আত্মজা ও একটি অস্টিন ১৯২৯
দেশবিভাগের সময়কার কিশােরদের অনেকেই আজ গুরুগম্ভীর অভিভাবক। তারা দশ বছর হল চালশের দরুন চোখে চশমা দিচ্ছে। একই ব্লেড়ে তারা সাশ্রয় করে হপ্তা-ভর দাড়ি কামায়। চাকরিতে রিটায়ারের সময় তাদের অনেকের আর দশ বছরও নেই। আবার অনেকে কবেই মরে-হেজে গেছে।
এরই ভেতর মিহির ঘােষাল প্রথম যৌবনে গুন্ডা হয়। ফাঁকা ট্রামলাইনে হরতালের দিনে সে লােহার আংটায় চাকা চালাত। গুন্ডাদের আগে মন্ত্রী হওয়ার রেওয়াজ ছিল না। তাই সে পঁচিশ বছর বয়সে গ্র্যাজুয়েট হয়। পড়াশুনা ভালো লাগতে থাকে তার। তাই একত্সময় দেখা গেল সে রীতিমতো চিন্তাশীল হয়ে পড়েছে। সারাদিন খাতা খুলে টেবিলে বসে থাকে। একসময় শােনা যেতে থাকল মিহির ঘােষাল লেখক—যাকে বলে অথর।
কোন রহস্য থেকে মানুষ সৃষ্টি করে তা আজও রহস্যময়। সৃষ্টিশীল প্রতিভাকে কোনো অঙ্কে মেলানোযায় না। মিহিরও কোনো অঙ্কে পড়ে না। সে নিজেই নিজের লেখার উৎস আর মিশেল নিয়ে মাথা খাটিয়ে টের পেয়েছে— যা ঘটে—তা লিখলে লেখা হয় না। বরং যা ঘটলেও ঘটতে পারে— এমনটা কোনো দৈবী পাগলামিতে জারিয়ে নিয়ে কাগজের ওপর শব্দ বসিয়ে গেলেই তবে লেখা হয়।
সামেন মিত্তিরের দুর্গাপুজোয় ক-বছর আগে মিহির ঘােষাল গুণীজন সংবর্ধনায় আঙুরবালা, পি.কে., হিন্দি ছবির ভ্যাম্প বিন্দুর সঙ্গে মানপত্র পায়। তারপর এই ক-বছরে তার শরীরের গুন্ডা গ্রন্থিগুলো বাৎসল্যে শিথিল হয়ে পড়ে। তার মগজের চৌষট্টি হাজার কোষে পরিণতির ছায়া পড়ে। সে গঙ্গার পাড়ে দাঁড়িয়ে সমুদ্রগুপ্তর নৌবাহিনীর দাঁড়িদের সমস্বর শুনতে কান পেতে রাখে। ভিনটেজ কার র্যালি দেখতে দেখতে জগতের তাবৎ বাতিল মােটরগাড়ির ইঞ্জিনে জমাট হর্সপাওয়ার থেকে কোটি কোটি অশ্বক্ষুরধ্বনি শুনতে পায়।
এইসব সময়ের শারদীয় কাগজপত্তরে তার লেখা বাড়তে থাকে। গেরস্থ মিহির কোনো কোনােদিন বেশি রাত অব্দি টেবিলে বসে লেখে। তখন তার বিছানায় বউ পাশ ফিরে ঘুমােয়। অবসন্ন মিহির পাশে শুয়েই ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের ভেতর তার সদ্য লেখা থেকে দু-একটা চরিত্র তাকে স্বপ্ন দিয়ে পরদিন সকালের লেখার পথ আগাম দেখিয়ে দেয়।
এক-একদিন লিখতে লিখতে ক্লান্ত হয়ে মিহির ঘােষাল বেশি রাতে কলকাতার আকাশে তাকায়। এই শহরেরই বাসিন্দা সব লেখকের শারদীয় লেখালিখির অসমাপ্ত জায়গাগুলো ঘন মেঘ হয়ে আছে—এটা বুঝতে পারে সে। আরো বুঝতে পারে এখানে এই মাটির পৃথিবীতে তাদের সবার। চেয়ে বড় একজন আর্টিস্ট আছে—যার সঙ্গে লিখে, গান গেয়ে, ছবি এঁকে এঁটে ওঠা যাবে না। সে গাছপালা মানুষজন দিয়ে এখানে লেখে, গায়, আঁকে। আপশােস! এটা আগে জানতে পারলে সে পঁচিশ বছর ধরে লেখালিখির পণ্ডশ্রমে যেত না। এখন মিহির ঘােষাল বােঝে—এখানে তার সৃষ্টি বলতে নিজের বড় ছেলেটি! আর তারপর দুই মেয়ে। এই তার মােট তিনখানি উপন্যাস—যা কিনা আরো ৫০। ৬০ বছর এই পৃথিবীতে টিকে থাকতে পারে। এইরকম হতাশ মন নিয়েই সে রােজ লিখতে বসে। তাই এই পৃথিবীর মানুষে-মানুষে কিংবা মানুষে-নিসর্গে নানান সম্পর্কের খাঁজে জমে থাকা জীবনের গুঁড়ো মিহির ঘােষাল যতটা পারে কুড়িয়ে নিয়ে সাদা কাগজে হরফ সাজিয়ে তুলে রাখে। এসব জিনিস আজকাল লােকে পড়তে চায় না। তবু কেউ কেউ পড়ে। তারা বাহবা দেয়— সম্ভ্রম দেখায়।
লেখা বাবদে তার এখন শুধু এইটুকুই প্রাপ্য। এরকম অবস্থায় তার একজন সমবয়সি লেখক বলল, তােমার কিন্তু একটাও প্রেমের গল্প নেই। একটাও প্রেমের উপন্যাস নেই।
মিহির ঘােষাল এই লেখকের লেখার খুব ভক্ত। সে নিজেও ব্যাপারটা ভেবেছে। মুখে বলল, আমিও ভেবেছি। কিন্তু কী করা যায় বলতো।
করার কিছু নেই মিহির— তােমার তো দিব্যি প্রেমের লেখা রয়েছে। আমি একজন সুন্দরী মেয়ের কথা লেখার সময় তাকে যেন টের পাই। মিহির ঘােষাল নিজের মনের ভেতর ডুব দিয়ে দেখল, সে সেরকম কিছু টের পায় না। তার লেখায় ছেলে বা মেয়ের কোনো ডেসক্রিপশন থাকে না। তাই পাঠক তার পছন্দমতো চেহারাগুলো দেখে নিতে পারে। মিহির ঘােষাল তখন বুঝল, এই যে সে কোনাে কিছু টের পায় না প্রেমের গল্প লিখতে পারার কারণ এটাই। এমনকি নিজের বউয়ের সঙ্গেও কাছাকাছি হলে কোনােদিন বাড়াবাড়ির দিকে যায়নি সে।
মেয়েদের ভেতর বড়ােজন এসেছে শ্বশুরবাড়ি থেকে। জামাই আসতে পারেনি। মিহিরের ছেলে রাউরকেল্লায়। ওরা বড়ো হয়ে যাওয়ায় মিহির টের পায়— ওদের জগৎ আলাদা হয়ে যাচ্ছে। এটাই নিয়ম। এরকম ভাবতে গিয়েও কষ্ট পায় মিহির। এক সময় মিহির তার ছেলেমেয়েদের নদী, পাহাড় এসব দেখাত। যেখানে এসব দেখা যায় সেখানেই ওদের নিয়ে বেড়াতে যেত সে। বড়ো কিছু করতে না পারুক বড়াে কিছু দেখুক।
বড়োমেয়ে এসে বলল, কাল সকালে আমরা ভিনটেজ কার র্যালি দেখতে যাব।
ছােটোমেয়ের বিয়ে হয়নি। সে বলল, চল না বাবা। সকালবেলাতেই বেরােব? অনেক লেখা বাকি বড়োমেয়ে বলল, অনেক তো লিখেছ। এবার কিছুদিন লেখা বন্ধ করাে বাবা। অন্যরাও তো লিখবে। আমরা কতদিন কোথাও একসঙ্গে যাই না বলত।
এই আমরা মানে– মিহির আর তার দুই মেয়ে। পারলে ওদের দাদাকেও এই সঙ্গে ধরতে চায় ওরা। কিন্তু দাদাটি দাড়ি কামাতে শিখেই দলছুট অনেকদিন।
মিহির ঘােষাল মাঝে মাঝে অবাক হয় তার বডােমেয়ে কত সহজে কত কঠিন সমস্যার সমাধান করে দেয়। অবলীলায়—
নানান সম্পর্ক নিয়ে লেখার ভেতরেও মিহির ইদানীং টের পায়— মানুষে মানুষে কিংবা মানুষে নিসর্গে সম্পর্ক ছাড়াও আরাে কিছু সম্পর্ক আছে। স্বামীর জগৎ থেকে বড়ােমেয়ের এই যে মাঝে মাঝে বাবার জগতে চলে আসা এটাও তো লেখার জিনিস।
জানলার বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিল। টেবিল ল্যাম্পটা নিভিয়ে দিয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকল মিহির ঘােষাল। বারােটা বাজতে দশ। ইদানীং মিহির ঘােষাল লক্ষ করে দেখেছে— গল্পে যেমন সন্ধেরাতে কুকুর অশরীরী আত্মার যাওয়া আসা টের পেয়ে সন্দেহবাতিকে ভুগ ভুগ করে ডেকে ওঠে— তেমনি এই বাড়ি-ঘরদোর, টেবিল, দোকানঘর, পাথর— এরা সবাই নিজেদের ভেতরে কথা বলে- শব্দশুন্য শব্দ করে। সে রাস্তায় বেরােলে এই ভাড়ার বাড়িটা পিছন থেকে তাকে ডেকেও বলে— সাবধানে ফিরে এসাে কিন্তু। আসলে ডালডার খালি টিন ডাস্টবিন থেকে পাশের দেওয়ালে গজানাে অশ্বত্থ চারার সঙ্গেও কথা বলে। কেমন আছিস ভাই?
গাছ, রােডরােলার, নিশুতি রাতের রেড রােড়– এরা কেউই চুপ করে নেই। আমাদের জুতসই কান নেই বলেই শুনতে পাই না। নয়তাে ওরা যে অনর্গল কথা বলছে— তা তাে আমি টেরই পাই।
একথা মনে আসতেই মিহির ঘােষাল বুঝল, সারা শহর ঘুমােচ্ছে। ঠিক তখনই তার পিঠে লাগা মশারি (শােবার খাটে বসে খাবার টেবিলে লিখে থাকে মিহির ঘােষাল) এক ঘষা দিয়ে বলল, এখন ঘুমােও। সকালে উঠে লিখবে।
কখন মশারি টাঙিয়ে দিয়ে গেল! বিড়বিড় করে একথা বলে অন্ধকার খাটে শুতে গেল সে। খাটের ওপাশে খালি জায়গা একটানা লেখার চেয়েও বেশি অন্ধকার। তার মানে মিহির ঘােষালের বউ ওখানে শুয়ে ঘুমিয়ে আছে। তক্ষুনি একটানা লেখার অবসাদ টপকে তারই চিন্তা তাকে উশকে দিল।
আমি লেখার সময় টের পাই না ঠিকই কিন্তু নিজের বিছানায় নিজের বিয়ে করা বউকেও টের পাব না? তাহলে কি আমি বরফ হয়ে যাচ্ছি! এইজন্যই অল্পবয়সিরা আমার লেখা ছুঁয়ে দেখে না। মিহির ঘােষাল— বাড়িতে তিনটি উপন্যাসের জন্মদাতা কলেজস্ট্রিটে ছত্রিশখানা উপন্যাসের পিতা নিজের মশারির ভেতর গাঢ় অন্ধকারে জায়গামতাে মুখ নামিয়ে আনল। পালটি মুখখানা জায়গা থেকে সরে গেল।
এ কি? আমাকে ঘুমের ভেতরেও প্রত্যাখ্যান? আশ্চর্য! ধরেই নিয়েছে স্বামী মানুষটা বরফ! মিহির ঘােষাল আবার মাথা নামাল!
এবারও পালটি মুখখানা সরে গেল।
ঘুমে অচেতন দশাতেও কেউ অপমান করতে পারে? এ তাে জানা ছিল
মিহিরের। সে এবার বেশ জোরে মুখখানা নামিয়ে দিতেই দুখানা হাত তাকে বাধা দিল। স্বামীর চুম্বন এভাবে ফিরিয়ে দেওয়ার মানেটা কী? ঘুম ভাঙিয়ে এখুনি কৈফিয়ত চাওয়া যায় কি?
এসব কথা অন্ধকারে নাড়াচাড়া করতে করতে চমকে উঠল মিহির ঘােষাল। বাধা দেওয়ার হাত দুখানা যেন অন্যরকম। বেডসুইচটা টিপেই তাকে নিভিয়ে দিতে হল।
ততক্ষণে সে গুদামে রাখা সরকারের বাতিল স্ট্যাচু। সেই অবস্থাতেই মিহির ঘােষাল অন্ধকার বারান্দায় এসে দাঁড়াল।
কখন যে বাবার সঙ্গে ছােটোবেলার মতাে শােবে বলে বড়ােমেয়ে এসে মায়ের জায়গায় ঘুমিয়ে পড়েছে একবার অন্য ঘরে শুয়ে পড়ার আগে ওদের মায়ের মিহিরকে বলে যাওয়া উচিত ছিল। মিহির খাওয়া-দাওয়ার পর ঘণ্টা দুই একমনে লিখেছে। কখন সারাবাড়ি অন্ধকার হল— কখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ল— এসব অনেকদিনই তার দেখা হয় না। মেঘ চিরে বেরােনাে চাঁদটিকে তার অর্থপূর্ণ মনে হল।
পরদিন বেশ দেরিতে ঘুম ভাঙল মিহির ঘােষালের। বাড়ির সবাই উঠে গেছে। জানলায় ঝকঝক করছে রােদুর। এই প্রথম সে টের পেল— কাল নিশুতি রাতের রক্তের চাপ ঘুম এসে আবার রক্তেই মিশিয়ে দিয়েছে। সে মাথা তুলে নিজের বােমেয়ের মুখে তাকাতে পারছিল না।
তখন পাশের ঘরে যাবার দরজায় পর্দা তুলে মেয়ের সঙ্গে মা চাপা গলায় কী বলছিল। মেয়ের হাতে একটা প্লেটে একগ্লাস দুধ বসানাে। মা আর মেয়ে দুজনেই যেন ত্রিকালদর্শিনী। জ্ঞানে অভিজ্ঞানে মজানাে। এক-একসময় মনে হয় মিহিরের মৃত্যুর কথা বলতে বলতে ওরা হাসতে পারে। আসলে দুজনেরই পেটে মানুষ জন্মায় বলে দুজনেরই এ পৃথিবীতে কোনাে কিছুর যেন পরােয়া নেই।
নিজের বউয়ের মুখে মিহির একটা কথা শুনতে পেল। পুরুষমানুষ সব পারে না। কোনো বিশ্বাস নেই—
কোন কথায় বউয়ের মুখে একথা? তার একটা আন্দাজ করে মিহির ঘােষাল কলম হাতে খােলা খাতার সামনে সিটিয়ে বসে থাকল।
তখন তার বডােমেয়ে বলল, না মা- বাবা আমাদের সেই ছেলে নয়।
এবার সে তার বাবার সামনে দুধভর্তি গ্লাসটা ঠক করে রেখে বলল, খেয়ে নাও। কাল অনেক রাত অব্দি লিখেছ।
দুধটা ঢকঢক করে খেয়ে মিহির গ্লাসটা ঠক করে টেবিলে রাখল।
মেয়ে বলল, আজ লেখা থাক বাবা। আজ আমরা ভিনটেজ কার র্যালি দেখতে যাব। চলাে। সকাল থেকেই তাে শুরু। ছুটকিকে ডাকি? ডাকো। ঘণ্টাখানেক পরে হরিশ মুখার্জি রােডে ভিড়ের ভেতরে বুড়কি আর ছুটকিকে নিয়ে মিহির ঘােষাল। রাস্তা দিয়ে গেল ১৯০৩ সালের রেনাে। ফরাসি মােটর গাড়ি। তাতে সেই সময়কার ফরাসি পােশাকে শশী আগরওয়ালা আর তার বউ। নেমন্তন্ন চিঠির সঙ্গে মালিকের নামের পাশে গাড়ির মডেলের সাল সন ছাপানাে সুন্দর কার্ড পেয়েছে মিহির ঘােষাল। রাজভবনের সামনে উদবােধনে পৌঁছতে না পেরে মাঝপথেই দু মেয়েকে নিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে সে।
একসময় এল উলসূলে। মিহির চাপা গলায় বলল—ব্রিটিশ গাড়ি। অষ্টম হেনরির প্রধানমন্ত্রী ছিল উললে। ছুটকি চাপা স্বভাবের। লজ্জা পেয়ে বলল, থাক বাবা তােমায় আর ধারাবিবরণী দিতে হবে না—
কালীঘাট ফলতা লাইনের ছােটো ট্রেন উঠে গেছে কবে। দেবকী বসু তারাশঙ্করের কবি’ ছবিতে এই রেললাইন দেখিয়েছিলেন। সেই লাইনের ইঞ্জিনের মতােই দেখতে। ১৯২৯ সনের অস্টিন টলতে টলতে এল। লম্বা নাকের ওপর চোখ বসানাে। পাদানিতে পুরু করে তামার ঝকঝকে পাত লাগানো। হর্নের আওয়াজ অনেকটা হ-র-র-র—। ড্রাইভারের অ্যাসিস্ট্যান্ট পেছনের লােহার মই বেয়ে ওপরের সিটে গিয়ে বসল। ৫০। ৫৫ বছর আগেকার গর্ব সাইকেলের মতাে স্পােক লাগানাে চার চাকায় ভর দিয়ে হাজরার মােড়ের দিকে ঘুরে গেল।
বুড়কি বলল, এ গাড়িটা আমাদের কিনতেই হবে। বেচবে কি—
ছুটকি বলল, বসবার জায়গাটা সবচেয়ে উঁচুতে। একদম ঘােড়ার গাড়ির মতাে, তাই না বাবা? বলে মিহির ঘােষাল ওদের নিয়ে রাস্তার পাশেই সর্দারজিদের জিলিপির দোকানে ঢুকল। তার পাশেই একতলা-দোতলা জুড়ে গুরুদ্বার। সেখান থেকে মাইকে গ্রন্থসাহেব পাঠ হচ্ছিল।
দোকানের ভেতরকার ছায়ায় বসে বুড়কি ছুটকি বলল, গাড়িটা কিনবে তাে বাবা?
বেচবে কি না আগে খোঁজ নে।
তা নিচ্ছি আমরা। র্যালিটা শেষ হতে দাও আগে। সে তাে এখনাে ঘণ্টা তিনেক। দেখতে দেখতে কেটে যাবে বাবা। তাই বলে অতক্ষণ আমি কিন্তু দোকানে বসে থাকতে পারব না।
খানিকক্ষণ পরেই ওরা আবার রেস দেখতে দাঁড়িয়ে গেল। দেখতে দেখতে মিহির ঘােষাল নিজেই মজে গেল। ১৯৩৩-এর একটা অস্টিন ট্যুরার টলতে টলতে বেরিয়ে গেল। হাতের ছাপানাে কার্ডে লেখা— দিঘাপতিয়া।
তার মানে তখনকার দিঘাপতিয়া জমিদারদের গাড়ি। এ গাড়ি কোনো রইস পূর্বপুরুষ চালাত। টু সিলিন্ডার। ভিক্টোরিয়ার সামনে কতবার এ গাড়ি পাক খেয়েছে। গ্যারাজ থেকে বের করে আজ অনেকদিন পরে ওকে চাল করা। হয়েছে। এ গাড়ির পয়লা সওয়ারি আজ বেঁচে থাকলেও তার ঝাপসা চোখে। নিশ্চয় সি.আর.দাশ. আশু মুখুজ্যের সময়কার ছায়া ছায়া কলকাতা ভাসে। সে সময় ট্যাক্সিগুলাে সব ফোর্ড নয়তো শেভ্রলে ছিল। গঙ্গা পেরােবার ব্রিজ দিনে দুবার খুলে দিত। বিনয় বাদল দীনেশের বেপরােয়া গুলি চালানাে রাইটার্সের সামনেকার লালদিঘি যে একদিন বিবাদি বাগ হয়ে যাবে সেদিন তা কে ভাবতে পেরেছিল। আজকের র্যালিতে তখনকার ইঞ্জিনগুলােকে আবার চালু করায় সেইসব ঘুমন্ত ঘােড়া কলকাতার রাস্তায় ফের দাপাতে দাপাতে বেরিয়ে পড়ল।
ওরা ফিরতে ফিরতে প্রায় বারােটা। হেঁটেই ফিরছিল তিনজনে। হাজরার মােড়ে এসে লাইট রেলের ইঞ্জিনমার্কা ১৯২৯-এর সেই অস্টিনের সঙ্গে দেখা।
ও বাবা। ইনি যে মুখ থুবড়ে পড়ে আছেন!
বুড়কির এ কথায় মিহির ঘােষাল দাঁড়িয়ে পড়ল। পাশেই ছুটকি। তিন ভঁজের বনেট খুলে প্লাগগুলাে চেক করছিল দুজন লােক। তাদের গায়ে তখনকার উড়ুনি। পাঞ্জাবির বড়ােবাবু কাট। পায়ে চামড়ার প্রজাপতি বসানাে পাম্পসু। হাতে বাঁকানাে ছড়ি। নাকের নীচে নকল গোঁফ লাগানো। দুজনেরই মাথা পাতা কেটে আঁচড়ানাে। অথচ তাদের চারদিকে হালের কলকাতা বয়ে যাচ্ছে। সেখানে ডবল ডেকার, ডিজেল ট্যাক্সি, মারুতি, কন্টেসা। এখন অনেক বেশি ঘােড়া আরও ঘন করে এসব গাড়ির ইঞ্জিনের ভেতর ঢুকিয়ে রাখা আছে।
কী হয়েছে ভাই? মিহিরের এ কথায় ইঞ্জিনে ঝুঁকে-পড়া লােকটা নকল গোঁফ খুলে পাঞ্জাবির পকেটে রাখল, প্লাগে মবিল বেরােচ্ছে।
এসব প্লাগ এখন পাওয়া যায় ? সব পাওয়া যায়। মল্লিক বাজারে খুঁজলেই পাবেন। টায়ার ?
তাও পাবেন। হালের মপেডের টায়ার লাগিয়েছি। বেশ ফিট করে। তাই চারটে কিনলেই চলে।
ছুটকি বলে বসল, বাবা–গাড়িটা কেনো। চুপ কর তো।
ইঞ্জিন থেকে মুখ তুলে অন্য লােকটি বলল, কিনতে পারেন কিন্তু। আমার ঠাকুর্দার কাকার গাড়ি। পড়ে ছিল অনেককাল। আমরা মােটামুটি চালু করেছি। বেশি দামও লাগবে না আপনার। দেখুন না—এখুনি চালু হবে।
রােদে দাঁড়ানাে যাচ্ছে না আর মিহিরের এ কথায় সদ্য গোঁফ শূন্য লােকটি বলল, ঠিকানা বলে যান—আমরা বিকেলে যাব।
ঠিক বিকেলে নয়— সন্ধের মুখে এসে গাড়িটা মিহির ঘােষালের ভাড়া বাড়ির সামনে দাঁড়াল। নেহাত বাঙালি পাড়া। শিবের ষাঁড়, ঘিয়ে ভাজা কুকুর দুইই আছে। আছে পাগল, ভিখারি আর অঢেল মানুষের বাচ্চা। ঝগড়া। ফুচকাওয়ালার ফেলে যাওয়া শালপাতা। মােড়ের মাথায় গুলতানি।
বুড়কি ছুটকি হ-র-র-র-রাে-হর-রাে-রাে-রাে হর্ন শুনে ছুটে বেরিয়ে এসে বােকা হয়ে গেল। চোখ ফেলতে পারে না। ছবির বইয়ের একটা লাইট ইঞ্জিন যেন বাড়ির সামনে এসে ডাকছে। এই ছুটকি যাবি না? চল গঙ্গার ধারে। হাওয়া খেয়ে আসি—
বিশ্বাস হয় না একদম। চাপা গলায় ছুটকি তার বাবাকে বলল, গাড়িটা কিনবে তো বাবা—
নিশ্চয়। এসব সময় মিহির ঘােষাল কখনাে পিছিয়ে যায় না। আর ভিনটেজ কারের দামই বা কত হবে। বড়ােজোর সাত-আট হাজার।
ষাঁড় বা কুকুর কখনো এমন জিনিস দেখেনি। ষাঁড় পর্যন্ত আগাগােড়া ডেকে হাঁটি হাঁটি পা করে এসে অস্টিন ১৯২৯-এর গায়ের গন্ধ শুকল। শুকে তার সন্দেহ হল—নিশ্চয় এটা সেই গড়গড়িয়ে ছুটে যাওয়া কোনাে ফাজিল জিনিস। কুকুর ছিল তিনজন। কিছুই স্থির করতে না পেরে তারা তারস্বরে চেঁচাচ্ছে। এলােপাথাড়ি জন্মানাে কিছু মানুষের বাচ্চা কোত্থেকে লাঠি এনে চাকার স্পােকে ঢুকিয়ে দিল।
মালিক আর তার সহকারীর গায়ে এবেলা এখনকার জামা-কাপড়। তাদের একজন সিট থেকে নেমেই মানুষের বাচ্চা, কুকুর আর ষাঁড় তাড়াতে লাগল।
মিহিরকে দেখে মালিক ভদ্রলােক বলল, আমার এই ড্রাইভারকে রেখে যাচ্ছি। আগে চড়ে দেখুন। যদি শখ থাকে তো এ গাড়ি কিনুন। পছন্দ হলে দামে আটকাবে না। বলেই মালিক হনহন করে চলে গেল। আধাে অন্ধকারে বুড়কি আর ছুটকিকে নিয়ে পেছনের মই বেয়ে ড্রাইভারের পেছনের সিটে এসে উঠে বসল মিহির ঘােষাল।
১৯২৯-কে দেখেই রাস্তার অ্যামবাসাডর, ফিয়াট, মারুতি সাত হাত দূরে সরে যায়। ছুটকি বলল, চমৎকার গাড়ি বাবা। সিটে বসে অন্য সব গাড়ির ছাদ দেখা যায়।
বুড়কি ছুটকির কানে কানে বলল, বেশি প্রশংসা করিস না। ড্রাইভার শুনতে পেয়ে দাম বাড়িয়ে দেবে। শেষে বাবা আর কিনতে পারবে না।
ছুটকি ফিক করে হেসে বলল, বাবা আমাদের সেই ছেলে নয় ! তিনজনেরই আরাম লাগছিল। মাথায় কোনাে ছাদ নেই। ভােলা বাতাসের আরাম সারা গায়ে লাগে গাড়িতে।
মুদিয়ালি দিয়ে শরৎ ব্যানার্জিতে পড়ে গাড়ি ধ-ধূ-ধর করে এলগিনে উঠল। তার পর শম্ভুনাথ হাসপাতালের গা দিয়ে এমন একটা রাস্তায় গিয়ে পড়ল—যেখান থেকে বাঁক দিয়েই একদম ক্যালকাটা ক্লাবের উলটোদিকে। কয়েক মিটার এগিয়ে দক্ষিণমুখাে হয়েই বাঁ হাতে এডােয়ার্ড কোর্ট।
আবছা ফুটপাথ। নিভু স্ট্রিট লাইট। এলােমেলাে কর্পোরেশনের গাছ। অস্টিন ১৯২৯ সেখানে পৌছেই থেমে গেল।
মিহির বলল, ইঞ্জিন গরম হয়ে যাচ্ছে বুঝি—
এমন কিছু নয়। বলে একলাফে ড্রাইভার নীচে নেমে বনেট খুলে ফেলল।
খানিক দেখে ড্রাইভার ওপরে সিটের দিকে তাকিয়ে বলল, লােক নেই আশেপাশে?
কেন ? লােক পেলে ভালাে হত। একটু ঠেলা দরকার। বুড়কি লাফিয়ে উঠল। আমরা ঠেলে দিচ্ছি। আপনি বসুন।
অগত্যা মিহির ঘােষালও বুড়কির পেছন পেছন নামল। কাঁচা বয়সের মেয়ে। শাড়ি গাছকোমর করে পেঁচিয়ে নিয়ে মিহির ঘােষালের পাশাপাশি সে ঠেলতে লাগল।
পাশেই স্ট্রিট লাইটের নীচে কয়েকটি মেয়ে দাঁড়িয়ে। তারা এক ঝাঁক পায়রা ওড়ানাের কায়দায় হেসে উঠল। মিহির চোখ ফিরিয়ে দেখল। নানা বয়সের মেয়ে সাত-আটজন হবে। বােধহয় সন্ধে সন্ধে এখানে সবাই মিট করে চৌরঙ্গি অব্দি আলাদা আলাদা হয়ে ছড়িয়ে পড়ে।
হাত দশেক ঠেলতেই গাড়ি স্টার্ট দিল বিকট শব্দ করে। সেই শব্দও ওদের আরেক পশলা হাসির তােড় চাপা দিয়ে ঢাকতে পারল না।
বুড়কি ছুটে গিয়ে উঠে বসল। তার পেছন পেছন মিহির ঘােষাল। অস্টিন ১৯২৯ আবার হরিশ মুখার্জিতে পড়ল। এদিকটা নির্জন ! দুধারের গেরস্থ বাড়িতে এইমাত্র লােডশেডিং হল। কাল রাখিপূর্ণিমা বলে চঁাদের সাইজটা কিছু বড়াে আর প্রায় গােল।
বুড়কি শান্ত গলায় জানতে চাইল, ওরা কারা বাবা? কারা? বুড়কি বলল, ওই যারা হেসে উঠল যখন আমরা গাড়ি ঠেলছিলাম? ছুটকি বলল, ভীষণ ফাজিল। মিহির ঘােষাল বলল, চিনি না। জানব কী করে?
অস্টিন ১৯২৯ বুড়কি ছুটকিকে বশীকরণ করে ফেলেছে। আবার মুদিয়ালি, শরৎ বাঁড়ুজ্যে, শম্ভুনাথ, ক্যালকাটা ক্লাব। সুন্দর চলেছে গাড়িটা। আলােতে, অন্ধকারে সমানে ছুটছে। রাস্তার অন্য গাড়িগুলাে ভড়কে সরে যাচ্ছে। সবাই আর কি পথ করে দিচ্ছিল।
কিন্তু আবার সেই স্ট্রিট লাইটের নিভু আলােতে এসে অস্টিন ১৯২৯ দাঁড়িয়ে গেল। মিহির দেখল—আলাের নীচে এবার ওরা তেরাে-চোদ্দজনের মতো । এখুনি বােধহয় চাদ্দিক ছড়িয়ে যাবে।
ড্রাইভার আমতা আমতা করে বলল, প্লাগে তেল উঠছে নিশ্চয়। ছুটকি বলল, ঠিক মতাে রিপেয়ার করেননি কেন?
অনেকদিন গ্যারেজে পড়েছিল তো ।
এবার আগে নামল মিহির ঘােষাল। পেছন পেছন বুড়কি। তাঁতের শাড়িটা এবারও তার কোমরে গাছকোমর করে প্যাচানাে। তারপর দুজনে পেছন থেকে ঠেলতে লাগল দুহাতে।
স্টার্ট নিয়েও গাড়িটা স্টার্ট নিল না। মিথ্যে কিছু কলকবজার শব্দ খট খট করে ওঠে শুধু।
ড্রাইভার ওপর থেকে মিহিরকে বলল, আপনি স্টিয়ারিংয়ে এসে বসুন। আমি ঠেলছি।
মিহির ঠেলতে ঠেলতেই বলল, না না আপনি বসুন। আমি স্টিয়ারিংয়ের কিছু জানি না।
উঁচু সিটে গ্যাট হয়ে বসা ছুটকি নীচের দিকে তাকিয়ে বুঝল, তাদের বাবা এবার হাঁপাচ্ছে। ভরসা যে পাশেই দিদি আছে। ঠিক তখনই লাইটপােস্টের নির্জন জায়গাটা থেকে আবার হাসির সেই হা পায়রা হয়ে ওপরে উঠল। এবারের দমকটা আরাে জোরালো ।
বুড়কির পাশাপাশি অস্টিনকে ঠেলতে ঠেলতে ওদিকে না তাকিয়েই মিহির বুঝতে পারছিল— বড়ােমেয়ের অল্প বয়সের জোর, দম, ঘাম অযথাই খরচ হচ্ছে। ১৯২৯-এর ইঞ্জিনের ভেতরকার জমাট ঘােড়াগুলাে কখন যে দাপিয়ে উঠে ছুটতে থাকবে কে জানে। তা দশ-বিশ মিটার তো ঠেলা হয়ে গেল। ঘােড়াগুলাে তাে জাগে না।
মিহির ঘােষাল একটু থেমে পড়েছিল। বুড়কি চেঁচিয়ে উঠল, কী বাবা— বুকে লাগল নাকি?
নাঃ। বলে মনে মনে মিহির ওই অবস্থাতেই নিজেকে বলল, এত চিন্তা ? সে নিজেকে থামতে দিল না। অটোমেটিক হয়ে গিয়ে আবার সে অস্টিন ১৯২৯-কে ঠেলতে লাগল।
এদিকটায় অফিস-পাড়া খানিক গিয়ে গেরস্থ এলাকায় ঢুকে পড়েছে। তাই বিশেষ লােকজন নেই। বাড়িগুলাের আলো নেভানো। তার ভেতর বুড়কির উদবিগ্নে চেরা ‘বাবা’ ডাকটা একটা গাড়িবারান্দায় গিয়ে আছাড় গেল। বেশ জোরে। যেন কথাটা চৌচির হয়ে ফেটে গেল।
আর অমনি দশ-বারো জোড়া হাত এসে অস্টিন ১৯২৯-কে ধাক্কা দিল। বুড়কি অবাক। মিহির ঘােষাল ক্লান্ত। ঠেলা ছেড়ে সে দাঁড়িয়ে গেল। কী ব্যাপার? হা হাসির মেয়েগুলাে প্রায় একসঙ্গে বলে উঠল, আপনারা গিয়ে উঠে বসুন। যান যান—স্টার্ট নিয়ে নেবে এক্ষুনি। বুড়কি পেছনে তাকাতে তাকাতে পেতলের পাদানিতে পা রেখে এক ঝটকায় ওপরে উঠল। সে পেছন দিকে তাকিয়ে।
ইঞ্জিনের ঘুমন্ত ঘােড়াগুলাে পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বছরের ঘুম ভেঙে এইমাত্র দাপাতে শুরু করেছে।
মিহির ঘােষাল উঠে বসতেই অস্টিন ১৯২৯ ঝাঁ করে বাঁক নিয়ে পি.জি. হাসপাতালের দিককার এলগিনে বাঁক নিল। ওরা সবাই তখন স্বচ্ছন্দে একটা বড়ো বাড়ির আড়ালে পড়ে গেল।
বুড়কি ছুটকি একসঙ্গে জানতে চাইল, ওরা কারা বাবা?
মিহির ঘােষাল বলল, আমি কি চিনি ? জানব কী করে?