আড্ডাবাজের জীবন
আড্ডাবাজের জীবনে কিছু হয় না এই বাক্য জ্ঞান হওয়া ইস্তক শুনে আসছি। কিন্তু আড্ডা ব্যতীত জীবন চলতেই চায় না। কিছু না হলে না হবে। চাই না কিছু। আড্ডা চাই। গল্পের আড্ডা। সাহিত্যের আড্ডা। তাস পাশার আড্ডা নয়। তাস আমি পছন্দ করি না।
আমার ছেলেবেলার কিছুটা দিন কেটেছে বসিরহাটের অদূরে দণ্ডীরহাট গ্রামে। আর সেই গ্রাম ছিল যেন আড্ডার পীঠস্থান। ছোট একটি বাজার ছিল হাই ইস্কুলের কাছেই। সেই বাজারে ছিল গোড়া বাঁধানো এক বকুল গাছ। সেই বকুলতলায় আমার আড্ডাজীবন শুরু। তখন ইস্কুল বালক। তবু আড্ডা দিয়েছি খেলার পর। ইস্কুল ছুটির পর। বাজারে ধনাদার চায়ের দোকানের ধরাটে ছিল বড়দের আড্ডা। ধরাট হলো বাঁশের চটা জুড়ে জুড়ে বেঞ্চির মতো করা। ওই ধরাটে বসলে তার জীবনে আর কিছু হয় না। এই কথা নীতিবাগীশ মেজদাদের মুখে শুনতাম। সেই ধরাটের আড্ডা আর কলকাতার রকের আড্ডা একই রকম বলা যায়। আমাদের কিশোর বেলায় কিংবা সদ্য যৌবন বেলায় রকের আড্ডায় যে রং ছিল বন্ধুতার, তা এখন নেই। কলকাতা শহর থেকে রকই উঠে গেছে। তবে উত্তর কলকাতায় এখনো আছে। শ্যামপুকুর স্ট্রিটে খুব ভালো আড্ডা দিয়েছি আজ থেকে প্রায় ৪০ বছর আগে। রকে। থাকতেন এখন খ্যাতিমান ভাস্কর বিমল মণ্ডল। থাকতেন প্রখ্যাত লেখক সমরেশ মজুমদার। থাকতেন প্রদ্যোত ভদ্র, কল্যাণ সর্বাধিকারী। এই আড্ডা ছিল সাহিত্য আর শিল্পের। সদ্য প্রকাশিত গল্প নিয়ে কথা হতো এখানে। বিমলের বাড়ি শ্যামপুকুর স্ট্রিটেই। তার কাজ দেখতে তার বাড়িতেও যাওয়া হতো। এখনো রবিবারে পুরনো পাড়ায় দেখা যায় পুরনো আড্ডা। রক না পেলে চায়ের দোকান। তাও না পেলে রাস্তার ধারে,ফুটপাথে দাঁড়িয়ে। আড্ডায় বন্ধুতা বাড়ে। আড্ডায় মত বিনিময় হয়। আড্ডা অতি মধুর। নিউ ইয়র্কের কুইনস সিটিতে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে বাঙালি বাংলাদেশিরা চায়ের কাপ হাতে আড্ডা দিচ্ছে, দেখেছি। আমিও যোগ দিয়েছিলাম।
আমি আড্ডা দিতে ভালবাসি। আড্ডা দিতে দিতে বড় হয়েছি। অভ্যাসটা রাখব কোথায়? জানি আড্ডা সময় খেয়ে নেয়, নিক, আড্ডা না দিলে যে ভাত হজম হয় না। আড্ডা কেরিয়ার নষ্ট করে, করুক, কিন্তু আড্ডা না হলে মন প্রসারিত হয় না। অনেক কিছু পাওয়া হয় না। যেহেতু বহুদিন নিবার্ন্ধব প্রায় থেকেছি বাইরে, দুর্গম গ্রামে, আমি তৃষ্ণার্ত হয়ে থাকতাম কলকাতার আড্ডার জন্য। আড্ডার বন্ধুদের সঙ্গে মানসিকতার মিল না থাকলে সেই আড্ডা ভেঙে যায়। নাটকের লোকজন একসঙ্গে, সিনেমার লোক একসঙ্গে আড্ডা দেন। আমি দেখেছি নাটকের আড্ডা। ন’টায় বসে সেই আড্ডা বেলা দুপুর পযন্ত গড়াত আমাদের ফ্ল্যাটে। বিভাস চক্রবর্তী, অশোক মুখোপাধ্যায়, মাণিক রায়চৌধুরীরা আসতেন।
শ্রদ্ধেয় কবি শঙ্খ ঘোষের বাড়ির আড্ডায় ছুটির দিনে কোনো বিরাম থাকে না। সকাল থেকে চলতে থাকে। বেলা তিনটে অবধি তা গড়াতে দেখেছি আমি। সেই আড্ডা কলকাতা শহরের সেরা আড্ডা। সেখানে তরুণ কবি থেকে প্রবীন কবি, গল্পকার, সিনেমা নির্মাতা, চিত্রকর, গায়ক থেকে অভিনেতা, নির্দেশক, কে না যান? ঘুরে এসে আনন্দ। আড্ডা শুধু শঙ্খবাবুর সঙ্গে নয়, সকলের সঙ্গে সকলের। আমার সৌভাগ্য হয়েছে সেই আড্ডায় কয়েকবার যাওয়ার। অপূর্ব অভিজ্ঞতা।
লিখতে আরম্ভ করলে বন্ধু বদলে যায় আমার। পাড়ার আড্ডা আর হয় না। পুরনো আড্ডা ভেঙে যায়, নতুন আড্ডা শুরু হয়। সেই আড্ডা অবশ্যই সাহিত্যের। পাড়ায় আড্ডা হত বাল্যকালের বন্ধুদের সঙ্গে। তারপর ‘একাল’ নামের একটি লিটল ম্যাগাজিন ঘিরে। ম্যাগাজিনটি পাড়া থেকেই বেরোত। সম্পাদক নকুল মৈত্রের বাড়ি। তাঁর সঙ্গে কফি হাউস। চায়ের দোকান। গল্প পড়া হত। সে এক দিন গেছে। ১৯৭৩-এর শেষ থেকে আমি কলকাতার বাইরে। ১৯৭৫-এর প্রথমে কবিপত্রের বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ। এক পক্ষ অন্তর কলকাতা ফিরে ২২/বি প্রতাপাদিত্য রোডে কবিপত্রের আড্ডায় গিয়ে পড়েছি। সেখানে কত নতুন প্রতিভাবান বন্ধু হয়েছিল। কবি তুষার চৌধুরী, অনন্য রায় (দু’জনেই এখন নেই), সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়, সমীর চট্টোপাধ্যায়, বৌধায়ন মুখোপাধ্যায়, দীপঙ্কর দাস, শচীন দাস, অসীম চক্রবর্তী (শেষ তিনজনই এখন নেই) ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায়। ছিলেন পবিত্র মুখোপাধ্যায়, প্রভাত চৌধুরী। একদিন এক আড্ডার সন্ধ্যায় বটুকদা (জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র), একদিন শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়…, কতজন। বটুকদা নিজ কন্ঠে, নবজীবনের গান শুনিয়েছিলেন। এস মুক্ত কর, মুক্ত কর…। কবিপত্রের আড্ডা সেই পঁচাত্তর থেকে। সেখানেই শৈবাল মিত্র, চণ্ডী মণ্ডলের সঙ্গে পরিচয়। আমার সেই সব বন্ধু অগ্রজরা অনেকেই তো নেই। শ্যামলদা, চণ্ডীদা, শৈবালদা, দীপঙ্কর, শচীন, অসীম, তুষার অনন্য। বৌধায়ন এখন ইংরেজি ভাষার মান্য কবি। আমি প্রায়ই নতুন গল্প বের করতাম ব্যাগ থেকে। মেদিনীপুরের নিঃসঙ্গবাস আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিত। একটা অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল সকালে উঠে লিখতে বসা। সেই অভ্যাস রয়ে গেছে। আমাকে নিয়ে তুষার বলত, সুলেখা কোম্পানির পাইপ লাইন অমরের কলমে ঢুকে গেছে। হা হা হা। কী হাসি। নির্মল বন্ধুতা। কী লিখব সেই সব দিন আর আড্ডার কথা। বারদুয়ারি, খালাসিটোলা… আড্ডা চলত। ১৯৮৩ নাগাদ আমার জন্ডিস হয়। তুষার বলেছিল, মদ খেয়েছি আমি, জন্ডিস হয়েছে তোর।
কত আড্ডার কথা মনে পড়ে। কলেজ স্ট্রিটে পুস্তক প্রকাশনী নামে একটি প্রকাশন সংস্থা সেই ১৯৭৫-৭৬ নাগাদ ষাট দশকের শ্রেষ্ঠ কবিতা প্রকাশ করেছিলেন। আর করেছিলেন পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা। সেই প্রকাশন সংস্থার কর্ণধার ছিলেন কনকবরণ মিত্র। বেলেঘাটা সুভাষ সরোবরের কাছে থাকতেন। কলেজ স্ট্রিটে তাঁর ঘরে এসে বসতেন জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী। প্রথম তাঁকে সেখানে দেখে আমি অভিভূত। সঙ্গে সমীর চট্টোপাধ্যায়, বৌধায়ন মুখোপাধ্যায়, শচীন দাস, কখনো তুষার থাকতেন। পবিত্রদা আর প্রভাত চৌধুরী তো ছিলেনই। সেখানে কতদিন আড্ডা দিয়েছি সেই পিতৃপ্রতিম লেখকের সঙ্গে। তিনি বলতেন সাহিত্যের নানা কথা। আমার গ্রাম জীবনের অভিজ্ঞতা শুনতেন নিবিষ্ট হয়ে। শেষে বলতেন, এ সব আমি দেখি নি, তুমি দেখেছ, তুমি লিখতে চেষ্টা করো। আমি একটি গল্প লিখেছিলাম ১৯৮৮ নাগাদ, ‘বাদশা ও মধুমতী’। যে ঘটনা সেই গল্পের সূত্র, সেই ঘটনা তাঁকে আমি বলেছিলাম ১৯৭৬ নাগাদ। তিনি অবাক হয়ে শুনেছিলেন। বলেছিলেন লিখতে। সেই লেখা এল বারো বছর বাদে সাপ্তাহিক বর্তমান পত্রিকায় তাঁকে স্মরণ করে একটি লেখা লিখতে গিয়ে। যা দেখিনি তাও মনে পড়ে গিয়েছিল যেন। তিনি ছিলেন লেখকের লেখক। এখনো তাঁকে পড়ি। এক জীবনে এত পাওয়া হয় না সাধারণত। মনে পড়ে এক এক সন্ধ্যায় আমরা বন্ধুরা, সমীর আমি গিয়ে হাজির হতাম পরিচয়ের আড্ডায়। দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন পরিচয় সম্পাদক। তিনি কথা বলতেন সাহিত্যের নানা বিষয় নিয়ে। জানি না কবে শ্রোতা থেকে সেই আড্ডার অংশীদার হয়ে গেলাম আমরা। পুজোর পর বড় আড্ডা হত পরিচয়ে। পুজো সংখ্যার লেখা নিয়ে সকলে তাঁদের প্রতিক্রিয়া জানাতেন। আমি পরিচয়ের ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংখ্যায় দীপেনদার সঙ্গে বসে সমস্ত দুপুর প্রুফ দেখায় সাহায্য করেছি। কপি মেলাতাম। দীপেনদা কাজের সঙ্গে সঙ্গে কত বিষয়ে না কৌতূহলী সেই তরুণের কৌতূহল মেটাতেন। তাঁর কাছে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা শুনেছি, প্রগতি লেখক শিবিরের কথা, শম্ভু মিত্রের কথা…কত কথা। নরেন্দ্রনাথ মিত্রের গল্প, মানিক – তারাশঙ্করের উপন্যাস নিয়ে কথা শুনেছি। কোন লেখা পড়তে হবে, তিনি জানাতেন। পরিচয় পত্রিকায় গল্প লিখি ১৯৭৫ সালে। শকুন্তলার জন্ম। সেই গল্প হারিয়ে গেছে। শারদীয়তে লিখি ১৯৭৬ সালে। গল্পের নাম রাজকাহিনি। দীপেন্দ্রনাথের সঙ্গে সারা দুপুর কথাবার্তা আমার জীবনে অনেক কিছু দিয়েছিল।
তখন কিন্তু ২২/বি প্রতাপাদিত্য রোডে আমাদের আড্ডা চলছিল। কবিপত্রের আড্ডা। এই সময়ে পবিত্রদা একদিন বললেন, শ্যামলদা, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় এসেছেন প্রতাপাদিত্য রোডে, আর কয়েকটা বাড়ি পরে ৫১/১ নম্বরে, চলো আলাপ করে দিই তোমাদের সঙ্গে। কুবেরের বিষয় আশয়ের শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়! সেই আমাদের আড্ডা কবিপত্র থেকে শ্যামলদার বাড়ি আড্ডা স্থানান্তরিত হয়ে যেতে লাগল কখনো কখনো। আর শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে আড্ডা ছিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ আর মনোরম দিন। তখন নিজেকে গড়ে তোলার সময়। ওই সময়ে অমন এক মহৎ লেখকের সঙ্গ পাওয়া জীবনের দুর্লভ অর্জন। শ্যামলদার সঙ্গে আড্ডায় আমি জীবনকে যেটুকু শিখেছি, জেনেছি, তাই নিয়ে এতটা বছর কেটে গেল। সেই আড্ডায় তুষার সমীর প্রভাতদা, শৈবালদা, কতজন যে বিভিন্ন সময়ে একসঙ্গে। এমনই আড্ডা আর গল্পের মানুষ ছিলেন তিনি, কলেজ স্ট্রিট থেকে টেনে নিয়ে গেছেন তাঁর বাড়ি। আমার হাতে ব্যাগ। আমি মেদিনীপুর থেকে এক পক্ষ পর বাড়ি ফিরছি। শ্যামলদা বাড়ি ফিরতেই দিলেন না। পরের দিন সকালে ফিরলাম।
একদিন সন্ধ্যায় তিনি বললেন, নদীর বয়স হয়, জানো? আমি চুপ করে আছি। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, সেই কুলটিকরিতে চালের দর কত? হাটে যাও? তিনি বললেন, বিভূতিভূষণের ইছামতী পড়েছ? অনুবর্তন, দৃষ্টি প্রদীপ? মেঘমল্লার গল্পটি? জীবনটাকে দেখে নাও। জরিপের এক চেনে কত লিংক থাকে? চাষা তার হেলে বলদের সঙ্গে কথা বলে, শুনেছ?
তিনি আমার আরম্ভে আমাকে পেলেই এই সব জিজ্ঞেস করতেন। এক সন্ধ্যায় সিদ্ধান্ত, তুই ধারাবাহিক উপন্যাস লিখবি। আমি যে লিখিনি কখনো? বন্ধুরা, তুষার সমীর বলল, চ্যালেঞ্জ নে। লেখ। তিনি বলেছিলেন, সম্পাদক বললে, না করতে নেই। আমার উপন্যাস লেখার শুরু তাঁর প্ররোচনায়। “পাহাড়ের মতো মানুষ” লিখেছিলাম, তখন আমি ২৭। কোন সূত্রই ছিল না, লিখতে আরম্ভ করলাম ডুলং নদীর তীরে রাজবাড়িতে ফিরে। উপন্যাস লিখতে শিখেছি লিখতে লিখতে। তিনি বলতেন, কচু গাছ কাটতে কাটতে তলোয়ার চালাতে শেখে সৈনিক, লিখতে লিখতে লেখক হয়। এখন সেই সব দিনের কথা মনে পড়ে।
মহাশ্বেতাদির বাড়িতেও সেই সময়ে, তার পরেও কম আড্ডা হয়নি। অসীম চক্রবর্তী, জয়ন্ত জোয়ারদার, নির্মল ঘোষ, কলকাতায় এলে দীপঙ্কর চক্রবর্তী(অনীক সম্পাদক) আরও কত মানুষ। তাঁর সঙ্গে আড্ডাও ছিল এই জীবনের বড় পাওনা। তাঁর বাড়িতেই আমি তৃপ্তি মিত্রকে দেখি একদিন। দুপুরে গিয়ে দেখি তাঁরা তাঁদের কম বয়সের কথা বলছেন। সেই তেতাল্লিশের মন্বন্তরের কথা। মায়ের কোলে ক্ষুধার্ত শিশুর মৃত্যু, লঙ্গরখানা, পথে মৃতদেহ পড়ে। আমি এখনো সেই কথা স্মরণ করে শিহরিত হই। আমাদের সেই আড্ডায় গীতা ঘটকের গানও শুনেছি মহাশ্বেতাদির বাড়িতে।
আনন্দবাজার পত্রিকা অফিসে রমাপদ চৌধুরীর ঘরে ছিল শনিবারের আড্ডা। আমি বহুদিন সেই আড্ডায় থেকেছি। সাহিত্য, শিল্পই ছিল সেই আড্ডার বিষয়। শনিবারের শেষবেলায় শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, বুদ্ধদেব গুহ কোনো কোনদিন আসতেন। বুদ্ধদেব গুহ, সিরাজদা আর শীর্ষেন্দুদার খুনসুটি ছিল অসামান্য। আসতেন হিমানীশ গোস্বামী, প্রখ্যাত চিত্রকর সুধীর মৈত্র, লেখক রমানাথ রায়, সুব্রত সেনগুপ্ত, শেখর বসু… কে নয়? আমাদের সমসাময়িক বন্ধুরা, রাধানাথ মণ্ডল, শিবতোষ ঘোষ, তপন বন্দ্যোপাধ্যায়, কানাই কুন্ডু, দীপঙ্কর দাস, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, নবকুমার বসু, মালবী গুপ্ত…থাকতেন। রাধানাথ এখন বেঁচে নেই। লন্ডন থেকে এলে নবকুমারের সঙ্গে দেখা হয়। সে এক মহাআড্ডাবাজ। খুব বন্ধুবৎসল। রমাপদবাবুর ঘরের আড্ডায় তিনি শুনতেন বেশি, বলতেন কম। আবার তাঁর মুখেই শুনেছি সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার কলকাতার কথা। মার্কিন সোলজারদের কথা। খড়গপুরে তাঁর শৈশবের কথা। একবার রবীন্দ্রনাথকে দেখেছিলেন রেলের কামরায়। তাঁরা কবিকে দেখতে অচেনা ফুল হাতে করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। জানালা দিয়ে তাঁর হাতে সেই ফুল তুলে দিতে, তিনি চিনতে পেরেছিলেন, বললেন, মুচকুন্দ! রবীন্দ্রনাথের রূপ বর্ণনা করেছিলেন রমাপদবাবু। রমাপদ চৌধুরীর ঘরে সেই আড্ডায় এমনি কত কথা শুনেছি। তিনি তরুণ লেখকদের সাহচর্য পছন্দ করতেন। তাঁর সঙ্গও অনেক দিয়েছে আমাকে।
আড্ডায় তো পাওয়া যায়। দেওয়া নেওয়া হয়। আমি এখন বুঝতে পারছি পেয়েছি বেশি। অনেক অনেক। সমকালের লেখকরা এক সঙ্গে বসে নতুন লেখা পাঠ হতো। রাধানাথের ছিল গল্পচক্র। আমরা ছিলাম তার অংশীদার। সেখানে কত গল্প পড়েছি পাণ্ডুলিপি থেকে। শুনেছি কত গল্প। এমনি এক অনতি সন্ধ্যায় এসেছিলেন সমরেশ বসু ও তাঁর দ্বিতীয়া স্ত্রী। বহুরাত অবধি তাঁর কাছে শুনেছিলাম ‘দেখি নাই ফিরে’ রচনার প্রস্তুতি কাহিনি। তখন তিনি লেখার জন্য তৈরি হচ্ছেন। উপাদান সংগ্রহ করছেন।
জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, দীপেন্দ্রনাথ, শ্যামলদা, মহাশ্বেতা, রমাপদ চৌধুরীর পরে আমার কাছে যে আড্ডা যে সংসর্গ মূল্যবান হয়ে উঠেছিল তা ছিল প্রতিক্ষণ পত্রিকা ঘিরে। প্রতিক্ষণ আমাদের সাহিত্যে বড় একটা ছায়া ফেলে গেছে। এখানে শিল্প নির্দেশক ছিলেন পূর্ণেন্দু পত্রী। তিনি পত্রিকার অলঙ্করণে এনেছিলেন অভিনব সৌন্দর্য। কবিতার পাতায় অলঙ্করণ প্রথম প্রতিক্ষণেই দেখি। প্রতিক্ষণ সম্পাদনা করতেন স্বপ্না দেব। প্রকাশক প্রিয়ব্রত দেব। প্রতিক্ষণের মতো রুচিমান সাময়িক পত্র আমি আর দেখিনি। এই পত্রিকার পুজো সংখ্যার অলঙ্করণ করতেন বিখ্যাত চিত্রকররা। আমার উপন্যাস হাঁসপাহাড়ির ছবি এঁকেছিলেন যোগেন চৌধুরী। পাতা জুড়ে সব রঙিন ছবি। প্রতিক্ষণের আড্ডা বসত মঙ্গল আর বৃহস্পতিতে। সেই আড্ডার মধ্যমণি ছিলেন দেবেশ রায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়। আমরা বন্ধুরা, নলিনী বেরা, রামকুমার মুখোপাধ্যায়, আফসার আমেদ, অশোককুমার সেনগুপ্ত, তরুণ লেখক জয়ন্ত দে, শিল্পী যুধাজিৎ সেনগুপ্ত, কবি সিদ্ধেশ্বর সেন, তরুণ শিলাদিত্য সেন… কতজন যে আড্ডা দিতাম। মাঝে মাঝে আসতেন দিব্যেন্দু পালিত, স্বপ্নময়, বালুরঘাট থেকে কলকাতায় আসা অভিজিৎ সেন, ভগীরথ মিশ্র। সেই আমাদের নানা রঙের দিন ফুরিয়ে গেল প্রতিক্ষণ পত্রিকা বন্ধ হয়ে যেতে। প্রকাশন সংস্থাটি রয়েছে। কী অপূর্ব তাঁদের বইয়ের ডিজাইন, ছাপা। বইমেলায় প্রতিক্ষণের স্টলে একটি আড্ডা ঘর হতো। সেই আড্ডা ঘর ছিল বইমেলায় আমাদের অফুরন্ত আড্ডার জায়গা। সেখানে একদিন দেখি কবি শামসুর রাহমানকে। বাংলাদেশের লেখকদের একটা ভাল ঠিকানা ছিল প্রতিক্ষণ। একদিন বাংলাদেশের আবুবকর সিদ্দিকি, একদিন তরুণ লেখক প্রশান্ত মৃধা। কতজন যে এসেছেন। সব নাম মনে নেই।
আড্ডা ছাড়া আমি পারি না। সেই কলেজ জীবনে যে কফি হাউসে প্রবেশ করেছিলাম, আর বের হতে পারিনি। এখনো শনি মঙ্গলে যাই। থাকে তরুণ বন্ধুরা। সমকালের নলিনী বেরা, সৈকত রক্ষিত, আমাদের পরবর্তী কালের জয়ন্ত দে, প্রবুদ্ধ মিত্র, অলোক গোস্বামী, সমীরণ দাস, মৈত্রেয়ী সরকার – এক সঙ্গে আড্ডা মারি। রমানাথ রায়, শেখর বসুরাও আসেন। আসে নবীন প্রজন্ম। কবিতার টেবিল সুইনহো স্ট্রিট পত্রিকার। সকলেই কবি। আমি তাপস রায়ের ডাকে তাদের টেবিলে বসি। আমি আড্ডায় নিজেকে সমৃদ্ধ করি। সত্তর থেকে সতেরর সঙ্গে মিশতে পারি। দে’জ পাবলিশিং-এ শুভঙ্কর দে, অপুর ঘরে যেদিনই যাই আড্ডা হয়। পুলক চন্দ থাকেন। তিমিরকান্তি কাজ করতে করতে যোগ দেয় আড্ডায়। আর নলিনী বেরা ও সমীর চট্টোপাধ্যায় এলে তো জমে যায় আড্ডা।
এখন টেকনোলজি দিয়েছে নতুন আড্ডার জায়গা। ফেসবুক, হোয়াট’স অ্যাপ। সেখানে বসে বাংলাদেশের স্বকৃত নোমান, অঞ্জন আচার্য, তাপস রায়, বিধান রিবেরু, অদিতি ফাল্গুনীর সঙ্গে আড্ডা হয়, প্রশান্ত মৃধার সঙ্গে কথা হয়। কথা হয় আমেরিকা বাসী বাংলাদেশের লেখক কুলদা রায়ের সঙ্গে। দীপেন ভট্টাচার্য, অনামিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। মত বিনিময় হয় অতি তরুণ বন্ধুদের সঙ্গে। ইন্টারনেট, ফেসবুকের আড্ডায় কত বন্ধু পেয়েছি। কত রকম কথা জেনেছি। পরস্পরের এই মত বিনিময় খুব জরুরি এই জীবনের জন্য। আমি কুলদা, স্বকৃত, অদিতির লেখা ইন্টারনেটে পড়ি। খবর পাই সে দেশের। অভিজিৎ রায়ের হত্যার পর বাংলাদেশে কী হয়েছিল, সেই খবর। ওঁরাও খবর পান এই দেশের। আমি বন্ধুদের ছাড়া থাকতে পারি না। কয়েক বন্ধু চলে গেছে। মন খারাপ হয়। যাওয়ার বয়স হয়নি কারোর। আড্ডাটা ভেঙে গেল যে। কফিহাউসে আমাদের আড্ডা আছে। থাকবে। চল্লিশ বছর ধরে কফি হাউস যাওয়া। মনে পড়ে রামুদার কথা। কফিহাউসের পরিবেশক। মনে পড়ে একা টেবিলে নিমগ্ন নির্মাল্য আচার্য। মনে পড়ে অনেকের কথা। কফি হাউসে ঢুকলে মনে হয় তাঁরা আছেন ভীড়ের ভিতরে। কলরোলে যে মিশে আছে তাঁদের কথা।