্য বাক্যে পঞ্চমুখে দাদী-নাতনী উভয়কে দগ্ধ করিতে লাগিল।

সেই রাত্রিতে আহারান্তে ভূঞা সাহেব তাঁহার দক্ষিণদ্বারী শয়ন-গৃহে খাটে বসিয়া পৈত্রিক রৌপ্য-ফরসীতে চিন্তিতমনে তামাক সেবন করিতে করিতে স্ত্রীকে কহিলেন, “দেখ, আজ সকালে তুমি যে কেলেঙ্কারী করিয়াছ, তাহাতে আমার কোন স্থানে মুখ দেখাইবার উপায় নাই।” গোলাপজান শুনিবামাত্র ক্রোধ কটাক্ষে গ্রীবা উন্নত করিয়া কহিল, “কি করিয়াছি?” ভূঞা সাহেব যতটুকু বিরক্ত হইয়া কথাটি পাড়িয়াছিলেন, গোলাপজানের ক্রোধ- কটাক্ষ দর্শনে ততটুকু থামিয়া গেলেন। এটকু সুর নরম করিয়া কহিলেন, “মা ও মেয়েকে বাপান্ত করিয়া গালা-গালি করিয়াছ কেন?” গোলাপজান গর্বভরে নিঃসঙ্কোচে কহিল, “বেশ করিয়াছি, আরও করিব।” ভূঞা সাহেব দুঃখিত স্বরে কহিলেন, “কথা বলিলেই তেলেবেগুনে জ্বলিয়া উঠ, তোমাকে আর কি বলিব?”

গো-জান। সাধে কি জ্বলিয়া উঠিতে হয়!

ভূ-সা। মা ও মেয়ে তোমার কি অনিষ্ট করিয়াছিল?

গো-জান। না, তাহারা আর অন্যায় করিবে কি? তাহারা পীর-মোরশেদের মত শুইয়া- বসিয়া খাইলে কোন দোষ নাই? আর আমি রাত-দিন আগুনের তাতে চুলার গোড়ে বসিয়া বাঁদী-দাসীর মত খাটুনী খাটিয়া তাহাদিগকে দু’একটা কাজের কথা বলিলেই যত দোষ।

ভূ-সা। কাজের কথা ছোট গলায় আদরের সহিত বলিলে দোষ হয় না। কিন্তু বাজারে- স্ত্রীলোকদিগের ন্যায় পাড়া মাথায় করিয়া অকথ্য-বাক্যে গালাগালি করিলে জাত-মান থাকে না। আমাদের ঘরে বৌ-ঝি অমন করিয়া গলাবাজী ও ইতরামী করিলে সমাজের নিকট আমাদের মুখ দেখান ভার হয়।

গো-জান (ক্রোধ-কম্পিত আননে)। হ্যাঁ, আমি বাজারে স্ত্রীলোক—আমি ইতর। এই বলিয়া অতি রোষে ঝট্‌কা দিয়া খাট হইতে নামিয়া পড়িয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া যাইবার উপক্রম করিল। ভূঞা সাহেব ভাবিলেন, যদি এ সময় ঘর হইতে চলিয়া যায় তবে মহাবিভ্রাট ঘটাইবে। হয় রাতারাতি জামতাড়া চলিয়া যাইবে, না হয় কুস্থানে রাত কাটাইয়া আমার মুখে চুন-কালি দিবে। এ নিমিত্ত তিনি হুকার নল ফেলিয়া থাবা দিয়া তাহার বস্ত্রাঞ্চল ধরিয়া ফেলিলেন। কিন্তু গোলাপজানের সক্রোধ বল প্রকাশে তাহার অবগুন্ঠন খুলিয়া গেল। ভূঞা সাহেব দেখিলেন, গোলাপজানের দুধে-আলতা-মাখান দেহলাবণ্য ভিত্তিগাত্র সংলগ্ন সুশুভ্র কাচ কাঞ্চনরশ্মি-প্রভায় জুলেখার সৌন্দর্যকে পরাভূত করিয়াছে। এই অপরূপ সৌন্দর্যসন্দর্শনে ভূঞা সাহেবের মস্তিষ্ক ঘুরিয়া গেল; তিনি গোলাপজানের হাত ধরিয়া বিনীতভাবে বলিতে লাগিলেন, “প্রিয়ে! আমাকে ত্যাগ করিয়া কোথায় যাইতেছ? তোমার অভাবে যে আমি দশ দিক অন্ধকার দেখি। রাগের মাথায় দু’কথা বলিয়াছি বলিয়াই কি ঘর হইতে বাহির হইয়া যাইতে হয়? এঘর-সংসার, গরু-বাছুর, চাকর-চাকরাণী সবই যে তোমার, সকলকেই যে তোমার হুকুম মত চলিতেই হইবে।” স্বামী এই সামান্য ঘটনায় অমন ভাবে অপরাধ স্বীকার করিলে, অতি দুর্জন স্ত্রীলোকের মনও অনেকটা কোমল হইয়া আসে। গোলাপজানের মনও নরম হইল, সে ক্রন্দনের স্বরে বলিল, “আমি কি তোমার গৃহস্থালীর লোকসান দেখিতে পারি? তোমারই সংসারের আয়-উন্নতির নিমিত্ত শরীর মাটি করিতেছি। আর তোমার কলাগাছের মত মেয়ে কেবল ফুলের সাজি হইয়া শুইয়া বসিয়া কাল কাটাইবে তাহাকে তোমারই সংসারের কাজে এক-আধটুকু ফরমাইস করিলে তোমার মা মুখে যা আসে তাই বলিয়া আমাকে গালিগালাজ করে, পারে ত’ ধরিয়া মারে। এমনভাবে আমি আর তোমার সংসার করিতে চাই না। তুমি আমাকে আমার ভাইয়ের বাড়িতে পাঠাইয়া দাও, সুন্দরী বিবি আনিয়া সংসার কর।” ভূঞা সাহেব দেখিলেন, তাঁহার প্রেয়সীর নয়নযুগল অশ্রুপ্লাবিত হইয়াছে; মনও খুব কোমল হইয়া আসিয়াছে। তখন তিনি প্রিয়তমার হস্ত ত্যাগ করিয়া তাহার স্খলিত অঞ্চলযোগে গলিত-নয়নবারি মুছাইয়া দিয়া কহিলেন, “প্রাণাধিকে! আর রাগ করিও না। তোমার ইচ্ছামত সংসার চালাও, আমি আর কিছুই বলিব না।” এই বলিয়া তিনি আদর পূর্বক তাহাকে খাটে তুলিলেন। সে রাত্রির পালা এইরূপেই শেষ হইল।

ভূঞা সাহেব গোলাপজানকে বিবাহ করিয়া শেষ জীবনে এইরূপ অভিনয় আরও অনেকবার দেখাইয়াছেন এবং ‘দেহ পদপল্লবমুদারম্’ বলিয়া পটক্ষেপ করিয়াছেন।

এস্থলে আমি মধুপুরের আর একটি ভদ্র পরিবারের সংক্ষিপ্ত বিবরণ ধৈর্যশীল প্রিয় পাঠক-পাঠিকাকে উপহার দিয়া আবদ্ধ পরিচ্ছেদ শেষ করিব।

এই ভদ্র পরিবারের অভিভাবকের নাম—ফরহাদ হোসেন তালুকদার। ইনি আমাদের হামিদার পিতা ও বালিকা-বিদ্যালয়ের শিক্ষক। ভূঞা সাহেবের বাড়ির সহিত সংলগ্ন পশ্চিমাংশে ইহার বাটী। নিজ বাটীতেই বিদ্যলয়। বিদ্যালয়ে পর্দার সুন্দর বন্দোবস্ত। বিবাহিতা অবিবাহিতা অনেক মেয়ে এই স্কুলে অধ্যয়ন করে। মধুপুরে তালুকদার সাহেবেরা বনিয়াদী ঘর। কালচক্রে তালুকের অনেকাংশে পরহস্তগত হইয়াছে; অবশিষ্ট তালুকের বার্ষিক আয় তিনশত টাকা মাত্র। তালুকদার সাহেবের খামারে তিন খাদা জমি। জমি বর্গা বা আধি দিয়া যে শস্যাদি প্রাপ্ত হন, তদ্বারা তাঁহার সংসার-খরচ চলিয়া যায়। পরিবারের মধ্যে স্ত্রী, কন্যা, এক শিশুপুত্র, এক চাকরানী ও একটি রাখাল চাকর। তালুকদার সাহেবের স্ত্রী শিক্ষিতা; কন্যা হামিদাকে তাঁহারা নিজ হাতে শিক্ষা পূর্বোল্লিখিত বেতা গ্রামে একটি সম্ভ্রান্তবংশীয় যুবকের সহিত বিবাহ দিয়াছেন। হামিদার স্বামী বি. এ. পাস করিয়া এক্ষণে কলিকাতার ল-ক্লাশে পড়িতেছেন। ফরহাদ হোসেন তালুকদার সাহেবের ন্যায় আত্মপ্রসাদী সুখী লোক অতি বিরল। ভূঞা সাহেবের সহিত তালুকদার সাহেবের বংশগত কোন আত্মীয়তা নাই; কিন্তু বহুকাল একত্র একস্থানে বাস করিয়া উভয় পরিবারে আত্মীয়তা অপেক্ষাও অধিকতর ঘনিষ্টতা জন্মিয়া গিয়াছে। ভূঞা সাহেব অপেক্ষা তালুকদার সাহেব বয়সে বড়, জ্ঞানে প্রবীন, স্বভাবে শ্রেষ্ঠ ও ধর্মে উন্নত। ভূঞা সাহেব সংসারের গুরুতর বিষয় তালুকদার সাহেবকে জিজ্ঞাসা না করিয়া সম্পন্ন করেন না।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, আনোয়ারা যে দুর্বিষহ শিরঃপীড়ায় ও জ্বরাতিশয্যে শয্যাশায়িনী হইয়া ছট্‌ফট্ করিতেছিল ও প্রবাল বকিতেছিল, আমরা আনুষঙ্গিক কথা-প্রসঙ্গে এ পর্যন্ত তাহার কোন তত্ত্ব লই নাই; এক্ষণে আসুন, আমরা ভূঞা সাহেবের অন্তঃপুরে প্রবেশ করিয়া একবার সেই পর্দানশীল আনোয়ারাকে দেখিয়া আসি। ঐ শুনুন, “মাথা গেল—মাথা গেল!” বলিয়া বালিকা চিৎকার করিতেছে। স্নেহশীলা দাদী-মা তাহার পিঠের কাছে বসিয়া চোখের জলে বুক ভাসাইতেছে।

এমন সময় ভূঞা সাহেব একবার ঘরের দ্বারে আসিয়া উঁকি মারিয়া কহিলেন “মা, রাত্রিতে মেয়ের কি কোন অসুখ করিয়াছিল, হঠাৎ এরূপ হইবার কারণ কি?” জননী চোখের পানি মুছিয়া কহিলেন, “কি জানি বাছা, রাত্রিতে মেয়ের ভাত খাইতে যাওয়ায় একটু বিলম্ব হইয়াছিল বলিয়া বৌ তাহাকে বাপান্ত করিয়া গালাগালি করিয়াছিল, তাই বাছা আমার, ঘেন্নায় ভাত-পানি ত্যাগ করিয়া ঘরে আসিয়া শোয়। শেষ রাত্রিতে যখন আমি তাহাজ্জদের নামাজ পড়িতে উঠি, তখন মেয়ে ঘুমের ঘোরে দুই-তিন বার জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে শেষে ‘মা, মা’ বলিয়া কাঁদিয়া উঠে। ভোরে হাত-মুখ ধুইয়া ঘরে আসিয়াই তাহার এ দশা হইয়াছে। নাক-চোখ-মুখ জবাফুলের মত লাল হইয়াছে, গা দিয়া আগুন ছুটিতেছে, থাকিয়া থাকিয়া প্রলাপ বকিতেছে। হামিদার মা দেখিয়া কহিল, “মেয়ের অবস্থা ভাল নয়। সত্বর ডাক্তার দেখান। “

ভূঞা সাহেব তখন ঘরে উঠিয়া স্বচক্ষে মেয়ের পীড়ার অবস্থা দেখিয়া চিন্তিত হইলেন এবং ধীরে ধীরে কহিলেন, “এখন কি করা যায়? ভাল ডাক্তার নিকটে নাই, টাকা-পয়সাও হাতে নাই, পাটগুলি খরিদ্দার অভাবে বিক্রয় হইতেছে না, এখন উপায় কি?”–এই বলিয়া তিনি ঘর হইতে বাহিরে আসিলেন। ছেলের কথা শুনিয়া মা ভাঙ্গিয়া পড়িলেন। এই সময় দক্ষিণদ্বারী ঘরের বারান্দায় বসিয়া গোলাপজান মাতা পুত্রের কথাবার্তা উৎকর্ণ হইয়া শুনিতেছিল। ভূঞা সাহেব প্রাঙ্গণে পর্দাপণ করিবামাত্র সে কুপিতা-বাঘিনীর মত গর্জিয়া উঠিল, কহিল “আমার গালির চোটে তোমাদের সোনার কমল শুকাইতে বসিয়াছে, এখন আর কি, পালের বড় গরুটা বেচিয়া তাহার জন্য ডাক্তার আনা হউক। তা যাহাই করা হোক, ফরেজ (আজিমুল্লার পুত্র) কাল টাকার জন্য আসিয়াছিল, তাহাদের খুব ঠেকা। আমি বলিয়া দিয়াছি, পাট বিক্রয় হইলেই তোমাদের টাকা দেওয়াইব। আমি ভাল মুখে বলিতেছি, আমার ভাইয়ের বিনা সুদের হাওলাতি টাকা শোধ করিয়া, যাহা মনে চায়, তাহাই যেন করা হয়।” এই বলিয়া গোলাপজান ঘৃণার সহিত মুখ নাড়া দিয়া সবেগে রান্নাঘরের আঙ্গিনার দিকে চলিয়া গেল। ভূঞা সাহেব অপরাধী মানুষের মত চুপটি করিয়া বাহির বাড়িতে আসিলেন। এই সময়ে আনোয়ারা পুনরায় প্রলাপ বকিয়া উঠিল, “মাগো, আমাকে কাছে লইয়া যাও, আমি আর এখানে থাকিব না।”

বেলা এক প্রহর অতীত হইয়াছে; একখানি পাসী ভূঞা সাহেবের বাহির বাড়ির সম্মুখ দিয়া পশ্চিম মুখে চলিয়া যাইতেছিল। নৌকার মাঝি ভূঞা সাহেবকে দেখিয়া কহিল, আপনাদের পাড়ায় পাট পাওয়া যাইবে?” ভূঞা সাহেব কহিলেন, “হ্যাঁ, আমার বাড়ি এবং আরও অনেক বাড়িতে পাট মজুদ আছে।” মাঝি নৌকার গতিরোধ করিয়া তাঁহার ঘাটে নৌকা বাঁধিল। একটি ভদ্রলোক ও তাঁহার পিছনে পিছনে আর একটি লোক পাট দেখিবার নিমিত্ত ভূঞা সাহেবের বাড়ির উপর নামিলেন। ভূঞা সাহেব ভদ্রলোকটিকে দেখিয়া কেমন যেন এক ধাঁধায় পড়িয়া অনেকক্ষণ তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন; পরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনাদের নৌকা কোথাকার?” সঙ্গীয় লোকটি বলিল, “বেলগাঁও জুট কোম্পানির।” ভদ্রলোকটিকে লক্ষ্য করিয়া কহিল, “ইনিই সেই কোম্পানির বড়বাবু।” ভূঞা সাহেবের ধাঁধা কাটিয়া গেল। বেলগাঁও বন্দরে সকলেই ভদ্রলোকটিকে ‘বড়বাবু’ বলিয়া সম্ভাষণ করিয়া থাকে। বড়বাবু কোম্পানির আদেশে পাটের অবস্থা দেখিয়া যান এবং নমুনস্বরূপ ২/৪ নৌকা বোঝাই করিয়া পাট লইয়া থাকেন। এবারও তিনি সেই উদ্দেশ্যেই মফঃস্বলে আসিয়াছেন।

ভূঞা সাহেব বড় বাবুকে সম্মানের সহিত নিজের বৈঠকখানায় বসিতে দিলেন। তাঁহার একজন চাকর একতাড়া পাট আনিয়া বড়বাবুর সম্মুখে রাখিল। সঙ্গীয় লোকটি পাট খুলিয়া নাড়িয়া চাড়িয়া দেখিতে লাগিল। এই সময় তালুকদার সাহেবও পাট বিক্রয় মানসে তথায় আসিলেন। তিনিও প্রথমে বড়বাবুকে দেখিয়া চমকিয়া উঠিলেন। আবার এই সময় আমাদের ভোলার মা কার্যোপলক্ষে বহির্বাটিতে আসিল। ঊর্ধ্বশ্বাসে বাড়ির মধ্যে যাইয়া, হামিদার মাকে কহিল, “মা-জান, মজার কাণ্ড—দুলামিয়া যে পাটের বেপারী।” হামিদার মা কহিলেন,

“তুমি বল কি?” ভোলার মা কহিলেন, “আমার চোখের কসম, সত্যি বলিতেছি দুলামিয়া ভূঞা সাহেবের বৈঠকখানায় বসিয়া পাঠ কিনিতেছেন!” হামিদার মা কহিলেন, “উনি কোথায় গেলেন?” ভোলার মা কহিল, “তিনি দুলামিয়ার কাছে গিয়াছেন।” হামিদার মা তখন ভোলার মাকে কহিলেন, ‘তুমি এখন যাও, তাঁহাকে বাড়িতে ডাকিয়া আন।” ভোলার মা পুনরায় বহির্বাটীর দিকে চলিল। এবার মা ও মেয়ে উভয়ে সন্দেহের দোলায় ঘুরপাক খাইতে লাগিলেন।

এদিকে বহির্বাটীতে পাটের দর-দস্তুর চলিতেছে; এমন সময় ভূঞা সাহেবের অন্তঃপুরে অস্ফুটস্বরে ক্রন্দনের রোল উঠিল। তালুকদার সাহেব কহিলেন, “বাটীর ভিতরে কাঁদে কে?”

ভূ-সা। বোধ হয় মা।

তালু। কেন! কি হইয়াছে?

ভূ-সা। মেয়েটি ভয়নাক কাতর হইয়া পড়িয়াছে।

তালুকদার সাহেব “বল কি!” বলিয়া বাড়ির মধ্যে চলিয়া গেলেন; কিয়ৎক্ষণ পরে ফিরিয়া আসিয়া ভূঞা সাহেব কহিলেন, “তোমার মত নির্দয় লোক ত আর দেখা যায় না। তুমি আসন্নমৃতা কন্যাকে ঘরে রাখিয়া পাট বিক্রয় করিতেছ! সত্বর ডাক্তার ডাক।”

এই সময় বড়বাবুর সঙ্গীয় লোকটি আড়ালে যাইয়া তামাক খাইতেছিল। সে বাবুর সাক্ষাতে তামাক খায় না। এ ব্যক্তি পাটের যাচনদার, বড়বাবুর সঙ্গে থাকে। যাচনদার পীড়ার কথা শুনিয়া ভূঞা সাহেবকে ছোট ছোট করিয়া কহিল, “আমাদের বড়বাবু খুব ভাল ডাক্তার, বাক্সভরা ঔষধপত্র ইহার নৌকায় আছে। ইহার মত জনতিহৈষী লোক আমরা দেখি না। পীড়িতের প্রাণরক্ষার জন্য ইনি নিজের প্রাণ তুচ্ছ জ্ঞান করেন। এমন কি চিকিৎসার জন্য কাহারও নিকট টাকা-পয়সা লন না। আপনি ইহার দ্বারা আপনার কন্যার চিকিৎসা করাইতে পারেন।” কৃপণস্বভাব ভূঞা সাহেব বিনা টাকায় চিকিৎসা হইতে পারিবে মনে করিয়া আশ্বস্ত হইলেন; কিন্তু কন্যা বয়স্থা মনে করিয়া ইতস্তত করিতে লাগিলেন। অবশেষে তালুকদার সাহেবকে সমস্ত কথা খুলিয়া বলায় তিনি বলিলেন “যে অবস্থা, তাহাতে পর্দার সম্মান রক্ষা অপেক্ষা এক্ষণে চেষ্টা করিয়া মেয়ের প্রাণ রক্ষা করাই সুসঙ্গত মনে করি; আমাদের হাদিসেও এইরূপ বিধান আছে।

ভূঞা সাহেব তখন আর দ্বিধাবোধ না করিয়া বড়বাবুকে যাইয়া কহিলেন, “জনাব! শুনিলাম আপনি একজন ভাল চিকিৎসক। আমার একটি কন্যা প্রাণসংশয়াপন্ন কাতর; আপনি মেহেরবাণীপূর্বক তাহার চিকিৎসা করিলে সুখী হইতাম।” বড়বাবু কহিলেন, ‘আমি চিকিৎসক নহি, তবে নিজের প্রয়োজনবশত ঔষধপত্র সঙ্গে রাখি, সময় ও অবস্থাবিশেষে অন্যকেও দিয়া থাকি।” ভূঞা সাহেব কহিলেন, “তা যাহাই হউক, এই আসন্ন বিপদে আমার উপকার করিতেই হইবে।” বড়বাবু তখন পীড়ার অবস্থা শুনিয়া শিষ্টাচার জানাইয়া কহিলেন, “তবে একবার দেখা আবশ্যক।”

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

যমুনার কৃশাঙ্গী তনয়াদ্বয় প্রকৃতির বিধানে যে স্থানে মিলিত হইয়া কোলে গা-ঢালিয়া দিয়াছে, সেই সঙ্গমস্থলের দক্ষিণতীরে রতনদিয়া গ্রাম। নীচজাতীয় কয়েক ঘর হিন্দু ব্যতিত গ্রামের অধিবাসী সবই মুসলমান। মুসলমানদিগের মধ্যে আমির-উল-এসলাম নামের একজন অবশিষ্ট ভদ্রলোকের বাস। তিনি গ্রাম হইতে একমাইল দূরে নীলকুঠিতে দেওয়ানী করিতেন। তিনি প্রথমে ময়মনসিংহ জেলায় হাজী সফীউদ্দিন নামক জনৈক পরম ধার্মিক মহাত্মার কন্যাকে বিবাহ করেন। এই শুভ প্রণয়ের প্রথম ফলস্বরূপ আমির-উল-এসলাম সাহেব একটি পুত্রসন্তান লাভ করেন। পিতার নিজ নামের সহিত সামঞ্জস্য রাখিয়া পুত্রের নাম রাখিয়াছিলেন—নুরুল এসলাম। নীলকুঠিতে দেওয়ানী করিতেন বলিয়া আমির-উল-এসলাম সাহেবের বংশ দেশের সর্বত্র দেওয়ান আখ্যায় পরিচিত।

সাধারণত নীলকুঠির প্রভু ও ভৃত্যগণের মধ্যে যেরূপ উৎকোচ-প্রিয়তার পরিচয় পাওয়া যায়, তাহাতে দেওয়ান আমির-উল-এসলাম সাহেবের আর্থিক অবস্থা খুব উন্নত হওয়া উচিত ছিল; কিন্তু তিনি ধর্মশীলা পত্নীর সংসর্গে ধর্মসাধনে যেরূপ উন্নত হইয়াছিলেন, আর্থিক উন্নতি বিষয়ে সেরূপ কৃতকার্যতা লাভ করিতে পারেন নাই। তবে তিনি ন্যায়-পথে থাকিয়া যাহা উপার্জন করিতেন, তাহাতে মিতব্যয়শীলা পত্নীর গুণে সংসারের অভাব পূর্ণ হইয়া কিছু কিছু উদ্বৃত্ত থাকিত। শেষে তিনি তদ্দ্বারা বার্ষিক পাঁচশত টাকা আয়ের একটি ক্ষুদ্র তালুক খরিদ করেন।

নুরুল এসলামের বিদ্যাশিক্ষার জন্য তাঁহার পিতা সমধিক মনোযোগী ছিলেন। দ্বাদশ বৎসর বয়ক্রমকালে নুরল এসলাম স্থানীয় নবপ্রতিষ্ঠিত মাইনর স্কুল হইতে বৃত্তিলাভ করেন; কিন্তু দুঃখের বিষয় এই বৎসর তাঁহার জননী তাঁহাকে ও তাঁহার দুইটি শিশু ভগিনীকে পরিত্যাগ করিয়া পরলোকগমন করেন। আমির-উল-এসলাম সাহেব পত্নীবিয়োগে সংসার অন্ধকার দেখিতে লাগিলেন বটে, তথাপি পুত্রের বিদ্যাশিক্ষার ঔদাসীন্য প্রকাশ করিলেন না। সময় মত তিনি পুত্রকে তাহার মাতুলালয়ে রাখিয়া ময়মনসিংহ জেলা স্কুলে পড়ার বন্দোবস্ত করিয়া দিলেন।

এদিকে সংসার অচল হইলেও গুণবতী প্রিয়তমা পত্নীর কথা স্মরণ করিয়া, দেওয়ান সাহেব দুই বৎসর যাবৎ বিবাহ করিলেন না। শেষে দেশস্থ নানা লোকের প্ররোচনা ও পরামর্শে নিজ গ্রামের দক্ষিণ গোপীনপুর গ্রামে মহোচ্চ বংশে আলতাফ হোসেন নামক এক ব্যক্তির বয়স্কা রূপবতী কনিষ্ঠা ভগিনীকে তালুকের অর্ধেক কাবিন দিয়া বিবাহ করিলেন। কালক্রমে এই পক্ষে দেওয়ান সাহেবের একটি কন্যা জন্মগ্রহণ করিল। এই কন্যা জন্মগ্রহণের পর নুরল এসলামের অপ্রাপ্ত বয়স্কা ভগিনীদ্বয়ের আর এ সংসারে তিষ্টান দায় হইল। পত্নীর বিদ্বেষ-ব্যবহারে ব্যথিত হইয়া দেওয়ান সাহেব কন্যাদ্বয়কেও তাহাদের স্নেহময়ী মাতামহীর নিকট ময়মনসিংহে পাঠাইয়া দিলেন। নুরল এসলাম ছুটির সময় মাতুলালয় হইতে বাড়িতে আসিতেন; কিন্তু বিমাতার ব্যবহারে শান্তি লাভ করিতে না পারিয়া স্কুল খুলিবার পূর্বেই ময়মনসিংহে চলিয়া যাইতেন। স্নেহশীল পিতা পুত্রের মানসিক কষ্ট অনুভব করিয়া নীরবে, নির্জনে অশ্রুমোচন করিতেন এবং নানাবিধ প্রবোধবাক্যে পুত্রের চিত্তবিনোদন করিতে প্রয়াস পাইতেন।

নুরল এসলাম চারি বৎসরে বৃত্তিসহ এনট্রান্স পাস করিয়া কলিকাতায় পড়িতে গেলেন। তাঁহার পিতা তাহাকে মাসে মাসে বৃত্তির উপর ২০/২৫ টাকা করিয়া খরচ পাঠাইতে লাগিলেন। খোদার ফজলে নুরল এসলাম দুই বৎসরেই প্রশংসার সহিত এফ.এ. পাস করিয়া বি.এ. পড়িতে আরম্ভ করিলেন; কিন্তু বৎসরের শেষে অকস্মাৎ নিদারুণ সান্নিপাতিক জ্বরে তাঁহার পিতার মৃত্যু ঘটায় নুরল এসলাম পরমারাধ্য পিতার অভাবে সংসার অন্ধকার দেখিতে লাগিলেন। বিমাতার চক্রান্তে ভূসম্পত্তি ও গৃহস্থালী নিবষ্ট হইবে ভাবিয়া, অগত্যা তিনি সে সকলের ভার নিজ হাতে লইলেন। সুতরাং বি.এ. পাস করা তাঁহার ভাগ্যে ঘটিল না।

প্রতিভাবলে পঠিত বিদ্যায় নুরল এসলাম যেরূপ কৃতকার্যতা লাভ করিয়াছেন, তৎসঙ্গে ভূয়োদর্শন-জনিত জ্ঞানও কম লাভ করিয়াছিলেন না। তিনি দেখিয়াছিলেন, চাকুরিজীবীর শারীরিক ও মানসিক সমুদয় ইন্দ্রিয় সর্বক্ষণ প্রভুর মনোরঞ্জন সম্পাদনের জন্য নিয়োজিত রাখিতে হয়, স্বাধীন ভাবে মানব-জীবনের মহতুদ্দেশ্য সাধনের সুযোগ তাঁহার ভাগ্যে বড় ঘটিয়া উঠে না; এ নিমিত্ত চাকুরিকে তিনি অন্তরের সহিত ঘৃণা করিতেন। বি.এ. পাস করিয়া স্বাধীন ব্যবসায়ের দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করিবেন, ইহাই তাঁহার জীবনের স্থির সঙ্কল্প ছিল।

কিন্তু পিতার মৃত্যুতে হঠাৎ তাঁহার ভাগ্যবিপর্যয় ঘটিল। তথাপি তিনি অভীপ্সিত সঙ্কল্পের প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া আপাতত বাড়ি হইতে ছয় মাইল পূর্বে বেলাগাঁও বন্দরে জুট-কোম্পানির অফিসে ৩৫ টাকা বেতনে চাকুরি গ্রহণ করিলেন। সপ্তাহে ২/১ বার আসিয়া বাড়ি-ঘরের তত্ত্বাবধান লইতে লাগিলেন।

পাঠ্যাবস্থায় অনেক ভাল ঘর হইতে তাঁহার বিবাহের সম্বন্ধ আসিয়াছিল; কিন্তু তিনি বি.এ. পাস করিয়া; উপার্জনক্ষম না হইলে বিবাহ করিবেন না প্রকাশ করায় তাঁহার পিতা সমস্ত সম্বন্ধ প্রত্যাখ্যান করিয়াছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর সংসারের সমস্ত ভার তাহাকে নিজ স্কন্ধে লইতে হইল, তিনি উপার্জনে নিযুক্ত হইলেন। এই সময়ে তঁহার বিমাতা তাহাকে এক দুরাশার ফাঁদে ফেলিবার চেষ্টা করিলেন। বিমাতার বিবাহযোগ্যা এক পরমাসুন্দরী ভ্রাতুষ্পুত্রী ছিল। তিনি ভাবিলেন, পতির অর্ধেক সম্পত্তি কাবিন-স্বত্বে তাহার প্রাপ্য হইয়াছে; এক্ষণে ভ্রাতুষ্পুত্রীকে নুরল এসলামের সহিত বিবাহ করাইয়া অপরাধ সম্পত্তি সেই কন্যার নামে লিখাইয়া লইবেন, তাহা হইলে প্রকারান্তরে সমস্ত সম্পত্তি তাহারই আয়ত্তে আসিবে, তিনি সংসারের কর্ত্রী হইয়া সুখে কাল কাটাইবেন। এইরূপ দুরাশায় প্রলুব্ধ হইয়া তিনি অগৌণে নুরল এসলামের সহিত ভ্রাতুষ্পুত্রীর বিবাহ সম্বন্ধ উত্থাপন করিলেন। নুরল এসলাম এ প্রস্তাব শুনিয়া জনৈক প্রবীণ আত্মীয়ের দ্বারা বিনয়সহকারে মাতাকে জানাইলেন, “আমি আপাতত বিবাহ করিব না, আপনার ভ্রাতুষ্পুত্রীকে অন্যত্র সৎপাত্রে বিবাহ দিউন।” পিতা যে বংশে কাবিন দিয়া নগদ অজস্র অর্থাদি ব্যয় করিয়া বিবাহ করিয়াছেন, মুরব্বিহীন নুরল এসলাম সেই উচ্চকুলোদ্ভবা সুরূপা পাত্রীকে বিবাহ করিতে অসঙ্কোচে অম্লান বদনে অস্বীকার করিলেন। ব্যাপার সহজ নহে। কিন্তু আমাদিগের অনুমান হইতেছে, এই প্রত্যাখ্যানের জন্য নুরল এসলামকে মর্মঘাতী ক্লেশ ভোগ করিতে হইবে, অশান্তির দাবানলে হয়ত তাহার জীবনের প্রথম ভাগ দগ্ধীভূত হইবে। যাহা হউক, তজ্জন্য আমরা নুরল এসলামকে এক্ষণে দোষী সাব্যস্ত করিতে পারি না। কারণ, ভবিষ্যতের গর্ভে কি আছে, কে বলিতে পারে? ভবিষ্যৎ বড়ই দুর্গম। মানুষ মানুষের পেটের কথা টানিয়া বাহির করে, বিজ্ঞানবলে তড়িৎ ধরে, আকাশে উড়ে, সাগরে ভাসে, পাতালে প্রবেশ করে, আবার মরা মানুষ জীবিত করিতে চায়; কিন্তু প্রত্যক্ষের অন্তরালে যে যবনিকা আছে তাহা ভেদ করিবার কথা ধারণায় আনিতেও অক্ষম। নুরল এসলাম ত নগণ্য যুবক।

নুরল এসলাম বুঝিয়াছিলেন, সংসার জীবনের সুখের মূল ধর্ম, অর্থকাম মোক্ষের সহায়। পারিবারিক ধর্মভাব ও প্রীতি-পবিত্রতা, অশিক্ষিতা স্ত্রীলোক সংসর্গে পাইবার আশা, মরুভূমিতে নন্দনকাননের সুখসৌন্দর্য ভোগের আশার ন্যায় দুরাশামাত্র। আমরা বাহিরের অবস্থায় যত লোককে ধনী, মানী, গুণি জানিয়া সুখী মনে করিয়া থাকি, ভিতরের অবস্থায় তাঁহাদের অধিকাংশ লোক প্রকৃতপক্ষে সুখী নয়, বরং নিরয়-নিবাসী; পরন্তু তাঁহাদের অর্ধাঙ্গিনী—অশিক্ষিতা সহধর্মিণীগণই যে এই নিরয়-রাজ্যের প্রতিষ্ঠাত্রী তাহাও সুনিশ্চিত। এই নিমিত্ত অশিক্ষিতা রমণীর প্রতি তাঁহার বিজাতীয় ঘৃণা ছিল। তিনি আরও দেখিয়াছিলেন, এদেশে যাহারা উচ্চকুলোদ্ভব বলিয়া অভিমান করেন, তাঁহাদের মধ্যে অনেকেই প্রাচীন আরবি-ফারসি বিদ্যা শিক্ষার একরূপ উদাসীন, অথচ আধুনিক পাশ্চাত্য-শিক্ষালাভে সবিশেষ মনোযোগী নহেন; পরন্তু কেবল কুলের দোহাই দিয়া ধরাকে সরা জ্ঞান করেন। পারিবারিক স্বর্গীয়-পবিত্রতা ইঁহাদের মধ্যে বড় দেখা যায় না। ইঁহাদের ২/৪ জন আবার একাধিক বিবাহ করিয়া, সেই সুখ-শান্তির মূলে কুঠারাঘাত করিয়া থাকেন এবং নিজে সেই আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হইয়া জীবনৃতভাবে কালকর্তন করেন। এইরূপ দেখিয়া ঐ সম্প্রদায়ের প্রতি তিনি শ্রদ্ধাবান ছিলেন না। তিনি নিজ পরিবারেই সংসার ধর্মের দ্বিবিধ অবস্থা সন্দর্শ করেন। প্রথমে দেখিয়া ছিলেন, তাঁহার জননী জীবিতকাল পর্যন্ত অতি প্রতুষ্যে উঠিয়া সর্বাগ্রে তাহার পিতার প্রাতঃকৃত্যের আয়োজন করিয়া দিতেন, পরে তিনি নিজে অজু করিয়া ফজরের নামাজ পড়িতেন। শেষে এক ঘণ্টা কোরআন শরীফ পাঠ করিয়া গৃহস্থালীর কার্যে মনোযোগীণী হইতেন এবং তাহা পরিপাটিরূপে সম্পন্ন করিয়া পিতার স্নানাহারের আয়োজন করতঃ পথপানে চাহিয়া থাকিতেন। তিনি নীলকুঠি হইতে পরিশ্রান্ত দেহে ঘরে ফিরিলে, মা তাঁহাকে বসিতে আসন দিয়া পাশে দাঁড়াইয়া বাতাস করিতেন। অনন্তর স্বহস্তে তাঁহাকে স্নানাহার করাইয়া শেষে চাকর-চাকরাণীদিগের আহারের তথ্য লইতেন, পরে নিজে আহারে যাইতেন। পিতার স্নানাহারের পূর্বে দিন কাটিয়া গেলেও মা আহার করিতেন না।

পিতার পীড়ার সময় মায়ের অবস্থায় দেখা যাইত পীড়া যেন তাঁহারই হইয়াছে। জননীর জীবিতকাল পর্যন্ত নুরল এসলাম সংসারের অভাব-অশান্তি কখনও প্রত্যক্ষ করেন নাই। আবার তাঁহার জননীর মৃত্যুর পরও বিমাতা যখন গৃহস্থালীর কর্ত্রী হইলেন, তখন তিনি দেখিতে লাগিলেন,—পিতার সেবাশুশ্রূষার জন্য ডাক পড়িলে কেবল চাকরাণীরাই তাঁহার সন্নিহিত হইত; বিমাতা কেবল সময় সময় অভাব-অভিযোগের কথা লইয়া পিতার নিকট উপস্থিত হইতেন। তাঁহার গর্ভজাত কন্যা ও নিজের সুখ-সুবিধা ছাড়া তিনি আর অন্য কোনদিকে নজর করিবার বড় অবসর পাইতেন না। মূল্যবান বস্ত্রালঙ্কার ও সুগন্ধি তৈলাদির জন্য তিনি পিতাকে অহরহ ত্যক্ত-বিরক্ত করিতেন। তাঁহার গতি-বিধিতে, তাঁহার প্রত্যেক কথায়, তাঁহার প্রতি নিঃশ্বাসে কেবল আভিজাত্যের অভিমানই প্রকাশ পাইত। এই খেয়ালের বশে তিনি পিতাকে আন্তরিক ভক্তি করিতে পারিতেন না। প্রবীন পিতা বিমাতার এই ভাব সবই বুঝিতেন এবং বুঝিয়া অনুতাপে দগ্ধ হইতেন, কিন্তু মুখ ফুটিয়া কিছু বলিতেন না। পিতা ১৪ দিনের জ্বরে প্রাণত্যাগ করেন; এই ১৪ দিন নুরল এসলাম ও তাহার ফুফুআম্মা দিনরাত খাটিয়া তাঁহার সেবাশুশ্রূষা করেন। এই সময় বিমাতা যে তাঁহার পরিচর্যা করেন নাই, তাহা নহে; কিন্তু তাঁহার পরিচর্যায় আন্তরিক অনুরাগ ছিল না। মৃত্যুর পূর্বে পিতার যখন শ্বাসকষ্ট উপস্থিত হইল ফুফু-আম্মা ফুকারিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন, বিমাতাও পতিশোকে শোকাকুলিতা হইলেন বটে; কিন্তু তদসঙ্গে লোহার সিন্দুকের চাবিটিও হস্তগত করিতে ভুলিলেন না। বিমাতার ব্যবহারে নুরল এসলামের করুণ হৃদয়ে দারুণ আঘাত করিল।

এই সমস্ত কারণে বিমাতা স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া বিবাহের সম্বন্ধ উত্থাপন করিলে, নুরল এসলাম ভাবিলেন, ‘ যে ঘরে এহেন বিমাতা, সেই ঘরে বিবাহের সম্বন্ধ বিশেষত পাত্রি সুন্দরী হইলেও অশিক্ষিতা।’ তাই তিনি অসঙ্কোচে বিমাতার প্রস্তাব অস্বীকার করিলেন। তিনি আরও ভাবিলেন, বিবাহ যাবজ্জীবনের সম্বন্ধ! মানবজীবনের সুখ-দুঃখ অধিকাংশকাল এই সম্বন্ধে উপর নির্ভর করে; সুতরাং বিশেষ বিবেচনা করিয়া মনের মত শিক্ষিকা পাত্রী পাইলে বিবাহ করিবেন, নচেৎ করিবেন না,—এইরূপ সঙ্কল্প করিয়া তিনি এ পর্যন্ত বিবাহ করেন নাই।

সপ্তম পরিচ্ছেদ

পাঠক অবগত আছেন আনোয়ারার পীড়ার কথা প্রসঙ্গে বড়বাবু কহিলেন, “একবার দেখা আবশ্যক।” ভূঞা সাহেব কহিলেন, “তবে মেহেরবাণী করিয়া বাড়ির ভিতরে চলুন।” তখন বড়বাবু ভূঞা সাহেব ও তালুকদার সাহেবের সহিত আনোয়ারার শয়নকক্ষে উপস্থিত হইলেন। বালিকার দাদিমা তৎপূর্বেই তাহাকে মশারি দ্বারা পরদায় আচ্ছাদিত করিয়া রাখিয়াছিলেন। ঘরে যে লোকজন প্রবেশ করিয়াছে, বালিকা তাহা টের পায় নাই; সে দুর্বিষহ শিরঃপীড়ায় অস্থির হইয়া এই সময় মশারি উল্টাইয়া ফেলিয়া দিল। তাহার দাদিমা, “পোড়ামুখী সব ফেলিয়া দিল” বলিয়া পুনরায় তাহাকে পর্দাবৃত করিতে চেষ্টা করিলেন। বড়বাবু কহিলেন, “আচ্ছা, একটু অপেক্ষা করুন, আমি শীঘ্রই পীড়ার অবস্থা বুঝিতে পারিব।” এই বলিয়া তিনি বালিকার মুখের দিকে তাকাইলেন। দৃষ্টিমাত্র বিস্ময়ে তাঁহার অন্তর আলোকিত হইয়া উঠিল; কিন্তু প্রচণ্ডবেগে ঘূণিত পৃথিবীর গতি যেমন অনুভব করা যায় না, সেইরূপ বাহিরের অবস্থায় বড়বাবুর ভাবান্তর অন্য কেহ টের পাইলেন না। তিনি বুঝিলেন, এই বালিকাই শেষে খিড়কীর দ্বার হইতে অন্তঃপুরে প্রবেশ করিয়াছে। এই সময় বালিকা একবার চক্ষু উন্মীলন করিল। তাহার রক্তচক্ষু দেখিয়া বড়বাবু একান্ত বিমর্ষ হইলেন; এবং সত্বর মাথায় জলপট্টি দেওয়া আবশ্যক মনে করিয়া কাঁচি ও সূক্ষ্ম বস্ত্রখণ্ড চাহিলেন। ভূঞা সাহেব তাহা আনিবার জন্য কক্ষান্তরে গমন করিলেন। বড়বাবু থার্মোমিটার দ্বারা পরীক্ষা করিয়া দেখিলেন, জ্বর ১০৫ ডিগ্রী। তিনি ব্যাকুলভাবে হাত ধরিয়া নাড়ী দেখিলেন। দেখিয়া বুঝিলেন সান্নিপাতিক জ্বর, বড়বাবু হতাশচিত্তে পুনরায় বালিকার মুখের দিকে চাহিলেন এবং অস্ফুটস্বরে কহিলেন, “দয়াময়! তুমি ইহাকে রক্ষা কর।” এই সময় আনোয়ারা জ্ঞানশূন্যভাবে পুনরায় চক্ষু উন্মীলন করিয়া পার্শ্ব পরিবর্তন করিল এবং প্রলাপের বাক্যে কহিল, “ইনি কি তিনি?”

ভূঞা সাহেব কাঁচি ও বস্ত্রখণ্ড লইয়া পুনরায় তথায় আসিলেন। বড়বাবু তাঁহাকে কহিলেন, “আপনি রোগিনীর ঠিক মাথার মাঝখানের একগোছা চুল কাটিয়া দিন”। ভূঞা সাহেব কহিলেন, “আমার কাটা ঠিক হইবে না, আপনি কাটুন।” বড়বাবু তখন বালিকার মাথার একগোছা চুল কাটিয়া ফেলিলেন। কর্তিত কেশগুলি এত চিক্কণ ও দীর্ঘ যে, তিনি ঐরূপ কেশ আর কখনও দেখেন নাই। ইতস্তত করিয়া তিনি আর চুল কাটিলেন না। কর্তিত স্থানের আশে পাশের চুল সরাইয়া মাথায় জলপটী বসাইয়া দিলেন। এই প্রক্রিয়ায় বালিকার অসহ্য শিরঃপীড়া অল্প সময়ে অনেকটা উপশমিত হইল। ভূঞা সাহেব বড়বাবুকে বিজ্ঞ ডাক্তার বলিয়া জ্ঞান করিলেন। বড়বাবু সকলের অজ্ঞানে ক্ষিপ্রহস্তে কর্তিত কেশগুলি অঙ্গুলিতে জড়াইয়া নিজ পকেটস্থ করিলেন।

অতঃপর সকলে উঠিয়া বহির্বাটীতে আসিলেন। বড়বাবু নৌকা হইতে ঔষধের বাক্স আনাইয়া দুই প্রকার দুই শিশি ঔষধ দিলেন। ক্ষুধা পাইলে দুধ-বার্লি পথ্যের কথা বলিয়া দিলেন। পাটের দর-দস্তর করিতে আর কথা খরচ কোন পক্ষেই হইল না। ভূঞা সাহেব ১৩০ মণ ও তালুকদার সাহেব ২৭ মণ পাট ৫ টাকা দরে বিক্রয় করিলেন। পাটের মূল্য মিটাইয়া দিয়া নৌকায় উঠিবার সময় ভূঞা সাহেব পাঁচটি টাকা দর্শনী স্বরূপ বড়বাবুকে দিতে উদ্যত হইলেন। বড়বাবু কহিলেন, “আমি টাকা লইয়া চিকিৎসা করি না, যেভাবে যতটুকু পারা যায়, মানুষই মানুষের উপকার কেিবন, এই মনে করিয়া চিকিৎসা করিয়া থাকি।” এই বলিয়া তিনি টাকা গ্রহণ করিলেন না। যাইবার সময় আরও বলিয়া গেলেন, “আমি স্থানান্তরে পাট দেখিয়া অপরাহ্ণ ৩/৪ টার সময় পুনরায় আপনার কন্যাকে দেখিয়া যাইব। আপনারা সাবধানে পর্যায়ক্রমে ঔষধ সেবন করাইবেন।” বেলা তখন প্ৰায় ১২ টা।

তালুকদার সাহেব পাট বিক্রয় করিয়া নিজ অন্তঃপুরে প্রবেশ করিলে হামিদার মা কহিলেন, “তুমি এতক্ষণে বাড়ির মধ্যে আসিলে? আমার যে উৎকণ্ঠায় প্রাণ বাহির হইবার মত হইয়াছে?”

তা-সা। কেন, কি হইয়াছে?

হা-মা। দামাদ মিঞা (জামাতা) কোথায়?

তা-সা। সে-কি! এমন সংবাদ তোমাকে কে দিল?

হা-মা। তবে কি মিথ্যা কথা? ভোলার মা শশব্যন্তে আসিয়া আমাকে বলিল, “দুলামিয়া ভূঞা সাহেবের বাড়িতে পাট কিনিতেছেন।” আমি ত শুনিয়া অবাক!

তালুকদার সাহেব হাসিতে লাগিলেন। এই সময় ভোলার মা তথায় আসিয়া তালুকদার সাহেবকে কিহল, “বাবজান, কৈ দুলামিঞাকে বাড়ির মধ্যে আনিলেন না?” তালুকদার সাহেব তখন উচ্চহাস্য করিয়া উঠিলেন এবং পরিহাস করিয়া ভোলার মাকে কহিল, “দামাদ মিঞাকে তুমি ডাকিয়া না আনিলে, তিনি আসিবেন না বলিয়াছেন।” ভোলার মা কহিল, “তবে আমি যাই, তাঁহাকে আদর করিয়া লইয়া আসি।” এই বলিয়া বৃদ্ধা গমনোদ্যত হইল। রহস্য বুঝিয়া তখন হাসির চোটে তালুকদার সাহেবের পেটে ব্যথা ধরিল। হামিদার মা স্বামীর হাসির ভাবে বুঝিলেন, ভোলার মা অন্য লোককে দামাদ মিঞার মত মনে করিয়াছে। তাই তিনি মুচকি হাসিয়া ভোলার মাকে কহিলেন, “দূর হতভাগী, চোখের মাথা কি একেবারেই খাইয়া বসিয়াছ?” ভোলার মার তখন কতকটা জ্ঞান হইল। সে কহিল, “তবে কি বুবুজানও খাইয়া বসিয়াছেন?” ভোলার মা হামিদাকে বুবুজান বলিয়া থাকে।

হামি-মা। ওমা! সে কি কথা? তাই বুঝি মেয়ে আমার ভাত-পানি ছাড়িয়া বসিয়াছে?

হা-পি। সে দেখিল কিরূপে?

ভো-মা। বুবুজানই ত’ তার সইদিগের আঙ্গিনা হইতে দেখিয়া আসিয়া পহেলা আমাকে বলিয়াছেন।

তালুকদার সাহেব ঘটনার রহস্য আদ্যন্ত বুঝিয়া হাসিতে হাসিতে অস্থির হইয়া পড়িলেন। হামিদা কক্ষান্তরে থাকিয়া সরমে মরমে মরিয়া যাইতে লাগিল।

অতঃপর, হামিদার পিতা স্ত্রীকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, “ঘটনা যেরূপ দাঁড়াইয়াছে তাহাতে সকলেরই ভুল হওয়া স্বাভাবিক। আমি এ বয়সে এমন এক চেহারার দুইজন লোক কোথাও কখন দেখি নাই। যিনি পাট কিনিতে আসিয়াছেন, তাঁহার সহিত দামাদ মিঞাকে বদল করা চলে। অন্যের কথা দূরে থাকুক, দামাদ মিঞা বলিয়া প্রথমে আমারই ভ্রম হইয়াছিল।” পিতার মুখে প্রকৃত অবস্থা শুনিয়া হামিদা হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিল। বলা বাহুল্য, আমাদের প্রাতঃকালে দৃষ্ট নৌকাস্থ যুবক, হামিদার ভ্রম-কল্পিত স্বামী, ভোলার মা’র দুলামিঞা, যাচনদারের বড়বাবু, আনোয়ারার চিকিৎসক ও আমাদের পূর্ববর্ণিত নুরল এসলাম একই ব্যক্তি। অতঃপর আমরা ইহাকে নাম ধরিয়া ডাকিব।

নুরল এসলাম অপরাহ্ চারটায় ফিরিয়া আসিয়া ভূঞা সাহেবের সহিত তাঁহার রোগীণীকে পুনরায় দেখিলেন। জ্বর কমিয়া ১০২ ডিগ্রীতে নামিয়াছে, চক্ষের লালিমা অনেকটা কমিয়াছে। তিনি ঔষধ বদলাইয়া দিয়া সে রাত্রি ভূঞা সাহেবের বাড়ির ঘাটেই নৌকা বাঁধিয়া অবস্থান করিলেন। মঙ্গলমত রাত্রি প্রভাত হইলে পুনরায় তিনি রোগীণীকে দেখিতে বাড়ির মধ্যে গেলেন। দেখিলেন, স্ফুটনোন্মুখ গোলাপ-কলিকা যেমন মধ্যাহ্নিক রবিকরতাপে বিবর্ণ ও কুঞ্চিত হইয়া যায়, নিদারুণ জ্বরোত্তাপে বালিকা সেইরূপ মলিন ও কৃশ হইয়া পড়িয়াছে; কিন্তু সুখের বিষয় তাহার জ্বর ও চক্ষুর রক্তাভ ভাব ছুটিয়া গিয়াছে। নুরল এসলাম বহির্বাটিতে আসিয়া রোগীণীর জ্বর-প্রতিষেধক বলকারক ঔষধ পথ্যের ব্যবস্থা করিয়া দিলেন এবং কহিলেন, “আমি পাটের অবস্থা দেখিতে কিছুদিন এ অঞ্চলে আছি, ২/৩ দিন পরে আবার আসিয়া ঔষধ বদলাইয়া দিয়া যাইব।” ভূঞা সাহেব নুরল এসলামের ব্যবহারে ও মহত্বে একান্ত মুগ্ধ হইলেন।

অষ্টম পরিচ্ছেদ

নুরল এসলামের চিকিৎসায়; আল্লার ফজলে, আনোয়ারার জ্বর বন্ধ হইয়াছে, শিরঃপীড়া আরোগ্য হইয়াছে, সে এখন স্বেচ্ছায় উঠা-বসা চলা-ফেরা করিতে পারে, তথাপি নুরল এসলামের ব্যবস্থানুসারে শরীরের বলধারণের জন্য এখনও সে নিয়মিতরূপে ঔষধ সেবন করিতেছে। হামিদা অহঃরহ তাহার কাছে আসে, বসে, প্রাণ খুলিয়া কত কথা বলে; আনোয়ারা কিন্তু অল্প কথায় সই-এর উত্তর দেয়। তাহার স্বভাব-সুলভ সরলতায় গাম্ভীৰ্য্য প্রবেশ করিয়াছে, যোগাভ্যস্তা তাপসবালার ন্যায় সে অধিকতর স্থিরা, ধীরা ও সংযতভাষিণী হইয়া উঠিয়াছে, দূর-ভবিষ্যৎ সুখ-দুঃখের চিন্তায় সে যেন সর্বদা আত্মহারা হইয়াছে; সে এক্ষণে কেবল নির্জনতা চায়, নির্জনে বসিয়া চিন্তা করিতে ভালবাসে। সুখের সংসারে চিরসোহাগে পালিতা অনুঢ়াকুমারী, তাহার আবার নির্জন চিন্তা কি? চিন্তা—নৌকার সেই মুখখানি! সেই সুঠাম সুন্দর প্রশান্ত সৌম্যমূর্তি। সেই প্রেম-পীযুষ বর্ষিণী অনাবিল করুণদৃষ্টি! তেমন সুন্দর, তেমন প্রেম-মাখান—জ্যোতিঃজড়ান শান্তিপ্রদ মুখের চাহনি সে এ পর্যন্ত কখনও দেখে নাই; তাই নির্জনে দেখিয়া সাধ পূর্ণ করিতে চায়, তাই তাহার নির্জনতার এত প্রয়োজন। যখন সে নৌকার কথা মনে করে, তখনই সেই মুখখানি তাহার চোখের সামনে ভাসিয়া উঠে; বালিকা তখন লজ্জায় অবনত আখি হয়। যখন সে ভাবে, তাঁহাকে দেখিতে এত সাধ কেন, আনন্দই বা হয় কেন? বালিকা ফাপরে পড়িয়া আবার ভাবে ভালবাসিলে কি পাপ হয়? লায়লী, শিরি, দময়ন্তী, সাবিত্রী ইহারাও ত’ সতীকুলোত্তমা। বালিকা হর্ষোৎফুল্ল হইয়া আবার ভাবে আহা কি সুন্দর কোরাণ পাঠ, কি মোহন উচ্চারণ! তেমন সুমধুর স্বরে কোরান পাঠ বুঝি আর শুনিতে পাইব না;—ভাবিতে ভাবিতে যুবকের পবিত্র-মূর্তি বালিকার মানসপটে প্রকৃত মূর্তিতে প্রকাশিত হয়, মোনাজাতের বিশ্বজনীন মহত্বে বালিকার ক্ষুদ্র হৃদয় ভরিয়া যায়। তখন সে যুবকের মোনাজাত-ভক্তিতে ভক্তি মিশাইয়া নির্জনে চোখের জলে বুক ভাসাইতে থাকে, আর ভাবে জগৎ মঙ্গলবিধায়ক, এমন ধর্মভাবে পূর্ণ, এমন উদারতার চরম অভিব্যক্তি মোনাজাত, কেবল ফেরেস্তাগণের মুখে শোভাপায়, খোদার প্রতি এমন স্তুতি-ভক্তি কেবল ফেরেস্তারাই করিয়া থাকেন।

বালিকা কখনও ভাবে, যিনি নিঃস্বার্থভাবে এ জীবন রক্ষা করিয়াছেন তাঁহারই চরণতলে প্রাণ উৎসর্গ করিলাম; কিন্তু অযোগ্যজ্ঞানে উপেক্ষা করিলে যে মরমে মরিয়া যাইব। আবার ভাবে—উৎসর্গের বস্তু হেয় হইলে ত’ কেবল ফেলিয়া দেয় না; কিন্তু ফেলিয়া না দিলেও যদি মনঃপুত না হয় তবে, দিয়া লাভ কি? না না, উৎসর্গ করাই ত’ স্ত্রীলোকের ধর্ম, লাভ চাহিব কেন?

ক্রমশ মন এইরূপে বালিকাকে স্বর্গীয় প্রেমের পথে টানিয়া লইয়া চলিল। একদিন জোহরের নামাজ বাদ আনোয়ারা শিশি হইতে এক দাগ ঔষধ ঢালিয়া সেবন করিল। শিশির গায়ে লেবেলে লেখা আছে, “প্রাতে, মধ্যাহ্নে ও বৈকালে এক এক দাগ সেবনীয়।” লেখা দেখিয়া আনোয়ারা ভাবিতে লাগিল, ‘এ লেখা নিশ্চয়ই তাহার নিজ হাতের, না হইলে এমন সুন্দর লেখা আর কাহার হইবে? জগতে যাহা কিছু সুন্দর তাহা তাঁহারই।’ আনোয়ারা আত্মহারা হইয়া তখন সেই পবিত্র মূর্তির ধ্যান করিতে লাগিল, হাতের শিশি হাতেই রহিয়া গেল। এই সময় একখানি কেতাব হাতে করিয়া হামিদা আসিয়া তাহার পার্শ্বে দাঁড়াইল। আনোয়ারার বহির্জগত তখন বিলুপ্ত–সে পার্শ্বে দণ্ডায়মান হামিদাকে দেখিতে পাইল না। হামিদা পূর্বেই রকম-সকমে বুঝিয়াছিল, সই ডাক্তার সাহেবের প্রতি অনুরাগিনী হইয়াছে। এক্ষণে তাহাকে আত্মহারাভাবে দেখিয়া কহিল, “সই, ঘরের ভিতরেও কি নৌকা প্রবেশ করিয়াছে?” আনোয়ারার তখন চমক ভাঙ্গিল। সে হামিদাকে পাশে দেখিয়া লজ্জায় ম্রিয়মান হইয়া হৃদয়ের ভার চাপা দেওয়ার জন্য কহিল, “সই, হাতে ওখানা কি বই?” হামিদা হাসিয়া কহিল, ‘বইয়ের কথা পরে কই, কার ভাবনা ভাবছ সই?” প্রেম-প্রফুল্ল আনোয়ারা তখন লজ্জা দূরে সরাইয়া উত্তর করিল, “কতক্ষণে আসবে সই,—ধ্যান করছি বসে তাই।” হামিদা কহিল, “অনেকক্ষণ ত’ এসেছি সই, তবে কেন সাড়া নেই?” আনোয়ারা কহিল আর চাপিয়া গেলে চলিবে না, তাই সে সইয়ের নিকট দেলের কথা আভাসে জানাইল। হামিদা শুনিয়া কহিল, “সই অজ্ঞাতকুলশীল বিদেশী লোককে ভালবাসিলে কেন? তাঁহার সহিত তোমার বিবাহের সম্ভাবনা কোথায়।” দর্পনে হাঁই দিলে তাহা যেমন সজল ও মলিন হইয়া উঠে, হামিদার কথায় আনোয়ারার মুখের অবস্থা সেইরূপ হইল, তাহার ইন্দ্রবর-নিন্দিত আয়ত আঁখি অশ্রুভারাক্রান্ত হইয়া উঠিল, সে কোনো উত্তর করিল না। হামিদা দেখিল, একেবারে মজিয়া গিয়াছে, পুষ্প ঘাতও বুঝি আর সহ্য হইবে না, তাই তাহার ভাবান্তর উৎপাদন জন্য বইখানি হাতে দিয়া কহিল, “এখান তুমিই বাবাজানকে আনিতে দিয়াছিলে? আনোয়ারা বই খুলিয়া দেখিল, ‘ওমর চরিত’ ‘মুখে কহিল,–’হাঁ।’

অনন্তর হামিদা কহিল, “সই, মানুষের মত যে মানুষ থাকে, আগে তাহা জানিতাম না। তোমার ডাক্তার সাহেবকে তোমার সয়া মনে করিয়া সেদিন খিড়কীর দ্বার হইতে দৌড়িয়া বাড়ি আসি, মনে নানারূপ সন্দেহ হওয়ায় সঠিক খবর জানিবার নিমিত্ত ভোলার মাকে তখনই নৌকার কাছে পাঠাইয়া দেই। পোড়ামুখী ফিরিয়া আসিয়া বলিল, ‘নৌকার আরোহী বেতার দুলামিয়া। কথা শুনিয়া প্রাণ উড়িয়া গেল।’ আনোয়ারা সইয়ের মুখে নিজের প্রিয়তমের সম্বন্ধে বিরুদ্ধ কথা শুনিয়া এতক্ষণ আকাশ-পাতাল ভাবিয়া স্তব্ধনিঃশ্বাসে চুপ করিয়াছিল। সই-এর এত কথার পর আর কথা না বলিলে সে অসন্তুষ্ট হইতে পারে, তাই পরিহাসচ্ছলে কহিল, “সই, উল্টা কথা কহিলে, স্বামীর আগমন সংবাদে উড়া প্রাণ ত’ আবাসে বসিবার কথা।“

হামিদা। তা ঠিক, কিন্তু এবার তাঁহার কলিকাতা যাইবার সময় ঝগড়া করিয়াছিলাম। আনো। (স্মিতমুখে) লাইলীর সহিত মজনুর বিবাদ। কেন—কি লইয়া?

হামিদা বেপর্দায় বেড়ান লইয়া স্বামীর সহিত যে সকল কথা হইয়াছিল, খুলিয়া বলিল। আনোয়ারা শুনিয়া বলিল, “জয় ত তোমারই, তবে ভয়ের কারণ কি?” হামিদা কহিল, “আমি তোমার ডাক্তার সাহেবকে স্বামী মনে করিয়াছিলাম।” এই বলিয়া সে জিভ কাটিল। কিন্তু কথাটি সইকে বুঝাইয়া বলিতে হইবে বলিয়া কহিল, “তিনি যখন আমাদের খিড়কী-দ্বারে অনাবৃত মস্তকে তোমার সাথে কথা বলিতে দেখিলেন, তখন ভয় না হইয়া যায় না। বিশেষত বেপর্দায় বেড়াই না বলিয়া বিবাহের দিন তাঁহার মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাইয়া দিয়াছি, এমতাবস্থায় বেপর্দায় দেখিয়া তিনি নিশ্চয় আমাকে অবিশ্বাস করিবেন, তাই প্রাণ উড়িয়া গিয়াছিল।”

আনোয়ারা স্মিতমুখে কহিল, এদিকে বেপর্দায় চলিয়া—ওদিকে চলি না বলিয়া স্বামীর বিশ্বাস জন্মান কি প্ৰবঞ্চনা নয়?

হামিদা। যদি প্রবঞ্চনা হয়, তবে তুমিও এ প্রবঞ্চনার জন্য দায়ী।

আনো। উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে?

হামিদা। তোমাকে এক দণ্ড না দেখিলে, তোমার সহিত কথা না বলিতে পারিলে আমি যে থাকিতে পারি না। সেদিন ভোরে যখন তোমাকে তোমাদের বাড়িতে পাইলাম না তখন খুঁজিতে খুঁজিতে তোমাদের খিড়কীর ঘাটে উপস্থিত হই। তখন হইতেই এ অসুখ, এ অশান্তি।

আনো। এরূপ স্থলে তোমার প্রবঞ্চনা-পাপের অংশভাগিনী হইতে রাজী আছি। কিন্তু সই! বিধির বিধান সেরূপ নয়; তাহা হইলে দস্যু নিজাম আউলিয়া হইতে পারিতেন না।

হামিদা। নিজাম আউলিয়ার কথা কিরূপ?

আনো। তোমার পিতা একদিন আমাদিগকে উক্ত মহাত্মার বিবরণ শুনাইয়াছিলেন। নিজাম প্রথমে ভীষণ দস্যু ছিলেন। তাঁহার প্রতিজ্ঞা ছিল, রোজ একটি করিয়া খুন না করিয়া পানি স্পর্শ করিবেন না। একদিন তিনি শাহ ফরিদকে খুন করিতে উদ্যত হন। তাপসশ্রেষ্ঠ ফরিদ নিজামকে বলেন, “তুমি নরহত্যা করিয়া যাহাদের গ্রাসাচ্ছদন সংগ্রহ করিয়া থাক, তাহাদিগকে একবার জিজ্ঞাসা করিয়া আইস, তাহারা তোমার এই মহাপাপের ভাগী হইবে কি-না? এমন কথা নিজাম জীবনে কখনও শুনেন নাই। হঠাৎ তার ভাবান্তর উপস্থিত হইল, তিনি দ্রুতপদে যাইয়া পরিজনদিগকে ঐ কথা জিজ্ঞাসা করিলেন; তাহারা কহিল, একজনের পাপের জন্য অন্যের কি শাস্তি হয়? এই কথায় নিজামের তত্ত্বজ্ঞানের উদয় হইল। অতঃপর তিনি সৎসঙ্গে থাকিয়া অশেষবিধ পুণ্যানুষ্ঠান দ্বারা ভীষণ পাপের প্রায়শ্চিত্ত করিতে লাগিলেন।

হামিদা। তবে সই, আমার এই প্রবঞ্চনা-পাপের প্রায়চিত্ত কিরূপে হইবে?

আনো। তুমি সয়ার নিকট কোনো কথা গোপন না করিয়া বা মিথ্যা না বলিয়া সব খুলিয়া বলিবে।

হামিদা। তাহাতেই কি আমার দোষের প্রায়চিত্ত হইবে?

আনো। হাঁ, তাহাই যথেষ্ট।

হামিদা। তিনি যদি তাহাতেও সন্তুষ্ট না হইয়া আমাকে ঘৃণার চক্ষে দেখেন, বা আমার সহিত কথা না বলেন?

স্বামীর অবহেলা কল্পনা করিয়া মুগ্ধা হামিদার চক্ষু অশ্রুভারাক্রান্ত হইয়া উঠিল।

আনো। তুমি ত’ এমন দোষ কর নাই—যাহাতে তিনি তোমাকে ঘৃণার চক্ষে দেখিতে পারেন বা তোমার সহিত কথা না বলিয়া থাকিতে পারেন।

তথাপি তিনি যদি অবস্থা বুঝিয়া ঐরূপ কোন ভাব প্রকাশ করেন, তাহা হইলে তুমি ধীরে ধীরে তাঁহার নিকট হইতে চলিয়া আসিবে, আর তাঁহার নিকট যাইবে না, কথাও বলিবে না। কিন্তু দূরে থাকিয়া যতদূর পার তাঁহার স্নান, আহার, সেবা-শুশ্রূষায় ত্রুটি করিবে না। এইরূপ করিলে সয়া যখন নির্জনে বসিয়া তোমার অভাব মনে করিবেন, তখন বিবেক তাঁহাকে প্রলুব্ধ করিবে। সামান্য কারণে নিদারুণ উপেক্ষার জন্য অনুতাপ আসিয়া তাঁহার হৃদয়ে কশাঘাত করিতে থাকিবে। তখন উল্টা-পালা আরম্ভ হইবে।

এই বলিয়া আনোয়ারা হাসিতে লাগিল।

হামিদা। লোকে কথায় বলে—’কারো সর্বনাশ, কারো মনে মনে হাস।’ সই, তোমার দেখিতেছি তাই।

আনো। উল্টা পালার ফল মনে ভাবিয়া হাস্য সংবরণ করিতে পারিতেছি না।

হামিদা। সই, উল্টা পালা কেমন?

আনো। অর্থাৎ—তখন তোমার মান ভাঙ্গাইতে সয়ার যে আমার প্রাণান্ত উপস্থিত হইবে!

হামিদা। আমি মান চাই না। তিনি সরল মনে দাসীর সহিত কথা বলিলে হাতে স্বৰ্গ পাইব।

আনো। তর্কস্থলে ঘটনা যতদূর দাঁড়াইল, আসলে ততদূর গড়ান সম্ভব নয়। কারণ, তোমার প্রবঞ্চনা ত’ হৃদয়ের নহে, বাহিরের ঘটনার জন্য। আর বেপর্দা ভাবও ত’ তেমন কিছু হয় নাই। প্রয়োজনবশত আমরা অনেক সময় খিরকীর দ্বারে আসিয়া থাকি। তবে তিনি (ডাক্তার সাহেব) যে আমাদিগকে কিছু অসাবধনভাবে হঠাৎ দেখিয়া ফেলিয়াছেন, তাহাই দোষের কথা হইয়াছে। যাহা হউক, সয়া যদি তোমাকে এ-পর্যন্ত না চিনিয়া থাকেন, তবে তোমাদের উভয়েরই পোড়াকপাল বলিতে হইবে।

হামিদা আনোয়ারার কথায় অনেকটা আশ্বস্ত হইয়া কহিল, “সই, তোমার ত’ বিবাহ হয় নাই, তবে তুমি স্বামী-স্ত্রী সম্বন্ধে এত কথা কি করিয়া জান?”

আনো। দাদিমার মুখে গল্প শুনিয়া, আর আমার মা ও মামানীদিগের ব্যবহার দেখিয়া।

এই সময় আনোয়ারার দাদিমা তথায় উপস্থিত হওয়ায় তাহাদের কথোপকথনের স্রোত প্ৰতিহত হইল।

নবম পরিচ্ছেদ

কয়েক দিবস পর অপরাহ তিন ঘটিকার সময় নুরল এসলাম আনোয়ারাকে পুনরায় দেখিতে আসিলেন। এই সময়ে পুরুষ মানুষ কেহই তাহাদের বাড়িতে ছিল না। বাদশা রামনগর স্কুল হইতে এখনও ফিরে নাই, চাকরাণীরা ঢেঁকি শালে। গতকল্য আজিমুল্লাহ আসিয়া তাহার ভগিণী গোলাপজানকে লইয়া গিয়াছে। এখন কেবল আনোয়ারা ও তাহার দাদিমা উপস্থিত। ভূঞা সাহেব কোথায় গিয়াছেন, কেহই জানে না। আমরা কিন্তু জানি,—পরম স্ত্রৈণ ভূঞা সাহেব আজিমুল্লার বাড়িতে গিয়াছেন। আনোয়ারার সহিত যাহাতে আজিমুল্লার পুত্রের বিবাহ হয়, তাহার পাকাপাকি বন্দোবস্তের নিমিত্ত চতুর আজিমুল্লা ভগিনীকে নিজ বাড়িতে লইয়া গিয়াছে, ভূঞা সাহেবও তথায় উপস্থিত। আজিমুল্লা ভগিণী ও ভগিণীপতিকে নানাবিধ সুখ- সুবিধার প্রলোভনে বশীভূত করিতে বদ্ধপরিকর হইয়াছে।

নুরল এসলাম বৈঠকখানায় প্রবেশ করিয়া কহিল, “ভূঞা সাহেব, বাড়ি আছেন?” আনোয়ারার দাদিমা বৈঠকখানা ঘরের আড়ালে থাকিয়া কহিলেন, “আপনি বসুন, খোরশেদ সকাল বেলায় কোথায় গিয়াছে। যাইবার কালে বলিয়া গিয়াছে, আজ ডাক্তার সাহেব আসিতে পারেন। তিনি আসিলে নৌকার লোকজনসহ তাঁহাকে জিয়াফ‍ করিবেন, আমি সত্ত্বর বাড়ি ফিরিব।” এই বলিয়া বৃদ্ধা আবার কহিলেন, “আমার অনুরোধ আপনি মেহেরবানী করিয়া নৌকার লোকজনসহ গরিবখানায় বৈকালে জিয়াফ‍ কবুল করুন।” ডাক্তার সাহেব কহিলেন, “জিয়াফতের আবশ্যক কি? আগে আপনার নাতিনীর কুশল সংবাদ বলেন।” বৃদ্ধা কহিলেন, “আপনার চিকিৎসার গুণে, আল্লার ফজলে নাতিনী আমার সম্পূর্ণ সুস্থ হইয়াছে।” এই কথা বলিয়া বৃদ্ধা আনোয়ারার ঘরের সম্মুখে যাইয়া তাহার নাম ধরিয়া ডাকিলেন। আনোয়ারা দাদিমার নিকট আসিয়া মৃদুস্বরে কহিল, ‘ডাকিলেন কেন?’

বৃদ্ধা। ডাক্তার সাহেব আসিয়াছেন, তাঁহাকে বৈকালে জিয়াফ‍ করিলাম, এখন পাকের যোগাড়ে যাও, আজ তোমাকেই রান্না করিতে হইবে।

শিশির-মুক্তাখচিত নববিকশিত প্রভাতকমল বলাকাকিরণোদ্ভিন্ন হইলে যেমন সুন্দর দেখায়, আনোয়ারার মুখ-পদ্ম এই সময় তদ্রূপ দেখাইতেছিল।

প্রবীণা দাদিমা তাহার মুখের দিকে চাহিয়া কি যেন চিন্তা করিলেন। বিশিষ্ট ভদ্রলোক নিমন্ত্রিত হইলে আনোয়ারাকেই পাক করিতে হইত। সে এক্ষণে পাকের কথা শুনিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কি রান্না করিব?”

বৃদ্ধা। ঘরের পোলাওয়ের চাল আছে, ঘি-মশলা সবই আছে।

আনো। তরকারি কি দিয়া হইবে?

বৃদ্ধা নাতিনীর মন বুঝিবার জন্য কহিলেন, “তোর টগর-জবা দুইটা দে। তোর বাপ বাড়ি আসিলে কিছু দাম লইয়া দিব।” টগর ও জবা আনোয়ারার স্নেহপালিত দুইটি খাসি মোরগের নাম। আনোয়ারা স্মিতমুখে কহিল, “দাম যদি দাও তবে পঁচিশ টাকার কম লইব না।” বৃদ্ধা সুযোগ পাইয়া কহিলেন, “যিনি বিনামূল্যে প্রাণ রক্ষা করিলেন, তাঁহারই জন্য মোরগ চাহিলাম, সেই মোরগের দাম অত টাকা চাহিলি? এই বুঝি লেখাপড়া শিক্ষার ফল উপকারীর উপকার স্বীকার করা বুঝি এইরূপেই শিখিয়াছিস?” আনোয়ারা কহিল, “তুমিই ত প্রথম দাম দিতে চাহিয়াছ। নচেৎ দুই-দশ মোরগ কেন, উপকারীর প্রত্যুপকারে জান দিতে পারি।” আনোয়ারা নবানুরাগে আত্মহারা হইয়া এই প্রথম অসাবধানে কথা কহিল। বৃদ্ধা কটাক্ষ করিয়া কহিলেন, “হাঁ বুঝিয়াছি, এখন পাকের যোগাড়ে যাও।” আনোয়ারার তখন চৈতন্যোদয় হইল, সে দাঁতে জিভ কাটিয়া সরমে মরমর হইয়া গেল। দাদি-নাতনীর কথা- বার্তা অনুচ্চরবে হইতেছিল—তথাপি নুরল এসলাম তাহা শুনিতে পাইলেন। আনোয়ারার শেষ কথা তাঁহার কর্ণে অমৃত বর্ষণ করিয়া হৃদয়ের অন্তস্থল অভিষিক্ত করিয়া তুলিল। তিনি অনাস্বাদিতপূর্ব সুখরস সিঞ্চনে বিভোর হইয়া ধীরে ধীরে নৌকায় গিয়া উপস্থিত হইলেন।

সন্ধ্যার পূর্বে ভূঁইয়া সাহেব বাড়ি আসিলেন। আনোয়ারার মোরগদ্বয় জবেহ করিয়া পোলাওয়ের আয়োজন হইল; তালুকদার সাহেবকেও দাওয়াত করা হইল। রাত্রিতে নৌকার লোকজনসহ নুরল এসলাম ভূঁইয়া সাহেবের নিমন্ত্রণ রক্ষা করিলেন। তৃপ্তির সহিত সকলের ভোজন ক্রিয়া শেষ হইল। আহারান্তে গল্পগুজব চলিল। তালুকদার সাহেব ও নুরল এসলামের পরস্পর বাক্যালাপে আনোয়ারার দাদিমা বাড়ির মধ্য হইতে নুরল এসলামের যাবতীয় পরিচয় ও অবস্থা জানিতে পারিলেন এবং জানিয়া তিনি যেন এক ভবিষ্যৎ আশার আলোক সম্মুখে দেখিতে পাইলেন।

আহারান্তে নুরল এসলাম নৌকায় আসিলেন। পাচক নৌকায় যাইয়া কহিল, “পাকের বড়াই আর করিব না এমন পোলাও-কোর্মা জন্মেও খাই নাই। আকবরী পোলাওয়ের নাম গল্পে শুনিয়াছিলাম; আজ তাহা পেটে গেল।” যাচনদার কহিল, “খুব বড় আমীর ওমরাহ লোকের বাড়িতেও এমন পাক সম্ভবে না।” নুরল এসলাম কহিলেন, “তোমাদের কথা অতিরঞ্জিত বলে বোধ হয় না; পাক বাস্তবিকই অনুপম হইয়াছিল।

প্রাতে নামাজ ও কোরান পাঠ শেষ করিয়া নুরল এসলাম বিদায়ের জন্য ভূইঞা সাহেবের বাড়ির উপরে আসিলেন। ভূইঞা সাহেব ১৫টি টাকা তাহার হাতে দিতে উদ্যত হইয়া কহিলেন; “আপনার চিকিৎসার মূল্য দেওয়া আমার অসাধ্য। কিন্তু ঔষধের মূল্যবাবদ এই সামান্য কিছু গ্রহণ করুন।” নুরল এসলাম কহিলেন, “আমি চিকিৎসা করিয়া টাকা লই না, পূর্বেই বলিয়াছি।” ভূইঞা সাহেব কহিলেন, “ইহা না লইলে মনে করিব অযোগ্যজ্ঞানে গ্রহণ করিলেন না। তাহা হইলে আমার অসুখের সীমা থাকিবে না। নুরল এসলাম কহিলেন, “আপনি টাকা দিলে আমি শতগুণে অসন্তুষ্ট হইব।” ভূইঞা সাহেব অগত্যা নিরস্ত হইলেন। ভূইঞা সাহেব ও তাঁহার মাতাকে সালাম জানাইয়া নুরল এসলাম বিদায় গ্রহণ করিলেন। যাইবার সময় তালুকদার সাহেবকেও সালাম করিয়া গেলেন।

দশম পরিচ্ছেদ

এদিকে আনোয়ারা অনেক সময় নির্জনে অশ্রুমোচন করিয়া অনিদ্রায় কাল কাটাইতে লাগিল। ফলত জ্বলন্ত অগ্নির উত্তাপে নববিকশিত কদলিপত্র যেরূপ বিশুষ্ক ও মলিন হইয়া যায়; সৌন্দর্য প্রতিমা বালিকা সেইরূপ নবীভূত ভাবান্তরে কৃশ ও বিবর্ণ হইতে লাগিল। হামিদা সইয়ের মনের ভাব বুঝিয়া আশ্চর্য হইল, নির্জনে তাহাকে নানাবিধ প্রবোধ দিতে লাগিল। আনোয়ারার দাদিমাও পৌত্রীর ভাবান্তর উপলব্ধি করিলেন। তিনি এক সময় পরিহাসচ্ছলে কহিলেন, “কি লো! ডাক্তারের বিচ্ছেদে পাগল হইবি নাকি?” আনোয়ারা মলিন মুখে নিরুত্তর রহিল।

আনোয়ারার পিতামহ আরবি-ফারসি বিদ্যায় প্রসিদ্ধ মুন্সী ছিলেন। বর্তমান সময়ে মৌলভী নামধারী সাহেবেরা জ্ঞান-গরিমায় বিদ্যা-বুদ্ধিতে সে-সময়ের মুন্সী সাহেবানদের শিষ্যগণের তুল্য-মূল্যও অনেকে বহন করেন না। যাহা হউক, আনোয়ারার দাদিমা, আনোয়ারার বয়সেই মুন্সী সাহেবকে পতিত্বে বরণ করেন। তাঁহাদের বিবাহ পরস্পর পবিত্র প্রণয়সূত্রে সংঘটিত হয়। তাঁহাদের এই বৈবাহিক জীবন যেরূপ সুখের হইয়াছিল, সচরাচর সেরূপ দেখা যায় না। স্বামীর গুণে আনোয়ারার দাদিমা আরবি-ফারসি শিক্ষায় সুশিক্ষিত হন। সুতরাং বিদ্যার অমৃত আস্বাদ তিনি পাইয়াছিলেন। সংসারের অবস্থাও তাহাদের খুব স্বচ্ছল ছিল। কিন্তু চির-সুখ-সৌভাগ্য কাহারও ভাগ্যে ঘটে না। বৃদ্ধার অর্ধেক বয়সে তাঁহার স্বামী এবং দুই পুত্র ও দুই কন্যা কালের কবলে পতিত হন। কিছুদিন পরে তাঁহার প্রাণাধিক পুত্রবধূ (আনোয়ারার মাতা) লোকান্তরে গমন করেন। কেবল মাত্র পুত্র খোরশেদ আলী ও পৌত্রী আনোয়ারা বৃদ্ধার শেষ জীবনের অবলম্বন হয়। বৃদ্ধা স্বামী, পুত্র, কন্যা ও পুত্রবধূর অসহ্য শোক শান্তির জন্য আনোয়ারাকেই অন্ধের যষ্টির ন্যায় বোধ করেন এবং স্বকীয় উন্নত হৃদয়ের স্নেহরাশি পৌত্রীতে ঢালিয়া দিয়া সুখ-দুঃখের চিরসঙ্গিনী হন। ফলত তাহাকে বৃদ্ধার অদেয় কিছুই ছিল না।

একদিন রাত্রিতে শয়ন করিয়া বৃদ্ধা ডাক্তার সাহেবের প্রতি নাতনীর অনুরাগ প্রকৃত কিনা, পরীক্ষা করিবার নিমিত্ত ধীরে ধীরে কহিলেন, “আনার শুনিলাম—তোর বাপ ফয়েজ উল্লার সহিত তোর বিবাহ বন্দোবস্ত করিয়াছে। আমি এ বিবাহ ভালই মনে করি। দুই তিন হাজার টাকার সম্পত্তি, পনর শত টাকার গহনা ও নগদ পনর শত টাকা পাবি, ফয়েজ উল্লাও তোর যোগ্য পাত্র হইবে।” আনোয়ারা শুনিয়া কোন উত্তর করিল না, বিরক্তির সহিত পাস ফিরিয়া শয়ন করিল।

বৃদ্ধা। কি লো! বিয়ের কথা শুনিয়া যে মুখ ফিরালি?

আনোয়ারা দেখিল, তাহার সহিত, কথা না বলিলে তিনি মনে আঘাত পাইবেন; তাই সে কহিল, “ও কথা আমি পূর্বেই শুনিয়াছি।”

বৃদ্ধা। কবে, কার কাছে শুনিয়াছিস্?

আনো। যেদিন আমি ব্যারামে পড়ি সেইদিন সইয়ের নিকট শুনিয়াছি।

বৃদ্ধা। তাই শুনিয়াই বুঝি মরিতে বসিয়াছিলি? এতদিন বলিস নাই কেন?

আনো। বলিবার কথা হইলে বলিতাম।

বৃদ্ধা। ও বিবাহে তবে তোর মত নাই?

আনোয়ারা নিরুত্তর। বৃদ্ধা আবার কহিলেন, “আচ্ছা তোর বাপ ত’ ঐ বিবাহ দেওয়াই ঠিক করিয়াছে। এখন তুই কি করিবি?”

আনোয়ারার কন্ঠনালী শুষ্ক হইয়া আসিতেছে, সে অনেক কষ্টে ঢোক গিলিয়া মৃদুস্বরে কহিল,” তুমি বাধা দিবে না?”

বৃদ্ধা। তোর বাপ ত, আমার কথা শুনে না। বাদশার মা যা বলে তাই সে করে।

আনোয়ারা কহিল, “আর একজন ঠেকাইবে।“

বৃদ্ধা। কে সে?

আনোয়ারা। আমরা ওজু করিয়া এক্ষণে যার নাম করিলাম।

দাদি-নাতনী এশার নামাজ পড়িয়া শয়ন করিয়াছিলেন। পুণ্যশীলা বৃদ্ধা আনোয়ারাকে বুকে চাপিয়া ধরিয়া কহিলেন, “আনার, আজ তোর কথায় আমার দেল ঠাণ্ডা হইল। যার নাম করিয়াছিস্ বলিলি, তাঁর প্রতি চিরদিন যেন তোর এইরূপ ভক্তি থাকে; সময়ে অসময়ে সকল অবস্থায় তিনিই তোকে রক্ষা করিবেন; তিনিই তোর সহায় হইবেন, তিনিই তোর মনোবাসনা পূর্ণ করিবেন।

এইরূপ বলিয়া বৃদ্ধা পুনরায় প্রকাশে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আচ্ছা, ডাক্তার সাহেবের সহিত তোর বিবাহের প্রস্তাব করিলে কেমন হয়?”

আনোয়ারা ইহাতেও কোন উত্তর করিল না, কিন্তু ডাক্তার সাহেবের নামে তাহার ঘন ঘন শ্বাস পড়িতে লাগিল। আরাধ্য প্রিয়জন প্রতি অকৃত্রিম-প্রেম-প্রযুক্ত তাহার হৃদয়তন্ত্রী বাজিয়া উঠিল; কন্ঠনালী জড়ীভূত হইয়া আসিল; তাহার গোলাপ গণ্ডদ্বয়ে ও ইন্দ্রবর-নিন্দিত নয়নদ্বয় লজ্জার আভা প্রতিফলিত হইয়া অপূর্ব শোভা বিস্তার করিল। অস্পষ্ট দীপালোকে বৃদ্ধা নাতিনীর এই বিদ্যালাবণ্যময়ী মূর্তি স্পষ্টরূপে দেখিতে পাইলেন না, কিন্তু তাহার সঘন নিশ্বাস ত্যাগে ও জড়সড় ভাবে বুঝিতে পারিলেন, ডাক্তার সাহেবের নামে মেয়ের হৃদয়ের অন্তস্থল আলোড়িত হইয়া উঠিয়াছে। তাই তিনি পরিহাস করিয়া কহিলেন, “কি লো, ডাক্তার সাহেবের নাম শুনিয়াই যে দশা ধরিল। কথা বলিস্ না কেন?”

আনোয়ারা জড়িতকণ্ঠে কহিল, “কি বলিব?”

বৃদ্ধা। ডাক্তারের সহিত বিবাহ দিলে তুই সুখী হইবি?

আনোয়ারা বাহিরের দিকে চাহিয়া কহিল, “দাদিমা, দেখ, জানালার পাশে কি সুন্দর চাঁদের আলো আসিয়াছে।” ঐ সময় সওয়ালের চাঁদের কিরণে রাত্রি দিনের মত দেখাইতেছিল। প্রবীণা বৃদ্ধা পৌত্রীর চতুরতা বুঝিয়া কহিলেন, “আ-লো! চাঁদের আলো যদি ডাক্তার হইত, তাহা হইলে বুঝি হাত ধরিয়া ঘরে তুলিতি।” আনোয়ারা মৃদুহাস্যে বৃদ্ধার গা টিপিয়া দিল। এইরূপ রসালাপ-প্রসঙ্গে বৃদ্ধা তন্দ্রাভিভূতা হইয়া পড়িলেন। আনোয়ারাও নিদ্রিত হইল।

বৃদ্ধা, নুরল এসলামকে উপযুক্ত পাত্রজ্ঞানে এবং নাতিনী তাঁহার প্রতি অনুরক্ত হইয়াছে বুঝিয়া ভাবিলেন, ‘এইরূপ অবস্থায় পাত্র বিবাহ স্বীকার করিলে, এই বিবাহে নাতিনী আমার চিরসুখী হইতে পারিবে!’ এ নিমিত্ত তিনি এই বিবাহ সংঘটনমানসে অতঃপর বিধিমত চেষ্টায় উদ্যোগী হইলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *