আত্মকথা

আত্মকথা

‘মাসিমা মালপো খামু’—’হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। আমি ঢাকার ভানু। আজ আমি আমার

 জীবনের কথা আপনাদের শোনাতে চাই।

আমার জন্ম ১৯২০ সালের ২৬ আগস্ট (১০ ভাদ্র) ঢাকা শহরের দক্ষিণ মৈসন্ডি অঞ্চলের ‘শান্তিনিকেতন’ নামের বাড়িতে। দেশ ছিল ঢাকা বিক্রমপুরের পাঁচগাও গ্রামে। আমার বাবা জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন ঢাকার নবাব এস্টেটের সদরের আমমোক্তার। অর্থাৎ বাবার কাজ ছিল ঢাকার নবাব এস্টেটে যত কেস হত, তার কোন কেসটা কোন উকিল করবেন সেটা ঠিক করে দেওয়া। আমার মা সুনীতিদেবী ১৮৮০ সালের ১ জানুয়ারি কলকাতার বাদুড়বাগানে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বেথুন স্কুল ও কলেজে পড়াশুনা করেন। মায়ের সহপাঠিনী ছিলেন হিরন্ময়ী সেন, কুমুদিনী মিত্র (শ্রী কৃষ্ণকুমার মিত্রের কন্যা) ও বাসন্তী দেবী (দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের স্ত্রী)।

ওঁর ছোটবেলাটা খুবই অভাবের মধ্যে কাটে। ১৮৯৯ সালে সিনিওর টিচার্স ট্রেনিং পাশ করার পর বেঙ্গল এডুকেশন বোর্ডে প্রথম ভারতীয় ‘ইন্সপেক্টর অব স্কুলস’ হিসেবে যোগদান করে কলকাতায় চাকরি করতে আসেন। এরপর বেঙ্গল বোর্ডের নতুন স্কিম ‘প্রথম হিন্দু জেনানা গভর্নেস’ হিসেবে ঢাকায় বদলি হন। তাঁর সঙ্গে বিবি আমিরুন্নেসাকে ‘মুসলমান জেনানা গভর্নেস’ ও মিসেস অগলিককে ‘খ্রিস্টান জেনানা গভর্নেস’-এর পদে অধিষ্ঠিত করা হয়। অন্ত:পুর নারী শিক্ষা প্রসারের জন্য এই পদটির সৃষ্টি হয়।

মায়ের কাজ ছিল গরিব, হরিজন শ্রেণির মহিলাদের নবাববাড়ি নিয়ে গিয়ে নবাব পরিবারের মেয়েদের কাছ থেকে সহবৎ শিক্ষা নেওয়ানো। এছাড়া তিনি দু:স্থ মহিলাদের জন্য সেলাইয়ের স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর এ-কাজে তাঁকে সাহায্য করেন গিটারবাদক সুজিত নাথের মা সরলাদেবী। এছাড়া আমার মা ঢাকার নবাব পরিবারের মহিলাদের প্রাইভেট টিউটরও ছিলেন।

মা ও বাবা উভয়েরই চাকরিসূত্রে ঢাকার নবাববাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল। সেই সুবাদে আমাদের মহল্লায় আমাদের একটু অন্য চোখে দেখা হত। আমার মায়ের বাবা, দাদামশাই ছিলেন যোগেন্দ্র চট্টরাজ। উনি সরোজিনী নাইডুর পিতা অঘোরনাথ চট্টরাজের সম্পর্কে খুড়তুতো ভাই। উনি তখনকার দিনের খুবই উন্নত হৃদয়ের মানুষ ছিলেন। ১৯২০ সালে আমার জন্মের পর তিনি আমার ভালো নাম রেখেছিলেন সাম্যময়।

এর কয়েক বছর আগে সোভিয়েত রাশিয়ার জন্ম হয়। আমার দাদামশাই ‘বিক্রমপুরের ইতিহাস’ নামে একটি বই লেখেন, যা স্কুলের পাঠ্যবই ছিল। ‘ইন্ডিয়ান মিরর হিস্ট্রি’ নামে একটি বইও লেখেন। ওই বইতে তিনি ব্রিটিশের Black Hole Tragedy (অন্ধকূপ হত্যা)-এর ঘটনাকে মিথ্যে প্রমাণ করেন। তদানীন্তন ব্রিটিশ সরকার বইটার ওই অংশটা বাদ দিতে বলেন। উনি ব্রিটিশ সরকারের অনুরোধ অগ্রাহ্য করলে, ব্রিটিশ সরকার ওই বই নিষিদ্ধ করে দেয়। তিনি ঢাকায় ‘স্কুল বুক সোসাইটি’ নামে একটি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন। এরপরে উনি কিছুদিন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সেরেস্তায় কাজ করেন।

আমরা তিন বোন, তিন ভাই; কিন্তু দুই ভাই অকালে মারা যান। আমার বড়দি শোভাদেবী আমার চেয়ে অনেকটা বড়। আমার শিশুকালেই তাঁর বিয়ে হয়ে যায়। তার পরে আমার বড়দাদা অজিত বন্দ্যোপাধ্যায় ছাব্বিশ বছর বয়সে পুলিশে চাকুরিরত অবস্থায় ১৯৩৮ সালে মারা যান। এরপর আমার আরেক দাদা মাত্র চার বছর বয়সে মারা যান। তারপর আমি। আমার পর ছোটবোন প্রতিমাদেবী।

ঢাকার নবাব এস্টেটে চাকরির আগে আমার বাবা কলকাতায় থাকাকালীন ঠাকুর পরিবারের ছেলে গগণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র অলোকেন্দ্র ঠাকুর ও নাট্যাচার্য্য শিশিরকুমারের গৃহশিক্ষক ছিলেন।

ছোটবেলা থেকেই আমার খুব নাটকের শখ ছিল, অন্যের অভিনয় নকল করার চেষ্টা করতাম। অনেক ছোটবেলা থেকেই সিনেমা, থিয়েটার দেখা শুরু করেছিলাম। আমার যখন বারো-তেরো বছর বয়স তখন ‘সীতা’ সিনেমায় শিশিরকুমারের অভিনয় দেখে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম। পাগলের মতো বাবা, মা, দাদা, দিদির কাছে শিশিরকুমারের অভিনয় দক্ষতার প্রশংসা করেছিলাম। বেশ খানিকক্ষণ আমার কথা শোনার পর বাবা আস্তে আস্তে বললেন, ‘তোর হিরো শিশিরকুমারের প্রাইভেট টিউটর ছিলাম আমি, অবশ্য কুড়ি-পঁচিশ বছর আগেকার কথা।’

শুনে স্তম্ভিত। আমার আইডল শিশিরকুমার, তার প্রাইভেট টিউটর আমার বাবা! বাবার ওপর শ্রদ্ধা আমার বেড়ে গেল হাজার গুণ।

তখন থেকেই ঠিক করলাম আমাকে অভিনেতা হতে হবে। এর আগেও একটা ঘটনা আমাকে অভিনেতা হবার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। মহর্ষি মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য আমাদের আত্মীয় ছিলেন। তিনি আমেরিকা থেকে ফেরার পর একদিন আমাদের বাড়ি এসেছিলেন। ওঁর ওই আগমন নিয়ে আমার মনে একটা উন্মাদনা জেগেছিল যেটা আমাকে ভবিষ্যতে অভিনেতা হবার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। আমার পড়াশোনার চেয়ে সবসময়ই অভিনয়ের প্রতি আকর্ষণ ছিল বেশি। আমার শিশু বয়সে প্রথমে ইস্কুল যাওয়া ঢাকার ‘পোগোস’ স্কুলে। তারপর সেখান থেকে যাই ‘সেইন্ট গ্রেগরীস’ স্কুলে।

এরপর হাইস্কুল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর জগন্নাথ কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করি। এরপর ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে বিএতে ভরতি হই। আমার একটা ভীষণ গর্বের ব্যাপার হল, আমি যেসব বিখ্যাত শিক্ষকদের কাছে পড়েছি, তাঁরা হলেন প্রখ্যাত বৈজ্ঞানিক সত্যেন্দ্রনাথ বসু, ডক্টর এইচ.এল. দে, ডক্টর এস.কে দে, কবি মোহিতলাল মজুমদার, মো: শহীদুল্লা, কবি জসিমুদ্দিন, ডা: জ্ঞান ঘোষ, রমেশচন্দ্র মজুমদার। প্রফেসর সত্যেন বসুর সঙ্গে ব্যক্তিগত জীবনে আমার খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল। উনি ১৯২১ সালে ‘ঢাকা ইউনিভার্সিটি’তে জয়েন করেন। আমি বিশেষ করে তাঁর ক্লাস অ্যাটেন্ড করতাম অন্য ক্লাস থাকলেও, ওঁর লেকচার শুনবার জন্য। কারণ উনি বাংলায় ফিজিক্সের লেকচার দিতেন। উনিই বোধহয় প্রথম শিক্ষক যিনি বাংলায় ফিজিক্স পড়াতেন। গোয়াবাগানের ২২, ঈশ্বর মিল লেনের লাল রঙের ওঁর বাড়িতে জন্মদিন ছাড়াও বহুদিন গেছি। শুধু যে আমি গেছি তা নয়, আমার স্ত্রী, আমার ছেলে পিনাকী, শুভেন্দু চ্যাটার্জী, রঞ্জিত গুপ্ত এমনি অনেককে সঙ্গে নিয়ে গেছি। ১৯৬৯ সালে যখন যাত্রায় জয়েন করলাম তার আগেও সত্যেনদার বাড়িতে গিয়ে বললাম, ‘সত্যেনদা, যাত্রায় জয়েন করলাম।’

উনি বললেন, ‘কেন?’

আমি বললাম, ‘সিনেমার লোকেরা আমায় তাড়িয়ে দিয়েছে, তাই যাত্রায় জয়েন করলাম।’

উনি বললেন, ‘তাতে লজ্জার কী আছে! যাত্রাও তো বেশ ভালোই।’ সিনেমার অনেক আগে থেকেই যাত্রা আছে, তা জানিস তো?’

তখন সিনেমা লাইনে যে ডামাডোল চলছে সেটা সত্যেনদা আগে থেকেই জানতেন, তাই আমাকে স্তোকবাক্য দিলেন। এরপর একবার আমার ছোটছেলে পিনাকীকে নিয়ে গেলাম, ও তখন যাদবপুর থেকে ফিজিক্স-এ ফার্স্ট ক্লাসে এম এসসি পাশ করে বেকার হয়ে বসে আছে। আমার উদ্দেশ্য, যদি সত্যেনদাকে বলে কোনও জায়গায় চাকরি অথবা রিসার্চ-এর ব্যবস্থা করা যায়।

সত্যেনদা কথায় কথায় পিনাকীকে জিগ্যেস করেন, ‘তুমি কী পড়ছ?’

পিনাকী বিজ্ঞের মতো উত্তর দিল, ‘আমার পড়াশোনা শেষ হয়ে গেছে।’

এই কথা শুনে সত্যেনদা মুচকি হাসলেন, আমার তো লজ্জায় মাথা কাটা গেল। প্রফেসর সত্যেন বোসকে বলছে পড়াশোনা শেষ! আমি তো ধড়ফড় করে উঠে পিনাকীর হাত ধরে বললাম, ‘সত্যেনদা আমার আজ বিশেষ কাজ আছে, আজ উঠি। অন্য আরেক দিন আসব।’

এই বলে পিনাকীকে নিয়ে বেরিয়ে গেলাম।

আমি বেরিয়ে গাড়িতে উঠে পিনাকীকে ধমকালাম, ‘এরকম একটা স্টুপিডের মতো কথা বললি কী করে? সত্যেনদা এতবড় সায়েনটিস্ট, এখনও লেখাপড়া করে চলেছেন, আর তুই তাঁকে বললি এম এসসি পাশ করেই তোর পড়াশোনা শেষ?’

আমার কথা শুনে ও আবার বলল, ‘শেষ-ই তো, আমি তো আর পড়ব না।’

ও চিরকালই কম কথা বলে, বললেও বিজ্ঞের মতো করে বলার চেষ্টা করে। বাড়ি এসে অনেক ভাবলাম, পরদিন সকালে ভাবলাম পিনাকীকে বুঝিয়ে বলব যদি সত্যেনদা রিসার্চের ব্যবস্থা করেন তাহলে ও যেন রাজি হয়। পরদিন সকালে দেখলাম পিনাকী বিজ্ঞের মতোই আমাদের দোতলার পেছনের দিকে বারান্দায় পায়চারি করছে। আমিও ওর পেছন পেছন ঘুরতে ঘুরতে ওকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম। আমি সাধারণত পৃথিবীর কাউকে এরকম তেল দেবার চেষ্টা করি না। কিন্তু নিজের ছেলের ভবিষ্যৎ তো, তাই আউট অফ দ্য ওয়ে ওকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম।

ও দেখলাম কোনওরকম বিশেষ পাত্তা না দিয়ে একটা প্যাসিভ অ্যাটিটিউড নিয়ে কেবল পায়চারি করে চলেছে আর মাঝে মাঝে হুঁ, হাঁ করে উত্তর দিয়ে চলেছে। ওর পেছনে খানিকক্ষণ ঘোরার পর মনে হল বৃথাই চেষ্টা করছি। ওকে বোঝানোর চেষ্টা ছেড়েই দিলাম। পরে অবশ্য ওকে ভাগ্যের ফেরে সেই রিসার্চ-ই করতে হল ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস থেকে।

আমাদের একটা প্রবাদ আছে, ‘সেই গাধা সেই জল খায়, তবু খানিকক্ষণ আউলাইয়া লয়।’

আমি অনেকবার নীলিমাকে নিয়েও সত্যেনদার ২২, ঈশ্বর মিল লেনের বাড়িতে গেছি। সে সত্যেনদার জন্মদিনেই হোক কি এমনি দিনেই হোক। এরকম একদিন নীলিমাকে নিয়ে গিয়ে দেখি সত্যেনদা বেহালা বাজাচ্ছেন। আমরা চুপ করে পাশে গিয়ে বসলাম। খানিকক্ষণ পরে আমাদের দিকে চোখ পড়লে সত্যেনদা বাজনা বন্ধ করে বললেন, ‘তোরা কতক্ষণ এসেছিস?’

নীলিমা বলে, ‘এই তো দু-মিনিট, বাজনা বন্ধ করলেন কেন সত্যেনদা, বাজান।’

সত্যেনদা বলেন, ‘না, অনেকক্ষণ বাজিয়েছি, তুই এবার একটা গান শোনা তো নীলিমা।’ বলে নিজের স্ত্রী, উষা বউদিকে ডাকলেন—’কই গো শুনবে এসো, কত বড় গাইয়ে এসেছে।’—এই বলে নীলিমাকে বললেন, ‘একটা কেত্তন গান শোনা।’

নীলিমার গান যখন শেষ হল তখন দেখি সত্যেনদা চুপ করে আমার দিকে চেয়ে চেয়ে হাসছেন। আমি বললাম, ‘কি সত্যেনদা, কিছু বলবেন?’

সত্যেনদা বলেন, ‘না, ভাবছি।’

আমি বলি, ‘কী ভাবছেন?’

সত্যেনদা বলেন, ‘না, ভাবছি তোকে বিয়ে করে নীলিমা লাভবান হয়েছে না নীলিমাকে বিয়ে করে তুই বেশি লাভবান হয়েছিস?’

আমি একবার সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বসুশ্রীতে বসে আছি, সুব্রত তখন বেঙ্গলের কালচারাল মিনিস্টার। সেবার খুব বড় করে যাত্রা সম্মেলন হবে, আমায় জিগ্যেস করে, ‘একজন খুব নামকরা গুণী ব্যক্তিকে দিয়ে উদ্বোধন করাতে হবে—কাকে দিয়ে করানো যায়?’

আমি বলি, ‘এই মুহূর্তে আমি যাঁকে যোগ্যতম ব্যক্তি বলে মনে করি তিনি হচ্ছেন প্রফেসর সত্যেন বোস। কারণ একে তো তিনি সত্যেন বোস তার ওপর উনি বেহালা বাজান, গান-বাজনা বোঝেন, আবার যাত্রা-থিয়েটার দেখতে ভালোবাসেন। সুতরাং যেহেতু ভালো বোঝেন, তাই বক্তৃতাটা প্রাসঙ্গিক এবং ভালোই দেবেন। আমাদের দেশের বেশিরভাগ গুণী ব্যক্তি যাঁরা গান, বাজনা বা যাত্রা-থিয়েটার বিশেষ বোঝেন না তাঁদের দিয়ে বক্তৃতা করানো হয়, তারা বেশিরভাগই হাবিজাবি অপ্রাসঙ্গিক কথা বলেন, সত্যেনদার ক্ষেত্রে সেটা হবে না।’

সুব্রত তো ওর ডিপার্টমেন্টের একজন সেক্রেটারিকে পাঠাল। সে ফিরে এসে বলে, ‘সত্যেন বোস রাজি হলেন না, বললেন, ভানুকে দিয়ে ওপেন করাও, ও খুব গুণী। আমার ছাত্র ছিল, আমি ওকে খুব ভালো জানি।’

তখন ওই সেক্রেটারি বলেন, ‘কিন্তু ভানুবাবু তো নিজেই এই যাত্রা সম্মেলনের সভ্য, ওকে দিয়ে কী করে করানো যাবে?’

তখন সত্যেনদা তাকে রসগোল্লা খেতে দিয়ে বলেন, ‘উপযুক্ত গুণী সভ্য লোককে দিয়ে না করিয়ে আমার মতো একজন অ-সভ্য লোক দিয়ে এরকম একটা মহৎ কাজ করাতে চাও? আমি যেতে পারব না। তুমি আমার কাছে যা খেলে শুধু গোল্লা, ভানুর কাছে রসটা পাবে।’ এই বলে ওকে ভাগিয়ে দিলেন।

এইসব মহাপুরুষের ভালোবাসা আশীর্বাদ পেয়েছি, তাই জীবনে সবরকম ক্রাইসিসের সময় এঁদের কথা চিন্তা করে ভয়, ভাবনা, উদ্বেগ, আশঙ্কা সব ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছি।

আমার মনে হয় আমিই ওঁর একমাত্র ছাত্র, যে ওঁকে ‘সত্যেনদা’ বলে ডাকার অনুমতি পেয়েছিলাম। সম্ভবত সত্যেনদার জীবনের শেষ দশ-পনেরো বছরের জন্মদিনগুলোর প্রায় সবক’টাতেই আমি উপস্থিত ছিলাম। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে আমার যে কমিক, স্কেচগুলো শুনেছেন, জীবনের শেষের দিকের জন্মদিনগুলোতেও আমাকে সেই কমিকগুলো করতে বলতেন। ওঁর জন্মদিন আমি কখনও ভুলতাম না যে কারণে, পয়লা জানুয়ারি আমার মায়েরও জন্মদিন। এই প্রসঙ্গে বলি, আমাদের সময়ে এখনকার মতো ঘটা করে জন্মদিনের রেওয়াজ ছিল না, বিখ্যাত মানুষদেরও না; একমাত্র ব্যতিক্রম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

আমার কাছে সত্যেনদা ছিলেন ভারতবর্ষের সবচেয়ে জ্ঞানীপুরুষ। তাই একদিন নিজের খেয়ালেই ১৯৪১ সালের পয়লা জানুয়ারি সত্যেনদার ঢাকার রমনার বাসায় ফুল, মালা, মিষ্টি নিয়ে গিয়ে ওঁকে প্রণাম করলাম। উনি তো অবাক, কারণ সেভাবে হয়তো জন্মদিন পালন করেন না। আমার দেখাদেখি আরও চল্লিশ-পঞ্চাশজন ছাত্র গিয়ে অনুষ্ঠান করে তাঁর জন্মদিন পালন করল।

আমার ছেলেবেলার নাটকে অভিনীত চরিত্রগুলো আমার খুব পছন্দের থাকত না। কিন্তু রোগা-পটকা চেহারা ও মিহি কণ্ঠস্বরের জন্য নাটকের পরিচালকরা যে চরিত্রের জন্য আমাকে নির্বাচিত করতেন, সেগুলোই আমাকে করতে হত। ‘শাজাহান’-এ জাহানারা, ‘পথের শেষে’ নাটকে সুখদা, ‘মেবার পতন’-এ মানসী, ‘সরলা’ নাটকে সরলা, এছাড়াও কুন্তী, সীতা প্রভৃতি চরিত্রগুলোয় অভিনয় করতে হত।

অবশ্য আমি অভিনয় করতে আসি এক প্রতিজ্ঞা থেকে। তখন আমি খুব ছোট, পাড়াতে স্টেজ বেঁধে অভিনয় হচ্ছে। আমার খুব আগ্রহ মহড়া দেখার। স্টেজটা মাথা সমান উঁচু। স্টেজের পাটাতনটা ধরে দেখছি, হঠাৎ একজন অভিনেতা ধাই করে আমার মাথায় এক লাথি কষিয়ে দিল। লাথিটা হজম করতে পারিনি। তখনই পণ করলাম, আমাকে স্টেজে নামতে হবে।

এর কিছুদিন পরে পাড়াতে ‘রণবীর’ নাটকের মহড়া চলছে, খগেন চক্রবর্তী ও আমোদ দাশগুপ্তের তত্বাবধানে। সেখানে আমি উৎসাহী শ্রোতা। উদয় সিংহের ভূমিকায় যাকে নেওয়া হয়েছিল তার অভিনয় পরিচালকের পছন্দ হচ্ছিল না। একদিন আমাকে উদয় সিংহের সংলাপ বলতে বলা হল। আমার অভিনয় দেখে পরিচালক আমাকেই পছন্দ করলেন। সুতরাং আমার জীবনের প্রথম অভিনয়ে আমি পুরুষের চরিত্রেই রূপদান করেছিলাম।

সিরিয়াস অভিনয় থেকে কৌতুক অভিনয়ে আমাকে উৎসাহ জুগিয়েছিলেন ঢাকার শ্রী রমণী ঘোষাল। এর নেপথ্যে একটা হাসির ঘটনা আছে। ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটকে আমাকে ‘বাচাল’-এর ভূমিকা দেওয়া হয়েছে। নন্দর চরিত্রে অভিনয় করছে শঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। তার সঙ্গে একটা সিনে ঢোকার আগে আমার পোশাকে আরশোলা ঢুকে যায়, আরশোলা বের করে স্টেজে ঢুকতে আমার দেরি হয়ে যায়। কিন্তু নন্দবেশী শঙ্কর চুপ করে না থেকে বানিয়ে বানিয়ে সংলাপ বলতে থাকে—’এ গৃহ অন্ধকার!’

আমি প্রায় সঙ্গে সঙ্গে স্টেজে ঢুকে বানিয়ে বানিয়ে বলি—’হোক অন্ধকার! আরশোলার হাত থেকে তো বেঁচেছি।’

তা দেখে উইংসের পাশে দাড়ানো রমণীদার খুব ভালো লাগে। উনিই আমাকে কমিক রোল করতে উৎসাহিত করেন।

আমার আত্মীয় এবং বন্ধুরা বলত অনেক ছোটবেলা থেকেই নাকি আমার ‘রেডি উইট’ ছিল। অনেক ছোটবেলায় একবার ঢাকায় এক রাজনৈতিক সভায় আমার যাবার ইচ্ছা থাকলেও বাবার বারণ ছিল ওই সভায় যাবার। তা সত্বেও আমি যাই। সভা শেষে যখন বাড়ি ফিরি তখন বাবা আমায় বলেন, ‘তোকে না আমি ওই মিটিংয়ে যেতে নিষেধ করেছিলাম।’

আমি না-থেমে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বলি, ‘কেউ যদি না-ই যায়, তবে ওরা সভা ডাকে কেন?’ আমি অত ছোটবেলায় এরকম উত্তর দেওয়াতে বাবা চুপ করে গেছিলেন। আর আমার দাদা, দিদিরা মুখ টিপে হেসেছিলেন।

আমি চিরকালই অবাধ্য ছিলাম এবং ফটফট করে বড়দের মুখের ওপর কথা বলতাম। আমাদের ঢাকার বাড়িতে যখন প্রথম ইলেকট্রিকের আলো এল তখন বাবা বললেন, ‘এখন কেউ আলো জ্বালাবে না, মণি (আমার দাদা) এসে আলো জ্বেলে উদ্বোধন করবে।’

কিন্তু আমার আর তর সয় না। কিছুক্ষণ বাদে আমি ফট করে সুইচ অন করে আলো জ্বেলে দিলাম। বাবা একটু ক্ষুণ্ণ হলেন কিন্তু কিছু বললেন না।

বাবা ভীষণ শান্ত স্বভাবের আর সৌম্যদর্শন ছিলেন। রোগা, ফর্সা আর সবচেয়ে আশ্চর্য ছিল বাবার দুটো চোখ—একটা চোখ ছিল হালকা নীল রঙের, আর আরেকটা চোখ ছিল চকোলেট রঙের। একবার আমরা নৌকা করে আমাদের দেশ পাঁচগাও থেকে ঢাকায় আসছিলাম, ঠাকুরদাদা মারা যাওয়াতে বাবার ন্যাড়ামাথা ছিল, তাঁকে দেখিয়ে মাঝিরা বলেছিল, ‘ওই দ্যাখ, গান্ধিমহারাজ যায়।’

আমার ছোটবেলায় ভয়-ডর বলতে কিছু ছিল না। যা একটু ভয় পেতাম মাকে আর আমার দাদাকে। একবার একটা আয়নার কাচ ভেঙে ফেলে সেটা কুয়োয় ফেলে দিই। দাদা সেটা দেখে আমায় ডেকে বলে, ‘এই যে তুই কাচটা কুয়োয় ফেললি, কুয়ো পরিষ্কার করার জন্য লোকটা নামবে, ভাঙা কাচের টুকরোয় তার পা কেটে গেলে সে মরে যাবে। আর সে মরে গেলে তোর ফাঁসি হবে।’

আমি তো ভয়ে আধমরা। তখন আমার পাঁচ-ছয় বছর বয়স, নিজেই নিজের গলা টিপে দেখছি কীরকম লাগে। শেষে সন্ধেবেলায় মা এসে আস্বস্ত করলেন যে, আমার ফাঁসি হবে না। ছেলেবেলাটা আমার বেশ রসে বসেই কেটেছে। আমরা যদিও ভাড়া বাড়িতে থাকতাম, প্রথমে দক্ষিণ মৈসন্তিতে। তারপরে রাজার দেউরী। কিন্তু বাবা-মা দুজনেই ভালো চাকরি করাতে কোনও কিছুর অভাব ছিল না। আমি, আমার দিদি ও ছোটবোনের দেখাশোনা করার জন্য আমার মেজো খুড়িমা আমাদের বাড়িতে থাকতেন। রান্না করার জন্য বিহারের ছেদি ঠাকুর ছিল। বাড়ির আর সব কাজ করার জন্য পালজি ও মরিয়মের মা ছিল।

মা সকাল দশটার সময় বেরিয়ে যেতেন আর ফিরতেন বিকেল পাঁচটায়। আমিও জুনিয়র স্কুল থেকে ফিরে বারোটায় খেয়ে বেরিয়ে যেতাম। সারাদিন বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে খেলতাম, অবসর সময়ে বদমায়েশি করতাম, অর্থাৎ অন্যের বাগানের আম-কাঁঠাল-পেয়ারার সদগতি করতাম।

আমার দিদি প্রকৃতি, লীলা রায়ের স্বদেশি দল ‘জয়শ্রী পার্টি’র সদস্য ছিল। ওখানেই আমার দীনেশ (গুপ্ত)দার সঙ্গে চেনাজানা হয়। দিদিকে দেখে আমিও উদ্বুদ্ধ হই। মাঝে মাঝেই দীনেশদার সঙ্গে সাইকেল চড়ে বেরিয়ে যেতাম নানান জায়গায়। আমায় দীনেশদা ছোটখাটো কাজ দিতেন অর্থাৎ কোথায় কোন পুলিশ যাচ্ছে, সদরঘাটে কোন পুলিশ অফিসার এল, তারপর টাঙায় চড়ে কোথায় গেল—এসব খবর ওঁকে দেওয়া ইত্যাদি। এই সূত্রে আমার ঢাকার সদরঘাটে রোজ যাতায়াত ছিল। ঢাকাইয়া গাড়োয়ানদের সঙ্গে বসে কুট্টি ভাষা রপ্ত করি ওই সময়ে। এমনও হয়েছে হয়তো কোনও পুলিশ এসে ঘোড়ার গাড়ি চড়ে তার গন্তব্য জায়গায় যাবে। আমিও গাড়োয়ানের পাশে বসে তাকে পৌঁছে দিলাম। পরে দীনেশদাকে এসে সেটা বলা আমার কাজ।

পুরস্কার মিলত লজেন্স, বিস্কুট ও সিনেমা যাওয়া, দীনেশদার সঙ্গে। আমি যা বুঝতাম না, দীনেশদা তা পরম যত্নে বুঝিয়ে দিতেন। লন চ্যানির ‘হ্যাঞ্চব্যাক ওফ নতরদাম’, চ্যাপলিনের ‘গোল্ডরাশ’, ফ্যায়ারব্যাস্কসের ‘থিফ অফ বাগদাদ’, রুডলাফ ভ্যালেন্টিনোর ‘সান অফ শেখ’। এছাড়া বাস্টার কিটন, হ্যারি ল্যাংডন, হ্যারল্ড লয়েড, লরেল হার্ডির প্রচুর ছবি, কমেডির প্রতি আমায় আকৃষ্ট করে।

সদরঘাটে থাকতে কয়েকটা মজার ঘটনা আমার মনে আছে। একবার এক সাহেব আমাদের টাঙায় উঠল। আমি তাঁর নাম জিজ্ঞাসা করাতে তিনি বললেন যে তিনি ইংল্যান্ড নয়, জার্মানি থেকে এসেছেন। তাঁর নাম ‘হের ভন পেপেনবার্গ’। আমি মহানন্দে দীনেশদাকে এই খবর দিলাম। পরের দিন দীনেশদা বললেন, ‘তুই বোকা বনেছিস, হের ভন পেপেনবার্গ কোনও নাম নয়, এর মানে হচ্ছে ‘ম্যান ফ্রম পেপেনবার্গ’ অর্থাৎ পেপেনবার্গের ভদ্রলোক। এই দীনেশদার কাছেই অনুশীলন পার্টির ত্রৈলোক্য মহারাজ, রাধাবল্লভ গোপ প্রভৃতির কথা, এর পরে মাস্টারদা, অনন্ত সিং, লোকনাথ বল প্রভৃতির গল্প বলে আমার মনে দেশভক্তির উদ্রেক করেন।

ছোটবেলাতেই দীনেশদার কাছে অনেক কিছু শিখেছি। স্বামী বিবেকানন্দর অনুজ ডা. ভূপেন দত্তের মুখেই গল্পটা শুনেছি—’পাঞ্জাবে একটা মিটিং-এ যাওয়ার সময় দীনেশদার সাইকেলের চাকা ফেটে যায়। কিন্তু মিটিং-এ ঠিক সময়ে পৌঁছোবার জন্য দীনেশদা ওই সাইকেল কাঁধে নিয়ে চার মাইল রাস্তা দৌড়ে গন্তব্যস্থলে যান।

বিনয়দার একটা ঘটনা আমাকে খুবই উদ্বুদ্ধ করেছিল। ঢাকা মিডফোর্ড হসপিটাল, বিরাট পাঁচিল দিয়ে ঘেরা, পাশ দিয়ে বুড়িগঙ্গা। তখনকার সাহেব হাসপাতাল পরিদর্শনে এসেছে। হঠাৎ গুলি করে বিনয়দা বেরিয়ে এলেন, প্রফুল্ল নামে এক বাঙালি ইনফরমার তাকে জাপটে ধরতে গেল, বিনয়দা এক ঘুষি মেরে তার কয়েকটা দাঁত ভেঙে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলেন। পকেটে রিভলভার থাকা সত্বেও ব্যবহার করলেন না। সবচেয়ে যে ব্যাপারটা আমায় উদ্বুদ্ধ করেছিল তা হল, একজন সাহেবকে গুলি করে কীরকম ঠান্ডা মাথায় আস্তে আস্তে হাঁটতে হাঁটতে সে-স্থান পরিত্যাগ করলেন!

দীনেশদার সঙ্গে ঘুরতাম বলে ঢাকা শহরে আমার চেয়ে অনেক শক্তিশালী বন্ধুবান্ধবরা আমাকে সমীহ করে চলত। মনে আছে, আমাদের অঞ্চলের কুখ্যাত গুন্ডা ভোলা মিঞা অসামাজিক কাজ করার জন্য দীনেশদার হাতে প্রচণ্ড মার খেয়েছিল। অথচ এই ভোলা মিঞা, দীনেশদার ফাঁসির পরের দিন বুক চাপড়ে কী কান্নাটাই না কেঁদেছিল! দিনটা এখনও মনে আছে, ১৯৩০ সালের ৭ জুলাই দীনেশদার ফাঁসি হয়েছিল।

এই দীনেশদার হয়ে খুদে গোয়েন্দাগিরি করার সুবাদে আমার কয়েকটা লাভ হয়েছিল, ঢাকার গরুর গাড়ির গাড়োয়ানদের থেকে কুট্টি ভাষা এবং কুট্টি জোকস রপ্ত করা। এই অশিক্ষিত কুট্টিদের কী সাংঘাতিক ‘সেন্স অফ হিউমার’ ছিল কল্পনা করা যায় না, এদের তাৎক্ষণিক উইটও কল্পনাতীত। আমার কমেডিয়ান হয়ে ওঠার পিছনে এদের প্রচুর অবদান ছিল। এদের কাছে শোনা জোকসগুলো আমি বাড়িতে, পাড়ায়, স্কুলে বলতাম। সবাই খুব হাসত, বড়রা বলত, ‘ভানু খুব সুন্দর ফাজলামি করে।’

পাড়ায় কোনও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হলে আমার যোগদান অবশ্যম্ভাবী ছিল। আমি অবশ্য কবিতা আবৃত্তি করার জন্য মঞ্চে উঠতাম। দু-একটা কবিতা বলার পরই বড়রা বলতেন, ‘ভানু অনেক হইছে, এইবার কুট্টিগো রগড়ের কথা কও।’ এরপর প্রায় সব অনুষ্ঠানেই আমাকে ডাকা হত।

মা ঢাকার নবাব পরিবারের মেয়েদের প্রাইভেট টিউটর হওয়াতে ‘মাস্টার-দিদিমণির পোলা’ হিসাবে কুট্টিদের কাছে আমার বেশ একটা মানসম্ভ্রম ছিল সেই ছোট বয়সেই। মনে আছে, তখন আমার আট-নয় বছর বয়স, আমার একটা জোকস শুনে বাড়ির বড়রা খুব হেসেছিলেন। এটা একটা সত্যি ঘটনা। এক টাঙাওয়ালার সঙ্গে আমি সদর ঘাটে বসে, একজন লোক (ঢাকার বাইরের, ঢাকাতে বেড়াতে এসেছে) টাঙাওয়ালাকে জিগ্যেস করল, ‘এই নদীর নাম কী?’

টাঙাওয়ালা বলল, ‘বুড়িগঙ্গা।’

লোকটা জিগ্যেস করল, ‘বুড়িগঙ্গা ক্যান?’

টাঙাওয়ালা উত্তর দিল, ‘গোমুখ থিইক্যা আইতে আইতে বুড়াইয়া গ্যাসে, হের লিগা এর নাম বুড়িগঙ্গা।’

এইরকম ঢাকাইয়া কুট্টিদের অনেক জোকস আমি ছোটবেলার থেকেই কমিক স্কেচ করতাম।

১) এক ভদ্রলোক সদরঘাটে নেমে এক জায়গায় যেতে চায়, যেটা বেশি দূর নয়। টাঙাওয়ালা বলে, ‘আটআনা লাগবো।’ ভদ্রলোক বলে, ‘অ্যাতো কেন, আমি যেখানে যাব সেটা তো ওই দেখাই যায়।’ টাঙাওয়ালা বলে, ‘আকাশে চাঁদ, তারাও দেখা যায়, তাহলে ওইখানে যাইতে কত ভাড়া হওয়া উচিৎ?’

২) এক ভদ্রলোক তার স্ত্রীকে নিয়ে ঘোড়ার গাড়ির কাছে দরদাম করছেন, ঘোড়াটা বার বার পেছনের দিকে তাকাচ্ছে কিন্তু নড়ছে না। ভদ্রলোক ও তাঁর স্ত্রী গাড়িতে উঠলেন, কোচোয়ান যতই হাট হাট চুক চুক করে, ঘোড়া মাথা ঘুরিয়ে পিছনে তাকায়, কিন্তু চলে না। কোচোয়ান শেষে বিরক্ত হয়ে ঘোড়াকে বলে, ‘তোমার কান লড়ে, ঘাড় লড়ে কিন্তু পা তো লড়ে না।’ ভদ্রলোক বলেন, ‘কী কোচোয়ান, তোমার ঘোড়ায় তো লড়ে না দেখি।’ কোচোয়ান মুখ ফিরিয়ে বলে, ‘লড়ব কী বাবু, আপনের বিবি যা মেকাপ দিসে, ঘাড় ঘুরাইয়া কেবল হেইটাই দেখে খাড়াইয়া খাড়াইয়া।’

৩) সদরঘাটে নেমে এক ভদ্রলোক টাঙাওয়ালাকে জিগ্যেস করেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যাইবা? কত নিবা?’ টাঙাওয়ালা বলে—’অনেক দূর বাবু, এক টাকা চাইর আনা লাগব।’ ভদ্রলোক গাড়িতে উঠে পড়েন। টাঙাওয়ালা বহুক্ষণ গাড়ি নিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরছে দেখে ভদ্রলোক জিগ্যেস করেন, ‘আর কত দূর মিঞা? আমার তো মনে হয় তুমি একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছ, তুমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চেনো তো?’ টাঙাওয়ালা বলে, ‘আরে এইখানেই আছিলো, খাড়ান, ওই বাবুরে জিগাইয়া লই।’ এই বলে গাড়ি থামিয়ে জিগ্যেস করে এবং হন্তদন্ত হয়ে ফিরে সওয়ারিকে বলে, ‘আরে হালার বাবু আগে কইবেন তো ইউনিভারসিটি যাইবেন। তখন থিক্যা কীয়ের হালা বিষবিদ্যালয় হাবিজাবি কন, আপনারে আধ ঘণ্টা আগেই চাইর আনা ভাড়ায় পৌঁছাইয়া দিতাম। লেখাপড়া না শিইখ্যা ঢাকা শহরে আহেন ক্যান?’

৪) এক ভদ্রলোক সদরঘাটে নেমে টাঙাওয়ালাকে বলেন, ‘আমি ঢাকা শহরটা ঘুইর‌্যা বেড়াইমু তারপর থিয়েটার দেখতে যামু, কত নিবা?’ টাঙাওয়ালা বলে, ‘প্রথম ঘণ্টা বারো আনা, তারপরের হগল ঘণ্টা আষ্ট আনা।’ ভদ্রলোক বলেন, ‘অ্যাতো ক্যান, না না আমি বারো আনাই দিমু।’ টাঙাওয়ালা বলে, ‘আরে আস্তে কন বাবু, ঘোড়ায় হাসবো।’ ভদ্রলোক বলেন, ‘তোমার তো রোগা হাড় জিরজিরে ঘোড়া, টানতে পারব?’ টাঙাওয়ালা বলে, ‘কন কী হালার বাবু, এই হালা পোংখিরাজ, হেইদিন হালা পাঙ্খা কাটছি, এখনো হালার ঘা শুকায় নাই।’

৫) একজন কুট্টি এক শ্রাদ্ধবাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে গেছে, খানিকক্ষণ পর একজনকে জিজ্ঞাসা করে, ‘যার ছেরাদ্দ তারে তো কোই দেখি না।’ ভদ্রলোক বলেন, ‘তিনি মরিসেন।’ কুট্টি—’আ হা: হা:, মরলেন কী কইরা?’ ভদ্রলোক বলেন, ‘সর্পাঘাতে।’ কুট্টি—’তা সাপটা কোনহানে কামরাইসিল?’ ভদ্রলোক—’কপালে।’ কুট্টি—’যাক, চক্ষু দুটি বাঁইচ্যা গেসে।’

৬) এক গোরা সাহেব মদ খেয়ে রাস্তায় খুব মাতলামি করছে, মেয়েদের হাত ধরে টানছে; এই দেখে দশ-বারোজন টাঙাওয়ালা সাহেবকে বেধরক মারতে থাকে। খানিকক্ষণ মার খেয়ে মাতাল সাহেব দু-হাত তুলে বলে, ‘দ্যাটস এনাফ, এনাফ।’ এক টাঙাওয়ালা বলে,—’একলা খাইতে কুলায় না, আবার হালার এনাইফ্যারে ডাকস।’

৭) জনৈক ভদ্রলোক বাজারে ঘুরছেন, এক টুপির দোকানে একটা টুপি দেখে পছন্দ হয়ে যায়। টুপিওয়ালাকে জিগ্যেস করেন, ‘এই টুপিটা কত দাম?’ টুপিওয়ালা বলে, ‘আট আনা।’ ভদ্রলোক বলেন, ‘সেকী অ্যাতো দাম! একটা শোলার টুপি তার দাম সাহেবগো হ্যাটের মতো? না না, আমি দুই আনা দিমু।’ পাশের জায়গায় একজন লোক মাটির হাঁড়ি, গ্লাস, বালতি বিক্রি করছিল, তার দিকে দেখিয়ে টুপিওয়ালা বলে, ‘তার থিক্যা ওই পয়সায় একটা মালসা কিইন্যা লন, মাথায় দেওন যাইবো, চিড়াও খাওন যাইবো।’

৮) ঘোড়ার গাড়ির গাড়োয়ান এক ভদ্রলোককে বাজারে নিয়ে গেছে। ভদ্রলোক এদিক-ওদিক চেয়ে কিছু খুঁজে বেড়াচ্ছেন। কোচোয়ান জিগ্যেস করে, ‘কী খোঁজেন বাবু?’ ভদ্রলোক বলেন, ‘আলপাকার জামা খুঁজছি?’ ভদ্রলোক খুব কালো, তার দিকে তাকিয়ে কোচোয়ান বলে, ‘আপনে হালার বাবু আলপাকা (কালো সিল্কের মতো জামা) খোঁজেন, আপনের গতর ভর্তি আলপাকা, বুকে চাইরটা বুতাম লটকাইয়া লন।’

৯) জুতোর দোকানে একটা জুতো দেখে পছন্দ হয়েছে এক ভদ্রলোকের। দোকানের লোককে জিগ্যেস করেন, ‘জুতোর দাম কত?’ দোকানি বলে, ‘পাঁচ টাকা।’ ভদ্রলোক বলেন, ‘না না, অত দিমুনা, তুমি দুই টাকায় দাও।’ দোকানি বলে, ‘দুই টাকা দিবেন? আচ্ছা; তাহলে কত্তা আপনার বগলের মাপটা দ্যান দেখি।’ ভদ্রলোক বলেন, ‘ক্যান, বগলের মাপ ক্যান?’ দোকানি —’দুই টাকার জুতা পায়ে দেওন যায় না, বগলে রাখতে হয়।’

১০) সদরঘাটে নেমে এক ভদ্রলোক এক ঘোড়ার গাড়ি পেরিয়ে আরেকটা গাড়ির দিকে যান। সেই গাড়ির গাড়োয়ান—’ও কত্তা, আমার গাড়ি ছাইরা ওই দিকে কই যান, চিনবার পারেন নাই? তা চিনবেন কী কইর‌্যা, দুই পোচরা (coat) রং লাগাইছি, আবার লাবুটের (রবার) চাক্কা ভি লাগাইছি, দ্যাহেন না গাড়ি ক্যামন চকচকায়? আমার গাড়ি ছাইর‌্যা কত্তায় (আপনার বাবা) কখনও কারও গাড়ি চড়ে নাই, আর তার পোলা হইয়া অন্য গাড়িতে চড়েন?’ ভদ্রলোক—’আমার বাবা কবে তোমার গাড়িতে চড়সে?’ গাড়োয়ান—’এই তো এক মাস আগে আমার গাড়িতে চইরা রমনা গেল।’ ভদ্রলোক—’আরে কী সব হাবিজাবি কও, আমার বাবা দুই বছর আগে মারা গ্যাসে।’ গাড়োয়ান—’কন কী হালার বাবু, তাইলে কত্তা কি আমায় দেখা (প্রেতাত্মা) দিয়া গেল নাকি?’

.

প্রথম ১৯৪৩ সালে আমার কমিক স্কেচের রেকর্ড বেরিয়েছিল, তার নাম ছিল ‘ঢাকার গাড়োয়ান’। এই রেকর্ডের জোকসগুলো আমি সদরঘাটে ঘোরাঘুরির সময়েই সংগ্রহ করেছিলাম। এই মূল স্কেচটা প্রায় পঁচিশ-ত্রিশটা জোকস সহকারে যখন পাবলিক ফাংশানে, জলসায় ক্যারিকেচার করতাম, তখন এটা প্রায় পনেরো-কুড়ি মিনিটের স্কেচ হত, ঢাকা শহরের নানান জায়গায় ১৯৩৫ সাল থেকে ৪১ সাল অবধি নানান অনুষ্ঠানে পরিবেশন করতাম। এটা সেইসময় খুবই জনপ্রিয় ছিল, কিন্তু রেকর্ডের জন্য কেঁটে ছেঁটে ৬ মিনিটে শেষ করতে হয়েছিল, যাতে অনেক কিছুই বাদ পড়েছিল।

এছাড়া এই স্কেচটা এপার বাংলায় আমি প্রথম প্রথম যখন পরিবেশন করতাম তখন প্রধান অসুবিধা ছিল, এপার বাংলার লোকেরা একেবারেই ঢাকাইয়া কুট্টিদের ভাষা বুঝত না, সেই জন্য উপভোগ করতে পারত না। তাই এই স্কেচটা আমি কখনও পরবর্তী জীবনে আর ফাংশানে পরিবেশন করতাম না। যাই হোক, আমার কৈশোরের উপাস্য দীনেশদা সম্বন্ধে যা বলছিলাম, ছোটবেলায় আট-নয় বছর বয়স থেকেই দীনেশদার সান্নিধ্যে থাকতাম। ভয় ডর বলে কিছুই ছিল না। এছাড়া ওঁর প্রভাবে প্রবলভাবে দেশভক্তিতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম।

দীনেশদা, যিনি হাসতে হাসতে জীবনের ফুটন্ত বেলায় ফাঁসির দড়ি গলায় পড়েছিলেন, মৃত্যুভয়কে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছিলেন।

দীনেশদা, বিনয়দার কথা ভাবতে ভাবতেই আমার বহু দিনের ব্যাধি মৃত্যুভয়কে জয় করেছিলাম। আমি বিনয়, বাদল, দীনেশের বাদল (সুধীর গুপ্ত)কে কোনওদিন চিনতাম না, শুনেছি তিনি পাটনায় থাকতেন, কিন্তু বিনয়দা, দীনেশদা আমার সারা জীবনের আদর্শ ছিলেন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস এঁরা যদি বিদেশে জন্মাতেন তবে এদের জীবনী নিয়ে পাঠ্যপুস্তক রচিত হত।

৮ ডিসেম্বর, ১৯৬৮-তে বিনয়-বাদল-দীনেশ-এর ছবি মহাকরণের বারান্দায় টাঙিয়ে তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হচ্ছিল। সেদিন আমার বাল্যবন্ধু মাখনজয় ও লেখক শৈলেশ দে-র সঙ্গে বসে আধুনিক নেতার বক্তৃতা শুনছিলাম। নেতাটি নানারকম তথ্য দিচ্ছিলেন, একবার বললেন, ‘ফাঁসির আগে দীনেশের ওজন বেড়ে গিয়েছিল।’ এত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল নাকি তার সঙ্গে দীনেশদার! অথচ একবারও বললেন না, জেল থেকে লেখা দীনেশদার চিঠিগুলো একসঙ্গে প্রকাশ করা উচিৎ। এগুলোর মাধ্যমে উত্তরসূরিরা জানতে পারত কী জাতের দামাল ছেলেরা সেইসময় বাংলায় জন্মেছিল।

দীনেশদা মারা যাবার পর বছরখানেক চুপচাপ পড়াশুনায় মন দেবার চেষ্টা করেছিলাম। তখন আমার গোয়ালনগরের পাড়ার ও সেইন্ট গ্রেগরি স্কুলের বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা, খেলাধুলা, নাটক প্রভৃতি নিয়ে ব্যস্ত থাকতে চেষ্টা করতাম। কিন্তু কিছুদিন পরেই আবার রাজনীতি করবার জন্য মন খুঁত খুঁত করত।

ছোটবেলার ট্রেনিং তো, রাজনীতির থেকে আলাদা থাকতে পারতাম না। ১৯৩৫ সাল, তখন আমার বয়স পনেরোতে পড়েনি, ঢাকার বিধানসভা নির্বাচন নিয়ে হইচই। কংগ্রেসের টিকিটে দাঁড়িয়েছিলেন হেমপ্রভা মজুমদার। ইনি পরিচালক সুশীল মজুমদারের মা। কংগ্রেস তখন ছিল একটা রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম। সেখানে বিভিন্ন দল একসঙ্গে যুক্ত ছিল। যেমন আমি ছিলাম অনুশীলন দলের কর্মী, সম্ভবত সর্বকনিষ্ঠ কর্মী। হেমপ্রভাদির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন ঢাকা কামরুন্নেসা কলেজের অধ্যক্ষা সুজাতা রায়। হেমপ্রভা মজুমদার সেবার জিতেছিলেন। তখন আমার খুবই ক্ষমতা, শাঁখারি বাজারের লোকদের নিয়ে আমি ‘বিজয় মিছিল’ করেছিলাম। এরকমভাবেই রাজনীতি, লেখাপড়া, অভিনয় একসঙ্গে চলছিল।

এর পর আমার মা, বাবা দুজনেই চাকরির থেকে অবসর গ্রহণ করলেন। সংসারের হাল ধরলেন আমার দাদা অজিত ব্যানার্জী, যাকে আমি ‘দাদু’ বলতাম। তিনি পুলিশে চাকরি পেলেন, বাবা-মার বয়স হওয়াতে উনিই আমার অভিভাবক হলেন। এই সময়টা আমরা বাসা বদল করে ৮০ নং গোয়ালনগরে একটা বাসা নিলাম। বেশ ভালোই চলছিল। কিন্তু এরপরেই ১৯৩৮ সালে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডিটা ঘটে গেল। মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়সে ‘দাদু’ অর্থাৎ আমার দাদা মারা গেলেন।

আমার জীবনটা ওলট পালট হয়ে গেল। আমার ওপর সংসারের ভার এসে যাওয়াতে রাজনীতির থেকে সরে আসতে থাকলাম। এই সময়েই আমি ঢাকা রেডিয়োয় শিল্পী হিসাবে বিভিন্ন প্রাোগ্রামে অংশগ্রহণ করি। বিশেষ করে ”দুনিয়ার হাল” নামে একটি প্রাোগ্রামে আমি নিয়মিত অংশগ্রহণ করতে থাকি। এই সময় আমার সমসাময়িক যাঁরা ঢাকা রেডিয়োতে ছিলেন তাঁরা হলেন ইন্দু সাহা, রামকৃষ্ণ রায়চৌধুরী, বংশীবাদক অমর চৌধুরী। এঁরা সবাই পরবর্তীকালে কলকাতা রেডিয়োতে যোগদান করেন। তবে এঁরা সবাই আমার অনেক পরে কলকাতা রেডিয়োতে আসেন।

এছাড়া আমি মোহিতলাল মজুমদার, কবি জসিমুদ্দিনের কবিতা আবৃত্তি করতাম ঢাকা রেডিয়োয়। জসিমুদ্দিন ছিলেন আমার কলেজের মাস্টারমশাই। কলেজে আমার অ্যাটেনডেন্স যথেষ্ট ছিল না। একবার উনি বললেন, ‘তুমি যদি এরকমভাবে কলেজ কামাই করো, তা হলে কিন্তু পরীক্ষায় বসতে দেব না, আমি জানি তুমি প্রক্সি দেওয়াও।’

আমি বললাম, ‘স্যার, তাহলে আমিও আপনার কবিতা রেডিয়োতে কমুনা।’

একথা শুনে উনি হেসেছিলেন।

আরেকটা মজার ঘটনা হল মো: শহীদুল্লাও আমাদের মাস্টারমশাই ছিলেন। ওঁর চুল ঘাড় অবধি বেশ লম্বা ছিল, উনি দ্রুতগতিতে হাঁটতেন। যখন তিনি হাঁটতেন তখন ঝাঁকড়া চুলগুলোও বেশ ছন্দে ছন্দে লাফাত। এই দেখে আমি নাম দিয়েছিলাম ‘টাট্টু ঘোড়া’। আমার এই কথা শুনে আমার বন্ধুরা হাসত। উনি যখনই আমাদের পাশ দিয়ে যেতেন তখনও আমার বন্ধুরা হাসত। এরকম দু-চার দিন হওয়ার পর একদিন শহীদুল্লা স্যার আমায় ডেকে বললেন, ‘এই ছোকড়া, তুমি আমায় ভ্যাঙাও কেন?’

আমি তো ভয়ে চুপ করে গেলাম। উনি বললেন, ‘উত্তর দাও। নইলে তোমায় আমি ছাড়ব না।’

আমি বললাম, ‘না স্যার, আমি আপনাকে ভ্যাঙাই না।’

উনি বললেন, ‘ভ্যাঙাও না তো তোমার বন্ধুরা হাসে কেন?’

আমি বাধ্য হয়ে বললাম, ‘স্যার আপনি হাঁটার সময় আপনার ঝাঁকড়া চুলগুলো লাফায়। ওইজন্য আমি নাম দিয়েছি ‘টাট্টু ঘোড়া’।

এ-কথা শুনে হেসে বললেন, ‘তুমি কি সবসময়ই রসিকতা করো?’ উনি কলেজের ফাংশানে আমার কমিক স্কেচ আগেই দেখেছিলেন, সেজন্যই এটা বললেন।

আমার আর একজন শিক্ষক, যাঁর নাম করতে আমি গর্ব অনুভব করি, তিনি হলেন ইতিহাসের প্রফেসর ড: রমেশচন্দ্র মজুমদার। ঢাকা ছাড়ার পরও কলকাতায় ওঁর সঙ্গে বহুকাল যোগাযোগ ছিল। এছাড়াও আমার স্বনামধন্য শিক্ষকদের তালিকায় ছিলেন এইচ.এল. দে, পদ্মিনী রুদ্র ও নির্মল গুপ্ত। এই নির্মল গুপ্ত ছিলেন আমার বন্ধু সিদ্ধার্থ রায়ের আমলের পুলিশ কমিশনার রঞ্জিত গুপ্তের বাবা।

আমার মধ্যে যে একটা বোহেমিয়ান ভাব ছিল, সেটা আমার মধ্যে এসেছিল প্রথমে আমার মা-র কাছ থেকে। মা যখন তাঁর শ্বশুরবাড়ি বিক্রমপুর পাঁচগাওয়ে যেতেন তখন তিনি ঘোরতর পর্দানশীন, কিন্তু শ্বশুরবাড়ির থেকে যখন তিনি নিজের বাড়ি অর্থাৎ ঢাকা শহরে ফিরে আসতেন তখন তিনি বাঘিনী।

মায়ের দু-একটা ঘটনা উল্লেখ করছি, যা আমাকে খুবই উদ্বুদ্ধ করেছিল। আমার মা তখন নিয়মিত কাজের সূত্রে ফিটন গাড়ি করে বেরোতেন। তাঁর গাড়ির জানলা বন্ধ থাকলেও বহুদিন লক্ষ করতেন একজন পুলিশ রোজই তাঁর পাদানিতে চড়ে খানিকক্ষণ গিয়ে নেমে পড়ত। একদিন গাড়োয়ানকে মা বললেন, ‘তুমি এই পুলিশটাকে উঠতে দাও কেন?’

গাড়োয়ান বললে, ‘কী করব মেমসাহেব, ভয়ে কিছু বলতে পারি না, পুলিশ তো।’

এরপর আরেকদিন পুলিশটা একইরকমভাবে মায়ের ফিটন গাড়ির পাদানিতে ওঠে। মা জানলা খুলে বলেন, ‘তুমি রোজ আমার গাড়ির পাদানিতে ওঠো কেন?’

পুলিশটা বলে, ‘আপনি চুপ করে বসুন, আপনার কোনও অসুবিধে হবে না।’

মা দরজা খুলে চলন্ত গাড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে পুলিশকে রাস্তায় ফেলে দেন। তারপরে গাড়ি থামিয়ে নেমে ওই পুলিশটা যেখানে ভূপতিত সেখানে গিয়ে বলেন, ‘আর কোনওদিন যেন না দেখি।’

এ-কথা শুনে পুলিশটিও হতভম্ব। আশেপাশের লোকেরা যারা ঘটনাটি দেখছিল তারাও হতভম্ব।

এর আগে আমার মা-র একটি অসম সাহসী ঘটনা আমাকে আপ্লুত করে ও দেশপ্রেমী হতে উদ্ধুদ্ধ করে। ১৯০২ সাল নাগাদ আমার মা তাঁর জ্যাঠতুতো ভাই, তদানীন্তন শিক্ষা অধিকর্তা ডা: পূর্ণানন্দ চট্টোপাধ্যায় (আই.সি.এস.)-এর সঙ্গে দেখা করার জন্য জলপাইগুড়িগামী ট্রেনে ওঠেন। মাঝপথে এক ব্রিটিশ মহিলা লটবহর নিয়ে সেই কামরায় ওঠে। আমার মার বোঁচকা-বুঁচকি সিটের ওপরে ছিল। খানিকক্ষণ পরে সেই মেমসাহেব আমার মার বোঁচকা-বুঁচকি সিটের থেকে ছুড়ে ফেলে দেয়। মা আবার কুড়িয়ে রাখেন। এরকম তিন-চারবার হওয়ার পর আমার মা আর সহ্য করতে না পেরে সেই মেমের চুলের মুঠি ধরে একটি এমন বিরাশি সিক্কার চড় কষান, যে সেই মেম অজ্ঞান হয়ে যায়। ভেবে দেখুন, তখন ঘোরতর ব্রিটিশ যুগ; সেই সময় এরকম কাণ্ড!

সমস্ত জায়গায় এই খবর চাউর হওয়াতে, সে এক প্যান্ডোমোনিয়ম হয়। দাদা পূর্ণানন্দ স্টেশনে বোনকে রিসিভ করতে এসে বুঝতে পারেন তাঁর বোনের কাণ্ড। তিনি আই.সি.এস অফিসার, তদুপরি সাহেবের মতো চেহারা হওয়াতে বোনকে গা বাঁচিয়ে স্টেশন থেকে বাড়িতে নিয়ে যান। পরের দিন সংবাদপত্রে বাঙালি মহিলার মেম-পেটানোর গল্পে হইচই পড়ে যায়।

যদিও আমার শিশুবয়সে মায়ের সান্নিধ্য আমি পাইনি তার চাকরি ও সমাজসেবামূলক কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকার দরুণ। কিন্তু তাঁর কাজকর্ম আমার জীবনকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। আর আমার শিশুবয়সে আমার মনে প্রভাব ফেলেছিল বাবার সততার এক ঘটনা। এই ঘটনাটা আমি আমার রবীনমামার কাছ থেকে শুনেছিলাম। উনি ছিলেন নবাব এস্টেটের উকিল, এক সময় আমরা এক বাড়িতেই থাকতাম।

বাবা তখন ছিলেন ঢাকার নবাব এস্টেটের সদর মোক্তার। ১৯১০-১১ সালের ঘটনা। ঢাকার নবাবের সঙ্গে কোনও এক জমিদারের একটা জমি নিয়ে বহুদিন ধরে কেস চলছিল। ঢাকার নবাব বাবার হাতে নব্বই হাজার টাকা দিয়ে ওই জমিদারের কাছে পাঠালেন ওই কেস উইথড্র করার জন্য। বাবা গিয়ে দেখলেন, কয়েকদিন আগে ওই জমিদার নিজেই কেসটি উইথড্র করে নিয়েছেন। ঢাকায় ফিরে এসে বাবা ওই টাকাটা ফেরত দিয়ে দিলেন। বাবার যেসব নবাব এস্টেটের বন্ধুরা ছিলেন তাঁরা বাবাকে তিরস্কার করতে লাগলেন, ‘কী মশাই, ওই টাকাটা ফেরত দিলেন! নবাব তো জানতেও পারতেন না, ওই টাকাটা আপনি দেননি। বড়লোক হবার এই সুযোগ নষ্ট করলেন?’

বাবা তাঁদের বলল, ‘অসৎ উপায়ের টাকা হজম হবে না।’

পরবর্তীকালে কলকাতায় যখন আমি আয়রন অ্যান্ড স্ট্রিল কন্ট্রোলে কাজ করতাম তখন যুদ্ধের বাজার। আজকের দিনে রথী, মহারথী বহু ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট মাহীন্দ্র, থাপার প্রভৃতি স্টিলের কোটার জন্য আমার অফিসে সারাক্ষণ ঘুরঘুর করত। এদের মধ্যে জনৈক মহারথী আমাকে স্টিলের কোটা বার করে দেবার জন্য একটা বিরাট অঙ্কের ঘুষ অফার করল। অফারটা এতই বিশাল অঙ্কের ছিল যে আমার সারাজীবনের অন্ন সংস্থানের জন্য আর ভাবতে হত না। মাথা ঘুরঘুর করতে লাগল। বাড়িতে এসে একান্তে বাবাকে জিগ্যেস করলাম, ‘ঘুষটা কি নেব? না ছেড়ে দেব?’

বাবা বললেন, ‘ছেড়েই দে, ভদ্রলোকের ছেলে, রাতে ঘুম হবে না।’

ভুল করেছিলাম? —জানি না!

আমার ছেলেবেলায় মা, বাবা ও দাদামশাইয়ের নানা গুণে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম, কিন্তু বেশি সময় কাটাতে পারিনি তাঁদের সঙ্গে। আমি বড় হয়েছি আমার মেজো খুড়িমা, তাঁর মেয়ে বড়কিদি, এঁদের মধ্যে । মেজো কাকা মাদ্রাজে চাকরি করতেন। তাই ওঁরা আমাদের সঙ্গে থাকতেন। এছাড়া দাদু (দাদা), প্রকৃতি (সোনাদি মেজদিদি)র সান্নিধ্যে বড় হয়েছি।

লালদিদি অর্থাৎ বড়দিদি শোভাদেবী, আমার শিশু বয়সে (২-৩ বছরেই) তাঁর বিয়ে হয়ে যায়। আর তাঁকে লালদিদি নাম দেন আমার দাদা মণি (অজিত)। বড়দি ভীষণ ফর্সা, তার ওপর লাল কাপড় পরে আসতেন। দূর থেকে মনে হত যেন কোনও একটা চলমান লাল জিনিস আসছে। তাই এই ‘লালদিদি’ নামকরণ। ওঁর বিয়ে হয়েছিল ঢাকার গন্ডারিয়ায়। ডাক্তার মনমোহন মুখোপাধ্যায়ের পুত্র ভবেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। চাকরিসূত্রে জামাইবাবু বেশির ভাগই বাইরে বাইরে থাকতেন। লালদিদি একাই দুই ছেলে, এক মেয়েকে নিয়ে থাকতেন। আমার মনে আছে আমি মাঝে মাঝেই লালদিদির বাড়িতে যেতাম। বাড়িটা ছিল বিরাট, পিছনে বিরাট বাগানসহ পুকুর ছিল। পুকুরভর্তি মাছ। ও বাড়িতে গেলে এলাহি খাওয়াদাওয়া হত। এর পরবর্তীকালে আরও এক মেয়ে ও দুই ছেলের জননী হন তিনি। ওই বাড়িতেই আমার দ্বিতীয় বোন প্রকৃতিদেবীর বিয়ে হয় বাদল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে। পরে এঁরা কলকাতার অশ্বিনী দত্ত রোডে চলে আসেন এবং শরৎবাবুর প্রতিবেশী হন।

তখন আমার পনেরো-ষোলে বছর বয়স, ঢাকার ৩০ নং গোয়াল নগরে থাকি। কিন্তু মাঝে মাঝেই কলকাতার দিদির অশ্বিনী দত্ত রোডের বাড়িতে চলে আসতাম। কলকাতায় তখন অনেক আকর্ষণ। শরৎবাবু ও-পাড়ায় থাকতেন। সিনেমা, থিয়েটার প্রভৃতি বিবিধরকম। আমার মনে আছে, উজ্জ্বলা সিনেমায় পরপর দুইদিন ‘সোনার সংসার’ দেখে ফেলেছিলাম। এই বইতে অহীন্দ্র চৌধুরী ও তুলসী লাহিড়ীর অভিনয় আমাকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছিল।

ওই সময়ই তুলসী লাহিড়ীর আরেকটি বই ‘বেজায় রগড়’ আমায় বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল। এই সময়টা কলকাতা-ঢাকা যাতায়াতটা বেশ বেড়েই গেছিল। এ ছাড়া কলেজ, সোস্যাল, রাজনীতি, সিনেমা, থিয়েটার নিয়ে আমার বেশ কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু ১৯৩৮ সালে দাদু ( আমার দাদা অজিত ব্যানার্জী) পুলিশে চাকুরিরত অবস্থায় মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়সে মারা যায়। এই ঘটনা আমার কাছে, আমার বৃদ্ধ বাবা, মা, বোনদের কাছে বজ্রপাতের মতো মনে হয়, আমাদের সংসারটা ওলট-পালট হয়ে যায়। এই সময়ে আমার বাবা, মা দুজনেই রিটায়ার করেছেন। সুতরাং আমার দাদাই সংসারের একমাত্র রোজগেরে ছিল আর রোজগার বলতে একমাত্র মায়ের পেনশন অথচ খাবার লোক আমি, বাবা, মা আমার ছোট বোন প্রতিমা, আমার খুড়িমা, ঠাকুর প্রভৃতি আট-নয়জন লোক। সুতরাং আমাকে হাল ধরতে হবে, অথচ তখন আমি কলেজে পড়ি। সেই সময় ঢাকা রেডিয়োতে চাকরি নিলাম।

বেশ চলছিল। ১৯৪০-এর অক্টোবর মাস, তখনও রাজনীতির সঙ্গে কিছুটা যোগাযোগ আছে। এই সময় একজন ব্রিটিশ পুলিশের ইনফরমারকে মারের ঘটনায় জড়িয়ে পড়ি। আমার নামে ওয়ারেন্ট বেরিয়ে গেল Town entermination-এর। আমি ধরা পড়লে আমার বুড়ো বাবা-মা’র কী হবে, এই ভেবে ১৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে পালানো মনস্থ করলাম। আমার বাল্যবন্ধু গোপাল মিঞা ও তার পরিবার ১৪ তারিখে কলকাতায় আসছিল গাড়ি করে। তাদের গাড়ির পিছনের সিটের পাদানিতে শুয়ে কলকাতা রওনা দিলাম। তখন আমার ২৯ ইঞ্চি বুকের ছাতি এবং ভীষণই রোগা হওয়াতে বিশেষ অসুবিধা হল না।

১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৪১, কলকাতায় পৌঁছে চারু অ্যাভিনিউতে দিদির (প্রকৃতিদেবী) বাড়িতে উঠলাম। আমার মা দিদিকে টেলিগ্রাম করে আগেই ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। ১৬ ফেব্রুয়ারি আমার ভগ্নিপতি বাদলবাবু আমায় ক্লাইভ স্ট্রিটে আয়রন অ্যান্ড স্টিল কন্ট্রোল অফিসে নিয়ে গেলেন চাকরির জন্য। লিন্ডসে স্ট্রিটের নকুল দাশের টেইলারিং-এর দোকান থেকে সুট বানানো হল, ইন্টারভিউ-এর জন্য। আমি চিরকালই ধুতি এবং বাংলা শার্ট পরে অভ্যস্ত। এই ইন্টারভিউ ছাড়া আরেকবার সুট পরেছিলাম, সেটা ১৯৭৬-এ আমেরিকা যাবার সময়। সেই দিনই ইন্টারভিউ দিয়ে চাকরি পেয়ে গেলাম। আমি যে খুব একটা চাকরি পাওয়ার যোগ্য তা নয়। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বাজারে অনেকেই চাকরি পাচ্ছিল, আমিও পেয়ে গেলাম। দিদির বাড়িতেই থাকতে লাগলাম।

এদিকে অফিসে, ক্লাবে থিয়েটার, রেডিয়ো থিয়েটার, ফাংশানে কমিক, ইস্টবেঙ্গল ক্লাব এবং নানা জায়গায় আড্ডা, সব একসঙ্গেই চলতে লাগল। ১৯৪১-এই কলকাতা রেডিয়োয় আমার প্রথম অভিনয় ‘চিকিৎসা সংকট’ নাটকে কবিরাজের ভূমিকায়। এই নাটকের মাধ্যমেই আমার সঙ্গে পরিচয় আমার আরেক আইডল ইন্দু মুখোপাধ্যায় (বর্তমান অভিনেতা শৈলেন মুখোপাধ্যায়ের বাবা)-এর। ইনি অসাধারণ অভিনেতা, ভারতবর্ষের কমেডিয়ানদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ।

আমার এই সময় থেকেই কর্মসূচি ঠাসা ছিল। সকালে ৮টায় বেরিয়ে রাসবিহারি মোড়ে অমৃতায়ন রেস্টুরেন্টে অথবা তার উলটোদিকে লক্ষ্মীনারায়ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার অথবা লেক মার্কেটের পাশে রাধুবাবুর চায়ের দোকানে আড্ডা। এই অমৃতায়ন বা রাধুবাবুর চায়ের দোকানে যাদের সঙ্গে আড্ডা মারতাম তাদের মধ্যে কয়েকজন পরবর্তী জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যেমন পরিচালক মনোজ ভট্টাচার্য, পরিচালক গুরু বাগচী, পরিচালক সলিল সেন, পরিচালক দুলাল গুহ, যে পরে বম্বে গিয়ে খুবই সফল হয়েছিল।

দুলাল তখন স্টুডিয়োতে ঘোরাফেরা করত কাজের জন্য। মাঝে মধ্যে এডিটরদের সহকারি হিসাবে কাজ করত, আবার অ্যামেচার থিয়েটারও করত। ঋষিকেশ ও ঋত্বিক হাজরার প্যারাডাইস কাফেতে আড্ডা মারত। কিন্তু মাঝে মাঝে অমৃতায়নেও আসত। এছাড়া নেপাল নাগ, বলীন সোম, শীতল, অমূল্য সান্যাল, মাউথ অর্গান বাজিয়ে প্রফুল্ল চক্রবর্তী, গৌতম মুখোপাধ্যায় (দেবী মুখোপাধ্যায়ের ভাই)-এরা রেগুলার আড্ডা মারত। আবার রাধুবাবুর চায়ের দোকানে সুধীরলাল, নিখিল সেন, শ্যামল, গৌরীপ্রসন্ন, পবিত্র মিত্র এদের আড্ডা ছিল। আমি এই জায়গাগুলোতে শুধুই যে আড্ডা মারতে যেতাম তা নয়, এখানে অনেক কাজের কথাও হত। আমার অভিনয় জীবনের প্রথম দিকের অনেক ফাংশান রাধুবাবুর চায়ের দোকান থেকে এবং সিনেমা-থিয়েটারের কাজ এই অমৃতায়ন রেস্টুরেন্ট থেকে হয়েছে। আমাদের ‘নতুন ইহুদী’ নাটকের সূচনা এই অমৃতায়ন থেকে হয়েছিল। এই ‘নতুন ইহুদী’ নাটকেই সম্ভবত আমার সাফল্যের সূচনা।

৪৮ সাল নাগাদ ‘উত্তর সারথী’ নামে একটা নাটকের দল প্রতিষ্ঠা করি বলীন সোম, নেপাল নাগ, সলিল সেনকে নিয়ে। এরপর কানু বন্দ্যোপাধ্যায়, বাণী গাঙ্গুলী, সাবিত্রী, গৌতম মুখার্জী, ধ্রুব চ্যাটার্জী, মনোজ ভট্টাচার্য, বিনু বর্ধন, রসরাজ চক্রবর্তী প্রভৃতি যোগ দেয়। দুই বছর ধরে এই নাটকের মহড়া চলে বলীন সোমের বাড়িতে। আরও পরে সুশীল মজুমদার শ্যাম লাহাও যোগ দেন। ১৯৫১ সালের ২১ জুন কালিকা সিনেমায় প্রথম অভিনীত হয় নাটকটি। এরপর মঞ্চস্থ হয় নিউ আম্পায়ার হলে। এই নাটকে আমার চরিত্রের নাম ছিল দুইখ্যা। এক জায়গায় আমার সংলাপ ছিল, ‘সোইইন্যা, তরা মানুষ চিনস নাই, ভালোমাইনসি কইরা এই দুনিয়ায় বাইচ্যা থাকন যাইব না। ভালো মানুষ পাইয়া হগলে তগো ঠকাইব। আমি খারাপ হইয়া গেসি দেইখ্যা তরা আমারে গালমন্দ করস। একখান আমার কথা মনে রাখিস, দ্যাশে আইজ যত ব্যাটা রাজা গজা হইয়া বইসে, হগলব্যাটাই চোর আর বাটপার, হগল ব্যাটাই খারাপ।’

প্রত্যেকটি শোয়ে এই ডায়লগের পর তুমুল প্রশংসা পেয়েছি। ছবি বিশ্বাস, জহর গাঙ্গুলি, নির্মল দে, অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, সুধীর মুখার্জি প্রভৃতি তখনকার দিনের বহু রথী-মহারথীরা এই নাটকটি দেখেন ও পছন্দ করেন। ‘নবান্ন’ র পরে নব্য ধারার নাটক হিসেবে ‘নতুন ইহুদী’র খুবই নামডাক হয়। এই নাটক হওয়ার পরই আমাদের সমস্ত শিল্পী এমনভাবে সিনেমায় চান্স পেতে লাগল যে আমরা নাটকটা বেশিদিন চালাতে পারলাম না। বিশেষ করে আমার আর সাবিত্রীর প্রচুর সুযোগ এল। এই ‘নতুন ইহুদী’ সিনেমাও হয়েছিল নেপাল নাগের প্রযোজনায়। সলিল সেনের এটিই প্রথম পরিচালনা, কিন্তু ছবিটি বিশেষ চলেনি। সাবিত্রীকে আবিষ্কার করেছিলাম এই অমৃতায়ন থেকেই। ও তখন কালীঘাটের ভিক্টোরিয়া ইস্কুলে পড়ত। বাঙাল ভাষায় কট কট করে ঝগড়া করতে করতে বন্ধুদের সঙ্গে যেত। আমাদের নাটকে ওই বয়সের একটা বাঙাল রিফিউজি মেয়ে দরকার ছিল। আমি একদিন স্কুলে যাবার রাস্তায় ওকে ধরলাম, ‘এই, তুমি নাটকে অভিনয় করবে?’

ও চোখ পাকিয়ে কট কট করে তাকিয়ে বলল, ‘আমায় জিগ্যেস করছেন কেন? আমার বাবার কাছে যান।’ সেই থেকে আমি ওর নাম দিয়েছি ‘কটকটি’।

যাই হোক, আমি একদিন ওর বাড়ি গিয়ে হাজির। সেখানে গিয়ে দেখলাম ওর বাবা আমার সম্পর্কে মামা। অনুরোধ করতে গেছিলাম, মামাকে দেখে সেটা দাবি হয়ে গেল। প্রথম দিন ওকে নিয়ে বলীন সোমের চেতলার বাড়িতে রিহার্সালে গেলাম। ওর প্রথম দিনের অভিনয় দেখে আমি মুগ্ধ, তখনই বুঝেছিলাম ওর হবে।

এইসব ‘৪৮-‘৪৯ সালের কথা। এর অনেক আগে থেকেই আমি ফাংশান কিংবা থিয়েটার সার্কেলে নাম করেছি। অমৃতায়নে থিয়েটার, ফাংশান পার্টিরা তো আসতই আমাকে বুক করতে। এ ছাড়া রাধুবাবুর চায়ের দোকানেও আমার অনেক ফাংশান পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ হত, তার প্রধান কারণ সুধীরলালের বাড়ি ছিল রাধুবাবুর দোকানের ঠিক উলটোদিকে। সুধীরলালের তখন প্রচণ্ড নাম। তাঁর কাছে গান শিখতে রোজ উৎপলা, শ্যামল, গায়ত্রী, নীতা বর্ধন, নিখিল সেনরা আসত। এক জায়গায় এত আর্টিস্টের দেখা পাওয়া যায়। সুতরাং প্রচুর ফাংশান পার্টি এখানে আসত। সুধীরলাল আমাকে বিশেষভাবে পছন্দ করতেন। তার পিছনে একটা ঘটনা আছে।

‘৪৭-‘৪৮ সালের ঘটনা, সুধীরলালের বাড়িতে সকাল ৬টা থেকে রাত ১২টা অবধি সবসময় গান বাজনা হত, এতে তিতিবিরক্ত হয়ে সুধীরলালের বাড়িওয়ালা জনক রোডের মাস্তানদের নিয়ে চড়াও হয়ে সাতদিনের মধ্যে বাড়ি থেকে উঠে যাওয়ার হুমকি দিলেন। সুধীরবাবু একদিন হুড়মুড় করে আমার চারু অ্যাভিনিউর বাড়িতে এসে বললেন, ‘আমাকে বাঁচান।’

আমিও আমার যত পূর্বতন অনুশীলন পার্টি করনেওয়ালা বন্ধু নির্মল চক্রবর্তী, মাখন জয়, থান প্রভৃতি মারপিট-করনেওয়ালা বন্ধুদের নিয়ে হাজির। তখনকার দিনে যে যার নিজের পাড়ায় শের ছিল; আমাদের রোগা, প্যাটকা, নিরীহ গোবেচারা উদ্বাস্তু বালক দল ভেবে ঝাঁপিয়ে পড়ল। পরবর্তী পনেরো মিনিট হকি স্টিক, সোডা বোতল দিয়ে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ চলার পর তাদের বোধোদহয় হল এ বড় কঠিন ঠাঁই, প্রচুর আহত সৈন্যদের নিয়ে তারা রণে ভঙ্গ দিল। এরপর থেকেই সুধীরলালের কাছে যে ফাংশান পার্টি আসত তাতেই আমাকে ঢুকিয়ে নিত, এমনকী নিজে যেচে এসে আমার বউ নীলিমাকে গান শিখিয়ে গেছিল। সুধীরলাল কখনও কারো বাড়ি গিয়ে গান শেখাত না, কিন্তু কৃতজ্ঞতাবোধে এটা করেছিল।

সুধীরলাল লোকটাও বেশ মজাদার মানুষ ছিল। সুধীরলালের পক্ষে যে সৈন্যসামন্ত জনক রোডের যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল, তাদের একজন ছিল আমার বাল্যবন্ধু, ঢাকার মাখন জয়। এই মাখনের একটা রেডিয়োর দোকান ছিল রাসবিহারী অ্যাভিনিউর মোড়ে লক্ষ্মীনারায়ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের কাছে। সে একবার ঠিক করল দক্ষিণেশ্বরে তার বাড়ির কাছে জলসা করবে সুধীরলাল তাঁর দলবলকে নিয়ে। স্বভাবতই কৃতজ্ঞতা বশে সুধীরলাল বিনা পয়সায় রাজি হয়ে গেল। এমনকী উৎপলা, শ্যামল, নিখিল, আমি প্রভৃতি যারা ছিল, সবাই বিনা পয়সায়। স্টেজের ফাংশান, শুধুমাত্র সুধীরলালের কথায় সবাই রাজি হয়ে গেল। কিন্তু সুধীরলালের একটা মাত্র শর্ত, তাকে একটা বোতল দিতে হবে।

মাখন তো এককথায় রাজি, সুধীরলালও খুব খুশি, মাখন তার ওপর লোভ দেখিয়েছে সুধীরলালকে ‘পন্টিয়াক’ গাড়ি করে নিয়ে যাবে ও পৌঁছে দেবে। কতবড় দু:খের কথা ভেবে দেখুন, সুধীরলালের মতো ওরকম একজন বিখ্যাত গায়কের গাড়ি ছিল না। যাই হোক, নির্দিষ্ট দিনে মাখন ‘পন্টিয়াক’ গাড়ি করে সুধীর ও কয়েকজন মহিলা শিল্পীকে নিয়ে রওনা হল। আমরা ট্যাক্সি করে বাদবাকিরা দক্ষিণেশ্বর পৌঁছোলাম। ফাংশান আরম্ভ হল, সময় গড়িয়ে যায়। রাত ১০ টার মধ্যে বার দশেক মাখনকে সুধীর তাগাদা দিতে লাগল, ‘আমার মাল কোথায়?’

শেষে রাত ১০.৩০ টা নাগাদ সুধীর মাখনকে জাপটে ধরে বলল, ‘এত রাত হয়ে গেল আমার মাল এল না। ব্যাপারটা কী?’

মাখন বলে, ‘আরে চিন্তা করেন কেন, কথা যখন দিসি তখন কথা রাখুম। আপনারে পন্টিয়াক গাড়ি কইরা আনুম কথা দিসিলাম, আনি নাই?’

সুধীর রেগে গিয়ে বলে, ‘পইন্টাক তর বিশেষ জায়গায়, এখনই মাল চাই। সুরা না হইলে আমার সুর বাইর হইবো না।’

এই ”অমৃতায়ন” ও ”রাধুবাবুর দোকান” ছাড়াও আমার আরেক রেগুলার যাবার জায়গা ছিল ইস্টবেঙ্গল ক্লাব। ১৯৪২ সাল থেকে আমার ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের মেম্বারশিপ ছিল, কার্ড নম্বর ২১৩। এছাড়া ‘উয়ারি ক্লাব’-এর ও লাইফ মেম্বার ছিলাম। আজকাল পল্টু, জীবন যা করে আমার সেইসময় প্রায় ওই কাজই ছিল গেটে দাঁড়িয়ে কার্ড চেক করতাম। ইস্টবেঙ্গলের খেলা থাকলেই আমি, দাশু মিত্তির, মৃগেন মিত্তিরের ছেলে জর্জ্জি মিত্তির, সুজন ব্যানার্জী—আমরা সব একসঙ্গে খেলার মাঠে যেতাম।

খেলার মাঠে আমার একটা কাজ ছিল যেটা খুব আনন্দের সঙ্গে প্রায় রোজই করতাম। ‘৪১ সাল থেকে ‘৪৫-‘৪৬ সাল পর্যন্ত প্রায় প্রত্যেকটা ইস্টবেঙ্গলের ম্যাচেই উপস্থিত থাকতেন শচীন কর্তা, সুরসাগর হিমাংশু দত্ত ও ”মেলোডি” রেকর্ড দোকানের মালিক সুশীল দে। বলে রাখা ভালো, সঙ্গীত সম্পর্কে আমার জ্ঞান শূন্য। গায়ক বলতে একজনকেই জানতাম, তিনি হচ্ছেন শচীন কর্তা। হাফ টাইমে শচীন কত্তার জন্য এক ঠোঙা চিনা বাদাম, চা, পান ও সিগারেটের ব্যবস্থা করতে হত আমাকে।

শচীন কত্তা খুব মজার লোক ছিলেন, একবার ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচে পাশাপাশি বসেছেন শচীন কত্তা ও সুলালদা (জহর গাঙ্গুলী)। শচীন কত্তা কট্টর ইস্টবেঙ্গল আর জহর গাঙ্গুলী পাঁড় মোহনবাগানের সাপোর্টার। ইস্টবেঙ্গলের দিকে বল গেলে সুলালদা হইহই করে ওঠেন আর মোহনবাগানের দিকে বল গেলে শচীন কত্তা। ইস্টবেঙ্গলের তখন দুর্ধষ টিম, সালে, আপ্পারাও, ভেঙ্কটেশ তখন দারুণ খেলছে। হাফ টাইমের পরে ইস্টবেঙ্গল গোল দিয়ে দিল আর তার পর থেকেই শচীন কত্তা সুলালদাকে লক্ষ্য করে নানারকম ঠাট্টা করতে লাগলেন। সুলালদা তো রেগে কাঁই। একবার কত্তা বলে উঠলেন, ‘আ: হা: হা:, কী খেলা! কী লয়! কী ছন্দ! যেন ফৈয়াজ খাঁর ঠুংরী।’

এই শুনে সুলালদা বললেন, ‘ও, আমাদের খেলাটা কিছু না বুঝি?’

কত্তা বললেন, ‘আপনাদেরটাও ভালো, কিন্তু সেটা কাঠখোট্টা ধ্রুপদ ধামার।’

সুলালদা তো রেগে লাল। অথচ খেলার পরে দুজনে হাত ধরাধরি করে ‘কাফে ডি মোনিকো’তে মদ্যপান করতে গেলেন। এই খেলার মাঠে আমার অনেক মধুর স্মৃতি আছে। ভেঙ্কটেশের বিয়ে বলতে গেলে আমরাই উদ্যোগ নিয়ে দিয়েছি। আপ্পারাও, সালে ও ধনরাজও আমার খুব বন্ধু ছিল। সালে একবার আমাকে রোগা মানুষ দেখে আমার সঙ্গে মজা করতে এসেছিল। আমায় জিগ্যেস করল, ‘ভানু, তুমারা পুরা নাম কেয়া হ্যায়?’

আমি বললাম, ‘ভানু ব্যানার্জী।’

সালে বলল, ‘তুম যিতনা দুবলা হ্যায়, তুমারা নাম ভি ওয়াসা ছোটা হ্যায়। দেখো হামারা নাম কিতনা বড়া হ্যায়, ‘পুথম পরমাভিল বাবাখান আব্দুল রদ্দার সালে।’

আমি বললাম, ‘ইয়ে তো হামার নিক নেম হ্যায়, হামারা আসলি নাম হ্যায়, ‘অ-য় অজগর আসছে তেড়ে, আমটি আমি খাবো পেড়ে, ইঁদুর ছানা ভয়ে মরে, ঈগল পাখি পাছে ধরে।’

ও চোখ গোল গোল করে বলে ‘ঔরভি হ্যায়?’

আমি পুরো লিকার যেন ডিগবাজি খায় পর্যন্ত বলে শেষে ‘ভানু ব্যানার্জী’ বলে শেষ করলাম।

সালে—আরিব্বাস! ইতনা বড়া নাম?

আজকাল যেরকম ক্লাব নির্বাচন নিয়ে হইচই হয়, আমাদের আমলে বিধানসভা নির্বাচন নিয়েও এত মারামারি হুড়োহুড়ি হত না। কিন্তু একবার ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের নির্বাচন নিয়ে হইচই মনে আছে আমার, যেটা সেসময় অতটা ছিল না।

সেটা ১৯৪৯-৫০ সাল হবে, আমাদের ক্যান্ডিডেট জে.সি. গুহ। তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন বিখ্যাত খেলোয়াড় অভিলাষ ঘোষের ভাই বাপি ঘোষ। উত্তর কলকাতার যে কয়েকজন মেম্বার ছিল তারা প্রায় সবাই বাপি ঘোষকে ভোট দেবে মনে হচ্ছিল। জে.সি. গুহ আমাদের কয়েকজনকে অর্থাৎ আমি, সুজন, সুশীল ভট্টাচার্য, সুনীল ঘোষ প্রভৃতিকে দমদম, বাগবাজার, শ্যামবাজার পাঠাতেন বাপি ঘোষের ভোট ভাঙাতে। সেখানে প্রায় মারামারি হবার যোগাড়। আমরা মেম্বারলিস্ট নিয়ে বাড়ি বাড়ি যেতাম, প্রচণ্ড খাটনি হয়েছিল সেবার।

যাই হোক শেষ অবধি জ্যোতিষ গুহই জিতলেন। পরবর্তীকালে যখন বসুশ্রীতে রেগুলার আড্ডা মারতাম, তখন দেখতাম ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের নির্বাচন নিয়ে হট্টগোল হচ্ছে কিন্তু সে আমাদের আমলের অনেক পরে। মন্টু ইস্টবেঙ্গলের মেম্বার হয়েছিল আমার অনেক পরে। ময়দানে আরও কিছু প্লেয়ারবন্ধু ছিল যাদের নিয়ে গর্ববোধ করতাম। তারা হল পাখী সেন, রাখাল মজুমদার, ছোনে মজুমদার, আমেদ প্রভৃতি। পরবর্তীকালে বসুশ্রীতে আড্ডা মারার সুবাদে প্রচুর প্লেয়ারের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল।

১৯৫৬ পর্যন্ত আমার ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। এরপর অফিসও ছেড়ে দিলাম, ময়দানও ছেড়ে দিলাম। আয়রন অ্যান্ড স্টিল কন্ট্রোল অফিসে ১৯৪১ সাল থেকেই আমি অনিয়মিত অফিস করতাম। অর্থাৎ বারোটায় গেলাম, তিনটেয় অফিস থেকে বেরিয়ে গেলাম। অর্থাৎ ‘আসি যাই মাইনে পাই’ কর্মসংস্কৃতির আমি একজন পাইয়োনিয়ার বলা যায়, কিন্তু যখন কাজ করতাম তখন ঝড়ের গতিতে কাজ করতাম। আমার কাছে কোনও ফাইল পড়ে থাকত না, এটা আমাদের অফিসের ম্যানেজার মি: হ্যামিলটন জানতেন। আমি যখন-তখন অফিসে কখনো ক্লায়েনটদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছি, সেই কমপ্লেইনও ওঁর কানে গেছে।

কিন্তু উনি কয়েকটি কারণের জন্য আমাকে খুব পছন্দ করতেন। এক হচ্ছে, আমি কদাপি ফাঁকি দিয়ে কাজ করতাম না। এবং ঝড়ের গতিতে ফাইল পাস করতাম। দ্বিতীয় গুণ, আমি কখনও ঘুষ খাইনি, মনে রাখবেন সময়টা হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভারত। ভারতবর্ষের যতরকম লোহার ব্যবসা, আমদানি, রপ্তানি সব আমাদের অফিসের মাধ্যমেই হত। আজকের দিনের প্রচুর রথী মহারথী ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট আমার অফিসে দিনের পর দিন স্টিলের কোটার জন্য ধর্না দিয়ে পড়ে থাকত। তাদের মধ্যে মাহীন্দ্র, মি: থাপার, আমিনচাঁদ প্যারেলাল প্রভৃতিকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম। ব্রিটিশ আমল হলে কী হবে, তখন যুদ্ধের বাজারে এই লোকগুলো অফিসের সবাইকে প্রায় কিনে রেখেছিল। আমাদের ম্যানেজার যত সেলাম পেত আমাদের অফিস থেকে, এই লোকগুলো তার থেকেও বোধহয় বেশি পেত। আমি কিন্তু এদের কখনওই বিশেষ পাত্তা দিতাম না। কারণ আমি জানতাম এরা কোটা আদায় করার জন্য আমাদের কাছে আসে।

একবার একটা ঘটনায় মি: হ্যামিলটন খুব খুশি হয়েছিলেন আমার ওপর। মি: মাহীন্দ্রকে অফিসের সবাই, এমনকী আমার ওপরওয়ালা, তাঁর ওপরওয়ালা সবাই খুব সমীহ করে চলতেন। মি: মাহীন্দ্র দেখেছিলেন আমি তাঁকে কদাপি সমীহ করতাম না। একজন সামান্য কেরানির এহেন বেয়াদপি তাঁর সহ্য হল না। একদিন উনি আমার উলটোদিকের চেয়ারে বসে একটা কাগজ আমার টেবিলে ছুড়ে দিয়ে আমার টেবিলে জুতোসুদ্ধ পা প্রায় আমার মুখের সামনে তুলে বলল, ‘এখুনি অর্ডারটা পাস করে দাও।’

আমার মাথায় রক্ত চড়ে গেল। হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে মি: মাহীন্দ্রর পা টেবিল থেকে ঠেলে সরিয়ে বললাম, ‘আগে সভ্য ভদ্র হয়ে এটিকেট শেখো, তারপর অর্ডার পাস করাতে আসবে।’

মি: মাহীন্দ্র সঙ্গে সঙ্গে কাগজ নিয়ে মি: হ্যামিলটনের ঘরের দিকে চলে গেল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে পিয়ন দিয়ে মি: হ্যামিলটন আমাকে ডেকে পাঠালেন, জিগ্যেস করলেন, ‘মি: মাহীন্দ্র আমাদের সম্মানীয় ক্লায়েন্ট, তাঁকে কেন অপমান করলে?’

আমি হ্যামিলটন সাহেবকে সমস্ত ব্যাপারটা বললাম।

হ্যামিলটন সাহেব মি: মাহীন্দ্রকে বললেন, ‘তোমার তো এমন করা উচিত হয়নি।’

মাহীন্দ্র আর কী বলবেন, হ্যামিলটনকে চটানোর ক্ষমতা তো নেই, তাই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

মাহীন্দ্র বেড়িয়ে যেতেই হ্যামিলটন সাহেব আমায় বললেন, ‘বেশ করেছ।’

হ্যামিলটন সাহেব আমায় যে এত পছন্দ করতেন তার আরেকটা কারণ ওঁর একজন মেমসাহেব প্রেমিকা (ইংলিশ লেডি) ছিল। হ্যামিলটন ছিলেন স্কটিশ, ওঁদের প্রেমপত্র আদান-প্রদানের কাজ আমিই করতাম। মেমসাহেব প্রেমিকা যখন অফিসে আসতেন, তখনই আমায় ডেকে বাঙালিদের ভুল ইংরেজির কমিক স্কেচ শুনতেন এবং এনজয় করতেন। এই জন্যই উনি আমাকে ভালোবাসতেন।

আরেকটা ঘটনাও ওঁকে খুব প্রভাবিত করে। তখন ১৯৪৩-৪৪ হবে, জনৈক নামকরা বাংলা তথা ভারতের নামকরা ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট আমাকে স্টিল কোটা বার করে দেবার জন্য বিরাট অঙ্কের টাকা অফার করল। প্রচণ্ড ঘাবড়ে গেলাম। বাড়িতে এসে বাবাকে জিগ্যেস করলাম, ‘কী করব?’

বাবা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘এই তো চাকরি করে খেয়ে ঘুমিয়ে ভদ্রলোকের মতো আছিস। চুরির টাকা পেয়ে রাতে ঘুমাতে পারবি?’

পরের দিন সেই ভদ্রলোককে বললাম, ‘ঘুষ নেব না।’

এই গল্পটা শোনার পর হ্যামিলটন সাহেবের আমার প্রতি স্নেহ আরও বেড়ে গিয়েছিল। অফিসে সবাই আমার ‘হ্যাপি গো লাকি’ অ্যাটিচুডের জন্য আমাকে পছন্দ করত।

আমার বিহারি দারোয়ান আমায় খুব পছন্দ করত। আমার রোগাসোগা চেহারার জন্য আমায় ‘খোকাবাবু’ বলে ডাকত। ওর ঘরে বসে ওর রান্না করা আলুসেদ্ধ-ভাত, ঘি সহযোগে খেয়ে, তারপর একটু ঘুমিয়েও নিতাম। তারপরে ওকে বলা ছিল, লাঞ্চের পর আমায় ও ডেকে দিত। তারপর অফিসে ঢুকতাম। অবশ্য যেদিন খেলা না থাকত। কারণ দুটোয় ঢুকে তিনটেয় বেরিয়ে গেলে একটু বেশি বাড়াবাড়ি হত—হ্যামিলটন সাহেবের মদত থাকলেও।

যেদিন খেলা থাকত না, থিয়েটার থাকত না, সেদিন আমি সিনেমা দেখতে যেতাম। নিজের মান উন্নত করার জন্য আমি প্রচুর ভালো ভালো ছবি দেখতাম। যুদ্ধের বাজারে বেশি সিনেমা রিলিজ হত না, অশোক কুমারের ‘কিসমাৎ’ রক্সি হলে এক বছরের বেশি চলেছিল। আমিই ২১ বার দেখেছিলাম এই বইটা। ভালোবাসতাম আমি সিনেমা, থিয়েটার দেখতে ভীষণ। চ্যাপলিনের ‘গ্রেট ডিক্টেটর’ অসংখ্যবার দেখেছিলাম। কলেজে থাকতে ফ্রাংক কাপরা পরিচালিত, রোনাল্ড কোলম্যান অভিনীত ‘লস্ট হরাইজন’ ভীষণ ভালো লেগেছিল। তখন থেকেই রোনাল্ড কোলম্যানের ভক্ত হয়ে যাই। কলকাতায় এসে ”টক অফ দা টাউন’, ‘ডাবল লাইফ’, ‘র‌্যানডম হার্ভেস্ট’ সব ছবিগুলোই দেখেছি। কলেজে উঠে প্রথমেই ‘ভিভাভিলা’ দেখেছিলাম। ওয়ালেস বিইরীর অভিনয়ও আমায় প্রভাবিত করেছিল। ‘হাওগ্রীন ওয়াস মাই ভ্যালি’, ‘মি: ডিভস গোস টু টাউন’, ‘সিটিজেন কেন’, ‘দে ডায়েড উইথ দেয়ার বুটস অন’, ‘আর্সেনিক ওল্ড লেস’, ‘ইন্সপেক্টর জেনারেল’, সর্বোপরি ‘লাইম লাইট’—এইসব ছবি এবং অভিনেতা-অভিনেত্রীদের দেখে উদ্বুদ্ধ হয়েছি, প্রভাবিত হয়েছি।

এছাড়াও সেইসময় নিয়মিত বাংলা ফিল্ম দেখতাম। ‘প্রতিশ্রুতি’, ‘উত্তরায়ণ’, ‘শেষ উত্তর’, ‘প্রিয় বান্ধবী’, ‘ছদ্মবেশী’—এইসব ছবি অনেকবার দেখেছি।

ভালো কমেডি সব সময়ই আমার মনে দাগ কাটত। কলেজ লাইফে দেখা ‘সোনার সংসার’ ছবিতে তুলসী লাহিড়ী ও অহীন্দ্র চৌধুরীর অভিনয় আমার এখনও মনে আছে। অহীনদা নিজের নাড়ী টিপে তুলসীদাকে জিগ্যেস করছেন, ‘আচ্ছা তোমার নাড়ী কি কখনও খুব দ্রুত চলে?’

তুলসীদা—’দ্রুত মানে? এমন দ্রুত চলে যে মনে হয় পাঞ্জাব মেলে করে দার্জিলিং যাই।’

অহীনদা—’ও:, আচ্ছা আবার মাঝে মাঝে থেমে যায়?’

তুলসীদা—’অ্যাঁ, আবার থামতে গেল কেন?’ (খানিকক্ষণ চিন্তা করে) ‘ও, থামবেই তো! ইষ্টিশন।’

এই সিনটা হিলারিয়াস ছিল। দুজনেই এত ভালো অভিনয় করেছিলেন যে বলবার কথা নয়। এর আগে তুলসীদার ‘মণিকাঞ্চন’ নামে একটা ছবিও বাংলা হাসির ছবির ইতিহাসে এক সম্পদ। ‘দাতা বিনয়ের নিষ্কাম ছাতার গল্পো’ ও ‘দ্যাশের শিল্প দ্যাশেতে রাখিব’ গানটি উল্লেখযোগ্য।

তুলসী লাহিড়ীর কমেডি আমার ভীষণ ভালো লাগত। ওঁর কমেডি আমাকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিল। ইন্দু মুখোপাধ্যায়ের অভিনয়ও আমাকে খুব প্রভাবিত করেছিল। আমি বড়ুয়া সাহেবের অভিনয়ের খুব একটা ভক্ত ছিলাম না কিন্তু ”রজত জয়ন্তী” আমার খুব ভালো লেগেছিল। একটা সিন ছিল পাহাড়িদার ওপর বড়ুয়া সাহেব খুব রেগে গিয়ে বলেন, ‘তোমায় একটা ঘুঁষি মারব।’—এই সংলাপ বলার ভঙ্গি এতটাই মজার ছিল যে আজও আমার মনে আছে।

বড়ুয়া সাহেবের অভিনয়ের খুব একটা ভক্ত না হলেও আমি প্রমথেশ বড়ুয়ার পরিচালনার এক নম্বর ভক্ত। নির্মল দে, সুশীল মজুমদারের কাছে বড়ুয়া সাহেবের ফিল্ম টেকনিকের উৎকর্ষতার এত গল্প শুনেছি যে, বড়ুয়া সাহেবকে আমার একটা অন্য জগতের মানুষ বলে মনে হয়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ১৯৩৭ সালে যদি ভারতের ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে যাবার সুযোগ হত, তাহলে নিশ্চিতভাবে, ‘মুক্তি’ ছবি ভারতের প্রথম অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্ত সিনেমা হত। ‘মুক্তি’ ছবির একটা ডায়লগ আমাকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল—এক জায়গায় বড়ুয়া সাহেব মাথায় চার-পাঁচটা টুপি পরে বসে আছেন। ওঁর বড়লোক বউ কাননদেবীকে বললেন, ‘টুপি পরলেই যদি সভ্য হওয়া যায়, তবে আমি সভ্যতার কাঞ্চনজঙ্ঘা।’

আমি নির্বিঘ্নে আমার অফিসে যাওয়া, সিনেমা, থিয়েটার দেখা এবং করা অর্থাৎ সকাল ৮টায় বেরিয়ে রাত ১০-১১টা অবধি যে করতে পেরেছিলাম তার কারণ হল আমার দিদি প্রকৃতিদেবী। ১৯৪১ সালে কলকাতায় এসে এক বছরের বেশি আমি আমার এই দিদির বাড়ি, চারু অ্যাভিনিউতে ছিলাম। আমার দিদির তখন নিজেরই নানারকম ঝক্কি, ঝামেলা। একটা তিন বছরের বাচ্ছা মেয়ে নোরা, তার ওপর আমি দিদির বাড়িতে যাবার পরেই আরেকটা মেয়ে বুলির জন্ম হল। এই দুজন মেয়ে, তাঁর স্বামী, আমার ভগ্নিপতি বাদলবাবু, তার ওপর আমাকে দেখভাল করতে হত। প্রায় নিরুদ্বেগেই দিদির বাড়িতে কাটিয়েছি।

কিন্তু আমার একটা গভীর উদ্বেগের কারণ ছিল আমার রিটায়ার্ড, বৃদ্ধ মা, বাবা, অবিবাহিত বোন টুনটুনি ও সর্বোপরি আমার অবিবাহিত, আধপাগলা মামা। আমার দিদি (প্রকৃতি) এত ঝামেলার মধ্যেও ৬৯ নং চারু অ্যাভিনিউতে ভোলানাথ দে-র বাড়িতে একটা বেশ প্রমাণ সাইজের ঘর ভাড়ার ব্যবস্থা করে দিলেন; মা, বাবা, বোন ও মামা সবাই এসে ও-বাড়িতে উঠলেন। এ-বাড়ির একটা সুবিধে ছিল এই যে, আমার ঘরের সামনে একটা বিরাট গাড়িবারান্দা ছিল। সেটাও পরের দিকে আমার ঘর হয়ে গেছিল। বাইরের লোক যারা আসত চৌকি পেতে তাদের ওখানেই বসাতাম। কাজের কথাবার্তা ওখানেই হত। আমরা গরমকালের রাতে চৌকি পেতে ওখানেই শুয়ে পড়তাম।

আমার এই ওপেন গাড়িবারান্দার বৈঠকখানায় সব গণ্যমান্য ব্যক্তিরা শুয়ে, বসে গান করে আড্ডা মেরে গেছে। সুধীরলাল, হেমন্ত ও তার পরিবার, শ্যামল, আল্পনা, উৎপলা, সতীনাথ, ছবিদা, উত্তম, জহর রায়, পাহাড়ীদা, বম্বের তালাত মামুদ, সজ্জন কে না এসেছে ওখানে! এমনকী আমার ওই গাড়িবারান্দায় ছোট রাবারের বলে ভেঙ্কটেশ, ধনরাজ, আমেদ, আমার ছেলে ও তার বন্ধুদের সঙ্গে খেলে গেছে।

আমার বাবা-মা কলকাতায় আসার কিছুদিন পরেই আমার ছোট বোন টুনটুনি (প্রতিমা)র বিয়ের ব্যবস্থা করলেন আমার দিদি প্রকৃতি, গিরিডির অনুপ চ্যাটার্জীর সঙ্গে। বিয়েটাও আমার দিদির বাড়িতে হয়েছিল। বোনের বিয়েয় বাবা, মা, মামা-কে দেখাশোনা করার জন্য দিদি তার রান্নার ঠাকুর দ্বারভাঙার বালচাঁদের খুড়তুতো ভাই যোগেশ্বরকে রাখার ব্যবস্থা করলেন। যোগেশ্বর তখন বারো-তেরো বছরের ছোকড়া, পরবর্তী জীবনে মা তাকে শিখিয়ে পড়িয়ে নেন। যোগেশ্বরই আমাদের পরিবারের সুপারভাইসার।

যোগেশ্বরের একটাই ঝামেলা ছিল, ভীষণ সিনেমা দেখত। আমার বাড়ির পাশেই ভবানী, দীপ্তি সিনেমায় প্রত্যেক সপ্তাহে দুটো করে হিন্দি সিনেমা দেখা চাই-ই। শ্যাম, সুরাইয়া, মীনাকুমারী, দিলীপ কুমারের সিনেমার গান একদম মুখস্থ। আবার যোগেশ্বরের দাদা বালচাঁদ, যে আমার দিদির বাড়িতে কাজ করত সে আমার সঙ্গে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে যেতে যেতে ঘোরতর ইস্টবেঙ্গল সাপোর্টার হয়ে গেল, ইস্টবেঙ্গলের গেটে দাঁড়াতেও আরম্ভ করল।

এরা সবাই আমাকে ‘মামাবাবু’ বলে ডাকত। নোরা, বুলির মামা হওয়ার সুবাদে চারু অ্যাভিনিউতে ওদের বয়সি এবং ওদের ছোটদের সবার কাছে আমি ‘ভানুমামু’ হয়ে গেলাম। বুলির জন্মের পর আমার মামাগিরিও বেড়ে গেছিল, কারণ তার পরপরই আমার বড়দিদি শোভাদেবীর ছেলে খোকন এবং আমার ছোট বোন প্রতিমার মেয়ে পিউলির জন্ম হয়। সুতরাং এই সময়টা আমার মামাগিরি প্রায় সর্বজনীন রূপ নিয়েছিল। কারণ আমার বড় বোনের ছ’টা, মেজো বোনের দুটো, আমার ছোট বোনের তিনটে। —এই এগারোটা নিজের ভাগনে, ভাগনি ও চারু অ্যাভিনিউ-এর অগুনতি ভাগনে, ভাগনি ছিল আমার।

১৯৪৫ সাল অবধি থিয়েটার-জলসায় কৌতুক নকশা, রেডিয়োতে নাটক, স্টিল কন্ট্রোলের অফিস, ইস্টবেঙ্গল ক্লাব করে কেটে যাচ্ছিল। ১৯৪৬ সালে আমি পাড়ার নাটক ‘চন্দ্রগুপ্ত’তে চাণক্যের পার্ট করি। আর চন্দ্রগুপ্তর চরিত্রে অভিনয়ের সময়ে ‘পানুদা’, সাহিত্যিক হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়, আমার অভিনয় দেখে অভিভূত হয়ে আমাদের পাড়ার ভুজঙ্গডাক্তার তথা ভুজঙ্গ ব্যানার্জী, সুশীল মজুমদারের বাড়ি নিয়ে গিয়ে বলেন, ‘ও একটা সাংঘাতিক ভালো আর্টিস্ট, ওকে আপনার নিতেই হবে।’

ভুজঙ্গ ছিলেন সুশীলদার অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টার, তাঁর জোড়াজুড়িতে সুশীলদা একটা খুবই ছোট, দুই দিনের শুটিং-এর রোল দিলেন ‘অভিযোগ’ ছবিতে। এবং তার পরের বই ‘সর্বহারা’য় একটা মোটামুটি বড় রোলের প্রতিশ্রুতি দিলেন।

এই ‘অভিযোগ’ ছবিটি আমার সর্বপ্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা। তখনকার দিনের আলোড়ন সৃষ্টিকারী জুটি সুমিত্রা দেবী ও দেবী মুখার্জী ওই ছবির হিরো-হিরোইন ছিল। প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত হলেও প্রথমে শুটিং কিন্তু আমি ও-ছবিতে করিনি। আমার প্রথম শুটিং করা ছবি ‘জাগরণ’। ‘জাগরণ’-এর পরিচালক বিভূতি চক্রবর্তী। ইনি ছিলেন বড়ুয়া সাহেবের অ্যাসিস্টেন্ট। বিভূতিবাবুর সঙ্গে আমার পরিচয় করে দেন জীবনদা। জীবন দত্ত একসময় ঢাকায় থাকতেন, পরে ইনি কয়েকটি ছবি প্রযোজনাও করেন। আমার বিয়ের তিনদিন পরেই ‘জাগরণ’ ছবির শুটিং হয় রাধা ফিল্ম স্টুডিয়োতে।

আমার স্ত্রী নীলিমা টালিগঞ্জ কবরখানার পাশে দিগম্বরীতলার মেয়ে, ওর সঙ্গে বিয়েটা হঠাৎ-ই হয়ে যায়। ও গান শিখতে আসত আমাদের বাঙালপাড়ায় মধুদা (সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায়)-র কাছে, সেই ১৯৪৪ সাল থেকে। পাড়ার ছেলে হওয়ার সুবাদে মধুদার বাড়িতে আমার যাতায়াত ছিল। সিদ্ধেশ্বর ও রত্নেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের কাছে তখন অনেকে গান শিখতে আসত। একবার শ্রীরামপুর কোর্টে এক জলসায় মধুদা আমায় নিয়ে যায়, সঙ্গে গাড়িতে নীলিমাও ছিল। আমার তখন পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়স। বাড়িতে বুড়ো বাবা-মা, একটা বিয়ের দরকার ছিল; মধুদাই উদ্যোগী হয়ে আমার মা আর ওর বাবা-মার সঙ্গে কথা বলে বিয়ের ব্যবস্থা করে।

১৯৪৬ সালে ২৩ ফেব্রুয়ারি বিয়ের দিন স্থির হল। কিন্তু নীলিমার বাবা পরেশ মুখার্জী বেঁকে বসলেন। কারণ মাত্র বছর তিনেক আগে বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। তদুপরি সেইসময় কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়ে গেছে। আমরাও জোরাজুরি করছি ওই দিনই বিয়ে দেবার জন্য। কারণ ২৭-২৮ ফেব্রুয়ারি আমার জীবনের প্রথম সিনেমার শুটিং। একবার নীলিমার চরম রক্ষণশীল বাবা যদি জানতে পারতেন যে তাঁর হবু জামাই সিনেমায় অ্যাকটিং করার মতো চরম পাপকাজে লিপ্ত তাহলে কিছুতেই বিয়ে দিতেন না।

তখন আমি বললাম, ‘মার্চ মাসে আমাকে দিল্লি ট্রান্সফার করে দেবে সুতরাং তার আগে বিয়ে করতেই হবে।’

নীলিমার বাবা বললেন, ‘ঠিক আছে, কিন্তু এই ঝামেলার বাজারে আমার কিছু কেনাকাটার সময় নাই।’ আমরা তাতেই রাজি হয়ে গেলাম।

২৩ ফেব্রুয়ারি বিয়ে হয়ে গেল। ২৬ ফেব্রুয়ারি দ্বিরাগমনের দিন শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছে নীলিমাকে জমা করেই হাঁটা দিলাম স্টুডিয়োর উদ্দেশ্যে, সন্ধ্যা ৫টা নাগাদ। ওদের পাড়ার মোড়েই রাধা ফিল্ম স্টুডিয়ো। স্টুডিয়ো পৌঁছেই পরিচালক বিভূতি চক্রবর্তীর কাছে গেলাম। আমাকে দেখেই ওঁর খুব পছন্দ হয়ে গেল। বললেন, ‘আমার ছবিতে দুর্ভিক্ষপীড়িত চিমসে চেহারার একটা চরিত্র আছে, সেটা তুমি করবে।’

তখন আমার ওরকমই চেহারা ছিল। তদুপরি উনি নাকি সমস্ত ফিল্ম লাইনে ওরকম চেহারার লোক খুঁজে পাচ্ছিলেন না।

আমার ডায়লগ ছিল এক লাইনের। আমার বউকে বলছি, ‘আমার মেয়ে খেঁদিকে বিক্রি করে দিয়ে এলাম এক টাকায়।’

আমার ধারণা ছিল, আমার ছোট রোল, হয়তো ২-৩ ঘণ্টার মধ্যে ছেড়ে দেবে। ১০টা বেজে যায়, ১১টা বেজে যায়, আমার শুটিং তো শেষ হয় না। হঠাৎ একজন লোক এসে বলল, আমাকে এক ভদ্রলোক খুঁজছেন। চেয়ে দেখি আমার সামনে টাক মাথা, ফর্সা, বেঁটেখাটো আমার মূর্তিমান শ্বশুরমশাই।

আমি হতবাক, অপ্রস্তুত, নির্বাক। নির্বাক কারণ, আমার রোলটা ছিল একজন দুর্ভিক্ষপীড়িত লোক-এর। লজ্জা নিবারণের জন্য একটা চট পড়ে আছি দড়ি দিয়ে বেঁধে। আর আমার শ্বশুর হতবাক তার সদ্য বিবাহিত মেয়ের স্বামীর এরকম সঙের মতো সাজ, মেকাপ দেখে। উনি জীবনে কখনও সিনেমা দেখেননি, পৌরাণিক যাত্রাপালা ছাড়া উনি কখনও কিছু দেখেননি।

যাই হোক, ডিরেক্টর বিভূতি চক্রবতী আরও আধঘণ্টা পরে আমায় ছেড়ে দিলেন। এই আমার প্রথম ছবি ‘জাগরণ’ এর শুটিং-এর অভিজ্ঞতা। এই বইতে আমার স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন রেণুবালা সুখ। ইনি সেইসময় পেশাদারী মঞ্চের নামকরা অভিনেত্রী ছিলেন। এই শুটিং-এর পরেই পরপর সুশীল মজুমদারের ‘অপরাধী’ ছবির শুটিং করলাম, তার পরেই প্রমোদ দাশগুপ্তের পরিচালনায় ‘যা হয় না’। কিন্তু ‘যা হয় না’র শুটিং ১৯৪৬-এ হলেও রিলিজ হয় আও ৩-৪ বছর বাদে।

এর পরেই আমার সিনেমায় অভিনয় করার আগ্রহ বেড়ে গেল। আমার দৈনন্দিন জীবনের রুটিনে আরেকটা কাজ সংযোজিত হল, তা হল, স্টুডিয়ো ঘুরে ঘুরে রোল যোগাড় করা। এই ‘যা হয় না’ ছবির শুটিং-এ অ্যাসিস্টেন্ট সাউন্ড রেকর্ডিস্ট দেবেশের সঙ্গে আলাপ হয়। দেবেশ ঘোষের কাজ ছিল সাউন্ড ভ্যানে গাইড ট্রাক করা।

পরবর্তী জীবনে ওর বিয়ে দিয়েছিলাম বলতে গেলে আমিই, অভিনেতা মৃত্যুঞ্জয় ব্যানার্জীর কন্যা রঞ্জনার সঙ্গে। রঞ্জনাও পরে সিনেমায় নেমেছিল। দেবেশ পরবর্তী জীবনে কয়েকটা বাংলা এবং হিন্দি সিনেমা প্রযোজনা করেছিল।

এই সময়েই আমি বিমল রায় পরিচালিত ‘মন্ত্রমুগ্ধ’ ছবিতে অভিনয় করি। ‘উদয়ের পথে’ করার পর বিমল রায়ের তখন খুব নামডাক। এখানেই আমার সঙ্গে তখন বন্ধুবর অসিত সেনের ঘনিষ্ঠতা হয়। ওর সঙ্গে পরিচয় আগেই ছিল, কারণ ও আমার চারু অ্যাভিনিউর প্রতিবেশী ছিল। পরবর্তী জীবনে ও বিমলদার সঙ্গে বম্বে চলে যায় এবং ওখানে কমেডিয়ান হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সময়টা আমরা একটা দল বেঁধে স্টুডিয়োয় ঘুরতাম কাজের জন্য। আমাদের দলে থাকত গৌতম (অভিনেতা দেবী মুখোপাধ্যায়ের ভাই), কালিদাস বটব্যাল ও তার ভাই প্রদীপ কুমার, জহর রায়, দুলাল গুহ প্রভৃতি।

এই ‘মন্ত্রমুগ্ধ’ ছবিতে আমার অনেক বন্ধুই কাজ করেছিল। যেমন বন্ধুবর মনোজ ভট্টাচার্য। পরবর্তীকালে ও বিমল রায় প্রাোডাকসন্সের একটি ছবি পরিচালনা করে, তার নাম ‘তথাপি’। এই মনোজ ভট্টাচার্যই প্রথম ‘নতুন ইহুদী’ নাটক মঞ্চস্থ করার কথা বলে। ঋষি ছিল ‘মন্ত্রমুগ্ধ’ ছবির সহকারী সম্পাদক, সর্বোপরি দুলাল গুহ ও আমি এই ছবিতে একসঙ্গে শুটিং করি। পরবর্তী জীবনে বন্ধুবর দুলাল বম্বে গিয়ে বিখ্যাত পরিচালক হয়ে যায়। দুলাল এর পরেও মনোজ ভট্টাচার্যের ‘তথাপি’ ছবিতে অভিনয় করে। ‘তথাপি’ ছবিতে আমার বেশ কয়েকজন বন্ধু কাজ করেন, যেমন সুনীল দাশগুপ্ত, বলীন সোম, কালী প্রভৃতি। এই ছবিতে ঋত্বিকও অভিনয় করে। সহকারী পরিচালকও ছিল সে এই ছবিতে।

এই ছবির বেশিরভাগ অভিনেতা থিয়েটারের, যেমন, বিজনদা, গঙ্গাদা ও শোভাদি এর আগে ‘নবান্ন’য় ভীষণ নাম করেছিল। এ-ছবির স্টার ছিল নাট্যচার্য্য মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য ও প্রভাদেবী। আমি আগেই প্রভাদেবীর অভিনয়ের ভক্ত ছিলাম। এই ছবিতে একটা ভীষণ ইমোশন্যাল সিন ছিল। প্রভাদি ঝরঝর করে কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলছে। মনোজ ‘কাট’ বলার সঙ্গে সঙ্গে প্রভাদি সেই প্রবল আবেগ বন্ধ করে সঙ্গে সঙ্গে আমায় বলে, ‘দে একটা বিড়ি দে।’

চোখের আই সকেটে যা জল ভরে ছিল তাও প্রায় নিমেষেই শুকিয়ে গেল। এরকম অভিনেত্রী আমি জীবনে কখনও দেখিনি, সাবিত্রী ছাড়া।

আজকাল সব স্টার অভিনেতাদের আবেগপূর্ণ অভিনয়ের শুটিং যে দেখি, পরিচালক ‘কাট’ বলার পর দশ মিনিট পরেও কান্নার আবেগ থামাতে পারে না। তাই দেখে আবার স্টুডিয়োর কিছু বোদ্ধারা বলেন, ‘কী দারুণ অভিনেত্রী, কী ন্যাচারাল দেখেছেন!’

আমি বলি অভিনয় খুব বেশি ন্যাচারাল হলে মুশকিল আছে। কারণ কাউকে খুনের সিনে খুব বেশি ন্যাচারাল অভিনয় করতে গিয়ে যদি সজোরে পেটে ছুরি মেরে দেয়, তাহলে সেটা বেশ মুশকিলের ব্যাপার হবে।

এই ‘তথাপি’ ছবিতে আমার পার্ট ছিল একজন বোবা-কালার। এর আগে সুশীলদা (মজুমদার) ‘সর্বহারা’ ছবিতে একটা ভালো পার্ট দিয়েছিল। এই ‘সর্বহারা’ ছবিতে কাজ নিয়ে অনেক গল্প আছে। প্রথমত, সুশীলদার তখন ভীষণ নামডাক, আমার বাবা ও সুশীলদার বাবা একই সঙ্গে ইস্কুলে পড়তেন। আমি ছাত্রাবস্থায় ঢাকার নির্বাচনে সুশীলদার মা হেমপ্রভাদেবীর হয়ে ক্যাম্পেইন করতাম, সর্বোপরি এইসময় সুশীলদার লেক অ্যাভিনিউর বাড়িতে আমার রেগুলার যাতায়াত ছিল। মধুদা (সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায়) এই সিনেমায় অভিনয় করেছেন এবং সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন। মধুদা তার ছাত্রী তথা আমার সদ্য বিবাহিত স্ত্রী নীলিমাকে দিয়ে তিন-চারখানা গান গাইয়েছিলেন। ওর সঙ্গে ডুয়েট গায় রবিদা (রবীন মজুমদার)। রবিদাই এই ছবির নায়ক। গায়ক, নায়ক হিসাবে রবিদার তখন সাংঘাতিক নামডাক। আমার মনে হয় সায়গলের পরে গায়ক-নায়ক হিসাবে সর্বশ্রেষ্ঠ রবীন মজুমদার।

আবার আমার আদর্শস্থানীয় অভিনেতা তুলসীদা (তুলসী লাহিড়ী) এ ছবির কাহিনিকার ও গীতিকার। তুলসীদা বিশেষ যত্নসহকারে নীলিমাকে তাঁর গানগুলি শিখিয়েছিলেন। কারণ এই গানগুলি ছিল রংপুর জেলার গ্রামের ভাষা। এই ছবিতে মধুদার ভাইপো পল্টনও (মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়) গান গেয়েছে।

‘নতুন ইহুদি’ নাটক এবং ‘সর্বহারা’, ‘তথাপি’ ছবির দৌলতে আমি তখন কাজ পেতে লাগলাম। অর্থাৎ ডিরেক্টরদের কাছে রোল চাইলে পাচ্ছিলাম। আমার যে একটু নাম হচ্ছে তা বুঝছিলাম। কারণ এর আগে সিনেমায় আমার নাম ‘প্রভৃতি’দের মধ্যে থাকত। এবার আমার নাম প্রভৃতির আগে স্থান পেল। অবশ্য এইসময় নামের পাশে ব্রাকেটে (অ্যাঃ) থাকত। অর্থাৎ অ্যামেচার। তখন সরকারি অফিসে কাজ করতাম। নিয়ম ছিল, সরকারি অফিসে কাজ করলে আবার অন্য কোনও সোর্সে রোজগার করা যাবে না। তাই এই (অ্যাঃ)-এর ছলনার আশ্রয় নিতে হত। অর্থাৎ বোঝানো হত বিনা পারিশ্রমকে কাজ করছি। সেকালে এটাই নিয়ম ছিল।

‘সর্বহারা’র পরে ‘বসু পরিবার’ কিংবা ‘পাশের বাড়ি’ অবধি এই ৪-৫ বছর আমার ২০-২২টা ছবিতে অভিনয় করা হয়ে গেছে। এই সময়ে ‘কৃষাণ’ ছবিতে অভিনয় করেছিলাম। এটির পরিচালক ছিলেন অর্ধেন্দু মুখার্জী। এই ছবির শুটিং-এর কথা আমার মনে থাকবে।

অর্ধেন্দু মুখার্জী নিজে অভিনয় জানতেন। রিহার্সাল করাবার সময় একজায়গায় বললেন, ‘তোমার তো জিভের আড় ভাঙেনি এখনও। তুমি অ্যাকটিং করতে এয়েচো।’

আমি তো তা শুনে খুবই দু:খিত হয়ে পড়লাম, ফ্লোরের বাইরে গিয়ে মনে মনে ডায়লগ আওড়াতে লাগলাম! আমি নিজের মনে বিড়বিড় করছি দেখে পাশের ফ্লোর থেকে ছবিদা এসে জিগ্যেস করলেন, ‘কী বাবা, পার্টটা বলো দেখি।’

আমি বললাম। ছবিদা শুনে বললেন, ‘ঠিকই তো আছে, আসলে কী জানিস, তুই তো বাঙালের পো, সেইজন্য তোর উচ্চারণ নিয়ে একটু মশকরা করল।’

এই সময়টাতে ছবিদার সঙ্গে আমার খুবই ঘনিষ্ঠতা ছিল, আর ছবিদা তখন ‘বাংলা সিনেমার সম্রাট’। প্রসঙ্গক্রমে বলি, আমি ছবিদার প্রবল ভক্ত। সুশীলদার ‘অভিযোগ’ ছবির শুটিং চলাকালেই ছবিদার পিছু পিছু ঘুরতাম, ভাব জমাবার চেষ্টা করতাম। ওঁর শুটিং থাকলে আমার কাজ না-থাকলেও ওঁর ‘শট’ দেখতাম, কিন্তু ছবিদা সেইসময়ে বিশেষ পাত্তা দেননি। ভেবেছেন স্টুডিয়োয় হারা-উদ্দেশ্যে যেসব লোকজন ঘুরে বেড়ায় তাদেরই কেউ হবে হয়তো। তারপরে একদিন সুশীল মজুমদারের সঙ্গে ‘নতুন ইহুদী’ দেখতে যান। তারপর থেকেই আমাকে পাত্তা দিতে আরম্ভ করলেন।

অন্য লোক থাকলেও, পানটা আমাকেই কিনতে দিতেন। এই সময়েই সুশীলদার পরিচালিত ‘দিগভ্রান্ত’ নামে একটা ছবিতে অভিনয় করি। এ ছবিতে নায়কের পার্টটা করে আমার বিশিষ্ট বন্ধু গৌতম মুখার্জী (দেবী মুখার্জির ভাই)। এই সময়েই ‘মানদণ্ড’ সিনেমাটা করি, এর পরিচালক ছিল রতন চ্যাটার্জী। এই ছবিতে ছবিদার সঙ্গে একটা সিন বেশ প্রশংসিত হয়েছিল।

ছবিদা সম্বন্ধে বলি, ছবি বিশ্বাস হচ্ছেন অভিনয়জগতে আমার মেনটর, আমার আইকন, বড়বাবু শিশির ভাদুড়ী এবং ছবিদা হচ্ছেন আমার জীবনের পরম পূজনীয় ব্যক্তি। ছবিদা সিনেমায় আসার আগেই রঙ্গমঞ্চে ‘প্রফুল্ল’, ‘বিজয়া’, ‘দুই পুরুষ’, ‘চরিত্রহীন’ প্রভৃতি নাটকে নাম করেছিলেন। কিন্তু সিনেমায় ছবিদার নাম হয় অনেক পরে, ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’, ‘নর্তকী’, প্রভৃতি ছবিতে অভিনয়ের গুণে খুবই নাম হয়। কিন্তু গ্ল্যামার হিরো বা ম্যাটিনি আইডল বলতে যা বোঝায় তা তিনি কোনওদিন ছিলেন না। যেটা দুর্গাদাস বন্দোপাধ্যায় ছিলেন। তার কারণ হয়তো ছবিদা যখন সিনেমায় এসেছেন তখন তাঁর হিরো হবার বয়স ছিল না। কিন্তু পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করে হিরোকে ছাপিয়ে যাওয়ার অভিনয় ক্ষমতা ছবিদা ছাড়া আর কারও ছিল না। এমন অনেক সিনেমা আছে যাতে হিরো, হিরোইন বাদ দিয়ে শুধু ছবিদার সিনগুলো দেখতে দর্শকরা যেত। ‘মানদণ্ড’ ছবিতে ছবিদার চরিত্র ছিল এক জমিদারের। ছবিদাকে সবরকম পার্টেই মানাত, কিন্তু জমিদারের চরিত্রে সাংঘাতিক মানাত—ওই সাংঘাতিক ভালো চেহারা, ওইরকম বাচনভঙ্গি অসাধারণ! ছোট জাগুলিয়ার সত্যিকারের জমিদার-ই তো ছিলেন ছবিদা। অথচ ‘৪৬-এ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর পার্ক সার্কাসের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হয়ে কলকাতার অনেক দূরে শহরতলি বাঁশদ্রোনীতে বাড়ি ভাড়া নিলেন। বাঁশদ্রোনী তখন ২৪-পরগনার গ্রাম ছিল। ছবিদা যাওয়ার পরেই দেশ ভাগ হল। তখন অনেক উদ্বাস্তুরা ওখানে আশেপাশে কলোনী করে থাকতে আরম্ভ করল। তারপরেই কিছু লোকজন দেখা যেত।

আমি ছবিদার সিনেমা দেখতে আরম্ভ করি কলকাতায় আসারও অনেক পরে। প্রথম ছবি বোধহয় ‘সমাধান’। এরপর পরপর কয়েকটা ছবি দেখি। আমি বেশ বুঝেছিলাম যত দিন যাচ্ছে ছবিদার সিনেমার অভিনয়ে তত উন্নতি হচ্ছে। ‘দুই পুরুষ’, ‘বিরাজ বৌ’-এর ছবিদা সুপারস্টার। এই সময় থেকে বোধকরি ছবিদা বাংলা সিনেমায় ‘হাইয়েস্ট পেইড-স্টার’ হয়ে যান। পার্শ্বচরিত্রাভিনেতা হওয়া সত্বেও এই ‘মানদণ্ড’ ছবির শুটিং চলাকালে আমার ছবিদার সঙ্গে ভীষণ ভালো সম্পর্ক তৈরি হল, একেবারে নিজের দাদার মতো। বয়সে ইনি আমার চেয়ে অনেক বড়। আমার অবিচল ভক্তি ছিল ছবিদার প্রতি। সেটা ‘৪৯ সাল হবে, তার পর থেকে ছবিদা যতদিন বেঁচে ছিলেন অর্থাৎ ১৯৬২ অবধি।

ফিল্মলাইনে মনে হয় আমিই ছবিদার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ছিলাম। ছবিদার নামে আমি একপায়ে খাড়া। আবার ছবিদাও আমার আবদার শুনতেন। আমাদের ‘অভিনেত্রী’ সঙ্ঘর জন্ম বলতে গেলে আমার সঙ্গে ছবিদার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের জন্যই। সেটা ‘৫০-‘৫১ সাল হবে। বিকাশদাকে রেডিয়ো নাটক করার সুবাদে ‘৪২-‘৪৩ সাল থেকে চিনতাম, সেই সময়টা আমরা প্রায় অচেনা অভিনেতা। বিকাশদা ‘রত্নদীপ’ এবং আমি ‘বরযাত্রী’ করে সবে একটু নাম করেছি। ইন্দ্রপুরী স্টুডিয়োতে আমি আর ছবিদা ‘অনুরাগ’ বলে একটা বইয়ের শুটিং করছি, আর বিকাশদা বোধহয় হেমেন গুপ্তর ‘৪২-এর শুটিং করছে। আমি গাছের নীচের চাতালে বসে আছি ৭নং ফ্লোরের কাছে। হঠাৎ বিকাশদা আমায় ডেকে বলল, ‘জরুরি কথা আছে’। কথাটা কী? না, একটা আর্টিস্টদের সংগঠন গড়া দরকার। কারণ একে তো প্রাোডাকসন্স ম্যানেজারের দাপটে মেইন আর্টিস্টরা ছাড়া কেউই পুরো টাকা পেত না। তার ওপর বেশ কয়েকজন পুরোনো আর্টিস্ট প্রায় অনাহারে মারা গেছিলেন, যেমন কুসুমকুমারী ইত্যাদি; তার জন্য একটা তহবিল গড়া দরকার।

আমি তো শুনে লাফিয়ে উঠলাম। বিকাশদা বলল, ‘তুমি আমি লাফালে কিছু হবে না, ছবিদাকে তুই রাজি করা, তাহলেই কেল্লাফতে।’

সঙ্গে সঙ্গে বিকাশদাকে নিয়ে ছবিদার কাছে গেলাম। ছবিদা স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বললেন, ‘কী জগাই-মাধাই, কী মতলবে ঘুর ঘুর করছ?’

আমি বললাম, ‘আপনার কাছে একটা বিশেষ কাজে এসেছি।’

ছবিদা বললেন, ‘সে তো বেশ বুঝেছি, এবার বলো কাজটা কী?’

বিকাশদা গড়গড় করে তার প্রাোজেক্ট রিপোর্ট বলতে লাগল। ছবিদা বললেন, ‘এ তো সুধী প্রধান ও আর্টিস্ট অ্যাসোসিয়েশন করেছিল, সেটা তো মুখ থুবড়ে পড়েছে। যাই হোক, তোমরা কাল সকালে আমার বাড়ি এসো।’

পরদিন ছবিদার বাঁশদ্রোনীর বাড়ি গেলাম। উনি সব শুনে বললেন, ‘খাটাখাটনি সব তোমরা জগাই-মাধাই করবে, আমি কেবল উপদেশ দেব।’

আমরা তাতেই রাজি। এরপর ছবিদার নাম করে সুশীল মজুমদার, ছায়াদেবী, তুলসী লাহিড়ী, মিহির ভট্টাচার্য, মলিনাদেবী প্রভৃতিকে ডেকে একদিন মিটিং করে কমিটি গঠন হল, প্রেসিডেন্ট : নরেশ মিত্র। ভাইস প্রেসিডেন্ট : অহীন্দ্র চৌধুরী, তুলসীদাস লাহিড়ী, মহেন্দ্র গুপ্ত। জেনারেল সেক্রেটারি : ছবি বিশ্বাস। জয়েন্ট অ্যাসিস্টেন্ট সেক্রেটারি : বিকাশ রায়, ভানু ব্যানার্জী। ট্রেজারার : শিশির মিত্র। মেম্বারস : সুশীল মজুমদার, পাহাড়ী সান্যাল, কানু বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর গাঙ্গুলী, ধীরাজ ভট্টাচার্য, অভি ভট্টাচার্য, মলিনাদেবী প্রভৃতি। ‘অভিনেত্রী সঙ্ঘ’র জন্ম হল।

প্রথম দিকে আমাদের অফিস ছিল ছবিদার বাড়িতে। পরে আমার জামাইবাবু ভবেশ মুখোপাধ্যায়ের দাদা ডাক্তার যোগেশ মুখোপাধ্যায় ধর্মতলায় অফিসঘর জোগাড় করে দেন, যেটা এখনও ‘অভিনেত্রী সঙ্ঘ’র অফিস। সুতরাং বিকাশদা হচ্ছে অভিনেত্রী সঙ্ঘের জন্মদাতা পিতা, ছবিদা জ্যাঠামশাই এবং আমি একমাত্র কাকা। আমি যে ছবিদার একনিষ্ঠ ভক্ত, তা শুধু তাঁর সিরিয়াস অভিনয়ের জন্য নয়, ছবিদার যে কী সাংঘাতিক কমেডি সেন্স ছিল, যারা তাঁর সঙ্গে মেশেনি তারা জানে না। ছবিদা যদি কমেডি অভিনয় করতেন তবে আমি হলফ করে বলতে পারি ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, তুলসী চক্রবর্তী, জহর রায়ের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে যেত। ছবিদা বউবাজারের ‘দ্যাট আ বেটা’ ক্লাবে মদ্যপান করে একদিন ট্যাক্সি করে বসুশ্রী সিনেমায় আসছেন, ট্যাক্সিচালক ছোকড়া বাচাল গোছের বাঙালি সন্তান। ছবিদাকে দেখে দ্বিগুণ উৎসাহে ফরফর করতে লাগল এবং ‘জ্যাঠাবাবু’ সম্বোধন করতে লাগল। ছবিদার ব্যাপারটা মোটেই পছন্দ নয়। বললেন, ‘আমি যে তোমার বাবার চেয়ে বয়সে বড়, তা তুমি কী করে বুঝলে?’

ছোকরা ওসব সাটল হিউমার বোঝে না, বকবক করতেই লাগল।

ছবিদা মনে মনে ঠিক করলেন একে টাইট দিতে হবে। বসুশ্রীতে থেমে ছোকরাকে জিগ্যেস করলেন ‘কত উঠেছে?’

ছোকরা দুটাকা না আড়াই টাকা মিটারে উঠেছে বলল।

ছবিদা বললেন, ‘আচ্ছা ভাইপো, বউবাজারের ‘দ্যাট আ বেটা’ ক্লাব থেকে কালীঘাটের বসুশ্রী পর্যন্ত যদি দুটাকা ওঠে, কালীঘাটের বসুশ্রী থেকে বউবাজারের ‘দ্যাট আ বেটায়’ যেতে কত উঠবে?

ছোকরা বলে, ‘একী বলেন জ্যাঠাবাবু, ওখান থেকে আসতে যত উঠবে, যেতেও ততই উঠবে।’

ছবিদা বলেন, ‘তাই বুঝি! আচ্ছা বলো তো খোকা, দুগগা পুজোর কতদিন পরে কালীপুজো?’

ছোকরা বলে, ‘এই মাসখানেক পরে।’

ছবিদা—বা: বেশ! এবার বলো কালীপুজোর কদ্দিন পরে দুগগা পুজো?

ছোকরা এবার থতমত খেয়ে যায়।

ছবিদা বলেন, ‘তুমি ভাবতে থাকো, আমি চললাম।’

পাহাড়ীদাকে নিয়ে ছবিদার অজস্র প্র্যাকটিক্যাল জোক আছে। একবার একটা ছবির শুটিংয়ে ছবিদা, পাহাড়ীদা আরও কয়েকজন গল্প করছেন। বোধহয় সাবিত্রী, কাবেরী এরা ছিল। মেয়েদের দেখলে পাহাড়ীদা একটু স্মার্ট হওয়ার চেষ্টা করতেন। ছবিদা হঠাৎ জিগ্যেস করলেন, ‘আচ্ছা পাহাড়ী, তোর আর আমার তফাত কী বল তো?’

পাহাড়ীদা বললেন, ‘তুমি লম্বা, আমি তত লম্বা নই; কিন্তু তোমার চেয়ে আমি স্মার্ট।’

ছবিদা বলেন, ‘শুধু তাই বুঝি?’

পাহাড়ীদা আবার বলেন, ‘তুমি মনে করো তুমি আমার চেয়ে ভালো অভিনেতা।’

ছবিদা—’শুধু কি তাই?’

পাহাড়ীদা বলেন, ‘আর কী?’

ছবিদা—আসলে পার্থক্য হল, আমি সারাজীবন জমিদার হয়ে রইলাম আর তুই সারাজীবন আমার নায়েব হয়েই রইলি, সারাজীবন আমার সাব-অর্ডিনেট হয়েই রইলি।

আরেকবার ইন্দ্রপুরী স্টুডিয়োতে ছবিদা মেক-আপ রুমে মেক-আপ নিচ্ছিলেন। সেদিন খুব গরম ছিল। হঠাৎ পাহাড়ীদা গলদগর্ম হয়ে সেখানে পৌঁছোলেন, হাতের ফাস্ট-এইড বক্সটা রেখে রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলতে লাগলেন, ‘বাপরে বাপ, পৃথিবীতে কোথাও শান্তি নেই।’

ছবিদা বলে ওঠেন, ‘এতক্ষণ এখানে ছিল, তুই আসার আগে অবধি।’

বিকাশদার সঙ্গেও ছবিদা এরকম করতেন। একবার সুশীলদার একটা ছবির শুটিং করতে ছবিদা, বিকাশদা, সুশীলদা ও তাঁর স্ত্রী আরতি মজুমদার, প্রণতি ঘোষ, স্বাগতা এরা সব ছিল, শুটিং করতে দার্জিলিং গেছে। দার্জিলিংকে তখন ‘ভারতের সুইজারল্যান্ড’ বলা হত। সকালে ম্যানেজার এসে কে কী খাবে তার অর্ডার নিতে এল। বিকাশদা ও আরও দু-চারজন ইংলিশ খানার অর্ডার দিল। ছবিদা আর বাকি সবাই বাংলা খানা, মাছের ঝোল-ভাত অর্ডার দিল। রাতে খাবার টেবিলে ছবিদা, বিকাশদা, সুশীলদাসহ আর ৬-৭ জন পুরুষ-মহিলা বসল, ইংলিশ খানা কেবলমাত্র বিকাশদা, সুশীলদা ইত্যাদি দু-তিনজনের জন্য হয়েছিল, অথচ তার সিংহভাগই ছবিদা খেয়ে নিলেন, তারপর বাংলা খানাও খেতে লাগলেন। বিকাশদা প্রতিবাদ করে বলল, ‘ছবিদা, আপনার তো ইংলিশ খানা খাওয়ার কথা নয়, আপনিই তো সব খেয়ে নিলেন!’

ছবিদা দমে না গিয়ে বললেন, ‘কী করব বল, বেয়ারাগুলো সাহেবি খানা খাওয়ার উপযুক্ত সাহেবি চেহারা দেখে আমাকেই দিচ্ছে, তোর বেগুনপোড়া-মার্কা চেহারা দেখে কেউ তোকে দিচ্ছে না। তোকে যে এখনও টেবিল থেকে উঠিয়ে দেয়নি, সেটাই তোর ভাগ্য।

বিকাশদার প্রথম পরিচালিত ছবি ‘অর্ধাঙ্গিনী’তে আমার বাড়ির প্রায় সবাই অভিনয় করেছে, আমি, আমার তিন ছেলে-মেয়ে, আমার ভাগনি বুলি এবং আমার বাড়ির আরেক ভাড়াটের ছেলে চন্দন। সেটা ১৯৫৪ সাল। ছবিদার সঙ্গে আমার প্রায় রোজ দেখা হয়, আমরা সবাই অভিনয় করছি দেখে, ছবিদারও ইচ্ছে এই ছবিতে অভিনয় করে, বিশেষ করে আমার মেয়ে ভুটি তখন আড়াই বছরের। ওকে ছবিদা খুবই ভালোবাসতেন। একদিন আমি, আমার ছেলে-মেয়েরা সবাই একটা সিনে পার্ট করছি, একটা নেমন্তন্ন বাড়ির সিন, অনেকে আছে, টেকনিসিয়ান স্টুডিয়োতে ১ নং ফ্লোরে শুটিং চলছে—ছবিদা এসে হাজির। ৩ নং ফ্লোরে ওঁর শুটিং হচ্ছিল সুশীলদার ‘শুভরাত্রি’ ছবির। ওখানেও ভুটি পার্ট করছিল। ভুটিকে কোলে করেই এলেন ছবিদা, সটান বিকাশদাকে এসে বললেন, ‘আমার পার্ট চাই।’

বিকাশদা বলল, ‘আপনার পার্ট নেই।’

ছবিদা বলেন, ‘পাহাড়ীকে বাদ দিয়ে আমায় নে।’

বিকাশদা বলে, ‘পাহাড়ীদার অলরেডি ৪-৫ দিন শুটিং হয়ে গেছে, বাদ দেওয়া যাবে না।’

ছবিদা বলে, ‘তাহলে অমরকে (অমর মল্লিকা) বাদ দে।’

বিকাশদা—না, তা হয় না।

ছবিদা—তাহলে ভানুকে বাদ দে।

বিকাশদা—অসম্ভব, ভানুর ইম্পর্টেন্ট রোল, তার ওপর বাঙাল চাকরের পার্ট, আপনি বাঙালের ভাষা বলবেন?

ছবিদা—ওটা ঘটি চাকর বানিয়ে দে।

বিকাশদা—না না, আপনি যান তো ডিসটার্ব করবেন না। ভুটিকে আদর করতে হয়, ভানুর বাড়ি গিয়ে আদর করবেন।

গঙ্গাদা, গঙ্গাপদ বসু নিপাট ভালো মানুষ, সাত পাঁচে নেই, তাঁকে নিয়েও একবার ছবিদা পড়েছিলেন। ব্যাপারটায় আমিও অবাক হয়েছিলাম কারণ, বিনা কারণে ছবিদা কখনও কারুর পেছনে লাগতেন না। অনেক পরে জেনেছিলাম তখনকার দিনের কয়েকজন, অ্যামেচার থিয়েটারের মহারথী অভিনেতা প্রফেশনাল থিয়েটার নিয়ে বেশ কিছু বিদ্রুপ ও অত্যন্ত জঘন্য মন্তব্য করেছিলেন, তাদের তো আর তখনই হাতের কাছে পাচ্ছেন না, তাই অ্যামেচার থিয়েটারের অন্যতম অভিনেতা, গঙ্গাদাকে সামনে পেয়ে ওঁকে দিয়েই ঝাল মেটালেন। অথচ গঙ্গাদার মধ্যে কোনওরকম তথাকথিত লোকদেখানো ভণিতা ছিল না, উনি একইসঙ্গে অ্যামেচার থিয়েটার ও প্রফেশনাল সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন।

ব্যাপারটা হল, আমরা অনেকে ট্রেনে করে ‘দাদাঠাকুর’-এর আউটডোরের শুটিং-এ যাচ্ছি। এক জায়গায় ছবিদা, আমি, বুড়ো অনেকে আছি। আরেকটা জায়গায় বেশ দূরে গঙ্গাদা, ক্যামেরাম্যান তরুণ প্রাোডাকসন ম্যানেজার সুখেন, অভিনেতা তরুণ, তার ভাই, আমাদের বন্ধু রমেন ইত্যাদি ছিল। সেই সময়টা ছিল শীতকাল। ছবিদার প্রবল হাঁপানির টান হলে রাত তিনটে-চারটে অবধি জেগে থাকতেন। রাত বারোটা নাগাদ মাল-টাল খেয়ে টং হয়ে বললেন, ‘চল, ঘুরে আসি।’

আমি বললাম, ‘কোথায়?’

বললেন, ‘চল গঙ্গার সঙ্গে গল্প করে আসি।’

আমি ছবিদাকে হাড়ে হাড়ে চিনি, তখনই বুঝেছি কোনো এক কারণে ছবিদা আজ গঙ্গাদার পিলে চমকানোর ব্যবস্থা করছেন। আমি ভীষণ ঘুমকাতুরে ছিলাম। ছবিদা সেটা জানতেন।

আমি বললাম, ‘অসম্ভব, দু-চোখ খোলা রাখতে পারছি না। এখনই না ঘুমালে কালকে শুটিং করতে পারব না।’ খানিকক্ষণ জোরাজুরির পর ছবিদা বিফল হয়ে একাই চলে গেলেন।

পরের দিন সকালে রবি রায়চৌধুরীর (রবসন) কাছে পুরো গল্প শুনলাম। গঙ্গাদা ঘুমিয়ে ছিল, ছবিদা চুপটি করে তার পায়ের পাশে বসে আস্তে আস্তে ধাক্কা দিয়ে বললেন, ‘ও গঙ্গা, গঙ্গা, ঘুমোলে ভাই গঙ্গা?’ রবসনের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কী ঘুম রে বাবা, গঙ্গাপ্রাপ্তি হল নাকি?’

ঘুম থেকে জেগে গঙ্গাদা দেখে ছবিদা তার পায়ের কাছে বসে আছেন। গঙ্গাদা তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বসলেন—’আরে ছবিদা, ছি: ছি:, আপনি পায়ের কাছে বসে আছেন?’

ছবিদা বললেন, ‘আরে তোমার সঙ্গে গল্প করতে এলুম। জানোই তো আমার দারুণ হাঁপানির টান, রাতে ঘুম হয় না। সবার সঙ্গে তো আর গল্প করা যায় না, তুমিই এখানে যোগ্যতম ব্যক্তি, তাই তোমার কাছেই এলুম; ঘুম ভাঙালাম বলে কিছু মনে করলে না তো ভাই গঙ্গা?

গঙ্গা বলে, ‘আরে না না ছবিদা, আপনার মতো একজন মহান লোক গল্প করতে এসেছেন, এ তো আমার সৌভাগ্য আর আমার রাত জাগা অভ্যেস আছে।’

ছবিদা কিছুই বলেন না, গঙ্গাদার চোখ বুজে এসেছে। হঠাৎ ছবিদা বলেন, ‘গঙ্গা যে-সে লোক নয়, গঙ্গার পুণ্য জলে সব পাপ ধুয়ে যায়। কী, ঘুমোলে ভাই গঙ্গা?’

গঙ্গাদা তো বুঝে ফেলেছেন যা বুঝবার, বললেন, ‘না না, আপনি বলুন না।’

আবার খানিকক্ষণ চুপ, গঙ্গাদাও ঢুলছেন। আবার ধাক্কা মেরে বলেন, ‘এই গঙ্গা ভাই যে-সে লোক নয়, মা গঙ্গা, আদি গঙ্গা, আমার বাড়ির সামনে দিয়ে টালির গঙ্গা, ওঁ গঙ্গা, মা গঙ্গার কত রূপ! কী ঘুমোলে ভাই গঙ্গা?’

এইভাবে পান খেতে খেতে, পান করতে করতে, ক্রমান্বয়ে গঙ্গাদার পেছনে লাগতে লাগতে রাত ৩ টে।

গঙ্গাদার চক্ষু বিস্ফারিত, গঙ্গাদা টাক ঢাকার জন্য বাঁদিকের চুল অনেক বড় রাখতেন, সেই চুলে টাক ঢেকে ডানদিকে ফেলতেন। সেই, প্রায় ৮-১০ ইঞ্চি লম্বা চুলের গোছা তখন সটান দাঁড়িয়ে গেছে। অবশেষে ছবিদা সকাল ৪টের সময়ে বললেন, ‘এবার আমি ঘুমোতে চললুম, তুমিও ঘুমাও ভাই গঙ্গা।’ ততক্ষণে গঙ্গাদার ঘুম কপালে উঠেছে।

ছবিদা অভিনয়ের সময় নানারকম প্যাঁচপয়জার করতেন, তাতে যারা কো-অ্যাকটর তাদের বেশ অসুবিধা হত, বিশেষ করে নাটকে হঠাৎ নিজের ডায়লগ ছেড়ে নানারকম খেলতেন। সেগুলো প্রাসঙ্গিকই থাকত। কিন্তু খুব পাকা কো-অ্যাকটর না হলে ভীষণ ঝামেলা হত। একবার এক নাটকে আমি ছবিদার কাছে বাড়ি ভাড়া চাইতে এসেছি। ছবিদার টানাটানির সংসার, ভাড়া দিতে পারে না। আমি রাগারাগি করে বেরিয়ে যাচ্ছি, ছবিদা আমায় থামিয়ে বলেন, ‘আহা রাগ করবেন না, চা খেয়ে যান?’

আমি বলি, ‘না।’

উনি বলেন, ‘ডাব খেয়ে যান।’

আমি বলি, ‘না।’

উনি আবার বলেন, ‘তা হলে চা খেয়ে যান।’

আমি বলি, ‘না।’

ছবিদা আবার বলেন, ‘তা হলে ডাব খেয়ে যান।’

আমি বলি, ‘তাহলে চা আর ডাব দুটোই খাব, যান নিয়ে আসুন।’

ছবিদা গলা নামিয়ে বলেন, ‘বাবা বেশ দিলি তো। এসব ডায়লগ ছিল না, আমার এতে কনফিডেন্স বেড়ে গেল।’

একদিন অনুপ, সন্ধ্যা সবাই ছিল। আমি বললাম, আজকে ছবিদাকে আমি খেলাব। আমাদের মধ্যে একজন দুমুখো লোক ছিল, সেটা হল সুখেন। ছবিদাকে গিয়ে বলল, ‘ভানুদা আপনাকে আজ খেলাবার তাল করেছে।’

ছবিদা শুনে মুচকি হাসলেন। আমার সিন ছিল ছবিদার কাছে ভাড়া চাইতে গেছি। উনি ভাড়া দিতে পারছেন না, এই নিয়ে দু-কথা। আমি সিনে ঢুকেছি, ঢুকে ডায়লগ বলছি, ছবিদা আর কিছু বলে না।

আমি ভাবছি একটু বাদে বলবে, কারণ ছবিদা এমনিতেই অনেক ফুটেজ খেয়ে ডায়লগ বলতেন, কিন্তু সেদিন আর বলে না। বেশ খানিকক্ষণ বাদে বলেন, ‘আপনার নাম কী?’

আমি বলি, ‘কৃতান্ত বিশ্বাস।’

ছবিদা—কাউকে সহজে বিশ্বাস করবেন না।

আমি বলি, ‘ঠিক আছে, আপনার উপদেশ মনে রাখব।’

তারপর আবার বলেন, ‘আবার কাউকে খামোকা অবিশ্বাসও করবেন না।’

আমি বলি, ‘বেশ তাই হবে।’

এগুলো সব ডায়লগের বাইরে ছবিদার খেলা চলছে। এবার বলেন, ‘বিশ্বাস করবেন না, অবিশ্বাসও করবেন না; তাহলে কী করবেন?’

আমি তো প্রমাদ গুনছি, চুপি চুপি বলি, ‘অন্যায় হয়ে গেছে মাপ করে দিন।’

ছবিদা জোরে জোরে বলেন, ‘বিশ্বাস করবেন না, অবিশ্বাসও করবেন না, তাহলে কী করবেন বলুন?’

তারপরে আস্তে আস্তে আমাকে বলেন, ‘বল, বাড়ি গিয়ে ভাবব।’

সেবারকার মতো তাই বলে পার পেয়ে গেলাম। একবার স্টারে ‘শ্রেয়সী’ নাটকের সময় একটা সিনে ছবিদা, আমি, বসন্ত, অনুপ আরও কে কে ছিল। সিনটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল, বসন্ত খুব উত্তেজিত হয়ে ছবিদাকে কিছু জিজ্ঞাসা করছে, কিন্তু ছবিদা উত্তর দিচ্ছেন না, এরকম চার-পাঁচবার হবার পর বসন্ত ফিসফিসিয়ে বলে, ‘কী ছবিদা, ডায়লগ বলুন?’

ছবিদা ফিসফিসিয়ে বলেন, ‘ডায়লগ বলব কী, সামনের রো-তে দেখ।’

আমরা সবাই দেখি সামনের রোতে আট-দশজন চাইনিজ ডেলিগেশনের লোক বসে আছে। আমরা বললাম, ‘কী হয়েছে তাতে?’

ছবিদা বলেন, ‘না, আমি ভাবছি ওরা জেগে আছে না ঘুমিয়ে আছে!’ (চাইনিজদের চোখ ছোট কুতকুতে, তাই নিয়ে ছবিদার বাম্পার)।

অনুপ আর আমি হাসি চাপবার জন্য পিছন ফিরে দ্রুত স্টেজ থেকে বেরিয়ে গেলাম। কিন্তু বসন্তর তো ডায়লগ ছিল, ও কী করবে ভাবতে না পেরে খানিকক্ষণ ‘থ’ মেরে দাঁড়িয়ে রইল, তার পরে ম্যানেজ করে বলে, ‘আচ্ছা, আমি আবার পরে আসছি।’ বলে দ্রুত বেরিয়ে যায়।

আমরা উইংস থেকে বেরিয়ে গিয়ে হাসছি, বসন্ত হন্তদন্ত হয়ে এসে বলে, ‘দেখলি বুড়োর কাণ্ড! কীরকম বেইজ্জত করল পাবলিকের সামনে।’

ছবিদা এইসব মজা করার জন্যেই সেইসময়টা স্টারে জয়েন করেছিলেন। স্টারে আগের নাটকগুলো জমছিল না। সেটা ১৯৫৮ সাল হবে। আমার সিন হয়ে যাবার পর একদিন স্টার থেকে বাড়ি আসার জোগাড় করছি। হঠাৎ দেখি মেক-আপ রুমে মল্লিক সাহেব, সলিল মিত্র ও দেবুদা এসে হাজির। ওঁরা সবাই মিলে ‘জলসাঘর’ ছবিতে ছবিদার অ্যাকটিংয়ের খুব প্রশংসা করতে লাগলেন। মল্লিক সাহেব বলেন, ‘দেখো না ভানু, ছবিবাবুকে স্টারে নাটকের জন্য যদি রাজি করানো যায়।’

আমি বললাম, ‘দেবুদা (দেবনারায়ণ গুপ্ত) থাকতে আমায় বলছেন?’

দেবুদা বলেন, ‘নারে বাবা, আমি রোজই যাচ্ছি, চা, পান খাচ্ছি কিন্তু কিছুতেই আর থিয়েটারে রাজি করাতে পারছি না (ছবিদা সত্যিই বছর দশেক ধরে আর থিয়েটার করছেন না সেই সময়টা), তুমি একটু দেখো না, তুমি ছবিদাকে দিয়ে অসাধ্যসাধন করাতে পারো।’

আমি পরের দিন বসুশ্রীতে আড্ডা মারার সময় ছবিদাকে বললাম, ‘ছবিদা, আপনার সঙ্গে একটা ইমপর্টেন্ট কথা আছে।’

ছবিদা হাত তুলে বলেন, ‘বুঝেছি, দেবু পাঠিয়েছে তোকে, কিন্তু আমার আর থিয়েটার করার ইচ্ছা নেই, ভীষণ খাটনি হয়, তার ওপর হাঁপানির টানটাও বেড়ে গেছে।’

সেই সময়েই সন্ধ্যাও (সন্ধ্যা রায়) সেখানে ছিল। আমি বললাম, ‘আমি, আপনি সন্ধ্যা বেশ মজা করে থিয়েটার করব।’

ছবিদা বললেন, ‘শুধু মজায় তো হবে না আরও কিছু তো দেখতে হবে।’

আমি ফোন করে দেবুদাকে বললাম, ‘আমি এই অ্যামাউন্টে টাকাটা ছবিদাকে অফার করেছি (সেইসময় বাংলাদেশে ওই পরিমাণ টাকা তখন কেউ থিয়েটারে পেত না), আপনারা রাজি তো?’

দেবুদা, মল্লিক সাহেবকে ফোন করে জেনে আমায় বললেন, ‘রাজি।’

এই ছবিদা আবার ১০ বছর পরে থিয়েটারে যোগ দিলেন স্টারের ‘ডাক বাংলো’ নাটকে। ‘ডাক বাংলো’র পর ‘শ্রেয়সী’তেও ছবিদা কিছুদিন অভিনয় করেছিলেন।

ছবিদার এই সব প্যাঁচ-পয়জারে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হতেন যিনি তিনি হচ্ছেন তুলসীদা। তুলসীদা ট্রামে করে বাড়ি ফিরতেন, হাতিবাগান থেকে হাওড়ায় ফিরতে ১০.৩০টা-১১টা হয়ে যেত, তাতে ওঁর খুবই অসুবিধা হত।

ছবিদা সিনেমাতেও নিজের ইচ্ছামতো ডায়লগ লাগাতেন, তাতে কো অ্যাক্টরদের অসুবিধা হত। একবার টেকনিসিয়ান স্টুডিয়োতে ২নং পোড়া ফ্লোরের কাছে আমাদের ‘কাঞ্চনমূল্য’ বইয়ের সেট পড়েছে। ১নং ফ্লোরে উত্তমের একটা ছবির শুটিং চলছে। সকাল থেকে লক্ষ করছিলাম, উত্তম ১নং ফ্লোর থেকে হাঁটতে হাঁটতে ৩নং ফ্লোরের দিকে যাচ্ছে, আবার হাঁটতে হাঁটতে ফিরছে, মাঝে শট থাকলে শট দিয়ে আবার পায়চারি করছে। বেশ অনেকক্ষণ চলার পর আমি উত্তমের কাছে গেলাম, দেখলাম ও আমাকে লক্ষ করেও কিছু না বলে আবার পায়চারি করতে লাগল।

আমিও ছাড়ার পাত্র নয়। আমি ওর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে বললাম, ‘কী হল? গৌরীর সঙ্গে ঝামেলা?’

উত্তম ‘না’ বলে আবার হাঁটতে লাগল আর বিড়বিড় করতে লাগল।

আমি বললাম ‘গৌতমের (ওর ছেলে) কিছু হয়েছে?’

ও থেমে বলে, ‘আরে না বাবা, ওসব কিছু না, ছবিদার সঙ্গে একটা বড় শট আছে, জানিস তো বুড়োটা কেমন ডায়লগ নিয়ে প্যাঁচ মারে, তাই আমার ডায়লগটা ঝালিয়ে রাখছি।’

ছবিদার আরেকটা বিখ্যাত প্যাঁচের গল্প হচ্ছে ‘সাজাহান’ নাটকের কম্বিনেশন নাইট হচ্ছে। একটা সিনে সাজাহানরূপী ছবিদা গলার থেকে মালা খুলে ‘জাহানারা’রূপী সরযূদিকে বলে, ‘এ মালা আমি তোমায় দিলাম জাহানারা।’

এদিকে ছবিদার আলগা দাড়ি-গোঁফও মালার সঙ্গে উঠে এল। তাই দেখে ফিসফিসিয়ে সরযূদি বলে, ‘ছবিবাবু, মালার সঙ্গে দাড়িগোঁফ লেগে রয়েছে, হলসুদ্ধ লোক এটা দেখছে।’

ছবিদা বেশ জোড়েই বলেন, ‘ওটাও দিলাম।’—হলসুদ্ধ লোক হেসে উঠল।

ছবিদার সঙ্গে মাঝে মাঝে আড্ডা মারতে মারতে তর্কাতর্কিও হত। ছবিদা পরিচালক হিসাবে দেবকীবাবুকে খুব পছন্দ করতেন। আর আমার সবচেয়ে পছন্দের পরিচালক ছিলেন বড়ুয়া সাহেব। একবার ‘গ্র্যান্ড হোটেল’ ছবি নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। এই ছবিতে জন এবং লায়োনেল ব্যারিমূর ছিল ছবিদার ভীষণ পছন্দের, আমার ফেবারিট আর্টিস্ট ছিল ওয়ালেস বিইরি। এবার লায়োনেল ব্যারিমূর আর ওয়ালেস বিইরির মধ্যে কে বেশি ভালো অভিনয় করেছে এ ছবিতে, তাই নিয়ে খানিকটা তর্কাতর্কি চলল।

মাঝে দু-বছর আমি জুবিলি পার্কে ঘর ভাড়া নিয়েছিলাম। তখন আবার ছবিদার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ আরও বেড়ে গেছিল, কারণ ছবিদার প্রাণের দোস্ত নৃপতিদা তখন জুবিলী পার্কে থাকত। সুতরাং বিকালবেলায় আমার বাড়িতে আড্ডা মেরে, রাতের বেলায় নৃপতিদার বাড়িতে আড্ডা মারতে যেতেন। আবার নৃপতিদার বাড়ির ওপরে বীরেন (বীরেন চ্যাটার্জী) থাকত। মাঝে মাঝেই, বিশেষ করে গরমকাল হলে বীরেনের ছাতে বেশ করে পানসভা বসত। ছবিদা, নৃপতিদা, বীরেন ছাড়াও সুশীলদা, নীতিশদা, সরোজদা (সরোজ সেনগুপ্ত) ইত্যাদি প্রভৃতি বিবিধ প্রকার তারকার সমাগম হত। ছবিদা মাঝে মাঝেই আমাকে টানাটানি করতেন। কিন্তু বিশেষ জোরাজুরি করতেন না, কারণ বুঝতেন সংসারে অশান্তি হবে।

ছবিদা মদ্যপান করলে একটা মজার খেলা খেলতেন, সেটা হল, গাড়ি করে কলকাতার বাইরে কোনো জায়গায় নিয়ে গিয়ে রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে আসতেন। একবার নৃপতিদাকে ডায়মন্ড হারবারে ফেলে পালিয়ে এসেছিলেন।

ওই ঘটনার পরে নৃপতিদা খুব সেন্টিমেন্টাল কথাবার্তা বলাতে ছবিদা বললেন, এমনটি আর কখনও হবে না। এরপর একদিন একটা খুব মজার ঘটনা ঘটল, নৃপতিদার বাড়িতে পান-ভোজন হওয়ার পর ছবিদা গাড়ি নিয়ে একা বাঁশদ্রোনী ফিরবেন। নৃপতিদা কিছুতেই ছবিদাকে একা ছাড়বেন না, গাড়িতে চড়ে বসলেন। বাঁশদ্রোনীতে গিয়ে ছবিদা আবার নৃপতিদাকে অত রাত্রে একা জুবিলি পার্কে ফিরতে দেবেন না। তাই ছবিদা ওঁকে নিয়ে জুবিলি পার্ক এলেন। এভাবে জুবিলি পার্ক ও বাঁশদ্রোনী করতে করতে রাত কাবার হয়ে গেল।

ছবিদা আমার সঙ্গে যেটা করতেন সেটা একটু অন্যরকম, আমাকে হয়তো রাস্তায় ছেড়ে দিলেন, আমি গাড়ি থেকে নেমে হাঁটা মারলাম। আবার একপাক ঘুরে এসে আমায় গাড়িতে উঠতে বলতেন। আমিও চালাক কম না। একবার এরকম হওয়ার পর কোনো দরজা-খোলা-বাড়ির গলিতে ঢুকে পড়তাম, ছবিদা গাড়িতে তিন-চার পাক খেয়ে আমায় না-পেয়ে বাড়ি ফিরে যেতেন।

তবে ছবিদার একটা গুণ ছিল, তাঁর রসিকতা যে খোলা মনে না নিত তার সঙ্গে তিনি রসিকতা করতেন না। যেমন কমলদা (কমল মিত্র), সুলালদা (জহর গাঙ্গুলী)-দের সঙ্গে কখনও রসিকতা করতেন না।

এহেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ ছবিদাকেও একবার হেনস্থা হতে হয়েছিল। এটা আমার ছবিদার কাছেই শোনা। ছবিদা একবার বড়বাবু (শিশির কুমার ভাদুড়ী)-র কাছে গেছিলেন তাঁকে দিয়ে একটা নাটক করাবার জন্য। ছবিদা ও তাঁর সঙ্গে দু-একজন গেছিলেন। তাঁদের সবাইকে বসিয়ে পাক্কা দু-ঘণ্টা ধরে নাটকের সংলাপ বলালেন বড়বাবু। ছবিদাকে বললেন, ‘তোমার অভিনয়-ক্ষমতায় যদি আমাকে নম্বর দিতে বলা হয়, তাহলে তোমাকে আমি ”শূন্য” দিলাম। আগে তিন-চার মাস রিহার্সাল দাও, তারপরে এসো; যদি দেখি নাটকে অভিনয় করার উপযুক্ত হয়েছ, তখন ভাবব।

ওখান থেকে বেরিয়ে সোজা বাড়ি চলে এলেন। ঘাবড়ে টাবড়ে জাঁদরেল ছবি বিশ্বাসের তখন নাজেহাল অবস্থা। ছবিদার আর একটা বিশেষ গুণ ছিল, রাখঢাক রেখে কথা বলতেন না, যা বলবার সামনাসামনি বলতেন।

আবার কিছু জায়গায় সেটা ভালো না দেখলে আমার ওপর দিয়ে চালিয়ে দিতেন। যেমন, কিছু অভিনেতা-অভিনেত্রীর অভিনয় তাঁর ভালো লাগত না, কৃত্রিম বলে মনে হত। লোকমহলে সেটা নিজের অভিমত না বলে বলতেন, ‘এই তো ভানু বলছিল, ওর অভিনয় আমার কৃত্রিম বলে মনে হয়, একেবারে এ-ছবির অন্যদের সঙ্গে মানানসই নয়।’

আমি হয়তো এমন কথা কখনো আগে বলিনি, কিন্তু ছবিদার কথা শুনে মনে হল তাই তো, ছবিদা যখন বলছে তখন তাই-ই হবে।

ছবিদার বাড়ি যখন প্রথম প্রথম যেতাম, তখন দেখতাম ছবিদা বাগানের জন্য প্রচুর খরচ করতেন, গোলাপের বিরাট বাগান। সিঙ্গাপুর থেকে নানারকম গাছের চারা আনিয়েছিলেন। আবার বেগুন, কুমড়ো নানারকম তরকারি হত। আবার গোয়ালঘরে জার্সি গরু ছিল। সে এক এলাহি ব্যাপার! আমি ভাবতাম বিডন স্ট্রিটে নিজের বাড়ি, পার্ক সার্কাসের নিজের বাড়ি ছেড়ে ২৪ পরগনায় এরকম, প্রায় গ্রামদেশের মতো বাঁশদ্রোনীর ভাড়াবাড়িতে ছবিদা এত খরচা করেন কেন? ভাড়া বাড়ি কোনো দিন তো ছেড়ে দিতে হবে, তাই একদিন এই কথা বললাম।

ছবিদা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘মিডল ক্লাস কেরানি মেন্টালিটি তো, তুই বুঝবি না, আমি যেখানে যতদিনই থাকি জমিদারের মতো থাকতেই ভালোবাসি।’

ছবিদার এরকমই একটা ইন বর্ন জমিদারি মেজাজ ছিল। এইজন্যই ‘জলসাগর’, ‘দেবী’ এইসব ছবিতে তার অভিনয় জলভাত ছিল। প্রকৃতপক্ষে সেইসময়ে আমাদের ফিল্ম লাইনে একটা কথা চালু ছিল, ‘এ ফিল্ম ইজ ডিরেক্টর মিডিয়া’ বিশেষ করে সত্যজিৎ রায়, তপন সিনহার মতো ডিরেক্টর হলে তো বটেই। কিন্তু আমরা জোক করে বলতাম, কেবল তিনটে ছবি ডিরেকটর্স মিডিয়া নয়; তা হল ‘জলসাঘর’, ‘দেবী’, আর ‘কাঞ্জনজঙ্ঘা’।

কিন্তু আমার যেটা আশ্চর্য লাগে সেটা হল ‘দাদাঠাকুর’, ‘হেডমাস্টার’, বিশেষ করে ‘কাবুলিওয়ালা’তে ওঁর অভিনয়। শুনেছি, অসিত চৌধুরীর ইচ্ছা ছিল ‘কাবুলিওয়ালা’তে রাধামোহনদাকে নেওয়া হোক, কারণ কাবুলিওয়ালার একটা গরিব, দরদী দিল কাবুলি। ছবিদার মতো জমিদারি মেজাজের একেবারেই নয়। কিন্তু তপনবাবু তো ভীষণ ইনটেলিজেন্ট ও দূরদর্শী ছিলেন, উনি জানতেন এ অভিনয় ছবিদা ছাড়া আর কেউ পারবে না। প্রথম কয়েকদিন ছবিদা কাবুলিওয়ালাদের সঙ্গে মিশে তাদের অ্যাকসেন্ট রপ্ত করে বেশ ভালো ভালো জরির চোপ্পা চাপকান পরে অভিনয় করতে লাগলেন, তার ওপর গোঁফ-দাড়ি আলগা। শুটিং চলাকালীন প্রথম-প্রথম ইউনিটের লোক দুশ্চিন্তায় ছিল।

তারপরে ছবি তো রিলিজ হল। হইহই ব্যাপার। ছবিদার অভিনয়ে বাংলাদেশ অভিভূত।

১৯৫৭ সালে ছবিদা, তপনবাবু প্রভৃতি বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে গেলেন ‘কাবুলিওয়ালা’ ছবি নিয়ে। আমি ছবিদাকে ‘সি অফ’ করতে দমদম গেছিলাম প্রবল উৎসাহে, নিশ্চিত ছিলাম আর যাই হোক ছবিদা ‘শ্রেষ্ঠ অভিনেতা’র প্রাইজ পাবেনই। পরে ছবিদা ও তপনবাবুর থেকে বার্লিনের গল্প শুনে যা বুঝেছিলাম, বার্লিনে ছবি দেখানোর আগে কলাকুশলীরা মঞ্চে উপস্থিত হয়ে ছবি সম্বন্ধে কিছু বলবেন। কিন্তু ছবিদা হলে পৌঁছোলেন অনেক পরে। সুতরাং তপনবাবু একাই ম্যানেজ করলেন। যে হলে ছবিটা দেখনো হয়েছিল সে হলটা পুরো ভর্তি ছিল। (সেবার বার্লিন আবার তারকাখচিত ছিল) মার্লন ব্যান্ডো, হেনরি ফন্ডা, গ্লেন ফোর্ড প্রভৃতি পৃথিবী-বিখ্যাত তারকারা ছবিদার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত একজন স্পেনের অভিনেতা সেবার শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পেলেন। ছবিদাকে নিয়ে সেখানে পৃথিবীর সব বড় বড় ফিল্ম ক্রিটিকরা প্রেস মিট করেছিল। কোনও এক ক্রিটিক ছবিদাকে জিগ্যেস করেছিল ‘তুমি তোমার সমকক্ষ অভিনেতা এখানে কাকে মনে করো?’

যে ক্রিটিক প্রশ্ন করেছিল সে ভেবেছিল হয়তো ছবিদা মার্লন ব্যান্ডো, হেনরি ফন্ডার মতো তখনকার কোনও দিকপাল অভিনেতার নাম করবেন। কিন্তু ছবিদা পাত্তা না দিয়ে বললেন ‘হু এলস দ্যান ব্যারিমোরস’, ছবিদার সবচেয়ে পছন্দের অভিনেতা ছিল জন ও লায়োনেল ব্যারিমুর ভ্রাতৃদ্বয়। (বিশেষ করে ছবিদার অভিনয়ে লায়োনেল ব্যারিমুরের প্রভাব ছিল) রাজকাপুরও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। রাজ তো ছবিদার অভিনয় দেখে অভিভূত হয়ে গেছিল। টাইমস পত্রিকার ক্রিটিক তো লিখেছিল, ‘He is so good his performance was so mesmerising that he makes you forget about his beard।’

বিমল রায় পরে হিন্দিতে এ-ছবি করার কথা ভেবেছিলেন, কিন্তু ছবিদার জায়গায় কাকে নেবেন তা ভেবে অনেক দিন এ-ছবিটা করেননি।

ছবিদার মানবিক দিক সম্বন্ধে কিন্তু অনেকেই অনেকরকম কথা বলেছেন। উনি নাকি টাকা-পয়সা নিয়ে ঝামেলা করতেন, ঠিক সময়ে শুটিং-এ আসতেন না। আমার নিজের এক্সপিরিয়েন্স কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা। ১৯৬০ সালে যখন আমার মা মারা যান, শ্মশানে আমার হাতে জোর করে পাঁচশো টাকা গুঁজে দেন। আমার হয়তো দরকারও ছিল না। কিন্তু ছবিদা বললেন, ‘রেখে দে, দরকার হবে।’

‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’, ‘সখের চোর’, ‘ভ্রান্তি বিলাস’ ছবির প্রযোজক অনন্তদা (অনন্ত সিং) এ-ছবিগুলিতে অভিনয় ছাড়াও অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাজগুলোও আমি করেছি। ‘নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতিতে’, প্রযোজক বি.এল. খেমকা, এ ছবির অনেক প্ল্যান-প্রাোগ্রাম নির্মলদা (ডিরেক্টর নির্মল দে)-র সঙ্গে মিলে আমিই করেছি। এ ছাড়া ‘কাঞ্চনমূল্য’ ছবির প্রাোডিউসার আমিই ছিলাম। এসবক’টি ছবিতে ছবিদা কাজ করেছেন। একদিনও শুটিং-কলটাইমের পর পৌঁছোননি।

আর টাকার কথা কী বলব, ‘কাঞ্চনমূল্য’ ছবির সময় ছবিদার রেট ছিল ডেইলি দু’হাজার টাকা। আমি তো পাঁচশো টাকা দিয়েছি। তা-ও আবার রেগুলারলি দিতে পারিনি। প্রায় ১০-১২ দিন ওর শুটিং ছিল। প্রত্যেকদিন কল টাইমের আগে পৌঁছেছেন। বহুদিন প্যাক আপ হবার পরও থেকে গেছেন আড্ডা মারার জন্য।

‘স্কাইরুম’ রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার ছবিদার শুটিং থাকলে রোজ এক প্যাকেট হ্যাম, সসেজ নিয়ে আসত, কোনওদিন আমাকে কিংবা আমার ছেলে গৌতমকে (এ-ছবিতে মেইন রোলে পার্ট করেছিল) না দিয়ে খাননি।

আমার স্ত্রী নীলিমার একটা গানের স্কুল ছিল, নাম ‘সঙ্গীতশ্রী’। প্রত্যেক বছর বার্ষিক উৎসব হত। ১৯৬১ সালের জুলাই মাসে একাডেমিতে ‘কাবুলীওয়ালা’ নাটক হওয়ার কথা ছিল। ছবিদা ও মালা বাগ (শিখা বাগের বোন)-এর অভিনয় করার কথা ছিল। ছবিদা একটা পয়সা তো নেন-ইনি সেদিন প্রবল বৃষ্টির নাটকটাও হয়নি। কিন্তু ছবিদা, সবাই চলে গেলে তারপরে আমায় নিয়ে বাড়ি পৌঁছে দেন, এমনকী ছবিদার মতন ওরকম ভীষণ ব্যস্ত মানুষ আট-দশ দিন আমার বাড়িতে রির্হাসালও দিয়েছিলেন।

আবার ছবিদা আমার পেছনেও লাগতেন। একদিন স্টারে ‘ডাক বাংলো’ নাটক আমার ছেলেমেয়েরা দেখতে এসেছে। তার কয়েকদিন আগে আমার মেয়ের অভিনীত ‘নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতিতে’ রিলিজ হয়েছে। আমি মেকআপ রুমে বসে আছি, হঠাৎ আমার মেয়ে বাসবী এসে বলল, ‘বাবা, আমি তো প্রথম ছবিতেই অভিনয়ের জন্য প্রাইজ পাব, কিন্তু তুমি এতদিন অভিনয় করে কী পেলে?’

আমি মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছি, পাশের চেয়ারে মেকআপ নিতে নিতে ছবিদা বললেন, ‘দাও, উত্তর দাও, চুপ করে থাকলে তো হবে না।’

বুঝলাম পুরোটাই ছবিদার শেখানো। ছবিদা যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন বেশ দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল,। ‘হাই হিল’ ছবিতে বোধহয় শেষ কাজ করেছি ছবিদার সঙ্গে।

একদিন দিঘা থেকে ফিরে ছবিদা আমার বাড়ি এলেন। দেখলাম মুখে হাত চাপা দিয়ে কথা বলছেন। জিজ্ঞাসা করলাম ‘কী হয়েছে?’

বললেন, ‘দাঁত তুলেছি, আজ জাগুলিয়া যাচ্ছি; তুই আর জোজো (বসুশ্রীর সুবোধ মুখার্জী) চল আমার সঙ্গে।’

আমি বললাম, ‘আমি তো যেতে পারব না। রেডিয়োয় নাটক আছে।’

আমি না-যাওয়াতে জোজোও গেল না। সেদিন যখন রেডিয়ো নাটক করছি, হঠাৎ বীরেনদা (বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র) বললেন, ‘ভানু, ছবি নেই, গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে।’

প্রথম কয়েক মিনিট চুপ করে থেকে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। সম্বিত ফিরে পেতেই আর.জি.করে ছুটলাম যেখানে ছবিদার মরদেহ রাখা আছে। পরের কয়েক ঘণ্টা আমার যেন ঘোরের মধ্যে কাটল। নিজেকে দোষ দিচ্ছিলাম, ভাবছিলাম যদি আমি যেতাম, জোজো গাড়ি চালাত, তাহলে আর এই অ্যাক্সিডেন্ট হত না। এতবড় ক্ষতি আমার জীবনে বেশি হয়নি। উনি মাথার ওপরে দাদার মতো, বটগাছের মতো ছিলেন। দিনটা মনে আছে, ১৯৬২-র ১১ জুন।

যা বলছিলাম, ১৯৫০ সালেই আরেকটা বইয়ে অভিনয় করেছিলাম, ‘দ্বৈরথ’ নামে, যার পরিচালক ছিল সুধীশ ঘটক। এর পরের বছর যে-ক’টা ছবি করেছিলাম তার মধ্যে আমার বন্ধু কালিদাস বটব্যাল পরিচালিত ‘পলাতক’-এ ওর ভাই, আমার বন্ধু প্রদীপ কুমার এই বইয়ের হিরো। এর পরেই প্রেমেনদার (সাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্র) পরিচালনায় ‘সেতু’ ছবিতে একটা ভালো চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। কিন্তু এই বছরে আমার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল অনন্তদা (অনন্ত সিংহ)র সঙ্গে পরিচয়। অনন্তদা আমার কিশোর বয়সের হিরো। যখন আমি দীনেশদার (দীনেশ গুপ্ত) সর্বক্ষণের সহচর ছিলাম তখনই দীনেশদার মুখে সর্বক্ষণ চট্টগ্রামের এইসব নায়কদের প্রশংসা শুনতাম।

অনন্তদার তখন হাইকোর্টের পাশে একটা ঘর ছিল। সেই অফিসে বসে ফিল্ম প্রাোডাকশনের পরিকল্পনা হত। তখন অনন্তদার পার্টনার ছিল সত্যেনদা (সত্যেন বসু), হেমেন গুপ্ত, সেন জুয়েলার্সের মালিক প্রভৃতি।

এদের পরবর্তী বই সত্যেনদা পরিচালিত ‘বরযাত্রী’ ছবিতে চান্স পেলাম একটা ছোট রোলে। এই ছবি থেকেই একটু-আধটু নাম করলাম, অর্থাৎ কিনা পথেঘাটে লোকজন আমায় দেখলে তাকিয়ে থাকত। তাছাড়া বুকলেট ইত্যাদি প্রভৃতির আগে আমার নাম বসত। এই ‘বরযাত্রী’ ছবির সুবাদে আমার কিশোর বয়সের নায়ক অনন্ত সিংহ-র কাছে আমার যাতায়াত আরম্ভ হল। অনন্তদার মাধ্যমে আমার কিশোর বয়সের আর সব নায়ক লোকনাথ বল, অম্বিকেশ চক্রবর্তী, গণেশ ঘোষ, কল্পনা দত্ত প্রভৃতির সঙ্গে দেখা হল। অনন্তদা, জুলু সেনের বাড়িতে অনেক সময় থাকতেন। এই বাড়িতে যাতায়াতের সূত্রে জুলু সেনের ভাইপো সুকু সেন ও তার স্ত্রী ছবি সেনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বেড়ে গেল।

অনন্তদার সূত্রেই কমিউনিস্ট পার্টির ছোট-বড় নেতার সঙ্গেও পরিচয় হয়েছিল। অনন্তদার সঙ্গে আমার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল, তখন আমার একটু-আধটু নাম হয়েছে, মানে ‘৭৪।।’ পেরিয়ে গেছে। একদিন অনন্তদার সঙ্গে কোনও একটা কাজে মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায়ের কাছে গেছি। আগে শুনেছিলাম বিধানবাবু সবাইকে নাম ধরে ডাকেন এবং ‘তুই’ সম্বোধন করেন। আমরা প্রায় আধঘণ্টা বিধানবাবুর সঙ্গে ছিলাম। আমি অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, বিধানবাবু একবারের জন্যেও অনন্তদাকে নাম ধরে ডাকলেন না অথবা ‘তুই’ সম্বোধন করলেন না।

‘বরযাত্রী’ ‘ভুলি নাই’ বইয়ের সময় থেকেই দেখছিলাম অনন্তদা নিয়মিতভাবে ফিল্মে ইনভেস্ট করছেন। এরপরে সত্যেনদা বম্বে চলে গেলেন সদলবলে। তার পরেই একটু ভাঁটা পড়েছিল। এর বেশ কিছুদিন পর সত্যেনদা ও অনন্তদা একটা কোম্পানি খুলে ছবি প্রাোডাকশন আরম্ভ করলেন। অনন্তদা তখন থেকেই আমার কাছ থেকে সিনেমা বিষয়ক পরামর্শ গ্রহণ করতেন। আমি আর অনন্তদা সুশীলদার বাড়ি গিয়ে একটা ফিল্মের পরিকল্পনা করলাম। সাবিত্রী, উত্তমকে ভেবে ‘শেষ পরিচয়’ ছবি। সাবিত্রীর ডাবল রোল। উত্তম কোনও কারণে রোলটা ছেড়ে দেওয়াতে বসন্তকে নেওয়া হল।

প্রচুর টাকা খরচ করে এই ছবিটা করেছিলেন অনন্তদা। বম্বে গিয়ে লতা মঙ্গেশকরের গান রেকর্ড করা হয়েছিল। এটাই বোধহয় লতার প্রথম বাংলা ফিল্মে গাওয়া গান। এই ছবি শুরু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই বিকাশদাকে পরিচালক করে ‘নতুন প্রভাত’ ছবি শুরু হল। কিন্তু এই দুটো ছবির একটাও চলল না।

কিন্তু অনন্তদা দমবার পাত্র নন। কিছুদিন বাদেই আবার একটা ছবির পরিকল্পনা করেন। ততদিনে সুকুদা পুরোদমে ফিল্মে ঢুকে গেছেন, উনি পি.জি. উডহাউস-এর কাহিনি অবলম্বনে একটা কাহিনি লিখতে লাগলেন। কিন্তু অনন্তদা ততদিনে একটু-আধটু ফিল্ম ব্যবসা শিখে গেছেন। তাই আবার একটা ছবি করার প্ল্যান করলেন। প্রথমেই ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’ নিয়ে ফ্লোরে গেলেন। প্রফুল্ল চক্রবর্তী এই ছবির পরিচালক। এই ছবির বাজেট কম ছিল। আমাকে হিরো বানিয়ে এই কমেডি ছবি আরম্ভ হল। হিরোইন আনকোরা, অনন্তদার বন্ধু ডাক্তার নন্দীর কন্যা কণা নন্দী, পরে অনন্তদা কণার নাম পালটে বাসবী রাখলেন।

‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’ ওঁর প্রথম ছবি। এই ছবি নিয়ে প্রথমে আমার কাছে আসে আমার বন্ধু প্রফুল্ল চক্রবর্তী। এর আগেও দু-তিনটে ছবি পরিচালনা করেছিল। গল্পটা ইন্টারেস্টিং ছিল, এই গল্পটা ‘৪০-এর দশকের হলিউডের ‘Here comes Mr. Jordan’ অবলম্বনে তৈরি হয়েছিল। কিন্তু দিন দশেক শুটিং-এর পরে দেখলাম বিকাশদাও একই গল্প নিয়ে, আমাকে ও জীবেন বসুকে হিরো বানিয়ে ‘র্স্বগমর্ত্য’ নামে একটি ছবি করছে। অনন্তদাকে এই কথা বলতেই অনন্তদা তো আর এ-ছবি করবেন না বলে মনস্থির করলেন। আমি, ছবিদা, প্রফুল্ল, সুকুদা সবাই মিলে ওঁকে ধরেবেঁধে বললাম ছবির গল্প চেঞ্জ করে স্যাটায়ারধর্মী করে নতুন করে বানাব। উনি গররাজি হয়ে পুরো ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দিলেন। এরপর আমি প্রফুল্লর সঙ্গে বসে পুরো গল্পটা পালটে স্বর্গের এপিসোডে স্যাটায়ার যোগ করে অনেক বড় করে দিলাম।

এসব সত্বেও অনন্তদার মন:পূত হয়নি। ‘ব্যাড ইনভেস্টমেন্ট’ ভেবে টাকা খরচ করতে চাইছিলেন না। আমি এদিক-ওদিক থেকে টাকা যোগাড় করে ছবি শেষ করলাম। শেষ করার পর অনন্তদা বিকাশদাকে গিয়ে বললেন, আগে আমার ছবি রিলিজ হবে, তারপরে আপনি ‘স্বর্গমর্ত্য’ রিলিজ করবেন। মন্টুকে ধরে বীণা, বসুশ্রী হল পাওয়া গেল, মুরলীধর চ্যাটার্জীর ধর্মতলার অফিসে ডিস্ট্রিবিউশনের অফিস খোলা হল। রিলিজটা বেশ ধুমধাম করে হল।

ভানু বাড়ুজ্যেকে রোমান্টিক হিরো বানিয়ে ছবি এরকমভাবে রিলিজ এর আগে হয়নি। আর আগে কমেডি ছবিতে হিরো হয়েছি, কিন্তু রোমান্টিক হিরো হয়ে ছবি এটাই প্রথম। আর্ট ডিরেক্টর সুনীলকে দিয়ে একটা ‘স্পুটনিক’ বানিয়ে বসুশ্রী পোর্টিকোর ওপর ঝুলিয়ে দেওয়া হল। রাশিয়া তখন কুকুর লাইকাকে নিয়ে মহাশূন্যে ‘স্পুটনিক’ পাঠিয়েছিল; আইডিয়াটা খুবই নতুন ছিল। ঋত্বিকও খুব পছন্দ করেছিল আইডিয়াটা, এতটাই করেছিল যে ওর পরের বই ‘অযান্ত্রিক’ রিলিজ হয়েছিল বসুশ্রীতে। বসুশ্রী সিনেমার ওপরে একটা ‘জগদ্দল’ গাড়ি তুলে দিয়েছিল। যাই হোক, অনন্তদা তো ধরেই নিয়েছিলেন ছবি ফ্লপ হবে। কিন্তু ছবি বাম্পার হিট হল, আমারও কদর বেড়ে গেল। এরপরে ‘ভ্রান্তি’ ও ‘সখের চোর’ নামে আরও দুটো ছবি করলেন অনন্তদা (‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’-এর পর উদ্বুদ্ধ হয়ে অনন্তদা নীহাররঞ্জন গুপ্তের গল্প নিয়ে সুচিত্রা সেনকে কাস্ট করে একটা গল্পের কথাও ভেবেছিলেন)। কিন্তু এ-ছবি দুটো ফ্লপ করাতে ও-ছবি আর করা হয়নি।

ইতিমধ্যে আমাদের সম্পর্কেও একটু ভাঁটা পড়েছিল। এর আগে ছয়-সাত বছর অনন্তদা, ছবিদি ও সুকুদার সঙ্গে নিত্যদিন দেখাসাক্ষাৎ হত। আমার বউ, ছেলে, মেয়েকে অগণিত দিন বালিগঞ্জের ‘কোয়ালিটি’ গড়িয়াহাটের ‘নিরালা’ কিংবা ‘পিপিং’য়ে খাওয়াতেন। এর আগে অবশ্য মন্টু ‘সাবির’ ‘আমিনিয়ায়’ খাওয়াতে নিয়ে যেত। সুতরাং এঁদের দৌলতে আমার ছেলেমেয়েরা অত্যন্ত বাচ্চা বয়স থেকেই হোটেল, রেস্টুরেন্ট শিখে গিয়েছিল।

এরপর অনন্তদা যখন ধরা পড়লেন, তখন আলিপুর জেলে আমি মাঝে মাঝে যেতাম। আমার সঙ্গে আমার বন্ধুরাও যেত। আমার মেয়ের বিয়ের নিমন্ত্রণ করতে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে গেছিলাম, অনন্তদার নিজের জন্য এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ ক’জনের জন্যে খাবারও পাঠিয়েছিলাম বিয়ের দিন। আমার দুর্ভাগ্য, জেল থেকে ছাড়া পাবার পর অনন্তদা আর বেশিদিন বাঁচেননি।

‘বরযাত্রী’র পর মোটামুটি বেশ ছবির অফার আসতে আরম্ভ করল। এরপর ‘বসু পরিবার’ ও ‘পাশের বাড়ি’ ছবি রিলিজের পর আমায় আর ফিরে তাকাতে হয়নি। এর পরের আট-দশ বছরের মধ্যে পনেরো-ষোলোটা ছবির কাজ প্রত্যেক বছরে আসতে আরম্ভ করল। সর্বপ্রথমে উল্লেখযোগ্য যেটা সেটা হচ্ছে আমার দেখা অন্যতম শ্রেষ্ঠ পরিচালক নির্মল দে-র ‘বসু পরিবার’ ছবিটা। এতে উল্লেখ্য যে আমাদের ‘নতুন ইহুদী’ নাটকের অনেকেই এই বইটাতে অংশ নিয়েছিল। আমি ছাড়া সাবিত্রী, নেপাল নাগ, বাণী গাঙ্গুলী। আবার সলিল সেন-কে নির্মলদা এ ছবির অ্যাসিসটেন্ট ডিরেক্টর হিসেবে নেয়। বিশেষ করে নির্মলদার চিত্রনাট্য করতে সলিল বিশেষভাবে সাহায্য করে।

এর কয়েক দিন আগে সুধীর মুখার্জীর কাছে গিয়েছিলাম, বিনু বর্ধনকে ধরে। সুধীরদাকে আগেই চিনতাম কারণ অনন্তদা, সত্যেনদার ছবিগুলোর সঙ্গে উনি যুক্ত ছিলেন। শুনেছিলাম উনি মনোজ বসুর বিখ্যাত গল্প ‘বাঁশের কেল্লা’ নিয়ে ছবি করার কথা ভাবছিলেন। আমার যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল, যদি এই ছবিতে চান্স পাওয়া যায়। কিন্তু উনি বললেন, ‘বাঁশের কেল্লা’ এখন করছি না। ‘বরযাত্রী’র সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে তখন উনি একটা কমেডি ছবিটা করার কথা ভাবছেন। ছোট বাজেটের ছবি। তিনি বললেন, ‘তোমার যা চেহারা তাতে একটা কমেডি-প্রধান চরিত্রের জন্য তোমায় ভাবছি। সব নতুন ছেলে-মেয়ে নিয়ে ছবিটা হবে। নামকরাদের মধ্যে কেবলমাত্র ধনঞ্জয়। আগের ছবি ‘বরযাত্রী’তে একটু নামডাক হয়েছে।

তখনও নায়িকার চরিত্রে কাউকে ভাবা হয়নি। একমাত্র স্টার ধনঞ্জয়, তা-ও গানের জন্যে। যাই হোক, ওখানেই ঠিক হল সাবিত্রীকে হিরোইনের ভূমিকায় নেওয়া হবে। এ বছর ‘বসু পরিবার’, ‘পাশের বাড়ি’ দুটোই খুব হিট হল। তাতে অনেকজন নতুন অভিনেতা-অভিনেত্রী যথা, আমি, সাবিত্রী, উত্তম, জহর প্রভৃতির জায়গা হল। এর পরে আমার যে রোলগুলো আসতে লাগল সেগুলো বড় এবং ইমপর্টেন্ট।

১৯৫৩তে আমাকে হিরো বানিয়ে কমেডি ছবি তৈরি হল—’অদৃশ্য মানুষ’। হলিউডের ‘ইনভিসিবল ম্যান’ অবলম্বনে ছবিটা তৈরি হয়েছিল। তখনকার মেট্রো সিনেমায় ষোড়শী নামে এক লম্বা ব্যক্তি, প্রায় সাড়ে সাত ফুট তার হাইট ছিল, সেই-ই ‘ইনভিসিবিল ম্যান’-এর বাংলা সংস্করণ। পরিচালক অমর দত্ত ‘ইনভিসিবিল ম্যান’ ও ‘ফ্র্যাংকেনস্টাইন’-এর সংমিশ্রণে এক ভয়াবহ কমেডি তৈরির চেষ্টা করেছিলেন মনে হয়। এ ছবিতে আমার স্ত্রী নীলিমারও গান ছিল, হিরোইন সাবিত্রীর লিপে। এ ছবিটা খারাপ চলেনি। কিন্তু এম.পি. স্টুডিয়ো যখন পুড়ে যায় তখন এ-ছবির নেগেটিভও পুড়ে যায়। সুতরাং এ-ছবির আর কোনও অস্তিত্ব আজ আর নেই।

আমি একটা জিনিস লক্ষ করেছি, আমার মেয়ে ভুটি জন্মাবার পর থেকেই আমার কাজের উন্নতি দেখা গেল। আমি চারু অ্যাভিনিউতে ত্রিশ টাকা ভাড়ায় একটা ঘর নিয়েছিলাম। বিয়ের পর আরেকটা গ্যারেজের ওপর ঘর নিয়ে নিলাম। নিয়ে দেড়খানা ঘরের ভাড়া হল ৪০ টাকা, এই দেড়খানা ঘরে সাকুল্যে আটজন লোক থাকতাম। আমার বাবা, মা, মামা, আমি, আমার স্ত্রী ও তিন ছেলেমেয়ে। আমার বড় ছেলে গৌতম, ছোট ছেলে পিনাকী ও সর্বকনিষ্ঠ মেয়ে বাসবী অর্থাৎ ভুটি। আমাদের গাড়িবারান্দায় আর ও চার-পাঁচ জন লোক সারি পেতে শুয়ে পড়ত। তারা হল আমার রান্নার ঠাকুর দ্বারভাঙার যোগেশ্বর ও তার চার-পাঁচ ভাই, যারা আশেপাশে কাজ করত।

যোগেশ্বরের জ্যাঠতুতো ভাই বালচাঁদ আমার দিদির বাড়িতে কাজ করত। এই বালচাঁদ-ই হয়তো বাংলাদেশে সর্বপ্রথম বিহারি যে ইস্টবেঙ্গলের সাপোর্টার। আমার খেলার মাঠের সঙ্গী ছিল বালচাঁদ এবং আমার হিন্দি সিনেমার সঙ্গী ছিল যোগেশ্বর। প্রথম প্রথম যখন হিন্দি ডায়লগ বুঝতাম না তখন ও-ই বুঝিয়ে দিত। সেসব ‘৪০-‘৪৪ সালের কথা। এর আগে বেশ কিছু হিন্দি সিনেমার আর্টিস্ট যারা নিউ থিয়েটার্সে ছোটখাটো পার্ট করত, তারা আমাদের চারু অ্যাভিনিউতে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকত। যথা শ্যাম, সুন্দর, হীরালাল, পল মহেন্দ্র। এরা সব পরবর্তী জীবনে বম্বেতে গিয়ে নাম করেছিল। শ্যাম তো সুপারস্টার হয়ে গেছিল। শ্যাম-সুরাইয়া বিখ্যাত জুটি ছিল।

আমি তখন বম্বেতে ১৯৫৫ সালে গেছিলাম সত্যেন বসু পরিচালিত ‘বন্দিশ’ (ছেলে কার’ এর হিন্দি ভার্সন) ছবিতে অভিনয় করতে। একদিন বিমল রায়ের সহকারী পল মহেন্দ্র কয়েকজন অভিনেতা-কলাকুশলীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিচ্ছিল, ‘কলকাতাসে আয়া মসুর অ্যাক্টর ভানুবাবু’।

হঠাৎ এক ন্যাড়া মাথা ভদ্রলোক বলে উঠলেন, ‘ভানুবাবু হ্যায়! শালা গুন্ডা হ্যায়।’

এই লোকটা ছিল হিন্দি সিনেমার তখনকার বিখ্যাত ভিলেন হীরালাল।

ব্যাপারটা ছিল এরকম, শ্যাম, সুন্দর, হীরালাল আরও দু-চারজন অবাঙালি গাট্টাগোট্টা জোয়ান রোজই রাতে টালিগঞ্জ রোডে মদ খেয়ে ঝামেলা করত। পাড়ার মাস্তানরাও এদের কাছে ঘেষত না। একদিন পাড়ার সব প্রতিবেশী এসে কমপ্লেন করল, এদের অত্যাচারে টেকা যাচ্ছে না। সেটা ‘৪২-‘৪৩ সাল হবে। একদিন আমি আমার একমাত্র হাতিয়ার যা ঢাকা থেকে আনতে পেরেছিলাম, সেই হকি স্টিক আর আমার বাড়ি পাঁচ-ছয় জন দ্বারভাঙা বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে লাঠি নিয়ে রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হলাম। আমার হকি স্টিকের বাড়িতেই হীরালালের নিটোল মাথা বোধহয় ফেটেছিল। হীরালাল দশ-বারো বছর পরেও সেটা মনে রেখেছে।

আমি যখন ‘বন্দীশ’ করতে গেছিলাম তখন আমার বন্ধু দুলাল ওর ছবি ‘এক গাও কি কাহানী’তে একটা ছোট চরিত্রে প্রায় জোর করে নামিয়ে দিল। আসলে এ ছবিটা অনন্ত সিং ও সত্যেন বসুর প্রাোডাকসন্সের প্রথম হিন্দি ছবি ‘৪০-এর দশকের শৈলজানন্দের সুপার হিট বাংলা বই ‘শহর থেকে দূরে’র হিন্দি ভার্সান। সত্যেনদারই এই বইটা করার কথা ছিল, কিন্তু সেইসময় ‘বন্দীশ’ নিয়ে ব্যস্ত থাকায় তার অ্যাসিসটেন্ট দুলালকে দিয়ে ছবিটা করাবে স্থির হয়।

এই ‘শহর থেকে দূরে’ ছবিতে ফণী রায় নামে এক অভিনেতা অভিনয় করেছিলেন। ইনি যে খুব সাংঘাতিক বড় অভিনেতা তেমন কিছু নয়, কিন্তু এই ছবিতে ফণী রায় অনবদ্য অভিনয় করেছিলেন। আমার মনে আছে আমি ওঁর পার্ট দেখার জন্য চার-পাঁচবার এই বইটা দেখেছিলাম। বন্দীশ করার সময় সত্যেনদার যখন ‘শহর থেকে দূরে’র হিন্দি করছে, তখন আমার খুব ইচ্ছা ছিল ফণী রায়ের পার্টটা আমি করি। আমার তখন ফনী রায়ের মতোই রোগা প্যাকাটে চেহারা। শুধু মেকআপ করে বুড়ো সাজতে হবে, হিরোইনের বাবা সাজবার জন্য।

পার্টটা ছিল এক খিটখিটে বুড়ো গ্রামের কম্পাউন্ডার, যে মতের অমিল হলেই সবার সঙ্গে ঝগড়া করে। আমার কথা শুনে সত্যনদা, দুলালদা সব চেপে ধরল আমাকেই এই চরিত্রটা করতে হবে। কিন্তু আমি কিছুতেই রাজি হচ্ছিলাম না কারণ আমার হিন্দি উচ্চারণ ভীষণ খারাপ। একেবারে টিপিক্যাল বাঙালি, ‘ইধার সে মাটি কাটতে কাটতে উধারসে ধপ্পরাইয়া ফালাইয়া দাও’-মার্কা। একেবারেই সাবলীল ফিল করছিলাম না। তার ওপর ফনী রায়ের সেই দুধর্ষ অ্যাকটিংয়ের সঙ্গে যদি আমার তুলনা করে সেই ভেবে ঘাবড়ে যাচ্ছিলাম। আমার বুড়ো মা, স্ত্রী, সন্তানকে কলকাতায় ছেড়ে বেশিদিন থাকতে পারব না, কলকাতায় প্রচুর কাজ, ছেড়ে থাকতে পারব না, স্টার থিয়েটারের চাকরি চলে যাবে, এইসব ভুজুংভাজুং দিয়ে সত্যেনদা, দুলালকে আটকালাম।

কিন্তু দুলাল আমার এত দিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, সে ছাড়বার পাত্র নয়, আমাকে একটা ছোট কমেডি রোল জোর করে করাল। ফনী রায়ের পার্টটা জনি ওয়াকারকে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু সে না-করাতে আই.এস. জোহারকে দিয়ে করানো হল।

এই ছবিতে কাজ করতে গিয়ে তালাত মামুদের সঙ্গে বেশ ভাব হল। তালাত এ ছবির হিরো। তালাতের তখন গায়ক হিসাবে সাংঘাতিক নামডাক। সেই বছরই ও কলকাতায় এল ফাংশন করতে। ওকে একদিন আমার বাড়িতে নিয়ে এলাম আমার স্ত্রী নীলিমার সঙ্গে আলাপ করাতে। ও শুনেছিল, নীলিমা গানটান করে। আমার দেড়খানা ঘরে বিশেষ জায়গা না থাকাতে গাড়ি-বারান্দায় চৌকিতে বসতে হল। বিশেষ কথা হল না, কারণ কমুনিকেশনের প্রবলেম। নীলিমা একেবারেই হিন্দি জানত না, আর তালাতও বাংলা জানত না। আমিই খানিকটা চালিয়ে নিলাম।

তা-ও বাঁচোয়া, আমার উর্দু টিচার মুন্সিজি মেডিয়েটারের কাজ করাতে মিনিট দশেক আদান-প্রদান হল, চা-টা খেয়ে তালাত চলে গেল। কিন্তু তালাতকে বসে থাকতে দেখে বেশি দর্শক জমে গেছিল। মুন্সিজিও খুব খুশি, কারণ উনি তালাতের গানের ভক্ত ছিলেন।

মুন্সিজিকে রাখা সত্বেও আমার উর্দুর বিশেষ উন্নতি হয়নি। আলিফ, বে, তে-তেই আটকে ছিল। আমার হিন্দি একেবারেই ভলো নয়; যদিও উর্দুর মাস্টার মুনসিজির কাছে বেশ কিছুদিন হিন্দি শিখেছিলাম। কিন্তু ওই জিভের আড় ভাঙছিল না। ‘বন্দীশ’ করতে করতেই গুরু দত্ত ‘পিয়াসা’তে একটা চরিত্রের জন্য বলতে এসেছিল। কিন্তু একে তো হিন্দি ভাষায় কনফিডেন্স ছিল না, তার ওপর সদ্য বাবা মারা গেছেন। বুড়ি-মা বাড়িতে। ছোট ছোট তিন ছেলেমেয়েকে ফেলে বম্বেতে থাকার ভরসা পাচ্ছিলাম না। তার ওপর বেলা মুখার্জী, রুবী সেন, রত্না গুপ্তরা সারাক্ষণ বলছে আপনার হিন্দি কিস্যু হচ্ছে না। সুতরাং আমি প্রায় হাল ছেড়েই দিয়েছিলাম।

শেষ পর্যন্ত মীনাকুমারী একদিন আমায় উদ্ধার করল। একদিন শুটিং-এর সময় রুবী সেন, রত্না গুপ্ত আমাকে হিন্দি উচ্চারণ ঠিক করে দেবার চেষ্টা করছিল। মীনাকুমারী বললেন, ‘আপলোগ চুপ রহিয়ে, অ্যাকটিং কর রহে হ্যায় ইয়ে, আপলোগ কিউ বিচ মে বোল রহে হ্যায়? ভানুবাবু, আপ য্যায়সা কর রহে ওয়াই কিজিয়ে।’

এই কথায় এদের মুখ চুন। মীনাকুমারী তখন হিন্দি স্ক্রিনের সাম্রাজ্ঞী। ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী এবং তাঁর চেয়ে ভালো হিন্দি উচ্চারণ কারও আছে বলে আমার জানা নেই। ব্যস, আমার স্বঘোষিত হিন্দি মাস্টাররা সব চুপ মেরে গেল।

বম্বেতে যে কুড়ি-বাইশ দিন ছিলাম তখন দেখেছি বম্বের অভিনেতা, অভিনেত্রী, কুলাকুশলী, যাঁদের বাংলা সম্বন্ধে বিন্দুবিসর্গ জানা নেই, অথচ বাংলার কালচার সম্বন্ধে কী ভীষণ রেসপেক্ট ছিল। রোজদিনই কারো না কারো বাড়ি নিমন্ত্রণ থাকত। অন্তত তিন-চারটে পার্টিতে গেছি, দু-তিন জায়গায় বক্তৃতা দিতে হয়েছে।

একবার লাগাতার বৃষ্টির জন্য ‘বন্দীশ’-এর শুটিং দু’দিন বন্ধ ছিল। সত্যেনদার একটা পার্টিতে ডিনারের আগে আমায় বম্বের শুটিং এক্সপিরিয়েন্স সম্বন্ধে কিছু বলতে বলা হল। সেখানে শশধর মুখার্জী, ঋষিকেশ, কামাল আমরোহি, উষাকিরণ, গুরু দত্ত, কলিন পাল ও আরও অনেকে উপস্থিত হল। আমি কলকাতা, বম্বে কোনও তুলনামূলক আলোচনায় না গিয়ে সোজাসুজি বললাম, ‘When it rains very heavily, we say its raining cats and dogs, but in Bombay it rains elephents and Rhinocers.’

উপস্থিত সবাই এই জোকটা শুনে বেশ হেসেছিল।

‘৫৫ সালে আমি অনেকদিনের ভেটারন, কিচ্ছু না মাত্র ৩-৪ বছর হল নাম হয়েছে সিনেমায়। বিশেষ করে প্রবাসী বাঙালিরা ভীষণ সম্মান করে। তাছাড়া আমার অনেক পুরোনো বন্ধুরা প্রদীপ, কালিদাস বটব্যাল, ঋষিকেশ মুখার্জী, দুলাল গুহ, গৌতম মুখার্জী, বীরেন নাগ, অভি ভট্টাচার্য, প্রণতি, অনীতা গুহ, অনুরাধা, মালা সিনহা, অসিত সেন প্রভৃতি অগণিত বন্ধুবান্ধব তখন প্রতিষ্ঠিত। সবারই ইচ্ছা দল বাড়ুক। প্রায় সবাই চাইছে গুরুর ফিল্ম করি। গুরুও তখন প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু আমার তখন ত্রাহি ত্রাহি রব। ভেতো বাঙালি, সরকারি চাকরিতে অতদিন অ্যাবসেন্ট, স্টার থিয়েটারের চাকরিও যায় যায়, সুতরাং সবকিছু ভুলে হুড়মুড় করে কলকাতায় ফিরে এলাম। অতদিন বম্বেতে থাকার সুবাদেই মীনাকুমারী, অশোক কুমার, তালাত মামুদ, ডেইজি ইরানি, প্রভৃতির সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠতা হয়।

যাই হোক, বম্বে থেকে ফেরার পর দেখলাম কাজের চাপ আরও বেড়ে গেছে। প্রত্যেক মাসে কুড়ি-বাইশ দিন শুটিং, ১২-১৪ দিন স্টারে থিয়েটার, এছাড়া প্রচুর ফাংশান করতে হত। এদিকে স্টিল কন্ট্রোলের সরকারি চাকরি। মাসে ৩-৪ দিনের বেশি অফিস যেতে পারছিলাম না। তার ওপর নিয়ম অনুযায়ী নামের শেষে ব্রাকেটে (অ্যা:) অ্যামেচার লেখার কথা সেটাও করছিলাম না। আমার সদাশয় বস হ্যামিল্টন সাহেব রিটায়ার করেছেন। সব মিলে যাচ্ছে তাই অবস্থা। তখন আমার মাইনে ২৫০ টাকা।

‘মার কাটারি’ বলে একটা ড্রামাটিক ডিসিশন নিয়ে ফেললাম চাকরি ছেড়ে দেব ভাবলাম। আমার কথা শুনে আমার মা, দিদি সবার অজ্ঞান হবার অবস্থা। আমার যত চেনাশোনা লোক অবাক নেত্রে তাকিয়ে থাকে। তখনকার দিনে এরকম একটা সরকারি চাকরি ছাড়া আর ‘গলায় দড়ি’ দেওয়া একই ব্যাপার। আমার মা শুনেছিলেন আমার বড় ছেলে গৌতমের থেকে। আমি আর স্ত্রী যখন আলোচনা করছিলাম তখন গৌতম শুনেছিল, ও গিয়ে মাকে বলেছে। মা গিয়ে দিদিকে বললেন। বাধ্য হয়ে আমি একদিন মার সামনে গৌতমকে ধরে একটা অ্যাকটিং করলাম, বললাম, ‘তুই নাকি সবাইকে বলছিস আমি চাকরি ছেড়ে দিচ্ছি। চাকরি ছেড়ে দিলে খাব কী?’

মা তাতে আশ্বস্ত হলেন কিনা আমি জানি না, কিন্তু অনেক ভেবে দেখলাম, চাকরির চেয়ে সিনেমা, থিয়েটার থেকে অনেক গুণ বেশি রোজগার করছিলাম। রোজগার অনেক করছিলাম বটে, কিন্তু আমার অনেক ঝামেলাও ছিল। আমি দেড়খানা ঘরে থাকতাম, বিশেষ স্টাইলও ছিল না। কিন্তু আমার অনেক আনুষাঙ্গিক খরচা ছিল, খাওয়া-দাওয়ার প্রচণ্ড খরচ ছিল। ‘৫২ সাল থেকেই একটু আধটি খ্যাতি হয়েছিল, তার বিড়ম্বনা স্বরূপ ট্রাম, বাসে যাতায়াত বন্ধ করে দিতে হল। পাবলিকের টিটকারির জ্বালায়। পকেটে টান পড়লেও ট্যাক্সি চড়তে হল।

আরেকটা আমার বড় খরচ ছিল, সেটা হচ্ছে আমার বেশ কিছু আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব ছিল যারা একেবারে নি:স্ব হয়ে পূর্ব বাংলার থেকে এখানে চলে এসেছিল ‘৪৭ সালে। আমি খেয়ে পড়ে বেঁচে বর্তে আছি অথচ আমার নিকট আত্মীয়রা-বন্ধুরা না খেয়ে মারা পড়বে, এটা হয় না। তাই সেই ‘৪৭ সাল থেকে ‘৫৮ সাল অবধি জুবিলি পার্কে যাওয়া অবধি আমি ৫-৬টা পরিবারকে মাসে অন্তত রেশন তোলার টাকা দিয়ে আনন্দিত বোধ করতাম। ১৯৫৬ সালের ৭ জানুয়ারি ১৫ বছরের সরকারি চাকরি ছেড়েই দিলাম। তার কিছুদিন পরে স্টার থিয়েটারের চাকরিটাও ছেড়ে দিলাম। এতটাই সিনেমার কাজের চাপ ছিল। এর ওপর প্রচুর ফাংশান আসতে আরম্ভ করল। আমার মনেও একটা প্রচণ্ড সাফল্যের পরিতৃপ্তি। কারণ এর মধ্যে ৪ বার শ্রেষ্ঠ ‘কৌতুকাভিনেতা’র পুরস্কার পাওয়া হয়ে গেছে।

১৯৫২ থেকে সিনেমা পত্রিকা ‘উল্টোরথ’ হলিউডের ‘অস্কার’ পুরস্কার-এর আদলে ‘উল্টোরথ পুরস্কার’ দেওয়া আরম্ভ করল, আর এটা দেওয়া হত দশর্কদের ভোটে। প্রথমবার থেকেই দশবার পরপর ‘উল্টোরথ’ পুরস্কার পেলাম। আমার দেড়খানা ঘরের বাসায় প্রাোডিউসার ডিরেক্টর প্রভৃতি নানারকম লোকের ভিড় লেগে থাকত। তাদের বসবারও জায়গা দিতে পারতাম না।

কিছু বেশ ভালো রোল পেতে থাকলাম সিনেমায়, অর্থাৎ এর আগে তিন-চার দিনের কাজ থাকত। এখন ১৫-২০ দিনের কাজের ইমপর্টেন্ট রোল আসতে লাগল। ‘সাড়ে চুয়াত্তর’-এর পরে ‘ওরা থাকে ওধারে’, ‘গৃহপ্রবেশ’, ‘ছেলে কার’, ‘এটম বোম’, ‘লেডিজ সিট’, ‘অর্ধাঙ্গিনী’, ‘টনসিল’, ‘শেষ পরিচয়’ প্রভৃতি ছবিতে বেশ নাম হল। এছাড়া ‘চাটুজ্যে বাড়ুজ্যে’, ‘জয় মা কালী বোডিং’, ‘ওগো শুনছো’, ‘কাঁচা মিঠে’, প্রভৃতি ছবিতে মেইন রোল পেলাম। এছাড়া সমগ্র সিনেমা কেরিয়ারে আমার সবচেয়ে পছন্দের চরিত্রগুলো ‘টাকা আনা পাই’, ‘নতুন প্রভাত’, ‘হরি লক্ষ্মী’, ‘সূর্যমুখী’, প্রভৃতি ছবিতে সেগুলো এই সময়েই পেলাম।

‘৭৪।।’ -এর সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে বন্ধুবর অরুণ চৌধুরী (‘পাশের বাড়ি’র কাহিনিকার) নিজেই প্রাোডিউসার, ডিরেক্টর হয়ে ‘শ্বশুরবাড়ি’ (‘পাশের বাড়ি’র সিকোয়েল) বানাল, এতে আমার লিড রোল ছিল, হুয়াদা (শ্যাম লাহা) বানালেন ‘লাখটাকা’। এতেও আমার রোলটা বেশ বড় ছিল। অমর দত্ত বানালেন ‘অদৃশ্য মানুষ’, আমার মেইন রোল ছিল। সুকুমার দাশগুপ্ত করলেন ‘ওরা থাকে ওধারে’। এই ছবিটা উল্লেখযোগ্য এই কারণে যে সুকুমারদা এ-ছবিতে আমায় প্রচুর টাকা দিয়েছিলেন। অর্থাৎ কিনা ছবিদা আর সুচিত্রা পেয়েছিল দেড় হাজার, আমি আর উত্তম পেয়েছিলাম এক হাজার করে।

সব ছবিতেই যে এরকম অঙ্কের টাকা পাচ্ছিলাম তা নয়, একদিন স্টুডিয়োতে শুনলাম শিশির মিত্র ও গৌরাঙ্গ বসু একটা কমেডি ছবি প্রাোডিউস করছে, একদিন স্টুডিওয়ে গৌরাঙ্গকে ধরলাম, ‘গৌরাঙ্গ, কাবেরীর দাদা ও আমাদের সবিতা (চট্টোপাধ্যায়)র স্বামী (তখনও অবশ্য ওদের বিয়ে হয়নি), বললাম ‘কি মশাই, আপনি নাকি কমেডি বই নামাচ্ছেন?’

ও বলল, ‘হ্যাঁ, রসরাজ অমৃতলালের ‘চাটুজ্যে বাড়ুজ্যে।’

আমি বললাম, ‘আটিস্ট কাকে নিচ্ছেন?’

ও বলল, ‘রাজলক্ষ্মী, জহর প্রভৃতি।’

আমি বললাম, ‘এ কেমন অন্যায় কথা, কমেডি বই করছেন অথচ আমি নেই!’

ও বলল, ‘না মশাই, এ আমার ছোট বাজেটের বই, আপনাকে নিতে পারব না।’

আমি বললাম, ‘জহরকে তো নিচ্ছেন, ওকে কত দিচ্ছেন?’

ও বলল, ‘শুনলে হাসবেন, ৫০০ টাকা।’

আমি বললাম, ‘তাই সই, আমায় ৬০০ দিস।’

ও সঙ্গে সঙ্গেই আমার সঙ্গে কনট্রাক্ট করে আমাকে স্ক্রিপ্ট শোনাতে বসল, ছবি রিলিজের পর হিট করল।

‘টনসিল’ বইটির প্রযোজক ছিল মঞ্জু দে, এই বইটাতে আমার কয়েক ধাপ উন্নতি হয়েছিল। কারণ এই ছবিটা হচ্ছে কয়েকবছর পূর্বে নির্মিত সত্যেন বসুর ‘বরযাত্রী’ ছবির সিকোয়েল। ‘বরযাত্রী’তে আমার খুব ছোট একটা দু-দিনের রোল ছিল, সে জায়গা থেকে উন্নতি হয়ে ‘টনসিল’-এ আমি ১৫-১৬ দিনের রোল পেলাম। ‘বরযাত্রী’র মতো ‘টনসিল’-এও প্রায় একই কাস্ট ছিল, অর্থাৎ কালী, অনুপ, সত্য, যমুনাই একই চরিত্রে অভিনয় করল। কেবল ‘বরযাত্রী’র ত্রিলোচনের চরিত্রে হারাধনের জায়গায় ‘টনসিল’-এ এল অতনু কুমার, ঘোৎনার চরিত্রে অরুণ রায়চৌধুরীর জায়গায় এল জহর। আর রাজেনের চরিত্রে ভবেন নামে একটা ছেলে অভিনয় করেছিল, তার জায়গায় এলাম আমি। এটা ছিল একটি মেয়েলি-পুরুষ কবির চরিত্র। ‘টনসিল’-এ এটাই ছিল মেইন রোল।

এই ছবিটা খুব হিট করেছিল। এই ছবিতে অভিনয়ের জন্য আমি ১৯৫৬-র শ্রেষ্ঠ কৌতুকাভিনেতার ‘উল্টোরথ’ পুরস্কার পেয়েছিলাম। ছবিতে আমার বিপরীতে অভিনয় করেছিল মাধুরী নামের একটি মেয়ে, যে পরবর্তীকালে মাধবী মুখোপাধ্যায় নামে বিখ্যাত অভিনেত্রী হয়েছিল।

অভিনেতা সাধন সরকার উত্তম-পূর্ববর্তী যুগে নামকরা হিরো। আমার চেয়ে বয়সে ছোট হলেও সিনেমায় ও ছিল আমার চেয়ে ভেটেরান। একদিন আমার বাল্যবন্ধু সাহিত্যিক শৈলেশ দে সাধনকে নিয়ে আমার চারু অ্যাডিনিউর বাড়িতে এল। বলল, ‘তোকে মনে করে একটা কমেডি গল্প লিখেছি, সাধন এ-ছবিতে অভিনয় করবে, পরিচালনাও ওর।’

শৈলেশ গল্পটা শোনাল, ভালোই লাগল—খানিক ‘৭৪।।’ -এর মতো মেসের বাসিন্দাদের নিয়ে গল্প। আমার মেইন রোল ছিল এ বইতে। ঠিক হল, আমার বউ-এর চরিত্র করবে সাবিত্রী, কারণ একটা বাঙাল মেয়ের চরিত্র, তার ওপর কমেডি রোল; সাবিত্রীই ফিটেস্ট। কিন্তু সাবিত্রী ওদের বলল, ও বিবাহিত মেয়ের রোলে ওই কমেডি ফিল্মে কাজ করবে না।

আমি ভাবলাম এ ছবি আর হবে না। কয়েকদিন বাদে সাধন কলকার্ড পাঠাল। আমি মনে করলাম শেষমেষ সাবিত্রী রাজি হয়েছে। শুটিং-এর দিন ফ্লোরে গিয়ে সাবিত্রীকে আর দেখি না। রিহার্সালের সময় দেখি তৃপ্তি মিত্র। আমি তো ঘাবড়ে গেলাম, সাধনকে ডেকে বললাম, ‘তৃপ্তিকে নিয়েছিস বললি না তো!’

ও বলল, ‘সারপ্রাইজ দিলাম।’

আমি তো সেটে গিয়ে প্রথম শট দিলাম। শটের পর দেখলাম তৃপ্তি এমন জোরে আমার হাত খামচে ধরেছে যে আমার হাতে রক্ত জমে গেছে। আমি বললাম, ‘কী হয়েছে?’

তৃপ্তি বলল, ‘ভীষণ নার্ভাস লাগছে।’ (এটাই বোধকরি ওর প্রথম সিনেমার শুটিং) আমি পুরোপুরি অ্যাডভাইসর বনে গেলাম, বললাম, ‘ঘাবড়ান ক্যান, আপনি এত বড় অভিনেত্রী, কোনো ভয় নাই, আমি তো আছিই।’

তখনকার দিনের প্রায় সব কমেডিয়ান এই বইতে অভিনয় করেছিল। এই ছবিতে আমি ১৯৫৫ সালে শ্রেষ্ঠ কৌতুকাভিনেতার ‘উল্টোরথ’ পুরস্কার পেয়েছিলাম, পরবর্তীকালে এই গল্পটা নিয়ে যাত্রা করেছি, রঙ্গনায় নাটকও করেছি। বম্বের কমেডিয়ান হেমন্তর প্রযোজনায় মামুদও ঋষির পরিচালনায় এই গল্পটা নিয়ে ‘বিবি ঔর মকান’ ছবি করেছে।

খগেন রায়ের ‘আমার বৌ’ এই সময়কার আরও একটি উল্লেখযোগ্য ছবি। এ-ছবিতে আমার সেকেন্ড লিড রোল। এ ছবিতেই বোধকরি সুচিত্রার জীবনের একমাত্র কমেডি রোল। কমল গাঙ্গুলীর ‘ওগো শুনছ’ এবং জ্যোর্তিময় রায়ের ‘কাঁচামিঠে’-তেও আমার লিড রোল। ‘কাঁচামিঠে’তে অভিনয়ের জন্য আমি ১৯৫৭-এর শ্রেষ্ঠ কৌতুকাভিনেতার ‘উল্টোরথ’ পুরস্কার পেয়েছিলাম। কিন্তু এই ছবিগুলোর মধ্যে আমার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রোল হচ্ছে জ্যোতির্ময় রায় পরিচালিত ‘টাকা আনা পাই’-এর বিশু চরিত্রটি। এর আগেও জ্যোর্তিময় রায়ের কাহিনি নিয়ে চিত্ত বসুর পরিচালনায় ‘ছেলে কার’ ছবিতেও আমার সেকেন্ড লিড।

এই পিরিয়ডে আরও বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চরিত্রে কাজ করেছি। অরুণের পরিচালনায় ‘লেডিস সীট’ নামে একটা বইতে কাজ করেছি, সেটাও আমার মেইন রোল। সুকুমার দাশগুপ্ত পরিচালিত ‘সদানন্দের মেলা’, অজয় কর পরিচালিত ‘গৃহপ্রবেশ’, সুশীল মজুমদারের ‘ভাঙা গড়া’ দেবকী বসুর ‘ভালোবাসা’, চিত্ত বসু পরিচালিত ‘একটি রাত’, বিকাশ রায় পরিচালিত ‘সূর্যমুখী’, সুশীল দা পরিচালিত অনন্তদা প্রযোজিত ‘শেষ পরিচয়’, বিকাশ রায় পরিচালিত ‘নতুন প্রভাত’। এই ছবির চরিত্র আমার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রোল। এরপরে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ‘যমালয়ের জীবন্ত মানুষ’ হিট করল। তাতে আমার বাজারদর বেশ বেড়ে গেল। এরপর থেকে ৫-৬ দিনের শুটিংয়ের আন ইম্পর্টেন্ট রোল নেওয়া বন্ধ করলাম, ১০-১৫ দিনের শুটিং, ইম্পটেন্ট রোল ছাড়া সব অফার রিজেক্ট করতে থাকলাম। তাতে অবশ্য আমায় ফল ভুগতে হয়েছে, সে গল্প পরে বলছি।

এই সময়েই দেড়খানা ঘরের চারু অ্যাভিনিউর বাসা পালটে টালিগঞ্জে ট্রাম ডিপোর কাছে একটা তিন কামরার গ্যারেজওয়ালা ঘর ভাড়া করলাম, একেকটা ঘরের মেঝেতে একেক রংয়ের টাইলস। পেছনেই অত বড় ঝিল, সামনে গ্যারেজ। এসব দেখে আমার বাচ্চাদের তো মহা আনন্দ, আমার সাফল্যের চূড়া বলা যায়। গাড়ি অবশ্য আমি আগেই, ১৯৫৫ সালে কিনেছিলাম কিন্তু সেটা ছিল সেকেন্ডহ্যান্ড অস্টিন অফ ইংল্যান্ড। সে-গাড়ি দেখে জহর তো খুব খুশি। আমি আর উত্তম শুটিং করছিলাম ইস্ট ইন্ডিয়া স্টুডিয়োতে ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’ বইয়ের জন্য। এই ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’ বহুদিন আগে হয়ে গেছিল, বোধকরি কাননদেবীর ওটাই প্রথম বই ছিল। হেমচন্দ্র চন্দ্র পরিচালিত এই রিমেক ভার্সানে আমার খুব ইম্পর্টেন্ট রোল ছিল। একদিন শুটিং চলাকালীন আমাদের প্রাোডিউসার খেমকা সাহেব তাঁর অফিসে ডেকে আমাকে বললেন, উনি আমায় দিয়ে একটা ছোট বাজেটের সিনেমা করাতে চান, যার যাবতীয় অ্যারেঞ্জমেন্ট আমায় করতে হবে অর্থাৎ কিনা উনি টাকা ঢালবেন, কিন্তু বই পছন্দ করা থেকে যাবতীয় কুলাকুশলী আমার পছন্দমতো হবে।

ফ্লোরে ফিরে এসে উত্তমকে একথা বলতে ও তো মহা খুশি। বলল, ‘তাহলে লেগে যা, কিন্তু ডিরেক্টর নিস নির্মলদা (নির্মল দে)কে। আমি বললাম, ‘তা আর বলতে! আমি অলরেডি ভেবে নিয়েছি, উত্তম ও আমার দুজনেরই সবচেয়ে পছন্দের ডিরেক্টর ছিল নির্মল দে, বিশেষ করে ‘চাঁপা ডাঙার বউ’তে অভিনয় করে উত্তম তো সম্পূর্ণরূপে নির্মলদার ডিরেকশনের গুণমুগ্ধ হয়ে গেছিল। আমার তো মনে হয় ‘চাঁপা ডাঙার বউ’তে উত্তমের অভিনয় ওর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ অভিনয়।

আমি এই প্রস্তাবটা পেয়ে খুবই আনন্দিত হলাম। ভাবলাম, অ্যাদ্দিনে আমার মনের মতন চরিত্রে অভিনয় করতে পারব, বিশেষ করে খেমকা সাহেব যখন আমায় ফ্রি-হ্যান্ড দিয়েছে। ব্যারাকপুরে অবধূতের সঙ্গে দেখা করে তাঁর ‘নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতিতে’ গল্পের রাইট কিনলাম। একটা বই নিয়ে সোজা নির্মলদার ভবানীপুরের বাসায় গিয়ে বললাম, ‘এটা করতেই হবে।’ বইটা দিয়ে বললাম, ‘সিনারিও লিখতে থাকুন।’ আমার সঙ্গে অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টর বিবেক বক্সী গেছিল, ওকে বললাম, রোজ এখানে আসবি আর নির্মলদাকে লিখতে সাহায্য করবি। আর সুনীল (সুনীলরাম)কে বললাম, ‘সব সময় দেখবি নির্মলদার কী দরকার, তুই এনে দিবি; নির্মলদাকে বাড়ি থেকে বেরুতে দিবি না।’

নির্মলদা এসব দেখে বলেন, ‘তুমি কি আমায় গৃহবন্দি করে রাখার মতলব করছ?’

চিত্রনাট্য লেখা আরম্ভ হল, আমি নির্মলদার সুবিধার জন্য দিন দুয়েক অবধূতকে নির্মলদার সঙ্গে বসিয়ে দিলাম। এরপরে মহা উৎসাহে ইস্ট ইন্ডিয়ায় সেট ফেলে শুটিং আরম্ভ হল। আমার মেয়ে বাসবী এ-ছবির মেইন রোলে অভিনয় করল। ছবিদা সময় সময় গাইড করতেন। ছবিদা এ-ছবিতে একটা অবিস্মরণীয় চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন।

কিন্তু আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল নির্মলদা ঠিক পুরোপুরি ভরসা পাচ্ছে না। তার প্রধান কারণ আমার সিরিয়াস রোলে অভিনয় দর্শক কীভাবে নেবে! তাই নির্মলদা আগে যা কোনওদিনও করেননি তাই করলেন, নির্মলদা তার ছবির মিউজিক নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাতেন না, কিন্তু খেমকা সাহেবকে বলে এ-ছবির মিউজিকের জন্য একটা বেশ ভালো বাজেট বরাদ্দ করালেন। নচিকেতাকে সুরের দায়িত্ব দিয়ে ছয়-সাতটা গান ঢোকালেন, হেমন্তকে বম্বে থেকে আনিয়ে গান করালেন। এ ছাড়া মানব, শ্যামল, গায়ত্রী ও আমার স্ত্রী নীলিমাকে দিয়ে বাদবাকি গানগুলো করালেন।

যাই হোক ছবি রিলিজের পর ছবি প্রশংসিত হল, কিন্তু ব্যবসা তেমন কিছু করতে পারল না। কিন্তু এই ছবি হিট না হলেও আমার এ সময়ের অনেকগুলো ছবি হিট হল। ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’-এর সাফল্যের পর অনেকগুলো ভালো ভালো অফার আসতে আরম্ভ করল। পরিচালক কনক মুখার্জী একদিন এসে একটা কমেডি ছবির স্ক্রিপ্ট শোনাল, গল্পটা মোটামুটি ভালোই লাগল কিন্তু ছবির নাম শুনে তো আমার চক্ষু চড়কগাছ, ‘ভানু পেলো লটারি’।

নামটা শুনেই আমার পূর্ববর্তী ২৯ ইঞ্চি বুকের ছাতি ফুলে ৩৬ ইঞ্চি হয়ে গেল, মনে হল মাটি থেকে ছয় ইঞ্চি ওপরে ভাসছি। একজন সিনেমা আর্টিস্টের নামে এর আগে কোনো সিনেমা হয়েছে বলে আমি তো শুনিনি, মনে হল নোবেল প্রাইজ পেলাম। প্রযোজক বিষ্টু সরকার। ছবি রিলিজের পরে ভালোই হিট হল। রামদা (রামানন্দ সেনগুপ্ত), সত্যেন (চ্যাটার্জী), দেলু (নাগ), ওরা সব টেকনিশিয়ানরা মিলে একটা বই প্রাোডিউস করার কথা ভাবছিল। একদিন সত্যেন ও মৃণাল গুহঠাকুরতা এসে ‘পার্সোনাল অ্যাসিস্টেন্ট’ নামে একটা ছবির প্রস্তাব দিল। মৃণাল এ-ছবির ডিরেক্টর। চিত্রনাট্য পছন্দ হল। শুটিং আরম্ভ হল। নায়িকা একদম আনকোরা, বম্বের কিশোরকুমারের পত্নী রুমা এ-ছবির নায়িকা। এটাই তার প্রথম বাংলা ছবি। ছবি করতে করতে পরে মৃণালের কাছে শুনলাম এ ছবির অরিজিনাল কাস্ট ছিল কালী ও অরুন্ধতী। অরুন্ধতীর গল্পটা শুনে ভালো লাগে, ও উত্তমকে প্রস্তাব দেয় হিরোর পার্টটা করতে। উত্তম রাজি হয়েছে দেখে সত্যেন, দেলু দ্বিগুণ উৎসাহে নচিকেতাকে দিয়ে উত্তমকে ভেবে হেমন্তর গলার ৩-৪টে গান করে ফেলল। উত্তম শুটিং শুরু হওয়ার আগে চিত্রনাট্যে কয়েকটা সিন বাদ দিতে বলল কিন্তু মৃণাল, সত্যেন চিত্রনাট্য চেঞ্জ করতে রাজি না হওয়ায় উত্তম নিজে থেকে সরে গেল।

উত্তম সরে যাওয়াতে অরুন্ধতীও সরে গেল। এই হল আমার আর রুমার ‘পার্সোনাল অ্যাসিস্টেন্ট’-এ কাস্ট হওয়ার নেপথ্যকাহিনি। এদিকে নচিকেতাও মহা খাপ্পা, বলল, ‘আমি কোথায় উত্তম এ-বইয়ের হিরো ভেবে মিউজিক দিলাম, ভানু হিরো হবে জানলে এ ছবির সুরই দিতাম না। তারপর ছবি হিট হবার পর নচিকেতা বলল, ‘ভানুদা লিপটা ভালোই দিয়েছে।’

পরিচালক পশুপতি চট্টোপাধ্যায় একদিন এসে বললেন যে ওঁর একটা স্ক্রিপ্ট রেডি যেটা ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’-এর সিকোয়াল। স্ক্রিপ্ট শুনে আমার মনে হল এমন কিছু নয়, কিন্তু ভেটেরান ডিরেক্টর পশুপতি চ্যাটার্জী, তাঁর কথা ফেলতে পারলাম না। উনি বললেন, ‘তুমি আছ, জহর আছে, ছবিদা আছে, বই টেনে নিয়ে যাবে।’

তখনকার দিনের কিছু ফিল্ম নির্মাতা ছিল যাদের ধারণা ভানু, জহর একসঙ্গে থাকলেই ছবি হিট, তা সে যেরকমই গল্প হোক।

কিছু লোক আবার আমাদের দিয়ে লরেল, হার্ডির নকল করে কমিডি ছবি করার চেষ্টা করেছিল। যেমন বংশী আঁশ ‘চাটুজ্যে বাড়ুজ্যে’-তে আমাকে আর জহরকে দিয়ে লরেল-হার্ডির বাংলা সংস্করণ করাতে চেয়েছিল। জহর তো মহা উৎসাহে হার্ডির অনুকরণে গোঁফ ছেটে ফেলল। বংশী আঁশ ও গৌরাঙ্গ কিছু ফানি স্ল্যাপস্টিক সিচুয়েশন ঢুকিয়েই দিয়েছিল। কিন্তু আমি বললাম, ‘সিচুয়েশন যেরকমই হোক আমি কিন্তু লরেলের নকল করব না, আমি আমার মতোই অভিনয় করব।’

এ ছাড়া তপন সিনহার ‘কালামাটি’, বিশু দাশগুপ্তর ‘ডাক্তারবাবু’-তে এমন কয়েকটা উল্লেখযোগ্য চরিত্রে অভিনয় করলাম, এই সময় চারিদিক থেকেই সাফল্য এল। একদিন নতুন ফিয়াট গাড়ি নিয়ে স্টুডিয়োতে ঢুকছি, ছবিদাকে দেখাতে, ছবিদা দেখে বললেন, ‘বা: বা:, বেশ গাড়ি কিনেছিস, কিন্তু কথা হচ্ছে তুই সাইড রোলে পার্ট করে নতুন গাড়ি নিয়ে ঘুরবি আর আমি মেইন রোলে পার্ট করেও পুরোনো গাড়ি নিয়ে ঘুরব এ তো ঘোরতর অন্যায়, এ হতে দেওয়া যায় না, তুই গাড়িটা রেখে যা। আমি কয়েকদিন এ গাড়ি চড়ে নিই।’

আমি ‘তথাস্তু’ বলে ছবিদার কাছে গাড়ি রেখে চলে এলাম। আমার অবশ্য তাতে বিশেষ অসুবিধা হয়নি, কারণ তখন অস্টিনটাও ছিল, ওটাই চড়তাম, বেশ কিছুদিন পরে ছবিদা আমার ফিয়াট গাড়িটা ফেরত পাঠালেন, একদিন ওই গাড়িটা চড়ে ‘মৃতের মর্তে আগমন’ বইয়ের শুটিং করতে গেলাম।

আমার গাড়ি দেখে জহর ইউনিটের কয়েকজনকে গাড়িটার সামনে দাঁড় করিয়ে বক্তৃতা দিতে লাগল, ‘এ গাড়ি ভানু কিনেছে, একজন বাংলাদেশের কমেডিয়ান, কমেডি করে নতুন গাড়ি কিনেছে, এ গর্ব ভানুর একার নয়, আমাদের সবার। এ গাড়িও ভানুর একার নয় আমাদের সবার।’ এই বলে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘প্রত্যেক শনিবার সকালে আমার কাছে গাড়ি পাঠিয়ে দিবি।’ জহরের ছেলে তখন তারকেশ্বরে বোর্ডিং স্কুলে পড়ত, প্রত্যেক শনিবার জহর গাড়ি করে তাকে দেখতে যেত।

এসময় সাফল্য যেমন এল তেমন বিড়ম্বনাও এল, বিপদও এল। এই সময় আমার জুবিলী পার্কের বাড়িতে বিরাট চুরি হয়ে গেল, আমার বউয়ের প্রায় সত্তর ভরির মতো সোনা, বাড়িতে যত রূপোর মেডেল ছিল এবং যত ক্যাশ টাকা ছিল সব চুরি হয়ে গেছিল। পরে পুলিশের কাছে শুনেছিলাম তখনকার দিনে এক নামকরা চোর আমার বাড়িতে চুরি করেছে, আমার বাসার পিছনে একটা ঝিল ছিল সেটা গলফ ক্লাবের দিক থেকে সাঁতরে আমার জুবিলী পার্কের বাসায় এসে চুরির মাল নিয়ে আবার সাঁতরে ওপারে গিয়ে পগারপার।

আর বিড়ম্বনার কারণ হল এই সময় আমায় হিরো বানিয়ে ৫-৬টা ছবি হিট হয়ে গেল, এদিকে আবার ৫-৬ দিনের ছোট রোল নেওয়া বন্ধ করে দিলাম অর্থাৎ কিনা কমিক রিলিফের নামে যেসব আজেবাজে রোলগুলো আমাদের দেওয়া হত সেগুলো নেওয়া বন্ধ করলাম। এবার আমার ছবিগুলো হিট হওয়াতে ভালো রোলগুলোও আসা বন্ধ হয়ে গেল, কারণ তাদের ধারণা আমি বিরাট অঙ্ক হেঁকে বসব। এই ভয়ে প্রাোডিউসার, ডিরেক্টররা আর আসছিল না।

এরকমভাবে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ছবি যেমন প্রফুল্ল চক্রবর্তীর ‘গলি থেকে রাজপথ’ সুকুমার দাশগুপ্তর ‘হাত বাড়ালেই বন্ধু’, নির্মল মিত্রের ‘রাজধানী থেকে’ প্রভৃতি আরও অনেক ছবির রোল হাতছাড়া হল।

এ ছাড়া আমার আরেকটা ভয়ও গেড়ে বসেছিল, সেটা হল আমার তখন বয়স প্রায় চল্লিশ। সুতরাং এই বয়সে আমি কী রোল পাব? বাবা, কাকার রোল তো কেউ দেবে না। যাই হোক, একটাই শাপে বর হল, এইসময় আমি নিজস্ব প্রাোডাকশন করার পরিকল্পনা করছিলাম। আবার কাজ কম থাকাতে একটু রিল্যাক্সড ছিলাম, তাই ছেলে-মেয়ে-স্ত্রীকে নিয়ে এই সময়েই জীবনে প্রথম বেড়াতে বেরোলাম।

এতদিন আমার স্ত্রী, ছেলে-মেয়েকে নিয়ে বেরোবার কথা বললে আমার আড্ডাস্থল বসুশ্রীতে সিনেমা দেখতে বসিয়ে দিতাম, মন্টুর হলে তাদের অবারিত দ্বার ছিল, তাতে সুবিধা ছিল আমার বসুশ্রীতে রেগুলার আড্ডাটাও চালু ছিল আবার ছেলেমেয়েরাও মহা আনন্দে সিনেমা দেখে খুশি ছিল। প্রত্যেক রবিবার মর্নিং শোয়ে ‘লরেল হার্ডি’ বা ‘টার্জনের’ ছবি ওরা জীবনে অন্তত ১০০-১৫০টা দেখেছে। এ ছাড়াও বসুশ্রীতে অন্য বাংলা ও হিন্দি বই আরও যে কত দেখেছে তার সীমা পরিসীমা নেই। আমার মতোই আমার ছেলেমেয়েদেরও সেকেন্ড হোম ছিল বসুশ্রী সিনেমা।

কিন্তু এবার একটু অবসর পাওয়ায় ঠিক করলাম আমার পরিবারকে নিয়ে বেড়াতে বেরোব। আমি, আমার স্ত্রী, তিন ছেলেমেয়ে এবং বসুশ্রীর বন্ধু জোজো আর সমীরকে নিয়ে আমাদের নতুন ফিয়াট গাড়িতে করে গিরিডির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। গিরিডিতে আমার ছোটবোন টুনটুনি থাকত, অবশ্য এ বেড়ানোটা যে শুধুই বেড়ানো তা নয়, সেই একই সময় গিরিডির কাছে তোপচাঁচি আর উস্রি ফলস-এ ‘শখের চোর’ ছবির শুটিং-এর কাজ ছিল। সুতরাং আমার স্ত্রী, পুত্র, কন্যাদের আমার বোনের গিরিডির বাড়িতে রেখে দিয়েই শুটিং স্পটে চলে গেলাম, সমীর আর জোজোকে নিয়ে। সেখানে একটা বাংলো বাড়ি নিয়ে একটা বিরাট ইউনিট কাজ করছে। উত্তমের মোস্ট ফেবারিট জায়গা ছিল এই তোপচাঁচির স্পট। ওর অনেক ছবির আউটডোর লোকেশন হচ্ছে তোপচাঁচি।

লোকেশনে গিয়ে দেখলাম ছবিদা, কমলদা, উত্তম, প্রযোজক অনন্তদা, পরিচালক প্রফুল্ল চক্রবর্তী, প্রায় ৪০-৫০ জনের ইউনিট নিয়ে এলাহি কাণ্ড! যাই হোক, এই ‘শখের চোর’ ছবির শুটিং চলাকালীন একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছিল, একটা সিন ছিল সেখানে উত্তম বিছানায় ঘুমিয়ে আছে আর কলকাতার নামকরা ‘কাঁটা’ নামের চোর অর্থাৎ আমি উত্তমের বাড়িতে চুরি করতে রাতে ঢুকেছি, আমি পাইপ বেয়ে ওর বিছানার কাছে এসে মুখ নীচু করে দেখছি ও সত্যিই ঘুমিয়ে আছে কিনা। হঠাৎ উত্তম সজোরে ঘুঁষি মেরে ‘কাঁটা’রূপী আমাকে ধরাশায়ী করবে।

এখন হয়েছে কী উত্তমের হাতে একটা হিরের আংটি ছিল, কয়েকদিন আগে হিরেটা আংটি থেকে খুলে হারিয়ে যায়, কিন্তু উত্তম তা-ও আংটিটা পরে থাকত। হারিয়ে যাওয়া হিরের জায়গাটা উঁচু হয়ে থাকত বলে ও আঙুলের নীচে ঘুরিয়ে রাখত। কিন্তু ঘটনাচক্রে শুটিং-এর সময় ওই আংটির এবড়ো-খেবড়ো দিকটা সজোরে আমার ভুরুর ওপর গর্ত হয়ে ঢুকে গিয়ে প্রচুর রক্তপাত হয়, উত্তম তো ঘাবড়ে গিয়ে কান্নাকাটি আরম্ভ করল।

শুটিং প্যাক অ্যাপ করে ইউনিটের লোকেরা আবার জুবিলী পার্কের বাসায় পৌঁছে দিল। বাড়ি পৌঁছে আবার মহা ঝামেলা, আমার শ্বশুরমশাই সমস্ত ঘটনা শুনে বললেন, ‘এসব অ্যাক্সিডেন্ট ফেক্সিডেন্ট কিস্যু না, উত্তম ইচ্ছা কইরাই এইটা করসে?’

আমি তো ইউনিটের লোকের কাছে খুবই এমব্যারসড, ওঁকে যত বোঝাই উত্তম আমার খুবই কাছের, নিজের ভাইয়ের মতো। কে কার কথা শোনে!

আসলে আমার শ্বশুরমশাই খুবই সেকেলে, রামায়ণ-মহাভারতের বাইরে আসতে পারেননি, একেবারেই আদ্যিকালের লোক। বেশি কথাবার্তা বলতেন না, কেবল কোনও অঘটন ঘটলে নিজের মত প্রকাশ করতেন। এর আগে যে-রাতে আমার জুবিলী পার্কের বাসাতে চুরি হল, পরেরদিন সকালে তিনি সেখানে এসে বললেন, ‘তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।’

আমি আবার সেদিন খুব ব্যস্ত, কারণ সেদিন হেমন্তসহ আমার স্ত্রী ও মানবেন্দ্রর দু-তিনখানা গানের রেকর্ডিং, ইস্ট ইন্ডিয়া স্টুডিয়োতে ‘নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতিতে’ বইয়ের জন্য।

সকাল থেকে পুলিশ এসে প্রায় ২-৩ ঘণ্টা ধরে ডাইরি ফাইরি নিয়েছে, তা ছাড়া ফিল্মলাইনের ওপারের লোকেরা সমানে খবর নিতে আসছে। ১০টার সময় আমার শ্বশুরমশাই এসে গূঢ় কথা বলতে চাইলেন। বসতেই হল, উনি কোনও ভণিতা না করেই বললেন, ‘আমি না তোমারে ওই অনন্তর সঙ্গে মিশতে বারণ করসিলাম, গরুগা অখন দেখলা কী হইল?’

আমি কী করব ভেবে না পেয়ে চুপ করে থাকলাম, উনি বললেন। ‘অখন যাই, নীলিমার গান রেকডিং, আমাগো দুইজনেরই বাইরইতে হইব।’

উনি যখনই কথা বলতেন তখনই কোনও না কোনওভাবে শাসন করতেন। একবার উনি শুনলেন একটা বইয়ের শুটিংয়ের জন্য আমাকে বম্বে গিয়ে থাকতে হবে। বললেন, ‘তোমার পোলা-মাইয়ারা এখন ছোট, তোমার বেশিদিন বিদেশে থাকা ঠিক হবে না, তা ছাড়া বম্বে জায়গাটাও শুনসি ভালো না, ঠগ, জোচ্চোরে ভর্তি, যত তাড়াতাড়ি পারো ফিইরা আইবা।’

আমি ‘ঠিক আসে’ বলে রেহাই পেলাম। আমার বিশিষ্ট বন্ধু প্রদীপ (প্রদীপকুমার) প্রযোজিত ‘রায় বাহাদুর’ ছবির শুটিংয়ের জন্য বম্বে গেলাম। রোলটা ভালো ছিল, তা ছাড়া বাংলা ছবি হিসেবে বেশ ভালো টাকা দিয়েছিল, তাই এখানকার কয়েকটা বেশ কাজ হেল্ড-আপ করে বম্বে চলে গেলাম।

এর জন্য ১০-১৫ দিন বম্বে থাকতে হয়েছিল, সালটা ১৯৫৯-৬০ হবে। এই ক’দিন শুটিং চলাকালীন অনেক লোকের বাড়ি নিমন্ত্রণ পেয়েছিলাম, প্রচুর লোকের সঙ্গে আড্ডাও হয়েছে। এ-ছবির হিরোইন ছিল মালা সিনহা। মালারা ভবানীপুরের বাসিন্দা, ওর বাবা আমার পূর্বপরিচিত ছিল। একদিন সন্ধ্যায় দাদামণি (অশোক কুমার)-র বাড়িতে গেলাম, শোভা বউদি তো না-খাইয়ে ছাড়বেন না। আমি সান্তাত্রু�জে যে হোটেলটায় ছিলাম সেখান থেকে দাদামণির বাড়ি অন্তত ১৫-২০ মাইল দূরে ছিল। তড়িঘড়ি করে ৯ টা নাগাদ পৌঁছোলাম, গিয়ে দেখি দাদামণি তখনও কাজ থেকে ফেরেনি, সেখানে খানিকক্ষণ শোভা বউদির সঙ্গে আড্ডা মারার পর কিশোর এসে হাজির হল। দেখলাম কিশোরও সমানে উসখুস করছে। শোভা বউদি বলল, ‘ভালোই হয়েছে, তুইও ভানুর সঙ্গে খেয়ে যা, আর যাবার পথে ওকে হোটেলে পৌঁছে দিস, আমি দেখি রান্নার কতদূর কী হল।’

বউদি যাওয়ামাত্রই কিশোর বলে, ‘শিগগিরি পালিয়ে চলুন।’

আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘কেন?’

ও বলে, ‘মশাই, সাতদিনের বাসি মাছ খাওয়াবে বউদি।’

তখনকার দিনে আমরা রোজ টাটকা মাছই খেতাম। ফ্রিজে সাত দিন ধরে রেখে খাওয়ার রেওয়াজ ছিল না। শেষ অবধি সাতদিনের বাসি মাছ-ই খেতে হল, তেমন বিস্বাদ লাগেনি আমার অবশ্য।

আরেকদিন শচীন কর্তার বাড়িতে খেলাম। এটা আমার কাছে পরম পাওয়া, কারণ শচীন কর্তা ছিলেন আমার কাছে আইডল। আমি কোনওকালে সঙ্গীত বুঝতাম না; ঘোরতর ‘সঙ্গীত-অজ্ঞ’, কিন্তু আমি এতটাই শচীন কর্তার ভক্ত ছিলাম যে কলকাতায় চাকরি পাওয়ার প্রথম মাসেই মাইনে পেয়ে চারটে শচীন কর্তার রেকর্ড কিনে ফেললাম। আমার নিজের গ্রামোফোন ছিল না। কিন্তু তাতে কী? দিদির তো ছিল, ওর গ্রামোফোনেই শুনতাম, এ ছাড়া ইস্টবেঙ্গলের খেলা থাকলে রোজই কর্তার সঙ্গে দেখা হত এবং কথাবার্তা হত, তদুপরি মীরা (শচীন কর্তার স্ত্রী) আমার ঢাকার জগন্নাথ কলেজের ক্লাসমেট ছিল।

একদিন তো কর্তার বান্দ্রার ‘দি জেট’-এর বাড়িতে গেলাম, অনেকক্ষণ আড্ডা হল, তারপর খাওয়া। খাওয়ার পর কর্তা বললেন, ‘কী রকম খাইলা?’

আমি বললাম, ‘উপাদেয়!’

কর্তা শুনে বললেন, ‘মুরগির মাংসটা কেমন খাইলা?’

বললাম, ‘অপূর্ব, এমন আর খাই নাই।’

কর্তা বলেন, ‘কে রাঁধসে জানো?’

বলি, ‘মীরা নিশ্চয়ই।’ আমি জানতাম মীরা ভালো রাঁধে।

কর্তা বলেন, ‘না, সকালে রফি আইসা রাইন্ধা দিয়া গ্যাসে।’

আমি তো অবাক, রফি তখন ভারতবর্ষের সবচেয়ে নামকরা গায়ক।

কর্তা বললেন, ‘রফিরে কইলাম কলকাতার থিইক্যা আমার অনেক দিনের পুরানো বন্ধু খাইতে আইবো, রফি শুইন্যা নিজেই রাইন্ধা দিয়া গ্যালো।’

এদিকে শচীন কর্তা আমায় খাইয়েছে শুনে তো হইহই। নটরাজে একদিন শুটিং করছি, কিশোর আমায় দেখে বলে, ‘আপনি তো মশাই অসাধ্য সাধন করেছেন—দাদামণি, শচীনদা এরা কোনও দিন কাউকে খাইয়েছে বলে তো শোনা যায় না।’

কিশোর ছেলেটা বেশ মজার ছিল, এই ঘটনার বেশ কিছুদিন পরে একদিন আমার কলকাতার বাড়িতে এল জপনাথকে নিয়ে। জপনাথ নর্থ বেঙ্গলের ছেলে, সেই সময়ে বোধহয় কিশোরের সেক্রেটারি ছিল। এই সময়টায় ‘চারুলতা’ ছবিতে গান গেয়ে কিশোরের বেশ খ্যাতি হয়েছে। এটা-ওটা বলার পর আউট অফ কিউরিওসিটি আমি ওকে জিগ্যেস করলাম, ‘আপনি কার কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখেছেন?’

ও বলে, ‘সায়গল সাহেবের কাছে।’

আমি ভাবলাম গুল মারছে, কারণ সায়গল তো বহুদিন মারা গেছেন। ও আমার মনোভাব বুঝতে পেরে বলল, ‘আসলে সায়গল সাহেব সিনেমার জন্য যে ক’টা রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছেন অর্থাৎ সায়গলের গাওয়া মোট ৬টা রবীন্দ্রসঙ্গীত-ই জানি, আমি রেকর্ড বাজিয়ে শিখেছি।’

কিশোরের বাবা সেন্ট্রাল প্রভিন্সে উকিল ছিলেন। যখন কেস করতে নাগপুরে যেতেন, তখন ওখান থেকে সব বাংলা রেকর্ড কিনে আনতেন, ওগুলো শুনে শুনেই ও গান শিখেছে।

যাই হোক, এসব গল্প-টল্প করার পর আমার কাছে আসার কারণ বলল, ও সে-সময়টা কলকাতায় এসেছিল নিউ থিয়েটার্সের একটা বাংলা বইয়ের শুটিং করতে, অনেকদিন ধরে ও পুরোনো ‘ছদ্মবেশী’ বইটা রিমেক করবে বলে ভাবছিল, খানিকটা স্ক্রিপ্ট শোনাল। কিন্তু আমি তখন আর কমেডি বইয়ে সেকেন্ড লিড করব না বলে স্থির করে ফেলেছিলাম; ওকে সেটাই বললাম। ও অবশ্য ‘ছদ্মবেশী’ আর করেনি।’

আমি যখন বম্বেতে ‘রায়বাহাদুর’-এর শুটিং করতে গেছিলাম সেই সময়েই কলকাতায় আমার নিজস্ব প্রাোডাকসন্স ‘কাঞ্চনমূল্য’র তোড়জোড় চলছিল। আমার যেদিন কলকাতায় ফেরার কথা সেদিন ফিরতে পারলাম না, কারণ মালা দু-তিন দিন শুটিং-ডেট ফেল করাতে ‘রায়বাহাদুর’-এর কাজ পিছিয়ে যাচ্ছিল, আমার উদবেগ বাড়ছিল।

ওদিকে প্রদীপেরও ভীষণ উদবেগ বাড়ছিল কারণ প্রদীপের পরবর্তী প্রাোডাকশনের হিন্দি ছবি ‘দো দিলোঁ কী দাস্তান’-এ বৈজয়ন্তীমালার ডেট নিয়ে গন্ডগোল হচ্ছিল। আমি বম্বেতে থাকাকালীন প্রায় রোজই প্রদীপের বাড়িতে যেতাম, আমি লক্ষ করতাম প্রদীপ সবসময়ই টেনশনের মধ্যে আছে। ও ‘রায়বাহাদুর’-এর থেকে অনেক বেশি উদবিগ্ন ছিল ‘দো দিলোঁ কী দাস্তান’ নিয়ে। একে তো বিগ বাজেটের ছবি, তার ওপর বৈজয়ন্তীমালার ডেট পাওয়া খুব মুশকিল। সর্বোপরি পরিচালক হিসাবে প্রদীপের ওটাই প্রথম ছবি। এত সব ঝামেলা সত্বেও ওর মাথা খুব ঠান্ডা থাকত।

এখন ভাবি প্রদীপ আমার কত বড় বন্ধু ছিল, এত ডামডোলের মধ্যেও কিন্তু আমার একটা রিকোয়েস্ট রেখেছিল ওর হিন্দি ছবির ব্যাপারে। অথচ কখনও মুখ ফুটে বলেনি যে ওর এই সময়টা খুব খারাপ যাচ্ছিল। এই হিন্দি বইটা রিলিজ করতে প্রায় ৪-৫ বছর লেগেছিল।

১৯৫৬ সালের জানুয়ারি মাসে সিনে অ্যাডভান্সের সরোজ সেনগুপ্ত বাংলা, বম্বের আর্টিস্টদের নিয়ে ইডেন-গার্ডেন্সে এক বিরাট জলসার আয়োজন করে। বম্বের গায়কদের দিয়ে জলসা বাংলায় বোধকরি এটাই প্রথম ছিল। ইডেন গার্ডেন্সে প্যান্ডেল টাঙিয়ে ৬০-৭০ হাজার লোকের বসার জায়গা করে দিয়ে জলসা এর আগে কখনও হয়নি। কে না ছিল এই জলসায়—বম্বের লতা, মুকেশ, শচীন কর্তা, তালাত প্রভৃতি গায়ক, আর প্রদীপকুমার, ভারতভূষণ, স্মৃতিরেখা, কামিনী কৌশল, নলিনী জয়ন্ত প্রভৃতি তাবড় তাবড় আর্টিস্ট। এদিকে হেমন্ত থেকে আরম্ভ করে গুচ্ছেরখানেক কলকাতার আর্টিস্ট ছিল। অর্গানাইজাররা ঠিক করেছিল সন্ধে ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত কলকাতার আর্টিস্ট আর রাত ১২ টার পর থেকে পরের দিন ভোর ৬টা পর্যন্ত বম্বের আটির্স্টরা পারফর্ম করবে।

কিন্তু প্রথম থেকেই কিছু হুলিগান গন্ডগোল পাকাবার তালে ছিল, তারা কলকাতার আর্টিস্টদের গানের সময় লাগাতার গন্ডগোল করছিল। কলকাতার কোনো আর্টিস্ট গন্ডগোলের চোটে ২-৩ টের বেশি গান গাইতে পারছিল না, কারণ পাবলিক লতা, মুকেশের গান শুনতে চায়। রাত ৯টা-১০টা নাগাদ বাঁশরী লাহিড়ি গাইতে বসলে তুমুল গন্ডগোল আরম্ভ হল। কিছু বদমাশ লোক পেছনের দিকে প্যান্ডেলে আগুন ধরিয়ে দিল। দর্শকরা স্টেজের দিকে ইট-পাটকেলসহ যা পাচ্ছিল ছুড়তে আরম্ভ করল, বাঁশরী লাহিড়ী তো কাঁদতে কাঁদতে স্টেজ থেকে উঠে এল। বম্বের আর্টিস্টরা ভয় পেয়ে ঘাবড়ে গিয়ে কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না, এমন ঝামেলা তো তারা কোনওদিন দেখেনি।

এ সময় সরোজদা আমাকে ঠেলে স্টেজে ঢুকিয়ে দিল। আমি নমস্কার করে মাইকের সামনে আসতে আসতে দেখলাম লোকের তর্জন-গর্জন কমে পাবলিক হাসতে আরম্ভ করেছে। আমি বললাম, ‘আপনারা হাসতে হাসতেই আমার কয়েকটা কথা শুনুন, বম্বের আর্টিস্টরা আমায় বলেছে কলকাতার আর্টিস্টরা না গাইতে পারলে লতা, মুকেশ স্টেজে আসবে না, বম্বের কেউই আসবে না। আর যারা গোলমাল করছে তারা বাইরের লোক, তারা সবাই অবাঙালি, আপনারা যারা বাঙালি দর্শক আছেন তারা দেখুন ওরা যেন গোলমাল করতে না পারে (আমি খুব ভালোভাবেই জানতাম যারা গন্ডগোল করছে তারা সবাই বাঙালি)।

প্রায় সঙ্গেই সঙ্গে কাজ হল, বেশ কিছু সর্দার গোছের লোক ফায়ার বিগ্রেডের সঙ্গে আগুন নেভাতে থাকল, আর বেশ কিছু লোক ঘুরে ঘুরে জনতাকে গোলমাল থেকে বিরত করতে লাগল।

এসব দেখে বম্বের আর্টিস্টরা তো খুব ইমপ্রেসড। কে.এন. সিং, ডেভিড, সজ্জন, নলিনী জয়ন্ত, উষাকিরণ, কামিনী কৌশল প্রভৃতি আমাকে ধন্যবাদ দিতে লাগল। বিশেষ করে সজ্জন তো বিশিষ্ট বন্ধু হয়ে গেল। সজ্জন কলকাতায় এলেই আমার বাসায় থাকত। এই সময়টা ও ভরতমুনির নাট্যশাস্ত্র নিয়ে হিন্দিতে একটা বই লিখছিল। কলকাতায় মনোরঞ্জন ঘোষ নামে এক ভদ্রলোক ভরতমুনির নাট্যশাস্ত্রের ওপর একটা থিসিস লিখছিল। তার সঙ্গে দেখা করার জন্য ও মাঝে মাঝেই আসত।

বম্বের থেকে ‘রায়বাহাদুর’-এর শুটিং শেষ করে কলকাতায় ফেরার পর দেখলাম, ‘কাঞ্চনমূল্য’-র স্ক্রিপ্ট প্রায় রেডি, আমি ছবির প্রাোডাকসনের দিকে এই সময় খুবই মনোযোগ দিলাম। আমার মনে একটা ভয় ঢুকেছিল, তখন আমায় বয়স চল্লিশ অর্থাৎ বুড়ো হয়েছি। এই বয়সে আমাকে কমেডির রোল কে দেবে? আবার ওদিকে হিরো, হিরোইনের বাবার পার্টও দেবে না? তার জন্য ছবিদা, পাহাড়িদা তো ছিলেনই। যাই হোক, আবার স্টার থিয়েটার জয়েন করেছিলাম বলে বাঁচোয়া, অন্তত না-খেতে পেয়ে মরতে হবে না। দু-চারটে ভালো রোল আসছিল তখনও, আর ফাংশান তো ছিলই, কিন্তু সিনেমায় কাজ অনেক কমে গেছিল।

‘কাঞ্চনমূল্য’র ডিস্ট্রিবিউশনের জন্য আর.ডি বনশলকে পেয়ে গেলাম, কিন্তু শুটিং শুরু করার মুখে বিপত্তি, বিশেষ করে আর্টিস্ট সিলেকশন নিয়ে বিমল দে-র সঙ্গে খিটিমিটি লেগে গেল। আমার যে আর্টিস্ট সিলেকশন করা ছিল আর.ডি বনশলের কর্ণধার বিমল দে-র তাতে আপত্তি। ৩-৪ মাস শুটিং বন্ধ থাকার পর ঝামেলা মিটে গেল, তখন আবার অন্য কারণে খিটিমিটি। তার একটা গানের সিনে আমার ঠিক করাই ছিল তুলসীদা-কে নেব। বিমলদার আবার ইচ্ছা গানটা যখন মিন্টু দাশগুপ্ত গেয়েছে তখন পার্টটা ও-ই করুক। কিন্তু আমি তো ঠিক করে রেখেছি এক সিনের পার্ট হলেও তুলসীদা আমার ছবিতে থাকবেই। অবশ্য তুলসীদাই শেষ অবধি চরিত্রটা করল। তুলসীদার তখন শরীর বেশ খারাপ কিন্তু আমি প্রায় জোর করে ওকে দিয়ে পার্টটা করালাম। স্টার থিয়েটার সূত্রে তুলসীদার সঙ্গে আমার অনেক দিনের হৃদ্যতা। আমার মনে আছে তখন ‘শ্যামলী’ নাটক করি। সেবার ৭৪।।. ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ কৌতুকাভিনেতার পুরস্কার পেয়েছিলাম। তুলসীদাকে প্রণাম করলাম, তুলসীদা মাথায় হাত দিয়ে বললেন, ‘ব্যাটা বাঙাল, তুই সেদিন এসে আমাদের হারিয়ে দিলি?’

তুলসীদা লোকটা নির্ঝঞ্ঝাট, নিপাট ভদ্রলোক ছিল। একদিন আমি ‘পরিণীতা’ নাটক-এর জন্য স্টারের উলটোদিকে গাড়ি থেকে নামছি, হঠাৎ দেখি স্টার-এর দিকে ফুটপাথে দু-চারটে ছেলে-ছোকরা তুলসীদার জামার হাতা ধরে ধুতির কোছা ধরে টানাটানি করছে। আমি রাগে দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে একলাফে ওদিকের ফুটপাথে গিয়ে এলোপাথারি লাথি-ঘুঁষি মারতে থাকলাম। ছেলেগুলো লাথি খেয়ে চোঁচা দৌড়। তুলসীদা আমার হাত ধরে বললেন, ‘কেন বাবা রাগারাগি করিস, ওরা আমার টাক নিয়ে একটু ইয়ার্কি ফাজলামি করছিল, এখুনি স্টারের ভেতরে ঢুকে গেলে ওরা বাড়ি চলে যেত।

এরকম ভালোমানুষ ছিল তুলসীদা। যখন সিন থাকত না মাঝে মাঝে আমি তুলসীদার কাছে পুরোনো দিনের গল্প শুনতাম। তুলসীদা অনেক ছোটবেলাতেই সার্কাসদলের সঙ্গে পালিয়ে বর্মা চলে গেছিলেন। তুলসীদার কাকা থিয়েটার অর্কেস্ট্রা পার্টিতে বাজাতেন। তুলসীদার প্রথম নাটকে আত্মপ্রকাশ খুব মজার ঘটনা। তারাসুন্দরী তখন নাট্যসাম্রাজ্ঞী। উনি ‘রাজিয়া’ নাটক করছেন, একদিন একটা ছোট দূতের রোলে যিনি অভিনয় করেন তিনি এলেন না, তুলসীদাকে পার্টটা করতে বলা হল। ওঁর ডায়লগ ছিল, ‘জাঁহাপনা, পত্র’—ব্যস এইটুকুই। তুলসীদা স্টেজে ঢুকে সামনে দেখেন তারাসুন্দরী। তাঁর দিকে তাকিয়ে তারাসুন্দরী বলেন, ‘কী সংবাদ দূত?’

উনি তারাসুন্দরীকে দেখে ঘাবড়ে গিয়ে বলেন, ‘হাঁজাপনা, পোঁ।’ আসলে ‘জাঁহাপনা’র জায়গায় যখন বুঝলেন ভুল করে ‘হাঁজাপনা’ বলে ফেলেছেন তখন ‘পত্র’-এর জায়গায় ‘পোঁ’ বলেই থম মেরে গেছেন।

যাই হোক, তারাসুন্দরী ছিলেন দুর্ধর্ষ অভিনেত্রী, উনি তো স্টেজে ম্যানেজ করলেন, সিনের পর ভেতরে এসে তুলসীদার গালে সজোরে এক চড় কষিয়ে বললেন, ‘সামান্য ডায়লগ বলতে পারো না, থ্যাটার করতে এয়চো?

এই চড়টা তুলসীদার কাজে লেগেছিল। আমি অবশ্য এ গল্পটা অন্যভাবে দেখেছিলাম, স্বয়ং তারাসুন্দরীর হাতে চড় খাওয়া কম ভাগ্যের কথা নয়! তুলসীদা নিজে খুব ভালো হারমোনিয়াম, তবলা বাজাতে পারতেন, ভালো গানও গাইতে পারতেন।

যা বলছিলাম, ‘কাঞ্চনমূল্য’র তরজার সিনে তুলসীদা তো অভিনয় করলেন। গানটার সঙ্গে তুলসীদাকে কোমর নাচাতে বললাম, কিন্তু দেখলাম হাজার চেষ্টা করেও কোমর নাচাতে পারছেন না আর ঘেমে নেয়ে অস্থির। আমার এখন মনে হয় ওঁর তখন কোমরে ব্যথা ছিল অথচ আমি যেরকম বলছিলাম সেরকমটা না-পারার জন্য লজ্জায় ঘামছিলেন। সিনটা হয়ে যাবার পর তুলসীদা গুটি গুটি চলেই যাচ্ছিলেন স্টুডিয়ো থেকে। আমি তাড়াতাড়ি গিয়ে ধরে বললাম, ‘এ কী, টাকা না দিয়ে চলে যাচ্ছেন যে!’

তুলসীদা বললেন, ‘ও! নিইনি বুঝি? আচ্ছা সিনটা কীরকম হল রে? তুই যেমন চাইছিস পেরেছি কি?’

আমি বললাম, ‘খুবই ভালো হয়েছে।’ এই বলে ওঁর হাতে একশো টাকার নোট গুঁজে দিলাম।

তুলসীদা বলেন, ‘অ্যাতো দিলি কেন, আমার কিন্তু চেঞ্জ নেই, তুমি বাবা আমায় ভাঙিয়ে দাও।’

আমি বললাম, ‘ভাঙাতে হবে না আপনি পুরোটা রাখুন।’ বলে ওকে প্রণাম করলাম।

তুলসীদা তো মহাখুশি হয়ে আশীর্বাদ করলেন। এরপরে তুলসীদা আর বেশিদিন বাঁচেননি। ‘কাঞ্চনমূল্য’তে ডিস্ট্রিবিউটররা গান দেবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল, স্ক্রিপ্ট করার সময় একটা গান ছিল, আমার ইচ্ছা ছিল আমার ছবির সুরকার নির্মলেন্দুই গান গাইবে কিন্তু নির্মলেন্দু বিমলদার সঙ্গে শলা-পরামর্শ করে বম্বে থেকে হেমন্তকে এনে দুখানা গান গাওয়াল। আমার ছেলে গৌতম যে মেইন রোলে অভিনয় করেছিল তার লিপে নীলিমাকে দিয়ে গান গাওয়ানো হল। নীলিমা পল্লীগীতিই গাইত, সুতরাং বেমানান হয়নি।

এত ঝামেলা মিটিয়ে ছবি তো রিলিজ করলাম কিন্তু সেখানে আরও বড় বিপদ। ‘কাঞ্চনমূল্য’র সঙ্গে সঙ্গেই রিলিজ হল তখনকার দিনের সবচেয়ে ব্যয়বহুল স্টার কাস্ট ছবি ‘ঝিন্দের বন্দী’। আমি তো ভাবলাম একে উত্তমে হয় না, তার ওপর সৌমিত্র; এ-ছবি ছেড়ে একজন লোকও আমার ছবি দেখতে যাবে না, সিওর ফ্লপ। কিন্তু ঈশ্বরের অশেষ কৃপা, ছবি চলল।

যাই হোক ‘কাঞ্চনমূল্য’ ছবি চললেও ডিস্ট্রিবিউটরদের নিখুঁত অ্যাকাউন্টিং-এর জাগলারিতে আমার ঘরে আর পয়সা আসেনি। অথচ এই ‘কাঞ্চনমূল্য’ ছবি বানানো নিয়ে পুরো দুই বছর নানারকম টানাপোড়েন গেছে। প্রথমত, আমি এক ছা-পোষা বাঙালি কেরানি। হাজার রকম সাহায্য, অ্যাডভানটেজ সত্বেও এক এক পা এগোই তো তিন পা পিছোই, তার ওপর কয়েকদিন আগে আমার বাড়িতে অতবড় চুরি হয়ে সর্বস্ব গেছে; যত সোনা-দানা, সোনার মেডেল, রুপোর মেডেল, ক্যাশ সব ধুয়ে মুছে সাফ। একটা ছবির প্রাোডাকসন্স মানে ১ লাখের ওপর ধাক্কা, তখনকার দিনের ১ লাখ মানে আজকের দিনে অন্তত ১০-১২ লাখ। যদিও প্রথম থেকেই বনশলকে ডিস্ট্রিবিউটর পেয়ে গেছিলাম টাকা দেবার জন্য। এ ছাড়াও নানাদিক থেকে নানারকম সাহায্য পাচ্ছিলাম, তাহলেও যাদের থেকে টাকা নিয়েছি তাদের তো ফেরত দিতে হবে। এ ছাড়া নিজের পকেট থেকেও অনেক খরচ হয়ে গেছে।

প্রাোডিউসার হওয়া কম ঝক্কি নয়, এক সময় ভাবছিলাম করবই না, হঠাৎ একদিন আমার ডিরেক্টর নির্মল মিত্র আমাদের ছবির লেখক বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়কে বিহার থেকে আনিয়ে আমার জুবিলী পার্কের বাসায় হাজির, উনি তো এমন উৎসাহ দেখালেন যে, আমি লজ্জায় না বলতে পারলাম না। আমি এখনও ঠিক করিনি এই বই করব কিনা। এর দু-তিন দিন বাদেই নির্মল আবার নৃপেন্দু কৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে হাজির এ ছবির স্ক্রিপ্ট লেখাবার জন্য। নির্মল রীতিমতো প্রেসার করছিল। না-ভাবার কোনও সুযোগ দিচ্ছিল না। এ ছাড়া ফিল্ম লাইনের আমার সব বন্ধুরা, বিশেষ করে ছবিদা এমন উৎসাহ দিচ্ছিলেন যে আমার মতো ভেতো এবং ভীতু বাঙালি ‘মাভৈ:’ বলে ফিল্ম প্রাোডাকশনে ঝাঁপিয়ে পড়লাম।

আমি লোকটা কিন্তু অ্যাক্টিং এবং কেরানিগিরি ছাড়া কোনো সাবজেক্টেই বিশেষ পারদর্শী ছিলাম না। কিন্তু আমি সব কাজেই খুব রুটিনমাফিক চলতে ভালোবাসি। যা করি বেশ অর্গানাইজডভাবেই করি। কিন্তু কাজে নেমে দেখি পদে পদে গন্ডগোল। প্রথমত, আর্টিস্ট সিলেকশন নিয়ে তো প্রথম থেকেই গন্ডগোল। তারপর মেইন রোলে যে বাচ্চা ছেলের অভিনয় করবে, সেই নির্বাচন নিয়ে ঝক্কি। আমার ইচ্ছে ছিল বিভূ, সুখেনের মতো কাউকে নেওয়া। কিন্তু ওরা অলরেডি যুবক হয়ে গেছে। তিলক ছিল, কিন্তু তিলক গ্রামের ছেলের চরিত্র করার জন্য বেশি সফিস্টিকেটেড ছিল। অতএব নির্মল মিত্তিরের পাল্লায় পড়ে আমার ছেলে গৌতমকে নিতে হল। ভাবলাম শিখিয়ে-পড়িয়ে নেওয়া যাবে, এ ব্যাপারে বসুশ্রীর জোজো, মিনুরাও খুব উৎসাহ দিতে লাগল।

এর ওপরে মেজর ঝামেলা হচ্ছিল সুরকার নির্মলেন্দুকে নিয়ে। এমনিতে নির্মলেন্দু খুব ভালো ছেলে, আমায় খুব মান্যিগণ্যি করত। প্রথম প্রথম খুব উৎসাহ নিয়ে তলে তলে বনশাল কোম্পানির বিমল দেকে নিয়ে আমার অজান্তে হেমন্তকে দিয়ে দুটো গান গাওয়াবার ব্যবস্থা করল। হেমন্ত কমসম নিয়েও দুখানা গানে যা খরচ, অন্য শিল্পী নিয়ে গান করালে আটখানা গান হয়ে যেত। এদিকে হেমন্তকে ঠিক করে বাবুর আর দেখা নেই, হেমন্তকে গান তোলাবে কে? নির্মলেন্দু দেখি আমার বউকে দিয়ে হেমন্তর গানগুলো তোলাচ্ছে। আমি দেখে বললাম, ‘সেকী! তুই হেমন্তকে গান না শিখিয়ে নীলিমাকে শেখাচ্ছিস কেন?’

ও বলে, ‘দিদিভাই (নীলিমা) কীর্তনাঙ্গ গান ভালো শেখাবে কারণ কীর্তনের আর্টিস্ট তো! আমার চেয়ে ভালো শেখাবে।’

আমি ভাবলাম ঠিকই হয়তো। এরপরে দেখি টাইটেল মিউজিকে বাহাদুর খাঁকে নিয়েছে সরোদ বাজাবার জন্যে, অথচ রিহার্সালে নির্মলেন্দুর দেখা নেই। ওর অ্যাসিস্টেন্ট অমর সব ম্যানেজ করছে। আমার তো ভীষণ রাগ হল, সঙ্গীতের জন্য আমার এত বাজেট ছিল না। হেমন্ত, বাহাদুর খাঁকে এনে ও বাজেট বাড়িয়ে দিল অথচ ওর দেখা নেই। আমি অনুষ্ঠান করতে লাগলাম, পরে জানলাম উনি নিজের কাজ ছেড়ে পরোপকার করে বেড়াচ্ছেন।

রাজেন তরফদার আমার পাড়াতেই থাকত। রাজেনের কাছে জানলাম নির্মলেন্দুবাবু ওর ‘গঙ্গা’ ছবির গানের জন্য সবাইকে রিহার্সাল করিয়ে বেড়াচ্ছে। কারণ ওই ছবির সুরকার সলিল বোম্বাইতে ব্যস্ত। আমি তো রেগে কাঁই। নির্মলেন্দুকে খুঁজে বেড়াচ্ছি গালাগালি দেব বলে। গান টেকিং-এর দিন হেমন্তর গান টেক হয়ে যাবার পর তো ওকে ধরেছি। ও হাতজোড় করে বলে, ‘দেখো দাদাভাই, গান তো ভালো হয়েছে খুবই।’

আমি বলি, ‘তুই নিজের কাজ ছেড়ে পরোপকার করে বেড়াচ্ছিস কেন?’

ও বলে, ‘কী করব হেমাঙ্গদা তুলে নিয়ে যায়, তা ছাড়া দিদিভাই গান তুলিয়েছে বলে অনেক ভালো হয়েছে, আমি হলে পারতাম না।’

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ১৫ মিনিট ধরে আমায় এইসব ভুজং ভাজাং দিল। এতসব ঝামেলা সত্বেও আমার স্যাটিসফ্যাকশন হচ্ছে যে, সবাই ভালো কাজ করেছিল। ছবিদা, রাজলক্ষ্মীদির কথা তো বাদই দিলাম, বিকাশদা আমার বাবার চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছিল। অপর্ণাদি (অপর্ণাদেবী) ও ছবিদার স্ত্রীর একটা ছোট চরিত্রে অসাধারণ কাজ করেছিল।

যাই হোক, আমি যে-ভয় পাচ্ছিলাম, বয়স হয়ে যাওয়াতে আর রোল পাব না, অবস্থা ততটা খারাপ হয়নি। এই সময়টাতেই অসীম পাল আমাকে আর জহরকে মেইন রোলে নিয়ে ‘মি: অ্যান্ড মিসেস চৌধুরি’ নামে একটা কমেডি ছবি করল। এই ছবির কাহিনিকার আমার বাল্যবন্ধু শৈলেশ দে, কিন্তু ছবিটা বোধহয় খুব ‘হিট’ হয়নি। তারা বর্মন আমাকে, অনুপ আর সাবিত্রীকে নিয়ে ‘কানামাছি’ বইটা করল। এই বইটা কিন্তু হিট ছিল। এই ছবির জন্যও আমি সে-বছর সর্বশ্রেষ্ঠ কৌতুকাভিনেতার পুরস্কার পেয়েছিলাম। পরে এই ছবিটার গল্প নিয়ে হৃষীকেশ হিন্দিতে ‘গোলমাল’ নামে একটা বই করেছিল।

হৃষীকেশ আমার বহুকালের বন্ধু, সেই ‘৪৩-‘৪৪ সাল থেকে; কিন্তু ওর ছবিতে আমার কখনও অভিনয় করা হয়নি। তার প্রধান কারণ হল ও হিন্দি ছবিই করত বম্বেতে। একবার একটা বাংলা ছবির কথা অনেক দূর এগিয়েছিল ‘আনন্দ সংবাদ’ নামে। ‘হাটে বাজারে’ হিট হবার পর প্রাোডিউসার নেপাল দত্ত, অসীম দত্তরা ঠিক করেছিল এ-ছবিটি প্রাোডিউস করবে, রাজ কাপুর, উত্তম ও আমাকে নিয়ে। রাজ কাপুরের রোলটা ছিল কলকাতার এক পাঞ্জাবি ‘হ্যাপি গো লাকি’ টাইপ ছেলে, যে ভাঙা ভাঙা বাংলায় কথা বলে। উত্তমের রোলটা ছিল ওই পাঞ্জাবি ছেলেটির ফ্রেন্ড, ফিলজফার, গাইড। কিন্তু রাজ ক্যান্সারে মারা যায়। এই ছবিটা অনেক দূর এগিয়েও হল না, কারণ উত্তম রোলটা রিজেক্ট করল। শুনেছি এর আগেও রাজ, উত্তমকে ‘সঙ্গম’ ছবির রোল অফার করেছিল, কিন্তু সেটাও রিজেক্ট করেছিল। আমি লক্ষ করেছি উত্তম কোনও চরিত্রে যদি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ না করত সেই রোল অ্যাকসেপ্ট করত না, তা সে যতই লোভনীয় হোক।

আমার আরেকটা বেশ লোভনীয় অফার এসেছিল, সেটা অবশ্য অনেক আগে, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ ছবির পরে দিলীপ কুমার তপন সিনহার সঙ্গে ছবি করতে আগ্রহ দেখিয়েছিল হেমেন গাঙ্গুলীর কাছে। তাতে উৎসাহিত হয়ে হেমেন গাঙ্গুলী একটা ছবির প্রযোজনার কথা ভেবেছিল। তপনবাবুর পরিচালনায় সেই ছবির নাম ‘অন্য নগর’। দিলীপ কুমার অভিনীত এ ছবির বেশির ভাগ শুটিং হওয়ার কথা ছিল লন্ডনে। এ ছবিতে, আমিও নির্বাচিত হয়েছিলাম, কিন্তু ছবিটা আর হয়নি।

জুবিলী পার্কের বাড়িতে চুরির পরেই আমার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছিল। আমার মারও শরীর খারাপ হতে লাগল, বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন। আমার বাড়ির সমস্ত লোকই আর এ-বাড়িতে থাকতে চাইছিল না, সবাই-ই চারু অ্যাভিনিউতে ফিরবার জন্য উতলা হয়ে উঠেছিল। এদিকে আমার বাড়িতে মাঝে মাঝে চারু অ্যাভিনিউর পান্তু নামে একটা ছেলে যেত। সে সবসময়ই আমাকে চারু অ্যাভিনিউতে ফেরার জন্য অনুরোধ করত। একদিন পান্তু আর আমার বন্ধু দেবুকে বললাম, ‘আমার জন্য বাড়ি দেখ, চারু অ্যাভিনিউতে না পাওয়া গেলে তার পাশে হলেও চলবে।’ ওদের থেকে শুনে অনেকে আমার জন্য ঘর খুঁজতে লাগল।

অবশেষে দেবু (হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের ভাই) চারু অ্যাভিনিউতে একটা খুব সুন্দর বাড়ির সন্ধান দিল। ওর বাড়ির উলটো দিকেই দেববালা (বিগত দিনের ডাকসাইটে সুন্দরী অভিনেত্রী যিনি ‘মুক্তি’, ‘রিক্তা’, ‘দিদি’, ‘বিদ্যাপতি’, ‘গোরা’, প্রভৃতি অনেক ছবিতে অভিনয় করেছিলেন) তাঁরই বাড়ি। আমার দিদি প্রকৃতি ও দেবু গিয়ে দেববালাকে রাজি করালেন। সত্যি কথা বলতে কী উনি বাড়ি বানাবার পর থেকে কোনও সময়ই বাড়িটাতে থাকতেন না, সব সময়ই ভাড়া দিতেন। একসময় বিনয় (বিনয়, বাদল, দীনেশ) বসুর ভাই সূর্য্য বসুও এই বাড়িতে থাকতেন।

অবশেষে ১৯৬০ সালের ১ সেপ্টেম্বর, ঠিক দুর্গাপুজোর আগেই আমি আবার আমার পুরোনো পাড়া চারু অ্যাভিনিউতে ফিরে এলাম। বাড়ির সবাই বেজায় খুশি, মায় আমার আশি বছরের বৃদ্ধা মা।

পাড়ার লোকেরা কাতারে কাতারে দেখা করার জন্য আসতে লাগল। পান্তু প্রভৃতি পাড়ার যুবকরা এতই খুশি যে অন্য একজন লোককে বাদ দিয়ে আমাকেই পাড়ার পুজোর প্রেসিডেন্ট বানিয়ে দিল। এমনকী বড় পুজো করার জন্য সেবারের পুজোকে ‘সিলভার জুবিলি ইয়ার’ বানিয়ে দিল মিথ্যা মিথ্যা। আমি পাড়ার পুরোনো লোক। আমি জানতাম, ১৯৬০-এ চারু অ্যাভিনিউর পুজোর রজত জয়ন্তী বর্ষ হতেই পারে না। কিন্তু ওরা বড় করে ফাংশান টাংশান করবে বলে ‘রজত জয়ন্তী’ বর্ষ হল।

এই ফাংশানকে উপলক্ষ্য করে সেবার এক সাংঘাতিক মারপিট হয়েছিল আমাদের চারু অ্যাভিনিউর সঙ্গে পাড়ার পেছনের টালিগঞ্জ রোডের ছেলেদের। সে এক ধুন্ধুমার যুদ্ধ, আমাদের চারু অ্যাভিনিউর পান্তু, লম্বা বাবলু খুব মার খেয়েছিল। যারা মেরেছিল তারা প্রায় এক মাস বাড়িছাড়া ছিল পুলিশের তাড়া খেয়ে। পরে ভাইফোঁটার দিন ওই ছেলেগুলো আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে-টেয়ে কম্প্রোমাইজ করে নিল। এই ঘটনার পর প্রায় প্রত্যেকবার পুজোর ভাসানে চারু অ্যাভিনিউর ছেলেদের মারপিট প্রায় রেওয়াজ হয়ে গেছিল।

কথা প্রসঙ্গে আমার জীবনের একটা বড় খামতির কথা বলতে ভুলে গেছি, তা হল, আমার সঙ্গীত সম্বন্ধে জ্ঞান। আগেই নানা ঘটনায় বলেছি এটা এক দুর্বলতার জায়গা, সঙ্গীত সম্বন্ধে আমার জ্ঞান এতই কম ছিল যে আমায় সঙ্গীত-অজ্ঞ বলা যায়। আমার হৃদয় দিয়ে যে সুর আমি বুঝতাম সে গানই আমার ভালো লাগত। আমার ভালো লাগার মধ্যে শচীন কর্তার আর কেষ্টবাবু ছাড়া কারও গানই আমার মর্মে স্পর্শ করত না, এহেন সঙ্গীত-অজ্ঞ আমি এক মহা তাফালে পড়েছিলাম গান গাইতে গিয়ে। আমাকে সিনেমা, থিয়েটারে কখনও গানের সম্মুখীন হতে হয়নি, গুনগুন করেও গাইতে হয়নি।

এহেন আমাকে মহা বিপদের মুখে পড়তে হয়, সুধীরদার ‘পাশের বাড়ি’তে দুখানা গানের লিপ দিতে হবে। মহা মুশকিল, গানের সঙ্গে লিপ মেলানো এর আগে তেমন কিছু করিনি আর এখানে দু-দুখানা গান! একখানা গান ছিল অশোকের গলায় গাওয়া ‘যে কথা গোপনে রেখেছি মনে’, আরেকটা গান যেটা ছিল সেটা সব্বোনাশা। ধনঞ্জয় তখন বাংলার অন্যতম সর্বশ্রেষ্ঠ গায়ক, এহেন ধনঞ্জয়ের সঙ্গে আমার প্রতিযোগিতা ‘কোন এক গাঁয়ের বধূ’ গানটি নিয়ে।

আমি মহা ফাঁপরে পড়েছি। বন্ধুবর বিনু বর্ধনকে গিয়ে গোপনে সব খুলে বললাম, কী করা যায়? তিনি গিয়ে বেশ রসিয়ে কষিয়ে সুধীরদাকে বললেন ভানুর এই বিপদ, অশোককে দিয়ে ওকে একটু লিপ মেলানোর ব্যবস্থা করা যায় কিনা? সুধীরদা আমায় নিয়ে সলিলের সঙ্গে দেখা করে কিছু ব্যবস্থা করার কথা বললেন। সলিলের তখন ফিল্ম লাইনে এমন কিছু নাম হয়নি, তার ওপর সত্যেনদা, সুধীরদারাই বোধহয় ওকে সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে প্রথম চান্স দেয়।

ওদের মধ্যে খুবই হৃদ্যতা ছিল। সলিল বলল, ও-ই আমাকে ট্রেনিং দিয়ে দেবে। সলিল আমার চেয়ে বয়সে ছোট ছিল। আমি সোজা গিয়ে বললাম, ‘দেখো ভাই, সঙ্গীত সম্বন্ধে আমার জ্ঞান জিরো, মনে করো আমি একটা মাটির তাল, তোমাকে টিপে টাপে গড়ে দিতে হবে।’

ও শুনে মুখ টিপে হাসে, তারপরে বেশ কঠিন রিহার্সাল দিয়ে আমাকে কাজ চালানোর মতো তৈরি করে দিয়েছিল হয়তো, অর্থাৎ গানের কথাগুলো মনে রেখে লিপ মেলানোর ট্রেনিং। পরবর্তী জীবনে গানের সঙ্গে লিপ মেলাতে বিশেষ অসুবিধা হয়নি।

আসলে আমি খুব ভালো স্টুডেন্ট, একবার কিছু শিখলে সারাজীবন মনে রাখি। আমার স্ত্রী যখন বাড়িতে গান সাধত আমি পাশে বসে শুনতাম। গান গাইতে আমি Ignorant (অজ্ঞান) হলেও গান শুনতে খুবই ভালোবাসতাম, বিশেষ করে পল্লিগীতি, কীর্তন ও নজরুল গীতি। একদিন নীলিমা বলল, ‘শুধু শুধু বসে না থেকে আমার সঙ্গে তবলায় ঠ্যাকা দাও তো।’

তবলার আমি কিছুই জানতাম না, তো নীলিমা একদিন ঝাঁপতাল বাজাতে শিখিয়ে দিল। ব্যস, মনের সুখে বাজাতে লাগলাম। তারপরে আরেকদিন নীলিমা না বলতেই তবলা বাজাতে লাগলাম। কিন্তু ঝামেলা হল সেদিন নীলিমা অন্য তালের গান গাইছিল কিন্তু আমি তো কেবলমাত্র ঝাঁপতাল-ই জানি সুতরাং তা-ই বাজাতে লাগলাম। খানিকক্ষণ পরে নীলিমা বিরক্ত হয়ে তবলা কেড়ে নিয়ে বলল, ‘আর বাজাতে হবে না।’

আমার যে সঙ্গীতে বিন্দুমাত্র জ্ঞান নেই এটা বুঝেছিলেন বিচক্ষণ নির্মলদা (নির্মল দে), তাই সাড়ে চুয়াত্তর ছবিতে একটা সিন ছিল যেখানে মেসের সবাই মিলে গান গাইছে সাড়ে চুয়াত্তর, অজিত, জহর সবাইকে নির্মলদা গানের সঙ্গে লিপ মেলাবার সিনে নিলেন। অজিত, জহর দুজনেরই গানের বেশ জ্ঞান ছিল। অজিত তো আবার ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের খুঁড়তুতো ভাই ছিল। যাই হোক, আমার কিন্তু গানের সঙ্গে লিপ নিলেন না, আমায় বললেন, ‘তুমি গানের সঙ্গে হাততালি দাও।’

আমি যে গান জানি না তাতে আমি বিশেষ কুণ্ঠিত নই। কারণ আমার গুরুদেব ছবিদা এ ব্যাপারে আমার চেয়েও অজ্ঞ; সঙ্গীত সম্বন্ধে তাঁর বিন্দুমাত্র জ্ঞান ছিল না। অথচ দেখুন কত ছবিতে গানের সঙ্গে কী সুন্দর তাল মিলিয়েছিলেন! ‘পাশের বাড়ি’র অনেক দিন পর ছবিতে আমার লিপ মেলানো ‘নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতিতে’ ও ‘পার্সোনাল অ্যাসিস্টেন্ট’-এর মাঝে ১০০টা ছবিতে অভিনয় করে ফেলেছি কিন্তু কোনও ছবিতেই কেউ গান দেয়নি।

সুতরাং নচিকেতার রাগের কারণটা খুব অযৌত্তিক নয়। ‘নির্ধারিত শিল্পীর…’-র সঙ্গীত পরিচালনাও নচিকেতার, কিন্তু সেখানে ও বিশেষ আপত্তি করেনি যেহেতু ও-ছবির সব কিছুই আমার ছিল। কিন্তু ‘পার্সোনাল অ্যাসিস্টেন্ট’-এ অনেক আশা করে উত্তমের লিপে গান মানে সেই সময় সিওর হিট, উত্তমের লিপে হেমন্তর গান তখনকার দিনে ম্যাজিকের মতো কাজ করতো। এহেন জায়গায় আমার মতো একজন বেরসিক (গানের ব্যাপারে) রসিক (কমেডিয়ান) লিপ মেলাবে এতে নচিকেতার রাগ হওয়ারই কথা। তার ওপর আমি যাদের গানে আগে লিপ মিলিয়েছি তারা হল ‘পাশের বাড়ি’তে অশোক নামে আই.পি.টি-র একটি ছেলে কিন্তু ‘নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতি’তে শ্যামলের গান; আমার মিহি গলায় হেমন্তর গুরুগম্ভীর গান বোধহয় খুবই বেমানান।

যাই হোক, ‘পার্সোনাল অ্যাসিস্টেন্ট’ রিলিজ হবার পর নচিকেতাকে বলতে হয়েছে—’ভানুদা লিপটা ভালোই মিলিয়েছে’, লিপটা যে আমি ভালো মেলাই এ সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ পরবর্তী জীবনে মান্নাবাবুর মতো কঠিন সমালোচকও আমার সামনে খোকা (দীনেন গুপ্তা)র কাছে আমার প্রশংসা করেছে ‘৮০তে আসিও না’-র গানে লিপ মেলাবার জন্য। মনে রাখবেন মান্নাবাবু কিন্তু কঠিন সমালোচক আর সঙ্গীত ওঁর রক্তে, উনি কেষ্টবাবুর ভাইপো। কিছুদিন আগে আমি আর মান্নাবাবু দুজনেই এক ফাংশানে গেছিলাম, ওঁর গান হয়ে যাবার পর আমার পাশে এসে বসে বললেন, ‘কী রকম শুনলেন?’

আমি বললাম, ‘ও গানটা না গাইতেই পারতেন’, অর্থাৎ ‘মহাসিন্ধুর ওপার হতে’।

উনি বললেন, ‘আরে মশাই ওইজাতের গায়ক হয়ে উঠতে পারিনি এখনও, আসলে কাকার গানটা বেশিরভাগ লোকই এখানে শোনেনি, আর যারা শুনেছিল তারা ভুলে গেছে, আর এ গানটা আমার চিরকালের ভীষণ পছন্দের। আসলে আপনি কাকার গানের প্রবল ভক্ত তো, অন্য কারও গাওয়া গান আপনার মরমে ঢুকবে না।’

মান্নাবাবু লোকটাও খুব রসিক। ওঁর কাছে শোনা একটা জোক নিয়ে আমি একটা কমিক স্কেচ করেছিলাম। উনি খাদ্যরসিকও ছিলেন। দেখা হলেই বলতেন, ‘আপনার বাঙালবাড়ির রান্না একদিন গিয়ে খাব।’

কিন্তু আজ পর্যন্ত হয়ে ওঠেনি, অবশ্য উনি বাঙাল বাড়ির ঝাল রান্না খেতে পারতেন কিনা সন্দেহ আছে। এদেশিরা, রান্নায় ঝাল কম দেয় কিনা। অবশ্য, এটা সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, কারণ হেমন্ত ঘোরতরো এদেশি, বোধহয় বসিরহাটে দেশ, ওরা যে কী পরিমাণ ঝাল খেতে পারে না-দেখলে বিশ্বাস করা যায় না! ১৯৫৪ সালে তিন-চারবার সপরিবারে বা একা আমার বাড়িতে বাঙালের ঝাল রান্না খেয়েছে নির্বিকার চিত্তে, অথচ আমি হেন বাঙালের নাক-মুখ দিয়ে ঝালের চোটে লালঝোল মুছতে একাকার। হেমন্ত, বেলা, বেলার ভাইবোনেরা বেশ কয়েকবার তেল-কই, ইলিশ প্রভৃতি র‌্যালিশ করে খেয়েছে।

এহেন খাদ্যরসিক হেমন্তও একবার ঠকেছিল নীলিমার কাছে। এদেশি লোকেরা তোপসে মাছ ভাজা খেতে খুবই ভালোবাসে। নীলিমা একবার তোপসে মাছভাজা খেতে দিয়েছে, খাবার পর নীলিমা জিগ্যেস করে হেমন্তবাবু কেমন খেলেন?’

হেমন্ত বলে, ‘খুব ভালো, বিশেষ করে তোপসে মাছভাজাটা খুব ভালো।’ অজিত, সমরেশ, পরিমলও ছিল, ওরা সবাই ঘোরতর ঘটি।

নীলিমা চিরকালই মিথ্যে কথা বলতে পছন্দ করে না। আস্তে আস্তে মুচকি হেসে বলে, ‘হেমন্তবাবু, ওটা তোপসে মাছ নয়, পোয়া মাছ ভাজা।’

এই শুনে হোল গ্যাংয়ের মুখ চুপসে যায়, কিন্তু কী আর করা যায় আগেই তো বলে ফেলেছে খুব ভালো।

এদিকে আমার যে গায়ক বন্ধু (বয়সে অনেক ছোট)টি ভীষণ ঘনিষ্ঠ ছিল সে হচ্ছে শ্যামল। এই শ্যামল আর আমি দুজনেই বসুশ্রীতে রোজ আড্ডা মারতাম। শ্যামল কিন্তু কোনওদিন ঝালের ভয়ে আমার বাড়িতে খায়নি। সুধীরলালের বাড়ি যাওয়ার সূত্রে সেই ‘৪৫ সাল থেকেই চিনতাম। এমনকী বলতে গেলে শ্যামলের বিয়েও দিয়েছি আমি। আমার বাল্যবন্ধু বারীন ঘোষের ভাগনিকে গান শেখাত শ্যামল, গান শেখাতে শেখাতে প্রেম, তারপর বাড়ির অজান্তে বিবাহ। বারীনরা রাসবিহারীর মোড়ে লক্ষ্মীনারায়ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের বাড়িতে থাকত। একদিন দেখি বারীন আর তার ভাই গঙ্গা হাত-পা ছুড়ে বেজায় চেঁচামেচি করছে। কী ব্যাপার? না, বাড়ির অজান্তে শ্যামল ওদের ভাগনিকে বিয়ে করেছে।

আমায় দেখে আমার ওপর চড়াও।

আমি বললাম, ‘কী হয়েছে?’

না, শ্যামল এই কাণ্ড করেছে।

আমি বললাম, ‘বিয়ে যখন হয়েই গেছে তখন মেনে নে।’

ওরা হইহই করে উঠে বলে, ‘গান শিখিয়ে বউকে খাওয়াতে পারবে?’

আমি বললাম, ‘শ্যামল যে-সে গায়ক নয়, নামকরা গায়ক। তোর ভাগনির কোনও অভাব হবে না।’

‘বারীনকে তো মানানো গেল কিন্তু ওর ছোট ভাই গঙ্গাকে মানানো যায় না। একে তো সে রাসবিহারীর রগচটা মস্তান তায় আবার শ্যামলের বন্ধু। আবার সেইসময় বোধহয় গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গে শ্যামলের কিছু একটা ঝামেলা চলছিল সেটা গঙ্গা জানত, তাই সে হম্বিতম্বি করে, ‘এইসব বলে আমায় বোঝানো যাবে না।’ সে আর তাকে থামানো যায় না।

যাই হোক, পরে সবাই মেনে নেয়। বিয়ের পরে যখন শ্যামলের প্রথম ছেলের অন্নপ্রাশন হয় তখন আমি বারীনকে বলি, ‘কী, আমি যা বলেছিলাম তাই মিলল কি না?’

শ্যামলের বাজার তখন রমরমা। একটা মজার কথা হচ্ছে, শ্যামল আমায় ‘ভানুদা’ বলে ডাকত কিন্তু ওর বউ আমাকে ‘ভানুমামা’ ডাকত। শ্যামলের প্রায় একই সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল পল্টনের (মানবেন্দ্র)। পল্টন আমার বউকে নাম ধরে ‘তুই’ সম্বোধন করত, ওরা একই সঙ্গে মধুদা (সিদ্ধেশ্বর) ও রাঙাদা (রত্নেশ্বর মুখোপাধ্যায়)-র কাছে গান শিখত। এদিকে আমাকে ছোটবেলা থেকে পল্টন ‘ভানু কাকা’ বলে ডাকত।

আমি সিনেমা-আর্টিস্ট হলেও গানের সব শিল্পীদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক; আগেই যাদের নাম উল্লেখ করেছি, তা ছাড়াও আরও বেশ কয়েকজনের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ছিল, যেমন (ধনা) ধনঞ্জয়, আমার নাম হওয়ার অনেক আগে থেকেই সুপারস্টার, সেজন্য সবসময় একটা গাম্ভীর্য নিয়ে চলত, কম কথা বলত, গম্ভীর গম্ভীর ভাব। কিন্তু আমি দুর্মুখ বলে আমার সঙ্গে এসে কুশল বিনিময় করত।

একবার একটা ঘটনায় ওর সঙ্গে আমার বেশ হৃদ্যতা হয়েছিল, ‘পাশের বাড়ি’ সিনেমাতে সুধীরদার প্রথম পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। এটা একটা বেশ লো বাজেট ছবি। আমি, সাবিত্রী, সত্য—আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক পেয়েছিল ধনঞ্জয়। তারপরেই বোধহয় অরুণ রায়চৌধুরী, তা-ও কাহিনিকার হিসাবে। যাইহোক, ছবি রিলিজের পর সুপারহিট, আমি সোজা একদিন সুধীরদাকে ধরলাম, ‘দাদা, আমার টাকার ভীষণ দরকার, আর আপনার বই তো খুব হিট হয়েছে, আমার ৫০০ টাকা খুব দরকার।’

সুধীরদার তখন দেদার পয়সা, আমাকে ৫০০ টাকা দিয়ে বলল, ‘কাউকে যেন বোলো না।’

আমি বলি, ‘মাথা খারাপ, আমি কাউকে বলি!’

এই বলে টাকাটা নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে সাবিত্রী, সত্য, ধনঞ্জয়, জ্ঞানেশ সবাইকে বলি সুধীরদার ছবি দারুণ হিট, তোদের সবাইকে ডেকেছে বোনাস দেবে বলে।

এরা সবাই গিয়ে সুধীরদাকে চেপে ধরে টাকা আদায় করে। বিশেষ করে ধনঞ্জয় জোরাজুরি করে অনেক টাকা আদায় করে। এই ব্যাপারের পরে সুধীরদা আমার ওপর ভীষণ খাপ্পা হয়ে যায়, এতটাই খাপ্পা হয় যে এরপর ১০-১২ বছর একটা ছবিতেও আমাকে নেয়নি। শেষ অবধি ‘দাদাঠাকুর’ বইতে ছবিদার জোরাজুরিতে আমায় নিতে বাধ্য হয়।

উৎপলা সেনের সঙ্গে আমার ঢাকার থেকেই আলাপ, আগে দিদি ডাকতাম, পরে জানলাম ও আমার থেকে বয়েসে ছোট তখন থেকে নাম ধরে ডাকতে থাকলাম। উৎপলা, সতীনাথ আমার চারু অ্যাভিনিউর বাড়িতে গাড়িবারান্দায় চৌকির ওপর বসে গেয়ে গেছে, উৎপলার ‘ময়ূরপঙ্খী ভেসে যায়’ শুনে আমার ভগনিপতি বাদলবাবু কেঁদে কেটে একাকার।

নির্মলেন্দুর সঙ্গে আমার ভীষণ ভালো সম্পর্ক ছিল, আমায় খুব সম্মান করত। একবার ওদের পাড়ার মিনিস্টার আশু ঘোষের ফাংশানে একটা কাণ্ড হয়েছিল, আমি সবসময়ই খুব বেশি দেরি হলেও রাত বারোটার মধ্যে স্টেজে উঠতাম। এই ফাংশানটাতে রাত ১০টার সময় উঠতে গেলে নির্মলেন্দু বলে ওঠে, ‘দাদাভাই, আমার আরেকটা ফাংশান আছে, আমি তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেব, আমায় গাইতে দাও।’

আমি ভাবলাম ও খুব বেশি হলেও রাত এগারোটা অবধি গাইবে, বিশেষ করে ওর যখন আরেকটা ফাংশান আছে। ওরে বাবা, ১১টা বেজে গেল, সাড়ে ১১টা বেজে গেল, ততক্ষণে ২০-২২টা গান গেয়ে ফেলেছে, অথচ ওঠার নাম নেই! সেইসময় ওর খুব হিট গান ‘সোহাগ চাঁদ বদনী’ ধরেনি, আমি সমানে উইংসের পাশ থেকে ইশারায় ওকে তাড়া দিচ্ছি; সবশেষে গানটা ধরল কিন্তু ৮-১০ মিনিট হয়ে গেল ‘সোহাগ চাঁদ বদনী’ শেষ হওয়ার নাম নেই।

অবশেষে ডেসপ্যারেট হয়ে স্টেজে উঠে ওর মুখ চেপে ধরে বললাম, ‘বালা নাচোতো দেখি, শুধু বালায় হইবো না, হালা মধুবালারে চাই।’

শুনে মাঠ ভর্তি লোক ভীষণ হাসতে আরম্ভ করল। আমি বলি, ‘আমি ক্যারিকেচার কইরা চইলা যাই, তুই তারপর বালার বাকিটা গা।’

তরুণ ব্যানার্জী ছেলেটা খুব ভদ্র, মুখচোরা, কিন্তু ওরও ওই একই দোষ, একবার স্টেজে উঠলে ২৫-৩০টার কম গান না গেয়ে উঠত না। একবার একটা ফাংশানে গেছি, এরকম এক-দেড় ঘণ্টা ধরে গেয়ে যাচ্ছে, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। সে ফাংশানে জহরও ছিল, আমি আর জহর এক জায়গায় থাকলে বাকিরা সবাই প্রমাদ গুনত। আমাকে উসখুস করতে দেখে জহর বলে, ‘চল, ব্যাটাকে জোর করে তুলেদি।।’

তখন ও গাইছে, ‘মোর মালঞ্চে বসন্ত নাই’, জহর সোজা গিয়ে ওর মুখ চেপে ধরে, আমি ওর পরচুলা তুলে দিয়ে বলি, ‘মাথায় চুল না থাকলে বসন্ত থাকবে কী করে?’

আমার আর জহরের কাণ্ড দেখে সবাই প্রবল হেসে ওঠে। তরুণও চুল ঠিক করতে করতে বেরিয়ে যায়।

অজিত, জহরও নানারকমভাবে ফাংশানে গানের আর্টিস্টদের উত্যক্ত করত। শচীন গুপ্ত, মৃণাল, সনৎ, অখিলবন্ধু এমনকী সতীনাথের পিছনেও এরা লাগত। একবার আশুতোষ কলেজের ফাংশানে দিলীপ সরকার নামে একটা ছেলে গাইছে, ছেলেটা ভদ্র, সভ্য, সিরিয়াস টাইপের। ‘আমি এক রিক্সাওয়ালা’, বার তিনেক ‘আমি এক রিক্সাওয়ালা’ বলার পর হঠাৎ স্টেজের পাশ থেকে অজিত চেঁচিয়ে ওঠে, ‘এই, মায়ের বাড়ি (কালীঘাট) যাবি? কত নিবি?’

দর্শক এমন হাসতে লাগল যে দিলীপকে গান বন্ধ করে দিতে হল। তখনকারদিনের সব আর্টিস্ট-ই এগুলোকে হালকাভাবে নিত, কিন্তু আজকালকার কিছু শিল্পীর মেজাজ-গতিকই আলাদা। কলকাতার এক গায়ক আমার ওপর এমন চটেছিল যে এক ফাংশানে গিয়ে রটিয়ে দিয়েছিল আমি মারা গেছি।

অবশ্য সবাই এমন নয়, অনুপ ঘোষালকে নিয়ে আমি অনেক ফাংশান করেছি, ওর বোনও থাকত সঙ্গে, এরা ভদ্র, সভ্য। শক্তি ঠাকুর তো আমার বিশেষ স্নেহভাজন, আমাকে খুবই ভক্তি-শ্রদ্ধা করে। মাঝে মাঝেই আমাকে ওর বাড়িতে খাওয়ার নিমন্ত্রণ করে।

এ তো গেল গানের জগতের মানুষ, সিনেমার লোকদের প্রায় সবার সঙ্গেই আমার ভালো সম্পর্ক। বিকাশদার সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ করিয়ে দেয় পরিচালক প্রভাত মুখার্জী, তখন উনি রেডিয়োর বড় অফিসার। আমি আর বিকাশদা তখন রেডিয়ো-নাটক করি। একবার রেডিয়োর আন্দোলনে এই বিকাশদা, আমি, হেমন্ত, নীলিমা সান্যাল প্রভৃতি এই প্রভাতদার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখিয়েছিলাম।

বিকাশদার একটা কথা আমি চিরকাল মনে রেখেছি। ‘৪২-‘৪৩ সাল হবে, মা, বাবা, ছোটবোন, আমার চারু অ্যাভিনিউর বাড়িতে আছে। কয়েকদিন বাদেই বোনের বিয়ে, অনেক খরচ, তার ওপর সারা মাসের রেশন তুলতে হবে। হাতে পয়সা নেই। অগত্যা বিকাশদার কাছে চাইলাম ৪০ টাকা। বিকাশদা বলল, ‘কবে ফেরত দিবি?’

আমি বললাম, ‘এক বছর তো লাগবেই।’

বিকাশদা টাকাটা দেওয়াতে রেশন তুলতে পারলাম, এ উপকার আমি আজ পর্যন্ত ভুলতে পারিনি। এর পরেই বিকাশদা আমার শ্রদ্ধেয় দাদা হয়ে গেল। এরপরে বহুবার বিকাশদা আমাকে পরীক্ষা করার জন্য হলেও টাকা চেয়েছে, আমি দিয়ে দিয়েছি। বিকাশদা যখন পরিচালক-প্রযোজক হিসেবে প্রথম ছবি করছে ‘অর্ধাঙ্গিনী’ তখন আমার কাছে একটা ছোট রোলের অফার নিয়ে এল। অর্থাৎ কমিক রিলিফ, আমি এক কথায় রাজি। আমায় জিগ্যেস করল, ‘কত দিতে হবে?’

আমি বললাম, ‘যা পারবে দিয়ে দিও।’

এরপর আমায় বলল, ‘কয়েকটা বাচ্চা আর্টিস্ট দরকার।’

আমি আমার তিন ছেলেমেয়ে, ভাগনি বুলি ও আমাদের পাশের বাড়ির ভাড়াটের ছেলে চন্দনকে যোগাড় করে দিলাম। আমি যথাসম্ভব বিকাশদাকে সাহায্য করার চেষ্টা করতাম। অনন্ত সিং এক সময় অনেকগুলো বই একসঙ্গে প্রযোজনা করার প্রাোজেক্ট নিয়েছিল। তার মধ্যে বম্বেতে দুটো হিন্দি আর কলকাতায় দুটো বাংলা ছবি ছিল। কিছুদিন আগে বিকাশদা ওর লেখা একটা গল্প শুনিয়েছিল, আমি সত্যেনদা ও অনন্তদাকে গল্পটা শোনাই, ওদের পছন্দ হয়ে যায়, অনন্তদা টাকা দিতে রাজি হয়ে যায়। এই বইটি হচ্ছে ‘নতুন প্রভাত’, এতে আমার একটা ছোট রোল ছিল—একটা স্যানিটোরিয়ামে এক আধপাগলা মাস্টারমশাই, যে সারাদিন ক্রসওয়ার্ড পাজল করে, এই রোলটি আমার খুব পছন্দের।

বিকাশদা লোকটা খুব ইন্টারেস্টিং, ভীষণ ইন্টেলিজেন্ট, খুবই কালচারড। তবে অমায়িক নয়, যা বলবে মুখের ওপর স্পষ্ট বলে দেবে। কাউকে রেয়াত করে না, শুধু আমাকে ছাড়া, কারণ আমি কাঁচা…দি। সমগ্র ফিল্ম লাইনে সমস্ত লোককে দীপচাঁদ কাঙ্কারিয়া ‘তুই’ (সে তার চেয়ে বয়সে বড় হলেও) বলে সম্বোধন করত এবং সবাই তাকে ‘আপনি’, একমাত্র বিকাশদা ছাড়া। বিকাশদা দীপঁচাদকে ‘তুই’ বলে সম্বোধন করে। একবার দীপচাঁদ বিকাশদাকে বলে ‘তুই আমাকে ”তুই” ডাকিস কেন? ফিল্ম লাইনে সবাই আমাকে ”আপনি” বলে।’

বিকাশদা বলে, ‘তুই আমায় তুই ডাকিস বলে।’

বিকাশদার ট্রিমেন্ডাস অর্গানাইজিং স্কিল ছিল। আগেই বলেছি, ‘অভিনেত্রী সঙ্ঘ’র জন্মদাতা বিকাশদা, কিন্তু অভিনেত্রী সঙ্ঘ ভেঙে যে শিল্পী সংসদ হয়েছিল সেটাও বিকাশদারই ব্রেইন চাইল্ড। অভিনেত্রী সঙ্ঘ যেরকম ছবিদা ছাড়া হত না, শিল্পী সংসদও উত্তম ছাড়া হত না। বিকাশদা ৭-৮টা বই প্রাোডিউসড করেছে, কিন্তু কখনও টাকার অভাব হয়নি। এই দীপচাঁদ, রমনলালরাই চোখ বুঁজে টাকা দিয়েছে। বিকাশদার অভিনয় সম্বন্ধে কিছু বলার নেই, কিন্তু ওঁর যা প্রাপ্য সম্মান তার কিছুই পায়নি, কারণ বিদেশে প্রাইজ পাওয়া কোনো জগদ্বিখ্যাত ডিরেক্টরের ছবিতে কাজ করেনি বলেই বোধহয়।

সাবিত্রীর ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য, এত বড় অভিনেত্রী এই দেশে নেই—একথা শুধু আমি বলি না, ছবিদা, উত্তম সবার এই মত।

ভাগ্যিস উত্তম ‘নায়ক’ ছবিতে অভিনয় করেছিল, নইলে উত্তমের এই সাংঘাতিক পপুলারিটি হত কিনা সন্দেহ। উত্তমের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ‘দাদাভাই’য়ের মতো, বিশেষ করে উত্তমের অভিনয় জীবনের প্রথম দিকে আমার সঙ্গে সাংঘাতিক হৃদ্যতা ছিল, কত বিষয়ে কতরকম পরামর্শ যে নিত তা বলার নয়। ও আমার থেকে ছ’বছরের ছোট। আমাকে ‘ভানুদা’ ‘তুই’ বলে ডাকে। সেই থেকে আমরা সুখ দু:খের সঙ্গী। অমন ঠান্ডা মাটির মানুষ সমগ্র ফিল্ম লাইনে নেই। ‘শ্যামলী’ নাটকের সময় আমর ছিলাম হরিহর আত্মা। উত্তম মোটামুটি চারশো পঞ্চাশ নাইট অবধি ‘শ্যামলী’ নাটকে অভিনয় করেছে। প্রতিদিন নাটকের আগে আমার থেকে ওর প্রাপ্য ছিল ‘ওর গালে একটি চুমু’। ওকে প্রথম থেকেই দেখেছি, তাই জানি ওর কী সাংঘাতিক টেনাসিটি। কোথা থেকে ঘষে মেজে কোথায় উঠেছে, যারা তার খুব কাছের লোক তারাই কেবল জানে। তবে ওর অভিনেতা হয়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান নির্মল দে-র। ওর প্রথম নজরকাড়া অভিনয় ‘বসু পরিবার’ ছবিতে। অথচ আমার মনে আছে এই ছবিতে চান্স পাওয়ার জন্য নির্মলদার বাড়িতে প্রায় রোজ যদুবাবুর বাজারে বাজার করার পর ঢুঁ মারত। ভাগ্যক্রমে নির্মলদার বাড়ি ওর বাড়ির কাছেই ছিল।

আমরা ‘নতুন ইহুদী’র কয়েকজন অর্থাৎ নেপাল নাগ, আমি, সাবিত্রী, বানী গাঙ্গুলী এবং সলিল সেন তখন অলরেডি এই ছবিতে চান্স পেয়ে গেছি। আমি, সলিল, নেপাল প্রায় রোজ নির্মলদার বাড়িতে যাতায়াত করছি, নির্মলদা নেপালের ভাইয়ের চরিত্রে একটা নতুন মুখ খুঁজছে, অবশেষে উত্তমকে নিলেন। সেই সময় থেকেই আমার উত্তমের সঙ্গে হৃদ্যতা, উত্তম যে কী রকম তিলে তিলে নিজেকে গড়ে তুলেছে তা আমি দেখেছি। নির্মলদা যখন উত্তমকে ‘বসু পরিবার’-এ নিলেন, তখন বলেছিলেন ‘দেখো, নেপাল কিন্তু দুর্ধর্ষ অ্যাকটর, তার ভাইয়ের পার্ট তোমাকে করতে হবে, লড়তে হবে।’

বইটা বেশ লো বাজেটের ছিল, নির্মলদা একাধারে পরিচালক, কাহিনিকার, স্ক্রিপ্ট রাইটার, ক্যামেরাম্যান সবকিছু। পাহাড়ীদা, জীবেনদা ছাড়া নামজাদা একজন আর্টিস্টও নেই। সুতরাং আমাদের সবাইকে কাজ করে প্রমাণ করতে হবে। এম. পি. স্টুডিয়োতে শুটিং ছিল, তখন দেখেছি উত্তমের কী দুর্দান্ত অধ্যবসায়, টেনাসিটি! আমাদের লাঞ্চের পর একটা সিন ছিল, আমি বলছি, ‘টাকাটা তো আপনি শোধ দেবেন বলেছিলেন।’

উত্তমের ডায়লগ ছিল, ‘বলেছি’, তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে জোরে বলতে হবে, ‘সো হোয়াট?’ (তো কী হয়েছে?)।

লাঞ্চে ক্যান্টিনে গিয়ে দেখি উত্তম নেই, মাঠের মধ্যে সমানে নিজের মনে বিড় বিড় করছে আর কাঁধ ঝাঁকাচ্ছে, আমি গিয়ে দেখি ডায়লগ আওড়াচ্ছে। আমি বলি, ‘খাবি না?’

ও বলে, ‘আসছি, তুই যা।’

আমি খেতে চলে গেলাম। খেয়েটেয়ে জহর, নেপাল, সলিল, বিশুর সঙ্গে আড্ডা মারছি। দেখি ও বিড়বিড় করেই যাচ্ছে। জহর জিগ্যেস করে, ‘উত্তম ব্যাটা মাঠে বসে কী বিড়বিড় করছে রে?’

আমি বলি, ‘ডায়লগ আওড়াচ্ছে।’ এই বলে বিড়ি ধরিয়ে ওর কাছে গেলাম, ও দেখি তখনও কাঁধ ঝাঁকিয়ে চলেছে।

আমি যে ঘটনাটা বলছি সেটা ৪০-৪৫ মিনিটের ব্যাপার, ও সেদিন লাঞ্চ না খেয়েই ওই দু-মিনিটের শটটা দিল। উত্তমের যে কী দারুণ অধ্যবসায়, পেশেন্স আর শরীর-গ্ল্যামার সম্বন্ধে সচেতনতা ছিল তার প্রমাণ আরেকবার পেয়েছিলাম। ওর ‘ভ্রান্তিবিলাস’-এর শুটিং-এর সময় একবার চিকেন পক্স হয়েছিল, মুখে কিসমিসের মতো বড় গোটা উঠেছিল অনেকগুলো। আমি দুদিন ওকে দেখতে গেছিলাম, দুদিনই ঘণ্টাখানেক ধরে ছিলাম, একবারের জন্য মুখে হাত দিতে দেখিনি, যদি গলে গিয়ে মুখে স্পট পড়ে যায় এই ভয়ে। আমি ভুক্তভোগী, জানি কী ভীষণ চুলকায়!

ও গ্লামার সম্বন্ধেও ভীষণ সচেতন ছিল। একসময় পূর্ণ সিনেমার সামনে আড্ডা মারত, কিন্তু একটু নাম করার পর ওর বাড়ির সামনেও দাঁড়িয়ে আড্ডা মারত না। ওর শরীরের দিকে ভীষণ নজর। মনোতোষ রায়ের কাছে যোগ ব্যায়াম শিখত।

একবার বসুশ্রীর বাবলির কাছে শুনেছি—অনিল, যে রোজ বসুশ্রীর কফি হাউসে আড্ডা মারত, একদিন বসুশ্রীর পাশের পানের দোকান থেকে পান কিনে খাচ্ছে। উত্তম ওখান দিয়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ গাড়ি ব্যাক করে ফুটপাথের সামনে গাড়িটা নিয়ে জানলা খুলে বলে, ‘এই যে অনিল, রাস্তায় দাঁড়িয়ে যে ঘ্যাচর ঘ্যাচর চিবিয়ে পান খাচ্ছিস, ট্রামে-বাসে যত লোক যাচ্ছে তোকে দেখছে, কোন ব্যাটা উজবুক আছে পয়সা দিয়ে তোর সিনেমা দেখতে যাবে!’

অথচ এইসময়ে ‘অগ্নি সংস্কার’ রিলিজের পর উত্তম আর অনিলের মধ্যে অঘোষিত প্রতিযোগিতা ছিল। উত্তমকে আমি দিনের পর দিন উচ্চারণ, বিশেষ করে ইংরাজি উচ্চারণ পারফেক্ট করতে দেখেছি। প্রথম দিকে ওর বাংলার ‘স’, ইংরাজি ‘S’-এর উচ্চারণে গোলমাল ছিল, আমি বি.এসসি পাশ করেছি বলত। আমরা ওকে খ্যাপাতাম, ‘উত্তম বাশে চড়ে বাঁসদ্রোনিতে যাবি?’

অথচ পরে মাস্টার রেখে ও কী ভালো ইংরেজি উচ্চারণ করত। ময়রা স্ট্রিট থাকাকালে ও রেগুলার চৌরঙ্গি পাড়ায় হলিউডের সিনেমা দেখত।

উত্তমের জীবনে দুটো অধ্যায় আছে বলে আমি মনে করি। একটা প্রথম থেকে ১৯৬৯, তারপর থেকে এখন পর্যন্ত। আমি উত্তমের ঘনিষ্ঠ বলেই লক্ষ করছিলাম ‘নায়ক’-এর পর থেকেই ওর একটু পরিবর্তন হচ্ছিল। এর আগে অবধি ও একজন অত্যন্ত সরল কাজপাগল লোক ছিল। অবশ্য জীবনে অনেক কঠিন আঘাত পেয়েছে, সবচেয়ে বড় আঘাত ‘ছোটিসি মুলাকাত’। এর আগে উত্তম যা করেছে তাতেই সফল, ওর কেরিয়ারের প্রথম ৩-৪ বছর বাদে উত্তম যে শুধু ব্যস্ত নায়ক ছিল তা নয়, ও ছয়-সাতটা সুপারহিট ছবির প্রযোজক। কিন্তু ‘ছোটিসি মুলাকাত’-এর পর সর্বস্বান্ত হবার জোগাড়। ওর নিউ আলিপুরের বাড়ি বিক্রি করতে হল, ছবিগুলো বেচতে হল, যাচ্ছে তাই অবস্থা। তার ওপরে গোদের ওপর বিষফোড়ার মতো ওর প্রথম হার্ট অ্যাটাক এই সময়েই হল।

ও কিন্তু খুব কঠিন সময়েও অবিচলিত থাকত। একবার মনে আছে, ওর গাড়ি করে আমরা সবাই ‘ভ্রান্তিবিলাস’-এর শুটিং করে ওর বাড়িতে ফিরে যাচ্ছি, ইন্দিরা সিনেমায় তখন চলছে ‘অভিযান’। সবে ম্যাটিনি শো ভেঙেছে, হল থেকে বেরিয়ে পাবলিক উত্তমকে দেখে যাচ্ছেতাই রিমার্ক পাশ করতে লাগল—’আর চুলে ইউ ছাঁট মেরে ঘাড় ঘুরিয়ে বস্তাপচা অভিনয় আর কতদিন করবেন? অভিনয় কাকে বলে শিখে যান সৌমিত্রর কাছ থেকে।’

আমাকেও ছাড়েনি, ‘বুড়ো বয়সে বাঙাল কথা বলে আর কতদিন ভাঁড়ামো করবেন?’

ভাগ্যিস গাড়িতে ন্যাপা, বসুশ্রীর রবসন, ভানু রায় প্রভৃতিরা ছিল। কোনোরকমে ধমকে-ধামকে জনতাকে ধাক্কা-টাক্কা মেরে বার করে আনল। উত্তমের বাড়ি পৌঁছে আমরা দুজনেই মনমরা, কিন্তু ভগবানের আশীর্বাদ সে-বছরই ‘দাদাঠাকুর’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ কৌতুকাভিনেতার পুরস্কার পেলাম আমি। আর উত্তম প্রযোজিত ‘ভ্রান্তিবিলাস’ও খুব হিট হল।

ও প্রথম দিকে ভীষণ বেশি সরল ছিল। ওর তখন ‘শাপমোচন’, ‘অগ্নিপরীক্ষা’ বেরিয়ে গেছে। ভীষণ পপুলারিটি, তবে তখনও বিদেশি গাড়ি হয়নি। মাঝে মাঝেই শুটিং সেরে বাড়ি যাবার পথে আমার বাড়ি হয়ে যেত। কারণ ও জানত আমার বউ গায়িকা। তাই কখনও ওর গান শুনতে বা কখনও ও যে গান জানত সেটা নীলিমাকে শিখিয়ে দিত। গানের মাস্টারির শখ তখনও যায়নি। ওর হৃদয়টাও ছিল খুব বড়, ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির কত গরিব লোককে যে সাহায্য করেছে তার ইয়াত্তা নেই, এটা চিরকালই করেছে।

কিন্তু আমি লক্ষ করছিলাম, ‘নায়ক’ ছবিটা করার পর ওর মধ্যে একটা স্টারোচিত ব্যবহার চলে এসেছিল, খুব জোরে ইংরেজি বই পড়া, সিনেমায় ডায়লগ বলা আরম্ভ করেছিল।

আগে ওকে কেউ বলত এই হলিউড সিনেমাটা দেখ, ওটা দেখ, কিন্তু এ সময়টা দেখতাম ও নিজেই রেগুলার হলিউড ছবি দেখত, ইংরাজি হলগুলো ময়রা স্ট্রিটের কাছাকাছি হওয়াতে সুবিধাই হয়েছিল। এ সময়টাতেই একটা স্টারসুলভ দেওয়াল ওর চারিদিকে তুলে দিয়েছিল, যেটা আগে বিন্দুমাত্র ছিল না। এর জন্য কিন্তু ওর বিন্দুমাত্র দোষ ছিল না, বিশেষ করে ৭০-এর দশকের প্রথম দিক থেকেই ওর পরিষদবর্গ ছিল, তারাই দায়ী। এদের ভাবসাব এমন যে উত্তমের কাছে এরাই সবচেয়ে আপন। উত্তম যেন এদের সম্পত্তি, এদের জ্ঞান এবং গ্যাসের চোটে উত্তম সব সময় ধোয়াচ্ছন্ন থাকত।

উত্তমের অভিনয়ের ধারাও আগের চেয়ে অনেক বদলেছে। পিটার ও টুলের ‘বেকেট’ দেখে ও খুব প্রভাবিত হয়েছিল। ‘চৌরঙ্গী’, ‘রাজদ্রোহী’, ‘লাল পাথর’ ছবিতে এর প্রভাব দেখা যায়। এ নিয়ে আমি উত্তমকে ফোন করে খ্যাপাতাম। উত্তমের একটা জিনিসই কখনও পরিবর্তন হয়নি, সেটা হচ্ছে সিনিয়ারদের প্রতি সম্মান। আমি বা জহর ওকে নিয়ে অনেক ঠাট্টা করতাম কিন্তু ও জীবনে কোনওদিন রিঅ্যাক্ট করেনি। একবার ‘স্ত্রী’ ছবিতে আমরা শুটিং করছি, সিনেমার ঝগড়ার পর সবার মধ্যে একটা চাপা টেনশন। একটা শটে ওর অভিনয় দেখে আমি হাঁ-করে ওর দিকে তাকিয়ে আছি, ও এটা লক্ষ করেও কিছু বলল না। আমি হাঁ-করেই রয়েছি। ও তো খুব ইনটেলিজেন্ট, খানিক বাদে বলল, ‘বুঝলি ভানুদা, ভালোর একটাই রকম হয়, ভালো পার্ট করতে গেলে ছবিদার Influence চলেই আসে।

আমি বললাম, ‘তাই বলো, আমি ছবিদার প্রভাব দেখলাম বলেই হাঁ করেছিলাম, ওয়েট করছিলাম কতক্ষণে এটা বলবি।’

ওর মতো Seriousness আমি খুব কম দেখেছি। শট-এর পর একটা নাম-না-জানা অ্যাসিস্টেন্টকেও জিগ্যেস করত, ‘হ্যারে, ঠিক হয়েছে তো শটটা?’

যদি কেউ উত্তর দিতে আমতা আমতা করত তাহলেই ডিরেক্টরকে আবার শটটা নিতে বলত। এ জন্যই ঘষতে ঘষতে ‘কিছু না’-র থেকে এতবড় নায়ক হয়েছে।

সুচিত্রাকে আমি প্রথম থেকেই চিনি, অর্থাৎ ওর প্রথম বই ‘সাত নম্বর কয়েদী’তে আমিও অভিনয় করেছি। আমার বরঞ্চ তখন বেশ নাম হয়েছে, কিন্তু ও একেবারেই নতুন। ওর শ্বশুর ঢাকার নামজাদা বড়লোক ছিলেন। এই ছবির শুটিং চলাকালীনই ওকে দেখি নির্মলদার বাড়িতে, ‘৭৪।।’-এর অভিনয়ের জন্য চান্স খুঁজছে। নির্মলদার মাথায় তখন সাবিত্রী অথবা ভবানীপুরের একটি নতুন মেয়ে, মালা সিনহা। এদের কারও থেকে একজনকে নেওয়ার কথা ভাবছে। লো বাজেট ছবি, আমরা সবাই নতুন জমিতে আঁচড় কাটছি। হাসির ছবি বলে প্রাোডিউসারদের ঘোরতর আপত্তি, তার ওপর এতগুলো নতুন আর্টিস্ট।

যাই হোক, নির্মলদার এক কথা—তার কথামতো না হলে ছবি করবেন না। শেষ পর্যন্ত সুচিত্রাকেই নেওয়া হল। ছবি রিলিজের পর প্রবল হিট, আমাদের ভীষণ নাম হল, সুচিত্রা-উত্তম হিট রোমান্টিক জুটি হয়ে গেল।

এই সময়টায় সুচিত্রা অন্য মানুষ ছিল। সবার সঙ্গে ভীষণ মিশত। এ-সময় ওর অভিনয়ও খুব ভালো ছিল না। তখনকার নামকরা পরিচালক নীরেন লাহিড়ী ‘কাজরী’ ছবির শুটিংয়ের সময় বলেছিল , ‘সুচিত্রা যদি কোনওদিন অভিনয় করতে পারে, তাহলে আমি আমার হাতের পাঞ্জা কেটে রেখে দেব।’

সেই নীরেন লাহিড়ীই পরে একটা বইতে সুচিত্রাকে কাস্ট করতে গেলে সুচিত্রা বেশ দু-কথা শুনিয়েছিল বলে শুনেছি।

উত্তমের মতো সুচিত্রাও ঘষতে ঘষতে সাফল্যের চূড়ায় উঠেছে। ‘কাজরী’র থেকে ‘দীপ জ্বেলে যাই’, ‘সাত নম্বর কয়েদী’ থেকে ‘সাত পাঁকে বাঁধা’ দেখলেই বোঝা যায় ও কোথা থেকে কোথায় পৌঁছেছিল। আমি ওর মতো গ্ল্যামার সচেতন অভিনেত্রী ভারতবর্ষে দেখিনি। এক সময় ও ফিল্মলাইনে মেশাও বন্ধ করে দিয়েছিল।

একসময় আমার ভাগনি বুলি ওর সর্বক্ষণের সহচরী ছিল, কিন্তু ওর সঙ্গে কোনও সময়েই সিনেমার গল্প করত না। ওর আরেকটা গুণ ছিল, শুটিং-এর বাইরে আমার সঙ্গে কখনও দেখা হত না, কিন্তু আমার বাবা, মা মারা যাওয়ার পর দশ মিনিটের জন্য হলেও সমবেদনা জানিয়ে গেছিল। শুনেছি এরকম সমস্ত সহশিল্পীর খারাপ সময়ে গিয়ে সমবেদনা জানাত। সাংঘাতিক সৌজন্যবোধ ছিল ওর।

আমার স্ত্রীর সঙ্গে ওর বোধহয় দশদিনও দেখা হয়নি কিন্তু ওর কী ভীষণ সৌজন্যবোধ ছিল সে গল্প বলছি। ও যখন বম্বেতে ‘দেবদাস’ বইতে শুটিং করছে তখন আমিও প্রায় একই সঙ্গে সত্যেনদার ‘বন্দীশ’-এ শুটিং করতে গেছি। আমার সঙ্গে দেখা হতে বাড়ির সবার কথা জিগ্যেস করল। বম্বে থেকে ফিরে এসেছি, হঠাৎ আমার স্ত্রীর কাছে শুনি ওকে সুচিত্রা বম্বে থেকে একটা ছাপা শাড়ি এনে দিয়েছে। তখন সবে ছাপা শাড়ি বেরিয়েছে। আমায় শাড়িটা দেখিয়ে নীলিমা বলে, ‘ওকে কিছু দেওয়া উচিত।’ শুনে তো আমি প্রমাদ গুনেছি। কারণ ওকে তো যা-তা জিনিস দেওয়া যায় না। একে তখন উনি উঠতি সবচেয়ে নামকরা হিরোইন, তার ওপরে জমিদার ফ্যামিলির বউ। নিউ মার্কেট থেকে একটা ফরাসি সেন্ট কিনেছিলাম, সেই কড়ে-আঙুল প্রমাণ সেন্টের যা দাম তা শুনে আমার চক্ষু চড়ক গাছে। ফরাসি সেন্ট তো!

এরপরে ওর সঙ্গে বিশেষ দেখা হয়নি। কারণ ‘৬০-এর দশকের প্রথম থেকেই ফিল্ম লাইনের দু-একজন ছাড়া ওর সঙ্গে বিশেষ কারোর যোগাযোগ ছিল না। সুনু রায়চৌধুরি, অসিতবাবু এরকম দু-চারজনই ওর ঘনিষ্ঠ। তবে ও যে বালীগঞ্জে শচীন চৌধুরীর বাড়ি কিনেছে এটা ওর মুখেই শুনেছিলাম। এছাড়া বারীনের থেকে মাঝে মাঝে ওর খবর পেতাম।

ওর আরেকটা উত্তরণ আমি চোখের সামনে দেখেছি, প্রথম প্রথম যা রোল পেত তাই করত। একটু নাম হওয়ার পরেই পছন্দের রোল ছাড়া করতই না। তবে প্রথম দিকে ‘কাজরী’ ও ‘এটমবোম’ ছবিতে ওকে দিয়ে যে সাইড রোল করানো হয়েছিল, সেই ক্ষোভ ওর এখনও যায়নি। এ দুটো ছবিতেই সাবিত্রী লিড রোলে ছিল।

সাবিত্রীর অভিনয় দক্ষতা সম্বন্ধে আর কী বলব, সে তো আগেই বলেছি। তবে এক কথায় বলতে গেলে সাবিত্রীর মতো অভিনেত্রী ভারতবর্ষে তো নেই-ই, পৃথিবীতে আছে কিনা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। সিনেমার অভিনয় তো সবাই জানে। কিন্তু স্টেজে ‘শ্যামলী’ আর ‘মল্লিকা’তে ও যা অভিনয় করেছিল তা ভাবা যায় না! বিদেশে জন্মালে ওর ‘অস্কার’ বাঁধা থাকত। কিন্তু ওর একটা জিনিসের খুব অভাব, সেটা হচ্ছে ‘অভিনেত্রী-সুলভ কৃত্রিম গাম্ভীর্য নিয়ে চলা। ওর মধ্যে এটার খুবই অভাব।

আমার সমসাময়িক অভিনেতাদের মধ্যে জহরকে নিয়ে কিছু বলা দরকার। জহরের সঙ্গে আমার পরিচয় ‘৪১ সাল থেকে। পুরোনো পরিচয়ের সুবাদে সুশীলদার লেক অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে আমি যেতাম, জহরও ওখানে যেত। ও সুশীলদার স্ত্রী আরতিকে পাটনার থেকে আগেই চিনত। জহর তখন থেকেই চার্লি গোঁফ রেখে ‘গ্রেট ডিক্টেটর’ ছবির অনুকরণে অভিনয় করত। সেইসময় ওকে ‘বাংলার চার্লি’ বলা হত। সিনেমায় কমেডিয়ান হিসাবে ওর অবদান অনেক, কিন্তু থিয়েটার-অভিনেতা হিসাবে ওর দান অপরিসীম। রংমহল থিয়েটারটা ওর জন্যই বেঁচে ছিল।

জহর প্রথমদিকে যে ক্যারিকেচারগুলো করত সেগুলো প্রায় সবই অজিতের রচনা। অজিত-জহর জুটি জলসা মঞ্চে ‘৪০-‘৫০ দশকে ফাটাফাটি নাম করেছিল। কিন্তু অজিত পরের দিকে জলসায় আর তত মন দিত না। জহর এর পরে একাই মাতিয়ে দিয়েছিল।

আমাকে এবং জহরকে বেশিরভাগ পরিচালক ‘কমিক রিলিফ’ হিসাবে ব্যবহার করেছে। অর্থাৎ দর্শক যখন নায়ক-নায়িকার প্রেম দেখতে দেখতে হেঁদিয়ে গেছে, বাড়ি চলে যাবে কিনা ভাবছে, তখন আমাদের ‘একটি ক্ষুদ্র হাসির মুহূর্ত’ উপহার দেওয়ার জন্য নেওয়া হত। আমি এ-ব্যাপারটা অনেক আগেই, কিছুটা নাম করার পর, বিশেষ করে ‘৫০-এর দশকের শেষ ভাগ থেকে করা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। কিন্তু জহর জীবনের শেষ দিন অবধি করে গেছে। ওর কথা হচ্ছে, কাজ করতে হবে সে যত ক্ষুদ্রই হোক, ওকে রোজ কাজ করতেই হবে।

ও কোনওদিন পারিশ্রমিকের জন্য জেদাজেদি করত না, যেটা আমি খুবই করতাম। এক সময় হয়েছিল আমি যখন রোজ ২৫০ টাকা নিতাম, জহর তখন ৭০ টাকা নিত। একদিন আমি রেগেমেগে ওকে ধরে বললাম, ‘তোর লজ্জা করে না, তুই একটা এত বড় অভিনেতা, আমি ২৫০ টাকা নিচ্ছি আর তুই ৭০ টাকা নিচ্ছিস? অন্তত ১২৫ টাকা নে?’

ও অম্লানবদনে বলল, ‘না, না, আমার রোজ টোটাল খরচ ৭০ টাকা, ওতেই আমার চলে যাবে। আমার রোজ ৭০ টাকা চাই-ই, দরকার কী রেট বাড়িয়ে, যদি প্রাোডিউসার না আসে! সে চান্স আমি ওদের দেব না।’

এরকম কাজপাগলা লোক ছিল ও। সিনেমা লাইনে জহর সম্বন্ধে একটা জোক চালু করেছিলাম, তা হল, ‘জহর একটা আলোয়ান গায়ে দিয়ে মহালয়ার দিন বেরোয়, ১লা বৈশাখ তেল-চিটচিটে সেই আলোয়ান নিয়ে বাড়ি ফিরে কাঁচতে দেয়, এর মধ্যে একদিনও বাকি নেই, রোজ কাজ করে। তাছাড়া সিনেমা, থিয়েটার তো আছেই।

এই ছোট ছোট রোল করে সিনেমাতে ও যা দাগ কেটে গেছে ভাবা যায় না। একদিন রাত্রে বাড়িতে ফিরে দেখি আমার স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে সব হেসে চলেছে। কী ব্যাপার? না, টিভিতে ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ দেখাচ্ছে। সেই বইতে জহর একটা পুলিশ কনস্টেবলের চরিত্র এমন সুন্দর করেছে ভাবা যায় না! অনেকদিন আগে মনে আছে বিজলীতে ‘গুপি গায়েন বাঘা বায়েন’ রিলিজ করেছে। তখন সাংঘাতিক ডামাডোল, আমি, রবি, সৌমিত্র, অনুপ, সৌমেন্দু সবাই বিজলীর বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। কারণ ‘সংরক্ষণ সমিতি’ সে-বই চলতে দেবে না। অনেক লোক এসেও ভেতরে ঢুকছে না গোলমালের ভয়ে। আমার ছেলে গৌতমও আশেপাশে ছিল। রবি, অনুপ ওরা গৌতমকে ভেতরে ঢুকিয়ে দিল ছবি দেখতে। ছবি দেখে বেরোলে রবি, অনুপ বলল, ‘কেমন দেখলি, অভিনয় কেমন হয়েছে?’

ও বলল, ‘ভালো, কিন্তু জহরকাকা বেস্ট।’

এই শুনে রবি, অনুপ মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে।

জহর তখন বিরোধী দলে, কিন্তু আমাদের মধ্যে সম্পর্ক খুব ভালো ছিল। প্রথমদিন থেকেই কিছু লোক ছিল যাদের ধারণা, আমার আর জহরের মধ্যে ভালো সম্পর্ক ছিল না। অবশ্য চিরকালই বাঙালিদের একটা লাগিয়ে দেওয়ার মানসিকতা আছে। উত্তম-সৌমিত্র, সত্যজিৎ রায়-তপন সিনহা, সুচিত্রা-সাবিত্রী, হেমন্ত-মান্না, সন্ধ্যা-লতা, ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান—সবাইকে লড়িয়ে দাও। পাবলিকের ধারণা নেই আমার আর জহরের মধ্যে কী পরিমাণ সুসম্পর্ক ছিল! ১৯৬০ সালে আমার মা যখন মারা গেলেন, রাত তখন বারোটা, কোত্থেকে জহর খবর পেয়ে সেই রাতেই আমাদের বাড়ি চলে এল। পরের দিন সকাল আটটায় শ্মশানে যাওয়া অবধি সারাক্ষণ জেগে ছিল, আমার ছেলেমেয়েকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল। আমার মেয়ের বিয়ের সময় একদিন স্টুডিয়ো যাবার পথে আমার বাড়িতে নেমে বিয়েতে কী মেনু হবে জেনে আবার কিছু সাজেশন দিয়ে গেল। এমনি ছিল আমাদের বন্ধুত্ব।

কিছু লোক ছিল যারা আমার বা জহরের বাড়িতে সারাক্ষণ বসে থাকত, ওরা ফিল্ম-লাইনের সঙ্গে জড়িত, এদের সারাক্ষণ কাজ ছিল আমার কাছে জহরের নিন্দা করা আর জহরের কাছে আমার নিন্দা করা। একদিন এরকম একটা লোক এসে আমায় বলল, ‘ভানুদা, কী বলব, জহরদা কী ছোটলোক, আমাদের পাড়ায় ফাংশানে কমিক করছে লুঙ্গি পরে শীর্ষাসন করবে। চিন্তা করতে পারেন কতখানি অশিক্ষিত হলে এরকম কৌতুক নকশা করতে পারে?’

আমি বললাম, ‘কৌতুক নকশার কথা আমি শুনেছি, তবে যদি বলিস জহর অশিক্ষিত, তাহলে আমি বলব তোর চোদ্দোগুষ্টিতে জহরের মতো শিক্ষিত লোক নেই। তুই নর্থ ক্যালকাটাতেই থাকিস, কোনওদিন জহরের বাড়ি গিয়ে ওর লাইব্রেরিটা দেখে আসিস।’

এরপর ওই ছেলেটা আর আমার বাড়ি আসেনি। জহর ভীষণ উইটি ছিল, ওর সবচেয়ে বড় গুণ প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব। যে-কোনও ঘটনার তৎক্ষণাৎ কৌতুক রূপ দিতে পারত। ওর সাংঘাতিক ফিজিক্যাল ফিটনেস ছিল। যখন-তখন মাটিতে আছাড় খেতে সিদ্ধহস্ত ছিল। খুব খেটে অভিনয় করত।

কিন্তু আমাদের অভিনয়ের মূল্য কেউ দিতে চাইত না। He was a great artist। এর মধ্যে কোনও গোলমাল নেই। কিন্তু ও-ও আমাকে বলত, ‘হ্যা রে কী হচ্ছে বল তো? সব কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।’

জহরের গোলমাল যে কোথায় হচ্ছে, সেটা আমি ধরেছিলাম। কিন্তু একটা Pun-এ লোক হাসল, তখন মনে হত আরেকটু হাসাই। আবার মনে হল আরেকটু হাসাই। এবার কোথায় থামতে হবে সেটা না জানলে কমেডির পক্ষে মুশকিল।

জহর পাকা অভিনেতা। ও অভিনয়ক্ষমতা পেয়েছিল পৈতৃক সূত্রে। ওর বাবা সতু রায় সাইলেন্ট যুগে ব্রিটিশ ডমিনিয়ান ফিল্ম কোম্পানির অনেক ছবিতে অভিনয় করেছেন। একবার ‘বসু পরিবার’ ছবিতে আমরা সবাই অভিনয় করছি, পাহাড়িদা ছাড়া সবাই নাম-না-জানা অভিনেতা-অভিনেত্রী। পাবলিসিটিতে দেখলাম উত্তম, সাবিত্রী, সুপ্রিয়া, নেপাল, বাণী গাঙ্গুলী—সবার নাম দিয়েছে। কেবল আমার আর জহরের নাম নেই। আমি খুব উত্তেজিত, সবার নাম আছে আমাদের নাম নেই কেন?

জহর বলে, ‘চেপে যা না, আমাদের অভিনয় দেখেই পাবলিক আমাদের চিনে যাবে।’

আমি বলি, ‘তা না হয় হল, কিন্তু আমাদের নাম থাকবে না কেন?’ সোজা গিয়ে বিমল ঘোষকে চেপে ধরলাম, নির্মলদাও বলল, ‘সত্যি তো ওদের নাম কেন থাকবে না?’ বিমলের সঙ্গে আমার একটু কথা কাটাকাটি হল, কিন্তু জহর একেবারে স্পিকটি নট; এরকমই নির্বিরোধী ছিল ও।

শুনেছি সেসময় প্রথমদিকে ওর পারিশ্রমিক থেকে পাঁচ-দশ টাকা প্রাোডাকশন ম্যানেজাররা কেটে নিত। কিন্তু ও কোনওরকম কমপ্লেইনও করত না। এই ওর একটা দোষ ছিল। কোনওরকম ঝামেলায় কোনওদিন থাকত না। সিনেমায় যে এত আন্দোলন হয়েছে ও কিন্তু কোনওদিন অংশগ্রহণ করত না। ওকে মাত্র একবারই আন্দোলন করতে দেখেছিলাম, রংমহল থিয়েটার যখন বন্ধ হয়ে গেছিল। অবশ্য বিরাট বড় বড় কমিউনিস্টদের আমি দেখেছি সিনেমার আন্দোলনে কোনওদিন অংশগ্রহণ করত না।

যাই হোক, জহর সম্বন্ধে একটা জিনিসই আমি কোনওদিন বুঝতে পারিনি, তা হল ও পাটনা থাকার সুবাদে ভালো হিন্দি জানত, নাচগানও জানত অর্থাৎ হিন্দি ছবিতে কমেডিয়ান হিসাবে নাম করতে যা যা গুণ দরকার তার সব ক’টা ওর মধ্যে প্রবল ছিল; অথচ ওর হিন্দি ছবিতে নাম হল না কেন বুঝিনি। এরকমই পাওয়ার ঝুলি শূন্য থেকেই ১ অগস্ট, ১৯৭৭-এ মারা গেল। হাসপাতালে গিয়ে দেখলাম ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির কেউ নেই; না অভিনেত্রী সঙ্ঘর, না শিল্পী সংসদের কেউ। পরে সৌমিত্র এলে আমি অনেক দু:খে বললাম, ‘এটাই কি জহরের প্রাপ্য ছিল?’

সুশীলদা (মজুমদার)র সঙ্গে আমার বহুভাবে বহুদিনের আলাপ। সুশীলদার বাবা বসন্ত মজুমদার ও আমার বাবা ঢাকার জেনারেল অ্যাসেম্বলি স্কুলে একই সঙ্গে পড়তেন। তিনি কুড়ির দশকের স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। ওঁর স্ত্রী অর্থাৎ হেমপ্রভা মজুমদারও সেকালের ঢাকার কংগ্রেসের নেত্রী ছিলেন। তাঁর হয়ে আমি ১৯৩৫-এ ঢাকার নির্বাচনে কাজও করেছি। সুতরাং আমি যখন ‘৪১-‘৪২ সালে সুশীলদার বাড়িতে আড্ডায় গেছি তখন আমি অজানা, অপরিচিত কেউ নই। সুশীলদা একাধারে অভিনেতা, পরিচালক; উনি বড়ুয়া সাহেবের অ্যাসিস্টেন্ট হয়ে ছবির জগতে আসেন। এর আগে সুশীলদার পরিচালিত ও অভিনীত ‘রিক্তা’ দেখে মুগ্ধ ছিলাম, এ বইটা আমি অন্তত ৫-৬ বার দেখেছিলাম। আমার যদি পয়সা থাকত তবে এই ছবিটা সাবিত্রীকে কাস্ট করে রিমেক করাতাম।

আরেক জিনিয়াস, তুলসীদার (লাহিড়ী)র এই কাহিনি অবলম্বনেই উত্তম ‘উত্তর ফাল্গুনী’ ছবিটা করেছে। উত্তমেরও সাংঘাতিক পছন্দের ছবি ছিল ‘রিক্তা’। সুশীলদা বোম্বাইতেও হিন্দি সিনেমা পরিচালনা করেছে, তখন ওর সহকারী ছিল রাজ কাপুর।

এইসব গল্প সুশীলদার বাড়িতে আড্ডায় শুনতাম। আমি যখন রেগুলার সুশীলদার বাড়ির আড্ডায় যেতাম, তখন মাঝে মাঝে জহরও যেত সেই সময়েই সুশীলদা দুখানা সুপারহিট বই পরিচালনা করেছেন—’অভয়ের বিয়ে’ ও ‘যোগাযোগ’। অথচ আমার কোনওদিন হিম্মত হয়নি, আমাকে চান্স দেবার জন্য সুশীলদাকে বলার। কারণ, এক তো নৃপতিদা তখন সুশীলদার ঘরের আর্টিস্ট, সুশীলদার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়া ছাড়াও তখন কমেডিয়ান হিসেবে খুবই নাম, সুশীলদার সব ছবিতে উনি অভিনয় করেছেন। তাছাড়া আমি বা জহর তখন কৌতুকাভিনয় করি বটে কিন্তু সিনেমায় নামিনি।

অবশেষে সহকারী পরিচালক ভুজঙ্গ ব্যানার্জী ও বিশেষ করে সুধীর গুহর অনুরোধে ‘অভিযোগ’ বইতে ১৯৪৭ সালে প্রথম চান্স পেলাম ছোট্ট রোলে, তা-ও পাবলিসিটিতে আমার নাম কোথাও ছিল না। কুছ পরোয়া নেই, আমার খুবই আগ্রহ ছিল এই ছবিতে কাজ করার, কারণ সে সময়ের এই ছবিটি বিগ কাস্ট ছবি। একে তো সেসময়ের সবচেয়ে পপুলার রোমান্টিক জুটি দেবী মুখার্জী ও সুমিত্রা ছিলেন। তার ওপর ছবিদা, অহীনদা, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, এছাড়া রঞ্জিৎ রায়, তুলসীদা, নৃপতিদা, কুমার মিত্র ইত্যাদি নামকরা শিল্পীরা এই বইতে অভিনয় করেছেন। সুতরাং মুখ দেখালেও লাভ আছে।

এরপর থেকে সুশীলদা যত ছবি করেছেন প্রায় সব ছবিতেই আমি অভিনয় করেছি। এর মধ্যে ‘শেষ পরিচয়’ ছবিটা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, কারণ এ-ছবির প্রযোজক অনন্তদার সঙ্গে সুশীলদার পরিচয় আমিই উদ্যোগ নিয়ে করিয়ে দিই। সুশীলদা গুরুস্থানীয়, তাঁর জন্য কিছু করতে পেরে আমি ধন্য।

এ প্রসঙ্গে আরেকটা ঘটনা আমার মনে পড়ছে, কিছুকাল আগে রবি (ঘোষ) একটা থ্রিলার ছবিও পরিচালনার কাজে নামে, রবির এটাই প্রথম পরিচালনা। আমিও ওকে খুব উৎসাহ দিলাম। মাঝে মাঝে ফোনে খোঁজখবর নিতাম। একদিন ও একটা সাজেশন চাইল, ভিলেনের চরিত্রটার জন্য ওর একজন বয়স্ক অচেনা অভিনেতা দরকার, যে একদম নতুন। আমি সুশীলদার নাম সাজেস্ট করলাম। একে সুশীলদা বহুদিন অভিনয় করেননি, এ জেনারেশনের প্রায় কেউই ওঁকে চেনে না। সত্যি বলতে কী, রবিরও বোধকরি ওঁকে মনে নেই, অথচ উনি একজন দুর্ধর্ষ অভিনেতা।

প্রথমে রবি দোনামনা করছিল। আমি বললাম, ‘ট্রাই করে দেখ না, আমার বিশ্বাস নিশ্চয় পারবেন। প্রথম দিনের শুটিং-এর পর রবি ফোন করে বলল, ‘ভানুদা, দারুণ তোমার সাজেশন, সুশীলদা কী দারুণ অভিনেতা, গলার ভয়েসে কী সাংঘাতিক মডিউলেশন! আমি ঠিক যা চাইছিলাম তেমনই।’

আমি বললাম, ‘এই জানবে, বড়দের কথা শুনে চলো, জীবনে উন্নতি করবে।’ এই ছবিটার নাম ‘নিধিরাম সর্দার’।

আমি যখন প্রথম ফিল্মে আসি তখন অলরেডি নবাদা (নবদ্বীপ হালদার), অজিত চ্যাটার্জী, হুয়া (শ্যাম লাহা)দা, তুলসী (লাহিড়ী এবং চক্রবর্তী) দা-রা তখন মধ্যগগনে। এদের মধ্যে অজিতের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয়, তার কারণ হয়তো অজিত আমারই বয়সি অথবা দু-এক বছরের বড় হবে। হয়তো বলছি কারণ একবার অজিতের বাবার সঙ্গে যখন ওর সিমলা পাড়ার বাড়িতে কথা বলছিলাম, তখন তাঁকে অজিতের বয়স জিগ্যেস করাতে উনি বললেন, ‘যে বছর মোহনবাগান শিল্ড পায় সে-বছর ওর জন্ম।’—আমার সঙ্গে ওখানে সমরেশ রায়, হেমন্ত ছিল। আমরা সবাই অবাক, ওর বয়স কি এত হবে?

যাই হোক, ওখানে আমরা গেছিলাম অজিতের পাড়ার ফাংশানে। অজিত তখন মাঝে মাঝেই আমাকে আর জহরকে ফাংশানে সুযোগ করে দিত। জহরকে ঘন ঘন দিত; শুধু তাই নয়, জহরের প্রথম দিকের কমিক স্কেচগুলোর বেশিরভাগই অজিতের লেখা। ওরা দুজন একসঙ্গেই করত। জহরের কলেজ স্কোয়ারের বাড়িও মনে হয় অজিতই ঠিক করে দিয়েছিল। কিন্তু জহর যেমন ধাপে ধাপে উন্নতির শিখরে উঠেছিল, অজিতের কিন্তু কেরিয়ারের দিকে একেবারে মন ছিল না।

একবার অজিতকে জিগ্যেস করেছিলাম, ‘আজকাল তুমি সিনেমায় অ্যাকটিং কমিয়ে দিয়েছ কেন?’

ও বলল, ‘দূর দূর, এখানে কী করব, আমিও একদিন সাবু (অ্যালিফ্যান্ট বয়)র মতো হলিউডে চলে যাব।’

তখনই বুঝলাম ওর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ও কিন্তু ভীষণ উপকারী লোক। বসুশ্রীর আড্ডায় প্রথমে অজিতই আমায় নিয়ে যায়। ফিল্ম লাইন কিংবা গানের লাইনের বেশিরভাগ লোকের ফোনের কানেকশন ও করে দিয়েছে। বিধান রায়ের সঙ্গে ওর সাংঘাতিক রকমের জানাশোনা ছিল, সেই সুবাদে আমাদের লাইনের কারও কোনো দরকার হলেই ‘অজিত’। আর অজিত এইসব ফিলানথ্রোপি করতে করতে নিজের কেরিয়ারই ভুলে গেল।

‘৪০-‘৫০-এর দশকে অজিতের যে কী দাপট ছিল তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না! অথচ সেই অজিতই ৬০-এর দশক থেকে প্রায় অজানা হয়ে গেছিল; তাতেও ওর কোনও ভ্রুক্ষেপ ছিল না। হেমন্ত যদি কলকাতায় এল তো অজিত ওর সবসময়ের ছায়াসঙ্গী, এমনকী রঙমহলে থিয়েটার অ্যাবসেন্ট করেও। এই নিয়ে ওর ঘনিষ্ঠ বন্ধু জহরের সঙ্গে এমন মনোমালিন্য হল যে ও রঙমহল ছেড়ে দিল।

ওর ডোন্ট-কেয়ার-ভাব তো ছিলই, অথচ ওর পঙ্কজ মল্লিক, শচীন দেববর্মন কমিক স্কেচ তখনকার দিনের সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল। ওর মতো বৈঠকি আড্ডা-প্রিয়-বাঙালি আমি আর দেখিনি।

যাই হোক, অনেকদিন পর ও আবার আমার ‘জয় মা কালী বোর্ডিং’ থিয়েটারে অভিনয় করেছিল। অজিত ছাড়াও সরযূদি এবং আরও অনেক এক্স-রঙমহল এই নাটকে অভিনয় করছে।

.

অভিনয়জগতে অমার সবচেয়ে বড় আইডল শিশির কুমার ভাদুড়ী, বহুকাল আগে অর্থাৎ ১৯০৪-১৯০৫ সালে আমার বাবা জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ওঁর প্রাইভেট টিউটর ছিলেন; এজন্য আমি ভীষণ গর্ববোধ করতাম। আর এই কারণেই উনি আমাকে ‘মাস্টারমশায়ের ছেলে’ বলে সম্বোধন করতেন। ওঁর দেখাদেখি অহীনদা (অহীন্দ্র চৌধুরী) ও আমাকে ওই নামে ডাকতেন। আমি ছোটবেলা থেকে শিশির কুমারের ‘সীতা’, ‘চাণক্য’ ‘আলমগীর’ নাটকের ডায়লগ আওড়াতাম। এটাই আমার সবচেয়ে ‘টাইমপাস’ ছিল।

আমি মনে করি শিশির কুমারই বাংলা থিয়েটারের নব্য যুগের স্রষ্টা। আমি শিশির কুমারের এমন প্রবল ভক্ত ছিলাম যে, আমার ছেলেমেয়ে যারা শাম্মী কাপুরের ভক্ত, তাদের প্রায় জোর করে বসুশ্রী সিনেমায় ‘টকি অব টকিজ’ দেখতে পাঠিয়েছিলাম; সেটা ‘৬৩-‘৬৪ সাল হবে। শিশির কুমারের নাটক দেখার তো আর উপায় নেই কারণ তিনি আর ইহলোকে নেই। শিশির কুমারের সিনেমাটাই দ্যাখ, দেখে বোঝ উনি কী জাতের আর্টিস্ট ছিলেন।

ওরা ফেরার পরে জিগ্যেস করলাম, ‘কীরকম দেখলি?’—দেখলাম এত পুরোনো বই হলেও ওদের ভালোই লেগেছে। বড়বাবু ছাড়াও অহীনদা আর শৈলেন চৌধুরীর অভিনয়ও ভালো লেগেছে। বুঝলাম ওরা বুঝতে শিখেছে। আমি যে শিশির কুমারের সিনেমার খুব একটা ভক্ত ছিলাম তা নয়; যদিও ‘সীতা’, ‘পল্লী সমাজ’ প্রভৃতি সব ছবিই দেখেছি।

আমি এমনিতেই শিশির কুমারের নাটকের অভিনয়ের বেদম ভক্ত, তার ওপর আবার ইন্ধন জুগিয়েছেন ছবিদা আর সুশীলদা (মজুমদার)। এঁরা সবসময় এত শিশির কুমারের অভিনয় নিয়ে আলোচনা করতেন যে ওতেই আমি আরও প্রভাবিত হই। অবশ্য সন্তোষ সিংহ, কানু বন্দ্যোপাধ্যায়, এঁরা সবাই তখন শিশির কুমারের অভিনয়ের আলোচনা করতেন, কেউ বাদ নেই।

আসলে শিশির কুমার একটা ইনস্টিটিউশন, সবাই তাঁর দ্বারা প্রভাবিত। ১৯৫০-৫১ সাল নাগাদ ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে ‘আলমগীর’ নাটক দেখতে যাই। উনি তো আমাকে দেখেই (মাস্টারমশাই-এর ছেলে) উইংসের পাশে বসার ব্যবস্থা করে দিলেন। কিন্তু আমি তো ওঁকে দেখেই মনমরা হয়ে গেলাম, চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছেন না, ওঁকে দুজন ধরে ধরে হাঁটাচ্ছেন। আমি ভাবলাম আজকে উনি নিশ্চয়ই ডোবাবেন। সাজপোশাক পরে, মেক-আপ নিয়ে উনি তো দাঁড়িয়ে আছেন (দুজন লোক ওঁকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে), আমি ইষ্টনাম জপছি। ওঁর সিন আসার সঙ্গে সঙ্গে একজন লোক ওঁকে ঠেলে স্টেজে ঢুকিয়ে দিল।

ব্যস, তারপর যা দেখলাম অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয় Transformation! একমিনিট আগেও যিনি জবুথুবু, থপথপ করে চলছেন, স্টেজে ঢুকে তিনিই রয়েল বেঙ্গল টাইগার হয়ে গেলেন। তার দাপট কল্পনাতীত! এরকমও হয়? ওরকম একজন অসুস্থ লোক এরকম অভিনয় করতে পারেন? এই ঘটনাটা আমাকে চিরকাল ইনস্পায়ার করেছে।

বম্বের অভিনেতা সজ্জনের কাছে শুনেছি, পৃথ্বী থিয়েটার থেকে পৃথ্বীরাজ কাপুর ওদের শিশির কুমারের বাংলা নাটক দেখাতে নিয়ে এসেছিল। ওরা বাংলা কিছুই বোঝে না, তার ওপর শিশির কুমার জবুথুবু অবস্থা। পৃথ্বীরাজ ওদের নিয়ে এসেছে দেখাতে, স্টেজে অ্যাকটিং কাকে বলে। অথচ খানিকক্ষণ পর্যন্ত ওরা কিছুই দেখতে পারছে না। পৃথ্বীরাজের দু-পাশে বসা প্রেমনাথ ও সজ্জন সমানে ঠ্যালা দিয়ে বলছে, ‘কী বাবুজি, এই দেখতে নিয়ে এলেন?’

পৃথ্বীরাজ বলে, ‘ধৈর্য ধরে বোসো না, এক্ষুনি দেখতে পারবে।’

কিছুক্ষণ বাদে শিশির কুমারের ফর্ম আরম্ভ হল, অভিনয় দেখে সবাই স্তম্ভিত। এক বর্ণ ভাষা বুঝছে না। কিন্তু অ্যাকটিং যে কী পরিমাণ ফাটাফাটি হচ্ছে সেটা বুঝতে পারছে। নাটক শেষ হওয়ার পর পৃথ্বীরাজ ওদের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ক্যায়া বেটা, কুছ সমঝা, কুছ শিখা?’ ওরা তো তাজ্জব! এই ছিলেন শিশির কুমার।

আমার কেবল দু:খ হয়, উনি যে নাটক গ্রুপ নিয়ে আমেরিকায় গেছিলেন সেটা কেন সফল হল না? এই আমেরিকা সফরের পরে ওঁর জীবনে নানারকম দুর্যোগ নেমে আসে। উনি কত গুণের অধিকারী ছিলেন বলে শেষ করা যায় না, কিন্তু সেই হিসেবে সফলতা মোটেই পাননি। তিনি সুরেন্দ্রনাথ কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন। তিনি এমন দৃঢ়চেতা ছিলেন যে, মৃত্যুর কিছুকাল আগে পাওয়া ‘পদ্মভূষণ’ খেতাব প্রত্যাখ্যান করেন।

ওঁর মৃত্যুর পর আমরা অভিনেত্রী সঙ্ঘ থেকে জমি চেয়েছিলাম সরকারের কাছে, প্রশান্ত শূর মহাশয় আমাদের নীলরতন সরকার হাসপাতালের কাছে জমিও দিয়েছিলেন শিশির মঞ্চ করবার জন্য। কিন্তু সেটা হয়ে ওঠেনি কারণ অ্যামেচার থিয়েটারের এক মহারথীও একই প্রস্তাব নিয়ে আসেন, অথচ এঁরাই বহুকাল পূর্বে বলেছিলেন ‘শিশিরকুমার মুখব্যদান করে অভিনয় করেন।’ এই নিয়ে সভায় আমার সঙ্গে প্রবল বাদানুবাদ হয়, অবশেষে সরকার নিজেই ‘শিশিরমঞ্চ’ গড়ার পরিকল্পনা করে।

আজকাল হিরো বলতে যা বোঝায় আমাদের কালে সেরকম হিরো বলতে বুঝতাম দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তার হাঁটা-চলা চলন-বলনে একটা দৃপ্তভঙ্গী তাঁকে সে-সময়ের হিরো বানিয়ে দিয়েছিল। আমাদের সময়ে দু-দল দর্শক ছিল একদল ‘বড়ুয়াভক্ত’, যদিও আমি জানি ভারতবর্ষের সিনেমায় সিনেমাটিক অ্যাকটিং-এর জনক প্রমথেশ বড়ুয়া। কিন্তু দুর্গাদাস-ই ছিলেন আমার হিরো। উনিই একমাত্র হিরো যিনি সিনেমা এবং থিয়েটার দুটোরই একচ্ছত্র নায়ক ছিলেন।

জমিদার বংশের ছেলে, বিশেষ লেখাপড়া করেননি, সিনেমায় যেমন সব বিখ্যাত লোকের সম্বন্ধে গল্প চালু থাকে, তেমনি ওঁর সম্বন্ধেও একটি মজার গল্প চালু আছে। ‘কর্ণার্জুন’ নাটক দেখে অভিভূত হয়ে জনৈক সাহেব নাটকের পর গ্রিনরুমে গিয়ে দুর্গাদাসের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। দুর্গাদাসও আপ্লুত হয়ে সাহেবকে বলেন, ‘আই উইল ইট ইউ ইন মাই হাউস ওয়ান ডে।’

দুর্গাদাসের অনেক ছোট বয়সেই বিয়ে হয়ে যায়। নরেশ মিত্র দুর্গাদাসকে সিনেমায় নিয়ে আসেন। আমি ছোটবেলায় ‘কপালকুণ্ডলা’, ‘ইন্দিরা’ প্রভৃতি নির্বাক ছায়াচিত্র দেখে দুর্গাদাসভক্ত হয়ে গেছিলাম। এরপর সিনেমা যখন কথা বলতে শিখল, তখন ‘দেনা পাওনা’, ‘পরপারে’, ‘দিদি’, ‘বিদ্যাপতি’, ‘দেশের মাটি’, প্রভৃতি অনেক ছবি দেখেছি এবং অভিভূত হয়েছি। কিন্তু ওঁর শেষ ছবি ‘প্রিয় বান্ধবী’ দেখে সবচেয়ে বেশি অভিভূত হয়েছি। অথচ তখন বয়স প্রায় পঞ্চাশ বছর।

‘প্রিয় বান্ধবী’তে ওঁর অভিনয় ভারতীয় সিনেমায় অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনয়। শুধু আমি নয়, উত্তমেরও জীবনের সবচেয়ে ভালোলাগা অভিনয়ের অন্যতম এটি, উত্তম নিজে আমাকে বলেছে।

অনুপ, আমাদের অনুপকুমার দাস বয়সে আমার চেয়ে অনেক ছোট, প্রায় আমার ছেলে-মেয়ের বয়সি। কিন্তু অভিনয় জগতে আমার চেয়ে ঢের ভেটেরান। বোধহয় নির্বাক যুগ থেকে অভিনয় করছে। বিখ্যাত গায়ক ধীরেন দাসের ছেলে। সেই সুবাদে নজরুলের যাবতীয় ইতিহাস ওর কণ্ঠস্থ। কাজী নজরুল আমার প্রিয় মানুষ, ওঁর অনেক গল্প আমি অনুপের কাছ থেকে শুনেছি। ধীরেন দাসের ছেলে হওয়ার সুবাদে সেকালের প্রচুর ঘটনা ও জানে। এটা যে আমার প্রিয় সাবজেক্ট সেটা ও জানে, তাই আমার সঙ্গে ওর জমেও এই ব্যাপারে। ও অহীনদা, ডি.জি., অমর চৌধুরীর আমলের লোক। সেইজন্য ওকে আমরা মাঝে মাঝে ‘অনুপকাকা’ নামে সম্বোধন করি।

স্টারে একসঙ্গে থিয়েটার করার সুবাদেই হোক কিংবা সিনেমায় একসঙ্গে অভিনয় করার জন্যই হোক, ওর সঙ্গে আমার অনেককালের সুসম্পর্ক। ওর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হল সিনেমার আন্দোলন বা অভিনেতৃ সঙ্ঘের ডামাডোলের সময়। এ-সময়টা ও উত্তর কলকাতা থেকে উঠে এসে মৃণাল সেনের মনোহর পুকুর রোডের বাসায় থাকতে আরম্ভ করল। আমার বাড়ির কাছাকাছি হওয়ায় ঘন ঘন দেখাসাক্ষাৎ হত। সিনেমার আন্দোলনের পর সৌমিত্র, আমি, অনুপ—তিনজনেরই ছবির সংখ্যা কমে গেছিল। আমি একদিন ইয়ার্কি মেরে বললাম, ‘দ্যাখ, পুলুর কাজ না থাকলে প্রফেসারি করে খাবে, কিন্তু তুই কী করবি? চল, আমার সঙ্গে যাত্রায় আয়।’

এই সময়টায় গ্রামে-গঞ্জে ক্যারেকটার অ্যাকটর হিসাবে ওর খুবই পপুলারিটি ছিল, অন্তত রোজগারটা ও ভালোই করতে পারত যাত্রা থেকে। কিন্তু গম্ভীর হয়ে উত্তর দিল, ‘যাত্রাটা বিনিথ ডিগনিটি, ওটা করতে পারব না।’

আমি মন:ক্ষুণ্ণ হলাম, কারণ তখন আমি পুরোদমে যাত্রা করছি।

অনুপের খুব ভালো কমেডি সেন্স ছিল। কয়েকদিন আগে আমার জন্মদিন উপলক্ষ্যে অনুপ, সৌমিত্র, হরিদাস সান্যাল (যে রঙ্গনায় ‘জয় মা কালী বোর্ডিং’-এর প্রাোডিউসার)—ওরা সব এসেছিল। হরিদাস আর অনুপ খুব বন্ধু, এর আগে হরিদাস রঙ্গনায় অনুপের ‘অঘটন’ প্রাোডিউস করেছিল। হরিদাস সবসময়ই অনুপের পেছনে লাগার চেষ্টা করত। সেদিনও পেছনে লেগেছে, ‘তুই আবার বলিস, আমি কমিউনিস্ট, তুই কীসের কমিউনিস্ট? রোজ চাইনিজ খাস রেস্টুরেন্টে।’

অনুপ একটু চুপ করে থেকে উত্তর দিল, ‘তাহলে কি চাইনিজরা কমিউনিস্ট নয়?’

পুলু অর্থাৎ সৌমিত্রর সঙ্গে আমার সাংঘাতিক হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক, ও এখন আমার অঘোষিত মাস্টারমশাই। ও আমার চেয়ে অনেক ছোট, বলতে গেলে পরের জেনারেশন, কিন্তু আমি কোনওরকম বেগরবাই করলেই নীলিমা পুলুকে ফোন করে আমায় শাসন করতে বলে। পুলুর অভিনয়ক্ষমতাতো সবাই জানে, কিন্তু ও সাংঘাতিক জ্ঞানী ব্যক্তি। ওর বার্ধক্যের অনেক দেরি, কিন্তু ওকে ‘জ্ঞানবৃদ্ধ’ বলা যায়। সিনেমা, থিয়েটার সম্বন্ধে ওর যে কী প্রচণ্ড জ্ঞান তা সত্যিই ভাবা যায় না! ওর মধ্যে একটা সাংঘাতিক নেতাসুলভ ক্ষমতা আছে। ও কমিউনিজমে বিশ্বাস করে কিন্তু তা বলে কমিউনিস্টদের রেয়াত করে না।

জাগতিক, আধা-জাগতিক, মহাজাগতিক সব বিষয়েই ওর অসম্ভব জ্ঞান। আমার সঙ্গে যেরকম শিশির ভাদুড়ীর অভিনয় নিয়ে আলোচনা করতে পারে, তেমনি আবার আমার ছেলের সঙ্গে গিটার বাজিয়ে গায়কদের সম্বন্ধে আলোচনা করতে পারে, আবার অনলস সংগ্রাম করতে পারে। সিনেমার শ্রমিকদের নিয়ে গত কয়েকবছর যত সংগ্রাম হয়েছে তার সবগুলোতে পুলু শুধু অংশগ্রহণ-ই করেনি, নেতৃত্বও দিয়েছে। অথচ ফিল্ম লাইনে যে-ক’জন নামকরা কমিউনিস্ট আছে তাদের কিন্তু কোনওদিন এসব সংগ্রামের দিনে আশেপাশেও পাইনি।

পুলুর সঙ্গে আমার দেখাসাক্ষাৎ নিয়মিত আছেই, তদুপরি ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ নিত্যদিন হয়। ও বসুশ্রীতে তেমন একটা যায় না, কিন্তু আমাদের পাড়ার ডাক্তার মানিক চক্রবর্তীর বাড়িতে আমাদের রেগুলার আড্ডা আছে, আমার বাড়িতে বা ওর বাড়িতে তো আছেই। ওর বিষয়ে আমার যেমন কিছু অজানা নেই, তেমনি আমার বিষয়ে ওরও কিছু অজানা নেই। কারণ ও আমার গার্জিয়ান।

রবি অর্থাৎ রবি ঘোষ এখন প্রায় আমার নিত্যসঙ্গী। কারণ রবিকে আমি বসুশ্রীর আড্ডায় ঢুকিয়ে নিয়েছি, আজকাল রবি প্রায় নিত্য যাতায়াত করে বসুশ্রীর আড্ডায়। ওর বাড়িটা কাছে হওয়াতে ওর সুবিধাই হয়েছে। অনুভার সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর থেকেই আমার সঙ্গে হদ্যতা ছিল। রবি যখন ওর বন্ধু ডায়া প্রভৃতির সঙ্গে আড্ডা মারত তখনও আমি যেতাম। কিন্তু আজকাল প্রায় রোজই দেখা হচ্ছে। রবিকে বোধহয় আমি প্রথম দেখি ‘অঙ্গার’ নাটক দেখতে গিয়ে। তারপরে দেখি রূপবাণী হলে ‘উল্টোরথ পুরস্কার’ অনুষ্ঠানে। সেবার আমি গেছি ‘সর্বশ্রেষ্ঠ কৌতুকাভিনেতা’র পুরস্কার নিতে আর ও এসেছিল উৎপল ও শোভার সঙ্গে। শেক্সপিয়রের ‘টুয়েলফথ নাইট’-এর থেকে একটা অংশ অভিনয় করতে। রবির অভিনয় দেখে অভিভূত হয়ে গেছিলাম।

নাটকের পর আমি ওর প্রশংসা করলাম, তাতে ও একটু অবাকই হল। প্রথমত, ও তখন একেবারেই আনকোরা অভিনেতা, আর তখনকার দিনে অ্যামেচার আর প্রফেশন্যাল থিয়েটার-অভিনেতাদের মধ্যে রেষারেষি ছিল। ও ছিল অ্যামেচার থিয়েটারের (এই সংজ্ঞাটা আমি ঠিক বুঝতাম না কারণ ‘অঙ্গার’ তখন মিনার্ভায় নিয়মিত প্রফেশন্যাল থিয়েটারের মতোই চলছিল), আর আমি প্রফেশনাল। এর বহুদিন পর তনুবাবুর ‘একটুকু বাসা’র শুটিংয়ের সময় থেকে ওর সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠতা হল, আর আমি ওকে সঙ্গে সঙ্গে অভিনেত্রী সঙ্ঘের মেম্বার করে নিলাম। ওর নানারকম জাগতিক বিষয়ে গভীর জ্ঞান আছে সুতরাং আমাদের আড্ডার বিষয়ের অভাব কোনওদিন হয় না।

শুভেন্দুর সঙ্গে আমার খুব ভাব। ও প্রায় আমার ছেলের বয়সি, তা হলেও খুব ভাব। আসলে ‘৬০-এর দশকের বেশ কিছু লেখাপড়া-জানা ছেলেমেয়ে যে ফিল্ম লাইনে আসতে আরম্ভ করল এটা আমার খুব ভালো লেগেছিল। এর আগে সাধারণ বাঙালি সমাজ মনে করত ফিল্মে অভিনয় করা খুব বড় একটা গর্হিত কাজ। এইসব শিক্ষিত, ভদ্র ছেলে-ছোকরারা ফিল্ম লাইনে আসাতে সেই ধারনা ভাঙতে আরম্ভ করল। ‘চৌরঙ্গী’ বইতে কাজ করার সময় থেকে শুভেন্দুর সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠতা হতে আরম্ভ করেছিল। একজন ডাক্তার ফিল্মে অভিনয় করতে এসেছে, আমার সহশিল্পী, এ তো ভালো কথা। তদুপরি ওর সঙ্গে যখন আমার আলাপ হয়েছে তখন আমি প্রায় পঞ্চাশ, সুতরাং এই বয়সে একজন ডাক্তার বন্ধু দরকার। শুভেন্দু ছোকরা বেশ জ্ঞানীগুণী চালাক ছেলে, ব্যাপারটা বেশ বুঝেছিল; তাই ও কদাচিৎ আমার বাড়িতে আসত। আমিই বেশিরভাগ সময়ে ওর বসন্ত রায় রোডের তিনতলার বাসায় কষ্ট করে হলেও সিঁড়ি বেয়ে যেতাম, সম্পর্ক রাখার জন্য।

বুড়ো অর্থাৎ তরুণ কুমার আমার বিশেষ বন্ধু। আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট হলেও ওর সঙ্গে প্রথম অ্যাকটিং ‘জীবন তৃষ্ণা’। কিন্তু চিনতাম তারও আগে থেকে। ওই সময়টা ও সবসময় উত্তমের সঙ্গে থাকত। আমরা খ্যাপাতাম—’শ্রীরামচন্দ্রের লক্ষণ ভ্রাতা’। উত্তম তখন নায়ক হিসেবে খুব নাম করেছে, নানারকম লোক বিরক্ত করে, বুড়োর লম্বা-চওড়া চেহারা দেখে লোকে বিশেষ ভেড়ে না। তখন ও ছোটখাটো রোলে অভিনয় করছে, আমাকে ও খুব পছন্দ করত, আমাকে ফাঁকা দেখলেই আড্ডা মারতে বসে যেত। ভীষণ মিশুকে এবং ইন্টেলিজেন্ট। ওর সঙ্গে সম্পর্কটা গাঢ় হয় ‘পুষ্পধনু’র আউটডোর শুটিং-এর সময়। ও উত্তমের সঙ্গে গেছিল দিল্লিতে। সারাক্ষণ আমার সঙ্গে আড্ডা দিত।

ভীষণ ভালো চরিত্রাভিনেতা। কিন্তু এমন দাদা-অন্তপ্রাণ যে ‘আগে দাদা’, তারপর সবকিছু। বিশেষ করে উত্তমের নিজের প্রাোডাকসন্স হলে ও সেইসময় সব করত, এমনকী নিজেও অফার নেওয়া বন্ধ করে দিত। ও যখন ‘নহবত’ নাটক আরম্ভ করল, প্রত্যেকটা শতরজনীতে আমায় ডাকত আর হাতে কিছু গিফট গুঁজে দিত।

সত্যও আরেকজন, এই বুড়ো আর সত্য দুজনে এখন পার্টনার হয়েছে, এই দুটোই ফিল্ম লাইনের বাইরে নানারকম ব্যবসা করেছে। ‘পাশের বাড়ি’তে আমরা একসঙ্গে অভিনয় করেছি, আমার চেয়ে বয়সে ছোটো। কিন্তু আমার রোগা-সোগা চেহারা দেখে প্রথম প্রথম নাম ধরে ডাকত, কিন্তু পরে বাড়াবাড়ি হবে মনে করে শুধরে নিয়ে দাদাই ডাকতে আরম্ভ করল। ও কিন্তু সাংঘাতিক ভালো অ্যাক্টর। ও আবার সিনেমার স্ক্রিপ্ট, নাটকও লেখে, সিদ্ধার্থ রায়ের আমলে মিনিবাস করেছিল। শুনলাম বুড়ো, সত্য দুজনে মিলে একটা নাট্যমঞ্চ করার তালে আছে।

বসন্ত আমার অনেককালের বন্ধু। বয়সে ও আমার চেয়ে অনেক ছোট, এমনকী ও বোধহয় উত্তমের ছেয়েও ছোট, চুল পাতলা বলে বোঝা যায় না। ওর চেয়ে বয়সে বড় হিরোইন-এর সঙ্গে ও অনেক অভিনয় করেছে। কিন্তু ও আমাকে নাম ধরেই ডাকত। নাগপুরের মানুষ, তাই বাঙালিয়ানাটা কিঞ্চিৎ কম। জগতের সমস্ত বিষয়ে প্রচুর জ্ঞান, স্পষ্টবাদী, বেশ খানিকটা সাহেবিয়ানা আছে। আমি বিক্রমপুরের লোক কিন্তু আমাকেই বিক্রমপুরের ইতিহাস বলে দিতে পারে।

ওর সাংঘাতিক অ্যানটিক কালেকশন আছে। সব সময় ধোপদুরস্ত থাকতে ভালোবাসে। সম্প্রতি গণেশ নিয়ে মেতেছে, ওর রিজেন্ট পার্কের বাড়ি-ভর্তি গণেশ মূর্তি, আমি নাম দিয়েছি ‘গণেশ চন্দ্র অ্যাভিনিউ’। আমাদের মধ্যে খুবই আসা-যাওয়া, আমার যেটা ভালো লাগে সেটা হল ও ওর দুই ছেলেকে খুব ভালোভাবে বড় করেছে।

সুলালদা আমার সঙ্গে ঝগড়াও করতেন, আবার ভালোও বাসতেন। আমি যখন বাল্যকালে সিনেমা দেখতাম তখন থেকেই জহর গাঙ্গুলী সুপার হিরো, আমার বড় হওয়া অবধিও তাই। এতগুলো সুপার হিট ছবির সুপার হিরো, দুর্গাদাস ও বড়ুয়া সাহেব ছাড়া কেউ ছিল বলে মনে হয় না। সেই নির্বাক যুগ থেকে অভিনয় আরম্ভ করেছেন, যতদিন বেঁচে ছিলেন অভিনয় করে গেছেন। আমার মনে আছে আমাদের সিনেমার ইন্ডাস্ট্রিতে যখন ঘোরতর দুর্দিন অর্থাৎ ১৯৬৯ সাল, আমি দুয়েকবার ওঁকে দেখতে গেছি। উনি আমার বিরোধী পক্ষই ছিলেন। কিন্তু আমাকে বলেছিলেন, ‘এসব ঝামেলা মিটিয়ে নে।’ সে সময়টা তিনি অসুস্থ ছিলেন। উনি ঘোরতর মোহনবাগান সার্পোটার, এই নিয়ে তর্কাতর্কি ও হত। মোহনবাগানের হয়ে হকিও খেলেছেন সুলালদা। প্রথম বোধহয় নাম করেছিলেন ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’ বইতে। তারপর থেকে ‘দেনা পাওনা’, ‘বন্দী’ ‘মহানিশা’, ‘প্রফুল্ল’, ‘ছদ্মবেশী’, ‘শহর থেকে দূরে’, অগনিত ছবির নায়ক। আমরা একসঙ্গে ‘শ্যামলী’ নাটকও করেছি। কিন্তু আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে ‘এ্যান্টনি কবিয়াল’ নাটকে ভোলা ময়রার চরিত্রে অনবদ্য অভিনয়।

সুলালদার মতো পাহাড়ীদাও সে যুগের এক সুপার হিরো, পাহাড়ীদার বিশেষ গুণ হল ভালো হিন্দি জানতেন বলে প্রচুর হিন্দি বইতে অভিনয় করেছেন ও সারা ভারতে তাঁর পরিচিতি ছিল। উনি নির্ভেজাল ভালো মানুষ ছিলেন। আবার বেশি কথা বলতেন বলে সবাই ওঁর পেছনে লাগত। ছবিদা, আমি, জহর তো বটেই, আরও অনেকে লাগত। পাহাড়ীদার অনেক গুণ ছিল, অনেক কিছু জানতেন। কিন্তু দোষ হচ্ছে ওগুলো ফলাও করতে ভালোবাসতেন। ইন্দিরা সিনেমায় এক ক্লাসিক্যাল ফাংশানে ওস্তাদ বড়ে গোলাম একটা গান গাওয়ার পর উনি বললেন, ‘ললিত গাইলেন বুঝি?’

ওস্তাদজির পাশে এক সেতারি বসেছিলেন, উনি খুব রসিকও ছিলেন। তিনি বললেন, ‘না, ললিতের ভাই যতীন, পোস্ট অ্যান্ড টেলিগ্রাফে চাকরি করে।’

আমার মনে আছে, ‘রাজকুমারী’ ছবির শুটিং-এর পর আমি, দেবেশ, সলিল, ছায়াদি, তনুজা, পাহাড়ীদা, কালোদা, বুড়ো, আমরা সব আড্ডা মারছি। হঠাৎ পাহাড়ীদা তনুজাকে দেখে ফ্রেঞ্চ বলতে আরম্ভ করলেন। পাহাড়ীদা জানতেন তনুজা সুইজারল্যান্ডে পড়াশুনা করেছে। পাহাড়ীদার ফ্রেঞ্চ শুনে খানিকক্ষণ বাদে তনুজা বলে, ‘পাহাড়ীদা, আপনার ফ্রেঞ্চ কিস্যু হচ্ছে না।’ সবাই হেসে মরে। পাহাড়ীদা লোকটা ভোলাভালা উপকারী ছিলেন, সারাক্ষণ হাতে একটা ‘ফাস্ট-এইড বক্স’ নিয়ে ঘুরতেন, স্টুডিয়োতে কারও কেটে-ছরে গেলে, জ্বর, সর্দি-কাশি হলেই পাহাড়ীদার ওষুধ প্রথমে পড়ত। আমাদের সিনেমার ডামাডোলের সময় উনিও আমার বিরোধী দলেই ছিলেন, একদিন স্টুডিয়োতে আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘এইসব ঝুটঝামেলা, রাজনীতি ছেড়ে অভিনয়ে মন দে না।’ উনি ভীষণ নির্বিরোধী ‘হ্যাপি গো লাকি?’ মানুষ ছিলেন।

আমার পূর্ববতী যুগের অভিনেতাদের মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় ছিলেন তুলসী লাহিড়ী, ইন্দু মুখার্জী, এছাড়াও সত্য মুখার্জী, তুলসী চক্রবর্তী, রঞ্জিত রায়, নবদ্বীপ হালদার। ‘সোনার সংসার’ ছবিতে তুলসী লাহিড়ী, রঞ্জিত রায়, নবদ্বীপ হালদার ছিলেন। এঁরা সব সাংঘাতিক অভিনেতা; এই রঞ্জিত রায় যে কত বড় গুণী শিল্পী ছিলেন তা আজকালকার লোকেরা বিশেষ জানে না। ইনি ঢাকার লোক, এঁর মতো ভার্সেটাইল কমেডিয়ান খুব কমই আছে। সিনেমা, থিয়েটার, যাত্রা ছাড়াও এঁর কমিক গানের রেকর্ড আছে, বাংলাদেশে প্যারোডি গানের জন্মদাতা বলতে গেলে তিনিই। ‘তুমি নামো হে নামো’, ‘ভূতপূর্ব বাবা আমার বর্তমানে মেসো’, প্রভৃতি বিখ্যাত হাসির গান এঁরই গাওয়া। সিনেমাতেও এঁর কমিক গান ”শেষউত্তর” বইতে ‘ভিখু যাবে শ্বশুর বাড়ি’, ”ছদ্মবেশী”তে ‘ভদ্দর ঘরকা লেড়কী ভাগে’ প্রভৃতি বিখ্যাত। কিন্তু দু:খের কথা ‘৭৪।।’ ছবিতে এক সিনে ভূতের ওঝার পার্ট ছাড়া এঁকে আজকাল ছেলেরা মনে রাখেনি। এ ছাড়া ইনি পিয়ানো, বাঁশি প্রভৃতি বাজাতে জানতেন। সিনেমার গানে সুর দিয়েছেন, আবার নিজের অর্কেস্ট্রা পার্টিও ছিল।

রঞ্জিত রায়ের মতো দুর্ভাগ্য নবাদা অর্থাৎ নবদ্বীপ হালদারের নয়, কিন্তু ওঁকেও এখনকার লোক মনে রাখে না। রঞ্জিত রায়ের মতো নবাদাও ভার্সেটাইল কমেডিয়ান। নবাদার সব বিখ্যাত কমিক রেকর্ড আছে। নবাদা স্টেজে ক্যারিকেচারও অনেক করেছেন। নবাদার একটা গল্প আমায় মান্নাবাবু বলেছিলেন। অনেককাল আগে নবাদা কেষ্টবাবুর সঙ্গে দেখা করতে তাঁর বাড়ি যান, কিন্তু কেষ্টবাবু সেইসময় বাড়িতে না-থাকাতে উনি ফিরে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ রাস্তায় একটা গাড়ি ওঁর কাপড়ে কাদা ছিটকে দেয়; ওঁকে ফিরে আসতে দেখে মান্নাবাবু বলেন, ‘আপনি ফিরে এসেছেন ভালোই হয়েছে, কাকাও এসে গেছেন। আসুন কাকাকে ডাকছি।’

নবাদা বলেন, ‘কাকাকে ডাকার আগে বলো কাকার গাড়িটা কোথায়?’

মান্নাবাবু বলেন, ‘কেন, গাড়ি কী করবেন?’

নবাদা বলেন, ‘কেষ্টদার গাড়ি আমার কাপড়ে কাদা ছিটকে দিয়েছে।’—এই বলে পকেট থেকে একটা পেরেক বার করে বলেন, ‘এই পেরেকটা দিয়ে ওই গাড়ির চাকা ফুটো করব।’

হুয়াদা অর্থাৎ শ্যাম লাহা, আমার পূর্ববর্তী কৌতুকাভিনেতাদের অন্যতম। হুয়াদার প্রথম অভিনয় বোধহয় ‘ভাগ্যচক্র’। সুতরাং বাংলার টকিযুগের প্রথম থেকেই হুয়াদা অভিনয় করছে। হুয়াদা অভিনেতা হিসেবে যে খুব সাংঘাতিক তা আমার মনে হয় না, কিন্তু হুয়াদা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি হিসাবে পরিচিত। হুয়াদা কলকাতার বিখ্যাত লাহা পরিবারের ছেলে। কিন্তু হুয়াদা আসলে জন্মসূত্রে ‘শীল’ পরিবারের, তার মামাবাড়ি লাহারা দত্তক হিসাবে নেওয়ায় সে ‘লাহা’ পদবি নেয়। সুতরাং কলকাতার রইস পরিবারে জন্মসূত্রে কলকাতার এলিট মহলে তার অবাধ যাতায়াত, তিমিরবরণের কাছে তার সঙ্গীত শিক্ষা। পাহাড়ীদার সূত্রে তার নীতিন বসুর সঙ্গে আলাপ ও ‘ভাগ্যচক্র’ বইতে অভিনয়ের সুযোগ। অভিনয় ছাড়া ‘লাখ টাকা’, ‘ভোলা মাস্টার’ বই দুটি প্রযোজনাও করেন, কিন্তু ছবিগুলো না-চলায় ওপথে আর যায়নি। স্টারে হুয়াদা অনেক নাটকে অভিনয় করেছে।

অহীনদা, অহীন্দ্র চৌধুরী সে যুগের দুর্ধর্ষ অভিনেতা। বড়বাবু অর্থাৎ শিশির ভাদুরীর দেখাদেখি উনিও আমাকে ‘মাস্টারমশাই-এর ছেলে’ বলে ডাকতেন। অহীনদা কলকাতার সম্পন্ন পরিবারের ছেলে, ছোটবেলা থেকেই অভিনয়ের শখ ছিল। একই বছরে উনি স্টারে ‘কর্ণার্জুন’ নাটকে প্রথম অভিনয় করেন, আবার একই সঙ্গে ‘সোল অফ স্লেভ’ নামে একটি নির্বাক ছবিতে প্রযোজনা ও অভিনয় করেন। অহীনদার ‘সাজাহান’ আবার একই সঙ্গে অতুলনীয়। উনি আমাকে বিশেষ স্নেহ করতেন, কারণ ওঁর ছেলের নামও ভানু। উনি ‘পদ্মশ্রী’ উপাধিও পান অভিনয়ের জন্য। ১৯৭৪ সালে আমরা অভিনেত্রী সঙ্ঘর থেকে বসুশ্রী সিনেমা হলে পুরোনো অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সংবর্ধনা দিই। অহীনদা তখন খুবই অসুস্থ। অনুপ বারদুয়েক অহীনদাকে আসবার জন্য বলাতে উনি না করে দেন। আমি একবার কপাল ঠুকে ওঁর বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়ে বললাম, ‘অহীনদা, আপনি না এলে এ-অনুষ্ঠান বৃথা।’ আমার এককথায় উনি রাজি হয়ে গেলেন এবং এলেন, এতটাই আমায় স্নেহ করতেন।

কালোদা অর্থাৎ অসিতবরণের সঙ্গে আমার অনেকদিনের মধুর সম্পর্ক, কিন্তু দেখা হলেই প্রথমে খেস্তাখেস্তি দিয়েই আরম্ভ হয়। কারণ ও মোহনবাগান আর আমি ইস্টবেঙ্গল। খেলা দেখা অনেকদিন ছেড়ে দিয়েছি, ময়দানে যাই না প্রায় ১৯৫৫-৫৬ সাল থেকে। কিন্তু তবুও ফিল্ম লাইনে কিছু খাঁটি ঘটি আছে যারা দেখা হলেই ফুটবল দিয়ে ঝগড়া শুরু করবে। তার কারণ বোধহয় আমিই একমাত্র রেজিস্টার্ড ট্রেড মার্কড ‘বাঙাল’ বলে। আমাদের পূর্ববর্তী অর্থাৎ উত্তমের আগের যুগে সবচেয়ে বিখ্যাত রোমান্টিক হিরো বোধকরি কালোদা। আবার কালোদা আর রবিদা তখনকার বিখ্যাত গায়ক, নায়ক। সুতরাং ‘৪০-এর দশকের শেষভাগের মহানায়ক বলতে গেলে কালোদা। কালোদা প্রথমে তবলচি ছিলেন। কোনও এক জলসায় পাহাড়ীদা এরকম হ্যান্ডসাম তবলচি দেখে তাকে নিউ থিয়েটার্সে নিয়ে যান, সেখানেই ‘প্রতিশ্রুতি’ বইয়ের নায়ক, গায়ক হিসাবে চান্স পান। প্রথম ছবিতেই কেল্লাফতে, এরপর ‘কাশীনাথ’ ‘পরিণীতা’ করে সুপারস্টার বনে যান।

কালোদা খেস্তাখেস্তিতে পারদর্শী হলেও একজন বিশিষ্ট বাঙালি ভদ্রলোক। কালোদার মতো গালাগালিতে পারদর্শী আরও বহু লোক ফিল্ম লাইনে আছে।

কমলদাও গালাগালিতে কম যান না। কিন্তু যারা বাইরে থেকে দেখে তারা কি কেউ বলতে পারবে ওরকম বলিষ্ঠ, সুপুরুষ, গোল্ডেন ভয়েসের অধিকারী লোকটি এরকম ব্যাকরণসম্মত গালাগালি গুছিয়ে পরিবেশন করতে পারেন! কালোদার মতো কমলদাও মোহনবাগানের, সুতরাং ঝগড়া দিয়েই শুরু হয়। ওঁরা বর্ধমানের লোক। আরেক গোল্ডন ভয়েসের অধিকারী বিপিনদা (গুপ্ত) ওঁকে অভিনয় জগতে নিয়ে আসেন। কমলদার সঙ্গে অনেক নাটক করেছি। স্টারে আমার সঙ্গে অনন্তদা প্রযোজিত ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’, ‘শখের চোর’ ছবিতে কমলদা অভিনয় করেছেন। আমি একবার ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’ শুটিং-এর অবসরে আড্ডা মারার সময় অনন্তদাকে বলেছিলাম, যদি কোনওদিন ‘চট্টগ্রাম বিদ্রোহ’ নিয়ে বই করি তবে কমলদাকে অনন্ত সিং-এর পার্টটা দেওয়া উচিত। ব্যাপারটা দুজনেরই বেশ মনে ধরেছিল। কমলদা আজকাল আর অভিনয় করেন না বিশেষ, ল্যান্সডাউন রোড দিয়ে গেলে দেখা যায় ঘরের দরজার কাছে চেয়ারে বসে আছেন।

প্রমথেশ বড়ুয়ার পরিচালনার আমি সাংঘাতিক ভক্ত। আমি মনে করি ভারতবর্ষে সর্বপ্রথম নব্যধারার সিনেমার পরিচালকের নাম প্রমথেশ বড়ুয়া। পরাধীন ভারতের সিনেমাগুলো যদি বিদেশের ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে যাবার সুযোগ পেত তাহলে ‘কান’ ‘বার্লিন’ ‘ভেনিস’-এর গোল্ডেন লায়ন, গোল্ডেন বিয়ার পুরস্কারগুলো পেত প্রথম ভারতীয় সিনেমা হিসাবে।

আমি অভিনেতা বড়ুয়ার খুব একটা ভক্ত ছিলাম না। কিন্তু এটাও জানি, ভারতীয় সিনেমায় ফিল্মিক অ্যাকটিং উনিই প্রথম এনেছিলেন। ‘৩০-‘৪০ দশকের সিনেমাকে অবশ্য ‘বড়ুয়া যুগ’ বলা যায়। ওঁর যে পরিমাণ জনপ্রিয়তা ছিল তাতে তাঁকেই বাংলা সিনেমার প্রথম ‘মহানায়ক’ বলা যায়। উনি গৌরীপুরের রাজা ছিলেন। চালচলন, ধরনধারনও প্রিন্সলি ছিল। টেনিস খেলতেন, শিকার করতেন, প্রেসিডেন্সি থেকে গ্র্যাজুয়েট হয়ে ইংল্যান্ডে গিয়ে ‘ফক্স ফিল্মসে’ ফটোগ্রাফি শেখেন। সেখানে থেকে ফিরে এসে বড়ুয়া ফিল্মস নামে প্রাোডাকসন্স হাউস খুলে একটি বই প্রযোজনা করেন। ‘অপরাধী’ নামে এই ছবিতে দেবকীবাবু ছিলেন পরিচালক, বড়ুয়া ছিলেন ফটোগ্রাফার। এই ছবিতেই প্রথম লাইট ব্যবহার করেন। এরপর নিউ থিয়েটার্সে যোগ দিয়ে পরপর ‘দেবদাস’, ‘মুক্তি’, ‘অধিকার’, প্রভৃতি সব ছবিতে পরিচালক ও গায়ক হয়ে একের পর এক হিট ছবি বানাতে থাকেন। ওঁর একমাত্র হাসির বই ‘রজত জয়ন্তী’ও এই সময়েই বানানো।

ওঁর অ্যাসিস্টেন্টরা পরবর্তীকালে চলচ্চিত্রে নাম করেন। ফণী মজুমদার, বিমল রায়, সুকুমার দাশগুপ্ত, সুশীল মজুমদার, নির্মল দে প্রভৃতি।

আমার প্রথম সিনেমার অভিনয়ও এই বড়ুয়া সাহেব প্রযোজিত ‘জাগরণ’ ছবিতে। এই ছবির পরিচালক বিভূতি চক্রবর্তীও বড়ুয়া সাহেবের সহকারী ছিলেন।

সেযুগের মহানায়ক যদি হন প্রমথেশ বড়ুয়া, তাহলে মহানায়িকা ছিলেন কাননদেবী। নায়িকা, গায়িকা, হিসেবে সারা ভারতবর্ষব্যাপী তাঁর নাম ছিল। ‘জোর বরাত’ সম্ভবত গায়িকা হিসেবে ওঁর প্রথম সিনেমা। শোনা যায় ‘দেবদাস’ বইতে কাননদেবীরই নাকি প্রথম পার্বতীর চরিত্রে অভিনয় করার কথা ছিল। ১৯৩৫ থেকে আরম্ভ করে ‘৫০-এর দশকের মাঝামাঝি—ওঁর সবক’টি ছবি বিখ্যাত। আমি বোধহয় তাঁর প্রথম ছবি দেখেছিলাম, ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’ অনেক ছোটবেলায়।

এই ছবিতে আমার একজনের অভিনয় খুব ভালো লেগেছিল, সেটা কুমার মিত্র। উনি একটা কমেডি রোলে অভিনয় করেছিলেন। বছর কুড়ি-বাইশ বাদে যখন এই বইটা রিমেক হয়েছিল, তখন কুমার মিত্রের রোলটা আমি করেছিলাম।

আমার জ্ঞান যখন হল অর্থাৎ যখন সিনেমা বুঝতে শেখেছি তখন কাননদেবীর বই দেখি, ‘মুক্তি’। এরপর থেকে কাননবালার নাম ঘরে ঘরে ফিরত। একটা ঘটনা আমার মনে আছে, আমি যখন আমার প্রথম হাস্যকৌতুকের রেকর্ড ‘ঢাকার গাড়োয়ান’ রেকর্ড করছি, তখন একটা ভিখারির গলায় গান লাগাতে হবে। কিন্তু কী গান দেওয়া যায়? তখন ঠিক হল কাননবালার ‘আমি বনফুল’ লাগানো। ওঁর গানগুলো তখন অসম্ভব জনপ্রিয় ছিল, আজকাল যেমন সন্ধ্যা, লতার গান। কাননদেবী সিনেমা ছেড়ে দেবার পর অনেকগুলো সিনেমা প্রাোডিউস করেছিলেন, তার মধ্যে একটা ছবি ‘আঁধারে আলো’তে আমি অভিনয় করেছিলাম। অজয় কর, হরিদাস ভট্টাচার্য, তরুণ মজুমদার, কাননদেবী প্রযোজিত ছবিগুলোতেই প্রথম পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৬১ সালে কাননদেবী দু:স্থ মহিলা শিল্পীদের কল্যাণে ‘মহিলা শিল্পী সংঘ’ নামে এক প্রতিষ্ঠান শুরু করেন। সঙ্গে ছিলেন সুনন্দাদেবী, মঞ্জু দে, অনুভা, শিপ্রা মিত্র প্রভৃতি।

আমার মনে আছে এই প্রতিষ্ঠানের প্রথম মিটিং আমার বাড়িতে হয়। এই উপলক্ষ্যে আমি একটু খাবারদাবারের আয়োজন করি। প্রথমেই কাননদিকে মঞ্জু দে বলে, ‘ওই দেখে আসুন ভানু কীরকম এলাহি খাবারদাবারের আয়োজন করেছে।’

আমাকে ডেকে বলেন, ‘দেখি ভানুবাবু, আপনি কী কী খাবারের আয়োজন করেছেন?’

আমি লোকদের একটু বড় বড় সাইজের খাবার খাওয়াতে ভালোবাসি, তাই ভিয়েন বসিয়ে মাংসের শিঙাড়া, একটু ভালো সাইজের মনোহরার অর্ডার দিই। এইসব দেখে কাননদেবী বলেন, ‘ভানুবাবু আপনার বাড়িতে আর মিটিং করা যাবে না, এইসব খাবার বানিয়েছেন? আমি তো আমার বাড়িতে মিটিং হলে এত সব খাবারের আয়োজন করব না।’

কালী বাড়ুজ্যে আমার অনেককালের সহকর্মী, কালী আমার চেয়ে বয়সে ছোট কিন্তু ভাবটা দেখায় যেন আমার চেয়ে অনেক বড়। তার কারণ হয়তো সিনেমায় ও আমার আগে নাম করেছে। ও ভীষণ নির্বিকার টাইপের, আমার বাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটেই কতবার ওর নিউ আলিপুরের বাসায় গেছে। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকলে ও তাকাত না, আবার কখনও হয়তো চোখে চোখ পড়ে গেলে ‘কীরে কেমন আছিস?’ বলে চলে যেত আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই। এরকমই নির্বিকার টাইপের ছিল। আবার মাঝে মাঝে কথা বলতে গিয়ে তোতলায়। এই নিয়ে অজিত অনেক রসিকতা করে ওকে নিয়ে।

ও জীবনে অনেক কাজ করেছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিলিটারিতে ছিল। আই.পি.টি-এর প্রথম দিকের লোক হচ্ছে কালী। কিন্তু আজকাল আর কোনও যোগাযোগ নেই। বিশ্বরূপায় বহুকাল নাটক করেছে, বাংলাদেশের সব বড় ডিরেক্টরের ছবিতে অভিনয় করেছে। এই সৌভাগ্য বাংলাদেশের মাত্র গুটিকয়েক শিল্পীর আছে। অন্তত আমার তো নেই-ই।

মানিকবাবু অর্থাৎ সত্যজিৎ রায়কে বহুকাল ধরে চিনি, উনি চিত্র পরিচালক হওয়ার অনেক আগে থেকে ওঁকে সুকুমার রায়ের পুত্র ‘লম্বা মানিক’ হিসাবে চিনতাম। উনি ফিল্ম ফেডারেশন অর্থাৎ যাঁরা কলকাতায় রসোলিনি, ডি, সিকা, আইজেনস্টাইনের ভালো ছবি দেখাবার ব্যবস্থা করাতেন তাঁদের একজন কর্তাব্যক্তি ছিলেন। বসুশ্রীতে প্রথম দিন ‘পথের পাঁচালী’ দেখার পর অভিভূত হয়ে বসুশ্রীর অফিসে ঢুকে দেখি মানিকবাবু, মন্টু, আরও কয়েকজন বসে আছে। আমি সোজা ওদের মধ্যে গিয়ে বললাম, ‘আরে মানিকবাবু, এই সত্যজিৎ রায়টি কে? এ তো সাংঘাতিক ছবি বানিয়েছে!’

মন্টু বলে, ‘আরে মানিকবাবুই তো সত্যজিৎ রায়।’

আমি বলি, ‘আরে মশাই, কী ছবি বানিয়েছেন? আপনি কাননবালার চেয়ে বেশি পপুলার হয়ে যাবেন!’

মানিকবাবু শুনে খুবই হেসেছিলেন। সত্যজিৎবাবু কোনওদিনই তাঁর ছবিতে আমায় কাস্ট করেননি কিন্তু মাঝে মধ্যেই স্টুডিয়োতে, বসুশ্রীতে দেখা হলে হলে কুশল বিনিময় হত। এরপর ১৯৬৯ সালে ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ রিলিজ নিয়ে ফিল্ম লাইনে ঝগড়ার সময় ঘন ঘন দেখা হত। বিজলী সিনেমায় আমরা গার্ড দিতাম যাতে সংরক্ষণ সমিতির লোকেরা শো বন্ধ করতে না পারে। সেসময় দেখতাম সত্যজিৎবাবু নার্ভাস হয়ে ঘোরাফেরা করছেন।

নার্ভাস আমিও ছিলাম, নার্ভাসের চেয়ে বেশি মনের মধ্যে একটা অশান্তি, উত্তমের সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়াতে মনটা ভালো লাগছিল না। একবার বসুশ্রী সিনেমায় ‘সোনার কেল্লা’র প্রিমিয়ারের সময় সত্যজিৎবাবুকে কংগ্রাচুলেট করতে গেছি, হঠাৎ কোন এক চ্যাংড়া ফিল্ম রিপোর্টার ওঁর সামনে আমায় জিগ্যেস করল, ‘আচ্ছা ভানুদা, সত্যজিৎ রায় কেন আপনাকে কোনো দিন নেন না?’

আমার মুখ থেকে ফট করেই বেরিয়ে গেল, ‘উনি আমাদের মতো অশিক্ষিত লোকদের নেন না।’

উনি বিচলিত হয়ে বললেন, ‘আরে এটা কী বলছেন, আপনার উপযুক্ত ভালো রোল পেলে নিশ্চয়ই নেব।’ আজ অবধি অবশ্য উনি আমাকে নেননি।

তপনবাবু, তপন সিংহ আমার খুব ঘনিষ্ঠ। উনি বাংলার সর্বশ্রেষ্ঠ পরিচালকদের মধ্যে একজন যিনি আমাকে তাঁর বইতে রোল দেওয়ার উপযুক্ত মনে করেছেন। ওঁকে চিনি অনেকদিন থেকেই, সত্যেনদার ‘বরযাত্রী’ বইতে উনি সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন, ‘টনসিল’ ছবিতে ওঁর সঙ্গে প্রথম কাজ। এরপর ‘বাঞ্ছারামের বাগান’ অবধি অনেক ছবিতে অভিনয় করেছি। আমার মেয়ে বাসবীও ওর ‘অতিথি’ ছবিতে অভিনয় করে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পেয়েছে। সাংঘাতিক ভালো পরিচালক। সঙ্গীত সম্বন্ধে খুব ভালো জ্ঞান, খুব ভালো অভিনয় শেখাতে পারেন। উনিই বোধকরি একমাত্র পরিচালক যিনি ভালো ছবি বানান, আবার ছবি হিটও করাতে পারেন।

অরুন্ধতীকে অনেক আগে থেকেই চিনি। ঢাকায় থাকতে ও আমার ছোটো বোন প্রতিমার বন্ধু ছিল। সেইজন্য সম্পর্কটা কোনো সময়েই খুব সহজ নয়, ও আমায় দাদা ডাকবে না নাম ধরে ডাকবে এই নিয়ে একটা দোটানা আছে। ‘ছেলে কার’, টাকা আনা পাই’ প্রভৃতি ছবিতে একসঙ্গে কাজ করেছি। ও যখন ‘ছুটি’ পরিচালনা করছিল তখন আমার মেয়ে বাসবীকে প্রধান চরিত্রে চেয়েছিল, কিন্তু আমার মেয়ে তখন সেকেন্ডারি দেবে বলে আমার স্ত্রীর ঘোরতর আপত্তিতে আর করা হয়নি।

মৃণালবাবুর সঙ্গে আমার বহুদিনকার আলাপ। ‘৪৮-৪৯ সালে আমরা যখন রাসবিহারীর মোড়ে কয়েকজন সিনেমায় নামব নামব করছি বা নেমেছি, আড্ডা মারতাম। হাজরার মোড়েও আমাদের মতো মৃণাল, ঋত্বিক, ঋষি এরকম কয়েকজনের আড্ডা ছিল। হাজরায় গেলে ওঁদের সঙ্গে আড্ডা হত। পরবর্তী জীবনে অনুপ যখন অভিনেতৃ সঙ্ঘের হর্তাকর্তা হল তখন ওর বাড়িতে গেলে মাঝেমধ্যেই মৃণালবাবুর সঙ্গে আড্ডা হত। জ্ঞানী লোক, পলিটিক্স থেকে ইতিহাস থেকে সিনেমা, নানা বিষয়েই আড্ডা হত। সম্প্রতি যখন অভিনেত্রী সঙ্ঘে ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’ ছবি করবে মনস্থির করেছে তখন অনুপের খুবই ইচ্ছে ছিল মৃণালবাবু ছবিটা পরিচালনা করেন। আমার একই ইচ্ছা ছিল, কারণ মৃণালবাবু ছবিটা করলে অন্য একটা মাত্রা পেত। কিন্তু যেহেতু মৃণালবাবু অভিনেত্রী সঙ্ঘের সদস্য নন, তাই দিলীপ রায় ছবিটা করছে। মৃণালবাবুর সঙ্গে কোনো কাজ করার সৌভাগ্য হয়নি বটে, তবে ওঁর সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আমার।

মঞ্জু দে-র সঙ্গে আমার খুবই হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক। উনিও বিদুষী মহিলা, এই মুহূর্তে বেশ কয়েকজন শিক্ষিতা মহিলা সিনেমায় আছে, কিন্তু মঞ্জুর মতো স্মার্ট একজনও নেই। নেতাজির অন্তর্ধানের আগে যেদিন দেশপ্রিয় পার্কে শেষ ভাষণ দিল, শুনেছি সেদিন ও মেয়েদের ভলান্টিয়ার ইনচার্জ ছিল। ওকে ফিল্মে নিয়ে আসেন সুশীলদা, মঞ্জু সুশীলদার স্ত্রীর বন্ধু। তাই সুশীলদার লেক অ্যাভিনিউর বাড়িতে সিনেমায় নামার আগেও দেখেছি। প্রথম ছবি ‘৪২’-এই ও চরম খ্যাতি লাভ করে, এরপর তপন সিংহকে পরিচালক করে ‘অঙ্কুশ’, ‘টনসিল’, প্রভৃতি বই প্রযোজনা করে।

সোজা কথায় তপনবাবুকে ফিল্মে অনেক সাহায্য করেন মঞ্জু। ‘কাবুলীওয়ালা’ ছবিতে তপনবাবুকে নানাভাবে সাহায্য করে। ‘৪২-এর পর ‘রত্নদ্বীপ’, ‘জিঘাংসা’, ‘নীল আকাশের নীচে’ প্রভৃতি ছবিতে দুরন্ত অভিনয় করে মঞ্জু দে। আমি মনে করি মঞ্জু দে বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী।

অভিনয় ছাড়াও ওর নানা গুণ ছিল। আগেই বলেছি ও ভীষণ স্মার্ট মহিলা, কলকাতা-রাঁচি মোটর রেসে বহুবার অংশ নিয়েছে। প্রথম ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ও জুরি ছিল, হঠাৎ সিনেমা ছেড়ে আইন পড়তে বিলেত চলে যায়। তারপর ফিরে এসে স্টারে জয়েন করে। দুটো ছবি পরিচালনাও করে—’অভিশপ্ত চম্বল’ আর শরদিন্দুর ডিটেকটিভ গল্প ‘শজারুর কাঁটা’। প্রচুর পয়সা খরচ করে এই ছবিদুটো বানিয়েছিল, কিন্তু দুটোই চলেনি। শুনলাম ও আর ওর স্বামী এক সাধুর কাছে দীক্ষা নিয়েছে।

অনুভা আরেকজন খুবই শক্তিশালী অভিনেত্রী। ওর ‘কবি’ আর ‘রত্নদ্বীপ’ ছবির অভিনয় ভোলা যায় না। আমার সঙ্গে ওর আলাপ অভিনেত্রী সঙ্ঘর সূচনার সময় থেকে। ও মাঝে মাঝেই স্টারে আসত মল্লিক সাহেবের সঙ্গে, ঘোরতর মোহনবাগান সাপোর্টার। মহিলা শিল্পী সংঘ যখন চ্যারিটি শো করত, তখন সবক’টা নাটকেই অনুভা, মঞ্জুরা অভিনয় করত। রবির সঙ্গে ওর বিয়ে হওয়ার পর আমাদের ঘনিষ্ঠতা আরও বেড়ে গেছিল। ওর দু:খজনক মৃত্যুতে খুবই আঘাত পেয়েছিলাম।

পরিচালক সত্যেন বোসের সঙ্গে আমার আলাপ অনেক আগে থেকেই, হাইকোর্টের পাশে সত্যেনদাদের একটা ফিল্ম কোম্পানির অফিস ছিল, সেখানে অনন্তদা, সত্যেনদা, সুধীর মুখার্জী প্রভৃতি বসতেন। আমরা পার্ট চাইবার জন্য সেখানেও ধরনা দিয়েছি; কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য ভালোভাবে আমার নাম হওয়ার আগেই সত্যেনদা সদলবলে বম্বে পাড়ি দিয়েছিলেন। বিমল রায়ের গ্রুপের মতো সেই গ্রুপেও তপন সিংহ, সলিল চৌধুরী, দুলাল গুহ, বীরেন নাগ, হেমেন গুপ্ত, অভি, প্রণতি প্রভৃতি ছিল। অবশ্য বম্বে গিয়েও সত্যেনদা আমাকে ডেকেছিলেন ‘ছেলে কার’ ছবির হিন্দি ভার্সান ‘বন্দীশ’-এর জন্য। হিন্দিতে আমার অভিনয় করার মোটেই ইচ্ছে ছিল না ভাষাটা একেবারেই জানি না বলে। কিন্তু সত্যেনদার কথা ঠেকাতে পারিনি।

সত্যেনদার সঙ্গে কাজ না করলেও রেগুলার যোগাযোগ আছে।

খোকাকে অনেকদিন ধরে চিনি, ফিল্ম লাইনে অনেকগুলো খোকা আছে, আমি দীনেন গুপ্তর কথা বলছি। ও রামদার সহকারী ছিল, এরপরেও যখন ও ক্যামেরাম্যান হল তখনও অনেক ছবি করেছে। এরপর যখন খোকা প্রযোজক, পরিচালক হল তখন ‘বসন্ত বিলাপ’ ছবির একটা চরিত্রের অফার নিয়ে এসেছিল। তখন আমি যাত্রায় খুব ব্যস্ত থাকা সে ছবি করতে পারিনি। কিন্তু ওর পরের ছবি ‘সঙ্গিনী’তে করেছিলাম। এরপর অনেকগুলো ছবি করেছে, তার মধ্যে বেশ কয়েকটায় আমি অভিনয় করেছি। ও যে পরিচালক হিসাবে নাম করবে তা আমি আগেই ‘৮০-তে আসিও না’ করার সময় বুঝেছিলাম। ওর খুব ভালো সিনেমাটিক সেন্স আছে, ‘৮০-তে আসিও না’য় পরিচালক হিসাবে অত্যন্ত ভালো কাজ করেছিল, এটি আমার অন্যতম পছন্দের সিনেমা।

তনুবাবু অর্থাৎ তরুণ মজুমদারের প্রথম ছবিতে অভিনয় করি ‘আঁধারে আলো’তে। তার বহু দিন পর ও যখন প্রকাশ্যে এল অর্থাৎ ‘যাত্রিক’ ‘সব্যসাচী’ তখন স্বাধীন পরিচালক হিসাবে ওর প্রথম ছবি ‘আলোর পিপাসা’য় অভিনয় করি। একজন ভালো পরিচালকের যা যা গুণ দরকার তার সবগুলো তরুণবাবুর মধ্যে বিদ্যমান, ভীষণ ভালো সিনেমা সেন্স। খুব ভালো স্ক্রিপ্ট লেখে।

তপনবাবুর মতো আরেকজন পরিচালকও লাগাতার ভালো হিট ছবি দিয়ে চলেছে। সম্প্রতি ওর সঙ্গে ‘শহর থেকে অনেক দূরে’র রিমেকে কাজ করছি। এই ছবিটা আমার একটু দুশ্চিন্তার কারণ, কেননা অরিজিন্যাল বইতে ফণী রায় দুর্ধর্ষ অ্যাকটিং করেছিল, সেই চরিত্রটাই আমি করছি। তনুবাবু সমানে অভয় দিয়ে যাচ্ছে কিন্তু আমার ভয় যাচ্ছে না।

সন্ধ্যা রায়ের সঙ্গে ‘ডাক বাংলো’ নাটকে অভিনয় করেছি। ওর সঙ্গে আমার খুবই সহজ সম্পর্ক, কোনওরকম অসুবিধা হলেই আমার উপদেশ চাইত, খুবই সরল স্বভাবের মেয়ে। সারাজীবন বিশেষ করে প্রথমদিকে খুবই স্ট্রাগল করে উঠেছে। তারপর তরতর করে উঠেছে ওপরে। চ্যালেঞ্জ নেবার ক্ষমতা আছে। ‘ডাক বাংলো’ নাটকে যখন যোগ দিল, তার আগে কখনও নাটক করেছে বলে জানি না। কিন্তু ছবিদার সঙ্গে সমানে অভিনয় করে গেছে। ওর সিমপ্লিসিটির জন্য সবাই ওকে পছন্দ করে।

গীতা দে ভীষণ শক্তিশালী অভিনেত্রী। ও ভালো গানও জানে। ওর অভিনয়জীবন শুরু শ্রীরঙ্গমে, খুব ছোটবেলায়। তারপরে শিশির ভাদুড়ীর কাছে ওর নাট্যশিক্ষা, ও একই সঙ্গে নাটকে অভিনয়। সুতরাং খুবই শক্ত ওর অভিনয়ের বুনিয়াদ। স্টার থিয়েটারে ও নিয়মিত অভিনয় করেছে। সিনেমাতেও ক্যারেকটর অ্যাকট্রেস হিসাবে দুর্দান্ত অভিনয় করেছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘ডাইনী’। এ ছবিতে ওর-ই মেইন রোল, তাছাড়া অফিস ক্লাব সার্কিটে ও নামকরা অভিনেত্রী। আমার সহ অভিনেত্রী হিসাবে ও অনেক ছবি ও নাটকে সাঙ্ঘাতিক অভিনয় করেছে।

রুমা অর্থাৎ রুমা গুহঠাকুরতা আমার সঙ্গে হিরোইন হিসাবে প্রথম ছবি করেছে ‘পার্সোনাল অ্যাসিসটেন্ট’ ছবিতে। ওর মা সতীদেবী তখনকার দিনের নামকরা গায়িকা ছিলেন। রুমা এক সময়ে উদয়শঙ্করের গ্রুপে নেচেছে, ওর প্রথম ছবি বম্বে টকিজের ‘মশাল’ আর বাংলা ছবি ‘সমর’। এরপর ওর বিয়ে হয়ে যায় কিশোরের সঙ্গে, পরে ও কলকাতায় চলে এসে সলিলের সঙ্গে ইয়ুথ কয়্যারের নাচে অংশগ্রহণ করে। আমার সঙ্গে ‘৮০-তে আসিও না’ তে হিরোইন, ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’তেও কাজ করেছে।

পদ্মাদি অর্থাৎ পদ্মাদেবীর সঙ্গে আমার বহুকালের পরিচয় অর্থাৎ আমার সিনেমায় নামার আগেই। কারণ পদ্মাদি আমাদের চারু অ্যাভিনিউ-এর বহুকালের বাসিন্দা এবং আমার দিদির বিশেষ পরিচিত। পদ্মাদি বাংলা ছবির অনেক আগেই লাহোরে বম্বের হিন্দি ছবিতে অভিনয় করেছেন, ওঁর উল্লেখযোগ্য ছবি বড়ুয়া সাহেবের ‘শাপমুক্তি’। পদ্মাদি ও তাঁর ছেলেমেয়ে আমাদের খুবই ঘনিষ্ঠ।

সমগ্র অভিনয় জগতে সাবিত্রী ছাড়া যে মহিলা শিল্পী আমার সবচেয়ে ফেভারিট সে হলেন প্রভা, অভিনেত্রী তিনকড়ির সান্নিধ্যে একেবারে শিশু বয়স থেকে ইনি অভিনয় করেছেন। বড়বাবুর সঙ্গে ‘আলামগীর’ নাটকে দুর্ধর্ষ অভিনয় করেন তিনি, বড়বাবুর সঙ্গে আমেরিকাতেও নাটক করতে যান ১৯৩১ সালে। এ ছাড়া বড়বাবুর সঙ্গে ‘সীতা’, ‘যোগাযোগ’, প্রভৃতি নাটকে দুর্ধর্ষ অভিনয়ের সাক্ষর রাখেন। আমি ওঁর সঙ্গে ‘তথাপি”, ‘সাত নম্বর কয়েদি’, ইত্যাদি ছবিতে অভিনয় করে ধন্য হয়েছি।

.

নাটক নিয়ে উৎপলদত্তর প্রচুর কাজ আছে। নবনাট্য আন্দোলনের একজন অগ্রণী। আই.পি.টি.-এর নাটক দিয়ে প্রথম মানুষের নজরে আসেন। কিন্তু ওঁর প্রথম নাটক আরম্ভ শেক্সপিয়ারের ইংরাজি নাটক দিয়ে যা তৎকালীন কলকাতার ব্রিটিশ অধিবাসীদের জন্য পরিবেশন করা হত। তিনি আই.পি.টি.-এর গণনাট্য আন্দোলনেরও একজন পুরোধা। নানারকম পথনাটিকা নিয়ে তিনি গ্রামে-গঞ্জে নাটক করে বেড়াতেন। ওঁর সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ ‘৫৪-‘৫৫ সালে। উনি গোর্কির ‘মাদার’ নাটক করেছিলেন। আমি বলেছিলাম বাংলার লোকে গোর্কির ‘মা’ ঠিক বুঝতে পারবে না, তার চেয়ে মাটির কাছাকাছি কিছু অর্থাৎ গিরীশ ঘোষকে নিয়ে ভাবুন না, লিখুন না।

আজও দেখা হলে বলেন, ‘গিরীশ ঘোষকে নিয়ে আপনার কথাটা আমার আজও মনে আছে’। সিনেমাতেও বহুদিন ধরে অভিনয় করেছে। ওর প্রথম ছবি মধু বসুর ‘মাইকেল’। কিন্তু এরপর বহুবছর ও শুধু ‘উকিলের’ ভূমিকায় পার্ট করে গেছে। অবশেষে সত্যিকারের অভিনেতা হিসাবে স্বীকৃতি পেল মৃণালবাবুর ‘ভুবন সোম’-এ। ওর এত গুণ অথচ জীবনের প্রথম দিকে নানারকম টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। এখন অবশ্য ও চুটিয়ে বাংলা, হিন্দি এবং ইংরাজি ছবিতে অভিনয় করছে।

সরযূদি আজকাল নাটকের দর্শকের কাছে ভীষণ জনপ্রিয়। কিন্তু সরযূবালা খুব ছোট বয়সে নাটকে যোগদান করেন গায়িকা হিসাবে। তারপর নির্মলেন্দু লাহিড়ির সঙ্গে ‘চন্দ্রশেখর’, ‘শাজাহান’, প্রভৃতি নাটকে অভিনয় করেন। এরপর শিশির ভাদুড়ীর সঙ্গে ‘বিষ্ণুপ্রিয়া’, ‘সাজাহান’ নাটক করেন। রঙমহলে বহুদিন অভিনয় করেন, আমার সঙ্গে সম্প্রতি ‘জয় মা কালী বোর্ডিং’-এও অভিনয় করেছেন। বড়ুয়াসাহেবের সঙ্গে ‘শাপমুক্তি’, ‘মায়ের প্রাণ’ ছবিতেও অভিনয় করেছেন। উনি নাটকের ডাকসাইটে অভিনেত্রী হিসাবে সর্বজনপরিচিত। আমাকে খুবই স্নেহ করেন, সব ব্যাপারে আমাকে খুবই উৎসাহ দেন।

আমি কোনও বড় কাজে হাত দিলে মন্মথদার কাছে যাই। যাত্রায় যাবার আগে মন্মথদা আমাকে খুবই উৎসাহ দিয়েছিল। আবার যাত্রা ছেড়ে নাটকে যোগদানেও উপদেশ দিয়েছিলেন। আজকালকার নতুন ছেলে-ছোকরারা যারা অভিনয় জগতে এসেছে, তার মধ্যে বুবু আমার বিশেষ পরিচিত। বুবু ভঞ্জ মানে সমিত ভঞ্জ, তপনবাবুর ‘হাটেবাজারে’ ছবিতে শুটিং করতে করতেই ওর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয় বিবেক বক্সী। একদিন বিবেক বলে, ও মেদিনীপুর থেকে এসেছে, স্ট্রাগলিং অ্যাসপায়ারিং অভিনেতা কিন্তু কলকাতা শহরে থাকার মতো ভালো জায়গা খুঁজে পাচ্ছে না। আমিই বললাম, আমার বাড়ির ম্যাজেনাইন ফ্লোরে থাকতে পারে যদি আপত্তি না থাকে, একসময় মৃণাল গুহঠাকুরতা এখানে বাস করত। বুবু সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল। ও একটা সরল স্বভাবের ছেলে। খেটে বড় হওয়ার ইচ্ছে, দেখতে সুন্দর, গানও জানে। সুতরাং স্বভাবতই নাম করতে পেরেছে। আমাকে খুবই শ্রদ্ধা করে।

নতুনদের মধ্যে দীপঙ্কর দে বেশ লেখাপড়া জানা বুদ্ধিদীপ্ত চেহারার ছেলে। খুব ইন্টেলিজেন্ট। আমি চাই এরকম লেখাপড়া জানা ছেলেরা আরও বেশি করে ফিল্ম লাইনে আসুক। বিপ্লব, উজ্জ্বল আমার ‘জয় মা কালী বোর্ডিং’ নাটকের সুবাদে খুবই কাছের। বিপ্লব ভালো অভিনেতা। উজ্জ্বল, বিপ্লব দুই বন্ধু, দুজনেই খুব অ্যাম্বিশাস। বিপ্লব একটু রগচটা কিন্তু উজ্জ্বল খুব মানিয়ে চলতে পারে। উজ্জ্বল ‘জয় মা কালী বোর্ডিং’-এ রোমান্টিক হিরো। ‘জয় মা কালী বোর্ডিং’-এ রঙ্গনায় নাটকও করে আবার যাত্রাও মাঝে মাঝে করে। রঙ্গনায় অভিনয় করতে করতেই উৎপল দত্তের একটা ছবি, তপনবাবুর একটা ছবিতে কাজ করেছে, আমাদের ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’তেও অভিনয় করছে। আমার সঙ্গে বসুশ্রীর আড্ডাতেও ঢুকে গেছে। ওর সব ব্যাপারেই ভীষণ উৎসাহ। আমাকে প্রায় জোর করে, জ্যোৎস্না দত্তের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে বলে, যাত্রার অভিনয় করবে বলে। জ্যোৎস্না বলে, ‘সব রোল তো দেওয়া হয়ে গেছে কেবল একটা রোলই আছে, একটা নাচের দৃশ্য; ওর এত উৎসাহ যে নাচের রোলই সই, নাচবে।

উৎপল প্রসঙ্গে সাম্প্রতিক এক খবরে আসি। পুলু সম্প্রতি লরেন্স অলিভিয়ারের অভিনীত ‘স্লিউথ’ অবলম্বনে একটা দুর্ধর্ষ নাটক লিখেছে, যাতে মাত্র দুটো চরিত্র আছে। অলিভিয়ারের চরিত্রটাতে অভিনয় করার জন্য উৎপলকে অনুরোধ করেছিল, উৎপল রাজি না হওয়ায় আমাকে বলেছে নাটকটাতে অভিনয় করতে। এ একটা দারুণ চরিত্র, যদি শরীর পারমিট করে এ নাটকে অভিনয় করবই।

আগেই বলেছি ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’ ছবিতে আমি হিরো হিসাবে ছবি হিট করার পর, পরপর ‘ভানু পেল লটারি’, ‘পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট’, প্রভৃতি ছবিতে হিরো হিসাবে অভিনয় করেছিলাম, এগুলোও হিট হল। তাতে করে আমার অসুবিধেটা হল প্রাোডিউসার, ডিরেক্টররা কোন পার্টে আমাকে নেবে তাতে করে একটা কনফিউশন তৈরি হল। তার ওপর আমি কত টাকা নেব কমিক রিলিফ হিসাবে সেই টাকা দেওয়া যায় কিনা আমাকে তাই নিয়ে ধন্ধে পড়ে গেলেন। আর আমিও একটু রোল নেবার ব্যাপারে চুজি হয়ে গেলাম অর্থাৎ ইমপর্টেন্ট রোল ছাড়া নিচ্ছিলাম না।

এইসব করে কী হল, আমার রোলের অফার কমতে থাকল।’ ৬০ সাল থেকে আমার সিনেমায় অভিনয়ের সংখ্যা কমতে থাকল। তার ওপর প্রযোজক হয়ে ‘কাঞ্চনমূল্য’ করার পর আমার বেশ খারাপ অবস্থা। আমার ফিয়াট গাড়ি বেচে দিতে হল, অস্টিন বেচতে হল। কিন্তু গাড়ি ছাড়া রাস্তায় বেরোনো যায় না, চারদিকে লোক জমে যায়, ঠাট্টা করে। সুতরাং অনেক কষ্টেসৃষ্টে একটা বিদেশি ‘ফোর্ড টরাস’ গাড়ি কিনলাম।

কিনতেই হল। গাড়িটা ছিল সেকেন্ড হ্যান্ড, যে দালাল আমায় গাড়িটা বেচল সে তো অনেক গুল-তাপ্পি দিল। আমি একে গাড়ি সম্বন্ধে কিছুই জানতাম না, তার ওপর সেসময় বিদেশি গাড়ি খুব কম ছিল। সেই ফোর্ড গাড়ি কেনার ৬-৮ মাস পর থেকেই সাঙ্ঘাতিক ট্রাবল দিতে থাকল, প্রায় রোজ দিনই তাকে ঠেলে স্টার্ট করতে হয়। একে সিনেমায় বেশি কাজ নেই, তার সঙ্গে গোদের ওপর বিষফোঁড়া বিদেশি গাড়ি। আবার ফেলতেও পারছি না, ততদিনে অভ্যেস খারাপ হয়ে গেছে। আমায় প্রত্যেক বৃহস্পতি, শনিবার, রবিবার স্টারে অভিনয় করতে যেতে হত, কিন্তু বেশিরভাগ দিনই গাড়ি বেগড়বাই করাতে ট্যাক্সি করে যেতে হত। সুতরাং খরচ বেড়ে গেল ভীষণভাবে।

এই সময়ে ফিল্ম লাইনের কিছু লোক চাইছিল না যে আমি রোল পাই। আমায় ফিল্ম লাইনের একজন বলল, নির্মলদা নাকি ‘বিয়ের খাতা’ ছবিতে আমাকে নিতে চেয়েছিলেন কিন্তু তার প্রাোডাকসন্স কন্ট্রোলার বলেন, ‘আপনার কি ভানুম্যানিয়া হয়েছে? ভানু ছাড়া আর কেউ নেই নাকি?’ নির্মলদা অনিচ্ছা সত্বেও আমাকে বাদ দিলেন।

তা সত্বেও ‘কানামাছি’, ‘মি. অ্যান্ড মিসেস চৌধুরী’, ‘অভিসারিকা’, ‘দাদাঠাকুর’, ‘বধূ’ প্রভৃতি ছবিতে চান্স পেলাম। ‘৬১ সালে ‘কানামাছি’ আর ‘৬২ সালে ‘দাদাঠাকুর’ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ কৌতুকাভিনেতার পুরস্কার পেলাম। এই ‘বধূ’ ছবিটার প্রেক্ষাপটে একটা কাহিনি আছে। এই ছবির প্রযোজক বিমল ঘোষ এক সময় নির্মলদার কাছে আমার বিরুদ্ধে বলেছিলেন।

যাই হোক, এই রোলটা আমার বেশ পছন্দের। ‘দাদাঠাকুর’-এর রোলটাও আমার খুব পছন্দের, এ ছবিতে আমার রোল ছিল এক অশিক্ষিত ফুলুরি-বেগুনির দোকানদার, যাকে লেখাপড়া শিখিয়ে দাদাঠাকুর জঙ্গিপুরের মিউনিসিপ্যাল ইলেকশন জিতিয়ে দেয় এবং কমিশনার বানিয়ে দেয়। এই ছবির পরিচালক সুধীর মুখোপাধ্যায় ‘পাশের বাড়ি’ ছবির পর আমায় আর কোনো সিনেমায় নেননি, অনেকদিন পরে আবার এই ছবিতে (দাদাঠাকুর) নিলেন। অবশ্য ছবিদার খুব ইচ্ছে ছিল, এই রোলটা আমি করি।

এই সময়টাতে ছোটখাটো রোল যে একেবারেই করিনি তেমনটা নয়, পাঁচু বসাকের ‘বিষকন্যা’, অসিতের ‘স্বয়ংবরা’, তারু মুখার্জীর ‘ছবি’, অরবিন্দ মুখার্জীর ‘বর্ণচোরা’ প্রভৃতি ঘনিষ্ঠ কিছু বন্ধুবান্ধবের ছবি। এক সময় আমি ঠিক করেছিলাম নীহাররঞ্জন গুপ্তের একটা থ্রিলার গল্প নিয়ে ছবি করব, সুচিত্রাকে একটা ডবল রোলের চরিত্র দিয়ে। পয়সার অভাবে করা হয়নি। ভেবেছিলাম ‘কাঞ্চনমূল্য’ তো খারাপ চলছে না তার থেকে কিছু পয়সা এলে সেটা থেকেই ছবিটা করব, কিন্তু তা আর হয়ে উঠল না দুটো কারণে। এক তো আমার স্ত্রীর ঘোরতর আপত্তি, আবার ঘরের পয়সা ইনভেস্ট করে আবার ব্যবসা করা।

দ্বিতীয়ত, ডিস্ট্রিবিউটরের অ্যাকাউন্টিংয়ের জাগলারিতে আমার ঘরে ‘কাঞ্চনমূল্য’র লাভের এক পয়সাও এল না। অনন্তদা কিছুদিন বাদে নীহাররঞ্জন গুপ্তর কাছে গিয়ে একটা গল্প কিনে ছবি শুরু করে দিলেন আমাকে প্রায় না জানিয়েই। এই সময় অনন্তদা বিশেষ সম্পর্ক রাখতেন না আমাদের সঙ্গে। কারণ আমার স্ত্রী নীলিমা একদিন অনন্তদাকে আমার অনুপস্থিতিতে দু-চার কথা শুনিয়েছিল, যে ‘আপনার ৪-৫টা ছবিতে ভানুবাবু কাজ করল, আপনি এক পয়সাও দিলেন না, এ কেমন কথা!’

সেই সময়ে অনন্তদা বললেন, ‘ঠিক আছে, আপনারা তো এই জুবিলী পার্কের বাড়ি ছেড়ে দিচ্ছেন, আমি একটা বাড়ি কিনে দিচ্ছি আপনাদের জন্য।’ কালীঘাট পার্কের পেছনদিকে একটা বাড়িও দেখেছিলেন। কিন্তু সে বাড়ি আর কেনা হয়নি যে-কোনো কারণে হোক। কিন্তু অনন্তদা তারপর থেকে আমাদের বাড়ি আসা বন্ধ করে দিলেন।

এরপর আমার জীবনের আরেকটা সাঙ্ঘাতিক আঘাত এল, ছবিদা মারা গেলেন, সেই সময়ে ‘হাইহিল’ নামে একটা ছবির শুটিং করতে করতেই। ছবিদার মৃত্যুর শোক ভুলতে আমার বেশ অনেকদিন লেগেছিল।

এরপর একদিন উত্তম আমার বাড়িতে এল বুড়ো আর মানু সেনকে নিয়ে ‘কমেডি অফ এররস’-এর বাংলা অনুবাদ, বিদ্যাসাগর রচিত এক ছবির অফার নিয়ে। উত্তম আর আমার সমান ইম্পর্টেন্ট একটা রোল, আমাদের দুজনেরই ডাবল রোল। উত্তম তো আমাকে কনট্রাক্ট সই করাল, ‘গিনি সোনা’ দিয়ে অ্যাডভান্স করল। আমি তো অবাক, এর আগে কস্মিনকলে শুনিনি কেউ অ্যাডভান্স হিসাবে সোনা দিয়ে ছবির কন্ট্রাক্ট করছে! আসলে উত্তমের হৃদয়টা ছিল ভীষণ বড়, ওর একটা ভীষণ ইউনিক ও হাইক্লাস স্টাইল ছিল। এইসব দেখে আমি অভিভূত!

যাই হোক, ছবি তো আরম্ভ হল, আমি ও উত্তম ছাড়াও সাবিত্রী ছিল। বিধায়ক ভট্টাচার্যের স্ক্রিপ্টের বাইরেও রোজ আমাদের তিনজনের উদ্ভাবনী ডায়লগের সংযোজন হচ্ছিল। মানু সেনের তো পাগল হবার যোগাড়, কিন্তু উত্তমের ফুল লিবার্টি দেওয়া ছিল তাই আমরা নিজেদের মতো করছিলাম।

এই সময়টাতে আমিও ঠিক করলাম আর বাছাবাছি নয়, যা রোল পাব তাই করব। তার দুটো কারণ, এক তো আমি তখন চল্লিশ পেরিয়ে বুড়োর দলে, সুতরাং হিরোর বন্ধুর রোল পাওয়া অসম্ভব। আর দ্বিতীয় কারণ, অস্তিত্বের সংকট; সেই বছর আরও ৮-১০টা ছোটখাটো রোল অ্যাকসেপ্ট করতে থাকলাম। অবশ্য অনেক বেশি ফাংশানও করছিলাম আমি। আবার স্টারের চাকরিটাও ছিল, সুতরাং চলে যাচ্ছিল। খরচাও বেড়ে গেছিল, ছেলেমেয়েরা হাইস্কুলে, কলেজে পড়ছিল। সত্যি কথা বলতে এই চার-পাঁচ বছর ভালো কোনও চরিত্রে অভিনয় করিনি। একমাত্র ভালো রোল বলতে তপনবাবুর ‘গল্প হলেও সত্যি’। এই সময় হালই ছেড়ে দিয়েছিলাম, ভেবেছিলাম আর কিছু হবে না, বয়স পঞ্চাশের দিকে এগোচ্ছে, কমিক রোল ছেড়ে কিছু ক্যারেকটার রোল করার চেষ্টা করলাম। সেরকম উল্লেখযোগ্য রেসপন্স পেলাম না।

এমতাবস্থায় ভাবলাম ব্যবসা করলে কেমন হয়! এই সময়ে কংগ্রেসের আভা মাইতি কংগ্রেসের এক ফাংশানে সবার সামনে তখনকার মন্ত্রী জগন্নাথ কোলেকে বললেন, ‘ভানুবাবু আমাদের জন্য এত ফাংশান-চ্যারিটি করে, তার জন্য আমাদের তো কিছু করা উচিৎ। জগন্নাথদা, ভানুবাবুকে একটা মদের লাইসেন্স বার করে দিন।’

জগন্নাথ কোলে বলে, ‘আচ্ছা আমি দেখছি।’

আভা মাইতি বললেন, ‘দেখছি না, দিতেই হবে; আমি আপনার পেছনে পড়ে রইলাম।’

এরপর কিছুদিন বাদে জগন্নাথ কোলে আমাকে রাইটার্সে ডেকে বললেন, ‘দুর্গাপুরে একটা মদের লাইসেন্স আপনাকে দেওয়া যেতে পারে, আপনি কি করবেন?’

এরপর আমার স্ত্রীকে এই কথা বলাতে সে বিদ্রোহ করে ওঠে, ভদ্রলোকের ছেলে মদের ব্যবসা করবে এটা হতেই পারে না। কী আর করি! সাতদিন বাদে জগন্নাথ কোলেকে গিয়ে বলি আমার স্ত্রীর ঘোরতর আপত্তির কথা। তখন উনি বলেন, ‘যদি মেথিলেটেড স্পিরিটের লাইসেন্স চান সেটার লাইসেন্স দিতে পারি।’ আমি দিন সাতেক টাইম চাইলাম।

ইতিমধ্যে দেখি বাড়িতে রথীন ঘোষ নামে এক ভদ্রলোক উপস্থিত। অলরেডি বাজারে চাউড় হয়ে গেছে যে আমি স্পিরিটের লাইসেন্স পাচ্ছি। ওই ভদ্রলোক বহুদিন ধরে স্পিরিটের ব্যবসা করেন, আমাকে অফার দিলেন পার্টনারশিপের, তার বদলে পুরো ব্যবসাটা চালাবার ব্যবস্থা করবেন। নাকতলায় গোডাউন ভাড়া করে স্পিরিটের ব্যবসা আরম্ভ হল।

এই সময়টাতেই আমার মেয়ে বাসবী তপনবাবুর ‘অতিথি’ ছবিতে অভিনয় করার অফার পেল। আমি ডিসিশন নেবার ভার স্ত্রীর ওপর ছেড়ে দিলাম। একে রবীন্দ্রনাথের লেখা গল্প তার ওপর তপনবাবুর মতো অত বড় পরিচালকের ছবি, আমার স্ত্রী রাজি হয়ে গেল। বাসবী তখন এইটে পড়ত। এই সময় সবচেয়ে অবাক হওয়ার ব্যাপার হল আমার স্ত্রী চিরকালই একটু পর্দানশীন টাইপ। কিন্তু মেয়ের সঙ্গে মাঝে মাঝে শুটিংয়ে যেতে লাগল। এর আগেও স্টুডিয়োতে যেত যদি নিউ থিয়েটার্স বা টেকনিশিয়ানে ওর গানের রেকর্ডিং থাকত। অবশ্য নিউ থিয়েটার্স কিছু অজানা নয়, মি: মেহতা বা প্রাোডিউসার দিলীপ সরকার ওরা জানাশোনাই ছিল। আমার ছেলেরা এই সময় স্টুডিয়োয় যেত না, কারণ ওরা তখন ফাইনাল দিচ্ছিল। আমিই ওদের বারণ করেছিলাম তাই।

‘অতিথি’ ছবি রিলিজের পর উচ্চপ্রশংসিত হল, ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পেল। আমার ছবিদার রসিকতার কথা মনে পড়ে গেল।

যা বলছিলাম, এই সময়টা শুধু যে আমার খারাপ অবস্থা ছিল তা নয়, বাংলা সিনেমারই হাল এই সময়টায় খুব খারাপ হয়ে গেছিল। হিন্দি সিনেমার দাপটে বাংলা সিনেমার হাল অনেকদিন থেকেই খারাপ হচ্ছিল। আমি বিশ্লেষণ করে দেখেছি, সাধারণ বাঙালি দর্শক ‘৩০-‘৪০ দশকে হিন্দি সিনেমা মোটেই দেখত না। ‘৫০-এর দশকে কিছু কিছু হিন্দি সিনেমা বাঙালিরা দেখতে আরম্ভ করল। এটা আমার বিশ্লেষণ যে, ‘৫০-এর দশকেও কলকাতার আদি বাসিন্দারা অর্থাৎ শ্যামবাজার, বাগবাজার, ভবানীপুরের ছেলে-ছোকরারা ছবি-ছায়া, উত্তম-সুচিত্রার বাংলা সিনেমাই দেখত। কিন্তু বালিগঞ্জ, টালিগঞ্জ বিশেষ করে কলোনির ছেলেরা হিন্দি সিনেমা দেখতে আরম্ভ করল। ‘৫০-এর দশকের থেকে এই ট্রেন্ডটা বাড়তে বাড়তে ‘৬০-এর দশকের শেষদিকে এটা খুব বেশি বেড়ে গেল। ‘৭০-এর দশকের প্রথম থেকেই শ্যামবাজার, বাগবাজারের ছেলেরাও ভীষণভাবে হিন্দি ছবি দেখতে আরম্ভ করল।

এর ফলে বাংলা ছবির বাজারের ওপর খুবই বিরূপ ফল হল। এর আগে থেকেই আমাদের বাংলা ছবির বাজার সংকুচিত হতে থাকছিল। একে তো দেশ বিভাগের ফলে আমাদের বৃহত্তর পূর্ব বাংলার বাজার আগেই খুইয়েছিল, তার ওপর ‘৬০-এর দশক থেকে বিহার, আসামের বাজারও ভীষণভাবে কমে যাচ্ছিল। সুধী প্রধানের কাছে শুনেছি ‘৫৫-‘৫৬ সালে যেখানে ৫০-৫২টা বাংলা ছবি রিলিজ হচ্ছিল, সেখানে ‘৬৮-‘৬৯ সালে সংখ্যাটা ২০-২২-এ নেমে গেছিল। অথচ এই সুধীদার কাছেই শোনা ‘৪০-এর দশকে বাংলা ছবির সংখ্যা হিন্দি ছবির চেয়ে অনেক বেশি ছিল।

যাই হোক, ঈশ্বরের আশীর্বাদে ১৯৬৭ নাগাদ সময়টাতে আমার অবস্থা পূর্ববর্তী ৪-৫ বছরের তুলনায় উন্নত হল। যেটা কখনও ভাবতে পারিনি। তখন আমার বয়স প্রায় পঞ্চাশ অর্থাৎ বুড়োর দলে। তবুও এই সময়টাতে ‘৮০-তে আসিও না’ ছবিটা বেশ প্রশংসিত হয়েছিল।

এক সময়ে দাদামণি ‘হাটে বাজারে’ ছবির শুটিংয়ের সময় বেশ আগ্রহ দেখিয়েছিল যদি এই ছবিটি হিন্দিতে করা যায়। ওই ছবিগুলো ছাড়াও ‘হাটে বাজারে’ ‘চৌরঙ্গী’ ‘বাঘিনী’ ছবিগুলোতে ভালো চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছিলাম। হীরেন নাগের পরিচালনায় দেবেশের ‘শবরমতী’র শুটিং করতে আমেদাবাদে যেতে হয়েছিল। এ ছবির লেখক আমার সম্পর্কে মামাতো ভাই, আশুতোষ মুখার্জি। সুশীলদার ‘শুকসারী’ ছবিটাও এই সময়েই শুটিং করেছি।

এর পরেই এল ১৯৬৯ সাল। বাংলা সিনেমার ঘোরতর দুর্দিন। এই সময়ে পশ্চিমবঙ্গের সিনেমা হলের শ্রমিকরা বহুদিন ধরে টানা ধর্মঘট করে। আমরা অভিনেত্রী সঙ্ঘের তরফে তাদের সমর্থন করি। কিন্তু এই সমর্থন করা নিয়ে মনোমালিন্য হয়। সোজা কথায়, আমরা যারা একটু সোশালিস্টপন্থী, যেমন পুলু, আমি, অনুপ, অজিত লাহিড়ী, সলিল সেন প্রভৃতি একদিকে। আরেকদিকে উত্তম, অনিল, বিকাশদা, এবং উত্তমকে সমর্থন করে চলচ্চিত্র জগতের প্রায় বেশিরভাগ লোক।

আসলে ব্যাপারটা হয়েছিল কী বেশ কিছু সিনেমা হলের মালিক প্রযোজক ছিল এর মূলে। এদিকে সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতেও অসন্তোষ দেখা দিচ্ছিল। ফোর্থ ক্লাস টেকনিশিয়ানরা ওয়েজ বাড়াতে চাইছিল কিন্তু প্রযোজক, পরিবেশকরা বাংলা সিনেমার দুর্দিন বলে এড়িয়ে যেতে চাইছিল। প্রযোজকরা বুঝলেন উত্তমকে হাত করলে এই আন্দোলন ভাঙা কঠিন হবে না। এ সময়টা বেশ কিছু প্রযোজক বন্ধু সবসময় উত্তমের পাশাপাশি থাকত এবং শলাপরামর্শ দেবার চেষ্টা করত। প্রযোজক, পরিবেশক ও হল মালিকরা মিলে চলচ্চিত্র সংরক্ষণ সমিতি বানালেন। বললেন, চলচ্চিত্রের উন্নতির জন্যই এই অর্গানাইজেশন। কিন্তু আমাদের মনে হয়নি ফোর্থ ক্লাস টেকনিশিয়ান বা অন্য স্টাফদের বিশেষ কিছু উন্নতি হবে এর দ্বারা। তাই এটাকে সাপোর্ট করিনি।

এদিকে বুঝতে পারছিলাম অভিনেত্রী সঙ্ঘর মধ্যে একদল চাইছিল সংরক্ষণ সমিতিতে যোগ দিতে, তাই ভোটে যেতে হল। উত্তমের বিরুদ্ধে দাঁড়াল সৌমিত্র। সৌমিত্র ভোটে জিতে গেল, এতে উত্তমের চেয়েও উত্তমপন্থীরা ভীষণ অপমানিত বোধ করল। তার ফল হল অভিনেত্রী সঙ্ঘের মতো বিকাশদা, উত্তম ও অনিলকে নিয়ে বেরিয়ে শিল্পী সংসদ প্রতিষ্ঠা করল।

এই ব্যাপারটা আমাকে ভয়ানক পীড়া দিয়েছিল এই ভেবে যে, আমাদের এতদিনের অভিনেত্রী সঙ্ঘটা ভাগ হয়ে গেল। তা ছাড়াও ফিল্ম লাইনের এই অনর্থক ঝগড়াঝাঁটি আমার ভালো লাগছিল না।

সংরক্ষণ সমিতি নিয়ম করল সেন্সরের ডেট অনুযায়ী ছবি রিলিজ করবে, অর্থাৎ যে সিনেমার সেন্সর আগে হবে, সে-ছবি আগে রিলিজ করবে। এর মধ্যে নেপাল দত্ত, অসীম দত্তরা সত্যজিৎ রায়ের ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ রিলিজ করার ব্যবস্থা করল মিনার, বিজলী, ছবিঘর চেইনে। এদিকে সলিল সেন পরিচালিত উত্তম অভিনীত ‘মন নিয়ে’, অরোরার ‘আরোগ্য নিকেতন’, অসিত চৌধুরীর প্রাোডাকসন্সে-এর ‘কমললতা’ এবং সলিল দত্তের ‘অপরিচিত’ ছবিগুলো আগেই ওই চেইনে রিলিজের ব্যবস্থা করেছিল, সংরক্ষণের নিয়ম অনুযায়ী আগেই সেন্সর করিয়েছিল। যাই হোক, এসব ছবিকে টপকে ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ আগে রিলিজ হল মিনার, বিজলী চেইনে।

এতে সংরক্ষণ সমিতি বেজায় খেপে গেল; আমরা খবর পেলাম উত্তমের নেতৃত্বে সংরক্ষণ সমিতি এই ছবির রিলিজ আটকাবে। আমরা ঠিক করলাম ‘গুপী গাইন..’-এর রিলিজ সাপোর্ট করব। সেই অনুযায়ী আমি, সৌমিত্র, অনুপ, রবি, অনিল চৌধুরী, বংশী, অজিত লাহিড়ী, সৌমিন্দু—আমরা সব গার্ড দিতে লাগলাম। সত্যজিৎবাবুও ছিলেন, কিন্তু বিজলীর গেটের সামনে নয়, বিজলীর তিনতলায় বেশির ভাগ সময়ই বসে থাকতেন। উনি সেই সময় ভীষণ নার্ভাস ছিলেন। একে তো এটাই তাঁর প্রথম কমার্শিয়াল ছবি, পাবলিক কেমনভাবে নেমে সেই টেনশন, তার ওপর আবার সংরক্ষণ সমিতির ঝামেলা।

আমারও এইসময় মনের মধ্যে প্রচণ্ড দ্বন্দ্ব চলছিল। একদিকে কনিষ্ঠ ভ্রাতৃসম উত্তমের সঙ্গে এই মনোমালিন্য, অন্যদিকে আমার আত্মীয়স্বজন-বন্ধুরা অনবরত বলে যাচ্ছিল, ‘তোমার ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াবার কী দরকার! সত্যজিৎ তো তোমাকে জীবনে কোনও ছবিতে নেয়ওনি।’

তারা জানে না আমার কাছে আমার আদর্শই প্রথম। এটা ছিল মে মাসের প্রথম দিক, আমার মনে আছে, কারণ এর দিন দুয়েক পরেই আমার প্রথম হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল।

যাই হোক, শুক্র, শনি, রবি আমরা সকাল থেকেই বিজলী সিনেমার সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম রাত ৮টা পর্যন্ত। একে তো উত্তম, বিকাশদা প্রভৃতির সঙ্গে মনোমালিন্যের কারণে প্রচণ্ড মানসিক অশান্তি, তার ওপর গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো কিছু অবাঞ্ছিত ছেলেপিলে যারা উপর-পড়া হয়ে সমানে বলে যাচ্ছে, ভানুদা কিছু ভাববেন না, আমরা সব রেডি হয়ে হাজরা পার্কে আছি, কিছু হলেই চলে আসব।

এই ব্যাপারটাই সবচেয়ে বেশি পীড়া দিত। আমরা তো কোনো যুদ্ধে অবতীর্ণ হইনি, আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে দু-দলে মতপার্থক্য হয়েছে, সেটা আজ নাহয় কাল মিটে যাবে। আমি জানি উত্তম রেগে গেলে কীভাবে ওর রাগ মেটাতে হয়, আবার উত্তমও জানে আমার রাগ হলে কীভাবে আমাকে শান্ত করতে হয়। আবার খবর পাচ্ছিলাম ওদিকেও লোকজন ঝামেলা পাকাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। ঝামেলাকে আমি কোনোদিন ভয় পাই না, কিন্তু বাইরের লোকজন এরকম একটা সামান্য ব্যাপারকে এমন জায়গায় নিয়ে গেল যেটা আমার বা উত্তমের কন্ট্রোলের বাইরে চলে যাচ্ছিল—সেটাই আমাকে ভাবাচ্ছিল।

চারদিকে নানারকম উস্কানিমূলক কাজকর্ম চলছিল। একদিন হঠাৎ কিছু টেকনিশিয়ান এবং সহকর্মী অভিনেতা, অভিনেত্রী আমাকে টেকনিশিয়ান স্টুডিয়োতে ঘিরে ধরে হম্বিতম্বি—আমি নাকি তাদের নামে গালাগালি দিয়েছি। আমি তো হতভম্ব, যে টেকনিশিয়ানদের জন্য আন্দোলন করছি তাদের গালাগালি দেব? তারাই নাকি আমাকে মারতে চায়!

যাই হোক, ব্যাপারটা বেশিদূর আর এগোয়নি। আমি টেকনিশিয়ান স্টুডিয়ো থেকে নিউ থিয়েটার্স স্টুডিয়োতে যাচ্ছি, হঠাৎ গেটের সামনে কিছু স্থানীয় ছেলে আমার গাড়ি থামিয়ে বলে, ‘ভানুদা, শুনলাম আপনাকে ওরা মারতে এসেছিল, আপনি এক্ষুনি বলুন ওরা কারা ছিল? এক্ষুনি সবক’টার লাশ ফেলে দিচ্ছি।’

আমি তো দেখি মহা বিপদ, আমাদের ফিল্ম লাইনের সামান্য ঝগড়া যদি রাজনীতির হানাহানিতে পর্যবসিত হয় তাহলে তো মহা মুশকিল; যেসব ছেলেরা এসেছিল তারা সব সাঙ্ঘাতিক মার্কামারা লোকাল ছেলে। তাদের সামলাতে আবার একপ্রস্থ ঝামেলা!

এদিকে নিন্দুকেরা রটাচ্ছে আমি নাকি ডেঞ্জারাস ছেলেপিলেদের নিয়ে স্টুডিয়ো চত্বরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। পুরো ব্যাপারটাই আমাকে ভীষণ বিচলিত করেছিল। উত্তম আমার এত ঘনিষ্ঠ, ফিল্ম লাইনের আর সবাই আমার ঘরের লোকের মতো, তাদের সঙ্গে এই তিক্ততা আর ভালো লাগছিল না। নানারকমের কেচ্ছা, খেউড় চলছিল। দুপক্ষের কিছু দুষ্ট লোকের প্ররোচনায় আমাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি বেড়েই চলেছিল।

ইতিমধ্যে আমি খবর পেলাম সংরক্ষণ সমিতি ঠিক করেছে ভানু, সৌমিত্র, অনুপ প্রভৃতিকে বয়কট করা হল অর্থাৎ এদের কোনও ছবিতে নেওয়া যাবে না। আমি তো অবাক হয়ে গেলাম, একেবারে পেটে হাত! একে আমার পঞ্চাশ বছর বয়স, কেউ আমায় এমনিতে নেবে কিনা জানি না, তার ওপর ব্ল্যাকলিস্টেড হয়ে গেলাম! এ তো অস্তিত্বের সংকট।

আমি স্থির নিশ্চিত যে উত্তম এটা সমর্থন করতে পারে না। উত্তম তখন অভিনেত্রী সঙ্ঘের সভাপতি। তার দলের তিনজনকে ব্ল্যাকলিস্টেড করা হচ্ছে অথচ উত্তম কোনো প্রতিবাদ করল না!

উত্তম চাইলে এ জিনিস হতেই পারত না,—এই ব্যাপারটা আমাকে প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়েছিল যে মনোমালিন্য এমন জায়গায় পৌঁছেছে? ঘটনার দু-চারদিনের পরেই আমার হার্ট অ্যাটাক হল। প্রায় দু-মাস বাড়িতে রেস্ট নিলাম, যদিও বাড়িতে বসে বসেই খবর পাচ্ছিলাম সিনেমা লাইনের।

এ সময়েই ঠিক করে ফেললাম এই যদি অবস্থা হয় তাহলে সিনেমা লাইনে থাকবই না। কিন্তু বিকল্প কী? আমি আগেই দেখেছি, ইদানীং যাত্রায় মাঝে মাঝে ডাক আসত। গ্রাম-বাংলায় এখনও প্রচুর লোক আমার শো দেখতে আসে, সুতরাং যাত্রায় জয়েন করা যাক।

কিন্তু বললেই তো হয় না, প্রস্তুতি লাগে, পয়সা লাগে। তখন আমার পয়সাও নেই। ঠিক করলাম আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের থেকে তিন হাজার, চার হাজার করে ধার নেব। সেইমতো টাকা জোগাড় করতে থাকলাম। আমার শালা হারু তার বাইক বেচে টাকা দিল, আমার ভাগনে ভিটু জুটমিলে বড় কাজ করত, সে টাকা দিল। এইভাবে বেশ কিছু টাকা যোগাড় করলাম। রমনলাল ফুমরা বন্ধকি কারবার করে, ফিল্ম লাইনের অনেক হোমরাচোমরা ব্যক্তি তার থেকে টাকা নেয়; আমিও আমার অ্যামবাসাডার গাড়ি বন্ধক দিয়ে তার থেকে টাকা নিলাম।

ইতিমধ্যে কয়েকজন সরকারি চাকুরে লোক রেগুলার শখের যাত্রা করে, তারা একদিন আমার কাছে প্রস্তাব নিয়ে এল যে তাদের যাত্রার সংস্থা আছে, সেটা আমি কিনে নিই এবং তাদের নিয়ে রেগুলার যাত্রাপার্টি করি। আমি রাজি হয়ে গেলাম, ‘সুশীল নাট্য কোম্পানি’ নামে একটা যাত্রাপার্টি কিনে চিৎপুরে একটা গদি ভাড়া করলাম। কিন্তু আমি দেখলাম তখন নট্ট কোম্পানি, ভারতী অপেরা এদের সঙ্গে পাল্লা দিতে গেলে নতুন কিছু করতে হবে। এরা সব লাখ লাখ টাকা খরচ করে যাত্রার বড় বড় আর্টিস্ট নিয়ে কোম্পানি চালায়। আমি ঠিক করলাম থিয়েটারের ধাঁচে যাত্রা পালা করা এবং হাসির যাত্রাপালা করার কারণ সেটাই আমার ট্রেড মার্ক। তদুপরি এর আগে কেউ হাসির গল্প নিয়ে যাত্রা করেনি।

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে গ্রাম-বাংলার যাত্রার দর্শকরা দু-তিন রকমের পালা দেখতে চায়—সামাজিক নয়তো ঐতিহাসিক নয়তো ভক্তিমূলক। আমি ঠিক করলাম ‘সরলা’ নাটকটা করব, যেটায় একসময় গিরীশ ঘোষের পুত্র দানীবাবু গদাধরের চরিত্র করেছিলেন। তাঁর বিখ্যাত ডায়লগ, ‘আমি ডুডুও খাই টামুকও খাই।’ এটা আমার খুব পছন্দসই ছিল। সুতরাং ‘সরলা’ এবং একটি ভয়াল ভয়ংকর গল্প ‘রক্তে রাঙা হাঁসুলী ডাঙা’ (‘হাউস অফ ওয়াক্স’-এর গ্রামবাংলা সংস্করণ) নিয়ে নামলাম।

কিন্তু যাত্রাপার্টি নামাতে আরও কিছু টাকা দরকার। কী করা যায়? ইউকো ব্যাঙ্কের ব্রেবোর্ন রোড মেইন ব্রাঞ্চের নরেন ভট্টাচার্য মহাশয়ের সাহায্য নিলাম, উনি ওভারড্রাফটের ব্যবস্থা করে দিলেন। ‘মাভৈ:’ বলে যাত্রা শুরু করে দিলাম ১৯৬৯ সালে। এবছর আমার ফিল্মের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছিল, ‘সাগিনা মাহাতো’ ছাড়া তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য ছবিতে অভিনয় করিনি।

কিন্তু যাত্রায় প্রথম বছরে যা ব্যবসা করলাম তা মোটের ওপর খারাপ না। প্রথম বছরেই মোটামুটি আত্মীয়স্বজনদের থেকে যে ধারগুলো নিয়েছিলাম সেগুলো মিটিয়ে দিলাম। এই বছরের ব্যবসায় উৎসাহিত হয়ে পরবর্তী বছরগুলোতে পুরোপুরি হাসির নাটক নিয়ে যাত্রা আরম্ভ করলাম। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘জোর বরাত’, ‘চাটুজ্যে বাড়ুজ্যে’, ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’ প্রভৃতি যাত্রাপালাগুলো। এরপরে একটা স্যাটায়ারধর্মী নাটক করেছিলাম আমাদের বন্ধু রমাপতি বসুর ‘শ্রীযুক্ত আলিবাবা’ নাটক অবলম্বনে।

এই সময়ে আমার যাত্রার ফাঁকে ফাঁকে সিনেমাও চলছিল। আমি যে ভেবেছিলাম ব্ল্যাকলিস্টেড হওয়াতে আমার সিনেমার কেরিয়ারের বারোটা বেজে গেল, বাস্তবে সেরকম কিছু কিন্তু হল না। আন্দোলনের প্রথম বছর একটু-আধটু আঁচ পড়েছিল, কিন্তু পরবর্তী সময়ে তার বিন্দুমাত্র রেশ আর থাকল না। তার প্রথম প্রমাণ ‘সাগিনা মাহাতো’। তপনবাবু ও অরুন্ধতী সংরক্ষণ সমিতির দিকেই ছিলেন, বিশেষভাবে অরুন্ধতী। কিন্তু তপনবাবু এই ছবিতে বেশ একটা ভালো চরিত্রে কাজ দিলেন।

এই ছবিতে কাজ করতে করতে ইউসুফ অর্থাৎ দিলীপকুমারের সঙ্গে বেশ ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছিল, মাঝেমাঝেই স্টুডিয়োতে আমি, ইউসুফ, তপনবাবু, বলাই, প্রভৃতি আড্ডা মারতাম। ইউসুফের ব্যাডমিন্টন খেলার শখ ছিল, স্টুডিয়ো নেট পেতে সৌমিত্রর বউ দীপা, দীপু ঘোষ প্রভৃতি ইউসুফের সঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেলত। দর্শক হিসাবে আমাকে থাকতে হত।

সংরক্ষণ সমিতির ঘোষিত ব্ল্যাকলিস্টিং প্রথমেই ভেঙেছিল সলিল দত্তের ছবি ‘কলঙ্কিত নায়ক’-এ। সলিল উত্তমের খুবই ঘনিষ্ঠ, তাই এতে আমাদের দলের অনুপকে নিতে কোনও অসুবিধে হয়নি। সেই সময় উত্তমের ঘনিষ্ঠতম যে-ক’জন ছিল তার মধ্যে দেবেশ ঘোষ অন্যতম, তাই দেবেশও আমায় ওর ‘রাজকুমারী’ ছবিতে নিয়েছিল। অবশ্য এ ছবির পরিচালক সলিল সেন খুব জোরাজুরি করেছিল। সলিল আমার বহুকালের বন্ধু, অনুশীলন পার্টি করত, সিনেমা লাইনের যাবতীয় আন্দোলনে ও যোগদান করত। কেবল একবারই ও অ্যালুফ ছিল, সেটা হল ‘গুপী গায়েন…’ রিলিজের সময়। কারণ ও নিজে ভুক্তভোগী। ওর পরিচালিত ‘মন নিয়ে’ ছবির রিলিজ আটকে গেছিল।

যাই হোক, আমার যাত্রা আর সিনেমা চলতে লাগল একসঙ্গে অর্থাৎ মহালয়ার থেকে পয়লা বৈশাখ পর্যন্ত যাত্রা, এই সময়টায় কোনও শুটিং-এর ডেট দিতে পারতাম না। বছরের বাকি সময়টা অ্যাডজাস্ট করে শুটিং-এর ডেট দিতাম।

আমার যাত্রার অভিনয়কালে নানান অভিজ্ঞতা আছে। যেমন কুড়ি হাজার লোকের সামনে যাত্রা করে প্রচণ্ড হাততালি পেয়েছি, তেমনি ডাকাতের হাতেও পড়েছি। একবার কুচবিহারে ‘বৈকুণ্ঠের উইল’ পালাটা করে আমার গাড়ি করে ফিরছি, আর আমার দল বাসে করে যাচ্ছে মুর্শিদাবাদ। আমার সঙ্গে ছিল আমার ড্রাইভার লাহিড়ী আর আমার বন্ধু ল্যান্সডাইন রোডের বিজু। আমার আগে আগে আমাদের বাসটা যাচ্ছিল, ফরাক্কা ব্রিজ পেরোতেই দেখি গাছ থেকে পাঁচ-ছয়জন লোক ধুপধাপ বাসের ওপর পড়ছে। সঙ্গে সঙ্গে বাসটাও থেমে গেল। বাসে ২৫-৩০ জন ছিল, আমিও গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। আমার হাতে সবসময় একটা যাত্রার সোর্ড থাকত, বাসেও কতকগুলো সোর্ড আর চকোলেট বোম থাকত। আমি ওদের বললাম ওগুলো নিয়ে নেমে ওদের তাড়া কর। আমরা ১৫-২০ জন সোর্ড, বল্লম হাতে চকোলেট বোম নিয়ে ওদের তাড়া করলাম। ওরা প্রথমে হতভম্ব, ডাকাতরা চিরকাল ভয় দেখিয়ে এসেছে, ওদের যে কোনওদিন ভয় পেতে হবে এটা ওরা ভাবতে পারেনি। যাই হোক, ডাকাতরা দেখলাম অলিম্পিক রানারের স্পিডে দৌড়ে ভাগতেও পারে!

পরে আমরা থানায় গেলাম ডাকাতির রিপোর্ট করতে। ওখানে গিয়ে দেখি ওরা আগেই যাত্রার স্বপন কুমারের গাড়ি থামিয়ে ডাকাতি করেছে, ওরাও তার রিপোর্ট লেখাতে এসেছে।

১৯৭৬ সাল নাগাদ আমি ‘ভৈরবমন্ত্র’ আর ‘চাটুজ্যে বাড়ুজ্যে’ যাত্রাপালা করি, দুটোই লিখেছিল গৌরাঙ্গ। গৌরাঙ্গ বসু সবিতা চ্যাটার্জীর স্বামী, কাবেরী বসুর দাদা। গৌরাঙ্গ বহুদিন আগে থেকেই ফিল্ম লাইনের সঙ্গে জড়িত। আমার অভিনীত ‘চাটুজ্যে বাড়ুজ্যে’-র স্ক্রিপ্ট রাইটার আর প্রযোজক ছিল ও আর শিশির মিত্র।

এই সময়ে আরেকটা কাণ্ডও ঘটেছিল, গৌরাঙ্গ আমায় প্রস্তাব দিল, যদি ‘হর্ষবর্ধন গোবর্ধন’ যাত্রা করা যায়! শিব্রাম চক্রবর্তীর ‘হর্ষবর্ধন গোবর্ধন’ সারা বাংলায় খুবই জনপ্রিয়, গৌরাঙ্গ শিব্রামের খুবই ঘনিষ্ঠ। গৌরাঙ্গকে নিয়ে একদিন রওনা হলাম মুক্তারামবাবু স্ট্রিটের উদ্দেশ্যে। আমি শুনেছিলাম শিব্রামবাবু মিষ্টি খুব ভালোবাসেন। বেশ কয়েকটা জলভরা তালশাঁস-সন্দেশ নিয়ে নিলাম। মুক্তারামবাবু স্ট্রিটের বাড়িতে পৌঁছে দেখলাম একটা তক্তাপোষের ওপরে বসে আছেন, আমাকে দেখেই তড়াক করে এক লাফ দিয়ে এসে আমায় জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘কতদিন ভেবেছি কোনোদিন যদি দেখা হয় খুব ভালো হয়, ফার্স্ট ক্লাস।’

আমিও অভিভূত প্রায়। ঘণ্টাখানেক নানারকম কথা হল। এরপরে গৌরাঙ্গ আমাদের ভাবনার বিষয় তাঁকে জানাল। তিনি তো শুনে লাফিয়ে ওঠেন, বলেন, ‘শুধু যাত্রা কেন, সব কিছুই করো; কিন্তু আমার খুব ইচ্ছা তুমি যদি এটা বায়োস্কোপ করো।’

আমি ভাবলাম আইডিয়াটা খারাপ নয়। সিনেমা, যাত্রা যতরকম মাধ্যম আছে সবকিছুই এক্সপ্লয়েট করা যায়। যাই হোক, আমি বললাম, গৌরাঙ্গর সঙ্গে পরামর্শ করে কয়েকদিনের মধ্যেই কন্ট্রাক্ট পাঠাচ্ছি।’

ইতিমধ্যে একজন লোক, যে ওর দেখাশুনা করত সে এসে ভাত দিয়ে গেল। উনি বললেন, ‘তুমি বসো, আমি একটু খেয়ে নি, এখন না খেলে আমায় খেতে দেওয়ার লোক নেই।’

খাওয়া শেষ হওয়ার আগেই সন্দেশের বাক্সটা এগিয়ে দিয়ে বললাম, ‘ভাত খাওয়া শেষ হলে এটা খাবেন।’

উনি সঙ্গে সঙ্গেই বাক্সটা খুলে বলেন, ‘এখনই খাব।’ একটা শেষ করে বলেন, ‘আবার খাব।’—এরকম গোটা চারেক খেয়ে, ভাত খেয়ে নিলেন, আবার বসে খানিকক্ষণ গল্প করার পর উঠবার মুখে আমি ওঁর হাতে এক হাজার টাকা গুঁজে দিলাম।

উনি বলেন, ‘এটা কী?’

আমি বললাম, ‘অ্যাডভান্স।’

উনি জড়িয়ে ধরে বললেন—’আবার এসো কিন্তু।’

এরপর আমি একদিন কন্ট্রাক্ট-এ সই করে সিনেমা, থিয়েটার, যাত্রা, রেডিয়ো নাটক, সবকিছুর কপিরাইট নিলাম ‘হর্ষবর্ধন গোবর্ধন’-এর।

যাত্রা সম্বন্ধে আমার একটা স্যাটিসফ্যাকশন হচ্ছে আমার নিজের কোম্পানি বলে আমি আমার মনের মতো রোল নিতে পারি; যেমন আমার একটা পছন্দের রোল শরৎচন্দ্রের ‘বৈকুণ্ঠের উইল’-এ গোকুলের চরিত্রটা। সিরিয়াস চরিত্র কিন্তু বাংলার মানুষ আমাকে প্রবলভাবে এই সিরিয়াস চরিত্রেও অ্যাকসেপ্ট করেছিল। আমার ভয় ছিল, আমার সিরিয়াস অ্যাকটিং লোকে পছন্দ করবে না।

আমার ‘নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতিতে’ দেখে বিখ্যাত পরিচালক কার্তিক চ্যাটার্জী বলেছিলেন, ‘ভানু, আমি জানি তুমি সিরিয়াস রোল ভালোই করো, কিন্তু আমি চাই না তুমিও সিরিয়াস রোল করো। কারণ তুমিও সিরিয়াস রোল করলে আমরা হাসব কাকে নিয়ে! সবাই তো সিরিয়াস রোল করে, বাংলার লোক কেবলই কাঁদতেই চায়; হাসিটা তো প্রায় মুছেই গেছে।’

আবার আমরা যদি একটু স্যাটায়ারধর্মী হাসির কথা বলি সেটাও আবার কেউ নেয় না। আমি একটা কমিক স্কেচে বলেছিলাম, ‘মহাত্মা গান্ধির জন্মদিনে আমরা একদিন যদি মদ খাওয়া বন্ধ করে দিই তাহলে দেশ থেকে মদ খাওয়া উঠে যাবে?’

এই স্কেচ শুনে উত্তর কলকাতার এক ডাকসাইটে কংগ্রেস নেতা, যে নকশালদের হাতে মারা গেছে, তার ছেলে, যে কংগ্রেসে তৃতীয় শ্রেণির নেতাও নয়, সে হঠাৎ ফোন করে আমায় হম্বিতম্বি করল। অথচ প্রিয়, সুব্রতর মতো প্রথম শ্রেণির নেতা যাদের সঙ্গে আমার ঘনঘন দেখা হয়, তারা কিন্তু কোনওদিন কিছু বলেনি।

আবার ‘শ্রীযুক্ত আলিবাবা’ নাটকে সিধু নামে এক চরিত্র আছে, সেটা স্যাটায়ারধর্মী। সেই যাত্রা দেখে উত্তর কলকাতার এক কংগ্রেস নেতা আমায় বলে এটা আমার করা উচিৎ হয়নি, এটা নাকি মানুদাকে প্যারোডি করা হয়েছে। বুঝুন ঠ্যালা! অথচ সিদ্ধার্থ রায়ের সঙ্গে আমার অনেক জায়গায় দেখা হয়েছে, সে কিন্তু কোনওদিন কিছু বলেনি।

যাই হোক, এই ‘বৈকুণ্ঠের উইল’ যাত্রাটি ১৯৭৫ সালে ‘পশ্চিমবঙ্গ যাত্রা সম্মেলনে’ রবীন্দ্র কাননে প্রথম শো হয়। সেবার সব জাজেরা ঠিক করে আমার গোকুল চরিত্রের জন্য সে বছরের যাত্রার শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার আমায় দেওয়া হবে। কিন্তু চিফ জাজ দেবুদা অর্থাৎ দেবনারায়ণ গুপ্ত বলে, ‘ভানু জীবনে অনেক পুরস্কার পেয়েছে, ওর আর দরকার নেই’—এই বলে অন্য আরেক জনকে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার দিয়ে দেয়।

বঙ্গাইগাঁওতে এই ‘শ্রীযুক্ত আলিবাবা’ যাত্রার সময় ভীষণ ঝামেলা হয়, মারপিট হয়। প্রায় বায়নার অর্ধেক পয়সা নিয়ে আমাদের চলে আসতে হয়, বাধ্য হয়েই, কারণ আমার দলের লোকেদের নিরাপত্তার কথাও আমাকে ভাবতে হয়।

আমাদের দেশে কোনও বিখ্যাত লোক বা রাজনীতির লোককে নিয়ে স্যাটায়ার পছন্দ করে না তাদের অনুবর্তীরা, অথচ একদিন টিভিতে দেখলাম কুইন এলিজাবেথ আমেরিকায় গেছেন, তাঁকে সংবর্ধনা দিচ্ছে প্রেসিডেন্ট ফোর্ড। কমেডিয়ান বব হোপও সেখানে উপস্থিত। তাঁকে কিছু বলতে বলা হল। বব হোপ এক জায়গায় বলেন—‘I fail to understand how this person, who has no brain become the President of U.S.A!’

লোকে শুনে অট্টহাসি হাসল, আমাদের দেশের প্রাইমমিনিস্টারকে তাঁর সামনে তাঁকে নিয়ে কেউ রসিকতা করতে পারবে?

আমার তো রাজনারায়ণকে নিয়ে কমিক করার খুব ইচ্ছে, আসলে আমাদের দেশে কমিকটাকে খুব ছোট চোখে দেখা হয়, বিশেষ করে বাংলায়। আমরা যখন কমিক করি তখন লোকে বলে ভানু ভাঁড়ামোটা ভালোই করে।

রবীন্দ্রনাথের কাজকর্ম নিয়ে তো এত কাজ, রবীন্দ্রনাথের গান তো বাংলাদেশের সব লোকই জানে অথচ হাসির স্কেচগুলো কাউকে করতে দেখেছেন? আসলে আমাদের দেশের লোক কান্নাটাকে ভীষণ গুরুত্ব দেয়। এ নিয়ে একটা কমিক স্কেচ আছে—গোপালের মা মারা যাওয়ার আট বছর পর গোপাল দেশে ফিরল, তাই দেখে গোপালের পাশের বাড়ির গিন্নি তার পুত্রবধূকে বলে, ‘বউমা, তুমি রান্নাটা দেখো, আমি গোপালের বাড়ি গিয়ে একটু কেঁদে আসি।’ মানে গোপালের মায়ের শোকের কান্নাটা আট বছর বাদে দেখিয়ে আসবেন।

আবার কান্নারও ক্লাসিফিকেশন আছে, ছবিরও ক্ল্যাসিফিকেশন। আমি যদি বাংলা গল্প নিয়ে ছবি বা নাটক করি বা গিরীশ ঘোষ, বঙ্কিমচন্দ্রের বই করি সেটা বস্তাপচা বলবেন বাংলার অর্ধশিক্ষিত জ্বলন্ত ইন্টেলেকচুয়ালরা। সোফক্লেসের হাজার বছরের পুরোনো বই দেখে আনন্দে বিগলিত হয়ে যাবে এই লোকেরাই—ও বস্তাটা পচল না কেন? আবার কিছু লোক আছে তারা রামগরুড়ের ছানা, হাসির কথা শুনে পাবলিকলি হাসাটা তাদের কাছে নিম্নরুচির পরিচায়ক। সত্যজিৎ রায়ের হাসির মুহূর্তগুলি ছাড়া আর কোনও হাসির কথায় তারা হাসতে রাজি নয়।

সুতরাং হাসির নানারকম বিভাজন-বিশ্লেষণ আছে বাংলার তথাকথিত আলোকপ্রাপ্ত শ্রেণির মধ্যে। সম্প্রতি আমার ‘জয় মা কালী বোর্ডিং’ নাটকে পুরুষকে মেয়ে সাজানো হয়েছে বলে বেশ কিছু বিজ্ঞ লোক বিরক্ত হয়েছে। এরকম ‘মিস প্রিয়ংবদা’ সিনেমায় এবং ‘টনসিল’-এ আমি নার্স সেজেছিলাম বলে অনেকে বিরূপ সমালোচনা করেছিল। যদিও বাংলার আপামর জনসাধারণ চরিত্রগুলোকে পছন্দ করেছিল।

একজন আলোকপ্রাপ্ত (ইন্টেলেকচুয়াল) সমালোচক যে কিনা সত্যজিৎ রায়ের বই, ফেলিনি, অ্যান্তোনিয়নি ছাড়া ছবি দেখেন না, এক পার্টিতে আমাকে বিজ্ঞের মতো বলেন, ‘আমি এগুলোকে বিলো স্ট্যান্ডার্ড মনে করি, এগুলো কুরুচির পরিচায়ক, এগুলো করেন কী করে?’

আমি বললাম, ‘আপনি আরেকটা বইয়ের উল্লেখ করলেন না তো, ”বউঠাকুরানীর হাট” বইতে রবীন্দ্রনাথ রাজ অন্ত:পুরে মেয়ে সাজিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন যাকে সেই রমাই ভাঁড়ের পার্টটাও আমিই করেছিলাম। তবে কি নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত রবীন্দ্রনাথ এ-কাজ করলে ঠিক আছে? কিংবা ব্যাপারটা আপনি জানতেন না, কিংবা রবীন্দ্রনাথকে সমালোচনা করার মতো বিদ্যেবুদ্ধি আপনার নেই?’

আসলে কৌতুক ব্যাপারটাকে কেউ সিরিয়াসলি নেয় না, তাই যেমন-তেমনভাবে ট্রিট করে। কমিক যেন একটা এলেবেলে ব্যাপার—নায়ক-নায়িকার প্রেম দেখতে দেখতে যখন লোক হাঁফিয়ে যায় তখন আমাদের কমিক রিলিফ হিসাবে ইউজ করা হয়। আমাদের দেশে তো ভালো হিউমার-ই আজকাল লেখা হয় না। আগের বইগুলোতে চিত্রনাট্যে এমনভাবে হিউমার আসত যে একজন কমেডিয়ান ভালোভাবে কৌতুক পরিবেশন করতে পারত। তাছাড়া আমাদের মধ্যে লেখাপড়া না-জানা লোকের সংখ্যা এত বেশি যে ঠিক ও ভুল ইংরেজির Pun করা সব সময় সম্ভব হয় না। আপনি যদি ইংরাজি না-ই বোঝেন তাহলে ভুল বা ঠিক ইংরেজি পানিং-এর কোনও মানেই হয় না। একসময় আমি ভুল ইংরাজি নিয়ে কমিক স্কেচ করতাম যেটা সেই সময়ে খুবই গ্রহণীয় ছিল। যেমন, এক কোর্টে একটা মার্ডার কেসের শুনানি হচ্ছে। উকিল ইংরাজিতে জেরা করে যাচ্ছে, এদিকে সাক্ষী বাঙালিবাবু তার সাধ্যমতো ইংরাজিতে উত্তর দিচ্ছে।

উকিল—’টেল মি বাবু! হোয়ার দা মার্ডার অকার্ড?’

সাক্ষী—’নিয়ার দা পোলের নামা’ (পোল শেষ হয়ে যেখানে ঢালু রাস্তায় মিশেছে)।

উকিল—’হোয়ার ইজ দি অ্যাকচুয়াল স্পট।’

সাক্ষী—’ইন দি উইস্তা (উচ্ছে)র খ্যাত।’

উকিল—’হোয়াট ইজ উইস্তা?’

সাক্ষী—’ডিমিনিউটিভ সাইজ অফ করলা, ভেরি বিটার স্যার, ক্রোকোডাইল স্কিন লাইক (কুমিরের চামড়ার মতো দেখতে) বিটার বিটার স্যার।

উকিল—’উইথ হোয়াট দ্যা মার্ডারার কিলড দ্যা ভিক্টিম?’

সাক্ষী—’উইথ এ কাইস্তা (কাস্তে)।’

উকিল—’হোয়াট ইজ কাইস্তা?’

সাক্ষী—’ইউ ডোন্ট নো কাইস্তা? এ চাষির অলওয়েজ সঙ্গী, উইথ হুইচ চাষি কাট ধানস। ওয়ান সাইড ইজ মোলায়েম অ্যান্ড আদার সাইড ইজ খাঁজকাটা খাঁজকাটা।’

.

আরেকটা হচ্ছে, এক অফিসের বড়বাবু তার লিমিটেড ইংরেজি জ্ঞান নিয়ে তার ম্যানেজারকে মাইনে বাড়াবার কথা বলতে এসেছে। বাবু—’স্যার, প্লিজ ইনক্রিস মাই স্যালারি।’

সাহেব—’হোয়াই বাবু। ইউ আর অলরেডি হ্যান্ডসামলি পেইড।’

বাবু—’ইয়েস স্যার, বাট দি প্রব্লেম ইজ আই হ্যাভ এ বিগ ফ্যামিলি, ইউ সি স্যার, টোয়েনটি লিভস ফল ইন মাই হাউস এব্লা ওব্লা (আমার বাড়িতে রোজ ২০টা পাত পরে এবেলা-ওবেলা, এবেলা-ওবেলার ইংরাজি কী হবে ভেবে না পেয়ে যুক্তাক্ষর বলে দেয়)।

.

এক সাহেব তার বাঙালি মোসাহেবকে নিয়ে বাজারে বেরিয়েছে, বাজারে কলার কাঁদি দেখে সে কিনে নিতে চায়। কিন্তু মোসাহেব দেখে কলার কাঁদিতে একটা কলা পচা, এবার তার লিমিটেড ইংরাজি জ্ঞানে সাহেবকে বোঝাতে যায়। মোসাহেব—’স্যার, ডোন্ট বাই দিস বাঞ্চ।’

সাহেব—’হোয়াই বাবু?’

মোসাহেব—’ইউ সি স্যার, ইফ ওয়ান ক্লা পচেস ইন দ্য বাঞ্চ, পচেস দ্য বাঞ্চ ফুল।’ (কাঁদিতে একটা পচা কলা থাকলে পুরো কাঁদিই পচে যায়)।

.

আরেকটা ছিল, এক বড়বাবু ট্রেন থেকে কাচের পিস নামাতে গিয়ে কাচ ভেঙে যায়। তাতে সাহেব ম্যানেজার রেগে গিয়ে তাকে শোকজ নোটিস দেয়, বলে তোমার ব্যাড হ্যান্ডলিং-এর জন্য কাচ ভেঙেছে।’

তখন অনেক বুদ্ধি খাটিয়ে বাঙালিবাবু শোকজের উত্তরে লেখে—’কাইট কাইট ফাইট, স্টোন ইজ ফলেন, গ্লাস ইজ ব্রোকেন, রেসপনসিবল হু?’ (অর্থাৎ দুটো চিল আকাশে ঝগড়া করছিল, একজনের মুখ থেকে একটা ঢিল পড়ে কাচ ভেঙে যায়, তার জন্যে কে দায়ী?)

এই স্কেচগুলো আমার স্কুল, কলেজের ফাংশানে করতাম। আমার মাস্টারমশাইরা, তখনকার লোকেরা খুবই উপভোগ করত। সত্যেনদা (বসু) নিজেও তাঁর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে এগুলো শুনতে চাইতেন। সত্যেনদার জন্মদিনে বা অনেক আগে ঢাকাতে কিংবা এখানেও আমি একটা স্কেচ করতাম, যেটা অনেকেই তখন পছন্দ করত। সেটা হল—’জমিদার বাড়িতে অষ্টমীর পুজোর পাঁঠাবলি হইবে, কিন্তু বলি দিবে কে? কালীচরণের খোঁজ পড়িল। খোঁজ খোঁজ, কিন্তু কালীচরণের খোঁজ নাই। অবশেষে শ্মশানে খোঁজ মিলল গাঁজায় বুঁদ কালীচরণের। সবাই বলিল, চল কালীচরণ, জমিদারবাবু ডাকতেসে পাঁঠাবলি দিতে হইবে, সঙ্গে সঙ্গে কালীচরণ তো জমিদারবাড়িতে হাজির। খাঁড়া হাতে টলিতে টলিতে পাঁঠার কাছে গেল, কালীচরণ খাঁড়া হাতে প্রস্তুত, পাঁঠাও যূপকাষ্ঠে গলা দিয়া প্রস্তুত। ”জয় মা তারা” বলিয়া কালীচরণ তো মারিল কোপ, কোনও সাড়াশব্দ নাই, পাঁঠারও হেলদোল নাই। আবার কোপ, কোনও সাড়াশব্দ নাই। আবার কোপ, কোপের পর কোপ। দ্বাবিংশতিতম কোপের পর পাঁঠা কহিল ‘ব্যা’। ইহা দেখিয়া সবাই হই হই করিয়া উঠিল, ‘ধন্য কালীচরণ, ধন্য তোমার গর্ভবতী জননী।’ এই কথা বলিয়া যারপরনাই খুশি হইয়া জমিদারবাবু অত:পর কালীচরণের পিঠে যে চটি জুতা ছিঁড়িলেন অদ্যাবধি তাহার দাম ফিরত চাহেন নাই।’

পরবর্তীকালে এই স্কেচগুলো করি না, কারণ দেখলাম আমাদের কালে বিজ্ঞ মানুষ, অশিক্ষিত মানুষ, হাসির কথা শুনলে হাসত, কান্নার কথা শুনলেই কাঁদত। ইদানীংকালে মানুষ হিসাব করে হাসে, কাঁদে; আগে দেখে নেয় কে হাসছে, কে কাঁদছে। যে লোকটা অভিনয় করছে সে লেখাপড়া জানে কিনা? বিদেশি পুরস্কার পেয়েছে কিনা? এইসব নানারকম বাছবিচার করে হাসা, কাঁদার সিদ্ধান্ত নেয়। হাসি, কান্না মানুষের খুবই স্বাভাবিক, সহজাত রি-অ্যাকশন; কিন্তু তার মধ্যেও আজকাল ক্লাসিফিকেশন চলে এসেছে।

আমি যাত্রা করতে এখন একটা কারণেই আনন্দ পাই, সেটা হচ্ছে এখানে দর্শক বাংলার আপামর জনসাধারণ। এরা হাসি পেলে হাসে, কান্না পেলে কাঁদে, তার মধ্যে কোনও ভনিতা নেই। এদের হাসি-কান্নার কোনও ক্লাসিফিকেশন নেই।

আমি সিনেমা, থিয়েটার, যাত্রা, টিভি, রেডিয়ো, রেকর্ড, স্ট্যান্ড আপ কমিক সবরকমই করেছি। প্রসঙ্গক্রমে বলছি এটা নিজের ঢাক পেটানো নয়, ঐতিহাসিক সত্য। সেটা হচ্ছে ভারতবর্ষে স্ট্যান্ড আপ কমিকে আমি, অজিত, জহর হচ্ছি সর্বপ্রথম। আমাদের আগে কেউ করেছে বলে আমার জানা নেই। স্ট্যান্ড আপ কমেডি মানে কোনও একটা কারেন্ট সাবজেক্টকে নিয়ে ইমপ্রম্পটু কমিক স্কেচ বানানো। এর আগে যা হত তা হচ্ছে কমিক গান, প্যারোডি বা কোনও হাস্যকৌতুকের নাটককে মঞ্চে পরিবেশন করা, বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের হাস্য নাটকগুলো। আমাদের তিনজন ছাড়া নবাদাই একমাত্র কমেডিয়ান যে স্ট্যান্ড আপ কমেডি করতেন, তার মধ্যে আমিই বোধহয় প্রথম হাস্যকৌতুক পরিবেশন করতাম স্কুল, কলেজের ফাংশানগুলোতেই।

যা বলছিলাম, হাসি-কান্নার যে ক্লাসিফিকেশন আছে, বিশেষ করে অভিনয়ের মধ্যে কান্নার প্রকারভেদ আছে—যেমন ধরুন কান্না, আপনি টিভি বা সিনেমায় যে কান্না কাঁদবেন, থিয়েটার বা যাত্রায় সে-কান্না কাঁদলে চলবে না। থিয়েটারে আপনি কতটা চোখের জল ফেলছেন সেটা বোঝা যায় না, আপনি থিয়েটারে চোখের জল ফেলে একশা হয়ে যাচ্ছেন কিন্তু পাবলিক বুঝছে না যে আপনি কাঁদছেন, মানে থিয়েটারে গলার মডিউলেশনে বোঝাতে হবে আপনি কাঁদছেন।

কিন্তু সিনেমায় কান্নার সিনে ক্যামেরা ক্লোজ করলেই লোক দেখতে পাচ্ছে আপনি কাঁদছেন। তাছাড়া সিনেমায় সুবিধা হচ্ছে আপনি ঠিকভাবে যতক্ষণ না কাঁদতে পারছেন ততক্ষণ কেটে আবার শট নেওয়া যায়, সিনেমায় ভুল শুধরে নেওয়ার জায়গা আছে। আমার মতে সিনেমা অ্যাকটিং হচ্ছে সবচেয়ে সহজ মাধ্যম। তবে সিনেমা, টিভির অসুবিধা হল আপনি দর্শকের প্রতিক্রিয়া কী হল সেটা সঙ্গে সঙ্গে জানতে পারছেন না।

রেডিয়ো, রেকর্ডেও তাই। তাছাড়া এখানে পুরোপুরি ভার্বাল অ্যাকটিং-এর ওপর নির্ভর করতে হয়, ফিজিক্যাল অ্যাকটিং-এর কোনও সুযোগ নেই। যেমন একজন যখন রেডিয়ো বা রেকর্ডে রাজার চরিত্রে অভিনয় করেন তখন শুধুমাত্র গলার মধ্যে আভিজাত্য ফুটিয়েই তাকে বোঝাতে হবে সে রাজা। তেমনি চাকরের ভূমিকায় অভিনয়ের সময় তাকে একটা রাস্টিক টোন আনতে হবে। তখন যদি বাচনভঙ্গিতে সফিস্টিকেশন থাকে তাহলে চাকরের ভূমিকা ফুটে উঠবে না।

এখন অবশ্য রেডিয়ো, রেকর্ডে ভুল শুধরে নেওয়ার টেকনোলজি আছে। আমরা যখন প্রথম আসি তখন রেডিয়োয় লাইভ ব্রডকাস্টিং হত। সুতরাং ভুল শুধরে নেওয়ার ব্যবস্থা তখন ছিল না, তাই তখন প্রচুর রিহার্সাল দিতে হত। এখনও অবশ্য আমি রিহার্সাল দিতে যাই। কিন্তু গিয়ে দেখি আমার কো-আটির্স্ট আসেনি কারণ সে তো জানে, যতবার ভুল হবে ততবারই ভুল শুধরে নেবে। এ ব্যাপারটা ঠিক আমার মাথায় ঢোকে না। পুরোনো অভ্যেস তো, ভাবি রিহার্সাল ছাড়া আবার অভিনয় করা যায় নাকি? রেডিয়ো নাটকে যা টাকা দেয় আমাকে, তা আমার পেট্রোল খরচেই চলে যায়। তবু আমি রিহার্সালে যাই পুরোনো অভ্যাস বশে।

তবে যাত্রা, থিয়েটার করে আমি বেশি আনন্দ পাই, কারণ এই মাধ্যমগুলোতে দর্শকের রি-অ্যাকশন সঙ্গে সঙ্গেই বোঝা যায়। যাত্রায় চতুর্দিকে লোক বসে, তাই বোঝা যায় দর্শক কীভাবে নিচ্ছে, ভুল হলে নানারকম রিমার্কও করে। তাছাড়া যাত্রা, থিয়েটারে নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সুযোগ আছে। কোনও নাটকে যদি আমার ২৫০ লাইনস পার্ট থাকে, তাহলে আমি জানি যে যে ডায়লগগুলো আমি থ্রো করছি তার সবক’টি ঠিক হচ্ছে না। তখন তাই পরীক্ষা করে দেখতে পারি কোনটা বললে ভালো হয়। যেমন ধরুন, ‘জয় মা কালী বোর্ডিং’ থিয়েটারে রোমান্টিক হিরোর একটা ডায়লগ আছে—’রামকানিদা, শেফালিকে না পেলে আমি পাগল হয়ে যাব।’

এরপরে আমার ডায়লগ ছিল—’আরে ধ্যাত, মন্ত্রী পাগল হয় না মন্ত্রিত্ব গেলে।’

কিন্তু আমি দেখলাম এই ডায়লগটা পাবলিক তেমন ধরছে না, আজকাল মন্ত্রী পাগল হওয়াটা পাবলিক ধরে না, তাই আমি ডায়লগটা চেঞ্জ করেছি পঞ্চাশ নাইটের পর। আমি ডায়লগটা চেঞ্জ করে বললাম, ‘তুই পাগল হইলে তরে আমি নিজে গাড়ি কইর‌্যা পাগলা গারদে ভর্তি কইরা দিমু।’

এতে পাবলিকের এফেক্টটা অনেক বেশি হয়েছে। যাত্রা লোকশিক্ষার সবচাইতে বড় মাধ্যম হওয়া সত্বেও যাত্রার দিকে নজর দেওয়া হয়নি কখনও, যাত্রা বহুদিন অবহেলিত ছিল; আজকাল অবশ্য এই শিল্পের দিকে কিছু নজর দেওয়া হচ্ছে। তবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে গিয়ে চলচ্চিত্র ও মঞ্চের সব প্রয়োগকৌশল যাত্রায় ঢুকে পড়ছে, এতে যাত্রার স্বকীয়তা নষ্ট হচ্ছে।

অনেকে মনে করেন শহরের সফিস্টিকেটেড এরিয়ার লোকেরা গ্রামের লোকেদের চেয়ে অনেক বেশি বোঝে। তা কিন্তু নয়, বোঝাবুঝির ব্যাপারে সবাই-ই এক। আজকাল মহাজতি সদনে বা অন্য হলে যে যাত্রা হচ্ছে, সেগুলো কিন্তু যাত্রা নয়; তিনদিক ঘেরা স্টেজে যাত্রা হয় না, থিয়েটার হয়। যাত্রার ফর্ম আলাদা। বিলেতে শেক্সপিরিয়ন স্টেজ রিনোভেট হয় না কারণ তাতে স্যাংটিটি বজায় থাকে না। সব জায়গাতেই একটা নিজস্বতা থাকা উচিৎ। বিলেতে কেউ মারা গেলে তার ফিউনেরাল সারভিসে সবাই কালো পোশাক পরে যায়। আর আমাদের দেশে শ্রাদ্ধবাড়িতে বেনারসি শাড়ি পরে ছানার ডালনাটায় নুন বেশি না কম তাই নিয়ে আলোচনা করা একটা স্টাইল হয়েছে।

আমি গত দশ বছর ধরে যাত্রা করছি, আমার মতে যাত্রায় সিনেমা বা থিয়েটারের কোনো আঙ্গিকের প্রয়োজন নেই, শুধু ডে-লাইট জ্বালিয়ে আমি যাত্রা করে প্রমাণ করেছি যে অভিনয় দিয়ে আনুষঙ্গিক সব কিছুকে ঢেকে দেওয়া যায়। তবে স্টেজ ক্রাফটটা জানা দরকার। কীভাবে ঢুকতে হবে, কোথায় টার্ন নিতে হবে, কোথায় সেন্টার নিতে হবে, কোথা দিয়ে ডায়গোনালি ক্রশ করতে হবে—এসব কিছু হ্যারল্ড ডাইন-এর বইতে এঁকে দেখানো আছে।

আমি যাত্রার অনেক বড় বড় আটির্স্টকে জিগ্যেস করতে শুনেছি, ফ্রন্ট কোনটা? মানে বেশি দামের টিকিটের দর্শক কোন দিকে সেটাই তারা মিন করতে চান। আমি তা করি না। আমি how to turn? আমি আমার যাত্রার ডাইরেকশন নিজেই দিই। তাদের এগুলো শিখিয়েও দিই।

এ প্রসঙ্গে বলি আঙ্গিকের ক্ষেত্রে আমার একটা ভয় আছে। উৎপল দত্ত খুব শিক্ষিত ছেলে, ও নাটকের বিষয়বস্তুকে অদ্ভুত সুন্দরভাবে প্রেজেন্ট করতে জানে। স্টেজ ক্রাফট-এও উৎপল বহু নতুনত্ব এনেছে। কিন্তু ওর ‘অঙ্গার’ নাটকে কয়লার খনিতে জল ঢুকে যেখানে বহু লোক মারা যাচ্ছে, সেখানে তাপস সেনের আলোর খেলায় জল বেড়ে ওঠা দেখে দর্শক হাততালি দিয়েছে। কিন্তু আসলে এখানে লোকের মৃত্যু দেখে দর্শকের কান্না পাওয়ার কথা, অর্থাৎ এখানে আঙ্গিক অভিনয়ের আগে চলে গেল, আঙ্গিকই প্রধান হয়ে উঠল।

It is neither geometrical to prove nor logical to hold—এখানেই আমার আপত্তি। ‘সেতু’ নাটকেও দেখা যায় তৃপ্তি মিত্রর ওরকম সুন্দর অভিনয়ের চেয়ে তাপস সেনের ট্রেনের খেলা দর্শক বেশি করে উপভোগ করে। শুধু ওই সিনটা দেখবার জন্য তখন অনেক লোক বিশ্বরূপায় যেত। আঙ্গিক অভিনয়কে ছাপিয়ে উঠবে কেন? দুটোর মধ্যে Synchronisation প্রয়োজন, আজকাল যা আঙ্গিক দেখাচ্ছে, তার চেয়ে অনেক বড় আঙ্গিক আগেও ছিল।

এখনকার বিখ্যাত সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার জে.ডি. ইরানির বাবা আর্দেশির ইরানি স্টেজে অনেক ইল্যুশন সৃষ্টি করতেন। শিবের ত্রিনেত্র থেকে আগুন বেরোত, লোকের মাথা কেটে ফেলা হত। এইরকম সব করা হত। তারপর এলেন শিশির কুমার। আঙ্গিক বাদ পড়ল, অভিনয় বড় হয়ে গেল। আজকাল আবার আঙ্গিকের প্রাধান্য বেড়ে গেছে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এখনও অভিনয়েরই প্রাধান্য আছে। যেমন ‘নামজীবন’, ‘জয় মা কালী বোর্ডিং’ আমরা করি, নড়বার জায়গা নেই সেখানে, রিভলভিং স্টেজ যে স্পিডে ঘোরে তার অন্তত আট গুণ স্পিডে ঘোরা উচিত; কিন্তু ঘোরে না। তবুও লোক দেখছে—because there are so many dialogues and situations।

এখানে গ্রুপ থিয়েটারেরও কিছু অসুবিধার কথা বলি, কয়েকটা সহজ বাধা দূর করতে পারলে তারা আরও বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে পারত। যেমন ধরুন, রাজ্য সরকারের পরিচালনাধীন একটি মঞ্চের ভাড়া মাত্র ৪০০ টাকা, কিন্তু রিহার্সাল ফি ১০০ টাকা। অথচ স্টেজ রিহার্সাল না দিলে টিমওয়ার্ক ভালোভাবে হতেই পারে না। তাহলে দুটো রিহার্সাল দিলেই তো ২০০ টাকা বেড়িয়ে যাচ্ছে। এটা সেই ৩০০ টাকা বাড়ি ভাড়া আর ৩০০ টাকা ঝিয়ের মাইনের মতো ব্যাপার নয় কী?

তবে এখন পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যাপারে একটা সুবিধে আছে, কিছুই বোঝা না গেলে অনেকে সেটাই বেশি সুখ্যাতি করে। অর্থাৎ কিছুই যখন বোঝা যাচ্ছে না তখন নি:সন্দেহে এর মধ্যে কোনও গূঢ় অর্থ আছে। এটা সিনেমা, থিয়েটার দুই ব্যাপারেই প্রযোজ্য। এই নিয়ে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র একটা ব্যঙ্গাত্মক লেখা লিখেছিলেন—’বুঝতে না পারছে যত, ক্ষেপছে আনন্দে তত। এই Mental bankruptcy-র ফলে অনেকের কাছেই কিছু না-বুঝে অনেক কিছু বোঝার ভান করার সুবিধে হয়েছে।

আজকাল বিদেশি নাটকের অনেক অনুবাদ হচ্ছে, বিদেশি নাটকের আইডিয়া ভাবানুবাদ করলে আমার কিছু বলার নেই, কিন্তু হুবহু অনুবাদ মনকে নাড়া দিতে পারে না। আমার সয়েল-এর সঙ্গে যদি কোনও যোগ-ই না থাকে তবে সে-নাটক আকাদেমিতে দুদিনই চলতে পারে, কিন্তু টানা দিনের পর দিন চলতে পারে না। যেমন ধরুন, ‘রাজা অয়াদিপাউস’ আমাদের সমাজ কখনও মেনে নেবে না। ‘তিন পয়সার পালা’-য় ডায়লগ আছে—মেয়ে বাবাকে বলছে, ‘You can use me, but you have to pay for that.’ ডায়লগ শুনে আমাদের মা, মাসিরা আঁতকে উঠবে।

এখন অনেকেই কথায় কথায় স্ট্যানিস্লাভস্কি, ব্রেখট টেনে নিয়ে আসে। আমি বলি শিশির ভাদুড়ি, ছবি বিশ্বাস পর্যন্তই চেষ্টা করো না। উৎপল গ্রামে-গঞ্জে এক সময় স্ট্যানিস্লাভস্কির ‘মাদার’ নাটক করে বেড়াত। সে বহুকাল আগেকার কথা, আমি ওকে বলেছিলাম, ‘উৎপলবাবু, আমাদের গ্রাম-গঞ্জের মানুষরা বিদেশ সম্বন্ধে এত কম জানে যে মাদার যে মা-এর ইংরাজি তা-ও বহুলোক জানে না। স্ট্যানিস্লাভস্কি না করে গিরীশ ঘোষ নিয়ে ভাবুন না। শুধু সিনেমা-নাটক নয়, আমাদের সঙ্গীতেও বিদেশি প্রভাব ঢুকে গেছে। সঙ্গীতজগতের এক নামী লোক আমায় বললেন, ‘আমি আমার একটা গানে চাইনিস ফোক ব্লেন্ড করেছি।’

আমি বললাম, ‘কেন, ভারতীয় ফোকের ভাণ্ডার কি নি:শেষিত হয়ে গেছে, চিন যেতে হল কেন?’

আমরা অপসংস্কৃতি, অপসংস্কৃতি বলে চেঁচাচ্ছি, কিন্তু অপসংস্কৃতির সংজ্ঞাটাই এখনও পর্যন্ত ঠিক করতে পারিনি। দেশভর্তি লোক সব কমিউনিস্ট হয়ে গেছে, যার চোদ্দোপুরুষ দুদিন আগে পর্যন্ত কংগ্রেস করত, সে-ও কমিউনিস্ট।

‘মার্কসিস্ট’ এই কথাটাও উচ্চারণ করতে পারে না বলে ‘মার্কিস্ট’। লেখাপড়া, জ্ঞানগম্যি কিছু নেই, কিন্তু মার্কসিজম সম্বন্ধে জ্ঞান দিয়ে বেড়াচ্ছে। কাল মার্ক্স যে রাশিয়ান নন, জার্মান—সেটাও জানে না। ‘দাস ক্যাপিটাল’ মানে তাদের ধারণা ক্রীতদাসদের উত্থান; ‘মে ডে’ যে আমেরিকার থেকে হয়েছিল, রাশিয়ায় নয়—তা-ও জানে না। এমনকী যখন মিছিলে ধ্বনি দেয় ‘ইনক্লাব জিন্দাবাদ’, আমি হলফ করে বলতে পারি, বেশিরভাগ জানে না কথাটা ‘ইনকিলাব’, ‘ইনক্লাব’ নয়। ইনক্লাব, ইস্টবেঙ্গলের মতো কোনও ক্লাব নয়, এ নিয়ে অনেক কাল আগে আমার একটা কমিক স্কেচ ছিল।

এক হিন্দু বন্ধু ঢাকায় তার মুসলমান বন্ধুকে বলে, ‘তোরা ইংরাজদের বিরুদ্ধে আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে আন্দোলন করিস না কেন?’

মুসলমান বন্ধু বলে—ক্যান আসুম, তোরা জিগির দ্যাস ‘ইনক্লাব জিন্নাবাদ’, ক্যান ‘জিন্না’ বাদ ক্যান? ওইর লিগাই তো আসি না।

আজকালকার ছেলে-ছোকরারা আমাকে কমিউনিজম বোঝাতে এলে আমি তাদের বলি, ‘কম্যুনিজম তো সাম্যবাদ, আমার চেয়ে সাম্যবাদী তো আমি কাউকে দেখি না, আজ থেকে ৫৯ বছর আগে আমার দাদামশাই আমার নাম রেখেছিলেন ”সাম্যময়”। that I am a communist, I bear in my name. আপনি আমায় কমিউনিজম শেখাবেন কী করে?’

আবার অভিনয়ের কথায় আসি, অভিনয় করতে গিয়ে প্রথমেই আমি চরিত্রটিকে বিভিন্নভাবে দেখার চেষ্টা করি। অর্থাৎ অভিনয়ের জন্য দরকার Concentration and not involvement। এছাড়া প্রতিদিন যত লোক দেখছি তারা প্রত্যেকেই আমাকে সবসময় শিক্ষা দিচ্ছে। কোনও চরিত্র করবার আগে আমি প্রতিদিনের দেখা অসংখ্য লোকের চেহারা চিন্তা করি, তাদের বাচনভঙ্গি আমাকে সাহায্য করে। নাটকের দর্শক আমার কাছে ভগবান। আমি কখনওই তাদের ইগনোর করি না। পর্দায় ও মঞ্চে একই চরিত্রকে আমি দেখেছি মঞ্চের চরিত্রচিত্রন আমাকে বেশি আনন্দ দেয়। ‘নতুন ইহুদী’ বা ‘জয় মা কালী বোর্ডিং’-এই দুটি মঞ্চসফল নাটক চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয়েছে, এই দুটিতেই আমার অভিনীত চরিত্র একই, কিন্তু নাটকদুটিতে অভিনয় করে আমি যে শিক্ষালাভ করেছি, যে আনন্দ পেয়েছি প্রতিদিন দর্শকবৃন্দের প্রতিক্রিয়া থেকে সেই সুযোগ তো আর পর্দায় পাওয়া যায় না।

নাটকে অভিনয় একজন সৎ শিল্পীর কাছে continuous assesment-এর মতো। এই জন্য নাটকে অভিনয় আমার কাছে বেশি চিত্তাকর্ষক। অনেক সময় আমি দর্শকের আসনে আমার বিশ্বস্ত কোনো সত্যিকারের নাট্যরসিককে বসিয়ে রাখি, পরে নাটকের শেষে সেই রসিক ব্যক্তির সমালোচনা আমার অভিনয় ধারাকে পরিমার্জনা করতে, নিজেকে শিক্ষিত করতে সাহায্য করে। প্রচুর পরিশ্রম আর আন্তরিকতা না থাকলে এই শিক্ষা সম্ভব হয় না। আমরা যখন প্রথম ‘নতুন ইহুদী’ করি ১৯৪৭ সালে, তখন এই আন্তরিকতাই আমাদের মূলধন ছিল। যে আন্তরিকতার দৃষ্টান্ত ‘নবান্ন’ তখন রেখে গেছে।

দেশবিভাগ আমার কাছে প্রচণ্ড বেদনার। ‘নতুন ইহুদী’-এক অর্থে আমাদের বেদনার মূর্ত প্রকাশ, এর সঙ্গে ছিল আমাদের ভালো নাটক করার বাসনা, যে—নাটক বাস্তবের সামনে মানুষকে নিয়ে আসবে। বিশ্লেষণধর্মী নাটকের ইস্যু দর্শককে আনন্দের সঙ্গে চিন্তা করতেও শেখাবে। তাই ওই ছিন্নমূল মানুষগুলোর ছেড়ে আসা ভিটে, তাদের বিশাল জীবন আর বিপুল সামাজিক কর্মকাণ্ড—এই সত্যি কথাগুলো আমার কাছে একটা বাস্তব প্রয়োজন বলে মনে হয়েছিল। কাজেই আমাদের রাসবিহারী মোড়ের আড্ডায় যখন মনোজ ভট্টাচার্য এই বইয়ের কথা বলল তখনই আমি রাজি হয়ে গেলাম।

এই নাটকের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের বক্তব্য তুলে ধরতে পেরেছিলাম বলেই গ্রাম-গঞ্জ, সর্বত্র এই নাটক আমাদের করতে হয়েছে। আমরা প্রথম থেকেই এই নাটককে গণনাট্যের আদর্শে গড়ে তুলতে চেয়েছিলাম। যা আমি এখনও আছি। কলকাতা শহরের কয়েকটা হলকেন্দ্রিক নাট্য আন্দোলনে আমার বিশ্বাস কম, ওইক’টা জায়গায় কয়জন ‘গণ’ যায়? আজকের গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন অনেকটা সেইরকম নাটকবিলাসীদের হাতে পড়েছে।

সত্যিকারের প্রফেশনাল না-হওয়া পর্যন্ত গ্রুপ থিয়েটারের ভেতরে এই অবস্থা থাকবে বলে আমার ধারণা। কিন্তু প্রফেশনাল হতে গেলে আন্তরিকতা ছাড়াও পরিশ্রম করে যাওয়ার মানসিকতা দরকার। অন্যান্য সমস্ত বৃত্তির জন্য যে ধরনের পঠন-পাঠনের ব্যবস্থা আছে, অভিনয়ের ব্যাপারে আমার মনে হয় সে-ধরনের ব্যবস্থা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। কমার্শিয়াল বোর্ডের নাটক ও অভিনয়ধারার আলোচনায় তথাকথিত কোনও উচ্চগ্রামের কোনওপ্রকার অ-প্রশংসা আমার নেই; বোর্ডে কমার্শিয়াল নাটকের নির্বাচনের পিছনে শুধুই যে অর্থকরী মনোভাব কাজ করে তা বোধহয় সবসময় যথার্থ নয়, ভালো নাটকের অভাবও এর একটা অন্যতম কারণ। যে দু-একটা ভালো নাটক লেখা হচ্ছে তা নাট্যকাররা তাদের নিজেদের গ্রুপের জন্য বগলদাবা করে নিয়ে যাচ্ছে। ভালো নাটক মানে অবশ্যই ড্রামা অব দ্যা সয়েল। অধিকাংশ গ্রুপ থিয়েটার এখন নাটক-সমস্যায় জর্জরিত, যেটা অনেকাংশে বোর্ডেরও সমস্যা, গণনাট্য, সব নাট্যপর্যায় শেষ করে কলকাতার নাট্য আন্দোলন এখন বিদেশি নাটক নিয়ে ব্যস্ত।

ইতালিয়ান নাট্যকার, গ্রিক পরিচালক আর ভারতীয় অভিনেতাবৃন্দের মিলনে কলকাতার নাট্য আন্দোলনে মাঝে মাঝে অস্বাভাবিক ঢেউ আসে বইকি! যদি বোর্ডকে ভালো নাটক না দেওয়া যায় তাহলে সত্যিকারের শিল্পী, সংস্কৃতি সুস্থ হয়ে উঠবে না। এর সঙ্গে দরকার ভালো, সঠিক নাটক, প্রচুর পরিমানে লেখানোর আন্দোলন যাতে পাবলিক বোর্ডও সেই নাটকের প্লাবনে ভেসে যায় অথবা নিজের প্রয়োজনেই সেই সুস্থ মানবিক মূল্যবোধের নাটক করতে বাধ্য হয়। সত্যিই বুদ্ধিদীপ্ত, মানবিক আবেদন পুষ্ট বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির নাটকের বড়ই অভাব আমাদের দেশে; ভালো নাটক পেলে আমরা করি ও করবও, দশর্কও নাটক গ্রহণ করবে। এমন নাটক আমি করতে চাই না যা দর্শক বুঝতে পারবে না বা রিলেট করতে পারবে না।

কিছু নাট্য পরিচালক বা অভিনেতাদের মতো আমি বলতে চাই না যে আমার নাটক সাধারণের জন্য নয়। আমাদের দেশের দর্শকেরও নিরানব্বই শতাংশ অতি সাধারণ। চার্লি চ্যাপলিনের ছবি দেখে বুঝতে তো কোনও সাধারণ দর্শকের বুদ্ধির অভাবে ভুগতে হয় না। তাহলে কি বুঝব চ্যাপলিনই অতি সাধারণ?

আবার ‘নতুন ইহুদী’তে ফিরে যাই—কেননা উদয় সিংহের থেকে ‘নতুন ইহুদী’র মধ্যে দিয়ে আমি বর্তমানের একজন কৌতুক-অভিনয় শিল্পী। আমার এই বিভিন্ন রূপে বিচরণ ও শেষে কমিক আর্টিস্ট-এ উত্তরণ—এটা আকস্মিক নয়, অথবা মোটেই ধারা-বিরোধী নয়। এ-অভিনয় করলেও আমি লক্ষ করতাম যে আমার বাচনভঙ্গি দর্শকদের ভালো লাগছে; এই বাচনভঙ্গির সঙ্গে আমার ইনবর্ন উইট আর অসংশোধনীয় বাঙালত্ব যোগ হয়ে যে সমীকরণ সৃষ্টি হল, তা-ই আজকের আমি। শুধু যে বাঙাল ভাষাই আমাকে সাফল্য এনে নিয়েছে এটা আমি মানি না। ‘পাশের বাড়ি’ সিনেমাতে আমি বাঙাল ভাষা বলিনি। ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’, ‘৮০-তে আসিও না’, ‘ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিসটেন্ট’, ‘ভানু পেল লটারি’, ‘নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতিতে’, ‘পার্সোনাল অ্যাসিসটেন্ট’—এই ছবিগুলোতে আমি বাঙাল ভাষা বলিনি, তবে খাঁটি বাঙালের বাঙালত্ব একেবারে চলে যায়নি। সেইজন্য আমার সংলাপ বলার রীতিই আমাকে দর্শকের প্রশংসা এনে দিয়েছে।

অবশ্য এই সফল কৌতুকাভিনয় শিল্পীতে রূপান্তরিত হওয়ার জন্য চলচ্চিত্রে অভিনয় আমাকে সাহায্য করেছে। মঞ্চে ও সিনেমায় একসঙ্গে অভিনয় করে আমি এই দুই মাধ্যমের ভালো দিকগুলোর সঙ্গে বেশ পরিচিত। মঞ্চে অভিনয় যেমন প্রতিদিন আমায় দর্শকদের উষ্ণ অভিবাদনে আপ্লুত করে, তেমনি তাদের শীতল প্রতিক্রিয়া আমাকে ভাবায়, চিন্তিত করায়। সিনেমায় সেই নতুন করে ভাবার সুযোগ নেই। তবে এটা তো ঠিকই, পর্দার অভিনয়ের সাহায্যে আমি অনেক বেশি দর্শকদের কাছে অনেক কম সময়ে পৌঁছোতে পারি। তাই আমার মনে হয় আমার আজকের কৌতুক-অভিনয় শিল্পীতে পরিণতির জন্য চলচ্চিত্র অনেকটা সাহায্য করেছে। তবে চলচ্চিত্রের অভিনয়ের ভালো-মন্দ পরিচকালক ও অভিনেতা—এই দুজনের কো অপারেশন-এর ফল।

নাটকে অভিনেতার স্বাধীনতা একটু বেশি। সিনেমায় পরিচালকের নির্দেশানুসারে আমাকে অভিনয় করতে হয়—প্রায় অনেকটা অর্ডার সাপ্লাই-এর মতো। তবে এরই মধ্যে অনেক ভালো পরিচালকের সঙ্গে কাজ করে আমি খুশি।

এখনও যখন হঠাৎ কোনও ছবিতে আমায় সিরিয়াস রোল করতে বলা হয় আমি সানন্দে তা গ্রহণ করি, কারণ গতানুগতিক অভিনয়ের ধারার একটা টুইস্ট অথবা ব্রেক আমার মনের খোরাক। অভিনয়ের মধ্য দিয়ে যেমন আমি সত্যিকারের সৃষ্টির আনন্দ পাই, তেমনি এই কৌতুকাভিনয় আমাকে সামাজিক কর্তব্য পালন করতে সাহায্য করে। আমার বিচারে সমাজে কমেডিয়ানের একটা বিশেষ অস্তিত্ব এবং দায়িত্ব আছে। সেইজন্য যাঁরা আমাকে অঙ্গভঙ্গি আর অর্থহীন বাচালতার সাহায্যে কৌতুক সৃষ্টি করতে বলেন তাঁদের প্রতি আমার সবিনয় নিবেদন যে আপনারা একটা ফান্ডামেন্টাল মিসটেক করছেন।

বীরবল, গোপাল ভাঁড় কি শুধুই অর্থহীন ভাঁড়ামো করে গেছেন? বীরবল মোগল দরবারে শ্রেষ্ঠ চেতনাসম্পন্ন চরিত্র, তাঁর কাজ ছিল সম্রাটকে প্রয়োজনানুসারে চেতনা-সমৃদ্ধ করে তোলা। গোপাল ভাঁড় তো মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের বিবেকের মতো। শেক্সপিয়ারের ‘কিং লিয়ার’-এর ‘ফুল’ চরিত্রের প্রয়োজন কি শুধু গাধার টুপি পরে হল্লা করা? এঁরা প্রত্যেকেই তাঁদের রাজাদের চেতনা জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। তাঁদের মাধ্যম নিশ্চয়ই কৌতুক, কিন্তু কখনওই নিছক কৌতুক সৃষ্টি নয়।

আমার দুর্ভাগ্য যে দেশে আসল রাজাই নেই—কার চেতনা জাগাব! এখন রাজা ভেঙে দু-ভাগ হয়েছে। তবুও চেষ্টা করি ওই দ্বিতীয় রাজা অর্থাৎ শোষিত রাজার গণচেতনা আরও বেশি করে সমৃদ্ধ করে তুলতে অর্থাৎ আমি বেশ স্পষ্ট করেই বলতে চাই যে আমার নির্দেশনায় বা প্রযোজনায় আমি কখনওই ‘ভ্যাদভেদে’ নাটক করতে চাই না। সিনেমায় অনেক কিছুই দায়ে পড়ে করতে হয়, যদিও আমার ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’ ছবিতে আমি বহুদিন আগেই ভারতের জনসংখ্যা বিস্ফোরণ নিয়ে সরকারকে অবহিত করেছিলাম। আবার বর্তমান নাটকের শেষের দিকে আমি আবার এই সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছি কৌতুকের মধ্যে দিয়ে। ‘শ্রীযুক্ত আলিবাবা’ নাটকে আমি পাঁচশালা পরিকল্পনা রূপায়ণে ক্রমাগত ব্যর্থতার বিরুদ্ধে জনগণের আক্রোশের সংগঠিত রূপ দেখিয়েছি বৃদ্ধ মুস্তাফার হাতে ধনী আলিবাবার পতনের মধ্যে দিয়ে।

বর্তমানের অনেক সমস্যা আমাদের সামাজিক অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তোলে। তার প্রতিকার করা হয়তো আমার সাধ্য নয়, তবে সেই সমস্যার প্রকৃত চেহারা ও সমাধানের ইঙ্গিতবাহী কোনও কৌতুক নাটক করতে আমি সবসময়েই আগ্রহী। আবার যদি কোনও ‘নতুন ইহুদী’ নতুনভাবে করতে হয় তাহলেও আমি প্রস্তুত। এখন, আমাকে যদি কমিটেড শিল্পী বলা হয় তাহলে আমার কোনও আপত্তি থাকার কথা নয়, কেবল একটি ব্যাপার ছাড়া, নাটকের মধ্যে দিয়ে আমি মানুষের পক্ষে কথা বলতে চাই, সেটা রাজনৈতিক হতেই পারে। তবে আমি কোনও পার্টির রাজনৈতিক বক্তব্য আমার নাটকের মধ্যে বলতে চাই না। বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে ও দৃষ্টিভঙ্গিতে সচেতন করার জন্যে সমাজকে ও সাধারণ মানুষকে খোঁচা দিয়ে জাগিয়ে নাটক করে যেতে চাই যে সে ব্যঙ্গ বা সিরিয়াস যা কিছু হোক না কেন—এটাই আমার কমিটমেন্টের শেষ কথা।

একেবারে শুরুতে ‘নতুন ইহুদী’, বর্তমানে ‘জয় মা কালী বোর্ডিং’, আর মাঝে ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’—আমার শিল্পী মানসের গতি ও প্রকৃতি আলোচনা করার ও বুঝবার পক্ষে আমার মনে হয় এই ত্রিধারা প্রয়োজনীয় সাহায্য দিতে পারে। কারণ আমি আগেই বলেছি আমার অভিনয়-জীবনের বিকাশের মধ্যে কোনও আকস্মিকতা নেই বরং একটা স্বত:স্ফূর্ত স্বাভাবিকতা আছে। অভিনেতা হিসাবে আমার কোনও ক্ষোভ নেই বললে সবটা হয়তো বলা হয় না, আমি দারুণ ভয়াবহভাবে সংসারী ও সুখী অভিনেতা।

তবে এই সুখের মধ্যে একটা কাঁটা আছে, আমি এখনও ভালো রোলের সন্ধানে ব্যস্ত। সত্যিকারের ভালো চরিত্র আমাকে এখনও আকর্ষণ করে। আর সেইটাই আমি কম পাই। আমার সম্বন্ধে একটা কথা চালু আছে, শুনেছি যে আমি নাকি ‘কিঞ্চিৎ ডাল ব্রেন’-এর অধিকারী। আর তাই হয়তো রোলটাই খুঁজি অভিনয়ের জন্য, ভাঁড় হতে রাজি হই না। অবশ্য এই ‘ভাঁড়’ কথাটার উৎস মনে হয় জানা নেই অনেকেরই, আর তাই গোপাল ভাঁড়-এর রসালো কথাবার্তা থেকে ধরে নেওয়া হয়েছে ভাঁড় মানেই একটু রঙ্গতামাশা এবং একটু আদিরসাত্মক ব্যাপার মিলিয়ে একটা পদার্থ।

আসলে গোপাল ভাঁড় ছিলেন পেশায় ‘পরামানিক’ অর্থাৎ নাপিত। আর সেই সময়ে নাপিতদের ক্ষৌরকার্যের মালপত্র বহন করার বাক্স ছিল না, তাই তাঁরা ওগুলো মাটির ভাঁড়ে করে বহন করত। এইজন্য গোপালের ভাঁড়টা পদবি হয়ে গেছিল। এটা একেবারেই পেশাকেন্দ্রিক। যেমন পার্শিদের পদবি হয় আলুওয়ালা, কন্ট্রাক্টওয়ালা, দারুওয়ালা প্রভৃতি।

আমি খাঁটি বন্দ্যোপাধ্যায় এবং নিজের দাড়ি ছাড়া অন্য কারও কিছু কখনও কামিয়ে দিইনি, তাই কোনও অর্থেই আমি ভাঁড় নই বা হতেও চাই না। আমায় ভাঁড় ভেবে অনেকই স্থূল রসিকতা করতে আসে, ভেবে নেয় আমি কিছু জানি না। আবার আমার কিছু বন্ধু আমায় একবার বলেছিল, ‘আপনি তো বাঙাল কথা বলে হাসান।’

আমি বললাম—’শুধু বাঙাল কথা বলি বলেই বুঝি লোক হাসে? আপনি কোনোদিন টালিগঞ্জ ট্রামডিপো পেরিয়ে গড়িয়ার দিকে গেছেন?’

উনি বললেন, ‘কেন?’

আমি বললাম, ‘কখনও যাবেন না, আপনার হাসতে হাসতে মৃত্যু হতে পারে। কারণ ওখানে সবাই পূর্ব বাংলার রিফিউজি কলোনির লোক, সবসময় বাঙাল কথা বলেন। আরে মশাই হাসির কথা না বললে কি লোক হাসে? মাথায় শুধু লোম থাকলেই কি ভালো ফিল্ম ক্রিটিক হওয়া যায়? তার জন্য মগজ দরকার।’

শুনে কী বুঝলেন তিনি জানি না। দন্তবিকশিত করে হাসলেন, ‘আপনি কী যে বলেন!’

আসলে আমাদের হাস্যকৌতুক শিল্পীদের মানুষ কখনওই সিরিয়াসলি নেয় না। আমার মা মারা গেছেন, শ্মশানে গেছি। দু-একজন লোক হ্যা হ্যা করে হেসে আমাকে জিগ্যেস করে, ‘এই যে ভানুদা, এখানে আপনি, কী ব্যাপার?’

আমি বললাম, ‘আমার মা মারা গেছেন।’

তাতেও হাসি, ‘ও, তাই নাকি? হ্যা হ্যা।’

তারাও হয়তো তাদের কোনো নিকটজনকে সৎকার করতে শ্মশানে এসেছে, কিন্তু একটু হাসির চান্স পেলে কি ছাড়া যায়?

জহর মারা গেছে, মেডিক্যাল কলেজে গেছি আমি, সৌমিত্র, সরযূদি এরকম মাত্র কয়েকজন, সৎকারের ব্যবস্থা করছি; আমার মনের অবস্থা খুবই খারাপ। সমানে কয়েকজন লোক টিটকারি করে যাচ্ছে। রাগে আমার মাথায় আগুন জ্বলছে; সরযূদি বললেন, ‘শিঘ্রী ভানুকে এখান থেকে নিয়ে যাও, শেষকালে কী একটা করে বসবে।

রেগে গেলে আমার মাথার কিছু ঠিক থাকে না, তখন মনে থাকে না যে আমার বয়স হয়েছে, বুড়ো হয়েছি। আমাদের কখনওই কেউ সিরিয়াসলি নেয় না। আমার অনেককালের বন্ধু হৃষীকেশ উত্তমের বাবা মারা যাওয়ার পর শ্মশানে এসে আমাকে দু-চার কথা শোনাচ্ছিল, ‘কী সব ঝামেলা করছিস, এসব ঝগড়াঝাঁটি মিটিয়ে নে।’

আমি শান্ত থেকেই বললাম, ‘তোকে কে বলল ঝগড়াঝাঁটি করছি, কিছুই হয়নি ঝগড়াঝাঁটির মতো।’

তা-ও দমে না, সমানে বলে যেতে লাগল, আর বেশ কিছু রবাহুত দাঁত বার করে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছিল।

আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল, আমি রেগে গিয়ে বললাম, ‘তোকে অত বড় বড় কথা বলতে কে বলেছে, তুই কিছু জানিস না এত কথা বলছিস কেন?’

আমাকে তখন বুড়ো, দেবেশ সব সামলায়। আমার এক বন্ধু আমাকে একদিন বলে, তুই যখন মারা যাবি তখন লোকের কী রিঅ্যাকশন হবে বল তো?’

আমি বললাম, ‘কী আর রিঅ্যাকশন হবে? বলবে, দ্যাখ শালার মাথাটা ক্যামন নড়ছে,—হ্যা হ্যা। তবু ভালো। সেটা আমায় দেখে যেতে হবে না।’

আমাকে দেখে কমেডিয়ানদের সঙ্গে রগড় করবে বলে এক সফিস্টিকেড মহিলা একদিন এক পার্টিতে আমাকে কিঞ্চিৎ মদ্যপান করে প্রশ্ন করেন, ‘আপনাকে দেখলেই আপনার স্ত্রী হাসেন?’

আমি বললাম, ‘হাসির কথা শুনলে নিশ্চয়ই হাসেন, কিন্তু বিনা কারণে হাসতে যাবেন কেন?’

তিনি আর আমার পিছন ছাড়েন না, বলেন, ‘না না, বলুন না সবসময়ই কি আপনার স্ত্রী হাসেন? মানে আমার তো তাই মনে হয়।’

আমি দেখলাম মহা জ্বালাতন তো! একে একটু শিক্ষা দিতে হবে। আমি জিগ্যেস করলাম, ‘আপনার স্বামী কী করেন?’

সে চোখ উলটে উত্তর দিল, ‘বাবা, আমার স্বামী বিরাট বড় ডাক্তার, সার্জেন।’

আমি দেখলাম এই মওকা,—বললাম, ‘সার্জেন? তা আপনার স্বামী কি বাড়িতে সবসময় আপনাকে ছুরি-কাঁচি নিয়ে তাড়া করেন?’

মহিলা কিছু না বুঝে হা: হা: করে হাসতে লাগলেন। কিন্তু বান্দা ছোড়নেওয়ালা নয়, আবার আমার খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে কানে কানে বলে, ‘সত্যি বলছি ভানুবাবু, আপনাকে আমার ভীষণ ভালো লাগে।’

আমি খুব উচ্চস্বরে উত্তর দিলাম, ‘ইস, কিছুদিন আগে কইলেন না, তাহলে নীলিমারে বিয়াই করতাম না!’

এই কথা শুনে আশেপাশে যারা লক্ষ করছিল তারা এত জোরে হেসে উঠল যে ভদ্রমহিলা ঘাবড়ে গিয়ে সেখান থেকে ত্রস্তপদে প্রস্থান করলেন।

এ জন্মে যতগুলো লোক আমি মিট করেছি তাদের বেশিরভাগ লোকই এরকম—ভাবটা এমন, যাই ভানুর সঙ্গে একটু ছ্যাবলামি করে আসি। তাদের সবাই-ই যে অশিক্ষিত, অভদ্র তা নয়, বেশ কিছু তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত সমাজের বিদগ্ধ মানুষও আছে, যারা সিনেমাকেই ঘৃণা করে, কমেডিয়ানরা তো ধর্তব্যের মধ্যে নয়। আমি এমন দুজন মানুষকে জানি যারা সিনেমা লাইনটাকে অস্পৃশ্য বলে মনে করে অথচ তাদের সন্তানদের ছোট বয়সেই সিনেমায় অ্যাকটিং করতে পাঠিয়ে দিয়েছে। আমি একদিন বলেছিলাম, ‘আপনারা সিনেমাকে এত ঘৃণা করেন অথচ নিজের বাচ্চাকে অ্যাকটিং করতে পাঠিয়ে দিয়েছেন?’

তার মধ্যে একজন অদম্য আলোকপ্রাপ্ত লোক আবার বলেন, ‘তার কারণ নিশ্চয়ই আছে, সিনেমার লোকরা এতটাই খারাপ, দূষিত যে ভদ্রলোকের ছেলেরা মিশতে ভয় পায়, দূরে দূরে থাকে।’

আমার রাগ মাথায় চড়ে যায়। স্টুডিয়োয় বসে, আমার পেশা সম্বন্ধে এরকম অপমানকর উক্তি করছে কে? যে তার বাচ্চাকে নিজেই সিনেমায় নামিয়েছে, আবার শুটিংও দেখতে এসেছে। আমার এই রকম ভণ্ডামি সহ্য হল না, আমি রেগেমেগে বললাম, ‘ও, শুধু সিনেমার লোকেরাই খারাপ? সোনাগাছিতে ১৬ হাজার রেজিস্টার্ড বারবনিতা আছে, তারা শুধু সিনেমার লোকদের জন্যই জীবিকা নির্বাহ করে? আপনার মতো ভদ্রলোকেরা কেউ যায় না?’

সেখানে গীতাদেবীও অন্যান্যরা তখন আমাকে সামলায়। সারাজীবন সিরিয়াসলি জানপ্রাণ দিয়ে অভিনয় করে গেছি, অথচ কোনওরকম মর্যাদা পাইনি।

আমার মনে আছে, আমার বাবা মারা যাওয়ার পর একদিনও স্টারের নাটকে অনুপস্থিত হইনি, অথচ শ্রাদ্ধের পর মাথা ন্যাড়া হওয়ায় পরচুলা পরতে হয়েছে বলে কথা শুনতে হয়েছে, নাটকে ও সিনেমার শুটিংয়েও ওই কারণে কন্টিনিউটি থাকেনি। ‘বন্দীশ’ ছবিতে মুম্বাইয়ের লোকেরা ম্যানেজ করে নিয়েছে, কিন্তু কলকাতার পরিচালকরা বেশ অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন যেজন্য মা মারা যাওয়ার পর ন্যাড়া হতে পারিনি।

১৯৭৯-র ১২ জুলাই, যেদিন প্রথম ‘জয় মাকালী বোর্ডিং’ নাটকের অভিনয় করি সেদিন আমার তিনটে রিবস-এ ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছিল, কিন্তু আমি ভাবলাম আজ প্রথম দিন, আজ যদি ফেইল করি তাহলে তো কেলেঙ্কারি। তাই কষ্ট চেপে কাউকে কিছু না-জানিয়ে শো-টা কমপ্লিট করলাম। এরপরে আরেকদিন নাটক করতে করতে আমার বুকে খুব যন্ত্রণা হচ্ছিল, সেটা ছিল এক রবিবারের সেকেন্ড শো, সেখানে উপস্থিত ছিল আমার বন্ধু সুখাদা। সুখাদা আসলে আমার দাদার বন্ধু ডাক্তার সুখেন্দু মিত্র। আমার বুকে ব্যথা করছে, ঘামাছি শুনে আমাদের প্রাোডিউসার হরিদাস ওকে ডেকে নিয়ে এল ইন্টারভেলের সময়। উনি আমায় দেখে-টেখে বলেন, ‘শিঘ্রী শুয়ে পর, নাটক বন্ধ করে দে।’

আমি বললাম, ‘কেন?’

উনি বললেন, ‘তোর একটা মাইল্ড হার্ট অ্যাটাক হয়েছে।

আমি বললাম, ‘ও, মাইল্ড? তাহলে কোনো ভয় নেই, ব্যথাটা তো ফার্স্ট শোয়ের সময় থেকেই হচ্ছে, এখনও যখন সাংঘাতিক কিছু হয়নি তখন শো কমপ্লিট না করে আমি যাচ্ছি না।’

উনি তো রেগেমেগে অস্থির, তারপর আমায় কথা দিতে হল পরবর্তী তিন সপ্তাহ আমি বাড়িতে বিশ্রাম নেব, তারপরে উনি আমায় ছাড়লেন।

কাজের প্রতি এই ভালোবাসা, সিরিয়াসনেস শিখেছি আমাদের উত্তরসূরীর কাছে। সেই যে আগেই বলেছি যেদিন শিশির ভাদুড়ীর নাটক দেখতে গেছি, সেদিন মোটা চশমা-পরা প্রায় অন্ধ, জবুথবু ভীষণ অসুস্থ বড়বাবু আজ অভিনয় করতে পারবে কিনা—আমার গ্রেট ডাউট, সেই বড়বাবুকে যখন ঠেলে স্টেজে ঢুকিয়ে দেওয়া হল তখন উনি ‘রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার’। আর আরও আগে শুনেছি চিত্ত গোস্বামী নামে এক অভিনেতা ছিলেন, স্টেজে অভিনয় করতে করতে শুনলেন তাঁর অসুস্থ ছেলে মারা গেছে। কিন্তু ওঁর তখনও আরও দুটো সিন করতে হবে। নাটক শেষ করে তারপরে উনি বাড়ি গেলেন। এইসব ঘটনা আমায় খুব উদ্বুদ্ধ করেছে।

এবার আমার বাড়ির কথা কিছু বলি, আমার সংসারটাও ঠিক ক্যালেন্ডার না হলেও আমার কাজের পারস্পেকটিভে মনে আছে। আমি যখন ‘গল্প হলেও সত্যি’র শুটিং করছি তখনই আমার দুই ছেলে স্কুল ফাইনাল ও সেকেন্ডারি পাশ করল। আমার ছোট ছেলে পিনাকী লেখাপড়ায় ভালো, সে যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হল। এরপর তপনবাবুর আরেকটি ছবি ‘আপনজন’-এর সময় আমার মেয়েও স্কুল পাস করে উইমেন ক্রিশ্চান কলেজে ভর্তি হল। আমার বড় ছেলে গৌতম লেখাপড়ায় তেমন ভালো নয়। সে আশুতোষ কলেজে ভর্তি হল।

আবার সিনেমার কথায় আসি। আমি যখন প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম যে, আর কেউ হয়তো আমায় সিনেমায় নেবে না, সন্দেহ ছিল, আমার বয়সকে দর্শক অ্যাকসেপ্ট করবে কিনা! সেইসময় আমার আধবুড়ো পঁয়তাল্লিশ-ছেচল্লিশ বছর বয়সে অফার এল পাঁচু বসাকের ‘৮০-তে আসিও না।’ এই রোলটা আমার ভীষণ পছন্দের, কারণ এটা সিরিও কমিক রোল, মোর সিরিয়াস দ্যান কমিক। আবার মনে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব চলছে, কারণ কিছুটা রোমান্টিক সিকোয়েন্সও আছে। পঁয়তাল্লিশ-ছেচল্লিশ বছরের হিরোর ঠাট্টা, তামাশা, ঢিল-পাটকেল খাবারও ভয় আছে। আমার মনের এরকম দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখে ডিরেক্টর খোকা বলল, ‘কিছু ভেবো না তো, অ্যাদ্দিন ধরে পার্ট করছ, তুমি চ্যালেঞ্জ হিসাবে এটাকে নাও না, বাকিটা আমি ম্যানেজ করব।’

আমি জানি খোকার ভীষণ সিনেমাটিক সেন্স, যদিও ফোটোগ্রাফি ওর মেইন পেশা। ও কমিক অ্যাকটিংটাও খুব ভালো বোঝে। এ ছবিতে কাজ করতে করতে একটা জিনিস হয়েছিল, ও আমায় অভয় দেয় রোমান্টিক পার্টের সময়। আর আমি ওকে অভয় দিই, ‘তোর ভালো ডিরেক্টর হওয়ার সবরকম যোগ্যতা আছে, ফুলটাইম ডিরেক্টর হয়ে যা।’

আমি খুশি যে আমার ভবিষ্যদ্বাণী সফল হয়েছে এতদিনে। ১৪-১৫টা ফিল্ম ডিরেক্ট ও করে ফেলেছে, সবচেয়ে বড় কথা, সুচিত্রার মতো আর্টিস্টকে ম্যানেজ করে ‘দেবী চৌধুরানী’ ও করে ফেলেছে। ‘৮০-তে আসিও না’র পর ও একটা হাসির ছবিতে, অনেকটা ‘৭৪।।’-এর মতো গল্পে নিয়ে আমায় কাস্ট করেছিল; কিন্তু আমি করিনি এই ভেবে যে আমার বয়সের সঙ্গে বেমানান ওই রোল।

যাই হোক, ‘৮০-তে আসিও না’ আমি একটু দুরু দুরু বক্ষে স্পেশাল কেয়ার নিয়ে করেছিলাম। একে রোলটা আমার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রোল এই বয়সে, এবং আমার পছন্দমতো সিরিও কমিক রোল। রোলটাকে বেশি সিরিয়াস করবার জন্য আমি আমার কিছু কমিক অংশ ওকে বাদ দিতে অনুরোধ করেছিলাম। আমার অনুরোধ ও রেখে সেটা জহরকে দিয়েছিল। জহরের রোলটা তাতে বেশ বড় হয়ে গেছিল। আমার সবচেয়ে বড় স্যাটিসফেকশন যে সিনেমাটা দেখে আমার কড়া ক্রিটিক সেবাব্রত ও রবি আমার প্রশংসা করেছিল।

এই ছবিতে আমি এতটাই ইন্টারেস্ট নিয়েছিলাম যে গানের রেকর্ডিংয়েও উপস্থিত ছিলাম, যা আমি কোনওদিন করিনি। আমার দু-একটা হাম্বল সাজেশনও মান্নাবাবুকে দিয়েছিলাম যেগুলো আমার ক্যারেকটরের সঙ্গে মেলে। আমার বুড়ো হয়ে যাওয়ার পর আরেকটা খুব ইম্পর্টেন্ট ছবি ‘ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিসট্যান্ট’।

এই সময়টা আমার খুব সঙ্কটজনক মুহূর্ত, একে তো আমার বয়স পঞ্চাশোর্ধ, কমেডি রোলে ট্রেড মার্কড হয়ে গেছি। অর্থাৎ হিরো বা হিরোইনের বাবার রোল পাওয়ার চান্স নেই বললেই চলে। বয়স্ক চাকরের রোল ছাড়া কিছুই পাওয়ার সম্ভাবনা নেই, তার ওপর ফিল্ম লাইনের গোলমাল। যদিও সেটা বিশেষ কিছু সাঙ্ঘাতিক চেহারা নেয়নি, তবুও মনে মনে ভয়, আমাকে নেবে কিনা! যাত্রায় জয়েন করার পর প্রথম বছর ‘সাগিনা মাহাতো’ ছাড়া কোনও বিগকাস্ট ছবি করিনি। যখন হাল প্রায় ছেড়েই দিয়েছি তখন একটা অফার এল যা আমার জীবনের অন্যতম উল্লেখযোগ্য, এই ‘ভানু গোয়েন্দার’ অফার।

সেই সময়টা যাত্রার সিজন শেষে বাড়িতে ফিরে একমাত্র ছবির কাজ করছি, নির্মল মিত্রর ‘প্রথম বসন্ত’। একদিন বসুশ্রীতে আড্ডা মারছি, হঠাৎ আমাদের বন্ধু নান্টু রাউতকে নিয়ে মন্টু ঘরে ঢুকে বলল, ‘ভানুদা, নান্টু এসেছে তোমায় কিছু বলতে।’

আমি ভাবলাম কী না কী! নান্টু বলে, ‘আমরা ভাবছি একটা ছবি প্রাোডিউস করব তোমাকে কাস্ট করে।’

আমি বললাম—’এ তো ভালো কথা, গল্প ঠিক করেছিস?’

ওরা বলল একদিন এসে ডিটেইলসে কথা বলবে। কয়েকদিন পরে বসুশ্রীতে প্রণবদাকে (প্রবণ রায়) নিয়ে হাজির। প্রণবদা বলল, ‘তোমাকে নিয়ে একটা গল্প ফেঁদেছি, তোমার ভালো লাগবে। আমার স্ক্রিপ্টও মোটামুটি রেডি, একদিন আমার বাড়িতে স্ক্রিপ্ট শোনাব।’

কয়েকদিন বাদে প্রণবদার বাড়ি গেলাম। শুনলাম, ডিটেকটিভ স্টোরির ওপর কমেডি, ভানু গোয়েন্দা আর জহর আমার অ্যাসিসটেন্ট। পরে আমরা নামকরণ করলাম ‘ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিসটেন্ট’। গল্পটা হল শার্লক হোমসের মতো এক প্রাইভেট ডিটেকটিভ সিরিয়াসলি ক্রাইম ডিটেক্ট করার চেষ্টা করে কিন্তু পরে সেগুলো হাসির ব্যাপার হয়ে যায়। আমার তো একটা নতুন ধরনের রোল পেয়ে খুবই আনন্দ হল। দু-চারদিন প্রণবদার সঙ্গে বসে হাসির খোরাকগুলো জহরের দিকে দিয়ে আমি একটা সিরিয়াস ডিটেকটিভ, মি: জিভস-এর মতো কিছু করার চেষ্টা করলাম।

কিন্তু দিনকাল পালটে গেছে, ডিরেকটর আমাদের অংশ কেটে গুচ্ছেরখানেক গান-টান ঢুকিয়ে রোমান্টিক হিরো-হিরোইনের অনেক সিকোয়েন্স ঢুকিয়ে দিল প্রযোজকদের সঙ্গে পরামর্শ করে। আজকাল নাকি রোমান্টিক ছবি ছাড়া চলে না। যাই হোক, কী আর করা! দিনকাল খারাপ, মেনে নিতেই হল; প্রণবদার তো ভীষণ আপত্তি কিন্তু ওঁকেও মানতে হল, উনি তো আমার চেয়েও বুড়োর দলে।

এখন ঝামেলা হচ্ছে শুভেন্দু, লিলি হিরো-হিরোইনের পার্ট করেছিল ওদের দুজনেরই তখন অনেক নাম। ওরা বুঝতে পারছিল ওরা হিরো-হিরোইন হলেও মেইন রোলটা আসলে আমার, ফোকাসটা আমার আর জহরের ওপর। তাই অস্বস্তি লাগলেও শুভেন্দু, লিলি দুজনেই এতটাই আপনজন যে ওরা মুখ বুজে কাজ করে যাচ্ছিল।

এদিকে প্রাোডিউসার বাদল একেবারে আনকোরা লোক, ফিল্ম লাইনে এই প্রথম; ভানু, জহর মেইন চরিত্রে বলে প্রথমে ডিস্ট্রিবিউটর পেতে মুশকিল হচ্ছিল। অবশেষে মন্টুর সহযোগিতায় বসুশ্রীতে রিলিজ হল, বই হিট হল। শুধু কলকাতায় নয়, মফসসলেও হিট হল। ভানু-জহর দুজন আধবুড়ো, ক্ষয়ে যাওয়া কমেডিয়ানের ছবি হিট হবে—এটা কলকাতা শহরের অনেক নামীদামি বিজ্ঞ ডিস্ট্রিবিউটর একজিবিউটরও কল্পনা করতে পারেনি। যাই হোক, সে বছর ‘ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিসটেন্ট’ হিট হওয়াতে গ্রামে-গঞ্জে আমার যাত্রাও খুব হিট হল।

আমার যাত্রা হিট হওয়াতে সবচেয়ে খুশি হয়েছিল কলকাতার বন্ধকি কারবারি রমনলাল। সে মাঝে মাঝেই বলত—’আমি চাই না তোমাকে ধার নিয়ে মাসে মাসে মোটা সুদ গুনতে হয়, লাভের গুড় তো রমনলালই খেয়ে যাচ্ছে।’ যাই হোক, সুদসমেত সমস্ত ধার শোধ করে আমার গাড়িটা ছাড়িয়ে আনবার জন্য যেদিন ব্লুবুকটা ফেরত নিতে গেছিলাম সেদিন রমনলাল খুব খুশি হয়েছিল। হয়তো ভেবেছিল, ভানু কস্মিনকালেও ধার শোধ করতে পারবে না। আমি বলব, রমললাল ওয়াজ এ মানি লেন্ডার উইথ আ হার্ট।

এরপরে অনেকদিন আমি সিনেমায় ভালো রোল করিনি, ৪-৫ দিনের রোলও আর নিতাম না। পুরোটাই যাত্রায় আর মাঝে মাঝে ফাংশানে কমিক এই নিয়ে ছিলাম। এই সময়টাতেই সলিলের ‘স্ত্রী’-এর শুটিং করলাম। বহুদিন বাদে উত্তমের সঙ্গে শুটিং। উত্তমের আশেপাশে তখন অনেক লোক। প্রথম প্রথম বাধো বাধো, একদিন উত্তম এসে আমায় বলল, ‘কী ভানুদা, ক্যামন আছ?’

আমার কানে খটকা লাগল, কারণ উত্তম চিরদিনই আমায় ‘ভানুদা’, ‘তুই’ বলত।

আমি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলাম, ‘ভালোই আছি, আপনি ক্যামন আছেন?’

উত্তম খুব চালাক ছেলে, বলল, ‘সে কী, তুমি আবার আপনি-আজ্ঞে কবে থেকে ধরলে?’

আমি বললাম, ‘আপনি যবে থেকে ”তুই” ছেড়ে আমাকে ”তুমি” বলা ধরেছেন।’

আশেপাশে সলিল, রসরাজ প্রভৃতি হেসে ওঠাতে ব্যাপারটা স্বাভাবিক হয়ে গেল। ব্যস, ওইটুকুই। তারপরেই অ্যাজ ইউজুয়াল, ‘এই শটটা ক্যামন হল? আবার আরেকটা করবি নাকি?’—অর্থাৎ উত্তম যেমন চিরকালের।

.

এবার সংসারের কথায় আসি আবার। এর মধ্যে আমার বড় ছেলে আমার স্পিরিটের ব্যবসায় যোগদান করল, ছোট ছেলে পিনাকী যাদবপুর ইউনিভার্সিটি থেকে ফিজিক্স-এ অনার্স নিয়ে এম.এসসি পাস করল। মেয়ে বাসবী কম্পারেটিভ লিটারেচার নিয়ে যাদবপুরে এম.এ.-তে ভর্তি হল। এই সময়টায় যাত্রায় ব্যস্ত থাকায় বেশ কয়েকটা ফিল্মের অফার ছেড়ে দিতে হল। এর মধ্যে দিলীপ মুখার্জী, পিনাকী মুখার্জী, সলিল সেন, দীনেন গুপ্তর দুটো ছবি ছেড়ে দিতে হল। তার মধ্যেই আমার বহুকালের বন্ধু গুরু বাগচীর একটা ছবি ‘বিন্দুর ছেলে’ করলাম। আর খোকা অর্থাৎ দীনেন গুপ্তর দুটো ছবি করলাম। এই সময় আমার ছোট ছেলে পিনাকী এম.এসসি পাস করে বসে রইল অনেকদিন। নানা জায়গায় চাকরির চেষ্টা করা হল কিন্তু কোনও ভালো চাকরি পাচ্ছিল না। অবশেষে ‘৭৪ সালে ও আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস, ডালাস-এ পড়তে চলে গেল। মজার কথা, ও যেদিন চলে যাবে সেদিনই প্রিয় দাসমুন্সীর চেষ্টায় ‘ব্যাঙ্ক অফ এলাহাবাদ’-এর একটা চাকরি পেল। কিন্তু তখন তো ওর যাওয়া পাকা। ইতিমধ্যে আমার মেয়ে বাসবীও যাদবপুর থেকে এম.এ পাস করল।

প্রিয় দাসমুন্সী ও সুব্রত মুখার্জী দুজনেই কংগ্রেসের, আমি আবার সোশ্যালিস্ট অর্থাৎ একসময় অনুশীলন, এখন যারা অনেকেই আরএসপি-র। আমি যদিও সক্রিয়ভাবে আরএসপি করি না, কিন্ত বামপন্থা সমর্থন করি। বসুশ্রীতে আড্ডা মারার সূত্রে আমার প্রিয়, সুব্রতর সঙ্গে আলাপ। ভেবেছিলাম নব্য ধারার যুবক, এদের সঙ্গে নিশ্চয়ই আমার জমবে না। কিন্তু দেখলাম দুজনেই অন্যকরকম। প্রিয় তো ভীষণ আলাপি, এমনকী সমাজতন্ত্র, টেররিস্ট মুভমেন্ট, ব্রিটিশরাজ প্রভৃতি নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলাপ হয় ওর সঙ্গে।

আমি অবাক হই একজন কংগ্রেসি হয়েও কী পরিমাণ শ্রদ্ধা ওর চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ সম্বন্ধে, এবং এই বিদ্রোহ সম্বন্ধে ওর জ্ঞানও অপরিসীম। আমি কোনওদিন বিরোধী দল সম্বন্ধে ওকে কটু কথা বলতে শুনিনি। বরং নিজের দলেরই মাঝে মাঝে সমালোচনা করে।

সুব্রতও খুবই মার্জিত, ভদ্র, কোনওদিন রাজনীতির আলাপ নিয়ে তর্কাতর্কি হয়নি; বরং আমার মতামত বেশ মন দিয়ে শুনেছে। ও তখন বাংলার মন্ত্রী, আমি অনন্তদাকে নিয়ে কত কথা, গল্প বলেছি, ও মন দিয়ে শুনেছে। আর ও উপকারীও বটে। সুশীলদা প্রায় ১০-১২ বছর বসে, কোনও কাজ করছেন না শুনে আমার অনুরোধে যেচে সুশীলদাকে সরকারের দুটো ডকুমেন্টারির কাজ দিয়েছে।

আমার সঙ্গে আরএসপি পার্টির খুবই যোগাযোগ—মুর্শিদাবাদ, বহরমপুরে যাত্রা করতে গিয়ে ঢাকুদা অর্থাৎ ত্রিদিব চৌধুরীর সঙ্গে মাঝে মাঝেই দেখা হত। আরএসপি পার্টির প্রথম দিকে ক্ষিতীশ সেন, যোগেশ চ্যাটার্জী, জ্যাকিদা প্রভৃতি চারু অ্যাভিনিউর দেবু সেনের বাড়িতে মিটিং করত। জ্যাকিদা একই সময় চারু অ্যাভিনিউতে থাকতেন। কয়েকদিন আগে পর্যন্ত জ্যাকিদা অর্থাৎ যতীন চক্রবর্তীকে অত্যন্ত মান্য করতাম, জ্যাকিদার কথা আমার কাছে বেদবাক্যর মতো ছিল। নানা লোক নানারকম মন্তব্য করত ওর মন্ত্রিত্ব সম্বন্ধে, তাই নিয়ে কত শত লোকের সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়েছে। আরএসপি পার্টির বাড়ির জন্য যখন চাঁদা তোলা হয় তখন জ্যাকিদা আমায় চাঁদার বই দিয়ে দিয়েছিলেন। অনেক টাকা তুলে দিয়েছিলাম। তার মধ্যে ৯৯ শতাংশ কংগ্রেস সমর্থক, যেমন মন্টু বসু, শ্যামল মিত্র প্রভৃতি আমার চেনাশোনা সিনেমা জগতের প্রচুর লোকের থেকে চাঁদা নিয়েছি, যা আমি আগে কখনও করিনি।

কিন্তু সম্প্রতি আমি এহেন জ্যাকিদার ব্যবহারে মর্মাহত। সম্প্রতি আমার ভ্রাতৃসম ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সুজন ব্যানার্জী এসে বলল, ওর দাদার জন্য জ্যাকিদাকে বলে গল্ফ গ্রিনে যদি একটা ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা করা যায়! আমি প্রথমত, নিজের জন্য কখনও কাউকে রিকোয়েস্ট করি না, তার ওপর জ্যাকিদার সঙ্গে আমার যে সম্পর্ক, তাকে একটা রিকোয়েস্ট করাই যায় হয়তো। আমার চেয়ে অনেক কম চেনা, একেবারে অচেনা লোকও জ্যাকিদার কাছ থেকে ফ্ল্যাট আদায় করছে শুনছিলাম। আমি আর সুজন যাওয়াতে জ্যাকিদা এমন রূঢ় ব্যবহার করলেন যে আমি মর্মাহত, তার ওপর সুজনের কাছেও আমি খুবই নীচু হয়ে গেলাম।

সেদিন যে তাঁর অফিস থেকে বেড়িয়ে এসেছিলাম আজ অবধি আর ওঁর সঙ্গে দেখা হয়নি। ওঁর হয়ে প্রণব সাফাই গাইতে এসেছিল, আমি কথা ঘুরিয়ে প্রণব আর বল্লভদার সঙ্গে রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে লাগলাম। বল্লভদা, রাধাবল্লভ গোপ, ব্রিটিশ রাজত্বে ৩১ বছর জেল খেটেছিলেন। আমার প্রচুর শ্রদ্ধা ওঁর ওপর। উনি আবার মাঝে মাঝে আমার বাড়িতেও আসতেন। প্রণবও আমার প্রিয় পাত্র, সে-ও মাঝে মাঝে আসে। এছাড়া ক্রান্তি প্রেসে গিয়ে মাঝে মাঝে মাখনদা, সুখময়বাবুর সঙ্গে গল্প করি। ননীদা, দেবু ব্যানার্জী এঁদের সঙ্গেও আমার খুব ভালো সম্পর্ক। আমি লক্ষ করেছি জ্যাকিদার গল্প শোনার পর ওঁরা আরও বেশি করে আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখছেন। সিপিএমের নিরঞ্জন সেনের সঙ্গে কিংবা হরপ্রসাদ চ্যাটার্জির সঙ্গে আমার খুবই হৃদ্যতা। নিরঞ্জনবাবুর সঙ্গে মাঝে মাঝে সিনেমা জগতের মিটিং করতে লেক প্লেসের কমিউনে যেতাম, সে অবশ্য অনেককাল আগেকার কথা। তখন প্রায় রোজই প্রমোদ দাশগুপ্তর সঙ্গে গল্প হত। রাজনীতিতে আমার চিরকালই খুব আগ্রহ কিন্তু আমি কারও অন্ধ সমর্থক নই। জাত-পাত-রং না-দেখেই রাজনীতি করেছি এবং চিরকাল স্রোতের বিরুদ্ধে গিয়ে আন্দোলন করেছি।

যাই হোক, আমার ছেলে পিনাকীকে আমেরিকায় পাঠানোর পর ছয়-সাত মাস ওর বেশ কষ্টে কেটেছে। তারপর টিচার্স অ্যাসিসটেন্টশিপ পেয়ে গেল। ওর এই যাওয়া নিয়ে বেশকিছু গল্প আছে যেগুলো না বললেই নয়। সেই সময়টা অর্থাৎ ‘৭০-এর দশকের প্রথম দিকে আমেরিকার সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক বেশ খারাপ ছিল, তখন ভিসা পেতেও বেশ মুশকিল হত। প্রচুর ডিনাইড হত। পিনাকীর আমেরিকা যাওয়ার কোনও আগ্রহ ছিল না, বরং ও চিরকাল নির্বিরোধী, নতুন জায়গায় নতুন পরিস্থিতিকে কীভাবে মানিয়ে নেবে তাই নিয়ে আশঙ্কা ছিল। সবরকম আটঘাঁট বেঁধে ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাসে তো সুযোগ পেল, ওখানে ঘর ভাড়া করে থাকার ব্যবস্থাও হল সব ব্যাপারে আমার ভাগনে খোকন, যে তার দু-বছর আগেই আমেরিকা গেছিল, সেই ও নানারকম সাহায্য করল।

কিন্তু ভিসা রিজেক্টেড হয়ে গেল একরকম বাজে অজুহাত দেখিয়ে। আমাদের তো মাথায় হাত, কারণ ওর যাওয়ার মতো সবরকম যোগাড়যন্ত্র হয়ে গেছে, অনেক টাকাও অলরেডি খরচ হয়ে গেছে। আমি তো দিশেহারা। তো, ডেসপারেট হয়ে একদিন সিদ্ধার্থ রায়ের বাড়ি গিয়ে হাজির—যা হয় হবে, ওকে বলে দেখি। কিন্তু বাড়ি গিয়ে দেখি ও নেই। আমার চোখ-মুখ দেখে মায়া রায় বলল, ‘কী হয়েছে ভানুদা? আপনার কোনও প্রবলেম হয়েছে?’

আমি তো কোনওরকমে আমার সমস্যার কথা বললাম। ও শুনেই সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘আপনি আধঘণ্টা বসুন, আমি দেখি কী করতে পারি!’—এই বলেই ও সেক্রেটারি ভাস্কর ঘোষকে ফোন করে কী সব কথা বলল। ফোন রেখেই আমাকে বলল, ‘আমি এখনই দিল্লি চলে যাচ্ছি, আপনি এখনই আপনার ছেলেকে আমেরিকান কনস্যুলেটে পাঠিয়ে দিন, কিছু প্রবলেম হলেই ভাস্কর ঘোষের ফোন নম্বর দিয়ে দিচ্ছি, ওর সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।’

আমি তো পড়িমড়ি করে বাড়িতে ফিরে পিনাকীকে হ্যারিংটন স্ট্রিটের আমেরিকান কনস্যুলেটে পাঠিয়ে দিলাম যাতে ফার্স্ট আওয়ারেই ইন্টারভিউ হয়। আমাদের লাঞ্চের আগেই পিনাকী ভিসা নিয়ে ফিরে এল, বলল, ‘আধ ঘণ্টায় ভিসা হয়ে গেছে।’

মায়া রায় আমার যা উপকার করেছিল আমি জীবনেও ভুলব না। পিনাকী তো আমেরিকা গেল পড়তে, কিছুদিন পর থেকে দেখলাম আমার সোশ্যাল স্টেটাস চেঞ্জ হয়ে গেল। এমন কিছু লোক যারা আমায় দেখলে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে চলে যেত, হয়তো সিনেমা লাইনের লোকদের সঙ্গে কথা বলা ‘বিনিথ ডিগনিটি’ মনে করত, তারা হঠাৎ যেচে যেচে ‘কি ভানুদা, কেমন আছেন?’ (আমি উত্তর দেওয়ার আগেই) শুনলাম, ‘পিনাকী পড়াশুনা করতে আমেরিকা গেছে?’

আবার আরেকজন লোক, শিক্ষিত ছ্যাবলা টাইপের, কোনোদিনও আমায় পছন্দ করে না এবং জানে আমিও ওকে পছন্দ করি না, একদিন এক বিয়েবাড়িতে এসে—’আরে ভানুদা, আপনার ছেলে নাকি আমেরিকায় পড়তে গেছে? আমি তো ভাবতেই পারিনি একজন বাংলা সিনেমার কমেডিয়ান হয়ে ছেলেকে আমেরিকায় পাঠিয়েছেন?’

‘আমার তো মাথায় রক্ত চড়ছে, অনেক হাবিজাবি কথা বলে আমেরিকা সম্বন্ধে কাগজে পড়া অ্যার্টিক্যাল থেকে কিছু জ্ঞান দিয়ে অবশেষে বলে, ‘যাক, কেমন আছেন?’

বুঝলাম খেজুর করছে, বললাম, ‘আগে যেমন ছিলাম তেমনই আছি।’

ও ভাবল এই মওকা একটু রগড় করার, বলল, ‘আগে কেমন ছিলেন?’

আমি বললাম, ‘যদি না-ই জানো তবে এখন জিগ্যেস করছ কেন?’—মুখ কালো করে সে প্রস্থান করল।

ফোনে বিকাশদা, পাহাড়ীদা প্রভৃতি খবর নিত পিনাকীর ব্যাপারে। বিকাশদার ছেলে অনেক আগেই আমেরিকা গেছিল। যাই হোক, আমার একটু সোশ্যাল স্টেটাসের উন্নতি হয়েছে, সেটা বেশ বুঝলাম।

এই সময়টা যাত্রা, থিয়েটার ও সাংসারিক নানা কাজে ব্যস্ত থাকায় সিনেমায় অভিনয় অনেক কমে গেছিল, খুব ভালো চরিত্র না পেলে করতামই না। আর কয়েকজন বহুদিনের পরিচিত বন্ধুবান্ধবের ছবি করেছিলাম অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে, যেমন তনুবাবুর ‘সংসার সীমান্তে’, হীরেন নাগের ‘প্রিয় বান্ধবী’ প্রভৃতি। যাত্রাও পুরোদমে চলতে লাগল। এদিকে মেয়ে বাসবী এম এ পাস করেছে, তার বিয়ের কথা ভাবতে হবে। আমার স্ত্রী সমানে চাপ দিচ্ছে। ওদিকে ছেলে নির্বাচন আমার কাছে ভীষণ বদারসাম ব্যাপার। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে সিনেমা আর্টিস্ট-এর মেয়ের সঙ্গে আমাদের তথাকথিত বাঙালি সমাজের বৈবাহিক সম্পর্কের খুবই অনীহা ছিল। সিনেমা আর্টিস্ট মানে সমাজের সবচেয়ে নীচুস্তরের মানুষ, অস্পৃশ্য। আমার চেনাশোনা বন্ধুবান্ধবেরাও আমার সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনে বিপুল অনাগ্রহী।

অথচ খামোকা কারণে-অকারণে নাতির জন্মদিনেও আমাকে নিমন্ত্রণ করে ঝোলাঝুলি—আসতেই হবে। কারণ অতিথিদের দেখাতে হবে ভেনো, ভাউন্যা তাদের বুজুম ফ্রেন্ড।

যাই হোক, শেষকালে আমার স্ত্রীর বোনপো সোনা-র চেনা একটা ছেলে পাওয়া গেল, ইলেট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার উৎপল ঘটক। এর বাবা গত হয়েছেন, আই এল.ওতে বড় কাজ করতেন। ওর মা বাসন্তী ঘটক, ছেলের বিয়ে দিতে রাজি হলেন কারণ ওঁরা চিরকাল সুইজারল্যান্ডের জেনিভায় থেকেছেন, বাংলাদেশের লোকেদের মতো অকারণ লোক-দেখানো ছুঁচিবাই নেই বলেই। ওঁর ছেলেটি স্কুলিং সুইজারল্যান্ডে আর কলেজ করেছে ইংল্যান্ডের এসেক্স থেকে। একদিন সোনা উৎপলকে নিয়ে আমার বাড়িতে এসেছিল। ওরা একটা টিভি-সেট বানাবার কারখানা খুলছে, তার ব্যাঙ্ক লোনের জন্য গ্যারান্টার চাই। তো আমাকে গ্যারেন্টার হতে হবে। যেদিন সইসাবুদ হল সেদিনই আমার স্ত্রীর ছেলেটিকে দেখে ভালো লাগল। সোনার মাধ্যমে ওদের বাড়িতে প্রস্তাব দেওয়া হল, ওরা তখন থাকত কাঁকুড়গাছিতে ওদের দাদুর বাড়িতে। কারণ ওর বাবা মারা যাওয়ার পর যখন ফিরে এল ওদের নিজেদের নিউ আলিপুরের বাড়িতে, তখন ওদের ইনফ্লুয়েনসিয়াল মারোয়ারি ব্যবসায়ী ভাড়াটে আর উঠতে চায় না। শেষে কেস করা হল, কেস চলল ৫-৬ বছর, কেসে হেরেও উঠতে চায় না, অবশেষে প্রায় বলপ্রয়োগ করে ওদের ওঠানো গেল। আর আমার মেয়েরা নিউ আলিপুরে উঠে এল।

যাই হোক, বিয়ে তো যে-সে কথা নয়। এর আগে বিয়েতে কিছু কিছু যা কাজ করেছি আমার ভাগনি নোরা, বুলির বিয়েতে। আর তারপর আমার দুই ছেলের পইতে। কিন্তু মেয়ের বিয়ে যে, কত লোক নিমন্ত্রণ করব? বিয়ে কোথায় হবে? কারণ তখন আমার চেনাশোনার সার্কেল প্রচুর, কাকে ছেড়ে কাকে বলব! এত লোক তো ধরবে না আমার চারু অ্যাভিনিউর বাড়িতে।

অবশেষে বসুশ্রীর সবাই কোমর বেঁধে নেমে পড়ল। বসুশ্রীর বাবলি সরকার একদিন ল্যান্সডাউনের অরুণ চ্যাটার্জীর বিয়েবাড়িতে নিয়ে গিয়ে হাজির, অরুণ তো এক কথায় তিন-চার তলা দিয়েদিল। আমার তো প্যালপিটেশন চলছে, কত টাকা ভাড়া চাইবে! ও বলল, এক পয়সাও নেবে না।

আমি তো অবাক, তাই হয় নাকি! অবশেষে ১ টাকা নিল।

এ কথা শুনে সবাই তো অবাক, কারণ সেই সময়ে, ১৯৭৫ সালে যে-ক’টা বাড়ি বিয়ের জন্য দক্ষিণ কলকাতায় ভাড়া দিত তার মধ্যে অরুণ চ্যাটার্জীর ল্যান্সডাউনের এই বাড়িটি বিখ্যাত। সমস্ত কেটেছেঁটে নিমন্ত্রিতের সংখ্যা অসংখ্য। আর এই জনে জনে বাড়িতে গিয়ে নিমন্ত্রণ করা যে কী কঠিন কাজ সে বর্ণনা করা যায় না। অনন্তদাকে জেলে গিয়ে নেমন্তন্ন করলাম, উনি তো আর আসবে না, তবে ওঁর খাবার পাঠাব বলে এসলাম। উনি বললেন, শুধু ওঁকে পাঠালে হবে না, সঙ্গে আরও ৮-১০ জনের খাবার পাঠাতে হবে, যারা জেলে ওঁর ঘনিষ্ঠ।

এদিকে জেলে গিয়ে আরেক অভিজ্ঞতা হল। তখন জেলার আমার ছেলেবেলার স্কুলের বন্ধু বিনু রায়ঘটক। আমায় দেখে প্রথমে পুলকিত, তারপর যখন জানল অনন্তদাকে নিমন্ত্রণ করতে এসেছি তখন জ্ঞান দিতে আরম্ভ করল—’ও একটা ডাকাত, ওর সঙ্গে সম্পর্ক রাখা ঠিক নয়।’ তখনও কেস চলছে, তাই জিগ্যেস করলাম—’কী করে জানলি ও ডাকাত?’

আমার জেলার বন্ধু বলেই চলে, হ্যাঁ, ওর বাড়ি আছে আনোয়ার শাহ রোডে, গড়িয়ায়।’ নানারকম হাবিজাবি।

আমিও রসিকতা করে বললাম, ‘তোর বালীগঞ্জের বাড়ি কদ্দূর হল?’

ও বলল, ‘তুই কী করে জানলি আমি বালীগঞ্জে বাড়ি করছি?’

যা বাবা, আমি মশকরা করতে গিয়ে সেটাই যে সত্যি হয়ে যাবে তা ভাবিনি!

উত্তমের বাড়িতে শুনেছি খুব স্ট্রিক্ট, কারণ সুপ্রিয়া ফিল্ম লাইনের ঘনিষ্ঠদের সচরাচর দেখা করতে দিত না, মুষ্টিমেয় কয়েকজন ছাড়া। কিন্তু আমি কোনোদিন কড়াকড়ি মানতাম না, সোজাসুজি ঢুকে যেতাম উত্তমের ঘরে। আমি একটু গাইদর টাইপ তো। ঢুকেই উত্তমকে একটা কার্ড দিলাম ‘অরুণ চট্টোপাধ্যায়’ নামে, সুপ্রিয়া-কেও একটা কার্ড দিলাম। ময়রা স্ট্রিট থেকে সোজা চলে গেলাম গিরীশ মুখার্জী রোডে, সেখানে গিয়ে গৌরীকে নিমন্ত্রণ করলাম। শুনেছিলাম গৌরী আজকাল কোথাও যায় না; আমি বললাম, ‘আমি চাই ৮টার মধ্যে তুই আসবি, যদি না আসিস ৮টার মধ্যে তাহলে আমি নিজে বিয়েবাড়ি থেকে এসে তোকে নিয়ে যাব।’

গৌরী আমাকে বহুদিন থেকে জানে আমি কীরকম লোক, ও নিজেই এসেছিল ৮টার বহু আগেই। আর ছিলও অনেকক্ষণ।

প্রচুর লোক এসেছিল, আমার ছোটবেলার ঢাকার বন্ধু গোপাল মিয়াঁর ছেলে-বউরা এসেছিল। কেবল আমার ছোট ছেলে পিনাকী থাকতে পারল না, এটাই যা দু:খ। ল্যান্সডাউনের এই বিয়েবাড়ি নেওয়াতে সুবিধা হয়েছিল আমার চেনাশোনা সাউথ, নর্থ দুই ক্যালকাটার লোকদেরই আসার অসুবিধা হয়নি।

যাই হোক, বিয়ে তো ভালোভাবে মিটে গেল। তার ক্রেডিট অবশ্যই আমার স্ত্রীর প্রাপ্য, কারণ ৭০ ভাগ কাজ সে-ই করেছে। আমার একটাই অসুবিধা হল কাঁকুরগাছি গিয়ে মেয়েকে দেখতে হত, ঈশ্বরের কৃপায় অবশ্য সেটা বেশিদিন দেখতে হয়নি।

কিছুদিন বাদেই ওরা নিউ আলিপুরের বাড়িতে চলে এল। পরপর দু’বছর দুটো কাজের মতো কাজ হল (এক, ছেলেকে উচ্চশিক্ষার জন্য আমেরিকা পাঠানো, আর তার পরের বছর মেয়ের বিয়ে দেওয়া)। মনটা বেশ খুশি খুশি ছিল। এর পরের বছর অর্থাৎ ১৯৭৬ সালে আরেকটা খুশির ব্যাপার হল আমার সস্ত্রীক আমেরিকা যাত্রা। এই আমেরিকা যাত্রা আমার এক বিরল অভিজ্ঞতা। ১৯৭৬-এর ১২ জুন আমরা অর্থাৎ আমি আর আমার স্ত্রী আমেরিকা পাড়ি দিলাম, তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল টেক্সাসের ডালাসে আমার ছেলে পিনাকীর সঙ্গে দেখা করা।

কিন্তু আমি ডালাস যাচ্ছি শুনে আমাকে আর নীলিমাকে জুড়ে দেওয়া হল কয়েকটা শহরের ফাংশানে। আসলে গায়ত্রী বসুর স্বামী ঠান্ডু, গায়ত্রী আর শ্যামলকে নিয়ে একটা গানের ফাংশান-এর পরিকল্পনা করছিল, প্রধানত কানাডার টরেন্টোর সঙ্গে। আমাকে আর নীলিমাকে তার সঙ্গে জুড়ে আমেরিকাতেও বেশ কয়েকটা শহরে ফাংশানের প্রাোগ্রাম পেয়ে গেল।

প্রথমেই আমি আর নীলিমা ডালাসে গিয়ে আমার ছেলের সঙ্গে দেখা করলাম। তখনও শ্যামল, গায়ত্রীরা পৌঁছোয়নি।

ডালাসে একটা ঘরোয়া অনুষ্ঠান করলাম। সেইসময় আমেরিকায় অনুষ্ঠান করা প্রায় কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার করার মতো। যে-ক’জন গুটিকতক বাঙালি সে-জায়গায় থাকত তাদের কয়েকজন মাত্র আসত অনুষ্ঠান দেখতে। বড় শহরগুলোতে অবশ্য দু-তিনশো লোক হত। প্রথম কয়েকদিন তো ছেলের সঙ্গে আর আমার ভাগ্নে খোকন আর খোকার সঙ্গে কাটাতাম। আমার মেয়ের বিয়ের এক সপ্তাহ আগেই আমার ভাগ্নে খোকনের বিয়ে হয়েছিল কামিনীর সঙ্গে, ওরা গায়ানার প্রবাসী ভারতীয়।

আমার ছেলের ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস দেখলাম। আমরা ভারতীয় ইউনিভার্সিটি দেখেছি, ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাসের মতো বড় ক্যাম্পাস আমি কখনও দেখিনি। একটা ছোটখাটো শহরের মতো। পিনাকীও ক্যাম্পাসের মধ্যেই থাকত। ওর বিশেষ বন্ধু মার্ভ পিওয়ানি ও তার স্ত্রী ডায়নার সঙ্গেও আলাপ হল, মার্ভ আমায় পিনাকীর লেখাপড়া সম্বন্ধে সবকথা বলছিল। প্রথম দিন যেদিন ওকে ক্লাসে দাঁড়িয়ে ও কী শিখেছে বলতে হয়েছিল সেদিন নাকি ও খুবই ঘাবড়ে গেছিল। খুবই স্বাভাবিক, আমাদের দেশে এরকম পদ্ধতি তো চালু নেই।

খোকনের শ্বশুরবাড়ির মিস্টার নারায়ণ ও তাঁদের পরিবারের সঙ্গে কাটালাম।

ডালাসের ছোট অনুষ্ঠান করার পর শ্যামল, গায়ত্রীরা পৌঁছোলে আরম্ভ হল শহরগুলোর ফাংশান। তখনকার দিনে ছোট শহরগুলোয় ফাংশানের জন্য টাকা না দিয়ে মেমেন্টো দিত। এরপরে পরপর হিউস্টন, নিউ ইয়র্ক, নিউজার্সি, ওয়াশিংটন, লস এঞ্জেলস, ডেট্রয়েট প্রভৃতি শহরে ফাংশান করলাম। শেষ ফাংশানটা করেছিলাম হিউস্টনে। হিউস্টনের ফাংশান অর্গানাইজ করেছিল আমার ভাগ্নে খোকনের বাংলাদেশি বন্ধু আফতাব প্রভৃতিরা। বহুদিন বাদে দেশের কয়েকজন লোক দেখে খুবই ভালো লেগেছিল।

ওখানে আমার একটা জোক খুবই অ্যাপ্রিসিয়েটেড হয়েছিল—মাস্টারমশাই ছাত্রকে জিগ্যেস করছে—’বল তো বাঙাল আর বাঙালির মধ্যে কী তফাত?’

ছাত্র—বাঙাল পুংলিঙ্গ আর বাঙালি হচ্ছে স্ত্রী লিঙ্গ।

.

আরেকটা স্কেচ—এক ভদ্রলোক একজন কুট্টিকে বলে, ‘তুই কথা উচ্চারণ ঠিকভাবে করিস না ক্যান? শোনা রে হোনা কস ক্যান?’

কুট্টি বলে, ‘আমি তো হোনাই কই। আপনি হ্যান হনতে হোনেন হোনা।’ (আমি তো শোনাই বলি আপনি স্যান শুনতে শোনেন শোনা)—এগুলি খুব অ্যাপ্রিসিয়েটেড হয়েছিল বাংলাদেশিদের কাছে।

.

এই প্রত্যেকটি শহরে আশাতীত সংবর্ধনা পেলাম, নিউ ইয়র্ক বাদে। লস অ্যাঞ্জেলস-এর সুমন্ত্র, সুনীল আর নূপুর দত্ত, এদের সঙ্গে এখনও যোগাযোগ আছে। শঙ্কর তো এখন আমার ছেলে গৌতমের পার্টনার। ওদের একজনের বড় চুল আরেক জনের বড় দাড়ি, কী সব ডাবিং থিয়েটার-ফিয়েটার করবে। আমার একটা জমি আছে আনোয়ার শাহ রোডের কাছে, সেটা ওদের দিয়ে দিয়েছি। ওরা বিশেষ এগোতে পেরেছে বলে মনে হয় না।

শঙ্কর তো ওয়াশিংটন থেকে পাকাপাকি কলকাতায় চলে এসেছে। আজ বম্বে কাল দিল্লি করে বেড়াচ্ছে। ওরা একটা লাইসেন্স নাকি বাগিয়েছে বিজনেস করার জন্য, তবে সেটা শঙ্করের দৌলতে; আমার ছেলের তেমন কোনও এলেম আছে বলে মনে হয় না। সঙ্গে আবার জুটেছে শুভ গুহঠাকুরতার ছেলে ভীষ্ম। দেখি কদ্দূর কী করতে পারে!

যাই হোক, ডেট্রয়েটে ফাংশান করে খুব আনন্দ পেয়েছি, এখানকার লোকেরা যা খাতির-যত্ন করেছে ভুলবার নয়। ডেট্রয়েট শহরে ক্রাইম এত প্রবল যে এখানে ফাংশান করতে হয়েছে দিনের বেলা ২টোর সময়ে।

আমার আমেরিকা যাত্রার সর্বাধিক তিক্ত অভিজ্ঞতা হচ্ছে নিউ ইয়র্ক। আমার মনে হয় পরিকল্পনা করে আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা হয়েছে এখানে। প্রবীর রায় নামে একটা চরিত্র আছে যে নিজেকে কেউকেটা মনে করে। প্রচণ্ড হামবড়া ভাব, তার ভাবসাবটা এরকম যে আমি যেন তার দয়াতেই আমেরিকা যেতে পেরেছি, নইলে আমার মতো তুচ্ছ লোক আমেরিকায় যেতে পারে না। বেশ প্ল্যানট্যান করেই আমাকে অপমান করেছে, আর এই কাজে তার দোসর ছিল পিকে নামে আরেকটি চরিত্র।

এ অভিজ্ঞতা আমার একার নয়, বুড়ো, সত্যরা ওদের টিম নিয়ে ‘নহবত’ নাটক করতে আমেরিকা গেছিল। নাটক করে ফিরে এসে একদিন বুড়ো, সত্য আমার বাড়িতে এসে আমাকে জিগ্যেস করেছিল, আমি এই প্রবীর রায় নামে ব্যক্তিটিকে চিনি কি না? এ কলকাতায় এলে কোথায় থাকে? ইত্যাদি। আমরা ঠিকই করেছিলাম কলকাতায় এলে ওর সঙ্গে দেখা করে আমি, বুড়ো আর সত্য একসঙ্গে একান্তে আলাপ করে আসব, কিন্তু আজ পর্যন্ত ওর ‘পাত্তা’ লাগাতে পারিনি।

নিউ ইয়র্কের আর সবাই অবশ্য খুবই ভালো লোক। কিন্তু তাদের বোধহয় সেরকম কিছু ক্ষমতা নেই যে প্রবীরের ওপরে কথা বলবে।

ওয়াশিংটনে আমি সমরদার সঙ্গে দেখা করতে পেরেছি সেটা আমার সৌভাগ্য। সমরদা, ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের সমর সেন। আমি ওঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য রুনু অর্থাৎ রঞ্জিত গুপ্তের চিঠি নিয়ে গেছিলাম। সমরদা রঞ্জিৎ-এর চিঠি সরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘তোমার কি আবার কারুর ক্যারেক্টর সার্টিফিকেট দরকার নাকি?’

যাই হোক, ওয়াশিংটনের লোকেরা ভালো হওয়াতে অনেক কিছু দেখতে পেরেছি, ঘুরে বেড়িয়েছি, যেমন লস অ্যাঞ্জেলসে ইউনির্ভাসাল স্টুডিয়ো, ওয়ার্নার্স ব্রাদার্স স্টুডিয়ো দেখাটা স্বপ্নের মতো। ডিসনিল্যান্ডও দেখে নিয়েছি। নিউ ইয়র্কেও আমার ছেলের বন্ধুদের দৌলতে স্ট্যাচু অফ লিবার্টি দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। আর পৃথিবীর সর্বপ্রথম স্কাই স্ক্রেপার ‘এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং’ দেখে চক্ষু সার্থক করেছি। আমেরিকা থেকে কানাডা গিয়ে টরেন্টো, মন্ট্রিল, ওন্টারিওয়ে শো করে খুবই আনন্দ পেয়েছি, এসব জায়গায়গুলোতে খুবই সমাদর পেয়েছি। ওন্টারিওর শিপ্রা, অনিমেষ তো খুবই হৃদ্যতামূলক ব্যবহার করেছে, বিশেষ করে শিপ্রা তো এখনও যোগাযোগ রাখে। মন্ট্রিলে আমার বহুকালের চেনা রঞ্জন আমার সঙ্গে ছিল। মন্ট্রিলে আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্য অলিম্পিক দেখা, এটা আমার পরম সৌভাগ্য যে ১৯৭৬-এর মন্ট্রিল অলিম্পিকে উপস্থিত থেকে পতুর্গালের ‘ইউসেবিও’র খেলা চাক্ষুষ দেখেছি, যদিও ইউসেবিওর খেলা আমার তেমন কিছু ভালো লাগেনি।

উত্তর আমেরিকা সফর আমার কাছে একটা পরম সুখকর অভিজ্ঞতা। যদিও অর্গানাইজাররা আমাকে বিশেষ কিছু টাকাকড়ি দেয়নি এই অজুহাতে যে আমি তো ছেলের সঙ্গে দেখা করতে আসছিলাম-ই। তবে কয়েকটা জায়গা তো দেখতে পেলাম। আমার খুব ইচ্ছা যাওয়ার সময় যদি লন্ডনটাও দেখা যেত! লন্ডনে যুগান্তর পত্রিকার একটা বাড়ি আছে, যদি ওখানে ৩-৪ দিন থাকার ব্যবস্থা করা যায় সেইজন্য তুষারকান্তি ঘোষ মহাশয়ের সঙ্গে দেখা করলাম। উনি বিশেষ পাত্তা দিলেন না, তাই লন্ডনে যাওয়া হল না। এমনি সময়ে উনি বেশ খাতির করেন আমাকে, তাই ভেবেছিলাম হয়তো ওঁর দাক্ষিণ্য পাওয়া যাবে।

২৫ অগস্ট বিদেশ থেকে ফিরলাম। এসেই সলিলের ‘অসাধারণ’ ছবিতে একটা রোল পেলাম। একদিন উত্তমের সঙ্গে শুটিংয়ের পর খুব আড্ডা হল, ও-ই জানতে চাইল আমেরিকা সফর কেমন হল, পিনাকী কেমন আছে? ইত্যাদি। বুঝলাম ওরও খুব ইচ্ছা আমেরিকা ঘুরে আসবার। সেই বছরই গৌরাঙ্গের লেখা ‘চাটুজ্যে বাড়ুজ্যে’ আর ‘ভৈরবমন্ত্র’ যাত্রা করলাম। গুরু বাগচীর ‘রামের সুমতি’-তেও একটা ছোট রোল করলাম। আমেরিকা যাওয়ার আগেই তপনবাবুর ছবি ‘হারমোনিয়াম’-এ একটা রোলে শুটিং করলাম। এই সময়ই গৌরাঙ্গকে বললাম, ‘হর্ষবর্ধন গোবর্ধন’ নিয়ে কিছু ভাবনা চিন্তা করে একটা গল্প দাঁড় করানোর কথা। মুশকিল হচ্ছে ‘হর্ষবর্ধন গোবর্ধন’ পুরোটাই টিপিক্যাল শিবরামীয় Pun-এর ওপর নির্ভর, গল্প কিছু নেই। এর কয়েকদিন পরেই তপনবাবুকে ডেকে পাঠালেন, একটা নতুন ছবির স্ক্রিপ্ট শোনালেন, ‘এক যে ছিল দেশ’। গল্পটা আমার বেশ ইন্টেরেস্টিং মনে হল, অনেকটা পরশুরামের ‘পরশপাথর’-এর মতো অ্যাবসার্ড থিম-এর উপর। বেশ একটা জমাটি কমেডি, শংকরের লেখা গল্প।

এই সময়টা ছেলের বিদেশে পড়াশুনা, মেয়ের বিয়ে, আমার বিদেশযাত্রা ও যাত্রায় সাত মাস ব্যস্ত থাকাতে এবং ভালো রোল না-পেলে করব না—এই ডিসিশন নেওয়াতে বেশ কয়েকটা সিনেমার অফার নেওয়া গেল না। তার মধ্যে কনকের ‘দাবী’, ‘শর্মিলা’, ভোলা রায় প্রযোজিত ‘কবি’, দিলীপ মুখার্জি পরিচালিত আশুতোষের লেখা একটা ছবি, বিকাশদা পরিচালিত একটা ছবি, মহাশ্বেতার গল্প নিয়ে দিলীপ আরেকটা ছবি করেছিল, সেটায় ধীরেশ নামে একটা ছেলে যে খুব নীচু থেকে স্ট্রাগল করে উঠেছে, আমার প্রবল ভক্ত, তার অনুরোধ ঠেলতে পারলাম না। স্বদেশ সরকারের পরিচালনায় একটা ছবি করলাম, করতেই হল। এই সময়টা আমার এমন অবস্থা হয়েছিল যে মঞ্জু দে এসেছিল শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায়ের ডিটেকটিভ উপন্যাস নিয়ে, কিন্তু যাত্রার জন্য সেটাও করতে পারিনি। একদিন সুনীল অর্থাৎ সুনীল রাম সুশীল নামে এক পরিচালককে নিয়ে হাজির। সুনীল বহুদিনের পরিচিত, নির্মলদা অর্থাৎ নির্মল দের সঙ্গে বহুদিন ছিল। সুনীলও আগে ‘স্বয়ংসিদ্ধা’ ছবি করেছিল। যাই হোক, সুশীল ছবি প্রাোডিউস করছে, তারাশংকরের লেখা ‘দুই পুরুষ’ রিমেক করছে উত্তমকে নিয়ে, যে ছবিটা করেছিল বছর ৩০ আগে। স্ক্রিপ্ট শোনাল। স্ক্রিপ্ট শোনাবার আগে আমায় সুশীল বলল, ‘অনেক কষ্ট করে মাথা খাটিয়ে আপনার জন্য একটা দারুণ রোল বার করেছি।’ স্ক্রিপ্ট শোনবার পর আমি বললাম, ‘ক’দিনের রোল?’

সুশীল বলল, ‘চারদিন।’

আমি বললাম, ‘করব না।’

সুশীল বলল, ‘ভানুদা, দিন দিয়ে দেখবেন না, রোলটা দারুণ, এত কষ্ট করে বার করলাম, এখন কী করি?’

আমি বললাম, ‘যেখান থেকে বার করেছ সেখানে ঢুকিয়ে দাও।’ সুনীলকে বললাম, ‘ভালো রোল নিয়ে আসিস, তোর নেক্সট ছবি বিনা পয়সায় করে দেব।’

এর কিছুদিন পরেই সুনীল খোকাকে নিয়ে উপস্থিত, খোকা অর্থাৎ অভিনেতা দিলীপ রায় ‘দেবদাস’ করবে। উত্তম আর সৌমিত্রকে কাস্ট করে ছবি করছে, আমি একটু অবাকই হলাম। কারণ উত্তম চিরকালই বলত, দুটো ছবির আমি রিমেক করব না, একটা ‘প্রিয় বান্ধবী’ আরেকটা ‘দেবদাস’। কয়েকদিন আগে অবশ্য ও ‘প্রিয় বান্ধবী’ করেছিল। তাই ভাবলাম বুঝি ওর মত পরিবর্তন হয়েছে। ‘প্রিয় বান্ধবী’-এর শুটিং-এর সময়ে আমি একদিন জিগ্যেস করেছিলাম—’উত্তম মনে আছে?’

ছেলেটা এত ইন্টেলিজেন্ট, বলল, ‘হ্যাঁ, মনে আছে কিন্তু কী করব, সবাই বলল আগের ছবির কোনো অস্তিত্ব নেই, করে ফেলো।’

এ ছবিতে উত্তম বোধহয় সে সময়ে সবচেয়ে বেশি টাকা পেয়েছিল। আমি বললাম, ‘তাহলে উত্তম শেষমেশ রাজি হল ”দেবদাস” করতে?’

খোকা বলল, ‘আরে না না, উত্তমদা কিছুতেই দেবদাসের পার্ট করতে রাজি হল না। শেষে চুনীবাবুর পার্ট করতে রাজি হল। পুলু করবে দেবদাসের পার্ট।’

আমি দেখছি উত্তমের ভীষণ মনের জোর, যদি ‘না’ বলে তো পৃথিবী উলটে গেলেও করবে না।

যাই হোক, খোকার পরিচালক হিসেবে প্রথম ছবি, আর সুনীলকে আগে কথা দিয়েছিলাম ওর পরের ছবি করব, তাই একটা ছোটখাটো রোল করতে রাজি হয়ে গেলাম। শুটিং-ডেট যাত্রার সঙ্গে ক্ল্যাশ করছিল, তা-ও। এই সময়টা অর্থাৎ ‘৭৮-‘৭৯ সাল নাগাদ যাত্রার ধকলটা আর সহ্য হচ্ছিল না, শরীরটা বেশ খারাপ যাচ্ছিল। এই সময়টায় ‘দেবদাস’ ছাড়া আর বিশেষ কোনো ছবির শুটিং ও করেনি।

ধীরেশের একটা ছবির শুটিং করেছিলাম ‘সন্ধি’ নামে। দীপঙ্কর ছেলেটা স্মার্ট, এডুকেটেড, আবার হাত দেখতেও জানে। আমাকে সামনের দু-তিন বছর সাবধানে থাকতে বলেছে। অভিনয়টা খারাপ করে না, কিন্তু অভিনয় করতে এসে প্রথমদিকেই একটু বেহুদা ঝামেলায় পড়েছে।

ব্যাপারটা হল তপনবাবু ‘বাঞ্চারামের বাগান’ ছবি করেছিলেন প্রথমে উত্তমকে কাস্ট করে। আমিও ছিলাম। উত্তমের হাতে তখন একসঙ্গে ৯-১০ টা ছবি, তার ওপর হিন্দি ছবিও আছে। শরীরটাও মাঝে মাঝে পীড়া দিচ্ছে, মানে সব মিলে ভাজা-ভাজা অবস্থা, কিছুতেই ডেট দিতে পারছিল না। বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করে তপনবাবু দীপঙ্করকে কাস্ট করে নেয়। তাতে উত্তম বেশ আশাহত হয়। উত্তমের কিছু কাছের লোক খুব হম্বিতম্বি শুরু করে দেয়, দীপঙ্করকেও দু-চার কথা শুনিয়ে দেয়। আমি তাদের দু-একজনকে বলি—’দীপঙ্করের কী দোষ? ওকে তো সব জেনে বুঝে তপনবাবুই কাস্ট করেছে।’ অঞ্জন নামে এক ফিল্ম জার্নালিস্টও এই ঘটনাটা লিখেছিল। তাতে উত্তমের বন্ধুবান্ধব খুব ক্ষিপ্ত হয়ে যায়।

এই ঘটনাটা ফিল্ম জগতে বেশ আলোড়ন ফেলেছিল। এই অঞ্জনের এক গল্প নিয়ে শুভেন্দু একটা ছবি পরিচালনার পরিকল্পনা করেছিল, যার মেইন কাস্ট ছিল উত্তম। আমাকেও কাস্ট করেছিল। পুলিশের দুর্নীতি নিয়ে ছবিটা। ছবিটা নিয়ে আমার কৌতূহল ছিল, আবার ভয়ও ছিল, ওপরওয়ালারা করতে দেবে কিনা!

আজকাল আমার ছোটবেলার স্মৃতি খুব মনে পড়ে। সেই ঢাকার দক্ষিণ মৈসন্তি, গোয়ালনগর, সদরঘাট, গেন্তারিয়া, পাঁচগাঁও একদম ছবির মতো ভাসে চোখের সামনে। ১৯৭৪-এ আমার ছেলেবেলার বন্ধু অনিশ কিবরিয়া এসেছিল আমার বাড়িতে, সে জিগ্যেস করল—’বাংলা সেলিব্রেটিরা তো সবাই যায়, তুমি যাও না কেন?’

আমি বললাম, ‘তোমরা তো এখানকার সেলিব্রেটি, তার পয়সার সেলিব্রেটি, পাশের বাড়ির লোক নাম জানে না, এমন সেলিব্রেটি, সবাইকে ডেকেছ; আমাকে তো কোনওদিন ডাকোনি।’

 সে বলে, ‘তোমায় কী ডাকব?’ তুমি আমাদের লোক, আমাদের গর্ব। তুমি নিজের দেশে নিজে যাবে, তোমায় ডাকতে হবে?’

বেশ কথার মারপ্যাচে আমায় কাবু করার চেষ্টা করল। আমি বললাম, ‘বেশ, আমায় যদি দেশের গর্বই মনে করো তো দেশ তো কৃতী সন্তানকে সংবর্ধনা দেয়, তা-ও তো কোনওদিন দাওনি!’

ব্যস চুপ, বুঝল, আমার মনে গভীর দু:খ আছে। আনিস আবার সম্পর্কে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট তাজুদ্দিনের শ্যালক। এর এক বছর পরেই ‘চট্টগ্রাম স্মৃতিরক্ষা কমিটি’র সঙ্গে বাংলাদেশ গিয়েছিলাম, ফাংশান-টাংশান কিছু করিনি।

আমার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, আমার পুরোনো ঢাকাকে দেখা, প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর পর ঢাকা গেলাম। আমার পুরোনো বাড়িগুলো, যেখানে ছিলাম, সেইন্ট গ্রেগারিজ স্কুল, জগন্নাথ কলেজ, ঢাকা ইউনিভার্সিটি, সদরঘাট, মুকুল টকিজ প্রভৃতি দেখলাম। ঢাকার সুভাষ দত্ত পাকিস্তানের গোলমালের সময় কলকাতায় এসেছিল, আমার বাড়িতে দু-একবার এসেছিল। আমাকে স্টুডিয়োতে ডেকেছিল শুটিং দেখার জন্য। সেখানে করবী, ববিতা ইত্যাদি বাংলাদেশের নামকরা অভিনেত্রী, তাদের সঙ্গেও দেখা হল। আমার পুরোনো বন্ধু ঢাকার নামকরা গুন্ডা হাবিবা, তাকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করলাম। আমার বহুকালের বন্ধু গোপাল মিঁয়ার বাড়ি গেলাম, খেলাম, থাকলাম। অগণিত সাধারণ মানুষের সঙ্গে দেখা হল। তাদের ভালোবাসা পেলাম, কোনওরকম সরকারি অনুষ্ঠানের সংবর্ধনা-নিমন্ত্রণ পাইনি, যাইওনি।

দুই বাংলার লক্ষ কোটি মানুষের ভালোবাসা, সম্মান পেয়েছি; ওতেই আমার বেশি আগ্রহ। ঢাকা, চট্টগ্রামে অন্তত এক হাজার মানুষ আমার সঙ্গে দেখা করেছে, যারা কোনওদিন আমাকে দেখেনি, আমার সিনেমা দেখেনি। যাদের প্রত্যেকের বয়স পঁচিশের নীচে কিন্তু তারা আমার প্রত্যেকটা হাস্যকৌতুকের রেকর্ড শুনেছে, ভালোবেসেছে এবং আমি এসেছি শুনে সাক্ষাৎ করতে এসেছে। এটাই আমার কাছে পরম পাওয়া।

‘৭৭-‘৭৮-এ শরীরটা খারাপ হওয়া সত্বেও কয়েকটা নতুন নতুন পরিকল্পনা নিচ্ছিলাম। ভাবছিলাম, যখন যাত্রা করব না, তখন নিজস্ব একটা অ্যামেচার থিয়েটার গ্রুপ বানিয়ে নাটক করব মাঝে মাঝে। প্রথমেই শচীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অভিমানী আন্দামান’ করব ঠিক করলাম। ‘অভিরূপ’ নাম দিয়ে কয়েকজন ছেলে-ছোকরা যারা আমার সঙ্গে যাত্রা করত, তাদের নিয়ে অ্যামেচার থিয়েটার গ্রুপ তৈরি করলাম। প্রথমদিকে অরুণ মুখার্জী আর অমরনাথও ছিল। প্রধান উদ্দেশ্য নাটকের অভিনয়টা ঝালিয়ে রাখা আর নাটকের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করা। এরপর আরও একটা নাটক শক্তিপদ রাজগুরুর ‘লালদীঘির দিনরাত্রি’র কয়েকটা শো করে ফেললাম।

গ্রুপ থিয়েটার মানে লাভের কথা মনে-না রেখে ভালো নাটক করা। আমি গ্রুপ থিয়েটার করতে গিয়ে বেশকিছু গাঁটের পয়সা গচ্চা দিয়ে দিলাম। এমনিতে বেশিরভাগই তো বিনা পয়সায়, গানের সুরও দিল নীলিমা। ভালো লাইট করার জন্য কনিষ্ক সেনকে নিয়েছিলাম, আর মঞ্চ তৈরি করার জন্য আমাদের ড্রেস সাপ্লায়ার ধীরেনবাবুর ছেলে মনুকে নিয়েছিলাম। ওতেই প্রচুর বেরিয়ে গেল। এসব দেখেশুনে আমার স্ত্রী ঠিক করে ফেলল আমায় আর যাত্রা করতে দেবে না, কারণ আমার যাত্রার ধকল সহ্য হচ্ছিল না, মাঝে মধ্যেই শরীর খারাপ হচ্ছিল।

১৯৭৮ সালের সরস্বতী পুজোর দিন যাত্রা ক্যানসেল করতে হল, পরে আরও ৪-৫ দিন বাড়ি থাকব মনস্থির করলাম। বহুদিন বাদে সরস্বতী পুজো উপলক্ষ্যে বাড়িতে থাকলাম। অনেক লোক দেখতে এল। আর সেইদিনই বহুকালের পরিচিত হরিদাস সান্যাল এল। আগে ও কাস্টমসে চাকরি করত, আজকাল মাড়োয়ারিদের সঙ্গে ব্যবসা করে ভালোই পয়সা করেছে। নাটকের প্রাোডিউসর হয়েছে। ‘মল্লিকা’, ‘অঘটন’, প্রভৃতি নাটক প্রযোজনা করেছে। গণেশ মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে এসে বলল এবং প্রস্তাব দিল, ও আমাকে নিয়ে নাটক করতে চায়। নাটক নির্বাচন, অভিনেতা নির্বাচন ইত্যাদিতে আমার ফুল লিবার্টি। এর আগে ওর অনেক লস হয়ে গেছে, আমাকে মেকাপ করে দিতেই হবে।

আমার চেয়ে আমার স্ত্রীর উৎসাহ বেশি।

কিন্তু যাত্রা না করলে সংসার চলবে কী করে? আমার স্ত্রী-ই হরিদাসের সঙ্গে কথা বলে এমন একটা বিরাট অঙ্কের মাইনে বলল যে আমি হলে কস্মিনকালেও এরকম একটা অঙ্ক বলতে পারতাম না।

হরিদাস দেখলাম তাতেই রাজি হয়ে গেল। আমার সব শর্তেই সে রাজি হয়ে গেল। কেবল দেবুদা অর্থাৎ দেবনারায়ণ গুপ্তকে নিতে রাজি হচ্ছিল না, শিবাজির স্ক্রিপ্টটাই পুরো ছিল। আমি দেবুদাকে দিয়ে হিরো-হিরোইনের সিনে দেবুদার কিছু সংলাপ রেখে দিলাম, এবং দেবুদাকে উপদেষ্টা হিসাবে রাখলাম। যাত্রার দলের কয়েকজনকে রেখে রঙমহলের সরযূদি, অজিত, মনু ইত্যাদি সত্য লকা মঞ্জলা এবং উজ্জ্বল ও বিপ্লবকে নিয়ে ১২ জুলাই, ১৯৭৯ রঙ্গনায় ‘জয় মা কালী বোর্ডিং’ আরম্ভ করে দিলাম।

এদিকে যাত্রার সিজনে উইকডে-তে কিছু শো-ও নিতে থাকলাম। এটার জন্য নতুন কোম্পানি খুলে ফেললাম ‘মুক্ত মঞ্চ’ নামে। পুরোনো যাত্রা কোম্পানি ‘সুশীল নাট্য কোম্পানী’ নির্মল মুখোপা্যায়কে লিজ দিয়ে দিলাম। ১১৩, রবীন্দ্র সরণীতেই নতুন কোম্পানির অফিসটা হল। ‘জয় মা কালী বোর্ডিং’-এর প্রথম দিনেই আমার একটু শরীর খারাপ হয়েছিল, তাতে বোধহয় ফল ভালোই হয়েছিল। প্রথম থেকেই রমরমিয়ে চলছিল, প্রায় প্রত্যেকদিনই হাউসফুল। প্রত্যেকদিন টিকিট সেলের হিসাব নেওয়া আমার প্রায় অভ্যাস হয়ে গেছিল। দেড় বছরের মাথায় হরিদাসের ভার্সান অনুযায়ী সমস্ত পূর্ববর্তী লস মেকাপ করে প্রচুর লাভের মুখ দেখতে আরম্ভ করল। তিন বছরের ওপরে চলল, ৭০০ নাইট অতিক্রম করে গেল। অগণিত লোক দেখেছে, অগণিত লোককে পাশ দিয়েছি।

একদিন সুচিত্রা খবর পাঠাল ও আধঘণ্টার জন্য দেখতে আসবে। তার জন্য ফার্স্ট রোয়ের ১০টা সিট ফাঁকা রাখলাম। হলে ১০-১২টা চেনা-পরিচিত ছেলে রাখলাম যাতে ঝামেলা সামলায়। শো আরম্ভ হওয়ার ২ মিনিট আগে সুচিত্রা বলল, ‘আধঘণ্টার বেশি থাকতে পারব না।’

আমি বললাম, ‘তথাস্তু।’

শেষে দেখলাম পুরো শো-টা ও বসে দেখল। তিনজনকে নিয়ে এসেছিল। শো শেষ হওয়ার পাঁচ মিনিট আগে আমাকে ভূয়সী প্রশংসা জানিয়ে বেড়িয়ে গেল। ওদিকে আবার প্রমোদ দাশগুপ্তও এসেছিলেন একদিন। ‘জয় মা কালী বোর্ডিং’ আরম্ভ হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই আমার জীবনের অন্যতম সুসংবাদ, আমার নাতি অর্থাৎ আমার মেয়ে একটি ছেলের জন্ম দিল। ১৯৭৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বিশ্বকর্মা পুজোর দিন আমার নাতি সঞ্জুর জন্ম হল উডল্যান্ড নার্সিং হোমে।

প্রায় কোনো নামজাদা আর্টিস্ট না নিয়ে ‘জয় মা কালী বোর্ডিং’ আরম্ভ করলাম। অনেকে অনেকরকম জ্ঞান দিতে আরম্ভ করল। কেউ বলে একে নাও, তাকে নাও, ক্যাবারে ডান্স ঢোকাও, ইত্যাদি, প্রভৃতি। আমি যা মনে করেছি তেমন করেই আরম্ভ করলাম। এমনই নাম হল যে এক সময় বাস স্টপেজের নাম ‘জয় মা কালী বোর্ডিং’ স্টপেজ হয়ে গেল। অথচ সব নতুন আনকোরা অভিনেতা। হিরো, হিরোইন উজ্জ্বল ও মঞ্জুলা, একদম নতুন। ভিলেন বিপ্লবও নতুন। বিপ্লব ছেলেটা খুবই উদ্যোগী ও সম্ভবনা খুবই উজ্জ্বল মনে হয়। উজ্জ্বল, বিপ্লব ও গঙ্গাপদদার ছেলে স্বরাজ, এরা সব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একই সঙ্গে ‘জয় মা কালী বোর্ডিং’ থিয়েটার ও যাত্রা রমরমিয়ে চলতে লাগল। বৃহস্পতি, শনি, রবিবার দুটো শো, আর ছুটির দিনগুলিতে দুটো করে শো থিয়েটার। আর উইক-ডেগুলোতে যাত্রা চলতে লাগল। এর সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য মাঝেমধ্যেই আমার শরীর খারাপ চলতে থাকল।

এই সময়ে ফাংশানে যাওয়াও প্রায় বন্ধ করে দিলাম। অর্থাৎ এমন পয়সা হাঁকতে লাগলাম যে ফাংশান পার্টি পালিয়ে যেতে লাগল। ১৯৭৭-৭৮-এ যা পেতাম, ১৯৭৯-র পর সেটা প্রায় তিনগুণ করে দিলাম। কারণ জলসায় যেতে আর মন চাইত না। কিন্তু তা-ও প্রচুর অফার আসতে থাকল। আর তখন জহরও নেই, কিছু কিছু পার্টি আমি যা চাইছিলাম তা-ই দিতে রাজি; অত:পর যেতেই হত।

কিন্তু আমি ঠিক করে নিয়েছিলাম পয়লা বৈশাখ বসুশ্রীর ফাংশান ছাড়া আর কোনও ফাংশান করব না। আর বসুশ্রীর ফাংশান তো ঘরের অর্থাৎ টাকাপয়সার কোনো ব্যাপার নেই। কেবল আমি নই, শ্যামল, হেমন্ত, উত্তম এমনকী সন্ধ্যা, লতাও বসুশ্রীতে চিরকাল পয়সা না নিয়ে গেয়েছে। বসুশ্রীতে পয়লা বৈশাখের ফাংশান বাঙালির রিচুয়াল মতো হয়ে গেছিল।

এসময় আমার একটা উল্লেখযোগ্য পাওনা হল সিনেমায় চান্স-এর আগে ১০ বছর আমি যাত্রায় ব্যস্ত থাকায় বায়োস্কোপে কাজ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছিল। এমনকী তপনবাবুরও দু-একটা ছবিতে কাজ করতে পারিনি যাত্রার জন্য। খোকা অর্থাৎ দীনেন গুপ্ত সব ছবিতেই আমাকে কাস্ট করত। কিন্তু ওই যাত্রার জন্য ৪-৫টা ছবিতে কাজ করতে পারিনি। এ সময়টাতে প্রচুর ভালো ভালো কাজ ছেড়ে দিতে হয়েছে। যেমন পিনাকীর পরিচালনায় সুচিত্রা, উত্তম অভিনীত একটা ছবি, সলিল সেনের পরিচালনায় উত্তম, সুচিত্রা অভিনীত আরেকটা ছবি। বিকাশদা, অসীমের আরেকটা ছবি, যাতে উত্তম ছিল। পীযূষ বসু, মানু সেন, দিলীপ মুখার্জীর বেশ কয়েকটা ভালো অফার ছেড়ে দিতে হয়েছিল।

এরপর ১৯৭৯-এ আমি আবার ছবি নিতে আরম্ভ করলাম এবং পেতেও থাকলাম। ভাবলে অবাক লাগে, আমি ষাট বছরের বৃদ্ধ, তা-ও অফার পাচ্ছিলাম! সে বছরেই ৬-৭টা ছবির অফার পেলাম, ইনক্লুডিং ‘বাঞ্ছারামের বাগান’-এর প্রধান চরিত্রে। পরে অরুন্ধতীর আপত্তিতে আমি মেইন রোলটা পাইনি। তাতে আমার আক্ষেপ নেই, কারণ এর মধ্যেও দু-তিনটে আমার খুব পছন্দের চরিত্রে অভিনয় করেছি। তার মধ্যে একটা আমার বহুদিনের ভালোলাগা ‘শহর থেকে দূরে’-র কম্পাউন্ডার চরিত্রটি। সোজা কথায় এই চরিত্রটি আমার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে, রাতের পর রাত বারান্দায় পায়চারি করেছি। কারণ আগেই বলেছি ফণী রায় অরিজিন্যাল ছবিতে এমনই অনবদ্য অভিনয় করেছিলেন যে আমি কখনওই ভুলতে পারি না। এবং বেশ ভয়ে ভয়েই এই পার্টটা করেছি। পার্থ অর্থাৎ পার্থপ্রতিম একটা অফার নিয়ে এসেছিল, এটা একটা হাসির চরিত্র। আমার শরীরটা খুবই খারাপ কিন্তু তা-ও করতে হচ্ছে। এ ছবির নায়িকা সুচিত্রার মেয়ে মুনমুন।

এ ছাড়াও অসম্ভব শরীর খারাপ থাকা সত্বেও মরণপণ করে আমার যে বইটার শুটিং করতে হচ্ছে সেটা ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’ ছবিতে আমার অসম্ভব পছন্দের চরিত্র, ডাক্তার পাঁচুগোপালের চরিত্রটি। এটা আমার বায়োস্কোপ-জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভালো লাগা চরিত্র। কিন্তু এ-ছবি করতে গিয়ে যা ঝামেলা-ঝক্কি পোহাতে হচ্ছে তা অবর্ণনীয়। সন্দেহ হচ্ছে, এ ছবির রিলিজ হওয়া অবধি বাঁচব কিনা! প্রচুর জেদাজেদি করে এ-ছবি করা হচ্ছে, সমরেশ বসুর থেকে রাইট নেওয়ার পর থেকেই প্রত্যেকটা ব্যাপারে নানা মুনির নানা মত। কিন্তু আমার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা এ ছবি নামাতেই হবে; সকাল থেকে উঠে প্রতিদিন প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশটা ফোন করে পঞ্চাশ-ষাট রকম মতানৈক্য মেটাতে হচ্ছে। অনুপের খুব ইচ্ছা, মৃণালবাবু ছবিটা পরিচালনা করেন।

কিন্তু উনি তো অভিনেত্রী সঙ্ঘের সদস্য নন। প্রথমত, এটা অভিনেত্রী সঙ্ঘের ছবি; অভিনেতা, পরিচালক কেউ পয়সা নেবে না। মৃণালবাবু তো আর বিনা পয়সায় পরিচালনা করবেন না। মৃণালবাবু করলে এ ছবির ফেস্টিভ্যালে অ্যাওয়ার্ড পাওয়া আটকায় কে? কিন্তু উপায় নেই, দিলীপ রায় ডিরেক্টর। দিলীপের পছন্দের মিউজিক ডিরেক্টর সুধীন দাশগুপ্ত, সেখানে আবার কেউ কেউ নচিকেতাকে চায়। এদিকে একটা গানের বানী আমি আমার স্ত্রী নীলিমাকে দিয়েছিলাম, ‘আমি কে পাগল পারা’ কীরকম হয়েছে দেখতে; উনি আবার নিজেই গুনগুন করে সুর দিয়ে দিলেন, অনুপের লিপে গানটা খারাপ হয়নি, সুধীনকে শোনাতে ওরও ভালো লাগল, ওই সুরটাই রেখে দিল।

কিন্তু নাম তো সুধীনেরই যাবে, নীলিমার তাতে আপত্তি নেই। এদিকে গান গাইবে কে? সুধীন, দিলীপের ইচ্ছা অংশুমান গায়, এদিকে আমার ছেলে-মেয়ে-নীলিমার ইচ্ছে অমর পাল গায়, শেষ অবধি অমরই গাইল।

এদিকে হিরোইন শ্যামার চরিত্রে অভিনয় করার প্রবল ইচ্ছা মুনমুনের, ওদিকে দিলীপ রায় ঠিকই করে রেখেছে অপর্ণা সেনকে দিয়ে করাবে কিন্তু মুখে কিছু বলছে না, নতুন মুখ খোঁজা হচ্ছে। প্রায় দশ-বারোটা মেয়েকে দেখা হল, কাউকে খোকার পছন্দ হচ্ছে না। কারণ, ও তো ঠিকই করে রেখেছে অপর্ণা। এ ব্যাপারটা যে আমি জানি, সেটা আমি খোকাকে কিছুতেই বুঝতে দিচ্ছি না।

সবচেয়ে ঝামেলা লেখকের চরিত্র নিয়ে। আমার ধারণা ছিল পুলু এটা করবে। কিন্তু ও বিশেষ আগ্রহ দেখাল না। আবার দিলীপের পছন্দ শুভেন্দু। সুতরাং শুভেন্দুকেই কাস্ট করা হল। আমার মাঝে মাঝে শুটিং-এর সময় শরীর খারাপ হলে ও-ই অ্যাডভাইস দিত। আমি শুভেন্দুকে বললাম, তুই ডাক্তারিটা ছাড়িস না, চেম্বার খোল, আর আমায় দিয়ে ওপেন করাবি।

এ-প্রাোডাক্সনের জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবই আমায় করতে হচ্ছে। এলাহাবাদ যাওয়ার ট্রেনের টিকিট ষাট জনের, সে-ও আমি। ১০০টা টেন্ট লাগবে, তা-ও আমি। একদিকে দিলীপের সঙ্গে শট ডিভিশন নিয়ে কথা বলছি, অন্যদিকে রতনের সঙ্গে প্রাোডাকসন্স নিয়ে কথা বলতে হচ্ছে।

পাগল হয়ে যাওয়ার অবস্থা, তার ওপর শরীরের অবস্থাও ওই পরিমাণে খারাপ। আমাদের যে যা পারি কুড়িয়ে বাড়িয়ে পয়সা লাগাচ্ছি। তাও রঞ্জিতমলের ডিস্ট্রিবিউশন পাওয়া গেছে, তার ওপর ইউনাইটেড ব্যাঙ্কের ওভারড্রাফট।

গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো আবার অভিনেত্রী সঙ্ঘর ইলেকশন, অনুপকে জেতাবার জন্য জান-নিকেশ অবস্থা। অনুপকে যারা ভোট দেবে না তাদের কাছেই প্রথমে গেছি; যাই হোক, শেষ অবধি অনুপ জিতল। আমার শরীর ভেঙে গেছে, আমি আর বেশিদিন টানতে পারব না। দেখি অনুপ কেমন চালায় অভিনেত্রী সঙ্ঘ! ওকে বুঝতে হবে এই সঙ্ঘ এক সময়ে সারা বাংলার অভিনেতাদের সুখ-দু:খের পাশে থেকেছে। বিকাশদা প্রতিষ্ঠিত, ছবিদার আশীর্বাদে বর্ধিত অভিনেত্রী সঙ্ঘর একটা ঐতিহ্য আছে।

আমার মনে পড়ছে আমি ফাংশান করা মোটামুটি ছেড়ে দিলেও বসুশ্রীর পয়লা বৈশাখ ছাড়া কয়েকজনের করি, যেমন আমার ছেলের বন্ধু বসুশ্রীর রেগুলার আড্ডার ছোকরা বিশু ১৯৮০-র ২৪ জুলাই একটা ফাংশানে ডেকেছিল রবীন্দ্র সদনে। আমার আবার সেদিন ‘জয় মা কালী বোর্ডিং’-এর শো-ও ছিল। যাই হোক, আমার পৌঁছোতে পৌঁছোতে রাত ৯টা বেজে গেল। আমার পারফরমেন্স শেষ হতে হতে প্রায় রাত ১০টা। রবীন্দ্র সদন থেকে বেরোচ্ছি, বিশু হঠাৎ এসে বলল, ‘ভানুদা, শুনলাম উত্তমদা মারা গেছে।’ আমি পাত্তা না দিয়ে গাড়ি করে বাড়ি চলে এলাম। উত্তম এর আগে বহুবার মরেছে।

বাড়িতে ঢোকা মাত্র মন্টু বসুশ্রী থেকে ফোন করে বলল, উত্তম নাকি বেলভিউতে! আমি সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি নিয়ে বেলভিউ গেলাম। ওখানে গিয়ে দেখলাম বুড়ো গম্ভীর মুখে কয়েকজনের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখামাত্র এসে বলল, ‘তুমি আবার এই শরীরে এখানে এলে কেন?’

আমি একটু চেঁচিয়েই বললাম, ‘কী হয়েছে বল আমাকে।’

সলিল দত্তও ছুটে এল, বলল, ‘আজ ওর ছবির শুটিং ছিল একটু ধকল বেশি গেছে, সেইজন্য শরীরটা খারাপ।’

আমি বললাম, ‘কত খারাপ, সব বল।’

বুড়ো বলল, ‘দাদার নতুন ফ্ল্যাটে শুটিং সেরে এসে, ওর পাশের ফ্ল্যাটে দেবেশের ওখানে একটু টিফিনের আয়োজন ছিল। দেবেশ ওর বিশেষ বন্ধু, তাই পানভোজনটা একটু বেশিই হয়ে গেছিল। রাত ৯টা নাগাদ একটা ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হয়েছে।’

আমি তো বেশ ঘাবড়ে গেলাম। বুড়ো বলল, ‘তুমি আবার শরীরটা খারাপ কোরো না, বাড়ি যাও, তেমন কিছু হলে খবর দেব।’

আমি তো ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বাড়ি চলে এলাম। পরের দিন সকাল ৬টা নাগাদ বুড়োর ফোন এল, ‘উত্তম নেই।’

আমার তো প্রথমেই পুরো মাথাটা ব্ল্যাঙ্ক হয়ে গেল। ওর সঙ্গে ১৯৫২-৫৩ সাল থেকে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। পরের দিকে হয়তো অত দেখাশুনা হত না। কিন্তু পয়লা বৈশাখ উত্তম প্রায় নিয়মমাফিক বসুশ্রীর ফাংশানে হেমন্ত ও আমাকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করত এবং আমার থেকে ওর প্রাপ্য ছিল ওর গালে একটা চুমু। জীবনে কোনোদিন এর অন্যথা হয়নি। সেই কনিষ্ঠ ভ্রাতাসম উত্তম আমার আগে চলে গেল, এটা আমার ওপর একটা ভীষণ আঘাত ছিল। একটা চুয়ান্ন বছরের ছেলে প্রায় সম্রাটের মতোই চলে গেল!

বহুদিন মনটা খুবই ভারাক্রান্ত ছিল। এর কিছুদিন পরেই একটা সাঙ্ঘাতিক রকমের মন ভালো-করা খবর পেলাম, তা হল আমার ছেলে পিনাকী এনভয়রনমেন্টাল সায়েন্সে পি.এইচ.ডি করে ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়েছে।

এদিকে শরীর ভীষণ খারাপ, মাঝে মাঝেই বাড়িতে শুয়ে পড়ছি। আজ ক্যালকাটা হাসপিটাল তো কাল উডল্যান্ডস নার্সিং হোম; কাজের খুবই ক্ষতি হচ্ছে। বিশেষ করে ‘জয় মা কালী বোর্ডিং’ নাটকের খুবই ক্ষতি হচ্ছে। আমার ওপর এতজন লোকের রুজি-রোজগার নির্ভর করছে, সুতরাং আমি মোটেই নাটক বন্ধ করতে চাই না।

কিন্তু নীলিমা আজকাল নতুন চাল চেলেছে। আমার শরীর খারাপ হলেই পুলুকে খবর দেয়, পুলু আবার হরিদাসকে আমার বাড়িতে আসতে বলে। এবার ওরা এলে হরিদাসকে পুলু বলে, ‘ভানুদার শরীর খুব খারাপ, এখন দু-একদিন নাটক বন্ধ রাখ।’

আমি কিছু ওজর আপত্তি করলে পুলু একদম লিগ্যাল গার্জেনের মতো চুপ করিয়ে দেয়, কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম হরিদাস এই ধকল আর বেশিদিন সহ্য করবে না। এদিকে আমি শুনতে পারছিলাম দেবুদা নানারকম কথা বলে বেড়াচ্ছেন, হরিদাসকে নাকি বলেছেন, ‘ভানু তো আর বেশিদিন বাঁচবে না, ”জয় মা কালী বোর্ডিং” আর চালাবার দরকার কী?’

আমার টোটাল টিমটাই ভেঙে যাওয়ার যোগাড়। আমার মনে খুবই আঘাত লেগেছে কারণ এই দেবুদাকেই নিয়েই হরিদাস সবচেয়ে আপত্তি করেছিল শুরুর দিকে, শৈলেশ-এর-ও ঘোরতর আপত্তি ছিল দেবুদার নাম দেওয়াতে। কারণ ওর অনুমতি নেওয়ার সময় ও কেবল শিবাজি রায়কে অনুমতি দিয়েছিল, আমিই জোর করে দেবুদাকে নিই।

বাজারে কানাঘুষা, হরিদাস নাকি নতুন নাটক আরম্ভ করবে। একে তো আমার শরীর খারাপের জন্য ঘনঘন শো বন্ধ হচ্ছিল, তার ওপর আমি যে ‘মুক্ত মঞ্চ’ নামে গ্রামে-গঞ্জে মাঝেমাঝেই ‘জয় মা কালী বোর্ডিং’-এর শো করছিলাম, তাতে ওর মোটেই সায় ছিল না।

যাইহোক, এই কথা শুনে সুধাংশু মিত্র নামে এক থিয়েটারের প্রাোডিউসার আমার বাড়িতে এসে হজির, সে রঙমহলে নতুন করে ‘জয় মা কালী বোর্ডিং’ করাতে চায়। আমিও নতুন উদ্যমে লেগে গেলাম। কিন্তু আমার রঙ্গনার টিম ততদিনে প্রায় ভেঙে গেছে। সত্য, লকা নামে দুটো ছেলে, যাদের আমি প্রায় তুলে এনে রঙ্গনায় চান্স দিয়েছিলাম, তারা প্রবল নাম করে এবং যখন বলি রঙ মহলে যোগ দিতে, তারা সঙ্গে সঙ্গে অস্বীকার করে।

শুধু তাই নয়, নতুন হিরো, হিরোইন খুঁজতেও আমাকে লায়লট হতে হয়, কারণ যে শুধু দেবুদা বিরুদ্ধতা করেছিলেন তা নয়। আমি একজন নতুন অভিনেতাকে হিরোর পার্ট করার প্রস্তাব দিই, সে রাজি হয়েও পরে করতে অসম্মত হয়। পরে শুনি সেই অভিনেতাকে দুজন অভিনেত্রী আমার নাটকে যোগ দিতে বাধা দেয়। অবশ্য নানারকম বাধা সত্বেও আমি রঙমহলে নাটক আরম্ভ করে দিয়েছি। কিন্তু এখানেও শরীর খারাপের জন্যে মাঝে-মাঝেই শো বন্ধ করে দিতে হচ্ছে।

শরীরটা একেবারেই ভেঙে গেছে, এর মধ্যেই সুখের কথা যে আমার নাতি সঞ্জু বড় হচ্ছে। বেশ লায়েকও হয়েছে। রঙ্গনায় ৫০০ রজনীর দিন ও সেখানে ছিল। তখন ওর দু-বছর বয়স। যতবার ডায়লগ বলতে যাই ততবার ‘জয় মা কালীর বাত্তা’ বলে চিৎকার করছে। সে-নাটক বন্ধ হবার উপক্রম। এর আগে একদিন বাড়িতে রবিবার ডাবল শোয়ের আগে দুপুরে ঘুমোবার চেষ্টা করছি, আর সঞ্জু বারবার-ই আমায় ঘুমের মধ্যে ধাক্কা মেরে ‘দা-ভাই, তুমি কি ভানু বদ্দায়?’—বলে পালিয়ে যাচ্ছে। আর আমার ঘুমের দফারফা।

আরও খুশির খবর, পিনাকী পোস্ট ডক্টরেট করেছে ওকলাহোমা ইউনিভারসিটিতে। সবদিকেই ভালো খবর, কেবল আমার বড় ছেলে গৌতম কী করবে জানি না!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *