উপন্যাস
বড়গল্প
ছোটগল্প
1 of 2

আতা গাছে তোতা পাখি

আতা গাছে তোতা পাখি

এক

বড়মামা চায়ে চুমুক দিতে দিতে হঠাৎ লাফিয়ে উঠলেন।

মেজোমামা বললেন, ‘কী হল?’

মাসিমা বললেন, ‘মনে হয় বিষাক্ত একটা কিছু ঠ্যাঙে কামড়েছে।’

বড়মামা কোনও কথা না বলে ঘরের মাঝখানে ফাঁকা জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালেন। শরীরটাকে ডাইনে-বাঁয়ে বারকতক মুচড়ে বলতে থাকলেন, ‘অস্থির, অস্থির লাগছে। বহৎ অস্থির। খাঁচাকা অন্দরমে আগ্নেয়গিরি ঘুঁস গিয়া।’

মেজোমামা বললেন, ‘আলসার। এন্ডোস্কোপি। ঘি, তেল, ভাজা, রিচফুড সব বন্ধ। পেঁপে সেদ্ধ, গলা ভাত। বড়মামা মেজোমামার কথায় কান না দিয়ে স্পট জগিং শুরু করলেন। কাচের সেন্টার টেবিল থেকে ঝকঝকে একটা চামচে কাঁপতে-কাঁপতে ঠং করে মেঝেতে পড়ল।

মাসিমা কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘ধুমসোটা হঠাৎ লাফাতে শুরু করল কেন?’

বড়মামা হাঁপাতে-হাঁপাতে বললেন, ‘খানিকটা এনার্জি রিফিল করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে, তা না হলে আমি বোমার মতো জগতের ওপর ফেটে পড়ব।’

মেজোমামা সঙ্গে-সঙ্গে বললেন, ‘তুমি ফাটবে ফ্যাটে। খাওয়াদাওয়া কন্ট্রোল করো। সপ্তাহে একদিন উপোস। আর পরিশ্রম করো। রোজ দশ মাইল হাঁটো।’

বড়মামা বললেন, ‘চুপ! আমি একটা কিছু করতে চাইছি। বিরাট একটা কিছু। সেটা কী?’

চেয়ারে বসলেন। শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে আসছে। একসঙ্গে জোড়া টোস্টে কড়কড়ে কামড়। কড়ড়-মড়ড় শব্দটা একটু মেলাতেই চায়ে চুমুক। তারপর বললেন, ‘ভেতরে তাঁর আবির্ভাব ঘটেছে।’

মেজোমামা জিগ্যেস করলেন, ‘কার?’

‘কখনও মনে হচ্ছে পরম্পুরুষ শ্রীকৃষ্ণ।’

‘বাঁশি বাজাচ্ছেন?’

‘না, রথের চাকার শব্দ, ধুলো উড়ছে। দুর্যোধন চিৎকার করছে—ফায়ার।’

‘মরেছে, তখন তো গোলা, বারুদ, বন্দুক, এসব ছিল না। বড়মামা পাত্তা না দিয়ে বললেন, ‘কখনও সন্দেহ হচ্ছে খ্রাইস্ট নয় তো!’

‘মরেছে, বরাতে কষ্ট আছে। ক্রুশে ঝুলে থাকতে হবে তিনদিন।’

‘ঠিক কে ঢুকেছেন বুঝতে পারছি না। মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যও হতে পারেন। মাঝে-মাঝে ভেতরে প্রেমের প্রবাহ ছুটছে। মনে হচ্ছে খড়কুটোর মতো ভেসে যাই। কী হবে এই সংসারে থেকে! প্রেম নেই, দয়া নেই, মমতা নেই। স্বার্থ, স্বার্থ, অর্থ, অনর্থ, আমি চলে যেতে চাই, দূরে, বহুদূরে। কোনও অজানা দেশে। ভালুকের সঙ্গে বন্ধুত্ব করব। বাঘের থাবায় ফ্রেন্ডশিপ ব্যান্ড বেঁধে দেব। হাতির পিঠে চেপে অরণ্যে যাব। যেহেতু আমার ভেতরে কোনও হিংসা থাকবে না, সেইহেতু ওরা আমাকে কিছু বলবে না। শবর বধূ সকালে এসে চাক ভাঙা মধু খাইয়ে যাবে। শবর আসবে ফল নিয়ে। শবর কন্যা মালা গেঁথে গলায় পরিয়ে দেবে। ঝরনার জলে স্নান করার সময় পিঠে ছোবড়া ঘষে দেবে। মধ্যাহ্নে বাসমতী চালের ভাত, কপিলার দুধ থেকে তৈরি খাঁটি গাওয়া ঘি। পাঁচরকম ভাজা। ধীবরের জালে ধরা টাটকা মাছের কোলাপুরি ঝাল। পাতার শয্যায় নিশ্চিন্ত নিদ্রা। রাত্রে মাত্র কুড়িখানা ফুলকো লুচি, কাশ্মীরি আলুর দম। সারারাত মাদল বাজবে, মশালের আলো নাচবে। পাহাড় থেকে পাথর গড়িয়ে পড়বে। বলতে পারিস ভাই, কোথায় আছে সেই দেশ?’

মেজোমামা উঠে গেলেন। কলেজ আছে। মাসিমা রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালেন। বড়মামার কম্পাউন্ডার এসে বললেন, ‘চেম্বারে সাতজন।’

বড়মামা নিজের মনেই বলতে থাকলেন। ‘অসুখ, অুসখ, অসুখ। মানুষের মন সব বিষিয়ে গেছে। সেই বিষে নীল। ভেতরে কিলবিল করছে বিষধর সাপ। একটা সাপ খেলানো বাঁশি চাই।’

দুই

সাতটার সময় মেজোমামা কলেজ থেকে ফিরলেন। সঙ্গে বিখ্যাত কাইজারকাকু। অনেকদিন পরে এলেন। ইস্তানবুলে ছিলেন। সারা বিশ্বে তাঁর বিশাল ডিম্যান্ড। প্রেততত্ত্ববিদ। এটা তাঁর আসল পরিচয় নয়। আসল পরিচয়, তিনি বিশ্বের বিখ্যাত গণিতজ্ঞ। আইনস্টাইনের সঙ্গে ‘কসমিক চেস’ খেলতেন। কঠিন খেলা। পদে পদে হায়ার ম্যাথেমেটিকস। খেলাটা উদ্ভাবন করেছিলেন কাইজারকাকু। আইনস্টাইন বুকে জড়িয়ে ধরে তিন মিনিট ধরে নন-স্টপ বলে গিয়েছিলেন, ‘you are great, you are great.’ সেকাল হলে আমি তোমাকে জার্মানির ‘কাইজার’ করে দিতুম। সেই খবর লন্ডনের খবরের কাগজে বেরোতেই নোবেল পুরস্কারের শর্টলিস্টে কাকুর নাম উঠল। মেলবোর্ন থেকে ডাক এল বক্তৃতা দেওয়ার। বিচিত্র বিষয়, ‘চ্যাপ্টা নাকে বাতাস বেশি ঢুকবে, না খাড়া নাকে!’

কাইজারকাকুর হাতে তাঁর সেই বিখ্যাত এয়ার ব্যাগ। সারা পৃথিবীর টিকিট লাগানো। গাঢ় নীল রং। দূর থেকে দেখলে মনে হবে কালো। এই বাড়ির পেছনে সুন্দর বাগান। সেখানে একটা সায়েবি বাংলো। আমার দাদু নিজের প্ল্যানে, নিজে দাঁড়িয়ে তৈরি করিয়েছেন। বিলেতে গিয়ে এইরকম একটা বাংলো দেখেছিলেন টেমস নদীর ধারে। দাদু তখন অক্সফোর্ডে ছিলেন। ভীষণ ভালো মেধাবী ছাত্র। দাদুর দাদু রাজা রামমোহনের ডান হাত ছিলেন। সতীদাহ নিবারণ আন্দোলনে তাঁর বিরাট ভূমিকা ছিল। গঙ্গার ধারে ব্রাহ্মণ গুণ্ডারা পিটিয়ে সামনের দুটো দাঁত ফেলে দিয়েছিল। সেই দাঁত দুটো ওই ঘরে একটা কাচের কৌটোয় সযত্নে রাখা আছে। আরও অনেক জিনিস আছে। তিনি যা-যা ব্যবহার করতেন। রাজার দেওয়া পাগড়ি, আলখাল্লা। বেন্টিঙ্ক সায়েবের দেওয়া কেনসিংটনের ছড়ি, কুইনের দেওয়া কুইলের কলম। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দেওয়া গামছা। প্রিন্স দ্বারকনাথের দেওয়া প্যারিসের জর্দার কৌটো। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের দেওয়া পশমের আসন, চামড়া দিয়ে তৈরি বৈদিক পৈতে।

এই ঘরে আরও অনেক সুন্দর, সুন্দর ব্যাপার আছে। দাদু গ্রিস থেকে দুটো হার্প এনেছিলেন। এক ধরনের তারের বাদ্যযন্ত্র সুরমণ্ডলের মতো। ক্লিওপেটা এই বাদ্যযন্ত্রের ঝিলমিল বাজনা শুনতে-শুনতে গোলাপ ফুলের পাপড়ি বিছানো বিছানায় ধীরে-ধীরে ঘুমিয়ে পড়তেন। তাঁর পাশে শুয়ে থাকত কারুকার্য করা হাতির দাঁতের একটা চোঙা। তার মধ্যে থাকত খয়েরি রঙের একটা বিষধর সাপ। লাউডগার মতো সরু, কিন্তু ভীষণ বিষ। এক ছোবলেই সাবাড়। বিছানাটা ঘড়ির কাঁটার মতো ঘুরত। বারোটা, একটা, দুটো, তিনটে, চারটে, পাঁচটায় মোরগের ডাক। প্যারেড গ্রাউন্ডে বর্ম-শিরস্ত্রাণ, অস্ত্র-শস্ত্রের ঝনাৎকার।

এই হার্প দুটোর একটা দক্ষিণের জানলায়, আর-একটা উত্তর দিকের জানলায়। একটু জোরে বাতাস বইলেই হালকা মধুর সুরে ঘরটা ভরে যায়, যেন আকাশে কনসার্ট। আরও একটা কারসাজি দাদু এই ঘরে করে রেখে গেছেন। একটা সুইচে সব জায়গার আলো জ্বলে উঠবে, সঙ্গে-সঙ্গে বাজতে থাকবে গানের সুর—ধন ধান্য পুষ্পে ভরা। এক মিনিট ধরে বাজবে। এরপর যে-যে ঘরের আলো লাগবে না নিবিয়ে দিলেই হবে। বসার ঘর ছাড়া আরও তিনটে ঘর আছে। একটা ঘরের নাম শেক্সপিয়ার রুম, আর-একটার নাম ডিকেনস রুম, তৃতীয়টা রবীন্দ্র বিতান। প্রত্যেকটি ঘরে বড়-বড় ছবি শেক্সপিয়ার, ডিকেনস, রবীন্দ্রনাথ। সুন্দর, সুন্দর শেলফে তাঁদের বই। মেজোমামার যত্নে সব ঠিকঠাক আছে।

কাইজারকাকু যখনই আসেন, এই বাংলোতে থাকেন। তিনি নিজের মতো করে কিছুটা সাজিয়েছেন। বসার ঘরের সিলিং-এ বৃত্তের-পর-বৃত্ত আঁকিয়েছেন, যেন গোলোক ধাঁধা। তাকালে মাথা ঘুরে যাবে। কসমিক সার্কল। এই ঘরে তিনি সিঁয়াসে বসেন। একটা গোলাপি আলোর রশ্মি ছুঁড়ে দেন ওপর দিকে। ঘর অন্ধকার। কিছুক্ষণের মধ্যেই কেমন-কেমন লাগে। সবকিছু ঘুরতে থাকে। অনেক অদ্ভুত-অদ্ভুত শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। ঝড়ের শব্দ, কান্নার শব্দ, ভারী ঘণ্টার শব্দ। ছড়ছড় করে জল পড়ার শব্দ।

কাইজারকাকুর চেহারা রাজপুত্রের মতো। প্রায় ছ-ফুট। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। ভন ব্যারনের মতো এক মাথা কোঁকড়া-কোঁকড়া চুল। ইংল্যান্ডের রবিনস অবিকল নিউটনের মতো চুল করে দিয়েছিলেন। আমেরিকায় ওই চুল দেখে কাউবয়রা প্যাঁক-প্যাঁক করে আওয়াজ দিতে শুরু করল। তখন হলিউডের সেলুনে গিয়ে বার্ট ল্যাংকাস্টার ছাঁট দিলেন। স্পিলবার্গ জানলা দিয়ে দেখে সঙ্গে-সঙ্গে চিঠি ছাড়লেন। আমার নেক্সট ছবি ‘ইন্ডিয়ান পাপা’তে তোমাকে আমি রোম্যান্টিক ভিলেনের ভূমিকায় চাই। কাকু লিখলেন, সরি ডিরেকটার! আমি একজন বিজ্ঞানী। ব্রহ্মা আমার ফাদার, বিষ্ণু�আমার আংকল, মহাদেব আবার ফ্রেন্ড। আমি কসমিক চ্যারিয়টে ইনফিনিটেতে ফ্লোট করি। পৃথিবীর পাঠানো স্যাটেলাইটে বসে বিশ্রাম করি। আকাশের গায়ে অক্ষর লিখি।

স্পিলবার্গ রেগে গিয়ে ফোনে বলেছিলেন, ‘ইউ আর এ রাবিশ।’ কাইজারকাকু বলেছিলেন, ‘ধন্যবাদ। দিস আর্থ ইজ এ ডাস্টবিন। আই নো দি অ্যাড্রেস অফ হেভন।’ স্পিলবার্গ খটাস করে ফোন রেখে দিয়েছিলেন। কাইজারকাকু আমাকে ডাকলেন, ‘চ্যাম্প, চলো যাই আমাদের ডেরায়।’

ব্যাগটা নিতে গেলুম। দিলেন না। বললেন, ‘নিজের ভার নিজেই বহন করো মাস্টার। আমার মা বলতেন, ‘এই পৃথিবীতে কেউ কারও গাধা নয়।’ নিজের ডান হাত কপালে ঠেকালেন। মাকে প্রণাম জানালেন। নীচু গলায় বললেন, ‘যেখানেই থাকো, আমাকে দেখো। তুমিই আমার সব।’

ঘরে ঢুকে একটা চেয়ারে মাথা নীচু করে বসে রইলেন বেশ কিছুক্ষণ। কাকুর বাবা ছিলেন বাঙালি, মা তুর্কি। দুজনের ছবিই আমাকে দেখিয়েছেন। স্বর্গের মানুষ। সুন্দর দেখতে। মা যেন অপ্সরা! রেশমের মতো চুল। টানা-টানা চোখ। বাঁশির মতো নাক। ধারালো মুখ, ধারালো চিবুক। ছবিতে একটু হেসেছেন। সামনের দুটো দাঁতে মুক্তর ঝিলিক। ছবিটা দেখে মাসিমা আমাকে বলেছিলেন, ‘অনেকটা তোর মা, আমার দিদির মতো দেখতে।’ সে হতে পারে। আমার মাকে তো আমি সে-ভাবে দেখার সুযোগ পাইনি। মা আমার পাশে ছিলেন আমার কান্নার কালে। মা বলে খলখল করে যখন হাসতে শিখলুম, তখন মায়ের জুতো জোড়া পড়ে আছে, ফরসা ধবধবে পাতলা পা দুটো আকাশের গা বেয়ে নক্ষত্রলোকে উঠে গেছে। যাকগে, ওসব কথা আর ভাবি না। মাসিমা আমার মায়ের অর্ধেক। দুইমামা আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। বড়মামার সঙ্গে আমার বড় মজা। খেলার সাথী। কত কাণ্ডই যে হয় আমাদের দুজনে। মাঝে-মাঝে দুজনেই মাসিমার কাছে বেধড়ক বকুনি খেয়ে বাগানের শেষ মাথায় গাব গাছের তলায় বসে দুজনে আলোচনা করি। বড়মামা হয়তো বললেন, ‘গেলাসটা যখন ভাঙল, তখন কী সুন্দর একটা আওয়াজ হল বল? ঝনঝন খনখন।’

‘আপনি সব ছেড়ে ওটাকে টার্গেট করলেন কেন?’

‘দেখলুম হাতের টিপ এখনও ঠিক আছে। ছেলেবেলায় এক ঢিলে পাঁচটা আম পাড়তুম। তা ছাড়া পুরনো না ভাঙলে নতুন আসে না। গেলাসটার বয়েস জানিস? পঞ্চাশের কম নয়।’

 এই রাতেও কাইজারকাকু গামছা পরে পুকুরে স্নান করতে গেলেন। তিনদিন আগে আমি ওখানে একটা গোখরো দেখেছি। বেকায়দায় ব্যাং ধরে বসে আছে। কাকুকে বললুম, গ্রাহ্যই করলেন না।

পুকুরের ওপারে আমাদের বাগানের বাইরে দিয়ে রেললাইন চলে গেছে। সিগন্যালের আলো পুকুরের জলে চিকচিক করছে। এক্ষুনি একটা টেন গেল। খোপ-খোপ আলো ঝাঁঝাঁ করে বেরিয়ে গেল। দূরপাল্লার মেল টেন। সুপার ফাস্ট।

কাইজারকাকুর বিশ্বাস, এই পুকুরের জলে সালফার আছে। স্কিনের পক্ষে খুব ভালো। সালফার থাকার মানে পুকুরের তলায় একটা প্রস্রবণ আছে। পৃথিবীর গভীর গর্ভ থেকে বেরিয়ে আসছে গন্ধক ধোঁয়ার আকারে, গ্যাসের আকারে। আগ্নেয়গিরির প্রবল উত্তাপে মৌলিক ধাতু গ্যাস হয়ে বেরিয়ে আসে।

পুকুরে দাদুর আমলের ঘাট। রংবেরঙের পাথর দিয়ে বাঁধানো। যেমন রোজগার করেছেন সেইরকম খরচ করে গেছেন। গর্ব করে বলতেন, ‘ওরে! এ গরিব প্রজাদের বুকে বাঁশ ডলে আদায় করা খাজনার টাকা নয়। নিজের মেধার অর্জন।’ বিলেতে তিনিই প্রথম ডারউইনের বিবর্তনবাদের মস্ত বড় একটি ফাঁক বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে এনেছিলেন। হইহই পড়ে গেল। শার্লক হোমসের জন্মদাতা স্যার আর্থার কোনান ডয়েল মাঝরাতে ছাতা মাথায় দিয়ে বেনসিংটলে দাদুর অ্যাপার্টমেন্টে এসে বলে গেলেন, ভোর হওয়ার আগেই চ্যানেল পেরিয়ে ফ্রান্সে পালাও। তোমাকে মেরে ফেলার চক্রান্ত হয়েছে। একরোখা দাদু তর্ক করতে চেয়েছিলেন। কোনান সাহেব এক চড় মেরে বলেছিলেন, ছাগল! ইংলিশ গুণ্ডাদের তুমি চেনো না। যা বলছি, শোনো। কাইজারকাকু সোজা রাজস্থানে চলে এলেন। সেই সময় সত্যজিৎবাবুর শ্যুটিং হচ্ছিল। কাকু একই হোটেলে ছিলেন। পুরো টিমটার সঙ্গে আলাপ হয়ে গিয়েছিল। সত্যজিৎবাবু বলেছিলেন, আপনার প্রোফাইল খুব ইন্টরেস্টিং। কামু মুখার্জির সঙ্গে রোজ পাঞ্জা লড়তেন। সারারাত গল্প। গল্পের শেষ নেই। হঠাৎ একদিন হোটেল লাউঞ্জে বেঁটে মতো এক বিদেশি দেখে সন্দেহ হল। লোকটাকে রোমে দেখেছিলেন। আইসক্রিম খাচ্ছিল। তখন সন্দেহ করার মতো কিছু হয়নি। তিনদিন পরে কলোসিয়ামে একটা মার্ডার হল। শহরের দেওয়ালে-দেওয়ালে ছবি পড়ল। ওয়ান্টেড। ওই লোকটার ছবি। সেই লোকটা হোটেল লবিতে। কাইজারকাকু কোনওরকম রিস্ক না নিয়ে চলে এলেন কলকাতার ফড়েপুকুরে বন্ধু নিত্যানন্দ গোস্বামীর বাড়িতে। আমেরিকার পুরোহিতগিরি করেন। নিউইয়র্কে কাকুকে মন্ত্র পড়িয়ে মা দুর্গাকে অঞ্জলি দিইয়েছিলেন। ভদ্রলোক খুব নস্যি নিতেন। বিশ্রী অভ্যাস। লোকে বিরক্ত হয়। ঘেন্না করে। কাইজারকাকু কিউবা থেকে নস্যিকাঠ আনিয়ে দিয়েছিলেন। শুঁকলেই নস্যির কাজ করবে। সেই থেকেই বন্ধুত্ব।

নিত্যানন্দবাবুর একগাদা অলৌকিক ক্ষমতা। মহা দুর্ভাগ্যের মধ্যে দিয়ে এই মহা সৌভাগ্য এসেছিল। ঝড়-জলের রাত। মাইনাস টেম্পারেচার। হিমালয়ে এক পাহাড়ের কার্নিসে ঝুলছিলেন। গৃহদেবতার ওপর রাগ করে গৃহত্যাগ করেছিলেন। সতী গঙ্গায় স্নান করতে গিয়ে দামি হিরের আংটি হারিয়ে ফেলেছিলেন। আংটিটা নালিকুলের দুর্দান্ত জমিদার নক্ষত্র রায় দিয়েছিলেন। তাঁর পূর্বপুরুষরা তারকেশ্বর লাইনে ডাকাতি করতেন। নিত্যানন্দবাবু বাগবাজারের ঘাটে গিয়ে জেলেদের কাছে সকাল সাড়ে সাতটার পরে ধরা বোয়াল মাছের খোঁজ করলেন। ছেলেবেলায় ঠাকুমার কাছে গল্প শুনেছিলেন, রাজকুমারীর অঙ্গুরি সরোবরে জলকেলির সময় হারিয়ে গিয়েছিল। পরে সেটি বেরিয়ে ছিল এক বোয়াল মাছের পেট থেকে। সেদিন নিত্যানন্দবাবুর বোয়াল মাছ খোঁজা দেখে ঘাটের এক প্রবীণ মানুষ বেড়াতে-বেড়াতে বলেছিলেন, কলকাতায় আজকাল অনেক রকম পাগল তৈরি হচ্ছে। এসব সিনেমা, থিয়েটারের এফেক্ট। সর্দি বসে গেলে নিমোনিয়া হয়, প্রেম বসে গেলে পাগল। সেই সময় এক সাধু স্নান করে উঠছিলেন, তিনি বললেন, বোয়াল মাছ হরিদ্বারের গঙ্গায় পাবে। এক-একটার ওজন এক মন, দেড় মন। পাথর খায়।

নিত্যানন্দ বাবু জিগ্যেস করলেন, ‘হিরের আংটি?’ সাধু বললেন, ‘ও তো মুখশুদ্ধি। নিজামের ঘোড়ার গলার সোনার ঘণ্টা খেয়ে ফেলেছিল, আমার পরমগুরুর কমণ্ডুল। ওসব মাছের ধারে-কাছে না যাওয়াই ভালো বাবাজি।’

নিত্যানন্দবাবু সেদিন গৃহদেবতার সামনে হাজার আট বেল পাতা, দেড় সের গাওয়া ঘি দিয়ে হোম করলেন। স্ত্রীকে বললেন, প্রভু সন্তুষ্ট হয়েছেন। আমাকে জানিয়ছেন কোথায় আছে আংটি। সিংহাসনের তলায় হাত ঢোকাও। তিনি হাত চালালেন অজানা মুলুকে। সেখানে বহুদিন ধরে একটি তেঁতুলে বিছে তপস্যা করছিল। যে আঙুলে আংটি ছিল সেই আঙুলেই দংশন। আঙুল ফুলে কলাগাছ। চিৎকারে সবাই ছুটে এল। একজন নিয়ে এল বিছাবজ্র। তাদের বাড়িতে প্রচুর কাঁকড়াবিছে। জুতোর ভেতর থাকতে ভালোবাসে। রোজই একে-ওকে কামড়ায়। এই বজ্র শিলে ঘষে লাগাতে হয়। নিত্যানন্দবাবু দেবতাকে বললেন, ‘প্রভু বেইজ্জত করে দিলে! শিক্ষা হল, লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। আমি চললুম। তুমি উপোস করে মরো। আমার অনেক টাকার সন্দেশ ধ্বংস করেছ।’

হরিদ্বারে আসার পর, প্রবল জ্বর আসার মতো প্রবল বৈরাগ্য এল। সব ঝুট হ্যায়। কথাটা একটু জোরে বলে ফেলেছিলেন। গঙ্গার ধারে। পাশেই ধ্যানে ছিলেন জটাধারী এক সন্ন্যাসী। তাঁর চোখ খুলে গেল। টর্চ-লাইটের মতো জ্যোতি। বললেন, ‘এত দিনে বুঝলি! আমি একশো বছর আগে বুঝে ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে পড়েছি।’

‘এখন আপনার বয়েস?’

‘প্রায় দেড়শো। সেই সময় সিপাহি বিদ্রোহ। মীরাটে ছারখার হচ্ছে। আমি এক বিদ্রোহী। গভীর রাত। ঘোড়ার পিঠে। ঝড়ের বেগে ছুটছি। হঠাৎ দেখি আমার পাশে-পাশে বিরাট একটা তেঁতুল গাছও ছুটছে। ঠিক দেখছি তো! না, কোনও ভুল নেই। অনেক সায়েব মেরেছি। তবু ভয়ে অজ্ঞান হয়ে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গেলুম। যখন জ্ঞান হল, দেখি, পড়ে আছি তেঁতুল তলায়। সেই গাছ কথা বলছে—আমি এক ঋষি। এই গাছ আশ্রয় করে আছি। সংসারে কিছুই পাবি না। সন্ন্যাসী হয়ে যা। চলে যা কেদারে। সেখানে তোর গুরু আছে।’

কেদারের মন্দির তখন বন্ধ হয়ে গেছে। চারপাশে বরফ নেমেছে। পাহাড়-পর্বত সব মহাদেবের মতো সাদা। পাহাড়ের গায়ে ঝরনার ধারা জমে বরফের স্টিক। ফাটলে ফুটে আছে ছোট-ছোট বরফ ফুল। মুক্তোর মতো রং। কোথাও-কোথাও খাড়া হয়ে আছে বরফের ঝাড়ু। ঝ্যাঁটার মতো খোঁচা বরফ। পাহাড়ে কত কী হয়! এভারেস্টের যে-দিকটায় মানুষ কোনওদিনই যেতে পারবে না, সেইখানে বিশ্বকর্মার বরফ ওয়ার্কশপ। সেখানে সারা শীত দেবতাদের জন্যে বড়-ছোট নানা মাপের বরফের সিংহাসন, খাট, পালঙ্ক তৈরি হয়। ওই দিকে স্বর্গে যাওয়ার সিংহদ্বার। পঞ্চপাণ্ডবদের বাংলো। দ্রৌপদী সরোবর, কুন্তী কিচেন। দুর্যোধন স্টিম লন্ড্রি। দুঃশাসন সেলুন। অর্জুন স্পোর্টস কমপ্লেক্স। সহদেব বিউটিপার্লার। নকুল টিউটোরিয়াল। ভীমসেনের গদা গ্যারেজ। যুধিষ্ঠিরের যোগ সেন্টার। আরও ভেতরে উত্তরা সিনেমা হল। ঘটোৎকচের যাত্রা-গদি। শ্রীকৃষ্ণ সিন্থেসাইজার শিক্ষা কেন্দ্র। কংস লাফিং ক্লাব।

বেদব্যাস স্টেশনারি শপ। রম্ভা কল সেন্টার। জরাসন্ধ ধাবা। উর্বশী আইসক্রিম পার্লার। স্বর্গে পৃথিবীর মতো সবই আছে। কাইজারকাকু এইসব তথ্য নিত্যানন্দবাবুর কাছে পেয়েছেন। হিমালয়ের কোথাও একটা ফাটল আছে। কোনওরকমে কাত হয়ে গলে যেতে পারলেই স্বর্গ।

না, এইবার নিত্যানন্দবাবুকে দেখি। পাহাড়ের কার্নিসে ঝুলছেন। টেম্পারেচার সাব জিরো। ঝোড়ো-বাতাস। কাপড়, জামা, কম্বল সব উড়ে চলে গেছে। একেবারে নাঙ্গাবাবা। অবশেষে জয় বাবা কেদারনাথ। পাথরটা পাহাড়ের গা থেকে ছেড়ে গেল। পড়ছেন, পড়ছেন। আগুনে ধ্যাস।

অনেক নীচে গাছপালা ঘেরা একটি সবুজ উপত্যকা। এক নাগা সন্ন্যাসী, বিশাল পাহাড়ের মতো তাঁর চেহারা। এক ডজন ভালুক তাঁর শিষ্য। এক জোড়া কেঁদো বাঘ তাঁর পোষা কুকুরের মতো। ধুনি জ্বেলে ধ্যানে বসেছিলেন। নিত্যানন্দবাবু ধ্মাস করে সাধুর ঘাড়ে। তিনি ভেবেছিলেন মচ্ছর! দেখলেন মচ্ছর নয় একটা ঠিকটিকি। তারপর দেখলেন লিকলিকে এক মানুষ। এইভাবে গুরুর ঘাড়ে শিষ্যের পতন। আসমানসে আয়া। আও বেটা আও।

সেই নাগা গুরুর কাছ থেকে নিত্যানন্দবাবু কত কী পেলেন। কত সিদ্ধাই। শেষে গুরু বললেন, ‘মেরা জানেকা সময় আ গিয়া বেটা। তুম আভি চলা যাও।’ সেই বিরাট সাধু অলকানন্দার নীল জলে ভুড়ভুড় করে তলিয়ে গেলেন। ভেসে উঠল একরাশ বুজকুড়ি, মন্ত্রের মতো, স্তোত্রের মতো। নিত্যানন্দবাবু যেদিকে তাকাচ্ছেন, দেখছেন তাঁর গুরু দাঁড়িয়ে আছেন। ঘোর লেগে গেল। জ্ঞান হারালেন। জ্ঞান ফিরে আসার পর দেখলেন, হাতিবাগানের বাজারে আম কিনছেন। বুঝতে পারলেন না ব্যাপারটা কী হল। হাতে ব্যাগ। পকেটে টাকাপয়সা। পরনে খাটো ধুতি, ফতুয়া। পায়ে চটি। কাপড়ের দোকানের কাচে নিজের মুখ দেখলেন। দাড়ি, গোঁফ পরিষ্কার কামানো। একেবারে ফ্রেশ। পরে বাড়ি ঢোকা মাত্রই সকলের হইহই চিৎকার—এসেছে, এসেছে, এতদিন পরে এসেছে। বাড়ির কাজের মেয়েটি জোরে-জোরে বলে উঠল, যাক বউদি, তোমাকে আর বিধবা হতে হল না। নিত্যানন্দবাবু দেখলেন, বাড়িটার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। টবের চারা গাছ বড় হয়ে ফুলে ভরে গেছে। পাশের বাড়ির বৃদ্ধা মারা গেছেন। ছেলের গোঁপ বেরিয়েছে। এরপরে আরও বিস্ময়। ইচ্ছামাত্রই কাজ হয়ে যাচ্ছে। শুয়ে-শুয়ে যেই ভাবলেন, পাখাটা আর-একটু আস্তে ঘুরলে ভালো হয়, সঙ্গে-সঙ্গে এক পয়েন্ট কমে গেল। যেই ভাবলেন, তাড়াতাড়ি হাঁটতে হবে, অমনি পা দুটো মাটি ছেড়ে আধ হাত ওপরে উঠে গেল, শরীরটা প্রচণ্ডবেগে সামনের দিকে এগোতে শুরু করল। এইসব যে হতে লাগল নিত্যানন্দবাবু কারওকে কিছু বললেন না। চেপে রাখলেন। চেপে রাখা অত সহজ নয়। একজন কারওকে তো বলতে হবে, যে বুঝবে। সেই বোঝার মানুষটি হলেন কাইজারকাকু। শুধু বুঝলে হবে না বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও চাই। এরপরে যে আশ্চর্য কাণ্ড হল—ফতুয়ার ডান পকেটে হাত ঢোকাতেই উঠে এল, হারিয়ে যাওয়া সেই হিরের আংটি।

গভীর রাতে ছাতের চিলেকোঠায় কাইজারকাকু আর নিত্যানন্দবাবু। গুরু-শিষ্য মুখোমুখি।

গুরু।। আমি এইসবের ব্যাখ্যা চাই। আমাকে ভূতে ধরেছে না কি?

শিষ্য।। ভূতে ধরবে কেন? আপনি সময় থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কৌশলটা শিখে ফেলেছেন। স্পেনের বুলফাইট রিং-এ আমাকে একটা বদরাগি ষাঁড় মারাত্মক গুঁতিয়ে অজ্ঞান করে দিয়েছিল।

গুরু।। কী করতে গিয়েছিলে?

শিষ্য।। তখন আমার গবেষণার বিষয় ছিল—লড়াইয়ের ঠিক পরে ষাঁড়দের ব্লাড প্রেশার কতটা বাড়ে? যন্ত্রটা এক-এক করে চারটে ঠ্যাং-এ বাঁধতে হবে। দেখতে হবে চার-পা দিয়ে এগোলে প্রেসার এক হচ্ছে না ভিন্ন! ওরে বাবা! যেই সামনে গিয়ে বলেছি—’মিঃ বুল, চুকচুকচুক, আই উইল মেজর ইউর প্রেসার।’ সঙ্গে একজন দোভাষী। তিনি স্প্যানিশ বললেন, ‘লস বুলঅস, ফসফস, প্রেসারস।’ ব্যস, বুল ভাবলে, আমি বুলফাইটার, অথবা ক্রিকেট বল। হুক করে দিলে। সিক্স। প্রথমে স্টেডিয়ামের গড়ানে চালে। সেখান থেকে গড়াতে-গড়াতে বুলদের বোয়ালে।

গুরু।। বোয়ালে মানে?

শিষ্য।। গরু থাকে গোয়ালে, বুল থাকে বোয়ালে। সেখানে এক মাতৃসমা বুল আমাকে চাটতে শুরু করল। এইটুকুই মনে আছে, তারপর অজ্ঞান।

একমাস ‘কাবালডোস হসপিটালে’। এই একটা মাসের কথা আমার কিছুই মনে নেই। সময় আছে, কেবল আমার সময়টা গায়েব হয়ে গেল—কে যেন এক ঢোঁক জলের মতো গিলে ফেলল! ব্যাপারটার ‘ডেমনস্ট্রেশন’ দি—বিজ্ঞান মুখে বললে হয় না, করে দেখাতে হয়, তবেই বোঝা যায়—জ্ঞান আর কাণ্ডজ্ঞান। এই দেখুন, ভরতি এক গেলাস জল। কোঁতকোঁত করে দু-ঢোঁক খেলুম। গেলাসের জল প্রায় তিন ইঞ্চি উধাও। কোথায় গেল?

পেটে।

সে আমরা বলছি। জল কি জানে জল কোথায় গেল! সময়কে টিকটিক করে কোন অদৃশ্য টিকটিকি খেয়ে ফেলছে কেউ জানে না। এসব ভারী শক্তশক্ত বিষয়। আইনস্টাইন চেষ্টা করে চুলে জটপাকিয়ে ফেলেছিলেন। মাঝে-মাঝে নিজের নাম ভুলে যেতেন। নিজের বাড়ির মনে করে অন্যের বাড়িতে ঢুকে পড়তেন। আমাকে বলেছিলেন, don’t go near Time. She is a রাক্ষসী। Witch, knows every trick to be fool a man, destroyed my life and family.

কাইজারকাকু নিত্যানন্দবাবুর ওপর একটা বই লিখেছেন—Miracle man of Fariapukur. বইটা বিলেতে বেরোবে। প্রকাশ করবেন Richard Hamond। তিনি কোনও বিজ্ঞানী নন। মাছ ধরাই তাঁর নেশা। জল আর জলার ধারে বসে-বসে নিমোনিয়া হয়েছিল। বাঁচার আশা ছিল না। এক ভারতীয় যোগী কীভাবে ভালো করে দিয়েছিলেন। ইংল্যান্ডের চিকিৎসকরা বলেছিলেন—This is miracle।

কাইজারকাকু গোছগাছ করে নিজের ঘরে বসলেন। মেজোমামার কাশি পেয়েছে। এই সময়টায় রোজই তিনি কাশিতে আক্রান্ত হন। সে এক অদ্ভুত শব্দ। পাছে কেউ বিরক্ত হয় তাই বাগানের শেষপ্রান্তে একটা গুমটি ঘর আছে, সেইখানে চলে যান। নাম দিয়েছেন—কাশিঘর, কাশি কর্নার। ওই ঘরে আমার দাদুর আমল থেকে ভারি সুন্দর একটা গোসাপ সপরিবারে থাকে। দাদুকে দিয়েছিলেন গোয়ার সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে প্রাচীন গির্জার ধর্মযাজক ফাদার ডিসুজা। দাদু তাঁর সঙ্গে বিলিয়ার্ড খেলতেন। দাদুই সেখানে উইন্ড মিল বসিয়ে দিয়েছিলেন এক সার। এই বিজ্ঞানটা তিনি শিখে এসেছিলেন হল্যান্ড থেকে। দাদু ‘হার্ট লেকচার’ দেওয়ার আমন্ত্রণ পেয়ে সে-দেশে গিয়েছিলেন। হার্ট ওদেশের এক মস্ত বিজ্ঞানীর নাম। তিনি ভয়ঙ্কর একটা বিষয় প্রমাণ করেছিলেন—আলোর অভাব অন্ধকার নয়। আলোক বিচ্ছুরণকারী বস্তুকণার অভাবেই অন্ধকার হয়। যেমন, কাঠ আর কাচ। কয়লা আর হিরে। তিনি পরীক্ষা করে দেখিয়েছিলেন। বাতি জ্বলছে, আলো নেই, উত্তাপ আছে। শিখার জায়াগায় আঙুল দিলে আঙুল পুড়ে যাচ্ছে। আর একটু হলেই নোবেল পুরস্কার পেয়ে যেতেন। থিসিস চুরি হয়ে গেল। হার্ট সাহেব নিরুদ্দেশ। তন্নতন্ন করে খোঁজা হল সারা দেশে। শেষে ব্লুলেকের ধারে একটা কোটের বোতাম পাওয়া গেল। এই আবিষ্কারও এক কাহিনি। সেদিন আকাশে চাঁদ উঠেছিল। ব্ল লেকের ধারে যারা মাছ ধরে তাদের বাড়ি-ঘর। ওইদিন ছিল উৎসবের রাত। জলপরি উৎসব। লেকের ধারে সুন্দর-সুন্দর মেয়েরা পরি সেজে নাচে গায়। রাতের আকাশে চাঁদের আলোয় বড়-বড় ঘুড়ি ওড়ে। বড়-বড় লেজ লাগানো। বাতাসে সাপের মতো খেলা করে। হানস আন্ডারসেনের মূর্তি বসানো হয়। তিনি ছোটদের জন্যে কত রূপকথা লিখে গেছেন! পরিরা নাচতে-নাচতে গলায় মালা পরাবে।

এই নাচ যখন খুব জমে গেছে তখন এক দর্শক বালক দেখলে তার হাত ধরে কেউ একজন ডাকছে। সুন্দর মানুষ। বড়-বড় চুল, দাড়ি। চোখে ঝকঝকে সোনার ফ্রেমের চশমা। দেখলেই মনে হয় বড় কোনও বিজ্ঞানী। বালকটিকে নিয়ে তিনি ব্লু লেকের ধারে একটা জায়গায় নিয়ে এলেন। সেখানে একটা ঝোপের পাশে পড়ে থাকা বোতামটা দেখালেন। সোনালি বোতাম। বোতামে লেখা রয়েছে, ‘হার্ট’। তিনি বললেন, বোতামটা পুলিশ চিফ শ্যাস্কোকে দিয়ে বলবে, আমি জলের তলায় আছি। মানুষটি অদৃশ্য। ছেলেটি অজ্ঞান। ডুবুরি নামল জলে। পাওয়া গেল একটা লোহার কফিন। ভেতরে শুয়ে আছেন হার্ট।

দাদু তিনদিন ধরে একটা পেপার পড়েছিলেন। হইহই পড়ে গেল। দাদুকে বিশ্ববিদ্যালয় ডিলিট উপাধি দিল। এক মাস ধরে কত কী খাওয়াল, কত জায়গায় ঘোরাল। এই সময় তিনি ভ্যান্ডার মির সাহেবের কাছে উইন্ডমিল শিখলেন।

কাশি কর্নারে মেজোমামার কাশি থেমেছে। বড়মামার গাড়ি কান ফাটানো শব্দে ঢুকল। শব্দ শুনেই লোক বলে, হয় লরি, না হয় ডাক্তার মুখার্জি। গাড়িটা ছিল মেজর মোরের। ভূতের মতো কালো। সেইরকম বলবান। একেবারে মিলিটারি ম্যানের মিলিটারি মেজাজি গাড়ি। হিমালয়ান র‍্যালিতে পরপর দুবার টফি জিতে এসেছে। তৃতীয়বারে পা পিছলে ডিগবাজি। মোরে সাহেব বড়মামার মাছ ধরার বন্ধু। গাড়িটা বড়মামাকে উপহার দিয়ে বিলেতে বড় ছেলের কাছে চলে গেছেন।

গাড়ি থেকে নেমে সামনে কাইজারকাকুকে দেখে—’কাইজার’ বলে দু-হাত তুলে ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন, তারপর দুজনেই ব্যালেনস, রাখতে না পেরে জড়াজড়ি করে মাটিতে। নরম, নরম ঘাসের ওপর। সেখানে একটা কোলা ব্যাং বেড়াতে বেরিয়েছিল। এক লাফে বড়মামার বুকে।

বড়মামা উঠে বসলেন। ব্যাংটা পালানোর বদলে বড়মামার কোলে বেশ জমিয়ে বসল। আরাম পেয়েছে। বড়মামার সঙ্গে কীট, পতঙ্গ, সাপ, ব্যাং, বেঁজির খুব বন্ধুত্ব। আমার দাদু সিমুলতলায় একটা ফার্ম করেছিলেন। নাম রেখেছিলেন, ‘পোকামাকড়’। দেশ-বিদেশের জীববিজ্ঞানীরা দেখতে আসতেন। নতুন-নতুন কীটপতঙ্গ তৈরি হত ওই গবেষণা কেন্দ্রে। ওখানে যেসব জীব বিজ্ঞানী তাঁকে সাহায্য করতেন, দাদু তাঁদের বলতেন, কল্পনা করো, তারপর চেষ্টা করো বাস্তবে সেটাকে আনতে। সাজাহান বললেন, আমি পাথরে চোখের জল চাই। তৈরি হল তাজমহল। আকাশে উদ্যান প্রথম কল্পনায় এল রাজার মাথায়। তৈরি হল অন্যতম আশ্চর্য—Hanging Garden of Babylon.

দাদু একদিন বসে-বসে ভাবছেন, আমার একটা তিন-চার ইঞ্চি লম্বা পোকা চাই, শরীরটা হবে গলদা চিংড়ির মাথার মতো গোলাপি। রঙের আভা বেরোবে। আর মাথায় থাকবে ধপধবে সাদা একটা টোপর, যেন বিয়ের বর। পাশেই বসেছিলেন, বিশ্বস্ত বন্ধু, সব কাজের সহকারী, সনাতন মুর্মু। দুমকায় একটা টিলার ওপর তাঁর গড়ানে বাড়ি। ঘরের মেঝে পেছন দিকে প্রায় ৪৫ ডিগ্রি ঢালু। সামনের দিকে কিছু রাখলেই পেছন দিকে গড়িয়ে চলে যায়। সে এক মজা। রাতে সামনের দিকে বিছানা করে শোয়ালে। সকালে দেখা গেল, এ-দেওয়ালে এসে ঠেকেছে। ওদিকে ঢাল বেয়ে গাছপালার ডাল ধরে নামলেই পাহাড়ি নদী। বড়-ছোট অজস্র পাথর। ফাঁকে-ফাঁকে সাঁতার কাটছে ছোট-ছোট মাছ। মানুষটা বনে-জঙ্গলে ঘুরতে ভালোবাসে। জঙ্গলে যখন মহুয়া পাকে, সেই মহুয়ার নেশায় মাতাল হয়ে বিরাট একটা ভাল্লুক, সনাতনের বাড়ির দাওয়ায় উঠে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ে। এসব কথা আমার দাদুর সোনালি সবুজ রঙের ডায়েরিতে লেখা আছে। হলদে রঙের মোটা পার্কার কলমে লিখতেন। দেড় ইঞ্চি লম্বা পাকা সোনার নিব। কলমটা আজও আছে। ম্যাকমিলান কোম্পানি বইটা প্রকাশ করবেন বলে ঠিক হয়েছিল, Diary of a Worm catcher।

দাদু সনাতনকে বললেন, এইরকম একটা পোকা তোমার চোখে পড়েছ? বিশ্বস্ত সনাতন অনুসন্ধানে বেরিয়ে পড়লেন। হাতে মোটা লাঠি, কাঁদে ঝোলা। সঙ্গে একটা টাঙ্গি, টর্চ। পায়ে অ্যামুনিসান বুট। দাদু কলকাতা থেকে এসে দিয়েছিলেন। সাতদিন পরে সনাতন ফিরে এলেন শ-দুয়েক পোকার সংগ্রহ নিয়ে। দেখা গেল একটা পোকার চেহারা প্রায় ওইরকম। তবে টোপরটা সাদা নয়, কালো। ঠিক টোপর নয়, টোপরের মতো। পোকাটা একটা গির্জায় থাকত। বাগানের এক কোলে ডালিম গাছে। ফলের রস, ফুলের পরাগ, এইসব হল পোকাটার খাদ্য। দাদু পোকাটাকে তাঁর ডালিম গাছে তুলে দিলেন। এক বছরের প্রচণ্ড গবেষণার ফলে দাদুর কল্পনার পোকা বাস্তব হল। ভীষণ আনন্দ। নাম রাখা হল Groom, পনেরো দিন পরেই হতাশা। পোকাটা ঘোড়া-ফড়িং হয়ে এক লাফে উড়ে চলে গেল। দাদু বললেন, সনাতন। গির্জার পোকাটা গির্জার গাছে রেখে এসো।

সেই দাদুরই তো ছেলে, আমার বড়মামা। ব্যাংটাকে কোল থেকে নেমে যেতে অনুরোধ করলেন। আশ্চর্যের ব্যাপার, ব্যাংটা থুপুক করে নেমে গেল। বড়মামার কোনও ব্যাপারে মেজোমামার তো চুপ করে থাকা চলবে না।

মেজোমামা বললেন, ‘আমাদের ব্যাংবন্ধু, Frog friend.’ বলেই নানা সুরে কাশতে লাগলেন। বড়মামা পালটা চাল দিলেন, ‘আমাদের কাশিশ্বর। মাথায় জল ঢাল।’

কাইজারকাকু বললেন, ‘অকারণে এত কাশি হচ্ছে কেন? শুকনো কাশি।’

বড়মামা বললেন, ‘অকারণেই নয়, কারণেই হচ্ছে। ওই গুমটি ঘরে গিয়ে লুকিয়ে-লুকিয়ে সিগারেট ফুঁকে এসেছে। ডেলি, বাবুর তিন প্যাকেট সিগারেট লাগে।’

‘লুকিয়ে কেন?’

‘কুসি জানতে পারলে অগ্নিকাণ্ড হবে। কুসিকে আমরা দুজনে যমের মতে ভয় পাই। ফেরোসাস। কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখে। সেদিন মেজোকে পঞ্চাশবার ওঠ-বোস করিয়েছে।’

‘অপরাধ?’

‘রোজ সাবানদানিটাকে পুকুর করে রেখে আসছিল। ভালো কথায় শুনছিল না। বাথরুমে ঢুকলেই ক্লাসিক্যাল আর্টিস্ট। গাধার কালোয়াতি। দিয়েছে ঢিট করে। আমার যা আনন্দ হয়েছিল। যেমন কর্ম তেমন ফল। এটাকে আর মানুষ করা গেল না।’

মেজোমামা বললেন, ‘নিজের কথাটা বলছ না কেন?’

কাইজারকাকু জানতে চাইলেন, ‘সেটা কী?’

বড়মামা বললেন, ‘ও কিছু না, পেটি কেস। সামান্য ব্যাপার। দেখে ফেলেছিল তাই।’

মেজোমামা বললেন, ‘আমি বলছি। বাবু মশমশ করে জুতো পায়ে ঘরে ঢুকলেন। নাচব-নাচব ভাব। কুসি ক্যাঁক করে ধরেছে। রাস্তার জুতো পরে ঘরে? তুমি একজন ডাক্তার! জুতো বাইরে, জুতোর জায়গায়। ভেবেছিল, ‘সরি’, বলে পার পেয়ে যাবে। দাঁড়াও, যাচ্ছ কোথায়! একবালতি জল এল। ডিসইনফেকট্যান্ট পড়ল। ঘর মোছা এল। আঃ, হাঁটু গেড়ে-গেড়ে, এদিক থেকে ওদিক, ওদিক থেকে এদিক। ঘেমে-নেয়ে, হাঁপিয়ে। আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। যতই হোক, অতবড় একজন ডাক্তার! বিশ্রীভাবে মেঝেতে হামাগুড়ি দিচ্ছে। কুসি বললে, আশা করি মনে থাকবে? ভয়ে-ভয়ে বললে, হ্যাঁ, সার! ডায়োসেসানে পড়া মেয়ে। তার সঙ্গে চালাকি! যত রকমের ব্যাড হ্যাবিটস এই বড়টা কালটিভেট করেছে!’

পেছনে চটির শব্দ। মাসিমার গলা, ‘কালটিভেট করাচ্ছি। কচুরি ঠান্ডা হয়ে গেল, এখানে পথসভা হচ্ছে? এত দিন পরে এত বড় একজন মানুষ এসেছে! বহুক্ষণ আগে আমি গাড়ির শব্দ পেয়েছি। এখনও জামাকাপড় ছাড়া হয়নি! ভিজে ঘাসের ওপর থেবড়ে বসে আছ?

মেজোমামার মন্তব্য, ‘পেছনে সর্দি হলে কে দেখবে? হিপহপ!’

মাসিমা মেজোমামার দিকে সরে গিয়ে বললেন, ‘দেখি, হাঁ করো। আবার তুমি সিগারেট খেয়েছ। সেদিন ঠাকুরঘরে, তামা-তুলসী ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করলে! ছিছি, তুমি না অধ্যাপক! মিথ্যেবাদী অধ্যাপক।’

বড়মামা গম্ভীর গলায় বললেন, ‘ভদ্রলোক কবে সত্যবাদী ছিলেন!’

মাসিমা বললেন, ‘কাইজার! তুমি এই দুটোর কাজিয়া কোনওরকমে বন্ধ করে দিতে পারো?’

‘না দিদি। এসব হল চরম ভালোবাসা।’

মাসিমা বাড়ির দিকে হাঁটতে-হাঁটতে বললেন, ‘বয়েজ! ফলো মি।’ বাধ্য ছেলেরা সব লাইন দিয়ে চলেছে। যতই এগোচ্ছে ততই নাকে স্পষ্ট হচ্ছে কচুরির গন্ধ। গোলাপি আকাশ এখন একেবারেই কালো। অশ্বত্থগাছে প্যাঁচার ডাক। রাত ঘোষণা করছে। দূরে সানাই বাজছে। ওদিকে একটা প্রাচীন মন্দির আছে। আরতির সময় সানাই বাজে। বড় একটা পুকুর আছে। ভয়ে কেউ নামে না। নামলেই তলিয়ে যায়। কে যেন টেনে নেয়। হাঁস পর্যন্ত সাহস পায় না। অন্ধকার রাতে বড়-বড় মাছ ঘাই মারে। জল জড়ানো শব্দ। মন্দিরের পুরোহিতের গায়ে কাঁটা দেয়। অনেক তালগাছ আছে। বাবুইপাখির বাসা বাতাসে দোল খায়।

গরম, গরম কচুরির প্রবেশ। কাইজারকাকু বললেন, ‘দীর্ঘকাল পরে দর্শন পেলুম। পুলকিত প্রাণ। সিক্ত মুখ গহ্বর। বড়মামা মেজোমামাকে বললেন, ‘দিল খুলে খা। আমি আছি তোর পাশে।’

মাসিমা বললেন, ‘আহা হা! মামার বাড়ি। চারখানার বেশি একটাও নয়।’ ঘরে মুচমুচ শব্দ ছড়িয়ে পড়ল। মেজোমামা বললেন, ‘ওই জন্যেই মানুষ চুরি করে খায়।’

‘তোমাদের যতই খাওয়াও, চুরি করে খাওয়া বন্ধ হবে না। স্বভাবে ঢুকে গেছে।’

এই কথা শুনে বড়মামা, মেজোমামার কী আনন্দ। বড়মামা বাঁ-হাতে মেজোভাইকে জড়িয়ে ধরেছেন। ডান হাতে নিটোল একটি কচুরি। ‘বল মেজো, কি আনন্দের দিনই না ছিল আমাদের। প্রেমদার কুল বাগান তো আমরাই সাবড়ে করতুম। বাবার কাছে নালিশ এল। বাবা জিগ্যেস করলেন, ‘প্রেম, কত টাকার কুল খেয়েছে বলে মনে হয়?’ প্রেমকাকু বাবাকে ভীষণ সম্মান করতেন, বললেন, ‘ছিছি, আমার বলতে আসার কারণ, টক কুল অত খেলে জ্বর হবে, পেট খারাপ!’ কীসব মানুষ ছিলেন! সবাই চলে গেলেন। নিষ্ঠুর, নিষ্ঠুর!’ বড়মামার চোখে জল।

তিন

পশ্চিম দিকে বেশ কিছুটা হাঁটলে অপূর্ব এক জায়গা। নারায়ণ পল্লি। কাঁকরের রাস্তা। সার সার চালাবাড়ি রাস্তা ঘেঁষে উঠেছে। রাস্তাটা যেন বাড়িগুলোর উঠান। পা বাড়ালেই পথ। তেমনি পরিষ্কার। গেলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। বাড়িগুলোর পেছনে হ্রদের মতো বিরাট লম্বা একটা পুকুর। ইতিহাসের কোনও এক সময় বর্ধমানের মহারাজের এই জায়গাটি খুব ভালো লেগেছিল। এই হ্রদ তিনি খনন করিয়েছিলেন। স্থাপন করেছিলেন বিশাল শিবমন্দির, নাট মন্দির। পথটা আরও পশ্চিমে একটা জঙ্গলে ঢুকে গেছে। ওদিকটা বিহার। স্বদেশি আন্দোলনের দিনে মহাত্মা গান্ধি এখানে এসেছিলেন। তখনই নাম হল ‘নারায়ণ পল্লি’। নরনারায়ণদের বাসস্থান। বর্ধমানের রাজার দুর্গ-ধরনের সেই বাড়িটাই এই অঞ্চলের একমাত্র বাড়ি। বিশাল লোহার গেট। খোলার সময় ঠং করে শব্দ হয়। কার্নিশের পায়রার ঝাঁক ফটফট করে উড়ে যায়।

এই পল্লিতে ঢুকলে মন হয় বিরাট একটা মানব পরিবারে ঢুকে পড়েছি। সবাই কোনও না কোনও কাজে ব্যস্ত। শিবমন্দিরের সঙ্গে সংযুক্ত নাটমন্দিরে ছেলে-মেয়েদের ক্লাস বসে। স্বদেশি আমল থেকে চলে আসছে, একটানা এত বছর। দুর্গের মধ্যে একটা ছাপাখানা আছে। একটা কাগজ বেরোয়। ব্রজবাবু সম্পাদক। সেই কাগজে বড় মামা ডাক্তারি নিয়ে লেখেন। মেজমামার বিষয় শিক্ষা। মাসিমা দেখেন মেয়েদের পাতা।

পাথরের বাড়ি। অন্ধকার, অন্ধকার, ঠান্ডা, ঠান্ডা। কথা বললে ধ্বনি-প্রতিধ্বনি হয়। অনেক আগে আমি আর পম্পা একবার ঢুকেছিলুম। পম্পার খুব সাহস। গরমের দুপুর। স্কুল ছুটি। এসে বললে, চল অ্যাডভেনচার করে আসি। মাসিমার একটা ডেক চেয়ার আছে। দুপুরে নাকের ডগায় চশমা ঝুলিয়ে জিম করবেটের ‘লেপার্ডস অফ রুদ্রপ্রয়াগ’ পড়ছিলেন। জিম করবেট আমার বাবাও খুব পড়তেন। পড়তে পড়তে মাসিমার চোখ লেগে গেছে। মাসিমার অনুমতি ছাড়া আমি কিছু করি না, করব না কোনও দিন। পম্পা আমার এই কথাটা খুবই মানে। চার্চের ফাদার তাকে শিখিয়েছেন, লুকিয়ে কিছু করাটাই পাপ। যারা ভালোবাসে তাদের মনে দুঃখ দিতে নেই।

রোজ যেমন হয়, কিছুক্ষণের মধ্যেই মাসিমার নাকের ডগা থেকে চশমাটা কোলে পড়ে গেল। নড়েচড়ে বসে বললেন, যাঃ, ঘুমিয়ে পড়েছিলুম—ভেরি ব্যাড স্টুডেন্ট। সেই সময় পম্পি বললে, আমরা একটু রাজবাড়ি থেকে ঘুরে আসব?

মাসিমা বললেন, ‘দুঃসাহসী কিছু করে বসিস না পম্পি। তোকে আমার বিশ্বাস নেই। গেছো মেয়ে।’

ছাপাখানাটা সেদিন বন্ধ ছিল। কেউ কোথাও নেই। বাড়িটার একজন বয়স্ক কেয়ারটেকার আছেন। তিনি খুব কম সময়ই জেগে থাকেন। পম্পি নাকে ঘাস ঢুকিয়ে মাঝে-মাঝে জাগাবার চেষ্টা করে, তখন তিনি উপুড় হয়ে যান। মানুষটার শরীরে রাগ নেই। আমাদের দুজনকে ভালোওবাসেন। আমাদের লক্ষ্য বাড়ির পেছন দিকটা। কী আছে ওই দিকে! নানা গুজব। কেউ একটা মস্ত পাইথন দেখেছে। কেউ উঁচু ছাতের আরও উঁচু গম্বুজে মাঝরাতে একটা গেরিলাকে বসে থাকতে দেখেছে। দু-হাতে দুম-দুম করে বুক চাপড়াচ্ছে। কেউ খুব ভোরে দেখেছে, এক বৃদ্ধা পদ্মপুকুরে চান করে তাড়াতাড়ি গড়ের একটা ঘুপচি ঘরে ঢুকে যাচ্ছে। নানারকমের নানা কথা। মাথামুণ্ডু নেই। বড়দের মুখে এইসব শুনে-শুনে এমন হয়েছে, রাতের দিকে গা-ছমছম করে। মনে হয়, পেছন দিকে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। মাঝরাতে মাথার শিয়রে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে।

পাথর বাঁধানো মেঝে। লম্বা করিডর। কখনও ডান দিকে, কখনও বাঁ-দিকে বেঁকেছে। একটা থেকে আর একটা বেরিয়ে গেছে। দু-পাশে নিরেট দেওয়াল। যেন সুড়ঙ্গ। রাজারা রহস্য ভালোবাসতেন। রোমাঞ্চে ভরা যৌবন। কোথাও আলো এসেছে, কোথাও আঁধার। মাথার ওপর সেই কোন উঁচুতে ছাত! আমাদের দিক ভুল হয়ে গেছে। পুব দিক দিয়ে ঢুকেছি, এখন কোন দিকে এসেছি? পম্পি বললে, ‘একটা কম্পাস আনা উচিত ছিল।’

আমরা একটা জায়গায় এসে আটকে গেলুম। সামনে পাথরের দেওয়াল। ছোট্ট গোল একটা গর্ত। চোখ রাখলে ভেতরে থকথকে অন্ধকার। পম্পি অনেকক্ষণ দেখে বললে, ‘পালিয়ে চল, ভেতরে সাদা সাদা কারা যেন বসে আছে।’

আমার আর দেখার সাহস হল না। পম্পি বললে, ‘মনে হয় অনেক কঙ্কাল। এই ঘরটা একটা কবরখানা। পালা, পালা।’ অনেক ঘুরপাক খেয়ে আমরা পশ্চিম দিকে, যে দিকে ঘুরঘুট্টে জঙ্গল, সেইদিকে বেরিয়ে এলুম। সূর্য ডুবে যাচ্ছে, আর সামনেই দাঁড়িয়ে সেই বৃদ্ধা। দুজনেই ভয়ে চিৎকার করে উঠেছি।

পরিষ্কার মানুষের গলা, ‘ভয় পেলি কেন, রাধাকৃষ্ণ যেন! কোথা থেকে এলি দুটিতে। আমি ভূত নই রে মানুষ! এটা আমার জায়গা রে! আয় আমার ঘরে আয়।’

বৃদ্ধা এক কথায় পম্পির দিদা হয়ে গেলেন। এক হাতে শরীরের কাছে টেনে নিয়ে যে জায়গাটায় থাকেন সেই দিকে চলেছেন। সে এক সুন্দর শ্বেতপাথরের মন্দির। তিন দিকে জল। পদ্ম ফুটে আছে। রেলিং ঘেরা বারান্দা। শ্যামসুন্দরের বিগ্রহ, পাথরের সিংহাসনে। সুন্দর গন্ধ। পম্পি কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে থেকে বললে, ‘কী সুন্দর।’ দুচোখে জল। দিদা বললেন, ‘কাঁদছিস?’

পম্পি বললে, ‘এই ভগবানটাকে আমার খুব ভালো লাগে। আমি তার বাঁশি শুনেছি।’

দিদা বললেন, ‘তুই যে রাধা, আর ওই তোর জ্যান্ত কৃষ্ণ।’

আমাকে দেখালেন। পম্পি দিদার বুকে মুখ গুঁজে দিয়ে দুহাতে জড়িয়ে ধরল। রাধাকে আমি দেখিনি। সেদিন পম্পিকে দেখে মনে হল, এই তো রাধা। আমার দেখাটা পালটে গেল সেই দিনই। তবে আমি কৃষ্ণ নই। আমি একটা বোকা ছেলে। আমার বাবা নেই, মা নেই। মামার বাড়িতে মানুষ হচ্ছি। মাসিমা আমার মায়ের চেয়েও মা। বড়মামা বলেন, আমি তোর জন্যে আমার জীবনটাও দিয়ে দিতে পারি। তুই শুধু মানুষ হ, বড় হ। অনেক অনেক বড়। তবু, একটা অভাব। গ্রীষ্মের রোদ খাঁ-খাঁ দুপুরে কাকের শুকনো ডাক শুনলে কেবল মনে হয়, শঙ্কর কাকুর মতো সন্ন্যাসী হয়ে যাই। গভীর রাতে হিমালয়ের জঙ্গলে ধুনি জালিয়ে বসে থাকব। পেছনে খসখস শব্দ। বাবা আর মা। খোকা! আমরা আছি। তোর চারপাশে আছি। এগিয়ে যা। পথের শেষ নেই।

‘দিদা, ওই গুমটি ঘরটার মধ্যে কারা সব বসে আছে যেন!’

‘এই বংশের বড়-বড় পূর্ব পুরুষদের পাথরের মূর্তি। সব বিলেতে তৈরি।’

‘ওখানে কেন?’

‘কোথায় রাখবে? রাজা নেই, রাজত্ব নেই। বছরে একবার ওরা আমেরিকা থেকে আসে। লোকজন দিয়ে ঝাড়-পোঁছ করায়।’

‘ঢোকে কীভাবে?’

‘সে খুব মুশকিলের ব্যাপার। ওপরে যে গম্বুজ, সেই গম্বুজ ঘর থেকে একটা সিঁড়ি ঘুরেঘুরে ওই ঘরে নেমেছে। সে কালের ব্যাপার। রাজাদের আমলে ওটা ছিল বারুদ ঘর।’

ভালো-মন্দ খেয়ে আমরা সেদিন ফিরে এলুম। রাতে পড়ায় তেমন মন বসল না। কি একটা হচ্ছিল ভেতরে। তোলপাড়। মনে হচ্ছিল, মাঠের ওপর দিয়ে ছুটতে-ছুটতে পম্পির কাছে চলে যাই। কিছু বলব না। এমনি একবার দেখেই চলে আসব। সে সাহস হল না।

আজ নারায়ণ পল্লিতে উৎসবের পরিবেশ। কারণ কাইজারকাকু এসেছেন। বড়মামা, মেজমামা, কাইজারকাকু তিনজনে বীরদর্পে হাঁটছেন। পেছনে আমি আর মাসিমা। মাসিমার হাতে নামারকমের জিনিস তো থাকবেই। পল্লির বাচ্চাদের দেবেন। সবই তাঁর নিজের হাতের তৈরি। সারাদিনই তো কিছু না কিছু করছেন। এই পল্লিতে কাইজারকাকুর এক প্রাণের বন্ধু থাকেন, আমাদের গজেনদা। গজেন ভাস্কর। তাঁর একটা স্টুডিও আছে। শান্তিনিকেতনের বিখ্যাত ভাস্কর রামকিঙ্কর বেইজের এক ছাত্রের কাছে তিনি কাজ শিখেছেন। গজেনদার স্টুডিওটা বেশ মজার। পেছনদিকে দিঘি। তারই একপাশে ছোট্ট একটি চালায় তিনি থাকেন। একটা তক্তাপোশ, তার ওপর একটা মাদুর। পাটের ফেঁসো ভরতি একটা বালিশ। তক্তাপোশের তলায় এক প্রস্থ বাসন। চালার বাইরে দাওয়ায় একটা কাঠ কয়লার উনুন। নিজেই রান্না করেন। নিজে খান আর পাঁচজনকে ডেকে-ডেকে খাওয়ান। দেওয়ালে সাবেক কালের একটা হুঁকো ঝুলছে তার পাশে একটা একতারা। স্টুডিওটা কিন্তু বেশ বড়। টিনের চাল চারপাশে খোলা। গজেনদা হাঁস ভালোবাসেন। হাঁসের হবি। পৃথিবীতে যতরকমের হাঁস আছে, সব তাঁর সংগ্রহে আছে। সকালবেলা সব হেলতে-দুলতে দিঘির জলে গিয়ে নামে। দিশি হাঁসের গলা একটু চড়া। চিনে হাঁস একটু লাজুক। এদের মধ্যে একজাতের হাঁসের নাম খাঁকি ক্যাম্বেল। নানা সুরের অর্কেস্ট্রা সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত চলতেই থাকে। গজেনকাকু কাজ করতে-করতে মাঝে-মাঝে বেড়িয়ে গিয়ে হাঁসদের খাইয়ে আসেন। মনের কথা, প্রাণের কথা সব ওই হাঁসদের সঙ্গে। কাইজারকাকু এই মানুষটির কাজ দেশ বিদেশে ছড়িয়ে দিয়েছেন। এই জায়গাটা পম্পির খুব প্রিয়। এখানে তাঁর একটা কোণ আছে। সেখানে বসে সে কাজ করে। এখন তাঁর প্রধান কাজ হল এক ডেলা পাথর নিয়ে ছেনি দিয়ে কাটা। গজেনকাকু বলেন, কিছু করতে চেও না, শুধু কেটে যাও। কাটতে-কাটতেই এক সময় দেখবে পাথর থেকে একটা মূর্তি বেড়িয়ে এসেছে। নিজেকে ধরে রেখো না ছেড়ে দাও।

আমরা যখন গিয়ে পৌঁছোলুম, তখন দেখলুম রাস্তার ওপর একটা চ্যাটাই বিছিয়ে, দেওয়ালে ঠেস দিয়ে, চোখ বুজিয়ে পুতুলদিদির দোকানের গরম তেলেভাজা খুব আয়েস করে খাচ্ছেন। কাইজারকাকু কিছুটা দূর থেকে চিৎকার করে বললেন,—’গজরাজ একাই সব সাবাড় করবে?’

”কাইজার” বলে গজেনকাকু মহানন্দে লাফিয়ে উঠলেন। একটা আলুরচপ গাড়ির চাকার মতো গড়িয়ে গেল, ‘ধর-ধর’ করে গুণ্ডা সাইজের একটু ফুলুরি পেছন-পেছন দৌড়োচ্ছে। বড়মামা যেহেতু স্বাস্থ্যবিদ তিনি বললেন, ‘সর্বনাশ! গজেন অম্বলে মরবে।’

বড়দা খেটে খাওয়া মানুষের অম্বল হয় না। ওসব শৌখিন লোকদের হয়।

মেজোমামা বললেন, ‘পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুস্বাদু খাবার আমাদের তেলেভাজা। শিল্পীর কাছে আমার নিবেদন, যা থাকে বরাতে আজ এক ঝুড়ি হয়ে যাক, কাইজারের অনারে।’

দূর থেকে ছুটতে ছুটতে আসছে একজন, ফিতে বাঁধা বিনুনি। এপাশে ওপাশে দুলছে। ফ্রক উড়ছে, দেখেই চিনেছি পম্পি আসছে। ওই গড়ের দিদা সেদিনে আমার চোখে রাধিকার কাজল লাগিয়ে দিয়েছেন। সেই থেকে পম্পিকে দেখলেই মনে হয়—সে পম্পি নয় শ্রীমতী। আর তখনই আমি আগের মতো সহজ হতে পারি না। কীরকম একটা লজ্জা আসে।

পম্পি ছুটতে ছুটতে এসে ধপাস করে আমাকেই একটা গুঁতো লাগাল। বড়মামা ঠিক আমার পেছনে ছিলেন তাই উলটে পড়ে গেলুম না।

বড়মামা বললেন, ‘হঠাৎ তোর কী হল? বাছুরের মতো ছুটছিস?’ পম্পি বললে, ‘আমার মাসিমা এসেছেন।’

মাসিমা তাঁর সব জিনিস পম্পিকে দিয়ে বললেন, ‘এখানে বসে সব ভাগ ভাগ কর।’ সব ডেকে আন। পুজো এসে গেল না। তুই সব বিতরণ করে দে। এটা হল ফার্স্ট লট।’

কাইজারকাকুকে ঘিরে সবাই গোল হয়ে বসেছেন। দোকানে তেলেভাজার অর্ডার চলে গিয়েছে। গজেনকাকুর ঘরে মস্ত একটা কেটলি আছে। সারাদিনে কতবার যে চা খান! চা-এর দায়িত্ব মাসিমার। বড়মামা বললেন, ‘আজ রাতে আমরা কেউ বাড়ি ফিরব না।’

মেজোমামা বললেন, ‘তুমি যে বল আট ঘণ্টা ঘুম না হলে শরীর খারাপ হয়।’

বড়মামা বললেন, ‘তুমি এখানেই শুয়ে পড়বে। তোমার তো একটি কাজ—খাই-দাই আর নাক ডাকাই। শরীরের মধ্যপ্রদেশের অবস্থাটা কি দেখেছ একবার। আগে চলে ভুঁড়ি, পিছে চলে নর।’

মেজোমামা এতটুকু অসন্তুষ্ট না হয়ে বললেন, ‘বড়, ভুঁড়িটা আমাদের বংশের ধাতে ভাই! আমাদের ঐতিহ্য, গৌরব, গর্ব, আভিজাত্য…।’

মাসিমা বললেন, ‘ব্যস, ব্যস। স্টপ, স্টপ।’

পম্পি আমার হাতটা ধরে বললে, ‘ভেতরে চল। একটা জিনিস দেখাব।’ হাঁসগুলো সব লাইন দিয়ে ঢুকছে। এইবার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়বে। সবুজ জল, নীল আকাশের স্বপ্ন দেখবে। পম্পির কর্মশালা। ছোট বড় পাথর, ছেনি, হাতুড়ি, উকো।

‘বোস।’

একটা পাথরের গোলা বের করে বললে, ‘এই দেখ, কাটতে কাটতে তোর মুখ বেরিয়ে এসেছে। একেবারে তোর মুখ। কপাল, নাক, ঠোঁট, দাড়ি। চল, কাইজারকাকুকে দেখাই, চিনতে পারেন কি না দেখি।’

আমরা ফিরে এসে শুনলুম :

বড়মামা বলছেন, ‘আমি কিন্তু গুনছি মেজ।’

‘গুনলেই হবে? স্টপ বলবি। থামব না, তখন হাতটা চেপে ধরবি।’

কাইজারকাকু পাথরের মুখটা দেখে বললেন, ‘একেবারে ঠিক, ঠিক। একজন বড় ভাস্কর আমাকে বলেছিলেন, ‘পাথরে মানুষের মুখ লুকিয়ে থাকে। শিল্পী যে মুখ ভাবতে ভাবতে কাজ করে সেই মুখটাই ফুটে ওঠে। Here is the truth. পম্পি আমি তোমাকে স্কাল্পটার করব। রদাঁর মিউজিয়ামে কাজ শেখাব। ইতালিতে ভূমধ্যসাগরের তীরে আমার একখণ্ড জমি আর বাংলো আছে। সিসিলি সুন্দর জায়গা। চারিদিকে বড়-বড় অলিভ গাছ। যখন ফুল আসে, মনে হয় স্বর্গটা বুঝি পৃথিবীতে নেমে এসেছে। সারা দিন সারারাত সমুদ্রের ঢেউ তটে আছড়ে পড়ে সাবানের ফেনা হয়ে যাচ্ছে। দেখি আর মনে হয় চোখ চেয়ে, স্বপ্ন দেখছি না ত! নেপলসে বসে শেলির লেখা কবিতা,

 The sun is warm, the sky is clear,

 The waves are dancing fast and bright.

 Blue isles and snowy mountains wear

 The purple noon’s transparent might

 The breath of the moist earth is light.

সেইখানে তোকে একটা স্টুডিও করে দেব। আমার ফ্রেন্ড গজরাজকেও নিয়ে যাব।’

পম্পি মুখ নীচু করে বসেছিল। মুখ তুলল। চোখে জল।

কাইজারকাকু বললেন, ‘জল! চোখে জল কেন? কারণটা কী?’

‘আমরা এখান থেকে চলে যাচ্ছি।’

‘চলে যাচ্ছি মানে? কোথায় যাচ্ছিস?’

‘সম্বলপুরে। দাদার কাছে।’

‘দাদা কী করে?’

‘কাঠের ব্যাবসা। ব্যাবসাটা খুব বড় হয়ে গেছে। একা সামলাতে পারছে না। আমি যাব না কাকু। আমি এই জায়গা ছেড়ে কিছুতেই যাব না।’

কাইজারকাকু জোর গলায় বললেন, ‘কেউ যাবে না। চল ত, তোর বাবার কাছে।’

আমরা সবাই চললুম। গজেনকাকুও আমাদের দলে। বারে বারে বলছেন, ‘মামার বাড়ি পেয়েছে। থাকব না। বেঁধে রাখব।’

পম্পি মাঝে-মাঝেই আমার হাতটা ধরে ফেলছে। কিছুদূর এগোতেই আমাদের সেই নতুন দিদা। উলটো দিক থেকে আসছেন, গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে।

‘ওরে দল বেঁধে তোরা কোথায় যাচ্ছিস রে?’

বড়মামা বললেন, ‘রাবণ বধ করতে।’

‘ব্যাটা, আবার এসেছে বুঝি! সীতাদের সাবধানে রেখো।’

‘সে আর গেল কই? রামচন্দ্রই চলে গেলেন, আর এলেন না।’

‘কেন রে, আমার কৃষ্ণ আছে। বাঁশিটাই কেবল হারিয়ে ফেলেছে।’

একগালে হাসি। আমাদের দিকে তাকালেন। কেউ বুঝল না, কেন তাকালেন।

অনেকটা জমির ওপর শঙ্করকাকুর বাড়ি। সামনের দিকটা পাকা দোতলা। পেছন দিকটা চলো। মেঝে সান বাঁধানো। পেছন দিক দিয়ে বেরলেই বাগান, যার নাম ‘বায়ো গার্ডেন’। গাছপালা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জায়গা। কাইজারকাকু বীরদর্পে আমাদের নিয়ে ঢুকলেন, ‘কোথায় সেই শঙ্কর?’

শঙ্করকাকু মেঝেতে বসে খুব সাবধানে কী একটা প্যাক করছিলেন। চমকে উঠে দাঁড়ালেন, ‘কাইজার!’

কোমরে খট করে একটা শব্দ হল।

বড়মামা বললেন, ‘এই রে! আ গিয়া। শলভাসন ছাড়া গতি নেই আর। এইবার চিৎ-পটাং, পটাং-চিৎ।’

শঙ্করকাকু বললেন, ‘খুব উৎকৃষ্ট সময়ে ভগবান তোমাকে পাঠিয়েছেন কাইজার, তোমার কাছ এইসব আমি রেখে যেতে চাই।’

‘শাট আপ ইউ স্কাউন্ড্রেল!’

শঙ্করকাকু থতমত খেয়ে গেলেন।

‘কোথায় কোন ভবিষ্যতের দিকে যেতে চাইছ! জানো, আমি এক নম্বর বক্সার।

এক ঘুসিতে সামনের সব কটা দাঁত ফেলে দেব।’

ভেতরের ঘর থেকে কাকিমা বেরিয়ে এসেছেন। কাঁদো-কাঁদো মুখে বললেন, ‘যদি কিছু অন্যায় করে ফেলে থাকে আপনারা ক্ষমা করে দিন।’

‘ক্ষমা! ক্ষমা পেতে পারে একটি শর্তে, এই নারায়ণ পল্লি ছেড়ে কোথাও যাওয়া চলবে না।’

মেজোমামা গান গেয়ে উঠলেন,

 ‘জনম আমার এই দেশেতে,

 যেন এই দেশেতেই মরি।’

মাসিমা বললেন, ‘আহা! যেমন গলা, সেইরকম গান? প্রাণ জুড়িয়ে গেল।’

মেজোমামা বললেন, ‘বোম্বাইতে রফিসাহেব একবারই আমার ছোট্ট একটা গজল শুনেছিলেন। শুনে বলেছিলেন, তুমি আর বেশি বাড়াবাড়ি কোরো না তাহলে আমাকে গান ছেড়ে দিতে হবে।’

বড়মামা বললেন, ‘মেজো, আমি তখন ছিলুম, মিথ্যে কথা বোলো না। রফিসাহেব আমাকে বললেন, ছেলেটা কে! মানুষের গলায় এমন গাধার কনসার্ট আমি আগে কখনও শুনিনি। তবে হ্যাঁ, আমার গলায় নজরুলের গান শুনে কিছুক্ষণ সেনসলেস হয়ে গিয়েছিলেন। সুস্থ হয়ে বললেন, আমি এই গান শিখব। তারপরেই রেকর্ড বেরুল।’

মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে আমরা সবাই বসেছি। বেশ জমিয়ে। কাইজারকাকু বললেন, ‘হিয়ার ইজ মাই স্কিম। না, বসে হবে না। স্পটে চলুন।’

বাড়ির পেছন দিকে বেরিয়ে এলুম। কাইজারকাকু দেখাতে লাগলেন, ‘ওই যে দূরে তিনটে টিলা। পেছন দিকে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। এখান থেকে ওই টিলা পর্যন্ত যতটা জমি পড়ে আছে, সবটাই আমরা নিয়ে নেব। আর এই দিঘিটার ওপর দিয়ে চলে যাবে সুন্দর একটা ব্রিজ। এখানে হবে বায়ো পার্ক। বিদেশ থেকে সমস্ত পরিকল্পনা, নকশা আমি করে এনেছি। শঙ্করের একটা গবেষণাকেন্দ্র এখানে থাকবে। গজেন পৃথিবীর সমস্ত অঞ্চলের মানুষের মূর্তি তৈরি করবে। একটা বেঞ্চে একজন সাহেব বসে আছে। আবার আর-এক জায়গায় জামাইকার একজন মহিলা। মাথায় কলার ঝুড়ি নিয়ে যাচ্ছে। এক জায়গায় একজন বড় ইন্ডিয়ান ঘোড়ার পিঠে।’ পেছন থেকে কেউ একজন বললেন, নারী কণ্ঠ, ‘এক জায়গায় পথ দিয়ে তিনজন বৈষ্ণব চলেছেন, খোল, করতাল নিয়ে।’

‘দিদা, তুমি!’ পম্পির কী আনন্দ!

ঘরে ফিরে এসে কাইজারকাকু বললেন, ‘বিরাট পরিকল্পনা। ব্লু-প্রিন্ট রেডি, এমনকি টাকা। সম্বলপুরে নিঃসম্বল হয়ে কে থাকে দেখি! যে যাওয়ার চেষ্টা করবে তার ঠ্যাং ভেঙে দেবে।’

দিদা বললেন, ‘ও ছেলে, আমার মন্দির আর জঙ্গলটাও তুমি ঢুকিয়ে নাও। বিরাট আতা বাগান। আতা গাছে তোতা পাখি। ঝিলের জলে কমলে-কামিনী। পলাশ গাছে লাল পতাকা। তোমার নামটি কী গো? বেশ স্বপ্ন দেখালে!’

‘এখানে আমাকে সবাই কাইজার বলে।’

‘নামের আবার এ কী ছিরি! ও নামে আমি ডাকতে পারব না। তুমি আমার গৌরাঙ্গ। রাধা, কৃষ্ণ আমি আগেই পেয়ে গেছি।’

রাজবাড়ির দিদা সে-কালের গল্প জমালেন। বাইরে ভরা চাঁদ। আলোর আভা ভেতরে এসেছে। তিন টিলার ওধারে মাদল বাজছে। ওদিকের গ্রামে উৎসব আছে। সকালে গাধার পিঠে চেপে মোল্লা নাসিরুদ্দিন ওই দিকে গেছে। সে এক মজার মানুষ। এই পল্লিতেই তার একটা আখড়া আছে। মজার গান, কমিকস করে। আলখাল্লা পরে নাচে। লোকে হাসে। পায়ে বিরাট নাগরা। মাথায় বিশাল পাগড়ি। বলে, আমি সেই মোল্লা নাসিরুদ্দিন।

দিদা বলছেন, ‘সবাই শুনছেন, নারায়ণ পল্লি নয়, নারায়ণ নগরের পুরনো কথা। দিদা রাজস্থানের রাজবংশের মেয়ে। এখানে এক সময় বিরাট একটা নগর ছিল। লোকজন, রাজবাড়ি, কেল্লা। মানুষের কোনও অভাব ছিল না। দেশ-বিদেশের পণ্ডিতরা আসতেন, ব্যবসায়ীরা আসতেন। সুন্দর একটা নদী ছিল। সেই নদীটা হঠাৎ বসে গেল। পড়ে রইল বালি। ছোট-বড় পাথর। নৌকোর কঙ্কাল। তারপরে বর্গি এল দেশে। সে এক ভীষণ উৎপাত। মানুষ পালাতে লাগল। তখন এই গড়টা খুব কাজে লেগেছিল। এইবার একটা সত্যি কথা বলি। সেদিন এদের বলিনি। ভয় পাবে বলে বলিনি। তোরা যে ফুটোঅলা ঘরটা দেখেছিস, ওই ঘরে সত্যি-সত্যি একটা গরিলা আছে। সেই রাজাদের আমলের। তার বয়েস যে কত হল, আমি বলতে পারব না বাপু। গভীর রাতে সে গম্বুজের ওপর উঠে চুপ করে বসে থাকে। জঙ্গলে গিয়ে খেয়ে আসে। দিনের বেলা ঘুমোয়। ওই ঘরটা সেইসময় ছিল তোষাখানা। চৌকিদার ছিল ওই গরিলা। ধন, দৌলত এখন আর কিছু নেই। ওই সম্পত্তি আমি আগলে বসে আছি। যক্ষীবুড়ি। গৌরাঙ্গ আমাকে মুক্তি দাও। প্রভাসতীর্থে ফিরে যাই। আর তো কয়েকটা বছর। তলানি পড়ে আছে।’

কাইজারকাকু বললেন, ‘এই যাই-যাই শুনলে খুব রাগ হয়। কেউ যাবে না, কোথাও যাবে না। আজ থেকে আপনি আমার দিদি। রানী দিদি। টাকা পয়সা আপনার কাছে থাকবে। আপনি হবেন কোষাধ্যক্ষ। আর ওই পার্কে গরিলাটার জন্যে তৈরি হবে সুন্দর একটা ঘর—গরিলা হাট। একটা টয় ট্রেন থাকবে। তিন টিলা পর্যন্ত যাবে।

শঙ্করকাকু বললেন, ‘আনন্দে আমার ভেতরটা গুড়গুড় করছে। লুচি, বেগুনভাজা খেতে ইচ্ছে করছে।’

বড়মামা বললেন, ‘আবার আমার সেই অস্থির-অস্থির ভাবটা ফিরে আসছে। করতে হবে, একটা কিছু করতে হবে।’

মেজমামা বললেন, ‘অনেক করেছি, আর ওসব ভালো লাগে না। আমি বরং একটু শুয়ে পড়ি।’

দিঘির জলে চাঁদ নেমেছে। আমি আর পম্পি বসে আছি ঘাটে। সাদা একটা নিশাচর হাঁস জল ছুঁয়ে উড়ে গেল। সেই অদ্ভুত কঁক, কঁক ডাক। পম্পি বললে, ‘আমাদের এখনও অনেক বড় হতে হবে। অনেক অনেক বছর। তোর পুরোটা আমি বানাব। একটু একটু করে। মনের মতো করে।’

‘মানে?’

‘মানেটা তুই দিদার কাছে জেনে নিস। হাঁদারাম।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *