এক
সন্ধ্যা দ্রুত পায়ে এই শহরের প্রান্তসীমার গ্রাম-গ্রাম এলাকাটাতে নামছে আর তেরো বছরের বাচ্চা ছেলে জাহেদের ততই বেশি করে মনে হচ্ছে যে, আজ রাতের নৌকায় বাবার সঙ্গে আড়িয়াল খাঁ নদীতে যাবার ব্যাপারে এ বাড়ির লোকগুলোকে রাজি করানোর সময়টুকু তার কমে আসছে, কমেই আসছে। ‘রাতের নৌকা’, শব্দ দুটো নিয়ে ভাবল সে। তার মনে হল, ব্যাপারটার মধ্যে কেমন এক শান্ত ও কম্পনশূন্য কী যেন আছে, আর সারাদিন ধরে গড়িয়ে চলে রাতে পৌঁছানো দিনের মধ্যেও তো আছে কেমন অচাঞ্চল্য, স্থিরতা। অন্যদিকে সন্ধ্যা? সন্ধ্যার মধ্যে সবসময়েই এক থরথরানি, এক ডানা ঝাপটানি, এক দ্রুততা। দ্যাখো না পাখিগুলো কেমন তখন ছটফট ছুটে যায় ঘন-গাঢ় জঙ্গলের দিকে?—ভাবল জাহেদ। কিন্তু এসব সে যে ভাবল ঠিক এই-এই শব্দে, তা না। এ জাতীয় শব্দ মনে জড়ো করার বয়সই তো হয়নি তার। তবে মূল ভাবনাটা ছিল তার তেমনই—যে শব্দ দিয়েই সেটা ভাবুক সে, তার ভাবনাটা ছিল ঠিক তেমন।
স্কুলের বাংলার প্রিয় শিক্ষক এনায়েত স্যার তাকে বিভূতিভূষণের আরণ্যক পড়তে দিয়েছিলেন, কারণ সে ক্লাসে ‘একটি নৌকা ভ্রমণ’ নামে এক রচনা লিখে সেটার শেষ লাইনে লিখেছিল: ‘আমাদের নৌকা বাঁ দিকে খালের মধ্যে বাঁক নিল, আর ডানদিকে নদী তখন স্থির বয়ে যায়-কুলুকুলু।’ স্যার জাহেদের লেখা ওই লাইন পড়ে মুগ্ধ হয়ে গেলেন, সবাইকে বললেন, ‘বারো বছরের বাচ্চা ছেলে। ম্যাজিক ছেলে! ম্যাজিক ছেলে! কী লিখেছে! ভাবা যায়?’ এরপরই তাকে নিয়ে ভুল ভেবে বসলেন তিনি, তাকে দিলেন আরণ্যক পড়তে। না, স্যারের পড়তে দেওয়া আরণ্যক মাথায় ঢোকেনি জাহেদের। কারণ যেসব শব্দে সেটা লেখা, সেগুলো মাথায় ঢুকবার মতো মাথাই তখনও হয়নি তার। কী মনে করে টেনশনে ভরা আজকের এই সন্ধ্যায় তাদের বসার ঘরের বেতের সোফায় নিজেরই আগে ফেলে রাখা তার মেরুন রং কবিতার খাতার পাশে পড়ে থাকা আরণ্যক বইটা খুলল জাহেদ।
‘জনশূন্য বিশাল লবটুলিয়া বইহারের দিগন্তব্যাপী দীর্ঘ বনঝাড় ও কাশের বনে নিস্তব্ধ অপরাহ্ণে একা ঘোড়ার উপর বসিয়া এখানকার প্রকৃতির এই রূপ আমার সারা মনকে অসীম রহস্যানুভূতিতে আচ্ছন্ন করিয়া দিয়াছে, কখনও তাহা আসিয়াছে ভয়ের রূপে, কখনও আসিয়াছে একটা নিস্পৃহ, উদাস, গম্ভীর মনোভাবের রূপে; কখনও আসিয়াছে কত মধুময় স্বপ্ন, দেশ-বিদেশের নরনারীর বেদনার রূপে।’
এটুকু তা-ও বুঝল সে, এমনকী এটাও বুঝল যে, পরপর তিন বাক্যের শেষে রূপে-রূপে-রূপে লিখে কাজটা ভাল করেননি বিভূতিভূষণ। কিন্তু এরপর?
—’সে যেন খুব উচ্চদরের নীরব সঙ্গীত—নক্ষত্রে ক্ষীণ আলোর তালে, জোছনারাত্রের অবাস্তবতায়, ঝিল্লির তানে, ধাবমান উল্কার অগ্নিপুচ্ছের জ্যোতিতে তার লয়-সঙ্গতি।’
প্রকৃতির রূপের এই আজব শব্দে আজব বর্ণনা ঠিক ধরে উঠতে পারল না জাহেদ।—’নীরব সঙ্গীত’, ‘জোছনারাত্রের অবাস্তবতা’, ‘অগ্নিপুচ্ছের জ্যোতিতে লয়-সঙ্গতি’। মানে কী? তবে তার মনে হল এখন সে এসব না বুঝলেও, এই সবই বোঝার সময় তার জীবনেও একদিন আসবে, এ লাইনগুলোর পাঁচ লাইন নিচেই যে লেখা ‘অনবগুণ্ঠিতা মোহিনী’, সেটা বোঝার সময়ও তার জীবনে আসবে। তার মনে হল, হুম, আপাতত কঠিন এসব ভাবনা পরের কোনো সময়ের জন্য তুলে রেখে আজ রাতে বাবার সঙ্গে আড়িয়াল খাঁ যেতে পারলেই চলবে তার। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠল জাহেদ, ‘বইঠো, এইসব বোঝার সময় আ…স…বে।’
বইঠোকে দেখে জাহেদের মনে হল, হুঁ, সন্ধ্যা আজ তো রীতিমত লাফিয়ে চলছে বইঠোর মতো—তাদের পাড়ার কুকুর বইঠো, যাকে তার বোন পারভিন ডাকে বুট্টি বলে। জাহেদ জানালার শিকের ফাঁক দিয়ে দেখল বইঠো ওই দূরে দাঁড়িয়ে পড়েছে টমেটোর উঁচু ঝাড়ের কাছটায়, টমেটোর পাতাগুলো বইঠোকে ছুঁতে গিয়েও ছোঁয় না, কারণ বইঠোকে নিয়ে তাদের ভয় যে, কী এক বিশ্রীভাবেই না তাহলে সে ডেকে উঠবে ক্রেওও করে। কুকুরের ডাককে সবাই বলে ঘেউ, তার চাখারের বন্ধু সার্কাসের জোকার ঈমান বলে খেউ, নয়তো কেঁউ- কেঁউ-কেঁউ-কেঁউ, আর ওভাবে কুকুরের ডাক মানুষের গলায় ডাকতে ডাকতেই সে বেতফলগুলো কেড়ে নেয় জাহেদের থেকে। কিন্তু জাহেদের সবসময় মনে হয় যে, ভুল হচ্ছে—ভাল করে শোনো, কুকুর আসলে ডাকে ওঁয়াউআউ-ওঁয়াউআউ, আর বইঠো ডাকে ক্রেঁওও-ক্রেঁওও।
এ সময়ে ক্রেঁওও-ক্রেঁওও বলেই ডেকে উঠল বইঠো—তার গলা তখন টানটান, তার কান্নার সুর তখন ধ্রুব; আর জাহেদের মনে হল পৃথিবীর সবকিছু কেমন গোঁজামিলে ভরা। ‘গোঁজামিল’ শব্দটা তার নতুন শেখা। সে প্রথমে ভেবেছিল ওটা ঘোজামিল। কিন্তু তার মালেক হুজুর তাকে বলেছেন, ‘গোঁজা, জাহেদ, গোঁজা; গ-য়ে চন্দরবিন্দু, যেমন ধরবা যে নারকেল গাছের পাতা একলা গ্যাছে ডাইনদিকে আর হেডির মাথায় ওডছে চান্দ।’ হুজুরের কাছে চন্দ্রবিন্দুর এ বর্ণনা শুনে জাহেদের মনে হয়েছিল, সবকিছু যদি গোঁজামিল না-ও হয় তো অনেক কিছুই আজগুবি, অনেক কিছুই খামোখা, যেমন বইঠোকে সারাদিন কেউ যে কোনো খাবার দেয়নি, সেটা খামোখা। কারণ তারা চাইলে তাকে খাবার দিতেই পারত, কিন্তু দেবে না, কারণ—জাহেদ একা একাই জোরে বলল, ‘মানুষ ছোটলোক, বইঠো, মানুষ ছোটলোক।’
বইঠো তার নাম দ্বিতীয়বারের মতো শুনে টানটান হল, খালি পেটে সে তীরের মতো, ঝাড়ুর শলার মতো হল। জাহেদ তার ওই টানটান পেট দেখে জোরে একবার ডাকল, ‘ব-ই-ঠো’, যেন সে নৌকার পাতলা বৈঠা কোনো। কুকুরটাও শুধু একবারের জন্য তাকাল তার দিকে, তারপর পেছনের দুই পা একসঙ্গে উঁচু করে টমেটোর ঝাড়টাকে লাথি মেরে স্প্রিংয়ের মতো লাফিয়ে উঠে দৌড়ে গেল বড়লোক মুরাদদের বাড়ির দিকে। কিন্তু তাতেই টমেটোর পাতাগুলোয় এমন এক এলোধাবাড়ি আন্দোলন জাগল যে, জাহেদের মনে হল বইঠো জ্বীনের মতো করে, ভূতের মতো করে যেন দৌড়ে গেছে পেছনের দিকে। কারণ সবচেয়ে বড় যে টমেটোর গাছটা, যাকে কুলবরইয়ের গাছই বলা যায় মন চাইলে—এত বড় সে, এত প্রকাণ্ড সে—সেই গাছ তখন ঝটাৎ করে টেনে ধরল বইঠোর লেজ এবং তার গাছ-গাছ গলায় সে স্পষ্ট ডেকে উঠল ‘বঠো’ বলে।
টমেটো গাছের মুখে এরকম উদ্ধতচারী কথা জাহেদ যে আজ প্রথম শুনেছে তা না। তবে আজই প্রথম তার এসব নিয়ে কোনোকিছু ভাববার সময় নেই, যেহেতু তাকে এখন বাড়ির এতগুলো মানুষকে রাজি করাতে হবে যে, সে তার বাবা কাশেম মিঞার সঙ্গে আজ রাতে নৌকায় আড়িয়াল খাঁ যাবে—সেখানে তার অনেক কাজ আছে। কাজটার কথা ভাবতেই মুচকি হাসল জাহেদ। ওই তার মনে পড়ল চাখারের বন্ধু ঈমানের মুখ, তার মালেক হুজুরের মুখ। কিন্তু বাড়ির মানুষগুলো তাকে যদি আড়িয়াল খাঁ যাবার অনুমতি না দেয়, তো? তো—ট্যারর-ট্যারর, ভাবল সে। ভাবল যে, তাহলে এমনকী এ বাড়ির সবাইকে গুলি করে মারতেও সে রাজি। কিন্তু…তার যে কোনো বন্দুক নেই!
বন্দুকের কথা মনে হতে লজ্জায় জিভ কাটল জাহেদ। এ কী কথা যে, নিজের বাসার লোকজনকে সে গুলি করবে? তার মা সবসময় বলেন, বস্তির ছেলেদের সঙ্গে মিশে মিশে ছেলেটা গেছে। তাই কি? ওদিকে পৃথিবীর সবকিছু যেমন ছত্রখান হয়ে উঠেছে, তাতে ওরকম ভয়ংকর ট্যারর ভাবনা ভাবাটা আবার দোষেরই বা কী?
ছত্রখান পৃথিবীর কথা ভাবতেই জাহেদের মনে পড়ল তিন দিন আগের ঘটনাটা। তারা চার বন্ধু—সে, রিয়াজ, মিরাজ ও কাইল্লা কবির—একসঙ্গে বাড়ির লাগোয়া মাঠে ট্রাকের পাশে রাখা বালিতে খেলছে, তখন হইহই রব উঠল সালাম জমিদারদের বাড়ির ওদিকটা থেকে। জাহেদ দেখল লোকজন লুঙ্গি তুলে দৌড়ে যাচ্ছে সেই পথে, পায়ের স্যান্ডেল হাতে নিয়ে ছুটে যাচ্ছে সেইদিকে। কাইল্লা কবির শুধু বলল, ‘দৌড়া’। তারপর তারা দৌড়, তাদের পেছন পেছন ওঁয়াউআউ-ক্রেঁওও করতে করতে বইঠো
ওই বাড়ির সামনে একটা মাটির রাস্তা, সে রাস্তা গেছে জাহান্নামের দিকে, আর সেই রাস্তার ওপরে দীর্ঘ এক সুপারি ঝাড়ের নিচের ঢালুতে জাহেদ দেখল ভাটিখানার লোকেরা এক একরত্তি-প্যাকাটি শরীরের চোরকে পেড়ে ফেলেছে। সে দেখল পুরো দলটার মাথার দিকে আছে তার বড় ভাই শাহেদ, আছে শাহেদ ভাইয়ের গুণ্ডা বন্ধুরা, আর ভাটিখানা দাপিয়ে বেড়ানো রিকশাওয়ালা-ঠেলাওয়ালা-মুটেমজুর-শনপাপড়িওয়ালার দল। শাহেদ একটা বড় মোটা ছিলা লোহা-লোহামতো বাঁশ নিয়ে শং-শং মারল চোরটার খোলা পায়ে, মারল আর মারতেই থাকল। বোঝাই যাচ্ছে চোরটার লুঙ্গি খুলে পড়ে গেছে বহু আগে, সেই লুঙ্গি এখন লেপটে আছে তার বুকের কাছে, তার লোমে ভরা অণ্ডকোষদুটো থেকে ঝরছে রক্ত, সেই রক্ত আবার নামছে তার উরু বেয়ে, এবার সেই উরুর ওখানেও শাহেদ মারল শং-শং-শং। তখনই রিয়াজ ঝাঁ করে ঘুরিয়ে দিল জাহেদের ঘাড়। ঘাড় ঘুরল উপস্থিত বাকি সবারও, কারণ জাহান্নামের ওই খরখরে দিকটা থেকে ‘পাও ভাইঙ্গা দেই? পাও ভাইঙ্গা দেই?’ বলে চিৎকার করে বড়লোক মুরাদদের বাড়ির চৌকিদার মিল্টন মোল্লা অনেক লম্বা ডাণ্ডার এক হাতুড়ি তার মাথার চারদিকে ঘোরাতে ঘোরাতে তখন এদিকে ছুটে আসতে লাগল বনবন। সবাই একযোগে মিল্টনকে বলল, ‘দেও’। আর সকলের সেই ‘দেও’-টা ছাপিয়ে উঠল বড়লোক মন্টু খাঁর একমাত্র পুত্র মুরাদের বেপরোয়া-বলগাহীন তারস্বর: ‘দেও, দেও, চোরের মাথা-পাও-ঘেডি-হাঁডু সব ভাইঙ্গা দেও।
জাহেদ দেখল ও শুনল যে, চোরটা মাথা সামান্য তুলে তার চোখের সাদা দেখিয়ে তাদের উদ্দেশে তখন মিনতি রাখছে, জানে মাইরো না, আর ভাড়িখানা আমু না’। তারপরেই কী বিরাট এক শব্দ—ফটাক।
চোরটা তখনও বলছে ‘ভাড়িখানা আর আমু না, ভাড়িখানা আর আমু না’, সেইসাথে বড়রা ওখান থেকে দুহাতে ছিটকে সরিয়ে দিয়েছে জাহেদদের মতো ছোটদেরকে এবং সেই তখুনি জাহেদ চিৎকার তুলল, ঠিক করলা না, কাজটা কেউ ঠিক করলা না’। তখন রিয়াজ-মিরাজ ও কাইল্লা কবির তাকে টেনে ধরে নিয়ে গেছে খানিক দূরে, ভিড়ের বগল পেরিয়ে পায়ের দিকে, আর কাইল্লা কবির হাঁপাতে হাঁপাতে বলেছে, ‘পায়ের হাড়ির সাদা দেখছি, মাইনষের পায়ের হাড়ি পুরা সাদা। কথাটা বলেই কাইল্লা কবির তার হাফপ্যান্ট এক হাতে আটকে ভিড়ের দিকে মুখ করে অন্য হাত আকাশে গুঁতিয়ে এরপর চিৎকার তুলল- ‘ট্যারর-ট্যারর’।
জাহেদ দেখল কাইল্লা কবির ট্যারর বলার সঙ্গে সঙ্গে সে কী বৃষ্টি নামল ওই পা-ভাঙা, পা ছিলে পা কেটে হাড়ের সাদা বেরিয়ে আসা চোরটার গায়ের ওপরে—ঝমঝম। সেই বৃষ্টি ছাপিয়ে চোরটা শুধু তার মৃত্যুর আগে আর্তনাদ করে এটুকুই বলে যেতে পারল যে, ‘রাজা ভক্তি মিশ্র’।
আর ওই সবাই বলল, ‘মইরা গ্যাছে’; বলল, ‘হার্ট অ্যাডাক’; বলল, ‘এখন দ্যাখবায়ানে ভাড়িখানায় কী অয়; বলল, ‘ভক্তি মিশ্রেরা ভয়েমকর লোক’; আর কাইল্লা কবির চিংড়ি মাছের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে সুপারি গাছগুলোর ঢাল বেয়ে বারবার উঠতে ও পড়তে লাগল তার নিরাকার বন্দুকের ট্যারর ট্যারর আওয়াজ তুলে।
.
ঘরের ভেতর দিকে তাকাতে গিয়ে এবার জাহেদ আরও একবার বাইরে তাকাল। সন্ধ্যা নেমে রাত হয় হয়, তার মানে চাঁদ উঠেছে আকাশের কোনো একদিকে। কোন দিকে তা সে জানে না। জ্যোতির্মণ্ডলের এই ব্যাপারগুলো এখনও তার কাছে স্পষ্ট নয়। কিন্তু সে ভাবল—হয়ে যাবে, শিগগির একদিন সব স্পষ্ট হয়ে যাবে, যেহেতু সে এ বয়সেই জানে যে চাঁদ যখন ওঠে তখন সে তার আশপাশে মেঘ জড়ো করে নিয়েই ওঠে। কিংবা মেঘেরাই দল বেঁধে উসকে দেয় চাঁদকে তাদের ওপরের দিকটায়, যেহেতু চাঁদ সেখানে উঠতে চায় না, চাঁদ সেখানে থাকতে চায় না, চাঁদ শুধু পালায় মেঘেদের ভেড়ার লোমের মতো থোকা থোকা বিস্তার থেকে পালিয়ে সে সরে যায়, সরে সরে যেতে চায়। ঠিক যেমনটা জাহেদ দেখেছে চাখারের লক্ষ্মণ দাস সার্কাসে, যেখানে জেব্রার সঙ্গে মঞ্চে আসে যে মেয়েটা যার পেছনে তখন বেঁটে ঘোড়ার দল, আর যার বাঁয়ে মঞ্চের কিনার ঘেঁষে লাল নাক লাগানো চার জোকার বামন বালক (যে-চারজনের একজন তার বন্ধু ঈমান, যদিও ঈমানকে ঠিক বামন বলা যায় না) – সেই মেয়ে অতখানি আলোর সামনে তার ব্লাউজের টাইট ভাবটা নিয়ে লজ্জা পেয়ে সরে যায় মঞ্চ থেকে দ্রুত, যেভাবে মেঘ দেখলে দৃশ্যপট থেকে সরে যায় চাঁদ, আর জাহেদ জলদি শিস দিয়ে উঠে থামতে বলে মেয়েটাকে, বলে চলে না যেতে। তখন তার পাশে বসা মালেক হুজুর তার মাথায় বাড়ি মেরে বলেন, ‘বান্দর হচ্ছ ক্যানো জাহেদ? শিস দেও? ছি!’
আকাশের কোথাও চাঁদকে খুঁজে না পেয়ে জাহেদ ঘরের ভেতরে তাকাল। তারপর তাদের এই কোনার ঘর ছেড়ে সে গেল এর পরের ঘরে, এ বাসায় যেটার নাম ‘মাঝখানের ঘর’। সেখানে জাহেদ দেখল সবাই আছে ওরা-তার মা, বাবা, বড় ভাই শাহেদ, বড় বোন পারভিন, সবাই।
মাঝখানের ঘরের তিন কিনার জুড়ে—এক কিনারে খাট-বিছানা পাতা—কিংবা ওই ঘরের পুরোটা জুড়ে হাঁটতে থাকা তার মায়ের পেছন পেছন এবার ঘুরতে লাগল জাহেদ। তার মা, সবসময় টেনশনে থাকা এক মহিলা…হুম, তাকে জাহেদ কখনোই বুঝতে পারে না যে, তিনি কিসে কীভাবে রিঅ্যাক্ট করবেন। জাহেদকে চরকির মতো পাশে ঘুরতে দেখে তার মা বিরক্তই হলেন, আর একেকবারের বিরক্তিতে বলতে লাগলেন একেক কথা যে, ‘তুমি একটা বাচ্চা ছেলে। বড়দের সাথে নদীতে গিয়ে কিছু ভাল লাগবে? তখন তো কানবা। কানলে তোমারে কে দেখবে শুনি?’ আবার এরকম যে, ‘তোমার বাবারেই বা কেন নদীতে যেতে হবে এই রাত-বিরাতে? তোমার ওমর আলি চাচা কি ভাল মানুষ? এই শাহেদ, তোদের ওমর চাচা কি ভাল মানুষ?’
বড় ছেলে শাহেদ সাফসাফ বলে দিল, ‘বাবা, ওমর চাচা তো মানুষ ভাল না। তুমি কেন তার সাথে রাতের বেলা নদীতে যাবা? মা, জাহেদ যেতে চায়, যাক। বাবার একলা যাওয়ার দরকার নাই। ওমর চাচা লোক খারাপ।’
জাহেদ জোরে বলে উঠতে চাইল, ‘শাহেদ ভাইয়া, তুমিও তো মানুষ ভাল না। তিন দিন আগে যে চোর, যে গরিব চোর মারা গেল, জনি না মুকুল নাম, তার মা ভাটিখানায় এসে তো তোমার নাম ধরে অভিশাপ দিয়ে গেল। তুমি বাঁশ দিয়ে তারে পিটাইছ, তার পা ভাঙছ।’ কিন্তু অতকিছু আজ এখানে বলবে না বলে মনস্থির করে নিয়েও শেষমেশ থেমে থাকতে পারল না জাহেদ। সে চিৎকার করে বলেই বসল, ‘জনি না মুকুলের মা তোমারে অভিশাপ দিছে শাহেদ ভাইয়া। তুমি তার ছেলেরে মেরে ফেলছ। তার ছেলে সামান্য চাল-ডাল চুরি করছিল কোন বাসায়।’
জাহেদের দিকে তেড়ে এল পারভিন। বলল, ‘জাহেদ, জাহেদ, বড় ভাইয়ের সাথে কেউ এইভাবে কথা বলে? আশ্চর্য! আশ্চর্য! চোর ধরা পড়ছে, সবাই মিলে চোর পিটাইছে, তাতে শাহেদের কী দোষ? কে বলল যে, শাহেদই চোর মেরে ফেলছে? ছি! চোরের মা আসছে ভাল কথা, চোরের মা তার ছেলের লাশ নিতে আসবে না?’
জাহেদের মনে হল সে বড় বোনকে বলে বসে, ‘হুঁ, সবার মা শুধু এরে খুঁজতে তারে খুঁজতে ভাটিখানাতেই আসবে, তাই তো? মরা ছেলের লাশ খুঁজতে আসবে তার মা, নতুন বাচ্চার বাপ খুঁজতে আসবে বাচ্চার মা। ভালই তো। ভালই তো।’ কিন্তু অতকিছু আজ এখানে বলা ঠিক হবে না বলেই মনে হল তার। তবু এটুকু না বলে পারল না সে, শুধু এটুকু—’আপা, মমতা নামের ওই লম্বা মহিলা তার বাচ্চার বাপরে খুঁজতে ভাটিখানাতেই তো আসছিল।’
পারভিন ধাম করে চড় মারল জাহেদের গালে। বলল, ‘ছোট মুখে বড় কথা, খালি ছোট মুখে বড় কথা। মা, তোমাদের মনে হয় যে ওর বয়স তেরো! মনে হয়?…আর এই ব্যাটা, শাহেদ তো তোর পক্ষেই বলল যে, নদীতে বাবার সাথে তুই যাবি। তা-ও তুই শাহেদের পিছনে পড়লি! সামাদ সাহেব ওই মহিলারে টাকাপয়সা যা দেওয়ার দিছে, তা-ও তুই সামাদ সাহেবের পিছে পড়লি?’
চড় খেয়ে জাহেদ দৌড়ে ফেরত চলে গেল বসার ঘরে, তারপর সেখান থেকে জানালার কাছে। জানালার পর্দা টেনে সরাতে সে দেখল কার যেন নাকের সর্দি প্রায় সাদা এক দড়ি হয়ে ঝুলছে ওখানকার এক শিক থেকে। তার মনে পড়ল এই সেদিন-যেদিন মমতা নামের মহিলা সামনের মাঠে দাঁড়ানো ট্রাকটার পাশে তৈরি হওয়া অসংখ্য বালির ঢিবি ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সদ্যোজাত একটা বাচ্চা কোলে নিয়ে খুন-খুন করে কাঁদছিল—সেদিন তার বন্ধু রিয়াজের ভাই মিরাজ নিজের নাক থেকে হাতে, পরে হাত থেকে তাদের জানালার শিকে তার নাকের সর্দি লাগিয়ে রেখে চলে গিয়েছিল। জাহেদ মনে মনে বলল, ‘নোংরা মিরাজ, শুয়ারের বাচ্চা মিরাজ’।
তারপর চড়চড় ঝুলে থাকা ওই শিকনির দড়ি একটা ঝাড়ুর কাঠি দিয়ে শিক থেকে ঠেলে ফেলে সে তাকাল বাইরের দিকে, ট্রাকের বালুর ঢিবিগুলো পেরিয়ে ওইপাশে, যেখানে সেই মুহূর্তে ঘন কালো হয়ে আসা অড়বরইয়ের দুই গাছের একটায় গোল-গোল বল-বল অড়বরই ফলের গা থেকে এক লেজকাটা টিয়া ‘যা-ভাগ, যা-ভাগ’ বলে লাথি মেরে সরিয়ে দিচ্ছিল একটা চাপাখি ধরনের লম্বা-ঠোঁট কালো টিঙটিঙে পায়ের চাপাখিকে, যে চাপাখিগুলো ঠোঁট বাঁকা করে বেহায়ার মতো ঘুরে বেড়ায় আমানতগঞ্জের বিলে। জাহেদ টিয়াটাকে ডাকল, ‘টি-য়া, টি-য়া’। টিয়া তার উত্তর করল না কোনো। সে ক্যা-ক্যাঁ করে ছেড়ে গেল অড়বরইয়ের আধা-গোল পাতাগুলো, আর যাবার সময় জাহেদের জানালার প্রায় কাছে এসে বলে গেল, ‘ন্যায়বিচার নাই, ন্যায়বিচার নাই।’
জাহেদের তক্ষুনি মনে পড়ল দিন পনেরো আগের সেই মমতা নামের মহিলার মুখ। কে তাকে মহিলা বলবে? ভাটিখানার এরা বলেছে মহিলা, কিন্তু এক বাচ্চাই তো ছিল সে—প্রায় ছোট একটা মেয়ে, দুধের মতো গায়ের রং, মধুর মতো ঘাড়ের রং, দুধ আর মধু, মধু আর দুধ, এবং তার চুল খোলা। সে সামাদ সাহেবের মুখের ওপর তাকে জানিয়ে দিল একদম না থেমে, অনবরত মুখের দুকোনায় সাদা ফেনা তুলে এই কথাগুলো: ‘আমনে আমার লগে অন্যায় করছেন, আমি আমনের কাছে কিচ্ছু চাই না। এই বাচ্চা আমনের। আমি দোষ করছি আমনের গোডাউনে পাক করতে গিয়া। আমনে আমারে ভালবাসার জালে ফাঁসাইছেন। আমনে আমারে বলেন নাই যে, আমনে বিবাহিত। আর আমনে জরমো নিয়ন্ত্রক নিতে বাধা দিছেন। আমনে বলছেন বাচ্চা হইলে হইবে, ওই বাচ্চা আমার, আমি তোমারে ভালবাসি মমতা।’
ট্রাকের চারপাশ ঘিরে তখন মানুষের ভিড়—মানুষ আর মানুষ। রিয়াজ-মিরাজের বাবা আহকামউল্লাহ মুনশি তার পাজামার ফিতেয় জোরে গিঁট বেঁধে ভিড়ের সবাইকে এক ধমকে থামিয়ে দিয়ে চিৎকার করে উঠলেন সামাদ সাহেবের উদ্দেশে, তখন সামাদ সাহেবের পাশে তার প্রবল সুন্দরী বড় মেয়ে আঁখি। তিনি চিৎকার দিয়েছেন, ‘আঁখি, তোমার বাবারে নিয়া যাও। সামাদ তুমি অন্যায় করছ, টাকাপয়সা দিয়া এখন সেটেল করো। আমাদের বউ-বাচ্চা এইহানে থাকে। এডি এইহানে চলবে না।’
সামাদ সাহেব সবচেয়ে জোরে গলা ছেড়ে তখন কেঁউ-কেঁউ, তখন ক্রেঁওও ক্রেঁওও: ‘আমি নির্দোষ। এই মহিলা বেশ্যা মহিলা। আমি তারে চিনি না।’
সামাদ তার কথাটা বলে শেষ করতেও পারেননি, মমতা নামের ওই দীর্ঘদেহী দুধ-মধু নারী তার কোলের বাচ্চাকে বলের মতো ছুড়ে দিলেন সামাদ সাহেবের দিকে, সেইসঙ্গে গলার অনেক ভেতর থেকে চিৎকার দিলেন কেমন ‘ওহ্ আল্লাহ, ও-ও-গো-ও-ও’। বাচ্চাটাকে শূন্য থেকে তখন ধরতে গেল আঁখি, ধরতে গেল পারভিন, কিন্তু মাটি থেকে সামান্য ওপরে তাকে ধরে ফেলল কাইল্লা কবির। কবিরকে হাততালি দিল সবাই। অজস্র ওই হাততালির মধ্যেই বিখ্যাত চোর সর্দার ভোরোটটি গান্ডু, অন্য নামে ছেঁচকি, অন্য নামে রাজা ভক্তি মিশ্র তার সরুচিকন ছুরি বের করলেন লুঙ্গির খোঁট থেকে, লুঙ্গির গোঁজা থেকে এবং তার সেই সরুচিকন লম্বা চামচের মতো ছুরি সামাদের বুকের ওপর চেপে ধরে সামাদকে পেছনের মাটিতে প্রায় শুইয়ে ফেলে বললেন, ‘টাকাপয়সা দাও, নাইলে গলা কাটব। বাহার বাজু, বাহার বাজু, তুমি সামাদের থেকে নিয়া টাকা গুইন্যা দিবা মমতা মাইয়াডারে। আমি চোর হইতে পারি, কিন্তু ভাড়িখানা ভরদোলোকের পাড়া গো।’
এরপরই একদল লোক, রাজা ভক্তি মিশ্রের পেছন পেছন থাকা একদল লোক সামাদের ঘাড়ে মারল, সামাদের মুখে মারল, তারপর সামাদের বড় মেয়ে আঁখির কাছে জানতে চাইল, ‘তোমার মায় কই? তোমার মায় কই?’ এবং সেই প্রশ্ন করতে করতে তারা উত্তরের জন্য না থেমে তাদের বাম বগলে সামাদ সাহেব ও ডান বগলে মমতাকে নিয়ে শনশন দৌড় দিল নিউ ভাটিখানা রোড ধরে—কাইল্লা কবিরের কোলে বাচ্চাটা তখন কাঁদছে। হ্যাঁ, তখনও সে কাইল্লা কবিরের কোলে, আর কাইল্লা কবির ডেকে চলেছে, ‘জাহেদ আয়, রিয়াজ আয়, মিরাজ আয় রে। দ্যাখ দ্যাখ বাচ্চার মুখে কী সুন্দর গন্ধ!’ তারপর মমতা ও সামাদের পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে সব ছাপিয়ে কাইল্লার সেই উন্মাদের মতো ট্যারর-ট্যারর-এক হাতে বাচ্চা, অন্য হাতে অদৃশ্য বন্দুক থেকে বেরোনো তার গুলির আওয়াজ।
কিন্তু জাহেদ কাইল্লা কবিরের ডাক শুনেও সেদিন যেতে পারেনি কোনোদিকে, কারণ ততক্ষণে তাকে তার জামার কলার আঁকড়ে আটকে ধরেছিল তার বড় বোন পারভিন। সে বলছিল, ‘খবরদার যাবি না, জাহেদ।’ আর জাহেদ বলছিল, ‘যাব, যাব, আপা আমি যাব।’ আর রাজা ভক্তি মিশ্রের বডিগার্ড বেয়াদব বাহার বাজু জাহেদের কথা শুনে পারভিনকে বলছিল, ‘জাহেদে যাইবে। তোমার বাপে জেলে আছিল, পারভিন। ভদ্রলোকের পরিবার সাইজ্যা লাভ নাই। বেশ্যা মাইয়ার লগে লুইচ্চা গোডাউন মাতবরের খেইল দেখতে অসুবিধা কোনডে গো?’
কিন্তু জাহেদ মমতা ও সামাদের যাত্রাপথের ওদিকটায় যেতেই পারল না, কারণ পারভিন ততক্ষণে তার জামাও খামচে ধরেছে, বলেছে, ‘জাহেদ, চোরের বাচ্চারা বললেই আমরা অভদ্রলোক হই না।’ আর বাহার বাজু পারভিনের এই কথা শুনে বলেছে, ‘উহ্, বড্ড ভদ্রলোক আইছে গো। হাইগ্যা হোচে না, পাইদ্যা গলা পানিতে।’
ওভাবে তারা সবাই চলে গেল বালির ট্রাকের মাঠ ছেড়ে। যাওয়ার সময় দলের অন্য কেউ না, শুধু মমতা নামের দুধ-মধু গায়ের কালো ছাড়া-চুল মেয়েটা সবার জন্য রেখে গেল দুঃখ, সে বইঠোর ক্রেওও ক্রেঁওও চিৎকারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলে গেল, ‘অভিশাপ পড়বে তোমারদিগের ভাড়িখানায়। আমার সন্তানরে অবৈধ সন্তান বানাইল যারা, ঠাডা পড়বে তাহাদের পেরেতেকটা বাড়িতে, পেরেত্তেকটা বাচ্চার উপারে।’ জাহেদ তাকিয়ে দেখছিল মমতার সেই বিদায় বেলার চোখ—তাতে যেমন ছিল লজ্জাশূন্য-বেশরম চাহনি, তেমনই পৃথিবীর মানুষগুলোর জন্য করুণাহীন এক কষষ, মমতাশূন্য এক ঝাল।
.
এতক্ষণে তার মা মাঝখানের ঘর থেকে চলে এসেছেন তাদের এই বসার ঘরে, যেখানে জাহেদ তখনও দাঁড়ানো জানালার শিকটা ধরে—শিকের গা বেয়ে ঝুলতে থাকা মিরাজের নাকের নোংরা বাদামি সর্দির লম্বা দড়িটুকু শুধু তখন নেই। মা এসে হাত রাখলেন জাহেদের মাথায়, বললেন, ‘পারভিন তোকে চড় দিছে, আমি পারভিনকে বকছি। কিন্তু শাহেদের নামে এইসব বলবি না, জাহেদ। পুলিশ শুনলে কী জানি কী ঝামেলা করে, বাবা!’
জাহেদ বুঝল, কিন্তু মুখে কোনো আওয়াজ করল না। সে ভাবছে, এই-ই সুযোগ তার মা-কে বলে দেওয়া যে, কেন সে যেতে চায় রাতের আড়িয়াল খাঁ-য়। কিন্তু পরক্ষণেই তার মন বলল, সত্যিটা জানলে মা তাকে কখনোই যেতে দেবেন না, উল্টো তার এইসব ‘আজগুবি’ বিশ্বাস নিয়ে হাসাহাসি করবেন, মালেক হুজুরকে আরও বেশি করে গালি দেবেন। অতএব মুখ বুজে থাকল জাহেদ।
মা এবার তাকে বললেন, ‘চল ওই ঘরে চল। হা-হা, শাহেদ বলে নদীতে তোর বাবার একলা যাওয়ার দরকার নাই, তার নাকি তোরে সাথে লাগবে। বাব্বা, তুইও একখান মানুষ, আর তুই হবি তোর বাপের পাহারাদার!’ কথাটা বলে তিনি জাহেদের কাছে এসে তার কান টেনে দিলেন আদরের ছলে, আবারও বললেন, ‘কি, তুই তোর বাপেরে পাহারা দিতে নদীতে যাবি? ওইখানে ঢেউ বেশি হলে তুই নৌকা সোজা রাখবি? বান্দর ছেলে, আমার বান্দর ছেলে।’
নদীর ঢেউই যদি হবে সবার ভয়ের কারণ, তাহলে–জাহেদের মনে হল—তাহলে আসলে তো ভয়ের কোনো কিছু নেই, কারণ নদীতে ঢেউ তো থাকবেই। তার মা তাকে আবার বললেন, ‘আমার ছেলে তাহলে বড় হইছে।’ কথাটা বলে তিনি টিপে দিলেন জাহেদের গাল এবং কথার মাঝখানেই হাঁটা দিলেন মাঝখানের ঘরটার দিকে, ‘এইবার সে তার বাপকে দেখে রাখবে, তার মা-র যত্ন নিবে বুড়া বয়সে।’
এ কথায় জাহেদ ঝাঁ করে বলে উঠল, ‘মা, তুমি নানির কোনো যত্ন নেও নাই। নানি মারা গেল পাশের আনোয়ারা আপাদের বাড়ির বারান্দায়।’
মাঝখানের ঘরের দরজা থেকে ছুটে এদিকে ফিরে এলেন তার মা। তিনি স্তম্ভিত হয়ে গেছেন ছেলের কথা শুনে। বললেন, ‘এইটা কি বললি জাহেদ? আমি আমার মা-র যত্ন নেই নাই, মানে?’
জাহেদ বলল, ‘না। নেও নাই। নিলে নানি কী করে শুয়ে থাকত আনোয়ারা আপাদের ঘরের বারান্দায়? তোমরা তো কেউ তারে দেখতেও যাইতা না, খাবারও দিতা না।’
জাহেদের মা তাকে একটা চড় মারতে গিয়েও থেমে গেলেন। তিনি জোর গলায় সবাইকে ডাকলেন ওই ঘরে, তারপর সবাই ওখানে ছুটে এলে বললেন, ‘দ্যাখো তোমরা, জাহেদ কী বলে! আমরা নাকি আমার মা-রে আনোয়ারাদের বাসার বারান্দায় ফেলে রাখছিলাম। ছি! ছি! এইটা বলে আমাদের ঘরের ছেলে?’
জাহেদের বাবা বসে পড়লেন বেতের সোফার ওপরে। শাহেদ ও পারভিন ঘরের এদিক-ওদিক একটু ঘুরে একসঙ্গে দাঁড়িয়ে গেল দু ঘরের মাঝখানের দরজার আড়া ধরে। জাহেদের বলতে ইচ্ছা করল অনেক কিছু যে, কীভাবে শাহেদ ভাই এই সেদিন, এইমাত্র বছরখানেক হয় একদিন বিরক্ত হয়ে তার নানির ওই শীতলপাটির বিছানায় ছুড়ে মেরেছিল পানি ভরা কাঁসার গ্লাস এবং নানি তখন কেমন করে কেঁদেছিলেন এ কথা বলতে বলতে যে, ‘আল্লাহ তুমি আমাদে নিয়া দাও।’
শেষদিকে এসে নানির কথা পরিষ্কার বুঝতে পারত না জাহেদ, কারণ তার সব কথা দাঁতের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যেত কেমন ছলাৎ-ছলাৎ, কারণ ততদিনে তার আর দাঁতই ছিল না কোনো। ওদিকে পারভিন তাকে ডাকত ‘শাঁকচুন্নি নানি’ বলে, কারণ নানির গায়ের রং ছিল হাড়-কালো। সেই ডাক শুনে নানি পারভিনকে বলতেন ‘পাতপিন পাতপিন, ত্যাকদিন তুইও তানবি পাতপিন, তুইও তানবি।’ সে কথায় পারভিন হাসত আর বলত, ‘আমিও কানবো? তো কানবো। আমি কানলে মানুষের মায়া লাগবে। কিন্তু কালো পেত্নি কানলে মানুষ তাকায়ও না, নানি।’
নানি তখন উত্তর দিতেন, ‘কালো পেত্নি দনমো দিথে তোর মা-রে, তোর মা দনমো দিথে তোরে। বেথথা মাইয়া, নাঈমের থাথে শুইয়া বেড়ায়। লজ্জা হয় না?’
নাঈমকে নিয়ে এই নোংরা কথা বলতে শুনে এবং তাকে ‘বেশ্যা মাইয়া’ বলে ডাকা হয়েছে দেখে পারভিন তখন আগুন। সে শুধু দাঁত কিড়বিড় করে তখন বলত এমন যে, ‘তুই হইলি বেরাশি বছরের খানকি বুড়ি, বেরাশি বছরের মাগি কচ্ছপ। তুই আমার মা-রে জন্ম দিছিস ভাবতেও আমার কষ্ট হয়।’
সেই দিনগুলোতে পাড়ার মধ্যে কত কথা, চারদিকে কত ফিসফিস যে, শাহেদ-জাহেদের মা নিজের মাকে থাকতে দিয়েছে পাশের বাড়ির বাজে মহিলা আনোয়ারা খাতুনের ঘরের বারান্দায়। ছি! ছি!—আর কে ওই আনোয়ারা খাতুন? একসঙ্গে পাঁচ বাচ্চার জন্ম দিয়ে বরিশাল শহর জুড়ে হইচই ফেলে দেওয়া নষ্ট মহিলা—’দুধ দেখাইয়া চলে, ধামার মতো দুধ, সেইডা বালকদিগরে দেখাইয়া দেখাইয়া চলে,’ আনোয়ারাদের বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে প্রায় চিৎকার করে এ কথা বলতেন রড-সিমেন্টের দোকানদার বিদ্দুত বিশ্বাস। তিনি তার পাঞ্জাবির ঝুল ওপরে তুলে পেটটা বের করে ওই ঝুল দিয়ে নিজের চোখ ঢাকতেন যাতে করে আনোয়ারাদের ঘর তার চোখে না পড়ে, কারণ তাহলে তার ব্যবসায়ের ক্ষতি হবে।
‘খারাপ মুসলমান মাইয়া। হুঁ, মুসলমান মাইয়ারা জাতেই খারাপ হয়’, এই কথাও তাকে বলতে শুনেছে জাহেদের বোন পারভিনের প্রেমিক নাঈম। কথাটা শোনার দিনই নাঈম তাদের চারজনকে—জাহেদ-রিয়াজ-মিরাজ-কাইল্লা কবির—বলেছে, ‘তোমাদেরে বলে রাখলাম। ওই মালাউনের সব শক্তি মুরাদের বাপ ও সালাম জমিদার। ব্যবসার সম্পর্ক। কিন্তু একদিন আমাদের কাজে লাগবে তার কওয়া কথাটা। মনে রাখবা, সে আমাদের মুসলমানের মা-বোন নারীজাত নিয়ে এইরকম নোংরা কথা বলছে।’
এই বিদ্দুত বিশ্বাসই একদিন জাহেদকে বলেছিলেন, ‘অ্যাই পোলা, অ্যাই কাশেমের পোলা, টমাটো গাছ পোঙ্গায় ভইর্যা কী করো? এদিকে আও।’
জাহেদ কাছে যেতে তিনি তার কানের কাছে মুখ এনে হিসহিস করে উঠেছিলেন, ‘তোমার বাপ তো জেলে। তোমাদের সংসার চালায় কেডা? হুনছি যে, তোমার ভাই শাহেদ নিকি তার এইডা’–পাজামার ওখানে নিজের জিনিসটা শক্ত করে মুঠোয় ধরেছিলেন তিনি তখন—’আনোয়ারা মাগিরে ভাড়া দিয়া দিয়া তোমাগোর সংসার চালাইতেছে। একেকবার কতো কইর্যা সে পায় একেকটা লাগানের জইন্য, জানো নিকি?’
সেই আনোয়ারার বাসার বারান্দায় জন্ডিসে পড়ে শুয়ে থেকে একদিন সকালবেলা মারা গেলেন জাহেদের নানি, ঠিক যে-সকালের আগের সকালে তাদের মা পাশের ওই ঘর থেকে নিজের ঘরে এসে তার তিন ছেলেমেয়েকে বলেছিলেন, ‘তোমাদের নানির অবস্থা খারাপ। ডাক্তার হরলাল আসছিল। বলে গেছে এই ওষুধগুলা লাগবে, দাম পড়বে পনেরো শ টাকা। আমি কোথায় পাব পনেরো শ টাকা? কোথায় পাব? তাই আমি মালাউন হরলালের প্রেসক্রিপশন এই ছিঁড়লাম, এই ছিঁড়লাম, এই ছিঁড়লাম।’
জাহেদের মনে আছে, তার কথা শেষ হবার আগেই প্রেসক্রিপশন ছিঁড়ে-ভিঁড়ে টুকরো টুকরো, সেগুলো তখন ঘরের মেঝেতে, জাহেদ তখন ছেঁড়া কাগজগুলো টোকাচ্ছে। ঠিক সে মুহূর্তে তাদের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল ভগীরথ, কোকিল ও কসাই—তাদের তিন পোষা মুরগি; এবং কসাইয়ের পেছন দিকে শুধু—তাদের বড় পান্তামুখী হাঁসটা। জাহেদ শুনল গুধু বলছে, ‘প্যাঁক-প্যাঁক কেলেঙ্কারি, প্যাঁক-প্যাঁক বিচার নাই, বিচার নাই।’
গুধুর এই কথা শুনে দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল জাহেদ, ছুটে গিয়েছিল আনোয়ারাদের বাড়ির পেছনের উঠানে, যার এক কোনায় উঁচু সিমেন্টের এক ছোট ও ভাঙা জায়গা, যার ওপরে দড়ি দড়ি হয়ে পড়ে ছিলেন তার নানি। জাহেদ নানিকে বলেছিল, ‘ও নানি, সুপারি খাবা। ও নানি, পান খাবা?’
নানি বললেন না কিছু, শুধু বালিশে মাথা দিয়ে পড়ে থেকে তার বিরাশি পার হওয়া অস্বচ্ছ-ঘোলা চোখে তাকিয়ে রইলেন জাহেদের পেছন পেছন দৌড়ে আসা কসাইয়ের দিকে। কী সাহস ওই সবচেয়ে বড় মুরগি কসাইটার? সে দুমদুম করে হেঁটে যেতে লাগল জাহেদের নানির কাছে, আর জাহেদের ভয় হল কসাই আজ তার নানিকে ঠোকর মারবে। জাহেদ কসাইকে বকা দিল, বলল, ‘কসাইয়ের বাচ্চা কসাই, বড় বাড়ছ। এইখান থেকে যাও। সকাল যে হইছে তা দ্যাখো না? বাইরে যাওয়ার মন নাই? ডাকব খছাক-রে? ডাকি?’
বলেই জাহেদ মুখ হাঁ করল, মুখের সামনে নিজের হাত নিল গোল করে এবং সামনের ঘন কালো হয়ে ওঠা, হাজারো বিষবৃক্ষে ভরা পুকুরের ডান পাড়টার দিকে তাকিয়ে পেছনের হিন্দুপাড়ার চাল ব্যবসায়ী বিজয় মহাজনদের পোষা তুঁত রং বড় গুইসাপ খছাককে ডাকবার জন্য সে স্রেফ খছাকের খ-টুকু উচ্চারণ করেছে, ‘খ’ বলে খ-র শেষের অ-অ-অটুকু ধরে একটু টান দিয়েছে, আর তাতেই কোকিল, কসাই ও ভগীরথ ওখান থেকে মুহূর্তের মধ্যে হাওয়া। শুধু পান্তামুখী হাঁস গুধু তার বড় পাছা শূন্যে উঁচুতে তুলে ঝিংঝিং সেটা একবার এদিক একবার ওদিক ঘুরিয়ে বসে গেল নানির সিমেন্টের বিছানার নামায়। জাহেদ হাত রাখল তার নানির কপালে। নানি বললেন, ‘দন্দিথ’, মানে জন্ডিস।
জাহেদ বলল, ‘চিকিৎসা করানোর টাকা নাই, নানি।’
নানি বললেন, ‘আথে। তোথ মা-র কাথে তুকানো আথে। তিন্তু আমাত দন্য খদত কতবে না। আমাত দন্য খদত করবে না।’
জাহেদ নানিকে জিজ্ঞাসা করল যে, তার মায়ের কাছে কোথায় লুকানো আছে টাকা, যা তিনি তার নিজের মা-র জন্য খরচ করবেন না? কোথায় সেটা? নানি তার জন্ডিসে পোড়া বেনে বৌ রং দড়ি-হাতটা বাড়িয়ে দিলেন নিচের দিকে, যেখানে বসে ছিল গুধু। তিনি জাহেদের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে শুধু বললেন, ‘গুধু, গুধু, ভাদো আথো গুধু?’
জাহেদই জবাব দিল, ‘নানি, গুধু ভাল আছে। গুধু হিন্দুপাড়ার হাঁসদের সাথে আর মেশে না, নানি।’
নানি গুধুর পিঠ থেকে হাতটা সরিয়ে নিজের কোলের ওপরে রেখে জাহেদকে বলেছিলেন, ‘দাহেদ, দাও। দাহেদ, দাও’। মানে—জাহেদ, যাও। ঠিক তখন ঘরের দরজা খুলে জাহেদকে ডেকে বসেছিলেন আনোয়ারা আপা, ‘জাহেদ, নানিরে জ্বালাইয়ো না তো। এদিকে আসো।’
জাহেদের মনে হল, এই ঘুমঘুম সকালে আনোয়ারা আপা তাকে তার বড় দুধ দেখাবেন। জাহেদ সেটা দেখতে লাফ দিয়ে উঠে আনোয়ারার ঘরে যাবে, তখন উল্টোদিক থেকে, পাশের বাড়িটা থেকে তার মা তাকে জোর গলায় ডাক দিলেন, ‘জাহেদ, জলদি আসো।’ অর্থাৎ তিনি জাহেদকে এমন হালকা-আলো ও হালকা-অন্ধকার মেঘলা সকালে আনোয়ারার ঘরে ঢুকতে দেবেন না। আনোয়ারা শুনলেন জাহেদের মায়ের চিৎকার। জাহেদ স্পষ্ট দেখল যে, আনোয়ারা তার ব্লাউজে হাত দিয়ে ব্লাউজটা নিচের দিকে ধরে টানটান করছেন এবং তার ফলে ভালই দেখা যাচ্ছিল আনোয়ারার দুই বুকের মাঝখানের কাটা, কাইল্লা কবির যাকে বলে, ‘দুই টাংকির মাঝের খাল, দুধের টাংকির মাঝ দিয়া গ্যাছে লাখুটিয়ার খাল। হি-হি।’ আনোয়ারাও গলা সমানে উঠিয়ে জাহেদের মা-কে শুনিয়ে দিলেন, ‘কাইল রাতে হরলাল ডাক্তারের নতুন ফিস হইছে কুড়ি টাকা। লিইখ্যা রাখছি আপা। হরলাল বলছে, পনেরো শ টাকার ওষুধ লাগবে। হরলাল বাকিতে ঔষদ দেবে না, বইল্যা গেছে। পেসকিপশন আমার কাছে আছে।’
এ ঘটনার পরের সকালেই জাহেদ স্কুলে যাবে যাবে করছে, উল্টোদিকের রিয়াজ-মিরাজদের বাসা থেকে প্রতিদিনের চিৎকার ভেসে আসছে যে, ‘শামছু হারামজাদা কই?’ অর্থাৎ তাদের তিনজনকে জিলা স্কুলে নিয়ে যাবে যে-রিকশাওয়ালা শামছু, তার এখনও কেন দেখা নেই, তখন ভোর-সকালের ভাটিখানা কাঁপিয়ে রাস্তা ধরে গান গাইতে গাইতে পাড়ায় ঢুকল আগুন-খাওয়া মিজান- রিয়াজ-মিরাজের আপন চাচাতো ভাই, থাকে বরগুনা। মিজানের সে কী তার মুখ ভরে কেরোসিন পুরে তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে আগুনের জ্বলন্ত ফুঁ দেওয়া, যে-ফুঁ দেখে চার হাত-পা শূন্যে তুলে চিৎকার শুরু করে দেয় বইঠো, ডাকে ক্রেঁওও ক্রেওও। আর সেই একই আগুনখেকো মিজানের আবার সে কী গানের গলা, মনে হয় যেন সুরের গয়না দিয়ে মোড়া, তালের পাঁচলহরী অলংকার তাতে পোরা। মিজান জোর গলায় তখন গান গাইছে আর হেঁটে হেঁটে এদিকে আসছে, জানালা দিয়ে সেই দৃশ্য দেখছে জাহেদ। মিজানকে দেখে সেদিন অনেক খুশি হয়েছিল জাহেদ, আর মিজান জানালার শিক ধরে জাহেদকে দাঁড়ানো দেখে তার গলা ছেড়েছিল আরও:
তোমার সমাধি ফুলে ফুলে ঢাকা
কে বলে আজ তুমি নাই
তুমি আছো মন বলে তাই।
হ্যাঁ, গানের ওই কলিগুলোর সাথে সাথে এই প্রথম কাকডুমুর, কামিনী, উঁচু উঁচু পলাশ ও নিমের দলটা পেরিয়ে দৃশ্যমান হল মিজানের মুখ—তার কাঁধে একটা ব্যাডমিন্টন খেলার ইয়োনেক্স লেখা ব্যাগ, আর তার দুই হাত মুখের সামনে ধরা, যেন তার গানটা এমন শোনায় যে মাইকে বাজছে তার গান:
তোমারই অমর নাম জয় গৌরবে,
স্মরণে যে চিরদিন জানি লেখা রবে।
মরণে হারায়ে তোমারে খুঁজে পাই,
কে বলে আজ তুমি নাই?
তুমি আছ মন বলে তাই।
জাহেদ ডাক দিল, ‘মি-জা-ন।’ মিজান জাহেদের দিকে হাত তুলে রিয়াজ-মিরাজদের বাড়িতে ঢোকার মুখের ড্রেনটা পার হবার জন্য মাত্র তখন বাঁয়ে ঘুরেছে, তখনও তার এক হাত মুখের কাছে, মুখে আবার গানের ওই ‘তোমার সমাধি’ লাইনটা, ঠিক সে মুহূর্তে চারদিকে জাগল আনোয়ারার পাড়া-কাঁপানো চিৎকার: ‘রহিমা খালা মারা গেছে। ইন্নালিল্লাহে রাজেউন। রহিমা খালা মারা গেছে।’
ওই গান চলতে চলতে বাতাসে ভেসে আসা মৃত্যুসংবাদ একটা জিনিসকে স্পষ্ট করে যে, (গানের ‘ফুলে ফুলে ঢাকা’ কথাগুলো যেমন স্পষ্ট ও উজ্জ্বল) মানুষেরা প্রজাতি হিসেবে হাস্যকর; তারা গর্বোন্মাদ, কুৎসিত, স্বার্থপর ও নিজেদের ব্যাপারে ভুল ধারণায় আত্মভোলা। কিন্তু তারপরও তাদের এই মরিয়া পরিস্থিতির হিসাব মেলানোর কোনো কোনো প্রচেষ্টা—যেমন তাদের গান, তাদের গল্প, জাহেদের গুধু নামের হাঁসটাকে গু-ধু বলে ডাকবার সুর, এইসব—বলতে গেলে মাত্র এই কটা ‘সব’ কী করে যেন সুন্দর, কীভাবে যেন তারা ভয়ালসুন্দর ও মহিমময়।
সে মুহূর্তে আনোয়ারাদের বাসার দিকে ছুটে যাওয়া জাহেদকে দেখে, সদ্যমৃত মায়ের কাছে পাগলের মতো দৌড়ে যাওয়া ওই মায়ের মেয়ে জাহেদের মা-কে দেখে, পান ছেঁচার ধারালো যন্ত্রটা কদিন আগে বুড়ির শরীর বরাবর ছুড়ে মারা তার নাতনি পারভিনকে দেখে, আর হইহই করতে করতে পাড়ার বাকি সবার হাহাকারের সুর তুলে ওই নষ্টা মেয়ে আনোয়ারাদের বারান্দার দিকে—ভাটিখানার বাচ্চারা যে-বাড়ির চারপাশে বলত যে ছড়ানো শুধু ‘রাজা কনডমের প্যাকেট আর প্যাকেট’—পড়িমরি দৌড়ে যেতে দেখে, যে-কারোই মনে হবে ‘সমাধি’ বিষয়ক এক গান চলবার সময়ে যে-শহরের যে-জায়গায় এইমাত্র মৃত্যু হল একজন এত বছরের সামাজিক ও সজ্জন বুড়ির, সেটার মধ্যে যে কমেডি রয়েছে তা এই শহরেরই নিজস্ব ট্রেডমার্ক-লাগানো কমেডি, যেখানে কারওই কোনো ধারণা নেই নিজেদের পায়ের তলার মাটি নিয়ে, নিজেদের অবস্থান নিয়ে; যেখানে কারও কাছেই টাকা নেই বেশি–চাল, ডাল ও পৌনে এক কেজি খাসির গোশ কী দুই খণ্ড কাছিমের মাংস কিনবার থেকে বেশি, এমনকী ফার্নিচার ব্যবসায়ী এবং ‘জ্ঞানী’ চিট্টাগুড় চাচারও না; যেখানে অন্যের মৃত্যুতে একদম নকল কান্না কেঁদে সামাজিক হওয়ার বিষয়টা অনেক বড় বিষয়। ‘ভাটিখানা – বরিশাল ট্রেডমার্ক-লাগানো কমেডিটার মধ্যে চলতে থাকা এই এতগুলো বিষয় কীভাবেই না ওখানে হাত ধরাধরি করে চলত সেই ১৯৮১ সালের বরিশালে–সবাইকে খালি হাসাতে ও মজা দিতে।
.
জাহেদের বাবা এ পর্যায়ে সব ঝামেলার অবসান ঘটিয়ে দিলেন এক কথা বলে। তিনি বেতের সোফাটার পিঠের দিকে এমনভাবে হেলান দিলেন যেন শুয়েই পড়েছেন এবং এখনই ঘুমের মধ্যে চলে যাবেন। শুয়ে-বসেই তিনি তার দু হাতে নিজের কপাল টিপতে টিপতে বললেন, ‘বাচ্চা ছেলে যা বোঝার বুঝছে। আমি জেলে ছিলাম। টাকাপয়সা ছাড়া তোমাদের অবস্থা ছিল তখন মরিয়া। আল্লাহ আমার শাশুড়িরে বেহেশত নসিব করুক। এই নিয়ে আর একটাও কথা নাই। জাহেদ, তোর বড় ভাই তাহলে বলছে তুই আমার সাথে আড়িয়াল খাঁ যাবি। সো, রেডি-ছেড়ি-গো।’
তিনি হাসতে হাসতে খেলবার ছলে শেষ কথাটা বলে জাহেদকে ইঙ্গিত দিলেন তৈরি হয়ে নিতে। তখনই জাহেদের মা বসার ঘরে ঢোকার মূল দরজার কাছ থেকে ছুটে এসে দাঁড়িয়ে গেলেন স্বামীর সামনে। পারভিন ততক্ষণে চলে এসেছে মায়ের পাশে। তাদের মা তার হাত রাখলেন পারভিনের কাঁধে এবং বললেন, ‘আমার কাছে মা-র চিকিৎসার জন্য একটা টাকা ছিল না। একটা টাকা ছিল না। আল্লাহ সবকিছুর বিচারক। আল্লাহু হাকিমু কুল্লি শাইইন। কিন্তু জাহেদ আজকে নদীতে যাবে না। গেলে শাহেদ যাবে। জাহেদ সাঁতার পারে না।’
মায়ের এই শেষ বাক্য শুনে কান্নায় ফেটে পড়ল জাহেদ। এক সেকেন্ড লাগল না তার এই কান্নাটা কাঁদতে। সে শুরু করল স্রেফ উঁহু-উঁহু দিয়ে, তারপর বদলাতে লাগল সেটার ভাষা, বদলাতে লাগল ধ্বনি। এবার তার কান্না একটানা চলতে লাগল উমউ-উমউ আওয়াজ তুলে, গলার ওপর দিক থেকে বের হতে থাকা সুরেলা এক গোঙানিতে। কিন্তু জাহেদের হঠাৎ মনে হল—না, তার কান্নাটা আসলে হচ্ছে না, একদমই যথেষ্ট গাঢ় কান্না হচ্ছে না সেটা। তার মনে হলো কাঁদলে কাঁদতে হবে কান্নারই মতো করে, কথা বলতে বলতে কান্নার পিসগুলো কথার মাঝখানে ঢুকিয়ে দিতে দিতে। সে তা-ই করল তৎক্ষণাৎ।
এবার সে কাঁদতে লাগল তার টানা বলে যাওয়া বিলাপ-বাক্যগুলোর ছেদে ছেদে: ‘আমি যাব। উমউ। আমি সকাল থেকে বলছি যে, আমি যাব বাবার সাথে। উমউ। শাহেদ ভাইয়া কোথা থেকে আসলো? উমউ। শাহেদ ভাইয়া জনি না মুকুল নামের চোরটারে পিটায়ে মারছে। এই বাসায় তার কোনো বিচার নাই। উমউ আমরা তো নৌকায় থাকব, সাঁতারের দরকার লাগবে কেন? উমউ। সবসময় তোমরা আমার সাথে এইগুলা করো, ও-ও-ও-মা-ও-ও, যেটা সামাদ চাচা করছে মমতার সাথে। উমউ। পুকুরে যে বাচ্চার লাশ পাওয়া গেল সেইটা তো মমতার বাচ্চা ছিল। ও-ও-ও-মা-ও-ও। আমি সব জানি। সব জানি। ওঁ-ওঁ-ওঁ।
জাহেদের এই নাটকীয় কান্না শুনে পারভিন তার সব রাগ ভুলে হেসে ফেলল আর বলল, ‘থামবি জাহেদের বাচ্চা, জাহেদ? একটা আছাড় দেব তোরে। কসাই দিয়ে ঠোকর খাওয়াব। মিথ্যা মিথ্যা কান্দিস, শয়তান ছেলে। আমি জানি তো তুই হাসতেছিস, হারামজাদা।’
তারপর পারভিন নিজের শরীর ঝুঁকিয়ে জাহেদের চোখে চোখ রেখে আবার বলল, ‘এইসব চালাকি তুই শিখছিস কোত্থেকে? রিয়াজ-মিরাজ আর ওই বান্দরগুলার সাথে মিশে তুই একদম গেছিস। পুস্কুনির বাচ্চার লাশ নিয়েও দেখি তোদের ফটফটানি আছে। বাহ-বাহ।’ এবার সে তার মা-র দিকে তাকিয়ে, ‘ও মা, তোমার এই ছেলে গেছে। নাটক ছাড়া আর কী পারে ও? আর কী পারে?’
মা-র মুখ থমথমে। তিনি মুহূর্তের মধ্যে দাঁড়ানো থেকে বসে পড়লেন একদম ঘরের মেঝেয়। তার শাড়ির নিচের সায়াটা বেরিয়ে আছে বেশি স্পষ্ট হয়ে। তিনি তার দু হাত দিয়ে দুই কানের দুই দুল খুলে ছুড়ে মারলেন জাহেদের দিকে আর পা দুটো ছটফট করে মেঝেতে বাড়ি মেরে বলতে লাগলেন, ‘ওই দুল আমি কেন বেচতে দেই নাই? মা-র ডাক্তারের জন্য ওই দুল আমি কেন বেচতে দেই নাই? ও আল্লা, ও আল্লা!’
শাহেদ সরে এল জাহেদের পাশে, কানে কানে তাকে বলল, ‘জাহেদ, যা। মা-র পাশে যেয়ে বস। মা তোর কথায় অনেক কষ্ট পাইছে। এইভাবে কেউ বলে? তোকে না সবাই বলে অ্যারিস্টটল! অ্যারিস্টটল কোনোদিন এইভাবে মা-কে কষ্ট দিয়ে কথা বলে?’
জাহেদ দাঁড়িয়ে আছে থম মেরে। সে দেখল তার মায়ের একটা লাথি গিয়ে পড়েছে এক কাঠের শোকেসের গায়ে আর শোকেসের ভেতরে থাকা সব উলের পুতুল, ঝিনুকের পুতুল, কাঠের পুতুল, তুলার পুতুল এবং যত যত কাপড়-ত্যানা-ন্যাকড়ার সস্তাদর্শন ধুলোকালি মাখা পুতুল রয়েছে, তারা সব একসঙ্গে তার মায়ের উদ্দেশে চিল্লিয়ে উঠেছে—’খেয়াও’।
অতএব মা এবার সাবধানে পায়ের বাড়ি মারছেন মেঝেয়, মেঝের গরম সিমেন্টে। শাহেদ আবার এল জাহেদের কাছে, তার পিঠে গুঁতো দিল একটা, ফিসফিস করে বলল, ‘যা, মার কাছে যা’।
শাহেদের কথাটা শুনলেন তাদের বাবা কাশেম। তিনি বেতের সোফার ওপরে ততক্ষণে প্রায় শুয়ে পড়েছেন, প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছেন। ওই ঘুম-ঘুম অবস্থার মধ্য থেকেই এক চোখ টপাৎ করে তিনি খুললেন জাহেদের জন্য। জাহেদ তা-ও নড়ল না।
হুম, ঠিক এভাবেই সে স্থির দাঁড়িয়ে ছিল তাদের সবজিবাগান ধরে, সেই সকালে, যখন এক ছোটখাট লক্কড়মতো ঝক্কড়মতো রং-হীন ট্রাক এসে হাজির হয়েছিল তাদের নিউ ভাটিখানা রোডে, তার নানি রহিমা বেগমের মরদেহ বরিশাল থেকে তাদের গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার আল্লার দরগায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। জাহেদের বন্ধুরা তখন জাহেদকে ঘিরে ধরেছিল বেগুন খেতের পাশে; বরবটি, মরিচ ও শিম খেতের পাশে। সবসময়ের তিনজন বাদেও সেখানে ছিল আগুন-খাওয়া মিজান, ছিল মন্টু খাঁদের বড়লোক বাড়ির মুরাদ ও মুরাদের বড়লোক বন্ধু অক্সফোর্ড মিশন স্কুলের হেডমাস্টার ডি সুজার ছেলে প্রেডিক্ট ডি সুজা। প্রেডিক্ট জাহেদকে ইংরেজিতে সান্ত্বনা দিচ্ছিল, ‘এভরিওয়ান ডাই মাই ব্রাদার’। আর কবির তখন খ্যাক করে উঠেছিল এই বলে যে, ‘ইংরেজি চোদান, হালার খ্রিস্টানের পুত, কালা চামড়ার খ্রিস্টান।’ তারপর সবার কী হাসি, সে কী হাসি!
ট্রাকটা তখন পেছনে ঘুরে বালির মাঠের শেষ মাথায় যাচ্ছে, আনোয়ারাদের বাড়ির একদম বারান্দা পর্যন্ত চলেই গেছে বলা যায়, আর বিদ্দুত বিশ্বাসের সিমেন্টের দোকানে কাজ করা লেনজা নামের ছেলেটা চিল্লাছে, ‘ড্রাইভার চাচা, ড্রাইভার চাচা। ওই বাড়ি পুরা ভাইঙ্গা দাও, ট্রাক চালাইয়া দাও বাড়ির উপার দিয়া।’ সে কথায় লেনজাকে মাথায় বাড়ি মেরে বসেছেন তার বস বিদ্দুত বিশ্বাস, তিনি সবাইকে শুনিয়ে বলেছেন, ‘বাড়ি ভাইঙ্গা কাজ হবে? ভাঙ্গতে হবে ওই খানকি মহিলার মাজার হাড্ডি, জানি সে আর কিছু ভিত্রে নিতে না পারে।’ তখন কাইল্লা কবির তার বন্ধুর দলটাকে বলে চলেছে কিছু অশ্লীল কথা, এরকম যে, এক বাঙালি খিরিস্টান ছেলেকে সাহেব ভেবে প্রেমে পড়ে বিয়ে করেছিল আলেকান্দার সুন্দরী বিথী, জিলা স্কুলের এক বড় স্যারের মেয়ে। বিয়ের রাতে বিথীর খিরিস্টান স্বামী যেই তার প্যান্ট খুলেছে, আন্ডারওয়্যার খুলেছে, বিথী নাকি তখন চিৎকার দিয়ে বলে উঠেছিল, ‘ও মা! তুমি না খিরিস্টান! পেনিস তাইলে কালা ক্যানো?’
তারপর তারা আবার সবাই হা-হা-হা। এরই মধ্যে প্রেডিক্ট ডি সুজা কবিরকে শাসিয়ে বসল যে, ‘তুই খ্রিস্টানদের নিয়া ফাজলামি করো শালা? তোরে আমি জ্যান্ত বস্তায় ভইরা দপদপিয়া ফেরির নামায় যদি না পুঁতছি তো আমার নাম প্রেডিক্ট না।’
কবির তার উত্তরে বলেছিল, ‘তাইলে আপনের নাম আইজক্যা থাইক্যাই ধরেন—লেনজা।’ এরপর তার চেয়ে বয়সে অনেক বড় প্রেডিক্টকে সে জোরে ডেকেছে ‘লেনজা-লেনজা’ নামে, আর ওদিকে ট্রাকের পাশে ঘোরাঘুরি করা বিদ্দুত বিশ্বাসের কর্মচারী হতদরিদ্র ওই লেনজা সেই ডাক শুনে ছুটে এসেছে এইদিকে এবং তখন না-খাওয়া শূন্য পেটের লেনজাকে দেখে নতুন লেনজা প্রেডিক্ট ডি সুজা লজ্জা ও অপমানে একশেষ।
লেনজা তার দিকে কাউকে তাকাতে না দেখে শেষমেশ জাহেদকে বলেছে, ‘জাহেদ, আমারে ডাকল কেডা?’
জাহেদ জবাব দিল, ‘জানি না। কিন্তু লেনজা তুমি আমানতগঞ্জের বিলে বাইল্লা মাছ ধরতে আহো না ক্যানো?’
জাহেদের প্রশ্ন শুনে মরা বাড়ি থেকেই তখন আওয়াজ তুলেছিল শাহেদ (জাহেদের বাবা সেসময় জেলে), ‘আহো না কী কথা? ছি জাহেদ, ছি!’
বাতাসে ভাসতে থাকা ওই ছি-ছিটার মধ্যেই বালির মাঠে নানির জানাজা
পড়ানো হয়ে গেল। জানাজার মাঝখানে মুরাদ পু-ও-ও করে বায়ুত্যাগ করে বসল জোরে, আর তা শুনে তাদের সে কী হাসি। জানাজাটা পড়িয়েছিলেন মালেক হুজুর। মোনাজাতের শেষে তিনি জাহেদদের দলটার কাছে এসে জানতে চাইলেন, ‘জানাজার মদ্দে এত্তবড় অন্যায়ডা কেডা করল? রিয়াজ? জাহেদ? কবির? কও শুনি।’
কবির বলে দিল, ‘খিরিস্টানের পুত পেডিক্ট ভাইয়ে পাদ দিছে। তিনি জানাজায় দাঁড়াইছেন ক্যান? তিনি কি মুসলমান? তিনি ইচ্ছা কইরা পাদ দিছেন জানাজা নিয়া তামাশা করতে, হুজুর।’
মুরাদ নিতে পারল না তার বড়লোক বন্ধুর এই অপমান। সে বলল, ‘হুজুর, আমি দিছি। পাদ আমি দিছি। আপনের কোনো পোরোবলেম? কাইল্লা কবিরের সমান দুই টাকার ফকিননি হুজুর আসছে আমারে পাদ দেওনের আইন শিখাইতে।’
মুরাদের এ জাতীয় গরিবকে অপমান করে বলা কথার ঝাল সহ্য করতে পারল না অতি-গরিব কাইল্লা কবির। সে মাটিতে বালি সরানোর জন্য পড়ে থাকা বেলচাটা হাতে নিয়ে ধুম করে মেরে বসল মুরাদের মাথায়। বাড়িটা লাগল মুরাদের গাল জুড়ে, কপালের এক পাশ জুড়ে এবং তার কপাল ফেটে রক্ত বেরুতে লাগল ঝমঝম, যেমন বৃষ্টি পড়ে কোনো শ্রাবণের দিনে। হিন্দু পাড়ার ওরা, চোর সম্রাট ভক্তি মিশ্রের বডিগার্ড বাহার বাজুসহ ওরা যারা কবিরকে সহ্য করতে পারে না মোটেই, কারণ কবির বেশি গরিব, বেশি গরিবের কোনো ‘সরমান’ নাই, সেই ওরা ধর-ধর করে ধরতে গেল কবিরকে … আর কবির সে কী দৌড়, সে কী দৌড়…তখন তার পেছনে পেছনে ছুটছে বইঠো, বইঠোর পাশে একদম একশভাগ খাকি রং কুকুর দিলারা। মুরাদ ততক্ষণে মাটিতে পড়ে গোঁঙাচ্ছে। মুরাদকে চ্যাংদোলা করে ধরেছে সবাই, বলছে যে, ‘হাসপাতাল লাগবে, হাসপাতাল, সেলাই লাগবে রে।’
মুরাদের বাবা ধনী মন্টু খাঁ এই প্রথম বেরিয়েছেন তাদের প্রাসাদের মতো বাড়িটা থেকে। তিনি আওয়াজ তুলেছেন, ‘হাউ হাউ, আমার ছেলেকে কে মেরল? হু হিট মাই সন?’
তখন পারভিনের প্রেমিক নাঈম আর সামলে রাখতে পারল না তার হাসি, বলল, ‘মেরল? মারলরে বলে মেরল?’
নাঈমকে হাতের ধাক্কা মেরে থামিয়ে দিয়ে নাঈমের সবচেয়ে কাছের বন্ধু মোশতাক বলল, ‘রাখ নাঈম, আসল খ্যালা তো এহনই হইবে আবগারির মাঠে। দিলারা ম্যাডামে দৌড় দিছে বইঠোর পিছে, হা-হা-হা।’
ট্রাক ড্রাইভার চিৎকার দিয়ে উঠলেন, ‘ডেডবডি তিন মিনিটের মইদ্দে টেরাকে না উঠছে তো আমি চললাম। একশত আটাশি, একশত উনাশি, একশত আটাত্তর, একশত সাতাত্তর, একশত ছিয়াত্তর…।’ তার এই কাউন্টডাউন ছাপিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন নষ্টা নারী আনোয়ারা, ‘ওই শুয়ারের বাচ্চা টেরাক ড্রাইভার, চুপ কর। আমরা এহানে লাশের লগে বইস্যা সাতচারা খেলতেয়াছি, না?’
মিরাজ এ সময় ঘেঁষে এল জাহেদের দিকে, যখন কিনা মিজান বেগুনবাগানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে গুনগুন করে গাইছে:
কাজল নদীর জলে ভরা ঢেউ ছল ছলে
প্রদীপ ভাসাও কারে স্মরিয়া?
সোনার বরণী মেয়ে বলো কার পথ চেয়ে
আঁখি দুটি ওঠে জলে ভরিয়া।
মিরাজ বলল, ‘দ্যাখ দ্যাখ, আঁখিরে দ্যাখ রে, ব্যাডারা। মিজানরে ক্যামনে দেখতেয়াছে আঁখি হেইডা দ্যাখ।’
জাহেদ তাকাতে পারল না আঁখিদের বাড়ির দিকে। আঁখিকে দেখলে এমনিতেই তার ভেতরে কেমন এক অস্বস্তি হয়, কারণ আঁখি বেশি সুন্দর, আর আঁখির বাবা সামাদ সাহেবকে তার সহ্য হয় না, একদম সহ্য হয় না। আর আসল কথা তাকে এরইমধ্যে ঘরের ভেতর থেকে ডেকে বসেছে তার বোন পারভিন। ‘নিশ্চয়ই নাঈমের জন্য চিঠি দেবে, ভাবল জাহেদ। কিন্তু তার ভাবনা থামিয়ে দিয়ে মিরাজ বলল, ‘আমি জানি কবির কোথায় পালাইছে। আইজকা তোর নানি মরছে, আইজকা স্কুল নাই। চল কবিররে লইয়া আমরা অভিরুচি হলে যাই। বারোটার শো-তে কী জানি একটা ড্রাগন-ম্রাগন সিনামা চলে।’
জাহেদ বলল, ‘যামু। তোরা ভাডিখানার মোড়ে যা, আমি ঘর সামলাইয়া আসতেয়াছি।’
জাহেদের কথার মধ্যেই নান্টু ভাই—পাড়ার প্রথম বাড়ির নান্টু ভাই যিনি কিনা ভাটিখানা-কাউনিয়া আমানতগঞ্জ ‘চাঁদের হাট’-এর সভাপতি-মুখ গম্ভীর করে জাহেদের কাছে হেঁটে এসে তার মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘কেন্দো না জাহেদ, আমার নানি মারা গেলেও আমি অনেক কেন্ছিলাম। কিন্তু কী লাভ কেন্দে? যে-যাবে, সে কি আর ফিরত আসবে?’
ট্রাক ড্রাইভার নান্টু সাহেবের কথাটা শুনলেন। তিনি তার সরু দাড়িতে হাত রেখে বললেন, ‘চুয়াত্তর, তেয়াত্তর, বাহাত্তর…থামলাম। এইহানে কে কান্দে কার লাইগ্যা? মরা বাড়ি দেখলাম বড়ে একখানা। একজন জানাজায় পাদ দেয়, একজন আরেকজনরে মাইর্যা রক্ত বাইর কইর্যা দেয়, আর এক খানকি বেডি চিল্লায়। কিন্তুক কারও মাথায় আসল কথাডা নাই যে গরম পড়ছে, লাশ যাইবে কুষ্টিয়া, লাশ পচবেয়ানে রাস্তায়।
নানির লাশ রাস্তায় পচবে শুনে ওইমাত্র বাড়ির ভেতরে ক্ষেপে উঠল নানির প্রিয় পান্তামুখী হাঁস গুধু। সে প্রকাণ্ড জোরে ডাক দিয়ে পাড়া কাঁপিয়ে ফেলল- প্যাঁক-প্যাঁক-প্যাঁক। গুধুর গলায় এরকম আর্তনাদ শুনে ভয় পেয়ে গেল জাহেদ, কারণ তার মনে হল নিশ্চিত খছাক এসেছে—চালের কারবার করা বিজয় মহাজনদের গুইসাপ খছাক। জাহেদ মুরাদের রক্তের চিহ্নমাখা বেলচা হাতে তুলে নিয়ে রিয়াজ, মিরাজ ও মিজানকে সঙ্গে আসার ইঙ্গিত দিয়ে গলা ছেড়ে চিৎকার দিল: ‘খ-ছা-ক’।
তার এই খছাক ডাক শুনে ভয়ে ট্রাক থেকে নিচে নেমে এলেন ট্রাক ড্রাইভার। তিনি বললেন, ‘সাতান্ন, ছাপান্ন;’ আর মুরাদের বাবা ধনী মন্টু খাঁ বললেন, ‘হোআট ইজ দিস? হোআট হ্যাপেন? হু হিট মাই সন? আমার বন্দুক কোথায়?’ এবং বিজয় মহাজন আমড়া গাছটা ধরে ঝাঁকাতে লাগলেন এই কথা বলে, ‘জাহেদ জাহেদ, খছাকরে মারলে ভাড়িখানায় হিন্দু-মোসলমান আগুন জ্বলবে কইলাম।’ তার ঝাঁকি খেয়ে আমড়া গাছ থেকে মাটিতে ঝরে পড়ল চার-পাচটা শুঁয়োপোকা। তারা হতভম্ব।
জাহেদের বাবা চোখ বন্ধ অবস্থায়ই খেয়াল করেছেন, বড় ভাই শাহেদ বলা সত্ত্বেও জাহেদ তার মা-র কাছে যায়নি, যে-মা তার নিজের মায়ের শেষ দিনগুলোয় প্রচণ্ড অর্থাভাবে তাকে অবহেলা করে এখন ভুগছেন অপরাধবোধে। নিজের স্ত্রীর ওপর এতটা অন্যায় মেনে নিতে পারলেন না কাশেম মিঞা। তিনি দড়াম করে উঠে বসলেন বেতের সোফার ওপরে, ওখানে হাঁটু মুড়ে বসে তার পিঠটা মিশিয়ে দিলেন সোফার পেছনভাগের মাঝ বরাবর, আর এবার সেই পিঠ ঘষে ঘষে চুলকালেন সোফার উঁচু-উঁচু হয়ে থাকা বেতের বাঁধুনিগুলোর গায়ে এবং আকস্মিক দুচোখ ঠাক করে পুরো খুলে বললেন, ‘আমার সাথে নদীতে জাহেদ যাবে না। মালেক হুজুর ওকে মহা বেয়াদব বানাইছে। আর ও কী মনে করে, ও কী মনে করে আমি জেলখানা থেকে বের হয়ে শুনি নাই যে, নানির মরার দিন ও বন্ধুদের সাথে অভিরুচি হলে সিনেমা দেখতে গেছিল? আমাকে কে বলে নাই যে, কাশেম ভাই কী কাজ করল এটা আপনার ছোট ছেলে জাহেদ? রিয়াজ-মিরাজ-মিজান সিনেমা দেখছে তো দেখছে, আপনার শাশুড়ি আম্মা তো ওদের কিছু হয় না, কিন্তু তিনি তো জাহেদের আপন নানি হইতেন। লোকজন আমাকে বলল, ‘দেইখেন আপনার ছেলে মানুষ না হয়ে আবার হায়ওয়ান না হয়ে যায়’। ছি!’
এটুকু বলে থামলেন তিনি। তারপর হাত মুঠো করে দাঁড়িয়ে গেলেন দ্রুত এবং সেই মুষ্টিবদ্ধ হাত শূন্যে জাহেদের দিকে ছুড়ে বললেন, ‘হায়ওয়ানই তো হচ্ছে আমার ছেলে। সে এখন তার ভাইয়ের পিছনে লাগছে, তার মায়ের পিছনে লাগছে, এরপর আমার পিছনেও লাগবে। বস্তির ছেলেদের সাথে মিশলে এই ছাড়া আর কী আশা করা যায়? কী আশা করা যায়?’
জাহেদের মন অনেক খারাপ হয়ে গেল বাবার কথা শুনে, যদিও সে হায়ওয়ান শব্দের অর্থ জানে না। কিন্তু সে বুঝল, এর মানে শয়তান জাতীয় কিছু। তার মনে হল তাকে আসলে কেউই বুঝতে পারে না, তারা এমনকী এ-ও বুঝতে পারে না যে, কেন ওভাবে চোর নামের মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলা খারাপ, কেন অবৈধ সন্তানের জন্ম দিয়ে সন্তানকে ঘরে না নেওয়া খারাপ, কেন নিজের বৃদ্ধা মা-কে মৃত্যুর আগের দিনগুলোয় অবহেলা করা খারাপ। এতগুলো খারাপের বিপরীতে তার বাবা তার খারাপটা কী বের করলেন, শুনি? হুঁহ, কেন সে নানির মৃত্যুর দিনে সিনেমা দেখতে হলে গিয়েছিল, আর কেন সে বস্তির কাইল্লা কবিরদের সঙ্গে মেশে? জাহেদের স্পষ্ট মনে হল, এ দুটো কাজই কোনো মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলার চাইতে ভাল, যদিও প্রথমটা, ওইরকম দিনে ওই সিনেমা দেখতে যাওয়ার ব্যাপারটা, সেদিন আসলেই একটু বেশি হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু এসব বিবেচনাবোধ ছাপিয়ে তার কাছে আসল কথা বলে মনে হল এটুকুই যে, তার বাবা নিজ মুখে বলে দিয়েছেন তিনি তাকে নদীতে নেবেন না, তিনি শাহেদকে সঙ্গে নিয়ে আড়িয়াল খাঁ যাবেন। হায়, হায়, এরা কি কিছু জানে যে, কেন সে রাতের আড়িয়াল খাঁয় যেতে চায়? তা নিয়ে এদের খবর আছে কোনো? এদের সামান্য খবর আছে যে, কেন সে দেখতে চায় কীভাবে দূর স্বরূপকাঠির দিক থেকে, ইন্দেরহাটের দিক থেকে রাতের কালো নদীতে স্রোতের সঙ্গে বারবার এসে মেশে রিঠা মাছের ঝাঁক? সে শুনেছে, মাছগুলো চারপাশ থেকে আঁকড়ে ধরে রাতের নৌকা, আর নৌকার গায়ে তাদের পিচ্ছিল শরীর লম্বালম্বি খাড়া করতে করতে তারা ওপরে তাকিয়ে একপলকে দেখে নেয় আকাশে জ্বলজ্বল তারা আছে কী নেই, থাকলে কত আছে, আর না থাকলে আছে তাদের আশার থেকে কত কম। আর তখন, তখনই কী করে ওই রিঠা মাছগুলো ডাকে মুখে কিটকিটকিট শব্দ তুলে। তারা ওভাবে এক মাছ কথা বলে আরেক মাছের সঙ্গে, কারণ ততক্ষণে ঠিকই তাদের মধ্যেকার কোনো কোনো মাছ দেখে ফেলেছে যে, আকাশের কিছু তারা ছিটকে পড়েছে নদীর পানিতে এবং পানির সে জায়গাগুলো তাতে জ্বলে উঠেছে কেমন ঝিকমিক করে। জাহেদ শুনেছে, ওই পানির স্রেফ একটু টুকরো, ওই আলোজ্বলা নক্ষত্রের পানির স্রেফ একটুখানি মুঠোতে ধরতে পারলে কি কোনোমতে বোতলে ভরে বাড়ি নিয়ে যেতে পারলে সেটা কিছুক্ষণের মধ্যে হয়ে যাবে সোনাদানা, হীরে-জহরত, দামি পাথর, দামি মণিমাণিক্য।
সে তাদের বাড়িতে আরবি পড়াতে আসা ভাল মানুষ মালেক হুজুরের কাছ থেকে তালতলীর দিকের নদীর পানিতে মিশে থাকা ওই গুপ্তধনের কথা শুনেছে অনেকবার। সেই গল্প সে পরে আবার শুনেছে তার বন্ধু রিয়াজ-মিরাজের কাছ থেকেও। আর আসল কথা, মালেক হুজুর তাকে স্পষ্ট বলেছেন, ‘গুপ্তধন হগ্গলে পায় না জাহেদ। য্যারা সাহস করে, খালি হ্যারা পায়। তুমি নদীর জ্বলেন্ত পানি ধরবা আর কিছুই পাইবা না, পিরথিবি এত্তো তো ফালতু হয় নাই, বাচ্চা পোলা।’
সেই মালেক হুজুরকেই কিনা এ বাড়ির লোকেরা উঠতে বসতে গালি দেয়, দোষারোপ করে জাহেদের মাথা খাওয়ার জন্য? কে কার মাথা খেয়েছে? নাঈম খেয়েছে পারভিনের মাথা। একগাদা গুণ্ডা ছেলেপেলে খেয়েছে শাহেদের মাথা। ওমর আলি খেয়েছে কাশেম মিঞার মাথা।—এই তো হিসাব, এই তো! আর এই তারা কিনা তাকে শোনায় মাথা খাওয়ার গল্প? বস্তির ছেলে কবিরের সঙ্গে, পদমের সঙ্গে, তপনের সঙ্গে সে মেশে তো, তাতে কার কী ক্ষতি হয়েছে এ বাসার? ওমর আলির সঙ্গে মিশে যে তার বাবা কাশেম মিঞা সব হারাল, প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা-পয়সা সব হারিয়ে তাদের পরিবারটাকে পথে বসাল, সেই বিচার, সেই বিচার কে করবে? তার বাবার হারানো খোয়ানো টাকাগুলো উদ্ধারের জন্যই তো এতকিছু প্ল্যান করেছে জাহেদ। সেজন্যই তো সে যখন থেকে শুনেছে যে, আজ সন্ধ্যার পরে তার বাবা নদীতে যাবেন ওমর চাচার সঙ্গে, ওই তক্ষুনি সে অস্থির ও উন্মনা হয়ে উঠেছে, সারাদিন বাড়ির সবার সঙ্গে ঘ্যানঘ্যান করেছে বাবার সঙ্গে তার নদীতে যাবার একটা ব্যবস্থা করে দিতে। কেন? সেটা কি তার নিজের জন্য?
না, সেটা সে আড়িয়াল খাঁ গেলে তাদের রিক্তহাত-শূন্যহাত এই পরিবারে কিছু টাকা আসবে বলেই। পারভিনের বিয়ে দিতে হবে, একটা পয়সাও নেই। শাহেদ বিদেশে যাবে পড়তে; কিন্তু রাশিয়া যাবে না-কি জার্মানি যাবে, তা বুঝতে সে যে সামান্য ঢাকায় যাবে, সেই পয়সাও তাদের নেই। আর প্রতিদিন সকালে তারা যে জাহেদকে নতুন বাজারে পাঠায় এবং সে যে ওখানে ছোট নদীটার এই পাশে, জেলখানার দেয়ালটার এই পাশে মাছ ও মাংস কোটার জায়গাটায় কাছিমের জবাই দেখে পরে রোজ রোজ দুচারটা মলা মাছ ব্যাগে ভরে বাড়িতে ফেরে—এভাবেই চলবে সবকিছু? চিরকাল?
তবে, জাহেদের মনে হল, বাবার সঙ্গে এই রাতের নদীতে যাবার পেছনে তার নিজেরও স্বার্থ আছে কিছু। তাকে যে করেই হোক বাঁচাতে হবে চাখারের বন্ধু ঈমানকে—সার্কাসে জোকারের কাজ করত যে-ঈমান, জোকারের ওই কাজ করতে করতে ভয়ংকর এক ঘটনায় জড়িয়ে গেল যে-ঈমান। হুম, যে করেই হোক ঈমানকে বাঁচাতে হবে তার—ঈমান, তার প্রাণের বন্ধু, গুপ্তধন বেচে টাকা পেলে সেই টাকার চার ভাগের এক ভাগ দিয়ে যাকে সঙ্গে করে সে চলে যাবে তেগুচিগালপা। তার মানে টাকার চার ভাগের তিন ভাগ তো তার পরিবারই পাচ্ছে, নাকি? মালেক হুজুরকে দেওয়া সামান্য কিছু বাদে পুরো তিন ভাগ। এটুকুও তারা কেউ বোঝে না?
জাহেদের মনে পড়ল তার বোন পারভিন আজ দুপুরে তাকে কথা দিয়েছিল বাবার সঙ্গে তার নদীতে যাওয়ার ব্যবস্থাটা সে-ই করে দেবে। বিনিময়ে এখন থেকে জাহেদকে সবসময় চলতে হবে পারভিনের কথামতো, আর এতে যদি জাহেদ রাজি থাকে তাহলে এ ব্যাপারে মা-কে দিয়ে বাবাকে হ্যাঁ করানোর দায়িত্ব পারভিনের। জাহেদ তো রাজি হয়েছিল বোনের সঙ্গে এই চুক্তিতে যেতে। এমনকী সে তার বোনকে এটাও বলেছিল যে, কাল থেকে বিনা বাক্যব্যয়ে সে শুধু প্রতিবেশী নাঈম ভাইয়ের কাছ থেকে চিঠি-বই-কবিতাই বোনকে এনে দেবে না, নাঈমের সঙ্গে বোনের বিয়েতে ঈমানের সার্কাসের দলটাকেও চাখার থেকে নিয়ে আসবে ভাটিখানা। কী সুন্দর হবে যদি ঈমান সেই রাতে সার্কাসের ছুতোয় তার পাশে থাকে, আর তখন মুখে কেরোসিন ভরে আকাশে আগুন ছোড়ার পরে যদি মিজান শুধু একটু গান গায়—’হ্যালো, হ্যালো, আমার এইবারের গান, ‘আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা থাকে’ – কিন্তু যে-ই সন্ধ্যা নামতে লাগল, সেই কীভাবে বিগড়ে যেতে লাগল তার বোন, তার হারামি বোন।
জাহেদের হঠাৎ মনে হল, বোনকে সে নাঈম ভাইয়ের বিষয়টা বলেই বোধহয় ভুল করেছে। তার মনে হল, এর ফলে তার বোন আসলে মনে মনে তার ওপরে ক্ষেপে গেছে। সে বরং জাহেদকেই সন্দেহ করে বসেছে গত সপ্তাহে এ বাসায় ঘটে যাওয়া বিশাল হইচইটার পেছনে কলকাঠি নাড়ার লোক হিসাবে।
জাহেদ মায়া-মায়া চোখে তাকাল তার বোনের দিকে। সে যতটা পারছে এড়িয়ে চলছে তার বাবার রক্তচক্ষু, এড়িয়ে চলছে মেঝেতে বসে নিজের মায়ের মৃত্যু নিয়ে বিলাপ করতে থাকা তার মায়ের চোখের পানি। পারভিন ঠিক এসময়ে জাহেদের ছলছল দু চোখ দেখে বলে উঠল, ‘বাবা, তুমি যাও তো। জাহেদ যাবে না। শামসু এখনও আসলো না ক্যানো?’
জাহেদ কল্পনাও করেনি তার জলে ভরা চোখ দেখে শেষমেশ এই কথা বলবে তার বোন। সে অবাক হল খুব। কী ভাবছিল সে, আর কী এখন বলল তার মায়ের পেটের নিজের বোন পারভিন? বোনের এই রায় শুনে আবার হুহু করে কেঁদে ফেলল জাহেদ—প্রায় চিৎকার করে। তার কান্না ছাপিয়ে তাদের মা এই প্রথমবারের মতো শক্ত মেঝের থেকে উঠে দাঁড়িয়ে শক্ত জেরা শুরু করলেন তাদের বাবাকে, ‘কেন তোমাকে রাত-বিরাতে যেতে হবে নৌকার মধ্যে? ওমর আলির সঙ্গে আর কে কে যাচ্ছে, শুনি?’
তিন ছেলেমেয়েই এবার চুপ। শুধু জাহেদ তখন কাঁদছে সামান্য খুন-খুন, আর বাইরের উঠানে তাদের তিন পোষা মুরগি অস্থির হয়ে পড়েছে যে, রাত তো নেমে গেল, তবু এখনও কেন তাদেরকে খোঁয়াড়ে ঢোকাচ্ছে না পারভিন নামের ওই বেটি? জাহেদ দেখল তারা সবাই বসার ঘর ছেড়ে কী করে কী করে যেন চলে এসেছে মাঝখানের ঘরটায়। এবার ঘরের জানালার লম্বা গ্রিলের ফাঁক দিয়ে সে তাকাল মুরগি তিনটার দিকে, আর কান খাড়া করে শুনতে চাইল তার বাবা তার মায়ের জিজ্ঞাসার কী উত্তর দেন।
}
আসলে জাহেদ ধরতেই পারছে না, ওমর চাচাকে নিয়ে কী ভয়ের কথা বলছে এরা সবাই। ওই ওমর আলি তার বাবার সঞ্চয়টুকু নিয়ে ব্যবসায় খাটিয়ে ব্যবসা ফেল মেরেছেন কি বাবার টাকা সব মেরে দিয়েছেন, এই তো? এর বাদে তাকে নিয়ে আরও বেশি ভয় কেন এ বাড়ির লোকজনের? কীসের ভয়?
ঠিক এ সময়ে বাইরে রাস্তায় টমেটো গাছগুলো পেরিয়ে যে ছোট নিউ ভাটিখানা রোড, সেখানে হইচই বাঁধিয়ে ফেলল কুলফিওয়ালা নাঈম্মিয়্যা। সে কদিন পরপর এ পাড়ায় আসে এই সন্ধ্যা পড়ে এলে এলে, আর নির্ঘাত ঝগড়া বাঁধিয়ে ফেলে বেচা কুলফির সংখ্যা নিয়ে, আরও কতকিছু নিয়ে—যেমন তোমার টাকা ছেঁড়া, যেমন তোমার কাছে আগে পাই আরও বারো টাকা। আর মানুষও গরমে কুলফি কেনে বটে। এত কুলফি কেনার টাকা কোথায় পায় ওই দালানবাড়ির লোকজন? নাঈম্পিয়্যা কুলফি বেচতে এলেই এ কথা সবসময় ভাবে জাহেদ, আর ভাবে তাদের বাসার লোকজনের কিনা সবার জন্য একটা করে কুলফি না, সবাই মিলে ভাগ করে খাওয়ার মোটে একখানা কুলফি কেনারও টাকা নেই। হাহ্!
তার বাবা তখনও নিরুত্তর। তিনি অপ্রস্তুত হয়ে তার মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে জোকারের মতো একখানা লম্বা লাঠি দিয়ে নিজের পিঠ চুলকাচ্ছেন—খচ্ খচ্। তার ভাব এমন যে, প্রশ্নটা তিনি শোনেনই নি। তার মা স্বামীকে এবার জোর আওয়াজেই বললেন, ‘কী, কোনো উত্তর করছ না কেন? রাতের বেলা তোমার নদীতে যাওয়া লাগবে কেন ওমরের সাথে? ওমর একটা মানুষ? তোমার মনে হয় ওমর একটা মানুষ? জেলখানায় পরিচয় হওয়া লোক আবার ভাল হয়? তুমি না হয় ভাল মানুষ, জেলে গেছ লোকের শয়তানিতে। কিন্তু ওমর ব্যাটা ফাজিল, বাটপাড় ওমর। স্রেফ চার লাখ টাকা ছিল প্রভিডেন্ট ফান্ড আর আমার সঞ্চয় মিলাইয়ে তোমার সারা জীবনের সঞ্চয়। তার পুরোটা খেল সে মাত্র আট-নয় মাসে। পুরোটা?’
জাহেদ তার বোনের কানে কানে গিয়ে বলল, ‘নাঈম্মিয়্যা আসছে। কুলফি বেচে। হি-হি।’
পারভিন ক্ষেপে গেল জাহেদের ওপরে। পারভিন এটা নিতেই পারে না যে, তার ভালবাসার মানুষের নাম নাঈম, আবার এই পাড়ায় কুলফি বেচতে আসা লোকটার নামও কিনা নাঈম। আর কী বদখত চেহারা ওই কুলফিওয়ালা নাঈমের। সে পাড়ায় ঢুকে তার পিঠে বেঁধে নিয়ে চলা টেবিল নামিয়ে কুলফির মেটে রঙ মটকাটা সেই টেবিলের ওপরে রাখে কেমন বিশ্রী দুম করে, তারপর তার পিঠের যে-জায়গায় টেবিল ছিল, সেখানটা চুলকায় কীরকম নোংরা দাঁত দেখিয়ে। আর মুখে বলে, ‘ইয়া আল্লাহ, ইয়া খোদা’ এবং তারপর তার সেই হাঁক: ‘বাড়িখানার বাচ্চারা, কুল-ফি-ই-ই।’ তারপরই তার ওই জঘন্য ঝড়ং-ঝড়ং শব্দ! কী বিশ্রী ঝড়ং-ঝড়ং আওয়াজই না তখন হয় তার ওই হাতের খঞ্জনির মতো জিনিসটা থেকে, আর সেটা শুনে দালানবাড়ির বদমাশ ছেলেগুলো কীভাবে বিদেশি কুকুরের মতো দৌড়ে ছুটে আসে জিভ বের করে হাঁপাতে হাঁপাতে তাদের পেটের চর্বিতে হাত রেখে, তাদের মোটা পাছায় হাত রেখে এবং এই চিৎকার করতে করতে যে, ‘নাঈম্মিয়্যা, আমারে উপরের থেকে দিবা।’
পারভিন প্রায়ই ভাবে কী আছে মটকার ওপরের দিকের কুলফিতে, যা কিনা নিচের দিকে নেই? একটু সামান্য বেশি নরম নরম ওরা, এই তো? আর নিচেরগুলো একটু পাথর-পাথর, এই তো? তা নিয়ে এতো জোরে ‘নাঈম্মিয়্যা- নাঈম্মিয়্যা’ বলে ডাকার কী আছে ছেলেগুলোর?
পারভিন একদম সহ্যই করতে পারে না (এটাই তার কাছে এই পুরো পৃথিবীর সবচাইতে অসহ্যকর বিষয়) বিশেষ করে মন্টু খাঁ-র ছেলে মুরাদকে, যে কিনা অকারণে অতিরিক্ত ‘নাঈম্মিয়্যা-নাঈম্মিয়্যা’ বলে ডাকতে থাকে, ডাকতেই থাকে পারভিনদের বাড়ির দিকে মুখ রেখে। পারভিন বোঝে না এইসব মনে করো? জাহেদই বোঝে, আর পারভিন তো বুঝবেই। সে জাহেদের চাইতে প্রায় দশ বছরের বড়।
পারভিন এই সেদিনও তার নাঈমকে বলেছে, ‘নাঈম, নাঈম, তুমি যদি ওই শয়তানের বাচ্চা মুরাদরে না পিটাইছ তো, আমার কাছে আসবা না। পিটানি ও না, ওরে লুলা করে দিবা তুমি। ওকে?’
নাঈম অবাক হয়েছে পারভিনের মুখে ইংরেজি ‘ওকে’ শুনে, আর তখন তাকে বলেছে, ‘হাতটা দাও, তাহলে একটা কথা বলি। দাও, হাতটা দাও।’ পারভিন হাত দেয়নি। সে মোরগফুলগুলোর ওপরে হাত বুলিয়ে সেই হাত নাঈমের নাকের সামনে নিয়ে বলেছে, ‘আমার কথার উত্তর দিবা, তাহলে হাত পাবা। আরও অনেক কিছু পাবা।’
নাঈম জানে ওই ‘আরও অনেক’ কিছুটা কী। সেটার মানে জড়িয়ে ধরা, যাকে ইংরেজিতে বলে ‘হাগ’। কিন্তু কথাটার সঙ্গে বাংলা হাগা-র মিল আছে বলে পারভিন যদি কখনও বিশেষ মুডে থাকতে তাকে বলে বসে ‘হাগ মি’, তখন নাঈম লজ্জা পেয়ে যায় একটা মেয়ের মুখে এই হাগামোতা জাতীয় বাজে শব্দ শুনে। হ্যাঁ, পারভিনের ‘আরও অনেককিছু’-র মানে নাঈম জানে—প্রথমে ওই হাগ; তারপর চুমু; তারপর পারভিন নাঈমের হাতটা নেবে নিজের বুকের ওপরে, নাঈমকে বলবে, ‘কাপড়ের নিচ দিয়ে হাত দেও নাঈম’; বলবে, ‘মুখ খোলো না ক্যানো, ডিম খাইছ নাকি? আজব ছেলে, ডিম খেয়ে তারপর আসছে লাভারের কাছে।
পারভিনের মুখে ‘লাভার’ শব্দটাও নাঈমের কাছে আজবই লাগে। সে পারভিনের কানের মধ্যে মুখ ঢুকিয়ে বলে, ‘লাভার বলবা না তো। মনে হয় যেন কোনো মেশিন। লাভার তো বলে সাইকেলের গ্যারেজের লোকেরা।’
পারভিন তখন তাকে বলে, ‘তুমি আজব, তুমি আজব। সাইকেলের গ্যারেজে আবার লাভার কোথায় আসলো? কী যে বলো! মুখ খোলো, জিভ দাও।’
নাঈম তখন কোনোমতে তাকে জানায় যে, সে ডিম খায়নি, আর সাইকেলের গ্যারেজে ট্যাংরা মাছের চাষ হলেও এ মুহূর্তে তার কী, কার কী, তার বাপের কী! সে তার জিভের ওপরে চুমু নামের অনেকগুলো কামড় খায় পারভিনের দাঁত দিয়ে—কিটকিটকিট, এবং পারভিনের কাছে বকা খাওয়ার আগেই তার কামিজের ভেতর দিয়ে হাত ঢুকিয়ে তার বুকে হাত রাখে, হাত এদিকে-ওদিকে করে, যেন বা সে কিছু একটা খুঁজছে তার প্রেমিকার বুকের ওইখানে। পারভিন হঠাৎ বলে, ‘লাভার না, ঠিক আছে। আমাকে বলবা জান।
নাঈমের শ্বাস তখন অনেক ঘন হয়ে আসে। সে ইচ্ছে করে পারভিনের গায়ের মধ্যে ঘেঁষে লেপটে এসে পারভিনকে বোঝায় যে, সে পুরুষ, তার নিচের দিকে সব এখন শক্ত, যেমন তার হাঁটুও, যেমন তার কাফ মাসলও।
‘কাফ মাসল’ শব্দটা নাঈম নতুন শিখেছে তালতলীর ঘাটের ওখানে এক গ্যারেজের মালিক ও একইসঙ্গে কুংফু ক্যারাটের শিক্ষক সানজিদ কাজির কাছ থেকে। এই একই লোকের থেকে সে আরও শিখেছে যে, গ্যারেজের একটা লম্বামতো মেশিনের নাম হচ্ছে লাভার। সেদিন পারভিনের বাবা কাশেম মিঞার সঙ্গে নিউ ভাটিখানা রোডের মোড়ে দেখা হয়ে গেলে নাঈম ঘাবড়ে গিয়ে তাকে সোজা বলে বসেছিল, ‘ভালুজান, খালু আছেন? আপনার কাফ মাসল ভাল আছে?’ কাশেম মিঞা অবাক হয়ে তাকে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘তোমার কথা পছন্দ হল না নাঈম। তোমার বন্ধু মোশতাক সেদিন আমাকে বলল, ‘জেলখানায় ভাল ছিলেন খালু?’ আর আজকে তুমি আমারে খালু না বলে বললা—ভালু। সব বেয়াদব হয়ে গেছ তোমরা, সব বেয়াদব।’
মানুষটা তার জান পারভিনের বাবা, তাই নাঈম একমুহূর্ত দেরি করেনি পা ছুঁয়ে সালাম করবার নামে তার কাছে তৎক্ষণাৎ মাফ চেয়ে নিতে। সে অবশ্যই বলতে চেয়েছিল, ‘খালুজান, ভাল আছেন’; সে অবশ্যই কোনোকিছু জিজ্ঞাসা করতে চায়নি মানুষটার কাফ মাসল নিয়ে—ওটা স্রেফ তার মুখ থেকে বেরিয়ে গেছে, জাস্ট এমনিই বেরিয়ে গেছে। আর মোশতাক তাকে, তার ভবিষ্যৎ শশুরকে জেলখানার কথা মনে করিয়ে দিয়ে এইরকম অপমান করবে এবং নাঈম ছেড়ে দেবে মোশতাককে? সে কাশেম মিঞার পা আঁকড়ে ধরে বলল, ‘ভালু, আমারে মাফ করে দিয়েন। আমি ভালুরে খালু বলতে চাই নাই। আর মোশতাকের বেয়াদবির শিক্ষা আপনি পাবেন, আপনি পাবেন।’
কাশেম মিঞা তখন অবাক হয়ে বলেছেন, ‘আমি কেন সেই শিক্ষা পাব? কী আবোলতাবোল বলছ তুমি, নাঈম?’
নিজের ভুলের পরে ভুলের পরে ভুল করা দেখে নাঈম সেখানে আর এক মুহূর্ত থাকেনি। সে তার হবু শ্বশুরের সামনে থেকে দৌড়ে পালিয়ে যেতে যেতে চিৎকার করে বলেছে, ‘মোশতাকের শাস্তি হবে খালু, মোশতাকের শাস্তি হবে।
পারভিনের হাতটা সে মোরগফুলগুলোর গায়ে জোর করে ঠেসেই ধরল। ফুলের একটা ডাণ্ডা লেপটে গেল মেয়েটার ডান হাতে এবং প্রায় লালমতো রংয়ে ভরে গেল তার হাতের কবজি, আর ফুলের গায়ের রেশম-রেশম লোমগুলো চিকচিক করতে লাগল তার আঙুলের নখের ডগায়। পারভিন লজ্জায় রঙিন হয়ে গেল মুহূর্তের মধ্যে, বলল, ‘বিয়ের পরে আমাকে রেপ করবা তো?’
নাঈম বুঝল না এ কথার সে কী উত্তর দেবে। তার বউ স্বামীর কাছে ‘রেপ’ হতে চায়? নাঈম বলল, ‘করব। কিন্তু পুলিশ যদি জানে, হা-হা?’ নাঈমের জোকটুকু শুনে হেসে ফেলল পারভিনও। তারপর মুহূর্তের মধ্যে সেই হাসি থামিয়ে কঠোর-কঠিন মুখ করে সে বলল, ‘মুরাদরে মারবা না? শয়তানের বাচ্চা মুরাদ। কুলফিওয়ালা না আসলেও আমাদের বাড়ির দিকে তাকায়ে সে চিল্লায়—’নাঈম্মিয়্যা আসছে, কুলফি খাইবেন কেউ মুখে ভইর্যা?’ বোঝো তুমি ওর এই কথার মানে? বোঝো তুমি? ছি!’
নাঈম ছেড়ে দিল পারভিনের হাত। তাকে বলল, ‘শোনো, মুরাদের মাইর কিন্তু মুরাদ খাইছে তোমার নানি মারা যাওয়ার দিনে। মনে নাই? শুয়ারের বাচ্চার কপালে এখনও আটটা সেলাইয়ের দাগ। ডান গালে, ডান কপালে। আমিও সমান-সমান সেলাই দিব ওর বাম কপালে, দেখো।’
এ কথা শুনে পারভিন নাঈমের বুক বরাবর হাতের জোর ধাক্কা মেরে তাকে বলল, ‘তুমি দিবা ছাতা। আজ পর্যন্ত নিজের লাভারের বুকে একটা দাগ বসাতে পারো নাই, আবার বড় বড় কথা। শোনো সেদিন দেখি ‘বিচিত্রা’-য় ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপনে একজন লিখছে, তার নাম ‘ঝড়ের পাখী, রাজশাহী’, সে লিখছে: ‘নিশি, অভদ্রতার অর্থ তুমিই দেখালে, তাই বুঝলাম। বুক ভরা দাগের কথা ভুলে গেলে, সেটাও বুঝলাম।’
নাঈম সবসময় ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’-র ওই ‘ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন’ অংশগুলো পড়ে। ওখানে ছাপা হওয়া বিজ্ঞাপন দেখেই সে মাত্র গত সপ্তাহে পারভিনকে কিনে দিয়েছে ম্যানোলা-র সি-বো ভ্যানিশিং ক্রিম, আর ক্রিমের বিজ্ঞাপনের ওই সংখ্যায়ই সে দেখেছে ‘ঝড়ের পাখী’ নামের লোকটার এই একই বিজ্ঞাপন— হারানো প্রেমিকা নিশির উদ্দেশে লেখা ওই লোকের ওই কষ্টের কথাগুলো। তবে ‘বিচিত্রা’-র সেই সংখ্যায় তার ভাল লেগেছিল আসলে অন্য দুই বিজ্ঞাপন। একটা লিখেছিল ‘মিথ্যুক’ নামের এক লোক যে, ‘পৃথিবীর সব প্রেমিকই অসুখী’। আরেকটা চিট্টাগাং থেকে ‘সারেং’ নামের একজন, যে, ‘তুমি গোলাপের দুর্বল প্রতিদ্বন্দ্বী মাত্র। ঠা… ঠা…ঠা…ঠা, টাস…টাস…টাস। দ্রিম, বু-উ-ম।’
নাঈম পারভিনকে জিজ্ঞাসা করল, ‘বুক ভরা দাগ আমি তোমারে কোথায় বসে দেব, জান? এই কাঞ্চন-এলিজাদের বাগানে? তুমি পাগল হইছ?’
পারভিন বুঝল তার কথা, বলল, ‘হুম্ম্, চলো একদিন তালতলী থেকে নৌকা নিয়ে আমরা আড়িয়াল খাঁ ঘুরতে যাই। ছইওয়ালা নৌকা আছে। মাঝিরে পাঁচ টাকা দিলে মাঝি কখনোই ভিতরে তাকায় না।’
নাঈম জিজ্ঞাসা করল, ‘সেটা তুমি কী করে জানো, পারু?’
পারভিনের ভাল লাগল নাঈমের মুখে এই ‘পারু’ ডাক। সে বলল, বিচিত্রা’-য় পড়ছি। ওই ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপনেই। একজন লিখছিল, তোমাকে আমি দেখাব, বরিশাল থেকে ‘কুয়াশা’ নামের একজন লিখছিল, কী জানি লিখছিল, এই ধরো যে, ‘নীলাম্বরী, বুঝতে পারছি ভাবীর নির্দেশেই আমাকে টেলিফোন করা বন্ধ করেছ। তার মানে ভাবীকেই বলে দিতে হবে যে, তুমি কীভাবে আমার ব্রেজনেভে জামবাক লাগিয়েছিলে আড়িয়াল খাঁতে পৰ্দা ঢাকা ছইয়ের মধ্যে। যত ভাব, তত লাভ।’
নাঈম বুঝল পারভিন কোত্থেকে আড়িয়াল খাঁ-য় নৌকার ছইয়ের মধ্যে আদর-সোহাগ করার কথাটা জেনেছে। তার ভাল লাগে পারভিনের এইসব স্মার্টনেস। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘ব্রেজনেভ তো রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিল, না জানি আছে। ‘আমার ব্রেজনেভে’ মানে, পারু?’ কথাটা বলে তখন মুচকি মুচকি হাসলও নাঈম।
পারভিন চকিতে চারদিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে ঝট করে তার ডান হাত দিয়ে ধরে বসল নাঈমের ওইখানটা, প্যান্টের ওপর থেকেই, আর বলল, ‘লাজুক রহমান, ‘সিক্সটি নাইন’ কী বোঝো না, ‘বিপ্লবী ব্রেজনেভ’ কী বোঝো না, ‘রাজা’ কেন গর্তে তা বোঝো না, আর তুমি…তুমি মেরে সেলাই দিবা মুরাদের কপালে?’
এরপর হাতটা নাঈমের ওখান থেকে সরিয়ে নিয়ে দু পা পিছিয়ে গেল পারভিন। দাঁড়াল এলিজাদের গোলাপের বেড়ে, তার পায়ের পাতা তখন প্রায় ডুবেই গেল সার দেওয়া কাঁচা মাটিতে এবং ওখানে পড়োপড়ো অবস্থায় দাঁড়িয়ে থেকে সে নাঈমের দিকে ক্রূর এক চোখে তাকিয়ে বলল, ‘শোনো নাঈম। মুরাদ চিল্লায়ে পাড়ার সবাইরে শুনায়ে আমারে মুখে ভরে ‘নাঈম্মিয়ার কুলফি’ খাওয়ার কথা বলে। মুরাদ আমারে বুঝায়, আমি তোমার যেইটায় হাত দিলাম সেইটা সবসময় আমার মুখে ভরে থাকি। খানকি মাতারি মন্টু খাঁর পেটমোটা বউ রাজিয়া খাতুনের ওইখানটা ফেটে বেরোইছে যে মুরাদ, সেই মুরাদের কপাল কাটার তোমার দরকার নাই। ওর কপাল কাইল্লা কবিরই কাটছে। তুমি খালি মুরাদের ওই কুলফিটা কেটে আমার হাতে এনে দিবা। তাহলে আমি বুঝব যে, তুমি ব্রেজনেভের ব্যাটা। যাও।’
নাঈম যায় না। সে তার হবু স্ত্রীর ক্রোধের মাত্রা দেখে মনে মনে খুশি হয়। নাঈম জানে তার বয়স হয়েছে, পৃথিবীর সবটা বোঝার মতোই এক বয়স। পঁচিশ। পারভিনের থেকে সে তিন-চার বছরের বড় আর যথেষ্ট বড় এটুকু বুঝতে যে, এই পৃথিবী অনেক পুরোনো এবং সে বারবার একেকজনের কাছে নতুন হয়ে ওঠে ক্রোধ ও ঘৃণা তাকে নতুন নতুন রূপ দেয় বলেই। সে বোঝে, ভালবাসার রহস্য কোনো পাগলের মাথায় চলা রহস্যের বোধের মতোই—সুন্দর, কমনীয়, ঐন্দ্রজালিক সব মায়া দিয়ে ভরা, এমন এক মায়া যা মনকে শেষমেশ শান্তই করে; মনের ভেতরে চলতে থাকা ঝড়গুলোকে, গভীর অনুভূতিলোকে সে বুকের বাইরের ওপরভাগে নিয়ে আসে কোনো ব্যথার জন্ম না দিয়েই।
কিন্তু সে এ-ও জানে, ওইটাই সব না। ওইটাই যদি সব হতো তাহলে ইট-বালু-সিমেন্ট দিয়ে গড়া এই বাড়িঘরগুলো এবং তার মধ্যে বাস করা মানুষগুলো স্রেফ রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকেই বুঝে যেত যে, এই প্রত্যেকটা বাড়ির প্রত্যেকটা ইট বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোনো না কোনো বিরাট শক্তির সঙ্গে যুক্ত, এমন যে, যেন বা পারভিনদের বাড়িটা তাহলে হতো পাঁচ শ বছরের পুরোনো, আর সেই সঙ্গে মুরাদদেরটাও, আবার তাদেরটাও। এমন যে, তাহলে রাত নামলেই ভাটিখানার সবাই ট্রাক দাঁড়ানো ওই বালির মাঠে পাটি পেতে বসে যেত আকাশ দিয়ে ছুটে চলা ধূমকেতুগুলো দেখতে, চলন্ত-অস্থির তারাগুলোকে দেখতে। কিন্তু তা তো করে না মানুষেরা। কারণ, তারা সবাই জানে—এখানে ভাল মানুষেরা বহিরাগত, অনাহূত; তারা সমাজচ্যুত, তারা নির্বাসিত; তারা হতভাগা ও নিরাশ্বাস, যেহেতু পৃথিবী মুরাদদের মতো অসভ্য মানুষদের শাসনে থাকা এক পান্তামুখী হাঁস। পৃথিবী তারই জানের টুকরো পারভিনের ভাই শাহেদের ব্লেডের চেন নিয়ে ঘোরা গুণ্ডা বন্ধুর দল নিউটন-আলমাজী-রাঙ্গাদের মুঠোর মধ্যে সিঁটিয়ে থাকা এক উল্টোপাল্টা পর্দাহীন ঘর, যে ঘরের মেঝে ছাদে, আর ছাদ মেঝেয়। নাঈমের ভাল লাগে যে, তার প্রেমিকা পারভিন সেই ঘরের সবটা চিনে ফেলছে এবং সেই ঘরের চাবি কোমরে কী করে গুঁজতে হয় তা-ও সে বুঝে ফেলছে-দ্রুত, দ্রুত, দ্রুত।
সে পারভিনকে বলতে চাইল পৃথিবীর আত্মার কথা। বলতে চাইল যে, যা কিছু আমাদেরকে টানে—এমনকী পারভিনের স্তন, এমনকী পারভিনের সালোয়ারের নিচে থাকা আড়িয়াল খাঁ নদী—তার কোনো কিছুই এলেবেলে না, কোনোকিছুই বাছবিচারহীন না। আবার এই পৃথিবী মুরাদ-নিউটন-আলমাজী- রাঙ্গা দিয়ে ভরে আছে বলে ব্যাপারগুলো এমনও না যে, যা কিছু এখানকার মানুষকে টানে, তার প্রতিটা জিনিসের ব্যাখ্যার কোনো ক্লু আছে, কোনো চাবি আছে এবং মানুষেরা সেই চাবি হাতে নিয়ে সেসব রহস্যকে উন্মোচিত করার মন্ত্রটা জেনে ফেলেছে।
তার মানে, নাঈমের মনে হল, তার মানে পৃথিবী পুরোনো হতে পারে, আকাশজুড়ে ছুটে চলা ধূমকেতুদের সঙ্গে ভাটিখানার প্রতিটা বাড়ির প্রতিটা ইটের সম্বন্ধ থাকতে পারে, কিন্তু পৃথিবীর তালা এক স্থির ও মোটা পাথরে বানানো তালা এবং সে-তালার কোনো চাবি কারও কাছে নেই, কারণ এ পৃথিবীর আত্মা বলে কিছু আসলে নেই।
অতএব—কাঞ্চন ও এলিজাদের গোলাপের বেডের ওপাশে পারভিনকে রাগে-দুঃখে চোখ মুছতে মুছতে চলে যেতে দেখে ভাবল নাঈম-অতএব মুরাদের পুরুষাঙ্গ ব্লেড দিয়ে গোড়া থেকে কেটে সেই কাটা অঙ্গ বরফকলের বড় চাঁইয়ের মধ্যে রাতভর, একটা পুরো উল্কাজ্বলা রাতভর রেখে দিয়ে পরে ভোরে ওইটার কুলফি বানিয়ে পারভিনের হাতে একদিন সে তুলে দেবেই দেবে।
কিন্তু, আরও ভাবল সে, তার ভেতরকার এই পাশবিক হিংস্রতার কথা পারভিনকে জানানোর তার এখন কোনো দরকার নেই। সে যেমন আছে, পারভিনের কাছে আপাতত তেমনই থাকুক সে, সেটাই ভাল। সেটাই ভাল যে, পারভিন মনে করে সে কিছু বোঝে না, সে জানে না ‘বিচিত্রা’র ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন-এর ওই ‘ব্রেজনেভ’ বলতে কোন জিনিসটাকে বোঝানো হয়েছে; সে জানে না ‘লাভার’ মানে কী; বউকে আদর করে ‘রেপ’ করা বলতে কী বোঝায়; আর কী ‘সিক্সটি নাইন’, কী ‘রাজা’, কী ওই রাজার গর্তে ঢুকে যাওয়া। ওইটাই ভাল, পারভিনের তাকে অতো বুঝতে না পারাটাই ভাল।—প্রতিহিংসায় পুড়তে থাকা প্রেমিকার কাছে বোকা সেজে থাকাটাই ভাল, না হয় তো দুজনের আক্রোশপরায়ণতার আগুন একসঙ্গে মিললে ভাটিখানা রোডের পুরোটা পুড়ে যাবে, সবকিছু হয়ে যাবে ঠা….ঠা…ঠা…ঠা, টাস…টাস…টাস, দ্রিম, বু-উ-ম।
নাঈম দৌড়ে গেল পারভিনের কাছে। পারভিন ততক্ষণে ঢুকে গেছে জামের ঘন বাগানটার মধ্যে, যেখানে সূর্যের আলো বলতে গেলে ঠিকমতো মাটিতে পৌঁছাতেই পারে না। নাঈম ডাকল পেছন থেকে—’পারভিন, পারু’। পারভিন স্পষ্ট চোখ মুছতে মুছতে এবার আরও জোরে হেঁটে চলেছে তার লাভারের ডাকের প্রতি ভ্রুক্ষেপহীন। নাঈম ওর সঙ্গে এক ধরনের একটা স্বেচ্ছা-দূরত্ব রেখেই বলল, ‘মুখে ভরে কুলফি খাওয়া বলতে মুরাদ কী বোঝায়, তা আমি বুঝি, পারু।’ তা-ও পারভিন হেঁটেই চলল।
হঠাৎ জামের বাগানটা আরও জঙ্গলাবৃত, আরও কেমন অন্ধতমসাচ্ছন্ন, অতএব আরও মনে হল ঝঞ্ঝাসমাকুল, আরও মানুষের হৃদয় উৎসারিত অসংখ্য শোকপ্রবাহে ভরা। তাই হাওয়া উঠল পাতাদের ঝিরঝির ঝিরঝির জাগিয়ে—সে শব্দ সন্তাপবেদনার, সে শব্দ আক্ষেপজনক। আর সে ব্যাপারটাই, জামের লাখো পাতার ওই বুদ্বুদন ফির-ফির হাওয়ার ঘটনাটাই, বদলে দিল নাঈমকে। সে ভুলে গেল যে, এই সে-ই একটু আগে পারভিনের কাছে বোকা সেজে থাকার মনস্থির করেছিল। দৌড়ে পারভিনের সামনে চলে এল নাঈম, বলল, ‘মুরাদ অনেক অপমান করে তোমারে? প্রত্যেকদিন?’
পারভিন বলল, ‘না। যেদিন যেদিন কুলফিওয়ালা নাঈম্মিয়্যা আসে না, সেদিন সেদিন।’
‘কী চাও তুমি? বলো, স্পষ্ট করে বলো’, জানতে চাইল নাঈম।
পারভিন তাকাল জামবাগানের ডানে, জামবাগানের বাঁয়ে, সামনে, পেছনে, এমনকী ওপরের দিকেও। তারপর কোনাকুনি বামে যেদিকে বাগানের রাস্তা গিয়ে মিশেছে সালাম জমিদারদের বাড়ির সামনের রাস্তা হয়ে জাহান্নামের রাস্তার ওখানটায়, সেদিকে তাকিয়ে সে আঙুল তুলে দূরে দেখাল একটা ঘুমন্ত প্রাণীকে—বইঠোর বন্ধু শতভাগ খাকি রং মাদী কুকুর দিলারা।
পারভিন বলল, ‘কেউ নাই, দিলারা ছাড়া। এখন তুমি আমাকে তোমার ওইটা দেখাবা। আমি আজও কোনো বড় ছেলের ওই জিনিস দেখি নাই। আমি যেন কল্পনায় রোজ মুরাদের কেটে নেওয়া, বরফ-হওয়া, কুলফি হওয়া ওটারে ভাবতে পারি, তাই আমাকে তুমি দেখাবা যে, বড়দের ওই জিনিসটা দেখতে কেমন হয়।’
নাঈম প্যান্টের হুক খুলল, চেনের জায়গায় লাগানো তিন বড় বোতাম খুলল, প্যান্টটা নামালো তার হাঁটুর থেকে একটু ওপরে, জাঙ্গিয়া নামালো তার আরও একটু ওপরে, আর জাঙ্গিয়া নামাতেই ঝাঁ করে হিলিয়াম-নিয়ন-ক্রিপটনের অগ্নিবাহু ছড়িয়ে প্রায় জামের ডাল বরাবর চোখ রাখল এক চড়া ও তেজালো শিরতোলা হাঁপরে-ভাজা শাবল। পারভিন আয়ত্তে নিল ওটাকে। পারভিনের আচরণের মধ্যে কোনো কাম নেই, কোনো সংবেশিত হওয়াও নেই। সে শুধু মুঠোর মধ্যে শাবলটাকে ধরে কল্পনা করতে লাগল যে, কী করে অতীতের সমস্ত অপমান একদিন সৌন্দর্য ও আনন্দের বর্তমান হবে, আর সুখের হবে ভয়ে অতি ছোট রেশমগুটির মতো হয়ে থাকা তার জীবনের আসল বড় আত্মাটুকু।
সে চোখ বড় করে দেখতে থাকল নাঈমের হাঁসফাঁস, তার চোখ-নাক-মুখ- কপালের তছনছ ও ছত্রখান অবস্থা, আর ওই সে বুঝে গেল মুরাদকে খোজা- ছিন্নাণ্ড-খাসি করার কাজটা কতো সোজা, কতো সোজা!
পারভিন এবার ছ্যাঁ করে নাঈমের ওটা হাত ঝাড়া মেরে সরিয়ে দিল তার হাতের মুঠো থেকে, যেভাবে আমরা ছুড়ে মারি কোনো ভেতরে পোকা বসে থাকা দুর্দান্ত আপেল, এবং নাঈমকে বলল, ‘প্যান্ট পরো। মুরাদরে যা করার আমিই করব। কুলফি না, নাঈম, হাসল সে, ‘কাবাবকুচি হবে ওরটা, দেখো।’
নাঈম অবাক হল, আবার খুশিও হল এবং গলা ছেড়ে ডাক দিল, ‘দি-লা-রা।’ দিলারা ডাক শুনে ডিগ-ডিগ করে দ্রুত চলে এল তাদের কাছে। নাঈম দিলারার গলার নিচে তার হাত বুলাতে বুলাতে পারভিনকে বলল, ‘শহর বলো আর যা-ই বলো, এইগুলা গাঁও-গেরাম। দ্যাখো না রাত হলে কেমন অন্ধকার হয় সবদিক? তোমার ছোট ভাই জাহেদ তো চাখারে গেছিল মালেক হুজুরের বাড়িতে। ওরে জিজ্ঞাসা করো তো, চাখার কি এত কুচকুচে অন্ধকার হয় রাত্তিরে, যেটা হয় আমাদের নিউ ভাটিখানা রোড? জিজ্ঞাসা করো তো।’
পারভিন নাঈমের ওইটা থেকে ভেজা ভেজা এক জিনিস তার হাতে লেগে যাওয়া নিয়ে তখন স্মিতমুখ। সে হাত মুছল দিলারার পিঠে, হাত মুছল ঘাসে, তারপর একটা জামগাছের কাণ্ড ধরল শক্ত করে, আর নখ দিয়ে গাছের গা খুঁচে খুঁচে এবার গাছের ভেজা চামড়া তার নখগুলোর মধ্যে ভরে সেই নখ নাঈমের দিকে আচমকা তুলে বলল, ‘আমি বললাম কী কাবাবকুচির কথা, আর তুমি বলো কী?’
নাঈম তখন উত্তর দিল, ‘একই কথা বলি। মুরাদরা বড়লোক। মুরাদের বাপ মন্টু খাঁ কাইল্লা কবিররে জেলে রাখল ছয়-ছয়টা মাস। দ্যাখো নাই? কত্ত বড় পাওয়ারফুল কন্ট্রাক্টর। সেই মুরাদের সাথে তুমি যুদ্ধে যাবা? এই গাঁও-গেরামে কোনো বিচার নাই। সাবধান, পারু। তাই বললাম কী, আমাকে সামলাতে দাও।’
পারভিন বলল, ‘শোনো, গতকাল মুরাদ কী বলছে জানো? গতকাল কুলফিওয়ালা নাঈম্মিয়্যা পাড়ায় আসছে, আর মুরাদ চিৎকার দিল—’ভাটিখানার পোলাপান সব লাইন দিয়া আসো, সব লাইন দিয়া আসো।
নাঈম চমকে গেল পারভিনের মুখে এই কথা শুনে। সে বলল, ‘কী? লাইন দেবার কথা বলেছে মুরাদ? তুমি নিজে শুনছ?’
পারভিন মুখ কালো করে বলল, ‘বলছে। আমি নিজে শুনছি। মুরাদের কারণে পাড়ার সবাই তোমার সাথে আমার লাইন চলার কথা জানে, নাঈম। তুমি কি মনে করো, আমরাই শুধু চালাক আর বাকিরা বোকা? এই গাঁও-গেরামের লোক, তুমিই তো বললা এটা গাঁও-গেরাম, এইখানের লোক বোকা হয় না, শহরের লোক বোকা হয়। হুঁ, ভাটিখানা একটা গাঁও-গেরাম। শোনো বিয়ের পর আমরা এখানে থাকব না।’
নাঈম তৎক্ষণাৎ উত্তর দিল, ‘না, এইখানে থাকব না। দ্যাখো না সবদিকে শুয়ার ঘোরে। হিন্দুগুলার শুয়ার। আর কী রকম গুয়ের গন্ধ, শালা। লাইন-চোদানি মুরাদকে খাসি করার পরে এইখানে আমরা এমনিতেও থাকতে পারব না-পারভিন, গুয়ের গন্ধঅলা এই শালার জায়গায় আমরা এমনিতেও মনে হয় থাকতে পারব না।
পারভিনের এই তেজি ও বীরবিক্রম নাঈমকেই ভাল লাগে। আর আজ থেকে তার আরও ভাল লাগবে—মনে মনে ভাবল সে শিরতোলা, হাঁপরের আগুনে ভাজা চড়া ও তেজালো শাবলের এক বিশেষ গোপন নাঈমকে। সেটাই হওয়ার কথা। ব্যাটাছেলে ব্যাটাছেলের মতোই হবে। বইঠো হবে বইঠোরই মতো—তীরের মতন টানটান, সরু, ছিপছিপ, মেদহীন, কিন্তু লক্ষ্যভেদী, এমন যে দিলারা তার ধাক্কা খেতে খেতে ক্যাঁ-ক্যাঁ-ক্যাঁ, বইঠোর জিনিসটা ভেতরে নিয়ে টানাটানি করতে করতে দিলারার চোখ ধোঁয়া-ধোঁয়া। অনেকবার বইঠো আর দিলারার সেই প্রেমের দৃশ্য দেখেছে পারভিন, আর তখন দিলারার জায়গায় ভেবেছে নিজেকে, এবং বইঠোর জায়গায় আজ থেকে সে ভাবতে পারবে তার নাঈমকে। হাতটা এবার সে মুছল তার কামিজের পাড়ের দিকে; তারপর সেখানে, যেখানে তার কামিজটা আঁকড়ে ধরে আছে তার সুউন্নত বুক।
.
পারভিন ওই ক্ষ্যাপাটে নাঈমের কথা মনে করে, তার নাঈমকে নিয়ে ফাজলামি করার কারণে এতক্ষণে ঝট করে মেরে বসল তার ভাই জাহেদের ঘাড়ে। ঠিক এসময় তাদের বাবা স্ত্রীর আক্রমণের মুখে পড়ে নিজের ডিফেন্সে কথা বলা শুরু করেছেন। এর মাঝখানে ঘাড় ছেড়ে জাহেদের মাথায় ঠাং করে মেরে ভাইয়ের কানে কানে শুনিয়ে দিয়েছে পারভিন, ‘বেশি বাড়িস না। তোর আড়িয়াল খাঁ যাওয়া এক্কেবারে ছুটায়ে দেব, জাহেদ।’
জাহেদ বোনের কথা শুনে আবার শুরু করল কান্না। তার মা তার দিকে চোখ গরম করে তাকালেন এবার, কারণ তাদের বাবা কথা বলতে শুরু করেছেন। এখন সব চুপ। এখন সব দৃশ্। বাবা বললেন, ‘বাচ্চাগুলার সামনে জেলখানার কথা না বললে হয় না তোমার? না বললে হয় না? আমি কয়লা ওমরের ব্যবসায় যখন টাকা দিলাম, তখন তোমারে বলি নাই? তোমরা কে কে তখন বলো নাই যে, ঠিক আছে? কে বুঝছিল যে, ওমর এত বড় একটা টাউট? ওমর আমারে ‘বড় ভাই’ ডাকল। ওইখানে, জেলে, প্রত্যেকদিন সে আমারে পাহারা দিয়ে রাখত। জেলে টয়লেটে যাওয়ার লাইন কতো লম্বা, জানো? কত্তো লম্বা সেই লাইন! ওমরকে না পেলে আমি ওই শুয়ারের খোঁয়াড়ে দুই দিনও টিকতাম না। তা, আমি তারে বিশ্বাস করব না তো কি মালেক হুজুররে করব?’
তাদের মা এইবার আরও ক্ষেপে গেলেন, ‘বিশ্বাস করছ, তো করছ। সে তোমার চার লাখ টাকা আট মাসে গাপ করে ফেলছে, তো ফেলছে। কিন্তু তুমিই না সেদিন বললা কেস করবা? আর আজ হঠাৎ ওই লোকের সাথে তোমার নদীতে যাওয়া লাগবে, তা-ও রাতের বেলায়? আর মালেক হুজুরের কথা কেন তুললা তুমি? সে এই কথায় আসলো কী করে?’
জাহেদের কান খাড়া হয়ে গেল। মালেক হুজুর তাকে সকালবেলা আরবি পড়াতে আসতেন। তিনি জাহেদকে স্নেহ করেন যেভাবে কোনো মানুষ করে তার নিজের সন্তানকে। এই জাহেদকেই তিনি মাত্র নয় মাস আগে, গত সেপ্টেম্বরের শুরুতে, তার গ্রামের বাড়ি চাখারে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে দুদিনের জন্য গিয়ে জাহেদ থেকে এসেছিল প্রায় দিন পনেরো। সে ওই গ্রামে বিয়ে খেয়েছিল দুটো, বেতের বনে ঘুরেছিল প্রতিটা দিনের প্রত্যেক বেলা, লক্ষ্মণ দাস সার্কাস দেখেছিল মোট পাঁচ-ছবার, আর ‘চিরকালের বন্ধু’ হিসেবে পেয়েছিল ওই সার্কাসের জোকার একজনকে, নাম—ঈমান। ঈমান তাকে বলেছিল, ‘শহরের বাবু তুমি ভাই, দুজনে যদি একবার ঢাকা যাইতে পারতাম তো বুঝতা কীসেরতে কী?
জাহেদ জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘মানে?’
‘মানে একটা যে, আর যখন কোনো খাওয়া পাওয়া যায় না কোনোদিকে, তখন পানকৌড়িগুলারে খায় লালচেবুক ঈগোল। জানো নাকি শহরের বাবু?’
‘ঈমান, আমারে তুমি শহরের বাবু শহরের বাবু বলবা না’, উত্তর দিয়েছিল জাহেদ। ‘তুমি আমারে আসলে এই ঈগোলের গল্প বলতে চাও নাই। আমি তোমার চোখ দেইখখা বুঝছি যে, তুমি কোনো খারাপ কথা বলতে চাইছিলা। কিন্তু এখন কথা ঘুরাইতেছ। ঈমান, ঈমান, বলো আসল কথা, তোমার ঈমানের কসম।’
ঈমান তখন জাহেদকে বলেছে, ‘খারাপ কথা এইটা যে, তুমি আসছ মালেক চাচার বাড়িতে, তোমার মালেক হুজুরের বাড়িতে। কিন্তু মালেক চাচা তোমারে তাগো ঘরে ঘুমানেরও জায়গা দেয় না। কেমনে দেবে? হ্যারা আমাগো মতম হাড়- গরিব। বাড়িতে কিছু আছে? ওঁয়াপোকা, ডাঁশ পিঁপড়া আর কাউ-কাউ মুড়ি ছাড়া ওই বাড়িতে কিছু আছে? বিছানাও নাই, পাটিও নাই। সে তাই রাতে তোমারে নিয়া শুইতে দেয় মসজিদের লগের পুষ্কনির ঘাড়ে। তুমি কী মনে করো, তুমি যে পরিমাণ লাল-টুকুটুক শহরের পোলা—তোমারে যদি রাইতের আন্দারে ফৌজি, দেবদাস আর তুফানে খারাপ কাম করে তোমার সাতে? ঠেকাইতে পারবা তুমি ওগোরে? আমি কি ঠেকাইতে পারছি আমার সার্কাসের ম্যানেজার বাংগরা দাসরে? জোকারগো টেরনিং দেওয়া অনু টেইলাররে? আমার পাছার ওইহানে যদি তাকাও জাহেদ, তো দেখবা যে, হ্যারা সব ঘাও কইরা দেছে। পায়খানা করতে যখন যাই, তখন দেহি যে পায়খানার রাস্তার দরজা এই একদম হাতের মইদ্দে চইল্যা আসে, এই একদম একখানা কদমফুলের লাহান। শোনো, সাবধান। চাখার বড় খারাপ জায়গা। শেরেবাংলার চাখারে হ্যার নামের শেরটা নাই জাহেদ, কিন্তুক গোয়ামারানি বাংলা আছে পুরাটাই। তুমি তোমার মালেক হুজুররে বলতে পারো না, হুজুর আমারে বেড়াইতে লইয়া আইয়া ক্যান আপনে পুষ্কনি ঘাড়ের সিমেডে ঘুমাইতে দ্যান? জাহেদ, তোমার পেরতি ফৌজি, দেবদাস ও তুফানের চোখ পড়ছে কইলাম। ওগো বন্ধু, হাজত খাইট্যা আওয়া কোড়ল দেখলাম কাইল আমারে কয়, ‘ওই জোকারের পুত জোকার, তোর পুটকি তো কালা, কিন্তুক হুনছি তোর শহরের দোস্তের পুটকি নাকি লাল।’ বোঝলা জাহেদ, বোঝলা?’
এরপরই সামনের তিতজামের গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে ঈমান এ পৃথিবী সম্বন্ধে গোপন কথা যা জানে, তা গলা গম্ভীর করে জানাল জাহেদকে। ‘শোনো, ঢাকা শহরে তারা যা-যা করে, সব করে গুছোলখানায়, আমি হুনছি। ওই ফৌজি, তুফানরা যা করে, তা করে পুস্কুনির নামায়। কইরা পুস্কুনির পানি দিয়া ধুইয়া তারপর গান গাইতে গাইতে যায় ফুটবল খেলতে। ওগো পিরিয় গান জানো কোনডা? ‘পথের কেলান্তি ভুলে’ নামে একখান গান আছে না, যেইখানে মা-মা ডাক রইছে অনেক- সেইডা। ওরা তহন খুশি মনে ওগো মা-রে ডাকতে ডাকতে মনে কয় থ্যাংক ইউ দেয় যে, ঢাকার কাম ওরা চাখারেই করতে পারতেয়াছে। হাহা। ঢাকার কাম নিয়া জানো তুমি কিছু? জানো?’
জাহেদ স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল তার নতুন বন্ধু ঈমানের মুখে এই কথা শুনে, যেমন সে হয়েছিল বড়লোক মুরাদদের বাড়ির চৌকিদার মিল্টন মোল্লা যেদিন তাদেরকে বলেছিল এটা যে, ‘হোনো, কোথা হইতে তুমি বা তোমরা আসছ সেইডা জানো? বাপ-মায়ে ওই কাজটা করবার পরে বাপের গান্ধা ধাতু মা-য় গ্লাসে কইরা খাইলে পরে মাইনষের বাচ্চা হয়। খবরদার তোমাগো বাপ-মায়ের শোওনের ঘরের কোনো গ্লাসের থেইক্যা কোনোদিন পানি পান করিবা না। ওয়াক থু, ওয়াক থু।’
চাখারে সেদিন জাহেদের ঠিক ততটাই ভাল লেগেছিল অচেনা পৃথিবীর অচেনা বিষয় নিয়ে ঈমানের ওসব ধ্যান-ধারণা, যতটা তার আগে লেগেছিল মিল্টন মোল্লার সেই আজগুবি পর্যবেক্ষণ। কিন্তু এসবের কী উত্তর দেবে বুঝতে না পেরে ঈমানকে সে বলেছিল, ‘ঈমান, ঈমান, বলো যে আমরা ‘চিরকালের বন্ধু’। বলো ঈমান।
ঈমান পকেট থেকে এত্তগুলো বেতফল নিয়ে সেগুলো জাহেদের হাতের মুঠোয় দুম ভরে দিয়ে হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘যাও ‘চিরকালের বন্ধু’ হইলাম তোমার। অসুবিদা নাই।’
এরপরই জাহেদ তাকে বিশ্বাস করে বলেছিল যে, হুজুর যে তাকে ইচ্ছা করে ঘরে ঘুমাতে দেন না, ব্যাপার তেমন না। হুজুরদের বাসার ওই ছোট্ট গুমোট ঘরে বাতাস চলাচলের কোনো নামগন্ধ নেই, গরমে সেখানে এই সেপ্টেম্বরের শুরুতেও কোনোভাবেই ঘুমানো যায় না, জুন-জুলাইয়ের অবস্থা তো আল্লাহই জানেন। আর আসল কথা, ঘরটাই এমন যে, এদিকে নড়লেও হাঁড়িকুড়ি, ওদিকে নড়লেও হাঁড়িকুড়ি—কী একখানা অবস্থা! তাই তাকে হুজুর না, হুজুরের মা বলেছেন, ‘অ্যাই শহরের ছেলে হোনো;’ তারপর তিনি তার নিজের ছেলেকে, ‘শহরের পোলাডারে লইয়া এম্মে আইছ, মালেক। সাহেবের পোলা, মশা কামড়াইয়া পোলাডার হোগা-পিঠ লাল কইরা দেছে। মশার জখম, ও আল্লা। ওরে মরজিদের পুস্কুনির ঘাড়ে লইয়া ঘুম দেওয়াও। অয় উল্ডা ফজরের আজান দেওয়া হিখুক।’
জাহেদ সবটা খুলে বলল ঈমানকে। তারপর এ-ও বলল যে, ‘গুণ্ডা ছেলেগুলার নাম এমন আজব ক্যান? ফৌজি, দেবদাস, তুফান? তুফান তাও একটা নাম হয়, কিন্তু বাকি দুইটা? ছি!’
জাহেদ জোরের সঙ্গে ঈমানকে বলেছিল তার ছি-টা। ঈমান তখন বুঝল, জাহেদ আসলেই একটা ভাল ছেলে এবং সে এখনও এ পৃথিবীর কিছুই জানে না। তবে আসলে ঈমান সেদিন ধরতে পারেনি যে, জাহেদ সবই জানে। এই জানাজানির ফয়সালা করতেই যেন ঈমান তাকে জিজ্ঞাসা করে বসেছিল, ‘ছি ছি করো? কিন্তু বাচ্চা হয় কেমনে সেইডা জানো?
জাহেদ ঈমানকে বলেছিল, সে জানে বাচ্চা কী করে হয়। সে সবটা শুনেছে তার ভাটিখানার বন্ধু রিয়াজ-মিরাজের কাছ থেকে এবং জেনেছে যে, মুরাদদের বাড়ির চৌকিদার মিল্টন মোল্লা এ বিষয়ে তাদেরকে আগে চরম এক ফালতু কথা বলেছিল শুধু। ঈমান হা-হা করে ডেকে উঠেছিল জাহেদের এই কথা শুনে। সে জোরে লাফিয়ে উঠে তেড়ে এসেছিল জাহেদের দিকে, তারপর তাকে একরকম গায়ে খোঁচা দিয়ে বলেছিল, ‘কী? ওই মিল্টন ছাগলে তোমাগোরে কী কইছিল? বাচ্চা হয় গ্লাসে কইর্যা ধাতু খাইলে? হা-হা-হা-হা, ওরে পঙ্খী রে পঙ্খী, তোর কত যে নিশানা! হা-হা-হা।’
জাহেদ অনেক লজ্জা পেয়েছিল ঈমানের হাসি শুনে, আর সে অবাক হয়ে গিয়েছিল ‘ধাতু’ নামের শব্দটা শুনেও। তারা বরিশালে তো বলে- পানি। আর চাখারের এই ছেলে বলে—ধাতু। ধাতু কী, জিনিস? কী লজ্জার কথা! পঙ্খীর নিশানাই বা কী? সে ঈমানের কাছে জানতে চাইল, ‘ধাতু কী, ঈমান?’
ঈমান উঠে দাঁড়াল, বলল, ‘বলমু না।’
জাহেদ বলল, ‘যদি বলো তো, আমি আবার চাখারে আসব। তারপরে তোমারে শিখাব যে, আমার বাংলার স্যার এনায়েত স্যার আমাদেরে কী বলছে ওই গোলাপফুল’—হাত দিয়ে সে মাদ্রাসার পাশে বেড়ে ওঠা গোলাপের দশ বারোটা গাছকে দেখাল – ‘তা নিয়া, আর কী বলছে গোলাপপ্রতিম ফুল নিয়া। গোলাপপ্রতিম কথাডা হুনছ এর আগে কোনোদিন?’
ঈমান বলল, ‘না। গোলাপপ্রতিম আবার কী?’
জাহেদ বলল, ‘সেইডাই তো পরেরবার চাখার আইস্যা বলব তোমারে যে, স্যার কিসেরে বলছে গোলাপসদৃশ, গোলাপপ্রতিম। বিজি লিজি ফুলের কথা ও বলব তোমারে। ওরা দেখতে এক্কেবারে গোলাপের মতম, কিন্তু গোলাপ না। যদি জানতে চাও এইগুলা কী, তাইলে আমারে আগে বলো, ধাতু কী জিনিস?’
ঈমান বলল, ‘শুয়ারের বাচ্চা, শুয়ারের বাচ্চা, শুয়ারের বাচ্চা।’
জাহেদ অবাক হল খুব। বলল, ‘এত রাগ হইলে বলা লাগবে না ঈমান। আমি বুঝছি।’
ঈমান তখন এক লাথি মারল তার পায়ের কাছে ঘুরতে থাকা কালো এক ভোমরার গায়ে—ঘন-ময়ূরী নীল তার ডানা, কোনো মরা কাঠের ভেতরে বানানো তার বাসা থেকে বেরিয়ে সে এসেছিল এখানকার পুকুরপাড়ের টমেটো ও বেগুন ফুলের থেকে তার বাচ্চাদের খাবার হিসেবে পরাগরেণু নিতে। ভোমরাটা ঈমানের লাথি খেয়ে ঘু-ঘু-ঘু শব্দ করে মাথা ঘুরে পড়ে গেল পুকুরের একদম কিনারায়। ঈমান চিৎকার করে উঠল, ‘তুমি কিছুই বোঝো নাই জাহেদ। বাংগরা দাস, অনু টেইলার আর ফৌজিদের লগের তুফান মাস্তান, হেরা আমার পাছার দিকে যা মাখাইয়া রাইখ্যা যায়, হ্যার নাম ধাতু। কিছুদিন যাউক, তারপর বাংগরা দাস ভাউরার ছোড পোলাডার পাছায় আমিও যা মাখামু, হেইডার নাম ধাতু। তুমি দেইখো। আর আমাগো জোকারগো টেরনিংয়ের আমি খ্যাতা পুড়ি। টেরনিং মাস্টার অনু টেইলারের আমি গুষ্টি মারি। ওই শুয়ারের পুত অনু টেইলারের ছোট মাইয়াডার উরুত থেইক্যা পাওয়ের পাতা পর্যন্ত একদিন আমি যা মাখাইয়া রাখমু, হ্যার নাম ধাতু।’
‘ঈমান, ঈমান’, জাহেদ ধাক্কা দিল ঈমানকে। ঈমান শুয়ে পড়ল ঘাসে, বলল, ‘ভোমরাডিরে লাখি মাইরা ভুল করছি রে, ভুল করছি। আইজকা রাইতে সার্কাস আছে। আইজকা আমারে আল্লায় শাস্তি দিবে।’
জাহেদ দাঁড়িয়ে পানির কাছের মাটিতে পড়ে থাকা ভোমরার দিকে যাবে, কোত্থেকে ছুটে এলেন মালেক হুজুর, বললেন, ‘জাহেদ ব্যাটা, আসো, এদিকে আসো।’
জাহেদের খুব খারাপ লেগেছিল ওভাবে ঈমানের অনেক কষ্টের কথার মাঝখানে তার ‘চিরকালের বন্ধু’কে ছেড়ে যেতে। কিন্তু সে-ই বা কেমন ‘চিরকালের বন্ধু’ হল, যে কিনা তাদের ভাটিখানার বাচ্চা ছেলেদের আগে জানা একটা ভুল জিনিস নিয়ে ওরকম হাসবে? বলবে যে, ‘পঙ্খীরে পঙ্খী, তোর কত নিশানা!’ কী আজব কথা! আর সে তো তাকে বলেছেই যে, ভাটিখানার তারা সবাই এটা ভুল জানত। সবাই, এমনকী তার বোনের সঙ্গে লাইন-মারা নাঈম ভাইও। তারপরও এভাবে ‘পঙ্খীরে পঙ্খী’ বলে ঈমানের এরকম তাচ্ছিল্যের হাসি হাসা কেন?
হুজুর সেদিন তখন জাহেদকে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন মাদ্রাসার দিকে, এটা বলতে বলতে যে, ‘জাহেদ বাবা, তোমারে কইছি না তুমি ঈমানের লগে মিশবা না। সার্কাসের জোকারেরা কোনোকালে ভাল ছেলে হয় না। সার্কাসের মদ্দে খালি খারাপ কাম আর খারাপ কাম।’
জাহেদ বলল, ‘জ্বি হুজুর, বলেছেন।’
হুজুর বললেন, ‘মুই যদি আর একবারও দেহি যে তুমি ঈমানের লগে আছ, তাহা হইলে আমি তোমাকে বরিশাল ফিরত লইয়া যামু। তোমার তহন বেড়ানি শেষ।’
জাহেদ কাউ-কাউ করে কেঁদে উঠে হুজুরের কাছে তখন আবদার ধরেছিল, ‘না হুজুর, না। আমি এত তাড়াতাড়ি বাড়ি যাব না। আর আইজ রাতে আমারে সার্কাসে যাইতেই হবে। আজকে সার্কাসে হ্যারা আনবে একটা নতুন হাতি, যে হাতি টেবিলে বসতে পারে, আবার সামনে বসা সব লোকরে ভিজাইয়াও দেতে পারে। হুজুর, হুজুর, ঈমানের ওস্তাদে আমারে বলছে, আইজকা রাতে আরও থাকবে দশটা নতুন রাজহাঁস। ওই রাজহাঁসগুলা বসতে বললে বসে, ওঠতে বললে ওঠে, পাছা দেখাইয়া নাচতে বললে নাচে।’
হুজুর বকা দিলেন, ‘জাহেদ। পাছা বললা? এত খারাপ কথা শেখতেয়াছ তুমি। ছি! আর ঈমানের ওস্তাদের নামডা কী?’
জাহেদ বলল, ‘সরি, হুজুর।’
হুজুর জোরে ধমক দিলেন তাকে, ‘জাহেদ, ঈমানের ওস্তাদের নামডা কী, হুনি?’
জাহেদ জানাল, ‘অনু টেইলার।’
হুজুর চুপ করে গেলেন তার উত্তরটা শুনে। তিনি একটা দেবদারুর গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন আর বললেন, ‘তোমাকে বরিশাল চলিয়া যাইতে হইবে, জাহেদ।’
জাহেদ ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠে বলল, ‘না, আমি এত তাড়াতাড়ি বরিশাল যাব না। আমি আরও সাতদিন থাকব হুজুর।
এবার সবকিছু চুপচাপ। দূরের খিড়কি পুকুরে গ্রামের মেয়েরা ঘর-গেরস্থালির কাজ শেষে তখন শীতল পানিতে ডুব দেবার জন্য প্রস্তুত-প্রস্তুতমতো আর পুকুরপাড়ের নারিকেল-কদবেল-তেঁতুলের পাতায় হাওয়া খেলা করে যাচ্ছে তার শাশ্বত কোমলাঙ্গ দেখিয়ে—স্পষ্ট মনোমোহন সেই হাওয়া, পরিষ্কার চিত্তরঞ্জন চিরকালের বাতাস, যা কিনা আজ অবধি কারও কাছে একটা পয়সাও না চেয়ে পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ায় পৃথিবীর গোলটাকে বেড় দিয়ে। পুকুরের পানিতে শাপলা-কলমি-হেলেঞ্চা -পদ্মের পাশ ঘিরে সেই হাওয়ার চক্করে পড়ে দেখা যায় তখন আরও ঘুরে চলেছে অজস্র পানা। আহা! পানির ওই শাকগুলো মানুষ কতটা খায়, আর কতটা খায় সাপ-ব্যাঙ-কচ্ছপে?
হুম, এ পৃথিবীতে জীবনের ভেতরবারান্দায় এমন কোনো অবস্থা এমনি-এমনি কিংবা স্বাভাবিক-শাশ্বতভাবেই বিরাজমান নেই যে, যার জন্য মানুষকে ভাল মানুষ হতেই হবে, ভাল কাজ করতেই হবে; যেমন কোনো গায়কেরও গলার মধ্যে এমন কোনো শর্তের ঝুনঝুনি বাঁধা নেই যে, তার সুরটাকে ঠিকভাবে ধরার জন্য বারবার বারবার সঠিক সুরের যত পারা যায় তত কাছাকাছি তাকে যেতেই হবে। মানব জীবনের, এই লক্ষ্মণ দাস সার্কাস ও আহত ভোমরায় ভরা মানব জীবনের এ সমস্ত দায়বোধ, এ সমস্ত দায়িত্ববোধ আসলে অন্য পৃথিবীর, এ পৃথিবীর নয়। এমন তো না যে, প্রকৃতি মানুষের এইসব ভাল কাজ খারাপ কাজের তোয়াক্কা করে। এমন তো না যে, পৃথিবীর মানুষের যার যার ভাষার তার তার আকাশে রোজ সকালে কী অন্তত দু বছর-দশ বছরে একবার আকাশজুড়ে লেখা ভেসে ওঠে যে, ‘হে মানুষেরা, মানুষের প্রতি ন্যায়বিচার কোরো’; কিংবা ‘মিথ্যা বলবে না, মিথ্যা বলা পাপ’; কিংবা ‘গরিবের প্রতি মায়া কোরো’। তার মানে, এগুলো পৃথিবীর আদি প্রকৃতির মৌল কথা নয়। এগুলো মানুষের বানানো কথা, মানুষের নিজেদের প্রয়োজনে তৈরি করা নিজেদের আচার-বিচার-আইন-ব্যবস্থার বিধিমালা। আসল যে-পৃথিবী, আদি-অনাদিকালের ব্রহ্মাণ্ডের প্রকৃত যে-প্রকৃতি, তার বয়েই গেছে মানুষকে লাইনে রাখায়, তার বয়েই গেছে ভাল কাজ ও খারাপ কাজের তালিকা তৈরিতে, তার বয়েই গেছে মুসলমান-ইহুদি-হিন্দু-খ্রিস্টান ভেদাভেদে আর মানুষের পাপ-পুণ্যের হিসাব মেলানোয়!
তার মানে—ভাল কাজ, সদাচরণ, ভাল মানুষ, মহৎ উদ্দেশ্য ইত্যাদি ইত্যাদি দারুণ শব্দগুলো সব এমন এক পৃথিবীর সুন্দর শব্দ যেখানে স্নিগ্ধতার মানে ভিন্ন, জ্ঞানগোচরের মানে ভিন্ন, সত্য ও শৃঙ্খলার মানে ভিন্ন।—সেই পৃথিবীকে ছেড়ে সবাই কীভাবে এই পৃথিবীতে আসে এই দশ রাজহাঁসের নাচ ও পাশাপাশি অনু টেইলারের অরাজক নৃশংসতা এখানে যে একই তালে চলছে, সেটা দেখবার লোভে!
.
মালেক হুজুর দেবদারু গাছের থেকে তার পিঠ সরিয়ে নিলেন, কারণ গাছে হাঁটা পিঁপড়াগুলো হুজুরকে কামড়ে বসেছে। তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে। এইহানে আরও সাত দিন থাকতে পারবা, ঠিক আছে। কিন্তু তাহা হইলে তুমি আমারে বলো, ঈমান ওই ওহানে বইস্যা তোমারে তোমার কানের মইদ্দে কী বলল?’
জাহেদ কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই হুজুরকে বলে দিল এইটুকু, ঝাঁ করে, ‘ঈমান বলছে, ঈমান বলছে যে ঢাকায়, ঈমান বলছে যে ঢাকার শহর আছে না ওইখানে…ছেলেমেয়েরা গোসলখানায় খারাপ কাজ করে। ঢাকার লোকেদের পাকাবাড়ির গোসলখানাই বিরাট বিরাট। সেই গোসলখানায় ঢুইক্কা ছেলেমেয়েরা খারাপ কাজ করে। ঈমান এইটা বলছে।’
হুজুর এ কথা শুনে তাকে বকা দিয়ে থামালেন, বললেন, ‘জাহেদ জীবনে কী চাও? তোমারে কইছি যে, আল্লাহতায়ালা নেক বান্দার লাইগ্গা গুপ্তধন রাখিয়াছেন। তার একখান শুধু পাবা, সারা জেবনে তাহা হইলে আর চিন্তা করতে হইবে না কিছুর। কই নাই?’
জাহেদ বলল, ‘কইছেন, হুজুর।’
হুজুর জাহেদকে মাদ্রাসার দরজার মুখে রোদে পুড়তে থাকা গরম টিনের ওপর প্রায় ঠেসে ধরে এবার বললেন, ‘তুমিই তাইলে ঠিক করো ওই গুপ্তধন পাওয়ার লাইগগা খোদার নেক বান্দা হবা, নাকি গোসলখানায় খারাপ কাজ করার লাইগা জেবনে বড় হবা?’
জাহেদ হুজুরের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘গুপ্তধন পাওয়ার জন্য খোদার নেক বান্দা হব।’ কিন্তু তার এটাও মনে হল যে, গোসলখানায় করা খারাপ কাজটাও সে করতে চায়, সে জানতে চায় ওখানে ‘এগজাকলি’ কী হয় ঢাকার শহরে? কিন্তু সেই ইচ্ছা চেপে গিয়ে সে হুজুরকে বলতে লাগল, ‘আপনি তো আমারে সবটা বলতেছেন না হুজুর। আপনার বোনেও, মানে সাথী আপা, আমারে বলল যে, আমার ভাই সব জানে। আমি তোমারে আর বলব না ওইসব দোয়া-দরুদের কথা। তারপর,’ জাহেদ কাঁদো কাঁদো হয়ে পড়ল এ মুহূর্তে। ‘তারপর আপনি আমারে কাল রাইতে বললেন, ফজরের আজান আমি দিলে আপনি আমারে সব বলবেন, গুপ্তধনের সব দোয়া-দরুদ শিখাইবেন। আমি ঘুমাই নাই হুজুর। আমি ফজরের আজান দিছি। চিশতি ঈমাম আমারে বলল, ‘ভাল আজান দিছস শহরের ছ্যাড়া। কিন্তু তোর মালেক হুজুরে কই?’ আপনি তখনও আসেন নাই। ভোরে পুকুরে কেমনে যে ঘাই দেয় মাছগুলা, হুজুর। চিশতি ঈমাম আমারে দেখাইলেন সেইটা, বললেন, ‘পানির দিকে তাকাইয়া আছস ক্যান ওমনে? তোর হুজুরে নিশ্চয় তোরে পানি থাকা গুপ্তধনের কথা বলছে! বলে নাই?’ তারপর তিনি তার মাথা পুব-পশ্চিম নাড়াইতে নাড়াইতে কইলেন, ‘মালেক একটা পাগল, মালেক কোথায় কোন ইরানি বইতে পড়ছে এইসব কথা, শিয়াদের কথা। আরে, পানিতে, পানির যতো নিচে যাবি তাহাতে মগুর মাছ ছাড়া আর কিছু থাহে নাহি? মুখ হাঁ করা মানুষ খাওয়া মগুর মাছ’।’
মালেক হুজুর জাহেদের থেকে এই কথা শুনে তার ঠোঁটের ওপরে হাতের আঙুল ঠেকিয়ে শৃশ্ বলে তাকে ঠেলে আনলেন সেই পুকুরপাড়ে। তারপর চারদিকে তাকিয়ে নিয়ে ফিসফিস বললেন, ‘তুমি কিন্তু বাড়ি ফেরত গ্যালে বাড়ির কাউরে বলবা না যে, হুজুরের গ্রামের মসজিদের ঈমাম তোমারে তুই কইর্যা বলছে। তোমার মা তাহা হইলে খুব কষ্ট পাবেন, তিনি আমার বোন। তোমার পিতাও তাহা হইলে খুব কষ্ট পাবেন, তিনি আমার ভাই। তুমি কথাডা শাহেদ, পারভিন ওদেরেও বলবা না। আমি চিশতি ঈমামরে দ্যাখতে পারি না। কিন্তু কী করব, কী করব? তিনি বড় হুজুর।’
‘কেন দেখতে পারেন না তারে?’ জানতে চেয়েছিল জাহেদ। প্রশ্নটার কী উত্তর দেবেন বুঝেই পাচ্ছিলেন না মালেক হুজুর। তিনি মাথা চুলকাতে লাগলেন। জাহেদকে ছেড়ে পাঁচ সেকেন্ডের জন্য তিনি রোদের মধ্যে হেঁটেও এলেন।
তারপর জাহেদের ঘাড় ধরে তার মুখটা পুকুরের দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে তিনি বললেন, ‘কারণ সে আল্লাহর নেয়ামত ‘গুপ্তধন’-এ বিশ্বাস করে না। পানিতে যদি আসমানের তারা খইস্যা পড়ে, তাহাতে পানি যদি জ্বলে, পুকুরের হউক কি নদীরই হউক, তহন সাহস যাগের থাকে, তারা পাইবে সেই জিনিস। আড়িয়াল খাঁ যদি যাও, যেইখানে আড়িয়াল খাঁ ঘুইর্যা আইস্যা মেলছে বাবুগঞ্জ লঞ্চঘাটের দিক থিক্যা, আইস্যা মেলছে কেত্তনখোলার সাথে, মেলছে চরমোনাই যেইদিকে সেইদিকে, মেলছে ঢাকা-ঝালকাঠি লঞ্চ যায় যেইখান দিয়া,’ জাহেদ তাকিয়ে তাকিয়ে তার মালেক হুজুরকে দেখছে তখন, দেখছে যে হুজুর কথাগুলো বলতে গিয়ে হারিয়েই যাচ্ছেন তার দুই চোখ বরিশালের উ-ই-ই দিকে ভাসিয়ে দিয়ে, যেইদিকে আছে একসঙ্গে পাঁচ নদী—পাঁচ, কারণ হুজুরই জাহেদকে বলেছেন যে, ওরা ‘পাঁচ’। হুজুর বলতে লাগলেন, ‘কালাবদর, নয়া ভাঙ্গানি, বিঘাই, কেত্তনখোলা, সব আইস্যা জাহেদ চাইপ্যা ধরছে আড়িয়াল খাঁরে। আমি দোয়া-দুরুদের হিসাব মিলাইয়া দেখছি যে, সেই আড়িয়াল খাঁ-তে তুমি সেই জিনিস পাইবা, যা আমি তোমারে বলি তা তুমি পাইবা যুদি খালি সাহস করো, যুদি খালি রাইতের বেলায় যাও, আর তোমার লগে যুদি থাহে এই তাবিজ।’
তাবিজটা ছোট, কালো এক খেজুর বিচির মতো। সেটা জাহেদের হাতের মুঠোয় ঠেলে দিলেন হুজুর আর তাকে বললেন, ‘আমার সন্তান নাই। তোমারে সন্তানের মতম ভালবাসি, তাই তোমারেই দিলাম। তুমি আমাগো বাড়িত বেড়াইতে আসছ। এত্তবড় সাহেবের পোলা এই গরিবের বাড়িতে আইছে। কিন্তু আমি তারে না খাওয়াইতে পারছি মুরগি-পুলাউ, না খাওয়াইতে পারছি রুই-কাতলা। আর তারে আমার গরিব ঘরের মশাগুলা ক্যামনে ছাঁইক্ক্যা ধরছে! মশাগুলা তার গালে পিডে ঘাও কইর্যা দেছে’, তিনি হাত দিলেন জাহেদের গালে, সবচেয়ে বেশি ফুলে থাকা তার বাঁ চোখের নিচের জায়গাটাতে, আর কাঁদতে লাগলেন ফিচ-ফিচ। বলতে লাগলেন, ‘মশা তার শরিলে ঘাও বানাইয়া দেছে। আহা আমার বাচ্চাডা। তারপরেও এ্যায় কিনা আমারে কয়, হুজুর আমি বরিশাল যামু না, আমি খালি বেতের ফল খাইয়া আরও ম্যালা দিন থাকমু এইহানে। আহারে আমার বাচ্চাডা।’
জাহেদের খারাপ লাগতে লাগল, হুজুরের দারিদ্র্য নিয়ে জাহেদের মন খারাপ হওয়া শুরু হল। সে এখনও এই বিষয়গুলো পুরো বোঝে না। সে শুধু বুঝতে পারে যে, হুজুরের হিসেবে তারা বড়লোক, কিন্তু তার নিজের বোন পারভিনের হিসেবে এই তারাই আবার গরিবস্য গরিব, যখন কিনা মুরাদরা শুধু বড়লোক। কিন্তু হুজুরের কান্না শুনে তার হঠাৎ এমনি এমনি মনে হল, তাহলে মুরাদদের হিসেবে আবার নিশ্চয় মুরাদরা গরিবই, ওদের হিসাবে বড়লোক তো শুধু সালাম জমিদার। আর সালাম জমিদারের হিসেবে তাদের নিশ্চয় চলছে কোনোমতে, তাদের তুলনায় বড়লোক তো শুধু বাজার রোডের মোহন মিয়ারা। আবার মোহন মিয়াদের হিসেবে তারা বরিশালের মাপে কিছু একটা বটে, কিন্তু ঢাকার মাপে কিছুই না, কারণ ঢাকার মাপে তাদের অত বড় কোনো বাথরুমই নেই যার মধ্যে খাট বিছানো থাকে এবং সেই খাটে শুয়ে ছেলেমেয়েরা কাপড়চোপড় খুলে অসভ্য কাজগুলো করে। ভাটিখানার কাইল্লা কবির যেমন বলে– ‘পচাফচফচ কাজ।’
এই কথাগুলো মনে হতে জাহেদ শেষমেশ হুজুরকে জিজ্ঞাসা করেই বসল দুম করে, ‘হুজুর, আমাদের কাইল্লা কবির আছে না, ওই যে-ছেলেটা যে আপনি আমারে পড়ান শুরু করলে আলিফ-বা-তা-সা নিয়া ভেঙায় জানালার ওইপাশ থিকা, ওই যে কাইল্লা কবির…।’
হুজুর বললেন, ‘হ, চিনছি তো। তোমার বস্তির দোস্তো। কী হইছে কাইল্লা কবিরের?
জাহেদ এই দফা হঠাৎ লজ্জা পেয়ে গেল, বলল, ‘না, থাক বলব না। খারাপ কথা। বলব না।’
হুজুর তাকে টেনে পুকুরের পাড়ের ঘাসের ওপরে বসালেন, নিজেও বসলেন পাশে। এই জায়গাটা ভরা এক সারি কেলিকদম গাছ দিয়ে, বিশটা তো হবেই, আরও বেশি হতে পারে। জাহেদ দেখল যে, মালেক হুজুর হাঁ করে তাকিয়ে আছেন গাছে ধরে থাকা হলুদ রং বলের মতো কেলিকদম ফুলগুলোর দিকে। ওদেরই নিচের দিকের ডালে আবার ওই বল-ফুলগুলোই কিনা সবুজ, কাঁচা–এখনও হলুদ বলের মাঝখানে ওরা সাদা পেরেক-পেরেক মতো হয়ে ওঠেনি। একঝাঁক সবুজ-ডোরা কাঠঠোকরা উড়ে গেল কেলিকদমের লাইন ধরে। স্পষ্ট যে, প্রতিটা গাছে এই পাখিরা এতক্ষণ বসেছিল জোড়া বেঁধে, দুটো করে। তার মানে, জাহেদ দ্রুত গুনে দেখল, বিশটা গাছ থেকে আলাদা আলাদা উড়াল দিল চল্লিশটা সবুজ-ডোরা। ওরা আলাদা উড়ে একসঙ্গে গিয়ে মিলল পুকুরের মোটামুটি মাঝখানে, তারপর ওখান থেকে এক দল হয়ে ওই চল্লিশ ওরা শরীর অল্প উঁচুতে তুলে সাঁই করে গুলির মতো চলে যেতে লাগল চাখার কলেজের দিকে।
জাহেদকে মাত্র গতকালই ঈমান বলেছে যে, ঈমানের বাবা তাকে বলেছেন যে, ঈমানের বাবার বন্ধু বিদ্যুৎ বিভাগে কাজ করা পেরু ভাই নামের এক লোক তাকে বলেছেন যে, চাখারে শীঘ্রই ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ চলে আসবে। তখন সবদিকে থাকবে বড় বড় পোস্ট, আর তা থেকে এদিক-ওদিক জুড়ে ছড়িয়ে যাবে তার, আর তখন চাখারের বিখ্যাত এই হাজার সবুজ-ডোরা কাঠঠোকরার দল চাখার ছেড়ে চলে যাবে।
ঈমান তাকে বলেছিল, ‘শহরের বাবু, তুমি যদি মইর্যা থাকা সবুজ-ডোরা দেখতা তো, তাইলে দেখতা যে ওগোর পাছা কেমন চিকচিকা হলুদ। আর গায়ের রং আমার মায় কয়—জলপাই। জলপাই কী জিনিস, দেখছ তুমি?’
জাহেদ অবাক হয়েছিল ঈমান জলপাই কী তা জানে না দেখে। সে উত্তর দিয়েছিল, ‘আহহারে, তুমি জলপাই খাও নাই? চুকা। বরইয়ের মতম। রাইখ্যা দিবা তো আমড়ার মতম—বিচ্ছায় আইস্যা ছাইয়া ফেলবে। বোঝতেয়াছ?’
‘বোঝতেয়াছ’ কথাটা বলেই জাহেদের মনে হল, তার মা তার মুখে এই ভাষা শুনলে কীভাবে তাকে সোজা একটা চড় মারতেন। সে নিজেই বোঝে মাত্র এই তিন চারদিনের মধ্যে তার মুখের ভাষা কত বদলে গেছে, কত সেটা হয়ে গেছে ‘বোস্তির খাড়ি বরিশাইল্যা পোলাপানগুলার লাহান।’
মালেক হুজুর জাহেদের ধ্যান ভেঙে দিলেন, তাকে বললেন, ‘জাহেদ, তাবিজটা হারাইয়ো না। চান্স মেললে আড়িয়াল খাঁ যাইও। দেহি, আমি তোমারে লইয়া যামু একবার। দেহি। টাকা-পয়সা আমারও দরকার। আবার তুমি বাচ্চা মানুষ ওই আগুন-পানি পাইলেও বোতলে ভরতে পারবা কিনা আমার সন্দেহ লাগে। আবার পানি তুমি পাইলা, কিন্তু তাবিজ হাতে নিয়া দোয়ার কাজডা ঠিকমতো পারলা না, দোয়া ভুল করলা, তাইলে ওই পানি কিন্তুক থাইক্যা যাবে খালিই পানি।’
জাহেদ বলল, ‘দোয়াটা শিখাবেন না, হুজুর?’
হুজুর তখন তাকিয়ে আছেন কেলিকদমগাছগুলোর দিকে। জাহেদও তাকাল সেদিকে। হুজুর বললেন, ‘আমাগো এইহানে কেলিকদমরে কয় কুমিয়ারি। আমার মায় কয় ফুটিকদম। কেমন সুন্দর না গাছগুলা, জাহেদ? তা, তুমি সকালে কী খাইছ? আমি তো বড় মাদ্রাসায় গেছিলাম। তোমারে কী খাইতে দিছে সাথী?’
জাহেদ বলল, ‘সাথী আপা আজকে দিছে মুড়ি দিয়া গুড়, আবার সবেদা ফলও দিছে একখান। আমি মজা কইরা খাইছি হুজুর।’
হুজুর বললেন, ‘বাড়িতে গিয়া বইল্যা দিবা এইসব?’
জাহেদ বলল, ‘বলমু না, যদি দোয়াটা না শিখান।’
হুজুর বললেন, ‘দোয়া শিখামু যদি আমারে বলো যে, কী তুমি আমারে বলতে গেছিলা, কিন্তুক বললা না?’
জাহেদ লজ্জার মধ্যে পড়ে গেল। অনেক খারাপ কথা এইটা। কথাটা তাকে বলেছে কাইল্লা কবির না, বলেছে চাখারেরই গুণ্ডা তুফান-ফৌজি-দেবদাসরা। সে আবারও ভাবল, মানুষের নাম এত ফালতু হতে পারে? হুজুর তাকে ধমক দিলেন, ‘বলো। আর যদি না বলো, তাইলে আমি তোমারে দোয়া শিখামু না। তহন তাবিজ লইয়া আড়িয়াল খাঁ যাইবা ঠিক, কিন্তু পানি থাইক্যা যাইবে খালিই পানি I আড়িয়াল খাঁ যেইখানে মেলছে জাহেদ কেত্তনখোলার লগে…।’ জাহেদ এইবার হুজুরের আগে আগে বলতে লাগল, ‘যেইখানে মেলছে কালা বদর, নয়া ভাঙ্গানি, বিঘাইয়ের নামায়…’
হুজুর হাসতে হাসতে বললেন, ‘চুপ, দুষ্টুপোলা।’
তারপর হুজুর একা, ‘ঢাকা-ঝালকাঠি লঞ্চ যায় যেইখান দিয়া, তোমাগোর তালতলীর নদী ধইরা ডাইন দিকে, সেইখানে রাইতের বেলা উপারে খালি আকাশ আর আকাশ। এতখানি আসমান চাখারে নাই, চাখার-বরিশাল মিইল্যাও নাই। এত্ত বড় আকাশ’। হুজুর হাত দিয়ে ইঙ্গিত দিলেন আকাশের আয়তনের দিকে, আর হুজুরের হাত তোলা দেখেই কিনা, পুকুরের ওপারের ডেউয়া, বউলা গোটা, বট গোটা, পাকুড় ও তিতিজামের লাইন ধরে মাটিতে বসে থাকা কাকগুলো একসঙ্গে উড়ে পানির ওপরে স্থির হয়ে থাকল এক মুহূর্ত, তারপর জাহেদদের দিকে ছুটে এসে আকস্মিক ওপরে উঠে চলে গেল মসজিদের টিনের চাল ছাড়িয়ে বরিশাল বরাবর।
হুজুর বলতে লাগলেন, ‘আড়িয়াল খাঁ-র ওই বিরাট আকাশে রাইতে নখ ছিটকাইয়া নদীতে পড়বেই। বোঝতেয়াছ জাহেদ? ওই নখত্রের পানির এক বুতোল পাইবা তো, জীবনে আর কিচ্ছু লাগবে আমারদের? তুমি পাইলে তো মুইও পাইলাম, নাকি? তোমার পাওয়া গুপ্তধন অলংকারের দোকানে বেইচ্চা তুমি পাইলা ধরো এক লাখ টাকা। না থাক, অত টাকার দরকার নাই। ধরো, পাইলা আশি হাজার। হেইডাও বেশি বেশি, তা-ও ধরলাম। তো সেই আশি থিইক্যা দশ তো দিবা তোমার মালেক হুজুররে, নাকি?’
জাহেদ বলল, ‘দিব। দশ হাজার না, আপনারে আমি এগারো হাজার দিব। সত্যি, হুজুর। কিন্তু দোয়াটা তো বললেন না।’
আবার সেই একই কথা হুজুরের—জাহেদ তাকে তার ওই লুকিয়ে যাওয়া, চেপে যাওয়া গোপন কথা না বলা পর্যন্ত দোয়াটা তিনি তাকে শেখাবেন না। জাহেদ মনস্থির করেই ফেলল যে, অত খারাপ কথা হুজুরকে সে বলতে পারবে না। আর কী এক কথা ওইটা, ওটা সে হুজুরকে বলবেই বা কোন শব্দ দিয়ে? তাই জাহেদ কপট রাগ দেখিয়ে উঠে দাঁড়াতে গেল। হুজুর তখন তাকে টেনে বসালেন একই জায়গায়। জাহেদ একবার তাকাল তার পায়ের দিকে এগিয়ে আসতে থাকা লাল ডাঁশ-পিঁপড়াদের দিকে, তারপর ডান পা তুলে পিঁপড়ার দলটাকে স্যান্ডেলের তলায় পিষে সে হুজুরকে বলে দিল, সাফ-সাফ গলায় বলে দিল, ‘আপনি যদি আমারে এইরকম জোর করেন, খারাপ কথা বলা নিয়া এইরকম জোর করেন, তাইলে আমি বরিশাল গেলে পরে বইল্যা দেব যে, আপনি আমারে রাইতে পুস্কুনি ঘাটের সিমেন্টে ঘুমাইতে দেন। আর আমি বলব যে, মোটা লাল কালা চাইলের ভাত আমি খাইতে পারি না, তারপরও আপনি আমারে সেই ভাতই খাইতে দেন।’
জাহেদের কথা শুনে মালেক হুজুরের চোখে দুঃখ-কষ্ট-অভিমানের পানি চলে আসতে এক সেকেন্ড সময় লাগল না। হুজুর বললেন, ‘জাহেদ, আমরা গরিব। তুমি আইছো ক্যান এইহানে বেড়াইতে? আমি তোমারে আনছি, জাহেদ? আমি আনছি? তুমিই তো বললা, হুজুর চাখার যাব, আমার আব্বা-আম্মারে বলেন। আমি তোমারে খালি ব্যাতের বাগানের গল্প করছিলাম কয়দিন, তারপর তুমি ধরছ আমারে। এতখানিক নিষ্ঠুর হইয়ো না আমার পেরতি।’
জাহেদের লজ্জা লাগল হুজুরের কথা শুনে। সে হুজুরের হাত ধরে বড়লোকদের মতো ‘সরি’ শব্দটা বলতে চাইল। ওই শব্দ সে বহুবার জিলা স্কুলে শুনেছে তার বড়লোক বন্ধুদের মুখে, যারা টিভিতে মিকিমাউস না কী যেন দেখে, আর আরও কী কী বিদেশি ছবি দেখে, তারপর স্কুলে নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করে, বলে, ‘রবার্ট দেখছস কেমনে অ্যালিসরে এক্কেরে শোওয়াইয়া দিল?’ কিংবা ‘রাখ তোর ‘ফল গাই’। অ্যাড দেখছস ‘নাইট রাইডার’-এর? টিংকটিটি- টিংকটিটি-টিংকটিটি-টিংকটিটি…।’ তাদের মুখের এই এক টিংকটিটি-টিংকটিটি সুর শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে গেছে জাহেদ এবং তার মতো অন্য গরিব ছাত্র যারা, যাদের বাসায় এখনও টিভি আসেনি। জাহেদ বুঝল, ওই টিভি কেনার জন্য হলেও তাকে গুপ্তধন পেতেই হবে। সে হুজুরকে বলে বসল, ‘ঠিক আছে। আমি আপনারে বলব খারাপ কথাটা। কিন্তু তাইলে আপনি আমারে দোয়া শিখাইবেন। তখন আমি আড়িয়াল খাঁ যাব, তারপর নখরের পানি থেকে যা পাব, তার মধ্যে এগারো হাজার টাকা আপনার। ঠিক আছে, হুজুর?’
সে ‘ঠিক আছে, হুজুর?’ প্রশ্নটা করল টেনে টেনে, আর পায়ের স্যান্ডেল উল্টে দেখতে লাগল স্যাণ্ডেলের নিচে চ্যাপ্টা হয়ে মরে থাকা পিঁপড়াদের। কাকগুলো টিনের চাল ছেড়ে আবার ফিরে যাচ্ছে তিতিজাম, বট-পাকুড়ের দেয়ালটার দিকে। হুজুর বললেন, ‘ঠিক আছে। কিন্তু আমরা যে এত গরিব সেইটা নিয়া তুমি বাড়িত ফিইর্যা গিয়া পাষাণ-হৃদয় হইবা না। আর অলংকারের দোকানে হীরা-মানিক বেইচ্যা যা-ই পাইবা, আমার এগারো হাজার ফিক্সড। পঞ্চাশ হাজার পাইলেও এগারো হাজার আমার, তুমি আশি হাজার পাইলেও এগারো হাজার আমার। আবার জাহেদ তুমি যদি ধরো পাইলা দশ লাখ? ওরে বাবা!’
জাহেদ এবার তার চোখ মাটির দিকে করল, ঘাড় শক্ত করল, তারপর হুজুরকে বলল, ‘খারাপ কথা হইল—তুফান, ফৌজি, দেবদাস আমারে বলছে… ওরা আমারে বলছে… গেরামে যখন ছেলেমেয়েরা বিয়া করলে চেক্স করে, তহন কিচ্ছু হয় না। কিন্তু শহরের লোকেরা নাকি এ যাইবে ওর বউয়ের কাছে, ও যাইবে এর স্বামীর কাছে। গিয়া যদি তারা চেক্স করে, তাইলে নাকি ছেলেদের ওইটা মেয়েদের ভিতর থিকা আর বাইরায় না, আটকাইয়া যায়। ফৌজি বলছে, লক হইয়া যায়। আর তখন নাকি পোলা-মাইয়া দুইডারেই একলগে হাসপাতাল নেওন লাগে সেই লক খোলনের জইন্য। সে বলছে যে, তোগো শহরে সবতে নোংরা, তাই আল্লায় দিছে ওই সিস্টেম। হাসপাতালে ওইটা কাইট্যা লক খোলন লাগে পাপ কাম করলে।
হুজুর কথাটা শুনলেন। তিনি তাকালেন পাশের কেলিকদমের গাছে ফুটে থাকা হলুদ-সাদা থেকে খয়েরি-খয়েরি হয়ে আসা ফুলগুলোর দিকে। তারপর ঝট করে জাহেদকে তিনি চড় মারলেন একটা—সাবধানে, আস্তে। আর বললেন, ‘তোমারে বলছি না গিদর ওই পোলাপানের সাথে মিশবা না।’
তারপর একটু বিরতি। জাহেদের মাথা তখন নিচু হয়ে আছে লজ্জায়। তখন হুজুর আবার, ‘শোনো, স্বামী-স্ত্রীর মিলন আল্লাহর নেয়ামত। তাহা থেকেই জন্ম হইছ তুমি, তোমার বুইন, তোমার ভাই শাহেদ, আমার বুইন সাথী, আমার টাইফোয়েটে মইরা যাওয়া তিন-তিনডা ভাই। আল্লায় যেমনে জন্মও দেয়, তেমনে তুইল্যা নেওয়ার কালে চাইলে সোনা কাইট্যাও তুইল্যা লয়। ফৌজি-তুফানদের কথার সত্যাসত্য আমি জানি না। জানিয়া লবো। কিন্তু তুমি এইসব নিয়া বিশেষ মাথা ঘামাইবা না। একবার আড়িয়াল খাঁ-তে গুপ্তধন পাইবা তো, এই মরত্তের পিরথিবিতেই কোনো হুর-পরী শাদি কইর্যা চেক্সের সব জানিয়া লবা। আর শাদির আগে পর্যন্ত কখনোই নিজের নুনুতে খারাপ চিন্তা করে হাত রাখিবা না। নিজে নিজে নিজের ওইটা ঘাঁটাঘাঁটি পেরচন্ড খারাপ কাম।
তাতে স্মৃতি নষ্ট হয়, প্ররসাবে জ্বালাপোড়া হয়, আরও নানাবিধ ব্যাধি হয়। এইটা মনে রাখিবা।’
জাহেদ জিজ্ঞাসা করল, ‘হুজুর, আপনি বিয়া করেন নাই কেন?’
হুজুর একদম এক কথার উত্তর দিলেন, ‘কোরান শরিফের আয়াতের হেতু জাহেদ আমার দিল ঠাণ্ডা, আমার শরিল ঠাণ্ডা। আর বোনের বিয়ার আগে কোন বেরহম ভাই আছে যে বিয়া করে, বোকা?’
.
জাহেদের স্পষ্ট মনে পড়ল সে রাতে চাখার কলেজের মাঠের পাশের বিরাট এক মাঠে তার শেষবারের মতো লক্ষ্মণ দাস সার্কাস দেখবার কথা। পর্দা উঠতেই সেদিন প্রথমে মঞ্চে উঠেছিল ঈমান, আর সে মাইকে মুখ রেখে সবাইকে বলেছিল, ‘স্বা-এর গোয়ার মইদ্দে তম–স্বাগোয়াতম।’
সেই কথা শুনে সবার কী হা-হা হাসি! লক্ষ্মণ দাস নিজে এ সময় মঞ্চে হাজির তার ভাই বাংগরা দাসকে নিয়ে। লক্ষ্মণ দাস দর্শকদের উদ্দেশে বললেন, ‘আজকের সার্কাসের রাত ভিন্ন। আজকে আকাশে যেমন অনেক তারা, তেমন আমাদের তাঁবুর পিছনে অনেক নতুন ট্রেনিং পাওয়া রাজহাঁস। তেমন নতুন পড়াশোনা করতে শেখা হাতি, নাম তার গুয়াহাতি। কারণ সে আসছে ভারতের আসামের কামরূপ-কামাখ্যার গুয়াহাটি থেকে। আপনারা যারা জানেন, তারা জানেন গুয়াহাটি কামরূপ কামাখ্যার একখানা ছোট অংশ, আর কামরূপ কামাখ্যা আমারদিগের দিলের মতন বড়। আমি বৃদ্ধ মানুষ, আর বলব না। আপনেরা দোয়া রাখবেন, আমার ডায়াবিটিস, তাই কথা আপনাদিগের সঙ্গে কথা বলবে আমার ছোট ভাই বাংগরা দাস কথা…।’
বাংগরা দাস মঞ্চে উঠেই প্রথমে নিজের প্যান্টের জিপার খুললেন। তারপর জিপার ঝট করে আটকাতে গিয়ে ব্যথায় চিৎকার দিলেন, ‘উঁহু-হুঁ।’ তার সেই চিৎকার শুনে ঈমানসহ মোট চার বামন—তাদের গায়ে কটকটা হলুদ রং জ্যাকেট, লাল রং টাই, তারা তাদের টুপি খুলে ছুড়ে মেরেছে যার যার পায়ের কাছে এবং মুখ হাঁ করে দেখিয়েছে যে, তাদের জিভের রং তেমনই লাল যেমন লাল তাদের ঠোঁট, যেমন লাল তাদের গালের পাশটা, যেমন কিনা রক্ত দিয়ে আঁকা, যেমন কিনা হাহা-খাই-খাই পৃথিবীকে যেন কাঁচা চিবিয়ে খায় তারা—তারা সেই চার বামন একসঙ্গে যার যার পাছায় লম্বা লাঠির এক বাড়ি মেরে, অর্থাৎ চার পাছায় চার বাড়ি মিলে একটাই ফটাৎ, একটাই ফড়াৎ, তারা বলে বসল একযোগে, ‘মালিকের ধন-সম্পদ সব আপনারা দেখতেছেন যে আটকাইয়া গ্যাছে। প্যান্টের চেন যার আটকাল, তার কী বা আর ধন, কী বা আর যুদ্ধের সাবস (সাহসকে ‘সাবস’ বলল তারা)? তো, এখন আমাদের এই শক্তিশালী-বলশালী-পুরুষালি মালিকের ধনটি খুলিবেন আমাদের একমাত্র সিল-ডলফিন মাছ, বোনের স্নেহ হইতে বঞ্চিত মাছ, ভাইয়ের স্নেহ হইতে বঞ্চিত মাছ—অঙ্গরূপা। আসো অঙ্গরূপা, আসো।’
একটা জঘন্যদর্শন লিপস্টিক লাগানো সিল মাছ না শুশুক না ডলফিন মাছ না জানি কী ওরকম এক মাছ, নাম তার অঙ্গরূপা, সে এবার তার লেজ ছেঁচড়াতে ছেঁচড়াতে, তার তেলতেলে নাদুসনুদুস পেট ও বিরাট লেজ হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে এবং তার গোঁফের মধ্যে সারা দুনিয়ার প্রতি তার ঘৃণা ও তার রক্তপিশাচ নিষ্ঠুরাচরণ প্রকাশ করে-করে-করতে-করতে দুলদুল হাজির হল মঞ্চে তার কাজ বাংগরা দাসের প্যান্টের জিপার তার সাদা শেফালি ফুলের মালার মতো সাজানো দাঁত দিয়ে খোলা এবং একইসঙ্গে তার লাল জিভ দিয়ে বাংগরার প্যান্টের ওখানটা ওরাল সেক্স করবার ধরনে চেটে দেওয়া। হায়, দর্শকেরা যে এটাই চায়!
মঞ্চের আড়াল থেকে মাইকে আওয়াজ উঠল, ‘অঙ্গরূপা এখন নারীজাতির মতম করে এই কাজটা করবে, বাংগরা দাসের ধন-সম্পদের পেরতি তার এই আদরসোহাগটা দেখাবে। সেইজন্য আগে কাটা হবে অঙ্গরূপার দুইখান গোঁফ আর, ভাইয়েরা, অঙ্গরূপার সেই গোঁফ কাটবে আমাদের লক্ষ্মণ দাস সার্কাসের নাপিত, আমাদের আজকে রাতের প্রধান আকর্ষণ দশ রাজহাঁস – কার্তিক-বজ্রধর- জহ্নু-পিনাকপাণি-বৃষাকপি-গোপবল্লভ-কংসারি-সিদ্ধসেন-কুঞ্জরবদন ও মকরাঙ্ক, হ্যাঁ ভাইয়েরা, আমাদের এই নতুন দশ রাজহাঁসের প্রিয়তম কেষ্ট-কানাই, আমাদের জোকার– ঈমান দাস। ঈমান দাস করবে এই কাজটা। হাততালি শেরেবাংলার বাপের ঘরের নাতি, মায়ের ঘরের দুলাভাই, ভাইয়েরা আমাদের, হাততালি।’
এবার ঈমান ওই অঙ্গরূপার গোঁফ—সিল-ডলফিন ধরনের মাছের মুখটা তখন বাংগরা দাসের প্যান্টের চেনের ওখানে—কাটতে গিয়ে বাংগরা দাসকে কানে কানে চুপচাপ বলল, ‘মালিক, দ্যাখেন দর্শক কত্তো হাসবে! আপনি খালি আপনার ধনসম্পদটা আমারে একটু হাতে নিতে দ্যান, দ্যাখেন অঙ্গরূপা তাইলে কেমনে তার গা তেলতেল দুলাইয়া হাসবে। একবার, মাত্র একবার ওইটা আমি হাতে নিম্ন মালিক। আর দ্যাখেন আইজকে রাতে আমার পাছা কেমন তেল মাখা, রাজহাঁসগুলার পাছার মতম কেমন পিছলা, মোটা পাছা রাজহাঁস মকরাঙ্কের মতম কেমন ফোলা ফোলা, মালিক।’
বাংগরা দাস প্রবল উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। তার ‘চেক্স’ তখন তার মাথায়, চুলে, ঘাড়ে, গর্দানে, চোখে, সবখানে। জাহেদ চিল্লাছে, ‘ঈমান দাস, ঈমান দাস’। জাহেদ এরপর কথাটা বলছে ছন্দ বানিয়ে, ছড়ার ছন্দ: ‘ঈমান দাস, ঠাস ঠাস।’ দর্শকেরাও তা শুনে হা হা হাততালি দিয়ে বলে উঠল, ‘ঈমান দাস, ঠাস ঠাস’। জাহেদ অপেক্ষায় আছে দেখবে যে, ঈমান কী করে অঙ্গরূপা সিল মাছটার গোঁফ ছাঁটে, আর অঙ্গরূপা তখন কেমন গা ঢলঢল করতে করতে ভাবপ্রকাশ করে যে, ‘এই পিরথিবির মাইনষেরা খারাপ না, মামু!’
ঠিক ওসময়ে মঞ্চের বাকি সব আলো নিভে গেল। প্রবল উত্তেজিত বাংগরা দাস তার প্রবল উত্তেজিত ধনসম্পদটা কোনোরকম সামান্য লজ্জায় বের করে হাতে পুরে দিল ঈমানের-তিনি তখন শুধু এটাই ভাবছেন যে, আজ রাতে ঈমান ছেলেটা কেমন পাছা তুলে তুলে তাকে সহায়তা করবে তার ভালবাসার দুষ্টুমিষ্টি কাজে।
ঈমান সিল-ডলফিন-শুশুক মাছ অঙ্গরূপাকে বলল, ‘গোঁফ বাড়া, শালা উত্তর মেরুর সিল মারা, মোহরমারা, চেক্সভরা মাছ, তোর গোঁফ বাড়া’, আর দর্শকেরা তা শুনে হেসে খুন। তারা চিল্লিয়ে উঠল ঈমানের মুখের ‘চেক্সভরা’ শব্দটা শুনে, কারণ তারা আশা করেছিল ঈমান বুঝি বলবে, ‘কামবাই ভরা মাছ।’ তারা তাই হা-হা-হি-হি, তারা তাই খিলখিল-কিলকিল। আর এবার ঈমানের হাতে এক কাপড় কাটার কাঁচি, এক শক্তপোক্ত ঝিকমিক-চিকমিক টেইলার সিজর। ঈমান হাত দিল অঙ্গরূপার সবচেয়ে লম্বা গোঁফটায়। তখন তার কবজির পেছন দিকে এতগুলো দর্শকের সামনেও লজ্জাহীন ধাক্কা দিল বাংগরা দাসের ধনসম্পদ, মাথায় ভিজে হীরার মতো চিকচিক করতে থাকা তার বুঁদ-চুর-ভোম তারসানাই। এবং তখনই ঝাঁ করে বাঁ করে সাঁ করে ধ্যাঁ করে ঝ্যাৎ করে ঈমান অঙ্গরূপা সিল-শুশুকের গোঁফ ছেড়ে সোজা সাঁই করে তার হাতের চিকমিক টেইলার সিজরটা দিয়ে এক কোপে কেটে নিল পানি চলে আসা, ধাতু-চলে-চলে-আসা বাংগরা দাসের প্রায় আট ইঞ্চি সাইজের পুরো ধন ও সম্পদটাকে, তার ক্রমবর্ধমান ওই মত্ত ছটফটানিটাকে।
মঞ্চের মেঝে ভরে গেল রক্তে—অনেক ঝাঁকি দিয়ে, অনেক ছলাৎ ছলাৎ দিয়ে, বলকে বলকে ওঠা, হুড়োহুড়ি লাগানো লাল রক্তে। আর ঈমান তখন দৌড়, টেইলার সিজরটা সে তার ট্রেনার অনু টেইলারের মুখ বরাবর ছুড়ে মেরে ভো দৌড় দর্শকসারির দিকে। তারপর সেখান থেকে কোনোমতে জাহেদকে জড়ো করে, বগলদাবা করে সে দৌড়াল তাঁবুর বাইরে, যখন তাঁবুর ভেতরে অঙ্গরূপা নামের সিল-ডলফিন মাছটা বেশ গলায় ঢেঁকুর তুলে বলছে, ‘কাটা ধোনটা কি ঈমান দাস সঙ্গে নিয়া গেছে? আমি এখন কীসে চুম্মা দিব? গেঁঘর গেঁঘওর।’
মঞ্চে ঝুলিয়ে রাখা মাইক্রোফোনে তখন অঙ্গরূপা বেচারার কিচ-কিচ-কিচ, সিল-শুশুক মাছ বেচারার গেঁঘর-গেঁঘওর ভারি আওয়াজ, আর বাংগরা দাসের মরণ চিৎকার যে, ‘শাউয়ার পোলা ঈমান আমারে পেরতারিত করল এইভাবে, দাদা? বাঁচাও।’—তার দাদার নাম লক্ষ্মণ দাস, তিনি এক হাত না, পুরো দু হাত দিয়ে সেসময় ধরে রেখেছেন তার নিজের ধনসম্পদ, ঝুলে পড়া অণ্ডকোষসহ।
.
ওই রাতেই সার্কাসের জোকার ঈমানের সঙ্গে জাহেদের ছিল শেষ দেখা। তারা যখন পালাচ্ছে, তখন চাখার কলেজের মাথায় যে কালভার্ট, সেটাই ছিল জাহেদের শেষ কোনো চেনা জায়গা, আর রাতের বাকিটা ছিল সবই অজানা, অচেনা। রাতও ছিল সেটা একটা বটে—দশ কালো হাত-পা বাড়িয়ে দশদিকে ছড়ানো এবং একটু পরপর ম্যাপলের মতো পাতা ও সজারুর কাঁটার মতো ফলে ভরা ঘাগরা শাকের অজস্র ঝাড় ঘিরে বাজতে থাকা পুলিশের বাঁশি।
কোন এক নদীর ধারে এসে থামল তারা দুজন, কিন্তু রাত তখন কতো হয় তা কেউ জানে না। কেউ-টাই তো ছিল না কোনোদিকে। জাহেদের স্রেফ মনে আছে নদীতে চলা নৌকার টিমটিমে আলোয় দেখা যাচ্ছিল এই পাড় ধরে দাঁড়ানো মসৃণ দেহের গগনশিরীষ গাছগুলোকে। একটা নৌকা অন্ধকার ফুঁড়ে তাদের ঠিক সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল হঠাৎ। মাঝি তার হারিকেন তুললেন ওপরের দিকে, আর মাঝির সাগরেদ ছেলেটা টর্চ মারল জাহেদদের মুখের ‘পরে। পেছনে নদীর জলের দিক থেকে কেমন ‘মডি মডি’ ধরনের এক আওয়াজ ভেসে আসতেই জাহেদ তাকাল পেছন ফিরে, আর দেখল টর্চের আলোয় দেখা যাচ্ছে কতগুলো গগনশিরীষের শিম-শিম ফল। সে নিশ্চিত যে, তার এনায়েত স্যার হলে বলতেন, ‘দ্যাখো জাহেদ, শিম-প্রতিম ফল।’ আর আরও বলতেন, ‘শোনো, যখন মনে হবে এইটা আসলে শিম না, এইটাকে খাওয়া যাবে না, এইটা কেবল শিমের সদৃশ এক অর্থহীন ফল, যখন জীবনে এরকম মনে হবে যে সব হারিয়ে গেছে, সব খোয়া গেছে, তখন তুমি বাচ্চা ছেলে ঠিক ওই সময়েই বুঝবে যে, ওই যে সব হারিয়ে গেছে ভাবলা, তার মানেই হচ্ছে সব ফেরত আসবে একদিন। মানে কেউ-না-কেউ কিছু-না-কিছু তখন এসে তোমাকে বাঁচাবে।’
একথা বলে এনায়েত স্যার, ভাবল জাহেদ, নিশ্চিত তার জামার হাতা গুটাতেন এবং তার মুখের মাত্র ইঞ্চিখানেক দূরত্বে এসে জিভটা একটু পরপর দেখিয়ে তাকে বলতেন, ‘সব দরজায় ধাক্কা মারি আমরা, জাহেদ। কোনো দরজাই খোলে না। হ্যাঁ, এইরকম সময়ও জীবনে আসে। কিন্তু মজা কী জানো? যে দরজাটার ওপরে এসে তুমি শেষে হুমড়ি খেয়ে পড়লা, সেইটাই সেই দরজা যেইটা কিনা খুলবে—তুমি বিশ বছর ধরে যে দরজা খুঁজছ, সেইটাই সেই দরজা।’
জাহেদের মনে হল, এই নৌকাই তাদের আজকের রাতের সেই ‘দরজা’। সে মাঝিকে বলল, ‘মাঝি চাচা, আমাদেরে বরিশালে নেবেন? টাকা যা লাগে বরিশাল গিয়া দেব।’
মাঝি বললেন, ‘না, না। তোমার এই বন্ধুর তো হাতে রক্ত। কী ঘটনা ঘটাইছ আগে কও।’
ঈমান উত্তর দিল, ‘আমি ঈমান। লক্ষ্মণ দাস সার্কাসে কাজ করি। জোকারের কাজ। সার্কাসের মালিকের ভাই হিন্দু বাংগরা দাস আমারে রোজ রাতে পাছা মারে। আমি আজকে তাই সার্কাসের খেলা দেখাইতে দেখাইতে বাংগরা দাসের ওইটা কাইট্যা ফালাইছি।’
ওই নৌকার পাশে যে তখন আরও কয়েকটা নৌকা দাঁড়ানো, সেটা জানা ছিল না জাহেদদের। সম্ভবত ওদের দুটো থেকে একযোগে ডাক উঠল, ‘বাংগরা দাসে মারা গেছে। আধাঘণ্টা আগে, বানারিপাড়ার হাসপাতালে।’
ঈমান সেটা শুনে বলল, ‘ওরে পঙ্খীরে পঙ্খী, তোর কত যে নিশানা!’
জাহেদ ঈমানের খুশিটা দেখল। সে নিজেও খুব খুশি হল আর মনে মনে বলল, ‘ওরে পাখিরে পক্ষী, তোর কত যে নিশানা,’…এবং সে দেখল অন্ধকারের বিনিশ্চল এক পর্দা ফুঁড়ে একটা নৌকা থেকে রীতিমত নদীর পাড়ে তাদের দিকে ভেসে এলেন এক লোক—তার মুখে ছোট দাড়ি, তার ভাবভঙ্গী একদম এক গগনবিহারী খেচরের। তিনি তার পোঁ-পোঁ-পি-পিঁ গলায় তাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে (টর্চের আলো তখনও পেছনের গগনশিরীষের লাইনটার মাথার ওখানে ঈমানের উদ্দেশে দৃষ্টি পাথর করে নিয়ে বললেন, ‘তুমি তো শহর থেইক্যা আসা মালেক হুজুরের ছাত্র। মালেক হুজুরের হুজুর যে চিশতি ঈমাম, আমি তার আপন ভাই-জুম্মা, জুম্মা ফরাজি। বড় ভাইয়ের পুরা নাম চিশতি ফরাজি, ঈমাম টাইটেল ওইটাতে লাগছে পরে।’
জাহেদ বলল, ‘তো?’
জুম্মা বললেন, ‘তোমার খুঁজে চাখার তোলপাড়। তোমার ভয় নাই। তুমি মানুষ মারো নাই। কিন্তু বীরত্ব তো কিছু দেখাইল ঈমানে। ঈমানের বাপে খুশি, বাপের বন্ধু পেরু খুশি, পেরুর লগে চল্লিশ দিনের চিল্লায় যাওয়া আমরা খুশি। ওর সাথে গর্হিত অপরাধ করছিল বাংগরা দাস। তার মৃত্যুই কাম্য। হিন্দুর বাচ্চা মুসলমানের বাচ্চার পাছা মারত। নাউজুবিল্লাহ! হিন্দুর বাচ্চা মুসলমানের পোলারে মাইক দিয়া সার্কাসে ডাকত ‘ঈমান দাস’ বইল্যা। ভাবা যায়? ঈমান শব্দের মানে জানে না স্যায়? সেই ঈমানের পরে—দাস? নাউজুবিল্লাহ!’
তারপর সব চুপ। মাঝি হাতের হারিকেন নৌকার ডেকে নামিয়ে তাদেরকে বললেন, ‘তোমরা রাইতে খাইছ?’
জাহেদই উত্তর দিল, ‘না।’
ঈমান বলল, ‘আমি খাব না। আমারে কি পুলিশ জেলে নিবে?’
হারিকেন হাতে ধরা ওই মাঝি জানালেন, ‘অবশ্যই নিবে। কিন্তুক এইটা পেরসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমল। হিন্দু গো ভাত নাই। চাখারে তো নাই-ই। তুমি কয়দিন বেড়াইয়া আসবা জেলখানায়। বাস্।’
অন্ধকারের মধ্যে শুয়ে থাকা, অন্ধকারের গায়ে লেপটে থাকা, মিশে-পিষে থাকা নৌকাগুলো থেকে এবার একসঙ্গে আওয়াজ এল-ড্যাডাং ড্যাডাং। নৌকার পরে নৌকা ভরা লোকেরা তাদের খাবারের থালা বাজিয়েছেন চামচ দিয়ে, মনের তবলা বাজিয়েছেন যার যার বুকের ওপরে তাদের মোটা মোটা মাঝি-প্রতিম আঙুলের বাড়ি মেরে। একজন বললেন, ‘তোমার পক্ষে সাক্ষী দেবে আরও তিন জোকারে—চড়চড়ি, বগা আর চন্দন। ভয় পাইয়ো না। চাখারের সব মোসলমান এক হইয়া সব দেখতেয়াছে। লক্ষ্মণ দাস সার্কাস বন্ধ। চাখার থেইক্যা লক্ষ্মণ দাস সার্কাসরে—কী?’
প্রায় দশ-বারোজন মানুষের গলায় উত্তর উঠল, ‘লাখি।’
আবার উনি চিল্লিয়ে, ‘চাখারের পবিত্র মাটি থেইক্যা মালাউনের সার্কাসরে—কী?’
আবার সবাই একসঙ্গে, ‘লাখি।’
এরপর জুম্মা ফরাজি ও দুই লোক জাহেদকে সঙ্গে নিয়ে চাখারের পথে হাওয়া—তারা দৌড়ে দৌড়ে চলেছেন, আর জাহেদ দূর থেকে দূরে সরে যাওয়া দৃশ্যপটে ঈমানকে শেষবারের মতো দেখছে যে, ঈমান মিলিয়ে যাচ্ছে নদীর হা-হা খাঁ-খাঁ করে ওঠা অন্ধকারে-নদীর পানিতে তখন কেমন ডিণ্ডিম ডিণ্ডিম শব্দ, কেমন এক মডি-মডি আওয়াজ। জাহেদ এভাবে অনেকটা দূরে চলে এসেছে, কিন্তু তাকে থামতেই হল, কারণ ঈমান তার উদ্দেশে চিৎকার দিয়েছে, ‘তেগুচি না কই জানি গ্যালে আমারে লইয়া যাইও, জাহেদ।
জাহেদ এক ঝটকায় তার হাত ছাড়িয়ে নিল জুম্মা ফরাজির হাত থেকে। তারপর সে জানে না ঈমান ওই কালো গোঁফওয়ালা সূচিভেদ্য অন্ধকারে তখন কোনদিকে কোথায় বায়ুকোণে, নাকি অগ্নিকোণে, ঈশাণকোণে নাকি ডাহিন কোণে; তাই সে সবদিকের সেরা দিক দিগদিগন্তের সীমানা ছাড়ানো আকাশ গুম্বুজের দিকে তাকিয়ে প্রাণপণে ডেকে উঠল: ‘তেগুচি না। তেগুচিগালপা, ঈমান, তেগুচিগালপা।’
.
এ সময়ে বাবার গলা শুনে ঝট করে আবার বর্তমানে ফিরে এল জাহেদ। সে তার চোখের সামনে দেখছে যে, বসার ঘরের মেঝেতে বসে তার মায়ের ছুড়ে মারা কানের দুল দুটো অবিশ্বাস্যরকম একসঙ্গে পড়ে আছে তাদের মাঝখানের ঘরের কিনারে, যেখানটায় খাট-বিছানা পাতা—ওই দুই দুল পড়ে আছে সেই খাটের এক পায়ার পাশে। সে ও দুটো হাতে তুলে তার মাকে দিল, আর বাবার জোরালো গলা তার কানে আসতেই মন দিল এই এখনের মধ্যে। সে দেখল, তার বাবা তখন কাঁদো-কাঁদো হয়ে তার মা-কে বলছেন, ‘ঝামেলা কোরো না তো তোমরা এত। ওমর আমার টাকা দিচ্ছে না, কারণ ওমর টাকা সব হারাইছে। ব্যবসা তো ব্যবসা, আর কয়লার ব্যবসা সোজা না। ধরলাম সে আমার টাকা মেরেই দিছে। কিন্তু আমাকে জেলখানায় বড় ভাই তো সে ডাকছে, নাকি? টাকা তার কাছ থেকে না পেলে ধরলাম কপালে না থাকলে না পাব। কিন্তু তাই বলে তার সাথে নৌকায় নদীতে যাওয়া যাবে না? কথা হল?’
তাদের মা এবার রীতিমত ক্ষেপেই গেলেন। তিনি গিয়ে বসলেন তার মেয়ে পারভিনের পড়ার চেয়ারে এবং স্বামীর উদ্দেশে চিৎকার করে বলতে লাগলেন, ‘তুমিই তো সেদিন বললা কেস করবা। আমার কথার সোজা উত্তর দিচ্ছ না কেন তুমি? তোমাকে বড় ভাই ডাকছে, না কী ডাকছে, সব তো আমার দেখা আছে। চার লাখ টাকার পুরাটা মেরে দিল। কিন্তু আসল কথা বলো—নদীতে কেন? রাতের বেলা নৌকায় কী? সাথে কারা যাচ্ছে তোমাদের? যাচ্ছ কই তোমরা?’
তাদের বাবা এবার চুপ। তিনি সরাসরি প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেবার প্রয়োজনীয়তার মুখে পড়ে গেছেন। তিনি তার হাতের লাঠি দিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা জাহেদের মাথায় টুক টুক করে বাড়ি মারতে লাগলেন। ঘরজুড়ে তখন কেবল শোনা যাচ্ছে ওই শব্দটাই-টুক, টুক, টুক। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে অনেক, সময় হারিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। তাদের বাবা নরম-চিকন গলায় জাহেদকে বললেন, ‘জাহেদ, তোর মাথায় বাড়ি কিন্তু লাঠির পড়ছে না। তোর মনে হচ্ছে ওইটা লাঠি, কিন্তু আসলে কী? খোসাল মামারে আল্লার দরগায় বিশ ফুট হাত বাড়ায়ে কে মাথায় বাড়ি মারছিল, বাঁশঝাড় থেকে? কে?
মুচকি মুচকি হাসতে লাগলেন তিনি, আর জাহেদের মনে পড়ল খোসাল মামার ওই রক্ত-হিম করা গল্প, যার শুরু হবে সামান্য এক বোতল ভূত দিয়ে, তারপর গল্পের মাঝামাঝি সে যাবে বাঁশঝাড়ের শাঁকচুন্নির দিকে, আর শেষে কুষ্টিয়া পার হয়ে, কালিগঞ্জ পার হয়ে বেনাপোল বর্ডারের বিস্তীর্ণ খোলা মাঠে ভোরের আগে-আগের আলেয়াদের কাছে। জাহেদের মনে হল, তার বাবা বেশি ভাল মানুষ,
ঠিক তিনি নিজেই যেমন বলেন, ‘আমি জোকার। লক্ষ্মণ দাস সার্কাস থেকে ভুল করে তোদের এইখানে চলে আসছি, জাহেদ।’
জাহেদের মনে হল ওরকম ভাল মানুষটাকে নিয়ে তার মা অহেতুক চিন্তা করছেন, ওরকম এক মানুষকে তাদের ওমর চাচা কিচ্ছু করবেন না। কিন্তু এ সময়ে চিৎকার দিয়ে উঠল জাহেদের বড় ভাই শাহেদ। সে বলে বসল, ‘বাবা, তুমি এইসব খোসাল মামার গল্প রেখে মা-র প্রশ্নের সোজা উত্তর দাও।’
শাহেদের দেখাদেখি এবার পারভিনও, ‘নদীতে কেন যাবা, বাবা? ওমর চাচা বুঝলাম ভাল মানুষ, বুঝলাম তোমারে সে বড় ভাই ডাকছে। কিন্তু রাত-বিরাতে ওর সাথে নৌকায় কী?’
একদম কোনার মধ্যে ঠেসা এক অবস্থায় পড়ে গেলেন তাদের বাবা। তিনি গলা দিয়ে শব্দ করলেন উহখ্ উহখ, শব্দ করলেন খুশ-খুশ। তাদের মা এবার এই ঘর কাঁপিয়ে বলে উঠলেন, ‘অকারণে কাশবা না। তোমার কাশি হয় নাই। আর পারভিন, ওমর আলি ভাল মানুষ কী করে হয়? কীসের ভাল মানুষ সে? জেল থেকে সোজা বের হল, হয়েই তোর বাবারে বলল, ‘আমার কয়লার ব্যবসায় টাকা দেন, প্রতি লাখে বছরে পঞ্চাশ হাজার করে পাবেন, চার লাখে বছরে দুই লাখ করে প্রফিট।’ কীসের প্রফিট? বাড়িতে আসলেই সে কী বলে?—’ভাবি, মন খারাপ করবেন না, সব টাকা খাতায় জমতেছে। সব একসাথে দিয়ে দেব।’ কীসের ভাল মানুষ ওমর আলি? ভণ্ড সে। গুণ্ডা সে। কয়লার ব্যবসা করা লোক গুণ্ডা না তো কী? কেন জেলে গেছিল ওমর আলি? তোর বাবা তোদেরে সেটা বলছে কোনোদিন? বলে নাই। কিন্তু আমি জানি। আমি জানি। বলব? বলো তুমি, আমি বলব তোমার ছেলেমেয়েদের যে, তাদের ওমর চাচা কেন জেলে গেছিল, কেন তার আট বছরের জেল হইছিল? বলি?’
তাদের বাবা দৌড়ে চেয়ারটার কাছে গেলেন, হাতে ধরা বেতের লাঠি মেঝেতে ফেলে স্ত্রীর মুখটা হাত দিয়ে চেপে ধরে বলতে লাগলেন, ‘না, না, না। বলবা না। বাচ্চাদের শোনা যাবে না।’
বাবার এই আতঙ্ক দেখে জাহেদের মনে হল, নিশ্চয় ব্যাপারটা ছেলেমেয়েদের খারাপ কাজ ওই ‘চেক্স’ সংক্রান্ত কিছু হবে। কিন্তু তাহলে তো ওমর চাচার হাসপাতালে যাওয়ার কথা, জেলে তো না। সে বিরক্ত হল আলোচনা এতদিকে চলে যাচ্ছে কিন্তু কিছুই তার আড়িয়াল খাঁ ভ্রমণের সম্ভাবনার দিকে যাচ্ছে না দেখে। কানে কানে সে তার বোনের কাছে জানতে চাইল, ‘আপা, কী করছে ওমর চাচা?’
পারভিন তাকে বলল, ‘ঢং করিস না, জাহেদ। তোর যাওয়া হবে না। বাবারই যাওয়া হয় কিনা ঠিক নাই।’
মেয়ের শেষ বাক্যটা শুনলেন তাদের বাবা। তিনি চিল্লিয়ে বলে উঠলেন, ‘না। আমারে যেতেই হবে। না গেলে সব হারাব।’
তাদের মা স্বামীর সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে এবার চোখে চোখ রেখে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মানে?’
সবকিছু শান্ত। বাইরে কুলফিওয়ালার তার কুলফির মটকা মাথায় তোলার শব্দটাও টের পাওয়া যাচ্ছে। জাহেদ তার বোনকে আজ আর এই কথা বলে ক্ষেপাল না যে, ‘তোমার নাঈম্মিয়্যা তোমারে ছেড়ে চলে যায়, আপা।’
তাদের বাবা বুঝলেন, তাকে কথা বলতেই হবে। তিনি হুড়মুড় করে বলে বসলেন, ‘ঘটনা আসলে কিছু না। ঘটনা নরমাল। ওমর আলি বলছে, টাকার বদলে সে আমারে জমি দেবে। আমরা এখান থেকে প্রথমে তালতলী বাজার যাব। জাহেদ যাক সাথে, অসুবিধা নাই। সকাল থেকে যেতে চাচ্ছে ছেলেটা, যাক। নৌকায় আমরা পশ্চিম চরবাড়িয়া হয়ে আড়িয়াল খাঁ-র ওইখানে গিয়ে পড়ব। মাত্র এক ঘণ্টা। তারপর লামচারি গণি মিয়ার বাজারের ওখান থেকে আট হাজারের দিকে একটা চর আছে। ওমর ওই পুরাচের কিনতেছে এক লোকের কাছ থেকে। আমাকে ওমর বলছে, ভাই আপনি চরের অর্ধেকটা নিয়া নেন। গত মাসে সে বলছে আজকের কথা যে, আমরা ওইখানে যাব, সে আমাকে আমার জমি দেখাবে। পছন্দ হলে কাগজপত্র পরে করা হবে। আমি পুরো চার লাখ টাকার সমান জমি পাব।
আবার সব চুপ, কিন্তু তা মাত্র সামান্য খানিকের জন্যই। তাদের মা বলে বসলেন, ‘তা, ভাল কথা। কিন্তু তুমি তার সেই কথা বিশ্বাস করলা?’
বাবা বললেন, ‘না গেলে বিশ্বাস-অবিশ্বাস কোনোটা কেমনে করব? ওই চরের জমি পাবে তিন জন-ওমর, আমি, আর হায়দার। হায়দাররে তোমরা চিনো না। বামন লোক, ভাল লোক। হায়দার এই জমির খোঁজ পাইছিল প্রথমে। বৰ্মন রোডের ওইখানে হায়দারের বাসা। তার বইয়ের দোকান আছে বগুড়া রোডে, বই-খাতা-স্টেশনারির দোকান। হায়দার জমিটা ওমররে কিনে দিচ্ছে তার একরকম এক সম্মনধির কাছ থেকে। এইসব গল্প তোমাদের শোনার কারণ নাই, দরকার নাই।’
জাহেদের এসব কোনো কথাই এখন আর খারাপ লাগছে না। সে খুশি, তার বাবা বলেছেন যে, সে তার সাথে যাচ্ছে। সে আরও খুশি, তারা তাহলে সকাল থেকে শুনছিল যে আড়িয়াল খাঁ-র গল্প, তার মালেক হুজুর তাকে বলেন যে আড়িয়াল খাঁ-র গল্প, সেই আড়িয়াল খাঁ-তেই যাচ্ছেন তার বাবা। আর সে আরও আরও খুশি যে, তার বাবার এই শেষ কথাগুলো বলা খুব ভাল হয়েছে। এখন তার বড় ভাই শাহেদের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, বাবা যেতে পারবেন, বাবাকে আটকানোর আর কোনো উপায় নেই। জাহেদের মনে হল, বাবা হায়দার নামের লোকটার কথা বলে আসলে খুব ভাল করেছেন, কারণ সবাই তাতে করে বুঝেছে—রাতের নদীতে ওমর আলির সঙ্গে তিনি একা যাচ্ছেন না।
ঠিক এ সময় বাইরে রিকশার বেলের টিং-টিং শব্দ হল খুব জোরে। বাড়ির মেন দরজা বাদ দিলে পাশে উঠানে ঢোকার যে ছোট দরজা, তা দিয়ে ঢুকে পড়ল রিকশাওয়ালা শামছু, বলতে গেলে এ পরিবারেরই লোক—এ বাড়ি ও রিয়াজ-মিরাজদের বাড়ির উঠানে ঢুকে সোজা রান্নাঘরে গিয়ে হাজির হওয়ার এবং এমনকী এ পরিবারের পারভিন-শাহেদ-জাহেদের ওপরে চাইলে হম্বিতম্বি করারও অধিকারপ্রাপ্ত তাগড়াই শরীরের এক চোখ-কান খোলা মানুষ, প্রতিদিন যে কিনা জাহেদকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে আসে, আবার স্কুল শেষে ভাটিখানায় ফেরত দিয়ে যায়। আগে তার সঙ্গে স্কুলে যেত তার বড় ভাই শাহেদ, কিন্তু সে এখন কলেজে উঠে যাওয়ার পরে মটরসাইকেল চালায়। জাহেদের সঙ্গে তিনজনের ভাড়া সমান-সমান-সমান এই মাসিক চুক্তিতে এখন স্কুলে যায় তার বন্ধু দু ভাই- রিয়াজ ও মিরাজ। শামছু হাঁক দিল, ‘কাশেম ভাই, দেরি হইয়া গ্যালো তো। চলেন।’
তাদের বাবা নিজের ঘরের দিকে যাবার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছেন, তিনি হাত তুলে জাহেদকে ইশারা করলেন তার পেছন পেছন আসতে। জাহেদ ছুটে এল তার বাবারও আগে আগে, কারণ তাকে নদীর পানি ধরার একটা বোতল নিতে হবে সাথে, তাবিজটা তার হাফপ্যান্টের পকেটে রাখাই আছে। কিন্তু তার বাবার পথ আটকে দাঁড়ালেন তাদের মা, বললেন, ‘সব বুঝলাম। হায়দার না কে, তার কথাও বুঝলাম। কিন্তু তোমাকে চরের জমি দেখাতে রাতের বেলা কেন? দিনের বেলাও তো যাওয়া যায়। রাতে কেন? আর নৌকা কার?
জাহেদকে অনেক খুশি করে দিয়ে এই দফা রেগে উঠলেন তাদের বাবা। তিনি তার সবসময়ের হাসিমুখ জোকারের চেহারা ছেড়ে হঠাৎ হয়ে উঠলেন এ বাড়ির অন্নসংস্থানের একমাত্র কর্তা—কিছুটা ভারিক্কি, কিছুটা গম্ভীর। তিনি স্ত্রীকে দাঁত কিড়মিড় করে, চোখ কটমট করে বলে বসলেন, ‘সবকিছুর জবাব আমি দিতে পারব না। সংসার আমি চালাই, সংসার চালাতে দাও। আমাকে ওমর ও হায়দার বলছে, রাতে নদীতে ঢেউ কম থাকে, রাতে নদী শান্ত থাকে। সেই কবে তারা বলছে, মে মাসের শেষাশেষি একদিন রাতে নদী শান্ত থাকবে, সেদিন যাব। আর বলছে চরের এখনকার মালিক যে, সে আমাদেরকে রাতেই ডাকছে। তারা মাছ ধরে খায়, তাদের কাছে দিন-রাত আলাদা নাই।’
তাদের মা বললেন, ‘রাগ দেখাবা না। তুমি জানো তুমি উল্টাপাল্টা বলতেছ, তাই রাগ দেখাচ্ছ। যাও, যা মন চায় করো। আমাদের কথা তুমি কোনোদিন শুনো নাই। দশ টাকার জমি বুঝায়ে দিয়ে তোমাকে ওমর বলবে চার লাখ টাকার জমি। আর আড়িয়াল খাঁ-র মাঝখানের এক চরে বিরাট জমি পেলেও আমাদের কী? ওই জমি ধুয়ে তুমি পানি খাবা? নাকি ওই জমিতে বাদামের চাষ করে চাষি হবা, তারপর বাদাম বেচে সংসার চালাবা?’
তাদের বাবা একইরকম মুখ ঝামটা মেরে বলে দিলেন, ‘আমি আর হায়দার ওই চরে হোটেল দিব, বইয়ের দোকান দিব। আর জমিতে চাষাবাদ তো হবেই, পুকুরও হবে। তাতে আমার আর হায়দারের ফিফটি-ফিফটি ফিশারিজ ও কোল্ড স্টোরেজও হবে। জমি আমার, টাকা হায়দারের। আর কিছু?’ এরপর চিৎকার দিয়ে শব্দ দুটো আলাদা করে করে তিনি বললেন, ‘আ-র কি-ছু?’
মা তবু থামলেন না। তিনি ফের জিজ্ঞাসা করলেন, ‘নৌকা কার? শুনি?’
বাবা তার গায়ে পাতলা একটা পাঞ্জাবি চাপাচ্ছেন। জাহেদ বাবার পেছন পেছন গিয়ে তাকে তার পাঞ্জাবি হাতে তুলে দিয়েছে আর ভাবছে বোতলটা সে রেখে এসেছে রান্নাঘরের মাচায়, কাশির ওষুধের এক বড় শিশি-বোতল। তো কীভাবে সে ওটাকে নেবে এখন? তাই পাঞ্জাবি বাবার হাতে দিয়েই সে উঠোন বরাবর দৌড় দিয়েছে উঠোনের পাশে চাপকলের ধারে বানানো তাদের রান্নাঘরটার দিকে, যেখানে আছে মুরগির খোঁয়াড়, যেখানে আছে তাদের হাঁসের ঘরও। আর সে দৌড়াতে দৌড়াতে পেছন দিক থেকে শুনছে যে, তার বাবা তার মা-কে বলছেন, ‘ইলতুত্মিশের নৌকা। ইলতুত্মিশরে তো চেনো তুমি, নাকি? কত বড় মানুষ। যাই।’
শাহেদ সে মুহূর্তে দাঁড়িয়ে গেল দরজা ধরে, বলল, ‘বাবা, শামছুর রিকশায় তোমাদের যাওয়া লাগবে না। তোমাদের দুজনরে আমি মটরসাইকেলে তালতলী ঘাট দিয়ে আসব।
তাদের বাবা হাতের এক ঝটকা মেরে সরিয়ে দিলেন বড় ছেলেকে, আর জাহেদ তার পায়ের এক লাথি মেরে ভয় পাইয়ে দিল তিন মুরগি ভগীরথ, কোকিল ও কসাইকে। সে মুখ দিয়ে ডাকল—’গুধু, গু-ধু’। তার মুখের শুধু ডাকটা শুনে নিজের থেকেই খোঁয়াড়ে গিয়ে শুয়ে পড়া বড় পান্তামুখী হাঁসটা ডেকে উঠল, ‘প্যাঁক-প্যাঁক-প্যাঁঅ্যাঅ্যাক’।
জাহেদ হাঁসটাকে উত্তর দিল, ‘আছি, ভাল আছি, গুপ্তধন আনতে যাইরে গুধু’।
সে সময় বাড়ির মেন দরজা ধরে এদিকে তাকিয়ে স্তম্ভিত ভেজা চোখে দাঁড়িয়ে আছেন তাদের মা। তার পাশে জাহেদের বোন পারভিন, যার মনে হচ্ছে এক্ষুনি যে করেই হোক নাঈমকে খবর পাঠাতে হবে যে, তার বাবা ওমর আলির মতো এক বদলোকের সাথে (সে জেলে কেন গেছে সেটা বাবা তার মাকে যেভাবে বলতে দিলেন না, তাতেই পারভিন বুঝে গেছে তার ওমর আলি চাচা এক সাংঘাতিক খারাপ মানুষ) গেছে তালতলী নদী ধরে পশ্চিম চরবাড়িয়া হয়ে হাজিবাড়ির দিকটা ধরে সাংঘাতিক আড়িয়াল খাঁর মোহনার দিকে। সেই মোহনা পুরো পার হয়ে তাদের নৌকা কিনা যাবে আট হাজারের কাছে, এই এত রাতে? সে নাঈমকে আরও বলবে, তার বাবার সঙ্গে আছে তার ছোট ভাই জাহেদ, যে কিনা কিছুই বোঝে না এই দুনিয়ার। তার হুজুর তার মাথায় কী ঢুকিয়েছে আল্লা জানে! সে আসলে এ দুনিয়াতেই আর নেই এবং সেজন্যই তো তাদের বাবা সবসময় বলেন, ‘মালেক হুজুর আমাদের যে ক্ষতি করছে, সেই ক্ষতি আর কেউ করে নাই। এত্তবড় বিশ্বাসভঙ্গ। ওহ খোদা!’
জাহেদের মা কী থেকে কী মনে করে তার চলে যেতে থাকা ছেলে জাহেদের উদ্দেশে চিৎকার দিয়ে উঠলেন, ‘গুধু শুধু করবি না, জাহেদ। গুধু হারামজাদা আজকে হিন্দু পাড়ায় গিয়ে হিন্দু হাঁসগুলার সাথে মিশছে। এর পরে খছাকে খেতে আসলে ওকে কেউ বাঁচাবি না।’
তার বাবা স্ত্রীর এই কথা শুনে থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন সবজি বাগানের কিনারে, তারপর চার কদম পেছনে হেঁটে এসে দাঁড়ালেন আমড়াগাছটার কোনায় আর বললেন, ‘তুমি এসব কী বলো? হাঁস আবার হিন্দু-মুসলমান হয়? দেশের অবস্থা এ কী হচ্ছে!’
তাদের মা মুখ ঝামটা মেরে বলে দিলেন, ‘হয়। তোমার এত দেশ নিয়া ভাবা লাগবে না, তুমি নিজেরে নিয়া ভাবো।’
জাহেদ ছুটে গেল বোন পারভিনের কাছে। তারপর বোনের হাত দুটো ধরে, কাঁধ ধরে, কোমর ধরে, পা দুটো প্রায় প্রায় ধরে তাকে মিনতি জানাল, ‘আপা, আপা, খছাক জানি গুধুর বাসায় না আসে। তুমি এক্ষুনি ওদের ওইখানে মশাল জ্বালায়ে রাখবা। বলো আপা, রাখবা?’
জাহেদের বোন উত্তর দিল, ‘ওকে, রাখব। তুই যা।’
জাহেদ গুধুর খোঁয়াড়ের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল, ‘কুল হু আল্লাহু আহাদ, আল্লাহুস সামাদ…,’ তারপর সুরা শেষ হতেই হাঁস-মুরগিদের বসতঘরের ওদিকের বাতাসে সে ভাসিয়ে দিল তার জোর এক ফুঁ।
তার পরপরই তারা দুজন—বাপ-ছেলে—শামছু মিয়ার রিকশাতে। আর শামছু মিয়া ডেকে উঠল, ‘চলেক চলেক চলেক’ এবং তার রিকশার পথ থেকে সরে গেল লুলা ভিখিরির দল, যারা সন্ধ্যারাতের ভিক্ষাতে নেমে ইতোমধ্যে শুরু করে দিয়েছে তাদের গান: ‘আমার আল্লাহ নবীজির নাম, মনে ভরসা; মোছলমানে ভিক্খা দিবে, এইডা ভরসা- আম্মা গো, দুগ্গা ভিক্খা দেন।’
.
হন্তদন্ত হয়ে তখন মুরাদদের বড়লোকের বড় বাড়ির বড় গেট থেকে বেরোলেন বড় সিমেন্টের ব্যবসায়ী বিদ্দুত বিশ্বাস। মুরাদের বাবা মন্টু খাঁ তার ব্যবসায়িক পার্টনার এবং একমাত্র মুরাদের বাবা ও সালাম জমিদারের বেলায়ই তার কাছে কোনো হিন্দু-মুসলমান নেই। তিনি লুলা ভিখিরিগুলোকে বললেন, এমনভাবে বললেন যেন পাড়ার সবাই শুনতে পায়, ‘মোছলমানে ভিক্ষা দিবে না। এইখানে ওই গান গাইলে তোমাদের হবে না, আর কতবার কমু? মোছলমানে আবার কীসের ভিক্ষা দিবে? ভাটিখানার মোছলমানেরা নিজেরাই ভিক্ষুখ।’
রিকশাওয়ালা শামছু সহ্য করতে পারল না বিদ্দুত বিশ্বাসের এই কথা। সে চিৎকার দিয়ে উঠল, ‘বেশি বাইড়েন না বিদ্দুত মিঞা। আপনের দোকানের রড আপনের পাছায় ভইর্যা দেওয়ার মতম মোছলমান পোলাপান ভাড়িখানায় আছে কইলাম।’
বিদ্দুত বিশ্বাস অপমানে লাল হয়ে দৌড়ে এসে দাঁড়ালেন শামছুর রিকশার সামনে, বললেন, ‘শামছু, বেয়াদপ হইছ?’
শামছু বলল, ‘না। আমনে আগে খারাপ কথা কইছেন। দ্যাহেন নাই গত বছর আমনের বড়লোক বন্ধু মন্টু খাঁর পোলা মুরাদে কেমন বেলচার কোপ খাইল? এইডার নাম ভাডিখানা। এহন পথ ছাড়েন।’
বিদ্দুত বিশ্বাস কিছু বললেন না। তিনি দেখলেন রিকশায় কাশেম মিঞা ও জাহেদ বসা, কিন্তু তাদেরকে দেখেও যেন দেখলেন না তিনি, শুধু রিকশার পথ ছেড়ে চলে যেতে লাগলেন পুকুরের ওদিকে। কিন্তু তিনি পাঁচ কদমও যাননি, দৌড়ে ফিরে এলেন রিকশার একদম সামনে। তারপর জাহেদকে বললেন, ‘জাহেদ, জাহেদ, জানো তো কাল রাত থেকে মুরাদরে পাওয়া যাচ্ছে না।’
জাহেদ বলল, ‘জানি না তো, কাকা।’
শামছু বলল, ‘কী বলেন? আপনের বন্ধু মন্টু খাঁ-র পোলা আমাদের মুরাদ?’
বিদ্দুত বিশ্বাস হাত ধরে বসলেন কাশেম মিঞার। তাকে বললেন, ‘কাশেম ভাই, কী সব কাণ্ড! পনেরো দিন আগে মমতা নামের ওই মাইয়া এইখানে আসলো কোলে বাচ্চা নিয়া। তার চার দিন পরে পুস্কুনিতে পাওয়া গেল নতুন বাচ্চার লাশ। তারপর গত পরশু মারা গেল চোর জনি না মুকুল। ভাড়িখানায় এহন পুলিশ ঘোরতেয়াছে। আর এর মইদ্দে মুরাদরে পাওয়া যাইতেছে না কাল রাত থেইক্যা। আমার বন্ধুর তো বেহুঁশ অবস্থা।’
কাশেম মিঞা বললেন, ‘চিন্তার কথা। কিন্তু আমনের সাথে পরে কথা বলি এইসব নিয়া? এখন একটু কাজে যাই। মুরাদ বাচ্চা ছেলে, দেখবেন আজ রাতের মধ্যেই বাসায় চলে আসবে। মন্টু ভাই কি ঘরে?’
বিদ্দুত বিশ্বাস সে কথার জবাব দিলেন না কোনো। আনোয়ারা খাতুনের বাড়ির কিনার ঘেঁষে সাঁ করে তার কর্মচারী লেনজা মাঠটা পেরিয়ে ভূতের মতো এখানে উদয় হতেই বিদ্দুত লেনজাকে জানালেন, ‘আমি দোকানে যামু। লেনজার বাচ্চা লেনজা, শুয়ারের পুত, তুই উজ্জ্বলরে গিয়া ক মটরসাইকেল এইহানে লইয়া আসতে। যা দৌড়া।’
লেনজা দৌড় দিল বিদ্দুত বিশ্বাসের ছেলে উজ্জ্বল বিশ্বাসকে কথাটা বলতে। লেনজার মনে হল সে ছুটে গিয়ে উজ্জ্বলকে বলবে, ‘দাদা দাদা, মটরসাইকেলে সালাম জমিদারগো জাহান্নামের রাস্তা আমনের নেলে আইজকা হইবে না। জাহেদগো বাড়ির সামনে আমনের বাপে খাড়াইয়া রইছে। হ্যায় বিরাট চ্যাতা আমনে পুষ্কনির উপার দিয়া মটরসাইকেল চালাইয়া দ্যান, দ্যাখবেন ঠিকই তা পানির উপার দিয়া ছরছরাইয়া চলবেয়ানে। হা-হা।’
লেনজা দৌড়াতে লাগল একরকম চঞ্চ-মঞ্চ নাচ নাচতে নাচতে। বরগুনার মিজান, রিয়াজ-মিরাজের আপন চাচাতো ভাই আগুন-খাওয়া গান-গাওয়া মিজান তাদেরকে শিখিয়েছে এই চঞ্চু-মঞ্চ নাচ, অন্য নামে ‘চুতিয়া নৃত্য’– দুই কাঁধ দুবার দুবার করে সামনে পেছনে নাচিয়ে, তারপর নাক দিয়ে জোরে হুঁহ্ আওয়াজ করে দুহাত ঝট করে হাঁটুর কাছে নিয়ে যাওয়ার নাম চঞ্চু মঞ্চ-চুতিয়া নৃত্যু, যা কিনা জমে কেবল সামনে কেউ থাকলেই। কারণ, নর্তকের ওই ঝট দুহাত তখন চকিতে ধরতে যায় সামনের মানুষটার অণ্ডকোষ, কাইল্লা কবিরের ভাষায়: ‘হ্যার শাউয়া। কিন্তুক শুকুধধু (মানে শুদ্ধ) ভাষায় কয়—শেউ। হা-হা।’
বিদ্দুত বিশ্বাস লেনজার উদ্দেশে চিল্লিয়ে উঠলেন, ‘লেনজা, আমি আবার মন্টু ভাই-র বাসায় গেলাম।’
বিদ্দুত বিশ্বাসের এই চিৎকারটা শুনল পারভিন, শুনল তার মা-ও। তারা দুজন তখনও বাড়ির মেন দরজা ধরে ভেজা চোখে এদিকে তাকিয়ে দাঁড়ানো, দুজনেই কাশেম মিঞা ও জাহেদের এত রাতে আড়িয়াল খাঁ যাওয়া নিয়ে বিশাল দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। পারভিনের মনে হল, না, এক্ষুনি যে করেই হোক তাকে তার জান, তার চড়া ও তেজালো শিরতোলা শাবলের বীরবিক্রম নাঈম রহমানকে খবর পাঠাতে হবে।
পারভিন আল্লাহর কাছে গভীর প্রার্থনা রেখে ডাকল, ‘নাঈম, নাঈম।’ আর রাস্তায় সে মুহূর্তে গড়াতে শুরু করা ছয় লুলা ভিখিরির দলটাকে দেখে-শুনে পার হয়ে সেই নাঈমই কোত্থেকে এসে উদয় হল আমড়াগাছটার পাশে, বদ মহিলা আনোয়ারা খাতুনের বাড়ি এবং সে বাড়িতে একসঙ্গে জন্ম হওয়া পাঁচ বাচ্চার সান্ধ্যাকালীন কান্নাকে বাঁয়ে রেখে। মেইন দরজার সামনে পারভিনের মা তখন আর নেই, তিনি শেষমেশ ঘরের ভেতর ঢুকে গেছেন। পারভিন খুশি হল যে, বেশ অন্ধকার নেমে এসেছে, অতএব ভাল করে এদিকে না তাকালে রাস্তা থেকে তাকে ও নাঈমকে কেউ আর দেখতে পাবে না। সেইসঙ্গে রাস্তা ও এই দরজার মাঝখানে দেয়ালমতো তুলে দাঁড়ানো বাঘা টমেটোর ঝাড়টা তো আছেই। সন্ধ্যার আঁধারে আরও ঘন হয়ে আসা কুলবরইয়ের সাইজ সব বাঘা টমেটোর গাছ আছে ওখানে, যাদেরকে আবার ঘিরে আছে সালাম জমিদারদের বাড়ির মাঠের ছোট-ছোট গাছ থেকে বইঠোর দুর্দান্ত কুকুর বন্ধুদের তাড়া খেয়ে এদিকে আসা কাচপোকাদের দল, যারা দেখতে যতই ময়ূরী ময়ূরী ভাস্বর ফ্লোরেসেন্ট হোক না কেন, পারভিনের কাছে আজও স্রেফ গান্ধিপোকাই।
নাঈম নিঃশ্বাস একরকম চিপে রেখে পারভিনকে বলল, ‘পারু–ঠা-ঠা, টাস- টাস, দ্রিম-বুউম, জান। মুরাদ তোমারে আর কোনোদিন মুখ ভরে নাঈম্মিয়্যার কুলফি খাওয়া নিয়ে অপমান করবে না। ওই খানকি মাতারি মন্টু খাঁর বউয়ের ওইটা ফেটে বের হইছে যে মুরাদ, সে ফিনিশ, জান।’
পারভিন বলল, ‘কী বলো? মানে? ফিনিশ মানে?’
নাঈম আরও ঘেঁষে এল পারভিনের কানের মধ্যে, ‘ফিনিশ মানে ফিনিশ। এই নাও।’
নাঈম পারভিনের হাতে দিল একটা খাকি রঙের খাম—পাতলা এক খাকি বড় খাম, যার সবটা পাশ ভেজা, এমন যে, পারভিন সন্ধ্যায় ওই চারপাশের তরুছায়ার মধ্যে খামটা হাতে ধরতেই খুলে এল তার সব বর্ডারের সব জোড়া এবং বুউম—মুরাদের নরম কুলফি সোজা পারভিনের হাতের মুঠোয়। ওই কুলফি দিয়ে তখন আর রক্ত গড়াচ্ছে না, কেবল ওর গোড়া থেকে বের হচ্ছে কেমন গেজানো পানি-পানি কষ-কষ কী যেন। পারভিন একটুও ঘাবড়ে গেল না, একটুও ভয় পেল না। সে শুধু বলল, ‘আমি না বলছিলাম, আমি কাটব।’
নাঈম এবার প্রথমে পারভিনের কান বেড় দিয়ে পরে তার চুলে, তার গালে, তার কান ও কপালের মাঝখানে নিয়ে এল নিজের মুখ। সে বলল, ‘সেইটা পারা গেল না। ঈশ্বরদীর ওই রেলগাড়ি ভেঙে খাওয়া লোকেদের বরিশাইল্যা নেতারা জানাল, ‘সরি, মাইর্যা ফেলা হইছে। তোমার নারীর আসার জন্য অপেক্ষা করা সম্ভব হইল না’।’
পারভিন বলল, ‘কারা মারছে? ঈশ্বরদীর ওরা? মুরাদ একদম মারা গেছে? কী বলো, নাঈম!’
নাঈম আমড়াগাছের কাণ্ডের সঙ্গে শরীর খাড়া করে পারভিনকে ইঙ্গিত দিল তার দিকে ঘন হয়ে আসতে। পারভিন তার হাতে খাকি খামটা ধরে রেখেই নাঈমের একদম কাছে ভিড়ে এল। নাঈম বলল, ‘শোনো, আমি আমার মায়ের চারটা সোনার চুড়ি দিছি ওদেরকে। কাল। আর বলছি, মুরাদ দেখতে পোটকা মাছের মতো, সন্ধ্যায় সে বসবে গিয়ে হারুনের চায়ের দোকানে। তারপর ওখান দিয়ে যেই সে বের হবে, সেই ছেলেধরাদের একটা রুমাল ওর মুখে চাপা দিলেই হইল। তারপর আপনেরা ওকে টেনে নিয়ে যাবেন ভাটিখানা-কাউনিয়ার কোলায়। তুমি দেখছ সেই কোলা?’
পারভিন জানাল, ‘দেখছি।’
নাঈম বলল, ‘আমাদের এইখানে এসে যে বাসা বানছে রেলগাড়ি ভেঙে খাওয়া লোকজন, সেইটা জানো তুমি? বরিশালের পুলিশ অফিস, মেয়র অফিসে তো বিরাট তোলপাড়। তারা ঈশ্বরদী থেকে রাজশাহী এমন কোনো রেলগাড়ি নাই যে খোলে নাই, ভাঙ্গে নাই, ভেঙ্গে নিয়ে বেচে নাই। তারা সিট ভাঙে, রেলের পায়খানা ভাঙে, রেলের চেইন ভাঙে, দরজা ভাঙে, লাইট ভাঙে, লাইটের ঢাকনা ভাঙে, বগির জানালার কাচ ভাঙে, পায়খানার চেন লাগানো বদনা ভাঙে, সিটের রেক্সিন ভাঙে, আর শুনছি তারা এমনকী রেলগাড়ির ফ্লোর আর ছাদও ভাঙে। কী সাহস তাদের, পারভিন! স্রেফ এখন বিপদে পড়ে আসছে বরিশাল…ওদের মধ্যে অরিজিনাল বরিশাইল্যা যারা তারা আসছে বরিশাল, আবার ঈশ্বরদী চলে যাবে সবকিছু ঠাণ্ডা হলে। তারপর রেলগাড়ি ভাঙবে রোহনপুর পর্যন্ত, সৈয়দপুর পর্যন্ত। আমার প্রস্তাব শুনে তারা বলল, ‘চার চুড়িতে হইবে না, গলার চেইন লাগবে, কানের সোনার চার দুলও লাগবে, আরও লাগবে মাইয়াদের পায়ে পরার ভাল স্যান্ডেল।’ আমি বললাম, ‘এই লন আমার মায়ের চার চুড়ি, আর বাকিটা দেবে আমার বান্ধবী, যারে ওই খাচ্চর মুরাদ জ্বালায়।’ তা, তুমি কী কী দিতে পারবা, বলো তো?’
পারভিন উত্তেজনায় তখন কাঁপছে। সেভাবেই সে বলল, ‘আমি দেব আমার নতুন সাবান, আমার ম্যানোলা ক্রিম, আমার তিব্বত ক্রিম, আমার গলার চেন, কানের দুল, আর তিন জোড়া স্যান্ডেল। অবশ্যই দেব নাঈম। তুমি তাড়াতাড়ি বলো যে, তারপর কী হল?’
কাল সন্ধ্যায় নাঈম তারপর শিস দিয়েছিল ওই রেলগাড়ি ভেঙে খাওয়া লোকদের লিডারের দিকে, লিডারের নাম জয়ন্ত। নাঈম ফের অন্যরকম মোটা সুরে এরপর শিস দিল তাদের লিডারের ভাড়া করা ছেলেধরা রুস্তমের দিকে। জয়ন্ত ও রুস্তম বুঝল, এই এক্ষুনি চায়ের দোকান থেকে বের হবে মুরাদ, পোটকা মাছের মতন মোটা সে, তার গাল ও কপাল জুড়ে আছে আট সেলাইয়ের দাগ। জয়ন্ত নাঈমকে বলেছিল, ‘অন্ধকারে কিছুই তো দ্যাহা যাইতেছে না।’ তখন রুস্তম জয়ন্তকে বলল, ‘লিডার, সেইটাই ভালা। মুরাদরে আমি চিনি। অন্দকার কোনো সমেস্যা না।
তারা দুজনে তখন নাঈমকে জানালো, ‘যাও, যাও কোলার ওইদিকে গিয়া বইয়া থাকো। আমরা আসতেয়াছি।’
নাঈম দ্রুত চলে গেল কোলার সে দিকটায়, যেখানে পুলিশ যায় না, ভিডিপি-আনসারও যায় না, বইঠোর বন্ধুরা ছাড়া ভাটিখানার অন্য কেউ কখনোই যায় না। অতএব যেখানে স্রেফ কুকুরের ঘেউ ঘেউ আর রাত হলে শিয়াল ডাকে হুঁয়া-হুক্কা-উউউ।
নাঈম যেতে যেতে চায়ের দোকানটার দিকে পেছন ফিরে তাকাল। বলতে গেলে ওদিকের কিছুই সে দেখতে পেল না, কিছুই দেখা গেল না তার ছেড়ে আসা গলিপথের ওখানটায়, যেখানে ততক্ষণে গল্প করতে করতে মুরাদের মুখে রুমাল না, সাক্ষাৎ এক ছোট তোয়ালে চেপে ধরেছে ছেলেধরা ‘চটের বস্তা রুস্তম’। ওটাই রুস্তমের আসল নাম, তার কারণ সে ‘ধরা ছেলে’ বস্তায় পোরার জন্য সবসময় একটা চটের বস্তা সঙ্গে নিয়ে ঘোরে। নাঈম জানে, মুরাদকে ধরার সময়ে রুস্তমের সঙ্গে ছিল রুস্তমের ছোট ভাই সোহরাব। তাদের দুজনের ব্যবসা আসলে বস্তার–বস্তার মধ্যে বাচ্চা ছেলে কি বড় ছেলে পুরে সোজা কীর্তনখোলার ওপারে কাউয়ার চরে চলে যাও, কাউয়ার চরে—যেখানে প্রতি রোববার সন্ধ্যার পরে বিক্রি হয় মানুষের দুঃখ পাওয়া কিডনি, মানুষের কাঁদতে থাকা লিভার, আর হাঁসফাঁস করতে থাকা অগ্ন্যাশয়।
নাঈম রেলগাড়ি ভেঙে খাওয়া লোকগুলোর কোলা নামের ওই বিস্তীর্ণ খোলা তৃণপ্রান্তরে খাড়া করা রঙিন কাপড়ের বিশ-পঁচিশ বসতির তখন অনেক কাছে চলে এসেছে। সে দেখছে যে, তাদের নারীরা চিৎকার করে এ ওকে ডাকছে খ্যাকখ্যাক, এ ওকে বলছে চ্যাটাং চ্যাটাং, আর এক দশাসই মহিলা বাপান্ত করছেন কাদেরকে যেন, বলছেন, ‘ভোঁ-ভোঁ, রাত্রি দ্বিপ্রহর হইলে কি আমার কন্যারে শান্তি দিবি তুই? সে তোরে বিয়া করছে আমৃত্যু কুমারী থাকতে নি? তোর মতো দুধের বাচ্চার ডেপোমি দ্যাখতে কি আমার মাইয়াটা রাতের পর রাত ন্যাংটা হইয়া শুইয়া থাকবে ঘরের বরগা কোলে লইয়া? মৈথুন আজকে রাতে না হইবে তো, এই বিয়া বাতিল। তোর দুধের বাচ্চার হোলের, তোর সাবু খাওয়া পোঁতার আমি খ্যাতা পুড়ি। আমি কান্তার মা, আমি কান্তার বাপ। শুনছস?’
এর একটু পরে কোলার খরখরে মাঠ ধরে ভারি একটা বস্তা তাদের ওই বসতির দিকে টানতে টানতে ঘেমে-নেয়ে অস্থির রুস্তম ও সোহরাব, আর হাঁপাতে হাঁপাতে কাউ-কাউ রেলগাড়ি ভেঙে খাওয়া লোকেদের লিডার জয়ন্ত। জয়ন্ত চিৎকার দিল, ‘আমি জয়ন্ত জানোয়ার, অরূপ-দীপু আর ম্যাকেনরোরে এইদিকে পাড়া, খানকির পোলারা।’
রুস্তমের ভাই সোহরাব নাঈমের কাছে ছুটে এসে বলল, ‘মুরাদে অজ্ঞান, বস্তার মইদ্দে’। তারপর আরেক ছুট দিয়ে সে মিলিয়ে গেল বিশ-পঁচিশ বসতির সেই রঙিন কাপড়ের কসবায়। নাঈম ওই দেখল ম্যাকেনরোকে, তার চেহারা ঘাড়ে গর্দানে ষাঁড়প্রতিম। সে আরও দেখল অরূপকে, যে দেখতে ঠিক লোমশ-রোমশ দানা বাঁধা এক গরিলা। সেইসঙ্গে সে দেখল টিঙটিঙে ঢ্যাঙ-ঢ্যাঙে হাইজাম্পের লম্ফননিপুণমতো দীপুকে—দীপুর হাতে এক ঔদার্যহীন মরিচাপড়া লোহার করাত, যার কাঁটাকাঁটা ব্লেড তখন চিকচিক লিডার জয়ন্তের ধরানো বৃস্টল সিগারেটের আগুনে।
তারা নাঈমকে বলল, ‘ভিতরে আসো।’ সে ভেতরে গেল। ভেতরে একটা অপারেশন থিয়েটারের মতো টেবিল – টেবিল না, খাট; শুকনো খটখটে তোষক- বালিশ-কাঁথাহীন এক খাট। সোহরাব ও রুস্তম সেই খাটে ঝরাপাতা ঝাড়ার মতো বস্তা থেকে ঝেড়ে ফেলল মুরাদকে। জয়ন্ত বলল, ‘কী বলে সে তোমার বান্ধবীরে? কী বলে বড়লোকের নান্দুসনুদুস পোলা?’
নাঈমের মনে তখন একটুও ভয় নেই, সে স্রেফ অতি উত্তেজিত। সে রাগের থেকে তার ভাষাকে পুরো বস্তির-বরিশাইল্লা ভাষা বানিয়ে বলল, ‘শুয়ারের বাচ্চা মন্টু খাঁর পোলা তার মা রাজিয়া বেগমের গোয়া দিয়া বাইরাইয়াই লাইগ্যা রইছে আমার বান্ধভীর পিছে। বলে, নাঈম্মিয়্যার, মানে আমার, কুলফি মুখে লইয়া নাকি সারাদিন বইস্যা থাকে আমার বান্ধভী। ছি! আরও বলে, রেলগাড়ি ভাইঙ্গা খাওয়া ছোটলোক চোরের দল ভাড়িখানার কোলায় আইস্যা ভাড়িখানারে দূষিত করছে। বলে যে, এগো লিডার জয়ন্তের কুলফি মুখে না লওন না খাওন পরযন্ত ভাড়িখানার ছেমড়িগো নিচে চুলকাইতেছে। আরও বলে, রেলগাড়ি ভাইঙ্গা খাওয়া লোকেদের লিডার জয়ন্তের মাইয়া কান্তা একটা খারাপ মাইয়া, জঘেন্য মাইয়া, সে দুশ্চরিত্রা। বলে যে…’।
নাঈমকে এক ধমক দিল জয়ন্ত, বলল, ‘এত কথা নাই হারামির ছাওয়াল। এই লও শালার কুলফি, তোমার বান্দবীরে দিবা।’ এ কথা সে বলে শেষও করেনি, বাতাসে তখনও ভাসছে তাকে বলা নাঈমের মিথ্যা কথাগুলো, যখন দীপু নামের অসংযমী ও লম্ফনপ্রিয় সরু-পাতলা লোকটা করাত দিয়ে ওহ্ মা গো ওই এক পোঁচে কেটে নিল মুরাদের দুম্বা। বলল, ‘গোড়ার কিছু বালসমেত দিলাম তোমারে। এই চ্যাং তোমার বান্ধভীর জইন্য।’
পুরুষাঙ্গ কাটা যেতেই অজ্ঞান মুরাদ আর্তচিৎকার দিয়ে চোখ খুলল তার। সে তখন পুরো সজ্ঞান, সে তখন রক্ত ঝরাচ্ছে ভূমিকম্পে ফাটল ধরা পানির টাংকির মতন। ওই আলোআঁধারির মধ্যেই নাঈমকে এক ঝলকে দেখে নিয়ে সে মিনতি রাখল, ‘নাঈম ভাই, আমারে বাঁচান, এরা কারা?’
নাঈমকে কোনোদিন ভালমতো নাঈম ভাই বলে ডাকে না সে, যদিও নাঈম তার থেকে বয়সে এক-দু বছরের বড়। সে বলে ‘ওই নাঈম’ কিংবা ‘হোই নাঈম’। কিন্তু আজ সে ডাকল, ‘নাঈম ভাই’। হুম, নাঈম তার সাত-জনমের ভাই, নাঈম তার মাশাল্লাহ একই মায়ের পেট থেকে বের হওয়া একই লাটিমের সুতা ও টোটো।
নাঈম লিডার জয়ন্ত ও তিড়িংবিড়িং দীপুকে সেই বরিশাইল্লাতেই বলল, ‘ও আল্লারে, ও আমারে দেইখ্যা ফেলছে। ওরে আর বাঁচান যাইবে না। ওর বাবা বড় কন্ট্রাক্টর। বড়লোক। ওগো অনেক খ্যামোতা।’
জয়ন্ত বলল, ‘বাপে পাওয়ারফুল লোক। হুম। তাইলে কানের দুল আরও বাড়ল দুই জোড়া। এই ম্যাকেনরো, ওর গলা কাট। টিঙটিঙা তুই তোর করাত ম্যাকেনরোরে দে।’
ষাঁড়প্রতিম ম্যাকেনরো মুরাদকে একটা শেষ শব্দ, একটা অন্তিম আওয়াজও করতে দিল না। সে মুরাদ নামের রেলগাড়িটাকে চ্যাৎ করে ভেঙে টুকরো করে সেই রেলগাড়ির, ধরা যাক, মানুষপ্রতিম গলার মধ্যে চুবিয়ে ডুবিয়ে দিল তার হাতের করাত।
সোহরাব-রুস্তম দুজন এবার একসঙ্গে বলল, ‘জয়ন্ত দা, আমরা ছেলেধরা। আমরা অবেশ্যই মানুষের লিভার কাটি, কিডনি কাটি, হার্ট কাটি। কিন্তুক খাডে ফালাইয়া সোনা আর গলা কাটি না। আপনারে ভালবাসি তাই এই কামড়া করলাম। বিশ্বাস আছে যে, আমনে আমারদের ঠকাইবেন না।’
রঙিন কাপড়ে বেড় দেওয়া অস্থায়ী ঘরে রক্ত তখন প্রবল প্রবাহিত, ওখানে রক্ত তখন ঝাঁকুনি দিয়ে দিয়ে খাটের নিচের পৃথিবীর মাটিতে দ্রুত সঞ্চরমাণ। জয়ন্ত নাঈমকে বলল, ‘খোকা, তুমি তোমার কুলফি পাইয়াছ। গরিলা অরূপ তোমারে একখান খাম দেবে। চইল্যা যাও। আজকের মতো ভাগো। বাকি সব দেওয়ার টাইম থাকল তোমার তিন সন্ধ্যা। আমার বউ এমনেতেই ক্ষ্যাপা যে, তার ছোট মেয়ে কান্তার দরজা এহনও কান্তার নতুন স্বামীতে ভাঙ্গে নাই। আমরা এমনেতেই পোলাপানের পোলাপালানিতে মহা বিরক্ত। যাও।’
নাঈমের পেছন পেছন মুরাদের রক্ত তখন ঘাই মারছে। নাঈম পালাল সেই ঘর থেকে। যাবার সময় শুধু কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘আপনাদের ধন্যবাদ। আমি কথা দিছি এইসব এই পিথিবির কেউ জানবে না। আপনেরাও কথা দিছেন…।’ সে তার বাক্য শেষ করতেও পারেনি, জয়ন্ত গর্জন করে উঠল, ‘চোদানির পোলা, ভাগ। আমাদেরে আইছে রেলগাড়ি ভাঙ্গার হাদিস শিখাইতে। হা-হা-হা।’
ঘরের মুখে তখন দাঁড়িয়ে কান্তার পুরুষ্ট মা। তিনি ঘরের ভেতরে তাকালেন একবার, তারপর স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বম-বম, আমার অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসছে গো। ছেলের বয়স তো বেশি হইবে না। এ কী ভ্রষ্টাচার তোমারদের? ওই ঘরে তো দেখি তোমরা রক্তনিশান উড়ায়ে দিছ জননেন্দ্ৰিয় কাটতে গিয়া।’
নাঈম বুঝল, তিনি তখনও জানেন না যে, মুরাদকে পুরো গলা কেটে মেরেই ফেলা হয়েছে কীভাবে কীভাবে ঠিভাবে ভুভাবে ওহহো গোতগোত ওহহো ফর্দাফাই কাটাকুটা খণ্ডখণ্ড উগ্রস্বভাবী ধনীর দুলাল দেহখানা ওহহো দুই খণ্ড লিঙ্গ আলাদা ধরলে তিন খণ্ড কান্তার মা চর্বিবহুল উচ্ছ্রিত!
.
পারভিন নাঈমের হাতে ভেজা খামটা দিয়ে বলল, ‘এক সেকেন্ড দাঁড়াও।’ আমড়া গাছের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াল নাঈম। তার হাতে মুরাদের ছোট প্রাণহীন কুলফি। কুলফিভরা খামের দিকে তাকিয়ে নাঈম মনে মনে বরিশাইল্লায় বলল, ‘ইবলিস’। আর এবার সরবে, ‘চিনছস এইবার আমার নাম যে নাঈম্মিয়্যা, শালা বড়লোকের পুত? আমি কি তোগো কাইল্লা কবির যে, আমি বেলচা দিয়া ধনী- আমিরের কপাল কাডি?’
তখন ঘামছে নাঈম। সে আরও ঘামল এই এখন পারভিনের এনে দেওয়া ছোট সাইজের দা-টা হাতে নিয়ে। পারভিন বলল, ‘বাঘা টমেটোগুলার মধ্যেখানে সবচাইতে যে বড় টমেটোর কুলবরই ঝাড়, ওইখানে গর্ত করো, ওইখানে কুলফি পৌঁতো, যাও।’ চ
নাঈম রওনা দিল সেদিকে। পারভিন থামাল তাকে, বলল, ‘খামটা দাও দেখি একবার।’ নাঈম খাম দিল তাকে। পারভিন খামের ভেতর উঁকি দিয়ে ভেতরে রাখা চিঠি শেষ একবার দেখার মতো করে মন ভরে দেখে নিল মুরাদের অবচ্ছেদ করা শেউ, আর মুখে বলল, ‘নাঈম, দেখছ কতো ছোট একটা চ্যাং?’
তারা দুজনেই এরপর হাসল খিলখিল, হাসল ফোঁস ফোঁস, ফিক ফিক, ঘোঁত ঘোঁত। তখন রাস্তায় মটরসাইকেল ভরাম-ভরাম করে চালানো পারভিন ও জাহেদের ভাই গুণ্ডা শাহেদ—বখাটে, উন্মার্গগামী, দুরাত্মা এবং ব্লেডের চেন হাতে নিয়ে ঘোরা আলমাজী, রাঙ্গা ও নিউটনের বন্ধু শাহেদ—দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে ওই ছয় লুলা ভিখিরির গড়ানি এবং ভাবছে আড়িয়াল খাঁ-য় তার বাবা ও ছোটভাইয়ের এই বিপজ্জনক নৈশযাত্রা নিয়ে সে করবেটা কী? আর তার বাবা নৌকার মালিকের কী আজব এক নাম বলে গেলেন—ইলতুত্মিশ? সেই ইলতুত্মিশকে আবার তাদের মা চেনেন? সত্য কথা? নাকি এটা বাবার জোর করে একটা কিছু মা-র ওপরে চাপিয়ে দেওয়া?
তখনই ভিখিরিগুলোকে পার হয়ে কাউনিয়া জানকী সিংহ রোডের দিক থেকে প্রায় পঞ্চাশটা শুয়োর রাস্তা ধরে তাড়িয়ে আমানতগঞ্জের দিকে নিয়ে যেতে লাগল নমঃশূদ্র মেথরদের দল – সামনে হেড-মেথর হরিজন পল্লির সর্দার, মেথর-ক্ষৌরকার-নিকারী-পাত্র-মালোদের নেতা চমন বাশফোর। শুয়োরগুলো হাসছে ঘোঁত ঘোঁত করে এবং তাদের গা থেকে ভুরভুর গন্ধ বের হচ্ছে গুয়ের, আর সেই গন্ধ দ্রুত ভাসিয়ে ভরিয়ে দিচ্ছে পুরো নিউ ভাটিখানা রোড। গন্ধছড়ানো শুয়োরেরা ঘোঁত ঘোঁত রেখে এই দফা মন ভরে ডাকতে লাগল ‘ওখর ওখর’- আর চমন শাহেদকে রাস্তা ধরে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার লম্বা গোঁফে হাতের আঙুল মুচড়ে মুচড়ে বললেন, ‘মন খারাপ ক্যান বড় মিয়া? পেরসিডেন জিয়াউর রহমান মরছে বইল্ল্যা? সে তো আমাগো হিন্দুগোরে অনেক কষ্ট দিছে। কিন্তুক আমার মনে কইতেয়াছে স্যায় মরে নাই। স্যায় খালি বিষ্টির মইধ্যে ফাটকি দিছে চিট্টাগাং থিকা আমারদিগের লাখুটিয়া খালে পালাইয়া আইস্যা। তো, তোমার তোমার ছুডোডায় কই? ছুডো দুষ্টু জাহেদডায়?’
টমেটো খেতের মধ্যে মুরাদের পুংশ্চিহ্ন কবর দিয়ে এখন ওখানে লুকিয়ে বসে থাকা নাঈমকে আর বেশিক্ষণ পাহারা দিয়ে যাওয়ার উপায় দেখল না পারভিন। কারণ সে শুনল যে, বিজয় মহাজনের পোষা তুঁত রং বড় গুইসাপ খছাক এক আজব শব্দ করে—চটটড়াক-চট্টড়াক-হিস্, চটটড়াক-চটটড়াক হিস্ – ডেকে উঠেছে কাঞ্চন ও এলিজাদের গোলাপবাগানের ওদিকটা থেকে। পারভিন বুঝল, কোনোমতেই খছাককে গুধু, কোকিল, ভগীরথ ও কসাইদের খোঁয়াড়ের কাছে যেতে দেওয়া যাবে না। সে তার আদরের ছোটভাই জাহেদকে কথা দিয়েছে ওদিকটায় মশাল জ্বালিয়ে রাখবার, যেন আগুন দেখে খছাক ভাগে, যেন মশালের মৃদু কিন্তু টকটকে যজ্ঞকুণ্ড দেখে খছাক সাহস না পায় তার ট্যাটাপ্রতিম জিভ দিয়ে ওই হাঁস-মুরগিগুলোর জীবনপ্রদীপ চেটে দেবার। অতএব সে তার মায়ের উদ্দেশে চিৎকার করে উঠল, ‘মা, মশালের কেরোসিন কোথায় রাখছ?’