তৃতীয় খণ্ড (স্নেহের চুমকিকে)
3 of 6

আড্ডার ঘরানা

আড্ডার ঘরানা

আমাদের আড্ডারও নানারকম ঘরানা আছে, গানের ঘরানার মতো। আমাদের পরিবারের ঘরানা গত একশো বছরের প্রাচীন। যেমন বলা হয়, আমাদের পুজো একশো বছরের পুরোনো, সেই প্রপিতামহের আমল থেকে চলে আসছে। সেই একই ধারায়।

আমার পিতামহের আমল থেকে চলে আসছে আড্ডার একটা বিশিষ্ট ধারা। কাজের অবসরে আড্ডা। আড্ডার জন্যে অবসর নয়। অনেকটা সেই ইংরেজি প্রবাদের মতো, ইট টু লিভ, নট লিভ টু ইট। আড্ডায় তাস, পাশা, দাবার প্রবেশ নিষেধ। আর আড্ডা যেন কিছু দিতে পারে। বেকার আড্ডা নয়। পরচর্চা একেবারেই নয়। তবে একজন আর একজনকে ভদ্রভাবে, বুদ্ধিদীপ্তভাবে উত্যক্ত করতে পারবেন, কিন্তু শালীনতার সীমা লঙ্ঘন না করে । জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোচনা হবে। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির কথা আসবে। ভাল সিনেমার প্রসঙ্গ, ভাল বইয়ের আলোচনা, দেশ-ভ্রমণের অভিজ্ঞতা, উইট হিউমার স্যাটায়ার। পারস্পরিক জ্ঞানবিনিময়। আমার ছেলেবেলা থেকে আড্ডার এই ঘরানাই আমি দেখে আসছি। এমনও দেখেছি, আড্ডায় অঙ্ক কষা হচ্ছে। যাঁর অঙ্কের জ্ঞান বেশি, তিনি আর একজনের ছেলের কঠিন কোনও অঙ্ক সমাধান করে দিচ্ছেন, পিতা গিয়ে পুত্রকে শেখাবেন।

রবিবার সকালে বাজারাদি হয়ে যাওয়ার পর এই আড্ডা বসত। আর শনিবারের সন্ধ্যায়। আড্ডা রকে নয়, বসত ঘরে। বেশ আরাম করে সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসতেন। ঘরে একটা ইজিচেয়ার অবশ্যই থাকত। সেটির দখল নিতেন আড্ডার প্রবীণতম সদস্য। চেয়ার, চৌকি, টুল, টেবিল এলোমেলো এলাহি বসার আয়োজন। সেযুগের বাঙালি খুব ফাংশানাল ছিলেন। কোনওরকম ইন্টিরিয়ার ডেকরেশনের ধার ধারতেন না। একালের যেমন সবই মাপা-মাপা, সবই ভীষণ কৃত্রিম।

যেমন, ড্রয়িংরুম মানে একচিলতে একটা ঘর। বই পড়ে সাজানো। হয়তো এক পাশের দেওয়ালে একটা মাদুর ফিট করা। কালচার। গৃহস্বামী গ্রামীণ সংস্কৃতি-সচেতন। মাদুর তাই মেঝে থেকে দেওয়ালে গিয়ে উঠেছে। একপাশে কোনাচে করে রাখা একটা বুক কেস। ফর্দ মিলিয়ে দশকর্মার জিনিস কেনার কায়দায় বইমেলা থেকে সময়ের নাড়ি টিপে বই কেনা। একটা সায়েনস ফিকশান, একটা জেনারেল নলেজ, গোটাকতক অমনিবাস। টিভি সিরিয়ালের চেতনায় সচিত্র সহজ রামায়ণ, মহাভারতের ক্ষীর। এইরকম আর কি! বই রাখার পর সামনের খালি জায়গায় রাজ্যের টুকিটাকি। পুতুল, ছোট ফুলদানি, দামি কাপ। একটা বই চাইলে কেরামতির ঠেলায় অন্ধকার। এটা সরাও সেটা সরাও। শেষে বই বেরোল। পাতায় পাতায় নিমপাতার পুর। গ্যামাকসিনের প্রলেপ।

আর একদিকে টেলিভিশন। গণেশ ছাড়া যেমন দোকান হয় না, সেইরকম টিভি ছাড়া বৈঠকখানা হয় না। টিভির ওপর ঢাকা, তার ওপর একটা কিছু কারুসামগ্রী। ঠ্যাং তুলে বক দাঁড়িয়ে আছে। যেন গৃহস্বামীর জীবনদর্শন। একটা পা তুলেই রেখেছি, আর একটা পা তুলে নিলেই এবারের মতো খেল খতম। অথবা ধ্যানী বুদ্ধ। নেপালে গিয়ে কিনেছিলেন। টিভি চালাবার প্রয়োজন হলে, প্রথমে মূর্তি নামাও। তখন চতুর্দিক থেকে সাবধানবাণী, ভাঙে না যেন, ভাঙে না যেন। তারপর চাপা সরিয়ে টিভি দর্শন। বন্ধ করার পর ‘রিভার্স’ প্রক্রিয়া। একটা ডিভান। তার ওপর টানটান চাদর। এক প্রস্ত সোফাসেট। সেন্টার টেবল। এক ফালি কার্পেট। তার ওপর দিয়ে এমন ভাবে যেতে হবে, যেন এঁকে বেঁকে না যায়। সিমেট্রি নষ্ট হয়ে যাবে। জুয়েল থিফের হিরে-চুরির কায়দায় হাঁটতে হবে। মুড়ি চানাচুর খাওয়ার সময় পাখা বন্ধ। মুড়ি উড়ে কার্পেটে পড়বে। বিস্কুট ভেঙে-ভেঙে খাওয়া চলবে না। গুঁড়ো পড়বে। ‘একদা এক বাঘের গলায় হাড় ফুটিয়াছিল’-র কায়দায় হাঁ করে বিস্কুটে কামড় মেরে টুকরো আর গুঁড়ো মুখে ধরে নিতে হবে অসীম কায়দায়। তা না হলে গৃহকর্ত্রী কর্তাকে বলবেন, কী সব বন্ধুবান্ধব বাড়িতে আনো। গাঁইয়া। টোস্ট নিষিদ্ধ। জোরে হাসা, কাশা, হাঁচা চলবে না। স্পিকার-ফাঁসা গলায় হাসতে হবে। আর হালকেতার এই ধরনের বাড়িতে আড্ডা! ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে আড্ডা। একালের ঘড়ির অ্যালার্মও পাড়া জানান দিয়ে বাজে না। কোয়ার্জ অ্যালার্ম। ছুঁচোর মতো চিঁকচিঁক শব্দ করে। অ্যালার্ম বাজলেই আড্ডা শেষ। টিভির আলোচনা অনুষ্ঠানের মতো। সময় হয়ে গেলেই ‘কাট’। যতটা হল, ততটাই হল। আড্ডার কন্ট্রোলার গৃহিণী। একটু এদিক সেদিক হলেই সংসারে লঙ্কাদহন সারং। লঙ্কাদহন সারং একটি রাগ। যে মেঘ গর্জন করে না, সে মেঘ যেমন দেয় না কিছুই, বারিহীন, সেইরকম যে-স্ত্রী গর্জন করে না, সে-স্ত্রী ইস্ত্রি। স্ত্রীজাতির গর্জনে যে রাগিনী, তার নাম লঙ্কাদহন সারং!

আমরা আমাদের পরিবারে যে আড্ডা দেখেছি, সেই আড্ডায় ঘড়ির কোনও স্থান ছিল না। ঘড়ি যেন আবিষ্কারই হয়নি। সময়-নিরপেক্ষ একদল মানুষ। সাহসী তো অবশ্যই। যমরাজ ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে প্রশ্ন করলেন, এই ত্রিভুবনে কে যথার্থ সাহসী! ধর্মরাজ বললেন, প্রভু! যে নিজের পরিবারকে ভয় পায় না, এই ত্রিলোকে সেই প্রকৃত সাহসী। তখন বলেননি, এখন হলে বলতেন।

আড্ডার মশলা হল, মুড়ি তেলেভাজা আর ঘড়ি-ঘড়ি চা। মুখ না চললে আড্ডা অচল। শুকনো আড্ডা জমে না। যেমন বর্ষণ না হলে চাষ ভালো হয় না। তেলেভাজা দোকানের হলে চলবে না। আড্ডাধারীর বাড়িতে ভাজাতে হবে। অফুরন্ত সাপ্লাই আসবে অন্দরমহল থেকে। যে-গৃহে গৃহকর্তার হুকুম চালাবার স্বাধীনতা নেই, সে-গৃহে আড্ডায় প্রাণ-প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা খুবই কম। মাপা এক কাপ চা, দু-খণ্ড বিস্কুট, যেন রোগী দেখতে এসেছি। বহু সদস্য-বিশিষ্ট হাসিখুশি একটি পরিবার অন্তরালে থেকে আড্ডাকে সাপোর্ট করবে, তা না হলে আড্ডার চেহারা দাঁড়াবে একালের হাং-পার্লামেন্টের মতো। মদত না দিলে আড্ডা জমে না। কাজের লোক আসেনি, দুধ আসেনি, লোডশেডিং, পরিবারের আধকপালে। বড় ছেলে ফড়কে বেরিয়ে গেছে, মেয়ের সঙ্গে মায়ের খণ্ডযুদ্ধ হয়ে গেছে। ছোটবউ পরিবার ভাঙার প্যাঁচ কষেছে, ছোট বোনের ক্যানসার সন্দেহ করা হচ্ছে, বাজারদর মই বেয়ে ক্রমশই টঙে চড়ছে। উচ্চ-মাধ্যমিকের ফল গাছে দোল খাচ্ছে, ছোট ছেলে কলেজে ঢুকতে গিয়ে ধোলাই হয়েছে। কোষাগারে টাকা নেই বোনাস আটকে গেছে। নাকে সামান্য সুবাস ধরাতে পারে এমন চা শয়ের ওপর লাট খাচ্ছে। সরষের তেল তরল সোনা। পেটে পেপটিক আলসার খোঁচা মারছে। তালগোল-পাকানো এমত পরিস্থিতিতে আড্ডা হতে পারে! এ তো শ্রাদ্ধের পরিবেশ। স্মরণসভা হতে পারে। কিছু মানুষ কিছুক্ষণ পেঙ্গুইন পাখির মতো এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে থাকতে পারে। কথাবার্তা অবশ্যই চলবে। সেটা এইরকম :

ক. ক্যানসার কীরকম বেড়েছে দেখেছ। ঘরে-ঘরে। প্রতি পাঁচজনের একজন।

খ. অ্যাবসলিউটলি নো মেডিসিন। ওনলি একসপেরিমেন্ট।

গ. হবে না ! যা পলিউশান। দেয়ার ইজ নো সলিউশান।

ঘ. সবই তো ভেজাল। আসল জিনিস তো বাজারে নেই। গাছের গোড়ায় কেমিকেল সার। ফলে কারবাইড।

ক. বাতাসে গাড়ির ধোঁয়া।

খ. বাঙালি ভাজা খেয়েই গেঁজে গেল। আলু ভাজা, পটল ভাজা, বেগুন ভাজা, বড়া ভাজা। কোন তেলে ভাজা খাচ্ছ চাঁদ। সরষের তেল বলে কিছু আছে?

গ. আরে খাওয়াটাওয়া কিছু নয়, আসল হল অ্যাংজাইটি। দুশ্চিন্তা।

ঘ. আমার ছেলের ফিউচারটা নষ্ট করে দিলে। জয়েন্ট এনট্রেন্স দিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং-এ চান্স পেলে। লিস্টের প্রথমেই নাম। এইচ. এস.-এ ফেল করিয়ে দিলে। খাতাই দেখলে না।

ক. আমার ছেলে ডব্লু. বি. সি. এসে সিলেকটেড হল, মন্ডল কমিশনে বাদ চলে গেল।

খ. আমরা তো মরবই, পরের জেনারেশনটা একেবারে শেষ হয়ে গেল।

গ. র‌্যাগিং নিয়ে কাণ্ডটা একবার দেখছ!

ঘ. রাশিয়ায় কী হচ্ছে বলো তো?

ক. তার আগে বলো কলকাতার নরকে আবার কবে প্লাগ আসছে! রাস্তাঘাটের অবস্থা দেখেছ! ক্যালকাটা থ্রি হান্ড্রেডের অবদান জঞ্জালের টাব।

খ. মাঝে-মাঝে মনে হয়, কবে মরে বাঁচব!

গ. অতই সহজ! পাপের প্রায়শ্চিত্ত করো। আরও কিছু খেল দ্যাখো। সব চৌপাট হয়ে যাক।

ঘ. দেশে কি কোনও পার্টি নেই?

ক. অবশ্যই আছে, ব্যান্ডপার্টি, তাসা পার্টি, বড় বড় ক্লাবে মাতাল পার্টি। পার্কে পার্কে গাঁজা পার্টি, পাড়ায়-পাড়ায় সাট্টা পার্টি। পার্টির অভাব আছে! পার্টিরই তো যুগ।

এক সমস্যা থেকে আর-এক সমস্যায় ঘুরপাক খেতে-খেতে এক সময় চার ভদ্রলোক ক্লান্ত হয়ে উঠে পড়বেন। ক বাবু বললেন, ‘যাই, ভায়রাভাইকে দেখতে যেতে হবে। অটো করে যাচ্ছিলেন সাউথ বেঙ্গলের দমকা মিডি বাস অটোর সঙ্গে ভায়রাকেও চুরমার করে দিয়েছে। খ. বাবু মেয়ের বিয়ের টাকার ধান্দায় বেরোবেন। দেড় লাখের কমে কোনও ছেলেই পিড়েয় বসবে না। তারপর বাবাজীবন কী কায়দায় টরচার চালাবেন তিনিই জানেন। শিশুসদনের দরজা বন্ধ, রোগীদের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে, গ. বাবু শ্যালিকার চিন্তায় অস্থির। ঘ. বাবুর গৃহিণীর হাই সুগার। জবরদস্ত আড্ডা শেষ হয়ে গেল। সেন্টার টেবিলে পড়ে রইল খালি সিগারেটের প্যাকেট। গায়ে লেখা স্ট্যাটুটারি ওয়ার্নিং, সিগারেট স্মোকিং ইজ ডেনজারাস ফর হেলথ।

আমাদের যৌবনে, কী কৈশোরে এমন আড্ডা দেখিনি। আমাদের বৈঠকখানা মজার-মজার মানুষে ভরে যেত। চড়া গলা, উদাত্ত হাসি। পেছনে লাগার মতো সাদাসিধে একজন ভালোমানুষ অবশ্যই থাকতেন। একজন কারোকে নিয়ে মজা করতে না পারলে আড্ডা ম্লান হয়ে যায়। সকলকেই যে কথা বলতে হবে, তা নয়। কিছু তাল শ্রোতারও প্রয়োজন। কয়েকজন বলবেন, কয়েকজন শুনবেন। সেই পারিবারিক আড্ডায় গোঁড়া এক ব্রাহ্মণ আসতেন। আমার উদারপন্থী জ্যাঠামশাই তাঁকে নিয়ে খুব রসিকতা করতেন। তাঁর চরিত্রে কিছু অসঙ্গতি ছিল। ডিম খেয়েছেন বললে তিনি ভয়ঙ্কর রেগে যেতেন। আর, আমার জ্যাঠামশাই বিচিত্র পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে তাঁকে ডিম খেতে দেখেছেন বলে দাবি করতেন। তারপর বলতেন, ডিমে তুলসীপাতা দিলে ডিম আর ডিম থাকে না, কুলি-বেগুন হয়ে যায়। যেমন গঙ্গার জল দিয়ে মাংস রাঁধলে হয়ে যায় গাছ-পাঁঠা। এই আড্ডায় আর একজন আসতেন, তিনি ছিলেন ভূত-বিশেষজ্ঞ। যেখানেই গেছেন, সেইখানেই ভূতের দর্শন পেয়েছেন। রকম রকম ভূত। ভূতের গল্প বলতে-বলতে নিজেই এত ভয় পেয়ে যেতেন যে, একা-একা আর বাথরুমে যেতে পারতেন না। এইরকম ভৌতিক অবস্থায় পেছন থেকে তাঁর ঘাড়ে কেউ ফুঁ দিলে চমকে উঠে পাশের কারোকে জড়িয়ে ধরতেন। শেষে লজ্জা ঢাকতে কর্ণাটকের ফুঁ-মারা ভূতের গল্প জুড়তেন।

আর একজন আসতেন ভোজনরসিক। সুযোগ পেলেই খাওয়ার প্রসঙ্গ। গুজরাতের স্যালাড। নবদ্বীপের ইলিশ। শক্তিগড়ের ল্যাংচা। জনাইয়ের মনোহরা। কাশীর মালাই। লখনউয়ের চাঁপ। বলতে-বলতে তিনি বিভোর হয়ে যেতেন। সঙ্গে-সঙ্গে অন্য সবাই তাঁদের নিজেদের খাওয়ার অ্যাডভেঞ্চারের কথা বলতে শুরু করতেন। আড্ডার মজাই হল, কেউই সহজে হারবেন না। এক ধরনের প্রতিযোগিতা। কথায়-কথায় একবার চুস্ত পাজামার কথা উঠেছিল। এক আড্ডাধারী বললেন, ‘সে জিনিস কলকাতায় কে করবে? রিয়েল চুস্ত আমি লখনউতে করিয়েছিলুম। টেলারের নাম ছিল সাবির আলি। দোকানে গিয়ে দাঁড়ালুম। কাপড় কেটে গায়ে চড়িয়ে দিলে। আমি দাঁড়িয়ে আছি। দুদিকে ওস্তাগড় ছুঁচ-সুতো দিয়ে পটাপট সেলাই করে যাচ্ছে। কী সুইফট হাত। পাজামা শরীরে ফিট করিয়ে দেড় ঘণ্টার মধ্যে ছেড়ে দিলে। পাছে বিরক্ত হই, হাতের কাছে এক হাঁড়ি কাবাব। মাঝে-মাঝে মুখে পুরছি।’

উত্তরে একজন বললেন, ‘এ তোমার নাকসভমিকা কেস। পেট গরম হয়েছে। এক ডোজ খেয়ে নাও। তা না হলে ও-পাজামা আর খুলতে পারবে না।

একবার নরম রুটির প্রসঙ্গ উঠেছিল। কে কত নরম রুটি খেয়েছে। একজন বললেন, ‘তাঁর পিসিমা নাকি এমন রুটি করতে পারেন, হাত দিলে মনে হবে লেপের টুকরো। তুলতুলে নরম। একসঙ্গে পরপর বিছিয়ে চাদর পেতে কারোকে শুইয়ে দিলে মনে হবে জামিয়ারের বিছানায় শুয়ে আছে। ফর্মূলাটাও বলেছিলেন। যতটা সম্ভব কম জলে ঘরের জানলা বন্ধ করে ময়দা মাখতে হবে ময়ান দিয়ে। ময়দার তালের সঙ্গে কুস্তিগীরের মতো কোস্তাকুস্তি করতে হবে। ময়দার তাল কুলকুল করে ঘামবে। যত ঘামবে তত নরম হবে রুটি। নরম রুটির টেক্কা মেরে বেরিয়ে যাবেন একজন, তা কেমন করে হয়। সঙ্গে-সঙ্গে আর-একজন পাতলা রুটির প্রসঙ্গ তুললেন। সে-রুটি তৈরি করতেন তাঁর মা। এত পাতলা যে, জোরে বাতাস দিলে ঘুড়ির মতো উড়ে যেত। একটার ওপর আর একটা রাখতে হত কাগজের সেপারেশন দিয়ে। মসলিনের মতো, উড়ুনির মতো। বিদেশের প্রদর্শনীতে পাঠাবার কথা হয়েছিল একবার, আর্টস অফ ইন্ডিয়া বিভাগে।

রুটি থেকে মাছ। মাছ থেকে মশা। মশা থেকে ছারপোকা। কাক থেকে কোকিল। সকলেই একবার করে শৈশবে ফিরে যেতেন। কার পিতা কত রাগী ছিলেন, সে প্রসঙ্গ এসে পড়ত। আসত ফুটবল খেলার কথা। গোলপোস্ট এপাশে, মানুদা এমন শট মারল ওদিকের গোলে ঢুকে গেল বল, গোলার মতো।

কখনও আবার আড্ডা নয়। গান। প্রায়ই বড় কোনও ওস্তাদ এসে পড়তেন। তখন বিছানো হত আসর। তবলা, তম্বুরা, হারমোনিয়াম। সুর-ধারায় সব মশগুল। ঘড়ি ঘুরে চলেছে। রাত চলে গেছে মধ্যরাতে, অবগাহনে। শিল্পীর কণ্ঠে কেদারা কাঁদছে। বসে আছেন একঘর মানুষ। জীবনের থইথই দু:খ থেকে যাঁরা সুখ ছেঁকে নেওয়ার কৌশল জানতেন। তখন পরিবারের বাইরেও পরিবার ছড়িয়ে যেত সামাজিক স্নেহের বন্ধনে। গোটা পাড়াটাই একটা বিশাল পরিবার। এখনকার মতো স্বার্থের খুপরি নয়।

সেই আড্ডা, মানুষের সেই নির্দোষ মিলন আজ কোথায়! আগে মারত আড্ডা, এখন মারে মানুষ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *