তৃতীয় খণ্ড (স্নেহের চুমকিকে)
3 of 6

আতঙ্ক

আতঙ্ক

একজন মানুষ হনহন করে আপন মনে হেঁটে চলেছেন। বগলে একটা ফোলিও ব্যাগ। দিন শেষ। কর্ম শেষ। ভদ্রলোক বাড়ি ফিরছেন। ফেরার পথে টুকটাক, ছেলেমেয়ের জন্যে, কী স্ত্রীর জন্যে কিছু কেনাকাটা করবেন। বলা যায় না পরের দিনের বাজারটাও হয়তো সেরে রাখবেন। ভদ্রলোক হয়তো এই শহরের মানুষ নন। রোজ ট্রেন ধরে আসেন, ট্রেন ধরে ফিরে যান নৈহাটি কী হালিশহরে। প্রতিদিন সময়ের আট থেকে দশ ঘণ্টা ফেলে রেখে যান এই শহরে। জীবনের সময় যদি ফুল হত, আর সে ফুল যদি না শুকত, তাহলে দেখা যেত, শেষ চাকরির দিনের সায়াহ্নে তিনি কুসুমাস্তীর্ণ পথের ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরছেন। অবাক হয়ে প্রশ্ন করছেন, ‘এ কী, এত ফুল!’ হ্যাঁ, তোমার জীবন-তরু থেকে ঝরেপড়া, তোমারই জীবনের মুহূর্ত। ফুল হয়ে ঝরে পড়েছে।

মানুষ যতদিন চাকরি করে, ততদিন তার জীবন যেন অভ্যাসের চাকা। মাপা সকাল। চা খেতে খেতেই শেষ। এরপর ছোটা। দিনের মৃত্যু হল অফিসঘরের কফিনে। মানুষটি যখন আবার পথে এসে নামল, তখন রোদ্রৌজ্জ্বল ঝকঝকে দিনটি আর নেই। আঁধারে ঢেকে আছে চারপাশ। সকালে টানে কর্মস্থল। রাতে টানে গৃহ। এই টানাটানিতেই যৌবন চলে যায়। আসে প্রৌঢ়ত্ব। এইভাবেই একদিন অবসর। তখন বিরল কেশ। হৃত বল। ক্ষীণ দৃষ্টি। দুর্বল মেধা। অভ্যাসের চাকা থেকে জীবন খুলে যাবার পর মনে হতে থাকে, আর তো কিছুই করার নেই। আবার এও মনে হয় কী-ই বা করলুম। চাকরি। বিয়ে। সন্তান-সন্ততি। অর্থচিন্তা। রোগের সেবা। সংসারের খিদমত খাটা। একজন রাজমিস্ত্রি বৃদ্ধ বয়সে গর্ব করে বলতে পারেন, আমি ইটের পর ইট গেঁথে গেঁথে হাজারখানেক ইমারত বানিয়েছি। সেখানে এখন মানুষের আলোকোজ্জ্বল সংসার। সুখদু:খের খেলা। আমি মানুষকে ছাদ দিয়েছি। একজন কৃষক বলতে পারেন—আমি একের পর এক ধান ফলিয়ে মানুষের ক্ষুন্নিবৃত্তি করেছি। একজন কেরানির জীবনে বলার মতো, গর্ব করার মতো কিছুই নেই। এক অফিস ফাইল ফলিয়েছি। কিছু কাগজ, কিছু নোট। যার কোনও মাথামুণ্ডু নেই। আইন মোতাবেক চাকরি বাঁচানো। সময় সময় বাগড়া দিয়ে অন্যের পথ আটকানো। একটু পরচর্চা। একটু কাছা টেনে ধরা। একটু তৈলমর্দন। একটু কান ভারী করা। কখনও ধাক্কা মারা, কখনও বেমক্কা ধাক্কা খাওয়া।

সারা জীবনের রাজবেশ হল, অফিসে একটি ট্রাউজার আর হাওয়াই শার্ট আর ঘরে লুঙ্গি ও ভেন্টিলেটার বসানো গেঞ্জি। রাজভোগ হল, কাঁকরমণি চালের ভাত, পুঁই পোস্তর ঘ্যাঁট। কখনও চারা পোনার ঝাল। মাঝেমধ্যে মাংস। স্কুল, কলেজের কোনও শিক্ষারই ব্যবহার হল না, কাজে লাগল শুধু সাধারণ বুককিপিং। সারাজীবন পুরনো ডায়েরির পাতায় শুধু এই করা, জমা মাহিনাবাবদ দু-হাজার। খরচ, কাজের মহিলা পঞ্চাশ, সংগীত শিক্ষক পঞ্চাশ, তবলা সহযোগী তিরিশ, গৃহশিক্ষক দেড়শো। অঙ্কের পর অঙ্ক। শেষে যোগ। চক্ষু চড়কগাছ। সার্ভিস চার্জেই সাত-আটশো বেরিয়ে গেল। হাতে রইল সাকুল্যে বারোশো। এইবার পায়ের মাপে জুতো নয়, জুতোর মাপে পা। বারোশোয়, হবে পথখরচ, বাজার, র‌্যাশান, মুদিখানা, সাবান, লোকলৌকিকতা, অতিথি-আপ্যায়ন। পৃথিবীর যে কোনও অর্থমন্ত্রী এই বাজেট টানতে হবে শুনলে, ল্যাজ তুলে দৌড় মারবেন। আমার মতো মধ্যবিত্ত কেরানির একমাত্র ভরসা ঈশ্বর। মাঝে-মাঝে ভাবি, কী করতে ডিফারেনশিয়াল ক্যালকুলাস, ইন্টেগর‌্যাল ক্যালকুলাস, কনিক সেকসান, স্ট্যাটিসটিকস, ডাইনামিকস পড়েছিলুম। কি করতে পড়েছিলুম ফিজিকস, কেমিস্ট্রি। জীবন তো চলেছে একটি বিদ্যার ওপর ভর করে, যোগ আর বিয়োগ। দু-হাজার থেকে আটশো গেল, হাতে বারোশো। রোজ কুড়ি টাকা হিসাবে বাজার, মাসে ছশো। বারোশো থেকে ছশো গেলে হাতে ছশো। আয়ের ঘর যোগের খেলা নেই। যোগের খেলা বিয়োগের ঘরে অর্থাৎ ব্যয়। ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে মানুষের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়। সেই রকম মাঝমাসে সব টাকা বেরিয়ে গিয়ে একই অবস্থা। হাত কাঁপছে, পা কাঁপছে, গলা টানছে, কান ভোঁভোঁ, চোখ দুটো যেন কাটা ছাগমুণ্ডের হলদেটে স্থির বিভীষিকা। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যদি প্রশ্ন করা হয়, কী দেখে চোখ অমন ছানাবড়া হল ভাই! হিসেবের খাতা। ননস্টপ টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে, বেরিয়েই যাচ্ছে। সংসারে অর্ধেক মাস কাটে বিকারের রুগির মতো। এরই মধ্যে কারুর একটার বেশি তিনটে হাঁচি হলেই আতঙ্ক। এই রে ! বিছানা নিলে বুঝি। নিজেই বসে গেলুম ফুটবাথ করতে। সে প্রায় হাতে পায়ে ধরার অবস্থা, দয়া করে পড়িস না ভাই! বিছানা নিলেই ডাক্তারবদ্যি। তার মানে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। এক একজন ক্ষীণজীবী মানুষ থাকেন যাঁদের অল্পেই ঠান্ডা লাগে। জ্বর, সর্দিকাশি হয়। এমন মানুষকে সকলেই সাবধান করেন—ওহে বেশি বাড়াবাড়ি কোরো না। কেরানির সংসারেও সেই একই অবস্থা। বড়ই ক্ষীণজীবী। খুব সাবধানে রাখতে হয়। লক্ষ্মীর ভাঁড় আর পুরোনো খবরের কাগজ বিপদের রক্ষাকর্তা।

কী নিয়ে বেঁচেছিলে? আতঙ্ক। এই বুঝি গেল! অবসর জীবনেও আতঙ্ক। তখন আতঙ্কের সিংহাসনে আসীন। পেনশনে পাঁচদিন চলবে। বাকি পচিঁশটা দিন? চাকরি, পাশপোর্ট, আরও নানারকম অবেদনপত্রে, ফাদারস নেম, পিতার নাম লিখতেই হয়, সেইটাই নিয়ম। ফাদারের দিন শেষে সানের দেখা কজন পায়! জীবন-সূর্য ঘুপচি ঘরে মলিন শয্যায় অস্ত যায়। নেড়া মাথার বিজ্ঞাপন দেখে পুত্রটিকে বোঝা যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *