আত্মা এবং দেহ
এক
দিনগুলি গড়িয়ে চলে এব রাতগুলি সংক্ষিপ্ত। আর আমরা দু’জন ক্ষিপ্র পদে চলি দক্ষিণদিকে। আমাদের উটগুলি এখন খুবই সুস্থ, শক্তিমান। সম্প্রতি তাদের পারি খাওয়ানো হয়েছে এবং গত এক দু’দিন তাদেরকে প্রচুর ঘাস খেতে দেওয়া হয়েছে চারণ ক্ষেত্রে। মক্কা আর এ জায়গার মধ্যে এখনো রয়েছে চৌদ্দ দিনের পথ এবং তার বেশিও হতে পারে, যদি আমরা কিছুটা সময় কাটাই- যার খুবই সম্ভাবনা রয়েছে- হাইল ও মদীনা নগীরতে, যে শহর দু’টি পড়বে আমাদেরই রাস্তায়।
এক অস্বাভাবিক অধৈর্য আমাকে পেয়ে বসেছে- এমন একটা তাগিদ যার কোন ব্যাখ্যা আমার জানা নেই। এতোদিন আমি মনের আনন্দে কোনরকম তাড়াহুড়া না করেই সফর করেছি; জলদি জলদি গন্তব্যে পৌঁছানোর বিশেষ তাকিদ ছিলো না কখনো। সফরে পূর্ণতা এবং লক্ষ্যস্থল সবসময়ই মনে হয়েছে আকস্মিক। কিন্তু এখন আমি উপলব্ধি করতে শুরু করলাম তা-ই যা আমি আরব দেশে আমার বহু বছরে কখনো উপলব্ধি করিনিঃ রাস্তার শেষপ্রান্তে পৌঁছানোর অধৈর্য। রাস্তার শেষ কী? মক্কা দেখা? আমি এই পবিত্র নগরীতে এতোবার গিয়েছি এবং এ জীবনধারাকে এতো বিশদভাবে আমি জানি যে, মক্কা আর আামার জন্য নতুন কোন আবিষ্কারের প্রতিশ্রুতি বহন করে না- অথবা একটি নতুন কোন আবিষ্কার, যা আমি প্রত্যাশা করছি? নিশ্চয়ই তাই হবে। কারণ আমি মক্কার দিকে আকৃষ্ট হচ্ছি একটি অদ্ভুত ব্যক্তিগত প্রত্যাশায়। পৃথিবীর প্রত্যেক অঞ্চল থেকে আগত বহু জাতির মানুষের জামায়েতসহ মুসলিম বিশ্বের এই আধ্যাত্মিক কেন্দ্রটি, আমি একন যে- জগতে বাস করছি তার চাইতে, প্রশস্ততরো এক জগতের প্রবেশ- পথ যেন। এ নয় যে, আমি আরব দেশ নিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি; না আমি আরবের মরুভূমি, তার শহর, তার অধিবাসীদের জীবনধারা ভালোবাসি, যেমন আমি আরবের মরুভূমি, তার শহর, তার অধিবাসীদের জীবনধারা ভালোবাসি, যেমন আমি সবসময়ই তাদের ভালবেসেছি। প্রায় দশ বছর আগে সিনাই মরুভূমিতে আরব-জীবনের যে প্রথম আভাস পেয়েছিলাম, তারপর কখনো আমার কাছে নৈরাশ্যের কারণ ঘটেনি এবং পরবর্তী বছরগুলি আমার প্রথম প্রত্যাশাকেই কেবল মজবুত করেছে। কিন্তু দু’দিন আগে ইদারার কাছে আমি যে-রাতটা কাটিয়েছি তখন থেকে আমার মধ্যে এই প্রত্যয় জন্মেছে যে, আরব মুলুক আমাকে তার যা দেবার ছিলো সবই দিয়েছে নিঃশেষে।
আমি শক্ত-সমর্থ, তরুণ এবং স্বাস্থ্যবান। অহেতুক ক্লান্ত না হয়ে আমি একলাগা ঘণ্টার পর ঘণ্টা উট হাঁকিয়ে চলতে পারি। আমি সফর করতে পারি এবং বহু বছর ধরেই আমি সফর করে চলেছি বেদুঈনের মতো, তাঁবু এবং ছোট-খাট সেসব আরাম-আয়েশ ছাড়াই, যা নযদের শহুরে লোকদের মতে দীর্ঘ সফরে অপরিহার্য। বেদুঈন জীবনের ছোট-খাট সব রকম নিপুণতার সাথেই আমি অভ্যস্ত এবং আমার প্রায় অজান্তেই আমি গ্রহণ করেছি নয়দী আরবের চালচলন ও রীতিনীতি। কিন্তু এ-ই কি সম্ভাব্য সব কিছু? আমি কি এতোদিন আরব মূলুকে বাস করেছি কেবলমাত্র একজন আরব হওয়ার জন্য? কিংবা একি এমন কিছুর জন্য প্রস্তুতি যা এখনো ঘটেনি?
….. …… ….. ……
আমি যে চাঞ্চল্য এখন অনুভব করছি তা মধ্যপ্রাচ্যে আমার পয়লা সফরের পর ইউরোপে ফিরে এসে যে তীব্র অধৈর্ড আমি উপলীব্ধ করেছিলাম অনেকটা তারই মতোঃ একটি প্রচণ্ড আবিষ্কারের ঠিক পূর্বমূহূর্তে হঠাৎ থেকে যাওয়ার উপলব্ধি- যে আবিস্কার ঘটতে পারতো আমার জীবনে, যদি আমার হাতে থাকতো কেবল আরো বেশি কিছু সময়।
আর জাহান ছেড়ে আবার ইউরোপ প্রবেশ করার প্রাথমিক চাপ কিছুটা ফিকা হয়ে এসেছিলো- ১৯২৩ সালের শরৎকালে, সিরিয়া ত্যঅগের পর, আমার কয়েক মাস তুরস্কে কাটানোর ফলে। মোস্তফা কামালের তুরস্ক তখনো প্রবেশ করেডিন তার সংস্কারবাদী অনুকরণের পর্যায়ে। তখনো তুরস্ক ছিলো তার জীবনধারার ও ঐতিহ্যের দিক দিয়ে খাঁটি তুর্কী; এবং এজন্য ইসলাম ধর্মের ঐক্যবন্ধনে তখনো সে ছিলো আরব জীবেনর সাধারণ। গতিধারার সংগে সম্পর্কিত। কিনতু তুরস্কের হৃদয়ের দ্বন্দ্বে মনে হয়েছিলো বেশ কিচুটা ভারিক্কি, কম স্বচ্ছ, কম লঘু এবং অনেক বেশি প্রাচ্য দেশীয়। যখন আমি স্থলপথে সফর করি ইস্তাম্বুল থেকে সোফিয়া এবং বেলগ্রেড়ে, মাশরিক থেকে মাগরিবে প্রবেশ আকস্মিক একটা ছেদের মতো মনে হয়নি আমার; চিত্রগুলি বদলালো ধীরে ধীরে, ক্রমশ, একিট পরিবেশ- মিনারের সংখ্যা ক্রমেই কমে আসছে, পুরুষদের লম্বা ‘কাফতানে’র জায়গায় দেখা গেলো কিষাণদের কোমরবন্ধ আঁটা জামা। আনাতোলিয়অর বিক্ষিপ্ত গাছপালা ও উপবন যখন হারিয়ে গেলো সার্বিয়ার ফার বনাঞ্চলে তখন সহসা ইতালীর সীমান্তে আমি দেখতে পেলাত- আমি আবার ইউরোপে ফিরে এসেছি।
ত্রিয়েস্ত থেকে ভিয়েনার দিকে যাচ্ছি আমি ট্রেনে। চলতে চলতে তুরস্ক আমার মনের উপর যে- সব ছাপ এঁকে দিয়েছিলো সেগুলির সজীবতা হারিয়ে যেতে লাগলো এবং আরব মুলূকগুলিতে আমি যে আঠারোটি মাস কাটিয়েছিলাম তা-ই কেবল টিকে রইলো একমাত্র বাস্তবরূপে। এ আমার কাছে মনে হলো যেন একটা কশাঘাত যখন আমি বুঝতে পারলাম, আমার এককালের অতো পরিচিত ইউরোপীয় দৃশ্যাবলীর দিকে আমি তাকাচ্ছি এক বিদেশীর চোখে। মানুষগুলি মনে হলো ভয়ানক কুৎসিক, গতিবিধি ওদের রূঢ় এবং বিশ্রী; ওরা যা সত্যি সত্যি অনুভব করে আর চায় তার সাথে ওদের প্রত্যক্ষ কোন সম্পর্কেই নেই; এবং হঠাৎ এক ঝলকে আমি বুঝতে পারলাম, ওরা যা- কিছু করছে তাতে একটা উদ্দেশ্যের বাহ্যিক আভাস থাকলেও ওরাওদের অজান্তেই বাস করছে এক ছলনার জগতে
… আরবদের সহবতে আসার ফলে জীবনে আমি যাকে অপরিাহর্য এবং মৌলিক মনে করেছি, অতোদিনে তার প্রতি আমার মনোভাব একেবারে স্পষ্টই এবং অপরিবর্তনীয়ভাবেই বদলে গেছে; অনেকটা বিস্ময়ের সংগে আমি স্মরণ করলাম- আমার পূর্বে বহু ইউরোপীয়ই অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে আরব জীবনধারা; তাহলে এ কী করে সম্ভবপর হলো যে, আমি যে আবিস্কারের ধাক্কায় বিচলিত হয়েীছ ওদের সে ধাক্কা লাগেনি? অথবা ওদেরও কি তা লেগেছে? ওদের কেউ কেউও কি ওদের মর্মের গভীরে বিচলিত হয়েছে যেমন আমি এখন হয়েছি?
এ প্রশ্নের জবাব কয়েক বছর পর আমি পেয়েছিলাম আরব মুলুকে। জবাবটি এসেছিলো জেদ্দায় তখনকার দিনের ডাচ মন্ত্রী ডঃ ভ্যান ডার মিউলেনের কাছ থেকে। তিনি ছিলেন এক উদার বহুমুখী সংস্কৃতির মানুস। আপন ধর্ম খৃশ্চানিটিকে তিনি এমন একটি আবেগ ও নিষ্ঠার সাথে আঁকড়ে ছিলেন যা আজকের পশ্চিমী লোকদের মধ্যে একেবারই বিরল। কাজেই বলা যায়, বোধগম্যবাবেই তিনি ধর্ম হিসাবে ইসলামের বন্ধু ছিলেন না। তা সত্ত্বেও তিনি আমার কাছে স্বীকার করেছিলেন- জীবনে যেসব দেশের সংগে তাঁর পরিচয় হয়েছে তার প্রত্যেকটি থেকে, এখন কি তাঁর নিজের দেশ থেকেও আরব দেশকে তিনি ভালোবাসেন বেশি। হিজাজে তাঁর কাজের মেয়াদ যখন প্রায় ফূরিয়ে এসেছে, তখন আমাকে তিনি একবার বলেছিলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, কোন তীক্ষ্ণ অনুভূতিশীল মানুষ কখনো আরবীয় জীবনের যাদু-প্রভাব থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারবে না, পারবে না আরবদের মধ্যে কিছুদিন কাটানোর পর এ প্রভাবকে তার হৃদয় থেকে উপড়ে তুলে ফেলতে। কেউ যদি এদেশ থেকে চলে যায়, চিরদিনের জন্য তবু সে হৃদয়ে বহন করবে এই মরুভূমির হাওয়া এবং হামেশাই সে পেছনে ফিরে এক দিকে তাকাবে উৎসুক আকাংখায়, তার নিজের ঘরবাড়ি যদি অনেক বেশি ঐশ্বর্যশালী এবং অনৈক বেশি সুন্দর অঞ্চলে হয়… তবুও’।
আমি কয়েক হপ্তার জন্য ভিয়েনায় থাকি এবং আমার আব্বার সংগে একটা আপোসে আসি। আমার বিশ্বাবিদ্যালয় ত্যাগ এবং যে অসৌজন্যের স াথে আমি তাঁর বাড়ি ছেড়ে বের হয়ে পড়েছিলাম তার জন্য তিনি তাঁর রাগ ইতিমধ্যেই জয় করেছিলেন। আর যা’ই হোক, আমি এখন ‘ফ্রাংকফৃর্টঅর শাইটুঙ’- এর সংবাদদাতা; এটি এমন একটি নাম, যা তখনকার দিনে মধ্য ইউরোপে উচ্চারিত হতো প্রায় সভয় শ্রদ্ধার সাথে। এই পত্রিকার সংবাদদাতা হয়ে আমি সকলের উপর থাকবো, আমার এই দম্ভপূর্ণ দাবি আমি সার্থক প্রমাণ করেছি।
ভিয়েনা থেকে আমি সোজা রওনা করি ফ্রাংকফুর্টে, সশরীরে সেই কাগজের অফিসে হাজিরা দিতে, যার জন্য আমি এক বছরের অধিককাল ধরে লিখে চলেছি। ওখানে আমি হাজির হই প্রচুর আত্মবিশ্বাস নিয়ে; কারণ ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে আমি যে-সব চিঠি-পত্র পেয়েছিলাম তাতে আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিলো যে, আমার কাজে ওরা খুবই খুমি। আমি সত্যি সত্যিই ওখানে ‘হাজির হয়েছি’। এই উপলব্ধি নিয়ে ঢুকলাম
‘ফ্রাংকফুর্টার শাইটুঙ’-এর গম্ভীর পুরানো ফ্যাশানের প্রাসাদে। ঢুকে প্রধান সম্পাদক বিশ্ববিখ্যাত ডক্টর হাইনবিশ সাইমন- এর নিকট আমার কার্ড পাঠিয়ে দিলাম।
যখন আমি তাঁর কামরায় ঢুকি, মুহূর্তকালের জন্য তিনি তাকালের নির্বাক বিস্ময়ে; চেম্বার থেকে উঠতেও তিনি ভুলে গিয়েছিলেন। কিন্তু শিগগিরই তিনি তাঁর সমাহিত বাব ফিরে পেলেন এবং দাঁড়িয়ে আমার সংগে হাত মেলালেন।
-‘বসুন, বসুন। আমি আপনারই অপেক্ষা করছিলাম’। তিনি আমার দিকে নিষ্পলক চোকে তাকিয়ে রইলেন আর কোন কথা না বলে। ফলে, আমি অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম।
-‘কোন ক্রটি হয়েছে কি ডঃ সাইমন?’
-‘না, না, কোন ক্রটি হয়নি। কিংবা বলতে পারেন সবই ভূল…’। তারপর তিনি সশব্দে হাসিতে ফেটে পড়লেন এবং বললেন. –‘যেমন করেই হোক, আমি আশা করেছিলাম একটি মাঝারি বয়সের লোকের সাথে সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছি, যার চোখে রয়েছে সোনালী ফ্রেমে আঁটা চশমা; আর আমি কিনা দেখতে পাচ্ছি একটি বালাককে… ওহো, আমাকে মাফ করুন- যদি কিছু মনে না করেন- আপনার বয়স কতো?’
হঠাৎ আমার মনে পড়লো কায়বোর ফুর্তিবাজ ডাচ সওদাগরের কথা; সেও আমাকে এক বছর আগে একই প্রশ্ন করেছিলো। আামি উচ্চ হাস্যে ফেটে পড়লাম, ‘আমার বয়স তেইশের কিছু উপরে স্যার, চব্বিশের কাছাকাছি’ তারপর আমি যোগ করি, ‘আপনি কি মনে করেন ‘ ফ্রাংকফুর্টার শাইটুঙ’- এর জন্য এ বয়স খুবই কম?’
-‘না’, ধীরে ধীরে জবাব দেন সাইমন, ‘ফ্রাঙ্কফুর্টঅর শাইটুঙ’-এর জন্য নয়, আপনার প্রবন্ধগুলির জন্য। আমি তো ধরেই নিয়েছিলাম আত্মপ্রচারের স্বাভাবিক ইচ্ছাকে জয় করে নিজের ব্যক্তিত্বকে সম্পূর্ণরূপে লেখার আড়ালে রেখে দেয়া, যেমনটি আপনার লেখায় লক্ষ্য করেছি, তা আরো অনেক বেশি বয়সের মানুষের পক্ষেই সম্ভব। আপনি জানেন, এ হচ্ছে পরিণত সাংবাদিকতার গোপন রহস্যঃ আপনি যা দেখেছেন, শুনেছেন এবং ভাবছেন তার সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠভাবে লেখা, সেই সব অভিজ্ঞতাকে আপনার নিজের একান্ত ‘ব্যক্তিগত’ অভিজ্ঞতার সংগে না জড়িয়ে…। পক্ষান্তরে এ বিয়ষে চিন্তা করে এখন আমার মনে হচ্ছেঃ কেবল খুব এক তরুণই লিখতে পারতো অতো বেশি আগ্রহ উদ্দীপনার সাথে, অতো বিপুল- আমি কেমন করেই যে বলি- অতো বিপুল পুলক রোমাঞ্চের সাথে…
এরপর তিনি একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলেন- ‘আমি এ আশই করছি যে, এ যেন ক্ষয়ে না যায়। এবং আপনি যেন আর সব্বাইর মতো আত্মতুষ্ট, ভোঁতা স্থুল হয়ে না পড়েন-‘।
মনে হয়, আমার এই অীত তারুণ্যের আবিষ্কারই ডঃ সাইমনের এ বিশ্বাসকে আরো শক্ত ও জোরদার করে তোলে যে, তিনি আমার মধ্যে খুবই সম্ভাবনাময় এক সাংবাদিকের সাক্ষাৎ পেয়েছেন। তিনি পুরাপুরি একমত হলেন যে, যতো জলদি সম্ভব আমার আবার মধ্যপ্রাচ্যে ফিরে যাওয়া উচিত। যতো শীগগিরই ফেরা যায় ততোই ভাল। টাকা-পয়সার দিক দিয়ে এ ধরনের একটি পরিকল্পনার পথে আর কোন বাধা নেই। কারণ শেষপর্যন্ত জার্মান মুদ্রাস্ফীতিকে আয়ত্তে আনা সম্ভব হয়েছে এবং মুদ্রামূল্যে স্থিতিশীলতা আসার ফলস্বরূপ প্রায় সংগে সংগেই এসেছে সমৃদ্ধির এক প্লাবন। ‘ফ্রাংকফুর্টার শাইটুঙ’ আবার সামর্থ্য অর্জন করেছে তার বিশেষ সংবাদদাতাদের ভ্রমণের খরচ বহন করতে। অবশ্য আবার মধ্যপ্রাচ্যের পথে বের হয়ে পড়ার আগেই, এ সংবাদপত্রটির সাথে যে বইটি লেখার জন্য প্রথমে আমি চুক্তি করেছিলাম, সে বইটি আমাকেলিখৈ দিতে হবে এবং এ-ও ঠিক হলো যে, এই সময়ের মধ্যে আমাকে সম্পাদকীয় দফতরের সংগে যুক্ত থাকতে হবে, যাতে করে আমি একটি বড় খবরের কাগজের কাজের খুঁটিনাটি সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করতে পারি।
ফের বিদেশে যাবার জন্য আমার অধৈর্য সত্ত্বেও ফ্রাঙ্কফুর্টের ঐ মাসগুলি ছিলো ভয়ানক রকমের উদ্দীপনাপূর্ণ। ‘ফ্রাংকফুর্টার শাইটুঙ কেবল একটি বড় সংবাদপত্রই ছিলো না, এ ছিলো রীতিমতো এক গবেষণা কেন্দ্র। পূঁতাল্লিশজন পুরা সম্পাদক ছিলো এ কাগজটির। বার্তাকক্ষে যে বহু সংখ্যাক সহ-সম্পাদক এবং সহকারী কাজ করতো তাদেরকে এখানে গোণা হয়নি। সম্পাদকীয় কাজটি ছিলো বিশেষভাবে বিশেষজ্ঞদের কাজ। পৃথিবীল প্রত্যেকটি অঞ্চল এবং প্রত্যেকটি রাজনৈতিক অথবা অর্থনৈতিক বিষয় অর্পিত ছিলো এমন একজন সম্পাদকের হাতে যিনি ছিলেন নিজ ক্ষেত্রে এক অসাধারণ বিশেষজ্ঞ। আর এ ছিলো সেই পুরানো ঐতিহ্যেরই অনুসরণ যে, ‘ফ্রাঙ্কফুর্টঅর শাইটুঙ’-এর রচনা ও খবর কেবল চলমান ঘটনার ক্ষণিক প্রতিফলনই হবে না, বরং তা হবে এক ধরনের প্রমাণ্য সাক্ষ্য, যার উপর রাজনৈতিক এবং ইতিহাসবিদেরা পারবেন নির্ভল করতে। একথা সবাই জানতো- বার্লিনের পররাষ্ট্র দফতরে ‘ফ্রাঙ্কফুর্টার শাইটুঙ- এর সম্পাদকীয় এবং রাজনৈতিক ভাষ্যগুলি ফাইল করা হয়- বিভিন্ন বিদেশী সরকারের ‘চিঠিপত্র’ যেমন শ্রদ্ধার সাথে ফাইল করা হয় তেমনি। (বস্তুত এই পত্রিকার বার্লিন দফতরের তখনকার দিনর প্রধান সম্পর্কে বিসমার্ক বলেছিলেনঃ ডঃ স্টেইন হচ্ছেন বার্লিন দরবারে ‘ফ্রাঙ্কফুর্টার শাইটুঙ’-এর রাষ্ট্রদূত) এ ধরনের একটি প্রতিষ্ঠানের সদস্য হওয়া আমার বয়সের একজন তরুণের জন্য ছিলো সত্যি সত্যি গৌরবের ও আনন্দের। এ আনন্দ আরো বেশি করে অনুভব করি এজন্য যে, মধ্যপ্রাচ্যে সম্পর্কে আমি দ্বিধার সাথে যে- সব মতামত পেশ করেছি সেগুলির প্রতি সম্পাদকেরা গভীর মনোযোগ দিয়েছেন এবং প্রায়ই সেগুলি দৈনিক সম্পাদকীয় বৈঠকের বিষয়বস্তু হয়েছে। অবশ্য আমার চূড়ান্ত সাফল্য সেই দিনই এলো যেদিন আমাকে বলা হলো সাম্প্রতিক মধ্যপ্রাচ্য সমস্যার উপর একটি সম্পাদকীয় প্রবন্ধ লিখতে।
‘ফ্রংকফুর্টার শাইটুঙ’- এ আমাকে যে কাজ দেওয়া হলো তা আমার সজ্ঞান চিন্তার পেচনে যোগায় বিপুল উদ্দীপনা্। আগে সবসময়েই আমার চিন্তার যে স্বচ্ছতা ছিলো তার চাইতে আরো অনেক বেশি স্বচ্ছতার সাথে আমি আমার প্রাচ্যদেশের অভিজ্ঞতাকে মিলিয়ে দেখতে লাগলাম পাশ্চাত্যের সাথে, যার আমি অংশ হয়েছি আবার, ঠিক যেমন ক’মাস আগে আরবদের হৃদয়ের নিরাপত্তাবোধ এবং তাদের আচরিত ধর্মের মধ্যে একটা যোগ আবিষ্কার করেছিলাম তেমনি এখন আমার মনে হতে লাগলো- ইউরোপের যে আত্মিক সংহতি নেই আর তার নৈতিকতায় যে নৈরাজ্য বিদ্যমান তার কারণ হয়তো ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে তার সম্পর্কচ্ছেদ- যে বিশ্বাস পাশ্চাত্য সভ্যতাকে রূপ দিয়েছিলো একদিন।
এখানে আমি দেখতে পেলাম এমন এক সমাজ যা আল্লাহকে পরিত্যাগ করার পর একটা নতুন রূহানী পথের সন্ধানে রয়েছে; কিন্তু জাহিরা পশ্চিমের খুব কম লোকই উপলব্ধি করেছে সমাজের সেই লক্ষ্যটি কী-। জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতসারে প্রতীচ্যের অধিকাংশ লোক কম-বেশি অনেকটা এ ধরনেরই চিন্তা করতো বলে মনে হয়- ‘যেহেতু আমাদের বুদ্ধি, আমাদের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষণ, আমাদের হিসাব-নিকাশ, মানব জীবনের সূচনা এবং দৈহিক মৃত্যুর পর তার পরিণাম সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে কিছু ব্যক্ত করে না, আমাদের তাই উচিত সমস্ত শক্তিকে আমাদের বৈষয়িক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সম্ভাবনা বিকাশের জন্য নিয়োজিত করা- অতীন্দ্রিয় নীতিশাস্ত্র আর স্বতঃসিদ্ধ ধ্যান-ধারণা, যা বৈজ্ঞানিক প্রমাণের ধার ধারে না, তার দ্বারা আমাদের নিজেদেরকে বন্দী করা উচিত নয়’। তাই প্রতীচ্যের সমাজ যদিও প্রকাশ্যে আল্লাহকে অস্বীকার করেনি তবুও তার বুদ্ধিবৃত্তিক জীবন-ব্যবস্থার তাঁর জন্য আর কোন স্থানই সে রাখেনি।
বেশ কয়েক বছর আগে আমার পূর্বপুরুষদের ধর্ম সম্বন্ধে আমি যখন নিরাশ হয়ে পড়ি তখন আমি খুশ্চান ধর্ম নিয়ে কিছু চিন্তা করেছিলাম। আমার দৃষ্টিতে আল্লাহ সম্পর্কে খৃশ্চান ধারণা ছিলো ওল্ড টেস্টামেন্টের ধারণা থেকে অনেক-অনেক বেশি মহৎ, কারণ এ ধর্ম আল্লাহর ভাবনাকে কোন এক মানবগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্দ করেনি, বরং তিনি যে গোটা মানবজাতির পিতা- এই ধারণার জন্ম দিয়েছে। অবশ্য, খৃশ্চান ধর্ম- বিশ্বাসের মধ্যে এমন একটি উপাদান রয়েছে যা এই ধর্মের সার্বিক দৃষ্টিভংগী থেকে এক বিচ্যুতি; সে উপাদানটি হচ্ছেঃ খৃশ্চান ধর্মের দৃষ্টিভঙ্গীতে দেহ ও আত্মার মধ্যকার প্রভেদ, বিশ্বাসের জগৎ ও বাস্তব বৈষয়িক জগতের মধ্যকার ব্যবধান ও পার্থক্য।
যে-সব প্রবণতা জীবনকে এবং জাগতিক উদ্যমকে সত্য বলে স্বীকার করতে চায় সে-সব থেকে শুরুতেই খৃশ্চান ধর্ম বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায়, আমার মনে হলো, খৃশ্চান ধর্ম বহু আগেই পাশ্চাত্য সভ্যতার পেচনে একটি নৈতিক উদ্দীপনা যোগাবার শক্তি সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেছে। খৃশ্চান ধর্মের অনুসারীরা এ ধারণায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠে যে, মানুষের ব্যবহারিক জীবনে নাক গলানো ধর্মের কাজ নয়। ওরা ধর্মীয় বিশ্বাসকে একটা শান্তিপ্রদ প্রথা ভেবেই সন্তুষ্ট, যে প্রথার উদ্দেশ্য- ব্যক্তিগতভাবে পুরুষ ও নারীর মধ্যে একটা অস্পষ্ট ব্যক্তিগত নৈতিকতাবোধের, বিশেষ করে যৌন ব্যাপারে নৈতিকতার পোষণ ছাড়া আর কিছুই নয়। এভাবে চার্চের একটি বহু প্রাচীন দৃষ্টিভংগির সহায়তায় ওরা সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের গোটা ক্ষেত্রটিকেই নিজেদের গণ্ডির বাইরে রেখে দিয়েছে। চার্চের সেই দৃষ্টিভংগীটি হচ্ছেঃ ‘আল্লাহর পাওনা আল্লাহকে দাও এবং সিজারের পাওনা দাও সিজারকে’- এই বিভাগ। এভাবে সামাজিক, অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের ক্ষেত্রকে নিজেদের গণ্ডির বাইরে রেখে দেওয়ায় খৃশ্চান রাষ্ট্রনীতি ব্যবসা-বাণিজ্য যে-পথ ধরে বিকাশ লাভ করেছে তা হযরত ঈসা কল্পিত পথ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। জাগতিক ব্যাপারে তাঁর অনুসারীদের একটা বাস্তব পন্হা নির্দেশ করতে না পারায় পাশ্চাত্য জগত যে ধর্ম অনুসরণ করে, আমার মতে, তা হযতর ঈসার সত্যিকার উদ্দেশ্যের এবং বলা যায়, অনুসরণ করে, আমার মতে, তা হযরত ঈসার সত্যিকার উদ্দেশ্যের এবং বলা যায়, প্রত্যেক ধর্মেরই যা মূল লক্ষ্য তার বিচারে ব্যর্থ হয়েছে? সেই উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যটি কি? মানুষ কিভাবে অনুভব করবে শুধু তা’ই নয়, বরং কিভাবে সে সঠিক জীবন-যাপন করবে তা দেখানোই হচ্ছে সেই লক্ষ্য। নিজের ধর্ম একভাবে না একভাবে তাকে নিরাশ করেছে, ব্যর্থ করেছে, এই সহজাত অনুভূীতর ফলে প্রতীচ্যের মানুষ বিগত কয়েক শতাব্দীতে খৃশ্চান ধর্মে তার সর্বপ্রকার বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে। এই বিশ্বাস হারানোর ফলে সে এই প্রত্যয়ও হারিয়েছে যে, বিশ্বজগত একটিমাত্র পরিকল্পক মনের অভিব্যক্তি এবং সে কারণে, তা এক সুসমন্বিত সমগ্র। আর এ প্রত্যয় হারিয়েছে বলেই এখন সে জীবন-যাপন করছে এক আধ্যাত্মিক ও নৈতিক শূণ্যতার মধ্যে। পশ্চিম যে এভাবে ধীরে ধীরে খৃশ্চান ধর্ম থেকে দূরে সরে পড়েছে তার মধ্যে আমি দেখতে পেলাম, ইহজীবনের প্রতি সেন্ট পলের যে ঘৃণা একেবারে শুরুতেই এবং সম্পূর্ণভাবেই হযরত ঈসার শিক্ষাকে দুর্বোধ্য করে তুলেছিলো তারই বিরুদ্ধে এক সবল বিদ্রোহ। তাহলে, পাশ্চাত্য সমাজ কি করে এখনো দাবি করতে পারে খৃস্ট সমাজ বলে? এবং একটি বাস্তব বিশ্বাস ছাড়া কী করেই বা ওরা বর্তমান নৈতিক নৈরাজ্যকে কাটিয়ে ওঠার আশা করতে পারে?
নিজস্ব অবস্থান থেকে উলট-পালট, উৎক্ষিপ্ত বিপর্যস্ত এক বিশ্বঃ এ-ই ছিলো আমাদের পাশ্চাত্য জগত। অভূতপূর্ব ব্যাপকতার সাথে রক্তপাত, ধ্বংসলীলা, হিংসাত্মক হানাহানি, বহু সামাজিক প্রথাপদ্ধতির ভাঙন, আদর্শের সংঘাত, নতুন নতুন জীবন-পদ্ধতিরে পক্ষে তিক্ত, সর্বাত্মক সংগ্রাম- এগুলিই ছিলো আমাদের সময়কার লক্ষণ। একটি বিশ্বযুদ্ধের ধূম্রজাল আর ধ্বংসলীলা থেকে অসংখ্য ছোট ছোট যুদ্ধবিগ্রহ এবং বহু বিপ্লবে ও প্রতিবিপ্লবের মধ্যে থেকে- তখন পর্যন্ত লিপিবদ্ধ সমস্ত কিছুকে ছাড়িয়ে যাওয়া অর্থণৈতিক বিপর্যয় থেকে- এককথায়, ভয়ংকর এ সকল ঘটনা থেকে মাথা তুলে দাঁড়ানো একটি সত্য যে, কেবল বৈষয়িক এবং কারিগরি প্রগতির উপর প্রতীচ্যের বর্তমান একান্ত- নির্ভরশীলতাই আজকের নৈরাজ্য ও বিশৃংখলাকে দূর করে একটা ঐক্য ও শৃঙ্খলা স্থাপন করতে কিছুতেই সক্ষম নয়। মানুষ কেবল রুটি খেয়েই বাঁচে না, আমার এই সহজাত যৌবন-ধর্মী প্রত্যয় দানা বাঁধলো এই বুদ্ধিগত প্রত্যয়ে যে, মানুষ বর্তমানে ‘প্রগতির’ যে পূজা করছে তা আগের দিনের অবিমিশ্র মূল্যে বিশ্বাসের্ই একটি দুর্বল অস্পষ্ট প্রতিকল্প ছাড়া কিছুই নয়- আরর এই মিথ্যা বিশ্বাস সে-সব মানুষই উদ্ভাবন করেছে যারা অবিমিশ্র শর্তাতীত মূল্যে বিশ্বাস করবার হৃদয়গত সমস্ত ক্ষমতাই হারিয়ে ফেলেছে এবং এখন এই বিশ্বাসের দ্বারা নিজেদের ছলনা করছে যে, কোন- না কোনভাবে কেবল বিবর্তনের তাড়নায়ই মানুষ তার বর্তমানের বাধা-বিধ্নগুলি কাটিয়ে উঠবে। আমি বুঝতে পারলাম না, এই খেয়ালী বিশ্বাস থেকে নির্গত নতুন সব অর্থনৈতিক ব্যবস্থঅর কোন একটি কী করে পাশ্চাত্য সমাজের দুঃখ-দূর্দশার একটি সাময়িক প্রতিষেধকের বেশি কিছু হতে পারে? এ ব্যবস্থাগুলি বড় জোর এর কোন- না- কোন লক্ষণেরই কেবল চিকিঝসা করতে পারে, কিন্তু ব্যাধির মূল কারণের কখনও নয়।
…… …… ……. ……..
আমি যখন ‘ফ্রঙ্কফুর্টার শাইটুঙ’-এর সম্পাদকীয় দফতরে কাজ করছিলাম তখন প্রায়ই বার্লিনে যেতাম যেখানে ছিলো আমার প্রায় সকল বন্ধু-বান্ধব এবং বার্লিনে এ ধরনের একটি সফরকালেই সেই নারীর সংগে আমার সাক্ষাৎ হয়, পরবর্তীকালে যে হয়েছিলো আমার সহধর্মিনী।
রোমানিশেজ ক্যাফের জমজমাট ভিড়ের মধ্যে যে মুহূর্তে আমাকে এলসার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়অ হয় তখন থেকেই আমি তার প্রতি ভীষণ আকৃষ্ট হয়ে পড়ি। এ আকর্ষণ কেবল তার চেহারার নাজুক সৌন্দর্যের জন্য নয়, বরং তার সংকীর্ণ, সুবিন্যস্ত অস্থিবিশিষ্ট মুখমণ্ডলের জন্য, যাতে রয়েছে তাৎপর্যপূর্ণ গভীর নীল দু’টি চোখ আর অনুভূতিশীল নাজুক মুখ, যা ব্যক্ত করে রসবোধ ও মেহেরবানী,- বরং তারও চাইতে বেশি, যে-হৃদয়গত ইন্দিয়জ সহজ গুণের মাধ্যমে সে মানুষ এবং বস্তুকে গ্রহণ করে, সে কারণে। এলসা ছিলো একজন চিত্রশিল্পী। পরে আমি জানতে পেরেছিলাম ওর শিল্পকর্ম উঁচু দরের না হলেও ওর সেই স্নিগ্ধ উজ্জ্বল গভীরতা- ওর সমস্ত কথায় ও অংগভংগীতে যা ব্যক্ত হতো- ওর সমস্ত শিল্পকর্মও বহন করতো তারই ছাপ, যদিিও তার বয়স ছিলো আমার চাইতে পনেরো বছর বেশি, অর্থাৎ তখন তার বয়স পঁয়ত্রিশের উপর- তবু তার মসৃণ মুখমণ্ডল আর ক্ষীণ, নমনীয় শরীরের জন্য তাকে দেখলে মনে হতো অনেক কম বয়সের। জীবনে খাঁটি নর্ডিক জাতের যতো মানুষ আমি দেখেছি, সম্ভবত এলসাই হচ্ছে তাদের সুন্দরতম প্রতিনিধি। বিশুদ্ধ নর্ডিক জাতের মানুষের চেহারায় যে পরিচ্ছন্নতা ও তীক্ষ্ণতা থাকে সবই ছিলো তার মধ্যে; কিন্তু এ জাতেরই মানুষের মধ্যে প্রায়ই যে অনমনীয়তা এবং অনুভূতিহীনতা দেখা যায় এলসা ছিলো তা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। এলসার জন্ম সেই সব পুরানো হলস্টিন পরিবারগুলির একটিতে, যাদেরকে বর্ণনা করা যেতে পারে ইংরেজ ‘জোতদার সম্প্রদায়েরে’ উত্তর-জার্মান সমগোত্রীয়রূপে। কিন্তু তার চলাফেরা ও আচরনের মধ্যে যে সংস্কারমুক্ত স্বাধীনতা ছিলো তা’ই জোতদারসুলভ বস্তুনিষ্ঠতার স্থলে তাকে দিয়েছিলো সম্পূর্ণ এক অ-নর্ডিকসুলভ উষ্ণতা আর স্বাভাবিক বিচক্ষণতা। এলসা ছিলো বিধবা, তার ছিলো ছ’বছরের একটি পুত্র, যাকে সে খুবই ভালোবাসতো।
নিশ্চয়ই শুরু থেকেই এ আকর্ষণ ছিলো দু’তরফা, কারণ প্রথম সাক্ষাতের পর প্রায়ই আমরা একে অপরের সাথে দেখা করতে থাকি। আরব জগতের সাম্প্রতিক ছাপ আমার মনেক এতোটা আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো যে, আমি স্বাভাবিকভাবেই এলসাকে সেসব বলতে থাকি আর এ-সব ছাপ আমার মধ্যে যে মজবুত অথচ এখনো বিচ্ছিন্ন অনুভূতি ও ধারণার জন্ম দিয়েছে সেগুলির প্রতি সে আমার বেশিরভাগ বন্ধু-বান্ধব থেকে ভিন্নরূপে এক অসাধারণ সমঝদারি ও সহানুভূতির পরিচয় দেয়। এলসাকে এতো গভীর করে এসব জানাতে চেয়েছি যে, নিকট-প্রাচ্যে আমার সফরের বর্ণনা করে আমি যে বইটি লিখছিলাম তারি একটি ভূমিকা লিখতে গিয়ে আমার মনে হলো, আমি যেন এলসাকেই সম্বোধন করে লিখছিঃ
যখন কোন ইউরোপীয় ইউরোপের এমন কোন দেশে সফর করে যা সে আগে কখনো দেখেনি তখন সে কিছুটা বিস্তৃততরো হলেও নিজের পরিবেশের মধ্যেই বিচরণ করে চলে এবং সহজেই, অভ্যাস যে-সব জিনিসের সংগে তাকে পরিচিত করেছে এবং চলার পথ যে- নতুনের সাথে তার সাক্ষাৎ হচ্ছে তার পার্থক্য সে বুঝতে পারে; কারণ আমরা জার্মানই হই আর ইংরেই হই এবং ফ্রান্স, ইতালি অথবা হাঙ্গেরী যে-কোন দেশের ভিতর দিয়েই সফর করি না কেন, ইউরোপের মন ও চেতনা আমাদের সবাইকে বেঁধে দেয় এক ঐক্যবন্ধণে। আমরা যেহেতু নানা অনুষঙ্গের একটি সুনির্দিষ্ট পরিধির মধ্যে বাস করি সে কারণে আমরা একটা সাধারণ ভাষার মতোই এই সব অনুসংগের মাধ্যমে একে অপরকে বুঝতে এবং নিজেদেরকে অন্যের বোধগম্য করে তুলতে সক্ষম হই। আমরা এই ব্যাপারটিকে বলি সাংস্কৃতিক মিলন। এ জিনিসটির অস্তিত্ব নিশ্চয়ই একটি সুবিধা, একটি ফায়দা। কিন্তু অভ্যাস থেকে যে-সব সুবিধা উদগত হয় সে সবের মতোই এটিও কখনোপ কখনো অসুবিধা হয়ে দাঁড়ায়; কারণ মাঝে মাঝে আমরা দেখতে পাই, আমরা সেই বিশ্বজনীন চেতনায় যেন সুতী পশম দ্বারা আচ্ছাসিত। আমরা লক্ষ্য করি সে অভ্যাস আমাদের ঘুম পাড়িয়ে হৃদয়ে এসে দিয়েছে আলস্য; এ আমাদের ভূলিয়ে দিয়েছে আমাদের আগেকার অধিকতরো সৃজনশীল সময়ের বিপজ্জনক পথে চলার উদ্যমকে, সেই স্পর্শাতীত সত্যের সন্ধান লাভের প্রয়াসকে। আগেকার সেই সব জামানায় হয়তো এগুলিকে বলা হতো স্পর্শাতীত সম্ভাবনা, এবং আবিষ্কারক, অভিযাত্রী অথবা শিল্পী, যারাই তার সন্ধানে বার হয়ে পড়েছিলো তারা সবসময়ই নিজেদের জীবনের গহনতম উৎসেরই অনুসন্ধান করেছে। আমরা যারা দেরীতে এসেছি তারাও নিজেদেরই জীবনকে খুঁজে ফিরছি; কিন্তু আমাদের নিজেদের জীবন আপনা-আপনি পাঁপড়ির পর পাঁপড়ি মেলে বিকাশিত হবার আগেই আমরা তাকে পাবার বাসনায় আচ্ছন্ন এবং এই ধরনের প্রয়াসের আড়ালে যে পাপ প্রচ্ছন্ন রয়েছে আমরা অস্পষ্টভাবে তা আশংকা করছি। বহু ইউরোপীয় আজ অনযুভব করতে শুরু করেছেঃ বিপদকে এড়িয়ে চলার ভয়ংকর বিপদ!
এ বইটিতে আমি এমন একটি এলাকায় আমার সফরের কথা বর্ননা করছি ইউরোপ থেকে যার পার্থক্য এতোই বৃহৎ যে, এ দু’য়ের মধ্যে সহজে সেতু তৈরি করা সম্ভব নয়, এবং বলা যায়, এ পার্থক্যটি এক দিকে থেকে বিপদেরই শামিল। আমরা পেছনে ফেলে চলেছি এতো বেশি এক-রূপ এক-পরিবেশের নিরাপত্তাকে, যেখানে অপরিচিত তেমন কিছুই নেই এবং নেই বিস্ময়কর কিছু- আর আমরা প্রবেশ করছি অন্য এক জগতের বিস্ময়কর অদৃষ্টপূর্ব বৈচিত্র্যের মধ্যে।
আমরা যেনো আত্মপ্রতারণা না করিঃ সেই ভিন্ন জগতে যে বহু বর্ণাঢ্য ছবি আমাদের পথে পড়বে, আমরা হয়তো তার এটির বা ওটির মর্ম বুঝতে পারি; তবে, একটি পাশ্চাত্য দেশে গোটা চিত্রটির মর্ম যেমন সচেতনভাবে বোঝা সম্ভব এই আলাদা জগতে তা আমাদের পক্ষে কখনো সম্ভব নয়। এই ভিন্ন জগতের মানুষ থেকে আমাদেরকে যা আলাদা করেছে তা কেবল স্থান নয়, স্থানের অতিরিক্ত আর কিছু। কী করে ভাবের আদান-প্রদান চলতে পারে ওদের সংগে? শুধুমাত্র ওদের ভাষা বলতে পারাই যথেষ্ট নয়। ওরা ওদের জীবনকে কিভাবে উপলব্ধি করে কেউ যদি তা বুঝতে চায় তাকে পুরাপুরি সংস্কারমুক্ত হয়ে ঢুকতে হবে ওদের পরিবেশে এবং ওদের সংগ ও অনুষঙ্গগুলির ভেতর শুরু করতে হবে জীবন-যাপন। তা কি সম্ভব? এবং তা বাঞ্ছনীয় হবে? হয়তো আমাদের পুরানো পরিচিত চিন্তাভ্যাসের বদলে বিদেশী অপরিচিত চিন্তাভ্যাস গ্রহণ করা তেজারতি হিসাবে পরিণামে ক্ষতিকরই হবে।
কিন্তু সত্যই কি আমরা ওই জগতের বহির্ভূত? আমি তা মনে করি না। আমরা যে নিজেদেরকে বহির্ভূত বলে অনুভব করি তার প্রধান কারণ আমাদের পাশ্চাত্য চিন্তা-পদ্ধতি আমাদেরই একটি নিজস্ব ভুলের উপর দাঁড়িয়ে আছে। আমরা বিদেশী অপরিচিত সৃজনধর্মী মূল্যকে খাটো করে দেখতে অভ্যস্ত এবং সবসময়ই তাকে আঘাত করতে, আমাদের নিজ শর্তে তাকে আত্মসাৎ করতে, আমাদের নিজ বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবেশে তাকে গ্রহণ করতে প্রলুব্ধ। অবশ্য আমার মনে হয়, আমাদের এ উৎকণ্ঠার যুগে এ ধরনের উদ্ধত প্রয়াসের আর কোন অবকাশ নেই। আমরা অনেকেই উপলব্ধি করতে শুরু করেছি যে, সাংস্কৃতিক ব্যবধান বুদ্ধিগত বলাৎকারের মাধ্যমে নয় বরং অন্য উপায়ে জয় করা যেতে পারে এবং জয় করা উচিত। হয় তো আমাদের ইন্দ্রিয়গুলিতে এর নিকট সমর্পণ করেই তা জয় করা যেতে পারে। যেহেতু এই অপরিচিত জগত, আপনি যা কিছু আপনার স্বদেশে জেনেছেন তা থেকে এতো সম্পূর্ণভাবে ভিন্ন, যেহেতু সেই জগতে এতো বেশি কিছুর অবকাশ রয়েছে যা রূপে ও ধ্বনিতে আশ্চর্য রকমে অভিনব এবং বিচিত্র সে কারণে, আপনি যদি মনোযোগী হন, কখনো কখনো তা, সুদুর অতীতে যে-সব বস্তুর সংগে ছিলো আপনার পরিচয় এবং দূর-অতীতে যা বিস্মৃতির আড়ালে হারিয়ে গেছে, সে-সবের ক্ষণিক স্মৃতির পরশ বুলিয়ে যাবে আপনার উপর- আপনার নিজের জীবনের সেই স্পর্শনাতীত বাস্তবতাগুলি। এবং আপনার জগতকে সেই ভিন্ন, সেই অপরিচিত জগত থেকে আলাদা করেছে যে গহ্বর তার ওপর থেকে স্মৃতির এই নিশ্বাস যখন আপনার নিকট পৌঁছায় তকন আপনি নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করেনঃ হয়তো এখানেই- এবং কেবল এখানেই সকল সফর, সকল ভবঘুরেমীর অর্থ নিহিত কি নাঃ কী সেই অর্থ? না, আপনার চারপাশের জগতের অজ্ঞাত-পরিচয় বৈচিত্য সম্পর্কে সজাগ হয়ে ওঠা আর তাতে করে আপনার নিজের ব্যক্তিগত বিস্মৃত বাস্তবতাকে নতুন করে জাগ্রত করা….।
এবং আমি অন্ধকারে পথ হাতড়ানো মানুষের মতো এই বাধো বাধো কথাগুলির দ্বারা এতো অসার্থকভাবে যা বলবার চেষ্টা করেছিলাম- এলসা যেহেতু তার সহজাত অনুভুতি দিয়ে তার মর্ম বুঝতে পেরেছিলো, তা’ই আমি তীব্রভাবে অনুভব করলাম যে, এলসা এবং কেবল এলসাই- বুঝতে পারে আমি কিসের পেছনে ছুটেছি এবং এলসাই পারে আমার এই অনুসন্ধানে আমাকে সাহায্য করতে।
দুই
দীর্ঘ উদ্দেশ্যহীন সফরের আরো একটি দিন ফুরিয়ে গেলো। নৈঃশব্দ আমার ভেতর এবং নৈঃশব্দ আমার চারপাশের রাত্রিতে। বালিয়াড়ির উপর দিয়ে বাতাস বয়ে চলে আস্তে আস্তে, আলতো পরশ বুলিয়ে এবং বালিয়াড়ির ঢালুর বালুতে কোঁকড়ানো চুরের মতো ঢেউ খেলে। যে আগুন জ্বালানো হযেছে তারই সকীর্ণ বৃত্তের মধ্যে আমি দেখতে পাই জায়েদের মূর্তি.. তার পাত্র ও কড়াইগুলি নিয়ে ব্যস্ত, আমাদের জীবনের থলেগুলি পড়ে আছে নিকটেই, রাতের জন্যে তাঁবু খাটানোর সময় আমরা যেখানে ছুঁড়ে ফেলেছিলাম সেখানেই- আর উঁচু কাঠের হাতলওয়ালা আমাদের জীনগুলিও। কিছুদূরে এরই মধ্যে অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে হামাগুড়ি দিয়ে পড়া দুটি উটের দেহ; দীর্ঘ সফরে ওরা ক্লান্ত ওদের গলা বালির দৃশ্যমান অথচ আপনার হৃদস্পন্দনের মতোই আপনার নিকটে, শূণ্য মরুভূমি।
পৃথিবীতে এর চাইতে সুন্দর অনেক ল্যাণ্ডস্কেপ রয়েছে, কিন্তু কোনটিই, আমি মনে করি, এমনি চূড়ান্ত ক্ষমতা সহারে মানুষের আত্মাকে গড়ে তুলতে পারে না। মরুভূমি তার কাঠিন্যে ও প্রায়-বসতিহীন গাছপালা-শূণ্য বিস্তৃতিতে সমস্ত ছলাককলাকে মুছে দেয় আমাদের জীবনের মর্ম-উপলব্ধির বাসনা থেকে-মুছে দেয়, অধিকতর সদয় প্রকৃতি যে- বহুবিধ প্রবঞ্চনার ফাঁদে ফেলে মানুষকে তার চারদিকের জগতে তার নিজের কল্পনা আরোপ করতে বাধ্য করতে পারে, সেগুলিকে; মরুভূমি হ চ্ছ নগ্ন এবং পরিচ্ছন্ন- সে আপোস করতে জানে না। যে-ব মনোরম খেয়াল মর্জি মাফিক চিন্তার মুখোশ হিসাবে ব্যবহৃত হতে পারে, মরুভূমি সেগুলিকে ঝেঁটিয়ে তাড়িয়ে দেয় মানুষের হৃদয় থেকে এবং এভাবে তাকে মুক্ত করে এমন এক পরমের নিকট আত্মসমর্পণ করার জন্য- যার কোন আকার নেইঃ সকল দূরের চাইতে দূর, অথচ যা-কিছু নিকট তার চাইতেও কাছে।
মানুষ যখন চিন্তা করতে শিখেছে তখন থেকেই মরুভূমি হচ্ছে এক আল্লাহকে তার সমস্ত বিশ্বাসের লালনকেন্দ্র। একথা সত্য, কোমলতরো পরিবেশ এবং আরো বেশি অনুকূল আবহাওয়ায়ও মানুষ বারবার তাঁর অস্তিত্বের এবং একত্বের হদিস পেয়েছে- যেমন প্রাচীন ইউনানীদের ‘মৈরা’র ধারণায়ঃ এই মৈরা এমন একটি অনির্বাচনীয় শক্তি যা অলিস্পাসের সকল দেবদেবীর ক্ষমতার উৎস এবং তাদের আয়েত্তের বহির্ভুত। কিন্ত এ জাতীয় ধারণা কখনো একটা অস্পষ্ট অনুভূতি, একটা কিয়াসী উপলব্ধির ফল ছাড়া বেশি কিছু ছিলো না, ছিলো না তা নিশ্চিত প্রজ্ঞার ফল, যতক্ষণ না চোখ-ধাঁধানো নিশ্চয়তার সংগে এই জ্ঞান উদ্ভাসিত হলো মরুভূমির মানুষের নিকট, মরুভূমিরই মধ্য থেকে। মিদিয়ানের মরুভূমির একটি আগুন-ধরা কাঁটাবন থেকেই আল্লাহর বানী ধ্বনিত হয়েছিলো মূসার নিকট; যূদী মরুভূমির বিয়াবানেই হযরত ঈসা পেয়েছিলেন আল্লাহর রাজ্যের পয়গাম এবং মক্কার নিকটে মরু-পাহাড়ের হেরা গুহায়ই প্রথম ওহী নাযিল হয়েছিলো আরবের নবী মুহাম্মদের (স) নিকটে।
তাঁর নিকট এ এসেছিলো শিলাময় পাহাড়ের মধ্যবর্তী সেই সংকীর্ণ, শুষ্ক গিরি সংকটে, সেই মরুভূমির রোদে পোড়া নগ্ন উপত্যকায়। কী ছিলো সেই পয়গাম?- না, দেহ ও আত্মার মিলনে যে জীবন সেই জীবনের সামগ্রিক স্বীকৃতিঃ যে পয়গামের পরিণাম- বিভিন্ন কবিলার রূপহীন ধর্মহীন এক জাতিকে একটি নির্দিষ্ট অবয়ব ও লক্ষ্য দান করা এবং তার মাধ্যমে কয়েক দশকের মধ্যেই একটি শিকা, এবং একটি প্রতিশ্রুতির মতো ছড়িয়ে পড়া, পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগর এবং পূর্বদিকে চীনের প্রাচীর পর্যন্ত। তার নিয়তি ছিলো তেরশ’ বছরের অধিককাল পরেও, সব রকমের রাজনৈতিক অবক্ষয় কাটিয়ে উঠে, এমনকি, এ পয়গাম যে-মহৎ সভ্যতার জন্ম দিয়েছিলো সেই সভ্যতার পরও টিকে থেকে, আজ পর্যন্ত একটি মহান আধ্যাত্মিক শক্তি হিসাবে কায়েম থাকা- সেই পয়গাম যা এসেছিলো আরবের নবীর নিকট….।
…. ….. ….. …..
আামার সময় কাটে ঘুমিয়ে এবং জেগে।আমি চিন্তা করি সেই দিনগুলির কথা যা চলে গেছে, কিন্তু এখনো মৃত নয়। আমি ঘুমিয়ে পড়ি এবং স্বপ্ন দেখি, আবার আমার ঘুম টুটে যায়, আবার আমি উঠে বসি। আমার জাগরণের আধো-আলো আধো-ছায়অ স্বপ্ন এবং স্মৃতি বয়ে চলে একত্রে, কোমলতার সংগে।
রাত এখন ভোরের কাছাকাছি। আগুন একদম নিভে গেছে। নিজের কম্বলে জড়িয়ে ঘুমাচ্ছে জায়েদ। আমাদের উট দু’টি পড়ে আছে নিস্পন্দ, যেন মাটির দু’টি ঢিবি। নক্ষত্র এখনো দেখা যাচ্ছে আসমানে এবং আপনি হয়তো ভাবতে পারেন, এখনো ঘূমানোর সময় আছে। কিন্তু পূব আসমানের নিচুতে দেখা দেয় অন্ধকার ফুঁড়ে ফ্যাকাশে হয়ে বের হয়ে আসা একটি অনুজ্জ্বল আলোর রশ্মি আরেকটি গাঢ়তর শিকার উপরে, যা ছড়িয়ে আছে দিগন্তের উপরেঃ যুগল নকীব, ভোরের, ফজরের সালাতের সময়ে।
আমার উপরে আমি তেরছা দেখতে পাই শুকতারাটিকে, যাকে আরবরা বলে, আয-যোহরা, জ্বলজ্বলে নক্ষত্র। আাপনি যদি ওদেরকে জিজ্ঞাস করেন এ সম্পর্কে, আপনাকে ওরা বলবে, এককালে এই উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলো এক রমনী….
এক সময়ে দুই ফেরেশতা ছিলো হারুত আর মারুত নামে। বিনয় আর নম্রতা যদিও ফেরেশতাদের জন্য শোভনীয়, তবু এই দুই ফেরেশতা ভূলে গিয়ে অহংকার করেছিলো যে, তাদের পবিত্রতা অক্ষয়, অজেয়। আমরা নূরের তৈরি- পুরুষের ঔরসজাত দুর্বল মানুষের এসবের উর্ধ্বে! কিন্তু তারা ভূলে গিয়েছিলো তারা পবিত্র কেবল এ কারণেই যে, তাদের কামনা বলে কিছু নেই এবং কামনাকে দমন করবরা জন্য কখনো তাদের বলাও হয়নি। তাদের ঔদ্ধত্যে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন এবং তাদেরকে বলেন, ‘তোমরা পৃথিবীতে যাও এবং সেখানে তোমাদের পরীক্ষার মুকাবেলা করো’। দাম্ভিক ফেরেশতারা পৃথিবীতে নেমে আসে এবং মানুষের দেহে মানব সন্তানদের মাঝে ঘুরে বেড়াতে থাকে- আর পয়লা রাতেই ওরা দেখা পায় এক রমনীর, যার সৌন্দর্য্য এতো বিস্ময়কর ছিলো যে, লোকেরা তাকে বলতো আয-যোহরা…. উজ্জ্বল রমনী। যখন ফেরেশতা দু’জন তাদের এই মুহূর্তেল মানুষের চোখ এবং অনুভুতিদিয়ে যোহরার দিকে তাকালো, তাদের বুদ্ধি তালগোল পাকিয়ে গেলো এবং ওরো যেন ঠিক মানুষেরই সন্তান, তাই তাদের মনে জাগলো যোহরাকে পাওয়ার অদম্য ইচ্ছা। ওদের দু’জনেই যোহরাকে বলল, ‘তুমি রাযী হয়ে যাও আমার প্রতি’। কিন্তু যোহরা জবাব দিলো, ‘আমি তো অন্য এক পুরুষের। তুমি যদি আমাকে চাও, ওর হাত থেকে আমাকে অবশ্যি মুক্ত করতে হবে। ‘তখন হারুত মারুত ওই লোকটিতে কতল করে বসে এবং ওরা অন্যায়ভাবে যে রক্তপাত করেছিলো সেই রক্তে রাঙা হাত নিয়েই ওরা সেই রমনীর উপর মিটায় ওদের উদগ্র কামনা। কিন্তু যে মুহূর্তে ওদের কামনা আর রইলো না, তখনি, কিছুক্ষণ আগেকার এ দুই ফেরেশতার চৈতন্যোদয় হলো যে, পৃথিবীতে ওদের পয়লা রাতেই ওরা দ্বিবিধ পাপ করে বসেছেঃ হত্যা এবং ব্যভিচার, এবং ওদের অহংকারের কোন অর্থই হয় না! তখন আল্লাহ বললেন, ‘পার্থিব শাস্তি এবং পরলেঅকের শাস্তি’- এ দু’টির একটি বেছে নাও তোমরা’। তীব্র অনুশোচনায় পতিত ফেরেশতা দু’জন বেছে নেয় এই পৃথিবীর শাস্তি। তখন আল্লাহ হুকুম দিলেন- আকাশ এবং পৃথিবীর মধ্যে এদেরকে ঝুলিয়ে রাখা হোক শৃংখলিত করে এবং এভাবেই ওরা ঝুলানো থাকবে হাশরের দিন পর্যন্ত, ফেরেশতা এব্ং মানষের প্রতি এই নসিহতরূপে যে, সমস্ত সদগুণই আপনা- আপনি ধ্বংস হয়ে যায় যখন তাতে থাকে না বিনয় এবং নম্রতা। কিন্তু কোন মানব-চক্ষুই যেহেতু ফেরেশতাদের দেখতে সমর্থ নয়, তাই আল্লাহ আয-যোহরাকে একটি নক্ষত্রে রূপান্তরিত করে ঝুলিয়ে দিলেন আসমানে, যাতে মানুষ সবসময়ই তাকে দেখতে পায় এবং তার কাহিনী ইয়াদ করে মানুষ স্মরণ করে হারুত আর মারুতের দুর্ভাগ্যেল কথা। এই কাহিনীর রূপরেখা ইসলামের চেয়ে অনেক- অনেক বেশি প্রাচীন মনে হয়। প্রাচীন সিমাইটরা তাদের দেবী ইশতারকে কেন্দ্র করে- পরবর্তীকালে যিনি হয়েছিলেন গ্রীসীয়দের দেবী এফ্লোদিতে, – যে সব উপকথার জাল বুনেছিলো, তারই কোন একটি থেকে এই কাহিনীর উৎপত্তি। আমরা যে গ্রহকে ‘শুক্র’ বলে জানি সেই গ্রহ আর এই দুই দেবীই এক বলে সনাক্ত করা হয়েছে। কিন্তু আমি যে রূপে এই গল্পটি শুনেছিলাম তাতে হারুত মারুতের কাহিনীটি হচ্ছে মুসলিম মানসের এক নিজস্ব সৃষ্টি। এ কাহিনী এ ধারণারই দৃষ্টান্ত যে, বস্তু-নিরপেক্ষ পবিত্রতার কোন নৈতিক তাৎপর্যই নেই যতক্ষণ তা নির্ভর করে কামনা-বাসনা না-থাকার উপরে। কারণ বারবার ঘুরে ফিরে ভাল আর মন্দের মধ্যে একটি বেছে নেয়ার প্রয়োজনই কি সমস্ত নৈতিকতার ভিত্তি নয়?
বেচারা হারুত মারুত এ কথা জানতো না। যেহেতু ফেরেশতা হিসাবে ওরা কখনো কোন প্রলোভনের সম্মুখীন হয়নি তাই ওরা নিজেদেরকে মনে করতো পবিত্র এবং নৈতিকতার দিক দিয়ে মানুষের উর্ধ্বে। ওরা বুঝতে পারেনি যে, দৈহিক চাহিদার বৈধতা অস্বীকার করার পরোক্ষ অর্থ হবে মানুষের ক্রিয়াকলাপের মধ্যে সকল প্রকার নৈতিক মূল্যবোধের অস্বীকৃতি। কারণ কেবলমাত্র এই সব তাকিদ, প্রলোভন এবং সংঘাতের উপস্থিতিই… ‘বেছে নেয়ার সম্ভাবনাই- মানুষকে এবং কেবল মানুষকেই, আর কাউকে নয়, করে তোলে এক নৈতিক সত্তাবান প্রাণী, যার রয়েছে একটি আত্মা’।
এই ধারণার ভিত্তিতেই সকল উন্নততরো ধর্মের মধ্যে ইসলাম একাই আত্মাকে মানুষের ব্যক্তিত্বের একটি দিক বলে গণ্য করে এবং নিজের অধিকারেই তা একটি অন্য নিরপেক্ষ ব্যাপার, এরূপ মনে করে না। এর ফলে, মুসলিম দৃষ্টিতে মানুষের আত্মার বিকাশ তার প্রকৃতির সবক’টি দিকের সংগে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দৈহিক কামনা- বাসনা তার এই প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংগ। এগুলি কোন ‘আদি পাপে’র ফল নয়, বরং বাস্তব আল্লা- প্রদত্ত শক্তি, যাকে স্বীকার করে নিতে হবে এবং সেভাবেই ব্যবহার করতে হবে বুদ্ধিমত্তার সংগে। বলাবাহুল্য, আদি পাপের ধারণাই ইসলামী নীতিশাস্ত্রের নিকে অপরিচিত; তাই দেহের চাহিদাকে কি করে দমন করা যাবে তা মানুষের সমস্যা নয়, বরং সমস্যা হচ্ছে কেমন করে তার আত্মার চাহিদার সংগে সেগুলির সমন্বয় সাধন করা যাবে এমনভাবে যাতে করে জীবন হয়ে উঠবে পূর্ণ এবং সুকৃতিময়।
এই প্রায় অদ্বৈতবাদী জীবন-স্বীকৃতির মূল খুঁজে পাওয়া যাবে ইসলামের এই দৃষ্টিভংগীর যে, মানুষের আদি ফিতরত হচ্ছে মূলত সৎ। মানুষ জন্মগতভাবেই পাপী- এই খৃশ্চান ধারণা, অথবা সে জন্মগতবাবে হীন এবং অপবিত্র আর তাকে বহু জন্মের ভেতর দিয়ে করুণ ও দুঃখজনকভাবে পথ হাতড়াতে হাতড়াতে মোক্ষলাভ করতে হবে- হিন্দু ধর্মের এই শিক্ষা থেকে ভিন্ন সুরে আল- কুরআন বলেছেঃ ‘আমি তো সৃষ্টি করেছি মানুষকে শ্রেষ্ঠতম আবয়বে- পবিত্র অবস্থায়- (যে পবিত্রতা কেবল পরবর্তী ভ্রান্ত আচরণের ফলেই নষ্ট হতে পারে) অতঃপর আমি তাকে পরিণত করি হীনতমে, কিন্তু তাদেরকে নয়, যারা বিশ্বাসী এবং সৎকর্মপরায়ন’।
তিন
আমদের সামনে রয়েছে হাইলের পাম-তরুর বাগিচা।
আমরা থামলাম একটি পুরোনো ধ্বংসপ্রাপ্ত ওয়াচ-টাওয়ারের পাশে, শহর প্রবেশে আমাদের প্রস্তুতি হিসাবে। কারণ, পুরানো আরবীয় প্রথা, যার সংগে হামেশাই সম্পর্ক থাকে ব্যক্তিগত সুরুচি ও সৌন্দর্যবোধের, তার দাবি এই যে, সফরকারী যখন কোন শহরে প্রবেশ করে তখন সে যেন তার সবচেয়ে ভাল পোশাক পরে, নগরে প্রবেশ করে সজীব এবং পরিচ্ছন্নভাবে যেন এইমাত্র সে তার উটের উপর চড়েছে। কাজেই আমরা আমাদের বাকি পানি খরচ করে ফেলি আমাদের হাত মুখ ধোয়ার জন্য, আমাদের অবহেলিত দাড়ি ছেঁটে নিই এবং আমাদের জীনের উপর চাপানো তলে টেনে বের করি আমাদের শুভ্রতম জামা-কৃর্তা। আমরা আমাদের ‘আবায়া’র উপর থেকে এবং জীনের উজ্জ্বল রংয়ের ঝুলন্ত টাসেল থেকে কয়েক হপ্তার জমে-ওঠা মরুবালি ঝেড়ে ফেলি বরুশ দিয়ে এবং আমাদের উটগুলিকে সাজাই তাদের উত্তম অলংকারে।
এবং এতক্ষণে আমরা তৈরি হয়েছি হাইল শহরে আমাদেরকে পেশ করবার জন্য। এই শহরটি প্রকৃতির দিক দিয়ে অনেক বেশি আরবীয়, যেমন ধরুন, বাগদাদ অথবা মদীনা থেকে। আরব-বহির্ভূত কোন দেশ বা জাতির কোন উপাদানই এ শহরে নেই, -সদ্য দোয়অনো এক গামলা দুধের মতোই এ শহরটি পবিত্র এবং নির্ভেজাল। বাজারে এখানে দেখা যায় না কোন বিদেশী পোশাক, দেখবেন কেবল ঢিলা আরবী ‘আবায়া’, ‘কুফিয়া’ এবং ‘ইগাল’। মধ্যপ্রাচ্যের আর যে- কোন রাস্তার চেয়েও এর রাস্তাগুলি অনেক বেশি পরিচ্ছন্ন- এমনকি, নযদের জন্য যে- কোন শহর থেকেও- যে নযদ তার অপ্রাচ্য পরিচ্ছন্নতার জন্য মশহুর (সম্ভবত কারণ এই যে, এ দেশের মানুষ চিরকালই ‘আযাদ’ রয়েছে বলে প্রাচ্যের যে-কোন স্থানের চাইতে ওরা অনেক বেশি আত্মমর্যাদাোধ বজায় রেখেছে। এখানকার ঘর বাড়িগুলি চাপ দিয়ে শক্ত- করা কাদা-মাটির ঢেলা, একটির উপর আরেকটি বিছিয়ে তৈরি করা; ঘরগুলি মেরামত করা হয়েছে সুন্দরভাবে.. ব্যতিক্রম কেবল বিধ্বস্ত নগরীর প্রাচীরগুলি যা এখনো সাক্ষ্য বহন করছে ইবনে সউদ এবং ইবনে রশিদের পরিবারের মধ্যকার বিগত যুদ্ধের এবং ১৯২১ সালে এবং স্বয়ং ইবনে সউদ কর্তক শহরটি বিজয়ের।
তাম্রকারদের হাতুড়িগুলি পিটিয়ে পিটিয়ে তৈরি করছে সকল রকমের পাত্র, মিস্ত্রিদের করাতগুলি চিৎকার করে দাঁত বসিয়ে দ্ছে কাঠের মধ্যে, মুচিরা তলী লাগাচ্ছে স্যান্ডেলের। ভীড় ঠেলে ঠেলে চলেছে উট, পিঠে লাকড়ির বোঝা এবং মাখন ভর্তি চামড়ার মশক নিয়ে বাকি সব উট, যাদের বেদুঈনেরা এনেছে বিক্রির জন্য, বাতাসকে ভারাক্রান্ত করে তুলেছে তাদের গর্জনে। আলহাসা থেকে আনীত উজ্জ্বল জীনের থলেসমূহ আঙুল দিয়ে টিপে টিপে পরীক্ষা করছে অভিজ্ঞ হস্ত। নিলামদারেরা বাজারের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত চলেছে চিৎকার করতে করতে, তাদের জিনিস বিক্রির ঘোষণা করে করে ঘুরে-ফিরে নির্দিষ্ট তারিখে। এ ধরনের নিলাম যে কোন আরব শহরের একটি চিরচারিত বৈশিষ্ট্য। এখানে ওখানে আপনি দেখতে পাবেন শিকারী বাজ পাখী ওদের কাঠের দাঁড়ের উপর নিচে লাফাচ্ছে ওদের পা বাঁধা পাতলা চামড়ার ফালি দিয়ে। ‘মৌ-রঙা’ ‘সালুকী’ হাইণ্ড কুকুর ওদের সুন্দর অংশ- প্রত্যংগগুলি আলস্য ভরে রোদে ছড়িয়ে দিয়ে পড়ে আছে। জীর্ণ ‘আবায়া’ গায়ে কৃশ বেদুঈনেরা, চমৎকার পোশাক পরা নওকরেরা এবং আমীরের দেহরক্ষীরা- প্রায় সকলেই দক্ষিণের প্রদেশগুলির লোক- মেলামেশা করছে বাগদাদ, বসরা এবং কুয়েতের সওদাগর আর হাইলের বাসিন্দাদের সাথে। এই সব স্থানীয় বাসিন্দা অর্থাৎ পুরুষেরা- কারণ মেয়েদের তো আপনি বেশি কিছু দেখতে পাবেন না ওদের কালো ‘আবায়া’ ছাড়া, যা ঢেকে রাখে ওদের পা থেকে মাথা পর্যন্ত- এরা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে খুবসুরৎ খান্দানগুলির অন্যতম একটি খান্দানের লোক। আরবজাতি চেহারা আর অংগভংগীর যা কিছু সৌন্দর্য- সুষমা আজ পর্যন্ত লাভ করেছে, মনে হয়, তার সবই মূর্ত হয়েছে এই শাম্মার কবিলার মধ্যে, যার সম্পর্ক প্রাক- ইসলামী যুগের কবি গেয়েছিলেনঃ উচ্চভূমিতে বাস করে ইস্পাতের মতো তেজী পুরুষেরা আর গর্বিত সাধ্বী রমনীরা।
আমরা যখন ‘আমীরে’র কিল্লা সম্মুখে পৌঁছুই, যেখানে আমরা পরবর্তী দু’দিন থাকবো বলে স্থির করি, আমরা দেখতে পেলাম, আমাদের মেহমানদারেরা কিল্লার দরোজার বাইরে খোলা জায়গায় দরবার বসিয়েছে। আমীর ইবনে মুসা’দ হচ্ছেন ইবনে সউদের খান্দানের জিলুভী শাখার লোক এবং বাদশাহর একজন শ্যালক। ইনি বাদশাহর শক্তিশালী গভর্নরদের অন্যতম। এঁকে বলা হয় ‘উত্তরের আমীর’ কারণ, ইনি কেবল জবল শাম্মার প্রদেশের উপর কর্তৃত্বই করেন না, সিরিয়া এবং ইরাকের সরহদ পর্যন্ত সমগ্র উত্তর নযদ, যে এলাকার আয়তন প্রায় ফ্রান্সের মতোই বিশাল, এই গোটা অঞ্চলটির উপরই তাঁর কর্তৃত্ব।
‘আমীর’ যিনি আমার পুরানো দোস্ত এবং স্তেপ অঞ্চল থেকে এসেছে এমন একজন বেদুঈন ‘শায়াখ’ বসে আছেন কিল্লার দেয়াল বরাবর তৈরি একটি দীর্ঘ সংকীর্ণ ইটের বেঞ্চির উপর। লম্বা এক সারিতে তাঁদের পায়েল কাছে বসে আছে ইবনে মুসা’দ- এর ‘রাজাজিল’- রাইফেল আর রূপার খাপে ঢাকা তলোয়ারে সজ্জিত অস্ত্রধারী, রক্ষীরা, যারা দিনের মধ্যে কখনো তাঁকে ছেড়ে যায় না, যতোতটা না তাঁর রক্ষার জন্য তার চেয়ে বেশি তাঁর মর্যাদার খাতিরে; ওদের পরে রয়েছে বাজ পাখী পোষণেওয়ারা, পাখীগুলিকে দস্তানাপরা মুষ্টির উপর বসিয়ে- রয়েছে নিম্নস্তরের ভৃত্যেরা, বেদুঈনেরা, একদল অনুচর, ছোটো এবং বড়ো আস্তাবলের সহিস পর্যন্ত- সকলেই এক অপরকে সমান মনে করছে মানুষ হিসাবে, তাদের পদের পার্থক্য সত্ত্বেও। এবং এদেশে, যেখানে আপনি কখনো কাউকে সম্বোধন করেন না ‘আমার প্রভু’ বলে সালাতে আল্লাহকে সম্বোধন করা ছাড়া, সেখানে এর অন্যথা কী করেই বা সম্ভবপর হতে পারে? ওঁদের দিকে মুখ করে একটি বৃহৎ অর্ধবৃত্তের আকারে বসেছে বেদুঈন এবং শহুরে লোকেরা, যারা নিজেদের নালিশ এবং ঝগড়া-ফাসাদের বিষয় পেশ করছে ‘আমীরে’র কাছে ফয়সালার জন্য।
আমরা আমাদের উটগুলিকে এই বৃত্তের বাইরে বসিয়ে দিই। যে দু’জন অনুচর আমাদের কিকে দৌড়ে এসেছে তাদের হেফাজতে উটগুলিতে রেখে দিয়ে আমরা আগিয়ে যাই ‘আমীরে’র দিকে। তিনি দাঁড়িয়ে যান এবং যাঁরা বসেছিলেন তাঁর পাশে বেঞ্চির উপর এবং সম্মুখে যমীনের উপর, তাঁরাও তাঁর সংগে দাঁড়িয়ে গেলেন। আমার দিকেই তাঁর হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেনঃ ‘আহলান ওয়া সাহলান’- ‘আসুন, বসুন, আল্লাহ আপনার হায়াত দারাজ করুন’।
আমি আমীরের নাকের ডগায় এবং কপালে চুমু খাই আর তিনি চুমু খান আমার উভয় গালে; তারপর আমাকে টেনে বসিয়ে দেন বেঞ্চিতে, তাঁর পাশে। জায়েদ তার নিজের স্থান করে নেয় ‘রাজাজিল’দের মধ্যে।
ইবনে মুসা’দ আমাকে তাঁর মেহমানদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। এঁদের কেউ কেউ আমার কাছে একেবারে নতুন, আবার কেউ কেউ কয়েক বছর ধরে পরিচিত। এঁদের মধ্যে রয়েছে গাদবান ইবনে রিমাল, সিজারা শাম্মারদের সর্বোচ্চ ‘শায়খ’। এই হাসিখুশি প্রবীণ যোদ্ধাকে সবসময় আমি চাচা বলে ডাকি। তাঁর এই প্রায়-সম্পূর্ণ জরাজীর্ণ চেহারা দেখে কেউ আন্দাজও করতে পারবে না, তিনি উত্তর অঞ্চলের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ সর্দার; তিনি তাঁর তরুণী ভার্যার গায়ে সোনা ও মণি-মুক্তার এতো অলংকার চাপিয়ে দিয়েছেন যে, সাধারণের বিশ্বাস, এই তরুণী যখন তাঁর ষোলোটি খুঁটির ওপর স্থাপিত বিশাল তাঁবু থেকে বের হতে ইচ্ছা করেন তখন তাঁকে তাঁর গায়ের ভার রাখতে হয় দু’টি ক্রীতদাসীর উপর।
তাঁর চোখ দু’টি ঝিলিক মারতে লাগলো যখন তিনি আমাকে আলিংগন করলেন এবং আমার কানে ফিস ফিস করে বললেনঃ
-‘এখনো নতুন বৌ পাওনি?’
আমি এর জ বাবে কেবল স্মিত হাসি এবং কাঁধ ঝাঁকুনি দিই।
আমীর ইবনে মুসা’দ নিশ্চয়ই এই রসিকতা শুনে ফেলেছেন, কারণ তিনি উচ্চেস্বরে হেসে বললেন,
-‘শ্রান্ত মুসাফিরের জন্য দরকার স্ত্রী নয়, কফি’। তারপর তিনি হাঁক দেন,
‘কাহওয়া’
-‘কাহওয়া’- পুনরাবৃত্তি করে আমীরের নিকটতম নওকরটি এবং সারির শেষপ্রান্তে যে নওকরটি রয়েছে সেই এই ধ্বনিটি মুখে নিয়ে বলে ‘কাহওয়া’। এভাবেই তা চলতে থাকে যতোক্ষণ না আনুষ্ঠানিক আদেশটি গিয়ে পৌছায় দুর্গদ্বারে এবং তা আবার প্রতিধ্বনিত হয় ভেতরে। মুহূর্তের মধ্যে একটি নওকর আবির্ভূত হয় বাঁ হাতে ঐতিহ্যময় পিতলের কফিপত্র এবং ডান হাতে ছোট ছোট কয়েকটি পেয়ালা নিয়ে, আর পহেলা সে কফি ঢালে ‘আমীরে’র জন্য, দ্বিতীয়বার ঢালে আামার জন্য আর তারপর, বাকি মেহমানদের কফি পরিবেশন করে ওদের মর্যাদানুসারে। একবার অথবা দু’বার ফের ভর্তি করা হচ্ছে পেয়ালা এবং কোন মেহমান ইংগিত করেন যে, তাঁর আর দরকার নেই, তখন পেয়ালাটি আবার পূর্ণ করা এবং পরিবেশন করা হয় পরবর্তী মেহমানকে।
বোঝা যাচ্ছে, ‘আমীর’ ইরাক সীমান্তে আমার সফরের ফল জানতে উৎসুক। কিন্তু পথে আমার কী কী ঘটেছে, কেবল এই সব ছোট-খাট প্রশ্নের মধ্যে ধরা পড়ছে তাঁর ঔৎসুক্য, পূর্ণতরো খোঁজ-খবর নেওয়ার কাজটি রেখে দিচ্ছেন সেই সময়ের জন্য যখন একলা হবো আমরা দু’জন। তারপর, আমাদের উপস্থিতিতে যে-বিচারের শুনানীতে ছেদ পড়েছিলো তিনি আবার শুরু করলেন সেই শুনানী।
প্রতীচ্যে এ ধরনের সাদামাটা জটিলতামুক্ত বিচারালয় অকল্পনিয়, অবশ্য শাসক ও বিচারক হিসাবে সকল সম্মানই ‘আমীরে’র প্রাপ্য। কিন্তু বেদুঈনেরা তাঁকে যে সম্মান দেখায় তাতে গোলামি মনোভাবের কোন চিহ্নই নেই। বাদী এবং বিবাদী প্রত্যেকেই, সে-যে মানুষ হিসাবে আযাদ, এই চৈতন্যে সগৌরবে অবস্থান করছে। তাদের অংগভংগীতে কোন দ্বিধা-জড়তা নেই, তাদের কণ্ঠ প্রায়ই সোচ্চার এবং দৃঢ়তাব্যঞ্জক, আর প্রত্যেকেই আমীরে’র নিকট এভাবেই কথা বলছে যেন সে কথা বলছে বড়ো ভাইয়ের সংগে- তাঁকে ডাকছে, বাদশাহর নিজের ক্ষেত্রেও প্রচলিক বেদুঈন রীতি মোতাবেক, তাঁর প্রথম নাম ধ’রে, তাঁর খেতাব ধরে নয়। উগ্রতার আভাস মাত্র নেই ইবনে মুসা’দের অভিজাত্যের মধ্যে। তাঁর খাটো কালো দাড়ি শোভিত সুন্দর মুখখানা, তাঁর মাঝারি আকারের কিছুটা গাট্টাগোট্টা শরীরে ব্যক্ত করছে সেই সহজাত আত্মসংযম এবং সহজ মর্যাদাবোধ, যা আরবদেশে প্রায়ই দোর্দণ্ড প্রতাপের পাশাপাশি বিদ্যমান। ইবনে মুসা’দ খুবই গম্ভীর এবং কথাবার্তায় অতি সংক্ষিপ্ত্ কৃতিত্বপূর্ণ বাক্যে তিনি সহজ মামলাগুলির ফয়সালা করে ফেলেন কালাবিলম্ব না করে এবং একটু জটিল মামলাগুলি, যার জন্য আইনশাস্ত্রে পাণ্ডিত্য প্রয়োজন, পাঠিয়ে দেন সে এলাকার ‘কাযী’র নিকট।
কোন বৃহৎ বেদুঈন অঞ্চলে সবোর্চ্চ ক্ষমতার অধিকারী হওয়া সহজ নয়। বেদুঈনের নালিশের উত্তেজনাপূর্ণ জটিলতার মধ্যে সঠিক ফয়সালাটি পেতে হলে প্রয়েঅজন হবে সমূহ বেদুঈন কবিলা, বিভিন্ন পরিবারের সম্পর্ক, প্রধান প্রধান ব্যক্তিগণ, গোত্রগুলির পশুচারণ ক্ষেত্র, অতীত ইতিহাস ও বর্তমান মানসিক মেজাজমর্জি সম্পর্কে নিবিড় জ্ঞানের। এক্ষেত্রে বুদ্ধির ক্ষুরধারের মতোই প্রয়োজন হৃদয়ের চাতুর্যের এবং ভূলের হাত থেকে বাঁচার জন্য উভয়কে অবশ্যই কাজ করতে হবে এক সংগে সূচাগ্র সূক্ষ্ম সঠিকতার সাথে। কারণ বেদুঈনেরা তাদের প্রতি কোন অনুগ্রহ করা হলে জীবেন কখনো যেমন ভূলে না, ঠিক তেমনি তারা, বিচারের যে রায়কে অন্যায় মনে করে তা’ও কখনো ভুলে না। অপরদিকে, ন্যায়সংগত রায়কে যাদের বিরুদ্দে দেওয়া হয়েছে সে রায়, তারাও প্রায় সবসময়ই হাসিমুখে গ্রহণ করে। সম্ভবত ইবনে সউদের আর ‘সকল আমীর’ থেকেই ইবনে মুসা’দ শ্রেষ্ঠতরো, এই সকল শর্ত পূরণের দিক দিয়ে। তিনি এতো আত্মসমাহিত, এতো চুপচাপ এবং অন্তর্দ্বন্দ্ব থেকে এতোটা মুক্ত যে, যখনি তাঁর বিচারবুদ্দি একেবারে শেষপ্রান্তে পৌঁছায়, ঠিক সেই মুহূর্তে তাঁর সহজাত অনুভূতি প্রায় সবসময়ই তাঁকে দেখায় সঠিক পথ। তিনি জীবন নদের সাঁতারু। তিনি নিজেকে ভাসিয়ে দেন স্রোতের টানে এবং স্রোতের সংগে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেন নিয়ন্ত্রণ করেন স্রোত।
এই মুহূর্তে দু’জন জীর্ণ পোশাক পরা বেদুঈন উত্তেজনাময় বাক্য আর অংগভংগীর সাথে তাদের ঝগড়ার বিষয় পেশ করছে। সাধারণত বেদুঈনদের বিষয়ে কিছু স্থির করা কঠিন কাজ; তাদের মধ্যে সব সময় এমন কিছু থাকে যার ব্যাপারে আগাম কিছু বলা যায় না- হঠাৎ স্বতঃস্ফূর্ত উত্তেজনার সম্ভাবনা, যা আপোস করতে জানে না- সবসময় জান্নাত আর জাহান্নাম যেন একে অপরের কাছাকাছি। কিন্তু আমি এখন দেখতে পাচ্ছি, কেমন করে ইবনে মুসা’দ ওদের জ্বলন্ত গোস্বার মধ্যে ওদেরকে আলাদা করে দিচ্ছেন এবং তাঁর নিরুত্তাপ কথার দ্বারা শান্ত করছেন ওদের। কেউ কেউ মনে করতে পারে, ওদের একজন যখন নিজের হক প্রতিষ্ঠার জন্য উকালতি করছে, তখন অন্যকে তিনি হুকুম করবেন খামোশ হতে; কিন্তু না, তিনি তা করলেন না। বরং তিনি তাদের উভয়কে একই সাথে বলতে, গলাবাজিতে একে অপরকে ছাড়িয়ে যেতে দিলেন এবং কেবল মাঝে মাঝে তিনি ওদের মাঝাখানে এসে দাঁড়াচ্ছেন, এখানে একটি শব্দ, ওখানে একটি প্রশ্ন নিয়ে, আর পরমুহূর্তেই তিনি তলিয়ে যাচ্ছেন ওদের উত্তপ্ত তর্ক-বিতর্কের মধ্যে; তিনি হার মানেন এবং মনে হয় যেন তিনি পিছু হটছেন, কেবল কিছুক্ষণ পরেই আর একটি উপযুক্ত মন্তব্য নিয়ে ওদের মধ্যে এসে দাঁড়ানোর জন্য। এভাবে বাস্তবের সংগে বিচারকের নিজের মনকে খাপ খাইয়ে নেয়া যে-বাস্তবের ব্যাখ্যা করে চলেছে সম্পূর্ণ বিপরীতভাবে দুই ক্রুদ্ধ মানুষ- এ দৃশ্য মনোমুগ্ধকরঃ এভাবে খাপ খাইয়ে নেবার প্রয়াস আইনের অর্থে সত্যানুসন্ধান যতোটুকু নয়, তার চেয়ে বেশি হচ্ছে ধীরে ধীরে একটি গোপন বস্তুগত সত্যের উন্মোচন। ‘আমীর’ এই লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হন থেমে থেমে এবং সত্যকে টেনে বের করেন, যেন একটি সূক্ষ্ম তারের সাহায্যে, আস্তে আস্তে পরম ধৈর্যের সংগে, বাদী-বিবাদী দুয়েরই প্রায় অলক্ষ্যে… যখন ওরা হঠাৎ থেকে যায়, একে অপরের দিকে তাকায় বিস্ময়-বিমূঢ় দৃষ্টিতে এবং বুঝতে পারেঃ রায় দেওয়অ হয়ে গেছে এবং এ রায় স্পষ্টত এমনি ন্যায়সংগত যে, এর আর কোন ব্যাখ্যাই দরকার করে না… এর ফলে ওদের দু’জনের একজন দাঁড়িয়ে পড়ে দ্বিধার সংগে, তার ‘আবায়া’ লম্বা হয়ে ঝুলে পড়ে এবং ওর কিছুক্ষণ আগেকার প্রতিদ্বন্দ্বীর হাত ধরে প্রায় বন্ধুসুলভ ভংগীতে সবলে আকর্ষণ করেঃ ‘চলো’ এবং দু’জনেই দরবার থেকে বের হয়ে পড়ে, এখনো কিছুটা হতবুদ্ধি এবং একই সংগে ভাবমুক্ত, ‘আমীরে’র প্রতি অনুচ্চ কণ্ঠে শান্তি কামনা করতে করতে।
দৃশ্যটি চমৎকার- একটি খাঁটি শিল্প যেনঃ মনে হয় এটি যেন একটি নমুনা, আইনশাস্ত্র ও ইনসাফের মধ্যে ফলপ্রসূ সেই সহযোগিতার, যা প্রতীচ্যের আদালত ও আইন সভাগুলিতে এখনো রয়েছে তার শৈশবে; কিন্তু এখানে, যা একজন আরব ‘আমীরে’র কিল্লঅর সম্মুখে ধূলাবালিপূর্ণ বাজারের চকে ফুটে উঠেছে তার সার্বিক পূর্ণতায়!
ইবনে মুসা’দ মাটি দেয়ালে আলস্যভরে হেলান দিয়ে পরবর্তী মামলাটি নেন শুনানীর জন্য। তাঁর লেখা-পড়া দৃঢ় মুখমণ্ডল আর তার মধ্যে গহীন দু’টি চোখ, যার চাহনি উদ্দীপনাময় এবং মর্মভেদী- তাঁর এ মুখ হচ্ছে মানুষের এক সত্যিকার নেতার মুখ, তার জাতির মহত্তম গুণের উৎকৃষ্টতম প্রতীক। এই মহত্তম গুণটি কী? হৃদয়েল সহজ জ্ঞান।
উপস্থিত লোকজনদের আরো কেউ কেউ এমনতরো সপ্রশংস বিস্ময় ব্যক্ত করে প্রকাশ্যে। হারব কবিলার এক বেদুঈন, যে নাকি ‘আমীরে’র দেহরক্ষী, বসেছিলো আমার সামনেই মাটির উপর; লোকটি আমার দিকে গলা বাড়িয়ে দিয়ে স্মিত হাসিতে মুখ উজ্জ্বল করে বলেঃ
‘ইনি কি সেই সুলতানের মতো নন যাঁর সম্বন্ধে মুতান্নবী বলেনঃ
“তাঁর সংগে আমার মোলাকাত হয়েছিলো যখন তাঁর (চোখ) ঝলসানো তরবারি ছিলো কোষবদ্ধ,
আমি তাঁকে দেখেছি সে তরবারি ছিল রক্তরঞ্জিত,
এবং সবসময় আমি তাঁকে পেয়েছি
মানব জাতির সর্বোত্তমরূপে,
কিন্তু তবু তার মধ্যেও সবচেয়ে উত্তম ছিলো তাঁর মহৎ হৃদয়…?”
একজন নিরক্ষর বেদুঈন, দশম শতকে বাস করতেন এমন একজন শ্রেষ্ঠ আরব কবির কবিতা উদ্ধৃত করছে শুনে আমার কাছে তাতো বেখাপ্পা নয়, যেমন ঠেকতো বেবেরিয়ার কোন চাষীকে গ্যেটের কবিতা আওড়াতে শুনলে, কিংবা কোন ইংরেজ খালাসীকে উইলিয়াম ব্ল্যাক বা শেলীর কবিতা আবৃত্তি করতে দেখলে। কারণ পাশ্চাত্য জনসাধারণের মধ্যে শিল্পের অধিকতরো বিস্তার সত্ত্বেও পশ্চিমা সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ সম্পদগুলিতে আসলে গড়পড়তা ইউরোপীয় বা আমেরিকানের কোন অংশ নেই- পক্ষান্তরে অশিক্ষিত, এমনকি কখনো নিরক্ষর মুসলমানদেরও একটি বিপুল অংশ প্রত্যহ তাদের অতীতের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে শরীক হয়ে থাকে সচেতনভাবে। ঠিক যেমন এই বেদুঈনটি তার নিজের দেখা একটি অবস্থাকে দৃষ্টান্ত দিয়ে বোঝানোর জন্য মুতান্নাবী থেকে একটি উপযুক্ত চরন মনে করতে সক্ষম হয়েছে, তেমনি বহু জীর্ণ পোশাক পরা ইরানী, যারা স্কুলে পড়াশুনা করেনি- হতে পারে সে একজন ভিস্তি, বাজারের কুলি অথবা সীমান্ত চৌকির একজন সেপাই- হাফিজ, জামী অথবা ফেরদৌসীর অসংখ্য কবিতা বহন করে তাদের স্মৃতিতে এবং তাদের দৈনন্দিন কথাবার্তার বুনোটের মধ্যে সেগুলিকে দেয় গেঁথে। যে সৃজনশীলতা ওদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে করেছিলো অতো মহান, যদিও ওরা সেই সৃজনশীলতাকে অনেকখানি হারিয়ে ফেলেছে, তবু এই মুসলিম জাতিগুলি আজো একটি প্রত্যক্ষ, জীবন্ত সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছৈ ঐ উত্তরাধিকারের শীর্ষ চূড়াগুলির সাথে, এর মহত্তম সম্পদগুলির সাথে।
……. ……… ………… …………
দামেশকের বাজারে যেদিন আমি এ আবিষ্কারটি করি তার কথা আজো আমার মনে পড়ে। আমার হাতে ছিলো একটি পাত্র, পোড়ামাটি দিয়ে তৈরি একটি বৃহৎ গামলা। এর আকৃতিটি ছিলো অদ্ভুত গাম্ভীর্যময়ঃ বড় এবং গোলাকৃতি, একদিকে চাপা একটি গোলকের মতো, যার অনুপাত প্রায় হুবহু সাংগীতিক অনুপাতের সাথে তুলনীয়; পাত্রটির গোল উপরিভাগ থেকে, যার পেলবতা রমণীর গালের মতোই কোমল, দুটি হাতল নিখুঁতভাবে বেঁকে ঝুঁকে পড়েছে বাইরের দিকে, যা গ্রীক ‘এমফোরার’ জন্য হতে পারতো গর্বের বস্তু। ওর এই হাতের আঙুলের ছাপ দেখতে পাচ্ছিলাম কাদার মধ্যে, পাত্রটির ভেতর দিকে ঘুরিয়ে দেয়া কাঁদি ঘিরে সে তার ছেনির দ্রুত সুনিশ্চিত আঁচড়ে এমন সূক্ষ্ম লতাপাতার একটি চিত্র ফুটিয়ে তুলেছে যেন প্রস্ফুটিত গোলাপ ফুলের এক বাগিচার ইংগিত বহন করছে ছবিটি। কুমারটি কাজ করছে দ্রুত, প্রায় ঔদাসিন্যেল সংগে যখন সে সৃষ্টি করে চলেছে এই আশ্চর্য সরলতা, যা ইউরোপের মিউজিয়ামগুলিতে এত প্রিয়-প্রশংসিত সেলজুক ও ইরানী মৃৎশিল্পের সমস্ত গৌরব জাগ্রত করে মনেঃ কোন শিল্প সৃষ্টির কোন মতলব এই কুমারটির ছিলো না। সে যা তৈরি করছিলো তা হচ্ছে একটি রান্নার হাঁড়ি, আর কিছু নয়, কেবল একটি রান্নার হাঁড়িই, যা কোন ‘ফেলাহ’ বা বেদুঈন কয়েকটি তামার পয়সার বিনিময়ে যে- কোন বাজারে যে কোনদিন কিনতে পারে।
আমি জানি ইউনানীরা অনুরূপ বা এর চেয়ে বেশি পূর্ণতা এনেছিলো, সম্ভবত রান্নার পাত্রেও; কারণ ওরাও- ভিস্তি এবং বাজারের কুলি, সেপাই এবং কুমার প্রত্যেকেই- এমন এক সংস্কৃতিতে সত্যিকার অংশীদার ছিলো যা কেবল গুটি কয়েক বাছা বাছা ব্যক্তির সৃজনধর্মী ব্যগ্রতার উপর, কেবল প্রতিভাবান ব্যক্তিরাই পৌঁছুতে পারে এমন গুটি কয়েক উত্তুংগ চূড়ার উপর স্থাপিত ছিলো না, যে-সংস্কৃতি ছিলো সকলের সাধারণ সম্পদ। সুন্দর বস্তু যে-সব বস্তু ছিলো সে সংস্কৃতির অংগ, সেগুলিকে তাদের গর্ববোধ ছিলো তাদের দৈনন্দিন কার্যকলাপের অংগঃ সকলের মিলিত জীবন্ত অধিকারে নিরবচ্ছিন্ন অংশ গ্রহণ।
সেই পাত্রটি আমার দু’হাতে ধরে রাখতে রাখতে আমি উপলব্ধি করি- ধন্য সে সব মানুষ, যারা তাদের রোজকার রাঁধে এ ধরনের পাত্রে, ধন্য সে-সব মানুষ একটি সংস্কৃতির উত্তরাধিকারের যাদের দাবি ফাঁকা অহংকার নয়- তার চাইতে অনেক বেশি কিছু।
চার
-‘মুহাম্মদ, তুমি কি এখন আমার সাথে খেতে বসে আমাকে সরফরায করবে?’ ইবনে মুসা’দের কণ্ঠস্বরে আমার কল্পনার সূত্র ছিঁড়ে যায়; আমি চোখ মেলে তাকাই এবং দামেশকে আবার হারিয়ে যায় অতীতে, যেখানে তার স্থান; আর আমি ফের নিজেকে আসীন দেখতে পাই বেঞ্চির উপরে; ‘উত্তর অঞ্চলের আমীরে’র পাশে। বিচারসভা তখনকার মতো শেষ হয়েছে। মামলাবাজেরা বিদায় নেয় একে একে। ইবনে মুসা’দ বেঞ্চি থেকে উঠে পড়েন এবং তাঁর সংগে দাঁড়িয়ে পড়ে তাঁর মেহমান ও সান্ত্রীরা।
দলটি দু’ভাগ হয়ে পথ করে দেয় আমাদের জন্য। আমরা দাখিল দরোজা অতিক্রম করার পর ওরা আবার জমা হয় এবং আমাদের পিছু পিছু আসে কিল্লা প্রাংগণে।
কিছুক্ষণ পর ‘আমীর’ গাদবান ইবনে রিমার এবং আমি একসাথে খেতেবসি মন্ত বড় একটি খাঞ্চায়। ভাতের উপর রয়েছে একটি আস্ত ভেড়ার কাবাব। আমরা ছাড়া কামরার মধ্যে রয়েছে ‘আমীরে’র দু’জন পার্শ্বচর আর এক জোড়া সোনালী রঙের ‘সালুকী’ হাউণ্ড।
প্রবীণ গাদবান আমার কাঁধের উপর হাত রেখে বলেন, ‘তুমি এখনো আমার প্রশ্নের জবাব দাওনি- এখনো নতুন বিবি জুটলো না?’
আমি তাঁর এই জিদে হাসি, ‘আপনি জানেন, মদীনায় আমার এক বিবি রয়েছে- আমি আরেকজন বিবি যোগাড় করতে যাবো কেন?’
-‘কেন?- আল্লাহ আমাকে রক্ষা করুন, ‘এক’ বিবি, আর তুমি এখনো এক নওজোয়ান! কেন, আমি যখন তোমার বয়সের ছিলাম…’।
-‘আমি শুনেছি, শায়খ গাদবান,’ মাঝখানে বাধা দেন আমীর ইবনে মুসা’দ, ‘এখনো আপনি আগের চেয়ে কম যান না’!
-‘হে আমীর, আমি তো এখন জীর্ণ ধ্বংসাবশেষ। আল্লাহ আপনার হায়াত দারাজ করুন, কিন্তু কখনো কখনো আমার জীর্ণ হাড়গুলিকে তাতিয়ে নেওয়ার জন্য আমি চাই উষ্ণ নারী দেহের সান্নিধ্য।… কিন্তু তুমি বলো,’ আমার দিকে ফেরেন গাদবান,’ সেই যে দু’বছর আগে মুতায়েরী মেয়টিকে শাদি করেছিলে, তার খবর কী? ওকে নিয়ে তুমি কী করেছো?’
-‘কেন- কিছুই না; আর এই হচ্ছে আমার জবাব,’ আমি বলি।
-‘কিচ্ছুই না…?’ বৃদ্ধ তাঁর চোখ দু’টি বিস্ফরিত করে পুনরাবৃত্তি করেন, ‘সে কি এতোই বদসুরৎ ছিলো?’
-‘না, বরঞ্চ সে ছিলো ভারি খুবসুরৎ’।
-‘ব্যাপার কি?’ জিজ্ঞাস করেন ইবনে মুসা’দ, ‘কোন মুতায়েরী নবীনা সম্পর্ক তোমরা কথা বলছো? একটু আলোকপাত করো মুহাম্মদ’।
আমি সেই ব্যর্থ বিয়ে সম্পর্কে আমীরকে অবহিত করার চেষ্টা করি।
আমি তখন বাস করছি মদীনায়, স্ত্রী-হীন, একাকী। মুতায়ের কবিলার এক বেদুঈন, নাম ছিলো যার ফাহাদ, রোজ ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাতো আমার ‘কাহওয়ার মজলিসে’, আর আমাকে বলতো দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আমলে লরেন্সের নেতৃত্বে তার যতো রকমের অবিশ্ব্যাস্য অভিযানের কথা। একদিন সে আমাকে বলল, ‘কোন মরদেরই উচিত নয় একা জিন্দেগী গুজরান করা; কারণ, তাতে লোহু জমে দানা বাঁধবে তোমার শিরা-উপশিরায়ঃ তোমার উচিত শাদি করা’। এবং যখন আমি তাকে রসিকতা করে বললাম, ভাবী একটা কনেকে এনে হাজির করতে সে জবাব দিলো, ‘তা তো খুবই সহজ। আমার বোনাই মুতারিকের কন্যা এখন শাদির লায়েক হয়েছে এবং তার মায়ের ভাই হিসাবে আমি তোমাকে বলতে পারি, সে অতিমাত্রায় খুবসুরৎ’।
ফের রসিকতার ভংগীতে আমি তাকে বললাম ওর পিতা রাজী হবে কি না খোঁজ করে দেখতে। কী আশ্চর্য! পরদিন মুতরিক নিজেই আমার নিকটে এসে হাজির! স্পষ্টতই বিব্রতভাবে কয়েক পেয়ালা কফি শেষ করে, কিছু কেশে, কিছু ইতস্তত করে শেষতক তিনি আমাকে বললেন, ফাহাদ তাকে বলেছে যে, আমি নাকি তার মেয়েকে শাদি করতে চাই। ‘তোমাকে দামাদরূপে পেলে আমি ধন্য হবোঃ কিন্তু রোকেয়া যে এখনো শিশু, তার বয়স মাত্র এগারো’।
মুতরিক এখানে এসেছেন এ খবর পেয়ে ফাহাদ গোস্বায় একেবারে আগুন হয়ে উঠলো, ‘বদমাশ! মিথ্যুক বদমাশ, মেয়ের বয়স এখন পনেরো! আসলে সে গাঁয়ের আরব কারো কাছে মেয়ে শাদি দিতে চায় না। অন্যদিকে সে জানে ইবনে সউদের সাথে তোমার সম্বন্ধ কতো ঘনিষ্ঠ। তাই সরাসরি প্রস্তাব না- মঞ্জুর করেও তোমাকে আঘাত দিতে চায় না। তাই সে ভান করছে যে, তার মেয়ে এখনো শিশু। কিন্তু আমি তোমাকে বলছি, তার বুক দু’টি এই রকম’- এবং সে তার হাত দিয়ে বর্ণনা করে, আকারে ও অনুপাতে প্রলোভন জাগায়, এমন এক বক্ষদেশের- ‘ঠিক যেন ছিঁড়ে খাওয়া যায় এমন পাকা ডালিক’।
এই বর্ণনায় বৃদ্ধ গাদবানের চোখ দু’টি ঝিলিক দিয়ে ওঠেঃ ‘পঞ্চাদশী, হাসিন এবং কুমারী’… তারপরও সে বলে, ‘কিছুই না! এর চেয়ে বেশি আর কি চাইতে পারতে তুমি?’
-‘বেশ, সবুর করো, যতক্ষণ না কাহিনীর বাকি অংশটি শেষ করছি…. আমাকে অবশ্যি স্বীকার করতে হবে যে, আমার আগ্রহ ক্রমেই বেড়ে চলেছিলো, হয়তো বা মুতরিকের আপত্তির জন্যই তা আরো উদ্দীপিত হয়েছিলো খানিকটা। আমি ফাহাদকে দশটি সোনার মহর দিই। ফাহাদ আমার কাছে বিয়ে দেবার জন্য ক’নের মা-বাপকে বোঝাতে তার সাধ্যমতো চেষ্টা করে। অনুরূপ একটা উপহার পাঠানো হলো ক’নের মা, ফাহাদের বোনের নিকট। ওদের বাড়িতে সত্যি সত্যি কী ঘটেছিলো তা আমি জানি না। আমি শুধু এটুকু জানি যে, শেষতক ওরা দু’জনই এ বিয়েতে মুতরিককে রাজী করাতে সফল হয়।
-‘মনে হয় এই ফাহাদ’, ইবনে মুসা’দ বললেন, ‘খুবই ধূর্ত লোক। বোঝাই যাচ্ছে, সে এবং তার বোন আরো বড়ো বখশিস আশা করেছিলো তোমার কাছ থেকে! কিন্তু এরপর কি হলো?’
আমি তাদেরকে বলে চলি, কী করে কয়েকদিন পরে যথারীতি শাদি সম্পন্ন হয়েছিলো কনের গর-হাযিরিতে। রসুম মুতাবিক কনের প্রতিনিধিত্ব করেন তার পিতা, কনের ওলী এবং উকিল হিসাবেঃ কনের উকিল নিয়ে, দু’জন সাক্ষী সাক্ষ্য দেয় এজিনের সত্যতা সম্বন্ধে। এরপর শাদি উপলক্ষে এক ব্যয়বহুল সুস্বাদু খানা পরিবেশন করা হয়, তার সাথে এলো চিরাচরিত উপহার কনের জন্য (যাকে আমি এখন পর্যন্ত একবারো দেখিনি), তার আব্বা-আম্মার জন্য এবং আরো কয়েকজন নিকট আত্মীয়ের জন্য, যাদের মধ্যে, স্বাভাবিকভাবেই ফাহাদের স্থান ছিলো সর্বোচ্চ। সেই সন্ধ্যায়ই আমার জেনানকে আমার বাড়িতে নিয়ে আসেন কনের মা এবং কয়েকটি বোরখা-পরা মেয়ে, যখন পাশের বাড়িগুলির ছাদের উপর থেকে দফ বাজাতে বাজাতে বিয়ের গান গাইছিলো রমণীরা।
নির্ধারিত সময়ে আমি ঢুকি সেই ঘরে যেখানে আমার বউ এবং তার আম্মা ইন্তেজারি করছিলেন আমার জন্য। দু’য়ের মধ্যে আমি কোন ফারাক করতে পারছিলাম না। কারণ দু’য়ের মধ্যে আমি কোন ফারাক করতে পারছিলাম না। কারণ দু’জনেরই পা থেকে মাথা পর্যন্ত বোরখাতে ঢাকা। কিন্তু আমি যখন রসুম মতো ‘আপনি এখন যেতে পারেন,’ এই শব্দগুলি উচ্চারণ করলাম তখন বোরখাপরা মহিলাদের একজন উঠে পড়েন এবং আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে যান; এভাবেই আমি জানতে পারি, যে নারী রয়ে গেলো সে-ই আমার স্ত্রী’।
-‘এবং তারপর বাবা… তারপর কী ঘটলো?’ – ইবনে রিমাল প্রশ্ন করেন, যখন আামর বর্ণনায় এই পর্যায়ে আমি একটু থামি। ‘আমীর’ আমার দিকে তাকালেন কৌতুক মেশানো-দৃষ্টিতে।
-‘তারপর… বেচারী মেয়েটি বসে আছে; সাফ বুঝতে পারছি সে ভীষণ ঘাবড়ে গেছে- এভাবে একটা বিলকুল অপরিচিত মরদের নিকট ওকে সঁপে দেয়ায়। এবং যখন আমি ওকে আমার জানা পরম বিনয় ও নম্রতার সাথে বললাম, ওর মুখের নেকাব তুলতে, ও তার ‘আবায়া’ আরো মজবুত করে জড়ালো তার গায়’।
-‘ওরা সবসময় এরূপই করে’। উচ্চকিত কণ্ঠে বলেন ইবনে রিমাল, ‘বাসর রাতের শুরুতে সবসময়ই ওরা এ রকম আতংকিত থাকে। আর তাছাড়া, তরুণী বালিকার জন্য শরমিন্দা হওয়া শোভনীয়ও বটে। কিন্তু পরে ওরা সাধারণত খুশিই হয়ে থাকে…. তোমার উনি খুশি হননি?’
-‘না, তেমনি খুশি হয়নি। ওর মুখের নেকাব সরাতে হলো আমাকেই এবং তা সরানোর পর আমি দেখতে পেলাম অতি খুবসুরৎ এক লাড়কিকে, যার মুখের রঙ পাকা গমের, আকৃতি আণ্ডার মতো,
চোখ দু’টি বিশাল, আর ওর সুদীর্ঘ খেশদাম ও যে কুশনের উপর বসেছিলো তারই উপর ঝুলে পড়েছে। কিন্তু আসলেই এ ছিলো একটি শিশুর মুখ- যার বয়স কিছুতেই এগারোর বেশি হতে পারে না- ঠিক যেমনটি বলেছিলেন ওর বাপ, ফাহাদ এবং তার বোনের লোভই ওকে বয়সের বিচারে শাদির লায়েক বলে আমার কাছে তুলে ধরেছিলো। বেচারা মুতরিক মিথ্যা বলেননি একটুও”।
-‘কিন্তু তাতে কি হলো?’ জিজ্ঞাসা করেন ইবনে রিমাল। যেন আমি কি বলতে চাইছি তা তিনি বুঝতে পারেননি, ‘এগারো বছর কী অপরাধ করেছে? বালিকা তো বাড়ে- কেমন, বাড়ে না কি? আর সে আরো তাড়াতাড়ি বাড়ে খসমের বিছানায়…’।
কিন্তু আমীর ইবনে মুসা’দ বলেন, ‘না, শায়খ গাদবান তা নয়; ও তোমার মতন একজন নযদী নয়। ওর মাথায় মগজের পরিমাণ বেশি!’ এবং আামর দিকে ফিরে ইচ্ছাকৃত হাসি হেসে বলেন, “মুহাম্মদ, তুমি গাদবানের কথা শোন না। ও হচ্ছে একজন নযদী এবং আমরা প্রায় সকল নযদীরই মগজ (হাতে মাথার দিকে ইশারা ক’রে) ওখানে নয়- কিন্তু এখানে”- বলে তিনি অঙ্গুলি নির্দেশ করেন তার শরীরের সস্পূর্ণ এক ভিন্ন অংগের দিকে!
আমরা সকলেই হেসে উঠি এবং গাদবান তাঁর দাঁড়ির মধ্যে বিড়বিড় করে বলেন ‘তাহলে হে আমীর, আপনার চাইতে নিশ্চয়ই আমার মগজ বেশি!’
ওঁদের চাপে আমি ফের সেই কাহিনী বলে চলি; এবং ওঁদেরকে জানাই, এ বিষয়ে বৃদ্ধ গাদবানের যা-ই হোক, আামার বাল-বধূর এক্কেবারে কাঁচা বয়স আমার কাছে বাড়তি কিছু পওনা মনে হয়নি। ওর মামার একটা ন্যাক্কারজনক কৌশলের শিকার হয়েছিলো মেয়েটি। ওর প্রতি করুণা ছাড়া আর কিছুই অনুভব করিনি। মানুষ একটা শিশুর সাথে যেমন ব্যবহার করে আমিও ওর প্রতি তা-ই করি। ওকে আমি আশ্বাস দিই যে, আমার থেকে ওর ডর-ভয়ের কিছু নেই। কিন্তু ও একটা কথাও বললো না; বরঞ্চ ও যেভাবে কাঁপছিলো তাতে ওর আতংকই প্রকাশ পেলো। একটা তাকের উপর আঁতি-পাঁতি খুঁজে আমি পেলাম একখণ্ড চকোলেট; সেই চকোলেটটি আমি ‘ওফার’ করি ওকে। কিন্তু জীবনে কখনো ও চকলেট দেখেনি বলে প্রচণ্ডভাবে মাথা নেড়ে তা প্রত্যাখ্যান করে। আমি তখন ‘আলেফ-লায়লা’ থেকে মজাদার কাহিনী বলে ওকে সহজ করে তোলার কুশিশ করি। কিন্তু ও তা বুঝলো বলে মনে হলো না। কাহিনীকে ওর মজাদার মনে করার তো কথাই ওঠে না; শেষতম ওর এই পয়লা ক’টি কথা ও উচ্চারণ করে- ‘আমার মাথা ধরেছে’…. আমি কটি এসপিরিন ট্যাবলেট ওর হাতে গুঁজে দেই এক গেলাস পানিসহ; কিন্তু এতে ওর ভয়ের আকস্মিক অভিব্যক্তি ঘটলো আরো প্রচণ্ডভাবে (পরে আমি জানতে পেরেছিলাম, ওর কোন এক বান্ধবী ওকে বলেছে, বিদেশের এ সব অপরিচিত লোকেরা কখনো কখনো বাসর রাতে ওদের স্ত্রীদেরকে এ জাতীয় ওষুধ খাওয়ায় খুব সহজে ওদের উপর বলাৎকার করার জন্য!) পুরা দু’ঘন্টা বা তার কাছাকাছি সময়ে আমি ওকে বোঝাতে সক্ষম হই যে, সেরূপ কোন জবরদস্তির মতলব আমার নেই। শেষতক ওর বয়েসী শিশুদের মতোই ও ঘুমিয়ে পড়ে, যখন আমি ঘরের এক কোণে গালিচার উপর বিছানা বিছাই নিজের জন্য।
পরদিন সকালে আমি ওর মায়ের জন্য লোক পাঠাই এবং দাবি করি যে, তিনি যেন তাঁর মেয়েকে নিজ বাড়িতে নিয়ে যান। মহিলাটি তো বিস্ময়ে একেবারে হতবাক! অমন একটি সুস্বাদু লোকমা, এগারো বছরের কুমারীকে, কোন মরদ প্রত্যাখ্যান করতে পারে, অমন কশা জীবনে কখনো যেনো শোনেননি আমার শাশুড়ী। নিশ্চয়ই মনে করে থাকবেন, আমার মৌলিক ক্রটি রয়েছে!
-‘এবং তারপর,’ গাদবান জিজ্ঞাস করেন।
-‘কিছুই না- আমি মেয়েটিকে তালাক দিলাম, যে-হালে সে আামার কাছে এসেছিলো ঠিক সেই হালেই। ওর পরিবারের জন্য তেজারতিটি মন্দ হয়নি, কারণ ওরা মেয়েটিকে ফিরে পেলো এবং আমি যে দেনমোহর দিয়েছিলাম তা-ও, সাদির সব উপহারসহ। আর আমার ব্যাপারে চারদিকে এই গুজব ছড়িয়ে পড়লো যে,আমি না-মরদ, পুরুষত্বহীন এবং আমার কয়েকজন শুভানুধ্যায়ী বোঝাবার চেষ্টা করলো- সম্ভবত কেউ কিংবা আমার আগের কোন স্ত্রী যাদুটোনা করে থাকবে আমার উপর, যে যাদু থেকে আমি নিজেকে কেবল আরেকটি পাল্টা যাদুর সাহায্যেই আযাদ করতে পারি…’।
-‘মুহাম্মদ, আমি যখন মদীনায় তোমার পরের শাদির কথা আর তোমার ছেলের কথা ভাবি’, আমীর হাসতে হাসতে বললেন, ‘কোন সন্দেহ নেই যে, তুমি সত্যি একটা বড় রকমের যাদু করেছিলে…’।
পাঁচ
পরের রাতে আমি যখন আমার জন্য ছেড়ে দেয়া কামরায় ঘুমাতে যাচ্ছি, আমি দেখতে পেলাম জায়েদ, স্বভাবতই যেমন চুপচাপ তার চাইতে আজ সে অনেক বেশি নীরব। সে দরোজার কাছে এসে দাঁড়ায়, স্পষ্টই কোন সূদূর চিন্তায় যেন ও হারিয়ে গেছে। ওর থুঁতনি ওর বুকের উপর স্থাপিত আর চোখ দু’টির নজর মেঝেতে বিছানো খোরাসানী গালিচার নীল এবং শ্যাওলা- সবুজ গোল গোল নকশার উপর।
-‘এতোকাল পর, তোমার জোওয়ানী কালের শহরটাতে ফিরে এসে কেমন লাগছে জায়েদ?’- আমি ওকে প্রশ্ন করি, কারণ অতীতে আমি যখনই হাইলে এসেছি প্রত্যেক বারই জায়েদ এই শহরে ঢুকতে অমত করেছে।
-‘আমি ঠিক বলতে পারবো না চাচা’- ধীরে ধীরে ও জবাব দেয়…’ এগারো বছর- এগারো বছর চলে গেছে, আমি যখন শেষবার এখানে আসি। আপনি জানেন, আমি এখানে আসি, আমার অন্তর কিছুতেই রাজী হতে পারতো না এর আগে। কারণ, এলেই আমি দেখতে পেতাম দক্ষিণের লোকেরা বাদশাহী করছে ইবনে রাশিদের প্রাসাদে; এ আমার পক্ষে বরদাশত করা সম্ভব হতো না। কিন্তু যিলহাল আমি কিতাবের ভাষায় নিজেই বলছি-‘ হে আল্লাহ, সার্বভৌমত্বের অধিকারী, তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা দাও এবং যার নিকট থেকে ইচ্ছা, ক্ষমতা কেড়ে নাও। তুমি যাকে ইচ্ছা সম্মানিত করো এবং যাকে ইচ্ছা অধঃপতিত করো- তোমার হাতেই সমস্ত কল্যাণ এবং তোমার ক্ষমতা সমস্ত কিছুর উপরে’। বে-শক আল্লাহ ইবনে রশিদের খান্দানকে সুলতানাত দিয়েচিলেন, কিন্তু ওরা জানতো না, সেই ক্ষমতার সঠিক প্রয়োগ কী করে করতে হয়। ওরা ওদের কওমের প্রতি ছিলো দরাজ-দীল, কিন্তু স্বজনদের প্রতি কঠোর নির্দয় আর দেমাগে লাগাম ছাড়া, ওরা খুনাখুনি করেছে, ভাই ভাইকে কতল করেছে, আর এ জন্যেই আল্লাহ ওদের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছেন এবং তা ফিরিয়ে দিয়েছেন ইবনে সউদের কাছে। আমার মনে হয়, এ নিয়ে আমার আর দুঃখ করা উচিত নয়; কারণ কিতাবে কি লেখা নেই, ‘কখনো কখনো তোমরা কোন জিনিস ভালোবাসো এবং হতে পারে তা তোমাদের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর এবং কখনো কখনো তোমরা কোন কিছুকে ঘৃণা করে থাকো- যদিও তা তোমাদের জন্য হতে পারে উত্তম?’
জায়েদের কণ্ঠস্বরে একটা মিষ্টি স্নিগ্ধ আত্মসমর্পণের ভাব- এই আত্মসমর্পণের অর্থ যা ইতিমধ্যে ঘটে গেছে এবং এ কারণে, যাকে আর পাল্টানো সম্ভব নয় তারই স্বীকৃতি ছাড়া আর কিছু নয়। অতীত অপরিবর্তনীয় এই বাস্তব সত্যের প্রতি মুসলিম হৃদয়ের এই নীরব সম্মতি, যার অর্থ এই স্বীকৃতি যে, যা কিছু ঘটেছে তা যেভাবে ঘটেছে ঠিক সেভাবেই ঘটবার ছিলো এবং আর অন্য কোনভাবেই তার ঘটতে পারতো না- মুসলিম- হৃদয়ের এই রেজামন্দিকে অহরহ পাশ্চাত্যবাসীরা ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিতে অন্তর্নিহিত এক প্রকার ‘অদৃষ্টবাদ’ বলে ভূল ক’রে থাকে। কিন্তু ভাগ্যের প্রতি মুসলিমদের এই রেজামন্দির সম্পর্ক হচ্ছে অতীতের সাথে, ভবিষ্যতের সাথে নয়; এই স্বীকৃতির অর্থ কর্মের প্রত্যাখ্যঅন নয়, আশা ছেড়ে দেওয়া নয়, নিজেকে উন্নত করার উদ্যম পরিত্যগ করা নয়; বরং বাস্তব অতীতকে আল্লাহর কাজ ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে অস্বীকার করা।
-‘এবং তা ছাড়া’, জায়েদ তার কথার জের টেনে চলে- ‘শাম্মারদের প্রতি ইবনে সউদ মন্দ কছিু করেননি। ওরাও তা জানে, কারণ বছর তিনেক আগে কুত্তা আদ-দাবিশ যখন তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলো, তখন কি তারা তলোয়ার নিয়ে তাঁকে সমর্থন করেনি?’
সত্যই ওরা তা করেছিলো, আর খাঁটি আরবেরা ওদের জীবনের মহত্তম মুহূর্তগুলিতে যে বৈশিষ্ট্যরে পরিচয় দিয়ে থাকে বিজিতের সেই পৌরুষের সাথে। তা ওরা করেছিলো সেই সাংঘাতিক বছরটিতে, ১৯২৯ সালে, যখন ফয়সাল আদ-দাবিশের নেতৃত্বে পরিচালিত ভয়ংকর বেদুঈন বিদ্রোহ ইবেন সউদের রাজত্বের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলো, তখন নযদের বাসিন্দা সবকটি শাম্মার কবিলাই, বাদশাহর প্রতি তাদের এককালের দুশমনি ভুলে গিয়ে তাঁর পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিলো। পরে বিদ্রোহীদের উপর বাদশাহ যে-বিজয় লাভ করেন তাতে ওদের অবদান রয়েছে প্রচুর। এই আপোস-মীমাংসা সত্যই এক উল্লেখযোগ্য ব্যাপার, কারণ মাত্র ক’ বছর আগে ইবনে সউদ হাইল জয় করেছিলেন অস্ত্র বলে, এবং এভাবে উত্তর অঞ্চলের উপর ফের কায়েম করেছিলেন দক্ষিণের হুকুমত; এবং আরো উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে, শাম্মার খান্দান ও দক্ষিণ নযদের লোকদের মধ্যে যুদ যুদ স্থায়ী এই পারস্পরিক ঘৃণা-বিদ্বেষ যে নযদীদেরই একজন হচ্ছেন ইবনে সউদ নিজে। এই ঘৃণা কোন রাজবংশের ক্ষমতার দ্বন্দের চাইতেও অনেক বেশি গভীর। বহুলাংশে এ ঘৃণা (যা সাম্প্রতিক আপোস-রফাও পুরাপুরি মুছে দিতে পারেনি) হচ্ছে দক্ষিণ আর উত্তরের মধ্যে চিরাচরিত মুকাবিলারই প্রকাশ, যা আারবদের গোটা ইতিহাসের ধারা বেয়ে চলে এসছে- যার নমুনা পাওয়া যাবে আরো অনেক জাতির ইতিহাসে। কারণ, বিলকুল স্বতন্ত্র পড়শী জাতিগুলির মধ্যে জাতিগত অপরিচয় যে দুশমনি সৃষ্টি করতে পারে, প্রায়ই দেখা যায়, নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত গোত্রগুলির মধ্যেও জীবনের আভ্যন্তরীণ ছন্দে- তালে সামান্য একটু পার্থক তার চেয়ে বেশি দুশমনি পয়দা করতে পারে।
রাজনৈতিক প্রতিদ্বিন্দ্বিতা ছাড়াও আরো একটি ব্যাপারের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে আরবের উত্তর এবং দক্ষিণ অঞ্চলের মধ্যকার আবেগাত্মক বৈপরীত্বের ক্ষেত্রে। নযদের দক্ষিণেই, রিয়াদের নযদিকে প্রায় দু’শো বছর আগে আবির্ভূত হয়েছিলেন পিউরিটান সংস্করক মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাব; এবং বিভিন্ন গোত্রকে- যারা নামে মাত্র মুসলমান ছিলো সে সময়ে- উদ্দীপিত করেছিলেন ধর্মীয় এক নতুন আবেগে। তখনকার দিনের অখ্যাত ইবনে সাউদের খান্দানে- যার ছিলো ছোট্ট শহর দাবিয়া’র সরদার- এই সংস্কার পেয়েছিলেন সেই লৌহ বাহু, যার তাঁর প্রেরণাগর্ভ বাণীকে দেয় কর্মে শক্তি এবং কয়েক যুগের মধ্যেই আরব উপদ্বীপের এক বিশাল অংশকে সেই জ্বলন্ত আপোসহীন বিশ্বাসের আন্দোলনৈর আওতায় করে ঐক্যবদ্ধ- বিশ্বে যা পরিচিত ‘ওয়াহাবী মতবাদ’ নামে। গত দেড়শো বছরের সবকটি ওয়াহাবী যুদ্দ এবং বিজয়ের ক্ষেত্রেই দক্ষিণের এই লোকেরা হামেশা উচ্চে তুলে ধরেছে পিউরিটানিজমের ঝাণ্ডা, আর উত্তরের লোকেরা কেবল আধমনাভাবে থেকেছে ওদের সাথে, কারণ তন্ত্রের দিক দিয়ে শাম্মার কবিলা ওয়াহাবী মযহাবের সাথে একমত হলেও দক্ষিণের জ্বলন্ত অনমনীয় ধর্মীয় প্রর্বনা থেকে ওদের হৃদয় সবসময়ই অবস্থান করেছে বহুদূরে। সীমান্ত দেশ সিরিয়া এবং ইরোকের কাছাকাছি বাস করায় এবং সবসময়ই ওদের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্পর্ক থাকায় শাম্মার কবিলা বহু যুগের ধারায় তাদের দৃষ্টিভংগিতে লাভ করেছে একটি কোমল উদাসীনতা আর আপোসের জন্য মানসিক প্রস্তুতি, যা অনেক বেশি বিচ্ছিন্ন দক্ষিণের মানুষদের কাছে অজ্ঞাত। দক্ষিণের লোকেরা কেবল চরমের সাথেই পারিচিত, এবং গত দেড়শো বছরে ওরা জিহাদের খোয়াব দেখা ছাড়া আর কিচুই ভাবেনি। গর্বিত উদ্ধত এসব লোকেরা মনে করে, কেবল ওরা নিজেরাই হচ্ছে ইসলামের খাঁটি প্রতিনিধি এবং আর সকল মুসলিম জাতিই হচ্ছে খারেজী।
এসব সত্ত্বেও ওয়াহাবীরা কোন আলাদা ফেরকা মোটেই নয়। ‘ফেরকা’র কথা উঠলেই বুঝতে হবে কতকগুলি আলাদা আলাদা মতের অস্তিত্ব রয়েছে- যা একটি ফেরকার অনুসারীদেরকে একই ধর্মের আর সকল অনুসারী থেকে আলাদা করে দিয়েছে। অবশ্য, ওয়াহাবী মতবাদে কোন পৃথক বিশ্বাস নেই; পক্ষান্তরে এ আন্দোলন, ইসলামের মৌলিক শিক্ষার চারপাশে বহু শতাব্দীর পরিক্রমায় যেসব আস্তর পড়েছে এবং যেসব নীতি ও বিশ্বাস ইসলামের উপর আরোপিত হয়েছে সেগুলি দূর করে রাসূলুল্লাহর মৌলিক শিক্ষায় ফিরে যেতে চেয়েছে। আপোসহীন স্পষ্টতার দিক দিয়ে এ আন্দোলনে নিশ্চয়ই এমন একটা উদ্যোগ ছিলো, যা ইসঅমের শিক্ষাকে যেসব কুসংস্কার আচ্ছান্ন করে রেখেছে সেগুলি থেকে ইসলামকে মুক্ত করতে পারতো কালক্রমে। বলাবাহুল্য, আধুনিককালের ইসলামের সবকটি রেনেসাঁ আন্দোলনেরই- ভারতের ‘আহলে হাদীস’ আন্দোলন, উত্তর আফ্রিকার সেনুসী আন্দোলন, জামালউদ্দীন আফগানী এবং মিসরের মুহাম্মদ আবদুহুর প্রচেষ্টা সব কিছুরই- উৎস সোজা খুঁজে পাওয়া যাবে আঠারো শতকে মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাব যে আধ্যাত্মিক গতিবেগের সূচনা করেছিলেন তারই মধ্যে। কিন্তু নযদে তাঁর শিক্ষার যে পরিণতি ঘটেছে তার দু’টি ক্রটি রয়েছে, যে কারণেও এ আন্দোলন আত্মিক বিকাশের একটি শক্তি হয়ে উঠতে পারেনি। এর একটি ক্রটি হচ্ছে সেই সংকীর্ণতা যার দ্বারা এ আন্দোলন প্রায় সকল ধর্মীয় প্রচেষ্টাকেই আক্ষরিক অর্থে ধর্মীয় আদেশ- নিষেধ পালনৈর মধ্যে সীমিত করার চেষ্টা করে, বাইরের আবরণ ভেদ করে তার আধ্যাত্মিক মর্মকেন্দ্র প্রবেশের প্রায়োজনকে অবহেলা করে। অপর ক্রটিটি খোদ আরব চরিত্রের মধ্যেই নিহিত- কেবল আমরাই সৎ পথ প্রাপ্ত- সেই অত্যুৎসাহী ধার্মকন্মন্য অনুভূতির মধ্যে- যা কাউযকে ভিন্ন মত পোষণ করার অধিকার দিতে রাজী নয়। এ মনোভংগী সত্যিকার সিমাইটের এক বৈশিষ্ট্য যেমন আরেকটি বৈশিষ্ট এর ঠিক বিপরীত- ধর্মীয় ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীনতা। ।আরবদের এ একটি দুঃজনক গুণ যে, ওদেরকে সব সময়ই দোল খেতে হবে দু’টি মেরুর মধ্যে এবং ওরা কখনো একটা মধ্য পন্হা খুঁজে বের করতে সক্ষম নয়। একদা, প্রায় দু’শো বছর আগে নযদের আরবেরা ছিলো হৃদয়ের দিক দিয়ে মুসলিম জাহানের আর যে- কোন জনগোষ্ঠী ইসলাম থেকে অনেক দূরে; অথচ মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাবের পর থেকে ওরা যে নিজেদেরকে কেবল দীনের যোদ্ধাই মনে করছে তা নয়, ব রং দীনের প্রায় একমাত্র মালিক-মুখতার বলেও গণ্য করে আসছে।
মুসলিম সমাজের আন্তর্জাগতিক পুনরুজ্জীবনের প্রয়াস ওয়াহাবী মতবাদের আধ্যাত্মিক তাৎপর্য। কিন্তু এ তাৎপর্য ঠিক সেই মুহূর্তেই বিকৃত হয়ে পড়লো যখন এ মতবাদের বাহ্য লক্ষ্য- সামাজিক ও রাষ্ট্রিয় ক্ষমতা অর্জন পূর্ণ হলো আঠারো শতকের শেষের দিকে, সউদী রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এবং উনিশ শতকের গোড়ার দিকে আরবের বৃহত্তর অংশে সেই রাজ্যের সম্প্রসারণে। মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাবের অনুসারীরা ক্ষমতায় আসার সাথে সাথেই তাঁর চিন্তাধারা পরিণত হলো সযত্নে রক্ষিত মমিতে, কারণ আত্মা ক্ষমতার গোলাম হতে পারে না এবং ক্ষমতাও চায় না আত্মার গোলাম হতে।
নযদের ওয়াহাবের ইতিহাস হচ্ছে একটি ধর্মীয় ভাবধারার ইতিহাস, যে-ভাবধারা প্রথমে উদ্দীপনা ও প্রত্যাশার ডানায় ভর করে উঠেডিছলো আকাশে এবং পরে লুটিয়ে পড়েছে ‘কেবল আমিই ঠিক পথে আছি’ এই অহমিকা বোধের নিম্নভূমিতে; কারণ সমস্ত সদগুণিই আপনা-আপনি ধ্বংস হয়ে যায়, যখন তাতে থাকে না প্রত্যাশা আর বিনয়- নম্রতাঃ হারুত! মারুত!