দুই
রিকশা আমানতগঞ্জ রোডে উঠে গেল। জাহেদ তার বাবার পাশের সিটে বসা। সাধারণত সিটে বসতে তার কষ্ট হয়, রিকশার সিট থেকে সে শুধু পিছলে পড়ে যায়। কিংবা ওইটাই তার খেলা। খেলাটা শুরু করতেই বাবার বকা খেল সে। বাবা কড়া গলায় তাকে বললেন, ‘জাহেদ, চুপচাপ বসো।’
জাহেদের মনে হল, আজ চুপচাপ বসে থাকাই ভাল, কারণ আজ সে লাফালাফি বেশি করলে গুপ্তধন হাতে তোলার দোয়াটা ভুলে যাবে। ওই দোয়া সে মনে মনে পড়ছে, এমন সময় তাদের রিকশার গা ঘেঁষে, রিকশার চাকার সঙ্গে গা লাগিয়ে ডানে বিলের দিকে চলে গেল শুয়োরদের সেই চল্লিশ-পঞ্চাশের দলটা। জাহেদ শুনল ওরা ডাকছে ওদের আজব সেই ওখর-ওখর ডাক। শুয়োরের বড় দলগুলো দেখতে তার সবসময়েই ভাল লাগে। আরও ভাল লাগে দেখতে যে, কীভাবে ওদের সারা গায়ে মাখানো থাকে গু, কীভাবে কোনো কোনোটার পিঠে, ঘাড়ে, মুখে, পাছার দিকে গু ইত্যাদি শুকিয়ে ঠংঠো হয়ে থাকে চলটার মতো। তার বাবা বললেন, ‘জাহেদ, ওদিকে তাকায়ো না। শুয়োর দেখাও হারাম।
জাহেদ বাবাকে বলল, ‘কেন শুয়োর হারাম হল, বাবা?’
বাবা তাকে বলতে লাগলেন, ‘আসলে শুয়োরের মধ্যে আলাদা হারাম-হালালের কিছু নাই, জাহেদ। তোমার যদি হার্টের সমস্যা থাকে, তাহলে গরুর মাংস, খাসির মাংসও তোমার জন্য হারাম। হা-হা।’
শামছু শুয়োরের ওই বিরাট পালের কারণে তখন তার রিকশা থামিয়ে ফেলেছে। সে বলল, ‘এইডা কী কন, কাশেম ভাই?’
কাশেম বললেন, ‘হ্যাঁ শামছু, ঠিকই বলি। দ্যাখো শুয়ার কী করে নোংরার মধ্যে ঢুকে আনন্দে ঘোঁত ঘোঁত করে। তুমি ধরো একটা ময়লার মধ্যে পড়লা, তাহলে তুমি তো চাবা ময়লা থেকে উঠতে। কিন্তু শুয়ার একটা প্রাণী, সে কিনা ময়লার মধ্যে পড়ে থেকে খুশি। আমি বলি কী, শুয়োরের ওই স্বভাবটা হইল হারাম। নোংরার মধ্যে থেকে ওর ওই আনন্দ নেওয়াটা হারাম। মাংসের ভিতরে আবার কী আছে? যার বডিতে এইটা-এইটা বেশি, তার জন্য তো হাঁসের মাংসও হারাম, নাকি?’
শামছুর পছন্দ হল না কাশেম মিঞার কথাবার্তা, কিন্তু জাহেদের সেগুলো ভাল লাগল খুব। তার বাবা তার অনেক প্রিয়, কারণ তিনি মাঝে মাঝেই এ ধরনের অন্যরকম চিন্তা করতে পারেন। শামছু বলল, ‘জাহেদ, বাপের এইসব জ্ঞানী কথা হুইন্নো না। হিন্দুরা আর খিস্টামেরা শুয়ার খায়, তাই শুয়ার হারাম। কতা শেষ।
কাশেম শামছুর পিঠে গুঁতো দিয়ে বললেন, ‘তোমাদের সমস্যা কী? তোমরা সবকিছুতেই হিন্দু-মুসলমান করো ক্যানো-হিন্দু-মুসলমান? এইটাই তো হারাম কাজ। এই নোংরা হারাম চিন্তার মধ্যে সারাদিন মাথা ডুবায়ে আবার খুশি মনে হিন্দুদের কী সুন্দর ফুরফুর গালি দিচ্ছ! পাখিদের, সাপদের, মাছদের, ব্যাঙদের মধ্যে তো হিন্দু-মুসলমান নাই। শুধু মানুষের মধ্যে থাকল এইটা? গাছেদের মধ্যে না, নদীদের মধ্যেও না।’
নিকারী-পাত্র-মেথর-মালোদের নেতা চমন বাশফোর এসে তখন দাঁড়িয়েছেন জাহেদদের রিকশার পাশে। তিনি ডাকলেন, ‘জাহেদ নি?’ ডাকলেন, ‘কাশেম ভাইজান?’
শামছু বলল, ‘চমন, রিকশার কাছ থেইক্যা সরো। সারা গায়ে তোমার গু। উখউ।’ কথাটা বলার সময় নাক সরু করে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকল শামছু।
চমন বললেন, ‘তুই হইলি রিকশাওয়ালা। কিন্তু তোর ভাবটা হইল যে, তুই সম্রাট শাজহাহান (জাহেদ মুচকি হাসল শাহজাহানকে শাজহাহান বলতে শুনে)। বাপরে! তুই কি ব্রাহ্মণ নাকি যে, গু দেইখ্যা ওইরকম করোছ?’
জাহেদ তার বাবাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘বাবা, গু দেখলে ব্রাহ্মণেরা কীরকম করে?’
চমন বাশফোর তখন তাদের দিকে হাত নাড়িয়ে সন্ধ্যার চিন্ময় অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছেন, জাহেদকে তার বাবা উত্তর দিলেন, ‘ব্রাহ্মণ গু দেখলে পালায়। আর কী?’
জাহেদ শামছুকে বলল, ‘ব্রাহ্মণে গু দেখলে পালায়। আর কী, শামছু?’
তার বাবা এবার হাসলেন। হেসে বললেন, ‘আর তোমার ওমর চাচা ব্যবসায়ী মানুষ। তিনি গু দেখলে ভাবেন, এই গু দিয়ে সার বানায়ে ব্যবসা করা যাবে। হা-হা।’
জাহেদ বুঝল, একই জিনিসকে কী করে একেকজন একেকভাবে দেখে। একই গু দেখে একজন পালায়; আর যে-জন বুদ্ধিমান, সে আবার ওই গু দিয়ে ব্যবসাও করে। বাহ! সে জোরে হাসল, ‘বাবা, বুঝছি। তুমি বুদ্ধিমান আছ, বাবা।’
.
চমন বাশফোর বিলের দিকে যাওয়ার ছোট সরু গলির মোড়ে তখনও ঢোকেননি, তিনি জাহেদদের রিকশার উদ্দেশে এবার চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘হোনলাম, ভাড়িখানার কোলার শ্যাষের কাউনিয়ার কিনারে যে জাগরণী সংঘের বাঁশবাগান, সেইখানে মন্টু খাঁ-র পোলা মুরাদের লাশ মেলছে।’
কাশেম মিঞা কথাটা শুনে এত ভয় পেলেন যে, তিনি রিকশা থেকে রাস্তায় পড়ে গেলেন। শামছু বলল, ‘ইন্নালিল্লাহ, ইন্নালিল্লাহ। কখন শোনলা চমন?’
জাহেদের সারা গায়ে তৎক্ষণাৎ কাঁটা দিয়ে উঠল কিটকিটকিট।
চমন বাশফোরের সময় নেই অত কথা বলবার। তিনি শেষদিকের কিছু শুয়োরের পিঠের ওপর দিয়ে ভেসে ভেসে মিলিয়ে গেলেন সন্ধ্যার অন্ধকারে, এই কথা বলতে বলতে যে, ‘পেরসিডেন জিয়াউর রহমানেও মরল আর ভাটিখানার মুরাদেও মরল, একোই রাতে।’
যেহেতু তিনি তখন শূন্যে ভাসছেন, জাহেদ দেখল ভেসে ভেসেই তিনি আবার কিছুটা ফিরে এসেছেন আমানতগঞ্জের রোডের দিকে, আর এবার বলছেন, ‘দুজনেই হিন্দু দ্যাখতে পারত না, শামছু। মুরাদ আমারে দেখলেই ছড়া কাটত—‘মালাউন গু-মুতালুন’, ‘মালাউন গু-মুতালুন’। তুমি কিন্তু সাবধান হইয়া যাও শামছু, কইলাম।’
মুরাদের মৃত্যুসংবাদ শোনামাত্র জাহেদ বুঝে গেল, আজ তার গুপ্তধনের কাছে যাবার পথে হাজার বাধা আসবার ব্যাপারটা তাহলে, হুজুরের কথামতো, শুরু হয়ে গেছে। সে দোয়াটা পড়তে লাগল মনে মনে, কিন্তু দেখল যে, মুরাদের দুঃখে এ মুহূর্তে কোনো দোয়াই মাথায় আসছে না তার। ‘থাক, এখন মনে না আসলেও হবে’, ভাবল সে, কারণ হুজুর বলেছেন এই দোয়া পড়তে হয় তারার পানিতে হাত দেবার ঠিক আগের মিনিটে। ‘পানির তহন দরজা খুইল্যা যায়,’ বলেছেন তিনি।
সেই হুজুরকে এত অবিশ্বাস কেন তার বাবার? অকারণে লোকটাকে এই বাসা থেকে বিদায় করে দেওয়া হয়েছে। তিনি এ মাসের পনেরো তারিখ থেকে তাদেরকে আরবি শেখাতে আসা বন্ধ করে দিয়েছেন। তারপরই দ্যাখো ভাটিখানায় মারা গেল একটা বাচ্চা, তার লাশ পাওয়া গেল জাহেদদের-আনোয়ারাদের ও পেছনের হিন্দু পাড়ার কমন পুস্কুনিতে (‘কমন’ শব্দটা নতুন শিখেছে জাহেদ, যেমন, ‘কমন কথাবার্তা’, ‘কমন চিন্তাচেতনা’), তারপর মারা গেল বাচ্চা এক চোর, তারপর কাল মুরাদ। সত্যি মুরাদ? মানে জাহেদের জন্য যে ছিল মুরাদ ভাই, আবার ঘৃণা থেকে ছিল শুধুই মুরাদ, সেই মুরাদ মারা গেছে?—বোঝো এইবার, ভাবল জাহেদ! আমার হুজুরের সাথে তোমরা এই অন্যায় করবা, তাহলে এসব তো হবেই। কেয়ামত নামবে, কেয়ামত।
এই পনেরো দিনের মধ্যে জাহেদের সঙ্গে হুজুরের দেখা হয়েছে দুবার- দুবারই নাজিরের পুলের গোড়ায়। তিনি জাহেদের রিকশা স্কুলে যাবার সময় তাকে এক নজর দেখবেন বলে দুবারই নিজের থেকে সময়ের একটা আন্দাজ করে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন ওখানে। শেষবার, এই মাত্র চার-পাঁচ দিন আগে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে তিনি জাহেদকে বলেছিলেন, ‘তোমার বাবা একটা অন্যায় করল জাহেদ। তোমার মা করছিল তার মায়ের লগে, আর তোমার বাবা করল আমার লগে। গুপ্তধনের কথা আমি তোমারে বলি নাই। ওইটা লিখাই আছে কিতাবে। আর তুমিও তো বাসার কাউরে কিছুটি বলো নাই। তাইলে হ্যারা আন্দাজ করল কেমনে যে, আমি তোমার মাথা বিগড়াইছি?—সবই অন্যায়।’
জাহেদের কানে কানে তিনি তার কথাটা বলে শেষও করতে পারেননি, রিকশায় বসা তার বন্ধু রিয়াজ-মিরাজ দুই ভাই খেঁকিয়ে উঠল, ‘ও বিসমিল্লাহ- আউজুবিল্লাহ মালেক হুজুর, কী বিড়বিড়াস জাহেদের কানে?’
আর রিকশাওয়ালা শামছু রিকশার ড্রাইভিং সিট থেকে নেমে তার গলার গামছা হাতে নিয়ে হঠাৎ তা দিয়ে মালেক হুজুরের গলা পেছনদিক থেকে চেপে ধরে বলল, ‘হুজুর, তোমারে চাকরি থিকা কাশেম ভাই বিদায় করছে তো করছে। এহন তার পোলার হোগার পিছ-পিছ থাকন চলবে না। দুইদিন দেখলাম। আর জানি না দেহি।’
শামছুর কথা শুনে হুজুর বললেন, ‘নাউজুবিল্লাহ।’ জাহেদ চিৎকার করে উঠে শামছুকে বলল, ‘খচ্চর শামছু—ছুছুছুছু।’
সঙ্গে সঙ্গে দলত্যাগ করে শামছুর বিরুদ্ধে ছড়া কাটা শুরু করে দিল রিয়াজ- মিরাজ। মালেক হুজুর ততক্ষণে সরে যাচ্ছেন রিকশার কাছ থেকে। তিনি কোনোমতে ম্যানেজ করেছেন তার শরীরটা জাহেদের কানের মধ্যে এলিয়ে দেবার কাজে, আর ফিসফিস করে তাকে বলেছেন, ‘রিকশার সিডের গর্তে আমি ঈমানের চিঠি রাখছি একখান।’ এরপর পাশের দোকানের বাটার-বনের এক বয়ামের গায়ে হাত রেখে ভেজা চোখে তিনি তাকিয়ে থেকেছেন জাহেদের দিকে। ততক্ষণে রিকশা চলতে শুরু করেছে, আর ছেলে তিনটা হাত একবার ওপরে তুলে আবার নিচে নামিয়ে বারবার বলে যাচ্ছে একই কথা: ‘খচ্চর শামছু—ছুছুছুছু।’ ‘খচ্চর শামছু’-টা বলবার সময়ে তাদের বুক মাথাসহ উঁচুতে উঠছে মোট চারবার, ধাপে ধাপে; আর ‘ছুছুছুছু’ বলতে গিয়ে সেটা আবার মাথাসহই নিচুতে নামছে চার দফা। বরগুনার মিজান ছড়া কাটার বা কাউকে ভেঙানির এই স্টাইলটার নাম দিয়েছে ‘লুক-লুক স্টাইল’, কারণ যে বা যারা এভাবে ছড়া কাটে, তাদের চোখের বল নাকি তখন কেমন ছিটকে বেরিয়ে আসতে চায় আনন্দ-বিস্ময়-ঘৃণায়।
সেদিন এরকম তারা বলেই চলেছে, লুক-লুক স্টাইলে ছড়া গেয়েই চলেছে, এবার রিকশা যখন নাজিরের পুল বেয়ে হড়হড় নেমে যাচ্ছে হাসপাতাল রোড বরাবর, তখন জাহেদের মনে হল তার হুজুরের প্রতি সত্যি অন্যায় করা হয়েছে—এমন যে, জাহেদের চলনবলন দেখে সেটার ফালতু বিচার করে তার নির্দোষ হুজুরকে ফেলে দেওয়া হয়েছে সেই বিচারের মুখে। আর একটু আগে শামছু হুজুরকে যা বলল তাতে তার কাছে এটা নিশ্চিত, শামছু একটা জানোয়ার, খুব শিগগিরই শামছুর ওইটা কাটা যাবে হাসপাতালে। সেই সাত-আট মাস আগে চাখারে থাকতে তাকে কথাটা বলেছিল ওখানকার খারাপ ছেলেরা-তুফান, ফৌজি, কোড়ল। তারা বলেছিল, বউ বাদ দিয়ে শহরের লোকেরা যখন অন্য মেয়ের সঙ্গে ‘চেক্স’ করে, তখন তাদের ‘ওই জিনিসটা মাইয়াদের ভিতর থিকা আর বাইরায় না, ভেতরেই আটকাইয়া রইয়া যায়, লক হইয়া যায়। আর তহন ওই লোকেরে হাসপাতাল নেওন লাগে সেই লক খোলনের কামে। হুম, হাসপাতালে ওই জিনিস কাইট্যা লক খোলন লাগে পাপ কাম করলে।’
জাহেদ ভাবল, শামছুকে হাসপাতালে যেতেই হবে, শিগগির। সে রাগের চোটে কোনোমতে শামছুর সিটের পেছনটা ধরে সামলে রাখল নিজের শরীর।
রিকশায় বসা শরীর এভাবে সামলাতে গিয়ে সে বুঝতে পারে না কেন কোনোদিন নাজিরের পুল থেকে রিকশা নেমে যাবার সময়ে তার মতো করে ভয় পায় না রিয়াজ-মিরাজ। ওরা কী দিয়ে বানানো?—জাহেদ রাগে শামছুর পিঠে খোঁচা দিল একটা। শামছু মাথা ঘুরিয়ে জাহেদের দিকে তাকিয়ে হাসল। বলল, ‘কী আণ্ডা পোলা, বাপের লগে নদীতে যাইতেয়াছ? দেখবায়ানে তোমারে কেমনে পানির বিল্লিতে ধরে।’
রিকশা আমানতগঞ্জের রোডে উঠে ‘মায়ের দোয়া’ পর্যন্ত চলে এসেছে। জাহেদ বাবার হাত ধরে সিটের ওপর বসে তাকিয়ে দেখছে চারপাশ। কী ঘন অন্ধকার! স্রেফ রাস্তার পাশের দোকানগুলোতেই আলো ফুটে আছে কিছু, তাছাড়া বাকিটা কী গাঢ় অন্ধকার! তার বাবা শামছুকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘শামছু, ওই শামছু, সব এমন চুপচাপ কেন? এমন তো আগে দেখি নাই।’
হঠাৎ রিকশার সামনের রাস্তা আলো করে ভুরুম-ভুরুম শব্দ তুলে তাদের পাশে হাজির হল শাহেদের মটরসাইকেল। জাহেদ বড় ভাইকে দেখে চিৎকার দিয়ে উঠল, ‘শাহেদ ভা-ই-য়া। বাবা, লুক, লুক, শাহেদ ভাইয়া।’ শাহেদের মটরসাইকেলে বসা ব্লেডের চেন হাতে নিয়ে ঘোরা গুণ্ডা বন্ধুর দলের নিউটন ও আলমাজী। রাঙ্গা নেই। জাহেদ দেখল তার শাহেদ ভাইয়ার সবচেয়ে খারাপ লোক বন্ধু রাঙ্গা আজ সঙ্গে নেই তাদের। শাহেদ তার বাবাকে বলল, ‘বাবা, আমাদের মুরাদের ডেডবডি পাওয়া গেছে। মন্টু খাঁ চাচার ছেলে মুরাদ। আজকে আড়িয়াল খাঁ যাওয়া যাবে না।’
কাশেম মিঞা রিকশার সিটে বসে ছেলের উদ্দেশে খেঁকিয়ে উঠলেন, ‘তুই এই কথা বলতে এতদূর আসছিস, শাহেদ? যা বাড়ি যা। নিউটন, বাড়ি যাও।’
আলমাজী দেখল যে, তার নাম ধরে কেউ কিছু বলল না। তাই সে নিজেই জোরে বলে উঠল, ‘আসসালাম আলাইকুম চাচা, দিনকাল খারাপ। পেরসিডেন্ট মরছে, মুরাদও মরছে। বাড়ি ফেরত যান চাচা, নদীতে যাইয়েন না।’
জাহেদ বুঝল, গুপ্তধন আনতে যাওয়ার পথের বাধাগুলোর দল বেঁধে ঘটা শুরু হয়ে গেছে ভালমতোই। সে প্রতিবাদ করে বলল, ‘শাহেদ ভাইয়া তোমরা বাড়ি যাও। আজকে মটরসাইকেল নিয়া বের হওয়ার দিন না। আহ্-হারে।’
তাদের বাবা বললেন, ‘ওয়ালাইকুম সালাম, আলমাজী। তোমার উপদেশ চাইছি আমি? চাইছি?’
শাহেদের মুখের ভাবভঙ্গি কিছুই বোঝা যাচ্ছে না অন্ধকারে। সে গলা চড়িয়ে শামছুকে বলল, ‘শামছু রিকশা ঘোরাও। বাবা আর জাহেদ তালতলী যাবে না।’
শামছু খেঁকশিয়ালের মতো ক্যাঁ করে উঠল, ‘শাহেদ, বেশি বড় মাইনষের ভাব দেখাইও না তুমি হেদিনও আমার রিকশায় ঘোরা বান্দর পোলা।’
শাহেদ বলল, ‘শামছু, মুখ সামলাইয়া কথা বলো।’
এ কথা শুনে শামছু ঝট করে নামল তার রিকশার চালকের সিট থেকে, দাঁড়াল হ্যান্ডেলের গায়ে হেলান দিয়ে আর ষাঁড় জবাইয়ের সময় ষাঁড় যেমনভাবে চিল্লায়, তেমন তার গলার ভেতরের-ভেতরের-ভেতরের এক গলায় চিল্লিয়ে সে বলল, ‘তোমার সাথে মুখ সামলানির কী আছে, শাহেদ? চোর জনি না মুকুলের মা নিজের পোলার লাশ নিতে আইস্যা তোমারে অভিশাপ দিছে, আমারে দেয় নাই। তোমারে বলছে, ‘ভাটিখানার শাহেদ যে-পোলা, সে মরবে জেলে পইচ্যা—সে মরবে হয় জেলে পইচ্যা, না হয় জন্ডিসে শরীর পইচ্যা।’ বলে নাই? আর তুমি আইছ আমারে মুখ সামলানি মারাইতে? আমার বিল্লি আমারে কয় মেঁয়াও!’-রিকশাওয়ালা হিসেবে অনেক বড় এক জ্ঞানী কথা (শোনা কথা; কিন্তু কোত্থেকে সে তা শুনেছে, সেটা তার মনে নেই) বলে দিয়ে নিজেই খুশি হল শামছু
আর জাহেদ হেসে উঠল শামছুর এই শেষ বাক্য শুনে। বাহ্, কী সুন্দর কথা, ভাবল সে, যেমন ছিল ঈমানের কথাটা যে, ‘ওরে পঙ্খীরে পঙ্খী, তোর কত যে নিশানা।’ হুহু করে ঈমানের কথা মনে পড়ে গেল তার। ঈমান এখন আছে বরিশালের জেলে, আর সেখান থেকেই সেদিন সে তাকে চিঠি লিখে মালেক হুজুরের মাধ্যমে পাঠিয়েছিল খাম বন্ধ করে। রিকশা সেদিন জিলা স্কুলে পৌঁছালে চিঠির খামটা রিকশার সিটের নিচ থেকে ঝাঁ করে তুলে নিয়ে জাহেদ দৌড়ে সোজা চলে গিয়েছিল স্কুলের পুকুরঘাটে, যেখানে, তার এনায়েত স্যারের কঠিন ভাষায়: ‘যেথায় তরুগণ নিয়তপুষ্পিত, নিত্য পদ্মের বিকাশ নলিনীতে।’ মানে কী এর? নলিনী?
জাহেদ খাম খুলেছিল কাঁপা কাঁপা হাতে আর দেখেছিল সেখানে সাদা এক পৃষ্ঠা জুড়ে ক্লাস ওয়ান-টুর বাচ্চাদের মতো হাতের লেখায় বড় বড় করে লেখা: ‘চিরকালের বন্ধু, জেলখানা বালো লাগে না। কিন্তুম বাংগরা দাস মারা গেছে, সেইটা বালো লাগে। এই পিথিবিতে শুধু অন্নায়, অবিচার বন্দু। জেল থেকে বাইরাইলে বাংগরার ছোট ছেলেরে ধর্শন করমু। তুমি দুয়া রাখিবা। অনু টেইলারের ছোট মেয়েরে মাফ করে দিছি, বন্দু। আর যদি চাও যে আমি এইসব খুমখারাপ আর না করি, তা হইলে আমারে জেল হইতে ছাড়াইয়া নিয়া তেগুচি নিয়া চলো। ইতি তোমার সারাজেবনের জুতার পালিশ—ঈমান। সদর রোড পচা জেল, জিলা বরিশাল, মহাদেশ বাংলাদেশ এশিয়া। বড় দেশ পিরথিবি সৌর্যমণ্ডল।’
কাশেম মিঞা শামছুকে বললেন, ‘শামছু, আমার ছেলের নামে ওই মহিলার অভিশাপ উচ্চারণ করার তোমার কোনো কাম নাই। তুমি থামো।’
তারপর শাহেদকে লক্ষ্য করে তিনি বললেন, ‘বাড়ি যাও, শাহেদ। তোমার মা-কে দেখে রাখো। আমরা রাত এগারোটার মধ্যে ফেরত আসব। নিউটন-আলমাজী, বাড়ি যাও।’
এবার শাহেদ তার গলার ওপরের গলায় ‘শামছুর বাচ্চা, শামছুর বাচ্চা’ বলতে বলতে আর নিউটন-আলমাজী ব্লেডের চেন সাং-সাং বাতাসে ঘুরিয়ে ‘আচ্ছালামু-লাইকুম চাচাজান, আচ্ছা-লামু-লাইকুম চাচাজান’ বলে হেসে কুটিকুটি হতে হতে ভুরুম-ভুরুম-ভুরুম মটরসাইকেল ঝড়াক উল্টো ঘুরিয়ে নিউ ভাটিখানা রোডের দিকে তড়াক তিনজনই হাওয়া।
.
আবার রিকশা চলছে। শামছু জোরে জোরে গাইল ‘ইয়ে দোস্তি’ নামের হিন্দি গানের দুঃখের ভার্শনটা। শাহেদের বাবা শামছুকে বললেন, ‘আমার কথার উত্তর না দিয়ে গান গাইছ, শামছু?’
শামছু বলল, ‘কী কথা কাশেম ভাই?’
‘সব এমন চুপচাপ কেন?’
শামছু তার গান না থামিয়েই গানের মধ্যে মধ্যে বলার মতো করে শুধু মাথা সামান্য এদিকে ঘুরিয়ে বলল, ‘পেরসিডেন্ট কালকে মরছে। আমাগো এটি হিন্দু এলাকা। হিন্দুগুলান আছে আনন্দ-ফুর্তিতে, কারণ হ্যাদের কথা হইল—এই লোকে মারছিল তাগো শেখ মজিবরে। এহন উচিত শিক্ষা হইল, স্যায়ও মারা গেল গুলিতে। আবার স্যায়ও মারা গেল রাইত গিয়া ভোরের দিকে নামনেরই কালে। হ্যারা কয়, ভগবান বিষ্ণুর শাস্তি এইটা। বিষ্ণু মেয়ায় নাকি ব্রহ্মা আর শিবের লগেত মিইল্যা দুনিয়ার সব কাণ্ডকারখানা ঠিকঠাক রাহে। হেইজন্যই নাকি যে-জিয়ায় মারছে মজিবরে, হেই জিয়ার সৈন্যেরা মারল জিয়ারে। বিষ্ণুর বিল্লি ব্রহ্মারে কইল মেঁয়াও। হা-হা।’
জাহেদের বাবার এই প্রথম মনে হল জিয়াউর রহমান মারা যাবার পরের রাতেই তার কি ঠিক হচ্ছে এরকম বাইরে যাওয়া, দূরে যাওয়া? পরের রাতও তো হয়নি আসলে। তিনি মারা গেছেন মাত্র গত রাতে। এখনও চব্বিশ ঘণ্টা হয় নাই, চব্বিশ ঘণ্টা হতে এখনও পাঁচ-সাত-আট ঘণ্টা বাকি। আর্মির লোক মারা গেছে, আমিও তো থাকতে পারে পথে, ভাবলেন কাশেম। জেলখানায় থাকার অভিজ্ঞতা থেকেই তার আর্মিকে খুব ভয়।
জেলখানায় এক সেকেন্ড লেফটেন্যান্টের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল তার। বাচ্চা ছেলে, কিন্তু সে তার নিজের বাবাকে মেরেছে। সেই ছেলে কাশেমের সাবান ধার নিতে নিতে একদিন কাশেমকে বলেছিল, ‘কাশেম চাচা, আমার বাপেরে মারছি না যে, নরমাল কিন্তু মারি নাই। এমনে হাতের মধ্যে নিয়া এমনে হাতের মধ্যে টাইন্যা তারে ছিঁইড়্যা ফেলছি খালি।’ কথাটা বলবার সময়ে সেই আর্মির ছেলে তার খরখরে তেল-ক্রিমবিহীন হাত দুটো কীভাবে যেন ঘুরিয়েছিল সামনে-পেছনে- নিচে ওপরে-সে যে এক কীভাবে, তা চিন্তা করে আজও ধরে উঠতে পারেননি কাশেম। তিনি শুধু বুঝেছেন যে, সে এক এমনভাবে যাতে করে ছিঁড়ে টুকরো হয়ে পড়ে যে কোনো কিছু—চটের বস্তা, টিনের বান্ডিল, মানুষের মাথা কিংবা জিভ থেকে নিয়ে নাক পার হয়ে কপাল পার হয়ে পুরো মুণ্ডুটাও।
জাহেদ দোয়াটা আরেকবার পড়ল মনে মনে। তাদের রাস্তার ডানধারের সব দোকানপাট বন্ধ। এ দোকানগুলোর পেছনেই আমানতগঞ্জের বিল। জাহেদ জানে, সামনে রাস্তা সরু হয়ে আসবে ‘সানফ্লাওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস’-এর ছোট মোড়টায়, তারপর ওই মোড় ধরে তারা কাল কি পরশু দুপুরে ছুটে যাবে সোজা ডানে ভেতরদিকে বিলে, যেটা ভরা শুধু পিছলা বাইল্লা মাছ, কুঁচে ও ঢোঁড়া সাপের দলে। ওই ঢোঁড়া সাপেরা বউ-বাচ্চা নিয়ে জোট বেঁধে সেখানে রোদ পোহাতে আসে দুপুর তিনটার দিকে, তারপর চরম অশ্রদ্ধাভরে দু-চারটে বাইল্লা মাছ পেটে ঢুকিয়ে আবার চলে যায় কীত্তনখোলার দিকে যাওয়ার পথের কাকডুমুর ও কাউয়াগাছের ঝোপটায়, যেখানে, জাহেদ-রিয়াজ-মিরাজ এরা জানে, ওই সাপেদের বংশ-পরম্পরার ঘরবসতি। জাহেদ পরিষ্কার দেখল এ সময় সানফ্লাওয়ার দোকানটা থেকে দুই লোক কেমন বাতাসে পিছলে পিছলে পা দিয়ে বাতাস ঠেলে উড়ে এসে পড়ল তাদের রিকশার গায়ে। সে ভয়ে বলে উঠল, ‘বাবা।’
তার বাবা তার হাত ধরলেন আর লোক দুটোকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমরা? ও মা, মোকারম আর মরজানি না?’
মোকারম ও মরজানি নামের লোক দুটো বললেন, ‘কাশেম? জেলখানার ঘাঁতঘোঁত ওয়ার্ডের কাশেম? এইটা তোমার ছেলে জাহেদ? বাহ বেশি টুকটুকা। তুমি তো এই ছেলের গল্প বেশি একটা জেলখানায় করো নাই কুনোদিন!’
শামছু রিকশা থামিয়েছে। কাশেম বললেন, ‘করেছিলাম, তোমরা ভুলে গেছ। এর গল্প করছি, এর বড়টা শাহেদ, তার গল্পও করছি। তা তোমাদের না যাবজ্জীবন হইছিল? খুশি হলাম তোমাদের দেখে। কতদিন পর! ভাল আছ তো?’
জাহেদ দেখতে পেল, মোকারম নামের লোকটা রিকশার সামনের চাকার গায়ে কেমন করে তার হাত চক্রাকারে বুলাচ্ছে। ছি! চাকার ময়লা সব তাতে তার হাতে লেগে যাচ্ছে না? আর মরজানি কোনো মানুষের নাম হল? সেই মরজানি ঘুরে এখন জাহেদের পাশে এসেছেন। জাহেদ বুঝল মরজানি তার তাবিজটা কেড়ে নিতে চান। তাকে মালেক হুজুর এটা বলেই রেখেছেন, ‘আড়িয়াল খাঁ-র যত কাছে যাবা, তত বিপদ খালি বিরিদ্ধিই পাইবে। পথ আগাইবে আর বিপদ বাড়তে থাকবে। কেউ কইবে রাস্তা বন্ধ, কেউ কইবে তাবিজ দে, কেউ কইবে পানির বুতোলডা দেহি পানি খামু। এইরকম।’
জাহেদের মনে হল, তার এসব বিপদ আজ কেটে যাবে, কারণ প্রথম কথা—তার এখনও মরার বয়স হয়নি, আর যা-ই হোক সে এই বয়সে মরবে না। অন্য লোক মরলে মরবে, যেমন মুরাদ মরেছে, কিন্তু সে মরতেই পারে না। তার জন্য মরা-টরার ব্যাপার পরে দেখা যাবে ধরনের একটা ব্যাপার। আর দ্বিতীয় কথা—যত যা-ই হোক, অতি বড় বিপদ অন্য বাসার জিনিস, তাদের বাসার না। তাদের বাসায় আসবে খালি ছোট-ছোট বিপদ, যেমন গুধুর খোঁয়াড়ের গায়ে এসে ভেতরে হাঁসটার দিকে জিভ বের করে উঁকি পর্যন্ত দেবে খছাক গুইসাপ, কিন্তু গুধুর কিছু হবে না; যেমন তার সামনে সার্কাসের মঞ্চে মানুষ মারবে ঈমান, কিন্তু সে ওটার মধ্যে জড়াতে গিয়েও জড়াবে না। হুম, এগুলো কোনো ব্যাপার না, কোনো ব্যাপার না, ভাবল সে। কাইল্লা কবির বলে, ‘তোমরা বড়লোকেরা এই অ্যামুন-সিন্দেলচোরেরা তোমাদের দোকান ভাঙবে ঠিকই, দুশকিরতিকারীরা তোমাদের টমেটোর খেতে আগুনও ধরো লাগাইবে ঠিকই, কিন্তু কুনোদিন এমন হইবে না যে, তোমাদের বাকোল যাবে। গরিবের গেলে বাকোলও যায়, বাকলার কাপড়ও যায়।’
জাহেদের অবাক লাগে কাইল্লা কবিরের এসব কথাবার্তা শুনে। মিরাজ সবসময় বলে, ‘আমাগোর দারশোনিক ফেরেন্ড কই?’ জাহেদ বোঝে ‘দারশোনিক’ কাকে বলে—তার জিলা স্কুলের বন্ধুরা, বড় ক্লাসের ছেলেরা, এমনকী স্বয়ং প্রধান শিক্ষকও তাকে ‘দার্শনিক’ বলেই আদর করে ডাকেন, ক্ষেপান, খোঁচা দেন। কিন্তু সে ওই ‘দারশোনিক’ শব্দটার চাইতেও বেশি ভাল করে বোঝে, কবিরদের বস্তির ভাষায় ‘বাকলা’ মানে মেয়েদের স্তন। বিশ্রী শব্দ ওই বাকলা। কিন্তু সে ভাবে, ‘তা-ও তো ছামার চাইতে ভাল। উল্ফ, ছামার চাইতে ভাল।’
কাশেম শামছুকে তাড়া দিলেন, ‘শামছু জলদি যাও। মোকারম, মরজানি, তোমাদের সাথে দেখা হবে পরে। আমরা একটা কাজে যাচ্ছি।’
ওরা দুজন তখন একসঙ্গে, একদম একজন আরেকজনের ছায়া মতো হয়ে বলে উঠলেন, ‘কী কাজ কাশেম? এই এত রাইতে যাও বেলতলার দিকে। কী কাজ? রাতে দেখছনি কেমুন অন্ধকার? জিয়াউর রহমানরে হ্যারা বলে বুলেট দিয়া ঝাঁজরা কইরা দেছে। আবার হ্যারাই বলল, জিয়াউর রহমানে মরে নাই, স্যায় পালাইয়া আসছে তার নিজের হাতে কাইট্টা যাওয়া খালের নামায়।’
কাশেম শঙ্কিত হয়ে উঠলেন। তিনি জানতে চাইলেন, ‘কোন খাল? কোন খাল?’
মোকারম তখন রিকশার সামনের চাকার বাঁ দিকের স্পোকের মধ্যে, আর মরজানি সেই একই চাকার ডান দিকের স্পোকের মধ্যে পা ঢুকিয়ে তাদের শরীর দুটো প্রজাপতির শরীরের দুই পাশের ধরনে সিমেট্রি মেনে একদিকে হাওয়ায় একজনের ডান হাত এবং উল্টো দিকে অন্যজনের বাঁ হাত উড়িয়ে-ভাসিয়ে দিয়ে এবার শামসুর শরীরের দুই কিনার থেকে উঁকি মেরে দুজনে কাশেম মিঞাকে ফের একযোগে বললেন, ‘লাখুটিয়া।’
কাশেম বলে উঠলেন, ‘আমরা তো ওইদিকেই যাই।’
জাহেদ আতঙ্কিত হয়ে পড়ল, কারণ তালতলী ঘাট থেকে লাখুটিয়ার খাল বাম দিকে, আর আড়িয়াল খাঁ ডানে। সর্বনাশ। সে তাড়াতাড়ি তার বাবাকে সংশোধন করে দিল, বলল, ‘না, না। আমরা লাখুটিয়া খাল যাই না। আমরা যাই আড়িয়াল খাঁ নদী।’
ওরা দুজন রিকশার চাকা থেকে নেমে দাঁড়িয়ে এবার একসঙ্গে হাত রাখলেন জাহেদের কাঁধে। তার বাবা তাকে বললেন, ‘আড়িয়াল খাঁ নদী না। নদ, বাবা।’
মোকারম ও মরজানি একসঙ্গে তার বাবাকে বলে উঠলেন, ‘নদীও যা, নদও তা। কাশেম ফালতু জিনিসের ভাবনায় বিভোর আছ, ওদিকে তোমার বড় ছেলে মারল চোর জনি না মুকুলরে। তোমার বড় ছেলে শাহেদ, মন্টু খাঁর বাড়ির চৌকিদার মিল্টন মোল্লা আর মন্টু খাঁ-র ছেলে মুরাদ—বলতে গেলে এরা তিনজনই মারল জনি না মুকুলরে। শোনো, সেই মুরাদরে কাল মারল আমাদের বস ছেঁচকি ওস্তাদ, তোমরা যারে কও রাজা ভক্তি মিশ্র, কও ভোরাটটি গান্ডু।’
জাহেদের মনে হল, কীভাবে এ দুজনের পক্ষে সম্ভব প্রতিটা বাক্য, প্রতিটা বাক্যের প্রতিটা শব্দ, প্রতিটা থামা, প্রতিটা না-থামা, সব, সব একসাথে করে বলা, তা-ও যখন বাক্যগুলো কিনা এত লম্বা-লম্বা? একইসঙ্গে তার মনে পড়ল, তিন দিন আগে কী করে চোর জনি না মুকুলের দিকে হাতুড়ি নিয়ে ছুটে আসছিল মন্টু খাঁ-দের চৌকিদার মিল্টন মোল্লা, আর তখন কেমন আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে মুরাদ ভিড়ের সবাইকে উৎসাহ দিচ্ছিল চোরটার ঘাড়-মাথা-হাঁটু সব ভেঙে দিতে এবং তার নিজের বড় ভাই শাহেদ কেমন করে ভেঙে-কেটে দিচ্ছিল চোরটার পা। আর…আর…তার মনে পড়ল চোরটা বৃষ্টির মধ্যে মারা যেতে যেতে এক পরমার্থিক শক্তি তার গলায় ভরে কীভাবে ডেকে যাচ্ছিল তার বস রাজা ভক্তি মিশ্রকে।
তাহলে মুরাদকে সেজন্যই খুন করল ভক্তি মিশ্রের লোকেরা? ‘কী ভয়েমকর, ভাবল জাহেদ। একইসঙ্গে ভাবল, কী ভয়ংকর ব্যাপার এটা যে, মরজানি নামের লোকটা তার তাবিজ কেড়ে নিতে চান! সে শক্ত করে চেপে ধরল তার বাবার হাত। বাবা তাকে বললেন, ‘এইটা তোর একটা চাচা। ভয় পাস কেন?’
ততক্ষণে কাশেমও আসলে চিন্তিত হয়ে উঠেছেন শাহেদকে নিয়ে। তিনি এর আগে বুঝতে পারেননি যে, মোটামুটি হাসিখুশি কিন্তু নামে বদনামে ওই একরকম ক্যারেকটার যে-ছেঁচকি, যে-ভোরাটটি গান্ডু, যে-ভক্তি মিশ্র, সে বাস্তবে এতটা ডেঞ্জারাস এক খুনী। এখন তিনি সেটা বুঝতে পারছেন। তার কারণ মূলত এই যে, বোঝা যাচ্ছে মোকারম ও মরজানি ভক্তি মিশ্রের ওখানে কাজ করে। এদের দুজনের একজনও লোক ভাল না। জেলের ঘাঁতঘোঁত ওয়ার্ডে এদের যৌথ পরিচয় ছিল এসিড মোকামর নামে—মোকারমের মোকা ও মরজানির মর একসঙ্গে করে।
মরজানি জাহেদের কানের মধ্যে তার সরু গুইসাপের জিভটা ঢুকিয়ে দিয়ে বললেন, ‘নদী আর নদ—ওই একই কথা খোকা, একই পানি। সামান্য ডান-বাঁও, এই যা।’
শামছু ‘ডান-বাঁও’ কথাটা শুনে ভয় পেয়ে গেল। ‘ডান-বাঁও’ খুব খারাপ শব্দ, খুব। শামছু যা বিশ্বাস করে তা করে। সে রিকশায় লাফিয়ে উঠে এবার সামনের চাকা দিয়ে ধাক্কা দিল মোকারমকে, তারপর নিজেই নিজের নাম ধরে চেঁচিয়ে উঠল, ‘খচ্চর শামছু ছুছুছু—সইরা যাও হক্কলে।’ কিন্তু রিকশা ছুটবে কী করে? মোকারম ও মরজানি যে তখন দৌড়ে চলেছেন রিকশার দুই পাশে। তারা দুজনেই দৌড়াচ্ছেন ও নাচছেন সেই চঞ্চু মঞ্চ নাচ, যা অন্য নামে চুতিয়া নৃত্য, আর কবিরের ভাষায় ‘বরগুনার মিজানের আবিকিরিতো শাউয়া পাকড়ানি নাচ।’
জাহেদ বুঝে গেছে এর সবটা এ দুই লোকের নাটক, আর এই এত এত নাটকের শেষে তাদের একটাই লক্ষ্য–জাহেদের কাছ থেকে গুপ্তধনের তাবিজটা কেড়ে নেওয়া। জাহেদ তার হাত হাফপ্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে ফেলল। ওরা দুজন এবার দুদিক থেকে তাদের চিরকালের এক গলার এক আওয়াজে বলে উঠলেন এক কথা: ‘কাশেম, শাহেদ জানি ভাটিখানা ছাইড়া যায় কিছুদিনের লাইগ্যা। তুমি আমাগো ঘাঁতঘোঁত ওয়ার্ডের বন্ধু। তাই এইটা জানাইয়া উপকার করলাম। আর তোমার জাহেদে বেশি টুকটুকা, বেশি টুকটুকা।
.
এরপর তারা রাস্তা থেকে হাওয়া। কিন্তু তারপরও রিকশা ছুটতে পারছে না, কারণ রাস্তা সরু। আর ব্যাপার একদম স্পষ্ট যে, আজ রাতে সে আরও সরু হয়ে এসেছে, যেহেতু তার দুপাশ এখন দু দিক থেকে যার যার মতো করে এঁকেবেঁকে চেপে এসেছে কেমন ভেতরের দিকে। জাহেদের মনে হল, তারা কোনো বড় মাঠ থেকে কোনো একটা গর্তের মধ্যে ঢুকছে যেন-ভাটিখানা কাচ ফ্যাক্টরির পাশে যে-পাইপগুলো পড়ে থাকে, অনেকটা সেগুলোর মাঝখানে। শুধু তফাৎ এই যে, তারা বন্ধুরা ওই পাইপের মধ্যে সিগারেট খেতে ঢোকে উবু হয়ে শরীর ভাঁজ করে, আর এখন তারা সেই একই পাইপের মধ্যে ঢুকে পড়ছে একদম কিনা রিকশা-টিকশা, জুতো-মোজা, মাথা, ঘণ্টি সবসহ।
জাহেদ শুনল হাতের ডানে যে বড় ক্যারিলিন সিলক্ মিলস লিমিটেডের লোগো লাগানো মশারির কাপড়ের দোকান, আর তার পেছনে যে আমানতগঞ্জের বিল, সেদিক থেকে প্রায় ধর্মের জিগিরমতো ক্রমাগত তেলবাড়া শব্দ আসছে ‘মডি মডি’। তারপর একটু চুপ, তারপর আবার ধীরে বলবৃদ্ধি ঘটতে থাকা ওই ‘মডি মডি’। সে তার বাবাকে বলল, ‘কীসের আওয়াজ, বাবা?’
তার বাবা বললেন, ‘দ্যাখো গিয়ে আমানতগঞ্জের বিলে কাদার মধ্যে হকি খেলা হচ্ছে।’
জাহেদ বলল, ‘না বাবা, এখন হকি হয় না। এখন ফুটবলের সিজন।
তার বাবা উত্তর দিলেন, ‘ওই একই কথা। সামান্য ডান-বাঁও।’
শামছু সঙ্গে সঙ্গে এই পৃথিবীর কোথাও কাকচিল বসতে না পারামতো ফুকার-হাকার দিয়ে উঠল তার মাথা পেছনে ঘুরিয়ে, ‘ডান-বাঁও খারাপ কথা, কাশেম ভাই। ডান-বাঁও বলবেন না, চতুরদিকে বিপদ।’
কাশেম বললেন, ‘ধুর শামছু, কীসের বিপদ?’
শামছু বলল, ‘বিপদ। রাজা ভক্তি মিশ্রের লোকেরা নামছে রাম-দা লইয়া। জিয়াউর রহমান মনে কয় মারা গ্যাছে ছুরিকাঘাঘাতে (জাহেদ শুনল শামছু একটা ‘ঘা’ বেশি বলেছে)। চোর জনি না মুকুলের মা আপনের পোলা শাহেদরে ভয়েমকর অভিশাপ দেছে। আর আমারতগঞ্জ বিলের ওইদিক থিইক্যা দ্যাহেন কেমুন আওয়াজ ওডতেয়াছে মটমডি মটমডি।’
কাশেম ঠিক করলেন বাড়ি ফিরে কাল সকালেই তিনি শাহেদকে পাঠিয়ে দেবেন তার নানি বাড়ি কুষ্টিয়ার আল্লার দরগায়। তিনি শামছুকে বললেন, ‘শাহেদকে নিয়ে চিন্তা কোরো না। কালই আমি ওরে অন্য শহরে পাঠিয়ে দিচ্ছি।’
শামছু বলল, ‘সেইডা কামের কাম, সেইডা একটা কামের কথা।’ ‘কামের কথা’ শব্দদুটো বলতে বলতেই সে হঠাৎ রিকশার সামনের চাকা ঢুকিয়ে দিল কেমন এক খাদের মধ্যে। জাহেদ তখন বিরাট ধাক্কা খেয়ে সটাৎ করে তার সিট থেকে পড়ে গেল রিকশার পাদানিতে। তার বাবা তাকে তৎক্ষণাৎ ধরে বসলেন আর বিশ্রী করে বকা দিলেন, ‘বসতেও পারো না? রিকশায় বসাও শেখো নাই?’
জাহেদ উল্টো বকা দিল শামছুকে, বলল, ‘শামছু, শামছু, তুমি সবসময় এমন করো। সবসময় গর্তের মধ্যে চলে যাও জানি আমি সিট থেকে পড়ি। শামছু খচ্চর।’
শামছু খাদ থেকে চাকা চুপচাপ তুলে ততক্ষণে রিকশা নিয়ে এগিয়ে গেছে আরও কয়েক গজ, তারপর ব্রেক করেছে রিকশার, কারণ তারা পৌঁছে গেছে মহাবাজ মোড়। মোড়ে পৌঁছাতেই বেশ ভাল বোধ হল কাশেম মিঞার, কারণ এই মোড়ে তা-ও অন্তত কিছু মানুষ আছে। তারা তিনজনই এবার দেখলেন, উল্টো দিক থেকে আসা আরেক রিকশায় বসে এক মধুভাষী যুবক ছেলে তার কোলের ওপরে একটা ব্যাটারি ফেলে এবং মুখের মধ্যে একখানা মাইক্রোফোন ঢুকিয়ে বলে যাচ্ছে, ‘প্রিয় ভাই ও বোনেরা, আগামীকাল মহাবাজ মোড়ে এক নতুন গরু জবাই হইবে। ইহা নরসিংদীর ষাঁড় গরু, যে-গরুর মাংস না আছে নতুন বাজারে, না আছে আলেকান্দা-শ্মশানঘাট-পুরান বাজারে। আগামীকাল সকাল ৮টায় নতুন গরু, নতুন গরু, নতুন গরু-প্রচারে মহাবাজ মোড় মাংস সমিতি।’
ঘোষণাটা শুনে জাহেদের মনে হল, আহা সে কতদিন হয় ভাল একটু গরুর মাংস খায় না। সে সবসময় তার মা-র কাছ থেকে কয়টা টাকা নিয়ে বাসার বাজার করতে নতুন বাজার যায়, আর চাল-ডাল-হলুদ-পিঁয়াজ-মরিচ-সবজির দোকানগুলো পার হয়ে গিয়ে দাঁড়ায় মুরগিদের বড় বাঁশ-ঝাঁকার ওই পাশে, হাঁসদের বড় কঞ্চি-ঝাঁকার ওই পাশে ভেজা সিমেন্টের বিরাট জায়গাটায়, যার চার পাশ জুড়ে গরুর মাংসের দোকান, খাসির মাংসের দোকান, পাঁঠার মাংসের দোকান। দোকানগুলোর সামনেটা থেকে মাংস ঝোলে লোহার বড়শিমতো আংটায়, আর দোকানিরা তাকে বলে, ‘ও জাহেদ, মাংস তো কেনতে দ্যাখলাম না কুনোদিন। তয় রোজ রোজ এইদিকে আইয়া কী দ্যাহো?’ জাহেদ তাদেরকে বলে না যে, সে এখানে আসে জেলখানার উঁচু দেওয়ালের পেছনে দিক বেড় দিয়ে বয়ে যাওয়া এই নদী কিংবা খালের পাড়ে বিশাল-বিশাল কাছিম জবাই দেখতে, যে-কাছিম তাদের খাওয়া মানা, যে-কাছিম শুধু হিন্দুরাই খেতে পারে। গরুর মাংসের দোকানদারেরা সব বোঝে, তাই তারা তাকে ফের বলে, ‘হারাম কাছিম দ্যাহার মইদ্দে কী আছে, জাহেদ? কাছিম দ্যাহো নাকি জেলখানার দেয়ালের উইপাশে তোমার বাপেরে দ্যাহো?’
জাহেদের তখন মনে পড়ে, তার বাবা আছেন উঁচু দেয়ালটার ওপাশে—কোনো অন্যায় না করে, কোনো সরকারি চাল চুরি বা লোপাট না করে কিছু চোর সহকর্মীর ষড়যন্ত্রে গোডাউনে চালের হিসাবের গরমিল ঘটে যাওয়ার কারণ থেকে চুপচাপ জেলে যাওয়া তার ভাল মানুষ, নির্দোষ বাবা।
জাহেদ এসে দাঁড়ায় ওই নদী কিংবা খালটার পাড়ে। তখন সিমেন্টের মেঝে বেয়ে বয়ে যাওয়া নানা পশুর নানা রক্তের ওপরে টিনের বালতি থেকে পানি ঢেলে লম্বা শলার ঝাঁটা দিয়ে ঝিড়-ঝিড় করে ঝাড় দিয়ে যাওয়া তার সমান বয়সী ছেলেটা, নাম জাকারিয়া কানিজ, জাহেদকে বলে, ‘জাহেদ সরো, জাহেদ সরো। ডেইলি ডেইলি তোমার ড্রিসটারব।’
জাহেদ তাকে শুনিয়ে দেয়, ‘জাকারিয়া পোলাদের নাম, কিন্তুক কানিজ পুরাই মাইয়াদের নাম।’
তার বাবার বন্ধু খাসির মাংসের দোকানি কাদির চাচা তার উদ্দেশে বলে ওঠেন, ‘জাহেদ, ভাষা ঠিক করো। ‘মাইয়াদের’ আবার কী কথা? তোমার বাপে জেলেরতে বাইরাইয়া এসব শোনলে মনে কষ্ট পাইবেন।
আবার জাকারিয়া কানিজ বলে, ‘জাহেদ সরো।’ জাহেদ দেখে জাকারিয়ার হাতে ধরা ঝাড়ুর আগায় লাল রং রক্ত, কালো রং রক্ত, লাল-কালো মেশানো টকটকে-ডগডগে-রগরগে রং রক্ত। সে সরে গিয়ে দাঁড়ায় একদম সিমেন্টের কিনারায়, যার পরে মাত্র দুই ধাপ নেমেছ কী তুমি পৌঁছে গেছ একদম ওই খাল কিংবা নদীর পাড়টায়, যেখান থেকে কাকদের অনবরত কা-কা-কা-কা ছাপিয়ে জেলের দেওয়ালের ভেতর দিক থেকে শোনা যায় প্যারেড-পিটির আওয়াজ, শোনা যায় কে যেন চিৎকার করে বলছে, ‘পুষ্পরাজ ওয়ার্ডের কয়েদিগণ, ঘাস কাটা শেষ;’ আবার অন্য কে যেন কোনদিকে ডেকে উঠছে, ‘ঘাঁতঘোঁত ওয়ার্ডের কয়েদিগণ, স্টান্ডাটিজ।’
‘স্টান্ডাটিজ’ মানে কী, জানে না জাহেদ। সে তখন একবারও মনে করে না তার বাবার কথা, কারণ সেটা করলে সে জানে সে কেঁদে ফেলবে ভেউভেউ। বাবার কথা মনে না করাটা নিশ্চিত করতেই এবার সে মন দেয় নদীর ঘাটে কাছিমগুলোর জবাইয়ের দিকে।
তার আজও মনে আছে কী করে একদিন হঠাৎ এক ছোট সাইজের কাছিম—যেটার দরদাম পুরো সেরে ফেলেছেন দুধ-সাদা ধুতি পরা এক হিন্দু তরুণ—জবাই হওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে কসাই বালক মহামূর্খের হাত থেকে সাঁৎ করে পিছলে গিয়ে ফুৎ করে নদীর পানিতে ডুব—তারপর হাওয়া, তারপর নেই, তারপর নেই-নেই-নেই। আর মহামূর্খ হালদার তখন কী করবে বুঝতে না পেরে বোকার মতো ঝাঁপ দিয়ে বসেছে নদীর জলে এবং সেই ফাঁকে চাটাইয়ের ওপরে উল্টো করে রাখা বড় দুই কচ্ছপী মোটামুটি ধুপধাপ হেঁটে গিয়ে কীভাবে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল সেই একই নদী কিংবা খালের জলে।
এবার দোকানের মালিক পরিতোষ তার হাতে বিরাট একটা রাম-দা নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন নদীর কিনারে আর চিৎকার করে বলতে লাগলেন, ‘মহামূর্খ হালদার, তুই আজকে নদী থিকা উঠবি না, তুই কালকেও নদী থিকা উঠবি না, তুই পরশুও নদী থিকা উঠবি না। আমি তোরে পুরা ছত্রিশ ঘণ্টা জলে চুবায়ে রাখব। খানকির পোলা খানকি, তুই উঠবি তো তোর গলা কমটের গলার মতো কাটা হইবে তোর গলা।
এবার পানিতে নিখোঁজ হয়ে মুক্তি পাওয়া ছোট কাছিমটা কেনার দরদাম শেষ করা ওই মার্জিত-পরিমার্জিত ছুঁতমার্গী তরুণ কাছিম দোকানের মালিক পরিতোষকে বলল, ‘মুখ খারাপ করবেন না। ছি! ওই ছোট বালক কি ইচ্ছে করে করেছে কাজটা, মনে করেন? এত্তগুলো কচ্ছপ একটা মাত্র বালক সামলাবে? দোকানে বেশি করে লোক রাখবেন।’
সেই কথা শুনে তিন কাছিমের অন্তর্ধান নিয়ে হাহাকার করতে থাকা পরিতোষ সোজা জুতোপেটা করার ঢঙে তেড়ে গেলেন তার খদ্দেরের দিকে এবং তার উদ্দেশে এই এক মুহূর্ত দা-টা উঠিয়ে পরমুহূর্তে সিমেন্টের ওপরে সেই দা টং করে ছেড়ে তাকে ‘বালের রবীন্দ্রনাথের নাতজামাই’ বলে গালি দিয়ে এক জোর ধাক্কা মেরে ফেলে দিলেন সোজা ওই নদীতে- সোজা। আর তখন সোজাই সে হাউমাউ করে ভেসে চলল স্রোতের সাথে সাথে দূর থেকে দূরে। ঘাটের কিনারে ভিড় করে আসা দর্শকশ্রোতা কেউ কেউ হাসল তাতে, কেউ বা চিৎকার দিল ‘ওহ আল্লাহ ওহ আল্লাহ’। কিন্তু জাহেদের শুধু মন খারাপই হল মহামূর্খ হালদারের জন্য, যে কিনা নদী বা খালের ওই পাড়ে ততক্ষণে মহা এক বেচারার মতো ভয়ার্ত উঠে দাঁড়িয়েছে তার মাথার ওপরে বিশ-পঁচিশটা মাংসচোর কাক নিয়ে এবং চেঁচিয়ে ডাকছে ‘মা-মা’।
কাকগুলো তখন পাঁক খেয়ে ঘুরছে সেখানে। তারা ডাকছে আর ডাকছে কা-কা-কা, যেন বা মহামূর্খ হালদার মানুষগোত্রের কেউ না, যেন সে নিরন্ন হতভাগা কাকগোত্রেরই একজন। অতগুলো লোকের হইহুল্লার ওই দৃশ্য দেখে যে কারও মনে উঁকি দেবে এই সত্য যে, মানুষের ডুকরে ওঠা উচ্চকণ্ঠ বিলাপের শাঁসটুকু বোঝার ক্ষমতা নদীর জলের থাকতে পারে, কি কাক-চিল-শকুনদেরও থাকতে পারে, কিন্তু তা অন্য মানুষের নেই। কারণ, তাদের বেঁচে থাকার অভিজ্ঞতার মধ্যখানটা ফাঁকা এই পৃথিবীর ফাঁকা এক নিশ্চয়তা দিয়ে মোড়া বলে তারা কোনো প্রমাণ ছাড়া মানতেই রাজি না যে, মৃত্যু এ জীবনে কোনো ব্যাপার। আর সেই মৃত্যু যদি হয় রামদার কোপে কি নদীর জলে ভেসে গিয়ে, তাহলে সেটা তো নিছকই হঠাৎ হয়ে যাওয়া দুর্ঘটনা মাত্র, যা দেখবার শেষে এক ধুত্তুরিমার্কা-কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলেই ওঠা যায়, ‘রহমত আলি, তোমার নরসিংদীর ষাঁড়ের মাংসের লেজের দিক যদি নিই তো সাফ সাফ বলো যে, সের কতো?’ এখন মাইকে ষাঁড় জবাইয়ের ঘোষণা শুনে জাহেদের মনে পড়ে গেল নতুন বাজারের রক্তের ঝাড়ুদার জাকারিয়া কানিজ নামের ছেলেটার কথা। আজ কত দিন হয় সে ওখানে জাকারিয়া কানিজকে দেখে না। কোথায় চলে গেছে সে? রক্ত ধোয়ার, রক্ত ঝাড়ু দেওয়ার গা-গোলানো কাজ ছেড়ে সে কি এখন ওখানকার বড়লোক মোহন মিয়াদের গাড়ির কাচ ধোয়? সে কি রক্ত ধোয়াধুয়ির কাজ বাদ দিয়ে এখন নিজেই গরু-খাসি-কাছিম জবাই করে সিমেন্টের ওই মেঝের জন্য রক্ত উৎপন্ন করে?
জাহেদের চিন্তায় ছেদ পড়ল লোকজনের কানাঘুষায়। সে শুনল, মহাবাজ জামে মসজিদের খামের সঙ্গে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ানো ফার্নিচারওয়ালা ‘জ্ঞানী’ চিট্টাগুড় চাচা তাদের দিকে তাকিয়ে জোরে বলছেন, ‘ও কাশেম, কই যাও? এত রাইতে কই যাও তালতলার দিকে?’
তার বাবা মুখ ঘুরিয়ে বললেন, ‘চিট্টা, তুমি? আমি যাই আড়িয়াল খাঁ। কাজ আছে।’
চিট্টা চাচা এদিকে হেঁটে আসতে লাগলেন। কিন্তু জাহেদ স্পষ্ট দেখল, যে-পথ ধরে চিটটা চাচা এদিকটায় আসছেন, যে-লাইন ধরে তিনি আসছেন, তাতে করে কোনোদিনও তিনি তাদের রিকশার ধারেকাছে এসে পৌঁছাতে পারবেন না। শামছু জাহেদকে বলল, ‘জাহেদ, রাস্তায় অনেক খানাখন্দ। তুমি বারবার পইড়্যা যাবা আর আমারে খচ্চর বইল্যা গালি দেবা। তুমি সামনের হ্যান্ডেলে আও।’
জাহেদের মনে হল, তার বাবা একটু আগে তাকে যে পরিমাণ বিশ্রী-বিরক্ত গলায় বকা দিয়েছেন ‘বসতেও পারো না’ বলে, তেমন এক বাবার পাশে বসার চাইতে অনেক ভাল রিকশার হ্যান্ডেলে শামছুর বুকের সামনে গিয়ে বসা।
শামছু যেন তার মনের কথা বুঝল। সে বলল, ‘আমার বুকের মইদ্দে আইস্যা বইস্যা থাহো টুকটুকা পোলা। আহো।’ জাহেদ শামছুর কথাটা শুনল, আবার চিট্টাগুড় চাচার দূরের এক ভুল রাস্তায় পা বাড়ানো পথ থেকে ভেসে আসা হটকানো চিৎকারটাও শুনল যে, ‘আড়িয়াল খাঁ-য় কী কাম? কার লগে সেইখানে যাও, কাশেম?’
তার বাবাও চিট্টার দিকে মুখ তুলে রাস্তার ওপাশের বিশালকায় শাখাপ্রশাখা ছড়ানো শিরীষগাছগুলোর লাখো ছোট সবুজ যে-পাতা, যারা কালো হয়ে আছে এই গাঢ় অন্ধকারে, সেগুলোর ওপর দিয়ে তার ডাকটা ভাসিয়ে দিয়ে চিট্টার উদ্দেশে বললেন, ‘যাই ওমর আলির সাথে। কয়লা ওমর। যাই ব্যবসার কাজে।’
চিট্টা তখন শ্যামল গাছগুলোর (বরিশালে শিরীষকে শ্যামলও বলে, আবার বিষহন্তা বা বিষন্তাও বলে) ভেতরে ভেতরে মিশেই গেছেন। সে মুহূর্তে তিনি দুই পৃথিবীর মাঝখানে দাঁড়ানো এক মানুষ, শ্যামল গাছগুলোর সঙ্গে নিজের শরীর ঠেকনা দিয়ে খাড়া হয়ে আছেন কোনো চৌকাঠের ‘পরে, এবং নিজেই বুঝছেন যে, তার অবস্থান দু পৃথিবীর মাঝখানেই বটে। হুম, অনেক বাচ্চা-অবশ্যই জাহেদও—এমনটাই অনুভব করে থাকে এবং সেজন্য তারা বাসায় মেহমান এলে দ্যাখো না কীভাবে লুকিয়ে থাকতে চায় ঘরের চৌকাঠ ধরে ঝোলা পর্দার আড়ালে? তাদের বাবারা মেহমানদের সামনে থেকে এবার তাদেরকে ডাকে, ‘এদিকে আসো তো মনজু, দ্যাখো কে এসেছে।’ আর মনজুরা বুঝে ফেলে, যে-ই বাসায় আসুক না কেন, তার সঙ্গে তাদের সত্যিকারের কোনো সম্পর্ক নেই। বুঝে ফেলে, তাদেরকে এভাবে ভিড়ের মধ্যে ডেকে ওই মেহমান লোকগুলো স্রেফ দেখতে চাইছেন যে, বাচ্চাগুলো আদৌ আলাদা মানুষ হয়ে উঠেছে কি-না? এ পৃথিবীতে একেকজন মানুষ আসে একেকজন আলাদা মানুষ হিসেবেই। বইয়ের ভাষায়—স্বতন্ত্র ব্যক্তিমানুষ। আর চারপাশের লোকজনও সবাইকে দেখতে শুরু করে সেভাবেই। তারপর দিন যায়, মাস যায়, বছর যায় এবং মানুষের যার-যার ওই আলাদা ব্যক্তিমানুষ হবার বোধটুকু আস্তে আস্তে মুছে যেতে থাকে—সমষ্টির শেখানো ঝাপসা-বিভ্রান্তিকর এক সমষ্টির বোধের সঙ্গে মিলিয়ে যাবার স্বার্থে। আর শেষমেশ দেখা যায়, মৃত্যু এসে ছোবল মেরে তুলে নিয়ে গিয়ে তাদের ওই আলাদা ‘কেউ’ হয়ে ওঠার শেষ সম্ভাবনাটুকুও গুঁড়িয়ে দিয়েছে। আহা, কেবল তখনই মানুষেরা বুঝতে পারে, সবটাই তাহলে ছিল মিছা-চালাকি ধোঁকা। বুঝতে পারে, হায়, তাদের তাহলে এ জীবনে আর এই পৃথিবীর ‘কেউ’ হয়ে ওঠা হল না, আর ওই পৃথিবীর কথা তো তারা মনে করেই উঠতে পারল না।
যেহেতু চিট্টাগুড় চাচা দুই দুনিয়ায় পা দিয়ে থাকা নিজের অবস্থানটা সম্পর্কে সচেতন, তাই দেখা গেল তার মধ্যে এ নিয়ে কোনো বিকার নেই যে, ওভাবে এদিকটায় আসতে থাকলে তিনি কোনোদিনও পৌঁছুতে পারবেন না কাশেমের কাছে। দুই পৃথিবীর খাঁটি বাসিন্দা হিসেবে পা চালিয়ে তিনি দেখা গেল ওরকম ওই এক নির্দিষ্ট পথ ধরেই এগিয়ে আসছেন, তার নিজের সংজ্ঞামতো একধরনের এগিয়ে আসা যাকে বলে। এবার চিট্টা শ্যামলের সাদা রংয়ের লোম-লোম ফুলগুলোর ঝামেলা-টামেলা দুহাতে সরিয়ে-টরিয়ে বেশ জোরের সঙ্গে বলে উঠলেন, ‘ওমরে তো লোক ভালা না। তার তো নদীতে গলা নামানির নাম আছে, কাশেম। আর সে আট বছর জেল খাটল ক্যান, জানো না?’
জাহেদ জিজ্ঞাসা করে উঠল, ‘কেন চাচা, কেন?’
চিট্টা তার বাবার ‘না-না, বোলো না চিট্টা’ বাধা উপেক্ষা করে এক বড় উঁচু শিরীষ-শ্যামলের মাথার ওপরে নিজের মাথা নিয়ে, পাশের আরেকটার গায়ের ওপরে শরীর আছাড় মারার মতো করে ছুড়ে মেরে প্রবল ক্লান্তির গলায় বললেন, ‘জাহেদ, তোমার ওমর চাচার বাড়ির কাজের মাইয়া ধর্ষণ হইছিল। যে তিনজন লোক ধর্ষণটা করছিল, পরে মেয়েটারে মাইরাই ফেলছিল, হ্যারা পুলিশরে বলছিল যে, ওমর রাত একটায় নিজের হাতে বাড়ির দরজা খুইল্যা দেয় তাদেরে ঘরে ঢোকানির জইন্য, আর…’
কাশেম হুংকার দিয়ে উঠলেন, ‘না, চিট্টা না। জাহেদ একটা বাচ্চা ছেলে। আর তুমি নিজেই বা ওর সামনে এত নাক তুলছ কেন?’
কিছুই বুঝল না জাহেদ তাদের কথার। সে শুধু শুনল, আমানতগঞ্জের বিল থেকে আসা মডি-মডি আওয়াজের সঙ্গে এখন মিলেছে তার বাবার ‘না’ ডাকের নৃ ধ্বনিটা এবং সবটা মিলে শোনাচ্ছে–ডি ডি মতো
যেই ডি আওয়াজটা এসে এবার আঘাত হানল মহাবাজ রোডের ওপর ঝুলতে থাকা শূন্যের গায়ে, ওই তখুনি রোডের মোড়ে স্থির হয়ে উঠল সবকিছু—প্রস্তরীভূত ও গুঁড়িশুঁড়ি মারা, জানুগতির ও খরখরে উদ্ভুট্টে।
দোকানগুলো থেকে এবার লোকজন সবাই তাদের রিকশার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল যার যার মতো—কেউ ধীরে, কেউ ঝটপট। চিট্টাগুড় চাচা তখন সোজা রাস্তা ছেড়ে গাছের ফাঁক-ফাঁক দিয়ে এদিকে কোনাকুনি আসার চেষ্টা করছেন, কিন্তু যত তিনি রাস্তায় উঠবেন উঠবেন, ততই সোজা রাস্তাটা তার কোনাকুনি হাঁটার কারণে হয়ে উঠছে অর্থহীন ও অনন্তের মতো লম্বা। কোনো মানুষ কি কেউ আজ পর্যন্ত কোনো মাঠে ঢুকতে পেরেছে মাঠটার পাশ দিয়ে অনন্ত-বিরতিহীন কোনাকুনি হাঁটতে হাঁটতে ওই মাঠে কখনোই না ঢুকে?
চিট্টা ওরকম এক কোনায় দাঁড়িয়ে অন্ধকারে কালো হয়ে আসা বড় এক ভাতকড়ইয়ের হলুদ রঙের ফুলে ভরা ডাল ধরে ঝাঁকি দিতে দিতে ওই ওপর থেকে তার গলার শব্দকে কণ্ঠ থেকে কোনাকুনি জিভের তলা দিয়ে বের করে
বললেন, ‘মানলাম না। আমার সাথে ওমরের তুলনা হয় না, তুলনা চলে না। আমি চিট্টা মানুষ খারাপ হইতে পারি, কিন্তু ওমরের সাথে তুলনা দিয়া তুমি আমারে নাক তোলার খোঁটা দিলা?’
যেহেতু চিট্টা গাছের মাথা ছুঁয়ে আছেন এবং ওরকম কোনাকুনি এক গলায় কথা বলেছেন, তাই গাছ থেকে রাতের আকাশে উড়ে গেল একগাদা ছোট বসন্ত বাওড়ি পাখি, যাদের মুখে এখনও বটগোটা, আর মুখের হাঁ-টা ভরা থাকবার কারণে যাদের ডাকগুলো শোনালো-কিচিমিচি; এবং এর বেশি কিছু না, স্রেফ কিচিমিচি। কাশেম লজ্জা পেয়ে গেলেন। তিনি রিকশা থেকে মাথা উঁচুতে তুলে বললেন, ‘আমি সরি চিট্টা, আমি সরি। কিন্তু তুমি বাচ্চা ছেলেরে দুর্বিষহ কোনো গল্প কেন বলবা?’
চিট্টা আকাশের দিক থেকে হেসে উঠলেন ঠা-ঠা, বললেন, ‘দুর্বিষহ! কী বাংলা পারো যে তুমি কাশেম! কী পরিমাণ মিডা-মিডা কথা পারে সবাই! সবাই—দোকানদার, হুজুর, মৌলভি, কসাই, স্যান্ডেলওয়ালা, তালাওয়ালা, ফার্নিচারওয়ালা, সক্কলে। হা-হা-হা। সবডি বোকা, সবডি জানোয়ার, সবডি খালি চায় নেতা হইতে—মোয়ামুড়ির দোকানদার যেমুন, তেমন মহাবাজ থানার দারোগাও। আমি আর কিছুই চাই না কাশেম, কিছুই না। খুনখারাবি আর মিথ্যা দ্যাখতে দ্যাখতে আমি কেলাতো। শুধু যদি মানুষ একটু কম আহাম্মক হইত, শুধু যদি হ্যারা একটু বেশি বুদ্ধিমান হইত! ওমরে বোকা, তাই না বুইঝ্যা সে নদীতে খালি লাশ ফেলতেয়াছে। লাভ নাই, কুনো লাভ নাই। আর তুমি তার ক্ষতি বাড়াইতে বাচ্চা পোলাডারে লগে লইয়া যাইতেয়াছ হেই নদীতে? ক্যান? রক্তের নদী তোমারে কবি বানাইছে, মাঙ্গের পুত? বাচ্চা পোলা সঙ্গে লইয়া রাম-দায়ের নিচে চাঁদনি দেখতে যাইতেয়াছ? ফার্নিচার বেইচ্যা আমি দ্যাশের সারবোভৌমো সাবমেরিনের কমান্ডার হব?’
চাল ব্যবসায়ী বিজয় মহাজন এ সময় এগিয়ে এলেন তার দোকান থেকে। এসে বললেন, ‘বোঝলাম সব কাশেম ভাই। আমনে আমার চাউলের দাম না দিয়া এই এত রাইতে তবে আড়িয়াল খাঁ যাইতেয়াছেন? তা-ও পরবর্তী বংশধর সঙ্গে লইয়া?’
জাহেদের একদম সহ্য হল না বিজয় মহাজনের কথাবার্তা। সে রাগের চোটে বিজয় মহাজনকে ভ্যাঙাল লোকটার পোষা গুইসাপ খছাকের মতো জিভ বের করে—’ল্ল্ল্ল্ হিসস, ল্ল্ল্ল্ হিসস।’ বিজয় মহাজন বললেন, ‘কী ব্যাপার জাহেদ? তোমার কি মৃগীরোগ হইয়াছে?’
জাহেদ বলল, ‘খছাকে যদি আমার হাঁস-মুরগি খাইতে আসে কাকা, তা হইলে দেখবেন ওর চামড়া খুইল্যা আমি জুতা বানাব।’
তার বাবা তার মাথায় জোরে আঙুলের গিঁটের ঠোকা মেরে বললেন, ‘মাথা একদম ফাটায়ে দেব জাহেদ। ভাষা ঠিক করো। ‘খুইল্যা’ আবার কী কথা? ছি!’
জাহেদ এবার সত্যি ধুপধাপ চড়ে বসল শামছুর সামনের রডে। সে এখন পা নাচাচ্ছে ফুর্তিতে, কারণ তার মনে হচ্ছে এ সবই—এই চিট্টাগুড় চাচার কথাবার্তা, এই খছাকের বাপ বিজয় মহাজনের খোঁটা—সবটাই বাহানা। এগুলো তার আড়িয়াল খাঁ যাবার পথের বাধা ছাড়া আর কিছু না, কিছুই না। কিন্তু এখন প্রথম ভাল কথা এই যে, সে একটা লোহার ওপরে বসা, আর লোহা শয়তান তাড়ায়। আবার তার সামনে আড়াআড়ি রিকশার ওই মূল লোহার যে-বড় রড, সেটার পেছনে রয়েছে কী তাগড়াই শরীরের শামছু, খচ্চর শামছু। অতএব তার ভয় নেই কোনো। দ্বিতীয় কথাটা কী, তা আর তার মনে পড়ল না।
শামছু মিয়া জাহেদের কানের মধ্যে মুখ ঢুকিয়ে বলল, ‘তুমি, রিয়াজ আর মিরাজ আমার রিকশায় বইস্যা কেমনে জানি হোই-হোই-হোই করো? হা-হা। মুই তো গরে গিয়া সেইডা তোমার চাচীরে কই। তারে সেইডা তোমাগো মতম লাফাইয়া লাফাইয়া দেহাই, তখন হ্যায় হাসে আর হাসে।’
জাহেদ বুঝল শামসু ও তার বউ এই হাসাহাসির পরেই খারাপ কাজটা করে, যার নাম ‘চেক্স’। না হলে নারী-পুরুষ মিলে তারা এভাবে হাসবে কেন? কিন্তু সে এ-ও বুঝল যে, যতই তারা খারাপ কাজ করুক, শামছুর ওই জিনিস কখনও তার বউয়ের ভেতরে লক হবে না, কারণ তারা বিয়ে করা। অতএব শামছুকে কোনোদিনও হাসপাতালে যাওয়া লাগবে না। জাহেদ শামছুর কানে কানে বলল, ‘তুমি কিচ্ছুই জানো না।’
এ কথা বলতে জাহেদের মনে পড়ে গেল তার বন্ধু ঈমানকে, চাখারের বেতবাগানের ঈমান, যে কিনা এরকম সন্ধ্যারাতে তার বাড়ির পেছনের পুকুরঘাটে বসে লাঠির মাথায় গামছা ফিডঠোকর বেঁধে হারিকেনের আলোয় চিংড়ি মাছ ধরত—প্রতিবার গামছা পানি থেকে ওপরে তুলত, আর প্রতিবারই জাহেদকে বলত, ‘আইজ রাইতে লক্ষ্মণ দাস সার্কাস নাই, জাহেদ। আইজ আমার জোকারের কামডাও নাই। বড় বাঁচা বাঁচলাম।’
জাহেদ ভাবল, সেই ঈমান এ মুহূর্তে বরিশালের জেলখানায় বসে নিশ্চিত মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলছে, ‘জাহেদ, আমরা না ‘চিরকালের বন্ধু’? তাইলে তুমি চইল্যা গেলা ক্যান?’
ওই জাহেদ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল — গুপ্তধনের টাকা পেলে সে সোজা চলে যাবে জেলখানা, গিয়ে সেই টাকা থেকে ঘুষ দেবে জেলের পুলিশকে, তারপর ঈমানকে সেখান থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দুজনে একসঙ্গে রওনা দেবে তেগুচিগালপা। জায়গাটা ঠিক তেগুচিগালপা কেন, তা সে জানে না। কিন্তু ওই নামটা শোনার পর থেকে তার বারবার মনে হয়েছে, তেগুচিগালপা কতো ভাল এক জায়গা- নিশ্চিত রাজার ছেলেরা ও রাজার মেয়েরা সেখানে রোজ ঘুরে বেড়ায় হীরা দিয়ে মোড়ানো বেতফলের বাগানে, আর সেখানে আরবি শেখার কষ্ট নেই, নামাজ পড়ার শাসন নেই এবং নেই জঘন্য-বদ মুরাদ, যে নাকি তার বড়লোক বাড়ির বড়লোকের উঁচু খাটের নিচের মেঝেতে বাসার কাজের মেয়ে রাজিয়াকে ‘চেক্স’ করে যখনই মন চায়, তারপর কুলফি কিনে রাজিয়ার বুকের মধ্যে ঠাণ্ডা কুলফি মাখিয়ে দিতে দিতে বলে, ‘শীত করলে কইবি, শীত না করলেও কইবি। কথা না কইলে গলা দাবাইয়া মাটিতে ন্যাংটা পুঁইত্যা রাখব।’
এই মুরাদই একদিন জাহেদকে বলেছিল, ‘খুব বারছো তুমি পোলা। তোমার ভাইয়ে মটরসাইকেল কেনার পর থিইক্যা তুমি খুব বাড়ছ। খুব রিয়াজ-মিরাজের লগে তোমার মাস্তানি, খুব কাইল্লা কবিরের লগে ভাব চোদাও, আর খুব আইছ আমারে তোমার ভাইয়ের গুণ্ডা বন্ধু রাঙ্গারে দিয়া ভয় দেখাইতে? হুহ্। আর ওইদিকে নাঈম্মিয়্যার বাচ্চা নাঈম যে সালাম মেয়ার বাসার পিছে জাহান্নামের রাস্তার ওইহানে মটমটিয়ার জঙ্গলে তোমার বুইনের ছামা উত্তর-দোখিন করতেয়াছে রোজ রোজ, হেইডা লইয়া কোনো কথা নাই? হেইডা তো লোকে ঠিকই দ্যাখছে।
জাহেদ তাকে বলেছিল, ‘মিতথা কথা। আমি নাঈম ভাইরে বলে দেব, আমার বাবারে দিয়া তোমার বাবারেও বলে দেব। তুমি বলছ আমার বোনের ছামা। আমি বলে দেব, মুরাদ ভাই।’
জাহেদ যেন কথাটা বড়দের কাউকে বলে না দেয়, তাই মুরাদ তাকে ম্যানেজ করার জন্য, কমবেশি তার কাছে মাফ চাওয়ার জন্য, একবার চেষ্টাও করেছিল। পরের দিন যেই শামছুর রিকশা সকালে হাজির হয়েছে তাদের বাসার দরজায়, দরজা না খুলে কাঠের ফাঁক দিয়ে জাহেদ দেখেছিল মুরাদ কেমন জুলুজুলু চোখে জাহেদদের দরজাটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে তাদের দালানবাড়ির দোতলার বারান্দা থেকে, যে-বারান্দায় মুরাদের মা রাজিয়া খাতুন শুধু সাদা গোলাপের টবই বসাননি, সেইসঙ্গে লাগিয়েছেন একগাদা চন্দ্রমুলার গাছ, যাদের পানপাতার মতো বিরাট পাতাগুলোর গায়ে সাপের চামড়ার কেমন লোলায়মান ডিজাইন।
জাহেদ কথাটা কখনও বলেনি তার নাঈম ভাইকে। প্রথম কথা, মানুষ আকারে-ইঙ্গিতে মাফ চাইলেও, তাকে মাফ করতে হয়; আর দ্বিতীয় কথা, কথা তো মিথ্যাই। সে জানে, তার বোন কখনোই ওই কাজ বিয়ের আগে করতে পারে না। তবু জাহেদ ঠিক করেছে, সে তার বোনকে একটা বেনামি চিঠি লিখবে। কাইল্লা কবির বা রিয়াজ-মিরাজকে ধরে হাতের লেখা অনেক কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে কিংবা আরও ভাল হয় বাঁ হাত দিয়ে লিখে একটা চিঠি সে পাঠাবে তার বোনকে, যেখানে তাকে সাবধান করা থাকবে বিয়ের আগে কোনো ছেলের সাথে খারাপ কাজ করলে ছেলে-মেয়ের নিচের অংশের ওইখানটা ‘লক’ হয়ে যাওয়া নিয়ে। মুরাদের কাছে কথাটা শোনার পর থেকে জাহেদ কোনোদিন ভাবতেই পারে না যে, তার বোন ও নাঈম ভাই দুজনে একদিন শক্ত আঠা দিয়ে একে অন্যের গায়ে একজোড় লাগানো অবস্থায় তাদের নিউ ভাটিখানার রাস্তা ধরে লাফিয়ে লাফিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ির দিকে আসবে এবং তখন তাদের পাছার দিকে বলতে গেলে কাপড় থাকবে না কোনো, বলতে গেলে তারা কোনোমতে হাতে ধরে রাখবে তাদের খুলে পড়ে যেতে চাওয়া, একরকম গিঁট দিয়ে বেঁধে রাখা যা কিছু কাপড়চোপড়।
আর এখন সেই মুরাদ নেই, সেই মুরাদ কিনা এ পৃথিবীতেই নেই। তাকে গত রাতে মেরে ফেলেছে রাজা ভক্তি মিশ্রের লোকেরা। হায়, হায়! ভাবল জাহেদ-একটা মানুষ, একটা তরুণ-তাজা মানুষ, তা সে যত বদমাশই হোক, তাকে কিনা একদম মেরে ফেলবে রাজা ভক্তি মিশ্র এবং তারপর তার লাশ ফেলে রাখবে কাউনিয়ার কিনারে জাগরণী সংঘের গা ছমছম বাঁশবাগানের নামায়?
জাহেদের মনে পড়ল তাদের, আনোয়ারার এবং পেছনদিকের হিন্দু পাড়ার ‘কমন’ পুকুরে সেদিন ভোরবেলা ভেসে ওঠা ত্যানা দিয়ে প্যাঁচানো বাচ্চার লাশটার কথা। তাদের বাবা চিৎকার দিলেন, ‘এই পুকুরের মাছ আর কখনোই খাওয়া যাবে না;’ তাদের মা বললেন, ‘এই পুকুরে আজ থেকে কাপড় ধোয়া নিষেধ, থালাবাসন ধোয়াও নিষেধ, পারভিন।’ আর থানার মোটা দারোগা হাজি ইকরাম নিজে ক’বার বাঁশি বাজিয়ে তার সঙ্গী পুলিশ কনস্টেবলদের বললেন, ‘কীরে তোরা বাঁশি বাজানো থামাইলি ক্যান? আমার চাকরিডা খাইতে চাইস? দেখছস না, বাচ্চার হাত শিং মাছে খাইয়া ফেলছে, বাচ্চার পা শোইল মাছে ঠোকরাইয়া ছ্যাঁদা করছে? বাইর কর এই পাড়ার কেডা কেডা পেরেগনেন্ট আছিল, কার কার বাচ্চা হওনের কথা আছিল। আর দ্যাখ আনোয়ারা ম্যাডামে ছয় নাম্বার বাচ্চায় বিরক্ত হইয়া সেইডারে গলা দাবানি দিয়া মাইরা ফালাইল কি-না!’
ততক্ষণে পুকুর পাড় ঘিরে লোক আর লোক। পারভিন বারবার পুকুরের শেষ মাথায় রাখা সাদা ত্যানা প্যাচানো বাচ্চাটাকে দেখছে এবং ডুকরে কেঁদে উঠছে নাঈম দৌড়ে পারভিনের কাছে গেল, বলল—যে কথা জাহেদ স্পষ্ট শুনল যে, নাঈম তার বোনকে বলল—’পারভিন, পাগল হইছ নাকি? লোকে ভাববে এইটা তোমার বাচ্চা, মানে আমার বাচ্চা।’
নাঈমের কথা শুনে ফেলল পুলিশ কনস্টেবল তারা মিয়া। সে তার বাঁশিতে ফুঁক দিয়ে বলল, ‘কী কইলা নাঈম, তোমার বাচ্চা ওইডা?’ নাঈম ভাই তখন তার প্রায় পায়ে পড়ে যায়। সে কোনোমতে ওইভাবে মিনতি জানিয়ে তাকে বলল, ‘তারা মিয়া স্যার, তারা মিয়া স্যার, চুপ করেন, চুপ করেন। আমি খালি একটা কথার কথা বলছি। আমার বাচ্চা হবে কোথা থেকে? আমি তো আপনের ছোট ভাই নাঈম। আমি কি এখনও বড় হইছি?’
নাঈম সত্যি বড় হয়েছে কি-না, সেটা সে এবার তারা মিয়াকে দেখাল তার দু চোখ হাত দিয়ে ওপর নিচে টেনে বড় করে করে। বলল, ‘এই দ্যাখেন, আমার চোখ দ্যাখেন। এই চোখ বাচ্চা জন্ম দেওয়ার মতো চোখ, বলেন?’
তারা মিয়ার সঙ্গী খ্রিস্টান কনস্টেবল আন্তর্জাতিক গোমেজ বাঁশি বাজালেন ফুত-পুত-পুত-পিড়িং এবং জোরে চিৎকার করে পুকুরের এপাড়-ওপাড়ের সবাইকে শুনিয়ে বললেন, ‘বাচ্চা হইতে লাগে, চোখ লাগে না, হা-হা। বাচ্চা হইতে কী জানি শুদ্ধ ভাষায় কয়, কী জানি—জননেন্দ্রিয়। আর লাগে নারীমানুষের ভ্যাজাইনা। হা-হা।’
জাহেদ সেই প্রথম জানল যে, ভ্যাজাইনা শব্দের এই তাহলে আসল অর্থ। পুলিশের দারোগা হ্যান্ড মাইক্রোফোনে পুকুরপাড় থেকে সবাইকে সরে যাবার আদেশ দিলেন: ‘পুকুরের পাড় খালি করেন। দুই-চার-দশ দিনের বাচ্চা নিয়া এত উতলা হওনের কিচ্ছু নাই। সরেন সরেন। ওরে তারা, ওরে আন্তর্জাতিক, তোরা বাঁশি বাজাইয়া লোকজন সরা। সাম্বাদিকরা আইলে দৈনিক কীৰ্ত্তনখোলায় খবরের চোড়ে আমারদিগের চাকরি শ্যাস।’
তখনই ট্রাক দাঁড়ানো বালির মাঠ পেরিয়ে পুকুরপাড়ে এসে দাঁড়ালেন একসঙ্গে তিন ব্যবসায়ী- মন্টু খাঁ, বিদ্দুত বিশ্বাস ও তাদের সবার স্থানীয় বস সালাম জমিদার। সালাম জমিদার ‘অডার’ করলেন, ‘মন্টু ইংরেজিতে কও। ইংরেজি ভাষার এই সিছুয়েশনে একটা বিশেষ গুরাত্ব আছে।’
মন্টু খাঁ দারোগার পাশে দাঁড়ানো পুলিশের হাত থেকে নিলেন হ্যান্ড-মাইক্রোফোনটা এবং সেই হ্যান্ড-মাইক্রোফোন নিজের হাঁটুর কাছে ঝুলিয়ে রেখে মুখের সামনে মাইক্রোফোন ধরাই আছে এমন এক ভাব করে বললেন: ‘হ্যালো—ওয়ান টু থ্রি, হ্যালো হ্যালো। হিন্দু পাড়ার লোকেরা যতই আই সে ইউ করুক, যতই আই টেল ইউ করুক, ওয়ান থিং ইজ কিলিয়ার—এই বাচ্চার হিন্দু-মুসলমান নির্ণয়ের বয়সই হয় নাই। বড় মানুষ হইলে না হয় একটা হিন্দু-মুসলমান কথা ছিল। আর মদগুর মাছে সারারাত ধরিয়া বাচ্চাটার পেনিস খেয়ে ফেলিয়েছে। পেনিস হ্যাজ ইটেন মদগুর মাছ। তাই, আই সে যে, এ লইয়া হিন্দু-মুসলমান ঝগড়ার কোনো অর্থ নাই। আই থিং, এইটা সেই মমতা নামের দ্যাট টল মহিলার নিউবর্ন বেবি। কিন্তু সামাদ মিয়া আমাদের সকলকে আজ সকালে সালাম সাহেবের বাসায় নিজের বাপ-মায়ের নামে স্যোয়ার করিয়াছেন যে, হিজ ইজ নট হিজ চাইল্ড। হি হ্যাজ নো চাইল্ড, মানে আঁখি ছাড়া। আর বলিয়াছেন মমতা ইজ এ ব্যাড ওমেন যে কিনা টাকার জন্য সব করবে, বাচ্চা পুকুরে ছুড়িয়া দিয়া মদগুর মৎস্যের ছোবলেও ফেলিবে। এই রহস্য অতএব উদঘাটন ইম্পসিবল। কারণ আমরা খোঁজ নিয়াছি যে, মমতা নামের টল মহিলা বরিশাল শহরের প্রখ্যাত জর্ডান রোড ছেড়িয়া চিরতরে তার নানাবাড়ি চাঁদপুর চলিয়া গ্যাছে। যাউক সে। হার লেট গো, উই পিসফুল। নো ব্যাড ওমেন ইন ভাটিখানা, উই পিসফুল। ওকে? ওকে?’
সবাই ওকে ওকে বলতে বলতে পুকুরপাড় থেকে চলে যাচ্ছে, খ্রিস্টান পুলিশ আন্তর্জাতিক গোমেজ তখন বাঁশি ফুঁকে চিৎকার দিয়ে উঠল, ‘জর্ডান রোডে ওই মহিলা তার বাসার সামনে একটি কাগজ লটকিয়ে গিয়েছে যে, শয়তান সামাদের সাথে হওয়া আমার সন্তান আমি ভাসাইয়া দিলাম ভাটিখানায় সামাদ শুয়ারের বাসার পাশের বাড়ির পুস্কুনিতে, জানি সে, জানি সে…’ আন্তর্জাতিক তার কথা শেষ করার আগেই মোটা দারোগা হাজি ইকরাম আন্তর্জাতিক গোমেজের পাছা বরাবর হাতের শক্ত লাঠির জোর বাড়ি মেরে বললেন, ‘ভাইয়েরা, বোনেরা, আন্তরজাতিকের প্রধান সমস্যা হইল মিথ্যা কথা বলা। এইরকম কোনো চিঠি আমরা পাই নাই। সবই আমার এই স্টুপিড কনস্টেবল বানাইয়া বলতেয়াছে। সাম্বাদিক আইলে আমি পরিষ্কার বলিয়া দিব যে, এইটা আন্তরজাতিক গোমেজেরই অবৈধ বাচ্চা। আর সালাম জমিদার সাহেবে নিজে যখন মন্টু খাঁ-র গলা দিয়া কথা বলিয়াছেন, তখন অন্য কোনো কথা নাই। তখন আর অন্য কোনো কথা থাকতে পারে না, পারে না, পারে না।’
সবাই বাড়ি চলে গেল। এবার পুকুরের পাড়ে আমরুল, হেলেঞ্চা, মালঞ্চ ও ঘাগড়ার ঝোপের পাশে কোদালের চার কোপে কাটা হল চার বড় ডাবল পদাউক পাতার সমান মাটির তাল এবং সেই ছোট পাখির গর্তের মতন গর্তের পাশে দাঁড়িয়ে দু লাইনের জানাজার দোয়া-নামাজ পড়ানোর শেষে কাপড় পেঁচানো বাচ্চাটাকে রাখা হল ওই টুটাফাটা ভেজা খোঁচে।
পারভিন তখন আবার কেঁদে উঠল উহুখ-উল্লখ করে। আবার নাঈম তাকে বলল, ‘বোকামি করছ কেন? সবাই দেখতেছে।’ আর জাহেদ দেখল ঘাগড়ার ঝোপটাকে আসলে বেড় দিয়ে ঘিরে রেখেছে কালমেঘের ঝোপালো গাছ এবং তার ছোট-ছোট ফুটকি ফুলগুলোর ফাঁক দিয়ে সেদিকে উঁকি মারছে মমতা নামের এক মহিলার মুখ আর আশ্চর্য যে, ওই ফুটকি ফুলগুলোকে দ্যাখো কীভাবে মাটি বরাবর নামিয়ে আনছে মমতার চোখের পানির বড় বড় ফোঁটা—এতই বড় ফোঁটা ছিল সেগুলো।
জাহেদ ঠিক করল, সে একদিন শিগগির তার ভাইয়ের গুণ্ডা বন্ধু ব্লেড ঘোরানো রাঙ্গাকে বলবে, ‘রাঙ্গা ভাই, সামাদ সাহেবের পিঠে আগামী মোহাররমের দিনে ব্লেড দিয়া আপনি খচাখচা করলে না আমি, রিয়াজ, মিরাজ, মিজান ও কাইল্লা কবিরে বুঝব যে, আপনে আমাদের রাঙ্গা আলেকজান্ডার।’
.
শামছুর রিকশা এতক্ষণে পুরো ঘেরা হয়ে গেল মহাবাজ মোড়ের ভয়ার্ত, বিমূঢ় ও ধ্যানশীল লোকজন দিয়ে। তারা ভীত, কারণ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান মারা গেছেন, আর ওদিকে মুরাদও। তারা বিমূঢ়, কারণ এইমাত্র খবর এসেছে, ভোরোটটি গান্ডু মুরাদকে মারেননি। তিনি একজন হিন্দু হয়েও ঘোষণা দিয়েছেন, ‘যদি আমি ওই বাচ্চা পোলারে মারিয়া থাকি, তা হইলে জ্যানো আমার অবস্থা হয় আবরাহার লাহান – আবরাহার হাতির বাহিনী কিছুই করতে পারে নাই সামান্য কয়ডা হইলদা-সবুজ ছুডো ছুডো আবাবিল পক্ষীর সামনে। ওই পক্ষী আইয়া কঙ্কর ফেলল, আর আবরাহার হাতির বাহিনী ফানাফানা হইয়া গেল, চাবানি ঘাসের লাহান হইয়া গেল। আমি রাজা ভক্তি মিশ্র যুদি ওই সামান্য বাচ্চা পোলারে সোনা কাইট্যা, গলা কাইট্যা মারিয়া থাকি, তাহা হইলে আমারে জানি আল্লাহ-ভগমান-খোদায় সামান্য মশক দুই লক্ষ পাড়াইয়া আজ রাইতেই ফানাফানা করিয়া দ্যান।
আর তারা ধ্যানশীল, কারণ এমন এক ঘন হয়ে আসতে থাকা রাতে যখন অদূরের বিলের থেকে ডাক উঠছে ‘মডি মডি’ আর সেই ডাক হাওয়ায় ভেসে আসছে মাদল শসা, মাদল ঝিঙা গাছগুলোতে ঝুলতে থাকা ধুন্দুল ও ঝিঙের খরখরে চেহারার লাখো ফুটোর মাঝখান দিয়ে প্রায় চুঁইয়ে চুঁইয়ে—যেভাবে স্পঞ্জের মধ্যে ঢোকে পানি, আবার বেরোয়—আর তাই শব্দটাকে শুনতে লাগছে হোমঙড হোমম্ড মতো, যেন বা এক লক্ষ লোককে তাদের গণদাফনের আগে সাজিয়ে গোসল দেওয়া হচ্ছে বিলের পাড়ে এক লাইনে শুইয়ে, এক দোয়ার নিচে, এক মন্ত্রের নিচে—তো, তখন তারা ধ্যানগম্ভীর হবেন না তো আর কী হবেন?
এই লোকগুলোর কাউকে কাউকে জাহেদ চেনে, আবার অনেককেই সে চেনে না। রঙিলা যে লোকের নাম, ওই যার বুকের বাম পাশে বড় এক ফোঁড়া মতো, সে শামছুকে বলল, ‘তুইও আরিয়াল খাঁ যাস শামছু? মরণের শখ হইছে বড়লোকগো লগে দল বাইন্দা?’
জাহেদের বাবা রঙিলাকে বললেন, ‘কী বলো রঙিলা? আমরা বড়লোক? চালের দাম দিতে পারি না, আর আমরা বড়লোক?’
চাল ব্যবসায়ী বিজয় মহাজন তার হাতের সাদা চাদরটা শূন্যে ভাসিয়ে দিলেন। এ-ও তার কথা বলার এক স্টাইল—গরিবের প্রতি তুচ্ছার্থে বলা। সেই চাদর এসে ছুঁয়ে দিল কাশেমের গালের বাম পাশ। জাহেদ হাত বাড়িয়ে চাদরটা ধরতে গিয়েও ধরল না, কারণ এটা—তার ব্যক্তিগত হিসেবে—জঘন্য গুইসাপ খছাকের জঘন্য বাপের জঘন্য চাদর। বিজয় মহাজন বললেন, ‘চাইলের দাম দিতে পারেন না তো খাসলতের জন্য। সরকারি চাকরিতে টাকা কম চুরি করছেন? কিন্তুক রাখছেন লুকাইয়া। বাইর করতে পারতেছেন না। আপনাগো পুস্কুনির মান্দারের পাড়ে খালি মোছলমান বাচ্চার ডেডবডিই পাওয়া যায় না, ওইহানে গর্ত খোঁড়লে আমার সব চাউলের সকল দামও পাওয়া যাইবে।’
জাহেদ কথাটা শুনল। বুঝল যে, এ কথার মধ্যেও আবার সেই গুপ্তধনের কথাই বলা আছে। কিন্তু ‘মোছলমান’ বাচ্চার লাশের বিষয়টা সে মেনে নিতে পারল না। কথাটায় ঘোর আপত্তি জানিয়ে সে বলল, ‘বিজয় কাকা, বাচ্চা হিন্দু ছিল না মোসলমান, তা কেউ জানে না। মদগুর মাছ তার ওইখান খাইয়া ফেলাইছিল। যারা যারা বিশ্বাস করে সে ছিল মমতা নামের মেয়েটার বাচ্চা, সে ছিল আঁখির সৎ ভাই, তারা বোঝে সে ছিল মোসলমানের বাচ্চা। কিন্তু খ্রিস্টান পুলিশ আন্তরজাতিক গোমেজ আমারে নিজে বলছে, বাচ্চার চেহারাটা হিন্দু ঠাকুর দেবতাগো মতম আছিল।’
জাহেদের বাবা তার মাথায় আবার এক ঠাং জোর টোকা দিলেন, বললেন, ‘ভাষা ঠিক করো জাহেদ। ‘মতম’, ‘খাইয়া’–এইসব কী কথা? ছি!’
ঠিক তখন বাতাস উঠল শোঁ-শোঁ, বাতাস উঠল ফিরফিরানির অতিরিক্ত গোঁ-গোঁ। হ্যাঁ, কাল রাতেও বৃষ্টি হয়েছে, বোঝা যাচ্ছে আজও হবে। জাহেদ শুনল রড-সিমেন্টের ব্যবসায়ী বিদ্দুত বিশ্বাস কাছেধারে তার বড় দোকানে কাজ করা লেনজাকে হামহুম করে বলছেন, লেনজা, মাল ভিতোরে তোল। শালার বৃষ্টি। ওই কাশেম ভাই, জিয়াউর রহমানরে মারছেনি বিষ্টির মইদ্যে? চটটোগ্রাম কাইল নি ভাসাইয়া লইয়া গেছে বৃষ্টি? হিন্দু গো পিছে যে লোক লাগবে, সেই লোক তো মরবেই ভরা বরোষায়।’
তার বাবা বিদুতকে বললেন, ‘হুঁ, হুঁ।’
বিদ্দুত দোকানে বসে থেকেই ক্ষেপে উঠলেন ভিড়ের উদ্দেশে, বললেন, এই চুদির ভাইয়েরা, সামনে থিককা সর। কাশেমের ছোড পোলাডারে দেহি।’
জাহেদ নিজে তার মুখ একটু বাড়িয়ে দিল বিদ্দুত বিশ্বাসের দিকে এবং তাকে বলল, ‘আপনেরে আমার পছন্দ না, বিদ্দুত কাকা। আপনি বাবা জেলে থাকতে বলতেন যে, শাহেদ ভাইয়া আনোয়ারা আপার সঙ্গে খারাপ কাজ করে, আর তা দিয়া আমাদের সংসার চলে। ছি!’
সে খুব খুশি যে, সারাজীবন নিজে অন্যের ‘ছি!’ শুনে শুনে এই প্রথম অন্য কাউকে ‘ছি!’ বলা গেল তাহলে। জাহেদের কথা শেষ হওয়া মাত্র হাউমাউ করে উঠলেন কাশেম মিঞা, ‘বিদুত, বিদুত, তুমি এইরকম এতখানি অকথ্য কথা বলেছ আমার পরিবার নিয়ে? বিদুত? বি-দ্-দু-ত।’
তার শেষ বিদ্দুত ডাকের মধ্যে কী এক আর্তি ছিল যে, সেটা শুনে সবার মন খারাপ হল। শামছু মন খারাপের চোটে বলেই উঠল, ‘এই জেবনে দুঃখের ভাগড়াই বেশি।’
বিদ্দুত চারপাশের প্রতিক্রিয়ায় ক্রোধান্বিত হলেন প্রচণ্ড। তিনি শামছুকে বললেন, ‘পৌরনীতি মারাইয়ো না, শামছু (তিনি আসলে বলতে চেয়েছিলেন ‘দর্শন’)। বাপের আগে বাল ফালানি পোলা ওই জাহেদ। ওরে আমি কীরকম সেনেহো করি, আর ও এতবড় একটা মিথ্যা কথা কইয়া দেলো? হায়, আল্লার খলিফারা, তোমরা সব বিচার কইরো। হায় জগদ্গুরু, তুমি সব বিচার কইরো।’
জাহেদ কান দিল না এই অসভ্য লোকের কথায়। কিন্তু বিদ্দুত ততক্ষণে নিজের গা-মন-মাথা সব ঝেড়ে নিয়েছেন দোকানের মেঝে থেকে বালু-সিমেন্ট ঝাড়ার মতো করে। তিনি জাহেদের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছেন সন্ধির হাত, আর একইসঙ্গে—তার দেখাদেখি—বাকি সবাই তখন যার যার হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিতে চাইল জাহেদদের রিকশাটাকে, কিন্তু দেখা গেল রিকশা সামান্য এগোতেই পিছিয়ে গেল ওই হাতগুলো, যেভাবে বিড়ালের মুখ থেকে তার মিনি-করাত বসানো জিভটা বের হয়ে সবসময় ফের ভেতরমুখো পিছিয়ে যায় এক অতি সাধারণ জিভ হয়ে। বিদ্দুত বিশ্বাস জাহেদের প্রতি ভালবাসা ভরা গলায় বললেন, ‘ছুডো মিয়া, তাইলে বাপের লগে তুমিও মরতে যাও? ভরা বরোষায়?’
জাহেদ মনে মনে বলল, ‘অসভ্য লোক। আস্তা অসভ্য লোক।’ কেন মরতে যাবে সে? তার এখন মরার বয়সই তো হয় নাই। আহ্-হা, মরার বয়সটা তো আগে হতে হবে, নাকি? সে লেনজার দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলল, ‘লেনজা, লেনজা, তুমি আমানতগঞ্জের বিলে আহো না ক্যান?’
জাহেদের বাবা এ সময়ে শরীর ঝুঁকিয়ে শামছুকে পার হয়ে তার ডান হাত বাড়িয়ে দিয়ে জাহেদের পিঠের ওপর বাড়ি মারলেন একটা, জোরে বললেন, ‘অ্যাই ছেলে, ‘আহো না’ আবার কী কথা? ছি! ছি!’
লেনজা জাহেদকে বলল, ‘জাহেদ, বোকা। ‘এগজিবিশন’ আইতে আছে না? আব্বায় সমবায়ের লগে মিইল্যা একখান টমেটো-কুমড়ার দোকান লইছেন। দেইখখো এই ফির সবচাইতে বড় কুমড়ার পুরুষ্কার কেডা পায়। বিলে যাওনের এহন টাইম আছে, দোস্তো?’
বিদ্দুত বিশ্বাস লেনজাকে তাড়া দিলেন, ‘শালার পুত, দোকানের রড গিয়া ঠেকতেয়াছে রাস্তার কুত্তার হোগার মধ্যে, সেইডার খবর নাই, আর আমার লেনজায় আছে এগজিবিশনের কুমড়া লইয়া। বাহ।’
জাহেদও জানে যে, ‘এগজিবিশন’ আসছে। সে এর মধ্যে মাইকে ঘোষণা শুনেছে, লোকজনকে বলাবলি করতে শুনেছে যে, বরিশালের জেলা এগজিবিশনে এবার লক্ষ্মণ দাস সার্কাস আসবে। তখনই তার মনে হয়েছে, হুম, তাহলে তার দেখা হচ্ছে বাকি তিন বামন-জোকার বগা, চন্দন ও চড়চড়ির সঙ্গে, দেখা হচ্ছে গুয়াহাতি নামের ওই হাতিটার সঙ্গে; আর কী সেই দশ রাজহাঁস, কী কঠিন সুন্দর তাদের সব নাম! অতগুলো নামের মধ্যে থেকে শুধু একটা নামই মনে আছে তার—কুঞ্জরবদন। তাহলে আবার দেখা হচ্ছে কুঞ্জরবদনের সঙ্গেও। জাহেদ মনে মনে ঠিক করে রেখেছে, তেগুচিগালপা গিয়ে সে ওখানকার ওই দেশের লোকাল গুধু-র মতো নতুন এক পান্তামুখী হাঁস কিনবে—কখনোই রাজহাঁস না, কখনোই রাজহাঁস না—আর সেটার নাম রাখবে কুঞ্জরবদন।
সে লেনজার মুখে এগজিবিশনের কথা শুনে ভেতরে ভেতরে উত্তেজিত হয়ে উঠল ঈমানের জোকার বন্ধুদেরকে আবার দেখার কথা কল্পনা করে। তার মনে হল, ওদেরকে দেখা মানে ঈমানকে দেখা। যেমন তার আজকাল এটা হয়—বাসের গায়ে, টেম্পুর গায়ে ‘চাখার’ শব্দটা সে লেখা দেখল তো, সে ছুটে যাবে ওটাকে ছুঁতে, আর তারপর ভাববে, ঈমানকেই ছোঁয়া হয়ে গেল।
এর পাশাপাশি তার কাছে এগজিবিশন মানেই বিরাট সব দেশিকুমড়ো, বিলাতি কুমড়ো, চালকুমড়ো, মিষ্টিকুমড়ো, গুড়কুমড়া দেখা—আর সেই সঙ্গে নারকেলের সাইজের পেয়ারা, কাঁঠাল সাইজের বিলাতি বেগুন, মাসকলাই রং বিড়াল বাচ্চা সাইজের টমেটো এবং কোলবালিশের মতো লাউ, আর আনোয়ারা আপার দুই পাছা একসঙ্গে মেলালে যে সাইজ হয় সেই সাইজের বাঙ্গি, যাকে কাইল্লা কবির বলে ‘কদু’, বলে ‘ফুটি’। তখন কাইল্লা কবির আনোয়ারা আপার কথা বলতে বলতে হাসে আর হাসে, বলে, ‘এগজিবিশনের ওইসব পোরতিযোগিতার স্টলে গেলে তোরা দ্যাহস কে কী বাঘাড় সাইজ সবজি ফলাইল। আর আমার অবস্তা? ওইহানে স্টলে আনোয়ারা আপার কদু আর ফুটি দেইখ্যা আমার ওই জিনিস আর লামে না। হা-হা-হা।’
না, একটু আগের ভিড় ভেঙে সরে যাওয়া মানুষগুলো তাদের রিকশাকে মোড় ছেড়ে যেতেই দিল না। কারণ শ্যামলগাছের মাথার কাছ থেকে গায়েবি আওয়াজের মতো করে চিট্টাগুড় চাচা ভিড়ের মানুষদের নির্দেশ দিয়েছেন জাহেদদেরকে যতটা পারা যায় বাধা দিয়ে যেতে। তাই তারা সব রিকশা বেড় দিয়ে কানাঘুষা করছে, ফিসফিস করছে। তো, সেই চিট্টাগুড় এইমাত্র শ্যামলগাছের মাথা ছেড়ে এঁকেবেঁকে পড়ে গেলেন তেলসুর ও ডেউয়াদের মাঝখানে। তিনি এখন আর কথাই বলতে পারছেন না, কারণ এই অনন্তকাল কোনাকুনি রাস্তায় রিকশার কাছে আসবার দীর্ঘ-দীর্ঘ হাঁটাপথের ক্লান্তি তাকে হঠাৎ ঘিরে ধরেছে ঝমঝম। ভিড়ের ভেতরে এবার কে যেন—জাহেদ চেনে না লোকটাকে—বলে উঠলেন, ‘কাশেম, তুমি বোকা নিকি? জিয়াউর রহমান আইস্যা আছরয় নিছে তার লাখুটিয়ার খালে। আর আইজকা তুমি যাও আড়িয়াল খাঁ? আর্মিরা আইজকা নৌকা চলতে দেবেয়ানে?’
তার বাবা বললেন, যদিও তিনি পানিতে চলা আর্মিদের টহল নৌকার কথা শুনে ভয় পেয়েছেন, সেই ভয় লুকিয়ে তিনি বললেন, ‘আর্মিদের নৌকা তো আমাদের কী?’
জাহেদ খুশি হল বাবার কথা শুনে। সে রিকশার রডের ওপর বসেই মাথা পেছনদিকে ঘুরিয়ে বাবাকে বলল, ‘বাবা, আমি আমার দেখা আছে। গত বছরের এগজিবিশনে মনে নাই তারা ১৯৭১ বানাইছিল উই এগজিবিশন মাঠের কোনায়? খড়ের বাড়িঘর বানাইছিল কত্তোগুলা। আর পাকিস্তানি বাহিনী আইস্যা মনে নাই যেই বাঙালির খ্যাড়ের ঘরবাড়িতে আগুন দিল, তখন একটা আর্মির হা-হা একটা আর্মির পাছার কাপড়ে লাগল আগুন হা-হা আর সে ওমা ও বাবা বাঁচাও বাঁচাও বইল্যা মনে নাই হা-হা কী দৌড় দিছিল মৎস্যমেলার পানির ফুয়ারার দিকে হা- হা-হা আর্মি।’
তার বাবা জাহেদকে বললেন, ‘জাহেদ আমি তোমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেব। তুমি বলছ খ্যাড়, তুমি বলছ আইস্যা, তুমি বলছ বইল্যা, তুমি ফোয়ারাকে বলছ ফুয়ারা। কাল খিচুড়িকে বলবা খেচুরি, রিকশাকে বলবা রিকা। ছি, জাহেদ ছি! শামছু, তুমি ওই বস্তিতে-মেশা জাহেদের মাথায় একটা বাড়ি মারো জলদি।’
তখনই ভিড়ের পেছন দিক থেকে পুরো ভিড়ের মাথার ওপর দিয়ে খরগোশের মতো করে, ভেকের মতো করে লাফ দিয়ে উঠে রিকশায় জাহেদের বাবার পাশে চড়ে বসলেন পুরো আমানতগঞ্জ-ভাটিখানা-কাউনিয়া-বেলতলা-তালতলার দুর্জন দুষ্টকর্মাদের সম্রাট ভোরোটটি গাণ্ডু ওরফে ছেঁচকি ওরফে রাজা ভক্তি মিশ্র ওরফে শুধু ভক্তি। হ্যাঁ, এই বিরাট এলাকার পুরো হিন্দু সম্প্রদায়ের রাজা সে, পুজোর রাতে মন্দিরের সামনে আরতির নাচ নাচে এক্কেবারে ল্যাংটো হয়ে, আর তখন কোনো মহিলা তার দিকে তাকায় না চোরাচোখে ছাড়া, কোনো পুরুষ তার দিকে তাকায় না হিংসা ও ঈর্ষা ছাড়া। কিন্তু বছর তিনেক আগে জাহেদরা যখন আরও ছোট, তখন তারা একবার ঠিকই নাচের সময়ে একটুখানি সাইজের এক কাঠি দিয়ে টুক-টুক গুঁতো মেরেছিল তার ওইখানে। তবে ভোরোটটি গাণ্ডুর কোনো খবরই ছিল না তাতে, কারণ তিনি সারাজীবন শত শত মানুষের বাড়িতে তার চোরের দল নিয়ে রাতবিরেতে চুরি করতে নেমে নিজের সিদকাঁটা গর্তের মধ্যে ঘাপটি মেরে পড়ে থেকে থেকে জেনে গেছেন যে, কী করে যখন-তখন স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়, কী করে এই চাইলেই ধ্যান ও এই চাইলেই তপস্যায় চলে যেতে হয়।
জাহেদ শুনেছে কয়েক বছর আগে রিয়াজ-মিরাজদের পেছনের ঘরে—যেখানে থাকে ওদের বড় নাসিম ভাই ও তার ‘সেকছি’ বউ জুঁথি ভাবি; ওদের আরেক ভাই মন্টু ও তার দেখতে পচা বউ লাইলি—সেখানে এক রাতে কী করে নিজেরই কাটা গর্তের মধ্যে সারারাত চুরির সুযোগের অপেক্ষায় ধ্যানে বসে থেকে থেকে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন ভোরোটটি। ভোরের দিকে দলের লোকেরা তার ঘুম ভাঙানোর শাস্তি এড়াতে তাকে ফেলে রেখে চলে গিয়েছিল চুপচাপ, এমনকী তার বডিগার্ড বেয়াদব বাহারও। ভোরোটটি সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখলেন তিনি ওই জায়গায় পড়ে আছেন একা, আর চিৎকার দিলেন, ‘বাহার বাজু, বাহার বাজু।’
তখন রিয়াজ-মিরাজের বাবা আহকামউল্লাহ মুনশি-ভোরোটটিকে নিয়ে ছোটবেলা থেকেই কম আতঙ্কিত ও বেশি বিরক্ত মুনশি—তার কাছে গিয়ে বললেন, ‘নাশতা কইরা যাও, ভোরোটটি।
ভোরোটটি বুঝলেন এ কথার মানে। তিনি শুধু মাটিতে শুয়ে থেকে তার দু চোখ সামান্য খুলে পাশে রাখা বিরাট চকচকে ভোজালিটা হাত দিয়ে ছুঁয়ে গা-এলানো এক কণ্ঠে বললেন, ‘মুনশি, তুমি আমারে চেনো। পুলিশরে খবর না দেলে হইত না? পুলিশে কি আমার গায়ের একখান লোমেও হাত দেতে পারবে? আমি চোর হইতে পারি, খুনি হইতে পারি, কিন্তুক ভাড়িখানা ভদ্রলোকের পাড়া গো, ভদ্রলোকের পাড়া। হেই পাড়ায় তুমি পুলিশ আনলা, মুনশি?’
আহকামউল্লাহ মুনশি ওই দৌড়ে গেলেন তার ঘরের ভেতরে এবং বড় দুই ছেলে নাসিম ও মন্টুকে তাদের যার যার বউয়ের কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে পাঠালেন থানায়। ব্যস্তসমস্ত হয়ে তার ছেলেদেরকে তিনি বললেন, ‘দৌড়াইয়া থানায় যা, আমি ভুল কইর্যা ফেলছি। গিয়া বল আব্বায় সব বানাইয়া বলছে। অতেএপ আমনেরা আইসসেন না আসলে কোনো চোর আমাদের বাড়িতে আসে নাই।’
সেই গাণ্ডু, সেই ছেঁচকি বুড়ো এখন কাশেমের পাশে, তারা দুজনে রিকশার একই সিটে বসা। তিনি মুখ দিয়ে আওয়াজ করলেন ‘বাও’, তিনি গলার ভেতর থেকে আওয়াজ করলেন ‘ঘুস’, আর সবাইকে বললেন ‘চুপ’ এবং রাতের অন্ধকারকে দেখে নিয়ে বললেন, ‘একটাও তারা নাইকক্যা।’ সেইমাত্র জাহেদের বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল অজানা হতাশা ও ভয়ে-আকাশে তারা না ফুটলে তার আজ আড়িয়াল খাঁ-য় গুপ্তধন পাবার সব আশা যে বৃথা।
ভোরোটটি এবার সিটে বসে থাকা শামছুর পিঠে সোজা লাখি মেরে তাকে রিকশা থেকে ফেলে দিয়ে বললেন, ‘কাশেম, তুমি কি কিচ্ছু জানো না? তালতলীর ওইহানে রাইতে নদীতে কী কী হয় তার কিচ্ছু জানো না? কয়ডা জ্যাতা লোক যে আর জ্যাতা নাই কাউনিয়া-আমারতগঞ্জ-মহাবাজ-বেলতলা-ভাড়িখানায়, সেইসবের কিচ্ছু জানো না তুমি? লোকগুলা গ্যাছে কই? সব পানিতে। সবড়ের জেবন গ্যাছে আড়িয়াল খাঁ-র পানিতে।’
কাশেম বললেন, ‘রাজা ভক্তি মিশ্র, আমি আপনারে ভোরোটটি বলে ডাকি। কিন্তু আজ থেকে আপনাকে ডাকব রাজা ভক্তি মিশ্র, ডাকব আপনি করে। আমি আসলে আপনার পায়ে পড়ি, আমার বড় ছেলে শাহেদকে জানে মারবেন না। ও না বুঝে আপনার দলের চোর জনি না মুকুলকে মারছে। সে গুণ্ডাদের সাথে মেশে, সে রাঙ্গা-আলমাজীদের সাথে মেশে, সে বোঝে নাই। বাচ্চা ছেলে, বোঝে নাই। আমি ঠিক করছিলাম আগামীকাল তাকে অন্য শহরে পাঠায়ে দেব, কিন্তু তখনই আল্লাহ আপনার সাথে এই মিলিয়ে দিলেন আমারে। অন্য শহরে গেলে আমার ছেলেটা একদম নষ্ট হয়ে যাবে, রাজামশাই। আপনি ওকে ক্ষমা করে দেন, রাজামশাই।’
কথাটা বলে কাশেম মিঞা ভোরোটটির দু-হাত জড়িয়ে ধরলেন যেভাবে ছবিতে দেখা যায় যে, সম্রাট আকবরের হাত জড়িয়ে আছেন আবজাখিয়ার সম্রাট গুয়াদিমভ জড়িদরভ। তার বাবার মুখের এই তেলতেলে আকুতি শুনে জাহেদের মহাবিরক্তি লাগা শুরু হল। কিন্তু সে চারপাশে তাকিয়ে দেখল ভোরোটটির ভয়ে ভিড়ের সবাই কেমন দূরে সরে গেছে। এমনকী চিট্টাগুড় চাচাও তেলসুর ও ডেউয়াদের মধ্যে শুয়ে থাকা ছেড়ে পিছিয়ে গেছেন চালতা, তেঁতুল ও শোনপাত্তি গাছের লাইনে, আর তিনি জাহেদদের আড়িয়াল খাঁ যাবার ব্যাপারটা শিকেয় তুলে রেখে এখন চিৎকার করছেন তার ফার্নিচার দোকানের মালসামানার কিছু একটা নিয়ে যে, ‘দুই দশে বারোটা চেয়ার, ছয় চোদ্দ চারটা খাট। খাটে শুইবেন কারণ কোমরের ব্যথা যাবে, আর জানালা বানাইবেন অর্ডার দিয়া বানাইবেন জানি প্ল্যান কইরা ওই জানালায় গিয়া মন ভালো রে ডাইক্যা আনতে পারেন।—এবার ছয় চৌকি, এবার ছয় চৌকি, এবার ছয় চৌকি! এবার চারপাই, এবার টুল, ওয় আল্লাহ এবার হাওয়াবালিশ! ঘুম আসছে গো—এবার হাওয়াবালিশ।’
হ্যাঁ, সবাই এরকম দূরে দূরে, কারণ পুরো রাস্তার দখল নিয়ে ফেলেছে একদল অস্ত্র হাতে লোক—তারা ভোরোটটির ‘অ্যাটাক বাহিনী। তাদের প্রত্যেকের হাতে হয় কিরিচ, কাটারি, তরবারি, না হয় ভোজালি কি ডাঙশ কি রামদা। জাহেদ রাস্তার আমানতগঞ্জের বিলের পাশটায় এই এদেরই একজনকে দেখল আর্মির মতো করে মাটিতে কনুই লাগিয়ে পুরো শোওয়া। তার হাতে কীভাবে যেন ধরা এক বীভৎসদৰ্শন কোঁচ, যাকে কাইল্লা কবির বলে, ‘গাণ্ডুর ট্যাটা, গাণ্ডুর ভল্লু’, আর মিরাজ তখন চিৎকার করে, ‘ওরে বস্তিবাসী দারশোনিক ফেরেন্ড, বল্লম-বর্শা কইতে কী লাগে?’
কাশেমের কথা শুনে ভোরোটটি মিনমিনে দুঃখিত গলায় ডাকলেন, ‘বেয়াদব বাহার বাজু, এদিকে আসো।’
বডিগার্ড বাহার বাজু আর্মিদের মার্চপাস্টের হুবহু নকল করে এসে দাঁড়াল রিকশার পাশে এবং তার হাতে ধরা ছোট্ট মাথাভাঙা বার-হ্যামার ধরনের পিস্তলটা উঠাল নিজের মাথার ওপরে আর আকাশে গুলি করল একটা’টিটিস’। সেই গুলির আওয়াজে গাছে বসা পাখিতে পাখিতে লেগে গেল পর্যাপ্ত ঝগড়া, আর পাখিদের ওই ঝগড়া চলমান থাকা অবস্থায়ই বাহার বাজু শ্রদ্ধাভরে কাশেম মিঞাকে বললেন, ‘রাজা ভক্তি মিশ্র এইয়া লইয়া আর একখান কথাও বলিবেন না। তিনি মন্টু খাঁ-র পুত্র মুরাদকে না খোজা করিয়াছেন, না হত্যা করিয়াছেন। তিনি পরিষ্কার জবানে ঘোষণা দিয়াছেন যে, তিনি যদি এত্তবড় বে-রহমি কাজটি করিয়া থাকেন, তাহা হইলে তাহার অবস্থা যেন হয় আমাদের পবিত্র কোরান শরিফের সুরা ফিলের আবরাহার লাহান, যেন আবাবিল পাখিদের মতম লাখ লাখ মশা আসিয়া তাহাকেও ছিনভিন করিয়া মারিয়া ফ্যালে।’
কাশেম মিঞা এই প্রথম ভোরাটটির এ শপথমূলক জবানবন্দির কথা শুনেছেন। তিনি একবার তাকালেন রাস্তার ওপরে দাঁড়ানো শামছুর দিকে, একবার সামনে রডে বসা ছেলে জাহেদের দিকে, আর শেষে তার বাঁয়ে বসা রাজা ভক্তি মিশ্রের দিকে। রাজা সামান্য মুচকি হাসলেন। কাশেম বুঝলেন এটা তাকে দেওয়া রাজার অভয়ের হাসি। অবশ্য অমন নিষ্পাপ হাসি দেখেও শেষমেশ ঘাবড়ে গিয়ে কাশেম থতমত অর্থহীন হঠাৎ বলে বসলেন, ‘চোর জনি না মুকুল তো মারা যাওয়ার সময় ‘রাজা ভক্তি মিশ্র’ বলে ডাক দিয়ে গেছে।’
বেয়াদব বাহার বাজু বেয়াদবের মতো এর উত্তর দেওয়া শুরু করবে, ভোরোটটি থামিয়ে দিলেন তাকে। বললেন, ‘নাম আমার ছেঁচকি, তাই কথা কইতেই হইল। আমার দলের চোর যুদি মরা যাবার সময়তে আমার নাম জপ কইরা যায়, সেইডা কি এইডা হইল যে, আমি তার নাম জপ কইর্যা বলছি তার মিত্যুর আমি পেরতিশোধ লইব?’
কাশেম চুপ। ভোরোটটি আবার বললেন, ‘আমারে কেউ নিজ মুখে বলতে হোনছে যে, জনি না মুকুলরে যারা যারা মারছে, তাদেরে রাজা ভক্তি মিশ্রে মারবে?
তার বিশাল বাহিনীর সবাই চেঁচিয়ে বলল, ‘না, রাজা না।’
এবার ভোরোটটি ঘুরে বসলেন কাশেম মিঞার দিকে, তারপর জাহেদকে বললেন, ‘ছুডো পোলা তুমিও শুনিও। ভোরোটটি চোর-ডাকাত-খুনি হইতে পারে, কিন্তুক সে জানে যে এইডা ভদ্রলোকের পাড়া। আর চুরি কইর্যা ধরা পইড়্যা যে-ছোড নামডাকহীম চোর ছ্যাঁচা খাইবে, স্যায় পাবলিকের হাতে তো মরতেই পারে, নাকি? তো, মুরাদের জরমো হইল বলতে গেলে আমার কোলে, আর আমি ওরে মারব? আমি এতখান অভদ্রলোক? আমারে মানুষ এতখান ভুল বোজে? কোরানে কী বলছে? বলছে, আছরয় চাইতেয়াছি ভোরের প্রভুর কাছে, আছরয় চাইতেয়াছি তার তৈরি করা জিনিসের খারাবি হইতে, আছরয় চাইতেয়াছি গিরায় ফুঁক দেয় যে মহিলা তার শয়তানি হইতে। বলে নাই, কাশেম?’
কাশেম ভোরোটটি ওরফে রাজা ভক্তি মিশ্রের মুখে আজ আবার কোরানের আয়াত শুনে নতুন করে ভয় পেলেন কিছুটা। তাই তিনি সামান্য সরে গেলেন তার কাছ থেকে এবং বললেন, ‘বলছে, রাজা। সুরা ফালাক।’
‘এইবার কেউ কেউ কি কইল? কইল, এইহানে মানুষে যে ভোরের মালিকের কাছে আছরয় চাইতেয়াছে, সেইডা বলা হয় নাই। তারা কইল, ফালাক মানে বলা হইছে, আছরয় চাইতেয়াছি নরকের মালিকের হইতে। এইডা কোনো কথা হইল? পিথিবির আলোকের যিনি জরমো দিছেন, তারে এইহানে বলা হইবে নরকের আগুনের মালিক?’
কাশেম বললেন, ‘তো?’
চিট্টাগুড় চাচা দুই গাছে দুই হাত, অন্য দুই গাছে দুই পা, আর ছিন্নরুহা গুলঞ্চ ঝুরির গায়ে লেগে থাকা মটর আকারের কমলা-লাল ফলের থোকায় নিজের মাথা ঠেসে দিয়ে বলে উঠলেন, ‘কথা সত্য। ফালাক মানে এইহানে, এই সুরায়—পোরভাত, ভোর। তো, ফালাকের মানে যারা বলে দোজখের আগুন, তারা ভুল যে বলে তা নয়। সেই কথা অন্যহানে ঠিক আছে। কিন্তুক তারা ভুল জায়গায় ঠিক কথা বলে। ওহ হো, কী যে কেলাতি!’
চিট্টাগুড়ের কথা পুরো উপেক্ষা-অবজ্ঞা করে কাশেমের ‘তো’-র উত্তরটা এবার দিলেন ভোরোটটি:
‘তো? একটাই কথা। ধরলাম যে, খোদারে এইহানে পোরভাতের মালিকের পাশাপাশি নরকের আগুনের মালিকও বলা হইছে। বলতেয়াছি যে, আমি যুদি মুরাদরে মারিয়া থাকি, আমি যদি তোমার পোলা শাহেদরে মারিয়া থাকার প্ল্যাম করি, আমি যদি মন্টু খাঁয়ের চৌকিদার মিল্টন মোল্লাহরে মারিয়া থাকার পোগরাম করি, তাহা হইলে যেন ওই নরকের অগ্নিকুণ্ড আমারে খাবলাইয়া খায়, তা যেন আমারে পোড়াইয়া জ্বালাইয়া অঙ্গার করে। আমার কতা শ্যাষ।’
কাশেমের মন শান্ত হল। জাহেদের মনও শান্ত হল বড় ভাইয়ের বিপদের আশঙ্কা এত সাফ-সাফ দূর হয়ে গেল বলে। কাশেম আবার হাত ধরে বসলেন ভোরোটটির। বললেন, ‘রাজা ভক্তি মিশ্র, আমি বিশ্বাস করলাম আপনি তাহলে মুরাদকে মারেন নাই, কিন্তু তা হলে কারা মারল মুরাদকে? ওইভাবে গলা কেটে কারা মারল মুরাদকে?’
ভোরোটটি সবাইকে শুনিয়ে উত্তরটা দিলেন তার, ‘ভাডিখানা-কাউনিয়া- আমারতগঞ্জের উপরে শনি আসিয়া বসছে। উত্তরবঙ্গের করাত-বাহিনী, রেলগাড়ি ভাইঙ্গা খাওয়া বিদেশিরা এইহানে আসিয়া বসছে। হ্যারা মানুষ কাটে করাত দিয়া। দ্যাখো, মুরাদরেও মারা হইছে করাতে। এই বিদেশিরা না গ্যালে আমারদের সামনের দিনে বিপদ—মহাবিপদ। আমারদের ভদ্রলোকের পাড়া ওই বিরিস্টল সিগারেট ফোঁকা জয়ন্ত, ওই ষাঁড়ের সমান ম্যাকানরো, ওই গরিলা সমান অরূপ…ওরা আমাদের পাড়া দখলে নেলে আমারদের সব শেষ। অতএপ সামনে যুদ্ধ হবে, অন্ধকার রাইতের অনিষ্ট হইতে আল্লাহ-খোদা-ভগবানের আশ্রয় চাইয়া যুদ্ধ হবে।’
ভোরোটটি তার শেষ ‘যুদ্ধ হবে’ কথাটা এত জোরে বললেন যে, চালতা-তেঁতুল ও শোনপাত্তি গাছের লাইনে পড়ে থাকা চিট্টাগুড় চাচা এবার শোওয়া থেকে সোজা দাঁড়িয়ে গেলেন তার মাথা দিয়ে আকাশ ফুঁড়ে, আর উইই উঁচু থেকে গায়েবি আওয়াজের মতো করে বললেন, ‘বিদেশিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হব-এ-এ-এ।’
ভোরোটটির পুরো বাহিনী সুর মেলাল চিট্টাগুড়ের এই যুদ্ধ-বারতার সঙ্গে, আর সেই বারতার শেষে ভোরোটটি গাণ্ডু শামছুকে ধমক দিয়ে ডেকে উঠলেন, ‘অ্যাই শামছু, রিকশা ঘুরা। জেবনে কাশেমের বাড়িতে লগগা মারি নাই, জেবনে ওর বাড়ির মাল তুলোন করি নাই, কারণ অয় ভরদোলোক। কামডি অয় আমাদেরে করতে দেয় নাই। কিন্তু তাই বইল্যা ওরে জানে বাঁচামু না? ওরে আমি আড়িয়াল খাঁ পাডামু হ্যার নিজের আর পোলার রক্তে আড়িয়াল খাঁ রাঙ্গা করতে?’
ছেঁচকি বুড়ার এই কথা শুনে জাহেদ শামছুকে টেনে কাছে এনে বলল, ‘শামছু, আমরা তোমার রিকশায় ক্যামনে হোই-হোই করি, সব তোমারে দেখাব। এমনকী তোমারে দুই হাজার টাকাও দিব। কিন্তু তুমি রিকশা ঘুরাবা না, তুমি তালতলী ঘাটে যাবা। তুমি তালতলী ঘাটে যাবা।’
পুরো ভিড়ের মধ্যে—ভোরোটটির ‘অ্যাটাক বাহিনী’-র মধ্যেও—গুঞ্জন উঠল যে, দুই হাজার টাকা এই ছেলে কোথায় পাবে? ‘দু-ই হা-জা-র টাকা’, হাহাকার করে বলে উঠল ওই ট্যাটা-ভল্ল-কোঁচ ধরে আর্মিদের মতো মাটিতে কনুই দিয়ে শুয়ে থাকা রাজার সৈন্যটা। তারপর সবার সামান্য খিলখিল হাসি; সবারই তখন মনে হচ্ছে, তারা এদিকে এগিয়ে এসে জাহেদের লাল গালটা টিপে দেবে। তখন চিট্টা কোন লম্বা পাইপের ওপাশের কিনার থেকে হাঁক দিয়ে উঠলেন, ‘পাগলের পরিবার। আড়িয়াল খাঁ আইজকা রক্তে যদি না বাসছে তো কইছি কী!’
তার শেষ ‘কী’ ডাকটা বাতাসের মধ্যে কাঁপতে কাঁপতে রিকশার দিকে ছুটে এল, আর জাহেদ মাথা নিচু করে সে ডাকের তরঙ্গকে এড়াল। কাশেম বুঝলেন, তাকে আড়িয়াল খাঁ যেতেই হবে, যেমন করে হোক ওই চরের জমিতে চাষবাস-ব্যবসাপাতি করে তাকে লস যাওয়া চার লাখ টাকা তুলতেই হবে। তিনি রাজা ভক্তি মিশ্রকে মোটামুটি সম্মান ও মোটামুটি অসম্মানের সঙ্গে একরকম জোর করেই নামিয়ে দিলেন রিকশা থেকে।
রাজা ভক্তি মিশ্র ওরফে ভোরোটটি ওরফে ওই মুহূর্তে সামান্য ছোট হয়ে যাওয়া কেবল ছেঁচকি বুড়ো চিৎকার করে উঠলেন, ‘শ্মশানে যাওয়ার আগের দিন তোগো বাসা বিট-বিট কইর্যা খুইল্যা লমু, কাশেম। তুই ভালবাসার মূল্য দেতে জানোস না। মোকারম আর মরজানি আমারে আগেই কইছিল তোর এই স্বভাবের কথা। তুই রাজা ভক্তি মিশ্ররে রিশখা হইতে নামাইয়া দেস? তুই রাজা ভক্তি মিশ্ররে আস্তে হইলেও ঠ্যালা দেস?’
কিন্তু কাশেমকে তার জবাব দিতে হল না, কারণ তাগড়াই শামছু ততক্ষণে জাহেদকে খুশি করে দিয়ে তার রিকশা এমনভাবে সামনে টান দিয়েছে যে, রিকশা এক নিমিষে মহাবাজ রোডের মোড় থেকে শফি মিয়ার গ্যারেজ, তারপর শফি মিয়ার গ্যারেজ থেকে পঞ্চায়েত বাড়ি জামে মসজিদের সামনে। জাহেদ খুশি-তালতলী রোড তাহলে শুরু হয়ে গেল। হুম, সে বাতাসে নদীর পানির গন্ধ শোঁকার চেষ্টা শুরু করে দিতে পারছে এতক্ষণে। তবে মূলত এ কারণ থেকেই সে সব থেকে বেশি খুশি যে, রাস্তার দুধার আর এখন ডান ও বাম দিক থেকে মাঝখানের দিকে সরে সরে আসছে না এবং গাছে গাছে এখন অন্ধকার থাকলেও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে—তার তাবিজ চুরির ধান্দায় থাকা লোকগুলো আর নেই। তবে বিরক্তির কথা যে, তারা এখনও পেছন দিক থেকে চিৎকার দিয়ে যাচ্ছে ঠিকই, সেই চিৎকার ভেঙে ভেঙে শোনাও যাচ্ছে ঠিকই। আওয়াজ এখনও আসছে যে, ‘জাহেদ মেঞা, আড়িয়াল খাঁ যাইয়ো না।’
জাহেদ রিকশা চালাতে থাকা শামছুকে জিজ্ঞাসা করল, ‘শামছু, আকাশে তো তারা নাই। নদীর উপরের আকাশেও কি একই হইবে?’
শামছু তখন তার পায়ের কাছে আঠার মতো লেগে থাকা কুকুরের দলটাকে তাড়াচ্ছিল লাথি দিয়ে দিয়ে। জাহেদ মাথা বাঁকিয়ে দেখল, রিকশা ধরে আসতে থাকা ওই কুকুরের দলের একটা কুকুর স্বয়ং তাদের বইঠো, মানে বুট্টি, গাঢ় বাদামি সারা গায়ে সাদা-সাদা ফোঁটাওয়ালা বুট্টির নকশা করা বুট্টি। জাহেদ শামছুকে বলল, ‘শামছু, লাথি মারবা না। আমাদের বইঠো।
শামছু রিকশা চালাতে চালাতেই জাহেদের কান মলে দিল এটা বলে যে, ‘ফাজলামি করো? বইঠো এইহানে আইবে কোথা দিয়া? আর বইঠো ঘুমায় রাইত আটটা বাজলেই। সব তোমার ফাজলামি। দুই হাজার টাকার কতা মনে আইল, আর কইয়া দিলা? দুই হাজার টাকা তুমি চেনো? সব তোমার দুষ্টামি। একদিন শাস্তি হইবে তোমার। একদিন বিরাট শাস্তি হইবে আমার রিশকা ধইর্যা হোই-হোই করা শুয়ারগুলার।’
তার বাবা বললেন, ‘শামছু, আদর করেই বলো আর যা-ই বলো, আমার ছেলেরে গালি দিবা না।’
শামছু বলল, ‘সরি, কাশেম ভাই।’
জাহেদ প্রচণ্ড লজ্জা পেল রিকশাওয়ালা শামছুর মুখে ইংরেজি ‘সরি’ শব্দটা শুনে। তার সবসময় খুব লজ্জা এইসব সরি, থ্যাংক-ইউ নিয়ে, আর বিশেষ করে জিলা স্কুলে বড়লোকের ছেলেগুলো যখন ‘বার্থ-ডে’ বলে, তখন। তাকে কাইল্লা কবির বলেছে, ‘বড়লোকেরা বার্থ-ডে করে। তারপর হ্যারা একখান জিনিস খায়, নাম হইল মদ, যেইটা খাইয়া চোরা ভোরোটটি গান্ডু চাচায় পূজার রাইতে ল্যাংটা হইয়া নাচে। সব আসছে ওই বারথ-ডে থিক্যা। পিথিবির যত পাপ, সব আসছে বারথ-ডে থিকক্যা।’
কবিরকে তখন মিরাজ পেছন থেকে লাথি মারে তার হাঁটুর দোলাটায়, বলে, ‘দরশন মারাও, শালা বোস্তিবাসী!’
জাহেদ মিরাজের মুখে সিনেমার মতো করে, সিনেমার নায়ক উজ্জ্বলের মতো লাজুক করে বলা ‘বোস্তিবাসী’ শব্দটা শুনে আবারও লজ্জা পায়। আবার জাহেদ জানে, এখন শামছুর ‘সরি’ শুনে তার বাবা শামছুকে বলবেন, ‘ওকে।’ ওই ওকে শব্দটা ভাবতেও তার লজ্জা লাগে। তার শুধু মনে হয় যে, তারা যেরকম রংচটা টিনের থালায় ভাত খায়, আর যেরকম কাঁঠাল পাতা হাতে ধরে উই দূর উঁচুতে পায়খানা করতে যায় পুকুরের পাড়ের মান্দারের পাশের কোঁতঘরে, তার সঙ্গে এইসব ইংরেজি শব্দ কোনোভাবেই যায় না, কোনোভাবেই না–আর গুড মর্নিং গুড-নাইটের তো প্রশ্নই আসে না।
সে হঠাৎ চিন্তা করতে লাগল, তার শিশি-বোতলটা কোথায়? নাহ্, সেটা তার মনে পড়ে গেল সাথে সাথেই। ঘাড় ঘুরিয়ে সে তার বাবাকে জিজ্ঞেস করল, ‘বাবা, আমার শিশি-বোতল আছে তো?’
তার বাবা কুকুরগুলোকে হ্যাট হ্যাট বলে হাত দিয়ে তাড়াতে তাড়াতে তাকে বললেন, ‘জাহেদ, বইঠো।
জাহেদ চিৎকার দিল, ‘সেইটা তো আমি আগেই বলছি। শামছু, বলি নাই? বাবা তুমি কি কিছু শোনো না? আমার বোতল?’
বাবা বললেন, ‘আছে। আমার পকেটে। তুই বোতল দিয়ে কী করবি? নদীর পানি বোতলে ভরে কী করবি? তোর মালেক হুজুর তোকে এইসব শিখাইছে, তাই না? আহারে, ছেলেটার মাথা কী করে খেয়েছে মালেকে? দিলাম আলিফ-বা শিখাতে, আর সে শিখাল গুপ্তবিদ্যা, কুফুরি, সব দুগ্গি-কাটনি। কী পাপ! কী পাপ!
শামছু আর নিতে পারল না এবার। মালেক হুজুরকে সে দেখতে পারে না। তালতলী ঘাট যখন প্রায় এসে গেছে, বইঠোর দল যখন এবার অনেক পেছনে, নদীর পানি থেকে যখন গন্ধ আসছে হলুদ-রসুনের এক আজব মিশ্রণের, শামছু তার রিকশা থামিয়ে দিল ঝটাৎ ব্রেক কষে, আর থেমে কাশেমের দিকে এক কদম এসে কাশেমের কানের ওপর পড়ে থাকা ঝাঁকড়া চুল তার নিজ হাতে সরিয়ে দিয়ে সে বলল, ‘আপনি কইলে গাঁড় মারব মালেকের? হ্যায় অ্যামনেতেও হিন্দু মেয়েদেরে লইয়া অসভ্য খারাব কথা কইছে। আমি হিন্দু গো একটু লেলাইয়া দেলেই হইবে। মোসলমানের পিছে লাগতে যাওনের সময় অগো ভয়ডর সব যায় গিয়া কই!’
জাহেদ হাই তুলল, ‘শামছু, থামলা ক্যানো খচ্চর শামছু—ছুছুছুছু?’
কাশেম শামছুর কথার উত্তরও দিতে পারেননি, লকড়-ঝক্কড় করতে করতে একটা আর্মির গাড়ি এসে থামল তাদের রিকশার পাশে। তা দেখে বুক ধক করে উঠল কাশেমের। জাহেদ রিকশার রডে বসেই নড়েচড়ে তাকাল সেই গাড়ির ড্রাইভিং সিটের দিকে। বাচ্চামতো চেহারার এক ছেলে, সামরিক ড্রেস পরা, গাড়ির জানালা দিয়ে মুখ বের করে কাশেমের উদ্দেশে বলল, ‘হয়আর আর ইউ গোয়িং?’
কাশেম বুঝতে পারলেন না যে, এ কথার ইংরেজিতে তিনি কী দিয়ে কীভাবে জবাব দেবেন। তাই তিনি স্রেফ ইংরেজিতেই বলে উঠলেন, ‘আড়িয়াল খাঁ।
ওই ছেলে এবার বলল, ‘আপনি বাংলায় বলেন। কেন যাচ্ছেন আড়িয়াল খাঁ? কে থাকে ওইখানে?’
কাশেম কাঁপতে কাঁপতে বললেন, ‘কেউ থাকে না। থাকবে। হোটেল হবে, লাইব্রেরি হবে। আমার জমি আছে। জমি দেখতে যাই।’
সামরিক লোকটা তখন তার গলা বাইরের দিকে আরও বের করে জাহেদের গালের উদ্দেশে তার হাত লম্বা করে দিতে দিতে কাজটাতে ব্যর্থ হয়ে শেষমেশ খেঁকিয়ে উঠল, ‘তা ভাল কথা। গুড। গুড। কিন্তু জানেন না, প্রেসিডেন্ট মারা গেছেন? একদিনও হয় নাই। যারা যারা আড়িয়াল খাঁ, লাখুটিয়ার দিকে যাচ্ছে আমরা তাদের সবাইকে মনিটর করছি। কেউই জানে না প্রেসিডেন্টের ডেডবডি কোথায়। তাই সবদিকে নানা সন্দেহ ঘনীভূত হইতেয়াছে।’
হেসে ফেলল জাহেদ। আর্মির লোকটার একটা ‘হইতেয়াছে’ শব্দেই ফটাৎ করে বেরিয়ে গেছে এ সত্য যে, সে আসলে খাঁটি বরিশাইল্যা, কিন্তু এখন ওই জলপাই-জলপাই কাপড় গায়ে দিয়ে কোনোমতে চেষ্টা করে যাচ্ছে সবাইকে বোঝাতে যে, সে টোকিওর সাহেব। সাহেব হলে মানুষ যে টোকিওরই হয়, সেটা স্কুলের নুরুল ইসলাম স্যার তাদেরকে হিরোশিমা-নাগাশিমা পড়াতে পড়াতে ভালমতো তাদের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছেন। জাহেদ মুখে বিড়বিড় করতে লাগল, নাগাশিমা-নাগাশিমা, আর অনুভব করতে লাগল যে, তার ভুল হচ্ছে কোথাও। আর সে জানে আর্মির লোকের এই বাধাটাই তার আড়িয়াল খাঁয় গুপ্তধন পাবার পথে যাওয়ার শেষ বাধা এবং এসব কোনো বাধাই টিকবে না যদি সে স্রেফ ঈমানের কথামতো নিজের ইচ্ছাশক্তি দিয়ে একটা ধ্যাত্ বলে দেয় সবকিছুর প্রতি। ঈমান তাকে বলেছে, ‘বিপদে পড়লে বন্ধু মনের ভিতরথে কইবা যে, যা বিপদ যা। কইবা যে—ধ্যাত। আর কইবা—কুলফু-আল্লা। মনে থাকবে?’
জাহেদের মনে আছে ঈমানের সঙ্গে যখন তার শেষবারের মতো দেখা হল, সেই যে চাখারের নদীর পানি জুড়ে মডি-মডি-ডিণ্ডিম-ডিণ্ডিম শব্দ, সেই যে ঈমান মিলিয়ে যাচ্ছে হাহা-খাঁখাঁ করা অন্ধকারে, লোকজন ঈমানকে সাহস দিচ্ছে পুলিশ তাকে কিছুই করবে না, কারণ তারা মুসলমান পুলিশ, আর এই ক্ষেত্রে মুসলমান এক ছেলের প্রতি উল্লঙ্ঘিত যৌন-নিপীড়ন চালিয়েছেন এক হিন্দু, অতএব তার ভয় নেই, তার কোনো ভয় নেই, তখন জাহেদ কী বিরাট সাহসের ছায়া দেখেছিল ঈমানের এতক্ষণের রংকানা চোখে, আর ঈমান তাকে কাঁদতে কাঁদতে কীভাবে সে মুহূর্তে বলেই যাচ্ছিল যে, সে জেলে থাকুক আর পুকুরের পানির নিচেই থাকুক, সে জানে সে সামনের দিনে ভাল থাকবে। ‘কেমনে আমি জানি সেইডা, জাহেদ?’ জাহেদ উত্তর দিতে পারেনি ঈমানের প্রশ্নটার, কারণ ততক্ষণে তার হাতটা জোরে মুচড়ে ধরে তাকে দূরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন জুম্মা ফরাজি। তখন ঈমানই বলেছিল, ‘জাহেদ, কুলহু আল্লাহ পড়ি আমি সবসেময়। তাই জানি।’
কিন্তু জাহেদের খালি মনে হচ্ছিল, ঈমানের এসব কথা আদতে অর্থহীন। সে ও ঈমান যে সামনের দিনে সবসময় ভাল থাকবে, তার কারণ একটাই—কারণ সামনের দিনে তারা দুজন একসঙ্গে থাকবে। জাহেদ তাকে সে রাতে বলেনি যে, আড়িয়াল খাঁর পানি থেকে অনেক গুপ্তধন পেয়ে খুব জলদি তার বিরাট টাকা হলে কিছুই যাবে আসবে না তখন ঈমান জেলে আছে নাকি মাদ্রাসায়, চাখারে আছে নাকি চরমোনাইয়ে। কারণ সে তখন যেখানেই থাকুক, দেখা যাবে কদিনের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে তেগুচিগালপা পর্যন্ত পৃথিবীর পথে পথে সে নির্বিঘ্নে নিরাপদে রয়েছে শুধু জাহেদের সঙ্গে, শুধুই জাহেদের সঙ্গে।
জাহেদ আর্মির লোকটাকে বেশ শুদ্ধ বাংলায় বলে উঠল, ‘আর্মি ভাই, আমাদেরকে সন্দেহ করার কিছু নাই। আমরা ভাল লোকজন। জিয়াউর রহমান আমার পরিচিত ছিলেন। তিনি আমাদের জিলা স্কুলে আসছিলেন। আমি মিথ্যা কথা বলি না। তিনি হেলিকপ্টারে নেমে আমাদের জিলা স্কুলে আসছিলেন। আমরা ক্লাসের ছাত্রেরা লাইন ধরে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম, আর তিনি যে কয়টা হাতে সেদিন তার হাত মিলাইছিলেন, আমার এই হাতটাও সেইটার একটা হাত। আর আমার বাবা খুব ভাল মানুষ। আমি তো বললামই যে, আমি ভাল, আবার রিকশাওয়ালা শামছুও ভাল। যেতে দিন।’
আর্মির ছেলেটা জাহেদের মুখে এই চ্যাটাং-চ্যাটাং কথা শুনে শুধু হাসল আর হাসল এবং বারবার তার মাথা গাড়ির ভেতরে একবার ফের বাইরে একবার করে করে বলতে লাগল, ‘বাচ্চা ছেলে, লাল্টু পোলা। বলে, যেতে দিন। দিন? দেন না, দ্যানও না, এক্কেবারে—দিন? হা-হা-হা। হাবিলদার গাড়ি ঘুরাও। যাও লাল্ট পোলা যাও। যেতে দিন—আড়িয়াল খিন। যেতে দিন-আড়িয়াল খিন। হাহ হা হা, বোম বোম বোম। অ্যাই বাচ্চা ছেলে’, জাহেদের উদ্দেশে সে তার উল্টো ঘুরতে থাকা গাড়ি থেকে চেঁচিয়ে বলতে লাগল, ‘ঘাসের উপর রুমালটা ছিল। ঘাম মুছবার জন্য যেই সেটা তুলতে গিয়েছি, অমনি রুমালটা বলল, ‘ম্যাও!’‘
জাহেদ সঙ্গে সঙ্গে ধরে ফেলল, আর্মির ছেলেটা কথা বলছে সুকুমার রায়ের হযবরল থেকে। অশ্বিনী কুমার টাউন হলে মাত্র গত ফেব্রুয়ারিতে সে নিজে অভিনয় করেছিল ওই নাটকে, ডিরেক্টর ছিলেন মিন্টু বসু। মাইকে বলত, ‘কাউনিয়া-ভাটিখানা-আমানতগঞ্জ ‘চাঁদের হাট’ আয়োজিত নাটক সুকুমার রায়ের হযবরল, পরিচালক মিন্টু বসু, তারিখ এত-এত-এত, সময় এতটা-এতটা-এতটা, টিটেকের মূল্য (কোনোদিনই মাইক নিয়ে রিকশায় ঘোরা ছেলেটা বলত না—টিকেট) মাত্র এত। ভাইয়েরা, অশ্বিনী কুমার টাউন হল, সদর রোড, বরিশাল। হ্যাঁ ভাই, হ্যাঁ ভোন, প্রিয় শহরবাসী—হযবরল আসছে। হযবরল বলতে আসছে যে, ‘পক্ষীরাজ যদি হবে, তাইলে ন্যাজ নাই কেন?’‘
জাহেদ জানে না আর্মির ছেলেটা শুনল কী শুনল না, তবু সে অন্ধকারে মিলিয়ে যেতে থাকা সামরিক গাড়িটার দিকে তাকিয়ে নেশাগ্রস্তের মতো চেঁচিয়ে বলল, ‘আমার নাম শ্রী কাক্কেশ্বর কুচকুচে, ৪১ নং গেছোবাজার, কাগেয়াপট্টি। সাত দুগুণে কত হয়? সাত দুগুণে চোদ্দ হয়। সাত দুগুণে চোদ্দর নামে চার, হাতে থাকল পেনসিল। কিন্তু তুমি যখন বলেছিলে, তখনো পুরো চোদ্দ হয় নাই। তখন ছিল, তেরো টাকা চোদ্দ আনা তিন পাই। আমি যদি ঠিক সময়ে ধাঁ করে ১৪ লিখে না ফেলতাম, তাহলে এতক্ষণে হয়ে যেত চোদ্দ টাকা এক আনা…।
শামছু জাহেদের মাথায় ভালই জোরে এক ঠোনা মেরে বলল, ‘জাহেদ থামো। কী বকবক করে এই ছেলে কাশেম ভাই! আমরা তালতলী বাজার আইস্যা পড়ছি।’