আড্ডা–পাসপরট
এত দেরিতে যে?
শোনো কথা! আড্ডাতেও আসতে হবে পাঙট্যুয়ালি?
হ্যাঁ, সেই কথাই তো হচ্ছে। তুমি তো হামেশাই পাঙট্যুয়ালি অন-পাঙটুয়াল।
আড্ডা প্রতিষ্ঠানের কাশীবৃন্দাবন কাইরো শহরে। এ সম্বন্ধে আমার গভীর গবেষণামূলক একাধিক গেরেমভারি প্রবন্ধ খানদানি অকসব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাত্মক বনেদি ত্রৈমাসিকে বেরুবার কথা ছিল, কিন্তু হঠাৎ কর্তাদের খেয়াল গেল যে আমার ওই সাতিশয় উচ্চপর্যায়ের লেখাগুলো যদি একবার তাঁদের কাগজে বেরোয় তবে সে-কাগজের মান বা স্ট্যান্ডারড চড়াকসে এমনই সুপুরিগাছের ডগায় উঠে যাবে যে, আর পাঁচজন লেখক সে মগডালে উঠতে পারবে না। অথচ পয়লা নম্বরি পাঠকমাত্রই আমার উচ্চাঙ্গ লেখায় পেয়ে গেছেন তাজা রক্তের সন্ধান, হয়ে গেছেন ম্যানইটার। সম্পাদকমণ্ডলী তখন আর পাঁচজনের লেখা বাসি মড়া পাচার করবেন কী প্রকারে! একবার ভাবুন তো, স্বয়ং কবিগুরু যদি কোনও সপ্তাহের দেশ পত্রিকায় ট্রামেবাসে, সুনন্দর জারনল এবং পঞ্চতন্ত্র সব কটাই লেখেন, তার পর আমাদের তিনজনের–এককথায় সৈয়দ সুনন্দ করের কী হাল হবে? পচা ডিম ছুড়বে আমাদের মাথায় পাঠকগুষ্টি কাগজ হয়ে যাবে বন্ধ। সম্পাদক, প্রকাশক, মুদ্রাকর, লেখক। সবাইকে বসতে হবে রাস্তায়। আমাদেরও তো কাচ্চাবাচ্চা আছে। ডাল-ভাত যোগাতে হয়।
আমার অত্যুৎকৃষ্ট রচনার মূল্য অকসব্রিজের কর্তৃপক্ষ বুঝুন আর না-ই বুঝুন–এটা কিন্তু ভুললে চলবে না তারা ইংরেজ। ইংরেজ ব্যবসা বোঝে। নেপোলিয়ন একদা বলেছিলেন নেশন অব শপ-কিপারজ–এখন বলা হয় নেশন অব শপ-লিফটারজ(১) (ভদ্রবেশী দোকান-লুটেরা)। ব্যবসা বোঝে বলেই তারা আমার লা-জবাব প্রবন্ধগুলো ইনশিওর করে সবিনয়, সকাতর ফেরত পাঠায়–ছাপালে তারা, তাদের আণ্ডাবাচ্চারা বেবাক-আণ্ডাহীন হবে সেই কারণ দর্শিয়ে।
তখন করি কী?
কথিত আছে, একদা লন্ডনে মারকিন হেনরি ফোরড দাবড়ে বেড়াচ্ছিলেন খাসা রহিসি রোলস রইস। পঞ্চম জরজ তাঁকে শুধোলেন, সে কী মিসটার ফোরড! আপনি বিজ্ঞাপনে বলেন ফোরড গাড়ি দুনিয়ার চিপেস্ট এবং বেস্ট গাড়ি, তবে রোলস চড়েন কেন? ফোরড বাও করে বললেন, আমার ম্যানেজারকে বহুবার বলেছি, আমাকে একখানা ফোরড গাড়ি দিতে। তার মুখে ওই এক কথা–ফোরড গাড়ি তৈরি হতে-না-হতেই সঙ্গে সঙ্গে বিক্রি হয়ে যায়; সে খদ্দের সামলাবে না মালিককে গাড়ি দেবে। খদ্দের মোর ইমপরটেনট দ্যান মালিক। অতএব, হুজুর বাধ্য হয়ে বাজারের সেকেন্ড বেস্ট মোটর–রোলস–কিনেছি।
গল্পটি মিশরের পিরামিডের চেয়েও প্রাচীন–যে পিরামিডের দিকে পিছন ফিরে আমরা কাইরোর কাফেতে বসি। কিন্তু ক্লাসিক্যাল কাহিনীর ভালে ওই তো চন্দন-তিলক! নিত্য নিত্য নব নব ফাড়া গরদিশে সাক্ষাৎ মুশকিলআসান।
আমি জানতুম, অকসব্রিজ ত্রৈমাসিকের পরেই সেকেন্ড বেস্ট কাগজ দেশ। সেখানে পাঠালুম। ছাপা হয়ে গেল (সম্পাদক-ম্যানেজার হয়তো সোল্লাসে ভেবেছিলেন, ওটা পয়সা কামানেওলা বিজ্ঞাপন), বই হয়েও বেরুল। পাঠক সাবধান! চীনেবাদামের ঠোঙা কদাচ অবহেলা করবেন না। একমাত্র ওই কাগজেই একখানা তাবল্লোক মল্লিখিত কাইরোর কাফে আড্ডা সম্বন্ধে নিবন্ধগুলো পড়তে পায়।
অতএব কাইরোর কাফে-আড্ডার সবিস্তর বর্ণনা নতুন করে দেব না। শুধু এইটুকু বলব কাইরোর কাফের তুলনায় আমাদের আড্ডা, ইংরেজের ক্লাব, জরমানের পাব, কাবুলির চা-খানা, ফরাসির বিরো–এস্তেক অবিমুক্ত ক্ষেত্র কাশীর জমজমাট ঘাট–সব শিশু শিশু। বৈজ্ঞানিক বলেন, আমাদের জীবনের এক-তৃতীয়াংশ কাটে শয্যায়–ন্দ্রিায়। কাইরোর কাফে হাসবে–কুট্টির ঘোড়ার মতো–আস্তে বলুন। তাদের জীবনযাত্রা একপ্রকার :
সকাল ৬টা থেকে ১০টা কাফে = ৪ ঘণ্টা। ১০টা থেকে ১টা দফতর। ১টা থেকে ২টা কাফে =১ ঘণ্টা। ২টা থেকে ৫টা দফতর, ৫টা থেকে ১২টা রাত কাফে = ৭ ঘণ্টা। ১২টা থেকে ৬টা ভোর নিদ্রাযোগে গৃহবাস অতিশয় অনিচ্ছায়।
একুনে, সর্বসাকুল্যে কাফেতে ১২ ঘণ্টা। জীবনের এক-তৃতীয়াংশ না ঘন্টা! হোলি রাশার সেই ফাটা ঘণ্টা যেটা কখনও বাজেনি।
কাইরো সজ্জনের জীবনের হাফ কাটে কাফেতে–অবশ্য বেটার হাফ-কে বাড়িতে রেখে! আর ছুটিছাটা, স্ট্রাইক রাজা ফারুকের মেহেরবানিতে হরবকৎ লেগেই আছে(২)–লটারি উত্তোলন দিবসচয় যদি হিসাবে নেন তবে সেই প্রথম প্রবন্ধের প্রথম তত্ত্বে ফিরে যাই : বাড়ি নিয়ে কি গুলে খাব, পারেন তো দিন একটি ননস্টপ-আড্ডার সন্ধান। তা হলে অবশ্যই প্রশ্ন উঠতে পারে, কাইরোতে লোকে বাড়ি বানায় কেন? মিশরবাসী তখন বিদেশিকে বুঝিয়ে বলে, প্রাচীন যুগে তারা আদৌ বানাত না, বানাত গোরের জন্য স্রেফ পিরামিড–চোখ মেললেই এখনও চতুর্দিকে দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু কই সে যুগের বাড়ি বাড়ি বানানোর বদ-অভ্যাস বাজে-খরচা তারা শিখেছে হালে, ইংরেজের কাছ থেকে, তার হোম নাকি তার কাসল (অ্যান্ড হি ইজ দ্য টাইরেন্ট ইনসাইড) আর বাড়ি বানানোটাই যদি এমন কিছু জব্বর মহষ্কর্ম, বাবুইকেই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী বলা উচিত, ওর মতো নিটোল, নিখুঁত বাড়ি বানিয়েছে আর কেউ? ছাত ধসে না, ট্যাকশো দিতে হয় না।–ইত্যাদি। (৩)
তা সে থাকগে, কোন্ কথা থেকে কোন্ কথায় চলে এলুম, ওই তো আড্ডার দোষ।
কাইরোর কাফে আমাকে বোঝাচ্ছিল, আমি পাঙটুয়াল, অর্থাৎ কথা দিয়ে থাকি ঘণ্টায় আসব বলে, আর আসি কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে ঘণ্টায় অর্থাৎ পাঙট্যুয়ালি… ইত্যাদি।
এর পর কাফে বলে কি না, আমি নাকি অন্-পাঙট্যুয়ালও বটে!
সেটা কী প্রকারের?
টুটেনখামেন-এর আমল থেকে এদেশের অলিখিত আইন, মিটিং যদি ধার্য হয়ে থাকে সাতটায়, তবে শুরু হয় আটটায়, দিল-হামেশাই হচ্ছে। আমি নাকি উপস্থিত হই কাঁটায় কাঁটায় সাতটায়। এটা নাকি অন-পাঙট্রয়াল পাঙট্যুয়ালিটি।
সেটা নাকি স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার একচেটে কারবার। নীলনদে কখনও প্রচুর জল আসার ফলে কাফের সকলে গায়ে রেশমের স্যুট চড়ায়, কখনও মাত্র কঞ্জিনটুকু সম্বল; কখনও সাহারায় ঝড়ের ঠেলায় ছ ফুট বালি জমে বাড়ির দেউড়ি বন্ধ হয়ে যাবে এবং তারই ফলে সর্বাপেক্ষা মারাত্মক পরিস্থিতি–কাফেতে আসার জো-টি নেই–এসবের হদিসান্বেষীরা নাকি পরবর্তীকালে আবহাওয়া দফতরের ডিরেকটার জেনরেল হয়।
ইতিমধ্যে আমাদের টার্ক–(তুর্কি বললে মানুষটাকে ভুদ্র বলে মনে হয়)–ইংরেজি অর্থে। টার্ক, সদস্য তওফিক এসে উপস্থিত।
পয়লা নম্বরের ধুরন্ধর এবং গোঁয়ার। আমাকে শুধোলে, কী বাবাজী, খানিকক্ষণ আগে তোমাকে দেখলুম এক আজব চিড়িয়ার সঙ্গে–ওহেন মাল কস্মিনকালে বাবা, এই বহুতর চিড়িয়ার শহর কাইরোতেও দেখিনি! ব্যাপারটা কী?
আমি বললুম, আর কও কেন? সেই কথাই তো এদের বোঝাতে যাচ্ছিলুম। সমস্ত বৈকেলটা কেটেছে ব্রিটিশ কনসুলেটে-বুনোহাঁস ধরার চেষ্টা কখনও করেছ? তাইতেই হেথায় হাজিরাতে দেরি?
বুনো হাঁস! সে আবার কী?
নয় তো কী? কিন্তু আমার সঙ্গে যে চিড়িয়া দেখেছিলে সে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিজ। আমার দেশের লোক।
কাফে অবাক। সে কী? আমরা তো জানতুম, তুমি কোথাকার সেই বাঙ্গালা না, কী যেন বলে, সেই দেশের একমাত্র লক্ষ্মীছাড়া এসেছ এদেশে।
সে কথা পরে হবে। উপস্থিত থোই, বিদেশে-বিভুঁইয়ে কেউ কখনও পাসপরট হারিয়েছে সকলেই একসঙ্গে শিউরে উঠলেন, কারও কপালে ঘাম দেখা দিল, কেউ-বা দেখি বন্ধ করে আল্লারসুলের নাম স্মরণ করছেন।
পাঠককে বুঝিয়ে বলি, এ সংসারে নানান ভয়াবহ অবস্থা আমরা দেখি, কাগজে পড়ি, শ্রবণ বা স্বল্পলব্ধ জ্ঞান না-হয় বাদই দিলুম। কিন্তু এ সবকটাকে হার মানায় মাত্র একটি নিদারুণ দুর্দৈব–বিদেশে পাসপটটি হারানো।
ছুটুন কনস্যুলেটে। তারা কানই দেবে না। লিখুন আপন দেশে। নো রিপলাই। কিংবা শুধোবে, পাপরূটের নম্বর ইস্যুর তারিখ গয়রহ জানাও। সেগুলো আপনি ডাইরিতে টুকে রাখেননি। আবার কনস্যুলেটে ধন্না। সঙ্গে নিয়ে গেছেন দু-পাঁচজন ভারতীয়। তাঁরা হলপ খেলেন, আপনি যে ভারতীয় সে বাবদে তাদের মনে কোনও সন্দেহ নেই। কনস্যুলেট বলবে, মাডাগাসকারের বিস্তর লোক ভারতীয় ভাষায় কথা কয়; তাই বলে তারা ভারতীয় ইনডিয়ান নেশনালিটির প্রমাণ কোথায় যে আমরা নয়া পাসপ দেব? বের করুন বার্থ সারটিফিকেট, এবং প্রমাণ করুন সেটা আপনারই।
হাজারোগণ্ডার হাবিজাবি হেনাতেনা চাইবে। এবং তাদের চাওয়াটা সম্পূর্ণ ন্যায্যতঃ হকৃতঃ। না চাইলে দুনিয়ার যত ভাগাবন্ড ব্লাডিভসটক থেকে আলসকা–এসে কিউ লাগাবে একখানা করকরে, ঝা চকচকে, সোঁদা সোঁদা গন্ধওলা ইনডিয়ান পাসপরুটের লোভে। এক ঝটকায় হয়ে যাবে ইনডিয়ান ন্যাশনাল, সঙ্গে সঙ্গে লন্ডনে গিয়ে মহারানির মোলাকাৎ চাইবে। যে বেচারাকে টারক তওফিক দেখেছিল পথিমধ্যে, সে সত্যি সিলেটের লোক।
আমি গিয়েছিলুম কনস্যুলেটে, প্যালেসটাইন যাবার জন্য অনুমতির (ভিজার) সন্ধানে। সেই জরাজীর্ণ লোকটাকে জবুথবু হয়ে এককোণে বসে থাকা অবস্থাতে দেখেই বুঝে গেলুম লোকটা সিলেটি।
এবং তাই। আমার মুখে সিলেটি শুনে ভ্যাক করে কেঁদে ফেলল। আমি একপাল লোকের সামনে মহা-অপ্রস্তুত।
ব্যাপারটা সরল, কিন্তু পরিণামে হয়ে গেছে বেজায় জটিল। মাসখানেক পূর্বে আলেকজান্দরিয়া বন্দরের কিছু দূরে একটা জাহাজডুবি হয়–ও-ই কোনও গতিকে বেঁচেছে, সম্পূর্ণ উলঙ্গাবস্থায়, গায়ের চামড়াও কিছুটা পুড়েছে। পাসপর তো সাপের মণি–রত্তিভর ডকুমেন্ট তার কাছে নেই। আর ওই একমাত্র সিলট্যা ভিন্ন অন্য কোনও ভাষায় একটি শব্দও সে বুঝতে পারে না।
কুল্লে কাফে মাথা নেড়ে সায় দিলে, ব্যাপারটা সঙিন।
ভাগ্যিস, ডেপুটি কনসালটি ছিলেন আমার পরিচিত–অতিশয় অমায়িক খানদানি ইংরেজ ভদ্রলোক। আমার আপন কাজ শেষ হয়ে গেলে খালাসিটার কথা পাড়লুম। সায়েব মাথা নেড়ে বললেন, বিলকুল হুম্বগ। আমি কলকাতায় কাজ করেছি পাঁচটি বছর। বাঙলা শুনলে বেশ বুঝতে পারি। ও যা বলল সে তো বাঙলা নয়।
মনে মনে আমাকে বলতে হল, পোড়া কপাল আমার। সাহেবকে বললুম, ওকে একটু ডাকলে হয় না? সায়েব সদাশয় লোক, বললেন, আলবৎ।
লোকটা আসামাত্রই আমি চালালুম তোড়সে সিলেটি। কিঞ্চিৎ কটুকাটব্যের কাঁচা লঙ্কা মিশিয়ে। উদ্দেশ্য তাকে একটু অতিশয় তাতিয়ে দেওয়া, নইলে যেরকম নসিকে ভিলেজ ইডিয়ট, পেটে বোমা মারলেও–। দাওয়াই ধরল। কাইকুঁই করে বলে গেল অনেক দুঃখের কাহিনী–চোখে সাত দরিয়ার নোনাজল। মিনিট পাঁচেক চলল রসালাপ। সায়েব খালাসিকে বললেন, টুম যাও। আমাকে শুধোলেন, এ-ও বাঙলা? আমি বললুম, লন্ডনের সঙ্গে উত্তর স্কটল্যান্ডের ভাষায় যে মিল–এ বাঙলার মিল কলকাত্তাইর সঙ্গে তার চেয়েও কম।
এর পর সায়েব যা বলল, তার থেকে পরিষ্কার বুঝে গেলুম, লোকটি সত্যকার ডিপলমেট। বললেন, দু-একটা শব্দ যে একবারেই বুঝতে পারিনি তা নয়। তবে কি জানো, ব্যাবু, ব্যাপারখানা আসলে কী? কোনও বিশুদ্ধ স্ট্যান্ডার্ড ভাষা–যেমন মনে করো প্যারিসের ফরাসি, কিংবা ধরো লন্ডনে প্রচলিত খানদানি ঘরের ইংরেজি সেটা শেখা কিছু অত্যধিক কঠিন কর্ম নয়। হাজার হাজার রুশ, পোল, হাঙগেরিয়ান চোস্ত ইংরেজি বলে খাসা ফরাসি কপচায়–কার সাধ্যি বলে কোনটা কার মাতৃভাষা নয়–এবং প্রসঙ্গত বলি, এরাই হয় বেস্ট স্পাই। কিন্তু মশাই, বিশুদ্ধ গাইয়া ডায়লেকট রপ্ত করাটা বড়ই কঠিন, প্রায় অসম্ভব। লন্ডনের কটা খানদানি ইংরেজই বলতে পারে খাঁটি ককনি?
সায়েবটি ছিল একটু দুঁদে টাইপ। খালাসিটার জন্মভূমির গ্রাম থানায় চিঠি না লিখে রেডটেপিজেমের মূর্ত প্রতীক এনকোয়ারি না করেই আপন জিম্মায় ছেড়ে দিল একখানা পাসপরুট।
নইলে ওই হতভাগা ক মাস ধরে কে জানে, হয়তো বারো বছর ধরে আপিসে দফতরে ধন্না দিত, রাস্তায় রাস্তায় ফ্যা-ফ্যা করে করে বেড়াত, খেত কী, মাথা গুঁজত কোথায়?
আর ইতিমধ্যে যদি কোনও সমধিক কর্মনিষ্ঠ তথা অত্যুৎসাহী উৎকোচাশ্রয়ী মিশরি পুলিশম্যানের নজরে পড়ে যেত? কাঁধে খাবলা মেরে শুধোত, তুমি তো বিদেশি বলে মনে হচ্ছে হে–নিকালো বাসবর (আরবিতে প নেই বলে ব আদেশ, এবং শব্দটি আরবরা ফরাসি থেকে নিয়েছে বলে শেষের টি উচ্চারিত হয় না–একুনে পাসপ উচ্চারিত হয় বাসবর, বা বাসাবর) তা হলে?
শ্রীঘর। তাতে যে আমাগো সিলট্যা মোতিমিয়ার খুব একটা ভয়ঙ্কর আপত্য (আপত্তি শব্দের সিলেটি রূপ) আছে তা নয়; জাহাজের কয়লাঘরের কারবালায় কারবার করছে যে লোক তার পক্ষে কাইরোয় কারাগার করীমা বখশায় বর হাল-ই-মা–আল্লার কৃপা তার ওপরে এসেছে।
কিন্তু ততোমধ্যে তার নয়া বাসবরের জন্যে যেটুকু ধরনা দেওয়া, তদবির করা সেটুকুনই-বা করবে কে? অবশ্য আখেরে এস্থলে তদবির করা-না-করা–বরাবর। বসুন্ধরা সর্বত্রই তদ্বির-ভোগ্যা নন–এখানে প্রকৃতি তার আপন গতি নেয়।
সাঁইমুরশিদ কবুল, আমি সব নই। কিন্তু আপনার-আমার মতো ক্ষীণকায় মধ্যশ্রেণির ভদ্রসন্তানকে যদি বিদেশের জেলে ঠেসে দেয় তবে কেঁসে যেতে কতক্ষণ? না-হয় সপ্রমাণ হল, কাইরোর জেলকে আপনি হার মানিয়ে বেরিয়ে এলেন। কিন্তু বেরুনো মাত্রই তো আপনি সেই ক্রাইমটি ফের করে ফেলেছেন, বিদেশে বিনা পাসপটে আপনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
অবশ্য আপনি তর্ক তুলতে পারেন, মিশর সরকারই আপনাকে রাস্তায় নামিয়ে ক্রাইমটি করছে, সেই কাজের আপনি ইফেকট মাত্র। ততোধিক কুতর্ক করতে পারেন, আজ যদি মিশর সরকারের প্রতিভূ পুলিশম্যান আপনাকে চোদ্দতলা বাড়ির ছাদ থেকে পেভমেন্টে ফেলে দেয় তবে সেটা আত্মহত্যা নয়।
***
কাফেতে এ নিয়ে বিস্তর মাথা-ফাটাফাটি হয়।
একমাত্র তওফিক আফেন্দি চরম অবহেলাভরা সুরে পরম তাচ্ছিল্যসহ মাঝে মাঝে বলছিল, যত সব! কিংবা আদিখেত্তায় মানওয়ারি অথবা ডিমের খোসায় কালবৈশাখী!
শেষটায় বলল, ছোঃ! আমার কাছে নিয়ে এলে না কেন?
নিবেদন করলুম, জানি তুমি একদা ছিলে মুস্তাফা কামালের বিবেকরক্ষক অধুনা ইসমেৎ ইনেনুর অমনিবাস এমবাসেডর, কিন্তু তথাপি।
বলল, যাহঃ! এইটুকু মশা মারতে বাঘের উপরে টাগ! না। কিনে দিতুম। কী আর এমন ক্লেওপাতার গুপ্তধন প্রয়োজন ওই সাসিটুকুর জন্য?
আমি অবাক হয়ে শুধোলুম, সে কী? পাসপর কি হাটের বেসাতি, যে–।
গম্ভীরকণ্ঠে বলল, দেখো, বৎস! তুমি আজহর মাদরাসার ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়ন করো; নাই-বা জানলে এসব জাল-জঞ্জুরির কায়দা-কেতা।
———–
১. পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নিবেদন : আশকথা পাশকথা (আর সেটা প্রাণধর্ম) না-শুনে যেসব বে-আড্ডাবাজ অথচ গুণী পাঠক মূল গল্পের খেই ছিনেজোঁকের মতো আঁকড়ে ধরে রাখতে চান তারা যেন ফুটনোটগুলো না পড়েন; কণামাত্র ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। অবশ্য তার অর্থ এ-ও নয় যে, মূল লেখা না পড়লে তার সর্বনাশ হবে।
শপ-লিফটারজ কথাটা ইংরেজের ওপর প্রথম আরোপ করেন ছদ্মনামধারী সরস লেখক সাকি।
২. আমার কাইরো-কাফে আশ্রম ওই সময়ে।
৩. ভারতের বাইরের বেদে মাত্রেরই বিশ্বাস তাদের আদিমতম পিতৃভূমি ভারতবর্ষ। তা হতেও পারে। এবং তাদের আর একটি বিশ্বাস, ভারতবর্ষ আগাপাশতলা বেদেদের দেশ, সবাই ঘুরে বেড়ায়, সুতরাং কেউ বাড়ি-ঘরদোর বাঁধে না!