আত্মার বিদ্রোহ [স্পিরিটস রেবেলিয়াস]
ম্যাডাম রোজ হানি
প্ৰথম পৰ্ব
দুর্দশাগ্রস্ত লোকটি একজন নারীকে ভালোবাসে এবং তাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করে, তার পায়ে ঢেলে দেয় তার চামড়ার ঘাম, শরীরের রক্ত এবং হৃদয়ের প্রাণ এবং তার হাতে তুলে দেয় অধ্যবসায়ের ফল এবং পরিশ্রমের রাজস্ব, কারণ যখন সে ধীরে ধীরে ঘুম থেকে জেগে ওঠে তখন সে দেখতে পায় তার হৃদয়, যাকে কিনতে চেষ্টা করেছিল, অন্তরঙ্গতার সঙ্গে তা অন্য মানুষকে দেওয়া হয়েছে তার লুকানো গোপনীয়তা ও গভীরতম ভালোবাসা উপভোগ করতে। দুর্গত নারীটি বেড়ে উঠেছে মনোযোগহীনতা ও যৌবনের অস্থিরতার ভেতরে এবং বিয়ের পর সে নিজেকে দেখতে পায় একজন পুরুষের গৃহে, তার ওপর ঝরে পড়ছে জ্বলজ্বলে সোনা ও মূল্যবান উপহারের বৃষ্টি এবং তার যথাযথ সম্মান ও প্রসংশনীয় গুণ অনুসারে অপর্যাপ্ত চিত্তবিনোদন, কিন্তু স্বর্গীয় মদ তার আত্মাকে তৃপ্ত করতে সক্ষম নয় যা ঈশ্বর ঢেলে দেন পুরুষের চোখ থেকে নারীর হৃদয়ে।
আমি রশীদ বেই নামান-কে চিনতাম তরুণ বয়স থেকেই। সে ছিল একজন লেবানীয়। জন্ম ও লালিত পালিত হয়েছে বৈরুত শহরে। প্রাচীন ও ধনী পরিবারের সদস্য হিসেবে সে সংরক্ষণ করেছিল তার পূর্বপুরুষের প্রথা ও গৌরব। রশীদ পছন্দ করত সাহসিকতা প্রদর্শন করতে যা প্রধানত ছিল তার পূর্বপুরুষের সততা। তার রুটিন মাফিক জীবনে সে মেনে চলত তাদের বিশ্বাস ও রীতিনীতিগুলি, যা সে সময়ে প্রাচ্যে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল।
রশীদ বেই নামান ছিল একজন উদার এবং সহৃদয় ব্যাক্তি, সেও বহু সিরিয়ানের মতো কেবলমাত্র বিভিন্ন জিনিসের বাইরের দিকটাই দেখত বাস্তবতার পরিবর্তে, কিন্তু নিজেকে সবসময়ই সে অনুগত রাখত তার পরিবেশের কণ্ঠস্বরের প্রতি। সে নিজে মজা উপভোগ করত বিভিন্ন ঝকমকে জিনিসের উজ্জ্বল্যের ভেতরে, যা তার চোখ ও হৃদয়কে অন্ধ করে দেয় জীবনের গোপনীয়তাকে জানতে, তার আত্মার গতিপথ পাল্টে দেওয়া হয়েছিল প্রকৃতির নিয়ম-কানুনের একটি উপলব্ধি থেকে। সে ছিল সেইসব মানুষদের একজন, দ্রুত যারা ভালোবাসা স্বীকার করে অথবা মানুষকে বিরক্ত করে, তারপর অনুতপ্ত হয় আবেগতাড়িত হয়ে।
রশীদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই তাকে প্ররোচিত করেছিল রোজ হানিকে বিয়ে করতে, বহুদূর থেকে যার আত্মা তার আত্মাকে আলিঙ্গন করেছিল প্রকৃত প্রেমের ছায়ার ভেতরে, যার সম্মিলনই হল একটা স্বৰ্গ।
কয়েক বছর অনুপস্থিত থাকার পর আমি বৈরুতে ফিরে এলাম এবং রশীদ বেই নামানকে দেখতে গেলাম। দেখলাম সে কৃশাকায় ও মিলন হয়ে গেছে। তার মুখের দিকে তাকালে যে কেউ দেখতে পাবে তিক্ত হাতাশার অপচ্ছায়, তার চোখ দেখলেই বোঝা যায় তার হৃদয় চূর্ণবিচূর্ণ এবং বিপদগ্রস্থ আত্মা। তার দুর্গাতির কারণ সম্পর্কে আমার ঔৎসুক্যের সীমা ছিল না, আমি দ্বিধা-দ্বন্দ্বে না ভুগে তাকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তোমার কি হয়েছে রশীদ? তোমার হাসির সেই উজ্জ্বলতা কোথায় আর সেই প্রসন্নতাই বা কোথায় গেল, যা শৈশব থেকেই ছিল তোমার সঙ্গী? তোমার কি কোনো প্রিয় বন্ধু মারা গেছে? অথবা বেদনার দিনগুলি কি তোমার সুখের দিনগুলিতে পুঞ্জিভূত করা সোনাগুলি চুরি করে নিয়ে গেছে? বন্ধু হিসেবে তুমি আমাকে বল তোমার এই মনোকষ্ট এবং শারীরিক দুর্বলতার কারণ কি?’
সে আমার দিকে বেদনার দৃষ্টিতে তাকাল, যেন আমি তার কাছে সুন্দর নিদগুলির নির্জন প্রতিমূর্তিকে ফিরিয়ে এনেছিলাম। দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠে সে বলল, ‘যখন একজন মানুষ তার বন্ধুকে হায়ায়, তখন অন্য বন্ধুরা তাকে স্বান্তনা দেয় এবং যদি সে তার সোনা হারায় তাহলে সে গভীরভাবে চিন্তা করে মুহূর্তের জন্য এবং দুর্ভাগ্যকে একত্রিত করে, বিশেষ করে যখন সে নিজেকে দেখতে পায় সুখী ও বোঝাবহণকারী হিসেবে। কিন্তু যখন কেউ তার হৃদয়ের স্বাচ্ছন্দ্য হারায় যেখানে সে সুখ খুঁজে পায় এবং কার সঙ্গে সে তা পুনস্থাপন করতে পারে? যখন হৃদয় তোমাকে বেদনা দেয় তখন তুমি কষ্টভোগ কর। কিন্তু যখন দিন ও রাত্রি অতিক্রান্ত হয় তখন তুমি জীবনের কোমল আঙুলের স্পর্শ অনুভব করবে, তারপর তুমি হাসবে এবং উল্লসিত হবে।
‘নিয়তি হঠাৎ করে এসেই উপস্থিত হয় এবং পোড়াতে থাকে। সে তার কর্মকাণ্ড শুরু করে ভয়াবহ দৃষ্টি নিয়ে এবং তোমার গলা চেপে ধরে তার তীক্ষ্ম আঙুল দিয়ে এবং তোমাকে সজোরে নিক্ষেপ করে মাটিতে, তার লোহা আবৃত পায়ে তোমাকে মাড়িয়ে যায়। তারপর সে হাসে এবং চলে যায় কিন্তু পরবর্তীতে অনুতপ্ত হয় এবং তোমাকে জিজ্ঞাসা করে সৌভাগ্যের ভেতর দিয়ে তাকে ক্ষমা করে দিতে। তার রেশমের মতো হাত সে সামনে বাড়িয়ে দেয়, তোমাকে উঁচুতে তুলে ধরে এবং তোমাকে শোনায় আকাঙ্ক্ষার গান। সে তোমার ভেতরে সৃষ্টি করে আস্থা ও লক্ষ্যের নতুন উচ্ছাস। যদি তুমি মনে করে থাক জীবন একটা চমৎকার পাখি যা তুমি দারুনভাবে ভালোবাস, আনন্দের সঙ্গে তোমার অন্তরাত্মার বীজ তাকে খাওয়াও এবং তোমার হৃদয়কে প্রস্তুত করে তোল তার খাঁচা হিসেবে এবং আত্মাকে তার বাসা হিসেবে। কিন্তু যখন তুমি তোমার স্নেহপরায়নতায় তাকে মুগ্ধ কর এবং ভালোবাসার সৃষ্টিতে তার দিকে তাকাও, সে তোমার হাত থেকে পালিয়ে অনেক উঁচুতে উঠে যায় তারপর সে অবতরণ করে এবং প্রবেশ করে অন্য খাঁচায় এবং কখনও তোমার কাছে আর ফিরে আসেনা। তুমি কী করতে পার? ধৈর্য ও বিলাপকে তুমি কোথায় খুঁজে পাবে? কীভাবে তুমি তোমার স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষাকে ফিরিয়ে আনতে পারবে? কি সেই ক্ষমতা যা তোমার আত্মার ভেতরে এখনও রয়েছে?
হৃদয়ের ভোগান্তিসহ শ্বাসরুদ্ধকর কণ্ঠে রশীদ এসব বলে উঠে দাঁড়াল এবং নলখাগড়ার মতো কাঁপতে লাগল উত্তর ও দক্ষিণ থেকে প্রবাহিত বাতাসের মাঝখানে। সে তার হাত দুটি প্রসারিত করল যেন সে তার বাঁকানো আঙুল দিয়ে কিছু একটা আঁকড়ে ধরতে ও ধ্বংস করতে চায়। তার ভাঁজপড়া মুখের রঙ ছিল সীসার মতো, স্থির দৃষ্টিতে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকলে তার চোখ দুটি বড় হয়ে যেত এবং তার মনে হত তাকে দানবের মতো দেখাচ্ছে, যা অস্তিত্বহীনতা থেকে বেরিয়ে এসেছে তাকে নিয়ে যেতে, তারপর সে তাকাল আমার দিকে এবং তার মুখমণ্ডল হঠাৎ পরিবর্তন হয়ে গেল; তার রাগ পরিণত হল তীব্র ভোগান্তি ও দুর্গতিতে এবং সে কেঁদে কেঁদে বলল, ‘এটা হল সেই নারী যাকে আমি দারিদ্র্যের মরণ থাবার ভেতর থেকে উদ্ধার করেছিলাম। আমি উন্মুক্ত করেছিলাম তার কাছে আমার ধনভাণ্ডার এবং দামি পোশাক ও অলংকার পরা মহিলারা তার প্রতি ঈর্ষাকাতর হয়ে উঠেছিল। এটা হল সেই নারী যাকে আমার হৃদয় ভালোবেসেছে এবং যার পায়ে আমি আমার মায়ামমতাকে ঢেলে দিয়েছি—সেই নারীর কাছে আমি ছিলাম প্রকৃত বন্ধু, অন্তরঙ্গ সঙ্গী এবং বিশ্বস্ত স্বামী। সেই নারী আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে এবং আমাকে ছেড়ে অন্যপুরুষের কাছে চলে গেছে তার সঙ্গে চরম দারিদ্র্য ও বিষাক্ত রুটি ভাগাভাগি করতে, যা লজ্জা ও অপমান মিশিয়ে দলাই মলাই করে বানানো হয়েছে। যে নারীকে আমি ভালোবেসেছিলাম সে ছিল একটা চমৎকার পাখি যাকে আমি আহার যুগিয়েছি এবং যার জন্য আমার হৃদয়টাকে বানিয়েছি খাঁচা এবং আত্মাকে তৈরি করেছি বাসা হিসেবে। সেই শুদ্ধ দেবদূত যে আমার স্নেহ ও ভালোবাসার স্বর্গে বসবাস করে, এখন সে একটা ভয়াবহ দানব হিসেবে আমার সম্মুখে আবির্ভূত হয়েছে, অবতরণ করছে অন্ধকারের ভেতরে তার পাপের শাস্তি ভোগ করতে এবং তার অপরাধের জন্য আমাকে কষ্ট দিত।’
সে হাত দিয়ে মুখ ঢাকল যেন সে নিজের কাছে থেকেই নিজেকে রক্ষা করতে চায়। সে নীরব হয়ে থাকল এক মুহূর্তের জন্য। তারপর সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল এবং বলল, ‘এই হচ্ছে সবকিছু, আমি তোমাকে বলতে পারি, দয়া করে আমাকে আর কিছু জিজ্ঞাসা কোরো না। আমার বিপর্যয়ে তোমার মন থেকে যেন কান্না-মেশানো স্বর উচ্চারিত না হয়, বরং একে হতে দাও নীরব দুর্ভাগ্য, সম্ভবত এটা বেড়ে উঠবে নৈঃশব্দের ভেতরে এবং আমাকে অনুভূতিহীন করে তুলবে যেন আমি শান্তিতে বিশ্রাম নিতে পারি।’
আমার চোখ পানিতে ভরে উঠল এবং হৃদয় পূর্ণ হয়ে গেল দয়ায় এবং নিঃশব্দে আমি তাকে বিদায় জানালাম। আমার কথার কোনো ক্ষমতা ছিল না তার আহত হৃদয়কে সান্ত্বনা দেওয়ার এবং আমার বিচক্ষণতারও ছিল না কোনো তীব্র আলো তার অনুজ্জ্বল আত্মাকে মোহগ্রস্ত করে তুলতে।
দ্বিতীয় পৰ্ব
কয়েকদিন পর আমি এই প্রথম ম্যাডাম রোজ হানির সঙ্গে দেখা করলাম ফুল বাগান ও গাছপালা ঘেরা একটা জীর্ণ কুটিরে। রশীদ বেই নামান-এর কাছে সে আমার সম্পর্কে শুনেছিল, যার হৃদয়কে সে চূর্ণবিচূর্ণ করেছিল এবং ছাপ দিয়েছিল সিলমোহরের এবং পরিত্যাগ করেছিল জীবনের ভয়াবহ ছাদের তলায়। তার উজ্জ্বল চোখের দিকে তাকালাম এবং শুনলাম তার আন্তরিক কণ্ঠস্বর এবং আমি মনে মনে নিজেকে বললাম, ‘এই নারী কি অত খারাপ হতে পারে? এই উজ্জ্বল মুখ কি একটা কুৎসিত আত্মা ও অপরাধী হৃদয়কে লুকিয়ে রাখতে পারে? এই কি সেই নারী যাকে খারাপ বলেছি এবং কল্পনা করেছি একটা সাপ হিসেবে, যে লুকিয়ে থাকে একটা চমৎকার পাখির আদলের ভেতরে?’ তারপর আবার ফিসফিস করে নিজেকে বললাম, ‘এই কি সেই সুন্দর মুখ যা রশীদকে দুর্গতির ভেতরে টেনে নিয়ে গেছে? আমরা কি শুনি নাই অবশ্যম্ভাবী সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকা বহু দুর্গতি ও গভীর ভোগান্তির কারণ? এই কি সেই সুন্দর চাঁদ নয় যা কবিদেরকে প্রেরণা যোগায় এবং এই একই চাঁদ ভয়াবহ গর্জনে সমুদ্রের নীরবতাকে ক্রুদ্ধ করে তোলে?’
ম্যাডাম হানি-এর মনে হল সে তার চিন্তাকে পড়তে ও শুনতে পারছে এবং তার কণ্ঠস্বর ছিল বীণার ঝংকারের চেয়েও মধুরতর। সে বলল, ‘আপনার সঙ্গে আগে আমার কখনও দেখা হয়নি। কিন্তু আপনার চিন্তা ও স্বপ্নের প্রতিধ্বনি শুনেছি জনতার মুখে মুখে এবং তারা আমাকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে আপনি দয়ালু এবং পীড়িত নারীদের জন্য আপনার রয়েছে সহমর্মিতা—যে নারীর হৃদয়ের গোপনীয়তা আপনি আবিষ্কার করেছেন এবং যার ভালোবাসা সম্পর্কে আপনি জানেন। আমাকে অনুমতি দিন আপনার কাছে আমার হৃদয়কে প্রকাশ করতে, তাহলেই আপনি বুঝতে পারবেন রোজ হানি কখনও অবিশ্বস্ত নারী ছিল না।’
আমার বয়স তখন বড়জোর আঠারো বছর যখন ভাগ্য আমাকে নেতৃত্ব দেয়। রশীদ বেই নামান-এর বয়স তখন চল্লিশ। সে আমার প্রেমে পড়ে এবং আমাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করে। আমার বসবাসের জন্য উপহার দেয় একটা চমৎকার গৃহ, সঙ্গে দাসদাসী। আমার পরিধানের জন্য তার দেওয়া পোশাকগুলি দামি এবং মূল্যবান রত্নশোভিত। সে আমাকে তার বন্ধু ও পরিবারের কাছে প্রদর্শন করত একটা দুর্লভ জিনিস হিসেবে। সে বিজয়ের হাসি হাসত যখন দেখত সমসাময়িকরা বিস্ময় ও মুগ্ধদৃষ্টিতে আমাকে দেখছে। গর্বে সে তার চিবুক উঁচু করে তুলত যখন নারীরা আমার প্রশংসা করত। কে এমন ফিসফিস শোনেনি, ‘এটা কি রশীদ বেই নামান-এর স্ত্রী অথবা তার পালিতা কন্যা?’ তখন অন্য জনের মন্তব্য, ‘যদি সে সঠিক বয়সে বিয়ে করত তাহলে তার প্রথম সন্তানের বয়স রোজ হানির থেকে বেশি হত।’
এই সবকিছুই ঘটেছিল যৌবনের গভীর মূর্ছা থেকে আমার জীবন জেগে ওঠার আগেই এবং ঈশ্বরের সামনে আমার হৃদয়কে পুড়িয়েছিল ভালোবাসার মশাল দিয়ে, আমার ভালোবাসার বীজের অঙ্কুরোদ্গমের আগেই। হ্যাঁ সবকিছুর জানাজানি হয়ে যায় সেই সময় যখন আমি বিশ্বাস করতাম যে প্রকৃত ভালোবাসা আসে চমৎকার পোশাক ও বিশাল অট্টালিকার ভেতর দিয়েই। যখন আমি আমার শৈশবের সুখনিদ্রা থেকে জেগে উঠলাম, তখন অনুভব করলাম ঐশ্বরিক আগুনের শিখা আমার হৃদয়কে পোড়াচ্ছে এবং একটা আধ্যাত্মিক ক্ষুধা ক্ষয় করছে আমার আত্মাকে, তাকে পরিণত করছে ভোগান্তির শিকারে। যখন আমি আমার চোখ খুললাম এবং দেখতে পেলাম আমার পাখাগুলি ডাইনে ও বামে গতিশীল, চেষ্টা করছে ভালোবাসার প্রশস্ত অন্তরীক্ষে আরোহণ করতে, কিন্তু তা কাঁপতে কাঁপতে ঝরে পড়ছে আইনের হাতকড়ার নিচে, যা আমার শরীরকে বেঁধে ফেলে অন্য পুরুষের সঙ্গে এই আইনের প্রকৃত অর্থ জানার আগেই। আমি সবকিছুই অনুভব করলাম এবং জানলাম যে, নারীর সুখ কখনও পুরুষের সম্মান ও মহিমার ভেতর দিয়ে আসে না, উদারতা ও মমতার ভেতর দিয়েও নয়, কিন্তু ভালোবাসার মাধ্যমে তাদের হৃদয়ের সম্মিলন ঘটে, তৈরি করে তাদেরকে জীবনের শরীরের একজন সদস্য এবং একটি শব্দ উচ্চারিত হতে থাকে ঈশ্বরের ঠোঁটের ওপর। সত্য যখন আমার কাছে নিজেকে দেখায় তখন আমি আইনের দ্বারা বন্দি অবস্থায় রশীদের অট্টালিকার ভেতরে, যেন একজন চোরের মতো চুরি করছি তার রুটি এবং অন্ধকার ও রাত্রির বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিটি বাঁকে তা লুকিয়ে ফেলছি। আমি জানতাম তার সঙ্গে প্রতিটি ঘণ্টা কাটানোর ঘটনাটা ছিল একটা ভয়াবহ মিথ্যাচার যা স্বর্গ ও পৃথিবীর সম্মুখে আগুনের চিঠিতে লেখা হয়েছে আমার কপালের ওপর। তার উদারতা ও অন্তরঙ্গতার পুরস্কার হিসেবে আমি তাকে ভালোবাসা দিতে পারি না। আমি তাকে ভালোবাসার চেষ্টা করেছি, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি। ভালোবাসা হচ্ছে একটা শক্তি যা আমাদের হৃদয়কে সৃষ্টি করেছে, যদিও আমাদের হৃদয় ঐ শক্তি সৃষ্টি করতে পারে না। তাই আমি প্রার্থনা করি এবং প্রার্থনা করি ঈশ্বরের সম্মুখে রাত্রির নীরবতার ভেতরে আমার আত্মার গভীরতায় একটি আধ্যাত্মিক যোগাযোগ তৈরি করতে যা আমাকে বহন করে নিয়ে যাবে সেই পুরুষের কাছে যাকে আমার সারা জীবনের সঙ্গী হিসেবে পছন্দ করা হয়েছে।
‘আমার প্রার্থনা অনুমোদিত হয়নি, কারণ ভালোবাসা ঈশ্বরের ইচ্ছায় আমাদের আত্মার ওপর অবতরণ করেছিল এবং তা দাবি হিসেবে নয়, নয় কোনো এক ব্যক্তির অনুরোধ হিসেবে। যা হোক, আমি দুই বছর ঐ লোকের বাড়িতে ছিলাম। সে সময় পাখিদের স্বাধীনতাকে হিংসা করেছি, যখন আমার বন্ধুরা আমাকে হিংসা করেছে আমার বেদনার্ত সোনার শৃঙ্খলকে। আমি ছিলাম সেই নারীর মতো যাকে তার শিশুর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে; আমি ছিলাম একটা শোকাচ্ছন্ন হৃদয়ের মতো এবং কোনো যোগাযোগ ছাড়াই টিকে আছি মনুষ্যপ্রজাতির আইনের নিষ্পাপ শিকারের মতো।
‘এক মেঘাচ্ছন্ন দিনে, আকাশের পেছন থেকে আমি তাকিয়েছিলাম, ‘দেখেছিলাম একটা কোমল আলোকরশ্মি ঝরে পড়ছে একজন মানুষের চোখ থেকে যে জীবনের পথে অসহায়ভাবে হাঁটছে। আমি আমার চোখ বন্ধ করি এবং নিজেকে বলি, ‘হে আমার আত্মা, কবরের অন্ধকার পুরোটাই তোমার, সুতরাং আলোর জন্য লোভী হয়ো না।’ তারপর আমি শুনলাম স্বর্গ থেকে আসা চমৎকার সংগীত যা এর শুদ্ধতার সঙ্গে আমার আহত হৃদয়কে ফিরিয়ে আনে, কিন্তু আমি আমার কান বন্ধ করলাম এবং বললাম, ‘হে আমার আত্মা, নরকের কান্না পুরোটাই তোমার, স্বর্গীয় গানের জন্য লোভ কোরো না।’ আমি আবার আমার চোখ বন্ধ করলাম সুতরাং আমি আর দেখতে পেলাম না এবং আমার কান বন্ধ করলাম সুতরাং আমি শুনতে পেলাম না। কিন্তু আমার বন্ধ করা চোখ তখনও দেখছিল সেই কোমল আলো এবং আমার কান তখনও শুনছিল সেই ঐশ্বরিক ধ্বনি। এই প্রথম আমি আতঙ্কিত হলাম এবং নিজেকে মনে হল ভিক্ষুকের মতো যে এক আমিরের প্রাসাদের কাছে একটা মূল্যবান অলঙ্কার দেখতে পেয়েছিল কিন্তু ভয়ে সে তা তুলে নিতে পারছিল না অথবা পরিত্যাগ করেছিল দারিদ্র্যের কারণে। আমি কেঁদেছিলাম—একটা তৃষ্ণার্ত হৃদয়ের কান্না, যে বন্যপশুবেষ্টিত ছোট্ট নদী দেখে মাটিতে পতিত হয় এবং অপেক্ষা ও পর্যবেক্ষণ করতে থাকে ভীত অবস্থায়।’
তারপর সে আমার দিক থেকে চোখ ঘুরিয়ে নিল যেন সে স্মরণ করছিল তার অতীত যার কারণে সে আমার মুখোমুখি হতে লজ্জা পাচ্ছিল; কিন্তু সে বলে যেতে লাগল, ‘সেইসব মানুষ যারা অনন্তকালের দিকে ফিরে যায়, প্রকৃত জীবনের মধুরতার স্বাদ উপভোগ করার আগেই এবং তারা একজন নারীর দুর্ভোগ উপলব্ধি করতে অক্ষম। বিশেষ করে যখন সে তার আত্মাকে নিয়োজিত করে সেই পুরুষের প্রতি যাকে সে ভালোবাসে ঈশ্বরের ইচ্ছায় এবং তার শরীর থাকে অন্যের কাছে এবং সেই শরীরকে আদর করা হয় আইনের কার্যকারিতার দ্বারা। এটা হচ্ছে একটা বিয়োগান্তক নাটক যা লেখা হয়েছে নারীর রক্ত এবং অশ্রু দিয়ে যা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের সঙ্গে পুরুষেরা পড়ে, কারণ তারা এটা উপলব্ধি করতে পারে না, যদি কখনও তা উপলব্ধি করেও তাহলে তাদের উচ্চহাসি পরিণত হবে অবজ্ঞা ও ঈশ্বরনিন্দায়, যা তার হৃদয়ের ওপর আগুনের মতো ক্রিয়া করবে। এটা একটা বিয়োগান্তক নাটক রাত্রির অন্ধকারের ভেতরে নারীদের আত্মার মঞ্চে মঞ্চস্থ হয়; যার শরীর বাঁধা থাকে একজন পুরুষের সঙ্গে, যে স্বামী হিসেবে তার কাছে পরিচিত, সে উপলব্ধি করে বিয়ে সম্পর্কে ঈশ্বরের উদ্দেশ্য কী। সে দেখতে পায় তার আত্মা সেই লোকটির ওপর পাখা না নাড়িয়ে আকাশে স্থির হয়ে ভেসে আছে, প্রেম ও সৌন্দর্যের সত্য ও শুদ্ধতার দিক থেকে যাকে সে শ্রদ্ধা করে। এটা একটা ভয়াবহ মর্মপীড়া যা শুরু হয়েছিল একজন নারীর ভেতরে তার দুর্বলতার অস্তিত্বের সঙ্গে সঙ্গে এবং পুরুষের ভেতরে শুরু হয়েছিল শক্তি উদ্ভবের সঙ্গে সঙ্গে। এটা কোনদিন শেষ হবে না যতক্ষণ না এই দাসত্বের দিনগুলি এবং দুর্বলদের ওপর শক্তিশালীদের শ্রেষ্ঠত্ব বিলুপ্ত না হয়। এটা একটা বীভৎস যুদ্ধ মানবতার দুর্নীতিগ্রস্ত আইন এবং ঐশ্বরিক প্রেম ও হৃদয়ের পবিত্র উদ্দেশ্যের ভেতরে। এরকম একটা যুদ্ধক্ষেত্রের ভেতরে গতকাল আমি শুয়েছিলাম, কিন্তু আমি একত্রিত করেছিলাম আমার অবশিষ্ট শক্তিটুকু এবং কাপুরুষতার লোহার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করেছিলাম নিজেকে এবং একত্রিত করেছিলাম আমার পাখাগুলি দুর্বলতায় পেঁচানো আবরণ থেকে এবং জেগে উঠেছিলাম প্রেম ও স্বাধীনতার প্রশস্ত আকাশে।
‘আজ আমি একজন, যে পুরুষকে আমি ভালোবাসি তার সঙ্গে। সে এবং আমি লাফিয়ে উঠি যেমন একজন আলো নিক্ষেপ করেছিল ঈশ্বরের হাত থেকে পৃথিবী শুরুর আগে। এই সূর্যের এমন কোনো ক্ষমতা নেই যা আমার কাছ থেকে আমার সুখকে কেড়ে নিতে পারে, কারণ এটা প্রবাহিত হয় আলিঙ্গনে আবদ্ধ দুটি আত্মা থেকে, একে গ্রাস করে নেয় উপলব্ধি, এটা দীপ্তিময় হয়ে ওঠে ভালোবাসায় এবং তা রক্ষা করে স্বর্গ।’
সে আমার দিকে তাকাল যেন সে আমার ওপর তার ব্যথার প্রতিক্রিয়া কী আবিষ্কার করতে চোখ দিয়ে আমার হৃদয়কে বিদ্ধ করতে চায় এবং শুনতে চায় আমার ভেতর থেকে তার কণ্ঠের প্রতিধ্বনি। কিন্তু আমি নীরব থাকি, সে তাকিয়েই থাকে। তার কণ্ঠে পরিপূর্ণ ছিল স্মৃতির তিক্ততা, আন্তরিকতার মধুরতা এবং স্বাধীনতায়, যখন সে বলে, ‘মানুষ আপনাকে বলবে রোজ হানি হল একজন নব্যতান্ত্রিক এবং অবিশ্বস্ত নারী যে তার আকাঙ্ক্ষাকে অনুসরণ করতে গিয়ে সেই লোককে পরিত্যাগ করে যে তাকে তার প্রতি অনুপ্রাণিত করেছিল এবং তাকে তৈরি করেছিল তার ঘরের শোভা। তারা আপনাকে বলবে সে একজন ব্যভিচারিণী এবং পতিতা, যে তার সমৃদ্ধ হাতে ধ্বংস করেছে ঐশ্বরিক বিবাহ বন্ধন এবং তা পুনঃস্থাপন করছে অশ্লীল মিলনের ভেতরে যা বয়ন করা হয়েছে নরকের কাঁটার ওপরে। সে খুলে ফেলেছে সদ্গুণের পোশাকগুলি এবং পরিধান করেছে পাপ ও অপমানের ছদ্মবেশ। তারা আপনাকে তার চেয়েও বেশি বলবে, কারণ তার পিতাদের প্রেতাত্মা এখনও তাদের শরীরের ভেতরে বসবাস করছে। তারা হল, পাহাড়ের পরিত্যক্ত গুহার মতো যা কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি করে কিন্তু তার অর্থ বোঝা যায় না। তারা উপলব্ধি করে না ঈশ্বরের আইন, উপলব্ধি করেনা প্রকৃত ধর্মের সত্য উদ্দেশ্য, পার্থক্য করে না পাপী ও নিষ্পাপ মানুষের। তারা বস্তুর উপরিভাগের দিকে তাকিয়ে থাকে তার গোপনীয়তা সম্পর্কে কিছু না জেনে। তারা সিদ্ধান্ত জানায় অজ্ঞতার সঙ্গে এবং বিচার করে অন্ধত্ব নিয়ে, তৈরি করে অপরাধী ও নিষ্পাপ মানুষ, তৈরি করে ভালো ও মন্দ—যাকে বলে ভারসাম্য। অভিশপ্ত হোক সেইসব লোকেরা যারা মানুষের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও বিচার করে থাকে…
ঈশ্বরের চোখে আমি তখনই ছিলাম অবিশ্বস্ত এবং ব্যাভিচারিণী যখন আমি রশীদ বেই নামান-এর বাড়িতে ছিলাম, কারণ সে প্রচলিত প্রথা ও রীতি অনুযায়ী আমাকে তার স্ত্রীতে পরিণত করেছিল স্বর্গের সম্মুখে এবং নিজেকে সে আমার জন্য প্রস্তুত করছিল স্বাভাবিকভাবে প্রেম ও মায়া মমতার আধ্যাত্মিক আইনের ভেতরে। আমি ঈশ্বর ও আমার চোখে ছিলাম পাপী, যখন আমি তার রুটি খেয়েছিলাম এবং তার উদারতার পুরষ্কার হিসেবে তাকে প্রদান করেছিলাম আমার শরীর। তখন আমি পরিচ্ছন্ন ও শুদ্ধ, কারণ ভালোবাসার আইন আমাকে মুক্ত করেছে এবং আমাকে বিশ্বস্ত ও সম্মানের যোগ্য করে তুলেছে। আশ্রয় ও পোশাকের জন্য আমি আমার শরীর বিক্রি করা বন্ধ করলাম। হ্যাঁ, আমি ছিলাম একজন ব্যাভিচারিণী এবং অপরাধী অথচ লোকে আমাকে সবচেয়ে সম্মানিত ও বিশ্বস্ত স্ত্রী হিসেবে জানে, কিন্তু তাদের মতামতে আমি একজন দূষিত নারী। কারণ, তারা আত্মাকে বিচার করে শরীরের পরিণতি দিয়ে এবং তার পরিমাপ করে বস্তুর মানসম্পন্নতার মাধ্যমে।’
তারপর রোজ হানি জানালার ভেতর দিয়ে বাইরে তাকাল এবং আঙুল দিয়ে শহরের দিকে দেখাল, যেন সে শহরের চমৎকার ভবনগুলির মাঝখানে দূর্নীতির ভূত ও লজ্জার ছায়া দেখতে পেয়েছে। সে সাধারণভাবে বলল, ‘ঐসব রাজকীয় ভবন এবং সম্ভ্রম উদ্রেককারী ভবনগুলির দিকে তাকান যেখানে বসবাস করে প্রতারণা, এসব প্রাসাদ ও চমৎকারভাবে সজ্জিত তাদের দেয়ালগুলির মাঝখানে বসবাস করে বিশ্বাসঘাতকতা, পচনের পাশাপাশি গলিত সোনা দিয়ে চিত্রায়িত ছাদের নিচে বসবাস করে মিথ্যাচার দাম্ভিকতার পাশে। লক্ষ্য করুন সেইসব জাঁকজমকপূর্ণ বাড়িঘর যা সুখ, মহিমা ও কর্তৃত্বের প্রতিনিধিত্ব করে, তারা আর কিছুই নয়, দুর্গতি ও সংকটের গুহা ছাড়া। তারা হল পলেস্তরা দেওয়া সমাধি, যার ভেতরে দুর্বল নারীদের বিশ্বাসঘাতকতা তাদের সুর্মা দেওয়া চোখ আর গাঢ় লাল রঙের ঠোঁটের পেছনে লুকিয়ে থাকে, আর তার বাঁকে বাঁকে অবস্থান করে স্বার্থপরতা এবং মানুষের পশুত্ব, সোনা ও রুপায় সর্বময় আইনের মাধ্যমে।
‘ঐসব উঁচু ও দুর্জয় ভবনগুলি যদি ঘৃণা, কপটতা এবং দুর্নীতির সৌরভে সুরভিত হয় তাহলে তাতে ফাটল সৃষ্টি হবে এবং তারা সেই ফাটলে পতিত হবে। গরিব গ্রামবাসীরা তাদের অশ্রুসজল চোখে ঐসব বসতির দিকে তাকায় কিন্তু যখন তারা দেখে যে, দখলকারীর হৃদয়ে প্রকৃত ভালোবাসা বলে কিছু নেই যা অবস্থান করে তার স্ত্রীর হৃদয়ের ভেতরে এবং পরিপূর্ণ করে তোলে তার হৃদয় রাজ্য, তখন সে হাসবে এবং পরিতৃপ্ত হৃদয়ে ফিরে যাবে তার শস্যক্ষেতে।’
তারপর সে আমার হাত ধরল এবং জানালার দিকে যেতে যেতে বলল, ‘আসুন আমি আপনাকে দেখাব মানুষের অপ্রকাশিত গোপনীয়তাগুলি, যাদের পথ অনুসরণ করতে আমি অস্বীকার করেছিলাম। দৈত্যাকৃতির স্তম্ভসহ ঐ প্রাসাদটার দিকে তাকাল। এই প্রাসাদে বসাবাস করে এক ধনী লোক যে উত্তরাধিকার সূত্রে তার পিতার কাছ থেকে অনেক সোনা পেয়েছে। কিছুদিন সমৃদ্ধ ও একই সঙ্গে পচনশীল জীবন যাপনের জন্য এক নারীকে বিয়ে করেছিল যার সম্পর্কে সে কিছুই জানত না, শুধু জানত তার পিতা সুলতানের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। দ্রুত তাদের বিয়ের প্রমোদ ভ্রমণ শেষ হয়ে যাওয়ার পর সে স্ত্রীর প্রতি বিরক্ত হয়ে পড়ল এবং সেইসব নারীদের সঙ্গে সময় কাটাতে লাগল যারা রুপার বিনিময়ে শরীর বিক্রি করে। তার স্ত্রী মাতালের পরিত্যক্ত শূন্য বোতলের মতো প্রাসাদে পড়ে থাকল একা। সে এই প্রথম কাঁদল এবং কষ্ট ভোগ করল। তারপর সে উপলব্ধি করল তার ভ্রষ্ট স্বামীর চেয়ে তার চোখের পানি অধিক মূল্যবান। বর্তমানে সে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছে এক যুবকের প্রেম ও অনুরাগের ভেতরে, যাকে সে ভিজিয়ে দিচ্ছে তার আনন্দের বৃষ্টিধারায় এবং তার হৃদয়ে সে ঢেলে দিচ্ছে অন্তরঙ্গ প্রেম ও মায়ামমতা।
‘বাগান-ঘেরা ঐ জাঁকজমকপূর্ণ বাড়িতে আপনাকে নিয়ে যাবার অনুমতি দিন আমাকে। এটা এমন একজন মানুষের বাড়ি যে সৎ পরিবার থেকে এসেছে,এই দেশ শাসন করেছে কয়েক প্রজন্ম ধরে, কিন্তু তাদের শাসনের মান, সম্পদ এবং মর্যাদা নিম্নমানের ছিল তাদের উম্মাদের মতো অর্থ খরচের প্রবণতাকে প্রশ্রয় দেওয়া এবং অলসতার কারণে। কয়েক বছর আগে এই লোকটি একজন কুৎসিত কিন্তু ধনী নারীকে বিয়ে করেছিল। স্ত্রীর ক্ষমতা হস্তগত করার পর সে তাকে অবহেলা করতে থাকে এবং আকর্ষণীয় সুন্দরী নারীদের সঙ্গে মেলামেশা করতে শুরু করে। তার স্ত্রী আজকাল সময় কাটায় চুলের পরিচর্চা, ঠোঁটে রঙ এবং শরীরকে সুরভিত করে। সে সবচেয়ে দামি পোশাক পরে এবং আশা করে কোনো যুবক হয়তো তার দিকে তাকিয়ে হাসবে এবং কোনো এক সময় তার সঙ্গে দেখা করতে আসবে। কিন্তু সবই ব্যর্থ হয়েছে, কারণ সে কখনও আয়নায় তার কুৎসিত আত্মার হাসি ছাড়া অন্যকিছু দেখতে পাবে না।
‘দেখুন ঐ বিশাল অট্টালিকা মর্মপাথরের প্রতিমূর্তি দিয়ে ঘেরা, এটা একটা সুন্দর রমণীর গৃহ। সে অদ্ভুত চরিত্রের অধিকারী। যখন তার প্রথম স্বামী মারা যায় উত্তরাধিকার সূত্রে সে তার স্বামীর সমস্ত ভূমি ও সম্পত্তি পায়। তারপর সে ক্ষীণ ও দুর্বলচিত্তের একটা লোককে নির্বাচন করে এবং তার স্ত্রীতে পরিণত হয় মন্দ লোকদের কটু কথা থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য এবং তাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে অন্যের ঘৃণা থেকে। এখন সে তার গুণমুগ্ধ ভক্তের ভেতরে মৌমাছির মতো বিচরণ করছে এবং ভক্তরা চুষে চুষে পান করছে সবচেয়ে মিষ্টি ও সবচেয়ে তৃপ্তিদায়ক ফুলটিকে।
‘এরপরের ঐ সুন্দর বাড়িটা নির্মাণ করেছে এই প্রদেশের বিখ্যাত স্থপতি, এর মালিক হচ্ছে লোভী এবং শাক্তপোক্ত এক লোক যে তার পুরো সময়টাই ব্যয় করে সোনার স্তূপটাকে বাড়িয়ে তুলতে এবং গরিবদের মুখমণ্ডল গুঁড়ো করে দিতে। তার অপূর্ব সুন্দরী এক স্ত্রী ছিল শারীরিক ও আধ্যাত্মিকভাবে, কিন্তু সে ছিল বাল্যবিয়ের শিকারে। তার পিতা একটা অপরাধ করেছিল কিছু বোঝার বয়স না-হওয়ার আগেই তাকে পরিত্যাগ করে এবং তখনই সে তার কাঁধে চাপিয়ে দিয়েছিল এই দুর্নীতিগ্রস্ত বিয়ে। সে এখন দেখতে হালকা পাতলা এবং প্রায় সময়ই তাকে বিষণ্ণ মনে হয় এবং তার বন্দি ভালোবাসা কখনও তার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসার পথ পায় না। সে ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে এবং ব্যাকুলভাবে কামনা করছে মৃত্যু এই দাসত্বের জাল থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এবং সেই লোকটির কাছ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেওয়ার জন্য যে তার জীবন ব্যয় করছে সোনা সংগ্রহের কাজে। বাকি সময় সে অভিশাপ দিচ্ছে নিজেকে একজন বন্ধ্যা নারীকে বিয়ে করার জন্য যে কখনও তার বংশপরিচয় রক্ষা ও অর্থের উত্তরাধিকার বহন করার জন্য একটি শিশুর জন্ম দিতে পারবে না।
‘ঐ যে বাড়িটি দেখছেন ফলবাগানে ঘেরা, ওখানে একজন আদর্শ কবি বসবাস করেন, যিনি একজন অজ্ঞ নারীকে বিয়ে করেছিলেন। যে তার কাজকে উপহাস করত কারণ সে এসব বুঝতে পারত না এবং তার চরিত্রকেও ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করত কারণ, তার মহত্তম শ্রেণীর জীবন যাপনের সঙ্গে সে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারত না। সেই কবি তার হতাশা থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন একজন বিবাহিত নারীকে ভালোবেসে, যে তার মেধার প্রশংসা করত এবং তাকে প্রেরণা যোগাত তার হৃদয়ে প্রেমের আলো নিক্ষেপ করে এবং তার কাছে সবচেয়ে সুন্দর ও স্বর্গীয় বাণীগুলি প্রকাশ করে সে মূর্ত করে তুলত সৌন্দর্য ও মুগ্ধতা।’
নীরবতা সাফল্যের সঙ্গে কয়েক মিনিট লড়াই করল এবং ম্যাডাম হানি জানালার ধারে একটা সোফায় বসলেন, যেন এসব বসতিতে ঘুরে ঘুরে তার হৃদয় ক্লান্ত। তারপর তিনি আস্তে আস্তে বলতে লাগলেন, ‘এইসব বসতিতে আমি বসবাস করতে অস্বীকার করেছিলাম, এইসব সমাধিতে আমিও আধ্যাত্মিকভাবে সমাহিত হয়েছিলাম। সেইসব লোক যাদের কাছ থেকে আমি মুক্ত হয়েছিলাম এবং সে ছিল তাদের একজন যে শরীর দ্বারা আকৃষ্ট হয়েছিল এবং অস্বীকার করেছিল আত্মার আকর্ষণকে এবং সে প্রেম ও সৌন্দর্য সম্পর্কে কিছু জানে না। তারা এবং ঈশ্বরের মাঝখানে গভীর মনোনিবেশকারী হচ্ছে ঈশ্বরের করুণা, ঈশ্বরের আইন সম্পর্কিত অজ্ঞতার জন্য। আমি বিচার করতে পারি না কারণ আমি তাদের একজন, কিন্তু আমি আমার হৃদয় থেকে সহানুভূতি জানাই। আমি তাদের ঘৃণা করি না কিন্তু আমি ঘৃণা করি দুর্বলের কাছে তাদের আত্মসমর্পণ এবং মিথ্যাচার। আমি আপনাকে এসব বললাম সেইসব মানুষের বাস্তবতাকে আপনার সামনে তুলে ধরতে যাদের কাছ থেকে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমি পালিয়ে এসেছি। আমি চেষ্টা করেছিলাম সেইসব মানুষের জীবনের ঘটনাবলি ব্যাখ্যা করতে যারা আমার বিরুদ্ধে খারাপ কথা বলে, কারণ আমি তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছেদ করেছি এবং ফিরে পেয়েছি নিজেকে। আমি তাদের ভূ-গর্ভস্থ অন্ধকার কারাগার থেকে উদ্ভূত হয়েছিলাম এবং আমার দৃষ্টিকে পরিচালিত করেছিলাম সেই আলোর দিকে যেখানে আন্তরিকতা, সত্য এবং ন্যায়বিচার জয়লাভ করে। তারা আমাকে এখন নির্বাসন দিয়েছে তাদের সমাজ থেকে এবং আমি তাতে খুবই আনন্দিত, কারণ তাদের সমাজ থেকে নির্বাসিত হয় না সেই একজন ছাড়া, যার সৎ আত্মা স্বৈরতন্ত্র ও নীপিড়ণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। সে দাসত্বের জন্য নির্বাসন পছন্দ করে না। সে কখনও স্বাধীন নয় স্বাধীনতা, সত্য ও দায়িত্বের যে কোনো পরিমাপে।
‘গতকাল আমি ছিলাম একটা ট্রের মতো এবং বহন করেছিলাম যাবতীয় রুচিকর খাবার এবং রশীদ বেই নামান কখনও আমার কাছে আসত না, যদি তার এসব প্রয়োজন না পড়ত। যদিও আমাদের দুজনের আত্মাই আমাদের থেকে বহুদূরে অবস্থান করত দুজন বিনয়ী ও সম্মানিত ভৃত্যের মতো। আমি নিজের সঙ্গে বিরোধিতা মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করেছি লোকে যাকে দুর্ভাগ্য বলে, কিন্তু আমার আত্মা অস্বীকার করেছে সারা জীবন আমার সঙ্গে একটা বেদির সামনে হাঁটু গেড়ে প্রার্থনা করতে, অন্ধকার যুগ যে বেদি খাড়া করে তুলেছে আমাদের সামনে এবং তাকে বলা হয় আইন। আমি ততক্ষণ আমার শৃঙ্খল ভেঙে ফেলিনি যতক্ষণ প্রেমের আহ্বান আমার কানে এসে না পৌঁছায় এবং যতক্ষণ না দেখি আমার হৃদয় জাহাজযাত্রার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারপর আমি শৃঙ্খল ভেঙে ফেলেছিলাম এবং বেরিয়ে গিয়েছিলাম রশীদের বাড়ি ছেড়ে খাঁচা থেকে মুক্তি পাওয়া একটা পাখির মতো এবং পেছনে ফেলে গেলাম যাবতীয় মূল্যবান রত্ন, পোশাক এবং ভৃত্যদেরকে। আমি চলে এলাম আমার পছন্দের মানুষের সঙ্গে বসবাস করতে, কারণ আমি জানতাম যে আমি যা করেছিলাম তা সততা জেনেই করেছিলাম। স্বর্গ চায় না যে আমি কাঁদি এবং কষ্ট পাই। বহু সময় রাতে আমি ভোর হওয়ার জন্য প্রার্থনা করি এবং যখন ভোর আসে তখন আমি প্রার্থনা করি দিন শেষ হওয়ার। ঈশ্বর চাননা যে আমি দুর্গত জীবন যাপন করি, কারণ তিনি আমার হৃদয়ের গভীরতায় স্থাপন করেছেন সুখের জন্য আকাঙ্ক্ষা। আমার হৃদয়ের সুখের ওপর বিশ্রাম নেয় তাঁর মহিমা।
এই হচ্ছে আমার গল্প এবং পৃথিবী ও স্বর্গের বিরুদ্ধে এটাই আমার প্রতিবাদ। এটা হচ্ছে তা-ই যা আমি পাই এবং পুনরাবৃত্তি করি যখন আমার কথা শোনার ভয়ে মানুষ তার কান বন্ধ করে ফেলছে এবং তাদের আত্মাকে নেতৃত্ব দিচ্ছে বিদ্রোহী হয়ে উঠতে যা তাদের শিহরিত সমাজের ভিত্তিভূমি ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলবে।
এই হল সেই এবড়োথেবড়ো পথ যা আমি খোঁদাই করেছি এবং খুঁড়তে থাকব আমার সুখের পাহাড়শীর্ষে না পৌঁছানো পর্যন্ত। যদি মৃত্যু এখন আমাকে নিয়ে যেতে আসে আমি নিজেকে অধিক আগ্রহের সঙ্গে উৎসর্গ করব স্বর্গের সেই সর্বময় সিংহাসনের মুখোমুখি কোনোরকম লজ্জা বা ভয় ছাড়াই। বিচার দিনের জন্য আমি প্রস্তুত এবং আমার অন্তঃকরণ বরফের মতো সাদা। সবকিছুর ভেতরে আমি ঈশ্বরের ইচ্ছাকে মান্য করি, আমি আমার অন্তরাত্মার আহ্বান অনুসরণ ও তার দেওয়া দায়িত্ব সম্পন্ন করেছি, যখন স্বর্গের দেবদূতদের কণ্ঠস্বর আমার কানে এসে পৌঁছায়। এই হল আমার নাটক, বৈরুত্বের লোকেরা যাকে বলে ‘জীবনের ওষ্ঠের ওপর একটা অভিশাপ’ এবং সমাজের শরীরের একটা অসুস্থতা, কিন্তু একদিন ভালোবাসা সূর্যরশ্মির মতো উদ্ভূত হবে তাদের হৃদয় থেকে যা সামনে বহন করে আনবে ফুলগুলি দূষিত পৃথিবী থেকে। একদিন পথিকেরা আমার কবরের পাশে থামবে, অভিবাদন জানাবে মাটিকে যার ভাঁজের ভেতরে থাকবে আমার শরীর এবং বলবে, ‘এখানে ঘুমায় রোজ হানি যে নিজেকে মুক্ত করেছিল মনুষ্য প্রজাতির ভঙ্গুর আইনের দাসত্ব থেকে বিধিসম্মতভাবে ঈশ্বরের শুদ্ধ ভালোবাসার আইন মেনে নিয়ে। সে মুখ ঘোরাল সূর্যের দিকে, সুতরাং মাথার খুলি এবং কাঁটার ভেতরে সে তার শরীরের ছায়া দেখতে পেল না।’
দরজা খুলে একটা লোক প্রবেশ করল। জাদুকরি আভায় তার চোখদুটি জ্বলজ্বল করছিল এবং তার ঠোঁটে ফুটে উঠেছিল প্রাণবন্ত হাসি। ম্যাডাম হানি রোজ যুবকের হাত ধরল এবং আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল এবং আমার নামের সঙ্গে অনেকগুলি স্তুতিবাচক শব্দ ব্যবহার করল। আমি জানতাম সে-ই হল সেই ব্যক্তি যার জন্য সে পুরো পৃথিবীকে অন্ধকার করতে পারে এবং অমান্য করতে পারে যাবতীয় জাগতিক প্রথা ও আইন।
নিয়ন্ত্রিত নীরবতার ভেতের আমরা বসেছিলাম। প্রত্যেকেই আমরা মগ্ন ছিলাম গভীর চিন্তায়। এক মিনিট পর আমি তাকিয়ে দেখি দম্পতি পাশাপাশি বসে আছে। আমি কিছু একটা দেখলাম যা আগে দেখি নাই এবং তৎক্ষণাৎ উপলব্ধি করলাম ম্যাডাম হানি রোজ-এর গল্পের মর্মার্থ। আমি উপলব্ধি করলাম সমাজের বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদের গোপনীয়তা, যা সেইসব ঠোঁটগুলিকে কষ্ট দিয়েছে, বিদ্রোহ করেছে প্রথা ও আইনের সীমাবদ্ধতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার আগেই। আমার মুখোমুখি একটা স্বর্গীয় আত্মাকে দেখেছিলাম যে সৃজন করেছিল দুটি চমৎকার ও ঐক্যবদ্ধ মানুষ, ধোঁয়াশার ভেতরে প্রেমের ঈশ্বর দাঁড়িয়েছিলেন তাদের ওপর প্রসারিত করে তার পাখাগুলি তাদেরকে রক্ষা করতে মন্দের কটুবাক্য খেকে। আমি দেখলাম একটা পুরোপুরি উপলব্ধি প্রবাহিত হচ্ছে হাসতে থাকা দুটি মুখ থেকে, যা আন্তরিকতায় উদ্ভাসিত এবং সদ্গুণ দ্বারা পরিবেষ্টিত। জীবনে এই প্রথমবারের মতো দেখলাম একটা নারী ও পুরুষের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে সুখের প্রেতাত্মা, ধর্ম দ্বারা অভিশপ্ত এবং আইন বিরোধী। আমি উঠে দাঁড়ালাম এবং তাদেরকে বিদায় জানিয়ে পরিত্যাগ করলাম তাদের পর্ণকুটির যা ভালোবাসা ও উপলব্ধির একটা বেদি হিসেবে খাড়া হয়ে উঠেছিল। আমি হাঁটতে থাকলাম। মনে পড়ল ম্যাডাম হানি আমাকে ঐ বাড়িগুলির কথা বলেছিলেন। সেই বসতির শেষপ্রান্তে পৌঁছে আমার মনে পড়ল রশীদ বেই নামান-এর কথা। আমি গভীরভাবে তার দুর্দশা সম্পর্কে চিন্তা করলাম এবং নিজেকে বললাম, ‘সে নিপীড়িত। স্বর্গ কি তার কথা কখনও শুনবে যদি ম্যাডাম হানি তার সম্পর্কে অভিযোগ করে? ঐ নারী কি ভুল করেছিল যখন সে তাকে পরিত্যাগ করে যায় এবং অনুসরণ করে তার হৃদয়ের স্বাধীনতাকে। অথবা সে কি অপরাধ করেছিল বিয়ের মাধ্যমে তার শরীরকে বশে এনে, ভালোবাসা দিয়ে হৃদয়কে বশীভূত করার আগেই। দুজনের ভেতরে কে পীড়িত হয়েছিল এবং পীড়নকারী ছিল কে? কে অপরাধী এবং কে নিষ্পাপ?’
কয়েক মুহূর্ত গভীর চিন্তার পর আমি আবার নিজের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলাম, ‘অনেক সময়ই প্রতারণায় প্রলুব্ধ হয়ে নারীরা স্বামীকে পরিত্যাগ করে এবং অনুসরণ করে সম্পদকে। কারণ ধনী মানুষ ও সুন্দর পোশাকের জন্য তার ভালোবাসা তাকে অন্ধ ও লজ্জিত করে তোলে। ম্যাডাম হানি কি ছলনা করেছিল যখন সে তার ধনী স্বামীর গৃহ পরিত্যাগ করে গরিবের জরাজীর্ণ কুটিরে যায়? অনেক সময় অজ্ঞতা নারীর সম্মানকে হত্যা করে এবং ফিরিয়ে আনে তার তীব্র অনুরাগ, সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং পরিত্যাগ করে স্বামীকে আকাঙ্ক্ষা দ্বারা প্ররোচিত হয়ে এবং অনুসরণ করে সেই মানুষকে যার কাছে নিজেকে ছোট করেও সে সুখী হয়। ম্যাডাম হানি কি তার শারীরিক আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলেন যখন জনসমক্ষে তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং তার অত্যন্ত পছন্দের মানুষের সঙ্গে মিলিত হন? তিনি গোপনে তার স্বামীর বাড়িতে থেকেও নিজেকে গোপনে তৃপ্ত করতে পারতেন, কারণ বহু পুরুষই রাজি ছিল তার সৌন্দর্যের দাস হতে ও তার ভালোবাসার জন্য জীবন উত্সর্গ করতে। ম্যাডাম হানি ছিলেন একজন দুর্গত নারী। যিনি সন্ধান করতেন কেবলই সুখ, যখনই তা তার মুখোমুখি হত তখনই তাকে আলিঙ্গন করত। এই হল সেই ভয়াবহ সত্য, যা সমাজ অশ্রদ্ধা করে।’ তারপর আমি আবার ফিসফিস করে বললাম, ‘এটা একটা নারীর জন্য অনুমোদনযোগ্য স্বামীর দুরবস্থার বিনিময়ে সুখ কিনে নেওয়া।’ আমার আত্মা বলল, ‘এটা কি একজন মানুষের জন্য বিধিসম্মত তার স্ত্রীর প্রেমকে দাসত্বে পরিণত করা, যখন সে উপলব্ধি করে এটা সে নিজের অধিকারে আনতে পারবে না?’
আমি হাঁটতে থাকলাম এবং ম্যাডাম হানির কণ্ঠস্বর তখনও আমার কানে বাজছিল যখন আমি শহরের শেষপ্রান্তে পৌঁছালাম। সূর্য অদৃশ্য হয়েছিল এবং নীরবতা শাসন করছিল শস্যক্ষেত ও তৃণভূমি, যখন পাখিরা গাইছিল তাদের সন্ধ্যার প্রার্থনাসংগীত। আমি সেখানে দাঁড়িয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে লাগলাম এবং তারপর আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম এবং বললাম, ‘স্বাধীনতার সিংহাসনের সম্মুখে বৃক্ষরা রঙ্গপ্রিয় মৃদুমন্দ বাতাসের সাথে উল্লসিত হয় এবং উপভোগ করে সূর্যের রশ্মি এবং চাঁদের আলো। স্বাধীনতার শ্রবণেন্দ্রিয়ের ভেতর দিয়ে এই পাখিরা ফিসফিস করে এবং স্বাধীনতার চারপাশে পাখা ঝাপটায় নদীর স্রোতের মতো শব্দ করে। স্বাধীনতার আকাশ জুড়ে এইসব চোখের সামনে তারা হাসে যখন ভোর হয়।’
পৃথিবীর ওপর সবকিছুই বাঁচে প্রকৃতির আইন অনুসারে এবং সেই আইন থেকে উদ্ভূত হয় স্বাধীনতার গৌরব ও উল্লাস, কিন্তু মানুষ এই সৌভাগ্যকে অস্বীকার করে কারণ সে স্থাপিত হয়েছে ঈশ্বর প্রদত্ত একটি সীমাবদ্ধ আত্মায়। কঠিন নিয়মের ভেতরে সে তার নিজের জন্য তৈরি হয়েছিল। মানুষ একটা সংকীর্ণ ও বেদনাদায়ক কারাগার তৈরি করে, যার ভেতরে সে বিচ্ছিন্ন করে প্রেম ও আকাঙ্ক্ষাকে। সে খনন করে একটা গভীর কবর যার ভেতরে সে সমাহিত করে নিজের আত্মা এবং আত্মার উদ্দেশ্য। যদি নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তি তার আত্মার নির্দেশে সমাজ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার কথা ঘোষণা করে এবং অমান্য করে আইন, তাহলে তার সঙ্গীরা বলবে সে নির্বাসিত হওয়ার গুণসম্পন্ন বিদ্রোহী অথবা পরিকল্পনা অনুযায়ী সবকিছু করার গুণসম্পন্ন একটি অখ্যাত প্ৰাণী। মানুষ কি আত্মবন্দিত্বের দাস হয়ে রয়ে যাবে পৃথিবীর সমাপ্তি পর্যন্ত, অথবা সে মুক্ত হবে অতিক্রান্ত সময় দ্বারা এবং একটা আত্মার জন্য একটা আত্মার ভেতরে বসবাস করতে? মানুষ কি পীড়াপীড়ি করবে নিচের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকাতে এবং ফিরে যেতে পৃথিবীর পেছনে? অথবা সে কি তার চোখ ঘোরাবে সূর্যের দিকে—সুতরাং মাথার খুলি ও কাঁটার ভেতরে সে তার শারীরিক ছায়া দেখতে পাবে না।
.
সমাধির কান্না
প্ৰথম পৰ্ব
আমীর হেঁটে আদালত কক্ষের ভেতরে প্রবেশ করে মাঝখানের চেয়ারে বসে পড়লেন এবং তার ডানে ও বামে বসেছিল দেশের বিচক্ষণ ব্যক্তিরা। তরবারি এবং বল্লম নিয়ে সজ্জিত পাহারাদার দাঁড়িয়েছিল। বিচার দেখতে আসা লোকেরা আনুষ্ঠানিকভাবে আমীরকে সম্মান জানাল, যার চোখ থেকে প্রবাহিত হচ্ছিল একটা শক্তি যা উপস্থিত লোকদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। বিচারের সময় উপস্থিত হলে আমীর তার হাত তুলে চিৎকার করে বললেন, ‘একজনের পর একজন অপরাধীকে সামনে নিয়ে এসো এবং আমাকে বলো কী অপরাধ তারা করেছে।’ কারাগারের দরজা খুলে গেল হিংস্র পশুর হাই তোলার মতো। ভূগর্ভস্থ অন্ধকার কারাকক্ষের বাঁকগুলিতে যে কেউ শুনতে পাবে হাতকড়া ও বেড়ির শব্দের প্রতিধ্বনি ও বন্দিদের বিলাপ হাহাকারের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। দর্শকরা আগ্রহী হয়ে ছিল মৃত্যুর শিকার পর্যবেক্ষণ করতে নরকের গভীরতা থেকে যা উদ্ভূত হচ্ছে। কয়েক মুহূর্ত পর দু’জন সৈন্য বেরিয়ে এল, একজন যুবককে বাহু দিয়ে জড়িয়ে ধরে। তার কঠিন মুখে ফুটে উঠেছিল আত্মার সততা এবং হৃদয়ের সামর্থ্য। সে আদালত কক্ষের মাঝখানে থামল এবং সৈন্যরা এক কোণায় সরে দাঁড়াল। আমীর স্থিরদৃষ্টিতে সরাসরি তার দিকে তাকালেন এবং বললেন, ‘এই লোক কী অপরাধ করেছে। যে এমন গর্বের সঙ্গে ও বিজয়দীপ্তভাবে আমার সামনের দাঁড়িয়ে আছে?’ আদালতের এক কর্মচারী বলল, ‘সে একজন খুনী। গতকাল সে আমাদের একজন কর্মকর্তাকে খুন করেছে, আশপাশের গ্রামগুলিতে যার গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল। যখন তাকে গ্রেফতার করা হয় তখনও রক্তাক্ত অস্ত্র সে হাতের মুঠোয় ধরে রেখেছিল।’ আমীর ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, ‘ফিরিয়ে নিয়ে যাও তাকে অন্ধকার কারাগারে এবং তাকে ভারী শিকল দিয়ে বাঁধো। তারপর তার নিজের তরবারি দিয়ে মাথা কেটে জঙ্গলে ফেলে দাও যেন পশুরা তার মাংস খেতে পারে এবং বাতাস বহন করে নিতে পারে তার শরীরের ঘ্রাণ তার পরিবার ও বন্ধুদের কাছে।’ যুবক কারাগারে ফিরে যাবার সময় উপস্থিত লোকেরা দুঃখভারাক্রান্ত চোখে তার দিকে তাকাল, কারণ জীবনের বসন্তকালে সে ছিল একজন যুবক।
সেনাবাহিনীর লোকটি কারাগার থেকে ফিরে এল একজন যুবতী নারীকে নিয়ে। তাকে বিষণ্ন দেখাচ্ছিল এবং তার মুখের ওপর আবির্ভূত হয়েছিল নিপীড়ন ও হতাশার চিহ্ন। তার চোখদুটি অশ্রুভেজা এবং তার মাথা বাঁকা হয়েছিল মর্মবেদনার ভারী বোঝায়। তাকে ভালো করে দেখার পর আমীর হঠাৎ করে চিৎকার করে উঠলেন, ‘আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে যে দুর্বল নারী, মৃতদেহের পাশে অপেক্ষা করতে থাকা ছায়ার মতো, তার কী অপরাধ? কী করেছে সে?’ একজন সৈন্য জবাব দিল, ‘সে একজন ব্যভিচারিণী। গত রাতে তার স্বামী আবিষ্কার করে তাকে অন্য এক পুরুষের বাহুর ওপর। তার প্রেমিক পালিয়ে যাবার পর সে তাকে এনে আইনের কাছে সমর্পণ করেছে।’ আমীর তার ভাবলেশহীন মুখের দিকে তাকালেন এবং নির্দেশ দিলেন, ‘তাকে অন্ধকার ঘরে নিয়ে যাও এবং তাকে একটা কাঁটার বিছানার ওপর শোয়াও যেন সে তার সেই স্মৃতি মনে করতে পারে যে অপরাধ করে সে তার ভালোবাসাকে কলুষিত করেছে; পান করাও তাকে সিরকা মিশ্রিত তিক্ত শরবত যেন সে সেইসব মধুর চুম্বনের স্বাদ স্মরণ করতে পারে। ভোর বেলায় তার নগ্ন শরীরকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাও শহরের বাইরে এবং পাথর নিক্ষেপ করো মারা না যাওয়া পর্যন্ত। তারপর নেকড়েদের উপভোগ করতে দাও তার শরীরের কোমল মাংস এবং কীটপতঙ্গদেরকে খেতে দাও তার হাড়গুলো।’ অন্ধকার কারাগারে ফিরে যাবার সময় লোকজন তার দিকে বিস্ময় ও সহানুভূতির দৃষ্টিতে তাকাল। আমীরের বিচারে তারা বিস্মিত হল এবং নারীর নিয়তির জন্য দুঃখ করতে লাগল।
সৈন্যরা ফিরে এল। সঙ্গে নিয়ে এল একজন দুঃখভারাক্রান্ত্র মানুষকে, যার হাঁটুদুটি কাঁপছিল এবং তার পুরো শরীর শিহরিত হচ্ছিল উত্তরের বাতাসের মুখোমুখি ছোট্ট চারাগাছের মতো। তাকে দেখাচ্ছিল শক্তিহীন, অসুস্থ ও আতঙ্কিত এবং সে ছিল দুঃস্থ এবং গরিব। আমীর তার দিকে বিরক্তির সঙ্গে তাকালেন এবং বললেন, ‘এই সমৃদ্ধ লোকটি, যে জীবন্তদের ভেতরে মৃতের মতো, কী করেছে সে?’ একজন প্রহরী বলল, ‘সে একজন চোর। সে দরজা ভেঙে আশ্রমে প্রবেশ করে ঐশ্বরিক পুষ্পাধার চুরি করেছে। গ্রেফতার হওয়ার সময় সেগুলি যাজকেরা তার পোশাকের তলায় দেখতে পায়।’ ডানাভাঙা একটি পাখির দিকে একটা ক্ষুধার্ত ঈগল যেভাবে তাকায় ঠিক সেভাবেই আমীর তার দিকে তাকালেন এবং বললেন, ‘তাকে কারাগারে নিয়ে যাও এবং শিকল দিয়ে বেঁধে রাখো এবং ভোরবেলায় তাকে টেনে হিঁচড়ে একটা উঁচুগাছের কাছে নিয়ে যাবে এবং ঝুলিয়ে দেবে মাটি ও স্বর্গের মাঝখানে যেন হাতদুটি লোপ পায় এবং তার শরীরের অঙ্গ- প্রত্যঙ্গ পরিণত হয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণিকায় এবং তা বাতাসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়।’ চোরটি কারাগারে ফিরে যাওয়ার সময় লোকজন ফিসফিস করে বলল, ‘এ রকম একটা দুর্বল লোক আশ্রমের ঐশ্বরিক পুষ্পাধারগুলি চুরি করেছে? কী সাহসী লোকটা, তাই না?’
এ সময় আদালত মুলতবি ঘোষণা করা হল এবং আমীর তার বিজ্ঞ লোকদের নিয়ে বেরিয়ে গেলেন সেনাবাহিনীর প্রহরায়। দর্শকরা চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল এবং জায়গাটা একেবারে শূন্য হয়ে গেল শুধুমাত্র বন্দিদের বিলাপ ও হাহাকার ছাড়া। এই সবকিছুই ঘটল যখন আমি এখানে দাঁড়িয়েছিলাম অতিক্রম করতে থাকা প্রেতাত্মাদের মুখোমুখি একটা আয়নার মতো। আমি গভীরভাবে চিন্তা করছিলাম মানুষের জন্য মানুষের তৈরি আইন সম্পর্কে, ধ্যান করছিলাম যাকে মানুষ ‘ন্যায়বিচার’ বলে এবং নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলাম জীবনের গোপনীয়তা সম্পর্কে গভীর চিন্তায়। আমি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অর্থ উপলব্ধি করতে চেষ্টা করেছিলাম। আমি হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিলাম নিজেকে দিগন্তের মতো হারিয়ে যেতে দেখে, যা মেঘের ওপরে অদৃশ্য হয়ে যায়। আমি ঐ জায়গা পরিত্যাগ করার সময় নিজেকে বললাম, ‘শাকসবজি পৃথিবীর বহুপ্রাণীর আহার যোগায়, ভেড়া সবজি খায়, নেকড়ে শিকার করে ভেড়াকে, ষাঁড় হত্যা করে নেকড়েকে, কিন্তু ষাঁড়কে লোভীর মতো খেয়ে ফেলে সিংহ, যদিও মৃত্যু দাবি করে সিংহকে। কোনো ক্ষমতা কি আছে যা অতিক্রম করবে মৃত্যুকে এবং এইসব হিংস্রতা পরিণত করবে চিরন্তন ন্যায়বিচারে? সেখানে একটা শক্তি আছে যা সমস্ত কুৎসিত জিনিসকে রূপান্তরিত করতে পারে সৌন্দর্যে? সেখানে কি কোনো পরাক্রমশালী আছে যে জীবনের সমস্ত উপাদানের হাত সহজেই আঁকড়ে ধরতে পারে এবং আলিঙ্গন করতে পারে উল্লাসের সঙ্গে, যেমন সমুদ্র উল্লাসের সঙ্গে গ্রাস করে ছোট ছোট নদীগুলিকে তার বুকের গভীরতায়? সেখানে কি কোন ক্ষমতা আছে যা গ্রেফতার করতে পারে যে খুন হয়েছে তাকে এবং খুনিকে, ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণীকে, ডাকাত এবং যার সমস্ত কেড়ে নেওয়া হয়েছে তাকে এবং তাদেরকে সেই আদালতে নিয়ে আসা হোক যা অধিক মর্যাদাসম্পন্ন এবং অধিক ক্ষমতাশালী আমীরের আদালতের চেয়ে।
দ্বিতীয় পৰ্ব
পরদিন আমি শস্যক্ষেতে যাবার জন্য শহর পরিত্যাগ করলাম যেখানে নীরবতা তার আত্মাকে উন্মুক্ত করে, যা হচ্ছে আত্মার আকাঙ্ক্ষা এবং যেখানে পরিশুদ্ধ আকাশ হতাশার জীবাণুকে হত্যা করে, শহরে যার পরিচর্যা করা হয় সংকীর্ণ রাস্তা এবং অন্ধকারময় জায়গাগুলিতে। আমি যখন উপত্যকায় পৌঁছালাম দেখলাম এক ঝাঁক কাক ও শকুন পাখা না নাড়িয়ে আকাশে ভেসে আছে এবং অবতরণ করছে। আকাশ পরিপূর্ণ করে তুলছে কাকের চিৎকার, শকুনের শিস এবং পাখার খশখশ শব্দে। সামনে এগুতে গিয়ে দেখলাম একটা মৃতদেহ, একটা উঁচু গাছে ঝুলছে। একটা মৃত নগ্ন নারীদেহ স্তূপীকৃত পাথরের ওপর ধোঁয়াশায় মিশে আছে এবং একটা যুবকের মৃতদেহ যার মাথা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন এবং তার রক্তে ভিজে যাচ্ছে মাটি। এরকম ভয়াবহ দৃশ্য দেখে আমার চোখ বেদনার কালো অবগুণ্ঠনে অন্ধ হয়ে গেল। আমি চারদিকে তাকালাম এবং কিছুই দেখতে পেলাম না মৃত্যুর অপচ্ছায়া ছাড়া, কিছুই শুনতে পেলাম না অস্তিত্বহীনতার হাহাকার ছাড়া, কাকের কা কা চিৎকারের সঙ্গে মিশে আকাশে স্থির হয়ে ভেসে আছে মনুষ্য আইনের কাছে যে অপরাধী ঠিক তার ওপর
তিনজন মানুষ যারা গতকাল ছিল জীবনের কোলে, আজ তারা অপরাধী হিসেবে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে, কারণ তারা মনুষ্যসমাজের আইন ভঙ্গ করেছে। যখন একজন মানুষ অন্য মানুষকে হত্যা করে, লোকে বলে সে খুনি, কিন্তু যখন আমীর তাকে হত্যা করে তখন আমীর ঠিক কাজটি করে। যখন একজন মানুষ আশ্রমের সম্পদ হরণ করে তখন তারা বলে লোকটা চোর, কিন্তু যখন আমীর তার সবকিছু হরণ করে তখন আমীর সম্মানযোগ্য। যখন একজন নারী তার স্বামীকে প্রতারিত করে তখন লোকে বলে সে ব্যভিচারিণী, কিন্তু আমীর যখন রাস্তায় নগ্ন হয়ে তাকে হাঁটতে বাধ্য করে এবং তারপর পাথর ছুঁড়ে হত্যা করা হয় তখন আমীর সৎ। রক্তপাত নিষিদ্ধ, কিন্তু আমীরের জন্য কে এটাকে আইনানুগ করেছে? অন্যের অর্থ চুরি করা অপরাধ, কিন্তু কাউকে হত্যা করা মহৎ কর্মকাণ্ড। স্বামীকে প্রতারণা করা হতে পারে একটা কুৎসিত কর্মকাণ্ড কিন্তু জীবন্ত মানুষের আত্মাকে পাথর মেরে হত্যা করা একটা চমৎকার দৃশ্য। আমরা কি একজন খারাপ মানুষের সঙ্গে খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে সাক্ষাৎ করব এবং বলব এটাই আইন? আমরা কি দুর্নীতির সঙ্গে যুদ্ধ করব অধিক দুর্নীতি দিয়ে এবং বলব এটাই আইন? আমরা কি অপরাধকে জয় করে নেব আরও বেশি অপরাধ দিয়ে এবং বলব এটাই ন্যায়বিচার? আমীর কি তার অতীত জীবনে কোনো মানুষকে হত্যা করেছিল? সে কি অপহরণ করে নাই তার অর্থ ও সম্পদের দুর্বল বিষয়গুলি? সে কি কখনও ব্যাভিচার করেনি? সে কি ভুল-ভ্রান্তির ঊর্ধ্বে যখন সে খুনিকে হত্যা করে, চোরদেরকে ফাঁসি দেয় এবং ব্যভিচারিণীকে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করে? চোরকে যারা গাছে ঝুলিয়েছিল তারা কারা? তারা কি দেবদূত, স্বর্গ থেকে অবতরণ করেছে অথবা মানুষ, যারা লুট করছে এবং অন্যায়ভাবে দখল করছে সবকিছু? খুনির মাথা কেটে ফেলে যারা, তারা কারা? তারা কি ঈশ্বরের আনুগত্য লাভকারী নবী, অথবা সৈন্য, যেখানে সেখানে রক্তপাত করছে? কারা ব্যভিচারিণীদেরকে পাথর নিক্ষেপ করে? তারা কি সত্যনিষ্ঠ সন্ন্যাসী যারা তাদের আশ্রম থেকে এসেছে অথবা তারা মানুষ যারা ভালোবাসে উল্লাসের সঙ্গে আইনের অজ্ঞতার নিরাপত্তা? আইন কী? কে দেখেছিল তাকে স্বর্গের গভীরতা থেকে সূর্যের রশ্মির সঙ্গে বেরিয়ে আসতে? কোন্ মানুষ দেখেছিল ঈশ্বরের হৃদয় এবং ইচ্ছা অথবা উদ্দেশ্যকে? কোন্ শতাব্দীতে দেবদূতেরা মানুষের ভেতরে হেঁটেছিলেন এবং প্রচার করেছিলেন, ‘জীবন উপভোগ করা থেকে দুর্বলদের নিষিদ্ধ কর, হত্যা কর অপরাধীদেরকে তরবারির ধারালো প্রান্ত দিয়ে এবং লোহার পা দিয়ে অনুসরণ কর পাপীর পদচিহ্ন।’
এভাবে আমার হৃদয় কষ্ট পাচ্ছিল, আমি কাছাকাছি ঘাসে পায়ের খসখস আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমি মনোযোগ দিয়ে তা শুনলাম এবং দেখলাম একজন যুবতী নারী গাছের পেছন থেকে বেরিয়ে আসছে। সে সতর্কভাবে চারদিকে তাকাল তিনটি মৃতদেহের কাছাকাছি আসার আগে। এক পলক সে যুবকের মাথাটা দেখল, যা কেটে ফেলা হয়েছিল। সে আতঙ্কে কাঁদতে লাগল, হাঁটু গেড়ে বসল এবং আলিঙ্গন করল তার শিহরিত বাহু দিয়ে। তারপর সে অশ্রু ঝরাতে শুরু করল এবং কোমল আঙুল দিয়ে স্পর্শ করল তার কোঁকড়ানো চুল এবং এমন স্বরে কাঁদতে থাকল যা বেরিয়ে আসছিল তার চূর্ণবিচূর্ণ হৃদয় থেকে। সে এই দৃশ্য বেশিক্ষণ দেখতে পারল না। সে শরীরটাকে একটা খাদের পাশে টেনে নিয়ে গেল, মাথাটা কোমলভাবে স্থাপন করল কাঁধের ওপর, মাটি দিয়ে ঢেকে দিল পুরো শরীর এবং কবরের ওপর রোপণ করল সেই তরবারি যা দিয়ে তার মাথাটা কেটে ফেলা হয়েছিল।
যুবতীটি পালাবার উদ্যোগ করেছিল; এমন সময় আমি তার দিকে হাঁটতে লাগলাম। সে আমাকে দেখে কাঁপতে লাগল। তার চোখ দিয়ে ক্রমাগত পানি ঝরছে। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘ইচ্ছা করলে আপনি আমাকে আমীরের কাছে নিয়ে যেতে পারেন। আমার মরে যাওয়াই ভালো এবং অনুসরণ করুন সেই ব্যক্তিকে যে আমার জীবন রক্ষা করেছে অবমাননার হাত থেকে, হিংস্র বন্যপ্রাণীর খাবার হওয়ার জন্য তাকে যেভাবে ফেলে রাখা হয়েছিল অন্তত তার চেয়ে।’ তারপর আমি বললাম, ‘আমাকে ভয় পেয়োনা। আমি ঐ যুবকের জন্য শোক প্রকাশ করেছি তোমার আগেই। কিন্তু, আমাকে বলো কীভাবে সে তোমাকে রক্ষা করেছিল অপমানের হাত থেকে?’ সে শ্বাসরুদ্ধকর কণ্ঠে বলল, ‘আমীরের এক কর্মকর্তা আমাদের খামারে এসেছিল খাজনা আদায় করতে। তারপর সে আমাকে দেখল এবং এমনভাবে তাকাতে লাগল যেভাবে নেকড়ে মেষশাবকের দিকে তাকায়। সে আমার পিতার ওপর অনেক খাজনা ধার্য করল, যা একজন ধনীর পক্ষেও প্রদান করা সম্ভব নয়। সে মুক্তিপণ হিসেবে সোনা প্রদান করে আমাকে ছাড়িয়ে আনার জন্য গ্রেফতার করে আমীরের কাছে নিয়ে যেতে চায়। আমার পিতার পক্ষে সোনা দিয়ে আমাকে ছাড়িয়ে আনা সম্ভব ছিল না। আমি প্রার্থনা করলাম যেন সে আমার কোনো ক্ষতি না করে, কিন্তু সে আমার কথায় কর্ণপাত করল না, কারণ তার হৃদয়ে দয়া বলতে কিছুই ছিল না। তখন আমি সাহায্যের জন্য চিৎকার করে কাঁদলাম এবং এই যুবক, বর্তমানে সে মৃত, আমাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে এল এবং জীবন্ত মৃত্যু থেকে আমাকে রক্ষা করল। ঐ কর্মকর্তা তাকে হত্যার উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু যুবকটি আমাদের বাড়ির দেয়ালে ঝুলতে থাকা একটা পুরোনো অস্ত্র দিয়ে লোকটিকে হত্যা করে। কিন্তু অপরাধীদের মতো সে পালিয়ে যায় না, মৃত কর্মকর্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে যতক্ষণ আইন এসে তাকে নিজের দখলে না নেয়।’ তার উচ্চারিত এসব কথা যে-কোনো মানুষের হৃদয়ে বেদনার উদ্রেক করবে। সে তার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে চলে গেল।
কয়েক মূহূর্তের ভেতর আমি এক যুবককে আসতে দেখলাম যে তার মুখ লুকাল আলখাল্লার ভেতর। ব্যভিচারিণীর মৃতদেহের কাছাকাছি এসেই সে থমকে দাঁড়াল এবং নিজের পোশাক খুলে তার নগ্ন শরীর ঢেকে দিল, তারপর সে তার আলখাল্লার ভেতর থেকে বের করল একটা ছুরি এবং একটা গর্ত খুঁড়ে তার ভেতরে সে শোয়ালো সেই নারীকে অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে এবং তারপর তাকে মাটি দিয়ে ঢেকে ঢেলে দিল তার চোখের পানি। তারপর কাজ শেষ করে সে একগুচ্ছ ফুল তুলল এবং তা শ্রদ্ধার সঙ্গে ছড়িয়ে দিল কবরের ওপর। সে যাওয়ার উদ্যোগ নিতেই আমি তাকে থামালাম এবং বললাম, ‘তুমি কি ঐ ব্যভিচারিণীর আত্মীয়-স্বজন? কী তোমাকে প্ররোচিত করেছে হিংস্র প্রাণীদের হাত থেকে তার নগ্ন শরীরকে রক্ষা করতে এবং নিজের জীবনকে বিপন্ন করে এখানে আসতে?’ সে আমার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকাল, তার বেদনার্ত চোখ তার দুর্গতিকে প্রকাশ করছিল এবং সে বলল, ‘আমি হলাম একজন দুর্ভাগা মানুষ যার ভালোবাসাকে পাথর মেরে হত্যা করা হয়েছে। আমি তাকে ভালোবাসতাম এবং সেও আমাকে ভালোবাসত। আমরা দুজন একসঙ্গে বেড়ে উঠেছি। ভালোবাসা ছিল আমাদের হৃদয়ের অধিপতি। ভালোবাসা আমাদের দুজনকে একত্রিত করেছিল, আলিঙ্গন করেছিল আমাদের আত্মাকে। একদিন আমি শহরে অনুপস্থিত ছিলাম এবং ফিরে এসে দেখলাম তার পিতা তাকে এমন একজন লোককে বিয়ে করার জন্য বাধ্য করছে যাকে সে ভালোবাসে না। আমার জীবন অন্তহীন সংগ্রামে পরিণত হল এবং আমার দিনগুলি পরিণত হল একটা দীর্ঘ রাত্রিতে। আমি আমার হৃদয়কে শান্ত করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু আমার হৃদয়ে স্থিরতা ফিরে এল না। অবশেষে আমি গোপনে তার সাথে দেখা করতে গেলাম এবং আমার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল একনজর তার সুন্দর চোখগুলিকে দেখা এবং তার আন্তরিক কণ্ঠস্বর শোনা। আমি তার বাড়িতে গিয়ে দেখলাম সে এক একা তার দুর্ভাগ্যের জন্য বিলাপ করছে। আমি তার পাশে বসলাম, নীরবতা ছিল আমাদের গুরুত্বপূর্ণ কথপোকথন এবং সদ্গুন ছিল আমাদের সঙ্গী। নীরবে আমাদের উপলব্ধির সময়গুলি পেরিয়ে যেতে থাকে। এমন সময় তার স্বামী প্রবেশ করল। আমি তার প্রতি মনোযোগী হওয়ার চেষ্টা করলাম, কিন্তু সে আমাকে উপেক্ষা করল এবং স্ত্রীর দুই হাত ধরে টেনে হিঁচড়ে রাস্তায় নামিয়ে আনল এবং চেঁচিয়ে বলল, ‘এসো, এসো তোমরা এবং দ্যাখো এক ব্যভিচারিণী এবং তার প্রেমিককে।’ সমস্ত প্রতিবেশী এসে জড়ো হল এবং পরবর্তীতে এল আইন এবং তাকে আমীরের কাছে নিয়ে গেল, কিন্তু সৈন্যরা আমাকে স্পর্শ করল না। অজ্ঞ আইন এবং ভারী প্রথাগুলি একজন নারীকে শাস্তি দিল তার পিতার ভুলের জন্য’।
এসব বলে লোকটি শহরের দিকে ঘুরে হাঁটতে শুরু করল আর আমি ভাবতে লাগলাম চোরের মৃতদেহটা উঁচুগাছের শাখায় ঝুলছে এবং প্রতিবার বাতাসে শাখাটা দুলে ওঠার সময় অল্প অল্প দুলছে। আমি অপেক্ষা করতে থাকলাম কেউ একজন আসবে এবং মৃতদেহটা মাটিতে নামিয়ে আনবে এবং মাটির ওপর তাকে শুইয়ে দেবে। প্রেমের জন্য শহীদ এবং সম্মানের সমর্থকের পাশাপাশি প্রায় এক ঘণ্টা পর কাঁদতে কাঁদতে এক হতভাগ্য নারী এসে উপস্থিত হল। ঝুলন্ত মানুষটার মুখোমুখি সে দাঁড়াল এবং শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রার্থনা করল। তারপর বহু সংগ্রাম করে সে গাছে উঠল এবং দাঁত দিয়ে কামড়ে দড়ির বাঁধন আলগা করল এবং মৃতদেহটা মাটিতে পড়ল ভারী ওজনের কাপড়ের মতো। তারপর সে নেমে এল, একটা কবর খুঁড়ল এবং চোরকে সমাহিত করল অন্য দুটি অপরাধীর পাশে। মাটি দিয়ে তাকে ঢেকে দেবার পর সে দুই টুকরো কাঠ জোগাড় করে একটা ক্রুশ তৈরি করল। তারপর তা স্থাপন করল কবরের মাথার দিকে। যখন সে শহরের দিকে ঘুরে যাবার উদ্যোগ নিল তখন আমি তাকে থামালাম এবং জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী তোমাকে প্ররোচিত করেছে এই চোরকে সমাহিত করতে?’ সে খুবই বেদনার সঙ্গে আমার দিকে তাকাল এবং বলল, ‘সে আমার বিশ্বস্ত স্বামী এবং দয়ালু সঙ্গী। সে আমার সন্তানদের পিতা—পাঁচটি ছোট ছোট শিশু; তার মধ্যে একজন ক্ষুধার কারণে মরতে বসেছে। সবচেয়ে বড়টির বয়স আট বছর এবং সবচেয়ে ছোটটি এখনও কোলের শিশু। আমার স্বামী চোর ছিল না। সে একজন কৃষক, আশ্রম-সংলগ্ন জমিতে কৃষিকাজ করত। আমাদের বেঁচে থাকার জন্য যাজক ও সন্ন্যাসীরা সামান্য যা খাবার দেয় তাই নিয়ে সে প্রতি সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে আসে। কিশোর বয়স থেকে সে তাদের শস্যক্ষেতে কাজ করছে। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যখন সে দুর্বল হয়ে পড়ে তখন তাকে তারা কাজ থেকে বাদ দিয়ে দেয়। পরামর্শ দেয় বাড়ি ফিরে যেতে এবং বয়স হলে সন্তানদেরকে পাঠাতে তার জায়গায় বহাল হওয়ার জন্য। সে যিশু খ্রিস্ট ও স্বর্গের দেবদূতদের নামে শপথ করে প্রার্থনা করেছে, কিন্তু তারা তার অনুরোধে কোনো কর্ণপাত করেনি। তারা দয়া দেখায়নি তার ও তার ক্ষুধার্ত সন্তানদের প্রতি, যারা অসহায়ভাবে খাবারের জন্য কাঁদছে। শক্তিশালী ও স্বাস্থ্যবান মানুষ ছাড়া ধনীরা কাউকে চাকরি দেয় না। তারপর রাস্তার ধুলোর ওপরে বসে দুহাত বাড়িয়ে দিয়েছে পথচারীদের সামনে, ভিক্ষা চেয়েছে এবং পুনরাবৃত্তি করেছে জীবনের পরাজিত ব্যথিত সংগীত এবং সে ক্ষুধা ও অবমাননায় কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু মানুষ তাকে সাহায্য করতে অস্বীকার করেছে এই বলে যে, অলস মানুষ ভিক্ষা পেতে পারে না। এক রাতে আমার শিশুরা একনাগাড়ে ক্ষুধায় কষ্ট পাচ্ছিল। বিশেষ করে সবচেয়ে ছোটটি, সে অসহায়ভাবে আমার শুকনো স্তন চুষে চুষে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। হঠাৎ আমার স্বামীর মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। রাতের অন্ধকারে সে বাড়ি ছেড়ে বেড়িয়ে পড়ল। সে গিয়ে প্রবেশ করল আশ্রমের শস্যভাণ্ডারে এবং সামান্য কিছু গম বের করে আনল। সে শস্যভাণ্ডারে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই সন্ন্যাসীরা তাদের সুখনিদ্রা থেকে জেগে উঠল এবং নির্দয়ভাবে পেটানোর পর তাকে গ্রেফতার করল। ভোরবেলায় তাকে আমীরের কাছে নিয়ে গেল এবং অভিযোগ করল সে আশ্রমে এসেছিল বেদির সোনার পুষ্পাধারগুলি চুরি করতে। তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হল এবং দ্বিতীয় দিন তাকে ফাঁসি দেওয়া হল। সে তার সবচেয়ে ছোট ক্ষুধার্ত সন্তানটির খাবার জন্য শস্যধার থেকে সামান্য কিছু শস্য তুলে নিয়েছিল যা তার নিজের শ্রমে অর্জিত, কিন্তু আমীর তাকে হত্যা করেছে, তার মাংস ব্যবহার করেছে খাদ্য হিসেবে পাখি ও পশুদের উদর পূর্ণ করার জন্য। এসব বলে নারীটি দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে প্রস্থান করল।
আমি কবরের সামনে দাঁড়িয়েছিলাম বক্তার মতো, কষ্ট পাচ্ছিলাম, কারণ আমি কথা বলতে পারছিলাম না, যখনই কোনো উচ্চ প্রশাংস করতে চেষ্টা করছি তখনই ভাষাহীন হয়ে পড়ছি, কিন্তু আমার ঝরে পড়া অশ্রুজল ছিল আমার কথা ও আত্মার পরিপূরক। আমার আত্মা বিদ্রোহ করেছিল, কারণ আত্মা ছিল ফুলের মতো যা অন্ধকার নামার সঙ্গে সঙ্গে তার পাঁপড়ি ভাঁজ করেছিল এবং আলোর অপচ্ছায়ার ভেতরে সে এর সুগন্ধ নিতে পারেনি শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে। আমি অনুভব করলাম মাটি নিপীড়নের শিকারকে তার ভাঁজের ভেতরে লুকিয়ে ফেলবে সেই নিঃসঙ্গ জায়গায় যা কানকে পূর্ণ করে দেবে কষ্ট পেতে থাকা আত্মার বেদনার্ত সংগীতে এবং আমাকে অনুপ্রাণিত করবে কথা বলতে। আমি নীরবতাকে ফিরিয়ে আনলাম কিন্তু যদি মানুষ বুঝে ফেলে কোন নীরবতা তাদের কাছে প্রকাশ করা হয় যখন তারা ঈশ্বরের খুব কাছাকাছি, উপত্যকার পুষ্পগুচ্ছের মতো। আমার দীর্ঘশ্বাস ফেলতে থাকা আত্মার শিখা যদি বৃক্ষকে স্পর্শ করে তাহলে তারা গতিশীল হবে এবং শক্তিশালী সেনাবহিনীর মতো কুচকাওয়াজ করবে তার শাখাগুলি দিয়ে আমীরের সঙ্গে যুদ্ধ করতে এবং অশ্রু ঝরাবে আশ্রমের যাজক ও সন্ন্যাসীদের মাথার ওপর। আমি সেখানে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম এবং অনুভব করলাম ক্ষমার মধুর অনুভূতি এবং বেদনার তিক্ততা ঝরে পড়ছিল আমার হৃদয় থেকে নতুন খনন করা কবরের ওপর—একজন যুবকের কবর, একজন দুর্বল তরুণীকে রক্ষা করতে গিয়ে যে তার জীবন উৎসর্গ করেছে, যার জীবন এবং সম্মান সে রক্ষা করেছিল হিংস্র মানুষের দাঁতের থাবা থেকে। একজন যুবক যার সাহসিকতার পুরস্কার হিসেবে তার মাথা কেটে ফেলা হয়েছিল এবং তার তরবারি প্রেরণ করা হয়েছিল তার মাথার ওপরে এমন একজনের দ্বারা যে তাকে রক্ষা করেছিল বীরত্বের প্রতীক হিসেবে সূর্যের সম্মুখে, যা জ্বলজ্বল করছিল মূর্খতা ও দুর্নীতিতে ভরপুর একজন আমীরের মুখোমুখি। একজন যুবকের কবর, যার হৃদয় প্রজ্জ্বলিত হয়েছিল ভালোবাসার অগ্নিশিখায় লোভ তাকে গ্রাস করার, যৌন লালসা তাকে দখল করার এবং নিপীড়নকারীদের দ্বারা পাথর ছুঁড়ে হত্যা করার আগেই…. সে তার বিশ্বস্ততা রক্ষা করেছিল মারা না-যাওয়া পর্যন্ত, তার প্রেমিক তার কবরে ফুল দিয়েছিল সেইসব আত্মাকে তাদের বিবর্ণ সময়গুলি সম্পর্কে বলতে, ভালোবাসা যাদের জন্য নির্ধারিত ছিল এবং যারা আশীর্বাদ পেয়েছে সেইসব মানুষের যারা জাগতিক বিষয়সম্পদের কারণে অন্ধ এবং অজ্ঞতার কারণে নীরব। একজন দুর্গত মানুষের কবর, আশ্রম সংলগ্ন মাঠে শ্রম দিয়ে যে দুর্বল হয়ে পড়েছে, কে তার ছোট্ট ক্ষুধার্ত শিশুটির খাবার জোগাতে একটি রুটি দেবে? বরং সে প্রত্যাখাত হয়েছিল। সে ভিক্ষা করতে শুরু করেছিল, কিন্তু মানুষ তার প্রতি মনোযোগ দেয়নি। যখন তার আত্মা তাকে নেতৃত্ব দিল আশ্রমের শস্যাধার থেকে সামান্য কিছু সংগ্রহ করতে, যা সে জোগাড় করেছিল এবং তাকে গ্রেফতার করার পর পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। তার দরিদ্র বিধবা স্ত্রী তার মাথার ওপর একটা ক্রুশ স্থাপন করেছে রাত্রির নীরবতার ভেতরে সাক্ষ্য দিতে স্বর্গের নক্ষত্রের সামনে সেইসব যাজকদের বিরুদ্ধে যারা যিশুখ্রিস্টের দয়ার্দ্র শিক্ষাকে ধারালো তরবারিতে পরিণত করেছে, যা দিয়ে তারা মানুষের গলা কেটে ফেলে এবং ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দুর্বলদের শরীর।
সূর্য অদৃশ্য হয়েছিল দিগন্তের পেছনে যেন সে এই পৃথিবীর সমস্যায় অবসন্ন এবং মানুষের বশ্যতার কারণে বিরক্ত। সেই মুহূর্তে সন্ধ্যা শুরু করল একটা সমৃদ্ধ অবগুণ্ঠন বরণ করতে নীরবতার মাংসপেশি থেকে এবং তা ছড়িয়ে দিল প্রকৃতির শরীরের ওপর। আমি আমার দু’হাত কবরের দিকে বাড়ালাম, তাদের প্রতীকগুলির দিকে আঙুল নির্দেশ করে তাকালাম স্বর্গের দিকে এবং কাঁদতে কাঁদতে বললাম, ‘হে সাহসিকতা, এই হল তোমার অস্ত্র, এখন এটা মাটিতে সমাহিত করো। হে ভালোবাসা, এই হল তোমার পুষ্পগুচ্ছ আগুনে ঝলসানো। হে, যিশু, এটা আপনার ক্রুশ, রাত্রির অস্পষ্টতার ভেতরে যা নিমজ্জিত।’
.
খলিল একজন নব্যতান্ত্রিক
প্ৰথম পৰ্ব
উত্তর লেবাননের এক নির্জন গ্রাম। সেই গ্রামের লোকেরা শেখ আব্বাসকে মনে করত একজন রাজকুমার। তার বিশাল অট্টালিকাটা দাঁড়িয়ে ছিল গরিব গ্রামবাসীর কুঁড়েঘরের মাঝখানে স্বাস্থ্যবান দৈত্যের মতো। সে বিলাসিতার ভেতরে বসবাস করত আর গ্রামবাসী তাড়া করে ফিরত দারিদ্র্যকে। শেখ আব্বাস যখন তাদের সঙ্গে কথা বলত তখন তারা মাথা নুইয়ে সম্মান জানাত তাকে। মনে হত, মনের ক্ষমতা তাকে নিয়োগ করেছিল আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যাদাতা ও মুখপাত্র হিসেবে। তাঁর ক্রোধে তারা শিহরিত হত এবং ছড়িয়ে ছিটিয়ে যেত প্রচণ্ড বাতাসে শরতের পাতার মতো। যদি সে কাউকে চড় মারে তাহলে তা গণ্য করা হয় নব্যতন্ত্র হিসেবে। যদি সে কোনো লোকের দিকে তাকিয়ে হাসে তাহলে গ্রামবাসী তাকে সবচেয়ে ভাগ্যবান মানুষ বলে সম্মান করে। দুর্বলতার কারণে মানুষ আব্বাসকে ভয় পায় না কিংবা তার কাছে আত্মসমর্পণ করে না। তাদের দারিদ্র্য ও আব্বাসের প্রয়োজনীয়তা তাদেরকে অবিরাম অবমাননার পর্যায়ে নিয়ে এসেছিল। এমনকি যে কুঁড়েঘরে তারা বসবাস করে এবং সে শস্যক্ষেতে তারা ফসল ফলায় তার মালিক হচ্ছে শেখ আব্বাস এবং এই ভূমি সে পেয়েছিল তার পূর্বপুরুষের কাছ থেকে।
জমি চাষ করা, বীজ বোনা এবং শস্য জড়ো করার সমস্ত কাজ সম্পন্ন হত শেখ-এর তত্ত্বাবধানে, যে তাদের কঠোর পরিশ্রমের পুরস্কার হিসেবে প্রদান করত শস্যের খুবই সামান্য অংশ যা তাদেরকে ক্ষুধাজনিত কারণে মৃত্যুমুখে পতিত হওয়া থেকে রক্ষা করত।
তাদের মধ্যে অনেকেরই ফসল তোলার আগে খাবারের অভাব দেখা দিত এবং তারা শেখ আব্বাসের কাছে এসে কাঁদতে কাঁদতে কয়েক পিয়াস্ত্রে (মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের মুদ্রার একক) আগাম দেবার অনুরোধ করত অথবা এক বুশেল (মেট্রিক পদ্ধতি প্রবর্তিত হওয়ার আগে শস্যের মাপ) গম ধার চাইত এবং শেখ আনন্দের সঙ্গে তাদের অনুরোধ রক্ষা করত, কারণ সে জানত ফসল তোলার সময় তারা তাদের ঋণের দ্বিগুণ পরিশোধ করবে। এসব মানুষ সারাজীবন এসব করতে বাধ্য হয়, সন্তানদেরকে ফেলে রেখে যায় ঋণের উত্তরাধিকারী করে। তারা তাদের প্রভুদের বশীভূত হয়েছিল যাদের ক্রোধকে তারা সবসময় ভয় পেত এবং যাদের বন্ধুত্ব পেয়েছিল তারা ক্রমাগত কিন্তু অসফলভাবে চেষ্টা করেছিল জয়লাভ করতে।
দ্বিতীয় পৰ্ব
শীত এল এবং সঙ্গে বহন করে নিয়ে এল প্রচুর বরফ ও প্রবল বাতাস। উপত্যকা ও শস্যক্ষেতগুলি শূন্য হয়ে গেল পাতাহীন গাছগুলো ছাড়া, যা মৃত্যুর অপচ্ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে থাকল প্রাণহীন সমতলভূমিতে।
মাঠের যাবতীয় উৎপন্ন দ্রব্য সংরক্ষিত হল শেখের গোলায় এবং পুষ্পাধারগুলি পূর্ণ হয়ে গেল আঙুর থেকে তৈরি মদে। গ্রামবাসীরা ফিরে গেল তাদের জীর্ণ কুটিরে জীবনের কিছুটা সময় আগুনের পাশে আলস্যের ভেতরে কাটানোর জন্য এবং স্মরণ করতে থাকল অতীতকালের গৌরব। ক্লান্ত দিন এবং দীর্ঘ রাত্রিগুলির কথা বলে গেল একজন অন্যজনকে।
পুরোনো বছরগুলি শেষ প্রশ্বাস গ্রহণ করছিল ধূসর আকাশে। রাত্রি আবির্ভূত হয়েছিল, যার ভেতরে নতুন বছরকে মুকুট পরানো হবে এবং তাকে বসানো হবে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সিংহাসনের ওপর। প্রবলভাবে বরফ পড়তে শুরু করল এবং শিস দিতে থাকা বাতাস শুরু করেছিল দৌড় প্রতিযোগিতা উঁচু পাহাড়ের শীর্ষ থেকে নরকের তলদেশ পর্যন্ত এবং উড়িয়ে দিচ্ছিল স্তূপাকারে পড়ে পড়ে থাকা বরফ যা জমা হবে উপত্যকাগুলিতে।
ঝড়ো বাতাসে গাছগুলি দুলছিল, শস্যক্ষেত ও ছোট ছোট পাহাড়গুলি ঢেকে গিয়েছিল যেন বরফের সাদা মেঝে এবং তার ওপর মৃত্যু লিখেছিল কিছু অস্পষ্ট বক্তব্য এবং তা আবার মুছে ফেলেছে। ধোঁয়াশা দাঁড়িয়েছিল বিভাজন হিসেবে উপত্যকার পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গ্রামগুলির মাঝখানে। জরাজীর্ণ কুঁড়েঘরের জানালা দিয়ে বেরিয়ে আসা আলো অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিল প্রকৃতির অবগুণ্ঠনের পেছনে।
কৃষকরা খুবই ভয় পেল। গবাদি পশুরা খাবার না খেয়ে ছাউনির তলায় দাঁড়িয়ে থাকল এবং এদিকে সেদিকে লুকিয়ে গেল কুকুরগুলি। যে-কেউ তখন শুনতে পাচ্ছিল বাতাসের তীক্ষ্ণ চিৎকার এবং উপত্যকার গভীরতায় প্রতিধ্বনিত হয়ে তা ফিরে আসার গর্জন। মনে হয় প্রকৃতি যেন রাগান্বিত হয়েছিল পুরোনো বছরগুলি অতিক্রান্ত হওয়ার কারণে এবং চেষ্টা করছিল ঠাণ্ডা ও জমে যাওয়া বরফের অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ করে প্রতিশোধ গ্রহণ করতে।
সেই রাতে উন্মত্ত আকাশের নিচে এক যুবক বাতাসের পদচিহ্ন অনুসরণ করে হাঁটার উদ্যোগ নিয়েছিল, যে পদচিহ্ন যোগযোগ স্থাপন করেছিল ‘দের কিজাইয়া’ এর সঙ্গে শেখ আব্বাসের গ্রামের। যুবকের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অসাড় হয়ে এসেছিল ঠাণ্ডায়। তার শক্তিকে দখল করে নিয়েছিল ক্ষুধা ও বেদনা। সে যে কালো পোশাকটা পরেছিল বরফ তার রঙ বদলে দিয়েছিল। তাকে দেখলে মনে হবে মৃত্যু আসার আগেই সে কাফন পরে ফেলেছে। সে সংগ্রাম করছিল বাতাসের বিরুদ্ধে। তার সামনে এগোতে অসুবিধা হচ্ছিল এবং অনেক চেষ্টা করে সে কয়েক পা এগিয়ে গেল। সে আহ্বান জানাল সাহায্যের জন্য এবং তারপর নীরবে দাঁড়িয়ে থাকল। ঠাণ্ডায় তার শরীর কাঁপছিল। তার সামান্য আশা ছিল বিশাল হতাশা ও গভীর দুঃখের মাঝে শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে যাওয়ার। সে ছিল একটা পাখির মতো যার ডানাগুলি ভেঙে গেছে। সে এমন একটা স্রোতের ভেতরে পড়ে গেছে যার ঘূর্ণি তাকে বহন করে নিয়ে যাবে গভীর থেকে গভীরতম তলদেশে।
যুবকটি আবার হাঁটতে শুরু করল এবং মাটিতে পড়ে থাকল যতক্ষণ তার শরীরে রক্ত সঞ্চালন না হতে থাকে এবং তারপর সে ভেঙে পড়ে। সে উচ্চারণ করে একটা ভয়াবহ শব্দ… একটা আত্মার কণ্ঠস্বর, যে বিপদের মুখোমুখি হয়েছিল মৃত্যুর ফাঁপা মুখের ভেতরে… মুত্যুপথযাত্রী এক যুবকের কণ্ঠস্বর, মানুষ যাকে দুর্বল করে তুলেছে এবং তাকে ফাঁদে ফেলেছে প্রকৃতি… কোনোকিছু না-থাকা শূন্যতার ভেতরে অস্তিত্বের জন্য ভালোবাসার একটি কণ্ঠস্বর।
তৃতীয় পৰ্ব
গ্রামের উত্তরে বাতাসে ছিন্নভিন্ন করে ফেলা মাঠের ভেতরে র্যাচেল এবং তার কন্যা মিরিয়ামের নির্জন বাড়িটা দাঁড়িয়েছিল। মিরিয়ামের বয়স আঠারো বছরের বেশি হবে না। র্যাচেল ছিল সামান রামির বিধবা স্ত্রী, যাকে ছয় বছর আগে খুন করা হয়েছিল এবং আইনের লোকেরা খুনিকে আজও খুঁজে পায়নি
লেবাননের অন্যান্য বিধবা নারীদের মতোই র্যাচেল দীর্ঘ ও কঠোর পরিশ্রমের ভেতর দিয়ে জীবন টিকিয়ে রেখেছিল। ফসল তোলার সময় সে ফসল কেটে নেওয়া শ্রমিকদের পেছন পেছন তাদের অসতর্কভাবে ফেলে যাওয়া ফসলগুলো সতর্ক চোখে কুড়িয়ে নিত এবং শরতে সে বিভিন্ন বাগান থেকে কিছু ফল সংগ্রহ করত, বাগানের মালিরা যে ফলগুলোর কথা ভুলে গেছে। শীতকালে সে উলের পোশাক বুনত এবং তা বিক্রি করে পেত সামান্য কিছু পিয়াস্ত্রা অথবা এক বুশেল শস্য। তার কন্যা মিরিয়াম ছিল খুবই সুন্দরী যে তার মায়ের এই পরিশ্রমের বোঝা কিছুটা হলেও ভাগাভাগি করত।
সেই ভয়াবহ ঝড়ের রাতে দুজন নারী আগুনের পাশে বসেছিল যার উত্তাপ কমে এসেছে। কারণ এর জ্বলন্ত কাঠগুলো এখন ছাইয়ের নিচে সমাহিত। তাদের পাশে একটা বাতি মিটমিট করে জ্বলছিল; যা থেকে ছড়িয়ে পড়ছিল হলুদ অনুজ্জ্বল রশ্মি অন্ধকারের হৃদয়ের ভেতরে প্রার্থনার মতো, যা বেদনার্ত মানুষের হৃদয়ে পাঠিয়ে দেয় আকাঙ্ক্ষার ভূত।
মধ্যরাতেও তারা মনোযোগ দিয়ে শুনছিল বাইরের বাতাসের হাহাকার। মিরিয়াম উঠে ছোট্ট জানালাটা খুলে অন্ধকার আকাশের দিকে তাকাল, তারপর তার চেয়ারে ফিরে এল চিন্তিত ও আতঙ্কিত অবস্থায়। বাইরে ঝড় তখন উন্মত্ত হয়ে ওঠেছে। হঠাৎ করেই মিরিয়াম সচকিত হয়ে ওঠে যেন সে এইমাত্র গভীর সুখনিদ্রা থেকে জেগে উঠেছে। সে চিন্তিতভাবে মায়ের দিকে তাকায় এবং বলে, ‘মা তুমি কি কিছু শুনতে পাচ্ছ? তুমি কি একটা কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছ যে সাহায্য চাইছে?’ তার মা কয়েক মুহূর্ত মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করে বলল, ‘বাতাসের কান্না ছাড়া আমি আর কিছুই শুনতে পাচ্ছি না।’ মিরিয়াম বলল, ‘আমি একটা কণ্ঠস্বর শুনেছি যা স্বর্গের গর্জনের চেয়ে গভীরতর এবং ঝড়ের হাহাকারের চেয়ে অধিক বেদনাদায়ক।’
এসব কথা বলার পর সে উঠে দাঁড়ায় এবং দরজা খুলে কয়েক মুহূর্ত মনোযোগ দিয়ে শোনে এং মাকে বলে, ‘আমি আবার শুনতে পেলাম মা।’ র্যাচেল দ্রুত দরজার কাছে এল এবং এক মুহূর্ত দ্বিধায় কাটানোর পর বলল, ‘হ্যাঁ আমিও শুনতে পেলাম। চলো গিয়ে দেখি কার কী বিপদ হল।’
র্যাচেল একটা লম্বা চাদর জড়ায় গায়ে, তারপর দরজা খুলে বেরিয়ে যায়। মিরিয়াম দাঁড়িয়ে থাকে দরজার কাছে। বাতাসে এলোমেলো হয়ে যায় তার দীর্ঘ চুল।
বাতাসের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাকে এগোতে হয়। ভয়ানক তুষার পড়ছে। কিছুদূর গিয়ে সে থামল এবং চিৎকার করে বলল, ‘কে ডাকছে… কোথায় তুমি?’ কোনো উত্তর আসে না। তারপর সে চিৎকার করে একই কথা বারবার বলে কিন্তু বজ্রপাতের শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না। সে সাহসের সঙ্গে সামনের দিকে এগোয় চারদিকে তাকাতে তাকাতে। কিছুক্ষণ হাঁটার পর সে বরফের ওপর গভীর পদচিহ্ন দেখতে পায়। সে এই পদচিহ্ন অনুসরণ করে আরও কিছুদূর এগোনোর পর একটা মানুষের শরীর পড়ে থাকতে দেখল বরফের ওপর সাদা পোশাকের তালির মতো। কাছাকাছি গিয়ে র্যাচেল তার মাথাটা হাঁটুর ওপর তুলে নিল। তার নাড়ি দেখে বুঝল সে এখনও বেঁচে আছে এবং তার বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ হলেও সুযোগ আছে। সে তার নিজের বাড়ির দিকে মুখ ঘুরিয়ে ডাকল, ‘মিরিয়াম তাড়াতাড়ি এসো আমি লোকটাকে খুঁজে পেয়েছি।’ মিরিয়াম বরফের ওপর মায়ের পদচিহ্ন অনুসরণ করে দ্রুত ছুটে আসে। সে তখন ভয়ে ও ঠাণ্ডায় কাঁপছিল। জড়বস্তুর মতো লোকটাকে পড়ে থাকতে দেখে সে কেঁদে ফেলে। র্যাচেল লোকটার ঘাড়ের নিচে হাত দিয়ে তাকে তুলে ধরে এবং চেঁচিয়ে মিরিয়ামকে বলে, ‘ভয় পেয়ো না। সে এখনও বেঁচে আছে। তার আলখাল্লার নিচের প্রান্তটা তুলে ধরো। একে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাই।’
ভয়ানক ঝড় ও প্রবল তুষারপাতের ভেতরে দুজন নারী একজন সংজ্ঞাহীন মানুষকে বহন করে নিয়ে যায় তাদের কুঁড়েঘরের দিকে। বাড়ি পৌঁছে তারা তাকে আগুনের পাশে শোয়ালে। র্যাচেল তার দুহাত ঘষে গরম করতে লেগে যায় এবং মিরিয়াম তার পোশাকের প্রান্ত দিয়ে চুল মুছে দিতে থাকে। কয়েক মিনিট পর লোকটা নড়েচড়ে উঠল শিহরিত হতে থাকল তার চোখের পাতা। সে একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলল… একটা দীর্ঘশ্বাস, যা বহন করছিল তার নিরাপত্তার আকাঙ্ক্ষা এবং তা ছিল এই করুণাময়ী নারীর হৃদয়ে। তারা লোকটার জুতো এবং কালো পোশাকটা খুলে দেয়। মিরিয়াম তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তার পোশাক দ্যাখো মা, আশ্রমের সন্ন্যাসীরা এরকম পোশাক পরে থাকে।’ আগুনে এক বোঝা কাঠ চাপিয়ে দেওয়ার পর র্যাচেল কন্যার দিকে হতবিহ্বল চোখে তাকায় এবং বলে, ‘এ রকম ভয়াবহ রাতে সন্ন্যাসীরা আশ্রম ছেড়ে বেরোয় না।’ মিরিয়াম বলে, ‘কিন্তু তার মুখে কোনো দাড়ি নেই। সন্ন্যাসীদের দাড়ি থাকে।’ র্যাচেল স্থিরদৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়। তার চোখ পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে মাতৃত্বের স্নেহে। সে তার কন্যার দিকে ফিরে তাকায় এবং বলে, ‘হোক সে সন্ন্যাসী অথবা অপরাধী তাতে কিছুই এসেই যায় না। তার পাটা মুছে শুকনো করে দাও।’
র্যাচেল পুরোনো একটা আলমারি খোলে, একটা মদের পাত্র নামিয়ে আনে এবং তা থেকে একটা মাটির পাত্রে মদ ঢালে। তারপর তার শরীর গরম করার জন্য তাকে খেতে দেয়।
মদে চুমুক দেওয়ার পর প্রথম সে চোখ খোলে। তার বেদনার্ত দৃষ্টি কৃতজ্ঞতার অশ্রুজলের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়—একজন মানুষের দৃষ্টি যে জীবনের প্রশান্ত স্পর্শ অনুভব করেছিল মৃত্যুর তীক্ষ্ণ থাবা থেকে বেরিয়ে আসার পর — বিশাল আকাঙ্ক্ষার একটি দৃষ্টি আকাঙ্ক্ষার পর মারা গিয়েছিল। তারপর লোকটা মাথা নোয়াল এবং তার ঠোঁট কাঁপছিল যখন সে উচ্চারণ করে, ‘ঈশ্বর আপনাদের দুজনকেই আশীর্বাদ করুন।’ র্যাচেল তার কাঁধের ওপর হাত রেখে বলে, ‘শান্ত হোন ব্রাদার। শক্তি অর্জনের আগেই কথা বলে নিজেকে ক্লান্ত করে তুলবেন না’ এবং মিরিয়াম বলল, ‘এই বালিশে মাথা রেখে বিশ্রাম নিন ব্রাদার। আমরা আপনাকে আগুনের আরও কাছে নিয়ে যাব।’
র্যাচেল পাত্রে আরো মদ ঢালল এবং তাকে খেতে দিল। সে তার কন্যার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তার পোশাকগুলি আগুনে শুকোতে দাও।’ মায়ের আদেশ পালন করার পর সে লোকটার দিকে দয়ার দৃষ্টিতে তাকাল, যেন সে তার আত্মার সমস্ত উষ্ণতা ঢেলে দিয়ে তাকে সাহায্য করতে চায়। র্যাচেল দুটো বড় রুটি নিয়ে এল, সঙ্গে সংরক্ষিত কিছু শুকনো ফল, তারপর তা সে ছোট ছোট টুকরো করে তাকে খাওয়াতে লাগল যেভাবে মা তার ছোট শিশুকে খাবার খাওয়ায়।
খাওয়ার পর সে শক্তি ফিরে পায় এবং উঠে বসে এবং আগুনের লাল শিখা তার বেদনার্ত মুখে প্রতিফলিত হতে থাকে, তারপর বলে, ‘দয়া ও নৃশংসতা মানুষের হৃদয়ে মল্লযুদ্ধে রত এই ভয়াবহ রাত্রির আকাশে উন্মত্ত উপাদানগুলির মতো, কিন্তু দয়া নৃশংসতাকে অতিক্রম করে যাবে কারণ এটা ঐশ্বরিক এবং এই রাত্রির সন্ত্রাস হচ্ছে একা এবং তা অতিক্রম করে যাবে যখন ভোরের আলো ফুটবে।’ কয়েক মিনিট নীরবে কেটে গেল এবং তারপর সে বলল ফিসফিস করে, ‘একজন মানুষের হাত আমাকে চালিত করে বেপরোয়া হতে এবং একজন মানুষের হাত আমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করে, মানুষ কত কঠোর এবং কী পরিমাণ দয়ালু।’ র্যাচেল বলল, ‘এরকম ভয়াবহ রাত্রে আশ্রম পরিত্যাগ করে কী পরিমাণ ঝুঁকে নিয়েছেন আপনি ব্রাদার যেখানে একটা পশুও এরকম রাতে ঝুঁকি নেয় না।’
যুবক চোখ বন্ধ করল যেন সে তার চোখের জলকে হৃদয়ের গভীরে ফিরিয়ে আনতে চায় এবং সত্যি সত্যিই যখন তারা এল তখন সে বলল, ‘বন্যপ্রাণীদের গুহা আছে, আকাশে উড়ে বেড়ানো পাখিদের রয়েছে বাসা, কিন্তু মানুষের পুত্রের মস্তিষ্ককে বিশ্রাম দেবার কোনো জায়গা নেই।’ র্যাচেল বলল, ‘যিশু নিজের সম্পর্কে একথা বলেছিলেন।’ যুবকটি আবার শুরু করল, ‘এটাই হল প্রত্যেক পুরুষের উত্তর যারা এই মিথ্যাচার, প্রতারণা ও দুর্নীতির যুগে আত্মা ও সত্যের অনুসরণ করতে চায়।’
কয়েক মুহূর্ত গভীর চিন্তার পর র্যাচেল বলল, ‘কিন্তু আশ্রমে অনেকগুলি আরামদায়ক কক্ষ রয়েছে এবং ধনভাণ্ডারগুলি সোনায় পরিপূর্ণ এবং যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা সেখানে রয়েছে। আশ্রমের ছাউনিতে মোটাসোটা বাছুর ও ভেড়ার মজুদ রয়েছে। কী কারণে এমন একটি স্বর্গ পরিত্যাগ করলেন মৃত্যুতুল্য এই রাতে?’ যুবক দীর্ঘশ্বাস ফেলল এবং বলল, ‘আমি ঐ জায়গা পরিত্যাগ করেছি কারণ আমি এটা ঘৃণা করি।’ র্যাচেল বলল, ‘আশ্রমে একজন সন্ন্যাসী হচ্ছে যুদ্ধক্ষেত্রে একজন সৈনিকের মতো, যে তার নেতার আদেশ মান্য করা প্রয়োজন মনে করে তাদের প্রকৃতি বিবেচনা না করে। আমি শুনেছি যে একজন লোক কখনও সন্ন্যাসী হতে পারে না, যতক্ষণ সে নিজের ইচ্ছা, চিন্তা ও আকাঙ্ক্ষা পরিত্যাগ না করে। কিন্তু একজন প্রধান যাজক তার সন্ন্যাসীদের কখনও অযৗক্তিক কোনো কাজ করতে বলে না। কীভাবে দেইর কিজাইয়া এর প্রধান যাজক আপনাকে এই ঝড় ও বরফের ভেতরে জীবন ত্যাগ করতে বলল?’ যুবকটি এবার বলল, ‘প্রধান যাজকের মত অনুযায়ী, একজন মানুষ কখনও সন্ন্যাসী হতে পারে না, যদি সে অন্ধ অজ্ঞ, বিচারবুদ্ধিহীন এবং বধির না হয়। আমি আশ্রম পরিত্যাগ করেছি কারণ আমি একজন বোধশক্তিসম্পন্ন মানুষ যে দেখতে, শুনতে এবং অনুভব করতে পারে।’
মিরিয়াম এবং র্যাচেল স্থিরদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে ছিল, যেন তারা তার মুখে এটা লুকানো গোপনীয়তা খুঁজে পায়। এক মিনিট গভীরভাবে চিন্তা করার পর মা বলল, ‘একজন মানুষ এরকম দুর্যোগের রাতে কী করে বাইরে যাবে ঝড় যার চোখ অন্ধ ও কানকে বধির করে তোলে।’ যুবক শান্তস্বরে বলল, ‘আমাকে আশ্রম থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল।’ তারা দুজনেই প্রায় একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল : ‘বহিষ্কার!’
যুবক তার মাথা তুলল, অনুতাপে দগ্ধ হচ্ছিল তার হৃদয়; কারণ সে ভয় পাচ্ছিল তাদের ভালোবাসা ও সহানুভূতি হয়তো ঘৃণা এবং অসম্মানে পরিণত হবে, কিন্তু যখন দেখল তাদের চোখ থেকে দয়া প্রবাহিত হচ্ছে এবং তাদের শরীর স্পন্দিত হচ্ছে দুশ্চিন্তায়, তখন সে শ্বাসরুদ্ধকর কণ্ঠে কলল, ‘হ্যাঁ। আমাকে আশ্রম থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল, কারণ আমি আমার কবর নিজের হাতে খুঁড়তে পারি না এবং আমার হৃদয় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল চুরি করা ও মিথ্যা কথা বলতে বলতে। আমি বহিষ্কৃত হয়েছিলাম কারণ আমার আত্মা অস্বীকৃতি জানিয়েছিল সেই সব লোকের উদারতা উপভোগ করতে যারা অজ্ঞতা দ্বারা পরিবেষ্টিত। আমাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল কারণ এইসব আরামদায়ক কক্ষে আমি বিশ্রাম নিতে পারতাম না, যা গরিব কৃষকদের অর্থে নির্মিত। এতিমদের মুখের জন্য সেঁকা রুটি আমার পাকস্থলী গ্রহণ করত না। আমার ঠোঁট উচ্চারণ করতে পারত না সেই প্রার্থনা যা সাধারণ ও বিশ্বস্ত মানুষের সোনা ও খাবারের বিনিময়ে কেনা হয়। একজন কুষ্ঠ রোগীর মতো আমাকে আশ্রম থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল, কারণ আমি বারবার তাদের কাজ ও বর্তমান অবস্থার সমালোচনা করেছিলাম।
নীরবতার ভেতরে র্যাচেল ও মিরিয়াম তার কথা গভীরভাবে চিন্তা করতে থাকে, স্থিরদৃষ্টিতে তার দিকে তাকায় এবং তারপর তারা বলে, ‘আপনার পিতামাতা কি বেঁচে আছেন?’ সে উত্তর দিল, ‘আমার পিতা নেই, মাতা নেই এবং এমন কোনো জায়গাও নেই যেটাকে আমার গৃহ বলতে পারি।’ র্যাচেল একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলল এবং মিরিয়াম দেয়ালের দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল চোখের জল গোপন করার জন্য।
যুবক এবার তাদের দিকে এমনভাবে তাকাল যেভাবে একজন সৈনিক তার মুক্তিদাতার দিকে তাকায়, যে তাকে শত্রুর বজ্রমুষ্ঠি থেকে উদ্ধার করেছে। সে আবার বলতে শুরু করল, ‘সাত বছর বয়স হওয়ার আগেই আমি আমার পিতাকে হারিয়েছি। আমাদের গ্রামের যাজক আমাকে দেইর কিজাইয়া-তে নিয়ে রেখে আসে সন্ন্যাসীদের কাছে, যারা আমাকে দেখে খুশি হয় এবং গরু ও ভেড়াগুলির দায়িত্ব দেয় আমার ওপর, যাদেরকে আমি প্রতিদিন চারণভূমিতে নিয়ে যেতাম। আমার বয়স যখন পনেরো তখন তারা আমাকে এই কালো আলখাল্লা পরায় এবং আমাকে নিয়ে যায় বেদির সামনে যেখানে প্রধান যাজক আমাকে বলেন, ‘বলো, ঈশ্বর এবং সমস্ত পুণ্যাত্মার নামে শপথ করছি এবং শপথ করছি আনুগত্য ও দারিদ্র্যের ভেতরে শুদ্ধ জীবন যাপন করব।’ আমি পুনরাবৃত্তি করলাম কথাগুলি তার চমৎকারিত্ব উপলব্ধি করার আগেই অথবা উপলব্ধি করলাম আনুগত্য, সদ্গুণ ও দারিদ্র্য সম্পর্কে তার নিজস্ব ব্যাখ্যা।’
আমার নাম ছিল খলিল এবং সেই সময় থেকে তারা আমাকে ব্রাদার মোবারক’ বলে ডাকত। কিন্তু তারা আমার সঙ্গে কখনও ব্রাদারের মতো আচরণ করত না। তারা অত্যন্ত রুচিকর খাবার খেত এবং পান করত উৎকৃষ্ট মদ আর আমি বেঁচে থাকতাম আমার অশ্রু মেশানো শুকনো সবজি ও পানি খেয়ে। তারা সুখনিদ্রা উপভোগ করত নরম বিছানায় আর আমি ঘুমাতাম ছাউনির পাশে ঠাণ্ডা ও অন্ধকার ঘরে পাথরের ওপর। প্রায়ই আমি আমাকে জিজ্ঞাসা করতাম, ‘কখন আমি সন্ন্যাসী হব এবং ঐসব ভাগ্যবান যাজকদের সঙ্গে তাদের উদারতা ভাগাভাগি করব? কখন আমার হৃদয়ে সেইসব খাবার ও পানীয়ের আকাঙ্ক্ষা থাকবে না যা তারা খায় এবং পান করে? কখন আমার শরীরের সেই কাঁপুনি থাকবে যা শুরু হয় ভয়ের কারণে আমার উপরোস্থ কর্মকর্তার মুখোমুখি? কিন্তু আমার সমস্ত আকাঙ্ক্ষাই ব্যর্থ হয়ে যায়, কারণ আমি একই অবস্থায় ছিলাম এবং পশুপালনের পাশাপাশি আমাকে বাধ্য করা হত কাঁধে করে পাথর বহন ও গর্ত খনন করতে। আমি আমার জীবন বাঁচিয়ে রেখেছি সামান্য রুটি দিয়ে যা আমার কঠোর পরিশ্রমের উপহার হিসেবে প্রদান করা হত। এমন কোনো জায়গা আমি চিনতাম না যেখানে যেতে পারি এবং আশ্রমের যাজকেরা যা করত তার কোনোকিছুই আমার ভালো লাগত না। তারা আমার মনকে বিষিয়ে দিয়েছিল যতক্ষণ না আমি চিন্তা শুরু করলাম যে পুরো পৃথিবী হল একটা দুঃখ ও দুর্গতির সমুদ্র এবং আশ্রমই হচ্ছে পাপমোচনের একমাত্র বন্দর। কিন্তু যখন আমি তাদের খাবার ও সোনার উৎস আবিষ্কার করলাম তখন খুশিই হলাম যে আমি এসবে ভাগ বসাইনি।’
খলিল সহজ সরলভাবে এসব বলে গেল এবং এমন বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকাল যেন সুন্দর কিছু একটা সে দেখতে পেয়েছে যা তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে কুঁড়েঘরের ভেতর। র্যাচেল এবং মিরিয়াম নীরব হয়ে রইল এবং সে বলে যেতে থাকে, ‘ঈশ্বর, যে আমার পিতাকে নিয়ে গেছে এবং আমাকে এতিম হিসেবে নির্বাসন দিয়েছে এই আশ্রমে, সে চায়নি আমি আমার সারাটা জীবন অন্ধের মাতা হেঁটে বেড়াই এই ভয়াবহ জঙ্গলে কিংবা তার ইচ্ছা নয় দুর্গতির দাসে পরিণত হই আমি বাকি জীবনের জন্য। ঈশ্বর আমার চোখ ও কান খুলে দেন, আমাকে দেখান উজ্জ্বল আলো এবং শোনান সত্য, যখন সত্য কথা বলেছিল।’
র্যাচেল উঁচুকণ্ঠে বলল, ‘সূর্যালোক ছাড়া ওখানে কি অন্যকোনো আলো আছে যা মানুষের ওপর জ্বলজ্বল করতে থাকে? মানুষ কি এই সত্য উপলব্ধি করতে সক্ষম?’
খলিল তার দিকে ঘুরল এবং বলল, ‘প্রকৃত আলো হল সেটাই, যা মানুষের হৃদয়ের ভেতরে প্রবাহিত হয় এবং আত্মার কাছে হৃদয়ের গোপনীয়তা প্রকাশ করে, তাকে সুখী করে তোলে এবং যুক্ত করে জীবনের সঙ্গে। সত্য হল নক্ষত্রের মতো রাত্রির অস্পষ্টতার পেছন থেকে যে আর্বিভূত হয়। সত্য হচ্ছে পৃথিবীর যাবতীয় সুন্দর জিনিসের মতো, সে তার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে না তাদের কাছে যারা প্রথম মিথ্যাচারের প্রভাব উপলব্ধি করে। সত্য হল একটি গভীর দয়া (সহৃদয়তা) যা আমাদেরকে প্রতিদিনের জীবন নিয়ে তৃপ্ত থাকতে শিক্ষা দেয় এবং একাই সুখ ভাগাভাগি করে মানুষের সঙ্গে।’
র্যাচেল উৎফুল্ল হয়ে বলে, ‘তাদের অনেকেই বেঁচে থাকে তাদের ভালো গুণের কারণে এবং তাদের অনেকেই বিশ্বাস করে অন্যের প্রতি সমবেদনা হল মানুষের প্রতি ঈশ্বরের আইনের ছায়া, কিন্তু এখনও পর্যন্ত তারা উল্লসিত হয়নি, মৃত্যু না আসা পর্যন্ত তারা দুর্গতির ভেতরেই থাকবে।’ খলিল উত্তর দিল, ‘ব্যর্থতা হল একটি বিশ্বাস এবং একটি শিক্ষা যা মানুষকে দুর্গত করে তোলে এবং মিথ্যাচার হল সদগুণ যা মানুষকে বেদনা ও হতাশার দিকে নিয়ে যায়। কারণ পৃথিবীতে মানুষ সুখী হবে এটা হল মানুষের উদ্দেশ্য এবং এই পথকে নেতৃত্ব দেবে পরিতৃপ্ত হতে এবং যেখানে সে যায় সেখানেই প্রচার করতে বাইবেলের নতুন নিয়মের বাণীগুচ্ছ। জীবনে যে স্বর্গের সাম্রাজ্য দেখে নেই, সামনের জীবনেও সে দেখতে পারবে না। প্রতারিত হব আমরা এই জীবনে। আমরা এসেছিলাম ঈশ্বরের নিষ্পাপ প্রাণী হিসেবে, শিখতে কীভাবে পবিত্র এবং চিরন্তন আত্মার প্রার্থনা করতে হয় এবং অনুসন্ধান করতে আমাদের জীবনের লুকানো গোপনীয়তাকে, যা আসে জীবনের সৌন্দর্য থেকে। এই হল সত্য যা আমি শিখেছি নাজারেতবাসীদের শিক্ষা থেকে। এই হল আলো যা আমার ভেতর থেকে আসে এবং আমাকে আশ্রমের অন্ধকার বাঁকগুলি দেখায় যা আমার জীবনে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এটাই হল সেই গভীর সত্য যা উপত্যকা ও শস্যক্ষেতগুলি আমার কাছে প্রকাশ করেছিল, যখন আমি ক্ষুধার্ত ছিলাম, বসেছিলাম একাকী এবং কাঁদছিলাম গাছের ছায়ায়।
এই হল ধর্ম—আশ্রমগুলির উচিত একে নিরপেক্ষ করে তোলা, ঈশ্বরের ইচ্ছা অনুযায়ী এবং যেভাবে যিশু শিক্ষা দিয়েছেন সেভাবে। একদিন সত্যের সৌন্দর্যের স্বর্গীয় আচ্ছন্নতায় আমার আত্মা আচ্ছন্ন হয়েছিল, আমি সাহসের সঙ্গে সন্ন্যাসীদের সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। সন্ন্যাসীরা বাগানের ভেতরে জড়ো হয়েছিল। আমি তাদের খারাপ কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে বললাম, ‘কেন আপনারা আশ্রমে আপনাদের দিনগুলি নষ্ট করছেন এবং গ্রহণ করছেন গরিবদের অকৃপণ দান, যে রুটি আপনারা খেয়ে থাকেন তা তাদের শরীরের ঘাম এবং হৃদয়ের অশ্রু দিয়ে তৈরি? কেন আপনারা বঞ্চিত করছেন আপনার দেশকে আপনার সাহায্য থেকে? যিশু আপনাদের পাঠিয়েছেন নেকড়ের ভেতরে মেষশাবক করে যা আপনাদেরকে মেষশাবকের ভেতরে নেকড়েতে পরিণত করেছে। কেন আপনারা ঈশ্বর ও মানুষের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন যিনি আপনাকে সৃষ্টি করেছেন। যে মানুষ জীবনের মিছিলের সঙ্গে হাঁটছে আপনারা যদি তার চেয়ে উৎকৃষ্ট হন, তাহলে আপনাদের উচিত তাদের কাছে যাওয়া এবং তাদের জীবনের উন্নয়ন ঘটানো; আর যদি আপনারা মনে করেন তারা আপনাদের চেয়ে উৎকৃষ্ট তাহলে আপনাদের উচিত তাদের কাছে থেকে শেখার আকাঙ্খা প্রকাশ করা। কীভাবে আপনারা শপথ গ্রহণ করেন দারিদ্র্যের ভেতরে বেঁচে থাকার, তারপর ভুলে যান কী আপনারা বলেছিলেন এবং বসবাস করেন বিলাসিতার ভেতরে? আপনারা কীভাবে একজন ঈশ্বরের অনুগত ব্যক্তিকে শপথ করান এবং তারপর বিদ্রোহ করেন সমস্ত ধর্মীয় মূল্যবোধের! কীভাবে সদ্গুণকে আপনারা আইন হিসেবে গ্রহণ করেন যখন আপনাদের হৃদয় যৌন লালসায় পরিপূর্ণ? আপনারা ভান করেন যে, আপনারা আপনাদের শরীরকে হত্যা করেছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আপনারা হত্যা করছেন আপনাদের আত্মাকে। আপনারা এমন ভান করছেন যেন জাগতিক জিনিসগুলো ঘৃণার যোগ্য কিন্তু আপনাদের হৃদয় তা গিলে ফেলে লোভীর মতো। ধর্মীয় শিক্ষা হিসেবে মানুষ আপনাদেরকে বিশ্বাস করে। সত্যি করে বলছি, আপনারা হলেন সেইসব গবাদি পশুর মতো যারা নিজেকে জ্ঞান থেকে সরিয়ে নিয়ে চমৎকার সবুজ চারণভূমিতে ঘাস খেতে ব্যস্ত। চলুন যাদের প্রয়োজন খুব বেশি তাদের কাছে ফিরিয়ে দিই এই আশ্ৰম সংলগ্ন ভূমি এবং ফিরিয়ে দিই তাদেরকে সোনা ও রুপা, যাদের কাছ থেকে তা নেওয়া হয়েছিল। চলুন আমরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ি আমাদের নিঃসঙ্গতাকে পরিত্যাগ করে এবং সেবা দান করি দুর্বলদের যারা আমাদেরকে শক্তিশালী করেছে এবং পরিচ্ছন্ন করি আমাদের দেশকে যেখানে আমরা বসবাস করি। চলুন আমরা এই দুর্গত জাতিকে হাসতে শেখাই এবং স্বর্গের উদারতা, জীবনের গৌরব ও স্বাধীনতায় উল্লসিত হই।’
‘মানুষের চোখের জল অধিকতর সুন্দর এবং ঈশ্বর তাতে বিশ্রাম ও প্রশান্তি যুক্ত করেন, তার ভেতরেই এখানে আপনারা নিজেদেরকে অভ্যস্ত করে তুলতে পারেন। সহানুভূতি, যা প্রতিবেশীদের হৃদয় স্পর্শ করে তা অধিক ক্ষমতাশালী আশ্রমের দৃশ্যহীন বাঁকগুলিতে লুকানো সদ্গুণের চেয়ে। দুর্বল অপরাধী অথবা পতিতাদের প্রতি সমবেদনা জানানো দীর্ঘ প্রার্থনার চেয়ে অধিক সৎকাজ যা আমরা মন্দিরে প্রতিদিন পুনরাবৃত্তি করি শূন্যতার ভেতরে।’
এ সময় খলিল একটা গভীর প্রশ্বাস গ্রহণ বাড়ল। তারপর র্যাচেলও একবার মিরিয়াম-এর দিকে তাকাল এবং বলতে শুরু করল, ‘এ সবকিছুই আমি সন্ন্যাসীদেরকে বলেছিলাম এবং তারা তা মনোযোগ দিয়ে শুনেছিল কিন্তু মুখের ভাব দেখে মনে হচ্ছিল একজন যুবক তাদের সামনে দাঁড়িয়ে সাহসের সঙ্গে যা বলেছে তা সত্য নয়।
আমার কথা শেষ হওয়ার পর একজন সন্ন্যাসী কাছে এগিয়ে এল এবং ক্রুদ্ধভাবে বলল, ‘তোমার সাহস তো কম নয়, তুমি আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে এভাবে কথা বলছ?’ অন্য একজন হাসতে হাসতে এগিয়ে এল এবং বলল, ‘তুমি কি এগুলো গরু ও শূকরের কাছ থেকে শিখেছ, তোমার তত্ত্বাবধানে যারা মাঠে ঘুরে বেড়ায়?’ এবং তৃতীয় ব্যক্তি উঠে দাঁড়াল এবং আমাকে এই বলে হুমকি দিল, ‘তুমি অবশ্যই শাস্তি পাবে হে নব্যতান্ত্ৰিক।’ তারপর তারা এমনভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল যেন আমি একজন কুষ্ঠরোগী। তাদের কেউ একজন প্রধান যাজকের কাছে অভিযোগ করলে তিনি আমাকে সন্ধ্যায় তলব করলেন। সন্ন্যাসীরা আমার ভোগান্তির পূর্বাভাস পেয়ে উৎফুল্ল হয়ে উঠল এবং সেই উল্লাস তাদের চোখ মুখ দিয়ে ফুটে বেরুতে লাগল যখন আদেশ দেওয়া হল আমাকে চল্লিশ দিন ও চল্লিশ রাত কারাগারে বন্দি করে রাখতে। তারা আমাকে অন্ধকার কারাকক্ষে নিয়ে গেল, যেখানে আমি কবরের ভেতরে শুয়ে কাটালাম। কারণ কোনো আলো দেখতে পেলাম না। আমি বলতে পারতাম না রাত্রি কখন শেষ হচ্ছে দিনের শুরু থেকে এবং কিছুই অনুভব করতাম না শুধু আমার নিচের মাটিতে কীটপতঙ্গের হামাগুড়ি দিয়ে চলাচল করা ছাড়া আমি কিছুই শুনতে পেতাম না ভারী পদক্ষেপে হাঁটার শব্দ ছাড়া, বিশেষ করে যখন তারা আমাকে খাবার হিসেবে সামান্য রুটি এবং এক পাত্র ভিনেগার মেশানো পানি দিয়ে যেত দীর্ঘ বিরতির পর।
যখন আমি কারাগার থেকে এলাম তখন দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম এবং সন্ন্যাসীরা বিশ্বাস করেছিল যে তারা আমার চিন্তাকে তাদের ইচ্ছামতো পরিচর্যা করতে পেরেছে এবং হত্যা করেছে আমার আত্মার আকাঙ্ক্ষা। তারা ভেবেছিল ক্ষুধা এবং তৃষ্ণা আমার দয়ার্দ্র উপাদানগুলির শ্বাসরুদ্ধ করে দিয়েছে ঈশ্বর যা আমার হৃদয়ে স্থাপন করেছিলেন। আমার চল্লিশ দিনের নিঃসঙ্গতার ভেতরে আমি একটা পদ্ধতি খুঁজে বের করেছিলাম যার সাহায্যে আমি এই সন্ন্যাসীদের সাহায্য করতে পারি আলো দেখতে এবং শুনতে জীবনের প্রকৃত সংগীত, কিন্তু আমার সমস্ত চেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে যায়, কারণ দীর্ঘকাল ধরে যে মোটা অবগুণ্ঠন বয়ন করা হয়েছে তাদের চোখের চারপাশে তা এত অল্প সময়ের ভেতরে ছিঁড়ে ফেলা যাবে না এবং তাদের কান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে অজ্ঞতার সিমেন্টের আস্তরণ দিয়ে, কোমল আঙুলের স্পর্শে তা অপসারিত হবে না।’
নীরবে কয়েক মূহূর্ত কেটে গেল। তারপর মিরিয়াম তাকাল তার মায়ের দিকে এবং বলল, ‘আপনার অবশ্যই সন্ন্যাসীদের সঙ্গে আবার কথা বলতে হবে, যদি তারা সত্যি সত্যিই আপনাকে আশ্রম থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার জন্য এই ভয়াবহ রাতকে নির্বাচন করে তাকে। তাদের শেখা উচিত দয়ালু হতে এমনকি তাদের শত্রুর সঙ্গেও।’
খলিল বলল, ‘সেই সন্ধ্যায় প্রচণ্ড ঝড়ে আকাশ উন্মত্ত হয়ে উঠল, আমি সন্ন্যাসীদের কাছ থেকে সরে এলাম। তারা গুটিসুটি মেরে আগুনের কাছে বসেছিল। বিভিন্ন গল্প করছিল এবং সেই সঙ্গে রসিকতা। তারা আমাকে একা দেখতে পেয়ে আমার প্রতি মনোযোগ দিল। আমি আমার বাইবেলের নতুন নিয়ম পড়ছিলাম এবং গভীরভাবে চিন্তা করছিলাম যিশুর চমৎকার বাণীগুলি, যা কিছুক্ষণের জন্য আমাকে ভুলিয়ে দিয়েছিল প্রকৃতির ক্রুদ্ধতা এবং আকাশে যুদ্ধরত উপাদানগুলি। এমন সময় তারা আমার কাছে এল এবং নতুন উদ্যামে রসিকতা করতে শুরু করল। আমি তাদেরকে অবহেলা করলাম। তাকালাম জানালা দিয়ে বাইরের দিকে কিন্তু সন্ন্যাসীরা ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল, কারণ আমার নীরবতা তাদের হাসি থামিয়ে দিয়েছিল এবং বিদ্রূপ করেছিল তাদের ওষ্ঠগুলিতে। তাদের একজন বলল, ‘তুমি কি পড়ছ হে বিশাল সংস্কারক’ তার কথার উত্তরে আমি আমার বই খুললাম এবং পড়তে লাগলাম, ‘হে সাপের প্রজন্মকে তোমাদেরকে সতর্ক করেছে ক্রোধের তীব্রতা থেকে পালিয়ে যেতে? অনুতাপের ফলগুলিকে সামনে নিয়ে এসো এবং চিন্তা কোরো না মনে মনে একথা বলবে যে, আমরা ইব্রাহিমকে পেয়েছি আমাদের পিতার কাছে, কারণ আমি তোমাদেরকে বলছি ঈশ্বর এইসব পাথর থেকে অসংখ্য সন্তান সৃষ্টি করতে সক্ষম এবং এখনও কুঠার পড়ে আছে গাছের শিকড়ের ওপর। সুতরাং প্রতিটি গাছ যা বহন করে আনে সামনে তার সবগুলি ভালো ফল নয় এবং যা টুকরো টুকরো হয়ে নিচে পড়ে এবং সংগৃহীত হয় আগুনের ভেতরে।’
আমি পড়া শেষ করলাম। সন্ন্যাসীরা চুপ করে থাকল যেন কেউ অদৃশ্য হাতে তাদের গলা টিপে ধরেছে। কিন্তু তারা মিথ্যা মনোবল সঞ্চয় করে হাসতে শুরু করল। একজন বলল, ‘আমরা বহুবার এগুলি পড়েছি এবং একজন রাখাল আমাদের সামনে তা পুনরাবৃত্তি করুক তা আমরা চাই না।’
আমি প্রতিবাদ করে বলি, ‘তোমরা যদি এসব পড়তে এবং তার অর্থ উপলব্ধি করতে পারতে তাহলে এসব গ্রামবাসী ঠাণ্ডা ও ক্ষুধায় মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করত না।’ একথা শুনে একজন সন্ন্যাসী আমার মুখে চড় মারল যেন আমি পাপের কথা উচ্চারণ করেছি। অন্য একজন লাথি মারল এবং তৃতীয়জন কেড়ে নিল আমার গ্রন্থটি এবং চতুর্থজন ডেকে আনল প্রধান যাজককে, যে দ্রুত ঘটনাস্থলে উপস্থিত হল রাগে কাঁপতে কাঁপতে এবং চিৎকার করে বলল, ‘গ্রেফতার করো এই বিদ্রোহীকে এবং টেনে নিয়ে যাও এই পবিত্র স্থান থেকে এবং তাকে বাইরে ফেলে দাও। ঝড় তাকে শিক্ষা দিক কীভাবে অনুগত হতে হয় এবং সেটাই ঈশ্বরের ইচ্ছা। তারপর তোমাদের হাত ধুয়ে পরিচ্ছন্ন করো তার পোশাক থেকে আসা নব্যতন্ত্রের দুর্গন্ধ। যদি সে ক্ষমা চাওয়ার জন্য ফিরে আসে, তাহলে দরজা খুলবে না, কারণ একটা কালসাপ কখনও ঘুঘুতে পরিণত হয় না যতই তাকে খাঁচায় বন্ধ করে রাখো কাঁটাগাছে কখনও ফোটে না ডুমুর, আঙুর বাগানে তা রোপণ করলেও।
আদেশ অনুযায়ী সন্ন্যাসীরা হাসতে হাসতে আমাকে টেনে হিঁচড়ে আশ্রমের বাইরে নিয়ে গেল। আমার পেছনে দরজাটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগেই আমি শুনতে পেলাম: ‘গতকাল তুমি ছিলে গরু ও শূকরের রাজা এবং আজ তুমি সিংহাসনচ্যুত। হে বিশাল সংস্কারক এখন যাও এবং নেকড়েদের রাজায় পরিণত হও এবং শিক্ষা দাও তাদেরকে মিথ্যাবাদীদের ভেতরে থেকে কীভাবে বাঁচতে হয়।’
খলিল একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর মুখ ঘোরাল এবং জ্বলন্ত আগুনের দিকে তাকাল। অপ্রসন্নভাবে কিন্তু মধুর ও প্রেমময় কণ্ঠে সে বলল, ‘আমাকে আশ্রম থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। সন্ন্যাসীরা মৃত্যুর হাতের মুঠোয় আমাকে সরবরাহ করেছিল। আমি অন্ধের মতো যুদ্ধ করেছিলাম সেই রাত্রির অন্ধকারে। প্রবল বাতাস আমার পোশাক ছিঁড়ে ফেলেছিল এবং রাশি রাশি বরফের ভাঁজে আটকে গিয়েছিল আমার পা যা আমাকে ক্রমশ নিচের দিকে টানছিল আমি পড়ে না যাওয়া পর্যন্ত। আমি বেপরোয়াভাবে কেঁদেছিলাম সাহায্যের জন্য। আমি অনুভব করেছিলাম মৃত্যু ছাড়া কেউ আমার আহ্বান শুনতে পায় না। কিন্তু একটা শক্তি আমার কান্না শুনছিল যা মূলত জ্ঞান এবং দয়া। সেই শক্তি চায়নি আমি মারা যাই জীবনের গোপনীয়তার কাছে, যা পরিত্যক্ত সে সম্পর্কে কোনো শিক্ষা পাওয়ার আগেই। সেই শক্তি আপনাদের দুজনকে পঠিয়েছিল নরক ও অস্তিত্বহীনতার গভীরতা থেকে আমার জীবনকে রক্ষা করতে।’
র্যাচেল ও মিরিয়াম অনুভব করল যে তাদের আত্মা যুবকের দুর্গতিকে বুঝতে পেরেছে। র্যাচেল সামনে এগিয়ে গেল এবং কোমলভাবে স্পর্শ করল তার হাত। তার চোখ থেকে অবিরাম ধারায় জল পড়ছিল। সে বলল, ‘স্বর্গ যাকে পছন্দ করেছে সত্যের রক্ষাকারী হিসেবে সে স্বর্গের ঝড় ও তুষারপাতের কারণে মরে যেতে পারে না।’ এবং মিরিয়াম বলল, ‘ঝড় এবং তুষারপাত হত্যা করতে পারে ফুলকে, কিন্তু বীজকে ধ্বংস করতে পারে না কারণ বরফ তাদেরকে উষ্ণ রাখে।’
এসব উৎসাহের বাণী শুনে খলিলের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এবং সে বলে, ‘আপনারা আমাকে বিদ্রোহী বা নব্যতান্ত্রিক মনে করেবেন না যেমন আশ্রমের সন্ন্যাসীরা করেছিল। আশ্রমে আমি যে কষ্ট ভোগ করে টিকেছিলাম সেটা হচ্ছে নিপীড়িত একটা জাতির প্রতীকচিহ্ন, যা এখনও সিদ্ধিলাভ করেনি এবং এই রাত্রি যার ভেতরে আমি মৃত্যুর প্রান্তে পৌছেছিলাম বিদ্রোহের মতো, তা পরিপূর্ণ ন্যায়বিচার পেয়েছে। সংবেদনশীল নারীর হৃদয় মানবতার সুখ দেখলে লাফিয়ে ওঠে এবং তার সৎ আত্মার দয়া থেকে বেরিয়ে আসে মানবতার প্রেম।’
সে তার চোখ বন্ধ করে বালিশের ওপর মাথা রাখল। দুই নারী আর কোনো কথা বলল না, কারণ তারা জানত ক্লান্তি তার দুচোখ দখল করে নিয়েছে। খলিল ঘুমিয়ে থাকল একটা হারিয়ে যাওয়া শিশুর মতো যে অবশেষে তার মায়ের বাহুতে নিরাপত্তা খুঁজে পেয়েছে।
র্যাচেল ও তার কন্যা ধীরে ধীরে হেঁটে তাদের বিছানার কাছে গেল এবং সেখানে বসে লক্ষ্য করতে থাকল যুবককে, যেন তারা তার যন্ত্রণাকাতর মুখে একটা আকর্ষণ লক্ষ্য করেছিল যা তাদের হৃদয়কে তার কাছাকাছি নিয়ে গেল। মা ফিসফিস করে বলল, তার বন্ধ-করা চোখে এক বিস্ময়কর শক্তি রয়েছে যা নীরবতার ভেতরে কথা বলে এবং উদ্দীপিত করে আকাঙ্ক্ষাকে।’
মিরিয়াম জবাব দিল, ‘মা চার্চের ছবিতে দেখা যিশুর হাতের মতো তার হাত।’ মা ফিসফিস করে বললেন, ‘তার মুখমণ্ডল একই সঙ্গে নারীর কোমলতা ও পুরুষের দৃঢ়তাকে ধারণ করে।
সুখনিদ্রার পাখাগুলি এই দুই নারীর আত্মাকে বহন করে নিয়ে যায় স্বপ্নের পৃথিবীতে এবং আগুন জ্বলে জ্বলে ছাই হয়ে যায় এবং তেলের বাতিটা অনুজ্জ্বল হতে হতে একসময় নিভে গেল। ক্রুদ্ধ ঝড়ের গর্জন বাড়তেই থাকল এবং অস্পষ্ট আকাশ ছড়িয়ে দিতে লাগল রাশি রাশি বরফ এবং প্রবল বাতাস সেই বরফ ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিল ডাইনে এবং বামে।
চতুর্থ পৰ্ব
পাঁচ দিন কেটে গেল এবং আকাশ থেকে তখনও প্রচুর বরফ পড়ছিল এবং নির্মমভাবে সমাহিত করছিল পাহাড় ও তৃণভূমি। খলিল তিনবার উদ্যোগ নিল সমতলভূমির দিকে যেতে, কিন্তু র্যাচেল প্রতিবারই তাকে বাধা দিয়েছে এই বলে, ‘ঐসব অন্ধ উপাদানের কাছে গিয়ে আপনার জীবনটাকে শেষ করবেন না ব্রাদার, এখানেই থাকুন। কারণ যে রুটি দুজনের জন্য পর্যপ্ত তা তিন জনেরই আহার যোগাবে এবং অগ্নিকুণ্ডের আগুন জ্বলতেই থাকবে আপনি চলে যাওয়ার পর যা আপনি আসার আগেও জ্বলছিল। ব্রাদার, আমরা গরিব কিন্তু অন্যদের মতোই আমরাও বেঁচে থাকি সূর্য ও মানবতার সামনে এবং ঈশ্বর দান করেন আমাদেরকে প্রতিদিনের খাবার।
মিরিয়াম দয়ার্দ্রচোখে তার দিকে তাকাল এবং একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কারণ যুবকটি গৃহে প্রবেশের পর থেকেই সে একটি ঐশ্বরিক ক্ষমতার উপস্থিতি লক্ষ্য করছে তার আত্মার ভেতরে যা জীবনকে সামনে এগিয়ে নিচ্ছে এবং আলো ছাড়াচ্ছে আত্মার এবং জাগিয়ে তুলছে নতুন করে মায়ামমতা যা তার আত্মার পবিত্রতার ভেতরে পবিত্রতম। কারণ জীবনে এই প্রথম সে সেই অনুভূতি উপলব্ধির অভিজ্ঞতা অর্জন করল যা তার হৃদয়কে একটা সাদা গোলাপে পরিণত করেছে, যা চুমুক দিয়ে পান করে ভোরের শিশিরকণা এবং সুগন্ধ গ্রহণ করে শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে সীমাহীন শূন্যতার ভেতরে।’
সেখানে অধিক শুদ্ধতা এবং অধিক প্রশান্তি নেই, হৃদয়ের ভেতরে যে একজন লুকানো আছে তার চেয়ে, সে হঠাৎ করে জেগে ওঠে এবং স্বর্গীয় সংগীতে পরিপূর্ণ করে তোলে নিজের আত্মা, যা তার দিনগুলিকে পরিণত করে বাঁচার স্বপ্নে এবং রাত্রিগুলিকে ভবিষ্যৎ বক্তায়। অধিক শক্তিশালী ও অধিক সুন্দর জীবনের রহস্যের ভেতরে কোনো গোপনীয়তা নেই সেই সংযুক্তির চেয়ে, যা কুমারীর আত্মার নীরবতাকে পরিণত করে অন্তহীন সচেতনতায়, যা একজন মানুষকে অতীত ভুলতে সাহায্য করে, কারণ এটা হৃদয়ের ভেতরে উদ্দীপ্ত হয়, যা আসন্ন ভবিষ্যতের মধুর ও নিমজ্জিত আকাঙ্ক্ষা লেবাননের নারীরা নিজেদেরকে পৃথক করে অন্য জাতির নারীদের সঙ্গে সারল্যের দ্বারা। যে পদ্ধতিতে শিক্ষাগতভাবে তার অগ্রগতি যা সংরক্ষণ করার জন্য প্রশিক্ষিত হয়ে ওঠে এবং দাঁড়িয়ে থাকে ভবিষ্যতের অন্তরায় হিসেবে। যদিও এ কারণে সে নিজেকে দেখতে পায় নিজের তদন্তকারী হিসেবে, যা তার হৃদয়ের নম্রতা এবং রহস্য। লেবাননের নারীরা হল বসন্তের মতো, যা পৃথিবীর হৃদয় থেকে বেরিয়ে আসে এবং অনুসরণ করে এর গতিপথ বিপদগ্রস্ত বাতাসের ভেতর দিয়ে, কিন্তু সমুদ্রে নির্গমনের কোনো পথ খুঁজে পায় না। এটা একটা শান্ত লেকে পরিণত হয়, সেখানে প্রতিফলিত হতে থাকে জ্বলজ্বলে নক্ষত্র এবং দীপ্তিমান চাঁদ। মিরিয়মের আত্মার স্পন্দন অনুভব করে খলিল যা তার আত্মার সঙ্গে সরাসরি পেঁচিয়ে যায় এবং সে জানত, ঐশ্বারিক মশাল যা তার হৃদয়কে আলোকিত করে তা মিরিয়ামের হৃদয়কেও স্পর্শ করেছে। সে এই প্রথমবারের মতো উল্লাসিত হল ছোট্ট নদীর মতো যে বৃষ্টিকে অভিবাদন জানাচ্ছে, নিজেকে অভিযোগ করছে তাড়াহুড়া করার জন্য, বিশ্বাস করছে এই আধ্যাত্মিক উপলব্ধি মেঘের মতো অতিক্রম করে যাবে, যখন সে চলে যাবে এই গ্রাম থেকে। সে প্রায়ই নিজেকে বলত, ‘এই রহস্য কী যা আমাদের জীবনে বিশাল ভূমিকা পালন করে? এই আইনগুলি কী যা আমাদেরকে পরিচালিত করে এবড়োথেবড়ো পথে এবং আমাদেরকে থামায় সূর্যের মুখোমুখি পৌঁছাবার আগেই যেখানে আমরা উৎফুল্ল হতে পারতাম। এই ক্ষমতা কী যা আমাদের আত্মাকে উত্তোলণ করে পাহাড় চূড়ায় না পৌঁছানো পর্যন্ত; হাসে ও মহিমান্বিত করে এবং হঠাৎ করেই আমরা জড়ো হই উপত্যকার গভীরে, কাঁদতে ও দুর্ভোগ পোহাতে থাকি? এই জীবন কি যা একদিন প্রেমিকের মতো আলিঙ্গন করে আমাদের এবং দ্বিতীয় দিন আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে শত্রুর মতো? গতকাল কি আমি কষ্ট পাই নাই? আমি কি নিজেকে টিকিয়ে রাখিনি ক্ষুধা, তৃষ্ণা, দুর্ভোগ ও ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের ভেতরে সত্যের প্রয়োজনে, যা স্বর্গ আমার হৃদয়ের ভেতরে জাগিয়ে রেখেছে। আমি কি সন্ন্যাসীদের বলি নাই সত্যের ভেতর দিয়ে সেই সুখের কথা, যা মানুষের ভেতরে ঈশ্বরের ইচ্ছা এবং উদ্দেশ্য? তাহলে ভয় কী? এবং কেন আমি আমার চোখ বন্ধ করি সেই আলো দেখে যা ঐ যুবতী নারীর চোখ থেকে প্রবাহিত হয়? আমাকে বহিষ্কার করা হয়েছিল এবং সে হচ্ছে গরিব, কিন্তু এটা ছিল রুটির ওপরে যা খেয়ে মানুষ বাঁচতে পারে। আমরা কী পর্যাপ্ততা ও দুর্ভিক্ষের মাঝখানে নেই, শীতে ও গ্রীষ্মের মাঝখানের বৃক্ষগুলির ভেতরে? কিন্তু র্যাচেল কি বলবে যদি সে জানতে পারে আমার ও তার কন্যার হৃদয় একটা বোঝাবুঝিতে পৌঁছেছে নীরবতার ভেতরে এবং পরস্পরের কাছাকাছি আসে এবং নিকটবর্তী হয় সর্বময় ক্ষমতার আলোর বৃত্তের ভেতরে। কী বলবে সে, যদি সে আবিষ্কার করে যে যুবকের জীবন সে বাঁচিয়েছে সে আকুল আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তার কন্যার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এই সাধারণ গ্রামবাসীরা কী বলবে যদি তারা জানতে পারে একজন যুবক যে আশ্রমে কোণঠাসা অবস্থায় দিন কাটাত, সে আশ্রম থেকে বহিষ্কৃত হয়েছে এবং এখন তার আকাঙ্ক্ষা জেগেছে এই সুন্দর যুবতীর কাছাকাছি বসবাস করার। তারা কি আমার কথা শুনবে যদি আমি তাদেরকে বলি যে, আমি আশ্রম পরিত্যাগ করেছি তাদের ভেতরে জীবনযাপন করতে একটা পাখির মতো, যে খাঁচার দাগ-পড়া স্বাধীনতার আলোর দিকে উড়ে যায়? কী বলবে শেখ আব্বাস যদি সে আমার কাহিনী শোনে? গ্রামের যাজক কী করবে যখন সে আমার বহিষ্কারের কারণ সম্পর্কে জানবে?’
খলিল তার নিজের পদ্ধতিতে কথা বলে যেতে থাকে নিজের সঙ্গে, আগুনের পাশে বসে ধ্যান করতে থাকে অগ্নিশিখার, যা তার ভালোবাসার প্রতীক এবং মিরিয়াম তাকিয়ে আছে তার দিকে, তার স্বপ্নগুলো পাঠ করছে তার চোখের ভেতর দিয়ে এবং শুনছে তার চিন্তার প্রতিধ্বনি এবং অনুভব করছে তার ভালোবাসার স্পর্শ, যদিও কোনো শব্দ উচ্চারিত হয়নি।
এক রাতে খলিল উপত্যকার মুখোমুখি একটা ছোট্ট জানালার পাশে দাঁড়িয়েছিল। উপত্যকা ও পাহাড়গুলি ঢাকা ছিল বরফের আচ্ছাদনে। মিরিয়াম এসে তার পাশে দাঁড়াল, আকাশ দেখল, তারপর ঘুরে দাঁড়াতেই চোখে চোখে দুজনের সাক্ষাৎ ঘটল। খলিল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল এবং চোখ বন্ধ করল যেন তার আত্মা প্রশস্ত আকাশে পাল উড়িয়েছে একটা শব্দের সন্ধানে। সে কোনো প্রয়োজনীয় শব্দই খুঁজে পেল না। কারণ নীরবতাই তাদের হয়ে কথা বলছিল। মিরিয়াম বলল, ‘বরফ গলে নদীর স্রোতের সাথে মিশে যাবে এবং পথগুলি শুকিয়ে যাবে, তখন কোথায় যাবেন আপনি?’ সে তার চোখ খুলল, তাকাল দিগন্তের দিকে এবং ব্যাখ্যা করল, ‘আমি সেই পথ অনুসরণ করব যেখানে আমার ভাগ্য এবং সত্য রক্ষার দায়িত্ব আমাকে নিয়ে যাবে।’ মিরিয়াম বেদনার সঙ্গে দীর্ঘশ্বাস ফেলল এবং বলল, ‘কেন আপনি আমাদের সঙ্গে থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না? কোথাও যাবার কি কোনো বাধ্যবাধকতা আছে?’ খলিল তার মিষ্টি কথায় মুগ্ধ হয়ে তার দিকে তাকাল এবং বলল, ‘গ্রামবাসীরা একজন বহিষ্কৃত সন্ন্যাসীকে প্রতিবেশী হিসেবে গ্রহণ করবে না এবং সেই বাতাসে শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করতে দেবে না যে বাতাসে তারা শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়। তারা মনে করে আশ্রমের শত্রু যে সে একজন নাস্তিক এবং ঈশ্বর ও তার সিদ্ধপুরুষদের দ্বারা অভিশপ্ত।’
মিরিয়াম চুপ করে থাকে। কারণ সত্য তাকে পুনরায় কথা বলতে বাধা দিল। এরপর খলিল ব্যাখ্যা করল, ‘মিরিয়াম, এই গ্রামবাসীদের শিক্ষা দেওয়া হয়েছে তাকে ঘৃণা করতে যে স্বাধীনভাবে চিন্তা করে। সেইসব লোক থেকে দূরে থাকতে বলা হয়েছে তাদের যাদের হৃদয় আকাশের অনেক উঁচুতে পাখা না নাড়িয়ে ভেসে থাকে। ঈশ্বর একজন অজ্ঞ মানুষের প্রার্থনাকে পছন্দ করেন না যে কাউকে অনুকরণ করে। গ্রামবাসীরা আমাকে বলবে আমি একজন নাস্তিক, কর্তৃপক্ষকে অমান্য করেছি, যারা ঈশ্বরের আশীর্বাদপ্রাপ্ত। আমি যদি তাদেরকে হৃদয়ের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে বলি এবং আত্মাকে ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করতে বলি তাহলে তারা আমাকে বলবে আমি একটা খারাপ লোক যে তাদেরকে যাজকের বিরুদ্ধে কাজ করতে বলেছে, যে যাজককে পৃথিবী ও স্বর্গের মাঝখানে স্থাপন করেছেন ঈশ্বর।’
খলিল সরাসরি এবার মিরিয়ামের চোখের দিকে তাকাল এবং বলল, ‘এই গ্রামে একটা জাদুকরি শক্তি আছে যা আমাকে দখল করেছে এবং গ্রাস করেছে আমার আত্মা। একটি ক্ষমতা যা খুবই ঐশ্বরিক এবং যা আমাকে কষ্ট ভুলতে সাহায্য করেছে। এই গ্রামে আমি মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছি এবং এখানে আমার আত্মা ঈশ্বরের আত্মাকে আলিঙ্গন করেছে। এই গ্রামে প্রাণহীণ ঘাসের ওপর ভেসে উঠেছে একটা চমৎকার ফুল। এর সৌন্দর্য আমার হৃদয়কে আকর্ষণ করেছে এবং এর সুগন্ধ পরিপূর্ণ করে তুলেছে এর সাম্রাজ্য। আমি কি এই চমৎকার ফুলটিকে পরিত্যাগ করে যাব এবং চলে যাব সেই মতামত প্রচার করতে যার কারণে আশ্রম থেকে আমি বহিষ্কৃত হয়েছি অথবা আমি সেই ফুলের পাশে রয়ে যাব একটা কবর খুঁড়তে এবং সমাহিত করতে আমার চিন্তাগুলি। আমি কী করব মিরিয়াম?’
তার কথা শুনে মিরিয়াম ভোরের রঙ্গপ্রিয় মৃদুমন্দ বাতাসে একটা পদ্মফুলের মতো কাঁপতে লাগল। চোখের ভেতর দিয়ে তার আত্মা ছড়াতে লাগল উত্তাপের বিকিরণ এবং সে দ্বিধান্বিত স্বরে বলল, ‘আমরা দুজনেই রহস্যময় ও দয়ালু ক্ষমতার হাতে সমর্পিত। তাঁর ইচ্ছা পূর্ণ হতে দিন।’
সেই মুহূর্তে দুটি হৃদয় একত্রিত হল এবং তারপর উভয় আত্মাই একটা মশাল জ্বালাল তাদের জীবনকে আলোয় উদ্ভাসিত করতে।
পঞ্চম পৰ্ব
সৃষ্টির শুরু থেকে আমাদের বর্তমান সময় পর্যন্ত, নির্দিষ্ট কিছু গোত্র উত্তরাধিকারের মাধ্যমে সমৃদ্ধ হয়েছে, যাজকদের সহযোগিতায় এবং তাদেরকে নিয়োগ করা হয়েছে জনগণের প্রশাসক হিসেবে। এটা সমাজের হৃদয়ের একটা প্রাচীন ক্ষত যা অপসারিত হতে পারে না অজ্ঞতার তীব্র অপসারণ ছাড়া।
উত্তরাধিকার সূত্রে যে মানুষ সম্মান অর্জন করে সে-ই তার অট্টালিকা নির্মাণ করে গরিবের অর্থে। যাজকরা তাদের মন্দিরকে সোজা করে তুলেছে অনুরক্ত প্রার্থনাকারীদের কবর ও হাড়ের ওপর। রাজকুমার আঁকড়ে ধরে কৃষকের বাহু যখন যাজকরা তার পকেট খালি করে দেয়, শাসকেরা ভ্রূকুটি করে তাকায় ভূমিপুত্রদের দিকে, বিশপ তাদেরকে সান্ত্বনা দেয় হাসিমুখে এবং বাঘের ভ্রূকুটি ও নেকড়ের হাসির মাঝখানে তারা ধ্বংস হয়ে যায়, শাসক নিজেকে আইনের রাজা হিসেবে দাবি করে এবং যাজকেরা দাবি করে তারা ঈশ্বরের প্রতিনিধি এবং এই দুয়ের মাঝখানে তাদের শরীর ধ্বংস হয়ে যায় এবং আত্মারা শুকিয়ে বিবর্ণ হয় শূন্যতার ভেতরে।
লেবাননের সেই পাহাড়টা ছিল সূর্যালোকে সমৃদ্ধ এবং জ্ঞানের দিক থেকে দরিদ্র, সৎ ও যাজকেরা হাত মিলিয়েছিল সেইসব কৃষকদেরকে শোষণ করতে যারা ভূমি কর্ষণ করত এবং ফসল তুলত বিধিসম্মতভাবে নিজেদেরকে রক্ষা করতে শাসকের তরবারি এবং যাজকদের অভিশাপ থেকে। লেবাননের ধনীলোকেরা গর্বভরে তার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘সুলতান আমাকে তোমাদের অধিপতি হিসেবে নিয়োগ করেছেন।’ কিন্তু লেবানীয়রা চুপ করে থাকত, কারণ মৃত মানুষ কথা বলতে পারে না।
শেখ আব্বাসের হৃদয়ে যাজকদের জন্য ভালোবাসা ছিল। কারণ তারা ছিল তার মিত্র, বিশেষ করে মানুষের মনকে গলা টিপে হত্যা করার এবং শ্রমিকদের ভেতরে কঠোর আনুগত্য ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে।
সেই সন্ধ্যায় যখন খলিল তার ভালোবাসার সিংহাসন মিরিয়ামের কাছাকাছি নিয়ে এল এবং র্যাচেল মমতার দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়েছিল, ফাদার ইলিয়াস ঠিক সেই সময় শেখ আব্বসাকে জানাল, প্রধান যাজক একজন যুবক বিদ্রোহীকে আশ্রম থেকে বহিষ্কার করেছে এবং সে আশ্রয় নিয়েছে সামান রামির বিধবা স্ত্রী র্যাচেল-এর বাড়িতে। এটুকু তথ্য পরিবেশন করে সে তৃপ্ত হতে পারছিল না। সে আরও বলল, ‘যে অশুভ আত্মাকে তারা আশ্রমে তাড়া করে ফিরেছে, গ্রামের পরিবেশে সে দেবদূতে পরিণত হতে পারে না এবং যে ডুমুরগাছ টুকরো টুকরো করে আগুনে ফেলে দেওয়া হয়েছে, পুড়ে যাওয়ার সময় তাতে কোনো ফল ধরবে না। যদি আমরা এই গ্রামকে পরিচ্ছন্ন রাখতে চাই পশুর বিষ্ঠা থেকে তাহলে আমাদের উচিত তাকে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেওয়া। যেমন সন্ন্যাসীরা দিয়েছিল।’ শেখ জানতে চাইল, তুমি কি নিশ্চিত যে এই লোকটি গ্রামের মানুষের ওপর খারাপ প্রভাব ফেলবে? তাকে আঙুরক্ষেতের শ্রমিক হিসেবে গ্রামে থাকতে দিলে কেমন হয়? আমাদের শক্তিশালী লোক দরকার।’
যাজকের চোখে মুখে অসম্মতি ফুটে উঠল। আঙুল দিয়ে দাড়ি আঁচড়াতে আঁচড়াতে সে বিচক্ষণতার সঙ্গে বলল, ‘যদি সে ঠিকমতো কাজই করত, তাহলে তাকে আশ্রম থেকে বহিষ্কার করা হত না। আশ্রমে কাজ করে এক ছাত্র যে গতরাতে আমার বাড়িতে ছিল, সে বলল যে, এই যুবক প্রধান যাজকের আদেশ অমান্য করেছে এবং সন্ন্যাসীদের ভেতরে প্রচার করেছে যে, ‘শস্যক্ষেত, আঙুর বাগান এবং আশ্রমের সোনা ও রুপা গরিবদেরকে ফিরিয়ে দিতে এবং ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিতে চারদিকে এবং সাহায্য করতে মানুষকে যাদের জ্ঞানের প্রয়োজন রয়েছে। এসব করলে তোমাদের স্বর্গীয় পিতা খুশি হবে না?’
এসব কথা শুনে আব্বাস প্রায় লাফিয়ে উঠল এবং একটা বাঘের মতো প্রস্তুতি নিল অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার। সে তার ভৃত্যদেরকে তক্ষুনি এ সম্পর্কে জানাতে বলল। তিনজন ভৃত্য প্রবেশ করল এবং শেখ বলল, ‘সামান রামির বিধবা স্ত্রীর বাড়িতে সন্ন্যাসীদের পোশাক পরা একজন যুবক আছে। তাকে বেঁধে এখানে নিয়ে এসো। যদি ঐ স্ত্রীলোকটি গ্রেফতার করতে বাধা দেয়, তাহলে তাকেও চুল ধরে টেনে নিয়ে এসো বরফের ওপর দিয়ে। কারণ যে অশুভ আত্মাকে আশ্রয় দেয় সেও একটি অশুভ আত্মা। ভৃত্যরা তাকে আনুগত্যের সঙ্গে অভিবাদন জানিয়ে বেরিয়ে গেল। তারা র্যাচেলের বাড়ির দিকে যেতে লাগল এবং যাজক তখন শেখ-এর সঙ্গে আলোচনা করতে থাকল কী ধরনের শাস্তি উপহার হিসেবে প্রদান করা হবে খলিল ও র্যাচেলকে।
ষষ্ঠ পর্ব
দিনশেষে রাত্রি ছড়িয়ে দিল তার ছায়া ঐসব বরফ-বোঝাই জরাজীর্ণ কুঁড়েঘরের ওপর। আকাশের নক্ষত্ররা অবশেষে আবির্ভূত হল অনন্তকাল থেকে আসা আকাঙ্ক্ষার মতো মৃত্যুর মর্মবেদনার ভোগান্তির পর। দরজা-জানালাগুলি বন্ধ ছিল এবং একটা বাতি জ্বলছিল। কৃষকেরা আগুনের পাশে বসে তাদের শরীর গরম করছিল। র্যাচেল, খলিল এবং মিরিয়াম একটা কাঠের টেবিলে বসে সন্ধ্যার খাবার খাচ্ছিল। ঠিক তখনই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হল এবং তিনজন লোক ভেতরে প্রবেশ করল। র্যাচেল এবং মিরিয়াম আতঙ্কিত হল, কিন্তু খলিলকে খুবই শান্ত দেখাল, যেন সে এই দুজনের অপেক্ষায় ছিল। একজন ভৃত্য খলিলের দিকে এগিয়ে গেল। তার কাঁধে হাত রাখল এবং জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি কি সেই ব্যাক্তি যাকে আশ্রম থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে?’ এবং খলিল বলল, ‘হ্যাঁ আমিই সেই লোক, তোমরা কী চাও?’ লোকটা উত্তর দিল, ‘আমাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তোমাকে গ্রেফতার করে শেখ আব্বাসের বাড়িতে নিয়ে যেতে। যদি তুমি যেতে না চাও তাহলে আমরা তোমাকে বরফের ওপর দিয়ে টেনে নিয়ে যাব, যেভাবে কসাই তার মৃত ভেড়াকে টেনে নিয়ে যায়।’
র্যাচেলের মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল। সে চেঁচিয়ে উঠল, ‘কী অপরাধ করেছে সে? কেন তোমরা তাকে বেঁধে বরফের ওপর দিয়ে টেনে নিয়ে যাবে?’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে দুই নারীই বলল, ‘তৈামরা তিনজন মানুষ একজনকে নিয়ে যেতে এসেছ? এভাবে তাকে কষ্ট দেওয়া একটা কাপুরুষতা।’ ভৃত্যগুলি রেগে গিয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘এই গ্রামে কি এমন নারী আছে যে শেখের আদেশ অমান্য করবে?’ তারা দড়ি বের করে খলিলকে বাঁধতে শুরু করে। খলিল গর্বভরে মাথা তোলে এবং একটা দুঃখের হাসি ফুটে ওঠে তার ঠোঁটে এবং সে বলে, ‘তোমাদের জন্য আমার দুঃখ হয়, কারণ তোমরা হলে একজন মানুষের হাতের শক্তিশালী ও অন্ধ যন্ত্র, যারা তোমাদের শক্তির সাহায্য নিয়ে দুর্বলকে নিপীড়ন করে। তোমরা হলে অজ্ঞতার দাস। গতকাল আমিও তোমাদের মতো ছিলাম, কিন্তু আগামীকাল তোমরাও মনের দিক থেকে মুক্ত হবে। যেমন আমি এখন মুক্ত। আমাদের মাঝখানে গভীর জলপ্রপাত যা আমার কণ্ঠস্বরের গলা টিপে ধরে এবং লুকিয়ে ফেলে আমার বাস্তবতাকে তোমাদের কাছ থেকে এবং তোমরা তা শুনতেও পারো না, দেখতেও পারো না। তোমাদের যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে আমার হাত বাঁধো।’ তার কথায় ভৃত্য তিনজন নীরব হয়ে গেল। মনে হল তার কণ্ঠস্বর তাদের ভেতরে নতুন উদ্যম জাগিয়ে তুলল, কিন্তু শেখ আব্বাসের কণ্ঠস্বর তখনও তাদের মনে বেজে যাচ্ছিল। সতর্ক করছিল দায়িত্ব সম্পন্ন করতে। তারা খলিলের হাত বেঁধে বাইরে নিয়ে গেল নীরবে। মনে হল তারা অনুতপ্ত। র্যাচেল এবং মিরিয়াম তাদেরকে অনুসরণ করল শেখের বাড়ি পর্যন্ত জেরুজালেমের কন্যার মতো যে যিশু খ্রিস্টকে অনুসরণ করেছিল মাউন্ট ক্যালভারি পর্যন্ত
সপ্তম পৰ্ব
কোনোরকম বিচার-বিবেচনা ছাড়াই দ্রুত সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে ছোট্ট গ্রামের কৃষকদের ভেতরে। তাদের সীমাবদ্ধ পরিবারের ভেতরে যা ঘটে তা নিয়ে তারা চিন্তিত হয় এবং নিজেদেরকে ব্যস্ত রাখে সেই আলোচনায়। শীতকালে বরফের চাদরের তলায় শস্যক্ষেত সুখনিদ্রায় মগ্ন। মানুষও আশ্রয় নিয়েছে আগুনের পাশে, কিন্তু তারা সাম্প্রতিক খবর সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠল।
খলিল গ্রেফতার হওয়ার অল্প কিছুক্ষণের ভেতরেই সংক্রামক ব্যাধির মতো খবরটা গ্রামবাসীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। তারা ঘর ছেড়ে দ্রুত সেনাবাহিনীর মতো চারদিক থেকে এসে শেখের বাড়িতে উপস্থিত হল। খলিল যখন আব্বাসের বাড়িতে পৌঁছাল তখন নারী, পুরুষ ও শিশুরা এসে সেখানে ভিড় করেছে, তারা আশ্রম থেকে বহিষ্কৃত নাস্তিককে এক ঝলক দেখতে চায়। তারা র্যাচেল ও তার কন্যার ব্যাপারে চিন্তিত, যারা তাদের গ্রামের পরিশুদ্ধ বাতাসে নব্যতন্ত্রের নারকীয় অসুখ ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করেছে।
শেখ বিচারকের আসনে বসল, তার পাশে বসল ফাদার ইলিয়াস। জনতা স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল সাহসের সঙ্গে তাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকের দিকে। র্যাচেল ও মিরিয়াম দাঁড়িয়ে আছে খলিলের পেছনে এবং তারা ভয়ে কাঁপছে। কিন্তু ভয় তার কি করতে পারে যে সত্য দেখেছে এবং অনুসরণ করছে তাকে? জনতার ঘৃণা সেই যুবতীকে কী করতে পারে যার আত্মা জেগে উঠেছে ভালোবাসায়? শেখ আব্বাস যুবকের দিকে তাকাল এবং ক্রুদ্ধকণ্ঠে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে শুরু করল, ‘তোমরা নাম কি হে?’ যুবক বলল, ‘আমার নাম খলিল।’ শেখ বলল, ‘তোমার পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজন কারা? এবং কোথায় তুমি জন্মেছ?’ খলিল কৃষকদের দিকে ঘুরল, যারা ঘৃণার দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়েছিল এবং বলল, ‘এই নিপীড়িত মানুষরাই আমার গোত্র এবং আমার আত্মীয় এবং এই বিশাল দেশই হল আমার জন্মস্থান।’ শেখ আব্বাস বিদ্রূপ করে বলল, ‘যাদেরকে তুমি গোত্র ও আত্মীয়-স্বজন বলছ তারা তোমার শাস্তি দাবি করছে এবং যে দেশকে তোমার জন্মস্থান দাবি করছ তা মোটেও তোমার দেশ নয়।’ খলিল উত্তর দিল, ‘অজ্ঞ জাতি সবসময়ই তাদের ভালো লোকদের গ্রেফতার করে এবং তাদেরকে নিয়ে যায় স্বৈরশাসকের সামনে এবং যে দেশ প্রজাপীড়কদের দ্বারা শাসিত হয় তারা কষ্ট দেয় সেইসব মানুষকে যারা দাসত্বের জোয়াল টানা থেকে রেহাই পেতে চায়। একজন ভালো ছেলে কি তার অসুস্থ মাকে পরিত্যাগ করে যায়? একজন দয়ালু মানুষ কি তার দুঃস্থ ভাইকে অস্বীকার করে? যে গরিব লোকেরা আমাকে গ্রেফতার করে এখানে এনেছে আজ এবং গতকাল যারা জীবন উৎসর্গ করেছিল তাদের সঙ্গে পার্থক্য কোথায়? এবং এই বিশাল পৃথিবী যা আমার অস্তিত্বকে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায় সে কি লোভী স্বৈরশাসককে গিলে ফেলে না?’
শেখ উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠল। তার উদ্দেশ্য এই লোকের সাহসকে দমন করা এবং দর্শককে প্রভাবিত করা থেকে লোকটাকে বিরত রাখা। সে খলিলের দিকে ঘুরল এবং বলতে লাগল, ‘তুমি হলে গবাদি পশুর রাখাল, তুমি কি মনে করো সন্ন্যাসীরা যে-পরিমাণ দয়া দেখিয়েছে আমরা তার চেয়ে বেশি দয়া তোমাকে দেখাব, যে আশ্রম থেকে বহিষ্কৃত হয়েছে? তুমি কি মনে করো আমরা একজন ভয়াবহ আন্দোলনকারীকে দয়া দেখাব?’ খলিল উত্তর দিল ‘এটা সত্য যে আমি একজন গবাদি পশুর রাখাল কিন্তু আমি আনন্দিত যে আমি একজন কসাই নই। আমি আমার পশুর পালকে সব সময় নেতৃত্ব দেই সমৃদ্ধ পশুচারণ ভূমিতে যেতে এবং কখনও তাদেরকে আমি কোনো অনুর্বর ভূমিতে চরতে নিয়ে যাইনি। আমি আমার পশুর পালকে পরিশুদ্ধ বসন্তের কাছে নিয়ে গেছি এবং কখনও তাদেরকে পান করতে দেয়নি দূষিত জলাভূমির পানি। সন্ধ্যায় নিরাপদে নিয়ে এসেছি তাদেরকে ছাউনিতে এবং কখনও তাদেরকে উপত্যকায় পরিত্যাগ করে আসিনি নেকড়ের খাদ্য হতে। পশুদের সঙ্গে আমি এরকম আচরণ করেছি এবং আপনারা যদি মানুষের সঙ্গে সেরকম আচরণ করতেন তাহলে এসব গরিব মানুষেরা বসবাস করত না পর্ণকুটিরে এবং কষ্ট পেত না দারিদ্র্য ও ক্ষুধায়। অথচ আপনারা এসব বিশাল অট্টালিকায় বসবাস করছেন সম্রাট নিরোর মতো।’
শেখের কপালে কয়েক বিন্দু ঘাম দেখা দিল এবং তার বোকামি পরিণত হল ক্রোধে, কিন্তু সে শান্ত থাকার চেষ্টা করল এবং ভান করল যে, সে খলিলের কথায় কোনো কর্ণপাত করেনি এবং সে খলিলের দিকে আঙুল নির্দেশ করে বলল, ‘তুমি একজন নব্যতান্ত্রিক এবং আমরা তোমার হাস্যকর কথা শুনব না, আমরা তোমাকে তলব করেছি অপরাধী হিসেবে। তোমার বিচার করতে এবং তোমার উপলব্ধি করা দরকার যে এই গ্রামের অধিপতির সামনে তুমি উপস্থিত হয়েছ, যাকে গভর্নর আমীর শিহাব-এর পক্ষ থেকে তার প্রতিনিধিত্ব করার জন্য ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তুমি দাঁড়িয়ে আছ ফাদার ইলিয়াস-এর সামনে, যে এই পবিত্র চার্চের একজন প্রতিনিধি যার শিক্ষা তুমি অস্বীকার করেছ। এখন নিজেকে রক্ষা করো অথবা হাঁটু গেড়ে বসো এইসব মানুষের সামনে আমরা তোমাকে ক্ষমা করে দেব এবং তারপর তোমাকে গবাদি পশুচারণের অনুমতি দেওয়া হবে, আগে যেভাবে ছিলে।’ খলিল শান্তভাবে বলল, ‘একজন অপরাধী অন্য একজন অপরাধীর বিচার করতে পারে না।’ সে জনতার দিকে তাকায় এবং তাদের উদ্দেশ্যে বলে, ‘হে আমার ভাইয়েরা, যে লোককে তোমরা তোমাদের শস্যক্ষেতের অধিপতি বলে থাকো এবং দীর্ঘকাল ধরে তোমরা তার বশ্যতা স্বীকার করে বেঁচে আছ, সে আমার বিচার করতে আমাকে নিয়ে এসেছে সেই অট্টালিকায় যা তৈরি হয়েছে তোমাদের প্রপিতামহের কবরের ওপর এবং যে লোক তোমাদের বিশ্বাসের মাধ্যমে তোমাদের চার্চের যাজক হয়েছে সে এসেছে আমার বিচার এবং তোমাদেরকে সাহায্য করতে আমার অবমাননা ও দুর্ভোগ বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য। তোমরা তাড়াহুড়া করে এখানে এসেছ চারদিক থেকে আমার দুর্ভোগ দেখতে এবং ক্ষমা পাওয়ার জন্য আমার মিনতি শুনতে। তোমরা এসেছ পশুর থাবার মাঝখানে ভয়ে কাঁপতে থাকা শিকারকে দেখতে। তোমরা আজ রাতে এসেছ বিচারকের সামনে একজন নাস্তিকের দাড়িয়ে থাকা দেখতে। আমি হলাম অপরাধী এবং আমি হলাম নব্যতান্ত্রিক যে আশ্রম থেকে বহিষ্কৃত হয়েছে। প্রবল ঝড় আমাকে নিয়ে এসেছে তোমাদের গ্রামে। তোমরা মনোযোগ দিয়ে আমার প্রতিবাদ শোনো এবং আমার প্রতি দয়া দেখানোর কোনো প্রয়োজন নেই, কিন্তু যথাযথ কাজটি করো, কারণ, দয়া করা হয় অপরাধীকে এবং একজন নিষ্পাপ মানুষও ন্যায়বিচার দাবি করে।’
‘আমি তোমাদেরকে এখন জুরি হিসেবে নিয়োগ করলাম, কারণ মানুষের ইচ্ছাই হল ঈশ্বরের ইচ্ছা। তোমাদের হৃদয়কে জাগিয়ে তোলো এবং মনোযোগ দিয়ে শোনো এবং তারপর তোমাদের বিবেক অনুযায়ী আমাকে অভিযুক্ত করো। তোমরা আমাকে বলেছ আমি একজন নাস্তিক, কিন্তু তোমাদেরকে জানানো হয়নি কী অপরাধ বা পাপ আমি করেছি। তোমরা দেখেছ আমাকে চোরের মতো বেঁধে রাখা হয়েছে, কিন্তু আমার অপরাধ সম্পর্কে তোমরা কিছুই শোনোনি, কারণ শাস্তি যখন বজ্রের মতো আসে আদালতে তখন অপরাধ প্রকাশিত হয় না। হে আমার সহগামীরা, আমার অপরাধ হচ্ছে তোমাদের দুর্দশাকে আমি উপলব্ধি করেছি, কারণ আমি সেই লোহাটার ওজন জানি যা স্থাপন করা হয়েছে তোমাদের গলার ওপর। আমার পাপ হচ্ছে তোমাদের নারীদের জন্য আমি হৃদয়ে যে বেদনা অনুভব করেছি তাই। আমার পাপ হচ্ছে তোমাদের শিশুদের জন্য আমার সহানুভূতি, যারা মৃত্যুর ছায়া মেশানো স্তন থেকে জীবনকে চুষে নেয়। আমি তোমাদেরই একজন এবং আমার পিতামহ এই উপত্যকায় বসবাস করতেন এবং একাই জোয়ালের নিচে তিনি মারা গেছেন যার কারণে তোমাদের মাথা নুয়ে পড়েছে এখন। আমি সেই ঈশ্বরকে বিশ্বাস করি, যিনি মনোযোগ দিয়ে শোনেন তোমাদের আত্মার দুর্ভোগের আহ্বান এবং আমি সেই গ্রন্থকে বিশ্বাস করি স্বর্গের সামনে যা আমাদেরকে ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ করে। আমি সেই শিক্ষাকে বিশ্বাস করি যা প্রত্যেককে সমান চোখে দেখে এবং আমাদেরকে উপস্থাপন করে পৃথিবীর ওপরে পাখাহীনভাবে, যা ঈশ্বরের সতর্ক পদক্ষেপের স্থান।
‘আশ্রমে আমি গরু চড়াতাম এবং গভীরভাবে চিন্তা করতাম তোমাদের সহ্যক্ষমতার বেদনাপূর্ণ অবস্থা সম্পর্কে। আমি তোমাদের প্রতারিত কান্না শুনেছি যা তোমাদের দুর্গত গৃহ থেকে এসেছে একটি অবদমিত আত্মার কান্না—একটি ভেঙে যাওয়া হৃদয়ের কান্না, এইসব শস্যক্ষেতের মালিকের দাস হিসেবে যা তোমাদের হৃদয়ের ভেতরে রুদ্ধ হয়ে আছে। আমি দেখতে পাই নিজেকে আশ্রমে এবং তোমাদেরকে শস্যক্ষেতে এবং আমি দেখি তোমরা মেষের পালের সঙ্গে একটা নেকড়েকে অনুসরণ করছ যে একজন মিথ্যাবাদীকে খুঁজছে এবং যখন আমি রাস্তার মাঝখানে থামি একটা মেষশাবককে সাহায্য করতে তখন আমিই সাহায্যের জন্য চিৎকার করে কেঁদে উঠি এবং নেকড়ে আমাকে ছিঁড়ে খায় তার তীক্ষ্ণ দাঁত দিয়ে।
‘আমি বন্দিত্ব, তৃষ্ণা এবং ক্ষুধার ভেতরে টিকে ছিলাম সত্যের খাতিরে যা শুধুমাত্র শরীরকে পীড়িত করে। আমি দুর্ভোগ অতিক্রম করেছি সহ্যক্ষমতারও ওপরে উঠে, কারণ আমি বেদনার্ত দীর্ঘশ্বাসকে কান্নার শব্দে পরিণত করেছি যা বাজে এবং প্রতিধ্বনিত হয় আশ্রমের প্রত্যেক বাঁকে বাঁকে। আমি কখনও ভয় পাইনি এবং আমার হৃদয় কখনও ক্লান্ত হয়নি। কারণ তোমাদের বেদনার্ত কান্না আমার প্রতিটি দিনের ভেতর প্রবেশ করিয়েছিল নতুন শক্তি এবং আমার হৃদয় হয়ে উঠেছিল সমৃদ্ধ। তোমরা এখন তোমাদেরকে এই বলে জিজ্ঞাসা করতে পারো, ‘যখন আমরা সাহায্যের জন্য কেঁদেছিলাম তখন কে সাহসের সঙ্গে তার ঠোঁট খুলেছিল?’ কিন্তু আমি তোমাদেরকে বলি, ‘তোমাদের আত্মা প্রতিদিন কাঁদে এবং সাহায্যের আবেদন জানাচ্ছে প্রতিরাতে, কিন্তু তোমরা তাদেরকে শুনতে পাও না, কারণ যে মারা যাচ্ছে সে কখনও শুনতে পায় না। তার হৃদয়ের ঘর্ঘর আওয়াজ শুধু তারাই শোনে যারা পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। জবাই করে ফেলা পাখি তার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বেদনার সঙ্গে নাচে কোনোকিছু না-জেনেই, কিন্তু যারা এই নাচের সাক্ষী তারা জানে এর কারণ কী। দিনের কোন্ সময়ে তোমরা বেদনার সঙ্গে দীর্ঘশ্বাস ফেলো? এটা কি ভোরবেলা, যখন ভালোবাসার অস্তিত্ব তোমাদের কাছে এসে কাঁদে এবং সুখনিদ্রার অবগুণ্ঠন অশ্রু ঝরায় তোমাদের চোখে এবং তোমাদেরকে শস্যক্ষেতে নিয়ে যায় দাসদের মতো? এটা কি দুপুরবেলা যখন তোমাদের ইচ্ছা হয় গাছের ছায়ায় বসতে জ্বলন্ত সূর্যের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে? অথবা সন্ধ্যায়, যখন তোমরা ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘরে ফিরে আসো। সামান্য খাবার ও দূষিত পানির পরিবর্তে অন্বেষণ করো সেই খাবার যা অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে? অথবা রাতে, যখন রাত্রি তোমাদেরকে নিক্ষেপ করে মলিন বিছানায় এবং যত দ্রুত সম্ভব সুখনিদ্রা তোমাদের দুচোখের পাতা বন্ধ করে দেয়, কিন্তু তোমরা বসে থাকো খোলা চোখে এবং ভয় পাও শেখের সেই কণ্ঠস্বর, যা তোমাদের কানে বেজে যেতে থাকে?
বছরের কোন্ ঋতুতে তোমরা বিলাপ করো না? এটা কি বসন্তে, যখন প্রকৃতি তার নতুন পোশাক পরে এবং তোমরা তার সাথে সাক্ষাৎ করো ছেঁড়া পোশাকে? অথবা গ্রীষ্মকালে, যখন তোমরা পাকা গম তুলে আনো এবং জড়ো করো ভূট্টার আঁটি এবং পূর্ণ করে তোলো তোমাদের প্রভুর আত্মা শস্য দিয়ে এবং যখন গোনাগুনি শুরু হয় তখন তোমাদের ভাগে কিছু নেই—শুধু খড়, শুধু খড়। এটা কি শরতে, যখন তোমরা ফল আহরণ করো এবং আঙুর বহন করে নিয়ে যাও আঙুর পেষণকারী যন্ত্রের কাছে এবং তোমাদের কঠোর পণ্ডশ্রমের পুরষ্কার হিসেবে পাও এক পাত্র সিরকা এবং এক বুশেল ওক গাছের বীজ? অথবা শীতে, বরফ বোঝাই কুঁড়েঘরের ভেতর যখন তোমরা আবদ্ধ হয়ে আছ, বসে আছ আগুনের পাশে এবং শিহরিত হচ্ছ, যখন রাগান্বিত আকাশ তোমাদের দুর্বল মন থেকে পালিয়ে যেতে তোমাদেরকে প্ররোচিত করে?
‘এই হল গরিবের জীবন, এই অনন্ত কান্না, যা আমি শুনি। এই হল তা-ই যা আমার আত্মাকে বিদ্রোহী করে তোলে নিপীড়নের বিরুদ্ধে এবং ঘৃণা করে তাদের চরিত্র। যখন আমি আমাকে ক্ষমা করতে বলেছিলাম সন্ন্যাসীদের তখন তারা ভেবেছিল আমি একজন নাস্তিক এবং বহিষ্কার ছিল আমার নিয়তি। আজ আমি এসেছি আমার দুর্গত জীবন তোমাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে অশ্রুজলে। এখানে এখন আমি তোমাদের নিকৃষ্ট শত্রুর হাতের মুঠোয়। তোমরা কি কখনও উপলব্ধি করেছ, যে ভূমিতে তোমরা পরিশ্রম করছ দাসের মতো তা কেড়ে নেওয়া হয়েছিল তোমাদের পিতার কাছ থেকে এবং তখন আইন লেখা হয়েছিল তরবারির ধারালো প্রান্তের ওপর? সন্ন্যাসীরা তোমাদের পূর্বপুরুষকে ঠকিয়েছিল এবং কেড়ে নিয়েছিল আঙুর ও শস্যক্ষেত, যখন ধর্মীয় শাসন লেখা হয়েছিল যাজকদের ঠোঁটের ওপর। কোন নারী অথবা পুরুষ প্রভাবিত হয়নি শস্যক্ষেতের প্রভুদের দ্বারা যাজকদের ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করতে? ঈশ্বর বলেন, ‘তাঁর ভুরুর ঘাম দিয়ে তুমি তোমার রুটি খাবে।’ কিন্তু শেখ আব্বাস তোমাদের জীবনের বছরগুলির পরিশ্রম দিয়ে সেঁকা রুটি খাচ্ছে এবং পান করছে তোমাদের অশ্রু-মেশানো মদ। ঈশ্বর কি তোমাদের থেকে এই লোককে আলাদা করেছে যখন সে মায়ের গর্ভে ছিল? অথবা এটা কি তোমাদের পাওনা যা তোমাদেরকে তার সম্পত্তিতে পরিণত করেছে? যিশু বলেছেন, ‘বিনামূল্যে তোমরা নিয়েছ এবং বিনামূল্য তোমরা দান করবে… কখনো সোনা, রুপা কিংবা তামার মালিক হয়ো না।’ তাহলে কোন্ শিক্ষা যাজকদেরকে প্রার্থনা বিক্রির অনুমোদন দিয়েছে সোনা ও রুপার বিনিময়ে? রাত্রির নীরবতার ভেতরে তোমরা প্রার্থনা করো, ‘আমাদেরকে আজকের জন্য খাবার দান করুন।’ ঈশ্বর তোমাদেরকে এই ভূমি প্রদান করেছেন যা থেকে তোমরা প্রতিদিনের আহার যোগাড় করবে, কিন্তু কোন্ সেই কর্তৃপক্ষ যে এই খাবার তোমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেবার অধিকার দিয়েছে সন্ন্যাসীদের?
‘তোমরা জুডাসকে অভিশাপ দাও, কারণ সে তার প্রভুকে বিক্রি করেছিল কয়েকটি রুপার বিনিময়ে, কিন্তু তোমরা তাকে আশীর্বাদ করো যে প্রতিদিন তাকে বিক্রি করে। জুডাস অনুতপ্ত হয়েছিল এবং নিজেকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিল তার ভুলের জন্য, কিন্তু এখনকার এসব যাজকেরা গর্বভরে হেঁটে বেড়ায় উজ্জ্বল পোশাক পরে এবং চমৎকার ক্রুশ ঝুলতে থাকে তাদের বুকের ওপর। তোমরা তোমাদের শিশুকে শেখাও যিশুকে ভালোবাসতে এবং একই সঙ্গে নির্দেশ দাও তাদেরকে মান্য করতে যারা তাঁর শিক্ষাকে অস্বীকার করে এবং অমান্য করে তার আইন।
‘যিশু খ্রিস্টের শিষ্যদের পাথর মেরে হত্যা করা হয়েছিল, কিন্তু যাজক ও সন্ন্যাসীরা হত্যা করছে তোমাদের আত্মাকে তোমাদের ভেতরে, সুতরাং তোমাদের দয়ার দানের ওপর তারা বেঁচে থাকে। কি তোমাদেরকে যুক্তি বা উপদেশ দিয়ে প্ররোচিত করবে পৃথিবীতে এরকম জীবনযাপন করতে যা পরিপূর্ণ দুর্গত এবং নিপীড়িত? যা তোমাদেরকে প্ররোচিত করে হাস্যকর বেদির সামনে নতজানু হতে যা নির্মিত হয়েছে তোমাদের পিতার হাড়ের ওপর? কোন্ ভাণ্ডার তোমরা সংরক্ষণ করেছ তোমাদের উত্তরপুরুষের জন্য?
‘তোমাদের আত্মা হচ্ছে যাজকদের হাতের মুঠোয় এবং তোমাদের শরীর শাসনের বন্ধ দাঁতের মাঝখানে। জীবনের কোন্ জিনিসটাকে বলবে এটা আমার? হে আমার সহযোগীরা তোমরা কি জানো, যাজকরাই হচ্ছে তোমাদের ভয়? সে একজন বিশ্বাসঘাতক যে বাইবেলকে ব্যবহার করে হুমকি হিসেবে তোমার অর্থ ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য… একজন ভণ্ড পরিধান করেছে ক্রুশচিহ্ন এবং তা ব্যবহার করছে অস্ত্র হিসাবে তোমার শিরা- উপশিরা কেটে ফেলার জন্য… মেষশাবকের চামড়ার ছদ্মবেশ পরেছে একটা নেকড়ে… একজন অতিভোজী যে বেদির চেয়ে খাবার টেবিল অধিক ভালোবাসে… সোনার জন্য ক্ষুধার্ত প্রাণী, যে সবচেয়ে দূরবর্তী ভূমিতে পড়ে থাকা একটা দিনারকেও অনুসরণ করে—একজন প্রতারক যে চুরি করে বিধবা ও এতিমদের সম্পদ। সে একটা অস্বাভাবিক অস্তিত্ব, যার ঈগলের মতো ঠোঁট, বাঘের মতো বজ্রমুষ্ঠি, হায়ানার মতো দাঁত এবং পোশাক সাপের মতো। বাইবেলটা তার কাছ থেকে কেড়ে নাও, ছিঁড়ে ফেল তার পোশাক, ছিনিয়ে নাও তার রুটি এবং তোমার যা ইচ্ছা তাই করো তার সাথে। তারপর তাকে একটা দিনার দাও এবং সে তোমাকে হাসিমুখে ক্ষমা করে দেবে।’
‘তার গালে চড় মারো এবং থুতু দাও এবং গলার ওপর পা তুলে দাঁড়াও, তারপর আমন্ত্রণ জানাও তাকে তোমার খাবার টেবিলে। সে তক্ষুনি সবকিছু ভুলে যাবে, খুলে ফেলবে তার বাঁধন এবং আনন্দের সঙ্গে তোমার খাবারে উদর পূর্ণ করে নেবে।
‘অভিশাপ দাও তাকে এবং ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করো তাকে নিয়ে। তারপর তাকে পাঠাও একপাত্র মদ অথবা একঝুড়ি ফল। সে তোমার পাপ ক্ষমা করে দেবে। যখন সে কোনো নারীকে দেখে তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, হে ব্যাবিলনের কন্যা আমার সামনে থেকে চলে যাও, তারপর সে নিজের সঙ্গে ফিসফিস করে, ‘কোন নারীকে প্রবলভাবে কামনা করার চেয়ে বিয়ে উত্তম।’ সে দেখে যুবক ও যুবতীরা ভালোবাসার মিছিলে হেঁটে চলেছে এবং সে তার দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে স্বর্গের দিকে এবং বলছে, ‘অহঙ্কারের অহঙ্কার এবং সবই অহঙ্কার’ এবং সে তার নির্জনতার ভেতরে নিজের সঙ্গে কথা বলে, ‘আইন এবং প্রচলিত প্রথা অস্বীকার করতে পারে আমার জীবনের আনন্দ, যা বিলুপ্ত হবে।’
‘সে মানুষের কাছে প্রচার করে, ‘বিচার কোরো না কারও পাছে তোমার বিচার করা হয়।’ কিন্তু সে সেইসব লোকের বিচার করে যারা তার কর্মকাণ্ডকে ঘৃণা করে এবং তাদেরকে নরকে পাঠিয়ে দেয় মৃত্যু তাদেরকে জীবন থেকে আলাদা করার আগেই।’
‘যখন সে কথা বলে তখন সে তার মাথা তোলে স্বর্গের দিকে। কিন্তু একই সময়ে তার চিন্তাগুলি হামাগুড়ি দেয় তোমাদের পকেটের ভেতরে।’
‘সে তোমাদেরকে সম্বোধন করে বৎস্য বলে, কিন্তু তার হৃদয় পিতৃসুলভ ভালোবাসাশূন্য এবং তার ঠোঁট শিশুদের দিকে তাকিয়ে কখনও হাসে না, সে তার বাহুতে বহন করে না কখনও কোনো নবজাতককে।’
‘সে মাথা নেড়ে নেড়ে তোমাকে বলে, ‘জাগতিক বিষয় আশয় থেকে আমাদের দূরে থাকা উচিত। কারণ জীবন অতিক্রান্ত হয় মেঘের মতো।’ কিন্তু তুমি যদি ভালোভাবে তার দিকে তাকাও তাহলে দেখতে পাবে সে জীবনকে মুঠোর ভেতরে ধরে আছে, বিলাপ করছে গতকাল চলে যাবার জন্য, নিন্দা করছে আজকের দিনের গতিশীলতাকে এবং আতঙ্কের সঙ্গে অপেক্ষা করছে আগামীকালের জন্য।
‘সে তোমাকে জিজ্ঞাসা করবে তুমি দান করবে কি না, যদিও দেবার মতো তার পর্যাপ্ত রয়েছে। জনসমক্ষে সে তোমাকে আশীর্বাদ করবে এবং যদি তুমি তাকে অবহেলা করো তাহলে সে তোমাকে অভিশাপ দেবে গোপনে।’
‘মন্দিরে সে তোমাকে বলবে গরিবদের সাহয্য করতে, কিন্তু তার বাড়িতে কেউ ভিক্ষা চাইলে সে তাকে দেখতেও পায় না এবং শুনতেও পায় না।’
‘সে বিক্রি করে তার প্রার্থনা এবং সে কখনও স্বর্গ থেকে বহিষ্কৃত কোনো নাস্তিককে ক্রয় করে না।’
‘এই হল সেই প্রাণী যাকে তুমি ভয় পাও। এই হল সেইসব সন্ন্যাসী যারা তোমাদের রক্ত চুষে খায়। এই হল সেইসব যাজক যারা ডানহাতে ক্রুশচিহ্ন আঁকড়ে ধরে এবং বাম হাতে টিপে ধরে তোমাদের গলা।’
‘এই হল সেই যাজক, যাকে তোমরা নিয়োগ করেছ তোমাদের সেবক হিসেবে। কিন্তু সে নিজেকে নিয়োগ করেছে তোমাদের প্রভু হিসেবে।’
‘এই হল সেই ছায়া যা তোমাদের আত্মাকে আলিঙ্গন করে আছে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত।’
‘এই হল সেই লোক যে আজ রাতে আমার বিচার করতে এসেছে, কারণ আমার আত্মা নাজারেতবাসী যিশুর শত্রুর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল, যিনি প্রত্যেককে ভালোবাসেন এবং আমাদেরকে আহ্বান জানান ভাই বলে এবং যিনি আমাদের জন্য ক্রুশের ওপরে মারা গেছেন।’
খলিল অনুভব করল গ্রামবাসীর হৃদয়ে একটা উপলব্ধির জন্ম হয়েছে। তার কথা তাদেরকে উজ্জীবিত করে তুলল। সে আবার বলতে শুরু করল, ‘ভাইয়েরা আমার, তোমরা জানো যে শেখ আব্বাসকে এই গ্রামের প্রভু হিসেবে নিয়োগ করেছে আমীর শিহাব। সে হচ্ছে সুলতানের প্রতিনিধি এবং এই প্রদেশের গভর্নর। কিন্তু আমি তোমাদেরকে জিজ্ঞাসা করি কেউ কি দেখেছে কোন্ ক্ষমতা সুলতানকে এই প্রদেশের ঈশ্বর হিসেবে নিয়োগ করেছে? হে, আমার সহগামীরা সেই ক্ষমতাকে দেখা যাবে না, শুনতে পাবে না, সে কথা বলছে কিন্তু তোমার হৃদয়ের গভীরে তুমি তার অস্তিত্ব অনুভব করতে পারবে। এটা হল সেই ক্ষমতা তোমরা যার প্রার্থনা করো প্রতিদিন এই বলে, ‘আমাদের পিতা, যার সৌন্দর্যের সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটে স্বর্গে।’ হ্যাঁ, তোমাদের পিতা যিনি স্বর্গে থাকেন এবং তিনি একজন, যিনি রাজা ও রাজকুমারদেরকে নিয়োগ করেন, কারণ তিনি ক্ষমতাবান সবকিছুর ওপরে। কিন্তু তোমরা কি মনে করো, তোমাদের পিতা যিনি তোমাদেরকে ভালোবাসেন এবং তোমাদেরকে দেখিয়েছেন সত্য পথ তার নবীদের মাধ্যমে, তার কি আকঙ্ক্ষা তোমরা নিপীড়িত হও? তোমরা কি সেই ঈশ্বরে বিশ্বাস করো যিনি স্বর্গ থেকে বৃষ্টি নিয়ে আসেন এবং মাটির হৃদয়ে লুকানো বীজের ভেতর থেকে বহন করে আনেন শস্য? তার কি আকাঙ্ক্ষা তোমরা ক্ষুধার্ত থাকবে, কিন্তু তার অকৃপণ দান উপভোগ করবে মাত্র একজন, সেই অনন্ত আত্মাকে কি তোমরা বিশ্বাস করো যে প্রকাশ করবে তোমাদের কাছে স্ত্রীর ভালোবাসা, সন্তানের দয়া, প্রতিবেশীর ক্ষমা এবং সে স্বৈরশাসকে পরিণত হয়ে তোমাদেরকে দাসে পরিণত করবে তোমাদের জীবনের ভেতর দিয়ে? তোমরা কি বিশ্বাস করো সেই অনন্ত আইন যা জীবনকে সুন্দর করে এবং সেই আইন কি তোমাদের কাছে একজন মানুষকে পাঠাবে সুখকে অস্বীকার করতে এবং নেতৃত্ব দেবে বেদনাদায়ক মৃত্যুর ভূগর্ভস্থ অন্ধকার কারাগারের দিকে? তোমরা কি বিশ্বাস করো তোমাদের শারীরিক শক্তি যা প্রকৃতি তোমাদেরকে দান করেছে তা তোমাদের শরীরেরও ওপরে থাকে সমৃদ্ধির ভেতরে?’
‘তোমরা এসব বিশ্বাস করতে পারো না। কারণ যদি তোমরা বিশ্বাস করো তাহলে তোমরা ঈশ্বরের বিচারকে অস্বীকার করবে যিনি আমাদের প্রত্যেককে মর্যাদার দিক থেকে সমান করে তৈরি করেছেন এবং তৈরি করেছেন সত্যের আলো, যা পৃথিবীর মানুষের ওপর জ্বলজ্বল করতে থাকে। কী তোমাদেরকে নিজের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করায়, শরীরের বিরুদ্ধে হৃদয়কে এবং সাহায্য করে তাদেরকে যারা তোমাদেরকে দাসে পরিণত করেছে অথচ পৃথিবীতে ঈশ্বর তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন স্বাধীন হিসেবে?
‘তোমরা কি নিজেদের প্রতি ন্যায়বিচার করো যখন তোমরা সর্বময় ঈশ্বরের দিকে চোখ তুলে তাকাও এবং তাকে আহ্বান জানাও পিতা বলে এবং তারপর ঘুরে মানুষকে অভিবাদন জানাও এবং তাকে বলো প্রভু?’
‘ঈশ্বরের পুত্র হিসেবে তোমরা কি তৃপ্ত মানুষের দাসত্ব করে? যিশু কি তোমাদেরকে ভ্রাতৃবর্গ বলে আহ্বানে জানান নি? যদিও শেখ আব্বাস তোমাদেরকে ভৃত্য বলে ডাকে। সত্য ও সাহসের ভেতরে যিশু কি তোমাদেরকে মুক্ত করেননি? যদিও আমীর তোমাদের পরিণত করেছে লজ্জা ও দুর্নীতির দাসে। যিশু কি স্বর্গে তোমাদেরকে মর্যাদাসম্পন্ন করেননি? তাহলে কেন তোমরা নরকে অবতরণ করছ? তিনি কি তোমাদের হৃদয়কে আলোকিত করেননি? তাহলে কেন অন্ধকারে তোমরা তোমাদের আত্মাকে লুকাচ্ছ? ঈশ্বর তোমাদের হৃদয়ে একটা উজ্জ্বল মশাল স্থাপন করেছেন যা জ্ঞান ও সৌন্দর্যে আলোকিত এবং তা অনুসন্ধান করে দিন ও রাত্রির গোপনীয়তা, সেই আলোকে নিভিয়ে দেওয়া এবং ছাইয়ের নিচে তাকে সমাহিত করা হচ্ছে একটি পাপ। ঈশ্বর তোমাদের আত্মাকে সৃষ্টি করেছেন পাখাসহ ভালোবাসা ও স্বাধীনতার প্রশস্ত আকাশে উড়তে। এটা খুবই দয়ার্দ্র ঘটনা যে, তোমরা তোমাদের পাখা কেটে ফেল নিজের হাতে এবং দুর্ভোগ পোহাতে থাকে তোমাদের আত্মা পৃথিবীর ওপর কীটপতঙ্গের মতো হামাগুড়ি দিয়ে।’
শেখ আব্বাস আতঙ্কের ভেতরে গ্রামবাসীদের মনোযোগ লক্ষ্য করল এবং উদ্যোগ নিল হস্তক্ষেপের, কিন্তু খলিল তাদেরকে আরও উৎসাহের সঙ্গে বলে যেতে লাগল, ‘ঈশ্বর তোমাদের হৃদয়ে ভালোবাসার বীজ বপন করেছেন। এটা একটা অপরাধ যে তুমি হৃদয় খুঁড়ে তা বের করেছ এবং নিজের ইচ্ছায় তা ছুড়ে দিয়েছ পাথরের ওপর, সুতরাং বাতাস তা ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেবে এবং পাখিরা তা তুলে নেবে খাবার হিসেবে। ঈশ্বর তোমাদেরকে সন্তান দিয়েছেন লালন-পালন করতে, শিক্ষা দিতে সত্য এবং তাদের হৃদয় পরিপূর্ণ করে দিতে অস্তিত্বের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস দিয়ে। তারা তোমাদেরকে দান করতে চায় জীবনের উল্লাস ও উদারতা। কেন তারা আজ তাদের জন্মস্থানে আগন্তুক এবং সূর্যের সম্মুখে শীতার্ত প্রাণী? যে পিতা তার সন্তানকে দাসে পরিণত করে, সে রুটির বদলে তার সন্তানের হাতে তুলে দেয় পাথর। তোমরা দেখ নাই সেই পাখিকে যে আকাশে তার শাবককে উড়তে শেখাচ্ছে? কেন তোমার সন্তানদেরকে শিক্ষা দাওনা দাসত্বের বেড়িকে সজোরে টেনে নিয়ে যেতে? তোমরা কি দেখেছ উপত্যকার সেই ফুলকে যে রৌদ্রতপ্ত মাটিতে জমা করে তার বীজগুলো? কেন তোমরা সন্তানদের কাছে সেই অন্ধকারের অঙ্গীকার করো না যা ঠাণ্ডায় মোড়ানো?’
নীরবতার ভেতরে কেটে গেল একটি মূহূর্ত এবং মনে হল খলিলের হৃদয় ব্যথায় জর্জরিত। কিন্তু এখন সে নিচু ও বাধ্যকণ্ঠে বলল, ‘যেসব কথা আজ রাতে আমি বললাম সেগুলিই আশ্রম থেকে আমার বহিষ্কার হওয়ার কারণ। যদি তোমাদের শস্যক্ষেতের প্রভু এবং চার্চের যাজক আজ রাতে আমাকে হত্যা করে, আমি আনন্দের সঙ্গে শান্তিতে মারা যাব। কারণ আমি আমার উদ্দেশ্য সফল করেছি তোমাদের কাছে সত্য প্রকাশ করে যা ঐ যাজকদের অশুভ আত্মা অপরাধ বলে মনে করে। আমি এখন সর্বময় ঈশ্বরের ইচ্ছাকে পূর্ণ করেছি। খলিলের কণ্ঠস্বরে একটা জাদুকরি বার্তা ছিল যা গ্রামবাসীদের আগ্রহকে বাড়িয়ে দিল। নারীরা তার দিকে এমন মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকয়েছিল যেন সে শান্তির বার্তাবাহক এবং তাদের চোখে জ্বলজ্বল করছিল আনন্দের অশ্রু।
শেখ আব্বাস এবং ফাদার ইলিয়াস রাগে কাঁপছিল। কথা শেষ করে খলিল কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে র্যাচেল ও মিরিয়ামের কাছে দাঁড়াল। নীরবতা বিরাজ করছিল আদালত কক্ষে এবং মনে হচ্ছিল খলিলের আত্মা বিশাল কক্ষের ভেতরে পাখা না নাড়িয়ে মাথার ওপরে ভেসে আছে এবং তার আত্মা শেখ আব্বাস ও ফাদার ইলিয়াসের ভয়ে শেষপর্যন্ত জনতার আত্মায় পরিবর্তিত হল, অপরাধবোধ ও বিরক্তিতে যারা বসে বসে কাঁপছিল।
শেখ আব্বাস হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। তার মুখমণ্ডল ফ্যাকাশে দেখাচ্ছিল। সে জনতার দিকে তাকাল এবং তার চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা জনতার উদ্দেশে বলল, ‘হে কুকুরেরা তোমাদের কী হয়েছে? তোমাদের হৃদয় কি বিষাক্ত হয়ে গেছে? তোমাদের রক্তের স্রোত কি থেমে গেছে এবং দুর্বল করে ফেলেছে তোমাদেরকে? তাই তোমরা এই অপরাধীর ওপর লাফিয়ে পড়তে পারছনা এবং পারছনা তাকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলতে? কী করেছে সে তোমাদের?’ জনতাকে তিরস্কার করার পর সে একটা তলোয়ার বের করল এবং খলিলের দিকে বাড়িয়ে ধরল। এমন সময় একজন শক্তপোক্ত গ্রামবাসী এগিয়ে এল, চেপে ধরল তার হাত এবং বলল, ‘অস্ত্র নামিয়ে নিন প্রভু, কারণ যে হত্যা করার জন্য অস্ত্র তোলে সেও তার নিজের অস্ত্রে মারা যেতে পারে।’
শেখ কাঁপতে লাগল এবং তার হাত থেকে অস্ত্র পড়ে গেল। লোকটা তার উদ্দেশে বলল, ‘বিশ্বস্ত ভৃত্য অপরাধ করার সময় তার প্রভুর সঙ্গে তা ভাগাভাগি করে না।’ এই লোকটি কিছুই বলেনি সত্য ছাড়া।’ অন্য এক লোক এগিয়ে এল এবং বলল, ‘এই লোকটা নিষ্পাপ এবং এই সম্মান তার প্রাপ্য’ এবং এক নারী উঁচুকণ্ঠে বলল, ‘সে ঈশ্বরের নামে শপথ করেনি অথবা অভিশাপ দেয়নি কোনো সিদ্ধপুরুষকে, কেন আপনি তাকে নব্যতান্ত্রিক বলছেন?’ র্যাচেল বলল, ‘কী তার অপরাধ?’ শেখ চিৎকার করে বলল, ‘তুমি একজন বিদ্রোহী। তুমি ভুলে গেছ তোমার স্বামীর ভাগ্যে কী ঘটেছিল? ছয় বছর আগে সে বিদ্রোহ করেছিল।’ এসব কথা শুনে র্যাচেল ক্রুদ্ধ বেদনায় কাঁপতে লাগল। কারণ সে দেখেছিল তার স্বামীকে হত্যাকারীকে। সে অশ্রু সংবরণ করে জনতার দিকে তাকাল এবং চিৎকার করে বলল, ‘এই হচ্ছে সেই অপরাধী যাকে তোমরা ছয় বছর ধরে খুঁজছ। এখন সে তার অপরাধ স্বীকার করছে। সে হচ্ছে খুনি যে তার অপরাধ লুকিয়েছিল। তার দিকে তাকাও এবং তার মুখের ভাষা পড়ো। পর্যবেক্ষণ করো তার আতঙ্ক, শীতের বৃক্ষের শেষ পাতার মতো সে কাঁপছে। ঈশ্বর তোমাদেরকে দেখিয়েছেন যাকে তোমরা সারাক্ষণ প্রভু হিসেবে ভয় পাও যে মূলত একজন খুনি অপরাধী। সে-ই আমাকে বিধবা বানিয়েছে এবং আমার সন্তানকে করেছে এতিম।’ র্যাচেলের এই কথায় শেখের মাথায় যেন বাজ পড়ল এবং মানুষের হৈহুল্লোড় এবং পরমানন্দ তার ওপর পতিত হল জ্বলন্ত কাঠের মতো।
যাজক কাঁপতে থাকা শেখকে বসতে সাহায্য করল। তারপর সে ভৃত্যদের ডেকে আদেশ দিল, ‘গ্রেফতার করো এই নারীকে যে তোমাদের প্রভুকে অভিযুক্ত করেছে তার স্বামীর হত্যাকারী বলে, যা পুরোপুরি মিথ্যে। তাকে এবং এই যুবককে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাও অন্ধকার কারাকক্ষে। যে প্রতিবাদ করবে সে-ই অপরাধী হবে। বহিষ্কার করা হবে তাকেও পবিত্র চার্চ থেকে।’ ভৃত্যেরা তার কথায় কান দিল না। তারা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল খলিলের দিকে তাকিয়ে। খলিল তখনও দড়ি দিয়ে বাঁধা অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। র্যাচেল দাঁড়িয়ে আছে ডানপাশে, মিরিয়াম বামপাশে একজোড়া পাখার মতো, যা স্বাধীনতার প্রশস্ত আকাশের অনেক উঁচুতে উড়তে সক্ষম।
শেখের দাড়ি উত্তেজনায় কাঁপছিল। ফাদার ইলিয়াস বলল, ‘একজন অপরাধী নাস্তিক ও একজন নির্লজ্জ ব্যভিচারিণীর জন্য তোমরা তোমার প্রভুর আদেশ অমান্য করছ?’ ভৃত্যদের ভেতর থেকে সবচেয়ে বয়সী একজন বলল, ‘খাবার ও আশ্রয়ের জন্য আমরা দীর্ঘদিন ধরে তার সেবা করছি। কিন্তু আমরা কখনই তার দাস নই।’ একথা বলে ভৃত্য তার আলখাল্লা ও পাগড়ি খুলে ফেলল এবং তা ছুঁড়ে ফেলল শেখের সামনে এবং বলল, ‘এই পোশাকের আমার আর দরকার নেই এবং আমি চাই না আমার আত্মা এই অপরাধীর সংকীর্ণ গৃহে কষ্টভোগ করুক।’ সব ভৃত্যই একই কাজ করল এবং যোগ দিল জনতার সঙ্গে যাদের চোখেমুখে ফুটে উঠছিল উল্লাসের বিকিরণ, যা ছিল সত্য ও স্বাধীনতার প্রতীক। ফাদার ইলিয়াস অবশেষে লক্ষ্য করল তার কর্তৃত্ব প্রত্যাখ্যাত হয়েছে এবং সে স্থান পরিত্যাগ করল। একজন শক্তসামর্থ লোক এগিয়ে এসে খলিলের বাঁধন খুলে দেয়। তাকায় আব্বাসের দিকে যে তার আসনের ওপর পড়েছিল মৃতদেহের মতো। তারপর দৃঢ়কণ্ঠে বলে, ‘এই শৃঙ্খলিত যুবক, যাকে আজ রাতে অপরাধী হিসেবে বিচার করার জন্য এখানে নিয়ে এসেছিলে, সে আমাদের নিপীড়িত আত্মাকে জাগিয়ে তুলেছে এবং আলোকিত করেছে আমাদের হৃদয়কে জ্ঞান ও সত্যের মাধ্যমে এবং এই গরিব বিধবা যাকে ফাদার ইলিয়াস মিথ্যা অভিযোগকারী বলেছে, সে প্রকাশ করেছে আমাদের কাছে আপনার ছয় বছর আগের অপরাধ। আজ রাতে আমরা এসেছি একজন নিষ্পাপ যুবক ও সৎ আত্মার বিচার দেখতে। এখন স্বর্গ আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে এবং আমাদেরকে দেখিয়েছে তোমার ভণ্ডামি। আমরা তোমাকে এখন পরিত্যাগ করব, অবহেলা করব এবং স্বৰ্গকে অনুমতি দেব তার ইচ্ছা পূরণ করতে।’
জনতার কোলাহল বাড়তে লাগল। একজন উচ্চৈঃস্বরে বলল, ‘চলো আমরা এই গৃহ পরিত্যাগ করি।’ অন্য একজন মন্তব্য করল, ‘চলো আমরা এই লোককে অনুসরণ করি র্যাচেলের বাড়ি পর্যন্ত এবং মনোযোগ দিয়ে শুনি জ্ঞানের কথা ও সান্ত্বনার বাণী’ এবং তৃতীয় এক ব্যক্তি বলল, ‘তার পরামর্শ মেনে চলা উচিত। কারণ সে জানে আমাদের কী প্রয়োজন।’ চতুর্থ এক ব্যক্তি বলল, ‘যদি সত্যি সত্যি আমরা ন্যায়বিচার চাই তাহলে চলো আমীরের কাছে অভিযোগ করি এবং আব্বাসের অপরাধ সম্পর্কে তাকে বলি’ এবং অনেকগুলি কণ্ঠস্বর বলল, ‘চলো আমরা আমীরের কাছে আবেদন করি খলিলকে আমাদের শাসক হিসেবে নিয়োগ দিতে এবং বিশপকে বলি ফাদার ইলিয়াস এই অপরাধের অংশীদার।’ এসব কথা শেখের কানে ধারালো তীরের মতো প্রবেশ করছিল। খলিল এক সময় হাত তুলে শান্ত স্বরে গ্রামবাসীদের বলে, ‘হে আমার ভাইয়ের তাড়াহুড়া কোরো না, বরং মনোযোগ দিয়ে শোনো এবং গভীরভাবে চিন্তা করো। তোমাদের জন্য ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের নামে আমি শপথ করে তোমাদেরকে বলতে চাই, আমীরের কাছে যেও না, কারণ সেখানে তোমরা ন্যায়বিচার পাবে না। মনে রেখো একটি হিংস্র পশু হিংস্র অন্য একজনকে শিকার করে না। এমনকি বিশপের কাছে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ সে জানে যে গৃহ ধ্বংস হওয়ার উপযুক্ত তা ধ্বংস হবেই। আমাকে এই গ্রামের শেখ হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার জন্য আমীরকে কখনও বোলো না। কারণ বিশ্বস্ত ভৃত্য খারাপ প্রভুর সাহায্যকারী হতে পছন্দ করে না। আমি যদি তোমাদের ভালোবাসার যোগ্য হই তাহলে আমাকে তোমাদের মাঝে বসবাস করতে দাও এবং ভাগাভাগি করতে দাও জীবনের সুখ ও দুঃখগুলি। আমাকে কাজ করতে দাও তোমাদের সঙ্গে গৃহে ও শস্যক্ষেতে। আমি যদি নিজেকে তোমাদের একজন করে তুলতে না পারি তাহলে আমি প্রতারকে পরিণত হব, যে তার বক্তব্য অনুযায়ী কর্ম করে না এবং এখন কুড়ালটা গাছের শিকড়ের ওপর পড়ে আছে। চলো আমরা শেখকে তার বিবেক ও সর্বময় ঈশ্বরের বিচারালয়ের সামনে একা রেখে এ স্থান পরিত্যাগ করি, যার সূর্য নিষ্পাপ ও অপরাধী উভয়ের উপরই আলো দেয়।’
এসব বলার পর খলিল এই জায়গা পরিত্যাগ করল এবং জনতা তাকে অনুসরণ করল যেন তার ভেতরে কোনো ঐশ্বরিক ক্ষমতা ছিল যা তাদের হৃদয়কে আকর্ষণ করেছে। ভয়াবহ নীরবতার ভেতরে শেখ বসে থাকল একটা ধ্বংসপ্রাপ্ত সমাধিস্তম্ভের মতো এবং কষ্ট পেতে লাগল পরাজিত নেতার মতো। জনতা যখন চার্চের প্রাঙ্গণে পৌঁছাল, তখন মেঘের পেছন থেকে বেরিয়ে এল চাঁদ, খলিল তাদের দিকে ভালোবাসার দৃষ্টিতে তাকাল সেই রাখালের মতো, যে সহৃদয়তার সঙ্গে তার পশুর পালের দিকে তাকিয়ে আছে। তার হৃদয়ে সহানুভূতি চলাচল করছিল গ্রামবাসীদের জন্য যারা একটা নিপীড়িত জাতিকে প্রতীকায়িত করছিল এবং খলিল দাঁড়িয়েছিল নবীর মতো, যে দেখছিল পূবের সমস্ত জাতিকে ঐসব উপত্যকাতে হেঁটে বেড়াচ্ছে এবং টেনে নিয়ে যাচ্ছে শূন্য আত্মা এবং ভারাক্রান্ত হৃদয়গুলি।
সে স্বর্গের দিকে দুহাত তুলে বলল, ‘এই গভীরতার তলদেশ থেকে আমরা তোমাকে আহ্বান জানাই হে স্বাধীনতা। আমাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনো। অন্ধকারের পেছন থেকে আমরা হাত বাড়িয়েছি তোমার প্রতি। আমাদের দিকে তাকাও। বরফের ওপরে বসে আমরা তোমার প্রার্থনা করছি হে স্বাধীনতা। আমাদের ওপর দয়া করো। তোমার বিশাল সিংহাসনের সামনে আমরা দাঁড়িয়ে আছি, ঝুলিয়ে দিচ্ছি আমাদের শরীরকে আমাদের প্রপিতামহের রক্তস্নাত পোশাক দিয়ে, ঢেকে ফেলছি মস্তিষ্ককে অবশিষ্ট রক্তমাখা কবরের ধুলোয়, বহন করছি সেই তরবারি যা বিদ্ধ করেছিল তাদের হৃদয়কে, তুলে ধরছি সেই বল্লম যা বিদ্ধ করে তাদের শরীর, টেনে নিয়ে যাই সেই শৃঙ্খল যা তাদের পদযুগকে ধীরগতিসম্পন্ন করে তোলে, চিৎকার করে কাঁদছি যা তাদের কণ্ঠকে আহত করে তোলে, বিলাপ এবং পুনরাবৃত্তি করছি আমাদের সেই ব্যর্থতার সংগীত যা কারাগারের ভেতরে প্রতিধ্বনিত হয় এবং পুনরাবৃত্তি করছি সেই প্রার্থনা যা আমাদের পিতার হৃদয়ের গভীরতা থেকে আসে। আমাদের কথা শোনো হে স্বাধীনতা, আমাদের কথা শোনো। নীল থেকে ইউফ্রেটিস পর্যন্ত ভেসে আসে কষ্ট পাওয়া আত্মার হাহাকার নরকের কান্নার ঐক্যের ভেতরে এবং পূবের শেষ প্রান্ত থেকে লেবাননের পাহাড়শ্রেণী পর্যন্ত বিস্তৃত আমাদের হাত মৃত্যুর উপস্থিতিতে শিহরিত হচ্ছে। সমুদ্রের তীরভূমি থেকে মরুভূমির প্রান্তসীমা পর্যন্ত অশ্রুপ্লাবিত চোখ সকাতরভাবে তোমার দিকে তাকায়। এসো হে স্বাধীনতা এবং আমাদেরকে রক্ষা করো।
‘পর্ণকুটিরের ভেতরে দারিদ্র্য ও নিপীড়নের ছায়ায় দাঁড়িয়ে তারা তাদের বুক চাপড়ায় এবং তোমার দয়ার জন্য সনির্বন্ধ আবেদন করে। আমাদেরকে লক্ষ্য করো হে স্বাধীনতা এবং আমাদের প্রতি দয়া করো। পথে পথে এবং দুর্গত গৃহে যুবকেরা তোমাকে আহ্বান জানায়। চার্চ এবং মসজিদে বিস্মৃত গ্রন্থখানি উন্মুক্ত হয় তোমার দিকে এবং বিচারালয় ও রাজপ্রাসাদে অবহেলিত আইন তোমার কাছে আবেদন জানায়। আমাদের প্রতি দয়া করো হে স্বাধীনতা এবং রক্ষা করো আমাদেরকে। আমাদের সংকীর্ণ পথে ব্যবসায়ীরা তাদের দিনগুলিকে বিক্রি করে সুযোগগ্রহণকারী পশ্চিমের চোরদেরকে শ্রদ্ধা জানাতে এবং কেউ তাকে পরামর্শ দেবে না। কৃষকেরা অনুর্বর শস্যক্ষেত কর্ষণ করে এবং বপন করে হৃদয়ের বীজ এবং তার পরিচর্যা করে অশ্রুজলে কিন্তু কোনো ফসলই তুলতে পারে না কাঁটা ছাড়া এবং কেউ তাকে প্রকৃত পথ সম্পর্কে শিক্ষা দেয়নি। আমাদের অনুর্বর সমতলভূমিতে নগ্নপায়ে ক্ষুধার্ত বেদুইনেরা ইতস্তত ঘুরে বেড়ায় কিন্তু তাদের প্রতি দয়া করে না। কথা বলো হে স্বাধীনতা এবং আমাদেরকে শিক্ষা দাও। আমাদের অসুস্থ পশুশাবকেরা ঘাসহীন তৃণভূমিতে চরে বেড়াচ্ছে। বাছুরেরা ক্রমাগত কামড়াচ্ছে গাছের শিকড় এবং আমাদের ঘোড়াগুলি চিবোচ্ছে শুকনো চারাগাছ। এসো হে স্বাধীনতা এবং আমাদেরকে সাহায্য করো। শুরু থেকেই আমরা অন্ধকারে বসবাস করছি এবং বন্দিদের মতো তারা আমাদেরকে এক কারাগার থেকে অন্য কারাগরে নিয়ে যায় যখন সময় আমাদের দুরবস্থাকে উপহাস করে। কখন আসবে ভোরবেলা? কতদিন আমরা বহন করব যুগের অবজ্ঞা? অসংখ্য পাথর আমরা টেনে নিয়ে গেছি এবং অসংখ্য জোয়াল স্থাপন করা হয়েছে আমাদের গলার ওপরে। কতদিন আমরা সহ্য করব মানুষের নিষ্ঠুরতা? মিশরীয় দাসত্ব, ব্যাবিলনীয় নির্বাসন, পারস্যের স্বৈরতন্ত্র, রোমানদের উৎপীড়ন এবং ইউরোপের লোভ… এই সবকিছুতেই আমরা কষ্ট পেয়েছি। এখন আমরা কোথায় যাচ্ছি এবং কখন আমরা সেই এবড়োথেবড়ো পথের মহিমান্বিত প্রান্তে পৌঁছাব? ফারাওদের বজ্রমুষ্ঠি থেকে নেবুচাদনেজার-এর থাবায়, আলেকজান্ডারের লৌহকঠিন হাতে, বীরদের অস্ত্রের মুখে, সম্রাট নীরোর তীক্ষ্ণ নখের কাছে এবং অশুভ আত্মার ধারালো দাঁতের মাঝখানে… আমরা এখন কার হাতে পতিত হব এবং কখন মৃত্যু আসবে এবং আমাদেরকে নিয়ে যাবে, যেখানে সবশেষে আমরা বিশ্রাম পেতে পারি?
‘আমাদের বাহুর শক্তিতে আমরা উত্তোলন করেছি মন্দিরের স্তম্ভগুলি এবং আমাদের পিঠে বহন করেছি নির্মাণসামগ্রী বিশাল দেয়াল ও অলংঘনীয় পিরামিড নির্মাণ করতে গৌরবের জন্য। কতদিন পর্যন্ত আমরা এসব চমৎকার প্রাসাদ নির্মাণ করব এবং বসবাস করব জরাজীর্ণ কুঁড়েঘরে? কতদিন পর্যন্ত আমরা ভরে তুলব ধনীদের শস্যাধার এবং দুর্বল জীবন টিকিয়ে রাখব শুকনো শস্যদানা দিয়ে? কতদিন পর্যন্ত আমরা চাষ করব রেশম এবং উল আমাদের প্রভুর জন্য এবং আমরা পড়ে থাকব ছেঁড়া একফালি কাপড়?
‘তাদের অন্যায়ের ভেতর দিয়ে আমরা নিজেদের ভেতর বিভক্ত করেছি এবং রক্ষা করেছি তাদের সিংহাসন। তারা ডুজদেরকে অস্ত্রে সজ্জিত করেছে আরবদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে এবং উত্তেজিত করছে সিয়াদেরকে আক্রমণ করতে সুন্নিদের এবং উৎসাহিত করেছে কুর্দিদেরকে বেদুইনদের জবাই করতে এবং মুসলিমদের উজ্জীবিত করছে খৃস্টানদের সঙ্গে বিতর্কে জড়িয়ে পড়তে। কতদিন পর্যন্ত একজন ভাই হত্যা করবে নিজের ভাইকে মায়ের কোলের ওপর? কতদিন পর্যন্ত ক্রুশচিহ্ন অর্ধচন্দ্র থেকে আলাদা থাকবে ঈশ্বরের চোখের সামনে? হে স্বাধীনতা আমাদের কথা শোনো এবং কথা বলো অন্তত নির্দিষ্ট একজনের পক্ষে, কারণ একটা স্ফুলিঙ্গ থেকেই একটা বিশাল আগুনের জন্ম হয়। হে স্বাধীনতা, জেগে উঠুক অন্তত একটা হৃদয় তোমার পাখার শব্দে, কারণ একটি মেঘ থেকে আসা আলো যা উদ্ভাসিত করে পাহাড়চূড়া ও উপত্যকার গর্তগুলি। ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাও তোমার ক্ষমতা এইসব কালো মেঘের সঙ্গে এবং অবতরণ করো বজ্রের মতো এবং ধ্বংস করো সেইসব সিংহাসন যা নির্মিত হয়েছে আমাদের পূর্বপুরুষের হাড় ও মাথার খুলির ওপর।
আমরা এখানে হে স্বাধীনতা,
করুণা করো আমাদেরকে হে এথেন্সের কন্যা,
উদ্ধার করো আমাদেরকে, হে রোমের ভগিনী,
পরামর্শ দাও আমাদেরকে, হে মূসার সঙ্গী,
সাহায্য করো আমাদেরকে, হে আমাদের অত্যন্ত প্রিয় মোহাম্মদ (স.),
শিক্ষা দাও আমাদেরকে, হে যিশুর নববধূ,
আমাদের হৃদয়কে শক্তিশালী করে তোলো যেন আমরা বাঁচতে পারি,
অথবা কঠিন করে তোলো আমাদের শত্রুকে যেন
অনন্তকালের ভেতরে আমরা বাঁচতে এবং
লোপ পেতে পারি।
এভাবে খলিল তার হৃদয়ানুভূতি ঢেলে দিচ্ছিল স্বর্গের সম্মুখে। গ্রামবাসী একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়েছিল গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে এবং তাদের ভালোবাসা লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছিল তার কণ্ঠের সঙ্গে যতক্ষণ তারা অনুভব না করল যে সেও তাদের হৃদয়ের অংশ। সামান্য নীরবতার পর খলিল জনতার দিকে তাকাল এবং শান্তস্বরে বলল, ‘রাত্রি আমাদেরকে এই গৃহে বহন করে এনেছে শেখ আব্বাসের গৃহের দিনের আলো উপলব্ধি করতে। নিপীড়ন আমাদেরকে গ্রেফতার করে এনেছে এই শীতল শূন্যতার মুখোমুখি যেন আমরা একে অন্যকে বুঝতে পারি এবং অনন্ত আত্মার মাথার নিচে জড়ো হই পাখির ছানার মতো। চলো এখন আমরা বাড়ি যাই এবং আগামীকাল দেখা হওয়ার আগ পর্যন্ত ঘুমাই।’
এসব বলার পর সে হাঁটতে শুরু করল। তাকে অনুসরণ করল র্যাচেল ও মিরিয়াম কুঁড়েঘর পর্যন্ত। জনতাও যে যার বাড়ির দিকে চলে গেল গভীরভাবে চিন্তা করতে করতে কী সে দেখেছে এবং শুনেছে এই স্মরণীয় রাতে। তারা অনুভব করল নতুন উদ্যমের একটা জ্বলন্ত মশাল তাদের অন্তরাত্মাকে ঘষেমেজে পরিষ্কার করে দিল এবং তাদেরকে পরিচালনা করল সঠিক পথে। প্রায় একঘণ্টা গ্রামের সমস্ত আলো নেভানো ছিল এবং নীরবতা গ্রাস করেছিল সমস্ত গ্রামকে এবং সুখনিদ্রা কৃষকদের আত্মাকে বহন করে নিয়ে গিয়েছিল এক বিশাল স্বপ্নের জগতে। কিন্তু শেখ আব্বাস ঘুমাতে পারল না এবং সে সারারাত দেখল অন্ধকারের অপচ্ছায়া ও তার অপরাধের বীভৎস ভূতগুলির মিছিল চলেছে।
অষ্টম পর্ব
দু’মাস পার হয়ে গেল। খলিল এখনও তার হৃদয়ানুভূতি ঢেলে দিচ্ছে গ্রামবাসীদের হৃদয়ে। বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে তাদের অধিকারকে এবং দেখাচ্ছে সন্ন্যাসী ও শাসকদের লোভ এবং নিপীড়ন। গ্রামবাসীরা মনোযোগ দিয়ে তার কথা শোনে, কারণ সে ছিল তাদের আনন্দের উৎস। তার বক্তব্য তাদের হৃদয়ে তৃষ্ণার্ত ভূমির ওপর ঝরে পড়া বৃষ্টির মতো পতিত হয়। নীরবতার ভেতরে তারা প্রাত্যহিক প্রার্থনার মতোই খলিলের বক্তব্য পুনরাবৃত্তি করে। ফাদার সামান তার বন্ধুত্ব পুনরুদ্ধারের জন্য তোষামোদ শুরু করে। সে দেখাতে চেষ্টা করে যে সে গ্রামবাসীদের অনুগত। কিন্তু গ্রামবাসী জানে সে শেখের অপরাধের সহযোগী। ফলে কৃষকরা তাকে অবজ্ঞা করে।
শেখ আব্বাসের স্নায়ুদৌর্বল্যের সমস্যা ছিল এবং সে তার প্রসাদের ভেতরে খাঁচাবদ্ধ বাঘের মতো হেঁটে বেড়াত। ভৃত্যদেরকে আদেশ দিত কিন্তু কেউ তার কথার উত্তর দিত না। মর্মর পাথরের দেয়ালের ভেতরে তার কথা কেবলই প্রতিধ্বনিত হত। সে চিৎকার করে তার লোকজনকে ডাকত, কিন্তু কেউ সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসত না একমাত্র তার বিষণ্ণ স্ত্রী ছাড়া, যে গ্রামবাসীদের মতোই শেখের নিষ্ঠুরতায় কষ্ট পেত। লেন্ট* উৎসবের সময় স্বর্গ বসন্তের আগমন ঘোষণা করলে শেখ মারা যায়। সে মারা গিয়েছিল দীর্ঘ মর্মবেদনা উপভোগ করে এবং তার আত্মাকে বহন করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তার কর্মকাণ্ডের গালিচার ওপর উলঙ্গভাবে দাঁড়াতে সেই উঁচু আসনের সামনে এবং শিহরিত হতে যা আমরা অনুভব করি কিন্তু দেখতে পাই না। শেখ আব্বাসের মৃত্যু সম্পর্কে কৃষকেরা বহু ধরনের কথা শুনেছিল। কেউ কেউ বলত শেখ পাগল হয়ে মারা গিয়েছিল, আবার অন্যেরা বলত হতাশার কারণে সে আত্মহত্যা করেছিল। কিন্তু যে নারী তার স্ত্রীকে সমবেদনা জানাতে গিয়েছিল সে জানায়, সে আতঙ্কে মারা গেছে, কারণ সামান রামির ভূত তাকে প্রতিরাতে সেই জায়গায় নিয়ে যেত যেখানে র্যাচেলের স্বামীকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল ছয় বছর আগে।
শেখের মৃত্যুর কয়েক মাস পর খলিল ও মিরিয়ামের গোপন প্রেম জানাজানি হয়ে গেল। এই চমৎকার সংবাদে গ্রামবাসী উল্লসিত হল, যা তাদেরকে নিশ্চিত করল যে খলিল এই গ্রামেই থাকবে। গ্রামবাসীরা এই সংবাদে একে অন্যকে অভিনন্দন জানাল। কারণ খলিল তাদের প্রতিবেশীতে পরিণত হবে।
ফসল তোলার মৌসুমে কৃষকেরা মাঠে মাঠে জড়ো করল ভুট্টা ও গমের আঁটি এবং তারপর তা নিয়ে গেল মাড়াইখানায়। এই ফসল নিজের গোলায় নেবার জন্য শেখ আব্বাস সেখানে ছিল না। এবার প্রত্যেক কৃষক নিজের ফসল তুলেছে। ভুট্টা ও গমে এবার সব কৃষকের বাড়ির উঠোন ভর্তি হয়ে আছে এবং তাদের পাত্রগুলি ভরে উঠেছে মদ ও তেলে। খলিল ভাগাভাগি করেছে তাদের সঙ্গে পরিশ্রম ও সুখ। সে কৃষকদেরকে সাহায্য করেছে শস্য জড়ো করতে, আঙুর পেষাই করতে এবং ফল আহরণ করতে। সে নিজেকে কখনও তাদের থেকে আলাদা ভাবত না। সেই বছর থেকে আমাদের আজকের সময় পর্যন্ত এই গ্রামের কৃষকেরা আনন্দের সঙ্গে ফসল তুলেছে যা তারা পরিশ্রমের দ্বারা প্রতি বছর বপন করে থাকে। তারা যে ভূমিতে শস্য এবং আঙুর ফলায় সেই ভূমি এখন তাদের নিজস্ব সম্পত্তি।
বর্তমানে সেই ঘটনার পর থেকে অর্ধশতাব্দী পার হয়ে গেছে এবং লেবানীয়দের জাগরণ ঘটেছে।
লেবাননের পবিত্র সিডার বনের দিকে যেতে যে-কোনো পর্যটকেরই দৃষ্টি আকৰ্ষণ করে সেই গ্রামটির সৌন্দর্য, উপত্যকার পাশে দাঁড়িয়ে আছে নববধূর মতো। উর্বর শস্যক্ষেত এবং বেষ্টিত ফলবাগান ঘেরা কুঁড়েঘরগুলি এখন আরামদায়ক এবং সুখীগৃহ আপনি যে-কোনো ব্যক্তিকে শেখ আব্বাসের ইতিহাস সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে সে আপনাকে একটা ধ্বংসস্তূপের দিকে আঙুল নির্দেশ করে বলবে, ‘এই হচ্ছে শেখের প্রাসাদ এবং এই হল জীবনের ইতিহাস’ এবং আপনি যদি খলিল সম্পর্কে অনুসন্ধান করেন তাহলে সে স্বর্গের দিকে আঙুল তুলে বলবে, ‘সেখানেই আমাদের প্রিয় খলিল বসবাস করে, যার জীবনের ইতিহাস লিখেছেন ঈশ্বর আমাদের হৃদয়ের পৃষ্ঠার ওপর জ্বলজ্বলে অক্ষরে এবং যুগ-যুগান্তরেও তা নিশ্চিহ্ন হবে না।
***
* যিশুর উপবাস স্মরণের উদ্দেশ্যে ইস্টারের পূর্বে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের চল্লিশ দিন ব্যাপী বাৎসরিক উপবাস এবং উপবাস শেষে উৎসব।