আদি-মধ্য-আধুনিক : বাঙলার জীবনের তিন কাল
কখন জন্মেছিলো বাঙলা ভাষা? কারা সেই প্রথম বাঙালি, যাদের কণ্ঠে বেজে উঠেছিলো একটি নতুন ভাষা, যার নাম বাঙলা? ঠিক একটি বাঙলা ভাষাই কি জন্ম নিয়েছিলো সেই ধূসর অতীতে? নাকি বাঙলার বিভিন্ন অঞ্চলে বাঙালির কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিলো বিভিন্ন রকম বাঙলা ভাষা? তা ঘটেছিলো কোন শতাব্দীতে? খুব নিশ্চিত ক’রে কিছুই বলা যায় না। কারণ যে-দিন জন্মেছিলো বাঙলা সে-দিনই তা কেউ লিখে রাখে নি। মানুষের বুক থেকে মানুষের মুখে এসে ধ্বনিত হয়ে আদি বাঙলা ভাষা মিশে গেছে আকাশেবাতাসে। তবে বাঙলা ভাষার জন্মের কাল সম্পর্কে নানা অনুমান করতে পারি আমরা, যেমন অনুমান করেছেন বাঙলা ভাষার বিভিন্ন ঐতিহাসিক।
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বাঙলা ভাষার জন্মলগ্নের খোঁজে একটু বেশি অতীতে যেতে ভালোবাসেন। তিনি মনে করেন ৬৫০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি কোনো সময়ে, অর্থাৎ সপ্তম শতকে, গৌড়ী প্রাকৃত থেকে জন্ম নিয়েছিলো আধুনিকতম প্রাকৃত বাঙলা ভাষা। এতো আগে বাঙলা ভাষার জন্ম না হ’লেও বাঙলা পৃথিবীর জীবিত ভাষাগুলোর মধ্যে অত্যন্ত বয়স্ক ভাষা। তবে আজকাল এতো বয়স্ক মনে করা হয় না বাঙলা ভাষাকে। ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মনে করেন ৯০০ বা ৯৫০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে, অর্থাৎ দশম শতকে, মাগধী অপভ্রংশ থেকে জন্ম নিয়েছিলো কোমল-মধুর-বিদ্রোহী বাঙলা ভাষা। এ-হিশেবেও বাঙলা ভাষার বয়স এক হাজার একশো বছর। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতই আজকাল গৃহীত।
হাজার বছর আগে যে-বাঙলা ভাষা বেজে উঠেছিলো আদি বাঙালিদের কণ্ঠে, তার সাথে আজকের বাঙলার অমিল অনেক। প্রথম জন্মের পর কেটে গেছে অনেক অন্ধকার শতাব্দী, জ্যোৎস্নায় জড়ানো অনেক শতক। বাঙলা ভাষাও জ্যোৎস্না অন্ধকার ভেঙে এগিয়েছে সামনের দিকে। জন্মকালে যে- বাঙলা ভাষা ছিলো, তা আজ শুনলে মনে হয় বহু অতীতের কণ্ঠস্বর শুনছি। যার কিছুটা বুঝি, বুঝি না অনেকটা। যার স্বর চেনা মনে হয় কখনো, আবার মনে হয় অচেনা। যেনো স্বপ্নের মধ্যে শুনছি জড়িয়ে-যাওয়া এক আধো অপরিচিত আধো পরিচিত ভাষা। ভাষা বদলে যায় কালেকালে; বদলে গেছে বাঙলা ভাষাও। বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন শতকে বিভিন্নভাবে বদলে, সুন্দর শক্তিশালী রূপময় হয়ে, গ’ড়ে উঠেছে আজকের বাঙলা ভাষা। কিন্তু তা এমন ছিলো না দুশো বছর আগে। আবার দুশো বছর আগে যেমন ছিলো, ঠিক তেমনি ছিলো না চারশো বছর আগে। আবার তেমন ছিলো না জন্মের লগ্নে জন্মের শতকে।
সেই পুরোনো সেই প্রথম কালের বাঙলা ভাষাকে বলা হয় প্রাচীন বাঙলা বা আদি বাঙলা ভাষা। সে-ভাষা সহজে বোঝা যায় না। পণ্ডিতদের ব্যাখ্যা প’ড়ে বুঝতে হয়। ৯৫০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ;–এই আড়াই শো বছরে বাঙলা ভাষা যে-রূপ নিয়েছিলো, তাকে বলা হয় আদি বাঙলা ভাষা। “চর্যাপদ” নামে একগুচ্ছ গান পাওয়া গেছে। ওই গানগুলো লেখা হয়েছিলো আদিযুগের বাঙলা ভাষায়। আদিযুগের পরের বাঙলা ভাষাকে বলা হয় মধ্যযুগের বাঙলা ভাষা। মধ্যযুগের বাঙলা ভাষা অতো সুদূর অচেনা নয়—অনেক কিছু বোঝা যায় তার। যদিও সবটা বোঝা যায় না। কিন্তু বোঝা যায় অনেক কিছু। তার অনেক শব্দ আজকের শব্দের মতো, তার ধ্বনি আজকের ধ্বনির মতোই অনেকটা। বাঙলা ভাষার মধ্যযুগটি খুব দীর্ঘ। ছ-শো বছরের এ-যুগ। ১২০০ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়ে যে-বাঙলা ভাষা কথিত হতো, আর পাওয়া গেছে যার লিখিত রূপ, তাকে বলা হয় মধ্যযুগের বাঙলা ভাষা। মধ্যযুগের শুরুতেই আছে দেড় শো বছরের একটি ছোট্ট যুগ। ১২০০ থেকে ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দের বাঙলা ভাষাকে বলা হয় আঁধার যুগের বা ক্রান্তিকালের বাঙলা ভাষা। ১৮০১ থেকে শুরু হয় আধুনিক বাঙলা ভাষা। উনিশ শতকের বাঙলা আর আজকের বাঙলার মধ্যেও অমিল অনেক। তবু ওই বাঙলারই পরিণতি বিশশতকের বাঙলা।