“আধা-ছানার মণ্ডা”
“আমি আলাদা তুমি আলাদা।”
ঠাকুর একদিন মহিমাচরণকে বোঝাচ্ছেন, ‘আমি’ হলো আমার অহং— আমার নাম-রূপ, আমার দেহ, আমার অস্তিত্ববোধ, আমার আকাঙ্ক্ষা, আমার অভিমান, আমার স্বার্থ। ঠাকুর ব্যাখ্যা করছেন : “অহং একটি লাঠির স্বরূপ— যেন জলকে দুভাগ কচ্ছে।” আমি আর তুমি।
আমার বাড়ি, আমার সাইকেল। একই বাড়িতে একসঙ্গে বসবাস — পিতা, মাতা, পুত্র, পরিবার। বলছি—আমার স্ত্রী; পরক্ষণেই চিৎকার করছি— বুকপকেট থেকে আমার টাকা নিয়ে গেলে কেন? আঙুল উঁচিয়ে তর্জন- গর্জন—আমার চেয়ারে কেউ বসুক, এটা আমি পছন্দ করি না। আমার ঘরে যাকে-তাকে ‘অ্যালাউ’ কর কেন, মেজাজ খিঁচড়ে যায়। খবরের কাগজটা আমি পড়ার আগেই পাশের ঘরে চলে গেল! আমার পাপোশটা বউদির ঘরে কেন! আরো সূক্ষ্মে গেলে দেখা যাবে ‘আমি’র ঘনত্ব বা ‘কনসেনট্রেশন’ আরো বেশি। স্বামী স্ত্রীকে বলছে : “মেজ বউদি যে-শাড়িটা পরে বাপের বাড়ি গেল, সেটা তোমার না! শাড়িটার দাম জান! ব্যাঙ্গালোর থেকে অনেক টাকা দিয়ে কিনে এনেছিলাম, এইবার একমাস পরে ছিঁড়েখুঁড়ে দাগরাজি করে ফেরত দিয়ে যাক!” অর্থাৎ শাড়িটা পুরোপুরি তোমার নয়, আমার শাড়ি তোমাকে পরতে দিয়েছি। আমি আর তুমি। স্ত্রীরও একটা ‘আমি’ আছে। সেই অভিমানে বলছে : “তোমার জিনিস ছুঁতে আমার ঘেন্না করে।” পিতার ‘আমি’ পুত্রকে বলছে : “আমার কোন জিনিসে তুমি হাত দেবে না। আমার শেভিং ক্রিম, টুথপেস্ট, পাউডার। নবাবি করার ইচ্ছা হলে নিজের রোজগারের পয়সায় কর।”
জগৎজুড়ে অসংখ্য ‘আমি’ কিলবিল করছে। স্বার্থের আঠায় আমিতে আমিতে জোড়া লাগে, স্বার্থ মিটে গেলেই জোড় খুলে আলাদা। ‘ম্যারেজ অফ কনভেনিয়েন্স।’ ঠাকুর বলছেন, সমস্ত ভেদাভেদের উৎস হলো কাম-কাঞ্চন। কাঞ্চনের প্রসঙ্গ না হয় বাদই দেওয়া গেল। প্রবলতর রিপু হলো কাম। বহু সাধনায় কামজয়ী হওয়া যায়। ঠাকুর নিজের ওপর প্রকৃতিভাব আরোপ করে কামজয় করেছিলেন। আরেকটা উপায় হলো, মুখ ঘুরিয়ে দেওয়া। জল যেদিকে গড়াতে চাইছে সেইদিকে যেতে না দিয়ে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া—আরেকটা প্রবলতর আকাঙ্ক্ষায় নিমজ্জিত করা। জ্ঞান-নয়নকে প্রহরী করা। বিচারকে প্রয়োগ করা—কি আছে, কি পাবে? অনিত্য থেকে নিত্যতে যাওয়া। ইন্দ্রিয় দিয়ে মানুষ কতটা ভোগ কতদিন করতে পারে! ইন্দ্রিয়ের দাস না হয়ে ইন্দ্রিয়কে দাস করা। গীতায় শ্রীভগবান বলছেন :
“তানি সর্বাণি সংযম্য যুক্ত আসীত মৎপরঃ।
বশে হি যস্যেন্দ্রিয়াণি তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা।।”
একেবারে ঠাকুরের কথা! ইন্দ্রিয়কে বশে আন। অর্থাৎ সংযম। সংযম সাধনার পর মৎপরায়ণ হও। ওঙ্কারনাদানুরক্তি। ঠাকুর মহিমাচরণকে বলছেন : “সমাধিস্থ হয়ে এই অহং চলে গেলে ব্রহ্মকে বোধে বোধ হয়।” শ্রীভগবান বলছেন—ইন্দ্রিয় বশে এলে প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিত হয় অর্থাৎ বদ্ধমূল হয়। এই প্ৰজ্ঞা কখনো বিচলিতা হয় না।”
সন্ন্যাসীর পথ গৃহীর পথ নয়। শতবার শত শ্লোক তারস্বরে পড়লেও অঙ্কট- বঙ্কট যাওয়ার নয়, ঠাকুর জানতেন। তিন কলম উপদেশ ছুঁড়ে দিলেই প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিত হবে না। ঠাকুর কেতাবী ছিলেন না, ছিলেন বাস্তবসচেতন। তাই বলছেন, সাবাধান হও। “খুব সাবধান না থাকলে ব্ৰহ্মজ্ঞান হয় না, তাই সংসারে কঠিন। যত সেয়ানা হও না কেন, কাজলের ঘরে থাকলে গায়ে কালি লাগবে। যুবতীর সঙ্গে নিষ্কামেরও কাম হয়।”
বাবা! ঘাবড়াও মাৎ! অতটা কঠোরের কথা তোমাকে বলছি না গৃহী। কিন্তু একটা কথা বলছি, জ্ঞানী হও। ভেড়া হয়ে থেকো না! স্বামী-স্ত্রী-পুত্র-পরিবারের দাস। খাবলে খুবলে শেষ করে দেবে। ‘আমি’-র চক্করে পড়ো না। ছিটকে দাও। বলদ কি করে! হাম্বা হাম্বা। লাঙল টানছে সারাজীবন। কাঁধে জোয়াল। ঘা। ভ্যানভ্যানে মাছি। শ্লথ হলেই প্রহার। অবশেষে কসাইখানায়। টুকরো, টুকরো। হাড়ে হলো বোনমিল। চামড়ায় হলো জুতো, আর নাড়ি-ভুঁড়ি শুকিয়ে তাঁত। ধুনুরির আঙুল পড়ামাত্রই ‘তুঁহু, তুঁহু’ (তুমি, তুমি)। হাম্বা হাম্বা (আমি, আমি) আর নেই। তুঁহু-তেই উদ্ধার। সংসার পিষে ফেলার আগেই কিল পাকড়ো।
শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন : “বেদান্তমতে স্বস্বরূপকে চিনতে হয়।” শ্রীকৃষ্ণ বলছেন :
“রাগদ্বেষবিযুক্তৈস্ত বিষয়ানিন্দ্রিয়ৈশ্চরন্।
আত্মশ্যৈর্বিধেয়াত্মা প্ৰসাদমধিগচ্ছতি।।”
স্বস্বরূপকে জেনেছি, জিতচিত্ত যোগী হতে পেরেছি, রাগ-দ্বেষ আর নেই, সমস্ত ইন্দ্রিয় আত্মবশীভূত। এই অবস্থায় বিষয় ভোগ করলেও, বিষয় আমাকে ভোগ বা ভাগ করতে পারবে না। ছিঁড়েখুঁড়ে শেষ করতে পারবে না।
“অহং একটা লাঠির স্বরূপ।” ঠাকুর বলছেন : “যেন জলকে দুভাগ করছে।” আমি আর তুমি। আমি করছি। আমি আম খাচ্ছি।, আমি অমুককে ঝেড়ে কাপড় পরিয়েছি, আমি মশারির মধ্যে ঢুকে মশা মারছি, আমি বলছি— আমি থাকতে ঐসব চলবে না। আমার বাড়ি, ইউ গেট আউট।
তুমি কে বাবা? কার মধ্যে কে রয়েছে! সবই তো তুমি! তোমারই তো আমি।
ঠাকুর বলছেন, আগে সমাধিস্থ হও। অহং-লাঠিটা তুলে নাও, তলিয়ে যাও। “এই অহং চলে গেলে ব্রহ্মকে বোধে বোধ হয়।”
তারপর ঠাকুর গৃহীকে একটু আলগা দিচ্ছেন। বলছেন, কেল্লায় থাক। কেল্লা কি না সংসার। সংসারে থেকে কিন্তু ঈশ্বরে মন রেখে সংযতেন্দ্রিয় হয়ে থাক এবং কাম-ক্রোধাদির সঙ্গে যুদ্ধ কর। তাই বলছেন, কেল্লা থেকে যুদ্ধ করা সহজ। বৈরাগ্য ভাল। কিন্তু পূর্ণ বৈরাগ্য আর কজনের পক্ষে সম্ভব? সুতরাং পারবে না যখন, তখন সংসারেই নাহয় থাকলে। কিন্তু মনে রেখো ঈশ্বরকে এবং মনে রেখো সংযমের কথা।
হাসতে হাসতে মহিমাচরণকে বলছেন : “আধা-ছানার মণ্ডা কখনো বা খেলে! সংসারীর পক্ষে তত দোষের নয়।
এটা নাহয় একটা রফা হলো; কিন্তু কাঞ্চন! বিভেদকারী মুদ্রা! মুদ্রারাক্ষসের হাত থেকে উদ্ধারের উপায়! আমি ধনী, আমার ‘ফার্স্ট ক্লাস’। একই ট্রেন, গোটা দুনিয়া তার যাত্রী। জন্মের প্ল্যাটফর্ম থেকে জন্মান্তরের স্টেশনের দিকে ছুটছে। সেই ট্রেনে মাইলোমিটার নেই, নেই মিনিটমিটার। আমার ফার্স্ট ক্লাস, তোমার সেকেন্ড ক্লাস।
ঠাকুর কাঞ্চনকে ক্ষমা করতে পারেননি। গতির দুর্গতি এইভাবে দেখিয়েছেন—টাকা⇒হিসাব→দুশ্চিন্তা→অহঙ্কার→লোকের ওপর ক্রোধ। “সূর্য দেখা যাচ্ছিল মেঘ এসে ঢেকে দিলে।”
জীবন-কুরুক্ষেত্রে শ্রীভগবান গৃহী অর্জুনকে বলছেন :
“যোগস্থঃ কুরু কর্মাণি সঙ্গং ত্যক্ত্বা ধনঞ্জয়।
সিদ্ধ্যসিদ্ধ্যোঃ সমো ভূত্বা সমত্বং যোগ উচ্যতে।।”
অহং কার? আমার নয়—তোমার। পরমেশ্বরের আরাধনাবুদ্ধিতে জীবন-ধূপ জ্বালানো।