1 of 2

আত্মজা – বিমল কর

আত্মজা

হিমাংশু স্বামী; যূথিকা স্ত্রী। ওরা বছর পাঁচেকের ছোট-বড়। দেখলে মনে হবে, ব্যবধান পাঁচের নয়, আট কিংবা দশের। মেয়ে পাশে থাকলে এ হিসেবটাও গোলমাল হওয়া বিচিত্র নয়। পুতুল যদি পনেরোয় পা দিয়ে থাকে আর যূথিকা সত্যি-সত্যিই গর্ভধারিণী হয় ও মেয়ের, তাহলে বলতে হবে, রোগা, খাটো চেহারার মেয়েরা বেশ বয়স লুকোতে পারে। যেমন যূথিকা। অবশ্য যূথিকা কখনো বয়স লুকোবার চেষ্টা করত না! বরং পুতুল যে তার মেয়ে—এ কথা হাবে ভাবে সাজে পোশাকে পরিস্ফুট করার ঝোঁকটা স্বভাবে দাঁড়িয়েছিল। এই চেষ্টা সত্ত্বেও পুতুলের মা যূথিকাকে মোটেই পঞ্চদশী কন্যার জননী বলে মনে হত না। বরং এই ধরনের সাজ-পোশাক ওর রোগা, খাটো চেহারার ওপর শালীনতা ও আভিজাত্যের একটা সুষমা ফুটিয়ে তুলত—যা দেখলেই মনে হওয়া স্বাভাবিক, পনেরো বছরের মেয়ের মা সাজার চেষ্টাটাও কৃত্রিম। আসলে, পরিচ্ছন্ন ও পরিমিত সজ্জার আশ্রয়ে একটি খাটো লঘু নারীদেহে মেদ-শুষ্ক দুর্বল অস্থিগুলো আশ্চর্যভাবে আত্মগোপন করত; এমন কি, পানপাতা ঢঙের ছোট একটি মুখে ব্যাধির যে বিবর্ণ রেখাঙ্কন স্বভাবতই দৃষ্টিগোচর হওয়ার কথা—তাও ঢাকা পড়ে যেত। বলা মুশকিল, যূথিকার মনের সুগোপন কোণে, ওরই অজ্ঞাতে এই দ্বিতীয় বাসনা ছিল কিনা—যদিও আচরণে উলটোটাই প্রকাশ পেত।

স্ত্রীর তুলনায় স্বামী বিপরীত মেরুর। যূথিকা একত্রিশ হলে হিমাংশুর ছত্রিশ হওয়ার কথা। স্বতন্ত্রভাবে ওকে দেখলে পরিণত যৌবনের দীপ্তিতে চোখ ঝলসে যায়। সুগঠিত অঙ্গ; স্বাস্থ্য সমৃদ্ধ। সর্বাঙ্গে তার সেই প্রাণবন্ত যৌবনের খুশি, হাসি। আর হিমাংশু তো সব সময়েই হাসছে। সকাল-দুপুর-সন্ধে সব সময়; সর্বত্রই। একটা মানুষ যে এত হাসতে পারে, ওকে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। এমনিতেই গলার স্বর ভরাট। জোরে হাসলে বাতাসের ঢেউ এমনভাবে গলা দিয়ে বাইরের হাওয়ায় এসে শব্দ তুলত, যা শুনলে মনে হবে—এক জোড়া পায়রা আগল দেওয়া ঘরে ডানার শব্দ তুলে উড়ছে। এমন হাসি দিনে অসংখ্যবার শোনা যায় হিমাংশুর পাশে থাকলে; যদিও সব সময়ের হাসিটা তার ঠোঁটে গালে লেগে থাকে, চোখেও কিছুটা। অনেকের এ হাসি পছন্দ, অনেকের নয়। যেমন পুতুলের খুবই ভালো লাগে; যূথিকার লাগে না। বরং দেখা গেছে—মাঝে মাঝে রীতিমত বিরক্ত হয় যূথিকা, কড়া সুরে ধমক দেয়; বলে, ‘ইস অমন বিকট শব্দ করে কী হাস?’ …অফিস যাবার মুখে হিমাংশু তখন হয়ত রুমালটা ট্রাউজারের পকেটে পুরছে, খুবই ব্যস্তভাব; তবু এক লহমা স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে চোখে বিস্ময় তুলে বলে “বল কি—যে-হাসি এককালে বাঁশির চেয়ে মধুর মনে হত তোমার, আজ তা বিকট হয়ে গেল!” একটা হয়ত অপ্রতিভ হয় যূথিকা, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সামলে জবাব দেয়, “এককালে রঙ্গ করার বয়স ছিল—করতুম। তা বলে আজও কি তোমার মতন ছেলেমানুষি করতে হবে?” স্ত্রীর কথায় আর একদফা হেসে দমকা হাওয়ার মতন বাইরে এসে দাঁড়ায় হিমাংশু, পাশের ঘরের দিকে মুখ বাড়িয়ে ডাকে, “পুতুল, রেডি? আমি নীচে নামলাম। তাড়াতাড়ি আয়।” কথা শেষ হতে না হতে দেখা যায় তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে হিমাংশু নীচে নেমে গেছে। পুতুল সবে বারান্দায়। মা-মেয়েতে চোখাচোখি হয়। যূথিকা পাশ কাটিয়ে নীচে নামতে থাকে হঠাৎ, তারপর সিঁড়ির মাঝ-বাঁকে দাঁড়িয়ে পড়ে। হিমাংশু পায়ে ক্লিপ লাগিয়ে সাইকেলের হ্যান্ডেলে হাত রেখে অপেক্ষা করছে; চোখ সিঁড়িতে। যূথিকা বিরস চোখে তাকিয়ে শুরু করে, “তুমি যাও, পতুল যাবে না।” …“যাবে না! কেন?” হিমাংশু বুঝেও না-বোঝার ভান করে। অসহ্য বিরক্তি মেশাননা গলায় যূথিকা এবার জবাব দেয়, “এক কথা একশোবার বলতে আমার ভালো লাগে না। কতবার না বলেছি, ওকে তুমি সাইকেলের পেছনে চাপিয়ে রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাবে না!” হিমাংশু চকিতে একবার স্ত্রীর মাথা টপকে দেখে নেয়। পুতুল এক সিঁড়ি এক সিঁড়ি করে নিঃশব্দে মার প্রায় পিঠের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।

চোখে-মুখে চট করে একটু অপরাধের ভাব ফুটোয় হিমাংশু, “আজ কিভাবে যে একটু দেরি হয়ে গেল গো—বুঝতেই পারলাম না! পুতুলের স্কুলের বাসটাও ফিরে গেল। কিন্তু অযথা স্কুল কামাই করা কি ভাল হবে? ওর আবার আজ অঙ্কের ক্লাস। কি রে, আজ না-হয় নাই গেলি, পুতুল!” বাপের কথায় মা ঘাড় ফিরিয়ে মেয়ের দিকে তাকায়। কান্না-কান্না মুখ করতে তিলমাত্র দেরি হয় না মেয়ের। আস্তে অথচ শব্দটা যাতে বাবার কানে যায় ততটুকু চড়িয়ে পুতুল বলে, “অঙ্কের ক্লাস কামাই গেলে বড্ড যা-তা ক’রে বলে মিস্ সরকার।” ঘূথিকা চূড়ান্ত শাসনের সুরে জবাব দেয়, “সে-কথা আগে মনে থাকে না; হেলাফেলা করে কেন তুমি স্কুলের বাস ফেল কর? শুনবে, বকুনি শোনাই উচিত।” একটু থেমে যূথিকা এবার স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বলে, “ট্রাম বাসে পৌঁছে দিতে বললে এক্ষুনি বলবে তোমার অফিসের লেট হয়ে গেছে। বুড়ো-ধাড়ি মেয়েকে সঙ সাজিয়ে সাইকেলের পেছনে করে রাস্তা দিয়ে না নিয়ে গেলে তোমার বাহার হয় না! যাও, যা খুশি কর গে।” কথা শেষ করেই যূথিকা ওপরে উঠতে থাকে—মেয়ে, স্বামী কারুর দিকে ফিরে তাকায় না। না তাকাক যূথিকা। পুতুল হরিণ গতিতে নীচে নেমে এসে বাবার পাশটিতে দাঁড়ায়। হিমাংশু মুচকি হেসে মেয়েকে সদরের দিকে পা বাড়াতে ইঙ্গিত করে।

মেয়ে-শাসনের রাশটা ইদানীং যূথিকা শক্ত করেই ধরেছে! ফলে, সাইকেলের পেছনে চেপে স্কুল যাওয়াই শুধু নয়, আরো অনেক খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে নিত্যই স্বামীকে র্ভৎসনা করেছে। মেয়েকেও। তবু যেমন বাপ, তেমনি মেয়ে। গায়ে মেখেও মাখে না। শতেক রকম ফন্দি করে এড়িয়ে যায় সমস্ত শাসন। কাজেই যূথিকার তরফ থেকে প্রায়ই কথা ওঠে।

মেয়েদের সাঁতারে ফার্স্ট হয়েছিল পুতুল। কাপ পেল, মেডেল পেল; সুইমিং কস্টিউম-পরা ছবি উঠল তার। কাপ-মেডেল দেখে যূথিকা অখুশি হয়নি। কিন্তু যেদিন পুতুলের সেই বিজয়িনী ছবিটা নিয়ে এলো হিমাংশু, যূথিকার সারা মুখ কুঁচকে উঠল। মেয়ের অসাক্ষাতে ছবিটা বাক্সের অন্ধকারে চালান করে দিয়ে যূথিকা স্বামীকে বলল, “আচ্ছা, মেয়ের তোমার বয়েস বাড়ছে না কমছে?”

“কেন?” হিমাংশু অবাক হয়ে চোখ তোলে।

“কেন কী, ওই নেংটিটা পরিয়ে কেউ ছবি তোলে ডাগর মেয়ের? ছি-ছি।”

“নেংটি? নেংটি আবার কোথায় পেলে তুমি? ওটা তো সাঁতারের জামা। বাঃ, আমারও ত অমন জামা আছে, ছবিও আছে; দেখনি নাকি তুমি?”

“তোমার থাকে থাক, মেয়ের থাকবে না।” যূথিকার গলায় এবার স্পষ্ট আদেশ, “হেদোর জলে সাঁতার কেটে মেয়ের তোমার জীবন কাটবে না; তাকে ঘর সংসার করতে হবে—ছি ছি, কী জঘন্য ছবি! পাঁচজনে তো চোখ দিয়ে তাই গিলে খাবে!”

“কী যে বলো?” হিমাংশু স্ত্রীর কথায় হেসে ফেলে, “রসগোল্লা না পান্তুয়া যে গিলে ফেলবে! তবে হ্যাঁ, দেখবে। দেখানোর জন্যই তো ওই ছবি; ওতে তোমার মেয়ের গর্ব। আর যদি অন্য কথা বলো, তবে বাপু, সত্যি কথাই তো; ভালো চেহারা দেখাবার জন্যেই।” একটু থেমে আবার, “এই ধর-না তোমার আমার কথা। বিয়ের আগে দাদু, মা—দুজনই তোমায় দেখেছিলেন; লুকিয়ে-চুরিয়ে আমিও। আর দিব্যি করে বলো তুমি, আমাকেও তুমি দেখেছিলে কিনা? হুঁ-হুঁ, বাব্বা—এত দেখাদেখি, ভালো লাগা, তবেই না বিয়ে?”

স্বামীর বাকবিন্যাসের তরলতায় যূথিকার গাম্ভীর্য ক্ষুণ্ণ হতে চলেছিল। তাড়াতাড়ি অন্তিম উষ্মাটুকু প্রকাশ করে ও বলল, “সব কথা নিয়ে হ্যালহেলে ভাব আমার ভাল লাগে না!” ওসবের বয়স পেরিয়ে গেছে, এখনো তোমার এই ছেলেমানুষি কি ভাল লাগে, না মানায়?” কথা শেষ করে যূথিকা আর দাঁড়ায় না, চলে যায়।

স্ত্রীর কথায় মুচকি হাসে হিমাংশু। ও লক্ষ করেছে—যূথিকা দিনে অন্তত দু-পাঁচবার চেষ্টা করে, হিমাংশু যে ছেলেমানুষির বয়স কাটিয়ে প্রায় প্রবীণত্বের সীমানায় এসে পৌঁছেচে সেটা স্মরণ করিয়ে দেবার। অথচ হিমাংশু জানে, এটা বাড়াবাড়ি যূথিকার। জোর করে বয়স পাকাবার চেষ্টা। বাস্তবিক, কী এমন বয়স ওর বা যূথিকার। নেহাত এক সেকেলে দাদুর পাল্লায় পড়ে গোঁফ ঘন হওয়ার বয়সে, সেই কুড়িতে, কলেজে পড়ার সময়ই তাকে বিয়ে করতে হয়েছিল পনেরো বছরের যূথিকাকে! নয়ত আজ তার বা যূথিকার এমন একটা বয়স হয়নি, যাতে বুড়োটে মেরে যেতে হবে। বরং আজকাল ছেলেরা কে-ই বা ত্রিশ-বত্রিশের আগে, আর মেয়েরা তেইশ-চব্বিশের আগে বিয়ে করে? একটু বয়সে বিয়ে হওয়াই ভাল—হিমাংশুর আজকাল এই ধারণা। অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ায় তার বা যূথিকার কিছু ক্ষতি হয়েছে। বই কি! একটা আশ্চর্য সিরসিরে তারুণ্যের আনন্দ যদিও বিয়ের সময় ওদের ঘিরে ছিল, বিয়ের পরেও, তবু যোল বছরে মা হয়ে যূথিকা মরতে বসেছিল। কী কষ্ট তার, কী ভয় হিমাংশুর! ভেবে ভেবে ভয়ে দুশ্চিন্তায় হিমাংশুর চেহারা শুকিয়ে গিয়েছিল, অমন সাঁতারু বুকের ফুসফুসটাও দুর্বল হয়ে পড়েছিল, কালি ধরেছিল চোখের নীচে। যাক্‌ ঈশ্বরের কৃপায় প্রচুর অর্থ সামর্থ্য ব্যয় করার পর যূথিকা বেঁচে উঠল। আবার সে ফিরে এলো এই আলোয়, হিমাংশুর স্পর্শানুভূতির গণ্ডির মধ্যেই। কিন্তু সে-যূথিকা আর নয়। মিষ্টি, মোলায়েম চেহারা আর নেই; বিবর্ণ, শুষ্ক, অস্থিসার, দীপ্তিহীন। তার শরীরে একটা গোলমেলে অঙ্গই চিরকালের জন্যে বিকল করে দিল ডাক্তাররা। দ্বিতীয় কোনো পুতুলের সম্ভাবনা থাকল না আর ওর জীবনে। না থাকুক, এক পুতুলই যথেষ্ট। যাকে হারাবার আশঙ্কায় প্রতি মুহূর্ত দুঃসহ হয়ে উঠেছিল, সেই যখন ফিরে এল, তখন হৃতস্বাস্থ্য, বাঁ-পা টেনে টেনে হাঁটা নির্জীব স্ত্রীই এক মুক্তপক্ষ বিহঙ্গের আনন্দস্বাদ বয়ে এনেছে হিমাংশুর জীবনে। খুঁত নিয়ে কে তখন মাথা ঘামায়? হিমাংশু ঘামায়নি; আজও ঘামায় না বোধহয়। খালি এইটুকুই মনে হয়, দুর্বল স্বাস্থ্যের আর সম্ভবত শারীরিক গোলমালের জন্যে যূথিকার স্বভাবেও কেমন একটা নির্জীবত্ব এসে পড়েছে দিনে দিনে।

সে-তুলনায় হিমাংশু অবশ্য ছেলেমানুষই, অন্তত ছেলেমানুষের মতন চঞ্চল, চপল, দুরন্ত স্বভাবের। এর জন্যে যদি দোষারোপ করতে হয়, তবে তার স্বতঃস্ফূর্ত জীবনীশক্তিকেই করা উচিত। প্রখর যৌবনের অমিত তাপে তার প্রাণশক্তি উথলে উঠছে, উপচে পড়ছে। তা নিয়ে কী করবে হিমাংশু তাই যেন ভেবে পায় না। অফিস-শেষে সাইকেলটাকে হাওয়ার গতিতে রাস্তার পাশ ছুঁয়ে উড়িয়ে নিয়ে যায়, র‍্যাকেট হাতে খেলতে নামলে হার্ড সার্ভিসে অপর পক্ষকে নাস্তানাবুদ করে তোলে, প্রতিটি অঙ্গ মত্ত হয়ে ওঠে টেনিস বলের চকিত বিচরণে। এতেই সে শেষ নয়, বা এতটুকুতেই। সুইমিং ক্লাবে আজও সে ট্রেনার; ব্যাকস্ট্রোকে সাঁতারু যুবকদের ভীতিস্থল। ছোটদের দল হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় চাঁদা উঠোতে, পুজোর প্যান্ডেল সাজাতে। বন্ধুরা ধরে নিয়ে যায় তাসের আড্ডায়, চৌরঙ্গি পাড়ার পানীয়-কক্ষে কখনো হয়ত। শেষের জিনিসটা সম্পর্কে তার আকর্ষণ বা অনুৎসাহ কোনোটাই নেই। কেমন একটা ঝোঁকের মাথায় চলে যায়। আর দেখা যায়, এমন দিনে বেশ রাত্রেও কার্জন পার্কে চক্কর মারছে হিমাংশু। মনে মনে হিসেব কষে যতক্ষণ না স্থির ধারণা জন্মাচ্ছে পুতুল ঘুমিয়ে পড়েছে, ততক্ষণ ট্রামে উঠবে না ও। রাগ করলেও যূথিকার কাছে এই ক্কচিৎ-কদাচিৎ অপরাধের মার্জনা আছে। ভয় পুতুলকে। পাছে পুতুল বুঝতে পারে, বাবা তার মদ খেয়েছে—সেই ভয়ে অনেক রাত করে অসাড় পায়ে হিমাংশু বাড়ি ঢোকে; উঁকি দিয়ে দেখে, মেয়েটা ঘুমিয়েছে কিনা। বিছানায় শুয়ে সেদিন নিজের ওপর যত রাগ, তত ঘৃণা হিমাংশুর। ছি-ছি—এমন নেশার দরকার কি, যাতে মেয়ের কাছে যেতে লজ্জা, মেয়েকে পাশে ডাকতে ভয়। সারা সন্ধে মেয়েটা নিশ্চয়ই কান পেতে বসে থেকেছে, পড়ার টেবিলে বসে বই খুলে রেখেছে অযথাই, একটা অক্ষরও চোখে দেখেনি। খেতে বসে খুঁতখুঁত করছে। শেষ পর্যন্ত অভিমানভরেই হয়ত ঘুমিয়ে পড়েছে। মনটা ভয়ঙ্কর রকম মুষড়ে পড়ে হিমাংশুর। শুয়ে শুয়ে প্রতিজ্ঞা করে, আর নয়—বন্ধুদের এই বাজে ফুর্তির পাল্লায় পড়ে নেশা-টেশা আর করছে না সে।

পরের দিন ভোর হতে না হতেই মেয়েকে নিয়ে আদরের আতিশয্য শুরু হয়ে যায়। যেন প্রায়শ্চিত্ত করছে হিমাংশু। সকাল-দুপুরটুকু কোনোরকমে কাটল, বিকেল থেকে বাপ-মেয়ে পাশাপাশি, ছায়ায়-ছায়ায় জোড়া। দোতলার খোলা বারান্দায় ফুলের টবে জল দিচ্ছে হিমাংশু, একদমে দুশো আড়াইশো ক্রস স্কিপ করে পুতুল ঘন ঘন শ্বাস টানছে, মুখ লালচে। তারপর মুখ হাত ধুয়ে সেজেগুজে বেড়াতে বেরোয় মেয়ে নিয়ে হিমাংশু। ট্যাক্সি চড়ো, টফি কেনো, গল্পের বই চাও ত তাই: রিবন, পেনসিল, গ্রামোফোনের রেকর্ড—যা চাও!

এমনি এক প্রায়শ্চিত্তের দিনে সকাল থেকে যা শুরু হয় যূথিকা তা মোটেই সহ্য করতে পারে না। মুখ-ফুটে স্পষ্ট করে বলাও যাচ্ছে না কিছু। এক পিসতুতো বোন এসেছে দিল্লি থেকে আজ সকালেই। বিকেল পর্যন্ত থাকবে; তারপর যাবে তার ভায়ের বাসায়। সেই বোন শিপ্রা যার নাম, দিল্লির কোন এক মেয়ে-কলেজে পড়ায়, এখনো কুমারী। যূথিকার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রয়েছে শিপ্রা। ওর সংসারের খুঁটিনাটি দেখছে আর গল্প করছে দিল্লির, আত্মীয়স্বজনের। আর বলতে কি, এরই ফাঁকে তার রোল্ডগোন্ডের চশমার ফাঁক দিয়ে বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখছে বাপ আর মেয়েকে। যূথিকাও সেটা লক্ষ করছে। কিন্তু অবস্থাটা এমন, কিছুই বলা যায় না। সবচেয়ে বেশি রাগ হয় যূথিকার ক্যালেন্ডারের লাল তারিখের ওপর। এত ছুটি যে কেন থাকে অফিস আর স্কুলের—যূথিকা বুঝতে পারে না। না থাকত ছুটি আজ, মেয়ে নিয়ে অত ঘটাপটা করে আদিখ্যেতা করার অবসর জুটত না হিমাংশুর। ছি ছি, শিপ্রাদি দেখছে তো! কী ভাবছে কে জানে! নিশ্চয়ই ভাল কিছু নয়। আভাসে, যেন শিপ্রাদি বুঝতে না পারে, তেমন ইঙ্গিতে, তবু কয়েকবার চেষ্টা করল যূথিকা হিমাংশুকে সরিয়ে নেবার—কিন্তু কেউ গায়ে মাখল না সে-কথা। প্রকাশ্যে কিছু বলতেও সঙ্কোচ হয়। কে জানে শিপ্রাদি যদি তেমন একটা খারাপ চোখে না নিয়েও থাকে, যূথিকার কথায় হয়ত অন্যরকম একটা ধারণা হবে। অগত্যা রুষ্ট হলেও ভয়ঙ্কর একটা অস্বস্তি চেপে রেখে যূথিকাকে সহজভাবেই সব দেখতে হয়, সহ্য করতে হয়। ওদিকে, ফাঁকা উঠোনে শীতের রোদ্দুরে, বালতিতে ঠাণ্ডা-গরম জল মিশিয়ে হিমাংশু তরল সাবানের ফেনা দিয়ে পুতুলের চুল ঘষে দেয়, পা-হাত রবারের স্পঞ্জ দিয়ে রগড়ে তেল উঠিয়ে ধবধবে করে, অলিভঅয়েল মাখায়।

বেলা গেল, দুপুরও। বিকেলের দিকে শিপ্রাদির ভাইপো গাড়ি নিয়ে হাজির। জোর তাগিদ তার। তাড়াতাড়ি চলে গেল শিপ্রাদিও।

খানিক পরে দেখা যায়, বাপ মেয়ের সাজগোজও শেষ হয়েছে। এবার তারা বেরুবেন। যূথিকা থমথমে মুখে সব দেখে যাচ্ছে, একটাও কথা বলেনি। বলবে না, এই তার প্রতিজ্ঞা বোধহয়। শেষ পর্যন্ত দেখবে এবং তারপর—। আজ যেন সেও মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে, ধূমায়িত হচ্ছে ভেতরে ভেতরে।

যাবার আগে হিমাংশু স্বভাবমতন কিছু টাকা চাইল। চাবিটাই দিয়ে দিল যূথিকা। তারপর কাপড় কাচতে বাথরুমে গিয়ে ঢুকল। ফিরে এসে দেখে, হিমাংশুরা চলে গেছে। সন্ধে হয়ে এসেছে এরই মধ্যে। বেশ অন্ধকার।

একটু রাত করেই ফেরে হিমাংশুরা। পায়ের শব্দ শোনে ঘরে বসে যূথিকা। হাসি-খুশি মুখ আর একটা অয়েলপেপারে মোড়া প্যাকেট হাতে ঘরে ঢোকে হিমাংশু একাই। চেয়ারে বসতে বসতে প্যাকেটটা যূথিকার দিকে এগিয়ে দেয়, “নাও, দেখ তো কেমন’হল তোমারটা।”

হাত বাড়াবার আগ্রহ দেখা যায় না যূথিকার। নিস্পৃহভাবে ও বসে থাকে, নির্বিকার মুখে। ধৈর্য ধরতে পারে না হিমাংশু। অয়েলপেপারের আচ্ছাদনটা খুলে ফেলে পশমের জামাটা এবার এগিয়ে দেয়। যূথিকা দেখে অল্প একটু সময়, তারপর কেমন একটা অভ্যাসবশে হাত বাড়িয়ে জামাটা টেনে নেয়।

জামা দেখছে না মনে মনে কিছু ভাবছে যূথিকা, ঠাওর করা মুশকিল। হয়ত ভাবছে এবং ভাবনাটাই ওর আড়ষ্ট হাতকে অল্প একটু চঞ্চল করেছে; যার ফলে পাট খুলে গেছে পশমের জামার। নরুন-সরু হাসির ছোঁয়া যূথিকার ঠোঁটে ফুটিফুটি করছে যেন। …এমন সময়টিতে দেখা গেল পুতুলকে, দরজার গোড়ায়, একেবারে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যূথিকার। চোখাচোখি হল মা আর মেয়েতে। মার চোখ মেয়ের সর্বাঙ্গ লেহন করল। আর পরমুহূর্তেই যূথিকার সারা মুখ থমথমে হয়ে আসে, একট রোদের আভাস ফুটতে-না-ফুটতেই আকাশ যেন আবার কালো মেঘে ছেয়ে যায়। থমথমে মুখটা অন্য দিকে ফিরিয়ে নেয় যূথিকা। ভুরুর ওপর আঁচড় কেটে অদ্ভুত একটা বিরক্তি চোখের পাতায় এসে জমেছে। দৃষ্টিটা এখন তার দেওয়ালে; তীরের ফলার মতো ছুঁচলো হিংস্র একটা টিকটিকির মুখের ওপর। হাতের আঙুলগুলোও যে জ্বালা করছে, এতক্ষণে স্পষ্ট যেন অনুভব করতে পারে যূথিকা। তবে তাই হবে, মোলায়েম পশমে নয়, তুষের আগুনেই অজান্তে হাত রেখেছিল ও।

ছুঁড়েই দিয়েছে, নাকি হাত থেকে খসেই পড়েছে ঠিক বোঝা যায় না, দেখা গেল পশমের জামাটা যূথিকার পায়ের তলায় মেঝেতে পড়ে। এক পলক মা’র দিকে তাকিয়ে, এগিয়ে এল পুতুল, টুপ করে জামাটা কুড়িয়ে নিল। চোখেমুখে তার অনেক বিস্ময়, কিছু কাতরতা। কী হল মা’র? পছন্দ হয়নি? এমন আকাশ-নীল রং জামাটার, গলার কাছে দু-সুতোয় তোলা সাদা ফুল আর লতার কাজ, দামও প্রায় বাইশ, বাস্তবিক যা সুন্দর, খুবই পছন্দ হয়েছে ওদের—ওর আর বাবার, তাই কিনা অপছন্দ মার? মনটা মুষড়ে পড়ে পুতুলের। তবু চুপচাপ সে দাঁড়িয়ে থাকে, মোলায়েম পশম মুঠোয় ভরে, বোকার মতন, বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে।

হিমাংশু মেয়েকেই দেখছে, সেই মেয়েকেই যার নাম পুতুল, দেখতেও পুতুলের মতনই—অমনই নধর গঠন, সুডৌল, সুশ্রী। টিয়াপাখি রঙের নিউ স্টাইল সোয়েটারে পুতুলকে যেন আরো সুন্দর দেখাচ্ছে, এতই অপরূপ যে, হিমাংশু মেয়ের দিকে তাকিয়ে তন্ময়, তদগত। ওই যে পুরু জমাট রক্তগোলাপ—পুতুলের সসায়েটারে বুকের ওপর নকশা তোলা—ওই গোলাপের লাল আভা যেন পুতুলকে আলো করে তুলেছে; তার গায়ের সবুজ, মুখ চোখ হাত-পা’র লালচে সাদায় সেই আলোর ঢেউ ফেনার মতন ছড়ানো-ছিটানো।

খুশিতে উপচে উঠে হিমাংশু ডাক দেয়, “গ্র্যান্ড! কাছে আয়, কাছে আয় তো পুতুল দেখি—”।

হিমাংশুর উচ্ছ্বাস আর ঘরের আলো দুই-ই যেন বেশ তীব্র। কাজেই যূথিকা চোখ না ফিরিয়ে পারে না। আর আশ্চর্য, হিমাংশুর কাছ ঘেঁষে দাঁড়াবার আগেই যূথিকা মেয়ের চোখে চোখ রেখে তাকিয়েছে বিষাক্ত দৃষ্টিতে।

পুতুল মার কুঞ্চিত চোখ-মুখের দিকে তাকিয়ে থেমে যায়। সামনে বাড়ানো পা আস্তে আস্তে টেনে নেয় পেছনে। হঠাৎ সব যেন আড়ষ্ট হয়ে এসেছে ওর।

মেয়ের মুখ থেকে দৃষ্টিটা সরিয়ে নিয়ে স্ত্রীর ওপরই রাখতে হয় হিমাংশুকে। আর সেদিকে তাকিয়ে চট করে চোখ ফিরিয়ে নেওয়াও সম্ভব হয় না। সহাস্য, উজ্জ্বল, মুগ্ধ একটি মুখ ধীরে ধীরে মলিন হয়ে আসে।

যূথিকা এক পাও সরে আসেনি; একটুও নড়েনি—শুধু ঘাড় ফিরিয়েছিল যতটুকু, ততটুকুই ফিরিয়ে রেখেছে এবং মেয়েকেই দেখছে এখনো, ঠিক তেমনিভাবেই অসহ্য একটা বিরক্তিতে। বোঝা যায়নি যূথিকা এবার কথা বলবে, ঠোঁট নড়তেই বোঝা গেল। একটা চিকন স্বর থেমে থেমে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হতে লাগল, ঘরে নীরবতা নিষ্করুণ একটি আদেশের কাঠিন্যে থমথমে হয়ে ভেঙে পড়ল।

“ও-ঘরে গিয়ে জামা ছেড়ে চুপচাপ বসগে যাও। শালটা গায়ে জড়িয়ে নিও।”

চোখ নামিয়ে নিয়েছে পুতুল অনেক আগেই। মার আকাশ-নীল রঙের পশমের জামার বোতামটাই অনর্থক খুঁটে চলেছে ও। বড্ড শক্ত, নখ বসে না। দাঁত দিয়ে কামড়াতে পারলেই যেন বেশ হত।

পুতুল ফিরেই যাচ্ছে, হিমাংশুর কথায় দাঁড়াল।

“তোমার শাসনের ঠেলায় বাপু অস্থির! তোর মার জামাটা দে তো, পুতুল।”

হিমাংশু হাত বাড়ায়। পুতুলকে বাবার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে কয়েক পা এগিয়ে আসতে হয় আবার। আসতে আসতেই বাবার কথা আবার কানে যায়, “পুতুলের গায়ে কেমন মানিয়েছে সোয়েটারটা বললে না? এবারে এই ডিজাইনটাই নতুন এসেছে।”

মার দিকে না তাকিয়েও পুতুল বুঝতে পারে, ভাল লাগেনি মার; কিছুতেই ভাল লাগতে পারে না।

“টাকাগুলোকে খোলামকুচির মতন ভাব তুমি”—যূথিকা বলছে, পুতুলও শুনে যাচ্ছে, “ছাইভস্ম কিনে আনছ, যা-তা ভাবে খরচ করছ। বলার কিছু নেই, ভাল লাগে না বলতে আমার।”

জানা কথাই মা এই ধরনের কিছু বলবে। পুতুল তাড়াতাড়ি বাবার হাতে মায়ের জামাটা কোনোরকমে ধরিয়ে দিয়ে দ্রুত পায়ে চলে যায়।

পুতুল চলে যেতে হিমাংশু যূথিকার দিকে তাকাল। যূথিকাও স্বামীর দিকে। দু-তিন পা সরে এসে বিছানায় বসে পড়ে ও।

“কী হল তোমার আবার?” হিমাংশু জানতে চায়, “অযথা মেয়েটাকে ধমকালে কেন?”

“ধমকালেই বা কী—!” যূথিকা হাত বাড়িয়ে হিমাংশুর হাত থেকে জামাটা টেনে নেয়। বিছানার একপাশে ছুঁড়ে দিয়ে বলে, “তোমার মেয়ের এসব ধিঙ্গিপনা আমার ভাল লাগে না। তুমি ওকে দিন দিন কী করে তুলছ? আমি ভেবেই পাই না—এরপর ওর কী হবে?”

“ও, এই! সেই পুরনো কাসুন্দি!” খানিকটা স্বস্তি পায় হিমাংশু। মুখে আবার হাসি ফুটে ওঠে। কোলের ওপর থেকে গরম শালটা তুলে বিছানার ওপর রেখে দেয়। আরাম করে সিগারেট ধরায় একটা।

যূথিকা তাকিয়ে তাকিয়ে সব দেখে। স্বামীর ভাবভঙ্গি থেকে মনের কথাটাও বোঝ যায়। অর্থাৎ হিমাংশু যে তার কথাগুলো পরম অবহেলায় সরিয়ে রাখল, যূথিকা তা বুঝতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে রাগটা দ্বিগুণ হয়ে জ্বলে ওঠে ওর।

“এসব তোমায় ছাড়তে হবে,” যূথিকা আদেশের সুরে বলে।

“কী?”

“মেয়ে নিয়ে এই ন্যাকামি।”

হিমাংশু স্ত্রীর দিকে চেয়ে এবার হেসে ফেলে; বলে, “মুশকিলে ফেললে। মেয়ের মাকে নিয়ে ন্যাকামি করতে চাইলেই কি তুমি রাজি হবে?”

যূথিকা ধমক দিয়ে ওঠে, “সব সময় তোমার তাচ্ছিল্যভাব আমার ভাল লাগে না।”

“কী-ই বা আমার ভাল লাগে তোমার?” হিমাংশু উঠতে উঠতে বলল, “ওই ত জামাটা কিনে আনলাম তোমার—ওটাই কি ভাল লেগেছে?”

“উঠো না; বসো।” যূথিকা হাত বাড়িয়ে স্বামীর পাঞ্জাবির হাত ধরল, “আমার জন্যে তোমায় জামা কিনে আনতে বলিনি।”

“না বললেই কি আনতে নেই?” হিমাংশু আবার বসে পড়েছে, “ইচ্ছে করে, আদর করেও তো মানুষ কিনে আনে।”

“আমার বেলায় ইচ্ছেও নয়, আদরও নয়”—ঘূথিকা কুটিল সুরে বললে, নিষ্ঠুরের মতন, ধারাল গলায়, “নেহাতই না আনলে নয়, বাধ্য হয়ে, মন রাখতে এনেছ।”

হিমাংশু চুপ। যূথিকার মুখ থেকে দৃষ্টিটা তুলে নিয়েছে। এখন দেওয়ালে টিকটিকিটা তার লক্ষে।

যূথিকার গলায় একটা শিরা নীল হয়ে ফুটেছে, কাঁপছে দপদপ। একটু থেমে কথাগুলো যেন গুছিয়ে নিল ও।

“এভাবে আমায় তুমি ভোলাতে চাও কেন? আমি কি ছেলেমানুষ?”

“বোধহয় তাই।” হিমাংশু আবার একবার চেষ্টা করল সহজ হবার। ফিকে একটু হাসি টেনে বলল, “তুমি আজকাল অল্পতেই বড় চটে ওঠ। তোমাদের মা-মেয়ের দুটো জামা কিনে এনে কী এমন অপরাধ করেছি, বুঝছি না।”

“বুঝবে না, বুঝবে না—।” যূথিকা অধৈর্য হয়ে উঠেছে, “মেয়ের তোমার গরম জামার অভাব আছে কিনা তাই একটা আঁটবুক, আধ-কোমরে মেমজামা কিনে আনলে? ছি-ছি—, চোখেরও একটা ভাল-মন্দ জ্ঞান থাকে মানুষের!”

“ফ্রকের সঙ্গে অমন জামাই তো পরে; মানানসই বলে না কিনেছি!”

“যে পরে পরুক, আমার মেয়েকে আমি পরতে দেব না। বেহায়াপনার মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছ তোমরা বাপবেটিতে। কি ভাবে লোকে—ছি-ছি—! পনেরো বছরের আইবুড়ো মেয়েকে তুমি—তুমি—” যূথিকা ঠোঁটের কথাটা যেন চেপে নিয়ে অনেক কষ্টে অন্য কথা টানল, “তুমি ফ্রক পরিয়ে রাস্তা-ঘাট ঘুরিয়ে আনছ!” ঘৃণায় নাক, চোখ, মুখ কুঁচকে ওঠে যূথিকার।

“বয়সটা এমন কি বেশি?” হিমাংশুকে যেন আজ তর্কের নেশায় পেয়েছে, “শাড়ি সামলাতে পারবে কেন পুতুল?”

“আমরা কিন্তু পেরেছি।” যূথিকার গলায়, ঠোঁটে শ্লেষ ফুটেছে তীক্ষ্ণতর হয়ে। “পনেরো বছরেই আমার বিয়ে হয়েছে; যোল বছরে মা হয়েছি। শুধু শাড়ি নয়, মেয়েও সামলেছি।”

বলার কথা আর খুঁজে পায় না হিমাংশু। তর্কের নেশাটাও হঠাৎ থিতিয়ে যায়। স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে যেন ও পনেরো বছরের সেই কিশোরী যূথিকাকে খোঁজবার চেষ্টা করছে এবং তুলনা করবার চেষ্টা করছে এই একত্রিশ বছরের যূথিকার সঙ্গে।

যূথিকাও উঠে পড়েছে। স্বামীর পাশে বসে থাকার মতন ধৈর্য নেই আর তার। অদ্ভুত একটা রি-রি সারা গায়ে-মনে। অস্বস্তিকর, অসহ্য জ্বালা। বাইরে শীত; তবু সেই শীতের হাওয়ায় গিয়ে না দাঁড়ালে ঘামের মতন লেপটে থাকা এই অস্বস্তিকর জ্বালা থেকে যেন মুক্তি নেই।

বাঁ পা-টা টেনে টেনে যূথিকা চলে যায়। হিমাংশু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে।

তারপর দুটো দিন যূথিকা গুম হয়ে থাকে। যতদূর সম্ভব কম কথা বলে, গলার স্বর খাদে নামিয়ে সংসারে তার উপস্থিতিটাকে নিরাসক্ত রাখতে চায়। তিন দিনের দিন গুমট ভাবটা কাটতে শুরু করে, পর্দা চড়ে যূথিকার স্বরের। আড়ালে বাপ আর মেয়ে মজা পাওয়ার হাসি হাসে। ওরা জানে, যূথিকার রাগের বহর কতখানি, তার পরিণতি কোথায়। এবার জেরটা একটু বেশিক্ষণ স্থায়ী হল, এই যা। তা হোক, গুমট ভাবটা কাটার সঙ্গে সঙ্গে হিমাংশু আর পুতুল স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাঁচল। এখন কিছুদিন শাসনের রাশটা একটু আলগাই থাকবে। যূথিকার স্বভাবই তাই। মেয়ে-বাপ—দুজনাই তা জানে। আর সেই কথা ভেবে দুজনাই পরম খুশি।

চার দিনের দিন পড়ল শনিবার। জানা গেল, দুপুরে যূথিকা যাবে শিপ্রাদিদের বাসায়। ফিরবে সন্ধেবেলায়। পুতুল স্কুল থেকে ফিরে এসে বাড়িতে একাই থাকবে, হিমাংশু যেন অফিসের ছুটির পর আড্ডা মারতে না গিয়ে সকাল সকাল বাড়ি ফিরে আসে।

স্কুলের বাসে ওঠার আগে পুতুল চুপি চুপি হিমাংশুকে তারিখটা স্মরণ করিয়ে দেয়, “আজই কিন্তু থারটিনথ্‌, বাবা; ভুলো না! সেই রসিদটা আমি তোমার শার্টের বুকপকেটে রেখে দিয়ে গেলাম।”

রসিদের কথা ভোলেনি হিমাংশু, কিন্তু অফিসের পর অন্য এক ঝামেলায় পড়ে তার দেরি হয়ে গেল। বাড়ি ফিরতে বেশ বিকেল। পুতুল তখন ঝি রাসমণির সাহায্যে পিঠের উপর সাপের মতো দুই বেণী ঝুলিয়ে সবে উঠে দাঁড়িয়েছে।

বাবার হাত থেকে প্যাকেটটা নিয়ে খুশির দাপটে পুতুল বলল, “আমি ভাবছিলাম তৈরি-ই হয়নি বোধহয়; দর্জিদের কাণ্ড! তুমি এত দেরি করলে কেন, বাবা?”

মেয়ের কাছে কৈফিয়ত দিতে দিতে হিমাংশু চেয়ারে বসল পা ছড়িয়ে। টানটান হয়ে। ঝুপ করে বাবার পায়ের কাছটিতে বসে পড়ল পুতুল। ত্বরিত হাতে জুতোর ফিতে খুলে, মোজা খুলে—জুতো জোড়া হাতে করে উঠে দাঁড়াল। ঘরের এক কোণে রাখল। বলল, “আমি তোমার চা করে আনি, হ্যাঁ—তুমি একটু জিরোও।”

“তা না হয় জিরোচ্ছি! কেমন করল ওটা দেখলি না?”

“দেখব, দেখব। দাঁড়াও না। তোমার চা দিয়েনি আগে। হাত-মুখ ধুয়েই একেবারে পরব।” সাপের মতন দুই লিকলিকে বেণী নাচিয়ে পুতুল ছুটল চা তৈরি করতে।

চা শেষ করে হিমাংশু আরাম করে সিগারেট ফুঁকল। উঠে ট্রাউজার ছেড়ে ধুতিটা জড়িয়ে নিল। বাইরের ফাঁকা দালানে অন্ধকার নেমেছে ততক্ষণে। তাতে কী? বেশ একটা আমেজ আর আরাম লাগছে। হিমাংশু চেয়ারের ওপর এলিয়ে চোখ বুজে পড়ে থাকল। টুক করে আলো জ্বলে উঠল ঘরের। চোখ খুলে হিমাংশু দেখে, পুতুল একেবারে ঘরের মাঝটিতে দাঁড়িয়ে, আলোর তলার সদ্যপরিচ্ছন্ন ধবধবে মুখটিতে ফুটফুটে হাসি। চোখের তারায় ফুলঝুরির দীপ্তি। গায়ে তার সদ্যআনা ক্রিমসন রঙের সেই লুজ ফ্রক। চুলের একটা বিনুনি গলার পাশ দিয়ে বেঁকা হয়ে বুকের মাঝটিতে এসে পড়েছে—আগায় যার সাদা জরির রিবনের তৈরি ফুল। ঝিকমিক করছে আলোয়। ঠিক যেন একটি লতান ডাঁটার ওপর এক থোকা ফুল ফুটে রয়েছে। আশ্চর্য, আশ্চর্য সুন্দর এই পুতুল। কী নিখুঁত অঙ্গ! কপাল, মুখ, চোখ, ঠোঁট, গলা—সব যেন সামঞ্জস্য করে কেউ এঁকেছে নিপুণ তুলিতে। দুটি হাত—যত নিটোল তত কোমল; দুটি পা তাও যেন লালচে মোমের ছাঁচে গড়া, মসৃণ, মোলায়েম, মধুর।

“মন্দ করেনি, না বাবা?” পুতুল লাজুক হাসি হাসে।

মেয়ের গলার স্বরে তন্ময়তা ফিকে হয় হিমাংশুর।

“ওয়ান্ডারফুল! রঙটা তোকে বিউটিফুল মানিয়েছে।”

“একটু কিন্তু বেশি ঢিলে করে ফেলেছে, যাই বল—।” মেয়ে খুঁত ধরছে এবার।

“নাম যখন লুজ ফ্রক তখন তো একটু ঢিলে-ঢালা হবেই, বোকা—!”

“বই-কি, তা বলে এত! এই দেখ না, হাঁটুর কাছটা ঘাঘরা মতন হয়ে গেছে, আর পিঠের কাছটায় বড্ড বেশি কাপড় রেখেছে, বুকের কাছে একটা কুঁচি দিয়ে নিতে হবে নিজেকেই—।” পুতুল একে একে টুকটাক খুঁত ধরিয়ে দিচ্ছে।

হিমাংশুকে উঠতে হয়। এত খুঁত যখন, তখন একবার ভাল করে দেখতে হয় অবশ্য। মেয়ের কাছটিতে এসে দাঁড়ায় ও। মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে। ফ্রকের কাপড়ের ঝুলের অংশটা একবার উঁচু করে একটু। মেয়ে বলে, হ্যাঁ—ওই পর্যন্ত হলে ভাল হত। হিমাংশু মাথা নাড়ে, ঠিক। তারপর বুক। হিমাংশু বুকের দু-পাশের কাপড় দু-হাতের আঙুলে আলতো করে ধরে কাপড়ের বিস্তৃতিটা পরখ করে, সঙ্কুচিত করে বুকের বস্ত্রাংশটা।—“কুঁচি দিয়ে নিলে কি ভালো দেখাবে রে—বরং একটু ছোট করতে দিয়ে এলে হয়।”—“না, না, দরকার কি,” পুতুলের আপত্তি, “আমি হাতেই এমন সুন্দর করে একটা হনিকম্বের কাজ করে নেব, দেখো—।” এরপর কোমর। সত্যি বেঢপ বড়ো করেছে, কাপড় রেখেছে একরাশ। হিমাংশুর দুই বিঘতের মধ্যে পুতুলের কোমরটা আঁট হয়ে থাকে। কী সরু, সুন্দর কোমর পুতুলের—হিমাংশু পরখ করে, ভাবছে, হাসছে, “তুই এবার একটু-আধটু নাচ শিখলেই ত পারিস, পুতুল—যা সরু কোমর তোর…”। পুতুল আনন্দে আত্মহারা : “সত্যি নাচ শিখতে ভীষণ ইচ্ছে আমার। আমাদের ক্লাসের রেখা, ছন্দা ওরা ত শেখে, কোথায় যেন। কিন্তু আমি যেন একটু ভারী বাবা ; ওরা বেশ হালকা। ” …“ভারী?” হিমাংশু হো হো করে হেসে ওঠে, টপ করে কোমরে বিঘত জড়িয়ে শূন্যে তুলে নেয় মেয়েকে! আচমকা মাটি থেকে পা উঠে যেতেই পুতুল ভয়ে হিমাংশুকে আঁকড়ে ধরে—তার হাত হিমাংশুর মাথার চুলে ঘাড়ে টলে পড়ে। ক্রিমসন রঙের লুজ ফ্রকের আড়ালে হিমাংশুর নাক, চোখ মুখ সব ঢাকা পড়ে গেছে। শুধু একটা অট্টহাসির অনেকখানি শব্দ ঘরের বাতাসে।

পুতুলকে নামিয়ে দিতেই সে গা মুখ ঘুরিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক অবস্থায় আনতে গিয়ে হঠাৎ কেমন যেন আড়ষ্ট হয়ে গেল। অর্ধস্ফুট শব্দ বেরুল, “মা!”

তাকাল হিমাংশু। দরজার গোড়ায় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে যূথিকা আর শিপ্রা। মনে হল, ওরা অনেকক্ষণই এসে দরজার কাছে দাঁড়িয়েছে।

“কখন এলেন আপনারা?” হিমাংশু শিপ্রার মুখে চোখ ফেলে হাসল, “আসুন—।”

“এসেছি অনেকক্ষণ, মেয়ে নিয়ে যা মত্ত ছিলেন, বুঝবেন কী করে?” শিপ্রার ঠোঁটের পাশে একটু বাঁকা হাসি খেলে গেল।

আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই যূথিকা শিপ্রাকে টেনে পাশের ঘরে চলে যায়।

আগের দিন কিছু না বললেও আজ শিপ্রা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কথা তুলল, “তোর মেয়ের বয়েস কত হল রে যূথি?”

“পনেরো।” বিরস, গম্ভীর মুখ যূথিকার।

“দেখলে যেন আরো একটু বেশি মনে হয়। তা, বড়-সড় হয়েছে ; ওকে ফ্রক পরিয়ে রাখিস কেন? চোখে কটকট করে লাগে।”

“সাধ করে কি পরিয়ে রাখি?” যূথিকা অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে তিক্তস্বরে বলছে, “ওর বাবার শখ, মেয়েকে শাড়ি পরতে দেবে না।”

“বাবার শখ?” ঠোঁট উলটে শিপ্রা একটা বিশ্রী শব্দ করল, “হিমাংশুর এই শখ নিজের চোখেই দুদিন দেখলাম।” আবার একটু থামল শিপ্রা, তারপর গলার স্বর নীচু করে, যেন উপদেশ দিচ্ছে এমনভাবে বলল, “জিনিসটা মোটেই ভালো নয়, যূথি। এসব আসকারা তুই দিবিনে। এ এক ধরনের কমপ্লেক্স!”

যূথিকা শেষ কথাটা বুঝল না। শিপ্রাদির চোখের দিকে তাকাল।

“মানে?”

“মানে—? ও, সে তুই বুঝবি না!” শিপ্রা যূথিকার অজ্ঞতাকে উপেক্ষা জানিয়ে অনুকম্পার হাসি টেনে আনল ঠোঁটে, “আসলে যূথি, এই—এই—ধরনের রুচি—কী বলব যেন একে—হ্যাঁ, এই ধরনের রুচি খুব খারাপ, নোংরা।”

যূথিকা কয়েক মুহূর্ত ফ্যাকাশে, অর্থহীন চোখে তাকিয়ে থাকে শিপ্রাদির মুখের দিকে। তারপর উঠে দাঁড়ায় আস্তে আস্তে। আলমারি খুলে টাকা বের করে। খান পাঁচেক দশ টাকার নোট এনে শিপ্রার মুঠোর মধ্যে গুঁজে দেয়।

“এতে হবে তোমার?”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ ; যথেষ্ট। আমি তাহলে উঠি যূথি। বেশি রাত হলে বাড়ি খুঁজতে বিপদ হবে। টাকাটা তোকে দিল্লি ফিরে গিয়ে পাঠাব কিন্তু।”

“সঙ্গে কাউকে নিয়ে যাও না।”

“না, না ; দরকার নেই। একাই বেশ যেতে পারব। চলি, অ্যাঁ—।”

শিপ্রা চলে যায়। নিচে নেমে বিদায় দিয়ে আসে যূথিকা।

ওপরে উঠে শাড়িটা বদলে নিয়ে কোনোরকমে বাথরুমে গিয়ে তপ্ত চোখে-মুখে, হাতে-পায়ে অনেকখানি জল ঢালে, তারপর সেই সপসপে ভিজে অবস্থাতেই বিছানায় এসে শুয়ে পড়ে। বাতি নিবিয়েই।

যূথিকা যে সেই শুয়ে পড়ল আর উঠল না, কথা বলল না। রাত বাড়ল। পুতুল এসে ডাকল মাকে। কেমন একটা আচ্ছন্নতার মধ্যে ভাঙা চাপা গলায় যূথিকা বলল, “তোমরা খেয়ে-দেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়। রাসমণিকে বল, সব গোছগাছ করে নীচের চাবি রেখে দিয়ে যাবে।”

রাত বেড়ে চলেছে। ঘড়িতে দশটা বেজে গেল। পুতুল এসে শুয়ে পড়ল মার পাশে। ধোয়া-মোছা সেরে রাসমণি ওপরে এসে চাবি রেখে গেল। বাইরে থেকে ভেজিয়ে দিল দরজা। হিমাংশু অনেকক্ষণ হল পাশের ঘরে গিয়ে ঢুকেছে। ও-ঘর এ-ঘরের মধ্যে যে-দরজা তাতে কপাট থাকলেও সে-কপাট বন্ধ হয় না ; একটা পর্দা শুধু ঝোলে। ও-ঘরেই হিমাংশু শোয়, তার নিজস্ব কাজকর্ম করে। স্বামীর শোয়া-বসার জন্যে, পুতুল বড়ো হবার পর, যূথিকা নিজের হাতেই এ-ব্যবস্থা করেছে।

হিমাংশুর ঘরে আলো জ্বলছে। নিশ্চয়ই সে ঘুমোয়নি। হয় কোনো বইয়ে না হয় ক্রসওয়ার্ড পাজলে ডুব দিয়েছে।

ঘড়ির কাঁটায় শব্দ ঠেলে রাত গভীর হয়ে আসে। সব নিস্তব্ধ। শীতের রাত। সমস্ত পাড়াটাই এতক্ষণে যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। এ বাড়িটাও। একটা বেড়াল সিঁড়ি দিয়ে পালিয়ে গেলে তার শব্দ শুনতে পাওয়া যায়, কেউ খিল খুললে ; জানালায় ছিটকিনি দিলেও খুট করে আওয়াজ ওঠে। এমন কি, পুতুল ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কেশে উঠছে—সেই খসখসে ভাঙা আওয়াজ নিবিড় নিস্তব্ধতার মধ্যে কানে লাগে। অনেকখানি ঠাণ্ডা খড়খড়ির ফাঁক দিয়েও যেন যূথিকাদের ঘরে ঢুকে পড়েছে। বারোটা বেজে গেল। ঘড়ির সেই ঘণ্টা পেটার শব্দটা যেন বারোটা মুগুর পিটে গেল ঘরের অন্ধকারে। ধকধক করে যাচ্ছে যূথিকার বুক, খসখসে একঘেয়ে কাশি কেশে চলেছে পুতুল। ফট করে বাতি জ্বলে উঠল। যূথিকার বিছানার পাশে হিমাংশু।

দেখছে বই-কি হিমাংশু—পাশাপাশি মা আর মেয়েকে। যূথিকা ডান দিকে কাত হয়ে শুয়ে, বালিশের ভাঁজের তলায় মুখ চাপা, ডান হাতটাও গালের ওপর দিয়ে কপাল বেয়ে বালিশের প্রান্তে এলিয়ে রয়েছে। কিছু ভাল করে দেখা যায় না। চোখের পাতা বোজা।

মার দিকেই মুখ করে কাত হয়ে ঘুমুচ্ছে পুতুলও। ক্রিমসন রঙের সেই লুজ ফ্রক এখনো তার অঙ্গে। গায়ের লেপটা সরে গেছে—অর্ধেক দেহটাই তার খোলা। হিমাংশু আরো একবার মুগ্ধ চোখে মেয়েকে দেখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে! সাদা চাদর আর বালিশের ফেনার মধ্যে সূর্যাস্তের রং ছোপানো একটি ঢেউ যেন। হয়ত দুঃস্বপ্ন দেখে ঠোঁট খুলে কেমন একটু ককিয়ে উঠে থেমে গেল পুতুল, আবার কাশল খুকখুক করে। নড়েচড়ে উঠে ফের শান্ত। রাত্রে কাশিটা বেড়েছে মেয়েটার। যেভাবে শোয়, রোজই হয়ত ঠাণ্ডা লাগে। গলার কাছটায় অত খোলা না রাখলেই কি নয়। হিমাংশু হাত বাড়িয়ে গলার কাছটায় জামার টিপকলটা এঁটে দেয় পুতুলের, লেপটা টেনে দেয় গলা পর্যন্ত। কতকগুলো চুল কপালের পাশ দিয়ে চোখে এসে পড়েছিল। আস্তে আস্তে সরিয়ে দেয়। গভীর সোহাগে গালে মুখে কপালে হাত বুলিয়ে সরে আসে। বারান্দার দিকের দরজাটা ফাঁক হয়েছিল। বন্ধ করে দেয় হিমাংশু। ছিটকিনি তুলে দেয়। বাতি নেবায়। তারপর পর্দা সরিয়ে যায় নিজের ঘরে।

বিছানার দিকেই এগুতে যাচ্ছে হিমাংশু, হঠাৎ কে যেন পিছন থেকে টান দিল চাদরে।

মুখ ফেরাতেই দেখে যূথিকা।

“তুমি ঘুমোওনি?” হিমাংশু অবাক।

“না।” ঘুম থেকে তো নয়ই যেন খুব জ্বর থেকে ও উঠে এসেছে, তেমনি শুকনো টকটকে ওর চোখ মুখ, তেমনি বিশ্রী ঝাঁঝ আর তিক্ততা তার গলায়।

“কী করছিলে তবে এতক্ষণ?” হিমাংশু আবার এগুতে চায়।

“তোমার কীর্তি দেখছিলাম।” যূথিকা আবার বাধা দেয়।

“কীর্তি!” অবাক চোখে চায় হিমাংশু!

“তাই।” ঠোঁটটা দাঁতে কামড়ে ধরেছে যূথিকা!

“স্পষ্ট করে বল যা বলতে চাও, হেঁয়ালি করো না। আমার ঘুম পাচ্ছে।” হিমাংশু এই প্রথম বিরক্ত হল।

“বলবই তো।” যূথিকা স্বামীর চাদর ছেড়ে দিল, অপ্রকৃতিস্থ দৃষ্টিতে তাকাল ঘরের এদিক-ওদিক। তারপর হঠাৎ, যে-কপাট এতকাল খোলাই থাকত রাত্রে, সেই পাশের কপাটটা পর্দা সরিয়ে বন্ধ করে দিল। এক মুহূর্ত থামল। কী ভাবল সে, কে জানে। দু-পা এগিয়ে সুইচটা অফ করে দিল। মুহূর্তে সারা ঘর অন্ধকারে ভরে গেল। একপাশের এক খোলা জানলা দিয়ে বাইরের একটু আলোর আভাস জেগে থাকল।

“বাতি নেবালে কেন?” অন্ধকারেই বিছানার পাশে এগিয়ে গিয়ে বসল হিমাংশু।

“অন্ধকারই ভাল। আলোয় তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতেও আমার ঘেন্না হয়।”

হিমাংশু কতদূর বিস্মিত হয়েছে অন্ধকারে ঠাওর করা যায় না।

“রাতদুপুরে কী পাগলামি শুরু করলে, যূথি? কী যা-তা বলছ!”

“পাগলামি নয়, যা বলছি তা তোমায় শুনতেই হবে। আমি আর পারছি না—আমার সহ্য-শক্তি আর নেই—নেই।” যূথিকা সত্যিই বুঝি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে, “তোমরা দুজনে—মেয়ে আর বাপে মিলে আমায় শেষ করে ফেলছ। কী চাও তুমি, আমি চলে যাই, আমি মরে যাই?”

“এসব কী বলছ?”

“ঠিক কথাই বলছি। তুমি কী বল ত, মানুষ না পশু? পুতুল না তোমার মেয়ে?”

অন্ধকারেও হিমাংশু একবার চমকে উঠে স্ত্রীকে দেখবার চেষ্টা করল।

“রাতদুপুরে তুমি এই কথা বলতে এসেছ?”

“হ্যাঁ—হ্যাঁ। রাতদুপুরে তুমি যেমন লুকিয়ে পনেরো বছরের মেয়ের ঘুমন্ত চেহারা দেখতে যাও।”

“যূথি”—হিমাংশু কিছু যেন বলতে চায়। কিন্তু তার গলার স্বর চাপা দিয়ে যূথিকার তীক্ষ্ণ, অসম্ভব তিক্ত, একরাশ অভিযোগ স্রোতের মতন বেরিয়ে আসে।

“তুমি বাপ হতে পার, কিন্তু সে মেয়ে ; তার রূপ আছে, বয়স আছে। তার কী নেই, কী হয়নি। জান না তুমি? তবু, এই মেয়ে নিয়ে তোমার বেহায়াপনা রোজ রোজ আমি দেখে যাচ্ছি। বাইরের লোক এসেও আজ দেখে গেল। ছি, ছি, ছি। কোন্ আক্কেলে তুমি ওর বুকে মুখ গুঁজে থাক, কোমর জড়িয়ে ধরো।” যূথিকার হাঁপ ধরে যায়। তবু অনেক কষ্টে দম নিয়ে আবার সে বলে, “এতদিন বুঝিনি, আজ বুঝতে পেরেছি, মেয়েকে ফ্রক পরাবার বায়না তোমার কেন।”

“চুপ কর, চুপ কর যূথি!” অন্ধকারেই হিমাংশু দাঁড়িয়ে উঠেছে। কাঁপছে তার গা, গলা।

“করব বইকি, চুপ ত করবই, চিরকালের মতনই। এত পাপ তোমার মনে তবু আমি থাকব ভেবেছ! আমি—”

যূথিকা আর পারে না, কান্নায় তার গলা একেবারেই বুজে এসেছে। অনেকটা ফোঁপানো আবেগের অদ্ভুত একটা ছমছমে শব্দ উঠিয়ে, আশ্চর্য করুণভাবে ডুকরে কেঁদে উঠে অন্ধকারেই ও চলে যায়। একটা শব্দ শুধু ওঠে। পাশের কপাট খুলে আবার বন্ধ হওয়ার শব্দ। সেই শব্দটা যেন হিমাংশুর বুকের হৃৎপিতে এসে আঘাত করে।

ক’টি তো মুহূর্ত। কিন্তু এই অল্প একটু সময়ের ব্যবধানে হিমাংশু এই ঘর, পরিবেশ, সংসার, স্ত্রী-কন্যা সমস্ত থেকে ছিটকে এক বীভৎস অন্ধকারে গিয়ে পড়েছে। সেখানে কিছু কি আছে? বাতাস, আলো? কিচ্ছু না। শুধু সাপের কুণ্ডলীর একটা হিমস্পর্শ, আর প্রতি পলকে শত সহস্র বিষাক্ত দংশন। যার বিষে এখনো সে অসাড়, যার ক্রিয়ায় এখনো সে অচেতন এবং যে-দংশনে তার স্নায়ু মৃত।

নিছক একটা মানসিক প্রাণ এখনো আশ্চর্যভাবে গিরি-গোপন শীর্ণ জলপ্রবাহের মতো ক্ষীণ স্রোতে বয়ে যাচ্ছে। শুধু এইটুকু মাত্র অনুভূতিতেই হিমাংশু এখনো কানের কাছে যূথিকার সেই তীক্ষ্ণ নির্মম নিষ্ঠুরের মতো শাণিত কথাগুলো শুনতে পাচ্ছে। আর শুধু শোনা নয়, যূথিকার প্রত্যেকটি অভিযোগ অদ্ভুতভাবে একটি একটি করে অসংখ্য ছবি ফুটিয়ে তুলছে। জীবন্ত করছে বহু ঘটনা, বহু মুহূর্ত, বহু অচেতন অভীপ্সা। পুতুলের বুকে মুখ গুঁজে হিমাংশু হাসছিল বটে, কিন্তু কোথায় একটা সুধার স্পর্শ যেন ছিল। ঠিক, ঠিক—পুতুলের হাঁটুর ওপর থেকে বস্ত্র সরিয়েছে ও কিন্তু চোখে পড়ছে—একটি অন্য আকাশ, কি ফুল, কি পাপড়ি। অস্বীকার করবে কি হিমাংশু, পুতুলের চুল, চোখ, সর্বাঙ্গের ঘ্রাণ ওর চিত্তে যে শিহরণ জাগিয়েছে তার মধ্যে কোনো আনন্দের স্বাদ ছিল না?

কোনো কিছুই অস্বীকার করবে না হিমাংশু ; করতে চায় না আজ। এই নিষ্ঠুর সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কার কাছে কি গোপন রাখতে পারে সে? নিজেকে? তারই তো অংশ পুতুল। নিজেকে গোপন করার অর্থই তো পুতুলের কাছে নিজেকে গোপন করা। হিমাংশু তা পারে না। যদি মনের সংগোপনে জট পাকিয়ে গিয়ে থাকে অজ্ঞাতে, অদ্ভুত কোনো আবর্ত সৃষ্টি হয়ে থাকে, তবে সব আজ প্রকাশ হোক।

জানলাটা হাট করে খুলে দেয় হিমাংশু। শীতের কুয়াশায় সমস্ত আচ্ছন্ন ; পাশের বাড়িটাও হারিয়ে গেছে। হয়ত অমনিই হবে—স্নেহের আর পিতৃত্বের কুয়াশায় হিমাংশুর সত্য পরিচয় ঢাকা ছিল। আবার যেন একটা বিষাক্ত ছোবল খেয়ে ওর চিন্তাটাই অসাড় হয়ে এল।

বাতি জ্বালবে নাকি হিমাংশু? এত অন্ধকার! যেন একরাশ অশরীরী প্রেতস্পর্শ ওকে ঘিরে রয়েছে। একটু আলো আসুক। হিমাংশু অস্থিরভাবে অন্ধকারে হাত বাড়ায়। হঠাৎ চমকে উঠে হাত সরিয়ে নেয়। না, না, অন্ধকারই ভাল। আলো নয়। আলো এসে হিমাংশুকে প্রকাশ করে দেবে, নিজেকেই নিজে সে দেখতে পাবে, স্পর্শ করতে পারবে। কুৎসিত একটা গলিত কুষ্ঠকে কি স্পর্শ করা যায়—না, প্রকাশ করা যায়! ঘিনঘিন করে ওঠে হিমাংশুর গা, মন, হাত পা। থাক, অন্ধকারেই থাক। আর যেন আলো না ফোটে। হা ঈশ্বর!

পলে পলে পলাতক সময় এসে রাত চুরি করে নিয়ে যায়। কখন যেন হিমাংশুর খেয়াল হয় তার চোখ, মুখ, মাথা সব পুড়ে যাচ্ছে। অসহ্য যন্ত্রণা, জ্বালা। একরাশ ছুঁচ ফুটে চলেছে মাথায়। কোথায় যেন, কোথায় যেন? হিমাংশু শক্ত মুঠিতে চুল চেপে ধরে টানে। টানে। আঃ! কী আরাম।

জলের জন্য আকুলি বিকুলি করছে প্রত্যেকটি শিরা, প্রতিটি স্নায়ু। একটু জল।

হিমাংশু কেমন করে যেন বারান্দার দিকের দরজাটা খুলে বেরিয়ে আসে। হুট করে ছুটে পালায় বেড়ালটা। ঠাণ্ডা কনকনে হাওয়া এসে গায়ে মাথায় চোট দিয়ে যায়। আরো একটু সম্বিত ফিরে পায় হিমাংশু। বুক টেনে টেনে নিশ্বাস নেয়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একবার আকাশ দেখে, কয়েকটা তারা। তারপর টুক করে বাথরুমের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে যায়। আবার একট মৃদু শব্দ। ভেতর থেকে ছিটকিনি তুলে দেয় হিমাংশু।

বাথরুমে এসে দাঁড়াতেই হিমাংশুর খেয়াল হয়—কাচের উঁচু জানালা দিয়ে একটু ফরসা এসে ঢুকছে। পা পা করে এগিয়ে যায় ও; জল নয়, আয়নার দিকে। আয়নায় স্পষ্ট, খুব অস্পষ্টভাবে মুখ দেখা যাচ্ছে তার। একেবারে কাছটিতে এসে দাঁড়ায় হিমাংশু। আয়নার বুকে একটা জল ধোওয়া স্লেট-রঙের ছবি ফুটেছে। তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে হিমাংশু সেই ছবির মধ্যে কাকে বুঝি খুঁজছে।

গালে হাত তুলতেই ছবির মধ্যে থেকে সেই ছায়াকৃতি লোকটাও নড়ে ওঠে—হিমাংশু সে নয়, কারণ হিমাংশু পিতা, কিন্তু ও অন্য লোক, যে পিতা নয়, পশু। যার দৃষ্টি সুস্থ মানুষের নয়, জানোয়ারের।

হিমাংশুরই অসম্ভব ঘৃণা হয় তার ওপর—। শুধু ঘৃণাই নয়, তাকে ধিক্কার দেয় হিমাংশু, ইচ্ছে হয় ওর টুঁটি চেপে ধরে, ওর রক্তের পঙ্কিল গন্ধে…।

আশ্চর্য, আরো কি ফরসা হয়েছে আকাশ—নাকি একটু আলো আসছে কোথাও থেকে। আয়নার ছবিটি আরো স্পষ্ট, আয়নার নীচের একটি সরু ব্র্যাকেটে সাজানো দাড়ি কামানোর সাবান, ডেটল, খুর, সেই রবারের হ্যান্ডেল, ব্রাশ সব ফুটে উঠেছে।

জানোয়ারটার চোখে চোখ রাখতেই আর ইচ্ছে হচ্ছে না হিমাংশুর। ওর রক্তের পঙ্কিল গন্ধ যেন ভেসে আসছে। বিকৃত মুখভঙ্গি করে হিমাংশু ব্র্যাকেটের ওপর থেকে খুরটা তুলে নেয়।

রক্তের স্বাদ আছে, কিন্তু গন্ধ আছে নাকি? নেই? কিন্তু, ভ্যাপসা পচা ঘায়ের মতন গন্ধ আসছে কোথা থেকে? পঙ্কিল রক্তের, কলুষ নিশ্বাসেরও হতে পারে। হতে পারে ওই পশুটার।

হিমাংশু আর সহ্য করতে পারছে না। ঘিনঘিনে গন্ধটা তার সর্বাঙ্গে জড়িয়ে গেছে। এমন কি বুঝি রক্ততেও মিশে গেছে।

মণিবন্ধের একটি শিরায় খুরটা জোর করে চেপে ধরল হিমাংশু। তারপর ছোট্ট একটু টান। ছত্রিশ বছরের অমিত-তাপে তপ্ত একটি যৌবনের উষ্ণ শোণিত ফিনকি দিয়ে ছুটে এল। আঃ, কী টনটনে আরাম! কী শান্তি! যেন হুহু করে জ্বর ছেড়ে যাচ্ছে। আরো একটু দ্রুত মুক্তি চাই, দ্রুত। এবার ডান হাতের মণিবন্ধে গভীরভাবে খুরটা টেনে দেয় হিমাংশু।

টুপ টুপ…জল কি পড়ছে? সিরসির করছে নাকি গা? ঘুম কি আসছে এতক্ষণে? হয়ত কিছুই না, সব ভুল—সব ভুল। তবু এ আশ্চর্য আরাম। যেন অনেক কলুষ রক্ত বিশুদ্ধ হাওয়ায় এসে শুদ্ধ হচ্ছে, তারই আরাম ; একটা পুঁজ রক্ত ভরা ফোঁড়া থেকে আশ্চর্য যাদুবলে যেন সব কষ্ট কেউ শুষে নিচ্ছে, তারই স্বস্তি।

আরো একটু আলো এসেছে না ঘরে! হিমাংশু চমকে চায়। ইস্‌, এ যে অনেক রক্ত। কোথাও তো কালো রঙ নেই, সেই কুৎসিত কালো, যাতে পাপের বীজ লুকিয়ে থাকে। নেই, নেই—? হিমাংশু তবু খোঁজে, সতর্ক চোখে। যদিও কেমন যেন আচ্ছন্নতা আসছে। এবং কান্নাও।

তবে কি নিষ্ঠুর সত্যটাও ফাঁকি দিয়ে গেল? হিমাংশুর দুর্বল শরীরটা আর একবার যেন মরিয়া হয়ে ওঠে। আর এবার খুরের গা দিয়ে শিথিল, কম্পিত, স্খলিত হতে গলার একটা শিরায় টান দেয়।

ধীরে ধীরে এতক্ষণে গভীর তন্দ্রা নেমেছে হিমাংশুর মনে, একটা অব্যক্ত যন্ত্রানাও ছড়িয়ে পড়েছে, নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়, তৃষ্ণাটা তালুর কাছে এসে ঠেলে ওঠে বেসিনের কাছে হাত বাড়াবার চেষ্টা করে হিমাংশু। পারে না। মাথা ঢুলে আসে, মেঝেতেই লুটিয়ে পড়ে।

অব্যক্ত একটা যন্ত্রণা পুরু ভারী লেপের মতন পা-মাথা সব ঢেকে ফেলেছে। বক চুঁইয়ে যেন একটি প্রশ্বাস আসে, একটি নিশ্বাস যায়। অদ্ভুত একটা আবেগ গলার কাছে পুঁটলির মতো পাকিয়ে গেছে। —আর ঘুম—গভীর, গভীরতর আচ্ছন্নতা। এই আচ্ছন্নতার মধ্যেই আকাশ যেন দেখতে পেল হিমাংশু, খানিকটা আকাশ এবং ক্রিমসন রঙের একটি মেঘ। মেঘ—মেঘ। না, মেঘ নয়; মেয়ে। হিমাংশুর মেয়ে, যার নাম পুতুল, বয়স পনেরো বছর নয়, পনেরো দিন। অসহায়, উলঙ্গ, নির্বোধ একটি রক্তপিণ্ড। কে? মেয়ে। …পনেরোটি পাপড়ি যেন আরো খুলে যায়, একে একে একটি করে—আর এক একটি পাপড়িতে একটি করে বছর বিকশিত হয়ে ওঠে পুতুল শুধু তিলে তিলে গড়ে উঠছে—হিমাংশুর হাতে হাতে। কল্পনায়, বাস্তবে। যা শুধু শীর্ণ শাখা তাকে শাখায় শাখায় প্রসারিত করে, পত্রপল্লবে সাজিয়ে, পুষ্পসম্ভারে ছেয়ে দিতে—হিমাংশু তার জীবনের সমস্ত সুষমা, শ্রম, স্নেহ অকৃপণভাবে ব্যয় করে চলেছে। কেন? এ কে? তার মেয়ে? এ কি ভিন্ন? হ্যাঁ, দেহ থেকে ভিন্ন। কিন্তু তবু ভিন্ন নয়, রক্তের সেই আশ্চর্য লীলার কাছে ওরা এক, সেই আত্মায় ওরা অভিন্ন। ওর আত্মায় এর জন্ম, এর জীবন, এর লীলা। আর হিমাংশু জানে এই অভিন্নতাকেও একদিন ভিন্ন করতে হবে, এই আত্মাকেও। কী নিষ্ঠুর। গ্রন্থিমোচনের আশঙ্কায় হিমাংশু ভয় পায়। ভয় পায় কেন? পাবে না—? পাবে বইকি, কারণ পুতুলও শেষে একদিন যূথিকা হয়েই সংসারে ফুটে উঠবে—যোল বছরে যার জীবন যৌবন, প্রেম, উদ্দীপনা, আনন্দ—সব অন্ধকার করে নেমে আসবে একটি চিরাচরিত অভ্যাস—যা কুটিল, জটিল, সতত সন্ত্রস্ত। আর তখন? তখন হিমাংশু শূন্য ; যেমন আজ, জীবনের সেই ছেলেবেলার সুখ, স্বপ্ন, মুক্তি সমস্ত থেকে সে শূন্য—যেমন বিতাড়িত যূথিকার উত্তপ্ত অনুরাগ থেকে। …হিমাংশুর হৃৎপিণ্ডে এতক্ষণে একটা সাহস এল, ভাসমান মনে একটি আশ্রয়। না, তবে এই তো কারণ, যা পনেরো বছরের পুতুলকে ছোট দেখেছে, ছোটই ভেবেছে। প্রার্থনা করেছে নিঃশব্দে, নিত্যদিন : পুতুল, আমার পুতুল, আমার কাছে ছোটটি থাক চিরকাল—ঈশ্বর, তুমি ওকে যৌবন দিয়ো না, প্রজাপতির রং ছুঁড়ো না ওর মনে। ও যে আমার সেই ছেলেবেলা, আমার সেই সুখ, সেই মন আর আনন্দ। সেই আত্মা, একটি শুধু অক্ষয় স্মৃতি। পনেরো বছরের যূথিকাকে নিয়ে আমি যা হারিয়েছি, যূথিকা যা হারিয়েছে, তার স্পর্শ কেন দেবে নিষ্ঠুরের মতন ওকেও?

হিমাংশু শেষে ঘুমের ঢেউয়ে ভেসে যাবার আগে চেষ্টা করল উঠে দাঁড়াবার, বাথরুমের দরজা ভেঙে ছুটে গিয়ে পুতুলকে বুকে জড়িয়ে ধরবার। কিন্তু তাই কি সে পারে? পারে না—। মন দিয়ে স্মৃতিকে জীবন্ত করা যায়, আত্মাকেও, কিন্তু দেহকে?

হিমাংশু একবার চোখের পাতা খুলেছিল একটু আর সেই মুহূর্তটুকু জুড়ে বাইরের ফরসার মধ্যে একটি বিনুনি ঝোলানো ক্রিমসন রঙের মুখ ছিল, একটি মুখ, যা হিমাশুর আত্মার। যে-ছবি ও নিজেই দেখেছে আর কেউ নয়। কেউ না।

1 Comment
Collapse Comments
সিমান্ত জয় November 14, 2022 at 12:02 pm

অসাধারণ।নিষ্পাপ,নিমোহ ভালোবাসা,স্নেহ এবং সন্তান বাৎসল্লের একটি গল্প।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *