আনন্দ অমৃতরূপে বিশ্বের প্রকাশ

আনন্দ অমৃতরূপে বিশ্বের প্রকাশ

রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভাবনায় মিলছে আধুনিক বিজ্ঞান এবং প্রাচীন উপনিষদ। আধুনিক বিজ্ঞান মহাবিশ্বের ভিত্তিস্তরে গভীর প্রত্যয়ে ক্রমেই আবিষ্কার করেছে তার অখণ্ডতা। উপনিষদেও বলা হয়েছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অখণ্ডতার কথা। বলা হয়েছে, একই আদিসত্তার প্রকাশ ঘটেছে অগ্নিতে, জলেতে, ওষধিতে, বনস্পতিতে— এই আদিসত্তা মহাবিশ্বের সর্বত্র প্রবিষ্ট, প্রকাশিত।

উপনিষদের এই শ্লোকটির প্রায় আক্ষরিক অনুবাদ করলেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘নৈবেদ্য’ কাব্যগ্রন্থের ৫৭ সংখ্যক কবিতায়:

তপোবন তরুচ্ছায়ে মেঘমন্দ্রস্বর

ঘোষণা করিয়াছিল সবার উপরে

অগ্নিতে, জলেতে, এই বিশ্বচরাচরে,

বনস্পতি ওষধিতে এক দেবতার

অখণ্ড অক্ষয় ঐক্য।

ব্রহ্ম শুধু এই বিশ্বের সর্বত্র উপস্থিত নেই, তিনি এই অখণ্ড মহাবিশ্বকে চালিতও করছেন। তাঁরই প্রতাপে অগ্নি তাপ দান করে, সূর্য উত্তাপ বিতরণ করে, ইন্দ্র, বায়ু ও মৃত্যু আপন আপন কাজ করে যাচ্ছে। এই বিশ্বাস কঠোপনিষদের। এই ভাবটিই হুবহু উচ্চারিত হল রবীন্দ্রনাথের কবিতায়:

…বিশ্বচরাচর

ঝরিছে আনন্দ হতে আনন্দ-নির্ঝর।

অগ্নির প্রত্যেক শিখা ভয়ে তব কাঁপে,

বায়ুর প্রত্যেক শ্বাস তোমারি প্রতাপে

তোমারি আদেশ বহি মৃত্যু দিনরাত

চরাচর মর্মরিয়া করে যাতায়াত।

(নৈবেদ্য: ৫৮)

মহাবিশ্বের অখণ্ডতার অন্য একটি দিকের ওপর আলোকপাত করেছেন অন্তত কিছু বিখ্যাত বিজ্ঞানী। আমার বই ‘বিজ্ঞানে ঈশ্বরের সংকেত’-এ তার আলোচনা করেছি।

সেই বিজ্ঞানীরা বলছেন, সমগ্র বিশ্বের মধ্যে, তার বুননে বুননে, ছড়িয়ে আছে অখণ্ড চৈতন্য। উপনিষদের ঋষিও উপলব্ধি করেছিলেন বিশ্বের অন্তর্নিহিত অখণ্ড চৈতন্যের অস্তিত্বকে। উপনিষদ সারা বিশ্বব্যাপী বিরাজমান এই অখণ্ড চৈতন্যকেই বলছে ব্রহ্ম।

রবীন্দ্রনাথের কাব্যে তাঁর বিশেষ এষণা তাঁকে নিয়ে গেছে সারা বিশ্বের বুননে ছড়িয়ে থাকা অখণ্ডচৈতন্যের উপলব্ধিতে। বিজ্ঞান-সমর্থিত সত্য ও উপনিষদের বিশ্ববোধ মিশে গেছে রবীন্দ্রনাথের ধ্যানে। তাঁর বিশ্বপ্রজ্ঞার মধ্যে ফুটে উঠেছে অসীম চৈতন্যের পরপারে দাঁড়িয়ে এক জ্যোতির্ময় সত্তা:

সৃষ্টিলীলা প্রাঙ্গণের প্রান্তে দাঁড়াইয়া

দেখি ক্ষণে ক্ষণে

তামসের পরপার,

যেথা মহা অব্যক্তের অসীম চৈতন্যে ছিনু লীন।

আজি এই প্রভাতকালে ঋষিবাক্য জাগে মোর মনে।

করো করো অপাবৃত, হে সূর্য, আলোক-আবরণ,

তোমার অন্তরতম পরম জ্যোতির মধ্যে দেখি

আপনার আত্মার স্বরূপ।

(জন্মদিনে: ১৩)

রবীন্দ্রনাথের ভাবনা, তাঁর দর্শন একদিকে যেমন উপনিষদের দ্বারা প্রাণিত, অন্যদিকে বিজ্ঞানের দ্বারাও অনেকটাই সমর্থিত। মহাবিশ্ব-বিষয়ে প্রাচীন ভারতের উপলব্ধির সঙ্গে আধুনিক বিজ্ঞানের সত্যসন্ধানের সকল বিভেদ যেন শেষ হয়ে গেছে রবীন্দ্রনাথের গানে, কবিতায়। রবীন্দ্রচেতনায় উপনিষদের প্রভাব সুদূর প্রসারিত। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের বিশ্ববোধ ছিল না বিজ্ঞানবিহীন।

আজীবন রবীন্দ্রনাথ ছিলেন আলোর উপাসক। একই সঙ্গে বিজ্ঞান ও উপনিষদ তাঁর আলোক-এষণার প্রেরণা। ঈশোপনিষদের আলোক-উপাসনার বীজমন্ত্র ধ্বনিত হয়েছে রবীন্দ্রকাব্যে বারবার। ‘পূরবী’ কাব্যের ‘সাবিত্রী’ কবিতাটির কথা মনে পড়ছে। রবীন্দ্রনাথের এই কবিতার বিষয় সূর্যের আলো ও প্রাণ। যে-আলো দূর করে অন্ধকার, যে-আলো প্রাণের উৎস:

তোমারি হোমাগ্নি মাঝে আমার সত্যের আছে ছবি,

তারে নমো নম।

তমিস্র সুপ্তির কূলে যে বংশী বাজাও, আদিকবি,

ধ্বংস করি তম,

সে বংশী আমারই চিত্ত, রন্ধ্রে তারি উঠিছে গুঞ্জরি

মেঘে মেঘে বর্ণচ্ছটা, কুঞ্জে কুঞ্জে মাধবীমঞ্জরী,

নির্ঝরে কল্লোল।

তাহারি ছন্দের ভঙ্গে সর্ব অঙ্গে উঠিছে সঞ্চরি

জীবনহিল্লোল।

আদিসত্তাকে মহাবিশ্বের আদিকবি বলে আবার কল্পনা করলেন রবীন্দ্রনাথ।

মহাবিশ্বের অন্তরে এবং রবীন্দ্রনাথের অন্তরেও যেন আলোর বাঁশি বাজাচ্ছেন এই আদিকবি। আলোর বাঁশিই লুপ্ত করছে অন্ধকার, জাগাচ্ছে প্রাণের হিল্লোল। মহাবিশ্বের সঙ্গে এভাবেই প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের অখণ্ডতা— তাঁর নিবিড় সম্পর্ক। রবীন্দ্রনাথের এই উপলব্ধি কিন্তু ঈশোপনিষদের আলোকবন্দনা ও ঋক্‌বেদের গায়ত্রীমন্ত্র থেকে একেবারেই দূরের নয়। ঋক্‌বেদের গায়ত্রীমন্ত্র১ বলছে, সূর্য শুধু জগৎকেই প্রকাশ করছে না, সেই সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে আমাদের বোধের সঙ্গে, চৈতন্যের সঙ্গে।

গায়ত্রীমন্ত্রের সূর্যবন্দনা যেন ফিরে এসেছে আধুনিক উচ্চারণে রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধে:

‘সূর্যের আলোর ধারা তো আমাদের নাড়িতে নাড়িতে বইছে। আমাদের প্রাণমন, আমাদের রূপরস, সবই তো উৎসরূপে রয়েছে ঐ মহাজ্যোতিষ্কের মধ্যে। সৌরজগতের সমস্ত ভাবীকাল একদিন তো পরিকীর্ণ হয়ে ছিল ওরই বহ্নিবাষ্পের মধ্যে। আমার দেহের কোষে কোষে ঐ তেজই তো শরীরী, আমার ভাবনার তরঙ্গে তরঙ্গে ঐ আলোই তো প্রবহমান। বাহিরে ঐ আলোরই বর্ণচ্ছটায় মেঘে মেঘে পত্রে পুষ্পে পৃথিবীর রূপ বিচিত্র; অন্তরে ঐ তেজই মানসভাব ধারণ করে আমাদের চিন্তায় ভাবনায় বেদনায় রাগে অনুরাগে রঞ্জিত। সেই এক জ্যোতিরই এত রং, এত রূপ, এত ভার, এত রস। ঐ-যে জ্যোতি আঙুরের গুচ্ছে গুচ্ছে এক এক চুমুক মদ হয়ে সঞ্চিত, সেই জ্যোতিই তো আমার গানে গানে সুর হয়ে পুঞ্জিত হল। এখনি আমার চিত্ত হতে এই যে চিন্তা ভাষার ধারায় প্রবাহিত হয়ে চলেছে, সেকি সেই জ্যোতিরই একটি চঞ্চল চিন্ময় স্বরূপ নয় যে জ্যোতি বনস্পতির শাখায়-শাখায় স্তব্ধ ওঙ্কার-ধ্বনির মতো সংহত হয়ে আছে? হে সূর্য, তোমারই তেজের উৎসের কাছে পৃথিবীর অন্তর্গূঢ় প্রার্থনা ঘাস হয়ে গাছ হয়ে, আকাশে উঠছে, বলছে, জয় হোক! বলছে, অপাবৃণু, ঢাকা খুলে দাও! এই ঢাকা-খোলাই তার প্রাণের লীলা, এই ঢাকা-খোলাই তার ফুল-ফলের বিকাশ। অপাবৃণু, এই প্রার্থনারই নির্ঝর-ধারা আদিম জীবাণু থেকে যাত্রা করে আজ মানুষের মধ্যে এসে উপস্থিত, প্রাণের ঘাট পেরিয়ে চিত্তের ঘাটে পাড়ি দিয়ে চলল। আমি তোমার দিকে বাহু তুলে বলছি, হে পূষন্, হে পরিপূর্ণ, অপাবৃণু, তোমার হিরণ্ময় পাত্রের আবরণ খোলো, আমার মধ্যে যে গুহাহিত সত্য, তোমার মধ্যে তার অবারিত জ্যোতিঃস্বরূপ দেখে নিই। আমার পরিচয় আলোকে-আলোকে উদ্ঘাটিত হোক।

* * *

আমাদের ঋষি প্রার্থনা করেছেন, তমসো মা জ্যোতির্গময়, অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে যাও। চৈতন্যের পরিপূর্ণতাকে তাঁরা জ্যোতি বলেছেন।… ধিয়ো যো নঃ প্রচোদয়াৎ— আমাদের চিত্তে তিনি ধীশক্তির ধারাগুলি প্রেরণ করছেন।

ঈশোপনিষদে বলছেন, হে পূষন্, তোমার ঢাকা খুলে ফেলো, সত্যের মুখ দেখি; আমার মধ্যে যিনি সেই পুরুষ তোমার মধ্যে।’

(যাত্রী)

মন্ত্রের মতো এই লেখা, যার মধ্যে মুছে গেছে গদ্য ও কবিতার বিভেদরেখা। এই আধুনিক মন্ত্রের মধ্যে উচ্চারিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের ধ্যান-উপলব্ধ সত্য। রবীন্দ্রনাথ এখানে গভীরভাবে অনুভব করেছেন মহাবিশ্বের অখণ্ডতাকে। যে-জ্যোতি আঙুরের গুচ্ছে গুচ্ছে মদ হয়ে সঞ্চিত, সেই জ্যোতিই পুঞ্জিত তাঁর গানে গানে সুর হয়ে। ধ্যানমগ্ন, অচঞ্চল, চিরন্তন অমূর্ত শক্তিকেই যেমন তিনি দেখতে পেলেন গাছের শাখায় শাখায় ওঙ্কার-ধ্বনির মতো সংহত হয়ে থাকা জ্যোতির মধ্যে, তেমনি তিনি উপলব্ধি করলেন সেই জ্যোতির মূর্ত চঞ্চল স্বরূপকেও। অদ্বৈত যে দ্বৈত হতে পারে, উপনিষদের এই প্রত্যয়কেই রবীন্দ্রনাথ প্রকাশ করলেন তাঁর নিজস্ব মন্ত্রমগ্ন ভাষায়। তারপর বললেন, বিশ্বব্যাপী অখণ্ড চৈতন্যের কথাও— সেই জ্যোতিই যেন চৈতন্যকে আমাদের মধ্যে ধীশক্তি রূপে প্রেরণ করছে। এই জগতের সঙ্গে আমরা এক অখণ্ড সূত্রে বিধৃত। তিনি উপনিষদের ভাষাতেই বললেন, ‘অপাবৃণু’। এই সত্য যেন উন্মোচিত হয়। যে-সত্যের উদ্ভাসে আমরা বুঝতে পারি, অমূর্ত ব্রহ্মই সারা বিশ্বে মূর্তরূপ ধরে ছড়িয়ে আছেন। তিনি মূর্তে-অমূর্তে সমান সত্য। ব্রহ্মের প্রকাশিত রূপ এই জগৎকে ভুল বলার ভ্রান্তি শুরু হয়েছিল হাজার বছর আগে। সেই ভুল থেকে না বেরতে পারলে সেটা হবে আরও এক ভুল।

রবীন্দ্রনাথ গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন বৃহদারণ্যক উপনিষদের মধুমন্ত্রের দ্বারা। মধুমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, যে-অখণ্ড ভাবের মধ্যে এই মহাবিশ্ব এই জগৎ ধৃত হয়ে আছে সেই ভাব হল ভুবনব্যাপী অন্তর্নিহিত আনন্দের। তাঁর গানের ভাষায় অকপটে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ধ্যানের এই অনুভব: ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে।’ মহাবিশ্বে পরিকীর্ণ আনন্দধারাই উপনিষদের পরিব্যাপ্ত হৃদয়বার্তা। উপনিষদের সেই মধুমন্ত্র— যে-মন্ত্রে উচ্চারিত অখণ্ড বিশ্ববোধ— সেই মধুমন্ত্রই ফিরে এসেছে রবীন্দ্রনাথের কবিতায়—

এ দ্যুলোক মধুময়, মধুময় পৃথিবীর ধূলি—

অন্তরে নিয়েছি আমি তুলি

এই মহামন্ত্রখানি,

চরিতার্থ জীবনের বাণী।

বিজ্ঞান এবং উপনিষদ— উভয়েরই প্রত্যয় জগতের অখণ্ডতার কোনও ক্ষয় নেই আদিস্তরে। মহাবিশ্বের সেই অখণ্ডতা চিরন্তন। মহাবিশ্বের এই অখণ্ডতার অনুভব এবং ধ্যানই প্রকাশিত হয়েছিল কোন সেই আদিকালে তপোবনের নিভৃতে উপনিষদের মন্ত্রে। রবীন্দ্রনাথও বললেন তাঁর কবিতায়, প্রায় মন্ত্রের উচ্চারণে, মহাবিশ্বের ক্ষয়হীন চিরন্তন অখণ্ডতার কথা— সেই শাশ্বত সত্যের কোনও মৃত্যু নেই

দিনে দিনে পেয়েছিনু সত্যের যা কিছু উপহার

মধুরসে ক্ষয় নাই তার।

তাই এই মন্ত্রবাণী মৃত্যুর শেষের প্রান্তে বাজে—

সব ক্ষতি মিথ্যা করি অনন্তের আনন্দ বিরাজে।

(আরোগ্য: ১)

উপনিষদের হাজার হাজার বছরের প্রাচীন গহন গম্ভীর বার্তাই নব রসে দীক্ষিত হয়ে, নব বর্ণে রঞ্জিত হয়ে, নব যুগের প্রত্যয়ে প্রাণিত হয়ে ফিরে এসেছে রবীন্দ্রনাথের কাব্যে, গানে এই অক্ষয় সত্যকে আমাদের কাছে উন্মোচিত করতে যে, জগতের মৃত্যুহীন অখণ্ড সত্তা প্রকাশিত হয়েছে অসীম গৌরবে জগতের মধুময়তার মধ্যেই।

বিজ্ঞানে প্রাণিত উপনিষদে দীক্ষিত রবীন্দ্রনাথ এই নিগূঢ় সত্যের অনুভবে উত্তীর্ণ হলেন, মহাবিশ্বের এই অখণ্ডতার উৎস সেই আদিজ্যোতি, যে-আদিজ্যোতিকে বাদ দিয়ে মহাবিশ্বের অখণ্ড চৈতন্যের প্রকাশকে ভাবা যায় না। তাঁর এই ধ্যান এবং উপলব্ধির শিকড় প্রসারিত উপনিষদে। রবীন্দ্রনাথ বললেন তাঁর এই বিশ্বাসের কথা প্রান্ত জীবনের কবিতায়— যেভাবে শুধু তিনিই বলতে পারেন—

আলোকের অন্তরে যে আনন্দের পরশন পাই,

জানি আমি তার সাথে আমার আত্মার ভেদ নাই।

এক আদি জ্যোতি উৎস হতে

চৈতন্যের পুণ্যস্রোতে

আমার হয়েছে অভিষেক,

ললাটে দিয়েছে জয়লেখ,

জানায়েছে অমৃতের আমি অধিকারী;

(আরোগ্য: ৩২)

জগতের যে আদিসত্তা, যে উৎস, তার সঙ্গে আমরা অবিচ্ছিন্ন সূত্রে আবদ্ধ রয়েছি। এই সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার নয়। আদিসত্তা বা সৃষ্টির উৎসের সঙ্গে আমাদের নিবিড় নিরবচ্ছিন্ন সম্পর্ক ক্ষয়হীন বলেই জগৎ বিধৃত এক অখণ্ড মধুময়তায়। এই জগৎকে মিথ্যা বলে ত্যাগ করলে তো সেই আদিসত্তা, আমাদের উৎসের সঙ্গেই আমাদের সম্পর্ক ছিন্ন করতে হয়! কিন্তু তা তো সম্ভব নয়। লিখলেন রবীন্দ্রনাথ—

পরম-আমির সঙ্গে যুক্ত হতে পারি

বিচিত্র জগতে

প্রবেশ লভিতে পারি আনন্দের পথে।

(আরোগ্য: ৩২)

উপনিষদের ঋষির ধ্যানেও যেমন, রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধিতেও তেমন,— মহানন্দ ও মহাবেদনা এক হয়ে যায় মহাবিশ্বের আদিসত্তার রূপ যখন জেগে ওঠে মনের মধ্যে—

একি পুলকবেদনা বহিছে মধুবায়ে!

‘পুলকবেদনা’ শব্দটির মধ্যে এক হয়ে আছে আনন্দ-ব্যথার মিশ্রিত রাগ। তারই মধ্যে বিরাজিত জগতের শাশ্বত স্বরূপ—

এই করেছ ভালো, নিঠুর হে, নিঠুর হে, এই করেছ ভালো।

এমনি করে হৃদয়ে মোর তীব্র দহন জ্বালো॥

আমার এ ধূপ না পোড়ালে গন্ধ কিছুই নাহি ঢালে,

আমার এ দ্বীপ না জ্বালালে দেয় না কিছুই আলো॥

সত্যের এই অপরূপ রূপের উদ্ঘাটনের জন্যেই তো উপনিষদের ঋষির প্রার্থনা। উপনিষদের সেই প্রার্থনাই হাজার হাজার বছর পেরিয়ে রবীন্দ্রনাথ পৌঁছে দিলেন আমাদের প্রাণে।

নক্ষত্রবেদীর তলে আসি

একা স্তব্ধ দাঁড়াইয়া, ঊর্ধ্বে চেয়ে কহি জোড়হাতে—

হে পূষন, সংহরণ করিয়াছ তব রশ্মিজাল,

 এবার প্রকাশ কর তোমার কল্যাণতম রূপ,

দেখি তারে যে পুরুষ তোমার আমার মাঝে এক।

(প্রান্তিক: ৯)

উপনিষদ বলছে, চেতনা উন্মোচিত হলে, আবরণ সরে গেলে, ঢাকনা খুলে গেলে, অন্ধকার অপসারিত হলে জগতের প্রতি কণায় কণায়, অণু-পরমাণুতে বিরাজমান উৎসের উপলব্ধি আমাদের হৃদয়েও আসে। উপনিষদের এই শাশ্বতবাণী কত যুগ-যুগান্তরের ব্যবধান পেরিয়ে পৌঁছোল আমাদের কাছে রবীন্দ্রনাথের ভাষায়।

এই ঘন আবরণ উঠে গেলে

অবিচ্ছেদে দেখা দিবে

দেশহীন কালহীন আদিজ্যোতি,

শাশ্বত প্রকাশপারাবার,

সূর্য যেথা করে সন্ধ্যাস্নান,

যেথায় নক্ষত্র যত মহাকায় বুদবুদের মতো…

(রোগশয্যায়: ২০)

তপোবনের উদার আকাশের তলায় উপনিষদের ঋষি তাঁর ধ্যানের মধ্যে পেয়েছিলেন এই সত্য— আনন্দরূপম অমৃতং যদ্‌বিভাতি। এই ঋষিবাণী গেঁথে গেল রবীন্দ্রনাথের চৈতন্যে। তাঁর কবিতায় নতুন ভাষায়, নব যুগের আলোয় ধরা দিয়েছে ভারতের প্রাচীন ঋষির ধ্যান থেকে উঠে আসা সত্য—

জীবনের দুঃখে শোকে তাপে

ঋষির একটি বাণী চিত্তে মোর দিনে দিনে হয়েছে উজ্জ্বল—

আনন্দ অমৃতরূপে বিশ্বের প্রকাশ।

(রোগশয্যায় ২৫)

সেই অমৃতরূপই জগতের অখণ্ডতা। ব্রহ্ম-সত্যের সঙ্গে জগৎ-সত্য না এক হলে, না মিশলে, জগতের অখণ্ডতাই তো ভেঙে যাবে। বিজ্ঞান এই অখণ্ডতাকে প্রমাণ করেছে। উপনিষদ এই অখণ্ডতাকে ধ্যানে পেয়েছে। পেয়েছে প্রজ্ঞায়। রবীন্দ্রনাথ জগতের এই অখণ্ডতাকে সহজ করে বুঝিয়ে দিলেন আমাদের—

অন্তহীন দেশকালে পরিব্যাপ্ত সত্যের মহিমা

যে দেখে অখণ্ড রূপে

এ জগতে জন্ম তার হয়েছে সার্থক।

(রোগশয্যায়: ২৫)

জগৎকে মিথ্যা বললে, ব্রহ্মের সঙ্গে আমাদের অখণ্ডতাবোধ থেকেই আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাব।

ঔপনিষদিক বিশ্বচেতনা ও রাবীন্দ্রিক বিশ্বদর্শন যখন উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে একই ধ্যানের আলোয়, আমরা দেখতে পাই তার অভিন্ন স্বরূপ। আবার বলছি, বিজ্ঞানের মতে মহাশূন্য শূন্য নয়। সম্পূর্ণ বায়ুবিহীন ভ্যাকুয়ামের মধ্যেও কাজ করে এক ভূতুড়ে ক্ষেত্রের শক্তি। এখন এই ধারণা বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে যে সমস্ত মৌলকণার মধ্যে রয়েছে নিহিত বিভিন্ন কোয়ান্টাম ক্ষেত্রের উদ্দীপনা। আর সারা জগৎ জুড়ে সব কোয়ান্টাম ক্ষেত্র সব দিকেই বিস্তৃত। সুতরাং মহাশূন্য শূন্য নয়। মহাশূন্য যেন এক বিশাল রান্নার কড়াই যার মধ্যে সর্বদা, অন্তহীনভাবে চলছে ফুটন্ত কোয়ান্টাম কার্যকলাপ। বলা যেতে পারে, মহাশূন্য যেন তাঁত বোনার অদৃশ্য কল। সেই বহুস্তরী বুননের মধ্যে মহাশূন্য জুড়ে কী বিস্তৃত হয়ে আছে? বিস্তৃত হয়ে আছে কোয়ান্টাম ফিল্ড। এবং সবথেকে মজার ব্যাপার যা একেবারেই জাদুবিস্ময়, সেই কোয়ান্টাম-ফিল্ড বুননবস্ত্রের প্রতিটি সূক্ষ্ম অংশের মধ্যেই রয়েছে পুরো উৎসটি! অর্থাৎ বস্ত্রের প্রতিটি অংশেই সম্পূর্ণ উৎস উপস্থিত!

আগেই বলেছি এ যুগের কিছু প্রথিতযশা বিজ্ঞানী বলছেন, সমগ্র বিশ্বের বুননে বুননে ছড়িয়ে আছে অখণ্ড চৈতন্য। উপনিষদও কি বলছে না প্রায় একই কথা? মহাশূন্য শূন্য নয়। সেখানে ভরে আছে প্রাণ। সেখানে চলছে এক অনন্ত বিশ্বলীলা। মহাশূন্য যেন ভরে আছে আনন্দের অনন্ত প্রকাশে। তা যদি না হত তা হলে এ জগৎ হয়ে যেত নিশ্চল, প্রাণহীন, অর্থহীন। মহাশূন্যে প্রাণের লীলা আছে বলেই তো সেই অসীম প্রাণবুনন, আনন্দপ্রবাহ আমাদের প্রাণিত করে।

আর রবীন্দ্রনাথ কী বললেন? আজকের বিজ্ঞান মহাশূন্যের বুননের সম্পর্কে যা জানে, তাঁর সময়ে তা জানত না। তবু উপনিষদের দীক্ষা তাঁর সামনে খুলে দিল সত্যের দ্বার। উপনিষদই ঘটাল তাঁর চোখের সামনে থেকে অন্ধকারের অপসারণ। তিনি দেখলেন—

শূন্য, তবু সে তো শূন্য নয়।

তখন বুঝিতে পারি ঋষির সে বাণী—

আকাশ আনন্দপূর্ণ না রহিত যদি

জড়তার নাগপাশে দেহমন হইত নিশ্চল।

কোহ্যেবানাৎ কঃ প্রাণাৎ

যদেষ আকাশ আনন্দো ন স্যাৎ।

(রোগশয্যায়: ৩৬)

মহাশূন্যের সঙ্গে আমরা প্রাণের সূত্রে আবদ্ধ, তাকে শূন্য বলে ত্যাগ করার, অস্বীকার করার যে কোনও উপায় নেই, মহাশূন্যের সঙ্গে বিশ্বজগৎ যে ওতপ্রোতভাবে সংলগ্ন, এ-কথা বৈজ্ঞানিক সত্য। সৃষ্টির উৎস, সেই আদিসত্তা মহাশূন্যেও বিরাজ করছে। ব্রহ্মকে সত্য বলে মেনে নিলে তাই মহাজগৎকেও সত্য বলেই মেনে নিতে হবে। জগৎ মায়া নয়। এমনকী মহাশূন্যও মায়া নয়। আমরা সবাই এক অখণ্ড সত্তার মধ্যে বিধৃত। ঈশোপনিষদের শুরুতেই তাই বলা হল, এই জগতের সমস্তই ব্রহ্মের দ্বারা আচ্ছাদিত। এই জগৎ সর্বদাই চলমান, সর্বদাই পরিবর্তনশীল, গতিই এই জগতের জীবন-অভিজ্ঞান। ভেবো না, জগৎ পরিবর্তনশীল বলেই জগৎ সত্য নয়, জগৎ মায়া। কারণ, এই চলমান জগৎ একটি শাশ্বত সত্তারই অভিব্যক্তি। জগতের এই নিত্য পরিবর্তনশীল রূপটি সম্ভব হয়েছে, কারণ তার আশ্রয়, তাকে ধারণ করে আছে এক নিত্যসত্তা। এই চিরন্তন সত্তাই আদিসত্তা, উৎস, ব্রহ্ম। জগৎকে ব্রহ্মই আচ্ছাদন করে আছে। কিংবা, বলা যেতে পারে, এই উৎস, আদিসত্তা বা ব্রহ্মই সারা জগতের সমস্ত কিছুর অন্তরে বাস করে বিশ্বজগতের মধ্যে দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করছেন।

শংকরাচার্যের প্রসঙ্গ আরও একবার টেনে আনা যাক। উপনিষদ বলছে সেই গূঢ় সাংকেতিক বার্তাটি, যার থেকে শংকরাচার্য বোধহয় বললেন জগৎকে ত্যাগ করো, জগৎ মিথ্যা। উপনিষদ বলছে, সারা জগতের সব কিছুর মধ্যেই ব্রহ্ম প্রকাশমান, ব্রহ্মের সত্তা-ছাড়া কোনও কিছুরই অস্তিত্ব নেই। যখন আমরা এইভাবে ভাবতে পারি, তখনই সঠিকভাবে আমরা জগৎকে ভোগ করতে পারি। ব্রহ্মময় জগৎকে ভোগ করার মধ্যে আসক্তির কোনও স্থান নেই। আমরা লোভহীনভাবে নির্লিপ্তির সঙ্গে ভোগ করতে পারি।

এতক্ষণ এতকথা বলার সারাৎসার হল এই— জগৎ মিথ্যা নয় মোটেই। জগৎ মায়া নয় একেবারেই। উপনিষদ আমাদের শিখিয়েছে কীভাবে এই জগৎকে ভোগ করতে হয়। উপনিষদের এই শিক্ষা আমাদের আলোচনার প্রেক্ষিতে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তাই পুনরায় বলছি, যে জগতের সর্বত্র ব্রহ্ম বিরাজমান সেই জগৎকে ত্যাগ করার কথা কখনওই উপনিষদ বলছে না। উপনিষদ বরং বলছে, এই জগৎকে ভোগের মধ্যে যদি আনন্দ নিয়ে আসতে চাও, যদি ভোগকে দুঃখ থেকে দূরে রাখতে চাও, তা হলে জগৎকে নির্লোভভাবে, নিরাসক্তভাবে ভোগ করো। ভোগের বস্তুর সঙ্গে জড়িয়ে পোড়ো না। ভোগের বস্তুর সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেই দুঃখ, তাকে লোভ করে পেলেই দুঃখ। কিন্তু নির্লোভ নিরাসক্ত ভোগের মধ্যে শুধুই আনন্দ।

এবারে আবার আসা যাক শংকরাচার্যের কথায়। ঈশোপনিষদের শুরুর দুটি সংকেত, ‘ঈশা বাস্যমিদং সর্বং’ আর ‘তেন ত্যক্তেন’, শংকরাচার্যের মতো মহাপণ্ডিত যেন বুঝেও বুঝতে চাননি? তিনি ব্যাখ্যা করলেন এইভাবে— জগৎ ব্রহ্মের প্রকাশ, জগৎকে আচ্ছাদন করে আছেন ব্রহ্ম, তাই জগৎকে আমরা সত্য বলে ভাবি। কিন্তু জগৎ মিথ্যা। জগৎকে আচ্ছাদন করে আছে ব্রহ্মের মায়া। জগৎ ব্রহ্মের মায়াবী প্রকাশ। এইভাবে যদি ভাবা যায় তা হলে সমস্ত জগৎকে, স্ত্রী-পুত্র-বিত্ত-স্বর্গের কামনা— সব কিছু ত্যাগ করা যাবে। এবং সব কিছু ত্যাগ করলেই ব্রহ্মাকে পাওয়া যাবে।

হয়তো নষ্টের গোড়া ঈশোপনিষদের শুরুর শ্লোকের দ্বিতীয় শব্দ ‘বাস্যমিদং’-এর মধ্যে লুকিয়ে থাকা ‘ব্যস্যম্’ শব্দটি। এক, গায়ে ঢাকা দেওয়ার আচ্ছাদন, অর্থাৎ পরিধেয় পরিচ্ছদ। দুই, বাস করার যোগ্য।

শংকরাচার্য ‘ব্যস্যম্’-এর প্রথম অর্থটি গ্রহণ করে বললেন, সারা জগৎ হল মায়ার আচ্ছাদন— সবটাই মিথ্যা। এই মায়ার আচ্ছাদনে ব্রহ্মের প্রকাশও মিথ্যা। ওই মিথ্যার মধ্যে, মায়ার বন্ধনে জড়িয়ে থাকলে সত্যকে পাওয়া যাবে না। জীবনের উদ্দেশ্য সত্যকে পাওয়া। অতএব জগৎকে মিথ্যা বলে ত্যাগ করো। ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা।

কিন্তু উপনিষদ বলছে ঠিক উলটো কথা। অর্থাৎ ‘ব্যস্যম্’ শব্দটিকে তার দ্বিতীয় অর্থে ব্যবহার করেছে উপনিষদ। উপনিষদ বলছে, ব্রহ্ম জগৎকে ঢেকে রাখেননি, তিনি জগতের প্রতিটি বস্তুকে নিজের বাসযোগ্য মনে করে তার মধ্যে বিরাজ করছেন। বিজ্ঞানও এরকম ভাবনা যথেষ্ট প্রমাণের সঙ্গে, প্রত্যয়ের সঙ্গে সমর্থন করে বলছে মহাবিশ্বের সবকিছুর মধ্যেই আদি উৎস উপস্থিত। সুতরাং যে-জগতের প্রতিটি বস্তুর মধ্যেই মহাসৃষ্টির আদিসত্তা, অর্থাৎ উৎস বিদ্যমান সেই জগৎকে ত্যাগ করার কোনও প্রশ্নই নেই। এই জগৎকে ব্রহ্মের মতোই সত্যজ্ঞান করতে হবে। এবং সেই জগৎকে নিরাসক্তভাবে ভোগ করার মধ্যেও কোনও অন্যায় নেই। জগৎ তো আমাদেরই জন্যে সৃষ্টি হয়েছে। ‘আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর তোমার প্রেম হত যে মিছে’, বললেন রবীন্দ্রনাথ। শুধু এই জগতের আনন্দকে নির্লোভভাবে, অনাসক্তির সঙ্গে ভোগ করলে দুঃখের কোনও কারণ থাকবে না। উপনিষদ তাই সেই সংকেতটুকু সংক্ষেপে পাঠিয়েছে আমাদের কাছে— তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথাঃ। এই সংকেতটাকেও এমনভাবে ব্যাখ্যা করলেন শংকরাচার্য জগৎ মিথ্যা প্রমাণ করার জন্যে— যা আমার মনে হয় না উপনিষদের প্রাণের কথা, বিশ্বাসের বার্তা।

‘তেন’ শব্দটির চারটি ব্যাখ্যা হতে পারে— এক, সেইজন্য। দুই, সেই অনিত্য বস্তুর দ্বারা। তিন, ব্রহ্ম বা আদিসত্তার দ্বারা। চার, সেই ত্যাগের দ্বারা। শংকরাচার্য জগৎকে মিথ্যা প্রমাণ করার জন্যে ঔপনিষদিক সংকেতের চতুর্থ অর্থটি গ্রহণ করলেন! তিনি বললেন, তেন ত্যক্তেন, অর্থাৎ সেই ত্যাগের দ্বারা ‘ভুঞ্জীথাঃ’ অর্থাৎ আত্মাকে, মানে নিজেকে পালন করবে। সোজা কথায়, জগৎকে মিথ্যা বলে ত্যাগ করে সেই ত্যাগের দ্বারা (তেন ত্যক্তেন) নিজের আত্মাকে পালন করো।

অন্য তিনটি অর্থ কিন্তু জগৎকে ভোগ করার আভাস দিচ্ছে। বলছে এ-জগৎ মিথ্যা নয়। প্রথম অর্থ— যেহেতু জগতের মধ্যে ব্রহ্মের প্রকাশ ঘটেছে, সেই কারণে এই জগতের আনন্দকে নির্লোভভাবে ভোগ করতে হবে। দ্বিতীয় অর্থ— যেহেতু জগৎ পরিবর্তনশীল ও অনিত্য বস্তুর দ্বারা গঠিত, তাই ভোগের বস্তুর সঙ্গে লিপ্ত না হয়েও এই জগৎকে ভোগ করতে হবে। তৃতীয় অর্থ— ‘তেন’, মানে ব্রহ্ম কর্তৃক প্রদত্ত জগৎকে নির্লোভভাবে ভোগ করবে— লোভ করবে না।

শংকরাচার্য ঈশোপনিষদের এই সংকেতের তিনটি প্রথম অর্থের একটিকেও না গ্রহণ করে যেন নিজের জেদেই জগৎকে মিথ্যা প্রমাণিত করতে তাঁর মায়াবাদকে সমর্থন করতে চতুর্থ অর্থটি গ্রহণ করে বললেন ‘তেন’ মানে সেই ত্যাগের দ্বারা ‘ভুঞ্জীথাঃ’ নিজের আত্মাকে পালন করবে।

কোন ত্যাগ? মিথ্যা বলে জগৎকে ত্যাগ। কারণ ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মায়া, মিথ্যা!

আরও একবার মনে করিয়ে দিচ্ছি হাজার বছর আগে শংকরাচার্যের এই ব্যাখ্যা আর তার প্রচার ভারতবর্ষের সভ্যতাকে শত শত বছর পিছিয়ে দিয়েছে। দৈনন্দিন জগৎকে অবহেলা করে, পার্থিব সাফল্যকে অবজ্ঞা করে। ‘জগৎ মিথ্যা’ এই ভ্রান্ত ধারণাই নষ্ট করেছে আমাদের কর্মসংস্কৃতি, আমাদের করে তুলছে আলস্যপ্রবণ, এবং এত বছর ধরে আমাদের মনের মধ্যে এই বদ্ধমূল ধারণার জন্ম দিয়েছে যে এই জগতে বিশেষ কাজকর্ম করে লাভ নেই, কারণ জগৎ মিথ্যা।

সম্প্রতি আবার একটি উলটো স্রোতও প্রবলভাবে দেখা দিয়েছে। আধুনিক ভারতের কর্মব্যস্ত ছেলেমেয়েরা ভুলে যাচ্ছে নির্লোভ নিরাসক্ত হওয়ার কথা। তারা যেন ভাবছে, ব্রহ্ম মিথ্যা, জগৎ সত্য। তাদের মনে রাখতে হবে, জাগতিক ভোগ থেকে ততক্ষণই আনন্দ পাওয়া যায় যতক্ষণ আমাদের মধ্যে কাজ করে নির্লিপ্তি, যতক্ষণ আমরা জড়িয়ে না পড়ি ভোগের বস্তুর সঙ্গে।

এই বইটি লিখলাম একটি মাত্র উদ্দেশ্যে, তা হল শংকরাচার্যের প্রচারিত ‘জগৎ মিথ্যা’ এই ধারণা থেকে যেন আমরা চিরদিনের জন্যে বেরিয়ে আসতে পারি, যেন হাজার বছরের এই ভুলটিকে এবার শুধরে নিতে পারি। সেই শুধরে নেওয়ার ভুল ভাঙার পথ আমাদের উপনিষদই দেখিয়েছে। দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, যে-কথা আমরা বারবার বলেছি। আবার যাওয়া যাক উপনিষদের কাছে। ঈশোপনিষদের দ্বিতীয় মন্ত্রেই রয়েছে আমাদের ভুল ভেঙে ফেলার ডাক।

ঈশোপনিষদের এই দ্বিতীয় মন্ত্রটি পরিষ্কার বলল, জগৎকে মিথ্যা জ্ঞান না করে যদি আমরা সকলে কাজ করে যাই, কর্তব্য করে যাই, তা হলে আমাকে সেই মহানন্দের মধ্যে একশো বছর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করবে (জিজীবিষেৎ শতং সমাঃ)। কিন্তু মানুষ কর্মের মধ্যে, ভোগের মধ্যে, লিপ্ত হয়ে যেয়ো না (ত্বয়ি নরে কর্ম ন লিপ্যতে)। অন্য কোনও পথ নেই (নান্যথেতোঽস্তি)।

শংকরাচার্য ঈশোপনিষদের এই দ্বিতীয় শ্লোকটিকেও ঔদ্ধত্যের সঙ্গে ব্যাখ্যা করে বললেন, উপনিষদ কাজের পথ দেখিয়েছে সাধারণ মানুষদের জন্য! শংকরাচার্যের মতে, ঈশোপনিষদের প্রথম মন্ত্রটিতে বলা হয়েছে একমাত্র সন্ন্যাসীদের জন্যেই জ্ঞানের পথ— যে-পথে যেতে জগৎকে মিথ্যা বলে ত্যাগ করতে হবে। আর কর্মের পথ আত্মজ্ঞানলাভে বঞ্চিত সাধারণ মানুষদের জন্য! এই ব্যাখ্যা সত্য থেকে সাধারণ মানুষকে দূরে নিয়ে যায়। যাঁরা ব্রহ্মকে পেতে চান, তাঁদের পথ কর্মত্যাগের পথ, জগৎ ত্যাগের পথ। তাই তাঁদের জন্য জগৎ মিথ্যা, ব্রহ্মই সত্য। কিন্তু সৃষ্টি চলার জন্যে সব মানুষকে তো সন্ন্যাসী হলে চলবে না। তাদের জন্যে জগৎ মিথ্যা সে যে মিথ্যা কতদূর!

শংকরের এই হাজার বছরের ভুল প্রচার থেকে বেরোবার সময় এসেছে। এই বই সেই কথাই মনে করিয়ে দেবে পাতায় পাতায়। আমার উদ্দেশ্য— উপনিষদের মন্ত্রের মধ্যে যেন আমরা জগৎকে সত্যরূপে ফিরে পাই, যেন দিনে দিনে সেই অনন্ত বর্ণময় সত্যের আমরা যোগ্য হয়ে উঠতে পারি— অগ্রদূত রবীন্দ্রনাথের ধ্যানমগ্ন, সারস্বত সহায়তায়। এই কথাটা আপনাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া প্রয়োজন।

শংকরাচার্য যাই বলে থাকুন, ঈশোপনিষদের প্রথম ও দ্বিতীয় মন্ত্রে যে গূঢ় কথাটি বলা হল, তার অর্থ জগৎ সত্য— জগৎ কোনওভাবেই মিথ্যা নয়। উপনিষদের প্রথম মন্ত্রে যে-ত্যাগের কথা বলা হয়েছে, তা কর্মত্যাগ নয়, জগৎ ত্যাগ নয়, তা আসলে জগৎকে দুঃখহীনভাবে, অনন্ত আনন্দের সঙ্গে ভোগ করার জন্যে আসক্তি ত্যাগের মন্ত্র। এবং সাধারণ মানুষের কাছেই উপনিষদের এই উপদেশ। দ্বিতীয় মন্ত্রটিও সাধারণ মানুষের জন্যেই, যেখানে বলা হয়েছে জীবনধারণ করতে মানুষকে কাজ করতেই হবে। উপনিষদ বলুন, গীতা বলুন, সব জায়গাতেই জগৎকে সত্য বলে কাজের ডাক— কিন্তু সেই কাজ যেন বাসনাহীন হয়।

উপনিষদ থেকে রবীন্দ্রনাথ শুধু ধ্যানের দীক্ষা পাননি, পেয়েছিলেন কাজের মন্ত্রও— সে-কথা যেন আমরা ভুলে না যাই। উপনিষদের বাণীর দ্বারা প্রাণিত হয়েই তিনি জগৎকে সত্যরূপে গ্রহণ করেছিলেন, বিশ্ব মায়া নয়, এ জগৎ স্বপ্ন নয়, তিনি ডাক দিয়েছিলেন এই জগৎকে বীতরাগ হয়ে উপভোগ করার, এই জগতের মধ্যে কাজ করার। সে-ডাক আমরা শুনেও যেন শুনতে পাইনি।

যুগে যুগে এমন মানুষ আসেন পৃথিবীতে যিনি আমাদের নতুন করে দেখতে শেখান, ভাবতে শেখান, বুঝতে শেখান। আমাদের প্রণোদিত করেন নতুন দেখার দেখায়। উপনিষদের ঋষিরা ছিলেন এমন মানুষ যাঁরা নতুনভাবে দেখতে শিখিয়েছিলেন সৃষ্টিকে। তাঁরা কখনই বলেননি জগৎ মিথ্যা।

রবীন্দ্রনাথ আর এক যুগপুরুষ যিনি আমাদের নতুনভাবে ভাবতে প্রেরণা দিলেন। তাঁর মধ্যে একত্রিত হয়েছে উপনিষদের বিশ্ববোধ, বিজ্ঞানের উন্মোচন। তিনি এক আধুনিক ঋষির মতো সূর্যের কাছে প্রার্থনা করলেন সেই ধ্যানজ্যোতি, সেই অপূর্ব আলো, সেই বিশ্বব্যাপী চৈতন্যের একটি অংশ যার দ্বারা তিনি অনুভব করতে পারবেন বিশ্বসৃষ্টির অন্তরে নিহিত সত্যকে—

হে প্রভাতসূর্য,

আপনার শুভ্রতম রূপ

তোমার জ্যোতির কেন্দ্রে হেরিব উজ্জ্বল,

প্রভাতধ্যানেরে মোর সেই শক্তি দিয়ে

করো আলোকিত;

দুর্বল প্রাণের দৈন্য,

হিরণ্ময় ঐশ্বর্যে তোমার

দূর করি দাও,

পরাভূত রজনীর অপমান সহ।

(রোগশয্যায়: ১৫)

রবীন্দ্রনাথের প্রার্থনা যেন হয়ে ওঠে আমাদেরও প্রার্থনা। আমাদেরও ধ্যান যেন সত্যের কিরণে হয়ে ওঠে উজ্জ্বল। আমরা যেন জগতের ঐশ্বর্যের আলোয়, সৌন্দর্যের উদ্ভাসে দূর করতে পারি আমাদের প্রাণের দৈন্য। আমরা যেন গত হাজার বছরের পরাভূত রজনীর অপমান, অন্ধকার থেকে এই উপলব্ধির আলোয় মুক্তি পাই। যেন বুঝতে পারি, ব্রহ্ম সত্য জগৎ সত্য। অখণ্ড এই মহাবিশ্বে এর চেয়ে মহত্ত্বর, পরমতর সত্য নেই। আজকের বিজ্ঞানলব্ধ বিশ্ববোধের আলোও সেই পথে।

১. যে দেবঽগ্নৌ যোঽপসু যোবিশ্বংভুবনমাবিবেশ।

যো ওষধিষু যো বনস্পতিষু তস্মৈ দেবায় নমোনমঃ॥

২. ভয়দস্যাগ্নিস্তপতি ভয়াত্তপতিসূর্যঃ।

ভয়াদিন্দ্রশ্চ বায়ুশ্চ পঞ্চমঃ।

৩. সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম তজ্জলানিতি॥ ছান্দোগ্য উপনিষদ ৩।১৪।১

১. ‘হিরণ্ময়েন পাত্রেণ সত্যস্যাপিহিতং মুখম’

১. তৎ সবিতুর্বরেণ্যং ভর্গো দেবস্য ধীমহি।

ধিয়ো যো নঃ প্রচোদয়াৎ॥

১. মধুবাতা ঋতায়তে মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবঃ

মধু নক্তম উতোষসো মধুসৎ পার্থিব রজঃ।

১. হিরণ্ময়েন পাত্রেণ সত্যস্যাপিহিতং মুখম্।

তত্ত্বং পূষণ্‌ অপার্বৃণু সত্যধর্মায় দৃষ্টয়ে॥

১. কোহ্যেবানাৎ কঃ প্রাণাৎ।

যদেষ তাকাশ আনন্দো ন স্যাৎ।

১. ঈশা বাস্যমিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ।

২. তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথাঃ মা গৃধঃ কস্যস্বিদ ধনম্‌।

১. কুর্বন্নেবেহ কর্মাণি জিজীবিষেৎ শতং সমাঃ।

এবং ত্বয়ি নান্যথেতোঽস্তি ন কর্ম লিপ্যতে নরে॥

১. ব্রহ্মণ্যাধায় কর্মাণি সঙ্গং ত্যক্ত্বা করোতি যঃ।

লিপ্যতে ন স পাপেন পদ্মপত্রমিবাম্ভসা॥ (গীতা ৫।১০)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *