আদিম নৃত্য
পুরুষ-মাকড়সা প্রেমে পড়িলে প্রেয়সীর সম্মুখে নানাবিধ অঙ্গ-ভঙ্গি সহকারে নৃত্য করিয়া থাকে। কিন্তু মিলন ঘটিবার পর নৃত্য করিবার মতো মনোভাব আর তাহার থাকে না। প্রেমমুগ্ধা স্ত্রী-মাকড়সা তাহাকে গ্রাস করিয়া উদরসাৎ করিয়া ফেলে।
যাহার আটটা পা এবং যোলটা হাঁটু আছে, সে যে সুযোগ পাইলেই নৃত্য করিবে তাহাতে বিস্ময়কর কিছু নাই। পরন্তু অতগুলা পা ও হাঁটু থাকা সত্ত্বেও মানুষ অনুরূপ অবস্থায় ঠিক অনুরূপ কার্যই করিয়া থাকে। ডারুইন মহাশয়ের কথা সত্য হইলে স্বীকার করিতে হয়, মাকড়সার সঙ্গে আমাদের রক্তের সম্বন্ধ আছে; হয়তো নারীজাতির সম্মুখে নৃত্য করিবার স্পৃহা আমরা উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করিয়াছি; এবং নারীজাতিও যখন আমাদের সঙের মতো নৃত্য দেখিয়া বেবাক গ্রাস করিয়া ফেলে তখন তাহারা তাহাদের আদিম অতিবৃদ্ধ-পিতামহীর মৌলিক বৃত্তিরই অনুসরণ করে।
কিন্তু এসব বাজে কথা। কাজের কথা এই যে, আমরা অহরহ নানা কলাকৌশল দেখাইয়া নারীকে ধাপ্পা দিবার চেষ্টা করিতেছি; কিন্তু ধাপ্পা টিকিতেছে না, নারীর মোহমুক্ত চোখে বারম্বার ধরা পড়িয়া যাইতেছে। উদয়শঙ্করের গলায় যিনি মাল্য দিবেন তিনি জানিয়া বুঝিয়াই দিবেন।
শ্রীমতী লূতারাণী ও শ্রীমান বীরেশ্বরের মধ্যে প্রণয়ঘটিত একটা জটিলতার সৃষ্টি হইয়াছিল। বলিয়া রাখা ভাল যে, এই প্রেমের প্রতিবন্ধক—আর্থিক সামাজিক ঐহিক দৈহিক পৈতৃক বা পারত্রিক—কিছুমাত্র ছিল না। কিন্তু প্রতিবন্ধক না থাকিলেই যদি মিলন ঘটিত তবে আর ভাবনা ছিল কি?
যা হোক, কবির ভাষায়—
খাঁচার পাখি ছিল সোনার খাঁচাটিতে
বনের পাখি ছিল বনে।
লূতা কলিকাতায় পিতৃভবনরূপ স্বর্ণপিঞ্জরে কাল্চারের ঝাললঙ্কা লালঠোঁটে ধরিয়া খুঁটিয়া খুঁটিয়া আহার করিত, এবং জমিদারের ছেলে বীরেশ্বর বনে বনে শিকার করিয়া বেড়াইত। সহসা কি করিয়া দুইজনে দেখাশুনা হইয়া গেল। তারপরেই উক্ত প্রণয়ঘটিত জটিলতা। এবং তারপরেই বীরেশ্বর লূতার সম্মুখে—মেটাফরিক্যালি—নাচিতে শুরু করিয়া দিল।
লূতার ঠোঁটে হাসি, চোখে কৌতুক; সে এই নৃত্য উপভোগ করিতেছে, কদাচিৎ হাততালি দিয়া তাহা জানাইয়া দেয়। উৎসাহিত বীরেশ্বর আরও বেগে নৃত্য করে। নাচিতে নাচিতে লূতার কাছে ঘেঁষিয়া আসে কিন্তু লূতা মৃদু হাসিয়া অলক্ষিতে সরিয়া যায়। নর্তক ও দর্শকের মধ্যে ব্যবধান পূর্ববৎ থাকিয়া যায়—কমে না।
কিন্তু ব্যাপারটা ক্রমে মেটারলিঙ্কীয় রূপকের মতো দুর্বোধ হইয়া দাঁড়াইতেছে। স্পষ্টভাষায় না বলিলে চশমাপরা অস্পষ্টদর্শী পাঠক বুঝিবেন না।
একদিন সন্ধ্যার পর লূতাদের ড্রয়িংরুমে লূতা ও বীরেশ্বর বসিয়া ছিল; লূতার ডাক্তার বাবাও এতক্ষণ ছিলেন, কিন্তু হঠাৎ ফোনে রোগীর আহ্বান পাইয়া তিনি বাহির হইয়া গিয়াছেন।
বীরেশ্বর উঠিয়া আসিয়া লূতার পাশের চেয়ারে বসিল। তাহার গায়ে সিল্কের পাঞ্জাবি, ঢিলা আস্তিনের ভিতর হইতে সাড়ে তিন ইঞ্চি চওড়া কব্জি সমেত বাহু খানিকটা দেখা যাইতেছে। সে ঈষৎ হস্তসঞ্চালনে বাহুর আরও খানিকটা মুক্ত করিয়া দিয়া অলসকণ্ঠে বলিল, ‘আজ ব্যায়াম সঙেঘর মিটিঙে বক্তৃতা দিতে হল।’
বিস্ময়-প্রশংসা-তরলিত স্বরে লূতা বলিল, ‘আপনি বক্তৃতা দিতেও পারেন?’
একটু হাসিয়া বীরেশ্বর বলিল, ‘পারি যে তা নিজেই জানতুম না; কিন্তু বলতে উঠে দেখলুম পারি।’
‘কি বক্তৃতা দিলেন?’
‘এই—স্বাস্থ্য, ব্যায়াম, শিকার সম্বন্ধে দু’চার কথা। সকলেই বেশ মন দিয়ে শুনলে।’
লূতা বলিল, ‘আপনি শুনেছি একজন মস্ত শিকারী। কি শিকার করেন?’
বীরেশ্বর তাচ্ছিল্যভরে বলিল, ‘বাঘ ভালুক—তা ছাড়া আর কি শিকার করব! সিংহ তো আমাদের দেশে পাওয়া যায় না।’
উৎসুকভাবে লূতা জিজ্ঞাসা করিল, ‘ক’টা বাঘ মেরেছেন?’
‘গোটা আষ্টেক হবে। —আমার বাড়িতে যদি কখনও যাও, দেখবে তাদের মুণ্ডুসুদ্ধ চামড়া আমার ঘরে সাজানো আছে। যাবে লূতা? একদিন চল না।’
লূতা হাসিল। প্রশ্নের জবাব না দিয়া বলিল, ‘আপনার খুব সাহস—না?’
ললাট ঈষৎ কুঞ্চিত করিয়া বীরেশ্বর বলিল, ‘সাহস! কি জানি। আছে বোধ হয়। কখনও ভয় পেয়েছি বলে তো স্মরণ হয় না।’ তারপর লূতার মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, ‘এবার তোমার জন্যে একটা বাঘ মেরে নিয়ে আসব, কি বল?’
লূতা আবার হাসিল; উজ্জ্বল চপল হাসি। বলিল, ‘সত্যি?’
‘হ্যাঁ।’—লূতার একখানা হাত নিজের হাতের মধ্যে তুলিয়া বীরেশ্বর বলিল, ‘বাঘের বদলে তুমি আমায় কি দেবে বল।’
আস্তে আস্তে হাত ছাড়াইয়া লইয়া লূতা বলিল, ‘কি দেব? বাঘের বদলে কি দেওয়া যেতে পারে? আচ্ছা, আপনাকে ভাল একটা প্রশংসাপত্র দেব।’
‘তার বেশী আর কিছু নয়?’
লূতা মুখটি ভালমানুষের মতো করিয়া বলিল, ‘প্রশংসাপত্রের চেয়ে বেশী আর আপনার কি চাই? ওর চেয়ে বড় আর কি আছে!’
বীরেশ্বর ক্ষুন্ন হইল, ঘড়ির দিকে তাকাইয়া বলিল, ‘আজ উঠতে হল, সাড়ে আটটা বেজে গেছে! পঞ্চাশ মাইল স্পীডে মোটর চালিয়ে যদি যাই, তবু বাড়ি পৌঁছতে দু’ঘণ্টা লাগবে।’
গাড়িবারান্দার সম্মুখে আয়নার মতো ঝকঝকে দীর্ঘাকৃতি একখানা মোটর দাঁড়াইয়া ছিল, লূতা বীরেশ্বরকে বিদায় দিতে আসিয়া বলিল, ‘কি চমৎকার গাড়ি! নতুন কিনলেন বুঝি?’
‘হ্যাঁ। বারো হাজার টাকা দাম নিলে। মন্দ নয় জিনিসটা।
তারপর বীরেশ্বর বোধ হয় পঞ্চাশ মাইল স্পীডে বাড়ির দিকে রওনা হইল।
লূতা ফিরিয়া আসিয়া বসিল। তাহার মুখে মনালিসার গূঢ় রহস্যময় হাসি।
ও হাসিটা কিন্তু মনালিসার নিজস্ব নয়; সকল নারীই সময় বুঝিয়া ঐরকম হাসিয়া থাকে।
লূতার বাবা ফিরিয়া আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘বীরেশ্বর চলে গেছে?’
‘হ্যাঁ।’—হঠাৎ হাসিয়া ফেলিয়া লূতা বলিল, ‘বীরেশ্বরবাবুর মতো এমন সর্বগুণমণ্ডিত লোক দেখা যায় না। তিনি বক্তৃতা দিতে পারেন, বাঘ মারতে পারেন, পঞ্চাশ মাইল স্পীডে গাড়ি চালাতে পারেন, শুধু নাচতে পারেন কিনা এ খবরটা এখনও পাইনি। বাবা, বীরেশ্বরবাবুর ভেতরের সত্যিকার মানুষটি কেমন?’
বাবা চিন্তা করিয়া বলিলেন, ‘জানি না।’
লূতার চোখদুটি এবার ক্রুদ্ধ ও সজল হইয়া উঠিল—কেন ওরা কেবলি অভিনয় করে! কেন এত যত্ন করিয়া সত্যকার মানুষটিকে লুকাইয়া রাখে? ছদ্মবেশের এই ভাঁড়ামি দেখিয়া লূতার লজ্জা করে, আর তাহাদের নিজের লজ্জা নাই?
কিন্তু লূতা মুখে কিছু না বলিয়া ধীরে ধীরে ঘর হইতে উঠিয়া গেল।
দিন সাতেক পরে বীরেশ্বর ফিরিল। তাহার মোটরের পিছনে একটা প্রকাণ্ড বাঘের মৃতদেহ বাঁধা।
লূতা দ্বিতলের জানালা হইতে দেখিয়াছিল, কিন্তু নামিয়া আসিতে বিলম্ব করিল। যখন নামিল তখন বীরেশ্বর তাহার বাবার কাছে বাঘশিকারের গল্প করিতেছে।
লূতাকে দেখিয়া বীরেশ্বর বলিল, ‘তোমার বাঘ এনেছি।’
লূতা স্ত্রীজাতি, সে বিস্ময় প্রকাশ করিল। তারপর কৌতূহল, ও শেষে আনন্দ জ্ঞাপন করিয়া বীরেশ্বরের বীরত্বের মূল্য অযথা বাড়াইয়া দিল। বাঘ পরিদর্শন হইল। তারপর বীরেশ্বর আবার বাঘশিকারের গল্প আরম্ভ করিল।
লূতার বাবা কাজের লোক, ক্রমাগত বাঘশিকারের গল্প শুনিবার তাঁহার অবকাশ নাই। তিনি এক ফাঁকে অপসৃত হইয়া পড়িলেন।
কাহিনী শেষ করিয়া বীরেশ্বর বলিল, ‘এবার তোমার বাঘ তুমি নাও।’
লূতা বলিল, ‘আমার বাঘ! বাঘের গায়ে কি আমার নাম লেখা আছে?’
‘নাম লিখতে আর কতক্ষণ লাগে। বল তো এখনি—’
‘তার দরকার নেই। —লাকি-বোন্টা আমায় দেবেন।’
বীরেশ্বর লূতার হাত চাপিয়া ধরিয়া বলিল, ‘লূতা, এবার তোমার পালা। তুমি আমায় কি দেবে?’
হাত টানিয়া লইয়া লূতা বলিল, ‘ও—ভুলে গিয়েছিলুম। দাঁড়ান, প্রশংসাপত্রটা লিখে পাঠিয়ে দিচ্ছি।’ বলিয়া সহাস্য মুখে উপরে চলিয়া গেল।
সুতরাং দেখা যাইতেছে, ঐহিক এবং দৈহিক, পৈতৃক এবং পারত্রিক প্রতিবন্ধক না থাকিলেও প্রণয়ের পথ কণ্টকাকীর্ণ। ক্রুদ্ধ বীরেশ্বর বাঘ লইয়া ফিরিয়া গেল এবং দশদিন ধরিয়া মেজাজ এমন তিরিক্ষি করিয়া রাখিল যে আত্মীয় পরিজন সকলেই সন্দেহ করিল মৃত বাঘের প্রেতাত্মা তাহার স্কন্ধে ভর করিয়াছে।
কিন্তু এগারো দিনের দিন হঠাৎ তাহার রাগ পড়িয়া গিয়া আবার নৃত্যলিপ্সা জাগিয়া উঠিল।
সে টেলিফোনে লূতাকে ট্রাঙ্ক-কল দিল। ওদিকে এই দশ দিনে লূতাও কিছু ম্রিয়মাণ হইয়া পড়িয়াছিল। নৃত্য দেখিলে রাগ হয়, আবার না দেখিলেও মন খারাপ হইয়া যায়—ইহাই নারীজাতির স্বভাব।
বীরেশ্বর টেলিফোনে বলিল, ‘তোমার লাকি-বোন্ তৈরি হয়ে এসেছে।’
উদ্গ্রীব স্বরে লূতা বলিল, ‘তৈরি হয়ে এসেছে! কোথা থেকে?’
‘স্যাকরা-বাড়ি থেকে। একটা ব্রোচ। পাঠিয়ে দিতে পারি?’
লূতার কণ্ঠ মধুর হইয়া উঠিল, ‘আপনার বুঝি কাজ আছে? নিজে আসতে পারবেন না?’
‘কাজ!’ বীরেশ্বর লাফাইয়া উঠিল, ‘তোমার ঘড়িতে ক’টা বেজেছে?’
‘তিনটে বেজে পাঁচ মিনিট। কেন?’
‘আচ্ছা, চারটে বেজে পাঁচ মিনিটে আমি গিয়ে পৌঁছুব।’
‘অ্যাঁ! এক ঘন্টায় সত্তর মাইল! না—না—’
কিন্তু বীরেশ্বর আর কিছু শুনিল না, টেলিফোন ফেলিয়া গ্যারাজের দিকে ছুটিল।
ঠিক চারটে বাজিয়া তিন মিনিটে লূতদের বাড়ির সম্মুখে একটা বিরাট শব্দ হইল। লোমহর্ষণ কাণ্ড! সত্তর মাইল নিরাপদে আসিয়া বীরেশ্বরের মোটর লূতার দ্বারের কাছে চিৎ হইয়া পড়িয়াছে। একটা লোহাবোঝাই তিন-টন্ লরি যাইতেছিল, তাহারই সহিত ঠোকাঠুকি।
মোটরের তলা হইতে বীরেশ্বরের সংজ্ঞাহীন দেহ বাহির করা হইল, তারপর ধরাধরি করিয়া লূতাদের বাড়িতে তোলা হইল। বাড়িতেই ডাক্তার। তিনি পরীক্ষা করিয়া বলিলেন, ‘ভয় নেই। মুখের আঁচড়গুলো মারাত্মক নয়; তবে বাঁ পায়ের টিবিয়া ভেঙে গেছে।’ বলিয়া ধনুষ্টঙ্কারের ইন্জেকশন্ প্রস্তুত করিতে লাগিলেন।
লূতা জিজ্ঞাসা করিল, ‘প্রাণের ভয় নেই?’
‘নাঃ। কিছুদিন বাবাজীকে একটু খুঁড়িয়ে চলতে হবে—এই পর্যন্ত।’
বীরেশ্বরের নৃত্য-জীবনের যে এই সঙ্গে অবসান হইয়াছে তাহা কেহ লক্ষ্য করিল না।
এক ঘণ্টা পরে বীরেশ্বরের জ্ঞান হইল। তখন সে সর্বাঙ্গে ব্যাণ্ডেজ লইয়া বিছানায় শুইয়া আছে। লূতা তাহার পাশে একটি টুলের উপর উপবিষ্ট।
লূতা জলভরা চোখে বলিল, ‘কেন এত জোরে গাড়ি চালিয়ে এলেন? না হয় দু’ ঘণ্টা দেরি হত?’
চিরন্তন প্রথামত বীরেশ্বর ‘আমি কোথায়’ বলিল না। বলিল, ‘আমার সারা গা এত জ্বালা করছে কেন?’
লূতার বুক দুলিয়া উঠিল, সে বলিল, ‘টিঞ্চার আয়োডিন।’
বীরেশ্বর বলিল, ‘আমার মুখখানা কি কেটেকুটে একেবারে বিশ্রী হয়ে গেছে?’
‘হ্যাঁ—কিন্তু ও কিছু নয়। বাবা বললেন, সেরে যাবে।’
বীরেশ্বর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল, ‘আর কি হয়েছে?’
‘আর বাঁ পায়ে ফ্র্যাক্চার হয়েছে।’
মর্মভেদী স্বরে বীরেশ্বর বলিল, ‘চিরজীবনের জন্যে খোঁড়া হয়ে গেলুম।’
লূতা উদ্বেলিত হৃদয়ে চুপ করিয়া রহিল। অনেকক্ষণ বীরেশ্বরও চুপ করিয়া রহিল; তারপর তাহার মুদিত চোখে দুই বিন্দু অশ্রু দেখা দিল। সে চোখ বুজিয়াই বলিল, ‘লূতা, আমরা ভারি বোকা।’
লূতা জিজ্ঞাসা করিল, ‘কেন?’
বীরেশ্বর বলিতে লাগিল, ‘কেন? আমরা যাকে ভালবাসি তাকে ভালবাসার কথা স্পষ্ট করে বলা দরকার মনে করি না—কেন নিজের যোগ্যতাই প্রমাণ করতে চাই। তাই, আজ বলবার অবকাশ যখন হল তখন আর সে-কথা মুখ থেকে বার করবার উপায় নেই।’
মৃদুস্বরে লূতা বলিল, ‘কেন উপায় নেই?’
অধীর ক্ষুব্ধকণ্ঠে বীরেশ্বর বলিল, ‘বোকার মতো কথা বলো না লূতা। কি হবে বলে? বললেই বা শুনবে কে? ভাঙা বাঁশির বেসুরো আওয়াজ কার শুনতে ভাল লাগে!’
লূতা বলিয়া উঠিল, ‘আমার ভাল লাগে—তুমি বল।’
‘লূতা!’ বীরেশ্বর প্রায় চিৎকার করিয়া উঠিল।
বাঁশি ভাঙিয়াই যে তাহার বেসুরো আওয়াজ সুরে ফিরিয়া আসিয়াছে, লূতা তাহা বলিল না। সে উঠিয়া বীরেশ্বরের ব্যাণ্ডেজ-বাঁধা মস্তকটি বুকের মধ্যে জড়াইয়া লইল, বলিল, ‘অত চেঁচিও না—পাশের ঘরে বাবা আছেন। এতদিন খালি ছেলেমানুষী করলে কেন? কেন নিজের সত্যিকার পরিচয় দিতে এত দেরি করলে?’
কিন্তু বীরেশ্বরের সত্যিকার পরিচয় দেওয়া তখনও শেষ হয় নাই। সে কিছুক্ষণ দাঁতে দাঁত চাপিয়া চুপ করিয়া রহিল, তারপর চাপা যন্ত্রণার সুরে বলিয়া উঠিল, ‘লূতা, মাথা ছেড়ে দাও—উঃ উঃ—অত জোরে চেপো না—বড্ড লাগছে—’
লূতারাণী দুর্বল অসহায় পুরুষকে তাহার বুভুক্ষু বক্ষে গ্রাস করিয়া লইল। এইরূপে প্রকৃতির আদিমতম বিধান সার্থক হইল এবং প্রত্যহ হইতেছে।
৫ আশ্বিন ১৩৪২