আত্মঘাতী নীতিমালা

আত্মঘাতী নীতিমালা

একজন তরুণ গবেষক আমাকে ইউনিভার্সিটি গ্রান্ট কমিশনের (UGC) সর্বশেষ প্রণীত অভিন্ন নীতিমালা পাঠালেন। পাবলিক ইউনিভার্সিটির শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতির এই অভিন্ন নীতিমালা ইউজিসির ওয়েবসাইটেও দেওয়া আছে। আমি খুব। মনোযোগ দিয়ে এটা পড়লাম। খুব আশ্চর্যের সঙ্গে উপলব্ধি করলাম, বাংলাদেশের কোনো পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে লেকচারার পদেও আবেদন করার যোগ্যতা আমার নেই! আমেরিকার একটা আইভিলিগ স্কুল থেকে আমার ফিল্ডের খুব ডাকসাইটে প্রফেসরের অধীনে পোস্টডক করে, স্টকহোম ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করে, পৃথিবীখ্যাত জার্নালে ৭টি ফার্স্ট অথরশিপসহ মোট ১২টি পাবলিকেশন করে, সুইডিশ কেমিক্যাল সোসাইটি থেকে সাড়ে ৩ লাখ ক্রোনরের স্কলারশিপ পেয়ে, ৯টি ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্সে (আমেরিকায় পাঁচটি) অংশগ্রহণ করেও দেশের কোনো পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে লেকচারার পদে আবেদনের যোগ্যতাই আমার নেই। অথচ চীনের সিয়ান জিয়াওতং ইউনিভার্সিটিতে সরাসরি অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর হিসেবে নিয়োগের জন্য নিয়োগপত্র পেয়েছি। দুনিয়ার যেকোনো দেশের ইউনিভার্সিটিতে আমি আবেদনের যোগ্যতা রাখি। কিন্তু আমার দেশে আবেদনের যোগ্যতাই রাখি না। তার কারণ, ইউজিসির অভিন্ন নীতিমালা অনুযায়ী লেকচারার পদে আবেদনের জন্য স্নাতকে (অনার্সে) জিপিএ-৩.৫০ থাকতে হবে। কিন্তু অনার্সে আমার জিপিএ হলো ৩.৪৭। ভাবলাম, নিজভূমে অযোগ্য বলেই তো পরবাসী!

দুনিয়ার কয়টা উন্নত সমাজের ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষক। নিয়োগের জন্য এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলকে গুরুত্ব দেওয়া হয়, সে তথ্য কি কেউ দিতে পারেন? অথচ আমরা গুরুত্ব দিই। দুনিয়ার বহু দেশে ইউনিভার্সিটির শিক্ষক নিয়োগে স্নাতকের ফলাফলকেও গুরুত্ব দেওয়া হয় না। ওরা গুরুত্ব দেয়। গবেষণার মানকে। পাবলিকেশনের মানকে। ওরা গুরুত্ব দেয়। রিসার্চ প্রপোজালকে। আমরা প্রফেসর পদের জন্যও এসএসসি, এইচএসছি পরীক্ষার ফলাফলকে গুরুত্ব দিই। এতে করে কত মেধাবী ও যোগ্য ছেলেমেয়ে বঞ্চিত হন, সেটা কি ভাবি?

অভিন্ন নীতিমালা অনুযায়ী, যাদের পিএইচডি থাকবে তাদেরও সহকারী অধ্যাপক হতে হলে এক বছরের শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকতে হবে। কিন্তু অনার্সের জিপিএ সে ক্ষেত্রে শিথিল হবে কি না, সে বিষয়ে সুস্পষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে একজন অধ্যাপক নিয়োগের জন্য যে যোগ্যতা চাওয়া হয়েছে সেখানেও এসএসসি, এইচএসসি ও স্নাতক পর্যায়ে নির্দিষ্ট জিপিএর কথা উল্লেখ আছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, অধ্যাপক হওয়ার জন্য (বিজ্ঞানের) কমপক্ষে ১২টি পাবলিকেশন থাকলেই চলবে। সেই ১২টি পাবলিকেশনের মাত্র ২টির ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর (IF) থাকলেই চলবে। ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর কত হতে হবে, সেটা উল্লেখ নেই। অর্থাৎ যদি সেটা ০.১ও হয়, তাহলেও সম্ভবত গ্রহণযোগ্য। আর বাকি ১০টি প্রকাশনা যদি দৈনিক সংবাদপত্রেও প্রকাশ করা হয়, তাহলেও গ্রহণযোগ্য হওয়ার কথা, যেহেতু ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টরের প্রয়োজনীয়তা নেই। একজন অধ্যাপক হওয়ার জন্য যে দেশে এত দুর্বল নীতিমালা তৈরি করে রাখা হয়, সেখানে তেজস্বী, দক্ষ, মেধাবী অধ্যাপক কেন তৈরি হবে? যে কয়েকজন মানুষ কঠোর-কঠিন পরিশ্রম। করছেন, তাঁরাই বা দীর্ঘদিন কেন কষ্ট করবেন? ড্রাইভিং ফোর্সটা কী? আমি অনেক সহকারী ও সহযোগী অধ্যাপককে চিনি, যারা কাজকে ভালোবেসে অনেক কষ্ট করেন। তারা হয়তো প্রমোশনের আশায় গবেষণা করেন না। কিন্তু তারা একসময় উপলব্ধি করবেন, তাঁদের চেয়ে আরামে-আয়েশে থেকে অনেকেই প্রফেসর হচ্ছেন, হবেন। সমপরিমাণ বেতন পাবেন। তাঁদের মনে প্রশ্ন জাগবে, এত কষ্ট করে কী লাভ? এই ধরনের। দুর্বল অদূরদর্শী অভিন্ন নীতিমালা অনেক উদ্যমী, পরিশ্রমী ও মেধাবীকে ডিমটিভেইট করেন। জাঁদরেল শিক্ষক ও গবেষক তৈরির পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। এ ধরনের নীতিমালা হলো আত্মঘাতী!

কী করে এমন একটা নীতিমালা প্রণয়ন করা যায়, সেটা আমার বোধগম্য নয়। তদুপরি এমন নীতিমালাকে অভিন্ন নাম দিয়ে মূলত খিল (লক) মেরে রাখা আরও বিপজ্জনক। অভিন্ন নীতিমালার নামে আমরা আরও বহু বিষয় করে রাখি, যেগুলো অনেক সময় চরম বৈষম্যের জন্ম দেয়! যেমন মনে করুন, ঢাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন থিওরেটিক্যাল ফিজিকসের প্রফেসর যিনি কিনা কেমব্রিজ থেকে পিএইচডি এবং আমেরিকার প্রিন্সটন থেকে পোস্টডক করে গেলেন। তার প্রায় ২৫টি পাবলিকেশন আছে। তিনি দেশে গবেষণা করেন। কঠোর পরিশ্রম করেন। স্টুডেন্টদের গাইড করেন। এই লোকটির বেতন আর বারোডাঙ্গা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাবিপ্রবি) গগনবিদ্যান বিভাগের প্রফেসর যিনি দেশে রাজনীতি করছেন, তাঁদের দুজনের বেতনের স্কেল যদি একই হয় (শুধু প্রফেসর বলে), তাহলে কি এই অভিন্ন নীতিমালা গ্রহণযোগ্য? এটাকে কি অভিন্ন নীতিমালা বলে? তাহলে, থিওরেটিক্যাল ফিজিকসের প্রফেসর কেন গবেষণা করবেন? তাঁর মটিভেশনটা কী? তার ড্রাইভিং ফোর্সটা কী? তার রেকগনিশন কোথায়?

পুরো দেশের পাবলিক ইউনিভার্সিটির জন্য এমন একটা অভিন্ন নীতিমালা তৈরি হয়ে গেল, অথচ দেশের শিক্ষকেরা কোনো উত্মা প্রকাশ করলেন না। তারা কেউ প্রতিবাদ করলেন না। ৫০ জন শিক্ষক ও গবেষক একটি জাতীয় পর্যায়ে বিবৃতি দিলেন না। কী অবাক হওয়ার মতো বিষয়! আমরা কি বুঝি, একটা নগরডুবির চেয়ে একটা ইউনিভার্সিটির শিক্ষা ও গবেষণার মান কমে যাওয়া অনেক উদ্বেগের! অনেক উৎকণ্ঠার। অনেক ভয়ংকর!

এই অভিন্ন নীতিমালার ভূমিকা বাক্যতে লেখা আছে, জাতি হিসেবে জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নতি লাভ করে আমরা দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে কতটা অবদান রাখতে পারব তা অনেকটাই নির্ভর করে উচ্চশিক্ষার মানের ওপর। এমন একটি নীতিমালা দিয়ে এই প্রতিযোগিতাময় দুনিয়ায় আমরা কেমন মানের উচ্চশিক্ষা আশা করি, সেটা বিবেচনার দায়িত্ব আপনাদের।