আতাপুরের বাঘ – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
রাধামোহনবাবুর দিন যত যাচ্ছে হ্যাপা তত বাড়ছে। এক বয়সে ভেবেছিলেন আর কী, পুত্ররা লায়েক হয়ে গেলেই তুড়ি মেরে জীবন কাটিয়ে দেবেন। খাবেন-দাবেন, দেশ ভ্রমণে বের হয়ে পড়বেন। কোনো দায় থাকবে না। পুত্রদের মানুষ করে তোলাই বড়ো কাজ। মা-বাবার আর দায় নেই। তাঁরা গত। ভাইদের থিতু করে দিতে পেরেছেন, বোনেদের সৎপাত্রে দান করে খুশিই ছিলেন, বাড়িঘর বানিয়ে নিজেও থিতু হতে গিয়ে দেখলেন, সব গড়বড় হয়ে গেছে।
তিনি সকালে ওঠেন, কেউ সকালে ওঠে না।
সকালে চা খাওয়ার অভ্যাস, কেউ চা করে দেয় না।
‘আরে, চায়ের কী হল!’
রান্নার মেয়েটির গলায় ঝাঁজ, ‘একসঙ্গে হবে। বউদি বারণ করেছে।’
বাড়িতে আটজন লোক, তিনজন কাজের লোক। খায়দায়, থাকে। মাইনেও কম না। আয়া থাকলে তার এক হ্যাপা, তাও তাঁর জানা ছিল না। গরিব বাবার পুত্র তিনি। স্বামী-স্ত্রীর রোজগারে বাবার সংসার, নিজের সংসার। টেনেটুনে কোনোক্রমে চলে যেত। শেষে সেই মানুষ এত বড়ো গাড্ডায় পড়ে যাবেন স্বপ্নেও ভাবেননি।
রান্নার মেয়েটা দেশে গেছে। সঙ্গে-সঙ্গে বউমারাও পোঁটলাপুঁটলি নিয়ে বাপের বাড়ি। পড়ে থাকলেন তিনি, তাঁর গিন্নি আর পুত্ররা। নাও এবারে ঠ্যালা সামলাও। তামাশা দেখার লোকের অভাব হয় না। গিন্নি হার্টের রুগি। তিনিও এখন অকাজের। সুতরাং ফের হেঁশেলে।
প্রতিবেশীরা দেখা হলেই বলবেন, ‘কী দাদা, বাঘারুর মা এল?’
‘না রে ভাই!’
‘কী করছিলেন? ডেকে-ডেকে সাড়া পাচ্ছিলাম না!’
কী যে করছিলেন, না জানার কথা না। তিনি খুবই পেট-পাতলা লোক। সকলে সব জানে। বাবুদের অফিস-কাছারিতে বের হওয়ার সময় ভাত, ডাল, মাছ পাতে দিতেই হয়। তারই আয়োজনে যে ব্যস্ত হেঁশেলে, না জানারও কথা না। তাদের টিফিন। এক হাতে—ঠিকে লোকটিও যতটা পেরেছে কাজ এগিয়ে দিয়ে গেছে। তিনি এখন হেঁশেলে হাত পুড়িয়ে রান্নায় ব্যস্ত, মাথাও কম গরম না।
‘পরে কথা হবে।’
পরে কী আর কথা হবে! বউমাদের কথা হবে, মুচকি হাসি। তাও তিনি টের পান। মেজাজ বিগড়ে গেলে গড়গড় করে সংসারের সব কথা বলে দেওয়ার স্বভাব।
‘বউমারা কী করে?’
‘অফিস করে, কলেজ করে আর বাড়িতে বসে উল বোনে। টিভি দেখে, বই পড়ে। নাটক, সিনেমা, রবীন্দ্রসদন আছে। কাজের অভাব! কেবল অর্ডার। এক গ্লাস জল ভরে খাবে না। কাজের লোকের কী দোষ দেব ভাই! এত ফাইফরমাশ, নিজেরা কুটো গাছটি নাড়বে না।’
‘আপনাকে কে খেতে দেয়?’
‘বাঘারুর মা।’
‘আপনার কাচাকাচি কে করে?’
‘বাঘারুর মা।’
‘সেই বাঘারুর মা বাড়ি গেছে। দশ দিনের কড়ারে গেছে, আজ এক মাস হয়ে গেল। চিঠিও নেই, ফেরারও নাম নেই। কাছেও না যে ঘুরে আসবেন। বাঘারুর মা আছে বলেই তিনি দু-বেলা দুটো সময়মতো খেতে পান—বাঘারুর মায়ের হাত জোড়া থাকলে ক্বচিৎ কখনো ফটাস করে একটা থালা ফেলে দিয়ে যায় কে? কোন বউমার কাজ এটি, বোঝার আগেই তিনি টের পান ভাত, ডাল, মাছ সবই এক পাতে। খা ব্যাটা।’
‘বাঘারুর মা আসবে তো?’
‘তা কী করে বলব ভাই! আমার আমলে একরকম, বউমাদের আমলে অন্যরকম। আমাকে তোয়াজ করলেই খাপ্পা। তোয়াজ করতে হবে তাদের। লোক টিকবে কেন ভাই? প্রবলেম চাইল্ড বোঝো? আয়াটি বাড়ির একটি আস্ত চালকুমড়ো। নাতি এখন চার বছরের, স্কুলে যায়। কাজটা কী বলো! তিনি দয়া করে খান আর গড়াগড়ি দেন। তিনি না থাকলে, কার কাছে রেখে যান বলো। আমরা তো বাড়ির কেউ না।’
‘সব ক-টাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলেই পারেন?’
‘পারি রে ভাই! রেগে বলেও ফেলেছিলাম—সব ক-টাকে বাড়ি থেকে বের করে দেব, সেজো পুত্র শুনে হা হা করে হাসল। ঘরে উঁকি দিয়ে বলল, সকালে বের করে দেবে, সন্ধ্যায় লণ্ঠন হাতে পুত্রদের খুঁজতে বের হবে কোথায় গিয়ে উঠল! তোমার মুখে ওসব কথা সাজে না। তোমাকে আমরা চিনি না!’
‘প্রবলেম চাইল্ডদের খবর কী?’
‘বাপের বাড়ি। বাঘারুর মা এলে তাঁরাও আসবেন।’
‘পোঁটলাপুঁটলি?’
‘সঙ্গে। আরে ভাই আমার বাবারও তো কম পোঁটলাপুঁটলি ছিল না! আমরা পাঁচ ভাই, তিন বোন। আমার চার। ওদের তো একটাই—হয় পোঁটলা নয় পুঁটলি। তারই কত বায়নাক্কা। স্কুলে যাও, সাঁতার শিখতে যাও, গানের স্কুল, নাচের স্কুল, খেলার মাঠ, কত কী!’
‘তাহলে দাদা হাত পুড়িয়ে ভাত খাচ্ছেন! বাঘারুর মা না এলে আপনার সংসার ফাঁকা। যখন ফিরছে না, চিঠি দিন। না হয় কাউকে পাঠিয়ে দিন। নিজেও চলে যেতে পারেন। বয়েস হয়েছে, একদন্ড তো বসে থাকতে দেখি না। ওপরে দেখছি ঘরও তুলছেন।’
তা প্রতিবেশীরা মিথ্যা বলে না। ওটা যে কী জ্বালা, রাধামোহনবাবু হাড়ে-হাড়ে টের পান। এ-বয়সে বাঘারুর মার খোঁজে যেতেও সাহস হচ্ছে না। কোথায় ন্যাজাত, কোথায় হাসনাবাদ, কী করে যেতে হয়, বাসে না ট্রেনে, ন্যাজাত হয়েও যাওয়া যায়, আবার হাসনাবাদ হয়েও যাওয়া যায়, তারপর ভটভটিতে—রাতে বাঘও বের হয়, লোকজনও তুলে নিয়ে যায়। অথচ সংসারে বাঘারুর মা না থাকলে যে বাঘের উপদ্রব শুরু হয়, তাতে করে ‘দুর্গা, দুর্গা’ বলে বের হয়ে যাওয়াও ঢের সুখের! বাঘের পেটে গেলে আরও সুখের, প্রবলেম চাইল্ডদের উৎপাত থেকে বাঁচা যায়!
কত যে সংসারে ফরমাশ—বাবা টেলিফোন বিল, বাবা ইলেকট্রিক বিল, বাবা বাজার, বাবা কলে জল নেই, বাবা বাথরুমের ফ্লাশ কাজ করছে না, বাবা সব ডিম পচা, ডিম পালটে আনুন, ডিম পালটাতে পালটাতে জেরবার, বাঘারুর মা না থাকলে আরও জেরবার। কাজেই পুত্রদের ছুটির দিনে বলেই ফেললেন, ‘আমি যাচ্ছি।’
গিন্নি তারস্বরে বলে উঠল, ‘কোথায়?’
‘বাঘারুর মায়ের খোঁজে।’
‘তোমার কি বাঘের পেটে যাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে?’
‘হয়েছে মনে হয়।’
‘তাহলে যাও। আমার কী, আজ আছি কাল নেই। এসে দেখবে আমিও আর-এক বাঘের পেটে চলে গেছি।’
‘তা আমাদের যাওয়াই ভালো। ছেলেদের ছুটি আছে, আমি না থাকলেও বিশেষ ক্ষতি হবে না।’
রাধামোহনবাবু খোঁজখবর নিয়ে জেনেছেন ন্যাজাত হয়ে গেলে বিদ্যাধরী নদী পড়বে। বিদ্যাধরী নদী কালিন্দী হয়ে রায়মঙ্গলে পড়েছে। হাসনাবাদ দিয়ে গেলে ইছামতী ধরে দক্ষিণের দিকে দেড়-দু-ভাটি পথ। তারপর আতাপুর। আতাপুরে বাঘ বের হয়। দিনে দিনে যেতে না পারলে বিপদ। বাঘ রাতের বেলা নদী পার হয়ে আসে। এসব খবর বাঘারুর মা তাঁকে দিয়েছে।
সেই এক সন্ধ্যায় যখন বাঘারুর মা এল, কেমন এক কাকলাশ চেহারা। ক্ষীণকায়, অনাহারে, অর্ধাহারে শরীরে মেদ-মাংস আছে কী নেই, বোঝা মুশকিল। শীতের রাতে হাজির। বিনতার দিদিকে কে গছিয়ে দিয়ে গেছে। সে আবার রামমোহনবাবুকে গছিয়ে দিয়ে গেল। প্রবলেম চাইল্ডদের ফরমাশের ঠেলায় রান্নার লোক যে দু-পাঁচ মাসের বেশি থাকে না, বিনতার দিদি এটা ভালোই জানত। ওদের পছন্দ অপছন্দ খুব বেশি। রাধামোহনবাবু জেরবার, যাকে দেবে তাকেই লুফে নেবেন। সেইসব কারণেই, শীতের রাতে এসে হাজির।
রাধামোহনবাবুর সসেমিরা অবস্থা। হাতের পাঁচ ফেলতে নেই। রেখে দিলেন।
কোটরগত চোখ, অস্থিচর্মসার ক্ষীণাঙ্গীকে প্রশ্ন, ‘তোমার কী নাম বাছা?’
হাঁটু গেড়ে প্রণাম। তারপরই ‘বাবা’ সম্বোধন।
‘আজ্ঞে বাবা, আমায় বাঘারুর মা বলে ডাকবেন।’
‘বাঘারুর মা! সে আবার কী!’ রাধামোহনবাবুর ভারি বিস্ময়!
‘বাঘারু আমার বড়ো ছেলে।’
‘কী করে?’
‘আজ্ঞে, বাঘ মারে।’
‘বাঘ! বলছ কী! বাঘ মারা তো বেআইনি। সরকার জানতে পারলে থানা হাজত হয়ে যাবে।’
‘আজ্ঞে বাবা, গোরু ছাগলের মতো মারতে মারতে বাঘকে নদীর ওপারে তাড়িয়ে দিয়ে আসে। বাঘ মারলে পাপ হয় আমরা গরিব চাষাভুষো মানুষও বুঝি। আমার বাঘারু বাঘ তাড়িয়ে দেয়, মারে না। বাঘারুর বাপ বাঘের ভয়ে দেশান্তরী।’
‘খোঁজ নেই!’
‘তা আজ্ঞে, আছে বাবা। মাঝে মাঝে আসে। দিনের বেলায় আসে। রাতে থাকে। ঘর থেকে বের হয় না। কখন বাঘে খায়!’
‘বাপকে বাঘে খাবে, বাঘারুকে পিঠে নিয়ে নাচবে, সে কখনো হয়!’
‘হয় বাবা। বাঘারু একবার লেজ ধরে বাঘকে খড়ের গাদা থেকে টেনে নামিয়েছিল, স্বচক্ষে দেখা। বাঘ তাড়া খেয়ে দৌড়োয়, বাঘারুও দৌড়োয়। গাঁয়ের লোকও দেখেছে।’
‘খড়ের গাদায় বাঘ! আর জায়গা পেল না!’
‘বাবা, বাঘের খুব শীত জানেন। শীতে কাতর, কী করবে বাবা। কোথায় যায়। তা বাঘারু যখন আছে, তার খড়ের গাদায় শুয়ে থাকাই ভালো। সে তো বাঘ মারে না। বনবিবির গোঁসা খুব কঠিন গোঁসা। তারে না ডরালে চলে! বাঘ মারলে দেবী কুপিত হন। বনবিবির বর না পেলে বাঘারু কখনো বাঘ তাড়াতে পারে?’
‘বাঘারু যখন আছে বাপ তার বাঘের ডরে দেশান্তরী হয় কেন? বাঘারু তাড়িয়ে দিলেই পারে!’
‘ওর যে বাবা আজ্ঞে কপালে লেখা আছে বাঘে খাবে। বাঘারুর ঠাউরদারে খেয়েছে। ঠাউরদার বাপকে খেয়েছে। জঙ্গলে কাঠ কাটতে গিয়ে ফিরে না এলে সুবচনীর থানে হত্যে। কিন্তুক ফেরে না। তা দেবীর দোষ দিয়ে লাভ নেই বাবা। কপালে লেখা থাকলে খন্ডন করে কার সাধ্য!’
থাকতে থাকতে আরও কত খরব দিত বাঘারুর মা।
ওপরে চা দিতে এসে বলত, ‘বুঝলেন বাবা, একবার রাতের বেলা ফিরছি, সোত্রাগাছির মেলা খুব বিখ্যাত। গেলেই কত কিছু কিনতে ইচ্ছে করে। কাচের চুড়ি, কানের টব, ঝাঁঝরি, হাতা, খুন্তি, মাটির কলসি সব কিছু। তা ফিরতে দেরিই হয়ে গেল বাবা। আটঘড়ার বাবুদের বাড়ি সুনসান, কেউ থাকে না। বাঘের দৌরাত্ম্যে সব বাড়িছাড়া।’
রাধামোহনবাবু বিরক্ত হয়ে বলেন, ‘আরে তোমার কী হল বলো! ফিরছিলে যখন বেশ করেছ, তার আবার এত কথা কেন?’
‘আজ্ঞে বাবা, কথাখান ঠিক থাকে না। বাবুদের বাড়ি পার হলেই বনজঙ্গল। রাস্তা আছে। হেঁতালের ঝোপ, গরান গাছের মতো। বাতাসে নড়ানড়ি করছে।’
বাঘারুর মায়ের এই দোষ। এক কথা বলতে বলতে লাইন পালটে ফেলে।
‘আজ্ঞে বাবা, তারপর যা বোঁটকা গন্ধ! জানি, মরণ লেখা। জঙ্গলের ভেতর মচমচ শব্দ। আমরা হাঁটি, তিনিও হাঁটেন। আমরা থামি, তিনিও থামেন। কার ঘাড় মটকাবে কে জানে! বুকে জল থাকে না গো বাবা। ভাগ্যিস বাঘারুর বাপ সঙ্গে ছিল না। থাকলে কী হত বলেন!’
‘বাঘারুর বাপকে খেত। শত হলেও কপালে লেখা।’ তারপর কী ভেবে রাধামোহনবাবু বলেছিলেন, ‘তাহলে বলতে হয় বাঘ তোমার লোক চেনে!’
‘কী যে বলেন গো বাবা, চিনবে না! না চিনলে বাঘারুরে বলে চিৎকার করতেই পালায়!’
‘বাঘারু কি স্বপ্ন দেখে?’
‘না গো বাবা, খেতেই পায় না, স্বপ্ন দেখবে!’
তারপরই কী বুঝে বাঘারুর মা বলেছিল, ‘আজ্ঞে, যদি গাঁয়ে যান, বাঘারুর কথা সবাই এক বাক্যে স্বীকার করবে।’
‘জঙ্গলে বাঘ কি উঁকি দিয়েছিল, না শুধু মচমচ শব্দই শুনেছিলে?’
আঁধার রাতে বাঘ দেখা যায় না জানেন। আগুনে-চোখ। চোখ জ্বলে। দেখলেই হাত-পা অবশ। সবাই বনবিবির পাঁচালি সুর করে পাঠ শুরু করে দিলাম বাবা। ও মা, দেখি পা-পা করে এগোচ্ছে আর পরিত্রাহি চিৎকার, ওরে বাঘারু রে, তোর মাকে বাঘে খেল রে! হাঁড়ি, পাতিল ফেলে ছুটব কী! আবার চিৎকার, ওরে বনবিবির দোহাই মানছে না রে বাঘারু। তুই কোথায় গেলি রে বাপ! তোর মা বাঘের পেটে গেলে তুই কী খাবি রে বাপ। বিশ্বাস করেন গো বাবা, এক লাফ। লম্ফঝম্ফ বনজঙ্গলে তান্ডব। ঊর্ধ্বশ্বাসে বাঘারুর নাম শুনেই ডরে পালাচ্ছে।
এত সব কথা রাধামোহনবাবু শুনে বলেছিলেন, ‘যাক, তোমার বাঘারু আছে। আমার তো তাও নেই বাছা। তোমার বাঘারুকে নিয়ে এসো একবার, দেখব।’
‘কী যে কথা বাবা বলেন গো! গাঁ থেকে তার ছুটি আছে? সে থাকে বলেই গাঁয়ে বাঘ ঢোকে না। বাঘারু বাঘের একটা মুখোশও পরে থাকে। নদী পার হয়ে চুপি চুপি বাঘ গাঁয়ে ঢুকছে শুনলেই, বাঘারু স্থির থাকতে পারে না। গাঁয়ের লোক মিলে একটা হলুদে রঙের জোব্বা বানিয়ে দিয়েছে। বাঘের মুখোশ বানিয়ে দিয়েছে। কোমরে নাকড়া বাঁধা। সে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায় আর বাদ্য বাজায়। আমার বাঘারুর বগলামুখী কবচ আছে, তারে খায় বাঘের সাধ্য কী! ওটা কোন সাধু তপস্বী তারে দিয়ে গেছে।’
‘বাঘারুর বয়স কীরকম?’
‘সেবারে বন্যা হল না! দেশ-গাঁ ডুবে গেল। আমরা পাঁচ কোশ দূরে স্কুলবাড়িতে উঠে গেলাম। মাঠে তাঁবু পড়ল। আমার বাঘারুও নেমে এল ধরায়। ওর বাপ আহ্লাদে আটখানা। আটকড়াই-এর দিন বাঘারুকে কোলে নিতেই আহ্লাদ বেড়ে গেল তার বাপের—কোলে নিয়ে সে কী কান্ড! ওগো কী নাদুসনুদুস—একেবারে বাঘের বাচ্চা!’
এই এক দুঃস্বভাব বাঘারুর মার। কথা সহজে শেষ হয় না। কথা না বলেও পারেন না রাধামোহনবাবু। বাড়িতে কার আর অত সময় আছে তাঁর সঙ্গে বকবক করবে! সবাই যে যার মতো থাকে। বাঘারুর মার সঙ্গেই দু-চারটে তবু কথা হয়। বন্যা কবে হয়েছে, তা দিয়ে যদি বয়স ঠিক করতে হয় তবে তিনি যে নাচার। বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, ‘বন্যা তো দু-চার সাল বাদে-বাদেই হয়। ও দিয়ে কী আর বয়স ঠিক করা যায়!’
তারপরই বলেছিল বাঘারুর মা, ‘আমার বাঘারু দুটো ছাগল পুষছে। হাট থেকে ডিম এনে বাচ্চা ফুটিয়েছে। ওর চারটে মুরগি, পাঁচটা হাঁস বাবা। বাঘারু ছাগল, হাঁস পালতে খুব ভালোবাসে।’
বয়স কিছুতেই বলছে না। ছাগল, হাঁস দিয়েও বয়স ঠিক করা কঠিন। বাধ্য হয়ে বলেছিলেন, ‘ওর বাপ তো মাসে মাসে আসে। দু-এক রাত থেকেও যায়। দেশান্তরী মানুষ তো, টাকার কথা ভোলে না। একবার বলবে, বাঘারুকে যেন নিয়ে আসে। দেখব।’
‘না গো বাবা, বউদিরা কর্তা আসে বলেই প্যানপ্যান করে। বাঘারুর এসে কাজ নেই।’
‘কাজ আছে। তুমি বাঘারুকে নিয়ে আসতে বলবে।’
কথা রেখেছিল। বাঘারু বয়স চোদ্দো-পনেরোর বেশি হবে না। সে পাঁচ-সাতদিন ছিল ঠিক, তবে সে তার মায়ের এত ন্যাওটা যে, একদন্ড তার মায়ের কাছছাড়া হয়নি। ডাকলে দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে, ভেতরে ঢুকতে সাহস পায়নি। মনে হয়েছে খুবই গোবেচারা স্বভাবের। সুন্দরবন থেকে হঠাৎ এত বড়ো শহরে ঢুকলে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যেতেই পারে। বাঘারুর দোষ দেওয়া যায় না।
সুতরাং বাধ্য হয়ে বাঘারুকে ডেকে বলেছিলেন তিনি, ‘ওরে বাঘারু, চোরের মতো লুকিয়ে বেড়াস কেন, কাছে আয়। আমাকে তোর ভয় কী!’
সে মাথা নীচু করে ঠায় হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে থাকলে তিনি বলেছিলেন, ‘তুই বাঘ তাড়িয়ে নদী পার করে দিয়ে আসিস?’
সে কিছু বলছে না।
‘কী রে, চুপ কেন?’
‘আজ্ঞে, গুপ্ত কথা। পাঁচ কান করতে নাই।’
‘আচ্ছা ছেলে তো! এমনভাবে কথা বলছ যেন সে সত্যি বাঘ তাড়ায়। বাঘ তাড়াবার গুপ্ত মন্ত্র তার জানা। তোর মা যে বলে, বাঘারু আছে বলে গাঁয়ে বাঘ ঢুকতে সাহস পায় না। তোর এত হিম্মত, দেখে তো মনে হয় না!’
‘আজ্ঞে, সব কী দেখে বোঝা যায়! তবে মার কী দরকার ছিল বলার! আমার মা না খুব বোকা।’
এরপর আর কী বলা যায়! তবে ছেলেটিকে দেখে তাঁর মনে হয়েছিল, খুবই নিষ্পাপ। বাড়িতে মা থাকে না, বাবা থাকে না, ভাই-বোনদের সামলায়, ছাগল, হাঁস, মুরগি পুষে সংসারের সাশ্রয় খোঁজে, সে যদি বাঘ তাড়ায়ই, দোষের কী!
‘তোর বগলামুখী কবচ আছে?’
‘তা আছে বাবু।’
‘যদি তোর দেশে যাই, বাঘে খাবে না তো!’
‘আপনি যাবেনই না। বাঘে খাবে কেন!’
‘গেলে খাবে বলছিস!’
বাঘারু এমন অবজ্ঞার হাসি হেসেছিল যে, তিনি কিছুটা বেকুব। বাঘের আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই তাঁর মতো লোককে খাওয়ার জন্য নদী পার হয়ে গাঁয়ে ঢুকবে। কিছুটা রসিকতা করার জন্যই বাঘারুর কাছে বাঘের প্রসঙ্গ তুলেছিলেন। বাঘ নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা সে পছন্দ করে না এটাও তিনি বুঝেছিলেন। আর তাতেই রাধামোহনবাবু কাবু। হয়তো কিছু একটা আছে বাঘারুর মধ্যে। তিনি কেন যে ভেবে ফেলেছিলেন, বনজঙ্গলে থাকতে থাকতে ছেলেটা জীবজন্তুর দুঃখ-কষ্ট টের পায়। বাঘের সঙ্গে বন্ধুত্ব থাকতেই পারে।
রাধামোহনবাবু বারাসাতে গিয়ে বাসে উঠে পড়লেন। সংসারে থাকলেও বাঘের তাড়া, আর জঙ্গলে গেলেও বাঘের তাড়া। তবে সেখানে বাঘারু আছে। সংসারে তাঁর তাও নেই। বাড়ির সবার ওপর ক্ষুদ্ধ তিনি। শেষ বয়সে হাত পুড়িয়ে রান্না করা যে কত বড়ো ব্যর্থতা, কে বুঝবে! গিন্নির অনুরোধ, পুত্রদের অনুরোধ কিছুই আর কর্ণপাত করলেন না। খুব সকালে বাস ধরলে ন্যাজাত চার-পাঁচ ঘন্টার রাস্তা। সেখান থেকে ভটভটি। ভটভটিতে উঠে গাঁয়ের নাম বলতেই, একজন বলে ফেলল, ‘আরে, বাঘারুর গাঁয়ে যাবেন, চলেন। ঘাট এলে নেমে যেতে বলব।’
‘কখন পৌঁছোব?’
‘নদী ঠাণ্ডা থাকলে সন্ধ্যা হবে।’
‘ঠাণ্ডা না থাকলে?’
‘সেটা ভগবান জানেন।’
কেমন এক গোঁ ধরে গেল। সাঁজ লাগুক, রাত হোক, তিনি যাবেনই। বাড়িঘর আর বনজঙ্গলে তাঁর কোনো তফাত নেই। যদি বাঘের দেখা পাওয়া যায়—তা আরও মজা। বাঘারুর দোহাই, বাঘারুর মায়ের দোহাই দিলেই বাঘ হয়তো রাস্তা চিনিয়ে বাড়ি দিয়ে আসবে।
নদীনালার দেশ এমন বিচিত্র হয়, তিনি জানতেনই না। সারাটা রাস্তা বাসে দাঁড়িয়ে, বসার জায়গা নেই, ঘেমে-নেয়ে কেমন অবসাদ শরীরে মানুষ এভাবে বাঁচে, আগে তিনি যেন জানতেন না। কোলে-কাঁখে বাচ্চা, হাঁটু জুড়ে বাচ্চা, খানাখন্দ পার হয়ে, ফসলের মাঠ পার হয়ে বাস ঢেউ ভাঙতে ভাঙতে শেষপর্যন্ত ন্যাজাতে নামিয়ে দিলে একটা টুলে বসে কিছুক্ষণ হাঁফালেন, চা-পাউরুটি খেয়ে আতাপুরের ভটভটি ধরেছেন, তারপর কেমন ঠাণ্ডা-নদীর জল, দু-পারের গাছপালা, নদী ঠাণ্ডা যে নয়, তাও টের পাচ্ছেন। প্রবল বাতাসে উঠেছে ঢেউ, আছড়ে পড়ছে ভটভটিতে, ডুবে গেলেও হয়—তাঁর নিজের জন্য কোনো ভাবনাই বোধ হয় কাজ করছে না। আসলে গোটা সংসারের ওপর ক্ষোভে তাঁর মাথাও বোধ হয় ঠিক ছিল না।
‘আর ভাই কতদূর!’
‘এই এসে গেলেন বলে!’
‘আর ভাই কতদূর!’
‘ওই যে গাঁয়ে লণ্ঠন জ্বলছে, ওটাই, নদীর বাঁক শেষ হলেই ঘাট দেখতে পাবেন।’
কিন্তু ঘাটে নেমে বুঝলেন, বেশ রাত হয়ে গেছে। গাঁয়ের কোনো চিহ্ন নেই। শুধু চারপাশে ঝোপজঙ্গল, আর ঘন হেঁতালের ঝোপ। ভটভটি থেকে ক-জন সওয়ারি নেমে নদীর পাড় ধরে হাঁটা দিলে, তাঁর কেমন সংবিৎ ফিরে এল।
‘শুনোন।’
মাথায় ধানের বোঝা। সে অতিকষ্টে তাঁর দিকে তাকাল। গাঁয়ের সাদাসিধে মানুষ। গায়ে ছেঁড়া গেঞ্জি। হাঁটুর ওপর কাপড় পরা। কোমরে গামছা বাঁধা। সে তাঁর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কিছু কবেন বাবু?’
ঘাটে শুধুমাত্র একটি হ্যাজাক জ্বলছে। ঝুপড়িমতো ঘরে কেউ একজন বসে রামপ্রসাদী গাইছে। তিনি বললেন, ‘এটা আতাপুরের ঘাট তো?’
‘আজ্ঞে বাবু, আতাপুরের ঘাট।’
‘গ্রামটা কোন দিকে?’
‘ও তো এক ক্রোশ পথ।’
পড়ে গেলেন মহাফাঁপরে। ঘাটের ঝুপড়িতে বসে মনের সুখে একজন কেউ হবে রামপ্রসাদী গেয়েই চলেছে। জ্যোৎস্নায় স্পষ্ট কিছু দেখাও যায় না। এই প্রথম তিনি টের পেলেন, বড়োই বিপাকে পড়ে গেছেন। রাগের মাথায় বের হয়ে এসে ঠিক কাজ করেননি। নদীর জলে কলকল শব্দ। বিশাল নদী, পাড় কোথায় বোঝারও উপায় নেই।
‘তুমি কোথায় যাবে ভাই?’
‘পাশের গাঁয়ে।’
‘কতদূর?’
‘সামনের জঙ্গল পার হয়ে গেলেই।’
‘আতাপুর যাব কী করে বলতে পারো?’
‘কার বাড়ি যাবেন?’
‘বাঘারুদের বাড়ি?’
লোকটি আর একটি কথা না বলে প্রায় ঊর্ধ্বশ্বাসে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল।
আচ্ছা লোক তো! বাঘারুর নাম শুনেই ভড়কে গেল, না, কোনো অশুভ ব্যাপার জড়িয়ে আছে। কী করেন! তারপরই মনে হল, সাহস সঞ্চয় করা দরকার। ঘাটে ফিরে গিয়ে ভাবলেন, রামপ্রসাদীকে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। যদি রাস্তা দুর্গম হয়, তবে না হয় ঘাটেই থেকে যাবেন।
আর আশ্চর্য! ঘাটে নেমে দেখলেন, কেউ আর গান গাইছে না। নদী বয়ে চলেছে আপন মনে। তিনি এবার ইষ্টনাম জপ করছেন। দপদপ করে হ্যাজাকের আলো নিভে গেলে, কে সেটা বাঁশের ডগা থেকে নামিয়ে নিয়ে চলে গেল! বোধ হয় জ্ঞান হারাবার মতো অবস্থা। সুখে থাকতে ভূতে কিলোয়—এখন কী করেন! আতঙ্কে শরীর অবশ হয়ে আসছে। বোধ হয় ভিরমি খেয়ে পড়ে যেতেন, তখনই বাঘারু হাজির।
‘বাবু, আপনি?’
‘আরে তুই। যাক, বাঁচালি। তোর মা যে ডুব মারল, কোনো পাত্তা নেই! আমার ঘরবাড়ি কে দেখে! তোর মার কোনো আক্কেল নেই! সে তো জানে, না থাকলে আমার কী হেনস্থা হয়!’
‘আসেন বাবু।’
বাঘারু আগে। তিনি পেছনে। বনজঙ্গলের ভেতর ঢুকে কেমন বোটকা গন্ধ।
‘বাঘারু, কীসের গন্ধ রে?’
‘আসেন বাবু। ভয় পাবেন না। সঙ্গে-সঙ্গে আসছেন। কিছু করবে না।’
‘তা জানি, তুই আছিস, কিছু করতে পারে।’ তারপরই রাধামোহনবাবু দেখলেন, বাঘারু হাঁটছে, আর তার সঙ্গে তিনিও হাঁটছেন।
‘বাবা বাঘারু, তিনি কি তোর সঙ্গে বাড়ি যাবেন? এত রাতে এঁকে আবার সঙ্গে নিলি কেন? না নিলে তোর ক্ষতি হবে?’
‘ক্ষতি কিছু হবে না। আপনি নতুন এয়েছেন, লোভ সামলাতে পারল না। তবে আমি আছি, কোনো ভয় নেই।’
‘সে জানি। তোর ওপরে ভরসা করেই দুর্গা দুর্গা বলে বের হয়ে পড়লাম। এই রে, আমার গা শুঁকছে!’
‘আপনি বড়ো ভীতু বাবু।’
‘এই রে, গা চাঁটছে। বাঘারু, বাবা বাঘারু, আর কতদূর যাবি বাপ। কখন থেকে হাঁটছি। উনি আমাদের সঙ্গে তোর বাড়ি যাবেন? না গেলে হয় না? আমার সঙ্গে তো দেখা হয়েই গেল। এখন নদী পার হয়ে তিনি জঙ্গলে চলে গেলে ভালো হয় না!’
‘যাবেন। সময় হলেই যাবেন।’
‘কখন সে সময় হবে?’
‘ওই তো বাবু, দেখছেন কুপি জ্বলছে উঠোনে—গিয়ে ডাকুন বাঘারুর মাকে। সাড়া পাবেন।’
তিনি দ্রুত হাঁটা দিলেন, কে সঙ্গে আছে কে নেই মনে থাকল না। কোনোরকমে সে আলোর কাছাকাছি গেলে রক্ষা পেয়ে যাবেন। বাঘারুর মা বের হয়ে এলে প্রাণে জল আসবে। তিনি ছুটছেন।
বাঘারু দূর থেকে চিৎকার করে বলল, ‘ছুটবেন না বাবু। ছুটলেই গপ করে গিলে ফেলবে।’
তিনি আর পারেন! থমকে দাঁড়ালেন। আর দেখলেন বাঘারু অদৃশ্য। সব অদৃশ্য। ‘বাঘারুর মা কুপি হাতে বের হয়ে দেখল, কলকাতার বাবু দাড়িয়ে আছে না। থরথর করে কাঁপছেন।
‘বাবা, আপনি? কী করে এলেন! এত রাতে! এত রাস্তা!’
‘তোমার বাঘারু দিয়ে গেল।’
আর সঙ্গেসঙ্গে বিলাপ, ‘ও গো বাবা, আমি যাই কী করে! বাঘারু আমার বাঘের পেটে গেছে। বাঘের পেটে গিয়েও শান্তি পায়নি। ঘাটে রাতে বসে থাকে। বিপদে-আপদে ঘাট থেকে মানুষকে বাড়ি পৌঁছে দেয়। ওর স্বভাব বাঘের পেটে গিয়েও বদলাল না গো বাবা। আপনি ওর দোষ নেবেন না।’
রাধামোহনবাবু আর পারেন! তিনি যথার্থই সংজ্ঞা হারালেন।