আদ্যনারায়ণ

আদ্যনারায়ণ

আজ যখন চতুর্দিকে সমস্তই বিশৃঙ্খল এবং বেনিয়ম, বার বার আদ্যনারায়ণবাবুর কথা মনে পড়ে।

অতি বাল্যকালেই তিনি লক্ষ করেছিলেন যে ধোঁয়া তা উনুনের ধোঁয়াই হোক আর তামাকের ধোঁয়াই হোক কখনও সোজা লম্বালম্বি উপরের দিকে ওঠে না, গোল পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ওঠে। তাই প্রথম যৌবনে তিনি তখন তামাক ধরলেন, গড়গড়া থেকে সোজাসুজি নল দিয়ে ধোঁয়া টানতেন না, এতে নাকি ধোঁয়া ঠিকমতো বেরিয়ে আসতে পারে না, ধোঁয়ার খুব অসুবিধে হয়।

বিশাল লম্বা গড়গড়ার নল নিজে অর্ডার দিয়ে মোরাদাবাদ থেকে তৈরি করিয়ে আনিয়েছিলেন। সেই আমলের মোরাদাবাদী বাইশ-ইঞ্চি হাতের ত্রিশ হাত।

কলকের টিকেতে আগুন দেওয়ার পর নল মুখে করে উঠে দাঁড়াতেন আদ্যনারায়ণ। তারপর গড়গড়ার চারদিকে বিশাল হলঘরের মতো বড় বাইরের বসবার ঘরে, কখনও উঁচু হয়ে চৌপায়ার উপর দিয়ে উঠে কখনও নিচু হয়ে টেবিলের পায়ায় গোল হয়ে নিজেকে নামিয়ে উঠিয়ে ঘুরে ঘুরে প্রায় আধ ঘন্টা ধরে তাঁর ধূমপান চলত।

সত্তর বছর বয়েস হয়ে যাওয়ার পর এতটা আর পেরে উঠতেন না আদ্যনারায়ণ। তখন একটা লম্বা শালগাছের গুঁড়ি বসবার ঘরে ছাদ ও মেঝের মধ্যে আড়াআড়িভাবে ফেলে নিয়েছিলেন; পুরো নলটা উপরে নীচে জড়িয়ে পেঁচিয়ে তাঁর মুখের কাছে ইজিচেয়ারে এসে পৌঁছাত, তাতে চোখ বুজে একটা করে সুখটান দিতেন, আর স্বগতোক্তি করতেন, ‘এভাবে কি ধোঁয়ার স্বাদ থাকে?’

একবার কলকাতায় এসে, তখন তাঁর প্রৌঢ় বয়েস, তিনি ট্রামের প্রথম শ্রেণীতে সবচেয়ে সামনের সারিতে বসে লক্ষ করেছিলেন, ট্রাম চালানো কাজটা খুব কঠিন নয় শুধু পা দিয়ে ঘন্টা বাজানো আর হাত দিয়ে হ্যান্ডেল চালানো তা হলেই ট্রামগাড়ি লাইন-বরাবর চলবে।

আদ্যনারায়ণ অনেক ভেবেচিন্তে বুঝতে পারলেন, প্রথম শ্রেণীর সামনের দিকটা একটু এগিয়ে দিলেই সেই সিটে বসে যে-কোনও যাত্রী ট্রাম চালিয়ে নিতে পারবে।

ট্রাম কোম্পানিকে এই পরামর্শই দিয়েছিলেন তিনি। গাড়ি যখন এত সহজ পদ্ধতিতেই চালানো সম্ভব, শুধু শুধু মাইনে দিয়ে একগাদা ড্রাইভার পুষে লাভ কী? ট্রাম কোম্পানি আদ্যনারায়ণের চিঠির উত্তরে বিনীতভাবে জানিয়েছিল যে, যাত্রীরা কি গাড়ি চালাতে রাজি হবে। আদ্যনারায়ণ সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন, ‘যে যাত্রী চালাবে তার কাছ থেকে ভাড়া নেবেন না; তা হলেই যাত্রীর অভাব হবে না।’ ট্রাম কোম্পানি কয়েকদিন পরে প্রশ্ন পাঠাল, ‘কিন্তু স্যার, যখন গাড়ি খালি থাকবে, কোনও যাত্রী থাকবে না?’ আদ্যনারায়ণ জবাবে জানালেন, তখন তো কন্ডাক্টর বেকার, সেই চালাবে। তারপর একজন যাত্রী উঠলেই সে চালাবে, তার কাছ থেকে টিকিট নেওয়া হবে না, পরের যাত্রীরা উঠলে তখন টিকিট নেওয়া হবে, শুধু আগের যাত্রী-চালক নেমে গেলে আরেকজন চালাবে, তারও ভাড়া লাগবে না। এইভাবে চলবে, লাস্ট স্টপ পর্যন্ত যদি কোনও প্যাসেঞ্জার না থাকে কন্ডাক্টর নিজেই চালিয়ে গাড়ি ডিপোতে ঢুকিয়ে দেবে।

দুঃখের বিষয়, আদ্যনারায়ণের সঙ্গে তখনকার ট্রাম কোম্পানির ইংরেজ পরিচালকমণ্ডলী আর পত্রালাপ বা অন্য কোনওরকম আলোচনায় যাননি। আদ্যনারায়ণ এই নিয়ে সারাজীবন ধরে আক্ষেপ করে গেছেন, ‘তখনই বুঝেছিলাম, ব্রিটিশ জাতটা একেবারে অধঃপাতে গেছে, ওদের আর সাম্রাজ্য চালাতে হবে না।’

এসব প্রায় চল্লিশ বছর আগেকার কথা। ট্রাম কোম্পানির সদর দপ্তরের পুরনো নথিপত্র ঘাঁটলে হয়তো এখনও এই যুগান্তকারী প্রস্তাবটি এই দুর্দিনে পুনর্বিবেচনার জন্যে উদ্ধার করা যায় এবং এখনও কার্যকর করতে পারলে হয়তো ট্রামের ভাড়া বাড়াতেই হবে না।

সঙ্গে সঙ্গে রেল দপ্তরকে অনুরোধ করব তাঁদের দপ্তরেও আদ্যনারায়ণের একটি পুরনো প্রস্তাব পড়ে রয়েছে, সেটি যদি বিবেচনা করেন। অবশ্য অনেক দেরি হয়ে গেছে, এখন বিদ্যুৎরেল চালু হয়েছে, এখন হয়তো সেই প্রস্তাব কার্যকরী করা যাবে না। তবুও বহু অঞ্চলে এখনও তো কয়লায় ট্রেন চলছে এবং অনেকদিন চলবে।

আদ্যনারায়ণের মূল প্রস্তাবটি সংক্ষিপ্তভাবে আমরাও বিবেচনা করে দেখতে পারি:

‘কয়লার সাহায্যে যে রেলগাড়ির ইঞ্জিন চলে সেই কয়লার উত্তাপ অনেকটাই অব্যবহৃত হয়ে নষ্ট হয়ে যায়। ইঞ্জিনের এবং বয়লারের গায়ে উপরে-নীচে তিন সারি করে দুই দিকে একেক সারিতে টানা ছয় ইঞ্চি পরপর এক-একটা দশ ইঞ্চি ব্যাসের বেশ বড় সাইজের উনুন করা চলে। এতে প্রত্যেক সারিতে কমবেশি চল্লিশটা করে উনুন ধরবে; তা হলে দুই দিকে তিন সারি করে সবসুদ্ধ মোট দুশো চল্লিশটা। একটা লাইনে সকালের দিকে যদি যাত্রীগাড়ি আর মালগাড়ি মিলিয়ে চারটে আর চারটে আটটা ট্রেন যাতায়াত করে তা হলে প্রায় দু’হাজার উনুন হয়ে যাচ্ছে। এই উনুনগুলোর জন্যে কোনও আলাদা কয়লায় দরকার নেই, ইঞ্জিনের উত্তাপেই এদের যথেষ্ট হয়ে যাবে।

এখন এই উনুনগুলোর পাশ দিয়ে লম্বা রেলিং করে রান্না করার জন্যে দাঁড়ানোর জায়গা করে দিতে হবে। তারপর পার্শ্ববর্তী স্টেশন এলাকাগুলির গৃহস্থদের মধ্যে বিলি বন্দোবস্ত করে নিতে হবে। যার যে স্টেশনে বাড়ি সেখান থেকে রান্নার জিনিসপত্র ও সরঞ্জাম নিয়ে উঠবে। রান্নার বিস্তৃতি ও পরিমাণের উপরে নির্ভর করে যার যে কয় স্টেশন পরে সম্ভব হবে রান্না শেষ করে সেখানে নেমে ফিরতি ট্রেনে ফিরে আসবে। এক টাকার মান্থলিতে বেশ কয়েক স্টেশন পর্যন্ত যাওয়া-আসা চলে (সেই আমলে), কিন্তু এক টাকার কয়লা বা অন্য জ্বালানিতে সারা মাস রান্না করা যায় না বাড়িতে। ফলে অনেকেই এই প্রস্তাবে রাজি হবে।’

জানি না, আদ্যনারায়ণের এই প্রস্তাবে রেলগাড়ি কেন সায় দেয়নি, তাতে অন্তত ট্রেন প্রতি আড়াইশো মান্থলি বেশি বিক্রি হবে, জাতীয় সম্পদ কয়লা তারও অপচয় কমবে। রেল-দপ্তর এর চেয়ে অনেক জটিল ও স্বাভাবিক সব পরিকল্পনা ইতিমধ্যে করেছেন, আদ্যনারায়ণের প্রস্তাবটিও খুঁজে বের করে একবার বিবেচনা করুন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *