আদর্শ গ্রাম

আদর্শ গ্রাম

ছোট্ট একটা গ্রাম, গ্রামের নাম ধারাপাত। চারদিকে পাহাড় আর ঘন সবুজে ঘেরা। মাঝখান দিয়ে কুলকুল করে বয়ে চলেছে খরস্রোতা এক পাহাড়ী নদী। প্রকৃতি যেন অকৃপণ হাতে গ্রামটাকে সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে। তাহলে কী হবে? গ্রামে যারা বাস করে তারা যে হত দরিদ্র। সেখানে না আছে পেট ভরানোর মত অন্নের সংস্থান, না আছে শিক্ষার আলোক। সেখানকার মানুষগুলোর রুজিরোজগার মূলতঃ বনের কাঠ, হোগলা পাতা আর পশুশিকারের ওপর নির্ভর। তাদের ঘুম ভাঙ্গে নাম না জানা নানান পাখির কলতানে। সূর্যের আলো নিভে গিয়ে পৃথিবীকে যখন কালো চাদরে ঢেকে দেয় তখন তারা যে যার ঘরে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘর বলতে অবশ্য শহরের মত ইঁট, কাঠ, পাথরে তৈরি দালান বাড়ি নয়। হোগলা পাতায় ছাওয়া জীর্ণ কুটির। সবাই যখন ঘুমে অচেতন, চারদিক যখন নিস্তব্ধ তখন শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, জোনাকির আলো আর রাতচরা পাখির ডাক নিস্তব্ধতাকে ভেঙে খানখান করে দেয়। শান্ত, নিরুপদ্রব, নিস্তব্ধ সেই গ্রামের এক ছোট্ট কুঁড়ে ঘরে বাস করে ততোধিক শান্ত, নির্বিরোধী এক মানুষ। একাই থাকে। সাতকূলে তার আপনজন বলতে কেউ নেই। বয়স আন্দাজ ৪০-৪২ হবে। সাল তারিখ কিছুই জানে না। গ্রামের লোকেদের কাছেই শুনেছিল সেই যে বছর বন্যায় ওদের সব গ্রাম, জঙ্গল, ঘরদুয়ার ভেসে গেছিল সে সময়ই ওর জন্ম। জন্মের পর ওর মা নিজের এবং একরত্তি বাচ্চাটাকে বাঁচাতে একটা পাহাড়ের ওপর আশ্রয় নিয়েছিল। আর ওদের সঙ্গেই একসাথে ছিল এক মা নেকড়ে আর তার ছানা। দুই মা-ই বোধহয় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিল তাই নেকড়ে বাঘ তার কোন ক্ষতিই করেনি। তারপর বন্যার জল সরে গেলে যে যার আশ্রয়ে ফিরে গিয়েছিল। কিন্তু তার মা আর স্বামীকে খুঁজে পায়নি। লোকজনের কাছে জেনেছিল সাপের কামড়ে সে মারা গেছে।

এর বেশ কিছুদিন বাদে জঙ্গলে কাঠ কুড়োতে গিয়ে তার মাকেও বিষাক্ত সাপের ছোবলে প্রাণ হারাতে হয়েছিল। সেই থেকেই সে একা। সারাদিন বনেবনে ঘুরে যা সংগ্রহ করে তাই দিয়ে ভিনগাঁ থেকে চাল, ডাল, নুনের ব্যবস্থা করে, নিজের হাতে রান্না করে খায়। একদিন রাতে প্রতিদিনকার মত খাওয়া দাওয়া সেরে সে শুয়ে পড়েছে। রাত ক’টা তা জানে না। আর জানা সম্ভবও নয়। সূর্য উঠলে বোঝে সকাল হল। সূর্য ঘড়িকেই সাক্ষী রেখে তারা দিনরাতের সময় স্থির করে। তা গোবর্ধন নামের সেই লোকটা তো ঘুমিয়ে পড়েছে। এমন সময় মনে হল কেউ যেন করাত দিয়ে কিছু কাটছে। এত রাতে কে আসতে পারে? সাতপাঁচ ভেবেও গোবর্ধন কূলকিনারা করতে পারল না। মনের ভুল ভেবে আবার ঘুমোতে চেষ্টা করল। কিন্তু, না, আবার সেই করাত দিয়ে জানলা কাটার শব্দ। ভয়ে ভয়ে বিছানায় উঠে বসল সে। হঠাৎ দেখল জানলাটা খুলে গেছে আর সেখান দিয়ে একটা লোক পা টিপে টিপে ঘরে ঢুকছে। নিশ্বাস বন্ধ করে বসে রইল গোবর্ধন। ভাবলে, চোর বোধহয়। কিন্তু তা কেন হবে? তার ঘরে তো একটা পেতলের থালা ছাড়া চুরি করার মত কিছুই নেই। দেখাই যাক্‌ না কী করে। গোবর্ধন দেখলে লোকটা আন্দাজে কিছু খোঁজার চেষ্টা করছে। তারপর ভাতের হাঁড়িটা খুঁজে পেয়ে, পরের দিন সকালে খেয়ে কাজে বেরোবে বলে যে ভাতকটা সে জল দিয়ে রেখে দিয়েছিল, সেগুলো গোগ্রাসে গিলতে শুরু করেছে। আহারে! খুব খিদে পেয়েছে বোধহয়। খুব মায়া হল গোবর্ধনের। মাথার কাছে রাখা টর্চটা হাতড়ে হাতড়ে খুঁজে বের করে ফেলল সে। আলো জ্বালাতেই লোকটা সতর্ক হয়ে উঠে দাঁড়াল। গোবর্ধন লোকটাকে কিছু না বলে তারদিকে এগিয়ে গেল। তারপর ইসারায় তাকে বসতে বলে লন্ঠনটা জ্বেলে নুন, পেঁয়াজ আর কাঁচালংকা বের করে এনে তাকে দিয়ে ভাত খেতে বলল। খাওয়া শেষ হলে গোবর্ধন তাকে রাতটা সেখানেই কাটিয়ে যেতে বললে লোকটা বলে উঠল, “বুঝেছি, আমাকে জামাই আদর করে খাইয়ে, ঘুম পাড়িয়ে, কাল সকালবেলা লোক জড়ো করে ধরিয়ে দেবার ধান্দা করছ। কিন্তু আমি ভুলছি না। আমাকে এখনই যেতে হবে”। গোবর্ধন তাকে নানাভাবে আশ্বস্ত করে, নিজের পাশে কাঁথা পেতে দিলে। আশ্চর্য, কিছুক্ষণের মধ্যেই সে ঘুমিয়ে কাদা হয়ে গেল। পরদিন যখন ঘুম ভাঙল তখন গোবর্ধন তার নাম ধাম পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে। সে বলল, “আমি গিরিন, গিরিন মৃধা। সাকিন দক্ষিণদাঁড়ি। একটা করাতকলে কাঠ চেরাইয়ের কাজ করতাম। আমার বউ সামান্য জ্বরে আজ তিন বছর হল আমায় ফেলে চলে গেছে। আপন বলতে ছিল ছেলে আর তার বউ। যতদিন কাজ ছিল ততদিন কোন অসুবিধা ছিলনা। ছেলে বউ আদরযত্ন করত পয়সার বিনিময়ে। কিন্তু মাস দুই আগে করাতকল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তার কাজ চলে গেছে। তাই ছেলে আর বউ তাকে বাড়ি থেকে দূর করে দিয়েছে। প্রথম কিছুদিন এর ওর কাছে চেয়ে চিন্তে খাবার ব্যবস্থা হলেও এখন আর ওকে কেউ কিছু দেয় না, দেখলেই মুখ ফিরিয়ে নেয়। কিন্তু ভাই, পেটের জ্বালা, বড় জ্বালা। তাই মান অপমান বিসর্জন দিয়ে এই রাস্তা ধরেছি। তা-তুমি কে ভাই”?

গোবর্ধন জানাল সে গোবর্ধন গায়েন। তারপর গিরিনকে বলল, “তুমি এখানেই থেকে যাও। আজ থেকে আমরা দু’ভাই গতর খাটিয়ে যা রোজগার করব তাতে আমাদের কষ্টেসৃষ্টে চলে যাবেখন”। গিরিনের চোখে আনন্দে জল এসে গেল। সে থাকতে রাজী হল। সে ছিল খুব পরিশ্রমী। দু’চারদিন পেট ভরে খেতে পাওয়ায় তার শরীরে বল ফিরে এল। সে এবার জোর কদমে কাজ শুরু করে দিল। একদিন গোবর্ধন বললে, “ভাই, গিরিন, আমাদের চারপাশে প্রচুর জমি। কেউ চাষ বাস করে না। আমরা যদি জমিকে চাষের যোগ্য করে তুলতে পারি তাহলে আমাদের যেমন উপকার হবে তেমনি আমাদের গাঁয়ের লোকেদেরও আর ফসল কিনতে ভিন্‌ গাঁয়ে যেতে হবে না। তারা আমাদের থেকেই কিনতে পারবে”। গিরিন তো এই প্রস্তাবে এককথায় রাজি হয়ে গেল। তারপর দু’জনে প্রচন্ড পরিশ্রমে পতিত জমিকে আবাদযোগ্য করে তুলল। তাদের দেখাদেখি অনেকেই এ কাজে লেগে গেল। ফলে তাদের আর কাউকে ফসলের জন্য অন্য গাঁয়ে যেতে হল না। বরং বাড়তি ফসল আশপাশের গ্রামে বিক্রি করে তারা পয়সার মুখ দেখল। গিরিন মোটামুটি কাজ চালাবার মত লেখাপড়া জানত। একদিন সে গোবর্ধনকে বলল, “ভাই, এ গাঁয়ের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা সারাদিন রোদে জলঝড়ে টো টো করে ঘুরে বেড়ায়। এদের যদি একটু লেখাপড়া শেখাই তা হলে কেমন হয়”? গোবর্ধন তো আহ্লাদে আটখানা। সে বললে, “এর চেয়ে ভালো আর কিছু হতে পারে না। আমি নিজে তো লেখাপড়া জানিনা। তাই তোমাকেই এর পুরো দায়িত্ব নিতে হবে। পারবে তো”? গিরিন মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল। কিন্তু পড়ানো হবে কোথায়? ছাত্রই বা জুটবে কোথা থেকে? তাই পরদিনই দু’জনে গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে বাবামাদের বুঝিয়ে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার কাজ শুরু করল। গাঁয়ের লোকেরাই উদ্যোগী হয়ে একটা মাটির বড় ঘর তৈরি করে দিল। পড়াশোনা শিখতে পেয়ে বাচ্চারা তো মহাখুশি। মা বাবারাও খুব উৎসাহের সঙ্গে তাদের পড়তে পাঠাতে লাগল। বছর কয়েকের মধ্যেই দেখা গেল গাঁয়ের বেশির ভাগ ছেলেমেয়েই লিখতে পড়তে শিখে ফেলেছে। রোদে রোদে আর ঘুরে বেরোয় না বলে তাদের চেহারাতেও একটা ছিরি ফিরে এসেছে। গ্রামের সকলেই এখন আনন্দের সঙ্গে চাষবাস করে। তাদের এখন আর কাঠপাতা কুড়োতে জঙ্গলে যাবার দরকার হয়না। তারা প্রত্যেকেই গিরিন আর গোবর্ধনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। মুখে মুখে তাদের খ্যাতি পাশাপাশি গ্রামেও ছড়িয়ে পড়ল।

আশেপাশের গ্রামের মধ্যে তাদের গ্রাম ধারাপাত একটি আদর্শ গ্রাম হিসাবে পরিগণিত হল। সর্বশিক্ষা অভিযান প্রকল্পে সরকার তাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত অবৈতনিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হল। গ্রামের লোকেদের শুভ ইচ্ছায় বিদ্যালয়ের নামকরণ হল “গিরিগোবর্ধন শিক্ষায়তন”। এই নামের মাধ্যমেই তারা গিরিন ও গোবর্ধনকে অমর করে রাখল।

গল্প বলা শেষ করে আম্মান বললেন “ক’দিন তোমরা আমায় জ্বালিও না। তোমাদের যদি আমার গল্প শুনতে ভাল লাগে তবে আমি আবার আরো গল্পের ঝুলি নিয়ে তোমাদের কাছে হাজির হব। ততদিন তোমরা মন দিয়ে পড়াশোনা আর খেলাধূলো করো বেশ। আর মনে রেখো শুধু পাঠ্যবই পড়ে আমাদের চারপাশের কোনো কিছু চেনা যায় না। চারদিকে কত অজানা জিনিস লুকিয়ে। তাই চোখ-কান খোলা রাখবে তোমরা। আর পরেরবার তোমরাও আমাকে নতুন নতুন কাহিনী শোনাবে। আম্মানের কথায় ঋভু, রিচা, তিতলি, তাতান আর তার বন্ধুদের মন খারাপ হয়ে গেলেও আম্মানকে কথা দিল এই ক’দিন তারা আম্মানের সব কথা মনে রেখে, তাকে বিরক্ত না করে নিজেরাও চোখ-কান খোলা রাখবে। আর পরেরবার নতুন গল্প শোনার সঙ্গে সঙ্গে তারাও নতুন গল্প বলবে।

ইংরেজি সাহিত্যের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা সোনালী ঘোষালের জন্ম কলকাতায়। সিঁথি রামকৃষ্ণ সঙ্ঘ সারদা বালিকা বিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেন। মৌলিক কবিতা ও শিশুসাহিত্য রচনার পাশাপাশি অনুবাদ কর্মেও যুক্ত। দুরারোগ্য ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও লেখনী ও অনুবাদ অব্যাহত। প্রকাশিত কবিতার বই ‘অবসরে’, ভ্রমণ কাহিনী ‘অমর কণ্টকের আনাচে কানাচে’। অনূদিত গ্রন্থ— ‘আফ্রিকার গল্প সংকলন’, ‘ল্যাতিন আমেরিকার নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ গল্প’, ‘গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস: মঙ্গলবারের ভাতঘুম ও অন্যান্য গল্প’, ‘’কর্তার সিং দুগ্‌গাল: একটি সংগীতের জন্ম ও অন্যান্য গল্প।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *