১০
হোটেলটাকে এখন কেল্লা বানিয়ে নেওয়া হয়েছে।
বড় ঘরগুলোর মেঝেতে তোশক গদি ফেলে শুয়েছে সবাই। প্রহরী মোতায়েন রয়েছে লিফট আর দরজায়। জানলাগুলোর বাইরে থেকে ধাক্কা পড়লেই সজাগ হওয়া যাবে।
চারিদিকে নিশ্চিদ্র নীরবতা।
রাত গভীর হয়েছে।
বড় ঘরের লাগোয়া ছোট্ট ঘরটায় পাঁচমিশেলি জিনিস রাখা হয়। এ ঘরে আলো জ্বলছে না। জানলা নেই।
ঘরদোর পরিষ্কার করার কেমিক্যালের হালকা সুবাস ভাসছে বাতাসে। লাইসল। ফিনাইল। ফার্নিচার পালিশ। মেঝে ঘষার মোম। দেওয়ালের তাকে সাজানো রয়েছে।
দরজা থেকে দূরতম কোণে, ডানদিকে রয়েছে বড় সাইজের মেটাল সিঙ্ক।
কলে লিক আছে। টপ টপ করে জল পড়ছে। দশ থেকে বারো সেকেন্ড অন্তর একটা করে ফোঁটা। প্রত্যেকটা ফোঁটা ধাতুর চাদরে আছড়ে পড়ছে—আর শব্দ হচ্ছে—টং।
এই ঘরের মাঝখানে সোফায় শুয়ে আছে শচীন, চাদরে ঢাকা সর্বাঙ্গ।
নিস্তব্ধ চারিদিক। শুধু একঘেয়ে টং টং টং শব্দটা ছাড়া।
বাতাসে ভাসছে রুদ্ধশাস পূর্বাভাস।
ঘুম নেই সুরেশ সাইকিয়ার চোখে। উনি ভাবছেন, শহরের গৃহপালিত পশুগুলো গেল কোথায়?
আলোহীন, গবাক্ষহীন, পাঁচমিশেলি জিনিস রাখার ঘরে অব্যাহত রয়েছে ওই একটা শব্দ। মেটাল বেসিনে টং টং টং আওয়াজ সৃষ্টি করে যাচ্ছে জলের ফোঁটা।
কিন্তু ঘর একেবারে নিস্তব্ধ নয়। অন্ধকারে কী যে নড়ছে। নরম, ভিজে ভিজে, চোরা শব্দ গুঁড়ি মেরে ঘুরছে ঘরময়।
ঘুম নেই মাধবীর চোখেও।
সুরেশ সাইকিয়া টহল দিতে বেরিয়েছিলেন। মাধবীর চোখ খোলা দেখে দাঁড়িয়ে গেলেন।
মাধবী বললে, ‘আপনার চোখে ঘুম নেই?’
সুরেশ বললেন, ‘ছেলেটার জন্যে মন কেমন করছে।’
‘আপনার ছেলে?’
‘এক ছেলে। বছর খানেক আগে গাড়ি অ্যাকসিডেন্টে ওর মা মারা যান। ছেলেটার ব্রেনে চোট লাগল। এক বছর হয়ে গেল—এখনও জ্ঞান ফিরে পায়নি।’
‘কোমা?’
‘হ্যাঁ।’
শচীনের লাশ যে-ঘরে, সেই ঘরে জল পড়া কিছুক্ষণের জন্যে বন্ধ হয়েছিল। ফের শুরু হয়েছে।
টং।
শচীনের সোফা ঘিরে চুপি চুপি কি যেন ঘুরছে। আওয়াজ হচ্ছে ছপ… ছপ… ছপ…।
কাদায় পা পড়লে যেমন আওয়াজ হয়।
শুধু এই আওয়াজই নেই ঘরের মধ্যে। শোনা যাচ্ছে আরও অনেক শব্দ… খুব কোমল, মৃদু শব্দ। হাঁপাচ্ছে কুকুর। ফ্যাঁস করছে বেড়াল। চাপা হাসি—কচি গলার হাসি। যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠছে একটি মেয়ে। গোঙানি। দীর্ঘশ্বাস। চড়ুই পাখির কিচিরমিচির। খুব আস্তে—বাইরের সান্ত্রীর কানে যেন না যায়। সাপের হিসহিসানি। র্যাটলস্নেকের কড়মড় বাদ্যি। মৌমাছির তীক্ষ্ণ গুঞ্জন। কুকুরের গজরানি।
আচমকা স্তব্ধ হল সমস্ত শব্দ। শুরু হয়েছিল হঠাৎ, শেষও হল হঠাৎ।
ফিরে এল নৈঃশব্দ্য।
এক মিনিট নৈঃশব্দ্য। আবার… টং।
আলোহীন ঘরে খসখস শব্দ… কাপড় চোপড়ে যেমন আওয়াজ হয়। শচীনের গা-ঢাকা চাদর খসে পড়ল মেঝের ওপর।
আবার পিছলে যাওয়ার আওয়াজ। শুকনো কাঠ ভাঙার আওয়াজ। চাপা শব্দে যেন হাড় ভাঙল।
আবার নৈঃশব্দ্য।
টং।
নৈঃশব্দ্য।
টং টং টং।
ভোরের দিকে ঘুম ভেঙে গেছিল পরির। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখল রাস্তা একদম নিঝুম। গাছের পাতা পর্যন্ত নড়ছে না। এখনও আলো ফোটেনি আকাশে।
ভোরবেলা দৌড়োনোর অভ্যেস আছে পরির। এই সময়ে ঘুম ভাঙলে আর শুয়ে থাকতে পারে না। তাই উঠে পড়ল। বেরিয়ে এল করিডরে। দরজায় দাঁড়িয়ে সান্ত্রী। লিফটের পাশে সান্ত্রী। সদর দরজার ম্যাজিক হোল দিয়ে বাইরের বাগানের পথে নজর রেখেছে একজন সান্ত্রী।
পরি ভাবল লম্বা করিডরেই একটু পায়চারি করা যাক। হেঁটে করিডরের শেষে টয়লেটের দিকে চলে গেল পরি। আবার ফিরে এল। আবার গেল।
সান্ত্রীরা হাসছে ওর কাণ্ড দেখে।
ভয়ানক কাণ্ডটা ঘটল ঠিক তখনই!
হেঁটে টয়লেটের বন্ধ দরজাটার সামনে গিয়ে যেই অ্যাবাউট টার্ন করতে যাচ্ছে পরি, আস্তে ফাঁক হয়ে গেল টয়লেটের দরজা। খোলা হল ভেতর থেকে।
দরজার ফাঁকে দাঁড়িয়ে শচীন। যার লাশ শোয়ানো আছে ছোট ঘরে—সেই শচীন। কিন্তু এখন তার গোটা মুখটা রয়েছে—নেই শুধু চোখ। সে জায়গায় দুটো নিতল গর্ত।
বিকট চেঁচিয়ে উঠেছিল পরি। তারপর আর কিছু মনে নেই।
পরি চোখ মেলে দেখে সে শুয়ে আছে বড় ঘরে। ওকে ঘিরে আছে সবাই।
মাধবী বললে, ‘ভুল, দেখেছিস।’
‘না দিদি, স্পষ্ট দেখেছি।’
‘তোর চিৎকার শুনেই সান্ত্রীরা দৌড়ে গেছিল। কেউ নেই টয়লেটে।’
‘আমি তাকে দেখেছি।’
‘সে এখন ছোট ঘরে।’
‘দেখেছ সেখানে আছে কি না?
মাধবী চাইল সুরেশ সাইকিয়ার দিকে। বেরিয়ে গেলেন তিনি হাতে রিভলভার নিয়ে। ফিরে এলেন। বললেন, ‘শুধু চাদর পড়ে মেঝেতে। শচীনের বডি নেই সোফায়।’
না, সান্ত্রীরা কেউ দেখেনি শচীনকে। দরজা তো বন্ধই রয়েছে। তা ছাড়া মরা মানুষ হেঁটে বেরিয়ে আসতে পারে না। অথচ ঘরে নেই জানলা।
আলো ফুটেছে আকাশে। শিবালয় শহরের চারপাশের পাহাড়ে পাহাড়ে এখন আলোর তরঙ্গ।
ঢাল বেয়ে নামছিল একটা শেয়াল। হঠাৎ থমকে গেল। একটা অপরিচিত গন্ধ পেয়েছে। গন্ধটা ভয়ের।
লোম খাড়া হয়ে গেল তৎক্ষণাৎ। সেই সঙ্গে ল্যাজ। তীরবেগে নেমে গেল ন্যাড়া পাহাড় বেয়ে। সামনে পড়ল ফুট দুয়েক চওড়া একটা গহ্বর। লাফ দিল তার ওপর দিয়ে। কিন্তু অপর পারে পৌঁছোতে পারল না।
বিদ্যুতের চেয়েও ক্ষিপ্রবেগে কী যেন লকলকিয়ে উঠল গর্তের ভেতর থেকে। সাপটে ধরল শূন্যপথের শেয়ালকে। নিমেষে টেনে নিল গর্তের মধ্যে। প্রায় পাঁচফুট গভীর গর্তের তলদেশে রয়েছে একটা সরু ফুটো। শেয়ালের শরীর সেই ফুটোয় ঢোকার কথা নয়। কিন্তু তবুও প্রচণ্ড টানের চোটে গোটা শরীরটা ঢুকে গেল তার মধ্যে, মড়মড় করে ভাঙতে লাগল হাড়।
নিস্তব্ধ চারিদিক।
পালে পালে পাহাড়ি ইঁদুর গুটি গুটি এসে দাঁড়াল গর্তের পাশে। চেয়ে রইল ভেতর দিকে। তারপর, একে একে লাফিয়ে নেমে গেল নিচে। প্রায় একশো ইঁদুর।
বেরিয়ে এল না কেউই।
খবর কিন্তু ছড়িয়ে গেল—
গভর্নমেন্টের হাজারো সতর্কতা সত্ত্বেও টেলিফোনে টেলিফোনে খবর চলে গেল। নানান দৈনিকের অফিসে। টনক নড়ল সংবাদ শিকারী সাংবাদিকদের।
ভোরের আলো ফোটবার পরেই শর্টওয়েভ রেডিয়ো আর ডিজেল-চালিত দুটো ইলেকট্রিক জেনারেটর পৌঁছে গেল শিবালয় টাউনের প্রান্তে। চার মাইল লম্বা সড়কের মাঝামাঝি জায়গায় দু’খানা ভ্যান ফেলে রেখে পালিয়ে এল চালকরা।
যেখানে রোড ব্লক করে আড়াআড়ি দাঁড়িয়ে পুলিশের গাড়ি, সেখানে এসে খবর দিতেই রেডিয়ো মারফত খবর চলে গেল হেডকোয়ার্টারে। হেডকোয়ার্টার থেকে খবর চলে এল সুরেশ সাইকিয়ার কাছে।
রাস্তা থেকে ভ্যান দুটোকে নিয়ে আসা হল হোটেল হেডকোয়ার্টারে। শহরের জীবাণু যাতে বাইরে চলে না যায়, তা বন্ধ করা হল এইভাবে।
চালু হয়ে গেল শর্টওয়েভ রেডিয়ো। এখন টেলিফোন যন্ত্র বিকল হলেও টিকেন্দ্রনগরের সঙ্গে যোগসূত্র বিচ্ছিন্ন হবে না।
এক ঘণ্টার মধ্যেই একটা জেনারেটর চালু হয়ে গেল। শিবালয় সড়কের পশ্চিমে বাতিস্তম্ভগুলোকে এখন এই জেনারেটর জ্বালিয়ে রাখবে। আর একটা জেনারেটরের সঙ্গে তারের সংযোগসাধন ঘটানো হল হোটেলের ঘরে ঘরে। রহস্যজনকভাবে রাতে যদি আলো চলে যায়, দু’এক সেকেন্ডের মধ্যেই জেনারেটর অটোমেটিক্যালি চালু হয়ে যাবে। দু’এক সেকেন্ডের অন্ধকারে অদৃশ্য শত্ৰু নিশ্চয় আর কাউকে ছিনিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না।
সকালবেলাতেই স্নান সেরে নিয়েছিল মাধবী। প্রাতরাশ খেয়ে চারজন সান্ত্রীকে নিয়ে গেছিল নিজের বাড়িতে—ওষুধপত্র আর ডাক্তারি সরঞ্জাম আনতে। হোটেলে এমার্জেন্সি চিকিৎসার জন্যে।
গোটা বাড়ি নিস্তব্ধ। সান্ত্রীরা কাঠ হয়ে ঢুকেছিল একটার পর একটা ঘরে—যেন গিলোটিন উঁচিয়ে রয়েছে প্রতিটা ঘরে ঘরে।
জিনিসপত্র প্যাকেটে বেঁধে নিল মাধবী অফিস ঘরে বসে। টেলিফোন বেজে উঠল ঠিক তখনই। প্রত্যেকের চোখ এমন দূরভাষ যন্ত্রের ওপর।
বেজে বেজে থেমে গেল টেলিফোন। বাজল আবার। এবার রিসিভার তুলল মাধবী। কিন্তু হ্যালো বলল না।
নৈঃশব্দ্য।
প্রতীক্ষায় রইল মাধবী।
এক সেকেন্ড পরেই শোনা গেল দূরাগত গাংচিলের ডাক। মৌমাছিদের গুঞ্জন। বেড়াল বাচ্চাদের সরু গলাবাজি। মানুষের কচি বাচ্চার কান্না। পরমুহূর্তেই আর এক বাচ্চার খিলখিল হাসি। কুকুরের ডাক। র্যাটলস্নেকের কড়মড় মড়মড় বাদ্যি।
গত রাত্রে এইসব আওয়াজই শুনেছেন সুরেশ সাইকিয়া। টেলিফোনে। বিচলিত হয়েছিলেন। কেন হয়েছিলেন, তা এখন বুঝল মাধবী।
পাখি গান গাইছে।
ব্যাং কটর কটর করছে।
বেড়াল ফ্যাঁস ফ্যাঁস আওয়াজ ছাড়ছে।
ফ্যাঁস ফ্যাঁস ডাক গজরানিতে পরিণত হল—পরক্ষণে রাগের হুঙ্কার—হুঙ্কার পালটে ভয়ানক যন্ত্রণার কাতরানিতে।
পরক্ষণেই শোনা গেল শচীনের গলা, ‘ডাক্তার নাকি? আমাকে দেখেই মূর্ছা গেল পরি! ছিঃ ছিঃ!’
দমাস করে রিসিভার নামিয়ে রাখল মাধবী। মুখ তার নিরক্ত। সান্ত্রীরা সাগ্রহে চেয়ে আছে তার দিকে। কিছুই ফাঁস করল না মাধবী। ঘাবড়ে যেতে পারে। এমনিতেই ভয়ে কাঠ হয়ে রয়েছে।
সদলবলে বেরিয়ে এল বাড়ি থেকে। পথে পড়ল একটা ওষুধের দোকান। সেখানে ঢুকে আরও কিছু ওষুধ তাক থেকে নামিয়ে যেই প্যাক করতে যাচ্ছে, আবার বাজল টেলিফোন।
রিসিভার ধরল মাধবী। ভেসে এল শচীনের কণ্ঠস্বর, ‘পালিয়ে কোথায় যাবেন?’
রিসিভার নামিয়ে রাখল মাধবী। এখন ওর হাত কাঁপছে।
দেখল সান্ত্রীরা। কিছু জিজ্ঞেস করল না।
সুরেশ সাইকিয়া বসেছিলেন টেলিফোন নিয়ে। কথা বলছেন টিকেন্দ্রনগর হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে।
বিনয় চৌধুরী নামে একজন ভদ্রলোকের সন্ধান পাওয়া গেছে কলকাতায়। মধ্যবয়স্ক। বইয়ের দোকান আছে। একটা নয়—দুটো। একটায় বেচেন নতুন বই আর একটায় শুধু পুরোনো বই। বেশি লাভ দ্বিতীয় দোকানে। বই পাগল মানুষ। বিয়ে-থা করেননি। শিবালয় শহরে গেছিলেন বেড়াতে। উতঙ্ক চৌধুরী নামে কোনও ভদ্রলোকের নাম ওঁর খাতাপত্তরে পাওয়া যায়নি। অন্যান্য দোকান দশটার পর খুললে আরও খোঁজ নেওয়া যাবে।
‘খোঁজ নিন। নামটা অদ্ভুত। খবর ঠিকই পাবেন।’
টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন সুরেশ সাইকিয়া। মাধবী ফিরল ঠিক তখন। মুখ তার পাণ্ডুরবর্ণ।
সঙ্কুচিত চোখে তা লক্ষ করলেন সুরেশ সাইকিয়া। শুধোলেন, ‘কী হয়েছে?’
টেলিফোন বৃত্তান্ত খুলে বলল মাধবী।
‘শচীনের গলা? অসম্ভব!’ অবাক হয়েছেন সুরেশ।
‘জানি। কিন্তু ওর গলা আমি চিনি।’
‘কেউ ওর গলা নকল করেছে।’
চুপ করে রইল মাধবী। ভুল ওর হয়নি। বৃথা তর্ক করতেও ইচ্ছে হচ্ছে না।
পরি ছুটতে ছুটতে এল ঠিক এই সময়ে, ‘আসুন, আসুন, অদ্ভুত কাণ্ড। দেখে যান… শুনে যান!’
হোটেলের রান্নাঘর। সান্ত্রীরা অস্ত্র বাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিমূঢ়ভাবে। বুঝতে পারছে না কী করবে। কেননা, আওয়াজটা আসছে সিঙ্কের ভেতর থেকে। কচি গলায় ‘আবোল-তাবোল’ বইয়ের ছড়া কাটছে। সিঙ্কের তলা থেকে পাইপ নেমে গিয়ে ঢুকেছে ড্রেনের মধ্যে। ছড়া ভেসে আসছে এই ড্রেনের ভেতর থেকে। ছেলেটা যেন ড্রেনের মধ্যে বহাল তবিয়তে রয়েছে। একটার পর একটা ছড়া কেটে যাচ্ছে। স্তম্ভিত সকলেই। আচমকা স্তব্ধ হল কচিকণ্ঠ।
সুরেশ এগিয়ে গেলেন ড্রেনের দিকে—ঝুঁকে দেখবেন বলে। বাধা দিতে গেছিল মাধবী। তার আগেই…
ফোয়ারার মতন তেড়েফুঁড়ে কাদাজল ছিটকে এল ড্রেনের ভেতর থেকে।
ভিজিয়ে দিল সুরেশ সাইকিয়ার ইউনিফর্ম। দুর্গন্ধে ভরে গেল গোটা ঘর। তেলতেলে কালচে-বাদামি কাদা থেমে থেমে তেড়ে এল পর-পর তিনবার।
তারপর কচিকণ্ঠ একবার শুধু হেসে উঠল। বিদ্রুপহীন নির্মল হাসি। সব চুপ পরক্ষণেই।
১১
শিবালয় শহর ভোরের আলোয় এখন শুচিস্নিগ্ধ। রাতের বিভীষিকার লেশমাত্র নেই আকাশে বাতাসে। আকাশ নির্মেঘ।
সিভিলিয়ান ডিফেন্স ইউনিট এসে গেছে শহরে। টেলিফোনে খবর পেয়ে রান্নাঘরের কাণ্ড দেখে মুহ্যমান সকলেই সে অবস্থা কাটিয়ে উঠেছেন।
কর্নেল ডিসুজার টিম এখনও দেখা যাচ্ছে না। রাস্তা নেমে গেছে নিচের দিকে—সব্বার চোখ সেইদিকে।
একটু পরেই আবির্ভূত হল একটা বড় গাড়ি। হাঁপ-ধরা ইঞ্জিনের আওয়াজ বাড়তে লাগল একটু একটু করে।
রাস্তা বেয়ে যেন গুঁড়ি মেরে উঠে এল মোট তিনটে গাড়ি। সবার আগে রয়েছে ঝকঝকে সাদা মোবাইল হোম। ছত্রিশ ফুট লম্বা বিশাল দানব। দু’পাশে নেই কোনও দরজা বা জানলা। প্রবেশ পথ নিশ্চয় একটাই—যা রয়েছে পেছনে। বিশাল বেঁকানো উইন্ডশিল্ড কালচে রঙের—ভেতরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। দূর থেকেই বোঝা যাচ্ছে, কাচ বেশ পুরু, সাধারণ মোবাইল হোমে যে রকম কাচ থাকে, তার চাইতে মোটা আর মজবুত।
দ্বিতীয় গাড়িটা রয়েছে এর পেছনে। তার পেছনে আসছে একটা ট্রাক—পেছনে টেনে আনছে তিরিশ ফুট লম্বা একটা ট্রেলার। ট্রাকের জানলার কাচও গাঢ় কালচে রঙের—বুলেট-প্রুফ নিশ্চয়।
রাস্তার মাঝে গিয়ে দাঁড়ালেন সুরেশ সাইকিয়া। দু’হাত মাথার উপর তুলে নেড়ে গেলেন—ড্রাইভারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন।
মোবাইল হোম আর ট্রাক নিশ্চয় মালপত্র বোঝাই—এত ভারী যে চড়াই রাস্তা বেয়ে উঠতে হাঁফ ধরে যাচ্ছে শক্তিশালী ইঞ্জিনগুলোর। ইঞ্জিনে কর্কশ শব্দ হচ্ছে। উঠছে এক ইঞ্চি এক ইঞ্চি করে, হোটেলের সামনে এসে গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে আড়াআড়িভাবে রাখল মোড় ঘুরে পাশের রাস্তায়—যাতে গাড়ি গড়িয়ে নেমে না যায়। এখানকার রাস্তা সমতল, ঢালু নয়।
অতি-গরম ইঞ্জিন তিনটে বন্ধ করে দেওয়া হল একে একে।
মাধবীর মনে উল্লাস। বিশেষজ্ঞরা এসে গেছে, আর ভয় কী।
ট্রাকের পেছনের দরজা খুলে গেল প্রথমে। লাফিয়ে নেমে এল কয়েকজন পুরুষ। প্রত্যেকের পরনে এয়ারটাইট ভিনাইল স্যুট। মাথায় মস্ত হেলমেট—বড় সাইজের প্লেক্সিগ্লাস ফেসপ্লেট রয়েছে সামনে। নিজস্ব এয়ার সাপ্লাই ট্যাঙ্ক রয়েছে প্রত্যেকের পিঠে। আবর্জনা পরিশোধনের ব্রীফকেস সাইজের বাক্সও রয়েছে পিঠে।
ঠিক যেন মহাকাশচারীরা নামছে ট্রাক থেকে। ছ’জন চটপটে পুরুষ নামল পর পর। নামছে আরও। প্রত্যেকেই বিলক্ষণ সশস্ত্র। লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল ক্যারাভানের দু’পাশে, গাড়িগুলোর দিকে পিঠ ফিরিয়ে। বিজ্ঞানী নয় এরা। সৈন্যবাহিনী। হেলমেটের ওপর লেখা প্রত্যেকের নাম—ফেসপ্লেটের ঠিক ওপরে। অস্ত্র উঁচিয়ে রয়েছে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর দিকে।
এগিয়ে গেলেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘এটা কী হচ্ছে?’
ওঁর সামনেই দাঁড়িয়েছিল যে সার্জেন্ট, তার অস্ত্র তৎক্ষণাৎ টার্গেট করল আকাশকে। নিক্ষিপ্ত হল একটা বুলেট। আওয়াজে কেঁপে উঠল শিবালয় শহর।
থমকে গেলেন সুরেশ সাইকিয়া। তার পাশের প্রহরীদের হাত চলে গেল কোমরের
অস্ত্রের দিকে।
গুলিবর্ষণ শুরু হওয়ার আগেই গলার শির তুলে চেঁচিয়ে উঠলেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘নো শুটিং!’
এগিয়ে এল একজন সোলজার। এর বুকে লাগানো একটা ছোট্ট রেডিয়ো অ্যামপ্লিফায়ার—লম্বায়-চওড়ায় ছ’ইঞ্চি। পিঁক পিঁক কণ্ঠস্বর বেরিয়ে এল অ্যামপ্লিফায়ার থেকে, ‘দয়া করে গাড়ির কাছ থেকে সরে দাঁড়ান। ল্যাবরেটরির ক্ষতি যাতে না হয় আমাদের তা দেখতে হবে। যে আসবে, সে মরবে, সে যেই হোক।’
‘আরে, আমিই তো ডেকে আনলাম তোমাদের।’
‘পিছিয়ে যান,’ সোলজারের জবাব একটাই।
এই সময়ে খুলে গেল প্রথম মোবাইল হোমের পেছনের দরজা। এয়ারটাইট পরিচ্ছদ পরে বেরিয়ে এল চার ব্যক্তি। কিন্তু তারা সোলজার নয়। এগিয়ে এল মন্থর চরণে। নিরস্ত্র প্রত্যেকেই। এদের একজন মহিলা। মাথার হেলমেটে লেখা নাম অপরাজিতা সোম।
দ্বিতীয় মোবাইল হোম থেকে নেমে দাঁড়াল ছ’জন পুরুষ।
মোট দশজন। লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল সোলজারদের পেছনে। নিজেদের মধ্যে কথা বলে নিল ইন্টার স্যুট রেডিয়ো মারফত। প্লেক্সিগ্লাসের পেছনে তাদের ঠোঁট নড়ছে দেখা যাচ্ছে—কিন্তু কথা ভেসে আসছে না বাইরে। বুকের বাক্স নীরব। তার মানে, প্রাইভেট আলোচনা করতে পারে ইচ্ছে করলে, তখন পাবলিক শুনতে পাবে না তাদের কথা।
এই মুহূর্তে ওরা চাইছে ওদের কথা যেন কেউ শুনতে না পায়। কিন্তু কেন? অবাক হয় মাধবী। এত লুকোছাপার কী আছে?
কর্নেল ডিসুজা এগিয়ে এলেন ঠিক এই সময়ে। দশজনের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে লম্বা।
খেঁকিয়ে উঠলেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘আগে জানতে চাই গান পয়েন্টে কেন রাখা হয়েছে আমাদের।’
‘সরি,’ নিরুত্তাপ স্বরে বললেন কর্নেল ডিসুজা। ঘুরে দাঁড়ালেন সোলজারদের দিকে, ‘রেস্ট।’
নিমেষে সাবমেশিন কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে গেল সৈনিক পুরুষরা।
বললেন কর্নেল ডিসুজা, ‘মিঃ সাইকিয়া, অযথা রাগ করবেন না। আমরা রিসার্চ টিম। মড়কের কারণ অনুসন্ধান করতে এসেছি, চিকিৎসার সরঞ্জাম নিয়ে আসিনি। ছোঁয়াচে রোগ নিয়ে কেউ যদি আমাদের মধ্যে সংক্রমণ শুরু করে দেয়, এত আয়োজন মাঠে মারা যাবে। তাই এত হুঁশিয়ারি।’
‘প্লেগের ভাইরাস পাছে আপনাদের মধ্যে চালান করে দিই, তাই তো এত ভয়?’ এই প্রথম কথা বলল মাধবী।
বললেন কর্নেল ডিসুজা, ‘আপনিই ডক্টর মাধবী লাহা? হ্যাঁ, ভয় সেইখানেই। ভাইরাসের প্রতিষেধক বের করার আগে নিজেরাই যদি সংক্রামিত হই তাহলে যে গোট দেশটা ছারখার হয়ে যাবে। সময় নষ্ট করবেন না। কাল রাতে যা-যা বলেছেন, আগে সব দেখান। তারপর শুরু করব ময়না-তদন্ত। ডক্টর লাহা, শুধু আপনি চলুন মিঃ সাইকিয়ার সঙ্গে। ডেডবডি আগে দেখেছিলেন আপনি। এতক্ষণে যদি কিছু পালটে গিয়ে থাকে, ধরতে পারবেন আপনি। চলুন।’
আহার্য নিবাস। রান্নাঘরে তিলধারণের স্থান নেই। অস্বস্তির-মধ্যে রয়েছেন সুরেশ সাইকিয়া। অদৃশ্য শত্রুর আক্রমণ আচমকা আরম্ভ হয়ে গেলে বেরোতে পারবেন তো?
দুটো উনুনের মধ্যে বসানো মুণ্ডু দুটোকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে—রয়েছে ঠিক আগের অবস্থায়। কাউন্টারের ওপর কাটা হাত দুটো ধরে রয়েছে বেলুনটা।
কর্নেল ডিসুজার ফটোগ্রাফার শাটার টিপে যাচ্ছে ক্যামেরায়। নানান দিক থেকে তুলে রাখছে অবিশ্বাস্য দৃশ্যের ছবি। তারপর ডজনখানেক ছবি তুলল খুব কাছ থেকে। ফটোগ্রাফিক রেকর্ড শেষ হলেই শুরু হবে ফোরেন্সিক কাজকর্ম।
কর্নেল ডিসুজা বলে উঠলেন, ‘মুজিব, তুমি তো নার্ভ গ্যাস স্পেশালিস্ট। দেখে কী মনে হচ্ছে?’
যাঁকে বললেন, তাঁর হেলমেটে লেখা রয়েছে পুরো নাম, মুজিব রহমান।
তিনি বললেন, ‘জবাবটা এত তাড়াতাড়ি দেওয়া যাবে না। তবে বিষ গ্যাস প্রয়োগ করা হয়েছে বলেই মনে হয়। যে কোনও নার্ভ গ্যাস চামড়ার সংস্পর্শে এলেই তিরিশ সেকেন্ড থেকে পাঁচ মিনিটের মধ্যে খতম করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।’
‘কীভাবে?’ প্রশ্নটা করলেন সুরেশ সাইকিয়া।
‘চামড়ার মধ্যে দিয়ে ঢুকে মিশে যায় রক্তস্রোতে—দশ সেকেন্ডের মধ্যেই। চলে যায় ব্রেনে। সঙ্গে সঙ্গে জখম করে ব্রেনের টিস্যু। আর তার মেরামত হয় না। পাঁচ-ছ’ঘণ্টা হাত-পা নাড়ার পুরো ক্ষমতা থাকে, গায়ে শক্তিও থাকে। কিন্তু ভোগে মন।’
‘ডিমেনসিয়া প্যারানয়েড,’ বললেন কর্নেল ডিসুজা, ‘বুদ্ধিশুদ্ধি গোলমাল হতে থাকে, আতঙ্ক আর ক্রোধ জাগে, ভাবাবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখবার ক্ষমতা লোপ পায়। মনে হয়, প্রত্যেকেই বুঝি ষড়যন্ত্র করছে। খুনখারাপির ইচ্ছেটা তখন মাথাচাড়া দেয়। মন বলে কোনও বস্তু আর থাকে না, খুনের মেশিন হয়ে যায়। এই অবস্থা থাকে চার থেকে ছ’ঘণ্টা পর্যন্ত। বিষ-আক্রান্ত ব্যক্তিরাই খুন করতে থাকে পরস্পরকে—যারা আক্রান্ত হয়নি, তাদেরও ছেড়ে দেয় না।’
‘মিউটেশনগ্রস্ত জলাতঙ্ক-ও তো হতে পারে,’ বললে মাধবী।
‘নার্ভ গ্যাস সে জিনিস নয়,’ জবাবটা দিলেন মুজিব। ‘গ্যাস একবার ছড়িয়ে উড়ে গেলে, আর ভয় নেই। শরীরের যা ক্ষতি করে যায়, তা কল্পনা করাও কঠিন।’
‘গ্যাস-ই যদি হয়, অনেক আগেই ছড়িয়ে উবে গেছে,’ বললেন ডিসুজা, ‘তবে সব কিছুর ওপরেই তার লেশ নিশ্চয় আছে। সেটাই পরীক্ষা করে দেখতে হবে।’
জিজ্ঞেস করলেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘খুনখারাপির ইচ্ছেটা থাকে চার থেকে ছ’ঘণ্টা পর্যন্ত। তারপর কী হয়?’
‘তারপরের অবস্থাটা চলে ছয় থেকে বারো ঘণ্টা পর্যন্ত,’ বললেন কর্নেল ডিসুজা, ‘নার্ভের দফারফা হতে শুরু করে। প্যারালিসিস ছড়িয়ে পড়ে ব্রেনের বিশেষ সেন্টারেও।’
‘খুলে বলুন।’
‘শরীরের অটোমেটিক ফাংশানগুলোর ওপর ব্রেনের নিয়ন্ত্রণ একটু একটু করে কমে যেতে থাকে। নিঃশ্বাস আটকে যায়, হার্ট চলতে চায় না, রক্তপ্রবাহ ব্যাহত হয়, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বেচাল হয়ে যায়। ছয় ঘণ্টা থেকে বারো ঘণ্টা নারকীয় যন্ত্রণার মধ্যে থাকে আক্রান্ত ব্যক্তি—’
‘হার্ট বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত চলে এই যন্ত্রণা?’
‘হ্যাঁ। বমি আর পায়খানাও লেগে থাকে।’
মাধবী বলে উঠল, ‘কিন্তু আমি যাদের মরতে দেখেছি, তাদের কেউ বমি বা পায়খানা করে মরেনি।’
‘বিশেষ জাতের নার্ভ গ্যাস বলেই নিশ্চয় তা হয়নি,’ জবাব দিলেন কর্নেল ডিসুজা।
‘তাহলে শচীনের অমন অবস্থা হল কেন?’
‘মথ-এর গল্প বলছেন?’ ডিসুজার স্বর একটু বেঁকা।
‘আগে সব দেখুন, তারপর মন্তব্য করবেন,’ মাধবীর স্বর এখন কঠিন। ‘তাহলে কাজ শুরু করা যাক,’ বলেই ইশারা করলেন ডিসুজা।
কাটা মুণ্ডু দুটোকে ঢুকিয়ে দেওয়া হল পোর্সিলেন বালতিতে—এয়ারটাইট ডালায় পড়ল তালা। কাটা হাত দুটোকে রাখা হল আর একটা বালতিতে। একটু ময়দা চেঁছে ঢোকানো হলে ছোট্ট প্লাস্টিক শিশিতে। নার্ভ গ্যাস নিশ্চয় লেগে আছে শুকনো ময়দায়। ভ্যাকুম ক্লিনার দিয়ে উনুন দুটোর ভেতরের সবকিছু টেনে নিয়ে ঢোকানো হল দুটো প্লাস্টিক ব্যাগে।
আগাগোড়া একটা টেপরেকর্ডার চলতে লাগল কর্নেল ডিসুজার বেল্টে। বৈজ্ঞানিকরা কাজ করছে—যা করছে, তা মুখে মুখে বলে যাচ্ছে। সব টেপ রেকর্ডারে উঠে যাচ্ছে। দৈবাৎ যদি এই দল খতম হয়ে যায়, পরবর্তী দল যেন জানতে পারে আগের ঘটনা।
এরপর যাওয়া হল রোগাটে ধরনের সেই বাড়িটায় যার একতলায় রয়েছে ছবি আর গিফটের দোকান।
রান্নাঘরে রয়েছে সেই মৃতদেহটা। ফ্রিজ খুলে রেখে হেলে রয়েছে ফ্রিজের গায়ে। ফুলে ঢোল শরীর। প্যাটপেটে শূন্য চাহনি।
ডিসুজা হুকুম দিলেন, ময়না তদন্ত করার জন্যে এই লাশ নিয়ে যাওয়া হোক।
বিড়বিড় করে বললেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘যে তদন্তই করুন না কেন, নার্ভ গ্যাসের সন্ধান পাবেন না। কোনও নার্ভ গ্যাসই শরীর ফুলিয়ে এরকম অবস্থা করে না।’
‘অ্যালার্জির জন্যেও হতে পারে। নার্ভ গ্যাসের অ্যালার্জি,’ কর্নেল ডিসুজা অম্লানবদনে এই কথা বলে ঢুকে গেলেন পাশের ঘরে, যে-ঘরে খাটে শুয়ে পয়েন্ট টু-টু অটোমেটিকে গুলিবর্ষণ করে গেছে পঁচিশ বছরের যুবক। আটটা গুলি লাগিয়েছে আততায়ীর গায়ে, অথচ রক্তপাত ঘটেনি।
বললেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘নার্ভ গ্যাস লক্ষ করে নিশ্চয় গুলিবর্ষণ করে যায়নি?’
‘গ্যাস নিশ্চয় ব্রেন বিগড়ে দিয়েছিল—দৃষ্টিবিভ্রম ঘটেছিল, ছায়াশরীর দেখেছে বিকল ব্রেনের কারসাজিতে। গুলি চালিয়েছে এলোপাতাড়ি।’
‘তাহলে আটটা কার্তুজ গেল কোথায়? ছায়াশরীরের গায়ে?’
‘আটখানা গুলি হজম করে হেঁটে বেরিয়ে যেতে পারে যে, সে কে কর্নেল ডিসুজা?’ মাধবীর স্বর এখনও কঠিন।
নিরুত্তর রইলেন কর্নেল। তাঁর সঙ্গীদের চোখে আতঙ্ক জাগছে একটু একটু করে। যুবকের মুখভাব অতিশয় বিকট—মরে গিয়েও ত্রাস বিকিরণ করে যাচ্ছে।
ফুলে ওঠা বডি দুটোকে প্লাস্টিক ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে গিয়ে সুরেশ সাইকিয়ার মুখে সব শুনলেন কর্নেল ডিসুজা।
বললেন, ‘আপনারা প্রত্যেকেই হ্যালিউসিনেশনে ভুগছেন। আগে আপনাদের পরীক্ষা করা দরকার।’
‘এতগুলো মানুষ কি একই সঙ্গে একই হ্যালিউসিনেশন দেখছে?’ মাধবী বললে কড়া গলায়।
‘ডাক্তার, মাস হলিউসিনেশন নতুন ব্যাপার কি?’
‘কয়েক সেকেন্ডে অন্ধকারে মধ্যে রমেশ থাপা অদৃশ্য হয়ে গেল কী করে?’ সুরেশ সাইকিয়ার প্রশ্ন।
‘পালিয়েছে। শহর ছেড়ে পালিয়েছে,’ কর্নেলের জবাব।
‘শচীনের অবস্থা অমন হল কেন? ডেডবডি উধাও হয়ে গেল কীভাবে?’ ‘মাস হ্যালিউসিনেশন।’
ঠিক এই সময়ে ঠক ঠক আওয়াজ শোনা গেল মাংস রাখার লকারের (কোল্ড স্টোরেজের) মধ্যে। ভেতরে থেকে কে যেন হাতুড়ি ঠুকে চলছে। সেই সঙ্গে শোনা গেল রমেশ থাপার কাতরানি, ‘উঃ! আর যে পারছি না! কী ঠান্ডা! কী ঠান্ডা! খুলুন—পাল্লাটা খুলুন।’
থ হয়ে গেলেন সুরেশ সাইকিয়া। চোখের পাতা পড়ল না মাধবীর। কটমট করে চেয়ে রইলেন কর্নেল ডিসুজা।
বললেন, ‘ভেতরে কে?’
জবাবটা এল লকারের ভেতর থেকেই, ‘আমি… রমেশ থাপা।’
‘ভেতরে ঢোকা হল কী করে?’
‘আমিই লুকিয়ে পড়েছিলাম, আর বেরোতে পারছি না।’
‘ঠান্ডায় তো এতক্ষণে মরে যাওয়া উচিত ছিল।’
‘বরফ জমানোর ঠান্ডা তো নেই… উ… হু হু… খুলুন-না পাল্লাটা।’
চোখের ইঙ্গিত করলেন কর্নেল। এগিয়ে গেল দু’জন হেলমেট পরা সান্ত্রী। রুখে দাঁড়ালেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘খুলবেন না।’
‘জ্যান্ত একটা লোককে মেরে ফেলতে চান?’ কর্নেল এখন প্রকৃতই মিলিটারি রুক্ষতা দেখাচ্ছেন।
‘কেউ নেই লকারে। গত রাতে আমি নিজে খুলে চেক আপ করেছি।’
‘তাহলে রমেশ থাপা ভেতরে গেল কী করে?’
‘ওটা রমেশ থাপা নয়।’
‘ননসেন্স। খোলো পাল্লা!’
একজন সান্ত্রী সাবমেশিন গান উচিয়ে দাঁড়ালো পাল্লার এক পাশে, আর একজন এক হাতে অস্ত্র বাগিয়ে আর এক হাত রাখল পাল্লার হ্যান্ডেলে।
আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলেন না সুরেশ সাইকিয়া। চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘প্লীজ! প্লীজ! পাল্লা খুলবেন না।’
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই কিন্তু পাল্লার হ্যান্ডেল আপনা থেকেই নেমে গেল নিচের দিকে। অথচ সান্ত্রীর হাতের চাপ তখনও পড়েনি হ্যান্ডেলে। নিমেষে খুলে গেল পাল্লা। লকলকে কালো বিদ্যুৎশিখার মতন কী যেন ফাঁক দিয়ে ঠিকরে এসে পাকসাট দিল সান্ত্রীকে। পলক ফেলার আগেই তাকে এক হ্যাঁচকা টানে সাবমেশিন গান সমেত টেনে নিয়ে গেল ভেতরে। দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল পাল্লা।
প্রকৃতই হতভম্ভ হয়ে গেলেন কর্নেল ডিসুজা এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গরা। লকারের ভেতর থেকে ভেসে এল দুমদাম শব্দ। যেন ঠিকরে ঠিকরে গিয়ে লকারের গায়ে আছড়ে আছড়ে পড়ছে সান্ত্রীর দেহ। ভেতরটা তো অনেক বড়। আট ফুট বাই ন’ফুট। গুলিবর্ষণও চলছে অবিরাম। তারপর সব চুপ।
ঢোক গিললেন কর্নেল ডিসুজা। বিমূঢ় চোখে তাকালেন সুরেশ সাইকিয়ার দিকে। ভাবখানা, ‘এখন কী করব?’
জবাব দিলেন সুরেশ শুষ্ককণ্ঠে, ‘সব ক’টা সাবমেশিনগান তাক করুন, তারপর পাল্লা খুলুন। সাবধান, এরপর কী ঘটতে পারে, আমার জানা নেই।’
ফের ঢোক গিললেন কর্নেল। কাজ হল অবশ্য সুরেশ সাইকিয়ার নির্দেশ মতোই। খোলা হল পাল্লা। ভেতরে জ্বলছে আলো। ছাদ থেকে ঝুলছে সান্ত্রীর দেহ—মাংস গেঁথে রাখার আঁকশি দিয়ে গাঁথা হয়েছে তার দেহ।
কিন্তু ঝুলছে শুধু তার কঙ্কাল। কঙ্কাল পরে আছে হেলমেট আর বিচিত্র পোশাক। এমনকী পায়ের মজবুত বিশেষ বুটজুতোও।
লকারের মেঝেতে পড়ে নেই একফোঁটা রক্ত! খালি কার্তুজের কিছু খোল গড়াগড়ি যাচ্ছে মেঝেতে। সীসের বুলেট কিন্তু পড়ে নেই কোথাও। যার দিকে ছোঁড়া হয়েছে গুলি, যেন তার গায়ে লেগেছে এবং স্রেফ হজম করেছে।
চকচকে খোলগুলোর দিকে তাকিয়ে বললেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘ক’টা গুলি ছিল অতবড় ম্যাগাজিনে? দু’শো?’
চোখ বড় বড় করে খালি খোলগুলোর দিকে চেয়ে রইলেন কর্নেল ডিসুজা। কথা বললেন না।
বললেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘খামোকা সময় নষ্ট করছেন। এটা নার্ভ গ্যাসের কেস নয়। আপনাকে সেই শিক্ষা দেওয়ার জন্যে আপনারই লোককে খতম করা হল তিল তিল করে। তাকে নিমেষে শেষ করে দিতে পারত, ভ্যানিশ করেও দিতে পারত। কিন্তু চোখে না দেখলে আর কানে না শুনলে তো আপনার বিশ্বাস হবে না। তাই গুলি ছোঁড়ার সুযোগ তাকে দেওয়া হয়েছে, গুলিবর্ষণের শব্দও আপনাকে শোনানো হয়েছে। তারপরেই দেহ চাঁছাপোছা হয়ে গেল কী করে? কোন ম্যাজিকে? সীসের গুলিগুলো গেল কার গায়ে? কর্নেল ডিসুজা, নার্ভ গ্যাস নয়, অপদেবতাও নয়, আরও ভয়ংকর অশ্রুতপূর্ব কিছুর রাজত্ব শুরু হয়েছে শিবালয় শহরে। তাদের হাতে আমরা খেলনার পুতুল ছাড়া আর কিছু নই।’
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কর্নেল বললেন, ‘কিন্তু রমেশ থাপার গলা তো আপনি চিনতে পেরেছিলেন?’
‘গলা নকল করা হয়েছে, যেমন টেলিফোনে শচীনের গলা শুনেছেন ডক্টর লাহা। জন্তু-জানোয়ারদের গলাবাজিও পুরো নকল।’
‘তাহলে তো বলব অতিপ্রাকৃত ব্যাপার।’
‘আমি বলব ঠিক উলটো, একেবারে প্রাকৃতিক বাস্তব ঘটনা।’
‘তাহলে বলুন সেটা কী?’
‘জানলে তো বলব?’ তেতো হয়ে গেল সুরেশ সাইকিয়ার গলা। ‘জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ল্যাবরেটরি থেকে হয়তো কোনও ন্যাচারাল মিউটেশন বেরিয়ে পড়েছে। কিছু জানোয়ারের ডিএনএ থেকে এমন দানব বানিয়েছে যারা ভূতের মতন অদৃশ্য থেকে গোটা আর্মি নিকেশ করে দিতে পারে—বাতাসে মিলিয়ে দিতেও পারে। টারানটুলা আর কুমির, ভিমরুল আর বাঘ—এদের ডিএনএ স্ট্রাকচার মিলিয়ে মিশিয়ে একটা কল্পনাতীত সত্তা বানিয়ে তার মধ্যে মানুষের বুদ্ধি হয়তো ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। কী ভাবছেন, আমি পাগল হয়ে গেছি? ডক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের আধুনিক সংস্করণ দেখছেন মনে হচ্ছে? ডিএনএ রিসার্চ কদ্দূর গড়িয়েছে, সে খবর আপনিও তো রাখেন কর্নেল। এক কথায় তাই বলব, এমন এক অজানা শক্তির সঙ্গে মহড়া দিতে নেমেছি, যে শক্তি আমাদের যাবতীয় দুঃস্বপ্নকে ধূলিসাৎ করে দিতে পারে।’
ঢোক গিলে বললেন কর্নেল ডিসুজা, ‘প্রথমে ডেডবডিটার ময়না তদন্ত তো করা যাক—’
‘ঝটপট করুন,’ বললে মাধবী, ‘সময় ফুরিয়ে আসছে।’
লকারের মধ্যে যে ব্যক্তি নিমেষে কঙ্কালে পরিণত হল, তার নাম সার্জেন্ট জোশী।
এখন যাকে ম্যানহোল দিয়ে রাস্তার তলার পাইপে নামানো হল, তার নাম করপোরাল রহমান। লোহার মই নেমে গেছে নিচ পর্যন্ত। পাইপ কিন্তু শুকনো, জল যায় না এখান দিয়ে, জলের ড্রেন-পাইপ আলাদা।
এ পাইপ দিয়ে গেছে ইলেকট্রিকের গোছা গোছা তার। আধুনিক শহর। টেলিফোন, ল্যাম্পপোস্ট অথবা বাড়ির ইলেকট্রিক সাপ্লাইয়ের তার শূন্যে ঝোলে না—সবই রাস্তার তলা দিয়ে, এই পাইপের মধ্যে দিয়ে।
শুকনো খটখটে পাইপে মাথা সিধে করে দাঁড়ানো যায় না, কর্পোরাল রহমানকেও দাঁড়াতে হল সেইভাবে। মাথার মধ্যে ঘুরছে কিন্তু সেই দুশ্চিন্তা। সার্জেন্ট জোশী অত গুলি চালিয়েও আচমকা কঙ্কাল হয়ে গেল কী করে?
কংক্রিট মেঝেতে দাঁড়িয়ে টর্চ জ্বেলে চারিদিক দেখে নিল রহমান। একটু ভিজে ভিজে ভাব। দেওয়ালে ছাতা ধরেছে। তারের গোছা পাতা রয়েছে পলিথিন পাইপের মধ্যে দিয়ে।
সিঁড়ির তলা থেকে সরে এল রহমান। সিঁড়ি বেয়ে এখন নামছে আব্দুল করিম। কর্নেল ডিসুজার আর এক ডাকাবুকো স্যাঙাৎ। কংক্রিট মেঝেতে পা দিতেই রহমান টর্চের আলোয় তাকে দেখিয়ে দিল ভয়ের কিছু নেই পাতাল-সুড়ঙ্গে।
বুক কাঁপছে কিন্তু আবদুলেরও। সার্জেন্ট জোশীর কঙ্কাল কলেবর সে-ও দেখেছে।
ইলেকট্রিক কেবল নেমে এল ওপর থেকে। এই কেবল টেনে নিয়ে গিয়ে নামিয়ে দিতে হবে ইলেকট্রিক জাংশন বক্সে—যা রয়েছে একটু দূরে শিবালয় সড়কের তলার টানেলের ক্রশিংয়ে।
দু’পাশে টর্চ ফেলতে ফেলতে এগোচ্ছে দুই জওয়ান। কিম্ভূত পোশাক তাদের চলায় মন্থরতা এনে দিচ্ছে। টর্চের ফোকাস যতদূর যায়—ভয় পাওয়ার মতন কিছুই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না।
এসে গেছে ইলেকট্রিক জাংশন বক্স। শিবালয় সড়কের নিচের সুড়ঙ্গ কিন্তু সমান্তরাল নয়। নিচের দিক থেকে উঠে গেছে ওপর দিকে। যেন নরক থেকে
উঠছে স্বর্গে।
খসখস… খসখস… খড়মড় খড়মড় আওয়াজটা শোনা গেল ঠিক তখনই। গুরুভার ডেকন স্যুট পরে শব্দের দিকে তাকিয়ে এবং টর্চ মেরেই থ হয়ে গেল দুজনেই!
পালে পালে জন্তু উল্কাবেগে ধেয়ে আসছে শিবালয় সড়কের পাতালের দিক থেকে! খসখস খড়মড় আওয়াজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তাদের ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ের দরুন ঘনঘন শ্বাস-প্রশ্বাসের আওয়াজ। এ ছাড়া আর কোনও আওয়াজ নেই। কারও কণ্ঠ চিরে ঠিকরে আসছে না পাশবিক গজরানি।
তারা ধেয়ে আসছে নক্ষত্ৰবেগে ক্রশিংয়ের দিকে। প্রত্যেকেই সোজা চেয়ে রয়েছে সামনে… টানেল যেখানে ওপর দিকে উঠে গেছে সেইদিকে। কারোরই চাহনি নিবদ্ধ নয় দুই আগন্তুকের ওপর।
ওরা সরে এল পেছনের টানেলে—যে টানেল দিয়ে এসেছে সেইখানে।
নিমেষে ক্রশিং পেরিয়ে গেল ধাবমান পশুবাহিনী। শ’য়ে শ’য়ে পশু। ধেয়ে আসছে স্রোতের আকারে, রকমারি কুকুর বেড়াল—কিন্তু ঘেউ ঘেউ অথবা মিউ মিউ করছে না। আসছে কাঠবেড়ালি, খরগোশ। শিয়াল আর বেজি। ইঁদুর আর ছুঁচো। নেকড়ে আর বুনো বেড়াল।
রেডিয়োতে খবরটা দিয়ে দিল রহমান কর্নেল ডিসুজাকে। বললে, ‘পশুনদী দেখছি যেন, কিন্তু তেড়ে আসছে না। পাগলের মতন ছুটছে টানেলের ওপর দিকে।’
বলা শেষ হতে না হতেই এসে গেল সাপ। হাজারে হাজারে সাপ। জন্তুদের পাশে পাশে ধেয়ে আসছে। লম্বা কালো সাপ থেকে খুদে সবজেটে সাপ—সর্প বাহিনীর সব প্রজাতি হাজির এই প্রতিযোগিতায়।
কোনও সাপই দেখছে না দুই আগন্তুককে। তাদের শীতল চাহনি নিবদ্ধ সামনের দিকে—সুড়ঙ্গ যেদিকে একটু একটু করে উঠে গেছে ওপর দিকে—সেইদিকে।
রক্ত-জল করা হুঙ্কারটা আচম্বিতে ভেসে এল সেইদিক থেকেই।
মানুষের আর্তনাদ তাকে বলা যায় না, পাশবিক গজরানিও নয়। অথচ তা নিঃসৃত হচ্ছে সজীব কোনও কণ্ঠ চিরে। রক্ত হিম হয়ে যাচ্ছে সেই চিৎকারে। অথচ তার মধ্যে নেই আতঙ্ক অথবা যন্ত্রণা। ক্রোধ, ঘৃণা আর রক্ততৃষ্ণা ফেটে পড়ছে অমানবিক, অপাশবিক সেই বিকট নিনাদের মধ্যে।
লোম-খাড়া করা সেই চিৎকারের উৎস কাছাকাছি কোথাও নয়। অনেক দূর থেকে—পাহাড়ের ওপর দিক থেকে কল্পনাতীত সেই চিৎকার অন্তরের সমস্ত বিদ্বেষ, বিতৃষ্ণা, আক্রোশ উজাড় করে দিচ্ছে—এক-একটা ভয়াল হুঙ্কারের মধ্যে দিয়ে। সে কিন্তু থেমে নেই এক জায়গায়। বিপুল বেগে ধেয়ে আসছে এই দিকেই। তাই মুহুর্মুহু সুড়ঙ্গ প্রকম্পিত হচ্ছে, উচ্চ থেকে উচ্চতর মাত্রায়। দ্রুত, অতিদ্রুত লোমহর্ষক নিনাদের স্রষ্টা নিকটবর্তী হয়েই চলেছে। কানের মধ্যে দিয়ে যেন গোছ গোছ শলাকা ব্রেনের মধ্যে গেঁথে গেঁথে যাচ্ছে—অসাড় করে তুলছে মস্তিষ্ককে। একটু পরেই শোনা গেল গুরুভার শরীরের পদধ্বনি। ধুপধাপ আওয়াজে কাঁপছে সুড়ঙ্গ। অথচ মন্থর সে নয় মোটেই, বিপুলাকার কলেবরকে উড়িয়ে নিয়ে আসছে বিদ্যুৎসম গতিবেগে।
রহমান আর আবদুলের দুজনেরই মনে হল, স্বয়ং শয়তানও বুঝি এমন অপার্থিব হুক্কার সৃষ্টি করতে পারবে না সমগ্র শয়তানি বিদ্বেষ উজাড় করে দিয়েও। সুতরাং আর দেরি করা যায় না।
রহমান আগে ছুটল লোহার সিঁড়ির দিকে। জবরজং পোশাক নিয়ে লম্বা লাফ তো দেওয়া যাচ্ছে না। পেছনে আগুয়ান পাতাল-কাঁপানো পদধ্বনি আর কণ্ঠনিঃসৃত হুঙ্কার শুনতে শুনতে মইয়ের সামনে পৌঁছেই আগে উঠে গেল নিজে। পেছনে খানিকটা উঠেই পা পিছলে পড়ে যাচ্ছিল আবদুল, হাত বাড়িয়ে তার হাত খামচে ধরল রহমান। কিন্তু ধরে রাখতে পারল না…
হ্যাঁচকা টানে আবদুল করিম ছিটকে গেল মই থেকে টানেলের অন্ধকারে। অন্ধকারের আতঙ্ক তার নাগাল ধরে ফেলেছে…
১২
রেডিয়ো মারফত আবদুল কিন্তু জানিয়ে গেছিল কার খপ্পরে সে পড়েছে।
খোলা ম্যানহোল থেকে যেটুকু আলো আসছিল, সেই আলোতে বিকট বিভীষিকাকে দেখা গেছিল পলকের জন্যে। তারপরেই নিবিড় তিমিরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গিয়ে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করা হয়েছিল তার পোশাক—উরু আর পেটে কামড় বসানো হয়েছিল সবার আগে।
কিন্তু তার যে বর্ণনা মরতে মরতে দিয়ে গেছিল আবদুল করিম, তা যে বিশ্বাসের একদম বাইরে।
তার চেহারার অতি সামান্যই দেখেছিল আবদুল। গিরগিটির মতন অথচ গিরগিটি নয়, অতিকায় পোকা-ও নয়। অর্থাৎ পোকার আদল আছে কিম্ভূত অবয়বে, পলকের জন্যে চোখে পড়েছিল ক্ষুরের মতন ধারালো দু’সারি বল্লম সাজানো তার পিঠে। দেখেছিল বিরাট থাবা, নখগুলো তীক্ষাগ্র আঁকশির মতন। চোখ তার ধোঁয়াটে লালচে, লম্বাটে কণীনিকা কবরের মতন নিশ্চল নিথর। গায়ে তার চামড়া নেই, আছে আঁশ। মাথায় একজোড়া শিং ঠেলে উঠছে নরকাগ্নি ঠাসা চোখ জোড়ার ঠিক ওপর থেকে। বাঁকানো শিং—ভোজালি বললেই চলে। চোয়াল কুমিরের চোয়ালের মতন। চেরা জিব লকলকিয়ে পিছলে যাচ্ছে সারিবদ্ধ ছোরার মতন দংষ্ট্রার ওপর দিয়ে।
সুড়ঙ্গের অন্ধকারে আবদুলকে টেনে নিয়ে গিয়ে যখন উন্মাদের মতন অর্থহীন অট্টহাসি হাসছে তিমিরাবৃত সেই বিভীষিকা আর টুকরো টুকরো করছে আবদুলের পোশাক, তখনও কর্তব্য করে গেছিল মানুষটা। যথাযথ বর্ণনা দিয়ে গেছিল আকুল কণ্ঠে। তারপর আর বার্তা ভেসে আসেনি রেডিয়ো মারফত। সব শেষ হয়ে গেছিল।
ম্যানহোলের ঢাকনা টেনে এনে বন্ধ করে দিয়েছিলেন কর্নেল ডিসুজা নিজে। তখন তিনি ঘামছেন।
ইতিমধ্যে বিরামবিহীন পরীক্ষানিরীক্ষা চলছিল মোবাইল ফিল্ড ল্যাবরেটরি দুটোয়। সব নমুনা টেস্ট করা হয়েছে। সন্দেহজনক কিসসু পাওয়া যায়নি। এমনকী যে-জল থই থই করছিল মেঝেতে, উজাগর সিং যার নমুনা এনেছিলেন শিশিতে সেই জলও আলট্রা-পিওর! আশ্চর্য ব্যাপার! গ্যালন গ্যালন আলট্রা-পিওর জল কে ঢেলে দিয়ে গেল শিবালয় শহরে?
শব ব্যবচ্ছেদও শেষ হয়েছে। নার্ভ গ্যাস অথবা জীবাণুর সন্ধান পাওয়া যায়নি। অজানা কোনও রসায়নের চিহ্নও নেই কোথাও।
বৈজ্ঞানিক অপরাজিতা সোম ব্যাকটিরিয়া কালচার তৈরি করছিলেন মোবাইল ল্যাবোরেটরিতে বসে। নিহত ব্যাক্তির রক্ত থেকে নমুনা নিয়ে চলছে পরীক্ষানিরীক্ষা, ইনি পেশায় বংশাণুবিদ। জিন উপাদানের পুনর্মিলন নিয়ে বারো বছর গবেষণা করেছেন। মানুষের হাতে গড়া অণুজীব শিবালয় শহরে অনর্থ সৃষ্টি করে চলেছে—এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেই তাঁর কাজ সোজা হয়ে যাবে।
তবে এইমাত্র যে খবর তাঁর কানে এসেছে, তা শোনবার পর তাঁর মনে হচ্ছে, পিশাচগুরুদের নয়া এক্সপেরিমেন্ট চলছে নাকি নির্জন শহরে?
মাধবী বসে আছে তাঁর পাশে।
কর্নেল ডিসুজা জিজ্ঞেস করলেন সুরেশ সাইকিয়াকে, ‘এমন কোনও বিস্ফোরণ সম্প্রতি ঘটেছিল যার কোনও ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় না?’
‘বিস্ফোরণ?’
‘সুনাদী বিস্ফোরণ?’
‘তার মানে?’
‘সোনিক বুম।’
‘না।’
‘অস্বাভাবিক জোর কোনও আওয়াজ?’
‘না, না, না,’ ধোঁকায় পড়েছেন সুরেশ সাইকিয়া। কোন সিদ্ধান্ত নিতে চলেছেন কর্নেল, তা আন্দাজ করতে পারছেন না।
বলে চলেছেন কর্নেল, ‘অস্বাভাবিক কোনও উড়োজাহাজের খবর পেয়েছিলেন ধারেকাছে?’
‘না।’ একটু থেমে পাল্টা প্রশ্ন করলেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘আপনি কি ফ্লাইং সসারের কথা ভাবছেন?’
‘ফ্লাইং সসার বলতে লোকে ধরে নিয়েছে, আকাশ থেকে অদ্ভুত একটা স্পেসশিপ এসে নামল বুঝি পৃথিবীতে। মানুষের সঙ্গে অন্য গ্রহের উন্নত জীবদের অন্যরকমভাবে যোগাযোগেও তো ঘটতে পারে?’
‘আপনার কথায় হেঁয়ালি স্পষ্ট হল না। তবে, ফ্লাইং সসার জাতীয় কোনও আজব মহাকাশযান কখনও আশেপাশে দেখা যায়নি।’
একটু থেমে বললেন কর্নেল, ‘অন্য গ্রহের অতি উন্নত জীব এক্কেবারে অন্য রকমও তো হতে পারে।’
‘মানে?’
‘টেলিপ্যাথিতে অসাধারণ ক্ষমতা রাখে। আমরা যে-সব ঘটনাকে ভুতুড়ে কাণ্ড বলে উড়িয়ে দিই—তাদের পেছনেও এই টেলিপ্যাথিক যোগাযোগের চেষ্টা থাকতে পারে। যেমন, ঘরের ফানির্চারের আচমকা শূন্যে ভেসে ওঠা, জিনিসপত্রর শূন্যে ছিটকে যাওয়া, দেওয়ালের গা ফুঁড়ে তোড়ে জল বেরিয়ে আসা—অথচ সেখানে নেই কোনও জলের পাইপ, আগুনের গোলার শূন্যে ছুটোছুটি…’
‘আপনি ভূত মানেন?’
‘না। কিন্তু টেলিপ্যাথি দিয়ে পাঠানো চিন্তাধারায় বিশ্বাস রাখি। সাইকিক
এনার্জিকে ঠিকমতো গ্রহণ করতে না পারলে তা বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে।’
‘শিবালয় শহরে এই রকম কিছু একটা ঘটেছে বলে আপনার বিশ্বাস?’
‘জৈবিক দূষণ তো ঘটতে পারে… ভিনগ্রহীর সঙ্গে পৃথিবীগ্রহীর প্রথম ছোঁয়াছুঁয়ির সংস্পর্শ দোষ। হয়তো মহামারীর আকারে ছড়িয়ে পড়েছে।’
‘তাহলে সেই উন্নত ভিনগ্রহীকে পিশাচ ছাড়া আর কিছু বলা যায় না।’
‘ভিনগ্রহী হলেই যে পরোপকারী দেবতাবিশেষ হতেই হবে, এমন কোনও গ্যারান্টি আছে কি? গরিলা পরে মানুষ হয়েছে। কিন্তু গরিলারা মানুষের মতন এমন যুদ্ধপাগল নয়।’
চুপ মেরে গেলেন সুরেশ সাইকিয়া।
১৩
আকণ্ঠ ঠাসা প্রাতরাশ খেয়ে কুপোকাৎ হয়ে পড়েছিলেন ডক্টর উতঙ্ক চৌধুরী। দু’জন ছাত্র পড়তে এসেছিল তাঁর দু’ঘরের ফ্ল্যাটে। যত না পড়িয়েছেন, তার চেয়ে বেশি ঢুলেছেন। দুপুরের খাবার বাদ দিয়েছেন। বিকেল নাগাদ ভাবলেন এক কাপ চা তৈরি করে খাওয়া যাক, এমন সময়ে বেজে উঠল টেলিফোন।
ভুজঙ্গ বোনার্জীর ফোন, ‘ডক্টর চৌধুরী, এখুনি আসছি, সুটকেস গুছিয়ে নিন।’
‘কোথায় যাব?’
‘শিবালয় শহরে।’
‘সেটা কোথায়?’
‘গেলেই দেখতে পাবেন। হিমালয়ের কোলে। সেখানে ‘আদিম শত্রু’র আবির্ভাব ঘটেছে।’
‘কী বলছেন?’
‘জোর তদন্ত চলছে। কেউ হালে পানি পাচ্ছে না। কেউ বলছে নার্ভ গ্যাস, কেউ
বলছে অণুজীবের মহামারী, কেউ বলছে ভিনগ্রহীরা পৈশাচিক কাণ্ড শুরু করে দিয়েছে।’
‘পৈ… পৈশাচিক কাণ্ড!’
‘গোটা শহরের মানুষ আর পশুপাখি রাতারাতি অদৃশ্য হয়ে গেছে। কেউ কেউ ফুলে ঢোল হয়ে পড়েছে, কারও কাটা মুণ্ডু আর কাটা হাত শুধু রয়েছে। একজন ভ্যানিশ হয়ে যাওয়ার আগে আপনার নাম আর আপনার লেখা বইয়ের নাম লিখে রেখে গেছে। বইটা বোধহয় ভদ্রলোকের পড়া ছিল। তিনিই ধরতে পেরেছিলেন, আদিম শত্রু ফের হানা দিয়েছে। তদন্তকারীরা কিন্তু এখনও ধরতে পারেনি কাণ্ডটা ঘটিয়েছে কারা, তারা কী ধরনের বিভীষিকা। ডক্টর চৌধুরী, তাই আপনার এখুনি সেখানে যাওয়া দরকার।
‘আমি গিয়ে কী করব?’
‘আদিম শত্রু নিয়ে সাধারণের উপযোগী ভাষায় লিখতে বলে দিয়েছি আপনাকে। লেখা শুরু করেছেন?’
‘আর লেখা! সকালের খাবারই হজম হয়নি এখনও।’
‘রাস্তায় বেরলেই হজম হয়ে যাবে। শুনুন। শিবালয় শহরে যা দেখবেন, যা শুনবেন, তা আপনার আগামী বইয়ের চেহারা পালটে দেবে। গোটা পৃথিবীতে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ছাড়বে আপনার ‘আদিম শত্রু’র নয়া সংস্করণ। তৈরি হয়ে নিন। পনেরো মিনিট পরেই ট্যাক্সি নিয়ে আসছি। যাবো সোজা এয়ারপোর্টে। আপনার জন্যে শিলিগুড়ির প্লেনে একটা সিট বুক করে রেখেছি।’
‘প্লেনে যাব!’
‘খরচ যোগাবে আপনার নতুন পাবলিশার। এয়ারপোর্টে আপনাকে ঘিরে ধরবে রিপোর্টাররা। তাদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আপনি যা জানেন, তা বলে যাবেন।’
‘প্রেস কনফারেন্স!’
‘আজ্ঞে। আজ সকালে যে সব কাহিনি আমাকে শুনিয়েছেন, সব বলে যাবেন। মায়াদের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া, তিন হাজার চীনে সৈন্যর অন্তর্ধান। আরও কিছু ঘটনা—যদি মনে পড়ে। পড়ছে কি?’
‘অজস্র।’
‘যেমন?’
‘আমেরিকার প্রথম ব্রিটিশ কলোনি ভ্যানিশ হয়ে গেছিল রাতারাতি। রোয়ানোক আইল্যান্ড কলোনি।’
‘অবশ্যই সেটা বলবেন।’
‘কিন্তু আদিম শত্রুর কারসাজি ছিল তার পেছনে, সেরকম কোনও প্রমাণ তো নেই।’
‘ব্যাপারটা কী?’
‘১৫৯০-এর মার্চ মাসে স্যার ওয়াল্টার র্যালের টাকায় একটা ব্রিটিশ অভিযাত্রী দল রোয়ানোক আইল্যান্ডে ফিরে এসে দেখেছিল দ্বীপে কোনও প্রাণী নেই, মানুষও নেই, অথচ সবই ছিল আগে। কয়েকশো থিয়োরি হাজির করা হয়েছে, কিন্তু তা দিয়ে অবিশ্বাস্যভাবে সমস্ত মানুষ আর মনুষ্যেতর প্রাণীর উধাও হয়ে যাওয়ার কোনও ব্যাখ্যা বের করা যায়নি। যেমন ধরুন, রোয়ানোক আইল্যান্ডের খুব কাছেই থাকে ক্রোয়ানটোয়ান ইন্ডিয়ানরা—এরাই এই কাণ্ড ঘটিয়েছে। একটা গাছের গুঁড়িতে খুব দ্রুত ক্রোয়ানটোয়ান শব্দটা লিখে গেছিল রোয়ানোক আইল্যান্ডের কোনও এক ব্যক্তি, কিন্তু দিব্যি গেলে বলেছে ক্রোয়ানটোয়ানরা, এ-ব্যাপারে তাদের কোনও হাত নেই, কিছু জানেও না। তারা শান্তিপ্রিয় মানুষ। রোয়ানোক আইল্যান্ডে উপনিবেশ গড়তে তারা যথেষ্ট সাহায্য করেছে। সেই উপনিবেশ ধ্বংস করতে যাবে কেন? ক্রোয়ানটোয়ানরা সত্যিই যুদ্ধবাজ জাত নয়, তাদের কথা বিশ্বাস করা যায়। তা ছাড়া, গোটা আইল্যান্ডে কোথাও লড়াই-টড়াইয়ের কোনও চিহ্ন পাওয়া যায়নি। কারও ডেডবডিও পাওয়া যায়নি। হাড় পর্যন্ত নেই। নেই কোনও কবর।’
‘তাহলে ‘ক্রোয়ানটোয়ান’ নামটা গাছের ছালে খোদাই করা হল কেন?’ ভুজঙ্গ বোনার্জীর প্রশ্ন।
‘ক্রোয়ানটোয়ানরা নিশ্চয় জানে কারা এমন কাণ্ড ঘটাতে পারে। হয়তো তা নিছক কুসংস্কার। তবে ক্রোয়ানটোয়ানরা নিজেরাও লক্ষ করেছে, বোয়ানোক দ্বীপবাসীরা অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আশপাশের যে সব জঙ্গলে শিকার করতে যেত ক্রোয়ানটোয়ান শিকারীরা, সে সব জঙ্গল প্রাণীশূন্য হয়ে গেছে এক্কেবারে।’
‘কুসংস্কারটা কী জাতীয়?’
‘ওদের বিশ্বাস, সমস্ত অশুভ শক্তির মূল যে অশুভ শক্তি, যে-শক্তি কিছুই না অথচ সব কিছু হতে পারে, এ হল সেই শক্তির লীলা।’
‘প্রেতবিশ্বাসীরা অবশ্য এরকম কথা বলে।’
‘রোয়ানোক আইল্যান্ডের সব্বাইকে উড়িয়ে নিয়ে গেছে এই শক্তি—ক্রোয়ানটোয়ানদের বিশ্বাস।’
‘প্রেস কনফারেন্সে সব বলবেন। আমেরিকা একটা আশ্চর্য দেশ। সেখানে হইচই তুলতে পারলে আপনার বই মার-মার কাটকাট করে বেরিয়ে যাবে। তৈরি হয়ে নিন।’
এদিকে বৈজ্ঞানিকদের নিয়ে শহর পরিক্রমায় বেরিয়েছেন সুরেশ সাইকিয়া। দেখাচ্ছেন অদ্ভুত অসম্ভব দৃশ্যের পর দৃশ্য। কোথাও গাড়ি টাল খেয়ে রাস্তা থেকে ছিটকে গেছে। সব ক’টা জানলার কাচ তোলা। দরজাগুলোও ভেতর থেকে লক করা। অথচ গাড়ি যে চালাচ্ছে, সে মরে গিয়ে ফুলে ঢোল হয়ে আটকে রয়েছে স্টিয়ারিং আর সিটের ফাঁকে। কোথাও একটা গাড়ি আর একটা গাড়িকে ওভারটেক করতে গিয়ে সংঘর্ষ ঘটিয়ে গায়ে গা লাগিয়ে ব্রেক কষেছে রাস্তার ওপরেই। দুটো গাড়িরই সব কাচ তোলা, দরজাগুলো ভেতর থেকে লক করা, চালকরা কিন্তু মরে ঢোল।
কর্নেল ডিসুজা ইউটিলিটি বেল্ট থেকে ছোট্ট গাইগার কাউন্টার বের করে শেষের দুটো গাড়িকে পরখ করলেন। বিকিরণের লক্ষণ পেলেন না। চালকেরা বিকিরণের ফলে মারা যায়নি।
সুরেশ সাইকিয়া বললেন, ‘দেখে তো মনে হচ্ছে, গাড়ি নিয়ে অনেকেই পালাতে গেছিল শহর ছেড়ে। বিষ গ্যাসের ভয়ে সব কাচ তুলে দিয়েও রেহাই পায়নি।’
‘কার ভয়ে?’ মাধবীর প্রশ্ন।
ডিসুজা নীরব।
মাধবী সঙ্গে এসেছে শহরের রাস্তাঘাট তার চেনা বলে। একটা বাড়ির সামনের
দরজা দু’হাট খোলা দেখে এগিয়ে গেল নিজেই। থমকে গেল দোরগোড়ায়। হাতছানি দিয়ে ডাকল কর্নেলকে। তিনি কাছে আসতেই বললে, ‘রিটায়ার্ড আর্মি অফিসার। দেখুন কী অবস্থা করেছেন নিজের।’
উঁকি দিয়ে দেখলেন ডিসুজা। থ হয়ে গেলেন।
নিজের অটোমেটিক মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে গুলি চালিয়ে দিয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসার। কিন্তু কীসের ভয়ে?
পাশের বাড়ির বসবার ঘরে আর একটা দৃশ্য। সাদা দেওয়ালে আয়োডিন দিয়ে লেখা হয়েছে P R O। শেষ অক্ষরটার আধখানা লিখেই প্রাণ বেরিয়ে গেছে মেমসাহেব লেখিকার। প্রৌঢ়া। লুটিয়ে রয়েছে মেঝেতে।
বুলেট।
দু’খানা বাড়ির পরের বাড়িটা মাধবীর বান্ধবীর বাড়ি। বাড়ি ফাঁকা। কিন্তু রান্নাঘরের মেঝেতে শুধু বুলেট আর বুলেট। পুরো কার্তুজ নয়। শুধু সিসে। পেতলের খোল বাদ দিয়ে।
যেহেতু পেতলের খোল নেই ঘরের মধ্যে, অতএব বন্দুকের লড়াই হয়নি ওখানে। গান পাউডারের গন্ধও নেই। দেওয়ালে বা ক্যাবিনেটে বুলেটের গর্তও নেই।
শুধু বুলেট। যাদুমন্ত্রবলে যেন খসে পড়েছে হাওয়া থেকে।
এক মুঠো বুলেট তুলে নিয়েছিলেন সুরেশ সাইকিয়া। কোনও বুলেটই দুমড়ে থেঁতলে ফেটে যায়নি। আরও দেখলেন, রকমারি আগ্নেয়াস্ত্রর বুলেট ছড়িয়ে মেঝেতে, একটা বিশেষ আগ্নেয়াস্ত্রের নয়। বেশির ভাগই সাবমেশিনগানের বুলেট। যে টাইপের বুলেট আর সাবমেশিনগান রয়েছে কর্নেল ডিসুজার রক্ষীবাহিনীর কাছে।
সার্জেন্ট যোশীর সাবমেশিনগানের বুলেট নয় তো? লকারের মধ্যে ঢুকে বেধড়ক গুলি চালিয়েছিল। মেঝেতে শুধু খালি খোল পড়ে থাকতে দেখা গেছে। সিসের গুলি পাওয়া যায়নি একটাও। যাকে টিপ করে গুলি চালিয়েছিল সার্জেন্ট যোশী, সে কি সিসেগুলো লুফে নিয়ে ছড়িয়ে রেখেছে এই রান্নাঘরের মেঝেতে?
কপাল কুঁচকে রইলেন কর্নেল ডিসুজা। তিনি বিলক্ষণ হতভম্ব হয়েছেন।
হাতের বুলেট মেঝেতে ফেলে দিয়ে নতুন কয়েকটা সিসে তুললেন কর্নেল। আরও হতভম্ব হলেন। এ যে তাঁর নিজের রিভলভারের বুলেটের মতন।
ফেলে দিলেন মেঝেতে। তুললেন অন্য সিসের গুলি। রকমারি পয়েন্টের কার্তুজ।
হাজত দারোগা সুমন্ত সেনও মরবার আগে গুলিবর্ষণ করেছিল। তার সিসেগুলোও উড়ে এসে এখানে পড়ে নেই তো?
কাদের সঙ্গে লড়তে নেমেছেন কর্নেল ডিসুজা?
বাড়িটা অসাধারণ পরিষ্কার-পরিছন্ন। কিন্তু অস্বস্তি জাগিয়ে তোলে সুরেশ সাইকিয়ার মনে। সবুজ আর হলুদ রঙের বড্ড বাড়াবাড়ি। কার্পেট সবুজ তো দেওয়াল হলুদ। সোফায় হলদে সবুজ পাতা আর ফুল, চেয়ারগুলোয় মরকত সবুজ ঢাকনি, চীনেমাটির ল্যাম্পশেড হলুদ তো ঝুমকোগুলো সবুজ। দুটো বড় ছবি ঝুলছে দেওয়ালে, দুটোতেই সবুজ মাঠ আর হলুদ ফুলের ছড়াছড়ি। সবচেয়ে বাজে শোবার ঘর। চোখ ঝলসানো উৎকট ওয়াল পেপার দিয়ে মোড়া চারটে দেওয়াল।
ডেডবডি পড়ে নেই কোথাও। সেইটাই রক্ষে। রঙের ধাক্কাতেই চোখ আর মন কাহিল, ডেডবডি দেখলে অবস্থা হত আরও শোচনীয়।
রান্নাঘরের সিঙ্কটা পর্যন্ত সবুজ আর হলুদ রঙের। এরকম উৎকট বর্ণবাতিক সচরাচর দেখা যায় না। তাই কর্নেল ডিসুজা এগিয়ে গেছিলেন সিঙ্কের সামনে। থমকে গেছিলেন। হাত নেড়ে ডেকেছিলেন সুরেশ সাইকিয়া আর মাধবীকে।
সিঙ্ক ভরতি শুধু জড়োয়া গয়না আর হাতঘড়ি। বিয়ের আংটি গাদা গাদা। দামি দামি হাতঘড়ি অজস্র। মূল্যবান পাথরের নেকলেস থেকে আরম্ভ করে যত রকমের অলঙ্কার হতে পারে, সব দিয়ে বোঝাই করা হয়েছে সিঙ্ক।
ঘষঘষে গলায় বললেন ভিসুজা, ‘গাড়ির মধ্যে যাদের ডেডবডি দেখলাম, আর বাইরে যত ডেডবডি দেখেছি, কারও হাতে হাতঘড়ি দেখিনি, গয়নাগাঁটিও দেখিনি।’
মাধবী বললে, ‘এরকম খুনীও পৃথিবীতে দেখা যায়নি যে খুন করে, গয়নাগাঁটি গা
থেকে খুলে নেয় কিন্তু থলি ভরে সঙ্গে নিয়ে যায় না, অবহেলায় ফেলে যায় রান্নাঘরের সিঙ্কে।’
সুরেশ সাইকিয়া বললেন, ‘যারা মিসিং, তাদের গয়না আর রিস্টওয়াচ এখানে নিশ্চয় আছে। বডিগুলো গেল কোন চুলোয়? কোন নরকে?’
জবাব নেই। ঝিকমিক করে যেন বিদ্রুপ করে গেল সিঙ্কভরতি দামি গয়নাগাঁটি আর হাতঘড়িগুলো।
কমপিউটার টারমিনাল অন করে দিয়ে গাংচিলের চিৎকার এবার নিজেই শুনলেন কর্নেল ডিসুজা।
সেইসঙ্গে কুকুরের অবিরাম গজরানি। ঘেমে গেলেন কর্নেল।
আচমকা মিউ মিউ করে উঠল একটা বেড়াল। পরক্ষণেই ঘোড়ার হ্রেষারব।
মোবাইল-ল্যাবের এ-কোণ ও-কোণ দেখে নিলেন কর্নেল। কোনও চিহ্ন দেখতে পেলেন না।
র্যাটল স্নেকের খটখট কড়মড় বাদ্যি আরম্ভ হয়ে গেল এরপরেই।
ভনভন করছে মৌমাছি।
আচমকা স্তব্ধ হল মৌমাছি গুঞ্জন। কচি গলায় শুরু হল ‘আবোল তাবোল’ ছড়া…
আজগুবি নয়, আজগুবি নয়,
সত্যিকারের কথা—
ছায়ার সাথে কুস্তি করে
গাত্রে হল ব্যথা।
কর্নেল কিংকর্তব্যবিমূঢ়। গলাটা মানুষের, না না-মানুষের তা বোঝা যাচ্ছে না, মানুষের গলায় থাকে প্রাণের ছোঁয়া, এ গলায় তা নেই।
আচমকা খিলখিল করে হেসে উঠে এবার যে ছড়া বলে গেল, তা সুকুমার রায়ের ‘ছায়াবাজি’ ছড়া থেকে বিশেষ বিশেষ শব্দ তুলে নিয়ে স্বরচিত:
ছায়াবাজি নয় রে বোকা,
এ যে আসল মায়া,
রোদের ছায়া চাঁদের ছায়া,
শিশিরভেজা সদ্য ছায়া—
মায়া… মায়া… সবই মায়া।
গ্রীষ্মকালে শুকনো ছায়া, কাগের
ছায়া, বগের ছায়া
হালকা মেঘের পানসে ছায়া,
গাছের ছায়া, পাতলা ছায়া—
মায়া… মায়া… স্রেফ মায়া।
খামোকা লড়ে মরবি মর—
আমার খিদে মেটার পর।
ছায়া-মায়া কায়া কিছুই আমার নেই কো নেই,
আমি নিমর্ম, আমি ভীষণ, আমি শূন্য—কিন্তু আমিই সেই।
ছড়া থেমে গেল। আর কোনও আওয়াজ নেই। ঘামছে এখন প্রত্যেকেই।
টিকেন্দ্রনগর থেকে খবরটা এল ঠিক সেই সময়ে—নাটকীয়ভাবে। ‘আদিম শত্রু’ নামে একটা বই লিখেছিলেন ডক্টর উতঙ্ক চৌধুরী। লোকে তাঁকে বলত আধপাগল। কারণ তিনি ওই বইতে অনেক তথ্য তুলে ধরে বলতে চেয়েছিলেন, এই পৃথিবীর মাটি থেকে, এমনকী সমুদ্রের জল থেকেও মাঝে মাঝে মানুষ আর প্রাণী যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে দলে দলে। এই অদৃশ্যকরণের মূলে রয়েছে এক আদিম আতঙ্ক।
বইটা আর পাওয়া যায় না। বাথরুমের আয়নায় এই বই লেখকের নাম লিখেই আদিম আতঙ্কর পাল্লায় পড়েছেন একজন—নাম তাঁর বিনয় চৌধুরী।
লেখক স্বয়ং আসছেন শিবালয় শহরে।
১৪
চাঞ্চল্যকর খবরের পর খবর এসে পৌঁছোচ্ছে মোবাইল ল্যাবরেটরি থেকে। শিবালয় শহরের আকাশে-বাতাসে-জলে-মাটিতে কোত্থাও কোনওরকম জৈব সংক্রমণ ঘটেনি।
সবচেয়ে তাজ্জব ব্যাপার, ডেডবডি পরীক্ষা করে দেখা গেছে, তাতে কোনও জীবাণু নেই! শরীর প্রাণশূণ্য হলেই তাতে জীবাণু বাসা বাঁধে, তাই শরীর পচতে থাকে। কিন্তু শিবালয় শহরের ডেডবডিতে কোনও ব্যাকটিরিয়া নেই। এমনকী সজীব শরীরের কোলন অঞ্চলেও যে ব্যাকটিরিয়া থাকে তাও নেই।
শরীর একেবারে জীবাণুশূন্য!
মাধবী আড়ষ্ট গলায় বললে, ‘তার মানে একটাই। বডিগুলো অত্যন্ত শক্তিশালী প্রিজারভেটিভ, মানে, সংরক্ষণকর রসায়ন দিয়ে টাটকা রাখা হয়েছে।’
কর্নেল ডিসুজা দিশেহারা। ডেকন স্যুট খুলতে খুলতে বললেন, ‘কোথাও যখন জীবাণু সংক্রমণ ঘটেনি, তখন এই পোশাকের বোঝা নামিয়ে রাখা যাক।’
মরিয়া হয়ে গেছেন ভদ্রলোক।
পরি কফি এনে দিচ্ছে। মোট চার কাপ। ডক্টর অপরাজিতা সোম, মাধবী, সুরেশ সাইকিয়া আর নিজের জন্যে। ওরা এখন বসে আছে হোটেলের ডাইনিং রুমে। জানলার কাছে। পড়ন্ত রোদ ধুয়ে দিচ্ছে নিচের রাস্তা। রাত নামবে আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে। শুরু হবে আবার এক আতঙ্কঘন দীর্ঘ রাত্রি।
শিহরিত হল মাধবী। চুমুক দিল কফিতে।
অপরাজিতা সোম এখন কর্ডুরয় জিনস আর হলুদ ব্লাউজ পরে আছেন। রেশমের মতন চুল লুটোচ্ছে কাঁধে। বলছেন, ‘এরকম কাণ্ড ওয়াল্ট ডিসনির ফিল্মে দেখেছি। কিছু মাকড়শা আর পোকা শিকার ধরে তাদের গায়ে প্রিজারভেটিভ পুরে দেয় পরে খাওয়ার জন্যে। এখানকার বডিগুলো কেটেকুটে দেখা যাচ্ছে সেই একই ব্যাপার। তবে, এই প্রিজারভেটিভ আরও কড়া, আরও উন্নত।’
মাধবীর মনের চোখে ভেসে উঠল বিশালকায় মথ পোকা। কয়েকশো মথ পোকা ঘরে ঘরে ঢুকে প্রিজারভেটিভ ফুঁড়ে দিয়ে যেতে পারে, কিন্তু বন্ধ গাড়ির মধ্যে তারা ঢুকল কী করে?
সুরেশ সাইকিয়া বললেন, ‘পোকার কামড়ে শহরসুদ্ধ লোক মারা গেছে, এই কি বলতে চান?’
‘সেরকম প্রমাণ এখনও পাইনি। পোকা যখন হুল ফোটায়, হুল ফোটানোর দাগ তো থাকবে শরীরের কোথাও না কোথাও। আমরা সেরকম কোনও পাংচার দেখতে পাইনি ডেডবডিতে।’
‘আর একটা ডেডবডি নিয়ে ফের দেখলে হয় না?’
‘নিশ্চয় দেখব। তবে আশ্চর্য এই যে, ডেডবডিতে এক্কেবারে পচন ধরেনি ব্যাকটিরিয়া একদম না থাকায়। টিস্যু-বোঝাই প্রিজারভেটিভ রয়েছে। অদ্ভুত!’
‘প্রিজারভেটিভ যদি ফুঁড়ে ঢোকানো না হয়, তাহলে শরীরে ঢুকল কী করে?’
‘অনুমান করতে পারি।’
‘কী অনুমান?’
‘চামড়া শুষে নিয়েছে। সেকেন্ড কয়েকের মধ্যে টিসুতে পৌঁছে গেছে।’
‘নার্ভ গ্যাস নয় তো?’ মাধবীর প্রশ্ন, ‘প্রিজারভেটিভ এফেক্টটা স্রেফ সাইড এফেক্ট।’
‘না,’ অপরাজিতা জবাব দিলেন, ‘নার্ভ গ্যাস তো একধরনের বিষ-গ্যাস। জামাকাপড়ে লেশ লেগে থাকতই। তা পাওয়া যায়নি।’
‘তাহলে কী বলতে চান, মৃত্যুর কারণও এই প্রিজারভেটিভ?’ জানতে চাইলেন সুরেশ সাইকিয়া।
‘মৃত্যুর অন্যতম কারণ বলতে পারেন,’ বললেন অপরাজিতা সোম, ‘অন্যান্য কারণের মধ্যে অক্সিজেনের অভাবও থাকতে পারে।’
‘দম বন্ধ করে মৃত্যু?’ ঝুঁকে বসলেন সুরেশ সাইকিয়া।
‘হ্যাঁ। কিন্তু কোনটা সঠিক কারণ, তা বলা যাচ্ছে না।’
‘যারা মরেছে, তারা দু’এক সেকেন্ডের মধ্যেই মরেছে। দমবন্ধ মৃত্যুতে সময় লাগে তার চেয়ে বেশি। যার দম আটকে আসছে, সে ছটফট করবেই, কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই ছটফটানির চিহ্ন পাওয়া যায়নি।’
‘তা ঠিক,’ সায় দিলেন বংশাণুবিদ।
‘শরীর ফুলে ঢোল হয়েছে কেন?’ সুরেশ সাইকিয়া নাছোড়বান্দা।
‘প্রিজারভেটিভের বিষাক্ত প্রতিক্রিয়ার দরুন হতে পারে।’
‘সারা শরীর থেঁতলে যাওয়া?’
সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিতে পারলেন না অপরাজিতা সোম। দিলেন কিছুক্ষণ পরে ভুরু কুঁচকে, ‘বাইরে থেকে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল শরীরের ওপর, পরীক্ষায় তা জানা গেছে। হয়তো প্রিজারভেটিভের আর একটা অ্যালারজিক পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া। ফুলে উঠলে শরীরের সর্বত্র অমন কালসিটে পড়ে না। ঠিক যেন কিছু দিয়ে মারা হয়েছে। ঘনঘন মেরেই যাওয়া হয়েছে। অবিশ্বাসটা জাগছে সেইখানেই। এইভাবে পিটিয়ে গেলে অন্তত একটা হাড় ভো ভাঙবেই। অদ্ভুত ব্যাপার রয়েছে আর এক ক্ষেত্রে। গোটা শরীরের সমস্ত জায়গায় কালসিটের মাত্রা একই রকম, কম-বেশি কোথাও নেই। উরুতে যতখানি কালসিটে, বগলেও ঠিক ততখানি। অসম্ভব। বগলে মুগুর পৌঁছোয় না। জুতো পরে থাকা ডেডবডির পায়ের পাতায় কালসিটে পড়ল কী করে?’
মাধবী বললে, ‘কালসিটের কারণ তাহলে নির্ণয় করা যায়নি? মৃত্যুর কারণও
জানা যায়নি?’
‘না,’ চেয়ারে ঠেসান দিয়ে বসলেন অপরাজিতা সোম। তাঁর মুখে এখন দুশ্চিন্তার ছাপ। অপরাহ্ন আরও গড়িয়েছে। রাস্তা একদম ফাঁকা। গাছগুলো নিস্পন্দ। গোটা শহরে কবরের নীরবতা। ‘কর্নেল ডিসুজারা এত দেরি করছেন কেন? দশ মিনিট আগেই ফিরে আসা উচিত ছিল।’
উঠে দাঁড়ালেন সুরেশ সাইকিয়া, ‘আমি গিয়ে দেখছি।’
উঠে দাঁড়ালেন অপরাজিতা সোমও, ‘লক্ষণ সুবিধের ঠেকছে না।’
মাধবীও তা টের পাচ্ছে।
আতঙ্ক ফের খেল দেখাতে শুরু করেছে শিবালয় শহরে।