আদুরি

আদুরি

ভোর হতে না হতেই চলে আসে আদুরি। সেসময় একমাত্র কুন্দনন্দিনী বিছানা ছেড়ে উঠোনের দরজা খোলেন। এই সময় প্রতিদিনই প্রায় একই সংলাপ বিনিময় হয়। কুন্দনন্দিনী বিরক্ত হয়ে বলেন, ‘একটু আলো ফুটলে এলে কি অসুবিধে হয়? অ্যাঁ। অন্ধকারে যে বের হন, দিনকাল তো ভালো নয়।’

আদুরি ঠোঁট বেঁকায়, ‘যাকে যমেও ছোঁবে না তার আবার কীসে ভয়! নিজের ঘুম সহজে ভাঙে না, সেকথাই বলো।’

‘আমার ঘুম? ঘুম নিয়ে খোঁটা দিলি হারামজাদি? বিধবা হওয়ার পর চোখ থেকে ঘুম যে চলে গিয়েছে তা তুই বুঝবি কী করে? যা, উনুন ধরা। এখনই সবাই খাট থেকে নেমে চা—চা করবে।’

কাজ শুরু হয়ে যায় আদুরির। চা—বাগানের লাগোয়া এই বাড়িতে সে কাজ করছে দশ বছর। কুড়ি বছর বয়সে কাজে এসেছিল। নিয়ে এসেছিল ওর বাবা শনিচর। কুন্দনন্দিনী জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘ও যদি ভালো কাজ করে তো কথাই নেই। কিন্তু দুদিন বাদে যে বিয়ে হয়ে চলে যাবে। তখন আবার লোক খোঁজো, কাজ বোঝাও!’

শনিচর মাথা নেড়েছিল, ‘না মা। ওসব চিন্তা করতে হবে না। আদুরির বিয়ে অনেকদিন আগেই হয়ে গিয়েছে।’

বারান্দায় কুন্দনন্দিনীর পাশে দাঁড়িয়েছিল পুত্রবধূ আরতি। চোখ কপালে তুলে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘এই বললে ওর বয়স কুড়ি, বিয়ে অনেকদিন আগে হলে তা কত বছর বয়সে হয়েছিল?’

শনিচর হেসেছিল, ‘আমার বাপ তার বন্ধুর নাতির সঙ্গে বিয়েটা দিয়েছে। আমাদের কারও কথা শোনেনি। আদুরির বয়স তখন পাঁচ, ওর বরের বয়েস বারো।’

‘সর্বনাশ!’ আরতির মুখ থেকে শব্দটা বেরিয়ে এল।

কুন্দনন্দিনী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বিয়ের পর মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে না গিয়ে তোমার কাছে পড়ে আছে কেন? শ্বশুরবাড়ি কোথায়?’

‘তিলাগুড়ি চা—বাগানে ওর শ্বশুর কাজ করে। তার বাপ বিয়েটা দিয়েছিল বলে সে মেনে নিতে পারেনি। ভেবেছিল ছেলের বিয়ে দিয়ে অনেক টাকা পাবে, বাপের জন্যে তা পায়নি। তারপর বড় হয়ে ছেলে মিলিটারিতে নাম লিখিয়ে চলে গেল। ওরা কেউ যোগাযোগ রাখেনি। তাই বললাম, কোনো চিন্তা করবেন না, আদুরিকে একটু ভালোবাসলে দেখবেন ও সব কাজ করে দেবে।’ শনিচর মেয়ের মাইনে ঠিক করে চলে গিয়েছিল।

সেই থেকে আদুরি আসে ভোর না হতেই, বাড়ি ফিরে যায় সন্ধের আগেই। ওর কাজে তো বটেই, ব্যবহারেও সবাই খুশি।

এই আদুরি আজ ভোর না হতেই এই বাড়ির উঠোনে পা রাখল না, কুন্দনন্দিনী অবাক হলেন। ধীরে ধীরে বাইরের বারান্দায় গিয়ে তিনি সামনে তাকালেন। মাঠ, মাঠের পরে পিচের রাস্তা। ওই দিক দিয়েই আদুরি আসে। কিন্তু রোদ উঠে গেল, আদুরির দেখা পাওয়া গেল না।

বেলা বাড়ছে, রোদ চড়ছে কিন্তু আদুরির দেখা নেই। এতগুলো বছর ধরে সে কাজ করছে, কখনও না বলে কামাই করেনি। ছেলে প্রদীপ্ত বেরিয়ে গেল চায়ের ফ্যাক্টরিতে। ওর ডিউটির সময় হয়ে গিয়েছে। আরতি বলল, ‘মা, কাউকে পাঠিয়ে খোঁজ নিলে হত না? পাশের গাড়ির খোকনকে বলব?’

‘আমার মনে হচ্ছে শনিচরের শরীর খারাপ হয়েছে বলে আদুরি আসতে পারছে না। কী করা যাবে, নিজেদেরই হাত লাগাতে হবে!’ কুন্দনন্দিনী বললেন।

ওঁরা যখন গতরাতের এঁটো বাসন নিয়ে কলতলায় বসেছেন তখনই হইহই করে এসে পড়ল আদুরি। হাতে বড় চটের ব্যাগ। সেটা একপাশে রেখে আরতি আর কুন্দনন্দিনীকে সরিয়ে বাসন মাজতে বসে গেল।

ছাড়া পেয়ে স্বস্তি হল কুন্দনন্দিনীর। তবু বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এত দেরিতে এলি কেন? দেরি হবে এই খবরটা দিতে কি অসুবিধে হয়েছিল?’

কথা বলল না আদুরি। কিন্তু ফিক করে হাসল।

আরতি বললেন, ‘ওমা! ওভাবে হাসছিস কেন?’

জবাব না দিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বাসন মেজে চলল আদুরি। এক ঘণ্টার মধ্যে হাতের কাজ শেষ করে ব্যাগটা নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল আদুরি। পাঁচ মিনিট পরে যখন বেরিয়ে এল তখন শাশুড়ি—বউমার চোখ ছানাবড়। সাদা থান আর সাদা ব্লাউজ পরে বাইরে এসে আদুরি বলল, ‘আজ তোমরা রান্না করে নাও, আমাকে এখন যেতে হবে।’

কুন্দনন্দিনী হতভম্ব, ‘যেতে হবে মানে? কোথায় যাবি?’

‘আর বোলো না। আমার বাবা বুড়ো হয়ে গেছে।’

আরতি জিজ্ঞাসা করল, ‘তার বুড়ো হওয়ার সঙ্গে তোর কোথাও যাওয়ার কী সম্পর্ক? আর হঠাৎ এই পোশাক পরলি কেন?’

‘আমি বলেছি একদিনই পরব। কাল থেকে ছুঁয়েও দেখব না।’

আরতি কুন্দনন্দিনীর দিকে তাকাল ‘ওর কথা কিছু বুঝতে পারছেন মা? আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না—!’

কুন্দনন্দিনী গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ঠিক করে বল, কোথায় যাচ্ছিস?’

‘শ্বশুরবাড়িতে—!’ চিবুক নামাল আদুরি।

‘অ্যাঁ!’ শাশুড়ি—বউমার গলা থেকে শব্দটা একসঙ্গে ছিটকে এল।

‘তাই তো বললাম। বুড়ো হয়ে বাবার জেদ বেড়ে গিয়েছে। বলল, এতদিন যাওনি, ঠিক আছে, আজ যেতেই হবে তিলাগুড়িতে।’

‘কেন? আজ কী আছে সেখানে?’

‘ওমা, আমাকে যে বিয়ে করেছিল তার লাশ আসবে সেখানে। সেই লাশ বাপ—মা—বউকে দেবে মিলিটারি। তাই আমাকে যেতে হবে।’

‘কী বলছিস তুই? তোর স্বামীর লাশ আসবে মানে? সে কি মরে গিয়েছে?’ কুন্দনন্দিনী চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।

‘এতক্ষণ ধরে বলছি কী? কাশ্মীরে ছিল। সেখানে কারা বোমা ছুড়েছিল। সেটা গায়ে লেগেছিল, তাতেই মরে গিয়েছে লোকটা।’ আদুরি ব্যস্ত হল। ‘আমাকে দুপুর বারোটার মধ্যে ওখানে পৌঁছোতে হবে।’

‘তুই একা যাবি?’

‘না, না। আমার দেওর আসবে নিতে।’

‘বিয়ের পর তো কখনও যাসনি?’

‘কে বলল? পাঁচ বছর বয়সে পাঁচ দিনের জন্যে গিয়েছিলাম তো।’

আরতি জিজ্ঞাসা করল, ‘তাহলে এবার দ্বিরাগমনে যাচ্ছিস?’

‘তা বলতে পার।’ মাথা নাড়ল আদুরি।

‘তোর দেওরকে চিনতে পারবি?’

‘নাঃ! কী করে চিনব? তার তো তখন সাত বছর বয়স ছিল। আমার থেকে দু—বছরের বড়। আজ বাবা ওর সঙ্গে কথা বলার পর চিনিয়ে দেবে!’ মাথা নাড়ল আদুরি, ‘উঃ, আজ কত কাজ!’

‘দাঁড়া। শ্বশুরবাড়িতে যাচ্ছিস, কিছু টাকা নিয়ে যা!’ কুন্দনন্দিনী আরতিকে ইশারা করলেন।

‘না—না—না।’ হাত নেড়ে আরতিকে থামাল আদুরি, ‘টাকা লাগবে না। আমার যাওয়া—আসার সব খরচ ওরা দেবে।’

‘তা দিলেও হাতে কিছু রাখা উচিত আদুরি।’ আরতি বলল।

‘লাগলে ওদের কাছ থেকে চেয়ে নেব।’ আদুরি হাসল।

‘যদি না দেয়? কোনোদিন ঘর করিসনি, তুই তো ঘরের বউ নস।!’ কুন্দনন্দিনী বোঝাবার চেষ্টা করলেন।

‘আমাকে খুশি না করলে ওদের তো বিপদ হবে।’

‘মানে?’ আরতি বুঝতে পারল না।

‘ওদের ছেলে তো যুদ্ধক্ষেত্রে মারা গিয়েছে। তাই মিলিটারি অনেক টাকা দেবে। স্বামী মারা গেলে তার বউকে দেয়। তার মানে আমাকে দেবে। সেই টাকার জন্যে আমাকে ওরা খুশিতে রাখবে না?’ আদুরি বলল, ‘এবার আমাকে ছাড়ো, যেতে হবে।’

কুন্দনন্দিনী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তার মানে তুই আর কাজ করবি না?’

অবাক হল আদুরি, ‘একথা জিজ্ঞাসা করছ কেন?’

‘অত টাকা পাওয়ার পর তুই তো পায়ের ওপর পা তুলে বসে থাকবি।’

‘পাগল!’

‘মানে?’

‘ঝাঁটা মারি ওই টাকার মুখে।’

‘সেকী?’ একই সঙ্গে—শাশুড়ি—বউমা শব্দটা বলে ফেলল।

‘আচ্ছা বলো তো, যার চেহারা মনে নেই, এই এতগুলো বছরে যে আমার খবরও নিল না তার মরার পর আমি হাত পেতে টাকা নিতে যাব কেন? ওর বাপ—মা ভাইরা নিয়ে ফুর্তি করুক।’ আদুরি ব্যাগ তুলে নিয়ে পা বাড়াল।’

কুন্দনন্দিনী পেছন থেকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তাই যখন ভাবছিস তখন থান পরে যাচ্ছিস কেন?’

ঘুরে দাঁড়াল আদুরি, ‘কী করব বলো! বাবা বলল অ্যাদ্দিন তুই যা ছিলি তা ছিলি, কিন্তু আজ থেকে তুই বিধবা হয়ে গেছিস। মরা স্বামীর মুখ দেখে বিধবার দায়টা শেষ করে আয়। বুঝলে?’

কুন্দনন্দিনী এবং আরতি কথা বলতে পারলেন না।

আদুরি হাসল, ‘তোমাদের মুখ দেখে মনে হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারোনি।’ আজ থেকে আমি মুক্ত। বুঝলে? পাঁচ বছর বয়সে যে লোকটা আমাকে বেঁচে থাকতেও মেরে দিয়ে গিয়েছিল আজ তার মরা শরীর আমাকে বাঁচিয়ে দিতে আসছে। চললাম।’

ওঁরা দেখলেন, পাখির মতো উড়ে উড়ে চলে গেল আদুরি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *