আনন্দই ছিল তাঁর ঈশ্বর
আমাদের বাড়িতে সাধু-সন্ন্যাসী, তান্ত্রিক, জ্যোতিষী, হঠযোগী, গায়ক, বাদক, ভবঘুরে, ফকির-দরবেশের আনাগোনার বিরাম ছিল না। এঁদের অনেককেই পাত পেড়ে খাওয়ানো তো হতই, কেউ কেউ দু-চার দিন থেকেও যেতেন। মা বিশেষ রাগটাগও করতেন না। কারণ মায়ের প্রাথমিক শিক্ষাটা হয়েছিল সারদেশ্বরী আশ্রমে। বাবা ব্রিটিশ আমলের রেলের অফিসার হওয়ার সুবাদে রীতিমত স্যুটেড-বুটেড সাহেবসুবো ছিলেন বটে, কিন্তু কালীঠাকুরকে ভক্তিভরে প্রণাম না করে বেরোতেন না। আর ছিলেন বড়ই অতিথিবৎসল এবং উদার। সাধু-সন্ন্যাসী, ফকির-দরবেশদের তিনিই যেচে নিয়ে আসতেন বাড়িতে।
তখন আমরা কাটিহারে। বাংলোটি বড়সড়। চার দিকে অনেকটা ঘেরা কম্পাউন্ড। যে অভিজাত রেলপাড়ায় আমরা থাকতাম, তার নামই ছিল সাহেবপাড়া। কারণ বেশির ভাগ বাংলোতেই থাকতেন রেলের উচ্চপদস্থ ইংরেজ অফিসার। ক্রিসমাস বা নিউ ইয়ারে সেই সব বাড়ি থেকে পেল্লায় ঝুড়িতে ভেট আসত। রকমারি জিনিস থাকত, সঙ্গে মদের বোতল এবং জ্যান্ত মুরগিও। মা হেঁশেলে মুরগি ঢুকতে দিতেন না। মুরগি রান্না করত বাবার সেলুন কারের খানসামা পাঁচু শেখ।
এক দিন সন্ধেবেলা পূর্ণিয়া থেকে বাবা অতি সম্ভ্রমের সঙ্গে নিয়ে এলেন দাতাবাবাকে। পেল্লায় ভুঁড়িদার চেহারা, মাথায় ঘন জঙ্গলের মতো ঘেঁষ চুল, মুখময় কালো দাড়িগোঁফ, পরনে রক্তাম্বর, গলায় বেশ কয়েকটা পাথরের মালাও ছিল। মুসলমান ফকির ছিলেন তিনি। অতি সুগন্ধী দামি জরদা দিয়ে ঘন ঘন পান খেতেন। ঘণ্টায় ঘণ্টায় চা। আর সে কী প্রাণখোলা হাসি! হাসির দাপটে বাড়ি কেঁপে উঠত। কথায় কথায় হাসতেন। তিনি এলেই আমাদের বাড়িটার সব বিষাদ যেন উড়ে পালাত।
আমাদের পরিবারে কঠোর অনুশাসন ছিল, অব্রাহ্মণকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করা চলবে না। সাধু-সন্ন্যাসী, ফকির-দরবেশদের বেলায় কিন্তু মা-বাবা ব্যতিক্রম করতেন। দাতাবাবাকে আমরা পায়ে হাত দিয়েই প্রণাম করতাম।
দাতাবাবা বাড়িতে এলেই পাঁচু শেখের ডাক পড়ত। সে বাজার থেকে মুরগি কিনে তার বাড়িতেই রান্না করে নিয়ে আসত। শুনেছি, সে নাকি অসাধারণ রাঁধুনি ছিল। তবে আমি, দিদি আর মা ও সব খেতাম না। দাতাবাবার আবার মুরগি না হলেই নয়। খেতেও পারতেন বটে। আর কী তৃপ্তি করেই যে খেতেন! মুখে-চোখে সেই আনন্দের দীপ্তি ফুটে উঠত।
তখন কাটিহার, পূর্ণিয়া, সাহেবগঞ্জ, ভাগলপুরে দাতাবাবার খুব নামডাক। মস্ত ভবিষ্যৎদ্রষ্টা ফকির বলে তাঁর প্রবল খ্যাতি। লোকের মুখে মুখে ফিরত, দাতাবাবা পূর্ণিয়ার রাজাকে এক ভয়ংকর বিপদ থেকে বাঁচিয়েছিলেন। ঘটনাটা আজ আর স্পষ্ট মনে নেই। পূর্ণিয়ার রাজা বোধহয় একটা খুনের মামলার আসামি সাব্যস্ত হয়েছিলেন বা ও রকমই কিছু। এবং সেই মামলায় তাঁর গুরুতর সাজা হওয়ার কথা। দাতাবাবা কী করে তাঁকে বাঁচিয়েছিলেন, সেই ইতিবৃত্তান্তও জানি না। তবে সেই ঘটনার পর দাতাবাবার মস্ত ভক্ত হয়ে পড়েন পূর্ণিয়ার রাজা।
প্রথম প্রথম দাতাবাবা বাড়িতে এলে আমি একটু সিঁটিয়ে থাকতাম ভয়ে। কিন্তু আমাকে কোলের কাছে টেনে নিয়ে সস্নেহে পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে অনেক গল্প করতেন। উনি কিন্তু কখনওই নিজের মুখে তাঁর কোনও মহিমা বা কৃতিত্বের কথা বলতেন না। লোকে বললেও বিরক্ত হতেন। নিজেকে সাধুসন্ত বলে দাবিও করতেন না। অথচ অনেকের মুখেই শুনতাম ওঁর মহিমায় তাদের রোগ সেরেছে, সংকট কেটেছে, বিপদ দূর হয়েছে। আমার আবছা মনে পড়ে, মায়ের সোনার গয়না হারিয়ে গিয়েছিল। দাতাবাবাকে সেটা জানানোয় তিনি বিশেষ একটা জায়গায় খুঁজে দেখতে বলেছিলেন এবং সেখানেই সেটা পাওয়াও যায়।
দাতাবাবা পয়সাকড়ি নিতেন না। তাঁকে শুধু ভাল রান্না আর জরদা-পান নিবেদন করলেই খুশি। সেই খুশিটাই ছিল বিস্ফোরণের মতো। এমন অট্টহাসি হাসতেন যে, সেটা এখনও যেন সময়ের সরণি পেরিয়ে এসে আমার শ্রবণে হানা দেয়। আনন্দময় পুরুষ আর কাকে বলে!
হঠাৎ বজ্রাঘাতের মতো একটা খবর এল। দাতাবাবাকে চিটিং কেসে পুলিশ গ্রেফতার করেছে এবং ফাটকে পুরেছে। শুনে সকলেই মুষড়ে পড়েছিল। আমিও। আমার কেন যেন মনে হয়েছিল দাতাবাবা কাউকে ঠকাতেই পারেন না। সম্ভবত একটা সম্পদঘটিত মামলা ছিল সেটা। কেউ এক জন দাতাবাবাকে সম্পত্তি দান করে এবং কোনও শত্রুপক্ষ তাই নিয়ে চিটিং কেস করে বসে। পূর্ণিয়ার রাজা ভাল উকিল লাগিয়ে দাতাবাবাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন। ও দিকে শোনা যায়, থানায় তাঁর ওপর পুলিশ যথেচ্ছ অত্যাচার করেছে।
তবে কিছু দিনের মধ্যেই দাতাবাবা ছাড়া পেয়ে যান। এবং তারও কিছু পরে আমাদের কাটিহারের বাসাতেও আসেন। আশ্চর্য এই, কোনও পরিবর্তনই হয়নি তাঁর। সেই হাসি, সেই তৃপ্তি করে খাওয়াদাওয়া, তেমনই জমিয়ে গল্প করা, কিন্তু কখনও তিনি পুলিশের বিরুদ্ধে একটি কথাও উচ্চারণ করেননি। তাঁর সঙ্গে যারা শত্রুতা করেছিল তাদের কোনও রকম নিন্দেমন্দ করেননি। জিজ্ঞেস করলে খুব হাসতে হাসতে বলতেন, কপালে একটু হাজতবাস ছিল আর কী! এর বেশি কিছু নয়। দেখা গেল তাঁর আনন্দময় সত্তা থেকে কিছুই কেউ কেড়ে নিতে পারেনি। ধর্মকথা বলতেন না। উপদেশ দিতেন না। বোধহয় শুধু নিজের অফুরান আনন্দই ছিল তাঁর প্রকৃত ঈশ্বর।