আত্মার আত্মহত্যা
আমাদের সবেতেই ফাঁকি। এরজন্য দায়ী ‘ইলেকট্রিসিটি’। বিদ্যুতের আবিষ্কার আর তার জনমুখী ব্যবহার চালু হওয়ার পর থেকে ফাঁকিবাজি আরো বেড়ে গেল।
কিরকম?
সুইচ টিপলাম, ফটাস করে জ্বলে গেল আলো। সুইচ দেওয়ামাত্রই পাম্পের গর্জন—ছাদের ট্যাঙ্ক ভরে গেল। চিমনি পরিষ্কার, পলতে কাটা, তেল ভরার বালাই নেই। আলোটিকে সাবধানে রাখা, যাতে দমকা বাতাস না লাগে। কাছে সরে এসে, আলোর বৃত্তে বইখানি খুলে নিবিষ্ট অধ্যয়ন। আলোর বাইরে ছায়ান্ধকার, তারপর নিবিড় অন্ধকারের এলাকা। রাত বাড়ছে, চিমনিতে দীপের রাত্রিজাগরণের কালিমাও বাড়ছে। এই যে তিনটি বৃত্ত-আলো, ছায়ান্ধকার, ঘোর অন্ধকার—এই তো আমাদের মন। তিনটি অবস্থা—অজ্ঞান, অল্প আভাস, পূর্ণ প্রকাশ। আলো থেকে অনেক দূর অর্থাৎ অজ্ঞান, অল্প দূর অর্থাৎ আভাস- কি রয়েছে তা তেমন স্পষ্ট নয়। আর আলোর সন্নিকটে উদ্ভাস, অতঃপর নিবেশ-নিবিষ্ট-জ্ঞান।
বোতাম-টেপা আলোর জীবনের সান্ধ্যচিত্রটা এইরকমই ছিল। প্রথমে আলোর যত্ন, সাধুর নিত্য লোটা মাজার মতো কাঁচের চিমনি পরিষ্কার করা, আলোর রাতের পরমায়ু অর্থাৎ তেল ভরা, পলতেটিকে গোল করে কাটা— সামান্য গোলযোগে শিখা তেড়াবাঁকা হয়ে যেতে পারে। এটি যেন আলোর অ, আ, ক, খ। মন যদি পলতের মতো গোল না হয়, তাহলে জ্ঞানের আলোও ছেতরে যায়। অতঃপর আলোর বৃত্ত জ্ঞানের সাধককে টেনে আনবে একপাশে। মন নিবিষ্ট হবে, আঁধারে ঢাকা থাকবে অন্য যাবতীয় বিভ্রান্তি। সেসব থেকেও থাকবে না। রাত যত প্রভাতের দিকে যাবে, আলো তত পাণ্ডুর হবে। ঊষা এসে অন্ধকারের গলায় রবির কিরণমালা পরাবে। ঊষালগ্নে প্রতিদিন এই অদ্ভুত, অলৌকিক বিবাহ! আলো এসে অন্ধকারকে বরণ করে নেয়। ঠাকুরের সেই কথা—অবিদ্যা মায়াকে বিদ্যামায়ায় রূপান্তরিত করে নাও। আলোর বুকে অন্ধকারের—শ্যামার নৃত্য। সাক্ষাৎ সত্য। সংগ্রাম নয়—সমর্পণ। দূর থেকে দেখলে আলোও কালো। জ্ঞান থেকে দূরে এক দর্শন, জ্ঞানের কাছে আরেক দর্শন। ঠাকুর বললেন, দূর থেকে দেখি তাই সমুদ্র নীল, দূর থেকে দেখি তাই ভুবনমোহিনী জ্যোতির্ময়ী জগদম্বা কালো। কাছে গেলে শিব-শক্তি অভেদ। এইবার জ্ঞানের পারে যাও—আলোও নেই, কালোও নেই।
ঠাকুর কত অদ্ভুত, কত সহজ! বিভাগ করছেন—জ্ঞান আর চৈতন্য। জ্ঞানের পারে গেলেই চৈতন্য। সসীম থেকে অসীমকে দেখা আবার অসীম থেকে সসীমকে দেখা। আমার দেহবোধ রয়েছে দিন-রাত, জন্ম-মৃত্যু দেখছি। স্থান-কালের বোধ আছে। টনটনে ‘আমি’ রয়েছে একটা। আমি আর তুমি-র একটা বিভাজন রয়েছে স্পষ্ট। তখন ‘নেতি, নেতি’ করে এগচ্ছি সত্যের দিকে—শাশ্বতের দিকে। তিনি কেমন? শ্রীভগবান গীতায় বলে দিলেন—
“অজো নিত্যঃ শাশ্বতোইয়ং পুরাণো
ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।।” (গীতা, ২।২০)
পৃথিবীর দৃশ্যমান জগতের এক-একটাকে ধরছি। এটা নিত্য? এটা, এটা? না। কোনটাই অজ, নিত্য, শাশ্বত ও পুরাণ নয়। আমি সেই বস্তুকে চাই, যা অজ বা জন্মরহিত, নিত্য অর্থাৎ ত্রিকালে পরিণামশূন্য, শাশ্বত অর্থাৎ অপক্ষয়শূন্য ও পুরাণ অর্থাৎ বৃদ্ধিশূন্য। এগতে এগতে যখন প্রায় হতাশ, সবই তো চলে যায়! হু হু শব্দে বর্তমান চলেছে অতীতে, ভবিষ্যৎ এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে বর্তমানের বুকে। অনুক্ষণ এই তাণ্ডবে বসবাস। বাউলের দল এল। খানিক নাচাগানা হলো। তারপর চলে গেল। পড়ে রইল ভাঙা উনুন, পোড়া কাঠ। আবার এল একদল!
ঠাকুর বলছেন, অস্তিত্বের এই বহমানতা চোখে পড়াটাই উদয়—জ্ঞানের উদয়। যার পরেই প্রশ্ন আসবে—কে ঠেলছে? কে ঠেলে ঠেলে কাঠ গুঁজছে অস্তিত্বের অনির্বাণ হোমানলে? “কে খেলায়, আমি খেলি বা কেন?” মথুরবাবু সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন : “বাবা! লালফুলের গাছে লাল ফুলই হয়, সাদা ফুল কখনো হয় না; কেননা তিনি নিয়ম করে দিয়েছেন। কই লালফুলের গাছে সাদাফুল তিনি করুন দেখি?” ঠাকুর বললেন : “তিনি ইচ্ছা করলে সব করতে পারেন।”
হলোও তাই। একই ডালে দুটো ফেঁকড়িতে দুটো ফুল—একটি লাল, আরেকটি ধবধবে সাদা। ডালটি ভেঙে এনে মথুরবাবুর সামনে ফেলে দিয়ে ঠাকুর বললেন : “এই দেখ!
মথুরবাবু সবিস্ময়ে দেখলেন—লাল আর সাদা জবা!
অন্তরালে কার শক্তি, কোন্ শক্তি! ছোট্ট এতটুকু একটা বীজে বিশাল বটের শক্তি! নদীর গর্জমান তরঙ্গে বিদ্যুতের শক্তি! বিদ্যুতের বিস্ময়কর চালিকা শক্তি! আকাশে বিদ্যুতের এক চমকে কয়েক লক্ষ ভোল্টের উৎপত্তি! বালকের বিশ্বাস একরকম, বিজ্ঞানীর পঠিত জ্ঞানে একরকম, আর আধ্যাত্মিক মানবের জ্ঞানে সম্পূর্ণ অন্যরকম। সেটি কেমন? ঠাকুর বলছেন তাঁর বালক ভাইপো শিবরামের কথা। “ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে, আমার সঙ্গে ঘরের ভিতরে সে আছে; বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, তবুও দ্বার খুলে খুলে বাহিরে যেতে চায়। বকার পর আর বাহিরে গেল না, উঁকি মেরে মেরে এক-একবার দেখছে বিদ্যুৎ আর বলছে, ‘খুড়ো! আবার চকমকি ঠুকছে।
কে ঠুকছে? কোন্ সুদূর নভোলোকে বসে আছেন এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নিয়ন্তা! তাঁর কাছে সব আছে। বিরাট বিরাট চকমকি পাথর তাঁর হাতে। ঝড়ের রাতে আকাশের অলিন্দে বেরিয়ে এসে তাঁর ইচ্ছামত এক-একবার ঠোকেন, আর ব্রহ্মাণ্ড ঝলসে যায় নিমেষ-নীল আলোয়। বালক তার স্থির পরা- বিশ্বাসে সেই কনক হাতদুটি দেখতে পায়।
ঠাকুর কলেজে পড়া যুবক ছাত্রদের তড়িৎ-সম্বন্ধীয় আলোচনা শুনে প্ৰশ্ন করলেন : “হাঁরে, তোরা ও কি বলছিস? ইলেকটিকটিক মানে কি?” যুবক ভক্তেরা তখন পরম উৎসাহে তাঁদের কলেজী জ্ঞান প্রকাশ করতে লাগলেন। বলতে লাগলেন বজ্রনিবারক দণ্ডের উপকারিতা। “সর্বাপেক্ষা উচ্চ পদার্থের ওপরেই বজ্রপতন হয়, সেই কারণে ঐ দণ্ডের উচ্চতা বাড়ির উচ্চতার চেয়ে একটু বেশি হওয়া উচিত।”
ঠাকুর মন দিয়ে সব শুনে বললেন : “কিন্তু আমি যে দেখেছি, তেতলা বাড়ির পাশে ছোট চালাঘর—শালার বাজ তেতলায় না পড়ে তাইতে এসে ঢুকল! তার কি করলি বল! ওসব কি একেবারে ঠিকঠাক বলা যায় রে! তাঁর ইচ্ছাতেই আইন, আবার তাঁর ইচ্ছাতেই উলটে-পালটে যায়। যাঁর আইন, যিনি আইন করেছেন তিনি ইচ্ছে করলে আইন পালটে অন্য আইন করতে পারেন।”
‘নেতি নেতি’ করে যে-শূন্যে উপনীত হবে সেখানে জ্ঞান নয়, আছে চৈতন্য। জ্ঞান আপেক্ষিক, অনেক নিচের জিনিস। জ্ঞান হলো প্রত্যক্ষের জ্ঞান। চৈতন্য হলো চিদাকাশ। সেখানে জ্ঞানসূর্য উদিত হয়। কেন ব্রহ্মজ্ঞানের প্রয়োজন? সে-জ্ঞান কেমন? ‘ইলেকটিকটিক’-এর জ্ঞান নয়। কূপ থেকে ইন্দ্রিয়ের পাকানো দড়ি দিয়ে বোধের বালতিতে জল তোলা নয়। সমুদ্রের চরাচর উচ্ছ্বাসের মতো প্লাবিত হওয়া। “সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম” (ছান্দোগ্য উপনিষদ্, ৩।১৪।১)-এর চৈতন্য জাগরিত হওয়া। “ব্রহ্ম হতে কীট পরমাণু সর্বভূতে” নিজেকেই খুঁজে পাওয়া। এইটিই হলো আত্মজ্ঞান। আত্মজ্ঞানের বিকিরণের নাম চৈতন্য।
ঠাকুর সেই অবস্থায় পৌঁছেছিলেন জ্ঞান, ভক্তি আর তন্ত্রের পথ ধরে। সেই অবস্থাটা কেমন? পূজার জন্য ঠাকুর দূর্বা, বিশ্বপত্র তুলতে গেছেন। দূর্বা তুলতে তুলতে অনুভব করছেন—সর্বত্র চৈতন্য। ছিন্ন দূর্বাদলের বেদনা নিজে অনুভব করছেন। বিশ্বপত্র তুলতে গিয়ে পাতার সঙ্গে বেলগাছের ছাল একটু উঠে এসেছে। মনে হলো নিজের ছালই উঠে এল, বেলপাতা আর তোলা হলো না।
এই কথাই বললেন শ্রীভগবান তাঁর শ্রীমুখে—
“আত্মৌপম্যেন সর্বত্র সমং পশ্যতি যোহর্জুন।
সুখং বা যদি বা দুঃখং স যোগী পরমো মতঃ।।” (গীতা, ৬।৩২)
-–হে অর্জুন, যে-ব্যক্তি নিজের সঙ্গে অভিন্ন তুলনা করে সকল প্রাণীতে সুখ বা দুঃখ সমানভাবে দেখেন, সেই যোগীই শ্রেষ্ঠ।
অনুভূতির জগতে প্রবেশ করতে হলে নীরব, নিবিড় ধ্যানের প্রয়োজন। মনে, বনে, কোণে। বোতাম-টেপা ব্যস্ততার এই যুগে মন যেন স্কেটিং বুট পরে সদাই ধাবন্ত। বন হয় প্রমোদকানন, না হয় মাফিয়াদের লীলাক্ষেত্র। আর কোণ? আসবাব-পরিকীর্ণ!
সভ্যতার অসভ্যতায় মানুষের আত্মা আত্মহত্যা করেছে।