আনিকি পাসিকিভি
এক বাঙালি দম্পতির সঙ্গে জিনীভার এক বড় হোটেলে উঠেছি। প্রথম দিনই খানাঘরে লক্ষ্য করলুম, আমাদের টেবিলের দিকে মুখ করে বসেছেন এক দীর্ঘাঙ্গী যুবতী। দীর্ঘাঙ্গী বললে কম বলা হয়, কারণ আমার মনে হল এর দৈর্ঘ্য অন্ততপক্ষে পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চি হবে-আর আমরা তিনজন বাঙালি গড়পড়তায় পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি হই কি না-হই।
দৈর্ঘ্যের সঙ্গে মিলিয়ে সুগঠিত দেহ–সেইটেই ছিল তাঁর সৌন্দর্য, কারণ মুখের গঠন, চুলের রঙ এবং আর পাঁচটা বিষয়ে তিনি সাধারণ ইয়োরোপীয় রমণীদেরই মত।
ভদ্রতা বজায় রেখে আমরা তিনজনই যুবতীটিকে অনেকবার দেখে নিলুম। ফিস ফিস করে তার সম্বন্ধে আমাদের ভিতরে আলোচনাও হল। তখন লক্ষ্য করলুম, আমাদের দিকে তিনিও দু’চারবার তাকিয়ে নিয়েছেন।
সেই সন্ধ্যায় বাঙালি ভদ্রমহিলাটি হোটেলের ড্রয়িংরুমে বারোয়ারি রেডিয়োটা নিয়ে স্টেশন খোঁজাখুঁজি করছিলেন; আমি একপাশে বসে খবরের কাগজ পড়ছিলুম। হঠাৎ সেই যুবতী ঘরে ঢুকে সোজা মহিলাটির কাছে গিয়ে পরিষ্কার ইংরিজিতে বললেন, ‘আপনাকে সাহায্য করতে পারি কি? আপনি কি কোনো বিশেষ স্টেশন খুঁজছেন? আমার বেতারবাই আছে।’
পরিচয় হয়ে গেল। রোজ খাবার সময় আমাদের টেবিলেই বসতে আরম্ভ করলেন। নাম আনিকি পাসিকিভি-দেশ ফিনল্যান্ডে।
ফিনল্যান্ডের আর কাকে চিনব? ছেলেবেলায় ফিন লেখক জিলিয়াকুসের ‘রুশ বিদ্রোহের ইতিহাস’ পড়েছিলুম আর তাঁর ছেলে জিলিয়াকুসও বিখ্যাত লেখক—প্রায়ই ‘নিউ স্টেটসম্যানে’ উচ্চাঙ্গের প্রবন্ধাদি লিখে থাকেন। ব্যস।
কিন্তু তবু যেন পাসিকিভি নামটা চেনা-চেনা বলে মনে হয়। সে কথাটা বলতে আনিকি একটুখানি লজ্জার সঙ্গে বললেন, ‘আমার বাবা ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট।’
আমরা তিনজনেই একসঙ্গে বললুম, ‘অ।’
আনিকির সঙ্গে আলাপ হওয়াতে আমাদের ভারি সুবিধে হল। বাঙালি দম্পতি ইংরিজি আর বাঙলা ভিন্ন অন্য কোন ভাষা জানতেন না, কাজেই আমাকে সব সময়ই ওঁদের সঙ্গে বেরতে হত। আনিকি অনেকগুলো ভাষা জানতেন; তিনি তাদের নিয়ে বেরতেন। আর আমি য়ুনিভার্সিটি, লাইব্রেরি, মিটিং-মাটিং করে বেড়াতুম।
সুইস খানা যদিও বেজায় পুষ্টিকর। তবু একটুখানি ভেঁাতা—আনিকি ম্যানেজারের সঙ্গে কথা কয়ে তার পরিপটি ব্যবস্থা করে দিলেন। শামুনিকস দেখতে যাবার জন্য মোটর ভাড়া করতে যাচ্ছি-আনিকি এক দোস্তের গাড়ি ফিরিগ্র্যাটিস-অ্যান্ড-ফারনাথিং যোগাড় করে দিলেন। তা ছাড়া জিনীভা, লজান, মন্ত্রো, ভিলনভূ (রমা রলাঁ সেখানে থাকতেন) সম্বন্ধে দিনের পর দিন নানাপ্রকারের খবর দিয়ে আমাদের ওয়াকিবহাল করে তুললেন।
সূক্ষ্ম রসবোধও আনিকির ছিল। আমি একদিন শুধালুম, ‘আপনি অতগুলো ভাষা শিখলেন কি করে?’
বললেন, ‘বাধ্য হয়ে। ইয়োরোপের খানদানী ঘরের মেয়েদের মেলা ভাষা শিখতে হয় বরের বাজার কর্নার করার জন্য। ইংরেজ ব্যারণ, ফরাসী কাউন্ট, ইটালিয়ান ডিউক সক্কলের সঙ্গে রসালাপ না করতে পারলে বর জুটবে কি করে?’
তারপর হেসে বললেন, ‘কিন্তু সব শ্যাম্পেন টক্! এই পাঁচ ফুট এগারোকে বিয়ে করতে যাবে কোন ইংরেজ, কোন ফরাসি? তাকে যে আমার কোমরে হাত রেখে নাচতে হবে বিয়ের রাতের বল ডানসে! যা দেখতে পাচ্ছি, শেষটায় জাতভাই কোনো ফিনকেই পাকড়াও করতে হবে!’
আমি শুধালুম, ‘ফিনরা কি বেজায় ঢাঙা হয়?’
বললেন, ‘ছয়, ছয় তিন, ছয় ছয় হামেশাই। তাই তো তারা আর পাঁচটা জাতিকে আকসার হাইজাম্পে হারায়।’
রসবোধ ছাড়া অন্য একটি গুণ ছিল আনিকির। হাজির-জবাব। কিছু বললে চট করে তার জুৎসই জবাব তার জিভে হামোহাল হাজির থাকত।
একদিন বেড়াতে বেরিয়েছি তার সঙ্গে। এক ডেপো ছোকরা আনিকির দৈর্ঘ্য দেখে তাকে চেচিয়ে শুধালে, ‘মাদমোয়াজেল, উপরের হাওয়াটা কি ঠাণ্ডা?’
আনিকি বললেন, ‘পরিষ্কার তো বটেই। তোমার বোিটকা প্রশ্বাস সেখানে নেই বলে।’
আনিকির সঙ্গে আমাদের এতখানি হৃদ্যতা হয়েছিল যে তিনি আমাদের সঙ্গে লজান, মন্ত্রো, লুৎর্সেন, ইন্টেরল্যাকেন, ৎসুরিশ সব জায়গায় ঘুরে বেড়ালেন।
বিদায়ের দিন শ্ৰীমতী বসু তো কেঁদেই ফেললেন।
***
দু’এক বৎসর আমাদের সঙ্গে পত্র ব্যবহার ছিল। তার পর যা হয়-আস্তে আস্তে যোগসূত্র ছিন্ন হয়ে গেল। r
তারপর বহু বৎসর কেটে গিয়েছে, এখানে এক ফিন মহিলার সঙ্গে আলাপ। শুধালুম, ‘প্রেসিডেন্ট পাসিকিভির মেয়েকে চেনেন?’
গুম হয়ে রইলেন ভদ্রমহিলা অনেকক্ষণ। তারপর শুধালেন, ‘আপনার সঙ্গে এখন কি তার যোগাযোগ নেই?’
আমি বললুম, ‘বহু বৎসর ধরে নেই।’
বললেন, ‘তিনি চার মাস ধরে হাসপাতালে। পেটের ক্যানসার। বাঁচবেন না। আপনি একটা চিঠি লিখুন না। অবশ্য অসুখের কথা উল্লেখ না করে। জাসটি, এমনি হঠাৎ যেন মনে পড়ছে।’
সে রাত্রেই লিখলুম।
দিন চারেক পরে আরেক পার্টিতে সেই ফিন মহিলার সঙ্গে দেখা। সুধালেন, ‘চিঠি লিখেছেন?’
আমি বললুম, ‘হ্যাঁ’।
বললেন, ‘দরকার ছিল না। কাল দেশের কাগজে পড়লুম, মারা গেছেন।’