আদিম আতঙ্ক – ১

চিৎকারটা ভেসে এল অনেক দূর থেকে।

ভয়ের চিৎকার। নিঃসীম আতঙ্ক ঠিকরে এল গলা চিরে। কিন্তু ওই একবারই। আর না। একবার চেঁচিয়েই বুঝি দম ফুরিয়ে গেল মেয়েটার। অথবা থেমে গেল কলজে।

ম্যাগাজিনের পাতা থেকে চোখ সরে এসেছিল সুমন্তর। সুমন্ত সেন। হাজত দারোগা। ছোট মাপের অফিসার। বয়েসেও ছোট। মাত্র আটাশ বছর। মনটা তাই এখনও গল্পের জগতে ভেসে যেতে ভালোবাসে।

পড়ছিল একটা গা-ছমছমে গল্প। উদ্ভট। অবৈজ্ঞানিক। হোক। গায়ের লোম তো খাড়া হচ্ছিল।

ঠিক ওই সময়ে সৃষ্টিছাড়া ওই চিৎকার। নৈঃশব্দ্য খানখান করা। খুব অল্পক্ষণের জন্য।

ঘাড় কাত করে চোখ কুঁচকে রইল সুমন্ত। কিন্তু আর সে চেঁচাচ্ছে না। কণ্ঠে বুঝি কুলুপ পড়ে গেল নিমেষে।

চেয়ারে নড়ে উঠল সুমন্ত। সঙ্গে সঙ্গে কর্কশ আর্তনাদ করে উঠল চেয়ার। ভাঙা চেয়ারের চিৎকার।

খোলা জানলা দিয়ে বিকেলের রোদ এসে পড়েছে কাঠের টেবিলে। পালিশ-চটা খুবলে খুবলে যাওয়া সস্তা কাঠের টেবিল। থানার টেবিল এর চাইতে ভালো হয় না।

জানলা দিয়ে রাস্তার খানিকটা দেখা যাচ্ছে। এ তল্লাটের সব চাইতে চওড়া রাস্তা এটা। মূল সড়কও বটে। নাম, শিবালয় অ্যাভিনিউ।

রাস্তা এখন ফাঁকা। দু’পাশের গাছগুলোর পাতা নড়ছে হাওয়ায়। গোটা শহরে নিবিড় শান্তি ছড়িয়ে রয়েছে।

বেখাপ্পা ওই চিৎকারটা। ছন্দপতন ঘটিয়েছিল মুহূর্তের জন্যে।

এই সময়টা এইভাবেই ঝিমিয়ে থাকে টাউন। মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর ফাঁকা যায়। পর্যটনবিলাসীরা তখন এদিকে আসে না। হাজত আর থানার কাজও কম। বসে বসে হাতে-পায়ে মর্চে ধরে যায়।

কাজ শুরু হবে অক্টোবর থেকে। দলে দলে পর্যটকরা আসবে পাহাড়ঘেরা নিরালা এই তল্লাটে।

অলস চোখে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে সুমন্ত। নির্জন পথে গাড়ি নেই, মানুষ নেই, কুকুর পর্যন্ত নেই। একটামাত্র হোটেল খুলে রেখেছে বটে—অফ-সিজন বলে সেখানে তেমন লোকও নেই। দুটো মোটেলও খুলে রেখেছে—গাড়ি নেই সেখানেও।

পুরো টাউন এখন পাণ্ডব-বর্জিত। তা সত্ত্বেও কে অমন চেঁচাল?

জানলা থেকে চোখ সরিয়ে আনে সুমন্ত। চোখ ঘুরছে পত্রিকার পাতায়। এমন সময়ে আবার শোনা গেল একটা চিৎকার।

এবার বিষম আতঙ্ক বুঝি মূর্ত হয়ে উঠল কলজে-ছেঁড়া সেই চেঁচানির মধ্যে। আগের চিৎকারের চাইতেও লোমহর্ষক। আরও বিকট।

কিন্তু এ-চিৎকার তো নারী-কণ্ঠ ফুঁড়ে ঠিকরে এল না। এ যে পুরুষ-কণ্ঠ!

বহুদূর থেকে উত্থিত হয়েই নিমেষে স্তব্ধ হয়ে গেল বটে ঠিক আগের মতনই—কিন্তু ভয়ালতা অনুরণন জাগিয়ে চলল সুমন্তর কর্ণেন্দ্রিয় দিয়ে মস্তিষ্কের অণু পরমাণুতে…

পত্রিকা মুড়ে রাখল সুমন্ত। উৎকর্ণ হয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ—আবার যদি শোনা যায় বিশ্রী বিকট চিৎকার দুটোর যে কোনও একটা। কিন্তু টুঁটি-টেপা নৈঃশব্দ্য ফের চেপে বসেছে গোটা টাউনে।

একে তো হিমালয়ের কোল বলে এখানকার সবকিছুই বড় শব্দহীন। তার পর অফ-সিজন। অথচ দু’দুটো মানুষ একটু আগেই গলাবাজি করে গেল। দুজনেই ভয় পেয়েছে। তাই অমন অমানুষিক চেঁচিয়েছে। দুজনেই অকস্মাৎ নীরব হয়ে গেছে।

সুমন্ত সেন আর বসে থাকতে পারল না। পত্রিকা উলটে রাখল টেবিলে, চাপা দিল পেপারওয়েট দিয়ে। ফিরে এসে পড়বে। এখন একটু টহল দিয়ে আসা যাক।

উঠল চেয়ার ছেড়ে। আবার সেই কর্কশ চিৎকার। চেয়ারের চিৎকার।

রিভলভারটা সঙ্গে নেওয়া দরকার। যারা অমন বিকট চেঁচিয়েই গলায় কুলুপ লাগায়—নিশ্চয় তারা বিপদে পড়েছে। সব বিপদেরই মোকাবিলা করা যায় গুলিভরা রিভলভার হাতে থাকলে…

হোলস্টারশুদ্ধ বেল্ট আলমারি থেকে টেনে নামিয়ে কোমরে বেঁধে নিল সুমন্ত। এই বেল্টেই ঝোলে ছোট ছুরি। দু’মুখ ধারালো। এক হাতে ছুরি আর এক হাতে রিভলভার নিয়ে সুমন্ত একাই দশ-বিশ জনকে সামাল দিতে পারে।

চামড়ার বুট এবার তার নিজস্ব আওয়াজ তোলে মেঝের ওপর। সুমন্ত আকারে নাতিদীর্ঘ হতে পারে—কিন্তু ওর চলার মধ্যে ঠিকরে বেরোয় ব্যক্তিত্ব। বুটের এই খট খট আওয়াজ শুনলেই হৃৎকম্প হতে থাকে ক্রাইম-লিপ্ত মহাপুরুষদের। সেই সঙ্গে ওর রুদ্র চোখের চাহনি আর কাঠচেরা কণ্ঠের হুঙ্কার…

সব মিলিয়ে, অপরাধীদের কাছে সুমন্ত সেন একটা ত্রাস… একটা জীবন্ত বিভীষিকা। একাই পাকড়ায় দুষ্কৃতীদের—টেনে এনে ঢোকায় লক-আপে…

পাশাপাশি তিনটে খাঁচা। তিনটেই খালি। ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে খাঁচা তিনটের দিকে রুদ্রচক্ষু বুলিয়ে নেয় সুমন্ত। একটু পরেই নিশ্চয় খাঁচাদের খিদে মেটাতে পারবে। ওদের শূন্য উদর পূর্ণ করে দেবে।

খাঁচাঘরের পরেই বড় দরজা। এই দরজার পরে ভিজিটরদের ঘর। এ-ঘরে

বড় বড় বেঞ্চি পাতা।

খট খট খট খট শব্দের পাদুকা-বাদ্য বাজিয়ে এই দরজার দিকে অগ্রসর হয় সুমন্ত। চৌকাঠ এখনও পাঁচ ফুট দূরে। খাঁচাগুলো বুঝি তৃষিত নয়নে পাশ থেকে দেখছে ওকে। এমন সময়ে অস্ফুট একটা শব্দ শোনা গেল পেছনে।

নিমেষমধ্যে টানটান হয়ে গেল সুমন্ত সেনের সর্বাঙ্গ। কেননা, আওয়াজটা এল পেছনের যে-ঘর থেকে, সে-ঘরে তো এই মুহূর্তে কেউ নেই! একা বসেছিল সুমন্ত। সে ঘরে জানলা একটাই—গরাদ দেওয়া। দরজাও একটা—তাতে তালা ঝুলছে। ও ঘরে ঢুকতে হলে যেতে হয় এই খাঁচাঘরের মধ্যে দিয়ে।

কিন্তু কেউ ওর পাশ দিয়ে যায়নি—ঢোকেনি অফিসঘরে। কেউ ছিলও না সে ঘরে। অথচ, ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে না আসতেই এ কীসের আওয়াজ?

ক্ষীণ হলেও কান এড়ায়নি সুমন্তর। জুতোর খটখটানিতেও চাপা পড়েনি। হাওয়ায় ম্যাগাজিনের পাতা উলটে যাওয়ার আওয়াজও নয়—ম্যাগাজিন তো ও উলটে রেখে এসেছে—ওপরে চাপা দেওয়া আছে ভারী পেপারওয়েট…

এতগুলো চিন্তা একযোগে খেলে গেল সুমন্তুর সজাগ ব্রেনের মধ্যে দিয়ে। কোমরে রিভলভার ঝোলালেই পালটে যায় ওর চেহারা—ব্যক্তিত্ব শত-মুখ ছুরির মতন ফলা উঁচিয়ে ধরে।

তাই সজাগ হয়ে গিয়ে মুহূর্তের জন্যে নিথর দেহে দাঁড়িয়ে রইল সুমন্ত। পেছনের আওয়াজের দিকে ফিরে তাকানোর আগে সমস্ত শক্তি সঞ্চয় করল হাতে-পায়ে-চোখে। ঘুরে দাঁড়াল পরক্ষণেই…

বিস্ফারিত হল দুই চক্ষু! আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল দুই চোখের রুদ্র কটাক্ষে… শূন্য কক্ষ আর শূন্য নয়, এবং…!

এখন সেপ্টেম্বর সবে শুরু হয়েছে। বাতাসে সামান্য টান ধরেছে। অপরাহ্ন মিলিয়ে যাবার ফিকিরে আছে—জায়গা ছেড়ে দেবে সন্ধ্যাকে।

বিকেল আর সন্ধ্যা। ভাই আর বোন। এরা যখন হাত ধরাধরি করে, তখনই তো গোধূলি লগ্ন। বড় মিষ্টি এবং বড় রহস্যময়। পৃথিবীর প্রথম মুহূর্ত থেকে গোধূলির বড়ই সমাদর অন্ধকার দুনিয়ায়। রাতের চারটে প্রহরেই অশুভ অশরীরীরা নিজেদের বের করে আনে খাঁচার ভেতর থেকে। চলে তাদের অট্টরোল আর হট্টমেলা। প্রত্যূষের প্রভায় তারা গুটি গুটি কেটে পড়ে নিজেদের কন্দরে।

অশুভ বাসনাদের ফুর্তি শুধু তামসিক অন্ধকারেই—রজনীর তিমির অবগুণ্ঠনেই। তাদের উল্লোলনৃত্য—প্রভাতে সব নিরুদ্দেশ।

প্রকাণ্ড পৃথিবীর অজস্র অন্ধকার কারাগারে তখন তারা বন্দী। তাদের হদিশ আজও কেউ পায়নি। পৃথিবী আজও পরম রহস্যময় এদেরই জন্যে।

এরা ছিল, আছে, থাকবে।

শিবালয় টাউনেও নেমেছে গোধূলি। চারদিকের পাহাড়ে পাহাড়ে তার চোখজুড়োনো সুষমা ছড়িয়ে পড়ছে।

এ বড় সুন্দর জায়গা। ভূস্বর্গ বললেই হয়। যেদিকে দু’চোখ যায়, সেদিকেই শুধু পাহাড়। ঘন সবুজ ক্রমশ আরও ঘন হয়েছে পেছনের পাহাড়গুলোয়—একটু একটু করে কালচে হয়েছে, ধূসর হয়েছে, তারপর ধোঁয়াটে হয়ে দিগন্তে বিলীন হয়েছে।

সবুজ রঙের মধ্যে থেকে আরও একটা রং ঠেলে উঠছে। নীল রং। বড় বড় পাইন, ফার—যত রকমের চিরহরিৎ বৃক্ষ আছে—প্রত্যেকেরই গা মুড়ে দেওয়া হয়েছে যেন একই রকমের পুরু ফেল্ট কাপড় দিয়ে—যে-ফেল্ট পেতে দেওয়া হয় বিলিয়ার্ড টেবিলে। ঘন, মোলায়েম, স্নিগ্ধ। ছায়াগুলোও তাই যেন বড় ঠান্ডা। গোধূলি যতই সন্ধ্যার হাতে নিজেকে ছেড়ে দিচ্ছে—নরম শীতল ছায়াগুলো ততই লম্বা হচ্ছে—নিজেদের আকার আয়তন বাড়িয়ে চলেছে। মিনিটে মিনিটে গাঢ়তর হচ্ছে। এখুনি তো শুরু হবে তাদেরই রাজত্ব। ছায়া সাম্রাজ্য। তমিস্র-অধীশ্বরের আবির্ভাবের পথ চেয়ে তাই তারা ছায়ার কার্পেট পেতে দিচ্ছে গাছ আর পাহাড়ের পাশে পাশে।

মুগ্ধ চোখে মাধবী লাহা দেখে যাচ্ছে অবর্ণনীয় এই রূপরাশি। স্টিয়ারিং হুইলে দু’হাত রেখে তন্ময় হয়ে দেখছে প্রকৃতিকে। প্রকৃতি এমনই একটা সত্তা, যে নিতান্ত অ-কবিকেও কবি বানিয়ে দেয়। হিপনোটিক এফেক্ট ছড়িয়ে পড়ে কাঠখোট্টা ব্যক্তিরও অণু-পরমাণুতে।

গাড়ি ছুটছে… ছুটছে মাধবীর মনও। ছুটছে সেইখানে—যেখানে রয়েছে ওর গৃহ। সুইট হোম।

মাধবী বাড়ি ফিরছে। দীর্ঘ সময় পর।

শিবালয় শহরের হর্তাকর্তা বিধাতারা শহরের সৌন্দর্য বাড়িয়ে রেখেছেন শহরে প্রবেশের বহু আগে থেকেই। এখানকার রাস্তা তাই বেশ চওড়া। পাশাপাশি তিনটে গাড়ি নক্ষত্ৰবেগে যাতে ধেয়ে যেতে পারে—তার ব্যবস্থা।

মাধবী স্টিয়ারিং হুইলে একটু মোচড় দিয়ে গাড়ি ঢুকিয়ে দিল এহেন একটি রাস্তায়। কিছুদূর গিয়েই রাস্তা একটু সরু হয়েছে—কেননা এ রাস্তা এখন গিরিপথ হয়ে গেছে। দু’পাশে উদ্দাম উত্তুঙ্গ পাহাড়। মাঝখানে পাথর উড়িয়ে তৈরি

হয়েছে এই পথ। দুটো গাড়ি এখন পাশাপাশি যেতে পারে।

এইভাবেই পাঁচ মাইল পথ পেরিয়ে এল মাধবী। শিবালয় শহর আর বেশি দূরে নেই। পেছনের সিটের মেয়েটি এতক্ষণে একটি কথা বলল, ‘কী সুন্দর!’

দুই বোন, গাড়ি চালাচ্ছে মাধবী। পেছনে বসে পরি।

পনেরো বছর ছাড়াছাড়ি ছিল, দুই বোনে। মাধবী ডাক্তারি পাশ করে চাকরি করেছে। মা-বাবার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল শুধু চিঠির মধ্যে দিয়ে। বাবা আগে মারা গেল—একদিন পরেই মা। তাই পরিকে নিয়ে এসেছে মাধবী। শিবালয় টাউনে অনেক আগে একটা নিবাস রচনা করেছিল—বোনকে নিয়ে যাচ্ছে সেখানে। পরির বয়স তেরো, মাধবীর আটাশ।

গাড়ি ঢুকে পড়েছে শহরে। চলেছে শিবালয় অ্যাভিনিউর ওপর দিয়ে। দু’পাশের কটেজগুলো নানা ঢঙের—কিন্তু কংক্রিটের জঙ্গল হতে দেয়নি শহরকে। পাথর, স্লেট, ইট, কাঠ, টালি—এই, দিয়েই পাহাড়ি কুঁড়ের গড়নে তৈরি প্রতিটি আস্তানা।

এ-শহরের নিয়ম তাই। নিয়নের চোখ ধাঁধানো দ্যুতি পর্যন্ত বরবাদ। মামুলি কাঠের সাইনবোর্ড। ঠিক যেন একটা সাজানো পাহাড়ি গ্রাম। স্নিগ্ধতায় হাত পড়েনি আজ।

অথচ, মাধবীর মনে হল, এই মুহূর্তে শিবালয় শহর যেন মড়ার শহর হয়ে রয়েছে…

গা শিরশির করা এই নিস্তব্ধতা নাড়া দিয়েছিল পরিকেও। বলেছিল, ‘কথাও বলতে জানে না।’

‘কে রে?’

‘এই শহর।’

‘বড্ড চুপচাপ বলে?’

‘এত চুপচাপ ভাল্লাগে না।’

মাধবী নিজেও অবাক হয়েছে। বছরের এই সময়ে শিবালয় শহর ঠান্ডা মেরে থাকে ঠিকই—কিন্তু মড়ার মতন নিথর হয়ে থাকে না। কোথাও এতটুকু শব্দ নেই। আশ্চর্য!

খটকা লেগেছিল বলেই স্পীড কমিয়ে এনেছিল মাধবী। এমনিতেই স্পীড কমাতে হত। কেননা, রাস্তা পাহাড়ের গা বেয়ে সটান ওপর দিকে উঠে গেছে। রাস্তার শেষ যেখানে শহরেরও শেষ সেখানে। তারপরেই স্কি-লিফট। তুষার জমে যখন বরফ হয়ে যায়, তার ওপর দিয়ে তীরবেগে ধেয়ে যাওয়ার আর লাফিয়ে ছিটকে যাওয়ার মারাত্মক মঞ্চ।

স্কি-লিফট এই শহরের মূল আকর্ষণ। রয়েছে শহরের একদম মাথায়। সেখান থেকে পাহাড় আরও উঁচুতে উঠে গেছে। ওইটাই পশ্চিম দিক। পুব দিকটা নিচে। যেদিক থেকে ঠেলে উঠছে মাধবীর গাড়ি।

সাজানো শহর। ধনকুবেরদের চাঁদার টাকায় পরিচ্ছন্ন শহর। পুব থেকে পশ্চিমে খাড়াই উঠে গেছে এই যে রাস্তা শিবালয় অ্যাভিনিউ—এর দু’পাশে চতুষ্কোণ ব্লক। মাঝে মাঝে চৌমাথা। ডাইনে-বায়ে রাস্তা চলে গেছে। শহরের সর্বত্র যাওয়া যায় সহজেই। রাস্তা হারানোর ভয় নেই।

অথচ খাঁ খাঁ করছে দু’পাশ। বিচিত্র ব্যাপার।

শীতের আগের এই মিষ্টি বিকেলটায় কেউ বাড়ি বসে থাকতে চায় না। বারো মাস যারা এখানে থাকে, তারা এই নিরিবিলি অপরাহ্নকে হারাতে চায় না। বাড়ি থেকে বেরিয়ে আশে সব্বাই—বসে থাকে পথের পাশে বাঁধানো বেদীতে, বেঞ্চিতে, ব্যালকনিতে।

বারো মাসের মানুষ এখানে অবশ্য খুবই কম। বাড়ি খালি করে বেরিয়ে এলেও রাস্তায় লোক গিজগিজ করে না কোনও সময়ে। অথচ মনে হয়, বড় জীবন্ত শহর এই শিবালয় টাউন।

দার্জিলিং-এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এর জন্ম। দার্জিলিং-এর রাজনীতি এ শহরকে ছুঁতে পারেনি। পারবেও না।

পথের দু’পাশে দোকানগুলো তো খোলা রয়েছে। আলোও জ্বলছে। অথচ কেউ নেই দোকানে। বাড়িগুলোও প্রোজ্জ্বল—অথচ বারান্দায় কেউ নেই। গোল-গোল পাথর বাঁধানো বাহারি রাস্তায় কুকুর পর্যন্ত টহল দিচ্ছে না। শহরের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত বিলকুল ফাঁকা। অদ্ভুত!

একটা চৌমাথা এসে গেছে। এখান থেকে ডাইনে আর বাঁয়ে দুটো রাস্তা চলে গেছে। ঠিক এইখানেই আস্তে ব্রেক কষল মাধবী। তাকাল বাঁয়ে—পরপর তিনটে ব্লক এখান থেকেই দেখা যায়। কেউ নেই রাস্তায়। তাকাল ডাইনে। এদিকে রয়েছে চারটে ব্লক। দেখা যাচ্ছে গাড়ির জানলা থেকেই। এদিকেও পথ জনহীন।

স্টার্ট দেয় মাধবী। পরের চৌমাথায় দাঁড়ায়। তাকায় ডাইনে-বাঁয়ে। কেউ নেই। পরের চৌমাথাতেও একই অভিজ্ঞতা।

পরি এতক্ষণ চুপ করে ছিল দিদির কাণ্ড দেখছিল। চৌমাথায় চৌমাথায় থেমে থেমে এগোচ্ছে দিদি, আর একটু একটু করে বাড়ছে ভুরু কুঁচকোনো। শেষকালে বলেই ফেলল, ‘অত থামছ কেন?’

‘আলো-টালো জ্বলছে, অথচ কেউ কোথাও নেই।’

‘ঘরে বসে রয়েছে।’

‘এ-সময়ে ঘরে কেউ থাকে না।’

‘নিশ্চয় দারুণ প্রোগ্রাম আছে টিভি-তে।’

‘তা হবে।’

‘তুষার খানাঘর’ও এসে গেল পরের চৌমাথায়। এখানেও ব্রেক কষল মাধবী।

পরি বলল, ‘বেড়ে নাম তো।’

‘এ-শহরের সব কিছুই বাংলা। খাঁটি বাংলা। ইংরিজির নো অ্যাডমিশন।’

‘অথচ ফরেন টুরিস্ট আসে?’

‘তাদের জন্য ছোট বোর্ড আছে নিচের দিকে—দেখেছিস? বাংলা নামটা ইংরিজিতে লিখে তার ইংরিজি মানে দেওয়া হয়েছে।’

পরি যখন ছোট সাইনবোর্ড দেখছে, মাধবী তখন খানাঘরের ভেতরে চোখ চালিয়েছে।

আলো জ্বলছে এখানেও। কোণের জানলাগুলো ঝলমল করছে ভেতরের আলোয়। কাউকেই কিন্তু দেখা যাচ্ছে না।

অথচ ‘তুষার খানাঘর’ খুব পপুলার রেস্তোরাঁ। বাইরের মানুষের ভিড় শুরু হয় টুরিস্ট মরশুমে—কিন্তু বারো মাস এখানে আড্ডা মারতে আসে শহরের মানুষরা। খাবারদাবার সস্তা বলেই শুধু নয়—লোকজনের ব্যবহারও বড় ভালো। খাবার দিয়ে যায় মেয়েরা—হাসিমুখে। দোকানের মালিক নিজেও টেবিলে টেবিলে ঘুরে সবার খোঁজ খবর নেয়। সব মিলিয়ে, মনে হয়, বাড়ির বৈঠকখানায় এসে পড়লাম। কিন্তু এই মুহূর্তে কেউ নেই। না মালিক, না খদ্দের।

মেয়েগুলোও নিপাত্তা।

পরি বলেছিল—টিভি-র দারুণ প্রোগ্রাম আছে নিশ্চয়। সায় দিয়েছিল মাধবী। কিন্তু মন থেকে দেয়নি। প্রোগ্রাম যতই টেরিফিক হোক, রাস্তা আর দোকানপাট খাঁ-খাঁ করবে কেন?

গাড়ি উঠছে একটু একটু করে। ভুরু কুঁচকে দু’পাশে বাড়িগুলোর জানলা আর বারান্দা দেখতে দেখতে চলেছে মাধবী—কাউকেই উঁকি দিতে দেখছে না—দাঁড়িয়ে থাকতেও দেখছে না। রাস্তার একটামাত্র চলমান গাড়ি দেখে কেউ ছুটে বেরিয়েও আসছে না। কুকুরদের ঘেউ ঘেউ ডাকও শোনা যাচ্ছে না।

এই যে ঢালু রাস্তা পুব থেকে পশ্চিমে উঠে গেছে—এইটাই এই শহরের শিরদাঁড়া! এরই শেষের দিকে বাড়ি কিনেছে মাধবী। মূল রাস্তা থেকে একটু বাঁদিকে—স্কি-লিফট এর কাছেই। টুরিস্ট সিজনে বাড়ি থেকেই দেখা যায় স্কি-পাগলদের। আট ফুট লম্বা আর চার ইঞ্চি চওড়া কাঠের জুতো পায়ে বেঁধে কী পাগলামিই না করে বরফের ওপর।

মাধবীর গাড়ি এসে গেল বাড়ির সামনে।

দোতলা বাড়ি। পাথর আর কাঠ দিয়ে তৈরি। চমৎকার ডিজাইন। দাঁড়িয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। একতলায় তিনটে বড় জানলা—রাস্তার ওপরেই। ছাদ ঢালু—নীল আর কালো টালি দিয়ে ছাওয়া। সামনের দিকে বিশ ফুট চওড়া বাগান। বুক চিরে চলে গেছে গোল পাথর বাঁধাই রাস্তা। কোমর সমান উঁচু সবুজ ঝোপের বর্ডার দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে এই বাগান আর বাড়িটাকে।

ঝোপের মাঝামাঝি জায়গা থেকে শুরু হয়েছে বাগানের রাস্তা। রাস্তার শেষে বাড়ির উঠোন। সেখানকার নেমপ্লেট রাস্তা থেকেই দেখা যায়: ডা. মাধবী লাহা। নামের পাশে খানকয়েক ডিগ্রী।

মাধবীর গাড়ি এসে দাঁড়াল বাড়ির সামনে। কিন্তু দরজা খুলে কেউ বেরিয়ে এল না। যদিও মাধবী খবর পাঠিয়েছিল আগেই।

বাসন্তী কি ঘুমোচ্ছে? এই অবেলায়?

গাড়ি রাখার ছোট্ট জায়গায় গাড়ি ভিড়িয়ে দিল মাধবী। পরি বললে, ‘ফুটফুটে বাড়ি তো!’

মন্দ বলেনি পরি। শুধু ফুটফুটে নয়, টুকটুকেও বলা যায় ছোট্ট এই বাড়িটাকে। নিজের বাড়ি বলতে তো এতদিন কিছুই ছিল না মাধবীর। এই তার প্রথম নিজস্ব বাড়ি। এ বাড়ির দিকে তাকালেই মনটা শান্ত হয়ে যায়।

এখনও তাই হচ্ছে। এতক্ষণ ভুগছিল চাপা টেনশনে। এখন রিল্যাক্সড। আশপাশের অদ্ভুত পরিবেশ মুহূর্তের জন্যে মুছে গেল মন থেকে।

বললে, ‘একতলার অর্ধেক আমার। অফিস আর ওয়েটিং রুম। বাকি অর্ধেক ব্যাঙ্কের দখলে। তাহলেও সুন্দর বাড়ি। দেখলে মনে হয়, শুধু চেহারায় নয়—চরিত্রেও এ-বাড়ি আর পাঁচটা বাড়ির থেকে আলাদা। তাই নয় কি?’

‘ঠিকই তো।’

এতক্ষণ কথা হচ্ছিল গাড়ির মধ্যে বসে। এবার নেমে আসে বাগানের রাস্তায়। পড়ন্ত রোদ হিমেল হাওয়াকে যেন আয়-আয় করে ডেকে আনছে। কনকনে শৈত্য বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে। মাধবীর গায়ে ফুলহাতা সবুজ সোয়েটার। পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত জিনস ট্রাউজার্স। তা সত্ত্বেও হাড়সুদ্ধ যেন কেঁপে উঠছে। এ-সময়ে অবশ্য এখানকার আবহাওয়ায় এই খেলাই দেখা যায়। দিনে মোলায়েম ভাব—রাতে হাড়কাঁপানো ঠান্ডা।

একটানা অনেকক্ষণ ড্রাইভিং হয়েছে। আড়ষ্ট হয়ে গেছে মাসল। আড়মোড়া ভাঙে মাধবী। মাসল খিঁচে-ধরা তাতে যদি কমে। তারপর ঠেলে বন্ধ করে দেয় গাড়ির দরজা। খটাং আওয়াজটার প্রতিধ্বনি ফিরে আসে ওপরের পাহাড় থেকে, গড়িয়ে নেমে যায় নিচের শহরে। গোধূলির নিথরতায় জাগায় সামান্য শিহরণ—একটিমাত্র শব্দের শিহরণ।

ডাক্তার মাধবী লাহার কানের মধ্যে দিয়েই সেই শব্দ বিচিত্র এক বৈদ্যুতিক তরঙ্গ সৃষ্টি করে মগজের মধ্যে। গোটা মগজটা থমথম করে ওঠে সেই আশ্চর্য ইলেকট্রিক সিগন্যালে। একটিমাত্র শব্দ। মস্ত এক সঙ্কেত।

থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মাধবী। মনে পড়ে যায়, ফ্রেড হয়েলের লেখা বিখ্যাত সেই কল্পবিজ্ঞান উপন্যাসের সংলাপটা। এ সংলাপ মানুষের নয়—এক ইনটেলিজেন্ট কালো মেঘপুঞ্জের। আক্রমণ হেনেছিল সৌরজগতে। ধ্বংস করে এনেছিল পৃথিবীকে। কিন্তু ভালো লেগেছিল বিঠোফেনের বি-ফ্ল্যাট-মেজর সোনাটা।

বলেছিল, ‘শব্দকে আমরা ব্যবহার করি শুধু মনের মতন বৈদ্যুতিক ছন্দের প্যাটার্ন গড়ে নিয়ে ব্রেনকে আরও বেশি কাজে লাগানোর জন্যে।’

শব্দ! ইলেকট্রিক্যাল প্যাটার্ন! সিগন্যাল!

শৈত্যবোধটা আরও বেশি করে ছড়িয়ে পড়ে মাধবীর সারা গায়ে। আস্তে হেঁটে গিয়ে দাঁড়ায় গাড়ির পেছনে। তাকায় শিবালয় শহরের দিকে। শহরের মাঝের দিকে। কোথাও কিছু নড়ছে না।

পরিও তাকিয়েছিল নিচের শহরের দিকে। মুখে ভাসছে খুশি। কথাতেও ঠিকরে আসে উচ্ছ্বাস, ‘দিদিরে, এইখানেই আমি থাকব চিরকাল।’

জবাব দিল না মাধবী। তার মন তখন ছুটছে প্রতিধ্বনির পেছনে। ফিরে তো এল না প্রতিধ্বনির ঢেউ। নামতে নামতে হারিয়েই গেল। বাতাসের নরম শব্দ ছাড়া এখন আর কোনও শব্দ নেই।

সাইলেন্স, সাইলেন্স… খণ্ড খণ্ড নৈঃশব্দ্য বিরাজমান চারিদিকে। কসমিক সাইলেন্সও বুঝি এত ভয়াবহ নয়। নৈঃশব্দ্য তো একরকম হয়—একই চেহারার আর চরিত্রের হয়—সাহিত্যিকরা এককথায় বলেন অখণ্ড নৈঃশব্দ্য।

কিন্তু মাধবীর তো তা মনে হচ্ছে না। যেন অগুন্তি নৈঃশব্দ্য খণ্ড খণ্ড চেহারা আর চরিত্র নিয়ে ভাসছে তার চারপাশে। রাতের শ্মশানে টের পাওয়া যায় এই নৈঃশব্দ্যকে—টের পাওয়া যায় গোরস্থানে—মৃতদেহকে ঘিরে গড়ে ওঠে যে কালান্তক নৈঃশব্দ্য—এ যেন তাই।

ধাঁধায় পড়ে মাধবী। হঠাৎ এ-ধরনের ভাবনা মনের মধ্যে চেপে বসছে কেন, তা বুঝে ওঠে না। নৈঃশব্দ্য তো তার কাছে নতুন কিছু নয়। শব্দের উৎপাত অসহ্য লাগে তার কাছে বরাবরই। কিন্তু কখনও তো এমনভাবে ভাবেনি যে নৈঃশব্দ্যরও অনেক চেহারা, অনেক চরিত্র থাকতে পারে। এই মুহূর্তে টুঁটি টিপে ধরা বিশেষ এই নৈঃশব্দ্যটাকেই বা শ্মশানে অথবা গোরস্থানের নৈঃশব্দ্য বলে মনে হচ্ছে কেন? এই পাহাড়ি অঞ্চলে গরমকালের রাতের নৈঃশব্দ্য সে উপভোগ করেছে মনপ্রাণ দিয়ে। সে বড় মিঠে নৈঃশব্দ্য। যদিও তা নিরেট নৈঃশব্দ্য নয় মোটেই। ঝাঁকে ঝাঁকে পোকাদের উৎপাত চলে জানালার বন্ধ সার্সির ওপর। বাইরের বাগানে সমানে গান গেয়ে যায় ঝিঁঝিঁ পোকা। নিশাচর পাখি মাঝে মাঝে ডানা ঝাপটায়। হাওয়ায় মাঝে মাঝে অদ্ভুত আলোড়ন। সব আওয়াজ মিলে মিশে গিয়ে ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর হয়ে যখন তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করে—তখন তা নিছক নৈঃশব্দ্য না হলেও—শব্দের জগতে তার ঠাঁই নেই। এছাড়াও শহরের নিদ্রা যখন গাঢ় হয়, তখন জাগ্রত হয় আর একরকম নৈঃশব্দ্য। গোটা শহরটা ঘুমিয়ে থেকেও যেন জেগে থাকে। নিঃশব্দে বলতে থাকে—দেখ, দেখ, ঘুমন্ত নগরীকেও তুমি টের পাচ্ছ মনের কান দিয়ে।… এই নৈঃশব্দ্যকেও ভালোবেসেছে মাধবী। অতীন্দ্রিয় অনুভূতি দিয়ে উপলব্ধি করেছে, নিশীথ নগরীর নীরব সংলাপ।

কিন্তু এইমাত্র যে নৈঃশব্দ্য করাল দাঁতের কামড় মেরে বসে গেল তার অণু পরমাণুতে—এই রকম নৈঃশব্দ্য তো কখনও শোনেনি মাধবী। শীতের রাতের হাড় হিমকরা নৈঃশব্দ্যের চেয়েও এর কামড় অনেক বেশি ভেতরে প্রবেশ করেছে শুধু একটাই কারণে…

অতলান্তই শুধু নয়—এর অতলে রয়েছে আতঙ্ক—অজানা আতঙ্ক—মুখ বুজে ঘাপটি মেরে রয়েছে তারা নৈঃশব্দ্যের মধ্যে… সুযোগ পেলেই মাথা তুলবে—নৈঃশব্দ্যকে খান খান করে ছাড়বে…

আর ঠিক এই কারণেই নার্ভাস হয়ে যায় মাধবী। ভয়-ভয় ভাবটা প্রকটতর হয়ে ওঠে। অবাঙমানসগোচর ভয় সহস্র প্যাঁচ মেরে ঘিরে ধরে ওর তনুমনকে…

যেন এক দানবিক অট্টহাসির পৈশাচিক অট্টরোল ফেটে পড়ার আগে শক্তি সঞ্চয় করে চলেছে নৈঃশব্দ্য নিতলের অন্ধকূপে।

গলা ফাটিয়ে চেঁচাবে মাধবী? সে সাহসও হচ্ছে না। প্রতিবেশীরা যদি দলে দলে বেরিয়ে আসে? ওর নার্ভাসনেস দেখে অনুকম্পার চোখে তাকায়? সে যে ডাক্তার—ভয় পাওয়া তো তাকে সাজে না।

মুগ্ধ নয়নে পাহাড়ি গাঁয়ের দিকে চেয়ে থেকে বললে পরি, ‘এমন সুন্দর জায়গা ছেড়ে আমি কিন্তু যাচ্ছি না কোথাও। শান্তি… শুধু শান্তি!’

শান্তি? তা রয়েছে বটে। উপদ্রবের ছায়াও দেখা যাচ্ছে না। তবে কেন অনাহূতদের অস্তিত্ব টের পেয়ে এমন সিঁটিয়ে যাচ্ছে মাধবী? ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়? অতীন্দ্রিয় অতি-অনুভূতি বোধ? পাঁচটা ইন্দ্রিয়র বাইরের বিরাট জগৎ ওঁত পেতে থাকে তো অহোরাত্র—জীবজন্তুরা টের পায়—মানুষ সবসময় টের পায় না—মাধবীর মনের মধ্যে সেই শক্তির অকস্মাৎ উদয় ঘটছে কেন?

বোগাস! ছায়া দেখে চমকে উঠছে মাধবী। অল ননসেন্স!

গাড়ির পেছনকার ট্রাঙ্ক খোলে মাধবী। তুলে আনে পরির একটা বড় সুটকেস। তারপর আর একটা। দ্বিতীয় সুটকেসটা ধরে নামিয়ে নেয় পরি। হাত বাড়ায় ট্রাঙ্কের মধ্যে বাইরের ব্যাগটার দিকে।

‘বেশি বোঝা নিসনি। বারে বারে নিয়ে যাবি।’

বইয়ের ব্যাগ আর সুটকেস নিয়ে লন পেরিয়ে চলে আসে দু’জনে পাথর দিয়ে বাঁধানো পথে। পথের শেষে গাড়িবারান্দা। ছায়া জমছে সেখানেও। যেন ছায়ার ফুল ফুটছে। একে-একে পাপড়ি মেলে ধরছে।

সামনের দরজা খুলে ধরল মাধবী। পা ফেলল ভেতরে। হাঁক দিল, ‘বাসন্তী?’ জবাব নেই।

‘বাসন্তী, আমরা এসে গেছি।’

আওয়াজ মিলিয়ে গেল বাড়ির মধ্যেই। ভেতরের নৈঃশব্দ্য টুক করে গিলে নিল চড়া গলার ডাককে।

হলঘরের শেষ প্রান্তে জ্বলছে একটা আলো। বাড়ির আর কোথাও কোনও আলো জ্বলছে না। আলোটা জ্বলছে রান্নাঘরে। দরজাটা দু’হাট করে খোলা।

হাতের সুটকেস মেঝেতে নামিয়ে রাখল মাধবী। সুইচ টিপে জ্বালল হলঘরের আলো। ডাকল, ‘বাসন্তী?’

‘বাসন্তী কে, দিদি?’ হাতের বই-ব্যাগ আর সুটকেস মেঝেতে নামিয়ে রাখতে রাখতে বললে পরি।

‘বলতে পারিস আমার হাউস-কীপার। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ—সবই করে। ও তো জানে এখন আমরা আসব। সাড়া দিচ্ছে না কেন? হয়তো রাতের রান্না নিয়ে মশগুল।’

‘কানে কালা বোধহয়?’

‘আরে না।’

‘এখানেই থাকে?’

‘হ্যাঁ। গ্যারেজের ওপরে মেজানিন ফ্লোরে,’ কথা বলতে বলতে গাড়ির চাবি

আর মানিব্যাগ ড্রয়ারের মধ্যে রেখে দেয় মাধবী। আয়না লাগানো দেওয়ালে সাঁটানো ছোট বাহারি টেবিলের ড্রয়ার। পেতলের ফ্রেম দিয়ে বাঁধানো আয়না।

দেখেই ভালো লাগে পরির, ‘খুব বড়লোক তো তুমি। এমন সুন্দর আয়না—চব্বিশ ঘণ্টা কাজের লোক—’

হাসে মাধবী, ‘তোর মাথা! বাসন্তীর জন্যে খরচ তো করতেই হবে রুগি দেখব, না হাঁড়ি ঠেলব?’

‘বাসন্তী বোধহয় ওর ঘরে রয়েছে—চলো যাই।’

‘তাহলে রান্নাঘরের আলো জ্বলবে কেন? আগে চল রান্নাঘরে।’

হলঘর পেরতে থাকে মাধবী—পেছনে পরি।

এসে গেছে রান্নাঘর। বেশ বড়। সিলিং বেশ উঁচুতে। ঘরের মাঝখানে রান্নার জন্যে বড় টেবিল। চারটে ইলেকট্রিক বার্নার রয়েছে সেখানে, একটা গ্রিল, খানিকটা জায়গা কুটনো কাটা আর ময়দা মাখার জন্যে। মাথার ওপর থেকে ঝুলছে চকচকে স্টেনলেস স্টিলের ইউটিলিটি র‍্যাক। হাতা, চামচে, খুন্তি, বাটি, থালা—সবই লাগানো রয়েছে সেখানে—হাত বাড়ালেই যাতে পাওয়া যায়। টেবিল-কাউন্টারের ওপরটা সেরামিক টালি দিয়ে বাঁধানো। নিচের ক্যাবিনেটগুলো কালচে পালিশের কাঠ দিয়ে তৈরি। ঘরের শেষপ্রান্তে রয়েছে একজোড়া ওয়াটার বেসিন, একজোড়া গ্যাস উনুন, একটা মাইক্রোওয়েভ উনুন, আর একটা রেফ্রিজারেটর।

ঘরে ঢুকেই বাঁয়ে মোড় নিয়েছিল মাধবী, এগিয়ে গেছিল দেওয়ালের গায়ে লাগানো ছোট্ট লেখবার টেবিলটার দিকে। এই টেবিলে বসেই খাবারের মেনু বানায় বাসন্তী, বাজারের ফর্দ তৈরি করে, হিসেব লেখে। বাইরে কোথাও গেলে, এইখানেই চিরকুট লিখে রেখে যায়—যাতে মাধবী বাড়ি ফিরেই পড়ে নেয়। কিন্তু সেরকম চিরকুট নেই টেবিলে। ঘুরে দাঁড়াতে যাচ্ছে মাধবী, এমন সময়ে কানে ভেসে এল পরির অস্ফুট চিৎকার। জোরে নিঃশ্বাস নিয়েই থেমে গেল হঠাৎ।

পরি মাঝের রান্নার টেবিল ঘুরে এগিয়ে গেছিল ভেতর দিকে—টেবিলের শেষের দিকে। সে এখন দাঁড়িয়ে আছে রেফ্রিজারেটারের পাশে, চোখ দুটো ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে কোটর থেকে, চেয়ে আছে মেঝের দিকে। বিস্ফারিত

চাউনি নিবদ্ধ রয়েছে জোড়া বেসিনের মাঝে—তলার মেঝেতে।

দূর থেকে এইটুকু দেখেই আতঙ্ক ফেটে পড়ল মাধবীর অণু-পরামাণুতে। জোরে পা চালিয়ে এগিয়ে গেছিল মাঝের বড় টেবিল ঘুরে পরির দিকে।

মেঝেতে শুয়ে রয়েছে বাসন্তী। চিৎ হয়ে মারা গেছে। দু’চোখের পাতা পুরো খোলা, কিন্তু সে চোখে প্রাণ নেই। ফুলে ঢোল হয়ে রয়েছে ওপরের ঠোঁট আর নিচের ঠোঁট। চেপে বসেছে জিবের ওপর। ঠেলে বেরিয়ে রয়েছে জিব—তাতে গোলাপি ভাব নেই—বিবর্ণ।

চকিতে এই দৃশ্য দেখেই চোখ সরিয়ে নিয়েছিল মাধবী। তাকিয়েছিল ছোট বোনের দিকে।

মাধবীর পায়ের আওয়াজ পেয়ে পরির ঘোর কেটে গেছিল। ডেডবডির দিক থেকে চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে চেয়েছিল দিদির দিকে।

মাধবী ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল টেবিলের অন্যদিকে—ডেডবডি যেখান থেকে দেখা যায় না। বসাল টেবিলের সামনের চেয়ারে।

আস্তে আস্তে সহজ হয়ে আসে পরির দুই ঠোঁট। এতক্ষণ ছিল শক্ত। বললে, ‘ওই কি বাসন্তী?’

‘হ্যাঁ।’

‘কীরকম চেয়ে রয়েছে বলো? ফোলা সমস্ত শরীর… কালসিটে সারা গায়ে মুখে… চাউনিটা কী ভীষণ… অত কালসিটে কেন, দিদি?’

‘বেশ কয়েকদিন মড়া পড়ে থাকলে অমন তো হবেই।’

‘পচা গন্ধ তো নেই!’

ভুরু কুঁচকে যায় মাধবীর। দিন কয়েক আগে মারা গেলে শরীর কালচে মেরে যেতে পারে, ফুলেও উঠতে পারে—পচা গন্ধ তো থাকা উচিত।

ফের বলে পরি, ‘মুখের ভাব অমন বিকট কেন? চাউনি অমন কেন? দেখছে কাকে?’

কী বলবে মাধবী?

পরিই বলে গেল, ‘চেঁচিয়ে উঠেছিল বাসন্তী—মরে গেছে চেঁচানি শেষ হওয়ার আগেই।’

না, এরকম মড়া মাধবী লাহা কক্ষনো দেখেনি। পাশে হাঁটু গেড়ে বসে একদৃষ্টে

চেয়েছিল মাধবী। চেনা মানুষের ডেডবডি এত বিকৃত হলে মনের মধ্যে কষ্ট তো জাগবেই।

গোটা মুখখানা ফুলে গেছে। ফুলে উঠেছে শরীরটাও। বাসি মড়া ফুলে ওঠে ঠিকই, কিন্তু সেই ফোলা আর এই ফোলায় আকাশ-পাতাল তফাত। তার চেয়েও বড় কথা, বাসি মড়ার পাশে বসলে নাকে দুর্গন্ধ ভেসে আসবেই। বাসন্তীর মড়া থেকে কোনও বাজে গন্ধ বেরচ্ছে না।

আরও খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে মাধবী দেখল, কালচে আর ফেটে-ফেটে যাওয়া চামড়ার এহেন অবস্থা তো টিস্যু পচন থেকে হয়নি। পচন যদি শুরু হয়ে থাকে, তাহলে তার জের এখনও চলা উচিত। অথচ এত ঠাহর করেও সেরকম কোনও লক্ষণ মাধবীর চোখে ধরা পড়ছে না। ফোস্কা নেই, ফুসকুড়ি নেই, গলে যাওয়া নেই, ক্ষত নেই। রস পর্যন্ত গড়াচ্ছে না। শরীরে পচন ধরলে তার প্রথম প্রকাশ ঘটে চোখে—কেননা শরীরের অন্য টিস্যুদের চেয়ে অনেক নরম টিস্যু দিয়ে তৈরি হয় চোখ। কিন্তু বাসন্তীর চোখ তো চমৎকার রয়েছে। পচনের চিহ্নমাত্র নেই। চোখের মণিদুটোও পরিষ্কার। ঘোলাটে ভাব দেখাই যাচ্ছে না—মৃত্যুর পর যেরকম দেখা যায়।

এই চোখ যখন জীবন্ত ছিল, তখন সেখানে অষ্টপ্রহর খুশির জোনাকি নেচে নেচে বেড়াত। আর ভাসত মমতা। বয়সে বাষট্টি হতে পারে, মাথার সব চুল পেকে সাদা হয়ে যেতে পারে—তবুও মুখখানা ভারী মিষ্টি ছিল বাসন্তীর। ঠাকুমা-দিদিমাদের মতন মায়া-মমতায় ভরা সিগ্ধ শীতল। কখনও নরম, কখনও শক্ত গলায় শাসন করে গেছে মাধবীকে—যেন দুষ্টু নাতনি। কথার টানে নেপালি ছোঁয়া থাকত—কিন্তু বাঙালিয়ানা ছিল বেশির ভাগ। গান গাইত বড় মিষ্টি গলায়। রান্না করতে করতে করতে গান, বেসিন ধুতে ধুতে গান—গান ছাড়া বুড়ির জীবনে যেন আর কিছুই ছিল না। সেই গান এ বাড়িতে আর শোনা যাবে না।

মাধবী যতই চায় ততই মনে হয়, চামড়া যেন থেঁতলে গেছে। সারা গায়ে বুঝি কালসিটে ছড়িয়ে পড়েছে। কোথাও কালো, কোথাও নীল, কোথাও কালচে-হলদে—কোথাও একটা রঙের ওপর আর একটা চেপে বসেছে। চামড়াকে ভয়ানক ভাবে থেঁতলানো না হলে এরকম রং ফুটে ওঠে না। কিন্তু থেঁতলানি তো শরীরের এক-আধটা জায়গায় থাকা উচিত—শরীরময় এরকম থেঁতলানি যে একেবারেই নতুন ঘটনা। চামড়ায় এক ইঞ্চি জায়গাও বাদ নেই। প্রতি বর্গ ইঞ্চি চামড়াকে থেঁতলে পিটিয়ে ঘা দিয়ে কালসিটে ফেলে দেওয়া হয়েছে।

মুখের প্রতি সেন্টিমিটারেও সেই থেঁতলানির চিহ্ন। নোড়া দিয়ে যেন ধরে ধরে পেটানো মুখের সমস্ত চামড়া—এতটুকু ফাঁক রাখা হয়নি কোত্থাও। ভাঙচোর নেই কোনওখানে—গাড়ির অ্যাকসিডেন্ট ঘটলে যেমন দেখা যায়—এই রকম কালসিটে মেরে যায় গোটা মুখ—কিন্তু হাড়গোড় তো আস্ত থাকে না—যা রয়েছে এই মুখে—নাক চিবুক ঠোঁট চোয়াল—সবই রয়েছে আস্ত।

মেপে মেপে পিটিয়ে গেলে এইরকম কালসিটে দেখা দিতে পারে। কিন্তু তা কি সম্ভব?

আর একভাবে এই কালসিটে দেখা দিতে পারে। গোটা শরীরটাও বিরং হয়ে যেতে পারে। চাপটা যদি আসে শরীরের ভেতর থেকে। চামড়ার ঠিক নিচেই যে টিস্যু রয়েছে, সেই টিস্যু ফুলে উঠলে চামড়ার রং এইভাবে পালটে যেতে পারে। কিন্তু আপাদমস্তক এইরকম নিখুঁত থেঁতলানি আর কালসিটের ভাবকে ফুটিয়ে তুলতে হলে ফোলানিটা হওয়া উচিত আচমকা—ভয়ানক বেগে—অবিশ্বাস্য জোরে যদি না হয়, চামড়ায় সেরকম চাপ তো পড়বে না—কালসিটে আর থেঁতলানি জাগানোর মতন চাপ সৃষ্টি হবে না।

কিন্তু তা কি সম্ভব? না, কক্ষনো না।

শরীর কখনও দুম করে ফুলে বেলুন হতে পারে না—চামড়ায় অ্যাকসিডেন্টের এফেক্ট ফেলতে পারে না। জীবন্ত টিস্যু কখনওই এত বেগে হু-উ-উ-স করে ফুলে ওঠে না। কিছু কিছু অ্যালার্জি-কেসে হঠাৎ ফুলুনি বিচিত্র নয়—সবচেয়ে প্রকট ঘটনাটা দেখা গেছে পেনিসিলিনে যাদের অ্যালার্জি আছে, তাদের ক্ষেত্রে। কিন্তু এমন কোনও কারণের সন্ধান আজও পায়নি মাধবী যা মানুষের শরীরকে ধাঁ করে ফুলিয়ে তুলতে পারে, চক্ষের নিমেষে শরীরময় কুৎসিত কদাকার কালসিটের ছাপ মেরে যেতে পারে… প্রতি বর্গ সেন্টিমিটার চামড়াকে থেঁতলে দিতে পারে…

গোটা শরীরটার এইভাবে ফুলে ওঠাকে ময়না-তদন্ত স্ফীতি বলেও চালিয়ে দেওয়া যায় না। এরকম স্ফীতি অবশ্য কালেভদ্রে দেখা যায়—তখন তাকে ক্লাসিক কেস বলা যায়।

কিন্তু এ কেস সে কেস নয়; এ বিষয়ে তিলমাত্র সন্দেহ নেই মাধবীর মনে। থেঁতলানির জন্যেও যদি বা হয়, শরীর ফুলবে কেন? প্রথম খটকা তো সেইখানেই।

তাহলে কি বিষ প্রয়োগ? খুবই বিরল বিশুদ্ধ বিজাতীয় বিষ না হলে তো এমন কাণ্ড সম্ভব নয়। বিষবিজ্ঞানে আজও এমন বিষের কথা লেখা হয়েছে বলে মাধবীর মনে হয় না। তার চাইতেও বড় কথা, আশ্চর্য এই বিষের সান্নিধ্যে এল কীকরে বাসন্তী? বিষ ওর শরীরে ঢুকল কীকরে? বাসন্তীর তো কোনও শত্রু নেই।

বিষ নয়, বিষ নয়—অন্য কিছু।

বেকুব বনে যাচ্ছে মাধবী। আজ পর্যন্ত চিকিৎসাশাস্ত্র সম্বন্ধে যতটুকু জেনেছে সেই জ্ঞানের নিরিখে বাসন্তীর মৃত্যুর কোনও যুক্তিগ্রাহ্য কারণই খুঁজে পাচ্ছে না। হঠাৎ মাথার মধ্যে একটা চমক। নতুন কোনও সংক্রামক রোগ নয় তো?

‘দিদি!’ পরির গলায় উৎকণ্ঠা।

সাড়া দিল না মাধবী। ওর চেতনা জুড়ে তখন সাইক্লোন উঠেছে।

ডেডবডিতে এখনও আঙুল ছোঁয়ায়নি মাধবী। এখন মনে হল, জামাকাপড় না ছুঁলেও বুঝি ভালো হত। ছিটকে গিয়ে সিধে হয়ে দাঁড়ায় তক্ষুণি—সরে আসে মৃতদেহের কাছ থেকে।

হিমেল স্রোত নেমে যায় শিরদাঁড়া বেয়ে।

সেই প্রথম চোখ পড়ে বেসিনের পাশে কাটিং বোর্ডের ওপর। সেখানে রয়েছে চারটে বড় আলু, অর্ধেক কাটা কপি, একটা থলি, খানকয়েক গাজর, একটা লম্বা ছুরি, খোসা ছাড়ানোর একটা বিশেষ ছুরি। রান্নার আয়োজনে ব্যস্ত ছিল বাসন্তী—মরেছে তক্ষুণি। আচমকা। জিনিসপত্র সরিয়ে রাখবারও অবসর পায়নি। খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে হঠাৎ আছড়ে পড়েছে দুই বেসিনের মাঝের জায়গায়।

প্লেগ নয় তো?

প্লেগ—বিউবোনিক অথবা অন্য ধরনের—মানুষের আস্তানায় হানা দিয়েছে বহুবার পৃথিবীর নানান অঞ্চলে। এ অঞ্চলে তার আদিম নৃত্য কখনও ঘটেছে বলে মাধবীর জানা নেই—সম্প্রতিও কোনও কেস মাধবীর গোচরে আসেনি। এলেও তার চিকিৎসা আজকাল আর দুর্ঘট নয়। কিছু প্লেগের ক্ষেত্রে চামড়ায় পেটেকিয়া দেখা দেয়। ছোট ছোট লালচে-বেগুনি স্পট। রক্তক্ষরণের জন্যে। কখনও দাগগুলো কালচে মেরে যায়—গোটা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। মধ্যযুগে একেই বলা হত ‘ব্ল্যাক ডেথ’—কালো মৃত্যু। কিন্তু বাসন্তীর গোটা দেহ যেভাবে কালো হয়ে গেছে—যেভাবে মসীবর্ণ ধারণ করেছে—নিশ্চয় অগুন্তি পেটেকিয়া থুকথুক করছে চামড়ার প্রতিটি লোমকূপে। তা কি সম্ভব?

তা ছাড়া, হঠাৎ মারা গেছে বুড়ি। প্লেগ কক্ষনো নয়। কোনও সংক্রামক ব্যাধিই নয়।

মারধরের চিহ্ন নেই। রক্ত ঝরছে না কোত্থাও। গুলিবিদ্ধ হলে ক্ষত থাকত—তা-ও নেই। ছুরিকাঘাতের ছিদ্রও নেই। গলা টিপে ধরা হয়নি। পিটিয়ে নিকেশ করার কোনও লক্ষণ নেই।

ডেডবডিকে একপাক ঘুরে নিয়ে বেসিনের পাশে কাউন্টারে গিয়ে দাঁড়ায় মাধবী। ফুলকপির গায়ে আঙুল ছুঁইয়েই চমকে ওঠে। এখনও কনকনে ঠান্ডা। খুব জোর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ফ্রিজ থেকে বের করে রাখা হয়েছে কাটিং বোর্ডে।

বুড়ি মরেছে একঘণ্টার মধ্যেই। শরীর এখনও উষ্ণ থাকা উচিত। কিন্তু মরল কীভাবে? মারল কে?

পরিকে নিয়ে পাশের ঘরে চলে এল মাধবী। একটা অনিশ্চিত নৈঃশব্দ্য চেপে বসেছে গোটা বাড়িতে। হলঘরের কার্পেটের ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময়ে জুতোর ঘষটানি লেগে যে ফিসফিসানি—তাও যেন বজ্রধ্বনির মতন জোরালো শোনাচ্ছে কানে।

মাধবীর এই অফিসঘর ইদানীংকালের ডাক্তারদের মতন নয়। অত্যাধুনিক। ঘরের মাঝখানে একটা মস্ত টেবিল। পরিকে সেখানে বসিয়ে টেলিফোনের রিসিভার তুলে নিল মাধবী—উদ্দেশ্য, শিবালয় টাউনের শেরিফকে ফোন করবে। কিন্তু ডায়ালটোন পাওয়া গেল না। খুব নরম একটা হিস-হিস শব্দ ছাড়া আর কোনও আওয়াজ নেই। রিসিভার রেখে দিয়ে ফের তুলল মাধবী। সেই একই হিসহিস আওয়াজ। টেলিফোনও মরে গেছে।

এ বাড়িতে আর নয়। একটা মুহূর্তও আর নয়। উঠে দাঁড়ায় মাধবী, ‘পরি, চল।’

‘কোথায়?’

‘পাশের বাড়িতে। ফোন করব। এ ফোন ডেড।’

আস্তে আস্তে দরজা ঠেলে খুলে দেয় মাধবী। বুক ধড়াস ধড়াস করছে। বিকটদেহী নিশ্চয় কাউকে দেখবে দাঁত খিচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দরজার পাশে।

কেউ নেই। ঘর ফাঁকা।

দ্রুত এগিয়ে গেল দু-জনে। হলঘরের বাঁদিকে রয়েছে দোতলায় ওঠবার সিঁড়ি। মাধবী চেয়ে ছিল সেই দিকেই। কিন্তু সিঁড়ি থেকে লাফ দিয়ে নেমে এল না কোনও নরখাদক।

কেউ নেই সিঁড়িতে। কেউ নেই হলঘরে। কেউ নেই গাড়িবারান্দায়।

বাইরের গোধূলি দ্রুত ম্লান হয়ে যাচ্ছে রজনীর আবির্ভাবে। লক্ষ লক্ষ বিবর থেকে লক্ষ লক্ষ ছায়া। দানবরা গুটি গুটি বেরিয়ে আসছে দিবসের অবসান ঘটাবে বলে। এখুনি নিশ্ছিদ্র তমিস্রার আবির্ভাব ঘটবে গোটা শহরে।

বড়জোর আর দশ মিনিট।

সূর্য মজুমদার বাড়ি করেছিলেন খাসা। মাধবীর বাড়িকে ম্লান করে দিয়েছিলেন নকশার বাহাদুরিতে। পাশাপাশি দুটো বাড়ি। মাধবীর বাড়ি ছিমছাম। সূর্য মজুমদারের বাড়ি দেখলে চোখ কপালে ওঠে।

ডোরবেল পুশ করল মাধবী। মোলায়েম বাজনা বেজে উঠল ভেতরে। দরজা ছেড়ে একটু সরে এল—নিজের বাড়ি থেকে যদি কোনও ভাইরাস নিয়ে এসে থাকে—প্রতিবেশীর বাড়িতে তা ঢোকাতে চায় না। দরজায় কেউ এসে দাঁড়াল না। একসময়ে থেমে গেল মিউজিক। বেজে চলল কেবল ক্লাসিক্যাল মিউজিক। বিঠোফেনের মিউজিক। সূর্য মজুমদার বোধহয় মোহিত হয়ে রয়েছেন সুরের জগতে।

আবার বেল টেপে মাধবী। ডোরবেল মিউজিক বাজল, ধাপে ধাপে ফুলল, ধাপে ধাপে কমল, থেমে গেল। কেউ এল না দরজায়।

বেজে চলেছে বিঠোফেন।

‘বাড়িতে কেউ নেই মনে হচ্ছে,’ বললে পরি।

‘কেউ না থাকলে আলো জ্বলছে কেন, মিউজিক চলছে কেন?’

আচমকা একটা ঘূর্ণিঝড় তোলপাড় করে দিল গাড়িবারান্দার খানিকটা জায়গা। বাতাসের ঘুরন্ত ব্লেডে ছিঁড়েখুঁড়ে গেল মিষ্টি বিঠোফেন মিউজিক। বেতাল বাজনা খচমচ করে আছড়ে পড়ল কানে।

মাধবী ঠিকরে গেল দরজার সামনে। এক ঠেলায় দু’হাট করে দিল পাল্লা। আলো জ্বলছে স্টাডিরুমে—হলঘরের বাঁদিকে। দুধেলা প্রভা স্টাডির খোলা দরজা পেরিয়ে এসে পড়েছে হলঘরে—অন্ধকার লিভিংরুমের কিনারা পর্যন্ত!

‘পরমা? কুশল?’ ডাক দেয় মাধবী।

সাড়া নেই।

বিঠোফেনের বাজনা ছাড়া আর কোনও আওয়াজ নেই। ঘূর্ণিবায়ু প্রশমিত হয়েছে। মিউজিক তাল ফিরে পেয়েছে।

গলা চড়ায় মাধবী, ‘সাড়া নেই কেন? বাড়ি কি খালি?’

সিম্ফনি শেষ হয়ে গেল। নতুন মিউজিক আর শুরু হল না। নৈঃশব্দ্য।

‘সূর্যবাবু, আপনি কোথায়?’

গোটা বাড়ি নিস্তব্ধ। রজনী গাঢ়তর হচ্ছে।

পরি ঠোঁট কামড়ে ধরেই ছেড়ে দিল।

বললে, ‘দিদি, কিছু বুঝতে পারছ?’

মাধবীও তা উপলব্ধি করছিল। বললে আস্তে, ‘হ্যাঁ, পারছি। এখানে আর কেউ বা কারা রয়েছে। তাদের দেখা যাচ্ছে না।’

পেছনের লনে কেউ নেই। জানলার কাচের আড়ালে কেউ দাঁড়িয়ে আছে কি? বাইরে থেকে তাকে দেখা যাচ্ছে না—ভেতর থেকে সে কিন্তু দেখছে দুই বোনকে—মুখে চাবি দিয়ে। কিন্তু কেন?

শরীরের জার্মস পাছে বাড়ির মধ্যে চালান হয়ে যায় বলে এতক্ষণ দ্বিধা করেছিল মাধবী, এখন আর করল না। পরির হাত ধরে ঢুকল বাড়িতে। দাঁড়াল হলঘরের ঠিক মাঝখানে। বাঁদিকের দরজা খোলা—দুটো আলো জ্বলছে সে ঘরে। সব কিছুই দেখা যাচ্ছে—শুধু মানুষ ছাড়া। ঘর ফাঁকা। সূর্য মজুমদারের ফ্যামিলির কেউ নেই ও ঘরে।

তা সত্ত্বেও প্রত্যেকের নাম ধরে ধরে ডেকে গেলে মাধবী। ফিরে এল প্রতিধ্বনি।

নৈঃশব্দ্য যেন ওঁত পেতে রয়েছে মওকার অপেক্ষায়। এখুনি দেখা যাবে তার কায়া—অতিবড় দুঃস্বপ্নেও যে কায়াকে কল্পনা করা যায় না।

হলঘরের ডানদিকের লিভিংরুমে থই থই করছে তমিস্রা। দরজা ভেজানো রয়েছে। তবুও সেইদিকেই এগিয়ে গেল মাধবী। দরজার পাশের সুইচ টিপে আলো জ্বালল। কেউ নেই লিভিংরুমে। এ ঘরেই রয়েছে টেপডেক আর স্টিরিয়ো রেকর্ড প্লেয়ার। বিঠোফেনের মিউজিক বাজছিল এখানেই। গান চালু করে দিয়ে সপরিবারে বেরিয়ে গেছেন সূর্য মজুমদার।

এ ঘরের পাশেই ডাইনিং রুম। ডাবল ডোর ঠেলে ঢুকল মাধবী।

না, এখানেও কেউ নেই। ওপরে জ্বলছে ঝাড়লণ্ঠন—নিচের টেবিলে সাজানো চারজনের খাবার। শরবতে ভাসছে বরফের টুকরো—এখনও গলে যায়নি। মাংস ঠান্ডা মেরে এলেও এখনও চর্বির স্তর পড়েনি।

খুব জোর আধঘণ্টা আগে লোক ছিল এ ঘরে। খাওয়া চলছিল। তারপরেই আচমকা চারজনেই চলে গেছে। একখানা চেয়ার উলটে রয়েছে। চেয়ারের পাশে পড়ে রয়েছে একটা চামচ—ঘরের কোণে আর একটা।

নিশ্চুপ দুই বোন। অসহ্যতর হয়েছে সেই অব্যাখ্যাত অনুভূতিটা—নজরে রাখা হয়েছে দুজনকেই—তাদের দেখা যাচ্ছে না—তারা কিন্তু পলকহীন নয়নে দেখছে মাধবী আর পরিকে।

প্যারানোইয়া—মনের রোগ—মনকে প্রবোধ দেয় মাধবী।

পরি কিন্তু ফিসফিস করে বলে অন্য কথা, ‘বার্মুডা ট্র্যাঙ্গেল’ বইটা পড়েছ? মেরী সিলেস্টি… বড় জাহাজ… পাল তোলা… ১৮৭০ সাল কি ওই সময়ের কথা… হঠাৎ জাহাজটাকে ভাসতে দেখা গেছিল আটলান্টিকের মাঝখানে… টেবিলে খাবার সাজানো রয়েছে… কিন্তু মাঝিমাল্লা সব উধাও হয়ে গেছে… ঝড়ে জখম হয়নি জাহাজ… খোলে ফুটো হয়নি… লাইফবোট জাহাজেই রয়েছে… আলো জ্বলছে… পাল খাটানো রয়েছে… কোনও কারণ ঘটেনি জাহাজ ছেড়ে চলে যাওয়ার… অথচ খেতে বসেও কেউ খায়নি—আচমকা অদৃশ্য হয়ে গেছে… ঠিক এই ঘরের চারজনের মতন।

শুকনো হেসে মাধবী বললে, ‘বই পড়ে তোর মাথা বিগড়েছে। এখানে ও সব মিস্ট্রি নেই। হাওয়ায় মিলিয়ে যায়নি চারজনে।’

‘তাহলে গেল কোথায়?’

এ বাড়ির দস্তুরই আলাদা। টেলিফোন থাকে রান্নাঘরে। খাবার ঘরের দরজা ঠেলে সে ঘরে ঢুকল দুই বোন। সুইচ টিপে আলো জ্বালল মাধবী। টেলিফোন রয়েছে বেসিনের পাশে দেওয়ালের তাকে। রিসিভার তুলে নিয়ে কানে লাগিয়ে রইল মাধবী। ডায়াল টোন আসছে না। টেলিফোন মরে গেছে।

কিন্তু একেবারে ডেড হয়নি। তাহলে কোনও শব্দ শোনা যেত না। নিজের বাড়িতে টেলিফোন তুলেও ডায়াল টোন পায়নি, শুধু একটা নরম হিসহিস আওয়াজ ছাড়া কোনও শব্দ শুনতে পায়নি। কিন্তু এখানকার লাইন সে রকম নয়, ওপেন লাইন—ইলেকট্রনিক স্ট্যাটিক্স-এর নরম হিসহিস শোনা যাচ্ছে। ডেড হলে এ-আওয়াজ তো শোনা যেত না।

রিসিভারের তলায় স্টিকারে লেখা রয়েছে দমকল আর পুলিশের ফোন নাম্বার। ডায়াল টোন না থাকা সত্ত্বেও পুলিশ নাম্বারের বোতামগুলো টিপে গেল মাধবী। কিন্তু কানেকশন পেল না।

ফের একই নাম্বারের বোতামগুলোয় আঙুল চালানোর ইচ্ছে ছিল, কিন্তু তার আগেই মনে হল, টেলিফোনে কেউ যেন আড়ি পেতে রয়েছে। কান খাড়া করে শুনচ্ছে।

‘হ্যালো!’ ডাক দেয় মাধবী।

বহুদূরের সেই স্ট্যাটিক শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই।

টেলিফোনের লাইন ‘ওপেন’ থাকলে নিশ্চয় এইরকম আওয়াজই শোনা যায়—মনে মনে বলে মাধবী। লাইন ‘ক্লোজড’ হলে কোনও আওয়াজ শোনা যেত না।

কেউ যেন লাইনের অপর প্রান্তে বসে রয়েছে। মটকা মেরে রয়েছে। উৎকর্ণ হয়ে রয়েছে। মাধবীর প্রতিটি কথা গিলে গিলে খাচ্ছে। নিজে টুঁ শব্দ করছে না।

এমন শীতে গা-ঘামার কথা নয়। মাধবীর গা কিন্তু ঘেমে ওঠে। চাপা চিন্তাটা ঠেলে ঠেলে ওপরে উঠে আসতে চাইছে। মুখে বলল, ‘ননসেন্স।’ বলেই, নামিয়ে রাখল রিসিভার।

টেলিফোনের অপর প্রান্তের নীরব লোকটার ব্যবহার বিচলিত করেছে মাধবীকে।

সে কি এই বাড়িরই কোথাও ঘাপটি মেরে রয়েছে? এই টেলিফোনের এক্সটেনশন লাইন কি বাড়ির অন্য ঘরে আছে? সেইখানে বসে রয়েছে রহস্যময় আততায়ী?

হুঁশিয়ার হল মাধবী। গা হিম হয়ে আসছে। তীব্রতর হচ্ছে অনুভূতিটা। অদৃশ্য সত্তা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছে। তার ধৈর্য ফুরিয়ে আসছে।

দ্রুত চরণে বাড়ির বাইরে চলে এল দুই বোন। শিবালয় টাউনের রাস্তায় রাস্তায়, বাড়িতে বাড়িতে আলো জ্বলছে। আলো জ্বেলে ঘুমোচ্ছে গোটা শহর। ঘুমপাড়ানি বাতাস বয়ে যাচ্ছে শহরের ওপর দিয়ে।

হাঁটাপথে দুজনে এগিয়ে যায়। পুলিশ ফাঁড়ির দিকে।

ফাঁড়িতে ঢুকেই দেওয়ালের সুইচ টিপেছিল মাধবী—জ্বলে উঠেছিল মাথার ওপরকার আলো। তৎক্ষণাৎ তেউড়ে গেছিল মাধবীর গোটা শরীর।

সুমন্ত সেন লম্বমান রয়েছে মেঝের ওপর। নীলচে-কালচে কালসিটেমারা থেঁতলানো দেহ। ফুলে ঢোল। প্রাণহীন।

পরি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে গেছিল। দাঁড়িয়েই রইল।

বাসন্তীর মৃতদেহে যে-যে অবস্থা দেখে এসেছে মাধবী, সেই সব অবস্থাই রয়েছে সুমন্তর দেহে। তবে একটা জিনিস অতিমাত্রায় পরিস্ফুট হয়ে রয়েছে চোখের তারায় তারায়, আতঙ্ক। নিবিড় আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে গেছিল সুমন্ত সেনের মতন ডাকাবুকো মানুষ। নিঃসীম আতঙ্কর তুহিন-মুষ্টি নিমেষে প্রাণহরণ করে নিয়ে গেছে সুমন্তর—ঠিক যেরকমটি ঘটেছে বাসন্তীর ক্ষেত্রে।

কোমরে বাঁধা রয়েছে হোলস্টারের বেল্ট। খাপের রিভলভার পড়ে রয়েছে মেঝেতে।

নির্নিমেষে চেয়ে রইল মাধবী অস্ত্রের দিকে। মেঝেতে আছড়ে পড়েছিল সুমন্ত। সেই সময়ে রিভলভার খাপ থেকে ছিটকে পড়তে পারে মেঝের ওপর। কিন্তু মাধবীর তা মনে হল না।

সুমন্তই নিশ্চয় রিভলভার খাপমুক্ত করেছিল আততায়ীকে রুখে দেওয়ার জন্যে। তাই যদি হয়, তাহলে বিষ অথবা ব্যাধি—এই দুটোর কোনওটাই খতম করেনি সুমন্তকে।

তবে সে কে? অথবা, কী?

পরি দাঁড়িয়ে রইল দরজায়।

মাধবী ভাবছে। শিবালয় শহরের এই রহস্যময় মৃত্যু-অপদেবতার অকস্মাৎ নৃত্যের হেতু তাকে নির্ণয় করতেই হবে।

দীর্ঘ কয়েকটা সেকেন্ড ধরে নিরীক্ষণ করে গেল মারণাস্ত্রটাকে। আসন্ন মৃত্যুর দংষ্ট্রা থেকে আত্মরক্ষা করতে চেয়েছিল সুমন্ত। নিমেষে রিভলভার টেনে বের করেছে। তারপর?

নিকষ অস্ত্র মেঝে থেকে তুলে নিয়ে হাতের চেটোয় শোয়াল মাধবী। ছ-রাউণ্ড ক্যাপাসিটির সিলিণ্ডার। কিন্তু শূন্য রয়েছে তিনটে চেম্বার। পোড়া গান-পাউডারের কড়া গন্ধ গন্ধেন্দ্রিয়তে ধরা পড়ছে। তার মানে গুলি চলেছে সম্প্রতি। নইলে পোড়া গন্ধ এত তীব্র হত না। হয়তো আজকেই। বারুদের গন্ধ এত উৎকট যখন, তখন হয়তো ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই।

রিভলভার হাতে নিয়েই ঘরে চক্কর মারে মাধবী। চোখ আটকে যায় তিন জায়গায়। তিনটে তামার খোল। কার্তুজ। ভেতরে নেই বারুদ। নেই সিসে। কাজ শেষ করে মারণ বুলেটের খোল তিনটে গড়াগড়ি যাচ্ছে নীল মেঝের ওপর। কিন্তু কোনও বুলেটই নিক্ষিপ্ত হয়নি মেঝে লক্ষ করে। যদি হত, মেঝেতে ফুটো থাকত। দেওয়ালেও নেই বুলেট চিহ্ন, নেই কড়িকাঠে। মারণ-ধাতু আঘাত হানেনি কোত্থাও! আজব রহস্য!

জানলার কাচ অটুট… ভাঙেনি ফার্নিচার! তাজ্জব ব্যাপার!

সুমন্ত সেনকে আগে থেকেই চেনে মাধবী। ওর গুলি কখনও ফসকায় না। কথা বলতে বলতে খাপ থেকে রিভলভার টেনে পর-পর ছ’বার গুলি করে ছ’জনকে খতম করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। এখানে ছুঁড়েছে তিনটে বুলেট, তারপর আর সময় পায়নি—নিজেই খতম হয়েছে। কিন্তু বুলেট তিনটে নিশ্চয় তিনজনকে বিঁধেছে। রক্তপাত ঘটেনি কেন?

 স্খলিত চরণে ভেতরের ঘরে সুমন্তর টেবিলে গিয়ে দাঁড়ায় মাধবী। এ ঘরের ফ্লোরেসেন্ট টিউব জ্বালাই ছিল। সেই আলোয় দেখা যাচ্ছে টেলিফোন। তুলে নেয় মাধবী।

ডায়াল টোন নেই। আগের দু’বারের মতন এবারেও একটানা ইলেকট্রনিক

হিসহিসানি। যেন বহু পতঙ্গ মূঢ়পন্থায় সবেগে ডানা চালনা করে চলেছে। অর্থহীন সেই শব্দই বলে দিচ্ছে—লাইন ক্লোজড নয়, ওপেন রয়েছে। আর ঠিক আগের মতনই মনে হচ্ছে, লাইনের অপর প্রান্তে বাকহীন এক বদমাশ কানের পর্দায় রিসিভার লাগিয়ে বসে রয়েছে। সজোরে রিসিভার নামিয়ে রাখে মাধবী।

ঘরের পেছন দিককার দেওয়ালে রয়েছে রেডিয়ো আর টেলিটাইপ লিঙ্ক। মাধবী জানে না কী করে অপারেট করতে হয় টেলিটাইপ। খুটখাট করেও পারল না রেডিয়ো-কে মুখর করতে। অথচ, পাওয়ার সুইচ অন পজিশনে রয়েছে। ইন্ডিকেটর ল্যাম্প কিন্তু জ্বলছে না। মাইক্রোফোনও ডেড। সব যন্ত্রই ডেড।

দরজার বাইরে পরির পাশে গিয়ে দাঁড়ায় মাধবী। খোয়া চাঁদ উঠেছে আকাশে। পাহাড়ের মাথায়। রাস্তার ল্যাম্পের আলো যেখানে পৌঁছোতে পারছে না, চাঁদের মরা আলো ছায়ামায়ায় ঘিরে রেখেছে সেই সব অঞ্চলকে। এর বেশি কিছু দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু রুপোলি চাদরে গা মুড়ে যেন অনেক অজানা ভয়ংকর ওঁত পেতে রয়েছে—নির্নিমেষে দুই বোনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তারা অস্পষ্ট, কিন্তু অনস্তিত্ব নয়। তারা অদৃশ্য, কিন্তু অ-প্রাণ নয়। তারা অ-জড়, কিন্তু কুহেলী নয়। তারা শুধু আতঙ্ক—কল্পনাতীত, বর্ণনাতীত।

‘গোরস্থান,’ ফিসফিস করে বললে পরি, ‘গোটা শহরটাই একটা গোরস্থান।’

শিবালয় অ্যাভিনিউ ধরে হেঁটে চলেছে দুই বোন। মাধবীর হাতে রয়েছে সুমন্তর রিভলভার। তিনটে গুলি ভরা আছে। তাই যথেষ্ট। বাড়ির পর বাড়িতে উঁকি মেরে যাচ্ছে, বেল বাজাচ্ছে, কড়া নাড়ছে—কেউ সাড়া দিচ্ছে না। আলো জ্বলছে বাড়ির মধ্যে—অথচ শ্মশান—নৈঃশব্দ্য বিরাজ করছে ভেতরে।

পরি বলল, ‘দিদি, হঠাৎ সবাই মরে গেছে। কেন?’

মাধবী বললে, ‘সেটাই ভাবছি। রেডিয়েশনের জন্যে নিশ্চয় নয়—সেক্ষেত্রে শরীর পুড়ে যেত। দগদগে ঘা দেখা যেত। বিষের জন্যেও নয়—গোটা শহরটায় একসঙ্গে বিষের কাজ হতে পারে না। ফুড পয়জনিং-ও নয়—শহরের সমস্ত লোক একই পয়জনড্‌ ফুড একই সময়ে খেয়ে ফেলল, তা হয় না। জলের বিষও নয়—ঘড়ি ধরে শহরসুদ্ধ লোক বিষ-জল খেল একই সময়ে? অসম্ভব।’

কথা বলতে বলতে ‘আহার্য নিবাস’-এর সামনে এসে পড়েছে দুই বোন। এখানকার কেক, ব্রেড, প্যাসট্রি, প্যাটিস খুব নামকরা। মালিক রজনী শিকদার নিজেই বানান। দোতলায় থাকেন। ওঁর বউয়ের নাম মনোরমা।

বড় জানালার কাচে কপাল ঠেকিয়ে দেখল মাধবী—সেলসরুমের টেবিল-চেয়ার দেখা যাচ্ছে, কিন্তু কেউ নেই।

পরি বললে, ‘বিষাক্ত গ্যাসের জন্যে নয় তো?’

মাধবী বললে, ‘এদিকের পাহাড়ে কোনও ফ্যাক্টরি নেই। টক্সিক জঞ্জাল নেই। বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হবে কী করে?’

আলো জ্বলছে ‘আহার্য নিবাস’-এর রান্নাঘরে। ঢুকতে গেল মাধবী। কিন্তু তালা দেওয়া ভেতর থেকে।

‘পেছন দিক দিয়ে ঢুকব,’ বলে কাঠের ফটকের দিকে পা বাড়ায় মাধবী। তৈলহীন কব্জা আর্তনাদ করে ওঠে ঠেলা খেয়ে।

ভেতরে একটা টানা লম্বা গলিপথ। একদিকে বিউটি পার্লার। আর একদিকে আহার্য নিবাস। ঘুটঘুটে অন্ধকার। বহুদূরে টিমটিম করে জ্বলছে একটা আলো।

অন্ধকার গলিপথ নিছক তমিস্রায় ঠাসা নয়। তমিস্রার গর্ভে ওঁত পেতে রয়েছে যেন আরও অনেক কিছু। প্রতি পদক্ষেপে সঙ্কীর্ণতর হচ্ছে গলিপথ—বাড়ছে দুই বোনের বুকের মধ্যে ঢেঁকির পাড় পড়ার আওয়াজ।

সিকিপথ এসেই মনে হল, সুড়ঙ্গে শুধু ওরা দু’জন নেই আরও অনেকে আছে। মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যেন সজীব হয়ে উঠল মাথার ওপরকার ছাদ। দশ-বারো ফুট ওপরকার কড়িকাঠে কারা যেন সঞ্চরমান হয়েছে। অন্ধকার সবচেয়ে জমাট হয়েছে মাথার ওপরেই। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। অথচ মনে হচ্ছে, কিছু একটা রয়েছে সেখানে—একটা নয়, অনেক… অগুন্তি… চোখ নিয়ে না দেখেও তাদের অস্তিত্ব উপলব্ধি করা যাচ্ছে। পেছনে না তাকিয়েও পিছু নেওয়া বদমাশ লোককে যেমন টের পাওয়া যায়—ঠিক সেইভাবে। অস্বাভাবিক নৈঃশব্দ্য চমকে চমকে উঠছে শুধু দুই বোনের পা ফেলার আওয়াজে। সুড়ঙ্গের শেষের দিকে ম্যাড়মেড়ে আলোর দিকে জোরে পা চালিয়ে মাধবী ঘাড় বেঁকিয়ে তাকিয়েছিল ওপরের কয়লার মতন কালো কড়িকাঠের দিকে—আড়ষ্টভাবে। সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট দেখেছিল—তরল আলকাতরার মতনই সরে সরে যাচ্ছে নিরেট অন্ধকার। কায়া পালটাচ্ছে।

অন্ধকারের কায়া। শিউরে ওঠে মাধবী। কিন্তু চোখ নামাতে পারে না। সঞ্চরমান তরল তমিস্রা দেখেই যাচ্ছে আতঙ্ক-অবশ দুই চোখে। মাথার ওপর আছে মাচা—কড়িকাঠের দু’পাশে। এই দুই সারি মাচার মধ্যেই চলেছে পুঞ্জীভূত ছায়াদের নড়াচড়া—কায়াগ্রহণ…

মনের ভুল অবশ্যই। চোখের ভুল নিশ্চয়। দৃষ্টিভ্রম নির্ঘাৎ। এরকম ভুল সব মানুষই দেখে—ভয়-পঙ্গু মন চোখকে দিয়ে দেখায়—যার অস্তিত্ব নেই সেই ভয় ধরানো ভয়ানককে।

সুড়ঙ্গপথের অর্ধেক অতিক্রম করে এসেছে মাধবী। বাকি আর অর্ধেক। কিন্তু অকস্মাৎ পা বিদ্রোহী হচ্ছে কেন? কেন প্রচণ্ড বাসনা হচ্ছে, পেছন ফিরেই চম্পট দেওয়ার? অন্তরের গোপন গুহা থেকে নিরন্তর উঠে আসছে একটাই সতর্কবাণী—আর এগিও না… আর এগিও না… ওখানে আছে বিপদ—আছে মহা ভয়ংকর… আছে অপার্থিব বিভীষিকা…

ছুটে বেরিয়ে গেলেই হয়। এই সুড়ঙ্গে আর এক মুহূর্তও নয়। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে দৌড়োও!

অসম্ভব! মাধবী লাহা পাশ করা এবং পশার জমানো সফল চিকিৎসক। প্যানিক জিনিসটা ডাক্তারদের মানায় না।

দূরের বিষণ্ণ আলো এখন অনেক কাছে এগিয়ে এসেছে। পেছনের অন্ধকারই বরং অনেকটা পথ জুড়ে বিস্তৃত রয়েছে। অজান্তেই পদক্ষেপ দ্রুততর করে মাধবী। তারপর দৌড়ায়। ঊর্ধ্বশ্বাসে বাকি পথটুকু পেরিয়ে এসে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ে আলোর রাজ্যে।

পরি হুমড়ি খেয়ে পড়ে মাধবীর গায়ে। এক হাতে তাকে সিধে করে দাঁড় করিয়ে দিয়ে, আর এক হাতে রিভলভার তুলে মাধবী ঘুরে দাঁড়ায় অন্ধকার ঢাকা সুড়ঙ্গপথের দিকে।

হাঁপাতে হাঁপাতে পরি বলে, ‘টের পেয়েছ?’

‘পেয়েছি। কড়িকাঠের ঠিক নিচে। পাখি-টাখি হবে, অথবা বাদুড়।’

‘না… না… সিলিং-এর নিচে নয়। দেওয়ালের গা ঘেঁষে… গুঁড়ি মেরে ছিল।’

‘কিন্তু আমি তো দেখলাম, মাচার মধ্যে কী যেন নড়ছে।’

‘না দিদি, দেওয়ালের গা ঘেঁষে।’

‘কী?’

‘স্পষ্ট দেখিনি।’

‘শুনেছিস কিছু?’

‘গন্ধ-টন্ধ কিছু?’

‘না… তবে… অন্ধকার কি নড়ে?’

‘আমিও তাই দেখেছি—মাচায়।’

নির্নিমেষ দৃষ্টি নিবদ্ধ রয়েছে সুড়ঙ্গের দিকে। ঘাপটি মেরে যারা এতক্ষণ অবলোকন করেছে দুই সহোদরাকে—এবার নিশ্চয় বায়ুবেগে তাদের আবির্ভাব ঘটবে সুড়ঙ্গের বাইরে। ঝাঁপিয়ে পড়ার আগেই যাতে অনলবর্ষী চোঙা থেকে মারণ বুলেট ধেয়ে যেতে পারে, তার জন্যে তৈরি মাধবী। চোয়াল শক্ত। কিন্তু তমিস্রার জঠর ফুঁড়ে ধেয়ে এল না কোনও বিভীষিকাই।

মাধবী বললে, ‘শুধু শুধু দৌড়োলাম। সত্যিই যদি কিছু থাকত, এতক্ষণে বেরিয়ে আসত বাইরে।’

‘হয়তো।’

‘এখনও ঘোর কাটেনি তোর?’

এক ঝাপটা ঠান্ডা হাওয়া আচমকা তোলপাড় করে দিয়ে যায় সুড়ঙ্গ পথ।

‘বেড়াল নিশ্চয়,’ বললে মাধবী।

‘বেড়াল নয়,’ পরির জবাব।

‘বেড়ালের চেয়ে বড়… অনেক বড়।’

‘ঠিক আছে। চল, ভেতরে ঢোকা যাক,’ আহার্য নিবাসের খিড়কির দরজার দিকে এগোয় মাধবী—পরি বারবার পেছন ফিরে চাইছে।

দরজা খোলা রয়েছে। ভেতরে আলো জ্বলছে। সরু লম্বা ভাঁড়ার ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে দু-জনে। পাশের ছোট দরজার পরেই বিরাট কিচেন। মশলার সুবাস ভেসে আসছে। সুগন্ধে ঈষৎ ফিকে হয়ে আসে টেনশন।

রয়েছে দুটো ওয়াশ-বেসিন, একটা ফ্রিজ, কয়েকটা ওভেন, বেশ কয়েকটা স্টোরেজ ক্যাবিনেট, ময়দা ঠাসবার একটা মেশিন—এ ছাড়াও বেশ কিছু যন্ত্রপাতি। ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা লম্বা কাউন্টার। বেশ চওড়া। খুচখাচ কাজ করা হয় এর ওপরেই। এই কাউন্টারের একটা দিক চকচকে স্টেনলেস স্টিলের পাত দিয়ে ঢাকা—আর একটা দিকে কাঠের পাটাতন পাতা। মাংস কাটার জায়গা। চকচকে স্টিল রয়েছে যেদিকে ভাঁড়ার ঘরও সেদিকে। এই দিক দিয়েই কিচেনে ঢুকছে দুই বোন। ইস্পাতের পাতের ওপর সাজানো বিস্তর বাসনকোসন—পরিষ্কার ঝকঝক করছে। গোটা কিচেন জুড়ে শুধু চেকনাই।

কেউ নেই ঘরে।

গোটা শরীরে যেন ইলেকট্রিক শক বয়ে গেল সেই মুহূর্তে। জড়ো করা বাসনকোসনের ওপর দিয়ে দেখা যাচ্ছে কাউন্টারের মাঝখানটা। এক তাল ময়দার ওপরে গাঁথা একটা কাঠের বেলুন—লেচি পাকানোর আগের অবস্থা। দুটো হাত ধরে রয়েছে বেলুনের দু’দিক। শুধু দুটো হাত কব্জি পর্যন্ত রয়েছে। কব্জির পর থেকে হাতের বাকি অংশ আর নেই।

সবেগে পেছিয়ে এসেছিল পরি। মেটাল ক্যাবিনেটে পিঠ আছড়ে পড়ায় ঝনঝন করে উঠেছিল ভেতরকার জিনিসপত্র। ধারালো ক্ষুরের মতই নিদারুণ আতঙ্ক অকস্মাৎ বুঝি গলা চিরে দিয়ে যায় মাধবীর। এ কী সম্ভব?

স্তম্ভিত মাধবী এবার দু-পা এগিয়ে গেছিল ময়দার মণ্ডর দিকে। পা চলতে চাইছে না। কিন্তু যেন সম্মোহনের ঘোরে তাকে এগিয়ে যেতেই হচ্ছে। আরও কাছ থেকে দেখবার আত্যন্তিক বাসনায়।

শুধু দুটো হাত মণিবন্ধ পর্যন্ত। থেঁতলানো নয়, কালসিটে খাওয়া নয়, ফুলেও ওঠেনি। চামড়ার আভা সুস্পষ্ট—একটু যা ফিকে। ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়েছে সাদা ময়দায়।

এই প্রথম রক্ত দর্শন করল মাধবী। কিন্তু রক্ত ওর চোখ টানছে না, টানছে হাতের উলটো পিঠের সাদা লোম, মোটা গাঁটওলা বেঁটে আঙুল। পুরুষের হাত। রজনী শিকদারের।

‘দিদি!’

ডাক শুনে চমকে ওঠে মাধবী। হাত তুলে আঙুল-এর সংকেতে কিচেনের আর একটা দিক দেখাচ্ছে পরি।

তিনটে ওভেন রয়েছে সেদিকে—মাংসের কিমা বানানোর প্রান্ত যেদিকে—তারও ওদিকে—ঘরের একদম শেষদিকের দেওয়ালের গায়ে। একটা খুব বড়; নিরেট দুটো দরজার একটা ওপর দিকে, আর একটা নিচের দিকে, রয়েছে আরও দুটো ওভেন। সাইজে প্রথমটার চেয়ে ছোট, দুটোরই সামনে একটা করে পাল্লা। পাল্লার মাঝে কাচের চাকতি বসানো। এই চাকতি দিয়ে দেখা যাচ্ছে, দুটো উনুনেরই ভেতরে বসানো রয়েছে দুটো মুণ্ড। গলা থেকে কাটা মুণ্ডু। একজন রজনী শিকদার। সাদা চুলে লেগে লাল রক্ত। বিষম যন্ত্রণায় চেপে ধরেছে দুই ঠোঁট। আর একটা মনোরমা শিকদারের। মুখ হাঁ করে রয়েছে—যেন চোয়াল খুলে ঝুলে পড়েছে।

বুক ধড়াস ধড়াস করছে। মাধবী চোখে ঝাপসা দেখছে। ময়দার মণ্ডর ওপর হাত দুটো বেলুন ধরে স্থির হয়ে রয়েছে বটে, কিন্তু আচমকা জীবন্ত কাঁকড়ার মতন শূন্যপথে ধেয়ে এলেও মাধবী আর অবাক হবে না।

গেল কোথায় শিকদারের কাটা ধড়গুলো? বড় উনুনের ভেতরে? দরজা বন্ধ তাই দেখা যাচ্ছ না? নাকি, ফ্রিজের মধ্যে?

দলা পাকিয়ে ওঠে মাধবীর গলায়। আগের সেই ভয়াল অনুভূতিটা ফের ফিরে এসেছে। কারা যেন নিষ্পলক চাহনি মেলে ওদের দেখে যাচ্ছে। সবেগে তাই ঘুরে দাঁড়ায় পরির দিকে, ‘চ, এখানে আর নয়।’

বলেই, পরির হাত ধরে দৌড়ায়—অন্ধকার গলির দিকে নয়—সেলস রুমের দিকে। পৌঁছে যায় বাইরের দরজায়। ল্যাচ ঘুরিয়ে দরজা খুলে ছিটকে গেল বাইরের খোলা বাতাসে। ছুটে গিয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ায় পাইন গাছের গুঁড়িতে।

ফিসফিস করে মাধবী বললে, ‘আশ্চর্য! মাত্র কয়েক ফোঁটা রক্ত রয়েছে কিচেনে। অথচ রক্ত থই থই করা উচিত ছিল।’

পরি বললে, ‘ধস্তাধস্তির চিহ্নও নেই।’

‘একটা জিনিসও ভাঙেনি—সরেনি,’ ঢোক গিলল মাধবী।

যেন কলজে-মুক্ত হাওয়ার দমক ভেসে আসে শহরের দিক থেকে।

পরিকে পাশে নিয়ে হনহন করে ফুটপাত দিয়ে হাঁটছে মাধবী। মনের চোখ থেকে তাড়াতে পারছে না সারিবদ্ধ বীভৎস দৃশ্যগুলো।

ওরা এখন শিবালয় অ্যাভিনিউর পুব ব্লকে। হিসেব-বিশেষজ্ঞ শান্তনু ব্যানার্জীর বাড়ির সামনে দাঁড়ায় মাধবী। ওঁর স্ত্রী শান্তা টুরিস্ট সিজনে কফি হাউস খুলে বসে। দুজনের ছোট্ট সংসার।

দুজনেই বাড়তি সময় কাটান শখের রেডিয়ো নিয়ে, এই তাঁদের একমাত্র হবি।

বেতার বিজ্ঞানে দক্ষ দুজনেই। ওঁদের শর্টওয়েভ রেডিয়োটার কথা মনে পড়তেই মাধবী ছুটে এসেছে।

এক পাল্লার সদর দরজাটা ভেতর থেকে লক করা। আলো জ্বলছে ভেতরে অথচ পুশবেল টিপলেও কেউ সাড়া দিচ্ছে না।

ঘুরে গিয়ে পৌঁছোল বাড়ির পেছনে। এখানেও আলো ঠিকরে আসছে হলুদ কাচের মধ্যে দিয়ে। রান্নাঘরের দরজাও লক করা ভেতর থেকে। জানলায় পর্দা টানা থাকায় ভেতরের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে না।

কাচে টোকা দিল মাধবী। সাড়া নেই।

শান্তনু ব্যানার্জী মিতব্যয়ী পুরুষ। গ্রীলের খরচ বাঁচিয়েছেন—জানলায় শুধু কাচের পাল্লা বসানো। এ শহরে চোর-ছ্যাঁচোড়ের উপদ্রবও নেই।

রিভলভারের বাঁট দিয়ে জানলার কাচ ভেঙে ফেলল মাধবী। হাত ঢুকিয়ে খুলল ছিটকিনি। পাল্লা টেনে খুলে আগে ঢুকল নিজে—পেছনে পরি।

ব্যানার্জী পরিবার রয়েছে এই ঘরেই। শান্তা চিত হয়ে শুয়ে মেঝেতে। শান্তনু বসে রয়েছেন চেয়ারে। সামনের টেবিলে তাঁর রেডিয়ো। মাথা হেলে পড়েছে তার ওপর। ঘাড় কাত হয়ে রয়েছে। তাই দেখা যাচ্ছে খোলা চোখের আতঙ্ক। একই আতঙ্ক জেগে রয়েছে শান্তার চোখেও। দুজনেরই সারা শরীর থেঁতলানো। কালসিটে পড়া ফুলে ঢোল। কিন্তু মরবার পরেও মুখের মাসল ঢিলে হয়ে যায়নি কারুরই।

শান্তনু ডান হাতের মুঠোয় ধরে রয়েছেন একটা মাইক্রোফোন। রেডিয়ো মেসেজ পাঠানোর চেষ্টা করেছিলেন। নিশ্চয় পারেননি, পারলে, এতক্ষণে পুলিশ এসে পৌঁছোত। রেডিয়ো নিষ্প্রাণ।

বিশেষ একটা দরজার গায়ে রচনা করা হয়েছে একটা ব্যারিকেড। এ দরজা ভেতর থেকে ঠেলে খুলতে হয়—ঘরটা ছোট্ট, বাজে জিনিসপত্র থাকে। ব্যারিকেড তৈরি হয়েছে এই দরজার গায়ে, যাতে ভেতর থেকে খোলা না যায়। চেয়ার, সোফা, টিভি এনে ঠেসে রাখা হয়েছে কপাটের গায়ে। নাইট-ল্যাচও নিশ্চয় আঁটা হয়েছে।

এত ভয় কেন? কাকে? কী আছে ওই ছোট্ট ঘরে? অথচ তাকে আটকে রাখা যায়নি। চেষ্টার কসুর করেননি কর্তাগিন্নি। আতঙ্ক কিন্তু ঢুকে পড়েছে এই ঘরে। সেই মুহূর্তেই বোধহয় শেষ চেষ্টা করেছিলেন। শখের রেডিয়ো সেট মারফত মেসেজ পাঠানোর শেষ চেষ্টা।

কিন্তু ঢুকল কী করে? জানলা তো বন্ধ ছিল ভেতর থেকে। দরজার নিচে আধ ইঞ্চির মতন একটা ফাঁক রয়েছে বটে, কিন্তু সেখান দিয়ে এমন কী মহা আতঙ্ক প্রবেশ করল যে কলজে বন্ধ হয়ে গেল স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই? কড়িকাঠের কাছে লম্বায় চওড়ায় ইঞ্চিছয়েক ঘুলঘুলিটাতেও লোহার জাল বসানো।

মাধবী বললে, ‘বাইরে চ, পরি।’

চৌকাঠ পেরতে যাচ্ছে দুজনে, ঠিক এই সময়ে বেজে উঠল টেলিফোন। গোরস্থান-নৈঃশব্দে এই প্রথম আওয়াজ। হৃৎপিণ্ড ধড়াস করে উঠল দুজনেরই।

টেলিফোন বসানো রয়েছে রেডিয়োর পাশে। এগিয়ে গিয়ে রিসিভার তুলল মাধবী, ‘হ্যালো?’

কোনও প্রত্যুত্তর নেই। কে যেন কান খাড়া করে শুনছে মাধবীর কণ্ঠস্বর। দূরায়ত ক্ষীণ সমুদ্রোচ্ছাসের মতন অদ্ভুত একটা আওয়াজ ছাড়া আর কোনও শব্দ ভেসে আসছে না কানে।

তর্ক-বিতর্ক চলছে মাধবীর মনের মধ্যে।

টেলিফোন করছে যে, সে মানুষ নয়!

ননসেন্স!

সে মানুষ নয়, জড়পদার্থও নয়, তার চেতনা আছে!

তোমার মাথা খারাপ হয়েছে!

ভাষা দিয়ে তার কুটিলতাকে প্রকাশ করা যায় না—সে নিখাদ নির্মমতা!

থামো!

মনের সমস্ত জোর দিয়ে রিসিভার নামিয়ে রাখতে যাচ্ছে মাধবী, এমন সময়ে ক্লিক করে উঠল টেলিফোন—ডায়াল টোন ফিরে এল পরক্ষণেই।

নিথর হয়ে যায় মাধবী। কী করবে এখন? পরক্ষণেই টিপে ধরে জিরো বাটন। রিং-এর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। মিষ্টি স্বাভাবিক আওয়াজ।

‘অপারেটর স্পিকিং।’

‘এমার্জেন্সি,’ রুদ্ধশ্বাসে বলে যায় মাধবী, ‘টিকেন্দ্রনগরে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে দিন—এখুনি।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *