আদ্যাশক্তি মায়ের খোঁজে

আদ্যাশক্তি মায়ের খোঁজে

 শরতের অপরূপ প্রকৃতির শোভা দেখে মা দুর্গার কথা মনে মনে খুবই চিন্তা করি। ভাবি—মায়ের আগমনে সারা জগৎ যেন আনন্দে মেতে উঠেছে। নীলাকাশের বুকে শুভ্র মেঘ ভেসে যায়। মাঠে সবুজ ধানক্ষেত। নদীর বালুচরে কাশফুলের মনোলোভা নৃত্য। গ্রাম্য পুকুরে পদ্মফুলের অপরূপ শোভা। মানুষের মনোজগতের হালকা পরিবর্তন। সবকিছুই যেন সুস্পষ্টভাবে অনুভূতিতে ধরা দেয়।

মা বিশ্বময়ী। আদ্যাশক্তি জননী। জগতের সমস্ত কিছুতে তাঁর সত্তা ওতপ্রাোত ভাবে জড়িত—’যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেন সংস্থিতা’। সেই দেবী—যিনি সমস্ত ভূতে বিদ্যমান তিনিই মা—আমাদের আদরের, ভালোবাসার প্রাণজুড়ানো জিনিস। সমস্ত ভুবনজুড়ে তিনি জাগ্রতা। সর্বদা সচেতন। কিন্তু তাকে প্রত্যক্ষ করতে পারছি কই? আমরা যে জগৎ দেখি—মাকে দেখি না, মানুষের মন দেখি মাতৃমন দেখি না—কেন এমন মায়ের কু-পুত্র হলাম আমরা—হ্যাঁ, মাকে দেখতে পাচ্ছি না কেন?

ভাবতে ভাবতে মনটা গম্ভীর হল। সকলের দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে তাই মাকে দেখার চেষ্টা করি। সামাজিক বা অন্য কোনো পরিচয়ে কেউ এলে কথা বলতে ভালো লাগে না। মনে হয় মাতৃভাব চলে যাবে। বিষয়ময় জগতে আছড়ে পড়বে মনটা। তাই এখন কথার চেয়ে চিন্তা করি বেশি। সজাগভাবে মনের চিন্তাগুলিকে লক্ষ রাখি। মনে মনে ভাবি—আমি যেমন চিন্তা করছি, তেমনি জগতের সব নর-নারীই তো আপনভাবে চিন্তা করছে। আর সকলেই কমবেশি নিজের নিজের চিন্তাগুলিকে দেখছে। কিন্তু সকলের ভেতর থেকে নিজ নিজ মনকে কে দেখছে? তিনিই কি মা? তাহলে মাকে আধার করে জগতের সব মানুষেরা চিন্তা করছে। জীবনযাপন করছে। জগৎটা যেন একটি চিন্তার স্রোত। চিন্তারূপিণী মা। সকলের অন্তরে তিনি চিন্তারূপে আছড়ে পড়ছেন।

আমাদের চিন্তার জন্যই এই অচেনা জগৎটা চেনা চেনা লাগছে। এই আকাশ, এই বাতাস, এই জল, এই মাটি, এই তাপ—এদের কি কোনো নাম ছিল কোনোদিন? না—কখনই ছিল না। প্রকৃতির রাজ্যে কোনো নাম নেই। মানুষের চিন্তাই নাম দিয়েছে—এক-এক করে সবকিছুরই।

কেন জানি না এসব ক্রমাগত চিন্তা করে করে জগতের সবকিছুকেই আমার বেশি বেশি অচেনা লাগছে। বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছি, চতুর্দিকে মায়ের নানারকমের ভাব ও ঐশ্বর্য দেখে। যে নীলাকাশকে এতদিন দেখে এসেছি অবহেলাভাবে এখন তার গহন সৌন্দর্যে মন মগ্ন হয়। যে বাতাস নিত্য এতদিন গায়ে মাখামাখি করত এখন তার ছোঁয়া সমগ্র অনুভূতি দিয়ে নিতে পারি। তার সত্তা স্পর্শ করে সর্বাঙ্গে ভালোবাসা জানায়। জুড়িয়ে দেয় তৃষিত তাপিত প্রাণ। পুলকিত হয় দেহমন। তাঁর দয়ায় তো আমাদের বেঁচে থাকা। নইলে কোথায় আমরা মানুষ? বাতাস যদি না থাকত তাহলে কোথায় থাকতাম আমরা? মনের কোণে আশা-প্রীতি-স্বপ্ন-কল্পনার নানা জাল বুনতে পারতাম কি? না—কখনই তা পারতাম না। তাই বাতাসকে স্বয়ং জাগ্রত মাতৃসত্তা বলে প্রণাম জানালাম আমি। আর যে জল আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে তার কথা কিই-বা বলব! জলই জীবন। জীবন মানেই বেঁচে থাকা। অনন্ত প্রকৃতির কোলে একটু দেহবোধ। মনোবোধ। সুখ-দুঃখ, আমার-তোমার-তার অনুভূতি। তাই জলের সঙ্গে সখ্যতা পাতিয়েছি গভীরভাবে। জলের কোনো স্বাদ আছে কিনা এখন সচেতনভাবে তা লক্ষ করি। আর মাটির উপর আমরা মানুষেরা কীভাবে আস্তে আস্তে চলাফেরা করছি, জীবনযাপন করছি এবং মৃত্যুর সময়ে চিরশায়িত হচ্ছি তাই বসে বসে ভাবছি। মাটি তো নয়—যেন সাক্ষাৎ মা জগন্ময়ী—আচ্ছা! এমন মাটির বুক চিরে কীভাবে, কখন এত হরেকরকম গাছপালার আবির্ভাব হল? এমন সুন্দর সুন্দর রং-বেরঙের প্রাণজুড়ানো ফুল, অদ্ভুত প্রজাপতি, গুনগুনে মৌমাছি এবং জিহ্বার সর্বদা স্বাদ লেগে থাকা এমন অপরূপ ফলগুলি গাছ থেকে কীভাবে আবির্ভূত হল? প্রকৃতির রাজ্যে সব যেন কেমন সুন্দরভাবে সাজানো। বাড়ির পাশে আমগাছটি সারা বছর নিশ্চুপভাবে দাঁড়িয়ে আছে। কোনো সাড়াশব্দ নেই। হঠাৎ বসন্তের হাওয়া গায়ে লাগতেই তার সারা অঙ্গে মুকুলে ভরে গেল। কত মৌমাছি, কত নাম না জানা পোকা উড়ে এল মুকুলে। পরাগমিলন ঘটাল। ধরল আম। তারপর বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠমাসে সেই আম কি অপরূপ স্বাদ ও রসমাধুর্যে হল ভরপুর। কেন এমন হয়? কার মাথায় এমন ঘটনা ঘটাবার অদৃশ্য হাত রয়েছে?

চিন্তা আমার গভীর থেকে গভীরতর হল। সেই অসীম মহাশক্তিকে মন দিয়ে অনুভব করছি। কিন্তু ধরতে পারছি না। কেবলই আকাশ-বাতাস-তাপ-জল-মাটিতে মন হাবুডুবু খাচ্ছে। ভাবছি আমি একজন মানব। মনে হচ্ছে আমার শরীরটা স্থির হয়ে বসে আছে। কিন্তু স্থিরত্ব তো কোথাও দেখতে পাচ্ছি না। শরীরের ভেতর অনবরত নানা কাজকর্ম চলছে। ক্রিয়া সর্বত্র। চামড়ার ভেতরে স্তরে স্তরে রয়েছে কত কত হাড়, মাস, মজ্জা, স্নায়ু, রক্ত, মল, মূত্র, পিত্ত—এ-সবের কোনটা আমি? ছিলাম ছোট্ট একটি ভ্রূণ। তারপর হল দেহের রূপান্তর। অঙ্গে ফুটে উঠল ইন্দ্রিয়। গর্ভমোচন হলে সেসব ইন্দ্রিয় প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে মেতে উঠল নানা কর্মে। অসহায় আমি। সুখ-দুঃখের প্রবাহে ভেসে চলেছি। লোকে বলে দেহটা শৈশব, কৈশোর, যৌবন পার করে বার্ধক্যে উপনীত হতে যাচ্ছে। তারপর বিদায় লবে। অনন্ত কালের মাঝে এইমাত্র ক’দিনের জন্য আমার আসা। তোমাদের মাঝে থাকতে। তোমাদের সুখ-দুঃখ-বেদনা-ভালোবাসার অনুভূতির রঙে মনটিকে রাঙাতে। ক’দিনের এই ‘আমার’ অস্তিত্বের উপস্থিতি। মনোরাজ্যের কলকলানি। অহংকারের পদধ্বনি। তারপর আবার সেই—আমি নেই, তুমি নেই, পরিচিত কেউ নেই—সব মিলিয়ে গেছে কোন গোপন লোকে—দু’দিনের এই দেখাশোনা, চেনাজানা, ভালোবাসা—হাসা-কাঁদা—কে এমনভাবে নাচাচ্ছে? অ্যাঁ—কে নাচায় এমন করে তোমায়-আমায়—বলতে পার, ভাই?

মনকেই এই সহজ অথচ জটিল প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলাম। এতে মন গেল বিগড়ে। সে আমাকে দিল জোর ধমক। বলল—তুমি এমন নির্মম বাস্তবের চিন্তা করছ কেন? জগতের লোকেদের মতো মিথ্যা কল্পনায় ভেসে থাকতে পার না? কেন তুমি চিন্তা করছ এমনভাবে? কী হবে এতসব চিন্তা করে? যে মাটির উপর দিয়ে তুমি চলাফেরা করো তাকে মাটি বলো কেন? ‘টি’টা বাদ দিয়ে ‘মা’ বলে শ্রদ্ধা জানাতে পার না। প্রণাম করতে দ্বিধা হও কেন তারে? মা-মাটি-মানুষের কথা কি তোমার মনে নেই? এরা সকলই তোমার মা। এইসব মাতৃঅঙ্গকে প্রণাম কর। তোমার চিন্তার দৈন্য কেটে যাবে। সর্বদা আনন্দে থাকবে।

মাটিকে ‘মা’ বলে চিন্তা করতে করতে আমার দুষ্টু মন সোজা সুমেরুর মাটিহীন বরফের দেশে হাজির হল। চোখ মেলে দেখলুম এখানে কোনো মাটি নেই। শুধু বরফ। জমাটবাঁধা। শুভ্র মেঘের স্পর্শে সে বরফের শোভা কী অপরূপ! ওই সুদূর নীলাকাশে অনন্তের হাতছানিতে মন যেন পাখা মেলে উড়ে যেতে চায় কোনো অচিনপুরীতে—যেখানে মন নেই, ব্যথা নেই, বেদনাও নেই—আছে কেবল আনন্দ—এক ও অখণ্ড আনন্দ। আসলে আমাদের মনটা শুভ্র স্ফটিকের মতো। এর গাত্রে প্রতিচ্ছবি পড়ছে সমগ্র জগতের—তার নানা রূপ-বর্ণ-গন্ধ-স্পর্শের। স্ফটিক যেমন তার চারপাশের বস্তুকে আপনদেহে প্রতিফলন ঘটায়, মনও তেমনি সংকল্প-বিকল্প প্রভাবে জগতের বিচিত্র শোভা দেখছে। এর ফলে প্রত্যেক মনে তৈরি হচ্ছে ভালো-মন্দ হরেকরকম সংস্কার। এই সংস্কার দিয়েই সে জগৎ দেখে। কিন্তু আমাদের মতো মানুষ আর কতটা দেখবে? মায়ের যে আমার সীমা নেই, তিনি অনন্ত অসীম। আকাশভরা সূর্য তারার মাঝে মা যে সর্বত্র বিরাজ করছেন। এমন মায়ের ধারণা করতে পারে কে? রামপ্রসাদ তাই মায়ের কথা ভাবতে গিয়ে গেয়েছেন—

”মায়ের উদর ব্রহ্মাণ্ড ভাণ্ড, প্রকাণ্ড তা জান কেমন

মহাকাল জেনেছেন কালীর মর্ম, অন্য কেবা জানে তেমন।

প্রসাদ ভাসে লোক হাসে, সন্তরণে সিন্ধু গমন

আমার প্রাণ বুঝেছে, মন বুঝে না, ধরবে শশী হয়ে বামন।”

‘মন’ যেন আমার একটি বামন। অত্যন্ত ছোটো মানব সত্তা। সে ধরবে আকাশের চাঁদ! বেশ মজার কল্পনা তো! দেখা যাক, কল্পনার পাখা ভর করে উড়ে যাই অনন্তে।

এসব নানা কথা ভাবতে ভাবতে দেখলাম মনের কোণে এক দৃঢ় সংকল্প খেলা করে গেল। সংকল্পটি উদয় হল, কিন্তু অন্যান্য সংকল্পের মতো পরক্ষণেই মিলিয়ে গেল না। সে কাজটি করার জন্য বুদ্ধির কাছে বারবার অনুমতি চাইল। বুদ্ধি অনুমতি দিল। জানতে চাইছেন কী সেই সংকল্প? হ্যাঁ—সংকল্পটি হল মনটি ব্রহ্মাণ্ডে বেড়াতে যাব বলছে। সঙ্গে নেবে ”মানস ক্যামেরা”—তুলে নিয়ে আসবে অবিশ্বাস্য সব মহাজাগতিক খেলা। সৃষ্টিকর্তার কর্মকাণ্ড। যেমন মনের ভাবা, শুরু হল তেমনি কাজ। মুহূর্তের মধ্যে মন চন্দ্রে গিয়ে আশ্রয় নিল। তারপর ক্ষণকাল নিশ্বাস নিয়ে মঙ্গলগ্রহের পাশ ধরে সুয্যিমামার কাছে উপনীত। মামার তপ্ত আদর-যত্ন গায়ে মেখে নিয়ে সোজা সে চলেছে তো চলেছে— ‘মানস ক্যামেরা’ চটপট সব ছবি তুলে নিচ্ছে। আর যেতে যেতেই মনের মধ্যে সংস্কারবশত মহাজাগতিক সব প্রশ্ন উঠছে। যেমন আদি বিশ্ব প্রথম কেমন ছিল? তা এমন উত্তপ্তই বা ছিল কেন? বিশ্বটা এখনও সৃষ্টির সময় যে বেগে সম্প্রসারণ হচ্ছিল বা বেড়ে বেড়ে যাচ্ছিল এখনও তা রয়েছে কেন? বেগটা কমে যাবে নিশ্চয়ই একদিন—তখন সম্প্রসারণের পরিবর্তে বিশ্বটা ক্রমশ ক্রম-সংকুচিত হতে থাকবে তো? তারপর একদিন ক্রম-সংকুচিত হতে হতে জ্ঞান-চৈতন্য ও আনন্দময় পরম মায়ের বক্ষে বিলীন হয়ে যাবে বিশ্বটা? এই সাধের মহাবিশ্বটা তখন ঈথার হয়ে যাবে। সমুদ্ররূপ ধারণ করবে ঈথারের। কোনো তরঙ্গ থাকবে না। একেবারে ধীর, স্থির, প্রশান্ত ভাব। দেশহীন, কালহীন, কার্যকারণ সম্পর্কহীন। কেবল শুদ্ধচৈতন্য এবং আনন্দস্বরূপ আনন্দরূপা মা-মহামায়া।

বেশ অনুভব করছি পৃথিবী গ্রহ থেকে মুক্তি পেয়ে মন আমার প্রবল গতিবেগে বিশ্বভ্রমণে বের হয়েছে, অথচ দেহটা পড়ে রয়েছে পৃথিবীর মাটিতে। ঠিক পৃথিবীর মাটি বললে ভুল হবে। কারণ পৃথিবী মহাব্রহ্মাণ্ডের মহাজাগতিক কাণ্ডকারখানায় একটি ক্ষুদ্র ধূলিকণা মাত্র। মন আমার ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যপ্রান্তে গিয়ে হাজির হয়েছে এবং আপন মনেই বলছে—বাপরে! কত অনন্ত নক্ষত্র জগতের মাঝে আমাদের সৌরজগৎকে বোঝাই যাচ্ছে না! আকাশের বুকে কোথায় যে আমাদের সৌরজগৎটা রয়েছে, আর সেখানে একটি পৃথিবী গ্রহের মাঝে আমার অস্থি, মাংস, স্নায়ুঘেরা দেহটা পড়ে রয়েছে! না—ওই দেহ মাঝে আমি আর ফিরে যাব না। এমন উন্মুক্ত আকাশের কোলে অনন্ত আনন্দের কি তুলনা হয়?

আমার সাধের মনটি এমন পাঁচরকম ভাবতে ভাবতে কখন যে বিরাট এক উজ্জ্বল তপ্ত আলোর নক্ষত্রের মধ্যে ঢুকে পড়েছে খেয়াল নেই। কিন্তু এ কি? উজ্জ্বল নক্ষত্রটিকে কে যেন দারুণভাবে তার নিজের ভেতরে ঢুকিয়ে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কী আশ্বর্য ঘটনা তো! আমাদের সূর্যের চেয়ে কয়েক হাজার গুণ বড়ো আস্ত একটা তপ্ত সূর্যকে এমনভাবে কে নিজের ভেতরে প্রবেশ করিয়ে নিতে চাইছে? মনটা সত্বর উজ্জ্বল নক্ষত্রের আকর্ষণ ছেড়ে দিয়ে আরও এগিয়ে গিয়ে দেখতে লাগল কে সেই নক্ষত্র খাদক? কার তীব্র লালসার স্বীকার হতে চলেছে এত বড়ো একটা সূর্য? যা দেখল মন—তাতে তার বিস্ময়ের সীমা রইল না। দেখছে কি একটা কৃষ্ণগহ্বর (Black Hole) মুখ হাঁ করে রয়েছে এবং তীব্রবেগে উজ্জ্বল নক্ষত্রটা তার মুখে ঢুকে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল। শিউরে উঠল মন। অবিশ্বাস্য অথচ সত্য ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করে মন ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে চলল। কয়েক কোটি মাইল এগিয়ে এক অসম্ভব সুন্দর তারার রাজ্যে গিয়ে সে শান্ত হল। এখানে এসে সে দেখল অগণিত ভিন্ন ভিন্ন রঙিন ছোটো-বড়ো তারারা ছন্দোবদ্ধভাবে নৃত্য করছে। অপরূপ সে নৃত্যশৈলী। স্বচ্ছ বুদ্ধি, উন্নত মেধা এবং অনন্ত মাধুর্যপূর্ণ সে নৃত্যের পশ্চাতে শিবজায়া দুর্গার যে নিপুণ হাত রয়েছে তাতে মনের বুঝতে কোনো সন্দেহ রইল না। এমন সুন্দর নৃত্য দেখে মন সমস্ত নৃত্যরত নক্ষত্রগুলির অবয়ব ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখল। মৃদু মৃদু আনন্দ আবেশে তাদের চুম্বন করল। তারপর আবার দৌড়,—তাকে যে বিশ্বপরিক্রমা শেষ করে দুর্গাপূজার আগেই ফিরতে হবে—স্বদেশে, পৃথিবীতে।

আলোর গতিবেগের চেয়েও দ্রুতগতিতে এগিয়ে যেতে যেতে মন একটি সুন্দর জায়গায় থমকে দাঁড়াল এবং অন্তর দিয়ে অনুভব করল এক আশ্চর্য জিনিস—যা ভাবতে গিয়েই মন-শরীরে আনন্দ ও বিস্ময়ে শিহরন খেলে গেল। মন দেখল—এ-পথে আগেই পৃথিবীর থেকে অনেক যোগীপুরুষ, অবতার পুরুষ এবং বিজ্ঞানীরা তাঁদের মন নিয়ে বিশ্ব-পরিক্রমা করে ইহলোক ত্যাগ করে চলে গেছেন। এর মধ্যে মহামনা আইনস্টাইনের মন-শরীরের ছাপ মন স্পষ্ট অনুভব করল। এছাড়া নিউটন, ম্যাক্সপ্লাঙ্ক, হাইজেনবার্গ থেকে শুরু করে একেবারে সাম্প্রতিককালে হকিং সাহেবের মনও যে নিত্য বিশ্বপরিভ্রমণ করে বেড়াচ্ছে—তা আমার মন বাবাজির অনুভূতিলোকে স্পষ্ট দাগ কেটে গেল। হকিং সাহেব মহামনা। সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে তাঁর মন। দেহরূপে তিনি বসে আছেন আমেরিকায়। এখনও বেঁচে। কিন্তু মনরূপে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। নিঃসার দেহের মধ্যে তাঁর মন স্থান-কাল-কার্যকারণের মায়ামোহ ছেড়ে মহাজগতে নিঃশব্দে বিচরণ করছে। আর তাঁর মনের দ্রষ্টারূপী চেতনা কত কী মজাদার কাণ্ড দেখছে! এটাও যে আমাদের মা দুর্গার মহালীলা তা আর ক’জনের হৃদয় মাঝে ধরা পড়ছে!

মহাজগতে বেড়াতে বেড়াতে মনে আবার দেখলাম একটু অভিমান এল। তাই না সেখানে উঠেও তার চিন্তা হল—বিজ্ঞানী আইনস্টাইন যা দেখে গেলেন, বলে গেলেন, অনুভব করে গেলেন—তা কিন্তু আমাদের দেশের ঋষি-মুনিরা তার জন্মাবার হাজার হাজার বছর আগেই বলে গেছেন। এ-ব্যাপারে সাংখ্যদর্শন প্রণেতা মহর্ষি কপিলকেই পুরোধা বলা যেতে পারে। এছাড়া মহামুনি যাগবল্ক্য, বশিষ্ঠ থেকে শুরু করে শঙ্করাচার্য, রামানুজ, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, অরবিন্দের মতো বহু মহামানব বিশ্বের মূলশক্তির সঙ্গে নিজেদের একাত্ম করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এঁদের কেউ কেউ সেই মহাশক্তিকে ব্রহ্ম বা চৈতন্য, আবার কেউ কেউ ‘মা’ রূপে সম্বোধন করে গেছেন। মহর্ষি কপিল সেই মহাশক্তিকে ‘পুরুষ’রূপে প্রথম চিন্তা করেছিলেন বলে মনে করা হয়। মোটকথা ভারতীয় ঋষিরাই প্রথম মহাজাগতিক তরঙ্গের সঙ্গে তাঁদের মনের বিস্ময়কর যোগসূত্র লক্ষ্য করেছিলেন। আর বিশ্বের সমস্ত কিছুই যে এক মহাশক্তি থেকে উদ্ভূত হয়েছে তাও গভীরভাবে অনুভব করেছিলেন। তাই না ঋষি মার্কণ্ডেয় ‘চণ্ডী’তে পাঠ করেছেন ”যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা। নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ” বলে।

অনন্তের বুকে ভাসতে ভাসতে মন চলেছে। দেখছে মহাকাশে বস্তুর ঘনত্ব সর্বত্র সমান নয়। নক্ষত্র ও গ্যালাক্সিগুলি বিভিন্নভাবে আকাশে বিরাজ করছে। কোথাও কেবল শূন্য আকাশ—কোটি কোটি আলোকবর্ষ জুড়ে শুধু আকাশ আর আকাশ—তারপর হয়তো পাওয়া গেল গ্যালাক্সির পর গ্যালাক্সির তরঙ্গ—মহাকাশরূপী সমুদ্রে ভেসে চলেছে—কবে যে এদের সৃষ্টি হয়েছে কে জানে? তবে ‘বিগ-ব্যাং’ বা মহাবিস্ফোরণের ফলেই যে নক্ষত্রগুলি ঐক্যবদ্ধভাবে ‘গ্যালাক্সি’ নাম নিয়ে মহাকাশে ভেসে চলেছে বা সম্প্রসারিত হয়ে চলেছে—এ-ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু কোথায় ঝাঁকে ঝাঁকে নক্ষত্রমণ্ডল চলেছে? কেউ জানে না। কেবল ‘মা’ জানেন। ‘মহাজাগতিক অণ্ড’ যেখান থেকে সৃষ্টি হয়েছে সেখানেই পুঞ্জীভূত হতে যাচ্ছে—চৈতন্যময়ী মায়ের কোলেই সে প্রতিষ্ঠিত হতে চাইছে। মা দুর্গা— চরমে কেবল জ্ঞানময়ী, চেতনাস্বরূপা এবং আনন্দময়ী। আনন্দই মায়ের স্বরূপ। সমস্ত দেবতাদের জ্যোতি থেকে তৈরি জ্যোতিস্বরূপা মা অসুর নিধন করে আনন্দস্বরূপে লয়প্রাপ্ত হন। আনন্দের মধ্যেই তাঁর সৃষ্টি-স্থিতি ও লয় ক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয়।

মহাবিশ্বের সাকার রূপের স্পর্শ পেতে পেতে মন চলে গেল অরূপে। সৃষ্টির আদিমতম অবস্থায়। না—এখানে আকাশ নেই, বায়ু নেই, তেজ নেই, জল নেই, মাটি নেই। ভূত তো এখানে তৈরিই হয়নি। মা এখানে নিরাকারা। দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চ-নীচহীন। যেহেতু মা আকারহীন তাই এখানে মহাকাল অনুপস্থিত। দৈর্ঘ্য ও প্রস্থযুক্ত বস্তুর মধ্যেই ‘কাল’ কাজ করে। কাল বা সময়ের ধারণা আকৃতিহীন বস্তুর পক্ষে সম্ভব নয়। মা এখানে মহাকালী রূপে তাই বিরাজিতা। ঘোর কৃষ্ণবর্ণা। মহাকালকে গ্রাস করে মা এই রাজ্যে ‘আদ্যাশক্তি মহাকালী’ রূপে প্রত্যক্ষা হয়েছেন। সাধকহৃদয়ে মায়ের এমন দিব্যরূপ প্রকটিত হয়।

চরম বিস্ফোরণের পূর্বে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড—ঈশ্বর, পরমব্রহ্ম বা ব্রহ্মময়ী মা কালীতে বিলীন হয়েছিল। জগতের সমষ্টিগত জ্ঞান, বুদ্ধি, কর্ম তথা যাবতীয় বিকাশের ধারণা—এই পরমাত্মায় ক্রমসংকুচিত রূপে বিরাজ করছিল। ক্রমসংকুচিত হল চৈতন্যের অত্যন্ত সূক্ষ্মতম অবস্থা। চৈতন্যময় পুরুষ প্রকৃতি বিজড়িত হয়ে এখানে অবস্থান করছে। এ যেন কারণসাগরে অনন্তনাগের ফণার নিচে ভগবান নারায়ণ শয়ন করে আছেন বলে যা বলা হয় তারই স্বরূপগত ধারণা। পরম চৈতন্যের অন্তঃকরণে সূক্ষ্মভাবে রয়েছে পূর্ব পূর্ব কল্পের জ্ঞানসংস্কার ও ইচ্ছাশক্তি। আর এই সুপ্ত ইচ্ছাশক্তি স্থূলরূপ ধারণা করার বাসনা পোষণ করতেই ঘটে যায় মহাজাগতিক বিস্ফোরণ। আকাশের বুকে ভাসমান জমাট বাঁধা কণাগুলি তখন তীব্রবেগে ঘুরতে থাকে। ফলশ্রুতিতে ‘মা দুর্গা’ আমার প্রথম ইন্দ্রিয়গোচর হলেন। তাঁর জ্যোতির্ময়ী অগ্নিস্বরূপা মহাসুন্দর রূপ দেখে সার্থক হল মনের। এতদিন মা ছিলেন আকাশ এবং গ্যাসীয় রূপে। আকাশ মনে অনুভূত হয়। আকাশ না থাকলে কোনো শব্দই কর্ণগোচর হয় না। কিন্তু আকাশকেও বায়ুর মতো প্রত্যক্ষ করা যায় না। এই আকাশ হল মায়ের প্রথম অনুভূত রূপ। আকাশ অগ্নির থেকে শ্রেষ্ঠ। আকাশের পর তারই অংশ থেকে সৃষ্টি হয় বায়ু। বায়ুর কোনো রূপ নেই। তবে প্রবল ক্রিয়াশক্তি আছে। এই বায়ুকে আশ্রয় করেই অগ্নির রূপ আমরা দেখতে পাই। মহাবিশ্বে অনন্ত নক্ষত্রলোক, সূর্য, চন্দ্র, বিদ্যুৎ এবং পৃথিবীর সমস্ত অগ্নির উত্তাপ সকলই আকাশকে আশ্রয় করেই নানারকম কাজ করে থাকে। অগ্নি বায়ুকে আশ্রয় করে তার অবাধ চলাচল গতিকে বাধা প্রদান করে। তখন উত্তাপ জোরকদমে আকাশে ছড়িয়ে পড়ে। আবহাওয়া অত্যন্ত গরম হয়ে ওঠে এবং বিদ্যুৎ চমকায় ও বৃষ্টি নামে। সেজন্য আদিতে এই অগ্নিই হল জলের কারণ। অগ্নিই স্বয়ং বিবর্তিত হয়ে জলরূপে নিজেকে প্রকাশ করে। আবার এই জল থেকে কালক্রমে মাটির আবির্ভাব হয়। মাটি বলতে মাটির ক্ষুদ্রতম অণু-পরমাণু। পরে তা সংগঠিত হয়ে পৃথিবীর রূপ ধারণ করে এবং নানারকম গন্ধ বিকিরণ করে।

কাজেই এই পৃথিবীর আশ্রয় কি? আকাশ। আমরা যা কিছু দেখছি, চিন্তা করছি, অনুভব করছি—তা সবই আকাশে ভাসছে। আকাশই সমস্ত কিছুর উৎস ও লয়ের স্থান। এই আকাশ হল পরমাত্মারূপী মায়ের যথার্থ প্রতীক। আকাশ থেকেই ক্রমশ বায়ু, অগ্নি, জল ও পৃথিবী উৎপন্ন হয়। আকাশের বুকেই আমাদের বেঁচে থাকা, কথাবলা, স্বপ্ন দেখা, প্রেম-ভালবাসার নীড় তৈরি করা এবং মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে বিদায় নেওয়া।

কিন্তু আকাশ কাকে আশ্রয় করে মহাজগৎকে প্রকাশ করেছে? ‘শব্দগুণ’ রূপ সূক্ষ্মতম তন্মাত্রকে। সূক্ষ্মতম তন্মাত্র (তমোগুণ) আশ্রয় করে রয়েছে অহংকারকে। অহংকারের উৎপত্তি মহতত্ব বা বুদ্ধিতত্ব বা সমষ্টি মন থেকে। সমষ্টি মন আশ্রয় করে রয়েছে অপরা-প্রকৃতিকে। অপরা-প্রকৃতি কিনা যিনি বিবর্তিত হতে পারেন। আবার অপরা প্রকৃতি শুদ্ধচৈতন্যস্বরূপা মা বা পরা-প্রকৃতিকে আশ্রয় করে রয়েছেন। পরপৃষ্ঠায় বোঝার জন্য একটি ছক দেওয়া হল—

পাঁচ জ্ঞানেন্দ্রিয়—চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক।

পাঁচ কর্মেন্দ্রিয়—হস্ত, পদ, বাক, পায়ু, উপস্থ।

পাঁচ তন্মাত্র—গন্ধ, রস, রূপ, স্পর্শ, শব্দ।

পাঁচ ভূত—ভূমি, জল, অগ্নি, বায়ু, আকাশ।

মন (অন্তঃকরণ)—চিত্ত, মন, বুদ্ধি, অহংকার।

আমার মনের রাজ্যে হঠাৎ-ই চণ্ডীর একটি শ্লোক বড়ো ধাক্কা দিতে লাগল, তাহল—’যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা/নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।’

‘সর্বভূত’ অর্থাৎ যা কিছু দেখছি, শুনছি, বলছি, ভাবছি, অনুভব করছি এবং যার দ্বারা অনুভব করছি সবই ‘মায়ের’ স্বরূপ—মা স্বয়ং। মা চিন্ময়স্বরূপা। কিন্তু চির স্থির নয়। শক্তিরূপা মা প্রত্যেক জিনিসকে স্পর্শ করে সৃষ্টি-স্থিতি ও প্রলয় করছেন। আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, শরীরটা আমাদের স্থির হয়ে বসে আছে। কিন্তু বাস্তবে শরীরটার—হাড়, মাস, মজ্জা, স্নায়ু, শ্বাস-প্রশ্বাস—সব নিয়ে একটি মহাক্রিয়া চলেছে। শরীরে এমন কিছু নেই যা একেবারে ধীর-স্থির। আবার মনও অনবরত চলমান। মন কোনো সময় বেশিক্ষণ স্থির নেই। মোটকথা এক মহাশক্তি সমগ্র বিশ্বজগৎ জুড়ে অনবরত পাক খাচ্ছে এবং এক-একটি জিনিস এর ফলে গঠন হয়ে আকাশের বুকে শোভা পাচ্ছে। মাতৃরূপা মহাশক্তি দুর্গার এক পাকের নাম সূর্য, অপর পাকের নাম চন্দ্র, অন্য আর একটি পাক হল বিশ্বজগৎ, বিশ্বমন, সৌরজগৎ, পৃথিবী, পর্বত, সমুদ্র, মরুভূমি, বনভূমি, পশুপক্ষী, মানুষজন, জন্ম-মৃত্যু, মন, নানা অনুভূতি, ব্যবহার, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, ভূত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ সবই মাতৃঅঙ্গে স্থিত। চিরন্তন ভাবেই রয়েছে। মায়ের ক্ষয় নেই, বিবর্ণতা নেই। স্ব-মহিমায় সর্বদা উজ্জ্বল। কেবল একবার দেখা দেয়, আবার অদৃশ্য হয়ে যায়।

আমরা ‘বিশ্বমূর্তিরূপা’ মাকে নিজ অনুভূতির মধ্যে আনতে পারি না। আমাদের চেতনা কুঁকড়ে গেছে, সংকুচিত হয়ে গেছে। ফলে আমরা ‘অসুর’ হয়ে পড়েছি। অসুর হল চেতনার ক্রমসংকুচিত রূপ। অসুর বধের জন্যই মায়ের ভয়ঙ্করী মূর্তিরূপে বিশ্বব্যাপী প্রকাশ। মহাবিশ্বের প্রেক্ষাপটে সমস্ত পৃথিবী জুড়েই চলেছে দেবাসুর সংগ্রাম। এই সংগ্রাম যেমন বাইরের দিকে ছড়িয়ে পড়েছে, তেমনি প্রত্যেক মানব-শরীরের হৃদয় ক্ষেত্রেও হচ্ছে। তাই মা দুর্গা অনাদিকাল থেকেই রয়েছেন। তাঁর ক্রিয়া সর্বদা প্রবহমানা। সমগ্র জগৎ যতদিন থাকবে ততদিনই তিনি প্রকট থাকবেন। তিনি কোনো অদৃশ্য বস্তু নয়। চিন্তা-ভাবনার অতীতও কিছু নয়। আর বৎসরে একবার যে কৈলাস থেকে মর্ত্যে বা বঙ্গভূমিতে বাপের বাড়ি আসেন তাও কিন্তু নয়। এসব ভাবাবেগসম্পন্ন বাঙালিমনের কল্পনা ছাড়া অন্য কিছুই নয়। তবে এমন শুভ মাতৃ-আরাধনার মধ্য দিয়েই অবশ্য ক্ষুদ্র মন বৃহৎ মাতৃস্বরূপের দিকে সচেতনভাবে পরিক্রমা করে।

যেসব সাধক মাতৃকৃপা লাভ করেছেন তাঁদের চেতনায় সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড সর্বদা প্রকট থাকে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে তাঁদের মন একাত্ম লাভ করে তাঁরা নিজেরাই ব্রহ্মাণ্ডময় অনুভূতির রাজ্যে প্রবেশ করেন। তাই মাতৃভক্ত সাধক রামপ্রসাদ লিখেছেন একটি গানে—

”মন তোমার এই ভ্রম গেল না, গেল না

কালী কেমন তাই চেয়ে দেখলে না।

ত্রিভুবন যে মায়ের মূর্তি জেনেও কি তাই জান না

মাটির মূর্তি গড়িয়ে মন করতে চাও তার উপাসনা।

জগৎকে সাজাচ্ছেন যে মা দিয়ে কত রত্ন সোনা

কোন লাজে সাজাতে চাস তায় দিয়ে ছার ডাকের গহনা।

জগৎকে খাওয়াচ্ছেন যে মা সুমধুর খাদ্য নানা

কোন লাজে খাওয়াতে চাস তায় আলোচাল আর মুগভিজানা।

মন তোমার এই ভ্রম গেল না গেল না।”

এমন শ্রেষ্ঠ মাতৃসাধকই মনে-প্রাণে অনুভব করেন যে, বিশ্বের সমস্ত বস্তুগত বা মনোগত সত্তার মধ্যে অখণ্ড মাতৃচেতনা বিদ্যমান। বাস্তবিকই আমরা সকলেই দৈহিক, মানসিক ও অধ্যাত্মগতভাবে এক। আমরা শরীরের দিক থেকেও এক। এই সমগ্র বিশ্ব হল এক জড়ের সমুদ্র। আমরা সেই জড় সমুদ্রে এক-একটি তরঙ্গ। খানিক জড় পদার্থ নিয়ে একটি আবর্ত বা তরঙ্গ সৃষ্টি হয়েছে। তরঙ্গের অপর নাম এক-একটি শরীর। কিন্তু তরঙ্গ সর্বদাই সমুদ্র থেকে উত্থিত হচ্ছে। জড়-সমুদ্র থেকে শরীররূপী তরঙ্গ আমরা সবাই। আবার তরঙ্গটি জড় সমুদ্রে মিলিয়ে যাচ্ছে। শরীরের এই বিনাশ হল সূক্ষ্মতম জড়কণাতে উপনীত হওয়া। আমার দেহে যেসব জড় পদার্থ রয়েছে তা কয়েক হাজার বা ক’বছর আগে আপনার দেহে বা অন্য কারওর মধ্যে ছিল। জড় অবিরাম গতিশীল অবস্থায় বিরাজ করে। কাজেই দেহগতভাবে আমরা একটিই জড়শরীর।

আবার মনের দিক দিয়েও আমরা এক এবং অখণ্ড সত্তা। সব মনই বিশ্বমনের অন্তর্গত। সেজন্য ঘটনাগুলিকে আমরা কমবেশি একইরকম অনুভব করি। কেউ দুঃখিত হলে ব্যথিত হই, উৎসবে সকলে আনন্দ করি। আমাদের দেহের অন্তরালে চিন্তারও একটি অসীম সমুদ্র রয়েছে। আমার মন এবং আপনাদের মন সেই সমুদ্রের অংশবিশেষ জলরাশি কিংবা উদ্দাম ঢেউ। আমাদের পরস্পরের চিন্তা সর্বদাই একে-অপরের মনে প্রবেশ করছে। যদি আমরা অন্তর্দৃষ্টি লাভ করি তাহলে দেখব আমাদের মনে কোনো চিন্তাই নষ্ট হয়নি। সবই সুনির্দিষ্ট জায়গায় রাখা আছে এবং সময়ে তা থেকে ভালোমন্দ ফল উৎপন্ন হচ্ছে। আর আত্মগতভাবে আমরা যে সর্বদাই এক ও অভিন্ন তা বলাই যায়। কারণ আমরা ব্যক্তিগতভাবে জীবাত্মা হলেও তা কিন্তু কোনো সময়েই পরমাত্মা থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। আমরাই সেই এক ও অখণ্ড পরমাত্মা স্বরূপ। কাজেই বিজ্ঞান ও দর্শনের দৃষ্টিতে চরমে সর্বদাই প্রমাণিত হয় যে, আমাদের সমগ্র জীবনই একের খেলা। আমরা দেহ, মনে ও আত্মায় এক। এক ছাড়া দুই কিছুই নেই। তাই দেবী-অম্বিকা নিশুম্ভকে বলেছিলেন—”একৈবাহং জগত্যত্র দ্বিতীয়া কা মমাপরা। পশ্যৈতা দুষ্ট ময্যেব বিশন্ত্যো মদবিভূতয়ঃ।” ৫/১০ (শ্রীশ্রীচণ্ডী) অর্থাৎ চণ্ডীকাদেবী বললেন—একা আমিই এই জগতে বিরাজিতা। আমার অতিরিক্ত অন্য দ্বিতীয়া এ-জগতে আর কে আছে? রে দুষ্ট, সমস্ত দেবীই আমার অভিন্ন শক্তি। এই দেখ তারা সব আমাতেই বিলীন হচ্ছে।

মোট কথা আমাদের চারপাশে সমস্ত জড়বস্তু এবং মনের সূক্ষ্মতম সত্তা সর্বদা আত্মাকে আশ্রয় করে রয়েছে। এই আত্মাই সৃষ্টি স্থিতি ও লয়ে হল ব্রহ্মের শক্তি মা দুর্গা। ইনি এখানে চৈতন্যময়ী। চেতনস্বরূপা। এই চৈতন্যসত্তাই ক্রমবিকাশের পথ ধরে মহৎতত্ব থেকে মহাবিশ্বের সমস্ত কিছু রূপ ধরে মহাকাশে বিরাজ করছেন। এজন্য একটি ভক্তিবান মানুষ বা মন হিসাবে আপনি যেখানেই থাকুন না কেন সর্বদাই অনন্তে আছেন, মহাব্রহ্মাণ্ডে আছেন। এই মহৎ সত্যে আপনি কলকাতার বাসিন্দা এবং অধ্যাপক অমুক চক্রবর্তী পরিচয়টা হল সংকীর্ণতম। মিথ্যা কথাই বলা যায়। অনন্ত বা সত্য সর্বদা একটাই হয়। আপনি সত্যেই রয়েছেন। কিন্তু চেতনায় জগৎরূপে স্থানগত, কালগত, সমাজগত আবরণ পড়ে রয়েছে। তাই মা দুর্গাদেবীর মহৎস্বরূপ অনুভবে গম্য হচ্ছে না। এজন্য নিরন্তর মাতৃ-আরাধনা প্রয়োজন।

আমরা জানি আর না জানি এটা অবশ্যই সত্য যে, আমাদের চিন্তার মধ্যে অনন্তের স্পন্দন লুকিয়ে রয়েছে। এই অনন্তের স্পন্দনের অপর নাম ভালোবাসা। এটি যত নিঃস্বার্থ, শুদ্ধ ও পবিত্র হয় ততই আমরা এক অতীন্দ্রিয় সত্যের মুখোমুখি হই। আর তখন আমাদের ব্যক্তিত্ব তার বিচ্ছিন্নতা ভাব কাটিয়ে উঠে বিশ্বব্যাপী এক ঐক্য ও শাশ্বত নীতির প্রতিষ্ঠা লক্ষ করে। এটা যতদিন না হয় ততদিনই আমাদের জীবনে সর্বদা দুঃখ, কষ্ট, অনৈক্য ও বিশৃঙ্খলা ছেড়ে থাকবে।

মায়ের আমার মহাজাগতিক লীলায় ক্ষুদ্র পিপীলিকা থেকে বৃহৎ সূর্য পর্যন্ত সমভাবে প্রবাহিতা। জীবজগতের যে কোনো সৃষ্ট পদার্থে নিশ্চয়ই কোনো না কোনো তাৎপর্য আছে। মানুষ তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ ও নিরীক্ষণের মাধ্যমে একদিন এই মহাসত্য আবিষ্কার করে। আর তখন সে বুঝতে পারে যে, সমস্ত কিছুর মধ্যেই অফুরন্ত এক মহাশক্তি বিরাজ করছে। এই মহাশক্তির প্রতীকরূপেই দুর্গাদেবীকে পূজা করা হয়। যাঁর সত্তা বিশ্বের সমস্ত রূপে-রসে-বর্ণে-গন্ধে-স্পর্শে বিরাজিতা—তিনিই আবার সাকার মূর্তি ধারণ করে পার্বতী রূপে শিবগেহিনী হয়েছেন। এটাই অভূত রহস্যময় ভাবনা। যাঁরা জ্ঞানচক্ষুর অধিকারী হয়েছেন তাঁদের মনে এমন ভাবনাই উদিত হয়। যেমন কৈলাসেই একদিন গণেশের মধ্যে হয়েছিল। একদিন কৈলাসে বসে শিব-শিবানী তাঁদের দুই পুত্রের জ্ঞান পরীক্ষার জন্য ডেকে বললেন যে, তোমরা দু’জনেই এখন সাবালক। সুন্দর যুবা রূপেই আত্মপ্রকাশ করেছ। শোনো—তোমাদের দু’জনের মধ্যে যে আগে বিশ্বজগৎ পরিভ্রমণ করে আসতে পারবে মায়ের কণ্ঠহার তার গলাতেই শোভা পাবে। এই কথা শোনামাত্রই শৌর্যবান কার্তিক তার ময়ূরে চড়ে বিশ্বভ্রমণে বেড়িয়ে পড়লেন। কিন্তু জ্ঞানী গণেশের মধ্যে কোনোরূপ চঞ্চলতা প্রকাশ পেল না। তিনি হয়তো মনে মনে ভাবছিলেন—”যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা” অর্থাৎ বিশ্বের সমস্ত পদার্থই মাতৃ-অঙ্গের ভূষণস্বরপ। মা স্বয়ংই বিশ্বময় বিরাজ করছেন। সুতরাং বিশ্বময় মানস পরিভ্রমণ কিংবা কার্তিকের মতো ময়ূর নিয়ে ঘোরা কোনো বুদ্ধিমান লোকের কাজ নয়। তার চেয়ে বরং মাকে করজোরে প্রদক্ষিণ করি। মনে এই চিন্তা হওয়া মাত্রই গণেশ ধীরে ধীরে দুর্গাকে প্রদক্ষিণ করতে লাগলেন। তিনবার প্রদক্ষিণ করে সম্মুখে বসে করজোরে বলতে লাগলেন—”মা তুমি বিশ্বেশ্বরী, বিশ্বপ্রসবিণী—তোমাকে প্রদক্ষিণ করা মানেই বিশ্বকে যথার্থ প্রদক্ষিণ করা হল।” দেবী এতে দারুণ খুশি হয়ে তৎক্ষণাৎ তাঁর কণ্ঠহারটি গণেশের গলায় পরিয়ে দিলেন। গণেশ আনন্দমগ্ন হয়ে ধ্যান-নিমীলিত নেত্রে বসে রইলেন। আর মনে মনে সম্মুখে উপস্থিতা মা পার্বতীকে দেখে ভাবছিলেন—এমন মা কার হয়? যিনি এই সম্মুখে উপবিষ্টা আবার তিনিই সমগ্র জগতে পরিব্যাপ্তা এবং সমস্ত জায়গায় অসুর বিনাশে সর্বদাই কর্মরতা! সত্যিই তাই।

এমন মহিমাময় মায়ের অশেষ পুণ্যকীর্তি ও যশের কথা বলতে গিয়ে ঋষি মার্কণ্ডেয় তাই লিখলেন—’ত্বং বৈষ্ণবীশক্তিরনন্তবীর্যা/বিশ্বস্য বীজং পরমাসি মায়া/সম্মোহিতং দেবি সমস্তমেতৎ/ত্বং বৈ প্রসন্না ভুবি মুক্তিহেতুঃ/অর্থাৎ হে দেবী, আপনি অনন্ত শৌর্যবীর্যশালিনী বিষ্ণুর জগৎপালিনী শক্তি। আপনি বিশ্বের আদিকারণ মহামায়া। আপনিই সমগ্র জগৎকে মোহগ্রস্ত করেছেন। আবার আপনিই প্রসন্না হলে এই মর্ত্যলোকের শরণাগত ভক্তদের মুক্তি প্রদান করেন। মায়ের সম্বন্ধে এই অনির্বচনীয় সত্য বাক্য পুনঃপুনঃ স্মরণ করে আসুন করজোরে তাঁর চরণে কৃপা প্রার্থনা করে প্রণাম করি—”জয়ন্তী মঙ্গলা কালী ভদ্রকালী কপালিনী/দুর্গা শিবা ক্ষমা ধাত্রী স্বাহা স্বধা নমোহস্তুতে।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *