আদিম আতঙ্ক – ১৫

১৫

থমথমে নিস্তব্ধ রাস্তায় পাওয়া গেছিল চারটে ডেকন স্যুট। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে ফুটপাতে, ড্রেনের ওপর, রাস্তার মাঝখানে। সাবমেশিনগানগুলোর অবস্থাও তাই। ট্রাকের পেছনের দরজা খোলা। গাড়ির মধ্যেও প্রচুর ডেকন স্যুট, মানুষ নেই ভেতরে। পড়ে রয়েছে তাদের সাবমেশিনগান।

হাঁক দিলেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘কর্নেল ডিসুজা?’

কবরের নৈঃশব্দ্য।

বলল মাধবী, ‘গুলিবর্ষণের সুযোগ কেউ পায়নি দেখছি।’

‘চেঁচাতেও পারেনি,’ বললেন অপরাজিতা সোম, ‘হোটেলে আওয়াজ নিশ্চয়ই পৌঁছোত।’

দুটো মোবাইল ল্যাবরেটরির দরজা খোলা। ভেতর থেকে বন্ধ নয়। ভেজানো।

সুরেশ সাইকিয়ার কেমন জানি মনে হল, ভেতরে ওঁত পেতে রয়েছে অজানিত আতঙ্ক।

রিভলভার হাতে নিয়ে একটা মোবাইল ল্যাবরেটরির দিকে এগোলেন সুরেশ সাইকিয়া। ঝটকান মেরে খুললেন দরজা। কেউ নেই ভেতরে। দুটো ডেকন স্যুট দুমড়ে মুচড়ে পড়ে রয়েছে মেঝেতে। আর একটা ঝুলছে কমপিউটার টার্মিনালের সামনের চেয়ারে।

এগিয়ে গেলেন দ্বিতীয় মোবাইল ল্যাবের পেছনের দরজায়। এবার দরজা খুললেন আস্তে আস্তে…

এখানেও নেই কেউ। দুটো ডেকন স্যুট পড়ে রয়েছে মেঝেতে।

আচমকা নিভে গেল ভ্যানের সমস্ত সিলিং লাইট। চমকে উঠলেন সুরেশ সাইকিয়া। পরক্ষণেই নিবিড় তিমির পাতলা হয়ে গেল হালকা সবুজ আভায়। এই আভা আসছে তিনটে ভিডিয়ো ডিসপ্লে টার্মিনাল থেকে। আচম্বিতে চালু হয়ে গেছে তিনটেই—নিজে থেকে।

শুধু চালু হয়েই যায়নি, জ্বলে উঠেই নিভে যাচ্ছে, আবার জ্বলে উঠছে। এতক্ষণ একই সঙ্গে তিনটেই জ্বলছিল আর নিবছিল, এবার একটার পর একটা জ্বলে উঠেই নিভে যেতে লাগল। এইভাবে চলল পর্যায়ক্রমে, তারপর জ্বলে রইল তিনটেই একসঙ্গে। অপার্থিব সবুজ আভায় থমথমে হয়ে রইল মোবাইল ভ্যানের ভেতরটা।

সিঁড়ি বেয়ে উঠে ভেতরে ঢুকে গেলেন সুরেশ সাইকিয়া, কারও নিষেধে কান দিলেন না। প্রথম টার্মিনালটার সামনে পৌঁছোতে না পৌঁছোতেই ইংরেজিতে যে শব্দগুলো ভেসে উঠল কালো পটভূমিকায় ফিকে সবুজ আলোয়, সেগুলোর বাংলা তর্জমা এই: আমি জানি, ঈশ্বর আমাকে ভালোবাসেন।

তিনটে স্ক্রিনেই ফুটে উঠেছে একই লেখা। মিলিয়ে গেল শব্দগুলো। ফুটল নতুন শব্দ।

ধর্মগ্রন্থের কপচানি লিখে গেলাম।

ভুরু কুঁচকে গেল সুরেশ সাইকিয়ার। এ আবার কী প্রোগ্রাম? কর্নেল ডিসুজার বৈজ্ঞানিক সহচররা নিশ্চয় এই আজব কথা কমপিউটারকে শিখিয়ে রাখেননি।

দপ করে একই সঙ্গে নিভে গেল তিনটে পর্দাই। জ্বলে উঠল পরক্ষণেই। এবার নতুন কথা: ভগবান-টগবান কিসসু নেই।

নিভে গিয়েই ফের ফুটিয়ে তুলল নতুন কথা।

আমি আছি। জ্যান্ত আমি।

কুড়িটা প্রশ্ন করব। জবাব দিতে পারবে?

রক্ত ঠান্ডা হয়ে এল সুরেশ সাইকিয়ার।

মোটর অ্যাকসিডেন্টের পর তোমার স্ত্রী-র ডেডবডি পাওনি কেন? কারণ সেই লাশ গড়িয়ে গেছিল খাদে। কঙ্কালটা আছে, বাকি সব আমার খিদে মিটিয়েছে। তোমার ছেলের জ্ঞান ফিরবে না। তাকেও আমি শেষ করব।

থ হয়ে গেলেন সুরেশ সাইকিয়া। সন্ধ্যা যত এগিয়ে আসছে, ঠান্ডা তত বাড়ছে। তা সত্ত্বেও ঘেমে উঠলেন পুলিশ প্রধান। এত ঘরোয়া খবর কমপিউটার জানিয়ে যাচ্ছে কী করে?

মনের কথা টের পেয়েই যেন জবাব দিয়ে গেল কমপিউটার।

কারণ, আমি সব জানি। আরও বলব?

‘ডক্টর সোম,’ ভাঙা গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘ভেতরে আসুন।’

তর তর করে সিঁড়ি বেয়ে মোবাইল ভ্যানের ভেতর ঢুকলেন অপরাজিতা সোম।

‘কমপিউটারে কীসব আবোলতাবোল প্রোগ্রাম ঢুকিয়ে রেখেছেন?’

ভুরু কুঁচকে গেল অপরাজিতা সোম-এর। ওঁর চোখের সামনেই নতুন লেখা ফুটে উঠল স্ক্রিনে:

বংশানুবিদ নাকি? হালে পানি পাবে না।

‘কে তুমি?’

আমিই সেই… যে ছিল… যে আছে… যে থাকবে।

সুরেশ সাইকিয়া বললেন, ‘এ যে কথা বললেও জবাব দিচ্ছে। জ্যান্ত কমপিউটার।’

‘তোদের যম আমি।’

অপরাজিতা সোম অটোমেটিক টাইপ রাইটারের সুইচ অন করে দিলেন। মুখে বললেন সুরেশ সাইকিয়াকে, ‘প্রশ্ন আর উত্তর দুটোরই রেকর্ড থাকুক। পরে কাজে লাগবে।’

ঘেঁচু কাজে লাগবে। তোরা মরবি।

খটাখট টাইপ করে গেলেন অপরাজিতা সোম।

‘কেউ এখানে আছে নাকি?’

হ্যাঁ।

‘কে তুমি?’

যাকে গুনে শেষ করা যায় না।

‘কী নাম তোমার?’

অনেক।

‘একটা নাম বলো।’

বললে আঁৎকে উঠবি।

‘তবুও শুনি।’

ধ্বংস।

‘আর কী কী নাম আছে?’

বাজে বকিসনি।

‘তোমার চেহারার বর্ণনা দাও।’

আমি জ্যান্ত।

‘আরও খুলে বলো।’

আমি খোলাখুলি—টের পাবি ঠিক সময়ে।

‘তুমি কি মানুষ?’

মানুষ হলেও হতে পারি।

‘কর্নেল ডিসুজা কোথায়?’

খতম।

‘ডেডবডি কোথায়?

নেই।

‘কোথায় লুকিয়ে রাখা হয়েছে?’

বড় বাজে বকছিস।

‘কর্নেল ডিসুজার সঙ্গে যারা ছিল, তারা কোথায়?’

খতম।

‘কে খতম করেছে? তুমি?’

হ্যাঁ।

‘কেন করলে?’

বাজে বকিসনি।

‘কেন খতম করলে?’

বড্ড বাড় বেড়েছে তোর।

‘খতম করলে কেন?’

সব মরেই আছিস—যত্তসব মাথামোটা।

‘কেন মারতে চাও আমাদের?

মরবার জন্যেই তো তোরা আছিস।

‘টিকে আছি শুধু মরবার জন্যে?’

তোরা আমার কাছে পোকামাকড়।

‘কী নাম তোমার?’

শূন্য।

‘বুঝিয়ে দাও।’

কিংবদন্তী।

‘বুঝিয়ে দাও।’

তোর হেঁড়ে মাথায় গোবর আছে।

মাধবী বললে, ‘স্রেফ পাগলামি, নয়তো মজা করা হচ্ছে।’

পরি বলে উঠল, ‘মজা নয়, মজা নয়, বাতাস ক্রমশ ভারী হয়ে উঠছে, আরও বেশি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে… সে আসছে… কায়াগ্রহণ করতে চলেছে।’

মাধবী চেয়ে রইল বোনের দিকে। এই উপলব্ধিটা তার লোমকূপেও এতক্ষণ শিহরণ জাগিয়ে চলেছিল। স্পষ্ট করে বলে উঠতে পারেনি।

সুরেশ সাইকিয়ার অবশ্য তা মনে হয়নি। প্যানিক আর টেনশন শরীরের ভেতর পর্যন্ত পালটে দেয়। এখন তাঁর ক্ষেত্রে ঠিক তাই হচ্ছে। গা ছমছম করছে। মনে হচ্ছে, এখুনি বুঝি অদৃশ্যলোক থেকে দৃশ্যমান হবে কল্পনাবহির্ভূত এক বিভীষিকা।

কমপিউটার স্ক্রিনগুলোয় একই সঙ্গে এবার ফুটে উঠল একটা প্রশ্ন।

সে আসছে কখন?

‘কে আসছে?’

ভূতের ওঝা।

‘সে কে?’

উতঙ্ক চৌধুরী।

‘উতঙ্ক চৌধুরীকে ভয় পাও?’

তোকে আগে মারব।

‘উতঙ্ক চৌধুরীকে ভয় পাও?’

তোকে সরু সুতোর মতন ফালা ফালা করব।

‘উতঙ্ক চৌধুরীকে ভয় পাও?’ আঙুল কাঁপছে অপরাজিতার।

আমি কাউকে ভয় পাই না।

‘তাহলে উতঙ্ক চৌধুরীর খবর জানতে চাইছ কেন?’

ও জানে আমি জানতে পেরেছি।

‘কী জানে?’

আমার সম্বন্ধে।

‘তুমি কী বা কে তা জানে?’

হ্যাঁ, তাকে চাই—এখানে।

‘কেন?’

আমার জীবনী লেখাব তাকে দিয়ে। তাই সে আসুক।

‘তাকেও মারবে নাকি?’

না, তাকে নিরাপদে বের করে দেব।

‘বুঝিয়ে দাও।’

তোরা সব্বাই মরবি। শুধু বাঁচিয়ে রাখব উতঙ্ক চৌধুরীকে। সেইটাই ওকে বলবি। নিরাপদে বেরিয়ে যেতে দেব—এ খবর না জানলে ও আসবে না।

‘উতঙ্ক চৌধুরীকে নিয়ে আমাদের বাঁচিয়ে রাখবে?’

বিনয় চৌধুরী একটু জেনে ফেলেছিল তাই তাকে সরিয়েছি। তোরা জেনেছিস, তোরাও মরবি… মরবি…।

‘বাঁচতে দেবে না?

না।

‘তুমি এসেছ কোত্থেকে?’

যেখানে সময় গেছে দাঁড়িয়ে।

‘বুঝলাম না।’

সময় শুরু হয়েছে যেখান থেকে—সেখান থেকে।

‘এখনও বুঝলাম না।’

মরলে বুঝবি।

‘তুমি কি অন্য গ্রহ থেকে এসেছ?’

না।

‘তুমি কে?’

বকাসনি।

‘তুমি কী?’

বকাসনি।

‘তুমি কী?’ আঙুল থরথর করে কাঁপলেও টাইপ করে গেলেন অপরাজিতা।

আমি মহা আতঙ্ক। আমি নামহীন দেহহীন বিভীষিকা। আমি যক্ষ রক্ষ লক্ষ লক্ষ কিম্ভুত অদ্ভুত হয়ে যেতে পারি, আমি মানুষ হতে পারি, দেবতাও হতে পারি। কখনও আমি কবন্ধ, কখনও আমার দশ মুণ্ড। দশটা মুণ্ডর একটা সাপের, একটা বাঘের, একটা হায়নার, একটা গণ্ডারের… আর শুনে কাজ নেই… আমিই সব… আমিই সব। অথচ আমি কেউ না। আমি স্রেফ শূন্য। অথচ আমি আছি সর্বত্র।

দপ দপ করে বারকয়েক জ্বলে অবশেষে নিভে গেল তিনটে টার্মিনাল। জ্বলে উঠল সিলিং এর আলো।

বুকের খাঁচা থেকে লম্বা নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বললেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘শেষ হল ইন্টারভিউ।’

১৬

দ্রুত ছায়া ঘনিয়ে আসছে। কোণে কোণে জমছে আঁধার। আকাশে কার্নিভালের রং লেগেছে—কমলা, লাল, হলুদ, বেগুনি। অথচ শিবালয় শহরে নামছে সামান্য আলো।

মোবাইল ল্যাবরেটরি পেছনে রেখে এগিয়ে গেল সবাই হোটলের দিকে। মোড়ের মাথায় জ্বলে উঠল স্ট্রিটল্যাম্প।

গোঙানির আওয়াজটা শোনা গেল ঠিক এই সময়ে।

ওদিকের ফুটপাথে লেংচে লেংচে যাচ্ছে একটা মস্ত অ্যালসেশিয়ান কুকুর। বড় কষ্টে পেছনের জখম একটা পা ঘষটে ঘষটে নিয়ে যাচ্ছে ফুটপাতের ওপর দিয়ে।

স্তম্ভিত চোখে চেয়ে রইলেন সুরেশ সাইকিয়া। মাধবীও নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। কেননা, শিবালয় শহরে এই প্রথম দেখা গেল জীবন্ত প্রাণী।

টম ডিক্সন একদৃষ্টে চেয়েছিল কুকুরটার দিকে। সুরেশ সাইকিয়ার এই সঙ্গীটি

আকার-আয়তনে দৈত্য সমান হলে কী হবে, স্বভাবে শিশুর মতন। গুলি চালায় নির্ভুল নিশানায় অথচ নিতান্ত নিরুপায় না হলে ট্রিগারে আঙুল চেপে বসে না। মায়া-দয়ার শরীর, মানুষ মারা তো দূরের কথা, মানুষ আর মনুষ্যেতর প্রাণীর তিলমাত্র কষ্ট দেখলেই তার বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে ওঠে। অথচ সে পুলিশ সার্জেন্ট।

কুকুরের কাতরানি বিলক্ষণ বিচলিত করেছে তাকে। পায়ে পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে রাস্তা পেরিয়ে যন্ত্রণাকাতর প্রাণীটির দিকে।

ধমকে উঠলেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘যেও না।’

টম ডিক্সন যেন মন্ত্রমুগ্ধ। শুনতেই পেল না।

বামাকণ্ঠের চিৎকারটা শোনা গেল তারপরেই। চেঁচাচ্ছে মাধবী। সন্দেহটা তার মনের মধ্যেও ফণা তুলেছে, ‘ডোন্ট গো।’

রাস্তা পেরিয়ে ওদিকের ফুটপাতে পৌঁছে গেল টম ডিক্সন। হেঁট হয়ে সস্নেহে আহত সারমেয়কে তুলে নিল বুকে।

অবিশ্বাস্য ঘটনাটা ঘটল পরক্ষণেই। জিব বের করে টম ডিক্সনের হাত চাটতে লাগল অ্যালসেসিয়ান।

গা শিরশির করে উঠেছিল টম ডিক্সনের। জীবন্ত প্রাণী যে এত কনকনে ঠান্ডা হয়, তা তো তার জানা ছিল না। বিশেষ করে কুকুর। গা তো গরম নয়, উলটে কেমন যেন ভিজে ভিজে।

জিব যেন আরও ঠান্ডা, ঠিক যেন বরফ দিয়ে তৈরি।

পরিবর্তনটা দেখা গেল সঙ্গে সঙ্গে।

গলে যেতে লাগল অ্যালসেসিয়ান। লোম অন্তর্হিত হল, চামড়া থসথসে হয়ে গেল। একদলা অবয়বহীন জেলির পিণ্ড বুকের কাছে ধরে রইল টম ডিক্সন।

নিদারুণ আতঙ্কে টম ডিক্সনের চক্ষুও বিস্ফারিত হয়েছে। সেই সঙ্গে অবর্ণণীয় যন্ত্রণাবোধ গোটা শরীরকে দুমড়ে-মুচড়ে দিতে চাইছে। ওর দুটো হাতই ঢুকে গেছে জেলির পিণ্ডর মধ্যে। বিষম যন্ত্রণার উৎস ওই দুটো হাত। যেন মাংস গলে যাচ্ছে কড়া অ্যাসিডে…

ঝটকান মেরে দুটো হাতই টেনে বের করে আনল টম ডিক্সন।

শুধু হাড় রয়েছে। আঙুলের ডগা থেকে কনুই পর্যন্ত শুধু সাদা হাড়। মাংস,

চামড়া, টিসু সব অদৃশ্য হয়ে গেছে জেলিপিণ্ডর মধ্যে।

পরিত্রাহি আর্তনাদ বিরামবিহীনভাবে বেরিয়ে আসছে টম ডিক্সনের গলা চিরে। কেননা, জেলিপিণ্ডকে সে ধরে নেই দু’হাতে—জেলিপিণ্ড কিন্তু আঁকড়ে আছে তার বক্ষদেশ। সেখানেও শুরু হয়েছে অকথ্য যন্ত্রণা। চামড়া মাংস বিলীন হয়ে যাচ্ছে জেলিপিণ্ডর গর্ভে। কদাকার পিণ্ড ফুলে উঠছে, গুটি গুটি এগোচ্ছে টম ডিক্সনের গলা আর কাঁধের দিকে। গগনভেদী চিৎকার করে যাচ্ছে বেচারী। মরিয়া হয়ে কঙ্কাল হাত দিয়ে জেলিপিণ্ড আঁকড়ে ধরে ছিনিয়ে নিতে গেল বুকের ওপর থেকে।

কনুই পর্যন্ত হাত অদৃশ্য হয়ে গেল জীবন্ত জেলিপিণ্ডর মধ্যে। চকিতে হাড় পর্যন্ত হজম করে নিল অপার্থিব ভয়ংকর সেই জেলি।

এ দৃশ্য আর দেখতে পারলেন না সুরেশ সাইকিয়া। এরপর কী ঘটবে, কী নারকীয় দৃশ্য প্রত্যক্ষ করতে হবে তা তিনি আঁচ করে নিয়েছেন। তাই, রিভলভার টেনে নিয়ে ধেয়ে গেলেন রাস্তার ওপর দিয়ে। জেলিপিণ্ড আর টম ডিক্সনের খুব কাছে গেলেন না। যদি অবয়বহীন পিণ্ড ছিটকে আসে তাকে লক্ষ করে?

রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে নিপুণ নিশানায় গুলি চালিয়ে দিলেন প্রিয় সার্জেন্টের খুলির মধ্যে। এবং, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে গোটা শরীরটার ওপর ছড়িয়ে গেল কালচে-হলুদ রঙের সর্বভুক জেলিপিণ্ড। ফুলে ফুলে উঠে টোল খেয়ে যেতে লাগল চারিদিকে। টম ডিক্সনকে আর দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু তার কী হাল হচ্ছে, সেটা আঁচ করা যাচ্ছে।

দেখাও গেল কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে। মাত্র কয়েক সেকেন্ড, তার বেশি নয়।

টম ডিক্সন বিলীন হয়ে গেছে জেলিপিণ্ডর অভ্যন্তরে। জেলিপিণ্ডও আয়তনে বৃহত্তর হয়েছে। টম ডিক্সনের গোটা শরীরটা যে এখন তার নিজস্ব উপাদান হয়ে গেছে।

স্বচক্ষে দেখেও বিশ্বাস করে উঠতে পারছিলেন না অপরাজিতা সোম। টম ডিক্সনকে নিজের মধ্যে শুষে নিল যে জেলিপিণ্ড, তার যেন ডিএনএ-র ওপর পুরো নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। চেহারা পালটাতে পারে খুশিমতো, অবিশ্বাস্য গতিবেগে—

হাড়গোড় পর্যন্ত পালটে নেয় নিজের উপাদানে।

এ ধরনের কোনও প্রাণী তো নেই। অসম্ভব। অপরাজিতা সোম জীববিজ্ঞানী। অপরাজিতা সোম বংশাণুবিদ। অথচ এহেন কাণ্ড তাঁর জ্ঞানবুদ্ধির সম্পূর্ণ বাইরে।

তাঁর বিস্ফারিত চক্ষুর সামনেই সহসা থলথলে জেলিপিণ্ড মাকড়সার আকার নিয়ে ছড়িয়ে পড়ল ফুটপাতের ওপর। অতিকায় অ্যামিবা আর ফাংগাসের মাঝামাঝি আকৃতি নিয়ে। ফুটপাতের ওপর দিয়ে মন্থরগতিতে পিছলে গেল অনতিদূরের খোলা ম্যানহোলের দিকে—যার ভেতরে ঢুকে রয়েছে ফিল্ড ল্যাবরেটরির ইলেকট্রিক পাওয়ার কেবল।

সুরেশ সাইকিয়া আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। উপর্যুপরি গুলিবর্ষণ করে গেলেন চলমান জেলিপিণ্ড লক্ষ করে। প্রত্যেকটা তপ্ত সিসে পিণ্ডদেহ ফুটো করে ভেতরে প্রবিষ্ট হল, তার বেশি কিছু না। জেলিদেহ কিম্ভূত আকার নিয়ে নির্বিকারভাবে এগিয়ে গেল ম্যানহোলের দিকে।

বিকট স্তম্ভটার আবির্ভাব ঘটল ঠিক তক্ষুণি, ম্যানহোলের ভেতর থেকে।

গোধূলি তখন ছায়াচ্ছন্ন করে তুলেছে রাজপথকে। অস্পষ্ট সেই আলোতে সহসা অবিশ্বাস্য গতিবেগে ম্যানহোলের ভেতর থেকে ঠেলে বেরিয়ে এল একটা জেলিপিণ্ড। নিমেষে ঠেলে উঠল ওপর দিকে থামের মতন। ম্যানহোলের গর্ত যতটা ব্যাসের, স্তরে ব্যাসও ঠিক তাই। যেন গোটা ম্যানহোলের তলদেশ ঠাসা রয়েছে এই জেলিপিণ্ড দিয়ে। দেখতে দেখতে ঠেলে উঠল দশ ফুট ওপরে। স্তব্ধ হল ঊর্ধ্ববেগ। দুলতে লাগল সাপের মতন। পরক্ষণেই সপাং সপাং করে আছড়ে পড়ল রাস্তায় আর ফুটপাতে। বিষম সংঘাতের বিপুল শব্দ কাঁপিয়ে তুলল শহর…

ইতিমধ্যে ফুটপাত কামড়ে ধরে সর্বভুক থলথলে জেলিপিণ্ড আছাড়ি-পিছাড়ি খাওয়া বিপুলকায় জেলিস্তম্ভের কাছে গিয়ে নিজেকে মিশিয়ে দিল থামের মধ্যে—যেন একই সত্তা—এতক্ষণ ছিল আলাদা, ছিল অন্য এক কার্যভার নিয়ে, সে কাজ শেষ করে ফিরে গেল মূল দেহে।

সোঁ-ও-ও শব্দ তুলে বিরাট স্তম্ভ সাঁৎ করে ঢুকে গেল ম্যানহোলের মধ্যে—প্রকৃত নিবাসে।

১৭

থমথমে মুখে ওরা ফিরে এসেছিল হোটেলে আর এক দফা শিহরিত হবার জন্যে। হোটেলে সান্ত্রীদের কেউ নেই। জিনিসপত্র অস্ত্রশস্ত্র যেখানে থাকার সেখানেই আছে। নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে দশজন মানুষ!

হোটেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছ’জন। এসেছিল অনেকজন, বেঁচে রয়েছে শুধু এই ছ’জন।

‘আহার্য নিবাস’এর পাশের গলিতে গতরাতে সঞ্চরমান তমালপুঞ্জ দেখেছিল মাধবী। মনে হয়েছিল মাথার ওপর মাচায় কী যেন নড়ছে। পরির মনে হয়েছিল, দেওয়ালে গুঁড়ি মেরে কী যেন বসে রয়েছে। এখন মনে হচ্ছে, দু’জনেই ঠিক দেখেছে। মুহুর্মুহু দেহ পালটায় যে, সে নিশ্চয় ওঁত পেতে ছিল সুড়ঙ্গের অন্ধকারে, ড্রেনের ভেতরে। নিঃশব্দে পিছলে যাচ্ছিল মাচার ওপর দিয়ে, দেওয়ালের কোণ ঘেঁষে। সুরেশ সাইকিয়াও পরে দেখেছিলেন, কী যেন চকচক করছে ড্রেনের মধ্যে। নিশ্চয় দেখেছিলেন তাল তাল প্রোটোপ্লাজম—ওঁত পেতে ছিল ড্রেনের ফোকরে, নজর রাখছিল ঘরের সবার ওপরে।

প্রথম মুখ খুলল মাধবী। বললে, ‘বন্ধ ঘরের রহস্য আর রহস্য নেই। দরজার তলার ফাঁক দিয়ে অথবা পাইপের মধ্যে দিয়ে পথ করে নিতে পারে কুৎসিত এই বহুরূপী জেলি।’

বললেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘কাচতোলা বন্ধ-দরজা গাড়িগুলোর ভেতরের রহস্যের সমাধান হয়ে গেল। গোটা গাড়িগুলোই হয়তো চারিদিক থেকে আঁকড়ে ধরেছিল, ফুটোফাটা দিয়ে ঢুকে পড়েছে ভেতরে।’

বাইরে কুয়াশা জমছে রাস্তার ওপর। স্ট্রিটল্যাম্পের আলোক-বলয় ঘিরে গড়ে উঠছে অস্বচ্ছ কুয়াশাপুঞ্জ।

সুরেশ সাইকিয়া বললেন, ‘পাঁচটা টহলদার গাড়ি যখন রয়েছে, পাঁচ দিক দিয়ে বেরিয়ে যাব শহর থেকে।’

‘মাঝপথেই আটকে দেবে,’ মাধবীর মন্তব্য।

‘সব শুনছে কিন্তু আড়াল থেকে,’ পরির চোখ ঘুরছে চারদিকে, ভয় ভাসছ চোখে।বারান্দা থেকে সরে এসে এখন বসে আছে ওরা ডাইনিংরুমে টেবিল ঘিরে। কফির মগে চুমুক দিতে দিতে প্রত্যেকে প্রত্যেকের মনের কথা বোঝার চেষ্টা করছে।

শুরু করলেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘আশ্চর্য ক্ষমতা বটে। ইচ্ছে করলে পেল্লায় মথও হতে পারে।’

‘কুকুর হতেও আপত্তি নেই,’ পরির মন্তব্য।

‘যা খুশি, তাই হতে পারে। আমার তো মনে হয়, যাকে গ্রাস করছে, তার চেহারা নিচ্ছে,’ মাধবী বুঝিয়ে দিলে।

‘অতবড় মথ কি পৃথিবীতে আছে?’ বললেন সুরেশ সাইকিয়া।

‘হয়তো ডাইনোসর আমলে ছিল।’

অবুঝের মতন বলে ওঠে পরি, ‘কী যে বলো। ম্যানহোল থেকে যার আবির্ভাব সে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে রয়েছে ম্যানহোলের নিচে পাতালে?’

‘জীববিজ্ঞানের হিসেবে সেটা সম্ভব নয়,’ বললেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘ডক্টর সোম, আপনি কী বলেন?’

‘না, বায়োলজি তা মানতে পারে না,’ অপরাজিতা সোম বিলক্ষণ ধোঁকায় পড়েছেন।

‘তাহলে কি সর্বভুক সর্বজ্ঞ সর্বরূপী এই জেলি অমর?’

চোখ নামিয়ে ভেবে নিলেন অপরাজিতা সোম। তারপর বললেন চোখ তুলে, ‘হতে পারে মেসোজোয়িক পিরিয়ডেও ছিল, ক্রমাগত নিজেকে পালটে নিয়ে প্রকৃতপক্ষে অমর হয়ে রয়েছে।’

বলে উঠলেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘ভ্যামপায়ার নাকি?’

‘মানে?’ চমকে উঠলেন অপরাজিতা সোম।

‘প্রাণশক্তি শুষে নিয়ে অমর হয়ে থাকে ভ্যামপায়ার, বই পড়ে জেনেছি। এটাও কি সেই জাতীয় কিছু? যাকে গ্রাস করছে, তার প্রাণশক্তি, তার মেদ-মজ্জা-মাংস, তার জ্ঞান, তার স্মৃতি—সবই আত্মসাৎ করে অমর হয়ে রয়েছে?

থমকে গেলেন অপরাজিতা, ‘মনে তো হচ্ছে তাই। একটা এক্সপেরিমেন্টের কথা বলি শুনুন। বিশেষ একটা পোকাকে একটা গোলকধাঁধায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। গোলকধাঁধায় ঘুরে খাবারের জায়গায় পৌঁছোতে তার সময় লেগেছিল অনেক। তাকে মেরে, চটকে খাবারের সঙ্গে খাইয়ে দেওয়া হয়েছিল আর একটা পোকাকে। সেই পোকাকে ছেড়ে দেওয়া হয় একই গোলকধাঁধায়। অনেক সহজে, অনেক কম সময়ে খাবারের কাছে পৌঁছে গেছিল সেই পোকা। ঠিক যেন আগের পোকার অভিজ্ঞতা আর স্মৃতি তার মনের ভাঁড়ারে জমা পড়ে গিয়েছে—’

ঢোক গিলে বললেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘তাহলে তো বলতে হয়, বিনয় চৌধুরীকে নিজের মধ্যে টেনে নিয়ে ভদ্রলোকের মগজের জ্ঞান আর স্মৃতিও আত্মসাৎ করেছে এই বিভীষিকা। বিনয় চোধুরী জানতেন উতঙ্ক চৌধুরীর নাম। আরও জানতেন একমাত্র উতঙ্ক চৌধুরীই জানেন, এই পাতাল-বিভীষিকা আসলে কী। ফলে, পাতাল-বিভীষিকাও জেনে গেছে উতঙ্ক চৌধুরীর নাম—খুঁজছে তাঁকে।’

‘বুঝলাম,’ শক্ত গলায় বললে মাধবী, ‘কিন্তু উতঙ্ক চৌধুরী জানলেন কী করে, পাতাল-বিভীষিকা আসলে কী?’

‘জবাবটা শুধু উতঙ্ক চৌধুরীই দিতে পারবেন।’

‘পরিকে হাতে পেয়েও ছেড়ে দিল কেন? আমরাই বা এখনও টিকে আছি কেন?’

‘টোপ, টোপ হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে আমাদের।’

‘কাজ শেষ হলেই—’

‘আমরাও শেষ হব।’

ধুম করে বিচ্ছিরি শব্দ শোনা গেল বাইরে। তেড়ে উঠে দাঁড়ালেন সুরেশ সাইকিয়া। আবার হল সেই শব্দ। আরও জোরে।

কান পেতে রইলেন সুরেশ সাইকিয়া। আওয়াজটা আসছে বাড়ির উত্তরের দেওয়াল থেকে মাটির লেভেলে শুরু হয়ে দ্রুত উঠে যাচ্ছে ওপরের দিকে।

কড়মড়-খটমট-খটখটাং শব্দ। যেন শুকনো নরকঙ্কালরা দল বেঁধে দেওয়াল বেয়ে উঠছে।

‘নতুন রূপ ধারণ করেছে পাতাল বিভীষিকা,’ বললেন সুরেশ সাইকিয়া।

ছ’জনে এগিয়ে গেল জানলার সামনে। কুয়াশা আরও ঘন হয়েছে।

হঠাৎ দেখা গেল রাস্তার ওপর এক আশ্চর্য আকৃতি। মাকড়সার জালের মতন তন্তুময় পা। কুয়াশায় দৃষ্টিভ্রম ঘটছে—অর্ধেক দেখা যাচ্ছে, বাকি অর্ধেক রহস্যময়। মস্ত গাড়ির মতন কিছু একটা হবে। খাঁজকাটা দাড়া—কাঁকড়ার দাড়ার মতন, কিন্তু আকারে দানবিক। অন্ধকারে মিলিয়ে গেল পরমুহূর্তেই। তারপরই দেখা গেল লিকলিকে শুঁড়, অ্যান্টেনার মতন দুলছে শূন্যে অনেকগুলো। পরক্ষণেই সবই হারিয়ে গেল অন্ধকারে।

শুষ্ক কণ্ঠে বললেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘এদেরই একজন উঠছে ছাদে।’

খটখট-কড়কড় আওয়াজ হচ্ছে এখন ছাদে। যেন হাতুড়ি পেটা হচ্ছে মাঝে মাঝে।

বলে উঠল পরি, ‘বিচ্ছিরি বিকট চেহারা ধারণ করছে কেন, দিদি?’

‘ভয় দেখানোর জন্যে।’

থেমে গেল ছাদের আওয়াজ। ঢোক গিলে বললেন অপরাজিতা সোম, ‘সারা গায়ে কালসিটের কারণটা এবার বোঝা গেল। পুরো দেহ মুড়ে নিয়ে চাপ দিয়ে গেছে, নিংড়ে নিয়েছে। প্রচণ্ড চাপ সমানভাবে পড়েছে, তাই অমন কালসিটে। দম আটকে গেছে এই কারণেই।’

‘প্রিজারভেটিভ প্রয়োগ করেছে একই সঙ্গে,’ বললে মাধবী।

‘সেইজন্যেই ইঞ্জেকশন দেওয়ার দাগ কোত্থাও দেখা যায়নি। গোটা শরীরের প্রতি বর্গইঞ্চিতে প্রতিটি লোমকূপের ভেতর দিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রিজারভেটিভ। বলতে পারেন, এক ধরনের অসমোটিক প্রেসার—অভিস্রবণ চাপ।’

বাসন্তীর ডেডবডির কথা মনে পড়ে গেল মাধবীর। শিউরে ওঠে সর্বাঙ্গ। অভিস্রবণ শক্তি কতখানি জোরদার হলে নিমেষে এমন কাণ্ড ঘটতে পারে?

‘জলটা কীসের?’ মাধবীকে চমকে দিয়ে বলে উঠল পরি।

‘জল?’

থই থই জল দেখা গেছে অনেক জায়গায়। সর্বরূপী আতঙ্ক নিংড়ে ফেলে রেখেছে ওই জল।’

‘এমন ভাবনা মাথায় আসছে কেন?’

বিজ্ঞের গলায় বললে পরি, ‘মানুষের শরীরে জলই তো বেশি। মানুষগুলোকে নিজের মধ্যে টেনে নিয়ে তাদের মেদ-মজ্জা-মাংস ক্যালরি দিয়ে নিজেকে আরও শক্তিমান করে তুলেছে। যেটা তার কাছে ছিবড়ে, সেটা ফেলে দিয়েছে। জল—জলই তার কাছে ছিবড়ে। এই জন্যে হাড় পাইনি, শরীরের চুল পর্যন্ত পাইনি, রয়েছে শুধু জল। বেশি জল যেখানে বেরিয়েছে সেখানে উবে যেতে সময় লেগেছে বলেই আমাদের চোখে পড়েছে। অল্প জল উবে গেছে।’

১৮

উতঙ্ক চৌধুরীর টেলিফোন এল টিকেন্দ্ৰনগর থেকে। কলকাতার এয়ারপোর্টে রিপোর্টাররা তাঁকে ছাড়েনি। জোঁকের মতন জেঁকে বসেছিল। নিরুপায় হয়ে উতঙ্ক চৌধুরী তাঁদের জানিয়েছিলেন রোয়ানোক আইল্যান্ডের কাহিনি, মায়া সভ্যতার অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার কথা, সামুদ্রিক প্রাণীদের রহস্যজনক অন্তর্ধান উপাখ্যান, ১৭১১ সালে গোটা একটা সৈন্যবাহিনীর তিরোধান প্রহেলিকা। শুনে রোমঞ্চিত হয়েছে প্রতিটি সাংবাদিক। তাই দেখে উৎসাহিত হয়ে আরও কাহিনি শুনিয়েছেন উতঙ্ক চৌধুরী। এস্কিমোদের গ্রাম আঞ্জিকুনিতে ১৯৩০ সালের নভেম্বর মাসে পা দিয়ে হতভম্ব হয়ে গেছিলেন এক ফরাসী পণ্যব্যাবসায়ী। গ্রাম খাঁ-খাঁ করছে। জীবন্ত প্রাণী কেউ নেই, না মানুষ, না কুকুর। আধ-খাওয়া খাবার ফেলেও পালিয়েছে প্রত্যেকেই। কিন্তু পালাতে গেলে তো স্লেজগাড়ি চড়ে যাবে। গাড়িগুলো রয়েছে যথাস্থানে, নেই শুধু কুকুরগুলো যারা টেনে নিয়ে যায় স্লেজগাড়ি। তার মানে একটাই, আচমকা যেন বাতাসে গলে মিলিয়ে গেছে সমস্ত পশু আর মানুষ। কবরখানার দম আটকানো নীরবতা বুকে নিয়ে বিরাজ করছে

শূন্য গ্রাম।

রিপোর্টারদের অবহিত করার জন্যেই সবশেষে নিজের তত্ত্ব হাজির করেছিলেন উতঙ্ক চৌধুরী। রহস্যাবৃত এই সব ঘটনার মূলে রয়েছে আদিম শত্রু।

 টেলিফোনে সুরেশ সাইকিয়া প্রথমেই বললেন, ‘আপনার ‘আদিম শত্রু’কে মনে হয় দেখলাম। অতিকায় অ্যামিবা বললেই চলে। যখন তখন চেহারা পালটাতে পারে, যে কোনও আকার ধারণ করতে পারে। কী, ঠিক বলেছি? এই কি আপনার ‘আদিম শত্রু’?’

‘হ্যাঁ। অতীতের কোনও এক যুগের বাসিন্দা কোনওমতে টিকে গেছে। লক্ষ কোটি বছর বয়স।’

টম ডিক্সন আর রমেশ থাপার বীভৎস মৃত্যুকাহিনির বর্ণনা দিয়ে গেলেন সুরেশ সাইকিয়া। মৃত রমেশ থাপার ফিরে আসার কথাও বললেন। সবশেষে বললেন, ‘এরপরও কি আসতে চান?’

হতভম্ব কণ্ঠে বললেন উতঙ্ক চৌধুরী, ‘এত দেখেও বেঁচে আছেন?’

‘বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। যাতে আপনাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে এখানে এনে ফেলতে পারি।’

‘আপনার কথার মানে বুঝতে পারছি না। আমাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ওখানে নিয়ে ফেলতে চায় ‘আদিম শত্রু’?’

‘হ্যাঁ। নির্বিঘ্নে বেরিয়ে যেতে পারবেন শহর থেকে—এই অভয় আপনাকে দিয়েছে আপনার ‘আদিম শত্রু’।’

‘গ্যারান্টি?’

‘হ্যাঁ,’ বলে সুরেশ সাইকিয়া শোনালেন সেই অতীব বিস্ময়কর কাহিনি—কমপিউটারের মাধ্যমে আদিম শত্রুর সঙ্গে কথোপকথন।

শুনতে শুনতে ঘেমে গেলেন উতঙ্ক চৌধুরী। পকেট থেকে রুমাল বের করে কপাল আর মুখ মুছলেন। তোতলাতে তোতলাতে বললেন, ‘ক-কখনও ভাবিনি—’ আর বলতে পারলেন না।

‘কী ভাবেননি?’

‘আদিম শত্রু যে কোনও মানুষের বুদ্ধির স্তরে পৌঁছোতে পারে কখনও ভাবিনি।’

‘অতি-মানুষের বুদ্ধির স্তরে পৌঁছে গেছে।’

‘আমি ভেবেছিলাম বোবা জন্তু, শুধু নিজেকে নিয়েই সজাগ।’

‘একদম না।’

‘তাই যদি হয়, বিপদ আরও বাড়ল।’

‘আসবেন কি?’

‘মুশকিলে ফেললেন।’

‘আসবেন কি না বলুন।’

‘সত্যিই যদি ইনটেলিজেন্ট হয় আদিম শত্রু, আমার ফিরে আসার গ্যারান্টি দেয়…’

টেলিফোনে শোনা গেল একটা শিশুকণ্ঠ, ‘আসুন না কাকু, কত খেলব দু’জনে।’

উতঙ্ক চৌধুরী জবাব দেওয়ার আগেই ধ্বনিত হল এক নারীকণ্ঠ, ‘ভয় নেই, ভয় নেই… চলে আসুন। যথাসময়ে ঠিক বের করে দেব শহর থেকে।’

পরমুহূর্তেই ধীর স্থির গম্ভীর কণ্ঠে বলে গেল এক বয়স্ক পুরুষ, ‘ডক্টর চৌধুরী, অনেক খবর পাবেন আমার সম্বন্ধে। অনেক জ্ঞান, অনেক তথ্য। আসুন, দেখুন, জ্ঞানের ভাণ্ডার বৃদ্ধি করুন। নিরাপত্তার গ্যারান্টি মিথ্যে নয়, সশরীরে বেরিয়ে যাবেন শহর থেকে।’

আর কোনও শব্দ নেই টেলিফোনে। ঘাবড়ে গিয়ে বললেন উতঙ্ক চৌধুরী, ‘হ্যালো… হ্যালো… এটা কি ইয়ার্কির সময়?’

ভেসে এল সুরেশ সাইকিয়ার কণ্ঠস্বর, ‘না, ইয়ার্কি নয়। আপনি যা শুনলেন, আমিও তা শুনেছি। কথা আমি বলিনি, বলেছে আপনার আদিম শত্রু, যাদের গ্রাস করেছে, তাদের গলা নকল করে।’

দরদর করে ঘামছেন উতঙ্ক চৌধুরী। মানুষের গলায় কথা বলে গেল অ্যামিবা?

রুমাল দিয়ে ফের মুখ মুছলেন। বললেন কাঁপা গলায়, ‘আমি যাব।’

‘প্রাণ নিয়ে ফিরে যাবেন, সে গ্যারান্টি সত্যি নাও হতে পারে।’

‘ইনটেলিজেন্ট প্রাণী যদি হয়—’

‘ইনটেলিজেন্স অবশ্যই আছে, সেইসঙ্গে আছে অশুভ ইচ্ছে। শুভ বলতে যা

বোঝায় এর মধ্যে তা নেই।’

সঙ্গে সঙ্গে ভেসে এল সেই শিশুকণ্ঠ, ‘আসুন কাকু, আসুন। কোনও ভয় নেই। যদি আসেন, তাহলে শুধু আপনি নন—এই ছ’জনও প্রাণ নিয়ে বেরিয়ে যেতে পারবে। আর যদি না আসেন, এদেরকে পিষে মারব, তারপর কাজে লাগাব—আমার কাজে।’

খুব মিষ্টি গলায় কথাগুলো বলা হলেও যে নিষ্ঠুর নির্মমতা ছিটকে ছিটকে গেল প্রতিটি শব্দ থেকে, তা আর এক দফা ঘামিয়ে দিল ডক্টর চৌধুরীকে। এবার শুধু ঘাম নয়, ধড়াশ ধড়াশ করছে হৃদ্‌যন্ত্র। কথা বললেন কিন্তু থেমে থেমে, ‘আমি আসছি।’

বললেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘আমাদের জন্যে আসবেন না। আপনাকে ছেড়ে দেবার কারণ আছে। আপনি ওর জীবনী লিখবেন, গোটা পৃথিবীকে জানাবেন। তাই আপনাকে বাঁচিয়ে রাখা দরকার। আমাদের প্রাণের কোনও দাম এর কাছে নেই।’

গোঁয়ারের মতো উতঙ্ক চৌধুরী বললেন, ‘আমি যাচ্ছি।’

‘ড্রাইভিং জানেন?’

‘জানি।’

‘শিবালয়ের বর্ডারে আপনাকে ছেড়ে দেবে একটা গাড়ি। আমাদের অন্য গাড়ি ওখানেই আছে। আপনি নিজে চালিয়ে আসবেন। রাজি?’

‘রাজি।’

১৯

শিবালয় শহরের শিব মন্দিরের ঘণ্টা বেজে উঠল রাত ঠিক তিনটে বেজে বারো মিনিটের সময়ে। বেজেই চলল ঢং ঢং করে।

হোটেলের লবিতে বসেছিল ছ’জনে। একই সঙ্গে চেয়ার ছেড়ে সিধে হয়ে দাঁড়াল তৎক্ষণাৎ। ককিয়ে উঠল সাইরেন। বেজেই চলেছে… দমকে দমকে যেন হাহাকার ছেড়ে যাচ্ছে।

বললে মাধবী, ‘উতঙ্ক চৌধুরী আসছেন মনে হচ্ছে।’

ছ’জনে বেরিয়ে গেল বাইরে।

শিবালয় শহরের নিচের দিকে কোণ ঘুরে আবির্ভূত হল একটা গাড়ি। হেডলাইটের আলো উঠে রয়েছে ওপর দিকে। রুপোলি চেকনাই জাগছে কুয়াশার পর্দায়।

ঢালু রাস্তা বেয়ে ধীর ধীরে উঠে আসছে গাড়ি। ব্রেক কষল ফুটপাত ঘেঁষে—সুরেশ সাইকিয়া যেখানে দাঁড়িয়ে সেখান থেকে দশ ফুট দূরে। নিভে গেল হেডলাইট।

খুলে গেল ড্রাইভারের দরজা। নেমে এলেন উতঙ্ক চৌধুরী। পুরু চশমার লেন্সের মধ্যে দিয়ে ভদ্রলোকের চোখ দুটো অস্বাভাবিক রকমের বড় মনে হচ্ছে। সাদা চুল এলোমেলোভাবে লেপটে রয়েছে কপাল আর কানের ওপর। হেড কোয়ার্টার থেকে এনেছেন একটা ইনসুলেটেড জ্যাকেট—গায়ে চাপানোর ফলে আরও বেঢপ হয়েছে আকৃতি।

স্তব্ধ হল ঘণ্টাধ্বনি। গোঁ-গোঁ করতে করতে থেমে গেল সাইরেন। এরপরের নৈঃশব্দ্য বর্ণনারও বাইরে।

এগিয়ে এলেন উতঙ্ক চৌধুরী, ‘সুরেশ সাইকিয়া?’

‘হ্যাঁ, আমি। চলুন, ভেতরে বসে কথা হবে।’

ছ’জোড়া চোখ নিবদ্ধ উতঙ্ক চৌধুরীর ওপর। তিনি বলে চলেছেন পৃথিবীর কোন কোন জায়গা থেকে অতর্কিতে রাতারাতি কীভাবে অদৃশ্য হয়ে গেছে মানুষ আর জন্তু।

বললেন, দক্ষিণ আমেরিকার জয়া ভার্দি শহরের অবিশ্বাস্য কাহিনি। আমাজন নদীর পাড়ে গড়ে উঠেছিল এই ব্যাবসা কেন্দ্র। বাচ্চাকাচ্চা নারীপুরুষ মিলিয়ে সেখানে মানুষ ছিল ছ’শো পাঁচজন। সব্বাই অদৃশ্য হয়ে গেল এক অপরাহ্নে। মিশন স্কুলে ব্ল্যাকবোর্ডে চকখড়ি দিয়ে শুধু লেখা ছিল: এর কোনও আকার নেই—অথচ সবরকম আকার ধারণ করতে পারে।

কথাটার মানে কী হতে পারে, তা বুঝেছিলেন শুধু উতঙ্ক চৌধুরী। কেননা, তিনি যে জানেন, সুপ্রাচীন মায়াশহরেও পাওয়া গেছে অনুরূপ একটা বার্তা। রাতারাতি মায়াশহর পরিত্যক্ত হয়ে যাওয়ার সময়ে লেখা হয়েছিল সেই বার্তা: অশুভ দেবতারা রয়েছে এই পৃথিবীতে। তারা ঘুমিয়ে আছে পাহাড়-পর্বতে। ঘুম ভাঙলে তারা লাভাস্রোতের মতন বয়ে যায়—শীতল লাভা—বহু আকার ধারণ করতে পারে। গ্রাস করে ধনী মানী দরিদ্রকেও, রেখে যায় না কোনও চিহ্ন।

বললেন উতঙ্ক চৌধুরী, ‘যে সবকিছু গ্রাস করে নেয় কোত্থাও কোনও চিহ্ন না রেখে সে ‘আদিম শত্রু’ ছাড়া কেউ নয়।’

জানালেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘এখানেও পেয়েছি একটা মেসেজ। একটা শব্দের কিছুটা।’

‘আধখানা শব্দ?’ উৎসুক হলেন উতঙ্ক চৌধুরী।

‘হ্যাঁ,’ বলে গেল মাধবী, ‘এক প্রৌঢ়া মেমসাহেব দেওয়ালে আয়োডিন দিয়ে P R O লিখেছেন—এর আধখানা—হলেও হতে পারে।’

‘মেমসাহেব?’ কৌতূহলে ফেটে পড়লেন উতঙ্ক চৌধুরী, ‘নিশ্চয় গ্রীসদেশের।’

হাঁ হয়ে গেল মাধবী, ‘জানলেন কী করে?’

‘প্রাচীন গ্রীসদেশে Proteus নামে এক উপদেবতা ছিল। আর নিবাস মান্টিতে। নিজস্ব চেহারা বলতে কিছুই ছিল না। ইচ্ছেমতো যে কোনও মূর্তি ধারণ করতে পারত, যাকে খুশি তাকে খেতে পারত।’

তিক্ত স্বরে বলে উঠলেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘আপনি বৈজ্ঞানিক হয়ে এই সব অলৌকিক কুসংস্কার কাহিনিতে বিশ্বাস করেন?’

‘অবশ্যই করি। আপনাকেও করতে হবে। নিজের চোখে তো দেখেছেন যার কোনও মূর্তি নেই, সে ইচ্ছেমতো যে কোনও মূর্তি ধারণ করতে পারে। পুরাকালে একেই বিভিন্ন উপদেবতা নামে ডাকা হয়েছে। পৃথিবীর সমস্ত দেশের সমস্ত পুরাণ কাহিনিতে এই ধরনের অদ্ভুত উদ্ভট উপদেবতার শারীরিক বর্ণনা পাবেন। দু’পাতা বিজ্ঞান পড়ে সব কিছুই আমরা উর্বর কল্পনাপ্রসূত বলে মনে করে এসেছি। কিন্তু এরা সব্বাই ছিল, এখনও আছে। আমাদের আদিম আতঙ্ক।

অপরাজিতা সোম বললেন, ‘ডক্টর চৌধুরী, যা বলে গেলেন, বৈজ্ঞানিক শব্দে যদি তা বলতেন, উপকৃত হতাম, কিন্তু আপনি এখনও বলেননি, জীববিজ্ঞানের শর্ত মেনে এ-প্রাণী নিজেকে টিকিয়ে রেখেছে কীভাবে। আমি শুনতে চাই আপনার বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদ, আপনার তত্ত্ব।

উতঙ্ক চৌধুরী জবাব দেওয়ার আগেই, ‘সে’ নিজে এল।

ডাইনিং রুমের বেসিনের কল ছিটকে বেরিয়ে এসে খটখটিয়ে গড়িয়ে গেল মেঝের ওপর দিয়ে। কল-হীন পাইপের মধ্যে দিয়ে সে বেরিয়ে এল গলগল করে অবিরাম স্রোতের আকারে। বেসিন ভরিয়ে গড়িয়ে গেল মেঝের ওপর। দেখতে দেখতে একমানুষ… দু’মানুষ… হাতির মতন দেখতে পেল্লায় আকার ধারণ করে কড়িকাঠ ছুঁয়ে ফেলল অবর্ণণীয় জেলিগোলক… ফুঁসছে… ফুলছে… ঘুরপাক খাচ্ছে…

আচমকা অনেকগুলো সরু মোটা শুঁড় বেরিয়ে এল জেলিপিণ্ড থেকে। একটা

নিজেকে বাড়িয়ে ধরল সাতজনের দিকে। সাতজনেই তখন চেয়ার ছেড়ে দেওয়ালের গায়ে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। শুঁড়টা এগিয়েই থমকে গেল মাঝপথে। শুঁড়ের ডগায় আবির্ভূত হল ছোট্ট একটা ছেঁদা… টপটপ করে জলীয় পদার্থ বেরিয়ে এসে পড়ল মেঝেতে। হলুদ রঙের তরল আরক।

যেখানে যেখানে পড়ল, ধোঁয়া উঠতে লাগল সেইখান থেকে, ফুটো হয়ে যাচ্ছে সিমেন্টের মেঝে। অবরুদ্ধ কণ্ঠে বললে মাধবী, ‘অ্যাসিড।’

মাধবীর এই আত্মজ্ঞানটার জন্যেই যেন অপেক্ষা করছিল লকলকে শুঁড়। ওর মুখের কথা শেষ হতে না হতেই সপাং সপাং করে দু’বার আছড়ে পড়ল টেবিল আর চেয়ারের ওপর। খান খান হয়ে গেল অতবড় টেবিল আর সব ক’টা চেয়ার। তারপরই শূন্যপথে অ্যাসিড ঝরাতে ঝরাতে এগিয়ে গেল ওদের দিকে।

পরি জড়িয়ে ধরেছে মাধবীকে। সুরেশ সাইকিয়া এক হাত রেখেছেন হোলস্টারের রিভলভারে—টেনে বের করা সাহস নেই। অপরাজিতা সোমের মুখ ছাইয়ের মতন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। উতঙ্ক চৌধুরী ফ্যালফ্যাল করে চেয়েই আছেন—চোখের পাতা ফেলতে ভুলে গেছেন। বিশু বোস আর উজাগর সিং নিথর চোখে দেখছেন লকলকে শুঁড় টিপ করেছে কার দিকে।

দুজনে দাঁড়িয়ে ছিলেন পাশাপাশি। শুঁড় এসে থেমে গেল বিশু বোসের নাকের সামনে—মাত্র এক ইঞ্চি দূরে। পরক্ষণেই সরে গেল পাশে। পাক দিল উজাগর সিং-এর গলায়। নিমেষে টেনে নিয়ে গেল ঘরের মাঝখানে।

বিকট আর্তনাদ করে উঠেছিল উজাগর সিং। দু’হাতে শুঁড় জাপটে ধরেছিল। এক ঝটকায় তার গোটা শরীরটা উঠে গেল শূন্যে। দু’চোখ ঠেলে বেরিয়ে এল কোটর থেকে। বিরামবিহীন রক্ত-জল-করা চিৎকারে বুঝি কেঁপে কেঁপে উঠল গোটা শিবালয় শহর।

ঢোক গিলে বললে মাধবী, ‘আহার্য নিবাসে’ কাটামুণ্ড তৈরি হয়েছিল কীভাবে তা দেখাচ্ছে—অ্যাসিড দিয়ে।

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে উজাগর সিং এর মুণ্ডটা সশব্দে আছড়ে পড়ল মেঝেতে। শুধু কবন্ধ দেহ ঝুলতে লাগল শূন্যে। পরমুহূর্তে কবন্ধও অদৃশ্য হয়ে গেল জেলিপিণ্ডর মধ্যে।

জেলিপিণ্ড এখন নব কলেবর ধারণ করছে অতিকায় মানুষ। দানব।

শুকনো গলায় বললেন অপরাজিতা সোম, ‘টিসু স্যাম্পেল যদি একটু পেতাম, মাইক্রোসকোপে দেখে নিতাম কোষের গড়ন। খতম করার অস্ত্র বের করা যেত।’

দানব বললে বজ্রকণ্ঠে, ‘ডক্টর উতঙ্ক চৌধুরী, ল্যাবরেটরিতে যান। আমার জীবনী লিখবেন, সব না জানলে লিখবেন কী করে?’

দানব শরীর থলথলে হয়ে গেল নিমেষে। আবার দেখা গেল জেলিপিণ্ড। সরু হয়ে পাইপের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে রইল না কিছুই।

উজাগরের মুণ্ডটা ছাড়া।

রাত তখন তিনটে বেজে চুয়াল্লিশ মিনিট।

সেকেন্ড ল্যাবরেটরির দরজা দু’হাট করে খোলা রয়েছে। ছ’জন ঠেসাঠেসি করে ঢুকেছে তার মধ্যে। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরে চোখ রেখেছেন বিশু বোস। কাউন্টারে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সুরেশ সাইকিয়া আর মাধবী। তিনটে উজ্জ্বল ভিডিয়ো ডিসপ্লে টার্মিনালের সামনে বসে উতঙ্ক চৌধুরী, অপরাজিতা সোম আর পরি।

কমপিউটার স্ক্রিনে কথা ফুটে উঠল—পাঠালাম একটা মাকড়সা।

‘মানেটা কী?’ বলে উঠলেন উতঙ্ক চৌধুরী।

স্ক্রিনে ফুটল নতুন লেখা—পেছনে দেখ। পরীর পেছনে।

চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে দাঁড়িয়ে উঠল পরি। ঘুরে দাঁড়িয়েই দেখল বিরাট একটা মাকড়সা। কুচকুচে কালো। স্থির হয়ে মেঝেতে দাঁড়িয়ে। এতগুলো মানুষের লাফিয়ে ঘুরে দাঁড়ানো তাকে চঞ্চল করেনি।

কিন্তু পরিবর্তনটা ঘটল চোখের সামনে, খুব দ্রুত। লম্বা ঠ্যাংগুলো ঢুকে গেল শরীরের মধ্যে। এখন সে একটা ডেলা ছাড়া কিছুই নয়। কালচে রং পালটে গিয়ে হয়ে গেল ধূসর-লাল। মাকড়সা আকৃতি বিলীন হয়েছে থসথসে জেলিপিণ্ডর মধ্যে। চকিতে জেলি নিল নতুন আকার—আরশোলা হয়ে গেল। পরমুহূর্তেই দেখা গেল, আরশোলা ফের জেলি হয়ে গিয়েই হয়ে গেল নেংটি ইঁদুর।

ভিডিয়ো ডিসপ্লেতে ফুটে উঠল নতুন লেখা—ডক্টর অপরাজিতা সোম, টিসু

স্যাম্পেল চেয়েছিলে, পাঠিয়ে দিলাম।

বিশু বোস বললেন, ‘হঠাৎ এত সদয় হয়ে উঠল কেন?’

বিষন্ন কণ্ঠে বললেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘কারণ ও জানে, ওকে খতম করার হাতিয়ার বার করার এলেম আমাদের নেই।’

মুহূর্তের জন্যেও স্থির নেই জেলিপিণ্ড, ফুঁসছে, ফুলছে, টোল খাচ্ছে, তেউড়ে যাচ্ছে।

স্ক্রিনে ফুটে উঠল শব্দের পর শব্দ:

চোখ মেলে দেখে নাও আমার শরীরের মাংসখণ্ডর অলৌকিক ক্রিয়াকলাপ। এই ক্ষমতা আর অমরত্ব শুধু আছে আমার মধ্যেই। আমি অবিনশ্বর। আমি মৃত্যুঞ্জয়ী। আমি সর্বরূপী। আমি সর্বত্র বিরাজমান। আমি সর্বজ্ঞ। ছুঁয়ে দেখ—কোনও ভয় নেই।

সাহসে বুক বেঁধে হেঁট হলেন অপরাজিতা সোম। তর্জনী বাড়িয়ে ডগা দিয়ে স্পর্শ করলেন স্পন্দিত জেলিপিণ্ডকে। বললেন, দরকার তো একটু টুকরোর।

‘লাইট মাইক্রোসকোপির জন্যে,’ সায় দিল মাধবী।

‘সেই সঙ্গে ইলেকট্রন মাইক্রোসকোপের জন্যে। আরও একটু বেশি দরকার কেমিক্যাল আর মিনারেল বিশ্লেষণের জন্যে।’

দপদপ করে লেখা ফুটে উঠেই নিভে যেতে লাগল পরম উল্লাসে: চালাও… চালাও… চালাও এক্সপেরিমেন্ট।

ওয়ার্ক কাউন্টারে মাইক্রোসকোপ নিয়ে বসে আছেন অপরাজিতা সোম। বললেন অস্ফুট স্বরে, ‘অবিশ্বাস্য!’

মাধবী বসে তার পাশেই আর একটা মাইক্রোসকোপ নিয়ে। তার স্বরেও জাগল বিস্ময়, ‘এরকম কোষ-গঠন কখনও দেখিনি।’

উতঙ্ক চৌধুরী জীববিজ্ঞানী নন। কোষ-গঠনের ব্যাপারে জ্ঞানদান করতে অক্ষম। তাই শুধু জিজ্ঞেস করলেন, ‘অবাক হচ্ছেন কেন?’

অপরাজিতা সোম বললেন, ‘বেশির ভাগ টিসুতেই কোষের গঠন নেই।’

মাধবী বললে, ‘আমার স্যাম্পেলেও দেখছি একই ব্যাপার।’

‘অথচ জৈব বস্তুতে কোষ-গঠন থাকে—থাকতেই হবে।’

‘স্যাম্পেল দেখে তো মনে হচ্ছে অজৈব বস্তু। কিন্তু তা হওয়া তো উচিত নয়।’

‘তা তো নয়ই,’ বললেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘এ যে কতখানি জ্যান্ত, তা তো চোখে দেখেছি, হাড়ে হাড়ে বুঝেছি।’

অপরাজিতা সোম বললেন, ‘কয়েকটা কোষ রয়েছে আমার স্যাম্পেলে—কিন্তু একটা আর একটা থেকে আলাদা।’

সায় দিয়ে গেল মাধবী, ‘আমিও তো তাই দেখছি। রকমারি কোষ যেন সাঁতরে বেড়াচ্ছে অথই অজানা সমুদ্রে।’

অপরাজিতা সোম বললেন, ‘কোষের দেওয়াল তো ঘনঘন পালটে যাচ্ছে নিউক্লিয়াসের রয়েছে তিনটে দাড়া। কোষের ভেতরে প্রায় অর্ধেক জায়গা জুড়ে রয়েছে। রহস্যময়।’

তিনটে কমপিউটারের স্ক্রিনেই একই সঙ্গে ফুটে উঠল একই কথা:

উজবুক কোথাকার! সর্বশক্তিমানের কোষ তো রহস্যময় হবেই।

স্যাম্পেলের অর্ধেক নিয়ে অপরাজিতা ও মাধবী পরীক্ষা করছিল। বাকি অর্ধেক ছিল একটা কাচের ডিশে। ঘনঘন কাঁপছিল সেই নমুনা। চেহারা পালটে উদ্ভট কীটপতঙ্গ হয়েই ফের জেলির আকারে ফিরে যাচ্ছিল।

অপরাজিতা সোম বললেন, ‘একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি। এই যে স্বরূপহীন টিসু, এই টিসু যখন খুশি যেরকম খুশি কোষ নকল করতে পারে। কিন্তু ওই যে ছাড়াছাড়া তিনটে দাড়াওয়ালা নিউক্লিয়াসের যে কোষ, ওইগুলোই কনট্রোল করছে সবকিছু। নিয়ন্ত্রণের হুকুম যাচ্ছে ওই কোষগুলো থেকেই, কীভাবে তা বলতে পারব না। স্বরূপহীন টিসু যখন কুকুরের চেহারা নিচ্ছে—তখন কুকুরের শরীরের কোষ গড়ে নিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু মাঝে সাঝে কয়েকটা ওই কোষ থাকছে, যাদের নিউক্লিয়াসের দাড়ার সংখ্যা তিন। যে কোষের দেওয়াল বেজায় নরম—স্থিতিশীলতা একদম নেই বললে চলে।’

‘তা থেকে কী বোঝা গেল?’ এতক্ষণে একটা প্রশ্ন নিক্ষেপ করলেন উতঙ্ক চৌধুরী।

‘আদিম শত্রু যখন জিরোয়, তখন তার টিসুর মধ্যে নিজের কোনও কোষ থাকে না, আর যখন জাগে, তখন ছড়ানো ছিটোনো ত্রিদাড়া বিশিষ্ট কোষগুলো যেভাবেই হোক এনজাইম বানিয়ে নেয়… কেমিক্যাল সিগন্যাল পাঠায়… স্বরূপহীন টিসুকে নিয়ন্ত্রণ করে।

‘শয়তানের নিধনের পন্থা কি বের করা গেল?’ খোঁচা দাড়ি চুলকে বললেন উতঙ্ক চৌধুরী।

‘না,’ সাফ জবাব দিলেন অপরাজিতা সোম।

কাচের ডিশে দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে চেহারা পরিবর্তন।

‘ব্রেন আছে কি?’ মাধবীর প্রশ্ন, ‘ধীশক্তির একটা কেন্দ্র নিশ্চয় আছে ‘আদিম আতঙ্ক’ নামক এই মহাপ্রভুর।’

‘ধরেছেন ঠিক। আমাদের ব্রেনের মতন না হলেও ওই জাতীয় কিছু একটা রয়েছে নিশ্চয়। যে জিনিসটা কন্ট্রোল করছে বিক্ষিপ্ত কোষদের, কোষগুলো কন্ট্রোল করছে নিরাকার প্রোটোপ্লাজম।’

উত্তেজিত হয়ে যায় মাধবী, ‘তাই যদি হয়, তাহলে বিক্ষিপ্ত কোষদের সঙ্গে ব্রেনের কোষদের একটা জায়গায় মিল থাকবেই। চেহারা পালটাচ্ছে না কেউই।’

‘যুক্তির দিক থেকে হক কথা বলেছেন। যে-কোষ হরদম চেহারা পালটায়, সে কোষ স্মৃতি, ধীশক্তি, যুক্তিশক্তির ভাঁড়ার হয়ে থাকতে পারে না। সিদ্ধান্তটা দাঁড়াচ্ছে এই—এগুলো জমা আছে যেখানে সে জায়গাটা স্থায়ী কোষদের মজবুত গঠন।’

মোলায়েম গলায় বললে মাধবী, ‘ব্রেনে তাহলে আঘাত হানা যায়। ব্রেন যখন স্বরূপহীন টিসু দিয়ে তৈরি নয়, তখন তা জখম হলে নিজেই নিজেকে মেরামত করে নিতে পারবে না। স্থায়ীভাবে জখম হবে ব্রেন। জখম যদি ভালোভাবে করা যায়—অনেকখানি জায়গা জুড়ে করা যায়, তাহলে শরীর গড়া হয়েছে যে স্বরূপহীন টিসু দিয়ে, তাদের কন্ট্রোল করতে পারবে না, তার মানে, মৃত্যু হবে শরীরের।’

বিস্ফারিত চোখে মাধবীর পানে চেয়ে রইলেন অপরাজিতা সোম, ‘ইউ আর রাইট।’

‘অত উল্লসিত হবার কারণ দেখছি না,’ বিরসবদনে বললেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘আদিম আতঙ্ক নামক এই প্রাণী এত বোকা নয় যে, ব্রেনকে এমন জায়গায় রেখে দিয়েছে যেখানে পৌঁছে যাবে আমাদের গুলিগোলা। ব্রেন আছে আমাদের নাগালের বাইরে—খুবই সুরক্ষিত জায়গায়… পাতালের সুগভীর কোনও গুহায়।’

নিভে গেলেন অপরাজিতা সোম, মন দিলেন টিসু স্যাম্পেলের কেমিক্যাল আর মিনারেল বিশ্লেষণের ফলাফলের দিকে। বললেন, ‘বহু রকমের হাইড্রোকার্বন রয়েছে দেখছি। কয়েকটা রয়েছে কণা পরিমাণে। হাইড্রোকার্বন দিয়ে ঠাসা। এমন তো দেখা যায় না।’

‘কার্বন কিন্তু সজীব টিসুর মৌলিক উপাদান। সুতরাং তফাতটা কোথায়?’ মাধবীর প্রশ্ন।

‘পরিমাপে। স্বাতন্ত্র্য মাত্রায়, এত রকমের হাইড্রোকার্বন এত অধিক পরিমাণে থাকাটা খুবই অস্বাভাবিক।’

‘তাতে কি আমাদের লাভ হচ্ছে?’

‘বুঝতে পারছি না,’ চিন্তাক্লিষ্ট চোখে বিশ্লেষণের ফলাফলের দিকে চেয়ে রইলেন অপরাজিতা সোম।

কাচের ডিশে ঘন ঘন রূপ পরিবর্তন করছে জেলিপিণ্ড। ফড়িং। শুঁয়োপোকা। পিঁপড়ে। মাকড়সা… একদৃষ্টে দেখে যাচ্ছে পরি।

‘পেট্রোলেটাম,’ বললেন অপরাজিতা সোম।

‘সেটা কী?’ সুরেশ সাইকিয়া উদগ্রীব হলেন।

‘পেট্রোলেটাম জেলি।’

‘ভেসেলিনের মতন?’

উতঙ্ক চৌধুরীর প্রশ্ন, ‘স্বরূপহীন টিসু কি পেট্রোলেটাম?’

‘না, না, না,’ জোরে মাথা নাড়লেন অপরাজিতা সোম, ‘মোটেই তা নয়। এ জেলি তো সজীব টিসু। কিন্তু হাইড্রোকার্বনের অনুপাতে সাদৃশ্য রয়েছে। পেট্রোলেটামের গঠনের চেয়ে অনেক বেশি জটিল এই টিসুর গঠন। মানুষের শরীরে খনিজ দ্রব্য আর রাসায়নিক দ্রব্য যত আছে, তার চেয়ে ঢের বেশি রয়েছে এই টিসুর মধ্যে। অ্যাসিড আর অ্যালকালির পঙ্‌ক্তি লক্ষণীয়… এদেরকে পুষ্টির কাজে লাগায় কীভাবে, ভেবে পাচ্ছি না… শ্বাসপ্রশ্বাস চালায় কীভাবে… রক্তসংবহনতন্ত্র নেই—অথচ সজীব রয়েছে কী করে… স্নায়ুতন্ত্র তো চোখে পড়ছে না—অথচ স্নায়ুর কাজ দিব্যি চলছে… কোষের নির্দিষ্ট গঠন বা আকার নেই অথচ নতুন টিসু গড়ছে কী করে! সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অতিরিক্ত মাত্রার হাইড্রোকার্বন…’

শেষের দিকে কথা ক্ষীণ হয়ে এল অপরাজিতা সোমের, শূন্য হয়ে এল চাহনি। চেয়ে আছেন টেস্ট রেজাল্টের দিকে কিন্তু কিছুই আর দেখছেন না।

ঠিক এই সময়ে শোনা গেল পরির উত্তেজিত কণ্ঠস্বর, ‘আসুন, আসুন দেখবেন আসুন।’

কাচের ডিশের দিকে চোখ বড় বড় করে চেয়ে আছে পরি—এতক্ষণ জেলিদেহ দ্রুত রূপ পালটে যাচ্ছিল এই ডিশে। অকস্মাৎ থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে স্থির হয়ে গেল জেলি—সাদাটে তরল পদার্থ বেরিয়ে এল তার গা থেকে। এখন তা নিষ্প্রাণ। নড়ছে না। অন্য মূর্তি ধারণ করছে না।

চামচে দিয়ে খোঁচা মারলেন অপরাজিতা সোম। নিষ্প্রাণ জেলি-জলীয় নড়েচড়ে গেল না। চামচে দিয়ে ঘেঁটে দিলেন। আরও পাতলা হয়ে গেল টিসু—কিন্তু সাড়া দিল না, নরম গলায় বললেন উতঙ্ক চৌধুরী—‘মৃত্যু’ এর নাম মৃত্যু।

যেন তড়িতাহত হলেন সুরেশ সাইকিয়া। তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন অপরাজিতা সোমকে, ‘ডিশে স্যাম্পেল রাখবার আগে কী রেখেছিলেন?’

‘কিচ্ছু না।’

‘নিশ্চয় কিছু ছিল। ভাবুন, ভাবুন। আমাদের জীবন নির্ভর করছে আপনার মনে করার ওপর।’

‘বলছি তো কিছু ছিল না।’

‘কোনও কেমিক্যালের তলানি?’

‘পরিষ্কার করা ডিশ। তলানি ছিল না।’

‘হতেই পারে না। এমন কিছু ছিল ডিশে যার ছোঁয়ায় ‘আদিম শত্রু’র দেহাংশ পঞ্চত্ব লাভ করেছে,’ সুরেশ উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছেন।

‘সেই জিনিসটাই আমাদের হাতিয়ার,’ নিষ্কম্প স্বরে বলে গেলেন বিশু বোস।

‘অত সোজা নয়,’ নিরুত্তাপ গলায় বললেন উতঙ্ক চৌধুরী, ‘আমরা সকলে দেখেছি—ইচ্ছে মতন স্বরূপহীন শরীরের খানিকটা আলাদা করে অন্য চেহারা ধারণ করার জন্যে পাঠিয়ে দিতে পারে ‘আদিম শত্রু’। মূল শরীর থেকে আলাদা হয়ে ওই টুকরো শরীর বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারে না। সুতরাং কেমিক্যাল অস্ত্র দিয়ে তার স্বরূপহীন শরীরের খানিকটা ধ্বংস যদি করি—‘আদিম শত্রু’ নিমেষে জখম অংশ ফেলে দিয়ে বাঁচিয়ে নেবে নিজেকে।’

মাধবীর রোখ চেপে গেল, ‘এটাও তো ঠিক যে, ‘আদিম শত্রু’র অংশবিশেষ নিজেই নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারে না। বিশেষ কতগুলো কোষ বিক্ষিপ্ত অবস্থায় এনজাইম সাপ্লাই পায় বলেই কাজ করতে পারে। ‘আদিম শত্রু’ তার পুরো অবয়বকে কব্জায় রেখেছে এই এনজাইম দিয়ে। কিন্তু তা কীভাবে?’

‘ব্রেনের সাহায্যে,’ আস্তে বললেন অপরাজিতা সোম। ‘মানুষের ব্রেন এনজাইম আর হরমোন তৈরির গ্রন্থিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করছে বলেই মানুষের শরীর চালু রয়েছে। ‘আদিম শত্রু’র ব্রেনও নিশ্চয় সেই একই কাজ করে চলেছে।’

সুরেশ সাইকিয়া বললেন, ‘বুঝলাম। কিন্তু এই আবিষ্কারটা আমাদের কী কাজে লাগবে জানতে পারি?’

জবাবটা দিল মাধবী, ‘ব্রেনকে ধ্বংস করতে পারলেই ‘আদিম শত্রু’ তার শরীরকে টুকরো টুকরো করেও আলাদা অংশগুলোকে টিকিয়ে রাখতে পারবে না।’

‘ব্রেনটা কোথায় সেটাই জানা নেই যখন, এ আবিষ্কার কোনও কাজেই লাগবে না,’ সুরেশ সাইকিয়া যেন হতাশ হলেন।

‘অত হতাশ হবেন না,’ মুখে হাসি টেনে এনে বললেন অপরাজিতা সোম, ‘ডিশের জেলির মৃত্যু থেকে একটা তথ্য তো জানা গেল।’

‘কী তথ্য?’

‘একটা রাসায়নিক ভারসাম্য বজায় রাখতে পারলেই স্বরূপহীন শরীর বেঁচে থাকে—নইলে মরে।’

সুরাহার ক্ষীণ একটা আশা অপরাজিতা সোমের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে কিন্তু তা নিয়ে কারও সঙ্গে কথা বলা মানেই ‘আদিম শত্রু’র গোচরে এনে ফেলা। সে ঠিক জানবেই। তার চাইতে সমাধানসূত্র থাকুক মগজের মধ্যে।

তাঁকে এখনই একটা জরুরি ফোন করতে বেরুতে হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *