আত্মার ব্রহ্মাণ্ড পর্যটন ( Under the Knife )
[‘Under the Knife’ প্রথম প্রকাশিত হয় ‘The New Review’ পত্রিকায় জানুয়ারি ১৮৯৬ সালে। ১৯১১ সালে প্রকাশিত ‘The Country of the Blind and Other Stories’ সংকলনটিতে গল্পটি স্থান পায়।]
হ্যাডনের বাড়ি থেকে ফেরবার পথে কেবলই ভাবছিলাম, কাল যদি মরে যাই তো কী হবে? বউ নেই যে কাঁদবে, বন্ধুবান্ধব যা আছে, তাদের ব্যাপারে আমি এমনই নিস্পৃহ যে, মোটেই শোকে বিহ্বল হবে না। বাল্যবন্ধু ছাড়া জীবনের শেষ ভাগে কিছু প্রতিদ্বন্দ্বী আর শুভাকাক্ষীও জুটিয়ে ফেলেছি, কিন্তু এদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই আমি এতই উদাসীন যে, আমার মৃত্যুতে তাদের যেমন কোনও মাথাব্যথা নেই–আমারও তা নিয়ে অযথা মস্তিষ্কপীড়ন নেই। সুতরাং দুনিয়ায় কেউ কেঁদে ভাসিয়ে দেবে না কালকের অপারেশনে আমি অক্কা পেলে।
ভাবাবেগ জিনিসটা যেন একেবারেই মরে গেছে আমার ভেতরে। একেবারেই নির্বিকার। শরীর ভেঙে পড়ার লক্ষণ নিঃসন্দেহে। ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে গেল। হঠাৎ খুব রক্তক্ষরণ হয়েছিল। মরতে বসেছিলাম। তখনকার সেই অনুভূতির ছিটেফোঁটাও আর নেই মনের ভেতরে–নিংড়ে বেরিয়ে গেছে বললেই চলে। নিবিড় প্রশান্তি–ভাগ্যের হাতে নিঃশেষে নিজেকে সঁপে দিলে যা হয়। বেশ কয়েক হপ্তা আগে অনুভূতি, উচ্চাশা, মমত্ববোধ–সবই ছিল পুরো মাত্রায়।
রক্তশূন্য হয়েছি আবার। হপ্তাখানেক কিছুই খেতে পারছি না। খিদেই নেই। মানুষ নামক প্রাণীটাকে চালিত করে যন্ত্রণা আর আনন্দবোধের চক্র। এই চক্র হঠাৎ আমার ভেতর থেকে সরে গেছে। তাই এই উদাসীনতা। ছোটখাটো ভয় আর আকাক্ষা থেকেই বড় রকমের আবেগ, অনুভূতি, মমত্ববোধের সৃষ্টি হয়। মৃত্যুর ছায়াপাত ঘটলেই অবসান ঘটে এই জটিল চক্রবর্তের। উদ্যম তিরোহিত হয়। তখন আর কিছুই থাকে না।
একটা কসাই-ছোকরার বারকোশে ধাঁই করে ধাক্কা খেতেই ছিঁড়ে গেল চিন্তার সুতো। ঘটনাটা ঘটল রিজেন্ট পার্ক ক্যানালের ব্রিজ পেরনোর সময়ে। নীলবসন ছোকরা ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে রয়েছে একটা কালো মালবাহী বড় নৌকোর দিকে। হাড় বার-করা সাদা ঘোড়া গুন টেনে নিয়ে যাচ্ছে নৌকোটাকে। ব্রিজের ওপরে হাত ধরে তিনটে খুশি-খুশি বাচ্চাকে নিয়ে আসছে একজন আয়া। উজ্জ্বল সবুজ গাছ, ঝকঝকে আকাশ, তরঙ্গায়িত কালো জল এবং বসন্তের মৃদুমন্দ সমীরণও নাড়া দিতে পারল না আমার অসাড় মনে।
কীসের পূর্বাভাস এই অসাড়তা? যুক্তিবুদ্ধির ধার তো ভোঁতা হয়নি। কেন এমন হচ্ছে, তা তো বেশ ভাবতে পারছি। অসাড়তা নয়, প্রশান্তি চেপে বসছে চেতনায়। মৃত্যুর পূর্বলক্ষণ নাকি? মন জানতে পেরেছে আগে থেকেই? মৃত্যুর কনকনে আলিঙ্গনে দেহ ঠান্ডা হওয়ার আগেই কি মন নিজে থেকেই এইভাবে সরে আসে জড়জগৎ আর অনুভূতির জগৎ থেকে? দলছাড়া মনে হল নিজেকে। জীবন থেকে, চারপাশের অস্তিত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার দরুন কিন্তু বিন্দুমাত্র পরিতাপের উদয় ঘটল না মনের মধ্যে। জীবনের চাঞ্চল্য চারদিকে। ছেলেমেয়েরা খেলছে, মালি-আয়ার সঙ্গে গল্প করছে, হাসতে হাসতে পাশ দিয়ে চলে গেল প্রাণবন্ত দুটি তরুণ-তরুণী, রাস্তার পাশের গাছগুলো নতুন পাতা মেলে ধরছে। সূর্যকিরণের দিকে, মর্মরধ্বনি শোনা যাচ্ছে ডালপালার মধ্যে। প্রাণময় এই জগতের অংশ ছিলাম আমিও। এখন নেই। ফুরিয়ে গেছে আমার ভূমিকা।
ক্লান্ত বোধ করছিলাম। পা যেন আর চলছে না। বসলাম রাস্তার পাশের সবুজ চেয়ারে। বেশ গরম পড়েছে। ঢুলুনি এল বসতে-না-বসতেই। তলিয়ে গেলাম অদ্ভুত স্বপ্নের মধ্যে। উদবেল চিন্তা ধুয়ে-মুছে গেল পুনর্জন্মের স্বপ্নদৃশ্যে। বসে রয়েছি চেয়ারেই, কিন্তু প্রাণ নেই দেহে৷ শুষ্ক, জীর্ণ দেহ। একটা চোখ খোবলাচ্ছে কয়েকটা পাখি। জাগ বলে কে হেঁকে উঠতেই বিদ্রোহী হল যেন রাস্তার ধুলো আর ঘাসের তলাকার মাটির ঢিপি। রিজেন্ট পার্কের এই বাগানটাকে কবরখানা বলে কোনওদিনই ভাবতে পারিনি। সেই মুহূর্তে কিন্তু দেখলাম, যত দূর দুচোখ যায়, কেবল কবর আর সমাধিস্তম্ভ। কাঁপছে, দুলছে, শিরশির করছে, কিলবিল করছে। কোথায় যেন একটা বিরাট গোলমাল চলেছে। জাগ্রত মড়ারা কবর ঠেলে উঠে আসতে চাইছে প্রাণপণে! রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছে সর্বাঙ্গ। সাদা হাড় থেকে খসে পড়ছে লাল মাংস। জাগ হাঁক আবার শোনা গেল কানের কাছে। কিন্তু দাঁতে দাঁত কামড়ে বসে রইলাম আমি। জাগুক সবাই, আমি জাগব না। দানোদের দলে ভিড়ব না। চাষাড়ে গলায় আবার জাগতে বলছি না? বলেই কাঁধ ধরে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিল চোয়াড়ে লোকটা। টিকিট চাইছে বাগানের মালি।
পয়সা গুনে দিয়ে টিকিট পকেটস্থ করে, হাই তুলে উঠে পড়লাম চেয়ার ছেড়ে, চললাম ল্যাংহাম প্লেসের দিকে। আবার মৃত্যুর চিন্তা জলপ্রপাতের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল মনের ওপর। আর-একটু হলে গাড়িচাপা পড়তাম মোড়ের মাথায়। ধাক্কাটা গেল কাঁধের ওপর দিয়ে। রক্ত তো বেরলই, সেই সঙ্গে উত্তাল হল হৃদযন্ত্র। টলতে টলতে সরে এলাম পাশে। কালকের মৃত্যু-ধ্যান আর-একটু হলেই মৃত্যু ঘটিয়ে ছাড়ত এখুনি।
যা-ই হোক, সেই দিনের এবং তার পরের দিনের অভিজ্ঞতা শুনিয়ে আপনাদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটাতে চাই না। সময় যতই গড়িয়েছে, ততই নিশ্চিত হয়েছি। কাল অপারেশন হবে এবং আমিও মরব। বাড়ি ফিরে দেখলাম, প্রস্তুতিপর্ব সাঙ্গ হয়েছে। ঘর পরিষ্কার। সাদা চাদর ঝুলছে। নার্স মোতায়েন হয়েছে। জোর করেই শুতে পাঠাল সকাল সকাল।
বড় কুঁড়ে মনে হল নিজেকে সকালবেলা। সকালের ডাকে আসা খবরের কাগজ আর চিঠিপত্র নিয়ে বসলাম বটে, কিন্তু মন দিতে পারলাম না। আমার লেখা নতুন বইটায় কয়েক জায়গায় ত্রুটি আছে, ছাপার ভুলও আছে–লিখেছে স্কুলের বন্ধু অ্যাডিসন। বাকি চিঠিপত্র ব্যাবসা সংক্রান্ত। এক কাপ চা ছাড়া খেতে দেওয়া হল না কিছুই। পাঁজরায়। যন্ত্রণাটা আরও বেড়েছে। কিন্তু অনুভব করতে পারছি না। রাত্রে ঘুমাইনি। মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল। তেষ্টা পাচ্ছিল। সকালে কিন্তু বেশ ভালোই লাগল। সারারাত অতীতের ঘটনা ভেবেছি। ভোরের দিকে অমরত্ব নিয়ে ভাবতে ভাবতে চুলেছি। ঘড়ি ধরে ঠিক সময়ে এল হ্যাডন–হাতে কালো ব্যাগ। মোব্রে এল তার পরেই। ওরা আসতে জবুথবু ভাবটা একটু কাটল। আটকোনা ছোট টেবিলটা খাটের পাশে এনে রাখল হ্যাডন। আমার দিকে পেছন ফিরে ব্যাগ থেকে জিনিসপত্র বের করে রাখতে লাগল টেবিলে। শুনলাম স্টিলের ওপর স্টিল রাখার আওয়াজ। চিন্তাধারা আর ডোবা জলের মতো বদ্ধ নয়। জিজ্ঞেস করেছিলাম, ছুরি চালালে খুব লাগবে কি?
হ্যাডন বলেছিল, মোটেই না। ক্লোরোফর্ম করা হবে তো। আমার হার্ট নাকি দারুণ মজবুত। নাকে ভেসে এসেছিল ঘুমপাড়ানি ওষুধের মিষ্টি গন্ধ।
পাশ ফিরিয়ে শুইয়ে দিয়েই ক্লোরোফর্ম দিয়েছিল তৎক্ষণাৎ। প্রথমে মনে হয়েছিল, দম আটকে আসছে। মরতে চলেছি তো জানি, এবার লোপ পাবে জ্ঞান। হঠাৎ মনে হল, সে কী! মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত হইনি তো এখনও অনেক কর্তব্য যে এখনও বাকি। কী কর্তব্য তা অবশ্য জানি না, মনেও করতে পারলাম না, কী কাজ এখনও করা হয়নি। জীবনে কী কী আকাক্ষা এখনও অপূর্ণ রয়েছে, কিছুতেই মনে করতে পারলাম না। অথচ মরবার ইচ্ছেও হল না। শারীরিক অস্বস্তি যন্ত্রণার পর্যায়ে পৌঁছেছে–বেশ উপলব্ধি করলাম। ছটফট করেছিলাম। তারপর নিস্পন্দ হয়ে গেলাম। নৈঃশব্দ্য আর তমিস্রা গ্রাস করল আমাকে।
কত মিনিট কত সেকেন্ড জ্ঞান হারিয়েছিলাম, বলতে পারব না। হঠাৎ গা শিরশির-করা আবেগহীন অনুভূতির মধ্যে দিয়ে টের পেলাম, আমি মরিনি। দেহের খাঁচার মধ্যেই রয়েছি। কিন্তু যেন মুক্তি পেয়েছি। পুরোপুরি নয়। মাংসময় দেহে আটকে আছি ঠিকই, কিন্তু দেহটা যেন আর আমার নয়। কিছুই দেখিনি, কিছুই শুনিনি, তবুও যা যা ঘটেছে, তার সবই টের পেয়েছি–শোনা আর দেখার মতোই। হ্যাডন ঝুঁকে রয়েছে আমার ওপর, বিরাট একটা স্ক্যালপেল হাতে পাঁজরা কেটে ফালাফালা করছে মোব্রে। যন্ত্রণা নেই। মাংস কেটে যাচ্ছে টের পাচ্ছি কিন্তু ভালোই লাগছে। যেন দুজন দাবা খেলোয়াড়ের দান দেওয়া দেখছি মজা লাগছে। কৌতূহল নিবিড়। হ্যাডনের মুখ শক্ত, হাত অচঞ্চল। কিন্তু অপারেশন যে সাকসেসফুল হবে না–এইরকম একটা ধারণা রয়েছে মনের মধ্যে। কী করে ওর মনের কথা টের পেলাম, তা বলতে পারব না।
মোব্রে কী ভাবছে, তা-ও টের পেয়েছিলাম। ও ভাবছিল, বিশেষজ্ঞ হয়েও হ্যাডন এত মন্থরগতি কেন? কী কী করা উচিত, বলতে চাইছে, মাথার মধ্যে চিন্তাগুলো হাজার হাজার বুদবুদের মতো ঠেলে উঠছে। হ্যাডনের দক্ষ ক্ষিপ্র ছুরিচালনা দেখে মুগ্ধ হয়েছে, তা-ও টের পাচ্ছি ওর চেতনার বিস্ফোরণ অনুভব করে। হ্যাডনের দক্ষতা মোরে মাথার মধ্যে ঈর্ষার সঞ্চার ঘটাচ্ছে, তা-ও উপলব্ধি করছি। যকৃৎ খুলে বার করে নেওয়া দেখলাম। হতভম্ব হলাম নিজের অবস্থা দেখে। মরিনি। কিন্তু জীবিত সত্তা বলতে যা বোঝায়, তা-ও নই। বছরখানেক যে বিষণ্ণতায় ভুগেছি, আচম্বিতে তা উধাও হয়েছে। চিন্তা করছি, উপলব্ধি করছি কিন্তু আবেগের ছিটেফোঁটাও অনুভব করছি না। জানি না আর কেউ এভাবে ক্লোরোফর্মে জ্ঞান হারিয়ে সবকিছু টের পেয়েছে কি না, অন্যের মনের মধ্যে ঢুকতে পেরেছে কি না, তারপরেও সব মনে রাখতে পেরেছে কি না।
মরিনি এখনও বলতে পেরেও এইটুকু বুঝলাম, মরতে আর দেরি নেই। ঢুকলাম হ্যাডনের মনের মধ্যে। ভয় পাচ্ছে একটা মূল শিরার শাখা কাটতে। স্পষ্ট দেখতে পেলাম ওর মানসিক দ্বন্দ্ব। গ্যালভানোমিটারের আয়নায় আলো কাঁপে যেভাবে থিরথির করে, ওর সজ্ঞান মনে তেমনি দুটো চিন্তার লড়াই চলছে। একটা আলো জোরালো হয়ে উঠছে। এই আলোয় দেখা যাচ্ছে ওর মনের ভাবনা–একটা কাটা শিরার ছবি। পরক্ষণেই জোরালো হয়ে উঠল আর-একটা আলোকময় চিন্তা-ভুল জায়গায় কাটা হয়েছে শিরা। ধস্তাধস্তি লেগে গেল দুটো আলোকময় সম্ভাবনাচিত্রে। প্রথমটা জোর করে হটিয়ে দিলে দ্বিতীয়টাকে। ভয় পেয়েছে হ্যাডন। বেশি কেটে ফেললেও বিপদ, কম কেটে ফেললেও বিপদ।
আচমকা যেন লক গেট খুলে তোড়ে জল বেরিয়ে গেল। দোটানার চিন্তাপ্রবাহ হু-উ-উ-স করে বেরিয়ে গেল ওর চেতনাকেন্দ্রের আলোময় অঞ্চল থেকে। মনস্থির করে ফেলেছে। হ্যাডন। টের পেলাম, শিরা কাটাও হয়ে গেল তৎক্ষণাৎ। ভাঙা গলায় পেঁচিয়ে উঠল সঙ্গে সঙ্গে। ছিটকে সরে গেল পেছনে। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছে। বাদামি-বেগুনি রক্ত। সে কী আতঙ্ক হ্যাডনের। দুই ডাক্তারই আটকোনা টেবিল থেকে স্ক্যালপেল তুলে নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল বিপর্যয় রোধ করার জন্যে। আমি কিন্তু জানলাম, মৃত্যু হল আমার সেই মুহূর্তেই–দেহটা অবশ্য তখনও আঁকড়ে রয়েছে আমাকে নাছোড়বান্দার মতো।
সবই উপলব্ধি করলাম। কিন্তু খুঁটিয়ে বর্ণনা আর দেব না। চেষ্টার ত্রুটি করেনি দুজনে আমাকে বাঁচিয়ে রাখতে। জীবনে এত ধারালোভাবে দ্রুতগতিতে কিছু উপলব্ধি করতে পারিনি। অবিশ্বাস্য গতিবেগে চিন্তা ছুটছে মনের মধ্যে দিয়ে–আশ্চর্য রকমের অনাবিল সুস্পষ্টভাবে। সঠিক মাত্রায় আফিম খেলে চিন্তারাশি যেভাবে গাদাগাদি অবস্থায় থেকেও স্পষ্ট থাকে, আমার তখনকার অবস্থা যেন সেইরকমই। এ ছাড়া আর কোনও উপমা মাথায় আনতে পারছি না। বুঝলাম, এখুনি সব শেষ হয়ে যাবে, মুক্তি পাব আমি। আমি জানি, আমি অমর। কিন্তু কী ঘটবে, তা জানি না। বন্দুকের নল থেকে ফুস করে ধোঁয়া ঠিকরে যায় যেভাবে, সেইভাবেই কি ছিটকে যাব দেহের খাঁচা থেকে? মৃতদের জগতে হাজির হব কি এবার? প্রেতচক্রে হাজির হব নাকি তারপর? বেরং প্রত্যাশা, আবেগহীন কৌতূহলে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিলাম সেই মুহূর্তে। তারপরেই একটা চাপ অনুভব করলাম। উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। যেন একটা অতিকায় মানবিক চুম্বক আমাকে আমার দেহ থেকে টেনে ওপরে তুলে নিয়ে যেতে চাইছে। বাড়ছে… ক্রমশ বেড়ে চলেছে অস্বস্তি। প্রচণ্ড আকর্ষণ আর এড়ানো যাচ্ছে না। অনেকগুলো দানবিক শক্তির সঙ্গে সঙ্গে আমি একটা খুদে পরমাণুর মতো যুঝে চলেছি। পারছি না… প্রচণ্ড এই আকর্ষণকে ঠেকিয়ে রাখার ক্ষমতা আমার নেই। ক্ষণেকের জন্যে একটা বিশাল কালো তমিস্রা জলপ্রপাতের মতো আছড়ে পড়ে মহা-আতঙ্কের অমানিশায় ডুবিয়ে দিল আমাকে… ভয়াবহ আতঙ্ক চকিতের মতো চাবুক আঘাতে জড়তা কাটিয়ে দিল আমার এক নিমেষের জন্যে। পরক্ষণেই দুই ডাক্তার, ছোট্ট ঘর, পাঁজরা-কাটা দেহ প্রবল জলোচ্ছ্বাসে একটা ফেণা-বুদবুদের মতো ভেসে গেল কোথায় কে জানে।
দেখলাম, শূন্যে ভাসছি। শুধু ভাসছি নয়, প্রচণ্ড বেগে ধেয়ে যাচ্ছি ওপরদিকে। অনেক নিচে দ্রুত ছোট হয়ে আসছে লন্ডনের ওয়েস্ট এন্ড। ঊর্ধ্বগতি কিন্তু পশ্চিম-ঘেঁষা। পাতলা ধোঁয়াশার মধ্যে দিয়ে দেখতে পেলাম অসংখ্য ছাদের চিমনি, মানুষ আর যানবাহনে বোঝাই সরু সরু রাস্তা, ছোট্ট ছোট্ট ধূলিকণার মতো চৌকোনা পার্ক, আর কাপড়ের গায়ে বিঁধে থাকা কাঁটার মতো গির্জের চূড়া। অচিরেই তা সরে গেল দৃষ্টিপথ থেকে পৃথিবী ঘুরছে বলে। সে জায়গায় আবির্ভূত হল পাশের গ্রাম, শহরতলি, নদী। কোথায় যে চলেছি নক্ষত্রবেগে, কিছু বলতে পারলাম না।
পলকে পলকে নিচের নিসর্গদৃশ্য বিশাল হতে বিশালতর অঞ্চল জুড়ে জেগে উঠল চোখের সামনে, শহর আর প্রান্তর, পাহাড় আর উপত্যকা, আরও কুয়াশাচ্ছন্ন, আরও ম্যাড়মেড়ে, আরও অস্পষ্ট হয়ে এল, পাহাড়ের নীল বর্ণ আর মাঠ-ময়দানের সবুজ রঙের সঙ্গে আলোকময় ধূসরাভা আরও বেশি মিশে যেতে লাগল। নিচে অনেক পশ্চিমে ছোট ছোট মেঘের টুকরো আরও ঝকমকে সাদা হয়ে উঠতে লাগল। মাথার ওপর আকাশের রংও পালটে গেল একটু একটু করে। প্রথমে যা ছিল বসন্তের আকাশের মতো নীলিমায় নীল, আস্তে আস্তে তা গাঢ়তর হয়ে মধ্যরাতের আকাশের মতো কালো হয়ে গেল, তারপর হল তুষার-ঝরা নক্ষত্রলোকের মতো মিশমিশে কালো, তারপর যে মসিকৃষ্ণ রংটি উপস্থিত হল, সেরকম কালো রং কখনও দেখিনি। প্রথমে দেখা গেল একটা তারা, তারপর অনেক, তারপর ঝাঁকে ঝাঁকে–অগুনতি। পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে এত নক্ষত্র একসঙ্গে কেউ কখনও দেখেনি। দিনের আলোয় তারা দেখা যায় না নীল গগনে। শীতের রাতেও দেখা যায় না। তারার আলো থাকে বলে। কিন্তু এখন আর চোখে ধাঁধা লাগছে না–রাশি রাশি তারার অদ্ভুত সমারোহ দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। মরলোকের কেউ এমন স্বর্গীয় দৃশ্য কখনও দেখেনি। অবিশ্বাস্যভাবে অদ্ভুত এবং আশ্চর্য হয়ে উঠেছে সূর্য। চোখধাঁধানো সাদা আলোয় গড়া সূর্য। পৃথিবী থেকে দেখায় হলদেটে। কিন্তু আমি দেখলাম ধবধবে সাদা সূর্য। লাল ডোরা রয়েছে সাদার ওপর। কিনারা ঘিরে লকলকে লোহিত অগ্নিজিহ্বা। দুপাশে পাখির ডানার মতো রুপোলি সাদা দুটো প্রত্যঙ্গ ঠিকরে গেছে মহাশূন্যের বহু দূর পর্যন্ত। ঠিক যেন ডানাওয়ালা গোলক। মিশরীয় ভাস্কর্যে দেখেছিলাম এই ধরনের ছবি। পার্থিব জীবনে সৌরচ্ছটার ছবি দেখেছিলাম–এখন দেখলাম স্বচক্ষে।
পৃথিবীর দিকে ফের তাকিয়ে দেখি, সৌরজগতের তৃতীয় গ্রহ সরে গেছে আরও দূরে। অনেক আগে থেকেই মাঠ-ময়দান-প্রান্তর পর্বতকে আলাদাভাবে চেনা যাচ্ছিল না। সব রং মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। এখন যা দেখা যাচ্ছে তা একটা সমান উজ্জ্বল ধূসর রং। মাঝে মাঝে ঝকঝকে সাদা মেঘপিণ্ড। সমুদ্র ডাঙার চাইতে গাঢ় ধূসর রঙের। পুরো দৃশ্যটা আস্তে আস্তে ঘুরে যাচ্ছে পূর্বদিকে।
দ্রুত ঘটে চলেছে ঘটনাস্রোত। পৃথিবী থেকে হাজারখানেক মাইল সরে আসার আগে নিজের কথা মনেই হয়নি। উপলব্ধি করলাম একটা আশ্চর্য ব্যাপার। আমার হাত নেই, পা নেই, দেহাংশ নেই, দেহযন্ত্র নেই, ভয় নেই, যন্ত্রণা নেই। বায়ুমণ্ডল ছাড়িয়ে এসেছি অনেকক্ষণ। চারপাশে শূন্যতা। মানুষের কল্পনাতীত। আমি কিন্তু নির্বিকার। নির্ভয়। সূর্যালোক ধেয়ে যাচ্ছে শূন্যতার মধ্যে দিয়ে। বস্তুতে প্রতিহত হচ্ছে না বলে আলো বা উত্তাপ দিচ্ছে না। নিবিড় প্রশান্তিময় বিস্মৃতিতে আছন্ন আমার সত্তা। যেন স্বয়ং ঈশ্বর আমি। সেকেন্ডে সেকেন্ডে অসংখ্য মাইল দূরে সরে যাচ্ছে বহু নিচে লন্ডন শহরের আমার ছোট্ট ঘরখানি–দুজন ডাক্তার আমার খোলসটাকে নিয়ে প্রাণপণে চেষ্টা করে চলেছে আবার তার মধ্যে প্রাণ ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু আমি যে মুক্তির স্বাদ, যে অনাবিল প্রশান্তি, যে অনির্বচনীয় পরিতৃপ্তি পেয়েছি, তার সঙ্গে মরজগতের কোনও আনন্দের তুলনা হয় না।
পলকের মধ্যে এতগুলো উপলব্ধির পর পৃথিবী ছেড়ে বেগে উধাও হওয়ার অর্থ সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। এত সহজ আর অবশ্যম্ভাবী ব্যাপারটা কেন যে আগে ভাবিনি, ভাবতে গিয়ে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। বস্তু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছি হঠাৎ–ভেসে যাচ্ছি শূন্যপথে। বস্তুজগতের সঙ্গে যেখানে এতটুকু বাঁধন ছিল, সব ছিঁড়ে বেরিয়ে এসে সেকেন্ডে সেকেন্ডে প্রচণ্ড গতিবেগে ধেয়ে চলেছি আকাশভরা সব চন্দ্র-গ্রহ-নক্ষত্রর দিকে। মাধ্যাকর্ষণের আকর্ষণ অনুভব করছি না। বস্তুরহিত বলেই মহাশূন্যে এত আকর্ষণশূন্য। মাংস দিয়ে গড়া পিঞ্জর পড়ে তো পৃথিবীতে। পৃথিবীকে আমি ত্যাগ করছি না–পৃথিবীই আমাকে ত্যাগ করছে–গোটা সৌরজগৎটাই সাঁ সাঁ করে সরে যাচ্ছে পাশ দিয়ে। চোখে দেখতে না পেলেও উপলব্ধি করছি, আমার মতোই মুক্তির আনন্দে বিহ্বল বহু আত্মা বিরাজমান আমার চতুর্দিকে। বস্তুপিঞ্জর থেকে মুক্তি পেয়ে, পাশবিক লোভ, নগ্ন বুদ্ধিমত্তা, অর্থহীন আবেগ-অনুভূতি থেকে ছাড়া পেয়ে আচম্বিতে উদবেল হয়ে উঠেছে প্রত্যেকেই। মহাশূন্য ভেদ করে ধেয়ে চলেছে তারা আমার পাশে পাশে–অদৃশ্য অবস্থায়!
পৃথিবী আর সূর্যের কাছ থেকে ক্রমশ দুরে সরে যেতে যেতে উপলব্ধি করলাম, অবিশ্বাস্যভাবে আকারে-আয়তনে বড় হয়ে যাচ্ছি যেন। মানুষের জীবনে বড় বলতে যা কল্পনা করা যায়, সেই তুলনায় অনেক… অনেক বড়। কিছুক্ষণের মধ্যেই পূর্ণিমার চাঁদের মতোই বৃহদাকার ধারণ করল পৃথিবী। মিনিটকয়েক আগে দ্বিপ্রহরের সূর্য প্রদীপ্ত রেখেছিল যেখানে ইংল্যান্ডে, এখন সেখানে দেখা যাচ্ছে রোদ্দুর ঝকঝকে আমেরিকাকে। মুহূর্তে মুহূর্তে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে আসছে পৃথিবী গোলক। কিনারায় আবির্ভূত হল চন্দ্র। নক্ষত্রমণ্ডলী দেখে অবাক হলাম। চেনাজানা তার মালা ছাড়াও দেখলাম অনেক অজানা অচেনা নক্ষত্রমণ্ডলী। প্রশান্ত দ্যুতি সমুজ্জ্বল নক্ষত্ররাশিতে উদ্ভাসিত মহাশূন্য। পৃথিবী পলকের মধ্যে সূর্যের মতো ছোট হয়ে এল। বিপরীতদিকে আলপিনের ডগার মতো মঙ্গল গ্রহকে দেখা গেল। মহাজাগতিক ধূলিকণার মতো পৃথিবী মিলিয়ে যাচ্ছে বহু দূরে। আতঙ্ক বা বিস্ময়–কোনওটাতেই আচ্ছন্ন হলাম না।
এরপরেই উপলব্ধি করলাম, মন মন্থরগতি হয়েছে, ধারণা নতুন রূপ নিচ্ছে, মঙ্গল গ্রহের কক্ষপথে আবর্তন দেখলাম, এক চিন্তা থেকে আরেক চিন্তার মধ্যেকার সময়ের ব্যবধান বেড়ে যাচ্ছে–এক-এক মুহূর্তে এক-একটা হাজার বছর অতিবাহিত হচ্ছে।
অনন্ত মহাশূন্যের কালো পটভূমিকায় এতক্ষণ নিশ্চল ছিল নক্ষত্রমণ্ডলী। হঠাৎ তাদেরকেও সরে যেতে দেখলাম। ছিটকে ছিটকে যাচ্ছে দুর হতে দুরে। আচমকা অন্ধকারের মধ্যে থেকে সূর্যকরোজ্জ্বল একঝাঁক প্রস্তরখণ্ড ধূলিকণার মতো আলোকময় প্রভায় চারদিক উজ্জ্বল করে দিয়ে বেরিয়ে গেল আশপাশ দিয়ে। মিলিয়ে গেল দুরে। তারপরেই দেখলাম, একটা উজ্জ্বল আলোর কণা দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। দেখতে দেখতে বড় হয়ে উঠল আলোটা। শনি গ্রহ। আকার বেড়েই চলেছে পলকে পলকে। মুহূর্তে মুহূর্তে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে পেছনের মহাকাশ আর অগুনতি নক্ষত্র। চ্যাপটা, ঘুরন্ত গ্রহের চারদিকে থালার মতো বলয় আর সাতটা উপগ্রহকে স্পষ্ট লক্ষ করা যাচ্ছে। নিমেষে বিশাল হতে বিশালতর হয়ে যেন আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল অতিকায় শনি গ্রহ, ধেয়ে চললাম অগুনতি পাথরের ধারাবর্ষণের মধ্যে দিয়ে… পাথরে পাথরে সে কী সংঘাত। ধূলিকণার তাণ্ডবনৃত্য আর গ্যাস-আবর্তের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে চকিতের জন্যে দেখলাম মাথার ওপর প্রকাণ্ড তিনটে বেল্ট; একই কেন্দ্র ঘিরে যেন তিনটে চন্দ্রালোকিত খিলেন। ছায়া পড়েছে নিচের ফুটন্ত প্রলয়কাণ্ডের ওপর। বলতে যতটা সময় গেল, তার এক দশমাংশ সময়ের মধ্যেই ঘটে গেল এত কাণ্ড। বিদ্যুঝলকের মতো উধাও হয়ে গেল শনি গ্রহ। সূর্যকে ঢেকে রাখল কয়েক সেকেন্ডের জন্যে। তারপরেই দেখা গেল আলোর পটভূমিকায় পাক খেতে খেতে মিলিয়ে যাচ্ছে একটা ধ্যাবড়া কালচে দাগ। ধরিত্রী মা-কে। আর দেখতে পেলাম না।
রাজকীয় গতিবেগে, অখণ্ড নৈঃশব্দ্যের মধ্যে দিয়ে পেরিয়ে এলাম সৌরজগৎ। যেন একটা জামা খুলে পড়ে গেল গা থেকে। অগণিত তারকারাজির মধ্যে নিছক একটা নক্ষত্র হয়ে জেগে রইল সূর্য-আশপাশে ধূলিকণার মতো গ্রহ–বহু দূরের আলোয় স্পষ্ট নয় কোনওটাই মিলেমিশে একাকার। সৌরজগতের বাসিন্দা আর নই আমি। এসে পড়েছি বাইরের ব্রহ্মাণ্ডে–বহিঃমহাকাশে। আরও দ্রুত ঘনীভূত হল কয়েকটা নক্ষত্রমণ্ডলী–চেনা তারকামণ্ডলীরা অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পর। ঘুরন্ত নীহারিকার মতো দেখতে হল মহাকাশের সেইদিকটা। তার ওপারে ব্যাদিত মহাশূন্যতা–খণ্ড খণ্ড নিঃসীম তমিস্রা–মাঝে মাঝে চিকমিক করছে নক্ষত্র। কমে আসছে সংখ্যায়। মনে হল যেন দ্রুত হতে দ্রুততর হচ্ছে ব্রহ্মাণ্ডের ছুটে যাওয়া–ধূলিকণার আকারে নিঃশব্দে বিলীন হচ্ছে মহাশূন্যে। ঝকঝকে নক্ষত্ররা আরও ঝকঝকে হয়ে উঠছে, কাছাকাছি এসে দেখছি, গ্রহদের গা থেকে ঠিকরে যাচ্ছে যেন ভৌতিক দ্যুতি। পরমুহূর্তেই দপ করে নিবে যাচ্ছে ভূতুড়ে আলো–মিলিয়ে যাচ্ছে অনস্তিত্বের মধ্যে। অস্পষ্ট ধূমকেতু, উল্কার ঝাঁক, বস্তুকণা, আলোককণার ঘূর্ণি সাঁত সাঁত করে বেরিয়ে যাচ্ছে পাশ দিয়ে। কেউ কোটি কোটি মাইল দূর দিয়ে, কেউ কাছ দিয়ে। অকল্পনীয় গতিবেগ প্রত্যেকেরই। ধাবমান তারকামণ্ডলী, ক্ষণিক অগ্নিস্ফুলিঙ্গ কুচকুচে কালো প্রকাণ্ড রাত্রির বুক ভেদ করে ছুটে এসেই মিলিয়ে যাচ্ছে নিমেষে নিমেষে। বিশাল হতে বিশালতর হচ্ছে নক্ষত্রহীন দুরের মহাশূন্য–যেদিকে আকৃষ্ট হয়ে চলেছি আমি বিরামবিহীনভাবে। দেখতে দেখতে মসিকৃষ্ণ এবং বেবাক শূন্য হয়ে গেল মহাকাশের সিকি অঞ্চল–দ্যুতিময় নক্ষত্রময় ব্রহ্মাণ্ড পেছনে ছুটে গিয়ে কাছাকাছি হতে হতে আলোকপুঞ্জ হয়ে গেল। এসে পড়লাম ধু ধু মহাশূন্যতার মধ্যে। কালো অমানিশা আস্তে আস্তে বিরাটতর হয়ে চারদিক থেকে ছেকে ধরল আমাকে–আগুনের কণার মতো নক্ষত্রগুলো ঝটিতি সরে গেল দূর হতে দূরে–নাস্তি আর শূন্যতার গহ্বরে একা আমি ধেয়ে চললাম কোথায় কে জানো বস্তু দিয়ে গড়া অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডও শেষকালে এক কণা আলোকময় ধুলোর মতো অস্পষ্ট হয়ে এল পেছনে–একেবারেই অদৃশ্য হতে আর দেরি নেই।
আচম্বিতে মহা-আতঙ্ক পেয়ে বসল আমাকে। ভাষা দিয়ে সেই আতঙ্ক অনুভূতিকে প্রকাশ করা যায় না। সীমাহীন এই অন্ধকারের মধ্যে আমার মতোই কি রয়েছে আরও অনেক অদৃশ্য আত্মা? পৃথিবীর সমাজবদ্ধ জীব আমি–আত্মাদের সমাজ কি পাব এখানেনা, একাই থাকতে হবে? কী অবস্থায় পর্যবসিত হয়েছি, তা-ও তো বুঝছি না। জীবসত্তা থেকে বেরিয়ে এসে সত্তা আর সত্তাহীনতার মাঝামাঝি পর্যায়ে পৌঁছে গেলাম নাকি? দেহের খোলস, বস্তুর খোলস সবই টেনে ছিঁড়ে নেওয়া হয়েছে আমার কাছ থেকে সঙ্গ আর নিরাপত্তা এখন নিছক মরীচিকা। চারদিকেই তো নিবিড় তমিস্রা–অখণ্ড নীরবতা। সত্তা ছিল –এখন নেই। কিছুই নই এখন আমি। নিতল গহ্বরে নিরতিশয় ক্ষুদ্র এক কণা আলো ছাড়া কিছুই তো আর দেখা যাচ্ছে না। প্রাণপণে শোনার, দেখার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু অসীম নৈঃশব্দ্য, অসহ্য অন্ধকার, বিভীষিকা আর নৈরাশ্য ছাড়া কিছুই উপলব্ধি করিনি।
ব্রহ্মাণ্ডের সব বস্তু যেখানে জড়ো হয়েছে, সেইখানে হঠাৎ দেখলাম একটা ক্ষীণ দ্যুতি। দ্যুতির দুপাশের পটিও নিঃসীম তমিস্রায় আবৃত নয়। যেন অনন্তকাল ধরে চেয়ে ছিলাম সেইদিকে। দীর্ঘক্ষণ প্রতীক্ষার পর ঝাপসা দ্যুতি স্পষ্টতর হল বটে, কিন্তু বোধগম্য হল না কিছুই। তারপরেই পটির চারদিকে আবির্ভূত হল অতিশয় ক্ষীণ, অতিশয় ম্যাড়মেড়ে বাদামি রঙের মেঘ। অসহ্য অসহিষ্ণুতায় অস্থির হয়েছিলাম। কিন্তু এত ধীরগতিতে মেঘটার ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধি পাচ্ছিল যে, কিছুতেই আন্দাজ করতে পারলাম না কী ধরনের বিস্ময়ের সম্মুখীন হতে চলেছি। মহাশূন্যের চিররাত্রির মধ্যে ওই অদ্ভুত লালাভ উষা কীসের সূচনা বহন করছে, কিছুতেই বুঝে উঠলাম না।
আস্তে আস্তে বিদঘুটে হয়ে উঠছিল মেঘের আকার। তলার দিকে যেন ঠেলে বেরিয়ে রয়েছে চারটে বস্তুপুঞ্জ–ওপরদিকে কী যেন একটা উঠে গেছে সিধে সরলরেখায়। অপচ্ছায়ার মতো এ আবার কী জিনিস? এ জিনিস দেখছি আগে… হ্যাঁ, হ্যাঁ, দেখেছি… কিন্তু কোথায় যে দেখেছি, কিছুতেই খেয়াল করতে পারলাম না। আচমকা উপলব্ধি করলাম বিচিত্র আকৃতির স্বরূপ। মুঠো-করা একটা হাত! মহাশূন্যে আমি একা, সামনে ওই প্রকাণ্ড ছায়াসম হাত, বস্তুময় গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এক কণা অকিঞ্চিৎকর ধুলোর মতো পড়ে রয়েছে ওই হাতের নিচে। তর্জনীতে ঝকঝক করছে একটা আংটি। আংটির কিনারায় চিকমিক করছে এক কণা অলো–যে ব্রহ্মাণ্ড ছেড়ে এলাম–ওই ব্রহ্মাণ্ড। মুঠোয় ধরা বস্তুটাকে দেখতে অনেকটা কালো ডান্ডার মতো। অনন্তকাল ধরে ভয়ে-বিস্ময়ে অসহায়ভাবে চেয়ে ছিলাম সেই হাত আর সেই ডান্ডার দিকে–কী যে ঘটবে এরপর, বুঝতে পারিনি। কেবলই মনে হচ্ছিল, ঘটবে না কিছুই, চেয়ে থাকতে হবে অনন্তকাল ধরে এইভাবে কোনওদিনই বুঝব না ওই হাত আর ওই ডান্ডার তাৎপর্য, কেন ওই উপস্থাপন, কীসের ছায়া। আমার সত্তাহীন নৈর্ব্যক্তিক সত্তায় থেকে যাবে শুধু যা অমোঘ, যা আদি এবং অন্তহীন–তারই উপস্থিতি। বৃহত্তর অন্য কোনও সত্তার ওপরে এই গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডটা প্রতিসরিত আলোককণা কি না, এ প্রশ্নের জবাবও পাব না কোনওদিন। কোনওদিনই জানব না এই রবি-শশী-তারাভরা বিশাল ব্ৰহ্মাণ্ড আরেকটা ব্রহ্মাণ্ডের পরমাণুমাত্র কি না, সেই ব্রহ্মাণ্ডটাও হয়তো আরেকটা ব্রহ্মাণ্ডের পরমাণু। এবং সে ব্রহ্মাণ্ডও আরেক ব্রহ্মাণ্ডের পরমাণু ছাড়া কিছুই নয়। এইভাবেই কি চলছে সৃষ্টির পরম্পরা? কে জবাব দেবে এই প্রহেলিকার? আমিই বা কী? বাস্তবিকই কি অ-বস্তু? আমার চারদিকে একটা দেহ দানা বেঁধে উঠছে যেন মনে হল–খুবই আবছা উপলব্ধি। নারকীয় তমিস্রার মধ্যে ওই হাত যে ইঙ্গিত বহন। করছে, নিশ্চিতভাবে তা বুঝলাম না। হৃদয়ভাব দিয়ে শুধু টের পেলাম, নিরাকারের মধ্যে থেকে অনেক আকার তৈরি হয়ে যাচ্ছে… কাঁপছে… দুলছে… আবার মিলিয়ে যাচ্ছে।
ঘণ্টাধ্বনির মতো একটা শব্দ শুনলাম। ক্ষীণ শব্দ। যেন অসীমের ওপার থেকে ভেসে আসা শব্দ–নিরেট তমিস্রা ফুঁড়ে আসতে হচ্ছে বলে, এত অস্পষ্ট। আবার… আবার সেই ঘণ্টাধ্বনি… অনুধ্বনিত হচ্ছে সুগম্ভীর শব্দে… অনুকম্পন আর অনুরণন কাঁপছে একটি ঘণ্টাধ্বনি থেকে আরেকটি ঘণ্টাধ্বনির অন্তর্বর্তী সময়ে। সেই সঙ্গে মনে হল যেন শক্তভাবে ডান্ডা চেপে ধরল হাতটা। হাতের অনেক ঊর্ধ্বে, অন্ধকারের মধ্যবিন্দুতে দেখলাম একটা আলোকবৃত্ত–অস্পষ্ট ফসফরাস-দ্যুতির মতো। ভৌতিক বর্তুলের মতো আলোক-গোলকের মধ্যে ধুক ধুক করে শব্দনাদ সৃষ্টি করে চলেছে ঘণ্টাধ্বনি। শেষ ধ্বনিটার সঙ্গে সঙ্গেই অদৃশ্য হয়ে গেল হাতখানা। বুঝলাম, সময় হয়েছে নিকট। শুনলাম বিপুল জলোচ্ছাসের গুরুগম্ভীর দূরায়ত গর্জন। মহাকাশের বুকে বিশাল পটির মতো কিন্তু স্থির হয়ে রইল কালো ডান্ডাটা। তারপরেই মহাশূন্যের দূরতম প্রান্ত পর্যন্ত ধেয়ে গেল একটা কণ্ঠস্বর অবসান ঘটল যন্ত্রণার।
তৎক্ষণাৎ অসহ্য হর্ষ-উল্লাসের আবর্তে মুহ্যমান হয়ে গেলাম। দেখলাম, উজ্জ্বল হয়ে উঠছে চকচকে সাদা বৃত্তটা, চেকনাই ছড়াচ্ছে কালো ডান্ডাটা, স্পষ্ট পরিষ্কার হয়ে উঠছে আরও অনেক কিছু। বৃত্তটা হয়ে গেল ঘড়ির ডায়াল, ডান্ডাটা আমার খাটের রেলিং। হ্যাডনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম আমার পায়ের দিকে রেলিং-এর পাশে–হাতে একটা ছোট কাঁচি। ঘাড়ের ওপর দিয়ে ম্যান্টেলে রাখা ঘড়ির ডায়ালে দেখা যাচ্ছে, কাঁটা দুটো এক হয়ে গিয়ে খাড়া হয়ে রয়েছে বারোটার ঘরে। আটকোনা টেবিলে কী যেন ধুচ্ছে। মোত্রে, পাঁজরে অনুভব করলাম একটা চাপা অনুভূতি–যাকে যন্ত্রণা বলা যায় না কোনওমতেই।
সাঙ্গ হয়েছে অপারেশন। আমি মরিনি। আচম্বিতে উপলব্ধি করলাম, আধখানা বছর জুড়ে থাকা চাপা বিষাদবোধও তিরোহিত হয়েছে মনের ভেতর থেকে।