আধুনিক তরজা
এনে দাও আমার ধরাচূড়া, বর্ম, শিরোস্ত্রাণ।
দেখি ফিরিয়ে আনতে পারি কিনা আমার অশ্বমেধের ঘোড়া।।
একটু বুঝিয়ে বলো।
আমার শৈশব। হতে চাই শিশু ভোলানাথ।
ফিরে পেতে চাই সেই নিরাসক্ত মন।
যেতে চাই সেই জগৎ পারাবারের তীরে।
যেখানে ছেলেরা করে মেলা।।
মাছের চোখের মতো মরা এই চোখ,
দেহযন্ত্র পুরোনো, প্রায় বিকল,
সময় তুলেছে ভাঁজ কপালে
শিথিল হয়েছে শরীর
কল্পনা মরে গেছে, স্মৃতি বিস্মৃতি
চলো যাই ধরে আনি অশ্বমেধের ঘোড়া।।
যা যায় তা যায়, সময় চলেছে এক মুখী।
বৃথা চেষ্টা
কিন্তু সেই ছেলেবেলা যেমন করিতে খেলা
তেমনি করিয়ো খেলা নির্ঝরের সনে’
মনে মনে ফিরে যাও শৈশবের কালে
গোল মুখ, গোরুর মতো নির্বোধ চোখ
গুরু মশাইয়ের পাঠশালা
অ-এ অজগর আসতো তখন তেড়ে
এখন আর আসে না
আ এ আমটি আর, পেড়ে খায় না
কিনেই না হয় খেলে।।
আর বাসের দোলায় ছন্দ মিলে যাবে:
কুমোর পাড়ার গোরুর গাড়ি
বোঝাই করা কলসি হাঁড়ি
গাড়ি চালায় বংশীবদন
সঙ্গে যে যায় ভাগ্নে মদন
ভেবে নাও, এখনও তুমি আছ শিশুটি
শঙ্খ ধবল চোখে কালো মনি
পাপের জন্ডিস হলুদের ছোঁয়া দেয়নি
সব কটা দাঁত এখনও ঠিকই আছে
হজমের গোলযোগ নেই,
একমাথা কালো চুল
কথায় কথায় খিল খিল হাসি
‘ওরে মোর শিশু ভোলানাথ,
তুলি দুই হাত
যেখানে করিস পদপাত
বিষম তাণ্ডবে তোর লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় সব,
আপন বিভব
আপনি করিস নষ্ট হেলাভরে
প্রলয়ের ঘূর্ণ চক্রপরে
চূর্ণ খেলেনার ধূলি উড়ে দিকে দিকে
আপন সৃষ্টিকে
ধ্বংস হতে ধ্বংসমাঝে মুক্তি দিস অনর্গল
খেলারে করিস রক্ষা ছিন্ন করি খেলেনা শৃঙ্খল।’
থামো থামো, হয় না যা, তা হয় না,
ছোট ছেলে হওয়ার সাহস
আছে কি এক ফোঁটা
তাই তো এমন বুড়ো হয়েই মরি
তিলে তিলে জমাই কেবল
জমাই এটা ওটা
পলে পলে বাক্স বোঝাই করি।
কালকে দিনের ভাবনা এসে
আজ দিনেরে মারলে ঠেসে
কাল তুলি ফের পরদিনের বোঝা
সাধের জিনিস ঘরে এনেই
দেখি, এনে ফল কিছু নেই
খোঁজের পরে আবার চলে খোঁজা।’
তোমার অসীমে
ওই তো মজা
‘জীবনের খরস্রোতে ভাসিছ সদাই
ভুবনের ঘাটে ঘাটে;
এক হাটে লও বোঝা শূন্য করে দাও অন্য হাটে
দক্ষিণের মন্ত্রগুঞ্জরণে
তব কুঞ্জবনে
বসন্তের মাধবীমঞ্জরী
যেই ক্ষণে দেয় ভরি
মালঞ্চের চঞ্চল অঞ্চল
বিদায় গোধূলি আসে ধূলায় ছড়ায়ে ছিন্নদল।
সময় যে নাই;
আবার শিশিররাত্র তাই
নিকুঞ্জে ফুটায়ে তোল নব কুন্দরাজি
সাজাইতে হেমন্তের অশ্রুভরা আনন্দের সাজি
হায় রে হৃদয়
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।’
জানি জানি,
নলিনীদলগত জলমতিতরলং, তদবজ্জীবনমতিশয়চপলম।
ক্ষণমপি সজ্জনসঙ্গতিরেকা, ভবতি ভবার্ণবতরণে নৌকা।।
যাবজ্জনমং তাবন্মরণং, তাবজ্জননীজঠরে শয়নম।
ইতি সংসারে স্ফুটতরদোষ:, কথমিহ মানব তব সন্তোষ:।।
দিনযামিন্যৌ সায়ং প্রাত:, শিশির বসন্তৌ পুনরায়াত:।
কাল ক্রীড়তি গচ্ছত্যায়ুস্তদপি ন মুঞ্চত্যাশাবায়ু:।।
অঙ্গং গলিতং পলিতং মুণ্ডং, দন্তবিহীনং জাতং তুণ্ডম।
করধৃতকম্পিতশোভিত দণ্ডং, তদপি ন মুঞ্চত্যাশাভাণ্ডম।
তাই তো তাই তো এই তো জীবন
বসন্তপ্রভাতে এক মালতীর ফুল
প্রথম মেলিল আঁখি তার,
প্রথম হেরিল চারি ধার।
মধুকর গান গেয়ে বলে,
মধু কই, মধু দাও দাও’।
হরষে হৃদয় ফেটে গিয়ে,
ফুল বলে, ‘এই লও লও।’
বায়ু আসে কহে কানে কানে,
ফুলবালা, পরিমল দাও।’
আনন্দে কাঁদিয়া কহে ফুল,
‘যাহা আছে সব লয়ে যাও।’
তারপর?
তরুতলে চ্যুতবৃন্ত মালতীর ফুল
মুছিয়া আসিছে আঁধি তার,
চাহিয়া দেখিল চারি ধার।
মধুকর কাছে এসে বলে,
‘মধু কই, মধু চাই-চাই।’
ধীরে ধীরে নি:শ্বাস ফেলিয়া
ফুল বলে, ‘কিছু নাই নাই।’
‘ফুলবালা, পরিমল দাও’
বায়ু আসি কহিতেছে কাছে।
মলিন বদন ফিরাইয়া
ফুল বলে, ‘আর কী বা আছে।’
সে তো মৃত্যু
সেই তো পরিণতি
‘বাল্য দিয়ে যে জীবনের
আরম্ভ হয় দিন
বাল্যে আবার হোক না তাহা সারা
জলে স্থলে সঙ্গ আবার
পাক না বাঁধন হীন,
ধূলায় ফিরে আসুক না পথহারা!’
জীবন তাহলে নদী
নদী, তুমি কোন কথা কও?
অশথের ডালপালা তোমার বুকের ‘পরে পড়েছে যে,
জামের ছায়ায় তুমি নীল হ’লে
আরও দূরে চ’লে যাই
সেই শব্দ সেই শব্দ পিছে পিছে আসে,
নদী না কি?
নদী তুমি কোন কথা কও?
তুমি যেন ছোট মেয়ে—আমার সে ছোট মেয়ে;
যত দূর যাই আমি হামাগুড়ি দিয়ে তুমি পিছে পিছে আস,
তোমার ঢেউয়ের শব্দ শুনি আমি :
আমারি নিজের শিশু সারাদিন নিজ মনে কথা কয় (যেন)।
কথা কয়—কথা কয়-ক্লান্ত হয় নাকো
এই নদী
একপাল মাছরাঙা নদীর বুকের রামধনু
বকের ডানার সারি শাদা পদ্ম-নিস্তব্ধ পদ্মের দ্বীপ নদীর ভিতরে
মানুষেরা সেই সব দেখে নাই।
কখন আমের বনে চলে গেছি
এইখানে কোকিলের ভালোবাসা কোকিলের সাথে
এইখানে হাওয়ায় যেন ভালোবাসা বীজ হয়ে আছে
নদীর নতুন শব্দ এইখানে; কার যেন ভালোবাসা পুষে
রাখে বুকে
সোনালি প্রেমের গল্প সারাদিন পড়ে
সারাদিন পাখি তাহা শোনে; তবু শোনে সারাদিন?
পাখিরা তাদের গানে এই শব্দ তবু
পৃথিবীতে খেতে মাঠে ছড়াতে পারে না,
নদীর নিজের সুর এ যে!
নদী, তুমি কোন কথা কও?
গাছ থেকে গাছে, আর মাঠ থেকে মাঠে রোদ শুধু মরে যায়
সব আলো কোন দিকে যায়!
নিজের মুখের থেকে রোদের সোনালি রেণু মুছে ফ্যালে নদী
শেষে রেনু মুছে ফেলে
সে যেন অনেক বড় মেয়ে এক—চুল তার ম্লান-চুল শাদা
শুধু তার ফুল নিয়ে খেলিবার সাধ
ফুলের মতন কোন ভালোবাসা নিয়ে
ধানের কঠিন খোসা বড় হিম শুকনো সব পাপড়ির মাঝে
সেই মেয়ে
ইতস্তত ব’সে আছে
গান গায়;
নদীর নদীর শব্দ শুনি আমি
নদী, তুমি কোন কথা কও!
সবই হল তবু বলি, বলে রেখে যাই,
‘তখন বয়স সাত।
মুখচোরা ছেলে,
একা একা আপনারি সঙ্গে হত কথা।
মেঝে বসে
ঘরের গরাদখানা ধরে
বাইরের দিকে চেয়ে চেয়ে
বয়ে যেত বেলা।
দূরে থেকে মাঝে মাঝে ঢঙ ঢঙ করে
বাজত ঘণ্টার ধ্বনি
শোনা যেত রাস্তা থেকে সইসের হাঁক।
হাঁসগুলো কলরবে ছুটে এসে নামত পুকুরে।
ওপাড়ার তেলকলে বাঁশি ডাক দিত।
গলির মোড়ের কাছে দত্তদের বাড়ি,
কাকাতুয়া মাঝে মাঝে উঠত চিৎকার করে ডেকে।
একটা বাতাবি লেবু, একটা অশথ,
একটা কয়েতবেল, এক জোড়া নারকেল গাছ,
তারাই আমার ছিল সাথী।
আকাশে তাদের ছুটি অহরহ,
মনে মনে সে ছুটি আমার।
আপনারি ছায়া নিয়ে
আপনার সঙ্গে যে-খেলাতে
তাদের কাটত দিন
সে আমারি খেলা।
তারা চির শিশু।
আমার সমবয়সী।
আষাঢ়ে বৃষ্টির ছাটে, বাদলা হাওয়ায়
দীর্ঘ দিন অকারণে
তারা যা করেছে কলরব
আমার বালকভাষা
হো হো শব্দ করে
করেছিল তারি অনুবাদ।
তারপরে একদিন যখন আমার
বয়স পঁচিশ হবে,
বিরহের ছায়াস্নান বৈকালেতে
ওই জানালায়
বিজনে কেটেছে বেলা।
অশথের কম্পমান পাতায় পাতায়
যৌবনের চঞ্চল প্রত্যাশা
পেয়েছে আপন সাড়া
সকরুণ মুলতানে গুন গুন গেয়েছি যে গান
রৌদ্রে ঝিলিমিলি সেই নারকেল ডালে
কেঁপেছিল তারি সুর।
বাতাবিফুলের গন্ধে ঘুমভাঙা সাথীহারা রাতে
এনেছে আমার প্রাণে
দূর শয্যাতল থেকে
সিক্ত আঁখি আর কার উৎকণ্ঠিত বেদনার বানী।
সেদিন সে গাছগুলি
বিচ্ছেদে মিলনে ছিল যৌবনের বয়স্য আমার।
তারপরে অনেক বৎসর গেল
আরবার একা আমি
সেদিনের সঙ্গী যারা
কখন চিরদিনের অন্তরালে তারা গেছে সরে।
আবার আরেকবার জানলাতে
বসে আছি আকাশে তাকিয়ে!
আজ দেখি সে অশ্বত্থ, সেই নারকেল
সনাতন তপস্বীর মতো।
আদিম প্রাণের
যে বাণী প্রাচীনতম
তাই উচ্চারিত রাত্রিদিন
উচ্ছ্বসিত পল্লবে পল্লবে।
সকল পথের আরম্ভেতে
সকল পথের শেষে
পুরাতন যে নি:শব্দ মহাশান্তি স্তব্ধ হয়ে আছে,
নিরাসক্ত নির্বিচল সেই শান্তি সাধনার
মন্ত্র ওরা প্রতিক্ষণে দিয়েছে আমার কানে কানে।