আত্মজ – ২য় অংশ

দুই

খাটে আধশোওয়া হয়ে চোখ বোলাচ্ছিলাম ফর্দে। পুরুতমশাই একটা লিস্ট ধরিয়ে গেছেন বটে। চাল ডাল তেল নুন সবজি ফুল ফল বেলপাতা কুশ তিল যব হরীতকী তিল ঘি মধু চিনি কলাপাতা পান সুপারি মসলা কী আছে, কী নেই। দানসামগ্রীর তালিকাও নেহাত ছোটো নয়। থালা বাটি গেলাস ছাতা চটি শাড়ি ঘড়া গামলা পিলসুজ …। লেডিজ চটির পাশে সাইজ লেখা আছে, ছাতাটাও রঙিন চাই, তাও খাট বিছানা বালিশ লেখেননি, মূল্য ধরে নেবেন। কতটুকু সাশ্রয় হলো কে জানে!
সব মিলিয়ে মোট কত লাগতে পারে? বাজেট ছাপিয়ে যাবে না তো? ব্যাংক থেকে শেষ ঝড়তি-পড়তি দশ হাজার তুলে নিয়েছি, প্রবীরদার কাছে চেয়েছি পাঁচ—কাজকর্ম, খাওয়া-দাওয়া সব এতে চুকবে তো? প্যান্ডেল নেবে তিন হাজার। ফ্ল্যাটবাড়ির শুধু ছাদটুকু ঘিরবে, তাও সাদা কাপড়, এর জন্য এত যে কেন চাইছে? চেয়ার-টেবিলে নয় শ … মেরেকেটে হাজার। শ্রাদ্ধের দিন নব্বইজনের মতো খাবে। নব্বই ইনটু ফিফ্টিফাইভ, মোটামুটি পাঁচ হাজার। মৎস্যমুখের দিন তিরিশ জন। আশি ইনটু তিরিশ মানে প্রায় আড়াই। সাকুল্যে হলো সাড়ে এগারো। কাজে নিশ্চয়ই হাজার তিনেকের বেশি পড়বে না। পরশু ঘাটকাজেও কিছু খরচা আছে। … মনে হয় টায়েটুয়ে কুলিয়ে যাবে। তেমন যদি হয় শ্রাদ্ধের দিন এক রকম মিষ্টি নয় কমিয়ে দেব। প্লেটপিছু পাঁচ টাকা বাঁচে। অর্থাৎ সাড়ে চার শ। একেবারে ফ্যালনা নয়। এভরি ফারদিং কাউন্টস।
আচমকা হাসি পেয়ে গেল। কী ছেলেমানুষি ভাবনা! কলসি দিয়ে লাখো মোহর গলে গেল, এখন কানাকড়ি বাঁচাতে পুটিংয়ের খোঁজ। শুধু নার্সিং হোমেই তো বেরিয়ে গিয়েছিল চল্লিশ হাজারের বেশি। ফিজিওথেরাপিস্টের পেছনে না হোক বিশ-বাইশ হাজার। প্রথম মাসখানেক দুবেলা দুটো নার্স ছিল। তারা কান মচড়ে এক শ কুড়ি এক শ কুড়ি দু শ চল্লিশ দুয়ে নিত প্রতিদিন। খরচায় উদ্ব্যস্ত হয়েই না ধাপে ধাপে নেমেছিলাম। দুটো নার্স থেকে রাতে নার্স দিনে আয়া, তারপর দুবেলা দুটো আয়া, শেষমেশ ওই রমা। মেয়েটা রাত-দিন থাকত, খাওয়া-দাওয়া নিত। তা নিক, মাইনেটা তো কম। মাসে দু-হাজার বাঁচানো চাট্টিখানি কথা নয়। এত সামলে, এত টেনেটুনেও প্রভিডেন্ট ফান্ডে লোন, কো-অপারেটিভে ধার …। শালা, ভাবতেই ইচ্ছে করে না। যা খসছে খসুক, এবার একবারেই চুকে যাক। আশা করি, আমি বা সুপ্তি কেউ ওভাবে পড়ে থাকব না। তেমন হলে মামপি গোগোল যে কী অভিশাপ দেবে!
সুপ্তি ঘরে ঢুকেছে। ঘটাং ঘটাং আলমারি খুলল। তাক হাতড়াচ্ছে।
—কী খুঁজছ?
—আরে দ্যাখো না, জ্বালিয়ে মারল।
—কে?
—রমা। শাড়ি শাড়ি করে আমায় পাগল করে দিল।
—দিয়ে দাও একখানা।
—একটা নয়, দু-দুটো দিয়েছি। মার শাড়ি। বললাম, সাদা খোল তো কী আছে, ছাপিয়ে নিস। মন উঠল না।
—কী চায়? বেনারসি?
—ওই রকমই কিছু পেলে ভালো হয়। সুপ্তি মুখ বেঁকাল, বলছে দিদার এত ময়লা ঘাঁটলাম, একটা সিল্কের শাড়ি অন্তত পাব না?
দুনিয়ায় নিজের প্রাপ্য সবাই বোঝে। রমার কী দোষ, আমার মা-ই কি ছেড়েছে? কর্তব্যের পাওনাটুকু উসুল করে নেয়নি?
বিরস মুখে বললাম, ঝুটঝামেলা হঠাও। দিয়ে দাও। ঈষৎ রংজ্বলা নিজের একটা মুরশিদাবাদী সিল্ক বার করে নিয়ে গেল সুপ্তি।
ফর্দখানা টেবিলে রেখে চিত হয়ে শুলাম। চোখটা আবার টানছে। শরীরে বেজায় ক্লান্তি। সকাল থেকে আজ ছোটাছুটিও গেছে বেশ। দুলুকে নিয়ে নেমন্তন্ন করতে বেরিয়েছিলাম। মানিকতলা শ্যামবাজার … উত্তর কলকাতার পাট চুকোলাম আজ। ফোনেই বলে দিয়েছি অনেককে, তবু এখনো তো কেউ কেউ আছে যারা মাতৃবিয়োগ ভারাক্রান্ত মুখটি না দেখতে পেলে সন্তুষ্ট হয় না। আড়াইটে নাগাদ বাড়ি ফিরে ঘি সহযোগে সেদ্ধভাত গলাধঃকরণ, ফলত যথেষ্ট টকে আছে গলা। এখনো।
তবে ক্লান্তিটা ঠিক অম্বলের জন্য নয়। এ শ্রান্তি যেন একটু অন্য রকম। ম্যারাথন দৌড় সাঙ্গ করে শেষ ফিতে ছোঁয়ার পর যেমনটা লাগে দৌড়বীরের, এ অবসাদ যেন সেই ধাঁচের। মাকে পুড়িয়ে আসার পর থেকেই শরীর একদম ছেড়ে গেছে।
চিন্তাটায় কটু গন্ধের আভাস আছে কি? ম্যারাথনাররা আমার মতোই শরীর নিংড়ে দৌড়োয় বটে, কিন্তু তাদের শেষ ফিতে ছোঁয়ার সঙ্গে কি মার মৃত্যুর তুলনা চলে? আমি কি প্রথম দিন থেকে ওই লক্ষ্যেই পৌঁছতে চেয়েছি? না না না না, কক্ষনো না। বরং উলটো পথেই তো দৌড়েছি, লড়াই করেছি মাকে বাঁচানোর জন্য। কায়মনোবাক্যে চেয়েছি মা সুস্থ হয়ে উঠুক, পুরোপুরি আগের মতো না হলেও হাঁটাচলা করুক, মোটামুটি একটা স্বাভাবিক জীবনে ফিরুক। সর্বস্ব উজাড় করেও যদি সামান্যতম উন্নতি না হয়, তখন মানুষের কেমন লাগে? মনে হয় না কি রেসিংট্র্যাকটা ক্রমে ঘুরে যাচ্ছে, পার হচ্ছি একটা লম্বা প্যাঁচালো পথ? ঘেমে নেয়ে যাচ্ছি, জিভ বেরিয়ে যাচ্ছে, ক্যালোরি শেষ, তবু ছোটো। কাঁহাতক পারে মানুষ?
সুপ্তি আবার এসেছে, হাতে চা। টেবিলে কাপ রেখে খাটে বসল। লাল পাড় কোরা শাড়ির আঁচল দিয়ে খাটের বাজু ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, তোমার সন্তুদাই জিতে গেল।
ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম, কেন?
—আমাদের ইচ্ছেটার তো মূল্য রইল না। মার ঘরে তো কাজ হচ্ছে না।
—সন্তুদা তো ভুল কিছু বলেনি। মার ঘরটা তো সত্যিই ছোটো। ড্রয়িংহলে কাজ হলে সুবিধেই হবে, শ্রাদ্ধের সময়ে লোকজন বসতে-টসতে পারবে। … ডেকরেটারকে বলে দিয়েছি ফরাস পেতে দেবে …
—আমার কোনো কিছুতেই আপত্তি নেই। তবে আমার লাগছে কোথায় জানো? তোমার ওই সন্তুদার কথাবার্তায়। … পিসির ঘরটা খুপরি … এত চাপা … আলোবাতাস খেলে না … যেচে পড়ে এসব শোনানোর অর্থ কী? আমরা যেন ইচ্ছে করে মাকে অন্ধকূপে রেখেছিলাম।
সুপ্তির আহত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। ফ্ল্যাটে আসার আগে সুপ্তি বারবার বলেছিল, মা আপনি বড় ঘরটা নিন। মা কিছুতেই রাজি হননি। এক গোঁ—আমি একা মানুষ, ওই ঘরের আমার কী প্রয়োজন। বরং বড় ঘরটা তোরা নে, মাঝেরটায় বাচ্চারা একটু হাত-পা ছড়িয়ে থাকুক।
হাত নেড়ে বললাম, সন্তুদার কথা ছাড়ো। খেটেখুটে দিচ্ছে …। আমরা তো জানি, আমরা মার জন্য কী করেছি।
—সবচেয়ে ভালো হতো বাড়িতে কাজটা না হলে। ফ্ল্যাটের সোসাইটির পারমিশন নাও, এর সামনে হাত কচলাও, ওর চাট্টি কথা শোনো … আমার একদম পছন্দ হয় না।
—কী করা যাবে? চৈতন্যমঠ গৌড়ীয়মঠ হেনামঠ তেনামঠ—সবই তো ঘুরে দেখা হলো। কোত্থাও জায়গা নেই। বাপ-মাকে চিতায় চড়ানোর আগেই যে লোকে শ্রাদ্ধের জায়গা বুক করে ফেলে আমি কী করে জানব? … একদিক দিয়ে ভালোই হলো। কেউ বলতে পারবে না মঠে টাকা ধরিয়ে মার কাজ সেরেছি।
—যারা কথা শোনানোর তারা ঠিক শোনাবে। এই তো, তোমার খুকুদি আজ কায়দা করে কত কী বলে গেল।
—কী বলেছে খুকুদি?
—মাসিকে তোমরা ন্যাজাল ফিডিংয়ে রাখলে পারতে, এই রমাটমারা কি তেমন সাবধানে খাওয়াতে পারে …! ঠারেঠোরে বলতে চাইছিল আমরা মার ঠিক যত্ন নিইনি।
—বলুক গে যাক। আমরা তো জানি আমরা কী করেছি। কথাটা ফের মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, বাইরের লোকের কথায় কান দিয়ো না।
—লাগে। বুঝলে, লাগে। দুই বছর ধরে সংসারের সব খরচ কিভাবে কাটল করে গেছি। ছেলেমেয়ের ফল বন্ধ করে মাকে আঙুরের রস, বেদানার রস খাইয়েছি। পুজোর সময়ে একটার বেশি জামা দিয়েছি মামপি গোগোলকে? দেনায় দেনায় অন্ধকার … মাস গেলে কেটেকুটে কটা টাকা হাতে পাও সে খবর কেউ নেওয়ার চেষ্টা করেছে কখনও? শুধু ওপর থেকে আহা, উহু। আজ বাদে কাল মামপি নাইনে উঠবে, ওর জন্য একটা ভালো টিউটর রাখা দরকার, পেরেছি রাখতে? সেই তো ঢোকাতে হলো কোচিংয়ের গোয়ালে। সুপ্তি জোরে নাক টানল, সারাক্ষণ খালি চিন্তা মার হরলিঙ্ ফুরোল কি না, মার কমপ্ল্যান আছে তো …।
মাকে ছেড়ে কোথাও গিয়ে দু-দণ্ড তিষ্ঠাতে পেরেছি? নতুন মাসির বিয়ে হলো, আমি সকালে মুখ দেখিয়ে এলাম, তুমি বিকেলে। কেন? মার জন্যই তো! তার পরও তোমার জেঠিমা বলে গেলেন রেণুর যখন টান উঠল তখন তুমি বুঝি ছিলে না বউমা! বলো, শুনতে কেমন লাগে? বলো?
—বাদ দাও। যারা করে, তাদেরই সমালোচনা হয়। এ তো জানা কথা, আমারও একটা ছোট্ট শ্বাস পড়ল, নাও, চা খেয়ে নাও। জুড়িয়ে যাচ্ছে।
চোখের কোল মুছে একচুমুকে কাপ শেষ করল সুপ্তি। উঠে লাগোয়া বাথরুমটায় গেল একটু। বেরিয়ে শুকনো গলায় জিজ্ঞেস করল, তুমি এখন কিছু খাবে?
সিগারেট ধরিয়েছি। কাঠি অ্যাশট্রেতে গুঁজে বললাম, কী খাব?
—ফল কেটে দিতে পারি।
—চা খেয়ে ফল?
—খানিকক্ষণ পরে খেয়ো।
—কত ফল খাব? বাদড়ও এত ফল খেতে পারে না।
সুপ্তি ফিক করে হেসে ফেলল, তোমার টুসিদি সকালে আবার একগাদা কলা, আপেল, সফেদা দিয়ে গেছে। গোগোল মামপি তো দেখছে আর আঁতকে আঁতকে উঠছে, যে আসছে হাতে ফল, মিষ্টি, যে আসছে হাতে ফল মিষ্টি … গোগোল, চুরি করে সন্দেশ খেত, এখন ফ্রিজের ধার মাড়াচ্ছে না।
—ফেলে দাও সব। কাজের লোকদের বিলিয়ে দাও।
—কত দেব?
—তাহলে নিজেই খাও বসে বসে। তুমি তো আপেল ভালোবাস।
—বাসতাম। এখন আর সহ্য হয় না।
—তাহলে এক কাজ করো। ফলকো গোলি মারো। মামপি গোগোলের জন্য তো লুচি হবেই, কটা বেশি করে ভাজো। বেলায় খেয়ে, এখন আর কিছু না খেয়ে আমরাও বরং তাড়াতাড়ি রাতের খাওয়াটা …
—তুমি লুচি খাবে?
—কী আছে? গোমাংস তো খাচ্ছি না।
—হ্যাঁ অ্যা, হুট করে তোমার কোনো আত্মীয় এসে পড়ুক, ওমনি রটে যাবে শাশুড়ি গত হওয়ার আনন্দে সুপ্তি বরকে লুচি গেলাচ্ছে।
—হু কেয়ারস্? আমরা কারো খাই, না পরি? অশৌচ মানামানিটা নিজেদের মনের ব্যাপার। তাও তো আমি … নেহাত মা এসবে বিশ্বাস করত বলে … এসব কাছা নেওয়া-টেওয়া আমার যথেষ্ট অকোয়ার্ড লাগে।
—আহা, পালন যখন করছই, পুরোটাই করো। আর তো মাত্র কটা দিন। এত দিন এত কিছু করলে আর মাত্র দু-চার দিনের জন্য ধৈর্য হারিয়ে ফেলবে?
ক্যাঁ ক্যাঁ ডোরবেল বাজছে। একটানা। নির্ঘাত মামপি। স্কুল থেকে এসেই ছুটেছিল কোচিংয়ে, ফিরল। গোগোল দরজা খুলতেই শুরু হয়ে গেছে লণ্ডভণ্ড কাণ্ড, ধুপধাপ আওয়াজ ড্রয়িং ডাইনিং স্পেসে। গোগোলের চিৎকার উড়ে এলো, মামপির হিহি হিহি।
চোখ কুঁচকে বললাম, কী নিয়ে লাগল দুজনের? এত হল্লা কিসের?
—আর কী! গোগোল কার্টুন চ্যানেল দেখছিল। মামপি নির্ঘাত ওর হাত থেকে রিমোট কেড়ে নিয়েছে।
ঠাম্মার মৃত্যুর পর দু-চার দিন থমকে ছিল ভাইবোন, আবার তারা সমে ফিরছে। গোগোলের স্বর চড়তে চড়তে সোপ্রানোয়, পাল্লা দিয়ে বাজছে মামপির হাসি।
সুপ্তি বিরক্ত মুখে বলল, দাঁড়াও দিয়ে আসি ঘা কতক। এত ধাড়ি মেয়ে, পাঁচ বছরের ছোট ভাইয়ের সঙ্গে কেমন লাগে দ্যাখো।
—থাক, কিছু বোলো না। মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, ফ্ল্যাটটায় প্রাণ ফিরুক। এ কদিনের দমচাপা ভাবটা কাটুক একটু।
সুপ্তি অস্ফুটে বলল, এ কদিন? না পঁচিশ মাস?
বলেই সুপ্তি নীরব। আমিও আর কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। বাইরে বিকেলটা মরে গেছে বহুক্ষণ, আমাদের বন্ধ দরজা-জানালা ভেদ করে মরা বিকেলটা তবু ঢুকে পড়ছিল ফ্ল্যাটে। চুঁইয়ে চুঁইয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *