আড্ডা

আড্ডা

কী বললেন স্যার? বাড়ি বিক্রি করতে এসেছেন? আমি কিনব? আমি! বাড়ি নিয়ে করবটা কী আমি? জন্ম নিলুম হাসপাতালে, পড়াশুনো করলুম হস্টেলে, প্রেম করেছি ট্যাক্সিতে, বিয়ে হল রেজিস্টারের আপিসে। খাই ক্যানটিনে–কিংবা যারে কয় ভোজনং যত্রতত্র–সকালটা কাটে কর্তাদের তেলাতে, তেনাদের তরে বাজার করে দিতে…হাটে-র্যাশনে, দুপুরটা আপিসে, মাঝে মিশেলে সিনেমা হলে সন্ধেটা। পটল তুললে শুইয়ে দেবে নিমতলায়। বাড়ি নিয়ে কি আমি গুলে খাব? তার চেয়ে বলি, আসলে আমার দরকার একটি আড্ডার। একটি অত্যুকৃষ্ণ আড্ডার। তার খবর দিতে পারেন? তবে বুঝব, আপনি একটি তালেবর ব্যক্তি!

কথাটা ন সিকে খাঁটি। অত্যুকৃষ্ণ কৃষ্ণ যদি কিষ্ট বা কেষ্ট হয় তবে উৎকৃষ্ণ-ই-বা হবে না কেন?) আড়া প্রতিষ্ঠানটি হালফিল পুরো-হাতা ব্লাউজের মতো ডাইইং ইনডাস্টরি–মৃতপ্রায়।

এহেন অবস্থায় অকস্মাৎ বিনা মেঘে পুষ্পঘাত! দিল্লি থেকে খবর এসেছে সদ্যভূমিষ্ঠ শিক্ষামন্ত্রী প্রতিজ্ঞা করেছেন, বাঙালিকে তিনি আড্ডাবাজ করে ছাড়বেন!

দিল্লি থেকে আসা খবরের সঙ্গে আমি প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ি না– বয়স হয়েছে। খবরটা ফলাও করে প্রকাশিত হবে, সঙ্গে সঙ্গে দেমাতি (dement) বেরুবে, ফের তস্য দেমাতি বেরুবে দলিলপত্রসহ, চোপরা-ভাটিয়া আফটার এডিট লিখবেন, পারলিমেনটে গোটা তিনেক মন্ত্রী নাকুনি-চুবুনি খাবেন, ওই নিয়ে খানদানি খানদানি আয় (আমাদের যৌবনে) তর্কাতর্কির ফলে গোটা তিনেক পেয়ারে মুখ দেখাদেখি বন্ধ হবে– তবে আমি ব্যাপারটার মোটামুটি আবছা-আবছা ধুয়াশাপারা একটা উমান্ (অনুমান নয়, তার আউটলাইন বড় ধারালো) করে নিই যে, ব্যাপারটা কী হয়ে থাকতে পারে। গোলনদাজদের কায়দা-করিনা নাকি এই দস্তুরেই হয়। প্রথম বোমা তাগ করবে লক্ষ্যবস্তু থেকে দূরে, পরেরটা কাছে, তার পর দুটোতে যোগ দিয়ে হাফাহাফি করে মোক্ষম মধ্যিখানে।

কিন্তু এ সংবাদখণ্ডটি নিয়ে কিঞ্চিনমাত্র দেমতি ডুয়েল হয়নি। দিল্লির লালাজি, মিয়াসাহেবরা খবরটা পরিবেশন করা সত্ত্বেও ব্যাপারটির গুরুত্ব এহমিয়ৎ সম্বন্ধে বিলকুল বে-খবর। আড্ডা? সো ক্যা বলা? মজলিস, মহফিল, মুশারা, জলসা, বয়েৎ-বাজি– আলবৎ লেকিন আ? সো ক্যা আফৎ, গজব? ওদের আড্ডা ভিন্ন বাথানের গরু– ওদের ভাষায় ভিন্ন ঝোঁপের চিড়িয়া– যেমন ওদের গোলাব জামুন আর আমাদের গোলাপ জাম।

তা সে যাই হোক যাই থাক, খবরটা যদি গুজব বা আফওয়া না হয় (হলে আগের থেকেই কলমে খৎ দিচ্ছি!) তবে বড় দুঃখের সঙ্গে শ্রীযুক্ত ত্রিগুণা স্যানকে তাঁরই দ্যাশ করিমগঞ্জের একটি পদাবলি ঘেঁষা লোকসঙ্গীত স্মরণ করিয়ে দেব :

দেখা হইল না রে, শ্যাম
আমার এই নতুন বয়সের কালে—

রসরাজের স্মরণে শ্রীমতী বলছেন, ঠাকুর! তুমি নির্দয় নও; আমাদের সাক্ষাৎ একদিন না একদিন হবেই হবে। কিন্তু তোমার সঙ্গে আমার এই নতুন (নতুন) বয়সে যে দেখা হল না, সে-ই আমার মর্মবেদনা।

ডাক্তারেতে বলে যখন মরেছে এই লোক
তাহার তরে বৃথাই করা শোক
কিন্তু যখন বলে জীবত
তখন শোনায় তিতো।

খানদানি আড্ডা এখন জীবন্ত। তার নতুন বয়স বহু কাল হল গেছে। এখন আর তার কোন্ গুণ আছে, তিন-গুণী?

আড্ডা সম্বন্ধে আমার যা বক্তব্য সে আমি বহুবার বহু স্থলে নিবেদন করেছি। বহু সিন্ধু পেরিয়ে বহু দেশ ঘুরেছি আড্ডার সন্ধানে পাপমুখে কী করে বলি, গিয়েছিলুম লবুজো কপচাতে; আখেরে সর্বত্র সর্ব পরীক্ষাতে নাগাড়ে ফেল মেরে মেরে বিলক্ষণ বুঝে গেলুম, আমার যদি জ্ঞানগম্যি কখনও হয়–তা সে ঝুটাই হোক আর সাচ্চাই হোক সেটা হবে আড্ডাতে শিক্ষামন্ত্রী যে তত্ত্বটি কনফারম করলেন এই অ্যাদ্দিন পরে … ফের বহু সিন্ধু পেরিয়ে দেশে এসে দেখি, সেই আড্ডার বিন্দুটি খরতাপে বাম্পপ্রায়।

খানদানি আড্ডা যে জীবন্ত সে তথ্য তর্কাতীত। এই যে কলকাতা শহরে ঝাঁকে ঝাঁকে পস্তলা-দস্তলা হামেহাল উঠছে তো উঠছেই এর কটাতে রক থাকে, বৈঠকখানা আছে? রক উঠেছেন ডাক-এ, আর বৈঠকখানার বদলে ড্রয়িংরুম। এদিকে ক্ষুদে একটি পেগটেবিলের উপর অতি পাতলা ডিমের খোলস-পরা পরসেলেনের প্লেটে স্ন্যাক, অন্যদিকে ফঙ্গবেনে টিপয়ের উপর বেলজিয়াম কাঁচের ঢাউস ফ্লাওয়ার ভাজ। সোফাতে আরামসে হেলানও দিতে পারবেন না, পাছে মাথার তেল লেগে সোফাভরণ চিটচিটে হয়ে যায়। বত্রিশটি দাঁতের মধ্যিখানে বেচারি জিভকে যেরকম অতিশয় সন্তর্পণে হাফিজ, খবরদার হয়ে নড়াচড়া করতে হয়, আপনাকেও করতে হবে তাই। তবে সান্ত্বনা, ভুগন্তি বাড়ির মালিকেরই সবচেয়ে বেশি। পাছে মহামূল্যবান কোনও জোড়াবাধা বস্তুর একটি ভেঙে যায়! বিলিতি মাল– এখন আর বাজারে পাওয়া যায় না।

গালগল্প যে একেবারেই হয় না, সেকথা বলা যায় না। তাকে সোয়ারে, মাতিনে (ম্যাটিনি) কনভেরজাৎসিয়োনে(১) যা খুশি নাম দিতে পারেন, এমনকি আজকের দিনের ভাষায় সেমিনার বললেও দোষ নেই কিন্তু একে আড্ডা নাম দিলে আমাদের নকিষ্যি কুলীন আড্ডার মেম্বরগণ একবাক্যে বলবেন, কঁহা আসমানকা তারা, আর কঁহা পিঠকা (আসলে ভদ্রসমাজে মূল শব্দটা অচল) পাঁচড়া!

গঙ্গাস্নান কমে যাচ্ছে কেন? পুণ্যবানরা নতুন নতুন ঘাট বানাচ্ছেন না তাই।

আড্ডা কমে গেল কেন? মডার্নরা রক বানান না বলে। পাল্লায় পড়ে কেউ কেউ-বা প্রাচীন দিনের অগোছালো বৈঠকখানাকে ড্রয়িংরুমের সাত চাপের কারবন কপি বানাচ্ছেন—- দিল্লিতে বলে বুড়ো ঘোড়ার গোলাপি ন্যাজ কিংবা বুড়ি দাদিমার হাতে বাহারে মেহদি।

কিন্তু এহ নিরতিশয় বাহ্য।

গুহ্য সমস্যা অপিচ সরলতম প্রশ্ন : এই যে আমাদের মন্ত্রীবর তরুণদের আড্ডাবাজ করে তুলবেন বলে যমুনা পুলিনে দাশরথির শপথ গ্রহণ করলেন সেটা কি অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করে কিংবা প্রকৃত আড্ডাবাজের ন্যায় ধ্যত্তর ত্তোর অগ্রপশ্চাৎ হুঙ্কার ছেড়ে?

ঝাড়া আঠারোটি দিন আমাদের আড্ডাটি এই নিয়ে কুস্তি করেছে। নানা প্রশ্ন, বহুবিধ সপলিমেনটরি, ততোধিক এফিডেভিট– সর্বশেষে এন্তের বুলু পিরিন্ট (আমাদের মন্ত্রীমশাই এ বস্তুটি বিলক্ষণ চেনেন ভাই ভাই তৈরি হল, অবশ্য আড্ডাধারী মাত্রই জানেন, আমাদের হাইজাম্প লঙ-জাম্প মুখে মুখে।

প্রতি প্রস্তাবের বিরুদ্ধেই পাল্টা প্রস্তাব উঠেছিল; তবে একটি বিষয়ে সকলেই একমত হয়েছেন।

যদ্যপি মন্ত্রী মহাশয় এলেমদার ব্যক্তি তথাপি এ-হেন কঠিন গুরুভার তিনি যেন ভিক্ষুণীর অধম সুপ্রিয়ার মতো এজমালি বা বারো-ইয়ারি পদ্ধতিতে উত্তোলন করেন। বিগলিতার্থ; — তিনি যেন।

১। একটি কমিশন নিয়োগ করেন।

এস্থলে আমার অতিশয় গোপনীয় একটি অভিজ্ঞতা থেকে জানাই, হাইকোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত জজকে আমি ব্যক্তিগতভাবে অন্তরঙ্গরূপে চিনি, যিনি একবার একটি আড্ডাবাজ ছোকরাকে অধ্যাপক পদের জন্য সুপারিশ করে জনৈক ভাইস-চ্যানসেলারের কাছে হুট হয়েছিলেন। ভি সি যখন জিভ কেটে বললেন, ছোকরা পাড় আড্ডাবাজ তখন তিনি জরডন জলে ধোয়া তুলসিপাতা-পানা মুখ করে নাইফ উত্তর দিয়েছিলেন ওই তো তার আসল এলেম।

একে কমিশনের চ্যারম্যান করতে পারলে সর্বরক্ষা– সকলং হস্ততলং!

২। ইতোমধ্যে দেখা গেল আরেকটি বিষয়ে আমাদের দশদিশি শিরদ্বন্দ্বী প্রকৃত আদ্যপ্রাণ ব্যক্তিকে কাটা ফালাইলেও সে কোনও কমিশনের সামনে সাক্ষ্য দিতে যেতে পারবে না। হরহামেশা হাজামৎ করছি আমরা উইলসন জনসনের, আর আমরা যাব কমিশনের সম্মুখে!

আড্ডাযজ্ঞের আমরা অভিশপ্ত (পুত, যাই বলুন) ভস্ম। আমরা যেতে পারব না, নীলকণ্ঠের চড়াই-উতরাই পেরিয়ে জটার ভিতর গঙ্গার সন্ধানে।

তিনিই আসতেন। আমি যার প্রতি দু লহমা পূর্বে ইঙ্গিত করেছি তিনিই আসবেন, স্বেচ্ছায় সানন্দে। শ্যামবাজার থেকে শুরু করে আড্ডা মেরে মেরে তিনি হেসেখেলে পৌঁছে যাবেন টালিগঞ্জে। রিপোর্ট যা লিখবেন সে এক অভিনব মেঘদূত! শ্যামবাজার-রামগিরি থেকে টালি-অলকা!

কিন্তু আমরা কমিশনকে বিভ্রান্ত বা প্রেজুডিস করতে চাই নে বলে অত্যধিক বাগবিস্তার থেকে নিরস্ত হচ্ছি। তবে একটি বিষয়ে তাবৎ গৌড়ভুমি যখন বিলক্ষণ সচেতন, সেটি যেন কমিশন বিস্মৃত না হন।

আড়া জীবন্মৃত কি না, যদি হয় তবে তার অমরুতাঞ্জন সঞ্জীবনী সুধা কী, সে নিয়ে তো কমিশন চিন্তা করবেনই যথেষ্ট সুযোগ পাবেন, আজকাল প্রায়ই বিজলি ভ্রষ্টা রমণীর মতো সাঁঝের বেঁকে চোখ মারতে মারতে আঁধারে গায়েব হয়ে যায়, তখন আত্ম-অন্বেষণী, বিশ্বভাবনা ভিন্ন গতি কী?–কিন্তু আমরা আগেভাগেই বলে রাখছি;–

বঙ্গসন্তান চাহে না অর্থ, চাহে না মান, চাহে না জ্ঞান– সে চায় ডিগ্রি!

আড্ডাবাজরূপে সে যদি স্বীকৃতি পায় এবং উমেদার মাত্রেই জানেন–খানদানি আড্ডাতে সিট পাওয়াটাই কী কঠিন কর্ম– তবে সে ডিগ্রি না নিয়ে ছাড়বে না।

এবং ওইসব বস্তাপচা পি-এইচডি, ডিফিল, হনোরিস কাউজা, সুমমা কুম লাউডে, দকত্যোর অ্যাস লেত্র, ফার্জিল-অল-মুহদিসিন, শমশির-ই-জমশিদই আলিমান, সাংখ্যবেদান্ততর্কচুক্ষু– এসব উপাধি-খেতাব-ডিগ্রি বিলকুল না-পাস।

তা হলে সে ডিগ্রির নাম কী হবে?

এ বাবদে ইহসংসারে সর্বাভিজ্ঞ মহাজনকে আমরা চিঠি লিখেছি।

 ইনি স্ট্রাসবুরগ শহরের সরকারি উপাধিদাতা।

 শহরের সদর দেউড়ি দিয়ে ঢুকলেন এক অশ্বারোহী–ইয়া মোছ, ইয়া তলোয়ার।

সামনেই সদররাস্তা-বুলভার জোড়া একটা টেবিলের পিছনে দাঁড়িয়ে ফ্রক কোট, টপ-হ্যাট, আতশি-কাঁচের চশমা পরা এক স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে- সরকারি কর্মচারী। আমাদের আই এ এস গোছ।

হুঙ্কারিলেন, তিষ্ঠ!

? ? ?

আপনি ডক্টরেট উপাধি ধরেন?

অশ্বারোহী অবতরণ পূর্বক সবিনয় : আজ্ঞে না।

গম্ভীর নিনাদ : এ শহরে ডক্টরেট না থাকলে প্রবেশ নিষেধ।

 কাতর রোদন : তা হলে উপায়?

মোলায়েম সান্ত্বনা : উপায় আছে বইকি। এই তো হেথায় টেবিলের উপর রয়েছে সর্ব গোত্রের উপাধিপত্র। আপনার দেশ?

আশাভরা কণ্ঠ :এজ্ঞে, লুকসেমবুরগ।

নুড়ি-চাপা ভিন্ন ভিন্ন ডাই থেকে একখানা করকরে কাগজ তুলে নিয়ে : আ–সুন, আসুন, স্যর (বিতে শ্যোন, প্লিজ!)। দক্ষিণা : পঞ্চাশত্রুদ্রা।

বিগলিত আপ্যায়িত কণ্ঠ : বিলক্ষণ, বিলক্ষণ (ডাংকে শ্যোন, মেনি থ্যাংকস)। এই যে।

অশ্বারোহী নগরকেন্দ্রে প্রবেশ করতে করতে ভাবল, আমার এই অশ্বিনীটি আমার বিস্তর সেবা করেছে। এর জন্য একটা হনোরিস কাউজা ডক্টরেট আনলে মন্দ হয় না। ঘোড়া ঘুরিয়ে উপাধিদাতার কাছে এসে তার সদিচ্ছা জানাল। আই এ এস দুঃখ-ভরা কণ্ঠে বললেন, ভেরি ভেরি সরি, হের ডকটর! এ শহরে ডকটরেট দেওয়া হয় শুধু গাধাদের। ঘোড়ার জন্য কোনও ব্যবস্থা নেই।

আমরা এরই উপদেশ চেয়ে পাঠিয়েছি। আমেন।

———

১. প্রথম দুটো শব্দ ফরাসি, তৃতীয়টি ইতালীয়। অর্থাৎ রসালাপ করার তত্ত্বটি বরঞ্চ লাতিন জাত কিছুটা জানে। শুনেছি, অ্যাংলো সেশনদের এমন ক্লাবও নাকি আছে যেখানে কোনও মেম্বার কথাটি বলামাত্র তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। একদা একজন মেম্বার নাকি আগুন লাগা মাত্রই আগুন আগুন বলে চেঁচিয়ে ওঠাতে ক্লাববাড়ি রক্ষা পায়। তাকে অনেক ধন্যবাদ জানাবার পর (অবশ্য লিখিতভাবে) খাতা থেকে তার নামটি কিন্তু কেটে দেওয়া হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *